রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিযুক্ত কর্মচারী ও আমীরগণের যাকাত আদায়ের অভিযান
ইবনে ইসহাক বলেন:
ইনতিকালের পূর্বেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম দখলকৃত সকল দেশ ও অঞ্চলের যাকাত আদায়ের জন্য তাঁর নিযুক্ত আমীর ও কর্মচারীগণকে পাঠান। সানয়াতে পাঠালেন মুহাজির ইবনে আবু উমাইয়াকে। তিনি সানয়াতে থাকাকালেই আনসী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বনু বিয়াজা আনসারী গোত্রের যিয়াদ ইবনে লাবীদকে (রা) হাদরামাউমে, আদী ইবনে হাতিমকে (রা) বনু তাই ও বনু আসাদ গোত্রে, মালিক ইবনে নুযাইরাকে (রা) বনু হানযালা গোত্রে, যাবারকান ইবনে বদরকে (রা) বনু সা’দ গোত্রের একাংশে, কায়েস ইবনে আসিমকে একই গোত্রের অপরাংশে এবং আল্ াইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠালেন নাজরানের (মুসলমানদের নিকট থেকে) যাকাত ও (খৃষ্টনদের নিকট থেকে) জিযিয়া আদায় করতে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মুসাইলিমার চিঠি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে তার জবাব
“আল্লাহর রাসূল মুসাইলিমার পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নিকট। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমাকে আপনার নবুওয়াতের অংশীদার করা হয়েছে। পৃথিবীর অর্ধেকটা আমাদের ভাগে এবং অপর অর্ধেক সুরাইশদের ভাগে। তবে কুরাইশরা সবসময় বাড়াবাড়ি করে থাকে।”
এই চিঠি নিয়ে দু’জন দূত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলো। ইবনে ইসহাক বলেন: ‘বনু আশজা’ গোত্রের জনৈক প্রবীণ ব্যক্তি আমাকে সালমা ইবনে নাঈমের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন যে, নাঈম বলেছেন, দূতদ্বয়ের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে পড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, “তোমাদের দু’জনের বক্তব্য কি?” তার বললো, “মুসাইলিমা যা বলে আমরাও তাই বলি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহর কসম দূতদের হত্যা করা যদি নীতিবিরুদ্ধ না হতো তাহলে আমি তোমাদের শিরচ্ছেদ করতাম।”
অতঃপর তিনি মুসাইলিমাকে লিখলেন, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মিথ্যা দাবীদার মুসাইলিমার প্রতি। যে ব্যক্তি আল্লাহর তরফ থেকে আগত হিদায়াতের অনুসারী তার ওপর সালাম। জেনে রাখ, পৃথিবী সম্পূর্ন আল্লাহর। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা করেন পৃথিবীর কর্তৃত্ব দান করেন আর আখিরাতের সাফল্য খোদাভীরুদের জন্য।” এই পত্রবিনিময় অনুষ্ঠিত হয় দশদ হিজরীতে।
বিদায় হজ্জ
অতঃপর যুলকা’দা মাস শুরু হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম হাজ্জের জন্য প্রস্তুত হলেন এবং মুসলমানদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন। যুলকা’দা মাসের পাঁচ দিন অবশিষ্ট থাকতে তিনি হজ্জ উপলক্ষে রওন হলেন।
হজ্জের প্রক্কালে তিনি জনগণকে হজ্জের নিয়মকানুন শিক্ষা দিলেন। তারপর তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। আল্লাহর প্রশংসার পর তিনি বললেন,
“হে জনগণ, আমার কথা শোন। আমি সম্ভবতঃ এই স্থানে এ বছরের পর আর কখনো তোমাদের সাথে মিলিত হতে পরবো না। হে জনতা, আজকের দিনে ও এই মাসে যেমন অন্যের জ্ঞান মালের ক্ষতি সাধন তোমাদের ওপর হারাম তেমনি কিয়ামত পর্যন্ত তা হারাম হয়ে গেল। তোমরা শীঘ্রই আল্লাহর কাছে হাযির হবে এবং নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। তোমাদের কাছে (আল্লাহর বানী) পৌছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমি পালন করেছি। যার কাছে কারো গচ্ছিত জিনিস রয়েছৈ সে যেন মালিকের কাছে তা ফেরত দেয়। সকল সুদ রহিত করা হলো। [৯৫. সব রকমের ঋণ, খুন ও জখমের প্রতিশোধ রহিত করা হয়।] তোমরা শুধু মূলধন পাবে। তোমরা কারো ওপর যুলুম করবে না, যুলুমের শিকারও হবে না। আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা যে, কোন সুদ চলবে না। আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সমস্ত সুদ রহিত করা হলো। জাহিলী যুগে সংঘটিত সকল খুন জখমের শাস্তি বা প্রতিশোধ গ্রহণ রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের পৌত্র ইবনে রাবীয়ার হত্যার শাস্তি বা প্রতিশোধ রহিত করছি। ইবনে রাবীয়া বনু লাইস গোত্রে দুগ্ধপোষ্য ছিল। বনু হুযাইল তাকে হত্যা করে। সেই হত্যাকান্ড দিয়েই আমি জাহিলী যুগের সকল হত্যাকান্ড ক্ষমা করার কাজ শুরু করছি।
অতঃপর হে জনতা, তোমাদের এই ভূখন্ডে শয়তানের আর কখনো পূজা অর্চণা প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। সে এ ব্যাপারে নিরাশ হয়েছে। তবে তোমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজে যাকে তোমরা তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করে থাক, শয়তানের আনুগত্য করলে তাতেই সে খুশী হবে। অতএব তোমদের দ্বীনের ব্যাপারে শয়তান সম্পর্কে সাবধান থেকো।
হে জনগণ, নিষিদ্ধ মাসগুলোকে পরবর্তী বছরের জন্য মুলতবী রাখা আরো জঘন্য কুফরী কর্ম। কাফিররা এই প্রথা দ্বারা গুমরাহীর পথে চালিত হয়। এর মাধ্যমে তারা রক্তপাতকে এক বছর বৈধ আর এক বছর অবৈধ করে নেয। এভাবে তারা আল্লাহর নিষিদ্ধ দিনগুলোকে ফাঁকি দেয়ার চক্রান্ত করে। এভাবে কার্যতঃ তারা আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজকে বৈধ এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বৈধ কাজকে অবৈধ করে নেয়। আকাশ ও পৃথিবীর প্রথম সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সময তার নিজস্ব নিয়মে গড়িয়ে চলেছে। আল্লাহর কাছে মাস হলো বারোটা। তার মধ্যে চারটা হলো নিষিদ্ধ। তিনটা মাস এক নাগড়ে আর একটা মুদার গোত্রের রজব মাস। সে মাসটা শা’বান ও জামাদিউস সানীর মাঝখানে অবস্থিত। [৯৬. রজব মাসকে ‘মুদার গোত্রের রজব’ বলার তাৎপর্য এই যে, এই মাসটাকে মুদার গোত্রেই গুরুত্ব দিত। আরবের কোন গোত্র এ মাস নিষিদ্ধ মাস হিসেবে আমল দিত না।]
তোমাদের নারীদের প্রতি তোমাদের কিছু কর্তব্য এবং অধিকার রয়েছে। নারীরা তোমাদের বিছানায় অন্য কাউকে শোয়বে না। এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত হবে না- এটা তাদের কর্তব্য। কেননা এটা তোমাদের ঘৃণার উদ্রেক করে থাকে। আর তা যদি করেই বসে তবে তাদের থেকে আলাদা বিছানায় শোয়া এবং মৃদু প্রহার করার অধিকার আল্লাহ তোমাদেরকে দিয়েছেন। তবে যদি পরিশুদ্ধ হয় তাহলে তাদের স্বাভাবিকভাবে খাদ্য ও পোশাক-পরিচ্ছদ দেয়া তোমাদের কর্তব্য। নারীদের প্রতি শুভকামী থাক। কেননা তারা তোমাদের কাছে অক্ষম বন্দীস্বরূপ। আল্লাহর আমানত হিসেবে তাদেরকে প্রহণ করেছো। আল্লাহর বিধান অনুসারেই তোমরা তাদেরকে বৈধ করে নিয়েছো।
হে মানব সকল, তোমরা আমার কথা হৃদয়ঙ্গম কর। আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার কাজ আমি সম্পন্ন করেছি। আর তোমাদের কাছে এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো বিপথগামী হবে না। প্রকাশ্য সুস্পষ্ট জিনিস আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ। হে জনগণ-আমার কথা শোনো ও হৃদয়ঙ্গম কর। জেনে রাখ, প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। মুসলমানরা ভাই ভাই। কাজেই নিজের ভাইয়ের কোন জিনিস তার খুশী মনে দান করা ছাড়া নেয়া অবৈধ। তোমরা লোকদের ওপর যুলুম করো না। হে আল্লাহ, আমি কি তোমার দ্বীন মানুষের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি?” লোকেরা বললো, “হে, আল্লাহ, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে তোমার দ্বীন পৌছিয়ে দিয়েছেন।” তিনি বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক।”
উসামা ইবনে যায়িদকে ফিলিস্তিন প্রেরণ
ইবনে হিশাম বলেন, উপরোক্ত ভাষণ দেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে
মদীনায় ফিরে গেলেন এবং জিলহজ্জের অবশিষ্ট দিনগুলো, মুহাররাম ও সফর মাস সেখানে কাটালেন। তারপর তাঁর আজাদকৃত গোলাম যায়িদের পুত্র উসামার নেতৃত্বে শামে (সিরিয়ার) একটি বাহিনী পাঠালেন এবং তাকে ফিলিস্তিনের বালকা ও দারুম অঞ্চল অধিকার করার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা সফরের প্রস্তুতি নিল। প্রথম হিজরতকারী সকল মুহাজির তাঁর সাথে যাত্রা করলেন।
রাজা-বাদশাহদের কাছে রাসূলুল্লাহ (সা) দূত প্রেরণ
ইবনে হিশাম বলেন:
ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় সাহাবীকে বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশাহর কাছে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। তাদের নিকট তিনি ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি পাঠান।
ইবনে হিশাম বলেনঃ আবু বাক্র হুযালী থেকে একজন বিশ্বস্ত লোক আমাকে জানিয়েছে যে, হুদাইবিয়ার দিন উমরা করতে বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তাঁর সাহাবীদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, “যে জনতা, আল্লাহ আমাকে সকল মানুষের নিকট রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। কাজেই ঈসার (আ) সহচরগণ যেমন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ চরেছিল তোমরা সেভাবে আমার বিরুদ্ধাচারণ করো না।” সাহাবীগণ বললেন, “হে, আল্লাহর রাসূল, ঈসার (আ) সহচরবৃন্দ কিভাবে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল?” তিনি বললেন, “আমি তোমাদেরকে যেসব কাজ করতে বলি তিনিও তাদের সেইসব কাজ করতে বলতেন। কিন্তু তিনি যখন কাউকে নিকটবর্তী কোথাও পাঠাতে চাইতেন তখন সে মুখ তার ও গড়িমসি করতো। ঈসা (আ) আল্লাহর নিকট এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করলেন। ফলে গড়িমসিকারীদের প্রত্যেকের এমন পরিণতি হলো যে, যাকে যে জাতির পাঠানো হলো সে সেই জাতির ভাষাভাষী হয়ে গেল।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের মধ্য থেকে কিছু লোককে দূত বানিয়ে বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি পাঠালেন। রোম সম্রাটের কাছে পাঠালেন দেহইয়া ইবনে খলীফা কালবীকে, আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফঅ সাহমীকে পারস্য সম্রাটের নিকট, আমর ইবনে উমাইয়া দামরীকে আবিসিনিয়ার নাজাশীর নিকট, হাতিব ইবনে আমরকে ইয়ামামার দুই বাদশাহ সুমামা ইবনে উছাল ও হাওযা ইবনে আলীর নিকট, আলা ইবনে হাদরামীকে বাহরাইনের বাদশাহ মুনযির ইবনে সাওয়ার নিকট এবং শুজা ইবনে ওয়াহাব আসাদীকে সিরীয় সীমান্ত রাজ্যের রাজা হারিস ইবনে আবু শামর গাসসানীর নিকট।
