ওল্ড টেস্টামেন্ট : সাধারণ সীমানা
ওল্ড টেস্টামেন্ট এর লেখক কে? এ প্রশ্নের জবাবে ওল্ড টেস্টামেন্টের অধিকাংশ পাঠকই সম্ভবত সেই কথা বলবেন, যা তারা বাইবেলের ভূমিকায় পড়েছেন। তারা হয়ত বলবেন যে, হোলি ঘোস্টের (জিব্রাইল) প্রেরনায় মানুষে লিখে থাকলেও আসল লেখক হচ্ছেন আল্লাহ।
বাইবেলের ভুমিকা লেখক কখনও এটুকু বলেই থেমে যান। ফলে আর কোন প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। কখনও তিনি আবার এ কথাও বলে থাকেন যে, মূল পাঠের সঙ্গে পরে হয়ত মানুষের রচনাও সংযোজিত হয়র থাকতে পারে। কিন্তু সেজন্য কোন বিতর্কমূলক অনুচ্ছেদের মূল” সত্য” পরিবর্তিত হয়নি। এবং এ”সত্য” শব্দটির ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়। গির্জা কর্তৃপক্ষ এ দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন। কেননা একমাত্র তারাই হোলি ঘোস্টের সহায়তায় বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের প্রকৃত পথ দেখাতে পারেন। চতুর্থ শতাব্দীতে খ্রিস্টান পরিষদ সমূহের সম্মেলনের পর গির্জা কর্তৃপক্ষই পবিত্র গ্রন্থের তালিকা প্রকাশ করেন এবং ঐ তালিকা ফ্লোরেন্স কাউন্সিল (১৪৪১), ট্রেন্ট কাউন্সিল (১৫৪৬) ও প্রথম ভ্যাটিকেন কাউন্সিলে (১৮৭০) অনুমোদিত হয়। সে অনুমোদিত গ্রন্থগুলিই এখন ক্যানন নাম পরিচিত। বহু গবেষণা ও পর্যালোচনার পর দিতীয় ভ্যাটিকেন কাউন্সিল অতি সম্প্রতি অহী সম্পর্কে একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেছেন। এ কাজে তিন বছরের (১৯৬২-১৯৬৫) একাগ্রতা ও পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়েছে। অধিকাংশ পাঠক বাইবেলের আধুনিক সংস্করণের শুরুতে এ বিবরণ দেখে আশ্বস্ত হয়েছেন। বাইবেলের সত্যতা সম্পর্কে বিগত কয়েক শতাব্দী যাবত প্রদত্ত নিশ্চয়তার বর্ণনা পরে তারা নিশ্চিত ও সন্তুষ্ট হয়েছেন। এ সম্পর্কে যে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন কথা তাদের আদৌ মনে হয়নি।
পাদ্রীদের এমন অনেক রচনা আছে, যেগুলি সাধারণত সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয় না। এ রচনা পড়লে বুঝা যায়, বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তকের সত্যতা সম্পর্কিত বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে যত জটিল বলে মনে হয়, আসলে কিন্তু তা তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। উদাহরণ হিসাবে বাইবেলের আধুনিক ফরাসী তরজমার কথা বলা যেতে পারে। জেরুসালেমের ব্লাইবিকেল স্কুলের তত্ত্বাবধানে এ তরজমা করা হয়েছে এবং কয়েকটি খন্ডে প্রকাশিত (প্রকাশক সার্ফ, প্যারিস) হয়েছে। এ তরজমা পরীক্ষা করলে প্রকাশভঙ্গিতে একটি সুস্পষ্ট ভিন্নতা ধরা পড়ে। স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, নিউ টেস্টামেন্ট এর মত ওল্ড টেস্টামেন্টেও এমন কিছু বিতর্কমূলক প্রশ্ন আছে, ব্যাখ্যাদাতাগন যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গোপন করেননি।
প্রফেসর এডমন্ড জ্যাকবের গ্রন্থেও আরও সুনির্দিষ্ট তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এ গ্রন্থের নাম দি ওল্ড টেস্টামেন্ট, (ফরাসী নাম লা এনাচিয়েন টেস্টামেন্ট, প্রকাশক প্রেসেস ইউনিভার্সিটেয়ার্স দা ফ্রান্স, প্যারিস) । ‘ সংক্ষিপ্ত অথচ খুবই নিরপেক্ষ প্রকৃতির এ গ্রন্থে একটি উত্তম বিশ্লেষনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
এডমন্ড জ্যাকব বলেছেন, অনেকেই অবহিত নন যে, আদিতে একখান মাত্র নয়, কয়েকখানি বাইবেল ছিল এবং তাদের পাঠও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে তৃতীয় শতাব্দীতে হিব্রু ভাষায় কমপক্ষে তিনখানি পৃথক পৃথক পুস্তক ছিল। প্রথমখানি পরবর্তীকালে মাসরোটিক নাম অভিহিত হয়, দিতীয় খানি আংশিকভাবে গ্রীক ভাষায় অনুদিত হয় এবং তৃতীয় খানি সামারিটান গ্রন্থ আমে পরিচিত হয়। খৃস্টের জন্মের পূর্বে প্রথম শতাব্দীতে ঐ তৃতীয় খানির ভিত্তিতে ও বদলে একখানি মাত্র গ্রন্থ প্রবর্তনের একটি সুস্পষ্ট প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু সেই প্রবণতা বাস্তব রূপ লাভ করে খৃস্টের জন্মের এক শতাব্দী পরে, তখনই বাইবেলের একটি মাত্র পাঠ সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়।
ঐ তিনটি পাঠই যদি আমরা পেতাম, তাহলে তুলনা করা সহজ হয়ে যেত এবং আদি পাঠ বা মূল পাঠ যে কি ছিল, সে সম্পর্কে আমরা একটি ধারনায় উপনীত হতে পারতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় তেমন কোন সুযোগ আমাদের সামনে নেই। ফলে অবস্থা দাড়িয়েছে এই যে, কামরান গুহায় পাওয়া ঈসার আমলের নিকটবর্তী খ্রিস্টান পূর্বকালীন সময়ের ডেড সী স্ক্রোল (বহরে লুত -এ পাওয়া লিখন), মূল পাঠের একটি ভিন্নরূপ সম্বলিত ও গাছের পাতায় লিখিত খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী দিতীয় শতাব্দীর টেন কমেন্ডমেন্টস (দশ ফরমান) এবং খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী পঞ্চম শতাব্দীর কিছু বিচ্ছিন্ন রচনা (কায়রোর পেনিজা) ছাড়া বাইবেলের যে প্রাচীনতম হিব্রু পাঠ পাওয়া যায়, তা হচ্ছে খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী শতাব্দীর।
