ইসলামের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি
রাষ্ট্রীয় আয়
এক ব্যক্তির জীবনযাত্রা সুষ্ঠুরূপে নির্বাহ করার জন্য যেমন ধন-সম্পদের প্রয়োজন, অনুরূপভাবে একটি সরকারের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ ও দায়িত্ব পালনের জন্য ধন-সম্পদের আবশ্যকতাও অনস্বীকার্য। ব্যক্তি যেখানে নিজস্ব উপায়-পন্থার সাহায্যে প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ আহরণ করে, রাষ্ট্র-সরকার সেখানে দেশবাসীর নিকট হেইতে বিভিন্ন কর ও রাজস্বের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করিয়া থাকে। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ইহাই গোড়ার কথা।
রাজস্বের সংজ্ঞা
অর্থনীতিদিগণ কর বা রাজস্বের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করিয়াছন। আয়ারল্যান্ডের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক চেষ্টিবল রাজস্বের নিম্ন লিখিত সংজ্ঞা দিয়াছেন:
‘রাজস্ব’ বলিতে কোন ব্যক্তি বা দলের সেই অর্থ বুঝায়, যাহা সরকারী কার্যসম্পাদনের উদ্দেশ্যে তাহার নিকট হইতে বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করা হয়। [পাবলিক ফিনান্স৭: তৃতীয় খনড, প্রথম অধ্যায়, ২৬১ পৃঃ]
বর্তমান যুগের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডাল্টন রাজস্বের সংজ্ঞা দিয়া বলিয়াছেন:
‘রাজস্ব’ সরকার পক্ষ হইতে অপরিহার্যরূপে ধার্যকৃত একটি দাবি বিশেষ।[প্রিন্সিপালস অব পাবলিক ফিনান্স, তৃতীয় অধ্যায় ২৬ পৃঃ]
রাজস্বের এই উবয় সংজ্ঞাই নির্ভুল বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে কোন নৈতিক দায়িত্ব বা সীমা রক্সা করার ভাবধারা আদৌ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। ইসলামী অর্থনীতিতে রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যয় করার ব্যাপারে এই মূলনীতি মনে রাখিতে হইবে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে উহা ধার্য করার ব্যাপারে যেমন অন্যায় ও শোষণের প্রশ্রয় দেওয়া যাইতে পারে না; অনুরূপভাবে সংগৃহীত রাজস্বের একটি ক্রান্তি পর্যন্তও অন্যায় পথে, যথেচ্ছভাবে ব্যয় করার কাহারো অধিকার নাই। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় উহার রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকেও ইসলামী রাষ্ট্রের আয় এবং ব্যয়কেও- স্থায়ী নৈতিক নিয়মের বাঁধনে দেওয়া হইয়াছে এবং তাহা লংঘন করার অধিকার কাহারও থাকিতে পারে না।
ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালের আয়-ব্যায়ের ব্যাপারে যে কেন্দ্রীয় অর্থনীতির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ স্বীকৃত হয়, দ্বিতীয খলীফা হযরত উমর ফারূকের ভাষায় তাহা নিম্নরূপ:
(আরবী**********)
আনুগত্যের যোগ্য কোন ব্যক্তির এই মর্যাদা হইতে পারে না যে, আল্লাহর নাফরমানী করিয়াও তাহার আনুগত্য করিতে হইবে। ‘তিনটি হালাল পন্থা ভিন্ন অন্য কোনভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদে হস্তক্ষেপ করার আমার কোনই অধিকার নাই। প্রথম: সত্য ও ন্যায়পরায়ণতার সহিত তাহা গ্রহণ করা হইবে; দ্বিতীয়ঃ ন্যায়পথেই উহা ব্যয় করা হইবে এবং তৃতীয় এই যে, উহাকে সকল প্রকার অন্যায় নীতির উর্ধ্বে রাখিতে হইবে।
অন্য কথায়, ইসলামী রাষ্ট্র কেবল সরকারী ব্যয়-বহনের জন্যই রাজস্ব আদায় করিবে না, দেশের গরীব, দুঃখী ও অভাবী মানুষের জন্য স্থায়ী কল্যাণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করার উদ্দেশ্যেও- পথিক, বেকার ও ঋণী লোকদের সাহায্য করার জন্যও- রাজস্ব আদায় করিবে।
প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ কর
ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের বিভিন্ন উপায়ের আলোচনার পূর্বে প্রত্যক্ষ কর ও অপ্রত্যক্ষ্য করের বিশ্লেষণ আবশ্যক। যে রাজস্ব নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি কিংবা অবস্থার লোকদের উপর আইনত ধার্য করা হয় উহাকে ‘প্রত্যক্ষ কর’ বলা হয়্ আর যে কর ধার্য করা হয় একজনের উপর; কিন্তু মূলত উহার সমগ্র কিংবা আংশিক পরিমাণ আদায় করিতে হয় অপর একজনকে, উহাকেই বলা হয় প্রত্যক্ষ কর।[অধ্যাপক ডালটন; পাবলিক ফিনান্স ৫ম অধ্যায়, ৩৩ পৃষ্ঠা]
