হিজরীর তৃতীয় সন: রাজী সফর
উহুদ যুদ্ধের পর আজাল ও কারাহ গোত্রদ্বয় থেকে এ দল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলো। তারা বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনার সহচরদের মধ্য থেকে একটি দলকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, যারা আমাদেরকে ইসলামের বিস্তারিত বিধান শিক্ষা দেবে ও কুরআন পড়াবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদ, খালিদ ইবনে বুকাইর, আসিম ইবনে সাবিত, খুবাইব ইবনে আদী, যায়িদ ইবনুদ দাসিনা ও অবদুল্লাহ ইবনে তারিককে পাঠিয়ে দিলেন। আমীর মনোনীত করলেন মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদকে। তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। হিজাজের এক প্রান্তে ‘উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী হুদয়ার ওপর অবস্থিত হুযাইল গোত্রের জলাশয় রাজীতে পৌঁছলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করলো। বিশ্বাসঘাতকরা হুযাইল গোত্রকেও সাহায্যের জন্য ডাকলো। সাহাবীগণ তখনও সওয়ারীর পিঠে। দেখলেন, তরবারীধারী লোকজন তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেছে। তাঁরা নিজ নিজ তরবারী নিয়ে লড়াই করতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তখন কাফিররা বললো, “আল্লাহর কসম, আমরা তোমাদেরকে হত্যা করতে চাই না। আমরা তোমাদের দ্বারা মক্কাবাসীর কাছ থেকে কিছু অর্থ আদায় করতে চাই।আল্লাহর কসম করে প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাদেরকে হত্যা করবো না।” কিন্তু মুরসাদ ইবন আবু মুরসাদ, খালিদ ইবনে বাকাইর এবং আসিম ইবনে সাবিত বললেন, “আমাদের কোন মুশরিকের প্রতিজ্ঞা বা অঙ্গীকারে আস্থা নেই।” আসিম ইবনে সাবিত নিন্মোক্ত কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন:
“আমার তো দুর্বলতা নেই, কেননা আমি শক্তিমান বর্শাধারী পুরুষ
আমার ধুনক রয়েছে এবং তাতে তীব্র ও তীক্ষè তীর রয়েছে।
শক্ত ও মোটা বর্শার ফলক সে তীরে আঘাত খেয়ে ছিটকে যায়
আসলে মৃত্যুই সত্য, জীবন হলো বাতিল।
আল্লাহ মানুষের জন্য যা নির্ধারিত করে রেখেছেন তা অনিবার্য
আর মানুষ তার অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য।”
অতঃপর তাঁরা কাফিরদের সাথে লড়াই করলেন এবং তিনজনই শাহাদাত বরণ করলেন।
আসিম নিহত হলে হুযাইল গোত্রের লোকজন তার মাথা সুলাফা বিনতে সা’দের নিকট বিক্রি করতে মনস্থ করলো। ঐ মহিলার দুই ছেলে উহুদ যুদ্ধে আসিমের হাত মারা যাওয়ার পর সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে, আসিমের মাথা পেলে সে তার খুলিতে মদ পান করবে। হুযাইল গোত্র এ উদ্দেশ্যে আসিমের মাথা পেলে সে তার খুলিতে মদ পান করবে। হুযাইল গোত্র ও উদ্দেশ্যে আসিমের মাথা আনতে গেলে ভিমরুল ও মৌমাছি তার লাশ ঘিরে রাখায় আনতে পারলো না। তারা বললো, “এখন ওটা এখানেই থাক। বিকাল বেলা ভিমরুল ও মৌমাছি চলে যাবে। তখন আমরা তার মাথা কেটে আনবো।” এই বলে তারা চলে গেল। ইত্যবসরে আল্লাহ ঐ এলাকায় বন্যার তা-ব বইয়ে দিলেন এবং সেই বন্যায় আসিমের লাশ ভেসে উধাও হয়ে গেল।
শাহাদাতের পূর্বে আসিম আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যে, তাঁর লাশ যেন কোন মুশরিক স্পর্শ করতে না পারে এবং তিনি নিজেও যেন কোন মুশরিককে স্পর্শ না করেন। কোননা তিনি মুশরিকদেরকে মনে প্রাণে অপবিত্র মনে করতেন ও ঘৃণা করতেন। উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন শুনলেন যে, ভিমরুল ও মৌমাছি ঘিরে রাখার কারণে মুশরিকরা আসিমের লাশ স্পর্শ করতে পারেনি, তখন বললেন, “আল্লাহ তাঁর মু’মিন বান্দাকে এভাবেই হিফাজত করেন। আসিম তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, কোন মুশরিককে তিনি স্পর্শ করবেন না এবং কোন মুশরিককেও তাঁর দেহ স্পর্শ করতে দেবেন না। আল্লাহ তাঁর মৃত্যুর পর তাকে ঠিক তেমনিভাবে রক্ষা করেছেন, যেমন জীবদ্দশায় তিনি নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন।”
