রাসূলুল্লাহর (সা) আন্দোলন প্রতিরোধে উতবার ফন্দি
একটি সুত্র আমাকে জানিয়েছে যে, বিশিষ্ট কুরাইশ সরদার উতবা ইবনে রাবীআ একদিন কুরাইশদের দরবারে বসে ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সমজিদে হারামে একাকী বসেছিলেন। উতবা বললো, “হে কুরাইশগণ, আমি মুহাম্মাদের কাছে যেয়ে কিছু কথা বলবো। তার কাছে কিছু প্রস্তাব রাখবো। হয়তো সে কিছু প্রস্তাব মেনে নেবে এবং তার প্রচার বন্ধ করবে। তোমরা এটা কেমন মনে কর?”
এ সময়ে হামযা ইসলাম গ্রহণ করায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করেছে। তাই সকলে বললো, “খুব ভালো প্রস্তাব। আপনি যান এবং কথা বলুন।”
উতবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেল এবং তাঁর পাশে গিয়ে বসলো। সে বললো, “ভতিজা, তুমি আমাদেরগোত্রের মধ্যে কতখানি সম্ভ্রান্ত ও বংশমর্যাদা সম্পন্ন তা তোমার অজানা নয়। তুমি একটা মারাত্মক ব্যাপার নিয়ে তোমার জাতির কাছে আবির্ভূত হয়েছ। তোমার এ দাওয়াত জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। তুমি তাদেরকে বেকুফ ঠাউরিয়েছ এবং তাদের পূর্বপুরুষদের হেয় প্রতিপন্ন করেছ। আমার কথা শোনো! তোমার কাছে কয়েকটা বিকল্প প্রস্তাব রাখছি। একটু ভেবে দেখো এর কিছু কিছু মেনে নিতে পার কিনা।”
রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “বেশ, বলুন। আমি শুন।”
উতবা বললো, “ভাতিজা, তুমি যে নতুন দাওয়াত দিতে শুরু করেছ, এর দ্বারা যদি বিপুল সম্পদ লাভ করা তোমার ইচ্ছা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তোমার জন্য অর্থ সংগ্রহ করে তোমাকে আমাদের ভিতরে সবচেয়ে বিত্তশালী বানিয়ে দেবো। আর যদি তুমি পদমর্যাদা লাভ করতে চাও তাহলে আমরা তোমাকে এ দেশের রাজা বানিয়ে দেবো। আর যদি এমন হয়ে থাকে যে, তোমার কাছে জ্বিন আসে, তাকে তুমি হটাতে পারছ না, তাহলে আমরা তোমার চিকিৎসা করাবো। যত টাকা লাগুক তোমাকে সুস্থ করে তুলবো। কেননা অনেক সময় জ্বিন মানুষের ওপর পরাক্রান্ত হয়ে থাকে এবং তাকে তাড়ানোর জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।”
এই পর্যন্ত বলে উতবা থামলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনোযোগ সহকারে উতবার কথা শুনছিলেন। তার কথা শেষ হলে তিনি বললেন, “হে আবুল ওয়ালীদ, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?”-“হাঁ।” তিনি বললেন, “তাহলে আমার কিছু কথা শুনুন।” উতবা বললো, বলো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুরা হামীম আস সাজদা তিলাওয়াত করা শুরু করলেন। “বিসমিল্লাহির রাহমনির রাহীম। হা-মীম! এটা পরমত করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া কিতাব। আরবী ভাষায় নাযিলকৃত কিতাব কুরআন। এর আয়তগুলোকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, জ্ঞানী লোকদের জন্য। সুসংবাদবাহী ও সতর্ককারী হিসেবে তা এসেছে। কিস্তু তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে; তারা শুনতে চায় না। তারা বলে, তুমি যে বিষয়ের দিকে আমাদের আহ্বান করছো, আমাদের মন তা থেকে পর্দার আড়ালে রয়েছে।”উতবা স্তব্ধ হয়ে শুনতে লাগলো। সে পেছনের দিকে হাতে ভর দিয়ে বসে খুবই মনোযোগের সাথে তাশুনছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করতে করতে ঐ সূরায় সিজদার আয়াতে গিয়ে থামলেন এবং সিজদা করলেন।[২৫.আয়াতটি হলো এই : দিন ও রাত,সূর্য ও চন্দ্র এ সবই আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। তোমরা সূর্য ও চন্দ্রের উদ্দেশ্যে সিজদা করো না- একমাত্র আল্লাহকে সিজদা কর,যিনি এসব সৃষ্টি করেছেন- যদি একমাত্র তাঁর ইবাদাত করতে প্রস্তুত থেকে থাক।] এরপর বললেন, “যা শুনবার তা তো শুনলেন। এখন যা করনীয় মনে করেন করুন।”
অতঃপর উতবা উঠে তার সঙ্গীসাথীদের কাছে ফিরে গেলো। সঙ্গীরা তাকে দেখে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, উতবা এক রকম চেহারা নিয়ে গিয়েছিল, এখন ভিন্ন রকম চেহারা নিয়ে ফিরে আসছে।” দলবলের মধ্যে গিয়ে বসতেই সবাই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “হে আবুল ওয়ালীদ, আপনার কথা কী?”
উতবা বললো, “আমি এমন বাণী শুনেছি যা আর কখনো শুনিনি। হে কুরাইশগণ, সত্যিই তা কবিতাও নয়, কোন জ্যোতিষীর কথাও নয়। তোমরা আমার কথা শোনো এবং এই ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। এই লোকটা যা করতে চায় করতে দাও। তার সাথে কোন সংশ্রব রাখো না। আমি নিশ্চিত যে, মুহাম্মাদ যে কথা প্রচারে নিয়োজিত, তা ভবিষ্যতে বিরাট আলোড়ন তুলবে। আরবরা যদি তার বিপর্যয় ঘটায় তাহলে তোমরা অন্যের সাহায্যে তার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেলে। আর যদি সে আরবদের ওপর জয়যুক্ত হয় তাহলে তার রাজত্ব তোমাদেরই রাজত্ব হবে। তার মর্যাদা তোমাদেরই মর্যাদার কারণ হবে। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সৌভাগ্যবান জনগোষ্ঠী।” এ কথায় সবাই একবাক্যে বলে উঠলো, “মুহাম্মাদ এবার তোমাকে যাদু করেছে।” উতবা বললো, “এটা আমার অভিমত। এখন তোমরা যা ভাল বুঝ কর।”
কুরাইশ নেতাদের সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) কথোপকথন
মক্কার কুরাইশ গোত্রসমূহের নারী ও পুরুষদের মধ্যে ইসলাম ক্রমান্বয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর কুরাইশরা মুসলমানদের যাকে পারতে আটক করে রাখতো এবং তার উপর কঠিন অত্যাচার চারাতো!
