হুনাইনের যুদ্ধ: ৮ম হিজরী
হাওয়াবিন গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা বিজয়ের কথা শুনে মালিক ইবনে আওফের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হলো। হাওয়াবিনের সাথে বনু সাকীফ, বনু নাসর, বনু জুশাম ও বনু স’দের সকলে ও বনু হিলালের স্বাল্পসংখ্যক লোকও সংঘবদ্ধ হলো। বনু সা’দ ও বনু হিলালের এই মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া বনু কায়েসের আর কেউ এই সেনা সমাবেশে অংশগ্রহন করেনি।
বনু জাশাম গোত্রে দুরাইদ ইবনে সাম্মা একজন প্রবীণ লোক ছিল। সে যুদ্ধ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ছিল। যুদ্ধের পরামর্শ দেয়া ছাড়া তার আর কোন কিছু করার ছিল না। বনু সাকীফের দু’জন সরদার ছিল। তাদের মিত্রদের মধ্যে ছিল কারেব ইবনে আসওয়অদ আর বনু মালিকের ছিল যুলখিমার সুবাই ইবনে হারেস এবং তার ভাই আহমার ইবনে হারেস। তবে মালিক ইবনে আওফ নাসারী ছিল গোটা বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক। মালিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলে তার বাহিনীর লোকদের প্র্রত্যেকে নিজ নিজ স্ত্রী সন্তান ও অস্থাবর সম্পদ সঙ্গে নিয়ে যেতে বাধ্য করলো। আমতাস উপত্যকায় পৌছলে তার কাছে দুরাইদ ইবনে সাম্মা সহ বিপুল জনতা সমবেত হলো। দুরাইদ আওতাস ইপত্যকায় পৌছে তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কোন জায় গা?” সবাই বললো, ‘আওতাস’। সে বললো, ‘হ্যা, এটা যুদ্ধের উপযুক্ত জায়গা বটে। বেশী উচুও না প্রস্তরময়ও না, আবার খুব বেশী নরমও না। তবে উট, ছাগল ও গাধার ডাক, আর শিশুদের কান্নাকাটি শুনতে পাচ্ছি কেন?” সবাই বললো, “মালিক ইবনে আওফ তার বাহিনীর লোকদের সাথে তাদের ধনসম্পদ ও স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আসতে বাধ্য করেছে।” সে বললো, “মালিক কোথায়?” মালিককে ডেকে আনা হলো। দুরাইদ বললো, “ওহে মালিক, তুমি নিজ গোত্রের পরিচালক ও নেতা। আজকের দিনের পরেও কত দিন আসবে তার শেষ নেই। এখানে উট, গাধা ও ছাগলের ডাক ও শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি কেন?” মালিক বললো, “আমি লোকজনের সাথে তাদের পরিবার পরিজন ও সহায়-সম্পদও নিয়ে এসেছি।” দুরাইদ বললো, ‘কেন?’ মালিক বললো, “প্রত্যেকের পেছনে তার পরিবার পরিজন ও সহায় সম্পদ থাকবে এবং তাদেরকে রক্ষা করারা জন্য সে প্রাণপণে লড়াই করবে। রণাঙ্গন ছেড়ে কেউ পালবে না।” দুরাইদ মালিকের যুক্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে বললো, “আসলে তুমি দেখছি মেষ পালকের মতই (বুদ্ধি রাখ, সেনানায়কের মত নয়)। যে পরাজিত হয়, তার কি আর কোন কিছুতে লাভ হয়? যুদ্ধে যদি পরাজয় ঘটে তাহলে নিজের বিপর্যয়ের সাথে সাথে নিজের পরিবার পরিজন এবং ধন সম্পদও গোল্লায় যাবে।”
দুরাইদ পুনরায় বললো, “বনু কাব ও বনও কিলাবের খবর কি?” মালিক বললো, “তাদের কেউ যুদ্ধে আসেনি।” দুরাইদ বললো, ‘তাহলে তো আসল লড়াকু বীর সিপাহীরাই আসেনি। আজ যদি সত্যিকার বিজয় ও পৌরব লাভের সুযোগ থাকতো তাহলে বনু কাব ও কিলাব অবশ্যই আসতো। আমার মনে হয়, বনু কাব ও কিলাব যেটা করেছে, তোমাদের তা অনুসরণ করা উচিত ছিল। আচ্ছা তোমাদের সাথে উল্লেখযোগ্য যোদ্ধাাদের কে কে এসেছে?” লোকেরা বললো “আমর ইবনে আমের ও আওফ ইবনে আমের।” দুরাইদ বললো, “ওরা দুর্বল যোদ্ধা, ওদের দিয়ে কোন লাভও হবে না, ক্ষতিও হবে না। হে মালিক শোন, হাওয়াযিন গোত্রকে শত্রুর মুখে নিক্ষেপ করে তুমি কোন ভাল কাজ করনি। তাদেরকে তাদের নিজ নিজ নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দাও। তারপর এই মুসলমানদের সাথে তোমার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে লাড়াই কর। তুমি যদি জয়লাভ কর তাহলে পরে এস তারা তোমার সাথে যোগ দেবে। আর যদি হেরে যাও তাহলে অন্ততঃ তোমার লোকদের পরিবার পরিজন ও ধনসম্পদ রক্ষা পাবে।” মালিক বললো, “না এটা আমি করবো না। তুমি নিজে যেমন বুড়ো হয়েছ, তোমার বুদ্ধিও তেমনি জরা ব্যধিগ্রস্ত হয়েছে। হে হাওয়াযিন জনতা, তোমারা হয় আমার আনুগত্য করবে নতুবা আমি এই তরবারী নিয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে একাই লড়ে যাবো।” আসলে দুরাইদের কথা মত কাজ করে তার খ্যাতি বা তার বুদ্ধিমত্তার সুনাম হোক এটা মালিকের মনঃপুত ছিল না। সমবেত যোদ্ধারা মালিকের আনুগত্য করার অঙ্গীকার করলো। দুরাইদ বললো, “আমি আজকের এ যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিপদের ঝুঁকি নিতে রাজী নই।” সে কবিতার ছন্দে বললোঃ
“হায়! আমি যদি এ যুদ্ধের সময় তরুণ থাকতাম
তাহলে হরেক রকমের রণকৌশল দেখাতাম। বিরাটকায়
পাহাড়ী ছাগল সদৃশ লম্বা চুলওয়ালা বাহিনী পরিচালনা করতাম।”
অতঃপর মালিক বললো, “মুসলিম বাহিনীকে দেখা মাত্রই তরবারী খাপমুক্ত করে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে।”
হাওয়াযিনের এই রণপ্রস্তুতির কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে আবু হাদরাদ আসলামীকে কৌশলে তাদের ভেতরে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করে আনতে পাঠালেন। আবদুল্লাহ তাদের ভেতরে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাওয়াযিনের মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সময় তাঁকে জানানো হলো যে, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার কাছে অনেক অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম রয়েছে। সাফওয়ান তখনও মুশরিক। তার কাছে লোক পাঠিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামাদি ধার চাইলেন শত্রর সাথে লড়াই করার জন্য। সাফওয়অন জিজ্ঞেস করলো, “মুহাম্মাদ, তুমি এগুলো কেড়ে নিচ্ছো নাকি?” রাসূরূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না, ধার নিচ্ছি এবং গ্যারান্টি দিচ্ছি যে,, এগুলো তোমাকে ফেরত দেয়া হবে।” সে বললো, “আমার আপত্তি নেই।” অতঃপর সে একশট বর্ম ও তার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অস্ত্র ধার দিল। কথিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ঐসব অস্ত্র পরিবহণের ব্যবস্থা করারও অনুরোধ জানান এবং সে যথাযথভাবে তারও ব্যবস্থা করে।
পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসীদের মধ্য থেকে দুই হাজার এবং মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর সাথে মদীনা থেকে আগত দশ হাজার সাহাবীসহ মোট বারো হাজার সৈন্য নিয়ে অভিযানে বের হলেন। এই সময় অবশিষ্ট মক্কাবাসীর জন্য তিনি আত্তাব ইবনে উসাইদকে মক্কার শাসক নিযুক্ত করেন এবং নিজে সসৈন্যে হাওয়াযিনের মুকাবিলায় অগ্রসর হন।
হারেস ইবনে মালিক থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইন অভিযানে বের হলাম। আমরা সবেমাত্র জাহিলিয়াত থেকে মুক্ত হয়েছি এবং জাহিলিয়াতের রসম রেওাজকে তখনো পুরোপুরি ছাড়তে পারিনি। যাতু আনওয়াত নামক একটা বিরাটকায় সবুজ পতেজ গাছ ছিল। কুরাইশ কাফিরগণ এবং অন্যান্য আরবরা প্রতিবছর ঐ গাছের কাছে আসতো, গাছের ডালে অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রেখে একদিন তার ছায়ায় অবস্থান করতো এবং সেখানে জন্তু জবাই করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইেিন যাওয়অর পথে একটা বড় গাছ দেখে আমরা বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! কাফিরদের যেমন যাতু আনওয়াত আছে, তেমনি আমাদেরও একটা যাতু আনওয়াত গ্রহণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবর, মূসার (আ) জাতি তাঁকে যেমন বলেছিল, কাফিরদের যেমন দেবদেবী আছে আমাদের জন্যও তেমনি একজন দেবতা গ্রহণ করুন,-তোমাদের এ উক্তিটাও তেমনি। এগুলো পুরনো প্রথা। তোমরা প্রচীন প্রথাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাচ্ছো।”
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, আমরা হুনাইন প্রান্তরের কাছাকাছি এলাম,, এবং তিহামার একটি প্রশস্ত পার্বত্য উপত্যকার মধ্য দিয়ে নেমে চলতে লাগলাম। তখনো ভোরের আলো দেখা দেয়নি। শত্রু সেনারা আমাদের আগেই ঐ উপত্যকায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং সংকীর্ন দুর্গম গিরিগুহায় ও তার আশেপাশে লুকিয়ে আমাদের জন্য ওত পেতে ছিল। তারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষমান ছিল। আমরা সম্পূন্য নিঃশংকচিত্তে গিরিপথ দিয়ে নেমে চলেছি- এই সময় হঠাৎ তারা একযোগে আমাদের ওপর প্রচন্ড হামলা চালালো। হামলার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে আমাদের লোকেরা যে যেদিকে পারলো উঠিপড়ি করে ছুটে পালাতে লাগলো এবং একজন আর একজনের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করলো না। কারো দিকে কারো বিন্দুমাত্র লক্ষ্য করার যেন ফুরসত নেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডান দিকে সরে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “হে সৈনিকরা! তোমরা কোথায় যাচ্ছো? আমার কাছে এসো। আমি আল্লাহর রাসূল। আমি আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ। কিসের জন্য উটের ওপর উপ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে?” কিন্তু স্বল্পসংখ্যক মুহাজির, আনসার ও পরিবারভুক্ত লোক ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে কেউ থাকলো না। সবাই চলে গেল।
ইবনে ইসহাক বলেনঃ মুসলিম বাহিনীর লোকেরা নণেভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামের কাছে অবস্থানকারী মক্কার কিছু পাষন্ড প্রকৃতির লোক পরাজয় অবশ্যম্ভাবী মনে করে নানা রকম কথাবার্তা চলতে লাগলো। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব বললো, “সমুদ্রের উপকূল পর্যন্ত গেলেও এদের পরাজয় শেষ হবে না।” লটারী, ভাগ্য গণণা ও জুয়া খেলার কাজে ব্যবহার্য তীর তখনো আবু সুফিয়ানের কাছেই ছিল।
জাবালা ইবনে হাম্বল চিৎকার করে বললো, আজ মুহাম্মাদের যাদুর ক্ষমতা শেষ হলো।” শাইবা উসমান বললো, “ঐ দিন আমি স্থির করলাম যে, মুহাম্মাদকে হত্যা করে কুরাইশদের সমস্ত খুনের বদলা নেব। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি যেই রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী হয়েছি, অমনি কি একটা ভয়ংকর বন্তু আমার সামনে এসে আড় হয়ে দাঁড়ালো, তা আমার মনকে আছন্ন করে ফেললো এবং তাকে হত্যা করতে পারলাম না। আমি উপলদ্ধি করতে পারলাম যে, তাঁকে আঘাত করা আমার সাধ্যাতীত।”
মক্কাবাসীদের একজন আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনের পথে মক্কা ত্যাপ করার পরপরই আল্লাহর সৈনিকদের বিপুল সংখ্যা দেখে তিনি বলেছিলন, “আজকে আর যাই হোক, সংখ্যা স্বল্পতার কারণে আমরা পরজায় বরণ করবো না।”
আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর সাদা খচ্চরটির লাগাম ধরে বলেছিলাম। আমি খুব মোটাসোটা ও বুলন্দ কণ্ঠের অধিকারী ছিলাম। ভীতসন্ত্রত হয়ে মুসলিম সৈনিকদের উর্ধশ্বাসে ছুটতে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে লোকেরা, আমি তোমাদেরকে কারো প্রতি ফিরে তাকাতে দেখছি না!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “আব্বাস! চিৎকার করে এভাবে যাক দাওঃ হে আনসারগণ! ওহে বাবুল বৃক্ষের নীচে অংগীকারদাতাগণ!”