যায়িদ ইবনে দাসিনা, খুবাইব ইবনে আদী ও আবদুল্লাহ ইবনে তারিক এরা তিনজন নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে বেঁচে থাকার প্রতি আগ্রহী হলেন। তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে গ্রেফতারী বরণ করলেন। কাফিররা তাঁদেরকে গ্রেফতার করে বিক্রির জন্য মক্কায় নিয়ে চললো। যাহরান পর্যন্ত পৌঁছলে আবদুল্লাহ ইবনে তারিক হাতের বাঁধন খুলে মুক্ত হলেন এবং তরবারী ধারণ করলেন। কাফিররা তাঁকে ধরতে পারলো না। কিন্তু দূর থেকে পাথর ছুড়ে তাকে শহীদ করলো। যাহরানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
অতঃপর খুবাইব ইবনে আদী ও যায়িদ ইবনে দাসিনাকে নিয়ে তাঁরা মক্কায় উপনীত হলো। কুরাইশদের কাছে হুযাইল গোত্রের দু’জন বন্দী ছিল। তাদের বিনিময়ে তারা ঐ দ্ইু সাহাবীকে কুরাইশদের কাছে বিক্রি করলো। খুবাইবনে কিনলো উকবা ইবনে হারেসের পক্ষে হুজায়ের ইবনে আবু ওহাব, যাতে উকবা তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ তাঁকে হত্য করতে পারে। আর যায়িদ ইবনে দাসিনাকে নিল সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া স্বীয় পিতা উমাইয়া ইবনে খালফের হত্যার বদলে হত্যা করার জন্য। সাফওয়ান তার গোলাম নাসতাসের সাথে তাঁকে হারাম শরীফের বাইরে তানয়ীমে পাঠিয়ে দিল হত্যার উদ্দেশ্যে। সেখানে আবু সুফিয়ান সহ কুরাইশদের এক বিরাট জনতা যায়িদকে ঘিরে ধরলো। যায়িদকে যখন হত্যা করার জন্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আবু সুফিয়ান বললো, “হে যায়িদ, তোমার বদলে আজ যদি আমরা মুহাম্মাদকে হাতে পাই এবং তাকে হত্যা করি ও তোমাকে তোমার পরিজনের কাছে পাঠিয়ে দিই তাহলে তুমি কি তা পছন্দ করবে?” যায়িদ বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি এতটুকুও পছন্দ করবো না যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে আছেন সেখানে থাকা অবস্থাতেই তাঁর গায়ে কাঁটা ফুটবে, তিনি তাতে যন্ত্রণায় ভুগবেন আর আমি নিজের পরিজনের মধ্যে আরামে বসে থাকবো।”
আবু সুফিয়ানের মন্তব্য এই যে, “মুহাম্মাদকে তার সাহাবীরা যেরূপ ভালোবাসতো এমন গভীর ভালোবাসা আর কারো মধ্যে আমি দেখিনি।” এরপর নাসতাস যায়িদকে হত্যা করলো।
হুজাইর ইবনে আবু ওহাবের এ মুক্তিপ্রাপ্ত দাসী মাবিয়া ইতিমধ্যেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, বলেন, খুবাইব আমার কাছেই ছিলেন। তঁকে আমার ঘরেই বন্দী করে রাখা হয়েছিলো। একদিন তাঁকে দেখলাম, মানুষের মাথার মত বড় একটা আঙ্গুরের থোকা নিয়ে আঙ্গুর খাচ্ছেন। অথচ এ সময় মক্কায় আঙ্গুর ছিল না। তাঁর হত্যার সময় যখন ঘনিয়ে এলো তখন মৃত্যুর প্রস্তুতিস্বরূপ পাক সাফ হবার জন্য আমার কাছে একখানা ক্ষুর চাইলেন। পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়ে আমি তাকে ক্ষুর আনিয়ে দিলাম। ক্ষুর নিয়ে ঐ ছেলেকে খুবাইবের ঘরে ঢুকতে বললাম। সে ঘরে চলে গেলে সহসা আমার মনে হলো। একি করলাম। সর্বনাশ! এই লোকটি যদি ছেলেটিকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয় তাহলে কি হবে? সে তো নিজের জীবন নাশের বদলে একজনের জীবন নিয়ে আগাম প্রতিশোধ নিয়ে নেবে। ছেলেটি যখন খুবাইবকে ক্ষুর দিল তখন তিনি বললেন, “তোমার মা তোমাকে এই ক্ষুর নিয়ে আমার কাছে পাঠানোর সময় ভয় পায়নি তো?” এই বলে ছেলেকে তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিলেন।