সেপ্চুয়াজিন্ট সম্ভবত গ্রীক ভাষায় প্রথম অনুবাদ। খৃস্টের জন্মের পূর্বে তৃতীয় শতাব্দীতে ইহুদীগণ আলেকজান্দ্রিয়ায় এ গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থের ভিত্তিতেই নিউ টেস্টামেন্ট প্রণীত হয়। খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এ গ্রন্থ, সহী বলে গণ্য হয়। খ্রিস্টান জগতে যে মূল গ্রীক পাঠ সাধারনভাবে প্রচলিত আছে, তা ভ্যাটিকেন সিটিতে রক্ষিত কোডেক্স ভ্যাটিকেনাস এবং লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত কোডেক্স সিনাইটিকাস নামক পান্ডুলিপি থেকে সংকলিত। এ দুটি পান্ডুলিপি খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী চতুর্থ শতাব্দীর।
এ প্রসঙ্গে আরমাইক ও সিরিয়াকে (পেশিত্তা) সংস্করণের ও উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে এগুলি অসম্পূর্ণ।
এ সকল বিভিন্ন সংস্করণ থেকে বিশেষজ্ঞগণ একখানি”মধ্যপন্থী” গ্রন্থ প্রস্তুতু করতে সক্ষম হয়েছেন। এটাকে বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে একটি আপোস অভিহিত করা যেতে পারে। এ ছাড়া দিভাষিক ও ত্রিভাষিক বাইবেলও রয়েছে এবং তাতে গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু, সিরিয়াক, আরমাইক এবং এমনকি আরবি ভাষাও ব্যবহার করা হয়েছে। বিখ্যাত ওয়ালটন বাইবেল (লন্ডন, ১৬৫৭) এরূপ একখানি গ্রন্থ। সকল বিষয় বিবেচনার স্বার্থে আর একটি ব্যপার উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিভিন্ন মতের খ্রিস্টান গির্জায় একই গ্রন্থ অনুসরণ করা হয় না অথবা একই ভাষায় তর্জমার ব্যপারে একই ভাবধারা গ্রহণ করা হয় না। এর কারন এই যে, ভিন্ন ভিন্ন বাইবেলে ভিন্ন ভিন্ন ধারনা পোষণ করা হয়েছে এবং তা ভিন্ন ভিন্ন গির্জা গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছে। তবে বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টেন্ট বিশেষজ্ঞগন দি একুমেনিক্যাল ট্রানশ্লেশন অব দি ওল্ড টেস্টামেন্ট নামে যে গ্রন্থ রচনায় নিয়োজিত আছেন তা একক ও সমন্বিত গ্রন্থ বলে পরিগনিত হতে পারে। (ইংরাজী অনুবাদকের মন্তব্য -১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এটা প্রকাশিত হয়। প্রকাশক – লে এডিশন ডু সার্ফ এবং লে বাজারস এট লে মাজেস, প্যারিস) ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ওল্ড টেস্টামেন্টের ক্ষেত্রে মানুষের হস্তক্ষেপ একটি বিরাট ভূমিকা পালন করছে। এক সংস্করন থেকে অপর সংস্করনে এবং এক তরজমা থেকে অপর তরজমায় স্বাভাবিকভাবে যে সকল রদবদল ও সংশোধন হয়েছে, তা থেকে সহজেই অনুমান করা যেতে পারে যে, বিগত দুই হাজার বছরেরও বেশী সময়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের মূল একাধিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
বাইবেলের উৎস
বইয়ের আকারে সংকলিত হওয়ার আগে বাইবেল লোকপ্রবাদ হিসাবে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল এবং সুর করে গানের মতও পাওয়া হত। অন্যান্য সকল প্রাচীন ধারণার মত এ লোক প্রবাদও সম্পূর্ণরূপে স্মৃতি -নির্ভর ছিল।
এডমন্ড জ্যাকব লিখেছেন-”প্রথম পর্যায়ে সকল জাতিই গান গেয়েছে। অন্যান্য সকল জায়গার মত ইসরাইলেও গদ্যের আগে পদ্য এসেছে। সেখানে দীর্ঘ দিন গান গাওয়া হয়েছে এবং ভালই গাওয়া হয়েছে। ইসরাইল জাতি তাদের ইতিহাসের ঘটনাবলী নিয়ে গভীর অনুভূতির সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার গান গেয়েছে। তাদের চোখে প্রত্যেকটি ঘটনার একটি তাৎপর্য ছিল। তাই গানের মারফত তারা বিভিন্ন আকারেও প্রকাশ করেছে। তারা বিভিন্ন কারনে গান গাইত এবং এডমন্ড জ্যাকোব তার অনেকগুলি উল্লেখও করেছেন। বাইবেলেও অনেক গানের উল্লেখ আছে – খানার গান, ফসল কাটার গান, কাজের গান, কুপের গান (গণনা পুস্তক ২১ ও ১৭), বিয়ের গান ও শোকের গান। অনেক যুদ্ধের গানও আছে, তার মধ্যে ডেবোবার গান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (বিচারকগন ৫, ১-৩২) । কেননা এ গানে খোদ ইয়াহউয়ের নির্দেশিত ও পরিচালিত বিজয়ের জয়গান করা হয়েছে (গণনা পুস্তক ১০ ও ৩৫) -” মৈত্রীশক্তি অগ্রসর হলে মুসা বল্লেন, হে ইয়াহউয়ে! জাগ্রত হউন! আপনার শত্রুগন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হউক, এবং আপনাকে জারা ঘৃণা করে তারা আপনাকে দেখামাত্র পলায়ন করুক।”
এছাড়া আরও আছে উপদেশক ও হিতোপদেশক (বুক অব প্রোভার্বস, ইতিহাস পুস্তকের প্রোভার্বস, এন্ড ম্য্যকসিমস), আশির্বানী ও অভিশাপবানী, এবং অহী পাওয়ার পর মানুষের প্রতি পয়গম্বরদের বিধান।
জ্যাকোব বলেছেন, এ সকল কথা ও কাহিনী হয় পরিবার থেকে পরিবারে প্রবাহিত হয়েছে, আর না হয় ধর্মশালা মারফত আল্লাহর বাছাই করা জাতির ইতিহাসের বিবরন হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। তারপর ইতিহাস দ্রুত প্রবাদে পরিনত হয়েছে, যেমন হয়েছে জোথামের প্রবাদের ক্ষেত্রে (বিচারকগন ৯, ৭-১২) । এ প্রবাদে” বৃক্ষগণ তাদের একজন রাজা বাছাই ও তাকে অভিষিক্ত করতে অগ্রসর হল, এবং পরপর জলপাই গাছ, ডুমুর গাছ, দ্রাক্ষালতা ও বেতস্লতাকে অনুরোধ জানাল।” এ বর্ণনায় জ্যাকোব লক্ষ্য করলেন,”ভাল গল্প বলার উতসাহে কথকগন অপরিচিত বিষয় বা যুগের অসম্ভাব্যতা নিয়ে মাথা ঘামাননি।” এবং এ কারনে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন-”ওল্ড টেস্টামেন্টে মূসা ও প্রধানদের বিষয়ে যে বর্ণনা আছে, তা থেকে সম্ভবত ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর একটি মোটামুটি ক্রমিকতা পাওয়া যেতে পারে। কথকগন মৌলিক বর্ণনার সময় মাধুর্য ও কল্পনার সাহায্যে হয়ত এমন অনেক সচেতন চিন্তাবিদের কাছেও মানুষ ও পৃথিবী সৃষ্টির আদিকথা বলে মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।”
