গসপেলঃ উৎস ও ইতিহাস
গসপেল পড়ার সময় অনেক পাঠকই কোন কোন বর্ণনার অর্থ উপলব্ধি করে বিব্রত এবং এমন কি লজ্জিতও হয়ে থাকেন। বিভিন্ন গসপেলে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা পড়েও তারা একই অবস্থায় পড়ে থাকেন। মন্তব্য করেছেন ফাদার রোজেট তাঁর ইনিশিয়েশন টু বি গসপেলস (ইনিশিয়েশন আলা ইভাঞ্জাইলঃ প্রকাশক- এডিশনস দ্যু সিউইল, প্যারিস, ১৯৭৩) নামক গ্রন্থে। সাধারণ খৃষ্টানগণ এ ব্যাপারে কতখানি চিন্তিত উদ্বিগ্ন, তা তিনি উপলব্ধি করেন একটি ক্যাথলিক সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থেকে পাঠকদের চিঠির জবাব দিতে গিয়ে। এ পাঠকগণ সমাজের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা ও বিত্তের মানুষ এবং তিনি লক্ষ্য করে দেখেছেন যে, তারা যে সকল অনুচ্ছেদ বা বিষয়ের ব্যাখ্যা চেয়েছেন, তা”স্ববিরোধী, হাস্যকর বা কলংকজনক না হলেও অস্পষ্ট ভাসা ভাসা এবং অবোধ্য।” কোন খৃষ্টান যদি মনোযোগ সহকারে পুরো গসপেল পাঠ করেন, তাহলে গভীরভাবে পীড়িত ও উদ্বিগ্ন হওয়া ছাড়া সত্যিই কোন উপায় থাকে না।
ফাদার রোজেটের বই ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং তাঁর এ মন্তব্য খুবই সাম্প্রতিক। মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্তও চার্চের উপাসনায় অথবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পাদ্রিগণ গসপেলের যে অংশটুকু পড়তেন বা ব্যাখ্যা করতেন অধিকাংশ খৃষ্টান কেবল সেটুকুই জানতেন। প্রোটেস্টান্টদের কথা বাদ দিলে অন্যান্য খৃস্টানগণ সাধারণত পুরো গসপেল কখনোই পড়তেন না। ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তকে কেবলমাত্র উধৃতি থাকত। মূল পাঠের পুরো উধৃতি কখনই দেয়া হত না। একটি রোমান ক্যাথলিক স্কুলে আমি ভার্জিল ও প্লেটোর বই দেখেছি, কিন্তু নিউ টেস্টামেন্ট দেখতে পাইনি। নিউ টেস্টামেন্টের গ্রীক সংস্করণও খুবই উপযোগী হতে পারত। কিন্তু ঐ গ্রন্থ কিম্বা খৃষ্টান ধর্ম সম্পর্কিত অন্য কোন রচনা যে কেন রাখা হয়নি তা আমি অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। ঐ সকল গ্রন্থ থাকলে আমরা ছাত্ররা হয়ত এমন সব প্রশ্ন করতাম, যার জবাব দিতে শিক্ষকগণ সত্যিই বেকায়দায় পড়ে যেতেন।
এ ধরনের উপলব্ধি থেকেই চার্চ কর্তৃপক্ষ খৃষ্টান বাইবেল পাঠকদের আগাম সতর্ক করে দিয়েছেন। ফাদার রোজেটের ভাষায় -”গসপেল কিভাবে পড়তে হয়, সে সম্পর্কে অধিকাংশ খৃষ্টানদেরই প্রশিক্ষন গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।” তাঁর ব্যাখ্যার সাথে একমত হোক বা না হোক, কিন্তু একটি কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, তিনি এ নাজুক পরিস্থিতির মুকাবিলা অন্তত করেছেন। তবে এভাবে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা কিন্তু খুব বেশী সংখ্যক অহীর ব্যাপারে করা হয়নি।
ব্যাপকভাবে বিলি- বন্টনের জন্য ছাপানো বাইবেলে যে ভূমিকা লেখা হয়ে থাকে, তাতে কখনই এমন কোন আভাস দেয়া হয় না যে, বর্ণনার মূল পাঠ, তাঁর সত্যতা, অথবা তাঁর লেখকের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যে সকল মূল লেখকের পরিচয় সম্পর্কে আদৌ কিছু জানা যায় না, অথবা জানার উপায় নেই, এ ভূমিকায় তাদের সম্পর্কে অনেক”সঠিক ও বিস্তারিত” তথ্য দ্যা থাকে। অনেক সম্য নিছক অনুমানকে প্রমানিত সত্য হিসেব পেশ করা হয়ে থাকে। অথবা বলা হয়ে থাকে যে অমূক পাদ্রি অমুক ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন। অথচ বিশেষজ্ঞগণ তাঁর ঠিক বিপরীত কথাই বলেছেন। যীশুর ধর্ম প্রচার সমাপ্ত হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট আবির্ভাব হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে তারা খুবই কম বলে দেখিয়ে থাকেন। তারা এমন একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন যে, বাইবেলের সমুদয় বিবরণই যীশু খৃষ্টের সমসাময়িক কোন প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রত্যক্ষ শ্রোতার মুখ থেকে শুনে একজন মাত্র লেখকই লিখে নিয়েছেন। অথচ বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন যে, মূল পাঠ যে বহুবারই রদবদল করা হয়েছে সে সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নেই। অবশ্য কোন কোন ভূমিকায় দু একটি অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দেয়ার সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয় বটে, কিন্তু যে তাচ্ছিল্য সহকারে ঐ সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে, তাতে সচেতন পাঠকের মনে সন্দেহ বরং জোরদারই হয়ে থাকে। এ ধরনের ভূমিকার সঙ্গে যোগ করা হয়ে থাকে পরিশিষ্ট, বিশেষোত টিকা। এ টিকায় সকল প্রকার অসম্ভাব্যতা, স্ববিরোধীতা ও সুস্পষ্ট ভ্রান্তির সুচতুর ব্যাখ্যা দিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা সচেতন ও অনুসন্ধিৎসু পাঠক এবং যারা সত্য উৎঘাটন করতে চায়, তাদের কাছে কণ কীছূঈ গপোণ ঠাকে না।
এবার আমি এমন একটি বিষয়ের অবতারণা করছি, যা পাঠককে আরও বেশী বিস্মিত করবে। বিশেষত যারা এ ধরনের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত নন, তারা তো রীতিমত হতবাক হয়ে যাবেন।
ম্যাথু বা জন যিশুর স্বর্গারোহন সম্পর্কে কোন কথাই বলেন নি। পক্ষান্তরে লুক তাঁর গসপেলে বলেছেন যে, স্বর্গারোহনের ঘটনা পুনরুত্থানের দিনই ঘটেছিল। আবার”এক্টস অব এপোসলস” নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, চল্লিশ দিন পরে ঘটেছিল। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, লুকই এ গ্রন্থের লেখক হিসাবে পরিচিত। মার্ক স্বর্গারোহনের কথা উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু কোন দিনক্ষন উল্লেখ করেননি। ফলে তাঁর বর্ণনা এখন সঠিক বলে গণ্য করা হয় না। এ অবস্থায় পরিষ্কার বুঝা যায় যে, কোন ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিতেই যীশুর স্বর্গারোহনের ঘটনাটিকে সঠিক বলে ধরে নেয়ার কোন উপায় নেই। অথচ ধর্মীয় ভাষ্যকারগণ এ ভিত্তিহীন হওয়ার ব্যাপারটিকে আদৌ কোন গুরুত্ব দিতে চান না।
এ ট্রাইকট তাঁর”লিটল ডিকশনারি অব দি নিউ টেস্টামেন্ট” (পেটিট ডিকশনেয়ার দ্য নোভিও টেস্টামেন্ট, প্রকাশক- ডেসক্লি এন্ড কোম্পানী, প্যারিস, ১৯৬০) নামক গ্রন্থে স্বর্গারোহন সম্পর্কে কোন উল্লেখই করেন নি। অথচ ব্যাপক প্রচার অ প্রসারের জন্যই এ বইখানি লিখিত ও প্রকাশিত হয়েছে। পক্ষান্তরে জেরুসালেমের বাইবেল স্কুলের শিক্ষক ফাদার বেনয় ও ফাদার বোইসমার্ড তাদের”দি সিনপসিস অফ দি ফোর গসপেলস” ( সিনপসে দ্যে কোয়াত্রে ইভানজাইলস, প্রকাশক- এদীশানস দুসার্ফ, প্যারিস, ১৯৭২) নামক গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের ৪৫১-৪৫২ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে লুকের গসপেল ও এক্টস অব এপোসলস গ্রন্থের বর্ণনায় যে পার্থক্য আছে,”সাহিত্যিক কৌশল” বলতে যে আসলে কি বুঝায়, তা বুঝতে পারা বোধ হয় তেমন সহজ কাজ নয়।
অন্তত ফাদার রোজেট যে বুঝতে পারেননি এবং ঐ যুক্তি মেনেও নেন নি, তাতে বোধ হয় আর কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি নিজেই যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাও ঠিক ঐ একই ধরনের। তিনি তাঁর”ইনিশিয়েশন টু দি গসপেল (১৯৭৩-১৮৭ পৃষ্ঠা) নামক গ্রন্থে বলেছেন” অন্যান্য বহু ঘটনার মত এ ঘটনার ক্ষেত্রেও ধর্মীয় তাৎপর্য অনুধাবন করে বাইবেলের বর্ণনা যদি কেবলমাত্র আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করা হয়, তাহলে আদৌ কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। আসলে এটা কোন বাস্তব ঘটনাকে কোন সাম্নজস্যহীন প্রতীকে প্রকাশ করার ব্যাপার নয়। যারা এ রহস্য আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন, তাদের ধর্মীয় উদ্দেশ্যের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। দেহধারী মানুষ হিসাবে আমাদের অনুভুতি ও উপলব্ধি দিয়ে আমাদের পক্ষে যা কিছু গ্রহণ সম্ভব, ঠিক সেই আকারেই তারা ঐ রহস্যময় ঘটনাগুলি আমাদের কাছে পৌছে দিয়েছেন।”
কিন্তু এ ব্যাখ্যা কিভাবে মেনে নেয়া যেতে পারে? তবে হ্যাঁ, সবকিছু বিনা শর্তে বিনা প্রশ্নে মেনে নেব, এ মনোভাব যদি গ্রহণ করা যায়, তাহলে বোধ হয় আর কোন সমস্যাই থাকে না।
ফাদার রোজেটের ভাষ্যের আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, এ ধরনের”অন্যান্য বহু ঘটনা” যে রয়েছে, তা তিনি স্বীকার করেছেন। সুতরাং বিষয়টি গভীরভাবে, বস্তুনিষ্ঠভাবে, এবং সামগ্রিকভাবে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। গসপেল রচনার সময় যে পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল এবং বিশেষত তখন যে ধর্মীয় পরিবেশ ছিল তা বিচার বিবেচনা করে দেখে তাঁর মধ্যে থেকেই ব্যাখ্যা ও মীমাংসা অনুসন্ধান করে বের কোঁড়াই সঙ্গত ও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। মূল মৌখিক কিংবদন্তি এক সময় লিখিত আকার লাভ করে, তারপর যুগে যুগে তা পরিবর্তিত হয় এবং আমাদের যুগ পর্যন্ত আসতে আসতে তা অনেকবার পরিবর্তিত হয়। এ কথা মনে রাখলে অবোধ্য, দুর্বোধ্য, স্ববিরোধী বা হাস্যকর বিবরণ দেখে বিস্মিত হওয়ার বোধ হয় আর তেমন সুযোগ থাকে না। বর্তমান যুগের প্রমানিত বৈজ্ঞানিক সত্যের সঙ্গে যে সকল বিবরণ সামঞ্জস্যহীন বলে দেখা যাচ্ছে, সেগুলি সম্পর্কেও ঐ একই কথা বলা যেতে পারে। মূল রচনা বা তাঁর রদবদল যে মানুষের দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছে, এ যুক্তি প্রবাহ থেকে সে কতাহি প্রমানিত হয়।
বিগত কয়েক দশকে ধর্মীয় রচনা সম্পর্কিত গবেষণা এবং বিশেষত বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এবং এ গবেষোণার ফল্লে ধর্মীয় ধ্যান ধারণায় যে পরিবর্তন এসেছে তাও স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্যারিসের ক্যাথলিকের ইনষ্টিটিউটের অধ্যাপক ফাদার কানেনগিসার তাঁর”ফেথ ইন দি রেজারেকশন, রেজরেকশন অভ ফেথ” (ফই এন লা রেজারেকশন, রেজারেকশন দ্য লা ফই, প্রকাশক বিউশেন কলেজ প্যারিস, ১৯৭৪) নামক গ্রন্থে বলেছেন-”পোপ দ্বাদশ পায়াসের আমলের পর বাইবেলের ব্যাখ্যা প্রক্রিয়ায় যে বিপ্লব এসেছে বিশ্বাসীগণ সে সম্পর্কে তেমন অবহিত নয়।” দ্বাদশ পারাস ১৯৩৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত পোপ ছিলেন। সুতরাং লেখক যে”বিপ্লবের” কথা বলেছেন তা অতি সাম্প্রতিক কালের ঘটনা এবং এ বিপ্লব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোন কোন বিশেষজ্ঞ সাধারণ খৃষ্টানদের সেভাবে শিক্ষা দিতেও শুরু করেছেন। ফাদার কানেনগিসার বলেছেন-”ব্যাখ্যা প্রক্রিয়ায় এ বিপ্লব আসার সঙ্গে সঙ্গে সুনিশ্চিত প্রাচীন ধারা রহিত হতে শুরু করেছে।”
তিনি হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন-”গসপেলে যীশু সম্পর্কে যে সকল খবর দেয়া হয়েছে, তা আক্ষরিক অর্থে মেনে নেয়া উচিত নয়। কারণ এগুলি আসলে কোন ঘটনা উপলক্ষে তাঁর সমর্থনে অথবা বিরোধিতায় রচনা করা, এবং রচনাকারীগণ যিশু সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ সমাজের কিংবদন্তি গুলিই লিখে দিয়েছেন।” যিশুর পুনরুত্থান সম্পর্কে জোর দিয়ে বলেছেন যে, গসপেলের লেখকদের মধ্যে একজনও দাবী করে বলেননি যে,”তিনি ঐ ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি আরও বলেছেন যিশুর অবশিষ্ট প্রকাশ্য জীবন সম্পর্কেও ঐ একই কথা বলা চলে। কারণ গসপেলের বিবরণ থেকেই দেখা যায় যে একমাত্র জুডাস ইসকরিয়ট ছাড়া কোন কোন হাওয়ারিই যিশুর ধর্ম প্রচার করার সময় থেকে তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেননি।
মাত্র দশ বছর আগে দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিলে যে প্রাচীন মতবাদ সমর্থিত ও অনুমোদিত হয়েছিল আমরা এখন তা থেকে অনেক পথ এগিয়ে এসেছি। অবশ্য অনেক আধুনিক রচনায় সেই প্রাচীন মতবাদই এখনও প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু তবুও সত্য ধীরে ধীরে পথ করে নিচ্ছে।
তবে ঐ সত্যকে তুলে ধরা খুব সহজ কাজ নয়। কারণ প্রাচীন কাল থেকে যে মতবাদ জোরেশোরে রক্ষা ও সমর্থন করে রাখা হচ্ছে, তাঁর বাধা খুব দুর্বল নয়। এ বাধা অতিক্রম করতে হলে একেবারে শিকড়ই কেটে দিতে হবে। অর্থাৎ খৃষ্টধর্ম অবির্ভাবের আলামতগুলিই সকলের আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
ইতিহাসের স্মারকঃ ইহুদী খৃষ্ট ধর্ম ও সাধুপল
অধিকাংশ খৃষ্টান বিশ্বাস করেন যে, যিশুর জীবনের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন, গসপেলগুলিই তারা লিখেছেন। সুতরাং এ রচনাগুলি হচ্ছে তাঁর জীবন ও শিক্ষার প্রশ্নাতীত প্রমাণ। সন্দেহের কোন কারণই এতে নেই। সুতরাং এ অবস্থায়, অর্থাৎ আদি ও আসল হওয়ার এ নিশ্চয়তা পাওয়ার পর যিশুর শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনার আর কোন সুযোগ থাকে না। তাছাড়া চার্চ যখন খোদ যিশুর দেয়া হুকুম -আহকাম জারি ও প্রয়োগ করার কাজে নিজুক্ত আছে, তখন প্রতিষ্ঠান হিসেব তাঁর বৈধতা সম্পর্কেও কোন সন্দেহ পোষন করা যেতে পারে না। ইদানীং গসপেলের যে সকল জনপ্রিয় সংস্করণ প্রকাশ করা হচ্ছে, তাতে ভূমিকা বা ভাষ্যের নামে এ জাতীয় ধারণাই প্রচার করা হচ্ছে।
গসপেল লেখকগণ যে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, এ কথাটি সর্বদা স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণহিসেবে পেশ করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ সাক্ষ্য-প্রমাণ ও তথ্য দিয়ে ওই দাবী সত্য বলে সাব্যস্ত করার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করেন না। তদুপরি দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্য ভাগে সাধু জাসটিন গসপেলকে”হাওয়ারিদের স্মৃতিকথা” বলে অভিহিত করেন। ঐ হাওয়ারি লেখকদের সম্পর্কে আদৌ কোন সন্দেহ প্রকাশ করাই মুস্কিল হয়ে পড়ে। মথি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে তিনি একজন বিখ্যাত ব্যাক্তি, কাফারনাউমের কাস্টম অফিসার ছিলেন এবং আরমাইক ও গ্রীক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। মার্ককে অতি সহজেই পিটারের সহকর্মী হিসেবে সনাক্ত করা যায় এবং স্পষ্টতই তিনিও একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। লুক হচ্ছেন একজন চিকিৎসক এবং পল তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। সুতরাং তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত খবর পাওয়া যায়। তারপর জন। তিনি গ্যাল্লিলি সাগরের জেলে জেবেদির পুত্র এবং যিশুর সার্বক্ষনিক সঙ্গী।