দেশবাসীর উপর প্রত্যক্ষ রাজস্ব ধার্য হওয়া উচিৎ না অপ্রত্যক্ষ রাজস্ব- অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এ সম্পর্কে বিশেষ মতভেদ রহিয়াছে। হেনরী জর্জ বলেন যে, একমাত্র ভূমি রাজস্বই দেশবাসীর উপর ধার্য রাজস্ব হওয়া উচিত। তাহার একমাত্র কৃষি উৎপন্ন ফসলকেই প্রকৃত উৎপাদন বলা যাইতে পারে। কৃষি উৎপন্ন ফলনই মূলত মানবজীবনের অপরিহার্য প্রয়োজনের পরিপূরক বলিয়া প্রত্যেকেই তাহা ব্যবহার করিতে বাধ্য। ফলে দেশের সকল মানুষের উপরই এইরূপ রাজস্বের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে পড়িয়া থাকে। কিন্তু এই রাজস্ব নীতির মূলে একটি সুস্পষ্ট ভুল বিদ্যমান। রাজস্বের এই নীতি গৃহীত হইলে নগদ সম্পদশারী লোকদের ঐশ্বর্যের উপর ইহার কোন প্রভাব পড়িবে না। বরং কেবল গরীব-দুঃখীদের উপরই রাজস্বের দুর্বহ বোঝা চাপাইয়া দেওয়া হইবে। [প্রিন্সিপালস এন্ড মেথড অব টেকসেশন, ২৪ পৃষ্ঠা]
অপ্রত্যক্ষ রাজস্ব নীতিতে মানুষের চক্ষে ধুলি দিয়া রাজস্ব আদায় করা হয়। জনগণ জানিতেও পারে না যে, তাহাদের উপর কর ধার্য করা হইয়াছে এবং তাহাদিগকে তাহা যথারীতি আদায়ও করিতে হইতেছে। কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজস্বনীতিতে জনগণের নিকট হইতে সরাসরি কর আদায় হয় বলিয়া তাহাতে কোনরূপ আতিশয্য দেখিতে পাইলে সঙ্গে সঙ্গেই জনগণ উহার বিরুদ্ধ তীব্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ফলে এই রাজস্ব ধার্য এবং উহা আদায় করণের ব্যাপারে কোনরূপ জুলুম হওয়ার সম্ভাবনা ও অবকাশ থাকিতে পারে না। আর অপর পক্ষে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম এবং রাষ্ট্রের যাবতীয় সামষ্টিক দায়িত্ব পালনের প্রতি জাগ্রত জনগণের আন্তরিক সমর্থন থাকে বলিয়া প্রকৃত প্রয়েঅজন-পরিমাণ রাজস্ব আদায় কার্য ব্যাহত হয় না। ফলে জনমতের গুরুত্ব, গণ অধিকারের মৌলিক ভাবধারা ও সামগ্রিক প্রয়োজন পূর্ণ করণ প্রভৃতি সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন হইতেও বিকাশ লাভ করিতে পারে।
কিন্তু বর্তমান কুটনৈতিক ও ষড়যন্ত্রকারী দুনিয়ার রাষ্ট্র-সরকারের অর্থ মন্ত্রীগণ সাধারণত সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নভাবে ও জনগণের অজ্ঞাতে কর আদায় করিবারই চেষ্টা করিয়া থাকে। কোলবিয়ার নামক একজন ফরাসী মন্ত্রী বলিয়াছেন ‘হাঁসের পালক এমনভাবে উৎপাটন কর, যেন উহা চিৎকার করারও অবসর না পায়।’ বস্তুত বর্তমান দুনিয়ার প্রায় সকল করাষ্ট্রেই রাজস্ব আদায় ও অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে এই নীতিই অনুসৃত হইতেছে।
উপরন্তু রাজস্ব আদায়ের এইসব নীতি ও পদ্ধতিতেই নৈতিক ভুল ও অন্তর্নিহিত মারাত্মকত ত্রুটি রহিয়াছে। এই জন্য বর্তমান দুনিয়ার প্রায় সব অর্থনীতিবিদগণ উভয় পদ্ধতিতেই রাজস্ব আদায় করার পরামর্শ দিয়াছেন- যেন উভয় পদ্ধতির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য তদুদ্ভূত দোষ-ত্রুটির ক্ষতিপূরণ করিতে পারে। এই দিক দিয়া ইসলামী রাষ্ট্রের রাজস্ব নীতির বৈশিষ্ট্য ও নির্ভুলতা অনস্বীকার্য। কারণ তাহাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয় দিক দিয়াই রাজস্ব ধার্য হয়। এই রাজস্ব আয়ের উপর ধার্য হয়, যতা যাকাত, ওশর (ফসলের একদশমাংশ কিংবা একবিশাংশ) এবং খারাজ ইত্যাদি ‘প্রত্যক্ষ কর’। অথচা তাহা ধার্য হয় মূলদনের উপর, যেমন চতুষ্পদ পালিত জন্তুর যাকাত, স্বর্ণ-রৌপ্যের যাকাত, ব্যবসায় পণ্যের যাকাত। ইহা সবই প্রত্যক্ষ কর- এর অন্তর্বুক্ত। আর অপ্রক্ষ কর, মেযন উত্তোলিত খনিজ ও নদী-সমুদ্র সম্পদ এবং শুল্ক ইত্যদি। এই সবের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কর ধার্যকরণ ব্যবস্থা গড়িয়া উঠে, যাহা আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের কর ধার্যকরণ ব্যবস্থার সহিত পুরাপুরি সংগতি সম্পন্ন।
ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের উপায়
ইসলামী রাষ্ট্রের বিরাট জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য যে বিপুল অর্থ সম্পদের আবশ্যক, তাহা পূর্ণ করিবার জন্য কুরআন মজীদে নিম্নলিখিত উপায়সমূহ নির্ধারিত হইয়াছে:
১. সর্ব প্রকারের যাকাত, সাদ্কা, ওশর বা মুসলমানদের ভূমিরাজস্ব, খনিজ সম্পদের ‘রয়ালটি’ ইত্যাদি।
