মানুষের বংশবিস্তার
মানুষের প্রাচীনতম রচনায় যখনই বংশবিস্তারের বিষয় এসেছে তখনই সেখানে ভুল বিবরণ দেয়া হয়েছে। মধ্যযুগে এমন কি আরও সাম্প্রতিককালে এ বিষয়টি কিংবদন্তি ও কুসংস্কারে আবৃত ছিল। তাছাড়া অবশ্য কোন উপায়ও ছিল না; কারণ বংশবিস্তারের জটিল প্রক্রিয়া বুঝার জন্য মানুষোকে প্রথমে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে জ্ঞান সংগ্রহ করতে হয়েছে, অনুবীক্ষন যন্ত্র আবিষ্কার করতে হয়েছে এবং শরীরবিদ্যা, ভ্রুণবিদ্যা, প্রসুতিবিদ্যা প্রভৃত বিভিন্ন বিষয়ে পূর্ববর্তী মৌলিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আবীষ্কার করতে হয়েছে।
কিন্তু কুরআনের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে বংশবিস্তারের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার উল্লেখ আছে, জন্মের বিভিন্ন স্তরের সঠিক বর্ণনা এবং কোথাও একটি মাত্রও ভুল বিবরণ নেই। সকল কিছু মানুষের বোধগম্য সরল ভাষায় সহজ ভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং ঠিক সেই প্রকারে বর্ণিত হয়েছে মানুষ যা বহুদিন পরে আবিষ্কার করেছে।
মানুষের বংশবিস্তারের বিষয়টি বিভিন্ন প্রসঙ্গে কয়েক ডজন আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট স্তর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুতরাং সম্পূর্ণ ব্যাপারটি বুঝার জন্য আয়াতগুলি একত্র করা প্রয়োজন। এ গ্রন্থে আলোচিত অন্যান্য বিষয়ের মত এ বিষয়ের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি একত্র করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
কতিপয় মৌলিক ধারণা
বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার কতিপয় মৌলিক ধারণা স্মরণ করা প্রয়োজন। কুরআন নাযিল হওয়ার সময় এবং তাঁর পরে বহু শতাব্দী যাবত এ সকল তথ্য মানুষের জানাছিল না।
মানুষের বংশবিস্তার প্রক্রিয়া অন্যান্য সকল স্তন্যপায়ী জীবের মত একই প্রকারের। ডিম্বাশয় থেকে বিচ্যুত হওয়া একটি ডিম্বের উর্বরতা লাভ করা থেকেই এ প্রক্রিয়ার শুরু হয়। নারীর মাসিক ঋতুচক্রের মাঝামঝি সময়ে জরায়ুতে এ উর্বরতা ঘটে থাকে এবং এ উর্বরতা ঘটায় পুরুষের শুক্র, কিম্বা আরও সঠিক ভাবে শুক্রকীট। একটি মাত্র শুক্রকীটই এ কাজের জন্য যথেষ্ট। সুতরাং উর্বরতা সাধনের জন্য ক্ষুদ্রতম পরিমাণের শুক্র বা বীর্যই প্রয়োজন হয়ে থাকে; কেননা ঐ পরিমাণ বীর্যের মধ্যেই লক্ষ্য লক্ষ্য শুক্রকীট থাকে। পুরুষের অন্ডকোষ শুক্র উৎপন্ন করে থাকে এবং মুত্রনালীর সঙ্গে সংযুক্ত কোষ ও নালীপথের পাশাপাশি অবস্থিত অন্যান্য গ্রন্থি থেকেও লালা উৎপন্ন হয়ে শুক্রের সঙ্গে মিলিত হয়।
উর্বর হওয়া ডিম্ব নারীর গর্ভের একটি সুনির্দিষ্ট স্থানে স্থিতি লাভ করে-জরায়ুর পথে গর্ভে অবতরণের পর ভ্রুণ গঠিত হয় এবং তা পেশী ও নালার মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করে। উর্বর হওয়া ডিম্ব যদি কখনও গর্ভের পরিবর্তে জরায়ুতে অবস্থান গ্রহণ করে তাহলে গর্ভধারণ বাধাগ্রস্থ হয়।
ভ্রুণটি যখন খালি চোখে দেখার মত হয় তখন তা একটি ক্ষুদ্র মাংসপিন্ডের মত দেখায় এবং তাঁর কেন্দ্রস্থলের মানুষের আকৃতি প্রথমে দৃশ্যমান হয় না। ভ্রুণ ক্রমে যে সকল পর্যায় অতিক্রম করে বড় হয় তা এখন সর্বজনবিদিত। এ সকল পর্যায়ে হাড়, পেশি, স্নায়ু, রক্তপ্রবাহ, নাড়িভুড়ি প্রভৃতি গঠিত হয়।
এ সকল আধুনিক প্রতিষ্ঠিত তথ্যের সঙ্গে এখন আমরা মানুষের বংশবিস্তার বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা মিলিয়ে দেখব।
কুরআনে মানুষের বংশবিস্তার
বংশবিস্তার সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য অনুধাবন করা খুব সহজ কাজ নয়। প্রথম অসুবিধে হচ্ছে এই যে, এ বিষয়ের বর্ণনা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। এ অসুবিধের কথা আমি আগেও উল্লেখ করেছি। কিন্তু আরও বড় অসুবিধে হচ্ছে শব্দার্থের সমস্যা এবং এ সমস্যার ফলে অনুসন্ধিৎসু পাঠ সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারেন।
আসলে বর্তমানের কুরআনের এমন অনেক তরজমা ও ভাষ্য চালু আছে যা এ বিষয়ে একজন বিজ্ঞানীকে অতি শজেই সম্পূর্ণ ভুল ধারনা দিতে পারে। উদাহরন স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, অধিকাংশ তরজমায় মানুষ”জমাট রক্ত” বা”আঠালো রক্ত” দ্বারা গঠিত হয়েছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ধরনের বর্ণনা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোন বিজ্ঞানীর কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞানের পটভূমিকা না থাকার কারণে বিশিষ্ট আরবী ভাষাবিদগণ যে কেন এ ধরনের ভুল করেছেন, তা আমরা মাতৃগর্ভে ডিম্বের অবস্থান গ্রহণ বিষয়ক অনুচ্ছেদের আলোচনায় দেখতে পাব।
বংশবিস্তার বিষয়ে কুরআনের বক্তব্য অনুধাবনের জন্য ভাষা জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান থাকা যে কতখানি অপরিহার্য এ মন্তব্য থেকেই তা অনুমান করা যেতে পারে।
মাতৃগর্ভে পূর্ণতা পাওয়ার আগে একটি ভ্রুণ ক্রমবিকাশের যে সকল পর্যায় অতিক্রম করে থাকে কুরআনে তা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে।
সূরা ৮২ (ইনফিতার) আয়াত ৬-৮:”হে মানুষ! কিসে তোমাকে তোমার প্রতিপালক সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করিল? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করিয়াছেন এবং সুসামঞ্জস্য করিয়াছেন, তিনি তোমাকে তাহার ইচ্ছামত আকৃতিতে গঠন করিয়াছেন।”
