আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত
কিছুদিন পর মুস’য়াব ইবনে উমাইর মক্কা ফিরলেন। মদীনার কিছু কিছু নওমুসলিম তাঁদের স্বগোত্রীয় পৌত্তলিকদের সাথে হজ্জ উপলক্ষে মক্কা গেলেন। আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁরা সবাই আকাবায় সমবেত হওয়ার জন্য [৩৮. দশই জিলহজ্জের পরবর্তী তিন দিনকে আইয়ামে তাশরিক বলা হয়। তাশরিক অর্থ চামড়া রৌদ্রে শুকানো। আরবরা এই সময় কুরবানীর পশুর চামড়া শুকাতো।] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কথা দিলেন। বলাবাহুল্য আল্লাহর রাসূলের মর্যাদা বৃদ্ধি ও বিজয় দান, ইসলাম মুসলমানদের শক্তিম ব্রদ্ধি এবং অংশীবাদ ও অংশীবাদীদের পতন ঘটাতে আল্লাহর ইপ্সিত মুহূর্তটি সমাগত হলে এই দ্বিতীয় বাইয়াত সম্পন্ন হ।েপ।া।
কা’ব ইবনে মালিক বলেন: আমরা আমাদের গোত্রের মুশরিক হাজীদের সাথে মক্ক অভিমুখে রওনা হলাম। আমরা ততক্ষণে নামায পঢ়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি এবং ইসলামের বিধি –বিধান শিখে নিয়েছি। আমাদের প্রবীণ মুরুব্বী ও গোত্রপতি বারা ইবনে মা’রূরও আমাদের সহযাত্রী। আমরা সফরে রওনা হয়ে মদীনা থেকে বেরুতেই রারা বললো, “শোনো, আমি একটা মত স্থির করেছি, জানি না তোমরা তাতে একমত হবে কিনা।
আমরা বললোম, “সেটা কি?” তিনি বললেন, “আমি ঠিক করেছি, কা’বাকে পেছনে রেখে নামায পড়বো না বরং কা’বার দিকে মুখ করেই নামায পড়বো। ” আমরা তাকে বললাম, “আমরা তো জানি, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিরিয়া অর্থাৎ বাইতুল মাকদাসের দিকে ফিরেই সামায পড়ে থাকেন। আমরা তাঁর বিরোধিতা করতে পারি না।” তিনি বললেন, “তা হলে আমি কা’বা ও বাইতুল
মাকদাস-উভয়ের দিকে মুখ করে নামায পড়বো।” আমরা বললাম, “আমরা কিন্তু তা করবো না।” তাই নামাযের সময় হলে আমরা বাইতুল মাকসাদের দিকে মুখ করে নামায পড়তাম আর তিনি পড়তেন কা’বার দিকে মুখ করে। এভাবে আমরা মক্কায় এসে পৌঁছলাম। তিনি জিদ ধরে এসেছেন তার জন্য আমরা তাকে তিরস্কার করতে করতে এসেছি। কিন্তু তিনি কোনক্রমেই তার জিদ বর্জন করেননি। মক্কায় পৌঁছার পর তিনি আমাকে বললেন, “ভাতিজা, আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে চলো। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করবো, সারাপথ আমি যেভাবে নামায পড়েছি, তা ঠিক হলো কিনা” তোমাদের কে যেভাবে আমার বিরুদ্ধে কাজ করতে দেখলাম, তাতে আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে।”
কা’ব ইবনে মালিক বলেন, “অতঃপর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে বেরুলাম। আমরা তাঁকে চিনতাম না এবং ইতিপূর্বে কথনো তাঁকে দেখিনি। একজন মক্কাবাসীর সাথে দেখা হলে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় আছেন?” সে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিন?” আমরা বললাম, ‘না।’ সে বললো, “তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে কি চেন?” আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ।’ আমরা আব্বাসকে আগে থেকেই চিনতাম। তিনি আমাদের এলাকা দিয়ে ব্যবসা উপলক্ষ্যে যাতায়াত করতেন। মক্কাবাসী লোকটি বললো, “মসজিদে হারামে প্রবেশ করে যাঁকে আব্বাসের সাথে বসা দেখবে তিনিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।” আমরা মসজিদে হারামে প্রবেশ করে দেখলাম, আব্বাস বসে আছেন আর তার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বসে আছেন। আমরা সালাম দিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বসলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এই দুই ব্যক্তিকে চেন?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি তাদেরকে চিনি। ইনি গোত্রপতি বারা ইবনে মা’রূর। আর ইনি কা’ব ইবনে মালিক।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সম্পর্কে যা বললেন তা আমি ভুলতে পারব না। তিনি বললেন,তিনি বললেন, “কবি কা’ব ইবনে মালিক না কি?” আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন বারা বললেন, “হে আল্লাহর নবী, আমি এই সফরে বের হওার পূর্বেই আল্লাহ আমাকে ইসলাম গ্রহনের তাওফীক দান করেছেন। এরপর আমি কা’বার দিকে মুখ করে নামায পড়তে লাগলাম। কিন্তু আমার সঙ্গীরা আমার মত অগ্রাহ্য করেছে। এজন্য আমি সংশয়াপন্ন হয়ে পড়েছি। হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কোনটা সঠিক মনে করেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি একটা কিবলার দিকে নামায পড়তে। ধৈর্য ধরে সেই কিবলার অনুসরণ করলে ভালো হতো।”
এরপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিবলাকে মেনে নিলেন এবং আমাদের সাথে বাইতুল মাকদাসের দিকে মুখ করে নামায পড়তে লাগলেন। পরে আমরা হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আইয়ামে তাশরিকের মাঝামাঝি সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আকাবায় সাক্ষাতের ওয়াদা করলাম। যেদিন হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শেষ হলো তার পরবর্তী রাতটাই ছিল আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হবার প্রতিশ্রুত রাত। তখন আমাদের সাথে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম আবু জাবির। তিনি ছিলেন অন্যতম সম্মানিত সমাজপতি। তাঁকেও আমরা সাথে নিলাম। কিন্তু আমাদের সাথে কারা আছে আর আমরা কি করতে যাচ্ছি তা আমাদের সহযাত্রী গোত্রীয় মুশরিকদেরকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেইনি। আমরা আবু জাবিরকে বললাম, “হে আবু জাবির, আপনি আমাদের একজন সম্মানিত সরদার। আপনি যে জীবন-পদ্ধতি অনুসরণ করছেন, তা আমাদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্বিত ব্যাপার। আপনি পরকালে দোযখের আগুনে নিক্ষিপ্ত হন তা আমরা চাই না।” অতঃপর তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম এবং তাঁকে জানালাম যে, আজ আকাবাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমাদের মিলিত হবার কথা রয়েছে। আবু জাবির তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আমাদের সাথে আকাবার বাইয়াতে অংশ গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি একজন আহ্বায়কে পরিণত হন।
সেই রাতে আমরা আমাদের কওমের লোকদের সাথে কাফিলার মধ্যেই ঘুমালাম। রাত এক-তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেয় ওয়াদা মুতাবিক আকাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নিশাচর পাখীর মত অতি সন্তর্পণে ও অতি গোপনে বেরিয়ে পড়লাম। পথ চলতে চলতে আমরা আকাবার নিকটবর্তী গিরিবর্তে গিয়ে সমবেত হলাম। আমরা সর্বমোট তিহাত্তর জন লোক জমায়েত হলাম। আমাদের সাথে দুইজন মহিলাও ছিলেন। তাঁরা হলেন মুসাইব বিনতে কা’ব ও আসমা বিনতে আমর ইবনে আদী। [৩৯. ইবনে ইসহাক বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন সময় মহিলাদের হাত স্পর্শ করতেন না। তিনি শুধু মৌখিক অঙ্গীকার নিতেন। তাঁরা অঙ্গীকার করলে তিনি বলতেন, ‘তোমরা যেতে পার। তোমাদের বাইয়াত সম্পন্ন হয়েছে।’ ]
