সীরাত গ্রন্থ রচনায় অগ্রণী মুসলিম ঐতিহাসকগণ
সীরাত গ্রন্থের প্রথম রচয়িতা ছিলেন উরওয়াহ ইবনুয্ যুবাইর ইবনুল ‘আওয়াম (৯২হি:), আব্বান ইবনে উস্মান (১০৫হি:), ওয়াহ্াব ইবনে মুনাববিহ (১১০ হি:), শুরাহবীল ইবনে সা’দ (১২৩হি:),ইবনে শিহাব আয্যুহরী (১২৪ হি:) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র ইবনে হাযাম (১৩৫ হি:)। এদের রচিত গ্রন্থাবলীর প্রায় সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু অংশ বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে। তাবাবীর ইতিহাসের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আর ওয়াহব ইবনে মুনাব্বিহর গ্রন্থের একটি অংশ বর্তমানে জার্মানীর হাইডেলবার্গ নগরীতে সংরক্ষিত আছে।
এঁদের পরে ইতিহাস ও সীরাত গ্রস্থের রচয়িতাদের আর একটি দল আবির্ভূত হন।তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ হলেন মূসা ইবনে উকবাহ (১৪১ হি:), মুয়াম্মার ইবনে রাশেদ (১৫০ হি:) ও মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (১৫২ হি:)। এদের পরবর্তী দলের প্রধানতম ব্যক্তিবর্গ হলেন, যিয়াদ আল বুকায়ী (১৮৩ হি:), ওয়াকেদী যিনি মাগাযী (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধের ইতিহাস) গ্রন্থের রচয়িতা (২০৭ হি:), ইবনে হিশাম (২১৮ হি:) এবং বিখ্যাত তাবাকাত প্রণেতা ইবনে সা’দ (২৩০ হি:)।
সীরাতে ইবনে ইসহাক
উল্লিখিত সীরাত গ্রন্থাবলীর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ, সর্বাধিক প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য এবং সবচেয়ে উন্নতমানের গ্রন্থ হলো সীরাতে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক। [১. “মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের আযাদকৃত দাস। তাঁর দাদা ইয়াসার কুফার পশ্চিমে বারিয়ার দিকে অবস্থিত শহর আইনুত তামারের অন্যতম যুদ্ধবন্দী ছিলেন। হযরত আবু বাক্রের খিলাফতকালে ১২ হিজরী সনে এই শহর মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হলে ইয়াসারকে মদীনায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে ৮৫ হজিরী সনে তাঁর পৌত্র মুহাম্মাদ জন্মগ্রহণ করেন। মদীনাতেই তিনি যৌবন কাটান। অত:পর মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো ভ্রমণে বের হন। ১১৫ হিজরী সনে তিনি ইস্কান্দারিয়া গমন করেন এবং মিসরীয় একদল হাদীসবেত্তার নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহ ও বর্ণনা করেন। এরপর তিনি আলজাজিরা, কুফা, রাই, বুহায়রা ও সর্বশেষে বাগদাদ সফর করেন। এখানেই ১৫২ হিজরী সনে তাঁর ইনতিকাল হয়। প্রখ্যাত মনীষী ইবনে আদী তাঁর সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেন যে,“সমসাময়িক বাদশাহদেরকে আজেবাজে পুস্তকাদি প্রণয়নের কাজ থেকে