কুরআনের তথ্যের মুকাবিলায়
যে পাঁচটি ক্ষেত্রে কুরআনে সৃষ্টি বিষয়ে যে তথ্য দেয়া আছে, আমরা তা পরীক্ষা করে দেখব।
১) কুরআনের বক্তব্য মুতাবেক আকাশমন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টির ছয় মেয়াদে যে সকল কাজ সম্পন্ন হয়েছে তা হচ্ছে জ্যোতির্মন্ডল ও পৃথিবীর গঠন এবং মানুষের বাসযোগ্য (খাদ্যসহ) হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীর ক্ষেত্রে কুরআনে যে সকল ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তা ঘটতে চার মেয়াদ সময় লেগেছে। এ চার মেয়াদের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের ভূতাত্ত্বিক চার মেয়াদের মিল আছে। আর আমরা জানি, মানুষের বসতি শুরু হয়েছে শেষ মেয়াদে। অবশ্য বিজ্ঞানের এ মেয়াদে বিভক্তি নিছক অনুমান মাত্র। সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারেন না।
লক্ষণীয় যে, আল কুরআনের সূরা হামিম্ম আস-সিজদায় (৯-১২ আয়াত) জ্যোতির্মন্ডল ও পৃথিবীর গঠন দু পর্যায়ে হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন সূর্য ও তাঁর উপজাত পৃথিবীকে যদি আমরা উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করি (একমাত্র এ উদাহরণই আমাদের বোধগম্য) তাহলে দেখা যায় বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে যে, আদি বাষ্প ঘনীভূত ও পরে পৃথক হয়ে সূর্য পৃথিবীর গঠিত হয়েছে। আল কুরআনে ঠিক এ কথাই বলা আছে। স্পষ্ট ও পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছে যে, ‘ধুম্র’ সমন্বিত ও পরে পৃথক হয়ে সূর্য ও পৃথিবী গঠিত হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, তথ্যগত দিক থেকে কুরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে।
২) আধুনিক বিজ্ঞানে একটি তারকা (যেমন সূর্য) ও তাঁর উপগ্রহের (যেমন পৃথিবী) গঠনের দুটি পর্যায়ের মধ্যে সংযোগের কথা বলা হয়েছে। কুরআনের যে আয়াত আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, তাতে এ সংযোগের কথাই সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩) আল কুরআনে বিশ্বজগত সৃষ্টির আদি পর্যায়ে যে ‘ধুম্রের’ অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে, তা স্পষ্টতই আধুনিক বিজ্ঞানের ‘আদি বাষ্প’।
৪) কুরআনে আকাশের সংখ্যা একাধিক বলে যে উল্লেখ আছে, আধুনিক বিজ্ঞান তা নির্দ্বিধায় সমর্থন করে। তারকারাজি ও তাদের সংখ্যা বহু হওয়া সম্পর্কে জ্যোতির্পদার্থবিদগণ যে অভিমত দিয়েছেন, তাতেই ঐ সমর্থন আছে। পক্ষান্তরে আমাদের এ পৃথিবীর মত (অন্তত কোন কোন দিক থেকে) আরও অনেক পৃথিবী আছে বলে কুরআন থেকে একটি ধারণা পাওয়া যায়, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এখনও এ ধারণার সত্যতা নিরূপণ করতে পারেনি। তবে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, একাধিক পৃথিবী থাকা খুবই সম্ভব।
৫) কুরআনে ”আকাশমন্ডল’ ও ‘পৃথিবীর’ মধ্যবর্তী স্থানে একটি ‘মধ্যবর্তী সৃষ্টি’র উল্লেখ আছে। আধুনিক বিজ্ঞানে সংগঠিত জ্যোতির্মন্ডলের বাইরে ‘অজ্ঞাত পদার্থের সেতু’র অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। অবশ্য কুরআনের বর্ণনায় যে সকল বিষয়ের অবতারণা করাহয়েছে, তার সবগুলি বৈজ্ঞানিক তথ্যদ্বারা সম্পূর্ণরূপে সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়নি বটে, কিন্তু বিশ্বজগতের সৃষ্টি সম্পর্কে কুরআনের তথ্যও আধুনিক জ্ঞানের মধ্য আদৌ কোন বিরোধ নেই। কুরআনের এ তথ্যের উপর জোর দেয়া এ কারণে বিশেষ প্রয়োজন যে, ঐ একই বিষয়ে বর্তমান কালের ওল্ড টেস্টামেন্টে যে সকল তথ্য আছে, তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আদোউ গ্রহণযোগ্য নয়। একই বিষয়ে বাইবেলের স্যাকারডোটাল সংস্করণে যে বিবরণ আছে, তা ব্যাবিলনে নির্বাসনের সময় পাদ্রিগণ নিজেরাই লিখেছিলেন এবং তাদের ধর্মীয় মতবাদের উপরে বৈধতার আবরণ দেয়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল। ইয়াহভিস্ট সংস্করণে যে বর্ণনা আছে তা এতই সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট যে, বৈজ্ঞানিক বিবেচনার আদৌ উপযুক্ত নয়। কুরআন ও বাইবেলের বর্ণনার এ বিরাট পার্থক্যের উপর আর একবার বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ ও দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। কারণ ইসলামের সে আদিকাল থেকেই মুহাম্মদের (সঃ) বিরুদ্ধে এ ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হচ্ছে যে, তিনি বাইবেলের বর্ণনার ব্যাপারে এ অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে অসত্য ও ভিত্তিহীন। চৌদ্দশত বছর আগের একজন মানুষ কেমন করে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল তথ্য বাদ দিয়ে তৎকালীন বিবরণ সংশোধন করলেন?এবং নিজের প্রচেষ্টায় কিভাবে এমন সব তথ্য ও বর্ণনা যোগ করে দিলেন, যার সত্যতা কেবলমাত্র বর্তমান কালের বিজ্ঞানের পক্ষে নিরূপণ ও সাব্যস্ত করা সম্ভব হল? সুতরাং বাইবেল নকল বা সংশোধন করার অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে যুক্তিহীন। সৃষ্টি বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা বাইবেলের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।
কতিপয় আপত্তির জবাব
তবে অন্যান্য বিষয়ে, বিশেষত ধর্মীয় ইতিহাসের বর্ণনার ক্ষেত্রে কুরআন ও বাইবেলের মধ্যে যে সাদৃশ্য আছে সে সম্পর্কে কোন মতবিরোধ নেই। এ প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ওল্ড টেস্টামেন্টের অনেক তথ্য ও শিক্ষা মিলে যাওয়া সত্ত্বেও কেউ তাঁর নকলের অভিযোগ উত্থাপন করেন না। অথচ সেইভাবে মিলে যাওয়ার কারণেই পাশ্চাত্যে মুহাম্মদকে (সঃ) প্রতারক (নাউযুবিল্লাহ) বলে অভিহিত করা হয় এবং বলা হয় যে, বাইবেল থেকে নকল করা সত্বেও সেই শিক্ষা নকলকে তিনি অহি বলে চালিয়েদিয়েছেন। তিনি খৃষ্টান পাদ্রিদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে সেই একই জিনিস অহি বলে চালিয়ে দিয়েছেন বলে যে অভিযোগ করা হয় তাও ঐ একই ভাবে ভিত্তিহীন। যারা এ অভিযোগ করে থাকেন, তাদের আমি আর ব্লাশেয়ার রচিত ‘দি প্রবলেম অব মুহাম্মদ (ল্য প্রবলেম দ্য মাহোমেট, প্রেসেস ইউনিভার্সিটেয়ারিস দ্য ফ্রান্স, প্যারিস, ১৯৫২) বইখানি আর একবার পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। এ সকল অভিযোগকে তিনি ‘আজগুবি উপকথা’ বলে অভিহিত করেছেন।