একথা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারন আছে যে, খৃস্টের জন্মের পূর্ববর্তী ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইহুদীগন যখন কেনানে বসতি স্থাপন করে, তখন প্রবাদ সংরক্ষন ও প্রচারের জন্য লেখার প্রচলন হয়েছে। কিন্তু যে বিষয়ে তখন সর্বাধিক স্থায়িত্ব আশা করা হত, সেই আইন লিখন ও সংরক্ষনের ব্যাপারে পরিপূর্ণ নির্ভুলতা ছিলনা। কারন দেখা যাচ্ছে, যে আইন আল্লাহর নিজের হাতেই লেখা বলে ধরা হয়, সেই দশ ফরমানই ওল্ড টেয়াস্টামেন্টের দুই জায়গায় দুই প্রকারে এসেছে – জোডাস (২০, ১-২১) এবং ডিউটারোনমি (৫, ১-৩০) । মূল বক্তব্য হয়ত ঠিকই আছে কিন্তু শব্দ প্রয়োগ, প্রকাশভঙ্গি ও বাগধারার পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। তখন চিঠিপত্র, চুক্তি, বিশিষ্ট লোকদের (বিচারক, পদস্ত পৌর কর্মকর্তা) নামের তালিকা, নছবনামা এবং গনিমত ও নজরানার মালের তালিকা লিখিত আকারে রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। এ সকল দলিল সংরক্ষন করার জন্য দফতরখানা গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে এ সকল দলিলের ভিত্তিতে বই রচিত হয়েছে এবং কিছু কিছু বই আমাদের পর্যন্ত ও এসে পৌছেছে। গভীরভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যায় প্রত্যেকটি বইতে একাধিক প্রকারের রচনা ও প্রকাশভঙ্গি ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হয় একই বইতে বিভিন্ন লেখকের রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ সম্ভবত এ বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন।
ওল্ড টেস্টামেন্ট প্রথমিকভাবে মৌলিক প্রবাদ ভিত্তিক হলেও বর্ণনায় অসংলগ্নতা আছে। এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের সম্পরক নেই। সুতরাং এ গ্রন্থের গ্রন্থনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে অপর কোন সময় ও স্থানের প্রাচীন সাহিত্য সৃষ্টির আদি প্রক্রিয়ার তুলনা করে দেখা যেতে পারে।
উদাহরন স্বরূপ ফ্রাংক – রাজবংশের আমলে ফরাসী সাহিত্য প্রক্রিয়া বিবেচনা করা যেতে পারে। যুদ্ধ, বিশেষত খৃস্টান ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ, বীরপুরুষদের বীরত্ব ও সাহসিকতা এবং অন্যান্য চাঞ্চল্যকর ঘটনার বিবরন তখনও ঐ মৌখিক প্রবাদেই সংরক্ষিত হত। ঘটনার কয়েক শতাব্দী পরেও এ সকল প্রবাদ কবি, লেখক ও ইতিহাসবিদদের অনুপ্রাণিত করেছে। এভাবে একাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে এ সকল বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রিত কাহিনীর ভিত্তিতে কাব্য ও মহাকাব্য রচনা শুরু হয়। তার মধ্যে”রোলা সঙ্গীত”-ই সবচেয়ে বিখ্যাত। সম্রাট শার্লিমেন যখন স্পেন অভিযান থেকে ফিরে আসেন, তখন রোঁলা (লা শানসন দ্যা রোঁলা) তার পশ্চাদরক্ষী বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। এ কাব্যগাঁথায় তার জীবন, বীরত্ব, ও আত্মত্যাগের কাহিনী বর্নিত হয়েছে। আত্মত্যাগের ঘটনাটি আদৌ কল্পনা নয়। ৭৭৮ সালের ১৫ আগস্ট পর্বতবাসী বাংক উপজাতির হামলার সময় ঐ ঘটনাটি ঘটেছিল। সুতরাং কাব্যের ঐ বরননাকে বিশুদ্ধ ইতিহাস বলে মেনে নিতে রাজি হবেন না।
বাইবেল গ্রন্থনার প্রক্রিয়াও ঠিক এভাবেই সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে হয়। যারা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না, তারা পুরো বাইবেল কেই কিংবদন্তি ও কাল্পনিক কাহিনীর সংকলন বলে মনে করেন। কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গে একমত নই। সৃষ্টির বাস্তবতা, আল্লাহর কাছ থেকে মূসার ওপর দশ ফরমান নাযিল হওয়া এবং সোলাইমানের আমলের মত মানুষের ব্যাপারে গায়েবী হস্তক্ষেপের ঘটনায় বিশ্বাস করা খুবই সম্ভব। কিন্তু তাই বলে আমাদের বিশ্বাস সর্বাত্মক হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা অবশ্যই ধরে নিতে পারি যে, বাইবেল মারফত আমরা যা পাচ্ছি, তা মূল ঘটনার সারসংক্ষেপ মাত্র এবং যে সকল বিস্তারিত বিবরন আছে তা কঠোর সমালোচনা ও পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন আছে। কারন মূল মৌখিক প্রবাদ যখন লিখিত আকার লাভ করেছে, তখন মানুষের কল্পনা ও অলংকরন অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাননা ছিল।
ওল্ড টেস্টামেন্টের বিভিন্ন পুস্তক
ওল্ড টেস্টামেন্ট বিভিন্ন দৈর্ঘ্য, আকার ও প্রকারের রচনার একটি সংকলন। মৌখিক প্রবাদের ভিত্তিতে এগুলি নয় শতাধিক বছর যাবত বিভিন্ন ভাষায় রচিত হয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে, বহুদিন পর পর, কোন ঘটনার ভিত্তিতে অথবা কোন বিশেষ প্রয়োজনবশত অনেক রচনাই সংশোধন ও সম্পূর্ণ করা হয়েছে।
এ বিপুল রচনাবলী সম্ভবত খৃস্টের জন্মের পুরবে একাদশ শতাব্দীতে ইসরাইলী রাজবংশের রাজত্বকালের প্রথম দিকে রচিত হয়েছিল। ঐ সময় রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে অনেকেই লেখক ছিলেন। তারা বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ছিলেন এবং তাদের ভূমিকা কেবলমাত্র লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে যে অসম্পূর্ণ রচনার উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রথমটি সম্ভবত এ আমলেই রচিত হয়েছে। তখন এগুলির লিখিত আকার দেয়ার একটি বিশেষ কারণও ছিল। তৎকালে বহু সঙ্গীত, কাব্যগাথা, ইয়াকুব ও মূসার নসিহত, দশ ফরমান, এবং ধর্মীয় রেওয়াজ সৃষ্টিকারী রাজকীয় হুকুমনামা সংরক্ষন করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হত। ওল্ড টেস্টামেন্টর বিভিন্ন পুস্তকে এখন এগুলির সন্ধান পাওয়া যায়। আরও কিছুদিন পরে সম্ভবত খৃস্টের জন্মের পূর্বে দশম শতাব্দীতে পেন্টাটিউকের””ইয়াহভিষ্ট”” গ্রন্থ রচিত হয়। এ গ্রন্থে আল্লাহকে ইয়াহওয়ে নামে অভিহিত করা হয় বলে গ্রন্থের ঐ নাম রাখা হয়। মূসার নামে যে প্রথম পাঁচখানি গ্রন্থ চালু আছে, তার মূলসুত্র হচ্ছে এ গ্রন্থ। পরে তার সঙ্গে”ইলোহিষ্ট” নামক রচনা, এবং তার”স্যাকারডেটাল” সংস্করনও যোগ করা হয়। আল্লাহকে”ইলোহিম” নামে অভিহিত করায় রচনাটিকে ইলোহিষ্ট বলা হয়। আর জেরুসালেম মন্দিরের স্যাকারডোট নামক প্রচারকদের নাম অনুসারে তাদের সংস্করন্টি স্যাকারডোটাল নামে পরিচিত হয়। দক্ষিণের জুডাহ রাজ্য থেকে পাওয়া ঐ প্রাথমিক ইয়াহভিষ্ট রচনায় দুনিয়ার আদিকাল থেকে ইয়াকুব – এর ইন্তেকাল পর্যন্ত ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