সূরা ৭১ (নুহ) আয়াত ১৪:”তিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন পর্যায়ক্রমে।”
এ সাধারণ বর্ণনার পাশাপাশি কুরআনের বংশ বিস্তার প্রসঙ্গে যে সকল বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা এভাবে তালিকাবদ্ধ করা যেতে পারেঃ
১) স্বল্পতম পরিমাণ শুক্রেই উর্বরতা সাধিত হতে পারে।
২) শুক্রের উপাদান।
৩) উর্বর ডিম্বের অবস্থান।
৪) ভ্রুণের ক্রমবিকাশ।
এ বিষয়গুলি এখন আমরা পরপর আলোচনা করব।
(১) স্বল্পতম পরিমাণ শুক্রেই উর্বরতা সাধিত হতে পারে
কুরআনে নিম্নলিখিত প্রকাশভঙ্গিতে এ ধারণাটি এগার বার উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ১৬ (নাহল) আয়াত ৪:”তিনি সামান্য পরিমাণ (শুক্র) হইতে মানুষ সৃষ্টি করিয়াছেন।”
যথাযথ কোন সঠিক শব্দ না থাকায় এখানে আরবী ‘নুতফা’ শব্দটি”সামান্য পরিমাণ (শুক্র)” বলে তরজমা করা হয়েছে। এ শব্দটি যে ক্রিয়াপদ থেকে এসেছে তাঁর অর্থ হচ্ছে”ফোঁটা ফোঁটা পড়া, টিপ টিপ করে পড়া” এবং বালতি খালি করার পর তলায় যা অবশিষ্ট থাকে সেই তলানি বুঝানোর জন্য এ শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সুতরাং এ শব্দ দ্বারা তরল পদার্থের সামান্য পরিমাণ বুঝায়। তরল পদার্থ বলতে এখানে শুক্রই বুঝানো হয়েছে, কারণ অপর একটি আয়াতে শব্দটি শুক্রের সঙ্গ সম্পর্কিত করা হয়েছে।
সূরা ৭৫ (কিয়ামা) আয়াত ৩৭:”সে (মানুষ) কি স্খলিত শুক্রবিন্দু মাত্র ছিল না?” এখানে আরবী”মণি” শব্দে শুক্র বুঝানো হয়েছে। অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে যে, ঐ ‘বিন্দু মাত্র’ একটি মজবুত নিরাপদ আধারে (আরবী”কাবাব”) স্থাপন করা হয় এবং আধারটি স্পষ্টতই যৌনাঙ্গ।
সূরা ২৩ (মুমিনুন) আয়াত ১৩:”অতঃপর আমি উহাকে (মানুষকে) একটি (শুক্র) বিন্দুরূপে স্থাপন করি এক মজবুত নিরাপদ আধারে।”
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মজবুত নিরাপদ আধার- এর বিশ্লেষণ হিসেবে আরবীতে যে ‘মাকিন’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তাঁর তরজমা করা প্রায় অসম্ভব। এ শব্দে মজবুত, নিরাপদ ও সম্মানিত স্থানের ধারণা প্রকাশ পায়। যেভাবেই বলা হোক না কেন শব্দটি দ্বারা সেই স্থানই বুঝায়, মাতৃগর্ভের যে স্থানে মানুষ বেড়ে উঠে। উর্বরতা প্রক্রিয়ার জন্য যে বিন্দু পরিমাণ শুক্রের প্রয়োজন হয়, এ বিষয়টির উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন; কারণ আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য থেকে এ বিষয়ে আমরা এখন ঠিক এ কথাই জানতে পেরেছি।
(২) শুক্রের উপাদান
কুরআনে উর্বরতা সাধনকারী তরল পদার্থের বর্ণনা যে ভাষায় দেয়া হয়েছে তা যথেষ্ট কৌতুহল উদ্দীপক।
(ক) ‘শুক্র’ – সুনির্দিষ্ট ভাবে – সূরা কিয়াম ৩৭ আয়াত।
(খ) ‘স্খলিত তরল পদার্থ থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে’- সূরা তারিক, ৬ আয়াত।
(গ) ‘ঘ্ররণিত তরল পদার্থ’ – সূরা সিজদা, ৮ আয়াত এবং সূরা মুরসালাত, ২০ আয়াত।
‘ঘৃণিত’ (আরবী ‘মাহিন’) শব্দটির প্রয়োগ তরল পদার্থ (আরবী ‘আমসাজ’) -”নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছি একবিন্দু মিশ্রিত তরল পদার্থ হইতে” – সূরা দাহার, ২ আয়াত। অধ্যাপক হামিদুল্লাহর মত অনেক ভাষ্যকারই এ ‘মিলিত’ অর্থে নারী ও পুরুষের তরল পদার্থের মিশ্রণ বুঝিয়েছেন। পূর্ববর্তী অনেক ভাষ্যকারও ঐ কথাই বলেছেন; কারণ উর্বরতা সাধনের শরীরবিদ্যাগত ব্যুৎপত্তি এবং বিশেষত নারির ক্ষেত্রে জীববিদ্যাগত অবস্থা বিষয়ে সঠিক ধারণা লাভ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারা ধরে নিয়েছিলেন যে, মিশ্রণ বলতে নর-নারীর তরল পদার্থের মিশ্রণই বুঝায়।
কায়রোর সুপ্রিম কাউন্সিল ফর ইসলামিক এফেয়ার্স সম্পাদিত ‘মুনতাখাব’ গ্রন্থের ভাষ্যকারের মত আধুনিক গ্রন্থকারগণ অবশ্য এ ধারনা সংশোধন করেছেন এবং বলেছেন যে ‘শুক্র বিন্দুটি ‘বিভিন্ন উপাদানে গঠিত। মুনতাখাবের ভাষ্যকার কোন বিস্তারিত বর্ণনা দেননি, কিন্তু যতটুকু বলেছেন আমার মতে তা যথেষ্ট সঙ্গতও বস্তুনিষ্ঠ।
শুক্রের উপাদান কি কি?
যে তরল পদার্থ শুক্র নামে অভিহিত হয়ে থাকে তা নিম্নলিখিত গ্রন্থিগুলি থেকে নিঃসৃত রস দ্বারা গঠিত হয়।
(ক) অন্ডকোষঃ এ স্থান থেকে নিঃসৃত রসে শুক্রকীট আসলে লম্বাটে কোষ বিশেষ এবং লেজের মত তাঁর একটি বর্ধিত অংশ আছে, এবং তা এক প্রকার হালকা রসে নিমজ্জিত থাকে।
(খ) শুক্রকোষঃ পুরুষাঙ্গের নিকটে অবস্থিত এ কোষে শুক্র জমা থাকে। এ পাত্র বা আধারে একটি নিজস্ব রসও নিঃসৃত হয়ে থাকে, কিন্তু তাতে উর্বরা সাধনের মত কোন উপাদান থাকে না।
(গ) লিঙ্গগ্রন্থিঃ এ গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস শুক্রকে ঘনত্ব এবং গন্ধ দিয়ে থাকে।
(ঘ) মূত্রনালীর সঙ্গে সংযুক্ত গ্রন্থিঃ এখানে যে তিনটি গ্রন্থি আছে তা তিনজন বিজ্ঞানীর নাম অনুসারে কূপারের গ্রন্থি, মেরির গ্রন্থি এবং লিটারে গ্রন্থি নামে পরিচিত। প্রথম দুটি গ্রন্থি থেকে আঠালো রস এবং তৃতীয় গ্রন্থি থেকে কাদা ব্বা গ্রিজ জাতীয় রস নিঃসৃত হয়ে থাকে।
কুরআনে যে ‘মিশ্রিত তরল পদার্থ’ – উল্লেখ আছে, এগুলি হচ্ছে তাঁর উৎস ও উপাদান।
এ বিষয়ে বলার মত কথা অবশ্যই আরও আছে। কুরআনে যেখানে বিভিন্ন উপাদানে গঠিত উর্বরা সাধনকারী তরল পদার্থের কথা বলা হয়েছে, সেখানে এ কথাও বলা হয়েছে যে, ঐ পদার্থ থেকে গৃহিত উপাদান নিয়ে মানুষের বংশ রক্ষা করা হবে। সূরা সিজদার ৮ আয়াতে এ অর্থই পাওয়া যায়ঃ
“অতঃপর (আল্লাহ) আতাহ্র বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস হইতে।”
