মি’রাজের ঘটনা
ইবনে ইসহাক বলেন, আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি যে, আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “বাইতুল মাকদাসের অনুষ্ঠানাবলী সমাপ্ত হলে আমার সামনে ঊর্ধাকাশে আরোহণের সিঁড়ি হাজির করা হলো। এমন সুন্দর কোন জিনিস আমি আর কখনো দেখিনি। মৃত্যুর সময় হলে মানুষ এই সিঁড়িই দেখতে পায় এবং এর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। আমার সঙ্গী (জিবরাইল) আমাকে ঐ সিঁড়িতে আরোহণ করালেন এবং আমাকে সাথে নিয়ে আকাশের একটি দরজায় গিয়ে থামলেন। এ দরজাকে ‘বাবুল হাফাযাহ’ বা রক্ষকদের দরজা বলা হয়। এখানে ইসমাঈল নামক একজন ফিরিশতা কর্তব্যরত রয়েছেন। তাঁর অধীনে রয়েছে বার হাজার ফেরেশতা এবং এইসব ফেরেশতার প্রত্যেকের অধীনেও আবার বার হাজার করে ফেরেশতা রয়েছে।” এই হাদীস বর্ণনা করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাআনের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন,
[আরবী *************]
“তোমার প্রভুর সৈন্য সামন্তের সংখ্যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না।” (সূরা আলা মুদ্দাস্সির)
“অতঃপর যখন আমাকে নিয়ে তিনি ভেতরে প্রবেশ করলেন তখন ঐ ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে জিবরীল, ইনি কে?’ তিনি বললেন, ‘ইনি মুহাম্মাদ।’ ফেরেশতা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনি কি নবী?’ জিবরীল বললেন, ‘হ্যাঁ।’ অতঃপর তিনি আমার কল্যাণ কামনা করে দোয়া করলেন।”
প্রথম আকাশে প্রবেশের পর আমি দেখতে পেলাম এক ব্যক্তি বসে আছেন। তাঁর কাছে সকল মৃত মানুষের আত্মা হাজির হচ্ছে। কোন কোনটা হাজির হলে তিনি খুব খুশী হচ্ছেন এবং প্রশংসা করে বলছেন, ‘এটি একটি পবিত্র আত্মা যা একটি পবিত্র দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।’ আবার কোন কোনটা হাজির হলে তিনি চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ করে বলছেন, ‘আহ! এটি একটি অপবিত্র আত্মা যা একটি পাপপংকিল দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।’ আমি জিবরাইলকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে জিবরাইল, ইনি কে?’ জিবরাইল বললেন, ইনি আপনার পিতা আদম (আ)। তাঁর কাছে তাঁর সন্তানদের আত্মা হাজির করা হয়। কোন মুমিনের আত্মা দেখলে তিনি আনন্দিত হয়ে বলেন, ‘এটি একটি পবিত্র আত্মা যা একটি পবিত্র দেহ থেকে বেরিয়েছে।’ ্আর কোনা কাফিরের আত্মা দেখলে তিনি আর্তনাদ করে ওঠেন, তাকে অপছন্দ করেন এবং তার প্রতি বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এটি একটি পাপাত্মা যা কোন পাপিষ্ঠ দেহ থেকে নির্গত হয়েছে।’
অতঃপর কতগুলো লোক দেখলাম। তাদের ঠোঁট উটের মত এবং তাদের হাতের মুঠোয় দগদগে জ্বলন্ত ছোট ছোট পাথর টুকরো রয়েছে। সেগুলো তারা মুখে পুরছে। আর পরক্ষণেই তা মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাতকারী।’
এরপর আরো কিছু সংখ্যক লোক দেখলাম। তাদের পেটের মত বীভৎস আকৃতির পেট আর কখনো দেখিনি। দেখলাম, ফেরাউনের সহযোগীদের যে পথ গিয়ে দোযখে নেয়া হচ্ছে, সেই পথের ওপর তারা [৩৪.ফিরাউনের সহযোগীদের জাহান্নামের কঠিনতম শাস্তি ভোগ করতে হবে বলে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।] অবস্থান করছে। তারা পিপাসা-কাতর উটের মত ছটফট করছে। আর ফিরাউনের দোযখগামী অনুসারীরা তাদেরকে পায়ের তলায় পিষ্ট করে যাচ্ছে তথাপি সেখান থেকে একটু সরে বসবার ক্ষমতাও তাদের নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা সুদখোর।’
অতঃপর আরো একদল লোক দেখলাম। তাদের সামনে উৎকৃষ্টমানের পুষ্ট গোশত রয়েছে। আর তার পাশেই রয়েছে উৎকট দুর্গন্ধ যুক্ত খারাপ গোশত। অথচ তারা ভালো গোশত বাদ দিয়ে খারাপ গোশত খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা সেই সব লোক যারা বৈধ স্ত্রী থাকতে নিষিদ্ধ স্ত্রী লোকের কাছো যায়।’
অতঃপর কিছু সংখ্যক নারীকে দেখলাম তাদের স্তনে রশি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘হে জিবরীল এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘এরা সেই সব নারী যারা ব্যভিচারের মাধ্যমে অন্যের ঔরসজাত সন্তান স্বামীর সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়।’
এরপর তিনি দ্বিতীয় আকাশে আরোহণ করালেন। সেখানে দুই খালাতো ভাই ঈসা (আ) ও ইয়াহইয়া ইবনে যাকারীয়ার (আ) সাক্ষাত পেলাম।
অতঃপর জিবরীল (আ) আমাকে তৃতীয় আকাশে আরোহণ করালেন। সেখানে এক ব্যক্তিকে দেখলাম। তাঁর চোহারা পূর্নিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল। আমি বললাম, ‘হে জিবরীল, ‘ইনি কে?’ তিনি বললেন, ‘ইনি ইয়াকুবের (আ) পুত্র ইউসুফ (আ)।’