খৃষ্টধর্মের আবির্ভাবকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে সাম্প্রতিক কালে যে সকল গবেষণা হয়েছে, তা থেকে দেখা যায় যে, এভাবে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে তথ্য পেশ করা তখন আদৌ সম্ভব ছিল না। গসপেলের লেখকগণ যে আসলে কারা এবং কি ধরনের লোক ছিলেন, তা আমরা একটু পরেই দেখতে পাব। তবে একটি কথা প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, যিশুর ধর্মপ্রচার শুরু হওয়ার পরবর্তীকালের ঘটনাবলী যেভাবে ঘটেছে বলে বলা হয়েছে, আসলে তা সেভাবে ঘটেনি, পিটারের রোমে যাওয়ার ফলেই চার্চের ভিত্তিভূমিও রচিত হয়নি। পক্ষান্তরে যিশুর ইহলোক ত্যাগ করার পর থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত দুই উপদলের মধ্যে বিবাদ-বিসস্বাদ ছিল। একটি উপদল ছিল পলের খৃষ্টধর্মের পক্ষে এবং অপর উপদলটি ছিল ইহুদী-খৃষ্টধর্মের পক্ষে। কালক্রমে পলের খৃষ্টধর্মই জয়লাভ করে এবং ইহুদী খৃষ্টধর্ম বিলীন হয়ে যায়।
খৃষ্টধর্মের উৎপত্তি বিষয়ে সাম্প্রতিক কালের আবিষ্কার সম্পর্কে অনেক বই লেখা হয়েছে। লেখকদের মধ্যে কার্ডিনাল ডানিয়েলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে”এটুডস” (স্টাডিস) নামক একখানি ফরাসী পত্রিকায় তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের নাম -”এ নিউ রিপ্রেজেন্টেশন অব দি অরিজিনস অব ক্রিশ্চিয়ানিটিঃ জুডিও ক্রিশ্চিয়ানিটি।” এ প্রবন্ধে তিনি ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, জনপ্রিয় পুস্তক পুস্তিকায় গসপেলের যে পটভূমি দেয়া হয়ে থাকে, প্রকৃত অবস্থা তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ প্রসঙ্গে আমরা তাঁর প্রবন্ধের প্রধান প্রধান কথাগুলি তুলে ধরছি।
যিশুর ইহলোক ত্যাগের পর হাওয়ারীদের ক্ষুদ্র দলটি একটি ইহুদী মাযহাব গঠন করে এবং”মন্দিরে প্রচলিত
উপাসনা পদ্ধতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকে।” পরে প্রকৃতি পুজারীগণ ধর্মান্তরিত হলে তাদের প্রাচীন উপাসনা পদ্ধতির কিছু অংশ যোগ করে তাদের জন্য”একটি বিশেষ পদ্ধতি” উদ্ভাবন করা হয়। তারপর ৪৯ খৃষ্টাব্দে জেরুসালেম কাউন্সিলে তাদের খাতনা এবং অপর কয়েকটি ইহুদী প্রথা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু”বহু জুডিও ক্রিশ্চিয়ান (ইহুদী খৃষ্টান”এ অব্যাহতি মেনে নিতে অস্বীকার করে। ” এ দলটি ছিল পলের দল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং প্রকৃতি পুজারী থেকে খৃষ্টান হওয়া লোকদের ব্যাপারে এ দুই দলের মধ্যে বিরোধ ছিল (৪৯ খৃষ্টাব্দের এন্টিওকের ঘটনা) । পলের বক্তব্য ছিল এই যে, এমন কি ইহুদীদের জন্য খাতনা, সাব্বাত এবং মন্দিরের উপাসনা বিধি অতিশয় প্রাচীনপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল। ইহুদী ধর্মের প্রতি এ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আনুগত্য থেকে খৃষ্টান ধর্মকে ভদ্র সমাজের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।”
ইহুদী-খৃষ্টানদের মধ্যে যারা”অনুগত ইহুদী” ছিল তাদের কাছে ছিলেন একজন বিশ্বাসঘাতক। তাদের দলিলপত্রে তাকে”শত্রু” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, এবং তিনি”দ্বিমুখী নীতি” অনুসরন করতেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে”।”৭০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত চার্চের আওতার মধ্যে ইহুদী খৃষ্টানগণই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পল ছিলেন সম্পূর্ণরূপে একজন বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তি।” নেতা ছিলেন যিশুর আত্মীয় জেমস, আর তাঁর সঙ্গে ছিলেন পিটার (প্রথম দিকে) ও জন।”জেমস ছিলেন ইহুদী খৃষ্টান দলের মুখপাত্র এবং পলের খৃষ্টধর্মের মুকাবিলায় এ দল ইচ্ছাকৃতভাবেই ইহুদী ধর্মের প্রতি অনুগত থাকত।” জেরুসালেমের ইহুদী খৃষ্টান চার্চে যিশুর পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জেমসের পর নেতা হন” সাইমিয়ন, ক্লিওপাসের পুত্র এবং এবং ক্লিওপাস ছিলেন যিশুর ভ্রাতুষ্পুত্র।
যে সকল ইহুদী-খৃষ্টান রচনায় যিশুর সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, কার্ডিনাল ডানিয়েলো তা থেকে একাধিক উধৃতি দিয়েছেন। এ রচনাগুলি হচ্ছে হিব্রুদের গসপেল (মিসরের ইহুদী-খৃষ্টান সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাওয়া), ক্লিমেন্ট রচিত হোমিলিজ এন্ড রিকপনিশন, হিপোটাইপোসিস, জেমসের দ্বিতীয় অয়াপোক্যালিপস, এবং টমাসের গসপেল। (এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ সমুদয় রচনাই পরে অ্যাপোক্রিফা বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ পল বিজয়ী হওয়ার পর যে চার্চ কায়েম হয়, তাঁর পক্ষ থেকে এগুলি গোপন করে ফেলা হয়। এবং পরে কাটছাট ও রদবদল করে মাত্র চারখানি ক্যানোনিক গসপেল বহাল রাখা হয়) । কার্ডিনাল ডানিয়েলো বলেছেন -“খৃষ্টধর্মের প্রাচীনতম বইপত্র ইহুদী-খৃষ্টানদেরই রচনা।” তিনি বিস্তারিত ভাবে তাঁর বর্ণনাও দিয়েছেন।
“চার্চের প্রথম একশো বছরে কেবলমাত্র জেরুসালেম ও ফিলিস্তিনেই নয়, বরং সর্বত্রই ইহুদী খৃষ্টান ধর্মই সর্বত্র প্রাধান্য লাভ করেছিল। পলের বিজয় লাভের পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থাই বিদ্যমান ছিল। পল তাঁর চিঠিপত্র যে বিরোধের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর কারণ এবং ব্যখ্যা হচ্ছে এই।” গ্যালাশিয়া, করিনথ, কলোসা, রোম এবং অ্যান্টিওক, সর্বত্রই গলকে এবিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
গাজা থেকে অ্যান্টিওক পর্যন্ত সিরিয়া – ফিলিস্তিন উপকুল যে ইহুদী-খৃষ্ট ধর্মের প্রভাবাধীন ছিল,”তাঁর উল্লেখ হাওয়ারিগণ ও ক্লিমেন্টের রচনাবলীতেই আছে।” এশিয়া মাইনরেও যে ঐ প্রভাব ছিল, তাঁর আভাস গ্যালাশিয়ান ও কলোসিয়ানদের কাছে লেখা পলের চিঠীতেই পাওয়া যায়। ফ্রিজিয়ায় ঐ প্রভাব থাকার খবর পাওয়া যায় পাপিয়াসের রচনা থেকে। আর গ্রীসের, বিশেষত এপোলোস এলাকার খবর পাওয়া যায় পলের নিজেরই একখানি চিঠি থেকে। এ চিঠিখানি ছিল করিনথিয়ানদের কাছে লেখা তাঁর প্রথম চিঠি। ক্লিমেন্টের চিঠি এবং হারমাসের রাখালের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রোম ইহুদী-খৃষ্ট ধর্মের”একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র” ছিল। সুয়েটোনিয়াস ও ট্যাসিটাসে খৃষ্টান বলে বুঝানো হত ইহুদীদের একটি মাযহাবকে। কার্ডিনাল ডানিয়েলো মনে করেন যে, আফ্রিকাতেও প্রথমে ইহুদী-খৃষ্ট ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল। হিব্রু গসপেল এবং ক্লিমেন্টের রচনায় সে রকমই আভাস পাওয়া যায়।
যে পটভূমিকায় গসপেল, অর্থাৎ বাইবেল, অর্থাৎ নিউ টেস্টামেন্ট রচিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিরোধ সম্পর্কে এ সকল তথ্য অবহিত হওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। মূল রচনা ভুবার রদবদল হওয়ার পর বাইবেলের যে ভাষ্য আমরা এখন দেখতে পাই, তাঁর আবির্ভাব হয় ৭০ খৃষ্টাব্দে ইহুদী যুদ্ধ ও জেরুসালেমের পতনের পর খৃষ্টানগণ প্রবল হয়ে অঠে। কার্ডিলনাল ডানিয়েলো ঘটনাটি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন-”ইহুদীদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার পর খৃষ্টাঙ্গণ তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে সরে থাকার নীতি গ্রহণ করে। তারপর গ্রীক খৃষ্টানগণ প্রাধান্য লাভ করে, পল মরনোত্তর বিজয় লাভ করেন এবং ইহুদীধর্ম থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে পৃথক হয়ে খৃষ্টান ধর্ম একটি তৃতীয় জাতিতে পরিনত হয়। তথাপি ১৪০ খৃষ্টাব্দের ইহুদী বিদ্রোহ পর্যন্ত ইহুদী-খৃষ্টধর্ম সাংস্কৃতিক দিক থেকে প্রাধান্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়।”
মার্ক ম্যাথু লুক ও জনের গসপেলের আবির্ভাব ঘটে ৭০ থেকে ১১০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে। তবে এগুলি প্রথম লিখিত ধর্মীয় বিধান ছিল না। কারণ পলের পত্রাবলী তাঁর অনেক আগেই লেখা হয়েছিল। ও কুলম্যান মনে করেন যে, পল সম্ভবত ৫০ খৃষ্টাব্দে থেসালোনিয়ানদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তিনি সম্ভবত মার্কের গসপেল রচনা শেষ হওয়ার কয়েক বছর আগেই নিখোজ হয়ে যান।
খৃষ্টানধর্মে পলই হচ্ছেন সর্বাধিক বিতর্কিত ব্যাক্তি। যিশুর পরিবার পরিজন এবং জেরুসালেমে অবস্থানরত জেমসের সমর্থক হাওয়ারিগণ তাকে যিশুর চিন্তাধারার প্রতি বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করতেন। ধর্ম প্রচারের জন্য যিশু যাদের বাছাই করে নিজের কাছে টেনে নিয়েছিলেন, তাদের বাদ দিয়ে পলই খৃষ্টধর্ম উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনি জীবনে কখনও যিশুকে দেখেননি, কিন্তু তথাপি তিনি এ কথা বলে তাঁর ধর্ম প্রচারের বৈধতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, একদা তিনি যখন দামেশক যাচ্ছিলেন, তখন যিশু পুনর্জীবিত হয়ে রাস্তায় তাকে দেখা দিয়েছেন। পল না থাকলে খৃষ্টধর্মের অবস্থা যে কি দাড়াত, এমন একটি প্রশ্ন সঙ্গত ভাবেই উত্থাপন করা যেতে পারে এবং এ প্রশ্নের জবাবে অনেক পরিস্থিতিই কল্পনা করা যেতে পারে। তবে গসপেল সম্পর্কে অন্তত এ কথা জোড় দিয়ে বলা যেতে পারে যে, একাধিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই বিবাদমান পরিস্থিতি যদি সৃষ্টি না হত, তাহলে ঐ রচনা আদৌ সৃষ্টি হত না। দুই পলের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ ও সংঘর্ষের সময়ই ঐ রচনা সৃষ্টী হয়েছিল। ফাদার কানেনগিসার তাই গসপেলকে”যুদ্ধের রচনা” বলে অভিহিত করেছেন। ঐ সময় উভয় পক্ষ থেকে যিশু সম্পর্কে যে অসংখ্য রচনা সৃষ্টি হয়, তা থেকে বাছাই করেই একটি সংকলন প্রস্তুত করা হয়। ঐ সময় পলের খৃষ্টধর্ম বিজয় লাভ করে এবং তাঁর ফলে তাকে কেন্দ্র করেই রচনাবলী গড়ে উঠে। এ রচনাবলীই” ক্যানন” নামে অভিহিত এবং চার্চ কর্তৃক স্বীকৃত। অন্যান্য সকল রচনা তখনই অনির্ভরযোগ্য বলে নিন্দিত এবং বর্জিত হয়।
এভাবে ইহুদী-খৃষ্ট ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাঁর কোন প্রভাবই এখন আর কোথাও নেই। তবে”জুডাস্টিক” বললে এখনও ঐ ধর্মের কথাই বুঝা যায়। কার্ডিনাল ডানিয়েলো এ বিলুপ্তির বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন -” চার্চ সকল ইহুদী সংশ্রব থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়ায় ইহুদী-খৃষ্টান ধর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং পাশ্চাত্যে দ্রুত বিলীন হয়ে যায়। প্রাচ্যে অবশ্য তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে বিশেষত ফিলিস্তিন, আরব, টানসজর্দানিয়া, সিরিয়া ও মেসোপোটোমিয়ায় ঐ ধর্মের ক্ষীণ অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। অন্যান্য সকল এলাকা মূল চার্চের সঙ্গে যোগ দেয়, যদিও তাদের সংস্কৃতিতে প্রবল সেমিটিক প্রভাব বিদ্যমান ছিল। ইথপিয়া এবং কালদিয়ার চার্চে এ প্রভাব এখনও দেখতে পাওয়া যায়।
চার গসপেলঃ উৎস ও ইতিহাস
খৃষ্ট ধর্মের প্রাথমিক যুগের কোন রচনায় গসপেলের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পলের রচনা প্রকাশিত হওয়ার অনেক পরে। দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে অর্থাৎ ১৪০ সালের পরে ধর্মীয় রচনাবলীর একটি সংকলন সম্পর্কে খবর পাওয়া যেতে থাকে। কিন্তু তা সত্বেও বলা হয়ে থাকে-”দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরু থেকেই বহু খৃষ্টান লেখক জানিয়েছেন যে, তারা পলের অনেকগুলি চিঠি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।” ১৯৭২ সালে প্যারিসে প্রকাশিত”একুমেনিক্যাল ট্রানশলেশন অব দি বাইবেল- নিউ টেস্টামেন্ট নামক পুস্তকের ভূমিকায় এ মন্তব্য করা হয়ে হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ পুস্তকখানি এক শতাধিক ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট বিশেষজ্ঞদের সমবেত প্রচেষ্টার ফসল।
পরবর্তীকালে যে গসপেল ক্যানোনিক অর্থাৎ সরকারী ভাষয় বলে গৃহীত হয়, তাঁর রচনা দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরুতে সমাপ্ত হলেও বহুদিন পর্যন্ত তা কারও জানা ছিল না। একুমেনিক্যাল ট্রানশলেশন গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ঐ গসপেলে বর্ণিত কোন কোন কাহিনী অন্যত্র উধৃত হতে থাকে। তথাপি কাহিনীগুলি মূল গ্রন্থ থেকে উধৃত করা হত না লেখকগণ বাচনিক কিংবদন্তির স্মৃতি থেকে উধৃত করতেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না।
বাইবেলের ঐ অনুবাদের ভূমিকায় বলা হয়েছে-” ১৪০ সালের আগে এমন কোন সংকলন সনাক্ত করা যেত।” ট্রাইকট তাঁর নিউ টেস্টামেন্টের অনুবাদের ভূমিকায় যা বলেছেন (১৯৬০) এ মন্তব্য ঠিক তাঁর বিপরীত। তিনি বলেছেন-” দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরু থেকেই লোকে”গসপেল” শব্দটি ব্যবহার করত এবং গসপেল বলতে তখন সেই গ্রন্থই বুঝানো হত যে গ্রন্থকে ১৫০ সালের দিকে সেন্ট জাস্টিন ‘দি মেমোরাইস অব দি এপোসলস’ (হাওয়ারিদের নীতিকথা) বলে অভিহিত করেছেন। ” দুর্ভাগ্যবশত এ ধরনের বক্তব্য ও মন্তব্য থেকেই গসপেলের সময় ও তারিখ সম্পর্কে সাধারণ মানুষেরমনে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
ভ্রান্ত ধারণা অবশ্য আরও আছে। গসপেল চারখানি শুরুতেই পূর্নাঙ্গ আকারে ছিল বলে যে কথা বলা হয়ে থাকে, তা আদৌ সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে যিশুর পর এক শতাব্দীরও অধিক কাল সময়ের মধ্যে গসপেল পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেনি। একমেনিক্যাল ট্রানশলেশন গ্রন্থের মতে ১৭০ সালের দিকে গসপেলগুলি পূর্ণাঙ্গ হয় এবং সরকারী ভাষ্যের মর্যাদা লাভ করে।
সেন্ট জাস্টিন গসপেলের লেখকদের হাওয়ারি (সাহাবী) বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাঁর এ অভিমত আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, একটু পরেই আমরা দেখতে পাব যে, লেখকগণ কেউ হাওয়ারি ছিলেন না।
ট্রাইকট বলেছিলেন, মথি, মার্ক ও লুকের গসপেল ৭০ সালের আগেই লেখা হয়েছিল। কিন্তু একমাত্র সম্ভবত মার্কের ক্ষেত্রে ছাড়া এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যান্য বহু লেখকের মত তিনিও গসপেলের লেখকদের যিশুর সঙ্গী বলে পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণে তিনি গসপেল রচনায় সম্ভাব্য সময় এমনভাবে নির্ণয় করেছেন, যাতে ঐ সময় যিশুর জীবনকালের কাছাকাছি হতে পারে। জনের ব্যাপারে ট্রাইকট বলেছেন যে, তিনি ১০০ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং খৃষ্টানগণ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাকে যিশুর নিকট সান্নিধ্যে উপস্থিত দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু তথাপি তাঁর নামে যে গসপেল প্রচলিত আছে, তা যে তারই রচিত, এমন কথা প্রমাণ করা কঠিন। অন্যান্য অনেক ভাষ্যকারের মত ট্রাইকটও মনে করেন যে, জন (এবং মথি) যে সকল ঘটনা বর্ণনা করেছেন তিনি নিজেই সে সকল ঘটনার যোগ্যতম সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ সমালোচক এ কথা মানেন না। এমন কি তারা চতুর্থ গসপেলের লেখক বলেও স্বীকার করেন না। কিন্তু গসপেল চারখানিকে যুক্তিসঙ্গতভাবে যিশুর সাহাবীদের”স্মৃতিকথা” বলে গ্রহণ না করা যায়, তাহলে ঐ গ্রন্থগুলি এল কোথা থেকে?