বাইবেলের অনেক পূর্ববর্তী বিশ্বাসের সঙ্গেও কুরআনের অন্যান্য বর্ণনার মিল আছে বলে ইঙ্গিত করা হয়ে থাকে।
ধর্মগ্রন্থে সাধারণত সৃষ্টিতত্ব বিষয়ক প্রবাদের সমর্থন অনুসন্ধান করা হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপবলা যায় যে, পলিনেশিয়ানদের মধ্যে এ মর্মে একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, আদি পানি অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল এবঙ্গালো আবির্ভূত হওয়ার পর তা পৃথক হয়ে যায়। এভাবে আকাশ ও পৃথিবী গঠিত হয়। এ প্রবাদটিকে বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্বের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য আছে বটে, কিন্তু তাই বলে ঐ প্রবাদ নকল করে বাইবেলের বিবরণ লেখা হয়েছে বলে অভিযোগ করার কোন যুক্তি নেই।
একইভাবে বিশ্বজগতের আদি উপাদানের প্রাথমিক বিভক্তি সম্পর্কে কুরআনে যে ধারণা আছে এবং যে ধারণা আধুনিক বিজ্ঞান সমর্থন করে, সে ধারণা বিভিন্ন আকারে বিভিন্ন প্রবাদে পাওয়া যায় বলে সেই প্রবাদ থেকে নকল করে কুরআনে বসিয়ে সেয়া হয়েছে বলাও একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ। তবুও এ প্রবাদ ও পৌরাণিক কিচ্ছাগুলি ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। ঐগুলিতে প্রায়শ এমন একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়, যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয় এবং আজগুবি বর্ণনা বাদ দিলে আমরা এখন যা সত্য বলে জানি (বা জানি বলে মনে করি), তাঁর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেও দেখা যায়। এ ধারণাটি হচ্ছে আদিতে আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর একত্রিত থাকা এবং পরে পৃথক হয়ে যাওয়া। কিন্তু জাপানে যখন ঐ ধারণার সঙ্গে ডিম, তাঁর মধ্যে একটি বীজ এবং চতুর্দিকে বিশৃংখলা থাকার কথা যোগ করা হয়, তখন সমগ্র ব্যাপারটিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। অন্যান্য দেশে ডিমের বদলে একটি চারাগাছ যোগ করা হয়। চারাটি আস্তে আস্তে বড় হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আকাশমন্ডল আলাদা হয়ে পৃথিবী থেকে উপরে উঠে যায়। এ ক্ষেত্রেও ঐ কাল্পনিক বিস্তারিক বিবরণটিই প্রবাদটির বৈশিষ্ট। তবুও মূল ধারণা কিন্তু সর্বত্রই পাওয়া যায়।
মানুষের কল্পনা যে কিভাবে অলংকার ও আচ্ছাদন সৃষ্টি করেছে, এবং কুরআনের
বর্ণনার সঙ্গে যে মৌলিক পার্থক্য আছে, তা দেখানোর জন্যই এখানে প্রবাদগুলির উল্লেখ করা হল। কুরআনের বর্ণনায় কোন আজগুবি বিবরণ নেই, ভাষা ও শব্দপ্রয়োগ সংযত এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সৃষ্টিতত্ব সম্পর্কে এরূপ সঠিক বিবরণ চৌদ্দ শতাব্দীর আগে কিভাবে কুরআনে এল, সে সম্পর্কে কোন মানবিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
কুরআনের জ্যোতির্বিদ্যা
আল কুরআনে আকাশমন্ডলী সম্পর্কে বহুবিদ চিন্তা ও ধারণা দিক নির্দেশ আছে। সৃষ্টি সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা আগেই দেখেছি যে, কুরানে একাধিক আকাশ ও একাধিক পৃথিবীর উল্লেখ করা হয়েছে, এবং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থানে একটি ‘মধ্যবর্তী সৃষ্টির’ কথা বলে হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান এ ‘মধ্যবর্তী সৃষ্টির’ প্রমাণ পেয়েছে। আকাশমন্ডলে অর্থাৎ পৃথিবীর বাইরে যে কি আছে, সে সম্পর্কে সৃষ্টি বিষয়ক আয়াতে একটি মোটামুটি ধারণা দেয়া হয়েছে।
সৃষ্টি বিষয়ক সুনির্দিষ্ট আয়াত ছাড়াও কুরআনে আরও প্রায় চল্লিশটি এমন আয়াত আছে যেখানে জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক তথ্য আছে। জ্যোতির্মন্ডলের সৃষ্টি বস্তু সম্পর্কে চিন্তা ও ধারণার দিকনির্দেশ আছে। কয়েকটি আয়াতে অবশ্য তারকা ও গ্রহমন্ডলীর সংগঠক হিসাবে স্রষ্টার মাহাত্ম অনুধাবনের আহবান ছাড়া আর কিছু নেই। যাহোক, আমরা জানি যে, তারকা ও গ্রহমন্ডলী একটি নিখুত ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে আছে এবং এ অবস্থান যে স্থায়ী ও সুদৃঢ় তা নিউটন তাঁর ‘গ্রহের পারষ্পরিক’ আকর্ষণ নীতিতে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
আমরা প্রথমেই যে আয়াতগুলি উধৃত করব, সেখানে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের জন্য তেমন কোন তথ্য নেই, তবুও আল্লাহর সর্বশক্তিমানতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই এ উধৃতি প্রয়োজন। তদুপরি বিশ্বমন্ডলের সংগঠন বিষয়ে দেড় হাজার বছর আগে কুরআনে যে বাস্তব সম্মত বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা অনুধাবনের জন্যও এ উধৃতি প্রয়োজন।
অহির ক্ষেত্রে এ সকল তথ্য ও প্রসঙ্গ একটি সম্পূর্ণ ব্যাপার। কারণ এ বিশ্ব সংগঠন বিষয়টি ওল্ড টেস্টামেন্টেও নেই, বাইবেলেও নেই। কিছু কিছু ধারণার উল্লেখ অবশ্য আছে কিন্তু তা যে সম্পূর্ণ ভুল ও কল্পনা মাত্র, তা আমরা সৃষ্টি বিষয়ক বাইবেলের বর্ণনার আলোচনাকালে দেখতে পেয়েছি। কুরআনে অবশ্য এ বিষয়টি গভীরও বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। যা বর্ণিত হয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যা বর্ণিত হয়নি তাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, কুরআন নাযিল হওয়ার সময় জ্যোতির্মন্ডলের সংগঠন সম্পর্কে যে সকল মতবাদ প্রচলিত ছিল, কুরআনে তাঁর কোন উল্লেখ নেই।
পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিকগণ ঐ সকল মতবাদ সম্পূর্ণ ভুল বলে সাব্যস্ত করেছেন। পরে এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ পেশ করা হবে।
ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নেতিবাচক হলেও তাঁর উল্লেখ করা খুবই প্রয়োজন। কারণ কুরআনে প্রদত্ত তথ্যের মানবিক ব্যাখ্যা – অন্য কোন ব্যাখ্যা নয়- সেরেফ মানবিক ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য যারা আকাশ পাতাল হাতড়ে বেড়ান, তাদের অনেককে আমি বলতে শুনেছিঃ”কুরআনে যদি জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক বিস্ময়কর বর্ণনা থেকে থাকে, তাহলে তাঁর কারণ হচ্ছে এই যে, আরবগণ ঐ বিষয়ে খুবই জ্ঞানবান ছিল।” কিন্তু তারা খেয়াল করে দেখেন না যে, মুসলিম দেহস সমূহে সাধারণভাবে বিজ্ঞানচর্চা হয়েছে কুরআন নাযিল হওয়ার পরে এবং সে আমলের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও কোন মানুষের পক্ষে কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি লিখে দেয়া জন্য যথেষ্ট ছিল না। পরে আমরা তথ্য ও উদাহরণ দিয়ে এ মন্তব্যের সততা সাওব্যস্ত করব।