কা’ব ইবনে মালিক বলেন, আমরা গিরিবর্তে সমবেত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতীক্ষায় রইলাম। অবশেষে তিনি তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছেলন। তখনও আব্বাস ইবলাম গ্রহণ করেননি। তিনি কেবল ভ্রাতস্পুত্রের ঐ গুরুত্বপূর কাজটি প্রত্যক্স করা ও তাঁর নিরপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যই এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বৈঠকে বসলেন, তখন সর্বপ্রথম আব্বাস আমাদের সাথে কথা বললেন। তিনি বললেন, “হে খাজরাজ গোত্রের জনম-ণী মুহাম্মাদ আমাদের মধ্যে কিরূপ মর্যাদার অধিকারী,তা আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে। তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের জুলুম নির্যাতন থেকে আমরা এ যাবত রক্ষ করেছি। তাঁর সম্প্রদাযের মধ্যে তিনি একটা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ফলে তাঁর সম্প্রদায় ও জন্মভূমিতে তিনি সম্মান ও নিরাপত্তার অধিকারী। তা সত্ত্বেও আপনাদের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ এবং আপনাদের মধ্যেই তিনি থাকতে কৃতসংকল্প। এখন আপনারা ভেবে দেখুন, তাঁকে আপনারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন তা রক্ষা করতে পারবেন কিনা এবং তাঁর শত্রুদের হাত থেকে তাঁকে নিরাপদে রাখতে পারবেন কিনা। তা যদি পারেন তা হলে আপনাদের দায়দায়িত্ব ভালো করে বুঝে নিন। আর যি মনে করেন যে, ভবিষ্যতে আপনারা তাঁকে তাঁর শত্রুদের হাতে সমর্পণ করবেন এবং সাথে করে নিয়ে যাওয়ার পরও তাঁকে লাঞ্ছনার মুখে ঠেলে দেবেন, তা হলে এখনই সেই দায়িত্ব গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। কেননা বর্তমানে তিনি তাঁর স্বজাতির কাছে ও আপর মাতৃভূমিতে সম্মানে ও নিরাপদে আছেন।” আব্বাসের এ কথাগুলো শোনার পর আমরা বললাম, “আপনার কথা আমরা শুনলাম। হে আল্লাহর রাসূল, এখন আপনি বলুন এবং যেমন খুশী অঙ্গীকার নিন!”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে এবার তাঁর কথা বললেন। প্রথমে তিনি কুরআন তিলাওয়াত করলেন, তারপর সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলামের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করলেন। অতঃপর বললেন, “আমি তোমাদের কাছ থেকে এই অঙ্গীকার চাই যে, তোমরা তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে যেভাকে বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকো, আমাকেও সেভাবে রক্ষা করবে।”
তৎক্ষণাৎ বারা ইবনে মা’রূর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত ধরে বললেন, “হ্যাঁ। যে মহান সত্তা আপনাকে নবী করে সত্যদীনসহ পাঠিয়েছে তাঁর শপথ করে বলছে, আমরা স্বজন ও স্ত্রী-সন্তানদের যেভাবে বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকি, আপনাকেও সেভাবে রক্ষা করবো। হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার আনুগত্য করার শপথ গ্রহণ করলাম। আল্লাহর শপথ, আমরা য্দ্ধু ও অস্ত্রের মধ্যেই লালিত পালিত। আমরা পুরুষানুক্রমে যোদ্ধা জাতি।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বারার কথা শেষ না হতেই আবুল হাইসাম ইবনে তাইহান বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের সাথে ইহুদীদের মৈত্রী সম্পর্কে রয়েছে এবং আমরা তা ছিন্ন করতে যাচ্ছি। এসব করার পর আল্লাহ আপনাকে বিজয় দান করলে আপনি কি আমভদের ত্যাগ করে নিজ গোত্রে ফিরে যাবেন?” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে বললেন, “আমি বরং তোমাদের জীবন মরণ ও সুখ দুঃখের চিরসঙ্গী হবো, তোমাদের রক্তপাতকে আমি নিজের রক্তপাত বলে গণ্য করবো। আমি চিরকাল তোমাদের থাকবো এবং তোমরা চিরকাল আমার থাকবে। তোমরা যার সাথে যুদ্ধ করবে, আমিও তার সাথে যুদ্ধ করবো।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্য থেকে বারো জন নকীব বা আহ্বায়ক নির্বাচন করে আমার কাছে পাঠাও যাতে তারা নিজ নিজ গোত্রের লোকদের এই অঙ্গীকারে শামিল করে নিতে পারে।” তারা তখন বারো জন আহ্বায়ক নির্বাচন করে। তন্মধ্যে নয় জন ছিল খাজরাজ গোত্রের এবং তিন জন আওস গোত্রের।[৪০. খাজরাজের নয় জন আহ্বায়ক হলেন: আসাদ ইবনে যুরারা, সা’দ ইবনে রাওয়াহা, রাফে’ ইবনে মালিক, বারা ইবনে মা’রূর, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম, উবাদা বনে ছামিত, সা’দ ইবনে উবাদা ও মুনযির ইবনে আমর ইবনে খুরাইস। আর আওস গোত্রের তিন জন ছিলেন: উসাইদ ইবনে হুদাইর, সা’দা ইবনে খাইসামা ও রিফায়া ইবনে মুনযির। ইবনে হিশাম বলেন, বিজ্ঞ ঐতিহাসিকগণ রিফায়ার স্থলে আবুল হাইসাম ইবনে তাইহানকে আহ্বায়ক বলে উল্লেখ করেন।]
যিনি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে হাত রেখে বাইয়াত করেন তিনি বারা ইবনে মা’রূর। পরে তিনি নিজ গোত্রকে ঐ বাইয়াতে শামিল করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমাদের এই বাইয়াত অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শয়তান আকাবার পর্বত শীর্ষ থেকে এমন জোরে চিৎকার করে উঠলো যে, ও রকম বিকট চিৎকার আমি আর কখনো শুনিনি। সে চিৎকার করে বলছিলো, “হে মিনাবাসী, মুজাম্মাম অর্থাৎ নিন্দিত ব্যক্তির সাথে ধর্মদ্রোহীরা যে যোগসাজশ করলো তা কি তোমরা লক্ষ্য করলে না? [৪১.মুজাম্মাম অর্থ ধিকৃত বা নিন্দিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মুহাম্মাদের (প্রশংসিত) বিপরীত শব্দ। মুশরিকরা তাঁকে এই নামে ডাকতো। আর যারা ইসলাম গ্রহণ করতো তাদেরকে বলতো সাবি অর্থাৎ সাবি অর্থাৎ ধর্মত্যাগী বা বে-দীন।] ওরা তোমাদের সাথে যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ হলো আকাবার শয়তান আযেব ইবনে উযাইবের চিৎকার।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা নিজ নিজ কাফিলায় বলে যাও।”
‘আব্বাস এবন উবাদা ইবনে নাদালা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, যে আল্লাহ আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ করে বলছি, আপনি চাইলে আমরা আগামীকালই মিনায় অবস্থানকারীদের ওপর তরবারী নিয়ে হামলা চালাবো।”
এরপর আমরা গিয়ে শয্যাগ্রহণ করলাম এবং সকাল পর্যন্ত ঘুমালাম। সকাল হতেই কুরাইশদের বিরাট একটি দল আমাদের ঘিরে ধরলো।। তারা বললো, “হে খাজরাজ গোত্রের লোকগণ, আমরা জানতে পেরেছি যে, তোমরা মুহাম্মাদকে আমাদের মধ্য থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছো এবং আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তার সাথে ষড়যন্ত্র¿ করছো। সত্যি বলতে কি, আরবের আর কোন গোত্রের সাথে যুদ্ধের চেয়ে তোমদের সাথে যুদ্ধ আমাদের কছে সবচেয়ে অপছন্দীয়।” এ কথা শুনে আমাদের যেসব মুশরিক সেখানে ছিল, তারা আল্লাহর শপথ করে করতে লাগলো, “এ ধরনের কোন ষড়যন্ত্রই এখানে হয়নি এবং আমরা তেমন কিছু ঘটেছে বলে জানি না।”
