বনু সুলাইম অভিযান
বদর যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় সাত দিন অবস্থান করেন। অতঃপর বনু সুলইম গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি নিজেই এতে নেতৃত্ব দেন এবং তাদের কাদর নামক একটি জলাশয় দখল করেন। এখানে কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হননি। মদীনায় শাওয়ালের বাকী দিনগুলো ও পুরো যিলকা’দ মাস কাটান। এই সময়ে তিনি কুরাইশ যুদ্ধবন্দীদের অধিকাংশকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেন।[৫৮. এই অভিযানে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিবা ইবনে আরকাতা গিফারীকে মদীনার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করে যান। কেউ কেউ বলেন, ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদীনার দায়িত্ব দিয়ে যান ]
সাওয়ীক অভিযান
জিলহাজ্ব মাসেই আবু সুফিয়ান ইবনে হারব সাওয়ীক অভিযান চালায়। এই বছর মুশরিকরা হজ্ব বাদ দিয়েই যুদ্ধে এসেছিল। কেননা আবু সুফিয়ান এবং কুরাইশদের অন্যান্য লোকেরা বদর থেকে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে মক্কায় ফিরেই প্রতিজ্ঞা করলো যে, মাহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আর একটি হামলা চালিয়ে উপযুক্ত প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত স্ত্রী সঙ্গমজনিত অপবিত্রতা দূর করার জন্য গোসলের পানি মাথায় লাগাবো না [৫৯. হজ্ব ও বিয়ে শাদীর মত এই গোসলেরও রেওয়াজ জাহিলিয়াত যুগে ছিল।] এই প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য আবু সুফিয়ান দুশো ঘোড় সওয়ার নিয়ে রওনা হলো। নাজদিয়া অতিক্রম করে সে মদীনার অনতিদূরে অবস্থিত ‘সায়েব’ নামক পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী একটি ঝর্ণার কাছে এসে তাঁবু স্থাপন করলো। অতঃপর রাতের আঁধারে সে বনু নাযীরের হুয়াই ইবনে আখতাবের বাড়ীতে পৌঁছে দরজায় করাঘাত করলো। হুয়াই শংকিত হয়ে দরজা খুলতে অস্বীকার করলো। অগত্যা আবু সাফিয়ান সালাম ইবনে মিশকামের কাছে গেল। এই ব্যক্তি ছিল তৎকালে বনু নাযীরের সরদার এবং তাদের আপৎকালীন সংকট মুকাবিলার জন্য সঞ্চিত তহবিলের সংরক্ষক। আবু সুফিয়ান তার বাড়িতে ঢোকার অনুমতি প্রার্থনা করলে সে অনুমতি দিল। সে তাকে আপ্যায়নও করলো। সালাম তাকে মদীনার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অবহিত করলো। অতঃপর আবু সুফিয়ান রাত থাকতেই তার সহচরদের কাছে চলে গেল। সে কুরাইশ বাহিনীর কিছু লোককে মদীনার পাঠিয়ে দিল। তারা মদীনার পার্শ্ববর্তী উরাইব নামক স্থানে উপনীত হলো। সেখানকার খেজুর বাগানে তারা আগুন জ্বালালো। সেখানে তারা আনসার ও তার জনৈক মিত্রকে তাদের একটি যৌথ কৃষি খামারে পেয়ে হত্যা করলো। তারপর যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। মদীনাবাসী তাদের এই কর্মকা- টের পেয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। বাশীর ইবনে আবদুল মুনযিরকে মদীনার দায়িত্বে রেখে গেলেন। ‘কারকারাতুল কাদর’ নামক স্থানে পৌঁছে আবু সুফিয়ান ও তার দলবলের কোন হদিস না পেয়ে ফিরে এলেন। খামারের ভেতরে তাদের ফেলে যাওয়া কিছু জিনিসপত্র দেখতে পেলেন। হালকা হয়ে দ্রুত পালানোর উদ্দেশ্যে তারা ওগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়।[৬০.ক্রুাইশদের ফেলে যাওয়া এই সব জিনিসের মধ্যে বেশীরভাগ ছিল গম বা জবের ছাতুÑ যা দুধ, মধু ও ঘি দিয়ে অথবা পানি দিয়ে খাওয়া যায়। এই ছাতুকে আরবীতে সাওয়ীক বলা হয়। আর এই কারনেই এই অভিযানের নাম হয়েছে ‘সাওয়ীক অভিযান।’] বিনাযুদ্ধে ফিরে আসা হলো বলে মুসলমানরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এটা কি আমাদের জিহাদ বলে গণ্য হবে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, “হ্যাঁ।”
যূ-আমার অভিযান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওয়ীক অভিযান থেকে ফিরে এসে যিলহাজ্ব মাসের অবশিষ্ট পুরো অথবা প্রায় পুরো সময় মদীনাতে অতিবাহিত করেন। তারপর নাজদের গাতফান গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযানকেই যূ-আার অভিযান বলা হয়। পুরো অথাবা প্রায় সমগ্র সফর মাস তিনি নাজদে অবস্থান করেন। পুরো রবিউল আউয়াল কিংবা অল্প কয়েকদিন বাদে রবিউল আউয়াল মাস মদীনাতেই কাটান।
বাহরানের ফুরু অভিযান
এবার কুরাইশদের বিরুদ্ধে তিনি আর একটি অভিযান পরিচালনা করলেন। তিনি হিজায অতিক্রম করে ফুরু অঞ্চল হয়ে বাহরান পৌঁছেন। সেখানে রবিউস সানী ও জামাদিউল উলা অতিবাহিত করেন। অতঃপর নিরাপদে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
বুন কাইনুকার যুদ্ধ
বনু কাইনুকার মূল ঘটনা ছিল এই যে, জনৈক আরব মহিলা কিছু পণ্যদ্রব্য নিয়ে বনু কাইনুকা গোত্রের বাজারে বিক্রি করে। সেখানে সে এক স্বর্ণকারের দোকানের কাছে বসে। দোকানের লোকেরা মহিলার মুখ খুলতে বলে। কিন্তু মহিলা তা করতে অস্বীকার করে। অতঃপর স্বর্ণকার এই মহিলার পরিধানের কাপড়ের একটা কোণা ধরে তার পিঠের সাথে বেঁধে দেয়। মহিলা এটা টের পায়নি। ফলে সে উঠে দাঁড়ালে অমনি উলঙ্গ হয়ে যায়। বাজারের লোকেরা তা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে। মহিলা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। জনৈক মুসলমান স্বর্ণকারের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে। স্বর্ণকার ছিল ইহুদী। তাই ইহুদীরাও সংঘবদ্ধ হযে ঐ মুসলমানকে হত্যা করে। তখন নিহত মুসলমানের পরিবার-পরিজন মুসলমানদের কাছে ফরিয়াদ জানায় তারা ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালালে বনু কাইনুকার সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ বেঁধে যায়।
মদীনার ইহুদীদের মধ্যে বনু কাইনুকাই সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অবরোধ করে অনুকূল শর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। এভাবে আল্লাহর সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নতজানু করলে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবসে সুলুল তাঁর কাছে এসে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের প্রতি সহৃদয় আচরণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কথায় কোন উত্তর দিলেন না। সে আবার বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করুণ।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্মের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলে তিনি বললেন, “আমাকে ছাড়।” এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর মুখম-ল রক্তিম হয়ে যায়। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, “আরে। আমাকে ছাড় তো।” সে বললো, “না, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণের নিশ্চয়তা আগে দিন, তারপর ছাড়বো। বিশ্বাস করুন, চারশো নাঙ্গামাথা যোদ্ধা এবং তিনশো বর্মধারী যোদ্ধা আমাকে সারা দুনিয়ার মানুষ থেকে নিরাপদ করে দিয়েছে। আর আপনি কিনা একদিনেই তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাচ্ছেন। আমি তাদের ছাড়া এক মুহূর্তও নিরাপদ নই”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আচ্ছা, বেশ। ওদেরকে তোমার মর্জির ওপর ছেড়ে দিলাম।”
এরপর উবাদা ইবনে ছামিত (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হলেন। বনু কাইনুকার সাথে তাঁরও মৈত্রী সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তাঁর কোন পরোয়া না করে তিনি তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিলেন এবং তাদের সাথে তার কৃত চুক্তির দায়দায়িত্ব থেকে তিনি আল্লাহ ও রাসূলের সামনে নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করলেন।তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার মিত্র ও বন্ধু শুধুমাত্র আল্লাহ, রসূল ও মু’মিনগণ। এসব কাফিরের মৈত্রী থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত।”
উবাদা ইবনে ছামিত ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সম্পর্কেই সূরা মায়িদার নিম্নলিখিত আয়াতগুলো নাযিল হয়,
“হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও খৃস্টানদের কখনো বন্ধু ও মিত্র হিসেবে গ্রহণ করো না। ওরা পরস্পরের মিত্র। তোমাদের মধ্য হতো যে ব্যক্তি তাদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে তাদেরই দলভুক্ত গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যালিমদেরকে সুপথ দেখান না। যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তাদেরকে তুমি দেখতে পাবে ইহুদী ও খৃস্টানদের ব্যাপার নিয়ে ছুটোছুটি করে আর বলে: আমাদের আশংকা হয়, আমাদের ওপর বিপদ-মুসিবত এসে পড়ে কিনা। আল্লাহ তো বিজয় দিতে পারেন কিংবা নিজের পক্ষ থেকে অন্য কোন ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারেন। তখন তারা মনের ভেতরে লুকানো ব্যাপার নিয়ে অনুতপ্ত হবে। মুমিনরা বলেঃ এই নাকি কসম খেয়ে লম্বা লম্বা বুলি আওড়ানো সেই লোকদের অবস্থা যারা বলে যে, তারা তোমাদের সাথেই রয়েছে। তাদের সমস্থ নেক আমল বরবাদ হয়ে গেছে। ফলে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। হে মু’মিনগণ, তোমাদের মধ্য হতে যদি কেউ তার দীন ত্যাগ করে, তাহলে সেদিন বেশী দূরে নয় যখন আল্লাহ এমন একটি দলের আবির্ভাব ঘটাবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন এবং যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, যারা মু’মিনদের প্রতি বিনয়ী এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কারো নিন্দা বা তিরস্কারের পরোয়া করবো না। এরূপ দৃঢ় হতে পারাটা আল্লাহ অনুগ্রহ বিশেষ। যাকে তিনি দিতে চান, এ অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন। বস্তুত: আল্লাহর সর্বত্র অনুগ্রহ বিশেষ। যাকে তিনি দিতে চান, এ অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন। বস্তুত: আল্লাহর সর্বত্র বিরাজিত সর্বজ্ঞ। তোমাদের বন্ধু ও মিত্র তো একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই সব মু’মিন যারা নামাযী, যাকাত দাতা ও আল্লাহর অনুগত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে আল্লাহর দলভুক্ত হবে এবং তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহর দলই চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে থাকে।”
যায়িদ ইবনে হারিসার কারাদা অভিযান
কারাদা নাজদের একটি জলাশয়। এখানে অভিযান পরিচালনার কারণ ছিল এই যে, বদরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কুরাইশরা তাদের সিরিয়া যাতায়াতের চিরাচরিত পথে চলাচল বিপদজ্জনক মনে করে ইরাকের পথ ধরে যাতায়াত করা শুরু করলো। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি ব্যবসায়ী দল এই পথ দিয়ে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করে। তাদের সাথে তাদের প্রধান পণ্যদ্রব্য ছিল বিপুল পরিমাণ রৌপ্য। বনু বাক্র ইবনে ওয়ায়িলের ফুরাত ইবনে হাইয়ান ছিল তাদের ভাড়াটে পথপ্রদশক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কাফিলাকে আক্রমণ করার জন্য যায়িদ ইবনে হারিসাকে পাঠালেন। তিনি কারাদার গিয়ে কাফিলাকে ধরলেন। কাফিলার লোকজন প্রাণভয়ে পালিয়ে গেলে তিনি পণ্যসম্ভারসহ সমগ্র কাফিলাটিকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন।
উহুদ যুদ্ধ
বদর যুদ্ধ থেকে পরাজয়ের কলংক মাথায় নিয়ে কুরাইশ কাফিররা যখন মক্কায় পৌঁছলো এবং আবু সুফিয়ান তার কাফিলা নিয়ে মক্কায় ফিরে গেল তখন আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবীআ, ইবরিমা ইবনে আবু জাহল ও সাফওয়ান ইবনে উমাইয়াসহ কুরাইশদের একটি দলÑ যাদের পিতা, পুত্র কিংবা ভাই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, আবু সুফিয়ানের কাছে গেল। আবু সুফিয়ানের ঐ কাফিলায় সেবার যে মুনাফা অর্জিত হয় তা তখনো তর কাছেই ছিল। তারা বললো, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মাদ তোমাদের বিরাট ক্ষতি সাধন করেছে এবং তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। এবার এই কাফিলার যাবতীয় সম্পদ দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য কর, তাহলে আশা করি আমরা আমাদের হারানো লোকদের উপয্ক্তু প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারবো।” সবাই সম্মতি দিল।
অতঃপর আবু সুফিয়ান, তার কাফিলার অন্তর্ভুক্ত অকুরাইশীগণ, বিশেষত: কিনানা গোত্র ও তিহামাবাসীদের মধ্যে যারা কুরাইশদের প্রতি অনুগত ছিল, যুদ্ধে যেতে সম্মাতি দিল, তখন কুরাইশগণও মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। প্রতিহিংসা বৃত্তিকে উস্কিয়ে দেয়ার জন্য এবং যোদ্ধাদের পালানো রোধ করার জন্য কুরাইশরা তাদের কিছু সংখ্যাক মহিলাকেও সঙ্গে নিল। সেনাপতি আবু সুফিয়ান স্বীয় স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাকে, উকরিমা বিন আবু জাহল উম্মে হাকিম বিনতে হারেসকে, হারেস বিন হিশাম ফাতিমা বিনতে ওয়ালীদকে, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বারযা বিনতে মাস’উদকে এবং আমর ইবনুল আস বারিতা বিনতে মুনাব্বিহকে সঙ্গে নিল। অতঃপর তারা মদীনা অভিমুখে অগ্রসর হলো।মদীনার সম্মাুখস্থ উপত্যাকার মুখে অবস্থিত খাল থেকে নির্গত দুইটি ঝর্নার কিনারে বাতনুস সুবখার পাহাড়ের কাছে গিয়ে তাঁবু স্থাপন করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ তাদের ঐ স্থানে অবস্থান গ্রহণের কথা শুনতে পেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বললেন, “আমি একটি ভাল স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, আমার একটি গরু জবাই করা হয়েছে। আর আমার তরবারীর ধারালো প্রান্তে যেন ফাটল ধরেছে। আরো দেখলাম, আমি একটা সুরক্ষিত বর্মের ভেতরে হাত ঢুকিয়েছি।[ ৬১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “গরু জবাই এর তাৎপর্য এই যে, আমার কিছু সংখ্যক সাহাবী নিহত হবে। আর আমার তরবারীর ধারালো প্রান্তে যে ফাটল দেখলাম সেটা আমার পরিবারভুক্ত এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার আলামত।”]এই বর্ম দ্বারা আমি মদীনাকে বুঝেছি। তোমরা যদি মনে কর, মদীনায় অবস্থান করবে এবং কুরাইশরা যেখানে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে থাকাকালেই তাদেরকে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দেবে, তাহলে সেটা করতে পার। তারপরও যদিওরা ওখানেই অবস্থান করে তাহলে সেটা তাদের জন্য খুবই খারাপ অবস্থান বলে প্রমাণিত হবে। আর যদি তারা মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে মদীনায় বসেই আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবো।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলে মদীনার বাইরে যেতে চাচ্ছিলেন না। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুলেরও মত ছিল অনুরূপ মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার বিপক্ষে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে যারা বদর যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি এবং যাদের জন্য আল্লাহ উহাদ ও অন্যান্য যুদ্ধে যোগদানের সৌভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন তাঁরা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, শত্রুর মুকাবিলার জন্য আমাদেরকে মদীনার বাইরে নিয়ে চলুন। ওরা যেন মন করতে না পারে যে, আমরা দুর্বল কিংবা কাপুরুষ হয়ে গেছি।”
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, মদীনাতেই অবস্থান নিন, বাইরে যাবেন না। আল্লাহর কসম,আমরা মদীনার বাইরে গেলেই শত্রুরা আমাদের ক্ষতি বেশী করতে পারবে। আর শত্রুরা যদি মদীনায় প্রবেশ করে আক্রমণ চালায় তাহলে আমরা শত্রুদের অধিকতর বিপর্যয় ঘটাতে পারবো। অতএব হে আল্লাহর রাসূল, কাফিররা যেমন আছে ওদেরকে তেমনি থাকতে দিন। তারা যদি ওখানেই থেকে যায় তাহলে এ জায়গাটা তাদের জন্য জঘন্যতম অবরোধস্থল বলে সাব্যস্ত হবে। আর যদি তারা মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে আমাদের পুরুষরা তাদের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে এবং স্ত্রী ও শিশুরা ওপর থেকে তাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করবে। আর যদি ফিরে যায় তাহলে যেমন এসেছিল তেমনি ফিরে যাবে।” পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যেসব মুসলমান মদীনার বাইরে কুরাইশদের সাথে লড়াই করতে আগ্রহী ছিলেন, তারা তাঁদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন এবং যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হলেন। সে দিনটি ছিল জুম’আর দিন। একই দিন মালিক ইবনে আমর নামক জনৈক আনসার ইন্তিকাল করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জানাযা পড়লেন। অতঃপর মুসলিম জনতার সামনে আসলেন। তিনি মদীনায় বসেই কুরাইশদের মুকাবিলা করতে চেয়েছিলেন ভেবে মুসলমানগণ অনুতপ্ত হলো। তারা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা আপনার মত পছন্দ করিনি,এটা আমাদের উচিৎ হয়নি। আপনি যদি মদীনাতেই অবস্থান করতে চান তবে তাই করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না, তা হয় না, যুদ্ধের পোশাক পরার পর যুদ্ধ না করে তা খুলে ফেলা কোন নবীর পক্ষে শোভা পায় না।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাজার সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হলেন। মদীনা ও উহুদের মধ্যবর্তী শাওত নামক স্থানে পৌঁছার পর প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক নিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল আলাদা হয়ে গেল। সে বললো, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওদের কথা শুনলেন, আমার কথা শুনলেন না। হে জনতা, আমি বুঝি না আমরা কিসের জন্য এতগুলো লোক প্রাণ দেবো?”
