যাতুর রিকা অভিযান (৪র্থ হিজরী)
বনু নাযীরের ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো রবিউল আউয়াল মাস ও জমাদিউল আউয়ালের একটা অংশ মদীনায় কাটালেন। এরপর নাজদে বনু মাহারিব গাতফানের উপগোত্র বনু সা’লাবার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেন।মদীনার শাসনভার অর্পণ করে গেলেন আবু যার গিফারীর ওপর। নাজদে গাতফান গোত্রের আবাসভূমি এলাকা নাখাল পৌঁছে তিনি শিবির স্থাপন করলেন। এটাই যাতুর রিকা [৬৬. রিকা অর্থ টুকরো কাপড় যা তালি দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই নামকরণের কারণ হলো এই অভিযানে তালি দেয়া পতাকা ব্যবহৃত হয়েছিলো। কেউ কেউ বলেন, ভূমি অত্যন্ত প্রস্তরময় হওয়ায় সৈন্যগণ পায়ে কাপড়ের টুকরো বেঁধে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে এই নাম হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, যাতুর রিকা একটি গাছের নাম বা ঘটনাস্থল ছিল।] অভিযান। এখানে তিনি গাতফান গোত্রের এক বিরাট সমাবেশের সম্মুখীন হলেন। উভয় পক্ষ পরস্পরের কাছাকাছি হলো। কিন্তু যুদ্ধ হলো না। তা সত্ত্বেও উভয় পক্ষ পরস্পর সম্পর্কে ভীত সন্ত্রস্ত্র থাকে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে প্রস্থান করেন।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন: আমি একটা দুর্বল উটে আরোহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নাখল থেকে রওনা হই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সদলবলে যাত্রা করলেন তখন অন্যান্য সহযাত্রী দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলো। আর আমি পেছনে পড়তে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এসে জিজ্ঞোসা করলেন, “হে জাবির, তোমার অবস্থা কি?” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পেছনে ফেলেছে।” তিনি বললেন, “উটটি থামাও।” আমি উটটিকে থামালাম, রাসূলুল্লাহও তাঁর উট থামালেন। এবার তিনি বললেন, “তোমার হাতের এই লাঠিটা আমাকে দাও অথাবা কোন একটা গাছ থেকে ডাল কেটে আমাকে লাঠি বানিয়ে দাও।” আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাঠি দিলাম। তিনি ঐ লাঠি দিয়ে আমার উটকে বেশ কয়েকবার গুতা দিলেন। তারপর আমাকে বললেন, “আরোহণ কর।” আমি আরোহণ করলাম। তখন আমার উটটি এত দ্রুতো চলতে লাগলো যে, রাসূলুল্লাহর উটকেও পেছনে ফেলে যেতে লাগলো।
কথা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “জাবির, তোমার উটটি কি আমার কাছে বিক্রি করবে?” আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, ওটা আপনাকে বিনামূল্যেই দেব।” তিনি বললেন, “না বিক্রি কর।” আমি বললাম, “কত দাম দেবেন?” তিনি বললেন, “এক দিরহাম।” আমি বললাম, “তাহলে ্আমার লোকসান হবে।” তিনি বললেন, “তা হরে দুই দিরহাম দেব?” আমি বললাম, ‘না।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রমাগত দাম বাড়াতে বাড়াতে এক উকিয়া (এক আউন্স) পর্যন্ত বললেন। তখন আমি বললা, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপান এই দামে খুশী তো?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’ আমি বললাম, “তাহলে আপনাকে ওটা দিলাম।” তিনি বললেন, “আমি নিলাম।” অতঃপর বললেন, “জাবির, তুমি বিয়ে করেছো?” আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “কুমারীকে না বিবাহিতাকে?” আমি বললাম, “বিবাহিতাকে।” তিনি বললেন, “একটা তরুণী বিয়ে কর না কেন? সে তোমার সাথে কৌতুক করতো। আর তুমিও তার সাথে কৌতুক করতে পারতে?” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা তাঁর সাতটি কন্যা রেখে উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এই জন্য আমি একজন বয়স্কা মহিলা বিয়ে করেছি, যে ওদের তত্ত্বাবধান ও লালন পালন করতে পারে।” তিনি বললেন, “আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি ঠিকই করেছো।” অতঃপর বললেন, “আমরা যদি সিরার পৌঁছে যাই তাহলে একটি উট জবাই করতে বলবো এবং তা জবাই করা হবে। অতঃপর তোমার স্ত্রীর মেহমানদারীতে একদিন সেখানে কাটাবো। তাকে ইসলামের কথা শোনাবো এবং সে আমাদেরকে বালিশ বিছানা দিয়ে যত্নআদর করবে।” ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের তো বালিশ নেই।” তিনি বললেন, “বালিশ অবশ্যই মিলবে। তুমি সেখানে পৌঁছার পর বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করবে।”
অতঃপর সিরারে [সিরার মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে একটি জায়গা।] পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উট জবাই করতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে তা জবাই করা হলো। আমরা ঐ উটের গোশত খেয়ে একদিন অতিবাহিত করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্ধ্যা বেলা বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। সেইসাথে আমরাও প্রবেশ করলাম। স্ত্রীকে সব ঘটনা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যা যা বলেছেন তা জানালাম। স্ত্রী তা শুনে বললো, “আমার সিদ্ধান্ত শুনে নাও, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথা শুনবো ও মানবো।”
সকাল বেলা আমি উটের মাথা ধরে টেনে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম এবং তাঁর থাকার ঘরের দরজার সামনে বেঁধে রাখলাম। অতঃপর আমি মসজিদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে গিয়ে বসলাম। মসজিদ থেকে বেরিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটটি দেখে বললেন, “এটা কি?” উপস্থিত জনতা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই উট জাবির নিয়ে এসেছে।” তিনি বললেন, “জাবির কোথায়?” সবাই আমাকে ডেকে তাঁর নিকট হাজির করলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভাহিজা, এ উট তুমি নিয়ে যাও। এটা তোমার উট।” অতঃপর বিলালকে ডেকে বললেন, “জাবিরকে নিয়ে যাও এবং এই উটের মূল্য বাবদ এক উকিয়া দাও।” আমি বিলালের সাথে গেলাম। আমাকে তিনি এক উকিয়ার কিছু বেশী দিলেন। আল্লাহর কসম, উটটি এভাবে বরাবরই আমার সমৃদ্ধি সাধন করে আসছিল এবং আমার বাড়ীতে তার গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করা হতো। নাজদের প্রস্তরপূর্ণ রণাঙ্গন থেকে বাড়ীতে তার গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করা হতো। নাজদের প্রস্তরপূর্ণ রণাঙ্গন থেকে ফিরবার পথে তার সাথে যে ঘটনা ঘটে, এটা সেই মর্যাদারই সর্বশেষ প্রতিফলন।
জাবির (রা) আরো বলেন, যাতুর রিকা অভিাযান শেষে নাখল থেকে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রওনা হলাম। এই সময় একজন মুসলমান জনৈক মুশরিকের স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে রণাঙ্গন থেকে প্রস্থান করলেন। তার স্বামী বাড়ীতে ফিরলো, ইতিপূর্বে সে অনুপস্থিত ছিলো। সে যখন তার স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহারের খবর শুনলো তখন কসম খেয়ে প্রতিজ্ঞা করলো যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহচরদের একজনকে অন্ততঃ হত্যা না করে সে ক্ষান্ত হবে না। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম পদচিহ্ন অনুসরন করে চলতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় পৌঁছে যাত্রাবিরতি করলেন। অতঃপর বললেন, “আজ সারারাত জেগে কে আমাদের পাহারা দিতে প্রস্তুত আছে?” একজন মুহাজির ও একজন আনসারী রাজী হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পাহাড়ের গুহার মুখে পাহারায় নিয়োগ কররেন। সাহাবীদ্বয় নিজেদের মধ্যে আপোষে রাতটি এভাবে ভাগ করে নিলেন যে, রাতের প্রথম ভাগ পাহারা দেবেন আনসারী এবং শেষের ভাগ মুহাজির। সেই অনুসারে মুহাজির প্রথম রাত ঘুমালেন আর আনসারী দাঁড়িয়ে নামায পড়া শুরু করলেন।
মুশরিক ঘাতক গভীর রাতে সোখানে এসে উপনীত হলো। নামায আদায়রত আনসারীকে দেখে সে বুঝতে পারলো যে, তিনি মুসলমানদের পাহারাদার। তৎক্ষনাৎ সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে তাঁর দেহ ভেদ করলো। অতঃপর সে ঐ তীর দেহ থেকে টেনে বের করে নিজের কাছে রেখে দিল। তা সত্ত্বেও তিনি অবিচলিত রইলেন এবং নামায অব্যহত রাখলেন। এরপর সে আরো একটা তীর নিক্ষেপ করলো এবং সেটিও তাঁর দেহ ভেদ করলো। অতঃপর ঘাতক তাও দেহ থেকে টেনে বের করলো এবং নিজের কাছে রেখে দিল। তা সত্ত্বেও তিনি নামাযে অবিচল রইলেন। অতঃপর সে তৃতীয় তীর নিক্ষেপ করলো। এই তীরও ওই সাহাবীর দেহ ভেদ করলো। ঘাতক তা টেনে বের করে নিজের কাছে রেখে দিল। এবার তিনি রুকু ও সিজদা করে নামায শেষ করলেন এবং তাঁর সঙ্গীকে জাগালেন। তাঁকে বললেন, “উঠে বস। ঘাতক আমাকে জখম করে অচল করে ফেলেছে।” সঙ্গে সঙ্গে মুহাজির লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘাতক উভয়কে দেখে বুঝলো যে, তাঁরা তার উপস্থিতি টের পেয়ে সাবধান হয়ে গেছে। তাই সে পালিয়ে গেল।
মুহাজির সাহাবী আনসারীর রক্তাক্ত দেহ দেখে বরলেন, “সুবাহানাল্লাহ! আপনি আমাকে প্রথম তীরের আঘাতেই জাগালেন না কেন?” আনসারী সাহাবী বললেন, “আমি নামাযে একটি সূরা পড়ছিলাম। সূরাটি শেষ না কের নামায ভঙ্গ করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু শত্রু অব্যাহতভাবে তীর নিক্ষেপ করতো থাকায় আমি রুকু সিজদা করে আপনাকে ডাকলাম। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবো এই আশংকা যদি না থাকতো তাহলে আমি খুন না হওয়া পর্যন্ত নামায় ভঙ্গ করতাম না।”
ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ যাতুর রিকা অভিযান শেষে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং রজবের শেষ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন।
দ্বিতীয় বদর অভিযান (৪র্থ হিজরী সন)