বস্তুত:তারা সত্য কথাই বলছিল। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানতো না। তারা যখন আল্লাহর শপথ করে কুরাইশদের এসব বলে আশ্বস্ত করছিল তখন আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। এরপর মিনা থেকে লোকজন চলে গেলে কুরাইশরা ব্যাপারটা আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান চালালো। শেষ পর্যন্ত তারা জানতে পারলো যে, ঘটনাটা সত্য। অতঃপর আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকদের সন্ধানে তারা চারদিকে ছুটাছুটি শুরু করলো। মক্কার নিকটবর্তী আযাখের নামক স্থাকে তারা সা’দ ইবনে উবাদা, মুনযির ইবনে আমররে সাক্ষাত পেলো। মুনযিরকে তারা ধরতে পারলো না, কেবল সা’দ ধরা পড়লেন। সা’দের চুল ছিল বেশ লম্বা। তারা তাঁকে ধরে উটের রশি দিয়ে দুই হাত ঘাড়ের সাথে এঁটে বাঁধলো। তারপর তাঁকে পিটাতে পিটাতে চুল ধরে টানতে টানতে মক্কায় নিয়ে গেল।
এ সম্পর্কে সা’দ নিজে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিম্নরূপ, আমি তাদের হাতে ধৃত ও বন্দী অবস্থায় ছিলাম। এমতাবস্থায কুরাইশদের একটি দল আমার কাছে আসলো। তাদের ভেতরে খুবই উজ্জ্বল ফর্সা, সুন্দর ছিপছিপে লম্বা ও মিষ্টি চেহারার অধিকারী এক সুদর্শন পুরুষকে দেখলাম। আমি মনে মনে বললাম: এই বিপুল জনতার মধ্যে কারো কাছে যদি ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করা যেতে পারে তা হলে এই ব্যক্তির কাছেই। কিন্তু এ লোকটা আমার কাছে এসে প্রথমেই আমাকে প্রচ- এক থাপ্পড় কষে দিলো। তখন আমি মনে মনে বললাম, এই লোকটার কাছ থেকেই যখন এমন ব্যবহার পেলাম, তখন আর কারো কাছ থেকেই ভালো ব্যবহার আশা করা যায় না। এভাবে তারা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। আমি তখন সম্পূর্ণ অসহায়। সহসা জনতার মধ্য হতে এক ব্যক্তি আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বললো, “আহ্! কি দুঃখজনক দশা তোমার। আচ্ছা কুরাইশদের ভেতরে কি তোমার জানাশোনা বা লেনদেন আছে এমন একটা লোকও নেই?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, আছে। আমি এক সময় যুবাইর ইবনে মুতয়িম ইবনে আদীর বাণিজ্য প্রতিনিধিদের আশ্রয় দিতাম এবং আমাদের অঞ্চলে কেউ তাদের ওপর যুলুম করতে চাইলে তাদেরকে রক্ষা করতাম। তা ছাড়া হারেস ইবনে হারব ইবনে উমাইয়ার বাণিজ্য প্রতিনিধিদেরকেও সাহায্য করতাম। ”লোকটি বললো, ‘তা হলে ঐ দু’জনের সাম উল্লেখ করে খুব উচ্চস্বরে ধ্বনি দাও। তাদের সাথে তোমার যে সম্পর্ক রয়েছে তার উল্লেখ কর।” আমি সঙ্গে সঙ্গে ঐ দু’জরের নামে ধ্বনি দিলাম। আর ঐ লোকটি তৎক্ষণাৎ যুাবাইর ও হারেসের সন্ধানে ছুটে গেলো এবং কা’বার সন্নিকটে মসজিদুল হারামের মধ্যে তাদেরকে পেলো।
অতঃপর সে তাদেরকে বললে, “মক্কার অদূরের সমভূমিতে খাজরারের একটা লোককে এই মুহূর্ত ভীষণভাবে পিটানো হচ্ছে। সো মার খাচ্ছে আর তোমরদের দু’জনের নামোল্লেখ করে বলছে যে, তার সাথে নাকি তোমাদের জানাশোনা আছে।”যুবাইর ও হারেস বললো, “লোকটি কে?” সে বললো, ‘সা’দ ইবনে উবাদা।” তারা বললো, “ঠিকই বলেছে। সে আমাদের ব্যবসায়ীদেরকে তাদের এলাকায় গেলে আশ্রয় দিতো এবং যুলুম থেকে রক্ষা করতো।” অতঃপর উভয়ে এসে সা’দকে জনতার হাত থেকে উদ্ধার করলো। তারপর সা’দ চলে গেলেন।
আকাবার শেষ বাইয়াত ও তার শর্তাবলী
আকাবার শেষ বাইয়াতটি সম্পন্ন হয় আল্লাহর তরফ থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি লাভের পর। তাই যুদ্ধের অঙ্গীকার ছাড়া এই বাইয়াতের শর্তাবলী ছিলো প্রথম বাইয়াতের শর্তাবলীর অনুরূপ। প্রথম বাইয়াত ছিল মক্কা বিজয়ের মহিলাদের বাইয়াতের অনুরূপ। কারণ প্রথম বাইয়াতের সময় আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধের অনুমতি দেননি। তাই অনুমতি লাভের পর আকাবার শেষ বাইয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’মিনদের নিকট থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, তারা দুনিয়ার সকল কাফিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। তিনি তাদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অঙ্গীকারের শর্তাবলী আরোপ করেন এবং সেই শর্তাবলী সহ অঙ্গীকার পালন করলে তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে বলে ঘোষণা করেন।
‘উবাদা ইবনে ছামিত (রা) বর্ণনা করেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যুদ্ধের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হলাম। সেই অঙ্গীকারের শর্তবলী ছিলো এই: অবস্থা কঠিন কিংবা স্বাভাবিক যা হোক না কেন আমরা সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলবো এবং আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারের পরোয়া করবো না।”
সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশ লাভ
আকাবার বাইয়াতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধের বা প্রয়োজনে রক্তপাত ঘটানোর অনুমতি দেয়া হয়নি। তখন পর্যন্ত তাঁকে শুধু আল্লাহর দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়া, যুলুম নির্যাতনে ধৈর্যধারণ করা এবং অজ্ঞ লোকদের ক্ষমা করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণকারী যেসব লোককে ঘরবাড়ী ত্যাগ করতে হয়েছিলো, তাদের উপরে কুরাইশরা চরম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিলো। অসহ্য নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ কেউ ইসলাম ত্যাগ করতেও বাধ্য হয়েছিলো। কুরাইশরা বেশ কিছু সংখ্যাক ঈমানদারকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলো। এভাবে মুসলমানেদের কেউবা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো, কেউবা ইসলাম পরিত্যাগ করেছিল, কেউবা দেশত্যাগ করেছিলো। তাদের তধ্যে অনেকে হাবশায় এবং অনেকে মদীনায় হিজরাত করেছিলো এভাবে সবদিক দিয়েই মুসলমানরা যখন লাঞ্ছিত ও সর্বস্বান্ত, কুরাইশরা খোদাদ্রোহিতার শেষ সীমায় উপনীত এবং তাঁর নবী প্রত্যাখ্যাত, তখনই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা এবং যালিম খোদাদ্রোহীদেরকে পর্যুদস্ত করার অনুমতি দিলেন। উরওয়া ইবনে যুবাইর ও অন্যান্য বর্ণনাকারীদের নিকট থেকে আমি যা জানতে পেরেছি। তদনুসারে আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠা ও ঈমানদারদের প্রতিরক্ষার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ ও রক্তপাত বৈধ ঘোষণা করে সর্বপ্রথম যে আয়াতগুলো নাযিল হয়, তা হলো-
[আরবী *************]
“যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হচ্ছে তাদেরকে (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া গেল। কারণ তারা মাযলুম। বস্তুত: আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করার মত ক্ষমতাশালী। তারা সেই সব লোক, যাদেরকে শুধু ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’ এই কথাটুকু বলার কারণে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ঘরবাড়ী থেকে তাড়িয়ে দেয় হয়েছে। আল্লাহ যদি একদল মানুষকে আরেক দল দিয়ে দমন করার ব্যবস্থ না রাখতেন তাহলে মন্দির, গীর্জা, সব ইবাদাতখানা ও মসজিদসমূহ, যেখানে বেশী করে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়ে থাকে ধ্বংস করে দেয়া হতো। আল্লাহকে যে সাহায্য করবে আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। বস্তুত: আল্লাহ শক্তিশালী মহা প্রতাপান্বিত। তারা সেই সব লোক যাদের আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা ও সুযোগ দিলেই নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ন্যায় ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবে এবং অন্যায় ও অসত্যকে প্রতিরোধ করবে। আল্লাহর হাতেই সব কিছুর চূড়ান্ত পরিণতি। (সূরা হজ্জ ৩৯-৪১)
অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের ওপর যুলুম নির্যাতন হওয়ার কারণেই আমি তাদের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ বৈধ করেছি। তারা মানুষের প্রতি কোন অপরাধ বা পাপ করেনি। তারা যখনই বিজয়ী হবে তখনই নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ প্রতিহত করবে। এরপর আল্লাহ আবার নাযিল করেনÑ
[আরবী *************]
“তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও যাতে কোন মু’মিনকে আর তার দীন পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা না হয় এবং একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য অবশিষ্ট থাকে।” (সূরা বাকারাহ্) অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাাত বা দাসত্ব করা হয়, অন্য কারো নয়।
মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরাত করার অনুমতি দান
আল্লাহর তরফ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন যুদ্ধের অনুমতি দেয় হলো আর মদীনাবাসীদের উপরোক্ত দলটি ইসলামী বিধানের অনুসরণ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুরসারীদের সর্বত্মক সাহায্য সহযোগিতা দানের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সব মুসলমানকে মদীনায় হিজরাত করে তাদের আনসার ভাইদের কাছে-চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য একটি নিরাপদ আবাসভূমি ও কিছুসংখ্যক ভাই সংগ্রহ করে দিয়েছেন।” ফলে মুসলমানগণ দলে দলে হিজরাত করতে শুরু করলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরাতের জন্য আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় মক্কায় অবস্থান করতে লাগলেন।
মদীনায় হিজরাতকারী মুসলমানদের বিবরণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের কুরাইশ বংশীয় প্রথম মুহাজির ছিলেন বনী মাখযুম গোত্রের আবু সালামা ইবনে আবুদুল আসাদ। আকাবার বাইয়াতের এক বছর আগে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন। ইতিপূর্বে তিনি আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে আসেন। এই সময় কুরাইশরা তাঁকে উৎপীড়ন করতে লাগলো। তিনি মদীনাবাসীদের ইসলাম গ্রহনের খবর শুনতে পেলেন। এবং তাঁর সাথে হিজরাত করে চলে গেলেন। আবু সালামার পর আমের ইবনে রাবীয়া এবং মদীনায় তার স্ত্রী লায়লা বিনতে আবু হাসমা মদীনায় হিজরাত করেন। তারপর আবুল্লাহ ইবনে জাহাশ তাঁর পরিবার পরিজন ও ভাই আবদ ইবনে জাহাশকে সাথে নিয়ে হিজরাত করেন। তাঁর ভাইয়ের আর এক নাম ছিলো আবু আহমাদ। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিলো ক্ষীণ। তা সত্ত্বেও তিনি কারো সাহায্য ছাড়াই মক্কার উচ্চ ও সমতল এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি ছেলেন একজন কবি।
এপর উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ও আইয়াশ ইবনে আবু রাবিয়া মাখযুমী হিজরাত করে মদীনায় চলে যান। অতঃপর ব্যাপকহারে মুসলমানগণ মদীনায় হিজরাত করতে থাকেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরাত
সাহাবীগণ হিজরাত করে মদীনায় চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাতের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় থেকে গেলেন। এ সময়ে আলী ইবনে আবু তালিব, আবু বাক্র সিদ্দীক ও মুষ্টিমেয় ক’জন সাহাবা ছাড়া আর কেউ মক্কায় ছিলেন না। অন্য যারা ছিলো তারা হয় কাফিরদের হাতে বন্দী ছিল নতুবা ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো। আবু বাকর (রা) প্রায়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হিজরাত করার অনুমতি চাইতেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলতেন, “তুমি তাড়াহুড়ো করো না। হয়তো আল্লাহ তোমাকে একজন সাথী জুটিয়ে দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই তাঁর হিজরাতের সঙ্গী হন। হযরত আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) এরপর থেকে তাই কামনা করতেন। কুরাইশরা যখন দেখলো যে, অন্যত্র তাদের গোত্রের বাইরের বহু লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গীরা তাদের কাছে হিজরাত করে চলে যাচ্ছে, তখন তারা বুঝতে পারলো যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহচরগন একটা নিরাপদ আবাসভূমি পেয়ে গেছেন। তাই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেশত্যাগের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেলো। তারা ভাবলো যে, তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছেন।
এ ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য তারা পরমর্শগৃহ ‘দারুন্ নাদওয়ায়’ সমবেত হলো। এই গৃহটি ছিলো কুসাই ইবনে কিলাবের বাড়ী। কুরাইশরা যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে এখানেই সমবেত হতো। এবার তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর ব্যাপারে কি করা যায়, তাই নিয়ে আলোচনা করতে বসলো। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তারা নির্ধারিত দিনে সেখানে সমবেত হলো। এই দিনকে ‘গণসমাবেশ দিবস’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তাদের পরামর্শ গৃহে ঢুকবার পথে ইবলিস কম্বল আচ্ছদিত এক বৃদ্ধের বেশে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সে ঠিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে সবাই বললো, “বৃদ্ধ এই লোকটি কে?” সে বললো, “আমি নাজদের অধিবাসী। [৪২.সুহাইলী মতে, শয়তান নিজেকে নাজদবাসী বলে পরিচয় দেয়ার কারণ হলো, কুরাইশরা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো যে, তিহামা অঞ্চলের কোন লোককে এই পরামর্শ সভায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। কেননা তারা মনে করতো, তিহামাবাসী মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমর্থক। এজন্য ইবলিস নাজদবাসী বৃদ্ধের রূপ ধরে আত্মপ্রকাশ করেছিলো।]