এই অবস্থায় পরিপেক্ষিতে একদিন সূর্যাস্তের পর প্রত্যেক গোত্র থেকে কুরাইশ সরদারগণ কা’বা শরীফের নিকট জমায়েত হলো। যারা জমায়েত হলো তারা হচ্ছে উতবা ইবনে রাবীয়া, শাইবা ইবনে রাবীয়া, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, নাদার ইবনে হারেস,আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম, আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব, যামআ ইবনে আসওয়াদ, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা, আবু জাহল ইবনে হিশাম, আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া, আস ইবনে ওয়ায়েল, নুবাইহ্ ইবনে হাজ্জাজ, মুনাববিহ ইবনে হাজ্জাজ এবং উমাইয়া ইবনে খালাফ। তারা পরস্পরকে বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদকে ডেকে পাঠাও, তার সাথে কথা বল, প্রয়োজনে ঝগড়াও কর। তাহলে জনতার কাছে তোমরা দোষ এড়িয়ে যেতে পারবে।” যথার্থই তাঁর কাছে দূত পাঠানো হলো। দূত গিয়ে বললো, “কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তোমার সাথে কথা বলার জন্য জমায়েত হয়েছেন। তাদের কাছে একটু চলো।”
একথা শোনা মাত্রই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ত্রস্তপদে তাদের কাছে ছুটে এলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, তিনি তাদের কাছে যে দাওয়াত দিয়েছেন সে সম্পর্কেই বোধ হয় তারা নতুন কিছু চিন্তাভাবনা করেছে। বস্তুতঃ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আস্তরিকভাবে কামনা করতেন যে, তারা সঠিক পথে ফিরে আসুক। তাদের গোয়ার্তুমি ও অত্যাচারে তিনি ভীষণ দুঃখিত ছিলেন। তিনি গিয়ে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের পাশে বসলেন। তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ তোমার সাথে কিছু কথা বলার জন্য আমরা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। খোদার কসম, তুমি তোমার সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ, তেমন আর কোন আরব কখনো করেছে কলে আমাদের জানা নেই। তুমি পূর্বপুরুষদের ভর্ৎসনা করেছ, প্রচলিত ধর্মের নিন্দা করেছ, দেব-দেবীকে গালিগালাজ করেছ, বুদ্ধিমান লোকদের বোকা ঠাউরিয়েছ এবং জাতির ঐক্যে ভাঙ্গন ধরিয়েছ। মোটকথা, আমাদের ও তোমার মধ্যে কোন খারাপ জিনিসই আনতে তুমি বাকী রাখনি। এখন কথা হলো এসব কথা বলে তুমি যদি সম্পদ অর্জন করতে মনস্থ করে থাক, তাহলে আমরা তোমাকে টাকা কড়ি সংগ্রহ করে দিই, যাতে তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী হতে পার। আর যদি এর দ্বারা তুমি পদমর্যাদার প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে আমরা তোমাকে সরদার বানিয়ে দিই। আর যদি তুমি রাজা বাদশাহ হতে চাও তাহলে এস তোমাকে আমাদের রাজা বানিয়ে নিই। আর তোমার কাছে যে দূত আসে সে যদি কোন জ্বিন-ভূত হয়ে থাকে এবং তোমার ওপর পরাক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে আমরা যত টাকা লাগুক, তোমার চিকিৎসা করাতে প্রস্তুত যাতে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ অথবা তোমার সম্পর্কে জনত্র কাছে আমাদের কোন জবাবদিহি করতে না হয়।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন, “তোমরা যা যা বলছ তার কোনটাই আমি চাই না। আমি যে দাওয়াত তোমাদের কাছে পেশ করেছি তার উদ্দেশ্য এ নয় যে, আমি তোমাদের সম্পদ চাই কিংবা তোমাদের সম্পদ চাই কিংবা তোমাদের মধ্যে পদমর্যাদায় শ্রেষ্ঠ হতে চাই কিংবা তোমাদের রাজা হতে চাই। আমাকে আল্লাহ তোমাদের কাছে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, তিনি আমার প্রতি এক কিতাব নাযিল করেছেন এবং তোমাদের জন্য সাবধানকারী ও সুসংবাদ দানকারী হতে আমাকে আদেশ করেছেন। তাঁর আদেশ অনুসারে আমি তোমাদের কাছে আমার প্রতিপালকের বাণী পৌঁছে দিয়েছি এবং তোমাদেরকে কল্যাণের জন্য সদুপদেশ দিয়েছি। এখন তোমরা যদি আমার এই দাওয়াত গ্রহণ করে নাও, তাহলে সেটা তোমাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য বয়ে আনবে। আর যদি তা প্রত্যাখ্যান কর তাহলে তোমাদের ও আমার ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা না আসা পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধারণ করবো।”
তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমরা যে কয়টা প্রস্তাব তোমার কাছে পেশ করলাম তার কোনটাই যদি তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে আর একটা কথা শোনো। তুমি তো জান, দুনিয়ায় আমাদের মত সংকীর্ণ আবাসভূমি আর কারো নেই, পানির অভাব ও অন্যান্য উপকরণের দৈন্যের কারণে আমরা যেরূপ দুঃসহ জীবন যাপন করি, পৃথিবীতে আর কোন জাতি এমন জীবন যাপন করে না। সুতরাং তোমার যে প্রভু তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, তার কাছে প্রর্থনা কর যেন তিনি এই পাহাড় পর্বতগুলোকে এখান থেকে দূরে সরিয়ে নেন যাতে আমাদের আবাসভূমি আরো প্রশস্ত হয় এবং তিনি যেন ইরাক ও সিরিয়ায় নদ-নদীর ন্যায় আমাদের এ দেশেও নদ-নদী প্রবাহিত করে দেন। তাঁর কাছে আরো প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের পূর্বপুরুষদের পুনর্জীবিত করেন এবং পুনর্জবীত পূর্বপুরুষদের মধ্যেই কুসাই ইবনে কিলাবও যেন অন্তর্ভুক্ত থাকেন যিনি অন্যতম সত্যবাদী ন্যায়নিষ্ঠ নেতা ছিলেন। তাদেরকে আমরা তোমার কথা সত্য না মিথ্যা জিজ্ঞেস করবো। তারা যদি বলেন তুমি সত্যবাদী এবং আমাদের দাবী অনুসারে তুমি যদি কাজ কর তাহলে আমরা তোমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবো, তোমার খোদাপ্রদত্ত মর্যাদা আমরা স্বীকার করবো এবং তোমাকে যথার্থই আল্লাহর রাসূল বলে মেনে নেব।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, “এসব ব্যাপার নিয়ে আমি তোমাদের কাছে আসিনি। আমাকে আল্লাহ যে জিনিস দিয়ে পাঠিয়েছেন, তাছাড়া আর কোন কিছু আমার ইখতিয়ারে সেই। আর যা দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে তা আমি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এটা যদি তোমরা গ্রহণ কর তাহলে এটা দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেবে। আর যদি অগ্রাহ্য কর তাহলে আল্লাহ তোমাদের ও আমার মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধারণ করবো।”