আবু সুফিয়ানের চ্যালেঞ্জের সময় ঘনিয়ে আসায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা’বান মাসে আবার বদর অভিযানে বেরুলেন[৬৭.উল্লেখ্য যে, এ সময় তিনি আনসারী সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সুুলুলকে মদীনার শাসনভার দিয়ে যান।]এবং সেখানে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। সেখানে তিনি আবু সুফিয়ানের অপেক্ষায় আটটি রজনী অতিবহিত করলেন। ওদিকে আবু সুফিয়ান মক্কাবাসীকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে মাজনা গিয়ে যাত্রাবিরতি করলো। সে যাহরান হয়ে এখানে উপনীত হয়। তারপর মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সে বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমাদের জন্য যুদ্ধ করা কেবল ভাল ফসল ফলার বছরেই শোভা পায়, যখন তোমরা তোমাদের গাছপালার তত্ত্বাবধান করতে পারবে এবং দুধ পান করতে পারবে। কিন্তু এটা তো অজন্মার বছর। আমি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরাও ফিরে চলো।” তার কথায় লোকেরা ফিরে গেল। মক্কাবাসী তাদেরকে ‘ছাতুখোর বাহিনী’ নামে অভিহিত করে। তারা বলতো, “তোমরা তো শুধু ছাতু খেতে লড়াইয়ে গিয়েছিলে।”
ওদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষায় বদরের প্রন্তরে বসে প্রহর গুনতে লাগলেন এই সময় মাখশা ইবনে আমর দামরী তাঁর কাছে এলো। ওয়াদ্দান অভিযানে এই ব্যক্তিই বনু দামরা গোত্রের পক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সন্ধি করেছিলো। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আপনি কুরাইশদের মুকাবিলা করতে এই জলাশয়ের পাশে এসেছেন?” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “সত্যিই তাই হে বুন দামরার ভাই! এ অবস্থা দেখেও তুমি যদি চাও তবে তোমাদের সাথে আমাদের যে সন্ধি রয়েছে তা প্রত্যাহার করে যুদ্ধ করতে আমরা প্রস্তুত। যুদ্ধের মাধ্যমেই আল্লাহ তোমাদের ও আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত করে দিন তা চাইলে তাতে আমাদের অমত নেই।” সে বললো, “না, হে মুহাম্মাদ, আল্লাহর শপথ, আমাদের তাতে কোন প্রয়োজন নেই।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। এই সময় মা’বাদ ইবনে আবু মা’বাদ আল খুযায়ী তাঁর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। সি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উপস্থিত দেখতে পেয়ে নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতে দ্রুত উট হাঁকিয়ে চলে গেল।
“(আমার উট) মুহাম্মাদের ও মদীনার কালো কিসমিস সদৃশ খেজুরের সান্নিধ্যের প্রতি বিতৃষ্ণ। সে ছুটে চলেছে তার বাপের পুরানো রসম রেওয়াজের প্রতি অনুগত হয়ে। কুদাইদের জলাশয়ে আজকে এবং দাজনাদের জলাশয়ে কালকে বিকালের মধ্যে তাকে পৌঁছে যেতেই হবে।[কুদাইদ মক্কার নিকটবর্তী একটি জায়গার নাম।]
আর সাহাবী আবদুল্লাহ রাওয়াহা আবু সুফিয়ানের অনুপস্থিতিকে লক্ষ্য করে নিন্মোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন,
“আবু সুফিয়ানের সাথে বদর প্রান্তরে মুখোমুখি হবার জন্য আমরা ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু তার ওয়াদার সত্যতা পেলাম না এবং সে ওয়াদা রক্ষাকারী নয়। কসম করে বলছি, তুমি যদি ওয়াদা রক্ষা করতে (হে আবু সুফিয়ান) ও আমাদের মুখোমুখি হতে তাহলে ধিকৃত ও তিরস্কৃত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হতে এবং মিত্রদেরকেও হাতছাড়া করে ফেলতে। এই বদর প্রান্তরেই আমরা উতবা ও তার ছেলের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফেলে গিয়েছি। আবু জাহলের লাশও এখানে রেখে গিয়েছি। তোমরা আল্লাহর রাসূলকে অমান্য করলে! তোমাদের ধর্মমত এবং তোমাদের কুৎসিত ও বিভ্রান্তিকর কর্মকা-কে ধিক! তোমরা আমাকে যতই ভর্ৎসনা করো, তবুও বলবো, রাসূলুল্লাহর জন্য আমার ধন-জন সবই কুরবানকৃত। আমরা তাঁর অনুগত। তাঁকে ছাড়া কাউকে কোন অঙ্গীকার দিই না। তিনি আমাদের জন্য অন্ধকার রাতের দিশারী ধ্রুব নক্ষত্র।”
দুমাতুল জান্দাল অভিযান (৫ম হিজরী: রবিউল আউয়াল)
বদরের দ্বিতীয় অভিযানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে যান এবং সেখানে একমাস অর্থাৎ যুলহাজ্জ মাসের শেষ পর্যন্ত অবস্থান করেন। মুশরিকরা এ বছর হজ্জ বর্জন করে। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনা আগমনের চতুর্থ বছর। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুমাতুল জান্দালে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে কোন সংঘর্ষ তো হয়ইনি, এমনকি তাঁকে সে স্থান পর্যন্ত যেতেও হয়নি। তিনি মদীনায় ফিরে এসে সেখানেই বছরের বাকী সময় কাটিয়ে দেন।
খন্দক যুদ্ধ (৫ম হিজরী, শাওয়াল)
পঞ্চম হিজরী সনের শাওয়াল মাসে খন্দক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের পটভূমি হলো, বন নাযীর ও বনু ওয়াইরের ইহুদীদের একটি সম্মিলিত প্রতিনিধি দল মক্কা গিয়ে কুরাইশদেরকে মদীনার ওপর হামলা চালিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আহ্বান জানায় এবং এ কাজে তাদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। এই দলের মধ্যে উল্লোখযোগ্য লোক ছিল বনু নাযীর গোত্রের সালাম ইবনে আবুল হুকাইক, হুয়াই ইবনে আখতাব, কিনানা ইবনে আবুল হুকাইক এবং ওয়াইল গোত্রের হাওয়া ইবনে কায়েস ও আবু আম্মার। তারা আরবের বহু সংখ্যক গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে প্ররোচিত করে। কুরাইশরা তাদেরকে বললো, “ইহুদীগণ, তোমরা প্রথম কিতাবের অধিকারী। আমাদের সাথে মুহাম্মাদের যে বিষয় নিয়ে মতভেদ, তা তোমরা ভাল করেই জান্ োতোমরাই বলো আমাদের ধর্ম ভাল না মুহাম্মাদের ধর্ম ভাল?” তারা বললো, “তোমাদের ধর্ম মুহাম্মাদের ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তোমরা সত্যের নিশানাবাহী!”
তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার এই আয়াতগুলো নাযিল করেন,
“তুমি কি সেই কিতাবধারীকে দেখোনি যারা মূর্তি ও খোদাদ্রোহী শক্তিকে মানে এবং কাফিরদেরকে মু’মিনদের চেয়ে বেশী সুপথপ্রাপ্ত অভিহিত করে। তারাই আল্লাহর অভিশাপগ্রস্ত। আর যারা আল্লাহর অভিশপ্ত তাদের কোন সাহায্যকারী কখনো মিলবে না। তাদের কি আল্লাহর রাজত্বে কোন অংশ আছে যে তারা মানুষকে তা থেকে কণামাত্রও দেবে না। নাকি তারা মানুষকে আল্লাহ যে অনুগ্রহ প্রদান করেছেন অর্থাৎ নবুওয়াত তার ব্যাপারে হিংসা করে? আমি ইবরাহীমের বংশধরকে তো কিতাব ও তত্ত্বজ্ঞান দান করেছি এবং তাদেরকে বিরাট রাজত্ব দিয়েছি। তাদের কেউ কেউ তার ওপর ঈমান এনেছে আবার কেউ কেউ তা গ্রহণ করতে মনুষকে বাধা দিয়েছে। তাদের জ্বালানোর জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট।”
ইহুদীরা যখন কুরাইশদের সম্পর্ক এরূপ কথা বললো তখন তাদের আনন্দ যেন আর ধরে না। অধিকন্তু তারা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হামলা চালানোর আমন্ত্রণ জানালো তখন তারা তাতে একমত হলো এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো। পরে ঐসব ইহুদী গাতফান গোত্রের কাছে গেল এবং তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানালো। তাদের সাথে নিজেদের অংশ নেয়ার আশ্বাস তারা দিল। তাদেরকে জানালো যে, কুরাইশরাও তাদের সাথে একমত হয়ে আক্রমণ চালাতে প্রস্তুত হয়েছে।
যথাসময়ে কুরাইশ বাহিনী ও তাদের দলপতি আবু সুফিয়ান যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়লো। গাতফানও বেরুলো বনু ফাজারা ও তার দলপতি উয়াইনা ইবনে হিসনকে সাথে নিয়ে। আর বুন মুররাকে সাথে নিয়ে হারেস ইবনে আওফ ইবনে আবু হারেসা ও আসজা গোত্রসে সাথে নিয়ে তার দলপতি মিসআর ইবনে রুযাইরা রওনা হলো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই যুদ্ধপ্রস্তুতির কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ মদীনার চারপাশে খন্দক বা পরিখা খনন করালেন। মুসলমানরা যাতে সওয়াবের আশায় এই কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয় সে জন্য তিনি নিজ হাতে পরিখা খননের কাজ করেন। তাঁর সাথে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে খননের কাঝে যোগ দেয়। তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ অবিশ্রান্তভাবে এই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কেবল কিছুসংখ্যক মুনাফিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের থেকে দূরে থাকে। তারা নানা রকমের ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কাজে ফাঁকি দিতে ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অজ্ঞাতসারে ও বিনা অনুমতিতে চুপিসারে বাড়ী চলে যেতে থাকে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের মধ্যে কারো যদি মারাত্মক অসুবিধাও দেখা দিত এবং অনিবার্য প্রয়োজনে নিজ পরিবার পরিজনের কাছে যাওয়ার দরকার পড়তো তা হলেও সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যথারীতি জানিয়ে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যেতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিতে কুণ্ঠিত হতেন না। প্রয়োজন পূরণের সাথে সাথেই তারা এসে অবশিষ্ট কাজে শরীক হতো। এভাবে তারা পুণ্যকর্মে আগ্রহ ও আন্তরিকতার প্রমাণ দিতো। আল্লাহ তায়ারা এসব মু’মিনের প্রসঙ্গে সূরা নুরের এ আয়াত ক’টি নাযিল করেন:
“মু’মিন তারাই Ñ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে রত থাকলেও তাঁর অনুমতি না নিয়ে কোথাও যায় না। যারা তোমার কাছে অনুমতি চায় তারাই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করে। হে নবী, তারা (মু’মিনরা) তোমার কাছে তাদের কোন ব্যাপারে অনুমতি চাইলে তুমি তাদেরকে ইচ্ছা হলে অনুমতি দিও এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল।”
মুসলমানদের মধ্যে যারা নিষ্ঠাবান, সৎকর্মের প্রতি আগ্রহী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অনুগত, তাদেরকে লক্ষ্য করেই এই আয়াত কয়টি নাযিল হয়।