২. ভিন্ন জাতির নিকট হইতে বিনাযুদ্ধে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ, জিযিয়া, গনীমতের মাল, খারাজ বা অমুসলমানদের অধিকারভুক্ত জমির খাজনা ইত্যাদি।
৩. দেশের সমষ্টিগত প্রয়োজন পরিপূরণের জন্য নাগরিকদের কিট হইতে আদায়কৃত চাঁদা বাবদ লব্ধ অর্থ।
নবী করীম (স) এবং খুলাফায়ে রাশেদুন কর্তৃক নির্ধারিত কর
নবী করীম (স) এবং খুলাফায়ে রাশেদুন নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকেও ইসলামী রাষ্ট্রের আয় হিসাবে গণ্য করিয়াছেন:
(১) ভূগর্ভে প্রাপ্ত সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ (২) রয়ালটি (৩) ইজারার খাজনা (৪) আমদানী ও রফতানী শুল্ক (৫) নদী-সমুদ্র হইতে প্রাপ্ত সম্পদ (৬) মালিক বা উত্তরাধিকারীহীন ধন-সম্পত্তি (৭) মুদ্রাশিল্প এবং রাষ্ট্রের মালিকানা ও কর্তৃত্বাধীন পরিচালিত জমি, বন ও শিল্প-ব্যবসায়লব্ধ মুনাফা।
আয়ের উল্লেখিত উপায়সমূহকে পরিমাণের দিক দিয়া চার ভাগে বিভক্ত করা চলে: (ক) ভূমি রাজস্ব- ওমর, ওশরের অর্ধেক, খারাজ।
(খ) খুমুস- যেসব রাজস্ব মুল সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ হিসাবে গ্রহণ করা হয়, যথা গণীমতের মাল, ব্যাক্তি-মালিকানার খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক সম্পদ ইত্যাদি।
(গ) যাকাত, সাদকা এবং নাগরিকদের নিকট হইতে লব্ধ টাকা। জিযিয়অও ইহারই অন্তর্ভুক্ত হইবে। (জিয়িা, খারাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে নাগরিকদের নিকট হইতে যাহা আয়অ করা হইবে, তাহার হার ও পরিমাণ নির্ধারণ ইসলামী রাষ্ট্রের বা পার্লামেন্টের কাজ।) যাকাত বিভিন্ন জিনিস হইতে বিভিন্ন হারে আদায় করার নির্দেশ রহিয়াছ্
(ঘ) মালিকবিহীন বা উত্তরাধিকারীহীন ধন-সম্পত্তি। ইহার সম্পূর্ণ ও সমগ্রটাই রাষ্ট্রীয় বায়তুলমালে জমা হইবে।
উল্লেখিত রাষ্ট্রীয় আয়সমূহকে অপর এক দিক দিয়া আবর দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে:
(১) যেসব আয়ের ব্যয়-ক্ষেত্র কুরআনে নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
(২) এবং যেসব আয়ের ব্যয়-ক্ষেত্র নির্ধারণ ও পরিকল্পনা গ্রহণের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালকদের (পার্লামেন্টের) উপর ন্যস্ত করা হইয়াছে। (অবশ্য তাহাও কুরআন হাদীসের মুল ভাবধারা অনুযায়ী জনগণের কল্যাণ দৃষ্টিতেই নির্ধারণ করিতে হিইবে।)
এখঅনে ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের উল্লেখিত উপায়সমূহের বিশ্লেষণ করা যাইতেছে।
ভূমি-রাজস্ব
রাষ্ট্রের সকল প্রকার ভূমির ভোগ-ব্যবহারের বিনিময়ে রাষ্ট্র-সরকারকে যে কর দেওয়া হয়, তাহাকেই ভূমি রাজস্ব বলে। ইসলামী রাষ্ট্রের ভূমিকে প্রধানত দুইভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে- ওশরি জমি ও খারাজী জমি।
যে জমির মালিক মুসলমান, মুসলমানই যে জমি সর্ব প্রথম আবাদ ও চাষোপযোগী করিয়া তুলিয়াছে, মুসলমান যথারীতি অস্ত্র-প্রয়োগ করিয়া যে সব জমি দখল করিয়াছে, এবং যে জমির মালিক ইসলাম গ্রহণ করিয়াছে, কিংবা রাষ্ট্র সরকার যে জমি নাগরিককে চাষাবাদের জন্য দান করিয়াছে তাহা সবই ‘ওশরি জমি’ নামে অভিহিত হইবে। কিন্তু যে জমির মালিক অমুসলিম, অমুসলিমগণিই যে জমি আবাদ ও চাষোপযোগী করিয়া লইয়াছে অথবা ইসলামী রাষ্ট্র যেসব জমি অমুসলিমদের পাট্টা দিয়াছে এবং তাহাদের কবুলিয়ত লইয়া তাহাদিগকে চাষাবাদ করার জন্য হস্তান্তরিত করিয়া দিয়াছে তাহা সবই ‘খারাজী’ হইবে।
‘ওশর’ অর্থ এক-দশমাংশ, মুসলমানদের কর্ষিত জমির ফসলের এক-দশমাংশের অর্ধেক পরিমাণ কর বা রাজস্ব গ্রহণ করা হয় বলিয়া উহাকে ‘ওশর’ বলা হয়।
ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
হে ঈমানদারগণ, তোমদের নিজেদের উপার্জিত ধন-সম্পদ এবং ভূমির উৎপন্ন ফসল হইতে উত্তম ও উৎকৃষ্ট অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর।
এই আয়অতের প্রথম অংশ হইতে যাবতীয় নগদ ধন-সম্পদ এবং ভূমির উৎপন্ন ফসল হইতে উত্তম ও উৎকৃষ্ট অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর।
এই আয়াতের প্রথম অংশ হইতে যাবতীয় নগদ ধন-সম্পদ বা টাকা পয়সার যাকাত ফরয হয়। শেষাংশ হইতে ভুমি রাজস্ব বা ওশর দেওয়ার আদেশ প্রমাণিত হয়।