“দি নিউ টেস্টামেন্ট” (প্রকাশম -প্রেসেস ইউনিভার্সিটেয়ারেস দ্য ফ্রান্স, প্যারিস, ১৯৬৭) নামকগ্রন্থে লেখক ও কুল্ম্যান বলেছেন-”প্রাচীন খৃষ্টান সম্প্রদায় মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনী লিখে ফেলেছিল এবং ইভানজেলিস্টগণ নিজ নিজ বিশ্বাস ও ইচ্ছা মোতাবেক কাহিনী সাজিয়েছেন। ঘটনার বিবরণ ও বানীর মধ্যে যোগসুত্র স্থাপন করেছেন এবং অসঙ্গতির স্থলে সঙ্গতি বিধানের চেষ্টা করেছেন। ‘তারপর’ ‘যখন তিনি’ ‘প্রভৃতি’ এ ধরনের কথা বসিয়ে দিয়ে তারা যিশুর দুটি কথার মধ্যে সম্পর্ক বিধান এবং ঘটনার ক্রমিকতা ও ধারাবাহিকতা দেখিয়েছেন। অর্থাৎ মার্ক, মথি ও লুকের গসপেল (এ তিনখানি সিনোপটিক গসপেল নামে পরিচিত) ইতিহাসের ভিত্তিতে রচিত নয় এবং কাঠামোগত দিক থেকে এগুলি বিশুদ্ধ সাহিত্যিক প্রচেষ্টা মাত্র।”
তিনি আরও বলেছেন -” এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কথা হচ্ছে এই যে, যিশুর জীবন তৎপরতা সম্পর্কে মুখে মুখে চলে আসা কাহিনীগুলি যখন প্রথমবারের মত লিখে ফেলা হয়, তখন জীবনী লেখার প্রয়োজনীয়তার চেয়ে ধর্মপ্রচার, উপাসনা এবং শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তার কথাই লেখকদের মনে বেশী জাগরুক ছিল এবং সকল বিবরণ তারা সেভাবেই লিখেছিলেন। যে বিশ্বাস তারা প্রচার করেছিলেন, তাঁর পোষকতায় যিশুর জীবন থেকে নজির উধৃত করেছিলেন। আসলে তাদের নিজস্ব উপদেশই ছিল আসল অথা। যিশুর জীবনের নজির তারা এনেছেন সহায়ক বিষয়বস্তু হিসেবে। যিশুর বাণীও তারা কখনও কখনও উধৃত করেছেন বটে, কিন্তু তাও ঐ একই উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ জীবনী লেখা নয়, ইতিহাস রচনা করা নয়, ধর্ম প্রচার করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।”
একুমেনিক্যাল ট্রানশলেশন অব দি বাইবেলের ভাষ্যকারগণও গসপেল রচনার ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে ঠিক কথাই বলেছেন।” মুখে মুখে চলে আসা কাহিনীর সঙ্গে যিশুর শিষ্যদের বক্তৃতা মিশ্রিত হয়েছে এবং এ মিশ্রিত বিষয়বস্তুই গসপেলে লিখিত হয়েছে এবং গসপেল যেহেতু বিভিন্ন লেখক লিখেছেন, সেহেতু স্বাভাবিক কারণেই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে এবং এক একজনের রচনায় এক এক ধরনের কিংবদন্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।”
নিউ টেস্টামেন্টের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট, এ উভয় শ্রেনীর একশতেরও বেশী সংখ্যক বিশেষজ্ঞ সমবেতভাবে এ অভিমত গ্রহণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিল বাইবেল সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা ঐ অভিমতের সঙ্গে ব্যাপকভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ। । ইতিপূর্বে ওল্ড টেস্টামেন্ট সম্পর্কে আলোচনার সময় আমরা ভ্যাটিকান কাউন্সিলের ঐ দলিলের কথা একবার উল্লেখ করেছি। ওল্ড টেস্টামেন্ট সম্পর্কে কাউন্সিল বলেছেন যে, ঐ গ্রন্থে”এমন বিষয়বস্তু আছে যা অসম্পূর্ণ এবং অপ্রচলিত।” কিন্তু গসপেল সম্পর্কে তারা এমন কোন সন্দেহ প্রকাশ করেন নি। পক্ষান্তরে তারা বলেছেন -”কারও পক্ষেই এ সত্য উপেক্ষা করা সম্ভব নয় যে, নিউ টেস্টামেন্ট সহ সকল ধর্মীয় রচনার মধ্যে গসপেলের স্থানই সকলের উর্ধে। কারণ গসপেল আমাদের ত্রাণকর্তার জীবন ও শিক্ষার বিশিষ্ট সাক্ষীদের প্রতিনিধিত্ব করে। চার্চ সর্বদা সকল ক্ষেত্রেই বলে এসেছে এবং এখনও বলছে যে, চারখানি গসপেলই যিশুর সঙ্গীদের কাছ থেকে এসেছে। খোদ যিশুর নির্দেশে তারা যা প্রচার করতেন। পবিত্র আত্মার অনুপ্রেরণায় তারা ঠিক তাই লিখে গিয়েছেন এবং তাদের সে রচনাই হচ্ছে ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিভূমি। আর সেই রচনা হচ্ছে মথি, মার্ক, লিক ও যোহন লিখিত সুসমাচার। আমাদের হোলি মাদার (পবিত্র মাতা) চার্চ বিনা দ্বিধায় ঐ চার গসপেল অনুমোদন করেন এবং পূর্বের ন্যায় এখনও ঘোষণা করেন যে, ঐগুলি ঐতিহাসিক দিক থেকে খাটি এবং মানবের চিরন্তন মোক্ষলাভের জন্য ইশ্বরের পুত্র যিশুর স্বর্গারোহনের পূর্ব পর্যন্ত যা করেছিলেন এবং যা শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা অতিশয় নিষ্ঠার সঙ্গে ঐ গ্রন্থগুলিতে বিধৃত আছে। আমরা যাতে যিশুর জীবন সম্পর্কে সর্বদা সত্য ও অকপটতথ্য লাভ করতে পারি, পবিত্র লেখকগণ গসপেলগুলি ঠিক সেভাবেই লিখে গিয়েছেন।”
এ বক্তব্যে কোন দ্বিধা নেই, কোন সন্দেহ নেই। গসপেলে যিশুর জীবন, কর্ম ও শিক্ষা সঠিকভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে, এ কথাই এখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, উপরে আমরা যে সকল লেখকের বক্তব্য উধৃত করেছি, তাদের অভিমতের সঙ্গে ভ্যাটিকান কাউন্সিলের সরকারী অভিমতের কোনই সামঞ্জস্য নেই। বিশেষত ফাদার কানেনগিজার যা বলেছেন এ প্রসঙ্গে তা আর একবার স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, গসপেলের কথা”আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা উচিত নয়, ঐগুলি কোন বিশেষ উপলক্ষ সামনে রেখে রচিত” এবং”যুদ্ধকালীন রচনা মাত্র”। আর গসপেলের লেখকগণ”যিশু সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কিংবদন্তিগুলি লিখে গিয়েছেন মাত্র।”
“একমেনিকাল ট্রানশলেশন অব দি বাইবেল” পুস্তকে লিখিত মন্তব্যও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। গসপেলের রচনা বিভিন্ন মহলের উপযোগী, চার্চের চাহিদা পূরনের উপযোগী এবং ধর্মপুস্তকের কোন কোন বক্তব্য ব্যাখ্যার উপযোগী করে রচিত হয়েছে। কোন ক্ষেত্রে ভুল সংশোধন এবং কোন ক্ষেত্রে বিরুদ্ধবাদীদের জবাব দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত হয়েছে। ইভানজেলিস্ট লেখকগণ মুখে মুখে চলে আসা কাহিনী থেকে নিজের নিজের পছন্দসই বিষয়বস্তু বেছে নিয়ে ঐগুলি রচনা করেছেন।”
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আমরা দুটি পরস্পর বিরোধী অভিমতের সামনে এসে দাড়িয়েছি। একদিকে আছে ভ্যাটিকান কাউন্সিলের অভিমত, আর অপরদিকে রয়েছে বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক অভিমত। কাউন্সিল বলছেন যে, গসপেলে যিশুর কর্ম ও বানীর সঠিক বিবরণ আছে। কিন্তু ঐ গসপেলেই যে স্ববিরোধিতা, অসম্ভাব্যতা, প্রাকৃতিক অবাস্তবতা এবং প্রমানিত সত্যের বিপরীত কথা আছে, তাঁর সঙ্গে ঐ বক্তব্যের সামঞ্জস্য বিধান করা আদৌ সম্ভব নয়।
পক্ষান্তরে যদি ধরে নেয়া হয় যে, কিংবদন্তি থেকে বিষোয়বস্তু বাছাই করে নিয়ে লেখকগণ নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি মোতাবেক ঐ গসপেল রচনা করেছেন, কিংবা ঐগুলিকে যদি বিশেষ উপলক্ষে রচিত অথবা যুদ্ধকালীন রচনা বলে গণ্য করা হয়, তাহলে ঐ রচনায় যে সকল স্ববিরোধিতা বা অসম্ভাব্যতা দেখতে পাওয়া যায় তাঁর কারণ সহজেই বোধগম্য হতে পারে। আসলে গসপেল যে মানুষেরই রচনা এবং বর্ণিত পরিস্থিতেই রচিত হয়েছে ঐ ভুলগুলিই তাঁর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। লেখকগণ ধরে নেয়া যায় যে খুব বিশ্বস্ত ছিলেন; কিন্তু তারা কোন তথ্য বা বিবরণে ভুল আছে বলে সন্দেহ না করেই তা লিখে গিয়েছেন। ফলে তাদের বিবরণে সমসাময়িক সম্প্রদায়ের প্রতিযোগিতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। এবং তাদের বিবরণের সঙ্গে অন্যান্য লেখকের বিবরণের মিল খুজে পাওয়া যায় না। আসলে তারা তাদের বিরুদ্ধবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যিশুর জীবন কাহিনী পেশ করেছেন।
ইতিহাসগত দিক থেকে গসপেল সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের আধুনিক অভিমতই যে সঠিক, তা আমরা আগেই দেখিয়েছি। খোদ গসপেলের বিবরণেই এ কথার সমর্থন আছে।
ম্যাথুর গসপেল (মথি লিখিত সুসমাচার)
নিউ টেস্টামেন্টের প্রথমেই আছে ম্যাথুর গসপেল। অপ্র তিনখানি গসপেল আছে তাঁর পরে। ম্যাথুর গসপেল আসলে ওল্ড টেস্টামেন্টেরই সম্প্রসারণ বিশেষ। সে হিসাবে তাঁর স্থান নির্ণয় যথার্থই হয়েছে।” একুমেনিক্যাল ট্রানশলেশন অব দি বাইবেল” পুস্তকের ভাষ্যকারগণ লক্ষ্য করেছেন যে,”যিশু ইজরাইলের ইতিহাস পূর্ণ করেছেন”, এ কথা প্রমাণ করার জন্যই এ গসপেল লেখা হয়। এ জন্য ম্যাথু ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে ঘন ঘন উধৃতি দিয়েছেন। এ সকল উধৃতিতে দেখানো হয়েছে যে, ইহুদীগণ যে ত্রাণকর্তার (মেসিয়া-মসিহ) অপেক্ষা করছিল, যিশু তাঁর মতই আচরণ করেছিলেন।
এ গসপেল শুরু হয়েছে যিশুর নসবনামা দিয়ে। (এ নসবনামা যে লুকের বর্ণিত নসবনামার বিপরীত, তা আমরা পরে দেখাবো) । ম্যাথু যিশুর বংশধারা দাউদের মারফত ইব্রাহীম পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছেন। মূল বিবরণে যে ভুল আছে, একটু পরেই তা আমরা উল্লেখ করব। অবশ্য অধিকাংশ ভাষয়কার এ ভুল নিরবে উপেক্ষা করে থাকেন। তবুও ইব্রাহীম থেকে বংশধারা টেনে এনে রচনার মূল মেজাজ প্রথমেই সাব্যস্ত করে দেয়াই ছিল ম্যাথুর স্পষ্ট উদ্দেশ্য। একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইহুদী বিধানের প্রতি যিশুর দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদা তুলে ধরেছেন। ইহুদী বিধানের মূলনীতিগুলি (উপাসনা, উপবাস ও দান) এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে।
যিশু তাঁর শিক্ষা প্রধানত নিজের লোকদেরই দেন। বারজন হাওয়ারির সঙ্গে তিনি এভাবে কথা বলেন-”তোমরা পর জাতিগণের পথে যাইওনা এবং শমরীয়দের কোন নগরে প্রবেশ করিওনা, বরং ইসরায়েল কুলের হারানো মেষগণের কাছে যাও” (মথি ১০৪-৬) ।” (তৌরাত বা পেনটাটিউকই ছিল শমরীয়দের ধর্মীয় গ্রন্থ। তারা অধিকাংশ ইহুদী আচার অনুষ্ঠান পালন করত এবং ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের আশা করত। কিন্তু তারা জেরুসালেমের ধর্মমন্দিরের পালটা একটি ধর্মমন্দির নির্মাণ করেছিল) ।”আমি একমাত্র ইসরায়েল কুলের হারানো মেষগণের নিকটেই প্রেরিত হইয়াছি।” (মথি ১৫, ২৪) । ‘ কিন্তু তারপরই মথি তাঁর গসপেলের শেষভাগে যিশুর প্রথম শিষ্যদের মিশন সকল জাতির প্রতি সম্প্রসারণ করেছেন। তিনি যিশুর মুখ দিয়ে এ হুকুম জারি করিয়েছেন,”অতএব তোমরা গিয়া সমুদয় জাতিকে শিষ্য কর” (মথি ২৮, ১৯) ।, কিন্তু প্রথম লক্ষ্য অবশ্যয়ই ইসরায়েল কুল। এ গসপেল সম্পর্কে ট্রাইকট বলেন, – গ্রীক আবরণের নিচে এ বইয়ের হাড় ও গোশত হইতেছে ইহুদী, আত্মাও তাই; সমগ্র বইয়ের মেজাজও ইহুদী এবং তাঁর সুস্পষ্ট আলামতও ঐ বইয়েই আছে।”
একমাত্র এ সকল প্রমাণ ও মন্তব্যের ভিত্তিতেই বলা যেতে পারে যে, মথির গসপেল ইত্যাদি খৃষ্টান সম্প্রদায়ের কিংবদন্তির ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে। ও কুল্ম্যান বলেছেন, এ সম্প্রদায়”ইহুদী ধর্ম থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল, কিন্তু একই সময়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের ধারাবাহিকতাও বজায় রাখার চেষ্টা করছিল। এ গসপেলের মূল বক্তব্য এবং সাধারণ মেজাজ থেকে এরূপ একটি ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টার আভাস পাওয়া যায়।”
তাছাড়া মূল পাঠে রাজনৈতিক বক্তব্যও দেখতে পাওয়া যায়। রোমানদের দখলে থাকার কারণে ফিলিস্তিন স্বভাবতই স্বাধীন হতে চেয়েছিল এবং এ জন্য তারা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। সকল জাতির মধ্যর তারা নিজেদের আল্লাহর মনোনীত জাতি বলে দাবী করায় তারা আশা করেছিল যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান হিসাবে সরাসরি তাদের সাহায্য করতে পারেন। কেননা অতীতে তিনি বহুবারই এরূপ সাহায্য করেছেন।
এখন, মথির পরিচয় নেয়া যাক। তিনি কেমন লোক ছিলেন? প্রথমেই সরাসরি বলে দেয়া ভাল যে, তাকে এখন আর যিশুর অন্যতম সাহাবী বলে স্বীকার করা হয় না। কিন্তু তবুও ট্রাইকট তাঁর নিউ টেস্টামেন্টের অনুবাদের (১৯৬০) ভাষ্যে তাকে সেভাবেই পেশ করেছেন। তিন বলেছেন-”যিশু যখন নিজের অন্তম শিষ্য হওয়ার জন্য তাকে ডেকে নেন, তখন মথি ওরফে লেভি কাফারনাউমের শুল্ক ফাড়ি বা কাষ্টম হাউজে কাষ্টম অফিসার পদে নিজুক্ত ছিলেন।” চার্চের ফাদার ওরিজেন, জেরোম ও এপিফেনিসও এ অভিমত পোষণ করেন। কিন্তু এ অভিমত এখন আর সঠিক বলে স্বীকার করা হয় না। কারণ একটি বিষয়ে আদৌ কোন দ্বিমত নেই যে মথি”গ্রীক ভাষীদের জন্য লিখেছেন বটে, কিন্তু তিনি ইহুদী আচার অনুষ্ঠান এবং আরমাইক ভাষা জানতেন।”