তারা বললো, “এ প্রস্তাবও যদি তোমার মনঃপূত না হয়, তাহলে তুমি নিজের জন্য একটা কাজ কর। তোমার প্রতিপালককে বল তোমার সাথে একজন ফেরেশ্তা পাঠাতে। তিনি আমাদের সামনে তোমার কথা সত্য বলে সাক্ষ্য দেবেন এবং তোমার পক্ষ হয়ে আমাদের সাথে কথা বলবেন। আর আল্লাহ তোমার জন্য আনেকগুলো বাগবাগিচা ও প্রাসাদ বানিয়ে দিক এবং অনেক সোনা রূপার ধনদৌলত দান করুক। এতে করে তোমার যে অর্থলিপ্সা দেখতে পাই তা মিটবে। কেননা তুমি তো আমাদেরই মত বাজারে ঘোরাফেরা কর এবং আমাদেরই মত জীবিকা অন্বেষণ কর। তোমার এসব ধনদৌলত হলে আমরা বুঝবো, তুমি যথার্থই আমাদের চাইতে শ্রেষ্ঠ এবং তোমার প্রভুর কাছে মর্যাদাবান। তুমি নিজের ধারণা মুতাবিক সত্যিই যদি রাসূল হয়ে থাক তাহলে এসব করে দেখাও তো দেখি।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, না এটাও আমি করবো না। আমি আল্লাহর কাছে এসব জিনিস চাইতে পারবো না। আমি তোমাদের কাছে এসব জিনিস নিয়ে আাসিনি। আল্লাহ আমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে পাঠিয়েছেন। তোমরা যদি আমার আহ্বানে সাড়া দাও, তবে সেটা হবে দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের সৌভাগ্যের উৎস। আর যদি প্রত্যাখ্যান কর, তাহলে আল্লাহ যা করেন তাই হবে। তিনি যতক্ষণ আমার ও তোমাদের মধ্যে নিষ্পত্তি করে না দেন ততক্ষণ আমি ধৈর্য ধারন করবো।”
তারা বললো, “তাহলে কয়েক টুকরো মেঘ আমাদের মাথার ওপর ফেলে দাও, যেমন তুমি বিশ্বাস কর যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তা পারেন। এটা না করলে আমরা তোমার ওপর ঈমান আনবো না।”
রাসূলুল্লাহ বললেন, “এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইখতিয়ারাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে অবশ্যই তা করতে পারেন।”
তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ, তোমার প্রতিপালক কি এটা জানতেন না যে, আমরা তোমার সাথে বৈঠকে বসবো এবং যা এখন তোমার কাছে চাইলাম তা তোমার কাছে চাইবো? তিনি কি তোমার কাছে এসে আমরা যেসব কথা উত্থাপন করলাম তার জবাব তোমাকে শিখিয়ে দিতে পারলেন না এবং তোমার দাওয়াত অগ্রাহ্য করলে আমাদের তিনি কি করবেন তা জানাতে পারলেন না? আমরা জানতে পেরেছি যে, ইয়ামামায় বসবাসকারী ‘রাহমান’ নামক এক ব্যক্তি তোমাকে এসব কথা শিখিয়ে দেয়। [২৬.লোকটি হলো মুসাইলিমা ইবনে হাবিব হানফী। সে মুসাইলিমা কাযযাব (মিথ্যাবাদী) নামে প্রসিদ্ধ। সে বয়সে প্রবীণ ছিল এবং জাহিলী যুগে তাকে ‘রাহমান’ বলে ডাকা হতো। (রাউদুল আনফ)]
আল্লাহর শপথ, আমরা কথনো রাহমানকে বিশ্বাস করবো না। মুহাম্মাদ, তোমার কাছে আমরা আমাদের অক্ষমতার কথা জানাচ্ছি। তোমার আচরণ আমাদের সাথে যতদূর গড়িয়েছে তাতে আমরা তোমাকে ছাড়বো না। হয় তুমি আমাদের ধ্বংস করবে নচেৎ আমরা তোমাকে ধ্বংস করবো- তার আগে আমরা ক্ষান্ত হবো না।” সমবেত লোকদের একজন বললো, “আমরা ফেরেশতাদের পূজা করি। ফেরেশতারা হলো আল্লাহর মেয়ে।’ আর একজন বললো, “আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে হাজির কর নচেৎ আমরা তোমরা ওপর ঈমান আনবো না।”
এসব কথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে চলে এলেন। তাঁর ফুফাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া ইবনে মুগীরাও তাঁর সাথে এলো। সে বললো, “শোনো মুহাম্মাদ তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তোমার কাছে কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করলো। তার একটাও তুমি গ্রহণ করলে না। তারপর তারা এমন কতকগুলো জিনিস তোমার কাছে দাবী করলো যা দ্বারা আল্লাহ তোমাকে যে পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন বলে তুমি নিজে বলে থাক তা জানতে ও বুঝতে পারে এবং তোমাকে স্বীকার করতে ও তোমার অনুসরণ করতে পারে। কিন্তু তুমি সে দাবগিুলোও পূরণ করলে না। তুমি যে তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তুমি যে আল্লাহর রাসূল তা জানার জন্যও তারা কিছু দাবী জানালো তোমার কাছে। তুমি তাও রাখলে না। আল্লাহর কসম, তুমি একটা সিঁড়ি দিয়ে আকাশে চড়বে এবং তোমাকে আকাশে উঠে যেতে আম স্বচোখে দেখবো, অতঃপর তোমার সাথে চারজন ফেরেশতা আসবেন এবং তারা তোমার দাবীর সত্যতার সাক্ষ্য দেবে- তানা হলে আমি তোমার ওপর ঈমান আনবো না। এমনকি তুমি যদি এসব করে দেখিয়ে দাও তাহলেও আমার মনে হয় না যে, আমি তোমার ওপর ঈমান আনব।”২৭.এই ব্যক্তি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ইসলাম গ্রহণ করেন।
এরপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে চলে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে ত্যাগ করে অত্যন্ত ব্যাথিত ও বিষণœ মনে বাড়ী চলে এলেন। কেননা তাঁকে যখন ডেকে নেয়া হয় তখন তিনি খুবই আশান্বিত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যতঃ যখন দেখলেন যে, তারা তাঁর থেকে আরো দূরে সরে গেল, তখন তাঁর দুঃখের সীমা থাকলো না।
আবু জাহলের আচরণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলে যাওয়ার পর আবু জাহল বললো, “হে কুরাইশ, শোন! মুহাম্মাদ বিছুতেই তার নীতি ত্যাগ করতে রাজী নয়। আমাদের ধর্মের সামালোচনা, আমাদের পূর্বপুরুষদের নিন্দা, আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধতা বলে বিবেচনা করা এবং আমাদের দেব-দেবীকে গালমন্দ করার বদ্ধমূল স্বভাব সো কিছুতেই পরিহার করবে না। আমি আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করছি, কাল যত বড় পাথর আমি উত্তোলন করতে পারি, হাতে নিয়ে তার অপেক্ষায় থাকবো। নামাযে যখনই সে সিজদায় যাবে, তখনই সেই পাথর দিয়ে আমি মাথা গুড়িয়ে দেবো। এরপর যা হয় হবে। তোমরা আমাকে বিচারে সোপর্দ কর কিংবা রক্ষা কর, সেটা তোমাদের বিবেচ্য। বনু আবদ মানাফ যা ভালো মনে করে তাই করবে।” সবাই কললো, “আল্লাহর শপথ আমরা কিছুতেই তোমাকে বিচারের জন্য সোপর্দ করবো না তুমি যা সংকল্প করেছো তা করে ফেলো।”