আমি আদেশ অনুসারে ডাকতে লাগলে প্রত্যেকে লাব্বায়েক বলে সাড়া দিতে লাগলো। এই সময় অশ্বারোহী সাহাবীদের কেউ কেউ ছুটন্ত ও পলায়নরত উটের গতি ফিরাতে ব্যর্থ হয়ে বর্ম দিয়ে তার ষ্কন্ধে আঘাত করেন। তাতেও ফিরতে না পেরে অস্ত্র িেনয়ে উট থেকে নেমে আসেন এবং উচকে ছেড়ে দেন। অতঃপর যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে সেদিকে এগিয়ে যান এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট পৌছে যান। এভাবে একশ জনের মত সাহাবী জমায়েত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন এবং তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলেন।
প্রথমে “হে আনসারগণ” বলে ডাকা হতে থাকে। পরে শুধু “হে খাযরাজ” বলে ডাকা শুরু হয়। কেননা খাবরাজ রণাঙ্গনে দৃঢ়চিত্ত বলে আরবদের কাছে সুপরিচিত ছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাযরাজের বহিনী নিয়ে এগুতে থাকেন। তারপর রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, প্রচন্ড সংঘর্ষ চলছে। তা দেখে বললেন,“এবার রণাঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।”
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেনঃ
হাওয়াবিন গোত্রীয় সেনাপতি উটের ওপর সওয়ার হয়ে লাড়াই করছিল। এই সময় আলী ইবনে আবু তালিব (রা) ও জনৈক আনসার তার দিকে ধেয়ে গেলেন এবং তার উটের পায়ে আঘাত করলেন। উট পিছনে ভর করে বসে পড়লো। তখন আনসারী সেনাপতিকে আঘাত হাঁটুর নীচ থেকে তার পা কেটে ফেললেন। সে তৎক্ষনাৎ নীচে পড়ে গেল। এই সময় যুদ্ধ অভংকর রুপ ধারণ করলো এবং এর গতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। মুসলমানগণ পরাজয়ের অবস্থা থেকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে সারিবদ্ধ যুদ্ধবন্দী না আসা পর্যন্ত তা শেষ হলো না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ারন ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মুত্তলিবের দিকে তাকালেন। তিনি সেদিন অথ্যন্ত দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করেন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলিম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅম দেখলেন, তিনি তার খচ্চরের লাগাম ধরে রেখেছেন। তা দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে?” তিনি জবাব দিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার ভাই।”
আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রান্তরের এক দিকে উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহানকে তার স্বামী আবু তালহার সাথে দেখাতে পেলেন। তিনি কোমর পেট একটা চাদর দিয়ে জড়িয়ে রেখেছেন। পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে আবু তালহা তখন তাঁর গর্তে। আবু তালহা উট তাঁর সাথে রয়েছে এবং উট ছুটে যাবে এই ভয়ে তার নাকের চুলের রশি শক্ত করে ধরে রেখেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উম্মে সুলাইম নাকি?” তিনি বললেন, “হ্যা”, হে আল্লাহর রাসুল, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি যেভাবে হামলাকারী শত্রুদেরকে হত্যা করছেন সেভাবে যারা আপনাকে ছেড়ে পালিয়ে যায় তাদেরকেও হত্যা করুন। কেননা তারা হত্যার যোগ্য।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,, “হে উম্মে সুলাইম। এ জন্য কি আল্লাহই যথেষ্ট নন?” তখন উম্মে সুলাইামের কাছে একটা খনজর ছিল। আবু তালহা বললেন, “হে উম্মে সুলাইম, খনজর কি জন্য।” উম্মে সুলাইম বললেন, “এটা রেখেছি এ জন্য যে, কোন মুশরিক আমার দিকে এগিয়ে আসতে দুঃসাহস দেখাে ল এ দ্বারা তার পেট ফেড়ে ফেলবো।” আবু তালহা বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, চোখের ব্যধি নিয়েও উম্মে সুলাইম কি বলছে শুনেছেন?”
আবু কাতাদাহ (রা) বর্ণনা করেনঃ হুনাইন যুদ্ধের দিন আমি দেখলাম একজন মুশরিক ও একজন মুসলমান পরস্পরের সাথে যুঝছে। এই সময় আর একজন মুশরিক ঐ মুশরিককে সাহায়ের জন্য এগিয়ে এল। তখন আমি তার পওর আক্রমণ চালিয়ে তরবারীর আঘাতে তার হাত কেটে ফেললাম। আর হাত দিয়ে সে আমাকে জাপ্টে ধরলো। সে আমাকে কিছুতেই ছাড়ছিলো না বরং মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই সে অধিক রক্তপাতে দুর্বল হয়ে না পড়লে আমাকে সে মেরেই ফেলতো। সে পড়ে গেলে আমি তাকে হত্যা করলাম। অতঃপর চারদিকে যে যুদ্ধ চলছিল সেজন্য তার দিকে আমি আর ভ্রুক্ষেপ করতে পারিনি। এই সময় জনৈক মক্কাবাসী এস তার জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিল। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করবে তার যাবতীয় জিনিস হত্যাকারী পাবে।” আমি বললাম, “ইয় রাসূলাল্লাহ, আমি একজনকে হত্যা করেছি। তার অনেক জিনিসপত্র ছিল। পরে যুদ্ধের প্রচন্ডতায় আমি আর তার দিকে লক্ষ্য করতে পারিনি। তার জিনিষপত্র কে নিয়েছে জানি না।” মক্কাবাসী একজন বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আবু কাতাদার কথা সত্য। ঐ নিহত ব্যিক্তির যাবতীয় জিনিসপত্র আমার কাছে রয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে ওকে আমার সাথে আপোষ করিয়ে দিন।” আবু বাক্র সিদ্দিক (রা) বললেন, “আল্লাহর কসম এ জিনিসপত্রের ব্যাপারে আপোষ বলবে না। তুমি আল্লাহর এক সিংহের কাছে মতলব স্দি করতে এসেছ- যে আল্লাহর দঈনের জন্য লাগাই করে? আর তুমি কিনা তার যুদ্ধলদ্ধ জিনিসে ভাগ বসাতে চাও?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আবু বাক্র ঠিকই বলেছে। তুমি আবু কাতাদাকে জিনিসগুলো ফিরিয়ে দাও।”
আবু কাতাদাহ বলেনঃ অতৎপর আমি ঐ সব জিনিসপত্র সেই মক্কাবাসী লোকটির কাছ থেকে আদায় করে বিক্রি করলাম। আর তার মূল্য দিয়ে ছোট একটা খেজুরের বাগান নিলাম। এটাই ছিল আমার জীবনে আমার মালিকানাভুক্ত প্রথম সম্পদ।
ইবনে ইসহাক বলেন: হাওয়াযিনরা পরাজিত হওয়ার পর হিসাব নিয়ে দেখতে পেল যে, সাকীফের বনু মালিক গোত্রেরই সবাদিক প্রানহানি ঘটেছে। এ গোত্রের সত্তর জন লোক যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রাবীয়া ইবনে হারেস ইবনে হাবীব। এ গোত্রের সেনাপতি ছিল যুলখিমাল। সে নিতহ হলে উসমান ইবনে আবদুল্লাহ সেনাপতি হয় এবং সেও নিহত এয়। এ যুদ্ধে মুশরিকদের শোচনীয় পরাজয় ঘটার পর তারা মালিক ইবনে আওফ সহ তায়েফ চলে যায়। এদের কিছু সৈন্য আওতাসে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করতে থাকে। আর কিছু সংখ্যক নাখলার দিকে চলে যায়। নাখলার দিকে যারা গিয়েছিল তাদের মধ্যে সাকীফের বনু গিয়ারা উপগোত্র ছাড়া আর কেউ ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৈন্যরা তাদের পিছু ধাওয়া করলো না। মুশরিক বাহিনীর যে অংশটি আওতাসের দিকে যায় তাদের পিছু ধাওয়া করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আমের আশয়ারীকে পাঠান। সেখানে তিনি কিচুয পরাজিত সৈন্যকে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দেন।