ইবনে হিশাম বলেনঃ আমার জানামতে সালীতকে সুমামা, হাওযা ও মুনযিরের নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল।
ইবনে ইসহাক বলেন: ইয়াযীদ ইবনে আবু হাবীব মিসরী আমাকে জানিয়েছেন যে, তিনি একটি বইতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আরব ও আজমের বাদশাহদের নিকট এবং বিভিন্ন দেশে প্রেরিত দূতদের নাম দেখেছেন। তিনি সাহাবীদেরকে প্রেরণের সময় কি কি উপদেশ দিতেন তারও উল্লেখ ঐ বইতে রয়েছে। ইয়াযীদ ঐ বইখানা প্রখ্যাত পন্ডিত মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরীর নিকট পাঠান। যুহরী বইখানাকে নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকৃতি দেন। ঐ বইতে বলা হয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের নিকট এসে বললেন, “আল্লাহ আমাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন। অতএব তোমরা আমার তর থেকে দাওয়াত পৌছিয়ে দাও। আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত বর্ষণ করবেন। ঈসার (আ) সহচরদের মত তোমরা আমার বিরুদ্ধাচরণ করো না।” সাহাবীগণ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, তারা কিভাবে বিরুদ্ধাচরণ করতো?” তিনি বললেন, ‘আমি যেরূপ তোমাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছে তিনিও তাদেরকে সেরূপ বিভিন্ন জায়গায় দাওয়াত পৌছানের দায়িত্ব দিতেন। যে ব্যক্তিকে তিনি নিকটবর্তী জায়গায় পাঠাতেন। সে খুশী হতো ও পছন্দ করতো। আর যাকে দূরে পাঠাতে চাইতেন সে অসন্তুষ্ট হতো ও অস্বীকার করতো। ঈসা (আ) এ বিষয়ে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করলেন। ফলে তাদের যাকে যে দেশে পাঠানো হতো সে সেই দেশের ভাষাভাষী হয়ে যেত।”
ইবনে ইসহাক বলেন: ‘ঈসা (আ) তাঁর যেসব সহচরকে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করেন এবং তাঁর যেসব অনুগামী পরবর্তীকালে প্রেরত হ৮ন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সহচর পিটার্স ও তার অনুগামী পলস। পলস হাওয়ারী বা ঈসার (আ) সহচর ছিলেন না। এদেরকে পাঠানো হয় রোমানদের কাছে আন্দ্রায়েস ও মানতাকে এমন এক এলাকায় পাঠান যেখানকার অধিবাসীরা মানুষ খেত। টমাসকে পাঠান প্রাচ্যের ব্যবিলনে, ফিলিপসকে পাঠান আফ্রিকার কারতাজান্না বা আফ্রিকায়। ইয়াহান্নাকে পাঠান আসহাবুল কাহাফের জনপদ আফসুস নগরে। ইয়াকুবকে পাঠান আরবের হিজাযে, সাইমনকে পাঠান বারবারদের অঞ্চলে এবং ইাহুদকে পাঠান জোড়দের স্থানে। ইয়াহুদ ঈসার (আ) সহচর ছিল না।
সর্বশেষ অভিযান
ইবনে ইসহাক বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবনে হারিসার পুত্র উসামাকে সিরিয়া প্রেরণ করেন এবং তাঁকে ফিলিস্তিনের বালকা ও দারুম এলাকা দখল করার নির্দেশ দেন। মুসলমানগন যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। এই অভিযানে প্রথম হিজরতকারী সকল মুসলমান অংশগ্রহণ করেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পীড়ার সূচনা
ইবনে ইসহা বলেনঃ উসামার নেতৃত্বে অভিযান শুরুর প্রস্তুতি চলতে থাকাকালেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের মধ্যে অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিতে আরম্ভ করে এবং শেষ পর্যন্ত এই অসুস্থতাতেই তিনি ইন্তিকাল করেন। অসুস্থতার সূচনা হয় মফর মাসের শেষের দিনগুলোতে অথবা পয়লা রবিউল আওয়ালে। পীড়ার সূচনা এভাবে হয় যে, তিনি একদিন গভীর রাত্রে মদীনার কবরস্থান বাকীউল গারকাদে যান এবং কবরবাসীর জন্য ইস্তিগফার করেন। পরদিন থেকে তিনি রোগ-যাতনার শিকার হন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আযাদকৃত গোলাম আবু মুয়াইহবা বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে মধ্যরাতের দিকে ডেকে তোলেন এবং বলেন, “হে আবু মুয়াইহিবা, আমি এই কবরস্থানের মৃতদের জন্য ইসতিগফার করতে আদিষ্ট হয়েছি। তুমি আমার সাথে চল।” আমি সাথে গেলাম। করবরস্থানের সামনে দাড়িঁয়ে তিনি বললেন,
“হে কবরবাসী, তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আজকে লোকেরা যে অবস্থায় পতিত হয়েছে তার চাইতে তোমরা ঢের ভাল অবস্থায় আছ। ফিতনাসমূহ গভীর অন্ধকার রাতের মত সমুপস্থিত যা ক্রমান্বয়ে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। যে দুর্যোগই আসছে তা পূর্ববর্তীটার চেয়েও মারাত্মক।
অতঃপর আমাকে সম্বোধন করে বললেন, “হে আবু মুয়াইহিবা! আমাকে দুনিযঅর ধনসম্পদ ও তার স্থায়ী ভোগাধিকার এবং তারপর জান্নাত দান করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, তুমি এই ধনসম্পদ ও তা স্থায়ীভাবে ভোগের অধিকার, জান্নাত ও আল্লাহর সাক্ষাত লাভ- এ দুইটি মধ্যে যেটি ইচ্ছা গুহণ কর।”
আমি বললা, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি দুনিযার ধন সম্পদ ও তা স্থায়ীভাবে ভোগ করার অধিকার অতঃপর জান্নাত- এ দুটোকে ইখতিয়ার করুন।” তিনি বললেন, “না, আমি বরং আল্লাহর সাক্ষাত সাক্ষাত ও জান্নাতই গ্রহণ করেছি।”
এরপর তিনি ‘বাকী’ কবরবাসীর জন্য দোয়া ও ইসতিগফার করলেন এবং ঘরে ফিরলেন। এরপরই তাঁর রোগ যাতনা শুরু হয় এবং তাতেই শেষ পর্যন্ত ইন্তিকাল করেন্
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়িশা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কাবী থেকে ফিরে এসে দেখলেন, আমি মাথাব্যথায় কাতর হয়ে বলছি,, “উহ, মাথা গেল।” এ অবস্থা দেখে রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আয়িশা, আমারই বরং মাথা গেল। তারপর বললেন, “আচ্ছা, তুমি দি আমার আগে মরে যাও আর আমি তোমার কাফন দাফন ও জানাযা করি, তাহলে কেমন হয়?” আমি বললাম, “আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সে কর্মটি হলে আপনি ঘরে ফিরে আপনার স্ত্রী নিয়ে আমোদ প্রমোদ করবেন।”
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, তাঁর রোগযন্ত্রণা দূর হয়ে গেছে। তখানো তাঁর স্ত্রীদের কাছে পালাক্রমে থাকতেন। কিন্তু সাহসাই রোগযন্ত্রণা বেড়ে গেল। এই সময় তিনি মাইমুনার (রা) ঘরে ছিলেন। তিনি তাঁর সকল স্ত্রীকে ডাকলেন এবং তাঁদের কাছে অনুমতি চাইলেন যে, তাঁর পরিচর্যা আমার ঘরেই হোক। সকলেই অনুমতি দিলেন।
রাসূলুল্লাহর (সা) স্ত্রীগণ বা উম্মুহাতুল মু’মিনীনের বিবরণ
ইবনে হিশাম বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নয়জন স্ত্রী ছিলেন। যথা: আয়িশা বিনতে আবু বাক্র (রা), হাফসা বিনতে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা), উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান ইবনে হরাব (রা), উম্মে সালামা বিনতে আবু উমাইয়া ইবনে মুগীরা (রা), সাওদা বিনতে যামআ ইবনে কায়েস (রা), যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা), মাইমুনা বিনতে হারেস ইবনে হাযন (রা), জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস ইবনে আবু দিরার (রা) ও সাফিয়া বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাব। একাধিক নির্ভযোগ্য বিজ্ঞজান থেকে এদের বিবরণ জানা গেছে।
[রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোট স্ত্রীসংখ্যা তের। কিন্তু উল্লিাখত নয় জন তাঁর ইন্তিকালের সময় বেঁচে ছিলেন। দুই জন আগেই মারা যান। আর দুই জনের সাথে নাম মাত্র বিয়ে হয়েছিল। তাঁর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গৃহিনী হননি।]
খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহ আনহা
খাদীজাই ছিলেন তাঁর প্রথমা স্ত্রী। তাঁর পিতা খুয়াইলিদ ইবনে আসাদ মতান্তরে ভ্রাতা আমর ইবনে খুয়াইলিদ খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম তাঁকে বিশটি বকনা উষ্ট্রী মোহরানা দেন। ইব্রাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কয়টি সন্তান তাঁর গর্ভেই জন্মে। তাঁর পূর্ব স্বামী ছিলেন আবু হালা ইবনে মালিক। তিনি ছিলেন তিনি ছিলেন বনু আবুদদ দার গোত্রের মিত্র বনু উসাইদের লোক। আবু হালার স্ত্রী থাকাকালে তাঁর গর্ভে হিন্দ নামে একটি ছেলে ও যয়নাব নামে একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। আবু হালার পূর্বে তাঁর বিয়ে হয় আতীক ইবনে আবিদের সাথে। সেখানেও তাঁর আবদুল্লাহ নামে একটি ছেলে ও জারিয়া নামে একটি মেয়ে জন্মে।
আয়িশা বিনতে আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহা
মাত্র সাত বছর বয়সে মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। মদীনায় হিজরাতের পর নয় বা দশ বৎসর বয়সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি আয়িশা (রা) ছাড়া আর কোন কুমারী মেয়েকে বিয়ে করেননি। তাঁর পিতা আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) তাঁকে বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মোহরানা স্বরূপ চারশো দিরহাম প্রদান করেন।
সওদা বিনতে যাম’য়া রাদিয়াল্লাহু আনহা
সালীত ইবনে আমর মাতান্তরে আবু হাতিম ইবনে আমর তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মোহরানা স্বরূপ চারশো দিরহাম প্রদান করেন। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম সাকরান ইবনে আমর। [৯৭. ইবনে হিশাম বলেন যে, ইবনে ইসহাক এই বর্ণনার সাথে একমত নন। তাঁর মতে আলী ও আবু হাতিম উভয়ে এই সময় আবিসিনিয়ায় প্রবাল জীবন যাপন করছিলেন। এই সময়ে তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুপস্থিত ছিলেন।]
যায়নাব বিনতে জাহাশ রাদিয়াল্লাহু আনহা
তাঁর ভাই আবু আহমাদ ইবনে জাহাশ তাঁর বিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মোহরানা দেন চারশো দিরহাম। তাঁর পূর্ব স্বামী ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আজাদ করা গোলাম যায়িদ ইবনে হারিসা (রা)।
যায়নাব সম্পর্কেই কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়: “যায়িদ যখন তাঁকে ছেড়ে দিল তখন আমি তোমার সাথে তার বিয়ে দিলাম।”
উম্মে সালামা বিনতে আবু উমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা
তাঁর আর এক নাম হিন্দ। তাঁর বিয়ে দেন তাঁরই পুত্র সালামা। তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুরের ছালভর্তি একটি গদি, একটি পেয়ালা, একটি প্লেট ও একটি যাঁতাকল দিলেন। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম আবদুল্লাহ আবু সালামা। সেখানে তাঁর চারটি সন্তান জন্মে। যথা: সালামা, উমার, যায়নাব এবং রুকাইয়া।
হাফসা বিনতে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহা
পিতা উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজে তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের সাথে চারশো দিরহাম মোহরানায় বিয়ে দেন। পূর্বে তাঁর বিয়ে হয়েছিল খুনাইস ইবনে হুযাফা সাহমীর সাথে।
উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান ইবনে হরব রাদিয়াল্লাহু আনহা
খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনে আস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর বিয়ের উদ্যোগ নেন ও প্রস্তাব দেন। তাঁরা উভয়ে তখন আবিসিনিয়ায় প্রবাসী জীবন যাপন করছিলেন। খোদ নাজাশী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের পক্ষ থেকে তাঁকে চারশো। দিনার মোহরানা দিয়ে দেন। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ আসাদী। তাঁর প্রকৃত নাম রমলা।
জুয়াইরিয়া বিনতে হারিস রাদিয়াল্লাহু আনহা
খুযায়া গোত্রের এই মহিলা বনু মুস্তালিক যুদ্ধে যুদ্ধবন্দিনী হয়ে আসেন এবং সাবিত ইবনে কায়সের (রা) অংশে পড়েন। জুয়াইরিয়া হারিসের কাছ থেকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তিলাভের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এই মুক্তিপণ প্রদানে সাহায্যের জন্য তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হন। রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মুক্তিপণ আদায় করতে রাজী হন এবং তাঁর সাথে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব দেন। জুয়াইরিয়া প্রস্তাবে সম্মত হন। অতঃপর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয।
ইবনে হিশাম উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুয়াইরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বনু মুস্তালিকের এলাকা থেকে ফিরলেন, পথিমধ্যে তিনি জনৈক আনসারী সাহাবার নিকট জুয়াইরিয়াকে আমানত রেখে তাঁকে রক্ষণাবেক্ষণ করার নির্দেশ দিয়ে মদীনায় চলে গেলেন। মদীনায় পৌছাবার পর জুয়াইরিয়ার পিতা হারিস ইবনে আবু দিরার কণ্যার মুক্তির জন্য মুক্তিপণ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপনীত হলেন। আকীক নামক স্থানে এসে হারিসের নজর পড়লো মুক্তিপণ স্বরূপ যে উটের বহর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে চলেছেন তার ওপর। দুটো উট তার অত্যধিক পছন্দ হলো। তিনি ঐ দুটো উটকে আকীক পাহাড়ের কোন এক গুহায় লুকিয়ে রাখলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, “হে মুহাম্মাদ, তোমরা আমার কন্যাকে বন্দী করে এনেছো। এই নাও তার মুক্তিপণ।” রাসূলুল্লাহ াসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সেই উট দুটোর কি হলো-যা তুমি আকীক পাহাড়েরর অমুক গুহায় লুকিয়ে রেখে এসেছো।” হারিস বললেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই আর আপনি আল্লাহর রাসুল। নিশ্চয়ই আপনাকে এ কথা একমাত্র আল্লাহই জানিয়েছেন।” হারিস ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর লোক পাঠিয়ে আকীক পাহাড় থেকে লুকানো উট দুটো আনলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাঁর সব কয়টি উট সমর্পণ করলেন। কন্যা জুয়াইরিয়াকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে দেয়া হলো।
সাফিয়া বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাব রাদিয়াল্লাহু আনহা
ইহুদী নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা সাফিয়াকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবার থেকে যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে আনেন এবং স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন। এই বিয়েতে তিনি এক অনাড়ম্বর ওলীমার আয়োজন করেন যাতে চর্বি বা গোশতের পরিবর্তে শুধু খোরমা ও ছাতু দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম কিনানা ইবনে রাবী ইবনে আবুল হুকায়েক।
মাইমুনা বিনতে হারিস রাদিয়াল্লহু আনহা
আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর বিয়ের আয়োজন করেন। এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে চারশো দিরহাম মোহরানা প্রদান করেন। তাঁর পূর্ব স্বামীর নাম আবু রোহম ইবনে আবদুল ্যযা। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তিনিই সেই মহিলা যিনি পবিত্র কুরআনের ভাষায় নিজেই নিজেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব যখন এই মহিলার নিকট পৌছে তখন তিনি উটের পিঠে সওয়ার ছিলেন। তিনি প্রস্তাবের জবাবে তৎক্ষণাৎ বললেন, “এই উট ও তার আরোহী আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের জন্য নিবেদিত।” মহান আল্লাহ এর পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল করেন, “(তোমার জন্য বৈধ করা হয়েছে) যদি কোন মু’মিন রমণী নিজে আত্মনিবেদন করে আর নবী যদি তাকে বিয়ে করতে চান তা হলে।”
কেউ কেউ বলেনঃ নিজেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সমর্পণকারিনী মহিলা তিনি নন বরং যায়নাব বিনতে জাহাশ। আবার কেউ বলেন, তিনি উম্মে শুরাইক গাযিয়া বিনতে জাবির। অন্যদের মতে তিনি বনু সামা গোত্রের জনৈকা মহিলা। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ব্যাপারটি বিলম্বিত করেছেন।
যায়নাব বিনতে খুযাইমা রাদিয়াল্লাহু আনহা
প্রথমে চাচাতো ভাই যাহাম ইবনে আমরের সাথে বিয়ে হয়। পরে উবাইদা ইবনূল হারিসের সাথে বিয়ে হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে চারশো দিরহাম মোহরানার বিনিময়ে তাঁকে বিয়ে দেন কাবীসা ইবনে আমর হিলালী। ফকীর মিসকীন ও দারিদ্রের প্রতি তাঁর অত্যধিক দয়া ও মমত্ববোধের কারণে তাঁকে উম্মুল মাসাকীন বলা হতো।
এই এগারো জন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী, যাদের সাথে তিনি দাম্পত্য জীবন যাপন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা) এবং যায়নাব বিনতে খুযাইমা (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালেল সময় ও তার পরে জীবিত ছিলেন। এছাড়া দু’জনের সাতে তাঁর দাম্পত্য জীবন যাপন করা সম্ভব হয়নি হয়নি। একজন আসমা বিনতে নু’মান কিন্দিয়া। এই মহিলাকে বিয়ে করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শ্বেত বা কুষ্ঠ আক্রান্ত পান। তাই তাকে উপঢৌকন দিয়ে তার পরিবার-পরিজনের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন। অপরজন ‘আমরা বিনতে ইয়াযীদ কিলাবিয়া। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেই তাঁর কাছ থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখছে এবং আল্লাহর কাছে পনাহ চাইছে।” অতঃপর তাকে তিনি তহার পরিবার-পরিজনের কাছে ফেরত পাঠান। কেউ কেউ বলেন, যে মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পানাহ চেয়েছিল অর্থাৎ দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করতে অস্বীকার করেছিল সে হলো আসমা বিনতে নু’মান কিন্দিয়ার চাচাতো বোন। কারো কারো মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কাছে ডাকলে সে (গর্বভরে) বলে, “আমরা অভিজাত গোত্রের মানুষ। লোকেরা আমাদের কাছে আসে। আমরা কারো কাছে যাই না।” একথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসল্লাম তাকে তার পরিবারের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের মধ্যে ছয় জন ছিলেন কুরাইশ বংশীয়। যথা – খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা), আয়িশা বিনতে আবু বাক্র (রা), হাফসা বিনতে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা), উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান (রা), উম্মে সালামা বিনতে আবু উমাইয়া (রা) ও সওদা বিনতে যামআ (রা)। আর বাদবাকী সাতজন অকুরাইশী। ছয় জন আরব বংশোদ্ভুত। যথা: যায়নাব বিনতে জাহাশ (রা) (বনু আসাদ গোত্রের), যায়নাব বিনতে হারেস (রা) (বনু আমের গোত্রের), যায়নাব বিনতে খুযাইমা (রা) (বনু খাযায়া গোত্রের), আসমা বিনতে নুমান কিন্দিয়া (রা) (কিন্দা গোত্রের) এবং আমরা বিনতে ইয়াযীদ (রা) (বনু কিলাব গোত্রের)। আর একজন অনারব (ইহুদী) বংশোদ্ভূত, সাফিয়া (রা) বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাব (বনু নাজীর গোত্রের)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগ সংক্রান্ত অবশিষ্ট বিবরণ
ইবনে ইসহাক বলেনঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়িশা থেকে উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবাহ, তাঁর থেকে মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম যুহরী এবং তাঁর থেকে ইয়াকুব ইবনে উতবা আমাকে জানিয়েচেন যে, আয়িশা (রা) বলেছেন, “(অন্যান্য স্ত্রীদের কাছ থেকে আমার ঘরে পরিচর্যঅর জন্য অবস্থানের অনুমতি লাভের পর) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ পরিবারভূক্ত দুই ব্যীক্ত ফযল ইবলে আব্বাস (রা) ও অন্য একজনের কাঁধে ভর করে মাথায় পট্রি বাঁধা অবস্থায় পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের মতে অপর ব্যক্তিটি ছিলেন আলী ইবনে আবু তালিব (রা)।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যন্ত্রণা বেড়ে গেল এবং তিনি কাতর হয়ে বললেন, “বিভিন্ন কুয়া থেকে সাত মশক পানি এনে আমার মাথায় ঢাল যাতে আমি জনগণের কাছে গিয়ে অঙ্গীকার আদায় করে আসতে পারি।” আমরা তাঁকে হাফসা বিনতে (রা) একটি বড় কাপড় ধোয় পাত্রের কাছে বসিয়ে তার মাথায় প্রচুর পরিমাণে পানি ঢাললাম। অবশেষে তিনি বললেন,
“যথেষ্ট হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে।”
যুহরী বলেন: আইয়ুব ইবনে বাশীর আমাকে জানিয়েছেন যে, মাথায় ব্যন্ডেজ বাঁধা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি বেরিয়ে এসে মসজিদের মিম্বারে বসলেন। অতঃপর তিনি মুখ খুলেই সর্বপ্রথম উহুদ যুদ্ধের শহীদদের জন্য রহমত কামনা করলেন ও তাঁদের জন্য ক্ষমা চাইলেন। তাঁদের জন্য রহমত কামনা করে তিিন অনেক দোয়া করলেন। অতঃপর বললেন, “এক বান্দাকে আল্লাহ দুনিয়ার সম্পদ ও আল্লাহর নিকট যে নিয়ামত রয়েছে তার মধ্যে যে কোন একটি বেছে নিতে বললেন। সেই বান্দা আল্লাহর কাছে যে নিয়ামত রয়েছে তা-ই বেছে নিল।” এ কথার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন আবু বাক্র সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বুঝেছিলেন যে, এই বান্দা খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কেউ নন। তাই তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমাদের নিজেদেরকে আর আমাদের সন্তান সন্ততিকে বরং আপনার জানের বদলায় কুরবানী করে দিই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু বাক্র একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ কর।” অতঃপর বললেন, “মসজিদের এই উন্মুক্ত দরজাগুলো বন্ধ করে দাও। তবে আবু বাক্রের ঘরের সাথে সংলগ্ন দরাজা বন্ধ করো না। কেননা আমার সহচর্যে যত লোক এসেছে তার মধ্যে আবু বাক্রকেই আমি সর্বাধিক নির্ভযোগ্য সহযোগী পেয়েছি।”
আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সাথে একথাও বলেছিলেন, “আল্লাহর বান্দাদের ভেতর থেকে কাউকে যদি আমি নিজের অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহন করতাম তাহলে আবু বাক্রকে গ্রহণ করতাম। কিন্তু যদিদিন আমরা আল্লাহর কাছে সম্মিলিত না হই ততদিন শুধু সাহচর্য, ভ্রাতৃত্ব ও ঈমানই আমাদের পারস্পরিক বন্ধনের যোগসূত্র হয়ে থাকবে।”
উরওয়া ইবনে যুবাইর প্রমুখ বিজ্ঞ ব্যক্তির সূত্র উল্লেখ করে আমাকে মুহাম্মাদ ইবনে যুবাইর জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রোগাবস্থায় থাকা সত্ত্বেও উসামা (রা) বাহিনী প্রেরণে বিলম্ব হওয়ায় অস্থিরতা প্রকাশ করেন। ওদিকে কেউ কেউ প্রবীণ মুহাজির ও আনসারগণ থাকতে অল্পবয়স্ক তরুণ উসামা অধিনায়ক মনোনীত হওয়ায় মৃদু আপত্তি প্রকাশ করছিলেন। একথা জেনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার মাথায় ব্যন্ডেজ বাঁধা অবস্থায় মিম্বারে এসে বসলেন। আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করার পর বললেন, “হে জনগন, উসামার বাহিনী তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও। তার অধিনায়কত্ব নিয়ে যদি তোমাদের মধ্যে কথা উঠে থাকে তবে এ ধরনের কথা তোমরা তার পিতার অধিনায়কত্ব নিয়েও তুলেছিল। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, উসামা এ কাজের যোগ্য আর তাঁর পিতাও এ কাজের যোগ্য ছিল।” এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে এলেন। মুসলমানগণ উসামার বাহিনী প্রেরণের আয়োজন করতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগযন্ত্রণাও প্রবল হতে লাগলো। উসামা বাহিনী নিয়ে যখন মদীনা থেকে এক ফারসাখ দূরে অবস্থিত ন্মিনভূমিতে পৌছেছেন, সেখানে তাঁর সেনাবাহিনীও পৌছেছে এবং অন্যান্য মুসলমানগণও তাঁর সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে, ঠিক তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা কি দাঁড়ায় দেখার জন্য। যুহরী বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব ইবনে মালিক আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন তাঁর ভাষণে উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জন্য দোয়া এবং মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে যা কিছু বলেছিলেন তার সাথে এ কথাও বলেছিলেন, “হে মুহাজিরগণ, তোমরা আনাসারদের দিকে ভালভাবে লক্ষ্য রেখ। অন্যান্য লোকদের তো ক্রমেই আর্থিক সচ্ছলতা এসে থাকে। কিনউত আনসারদের বর্তমান অবস্থার আলোকে সে অবকাশ নেই। তারা আমার গোপনীয়তার সংরক্ষক ও আশ্রয়দাতা ছিল। সুতরাং ভাল ব্যবহারের বদলায় তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে। আর তাদের থেকে কোন মন্দ ব্যবহার পেলে মাফ করে দিও।”
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে বাড়ীর মধ্যে প্রবশে করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রোগযন্ত্রণা বৃদ্ধি পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন।
এই সময় উম্মে সালামা ও মাইমুনা (রা) সহ তাঁর কতিপয় স্ত্রী এবং আসমা বিনতে উমাইস সহ মুসলমানদের কতিপয় স্ত্রীলোক তাঁর কাছে জমায়েত হলেন। তাঁর কাছে তাঁর চাচা আব্বাস (রা) আগেই উপস্থিত ছিলেন।
সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘লাদুদ’ নমাক ওষুধ খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। আর আব্বাস (রা) বললেন, “আমি তাঁকে অবশ্যই ‘লাদুদ’ খাওয়াবো।” শেষ পর্যন্ত তাঁকে লাদুদ খাওয়ানো হলো এবং তিনি সংজ্ঞা ফিরে পেলেন। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে এ জিনিস কে খাইয়েছে?” সবাই বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনার চাচা খাইয়েছেন।” তিনি বললেন, এটা হাবশার দিক থেকে আগত কিছু সংখ্যক মহিলার আনীত এক ধরনের ওষুধ। তোমরা কেন এটা প্রয়োগ করলে?” আব্বাস (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা আশংকা করেছিলাম যে, আপনি ফুসফুস প্রদাহে আক্রান্ত হয়েছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঐ রোগে আল্লাহ আমাকে কখনো আক্রান্ত করবেন না। আমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে আমার চাচা ছাড়া আর কেউ এই ‘লাদুদ’ থেকে অব্যাহতি পাবে না।” মাইমুনা (রা) কে রোযা অবস্থায় লাদুদ সেবন করতে হয়েছিল। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা তাঁর পরিবার-পরিজনকে ঐ ভুল কর্মের জন্য শাস্তি দোবর ব্যবস্থা করেছিলেন।
উসামা ইবনে যায়িদ (রা) বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়লে আমি এবং আমার সহগামী বাহিনী ও মুসলমানগণ মদীনায় ফিরে গেলাম এবং পরে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি, তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। কথা বলতে পারছেন না। আমাকে দেখে, তিনি আকাশের দিকে হাত তুলতে লাগলেন এবং হাত নামিয়ে আমার গায়ে রাখতে লাগলেন। এতে বুঝলাম যে, তিনি আমার জন্য দোয় করছেন।
আয়িশা (রা) বলেনঃ
রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ মুহুর্তে উপস্থিত হলে তাঁর শেষ যে কথাটা উচ্চারিত হতে শুনেছি তা ছিল এই: “বরং জানাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ যে বন্ধু, তাঁকে আমি চাই।” আমি তা শুনে মনে মনে বললাম: তিনি আমাদেরকে অগ্রাধিকার দেন না। এই সময় আমি বুঝতে পারলাম তিনি যে বলতেন “কোন নবীকে জীবন ও মৃত্যুর ইখতিয়ার না দিয়ে মৃত্যু দেয়া হয়নি, “-তার। মনোনীত সেই প্রয়তম বস্তুই তাঁর এই উক্তিতে বিঘোষিত হয়েছে-“বরং জান্নাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ যে বন্ধু তাঁকে আমি চাই।”
নামাযের জামায়াতে আবু বাক্র (রা) ইমামতি
যুহরী বলেন: হামযা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমারের কাছ থেকে আমি শুনেছি। আয়িশা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পীড়া অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেলে তিনি বললেন, “তোমরা আবু বাক্রকে নামায পড়িয়ে দিতে বল।” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আবু বকর অত্যন্ত কোমল হৃদয় মানুষ। তাঁর কন্ঠস্বর অত্যন্ত নীচু। কুরআন পড়তে গেলে প্রায়ই তাঁর কান্না পায়।” তিনি বললেন, “তাঁকে বল, নামায পড়িয়ে দিক।” আমি আবারও আমার কথার পুনরাবৃত্তি করলাম। তিনি বললেন, “তোমরা ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আচরণকারী মহিলাদের মত। যাও আবু বাক্রকে জামায়াতের ইমামতি করতে বল।” সত্য বলতে কি আমি আবু বাক্রকে (রা) ইমামতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিলাম বলেই ঐ কথা বলেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, যে কোন অঘটন ঘটলে লোকেরা আবু বাক্রকে (রা) দায়ী করবে এবং তাঁর ঘাড়েই দোষ চাপাবে। আমি জানতাম, লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্ত লোককে কখনো পছন্দ করবে না। এসব কারণেই আমি তাঁকে এ দায়িত্ব থেকে দূরে রাখতে আগ্রহী ছিলাম।
আবদুল্লাহ ইবনে যামআ বলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগ আশংকাজনক অবস্থায় পৌছার সময় আমি মুসলমানদের একটি দল সহ তাঁর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এই সময় বিলাল (রা) তাঁকে নামায পড়তে ডাকলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “নামায পড়াতে পারে এমন একজনকে ইমামতি করতে বল।” প্রথমে আমার দেখা হলো উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সাথে। আমি “হে উমার, আসুন নামায পড়ান।” উমার (রা) নামাযের ইমামতিতে দাঁড়িয়ে গেলেন। উমার ছিলেন উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী। তিনি তাকবীর বললে তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আবু বাক্র কোথায়? এটা আল্লাহ ও মুসলমানগণের মনঃপূত নয়।” আবু বাক্রকে (রা) ডাকা হলো। উমার (রা) তাঁর আরম্ভ করা নামায শেষ করলে তিনি এলন। তারপর থেকে তিনিই নামায পড়াতে লাগলেন।
আবদুল্লাহ ইবনে যামআ বলেন: উমার (রা) আমাকে বললেন, “হে ইবনে যামআ, ধিক্ তোমাকে! তুমি আমার সাথে এ কি আচরণ করলে? তুমি যখন আমাকে নামায পড়তে বলেছিলে তখন আমি ভেবেছিলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নামায পড়াতে বলেছেন। তা না হলে আমি পড়াতাম না।” আমি বললাম, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নির্দেশ দেননি আপনাকে নামায পড়াতে বলতে। তবে আবু বাক্রকে (রা) যখন পেলাম না তখন আমি উপস্থিত মুসলমানদের মধ্যে আপনাকেই নামায পড়ানোর জন্য সবচাইতে যোগ্য মনে করেছি।”
ইবনে ইসহাক বলেন: আনাস ইবনে মালিকের উদ্ধৃতি দিয়ে যুহরী আরো জানিয়েছেন যে, আল্লাহ যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিরদিনের জন্য আপন সান্নিধ্যে ডেকে নেন কেদিন ছিল সোমবার। মুসলমানগণ জামায়াতে ফজরের নামায আদায় করছিলেন ঠিক সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা তুলে এবং দরজা খুলে বেরিয়ে আয়িশার (রা) গৃহ সংলগ্ন দরজার চৌকাঠের ওপর দাঁড়ালেন। নামায আদায়কারী মুসলমানগণ তাঁকে এক নজর দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। এ সময় খুশীতে তাঁরা নামাযই ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কারো সাহায্য ছাড়া একাকী দাঁড়ানো দেখে তাদের মন থেকে সকল দুশ্চিন্তা ও আশংকা মুহুর্তের মধ্যে দূর হয়ে গেল। তিনি তাদের নামায আদায়ের শৃংখলা দেখে খুশীতে মুচকি হাসলেন এবং ইংগিতে বললেন, “নামায ছেড়ে দিও না বরং শেষ কর।” সেদিন সেই মুহুর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে যেরূপ মনোহর ভঙ্গীতে দেখেছিলাম, তেমন আর কখনো দেখিনি। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে গেলেন। লোকেরা তাঁকে রোগতুক্ত দেখে যে যার কাজে চলে গেল্ আবু বাক্র (রা) ও ‘সুনাহ’ এলাকায় তাঁর পরিবারের কাছে ফিরে গেলেন। [৯৮. এই স্থানটিতে আবু বাকরের (রা) জমি ও বাড়ী ছিল এবং সেখানে তিনি সপরিবারে থাকতেন।]
মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আমাকে কাসিম ইবনে মাহাম্মাদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন উমারের (রা) নামায পড়ানো তাকবীর শুনলেন তখন বললেন, “আবু বাক্র কোথায়? আল্লাহ ও মুসলমানগণের নিকট আবু বাক্র (রা) ছাড়া অন্যের ইমামতি গ্রহণযোগ্য নয়।” বস্তুতঃ উমার (রা) যদি তাঁর ইনতিকালের প্রাক্কালে একটি কথা না বলতেন তাহলে মুসলমানগণ সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করতো যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাক্রকে (রা) খলীফা নিয়োগ করে গেছেন। কিন্তু উমার (রা) মৃত্যুর পূর্বে এ ধারণা বাতিল করে দিয়ে যান। তিনি বলেন, “আমি যদি খলিফা নিয়োগ করে যাই তাহলে (বুঝে নিও যে) যিনি আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ছিরেন তিনিও ওটা তাদের স্বাধীন বিবেচনার ওপর সোপর্দ করে গিয়েছিলেন।” অতঃপর উমার (রা) খলিফা নিয়োগ না করে মারা যাওয়ায় মুসলমানগণরা বুঝলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাক্রকে খলিফা নিয়োগ কেের যাননি।
আবু বাক্র ইবনে আবদুল্লাহ আমাকে (ইবনে ইসহাককে) বলেছেন: সোমবার আুব বাক্র (রা) যখন ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথায় ব্যন্ডেজ বেঁধে সেখানে ইপনীত হলেন। লোকেরা খুশী হয়ে কাতার থেকে সরে গেল। আবু বাক্র (রা) বুঝতে পারলেন যে, লোকজন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যই এরূপ করেছে। তাই তিনি তাঁর স্থান থেকে পিছিয়ে আসলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পিঠে হাত হাত দিয়ে সামনে ঠেলে দিয়ে বললেন, “তুমিই নামায পড়াও।” তারপর তিনি আবু বাক্রের (রা) ডান পাশে বসে নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি মুসল্লীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে এত উচ্চস্বরে ভাষণ দিলেন যে, মসজিদের বাইরে থেকেও তা শোনা গিয়েছিল। তিনি বললেন, “হে জনমন্ডলী, জাহান্নামের আগুনকে উত্তপ্ত করা হয়েছে। আর দুর্যোগসমূহ অন্ধাকরা রাতের মত ঘনিয়ে এসেছে। মনে রেখ, আমার নিজস্ব কোন জিনিস তোমাধের মেনে চলতে হচ্ছে না। আমি কুরআনের জিনিস নিষিদ্ধ করিনি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ভাষণ শেষ করলে আবু বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বাস্থ্য স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ভেবে এবং দিনটি স্ত্রী বিনতে খারেজার পালার দিন বলে তাঁর অনুমতি নিয়ে স্বীয় পরিবারের কাছে ‘সুনাহে’ চলে গেলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহে প্রবেশ করলেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, সেদিন আলী ইবনে আবু তালিব (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে বাইরে এলে মুসলমান জনতা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “হে আবুল হাসান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন আছেন?” তিনি বললেন, “আলহামদুল্লিাহ”। তিনি সেরে উঠেছেন।” তখন আব্বাস (রা) তাঁর হাত ধরে বললেন, “আল্লাহর কসম, কয়েকদিন পর তোমাকে নেতৃত্ব নিতে হবে। আল্লহর কসম, আবুদল মুত্তালিবের ছেলেদের মুখে মৃত্যুর লক্ষ করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখেও তা দেখতে পেয়েছি। চল, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাই। যদি তাঁর অবর্তমানে ইসলাম ও মুসলমানদের দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তে তাহলে আমরা তা বুঝে নেব। আর যদি তা অন্যদের হাতে যায় তাহলে তাঁকে বলবো, আমাদের দিকে নজর দেয়ার জন্য তিনি যেন সবাইবে নির্দেশ দেন।” আলী (রা) বললেন, “আমি যাবো না। তিনি যদি এ দায়িত্ব আমাদেরকে দিতে অস্বীকার করেন তাহলে তাঁর পরে আর কেউ দেবে না।” অতঃপর সেইদিনই দুপুরের কাছাকাছি সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল করলেন।
আয়িশা (রা) বলেনঃ
সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ থেকে সরাসরি আমার কাছে এলেন এবং আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। এ অব্যবহিত পর আবু বকরের (রা) পরিবারের এক ব্যক্তি একটা সবুজ মিসওয়াক নিয়ে আমার কাছে এল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতের দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, মনে হলো তিনি ওটা চাইলেন। আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনাকে কি মিসওয়াকটা দেবো?” তিনি বললেন, “হাঁ।” অতঃপর তাঁকে দিলাম। তখন তিনি তা নিয়ে খুব বেশী করে মিসওয়াক কররেন এবং তারপর তা রেখে দিলেন। এরপর রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ আমার কোলের ওপর ক্রমেই ভারী হয়ে উঠতে লাগলো। তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, তাঁর চোখ বিস্ফারিত হয়ে আসছে। তিনি বলছিলেন, “জান্নাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ যে বন্ধু, তাঁকে চাই?” আমি বললাম, “আপনাকে নিজের মনের মত জিনিস চাইতে বলা হয়েছে। আপনিও উপযুক্ত জিনিস চেয়ে নিয়েছেন।”
এরপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ইবনে ইসহাক বলেন: আয়িশা (রা) বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার গৃহে অবস্থানের পালার সময়ে আমার বুকের ওপর মাথা রেখে ইনতিকাল করেছেন। আমি এক্ষেত্রে কারো ওপর যুলুম করিনি। আমি যে ইনতিকালের সময় তাঁকে কোলে ধরে রেখেছিলাম তারপর তাঁকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে অন্যান্য মহিলাদের সাথে মুখ ও বুক চাপড়াতে আরম্ভ করেছিলাম – সে সব আমর বোকামী, তারুণ্যসুলভ সরলতা ছাড়া কিছু নয়।”
আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, যে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল করলেন, তখন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “কতকগুলো মুনাফিক বলে বেড়াচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন। আল্লাহর কসম, তিনি মারা যাননি। তিনি কেবল মূসা আলাইহিস সালামের সত সাময়িকভাবে আল্লাহর কাছে গিয়েছেন। মূসা (আ) চল্লিশ দিনের জন্য আল্লাহর কাছে গিয়েছিলেন। তখন প্রচার করা হয়েছিল যে, তিনি মারা গেছেন। অথচ তার পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন। আল্লাহর কসম, মূসার (আ) মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার ফিরে আসবেন। এখন যার বলছে যে তিনি মারা গেছেন তাদের হাত পা কেটে দেয়া হবে।”
আবু বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালেরর খবর জানতে পেরে ছুটে এলেন্ উমার (রা) থকনও ঐ কথা বলে চলেছেন। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি আয়িশার (রা) ঘরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে গেলেন। তখন তাঁকে ইয়ামনী কাপড় দিয়ে ঘরের এক কোণে ঢেকে রাখা হয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের কাপড় সরিয়ে চুমু খেলেন। অতঃপর বললেন, “আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক। আল্লাহ আপনার জন্য যে মৃত্যু নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তা আপনি আস্বাদন করেছেন। এরপর আপনার কাছে আর কখনো মৃত্যু আসবে না।” অতঃপর মুখ ঢেকে দিলেন। তারপর বাহিরে বেরিয়ে দেখেন উমার (রা) সেই একই কথা বলে চলেছেন। তিনি বললেন, “উমার। তুমি ক্ষান্ত হও। চুপ কর।” উমার (রা) কছিুতেই থামতে রাজী হচ্ছিলেন না। এ অবস্থা দেখে আবু বাক্র (রা) জনগণকে লক্ষ্য করে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথা শুনে জনতা উমারকে (রা) রেখে তাঁর দিকে এগিয়ে এল। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করার পর বললেন,
“হে জনমন্ডলী, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের পূজা করতো সে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ মারা গেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদাত করতো সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব ও অবিনশ্বর।” তারপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন-
[আআরবী ******]
“মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বৈ আর কিছুই নন। তার পূর্বে বহু রাসূলস অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান কিংবা নিহত হন তাহলে কি তোমরা ইসলাম থেকে ফিরে যাবে? যে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কৃতজ্ঞ লোকদের আল্লাহ যথোচিত পুরস্কার দেবেন।” (আলে ইমরান)
এরপর মানুষের মধ্যে এমন বাবান্তর ঘটলো যে, মনে হচ্ছিল তারা যেন আবু বাকরের মুখে শোনার আগে এ আয়াত কখনো শোনেইনি। তার আয়াতটি আবু বাকরের কাছ থেকে মুখস্থ করে নিল এবং অনবরত তা আবৃত্তি করতে লাগলো। আবু হুরাইরা বলেন,, উমার (রা) বলেছেন, “আবু বাকরের মুখে এ আয়াত শোনার পর আমি হতবাক ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে গেলাম। পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমি তখনই অনুভব করলাম যে,, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসল্লাম সত্যিই ইনতিকাল করেছেন।”
বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে
ইবনে ইসহাক বলেনঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকালের পর আনসারী সাহাবীদের একটি দল সায়েদা গোত্রের ছাদযুক্ত চত্বরে জমায়েত হয়ে সা’দ ইবনে উবাদার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হলো। ফাতিমার (রা) গৃহে আলী (রা), যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা) নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য স্থাপন করলেন। উসাইদ ইবনে হুদাইরের (রা) নেতৃত্বে বনু আবদুল আশহাল গোত্রও তাঁদের অনুসরণ করলো। এই সময় এক ব্যক্তি আবু বাক্র (রা) ও উমারের (রা) কাছে এসে বললো, “আনসারগণের এই দলটি বনু সায়েদার চত্বরে জমায়েত হয়ে সা’দ ইবনে উবাদার নেতৃত্বে আলাদাভাবে জোটবদ্ধ হয়েছে। এমতাবস্থায় তোমরা যদি মুসলমানদের ঐক্য বজায় রাখার প্রয়োজন অনুভব কর তাহলে তাড়াতাড়ি তারেদ কাছে যাও। নচেৎ অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। অথচ এখনও পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাফন দাফনও সারা হয়নি। তাঁর পরিবার পরিজন এখনো তাঁকে রুদ্ধদার গৃহে সংরক্ষণ করছেন।” উমার (রা) আবু বাক্রকে (রা) বললেন, “চলুন, আমরা এই আনসারী ভাইদের কাছে গিয়ে দেখিম তাদের ব্যাপারটা কি?”