আরবী ‘সুলালা’ শব্দের তরজমা করা হয়েছে ‘নির্যাস’ বলে। এ শব্দটির তাৎপর্য হচ্ছে ‘কোন বস্তু থেকে গৃহিত, অপর কোন বস্তু থেকে আগত কোন বস্তুর উত্তম অংশ। ‘ যে ভাবেই বলা হোক না কেন এ শব্দে একটি সম্পূর্ণ বস্তুর অংশ বিশেষ বুঝা যায়।
যে কোষ দ্বারা ডিম্ব উর্বরা হয় অর্থাৎ বংশবিস্তার ঘটে তা লম্বা আকারের। তাঁর আয়তন এক মিলিমিটারের দশ হাজার ভাগের একভাগ। স্বাভাবিক যোউনমিলনে একজন পুরুষ কয়েক কোটি কোষ উৎপন্ন করে থাকে এবং তাঁর মধ্যে সাধারণত একটি ডিম্বকোষ প্রবেশ করে থাকে। অবশিষ্টগুলি পথিমধ্যে থেকে যায়। হিসেব করে দেখা গেছে একজন পুরুষ একবারের মিলনে কয়েক ঘন -সেন্টিমিটার শুক্র স্খলন করে থাকে এবং এক ঘন-সেন্টিমিটার শুক্রে ২ কোটি ৫০ লক্ষ্য শুক্রকীট থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিবিধ উপাদানে অতিশয় জটিল প্রক্রিয়ায় গঠিত এওটি তরল পদার্থের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ দ্বারাই বংশবিস্তারকার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। এ অবস্থায় আধুনিক গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক তথ্যের সংগে কুরআনের বর্ণনার পরিপূর্ণ সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য দেখে আমরা বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে পারি না।
(৩) উর্বর ডিম্বের নারী যৌনাঙ্গে অবস্থান গ্রহণ
ডিম্ব উর্বর হওয়ার পর তা জরায়ুতে নেমে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। এ বিষয়টিই কুরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
সূরা ২২ (হজ্জ) আয়াত ৫:”আমি যাহাইচ্ছা করি তাহা এক নির্দিষ্টকালের জন্য মাতৃগর্ভে রাখিয়া দিই।” ডিম্ব লম্বাকৃতি ধারণ করে আটিতে গাছের শিকড়ের মত জরায়ুর (মাতৃগর্ভের) মাংসল অংশে সংলগ্ন হয়ে সেখান থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে। ডিম্বের ঐ আকৃতির ফলে আক্ষরিক অর্থেই তা জরায়ুতে লেগে থাকে। এ তথ্য সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত হয়েছে।
এ লেগে থাকার ব্যাপারটি কুরআনের পাঁচটি স্থানে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ৯৬ (আলাক) আয়াত ১-২:”পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করিয়াছে, সৃষ্টি করিয়াছেন মানূষকে যাহা লাগিয়া থাকে তাহা হইতে।”
‘যাহা লাগিয়া থাকে’ হচ্ছে আরবী ‘আলাক’ শব্দের তরজমা। এটাই শব্দটির মূল অর্থ। তাৎপর্য হিসেব আর একটি অর্থ করা হয় ‘জমাট রক্ত’ বা ‘রক্তপিন্ড’ এবং অনেক তরজমায় এ অর্থ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ ব্যবহার ভুল এবং এ সম্পর্কে সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে। কারণ মানুষের জন্ম প্রক্রিয়া কখনই ‘জমাট রক্ত’ বা ‘রক্তপিন্ড’ স্তর আসে না। অপর একটি তরজমার ক্ষেত্রেও এ একই কথা প্রযোজ্য।
এ তরজমা হচ্ছে ‘আঠা বা সংযুক্তি’ এবং এ তরজমাও যথাযথ নয়। মূল অর্থ ‘যাহা লাগিয়া থাকে’ আধুনিক পরীক্ষিত তথ্যের সঙ্গে যথযথ ভাবে সংগতিপূর্ণ। ঐ ধারণা আরও চারটি আয়াতে এসেছে এবং সেখানে শুক্রবিন্দুর পূর্ণ অবয়ব পর্যন্ত ক্রমবিকাশ বর্ণিত হয়েছে।”
সূরা ২২ (হজ্জ) আয়াত ৫:”আমি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছি…… যাহা লাগিয়া থাকে হইতে।”
সূরা ২৩ (মুমিনুন) আয়াত ১৪:”আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি এমন বস্তুতে যাহা লাগিয়া থাকে।”
সূরা ৪০ (মুমিন) আয়াত ৬৭:”তিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন …… শুক্রবিন্দু হইতে, তারপর যাহা লাগিয়া থাকে তাহা হইতে।”
সূরা ৭৪ (কিয়ামা) আয়াত ৩৭-৩৮:”সে (মানুষ) কি স্খলিত শুক্রবিন্দু ছিল না? অতঃপর সে কি এমন বস্তুতে পরিণত হয় নাই যাহা লাগিয়া থাকে? অতঃপর আল্লাহ তাহাকে কি আকৃতি দান করেন নাই ও সুঠাম করেন নাই?”
যে অঙ্গে গর্ভধারন করা হয় তা বুঝানোর জন্য কুরআনে যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে আরবী ভাষায় জরায়ু বুঝানোর জন্য এখনও সেই শব্দই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোন কোন সূরায় তাকে আবার ‘নিরাপদ আধার’ নামেও অভিহিত করা হয়েছে এবং মনে হয় মাতৃগর্ভই বুঝানো হয়েছে, এ উল্লেখও ঠিক সেই পরিবেশেই করা হয়েছে এবং মনে হয় মাতৃগর্ভই বুঝানো হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এ আয়াতে এ অর্থই হয় বলে মনে করি, কিন্তু আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে এখানে আমি কোন বিস্তারিত ব্যাখ্যা করছি না। অপর একটি আয়াতের খুবই সতর্ক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সূরা ৩৯ (যুমার) আয়াত ৬:”তিনি তোমাদিগকে তোমাদিগের মাতৃগর্ভের ত্রিবিধ অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করিয়াছে।”
অন্ধকার হচ্ছে আরবী”জুলুমাত” শব্দের তরজমা। শিশুর দেহ গঠিত হওয়ার সময় যে তিনটি পর্দা তাকে রক্ষা করে থাকে, এখানে সেই তিনটি পর্দার কথাই বলা হয়েছে বলে কুরআনে আধুনিক ভাষ্যকারগণ মনে করেন। পর্দা তিনটি হচ্ছে পেটের দেয়াল, জরায়ু এবং ভ্রুণের চারদিকের তরল পদার্থ।
আমার মূল আলোচনার জন্য এ আয়াতটি উধৃত করার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণতার স্বার্থে উধৃত করলাম। এখানে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে দেহ- বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর বিরোধিতা করার কোন সঙ্গত যুক্তি আমার কাছে নেই, কিন্তু কুরআনে কি ঠিক ঐ অর্থেই ঐ কথা বলা হয়েছে?