একটি তীরে বিদ্ধ হয়ে আবু আমের আশয়ারী শাহাদত বরণ করেন। অতঃপর তাঁর চাচাতো ভাই আবু মূসা আশয়ারী সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় লাভ করেন এবং মুশরিকরা পরাজিত হয়।
পরাজয়ের মুখে মালিক ইবনে আওফ স্বগোত্রীয় একদল অশ্বারোহী নিয়ে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক উপত্যকায় অবস্থান করেন। তাদেরকে তিনি বলেন, “দুর্বল লোকেরা চলে যাক। অতঃপর শক্তিশালী লোকেরা আসবে। ততক্ষণ তোমরা এখানে অপেক্ষা কর।” দুর্বল পরাজিত সৈন্যরা চলে যাওয়া পর্যন্ত সে সেখানে অবস্থান করলো।
খালিদ ইবনে ওয়ালীদ এক মহিলাকে হত্যা করেন। তার লাশের কাছে উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপুল লোক সমাগম দেখতে পান। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “এখানে কি হয়েছে?” সকলে বললো, “খালিদ ইবনে ওয়ালীদ এক মহিলাকে হত্যা করেছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এক সহচরকে বললেন, “খালিদের সাথে গিয়ে দেখা কর এবং বল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে শিশু, মহিলা, অথবা দিন মজুর ও দাস দাসীকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন বলেছিলেন, “বনু সা’দ ইবনে বকরের বিজাদকে যদি পাও তবে তাকে পালাতে দিও না।” সে একটা বড় অপরাধ করেছিল। মুসলমানগণ তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন এবং তাকে সপরিবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধবোন শায়মা বিনতে হারেসকেও নিয়ে আসেন। পথিমধ্যে তার সাথে কিছু রূঢ় ব্যবহার করা হয়। তখন সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার দুধবোন।” তিনি বললেন, “তার প্রমাণ কি?” সে বললো, “যখন আমি আপনাকে আমার উরুর ওপর তুলেছিলাম তখন আপনি আমার পিঠে কামড় দিয়েছিলেন। সেই চিহ্ন টি এখনো আছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কামড়ের চিহ্নটি দেখে চিনতে পারলেন। তিনি নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে সসম্মানে বসতে দিলেন এবং বললেন, তুমি যদি আমার কাছে থাকা পছন্দ কর তাহলে সসম্মানে থাকতে পার। আর যদি পছন্দ কর যে, তোমাকে কিছু উপঢৌকন দিই এবং তুমি নিজ গোত্রে ফিরে যাবে তাহলে তাও করতে পার।” সে বললো, “আমাকে যা দিতে চান দিয়ে আমার গোত্রের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনেক কিছু দিয়ে তার কওমের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
বনু সাদের বর্ণনা অনুসারে তিনি তাকে মাকস্থল নামক একটি দাস এবং তার একটি দাসী উপঢৌকন দিয়ে বিদায় দিলেন। শায়মা পরে ঐ দাসদাসীকে পরস্পরে সাথে বিয়ে দেন এবং তাদের বংশধারা বহুদিন পযন্ত তাদের মধ্যে চলতে থাকে।
ইবনে হিশাম বলেনঃ
আল্লাহ তায়ালা হুনাইন যুদ্ধ সম্পর্কে এ আয়াত কয়টি নাযিল করেন,
“আল্লাহ তোমাদেরকে অনেকগুলো রণাঙ্গনে সাহায্য করেছেন। হুনাইনের যুদ্ধের দিনেও করেছেন-যখন তোমরা নিজ সংখ্যাধিক্যের কারণে গর্বিত হয়েছিলে। কিন্তু সে সাংখ্যাধিক্যে তোমাদের কোন লাভ হয়নি। সেদিন বিশাল পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল এবং তোমরা পালিয়েছিলে। তারপর আল্লাহ শান্তি ও স্বস্তি আনেন তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের প্রতি। আর তার এমন বাহিনী পাঠান যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আল্লাহ কাফিরদেরকে এভাবে শাস্তি দেন। বস্তুত: কাফিরদের সমুচিত শাস্তি এটাই।” (আত্ তাওবাহ)
ইবনে ইসহাক বলেনঃ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হুনাইনের সমস্ত যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধলব্ধ অর্থ এনে রাখা হয়। মাসউদ ইবনে আমও গিফারীকে গণীমত তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে গনীমত ও যুদ্ধবন্দীদেরকে জি’রানা নামক স্থানে রাখা হয়।
তায়েফ যুদ্ধ: ৮ম হিজরী সন
বনু সাকীফের পরাজিত বাহিনী তায়েফে গিয়ে নগরীর দ্বার রুদ্ধ করে দেয় এবং পুনরায় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। উরওয়া ইবনে মাসউদ ও গাইলান ইবনে সালামা হুনাইন ও তায়েফের অভিযানে অংশ নেননি। তারা জুরাশে ট্যাংক, কামান ও দবুর জাতীয় যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।
হুনাইনের বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানে বেরুলেন। এই অভিযান সম্পর্কে কা’ব ইবনে মালিক একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। তার অর্থ হলো- “তিহামা ও খাইবার থেকে আমরা সকল সংশয় দূর করে তরবারীকে বিশ্রাম দিয়েছিলাম। তরবারীগুলোকে আমরা দাওস অথবা সাকীফের যে কোন একটি বেছে নেয়ার অধিকার দিয়েছিলাম। আর সেসব তরবারী যদি কতা বলতো তবে চূড়ান্ত কথাই বলমো। সে তরবারী যদি তোমরা তোমাদের বাসস্থানের আঙ্গিনায় দেখতে না পাও, তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের কেউ (তোমাদেরকে) রক্ষা করতে চাইলেও তার প্রতি আমি মোটেই বন্ধুভাবাপন্ন হয়ো না। আমরা (তোমাদের) ঘরের ছাদগুলোকে ভেঙ্গে ওয়াজ্জের প্রান্তরে নিয়ে যাবো। ফলে তোমাদের ঘরবাড়ী বিরান হয়ে যাবে।