নিবৃত্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সশস্ত্র সংগ্রাম, তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তি ও বিশ্ব সৃষ্টির ইতিহাস রচনার কাজে আত্ননিয়োগ করতে উদ্বুদ্দ করা যদি ইবনে ইসহাকের একমাত্র কৃতিত্বও হতো, তথাপি এ কৃতিত্বে তিনিই অগ্রণী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত হতেন।”] এ গ্রন্থ তিনি রচনা করেন আব্বাসী শাসনামলের গোড়ার দিকে। বর্ণিত আছে যে, তিনি একবার বাগদাদে আব্বাসী শাসক মানসূরের দরবারে প্রবেশ করেন। মানসূরের সামনেই তাঁর পুত্র মাহদী উপবিষ্ট ছিলেন। মানসূর বললেন, “ইবনে ইসহাক, তুমি জানো ইনি কে?” ইবনে ইসহাক বললেন, “হাঁ, আমীরুল মুমিনীনের (মানসূর) ছেলে”। তখন মানসূর বললেন, “যাও, ওর জন্য এমন একখানা গ্রন্থ রচনা কর, যাতে আদমের (আ) সৃষ্টি থেকে শুরু কের আজকের দিন পর্যন্ত যবাতীয় ঘটনাবলীর বর্ণনা থাকবে”। তখন ইবনে ইসহাক চলে গেলেন এবং কিছুকালের মধ্যে উক্ত গ্রন্থ রচনা করে মানসূরের নিকট উপস্থপন করলেন। মানসূর বললেন, “ইবনে ইসহাক, তুমি গ্রন্থকে অতি মাত্রায় দীর্ঘ করে ফেলেছো। এখন গ্রন্থখানি সংক্ষিপ্ত করে লিখ”। এরপর ঐ বিশাল গ্রন্থখানি খলীফার কোষাগারে রেখে দেয়া হলো।
সীরাতে ইবনে হিশাম
ইবনে ইসহাকের পর আসেন ইবনে হিশাম। [২.আবু মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ইবনে হিশাম ইবনে আইয়ুব আল হিমইয়ারী। জন্মস্থান বসরা। পরে তিনি মিশরে গমন করেন এবং ইমাম শাফেয়ীর সাথে মিলিত হন। এরপর উভয়ে প্রচুর আরব কাব্যচর্চা করেন। সীরাতে ইবনে ইসহাকের সংক্ষিপ্ত সংকলন ছাড়াও ইবনে হিশাম হিমইয়ার গোত্রের রাজন্যবর্গ ও বংশাবলী সম্পর্কেও একখানি গ্রন্থরচনা করেন। তাছাড়া সীরাত সম্পর্কিত দুর্লভ কবিতাসমূহের ব্যাখ্যা করে আরো একটি গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। ২১৮ হিজরীসনে ফুসতাত নগরীতে তিনি ইনতিকাল করেন।]তিনি আমাদের জন্য এই সীরাত গ্রন্থকে সংক্ষিপ্ত করে পেশ করেন। এ কাজ তিনি সম্পন্ন করেন ইবনে ইসহাক কর্তৃক মূল গ্রন্থ রচনার প্রায় অর্থ শতাব্দী পরে। ইবনে ইসহাকের গ্রন্থের এই সংক্ষিপ্ত সার রচনায় তিনি যিয়াদ আল বুকায়ী নামক মাত্র এক ব্যক্তির মধ্যস্থতা গ্রহণ করেন।[৩.হাফেজ আবু মুহাম্মাদ যিয়াদ ইবনে আবদুল মালেক ইবনে আত্তুফাইল আল বুকায়ী আল আমেরী আল কুফী। বনী আমের ইবনে ছা’ছায়ার শাখা বনীল বুকা থেকে উদ্ভূত বলে তিনি বুকায়ী নামে পরিচিত। তিনি বাগদাদ আগমন করেন এবং সেখানে ইবনে ইসহাক থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামরিক অভিযানসমূহের ইতিবৃত্ত এবং মুহাম্মাদ ইবনে সালেম থেকে শরীয়াতের বিধান শিক্ষা ও প্রচার করেন। অত:পর কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেখাসে খলিফা হারুনুর রশীদের শাসনামলে ১৮৩ হিজরী সনে ইনতিকাল করেন। ইবনে