অতঃপর চতুর্থ আকাশে আরোহণ করে সেখানে আর এক ব্যক্তিকে দেখলাম। জিবরাইল জানালেন ইনি ইদ্রিস (আ)। অতঃপর পঞ্চম আকাশে আরোহণ করলাম। সেখানে দেখলাম, সাদা চুল ও দীর্ঘ শ্মশ্রুধারী এক বৃদ্ধ। অত সুন্দর বৃদ্ধলোক, আমি আর কখনো দেখিনি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরীল, ইনি কে?’ তিনি বললেন, ‘তিনি স্বজাতির কাছে প্রিয় হারুন ইবনে ইমরান (আ)’! অতঃপর ষষ্ঠ আকাশে পৌঁছলাম। সেখানে দেখলাম বাদামী রংয়ের লম্বা নাক বিশিষ্ট এক দীর্ঘায়ী পুরুষ, যেন শানুয়া গোত্রের লোক। আমি বললাম জিবরাইল ইনি কে?’ জিবরাইল বললেন, ‘তিনি আপনার ভাই মূসা ইবনে ইমরান (আ)।’
অতঃপর আমাকে সপ্তম আকাশে আরোহণ করালেন। সেখানে দেখলাম, বাইতুল মামুরের দরজার কাছে একটি চেয়ারে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তোমাদের সঙ্গী (অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সা) স্বয়ং তাঁর সাথে সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ। বাইতুল মামুরে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফিরিশতা প্রবেশ করে এবং তারা আর ফিরে আসে না। এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইনি কে?” তিনি বললেন, ‘তিনি আপনার পিতা ইবরাহীম (আ)।’
অতপর তিনি আমাকে নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করলেন। সেখানে ঈষৎ কালো ঠোঁট বিশিষ্ট একটি পরমা সুন্দরী যুবতীকে দেখলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কার জন্য?’ সে বললো, ‘যায়িদ ইবনে হারেসার জন্য।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবনে হারেসাকে এই সুসংবাদটি জানিয়ে দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এরপর আমি ফিরে এলাম। আসার পথে মূসা ইবনে ইমরানের (আ) সাথে দেখা হলো। বস্তুত: তিনি তোমাদের একজন উত্তম বন্ধু। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ওপর কয় ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছে?” আমি বললাম, ‘প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত।’ মুসা বললেন, ‘দেখ, নামায বড় কঠিন কাজ। তোমার উম্মাত খুবই দুর্বল। তুমি আল্লাহর কাছে ফিরে যাও এবং তোমার উম্মাতের জন্য দায়িত্ব আরো হালকা করে দিতে বল।’ আমি আল্লাহর কাছে ফিরে গেলাম এবং আমার ও আমার উম্মাতের দায়িত্ব হালকা করে দিতে অনুরোধ করলাম আল্লাহ দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন।অতঃপর ফিরে আসলাম। মূসার সাথে আবার দেখা হলো। তিনি আবার আগের মত বললেন। আমি আবার গিয়ে আল্লাহকে নামায কমিয়ে দেয়ার আবেদন জানালাম। আল্লাহ আরে দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন। এভাবে তিনি ক্রমাগত আমাকে পরামর্শ দিতে লাগলেন।
যখনই তাঁর কাছে ফিরে যাই, তিনি বলেন, ‘যাও, আরো কমিয়ে দিতে বলো। এভাবে কমাতে কমাতে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায বাকি রইল। এবারও মূসার (আ) কাছে ফিরে এলে তিনি আরো কমিয়ে আনার পরামর্শ দিলেন। আমি বললাম, ‘বহুবার আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়েছি এবং কমিয়ে দিতে বলেছি। আমি লজ্জাবোধ করছি। তাই আর ফিরে যেতে পারবো না।’
অতএব যে ব্যক্তি এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঈমান ও সতর্কতার সাথে পড়বে, সে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরয নামাযের সওয়াব পাবে।”
আবু তালিব ও খাদীজার ইনতিকাল
অতঃপর একই বছর আবু তালিব ও খাদীজা (রা) ইনতিকাল করেন। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর একের পর এক বিপদ-মুসিবত আসতে থাকে। খাদীজা (রা) ছিলেন তাঁর এক পরম সত্যনিষ্ঠ উপদেষ্টা। তিনি নিজের যাবতীয় দুঃখ কষ্টের কথা তাঁর কাছে বলতেন। আর চাচা আবু তালিব ছিলেন তাঁর সহায় ও ঢালস্বরূপ। তিনি কুরাইশদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতেন এবং তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতেন। মদিনায় হিজরাতের তিন বছর পূর্বে খাদীজা ও আবু তালিবের মৃত্যু ঘটে।
আবু তালিব মারা যাওয়ার পর কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এমন নির্যাতন শুরু করলো, আবু তালিবের জীবদ্দশায় যা তারা করার সাহস করেনি। এমনকি একদিন কুরাইশদের একজন অত্যন্ত নীচাশয় অর্বাচীন তার চলার পথে গতিরোধ করে তাঁর মাথায় ধুলো নিক্ষেপ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধুলো নিয়ে বাড়ী গেলেন। এ অবস্থা দেখে তাঁর এক মেয়ে ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর মাথার ধুলো মুছে পরিষ্কার করে দিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলছিলেন, “মা, কাঁদিস না! তোর আব্বাকে আল্লাহ রক্ষা করবেন।” এ পর্যায়ে তিনি বললেন, “আবু তালিব মারা যাওয়ার আগে কুরাইশরা আমার সাথে কোন রকম খারাপ আচরণ করতে পারেনি।”