এরপর খুবাইবকে কুরাইশরা তানয়ীমে নিয়ে গেল হত্যা করতে। খুবাইব বললেন, “তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে দু’রাকাত নামায পড়তে দাও।”তারা বললো, “ঠিক আছে, পড়।”
তিনি খুব নিখুঁতভাবে দু’রাকাত নামায প্রড়ে নিলেন। অতঃপর কাফিরদের সামনে গিয়ে বললেন, “তোমরা যদি মনে না করতে যে,আমি মরার ভয়ে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী নামায পড়ে সময় কাটাচ্ছি তাহলে আমি আরো কিছুক্ষণ নামায পড়তাম।” বস্তুত: মুসলমানরা যখনই এ ধরনের হত্যরর সম্মুখীন হন তখন দু’রাকাত নামায পড়া তাদের একটা রীতিতে পরণিত হয়েছে এবং খুবাইবই এ রীতির প্রথম প্রচলনকারী অগ্রনায়ক।
অতঃপর কাফিররা তাঁকে একটা কাঠের ওপর চড়িয়ে কষে বাঁধলো। এই সময় খুবাইব নিম্নরূপ দোয়া পড়লেন, “হে আল্লাহ, আমরা আপনার রাসূলের বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। সুতরাং আগামীকাল সকালের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আমাদের সাথে যে আচরন করা হলো তার খবর পৌঁছিয়ে দিন। হে আল্লাহ, এই দুশমনদেরকে আপনি গুনে গুনে এক এক করে হত্যা করুন এবং এদের কাউকে ছেড়ে দেবেন না।” অতঃপর তারা খুবাইবকে (রা) হত্যা কররো। আল্লাহ তাঁর ওপর রহমত নাযিল করুন।
আবু সুফিয়ান পুত্র মুয়াবিয়া (রা) বলতেন, “সেদিন খুবাইবের চারপাশে যারা জমায়েত হয়েছিলো তাঁদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের সাথে আমিও ছিলাম। তখন এরূপ জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল যে, কারোর ওপর অভিশাপ দেয়া হলে সে যদি তৎক্ষনাৎ কাত হয়ে শুয়ে পড়ে তাহলে এ অভিশাপ থেকে সে বেঁচে যায়।”
জুমাহী গোত্রের সাঈদ ইবনে আমেরকে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) সিরিয়ার কোন এব এলাকায় প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। তিনি আকষ্মিকভাবে লোকজনের সামনে মূর্ছা যেতেন। উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) একথা জানানো হলো। তাঁকে জানানো হলো যে, সাঈদের কি যেন হয়েছে। উমার (রা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে সাঈদ, তোমার কি হয়েছে? ” সাঈদ বললেন, “আমীরুল মু’মিনীন, আমর কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি। তবে আমি খুবাইবে হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলাম এবং খুবাইবের বদদোয়া শুনেছিলাম। সেই বদদোয়ার কথা যখনই আমার মনে পড়ে এবং আমি কোন মজলিসে থাকি তখনই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।” পরে উমারের কাছে থেকে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, আসিম ও মুরসাদের দলটি যখন রাজীতে আক্রান্ত হলো তখন সে খবর শুনে মুনাফিকরা মন্তব্য করলো, “ধিক এই ধোঁকা খাওয়া লোকগুলোকে যারা এমন করে মারা পড়লো। তারা বাড়ীতেও থাকলো না, আর তাদের নবীর দাওয়াতও পৌঁছালো না। ”আল্লাহ মুনাফিকদের এ কথাবার্তার জবাবে আয়াত নাযিল করলেন।”
[আরবী *********]