একুমেনিক্যাল ট্রানশলেশনের ভাষ্যকারগণ সম্ভবত মনে করেন যে, এ গসপেলের উৎপত্তি এভাবে হয়েছে-”সাধারণত ধরে নেয়া হয়ে থাকে যে, এ গস্পেল সিরিয়ায় সম্ভবত এ নটিওকে বা ফিসিনিয়ায় লিখিত হয়। কারণ সেখানে বহু ইহুদীর বাস ছিল।” (উল্লেখযোগ্য যে মথি যে সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন, সে ইহুদী-খৃষ্ট সম্প্রদায়ের অধিবাস আলেকজান্দ্রিয়াতেও হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হয়ে থাকে। অন্যান্য বহু ভাষ্যকারের মত কুলম্যানও এ সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন)”জামিনায় ৮০ সালের সিনাগগ সমাবেশ ঘটেছিল, সিনাগগ ও ফরাসীদের গোড়া ইহুদীবাদের বিরুদ্ধে সেরূপ একটি বিতর্কের আলামত আমরা দেখতে পেয়েছি।” এ পরিস্থিতে এমন অনেক লেখক আছেন যারা মনে করেন যে, প্রথম গসপেল ৮০-৯০ সাল সময়ের মধ্যে রচিত হয়েছিল, কিম্বা তাঁর কিছু আগেও রচিত হয়ে থাকতে পারে। এ সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছুই বলা যায় না, বলা সম্ভব না। আমরা যেহেতু লেখকদের আসল নাম জানিনা, সেহেতু খোদ গসপেলেই যে আভাস-ইঙ্গিত আছে, একমাত্র তাই হচ্ছে আমাদের সম্বল- যেমন পেশার পরিচয় থেকে আমাদের লেখককে চিনে নিতে হয়। আমরা জানতে পারি যে, তিনি ইহুদী রচনাবলী ও ঐতিহ্য বিষয়ে সুপন্ডিত। তিনি তাঁর জাতির ধর্মীয় নেতাদের জানেন ও শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু তাদের কঠোরভাবে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি ধর্মপ্রচারে এবং জনসাধারণের কাছে যিশুকে বোধগম্য করে তুলতে খুবই পারদর্শী। তদুপরি তিনি তাঁর শিক্ষা যাতে মানুষের বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হয়, সে ব্যাপারে খুবই জোর দিয়ে থাকেন। এ বিবরণ থেকে এমন একজন মানুষের ছবি পাওয়া যায়, যিনি একজন শিক্ষিত ইহুদী কিন্তু পরে খৃষ্টান হয়েছেন; এমন একজন গৃহস্থ”যিনি আপন ভান্ডার হতে নতুন ও পুরাতন দ্রব্য বের করেন (মথি ১৩, ৫২) ।” এ বিবরণ সে কাস্টম অফিসারের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না; কিম্বা যে মথিকে মার্ক ও লুক লেভি নামে অভিহিত করেছেন এবং যিনি বারোজন হাওয়ারির একজন ছিলেন, তাঁর সঙ্গেও খাপ খায় না।
মার্ক ও লুকের মত মথিও যে একই উৎস ও বিষয়বস্তু ব্যবহার করে তাঁর গসপেল লিখেছেন, এ বিষয়ে সকলেই একমত। তবে তাঁর বর্ণনা যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একটু পৃথক ধরনের, তা আমরা একটু পরেই দেখতে পাব। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুলম্যান মনে করেন যে, মথি মার্কের গসপেল থেকে ব্যাপকভাবে বিষয়বস্তু আহরণ করেছেন, যদিও মার্ক আদৌ যিশুর শিষ্য ছিলেন না।
মথি ওল্ড টেস্টামেন্টের মূল পাঠেও রদবদল করেছেন। তিনি তাঁর গসপেলের শুরুতে যে নসবনামা দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা তুলনা করার সময় আমরা এ রদবদল দেখতে পাব। তিনি তাঁর গ্রন্থে এমন বর্ণনা দিয়েছেন, যা”আক্ষরিক অর্থেই অবিশ্বাস্য।” যিশুর পুনরুত্থান প্রসঙ্গে প্রহরীদের ভূমিকার ব্যাপারে ফাদার কানানগিসার এ বিশেষণই প্রয়োগ করেছেন। যিশুর কবরে সামরিক প্রহরী থাকার কাহিনীর অসম্ভাব্যতা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন-”এ পর জাতীয় প্রহরীগণ তাদের উর্ধতন কর্মকর্তাদের খবর না দিয়ে খবর দিয়েছে বড় বড় পুরোহিতদের আর সেই পুরোহিতেরা তাদের পয়সা দিয়েছেন মিথ্যে কথা বলা জন্য। তবে এজন্য মথির প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি না হাসাই ভাল, কারণ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল গুরুতর এবং গুরুত্বপূর্ণো। তিনি তাঁর নিজের মত করে কিংবদন্তির তথ্য তাঁর বইতে সন্নিবেশিত করেছেন। ফলে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে, তা ‘জেসাস ক্রাইস্ট সুপারস্টার’ নামক মার্কিন ফিল্মের জন্যই শোভন হয়েছে।”
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ মন্তব্য যিনি করেছেন, তিনি একজন বিশিষ্ট ধর্মবিদ এবং প্যারিসের ক্যাথলিক ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক।
মথি যিশুর মৃত্যুকালীন ঘটনাবলীর যে বিবরণ দিয়েছেন, তা থেকে তাঁর উর্বর কল্পনাশক্তির আর একটি নজির পাওয়া যায়।
“আর দেখ, মন্দিরের পর্দাখানি উপর হইতে নিচ পর্যন্ত চিবিয়া দুইখান হইল, ভূমিকম্প হইল ও শৈল সকল বিদীর্ণ হইল এবং কবর সকল খুলিয়া গেল, আর অনেক নিদ্রাগত পবিত্র লোকের দেহ উত্থাপিত হইল, এবং তাহার পুনরুত্থানের পর তাহারা কবর হইতে বাহির হইয়া পবিত্র নগরে প্রবেশ করিলেন, আর অনেক লোককে দেখা দিলেন।”
মথি বর্ণিত (২৭, ৫১-৫৩) এ ঘটনা অন্য কোন গসপেলে উল্লেখ করা হয়নি। পবিত্র লোকদের দেহ যে কিভাবে যিশুর মৃত্যুর সময় জীবন্ত হল (অন্যান্য গসপেল মতে এ ঘটনা ঘটে শাব্বাথের প্রাক্কালে), এবং তাঁর পুনরুত্থানের পরে কবর থেকে বেরিয়ে এল (অন্যান্য গসপেল মতে এ ঘটনা শাব্বাথের পরদিন), তা বুঝতে পারা সত্যিই কঠিন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য অসম্ভব ব্যাপার সম্ভবত মথির গসপেলেই দেখতে পাওয়া যায়। যে সকল কথা যিশুর নিজের উক্তি বলে গসপেল লেখকগণ দাবী করে থাকেন, তাঁর মধ্যে মথির এ বিবরণটি ব্যাখ্যা কয়ড়াই সবচেয়ে কঠিন। যোনার চিহ্ন সম্পর্কিত বিষোয়ে তিনি ১২ অধ্যায়ের ৩৮-৪০ শ্লোকে বলেছেন-”যিশু যখন লেখক ও ফরিশিদের সঙ্গে ছিলেন, তখন তাহারা তাহাকে বলিল, হে গুরু, আমরা আপনার কাছে কোন চিহ্ন দেখিতে ইচ্ছা করি। তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, একালের দুষ্ট ও ব্যাভিচারী লোকে চিহ্নিত অন্বেষণ করে, কিন্তু যোনা আভববাদীর চিহ্ন ছাড়া আর কোন চিহ্ন ইহাদিগকে দেয়া যাবে না। কারণ যোনা যেমন তিন দিবারাত্র বৃহৎ মৎস্যের উদরে ছিলেন, তেমনি মনুষ্য পুত্রও তিন দিবারাত্রি পৃথিবীর গর্ভে থাকিতেন।”
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যিশু বলেছেন যে, তিনি তিন দিন তিন রাত মাটির নিচে থাকবেন। এ কারণে মথি (লুক ও মার্কের মতই) যিশুর মৃত্যু ও দাফনের সময় বলেছেন শাব্বাথের প্রাক্কালে। ফলে যিশুর কবরে থাকার মেয়াদ তিন দিন হয় হয় বটে, কিন্তু তিন রাত হয় না; হয় আসলে দুই রাত। অপর একটি স্থানেও (১৬, ১-৪) মথি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ ক্করেছেন বটে, কিন্তু সেখানে তিনি কোন নির্দিষ্ট মেয়াদের কথা বলেননি। লুকও মেয়াদ উল্লেখ করেননি (১১, ২৯-৩২) । পরে আমরা দেখতে পাব যে, মার্কের বর্ণনায় (৮, ১১-১২) আছে, যিশু নাকি বলেছেন যে, ঐ কালের কোন চিহ্ন দেয়া হবে না।
গসপেলের ভাষ্যকারগণ হামেশা এ প্রসঙ্গটি উপেক্ষা করে থাকেন। তথাপি ফাদার রোজেট এ অসম্ভাব্যতা উল্লেখ করে বলেছেন যে, যিশু মাত্র তিন দিন কবরে ছিলেন- একটি পুরো দিন এবং দুটি রাত। তিনি অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই বলে যে, আসলে”ওটা হচ্ছে কথার একটি বিশেষ ধরণ মাত্র, কিন্তু প্রকৃত অর্থ হচ্ছে তিন দিন।” এরূপ একটি অর্থহীন যুক্তি ভাষ্যকারগণ প্রয়োগ করতে পারেন, তা সম্ভবত আশা করা যায় না। তাদের আচরণ সত্যিই দুঃখজনক। লেখকের অথবা নকলকারের ভুলের দরুণই এ অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে, এ কথাও যদি তারা বলতেন, তাহলে নৈতিক দিক থেকে তা অধিক সন্তোষজনক ও গ্রহণযোগ্য হত।
কিন্তু এ সকল অসঙ্গতি ও অসম্ভাব্যতা ছাড়াও মথির গসপেলের একটি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্যবৈশিষ্ট্য আছে। এ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, ইহুদী-খৃষ্ট স্মপ্রদায় মূল ইহুদী ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তবুও ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখছে, গ্রন্থের সর্বত্র এ ভাবধারা ও মেজাজই হচ্ছে সবচেয়ে প্রবল। ইহুদী-খৃষ্ট সম্প্রদায়ের ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এ বৈশিষ্ট্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কের গসপেল (মার্ক লিখিত সুসমাচার)
চারখানি গসপেলের মধ্যে এ গসপেল খানিই সবচেয়ে ছোট এবং সবচেয়ে প্রাচীন। কিন্তু এ গ্রন্থ কোন হাওয়ারির লেখা নয়। লেখক হয়ত বড়জোর কোন হাওয়ারির শিষ্য ছিলেন।
কুলম্যান বলেছেন যে, তিনিমার্ককে যিশুর শিষ্য বলে গণ্য করেন না। তবে এ গসপেল রচনার কৃতিত্ব মার্কের উপর আরোপিত হওয়ার ব্যাপারে যারা সন্দেহ পোষণ করেন তাদের জন্য তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এ গ্রন্থ”কোন হাওয়ারির শিক্ষার ভিত্তিতে রচিত নয় বলে মথি ও লুক যদি জানতেন, তাহলে তারা এ গ্রন্থের ব্যবহার যেভাবে করেছেন, তা করতেন না।” কিন্তু এ যুক্তিতে কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। কুলম্যান তাঁর নিজের সন্দেহের সমর্থনে বলেছেন যে, তিনি নিউ টেস্টামেন্ট থেকে”জন ওরফে মার্ক” নামক এক ব্যাক্তির উক্তি হামেশা উধৃত করে থাকেন। কিন্তু এ সকল উধৃতিতে কোন গসপেল লেখকের নাম উল্লেখ করা হয় না এবং মার্কের রচনার মূল পাঠেও কোন লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
এ বিষয়ে তথ্যের অভাব থাকার দরুণ ভাষ্যকারগণ এমন সব খুটিনাটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা স্পষ্টতই বাহুল্য মনে হয়। মার্কের গসপেলে এরূপ একটি বিবরণ আছে-”আর, একজন যুবক উলঙ্গ শরীরে চাদর জড়াইয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিতে লাগিল; তাহারা তাহাকে ধরিল, কিন্তু সেসেই চাদরখানি ফেলিয়া উলঙ্গই পলায়ন করিল।” (মার্ক ১৪, ৫১-৫২) । একমাত্র মার্কের গসপেলেইএ ঘটনার বিবরণ আছে বলে ভাষ্যাকারগণ ধরে নিয়েছেন যে ঐ যুবক মার্কই হয়ে থাকবেন, সেই বিশ্বস্ত শিষ্য যিনি তাঁর গুরুকে অনুসরণের চেষ্টা করেছিলেন। (একুমেনিক্যাল ট্রানশলেশন) । অন্যান্যভাষ্যকারের মতে এ ঘটনা হচ্ছে”ব্যাক্তিগত স্মৃতি, সত্যতার প্রমাণ, বেনামী দস্তখত এবং তিনি যে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাঁর প্রমাণ।”
কুলম্যান মনে করেন যে,”লেখক ইহুদী বংশজাত ছিলেন বলে যে অনুমান করা হয়, বহু শব্দ ও বাক্য থেকে তাঁর সমর্থন পাওয়া যায়।” কিন্তু রচনায় ব্যবহৃত ল্যাটিন শব্দ ও বাক্য থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে যে তিনি গসপেলখানি রোমে রচনা করেছিলেন।” যে সকল খৃষ্টান ফিলিস্তিনে বাস করে না, তিনি তাদের লক্ষ্য করে কথা বলেছেন এবং ব্যবহৃত আরমাইক শব্দগুলি সতর্কতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন।
মার্ক রোমে পিটারের সঙ্গী ছিলেন বলে একটি ধারণা বহুদিন যাবত প্রচলিত আছে। পিটারের প্রথম চিঠির শেষ অনুচ্ছেদ হচ্ছে এ ধারণার ভিত্তি (অবশ্য ঐ চিঠি পিটারের লেখা বলে যদি ধরে নেয়া হয়) । পিটার লিখেছিলেন -”ব্যাবিলনে অবস্থিত সম্প্রদায়, যে সম্প্রদায় একইভাবে মনোনীত, আপনাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, আমার পুত্র মার্কও আপনাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।”একুমেনিক্যাল ট্রানশলেশনের ভাষ্যে বলা হয়েছে-”ব্যাবিলন বলতে সম্ভবত রোমই বুঝানো হয়েছে।”এ অনুমান থেকে ভাষ্যকারগণ ধরে নিয়েছেন যে, মার্ক যেহেতু পিটারের সঙ্গে রোমেছিলেন বলে ধারণা করা হয়ে থাকে, সেহেতু মার্কই লেখক হয়ে থাকবেন। অর্থাৎ অনুমানের ওপর অনুমান। সেই যে ১৫০ সালে হিরাপোলিশের বিশপ পাপিরাস যে যুক্তিতে মার্ককে এ গসপেলের রচয়িতা বলে দাবী করেছিলেন, এবং তাকে”পিটারের দোভাষী” এবং সম্ভবত”পলের সহযোগী” বলেউল্লেখ করেছিলেন, এখানেও ঠিক সেই একই ধরনের যুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে আর কি!