আবু তালিব রোগাক্রান্ত হলে রোগের চরম পর্যায়ে কুরাইশরা একদিন এই বলে সলাপরামর্শ করলো যে, তার রোগ মারাত্মক অবস্থায় উপনীত, হামযা ও উমার ইসলাম গ্রহণ করেছে, কুরাইশদের সকল গোত্রে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে, এমতবস্তায় আবু তালিবের কাছে আমাদের যাওয়া উচিত। তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর মধ্যস্থতায় মুহাম্মাদের সাথে আমাদের একটা চুক্তি করা উচিত। নতুবা তাঁর দলবল আমাদের ধনসম্পদ পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন, “উতবা ও শাইবা ইবনে রাবীয়া, আবু জাহল, উমাইয়া ইবনে খালাফ, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব প্রমুখ বড় বড় কুরাইশ নেতা আবু তালিবের কাছে গিয়ে হাজির হলো। তারা তাঁকে বললো, “হে আবু তালিব, আপনি আমাদের কাছে কতখানি শ্রদ্ধার পাত্র তা আপনার অজানা নয় আজ আপনি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। আপনার জীবন নিয়ে আমরা শংকিত। আপনার ভাতিজার সাথে আমাদের সম্পর্কের ধরনও আপনার জানা। কাজেই তাকে ডাকুন, মৃত্যুর আগে তার সাথে আমাদের একটা আপোষরফা করে দিয়ে যান। তার সম্পর্কে আমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিন এবং আমাদের সম্পর্কে তার কাছ থেকেও প্রতিশ্রুতি আদায় করে দিন, যাতে আমরা তার ওপর কোন বাড়াবাড়ি না করি এবং সে ও আমাদের ওপর কোন বাড়াবাড়ি না করে। আমরাও তার ও তার ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ না করে আর সেও আমাদের ওপর কোন বাড়াবাড়ি না করে। আমরাও তার ও তার ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ না করি আর সেও আমাদের ও আমাদের ধর্মের ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করে।”
আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এসে তাঁকে বললেন, “ভাতিজা, এরা তোমার সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তারা এসেছে তোমার নিকট থেকে একটা কথা নিতে এবং তার বিনিময়ে তোমাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিতে। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তোমরা আমার নিকট থেকে একটা মাত্র কথা গ্রহণ করে তাহলে সহগ্র আরবের মালিক হয়ে যাবে এবং অনারব লোকেরা সবাই তোমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে। ” আবু জাহল বললো, “বেশ! তা হলে একটা কেন, দশটা কথা গ্রহণ করতেও রাজী আছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা ঘোষণা কর যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং অন্য যে সব দেব-দেবীর পূজা করো তা আর করবে না।” এ কথা শুনে তারা সবাই হাততালি দিল। অতঃপর বললো, “আচ্ছা মুহাম্মাদ, তুমি কি চাও যে, আমরা অন্য সব দেব-দেবীর বদলে শুধুমাত্র একজনের পূজা করি? এটা তোমার একটা আজগুবি কথা।” এরপর তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, “দেখ, এই লোকটির কাছে তোমার যা প্রত্যাশা করছো তা সে কখনো দেবে না। অতএব তোমরা চলে যাও। তার ও তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর ফায়সালা না আসা পর্যন্ত বাপদাদার ধর্ম পালন করতে থাক।”
সবাই সেখান থেকে চলে গেলে আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ভাতিজা,আমার মনে হয, তুমি তাদেরকে অন্যায় কিছু অনুরোধ করনি।”
আবু তালিবের মুখে এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনে তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে আশার সঞ্চার হলো। তাই তিনি আবু তালিবকে এই বলে পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন, “চাচা, আপনি একবার বলুন। তাহলে কিয়ামতের দিন আপনার জন্য সুপারিশ করা আমার জন্য বৈধ হয়ে যাবে।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরূপ আগ্রহী হতে দেখে আবু তালিব বললেন, “ভাতিজা, আমার মুত্যুর পরে তোমার ও তোমার ভাই বোনদের অপমানিত হতে হবে এবং কুরাইশরা ভাববে যে আমি শুধু মৃত্যুর ভয়ে ঈমান এনেছি। এই আশংকা যদি না থাকতো তা হলে আমি কালেমা পড়তাম ও ঈমান আনতাম। আমি শুধু তোমাকে খুশী করার জন্যই এ কথা বলছি।”