কোন কোন লোক এমন ও আছে যার কথা পার্থিব জীবনে তোমাকে চমৎকৃত করে দেয় র্(অর্থাৎ মুখ দিয়ে ইসলামের চমৎকার বুলি আওয়ায়) এবং তার মনে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহকে সাক্ষী মানে (তার মনের অবস্থা তার মুখের কথার সম্পূর্ণ বিপরীত) অথচ সে ন্যায় ও সত্যের কট্রর দুশমন। (অর্থাৎ তোমার সাথে যখন আলাপ-আলোচনা করে তখন ঘোরতর বিতর্কে লিপ্ত হয়।) আর যখন সে ক্ষমতার অধিকারী হয় তখন পৃথিবীতে অরাজকাত ছড়ায় এবং ফসল ও মানবকুলকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। আল্লাহ তার এই ধ্বংসাত্মক বার্যকলাপ পছন্দ করেন না। তাকে যখন আল্লাহকে ভয় করতে বলা হয়, তখন তার আত্মসম্মানবোধ তাকে পাপের পথে আগলে রাখে এ ধরনের লোকের জাহান্নামই যথেষ্ট। আর তা অত্যন্ত খারাপ জায়গা। আবার কেউ কেউ এমনও আছে যে,আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য (আল্লাহর পথে জিহাদ করতে ও তার হক আদায় করতে গিয়ে) নিজেকে কুরবানী করে দিয়েছে। বস্তুত: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ওপর বড়ই অনুকম্পশীল।” শেষের কথা কয়টিতে রাজী অভিযাত্রী মুসলমানদের কথাই বলা হয়েছে।
এ ঘটনা সম্পকে ঐতিহসিকগণ খুবাইবের কবিতা উদ্বৃত করেছেন। খুবাইব যখন জানতে পারলেন যে, তাঁকে শূলে চড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় হয়েঁেছ তখন এ কবিতাটি বলেন:
“দলগুলো তাদের সকল গোত্রকে আমার চারপাশে একত্রিত করেছে
তারা যতদূর পারে আমার ওপর শত্রুতা জাহির করেছে,
কেননা আমি স্বীয় প্রাণ বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও আপন আদর্শে অবিচল রয়েছি।
তারা তাদের সকল নারী ও সন্তানদেরকে, জমায়েত করেছে,
আর আমাকে দীর্ঘ ও সুরক্ষিত ডালের নিকটবর্তী করা হয়েছে
(শূলে চড়ানোর জন্য)
আমার প্রবাস জীবন ও মর্মবেদনার আকুতি শুধু আল্লাহর কাছেই তুলে ধরছি।
আর শত্রুর দলসমূহ আমার হত্যার জন্য যে আয়োজন করেছে তাও।
অতএব, হে আরশের অধিপতি,আমার বিরুদ্ধে যে কুমতলব আঁটা হয়েছে,
তার ওপর আমাকে ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দিন।
শত্রুরা আমার গোশত বিক্রী করে দিয়েছে,
আর সেই সাথেই আমার জীবনের আশার প্রদীপ নিভে গেছে।
তবে সেটা (আসন্ন মৃত্যু ) কেবলমাত্র ইলাহর উদ্দেশ্যেই,
তিনি যদি চান আমার টুকরো টুকরো অঙ্গ প্রত্যঙ্গেও অশেষ বরকত
দান করতে পারেন,
তারা আমাকে এক ইলাহর বদলে মৃত্যু ও কুফরীর
কোন একটি গ্রহণ করতে বলেছিল।
আমার চোখ সে দুটোকেই অগ্রাহ্য করেছে এবং আমর মন
মোটেই (মৃত্যুভয়ে) ভীত নয়
আমি মৃত্যুর কিছুমাত্র পরোয়া করি না, কেননা আমাকে মরতে হবেই।
আমি শুধু নিস্তার চাই সর্বগ্রাসী জাহান্নামের আগুন থেকে।
আল্লাহর শপথ, আমি কোনই ভয় পাবো না যখন মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবো, আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিহত হয়ে আমি যে দিকেই ঢলে পড়িনা কেন।
আমি শত্রুর সামনে বিন্দুমাত্রও নমনীয়তা দেখাবো না,
প্রকাশ করবো না কোনই অস্থিরতা। কেননা আল্লাহর কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন।”
খুবাইবের জন্য শোক প্রকাশ করে হাস্সাস ইবনে সাবিত নিন্মোক্ত কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করেণ,
“তোমার চোখের কি হলো যে, অশ্রু থামছেই না (নিজেকে সম্বোধন করে)
বুকের ওপর দিয়ে অবিরত ধারায় গড়িয়ে চলেছে মুক্তার মত
খুবাইবের শোকে-যিনি সেই যুবকদের অন্যতম যারা জেনেছে,
তাঁর (আল্লাহর) সাথে যখন তুমি মিলিত হবে তখন ব্যর্থতা কিংবা
অস্থিরত থাকবে না।
অতএব, হে খুবাইব, তুমি চলে যাও! আল্লাহ তোমাকে উত্তম পুরষ্কার দিন।
তোমারা কি জবাব দেবে যদি নবী তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করেন (হে কুরাইশরা)
যখন পুণ্যবান ফেরেশতারা চক্রবালে সমবেত থাকবে,
কিসের বদলায় আল্লাহর সাক্ষীকে তোমরা হত্যা করলে?
একজন খোদাদ্রোহী সুবিধাবাদী ও দেশে দেশে উৎপাত সৃষ্টিকারী লোকের বদলায়?