আকাশ সম্পর্কে চিন্তা ও ধারণার সাধারণ দিকনির্দেশ
“উহারা কি উহাদিগের উর্ধস্থিত আকাশের দিকে তাকাইয়া দেখে না আমি কি ভাবে উহা নির্মাণ করিয়াছি এবং উহাতে কোন ফাটল নাই?”- সূরা ৫০ (কাফ) আয়াত ৬: সাধারণ বিষয় মানুষ।
“তিনি আকাশমন্ডলী নির্মাণ করিয়াছেন স্তম্ভ ব্যতীত- তোমরা ইহা দেখিতেছ…” সূরা ১৩ (রা’দ) আয়াত ২।
“আল্লাহই উর্ধদেশে আকাশমণ্ডলী স্থাপন করিয়াছেন স্তম্ভ ব্যতীত- তোমরা ইহা দেখিতেছ। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হইলেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মাধীন করিলেন………।”
আকাশমন্ডলী স্তম্ভের উপর স্থাপিত আছে এবং তাঁর ফলে তা পড়ে গিয়ে পৃথিবী বিধ্বস্ত করছে না বলে যে বিশ্বাস প্রচলিত আছে, এ দুটি আয়াতে তা মিথ্যা বলে সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
“তিনি আকাশকে করিয়াছেন সমুন্নত……” সূরা ৫৫ (রহমান) আয়াত ৭।
“তিনি আকাশকে স্থির রাখেন যাহাতে উহা পতিত না হয় পৃথিবীর উপর তাহার অনুমতি ব্যতীত।”- সূরা ২২ (হজ্জ) আয়াত ৬৫।
একথা এখন সর্বজনবিদিত যে, জ্যোতির্মন্ডলের বিভিন্ন গরহ০উপগ্রহের পারষ্পরিক বিপুল দূরত্ব এবং তাদের আকার ও আয়তনের ভিত্তিতে তাদের ভারসাম্য নির্ণীত ও রক্ষিত হয়ে থাকে। দূরত্ব যত বেশী হয়, পারষ্পরিক আকর্ষণের শক্তিও তত কম হয়। দুরত্ব কম হলে আকর্ষণের শক্তি বেশী হয়।
চাঁদ পৃথিবীর নিকটে অবস্থিত বলে আকর্ষণ শক্তির নিয়মে তা পৃথিবীর সমুদ্রের পানির উপরে প্রভাব বিস্তার করে থাকে এবং এ
ঘটনাটি জোয়ার ভাটা নামে পরিচিত। দুটি গ্রহ যদি পরস্পরের খুব কাছে এসে পড়ে, তাহলে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সংঘর্ষ যে হয় না তাঁর কারণ এই যে, সকল গ্রহ উপগ্রহ একটি নিয়মের অধীন হয়ে আছে। আল্লাহই যে তাদের নিয়মের অধীন করে রেখেছেন, কুরআনের বহু স্থানে তাঁর উল্লেখ আছে।
আল্লাহ নবীকে বলেছেনঃ”জিজ্ঞাসা কর কে সপ্তাকাশ এবং মহা আরশের অধিপতি?”- সূরা ২৩ (মুমিনুন) আয়াত ৮৬।
সপ্তাকাশ বলতে যে কেবলমাত্র ৭টি আকাশ বুঝায় না বরং অনির্দিষ্ট বহু সংখ্যক আকাশ বুঝায় তা আমরা আগেই ব্যাখ্যা করেছি।
“তিনি তোমাদিগের অধীন করিয়া দিয়াছেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত কিছু নিজ অনুগ্রহে, চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য ইহাতে রহিয়াছে নিদর্শন।”- সূরা ৪৫ (জাসিয়া) আয়াত ১৩।
“সূর্য ও চন্দ্র অবতরণ করে নির্ধারিত কক্ষপথে।” সূরা ২৫ (রহমান) আয়াত ৫।
“তিনিই বিশ্রামের জন্য রাত্রি এবং গণনার জন্যে চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করিয়াছেন।” সূরা ৬ (আনআম) আয়াত ৯৬।
“তিনি তোমদিগের অধীন করিয়াছেন সূর্য ও চন্দ্রকে যাহারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী এবং তোমাদিগের অধীন করিয়াছেন রাত্রি ও দিবসকে।” – সূরা ১৪ (ইব্রাহীম) আয়াত ৩৩।
এখানে একটি আয়াত অপর আয়াতের সম্পূরক। গ্রহ- উপগ্রহের একই নিয়মের অধীন করার ফলেই তারা নির্ধারিত কক্ষপথে নিয়মিত পরিক্রমণ করে। এ অর্থ প্রকাশের জন্য আরবী ‘দাইব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার মূল অর্থ হচ্ছে ‘কোন কিছুর জন্য নিষ্ঠা ও আগ্রহ সহকারে কাজ করা। ‘ কিন্তু এখানে শব্দটি যেভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁর অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে ‘নির্ধারিত আচরণের ভিত্তিতে অপরিবর্তনীয় আকারে নিষ্ঠার সঙ্গে কোন কিছু করে যাওয়া।’
সূরা ৩৬ (ইয়াসীন) আয়াত ৩৯: আল্লাহ বলেছেনঃ”এবং চন্দ্রের জন্য আমি নির্দিষ্ট করিয়াছি বিভিন্ন মনজিল; অবশেষে উহা শুষ্ক বাঁকা খর্জুর শাখার আকার ধারন করে।”
খেজুর শাখা শুকিয়ে সংকুচিত হয়ে বাঁকা চাদের আকারই ধারন করে। পরে বিষয়টির আরও ব্যাখ্যা হবে।
সূরা ১৬ (নাহল) আয়াত ১২:”তিনিই তোমাদিগের অধীন করিয়াছেন রজনী, দিবস, সূর্য এবং চন্দ্রকে; নক্ষত্ররাজিও অধীন হইয়াছে তাহারই বিধানে। অবশ্যই ইহাতে বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রহিয়াছে নিদর্শন।”
স্থল ও নৌপথে মানুষের ভ্রমন এবং সময়ের হিসেব রাখার সহায়ক রূপে জ্যোতির্মন্ডলের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, সেই বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকেই বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনেরসহজ ভাষা যারা বুঝতে পারে, তাদের লক্ষ্য করেই কুরআনের বাণীতে বলা হয়েছে, এ কথা মনে রাখলে এ মন্তব্যটির অর্থ অনুধাবন করা সহজতর হবে। এ কারণেই নিচের আয়াতটিতে আরও সহজ কথা এসেছে।
সূরা ৬ (আনআম) আয়াত ৯৭:”তিনি তোমাদিগের জন্য নক্ষত্র সৃষ্টি করিয়াছেন যেন তদ্বারা স্থলে ও সমুদ্রের অন্ধকারের তোমরা পথ পাও। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করিয়াছেন। ”
সূরা ১৬ (নাহল) আয়াত ১৬:”এবং তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন পথ নির্ণায়ক চিহ্নসমূহ এবং উহারা নক্ষত্রের সাহায্যেও পথের নির্দেশ পায়।”
সূরা ১০ (ইউনুস) আয়াত ৫: তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করিয়াছেন এবং উহার মনজিল নির্দিষ্ট করিয়াছেন যাহাতে তোমরা বৎসর গণনা ও কাল নির্ণয়ের জ্ঞান লাভ করিতে পার। আল্লাহ ইহা নিরর্থক সৃষ্টি করেন নাই। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এ সমস্ত নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।”
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাইবেলে সূর্য ও চন্দ্র উভয়কে ‘আলোক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং একটিকে ‘বেশী’ ও অপরটিকে ‘কম’ বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কুরআনে ঐ মাত্রার পার্থক্য নয়, মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরে ‘তেজস্কর’ ও ‘জ্যোতির্ময়’ বলা হয়েছে। এ পার্থক্য হয়ত নিছক শব্দগত পার্থক্য বলেও পরিগণিত হতে পারে, কিন্তু বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে দুটি যে একই আলোক নয়, তা আর কিভাবে বুঝানো যেত?