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ও উমার (রা) – এর বর্ণনা
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: [উমারের (রা) খিলাফতের শেষের দিকে আমি একদিন আবদুর রহমান ইবনে আওফের মিনাস্থ বাড়ীতে তাঁর অপেক্ষায় বসে আছি। আবদুর রহমান তখন উমারের (রা) কাছে ছিলেন। উমার তাঁর শেষ হজ্জ সমাপন করছিলেন। আবদুর রহমান (রা) উমারের (রা) কাছ থেকে ঘরে ফিরে দেখেন আমি তাঁর অপেক্ষায় বসে আছি। তৎকালে আমি তাঁকে কুরআন শরীফ শিক্ষা দিতাম। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) আমাকে বললেন, তুমি দেখলে অবাক হয়ে যেতে যে, একটি লোক আমীরুল মুমিনীন উমারের (রা) কাছে এস বলতে লাগলো, “হে আমীরুল মুমিনীন, অমুন ব্যক্তি সম্পর্কে কি আপনি কিছু বলবেন, যে বলেঃ উমার যদি মারা যেতেন তাহলে আমি অমুককে খলিফা নির্বাচন করতাম? আল্লাহর কসম, আবু বাকরের খলিফা হিসাবে নির্বাচিত হওয়াটা ছিল নেহাৎ আকস্মিক ও অপ্রত্যশিত ঘটনা।” উমার (রা) এ কথা শুনে (একজন বিশেষ ব্যক্তিকে খলিফা করার পক্ষে ক্যানভাস করার প্রবণতা এবং প্রথম খলিফার নির্বাচনের অবমূল্যায়ন হতে দেখে) রেগে গেলেন। তিনি বললেন, “আমি ইনশাআল্লাহ আজ বিকালেই জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবো এবং যারা মুসলমানদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিাকারকে বিকৃত ও বিনষ্ট করতে চাইছে, তাদের সম্পর্কে তাতেদরকে হুঁশিয়ার করে দেবো।” আবদুর রহমান (রা) বলেন, আমি বললাম, “হে আমীরূল মুমিনীন, এ কাজ করবেন না। কেননা হজ্জের সময় অনেক অজ্ঞ, অবুঝ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকও সমবেত হয়ে থাকে। আর আপনি যখনই জনসাধারনের মধ্যে দাঁড়াবেন তখন অজ্ঞ লোকেরা আপনার আশেপাশে থাকবে। আমার আশংকা হয়, আপনি যে কথা বলবেন অজ্ঞ লোকেরা তার ভুল অর্থ বুঝবে এবং চারদিক ছড়াবে। কাজেই মদীনায় ফিরে যাওয়া পর্যন্ত আপনি অপেক্ষা করুন। কেননা মদীনাই রাসূলের কেন্দ্রভূমি। সেখানে আপনি গণ্যমান্য ও জ্ঞানী গুণী লোকদের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ পাবেন এবং যা বলতে চেয়েছেন তা সেখানে অবস্থানকালে বললে, সেখানকার বিচক্ষণ লোকেরা তা সঠিকভাবে হৃদয়াঙ্গম করতে পারবে। কোন রকম কদর্থ করা বা ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ থাকবে না।” উমার বললেন, “বেশ, তাই হবে। আমি মদীনায় গিয়ে প্রথম সুযোগেই এ কথা বলবো।”
ইবনে আব্বাস বলেন: আমরা যুলহিজ্জার শেষে মদীনায় পৌছলাম। আমি মিম্বারের কাছাকাছি সাঈদ ইবনে যায়িদকে পেয়ে তার গায়ে গায়ে ঘেষে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরেই উমারকে (রা) আসতে দেখলাম। তখন সাঈদ ইবনে যায়িদকে বললাম, “আজকে তিনি এমন একটি কথা বলবেন যা খলিফা হওয়ার পর আর কখনো বলেননি।” সাঈদ একথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, “এমন কি কথা বলতে পারেন যা কখনো বলেননি?” যা হোক, উমার গিয়ে মিম্বারে বসলেন মুয়াযযিনের আযান শেস হওয়া মাত্রই আল্লাহর প্রশংসান্তে নিম্নরূপ ভাষণ দান কররেন,
“আজ আমি তোমাদেরকে এমন একটি কথা বলবো যা আমার ভাগ্যে ছিল বলেই বলতে পারছি। হয়তো বা আমার মৃত্যু কাছাকাছি এসেই এটা বলছি। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এর সঠিক মর্ম উলব্ধি করতে পারবে সে যেন অনর্থক আমি যা বলিনি, তা বলে না বেড়ায়। আল্লাহ মুহাম্মাদকে (সা) নবুওয়াত দান করেছিরেন এবং তাঁর ওপর কিতাব নাযিল করেছিলেন। তার ভেতর ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুড়ে হত্যা করাও সন্নিবেশিত হয়ের্ছি আমরা তা পড়েছি, শিখেছি ও অনুধাবন করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ শাস্তি কার্যকর করেছেন এবং তাঁর পরে আমরাও তা প্রয়োগ করেছি। আমার আশংকা হয় যে, দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন হয়তো কেউ বলে বসবে, “আমরা আল্লাহর কিতাবে তো ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যার শাস্তি কোথাও দেখতে পাই না।’ এভাবে আল্লাহর নাযিল করা একটা ফরয কাজ ত্যাগ করে লোক গুমরাহীতে লিপ্ত হবে। অথচ এই ‘রজম’ এর বিধান প্রত্যেক বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর জন্য আল্লাহ কিতাবে অকাট্যভাবে বিদ্যমান্ অবশ্য অপরাধটা সাক্ষী, কিংবা গর্ভসঞ্চার অথবা স্বীকারোক্তি দ্বার সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হওয়া চাই্ আমরা আল্লাহর কিতাবে এ বিধানও পড়েছি যে, নিজের পিতৃপরচয় বর্জন করো না। কেননা সেটা কুফরীর শামিল। সাবধান! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ঈসা আলাইহিস সালামের প্রশংসায় যেমন বাড়াবড়ি করা হয়েছিল আমার ক্ষেত্রে তেমন অতিরঞ্জিত প্রশংসা করো না। আমাকে শুধু ‘আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ বলে অভিহিত করো। আর একটা কথা বলছি, শোনো। আমি শুনেছি, অমুক ব্যক্তি নাকি বলেছে যে, উমার ইবনুল খাত্তাব মারা গেলে আমি অমুককে খলিফা মেনে নেব। তোমাদের কেউ যেন একথা বলে বিভ্রান্ত না করে যে, আবু বাকরের (রা) খিলাফত লাভ একটা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল। ঘটনাটা আসলে সে রকমই ছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে তার সম্ভাব্য কুফল থেকে রক্ষা করেছেন। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তোমাদের মধ্যে আবু বাকরের মত উচ্চ মযার্দাসম্পন্ন ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি আর কেউ নেই এবং ছিল না। সুতরাং যে ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে পরামর্শ না করে কাউকে খলিফা মেনে নিয়ে বাইয়াত করবে, তার খিলাফত অচল এবং যে বাইয়াত করবে তার বাইয়াতও অবৈধ ও অগ্রাহ্য হবে। কেননা ও দু’ব্যক্তিকে হত্যার হাত থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার আর কোন উপায় নেই।” [৯৯. এর তাৎপর্য এই যে, বাইয়াত তথা আনুগত্যের অঙ্গীকার দিয়ে কাউকে খলিফা, আমীর বা নেতা মেনে নেয়া একমাত্র পরামর্শ ও মতৈক্যের বৈধ হতে পারে। কিন্তু দুই ব্যক্তি যদি সমগ্র জামায়াত থেকে আলাদ হয়ে স্বেচ্ছাচারী পন্থায় একজন আর একজনের আনুগত্যের বাইয়াত করে তাহলে তা জামায়াতকে অগ্রাহ্য করা ওবিভক্ত করার শামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের বাইয়াত ঐ দুইজনের কারোই গ্রাহ্য হবে না। তারেদ ইভয়কে বর জামায়াত থেকে বহিস্কৃত করতে হবে, যে জামায়াত তাঁর সদস্যর ভেতর থেকে নেতা নির্বাচনে একমত। কেননা ঐ স্বৈরাচারী ব্যক্তিদ্বয়ের একজনকে যদি জামায়াত নেতা মেনে নেয় এবং বাইয়াত করে তাহলে যেহেতু তারা সমগ্র জামায়াতের মতামতকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করে জামায়াতকে অপমানিত করেছে, তাই তাকে কে কখন হত্যা করে বসে বলা যায় না এবং কেউ তারেদ নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারে না। (লিসানুল আরব, [আরবী ***] অধ্যায় দ্রষ্টব্য মূল শব্দ [আরবী ***] এর অর্থ প্রসঙ্গে।)]
উমার (রা) বরেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকালের পর আমরা খবর পেলাম যে আনসারগণ আমাদের বিরোধিতা করছেন। তাঁরা বনু সায়েদা গোত্রের চত্বারে তাঁদের গণ্যমান্য মুরব্বীদের নিয়ে সমবেত হলেন। আলী ইবনে আবু তালিব (রা), যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও তাঁদের সহচরগণ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাইলেন্ আর আবু বাকরের কাছে জমায়েত হলেন মুহাজিরগণ। আমি আবু বাকররেক (রা) বললাম, “আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের আনসার ভাইদের কাছে চলুন।” তাদের কাছে যাওয়ার পথে তাদের দু’জন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে আমাদের দেখা হলো। তারা আনসারদের মনোভাব জানালেন। অতঃপর বললেন, “হে মুহাজিরগণ, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?” আমরা বললাম, “আমরা এই আনসার ভাইদের কাছে যাচ্ছি।” তাঁরা বললেন, “তাঁদের কাছে আপনাদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনাদের যা করনীয় তা করুন।” আমি বললাম, “আমাদের যেতেই হবে।” অতঃপর আমরা বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, সমবেত আনসারগণের মাঝখানে এক ব্যক্তি কম্বল মুড়ি গিয়ে মুখ ঢেকে আছে। আমর বললাম, “তাঁর কি হয়েছে।” তাঁরস বললেন, “অসুখ।” আমরা সেখানে বসলে তাঁদের এক বক্তা আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের রিকালাতের সাক্ষ্য দিয়ে এবং আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করে ভাষণ দিতে শুরু করলেন। বললেন, “আমরা আল্লাহর আনসার এবং ইসলামের বীর সেনানী। আর হে মুহাজিরগণ। আপনার আমাদেরই একটি দল। আপনাদের একটি শান্তশিষ্ট মরুচারী দল আামদের সাতে এসে ইতিমধ্যেই যোগদান করেছে।”
উমার (রা) বলেন: আমরা দেখতে পেলাম, তারা আমাদেরকে আমাদের মূল আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করতে চাইছে এবং তার ওপর জোরপূর্বক নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছে। আমি এর জবাবে চমৎকার একটা বক্তৃতা তৈরী করলাম এবং তা আমার নিজের কাছে অত্যন্ত যুৎসই মনে হয়েছিল। আমি আবু বাক্রকে শোনাতে চাইলাম। আবু বাকরের (রা) মধ্যে এক ধরনের তেজস্বিতা ছিল যার জন্য তাঁকে আমি খুবই ভয় পেতাম এবং যথাসম্ভব তাঁর মনরক্ষা করে চলার চেষ্টা করতাম। আবু বাক্র (রা) বললেন, “উমার। তুমি কিছু বলো ান।” আমি তার জিদ ধরে তাঁর রাগ বাড়াতে চাইলাম না। আমাদের চেয়ে ঢের বেশী শ্রদ্ধাভাজন ও জ্ঞানী ছিলেন আবু বাক্র (রা)। তিনি তাঁদের কথার এত সুন্দরভাবে জবাব দিলেন যে, আমি অনেক সময় ধরে চিন্তা ভাবন করে যে বক্তৃতা তৈরী করেছিলাম – যাতে আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম তাঁর উপস্থিত বক্তৃতায় তার একটা কথাও বাদ তো গেলইনা বরং তার চেয়েও ভাল কথা তিনি বললেন। তিনি বললেন, “তোমরা নিজেদের মহৎ চারিত্রিস গুণাবলী ও অবদান সম্পর্কে যা বলেছোল তা যথার্থ বলেছো। আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে, এই কুরাইশ গোত্রের অবদান না থকালে আরবার ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতো না। তারা আরবদের মধ্যে মধ্যম ধরনের বংশীয় মর্যাদার অধিকারী এবং তাদের আবাসিক এলাকাও সমগ্র আরব জাতির মধ্যস্থলে অবস্থিত। আমি তোমাদের সবার জন্য এই দুইজনের যেকোন একজনকে পছন্দ করি। তোমরা এঁদের মধ্যে যাঁকে পছন্দ করা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হও ও বাইয়াত কর।” এই বলে তিনি আমরা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহর হাত ধরলেন। তাঁর এই শেষের কথাটি ছাড়া আর কোন কথা আমার কাছে খারাপ লাগেনি। আল্লাহর কসম, আমার মনে হচ্ছিল, শিরচ্ছেদের জন্য বধূভূমিতে এগিয়ে যাওয়া গুনাহর কাজ হলেও তা বোধ হয় আমার কাছে আবু বাক্র (রা) থাকতে মুসলমানদের আমীর হওয়ার চাইতে ঢের বেশী পছন্দনীয় হতো।