সে তার গোত্রের মুনাফিক ও সংশয়মান অনুসারীদের সাথে নিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম তদের পিছু পিছু গেলেন এবং বললেন, “আমি তোমাদেরকে দোহাই দিচ্ছি। তোমাদের মুসলমান ভাইদেরকে এবং আল্লাহর নবীকে উপস্থিত শত্রুর হামলার মুখে ফেলে যেও না।” তারা বললো, “যুদ্ধ হবে মনে করলে তোমাদের রেখে যেতাম না। আমাদের মনে হচ্ছে যুদ্ধ হবে না।” তারা যখন কিছুতেই রণাঙ্গনে ফিরে আসতে রাজী হলো না তখন আবদুল্লাহ বললেন, “হে আল্লাহর দুশমনরা, আল্লাহ তোমাদেরকে দূর করে দিন। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তোমাদের মুখাপেক্ষী রাখবেন না। আল্লাহই তাঁর জন্য যথেষ্ট।”
আনসারগণ বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদের ইহুদী মিত্রদের কাছে সাহায্য চাইলে কেমন হয়?” তিনি বললেন, “ওদের দিয়ে কোন কাজ নেই।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখলেন। উহুদ পাহাড়ের নিকটবর্তী উপত্যাকায় তিনি অবাস্থান গ্রহণ করলেন। সৈণ্যদেরকে পাহাড়ের নিকটবর্তী প্রান্তে মোতায়েন করলেন এবং পাহাড়কে পেছনে রেখে দাঁড়ালেন। সৈন্যদেরকে বললেন, “আমি যুদ্ধের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কেউ য্দ্ধু শুরু করবে না।” কুরাইশরা ইতোমধ্যে তাদের সমস্ত উট ও ঘোড়া উহুদের অদূরে মুসলমানদের খাল বিধৌত ছামগার ফসল সর্মদ্ধ ভূমিতে ছেড়ে দিয়েছে। এ জন্য যুদ্ধ শুরু করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম নিষেধাজ্ঞা শুনে জনৈক আনসার বললেন, “আউস ও খাজরাযের ফসলী জমি থেকে আমরা এখনো আমাদের প্রাপ্য অংশ আদায় করিনি। এমতাবস্থায় সেখানে পশু চরানো কিভাবে বরদাশত করা যায়?”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাতশ’ সৈন্যকে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে ৫০ জন সৈন্যের তীরন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি করলেন। তিনি সাদা কাপড় দ্বারা চিহ্নিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, “ঘোড়সওয়ার শত্রুদেরকে তীর বর্ষণ করে তাড়িয়ে দিও। যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করি আর পরাজিত হই কোন অবস্থায়ই কাউকে পেছন দিক থেকে আসতে দেবে না। দৃঢ়ভাবে নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে থেকো, যেন তোমার দিক থেকে আমরা আক্রান্ত না হই।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটো বর্ম এক সাথে পরে নিলেন এবং পতাকা দিলেন মুস’আব ইবনে উমাইরের হাতে।
পনর বছর বয়স্ক সামুরা ইবনে জুনদুব ও রাফে ইবনে খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন প্রথমে যোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করেননি।পরে অনেক সাহাবী বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, রাফে ভাল তীরন্দাজ।” তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দিলেন। রাফেকে অনুমতি দিলে আবার অনেকে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সামুরা রাফেকে মল্লাযুদ্ধে হারিয়ে দিতে পারে।” তখন তিনি সামুরাকেও অনুমতি দিলেন। কিন্তু উসামা ইবনে যায়িদ, আবদুল্লাহ ইবনে আমর, যায়িদ ইবনে সাবিত, বারা ইবনে হাযম ও উসাইদ ইবনে যুহাইরকে অনুমতি দেননি। পরে খন্দক যুদ্ধে তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়। তখন তাদের বয়স ছিল পনর বছর।
কুরাইশরা তাদের তিন হাজার যোদ্ধাবিশিষ্ট সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য সজ্জিত করলো। তাদের সাথে দুশো ঘোড়া ছিল। এই ঘোড়সওয়ার বাহিনীর ডান পাশে খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে এবং বাম পাশে ইকরিমা ইবনে আবু জাহলকে রাখা হলো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ তরবারী দেখিয়ে বললেন, “এই তরবারীর হক আদায় করতে কে প্রস্তুত আছো?” অনেকেই এগিয়ে গেল। তিনি কাউকেই তরবারী দিলেন না।
আবু দাজানা এগিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ তরবারীর হক কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ তরবারী দিয়ে শত্রুকে এত বেশী আঘাত হানতে হবে যেন তা বাঁকা হয়ে যায়।” আবু দুজানা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ওটা আমি নেব এবং হক আদায় করবো।” তিনি আবু দাজানাকেই তরবারিখানা দিলেন। বস্তুত : আবু দুজানা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও বীর যোদ্ধা। যুদ্ধের সময় তিনি ভীষণ গর্বিত ভঙ্গীতে চলতেন। তাঁর একটা লাল বন্ধনী ছিল। তা দিয়ে যখন নিজের গায়ে আঘাত করতেন তখন লোকে বুঝতো যে, তিনি এক্ষুণি যুদ্ধে নামবেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে তরবারীটা নেয়ার পর সেই বন্ধনীটা বের করলেন এবং নিজের মাথায় তা দিয়ে আঘাত করলেন। অতঃপর সৈন্যদের ব্যুহের মাঝে হেলে দুলে গর্বিত ভঙ্গীতে চলতে লাগলেন। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “রণাঙ্গন ছাড়া হাঁটা চলার এই ভঙ্গীটা আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয়। ”
ওদিকে আবু সুফিয়ান তার বাহিনীর পতাকাবাহী বনু আবদুদ দারের লোকদেরকে যুদ্ধে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে বললো, “হে বনু আবদুদ দার, তোমরা বদরের যুদ্ধে আমাদের পতাকা বহন করেছিলে। কিন্তু সে যুদ্ধে আমাদের কি পরিণতি হয়েছিলো তা দেখেছো। মনে রেখ, সৈন্যদের ওপর পতাকার দিক থেকেই হামলা এসে থাকে। পতাাক যদি নেমে যায় তাহলে সৈন্যরা পর্যুদস্ত হয়। সুতরাং তোমরা হয় পতাকা দৃড়ভাবে ধরে রাখবে নয়তো সরে যাবে। ওটা আমরাই ধরে রাখতে পারবো।” এ কথা শুনে পতাকাবাহীরা পতাকার প্রতি মনোযোগী হলো এবং আব সুফিয়ানের কাছে প্রতিজ্ঞা করে বললো, “আমরা আমাদের অধিনায়কত্ব তোমার কাছে অর্পণ করছি। আগামীকাল যখন আমরা লড়াইয়ে নামবো, তখন দেখে নিও আমরা কেমন লড়াই করি।” আবু সুফিয়ান এই সংকল্পই তাদের মধ্যে সৃস্টি করতে চেয়েছিলো।
পরের দিন লড়াই শুরু হলে উতবার কন্যা হিন্দ তার সহযোগী মহিলাদের সথে নিয়ে ঢোল বাজিয়ে পুরুষদের পিছু পিছু চলতে লাগলো এবং এই বলে তাদে উত্তেজিত করতে লাগলো:
“চমৎকার, হে বনু আবদুদ্ দার,
চমৎকার তোমাদের তৎপরতা) হে পশ্চাদ্দিকের রক্ষকগণ!
প্রতিটি ধারালো তরবারী দ্বারা আঘাত হানো”
তারা আরো বলছিলো, “যদি ধাবমান থাক, আলিঙ্গন করবো এবং নরম গদি বিছিয়ে দেবো
আর যদি পিছিয়ে যাও
আলাদা হয়ে যাবো,
আমাদের ভালোবাসা পাবে না তোমরা।”
উহুদের যুদ্ধে সাহাবীগণ যাতে পরস্পরকে চিনতে পারে সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে একটা প্রতীক ধ্বনি শিখিয়ে দিলেন, তা হলো, “আমিত, আমিত!” অর্থাৎ মরণ আঘাত হানো। মরণ আঘাত হানো।
ক্রমে যুদ্ধ তুমুল আকার ধারণ করলো। আবু দুজানা এমন অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলেন যে, যাকেই সামনে পান হত্যা করতে করতে এগিয়ে যান। যুবাইর ইবনুল আওয়াম বলেন, “মুশরিকদের একটা লোক আমাদের কোন সৈনিককে দেখলেই তাকে হত্যা করতে লাগলো। আবু দুজানা ও এই লোকটি পরস্পর কাছাকাছি এগিয়ে যেতে লাগলো। আমি দোয়া করছিলাম আল্লাহ যেন দু’জনকে একত্রিত করেন। অচিরেই দু’জন মুখোমুখি হলো এবং উভয়ে উভয়কে আঘাত হানতে শুরু করলো। মুশরিক লোকটা আবু দুজানাকে আঘাত করলো। আবু দাজানা তার চামড়ার তৈরী ঢাল দিয়ে আঘাত ফেরালেন। তরবারী ঢালের মধ্যে ঢুকে আটকে রইল। আর আবু দাজানা তাকে পাল্টা আঘাত করে হত্যা করলেন। অতঃপর দেখলাম তিনি হিন্দ বিনতে উতবার মাথার ওপর তরবারী উত্তোলন করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই তরবারী নমিয়ে নিলেন। [৬২. আবু দুজানা বলেন: রণাঙ্গনে দেখলাম কে একজন কাফিরদেরকে উস্কিয়ে দিচ্ছে। আমি তার প্রতিরোধে এগিয়ে গেলাম। তরবারী তুলতেই সে আর্ত চিৎকার করে উঠলো। দেখলাম সে একজন স্ত্রীলোক। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরবারী দিয়ে একজন নারীকে আঘাত করলে তরবারীর অমর্যাদা হবে মনে করে বিরত রইলাম।]
হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) য্দ্ধু করতে করতে আরতাহ ইবনে আবদ শুরাহবীলকে হত্যা কলেন। সে ছিলো পতাকা বহনকারী দলের অন্যতম সদস্য। পরক্ষণেই তিনি দেখতে পেলেন সিবা ইবনে আবদুল উয্যা তার পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছে। তিনি তাকে যুদ্ধের চ্যালেজ্ঞ দিলেন। বললেন, “ওহে হাজামনীর বেটা, আমার সামনে আয়। ” সিবার মা মক্কায় খাতনা করে জীবিকা নির্বাহ করতো।