ভূীম রাজস্ব আদায় করার আদেশ নিম্নলিখিত আয়াতে অধিক সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে:
(আরবী************)
ফসল পাকিয়া গেলে তাহা খাও, ফসল কাটিবার দিন উহা হইতে আল্লাহর ‘হক’ আদায় কর এবং এই ব্যাপারে আল্লাহ নির্ধারিত সীমা লংঘন করিও না। কেননা আল্লাহ সীমা লংঘনকারীদের আদৌ ভালবাসেন না।
এখানে ‘হক’ অর্থ জমির ফসল ভোগ করার বিনিময়। ইহা আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট হইয়াছে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালে ইহা আদায় করিতে হইবে।
ওশর ও ওশরের অর্ধেক
নবী করীম (স) আল্লাহ তা’আলার উল্লিখিত আদেশ অনুযায়ী ও তাঁহার অনুমতিক্রমে মুসলমানদের ভোগাধিকৃত ভূমির রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন। তিনি ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী************)
যে জমি বৃষ্টি, ঝর্ণাধারা বা খালের পানিতে সিক্ত হয় কিংবা যাহা স্বতই সিক্ত থাকে তাহারা ফসলের এক-দশমাংশ এবং যে জমি যে কোন প্রকারের পানি সিঞ্চনে কৃত্রিমভাবে সিক্ত হয় তাহার বিশ ভাগের এক ভাগ ফসল ভূমির কর রূপে তে হইবে।
তিনি বিভিন্ন এলাকার শাসন কর্তা ও ভারপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীদের প্রতি এই পর্যায়ে যে ফরমান জারী করিয়াছিলেন, তাহা হইতেও মুসলমানদের ভূমি-রাজস্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান লাভ করা যায়।
হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা)-কে ইয়ামেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া নবী করীম (স) যে নিয়োগ-পত্র দিয়াছিলেন, তাহাতে লিখিত ছিল:
(আরবী**********)
মুসলমান জমি হইতে এক-দশমাংশ রাজস্ববাবদ আদায় করিবে, এর পরিমাণ ফসল সে জমি হিইতে গ্রহণ করা হইবে, তাহা বৃস্টি বা ঝর্ণার (স্বাভাবিক) পানিতে সিক্ত হয় কিনতু যে সব জমিতে স্বতন্ত্র ভাব পানি দিতে হয় তাহা হইতে এক দশমাংশের অর্ধেক- বিশ ভাগের এক ভাগ রাজস্ব বাবদ আদায় করিতে হইবে।[তারীখ-ই-তাবারী, ফতহুল বুলদান ৮১পৃঃ]
অনুরূপভাবে হেমিয়ার-এর রাজন্যবর্গের নিকট প্রেরিত ফরমানেও স্পস্ট ভাষায়া বলা হইয়াছিল:
আল্লাহ এবং তাহার রাসূলের আনুগত্য স্বীকার কর, নামায পড় যাকাত দাও, গণীমতের মাল হইতে এক-দশমাংশ আল্লাহ এবং তাহার রাসূলের জন্য আদায় কর। এতদ্ব্যতীত জমির রাজস্বও দিতে থাক। যে জমি বৃষ্টি বা ঝর্ণার পানিতে বিনা পরিশ্রমে ও অতিরিক্ত ব্যয় ব্যতীত সিক্ত হয়, তাহার এক দশমাংশ ফসল সেচ ব্যবস্থার সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে সিক্ত জমির বিশ ভাগের এক ভাগ ফসল ভূীম রাজস্ব বাবদ আদায় করিতে থাক।[তারীখ-ই-তাবারী, ফতহুল বুলদান ৮১পৃঃ]
নবী করীম (স) মুয়ায ইবন জাবাল (রা)-কে ইয়ামেনের ট্যাক্স কালেক্টর হিসাবে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইয়া ছিলেন এবং খেজুর, গম যব, আংগুর বা কিশমিশ হইতে দশমাংশ বা উহার অর্ধেক রাজস্ব বাবদ আদায় করিবার নির্দেশ দিয়াছিলেন। [ফতুহুল বুলদান ৮৩ পৃঃ] মধুর উপরও ওশর ধার্য হইবে। কেননা নবী করীম (স) সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বর্ণনা করিয়াছেন:
(আরবী************)
তিনি মধুর ওশর আদায় করিয়অছেন।
মুসলমানদের জমিকে পানি-সেচের দিক দিয়া দুই ভাগে ভাগ করা এবং তাহা হইতে রাজস্ব আদায় করার ব্যপারে উল্লিখিত রূপ পার্থক্যের কারণ দর্শাইতে গিয়া ফিকাহ্ শাস্ত্রবিদগণ বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
কারণ শেষোক্ত প্রকার জমিতে অধিক শ্রম নিয়োগ করিতে হয়; কিন্তু প্রথম প্রকার জমি বৃষ্টি বা ঝর্ণার পানিতে স্বাভাবিকভাবেই সিক্ত হয় বলিয়া উহাতে কম শ্রমের প্রয়োজন হয়।[(আরবী**********)]
এ সম্পর্কে ইমাত খাত্তামী লিখিয়াছেন: (আরবী*********)
যে জমিতে ফসল ফলাইতে শ্রম ও ব্যয় কম হয় এবং লাভ বেশী হয় তাহাতে নবী করীম (স) গরীবদের পাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্রে যাহাতে শ্রম বেশী হয় তাহার অপেক্ষা দ্বিগুণ ওশর নির্ধারত করিয়াছেন। এই শেষোক্ত ক্ষেত্রে জমির মালিকদের প্রতি অুগ্রহ দেখান হইয়াছে।