জ্যোতিষ্ক মন্ডলের প্রকৃতিঃ সূর্য ও চন্দ্র
সূর্য একটি তেজস্কর আভা (দিইয়া) এবং চন্দ্র একটি আলোক (নূর) । এ অনুবাদই অধিক নির্ভুল মনে হয়। অনেকে অন্যভাবে যে অনুবাদ করে থাকেন, সেখাএন দুটি শব্দ প্রায় একই অর্থ বহন করে থাকে। ‘দিইয়া’ শব্দটি স্ব ধাতু থেকে এসেছে। কাজী মিরস্কি রচিত আরবী-ফরাসি অভিধানে তাঁর অর্থ বলা হয়েছে ‘উজ্জ্বল হওয়া’ ‘আলোকিত হওয়া’ (আগুনের মত) । অবশ্য ‘আলোক’ শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে অর্থের দিক থেকে সূর্য ও চন্দ্রের প্রকৃতিগত পার্থক্য তেমন বড় হয়ে ধরা পড়ে না। তবে এ পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য আমরা মূল কুরানেরই সাহায্য নিতে পারি।
সূরা ২৫ (ফুরকান) আয়াত ৬১:”কত মহান তিনি যিনি নভোমন্ডল সৃষ্টি করিয়াছেন রাশিচক্র এবং উহাতে স্থাপন করিয়াছেন সূর্য ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র।”
সূরা ৭১ (নূহ) আয়াত ১৫-১৬:”তোমরা কি লক্ষ্য কর নাই আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন সপ্ত স্তরে বিন্যস্ত আকাশমন্ডলী, এবং সেথায় চন্দ্রকে স্থাপন করিয়াছেন আলোকরূপে ও সূর্যকে স্থাপন করিয়াছেন প্রদীপরূপে?”
সূরা ৭৮ (নাবা) আয়াত ১২-১৩:”আমি তোমাদিগের উর্ধদেশে সুস্থিত সপ্ত আকাশ নির্মাণ করিয়াছি, এবং প্রোজ্জল দীপ সৃষ্টি করিয়াছি।”
প্রোজ্জল দীপ বলতে স্পষ্টতই সূর্য বুঝানো হয়েছে। আর চন্দ্রকে বলা হয়েছে এমন একটি জ্যোতিষ্ক যে আলোক দেয় (মুনির) । মুনির শব্দটি এসেছে ‘নূর’ ধাতু থেকে। তাহলে অর্হ দাড়াচ্ছে, যে আলো (নূর) চন্দ্রের (মুনির) ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। সূর্যকে অবশ্য প্রদীপ (সিরাজ) বা প্রোজ্জল (ওয়াহহাজ) দীপের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
মুহাম্মদের (সঃ) আমলের যে কোন মানুষের পক্ষে এ পার্থক্য উপলব্ধি করা খুবই সহজ ছিল। কারণ মরুভূমির বাসিন্দাদের কাছে সূর্যের তেজস্কর প্রোজ্জল রূপ এবং চন্দ্রের শীতল আলোক খুবই পরিচিত ছিল। সুতরাং কুরআনে এ দুটি জ্যোতিষ্ক বুঝানোর জন্য যে তুলনা ব্যবহার করা হয়েছে তা খুবই স্বাভাবিক হয়েছে। তবে লক্ষণীয় যে, এ তুলনায় এমন কিছু ব্যবহার করা হয়নি, যা তৎকালে ছিল কিন্তু এখন নেই। ফলে ব্যাপারটি উপলব্ধি করতে এতদিন পরে আমাদেরও কোন অসুবিধা হচ্ছে না।
আমরা জানি যে, সূর্য এমন একটি নক্ষত্র যা আন্তরিকভাবে জেওলন্ত হয়রা ফলে তাপ ও আলো বিকিরণ করে থাকে। পক্ষান্তরে চন্দ্র নিজস্ব কোন আলো দেয় না, বরং একটি অসাড় বস্তু হিসেবে (অন্তত বাইরের আবরণের দিক থেকে) সূর্য থেকে পাওয়া আলো প্রতিফলন করে মাত্র।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বিজ্ঞানের মারফত আমরা এখন সূর্য ও চন্দ্র সম্পর্কে না জানি, কুরানে তাঁর বিপরীত কোন কথা নেই।
নক্ষত্র মন্ডল
সূর্যের মত নক্ষত্রও আসমানী জ্যোতিষ্ক। এ জ্যোতিষ্কে অনেক প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে থাকে, তাঁর মধ্যে সহজে দেখা যায় যে তা হচ্ছে আলো সৃষ্টি। অর্থাৎ নক্ষত্র নিজের আলো নিজেই উৎপাদন করে থাকে।
নক্ষত্র শব্দটি কুরআনে তের বার এসেছে। আরবী ‘নজম’ বহুবচনে ‘নুজুম’ এ শব্দটি যে মূলধাতু থেকে এসেছে, তার অর্থ হচ্ছে আবির্ভূত হয়া, দৃশ্যমান হওয়া। ঐ শব্দে কেবল একটি দৃশ্যমান আসমানী জ্যোতিষ্কের তাৎপর্য এসেছে, কিন্তু জ্যোতিষ্কটি নিজেই আলোক উৎপন্ন করে, না অপরের আলোক প্রতিফলন করে, সে সম্পর্কে কোন আভাস আসেনি। তবে জ্যোতিষ্কটি যে তারকা, এ কথাটি পরিষ্কারভাবে বুঝানোর জন্য কুরআনে একটি গুণবাচক শব্দ ব্যবহার হয়েছে।
সূরা ৮৬ (তারিক) আয়াত ১-৩:”শপথ আকাশের এবং রাত্রিকে যাহা আবির্ভুত হয় তাহার; রাত্রিতে যাহা আবির্ভুত হয় উহার সম্বন্ধে তুমি কি জান? উহা এক উজ্জ্বল নক্ষত্র!”