পরদির আবু জাহল সত্যি সত্যি প্রকা- একখানা পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপেক্ষায় বসে রইলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নিত্যকার অভ্যাস মত নামায পড়তে গেলেন। মক্কায় বাস করলেও তিনি সিরিয়ার দিকে মুখ করে নামায পড়তেন। রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে এমনভাবে দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন যে, কা’বা তাঁর ও সিরিয়ার মাঝখানে পড়তো। তিনি নামাযে দাঁড়ালেন। আর কুরাইশরা তাদের সম্মেলন স্থলে বসে আবু জাহল কি করে সেজন্য অধীর আগ্রহে প্রহন গুনতে লাগলো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সিজদায় গেলেন তখন আবু জাহল পাথর উত্তেলন করে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল। তার কাছে যেতেই পরাজিত, ভীত-বিহ্বল ও বিবণর্ষ চেহারা নিয়ে ফিরে এলা। তার হাত দুটো যেন পাথরের ওপর নিথর ও নিশ্চল হয়ে গিয়েছে। সে পাথরখানা দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। এসময় কুরাইশদের কয়েকজন তার দিকে এগিয়ে গেল এবং বললো, “হে আবুল হাকাম, তোমার কী হলো?” সে বললো, “আমি মুহাম্মাদরে কাছে চলে গিয়েছিলাম এবং গতরাতে তোমাদের কাছে যে সংকল্প ব্যক্ত করেছিলাম, তাই কার্যকর করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু যে মাত্র তার কাছে গিয়েছি অমনি একটা প্রকা- ও ভয়ংকর উট তার ও আমার মধ্যে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো। আল্লাহর শপথ, আম কখনো এমন ভয়ংকর চুঁট, ঘাড় ও দাঁতওয়ালা উট দেখিনি। উটটা আমাকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত হেয়ছিলো।”
নাদার ইবনে হারেসের বিবরণ
আবু জাহলের এসব কথা বলার পর নাদার ইবনে হারেস উঠে দাঁড়ালো। সে বললো, “হে কুরাইশ জনতা, আল্লাহর শপথ, তোমাদের ওপর এমন এক আপদ আপতিত হয়েছে যার প্রতিকারে তোমারা এখনো কোন কৌশল অবলম্বন করতে পারনি। মুহাম্মাদ ছিল তোমাদের মধ্যে একজন তরুণ কিশোর মাত্র। সে ছিল তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ও সবচেয়ে সত্যবাদী। সে ছিল সবচেয়ে বিশ্বস্ত।ভ কিন্তু প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করা মাত্রই সে নতুন জিনিস নিয়ে আবির্ভূত হলো। তখন তোমরা তাকে বললে যাদুকর। না, আল্লাহর শপথ, সে যাদুকর নয়। আমরা যাদুকরদের দেখেছি। তাদের তন্ত্রমন্ত্র ও ফুকও আমরা দেখেছি। তোমরা তাকে বললে জ্যোতিষী। আল্লাহর শপথ, সো জ্যোতিষী নয়। জ্যোতিষীদের মারপ্যাঁচ ও রংঢং আমরা অনেক শুনেছি ও দেখেছি। পাগলের কথাবার্তায় যে জড়তা, আবোল াতবোল ও ভাবেবেগ থাকে, তা তাঁর কথাবার্তায় অনুপস্থিত। হে কুরাইশগণ, তোমরা নিজেদের অবস্থাটা খতিয়ে দেখ। আল্লাহর শপথ, তোমাদের ওপর এক ভয়াবহ মুসীবত আপতিত হয়েছে।”
নাদার ইবনে হারেস ছিল কুরাইশদের সবচেয়ে কুটিল ও কুচক্রী সেনাদের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নানাভাবে কষ্ট দেয়া ও তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা করাই ছিল তার কাজ। সে হীরায় কিছুকাল কাটিয়েছিল এবং সেখান থেকে পারস্যের রাজ-রাজাদের কাহিনী শিখে এসেছিলো। রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের উপাখ্যানও সে জানতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন বৈঠকে বসে আল্লাহর বাণী শোনাতেন এবং তাঁর জাতিকে পূর্বতন জাতিগুলো কিভাবে আল্লাহর রোষের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে সেসব কথা উল্লেখ করে হুঁশিয়ার করতেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা শেষ করে উঠে যাওয়া মাত্রই সে বলতো, “হে কুরাইশগণ, আমি মুহাম্মাদের চেয়েও সুন্দর কাহিনী বলতে পারি এসো, আমি তোমাদেরকে তাঁর কথার চেয়ে চটকদার কথা শুনাই।” অতঃপর সে তাদেরকে পারস্যের রাজাদের এবং রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের উপাখ্যান শোনাতো। তারপর বলতো, “মুহাম্মাদ আমার এসব কথার চেয়ে কি সুন্দর কথা বলতে পারে?”
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা বলতেন, “নাদার ইবনে হারেস সম্পর্কে কুরআনে আটটি আয়াত নাযিল হয়েছে।”
যখনই তার সামনে আয়াতগুলো পাঠ করা হয় তখনই সে বলে : এগুলো তো প্রাচীনকালের উপাখ্যান!” এই আয়াতটি এবং ‘প্রাচীন কালের উপাখ্যান’- এর উল্লেখ অন্য যেসব আয়াতে হয়েছে, তা এই নাদার ইবনে হারেস সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে
দুর্বল মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের অত্যাচার
যারা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করেছিলো সেসব সাহাবার ওপর মুশরিকরা ভীষণ অত্যাচার চালাতে লাগলো। প্রত্যেক গোত্র তার মধ্যকার মুসলমানদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কোথাও বা তাদেরকে অন্তরীণ রেখে মারপিট করে, ক্ষুৎপিপাসায় অবর্ণনীয় কষ্ট দিয়ে, কোথাও বা দ্বি-প্রহরে প্রচ- গরমের সময় মক্কার রৌদ্রতপ্ত মরুপ্রন্তরে শুইয়ে দিয়ে নির্যাতন চালাতে থাকলো। যারা দুর্বল এভাবে নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য করা হতো। কেউ কেউ অসহ্য নির্যতনের চাপে ইসলাম ত্যাগ করতো। আবার কেউ কেউ সাহায্য সমর্থন পেত এবং এভাবে আল্লাহ তাদেরকে রক্ষা করতেন। আবু বাকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ক্রীতদাস বিলাল এক সময় বনু জুমাহ গোত্রের এক ব্যক্তির ক্রীতদাস ছিলেন। তাঁর নাম ছিল বিলাল ইবনে রাবাহ। তাঁর মার নাম ছিল হামামাহ। তিনি তাদের মধ্যেই আশৈশব লালিত পালিত হয়েছিলেন। তিনি একজন নিষ্ঠাবান ও পবিত্রাত্মা মুসলিম ছিলেন। উমাইয়া ইবনে খালাফ ইবনে ওয়াহাব ইবনে হুযাফা ইবনে জুমাহ রৌদ্রতপ্ত দুপুরে তাঁকে মক্কার সমভূমিতে নিয়ে চিৎ করে শুইয়ে দিতো। অতঃপর তাঁর বুকের ওপর একটা প্রকা- পাথর চাপা দিয়ে রাখার নির্দেশ দিত। তারপর তাকে বলতো, “মুহাম্মাদকে অস্বীকার করে লাত ও উয্যার পূজা করতে রাজী না হলে আমৃত্যু এভাবেই থাকতে হবে।” এহেন কঠিন যন্ত্রণা ভোগের মুহূর্তেও তিনি কলতেন, “আহাদ” অর্থৎ আল্লাহ এক, আল্লাহ এক। তিনি এভাবে নিযৃাতন ভোগের সময় যখন ‘আহাদ’, ‘আহাদ’ উচ্চারণ করতেন, তখন মাঝে মাঝে ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল তাঁর কাছ দিয়ে যেতেন। বিলালের ঐ কথা শুনে ওয়ারাকা ইবনে নাওফেলও সাথে সাথে বলতেন, “আল্লাহর শপথ, হে বিলাল, সত্যই আল্লাহ এক, আল্লাহ এক, আল্লাহ এক।“ এরপর ওয়ারাকা উমাইয়া ইবনে খালাফের কাছে এবং বিলালকে নির্যাতনকারী বরী জুমাহ গোত্রের অন্যান্যদের কাছে যেয়ে বলতেন, “আল্লাহর শপথ, এই কারণে তোমরা যদি তাকে মেরে ফেল, তাহলে আমি তাকে অবশ্যই মহাপুণ্যবান মনে করবো এবং তার পদধূলি নেবো।” একদিন সেখান দিয়ে আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন বিলালকে সেই একই পন্থায় নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি উমাইয়া ইবনে খালাফকে বললেন, “এই অসহায় মানুষটাকে নির্যাতন করতে তোমার কি একটুও আল্লাহর ভয় হয় না? আর কত দিন এটা চালাবে?”