(উল্লেখ্য যে, বদর যুদ্ধে হারেসকে খুবাইব (রা) হত্যা করেছিলেন।)
বীরে মাউনার ঘটনা (৪র্থ হিজরী)
শাওয়াল মাসের অবশিষ্ট অংশ, যিলকাদ, যিলহাজ্জ ও মুহাররাম মাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান করলেন। এই বছরের হজ্জ মুশরিকরা বর্জন করেছিল। সফর মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বীরে মাউনার অভিযাত্রীদের পাঠিয়েছিলেন। এ ঘটনা ঘটে উহুদ যুদ্ধের মাত্র চার মাস পর।
ঘটনার পটভূমি হলো, ‘মুলায়িবুল আসিন্নাহ’ (বর্শা খেলায় পারদর্শী) নামে খ্যাত আবু বারা আমের ইবনে মালিক ইবনে জা’ফর রাসূলুল্লাহর সাথে দেখা করতে মদীনায় আসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সামনে ইসলাম পেশ করেন এবং তাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। সে ইসলাম গ্রহণও করলো না, ইসলামের বিরুদ্ধেও কিছু বললো না। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আপনি যদি কিছুসংখ্যক সাহাবীকে নাজদবাসীর কাছে পাঠিয়ে দেন এবং তারা তাদেরকে আপনার দ্বীনের প্রতি দাওয়াত দেন, আমার মনে হয়, তাহলে তারা আপনার দ্বীন গ্রহণ করনে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “নাজদবাসী তাদের ক্ষতি করতে পারে বলে আমার আশংকা হয়।” আবু বারা বললেন, “আমি তদের নিরাপত্তার জিম্মাদার। আপনি তাদেরকে পাঠিয়ে দিন। তারা জনগণকে আপনার দ্বীনের দিতে দাওয়াত দিক।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের মধ্য থেকে বাছা বাছা চল্লিশজন সুযোগ্য সাহাবীকে বনু সায়েদা গোত্রের বিশিষ্ট সাহাবী মুনযির ইবনে আমরের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। মুনযির ‘মুয়ান্নিক লিয়ামুত’ [তাঁকে এ উপাধিদানের কারণ হলো, তিনি শাহাদাত লাভের জন্য দ্রুতগতিতে ধাবমান হন।] (দ্রুত মৃত্যুকে আলিঙ্গনকারী) নামে অভিহিত হতেন। তাঁর সুযোগ্য সঙ্গী ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী হারেস ইবনে ছিম্মা, হারাম ইবনে মিলহান, উরওয়া ইবনে আসমা, নাফে ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারকা ও আবু বাক্র সিদ্দীকের (রা) মুক্ত গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা। তাঁরা রওয়ানা দিয়ে বীরে মাউনাতে গিয়ে অবস্থান করলেন। এই জলাশয়টি বনু আমেরের আবাসভূমি ও বনু সুলাইমের প্রস্তরময় এলাকার মাঝখানে অবস্থিত। উভয় এলাকাই জলাশয়টির নিকটবর্তী হলেও বনু সুলাইমের এলাকা ছিল অধিকতর নিকটবর্তী।
ইসলামের কট্রর দুশমন আমের ইবনে তুফাইলের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি নিয়ে গেলেন হারাম ইবনে মিলহান (রা)। তিনি যখন তার কাছে উপস্থিত হলেন, তখন সে চিঠির দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে হারাম ইবনে মিরহানকে হত্যা করলো। তারপর বাদবাকী সাহাবীদেরকেও খতম করার জন্য সে বনু আমেরের সাহায্য চাইলো। কিন্তু বনু আমের তার অনুরোধ এই বলে প্রত্যাখ্যান করলো যে, “ আমরা বনু বারার প্রতিশ্রƒতি ভঙ্গ করতে চাই না। আবু বারা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে।” আমের অগত্যা সুলাইমের কয়েকটি উপগোত্রের সাহায্য চাইল। তারা সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হলো এবং তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। সাহাবাগণ তাদেরকে দেখে তরবারী হাতে নিলেন এবং লড়াই করতে করতে শহীদ হলেন। শুধু কা’ব ইবনে যায়িদ রক্ষা পেলেন। কাফিররা তাঁকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যায়। অথচ তিনি বেঁচে ছিলেন। অনেক রক্তপাতের দরুণ দুর্বল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিহতদের স্তূপের মধ্য থেকে প্রাণ নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে যান এবং পরে খন্দকের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।
আক্রান্ত হবার সময় দু’জন সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া দামরী ও জনৈক আনসারী [মুনযির বিন মুহাম্মাদ বিন উকবা। ] সাহাবী কোন কারণে দল থেকে কিছুদূরে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা তাঁদের সঙ্গীদের বিপদের কথা জানতেন না। কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর কতকগুলো পাখী উড়তে দেখে তাঁদের মনে সন্দেহ জাগে। তাঁরা ভাবলেন, পাখীগুলোর ওড়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। তাঁরা তাঁদের অবস্থা দেখবার জন্য এগিয়ে গেলেন। দেখলেন সবাই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর তাঁদের ওপর আক্রমণকারী দলকেও উপস্থিত দেখলেন। আনসারী আমর ইবন উমাইয়াকে বললেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে মনে করেন?” তিনি বললেন, “আমার ইচ্ছা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি এবং সমস্ত ব্যাপার তাঁকে জানাই।” আনসারী বললেন, “যে রণক্ষেত্রে মুনযির ইবনে আমর শহীদ হয়েছেন সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে আমি পালাতে চাই না। আমি নিজে কখনো লোকমুখে হত্যাকা-ের খবর শোনার অপেক্ষায় বসে থাকতাম না।” অতঃপর তিনি লড়াই করে শহীদ হলেন।