এরপর আবু তালিবের অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এলে আব্বাস দেখলেন, আবু তালিব ঠোঁট নাড়ছেন। তিনি তাঁর মুখের দিকে কান এগিয়ে দিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ভাতিজা তুমি যে কালেমা পড়তে বলেছো, আমার ভাই তা পড়েছে।” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “আমি শুনতে পাইনি।”
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, কুরাইশদের যে লোকজন আবু তালিবের কাছে এসেছিল তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা এই আয়াত নাযিল করেছেনঃ
[আরবী *************]
“সা-দ। উপদেশ পরিপূর্ণ কুরআনের শপথ। অবিশ্বাসীরাই বরং অহংকার ও হঠকারিতায় লিপ্ত। তাদের পূর্বে আমি কত জাতিকেই না ধ্বংস করে দিয়েছি। তখন তারা আর্তনাদ করে উঠেছে। কিন্তু তখন আর রক্ষা পাওয়ার অবকাশ ছিল না। এই লোকেরা তাদের মধ্যে থেকেই একজন সতর্ককারী আবির্ভূত হওয়ায় বিষ্মিত হয়েছে আর অবিশ্বাসীরা বলতে লাগলো, ‘এই ব্যক্তি তো যাদুকর, মিথ্যাবাদী। সে কি সমস্ত খোদার স্থানে একজন মাত্র খোদাকে বসিয়েদিল! এটা নিতান্তই অদ্ভুত ব্যাপার!’ তাদের নোতারা এই বলতে বলতে চলে গেল, ‘চল, নিজেদের দেব-দেবীর প্রতি অবিচল থাকো। এটা অর্থাৎ যে কথা বলা হচ্ছে তা অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক। এ রকম কথা তো আমরা সাম্প্রতিক কালের কোন ধর্মের নিকট থেকেই শুনতে পাইনি। নিশ্চয়ই এটা মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরা সা-দ)
‘সাম্প্রতিক কালের ধর্ম’ অর্থ খৃস্টধর্ম- যার অনুসারীরা বলতো যে, আল্লাহ তিনজনের তৃতীয়জন। অতঃপর আবু তালিব মারা গেলেন।
সাহায্য লাভের আশায় বনু সাকীফ গোত্রের শরণাপন্ন হওয়া
আবু তালিব মারা যাওয়ার পর কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ভীষণ অত্যাচার শুরু করলো যা তাঁর চাচা আবু তালিব বেঁচে থাকলে তারা করতে পারেনি। তাই তিনি কুরাইশদের অত্যাচার প্রতিরোধে সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের আশায় তায়েফে বনু সাকীফ গোত্রের কাছে গেলেন।তিনি আশা করেছিলেন যে, তারা হয়তো ইসলাম গ্রহণ করবে, তাই একাকীই তিনি সেখানে গেলেন।
তায়েফে পৌঁছে তিনি বনু সাকীফ গোত্রের সবচেয়ে গণ্যমান্য তিন ব্যক্তির কাছে উপস্থিত হলেন। তারা তিন ভাই আবদ ইয়ালীল, মাসউদ ও হাবীব। তাদের পিতার নাম আমর ইবনে উমাইর। তাদের একজন কুরাইশ গোত্রের বনু জুমাহ উপগোত্রের বংশের মেয়ে বিয়ে করেছিলো। তাদের কাছে বসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলাম প্রচারে সহায়তা করার অনুরোধ জানালেন। তিনি তাদেরকে কুরাইশদের বিরোধিতার মুখে তাঁকে সমর্থন করার অনুরোধ জানালেন। তাদের একজন বললো, “আল্লাহ যদি তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়ে থাকেন তা হলে তিনি কা’বা শরীরফর গেলাফ খুলে ফেলুন।” [এর অর্থ সম্ভবতঃ এই যে, তাঁকে রাসূল করে পাঠানোর কারণে কা’বার মর্যাদা বিনষ্ট হয়েছে। কেননা তাঁর মত একজন অসহায় লোককে রাসূল বানানো তাদের কাছে অযৌক্তিক। -অনুবাদক] আর একজন বললো, “আল্লাহ কি রাসূল বানানোর জন্য তোমাকে ছাড়া আর কাউকে পেলেন না?” তৃতীয় জন বললো, “তোমার সাথে আমি কোন কথাই বলবো না। তুমি যদি তোমার দাবী অনুসারে সত্যিই রাসূল হয়ে থাকো তা হলে তো তোমার কথার প্রতিবাদ করতে যাওয়া বিপজ্জনক। আর তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তা হলে তোমার সাথে আমার কথা বলাই অনুচিত।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর কথা না বলে সেখান থেকে উঠে আসলেন। বিদায় হবার আগে তাদেরকে অনুরোধ করলেন যে, তোমরা যখন আমার দাওয়াত গ্রহণ করলে না তখন আমার কথা আর কারো কাছে প্রকাশ করো না। ওরা অন্যদের কাছে তাঁর কথা প্রচার করে তাঁর বিরুদ্ধে লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে এই আশংকায় তিনি এরূপ করলেন। কিন্তু তারা সে অনুরোধ রক্ষা করলো না। তারা বরং গোত্রের মূর্খ, নির্বোধ ও দাস শ্রেণীর লোকদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগালি দিতে ও হৈ হল্লা করতে করতে চারদিক থেকে ছুটে এলো। বিপুল সংখ্যক লোক তাঁকে ঘিরে ধরলো। তিনি বাধ্য হয়ে উতবা ও শাইবা ইবনে রাবীয়া নামক দুই ভাইয়ের দেয়াল ঘেরা ফলের বাগানে আশ্রয় নিলেন। তারা দুই ভাই সে সময় বাগানেই ছিলো। সাকীফ গোত্রের যেসব লোক তাঁর পিছু নিয়েছিলো তারা তখন ফিরে চলে গেল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি আঙ্গুর ঝোপের ছায়ায় গিয়ে বসলেন। উতবা ও শাইবা তাঁর উপর তায়েফবাসীর অবর্ণনীয় অত্যাচার এতক্ষন নীরবে প্রত্যক্ষ করছিলো। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কুরাইশ উপ-গোত্রের সেই মহিলাটির সাক্ষাত ঘটে। তিনি তাকে বললেন, “তোমার দেবররা আমার সাথে কি আচরণ করলো দেখলে তো?”