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে নাখলা ইয়ামনিয়াতে, তারপর কাব্নে, তারপর মুলাইহে, তারপর সেখান থেকে লিয়া এলাকার বুহরাতুর রুগাতে গিয়ে উপনীত হলেন এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করিয়ে তাতে নামায পড়লেন। এরপর দাইকা নামক রাস্তা দিয়ে নাখাবে গিয়ে বনু সাকীফের এক ব্যক্তির জমির কাছে ‘ছাদেরা’ নামক কুল গাছের নীচে যাত্রাবিরতি করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই লোকটির চরমপত্র দিলেন যে, “এই জায়গা খালি করে দিয়ে সরে যাও, নচেৎ আমরা তোমার দেয়াল ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবো।” লোকটি বেরিয়ে যেতে অস্বীকার করলে তিনি তার দেয়াল ভেঙ্গে দিলেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার যাত্রা শুরু করলেন। তায়েফের কাছাকাছি গিয়ে তাঁবু স্থাপন করে সৈন্যদের নিয়ে তাতে অবস্থান গ্রহণ করলেন। এইখানে কতিপয় সাহাবী তীরবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের সৈন্যরা তায়েফের দেয়ালের পাশেই অবস্থান নিয়েছিলেন, তাই নগরের ভেতর থেকে তায়েফবাসীদের নিক্ষিপ্ত তীর তাঁদের ওপর এসে পড়েছিল। তায়েফবাসীরা শহরের দরজা এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল যে, মুসলমানগণ তার ভেতরে ঢুকতে পারলো না। তীরবিদ্ধ হয়ে কতিপয় সাহাবী শাহাদত বরণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গোটা বাহিনীকে নিয়ে নগরীর সেই স্থানে স্থাপন করলেন যেখানে আজ তায়েফের সমজিদ অবস্থিত। তিনি তায়েফবাসীকে অবরোধ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই অভিযানে উম্মে সালামা (রা) সহ দুজন স্ত্রী সহগামিনী হয়েছিলেন। তাঁদের জন্য তিনি গম্বুজ আকৃতির দু’টি ঘর নির্মাণ করে দিলেন। সেই ঘরের মাঝে তিনি নামায আদায় করেন। অতঃপর তিনি সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। বনু সাকীফ ইসলাম গ্রহণ করলে আমর ইবনে উমাইয়া (রা) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায পড়ার জায়গাফ মসজিদ তৈরী করেন। এই মর্মে জনশ্রুতি আছে যে, ঐ মসজিদে একটি যোদ্¦া দল থাকতো। প্রতিদিনই তাদের রণহুংকার ও তর্জন গর্জন শোনা যেত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফবাসীকে অবরোধ করে তীর ধনুক দ্বারা তুমুল যুদ্ধ করলেন। [৮৩. ইবনে হিশাম বলেছেন,, এই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কামান ব্যবহার করেন। তায়েফবাসীর বিরুদ্ধে তিনি যে কামান ব্যবহার করেন সেটাই ইসলামের প্রথম কামান।]
তায়েফের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য যে দিনটি নির্ধারিত করা হয়েছিল সে দিন সমাগত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল সাহাবী একটি ট্যাংকের নীচে ঢুকলেন, অতঃপর তা নিয়ে তায়েফের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য সংঘবদ্ধভাবে অগ্রসর হলেন। বনু সাকীফ গোত্রের লোকরা তাদের ওপর আগুনে পোড়ানো লোহার শেল নিক্ষেপ করতে লাগলো। এতে সাহাবীগণ ট্যাংকের নীচ থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন। আর যিনিই বের হন তিনিই সাকীফের তীরে বিদ্ধ হন। এভাবে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান শহীদ হন। এই পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাকীফের বাগান কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণ তা কেটে ফেলতে শুরু করলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সাকীফের অবরোধ চলাকলে একদিন আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) কে বললেন, “হে আবু বাক্র, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমাকে এক পেয়ালা ঘি উপহার দেয়া হয়েছে। একটা মোরগ এসে ঠোকরাতে ঠোকরাতে পেয়ালার ঘি টুকু ফেলে দিল।” আবু বাক্র (রা) বললেন, “আমার মনে হয়, আজ আপনি বনু সাকীফকে পরাজিত করতে পারবেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমার ধারণাও তাই।”
একদিন উসমান ইবনে মাযউনের স্ত্রী খুয়াইলা বিনতে হাকীম (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহ যদি আপনাকে তায়েফবাসীর ওপর বিজয় দান করেন তাহলে বনু সাকীফের সবচেয়ে অলংকার সাজ্জিতা মহিলা বাদিয়া বিনতে গীলান অথবা ফারেগা বিনতে আকীলের অলংকার আমাকে দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “আমাকে যদি বনু সাকীফের ব্যাপারে অনুমতি না দেওয়া হয় তা হলেও?” খুয়াইলা একথা শুনে চলে গেলেন এবং উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) কথাটা জানালেন। উমার (রা) তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, খুয়াইলা যে কথা আমাকে জানালো তা কি আপনি বলেছেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হ্যা’। উমার (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বনু সাকীফের ব্যাপারে অনুমতি কি আপনি পাননি?” তিনি বললেন, ‘না।’ উমার বললেন, “তাহলে কি আমি এখন মুসলমানদেরকে এ স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হাঁ।’ উমার (রা) তখন মুসরিম বাহিনীকে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। যাত্রা শুরু হলে সাঈদ ইবনে উবাইদ আওরাজ দিলেন, “বনু সাকীফ যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেলো।” উয়াইনা ইবনে হিসন বললেন, “হাঁ, আপন মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে (রয়ে গেলা)।” জনৈক সাহাবী বললেন, “হে উয়াইনা! মুশরিকরা আল্লাহর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করলো আর তমি তাদের প্রশংসা করছো? অথচ তুমি এসছো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে লড়াই করতে। ধিক্ তোমাকে।” তিনি বললেন, “আসলে আমি তোমদের পক্ষে বনু সাকীফের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো সে জন্য আসিনি। আমি এসেছি এই উদ্দেশ্যে যে, মুহাম্মাদ তায়েফ জয় করলে আমি বনু সাকীফের একটা মেয়েকে হস্তগত করবো যাতে সেই মেয়রে গর্ভে আমার একটা পুত্র জন্ম নেয়। কারণ বনু সাকীফ অত্যন্ত তীক্ষè মেধার অধিকারী।”
অবরোধ চলাকালে তায়েফের কিছু সংখ্যক দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট আসে এবং ইসলাম গ্রহণ কলে। তিনি তাদের সবাইকে মুক্ত করে দেন। পরবর্তী সময়ে তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের কেউ কেউ ঐ দাসদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবেদন করে। আবেদনকারীদের মধ্যে হারেস ইবনে কালদা চিলেন অন্যতম। তিনি তাদের ‘না’ সূচক জবাব দেন এবং বলেন, “ওরা আল্লাহর মুক্ত বান্দা। ওদেরকে আবার আমি দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করতে পারি না।”
মোট বারোজন সাহাবী তায়েফে শাহাদাত বরণ করেন। তন্মধ্যে সাতজন কুরাইশ, চারজন আনসার এবং একজন বনু লাইস গোত্রের।
যুদ্ধ ও অবরোধ শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফ ত্যাগ করলে বুজাইর ইবনে যুহাইর তায়েফ ও হুনাইনের বর্ণনা দিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন যার মর্ম হলো-