মোট কথা সকল প্রকার ভূমিজাত ফসল হইতেই জমির উল্লিখিত রূপ পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে এক-দশমাংশ কিংবা উহার অর্ধেক পরিমাণ ফসল রাজস্ব বাবদ ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল-এ রাখিতে হইবে। বাগান ও শষ্যক্ষেত্র- এতদুভয়ের মধ্যে রাজস্ব ধার্য হওয়া না হওয়ার দিক দিয়া কোনরূপ পার্থক্র করা চলে না এবং কোন প্রকার উৎপাদনশীল জমিকে রাজস্ব আদায়ের বাধ্য-বাধকতা হইতে নিষ্কৃতি দেওয়া যাইতে পারে না। কারণ নবী করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন:
(আরবী**********) জমি যাহাই উৎপাদন করিবে, তাহাতেই এক-দশমাংশ রাজস্ব ধার্য হইবে। [কিন্তু ইমাম আবূ ইউসুফ এই ব্যাপারে স্পষ্ট দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলিয়াছেন: আমার মতে ওশর কেবল সেসব ফসলের উপর ধার্য হইকেব যাহা লোকদের নিকট সঞ্চিত থাকিবে। যাহা সংরক্ষণ যোগ্য নয়- তাহাতে ওশর ধার্য হইবে না। আর যাহা সাধারণতঃ সঞ্চয় করিয়া রাখা হয় না তাহাতেও ওশর হইবে না। -কিতাবুল খারাজ
এই পর্যায়ে এই কথাও মনে রাখিতে হইবে যে, ওশর বা অর্ধেক ওশর আদায় করা প্রত্যেক মুসলিমের উৎপন্ন ফসলের উপর কার্যকর হইবে, তাহা জমি খারাজী হউক কি ওশরি। কুরআন, হাদীস, ফিকাহ ও খুলাফায়ে রাশেদুনের অনুসৃত নীতি হইতে ইহাই প্রমাণিত।]
খারাজ
উপরে বলা হইয়াছে, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের মালিকানা ও ভোগাধিকৃত জমি হইতে যে রাজস্ব আদায় করিতে হয়,তাহাকেই ‘খারাজ’ বলা হয়।[‘খারাজ’ ফার্সী শব্দ, আরবী ভাষায় বলা হয়, (****)- কিতাবুল আমওয়াল গ্রন্থ বলা হইয়াছে (আরবী**********)-“তাদের (অমুসলিমদের) ভূমির উপর ট্যাক্স ধার্য হইবে।” এই আরবী (****) কেহ ইংরেজীতে Task কিংবা Tax বলা হয়। কিন্তু ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হইয়াছে- ‘এই শব্দটি মূল আরবী ভাষায় Choregia শব্দ হইতে গৃহীত। ইহার অর্থ রাজস্ব।]
‘খারাজের’ পরিমাণ নির্ধারণ করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য। ইসলামী রাষ্ট্রকে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা বিশেষ সতর্কতার সহিত জরিপ ও গুণাগুণ নির্ণয় করাইয়অ-ই এই কাজ সম্পন্ন করিতে হইবে। হযরত উমর ফারূক (রা) ইরাক, সিরিয়া ও মিসরের বিশাল বিস্তৃত উর্বর ও শস্য-শ্যামল ভূমি বিজয়ী মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন না করিয়া উহার উপর মুসলমানদরে রাষ্ট্রীয় ও সামষ্টিক মালিকানা স্থাপিত করিয়াছিলেন। উহার চাষাবাদ করা সম্পর্কে তথাকার প্রাচীন কৃষকদের সহিত বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন এবং উহার ‘খারাজ’ নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন। কিন্তু খারাজ নির্দারণের পূর্বেই তিনি উসমান বিন হানীফ (রা)-কে এই সকল জমির জরিপ সংক্রান্ত যাবতীয জরুরী কার্য সম্পন্ন করার জন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন। কেননা উসমান ভূমি রাজস্ব- বিশেষতঃ খারাজ ধার্য করণ সম্পর্কে- বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
ফলে তিনি দীবাজ কাপড় পরিমাপ করার ন্যায় এই সকল জমির জরিপ করিয়াছিলেন।
অমুসলিমদের জমি হইতে খারাজ হিসাবে যে রাজস্ব আদায় হইবে, তাহা রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থ-ভাণ্ডপারে-বায়তুলমালে- জমা হইবে এবং দেশের সার্বিক প্রয়োজন পূরণ ও সার্বজনীন কল্যাণ ও উৎকর্ষ সাধনের কাজে ব্যয় করা হইবে। প্রসিদ্ধ ইসলামী অর্থনৈতিক গ্রন্থ ‘কিতাবুল খারাজে’ বলা হইয়াছে:
‘খারাজ’ সমগ্র মুসলমানের- ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সম্মিলিত সম্পদ।’
প্রথমতঃ খারাজ নির্ধারণের ব্যাপারে জমির গুণাগুণ, উর্বতরতার পার্থক্য, প্রয়োজনীয় চাষের পরিমাণ পার্থক্য, পানি সেচের আবশ্রকতা ও অনাবশ্যকতার পার্থক্যের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে, যেন জমির প্রকৃত গুণ অনুপাতেই রাজস্ব ধার্য হইতে পারে। অন্যথায় ভূমি মালিকের উপর অবিচার হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে। আবার প্রকৃত পরিমাণ অপেক্ষা রাজস্ব কম ধার্য হইলে তাহাতে সমষ্টির অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়া নিশ্চিত।