(৪) জরায়ুতে ভ্রুণের ক্রমবিকাশ
ভ্রুণের ক্রমবিকাশের কতিপয় পর্যায় সম্পর্কে কুরআন যে বর্ণনা আছে তা আমাদের আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ এবং কুরআনে এমন একটি মাত্র বর্ণনাও নেই যা আধুনিক বিজ্ঞানের সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে। ‘যা লেগে থাকে’ সে বিষয়ের বর্ণনার পরে কুরআন আমাদের জানাচ্ছে যে ভ্রুণ এক পর্যায়ে ‘চর্বিত মাংস’ এর আকার ধারণ করে থাকে। তারপর হাড় সৃষ্টি হয় এবং তা মাংসে আবৃত হয়ে থাকে। সূরা ২৩ (মুমিনুন) আয়াত ১৪:”যাহা লাগিয়া থাকে তাহাকে আমি পরিণত করি চর্বিত মাংসপিন্ডে, পরে তাহাকে পরিণত করি অস্থি- পঞ্জরে, যাহা পরে আবৃত করি মাংস দ্বারা।”
আরবী ‘মুদগা’ শব্দের তরজমা চর্বিত মাংস, এবং ‘লাহম’ শব্দের তরজমা সাধারণ বা অচর্বিত মাংস। এ পার্থক্যটি লক্ষ্য করা প্রয়োজন। শুরুতেই ভ্রুণ একটি ক্ষুদ্র মাংসপিন্ডের আকারে থাকে। ক্রমবিকাশের একটি পর্যায়ে তা খালি চোখে চর্বিত (কিমা করা) মাংসের মত দেখায়। এ মাংসের মধ্যেই হাড়ের কাঠামো গড়ে ওঠে এবং এ হাড় পরে পেশী দ্বারা আবৃত হয় এবং এ ক্ষেত্রেই ‘লাহম’ শব্দটির প্রয়োগ হয়ে থাকে।
ভ্রুণের ক্রমবিকাশের সময় তাঁর কোন অংগ যে পূর্ণাকৃতি বিশিষত থাকে তা এখন মানুষ জানতে পেরেছে। সূরা হজ্জে যে ‘মুখাল্লাক’ (পূর্ণ আকৃতি দান) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তাঁর অর্থই নিশ্চয়ই এ রকম।
সূরা ২২ (হজ্জ) আয়াত ৫:”শুক্রকে আমরা এমন কিছুতে পরিণত করি যাহা লাগিয়া থাকে …উহাদের পূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট অথবা অসম্পূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট মাংসপিন্ডে পরিণত করি।”
কুরআনে ইন্দ্রিয় এবং উদর মধ্যস্থ অন্ত্রের আবির্ভাবেরও বর্ণয়া দেয়া হয়েছে। সূরা ৩২ (সিজদা) আয়াত ৯:” (তিনি) তোমাদিগকে দিয়েছেন চক্ষু, কর্ন ও অন্ত্র।”
যৌনাঙ্গের গঠনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ৫৩ (নাজম) আয়াত ৪৫-৪৬:”তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী, স্খলিত শুক্রবিন্দু হইতে।”
সূরা (ফাতির) আয়াত ১১:”আল্লাহ তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন মৃত্তিকা হইতে, অতঃপর শুক্রবিন্দু হইতে, অতঃপর তোমাদিগকে করিয়াছেন যুগল (পুরুষ ও নারী) ।”
সূরা ৫ (কিয়াম) আয়াত ৩৯:”অতঃপর তিনি কি তাহা হইতে সৃষ্টি করেন নাই যুগল নর ও নারী?”
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কুরআনের সকল বর্ণনা অবশ্যই আধুনিক কালের সাব্যস্ত ও স্বীকৃত তথ্যও ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। তাহলে দেখা যাবে যে উভয়ের মধ্যে পূর্ণ সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রয়েছে। একই সঙ্গে কুরআন নাযিল হওয়ার সময় মানুষের মধ্যে যে সকল ধ্যান ধারণা প্রচলিত ছিল তাঁর সঙ্গেও কুরআনের বর্ণনা মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন এবং এ ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাহলে দেখা যাবে যে, ঐ সকল ধ্যান০ধারনা কুরআনের বর্ণনার সঙ্গে কত সামঞ্জস্যহীন ও বিপরীতমুখী ছিল। আমরা আজ যেভাবে কুরআনের ব্যাখ্যা – বিশ্লেষণ করতে পারছি, তৎকালীন মানুষের পক্ষে তা অতি অবশ্যই সম্ভব ছিল না। কারণ আজা আমরা আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানের যে সাহায্য পাচ্ছি তৎকালীন মানুষের পক্ষে তা পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। প্রকৃত পক্ষে উনবিংশ শতাব্দীতেই মানুষ এ সকল বিষয়ে কিছুটা পরিষ্কার ধারণা পেতে শুরু করে।
সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী ভিত্তিহীন প্রবাদ, কল্পনা ও পৌরাণিক কাহিণির আশ্রয়ে নানাবিধ ধারণা ও মতবাদ গড়ে উঠেছিল এবং তা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী যাবত বহাল ছিল। তারপর হার্ভে যখন বলেন (১৬৫১) যে,”সকল জীবনই প্রথমত ডিম থেকে আসে” তখন ভ্রুণবিদ্যার ইতিহসার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ সময় অনুবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার হওয়ায় বিজ্ঞানের অগ্রগতি তরান্বিত হলেও মানুষ তখনও ডিম ও শুক্রকীটের পৃথক পৃথক ভূমিকা নিয়ে বাদানুবাদে লিপ্ত ছিল। বিখ্যাত প্রকৃতিবিশারদ বাফোন ডিম্ব-মতবাদের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু বনেট বীজের ‘একত্রে গ্রথিত’ হওয়ার মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এ মতবাদে বলা হর যে, মানবজাতির মাতা ইভের (হাওয়া) ডিম্বকোষে সকল মানুষের বীজ একটির মধ্যে অপরটির অপরটির এভাবে একত্রে গ্রথিত ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ মতবাদই আনুকূল্য লাভ করেছিল।
আমাদের আমলের এক হাজার বছরেরও বেশী সময় আগে যখন এ সকল উদ্ভট মতবাদ বেশ জোরেশোরেই চালু ছিল তখনই মানুষ কুরআন সম্পর্কে অবহিত হয়। এ গ্রন্থে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সত্য সহজ ভাষায় বর্ণিত আছে তা আবিশষ্কার করতে মানুষের কয়েক শত বছর লেগে গিয়েছে।
কুরআন ও যৌনশিক্ষা
বলা হয়ে থাকে যে, আধুনিক যুগেই সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে বহুবিধ আবিষ্কার হয়েছে। যৌনশিক্ষার ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে বলে মনে করা হয়ে থাকে এবং এ বিষয়ে শিশুদের সামনে যে জ্ঞানভান্ডার খুলে দেয়া হয়েছে তা ধুনিক বিশ্বের একটি বিরাট সাফল্য বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। অতীতে এ বিষয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্টতা আরোপ করা হত এবং অনেকে বলে এজন্য ধর্মই দায়ী। অবশ্য কোন ধর্ম দায়ী তা তারা নাম ধরে বলে নি।
ওপরে যে সকল তথ্য বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, চৌদ্দশত বছর আগেই মানুষের বংশবিস্তার বিষয়ক তত্বগত বিষয়গুলি মানুষের নজরে আনা হয়েছে। অধিকতর ব্যাখ্যার জন্য দেহের গঠন ও জীববিদ্যা তখন না থাকার কারনে যতখানি সম্ভব ততটুকুই তথ্যই দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরও মনে রাখা দরকার যে, তৎকালীন শ্রোতাদের বুঝতে পারার ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রেখেই বিষয়টি সহজ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে।
তবে বাস্তব অবস্থার বিষয়টি আদৌ উপেক্ষা করা হয়নি। মানুষের বাস্তব জীবনের দৈনন্দিন অবস্থা এবং সে অবস্থায় কেমন আচরণ করতে হবে সে সম্পর্কে কুরআনে বহু নির্দেশ আছে। যৌনবিজ্ঞানের কথাও এতে বাদ দেয়া হয়নি।
কুরআনের দুটি আয়াতে যৌনসংগমের বিষয় আলোচিত হয়েছে। আয়াতের ভাষায় সুনির্দিষ্টতা ও শালীনতা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু আয়াত দুটির বিভিন্ন তরজমা ও ব্যাখ্যায় যে পার্থক্য দেখা যায় তাতে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়। এ বিষয়ে আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি এবং অনেক তরজমা পড়ে দেখেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর অব মেডীসিন ডক্টর এ কে গিরডের তরজমাই আমার কাছে সঠিক বলে মনে হয়েছে, এজন্য আমি তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করেছি। তাঁর তরজমা নিম্নরূপঃ