যুবাইর ইবনে মতিয়িমের গোলাম ওয়াহশী বলেন, আমি হামযার দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখলাম, তিনি স্বীয় তরবারী শত্রুদের দিকে তুলছেন আর চোখের নিমিষেই তাদেরকে সাবাড় করে দিচ্ছেন। সামনের কাউকেই জীবিত ছাড়ছেন না। যুদ্ধ করতে করতে তাঁর সারা দেহ ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে ধূসর বর্ণের উটের মত হয়ে গেছে। এই সময় সিবা ইবনে আবদুল ইযযা আমার সম্মাুখ দিয়ে গিযে হামযার কাছাকাছি হলো। হামজা তাকে দেখে হুংকার ছাড়লেন, “এই হাজামনীর বেটা, আয় আমার কাছে, মজা দেখাই!” এই বলেই তাকে আঘাত হানলেন। কিন্তু তার মাথায় আঘাত লাগলোনা বলে মনে হলো। আমি হামযার প্রতি আমার বর্শা তাক করলাম। লক্ষ্য ঠিক হয়েছে বলে যখন নিশ্চিত হলাম, তখন ছুঁড়ে মারলাম তাঁর প্রতি। বর্শা তাঁর তরপেটে গিয়ে বিদ্ধ হলো এবং দুই উরুর মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তিনি এ অবস্থায়ও আমার দিকে এগুলেন। কিন্তু পরক্ষণেই শক্তিহীন হয়ে পড়ে গেলেন। আমি তাকে খানিকটা সময় দিলাম। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তখন আমি গিয়ে আমার বর্শা টেনে বের করলাম।
অতঃপর কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে ফিরে গেলাম। রণাঙ্গনে আমার হামযাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন কিছুর প্রয়োজন ছিল না। আমি তাকে হত্যা করতে পারলে স্বাধীন হতে পারবো জেনেই তাকে হত্যা করলাম। মক্কা ফিরে যাওয়া মাত্রই আমাকে স্বাধীন করে দেয়া হলো। অতঃপর মক্কাতেই বাস করতে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা জয় করলে আমি পালিয়ে তায়েফে গিয়ে অবস্থান করতে লাগলাম। কিন্তু তায়েফ থেকে একদর প্রতিনিধি ইসলাম গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। বুঝে উঠতে পারলাম না যে, কোথায় যাবো। ভাবলাম, সিরিয়া কিংবা ইয়ামানে চলে যাবো। কেননা সেখানে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। ইতোমধ্যে এক ব্যক্তি আমাকে বললো, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম গ্রহণ করলে এবং কালেমায়ে শাহাদাত পড়লে কাউকেই হত্যা করেন না।” এ কথা শুনে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে গেলাম। তিনি আমার উপস্থিতিতে এবং তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে সত্য দীনের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে দেখে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। চোখ তুলে একবার আমর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বসো। তুমি কিভাবে হামযাকে হত্যা করেছিলে আমাকে বলো।” আমি তাকে ঘটনাটি আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলাম। সব শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তুমি কখনো আমর সামনে আসবে না। আমি যেন তোমাকে না দেখি।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতদিন জীবিত ছিলেন আমি তাঁর কাছে গেলেই এক পাশে সরে যেতাম যেন আমার মুখ তিনি দেখতে না পান।
মুস’য়াব ইবনে উমাইর (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করার জন্য বীরোচিতভাবে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। তাঁকে হত্যা করেছিলো ইবনে কিময়া লাইসী। সে মনে করেছিরো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই হত্যা করেছে। তাই সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, “মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।” মুসয়াব নিহত হরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিবের হাতে পতাকা অর্পন করলেন। অতঃপর আলী (রা) ও অন্যান্য মুসলিম বীর শার্দুলেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
উহুদের যুদ্ধ ভয়ংকর রূপ ধারণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের পতাকাতলে বসলেন। তিনি আলী (রা) কে দূত মারফত নির্দেশ দিলেন যে, “পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাও।” আলী এগিয়ে গিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, “আমি বিভীষিকার বাবা।” [৬৩.কুরাইশ পক্ষের আবু সা’দ হুংকার দিয়েছিলো, “আমি বিভীষিকা সৃষ্টি কারী। আমার সাথে লড়তে কে প্রস্তুত আছে, আস।” এর জবাবেই আলী (রা) উক্ত হুংকার দেন।] আবু সা’দ এগিয়ে এসে তাকে বললো, “হে বিভীষিকার বাবা, তোমার লড়াই করার শখ আছে নাকি?” আলী বললেন, “হ্যাঁ, আছে।” অতঃপর উভয়ের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেল। আঘাত ও পাল্টা আঘাত চললো। অবশেষে আলী একটা আঘাত করেই তাকে ধরাশয়ী করে ফেললেন। ধরাশায়ী করেই আলী (রা) সেখান থেকে সরে গেলেন এবং তাকে মরণ আঘাত হানলেন না। আলীকে তাঁর সঙ্গীরা বললেন, “ওকে চূড়ান্ত আঘাত না করে সরে গেলেন কেন?” তিনি জবাব দিলেন, আবু সা’দ আমাকে তার যৌনাঙ্গ দেখিয়েছে। কিন্তু আমার মনে তার প্রতি দয়া ও করুণার সঞ্চার হলো এবং সেই করুনাবশেই আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম। তবে বুঝতে পেরেছি যে, স্বয়ং আল্লাহই তাকে হত্যা করেছেন।”
আসিম ইবনে সাবিত ইবনে আবুল আকলাহ (রা) যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মুসাফে ইবনে তালহা ও তাঁর ভাই জুলাস ইবনে তালহাকে হত্যা করেন। উভয়কেই তিনি এক এক করে বর্শা দিযে আঘাত করেন এবং প্রত্যেকে আহত অবস্থায় তার মা সুলাফার কাছে যায় এবং তার কোলে মাথা রাখে। সুলাফা পুত্রকে জিজ্ঞেস করে, “ হে প্রিয় বৎস, তোমাকে কে আহত করলো?” সে জবাব দেয়, “ইবনে আবুল আকলাহ।” তখন সুলাফা মান্নত করে যে, আসিম ইবনে সাবিত ইবনে আবুল আকলাহকে হত্যা করা সম্ভব হলে সে তার মাথা খুলিতে মদ পান করবে।
হানযালা ইবনে আবু আমের গাসীল [ফেরেশতারা তাঁকে গোসল দিয়েছিলেন বলে তাঁকে মরণোত্তর গাসিল উপাধিতে ভূষিত করা হয়।] আবু সুফিয়ানের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। এক পর্যায়ে হানযালা আবু সুফিয়ানের ওপর পরাক্রান্ত হয়ে ওঠেন। তা দেখে শাদ্দাদ ইবনে আসওয়াদ নামক কুরাইশ যোদ্ধা হানযালাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে হত্যা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে বললেন, “তোমাদের বন্ধু হানযালাকে ফেরেশতারা গেসল করাচ্ছেন। ” পরে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে জানা যায় যে, তাঁর ওপর গোসল ফরয ছিল। জিহাদের ডাক শোনার পর আর গোসল করার অবকাশ পাননি। তৎক্ষণাৎ রণাঙ্গনে চলে যান।
এরপর আল্লাহ মুসলমানদের ওপর সাহায্য নাযিল করেন এবং তাদের সাথে কৃত স্বীয় ওয়াদা পূরণ করেন। ফলে তারা কুরাইশ বাহিনীকে ব্যাপকভাবে হত্যা ও নির্মূল করতে সক্ষম হন। মুসলিম বাহিনীর আক্রমণের মুখে তিষ্ঠাতে না পেরে কাফিররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং মারাত্মকভাবে পরাজয় বরণ করে।
যুবাইর (রা) বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি উতবা তনয়া হিন্দ ও তার সহচরদেরকে উর্ধশ্বাসে পালাতে দেখেছি। তাদেরকে পাককড়াও থেকে বাঁচানোর জন্য মুশরিকদের কোন বড় বা ছোট দলকে এগুতে দেখলাম না। এভাবে বিজয় যখন ষোলকনায় পূর্ণ হতে চলেছে, তখন সহসা তীরন্দাজ বাহিনী তদের অবস্থান ত্যাগ করে পলায়নরত কুরাইশ বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো এবং আমাদের পেছরেন গিরিপথটাকে খোলা রেখে গেল। আমরা পেছন দিক থেকে আক্রান্ত হলাম। ঠিক এই সময় কে যেন চিৎকার করে বললো, “মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে।” অনন্যোপায় হয়ে আমরা রণাঙ্গনে ফিরে এলাম, আর কুরাইশ বাহিনীও আমাদের ওপর নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়লো। অথচ আমরা তাদের পতাকাবাহীদেরকে পর্যন্ত পর্যুদস্ত করেছিলাম এবং এতখানি অচল করে দিয়েছিলাম যে, তাদের ভুলু-িত পতকার কাছেও কেউ যেতে পারেনি। অবশেষে আমরাহ বিনতে হারেসিয়া নাম্নী এক মহিলা তা তুলে নিয়ে কুরাইশদের কাছে পৌঁছে দেয়। অতঃপর সেই পতাকাকে কেন্দ্র করে ও সম্বল করে তারা পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়।
মুসলমানগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। সেই সুযোগে শুত্রুরা তাদের ভেতরে ঢুকে ব্যাপক আক্রমণ চালালো। ফলে সে দিনটা হয়ে দাঁড়ালো এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা ও পরিশুদ্ধির দিন। বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমানকে আল্লাহ শাহাদাতের সম্মানে ভূষিত করলেন। এমনকি শত্রুরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তিনি শরীরের এক পার্শ্বে একটি আঘাত খেলেন। এতে তাঁর দাঁত ভেঙ্গে গেল এবং তাঁর মুখম-ল ও ঠোঁট আহত হলো। উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাস তাঁকে এ আঘাত করেছিলো। তাঁর সমগ্র মুখম-ল রক্তাক্ত হয়ে গেল। তিনি হাত দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে বললেন, “যে জাতি তার নবীর মুখম-ল রক্তরঞ্জিত করে সে জাতি কি করে কল্য্যন লাভ করবে? অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার দিকে ডাকছেন।” আল্লাহ তায়ালা তাঁর এ উক্তির জবাবে নিন্মোক্ত আয়াত নাযিল করলেন:
[আরবী *******]
“(হে নবী!) কোন চূড়ান্ত ফায়সালার ইখতিয়ার তোমার নেই। ইখতিয়ার রয়েছে আল্লাহর হাতে। তিনি তাদেরকে ক্ষমা করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন। কেননা তারা যালিম। ”(আলে ইমরান)
আবু সাঈদ খুদরীর (রা) বর্ণনা মতে উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাসের বর্শার আঘাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডান দিকের নিচের দাঁত ভেঙে যায় এবং তাঁর নীচের ঠোঁট আহত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে শিহাব জুহরী তাঁর কপাল জখম করে দেয়। আর ইবনে কুমরা তাঁর চোয়ালের উপরিভাগে আঘাত হানে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিরস্ত্রাণের দুটো অংশ ভেঙে তার চোয়ালের ভেতরে ঢুকে যায়। অতঃপর মুসলমানদেরকে তাদের অজান্তে ফেলে মারার মত জন্য আবু আমের যে গর্ত খুড়ে রেখেছিল তার একটি তে তিনি পড়ে যান। এই সময় আলী (রা) এসে তাঁর হাত ধরেন এবং তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা) তাঁকে ওপরে তোলেন। তাঁদের সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দাঁড়াতের সক্ষম হন। আবু সাঈদ খুদরীর পিতা মালিক ইবনে সিনান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের রক্ত চুষে নেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বললেন, “আমর রক্ত যার রক্তের সাথে মিশ্রিত হয়ে গোযখের আগুন তকে স্পর্শ করতে পারবে না।”
মুশরিক বাহিনী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এমন কে আছ, যে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য জীবন কুরবানী করতে প্রস্তুত? এ কথা শুনে যিয়াদ ইবনে সাকান সহ পাঁচজন আনসার সাহাবী উঠে দাঁড়ালেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিফাজতের জন্য এক একজন করে লড়াই করে শহীদ হতে লাগলেন। সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন যিয়াদ ইবনে সাকান কিংবা আম্মারা ইবনে ইয়াযীদ ইবনুস সাকান। তিনিও বীর বিক্রমে লড়াই করে গুরুতরভাবে আহত হলেন। ইতিমধ্যে মুসলমানদের একটি দল সেখানে ফিরে এলো এবং উক্ত আহত সাহাবীর পক্ষে লড়াই করে শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করে হটিয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত সাহাবীকে দেখিয়ে বললেন, “ওকে আমার কাছে আনো।” মুসলমানগণ তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে এলো। তিনি নিজের জানুর ওপর তার মাথা রেখে শোয়ালেন। এই অবস্থাতেই উক্ত সাহাবী ইনতিকাল করলেন।
আবু দুজানা (রা) নিজের দেহকে ঢাল বানিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর টিঠে তীর বিদ্ধ হচ্ছিলো আর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আড়াল করে তাঁর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন। এভাবে তাঁর গায়ে বিদ্ধ তীরের সংখ্যা প্রচুর। আ সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিরক্ষার চেষ্টায় তীর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। সা’দ বললেন, “আবু দুজানাকে দেখলাম, আমাকে একটার পর একটা তীর দিয়েই চলছেন আর বলছেন, ‘তোমার জন্য আমার পিতামাতা কুরবান হোক। তুমি তীর নিক্ষেপ করতে থাক।’ এমনকি সময় সময় তিনি ফলকবিহীন তীরও দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘নিক্ষেপ কর।”
পরাজয় ঘটার এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাহাদাত লাভের গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বপ্রথম চিনতে পারেন কা’ব ইবনে মালিক। কা’ বলেন, “শিরস্ত্রাণের ভেতরে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিলো আর তা দেখেই আমি চিনতে পারলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললাম “হে মুসলমানগণ, সুসংবাদ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেঁচে আছেন। তিনি এখানে।”অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ইশারা করে বললেন, “তুমি চুপ থাক।”
মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চেনার পর তাঁকে নিয়ে সবাই পর্বতের ঘাঁটিতে চলে গেলেন। এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন আবু বাক্র সিদ্দীক, উমার ফারুক, আলী ইবনে আবু তালিব, তালহা ইবন উবাইদাল্লাহ ও যুবাইর ইবনুর আওয়াম সহ একদল মুসলমান।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্বতের ঘাঁটিতে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন উবাই ইবনে খালাফ সেখানে পৌঁছলো। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, এ যাত্রা তুমি প্রাণে বেঁচে গেলেও তোমার নিস্তার নেই।” মসলমানগণ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ লোকটিকে সহানুভূতি দেখানো কি আমাদের কারো জন্য সঙ্গত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ওকে আসতে দাও।” সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলে, তিনি হারেস ইবনে সিম্মারের কাছ থেকে বর্শা নিলেন। কোন কোন বর্ণনানুসারে, বর্শা হাতে নেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন ভংয়কর পাঁয়তারা করলেন যে, উট প্রবল জোড়ে নড়ে উঠলে তার পিঠের ওপর বসা বিষাক্ত ভিমরুলের ঝাঁক যেমন ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়ে যায়; আমরাও ঠিক তেমনি ভীতসস্ত্রস্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে দূরে সটকে পড়লাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তার ঘাড়ের ওপর বর্শার আঘাত হানলেন। আঘাত খেয়ে উবাই ইবনে খালাফ তার ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লো এবং বেশ কয়েকটা গড়াগড়ি খেলো।
ইতিপূর্বে উবাই ইবনে খালাফ মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম সাথে দেখা করে বলতো, “হে মুহাম্মাদ, আমার একটা ঘোড়া আছে। তার নাম ‘আওজ’। তাকে আমি প্রতিদিন এক ফারাক (প্রতি ৪০ কেজি) ভুট্রা খাওয়াই। এই ঘোড়ায় চড়েই আমি তোমাকে হত্যা করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিতেন, “বরং আল্লাহ চাহেতো আমিই তোমাকে হত্যা করবো।”
উবাইয়ের কাঁধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জখমটি করে দিয়েছিলেন, সেটা তেমন গুরুতর জখম না হলেও তা দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। ঐ অবস্থাতেই সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, “আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ আমাকে খুন করেছে।” কুরাইশরা বললো, “আসলে তোমার মন অতিমাত্রায় ঘাবড়ে গেছে। তোমার কোন ভয় নেই।” সে বললো, “মক্কায় থাকাকালেই মুহাম্মাদ আমাকে বলেছিলো: তোমাকে আমিই হত্যা করবো।’ এখন আমার আশংকা হয়, সে যদি আমার প্রতি শুধু থুথুও নিক্ষেপ করে তা হলেও আমি মরে যাবো।” কুরাইশরা তাকে নিয়ে মক্কা অভিমুকে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে সারেফ নামক স্থানে আল্লাহর এই দুশমনের জীবনলীলা সাঙ্গ হলো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্বত ঘাটির মুখে উপনীত হলে আলী ইবনে আবু তালিব (রা) পানির সন্ধানে বেরুলেন, উহুদের পাশ্ববর্তী জলাশয় বা প্রস্তর ঘেরা হ্রদ ‘মেহরাস’ থেকে মশক ভরে পানি আনলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পান করতে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানিতে একটা দুর্গন্ধ পেয়ে তা পান করলেন না। বরং এ পানি দিয়ে তিনি মুখের রক্ত ধুয়ে ফেললেন এবং কিছুটা মাথায় ঢালতে ঢালতে বললেন, “আল্লাহর নবীর মুখকে যে ব্যক্তি রক্তে রঞ্জিত করেছে সে আল্লাহর ভয়ংকর ক্রোধের শিকার হবে।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্বতের একটি টিলার ওপর আরোহণে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং শুধু দুটি বর্মের সাহায্য নিয়ে শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। টিলায় আরোহণের চেষ্টায় ব্যর্থ হলে তালহা ইবনে উবাইদাল্লাহ (রা) তাঁকে ঘাড়ে করে আরোহণ করালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তালহা রাসূলের প্রতি যে সদাচরণ করলো তাতে তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে গেল।”
উহুদ যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিল বনু সা’লাবা গোত্রের মুখাইরীক। উহুদ যুদ্ধের দিন সে তার স্বগোত্রীয় ইহুদীদেরকে বললো, “হে ইহুদীগণ, তোমরা নিশ্চিতভাবেই জান যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য।” ইহুদীরা বললো, “আজ তো শনিবার।” সে বললো, “তোমাদের জন্য শনিবারের অজুহাত যুক্তিযুক্ত নয়।” অতঃপর সে তরবারী ও সাজসরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করলো। সে বললো, “আমি যদি মারা যাই তাহলে আমার সমস্ত সম্পত্তি মুহাম্মাদের। তিনি ঐ সম্পত্তি যেভাবে খুশী ব্যবহার করবেন। ” অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে গেল এবং তাঁর পক্ষে লড়াই করে নিহত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “মুখাইরীক ইহুদীদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি।”