সে বললো, “তুমিই তো ওকে খারাপ করেছো। এখন তুমিই ওকে এ অবস্থা থেকে রেহাই দাও।”
আবু বাকর বললেন, “আমি তাই করবো। আমার কাছে ওর চেয়েও তাগড়া ও শক্তিশালী একটা ছেলে আছে সে তোমার ধর্মের অনুসারী। এর বদলে আমি তাকে দিয়ে দেবো।” সে বললো, “আমি রাজী।” আবু বাক্র বললেন, “আমি রাজী। সেটা তোমাকে দিলাম।” অতঃপর তিনি সেটা দিলেন উমাইয়াকে এবং উমাইয়ার কাছ থেকে বেলালকে নিয়ে মুক্ত করে দিলেন। হিজরাতের আগে আবু বাক্র বিলালসহ মোট সাতজন নওমুসলিম গোলামকে স্বাধীন করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আমের ইবনে ফুহাইরা, উম্মে উবাইস ্এবং যিননীরা। যিননীরাকে মুক্ত করার সময় তাঁর চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশরা তা দেখে বললো, “ওর চোখ নষ্ট হয়েছে লাত ও উয্যার অভিশাপেই।” যিননীরা বললেন, “আল্লাহর শপথ, তোদের আমি কখনো মুক্ত করবো না”, তখন আবু বাক্র সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কথাটা শোনামাত্রই বললেন, “হে অমুকের মা, তুমি শপথ ভঙ্গ কর।” সে বললো, “কী বলছো! শপথ ভঙ্গ করবো? তুমিই তো ওদেরকে খারাপ করেছো। এখন তুমিই মুক্ত কর।” আবু বাক্র বরলেন, “আমি ওদেরকে নিয়ে নিলাম! ওরা মুক্ত ও স্বাধীন। মেয়ে দুটিকে বললেন, “তোমরা মহিলার আটা ফিরিয়ে দাও।” মেয়েদ্বয় বললো, “হে আবু বাক্র, আগে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেব এবং পরে আটা ফিরিয়ে দেব কি?” আবু বাক্ র বললেন, “সে তোমাদের ইচ্ছা।”
আর একবার তিনি বনী মুয়াম্মালের একজন নও মুসলিম বাঁদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উমার ইবনুল খাত্তাব তাঁর উপর নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে ইসলাম ত্যাগের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। উমার তখনো মুশরিক। তিনি মারতে মারতে যথন ক্লান্ত হযে গেলেন তখন তাকে বললেন, “তোর কাছে আমি ওজর জানাচ্ছি যে, শুধু ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কারণেই তোকে আর মারতে পাররম না।” মেয়েটি বললো, “আল্লাহ তোমার সাথে যেন এরূপ আচরণই করেন।” এই দৃশ্য দেখে আবু বাক্র তৎক্ষণাৎ বাঁদীটি কিনে নিয়ে মুক্ত করে দিলেন।
আবু বাক্রের (রা) পিতা আবু কুহাফা একদিন তাঁকে বললেন, “বেটা, আমি দেখছি তুমি শুধু দুর্বল দাস দাসীদেরকে মুক্ত করছো। যদি তুমি শক্তিশালী জোয়ান পুরুষ দাসদের মুক্ত করতে তাহলে প্রয়োজনের সময় তারা তোমার পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারতো।” একথা শুনে আবু বাক্র বললেন, “হে পিতা, আমি যা করছি তা একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যেই করছি।”
বনু মাখযূম গোত্রের লোকেরা আম্মার ইবনে ইয়াসার ও তাঁর পিতামাতাকে তপ্ত দুপুরের সময় মক্কার উতপ্ত মরুভূডমিতে নিয়ে নির্যাতন করতো। তাঁদের গোটা পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের ওপর নির্যাতন চলাকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের কাছে উপস্থিত হতেন এবং সান্তনা দিয়ে বলতেন, হে ইয়াসারের পরিবার, ধৈর্য ধারণ কর। তোমাদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।” আম্মারের মাতাকে (সুমাইয়া) তারা মারতে মারতে মেরেই ফেললো। তথাপি তিনি ইসলাম ত্যাগ করেননি।
আর পাপিষ্ঠ আবু জাহল যখনই শুনতো যে অমুক ইসলাম গ্রহণ করেছে, অমনি তার বিরুদ্ধে কুরাইশদেরকে উস্কিয়ে দিত। ইসলাম গ্রহণকারী যদি ভালো পদমর্যাদাধারী ব্যক্তি হতো তাহলেও তাঁকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতো এবং বলতো, “তুমি তোমার বাপের ধর্ম ত্যাগ করেছ। অথচ তোমার বাপ তোমার চেয়েও উত্তম। কাজেই আমরা তোমাকে বেকুফ প্রতিপন্ন করবো, তোমার মতামত যে খারাপ ও ভুল, তা আমরা প্রমাণ করে ছাড়বো, তোমার মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত করে তবে ক্ষান্ত হবো।” আর যদি তিনি ব্যবসায়ী হতেন তবে তাকে বলতো, “আমরা তোমার ব্যবসায়ের সর্বনাশ ঘটাবো এবং তোমার মালপত্র নষ্ট করে দেবো।” আর যদি দুর্বল কেউ হতো তাহলে মারপিট করতো ও তার বিরুদ্ধে লোকজনকে লেলিয়ে দিত।
সাঈদ ইবনে যুবাইর বলেন, “আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বসকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের ওপর কি এতদূর অত্যাচার চালাতো যার ফলে তারা ইসলাম ত্যাগ করলেও তাদের ওপর দোষারোপ করা চলতো না?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ। তারা তাঁদেরকে প্রহার করত এবং অনাহার ও পিপাসায় কষ্ট দিত। তাঁদের এক একজন এ ধরনের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এতদূর হীনবল হয়ে পড়তেন যে, সোজা হয়ে বসে থাকতেও পারতেন না।
এহেন নির্যাতন চালানোর পর তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করতো, ‘স্বীকার কর আল্লাহর ছাড়া লাত-উয্যাও তোমার মাবুদ?’ কেউ কেউ বলতো, হাঁ।’ এমনকি একটা তুচ্ছ পোকামকড়ও দেখিয়ে বলতো, ‘আল্লাহ্ ছাড়া একেও মাবুদ বলে মান তো?’ কেউ কেউ অসহ্য নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনন্যোপায় হয়ে বলতো, ‘হাঁ’।”