সূরা ৮৬ (তারিক) আয়াত ৬-৭:” (মানুষকে) সৃষ্টি করা হইয়াছে স্খলিত তরল পদার্থ হইতে। উহা নির্গত হয় পুরুষের যৌন অঞ্চলের সম্মিলনের ফলে।”
কুরআনে ‘সুলব’ (একবচন) শব্দ দ্বারা পুরুষের যৌন অঞ্চল এবং ‘তারাইব’ (বহুবচন) শব্দ দ্বারা নারীর যৌন অঞ্চল নির্দেশ করা হয়েছে। এ তরজমাই আমার কাছে সবচেয়ে সন্তোষজনক মনে হয়েছে। ইংরাজী ও ফরাসী অনুবাদকগণ সম্পূর্ণ পৃথকভাবে তরজমা করেছেন-” (মানুষ) সৃষ্টি করা হইয়াছে স্খলিত তরল পদার্থ হইতে, যাহা নির্গত হয় মেরুদন্ড ও পঞ্জরাস্থির মধ্য হইতে।” এটা তরজমার চেয়ে ব্যাখ্যা বলেই বেশী মনে হয়। কিন্তু তথাপি বিষয়টি বোধগম্য নয়।
স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেরে পুরুষের আচরণ পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে। স্ত্রীর মাসিক হওয়ার বিষয়ে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে হুকুম দিয়েছেনঃ
সূরা ২ (বাকারা) আয়াত ২২-২২৩:”লোকে তোমাকে রজঃস্রাব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বল, উহা অশুচি। সুতরাং তোমরা রজঃস্রাবকালে স্ত্রীসঙ্গ বর্জন করবে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী সংগম করিবে না। সুতরাং তাহারা যখন উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হইবে তখন তাহাদের নিকট ঠিক সেইভাবে গম করিবে যেভাবে আল্লাহ তোমাদিগকে আদেশ দিয়াছেন। আল্লহ তওবাকারীদের এবং যাহারা পবিত্র থাকে তাহাদিগকে পছন্দ করেন।”
“তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমাদের শস্যক্ষেত্রে তোমরা যেভাবে ইচ্ছা গমন করিতে পার। পূর্বাহ্নে তোমরা তোমাদের জন্য কিছু (সৎকর্ম) করিও।”
আয়াতের প্রথম অংশের অর্থ খুবই পরিষ্কার। এখানে মাসিক হওয়ার সময় স্ত্রী সঙ্গম করতে পুরুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে জমি চাষ করার প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে, বীজ বপনের আগে কৃষককে যা সম্পন্ন করতে হয়। বীজ থেকে অংকুরোদগম হয়, নতুন চারা জন্ম নেয়। এ উপমা দ্বারা যৌন সঙ্গমের উদ্দেশ্য অর্থাৎ বংশবিস্তারের কথা মনে রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর ব্লাশেয়ার আয়াতের শেষ অংশের যে তরজমা করেছন তাতে সঙ্গম-পূর্ব প্রাথমিক প্রস্তুতির প্রতি ইশারা করা হয়েছে বলে মনে হয়।
এ আয়াতে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা সাধারন প্রকৃতির। এ প্রসঙ্গে জন্মনিরোধের প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ আয়াতে কিম্বা অন্যত্র কোথাও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।
গর্ভপাত ঘটানোর বিষয়েও কোন উল্লেখ কোথাও নেই। ওপরে যে সকল আয়াত উধৃত করা হয়েছে তা অনুধাবন করলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, ‘যাহাহ লাগিয়া থাকে’ তাঁর ক্রমবিকাশের ফলেই ভ্রুণ থেকে মানুষের সৃষ্টি হয়। সুতরাং ব্যক্তিক মানুষের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও সম্মানের যে কথা কুরআনে বারবার বলা হয়েছে তাঁর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই গর্ভপাতের উপরে নিষেধাজ্ঞা ও নিন্দাবাদ এসে যায়। সকল তৌহিদবাদী ধর্মেই এখন এ মতবাদ পোষণ করা হয়ে থাকে। রোযার সময় রমযান মাসে রাতের বেলায় যৌনসঙ্গমের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
সূরা ২ (বাকারা) আয়াত ১৮৭:”সিয়ামের রাত্রে তোমাদের জন্য স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ করা হইয়াছে। তাহারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাহাদের পরিচ্ছদ। …… সুতরাং তোমরা তাহাদের সহিত সঙ্গত হও এবং আল্লাহ যাহা তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করিয়াছে তাহা কামনা কর।”
কিন্তু হজ্জের সময় মক্কায় স্ত্রীসঙ্গম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সূরা ২ (বাকারা) আয়াত ১৯৭:”যে কেহ এ মাসগুলিকে হজ্জ করা তাহার কর্তব্য মনে করে তাহার জন্য হজ্জের সময় স্ত্রী-সম্ভোগ বিধেয় নহে।” এ নিষেধাজ্ঞা শিকার করা এবং কলহ-বিবাদের ওপরেও আরোপ করা হয়েছে। তালাকের প্রসঙ্গে কুরআনে রজঃস্রাবের কথা পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সূরা ৬৫ (তালাক) আয়াত ৪:”তোমাদিগের যেসব স্ত্রীর ঋতুমতি হইবার আশা নাই, তাহাদিগের ইদ্দতকাল সম্পর্কে তোমাদিগের সন্দেহ হইলে জানিয়া রাখ তাহাদিগের ইদ্দতকাল হইবে তিন মাস এবং যাহারা এখনও রজঃস্বলা হয় নাই তাহাদিগেরও ইদ্দতকাল অনুরূপ এবং গর্ভবতী ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত।
তালাকের ঘোষণা থেকে তা বলবৎ হওয়ার সময় পর্যন্ত ইদ্দতকাল বা অপেক্ষা করার সময় বুঝায়। ‘যাদের ঋতুমতি হওয়ার আশা নাই’ বলতে যে সকল নারীর ঋতু স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাদের কথা বুঝানো হয়েছে। তথাপি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাদের তিন মাস অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। তারপর তারা পুনরায় বিয়ে করতেও পারে।
যারা এখনও রজঃস্বলা হয়নি তাদেরও তিনমাস অপেক্ষা করতে এবং গর্ভবতীদের সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। এ বিধানগুলি আধুনিক শরীরবিদ্যার নিয়ম-নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। নারীর বৈধব্য বিষয়েও কুরআনে অনুরূপ ন্যায়সঙ্গত বিধান আছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কুরআনে বংশবিস্তার বিষয়ে যে সকল তত্বগত বিবরণ এবং যৌন জীবন বিষয়ে যে সকল বাস্তব নির্দেশ উপদেশ আছে, তা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের কোন তথ্যের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়।
কুরআন ও বাইবেলের বর্ণনাঃ সাধারণ বৈশিষ্ট্য
বাইবেলে বর্ণিত অনেকগুলি বিষয়ে কুরানেও বর্ণিত হয়েছে। এরূপ সাধারণ বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে প্রথমতঃ নবীদের কাহিনী- নূহ, ইব্রাহীম, ইউসুফ, ইলিয়াস, ইউনুস, আইউব ও মূসার কাহিনী এবং ইসরায়েলী বাদশাহদের কাহিনী। সল, দাউদ ও সোলায়মানের কাহিনী। এছাড়া আকাশমন্ডলীর সৃষ্টি, মানব সৃষ্টি, বন্যা ও দেশত্যাগের মত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সুনির্দিষ্ট বর্ণনাও রয়েছে এবং এ সকল ঘটনার ক্ষেত্রে অলৌকিক শক্তির প্রয়োগ ঘটেছে। অবশেষ নিউ টেস্টামেন্ট মুতাবিক যিশু ও তাঁর মাতা মেরির ঘটনাবলীও রয়েছে।
আসমানী গ্রন্থ বহির্ভূত উৎস থেকে আমরা যে জ্ঞান লাভ করেছি সেই আধুনিক জ্ঞানের আলোকে আমরা যদি ঐ দুখানি আসমানী গ্রন্থে বর্ণিত বিষয়বস্তু বিবেচনা করি তাহলে আমাদের মনে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়? আমরা কি দেখতে পাই?