এ দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে মার্কের গসপেলের রচনাকাল দাঁড়ায় পিটারের মৃত্যুর পরেঅর্থাৎ একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন মতে ৬৫ ও ৭০ সালের মধ্যে এবং কুলম্যানের মতে ৭০ সালে।
মূল পাঠে কিন্তু একটি বড় গোলমাল পাওয়া যায়। রচনার কোথাও ঘটনার কোন ক্রমিকতা রক্ষা করা হয়নি। বিবরণের শুরুতেই (১, ১৬-২০) মার্ক সেই চারজন জেলের কথা বলেছিলেনযারা যিশুর একটিমাত্র কথাতেই সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে তাঁর সঙ্গী হয়েছিল। তারা যিশুকে চিনত না, কিন্তু যেইমাত্র তিনি বললেন,”আমি তোমাদের মানুষ ধরার জেলে বানিয়ে দেব,”অমনি তারা তাঁর সঙ্গে চলে গেল। প্রত্যেক ঘটনারই যে একটি সম্ভাব্যতা আছে, মার্কের বোধহয় তা মনে হয়নি।
ফাদার রোজেটের মতে মার্ক হচ্ছেন একজন”বিশৃংখল লেখক” চারজনের মধ্যে”দুর্বলতম লেখক, সবচেয়ে কাচা লেখক”। একটি ঘটনার বিবরণ যে কিভাবে লিখতে হয়, তিনি তাও জানেন না। ফাদার রোজেটের তাঁর এ মন্তব্যের পোষকতায় বারজন হাওয়ারি বাছাই করার বিবরণটি উধৃতকরেছেন। বিবরণটি এই-”পরে তিনি পর্বতে উঠিয়া, আপনি যাহাদিগকে ইচ্ছা করিলেন, নিকটে ডাকিলেন; তাহাতে তাহারা তাহার কাছে আসিলেন। আর তিনি বারজঙ্কে নিযুক্ত করিলেন, যেন তাহারা তাহার সঙ্গে সঙ্গে থাকেন ও যেন তিনি তাহাদিগকে প্রচার করিবার জন্য প্রেরণ করেন এবং যেন তাহারা ভূত ছাড়াইবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। এভাবে তিনি বারজন নিযুক্ত করিলেন এবং সাইমনকে পিটার নাম দিলেন” (মার্ক ৩, ১৩-১৬) ।
ফাদার রোজেট মনে করেন যে, এভাবে কখনও কোণ সঙ্গী বাছাই করা আদৌ সম্ভব হইতে পারেনা।
যোনার চিহ্নের ব্যাপারে মার্ক যে মথি ও লুকের সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলেছেন, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যিশুর ধর্ম প্রচারের সময় লোকদের চিহ্ন (নবুওতের প্রমাণ) দেখানোর ব্যাপারে মার্ক এমন একটি কাহিনী বর্ণনা করেছেন, যা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি বলেছেন-”পরে ফরিশিয়া বাহিরে আসিয়া তাহার সহিত বাদানুবাদ করিতে লাগিল, পরীক্ষা করার জন্য তাহার নিকটে আকাশ হইতে একটি চিহ্ন দেখিতে চাহিল। তখন তিনিআত্মায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া কহিলেন, এ কালের লোকেরা কেন চিহ্নের অন্বেষণ করে? আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি এ লোকদিগকে কোন চিহ্ন দেখানো যাইবে না। পরে তিনি তাহাদিগকে ছাড়িয়া আবার নৌকায় উঠিয়া অন্য পারে গেলেন।” (মার্ক ৮, ১১-১৩)
অতিপ্রাকৃতিক বলে প্রতিয়মান হতে পারে এমন কোন কাজ না করার জন্য যিশুর যে সংকল্প ছিল, এখানে তার নিজের তরফ থেকেই তাঁর সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। ফলে একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের ভাষ্যকারগণ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ লুক যেখানে বলেছেন যে যিশু একটি মাত্র চিহ্ন দেখাবেন (যোনার চিহ্ন, মথিও তাই বলেছেন), সেখানে মার্ক বলেছেন যে, কোন চিহ্নই দেখান হবে না। লুক অবশ্য আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেছেন যে, যিশু”চিহ্ন হিসেবে নিজেই কতিপয় অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা দেখালেন” (লুক ৭, ২২ ও ১১, ২০) ।
মার্কের সমগ্র গসপেল চার্চ কর্তৃক আদি ও আসল বলে স্বীকৃত। কিন্তু তবুও আধুনিক ভাষ্যকারগণ মনে করেন যে, শেষ অধ্যায়টি (১৬, ১৯-২০) পরে জুড়ে দেয়া হয়েছে। একুমেনিক্যাল ট্রাশ্লেশনের ভাষ্যকারগণ তো এব্যাপারে খুবই মুখর।
কোডেক্স ভ্যাটিকানাস এবং কোডেক্স সিনাইটিকাস নামে গসপেলগুলির চতুর্থ শতাব্দীর আমলের যে পূর্ণাঙ্গ পান্ডুলিপি পাওয়া যায়, তাঁর কোনটিতেই ঐ শেষ অধ্যাটি নেই। কুলম্যান বলেছেন -” পরবর্তী কালে কতিপয় গ্রীক পান্ডূলিপি এবং অপর কয়েকটি সংস্করনে ঐ উপসংহার যোগ করা হয়েছে, এবং তাঁর বিষয়বস্তু নেয়া হয়েছে অন্যান্য গসপেল থেকে।” আসলে এ সংযোজিত উপসংহারের কয়েকটি পাঠ দেখতে পাওয়া যায়। দীর্ঘ পাঠও আছে, আবার সংক্ষিপ্ত পাঠও আছে, এবং ১৯৫২ সালে প্রকাশিত বাইবেলের রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড (সংশোধিত মান) সংস্করণে এ উভয় প্রকার পাঠই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কোন কোণ দীর্ঘ পাঠে আবার কিছু কিছু অতিরিক্ত বিষয়বস্তুও দেখতে পাওয়া যায়।
ফাদার কানেনগিসার এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন -” যে সম্প্রদায়ের লোকেরা মার্কের গসপেলের আসল হওয়ার সনদ দিয়েছে, সরকারীভাবে ঐ গ্রন্থ তাদের হাতে পড়ার সময়ই ঐ শেষের শ্লোকগুলি বাদ দেয়া হয়েছে। মথি, লুক বা জন শ্লোকগুলি দেখেননি। কিন্তু কিছু যেন নেই অথচ থাকা উচিত, শূন্যস্থান পূর্ণ হওয়া উচিত সকলেই তা অনুভব করেছিলেন। বহু দিন পরে মথি, লুক ও জনের একই ধরনের রচনা যখন সর্বত্র প্রচলিত ছিল, তখন মার্কের গসপেলের জন্য একটি উপযুক্ত শেষ অধ্যায় রচনা করা হয় এবং এজন্য অন্যান্য গসপেল থেকে বিষয়বস্তু সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু মূলের সঙ্গে এ সংযোজনের যে মিল হয়নি, তা মার্কের গসপেলের ১৬ অধ্যায়ের ৯ থেকে ২০ শ্লোক পর্যন্ত পড়লে সহজেই ধরা যায়। দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত গসপেলের রচনাবলীতে যে কতখানি স্বাধীনতার সঙ্গে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, এ ঘটনা থেকে তাঁর একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে।”
মানুষ যে ধর্ম পুস্তকে রদবদল করেছে, এখানে একজন বিখ্যাত ধর্মবিদের কাছ থেকেই তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি পাওয়া যাচ্ছে।
লুকের গসপেল (লুক লিখিত সুসমাচার)
কুলম্যানের মতে লুক হচ্ছেন একজন”পুরাবৃত্ত রচয়িতা” আর ফাদার কানেনগিসার মনে করেন যে, তিনি একজন”প্রকৃত ঔপন্যাসিক।” থিওপিলিয়াসকে লেখা পূর্বকথায় লুক বলেছেন যে, যিশু সম্পর্কে পূর্বে যারা বিবরণ লিখেছেন, তাদের অনুসরণে একই বিষয়ে তিনি নিজেও একটি বিবরণ লিখতে যাচ্ছেন এবং এ উদ্দেশ্যে তিনি হাওয়ারিদের প্রচারিত তথ্য সহ চাক্ষুস সাক্ষীদের তথ্য ও বর্ণনা ব্যবহার করবেন। অর্থাৎ তিনি নিজেই একজন চাক্ষুস সাক্ষী নন। সুতরানগ বিবরণটি সুপরিকল্পিত এবং সাজানো গুছানো হবে বলে আশা করা যায়। এ বিবরণের ভূমিকা তিনি এভাবে লিখেছেনঃ
“আমাদের ধর্মীয় ইতিহাসে যে সকল ঘটনা ঘটেছে এবং তাঁর যে সকল তথ্য ও বর্ণনা চাক্ষুস সাক্ষী ও প্রচারকদের মারফত আমাদের কাছে এসেছে, অনেকেই তা সংগ্রহকরে একত্রিত করা কাজে হাত দিয়েছেন। আমি ঐ সকল বিষয়ে আগাগোড়া অবহিতহয়েছি বলে মনে করি যে, আমি যদি আপনার জন্য নিজেই ধারাভিকতা সহকারে এবংসুশৃংখলভাবে ঐ বিবরণ লিখি, তাহলে ভালই হবে এবং আপনাকে যে সকল বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে, তাঁর সত্য বিবরণ আপনি জানতে পারবেন।”
এ ভূমিকার প্রথম বাক্য থেকেই মার্কের সাথে লুকের পার্থক্য ধরা যায়। লুকের গসপেল ধ্রুপদী গ্রীক ভাষায় লিখিত একটি উতম সাহিত্যকর্ম এবং অমার্জিত বিষয়বস্তু থেকে মুক্ত।
লুক একজন অভিজাত বিদগ্ধ ব্যক্তি হিসেবে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। ইহুদীদের সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট। কুলম্যান দেখিয়েছেন যে, লুক মার্কের ইহুদী বিষয়ক অধিকাংশ অনুচ্ছেদই বাদ দিয়েছেন, যিশুর প্রতি ইহুদীদের অবিশ্বাস বড় করে দেখিয়েছেন এবং যে সমরীয়দের যিশু অপছন্দ করতেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল বলে দেখিয়েছেন। পক্ষান্তরে মথি বলেছেন যে, যিশু হাওয়ারীদের সর্বদা সমরীয়দের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলতেন। গসপেল লেখকগণ যে তাদের নিজ নিজ ব্যক্তিগত মনোভাব অনুসারে যিশুর মুখে কথা তুলে দিয়েছেন, তাঁর অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে এ হচ্ছে একটি। তারা হয়ত সরল বিশ্বাসেই এ কাজ করেছেন। গসপেলগুলি যে”যুদ্ধকালীন রচনা” অথবা”কোন বিশেষ উপলক্ষে রচিত” এ প্রমাণের পর তা কি আর অস্বীকার করার উপায় আছে? লুক ও মথি গসপেলের মেজাজ ও আওয়াজ তুলনা করা হলে ঐ বক্তব্য আরও বেশী পরিষ্কার হয়ে যাবে।
কিন্তু লুক আসলে কে ছিলেন? পল তাঁর কয়েকখানি চিঠিতে ঐ একই নামের যে চিকিৎসকের কথা বলেছেন, তিনি এবং গসপেল লেখক লুক একই ব্যাক্তি বলে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একুমেনিক্যাল ট্রানশলেশনের ভাষ্যকারগণ মনে করেন-”যে নিখুত ও নির্দিষ্ট ভাষায় তিনি পীড়িত ব্যাক্তির বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে গসপেল লেখকের চিকিৎসকের পেশা সাব্যস্ত হয়ে যায় বলে কয়েকজন ভাষ্যকার মনে করেন।”এ মন্তব্য অতিকথন এবং বাহুল্যপূর্ণ। লুক আসলে ঐরূপ কোন”বর্ণনাঃ দেননি।”যে ভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন, তা তৎকালীন সমাজের বিদগ্ধজনের ভাষা।” লুক নামে পলের একজন সফর সঙ্গী ছিলেন, কিন্তু তিনিই কি সেই ব্যাক্তি? কুলম্যান তাই মনে করেন।
লুকের গসপেলের সময়কাল কয়েকটি ঘটনার ভিত্তিতে অনুমান করা যায়- লুক মার্ক ও মথি গসপেলের সহায়তা নিয়েছেন। একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের বর্ণনা থেকে মনে হয় তিনি সম্ভবত ৭০ সালে টিটাসের সেনাবাহিনী কর্তৃক জেরুসালেমের অবরোধ ও ধ্বংস দেখেছিলেন। তিনি সম্ভবত এ সময়ের পরে তাঁর গসপেল লেখেন। কয়েকজন অবশ্য আরও আগে লেখা হয়েছে বলে উল্লেখ করে থাকেন।
লুকের বিভিন্ন বর্ণনা তাঁর পূর্ববর্তীদের বর্ণনার সঙ্গে আদৌ মেলে না। এ বিষয়ে আগেই মোটামুটি একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের ১৮১ থেকে শুরু করে পর পর কয়েক পৃষ্ঠায় এ অমিলের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। আর কুলম্যান তাঁর”নিউ টেস্টামেন্ট” নামক কিতাবের ১৮ পৃষ্ঠায় লুকের গসপেল থেকে এমন কয়েকটি বিবরণ উধৃত করেছেন, যা অন্য কোন গসপেলে পাওয়া যায় না এবং এগুলি তুচ্ছ খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে নয়।
যিশুর শৈশবকালের বর্ণনা গসপেলের একটি বিশিষ্ট বিষয়। মথি বিষয়টি লুকের তুলনায় ভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন এবং মার্ক যিশুর শৈশবকালের উল্লেখমাত্রও করেননি।
মথি ও লুক, এ দুজন যিশুর দু রকমের নসবনামা দিয়েছেন। যুক্তি ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ দুখানি নসবনামার পার্থক্য ও অসম্ভাব্যতা এত বেশী যে, এ বইয়ের একটি পৃথক অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। মথি ইহুদীদের লক্ষ্য করে লেখার কারণে কেন যে ইব্রাহীম থেকে নসবনামা শুরু করেছেন এবং কেন যে তিনি দাউদকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তা সহজেই বুঝা যায় এবং অনুরূপভাবে লুক একজন বিদগ্ধজন হিসাবে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণের কারণে কেন যে তাঁর নসবনামা আরও আগে থেকে শুরু করেছেন, তাও সহজেই বোধগম্য। দাউদের পর থেকে এ নসবনামা যে পরষ্পর বিরোধী, তা আমরা একটু পরেই দেখতে পাব।