খৃস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতেই লেখক পয়গম্বরদের আবির্ভাব হয়। ইসরাইলের আমোস ও হোসিয়া নামক দুজন এবং জুডায় মিকাহ নামক একজন লেখক- পয়গম্বরের খবর পাওয়া যায়।
খৃস্টপূর্ব ৭২১ সালে সামারিয়ার পতনের ফলে ইসরাইল রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য জুডাহ রাজ্যের হাতে চলে যায়। ধর্মীয় কিংবদন্তি সংরহের কাজ এ সময় থেকে শুরু হয়। এ সময়ই ইয়াহভিষ্ট ও ইলোহিষ্টের রচনাবলী একত্রিত করে তৌরাত নামে একখানি মাত্র গ্রন্থে রূপান্তরিত করা হয়। এ সময় ডিউটারোনমিও লেখা হয়।
খৃস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জোশিয়ার রাজত্বকালে পয়গম্বর জেরোনিয়ার আবির্ভাব হয়, কিন্তু তার বানী ও কর্মের বিবরণ লিখিত আকার লাভ করে আরও এক শতাব্দী পরে।
খৃস্টপূর্ব ৫৮৯ সালে ব্যাবিলনে প্রথম দেশান্তরিত হওয়ার পূর্বে জেকানিয়া, নাহুম ও হাবাক্কুকের গ্রন্থ লিখিত হয়। এ সময়ের পরে এজেকিয়েল তার ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করতে থাকেন। খৃস্টপূর্ব ৫৮৭ সালে দ্বিতীয়বার দেশান্তরিত হওয়ার কাজ শুরু হয় জেরুসালেমের পতনের সময় এবং তা খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সাল পর্যন্ত চলে।
এজেকিয়েল একজন বিখ্যাত পয়গম্বর ছিলেন। কিন্তু তাঁর গ্রন্থ বর্তমানে যে আকারে পাওয়া যায় তাঁর জীবদ্দশায় সে আকারে সাজানো ছিলনা। তাঁর ইন্তেকালের পর যে কাতিবগণ ঐ ভাবে সাজান, তারাই তাঁর আধ্যাত্মিক খলিফা বলে গণ্য হন। এ কাতিবগণ স্যাকারজোলটাল সংস্করণ নামে পরিচিত জেনেসিসের তৃতীয় সংস্করণ প্রস্তুত করেন। এ সংস্করণে জেনেসিসের একটি অধ্যায়ের অর্থাৎ পৃথিবীর আদিকাল থেকে ইয়াকুবের ইন্তেকাল পর্যন্ত সময়ের বিবরণ আছে। এভাবে তৌরাতের ইয়াহভিষ্ট ও ইলোহিষ্ট রচনার মূল পাঠের মধ্যে একটি তৃতীয় রচনার শামিল হয়ে যায়। পরে আমরা দুই থেকে চার শতাব্দী আগে লেখা কয়েকখানি গ্রন্থে এ তৃতীয় রচনার একটি কৌশলগত বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবো। এ একই সময় ল্যামেন্টেশন্সও (বিলাপ) প্রকাশিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে সাইরাসের হুকুমে দেশান্তরিত হওয়ার অবসান ঘটে। ইহুদীরা ফিলিস্তিনে ফিরে আসে এবং জেরুসালেমের মন্দির পুননির্মাণ করা হয়। ফলে পয়গম্বর ও প্রচারকদের কাজ পুনরায় শুরু হয়। এ সময় হাজ্জাই, জাকারিয়া, মালাচি ও ডানিয়েলের গ্রন্থ এবং ইসাইয়ার তৃতীয় গ্রন্থ ও বারুচের গ্রীক ভাষায় গ্রন্থ প্রনীত হয়।
আসলে দেশান্তরের ঘটনার পরবর্তী আমলে প্রধান প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থগুলি রচিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০সালের কাছকাছি সময়ে প্রোভার্বস, পঞ্চম শতাব্দীতে জব এবং তৃতীয় শতাব্দীতে একলেজিয়াস্ট বা কোহেলেথ, সঙ অব সঙস, ক্রনিকেলস প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড এবং এজরা ও নেমোলিয়া রচিত হয়। একইভাবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে একলোজিয়াসটিকাস বা সিরাহ্ন এবং প্রথম শতাব্দীতে বুক অব উইজডম ও বুক অব মাকাবিজ প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড লিখিত হয়। কিন্তু রুথ, ইসথার ও জোনার গ্রন্থ যে কখন লেখা হয় তা সহজে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তৌরাত ও জুডিথের গ্রন্থের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা বলতে হয়। যেহেতু খ্রিষ্টের জন্মের মাত্র এক শতাব্দী আগে ওল্ড টেস্টামেন্টের রচনাবলী গ্রন্থের আকারে সাজানো হয়েছে, সেহেতু এখানে যে সকল তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর পরেও সংশ্লিষ্ট রচনা গুলির পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়ে থাকতে পারে বলে ধরে নিতে হবে। কারণ খ্রিষ্টের জন্মের এক শতাব্দীর পূর্বকালে এ রচনাগুলির অধিকাংশই কোন সঠিক বা সুনির্দিষ্ট আকার লাভ করেনি।
এভাবে আদিকাল থেকে খ্রিস্টান ধর্মের আবির্ভাব পর্যন্ত ইহুদীগণ ওল্ড টেস্টামেন্টকে তাদের ধর্মীয় ও সাহিত্যিক মিনার বলে গণ্য করেছে। এ গ্রন্থে র বিভিন্ন খন্ড, অধ্যায় ও বিভাগ খ্রিস্টপূর্ব দশম ও প্রথম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত, সমাপ্ত ও সংশোধিত হয়েছে। এটা আমার ব্যাক্তিগত অভিমত নয়। এ তথ্য এবং ঐতিহাসিক জরিপের বিবরণ আমি একখানি সর্বজন স্বীকৃত নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেছি। গ্রন্থখানি হচ্ছে সলকয়ের ডোমিকান ফ্যাকাল্টির প্রফেসর যে পি স্যামড্রোল রচিত এনসাইক্লোপিডিয়া ইউনিভার্সালিস (প্যারিস ১৯৭৪, তৃতীয় খন্ড, ২৪৬-২৫৩ পৃষ্ঠা),”দি বাইবেল” নামক নিবন্ধ। এ সকল তথ্য উচ্চতম যোগ্যতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞগণ সত্য ও সাঠিকবলে সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং ওল্ড টেস্টামেন্টের বিষয়বস্তু অনুধাবন ও উপলব্ধি করার জন্য এ তথ্যগুলি মনে রাখা দরকার।