“হুনাইনের প্রান্তরে সমবেত হওয়ার দিনে, আওতাসে সমবেত হওয়ার প্রভাত কালে এবং বিদ্যুত চমকানের দিন শেষেক্তটি সম্ভবতঃ তায়েফ) তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। প্রতারণার মাধ্যমে হাওয়াযিন তার জনতাকে সমবেত করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা নীড়ভ্রষ্ট শতধঅ বিভক্ত পাখীর মত হলো। আমাদের কোন অবস্থান গ্রহণকেই তারা বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। পেরেছে শুধু তাদের প্রাচীর ও খন্দকের ভেতরটা ঠেকিয়ে রাখতে। তায়েফবাসী যাতে বেরিয়ে আসে সেজন্য চেষ্ট করলাম, কিন্তু দরজা বন্ধ করে তারা তাদের ঘরে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে থাকলো। তারা অনুতপ্ত হয়ে একদিন ফিরে যাবে সেই বিশালকায় বাহিনীর কাছে- যে বাহিনী মৃত্যুর দীপ্ত গৌরবে উদ্ভাসিত-যে বাহিনীর সমাবেশে সবুজ আভা পরিস্ফুট। (নাজাদের) হাযান পর্বতে যদি তাকে চালিত করা হয় তবে সে পর্বত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বনের সিংহরা কাঁটাযুক্ত ঘাসের ওপর দিয়ে যেভাবে চলে আমরা সেইভাবে চলি। যেন আমরা দ্রুতগামী ঘোড়া, যা চলার পথে কখনো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় আবার মিলিত হয়। সব রকমের যুদ্ধবর্মই আমরা পরে থাকি। এসব বর্মই আমাদের দুর্গের কাজ করে- যেমন অগভীর কুয়ার ভেতরে পুঞ্জিভূত বাতাস বেরিয়ে গেলে তা দুর্গের মত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বর্মগুলো এত দীর্ঘ যে তা আমাদের জুতা স্পর্শ করে এবং তা দাউদ (আ) এবং হীরার বাদশাহ আমর ইবনে হিন্দের তৈরী বর্মের মত সুনির্মিত।”
হাওয়াযিনের জমিজমা
যুদ্ধবন্দী, তাদের কিছুসংখ্যক লোককে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য উপঢৌকন দান এবং কিচু লোককে পুরস্কার প্রদানের বিবরণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণ হাওয়াযিনের বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দীকে সাথে নিয়ে তায়েফ থেকে জিরনাতে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। ইতিপূর্বে সাকীফের অবরোধ ত্যাগ করে তাদের থেকে চলে যাওয়ার সময় একজন সাহাবী তাঁতে বনু সাকীফের বজন্য বদদোয়া করতে বলেন। জবাবে তিনি বলেন, “হে আল্লাহ! সাকীফকে হিদায়াত দান কর ও আমার কাছে হাজির কর।”
হাওয়াযিনের একটি প্রতিনিধদল জিরানাতে এসে তাঁর সাথে দেখা করলো। তকন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হাওয়াযিনের গোত্রের ছয় হাজার শিশু ও নালি যুদ্ধবন্দী ছিল। আর উচ ও বকরীর সংখ্যা নির্ণয় করা যায়নি। প্রতিনিধিরা বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার জ্ঞাতি-গোষ্ঠী ও আত্মীয়-স্বজন। আমাদের ওপর কি ভয়াবহ বিপদ আপতিত তা আপনার অজানা নেই। অতএবআমাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করুন। আল্লাহ আপনার ওপর অনুগ্রহ করবেন।”
হাওয়যিনের এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালো। তার অব্যবহিত পর বনু সা’দ ইবনে বকরের এর একজন উঠে দাঁড়ালো। এ ব্যক্তি হলো যুহাইর ওরফে আবু সুরাদ। সে বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, যুদ্ধবন্দীদের ভেতর আপনার ফুফু, খালা ও আপনার লালন-পালনকারিণীরাই রয়েছে। [৮৪. লালন পালনকারিণী বলতে দুগ্ধ-দাত্রীদেরকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামের দুধমাতা হালিমা এই বনু সা’দ গোত্রেরই মহিলা ছিলেন এবং তা হাওয়াযিনেরই একটি শাখা।] আমরা যদি হারেস ইবনে আবু শিমার অথবা নুমান ইবনে মুনযিরকে দুধ খাওয়াতাম এবং তারা যদি আজ আপনার জায়গায় অধিষ্ঠিত হতো হাতলে তারাও আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতো। আপনি তো তাদের চেয়েও উত্তম।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা তোমাদের সম্পদ এবং স্ত্রী ও শিশুদের মধ্যে কোনটিকে অগ্রধিকার দিতে চাও?” তারা বললো, “আপনি যদি দুটোর একটাই নিতে বলেন তাহলে আমাদের শিশু ও মহিলাদেরকেই ফিরিয়ে দিন।” তিনি বললেন, “যেসব মহিলা ও শিশু আমার ও বনু আবদুল মুত্তালিব গোষ্ঠীর কাছে আছে তাদেরকে আমি দিয়ে দিচ্ছি। আর বাদবাকীদের জন্য তোমরা যোহরের নামাযের সময় জমায়াতে হাজির হও। তখন মুসলমানদের সবার কাছে এই বলে আবেদন জানাবে যে, ‘আমরা আমাদের স্ত্রী ও শিশুদের ফেরত চাই। যারা মুলমানদের কাছে রয়েছে তাদের জনস্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করছি তিনি যেন মুসলমানদেরকে সুপারিশ করেন আর যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট রয়েছে তাদের জন্য মুসলমানদেরকে অনুরোধ করছি তারা যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করেন।’ তখন আমি আমার কাছে যারা রয়েছে তাদেরকে ফেরত দেব এবং মুসলমানদেরকে অনুরোধ করবো যেন তারাও ফেরত দেয়।”
যোহরের নামাযের সময় হাওয়াযিন ও বনু সা’দের প্রতিনিধিরা রাসূলুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশমত কাজ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সামনে ঘোষণা করলেন, “সঙ্গে সঙ্গে মুহাজির ও আনসারগণও বললেন, “আমাদের কাছে যারা আছে আমরা তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের কাছে সমর্পণ করলাম।” কেবল আকরা ইবনে হারেস নিজের ও বনু তামীমের, উয়াইদা ইবনে হিসন নিজের ও বনু ফাজারের এবং আব্বাস ইবনে মিরদাস নিজের ও বনু সুলাইমের পক্ষ থেকে এ আবেদনে সাড়া দিলো না। কিন্তু বনু সুলাইম আব্বাসকে অগ্রাহ্য করে বললো, “ আমাদের যার কাছে যত নালী ও শিশু আছে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে অর্পণ করলাম।: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমাদের মধ্যে যারা নিজ নিজ অধিকার ত্যাগ করতে চাও না তাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, এরপর সর্বপ্রথমে যে যুদ্ধবন্দী আমার হস্তগত হবে তা থেকে তাদের প্রত্যেককে একটির বদলে ছয়টি করে দেবো। কাজেই এদের শিশু ও নারী ফেরত দাও।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম হাওয়াযিনের প্রতিনিধিদের জিজ্ঞেস করলেন, “মালিক ইবে ন আওফের খবর কি?” তারা বললো, “সে তায়েফে বনু সাকীফের সাথে রয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বললেন, “মালিকেেক তোমরা জানিয়ে দাও, সে যদি মুসলমান হয়ে আমার কাছে হাজির হয় তাহলে আমি তাকে তার সমস্ত সম্পদ ও বন্দী লোকদেরকে ফেরত দেবো এবং আরো একশো উট দেবো।” মালিকের আশংকা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রস্তাব বনু সাকীফ জানতে পারলে তারা তাকে আটক করবে। তাই সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করলো। সে পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় একটি উটকে তার বাহন হিসেবে প্রস্তুত করে রাখলো। অতঃপর তায়েফ থেকে গভীর াতে একটি ঘোড়ায় চড়ে ঐ উটের কাছে পৌছলো। অতঃপর সেই উটের পিঠে চড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হলো। কিরানা অথবা মক্কায় তাঁর সাথে মিলিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সকল বন্দী ও সম্পদ ফেরত দিলেন এবং একশোটি উটও দিলেন। সে ইসলাম গ্রহণ করলো এবং নিষ্ঠাবান মুসমলমানের পরিণত হলো। অতঃপর মালিক ইবনে আওফ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় একটি কবিতা আবৃত্তি করলো। কবিতাটি নিম্নরুপঃ