সাধারণ বিষয়ঃ কুরআন, গসপেল ও আধুনিক জ্ঞান
কুরআন ও গসপেলের সাধারণ বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে প্রথমেই একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ গ্রন্থের গোড়ার দিকে গসপেলের যে সকল বিষয়বস্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করা হয়েছে তাঁর একটিও কুরানেও উল্লেখ করা হয়নি।
কুরআনে যিশুর কথা অনেকবার উল্লেখ করা হয়েছে- মেরির নিকট তাঁর পুত্রের অলৌকিক জন্মের সংবাদ জ্ঞাপন, মেরি কর্তৃক ঐ সংবাদ প্রচার, পয়গম্বর হিসাবে যিশুর উচ্চ মর্যাদা, ত্রাণকর্তা হিসেবে তাঁর ভূমিকা, তাঁর পাওয়া অহি মানুষের নিকট প্রচার করা, ঐ অহি দ্বারা তৌরাতের সমর্থন ও সংশোধন, তাঁর ধর্মপ্রচার, তাঁর সাহাবী খলিফা ও অলৌকিক কার্য, তাঁর আল্লাহর নিকট উত্থান, রোজ কিয়ামতে তাঁর ভূমিকা প্রভৃতি।
কুরআনে সূরা ইমরান ও সূরা মরিয়মে যিশুর পরিবার সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা আছে। সেখানে তার মাতা মরিয়মের জন্ম, যৌবনকাল ও অলৌকিক মাতৃত্বের বর্ণনা আছে। যিশুকে সর্বদা ‘মরিয়মের পুত্র’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁর বংশ- পরিচয় কেবলমাত্র মাতৃকূল থেকেই দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ জৈবিক অর্থে তাঁর কোন পিতা ছিলেন না। আমরা আগেই দেখেছি এ ব্যাপারে কুরআনের সঙ্গে গসপেলের মথি ও লুকের বর্ণনার পার্থক্য আছে; কারণ তারা যিশুর পিতৃকূলের পরিচয় দিয়েছেন এবং দুজন দুরকম বিবরণ দিয়েছেন।
কুরআন যিশুকে তাঁর মাতৃকূলের শেজরানামায় নূহ, ইব্রাহীম ও মরিয়মের পিতার (কুরআনে নাম আছে ইমরান) বংশধারায় দেখানো হয়েছে।
সূরা ৩ (ইমরান) আয়াত ৩৩-৩৪:” আদম, নূহ ও ইব্রাহীমের পরিবার এবং ইমরানের পরিবারকে আল্লাহ সারা জাহানের উপর মনোনীত করিয়াছেন; তাহারা পরষ্পরকে আওলাদ……”
সুতরাং যিশু তাঁর মাতা মরিয়মের দিক থেকে এবং মরিয়মের পিতা ইমরানের দিক থেকে নূহ ও উব্রাহীমের আওলাদ। গসপেলে যিশুর পূর্ব পুরুষদের নামে যে ভুল আছে কুরআনে তাও নেই। এ গ্রন্থের গোড়ার দিকে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
তথাপি বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার প্রয়োজনে এ বিষয়টি আর একবার খেয়াল করা দরকার। তদুপরি মুহাম্মদ (সঃ) নিজেই কুরআন লিখেছেন এবং এজন্য প্রধানত বাইবেল থেকে নকল করেছেন বলে যে ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলা হয়ে থাকে, তাঁর মুকাবিলায় এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করা প্রয়োজন। মুহাম্মদ (সঃ) যদি সত্য সত্যই নিজে কুরআন লিখে থাকেন এবং বাইবেল নকল করে থাকেন, তাহলে তিনি যিশুর পূর্ব পুরুষ সম্পর্কিত বাইবেলের বর্ণনাটি নকল করলেন না কেন? তাঁর বদলে তিনি এমন একটি বর্ণনা কিভাবে বসিয়ে দিলেন যা ধুনিক জ্ঞানের আলোকে সকল বিতর্কের উর্ধে?
প্রসঙ্গত লক্ষণীয় যে, এ বিষয়ে গসপেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা দুটি পরষ্পর বিরোধী এবং সেই কারণে তাঁর একটিও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সাধারণ বিষয়ঃ কুরআন ওল্ড টেস্টামেন্ট ও আধুনিক জ্ঞান
কুরআনের সঙ্গে ওল্ড টেস্টামেন্টের কতিপয় সাধারণ বিষয় সম্পর্কে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ওল্ড টেস্টামেন্ট সম্পর্কে আলোচনার সময় পৃথিবীর সৃষ্টি বিষয়ে আলোকপাত করে দেখানো হয়েছে যে, ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। বিষয়টি যেহেতু আগেই একবার পরীক্ষিত এবং আলোচিত হয়েছে সেহেতু তাঁর পুনরাবৃত্তির আর প্রয়োজন নেই।
ইসরায়েলের বাদশাহদের সম্পর্কে কুরআন ও ওল্ড টেস্টামেন্ট উভয় গ্রন্থেই বর্ণনা আছে। কিন্তু এ বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য এবং পুরাতত্ব বিষয়ক তথ্য ও বিবরণ এতই স্বল্প যে তাঁর ভিত্তিতে ঐ সকল বর্ণনার সত্যাসত্য নির্ণয় করা আদৌ সম্ভব নয়। আধুনিক জ্ঞান এ বিষয়ে সত্যই অপর্যাপ্ত।
পয়গম্বরদের ব্যাপারেও প্রায় একই কথা বলা যেতে পারে। উভয় গ্রন্থে এ বিষয়ে বিবরণ আছে। কিন্তু ঘটনাবলীর স্থান, কাল ও পাত্রজনিত তথ্যের কতখানি আমাদের পর্যন্ত এসে পৌছেছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় হওয়ার পরই বিষয়টি আধুনিক জ্ঞানের আলোকে বিবেচনা করা সম্ভব হতে পারে।
তবে উভয় গ্রন্থেই এমন দুটি বিষয় আছে যা আধুনিক জ্ঞানের আলোকে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব এবং প্রয়োজন। বিষয় দুটি হচ্ছে নূহের আমলের বন্যা এবং মূসার আমলের দেশত্যাগ।
বন্যার ঘটনাটি পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব এ কারণে যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঐ বন্যা এমন কোন চিহ্ন রেখে যায়নি যা ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনার পোষকতায় উল্লেখ করা যেতে পারে। পক্ষান্তরে আধুনিক জ্ঞানে এমন কোন তথ্য নেই যার ভিত্তিতে কুরআনের বর্ণনার সমালোচনা করা যেতে পারে।
আর দেশত্যাগের ঘটনাটি পরীক্ষা করা সম্ভব এ কারণে যে, এ বিষোটি উভয় গ্রন্থে যে বর্ণনা আছে সাধারণভাবে তা স্পষ্টতই একে অপরের পরিপূরক এবং আধুনিক জ্ঞানে যে তথ্য পাওয়া যায় তা উভয়ের পরিপোষক।
নূহের আমলের প্লাবনঃ ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা
এ গ্রন্থের গোড়ার দিকে ওল্ড টেস্টামেন্ট বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্লাবনের ঘটনাটি আমরা বিশদভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি এবং স্মরণ করা যেতে পারে যে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি-
প্লাবন সম্পর্কে একটি নয়, দুটি বিবরণ আছে এবং তা দুটি পৃথক আমলে লেখা হয়েছে। প্রথমটি ইয়াহভিষ্ট বর্ণনা এবং তা খৃষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীর। দ্বিতীয়টি স্যাকারডোটাল বর্ণনা এবং তা খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর। সমসাময়িক পুরোহিতগণ লিখেছিলেন বলে এ বর্ণনাটি স্যাকারডোটাল নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