ওল্ড টেস্টামেন্টের রচনাবলীর মধ্যে অহী মিশ্রিত ছিল বলে বিশ্বাস করা র কারণ আছে। কিন্তু এখন গ্রন্থখানি আমরা যে অবস্থায় পেয়েছি, তাতে সেই অহী আর অবশিষ্ট আছে কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ আমরা আগেই দেখেছি মূল বর্ণনা অনেকবার রদবদল হয়েছে এবং অনেক লখকই হস্তক্ষেপ করেছেন। সুতরাং সহজেই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, তারা তাদের নিজ নিজ পরিবেশ, পরিস্থিতি ও পছন্দ অনুসারে যা ভালো মনে করেছেন, শুধু সেইটুকুই অবশিষ্ট রেখেছেন এবং এখন আমাদের পর্যন্ত শুধু সেইটুকুই এসেছে।
এ সকল বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের সঙ্গে বর্তমান প্রচারিত বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করনের ভূমিকায় প্রদত্ত বিবরণের তুলনা করা হলে দেখা যাবে যে, আসল তথ্য ও সত্য সম্পুর্ন ভিন্নভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থের রচনায় যে সকল ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। দ্ব্যর্থবোধক হওয়ায় যে সকল বিষয় বিভ্রআন্তি সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলি ঠিক সেভাবেই রেখে দেয়া হয়েছে। অসত্যকে সত্য বলে একটি ভূল ধারণা সৃষ্টির জন্য তথ্যের ব্যাপারটি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা হয়েছে। ’এভাবে বাইবেলের অধিকাংশ ভূমিকাতেই সত্য ও বাস্তবতা গোপন করে একটি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যে সকল গ্রন্থ কয়েকবার রদবদল করা হয়েছে (যেমন পেণ্টাটিউক) সে সকল ক্ষেত্রে স্রাসরি সে কথা না বলে শুধু বলা হয়েছে যে, কিছু কিছু খুটিনাটি বিষয় পরে যোগ করা হয়েছে, কিন্তু আসলেই যেখানে দীর্ঘ ব্যাখ্যার প্রয়োজন সেখানে অতিশয় গুরুত্তপূর্ণ বিষয় সম্পর্কেও নিরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। জনসাধারণের জন্য বিপুল সংখ্যায় মুদ্রিত ও প্রচারিত বাইবেলে এ ধরণের ভূল ও অশুদ্ধ তথ্য থাকা সত্যি দুঃখজনক।
তৌরাত বা পেন্টাটিউক
তৌরাত অর্থাৎ তোরাহ নামটি সেমেটিক। গ্রীক ভাষায় বলা হয় পেন্টাটিউক। অর্থাৎ পাচখন্ডে সমাপ্ত গ্রন্থ। পাচটি খন্ড হচ্ছে জেনোসিস, এক্সোডাস, লোভিটিকাস, নাম্বারস এবং ডিউটারোনমি। ওল্ড টেস্টামেন্টে যে উনত্রিশটি খন্ডের সংগ্রহ আছে, তাঁর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘এ পাচটি।
এ গ্রন্থে দুনিয়া সৃষ্টির শুরু থেকে ইহুদীদের কিনানে প্রবেশ করা পর্যন্ত সময়ের বিবরণ আছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইহুদীদের মিসরে নির্বাসিত হওয়ার পর এবং আরো সঠিকভাবে মূসার ইন্তেকালের পর তাদের ঐ দেশ দেয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ইহুদীদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের জন্য বিবিধ বিধানও দেয়া হয়েছে। এ কারণে এ গ্রন্থ ল (আইন) বা তোরাহ (তৌরাহ) নামেও অভিহিত হয়ে থাকে।
ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মে মুসাকেই বহু শতাব্দী যাবত তৌরাতের লেখক বলে মান্য করা হয়েছে। এ ধারণার ভিত্তি সম্ভবত এই যে, আল্লাহ মুসাকে বললেন -” এ ঘটনা (আমালেকের পরাজয়) স্মারক হিসাবে গ্রন্থে লিখে রাখ।” (এক্সোডাস ১৭, ১৪) । অথবা মিসর থেকে ইহুদীদের বেরিয়ে যাওয়ার সময়ের ঘটনায় যেমন আছে,”মূসা তাদের রওয়ানা হওয়ার স্থান সমূহের নাম লিখে রাখলেন।” – (নাম্বারস ৩৩, ২) এবং”মূসা এ আইন লিখলেন।” (ডিউটারোনমি ৩১, ৯১) । খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকেই মূসা তৌরাতের লেখক হিসেবে গণ্য হয়ে আসছেন। আলেকজান্দ্রিয়ার ফ্লাবিয়াস জোসেফাস এবং ফিলো ঐ একই ধারণা পোষণ করেছেন।
বর্তমানে অবশ্য এ ধারণা সম্পূর্ণ বর্জন করা হয়েছে এবং সকলেই এ বিষয়ে একমত হয়েছেন। তবুও নিউ টেস্টামেন্টে আবার মূসাকেই লেখক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। রোমানদের কাছে লেখা চিঠিতে (১০, ৫) লেভিটিকাস থেকে উধৃতি দিয়ে পল বলেছেন,” মূসা লিখেছেন, যে ব্যাক্তি আইনে বর্ণিত মতে সদাচরণ করে” ইত্যাদি। জন তাঁর গসপেলে (৫, ৪৬-৪৭) ঈসার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন -”তোমরা যদি মূসাকে বিশ্বাস করে থাক, তাহলে আমাকেও বিশ্বাস করবে; কারণ তিনি আমার সম্পর্কে লিখে গেছেন। কিন্তু তোমরা যদি তাঁর লেখাই বিশ্বাস না কর, তাহলে আমার কথা বিশ্বাস করবে কেমন করে?” এখানে তরজমা এবং ভাব প্রকাশে সম্পাদনা, অর্থাৎ রদবদলের আলামত পাওয়া যায়। কারণ গ্রীক ভাষায় মূল বর্ণনায়,”এপিসটেউয়েট” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে অর্থাৎ কথাটি ঈসার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে। অথচ এখানে দেখানো হয়েছে যে, তিনি নিজেই বলেছেন। এটা সম্পূর্ণ ভূল। কিভাবে আমি তা ব্যাখ্যা করছি।