তোমরা যে উপলক্ষে আজ সমবেত হচ্ছো, তা আমি শুনেছি। তাই তোমাদের কথাবার্তা শোনার জন্য এসেছি। আশা করি আমার উপদেশ ও পরামর্শ থেকেও তোমরা বঞ্চিত হবে না।”একথা শুনে সবাই তাকে পরম সমাদরে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। সে সবার সাথে প্রবেশ করলো। ততক্ষণে কুরাইশদের বড় বড় নেতা ও সরদার ভেতরে আসন গ্রহণ করেছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, “এই লোকটির তৎপড়তা বর্তমানে কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তোমরা সবাই তা জান। সে তার বাইরের অনুসারীদের নিয়ে কখন যে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার কোন ঠিক নেই। তার আক্রমণ থেকে আমরা এখন নিরাপদ নই। অতএব, সবাই মিলে তার ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।”
সলাপরামর্শ চলতে থাকলো। এক সময় একজন বললো, “তাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে কোন অর্গলবদ্ধ কুঠরীতে বন্দী করে রাখ। তারপর ইতিপূর্বে তার মত কবিদের যে পরিণতি হয়েছে তারও সেই পরিণতি অর্থাৎ শোচনীয় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাক। যুহাইব, নাবেগা ও তাদের মত অন্যান্য কবির এই পরিণতি হযেছিল। ” তখন বুড়ো বললো, “না, তোমাদের এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। তোমরা যদি তাকে বন্দী কর, তা হলে বদ্ধ কুঠরীতে তার বন্দী হওয়ার খবর তার বাইরের অনুসারীদের কানে চলে যাবে। সে অবস্থায় তারা তোমাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে তোমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অতঃপর তাদের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং একদিন তারা তোমাদের ওপর বিজয়ী হবে। কাজেই তোমাদের এ সদ্ধিান্ত সঠিক নয়। অন্য কোন সিদ্ধান্ত নিতে পার কিনা, ভেবে দেখ।”
এরপর আবার আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো। একজন বললো, “আমরা তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবো। এরপর তাকে নিয়ে আমাদের আর কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না। সে একাবার আমাদের কাছ থেকে চলে গেলে কোথায় গেলো বা কোথায় থাকলো আমরা তার কোন পরোয়া করবো না। সে চলে গেলে আমরা তার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। এরপর আমাদের পারস্পরিক মৈত্রী ও বন্ধুত্ব এবং অন্যান্য ব্যাপারে আমরা নিজেরাই শুধরে স্বাভাবিক করে নিতে পারবো।”
নাজদের বৃদ্ধ বললো, “না, এটাও সঠিক সিদ্ধান্ত হলো না। তোমরা কি তার অনুপম বাচনভঙ্গি, মিষ্ট ভাযা, যুক্তিগ্রাহ্য কথা এবং তথাকথিত ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত মন মগজ আছন্নকারী ব্যাপারগুলো দেখনি? তোমরা যদি এই পদক্ষেপ নাও, তাহলে এমনও হতে পারে যে, সে অন্য কোন আরব গোত্রে গিয়ে হাজির হবে, আর তার মিষ্ট ও হৃদয়গ্রাহী কথা দিয়ে তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং তারা তার অনুসারী হয়ে যাবে। অতঃপর তাদের নিয়ে তোমাদের ওপর হামলা চালিয়ে তোমাদের দেশ দখল করে তোমাদের হাত থেকে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবে। তোমরা এটা বাদ দিয়ে অন্য কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।”
এবার আবু জাহল বললো, “আমার একটা মত আছে য এতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কারো মাথায় আসেনি।” সবাই বললো, “বলো দেখি, আবুল হাকাম তোমার মত কি।”
সে বললো, “আমাদের প্রত্যেক গোত্র থেকে এক একজন শক্তিশালী সম্ভ্রান্ত যুবক বাছাই করতে হবে। তারপর তাদের প্রত্যেককে আমরা একটা করে ধারালো তরবারী দেবো। ওই যুবকেরা এক যোগে হামলা চালিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যা করবে। এভাবে আমরা তার থেকে নিস্তার পেতে পারি। আর তারা সবাই মিলে যখন এ কাজটা করবে, তখন মুহাম্মাদের খুনের দায় দায়িত্ব সকল গোত্রের ঘাড়েই কিছু না কিছু পড়বে। ফলে আবদ মানাফ গোষ্ঠী সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে লড়াই করে খুনের প্রতিশোধ নিতে পারবে না। রক্তপণ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হবে। আমরা সকল গোত্র মিলে তাদেরকে রক্তপণ দিয়ে দেবো।”
নাজদের বৃদ্ধ বললো, “এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি এর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আর হতে পারে না।”
এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে পরামর্শ সভার সমাপ্তি ঘোষনা করা হলো এবং সবাই যার যার বাড়ীতে চলে গেলো।
তৎক্ষণাৎ জিবরীল (আ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস তাঁকে বললেন, “আপনি প্রতিদিন যে বিছানায় ঘুমান আজ রাতে সে বিছানায় ঘুমাবেন না।”রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হলে নির্ধারিত ঘাতকের দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরের দরজায় এসে সমবেত হয়ে ওত পেতে থাকলো। তিনি কখন ঘুমান তার প্রতীক্ষা করতে লাগলো। ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর ওপর হামলা চালাবে এই তাদের বাসনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে আলী ইবনে আবু তালিবকে (রা) বললেন, “তুমি আমার বিছানায় ঘুমাও এবং আমার এই সবুজ হাদরামাউতী চাদর দিয়ে আপাদমস্তক আবৃত করে রাখ। তোমার ওপর তাদের দিক থেকে কোন আঘাত আসবে না, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাক।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমাবার সময় ঐ চাদরটি গায়ে জড়িয়ে নিতেন।
মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল কারযী বলেন, ঘাতক দলে আবু জাহলও ছিলো। ঘাতকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়ীর দরজার জাময়েত হলে আবু জাহল তাদেরকে বললো, “ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে যে, তোমরা যদি তার অনুসরণ কর তাহলে তোমাদের আরব ও অনারব সবার জন্য জর্ডানের বাগ বাগিচার মত অসংখ্য বাগ বাগিচা তৈরী করে দেয়া হবে। কিন্তু যদি তার অনুসরণ না কর তা হলে তোমরা ধ্বংস ও নির্মূল হয়ে যাবে। মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করে তোমাদেরকে আগুনে পোড়ানো হবে।”
ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে তাদের সামনে আসলেন। তিনি এক মুষ্ঠি ধূলি হাতে নিলেন। অতঃপর আবু জাহলকে লক্ষ্য করে বলতে লগলেন, “হ্যাঁ, আমি এ কথা বলি এবং যাদেরকে আগুনে পোড়ানো হবে তুমিও তাদেরই একজন।” এই সময় আল্লাহ তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিলেন। ফলে তারা তাঁকে দেখতে পেলো না। তিনি ঐ ধূলি তাদের মাথার ওপর ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। তিনি তখন সূরা ইয়াসীনের নিন্মোক্ত আয়াতসমূহ পড়ছিলেন-