আল কুরআনে সন্ধ্যা-নক্ষত্রের গুণবাচক শব্দ হিসাবে ‘সাকিব’ ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দটির অর্থ ‘যাহা কোন কিছু ভেদ করে। ‘ এখানে রাত্রির অন্ধকার ভেদ করার অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। উল্কাপাত বুঝানোর জন্যও সূরা সাফফাতে (সূরা ৩৭, আয়াত ১০) ঐ একই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, নক্ষত্রে অগ্নিকান্ডের ফলে উল্কাপাত হয়ে থাকে।
গ্রহমন্ডল
বর্তমাণে যুগে বিভিন্ন গ্রহ যেমন নির্দিষ্ট নামে সনাআক্ত করা হয়ে থাকে কুরআনে ঠিক সেইভাবে সনাক্ত করা হয়েছে কিনা বলা কঠিন।
গ্রহের নিজস্ব কোন আলো নেই তারা সূর্যের চারদিকে আবর্তিত হয়ে থাকে। পৃথিবী এ রকম আবর্তনশীল গ্রহ। গ্রহ হয়ত অন্যত্রও থাকতে পারে, কিন্তু যে সকল গ্রহের কথা এ যাবত জানা গিয়েছে তাঁর সবগুলিই সৌরজগতে অবস্থিত।
প্রাচীনকালে পৃথিবী ছাড়াও গ্রহের অস্তিত্ব মানুষের জানা ছিল। এ পাঁচটি গ্রহ হচ্ছে মার্কারি (বুধ), ভেনাস (মঙ্গল), মার্স (মঙ্গল), জুপিটার (বৃহস্পতি), এবং স্যাটার্ন (শনি) । সাম্প্রতিককালে আরও তিনটি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে- ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো। কুরআনে ‘কাওকাব’ (বহুবচনে কাওয়াকিব) শব্দ দ্বারা গ্রহমন্ডল বুঝানো হয়েছে, তবে গ্রহের সংখ্যা বলা হয়নি। ইউসুফের স্বপ্নে (সূরা ১২-ইউসুফ) এগারটি গ্রহের উল্লেখ আছে, কিন্তু ঐ বর্ণনা সংজ্ঞা হিসাবে কাল্পনিক।
‘কাওকাব’ শব্দের অর্থের একটি উত্তম সংজ্ঞা মনে হয় কুরআনের একটি বিখ্যাত আয়াতে দেয়া হয়েছে। এ সংজ্ঞার গভীরতর তাৎপর্যের আধ্যাত্মিক প্রকৃতি খুবই প্রকট এবং এ বিষয়ে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্কও আছে। তথাপি ঐ আয়াতে ঐ শব্দের বিষয়ে যে উপমামূলক বর্ণনা আছে তাতে মনে হয় সম্ভবত একটি ‘গ্রহের’ কথাই বলা হয়েছে।
সূরা ২৪ (নূর) আয়াত ৩৫:”আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি, তাহার জ্যোতির উপমা কুলুঙ্গি যাহার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ।” এখানে বিষয়টি হচ্ছে আলোক প্রক্ষেপণ করা, এমন একটি বস্তুর উপরে যা (কাঁচ) ঐ আলোক প্রতিফলন করে এবং নিজেও উজ্জ্বল হয়; ঠিক যেমন সূর্যের আলোকে চন্দ্র আলোকিত হয়। কুরআনে কাওকাব’ শব্দটির এ একটি মাত্র ব্যাখ্যামূলক বর্ণনা পাওয়া যায়।
অন্যান্য আয়াতেও শব্দটি আছে। কিন্তু তাঁর মধ্যে কয়েকটি আয়াতে শব্দটি দ্বারা যে কোন আসমানী জ্যোতিষ্ক বুঝানো হয়েছে তা নির্ণয় করা কঠিন। যেমন সূরা ৬ (আনআম) আয়াত ৭৬; এবং সূরা ৮২ (ইনফিতার) আয়াত ১-২।
তবে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে বিবেচনা করলে মনে হয় একটি আয়াতে অন্তত যে আসমানী বস্তুর কথা বলা হয়েছে তা আমাদের জানা গ্রহের দিকেই বিশেষভাবে ইঙ্গিত করে।
সূরা ৩৭ (সাফফাত) আয়াত ৬:”আমি তোমাদিগের নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজি দ্বারা সুশোভিত করিয়াছি।”
কুরআনের ‘তোমাদিগের নিকটবর্তী আকাশ’ বলতে কি সৌরজগত বুঝায়? একথা এখন সুবিদিত যে, আমাদের নিকটবর্তী আসমানী বস্তু নিচয়ের মধ্যে গ্রহ ছাড়া আর কোন স্থায়ী বস্তু নেই এবং সৌরজগতে সূর্যই একমাত্র নক্ষত্র যার নিজস্ব নাম আছে। সুতরাং গ্রহের কথা যদি না বলা হয়ে থাকে তাহলে আর যে কিসের কথা বলা হয়েছে তা নির্ণয় করা কঠিন। সুতরাং আয়াতটির যে তরজমা পেশ করা হয়েছে তা সঠিক বলেই মনে হয় এবং আমরা এখন গ্রহ বলতে যা বুঝাই কুরআনে সম্ভবত তাঁর কথাই বলা হয়েছে।
নিম্নতম আকাশ
কুরআনে কয়েকবারই নিম্নতম আকাশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিষ্কমন্ডলের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে নিম্নতম আকাশেই ঐগুলি অবস্থিত। আমরা আগেই দেখেছি যে, বিভিন্ন জ্যোতিষ্কের মধ্যে গ্রহকেই প্রথম স্থান দিতে হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে যে সকল বস্তুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে সেই সকল বস্তুর ধারণার সঙ্গে আল কুরআনে যখন বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক প্রাকৃতিক বিবরণ সংযুক্ত করা হয়, তখন তাঁর অর্থ আমরা ঠিক পরিষ্কারভাবে ধরতে পারি না।
যেমন একটু আগে উধৃত করা আয়াতটির (সূরা ৩৭ সাফফাত, আয়াত ৬:”আমি তোমাদিগের নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজি দ্বারা সুশোভিত করিয়াছি”) অর্থ আমরা সহজেই বুঝতে পারি। কিন্তু ঐ একই সুরার ঠিক পরবর্তী আয়াতে (আয়াত ৭) বলা হয়েছে-”ও ইহাকে রক্ষা করিয়াছি প্রত্যেক অবাধ্য শয়তান হইতে।” রক্ষা করার কথা সূরা আম্বিয়া (সূরা ২১ আয়াত ৩২)”এবং আকাশকে করিয়াছি সুরক্ষিত ছাদ” এবং সূরা হামীম- আস-সিজদাতেও (সূরা ৪১ আয়াত ১২)”এবং তিনি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করিলেন প্রদীপমালা দ্বারা এবং করিলেন সুরক্ষিত” উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু এখানে আমরা একটি সম্পূর্ণ পৃথক তাৎপর্যের সম্মুখীন হই।
তাছাড়া সূরা মূলকের (সূরা ৬৭) ৫ আয়াতে বলা হয়েছে-”আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করিয়াছি প্রদীপমালা দ্বারা এবং উহাদিগকে করিয়াছি শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণও এবং উহাদিগের জন্য প্রস্তুত রাখিয়াছি জলন্ত অগ্নির শাস্তি।” এখানে নিকটবর্তী আকাশে ‘শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ ‘ বলতে কি বুঝা যেতে পারে? ঐ প্রদীপমালাই কি নিক্ষেপের উপকরণ? (আমরা অবশ্য জানি যে, কোন উল্কা যখন বায়ুর ওপরের স্তরে এসে পৌছায়, তখন তারকা নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত একটি আলোকোজ্জল ঘটনা ঘটে) ।