হিশাম যে তাঁর এই উস্তাদের যথাযথ কদর করতেন, গ্রন্থের শুরুতে উল্লিখিত এই কথা কয়টি তারই প্রমাণ বহন করছে, “আমি সেইসব বিষয় বাদ দিযেছি যার বর্ণনা অনেকের কাছে অপ্রীতিকর লাগবে অথবা যা বুকায়ী নিজের বর্ণনা দ্বারা আমাদের কাছে প্রামাণ্য বলে সাব্যস্ত করেননি।”] ইবনে হিশাম কর্তৃক বর্ণিত ইবনে ইসহাকের মূল গ্রন্থখানি আজকের এই গ্রন্থে’র বিষয়বস্তুকে অত্যধিক সংক্ষিপ্ত ও সম্পাদিত আকারে পেশ করেন। কোন কোন জায়গায় কিছু সংযোজন ও সমালোচনা ও এর অঙ্গীভূত করেন। আবার কখনো অন্যান্য মনীষীর বর্ণনার সাথে ইবনে ইসহাকের বর্ণনার তুলনা বা যাচাই বাছাইও করেছেন। ঐ গ্রন্থের সংকলনে তাঁর অনুসৃত পদ্ধতির কিছু বর্ণনা তিনি গ্রন্থের শুরুতেই দিয়েছেন। এতদসত্তেও আমরা এব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করি না যে, ইবনে হিশাম জূর্ণ সততা, বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সাথে ইবনে ইসহাকের গ্রন্থ সংকলন করেছেন। তাথেকে তিনি একটি শব্দও পরিবর্তন করেননি। আর যেখানেই ইবনে ইসহাকের বর্ণনার ত্রুটি তুলে ধরা, কিংবা কোন দুর্বোধ্য বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়া অথবা কোন বর্ণনার বিরেধী অন্য কোন বর্ণনা পেশ করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন, সেখানে ‘ইবনে হিশাম বলেন’ উক্তি দ্বারা তা শুরু করেছেন।
সংক্ষেপকরণই মূলত: তাঁর সীরাত গ্রন্থ সংকলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এ জন্য তিনি সৃষ্টির আদিকাল থেকে শুরু করে হযরত ইসমাঈলের বংশধরদের ইতিহাস এবং অন্যান্য যেসব কাহিনীর সাথে সীরাতের কোন সম্পর্কই তিনি দেখতে পাননি, তাও বাদ দিয়েছেনে। আর সেইসব কবিতাও তিনি এর অন্তর্ভুক্ত করেননি, যার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তিনি সন্দেহ পোষণ করতেন।
যিনি ইবনে হিশামের সংকলন থেকে মূল সীরাত গ্রন্থে’র বিষয়বস্তুর সন্ধান লাভ করতে চেষ্টা করবেন, তিনি তাতে চরম নিষ্ঠ ও পরম বিশ্বস্ততার পরিচয়ই লাভ করবেন- যা সেই প্রচীন যুগের মুসলিম মনীষীদের বৈশিষ্ট্য ছিল।
সীরাতে ইবনে হিশামের মর্যাদা
মূলত: ইবনে ইসহাকের সীরাত গ্রন্থই সীরাত পাঠকদের জন্য প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রধান প্রামাণ্য গ্রন্থরূপে বিবেচিত হয়ে আসছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেতিহাসে বুৎপত্তিসম্পন্ন খুব কম লোকই এমন ছিলেন যাঁরা ইবনে ইসহাকের সীরাত গ্রন্থ’কে ঐ বিয়য়ের প্রধান পথ-প্রদর্শকরূপে গ্রহণ করেননি। এ সীরাতে ইবনে ইসহাকই প্রাচীনকাল থেকে “সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে জ্ঞানীজনের কাছে পরিচিত। কেননা ইবনে হিশাম এই গ্রন্থের সংকলক ও সংক্ষেপক ছিলেন। ইবনে খাল্লিকান বলেন,“ইবনে হিশামই ইবনে ইসহাকের সংগৃহীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামরিক ও সাধারণ জীবনেতিহাসসহ গোটা জীবনেতিহাসকে একত্রিত, সংকলিত ও সংক্ষিপ্ত করেছেন।এটাই বর্তমানে সীরাতে ইবনে হিশাম নামে পাঠক সমাজের হাতে শোভা পাচ্ছ।”