যেসব মুনাফিক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অনুমতি না নিয়েই চুপে চুপে চলে যেতো তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ আরো বলেনÑ
“তোমাদের প্রতি রাসূলের আহ্বানকে তোমাদের পরস্পরকে আহ্বান করার মত মনে করো না। আল্লাহ তোমাদের এইসব লোককে ভালভাবেই জানেন যারা আড়ালে আবডালে চুপে চুপে সরে পড়ে। রাসূলের হুকুম অমান্যকারীদের এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত যে, তাদের ওপর যে কোন মুহূর্তে মুসিবত কিংবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আপতিত হতে পারে। মনে রেখো, আসমান ও যমীনের সবকিছুই আল্লাহর। তোমরা কে সত্যের অনুসারী আর কে মিথ্যার অনুসারী তা তিনি ভালভাবেই অবহিত। আর যেদিন তাঁর কাছে তারা ফিরে যাবে সেদিন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্ক জানিয়ে দেবেন। বস্তুত: আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ।” (সূরা নূর আয়াত-৬৪)
এই আয়াত ক’টিতে রাসূলের অনুমতি না নিয়ে তাঁর নির্দেশিক কাজ থেকে গোপনে সরে পড়া মুনাফিকদের বিবরণ দেয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিখা খনন সম্পন্ন করতেই কুরাইশরা কিনানা গোত্র, তিহামার অধিবাসী ও তাদের বিভিন্ন গোত্রের লোকজন মিলিয়ে সর্বমোট দশহাজার যোদ্ধা নিয়ে এসে পৌঁছলো। তারা রুমা নামক স্থানে জুরুফ ও জুগাবার মধ্যবর্তী মুজতামাউল আসইয়ালে শিবির স্থাপন করলো। গাতফান গোত্রের লোকেরাও তাদের নাজদবাসী মিত্রদের নিয়ে হাজির হলো। তারা উহুদের পার্শ্ববর্তী ‘জাম্ব নাকমা’ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করলো। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন হাজার মুসলিম সৈন্য নিয়ে ‘সালা’ নামক পাহাড়কে পেছনে রেখে মুসলিম বাহিনীকে মোতায়েন করলেন। তাঁর ও শত্রুদের মাঝে থাকলো পরিখা। শিশু ও নারীদেরকে তিনি আগে ভাগেই দুর্গের মধ্যে রেখে আসার ব্যবস্থা করেন।
আল্লাহর দুশমন বনু নাযীর গোত্রের হুয়াই ইবনে আখতাব বনু কুরাইযার কা’ব ইবনে আসাদের কাছে গেল। বনু কুরাইযার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপোষ ও অনাগ্রাসন চুক্তির সংগঠক ছিল এই কা’ব ইবনে আসাদ। সে বনু কুরাইযার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরেক শান্তির অঙ্গীকার দেয় ও চুক্তি সম্পাদন করে। কা’ব ভেতরে বসেই হুয়াইয়ের আগমন টের পেয়ে তার মুখের ওপর দুর্গের দরজা বন্ধ করে দেয়। হুয়াই দরজা খুলতে বললে সে দরজা খুলতে অস্বীকার করে। হুয়াই পুনরায় দরজা খুলতে অনুরোধ কররে কা’ব বললো, “ধিক তোমাকে হুয়াই, তুমি একটা অলক্ষুণে লোক। আমি মুহাম্মাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ এবং সে চুক্তি আমি ভঙ্গ করবো না। আমি মুহাম্মাদের আচরণে প্রতিশ্রুতির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার পরিচয়ই পেয়েছি।”
হুয়াই বললো, “কি হলো! দরজাটা একটু খোল না। আমি তোমার সাথে কিছু আলাপ করবো।” কা’ব বললো, “আমি দরজা খুলতে পারবো না।” হুয়াই বললো, “তোমার খাদ্য গ্রহণ করবো মনে করেই তুমি দরজা বন্ধ করেছো।” এ কথায় কা’ব অপ্রস্তুত হয়ে গেল এবং দরজা খুলে দিল। অতঃপর সে বললো, “আমি তোমার জন্য এ যুগের শ্রেষ্ঠ গৌরব এবং উত্তাল তরঙ্গময় সমুদ্র এনে হাজির করেছি। নেতা ও সরদারসহ সমস্ত কুরাইশ বাহিনীকে আমি জড়ো করেছি এবং তাদেরকে রুমা অঞ্চলের মুজতামাউর আসইয়ালে এনে হাজির করেছি। অপরদিকে গোটা গাতফান গোত্রকেও তাদের নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ উহুদের পার্শ্ববর্তী ‘জাম্ব নাকমা’য় এনে দাঁড় করিয়েছি। তারা সবাই আমার সাথে এ মর্মে অঙ্গীকার ও চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদেরকে নিশ্চিহ্ন না করে ক্ষান্ত হবে না।” কা’ব বললো, “তুমি বরং আমার মুখে চুনকালি মাখানোর আয়োজনই করেছো। তুমি এমন মেঘমালা সমবেত করছো যা বৃষ্টি বর্ষণ করে পানিশূন্য হয়েছে। এখন তার শুধু তর্জন গর্জন সার। তার দেয়ার মত কিছুই নেই। অতএব, হে হুয়াই, ধিক্ তোমাকে! আমাকে উত্যক্ত করো না। যেমন আছি থাকতে দাও। মুহাম্মাদ আমার সাথে কোন খারাপ আচরণ করেনি। সে শুধু সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও প্রতিশ্রুতিপরায়ণতারই পরিচয় দিয়েছে।” তথাপি হুয়াই নাছোড়বান্দা হয়ে কা’বের সাথে লেগে রইলো। সে তার ঘারের ওপর হাত রেখে নাড়তে থাকলো এবং অবশেষে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে রাজি করাতে সক্ষম হলো। সে তার নিকট থেকে অঙ্গীকার আদায় করতে সক্ষম হলো। সে বললো যে, কুরাইশ ও গাতফান যদি মুহাম্মাদকে হত্যা না করেই ফিরে যায় তাহলে সে কা’বের সাথে তার দুর্গে অবস্থান করবে এবং উভয়ে পরস্পরের সুখ দুঃখের সম অংসীদার হবে। এভাবে কা’ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তি ভঙ্গ করলো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি আওস গোত্রের তৎকালীন নেতা সা’দ ইবনে মুয়ায ইবনে নু’মান (রা), খাযরাজের নেতা সা’দ ইবনে উবাদা ইবনে দুলাইম (রা), আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা) ও খাওয়াত ইবনে যুবাইরকে (রা) পাঠালেন। তাদেরকে বলে দিলেন, “তোমরা গিয়ে দেখো, যে খবরটা পেয়েছি তা সত্য কিনা। যদি সত্য হয় তাহলে ফিরে এসে সংকেতমূলক ধ্বনি দিয়ে আমাকে জানাবে। প্রকাশ্যে বরে সাধারণ মুসলমানদের মনোবল ভেঙে দিওনা। আর যদি তারা চুক্তির অনুগত থাকে তাহরে ফিরে এসে সে কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করবে।”
তারা গিয়ে দেখলেন কা’ব ও হুয়াই এবং তাদের সাঙ্গ পাঙ্গরা যে রকম জানা গিয়েছিলো তার চেয়েও জঘন্য মনোভাব পোষণ করছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে। তারা বললো, “রাসূলুল্লাহ আবার কে? মুহাম্মাদের সাথে কোন চুক্তি বা অঙ্গীকার নেই।” একথা শুনে সা’দ ইবনে মুয়ায (রা) তাদের তিরষ্কার করলেন।
জবাবে তারাও তাকে পাল্টা তিরস্কার করলো। বস্তুত: সা’দ ইবনে মু’য়ায একটু চড়া মেজাজের লোক ছিলেন। সা’দ ইবনে উবাদা তাকে বললেন, “তিরস্কার বাদ দিন। আমাদের ও তাদের মধ্যে যে চুক্তি রয়েছে, তা তিরস্করের চেয়ে অনেক বেশী।” এরপর উভয় নেতা ও তাদের সঙ্গীদ্বয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে এসে তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, “আজাল ও কারা।” অর্থাৎ আজাল ও কারার লোকেরা সাহাবী খুবাইব ও তাঁর সঙ্গীদের (রা) প্রতি রাজী’তে যেরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, এরাও সেই পথ ধরেছে। তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবার। হে মুসলমানগণ! তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো।”
এই সময় মুসলমানদের ওপর আপতিত দুর্যোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। তাদের মধ্যে ভীতি প্রবল হয়ে উঠলো। চারদিক থেকে চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকলো। মুসলিম দলভুক্ত মুনাফিকদের মুনাফেকীও প্রকাশ পেতে আরম্ভ করলো। মুআত্তিব ইবনে কুশাইর তো বলেই ফেললো, “মুহাম্মাদ আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে, আমরা পারর্স ও রোম সা¤্রাজ্যের যাবতীয় ধন-দৌলতের মালিক হয়ে যাবো। অথচ আজ অবস্থা এই যে, আমরা নিরাপদে পায়খানায় যেতেও পারছিনা।” আওস ইবনে কায়যী বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের বাড়ী-ঘর তথা পরিবার পরিজন অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। (অর্খাৎ তাদেরই গোত্রের কিছুসংখ্যক লোকের পক্ষ থেকে হুমকি এসছে।) অতএব আমাদেরকে বাড়ীতে ফিরে যেতে দিন। কেননা আমাদের বাড়ী-ঘর মদীনার বাইরে অবস্থিত।” এরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুশরিকরা বিশ দিনের বেশী এবং একমাসের কম সময় পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান করলেন। দুইপক্ষের মধ্যে তীর নিক্ষেপ ও অবরোধ ছাড়া আর কোন রকম যুদ্ধ হয়নি।
মুসলমানদের (অবরোধ দীর্ঘায়িত হওয়ার দরুন) দুঃখ-কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গাতফান গোত্রের দুইজন নেতা উয়াইনা ইবনে হিসন ও হারেস ইবনে আওফের কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠালেন যে, তারা যদি তাদের লোকজন নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের (রা) বিরওদ্ধে এই অবরোধ ত্যাগ করে চলে যায় তাহলে তিনি তাদেরকে মদীনার পুরা উৎপন্ন ফসলের এক তৃতীয়াংশ দেবেন। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও গাতফানীদের মধ্যে সন্ধি হলো এবং সন্ধির দলিল লেখা হলো। কেবল স্বাক্ষর দান ও সিদ্ধান্ত চূড়ান্তকরণের কাজটা বাকী রইলো। তবে লেনদেনের ব্যাপারে উভয় পক্ষের দরকাষাকষি ও সম্মতি দানের কাজটা চূড়ান্ত করা হলো। অবশিষ্ট কাজটুকু করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ ইবনে মু’য়ায ও সা’দ ইবনে উবাদাকে (রা) ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি তাদেরকে বিষয়টা অবহিত করলেন এবং পরামর্শ চাইলেন। উভয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এটা কি আমাদের কল্যাণার্থে আপনার প্রস্তাব, না আল্লাহ আপনাকে এজন্য নির্দেশ দিয়েছেন যা আমাদের করতেই হবে?” তিনি বললেন, “এটা আমার নিজের উদ্যোগ। কারণ আমি দেখছি গোটা আরব ঐক্যবদ্ধ হয়ে তোমাদের ওপর সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে এবং সবদিক দিয়ে তোমাদের ওপর দুর্লংঘ্য অবরোধ আরোপ করেছে। তাই যতটা পারা যায় আমি তাদের শক্তি চূর্ণ করতে চাচ্ছি।