উমার (রা) বলেন: আবু বাকরের (রা) এই ভাষণের পর আনসারদের একজন বললেন, “আমরা আরবদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তায় যেমন নির্ভরযোগ্য, মান মর্যাদায়ও তেমনি শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আমারেদ পক্ষ থেকে একজন এবং তোমাদের (কুরাইশদের) তরফ থেকে আর একজন আমীর হোক।” এরপর প্রচুর বাকবিতন্ডা হলো এবং বেশ চড়া গলায় কথা কথাবার্তা হতে লাগলো। আমার আশংকা হলো যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের দুই গোষ্ঠী মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে একটা বিভেদ বা কলহের সৃষ্টি হয়ে না যায়। আমি (সকল বিতর্কের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে) তৎক্ষণাৎ বললাম, “হে আবু বাক্র, আপনার হাতখানা বাড়িয়ে দিন।” তিনি বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাত ধরে বাইয়াত করলাম। এরপর মুহাজিররা বাইয়াত করলেন। তারপর আনসাররাও বাইয়াত করলেন। এরপর আমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে বকাঝকা করতে আরম্ভ করলাম। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারেদ একজন বললেন, “তোমরা সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলে।” আমি বললাম, “আল্লাহই সা’দ ইবনে উবাদাকে কোণঠাসা করে দিলে।”
যুহরী বলেছেন: উরওয়াহ ইবনে যুবাই (রা) আমাকে জানিয়েছেন যে, আবু বাক্র (রা), উমার (রা) ও অন্যান্য মুহাজিরগণ বনু সায়েদার চত্বরে যাওয়ার সময় যে দুজন আনসারীর সাক্ষাত পেয়েছিলেন তাঁরা হলেন উয়াইম ইবনে সায়েদা এবং বনু আজলানের মুয়ান ইবনে আদী। বর্ণিত আছে যে, উয়াইম ইবনে সয়েদা সেই ভাগ্যবান সাহাবীগণের অন্যতম যাদের প্রশংসায় আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেছিলেন-
[আরবী *******]
“সেখানে (মসজিদে কুবাতে) এমনসব লোক রয়েছে যার পবিত্রতা অর্জন পছন্দ করে। আর আল্লাহ পবিত্রতাকামী লোকদেরকে ভালবাসেন।” (তাওবাহ)
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এই গোষ্ঠীর মধ্যে উয়াইম ইবনে সায়েদা চমৎকার মানুষ।”
মুয়ান ইবনে আদী (রা) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল হয় সেদিন মুসলমানরা ব্যাপকভাবে কান্নাকাটি করেছিল এবং বলেছিল, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগেই আমাদের মরে যাওয়া উচিত ছিল। তাঁর ইনতিকালের পর আমারেদ ঈমানের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার আশংকা রয়েছে।” কিন্তু একমাত্র মুয়ান ইবনে আদী বলেছিলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে মরা পছন্দ করি না। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় যেমন তাঁর ওপর ঈমান এনেছি, তেমনি তাঁর ইনতিকালের পরও আবার নতুন করে ঈমান আনার সুযোগ পেয়েছি।” পরে আবু বাকরের (রা) খিলাফতের আমলে ইয়ামামার যুদ্ধে মুসাইলিমা কাযযাবের সাথে লড়তে গিয়ে তিনি শাহাদাত লাভ করেন।
যুহরী আনাস ইবনে মালিকের (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে জানান: বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে খিলাফতের প্রাথমিক বাইয়াত গ্রহণের পরদিন আবু বাক্র (রা) মসজিদের মিম্বারে বসলেন। তিনি কিছু বলার আগে উমার (রা) আল্লাহর প্রশংসা করে নিম্নরূপ ভাষণ দিলেন, “হে জনগণ, গতকাল আমি তোমাদেরকে যে কথা বলেছিলাম [অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যাননি, তিনি মূসার (আ) মত সাময়িকভাবে অন্তর্ধান হয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি] তা আমি কুরআন থেকে পাইনি এবং রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আমাকে তা বলেননি। আমার ধারণা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সমষ্টিগত জীবনের সকল দিক পুরোপুরিভাবে গুছিয়ে দিয়ে সবার শেষে ইনতিকাল করবেন। কিন্তু আসলে তা ঠিক নয়। আল্লাহর যে কিতাব দ্বারা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের মনোনীত লক্ষ্যে চারিত করেছেন সে কিতাব আল্লাহ তোমাদের মধ্যে বহাল রেখেছেন। এই কিতাবকে যদি তোমরা আঁকড়ে ধর তাহলে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যেদিকে চারিত করেছেন সেদিকে তোমাদের চালিত করবেন। আজ আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠতম তাঁর কাছেই তোমাদের নেতৃত্ব সমর্পণ করেছেন। তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম সঙ্গী- সওর পর্বত গুহায় তাঁর একনিষ্ঠ সহচর। অতএব তোমরা তাঁর কাছে বাইয়াত করে তাঁকে খলিফা বা আমীর হিসাবে গ্রহণ কর।” তখন েেলাকেরা দ্বিতীয়বার তাঁর হাতে বাইয়াত করলো। এটিই ছিল বনু সায়েদা চত্বরের বাইয়াতের পর সার্বজনীন বাইয়াত।
অতঃপর আবু বাক্র (রা) বক্তব্য রাখলেন। প্রথমে আল্লাহর যথোচিত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “হে জনমন্ডলী, আমাকে তোমাদের দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে। আসলে আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। আমি যদি ভাল কাজ কির তাহলে আমাকে সাহায্য করবে। আর যদি অন্যায় করি তাহলে আমাকে শুধরে দেবে। সত্যবাদিতাই বিশ্বস্ততা। আর মিথ্যাবাদিতা হলো বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের দুর্বল বিবেচিত হয়ে থাকে যতক্ষণ আমি আল্লাহর ইচ্ছায় তার প্রাপ্য হক না দিতে পারবো ততক্ষণ সে আমার কাছে শক্তিশলী। আর তোমাদের মধ্যে যে শক্তিশালী বিবেচিত হয়ে থাকে তার কাছ থেকে যতক্ষণ আম হক আদায় না করবো ততক্ষণ সে আমার কাছে দুর্বল। মনে রেখ কোন জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ ত্যাগ করলে আল্লাহ তাকে লাঞ্চনা গঞ্জনা ও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেন। আর অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও নোংরামি যে সমাজে ব্যাপক আকার ধারণ করে সে সমাজকে আল্লাহ বিপদ মুসিবত ও দুর্যোগ দিয়ে ভরে দেন। যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করবো ততক্ষণ তোমরা আমার কথামত চলবে। কিন্তু যখন আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করবো তখন তোমাদের আনুগত্য আমার প্রাপ্য হবে না। তোমরা নামাযের প্রতি যত্নবান থেকো আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত নাযিল করুন।”
ইবনে আব্বাস (রা) বলেন: উমারের (রা) খিলাফতকালে আমি একবার তাঁর সাথে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। একখানা ছড়ি হাতে তিনি যাচ্ছিলেন নিজের কোন কাজে। তাঁর সাথে তখন আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। তিনি আপন মনে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিলেন আর ছড়ি সগিয়ে নিজের পায়ের উপর আঘাত করছিলেন। সহসা আমার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, “হে ইবনে আব্বাস, জানো, কি জন্য আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের সময় ঐ কথা বলছিলাম?” আমি বললাম, “হে আমীরূল মুমিনীন, আমি তা জানি না। আপনিই ভাল জানেন।” তিনি বললেন, “আমি একটি আয়াত পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মাতের মধ্যে ততদিন থাকবেন যতদিন তাদের সর্বশেষ ক্রিয়াকলাপ দেখে তার ওপর সাক্ষ্য দিতে পারেন। এ ধারণার বশবর্তী হয়েই আমি কথাটা বলেছিলাম। আয়াতটি এই:
[আরবী *******]
“এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী উম্মাত বানিয়েছি যেন মানব জাতির জন্য তোমরা সাক্ষী হতে পারো। এবং রাসূল তোমারেদ জন্য সাক্ষী হতে পারেন।” (বাকারাহ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাফন দাফন
ইবনে ইসহাক বলেন: আবু বাকরের (রা) বাইয়াত সুসম্পন্ন হওয়ার পর মঙ্গলবার দিন জনগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাফনের আয়োজন করলো।
আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র ও হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ প্রমুখ আমাকে বলেছেন, আলী ইবনে আবু তালিব, আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব, ফযল ইবনে আব্বাস, কুসাম ইবনে আব্বাস, উসামা ইবনে যায়িদ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুক্ত গোলাম শাকরান (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) তাঁকে গোসল দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত হলেন। বনু খাযরাজ গোত্রের বনু আওফ পরিবারের আওস ইবনে খাওলী (রা) আলী ইবনে আবু তালিবকে (রা) বললেন, “হে আলী, আল্লাহর দোহাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাফন-দাফন আমাদের অংশ নিতে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।” আওস (রা) বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাব ছিরেন। আরী (রা) বললেন, “এসো।” তিনি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোসলে অংশগ্রহণ করলেন। আলী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের বুকের সাথে হেলান দিকে ধরে রাখলেন। আর আব্বাস, ফযল ও কুসাম (রা) তাঁকে আলীর (রা) সাথে সাথে প্রয়োজন মত ঘুরাতে লাগলেন। উসামা ইবনে যায়িত ও শাকরান (রা) তাঁর ওপর পানি ঢালতে লাগলেন আর আলী (রা) নিজের বুকের ওপর হেলান দিয়ে তাঁকে ধোয়াতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামা গায়েই ছিল। সেই জামার ওপর দিয়েই মৃদুভাবে কচলিয়ে ধুয়ে দিতে লাগলেন আলী (রা)। সরাসরি গায়ের চামড়ায় হাত লাগাননি। ধোয়ার সময় আলী (রা) বলছিলেন, “আমার মাতাপিতা আপনার ওপর কুরবান হোক। জীবিত বা মৃত উভয় অবস্থাতেই আপনার গোয়ে কত সুগন্ধ।” গোসলের সময় অন্যান্য মৃতের দেহ থেকে যেসব নাপাক বস্তু বের হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ থেকে তার কিছুই বের হয়নি।
আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত: গোসলের আয়োজন করতে গিয়ে গোসলের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকেরা মতবিরোধের শিকার হলেন। প্রশ্ন ছিল এই যে, অন্যান্য মৃতের মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাপড় খুলে ফেলে গোসল দেয়া হবে, না কাপড় গায়ে রেখেই গোসল দেয়া হবে। এই মতভেদ চলাকালে সহসা আল্লাহ তাদের ওপর ঘুম চাপিয়ে দিলেন। ঘুমের কারণে সকলেরই মুখ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বুকের ওপর এসে পড়লো। সেই অবস্থায় ঘরের একপাশ থেকে এক অচেনা ব্যক্তি তাদেরকে বললো, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাপড় গায়ে রেখেই গোসল দাও।” অতঃপর জামা গায়ে রেখেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গোসল দেয়া হলো এবং কাপড়ের ওপর দিয়েই গা কচলানো হলো।
ইবনে ইসহাক বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লামের গোসল সম্পন্ন হলে তিনটি কাপড় দিয়ে কাফন পরানো হলো, দুইখানা সুহারী এবং একখানা ইয়ামনী চাদর যা কয়েক ভাঁজ দিয়ে পরানো হলো।
ইবনে আব্বাস (রা): যখন কবর খননের প্রস্তুতি শুরু হলো তখন জানা গেল যে, আবু উবাইদা ইবনুল জারারাহ মাক্কাবাসীদের মত ‘দারীহ’ কবর খননেস পারদর্শী, আর আবু তালহা মদীনা ‘লাহাদ’ কবনর খননে পটু। আব্বাস (রা) দু’জনাকেই ডেকে পাঠালেন। বললেন, “ইয়া আল্লাহ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যেটা ভাল হয় তার ব্যবস্থা করে দাও। শেসে পর্যন্ত আবু তালহাকেই পাওয়া গেল এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লাহাদ কবর খনন করে দিলেন।
মঙ্গলবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাফন ও গোসল দিয়ে তাঁর বাড়ীতে তাঁর খাটে শুইয়ে রাখা হলো। এরপর দাফন নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে আবার মাতান্তর ঘটলো। কেউ বললেন, মসজিদে নববীতে দাফন করবো।” কেউ বললেন, “অন্যান্য সাহাবীদের কবরের পার্শ্বে দাফন করবো।” আবু বাক্র (রা) মীমাংসা করে দিলেন এই বলে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওায়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি যে, প্রত্যেক নবীকে তার ইনতিকালের জায়গাতে দাফন করা হয়েছে।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিছানার শুয়ে ইনতিকাল করেছিলেন তা তুলে ফেলে তার নীচেই কবর খনন করে হলো। লোকজন দলে দলে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জানাযা পড়তে লাগলো। পুরুষদের পড়া শেষ হলে মহিলার পড়লেন। তারপরে শিশু কিশোররা। অতঃপর বুধবারের মধ্যরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসল্লামকে দাফন করা হলো।
আয়িশা (রা) বলেন: বুধবারের মধ্যরাতে কোদাল মারার শব্দ শুনেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাফন করা হচ্ছে।
ইবনে ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শোয়ানের জন্য কবরে নেমেছিলেন আলী, ফযল, কুসাম ও শাকরান (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)।
আওস ইবনে খাওলী এবারও আলীর (রা) নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কবরস্থ করার কাজে আনসারদের অংশ দেয়ার দাবী জানালে আলী (রা) তাঁকে কবরে নামতে বললেন এবং তিনি সকলের সাথে নেমে ঐ কাজে অংশ নিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কম্বলটি ব্যবহার করতেন শাকরান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কবরে শোয়ানের সময় সেটিও তাঁর সাথেই দাফন করে দিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি বলেন, “আপনার পরে এ কম্বল আর কাউকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।”
মুগীরা ইবনে শু’বা (রা) দাবী করতেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ সাহচর্য লাভ করেছেন। কেননা তিনি তাঁর আংটিটি ইচ্ছা করে কবরে ফেলে রেখে উঠে আসেন। তারপর আংটি পড়ে গেছে এই অজুহাত দিয়ে সবার শেষে কবরে নেমে আংটি তুলে আনেন এবং রাসূলুল্লাহ সর্বশেষে স্পর্শ করেন। এভাবে তিনি সর্বশেষ সাহচর্যের দাবীদার হন।
আবদুল্লাহ ইবনে হারিসের মুক্ত গোলাম মুকাসসাম আবুল কাসিম বর্ণনা করেন যে, উমার (রা) কিংবা উসমানের (রা) খিলাফতকালে আমি আলীর (রা) সাথে উমরাহ করি। তিনি তাঁর বোন উম্মে হানীর বাড়ীতে থাকেন। উমরাহ শেষে যখন গোসর সম্পন্ন করলেন তখন ইরাক থেকে একদল মুসলমান তাঁর সাথে এসে দেখঅ করেন। তাঁরা জিজ্ঞেস করেন যে, মুগীরা ইবনে শু’বার এ দাবী সত্য কিনা যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ সাহচর্য লাভ করেছেণ। আলী (রা) বললেন, “সর্বশেষ সাহচর্য লাভ করেছেন কুসাম ইবনে আব্বাস (রা)।”
উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা জানান যে, আয়িশা (রা) তাঁকে বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোগ বৃদ্ধির সময় তাঁর গায়ে একটি চতুস্কোণ কালো কম্বল ছিল। সেটা দিয়ে তিনি একবার শুখ ঢাকছিলেন আর একবার খুলছিলেন। আর বলছিলেন, “সেই জাতির ওপর আল্লাহর অভিশাপ যারা নবীর কবরকে সিজদার জায়গায় পরিণত করে।” এ কথা বলে তিনি নিজের উম্মাতকে সাবধান করে দিচ্ছিলেন।
আয়িশা (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ অছীয়ত ছিল এই, “আরব উপদ্বীপে যেন ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন না থাকে।”
ইবনে ইসহাক বলেন:
রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের অব্যবহিত পর মুসলমানদেরকে ভয়াবহ দুর্যোগ ঘিরে ধরে। আয়িশা (রা) জানান যে, এই সময় আরবরা মুরতাদ হতে আরম্ভ করে, ইহুদী ও খৃস্টানরা মাথা তুলতে শুরু করে এবং মুনাফেকী ব্যাপক আকার ধারণ কলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হারানোর দারুন মুসলমানদের অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় শীতের রাতে বর্ষণসিক্ত মেঘ পালের মত। আবু বাকরের (রা) নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার র্পূব পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত থাকে। ইবনে হিশাম বলেন: আবু উবাইদা প্রমুখ বিজ্ঞ লোকেরা আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ মক্কাবাসী ইসলাম ত্যাগ করা মনোভাব গ্রহণ করে। তা দেখে মক্কার তৎকালীন শাসনকর্তা আত্তাব ইবনে উসাইদ ভয়ে আত্মগোপন করেন। এরপর সুহাইল ইবনে আমের মক্কাবীদেরকে সমবেত করে ভাষণ দেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের কথা জানিয়ে বলেন, “তাঁর ইনতিকালে ইসলাম আরো শক্তিশালী হয়েছে। যে ব্যক্তি সংশয় ও বিভ্রান্তি ছড়াবে আমরা তার শিরচ্ছেদ করবো।”
এরপর লোকজন মত পাল্টালো এবং আত্তাব ইবনে উসাইদ আত্মপ্রকাশ করলেন।
এই অবস্থার কথাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) বলেছিলেন, “এমন এক অবস্থায় সে পড়াবে যখন তুমি তাকে খারাপ বলতে পারবো না।”
হাসসান ইবনে সাবিত (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালে নিম্নলিখিত শোকগাথা রচনা ও আবৃত্তি করেন:
“মদীনাতে রাসূলের উজ্জ্বল নিদর্শন ও স্মৃতি রয়েছে।
সাধারন নিদর্শন ও স্মৃতিসমূহ বিলীন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
কিন্তু সেই পবিত্র স্থানের চিহ্নসমূহ অক্ষয় ও অমর,
যেখানে মহান পথ প্রদর্শকের আরোহণের স্মৃতি বিজড়িত মিম্বার বর্তমান।
সেখানে সেই সব ঘর রয়েছে যার মধ্যে আল্লাহর তরফ থেকে
জাজ্বল্যমান জ্যোতি নাযিল হতো
সেখানে তত্ত্বজ্ঞানের এমন সব কালজয়ী নিদর্শন বিদ্যমান
যা যুগ যুগ কালের অবর্তনেও বিকৃত হয় ন।
তা যতই প্রাচীন হয় ততই তা থেকে নতুন তত্ত্ব উদগত হয়।
সেখানে আমি চিনতে পেরেছি
রাসূলের (সা) চিহ্ন ও আদর্শকে, আরও চিনেছি
তাঁর কবরকে যাতে তিনি হয়েছেন সমাহিত।
সেখানে বসে আমি রাসূলের জন্য অশ্রুপাত করছি যার কারণে
অনেক চক্ষু অশ্রুপাত করে সৌভাগ্যবান হচ্ছে।
চক্ষুগুলো অশ্রুপাত করে প্রকৃতপক্ষে রাসূলের (সা)
অবদানগুলোই স্মরণ করছে-
যার সংখ্যা নির্ণয় করা আমার অসাধ্য।
আহমাদকে (সা) হারানোর বেদনায় রিক্ত ও ভারাক্রান্ত আমার মন তাঁর অবদান
স্মরণ করার কাজে নিয়োজিত হয়েছে।
কিন্তু তাঁর কোন অবদানের দশ ভাগের এক ভাগও স্মরণ করতে পারিনি।
কেবল দুঃ ভারাক্রান্ত মনে মুহাম্মাদ (সা) যে কবরে শুয়ে আছেন তার পাশে
দীর্ঘ সময় অবস্থান করা এবং অশ্রুপাত করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।
হে রাসূলের কবর, তুমি অশেষ বরকত ও কল্যাণের আধারে পরিণত হয়েছো।
যেমন হয়েছে নির্ভুল পথের দিশারী পদছোঁয়া এই গোটা অঞ্চল।
হে কবর, তোমার ভেতর ভেতর বরকাতে পরিপূর্ণ হয়েছে যা এক পূতঃপবিত্র সত্তাকে
ধারণ করে রেখেছে এবং আমার অতি প্রিয়জনকে।
প্রশস্ত ও স্তরে স্তরে সুবিন্যস্ত করে তৈরী করা হয়েছে।
সেই কবরের ওপর অনেকে অনেকে মকাটি ফেলেছে এবং চিরসবুজ
‘সুদ’ বৃক্ষ তাতে প্রোথিত হয়েছে।
রাত্রে লোকেরা (রাসূলুল্লাহকে (সা) সমাহিত করার মাধ্যমে
জ্ঞান, দয়া ও সহিষ্ণুতাকে
সমাহিত করেছে এবং তাঁর ওপর মাটি চড়িয়ে দিয়েছে যদিও
তিনি মাটিতে শোয়ানোর মত লোক নন।
সমাহিত করার পর তারা নবীকে (সা) হারিয়ে ব্যথিত মনে ফিরে গেছে
এবং তারেদ পিঠ ও হাত দুর্বল হয়ে গেছে।
সেই মহামনবের শোকে কাঁদতে কাঁদতে গেছে- যার শোকে তাঁর মৃত্যুর দিন
আকাশ আর পৃথিবীও কেঁদেছে
তাই তাঁর জন্য মানুষ আরো বেশী শোকাহত। কোনদিন কি
কোন মৃত ব্যক্তির শোক মুহাম্মাদের মৃত্যুশোকের সমতুল্য হয়েছে?
এই মৃত্যুর কারণে মানুষ ওহীর অবতরণক্ষেত্রে হারালো
যিনি ওহীর অবতরণক্ষত্রে ছিলেন তিনি আল্লাহর জ্যেতিতে উদ্ভাসিত ছিলেন
এবং সেই জ্যোতি তিনি ইয়ামান ও নাজদে পর্যন্ত বিতরণ করতেন।
যারা তাঁকে অনুসরণ করতো তাদেরকে তিনি দয়াময় আল্লাহর পথ দেখাতেন,
রক্ষা করতেন লাঞ্ছনা গঞ্জনা থেকে এবং ন্যায়ের পথ দেখাতেন।
তিনি তাদের এমন এক নেতা যিনি তাদেরকে হকের দিকে চাীরত করতেন
এবং তার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন।
তিনি সত্যের এমন এক শিক্ষক ও দিশারী
যার অনুসরণ করলেই পরিশুদ্ধি অর্জন করা যায়।
তিনি মু’মিনদের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন
এবং তাদের ওজর মেনে নিতেন।
যদি তারা ভালো ও নির্ভুল কাজ করতো তাহলে তো তাদের কল্যাণে
স্বয়ং আল্লাহই উদারহস্ত ছিলেন।
আর যদি তাদের ওপর এমন কোন কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হতো-
যা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য,
তাহলে একমাত্র তিনিই তা সহজ করে দিতেন।
মুহাম্মাদের (সা) অনুসরীরা যতদিন আল্লাহর নিয়ামতের মধ্যে থাকবে ততদিন
তিনি তাদের কাছে এমন এক দলীল হয়ে থাকবেন যা দিয়ে
তারা সকল ব্যাপারে সঠিক কর্মপন্থা নির্ণয় করতে পারবে।
মানুষের গুমরাহ হয়ে যাওয়া তাঁর কাছে অসহনীয় এবং তাদের হিদায়াত প্রাপ্তি
ও হিদায়াতের ওপর বহাল থাকা তাঁর একান্ত কাম্য।
—— সমাপ্ত ——-