বেশ কিছুসংখ্যক টীকাকার ও ব্যাখ্যাকার সীরাতে ইবনে হিশামের টীকা লিখতে এগিয়ে এসেছিলেন। তন্মধ্যে আবুল কাসেম আবদুর রহমান আস্ সুহাইলীর (৫৮১ হি:) “আর রাউদুল আনফ” নামক টীকাটি খুবই বিস্তারিত ও দীর্ঘ পরিসর।[৪.আবুল কাশেম আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে আলখুসায়মী আস-সুহাইলী আল আন্দালুসী আল মালকী। সুহাইল স্পেনের কোরা এলাকার অস্তর্গত একটি উপত্যকার সাম। তিনি ৫০৮ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ কর্নে এবং সেখানেই বসবাস করেত থাকেন। পরে মরক্কোতেও তিন বছর অতিবাহিত করেন এবং সেখানে ৫৮১ হিজরী সনে ইনতিকাল করেন।] এরপরে যিনি এই গ্রন্থের পর্যলোচনায় মনোযোগী হন, তিনি হলেন আবু যার আল খুশানী।[৫. আবু যার মুসআব ্ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মাসউদ আল জিয়ানী আল খুশানী। স্পেনের খুশাইন নামক গ্রামে এবং কাদায়ার খুশাইন গোত্রের নামানুসারে তিনি খুশানী বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি হিজরী ৫৩৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬০৪ সনে ইনতিকাল করেন।] তিনি এই দুর্বোধ্য অংশগুলোর ব্যাখ্যা করেন এবং তার গ্রন্থ ‘র্শাহ সীরাতুন্ নববীয়া’য় কিছু কিছু সমালোচনাও করেন। আর ডক্টর ব্রুনলাহ গ্রন্থখানি প্রকাশ করেন। বদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল আইনী“কাশফুল লিসান ফী শারহে সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে এর ব্যাখ্যা প্রণয়ন সম্পন্ন করেন ৮০৫ হিজরী সনে।
অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই কিছু কিছু গ্রন্থাকার এই গ্রস্থের সংক্ষেপকরণের দিকেও মনোযোগী হয়েছেন। তাদের একজন হলেন বুরহানুদ্দীন ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মাদ আল মুরহাল আশ্শাফেয়ী। ‘আযযাখীরা ফী মুখ্তাছারিস্ সীরাহ্” নামে আঠারটি অধ্যায়ে গ্রথিত এই গ্রস্থে তিনি সীরাতে ইবনে হিশামকে শুধু সংক্ষিপ্তই করেননি, বরং কিছু বিষয়ের সংযোজনও করেছেন।৬৬১ হিজরী সনে তিনি এই গ্রন্থ রচনার কাজ সমাপ্ত করেন। অত:পর ৭১১ হিজরী সনে আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে আবদুর রহমান আলওয়াসেতী “মুখতাছার সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে আর একটি সংক্ষেপিত গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন করেন।এমনকি কতিপয় গ্রন্থাকার সীরাতে ইবনে হিশামকে কাব্যাকারেও সংকলন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন (১) আবু মুহাম্মাদ আবদুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সাইদ আদ দুমাইরী আদ দাইরিনী, ওফাত ৬০৭ হিজরী, (২)আবু নছর আল ফাতাহ বিন মূসা বিন মুহাম্মাদ আল মাগরিবী, ওফাত ৭৯৩ হিজরী। শেষোক্ত গ্রন্থাকারের রচিত গ্রস্থের নাম “আল ফাতহুল কারীব ফী সীরাতিল হাবীব।” গ্রন্থখানি দশ হাজার পংক্তিতে সংকলিত হয়।