কিন্তু এ সকল বিষয় সম্ভবত আমাদের বর্তমান আলোচনার পরিধি বহির্ভুত। তথাপি একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরার স্বার্থেই এখানে এতগুলির উল্লেখ করা হল। বিষয়গুলি এখন পর্যন্ত মানুষের বোধ্যগম্যতার পরিধির বাইরে রয়েছে তার সাহায্যেও কোন বোধগম্য ব্যাখ্যা পাওয়া বোধ হয় সম্ভব নয়।
জ্যোতির্মন্ডলের সংগঠন
এ বিষয়ে কুরআনে যে সকল তথ্য আছে তা প্রধানত সৌরজগত সম্পর্কিত। অবশ্য সৌরজগত বহির্ভুত বিষয়বস্তু সম্পর্কেও অনেক উল্লেখ আছে এবং ঐ সকল বিষয়বস্তু অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সূর্য ও চন্দ্রের কক্ষপথ সম্পর্কে কুরআনে দুটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ আয়াত আছে।
সূরা ২১ (আম্বিয়া) আয়াত ৩৩:”আল্লাহই সৃষ্টি করিয়াছেন রাত্রি ও দিবস এবং সূর্য ও চন্দ্র। প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণ করে।”
এখানে একটি জরুরী তথ্য দেয়া হয়েছে এবং তা হচ্ছে এই যে, সূর্য ও চন্দ্রের নিজস্ব কক্ষপথ আছে। তাছাড়া আরও জানা যাচ্ছে যে, ঐ দুটি জ্যোতিষ্ক তাদের নিজস্ব গতিতে চলে। আয়াত দুটি থেকে একটি নেতিবাচক তথ্যও জানা যাচ্ছে। বলা হয়েছে যে, সূর্য একটি কক্ষপথে চলে, কিন্তু পৃথিবীর প্রসঙ্গে এ কক্ষপথ যে কি তা বলা হয়নি। কুরআন নাযিল হওয়ার সময় মনে করা হত যে, সূর্য ঘোরে এবং পৃথিবী স্থির হয়ে থাকে। খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর টলেমির আমল থেকে খৃষ্টপরবর্তী ষোড়শ শতাব্দীর কপারনিকাসের আমল পর্যন্ত এ বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। মুহাম্মদের (সঃ) আমলেও লোকে এ ধারণাই পোষণ করত, কিন্তু তবুও কুরআনের কোথাও তাঁর কোন উল্লেখ নেই।
চন্দ্র ও সূর্যের কক্ষপথ
আরবী ‘ফালাক’ শব্দটি এখানে ‘কক্ষপথ’ বলে তরজমা করা হয়েছে। কুরানের অনেক ফারসী অনুবাদক শব্দটির ‘গোলক’ অর্থ আরোপ করেছেন। প্রাথমিক তাৎপর্য অবশ্যই ঐ রকমই দাড়ায়। হামিদুল্লাহ কিন্তু ‘কক্ষপথ’ বলেই তরজমা করেছেন।
আগে যুগের যারা কুরআনের তরজমা করেছেন, তারা শব্দটি নিয়ে বেশ বিভ্রান্ত হয়েছেন। কারণ তারা চন্দ্র ও সূর্যের ভ্রমণপথ গোলাকার হওয়ার ধারনা করতে পারেননি। ফলে তারা ঐ পথের এমন একটি আকার অনুমান করেছেন যা সম্ভবত মোটামুটি সঠিক কিম্বা সম্পূর্ণ বেঠিক। সি হামজা বোবেকার তাঁর কুরআনের তরজমায় শব্দটির বিভিন্ন ব্যাখ্যার উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন-”লৌহদন্ডের মত ধুরা বিশেষ, যার চারদিকে চাকা ঘোরে, জ্যোতির্মন্ডলের গোলক, কক্ষপথ, রাশিচক্রের চিহ্ন, গতি, ঢেউ।” কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি কুরআনের দশম শতাব্দীর বিখ্যাত ভাষ্যকার তারাবীর এ মন্তব্যটিও উধৃত করেছেন-”আমরা যখন জানি না তখন নীরব থাকাই উচিত। ‘ সুতরাং মানুষ কক্ষপথের এ ধারণাটি যদি মুহাম্মদের (সঃ) আমলে জ্ঞাত বা পরিচিত থাকত, তাহলে কুরআনের ঐ আয়াত দুটির মর্ম উপলব্ধির করা তখন অত কঠিন হত না। সুতরাং কুরআনে একটি সম্পূর্ন নতুন ধারনা এসেছিল এবং তাঁর সঠিক তাৎপর্য কয়েক শতাব্দী পরে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
চন্দ্রের কক্ষপথ
চন্দ্র যে পৃথিবীর একটি উপগ্রহ এবং উনত্রিশ একবার পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এ ধারনা এখন ব্যাপক ভাবে প্রচলিত। তবে তাঁর কক্ষপথ একেবারে গোলাকার নয়, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে কিছুটা বাঁকা বলা হয়েছে। সুতরাং পৃথিবী থেকে চন্দ্রের যে দূরত্ব (২৪০০০০ মাইল) তা হচ্ছে গড় দূরত্ব।
সময়ের হিসাব করার জন্য চন্দ্রের গতি পর্যবেক্ষন করার প্রয়োজনীয়তার ওপর কুরআনে যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি। (সূরা ১০ ইউনুস, ৫ আয়াত, ইতিপূর্বে উধৃত)
জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে যখন কুরআন নাযিল হয় তখন সেখানকার বাসিন্দারা চন্দ্রের গতিবিধির ভিত্তিতে সময় গণনা করতে অভ্যস্ত ছিল। তদুপরি কুরআন যেহেতু প্রাথমিক ভাবে তাদের উদ্দেশ্যেই নাযিল হয়েছিল, সেহেতু আকাশ ও পৃথিবীর যে সকল চিহ্ন ও নিশানা তাদের বোধগম্য ছিল সেই ভাষাতে কথা বলে তাদের অভ্যাসকে বিপর্যস্ত না করাই সঙ্গত হয়েছিল। তাছাড়া তাদের চন্দ্র ভিত্তিক সময় গণনাও নিখুত ও কর্মোপযোগী ছিল। একথা এখন সর্বজনবিদিত যে মরুভূমির লোকেরা আকাশ পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে খুবই পারদর্শী ছিল; তারকার অবস্থান দেখে তারা জাহাজ চালাত এবং চাঁদের আকার দেখে সময় গণনা করত। সে আমলে এ প্রক্রিয়াই তাদের জন্য সবচেয়ে সহজ ও নির্ভরযোগ্য ছিল।