আবু হুরাইরা (রা) বলতেন, “তোমারা আমাকে বলে দাও, কে সেই ব্যক্তি যে জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ সে নামায পড়েনি?” লোকেরা জবাব দিতে না পেরে জিজ্ঞাস করতো, “কে সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি?” তিনি বলতেন, “বনু আবদুল আশহালের উসাইরিম আমর ইবনে সাবিত ইবনে ওয়াকাশ।” হুসাইন ইবনে আবদুর রহমান বলেন, “আমি মাহমুদ ইবনে আসাদকে জিজ্ঞেস করলাম, “উসাইরিম কি রকম লোক ছিল?” তিনি বললেন “সে আগে ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করতো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন উহুদ অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করেন সেদিন সে ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করে ও ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর নিজের তরবারী নিয়ে ছুটতে থাকে এবং রণাঙ্গনে পৌঁছে যায়। সে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করে এবং মারাত্মকভাবে আহত হয়ে নিশ্চল হয়ে পড়ে। পরে বনু আবদুল আশহালের লোকেরা রণাঙ্গনে তাদের লোকদের লাশ খুঁজতে গিয়ে তাকে পায়। তারা তাকে চিনতে পেরে পরস্পর বলাবলি করতে থাকে, উসাইরিম এখান এলো কিভাবে? সেতো ইসলামকে অস্বীকার করতো। তখন সবাই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “হে আমর, তুমি কি কারণে এখানে লড়াই করতে এলে? স্বগোত্রের টানে, না ইসলামের আকর্ষষে?’ সে বললো, ইসলামের আকর্ষণে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আমি ঈমান এনেছি এবং মুসলমান হয়েছি। তরপর তরবারী নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছিলাম এবং যুদ্ধ করে আহত হয়েছি। এর কিছুক্ষণ পরই উসাইরিম তাদের চোখের সামনে মারা গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘটনা শুনে বললেন: সে জান্নাতবাসী।”
আমর ইবনে জামুহ ছিলেন একজন সাংঘাতিক খোঁড়া লোক। তাঁর সিংহের মত চারটি ছেলে ছিল। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিভিন্ন রণাঙ্গণে লড়াই করতে যেতো।উহুদ যুদ্ধের দিন তারা তাদের পিতা আমরকে আটকিয়ে রাখতে চাইলো। বললো, “আল্লাহ আপনাকে যুদ্ধে যাওয়ার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। ” আমর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে বললেন, “আমার ছেলেরা আমাকে এই যুদ্ধে আপনার সাথে যেতে দিতে চায় না। আল্লাহর কসম, এই খোঁড়া পা নিয়েই আমি জান্নাতে প্রবেশ করার আশা রাখি।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ যে তোমাকে জিহাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন সে কথা ঠিকই।” পক্ষান্তরে তাঁর ছেলেদেরকে তিনি বললেন, “তোমাদের পিতাকে যুদ্ধে যেতে বাধা না দিলেও পার। এমনও তো হতে পারে যে, আল্লাহ তার ভাগ্যে শাহাদাত নির্ধারিত রেখেছেন।” অতঃপর আমর উহুদে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। ওদিকে উতবার কন্যা হিন্দ এবং তার সহচরীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিহত সাহাবীদের লাশ বিকৃত করতে শুরু করলো। তাঁদের নাক কান কেটে ফেললো। হিন্দ তা দিয়ে পায়ের খারু বা গুলফ বন্ধনী ও গলার মালা বানালো এবং যুবাইর ইবনে মুতয়িমের গোলাম ওয়াহশীকে সেইসব গুলফবন্ধনী, মালা ও কানের দুল উপহার দিল। সে হামযার কলিজা বের করে চিবালো, কিন্তু গিলতে না পেরে ফেলে দিল।
হালিস ইবনে যাব্বান সেদিন কুরাইশ বাহিনীতে হাবশী সৈন্যদের অধিনায়ক ছিল। সে আবু সফিয়ানের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। দেখলো, আবু সফিয়ান তার বর্শার ফলক দিয়ে হামযার চিবুকে আঘাত করছে আর বলছে, “অবাধ্য কোথাকার। এখন মজাটা আস্বাদন কর”। হালিস, এ দৃশ্র দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। বনু কিনানার লোকেরা কাছেই ছিল। তাদেরকে ডেকে বললো।, “হে বনু কিনানা, কুরাইশ নেতার বা- দেখো। নিজের মৃত চাচাতো ভাইয়ের সাথে কি আচরণ করছে।” আবু সুফিয়ান অপ্রতিভ হয়ে বললো, “কি আপদ, এটা আমার পদঙ্খলন। কাউকে বলো না।”
অতঃপর আবু সুফিয়ান রণাঙ্গণ থেকে ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। রওনা হবার পূর্ব মুহূর্তে সে পাহাড়ের ওপর আরোহণ করে উচ্চাস্বরে ধ্বনি দিল, “কর্মতৎপর লোকেরা যথার্থ পুরস্কার পেয়েছে। যুদ্ধের জয়পরাপয় পালাক্রমে হয়ে থাকে। একদিন এ পক্ষে, আর একদিন অন্যপক্ষে। হে হুবাল, (মূর্তির নাম) তুমি পরাক্রান্ত হও। অর্থাৎ তোমার ধর্মকে জয়যুক্ত কর।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ধ্বনির জবাব দেয়ার জন্য উমারকে (রা) নির্দেশ দিয়ে বললেন, “তুমি বল, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ। আমরা ও তোমরা সমান নই। আমাদের নিহতরা জান্নাতবাসী আর তোমাদের নিহতরা দেযখবাসী।” উমার যখন এই পাল্টা ধ্বনি দিয়ে আবু সুফিয়ানের জবাব দিলেন, তখন আবু সুফিয়ান বললো, “উমার, একটু এ দিকে এসো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারকে বললেন, “যাও, সে কি বলতে চায় শুনে এসো।” উমার এগিয়ে গেলেন। আবু সুফিয়ান বললো, “হে উমার, তোমাকে আল্লাহর দোহাই। সত্য করে বলো, আমরা কি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি?” উমর বললেন, “আল্লাহর কসম, না। তিনি এই মুহূর্তেও তোমার কথাবার্তা শুনেছেন।” আবু সুফিয়ান বললা, “তোমাকে আমি ইবনে কুময়ার চেয়ে সৎ ও সত্যবাদী মনে করি।” উল্লেখ্য যে, ইবনে কুময়া কুরাইশদের আছে বলেছিলো, “আমি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।”
অতঃপর আবু সুফিয়ান উমারকে সম্বোধন করে বললো, “তোমাদের নিহতদের কিছু লাশ বিকৃত করা হয়েছে। বিশ্বাস করো, আমি তা করতে নির্দেশ দেইনি, নিষেধও করিনি। আবার এ কাজে আমি খুশীও নই, অসন্তুষ্টও নই।”
আবু সুফিয়ান রণাঙ্গন ত্যাগ করে যাওয়ার সময় “তোমাদের সাথে আগামী বছর বদর প্রান্তরে আবার দেখা হবে” বলে যুদ্ধের আগাম চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশক্রমে জনৈক সাহাবী আবু সুফিয়ানকে জানিয়ে দিলেন যে, আগামী বছর তার মুকাবিলা করতে তাঁরাও প্রস্তুত রয়েছেন।
কুরাইশ বাহিনী ময়দান ত্যাগ করে রওয়ানা হয়ে যাবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে (রা) এই বলে পাঠিয়ে দিলেন যে, ওদের পেছনে পেছনে গিয়ে লক্ষ্য কর, ওরা কোথায় যায় এবং কি করে। তারা যদি অশ্বপালকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যায় এবং উটে আরোহণ করে তাহলে বুজতে হবে, তারা মক্কা অভিমুখে চলেছে। আর যদি ঘোড়ায় আরোহণ করে ও উট টেনে নিয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে তারা মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। আল্লাহর শপথ, তারা মদীনা আক্রমণ করতে চাইলেও আমি তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য নিযে হাজির হবো এবং প্রতিরোধ করবো।” আলী (রা) বলেন, “আমি তাদের অনুসরণ করলাম। দেখলাম,তারা অশ্বপাল দক্ষিন দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং উটে চড়ে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেছে।”
এবার মুসলমানগণ নিহতদের সন্ধানে বেরুলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সা’দ বিন রাবীর সন্ধান নিয়ে দেখ, সে মৃত, না জীবিত।” এক আনসারী সাহাবা তাঁর খোঁজ করতে লাগলেন। অবশেষে তাঁকে নিহতদের মাঝে মারাত্মকভাবে আহত ও মুমূর্ষু অবস্থায় পেলেন। তাঁকে বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে হুকুম দিয়েছেন তুমি বেঁচে আছ না মারা পড়েছো তা দেখতে।” সা’দ বললেন, আমাকে মৃতই মনে কর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার সালাম জানিয়ে বলো: হে আল্লাহর রাসূল, সা’দ ইবনে রাবী আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছে যে, একজন নবীকে তাঁর উম্মাতের পক্ষ থেকে যতটা উত্তম পুরস্কার দেয়া সঙ্গত তাই যেন আল্লাহ আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে দেন। আর মুসলমানদের নিকট আমার সালাম পৌঁছে দিয়ে বলো: সা’দ ইবনে রাবী বলেছে যে, তোমাদের একটি লোকও জীবিত থাকতে তোমাদের নবীর কাছে যদি দুশমন পৌঁছতে পারে তাহলে আল্লাহর কাছে তোমরা কোন সাফাই দিতে পারবে না।” এ কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই সা’দ মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়লেন। অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে সা’দের খবর জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের (রা) সন্ধানে বের হলেন। তাঁকে প্রান্তরের মধ্যস্থলে পেলেন। দেখলেন, তার পেট চিরে কলিজা বের করা হয়েছে এবং নাক কান কেটে তাঁর লাশ বিকৃত করা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সাফিয়া যদি দুঃখ না পেতো এবং একটা চিরস্থায়ী রীতির জন্ম হওয়ার আশংকা না থাকতো, তাহলে আমি হামযাকে এখানেই রেখে চলে যেতাম এবং তার লাশ পশু পক্ষিকে খেতে দিতাম। আল্লাহ যদি আর কোন রণাঙ্গনেও আমাকে কুরাইশদের বিরুদ্ধে জয়যুক্তকরে তাহলে আমি তাদের ত্রিশ জনের লাশকে এভাবে বিকৃত ও ক্ষতবিক্ষত করবো।” মুসলমানরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিদারুণ মর্মাহত ও চাচার প্রতি পাশবিক আচরণে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ ও বিচলিত দেখলো, তখন তাঁরাও প্রতিজ্ঞা করলো যে, কোন সময় কুরাইশদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হলে তারা তাদের লাশ এমনভাবে বিকৃত করবে যার কোন নজীর আরবের ইতিহাসে নেই।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের ঐ প্রতিজ্ঞা প্রসঙ্গেই আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন-