সা’দ ইবনে মুয়ায বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইতিপূর্বে আমরা এবং এসব লোক শিরক ও মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিলাম। তখন আমরা আল্লাহকে চিনতাম না এবং আল্লাহর ইবাদাতও করতাম না। সে সময় তারা মেহমানদারীর অথবা বিক্রয়ের সূত্রে ছাড়া আমাদের একটা খোরমাও খেতে পারেনি। আর আজ আল্লাহ যখন আমাদেরকে ইসলামের গৌরব ও সম্মানে ভূষিত করেছেন, সত্যের পথে চালিত করেছেন, তখন তাদেরকে আমাদের ধন-সম্পদ দিতে হবে? আল্লাহর কসম, আমাদের এ সবের কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর কসম, তরবারীর আঘাত ছাড়া তাদেরকে আমরা আর কিছুই দেবো না। এভাবেই আল্লাহ তাদের ও আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, তাহলে এ ব্যাপারে তোমার মতই মেনে নিলাম।” এরপর সা’দ ইবনে মুয়ায চুক্তিপত্র খানা হাতে নিয়ে সমস্ত লেখা মুছে ফেললেন। এরপর তিনি বললেন, “ওরা যা পারে করুক।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ শত্রুর অবরোধের ভেতরে অবস্থান করতে লাগলেন। কোন যুদ্ধই হলো না। অবশ্য আমর ইবনে উদ, ইকরিমা ইবনে আবু জাহল, হুবাইরা ইবনে আবু ওয়াহাব ও দিরার ইবনে খাত্তাব প্রমুখ কতিপয় কুরাইশ অশ্বরোহী যুদ্ধ শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছিলো। তারা ঘোড়ায় চড়ে বুন কিনানার কাছে এসে বললো, “হে বনু কিনানা, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আজ দেখবে যুদ্ধে কারা বেশী পারদর্শী।” অতঃপর তারা দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে গেল এবং পরিখার কিনারে থামলো। পরিখা দেখে তারা হতবাক হয়ে বললো, “আল্লাহর কসম, এটা এমন একটা যুদ্ধ কৌশল আরবরা কখনো উদ্ভবন করতে পারেনি।”[৬৮. ইবনে হিশাম বলেন, কথিত আছে যে, সালমান ফারসী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।]
অতঃপর পরিখার সবচেয়ে কম প্রশস্ত জায়গা দেখে তারা পরিখা পার হলো। ঘোড়ায় চড়ে তারা সালা পর্বত ও পরিখার মধ্যবর্তী মুসলমানদের অবস্থানে যেয়ে হাজির হয়। আলী (রা) কতিপয় মুসলমানকে সাথে নিয়ে মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং যে উন্মুক্ত স্থানটি দিয়ে কাফিররা ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছিল সেখানেই তাদের গতিরোধ করে দাঁড়ান। অশ্বারোহীরা তাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে।
‘আমর ইবনে আব্দ উদ বদর যুদ্ধে আহত হয়ে এতটা অচল হয়ে গিয়েছিল যে, উহুদ যুদ্ধে হাজির হতে পারেনি। সে নিজের মর্যাদা জাহির করার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ প্রতীক দ্বারা নিজেকে চিহ্নিত করে এসেছিল। সে এসেই হুংকার দিল, “কে লড়াই করবে আমার সাথে?” আলী (রা) তার সামনে এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, “হে আমর, তুমি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছিলে যে, কুরাইশদের কোন লোক তোমাকে যে কোন দুইটি কাজের একটির দিকে দাওয়াত দেবে, তুমি তা গ্রহণ করবে। সত্য কিনা?” সে বললো, ‘হ্যাঁ!’ আলী (রা) বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ইসলামের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি।”
সে বললো, ‘এতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।’ আলী বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ইসলামের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি।”
সে বললো, ‘এতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।’ আলী বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে যুদ্ধের দাওয়াত দিচ্ছি।” সে বললো, “তা ভাতিজা, আমি তো তোমাকে হত্যা করতে চাই না।” আলী (রা) বললেন, “কিন্তু আমি তো তোমাকে হত্যা করতে চাই।” একথা শুনে আমর উত্তেজিত হলো। সে ঘোড়ার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রথমে ঘোড়াকে হত্যা করলো এবং তার মুখে আঘাত করলো। অতঃপর আলীর (রা) দিকে এগিয়ে এলো। উভয়ের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ হলো। অবশেষে আলী (রা) তাকে হত্যা করলেন।
এরপর তার ঘোড়সওয়ার দলটি পরাজিত হয়ে পরিখা পেরিয়ে পালিয়ে গেল। আমর নিহত হওয়ায় হতাশ হয়ে আবু জাহল তনয় ইকরিমা বর্শা ফেলে পালালো। তা দেখে মুসলিম কবি হাস্সান ইবনে সাবিত বললেন:
“সে পালিয়ে গেল এবং আমাদের জন্য তার বর্শা ফেলে রেখে গেল।
হে ইকরিমা, তুমি এমন ভান করেছো যেন (যুদ্ধ) করোনি।
তুমি নর উটপাখির মত উর্ধশ্বাসে পালিয়েছো।
ভাবখানা এই যে তুমি যেন রাস্তা থেকেই আলাদা হয়েছো
তুমি আপোষের মনোভাব নিয়ে একটুও পেছনে ফেরনি।
(তোমার পালানো দেখে) তোমার পিঠ বলে মনে হচ্ছিলো।”
খন্দক ও বনু কুরাইযার যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের সংকেতধ্বনি ছিল “হুম, লা-ইউনছারুন।” অর্থাৎ শত্রুপক্ষের পরাজয় অবধারিত। শত্রুদের শক্তি ও পরাক্রম এবং অতিমাত্রায় সংখ্যাধিক্যের চাপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণকে প্রচ- ভয় ও ত্রাসের মধ্যে রণাঙ্গনে টিকে থাকতে হয়েছিলো।
অবশেষে নাঈম ইবনে মাস’উদ এসে বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমার গোত্র এ কথা জানে না। এখন আপনি আমাকে প্রয়োজনীয় যে কোন নির্দেশ দিন।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাদের মধ্যে তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে শত্রুপক্ষের বিশ্বাসভাজন। তুমি যদি পার, আমাদের পক্ষ হয়ে শত্রুদের পর্যুদস্ত করো। য্দ্ধু তো কৌশলেরই নামান্তর।”
নাঈম ইবনে মাস’উদ বনু কুরাইযা গোত্রের কাছে গেলেন। জাহিলী যুগে তিনি তাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। তিনি তদেরকে বললেন, “হে বুন করাইযা, আমি তোমাদের কত ভালবাসি তা নিশ্চয়ই তোমাদের জানা আছে। বিশেষ করে তোমাদের সাথে আমার যে নিখাদ সম্পর্ক রয়েছে, তা তোমাদের অজানা নয়।” তারা বললো, “হ্যাঁ, এ সত্য। তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ ছিল না।” তখন তিনি বললেন, “কুরাইশ ও গাতফানের অবস্থা তোমাদের থেকে স্বতন্ত্র। এ শহর তোমাদেরই শহর। এখানে তোমাদের স্ত্রী, সন্তান ও ধন-সম্পদ রয়েছে। এগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয়া তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কুরাইশ ও গাতফান মুহাম্মাদ ও তাঁর সাহাবীদের সাথে লড়তে এসেছে। তোমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতা করছো। অথচ তাদের আবাসভূমি, ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন অন্যত্র রয়েছে। সুতরাং তারা তোমাদের মত অবস্থায় নেই। তারা যদি এখানে স্বার্থ দেখতে পায় তাহলে তারা তা নেবেই। আর যদি না পায় তবে নিজেদের আবাসভূমিতে চলে যাবে। তখন তোমরা এই শহরে একাকী মুহাম্মাদের সম্মুখীন হবে। সে অবস্থায় তার বিরুদ্ধে তোমরা টিকতে পারবে না। অতএব মুসলমানদের সাথে লড়াই করতে হলে আগে কুরাইশদের মধ্য হতে কতিপয় নেতাকে জিম্মি হিসেবে হাতে নাও। তারা তোমাদের হাতে জামানত হিসেবে থাকবে। তখন তোমরা নিশ্চিন্ত হতে পারবে। তাদেরকে সাথে নিয়ে তোমরা মুহাম্মাদের সাথে লড়াই করা তোমাদের ঠিক হবে না।” তারা বললো, “তুমি ঠিক পরামর্শ দিয়েছো।”
এপর তিনি কুরাইশদের কাছে গিয়ে আবু সুফিয়ান ও তার সহযোগী কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে বললেন, “তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, আমি তোমাদের পরম হিতাকাক্সক্ষী এবং মুহাম্মাদের ঘোর বিরোধী। আমি একটা খবর শুনেছি। সেটা তোমাদেরকে জানানো আমার কর্তব্য ও তোমাদের হিত কামনার দাবী। কথাটা তোমারা কারো কাছে প্রকাশ করো না।”
নাইম বললেন, “তাহলে শোন। ইহুদীরা মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীদের সাথে তাদের সম্পাদিত চুক্তি লংঘন করে অনুতপ্ত হয়েছে। তারা মুহাম্মাদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে যে, আমরা যা করেছি তার জন্য অনুতপ্ত। এখন আমরা যদি কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের নেতৃস্থানীয় কিছু লোককে পাকড়াও করে তোমার কাছে হস্তান্তর করি আর তুমি তাদের হত্যা করো তাহলে কি তুমি আমাদের প্রতি খুশী হবে? এরপর আমরা তোমার সাথে মিলিত হয়ে কুরাইশ ও গাতফানের অবশিষ্ট সবাইকে খতম করবো।’ একথায় মুহাম্মাদ রাজী হয়েছে।” নাঈম আবু সুফিয়ানকে আরো বললেন, “ইহুদীরা যদি তোমাদের কতিপয় লোককে জিম্মী রাখতে চায় তা হলে খবরদার একটি লোকও তাদের হাতে সমর্পণ করো না।”
এরপর নাঈম গাতফানীদের কাছে গিয়ে বললেন, “হে বনু গাতফান, তোমরাই আমার স্বগোত্র ও আপনজন। তোমরা আমার কাছে সবার চাইতে প্রিয়। মনে হয়, আমার বিরুদ্ধে তোমাদের কোন অভিযোগ নেই।” তারা বললো, “তুমি সত্য বলেছো। তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নেই।” নাঈম বললেন, “তাহলে আমি যে খবর দিচ্ছি তা কাউকে জানতে দিওনা।” তারা বললো, “ঠিক আছে। তোমার কথার গোপনীয়তা রক্ষা করা হচে।” নাঈম তখন তাদেরকে অবিকল কুরাইশদের কাছে যা বলেছেন তারই পুনরাবৃত্তি করলেন এবং জিম্মীর প্রশ্নে কুরাইশদের কাছে য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন গাতফানীদের কাছেও তাই উচ্চারণ করলেন।
পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাসের শনিবারের পূর্বরাত্রের ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রাসূলের সপক্ষে গোটা পরিস্থিতির মোড় পরিবর্তন করে দিলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও গাতফান গোত্রের নেতৃবৃন্দ ইকরিমা ইবনে আবু জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশ ও গাতফানীদের একটি দল পাঠালো বনু কুরাইযার কাছে। তারা গিয়ে বনু কুরাইযাকে বললো, “আমরা আর তিষ্ঠাতে পারছি না। আমাদের উট-ঘোড়া সব মারা যাচ্ছে। সুতরাং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আমরা মুহাম্মাদের সাথে যুদ্ধ করে চূড়ান্ত একটা ফায়সালা করে নিতে চাই।” তারা বললো, “আজ শনিবার। এই দিন আমরা কিছুই করি না। ইতিপূর্বে আমাদের কিছু লোক শনিবারে একটা ঘটনা ঘটিয়েছিলো। তার ফলে যে পরিণতি হয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নয়। তাছাড়া আমরা তোমাদের সহযোগিতা করার জন্য মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবো না। তবে তোমরা যদি তোমাদের কিছু লোককে আমাদের হাতে নিরাপত্তার রক্ষাকবচ হিসেবে জিম্মী রাখো তাহলে তোমাদের সহযোগিতা করতে যুদ্ধে অংশ নিতে পারি। আমাদের আশংকা হয় যে, যুদ্ধে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা যুদ্ধ অব্যাহত রাখা কঠিন মনে করলে তোমরা আমাদের নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে মুহাম্মাদের মুঠোর মধ্যে অসহায়ভাবে রেখে নিজ দেশে ফিরে যাবে। অথচ মুহাম্মাদের মুকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই।”