মথি, মার্ক ও লুক যিশুর শিক্ষা ও প্রচারের অনেকগুলি বর্ননা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দিয়েছেন। খৃষ্টধর্মের এমন গুরুত্বপূর্ণ যে ঘটনা, সেই ইউকারিস্ট (নিস্তার পর্বের ভোজ- যিশুর সঙ্গে তাঁর শিষ্যদের সর্বশেষ রুটি- মদ ভোজন) সম্পর্কেও লুকের বর্ণনা মথি ও মার্কের বর্ণনার সঙ্গে মেলে না। (জনের বর্ণনার সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব নয়, কারণ নিস্তার পর্বের ভোজের সময় ধর্মীয় রীতি হিসাবে ইউকারিস্ট চালু হয়েছে বলে তিনি কোন উল্লেখই করেননি) । ফাদার রোজেট তাঁর ইনিশিয়েশন টু দি গসপেল নামক পুস্তকের ৭৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, ইউকারিস্ট অনুষ্ঠান প্রচলনের বর্ণনায় যে ভাষা ব্যবহার করেছেন (২২, ১৯-২৪) তা মথি (২৬। ২৬-২৯) ও মার্কের (১৪, ২২-২৪) ভাষা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, অথচ মথি ও মার্কের ভাষা প্রায় একই রকমের।” পক্ষান্তরে লুকের শব্দ প্রয়োগের বৈশিষ্ট প্রায় সাধু পলের মত (করিনথিয়ানদের উদ্দেশ্যে লিখিত প্রথম পত্র ১১, ২৩-২৫) ।
আময়ার আগেই দেখেছি যে, যিশুর পুনরুত্থান সম্পর্কে লুক তাঁর গসপেলে যা বলেছেন, এক্টস অব দি এপোসলস (হাওয়ারিদের কার্যক্রম) কিভাবে ঠিক তাঁর বিপরীত কথা বলেছেন। তিনি এ গ্রন্থের লেখক হিসাবে পরিচিত এবং স্বীকৃত; এবং গ্রন্থখানি নিউ টেস্টামেন্টের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গসপেলে তিনি পুনরুত্থানের ঘটনা ইস্টারের দিন ঘটেছিল বলেছেন, কিন্তু এক্টস গ্রন্থে বলেছেন যে কি সব অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাখ্যা আবিষ্কার করতে হয়েছে, তা আমরা আগেই দেখেছি।
একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের ভাষ্যকারদের মোট যারা বস্তুনিষ্ঠ হতে চেয়েছেন, তারা নিরুপায় হয়ে স্বীকার করেছেন যে, নীতিগতভাবে”বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে নির্ভুল রচনা করা লুকের মূল লক্ষ্য ছিল না।” যিশুর কবর থেকে উত্থান সম্পর্কে এক্টস গ্রন্থে লুকের বিবরণের সঙ্গে পলের বিবরণের তুলনা করতে গিয়ে ফাদার কানেনগিসার বলেছেন-”চারজন ইভানজেলিস্টের মধ্যে লুকই সবচেয়ে বেশী অনুভুতিপ্রবণ এবং সাহিত্যধর্মী। এবং তাঁর মধ্যে একজন প্রকৃত ঔপন্যাসিকের সকল গুণই বিদ্যমান।”
জনের গসপেল (জোহান লিখিত সুসমাচার)
জনের গসপেল অপর তিনখানি গসপেল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এ পার্থক্য এমনই প্রবল ও প্রকট যে, ফাদার রোজেট তাঁর ইনিশিয়েশন টু দি গসপেল গ্রন্থে অপর তিনখানি গসপেল সম্পর্কে মন্তব্য করার পর জনের গসপেল সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা পাঠকের মনে একটি তাৎক্ষনিক চমক সৃষ্টি করে। তিনি বলেন -”এ এক পৃথক জগত।”সত্যিই তাই। বিষয়বস্তু বাছাই, সাজানোর ধরণ, বর্ণনা ও কথোপকথনের ভঙ্গিতে এ গ্রন্থ বিশিষ্ট। রচনাশৈলী, ভৌগলিকতা এবং ঘটনার ক্রমিকতাও বিশিষ্ট। এবং কুলম্যানের মতে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকেও পৃথক ও বিশিষ্ট। অন্যদের তুলনায় জন যিশুর উক্তি পৃথকভাবে লিখেছেন। ফাদার রোজেট খেয়াল করে দেখেছেন যে, অন্যান্য গসপেলে যিশুর উক্তিগুলি”মৌখিক কথাবার্তার মত, জীবন্ত ও বাস্তব মনে হয়,” কিন্তু জনের গসপেলে পুরোটাই কেমন যে ধ্যানের ভাষা এবং এ মেজাজ এতই প্রবল যে, মাঝে মাঝে”মনে হয়”, এগুলি কি যিশুরই উক্তি! নাকি জন তাঁর নিজের অজান্তে নিজের চিন্তা-চেতনা দিয়ে যিশুর ধারণায় সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন।”
কিন্তু জনের পরিচয় কি? তিনি কে ছিলেন/ এ প্রশ্নের জবাব খুবই বিতর্কিত। এ ব্যাপারে নানা জনে নানা কথা বলেছেন। ফাদার রোজেট ও এ ট্রাইকট এ ব্যাপারে এমন একটি শিবিরের অনুসারে, যারা জনের পরিচয় সম্পর্কে কোণ সন্দেহ পোষণ করেন না। তারা বলেন, জনের গসপেল একজন চাক্ষুস সাক্ষীর রচনা, জন ছিলেন জেবেদির ছেলে এবং জেমসের ভাই। তাঁর সম্পর্কে অনেক খবরই সুবিদিত এবং অনেক বহুল প্রচারিত বইপত্রে তা ছাপাও হয়েছে। প্রতিকৃতি বিশারদদের মতে প্রায় সকল প্রতিকৃতিতেই জনকে যিশুর পাশে দেখা যায়, যেমন লাস্ট সাপারের (শেষ ভেঙ্গে) সময়। হাওয়ারি জন একজন সুপরিচিত ব্যাক্তি যে, গসপেলখানি তাঁর লেখা নয়, এমন কথা বোধ হয় কল্পনাও করা যায় না।
ঐ চতুর্থ গসপেল অত দেরিতে লেখা হলেও ঐ বিলম্ব বোধহয় জনের বিরুদ্ধে তেমন কোন মারাত্মক যুক্তি হিসাবে দাড় কয়ানো যায় না। এ গ্রন্থ যিশুর তিরোধানের পর প্রথম শতাব্দীর সম্ভবত শেষভাগে রচিত হয়েছিল। রচনার সময় যদি যিশুর তিরোধানের ষাট বছর বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে যিশুর আমলে জন যে যুবক বয়সের ছিলেন এবং তিনি যে একশো বছর বয়স পর্যন্ত বেচে ছিলেন এ ঘটনার সঙ্গে যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
ফাদার কানেনগিসার তাঁর যিশুর কবর থেকে উত্থান সম্পর্কিত গবেষণায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, একমাত্র পল ছাড়া নিউ টেস্টামেন্ট লেখকদের মধ্যে অন্য কেউ ঐ ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন বলে দাবী করতে পারেন না। তবুও জন দেখা যায় বলছেন যে, যিশু প্রথমবার টমাস ছাড়া কয়েকজন (সম্ভবত জন সহ) হাওয়ারির সমাবেশ দেখে দেন (২০, ১৯-২৪) এবং আট দিন পরে দ্বিতীয় বার একত্রে সকল হাওয়ারিকে দেখে দেন (২০, ২৫-২৯) ।
কিন্তু ও কুওম্যান তাঁর দি নিউ টেস্টামেন্ট নামক গ্রন্থে এ ঘটনাকে সত্য বলে মেনে নিতে পারেন নি।
একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, এ গসপেল জনের লেখা বলে মেনে নিতে অধিকাংশ ভাষ্যকার রাজি নন। অবশ্য এ (জনের লেখা না হওয়ার) সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ সকল আলামত থেকে এ কথাই মনে হয় যে, ঐ গসপেলেরযে এবারত আজ আমরা দেখতে পাই, তা সম্ভবত কয়েকজন লেখকের রচনা। ঐ গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে -” যে আকারে ঐ গসপেল এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা সম্ভবত লেখকের শিষ্যগণ প্রচার করেছিলেন এবং তারা ২১ অধ্যায় এবং খুব সম্ভবত কতিপয় টিকা (৪, ২ ও ৪, ১; ৪, ৪৪ ; ৭, ৩৭ ঘ; ১১, ২; ১৯, ৩৫) নিজেরাই যোগ করে দিয়েছিলেন। ভ্রষ্টা রমণীর কাহিনীর (৮, ২-১১) ব্যাপারে সকলেই একমত যে, এ ঘটনাটির উৎস অজ্ঞাত এবং কাহিনীটি পরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চার্চ কর্তৃপক্ষ এ কাহিনীকে মূল গ্রন্থের অঙ্গ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।”কুলম্যান মনে করেন যে,”১৯, ৩৫ শ্লোকটি চাক্ষুস সাক্ষীর দরখাস্ত” হিসেবে কিতাবে এসেছে। সমগ্র গসপেলের মধ্যে এ একটিমাত্র সুস্পষ্ট দস্তখত আছে, যদিও ভাষ্যকারগণ মনে করেন যে, এটা পরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
কুলম্যান মনে করেন যে, পরে যোগ করার ব্যাপারটি এ গসপেলের ক্ষেত্রে খুবই পরিষ্কার, যেমন ২১ অধ্যায়। এ অধ্যায়টি সম্ভবত”কোন শিষ্যের রচনা এবং তিনি মূল এবারতেও ছোটখাট রদবদল করে থাকতে পারেন।”
এ গসপেলের রচয়িতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ যে সকল অনুমান করে থাকেন, এখানে তাঁর বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ এ বিষোয়ে যে অস্পষ্টতা ও অনিশ্চয়তা রয়েছে, উপরে উধৃত বিশিষ্ট খৃষ্টান লেখকদের মন্তব্য থেকেই তাঁর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
জনের বর্ণিত বিভিন্ন কাহিনীর ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। অপ্র তিনটি গসপেলের বর্ণনার সঙ্গে এ কাহিনীগুলির পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। কুলম্যান এ পার্থক্যের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি অপর তিনজন ইভানজেলিস্টের মুকাবিলায় জনের মধ্যে একটি পৃথক ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পেয়েছেন এবং এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জন”কাহিনী, শব্দ, এবং বর্ণনা ভঙ্গি বাছাই করেছেন। ফলে তাঁর বর্ণনা দীর্ঘ হয়েছে এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে যিশুর মুখ দিয়ে তাই বলিয়েছেন যা খোদ পবিত্রাত্মা তাকে জানিয়েছিলেন।” এ কারণেই তাঁর বর্ণনায় ভিন্নতা এসেছে।
অনুমান করা যেতে পারে যে, জন তাঁর গসপেল সকলের শেষে লিখেছেন বলে নিজেদের চিন্তাধারার পোষকতাঁর জন্য সহায়ক কাহিনীগুলি বেছে নিয়েছেন। অন্যান্য গসপেলের কোন কোন বর্ণনা জনের গসপেলে না থাকার জন্য বিস্মিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন গ্রন্থের ২৮২ পৃষ্ঠায় এরূপ বর্ণনার কয়েকটি নজীর উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনার আদৌ উল্লেখ না থাকা অস্বাভাবিক মনে হয়। যেমন ইউকারিস্ট অনুষ্ঠান চালু করার বিষয়টি আদৌ বর্ণনা করা হয়নি। অথচ এ অনুষ্ঠান খৃষ্টধর্মের একটি মৌলিক ব্যাপার এবং ধর্মীয় সমাবেশের ভিত্তি স্বরূপ। জনের মত একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, যিনি ধ্যানের উপর এত জোর দিয়েছেন, তার পক্ষে এ ঘটনাটি উল্লেখ না করা অচিন্তনীয় ব্যাপার। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে এই যে, তিনি তাঁর লাস্ট সাপারের বর্ণনা, শিষ্যদের পা ধোয়ানো, জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার ভনিষ্যদ্বানী এবং পিটারের অস্বীকৃতির বর্ণোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
পক্ষান্তরে জনের গসপেল এমন অনেক কাহিনী আছে, অপর তিনখানি গসপেলে নেই। একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন গ্রন্থের ২৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। এক্ষেত্রে সম্ভবত অনুমান করা যেতে পারে, অন্যরা কাহিনীগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি, কিন্তু জন করেছেন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, জনের বর্ণনায় ( ২১, ১-১৪) দেখা যায় যিশু কবর থেকে উঠে এসে টাইবেরিয়াস সাগরের তীরে শিষ্যদের দেখা দিয়েছেন। এ ঘটনাটি লুকের অলৌকিকভাবে মাছ ধরার ঘটনারহবহু নকল ছাড়া আর কিছু নয়; অবশ্য জন অনেক খুটিনাটি বিষয় জুড়ে দিয়েছেন। লুকের বিবরণে (৫, ১-১১) অবশ্য বলা হয়েছে যে, মাছ ধরার ঘটনাটি যিশুর জীবিত থাকা কালে ঘটেছিল। এ বিবরণে জনের ঘটনাস্থলে হাজির থাকার একটি ইঙ্গিত আছে এবং জন তখন একজন প্রচারক ছিলেন বলে প্রবাদ আছে। যেহেতু জনের ঐ বর্ণনা তাঁর গসপেলে ২১ অধ্যায়ে আছে আছে এবং এ অধ্যায়টি পরে যোগ করা হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন, সেহেতু সহজেই অনুমান করা যায় যে, লুকের গসপেলে জনের নামের উল্লেখ থাকার কারণেই জনের গসপেলে কাহিনীটি পরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ যিশুর জীবনের একটি ঘটনা বহুকাল পরে বর্ণনা করার প্রয়োজন একজন গসপেল লেখকের এবারত বদল করতেও সংকোচ বোধ করা হয়নি।
অপর একটি বিষয়ে জনের গসপেলের সঙ্গে অপ্র তিনখানি গসপেলের পার্থক্য আছে। বিষয়টি হচ্ছে যিশুর ধর্মপ্রচারের মেয়াদ। মথি, মার্ক ও লুক বলেছেন, যিশু এক বছর কাল ধর্মপ্রচার করেন। জন বলেছেন, দু বছর। কুওম্যান এ পার্থক্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের ভাষ্যকারগণ এ বিষয়ে বলেছেন-”প্রথম তিনজন বলেছেন যে, যিশু দীর্ঘদিন গ্যালিলিতে ছিলেন; তারপর তিনি জুডিয়া অভিমুখে রওনা হন এবং পথে তাঁর অনেকদিন কেটে যায়। শেষ পর্যন্তু তিনি জেরুসালেমে অল্প কিছুদিন অবস্থান করেন। পক্ষান্তরে জন বলেছেন যে, যিশু ঘন ঘন এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা সফর করতেন। তারপর তিনি জুডিয়ায়, বিশেষত জেরুসালেমে দীর্ঘ দিন অবস্থান করেন (১, ১৯-৫১; ২, ১৩-৩, ৩৬; ৫, ১-৪৭; ১৪, ২০-৩১) । তিনি কয়েকটি পাসওভার (ইহুদীদের পান ভোজনের উৎসব ; দেবদূতরা মিসরে জনপদ ধ্বংস করে, কিন্তু ইহুদীদের ঘরবাড়ি অক্ষত রাখে, সেই ঘটনার বার্ষিকী) অনুষ্ঠানের কথাও উল্লেখ করেছেন। ফলে তাঁর মতে যিশুর ধর্ম প্রচারের মেয়াদ হয় দু বছরেরও বেশী।”
এ অবস্থায় আমরা কার কথা বিশ্বাস করব? মথি, মার্ক, লুকের? না জনের?