আমর ইবনে উমাইয়াকে কাফিররা আটক ও বন্দী করলো। তিনি মুদার গোত্রের লোক একথা শুনে আমের ইবনে তুফাইল তাঁর কপালের চুল কেটে নিল এবং তাঁর মায়ের একটা দাস মুক্ত করার মানত ছিল মনে করে তাঁকে সেই বাবদে মুক্তি দিল। এরপর আমর ইবনে উমাইয়া মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মদীনার অনতিদূরে অবস্থিত কারকারাতে পৌঁছলো বনু আমেরের দুই ব্যক্তি এসে তাঁর সাথে একই ছায়ায় বিশ্রাম নিতে লাগলো। বনু আমেরের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটা নিরাপত্তা ও আনাক্রমণ চুক্তি যে ছিল, সেকথা আমর জানতেন না। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, তারা বনু আমের গোত্রের লোক। তিনি একটু অপেক্ষা করলেন। যেই তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো অমনি উভয়ের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করলেন। তাঁর ধারণা ছিল, বনু আমের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের হত্যাকা- চালিয়েছে এবং সে কারণে বনু আমের থেকে প্রতিশোধ নেয়া উচিত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট উপনীত হয়ে আমর ইবনে উমাইয়া সমস্ত ঘটনা জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যে দু’জনকে হত্যা করেছো, তাদের জন্য আমাকে রক্তপণ (দিয়াত) দিতে হবে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ ঘটনা আবু বারাই ঘটালো। আমি এটা অপছন্দ করেছিলাম এবং শংকিত ছিলাম।” আবু বারা ঘটনা জানতে পেরে খুবই দুঃখিত হলেন। আমের ইবনে তুফাইল তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়ে দেয়ার এবং তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ওপর বিপদ নেমে আসায় আবু বারা ক্ষোভ প্রকাশ করে। নিতদের মধ্যে আমের ইবনে ফুহাইরাও ছিলেন। হিশাম ইবনে উরওয়াহ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমের ইবনে তুফাইল বলতো, “ঐ দলের ভেতরে একটি লোক ছিল যাকে হত্যা অব্যবহিত পর তাঁকে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে দেখলাম। অবশেষে দেখলাম সে যেন আকাশে উঠে উধাও হয়ে গেছে। কে সেই, লোকটি?” লোকেরা বললো, “সে আমের ইবনে ফুহাইরা।”
বনু নাবীরের বহিষ্কার (চতুর্থ হিজরী)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া (রা) কর্তৃক নিহত বনু আমেরের লোক দুটোর জন্য রক্তপণ আদায় করার ব্যাপারে সাহায্য চাইতে বনু নাযীরের কাছে গেলেন। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। বনু নাযীর ও বনু আমেরের মধ্যেও অনরূপ চুক্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বনু নাযীরের কাছে গেলেন তখন তারা তাঁকে স্বাগত জানালো এবং রক্তপণের ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতে সম্মত হলো।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাদের মাথায় চাপলো এক কুটিল ষড়যন্ত্র। তারা গোপনে সলাপরামর্শ করতে লাগলো কিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করা যায়। তারা মনে করলো, এমন মোক্ষম সুযোগ আর কখনো পাওয়া যাবে না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা প্রাচীরের পার্শ্বে বসে ছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন আবু বাক্র, উমার ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম। বনু নাযীরের লোকেরা পরস্পর সলাপরামর্শ করলো। তারা বললো, “কে আছ যে পাশের ঘরের ছাদে উঠে বড় একটা পাথর মুহাম্মাদের ওপর গড়িয়ে দিতে পারবে এবং তার কবল থেকে আমাদেরকে রেহাই দেবে?” বনু নাযীরের এক ব্যক্তি আমর ইবনে জাহাশ ইবনে কা’ব এ কাজের জন্য ছাদের ওপর আরোহণ করলো।
ঠিক এই মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে উঠলেন এবং মদীনায় ফিরে গেলেন। তাঁর সঙ্গী সাহাবীগণ তখনো টের পাননি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় গিয়েছেন। তাঁরা অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলেন তিনি ফিরছেন না, তখন তাঁরা তাঁর খোঁজে বেরুলেন। পথে এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে মদীনা থেকে আসছে। তাঁরা তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্ধান চাইলেন। সে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি মদীনায় প্রবেশ করতে দেখেছি।” সাহাবীগণ তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে বনু নাবীরের ওপর আক্রমণ করা জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর মুসলমানদেরকে নিয়ে তিনি বনু নাযীরের ওপর আক্রমণ চালালেন। তারা তাদের দুর্গসমূহে আশ্রয় নিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে খেজুরের গাছসমূহ কেটে ফেলতে ও তা জ্বলিয়ে দিতে আদেশ দিলেন। তা দেখে বনু নাযীরের লোকেরা দূর থেকে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ, তুমি তো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করতে এবং যে তা করতো তার নিন্দা করতে এখন কেন তুমি খেজুর গাছ কাটছো এবং জ্বালিয়ে দিচ্ছো?”