এ ব্যাখ্যার কাঠামো ও নজির আমি জেরুসালেমের বাইবেল স্কুলের প্রধান ফাদার দ্য ভক্স- ের কাছ থেকে নিয়েছি। তিনি ১৯৬২ সালে জেনেসিসের যে ফরাসী তরজমা করেন, তাঁর ভূমিকায় পেন্টাটিউকের একটি মূল্যবান যুক্তিপূর্ণ পরিচিতি দেন। ইভাঞ্জেলিস্টগণ মূসাকে তৌরাতের লেখক বলে যে পরিচয় দিয়ে থাকেন, তিনি তা স্বঈকার করেননি বরং বিপরীত কথাই বলেছেন। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে,” ঈসা ও তাঁর সাহাবাগণ যে ইহুদী রেওয়াজ অনুসরণ করতেন,” তা মধ্যযুগের শেষভাগ পর্যন্ত মেনে নেয়া হত। একমাত্র যিনি এ মতবাদের ঘোর বিরোধিতা করেছেন, তিনি হচ্ছেন দ্বাদশ শতাব্দীর আবেনেজরা। তারপর ষোড়শ শতাব্দীতে কালস্টাড উল্লেখ করেন যে, মূসার পক্ষে বোধ হয় ডিউটারোনমিতে (৩৪, ১৫-১২) তাঁর নিজের ইন্তেকালের বিবরণ লিখে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি এমন কয়েকজন সমালোচকের লেখা থেকেও উধৃতি দিয়েছেন, যারা সম্পূর্ণ না হলেও তৌরাতের অংশ বিশেষ মূসার রচনা বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন। তবে এ ব্যাপারে অরেটরির ফাদার রিচার্ড সাইমনের ভূমিকাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ। তিনি তাঁর”ক্রিটিকাল হিষ্ট্রি অব দি ওল্ড টেস্টামেন্ট” (হিস্টোয়ার ক্রিটিক দু ভাইয়াক্স টেস্টামেন্ট-১৬৭৮) নামক পুস্তকে তৌরাতের ঘটনাক্রমের অসঙ্গতি, একই বিষয়ের বহু পুনরাবৃত্তি, কাহিণীর সামঞ্জস্যহীনতা এবং রচনাশৈলীর বিভিন্নতা বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন। এ পুস্তক প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বত্র একটি লজ্জাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইতিহাসের কোন পুস্তকেই রিচার্ড সাইমনের যুক্তিধারা আর তেমন অনুসরন করা হয়নি। তখন প্রাচীন ঘটনার প্রসঙ্গে”মূসা লিখেছেন”, এ কথাই বলা হয়েছে। একটু আগে আমরা দেখেছি ঈসা নিজে নিউ টেস্টামেন্টে মূসার তৌরাত লেখার কথা সমর্থন করেছেন। ফলে একটি প্রাচীন কিংবদন্তি আরো শক্তিশালী হয়েছে। এ অবস্থায় তাঁর বিরোধিতা করা যে কত কঠিন, তা সহজেই অনুমআন করা যেতে পারে। তবে পঞ্চদশ লুইয়ের চিকিতসক জা আসটুকই সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে গেছেন।
১৭৫৩ সালে তাঁর”কনজেকচার্স অন দি অরিজিনাল রাইটিংস হুইচ এপিয়ার্সই মোজেজ ইউজড টু কম্পোজ দি বুক অব জেনেসিস (কনজেকচার্স সুলে মেমোয়ার্স অরিজিনক্স ডন্টহল পরাইট ক্যু মোইজে সিয়েস্ট সারভি পোর কম্পোজার লে লিভরা দ্য লা জেনেসি)” নামক পুস্তক প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বিশদভাবে দেখান যে, পেন্টাটিউক বা তৌরাত বহু উৎস থেকে সংগৃহীত রচনাবলীর সমষ্টি। তাঁর আগে অনেকেই হয়ত এ বিষয়টি লক্ষ্য করে থাকবেন কিন্তু তিনিি প্রথম সাহস করে কথাটি জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। তিনি উধৃতি দিয়ে দেখান যে, এমন দুটি রচনা জেনেসিসে পাশাপাশি রয়েছে, যার একটিতে আল্লাহকে ইয়াহওয়ে এবং অপরটিতে ইলোহিম নামে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং এ দুটি রচনা কখনোই এক উৎসের হতে পারেনা। আইকরন (১৭৮০-৮৩) অপর চারখানি গ্রন্থের ক্ষেত্রেও একই ধরনের তথ্য আবিষ্কার করেন। তারপর ইলগেন (১৭৯৮) লক্ষ্য করেন যে, আসটুক বর্ণিত যে রচনায় আল্লাহকে ইলোহিম নামে অভিহিত করা হয়েছে, তা আসলে দু’ভাগে বিভক্ত। ফলে পেন্টাটিউকের বুনিয়াদ আক্ষরিক অর্থে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
উনবিংশ শতাব্দীতে উৎসগুলি সম্পর্কে আরও ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয়। ১৮৫৪ সালে মোট চারটি উৎস স্বীকার করে নেয়া হয়। এগুলি হচ্ছে ইয়াহভিস্ট সংস্করণ, ইলোহিস্ট সংসকরন, ডিউটারোনমি এবং স্যাকারডোটাল সংসকরন। এমনকি তাদের সময়কাল নির্ণয় করাও সম্ভব হয়ঃ
(১) ইয়াহভিস্ট সংস্করণ খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীর বলে ধ্রা হয় (জুডায় লিখিত) ।
(২) ইলোহিস্ট সংস্করণ সম্ভবত তাঁর কিছু পরবর্তী কালের (ইসরাইলে লিখিত) ।
(৩) ডিউটারোনমি সম্পর্কে কেঊ মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর (ই জ্যাকব) এবং কেউ মনে করেন জোশিয়ার আমলের (ফাদার দ্য ভক্স) ।
(৪) স্যাকারডোটাল সংস্করণ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর নির্বাসনের আমলের অথবা তাঁর পরের আমলের।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, পেন্টাটিউকের রচনাবলীর মেয়াদ কমপক্ষে তিন শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু সমস্যাটি আসলে আরো জটিল। ১৯৪১ সালে এ লডস দেখতে পান যে ইয়াহভিস্ট সংস্করনে তিনটি উৎস আছে। এভাবে ইলোহিস্ট সংস্করনে চারটি, ডিউটারোনমি তে ছয়টি, এবং স্যাকারডওটাল সংস্করনে নয়টি উৎস আছে। এবং ফাদার দ্য ভক্স” যে আটজন ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থকারের রচনা সংযোজিত হয়েছে” বলে উল্লেখ করেছেন, তা বাদ দিয়েই। আরও সাম্প্রতিক কালে মনে করা হচ্ছে যে,”পেন্টাটিউকের যে সকল আইন বা বিধান আছে, তাঁর অধিকাংশের সন্দানই বাইবেলের বাইরে অন্যত্র পাওয়া যায়, এবং সেগুলি আর ও আগের আমলের।” তাছাড়া”পেন্টাটিউকের দলিল অর্থাৎ রচনাবলী যে সময় ও পটভূমি থেকে এসেছে বলে ধরে নেয়া হয়ে থাকে, রচনাবলীতে বর্ণিত কাহিণিগুলি সলে তাঁর ও অনেক আগের আমলের এবং ভিন্ন পটভূমির। ফলে, কিংবদন্তি কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে, সে সম্পর্কে আগ্রহ দেখা দিয়েছে।” অর্থাৎ সমস্যাটি এমন জটিল হয়ে দাড়িয়েছে যে তাঁর আগামাথা খুজে পাওয়াই মুশকিল।
অনেকগুলি উৎস থাকার কারণে পার্থক্য যেমন এসেছে, তেমনি পুনারাবৃত্তি ও এসেছে। ফাদার দ্য ভক্স উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বন্যা, ইউসুফের অপহরণ ও মিসরে তাঁর তৎপরতা সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য ও অসামঞ্জস্য রয়েছে। তাছাড়া একই ব্যাক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং গুরুত্তপূর্ণ ঘটনাবলীর পরস্পর বিরোধী বিবরণ দেয়া হয়েছে।