খারাজ এবং ওশরের মধ্যে যে পার্থক্য রহিয়াছে, সে সম্পর্কে সংক্ষেপে ইহাই বলা হয় যে, খারাজ জমি হইতে আদায় করা এবং ওশর আদায় করা হয় জমির উৎপন্ন ফসল হইতে। একাধিক সহোদর ভাইয়ের কোন ‘এজমালি’ জমি থাকিলে এবং তাহাতে সকলে নয়- কেহ কেহ ইসলামে দীক্ষিত হইলে- তখন ভূমি-রাজস্বও অনুরূপভাবে আদায় করিতে হইবে। অর্থাৎ মুসলমানের অংশ হইতে ওশর এবং অমুসলিমের অংশ হইতে খারাজ আদায় করিতে হইবে।
মুসলমানদের জমি হইতে ‘ওশর’ এবং অমুসলিমদের জমি হইতে ‘খারাজ’ আদায় করার ব্যাপারে কোনরূপ জোর-জুলুম, অবিচার কিংবা হিংসা-বিদ্বেষের প্রশ্রয় দেওয়া যাইতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম নাগরিকগণই প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার সার্বজনীন দায়িত্বের ভারপ্রাপ্ত হইয়া থাকে এবং সে জন্য তাহাদিগকে অন্যান্য দায়িত্ব ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পরিপূরণের উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণে- অমুসলিমদের অপেক্ষাও অনেক বেশী- অর্থ দানের দায়িত্ব পালন করিতে হয়। কাজেই জমির রাজস্বের দিক দিয়া সামান্য পার্থক্র হইলেও মোটামুটি মুসলমানকেই অধিক পরিমাণে অর্থ দান করিতে হয়।
দ্বিতীয়তঃ ‘ওশর’ কখনই এবং কোন অবস্থায়ই রহিত হইতে পারে না। উহার পরিমাণ চির-নির্দিষ্ট-হ্রাস-বৃদ্ধির বিন্দুমাত্র অবকাশও তাহাতে নাই। এমনকি স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান তাহা হইতে কাহাকেও নিষ্কৃতি দিতে পারেন না। কিন্তু প্রয়োজন হইলে উপযুক্ত কারণ থাকিলে- খারাজের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি করা, এমনকি অবস্থা বিশেষে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করিয়া দেওয়ারও রাষ্ট্রপ্রধানর পূর্ণ অধিকার রহিয়াছে।
তৃতীয়তঃ খারাজ বৎসরে একবার আদায় করা হয়, কিন্তু ওশর আদায় করা হয় প্রত্যেকটি ফসল হইতেই। বৎসরের মধ্যে যত প্রকারের ফসল যতবার ফলিবে, তত প্রকার ফসলের উপর ততবার ‘ওশর’ ফরয হইবে।
মুসলমানদের জমি হইতে যে ‘ওশর’ গ্রহণ করা হইবে; তাহা নিশ্চিতরূপে ফসল হইতে গ্রহণ করা হইবে। কিন্তু অমুসলিমদের নিকট হইতে রাজস্ব বাবদ যে খারাজ আদায় করা হইবে, তাহা ফসল কিংবা নগদ টাকা উভয়রূপেই আদায় করা হইদে পারে। খারাজ কিসে আদায় করা হইবে, তাহা নির্ধারণ করা ইসলমী রাষ্ট্রের কর্তব্র; যেমন কর্তব্য উহার পরিমাণ করা।
কিন্তু এ সম্পর্কে একটি সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করা এখানে বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। খারাজ বা ভূমিরাজস্ব ফসলে আদায় করিলে কৃষক বা ভূমি মালিকের পক্ষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা লাভ করা সম্ভব। কারণ তাহাতে ফসলের নির্দিষ্ট অংশ। কাজেই ফসল কম হউক বেশী হউক উহা হইতে ফসলের নির্দিষ্ট পরিমাণ আদায় করায় কৃষক বা ভূমি-মালিক বিশেষ কোন অসুবিধার সম্মুখীন হইতে হইবে না। কিন্তু খাজনা নগদ টাকায দিতে হয় বলিয়া তাহাতে কৃষক ও ভূমি-মালিকের বিশেষ অসুবিধা হওয়ার আশংকা রহিয়াছে। এই জন্য যে, কৃষক ও ভূমি-মালিককে রাজস্ব বাবদ দেয় টাকা জমির উৎপন্ন ফসল বিক্রয় করিয়াই সংগ্রহ করিতে হইবে। এমতাবস্থায় ফসল কম হইলে কিংবা শস্যের মূল্য হ্রাস পাইলে খাজনা বাবদ দেয় টাকা সংগ্রহ করা কঠিন ব্যাপর হইয়া দাঁড়াইবে। অতএব খারাজ আদায় কিসে করা হইবে, তাহা নির্মাণ করার পূর্বে এই দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা একান্ত আবশ্যক।
খারাজ আদায় করার ব্যাপারে খারাজ-দাতার প্রতি সহৃদয়তা প্রদর্শনের জন্য ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশ রহিয়াছে। হযরত উমর ফারূক (রা) এক ঘোষণায় বলিয়াছিলেন, ‘সরকারী কর্মচারীদিগকে জনগণের উপর জোর-জুলুম, অত্যাচার-নিষ্পেষণ চালাইবার জন্য কিংবা খাজনা ও বিবিধ প্রকার কর বাবদ তাহাদের যাবতীয় ধন-সম্পদ লুটিয়া লইবার জন্য কখনই প্রেরণ করা হয় না, তাহাদের প্রেরণ করা হয় দ্বীন-ইসলামের শিক্ষা প্রচারের জন্য- জনগণের জীবনকে সকল দিক দিয়া সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করিয়া তুলিবার জন্য। ইসলামের পতনযুগেও যে এই দিকে যথেষ্ট লক্ষ্য আরোপ করা হইত, ইতিহাস হইতে তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে। হাজ্জাজ বিন্ ইউসুফ তাঁহার শাসন-এলাকায় রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করিবার জন্য তদানীন্তন বাদশাহ আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের নিকট অনুমতি চাহিয়াছিলেন। উত্তরে বাদশাহ বলিয়াছিলেন: “সাধারণভাবে যাহা পাওয়া যায়, তাহাকেই যথেষ্ট মনে কর, যাহা সহজলভ্য নয়- যাহা লইতে জোর-জবরদস্তি করিতে হয়- তাহার লালসা করিও না। চাষী ও ভূমি মালিকদের জন্যও এমন পরিমাণ সম্পদ থাকিতে দাও যাহা দ্বারা তাহারা স্বচ্ছন্দে জীবন-যাপন করিতে সমর্থ হইবে।”