অতঃপর একটু শান্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে নিম্পরূপ দোয়া করলেন,
[আরবী *************]
“হে আল্লাহ, আমার দুর্বলতা, অক্ষমতা, সহায় সম্বল ও বিচক্ষণতার অভাব এবং মানুষের কাছে আমার নগণ্যতা ও অবজ্ঞা-উপেক্ষার জন্য আপনারই কাছে আমি ফরিয়াদ করছি। হে শ্রেষ্ঠ দয়াবান, আপনি দুর্বল ও উপেক্ষিতদের প্রতিপালক। আপনি আমারও প্রতিপালক। কার রহম ও করুণার ওপর আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন? আমার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে সেই অনাত্মীয়ের ওপর, না কি সেই শত্রুর যে আমার সাথে যে নিষ্ঠুর আচরণ করে সেই অনাত্মীয়ের ওপর, না কি সেই শত্রুর যে আমার ওপর প্রভাবশালী ও পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছে? আমার উপর আপনি যদি স্বস্তি ও নিরাপত্তা দান করেন তবে সেটা আমার জন্য নিঃসন্দেহে স্বস্তির কারণ। আমি আপনার সেই জ্যোতির আশ্রয় চাই যার আবির্ভাবে সকল অন্ধকার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং যার সাহায্যে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল সমস্যার সুরাহা হয়। আপনার সকল ভর্ৎসনা মাথা পেতে নিতে আমি প্রস্তুত। আপনার সাহায্য ছাড়া আর কোন উপায়ে শক্তি সামর্থ্য লাভ করা সম্ভব নয়।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এহেন শোচনীয় অবস্থা এবং এতক্ষণ যাবত তাঁর ওপর যে অত্যাচার চলছিল প্রত্যক্ষ করে উতবা ও শাইবা ভ্রাতৃদ্বয় তাঁর সাথে তাদের বংশীয় বন্ধনের কথা মনে করে বিচলিত হয়ে উঠলো। আদ্দাস নির্দেশ পালন করলো। সে আঙ্গুর ভর্তি পাত্রটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে নিয়ে রাখলো এবং তাঁকে বললো, ‘খান।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করলেন।
আদ্দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “একথা তো (অর্থাৎ বিসমিল্লাহ ) এ দেশের লোকদের বলতে শুনি না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আদ্দাস, তুমি কোন্ দেশের মানুষ? তোমার ধর্মই বা কি? ” সে বললো, “আমি একজন খৃষ্টান। আমি নিনুয়া বা নিনেভার অধিবাসী।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তিনি আমার ভাই। তিনি নবী ছিলেন, আমিও নবী।” এ কথা শোনামাত্রই আদ্দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঝুঁকে পড়লো এবং তাঁর মাথায়, হাতে ও পায়ে চুমু খেতে লাগলো।
এ দৃশ্য দেখে রাবীয়ার পুত্রদ্বয় পরস্পরকে বলতে লাগলো, “আরে! ছেলেটাকে তো নষ্ট করে দিল দেখছি।” আদ্দাস উতবা ও শাইবার কাছে ফিলে এল। তারা তাকে বললো, “কিহে আদ্দাস! তোমার কি হলো যে ঐ লোকটির মাথায় ও হাতে -পায়ে চুমু খেলে?” সে বললো, “হে আমার মনিব, পৃথিবীতে তাঁর চেয়ে ভালো লোক নেই। সে আমাকে এমন একটা বিষয় জানিয়েছে যা নবী ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না।” তারা বললো, “হে আদ্দাস, কি বাজে বক্ছো। তার প্ররোচনায় পড়ে তুমি নিজের ধর্ম পরিত্যাগ করো না কারণ তার ধর্মের চেয়ে তোমার ধর্ম উত্তম।”
নাসীবীনের জ্বিনদের ঘটনা
বনু সাকীফের কাছ থেকে হতাশ হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরে চললেন। পথে নাখলা [মক্কা থেকে দুই দিন দুই রাতের দূরত্বে অবস্থিত দুটো উপত্যকার নাম। একটার নাম নাখলাতুল ইয়ামানিয়া, অপরটির নাম নাখলাতুল শামিয়া।] উপত্যকায় পৌঁছে মধ্যরাতে তিনি নামায পড়ছিলেন। এই সময়ে নাসীবীনের সাতজন জ্বিন ঐ স্থান দিয়ে যাচ্ছিলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরআন তিলাওয়াত শুনলো। নামায শেষ হ’লে তারা নাসীবীনে [মুসেল থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে আববের একটি শহর বা জনপদ।]ফিরে গিয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের কাছে কুরআনের বানী পৌঁছিয়ে দিল- যার প্রতি তারা পথিমধ্যে শোনা মাত্রই ঈমান এনেছিলো। পবিত্র কুরআনের সূরা জ্বিন ও সূরা আহকাফে আল্লাহ এই জিনদের কাহিনী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বর্ণনা করেছেন। সূরা আহকাফের আয়াত কয়টি হলো, “সেই সময়ের কথা স্মরণ কর যখন আমি তোমার দিকে জ্বিনদের একটি দলকে পরিচালিত করলাম যেন তারা কুরআন শুনতে পারে। তারা সেখানে পৌঁছে পরস্পরকে বললো: ‘তোমরা চুপ করে শোনো’। তাদের কুরআন শোনা শেষ হলে তারা স্বজাতির কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে সাবধান করতে লাগলো। বললো, ‘হে আমাদের জাতি, আমরা এমন এক গ্রন্থের তিলাওয়াত শুনে এসেছি যা মূসার পরবর্তী সময়ে তাঁর কিতাবের ( তাওরাতের ) সত্যায়নকারী এবং সত্য ও নির্ভুল পথের দিশারী হয়ে নাযিল হয়েছে। হে আমাদের জাতি, আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি ঈমান আন তা হলে তিনি তোমাদের গুনাহ মাফ করবেন এবং তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রেহাই দেবেন।”
সূরা জ্বিনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, “হে নবী, তুমি বল যে, আমাকে ওহীর মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে একদল জ্বিন কুরআনের বাণী শুনেছে”…. এরূপ সমগ্র সূরাটিই জ্বিনদের সংক্রান্ত আলোচনায় পরিপূর্ণ।
ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে রাসূল্লাহ (সা) সব গোত্রের কাছে হাজির হলেন