বনু কুরাইযার এই জবাব নিয়ে প্রতিনিধিদল যখন ফিরলো তখন কুরাইশ ও গাতফানীরা পরস্পরকে বললো, “নাঈম ইবনে মাসউদ আমাদেরকে যে খবর দিয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। অতএব বনু কুরাইযাকে জানিয়ে দেয়া হোক যে, আমরা তোমাদের কাছে একজন লোকও জিম্মী হিসেবে সমর্পণ করতে রাজী নই। যুদ্ধ করার ইচ্ছা থাকেতো এসে যুদ্ধ করো।” কুরাইশ ও গাতফানীদের এ জবাব নিয়ে পুনরায় বনু কুরাইযার কাছে দূত গেলে বনু কুরাইযার নেতারা পরস্পরকে বললো, “দেখরে তো নাঈম যা বলেছে তা সম্পূর্ণ সত্য। কুরাইশ ও গাতফানীরা শুধু যুদ্ধই চায়। আমাদের ভালোমন্দ নিয়ে তাদের কোন মাতাব্যাথা নেই। তারা যদি লাভবান হয় তাহলে তো তাদেরই স্বার্থ উদ্ধার হলো। অন্যথায় তারা আমাদেরকে মুহম্মাদের হাতে অসহায়ভাবে রেখে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবে।”
কাজেই তার কুরাইশ ও গাতফানীদের জানিয়ে দিল যে, “যতক্ষণ না তোমরা আমাদের হাতে জিম্মী না দেবে ততক্ষণ আমরা তোমাদের সহযোগী হয়ে মুহাম্মাদের সাথে যুদ্ধ করবো না।” এভাবে তারা গাতফান ও কুরাইশদের প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করলো এবং শত্রুদের ভেতরে আল্লাহ কোন্দল সৃষ্টি করে তাদেরকে পর্যুদস্ত করে দিলেন। তদুপরি সেই প্রচ- শীতের রাতে আল্লাহ তাদের ওপর অত্যন্ত ঠন্ডা বাতাস প্রবাহিত করলেন। সে বাতাস তাদের তাঁবু ফেলে দিল এবং রান্নার আসবাবপত্র তছনছ করে দিল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাদের এই কোন্দল ও বিভেদের খবর পৌঁছলে তিনি সাহাবী হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে রাতের বেলা শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য পাঠালেন।
মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরাযী থেকে বর্ণিত। জনৈক কুফাবাসী সাহাবী হুযাইফা ইবনে ইয়ামানকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন ও তাঁর সাহচর্যে থেকেছেন?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সে বললো, “আপনারা তাঁর সাথে কি রকম ব্যবহার করতেন।” হুযাইফা বললেন, “আমরা তাঁর জন্য যথাসাধ্য পরিশ্রম করতাম।” কুফাবাসী লোকটি বললো, “খোদার কসম, আমরা যদি তাঁকে জীবিত পেতাম তাহলে তাঁকে মাটিতে হেঁটে চলতে দিতাম না, বরং ঘাড়ে চড়িয়ে রাখতাম।” হুযাইফা (রা) বললেন, ভাতিজা, শোনো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমরা পরিখায় ছিলাম। তিনি রাতের একাংশ নামায পড়ে কাটালেন। পরে তিনি আামাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছ যে শত্রুদের গতিবিধির খোঁজ নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে? আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, সে যেন জান্নাতে আমার সাথী হয়!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজ সেরে ফিরে আসার শর্ত আরোপ করেছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে কেউ-ভয়, শীত ও ক্ষুধার দরুন যাওয়ার শক্তি পাচ্ছিলো না। কেউ যখন প্রস্তুত হলো না তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন। ফলে আমাকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই হলো। তিনি বললেন, “হে হুযাইফা, যাও শত্রুদের ভেতরে যাও, তারপর দেখো তারা কি করছে। আমাদের কাছে ফিরে এসে তুমি কোন কিছু ঘটিয়ে বসোনা যেন।”
এরপর আমি গেলাম এবং সন্তপর্ণে শত্রু বাহিণীর ভেতরে ঢুকে পড়লাম। তখনো আল্লাহর অদৃশ্য সেন্যরা তাদেরকে হেস্তনেস্ত করে চলেছেক। তাদের তাঁবু ও রান্নার হাঁড়ি পাতিল সবই ল-ভ- হয়ে গেছে এবং আগুন নিভে গেছে।
তখন আবু সুফিয়ান তাদের বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা প্রত্যেকে নিজের আশেপাশে খেয়াল করে দেখো, অন্য কেউ আছে কিনা।” একথা শোনার পর আমিই প্রথম পার্শ্ববর্তী লোকের গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কে?” সে বললো, “অমুকের ছেলে অমুক।”[৬৯. শরহুল মাওয়াহেরে বর্ণিত হয়েছে: হুযাইফা বলেন, “আমার ডানপাশে যে ব্যক্তি বসেছিল, তার হাতের ওপর হাত রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’ সে বললো, ‘আমি আবু সুফিয়ানের ছেলে মুয়াবিয়া।’ তারপর বামপাশে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’ সে বললো, আমি আমর ইবনুল আস।”]
পরে আবু সুফিয়ান বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা যে স্থানে অবস্থান করছো সে স্থান আর অবস্থানের যোগ্য নেই। আমাদের উট-ঘোড়াগুলো মরে গেছে। আর বনু কুরাইযা আমাদেরকে পরিত্যাগ করেছে। আমরা যা অপছন্দ করি তারা তাই করেছে। প্রচ- ঝড় বাতাসে আমাদের কি দশা হয়েছে তা দেখতেই পাচ্ছ। আমাদের রান্নার সাজ-সরঞ্জাম, তাঁবু ইত্যাদি ল-ভ- হয়ে গেছে। এমনকি আগুনও নিভে গেছে। অতএব তোমরা সবাই নিজ বাড়ী অভিমুখে যাত্রা করো। আমি রওনা হচ্ছি।”
একথা বলেই সে তার উটের দিকে এগিয়ে গেল। উটটি ছিল বাঁধা। সে সেটির পিঠে উঠে বসলো। অতঃপর সেটিকে আঘাত করলো। তিনবার আঘাত করার পর সেটি লাফিয়ে উঠলো। উটটার বাঁধন খুললেও সেটি দাঁড়িয়েই ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আমাকে নির্দেশ না দিতেন যে, “ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন কিছু ঘটিয়ে বসবে না” তাহলে আমি ইচ্ছা করলেই তাকে হত্যা করতে পারতাম।
হুযাইফা বললেন, এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে গেলাম। তখন তিনি একটি ইয়ামানী কম্বল গায়ে জড়িয়ে নামায পড়ছিলেন। নামাযের মধ্যেই তিনি আমাকে দেখে পায়ের কাছে টেনে নিলেন এবং কম্বলের একাংশ আমার গায়ের উপর তুলে দিলেন। এই অবস্থায়ই তিনি রুকু ও সিজদা করলেন। সালাম ফিরানোর পর আমি তাঁকে শত্রুদের সব খবর জানালাম।
গাতফানীরা কুরাইশদের ফিরে যাওয়ার কথা জানতে পেরে স্বদেশ ভূমির পথে রওনা হলো। সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ পরিখা ত্যাগ করে মদীনায় চলে গেলেন এবং অস্ত্র রেখে দিলেন।
বনু কুরাইযা অভিযান (৫ম হিজরী)
জুহরের সময় জিবরীল (আ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন। তাঁর মাথায় ছিল রেশমের পাগড়ী। তিনি রেশমী কাপড়ে আবৃত জীনধারী খচ্চরে আরোহণ করে ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি অস্ত্র ত্যাগ করেছেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ‘হ্যাঁ।’ জিবরীল বললেন, “কিন্তু ফেরেশতারা এখনও অস্ত্র ত্যাগ করেনি। আর আপনিও রণাঙ্গন থেকে মুসলমানদের দাবীতেই ফিরছেন! হে মুহাম্মাদ আল্লাহ আপনাকে বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযান যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমিও সেখানে যাবো এবং তাদের তছনছ করে ছাড়বো।”
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে এই মর্মে ঘোষণা করতে বললেন, “যেসব লোক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কথা মানবে, তারা যেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়ে।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু তালিবের পুত্র আলীকে (রা) নিজের পতাকা নিয়ে বনু কুরাইযার এলাকা অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণও তাঁর অনুসরণ করলেন। আলী (রা) রওনা হয়ে তাদের দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে একটা যঘন্য উক্তি শুনতে পেলেন। এসব শুনে তিনি ফিরে চললেন, পথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এসব জঘন্য লোকদের কাছে আপনার যাওয়া উচিত নয়।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কেন? মনে হয়, তুমি তাদের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে কোন কটু ও অশ্রাব্য কথা শুনেছো।” আলী (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সত্যই তাই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাকে দেখলে তারা ঐ ধরনের কিছুই বলতো না।” অতঃপর তিনি বনু কুরাইযার দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছে বললেন, “হে বানরের ভাইয়েরা, আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছিত করেছেন তো? তাঁর শাস্তি ভোগ করছো তো?” তারা বললো, “হে আবুল কাসিম, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি প্রচলিত ডাক নাম) তোমার তো কিছুই অজানা নেই।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার ‘আত্তা’ নামক কূপের কাছে এসে তাঁবু স্থাপন করলেন। মুসলমানরা দলে দলে এসে তাঁর সাথে মিলিত হতে লাগলো। কেউ কেউ ইশার শেষ জামাতের পরেও এলেন। তারা তখনও আছর পড়েননি। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়তে। অনন্যোপায় হয়েই তাঁরা যুদ্ধের খাতিরে নামায বিলম্বিত করেছিলেন। তাই তাঁরা এশার পরে আছর পড়েন। এ জন্য কুরআনে তাঁদেরকে তিরস্কার করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পঁচিশ দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রাখলেন। ফলে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছিলো। আর আল্লাহ তায়ালা তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন।
কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের লোকজন স্বদেশ অভিমুখে রওনা হয়ে যাওয়ার পর হুয়াই ইবনে আখাতাব বনু কুরাইযার সাথে তাদের দুর্গে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযা দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনের উদ্দেশ্যেই সে সেখানে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযা সুনিশ্চিতভাবে যখন বুঝতে পারলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে যুদ্ধ না করে কিছুতেই ফিরে যাবেন না, তখন কা’ব ইবনে আসাদ গোত্রের লোকদের ডেকে বললো, “হে ইহুদীগণ শোনো! তোমাদের ওপর কি মুসিবত এসেছে দেখতে পাচ্ছো, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি তোমাদের কাছে তিনটি প্রস্তাব রাখছি। এর যে কোন একটা গ্রহণ করতে পার।” তারা বললো, “সে প্রস্তাবগুলো কি?” সে বললো, “মুহাম্মাদকে আমরা সবাই অনুসরণ করি ও মেনে নেই। আল্লাহর কসম, তিনি যে নবী তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট। আমাদের ধর্মগন্থেও তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এভাবে আমরা আমাদের নিজের এবং স্ত্রী ও সন্তানÑসন্তিতির জান ও মালের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হতে পারবো।” তারা বললো, “আমরা কখনো তাওরাতের কর্তৃত্ব অস্বীকার করবো না এবং তার বিকল্পও গ্রহণ করবো না।” সে বললো, “এটা যদি না মানো তাহলে এসো আমরা আমাদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের সাবইকে হত্যা করি। তারপর তরবারী নিয়ে মুহাম্মাদ ও তঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি। তখন আমাদের পেছনে কোন ঝামেলা ও দায়দায়িত্ব থাকবে না। তারপর আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে থাকবো। যদি আমরা নিহত হই তাহলে আমাদের বংশধরদের পরিণাম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েই মরতে পারবো। আর যদি জয়লাভ করি তাহলে নতুল করে স্ত্রী এবং সন্তানাদিও লাভ করতে পারবো।” সবাই বললো, “এই নিরীহ প্রিয়জনদেরকে মেরে ফেলবো এও কি সম্ভব? ওরাই যদি না থাকলো তাহলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি?” কা’ব বললো, “এটাও যদি অস্বীকার করো তাহলে আর একটা উপায় অবশিষ্ট থাকে। আজ শনিবারের রাত। সম্ভবতঃ মুহম্মাদ ও তাঁর সাহবীগণ আজকে আমাদের ব্যাপারে নিশ্চন্ত থাকবে। তাই, এসো, আমরা আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করি।” তারা বললো, “আমরা কি এভাবে শনিবারটার অমর্যাদা করবো? এ দিনে আমাদের পূর্ববর্তীরা যা করেনি, তাই করবো? অবশ্য কিছুসংখ্যক লোক করেছিলো। তার ফলে তাদের চেহারাও বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নেই।” কা’ব বললো, “আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে একটি লোকও এমন জন্মেনি, যে সারা জীবনে একটি রাতের জন্যও স্থির ও অবিচল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।”
তারপর কোন সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দূত পাঠিয়ে অনুরোধ করলো যে, “আপনি আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযিরকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। তার সাথে আমরা কিছু পরামর্শ করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পাঠিয়ে দিলেন। আবু লাবাবা গেলে সমগ্র গোত্রের লোক তার পাশে জমায়েত হলো এবং নারী ও শিশুরা তার কাছে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে আবু লুবাবার হৃদয় বিগলিত হলো। তারা বললো, “হে আবু লুবাবা তুমি কি মনে করো, মুহাম্মাদের ফায়সালাই আমাদের মেনে নেয়া উচিত?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সেই সাথে নিজের গলায় হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝালেন যে, সে ফায়সালা হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।
আবু লুবাবা বলেন, “আমি তৎক্ষনাৎ উপলব্ধি করলাম যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকরা করে বসেছি।”[৭০. বনু কুরাইযাকে অবরোধ করা হলো তারা নিজেদের ধ্বংস অনিবার্য মনে করে শাস ইবনে কায়েসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠালো। সে গিয়ে তাঁর কাছে বনু নাযীরকে যে শর্তে প্রাণভিক্ষা দেয়া হয়েছে সেই শর্তে প্রাণভিক্ষা দেয়ার সুপারিশ করলো অর্থাৎ শুধুমাত্র সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী ও উটের পিঠে যতটা মালপত্র নেয়া যায়, তাই নিয়ে যেতে দেয়া। আর অবশিষ্ট সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তারা রেখে যাবে। অস্ত্রশস্ত্র আদৌ নেবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অনৃরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সে বললো, “তাহলে শুধু আমাদের প্রাণভিক্ষা দিন এবং আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে আমাদের হাতে সমর্পণ করে বিতাড়িত করে দিন। উটের পিঠে করে মালপত্র মোটেই নিতে চাই না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাঁর ফায়সালা মেনে নেয়ার ওপরই গুরুত্ব দিলেন। শাস ইবনে কায়েস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই জবাব নিয়েই ফিরে গেল। (জারফানী প্রণীত শরহুল মাওয়াহেব) শরহুল মাওয়াহেযে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, প্রাণভিক্ষার অনুরোধ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাখ্যান করায় আবু লুবাবা মনে করেছিলেন যে, বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা মেনে নিলে তাদেরকে হত্যাই করবেন। তাই তাদেরকে ইংগিতে সেই বিষয়টাই অবহিত করেন।]আবু লুবাবা পরক্ষণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে না গিয়ে মসজিদে নববীতে চলে গেলেন এবং মসজিদের একটি খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে বললেন, “আমি যে ভুল করেছি তা আল্লাহ মাফ করে না দেয়া পর্যন্ত আমি এই স্থান থেকে নড়বো না, যে মাটিতে আমি আল্লাহ ও আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, সেখানে আমি আর কখনো কাউকে মুখ দেখাবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন আবু লুবাবার জন্য। পরে সমস্ত ব্যাপার শুনে বললেন, “সে যদি আমার কাছে আসতো তাহলে আমি তার জন্য ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু সে যখন এরূপ প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তাকে মুক্ত করতে পারি না।”
উম্মে সালামা (রা) বলেন, আবু লুবাবাকে ক্ষমা করা হলে আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি তাকে এ সুসংবাদ জানাবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “জানাতে পার।” অতঃপর উম্মে সালামা তাঁর ঘরের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে লুবাবা, সুসংবাদ! তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে।” উল্লেখ্য যে, তখনো পর্দার আয়াত নাযিল হয়নি।
এরপর তাকে মুক্ত করার জন্য মুসলমানগণ তার কাছে ছুটে গেল। কিন্তু আবু লুবাবা বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে মুক্ত করে না দিলে আমি নিজেক মুক্ত করবো না।” একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযরের নামাযে যাওয়ার সময় তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন।
ইবনে হিশাম বলেন, আবু লুবাবা ছ’দিন খুঁটির সাথে আবদ্ধ ছিলেন। প্রত্যেক নামাযের সময় তাঁর স্ত্রী এসে নামাযের জন্য বাঁধন খুলে দিত। তারপর আবার খুঁটির কাছে এসে তিনি নিজেকে বেঁধে নিতেন।
পরদিন সকাল বেলা বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত হলো। খবর শুনে আওস গোত্রের লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ছুটে এলো। বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, বনু কুরাইযা আমাদের মিত্র। খাযরাজ গোত্রের মুকাবিলায় তারা আমাদের সহায়তা করে থাকে। খাযরাজের মিত্রের (বনু কাইনুকার) ক্ষেত্রে আপনি কি আচরণ করেছেন তাতো আপনার জানাই আছে।” বনু কুরাইযার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কাইনুকা গোত্রকে অবরোধ করেছিলেন। তারা খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। তারাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তাদের প্রাণভিক্ষা চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রাণভিক্ষা মঞ্জুর করেছিলেন। আওস গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বনু কুরাইযার প্রাণরক্ষার অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, “হে আওস গোত্রের লোকজন, আমি তোমাদের একজনকে সালিশ নিয়োগ করি তবে তাতে তোমরা রাজী আছ তো?” তারা বললো, ‘হ্যাঁ।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সা’দ ইবনে মুয়াযকে আমি সালিশ নিযুক্ত করলাম।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে মুয়াযকে জনৈক মুসলমানের স্ত্রী রুফাইদার নিকট মসজিদে নববীর একটা তাঁবুতে রেখেছিলেন। এই মহিলা আহতদের চিকিৎসা এবং আর্ত মুসলমানদের সেবা করতেন। সা’দ খন্দক যুদ্ধে তীরের আঘাতে আহত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের বললেন, “সা’দকে রুফাইদার তাঁবুতে রাখ যাতে সে আমার কাছেই থাকে এবং আমি তার খোঁজ খবর নিতে ও সেবা-যত্ন করতে পারি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বনু কুরাইযার ব্যাপারে সালিশ নিয়োগ করলে তাঁর গোত্রের লোকজন তাঁকে একটা গাধার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে গেল। গাধার পিঠে তারা চামড়ার গদি স্থাপন করেছিল। তিনি ছিলেন খুব মোটাসোটা সুদর্শন পুরুষ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে বলতে থাকে, “হে সা’দ, তোমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করো। তোমাকে সালিশ নিয়োগ করেছেন এই জন্য যাতে তুমি তাদের প্রতি সহৃদয় আচরণ কর।” তারা খুব বেশী অনুনয় বিনয় করছে দেখে তিনি বললেন, “সা’দের জন্য সময় এসেছে সে যেন আল্লাহর দ্বীরেন ব্যাপারে কারো তিরস্কার বা ভর্ৎসনার তোয়াক্কা না করে।” একথা যারা তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের কেউ কেউ বনু আবদুল আশহালের বস্তিতে ফিরে গেল। তখন বনু কুরাইযার কিছু লোক তাদের কাছে এলো। সা’দ তাদের কাছে পৌঁছার আগেই তারা তাদের কাছে সবকিছু শুনে নিজেদের মৃত্যু অবধারিত মনে করে কাঁদতে লাগলো।[৭১. “সা’দের জন্য সময় এসেছে, সে যেন আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কারো তিরস্কার বা ভর্ৎসনার তোয়াক্কার না করে”- সাদের এই উক্তি শুনে তারা বুঝলো যে, তিনি হয়তো তাদের হত্যার রায় দেবেন। তাই মৃত্যুর আগেই নিশ্চিত মৃত্যুর আভাস পেয়ে তারা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল।]