“ইয়াসীন! জ্ঞানের ভা-ার কুরআনের কসম, নিশ্চয়ই তুমি রাসূল। তুমি সঠিক পথের ওপর আছ। এ কুরআন মহাপরাক্রান্ত করুনাময়ের নাযিল করা, যাতে তুমি এমন একটি জাতিকে সাবধান করে দিতে পার যাদের পূর্বপুরুষদের সাবধান করা হয়নি। পলে তারা অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। তাদের অধিকাংশ লোকই আল্লাহর আযাবের যোগ্য তাই তারা ঈমান আনছে না। আমি তাদের গলায় বেড়ি লাগিয়ে দিয়েছি। সেই বেড়িতে তাদের থুতনি পর্যন্ত শ্রংখলিত হয়ে গেছে। এ জন্য তারা মাথা উঁচু করে রয়েছে। আমি তাদের সামনে একটি প্রাচীর এবং পেছনে আরেকটি প্রাচীর দাঁড় করিয়ে তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি। তাই তারা দেখতে পায় না।” এই আয়াত কয়টি পড়তে পড়তে তিনি তাদের প্রত্যেকের মাথায় ধূলি নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর নিজের ইচ্ছামত একদিক চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর বাইরের এক ব্যক্তি তাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা এখানে কি জন্য অপেক্ষা করছো?” তারা বললো, “আমরা মুহম্মাদের অপেক্ষায় আছি।” সে বললো, “আল্লাহ তোমাদেরকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। মুহাম্মাদ তো তোমাদের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেছে। তোমাদের মাথায় কি রয়েছে, তা কি দেখতে পাচ্ছো না?” তখন প্রত্যেকে মাথায় হাত দিয়ে দেখলো, ধূলিতে মাথা আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
অতঃপর তারা গৃহতল্লাশী শরু করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাদর গায়ে দিয়ে আলীকে (রা) বিছানায় শয়িত দেখে বললো, “এই তো মুহাম্মাদ, চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে।” তাই তারা ভোর পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলো। সকালে আলী (রা) বিছানা থেকে উঠলে তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো, “লোকটা তাহলে তো ঠিকই বলেছে যে, মুহাম্মাদ চলে গেছে।”
ইবনে ইসহাক বলেন, আবু বাক্র ছিলেন খুব ধনবান ব্যক্তি। তিনি রাসূলুল্লাহর কাছে হিজরাতের অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলতেন, “তুমি তাড়াহুড়া করোনা। আল্লাহ হয়তো তোমাকে নিজের কথাই বলেছেন। তাই তিনি তখন থেকেই দুটো উট কিনে নিজের বাড়ীতে রেখেছিলেন। হিজরাতের প্রস্তুতিস্বরূপ তিনি এই কাজ করেছিলেন।
আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাক্রের বাড়ীতে সকালে হোক বা বিকেলে দিনে অন্ততঃ একবার যেতে ভুলতেন না। সেই দিনটা এসে উপনীত হলো যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কার স্বগোত্রীয়দেরকে ছেড়ে হিজরাত করে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। সেদিন তিনি দুপুরে আমাদের বাড়ীতে আসলেন। ঐ সময় কখনো তিনি আসতেন না। তাঁকে দেখে আবু বাক্র বললেন, “নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে তা না হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় আসতেন না।” তিনি বাড়ীতে প্রবেশ করলে আবু বাক্রের বাড়ীতে তখন আমি আর আমার বোন আসমা বিনতে আবু বকর ছাড়া আর কেউ ছিলো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা এখানে অন্য যারা রয়েছে, তাদেরকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দাও।” আবু বাক্র (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনার কি হয়েছে? আমাকে বলুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ আমাকে মক্কা থেকে চলে যাওয়ার ও হিজরাত করার অনুমতি দিয়েছেন।” আবু বাক্র বললেন, “আমিও কি সঙ্গে যেতে পারবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তুমিও সঙ্গে যেতে পারবে?।” আয়িশা (রা) সবলেন, সেদিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ আনন্দের আতিশয্যেও কাঁদতে পারে। আমি আবু বাক্র (রা) কে সেদিন কাঁদতে দেখেছি। অত:পর আবু কাক্র (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এই দেখুন, আমি এই উট দুটো এই কাজের জন্যই প্রস্তুত করে রেখেছি।” অতঃপর তারা আবদুল্লাহ ইবনে আরকাতকে পথ দেখিয়ে নেবার জন্য ভাড়া করে সাথে নিলেন। সে ছিলো মুশরিক। উট দুটো তার কাছেই রেখে গেলেন। সে নির্ধারিত সময়ের জন্য উট দুটির দেখাশুনা ও তত্ত্বাবধান করতে থাকলো।
ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা ত্যাগের সময় তাঁর মক্কা ত্যাগের কথা শধুমাত্র আলী ইবনে আবু তালিব (রা), আবু বাকর সিদ্দীক (রা) এবং আবু বাকরের পরিবার পরিজন ছাড়া আর কেউ জানতো না। আলীকে ব্যাপারটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই জানিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে মক্কায় কিছুদিন থাকতে বলেছিলেন। মক্কার লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নানা রকমের জিনিস গচ্ছিত রাখতো। যারা কোন জিনিস নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করতো না তারা তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আমানত রাখতো। কারণ তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথা সবার জানা ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাতের পর ঐ আমানত ফেরত দেয়ার জন্যই তিনি আলীকে (রা) দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং তাকে মক্কায় আরো কিছুদিন থাকার নির্দেশ দেন।
এবার আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়ী থেকে বের হবার পালা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আবু বাক্রের (রা) কাছে আসলেন। তারপর আবু বাক্রের ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে উভয়ে বের হলেন। অতঃপর তাঁরা মক্কার নিম্নভূমিতে অবস্থিত ‘সাওর’ পর্বতের একটি গুহার পাশে গিয়ে তার ভেতরে প্রবেশ করলেন। আবু বাকর তাঁর ছেলে ‘আবদুল্লাহকে বলে গেলেন, দিনের বেলায় লোকেরা তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলাবলি করে কিনা, তা যেন সে মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং সন্ধ্যার সময় তাঁদের কাছে গিয়ে সব কথা জানায়। (মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম ও পরে স্বেচ্ছায় মজুরীর ভিত্তিতে কর্মরত) ভৃত্য আমের ইবনে ফুহাইরাকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন, সে যেন দিনের বেলায় তাঁর মেষপাল চরায়, অতঃপর সেগুলোকে সাওরের ঐ পর্বত গুহার কাছে ছেড়ে দেয় এবং সন্ধ্যার সময় পর্বত গুহায় তাঁদের সাথে দেখা করে। আসমা বিনতে আবু বাক্র প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় তাঁদের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। [৪৩. হাসান বসরী (রহঃ) থেকে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ও আবু বাক্র (রা) সাওর পর্বত গুহায় পৌঁছেন রাতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রবেশের আগে আবু বাক্র (রা) গুহায় প্রবেশ করলেন। সেখানে কোন হিং¯্র প্রাণী বা সাপ আছে কিনা তা ভালো করে দেখে নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিপদমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি এরূপ ঝুঁকি নিয়েছিলেন। ]আবু বাক্রকে (রা) সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওর পর্বত গুহায় তিনদিন অবস্থান করেন। এদিকে কুরাইশরা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য একশো উট পুরস্কার ঘোষণা করলো। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র সারা দিন কুরাইশদের সাথেই মিলেমিশে থাকতেন এবং তাদের সলাপরামর্শ শুনতেন। তারা তাঁদের উভয়ের সম্পর্কে যা যা মন্তব্য করতো তাও শুনতেন। অতঃপর সন্ধ্যার সময় তাঁদের কাছে গিয়ে সারা দিনের যাবতীয় খবর জানাতেন। আর ভৃত্য আমের ইবনে ফুহাইরা মক্কাবাসীদের পশুপালের সাথেই আবু বাকরের (রা) মেষপাল চরিয়ে বেড়াতো। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই সেগুলোকে ‘সাওর’ পর্বতগুহার কাছে নিয়ে ছেড়ে দিতো, তখন তাঁরা উভয়ে মেষের দুধ দোহন করতেন অথবা জবাই করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র সকালে ‘সাওর’ পর্বত গুহা থেকে বেরিয়ে মক্কায় যেতেন তখন আমের ইবনে ফুহাইরা তার মেষপাল নিয়ে পিছু পিছু যেতেন যাতে তার পদচিহ্ন মুছে যায়। এভাবে তিনদিন অতিবাহিত হলে তাদের সম্পর্কে মক্কাবাসীদের হৈ চৈ ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসলো। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আরাকাত নিজে একটি উটে চড়ে রাসূলুল্লাহ ও আবু বাক্রের (রা) উট দুটিকে সাথে নিয়ে সাওর পর্বত গুহায় হাজির হলো। আসমা বিনতে আবু বাকর পথের খাবার নিয়ে তাদের কাছে আসলো। কিন্তু খাবার ঝুলিয়ে বেঁধে দেয়ার মত কোন রশি আনতে সে ভুলে গিয়েছিলো। উভয়ে রওনা হলেন। আসমা খাবার ঝুলানো চেষ্টা করলো, কিন্তু দেখলো কোন রশি নেই। অগত্যা সে নিজের কোমর বন্ধনী খুলে তা ফেড়ে রশি বনিয়ে খাবার বেঁধে ঝুলিয়ে দিলো। এই জন্য আসমা বিনতে আবু বাক্রকে ‘যাতুননিতাকাইন’ দুটি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণীর বলে অভিহিত করা হতো। [৪৪.ইবনে হিশাম বলেন, আমি একাধিক বিজ্ঞজনের কাছে শুনেছি যে, আমাকে যাতুননিতাকাইন অর্থাৎ ‘দুই কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী বলা হতো। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, আসমা যখন খাবারের পাত্র বেঁধে ঝুলিয়ে দিতে চাইলো, তখন নিজের বেল্টটি দ্বিখ-িত করলো, একটি দিয়ে তা ঘুরিয়ে বাঁধলো, অপরটি দিয়ে ঝুলালো।]
আবু বাক্র উট দুটোকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এনে সবচেয়ে ভালো উটটি তাঁকে দিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কুরবার হোক। এতে আরোহণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে উট আমার নয় তাতে আমি আরোহণ করবো না।” তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এটি আপনার। আপনার উপর আমার পিতামাতা কুরবান হোক।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না তবে কত দাম দিয়ে এটি কিনেছো বল।” আবু বাক্র উটের দাম বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি এই দামের বিনিময়ে উটটি নিলাম।” আবু বাক্র বললেন, “উট ও তার দাম উভয়ই আপনাকে দিয়ে দিলাম।”
অতঃপর উভয়ে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যাত্রা শুরু করলেন। আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ভৃত্য আমের ইবনে ফুহাইরাকে পথিমধ্যে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য পেছনে চড়িয়ে নিলেন।”
আসমা বিনতে আবু বাকর বলেন, আবু বাক্র (রা) ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওনা হয়ে যাওয়ার পর আবু জাহল সহ কুরাইশদের একটি দল আসলো। তারা আবু বাক্রের (রা) দরজার সামনে দাঁড়ালো। আমি তাদের কাছে গেলাম। তারা বললো, “তোমার আব্বা কোথায়? ” আমি বললাম, ‘আব্বা কোথায় জানি না।” সঙ্গে সঙ্গে পাষ- নরাধম আবু জাহল আমার মুখে এমন জোরে থাপ্পর মারলো যে, আমার কানবালাটি ছিটকে পড়ে গেলো।
অতঃপর তারা চলে গেলো। ইতিমধ্যে তিনদিন কেটে গেলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দিকে রওয়ানা হয়েছেন তার কোন হদিস পাওয়া গেলো না। হঠাৎ মক্কার নিম্নভূমি থেকে এক জিন গান গাইতে গাইতে আসলো। লোকেরা তাকে দেখতে পাচ্ছিলো না। কিন্তু তার আওয়াজ শুনে তাকে অনুসরণ করতে লাগলো। দেখতে দেখতে সে মক্কার উচ্চভূমি অতিক্রম করে চলে গেল। সে যে গানটি গাচ্ছিলো তা হলো:
[আরবী *************]
“মানুষের প্রভু আল্লাহ সেই দুই বন্ধুকে সর্বোত্তম পুরস্কার দিক-যারা উম্মে মা’বাদের বাড়ীতে [৪৫. উম্মে মা’বাদের প্রকৃত নাম আতিকা বিনতে খালিদ। সে বনু কা’ব গোত্রের এক মহিলা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ‘আবু বাক্র, আমের ইবনে ফুইহারা ও আবদুল্লাহ ইবনে আরকাত এই মহিলার বাড়ীতে যাত্রাবিরতি করেন। তাঁরা এই মহিলার কাছ থেকে কিছু গোশত ও খোরমা ক্রয়ের ইচ্ছা ব্যাক্ত করেন। কিন্তু সেখানে কোনটাই ছিলো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে মা’বাদের ঘরের এক কোণে একটা ছাগল দেখতে পেলেন। ছাগলটি দুধ দিতো না। তিনি ঐ মহিলার নিকট ছাগলটির দোহন করার অনুমতি চাইলেন। অতঃপর তিনি হাত দেয়ে তার পালান ধরতেই তা দুধে ভরে উঠলো। এ দৃশ্য দেখে মহিলা তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন]
আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তারা বদান্যতা সহকারে যাত্রাবিরতি করেছে, অতঃপর পুনরায় যাত্রা করেছে। যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের বন্ধু হয়েছে, সে সফলকাম হয়েছে। বনু কা’বের যুবতীটির মুসলিমদের ব্যবস্থা তদারক করার জায়গায় উপস্থিত থাকা ও উপবিষ্ট থাকার জন্য সমগ্র বনু কা’বই অভিনন্দিত হোক।”
তার এ কথা শুনে আমরা বুঝতে পারলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেছেন।”
সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জু’সাম বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার পথে মক্কা ত্যাগ করেন। কুরাইশরা তাঁকে পাকড়াও করে আনার বিনিময়ে একশো উষ্ট্রী পুরস্কার ঘোষণা করেন। একদিন আমি নিজ গোত্রের পরামর্শ সভায় বসে আছি আমাদেরই এক ব্যক্তি আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো। সে বললো, “আল্লাহর শপথ, আমি এই মাত্র তিনজনের একটা দলকে যেতে দেখে আসলাম। আমার মনে হয়, তারা মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গী সাথীরাই হবে।” আম তাকে চোখ টিপে চুপ করতে ইশারা করলাম। অতঃপর বললাম, “ওরা অমুক গোত্রের লোকজন। তাদের একটা পশু হারিয়ে গেছে, সেটাই খুঁজে বেড়াচ্ছে।” সে বললো, “হয়তো তাই।”