[আরবী *******]
“তোমরা যদি কাউকে শাস্তি দাও তাহলে তাদের পক্ষ থেকে যেমন শাস্তি তোমরা পেয়েছিলে তার সমপরিমাণ শাস্তি দাও। আর যদি সহিষ্ণুতার পরিচয় দাও তাহলে (জেনে রাখ) ধৈর্যশীলদের জন্য সেটাই উত্তম। তুমি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন কর। তেমার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া চাই। তাদের আচরণে মর্মাহত হয়ো না এবং তাদের দুরভিসন্ধিতে মনকে সংকীর্ণ করো না।”
এ আয়াত দুইটির প্রভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের ক্ষমা করলেন এবং লাশ বিকৃত করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে বললেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামযার লাশ একটি চাদরে আবৃত করলেন। তারপর জানাজার নামায আদায় করলেন। তারপর অন্যান্য লাশের পাশে এনে রাখা হলো এবং প্রত্যেকের জন্য তিনি জানাজা পড়লেন। এভাবে হামযার জন্য বাহাত্তর বার জানাজা পড়লেন।
ইবনে ইসহাক বলেন, হামযাকে দেখতে আবদুল মুত্তালিবের কন্যা সাফিয়া এলেন। হামযা ছিলেন তাঁর সহোদর ভাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়ার পুত্র যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে বললেন, “তুমি তোমার মার সাথে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দাও যেন সে ভাইয়ের এ মর্মান্তিক অবস্থা দেখতে না পায়। ” যুবাইর গিয়ে বললেন, “মা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে ফিরে যেতে বলছেন।” সাফিয়া বললেন, !“কেন?” আমার ভাইয়ের লাশ বিকৃত করার কথা আমি শুনেছি। ওটা আল্লাহর পথেই হয়েছে এবং তা আমার জন্য খুশির ব্যাপার। ইনশাআল্লাহ আমি সবর করবো এবং সন্তুষ্ট থাকবো।” যুবাইর বললেন, “আচ্ছা, তাহলে তাকে আসতে দাও।” সাফিয়া এলেন, হামযাকে দেখলেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়লেন ও তাঁর জন্য ক্ষমা প্রর্থনা করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তাঁর লাশ দাফন করা হলো।
মুসলমানদের অনেকে শহীদের লাশ মদীনায় নিয়ে দাফন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরে এরূপ করতে নিষেধ করেন এবং যেখানে নিহত হয়েছে সেখানেই দাফন করতে বলেন।
আবদুল্লাহ ইবনে সা’লাবা এথকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শহীদদের লাশ দেখলেন তখন বললেন, “আমি এঁদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহর পথে যেÑই আহত হয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ যখন তাকে পুনর্জীবিত করবেন, তখন তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সে রক্তের রং থাকবে রক্তেরই মত আর ঘ্রাণ হবে মৃগনাভির মত। তোমরা দেখ, এদের মধ্যে কে বেশী কুরআন আয়ত্ত করেছিল। অতঃপর সেরূপ ব্যক্তিকে অন্যান্যদের মুখোমুখি রেখে দাফন কর।” অতঃপর এক এক কবরে দুই থেকে তিনজনকে একসাথে দাফন করা হলো।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অভিমুখে রওনা হলেন। এই সময় হামনা বিনতে জাহাশ নাম্নী এক মহিলা তাঁর সাথে দেখা করলেন। তাঁকে প্রথমে তাঁর ভ্রাতা আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের শাহাদাতের খবর দেয়া হলে তিনি ইন্না লিল্লাহ পড়লেন ও ইস্তিগফার করলেন। এরপর তাঁকে তাঁর মামা হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের খবর দেয়া হলে তিনি পুনরায় ইন্না লিল্লাহ পড়লেন ও ইস্তিগফার করলেন এরপর তাঁকে জানানো হলো যে, তাঁর স্বামী মুসয়াব ইবনে উমাইর শহীদ হয়েছেন, তিনি চিৎকার করে উঠলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করলেন, “এজন্য মেয়ের স্বামী তাঁর কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।” মামা ও ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে তাঁকে অবিচলিত এবং স্বামীর মৃত্যুর খবরে চিৎকার করতে দেখেই তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু আবদুল আশহাল ও জাফর পরিবারের আনসারি সাহাবীদের বাড়ীর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন যুদ্ধে নিহত আপনজনদের বিয়োগে ব্যথিত ও শোক সন্তপ্ত পরিবারগুলোর মর্তভেদী কান্নার আওয়াজ শুনে তাঁর চোখও অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। এই সময় হামযার কথা মনে করে তিনিও কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “হাময়ার জন্য কোন ক্রন্দসী নেই!” পরে সা’দ ইবনে মুয়ায ও উসাইদ ইবনে হুদায়ের বাড়ীতে ফিরলে তারা তাদের পরিবারের নারীদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচার জন্য কাঁদতে ও বিলাপ করতে নির্দেশ দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামযার জন্য ঐসব মহিলার কান্না শুনতে পেয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন, মসজিদে বসে তার কাঁদছে। তিনি তাদেরকে বললেন, “আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। এখন তোমরা চলে যেতে পার। কেনান তোমরা আমাকে যথেষ্ট সাহনুভূতি দেখিয়েছ।”
বনু দিনারের আরেক মহিলা। তার স্বামী, ভাই ও পিতা উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। তাকে তার ঐসব আপনজনের নিহত হওয়ার খবর শোনানো হলে সে নির্বিকারভাবে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কি অবস্থা?” সবাই বললো, “তিনি ভাল। তুমি যেমন পছন্দ কর, তিনি সে রকমই আছেন।”মহিলা বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটু দেখাও। আমি তাকে দেখে নিই।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখানো হলো। মহিলা দেখেই বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি নিরাপদে আছেন, এটা দেখার পর আমার কাছে অন্য যে কোন মুসিবত নিতান্তই তুচ্ছ।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ীতে পৌছে তরবারীখানা তাঁর কন্যা ফাতিমাকে দিয়ে বললেন, “প্রিয় বেটি, এটা ধুয়ে পরিষ্কার কর। আজ এটি বড় কাজে এসেছে।” আলী ইনে আবু তালিবও তাঁর তরবারী ফাতিমাকে দিয়ে বললেন, “এ তরবারী খানা থেকেও রক্ত ধুয়ে দাও। আল্লাহর শপথ এটি বড় কাজে এসেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যদি আজ যুদ্ধে সত্যনিষ্ঠ হযে থাক, তবে জেনে রাখো, সাহল ইবনে হানিফ এবয় আবু দাজানাও তোমার সাথে জিহাদে সর্তনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে।”
উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১ ৫ই শাওয়াল শনিবার।পরদিন ১ ৬ই শাওয়াল রোববার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষক ঘোষণা করে দিলেন যে, শত্রুদের পিছু ধাওয়া করতে হবে। তবে গতকালের যুদ্ধে উপস্থিত থাকেনি এমন কেউ আজ যেতে পারবে না। বরং কাল যারা ছিল তারাই শুধু যেতে পারবে। এ কথা শুনে যাবির ইবনে আবদুল্লাহ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা আমার সাত বোনকে পাহারা দেয়ার জন্য আমাকে বাড়ীতে রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই মেয়েদের কাছে কোন পুরুষ থাকবে না এমনভাবে তাদের রেখে যাওয়া আমর বা তোমার কারো পক্ষেই সমীচিন হবে না। আর আমি বাড়ী বসে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তোমার জিহাদে যাওয়াকে অগ্রধিকার দেয়াও আমর পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব তুমি তোমার বোনদের কাছে থেকে যাও। তাই আমি তাদের কাছে থেকে গিয়েছিলাম।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুর পিছু ধাওয়ার অভিযানে তাকেও তাঁর সাথে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এই অভিযানের উদ্দেশ্যে ছিল শুধু শত্রুকে ভয় দেখানো। তাদের পশ্চাদ্ধাবন যে মুসলমানদের শক্তির পরিচায়ক এবং উহুদ যুদ্ধের বিপর্যয় যে তাদের কিছুমাত্র হতোদ্যম করে দেয়নি, শত্রুকে তা বুুঝিয়ে দেয়ার জন্যই এ অভিযান চালানো হয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানে বেরিয়ে মদীনা থেকে আট মাইল দূরে অবস্থিত হামরাউল আসাদ নামক স্থানে উপনীত হলেন। সেখানে সোম, মঙ্গল ও বুধবার পর্যন্ত অবস্থন করার পর মদীনায় ফিরে এলেন। এ সময় মদীনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে। মা’বাদ ইবনে আবি মা’বাদ আল খুযায়ী ছিলেন তখনো মুশরিক। তাঁর গোত্র খুযআর মুসলমান ও মুশরিক নির্বিশেষে প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতো এবং তিহামা অঞ্চলে তাঁর গোপনীয়তা সংরক্ষণ করতো। আর তিহমায় যা-ই ঘটুক তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করতো। তাঁর কাছে কিছুই গোপন করতো না। মা’বাদের সাথে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখা হলো। উহুদের ঘটনা সম্পর্কে সে বললো, “মুহাম্মাদ আপনার যে বিপর্যয় ঘটেছে তাতে আমরা ব্যথিত ও দুঃখিত। আমরা সাবাই কামনা করছিলাম যে, আপনাকে যেন আল্লাহ নিরাপদ রাখেন।” অতঃপর মা’বাদ চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামরাউল আসাদেই রইলেন। রাওহাতে [৬৪. মুজইনা গোত্রের বাসস্থান এই রাওহা জনপদ হাঁটাপথে মদীনা থেকে দুই দিনের দূরত্বে অবস্থিত। ]গিয়ে মা’বাদের দেখা হলো আবু সুফিয়ার ও তার অনুচরদের সাথে। তরা তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাদের ওপর পুনরায় হামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তারা পরস্পর বলাবলি করছিল, “মুহাম্মাদের সহচরদের প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় লোকদের অনেকেই তো খতম করেছি, কিন্তু একবারে নিশ্চিহ্ন না করে মক্কায় ফিরে যাচ্ছি। অবশিষ্টদের ওপর বরং আবার হামলা করবো এবং তাদেরকে শেষ করেই তবে ক্ষান্ত হবো।” এই সময় মা’বাদকে দেখে আবু সুফিয়ান বললো, “মা’বাদ, ওদিককার খবর কি?” মা’বাদ বললো, দেখলাম মুহাম্মাদ তার সহচরদের নিয়ে এক বিপুল জনতার সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং তাদের নিয়ে তোমাদের পিছু ধাওয়া করতে ছুটে আসছে। আমি এরূপ জনসমাবেশ আর কখনো দেখিনি। উহুদের যুদ্ধের দিন যারা যুদ্ধে আসেনি এবার তারাও মুহাম্মাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে।
তাদের মধ্যে তোমাদের ওপর এমন ভয়ংকর ক্রোধ ও আক্রোশ দেখলাম, যা আমি আর কখনো দেখিনি।” আবু সুফিয়ান বললো, “বল কি?” মা’বাদ বললো, আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি। ওরা হয়তো এক্ষুণি এসে পড়বে। তুমি রওনা হবার আগেই হয়তো ওদের ঘোড়ার মাথা দেখা যাবে।” আমরা তো ওদের অবশিষ্ট লোকগুলোকে সাবাড় করে দেয়ার জন্য পুনরায় হামলা করতে প্রস্তুত হয়েছি।” মা’বাদ বললো, “তাহলে আমি নিষেধ করছি। এ কাজটি করো না। তাদের প্রস্তুতি দেখে আমি একটা কবিতা পর্যন্ত রচনা করে ফেলেছি। আবু সুফিয়ান বললো, “কি কবিতা রচনা করেছো? শোনাও তো দেখি।” মা’বাদ বললো, “কবিতাটি এই:
“তাদের তর্জন-গর্জনে আমার উট তো ভয়ে ভিমরি খাওয়ার যোগাড়
খাট চুলওয়ালা ঘোড়ার পাল যখন যমীনের ওপর সয়লাবের মত বয়ে চললোঃ
দ্রুতবেগে ধেয়ে চললো লম্বালম্বা দৃপ্ত সিংহপুরুষদের নিয়ে রণাঙ্গনে
নিরস্ত্র সিপাহীদের মত তারা টলটলায়মান নতশির নয়।
আমি তৎক্ষনাৎ দৌড়ে পালালাম। ভাবলাম, পৃথিবীটা নুয়ে যাচ্ছে
যখন তার আমাদের দিকে ধেয়ে এল এক অপরজেয় অধিনায়কের সাথে।
আমি বললাম, সেই জনম-লরি পদাঘাতে উপত্যাকা কেঁপে উঠেছে।
পবিত্র হারামের অধিবাসীদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ও কা-জ্ঞানসম্পন্ন,
তাদেরকে আমি দ্ব্যর্থহনি ভাষায় সাবধান করে দিচ্ছি আহমাদের সেনাবাহিনী থেকে।
অবশ্য তাঁর বাহিনীর মধ্যে কোন ইতরামী নেই।
আসলে আমি যে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করছি তার জন্য উপযুক্ত ভাষা নেই।”এ বিবরণ শুনে আবু সুফিয়ান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যুদ্ধযাত্রা থেকে নিবৃত্ত হলো।
বনু আবদুল কায়েসের একটি কাফিলার দেখা হলো আবু সুফিয়ানের সাথে। সে বললো, “তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” তারা বললো, “মদীনায়।” আবু সুফিয়ান বললো, “কি উদ্দেশ্যে?” আরা বললো, “খাদ্য আনা নেয়ার উদ্দেশ্যে।” সে বললো, “তোমরা কি মুহাম্মাদের নিকট আমর একটা বার্তা পৌঁছে দেবে? পৌঁছে দিলে আমি আগমীকাল উকাযের বাজারে গিয়ে তোমাদেরকে প্রচুর পরিমাণ কিসমিস দেবো।” তারা বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে সম্মত হলো। সে বললো, “মুহাম্মাদকে বলবে যে, আমরা তার ও তার দলবলের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের অবশিষ্টাংশকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো হামরাউল আসাদে অবস্থান করছিলেন। তাঁর সাথে তারা সেখানে দেখা করলো এবং আবু সুফিয়ানের বার্তা তাঁর নিকট পৌঁছিয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে কথা শুনে বললেন, “হাসবুনাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকীল! (আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি অতি উত্তম অভিভাবক।)” অতঃপর ঐ এলাকায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে দুশমনের দু’জন চর মুয়াবিয়া ইবনে মুগীরা ইবনে আবুল আস ও আবু ইযযাত যামাহী ধরা পড়লো। শোষোক্ত ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করেছিলেন এবং পরে বিনা মুক্তিপণেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। সে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে হত্যা করবেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “মক্কায় গিয়ে তুমি তৃপ্তির সাথে বলবে যে, মুহাম্মাদকে দু’বার ধোঁকা দিয়েছি সে সুযোগ তোমাকে দেয়া হবে না। হে যুবাইর, ওর শিরচ্ছেদ কর।” যুবাইর সঙ্গে সঙ্গে তার শিরচ্ছেদ করলেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। মদীনায় আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবনে সুলুল নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রক্তি ছিল। প্রত্যেক জুম’য়ার দিন সে নিজের গোত্রের কাছে নিজের মর্যাদা জাহির করার জন্য একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই জনগণের সামনে ভাষণ দিতে শুরু করতেন, সে উঠে দাঁড়িয়ে বলতো, “হে জনম-লী, এই যে আল্লাহর রাসূল তোমাদের সামনে উপস্থিত। তাঁর দ্বারা আল্লাহ তোমাদের শক্তি ও সম্মান বৃদ্ধি করেছেন্ সুতরাং তোমরাও তঁকে সাহায্য ও সহযোগিতা কর এবং তাঁর কথা শোনো ও মেনে চল।” এই বলেই সে বসে পড়তো। উহুদ যুদ্ধের আগে তার এই ভূমিকায় কেউ আপত্তি করতো না। কিন্তু উহুদ যুদ্ধে সে জঘন্য বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং বহু সংখ্যক লোককে যুদ্ধের পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এরপরও সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণ দেয়র সময় জুম’য়ার দিন আগের মতই নিজের ভরিক্কী জাহির করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রমংসা করত উঠে দাঁড়ালো। মুসলমানগণ তৎক্ষণাৎ চারদিক থেকে তার কাপড় টেনে ধরলেন আর বললেন, “আল্লাহর দুশমন, বস্। তুই যা করেছিস তাতে তোর মুখে ওসব কথা শোভা পায় না।” তখন সে সমবেত মুসল্লীদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজকে গুরুত্ববহ করার জন্য যে কথাটি বলছিলাম তা যেন খারাপ কথা হয়ে গেল।” মসজিদের দরজায় জনৈক আনসারী সাহাবীর সাথে তার দেখা হলো। তিনি বললেন, “তোমার কি হলো?” সে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজকে গুরুত্ববহ করার চেষ্ট করছিলাম। তাতে তাঁর সহচরগণ আমার ওপর চড়াও হয়ে আমাকে টানতে ও তিরস্কার করতে লাগলো। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজকে গুরুত্ববহ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলাম অথচ সবার কাছে তা খুব খারাপ মনে হলো।”আনসারী সাহাবী বললেন, “যাও, তুমি ফিরে যাও। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন।” সে বললো, “তিনি আমার জন্য ক্ষমা চাইবেন এটা আমি চাই না।”
ইবনে ইসহাক বলেন, “উহুদ যুদ্ধ ছিল চরম পরীক্ষা ও মুসিবতের দিন। এটা দিয়ে আল্লাহ মু’মিনদের পরীক্ষা ও মুনাফিকদের ছাটাই বাছাই করেন। যারা মুখে ঈমানের দাবী করতো কিন্তু মনে মনে গোপনে কুফরী ধ্যান-ধারণা পোষণ করতো এই দিন তারা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। আর আল্লাহ তাঁর যেসব প্রিয় বান্দাকে শাহাদাতের সম্মানে ভূষিত করতে চেয়েছিলেন এ দিন তাদেরকে শাহাদাত দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।”