এ দুটি বর্ণনাকে পৃথক পৃথকভাবে সনাক্ত করা যায় না। একটির সঙ্গে অপরটি মিশ্রিত হয়ে আছে। একটির কোন কোন অনুচ্ছেদ অপরটিতেও পাওয়া যায়। জেরুসালেমের বাইবেল স্কুলের অধ্যাপক ফাদার দ্য ফক্স তাঁর জেনেসিসের তরজমার ভাষ্যে একটির বর্ণনার অনুচ্ছেদ যে কিভাবে অপর বর্ণনায় হুবহু বসিয়ে দেয়া হয়েছে তা উদাহরণ সহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। একটি বর্ণনায় মোট দশটি ইয়াহভিষ্ট অনুচ্ছেদ আছে। শুরুতে ও শেষে ইয়াহভিষ্ট অনুচ্ছেদ আছে এবং মাঝখানে দুটি ইয়াহভিষ্ট অনুচ্ছেদের মধ্যে একটি করে স্যাকারডোটাল অনুচ্ছেদে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। দুটি বর্ণনা যেহেতু ক্ষেত্রবিশেষে পরষ্পরবিরোধী, সেহেতু ঘটনার ধারাবাহিকতার দিকে নজর রেখে না পড়লে কোন বর্ণনাই যুক্তিসঙ্গত বা অর্থবোধক বলে মনে হবে না। ফাদার দ্য ফক্স নিজেই বলেছেন-”দুটি বর্ণনায় বন্যা দুটি পৃথক প্রক্রিয়ায় ঘটেছে বলে দেখা যায় স্থিতিকালও দুরকমের পাওয়া যায় এবং নূহ তাঁর কিশতিতে যে জীবজন্তু নিয়েছিলেন তাঁর সংখ্যাও দু বর্ণনায় দু রকম আছে।”
আধুনিক জ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, প্লাবন বিষয়ে বাইবেলের বর্ণনা নিম্নবর্ণিত কারণে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়ঃ
(১) ওল্ড টেস্টামেন্টে প্লাবনটি বিশ্বব্যাপী হয়েছিল বলে বর্ণিত হয়েছে।
(২) ইয়াহভিষ্ট বর্ণনায় প্লাবনের কোন সময়কাল উল্লেখ করা হয়নি; কিন্তু স্যাকারডোটাল বর্ণনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে এবং এমন সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে যখন ঐরূপ কোন বিপর্যয় ঘটা আদৌ সম্ভব ছিল না।
এ অভিমতের যুক্তিবাদ নিম্নরূপ
স্যাকারডোটাল বর্ণনায় সুস্পষ্টরূপে বলা হয়েছে যে, নূহের বয়স যখন ৬০০ বছর তখনই প্লাবন হয়েছিল। জেনেসিসের পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত শেজরানামা (স্যাকারডোটাল পাঠ থেকে গৃহীত এবং এ গ্রন্থের প্রথম দিকে উধৃত থেকে ) দেখা যায় যে, আদমের ১, ০৫৬ বছর পরে নূহের জন্ম হয়েছিল। সুতরাং আদম সৃষ্টি হওয়ার ১৬৫৫ বছর পরে বন্যা হওয়ার কথা। পক্ষান্তরে জেনেসিসের (১১, ১০-৩২) একই স্যাকারডোটাল পাঠে প্রদত্ত ইব্রাহীমের শেজরানামা থেকে দেখা যায় যে, ইব্রাহীম বন্যার ২৯২ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমরা বাইবেল থেকেই জানতে পারি যে, ইব্রাহীম মোটামুটিভাবে খৃষ্টপূর্ব ১৯৫০ সালে জীবিত ছিলেন। তাহলে বন্যাটি খৃষ্টোপূর্ব একবিংশ বা দ্বাবিংশ শতাব্দীতে হয়েছিল বলে স্থির করা যায়। এ হিসাব বাইবেলের প্রাচীন সংস্করণে প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তখন বিষয়টি সম্পর্কে মানুষের কোন জ্ঞান ছিল না বলে বিপরীত কোন যুক্তি উত্থাপন করা সম্ভব ছিল না। ফলে বাইবেল প্রদত্ত কালানুক্রম সকলে বিনা দ্বিধায় মেনে নিত। কিন্তু এখন প্রাচীন ঘটনাবলীর কালানুক্রম সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা সর্বজন গ্রাহ্য হয়ে যাওয়ায় ওল্ড টেস্টামেন্টের স্যাকারডোটাল পাঠের লেখকগণ যে কাল্পনিক সন-তারিখ দিয়েছিলেন তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বাইবেলের পরবর্তী সংস্করণ থেকে ঐ সন-তারিখ গায়েব করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে সকল শেজরানামা এখনও গায়েব করা হয়নি তাঁর ভিত্তিতে হিসাব করলেই ঐ মারাত্মক ভুল অতি সহজেই ধরা পড়ে। বাইবেলের আধুনিক ভাষ্যকারগণ অবশ্য ঐ ভুলের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন না, অথবা করতে সক্ষম হন না।
বর্তমান কালে এমন একটি ধারণা করা কিভাবে সম্ভব যে খৃষ্টপূর্ব একবিংশ বা দ্বাবিংশ শতাব্দীতে এমন একটি প্রলয়কান্ড হয়েছিল যার ফলে পৃথিবীর সকল প্রাণী (নূহের কিশতির আরোহীগণ ছাড়া) খতম হয়ে গিয়েছিল??তখন দুনিয়ার বেশ কয়েকটি অংশে মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং তাঁর ধ্বংসাবশেষ আমাদের পর্যন্তও এসে পৌছেছে। উদাহরণস্বরূপ ঐ সময় প্রাচীন রাজত্বের পর মধ্যবর্তী যুগ শেষ হয়ে মধ্য রাজত্বের শুরু হয়। বর্তমানে আমরা ইতিহাস সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ করেছি তাঁর আলোকে বিচার করলে ঐ প্লাবনে সকল মানব সভ্যতা ধ্বংশ হয়ে গিয়েছিল বলে দাবী করা হাস্যকর বলেই মনে হয়।
সুতরাং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে প্লাবন সম্পর্কে বাইবেলের বর্ণনা আধুনিক জ্ঞানের সম্পূর্ণ বিরোধী। আর বাইবেলের পাঠ যে মানুষের হাতেই রদবদল হয়েছে, একই বিষয়ে দুটি পাঠ থাকা থেকেই তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্লাবন বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা
কুরআনে প্লাবন সম্পর্কে একটি সাধারণ বর্ণনা আছে। এ বর্ণনা বাইবেলের বর্ণনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও কোন প্রশ্ন বা সমালোচনার সৃষ্টি করে না।
কুরআনে প্লাবনের কোন ধারাবাহিক বর্ণনা নেই। বিভিন্ন সূরায় নূহের জনগণের উপরে আপতিত শাস্তির কথা বলা হয়েছে মাত্র। সর্বাধিক পূর্নাঙ্গ বর্ণনা আছে ১১ সূরার (হুদ) ২৫-২৯ আয়াতে। ৭১ সূরায় (নূহ) এবং ২৬ সূরা (শুআরা) ১০৫-১৫৫ আয়াতে সর্বোপরি আছে নূহের নছিহতের বিবরণ। প্রকৃত ঘটনাপ্রবাহের বিবেচনায় যাওয়ার আগে আমরা প্রথমে আল্লাহর হুকুম অমান্যকারী সমাজের উপরে আল্লাহর গজব নাযিল হওয়ার সাধারণ পটভূমিকায় কুরআনে বর্ণিত প্লাবনের কথা বিবেচনা করব।
বাইবেলে আল্লাহর হুকুম অমান্যকারী সমগ্র মানবসমাজের শাস্তি হিসেবে সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্লাবনের কথা বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে কুরআনে কতিপয় সুনির্দিষ্ট সমাজের উপরে কতিপয় শাস্তি নাযিল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমন ২৫ সূরার (ফুরকান) ৩৫-৩৯ আয়াতে বলা হয়েছেঃ”আমি তো মূসাকে কিতাব দিয়াছিলাম এবং তাহার ভ্রাতা হারণকে তাহার সাহায্যকারী করিয়াছিলাম এবং বলিয়াছিলাম, ‘তোমরা সেই সম্প্রদায়ের নিকট যাও যাহারা আমার নিদর্শনাবলীকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। ‘ অতঃপর আমি সেই সম্প্রদায়কে সম্পূর্ন রূপে বিধ্বস্ত করিয়াছিলাম এবং নূহের সম্প্রদায় যখন রাসূল গণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করিল তখন আমি উহাদিগকে নিমজ্জিত করিলাম এবং উহাদিগকে মানবজাতির জন্য নিদর্শনস্বরূপ করিয়া রাখিলাম। সীমালংঘনকারীদিগের জন্যে আমি মর্মন্তুদ শাস্তি প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছি। আমি ধ্বংস করিয়াছিলাম আদ, সামুদ, রসবাসী এবং উহাদিগের অন্তর্বর্তীকালের বহু সম্প্রদায়কেও। আমি উহাদিগের প্রত্যেককে দৃষ্টান্ত দ্বারা সতর্ক করিয়াছিলাম এবং অবাধ্যতার জন্য উয়াহদিগের সকলকেই আমি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করিয়াছিলাম।”