এভাবে পেন্টাটিউক বিভিন্ন উৎস ও কিংবদন্তির সংগ্রহ হলেও লেখক গণ মোটামুটিভাবে দক্ষতার সঙ্গে তা একত্রিত ও গ্রন্থিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা কখনও দুটি বিবরণ পাশাপাশি বসিয়ে দিয়েছেন, আবার কখন ও দুটি বিবরণ মিশিয়ে এক্টিমাত্র বিবরণ হিসাবে পেশ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অসম্ভাব্যতা এবং পরস্পর বিরোধিতার ব্যাপারগুলি রয়েই গেছে। ফলে আধুনিক যুগের মূল উৎসগুলিই গভীর ও বস্তুনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছে।
পেন্টাটিউক বা তৌরাতের মূল রচনা পরীক্ষা করে দেখলে অতি সহজেই মানুষের হাতের কাজ বলে ধরা যায়। ইহুদী জাতির ইতিহাসের বিভিন্ন আমলের মৌখিক কাহিনী, কিংবদন্তি, এবং পুরুষানুক্রমে রক্ষিত রচনার ভিত্তিতে এ গ্রন্থ হয়েছে। বিবরণ শুরু হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর গোড়া থেকে একটি ইয়াহভিস্ট প্রবাদ দিয়ে, যাতে ইসরাইলের নিজস্ব তকদির বর্ণনা করা হয়েছে। এ তকদির হচ্ছে ফাদার দ্য ভক্সের ভাষায়,” মানব জাতির জন্য আল্লাহর মহাপরিকল্পনার যথাযথ স্থানে ফিরে যাওয়া।” আর শেষ হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে একটি স্যাকারডোটাল প্রবাদ দিয়ে, যাতে তারিখ এবং নসবনামা একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব যে, স্যাকারডোটাল সংস্করনে দুনিয়ায় মানুষের আগমন, সময়ের বিবর্তনে তাঁর অবস্থান এবং সৃষ্টিপ্রবাহ সম্পর্কে যে সকল বর্ণনা আছে, আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের মোকাবেলায় তা সম্পূর্ণ ভূল। স্পষ্টতই মূলের ওপর কলম চালাতে গিয়েই এ দশা হয়েছে।
ফাদার দ্য ভক্স লিখেছেন-” এ প্রবাদের কাহিনীগুলিতে আইনগত বৈধতার প্রশ্নই প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন সৃষ্টি সমাপ্ত করার পর রবিবারে বিশ্রাম গ্রহণ, নূহের সঙ্গে মৈত্রী, ইব্রাহীমের সঙ্গে মৈত্রী ও হাজামত, মাকপেলার গূহা খরিদ যার ফলে যাজকগণ কেনানে জমি লাভ করেন।” আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ প্রবাদটির মেয়াদ ব্যাবিলনে নির্বাসন থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত। সুতরাং ধর্মীয় সমস্যার সঙ্গে এখানে সম্পুর্ণ রাজনৈতিক সমস্যাও মিশে গেছে।
জেনেসিসের ক্ষেত্রে গ্রন্থখানির বিষয়বস্তু যে তিনটি উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছে, তা এখন সাব্যস্ত ও স্বীকৃত হয়েছে। ফাদার দ্য ভক্স তাঁর তরজমার বিশ্লেষনমূলক আলোচনায় জেনেসিসের কোন অনুচ্ছেদ কোন উৎসের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে, তাঁর একটি তালিকা দিয়েছেন। এ প্রমাণের ভিত্তিতে কোন অধ্যায়ে কোন উৎসের বিষয়বস্তু কতখানি আছে, তা প্রায় সঠিকভাবে নির্ণয় করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, জেনেসিসের প্রথম এগারটি অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব, বন্যা এবং বন্যা থেকে ইব্রাহীমের আমল পর্যন্ত সময়ের যে বিবরণ আছে তাতে দেখা যায় যে, একটি অংশ ইয়াহভিষ্ট সংস্করণ থেকে এবং তাঁর পরের অংশ স্যাকারডোটাল সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে। এবং সমগ্র বিবরণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। এ প্রথম এগারটি অধ্যায়ে ইলোহিস্ট সংস্করনের কোন বিষয়বস্তু নেই। তবে ইয়াহভিস্ট ও স্যাকারডোটাল ভাষ্য যে পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, তা বেশ স্পষ্টভাবেই বুঝা যায়। প্রথম পাচটি অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব এবং নূহের আমল পর্যন্ত বর্ণনায় দেখা যায় যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ইয়াহভিস্ট অনুচ্ছেদের পর একটি স্যাকারডোটাল অনুচ্ছেদ দিয়ে পর পর সাজানো হয়েছে। বন্যার বিবরণে, বিশেষত সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে এ বন্দোবস্ত আর ও ঘন ঘন করা হয়েছে ; অর্থাৎ এক ভাষ্যের একটি ছোত অনুচ্ছেদের পর অপর ভাষ্যের একটি ছোট অনুচ্ছেদ বসানো হয়েছে এবং এমনকি বাক্যের ক্ষেত্রেও এ সাজানো বন্দোবস্ত নজরে পড়ে। একটি জায়গায় দেখা যায় যে, মোট একশো লাইনের মধ্যে এভাবে সতেরবার ভাষ্য বদল করা হয়েছে। এ কারণেই আমরা যখন জেনেসিস পড়তে যাই, তখন অসম্ভাব্যতা ও অন্তর্বিরোধিতা প্রকটভাবে ধরা পড়ে। এ প্রসঙ্গে নিচের ছকটি লক্ষনীয়।
জেনেসিসের ১ থেকে ১১ অধ্যায়ে ইয়াহভিস্ট ও স্যাকারডোটাল ভাষ্যের অবসান।
* প্রথম সংখ্যাটি অধ্যায়ের নম্বর।
* ব্রাকেটের মধ্যে দ্বিতীয় সংখ্যাটি কলামের নম্বর। কলাম কখন ও দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ায় ক ও খ হিসাবে দেখানো হয়েছে।
* ই- দ্বারা ইয়াহভিস্ট এবং স-দ্বারা স্যাকারডোটাল ভাষ্য বুঝানো হয়েছে।
* উদাহরণ- ছকের প্রথম লাইনে বুঝানো হয়েছে যে, বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের ১নং অধ্যায়ের ১নং কলাম থেকে ২ নং অধ্যায়ের ৪-ক কলাম পর্যন্ত বিষয়বস্তু স্যাকারডোটাল ভাষ্য থেকে নেয়া হয়েছে।
অধ্যায় — কলাম থেকে — অধ্যায় — কলাম — উৎস
১ — (১) — ২ (৪-ক) — স
২ — (৪-খ) — ৪ — (২৬) — ই
৫ — (১) — ৫ — (৩২) — স
৬ — (১) — ৬ — (৮) — ই
৬ — (৯) — ৬ — (২২) — স
৭ — (১) — ৭ — (৫) — ই
৭ — (৬) — – — – — স
৭ — (৭) — ৭ — (১০) — ই
৭ — (১১) — – — – — স
৭ — (১২) — – — – — ই
৭ — (১৩) — ৭ — (১৬-ক) — স
৭ — (১৬-খ) — ৭ — (১৭) — ই
৭ — (১৮) — ৭ — (২১) — স
৭ — (২২) — ৭ — (২৩) — ই