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় উপস্থিত হলেন। দুর্বল শ্রেণীর মুষ্টিমেয় লোক-যারা তাঁর প্রতি আগেই ঈমান এনছিল তারা ছাড়া গোটা কুরাইশ সম্প্রদায়ই তাঁর নিকৃষ্টতম দুশমনে পরিণত হয়েছে। এমতবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের সময় মক্কায় আগত নানা গোত্রের লোকদের কাছে উপস্থিত হলেন। তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহব্বান জানালেন এবং বললেন, “আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত নবী। তোমরা আমাকে সমর্থন করো এবং যুলুম থেকে রক্ষা করো তা হলে আল্লাহ আমার কাছে যে বাণী পাঠিয়েছেন তা তোমাদের কাছে পেশ করবো এবং বিশ্লেষণ করবো।”
রাবিয়া ইবনে আব্বাদ বর্ণনা করেন:
আমি তখন সবেমাত্র যুবক। পিতার সাথে মিনায় গিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মক্কার বাইরে থেকে আগত বিভিন্ন আরব গোত্রের শিবিরসমূহে গিয়ে নিম্নরূপ ভাষণ দিচ্ছিলেন, “হে অমুক অমুকের বংশধর, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করো না। তোমাদেরকে এসব প্রতিমার পূজা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যাতে তোমরা আমাকে সমর্থন কর, আমার প্রতি ঈমান আন এবং আমাকে যুলুম থেকে রক্ষা কর আর আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিতে পারি।” এই সময় তাঁর পেছনে তাঁকে অনুসরণ করছিল একজন টেরাচোখা, মাথায় দুটো জটাধারী এবং আদন অঞ্চলের পোশাক পরিহিত একটি লোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই তাঁর দাওয়াতী বক্তৃতা শেষ করেন,অমনি সে বলে, “হে অমুক অমুকের বংশধর, এই ব্যক্তিটি (মুহাম্মাদ) তোমাদেরকে লাত ও উযযার পূজা ত্যাগ করতে বলছে এবং বনু মালিক ইবনে উকাইশের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক বর্জন করতে বলছে। [৩৫.উকাইশ অর্থ অপ্রাপ্ত উট যা যে কোন জিনিস দেখে ভয়ে পালায়। বনু মালিক ইবনে উকাইশ জ্বিনদের একটি গোত্রের নাম।] এক নতুন ও বিভ্রান্তিকর দাবী তুলে মানুষকে বিপথগামী করার চেষ্টা করছে। তার আহ্বান সে দিকেই। তোমরা তার কথায় কান দিও না এবং তার অনুসরণ করোনা।” আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছু ধাওয়া করে যে লোকটি তাঁর দাওয়াতকে খ-ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে, সে কে?” তিনি বললেন, “সে মুহাম্মাদের চাচা আবু লাহাব আবদুল উযযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব।”
ইবনে ইসহাক হলেন, ইবনে শিহাব যুহরী আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগতভাকে কিন্দা গোত্রের লোকদের প্রতিটি শিবিরে গিয়ে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিন্তু তাদের সরদার মুলাইহ সহ সকলে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।
তিনি বনু আমের ইবসে সা’সা’য়া গোত্রের লোকদের কাছেও যান, তাদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকেন এবং নিজেকে তাদের সামনে পেশ করেন। জবাবে বাইহারা ইবনে ফিরাস নামক এক ব্যক্তি বললো, “আমি যদি এই কুরাইশ যুবককে নিই তা হলে তার সাহায্যে গোটা আরব ভূমি দখল করতে পারবো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর নিম্নরূপ সংলাপ হয়,
বাইহারা: “আচ্ছা, যদি আমরা তোমার আনুগত্য করি ও তোমর কাজে সহায়তা করে অতঃপর আল্লাহ তোমাকে জয়যুক্ত করেন, তখন কি আমাদের হাতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেবে?”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম: “ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আল্লাহর ইখতিয়ারাধীন। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন।”
বাইহারা: “তাহলে শুধু তোমার খাতিরে সমগ্র আরব জাতির সামনে আমাদের বুক পেতে দেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? তুমি বিজয়ী হলে তো ক্ষমতা চলে যাবে অন্যদের হাতে তোমার এ কাজে আমাদের শরীক হওয়ার কোন দরকার নেই।”
এভাবে বনু আমের গোত্রও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলো। হজ্জ শেষে লোকদের মক্কা ত্যাগ করে নিজ নিজ এলাকার দিকে যাত্র করলো। বনু আমের গোত্রের লোকজনও নিজ গোত্রের কাছে ফিরে দিয়ে তাদের এক অতিশয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির কাছে উস্থিত হলো। বার্ধক্যের কারণে তিনি হজ্জে যেতে পারতেন না। প্রতি বছরই তারা হজ্জ থেকে ফিরে এসে ঐ বৃদ্ধের কাছে যেতো এবং সেখানকার ঘটনাবলী তাকে জানাতো। এ বছরও তারা ফিরে গেলে বৃদ্ধ তাদেরকে তাদের উৎসবের ঘটনাবলী জিজ্ঞেস করলো তারা বললো, “এবার কুরাইশদের এক যুবক আমাদের কাছে এসেছিলো। বনু আবদুল মুত্তালিব গোত্রের আরো একজন লোক তার পিছু পিছু এসেছিলো। সেই যুবকের দাবী হলো, সে নবী। সে আমাদের কে অনুরোধ জানিয়েছিলো যে, আমরা যেন তাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করি, তার সমর্থন করি এবং তাকে আমাদের এলাকায় নিয়ে আসি।” একথা শুনে বৃদ্ধ তার নিজের মাথার ওপর হাত দু’খানা রাখলেন এবং বললেন, “হে বনী আমের, তোমরা যা হারিয়ে এসছো, তা আবার ফিরে পাওয় যায় কিনা ভেবে দেখো। কারণ ইসমাঈলের বংশধর কখনো নবী হবার মিথ্যা দাবী করেনি। আল্লাহর শপথ, ঐ যুবক যা বলেছে তা সম্পূর্ণ সত্য। তোমরা কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে না?”
আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব কলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হানীফা গোত্রের লোকদের সাথেও তাদের আস্তানায় গিয়ে দেখা করেন, তাদের কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছান এবং তাঁকে সমর্থন দেয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তারা সবচেয়ে জঘন্যভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে কাজ চালিয়ে যেতে লাগরেন। হজ্জ কিংবা অন্য কোন উপলক্ষে মক্কায় কিছু লোক সমবেত হলেই তিনি তাদের কাছে যেতেন। এভাবে প্রত্যেক গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতেন। তাঁর কাছে আগত খোদায়ী রাহমাত ও হিদায়াত গ্রহণ করার জন্য তিনি অনুরোধ জানাতেন। যে কোন নামকরা ও গণ্যমান্য আরব মক্কায় এসেছে জানতে পারলেই তিনি তার কাছে যেতেন এবং আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিতেন।
বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের সুয়াইদ ইবনে ছামিত হজ্জ কিংবা উমরাহ উপলক্ষে মক্কা এসে সে খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে দেখা করলেন এবং তাকে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন ইসলামের দিকে দাওয়াত দিলেন সুহাইল বললো, “তুমি যে বাণী শোনাচ্ছ, তার অনুরূপ কিছু আমার কাছেও আছে।” রাসূলুল্লাহ বললেন,“ তোমার কাছে কি বাণী আছে? ” সে বললো, “লোকমানের বাণী সম্বলিত একখানি পুস্তিকা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এই বাণী খুব সুন্দর। তবে আমার কাছে যে বাণী, তা এর চেয়েও ভাল। তা হলো কুরআন, আল্লাহ আমার উপর নাযিল করেছেন,এটা হচ্ছে হিদায়াত এবং আলোর উৎস।”অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুয়াইদকে কুরআন পড়ে শোনালেন। তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সুয়াইদ এ দাওয়াত উপেক্ষা করলো না। সে বললো,“তুমি যে কুরআনের বাণী শোনালে, তা সত্যিই অপূর্ব। ” অতঃপর সুয়াইদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে বিদায় হয়ে মদীনায় নিজ গোত্রে ফিরে গেল। এর কিছুকাল পরেই খাজরাজ গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে। বনু ‘আমর গোত্রের লোকেরা বলতো, “আমাদের বিশ্বাস, সুয়াইদ মুসলমান হিসেবে মারা গেছে। ” মদীনার পার্শ্ববর্তী বুয়াস নামক স্থানে আওস ও খজরাজ গোত্রের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, তার আগেই সুয়াইদ নিহত হয়েছিল।
মদীনায় ইসলাম বিস্তারের সূচনা
অবশেষে সেই সময়টি এসে উপস্থিত হলো যখন আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়মাল্যে ভূষিত করা, তাঁর নবীকে অধিকতর মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা এবং তাঁকে দেয়া প্রতিশ্রুতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবারও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথরীতি হজ্জ উৎসবে আগত লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে ও তাঁকে আপন করে গ্রহণ করার জন্য আরব গোত্রগুলিকে অনুরোধ করতে লাগলেন। এবার তিনি কিছুসংখ্যক মদীনাবাসীর সাক্ষাত পেলেন। এরা ছিলেন মদীনার খাজরাজ গোত্রের একটি দল। আকাবার [ ৩৬. মক্কা থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত একটি জায়গার নাম। এটি মক্কা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি জায়গা। এখান থেকে পাথর নিক্ষেপ হজ্জের অন্যতম বিধি।] কাছাকাছি এক স্থানে তাদের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে। আল্লাহ এই দলটির কল্যান সাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই এই ঘটনা ঘটেছিলো। [৩৭. এ ঘটনা ঘটে নবুওয়াতের একাদশ বছরে।] তাদের সাথে দেখা হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কারা? ” তারা বললো,“আমরা খাজরাজ গোত্রের লোক।” তিনি পুনরায় বললেন, “যা ইহুদিদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ আপনারা কি তাদের অন্তর্ভুক্ত?” তাঁরা বললো, “হ্যাঁ।” তিনি বললেন, “আপনারা একটু বসবেন কি? আমি আপনাদের সাথে কিছু কথা বলতে চাই।” তারা বললো, বেশ,বলুন।” এরপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে বসলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে দাওয়াত দিলেন, তাদের সামনে ইসলাম পেশ করলেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করে শোনালেন।