আবিসিনিয়ার মুসলমানদের প্রথম হিজরাত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন একদিকে তাঁর সাহাবীদের ওপর অসহনীয় নির্যাতন চলছে। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ মর্যাদা লাভ ও আবু তালিবের সহায়তা লাভের কারণে তিনি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জীবন যাপন করছেন। অথচ তিনি তাঁদের ওপর আপতিত যুলুমকে কিছুমাত্র রোধ করতে পারছেন না। এ অবস্থায় তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, “তোমরা যদি আবসিনিয়ায় চলে যাও মন্দ হয় না। সেখানে একজন রাজা আছেন যার রাজত্বে কারো ওপর যুুলুম হয় না। এ দেশটা সত্য ও ন্যায়ের আশ্রয়স্থল। যতদিন এই অসহনীয় পরিস্থতি থেকে আল্লাহ তোমাদের মুক্ত না করেরন ততদিন সেখানে অবস্থান কর।” এই উপদেশ অনুসারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ কুফরীতে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য হবার আশংকায় এবং নিজের দ্বীন ও ঈমানকে বাঁচানোর তাকিদে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণের জন্য আবিসিনিয়ায় চলে গেলেন। ইসলামের অভ্যুদয়ের পর এটাই প্রথম হিজরাত।
এই হিজরাতের জন্য যাঁরা প্রথম স্বদেশ ত্যাগ করেণ তাঁরা হলেন উসমান ইবনে আফফান ও তাঁর স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা রুকাইয়া, আবু হুযাইফা ইবনে উতবা ও তাঁর স্ত্রী সাহলা বিনতে সুহাইল, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, মুসআব ইবনে ‘উমাইর, আবদুর রহমান্ ইবনে আউফ, আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদ ও তাঁর স্ত্রী লায়লা বিনতে আবি হাসমা, আবু সাবরা ইবনে আবু বুহম ও সুহাইল ইবনে বাইদা। এই দশজন আবিসিনিয়ায় হিজরাতকারী প্রথম মুসলমান। (ইবনে হিশামের মতে উসমান ইবনে মাযউন ছিলেন দলনেতা।) এরপর দেশত্যাগ করেন জাফর ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। তারপর একের পর এক মুসলমানরা সেখানে গিয়ে সমবেত হতে থাকেন। কেউবা সপরিবারে কেউবা পরিবার পরিজন ছেড়ে একাকী। এভাবে যেসব মুসলমান হিজরাত করে আবিসিনিয়ায় গিয়ে বসবাস করা শুরু করেন, তাঁদের সংখ্যা সর্বমোট ৮৩ জনে দাঁড়ায়। অবশ্য যেসব অল্পবয়স্ক শিশু কিশোর তাঁদের সাথে গিয়েছিল কিংবা সেখানে যাওয়ার পর জন্মগ্রহণ করেছিল তারা এ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত নয়।
মুহাজিরদের ফিরিয়ে আনার জন্য আবিসিনিয়ায় কুরাইশদের দূত প্রেরণ
কুরাইশগণ যখন দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ আবিনিনিয়ায় গিয়ে নিরাপদে ও শান্তিতে বসবাস করছেন, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, নাজাশীর নিকট দু’জন যোগ্য দূত পাঠাবে। এতে নাজাশী তাদেরকে সেখান থেকে ফেরত পাঠাবে এবং তারা তাদেরকে ধর্মান্তরিত করার সুযোগ পাবে। তারা মুসলমানদেরকে তাঁদের নিরাপদ ও নিরুপদ্রব আশ্রয় থেকে যে করেই হোক বের করে আনতে বদ্ধপরিকর হলো। এ উদ্দেশ্যে যে দু’জন লোককে পাঠালো তারা হলো আবুদল্লাহ ইবনে আবু রাবী’আ ও আমর ইবনুল ’আস ইবনে ওয়ায়েল। কুরাইশরা দূতদ্বয়ের মাধ্যমে নাজাশীকে দেয়ার জন্য বিপুল উপঢৌকন সংগ্রহ করলো। অতঃপর তাদেরকে নাজাশীর কাছে পাঠালো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিনী উম্মে সালামা বিনতে আবু উমাইয়া ইবনে মুগীরা বলেন, আমরা আবিসিনিয়ায় গিয়ে উপস্থিত হবার পর একজন উত্তম প্রতিবেশী পেলাম। তিনি স্বয়ং নাজাশী। আমরা আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করলাম। নির্বিঘেœ আল্লাহর ইবাদাত করতে লাগলাম। কোন কষ্টদায়ক ব্যবহারও কেউ করছিল না এবং কোন অপ্রীতিকর কথাও আমাদের শুনতে হচ্ছিল না। কুরাইশগণ একথ জানতে পেরে সিদ্ধান্ত নিল যে, নাজাশীর কাছে আমাদের ব্যাপারে দু’জন পারদর্শী দূত পাঠাবে এবং নাজাশীর কাছে আমাদের মক্কার দুর্লভ ও নয়ানাভিরাম জিনিস উপঢৌকন পাঠাবে। নাজাশীর কাছে মক্কা থেকে যেসব জিনিস আসতো তার মধ্যে সবচেয়ে উত্ম জিনিস বিবেচিত হতো সেখানকার চামড়া। তাই তাঁর জন্য কুরাইশরা প্রচুর চামড়া সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন। নাজাশীর রাজকর্মচারী ও দরবারীদের কাউকেই তারা উপহার দিতে বাদ রাখেনি। এসব উপহার উপঢৌকন সহকারে আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবী’আ ও আমর ইবনুল ‘আসকে পাঠালো এবং তাদের করণীয় কাজ তাদেরকে বুঝিয়ে দিল। তারা তাদেরকে বলে দিল, “মুহাজিরদের সম্পর্কে নাজাশীর সাথে কথা বলার আগে তোমরা প্রত্যেক দরবারী ও রাজকর্মচারীকে উপঢৌকন দিয়ে অনুরোধ করবে, তিনি যেন মুহাজিরদেরকে তোমাদের হাতে সমর্পণ করেন এবং সমর্পণ করার আগে তাদের সাথে যেন কোন কথা না বলেন।”
এরপর তারা রওনা হলো এবং নাজাশীর কাছে এসে উপনীত হলো। তখন আমরা উত্তম প্রতিবেশীর কাছে উত্তম বাসস্থানে বসবাস করছি। নাজাশীর সাথে কথাবার্তা বলার আগে তারা প্রতিটি দরবারী ও রাজকর্মচারীকে উপঢৌকন দিল। তাদের প্রত্যেককে তারা বললো, “আমাদের দেশ থেকে কতকগুলো বেকুব যুবক বাদশাহর রাজ্যে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তারা নিজ জাতির ধর্ম ত্যাগ করেছে অথচ আপনাদের ধর্মও গ্রহণ করেনি। তারা এক নতুন উদ্ভট ধর্ম তৈরী করেছে। সে ধর্ম আপনাদের ও আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। জাতির সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত লোকেরা আমাদেরকে বাদশাহর কাছে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি ওদেরকে ওদের স্বাজাতির কাছে ফেরত পাঠান। আমরা যখন বাদশারহর সাথে কথা বলবো তখন আপনারা বাদশাহকে ওদের ফেরত পাঠাতে ও ওদের সাথে কোন কথা না বলতে পরামর্শ দেবেন। কেননা তাদের দোষত্রুটি সম্পর্কে তাদরে জাতিই সবচেয়ে ছাল জানে।” দরবারীরা সবাই এতে সম্মতি জানালো। অতঃপর তারা নাজাশাকীকে উপঢৌকন দিল এবং তিনি তা গ্রহণ করলেন। অতঃপর তারা তাঁর সাথে কথা বলতে শুরু করলো। তারা বললো, “হে বাদশাহ, আমাদের দেশ থেকে কতিপয় নের্বোধ যুবক আপনার দেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা তাদের স্বাজাতির ধর্ম ত্যাগ করেছে এবং আপনার ধর্মও গ্রহণ করেনি তারা একটা উদ্ভট ধর্ম উদ্ভাবন করে নিয়ছে যা আপনার ও আমাদের কাছে অজ্ঞাত। তাদের ব্যাপারে আপনার কাছে তাদের কওমের সবচেয়ে সম্মানিত লোকেরা আমাদেরকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন। তাঁরা তাদেরও মুরব্বী ও আম্মীয়-স্বজন। ওদেরকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ নিয়েই আমরা এসেছি। তাদের কি দোষত্রুটি আছে সে সম্পর্কে তাদের মুরব্বীরা ও আত্মীয়রাই সমধিক অবগত।”