সীরাতে ইবনে হিশামের বক্ষ্যমাণ সংক্ষিপ্ত রূপ
যৌবনের প্রারম্ভে আমি এই গ্রন্থখানা আগাগোড়া পড়বার জন্য বার বার চেষ্টা করতাম কিন্তু এর রচনা পদ্ধতির বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতা ঘোর মানসিক পীড়া ও একঘেঁয়েমী সৃষ্টি করতে। ফলে খানিকটা এখান থেকে খানিকটা ওখান থেকে পড়তাম। ভাষার মাধুর্য ও লালিত্য এবং বিষয়বস্তুর মাহাত্ন্যই আমাকে এইসব বিচ্ছিন্ন অংশগুলো পড়তে আকৃষ্ট করতো। ঐ অংশগুলো আমার কাছে ঊষর মরুভূমিতে পুষ্পকাননের মত উপভোগ্য মনে হতো।
আসলে কুরআন-হাদীস পড়লে মনে যে নিখাদ বন্দেগীর ভাব জাগে ও ঐকান্তিক আনুগত্যবোধ অনুভূত হয় সীরাত বিষয়ক বই-পুস্তক পড়লে আমি ঠিক তেমনি ধরনের অসুভূতি লাভ করতাম। মনে হয়, কি এক অজানা রহস্যের দুর্বার আকর্ষণে আমি বার বার ওটা পড়তে চাইতাম। আমার মরহুম পিতাও সীরাত বিষয়ের একজন গ্রন্থাকার ছিলেন। “তালখিছুদ দুরুসিল আওয়ালিয়াহ ফিস সীরাতিল মুহাম্মাদিয়া” নামে তিনি ত্রিশটি অধ্যায়ে সমাপ্ত একখানা সংক্ষিপ্ত রচনা করেন। দীর্ঘদিন ব্যাপী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ওটাই ছিাল একমাত্র পাঠ্যপুস্তক। বলা বাহুল্য,তৎকালে সীরাত ছিল বিদ্যালয়গুলোর অন্যতম পাঠ্য বিষয়।
এতদসত্বেও সীরাতে ইবনে হিশাম গ্রন্থখানি আমি আগাগোড়া পড়তে সক্ষম হইনি। আগেই বলেছি যে, রচনা পদ্ধতির বিন্যস্ততার অভাব এবং অসংলগ্ন ও খাপছাড়া বর্ণনা রীতিই এর কারণ। সেখানে একজন সীরাত পাঠকের সমনে হঠাৎ করে এসে গতিরোধ করে দাঁড়ায় বদরের সকল যুদ্ধবন্দীর নাম, বদরের মুসলিম বাহিনীর ব্যবহৃত সমস্ত ঘোড়ার নাম, আনসার ও কুরাইশদের মধ্য থেকে যেসব মুসলিম সৈনিক বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, যারা শহীদ হন এবং মুশরিকদের মধ্যে যাঁরা নিহত হয় তাদের সকলের নামের সুদীর্ঘ ফিরিস্তি। অনুরূপভাবে বদর যুদ্ধে যেসব কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছে, পূর্ব-পুরুষের মহিমা কীর্তনমূলক যেসব সংলাপ উচ্চারিত হয়েছে, বংশ পরম্পরা উল্লেখ করে যেসব ভাষণ দেয়া হয়েছে, নিছক শব্দের মায়াজাল বুনে যে লম্বা বুলি আওড়ানো হয়েছে এবং সীরাতের মূল বিষয়ের সাথে সংগতিহীনÑ যদিও তার কাছাকাছি কুরআনের যেসব ব্যাখ্যার অবতারণা করা হয়েছে এর অধিকাংশ সীরাত গ্রন্থে’র প্রচলিত রীতি মুতাবিক বর্ণনা পরম্পরা তথা সনদের উল্লেখ যার গুরুত্ব একমাত্র সমালোচক পন্ডিতদের কাছেই স্বীকৃত, এসব জিনিস পাঠকের সীরাত অধ্যায়নে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়।