আগে থেকেই মহান আল্লাহ তাদের ইসলাম গ্রহণের সহায়ক একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। মদীনায় তাদের আশেপাশে ইহুদীরা বাস করতো। তারা আসমানী কিতাকের অধিকারী ছিলো এবং সেই সুবাদে তাদের কাছে ঐশী জ্ঞান ছিল। খাজরাজ ও অন্যান্য আরব গোত্র ছিল মুশরিক তথা প্রতিমাপূজারী। ইতিপূর্বে এইসব পৌত্তলিক আরবকে আগ্রাসী যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে ইহুদীরা তাদের এলাকা দখল করে বসতি স্থপন করে পৌত্তলিক ও ইহুদেিদর মধ্যে যখনই কোন অপ্রীতিকর অবস্থার উদ্ভত হতো, তখনই ইহুদীরা পৌত্তলিকদেরকে এই বলো শাসাতো, “এ যুগের নবীর আগমনের সময় আসন্ন হয়ে উঠেছে। ঐ নবী এলে আমরা তাঁর সেতৃত্বে ‘আদ ও ইরাম জাতিকে যেভাবে পাইকারী হত্যা করা হয়েছিল, তোমদেরকে সেইভাবে কচুকাটা করবো।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খাজরাজ গোত্রের দলটির সাথে আলাপ-আলোচনা করলেন এবং তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিলেন তখন তারা এক অপরকে বলতে লাগলো, “আল্লাহর শপথ, ইনিই তো সেই নবী যার কথা বলে ইহুদরিা আমাদেরকে হুমকি দেয় ও শাসায়। এখন ইহুদীদেরকে কিছুতেই আমাদের আগে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দেয় উচিত হবে না।” এইরূপ চিন্তার বশবর্তী হয়ে তারা তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলো। তারা বললো, “আমরা আমাদের সম্প্রদায়কে এক ভয়ংকর শত্রুর শত্রুতার মুখে অসহায় অবস্থায় রেখে এসেছি। আমরা আশা করি আল্লাহ আমাদের গোটা সম্প্রদায়কেই আপনার সমর্থক করে দেবেন। আমরা তাদের কাছে ফিরে গিয়ে আপনার দাওয়াত তাদের কাছেও তুলে ধরবো। আল্লাহ যদি তাদেরকে আপনার সমর্থক বানিয়ে দেন তা হলে আপনার চেয়ে স্মমানিত ও পরাক্রান্ত আর কেউ থাকবে না।”
এভাবে তারা ঈমান আনা ও ইসলামকে সত্য বলে মেনে নেয়ার পর নিজ এলাকায় ফিরে গেলেন। যতদূর জানা যায়, খাজরাজ গোত্রীয় এই দলটির সদস্য ছিল ছয়জন। মদীনায় পৌঁছে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য গোত্রের কাছে পেশ করলেন এবং তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। এভাবে ক্রমে মদীনার প্রতিটি ঘরে ইসলমের দাওয়াত পৌঁছে গেল। এমন একটি বাড়ীও অবশিষ্ট রইলো না, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা আলোচিত হতো না।
আকাবার প্রথম বাইয়াত
পরবর্তী বছর আরো বারো জন হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় আসলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আকাবায় সাক্ষাত করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ইসলাম গ্রহণ পূর্বক অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিত্যাগ করার অঙ্গীকার করলেন। এই অঙ্গীকার গ্রহণ অনুষ্ঠানকে আকাবার প্রথম বাইয়াত বলা হয়। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো মুসলিম নারীদের বাইয়াত গ্রহণের পদ্ধতিতে যা মক্কা বিজয়ের পরের দিন পুরুষদের বাইয়াত গ্রহণের অব্যবহিত পর সাফা পর্বতের ওপর অনুষ্ঠিত হয়। আকাবার প্রথম বাইয়াত অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয় কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পচিালনার নির্দেশ আসার পূর্বে। এ বাইয়াতে অংশ গ্রহণকারেিদর মধ্যে ছিলেন আসআদ ইবনে যুরারা, রাফে ইবনে মালিক, ‘উবাদা ইবনুস্ ছামিত এবং আবুল হাইসাম ইবনে তাইহান।
‘উবাদা ইবনুস্ ছামিত বলেন, “আমি আকাবার প্রথম বাইয়াতে উপস্থিত ছিলাম। আমরা ছিলাম বারোজন পুরুষ। নারীদের বাইয়াতের পদ্ধতিতেই আমাদের বাইয়াত সম্পন্ন হয এবং তাছিল যুদ্ধের নির্দেশ আসার পূর্বেকার ঘটনা। আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবো না, চুরি-ডাকাতি করবো না, ব্যভিচার করবো না, সন্তান হত্যা করবো না, কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটাবো না এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্যতা করবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এসব অঙ্গীকার পূরণ করলে তোমাদের জন্য জান্নাতও রয়েছে। আর এর কোন একটি ভঙ্গ করলে তোমাদের পরিণতি আল্লাহর হাতে ন্যস্ত থাকবে। ইচ্ছে করলে তিনি শাস্তি দেবেন, ইচ্ছে করলে মাফ করে দেবেন।”
ইবনে ইসাহাক কলেন: মদীনার এই দলটি যখন নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে মুস’য়াব ইবনে উমাইরকে পাঠিয়ে দিলেন তাদেরকে কুরআন পড়ানো, ইসলাম শিক্ষা দেয়া ও ইসলামী বিধানের তত্ত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। তিনি মদীনার শিক্ষাগুরুরূপে অভিহিত হতেন। তিনি মদীনার মুসলমানদেরকে নামাযও পড়াতেন। কেননা এক গোত্রের লোক অন্য গোত্রের লোকের ইমামতি করুক এটা আওস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় পছন্দ করতো না।