সা’দ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের কাছে পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমাদের নেতাকে স্বাগত জানাও।” তখন কুরাইশরা ও মুহাজিরগণ বলতে লাগলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ নির্দেশ ও কেবল আনাসারদের জন্য।” আনসারগণ বললেন, “এ নির্দেশ সবার জন্য।” এরপর সবাই তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “হে সা’দ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে আপনার মিত্রদের ব্যাপারে ফায়সালা করার দায়িত্ব দিয়েছেন।” সা’দ বললেন, “আমি যে ফায়সালা ঘোষণা করবো সেটাই ফায়সালা বলে স্বীকৃতি হবেÑতোমরা সবাই আল্লাহর নামে তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ?” তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর যে পার্শ্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সে দিকে ইশারা করে বললেন, “এখানে যারা আছেন তাঁরাও কি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?” সা’দ অবশ্য শ্রদ্ধাবশতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা উল্লেখ করলেন না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন সা’দ ঘোষণা করলেন, “আমার ফায়সালা এই যে, বনু কুরাইযার সব পুরুষকে হত্যা করা হোক, সমস্ত ধনসম্পদ বণ্টন করে দেয়া হোক এবং স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হোক।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, “তোমার ফায়সালা সাত আসমানের ওপর থেকে আল্লাহর যে ফায়সালা এসেছে তারই অনুরূপ।”
এরপর বনু কুরাইযার সবাইকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে বের করে এনে মদীনার কাইস বিনতে হারিসার বাড়ীতে আটক করে রাখা হলো। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার বাজারে গেলেনÑযেখানে আজও মদীনার বাজার অবস্থিত। এক দলে ভাগ করে আনলেন এবং ঐ সব পরিখার ভেতরে তাদেরকে হত্যা করা হলো। আল্লাহর দুশমন হুয়াই ইবনে আখতাব এবং বনু কুরাইযার গোত্রপতি কা’ব ইবনে আসাদকেও হত্যা করা হলো। তাদের সংখ্যা ছিল সর্বমোট ছয় বা সাত শ’। যারা তাদের সংখ্যা আরো বেশী মনে করেন তাদের মতে তাদের সংখ্যা ছিল আট থেকে নয় শ’য়ের মধ্যে। তাদেরকে যখন দলে দলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন তারা গোত্রপতি কা’ব ইবন আসাদকে জিজ্ঞেস করেছিল, “হে কা’ব, আমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করা হবে বলে আপনি মনে করেন?” কা’ব বললো, “তোমরা কি কিছুই বুঝ না? দেখছো না, যে ডেকে নিচ্ছে সে কেমন নির্লিপ্ত, নির্বিকার? দেখছো না তোমাদের যে যাচ্ছে সে আর ফিরে আসছে না? আল্লাহর কসম, সবাইকে হত্যা করা হবে।”
এভাবে এক এক করে সবাইকে হত্যা করা হলো।
ইসলামের জঘন্যতম দুশমন হুয়াই ইবনে আখতাবকে আনা হলো। তার গায়ে গোলাপী রংয়ের একটা পোশাক ছিল। সে এর সব জায়গায় ছোট ছোট করে ছিঁড়ে রেখেছিলো যাতে তা কেড়ে নেয়া না হয়। তার দু’হাত রশি দিয়ে ঘাড়ের সাথে বাঁধা ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দৃষ্টি পড়তেই সে বললো, “তোমার শত্রুতা করে আমি কখনোই অনুতপ্ত হইনি। তবে আল্লাহকে যে ত্যাগ করে তাকে পর্যুদস্ত হতেই হয়।” এরপর সে উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বললো, হে জনম-লী, আল্লাহর হুকুম অলংঘনীয়। বনী ইসরাইলের জন্য আল্লাহ ভাগ্যলিপি ও মহা হত্যাকা- নির্ধারিত করে রেখেছিলেন।” এ কথাগুলো বলে সে বসে পড়লো এবং এরপর তার শিরচ্ছেদ করা হলো।
উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রাদিয়ল্লাহু আনহা বলেন, বনু কুরাইযার একজন মহিলা ছাড়া আর কোন মহিলাকে হত্যা করা হয়নি। সেই মহিলাটি আমার কাছে নির্দ্বিধায় কথাবার্তা বলছিল আর হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তার গোত্রের লোক নিহত হচ্ছিলো। সহসা জনৈক ঘোষক উচ্চস্বরে বলল, “সে কি? তোমার কি হয়েছে?” সে বলল, “আমাকে হত্যা করা হবে।” আমি বললাম “অমুক মহিলা কোথায়?” একথা শুনে সে বললো, এই তো আমি।” “কেন?” সে বললো, “একটা কা- ঘটিয়েছি সে জন্য।” এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো এবং হত্যা করা হলো।[৭২. ইবনে হিশাম বলেন, এই মহিলাই যাঁতার পাথর ছুঁড়ে সাহাবা খাল্লাদ ইবনে সুয়াইদকে হত্যা করেছিলো।]
আয়িশা (রা) বলতেন, “সেই মহিলাটির কথা আমি ভুলতে পারি না। আমার এই ভেবে বিস্ময় লাগে যে, সে নিহত হবে জেনেও প্রফুল্লচিত্তে ও হাসিখুশীতে ডুবে ছিল।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আতিয়া কুরাযী বলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি তখন কিশোর। আমাকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক পেয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো।”
আইয়ুব ইবনে আবদুর রহমান বলেন, সালমা বিনতে কায়েস নাম্নী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈকা খালাÑ যিনি তাঁর সাথে উভয় কিবলামুখী হয়ে নামায পড়েছেন এবং মহিলাদের বাইয়াতে অংশগ্রহণ করেছিলেনÑ রাসূলুল্লাহর নিকট রিফায়া ইবনে সামুয়েল কুরাযীর জীবন রক্ষার আবেদন করেন। তিনি বলেন, “রিফায়া নামায পড়া ও উটের গোশত খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন ও তাঁর জীবন রক্ষা করেছিল। এই লোকটি (রিফায়া) প্রাপ্তবয়স্ক ছিল এবং সালমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলে। সে আগে থেকেই সালমার পরিবারকে চিনতো। এভাবে সালমা রিফায়ার জীবন রক্ষা করেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার ধন-সম্পদ, স্ত্রী ও সন্তানদেরকে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করেন। তারপর সা’দ ইবনে যায়িদ আনসারীকে বনু করাইযার কিছু সংখ্যক দাসদাসীকে দিয়ে নাজদ পাঠিয়ে দেন। তাদের বিনিময়ে তিনি সেখানে থেকে মুসলমানদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও ঘোড়া খরিদ করে আনেন।
বনু কুরাইযার মহিলাদের মধ্য থেকে রায়হানা বিনতে আমর বিন খুনাফাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্য মনোনীত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকাল পর্যন্ত সে তাঁর মালিকানায় ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বিয়ে করে পর্দার আড়ালে নেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সে বলে, “হে আল্লাহর রাসূল, তার চেয়ে বরং আমাকে আপনি দাসী হিসেবে আশ্রয় দেন। এটা আমার ও আপনার উভয়ের জন্যই অপেক্ষাকৃত নির্ঝঞ্ঝাট হবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা মতই কাজ করলেন তাকে দাসী হিসেবে গ্রহণ করার সময় সে ইসলাম গ্রহণের ঘোর বিরোধিতা করেছিল এবং ইহুদী ধর্মকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে দূরে রইলেন এবং মর্মাহত হলেন। একদিন তিনি সাহাবীদের সাথে বৈঠকে আছেন এমন সময় পিছনের দিকে জুতার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই সালাবা ইবনে সাইয়া আমাকে রায়হানার ইসলাম গ্রহণের খবর দিতে আসছে। ” সত্যই সালাবা এলেন এবং জানালেন, রায়হানা ইসলাম গ্রহণ করেছে। এমে তিনি খুশী হলেন।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবে খন্দক যুদ্ধ ও বনু কুরাইযার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কিভাবে মুসলমানগণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাদের ওপর কি অপার অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন এবং কিভাবে তিনি তাদেরকে সকল বিপদ থেকে উদ্ধার করে উভয় যুদ্ধে বিজয় দান করেছেন, তা বর্ণনা করেছেন। অথচ তার আগে মুনাফিকরা অবাঞ্ছিত কথাবার্তা বলেছিল। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, বিশাল এক বাহিনী তোমাদের ওপর চড়াও হলে আল্লাহ তোমাদের ওপর যে অনুগ্রহ বর্ষণ করেন তা স্মরণ কর। তখন আমি তাদের ওপর প্রচ- ঝটিকা এবং এমন এক সেনাবাহিনী (ফিরিশতা) পাঠিয়েছিলাম যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আর তোমাদের কার্যকলাপও আল্লাহ প্রত্যক্ষ করছিলেন। তারা যখন সবদিক থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ চালালো, যখন অনেকের চোখ ভয়ে বিষ্ফোরিত ও প্রাণ কণ্ঠনালীতে উপনীত হলো এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা রকমের ধারণা করতে লাগলে তখন মুমিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তাদেরকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়া হলো। মুনাফিক ও অসুস্থ মনের লোকেরা বলছিলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের একটা দল বললো: হে ইয়াসরিববাসীগণ, তোমাদের এখন অবস্থানের অবকাশ নেই, কাজেই ফিরে যাও। তখন তাদের কোন কোন দল নবীর কাছে এই বলে অনুমতি চাচ্ছিলো যে, আমাদের পরিবার পরিজন বিপদের সম্মুখীন। আসলে তা বিপদের সম্মুখীন ছিল না। তারা শুধু পালাবার বাহানা খুঁজছিল।”
আওস ইবনে কায়যী ও তার সমমনাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়।