সে আর কোন কথা বললো না। সেখানে অল্প কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমি বাড়ীতে গেলাম এবং ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে নিয়ে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। আমার ভাগ্য গণনার তীরটিও সাথে নিলাম। তারপর যুদ্ধের পোশাক পরে রওয়ানা হলাম। পথে বেরিয়ে এক জায়গায় গিয়ে তীর দিয়ে ভাগ্য গণনা করলাম। যা আমার একেবারেই অপছন্দ, তীর ঠিক সেই ভবিষ্যদ্বণীই করলো। অর্থাৎ ‘মুহাম্মাদের কোন ক্ষতি হবে না।’ আসলে আমার ইচ্ছা ছিলো তাকে পাকড়াও করে কুরাইশদের হাতে তুলে দিয়ে পুরস্কারের একশো উষ্ট্রী লাভ করা। তাদের পদচিহ্ন ধরে আমি দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে এগিয়ে চললাম ঘোড়টি আমাকে নিয়ে যেইমাত্র প্রবল বেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে, অমনি সেটি হোঁচট খেলো। আমি ঘোড়ার পিঠের ওপর থেকে ছিটকে রাস্তার ওপর এসে পড়লাম। আমি তখন মনে মনে বললাম,‘ব্যাপার কি!’ আবার ভাগ্য গননার তীর বের করে তা দিয়ে গণনা করলাম। এবারও একই ফল পাওয়া গেলো: ‘তার কোন ক্ষতি হবে না।’ অথচ এরূপ সিদ্ধান্ত আমার কাম্য ছিলো না। আমি তবুও নাছোড়বান্দা।
কিছুতেই থামতে রাজী নই। আবার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে জোরে ঘোড়া হাঁকালাম। মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীরা আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে এসে গেলো এবং তাদেরকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ সেই মুহূর্তে ঘোড়াটি আবার হোঁচট খেলো। আমি ছিটকে পড়লাম। মনে মনে বললাম ব্যাপার কি! আবার তীর বের করে গণনা করলাম। এবারও অবাঞ্ছিত সিদ্ধান্ত বেরুলো: ‘তাঁর কোন ক্ষতি হবে না।’ এবারও আমি দমলাম না। তাদেরকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম। আবার তাদেরকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। দেখতে পাওয়া মাত্রই ঘোড়া আবার হোঁচট খেলে এবার ঘোড়ার সামনের পা দুটি মাটিতে দেবে গেলো এবং আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। পা দু’খানা টেনে বের করার সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গা থেকে কু-লি পাকিয়ে ধোঁয়া বের হতে থাকলো। এবার আমি বুঝতে পারলাম যে, মুহাম্মাদকে আমার হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে এবং সে অজেয়। অতঃপর আমি তাদেরকে ডাক দিয়ে বললাম, “আমি জুসামের পুত্র সুরকা। তোমরা একটু থামো, তোমাদের সাথে আমার কথা আছে। আল্লাহর শপথ, তোমাদের ব্যাপারে আমার সংশয় দূর হয়ে গিয়েছে। আমার দিক থেকে কোন অবাঞ্ছিত ব্যাবহার তোমরা পাবে না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাকরকে বললেন, “তাকে জিজ্ঞেস করো সে আমাদের কাছে কি চায়?” আমি বললাম, “আমাকে একটা বাণী লিখে দাও। সেই লেখা তোমাদের ও আমার মধ্যে একটা প্রমাণস্বরূপ থাকবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকরকে কিছু লিখে দিতে বললেন।
আবু বাক্র (রা) একটা হাড়ের ওপর (অথবা কাপড়ের টুকরায় অথবা ভাঙ্গা মৃৎ পাত্রের টুকরায়) একটা বাণী লিখে আমার দিকে ছুড়ে মারলেন। আমি সেই টুকরাটা কুড়িয়ে নিলাম এবং আমার তীরের খাপের মধ্যে পুরে নিয়ে ফিরে আসলাম। এই ঘটনার কথা অতঃপর আর কারো কাছে ব্যক্ত করলাম না। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা জয় করলেন এবং হুনাইন ও তায়েফ অভিযান সম্পন্ন করলেন, তখন আমি ঐ লেখাটা নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী জো’রানায় তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। আমি আনসারদের একটি সেনাদলের কাছে উপস্থিত হলাম। তারা বর্শা দিয়ে আমাকে মৃদু খোঁচা দিতে দিতে বললো, “ভাগো, ভাগো। কি চাও এখানে?” আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি তখন উটের ওপর সওয়ার ছিলেন। আমি যেন এই মুর্হূতেও দেখতে পাচ্ছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চর্বির মত সচ্ছ ও শুভ্র পাদু খানি জিনের পাদানিতে রেখে বসে আছেন। আমি সেই লিখিত টুকরাটি উঁচু করে দেখিয়ে বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটি সেই বস্তু যাতে আপনি একটি বাণী লিখে দিয়েছিলেন। আমি জুসামের পুত্র সুরাকা। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আজ ওয়াদা পালন ও সৌজন্য প্রদর্শনের দিন। কাছে আস।” আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করলাম। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করার মত একটি বিষয় মনে হলে তা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু এখন তা মনে সেই। আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি নিজের উটের জন্য পানি দিয়ে চৌবাচ্চা ভরে রাখি। কিন্তু অন্যদের পথহারা উটগুলো এসে তার ওপর চড়াও হয় এবং পানি পান করে ফেলে। এভাবে ঐ সব উটকে পানি পান করাই তা হলে আমার সওয়াব হবে কি? তিনি বললেন, “ যে কোন প্রাণীর চাহিদা পূরণ করলেই সওয়াব হয়।” এরপর আমি নিজ গোত্রের কাছে ফিরে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমার সদকার প্রাণী পৌঁছিয়ে দিলাম।
ইবনে ইসহাক বলেন, পথপ্রদর্শক আবদুল্লাহ ইবনে আরকাত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সাথে নিয়ে মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে এগিয়ে চললো। অতঃপর উপকূলবর্তী এলাকায় গিয়ে উপনীত হলো। সেখান থেকে উসফান অঞ্চলের নিম্নভূমি দিয়ে অগ্রসর হয়ে কুদাইদ অতিক্রম করার পর খাররার নামক স্থানে গিয়ে উপনীত হলো। অতঃপর লেকফ্ ও মাদলাজা লেকফ্ অতিক্রম করে মাদলাজ মাহাজ নামক জায়গায় পৌঁছলো। সেখান থেকে মারজাহ মাহাজ, মারজাহ যিল গাদাওয়াইন তারপর বাতন যি কাশর ও জাদাজিদ হয়ে আজরাদ পৌঁছলো। তারপর মাদলাজা তিহিনের শত্রু এলাকা যা-সালাম অতিক্রম করে আবাবিদ ও তারপরে আল-ফাজ্জাহ অতিক্রম করলো।
ইবনে হিশাম বলেন, অতঃপর সে তাদেরকে নিয়ে আরজ নামক স্থাকে উপনীত হলো। তাখন সেখানকার অধিবাসীদের বেশ কিছু লোক সেখানে তাদের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলো। আসলাম গোত্রের আওস ইবনে হাজার নামক স্থানে উপনীত হলো। তখন সেখানকার অধিবাসীদের বেশ কিছু লোক সেখানে তাদের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলো। আসলাম গোত্রের আওস হাজার নামক এক ব্যক্তি ইবনুর রিদা নামক তার একটা উটে আরোহণ করিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। মাসউদ ইবনে হুনাইদা নামক তার এক ভৃত্যকেও সে তাঁর সাথে পাঠালো। এরপর পথপ্রদর্শক তাদের উভয়কে নিয়ে আরজ ত্যাগ করলো। রুকুবার ডান দিক দিয়ে সানিয়াতুল আয়ের হয়ে বাতনু রীমে গিয়ে উপনীত হলো। সেখান থেকে সরাসরি কুবায় বনু আমর ইবনে আউফ গোত্রের বসতিতে গিয়ে হাজির হলো। তখন ছিলো রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখের প্রখর রৌদ্র ঝলসানো দুপুর। সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপরে এসে গিয়েছে।