এই সময় বুন আওফ ইবনে খাযরাজ গোত্রের কতিপয় ব্যক্তি যথা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সুলুল, তার আমানত রক্ষক মালিক ইবনে আবু কাওফাল সুওয়াইদ ও দায়িম বুন নাযীরকে এই মর্মে বার্তা পাঠালো যে, “তোমারা ভয় পেয়ো না বা আত্মসমর্পণ করো না। আমরা কিছুতেই তোমাদেরকে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হতে দেব না। তারা যদি তোমারেদ সাথে যুদ্ধ করে তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে যাবো।” বনু নাযীর তাদের সাহায্যের অপেক্ষায় থেকে আত্মসমর্পন বা মুকাবিলা কোনটাই করলো না। আর শেষ পর্যন্ত কোন সাহায্যও এলো না। আল্লাহ তাদের মনে ভীতি সৃষ্টি করে দিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করলো, “রক্তপাত করবেন না। বরং আমাদেরকে বহিষ্কার করুন, আমরা আমাদের সব অস্ত্রশস্ত্র রেখে যাবো। অস্তাবর সম্পত্তির যতটুকু প্রত্যেকের উট বহন করে নিয়ে যেতে পারে, ততটুকু নিয়ে যাওয়অর অনুমতি দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অনুরোধ রক্ষা করলেন। বুন নাযীরের প্রস্তাব অনুসারেই কাজ করা হলো। তারা উটের পিঠে বহনোপযোগী অস্থাবর সম্পদ নিয়ে গেল। এই সময় কেউ কেউ তার ঘরের দরজার ওপরের অংশ ভেঙ্গে উটের পিঠে করে নিয়ে যেতে লাগলো। কতক লোক খাইবারে এবং কতক সিরিয়ায় বলে গেল। যারা খাইবার গিয়েছিলো তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিল সালাম ইবনে আবুল হুকাইক, কিনানা ইবনে রাবী ইবনে আবুল হুকাইক ও হুয়াই ইবনে আখতাব। খাইবারের অধিবাসীরা তাদের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করলো।
আবু বাকরের পুত্র আবদুল্লহ বলেন, “আবু বাক্র (রা) জানিয়েছিলেন যে, বুন নাযীর তারেদ স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে গিয়েছিলো। সেইসাথে তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলোও নিয়ে গিয়েছিলো। দাসীরা তাদের পেছনে থেকে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের মধ্যে উরওয়া ইবনে ওরারদ ’আবাসীর স্ত্রী উম্মে ’আমরও ছিল। সালমা নাম্মী ও মহিলাকে তারা তার স্বামীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল।[ ৬৫. এই মহিলার প্রথমে বিয়ে হয় মুযইনা গোত্রে। উরওয়া ইবনে ওয়ারদ একবার তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে লুঠতরাজ করে। সেই সময় এ মহিলাকে সে ধরে নিয়ে যায়। উরওয়া বনু নাযীরের কাছে প্রায়ই আসা যাওয়া করতো এবং তাদের কাছ থেকে ধার কর্জ নিত। আবার কখনো বা নিজের লুঠ করা দ্রব্যাদি বিক্রি করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু সে তাকে বিক্রি করতে অস্বীকার করে। তখন তারা উরওয়াকে মদ খওয়ায় এবং কৌশলে তাকে তার কাছ থেকে কিনে নেয়। এই ক্রয় বিক্রয়ে তারা প্রয়োজনীয় সাক্ষীও সংগ্রহ করে। উরওয়া পরবর্তী সময় আক্ষেপ করে এ সম্পর্কে এরূপ কবিতা আবৃত্তি করতো, “আল্লাহর দুশমনরা আমাকে মদ খাইয়ে মিথ্যাচার ও চক্রান্তের মাধ্যমে কাবু করে নিয়েছিল। হায় অদৃষ্ট! কিভাবে আমি এমন প্রস্তাবে রাজী হলাম, যা আমার বিবেক অপছন্দ করে।” ] তারা এত ধুমধাম ও গর্বের সাথে যাচ্ছিলো যে, সে যুগে আর কোন গোত্রকে ও রকম ধুমধাম করতে দেখা যায়নি।”
তারা অবশিষ্ট সমস্ত সম্পত্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য রেখে গিয়েছিলো। এই সমস্ত সম্পত্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিলো। সেটা তিনি যেভাবে খুশী কাজে লাগাতে পারতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সম্পত্তি শুধুমাত্র প্রথম হিজরাতকারী সাহাবাদের মধ্যে বণ্টন করেন। আনসারদের সাহল ইবনে হুনাইক ও আবু দুজানা সিমাক ইবনে খারাশা তাদের দারিদ্রের কথা জানালে তাদেরকেও কিছু দান করেন। বনু নাযীরের প্রসঙ্গে সমগ্র সূরা আল হাশর নযিল হয়। আল্লাহ বনু নাযীরের ওপর যে ভয়াবহ প্রতিশোধ গ্রহণ করেন এবং তাঁর রাসূলকে দিয়ে তাদের ওপর সৈন্য অভিযান পরিচারনা করিয়ে তাদে বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করান, এই সূরায় তার বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি আহলে কিতাব কাফিরদেরকে (মুসলিম মুজাহিদদের) প্রথম হানাতেই তাদের ঘরবাড়ী থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তোমরা ধারণা করতে পারনি যে, তারা বেরিয়ে যাবে। আর তারা মনে করেছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ওপর এমনভাবে চড়াও হলেন যে, তারা তা কল্পনাও করতে পারেনি। আল্লাহ তাদের মনের মধ্যে ভীতি সঞ্চর করে দিলেন। (ফলে) তারা তাদের ঘরবাড়ী নিজেদের হাতেও ভেঙ্গেছে আবার মুমিনদের হাত দিয়েও বঙ্গিয়েছে। কেননা তারা নিজেরাই তাদের ঘরের দরজায় উপরের অংশ ভেঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।)