“যদি (মদীনার) সকল দিক দিয়ে শত্রু ঢুকে পড়তো এবং তাদেরকে ফিৎনায় লিপ্ত হওয়ার অর্থাৎ শিরক করার আহ্বান জানানো হতো তাহলে তারা অবশ্যই তা করতো। এরূপ করতে তারা কদাচিৎ দ্বিধা করতো। ইতিপূর্বে তারা আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছিলো যে, রণেভঙ্গ দিয়ে পালাবে না। আল্লাহর ওয়াদা সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে। ( এই বনু সালামা ও বনু হারেসা গোত্রদ্বয় উহুদ যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ করার পর ওয়াদা করেছিল যে, আর কখনো তার এরূপ কাজ করবে না। সেই ওয়াদার কথা আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিলেনÑ যা তারা আপনা থেকেই করেছিল।) হে নবী, তুমি বল, মৃত্যু বা হত্যা থেকে পালিয়ে তোমাদের কোন লাভ হবে না। সেক্ষেত্রে অল্প কিছুদিন জীবনকে ভোগ করার সুযোগ পাবে মাত্র। বল, আল্লাহ যদি তোমাদেরকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করা কিংবা তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আল্লাহর সে সিদ্ধান্ত থেকে কে তোমাদের রক্ষা করতে পারে? আল্লাহ ছাড়া কাউকেই তার অভিভাবক বা সহায় হিসেবে পাবে না। তোমাদের মধ্যে কারা বাধা সৃষ্টিকারী এবং কারাই বা তাদের ভাইদেরকে বলে, ‘আমাদের সাথে এসো’। এসব মুনাফিকরা খুব কমই যুদ্ধে যেয়ে থাকে। (অর্থাৎ আত্মরক্ষা ও দায় সারার প্রয়োজন ছাড়া) শুধুমাত্র তোমাদের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ চরিতার্থ করাই তাদের উদ্দেশ্য। যুদ্ধ যখন সমাগত হয় তখন তাদেরকে তুমি দেখবে, তোমার দিকে ভয়ে এমনভাবে তাকাবে, মুমূর্ষ চেতনাহীন ব্যক্তির চোখ যেমন মৃত্যুর ভয়ে ঘুরতে থাকে। তারপর বিপদ কেটে গেলে তারা গণিমতের সম্পদের লোভে উচ্ছাসিত ভাষায় তোমাদের কাছে গিয়ে বড় বড় বুলি আওড়াবে। (অর্থাৎ এমন সব কথা বলবে যা তোমরা পছন্দ করো না। কেনান তারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না এবং কোন সওয়াবও পাবে না। তাই মৃত্যুকে তার ঠিক তেমনি ভয় পায় যেমন ভয় পায় মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে যারা বিশ্বাসী নয় তারা)। তারা ঈমান আনেনি ফলে আল্লাহ তাদের সকল সৎকাজ বিনষ্ট করে দিয়েছেন। বস্তুতঃ এটা আল্লাহর কাছে খুবই সহজ কাজ। তারা মনে করে, দলগুলো (অর্থাৎ হানাদার কুরাইশ ও গাতফান ) চলে যায়নি। আর যদি তারা পুনরায় হামলা করে বসে তাহলে তারা মরুভূমির বুকে বেদুঈনের মাঝে গিয়ে আশ্রয় নেবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের খোঁজÑখবর নিতে থাকবে, আর তোমাদের মধ্যে থাকলেও তারা খুব কমই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতো।”
এরপর আল্লাহ মু’মিনদেরকে সম্বোধন করে বলেন, “তোামাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে। আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসীদের জন্য।” [অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে থেকে কিংবা তার মর্যাদা থেকে স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট যারা তাদের জন্য নয়] এরপর মু’মিনদের সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহর প্রতিশ্রুত পরীক্ষাকে স্বীকার করে নেয়ার ও মেনে নেয়ার যে মনোভাব তাদের রয়েছে, তার উল্লেখ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “মু’মিনরা যে সময় হানাদার দলগুলোকে দেখলো তখন বললো: এ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দেয়া প্রতিশ্রুতি। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকেন। এ রকম পরিস্থিতি তাদের ঈমানকে ও আত্মনিবেদনকেই বাড়িয়ে দেয়।” (অর্থাৎ বিপদে ধৈর্য, অদৃষ্টের আছে আত্মসমর্পণ এবং সত্যকে মেনে নেয়ার মনোভাব)।
“অনেক মু’মিন আছে যারা আল্লাহর কাছে দেয়া অংগীকার পূরণ করেছে। তাদের কেউ তো কর্তব্য সমাধান করে ফেলেছে। (অর্থাৎ কাজ শেষ করে আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন, যেমন বদর ও উহুদের শহীদগণ) আবার কেউ কেউ প্রতীক্ষমান আছে। (অর্থাৎ আল্লাহর সাহয্যের জন্য এবং রাসূল ও সাহাবীগণ যা করে গেছেন তা করার জন্য তারা এতে আদৌ কোন পরিবর্তন সাধন করেনি। (অর্থাৎ কোন সন্দেহ-সংশয় বা সংকোচ পোষণ করেননি কিংবা বিকল্প পথ খোঁজেননি) আল্লাহ তায়ালা সত্যনিষ্ঠদেরকে তাদের সত্যনিষ্ঠার পুরষ্কার দেবেন এবং ইচ্ছা করলে মুনাফিকদের আযাব দেবেন, কিংবা মাফ করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু। আর আল্লাহ কাফিরদেরকে (অর্থাৎ কুরাইশ ও গাতফানীদেরকে) তাদের ক্রোধ ও আক্রোশসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। কোন কল্যাণই তাদের ভাগ্যে জোটেনি। মু’মিনদের হয়ে লড়াই করা জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। কেননা তিনি তো শক্তিমান পরক্রমশালী। আহলে কিতাবদের যে গোষ্ঠটি (অর্থাৎ বনু কুরাইযা) তাদের সাহয্য করেছিল আল্লাহ তাদের সুরক্ষিত জায়গাগুলো থেকে তাদেরকে বের করে এনেছেন এবং তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দিয়েছেন। ফলে তোমরা তাদের একাংশকে হত্যা ও অপরাংশকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছো। (অর্থাৎ পুরুষদের হত্যা করেছো এবং নারী শিশুদের বন্দী বানিয়েছ।) আর আল্লাহ তাদের ভূমি, ঘরবাড়ী, ধন-সম্পদ এবং যে জায়গা আদৌ পায়ে মাড়াওনি (অর্থাৎ খাইবার) সে জায়গাও তোমাদের অধিকারভুক্ত করে দিয়েছেন। বস্তুত আল্লাহ সবকিছুই করতে পারেন।”
বনু কুতাইবার সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে সা’দ ইবনে মুয়াযের জখমটির হঠাৎ অবনতি ঘটে এবং তিনি শাহাদাত লাভ করেন।
হাসান বাসরী (রাহ) বলেন, সা’দ খুব মোটাসোটা ও ভারী লোক ছিলেন। কিন্তু তাঁর লাশ বহনকারীরা তাঁকে অস্বাভাবিক রকম হালকা বোধ করে। তখন মুনাফিকদের কেউ কেউ বললো, সা’দ তো খুব ভারী ছিলেন। অথচ আমরা এত হালকা লাশ আর দেখিনি।”একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হালকা মনে হয়েছে তার কারণ এই যে, তার লাশ বহনকারীদের মধ্যে তোমরা ছাড়াও অনেকে ছিল (অর্থাৎ ফেরেশতা)। আল্লাহর কসম, সা’দের রূহ পেয়ে ফেরেশতারা উল্লাসিত ও আনন্দিত হয়েছে। তার ইনতিকালে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে।”
খন্দক যুদ্ধে তিনজন মুশরিক নিহত হয়েছিল। মুনাব্বিহ ইবনে উসমান তাদের একজন। সে তীরবিদ্ধ হয় এবং আহত অবস্থায় মক্কায় গিয়ে মারা যায়। আর একজন বনু মুখযুমের নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ। সে খন্দক ডিঙ্গিয়ে এসেছিল। ধরা পড়ে নিতহ হয়। সে তীরবিদ্ধ। তার লাশ মুসলমানদের অধিকারে ছিল। মুশরিকরা তার লাশ কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তার লাশ বা তার মূল্য দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।” অতঃপর তার লাশ দিয়ে দেয়া হলো। তৃতীয় ব্যক্তি ছিল বনু আমের গোত্রের আমর ইবনে আব্দ উদ। আলী ইবনে আবু তালিব (রা) তাকে হত্যা করেন।
বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযানে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে খাল্লাদ ইবনে সুয়াইদকে যাঁতার পাথর ছুড়ে মেরে হত্যা করা হয়। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বললেন, “খাল্লাদ দু’জন শহীদের সওয়াব পাবে।” সাহাবী আবু সিনান মারা যান বনু কুরাইযাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবরোধ করার সময়। তাঁকে বনু কুরাইযার গোরস্থানে দাফন করা হয়। খন্দকের দু’পাশে সেনা সমাবেশের অবসান ঘটলে এবং কাফিররা পরিখা ত্যাগ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এরপর কুরাইশরা আর কখনো তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে না বরং এরপর তোমরাই তাদের ওপর আক্রমণ চালাবে।”
বস্তুত তারপর কুরাইশ পক্ষ থেকে মুসলমানদের ওপর আর কোন আক্রমণ হয়নি। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাঁকে মক্কা বিজয়ের সুযোগ দেন।
বুন লিহইয়ান অভিযান
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুলহাজ্জ, মুহাররম, সফর, রবিউল আউয়াল ও রবিউস সানী এই ক’মাস মদীনায় অবস্থান করেন। বনু কুরাইযা বিজয়ের পর ৬ষ্ঠ মাসে জামাদিউল উলাতে তিনি বনু লিহইয়ান অভিযানে বের হন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল রাজীর অধিবাসিদের কাছে খুবাইব ইবনে আদী ও তাঁর সঙ্গীদের (রা) ফেরত চাওয়া। তিনি এমনভাবে বের হন যে, মনে হচ্ছিল তিনি সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করেছেন। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রাজীবাসীর ওপর আক্রমণ চালানো।
মদীনা থেকে বের হয়ে তিনি মদীনার পার্শ্ববর্তী পাহাড় গুরাব হয়ে সিরিয়াগামী রাস্তা ধরে প্রথমে মাখীদ, তারপর বাতরা গমন করেন। সেখানে বাম দিকে মোড় নিয়ে মদীনার অদূরবর্তী সমভূমি ‘বীনে’র ওপর দিয়ে ইয়ামাম পর্বতমালা অতিক্রম করে মক্কাগামী রাস্তা ধরে অগ্রসর হলেন। এরপর ক্ষিপ্রগতিতে বনু লিহ্ইয়ানের আবাসভূমি ‘গুরান’ পৌছেন। গুরান হলো আমাজ ও উসফানের মধ্যবর্তী সমভূমি যা ‘সায়া’ নামক অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। গুরান গিয়ে দেখলেন, তারা আগেভাগেই সাবধান হয়ে নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেছ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরানে শিবির স্থাপন করলেন। তাঁর অতর্কিত আক্রমণ লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, “আমরা যদি উসফানে শিবির স্থাপন করি তাহলে মক্কাবাসী মনে করবে আমরা মক্কা যাচ্ছি।” অতঃপর তিনি দু’শ ঘোড়সওয়ার সাহাবীকে সাথে নিয়ে উসফানে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। তারপর দু’জন ঘোড়সওয়ারকে পাঠালেন। তারা কুরাউল গুমাইম পর্যন্ত পৌঁছলো। তারার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র বহিনী নিয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, প্রত্যাবর্তনকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন, “আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী এবং আমাদের প্রতিপালকের প্রশংকারী। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই সফরের দুঃখ-কষ্ট থেকে এবং পরিবার পরিজন ও ধনÑসম্পদের ক্ষতি থেকে।”