বিশেষজ্ঞগণ ছাড়া অনেকেই জানেন যে জুলিয়ান (সৌর) ও চান্র ক্যালেন্ডারের মধ্যে সম্পূর্ন সামঞ্জস্যবিদ্যমান আছে- ২৩৫ চান্দ্রমাসে জুলিয়ান মতে ৩৬৫.২৫ দিনের বছরের ঠিক ১৯ বছর হয়। কিন্তু আমরা যে ৩৬৫ দিনে বছরের হিসাব করি তাও সঠিক হয় না, কারণ প্রত্যেক চার বছর অন্তর তা আবার সংশোধন করতে হয় (অতিবর্ষ) । চান্দ্র ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রে এ গরমিল দেখা দেয় ১৯ বছর পর পর (জুলিয়ান বা সোউর ক্যালেন্ডারের ১৯ বছর স্মরণ করুন) । এটাই মেটনিক চক্র, গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেটোনের নাম অনুসারে এ নামকরণ করা হয় এবং তিনি খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে সৌর ও চান্দ্র হিসাবের মধ্যকার এ সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক আবিষ্কার করেন।
সূর্যের কক্ষপথ
সূর্যের কক্ষপথের ধারণা করা আরও কঠিন। কারণ আমরা সমগ্র সৌরজগত সূর্যের চারদিকে বিন্যস্ত অবস্থায় দেখতেই অভ্যস্ত। কুরআনের আয়াতটি বুঝতে হলে আমাদের ধ্যান-ধারনার সাহায্য নেয়া প্রয়োজন।
আমাদের জ্যোতির্মন্ডলে অসংখ্য তারকা আছে। সমগ্র জ্যোতির্মন্ডলটির আকার একখানি থালার মত, তাঁর কেন্দ্রস্থলে তারকারাজির অবস্থান খুবই ঘন এবং কিনারের দিকে পাতলা। এ থালায় সূর্যের অবস্থান কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। জ্যোতিষ্কগুলি তাদের নিজস্ব কেন্দ্রের চারদিকে ঘোরে। ফলে সূর্যও ঐ একই কেন্দ্রের চারদিকে কক্ষপথে ঘোরে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে এ প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণ প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে। ১৯১৭ সালে শোপলি নামক একজন বিজ্ঞানী সূর্য থেকে জ্যোতির্মন্ডলের কেন্দ্রের দূরত্ব ১০ কিলোপারসেক অর্থাৎ ২ সংখ্যার পরে ১৭ টি শূন্য বসালে যত হয় তত মাইল বলে নির্ণয় করেন। নিজ কেন্দ্রের চারদিকে একবার ঘরতে জ্যোতির্মন্ডল ও সূর্যের প্রায় ২৫ কোটি বছর সময় লেগে যায় এবং এ ভ্রমণে সূর্যের গতি থাকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৫০ মাইল।
চৌদ্দ শতাব্দী আগে কুরআনে সূর্যের কক্ষপথের গতিবিধি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে এটা হচ্ছে সেই জিনিস। এ প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব এবং বিস্তারিত প্রণালী হাতে কলমে দেখিয়ে প্রমাণ করে দেয়ার সাফল্য অর্জন করা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব হয়েছে এবং এ সাফল্যও অনেক সাফল্যের মধ্যে একটি মাত্র।
মহাশূন্যে চন্দ্র ও সূর্যের নিজস্ব শক্তিতে চলার প্রসঙ্গ
বিদ্বান লোকেরা কুরআনের যে সক্ল তরজমা করেছেন, সেখানে এ ধারণাটি নেই। যেহেতু তারা জ্যোতির্বিজ্ঞানের সম্পর্কে কিছুই জানেন না, সেহেতু সংশ্লিষ্ট আরবী শব্দটির একাধিক অর্থের একটি অর্থ- ”সাঁতার দেওয়া”- গ্রহণ করে তরজমা করেছেন। সকল ফরাসী তরজমায় এ অবস্থা হয়েছে, এবং অন্যদিক থেকে খুবই প্রশংসনীয় আল্লামা ইউসুফ আলীর ইংরাজী তরজমাতেও (প্রকাশক -শেখ মুহাম্মদ আশরাফ, লাহোর পাকিস্তান) তাই ঘটেছে। (বাংলা অনুবাদকের টিকা-ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কুরআনের বাংলা তরজমার ক্ষেত্রেও বুকাইলি সাহেবের এ মন্তব্য প্রযোজ্য) ।
আরবী ক্রিয়াপদ ‘সাহাবা’ (উধৃত আয়াত দুটিতে ‘ইয়াসবাহুন’) শব্দটি যে তাৎপর্য বহন করে তা হচ্ছে স্বকীয় শক্তিতে চলা। শব্দটির সকল প্রকার অর্থ থেকেই এ ধারনা পাওয়া যায় যে, গতির চালিকা শক্তিটি সংশ্লিষ্ট গতিশীল বস্তুর নিজস্ব দেহ থেকেই আসছে। গতি অর্থাৎ চলার ব্যাপারটি যদি পানিতে ঘটে তাহলে সেটা ‘সাঁতার দেয়া’; আর যদি মাটিতে ঘটে তাহলে সেতা ‘হাঁটা’ অর্থাৎ পায়ের শক্তিতে চলা। কিন্তু গতির ব্যাপারটি যদি মহাশূন্যে ঘটে তাহলে বোধহয় শব্দতির মূল অর্থ অর্থাৎ স্বীয় শক্তিতে চলা প্রয়োগ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সুতরাং তরজমায় যে ভুল হয়েছে তা বোধহয় বলা যাবে না। কারণ প্রথমত চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরার সময় নিজের চারদিকেও ঘুরে থাকে, অর্থাৎ গড়পড়তা সারে ২৯ দিন। ফলে চাঁদের একইদিক সর্বদা আমাদের দিকে থাকে এবং দ্বিতীয়ত সূর্যের নিজের চারদিকে একবার ঘুরতে প্রায় ২৫ দিন সময় লাগে। এ গতিতে বিষুবরেখা ও মেরু অঞ্চলে কিছু পার্থক্য ঘটে থাকে (তাঁর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় আমরা এখন যাব না), তবে সামগ্রিকভাবে এ গতির শক্তি সূর্যের নিজস্ব দেহ থেকেই উৎপন্ন হয়ে থাকে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কুরআনে ব্যবহৃত শব্দটির অর্থগত তাৎপর্যে চাঁদ ও সূর্যের নিজস্ব শক্তিজাত গতির কথাই বলা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তথ্যে এ সত্যই সমর্থিত হয়েছে। সপ্তম শতাব্দীর একজন মানুষ, তা তৎকালে তিনি যতই জ্ঞানবান হয়ে থাকুন না কেন, এ ধারণাটি যে কেমন করে পেলেন তা বোধহয় ব্যাখ্যা করার কোনই উপায় নেই। তাছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রসঙ্গে মুহাম্মদকে (সঃ) নিশ্চয়ই জ্ঞানবান বলা যায় না।