“সমগ্র মানব সমাজে আমি মুহাম্মাদের সমতুল্য কোন মানুষ দেখিনি, বা শুনিনি।
সে কাউকে কোন কিছু দেয়অর প্রতিশ্রুতি দিলে তা যথাযথভাবে রক্ষা করে
এবং বিপুল পরিমাণে দান করে
উপরূন্ত তুমি যদি চাও
তবে সে আগামীকাল কি ঘটবে তাও বলে দিতে পারে।
যখন বড় বড় গোত্রতিরা নিজ নিজ বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র সহ পালিয়ে গেছে
এবং অত্রন্ত তীক্ষèধার তরবারীও আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত হয়েছে
ধূলিধূসরিত রণাঙ্গনে তখনো সে শাবকদের পাহারায় নিযোজিত ও
ঘাঁটিতে ওত পেতে থাকা হিংসের মহ অবিচল।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মালিক ইবনে আওফকে তার স্বগোত্রীয় মুসলমানদের এবং বনু সুমালা, বনু সালেমা ও বনু কাহম গোত্রের মুসলমানদের আমীর নিযুক্ত করেন। মালিক এইসব মুসলমানদের সাথে নিয়ে বনু সাকীফের বিরুদ্ধে অব্যাহত লাড়াই চালাতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদেরকে বশীভূত করেন। বনু সাীফের কবি আবু মিহজান খেদোক্তি করে কবিতা আবৃত্তি করে,
“একদিন শত্রুরা আমাদেরকে ভয় করে চলতো। অথচ
আজ কিনা বনু সালেম আমাদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে।
সকল সম্পর্কের পবিত্রতা লংঘন ও ওয়াদা ভঙ্গ কলে
মালিক তাদের সহযোগিতায় আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে। এমনকি
আমাদের বাড়ীঘরের ওপরে চড়াও হয়ে বসেছে।
অথচ আমাদেরই প্রতিশোধ নেয়ার কথা ছিল।”
অতঃপর মুসলমানদের মধ্যে অনেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফাই (বিনা যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ) তথা উট ও ছাগলের ভাগ দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। পীড়াপীড়ি করতে করতে তারা তাঁকে একটি গাছের নীচে নিয়ে গেলে গাছে তাঁর চাদর আচকে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা আমার চাদরখানা দাও। আল্লাহর কসম, তিহামার বৃক্ষরাজির মত বিপুল সম্পদও যদি থাকতো তাহলে আমি তা তোমাদের মধ্যে বন্টন করে দিতাম। আমার ভেতরে কৃপণতা, ভীরুতা ও মিথ্যার লেমমাত্রও তোমরা দেকতে পেতে না।” অতঃপর তিনি তার উটের পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং তার ঘাড়ের ওপর থেকে একটা চুল হাতে নিয়ে তা দেখিয়ে বললেন “হে মুসলিম জনতা, আল্লাহর কসম, তোমাদের ফাই থেকে-এমনকি এই পশমগাছি থেকেও আমার প্রাপ্য এক পঞ্চমাংশের বেশী নয়। অথচ সেই এক পঞ্চমাংশেও আমি তোমাদেরকেই দিয়ে দিয়েছি। সুতরাং যদি কেউ এই সম্পদ থেকে একটা সুঁই ও সুতাও নিয়ে থাক তবে তা ফিরিয়ে দাও। মনে রেখ, যে ব্যক্তি খিয়ানত করবে, কিয়ামতের দিন ঐ খিয়ানত তার জন্য আগুনের রূপ নেবে এবং চরম অপমান ও লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”
জনৈক আনসারী তার উটের হাওদার ছিঁড়ে যাওয়া অংশ সেলাই করার জন্য কিছু পশমের সুতা নিয়েছিলেন তিনি তা ফেরত দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ এ থেকে আমার প্রাপ্য অংশ তোমাকে দিলাম।” তিনি বললেন, “আপনি খিয়ানত সম্পর্কে যে কথা বলেছেন তাতে আমার এ জিনিসের মোটেই প্রয়োজন নেই।” অতঃপর তা ফেরত দিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন জয় করার উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় লোকদের সম্পদ প্রদান করেন। নিম্নলিখিত ব্যক্দিদেরকে তিনি একশ’টি করে উট দেন: আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়া, হাকীম ইবনে হিযাম, হারেস ইবনে কালদা, হারেস ইবনে হিশা, সুহায়েল ইবনে আমর, হুয়াইতিব ইবনে আবদুল উয্যা, আলা ইবন জারিয়া, উয়াইনা ইবনে হিসন, আকরা ইবনে হারেস, মালিক ইবনে আওফ ও সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া।
নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গকে একশ’র কম উট প্রদান করেন ৎ মাখরামা ইবনে রাওয়াল যুহরী উমাইর ইবনে ওয়াহাব আল-জুমাহী, হিশাম ইবনে আমর ও আমর ইবনে লুয়াই। আর সাঈদ ইবনে ইয়ারবু ও সাহমীকে পঞ্চাশটি করে উট দেন।
আব্বাস ইবনে মিরদাসকে দেন পঞ্চাশটিরও কম। সে রাগান্বিত হয়। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তিরস্কার করে নিচের কবিতাংশ আবৃত্তি করে,
“এগুলো আমার ছিনিয়ে নেয় দ্রব্য ছিল। আমি অশ্¦ শাবকের পিঠে সওয়ার হয়ে সমতল ভূমির জনপদে হামলা চালিয়ে এগুলো পেয়েছিলাম। নিজের গোত্রের লোকদের ঘুম থেকে জাগিয়ে রেখে ছিনিয়ে এনেছিলাম যেন তারা না ঘুমায়। কিন্তু তারা ঘমিয়ে পড়েছিল আর আমি একা জেগে ছিলাম। উয়াইনা ও আকরা যা পারেনি আমি ও আমার ঘোড়া সেই সম্পদ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। যুদ্ধের ময়দানে আমি একজন দক্ষ লড়াকু। কিন্তু আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে দেযা হয়নি। তবে একবোরে বঞ্চিত করা হয়নি। কেবল কয়েকটি ছোট উট আমাকে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর চারটি পা এখনো তেমন লম্বা হয়নি। হিসন এবং হারেস (একশো উট প্রাপ্ত উয়াইনা ও আকরার পিতা) আমার পিতার (মিরদাসের) চেয়ে সমাজে বেশি প্রতিপত্তিশালী ছিল না। আর আমি নিজেও ওদের দুজনের চেয়ে নগণ্য নই। আজ আপনি যাকে অপমানিত করলেন সে আর কখনো সম্মানিত হবে না।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণকে নির্দেশ দিলেন, “যাও, ওকে আরো কিছু দিয়ে খুশী কর এবং তার মুখ বন্ধ কর।” সাহাবাগণ তাকে আরো কিছুসংখ্যক উট গিয়ে খুশী করলেন।
আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রের নেতাদের প্রতি এরূপ বদান্যতা প্রদর্শন করায় এবং আনসারগণকে কিছুই না দেয়ায় তারা খুবাই অসন্তুষ্ট হন এবং কেউ কেউ আপত্তিকর কথাবার্তা বলা শুরু করেন। এমনকি কেউ কেউ বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আপনজনদেরকে খুশী করেছেন।” এ সময় সা’দ ইবনে উবাদা (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি গনীমতের সম্পদ যেভাবে বিলিবন্টন করলেন তাতে আনসারগণ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। আপনি এসব সম্পদ নিজের গোত্র কুরাইশ ও অন্যান্যদের মধ্যে বন্টন করলেন। অথচ আনসারদের কিছু দিলেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে সা’দ! তোমার নিজের মনোভাব কি?” তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আমার গোষ্ঠীর একজন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে তোমার গোষ্ঠীকে এখানে হাজির কর।”
সা’দ আনসারদেরকে সেখানে জমায়েত করলেন। কিছুসংখ্যক মুহাজিরও সেখানে এসে হাজির হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অনুমতি দিলেন। এরপর আবার কিছুসংখ্যক মুহাজির আসতে চাইলে তিনি আর অনুমতি দিলেন। এরপর আবার কিছুসংখ্যক মুহাজির আসতে চাইলে তিনি আর অনুমতি দিলেন না। এভাবে ঐ সকল আনসার সমবেত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের াকছে গেলেন। প্রথমে তিনি যথাযথভাবে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। অতঃপর বললেন, “হে আনসারগণ, তোমাদের পক্ষ থেকে কিচু আপত্তিকর কথা উচ্চারিত হতে শুনেছি এবং আমার ওপর তোমরা ক্ষুব্ধ ও ক্রুব্ধ হয়েছো বলে জানতে পেরেছি। বলতো আমি যখন তোমাদের কাছে আসি তখন কি তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ কি তোমদেরকে হিদায়াত দান করেননি? তোমরা কি দরিদ্র ছিলে না অতঃপর আল্লাহ কি তোমাদের সচ্ছল করেননি? তোমরা কি পরস্পরের শত্রু ছিলে না। অতঃপর আল্লাহ কি তোমাদেরকে পরস্পরের কাছে প্রিয় করে দেননি?” তারা বললেন, “হা। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই আমাদের ওপর সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহ করেছেন।” তিনি আরো বললেন, “হে আনসারগণ, তোমরা জবাব দাও না কেন?” তারা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনাকে কি জবাব দেবো? আল্লাহর রাসূলই আমাদের ওপর সবচেয়ে বেশী অনুগ্রহ করেছেন।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা বলতে পার যে, তুমি আমাদের কাছে এসেছিলে এমন অবস্থায় যখন কেউ তোমার প্রতি ঈমান আনেনি, আমরাই কেবল ঈমান এনছিলাম। সবাই তোমাকে নির্যাতন করেচিল শুধু আমরাই তোমাকে সাহায্য করেছিলাম, তোমাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল আমরাই তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম, তুমি অসহায় অবস্থায় আমাদের কাছে এসেছিলে আমরা তোমাকে আপনজন করে নিয়েছিলাম। এ কথাগুলো বললে তোমাদের মোটোই মিথ্যা বলা হেব না। এবং সবাই তার সত্যতা স্বীকার করবে। হে আনসারগণ, দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী সম্পদের জন্য তোমরা আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে গেলে? এক শ্রেনীর লোককে আমি আগেই আস্থাবান ছিলাম এটা কি তোমাদের পছন্দ হয়নি? হে আনসারগণ, তোমরা কি এতে খুশী নও যে, লোকেরা উট ও বকরী নিয়ে চলে যাক, আর তোমরা তার বদলে আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে যাও? যে আল্লাহর হাতে মাহুম্মাদের প্রাণ, তাঁর শপথ করে বলছি, আমাকে যদি হিজরাত করে আসতে না হতো, তাহলে আমি তোমাদেরই মত আকজন আনসার হতাম। সবাই যদি একপথে চলে আর আনসাররা যদি ভিন্ন পথে চলে আমি আনসারদের পথ ধরেই চলবো। হে আল্লাহ! তুমি আনসারদের প্রতি রহমত বর্ষণ কর, তাদের সন্তানদের ওপর এবং সন্তানদের বংশধরের ওপরও রহমত বর্ষণ কর।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ ভাষনে আনসার সাহাবীগণ এত কাঁদলেন যে, দাড়ি পর্যন্ত সিক্ত হয়ে গেল। তারা সমস্বরে বলে উঠলেন, “আমরা আমাদের ভাগে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়েই সন্তুষ্ট এবং তাতেই গৌরবান্বিত।’
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলেন। মুসলমানরাও যে যার কাজে চলে গেল।
জি’রানা থেকে রাসূলুল্লাহর (সা.) উমরা পালন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্তাব ইবনে উসাইদকে সাময়িকভাবে মক্কার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন এবং আত্তাব মুসলমানদের সাথে নিয়ে ৮ম হিজরী সনে হজ্জ পালন করেন।
ইবনে ইসহাক বলেনঃ
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আালাইহি ওয়াসাল্লাম জি’রানা থেকে উমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মাররুয যাহরানের নিকটবর্তী মাজান্নাতে বিজয়লব্দ অবশিষ্ট সম্পদ সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিলেন। উমরা সমাপন করে তিনি মদীনা চলে গেলেন এবং আত্তাব ইবনে উসাইদকে (রা) সাময়িকভাবে মক্কার শাসনকর্তা নিয়োগ করলেন। মুসলিম জনগণকে ইসলামের বিস্তারিত বিধান ও কুরআন শিক্ষ দেয়ার উদ্দেশ্যে আত্তাবের সাথে মুয়ায ইবনে জাবালকেও (রা) রেখে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বিজয়লব্ধ অবশিষ্ট সম্পদ সাথে করে মদীনায় নিয়ে গেলেন। তিনি এই উমরা সম্পন্ন করেন যুলকাদা মাসে। তাই তাঁর মদীনা গমন সংঘটিত হয়েছিল যুলকা’দার শেষায়শ অথবা যুল-হাজ্জের প্রথমাংশে। ইবনে ইসহাক বলেন, আরবদের প্রচলিত নিয়মেই সে বছরের হজ্জ সম্পন্ন হয়। আত্তাব (রা) মুসলমানদের সঙ্গে হ্জ্জ পালন করেন। [৮৫. ইবনে হিশাম বলেন, যায়িদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্তাবকে মক্কার শাসক হিসেবে নিয়োগ করার পর তাকে দৈনিক এক দিরহাম করে ভাতা দেন। তিনি একদিন মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, “এক দিরহাম ভাতা পেয়েও যার তৃপ্তি হয় না আল্লাহ তাকে কখনো তৃপ্ত করবেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দৈনিক এক দিরহাম করে ভাতা ঠিক করে দিয়েছেন। আমি এখন কারো মুখাপেক্ষী নই।”] এটা ছিল ৮ম হিজরী সন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তায়েফ ত্যাগের পর থেকে তথা যুলকা’দা মাস থেকে নিয়ে নবম হিজরী সনের রমযান পর্যন্ত তায়েফবাসী শিরক ও ইসলাম বিরোধিতায় অবিচল থাকে।