অতএব, হে বুদ্ধিমান লোকেরা, শিক্ষা গ্রহণ কর। আল্লাহ যদি তাদের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত না দিয়ে থাকতেন (যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি প্রতিশোধই বটে) তাহলে দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি দিতেন (তরবারী দ্বারা), অধিকন্তু তাদের জন্য পরকালে রয়েছে দোজখের শাস্তি (বহিষ্কার ছাড়াও)। তোমরা যেসব সতেজ খেজুর গাছ কেটে ফেলেছো অথবা শিকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছো উভয় কাজই আল্লাহর অনুমোদিত এবং তা শুধু নাফরমানদের অপদস্ত করার জন্যই। আর তাদের (বনু নাযীরের) যা কিছু সম্পদ আল্লাহ তাঁর রাসুলের দখলে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা তোমাদের উট ও ঘোড়া দৌড়িয়ে অর্জন করা জিনিস নয়, বরং আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে যার ওপর ইচ্ছা পরাক্রান্ত করে দেন। আর আল্লাহ তাঁর রাসূলের নিকট জনপদের লোকদের থেকে যে সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছেন ( অর্থাৎ উট, ঘোড়া চালিয়ে যুদ্ধ ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দখলে এসেছে। তা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের জন্য, আত্মীয় স্বজনের জন্য, ইয়াতীম মিসকীন ও পথিকের জন্য, যাতে সম্পদ শুধু তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে না থাকে। আর রাসূল তোমাদের কে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিবৃত্ত করেছেন তা থেকে নিবৃত্ত হও।”
এখানে আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিতরণের বিধান বর্ণনা করেছেন।
এরপর আল্লাহ বলেন,
“তুমি কি মুনাফিকদের অবস্থা দেখনি, তারা তাদের কুফরীতে লিপ্ত আহলে কিতাব ভাইদেরকে (অর্থাৎ বনু নাযীরকে) বলেঃ তোমাদেরকে যদি বহিষ্কার করা হয় তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাবো। আর তোমাদের স্বার্থের ব্যাপারে অন্য কারো কথা কখনো শুনবো না, আর যদি তোমাদের ওপর যুদ্ধ চপিয়ে দেয়া হয় তাহলে তোমাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করবে। আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তারা মিথ্যাবাদী। তারা যদি বহিষ্কৃত হয় তবে ঐ মুনাফিকরা কখনো তাদের সাথে বেরিয়ে যাবে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করা হলে কখনো সাহায্য করবে না, আর যদি সাহায্য করেও, তবে তারা (শেষ পর্যন্ত ময়দানে টিকবে না বরং মাঝখানেই) রণেভঙ্গ দিয়ে পালাবে। অতঃপর তাদের কাছে আর কোথাও থেকে কোন সাহায্য আসবে না। আসলো তাদের মনে তোমাদের ভয় আল্লাহর ভয়ের চেয়েও বেশী। কেননা তারা একটা নির্বোধের দল। তারা কখনো তোমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে পারবে না, যদি বা লড়ে তবে সুরক্ষিত জনপদে অথবা দেয়ালের অপর পাশ থেকে ছাড়া নয়। তাদের ভেতরে পারস্পরিক মতবিরোধ খুবই প্রকট। তোমরা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ মনে করলেও আসলে তাদের মন বিভেদ-ক্লিষ্ট। কেননা তারা বিবেক বুদ্ধিহীন গোষ্ঠী। তারা সেই জনগোষ্ঠীর মতই যারা, যারা অল্পদিন আগেই কৃতমর্তের ফল ভোগ করেছে। তাছাড়া তাদের জন্য আরো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। (অর্থাৎ বনু কুইনুকার মত) তারা শয়তানের মতই, যে শয়তান মানুষকে বলে: কুফরী কর। আর যখনই সে কুফরী করে, অমনি বলে: ‘আমি তোমার ধার ধারি না। আমি তো বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। ’তাদের উভয়্রেই শাস্তি হলো, তারা চিরকার আগুনে পুড়বে। আর ওটাই হলো যালিমদের কর্মফল।”