এ যুক্তি কেউ কেউ কবুল করেন না। তারা বলেন প্রাচীনকালে অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি এমন সব ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন যা এখন আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তারা নিশ্চয়ই বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর নির্ভর করেন নি, করেছিলেন দার্শনিক তথ্যের উপর। এ প্রসংগে পিথাগোরাস পন্থীদের নজির উল্লেখ করে বলা হয় যে, পৃথিবী যে নিজের চারদিকে ঘোরে এবং গ্রহসকল যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে এ তত্ব তারা সেই খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেই জোরেশোরে সমর্থন করেছিলেন। পরবর্তী কালে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। একইভাবে প্রতিভাবান চিন্তাবিদ মুহাম্মদ (সঃ) হয়ত এমন কিছু কল্পনা করেছিলেন যা বহু শতাব্দী পরে সত্য বলে সাব্যস্ত হয়েছে। এ যুক্তি দেখাতে গিয়ে তারা কিন্তু উল্লেখ করতে ভুলে যান যে, ঐ দার্শনিক যুক্তিবাদীগণ মারাত্মক মারাত্মক ভুলও করেছিলেন। নজির হিসেবে স্মরণ করা যেতে পারে যে, পিথাগোরাসপন্থীগণ এ কথাও জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, সূর্য মহাশূন্যে স্থির হয়ে আছে, সূর্যই বিশ্বজগতের কেন্দ্রবিন্দু এবং জ্যোতির্মন্ডলও সূর্যকেন্দ্রিক। প্রাচীন কালের দার্শনিকদের রচনায় বিশ্বজগত সম্পর্কে সত্য ও অসত্য ধারণার মিশ্রণ দেখতে পাওয়া একটি অতিশয় সাধারণ ব্যাপার। এ প্রতিভাধরগণ তাদের যুগের তুলনায় অনেক আগাম ধ্যান-ধারণা দিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু সেই সংগে অনেক ভ্রান্ত ধারণাও আমাদের দিয়ে গেছেন। সঠিক বৈজ্ঞানিক বিচারে এখানেই তাদের সঙ্গে কুরআনের পার্থক্য। কুরআনে বিশ্বজগত সম্পর্কে বহু প্রসং ও বিবরণ আছে এবং তাঁর প্রত্যেকটিই আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং একটিও বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিরোধী বলে সাব্যস্ত হয়নি।
দিনরাত্রির ক্রমিকতা
পৃথিবীকে যখন বিশ্বজগতের কেন্দ্রস্থল বলে ধরা হত এবং মনে করা হত যে সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, তখন দিন-রাত্রির ক্রমিকতার কথা বলতে গিয়ে সূর্যের গতিবিধির আদৌ কোন উল্লেখ করা হয়নি কেন? কুরআনে ঠিক এ প্রসঙ্গটি নেই, তবে বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
সূরা ৭ (আরাফ) আয়াত ৫৪:”তিনিই দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন যাহাতে উহাদিগের একে অন্যকে দ্রুতগইতে অনুসরণ করে…”
সূরা ৩৬ (ইয়াসিন) আয়াত ৩৭:”উহাদিগের জন্য এক নিদর্শন রাত্রি, উহা হইতে আমি দিবালোক অপসারণ করি ফলে সকলেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া পড়ে।”
সূরা ৩১ (লুকমান) আয়াত ৫:”তুমি কি দেখনা আল্লাহ রাত্রিকে দিবসে এবং দিবসকে রাত্রিতে পরিণত করেন?”
সূরা ৩৯ (যুমার) আয়াত ৫:”তিনি রাত্রি দ্বারা দিবসকে আচ্ছাইত করেন এবং রাত্রিকে আচ্ছাদিত করেন দিবস দ্বারা।”
উধৃত প্রথম আয়াতটির কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় আয়াতে একটি ছবি তুলে ধরা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতেই দিন ও রাত্রির একটি অপরটিতে পরিণত হওয়া সম্পর্কে কৌতুহল ব্যঞ্জক তথ্য দেয়া হয়েছে। আরবী ভাষার ক্রিয়াপদ ‘কাওয়ারা’ তরজমা করার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে বোধহয় ‘জড়ানো’ বা ‘পেঁচানো’ শব্দ ব্যবহার করা। ফরাসী তরজমায় আর রাশিয়ার তাই করেছেন। ক্রিয়াপদটির মূল অর্থ হচ্ছে মাথায় পাগড়ি ‘জড়ানো’ এবং এ ধারণাটি শব্দটি সকল তাৎপর্যেই প্রতিফলিত হয়।
কিন্তু মহাশূন্যে আসলে কি ঘটে থাকে?মার্কিন নভোচারীগণ পৃথিবী থেকে বহু দূরে চাদে অবস্থান কালে তাদের নভোযান থেকে ঘটনাটি দেখেছেন এবং তাঁর ছবিও তুলেছেন। তারা দেখেছেন যে সূর্য সর্বদাই (গ্রহণের সময় ছাড়া) পৃথিবীর উপরিভাগের অর্ধেক আলোকিত করে রাখে এবং অবশিষ্ট অর্ধেক অন্ধকার থাকে। পৃথিবী নিজ কেন্দ্রের চারদিকে ঘোরে এবং আলোকের অবস্থা একই থেকে যায়। ফলে ভূগোলকের আলোকিত অর্ধাংশ যেমন চব্বিশ ঘন্টায় একবার ঘরে, অন্ধকার অর্ধাংশও তেমনি ঐ সময়ে একবার ঘোরে। দিন রাত্রির এ স্থায়ী পরিবর্তনের কথা কউরানে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা এখন পৃথিবীর আবর্তন এবং সূর্যের (আনুপাতিক) স্থিরতা সম্পর্কে অবহিত আছি বলে বিষয়টি ধারণা করা ও বুঝতে পারা আমাদের পক্ষে সহজ হয়েছে। এ চিরন্তন জড়ানোর প্রক্রিয়া এবং ভূগোলকের এক অর্ধাংশের অপর অর্ধাংশের অবস্থানে প্রবেশ করার ব্যাপারটি কুরআনে এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যেন পৃথিবীর গোলাকার হওয়ার ধারণাটি তখন পরিচিত ছিল; কিন্তু স্পষ্টই তা সঠিক নয়।
দিনরাত্রির ক্রমিকতায় এ ধারনা ছাড়াও একাধিক পূর্ব ও একাধিক পশ্চিমের ধারণাটি উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিষয়টি সাধারণ পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভরশীল বলে নিছক বর্ণনামূলক। কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
সূরা ৭০ (মাআরিজ) আয়াত ৪০:”উদয়াচল ও অস্তাচল সমূহের অধিপতি।”
সূরা ৫৫ (রহমান) আয়াত ১৭:”তিনিই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্তা।”
সূরা ৪৩ (জুখরফ) আয়াত ৩৮:”এখানে ‘দুই পূর্বের মধ্যবর্তী দূরত্ব’ উল্লেখিত হয়েছে, এবং এ কথায় দুটি স্থানের মধ্যবর্তী বিপুল দূরত্বের ধারণা ব্যক্ত করা হয়েছে।”
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে উদয় ও অস্ত সর্বদা ঠিক একই স্থানে হয় না। মওসুম অনুসারে স্থানের পরিবর্তন হয়ে থাকে। পূর্বাচলের দু দিকের যে সর্বশেষ দুই স্থানে সূর্য উদিত হয় তাকে দুই পূর্ব বলা যায়। মধ্যবর্তী বিভিন্ন স্থানে বছরের বিভিন্ন সময়ে সূর্য উদিত হয় ও অস্ত যায়। এ ব্যাপারটি এতই সাধারণ যে তা খালি চোখেই দেখা যায় এবং তাঁর সত্যতা প্রমাণের জন্য কোন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না।