গসপেলের উৎস
গসপেলের যে সাধারণ পরিচয় ইতিমধ্যে তুলে ধরা হয়েছে, তা থেকে এবং বিশেষত এবারত পরীক্ষা করে দেখার পর এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, রচনাগুলি”অসংলগ্ন ও ধারাবাহিকতা বিহীন” এবং স্পষ্টতই”সমন্বয়ের অযোগ্য ও স্ববিরোধী।” এ রায় দিয়েছেন একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন অব দি বাইবেল গ্রন্থের ভাষ্যকারগণ। এ বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের বরাত দেয়া খুবই প্রয়োজন, কারণ বিষয়টি এমন অনুভূতিপ্রবণ যে, তাঁর বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। গসপেল সাহিত্যের কতিপয় বিব্রতকর বৈশিষ্ট সম্পর্কে চিন্তাশীল পাঠকের মনে যে সকল প্রশ্নের উদয় হয়ে থাকে, গসপেল রচনার সমকালীন ধর্মীয় ইতিহাস সম্পর্কিত কতিপয় ধারণা থেকে তাঁর জবাব যে কিভাবে পাওয়া যায়, তা আমরা আগেই দেখতে পেয়েছি। এখন বর্তমান যুগের বই-পুস্তকে কি বলা হয়েছে, বিশেষত গসপ্পেল রচনার সময় ইভানজেলিস্টগণের ব্যবহৃত উৎস সম্পর্কে কি বলা হয়েছে, তা জানা প্রয়োজন। রচনা সমাপ্ত হওয়ার পরবর্তীকালীন ইতিহাস থেকে বর্তমানে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় কিনা, তাও অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে।
চার্চ ফাদারদের আমলে উৎসের প্রশ্নটি হুব সহজভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। খৃষ্টধর্মের গোড়ার দিকে উৎস বলতে একমাত্র মথি লিখিত গসপেলের সম্পূর্ণ পান্ডুলিপি বুঝানো হত। ব্যাপারটি সমস্যার আকারে দেখা দেয় মার্ক ও লুকের প্রসঙ্গে। জন প্রসঙ্গে কোন সমস্যাই ছিল না, কেননা তাকে পৃথক ধরনের লেখক বলে মনে করা হত। গসপেলের দ্বিতীয় লেখক হিসেবে স্বীকৃত মার্ক সম্পর্কে সেন্ট অগাস্টিন বলেছেন যে, তিনি মথির রচনা দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে তাঁর (মথির) গ্রন্থের সংক্ষিপ্তসার প্রণয়ন করেছেন মাত্র। আর তৃতীয় লেখক লুক সম্পর্কে তাঁর অভিমত হচ্ছে এই যে, তিনি মথি ও মার্কে, এ দুজনের গ্রন্থ থেকেই তহ্য সংগ্রহ করেছেন। লুকের নিজস্ব ভূমিকা থেকেও যে এ অভিমতের সমর্থন পাওয়া যায়, তা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।
অর্থাৎ বিভিন্ন গসপেলের বয়ানের মধ্যে যে মিল ও সাদৃশ্য আছে, তা আমাদের মত সেই আমলের পাঠকের কাছেও ধরা পড়েছিল। বর্তমান যুগে একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের ভাষ্যকারগণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ হিসেব বের করেছেনঃ
১) তিন গসপেলে একই শ্লোক আছে ……৩৩০টি।
২) মথি ও মার্কে একই শ্লোক আছে …… ১৭৮ টি।
৩) মার্ক ও লুকে একই শ্লোক আছে …… ১০০টি।
৪) মথি ও লুকে একই শ্লোক আছে ………২৩০টি।
আবার প্রত্যেক গসপেলে এমন কিছু শ্লোক আছে, যা অন্য কোন গসপেলে নেই। এরূপ শ্লোকের সংখ্যা হচ্ছে মথি ৩৩০, মার্ক ৫৩ এবং লুক ৫০০।
চার্চ ফাদারদের আমল থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত দেড় হাজার বছর যাবত গসপেলের উৎস সম্পর্কে কেউ মাথা ঘামায়নি। সকলে প্রবাদ ও উপকথাকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছে। আধুনিক যুগে এ সকল তথ্য উদঘাটিত হওয়ারপর একটি নতুন উপলব্ধি শুরু হয়েছে এবং একজন ইভানজেলিস্ট অপর ইভানজেলিস্টথেকে তথ্য নিয়ে নিজ নিজ ব্যক্তিগত অভিমত অনুসারে কিভাবে যে নিজের বিবরণ রচনা করেছেন, তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিবরণ রচনার প্রয়োজন তথ্য সংগ্রহের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ তথ্য একদিকে যেমন এসেছেসংশ্লিষ্ট সমাজের মৌখিক প্রবাদ থেকে, অপর দিকে তেমনি এসেছে লিখিত আরমাইকদস্তাবেজ থেকে। এ দস্তাবেজ একত্রে সংগৃহিত আকারে সহজলভ্য ছিল কিনা তা জানার কোন উপায় নেই। তবে একথা ঠিক যে প্রত্যেক ইভানজেলিস্ট তাঁর নিজের প্রয়োজন তাঁর অংশবিশেষ মাত্র ব্যবহার করেছেন।
বিগত একশো বছরে এ বিষয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা হয়েছে এবং তাঁর ফলে একাধিক থিওরির জন্ম হয়েছে। এ সকল থিওরি ব্যাপক ও বিস্তারিত এবং ক্রমান্বয়ে আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। প্রথম থিওরিটি”হোজম্যানের দুই উৎস থিওরি” (১৮৬৩) নামে পরিচিত। কুলম্যান এবং একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের ভাষ্যকারগণ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, এ থিওরিতে বলা হয়ে থাকে যে, মথি ও লুক একদিকে হয়ত মার্ক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং অপরদিকে তারা হয়ত এমন একটি সাধারণ দস্তাবেজ ব্যবহার করেছেন, যা পরে হারিয়ে গিয়েছে। তাছাড়া তাদের উভয়ের হয়ত নিজস্ব পৃথক পৃথক উৎসও ছিল। এ বিবরণ থেকে নিম্নবর্ণিত ছকে উপনীত হওয়া যায়ঃ
কুলম্যান এ বিষয়ে নিম্নরূপ মন্তব্য করেছেনঃ
১) মথি ও লুক মার্কের যে রচনা ব্যবহার করেছেন, তা সম্ভবত তাঁর গসপেল নয়, আগের কোন রচনা হতে পারে।
২) মৌখিক প্রবাদের উপর এখানে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। অথচ এই বিষয়ের উপরই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল; কারণ যিশুর তিরিশ বা চল্লিশ বছরের বানী ও তৎপরতার বিবরণ একমাত্র এ মৌখিক প্রবাদেই ধরে রাখা হয়েছিল এবং যে সকল খৃষ্টান সম্প্রদায় এ প্রবাদ লিখে ফেলেছিল, প্রত্যেক ইভানজেলিস্টই তাদের মুখপাত্র ছিলেন মাত্র। এভাবেই সম্ভবত আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে বিভিন্ন প্রাচীন খৃষ্টান সম্প্রদায় যিশুর জীবন ও প্রচার সম্পর্কে যা কিছু অবহিত ছিল, আমাদের সামনে এখন যে গসপেল আছে, তাতে তাই প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের বিশ্বাস এবং ধর্মীয় ধ্যান-ধারণাও তাতে প্রতিফলিত হয়েছে। আর ইভানজেলিস্টগণ ছিলেন সেই সমাজেরই মুখপাত্র।
সাম্প্রতিককালে এবারত পরীক্ষা করে গসপেলের উৎসের অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঐ এবারত গঠিত হওয়ার একটি আরও জটিল প্রক্রিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে। জেরুসালেমের বাইব্লিকাল স্কুলের দুজন অধ্যাপক ফাদার বেন এবং ফাদার বয়েসমার্ড লিখিত”সিনপসিস অব দি ফোর গসপেলস” (১৯৭২-৭৩) নামক গ্রন্থে বিশেষ জোর দিয়ে বলা হয়েছে, জনশ্রুতি ও প্রবাদের ক্রমবিকাশের পাশাপাশি এবারতের ক্রমবিকাশও একইভাবে পর্যায়ে পর্যায়ে ঘটেছে। ফাদার বেনয় ফাদার বয়েসমার্ড লিখিত অংশের যে ভূমিকা লিখেছেন, তাতে এ ক্রমবিকাশের ফলাফল বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন -”প্রবাদের সুদীর্ঘ ক্রমবিকাশের ফলে শব্দ প্রয়োগ ও বর্ণনাভঙ্গি বর্তমানে যে আকার ধারণ করেছে, তা স্পষ্টতই এবং বোধগম্য কারণেই মূলের মত নয়। কোন কোন পাঠক হয়ত এ কথা জানতে পেরে বিস্মিত বা বিব্রত হবেন যে, যিশুর কোন কোন উক্তি, উপমা বা তাঁর নিজের ভাগ্য সম্পর্কিত ভবিষ্যতবানী আজ আমরা যে আকারে পড়ছি, তিনি নিজে ঠিক সে কারে বলেন নি। ঐ সকল কথা যারা আমাদের পর্যন্ত পৌছে দিয়েছেন, তারা তা নিজেদের মত করে বদল বা রূপান্তর করে দিয়েছেন। যারা এ জাতীয় ঐতিহাসিক তদন্তের সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের কাছে এ সত্য বিস্ময় এবং এমনকি কেলেংকারির ব্যাপার বলেও মনে হতে পারে।”
ফাদার বয়েসমার্ড একটি জটিল ছকের মারফত মূল এবারতের রদবদল ও রূপান্তর ব্যাখ্যা করেছেন। এ ছক তথাকথিত”দুই উৎস থিওরি” থেকে এসেছে এবং বিভিন্ন এবারতের পরীক্ষা এবং তুলনামুলক আকারের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। বিষয়টি অতিশয় জটিল বিধায় এখানে তাঁর কোন সংক্ষিপ্তসার দেয়া সম্ভব নয়। কৌতুহলী পাঠক প্যারিসের লেস এডিশনস ডু সার্ফ প্রকাশিত মূল গ্রন্থ”সিনপুস ডেস কোরাট্রেস ইভানজাইলস” পড়ে দেখতে পারেন।
চার প্রকারের মূল দলীলকে গসপেলের মূল উৎসের প্রতীক হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের নাম দেয়া হয়েছে ক, খ, গ ও ঘ।
ক- দলীল এসেছে ইহুদী-খৃষ্টান উৎস থেকে। মথি ও মার্ক এ দলীল দ্বারা অনুপ্রানিত হয়েছেন।
খ- দলীল হচ্ছে ক-দলীলের পুনর্ব্যাখ্যা। যে সকল গির্জায় প্রাচীন মূর্তিপুজা ও খৃষ্টীয় উপাসনা একই সঙ্গে চালু ছিল, সেই সকল গীর্জায় ব্যবহারের জন্য এ পূনর্ব্যাখ্যা করা হয়। মথি ছাড়া সকল ইভানজেলিস্টই এ দলীল দ্বারা অনুপ্রানিত হন।
গ- দলীল মার্ক, লুক ও জনের অনুপ্রেরণার উৎস।
ঘ- দলীল হচ্ছে মথি ও লুক যে সকল উৎস ব্যবহার করেছেন, তাঁর অধিকাংশের প্রতীক। এ দলীল হচ্ছে”দুই উৎস থিওরি” র সাধারণ দলীল।
কিন্তু বর্তমানে আমরা গসপেলের এবারত যে কারে দেখতে পাই, তা ঐ চারটি মূল দলীলের কোনটির ভিত্তিতে সরাসরি রচিত হয়নি। মাঝখানে একটি মধ্যবর্তী পাঠ বা সংস্করণ ছিল- মধ্যবর্তী বা মাধ্যমিক মথি, মাধ্যমিক মার্ক, মাধ্যমিক লুক ও মাধ্যমিক জন নামে যা পরিচিত। এ চারখানি মাধ্যমিক দলীল থেকে চারখানি গসপেলের চূড়ান্ত সংস্করণ রচিত হয় এবং অন্যান্য অনুরূপ গসপেল রচনাতেও অনুপ্রেরণা জোগায়। এক দলীলের সঙ্গে একাধিক দলীলের যে জটিল সম্পর্কে বিদ্যমান রয়েছে, একটু পরে একটি ছকে তা দেখানো হয়েছে। ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে এ গবেষণার ফলাফলের একটি সবিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এ গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, গসপেল এবারতের যেমন একটি”ইতিহাস” আছে, তেমনি ফাদার বয়েসমার্ডের ভাষায় একটি”ইতিহাস-পর্ব বিবরণও” আছে। অর্থাৎ চূড়ান্ত সংস্করণের আগে এমন একটি মাধ্যমিক সংস্করণও প্রণীত হয়েছিল। যিশুর জীবনের একটি সুপরিচিত ঘটনা, অর্থাৎ অলৌকিকভাবে মাছ শিকারের ঘটনা লুকের গ্রন্থে সেখানে যিশুর জীবদ্দশায় ঘটেছিল বলে লিখিত হয়েছে। এ অসামঞ্জস্য স্পষ্টতই বিরাট। কিন্তু বিভিন্ন উৎসের ব্যবহার এবং বিভিন্ন সংস্করণ প্রণয়নের কথা যদি স্মরণ রাখা যায়, তাহলে একটি সঙ্গত ব্যাখ্যা হয়ত খুজে পাওয়া যায়। এ অবস্থার ফলে আমাদের এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, আমরা যখন গসপেল পড়ি তখন আমরা যে যিশুর নিজের বলা কথা পড়ছি, এমন কোন নিশ্চয়তা থাকে না। ফাদার বেনয় একটু ঘুরিয়ে বললেও ঠিক এ কথাই বলতে চেয়েছেন। তিনি পাঠককে হুশিয়ারও করে দিয়েছেন, আবার সান্তনাও দিয়েছেন-“যিশুর নিজের মুখে বলা কথা সরাসরি শুনার আশা পাঠককে যদিও ত্যাগ করতে হয়, তাহলেও তাঁর জানা উচিত যে তিনি চার্চের কথা শুনছেন এবং চার্চ যে প্রভু যিশুর স্বর্গীয়ভাবে নিযুক্ত মুখপাত্র দোভাষীএ বিশ্বাস তাঁর থাকা উচিত। তাঁর আরও জানা উচিত যে প্রভু যিশু বহুদিন আগে এ পৃথিবীতেই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, আর এখন তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁর মহিমায়, তাঁর গরিমায়।”
বাইবেলের এবারত যিশুর নিজের কথা না হওয়ার এ আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সঙ্গে দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিলের বিপরীত ঘোষণা কিভাবে সমন্বয় করা সম্ভব? কাউন্সিল বলেছেন-”চার্চ এ চারখানি গসপেল এ কথা বলে নির্দ্বিধায় সমর্থন ও অনুমোদন করছেন যে, এ গ্রন্থগুলি ঐতিহাসিকভাবে খাটি ও অকৃত্রিম; এবং ইশ্বরের পুত্র যিশু তাঁর স্বর্গে আরোহণের পূর্ব পর্যন্ত এ পৃথিবীর জীবনে মানুষের চিরন্তন মুক্তি ও মোক্ষ লাভের জন্য যা কিছু করেছিলেন, বলেছিলন, অ শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা সঠিক ও বিশ্বস্তভাবে এ গ্রন্থ গুলিতে বিধৃত হয়েছে।”
স্পষ্টতই জেরুসালেম্র বাইব্লিকাল স্কুলের গ্রন্থে (সিনপসিস অব দি ফোর গসপেলস) এ ঘোষণার সত্যতা সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে।
ফাদার এম ই বয়েসমার্ড
সিনপসিস অব দি ফোর গসপেলস
সাধারণ ছক
দলীল ক খ গ ঘ = এবারত সংকলনে ব্যবহৃত মূল দলীল
মাধ্যমিক = এবারতের মাধ্যমিক সংস্করণ
এবারতের ইতিহাস
গসপেলগুলি লেখা হয়ে যাওয়ার পর তা নতুন ধর্ম খৃষ্টবাদের মৌলিক পুরাণে পরিণত হয়েছিল এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের মতই তাঁর উল্লেখ করা হত, এমন কোন ধারণা করা হলে তা ভূল হবে। কারণ তখন যিশুর কথা ও হাওয়ারিদের শিক্ষায় প্রধান বাহন ও উৎস ছিল মৌখিক প্রবাদ। আর লিখিত আকারে বহু আগে থেকেই প্রচলিত ছিল পলের চিঠিপত্র। এ চিঠিগুলি গসপেলের কয়েক দশক আগেই লেখা হয়েছিল।
আমরা আগেই দেখেছি যে, ১৪০ সালের আগে গসপেল রচনার কোন সংকলনের অস্তিত্ব থাকার কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। কোন কোণ ভাষ্যকার অবশ্য এখনও বিপরীত কথাই লিখে থাকেন। আমরা আরও দেখেছি যে, ১৭০ আগে পর্যন্ত গসপেলগুলি পুরাণ সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেনি।