এজন্য আমি বক্ষ্যমাণ সংক্ষেপিত গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য, অধ্যয়নের দারাবাহিকতা বিনষ্ট না করার ব্যবস্থা সম্বলিত ও নবতর আঙ্গিকে শোভিত করে সীরাতের এই নির্যাসটুকু ইপস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। অবশ্য মূল গ্রন্থের আসল বক্তব্য যাতে অবিকৃত থাকে, সে ব্যাপারে আমি পূর্ণ সচেষ্ট থেকেছি, যাতে করে পাঠক তা থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারেন ও আসল গ্রন্থ থেকে প্রামাণ্য তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। মূল গ্রন্থের একটি বর্ণও আমি পরিবর্তন করিনি। কেননা গ্রন্থকারের বক্তব্য অবিকলভাবে উপস্থাপন করা যে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য, তা আমি সব সময় মনে রেখেছি। ইবনে হিশামের কথা যথাযথভাবে উদ্ধৃত করা ও সেজন্য কথার শুরুতেই ‘ইবনে হিশাম বলেছেন’ বলে উল্লেখ করার রীতি আমি গ্রহণ করেছি ও তা অব্যাহতভাবে অনুসরণ করেছি। সংকলনের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারেই যেখানে যেমন করা দরকার করেছি। বাদ বাকী সমস্ত ইবনে ইসহাকের বক্তব্য, যা ইবনে হিশাম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যোখানে প্রয়োজন হয়েছে, কেবলমাত্র সেখানে ব্যতীত আর কোথাও আমি বর্ণনাদাতাদের নাম উল্লেখ করিনি, যদিও মূল গ্রন্থে ইবনে ইসহাক অথবা ইবনে হিশাম প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। ইবনে হিশামের সমস্ত উদ্ধৃতিতে আমি শৃঙ্খলার সাথে বিন্যস্ত করার প্রতি যত্নবান থেকেছি, প্রয়োজনবোধে তার কোন কোনটার ব্যাখ্য-বিশ্লেষন করেছি। এ ক্ষেত্রে সীরাত বিশ্লেষকদের বর্ণনা এর্ব বিশ্বস্ত হাদীস গ্রন্থ ও অভিধানের উপর আমাকে নির্ভর করতে হয়েছে।
যার মূল গ্রন্থ অধ্যয়নের সুযোগ থেকে বঞ্জিত, বক্ষ্যমাণ সংক্ষেপিত সংকলন তাদের পক্ষে ঐ গ্রন্থ পাঠের একটা সহজ পন্থাবিশেষ। এতে করে বর্তমান তরুণ সমাজের সাথে তাদের প্রাচীন ও সুমহান উতরাধিকারের সুষ্ঠু সংযোগসূত্র স্থাপিত হতে পারে।
পাঠকগণ এই গ্রন্থ মাত্র কয়েকদিনেই পড়ে শেষ করতে পারেন এবং তা থেকে দ্রুততার সাথে মূল্যবান ও কল্যাণকর জ্ঞানার্জনে সক্ষম হতে পারেন। কিন্তু এর স্থলে তাকে যদি মূল গ্রন্থ পাঠ করতে হতো যা বর্তমানে পাঠক মাত্রেরই নাগালের বাইরে তাহলে তাতে তার বহু মাস লেগে যেতো।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন এই গ্রন্থ দ্বারা সমাজকে উপকৃত করেন। জ্ঞানের রাজ্যে আমার এই ক্ষুদ্র ও নগণ্য প্রচেষ্টা সার্থক হলেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করবো। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টিই আমার এ প্রচেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য।
আব্দুস সালাম হারূন
মিসরুল জাদীদাহ্
মধ্য রমজান
১৩৭৪ হিজরী