একইভাবে ৭ সূরার (আরাফ) ৫৯-৯৩ আয়াতে নূহের সম্প্রদায় আদ, সামুদ, লুতের সম্প্রদায় (সদোম) ও মাদিয়ানের উপরে নাযিল করা শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্লাবনের প্রলয়কে কুরআনে নির্দিষ্টভাবে নূহের সম্প্রদায়ের জন্য শাস্তি হিসেবে পেশ করা হয়েছে। বাইবেলের বর্ণনার সঙ্গে কুরআনের বর্ণনার এটা প্রথম মৌলিক পার্থক্য।
দ্বিতীয় মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে এই যে, কুরআনে প্লাবনের কোন সন – তারিখেও দেয়া নেই, মেয়াদও দেয়া নেই, কিন্তু বাইবেলে দেয়া আছে।
প্লাবনের কারণ উভয় গ্রন্থে মোটামুটি একই রকম বর্ণিত আছে। বাইবেলের স্যাকারডোটাল বর্ণনায় (আদিপুস্তকে ৭, ১১) একই সময়ে দুটি কারণের ক্রিয়াশীল হওয়ার কথা আছে,”ঐ দিনে মহাজলধির সমস্ত উনুই ভাঙ্গিয়া গেল এবং আকাশের বাতায়ন সকল মুক্ত হইল।” পক্ষান্তরে কুরআনের ৫৪ সূরার (কমর) ১১-১২ আয়াতে বলা হয়েছেঃ”আমি উন্মুক্ত করিয়া দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারিবর্ষণে এবং মৃত্তিকা হইতে উৎসারিত করিলাম প্রস্রবন; অতঃপর আকাশের পানিও জমিনের পানি মিলিত হইল এক পরিকল্পনা অনুসারে।”
কিশতির আরোহীদের সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনা সুনির্দিষ্ট। আল্লাহ নূহকে যে হুকুম দেন তা সঠিকভাবেই পালন করা হয়। হুকুমে নিম্নলিখিত কাজ করতে বলা হয়।
সূরা ১১ (হুদ) আয়াত ৪০; “ইহাতে উঠাইয়া লও প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া, যাহাদিগের বিরুদ্ধে পূর্ব-সিদ্ধান্ত হইয়াছে তাহারা ব্যতীত তোমার পরিবার-পরিজনকে এবং যাহারা বিশ্বাস করিয়াছে তাহাদিগকে।” তাহার সঙ্গে বিশ্বাস করিয়াছিল অল্প কয়েক জন।
পরিবার থেকে যাকে বাদ দেয়া হয় সে ছিল নূহের এক পাপাচারী পুত্র। নূহের মিনতি সত্বেও তাঁর ব্যাপারে আল্লাহর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়নি (সূরা হুদ, আয়াত ৪৫-৪৬) । নূহের পরিবার (ঐ পুত্র বাদে) ছাড়াও কুরআনে কিশতির যাত্রী হিসেবে এমন কিছু লোকের উল্লেখ আছে যারা আল্লাহর উপরে ঈমান এনেছিল।
বাইবেলে অবশ্য অমন কোন মানুষের উল্লেখ নেই। আসলে কিশতির যাত্রী সম্পর্কে বাইবেলে তিনটি পৃথক বর্ণনা আছে।
প্রথম বর্ণনা-ইয়াহভিষ্ট পাঠ মতে ‘পবিত্র’ ও ‘অপবিত্র’ প্রাণী ও পাখির মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা হয়েছে। প্রত্যেক ‘পবিত্র’ প্রজাতির সাত জোড়া (সাতটি পুরুষ ও সাতটি স্ত্রী) এবং প্রত্যেক ‘অপবিত্র’ প্রজাতির এক জোড়া (একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী) প্রাণীও কিশতিতে নেয়া হয়। (উল্লেখযোগ্য যে, তৎকালীন সকল সেমিটিক ভাষায় ‘সাত’ বলতে সাধারণত ‘বহু’ বুঝাত। এখানেও তাই বুঝতে হবে।
দ্বিতীয় বর্ণনা- সংশোধিত ইয়াহভিষ্ট বর্ণনা মতে (আদিপুস্তুক ৭, ৮) ‘পবিত্র’ বা ‘অপবিত্র’ যেরূপই হোক না কেন প্রত্যেক প্রজাতির মাত্র এক জোড়া প্রাণী কিশতিতে নেয়া হয়েছিল।
তৃতীয় বর্ণনা- স্যাকারডোটাল পাঠ মতে কিশতিতে নূহ (তাঁর পরিবারের কেউ বাদ ছিল না) এবং প্রত্যেক প্রজাতির একজোড়া প্রাণী ছিল।
মূল প্লাবনের বিবরণ কুরআনের ২১ সূরার (হুদ) ২৫-৪৯ আয়াতে এবং ২৩ সূরার (মুমিনুন) ২৩-৩০ আয়াতে আছে। বাইবেলের বর্ণনাও প্রায় একই প্রকারের; তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই।
নূহের কিশতি যে স্থানে গিয়ে স্থল পেয়েছিল বাইবেলে তাঁর নাম আরারাত পর্বত (জেনেসিস বা আদিপুস্তক ৮, ৪) এবং কুরআনে তাঁর নামে জুদি (সূরা হুদ, ৪৪ আয়াত) । এ পর্বতটি আরমেনিয়ার আরারাত পর্বতমালার সর্বোচ্চ পর্বত বলে কথিত হয়ে থাকে, কিন্তু ঐ দুটি বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গতি বিধানের জন্য মানুষ যে তাঁর নাম বদল করেনি এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর ব্লাশেয়ার এ কথা সমর্থন করে বলেছেন যে, আরবে জুদি নামে একটি পাহাড় আছে। তবে নামের এ সামঞ্জস্য কৃত্রিমও হতে পারে।
পরিশেষে একথা বলা যায় যে, প্লাবন সম্পর্কে বাইবেল ও কুরআনের বর্ণনায় যে প্রধান প্রধান পার্থক্য আছে তা সঠিক ও সুনির্দিষ্ট ভাবেই সনাক্ত করা সম্ভব। কয়েকটি পার্থক্য অবশ্য বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের অভাবে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয়। তবে স্বীকৃত ও সর্বজন গৃহীত তথ্যের আলোকে বিচার করলে দেখা যায় যে বাইবেলের বর্ণনা সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত তথ্য ও জ্ঞানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ; বিশেষত প্লাবনের সন তারিখ এবং ভৌগলিক পরিধি সম্পর্কে এই কথা আরও বেশী প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে কুরআনের বর্ণনায় এমন কিছু নেই যার বিরুদ্ধে কোন বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা উত্থাপন করা যেতে পারে। তবে কেউ হয়ত এমন কথা বলতে পারেন যা, বাইবেল ও কুরআন নাযিল হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে মানুষের পক্ষে এমন জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব ছিল কিনা, যার ফলে ঘটনাটি সম্পর্কে সঠিক তথ্য অবগত হওয়া গিয়েছিল? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, না। কারণ, ওল্ড টেস্টামেন্টের সময় থেকে কুরআনের সময় পর্যন্ত এ প্রাচীন কাহিনীটি সম্পর্কে একমাত্র বাইবেল ছাড়া মানুষের কাছে আর কোন দলীল ছিল না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে ঘটনাটির বিবরনে পরবর্তীকালে যে অর্থ ও তাৎপর্যগত পরিবর্তন এসেছে তাতে মানুষের কোন হাত নেই। তাহলে এ পরিবর্তনের জন্য আর একটি ব্যাখ্যা বা কারণ মেনে নিতে হয় এবং তা হচ্ছে বাইবেলের বর্ণনার পরবর্তীকালে নাযিল হওয়া অহি।