উম্মে সালামা বলেন, নাজাশী মুহাজিরদের বক্তব্য শুনুক এটা আবুদল্লাহ ইবনে আবু রাবী’আ ও আমর ইবনুল ‘আসের কাছে সবচেয়ে অবাঞ্ছিত ব্যাপার ছিল। রাজার দরবারীরা রাজাকে বললো, “হে বাদশাহ, ওরা দু’জন ঠিকই বলেছে। তাদের জাতির তাদের দোষত্রুটি ভালো জানে। কাজেই ওদেরকে এই দূতদ্বয়ের হাতে সমর্পণ করে দিন। ওরা ওদেরকে স্বদেশ ও স্বজাতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাক।”
নাজাশী ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি বললেন, “না, এ পরিস্থিতিতে আমি তাদেরকে এই দূতদ্বয়ের হাতে সমর্পণ করবো না। একদল লোক আমার সান্নিধ্যে বাস করছে। তারা আমার দেশে অতিথি হয়েছে। তারা অন্যত্র না গিয়ে আমার কাছে আসাকে অগ্রগণ্য মনে করেছে। আমি তাদেরকে ডাকবো এবং এই আগন্তুকদ্বয়ের বক্তব্য সম্পর্কে তাদের বক্তব্যও শুনবো। যদি দেখি, এরা দু’জন যেরূপ বলছেন, আশ্রিতরা সত্যিই তদ্রƒপ, তা হলে ওদেরকে সমর্পণ করবো এবং তাদের জাতির কাছে ফেরত পাঠাবো; অন্যথায় পাঠাবো না। যতদিন তারা আমার কাছে থাকতে চাইবে সাদরে রাখবো।”
উম্মে সালামা বলেন, অতঃপর নাজাশী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ডেকে পাঠালেন। নাজাশীর বার্তাবাহক যখন মুহাজিরদের ডাকতে গেল, তখন সবাই পরামর্শে বসলেন। এক অপরকে জিজ্ঞেস করলেন, বাদশাহর কাছে গিয়ে কি বলা যাবে। সবাই এক বাক্যে বললেন, “আমরা যা জানি এবং আমাদের নবী যা নির্দেশ দিয়েছেন ত-ই বলবো। তাতে পরিণতি যা হয় হবে।”
তাঁরা দরবারে এলেন। নাজাশী তার আগেই ধর্মযাজকদে ডেকে হাজির করে রেখেছেন। তাঁরা বাদশাহর সামনে ইনজীল খুলে বসেছেন। বাদশাহ তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের সেই ধর্মটা কি যা গ্রহণ করে তোমরা নিজ জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছো।এবং আমার ধর্ম বা অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করোনি?”
জাফর ইবনে আবু তালিব উত্তরে বললেন, “হে বাদশাহ, আমরা ছিলাম অজ্ঞ জাতি। আমরা মূর্তিপূজা করতাম, মৃত জন্তুর গোশত খেতাম এবং অশ্লীল ও খারাপ কাজে লিপ্ত থাকতাম, আমরা নিকট আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, প্রতিবেশীকে অবজ্ঞা করতাম এবং আমাদের মধ্যে যে সবল সে দুর্বলের হক আত্মসাত করতো। এমতাবস্থায় আল্লাহ আমাদের কাছে আমাদের মধ্যে থেকেই এক ব্যক্তিকে নবী করে পাঠালেন। আমরা তাঁকে সম্ভ্রান্ত বংশীয় ও সত্যবাদী বলে জানি এবং বিশ্বস্ত ও সচ্চরিত্র রূপে তাঁকে দেখেছি। তিনি আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইাবাদাত করার ও তাঁর একত্বে বিশ্বাস করার আহ্বান জানালেন। আমরা আল্লাহকে ছাড়া অন্য যেসব বস্তু তথা পাথর ও মূর্তি ইত্যাদির পূজা করতাম, তা তিনি ছাড়তে বললেন। তিনি সত্য কথা বলা, আমানত রক্ষা করা, আত্মীয়ের সাথে সদাচরণ করা, প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং নিষিদ্ধ কাজ ও রক্তপাত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। তিনি আমাদের অশ্লীল কাজ করতে, মিথ্যা কথা বলতে, ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাত করতে ও নিরপরাধ নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করতে নিষেধ করলেন। আমাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত করতে ও তাঁর সাথে শরীক না করতে বললেন। নামায পড়তে ও যাকাত দিতে বললেন।” এভাবে জাফর একে একে ইসলামের বিধানগুলো তুলে ধরলেন।
জাফর আরো বললেন, “আমরা তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনলাম। তিনি আল্লাহর তরফ থেকে যেসব বিধান দিলেন তার অনুসরণ করতে লাগলাম। এক আল্লাহর ইবাদাত করতে লাগলাম এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করলাম না। তিনি যেসব জিনিস হারাম ঘোষণা করলেন আমরা তা থেকে বিরত রইলাম, আর যেসব জিনিস হালাল ঘোষণা করলেন আমরা তা হালাল বলে মেনে নিলাম। এতে আমাদের জাতি আমাদের শত্রু হয়ে গেল, তারা আমাদের ওপর নির্যাতন চালাতে লাগলো এবং আমাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত থেকে মূর্তিপূজায় ফিরিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। তারা আমাদের ওপর চাপ দিতে লাগলো যাতে আমরা ঘৃণ্য অপকর্মগুলোকে আবার হালাল মনে করে নিই। তারা যখন এভাবে আমাদের ওপর পরাক্রান্ত হয়ে উঠলো, যুলুম-নির্যতন দ্বারা আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুললো এবং আমাদের মনোনীত ধর্ম পালনে বাধা দিতে লাগলো, তখন আমরা আপনার দেশে এসে আশ্রয় নিলাম। অন্যদের চেয়ে আপনাকেই উত্তম মনে করলাম এবং আপনার প্রতিবেশী হয়ে থাকতে আগ্রহী হলাম। হে বাদশাহ, আমাদের আশা এই যে, আপনার কাছে অত্যাচারের শিকার হবো না।”
নাজাশী তাঁকে বললেন, “তোমাদের নবী আল্লাহর বাণী নিয়ে সেছেন্ তার কোন অংশ কি তোমার কাছে আছে?” জাফর বললেন, “হ্যাঁ, আছে।” নাজাশী বললেন, “আমাকে পড়ে শোনাও।” জাফর সূরা মারিয়ামের প্রথম থেকে কতিপয় আয়াত পড়ে শোনালেন। আয়াতগুলো শুনে নাজাশী কাঁদতে লাগলেন। তাঁর দাড়ি অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। তাঁর সাথে সাথে ধর্মযাজকরাও কাঁদতে কাঁদতে ইনজীল ভিজিয়ে ফেললেন। এরপর নাজাশী বললেন, “আমি নিশ্চিত যে, এই বাণী এবং ঈসার বাছে যে বাণী আসতো, উছয় একই উৎস থেকে নির্গত। হে কুরাইশ দূতদ্বয়, তোমরা বিদায় হও। আমি কিছুতেই ওদেরকে তোমাদের হাতে সমর্পণ করবো না। ওরা এখানেই থাকবে।”