খৃষ্টধর্মের প্রথম আমলে যিশু সম্পর্কে বহুবিধ রচনা প্রচলিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে এগুলি সঠিক ও আসলনয় বলে বহাল রাখা হয়নি ; এবং চার্চের হুকুমে এ জাতীয় সকল রচনা গোপন করে ফেলা হয়। এ কারণে এগুলির নাম দেয়া হয়েছে ‘এপোক্রিফা’। অবশ্য গোপন করা বা সরিয়ে ফেলা হলেও কিছু কিছু রচনা সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কারণ একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের ভাষ্যকারদের মতে”এগুলি সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান বলে মনে করা হত।” একই ধারণা বারনাবসের চিঠি সম্পর্কেও শোষন করা হত ; কিন্তু অন্যান্য রচনা”নির্মমভাবে অপসারণ করা হয়” এবং তাঁর ফলে এখন সেইগুলির অংশবিশেষ মাত্র পাওয়া যায়। এ রচনাগুলিকে ভ্রান্তির বাহক বলে গণ্য করা হয় বিধায় বিশ্বাসী খৃষ্টানদের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। তবুও চার্চের উধৃতি থেকে যতদূর জানা যায়, তাতে দেখা যায় যে, নাজারিনদের বাইবেল, হিব্রুদের বাইবেল এবং মিসরীয়দের বাইবেল মূল বাইবেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। টমাসের বাইবেল ও বারনাবাসের বাইবেল সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে।
কোন কোন গোপন করে ফেলা রচনায় কিছু কিছু ঘটনার কাল্পনিক বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এগুলি জনপ্রিয় জনশ্রুতি মাত্র। লেখকগণ বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গেই এ সকল উদ্ভট বিবরণ দিয়েছেন। অবশ্য এ ধরনের জনশ্রুতি অন্যান্য সকল বাইবেলেও পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে যিশুর মৃত্যুকালের কথিত ঘটনাবলী সম্পর্কে মথির কাল্পনিক বিবরণ স্মরন করা যেতে পারে। আসলে খৃষ্টবাদের গোড়ার দিকের সকল রচনাতেই কিছু কিছু গুরুত্বহীনতা ও চটুলতার সন্ধান পাওয়া যায়। এ সত্য সততার সঙ্গে স্বীকার করা উচিত।
চার্চ যখন সুসংগঠিত হয়ে উঠেছিল, সে সময় যিশুর সম্পর্কিত রচনার বহুলতার কারণে কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু ছাটাই-বাছাই করেন। সম্ভবত একশো বাইবেল বাতিল করে দেয়া হয় এবং মাত্র চারখানি বহাল রাখা হয়। এ চারখানি বাইবেলই এখন”ক্যানোনিক” বা স্বীকৃত বলে গণ্য হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে সাইনোপের মার্শিয়ম এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেন। তিনি ইহুদীদের ঘোরতর শত্রু ছিলেন এবং তখন সমগ্র ওল্ড টেস্টামেন্ট, যিশুর আবির্ভাবের পর রচিত সকল ওল্ড টেস্টামেন্টের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমগ্র রচনা, এবং ইহুদী-খৃষ্ট প্রবাদ ভিত্তিক সকল রচনা বাতিল বলে গণ্য করতেন। তিনি একমাত্র লুকের গসপেলকে সঠিক বলে গণ্য করতেন। কারণ তিনি মনে করতেন যে, লুক পল ও তাঁর রচনাবলীর একমাত্র মুখপাত্র।
এ কারণে চার্চ মার্শিয়ানকে বিপরীত মতাবলম্বী দু’জন বলে ঘোষণা করেন। তবে মথি, মার্ক, লুক ও জনের গসপেলের সঙ্গে পলের পত্রাবলীও অনুমোদন করেন। এ তালিকায় হাওয়ারিদের কার্যাবলীর ন্যায় অপর কিছু রচনাও যোগ করা হয়। তবে এ তালিকা কখনই চূরান্ত বলে গণ্য হয়নি; কারণ প্রথম কয়েক শতাব্দী যাবত এ তালিকা বরাবর রদবদল হয়েছে। পরবর্তী কালে যে সকল রচনা বাতিল বলে গণ্য হয়েছে, এক সময় তা অনুমোদিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল ; আবার বর্তমানে যে সকল রচনা অনুমোদিত নিউ টেস্টামেন্টের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলি ঐ সময় বাতিল বলে গণ্য করা হত। এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ৩৯৩ সালের হিপোরেজিয়াস কাউন্সিল এবং ৩৯৭ সালের কার্থেজ কাউন্সিল পর্যন্ত বজায় ছিল তবে ঐ চারখানি গসপেল অবশ্য সর্বদাই অনুমোদিত তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্বেও চার্চ কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণ রচনা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় ফাদার বয়েসমার্ড দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমরাও তাঁর দুঃখে শরীক হতে চাই। তিনি অবশ্য চার্চের এ হঠকারিতার কিছুটা সংশোধন করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁর”সিনোপসিস অব দি ফোর গসপেলস” নামক গ্রন্থে চারখানি স্বীকৃতি গসপেলের পাশাপাশি ঐ বাতিল রচনাও কিছু কিছু স্থান দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, চতুর্থ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্তও ঐ সকল গ্রন্থ বিভিন্ন পাঠাগারে পাওয়া যেত।
ঐ শতাব্দীর বিভিন্ন গ্রন্থ ও রচনা কঠোরভাবে সুশৃঙ্খল ও শ্রেনীবদ্ধ করা হয়। গসপেলের প্রাচীনতম পান্ডুলিপিগুলিও ঐ সময়ের রচনা। তাঁর আগের রচনা, তৃতীয় শতাব্দীর পাপিরি এবং দ্বিতীয় শতাব্দীর অপর একখানি গ্রন্থের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র আমাদের পর্যন্ত এসেছে। গাছের ছালের ওপর গ্রীক ভাষায় লেখা দুখানি প্রাচীনতম পান্ডুলিপি চতুর্থ শতাব্দীতেই রচিত হয়। তাঁর মধ্যে একখানি হচ্ছে”কোডেক্স ভ্যাটিক্যানাস”। এ গ্রন্থ এখন ভ্যাটিক্যান পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে; তবে কোথায় এবং কিভাবে যে তা পাওয়া গিয়েছে, সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। অপরখানি হচ্ছে”কোডেক্স সিনাইটিকাস”। এ গ্রন্থখানি সিনাই পাহাড়ে পাওয়া যায় এবং এখন লন্ডনের বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এ গ্রন্থে চার্চ কর্তৃক বাতিল ঘোষিত দুটি রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে আরও আড়াইশত (গাছের ছালে লেখা ) পান্ডুলিপি আছে বলে জানা যায় এবং তাঁর মধ্যে সাম্প্রতিকতম পান্ডূলিপিটি রচিত হয়েছে একাদশ শতাব্দীতে।”তবে নিউ টেস্টামেন্টের যে সকল কপি আমাদের পর্যন্ত এসেছে, তাঁর সবগুলি কিন্তু এক রকমের নয়। বিষয়বস্তুর দিক থেকে তাদের মধ্যে নানা প্রকারের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে এবং এ পার্থক্যের সংখ্যা অনেক। কোন কোন ক্ষেত্রে পার্থক্য হচ্ছে ব্যাকরণগত, শব্দগত বা শব্দের পরস্পরাগত। কিন্তু অন্যত্র এ পার্থক্য এমন আকার ধারণ করেছে যে, সমগ্র অনুচ্ছেদের অর্থই তাঁর ফলে ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে। কেউ এ পার্থক্যের নমুনা দেখতে চাইলে তিনি”নোভাম টেস্টামেন্টাম গ্রেইস”, (নেসল-এলান্ড। ইউনাইটেদ বাইবেল সোসাইটিজ, লন্ডন, ১৯৭১) নামক গ্রন্থখানি নাড়াচাড়া করে দেখতে পারেন। এ গ্রন্থে গ্রীক ভাষায় তথাকথিত”মধ্যপন্থী” এবারত আছে এবং টিকা ও হাশিয়া সহ সকল সংস্করণের পার্থক্যের নমুনা আছে।
পান্ডুলিপি যতই প্রাচীন বা সম্মানিত হোক না কেন, তাঁর এবারতের সঠিক হওয়ার ব্যাপারটি কিন্তু সর্বদাই বিতর্কিত। কোডেক্স ভ্যাটিক্যানাস এ মন্তব্যের একটি উৎকৃষ্ট নজীর। ১৯৬৫সালে ভায়টিক্যানের সম্পাদনায় এ গ্রন্থের একটি ফট-ব্লক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং সম্পাদকগণ তাদের ভূমিকায় জানিয়েছেন-”এ পান্ডূলিপি নকল করার (দশম বা একাদশ শতাব্দীতেনকল করা হয় বলে মনে করা হয়) কয়েক শতাব্দী পরে লেখাগুলি স্পষ্ট করার জন্য একজন লেখক তাঁর ওপর নতুন করে কলম বুলিয়ে দেন; কিন্তু ঐ লেখার যে অংশে তিনি ভুল মনে করেন, তার ওপর কলম বুলান নি।” ফলে যে অংশে কলম বুলানো হয়নি, তাঁর রং খুবই হালকা হলেও লেখাগুলি আবছা আবছা বুঝা যায়। তবে নতুন করে কালি দিয়ে মূল লেখা স্পষ্ট করার কাজ যে খুবই বিশ্বস্ততার সঙ্গে করা হয়েছে, এমন কোন আলামত পাওয়া যায় না। সম্পাদকগণ বলেছেন-” কয়েক শতাব্দী যাবত যারা এ পান্ডুলিপি সংশোধন করেছেন বা তাঁর হাশিয়া লিখেছেন, তাদের সঠিক পরিচয় এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে নতুন করে কলম বুলানোর সময় কিছু কিছু সংশোধন যে করা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।” বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে এ এবারতকে চতুর্থ শতাব্দীতে নকল করা বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু খোদ ভ্যাটিক্যানে গিয়ে অনুসন্ধান করলে বুঝা যায় যে, তাঁর পরে কয়েক শতাব্দী যাবত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হাতে ঐ এবারত রদবদল করা হয়েছে।
কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, অন্যান্য এবারতের সঙ্গে তুলনা করলেই তো সঠিক-বেঠিক নির্ণয় করা যেতে পারে। হ্যাঁ তা ঠি, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন এবারতের অর্থই যখন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তখন তুলনা করার জন্য রকটিকে আদি ও আসল বলে বেছে নেয়ার উপায় কি? তাছাড়া একথা তো এখন জানাই যাচ্ছে যে, প্রাচীনকালে একজন লেখক অপরের লেখার ওপর কলম বুলিয়ে যে সংশোধন করেছিলেন, তাই এখন সঠিক বলে মনে করা হচ্ছে। পরে আমরা দেখতে পাব যে, জন লিখিত একটি অনুচ্ছেদে”প্যারাক্লিট” সম্পর্কিত একটিমাত্র শব্দ প্র্যোগের ফলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে তাঁর অর্থ ও ভাবধারাকিভাবে সম্পূর্ণরুপে বদল হয়ে যায়। (প্যারাক্লিট একটি গ্রীক শব্দ, অর্থ শান্তিদাতা, চরম প্রশংসিত, সত্যের বাহক প্রভৃতি। ‘এ শব্দটি দ্বারা বাইবেলে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগম্নের ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে। জন ১৬:১৩। ‘ বাইবেলের অন্যত্র আরও স্পষ্ট ইশারা আছে। বাংলা অনুবাদক) ।
বিভিন্ন এবারতের পার্থক্য সম্পর্কে কুলম্যান তাঁর”দি নিউ টেস্টামেন্ট” নামক গ্রন্থে বলেছেন-”পরবর্তীকালের এবারতে যে পার্থক্য দেখা যায়, তা কোন কোন ক্ষেত্রে অসাবধানতার ফলে ঘটেছে। নকলনবিশ হয়ত একটি শব্দ বাদ দিয়েছেন, কিংবা একবারের বদলে দুবার লিখেছেন, কিম্বা কোন বাক্যে একই শব্দ দুবার ব্যবহৃত হয়ে থাকলে ঐ দু শব্দের মধ্যবর্তী বাক্যাংশ হয়ত বিলকুল বাদ দিয়েছেন। এ সব কিছুই ভুলক্রমে হয়ে থাকতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার হয়ত ইচ্ছাকৃত ভাবেও সংশোধন করেছেন, কিম্বা পার্থক্য কমিয়ে আনার সজ্ঞান চেষ্টায় অপর কোন এবারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য সংশোধন করেছেন। পরে নিউ টেস্টামেন্টের রচনাবলী যখন ক্রমে ক্রমে প্রাচীন খৃষ্টীয় সাহিত্য থেকে পৃথক হতে থাকে এবং পবিত্র বলে গণ্য হতে থাকে, তখন নকলকারীগণও সাবধান হয়ে যান। তারা পূর্ববর্তী নকলকারীদের মত ভুল না করে অথবা স্বাধীন চিন্তা প্রয়োগ না করে পবিত্র জ্ঞানে হুবহু নকল করতে থাকেন, এবং তাঁর ফলে আগের পার্থক্যগুলি হুবহু বহাল রাখেন। তাছাড়া কোন কোন নকলনবিশ কোন দুর্বোধ্য অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যা করার জন্য মার্জিনে হাশিয়া লেখেন। পরবর্তী নকলনবিশ হয়ত মনে করেন যে, হাশিয়ার অংশটি সম্ভবত ভুলক্রমে এবারতের বাইরে লেখা হয়েছে এবং তাঁর ফলে তিনি হাশিয়াটি এবারতের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। এ প্রক্রিয়ার ফলে নতুন এবারত আসলে আরও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে।”
কোন কোন পান্ডুলিপির নকলকারী এবারতে ব্যাপক রদবদল করেছেন। ষষ্ঠ শতাব্দীর জেরোমের ‘ভালগেট’ অথবা আরও আগের ‘ভেটাস ইটালিয়া ‘ র মত ল্যাটিন তরজমা, অথবা সুরিয়ানি ও কপটিক তরজমা বেশী নির্ভরযোগ্য? এ সকল তরজমা হয়ত উপরে উল্লেখিত পান্ডুলিপি থেকে করা হয়েছে এবং পরে সেই পান্ডুলিপি গায়েব হয়ে গিয়েছে। সঠিক তথ্য আমরা কিছুই জানি না।
এ সকল বিভিন্ন সংস্করণের এবারতকে কিছু কিছু সাধারণ বৈশিষ্টের ভিত্তিতে কয়েকটি পৃথক শ্রেনীতে ভাগ করা যায়। কুলম্যানের মতে এ শ্রেনীগুলি নিম্নরুপঃ
প্রথম শ্রেনীঃ তথাকথিত সিরীয় এবারত। এ এবারত সংকলনের ভিত্তিতে অধিকাংশ প্রাচীন গ্রীক পান্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে থাকতে পারে। ছাপাখানার কল্যাণে ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে এ এবারত ইউরোপের সর্বত্র ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তবে বিশেষজ্ঞগণ বলে যে, এ এবারতটিই সম্ভবত সবচেয়ে নিকৃষ্ট।
দ্বিতীয় শ্রেনীঃ তথাকথিত পাশ্চাত্য এবারত। এ শ্রেণীতে আছে প্রাচীন ল্যাটিন সংস্করণ এবং গ্রীক ও ল্যাটিন উভয় ভাষার কোডেক্স বেজাই ক্যান্টাব্রিজিনসিস। একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের ভাষ্যকারদের মতে এ এবারতের একটি স্পষ্ট বৈশিষ্ট হচ্ছে ব্যাখ্যা দেয়া, ভিন্নতর শব্দ প্রয়োগ করে একই অর্থ প্রকাশ করা, ভুল তথ্য পরিসংখ্যান দেয়া এবং স্ববিরোধিতার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা।
তৃতীয় শ্রেণীঃ তথাকথিত নিরপেক্ষ এবারত। কোদেক্স ভ্যাটিক্যানাস এবং কোডেক্স সিনাইটিকাস এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এ এবারতে যথেষ্ট বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতা আছে বলে কথিত হয়ে থাকে। নিউ টেস্টামেন্টের আধুনিক সংস্করণে এ এবারতই প্রধানত অনুসরণ করা হয়ে থাকে; যদিও একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের মতে এখানেও যথেষ্ট ত্রুটি আছে। এ ব্যাপারে আধুনিক যুগের সমালোচকগণ একমাত্র যা করতে পারেন, তা হচ্ছে একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশনের মতে এই যে, তারা চেষ্টা চরিত্র করে”এমন একটি এবারত পুনর্গঠন করতে পারেন, যা অন্তত মূলের কাছাকাছি আসতে পারে। কিন্তু তবুও অবস্থা যাই হোক না কেন সেই মূল আর ফিরে পাওয়ার কোন উপায় নেই।”