৭ — (২৪) — ৮ — (২-ক) — স
৮ — (২-খ) — – — – — ই
৮ — (৩) — ৮ — (৪) — স
৮ — (৬) — ৮ — (১২) — ই
৮ — (১৩-ক) — – — – — স
৮ — (১৩-খ) — – — – — ই
৮ — (১৪) — ৮ — (১৯) — স
৮ — (২০) — ৮ — (২২) — ই
৯ — (১) — ৯ — (১৭) — স
৯ — (১৮) — ৯ — (২৭) — ই
৯ — (২৮) — ১০ — (৭) — স
১০ — (৮) — ১০ — (১৯) — ই
১০ — (২০) — ১০ — (২৩) — স
১০ — (২৪) — ১০ — (৩০) — ই
১০ — (৩১) — ১০ — (৩২) — স
১১ — (১) — ১১ — (৯) — ই
১১ — (১০) — ১১ — (৩২) — স
মানুষ নিজের হাতেই যে কিভাবে বাইবেল সাজিয়েছে, ছক থেকে তা অতি সহজেই বুঝা যায়।
ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহ
এ গ্রন্থসমূহে আমরা ইহুদী জাতির ইতিহাস পাই। এ ইতিহাস তাদের প্রতিশ্রুত দেশে প্রবেশের সময় থেকে ব্যবিলনে নির্বাসিত হওয়ার সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। তারা খুব সম্ভব ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রতিশ্রুত দেশে প্রবেশ করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠো শতাব্দীতে ব্যাবিলনে নির্বাসিত হয়।
এখানে”জাতীয় ঘটনা” বলে কথিত ব্যাপারটির ওপর জোর দেয়া হয়েছে এবং ঘটনাটিকে আল্লাহর ওয়াদা পূরণ বলে পেশ করা হয়েছে। বর্ণনায় অবশ্য ঐতিহাসিক সত্যতা ও নির্ভুলতা উপেক্ষা করা হয়েছে। এ কথা মনে রেখেই ই জ্যাকোব বলেছেন যে, আই ও জেরিকোর কথিত ধ্বংসের ব্যাপারে গ্রন্থের বিচার পুস্তকের (বুক অব জাজেস) মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে পারিপার্শ্বিক শত্রুদের বিরুদ্ধে মনোনীত জাতির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং তাদের জন্য আল্লাহর সমর্থন। ফাদার এবং এ লিফার ক্রামপন বাইবেলের ভূমিকায় অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে বলেছেন যে, এ গ্রন্থখানি বেশ কয়েকবার রদবদল করা হয়েছে। মূল গ্রন্থের অনেকগুলি মুখবন্ধ এবং বিভিন্ন পরিশিষ্টের সংযোজন থেকেই তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায়। ’মূল বিবরণে রুথের কাহিনীও যোগ করা হয়েছে।
স্যামুয়েলের গ্রন্থ বুক অব স্যামুয়েল এবং দুখানি রাজাবলি গ্রন্থ (বুক অব কিংস) মূলত স্যামুয়েল, সল, দাউদ ও সোলাইমানের জীবনীমূলক গ্রন্থ। ’এগুলির ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ আছে। ঐতিহাসিক বিচারেই জ্যাকোব এসব গ্রন্থে অসংখ্য ভূল পেয়েছেন। কারণ একই ঘটনা সম্পর্কে একাধিক পরষ্পর বিরোধী বর্ণনা আছে। ’ইলিয়াস, এলিশা ও ইসাইয়া নবীর কথাও এ সকল গ্রন্থে আছে। অর্থাৎ ইতিহাসের সঙ্গে কিংবদন্তি মিশে গিয়েছে। ফাদার লিফাবারের মত অন্যান্য সমালোচকগণ অবশ্য মনে করেন যে, এ গ্রন্থগুলির”ঐতিহাসিক মূল্যের মৌলিকত্ব আছে।”
ঘটনাপঞ্জী এক ও দুই (ক্রনিকেলস ওয়ান এন্ড টু) উজাইরের গ্রন্থ (বুক অব নেহেমিয়া) খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থশতাব্দীতে ওয়াকেয়া নাবিশ (ক্রনিকেলার) নামধায়ী একই লেখকের রচিত। তিনি ঐ সময় পর্যন্ত সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনা করেছে, যদিও তাঁর দেয়া নসবনামায় কেবলমাত্র দাউদ পর্যন্ত হিসাব পাওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি স্যামুয়েলের গ্রন্থ থেকেই তথ্য নিয়েছেন। ই জ্যাকোব বলেছেন,”অসঙ্গতির দিকে খেয়াল না করেই তিনি হুবহু নকল করেছেন।” তবে তিনি এমন কিছু নতুন তথ্য দিয়েছেন যা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে সঠিক বলে সাব্যস্ত হয়েছে। ই জ্যাকোব বলেছেন,”লেখক কখনও কখনও ধর্মের প্রয়োজন মোতাবেক ইতিহাস লিখেছেন। রাজা মানাসেহ বিধর্মী ও অত্যাচারী হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন শান্তি ও সমৃদ্ধির রাজত্ব করেছেন। এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, কিছুদিন আসিরিয়ায় থাকার সময় রাজা ধর্মান্তরিত হন (ক্রনিকেলস দুই ৩৩ ১১) । কিন্তু বাইবেল অথবাঃ বাইবেল বহির্ভূত কোন গ্রন্থে এ ঘটনার কোন উল্লেখ নেই। উজাইরের গ্রন্থ এবং নেহেমিয়ার গ্রন্থও কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। বলা হয়েছে যে গ্রন্থ দুখানি অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য বিষয়ে পূর্ণ। যে আমলের ঘটনা (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী) তাতে বর্ণিত হয়েছে সে আমলটিই ভালভাবে পরিজ্ঞাত নয় এবং ঐ আমলের বাইবেল বহির্ভুত তেমন কোন দলিলও নেই।
তোবিতের গ্রন্থ (বুক অব টোবিট), জুডিথের গ্রন্থ (বুক অব জুডিথ) এবং ইস্থারের গ্রন্থও (বুক অব ইসথার) ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলে ধরা হয়। অথচ এ গ্রন্থগুলিতে ইতিহাসের চরম বেইজ্জত করা হয়েছে। ধর্মের প্রয়োজনে মানুষ ও জায়গার নাম বদল করা হয়েছে এবং চরিত্র ও ঘটনা সৃষ্টি করা হয়েছে। আসলে এগুলি হচ্ছে ঐতিহাসিক অসত্য ও অসম্ভাব্যতার মিশাল দেয়া (নীতিকথামূলক) কাল্পনিক কাহিনী।
মাকাবিজের গ্রন্থ (বুক অব মাকাবিজ) আবার একটু পৃথক ধরনের। এ সকল গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলী খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর। এ আমলের ঘটনাবলীর এটাই সবচেয়ে নির্ভূল বিবরণ। এ কারণে এ গ্রন্থগুলি খুবই গুরুত্তপূর্ণ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ঐতিহাসিক নামে যে গ্রন্থগুলি শ্রেনীবদ্ধ করা হয়েছে তাঁর একখানির সঙ্গে অপর খানির কোনই মিল নেই। কোন কোন গ্রন্থে ইতিহাস সঠিকভাবে বর্ণিত হয়েছে বটে, কিন্তু কোন কোন গ্রন্থে আবার বর্ণিত হয়েছে খেয়ালখুশী মত।