উম্মে সালামা বলেন, দরবার থেকে বেরিয়ে আমর ইবনুল ‘আস বললেন, “আল্লাহর শপথ, আগামীকাল আমি আবার নাজাশীর কাছে আসবো। তখন তাঁকে এমন কথা বলবো যা আশ্রিত মুসলমানদের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত সংযত ছিলেন। তিনি বললেন, “এরূপ করো না। যদিও তারা আমাদের বিরোদী, তথাপি আমাদের এতদূর যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ তাদের বহু রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন রয়েছে।” আমর ইবনুল ’আস বললেন, “আমি নাজাশীকে জানাবো যে, মুসলমানরা হযরত ঈসা ইবনে মারিয়ামকে স্রেফ আল্লাহর বান্দা বলে বিশ্বাস করে।”
পরদিন আমরা নাজাশীর দরবারে পুনরায় হাজির হয়ে তাঁকে বললেন, “হে বাদশাহ, আশ্রিতরা ঈসা ইবনে মারিয়াম সম্পর্কে একটা মারাত্মক কথা বলে থাকে। আপনি ওদের ডাকুন এবং ঈসা(আ) সম্পর্কে তাদের মতামত কি তা জিজ্ঞাসা করে দেখুন।”
বাদশাহ আবার মুসলমানদেরকে দরবারে ডাকলেন ঈসা (আ) সম্পর্কে মতামত জিজ্ঞাসা করার জন্য। উম্মে সালামা বলেন, এবারে আমরা সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলাম। মুসলমান মুহাজিররা আবার পরামর্শের জন্য সমবেত হলেন। সবার সামনে এখন নতুন প্রশ্ন, বাদশাহ ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে কি বলবো। অবশেষে সবাই স্থির করনেল যে, আল্লাহ যা বলেছেন এবং আমাদের নবী যে সত্য ধারনা দিয়েছেন, আমরা ঠিক তাই বলবো। ফলাফল যা হওয়ার হবে।
মুহাজিররা দরবারে হজির হলে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা মারিয়ামের পুত্র ঈসা সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ কর?” জাফর ইবনে আবু তালিব বললেন, “আমাদের নবী তাঁর সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছেন, আমরা তাতেই বিশ্বাস করি। তিনি বলেছেন, ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দা, তাঁর রাসূল, তাঁরই ফুঁকে দেয়া আত্মা এবং তাঁরই বাণী যা তিনি কুমারী ও পুরুষদের স্পর্শমুক্ত মারিয়ামের ওপর নিক্ষেপ করেছিলেন।”
এ কথা শুনে নাজাশী প্রবল উচ্ছ্বাসবশে মাটিতে হাত চাপড়িয়ে একখানা ক্ষুদ্র কাঠ হাতে নিলেন এবং বললেন, “আল্লাহর শপথ, তুমি যা বলেছো তার সাথে মারিয়ামের পুত্র ঈসার এই কাঠির পরিমাণ পার্থক্যও নেই।”
বাদশাহর এই কথা বলার সময় পার্শ্বস্থ দরবারীরা ক্রোধবশে ফিসফিস করে কি যেন বললো। বাদশাহ তা শুনে বললেন, “যতই ফিসফিস করোনা কেন, আমার মত অপরিবর্তিত থাকবে। হে মুহাজিরগণ, তোমরা এখন নিজ নিজ বাসস্থানে চলে যাও। আমার রাজ্যে তোমরা সম্পূর্ণ নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে বাস করতে থাক। যে তোমাদের গালাগাল করবে তাকে জরিমানা করা হবে। তোমাদের কোন একজনকেও কষ্ট দিয়ে আমি যদি পাহাড় স্বর্ণ লাভ করি, তথাপি আমি তা করা পছন্দ করি না। হে রজকর্মচারীগণ, তোমরা এই দূতদ্বয়ের দেয়া উপঢৌকনগুলো ফিরিয়ে দাও। ওগুলোতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।”
উম্মে সালামা বলেন, “এরপর তারা উভয়ে চরম লাঞ্ছনার গ্লানি মাথায় নিয়ে ফিরে গেলেন। তাদের আনা উপঢৌকনও ফেরত দেয়া হলো। আমরা তাঁর কাছে অত্যন্ত নিরুদ্বেগ আবাসিক পরিবেশ ও পরম সুজন প্রতিবেশীর সাহচর্যে বসবাস করতে লাগলাম।”
উম্মে সালামা বলেন, এইরূপ নিরুদ্বেগ পরিবেশে আমরা জীবন যাপন করছিলাম। সহসা আবিসিনিয়াা এক ব্যক্তি নাজাসীর সাথে তাঁর রাজত্বের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলো। সেই সময় আমরা যেরূপ দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছিলাম সেরূপ আর কখনো পড়িনি। আমাদের আশংকা ছিল ঐ ব্যক্তি যদি নাজাশীর বিরুদ্ধে জয়ী হয় তাহলে সে হয়তো নাজাশীর মত আমাদের আশ্রয় দিতে চাইবে না এবং আমাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারও স্বীকার করবে না। নাজাশী তাঁর ঐ প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলে গেলেন। দুই প্রতিপক্ষের মাঝখানে পড়লো নীলনদ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুহাজির সাহাবীগণ বললেন, “এমন কোন ব্যক্তি কি এখানে আছেন যিনি আবিসিনীয় জনগনের এই যুদ্ধের সময় রণাঙ্গণে উপস্থিত হবে এবং যুদ্ধের ফলাফল কি হয় তা দেখে এসে আমাদের জানাবেন?” যুবাই ইবনুল আওয়াম বললেন, “আমি যাবো।” বয়সে কনিষ্ঠতম এই সাহাবীর ইচ্ছায় সবাই সম্মতি দিলেন।
একট চামড়ার মশকে হাওয়া ভরে যুবাইরের সঙ্গে দেয়া হলো। তিনি ওটা বুকের ওপর স্থাপন করলেন। অতঃপর তার ওপর ভর করে সাঁতরে নীলনদের কিনারে গিয়ে উঠলেন। তারপর হেঁটে রণ্ঙ্গনে হাজির হলেন।
উম্মে সালামা বলেন, এই সময় আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকি যেন নাজাশী তার শত্রুর ওপর জয়লাভ করেন এবং দেশের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব বহাল থাকে। আমরা যখন যুদ্ধের ফলাফর জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ছিলাম তখন সহসা যুবাইরকে দেখা গেল। তিনি কাপড় নাড়তে নাড়তে দৌড়ে আসছিলেন এবং বলেছিলেন, “তোমরা সুসংবাদ শোন, নাজাশী জয়লাভ করেছেন। আল্লাহ তাঁর শত্রুকে ধ্বংস করেছেন এবং আবিসিনিয়ায় তাঁর কর্তৃত্ব বহাল রেখেছেন।” এরপর আবিসিনিয়ায় তাঁর শাসন সুসংহত হয়। আমরা সেখানে সর্বোত্তম স্থানে অবস্থান করছিলাম। অবশেষে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে যাই। তিনি তখনো মক্কায় অবস্থান করছিলেন।