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্র যে, বাসগৃহ যে জমির উপর থাকিবে, উহার মালিক গরীব হইলে উহার খাজনা আদায় করা যাইবে না।
বিভিন্ন সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ
গণীমতের মাল, খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদ প্রভৃতির প্রত্যেকটি হইতে এক-পঞ্চমাংশ ইসরামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালে জমা করা হইবে।
কাফিরদরে সহিত যুদ্ধ করিয়া ইসলামী মুজাহিদগণ যে ধন-সম্পদ ও আসবাবপত্র লাভ করিয়া থাকে, ইসলামী পরিভাষায় উহাকে বলা হয় গনীমতের মাল (Booty)। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
তোমরা জানিয়া রাখ, গণীমতের যে কোন মাল তোমাদের হস্তগত হইবে, তাহার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর জন্য, রাসূলের জন্য, রাসূলের নিকটাত্মীয়দের জন্য এবং ইয়াতীম, অভাবী ও নিঃসম্বল পথিকদের জন্য।
অর্থাৎ কাফির ও মুশরিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া জয়লাভ করলে যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের যে সব ধন-সম্পদ, অস্ত্র-শস্ত্র যানবাহন ও খাদ্যসামগ্রী মুসলমানদের হস্তগত হইবে, উহার পাঁচ ভাগের চার ভাগ বিজয়ী মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করা হইবে, আর অবশিষ্ট এক-পঞ্চমাংশ ইয়াতীম, মিসকীন, অভাবী ও নিঃসম্বল পথিকদের মদ্যে বিরতণের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালে জমা করা হইবে।[ মনে রাখিতে হইবে যে, ইসলামের প্রথম দিকে মুজাহিদদের জন্য কোন নির্দিষ্ট বেতন ছিল না। এই জন্য গনীমতের মালের চার-পঞ্চমাংশই তাহাদের মধ্যে বন্টন করা হইত। বর্তমান যুগে যেখানে সৈনিকদের বেতন নির্দিষ্ট রহিয়াছে বা নির্দিষ্ট হওয়া অপরিহার্য হইয়া পড়িয়াছেসেখানে গণমতের মালতাহাদের মধ্যে বন্টন করার প্রয়োজন নাই। বরং এই সম্পদ সৈনিকদের বেতন বাবদ খরচ করার জন্য সরকারী কোষে নির্দিষ্ট রাখা হইবে।]
খনিজ সম্পদের ‘রয়ালটি’ বাবদ উহার এক-পঞ্চমাংশ বায়তুলমালে জমা হইবে। কোন কোন ইসলামী অর্থনীতিবিদের মতে উহার শতকরা চল্লিশভাগ রাষ্ট্রের প্রাপ্য হইবে। এই মতের সমর্থনে বলা যাইতে পারে যে, হযরত উমর বিন্ আবদুল আজীজ (রা) খনিজ সম্পদের শতকরা চল্লিশভাগ রাষ্ট্রীয় বায়তুলমালে গ্রহণ করিয়াছিলেন।[কিতাবুল আমওয়াল- আবূ উবাইদা ৩৩৯ পৃঃ]
কিন্তু আমাদের মতে ‘রয়ালটি’র পরিমাণ সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যাপর। সকল খনির অবস্থা একইরূপ নহে। সকলটির উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণও কখনো সমান হয় না। এতদ্ব্যতীত উৎপন্ন খনিজ দ্রব্যের রকম-ভেদের দরুন মূল্যের দিক দিয়াও যথেষ্ট পার্থক্র হইয়া থাকে। এমন কি খনিজ দ্রব্য উৎপাদনের ব্যয়ও সকল খনিতে সমান হয় না।কাজেই প্রত্যেকটি খনির ‘রয়ালটি’র কোন স্থায়ী পরিমাণ নির্ধারণ সম্ভব নহে। বরং উহার পরিমাণ নির্ধারণের ভার ইসলামী রাষ্ট্রের উপরই ন্যস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু খনিজ সম্পদ হইতে গৃহীত পরিমাণকে ‘যাকাত’ মনে করা হইবে কি গণীমত, সে সম্পর্কেও ইসলামী রাষ্ট্রই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারে।
ইসলামী অর্থনীতিকদের মতে খনির ‘রয়ালটি’ কৃষিজাত দ্রব্রের ন্যায় উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গেই আদায় বাঞ্ছনীয়। সে জন্য বৎসর সমাপ্তির অপেক্ষা করিতে হইবে না। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, রয়ালটি বাবদ খনিজ দ্রব্য কিংবা রয়ালটির পরিমাণের মূল্য- উভয়েল যে কোন একটি আদায় করা যাইতে পারিবে। বলা বাহুল্য, প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালকৈ এই খনিজ সম্পদই বিপুলভাবে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী করিয়া তুলিয়াছিল। ইমাম আবূ ইউসুফ লিখিয়াছেন:
(আরবী**********)
এইভাবে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ ও সীসা-দস্তা প্রভৃতির যাবতীয় খনিজ সম্পদ হইতে (এক-পঞ্চমাংশ) রাজস্ব আদায় করিতে হইবে।
খনিজ সম্পদের ন্যায় ‘রোকাজ’ –‘ভূগর্ভ হইতে প্রাপ্ত ধন’ –হইতেও ইসলামী রাষ্ট্রের যথেষ্ট আয় হইতে পারে। এ সম্পর্কে নবী করীম (স) বলিয়াছেন: (আরবী**********) ‘রোকাজ বা ভূগর্ভ হইতে প্রাপ্ত সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রীয় বায়তুলমালে জমা হইবে’। (কিতাবুল আমওয়াল ৩৩৬ পৃঃ) ইমাম আবূ ইউসুফ লিখিয়াছেন:
(আরবী**********)
সমুদ্র হইতে যেসব সম্পদ লব্ধ হইবে তাহা হইতেও গণীমতের মালের মতই রাজস্ব গ্রহণ করিতে হইবে।
একাধিকারভুক্ত ব্যবসায়ের রাজস্ব
ইসলামী রাষ্ট্র ন্যায়-নিষ্ঠার সহি কাহাকেও বিশেষ কোন ব্যবসায় বা শিল্পকর্মের (Industries) একচেটিয়া অধিকার দান করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিলে তাহা কার্যকর করিতে পারিবে, ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে ইহা নিষিদ্ধ হওয়ার কোন কারণ নাই। কিন্তু তাহাতে সাধারণভাবে জনগণের কোনরূপ অসুবিধার সৃষ্টি হইলে যে এইরূপ একচেটিয়া অধিকার দান সঙ্গত হইবে না, তাহা বলাই বাহুল্য। হযরত নবী করীম (স) তায়েফ ইত্যাদি এলাকায় কোন কোন লোককে মধুমক্ষিকা পালন ও মধু উৎপাদন শিল্পের একচেটিা উপত্যকা নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। সেইসব উপত্যকায় অন্য কাহারো কিছু করিবার অধিকার ছিল না। সংশ্লিষ্ট শিল্প মালিকগণ উৎপনট্ন পণ্যের এক-দশমাংশ রাজস্ব বাবদ বায়তুলমালে জমা করিত। কারণ হযরত নবী করীম (স) বলিয়াছেন (আরবী**********) ‘মধুতেও ওমর (এক-পঞ্চমাংশ রাজস্ব বাবদ) ধার্য হইবে। হযরত উমর ফারূক(রা)-এর খিলাফতকালে এইসব একচেটিয়া শিল্প সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করা হয়। তখন আমীরুল মু’মিনীন এক ফরমানে বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
তাহারা নবী করীমের জীবদ্দশায় রাজস্ব বাবদ যাহা দিত, আজও তাহাই রীতিমত আদায় কর। তবে সংশ্লিষ্ট উপত্যকা তাহাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকিবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট উপত্যকা ফেরত লওয়া হইবে। কেননা মধু মৌমাছির ফসল। যাহার-ই-ইচ্ছা উহা খাইবে।
অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগ্রত হয় যে, এইরূপ একচেটিয়া শিল্প-ব্যবসায়ের সুযোগ ইসলামী সমাজে ধন-বন্টনের ক্ষেত্রে বিরাট বৈষম্যের সৃষ্টি করিবে না কি?…. এই সম্পর্কে অধ্যাপক বেন্হাম-এর নিম্ন লিখিত উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলিয়াছেন:
একচেটিয়অ শিল্প ব্যবসায় ধন-বন্টনে অসাম্য ও বৈষম্য সৃষ্টি করে বলিয়া সাধারণতঃ মনে করা হয়; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই আশংকা অনেক সময় বাস্তব না-ও হইতে পারে। [বেনহাম-কৃত ইকনমিকস-২২৫৬ পৃঃ]
বস্তুত বাহ্যদৃষ্টিতে ‘মনোপলি’ ব্যবসায়ে পুঁজিবাদ সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকিলেও তাহা কেবলমাত্র অনৈসলামিক সমাজেই থাকিতে পারে। ইসলামী সমাজে ‘মনোপলি’ ব্যবসায়েও কোন প্রকার পুঁজিবাদ সৃষ্টির সম্ভাবনা নাই।
তাহার কারণ এই যে, প্রথমতঃ এইরূপ ব্যবসায়ের উৎপন্ন দ্রব্যের এক-দশমাংশ রাজস্ব বাবদ রাষ্ট্রীয় বায়তলমালে বাধ্যতামূলক জমা করিতে হইবে। ইহাতেই পুঁজিবাদের মেরুদণ্ড চূর্ণ হইয়া যাইবে। এতদসত্ত্বেও কাহারো নিকট অধিক পরিমাণ পুঁজি জমা হইলে তাহার যাকাত, সদকা, ইত্যাদি আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য হইবে। ফলে একজনের চেষ্টা, শ্রম ও তত্ত্বাবধানে সঞ্চিত পুঁজি বহুজনের জন্য অন্য কথায় সমগ্র দেশের জনসমষ্টির সাধারণ কল্যাণে- ব্যয়িত হইবে। বস্তুত এই সুনিয়ন্ত্রিত পুঁজির সমাবেশে কাহারোই আপত্তি হইতে পারে না। কারণ, ধন-সম্পদের এইরূপ সমাবেশকে রাজবাড়ীর রিজার্ভ ট্যাংকের সহিত নয়- পর্বত নির্ঝরের নিরন্তন পানি নিস্কাশনের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে।
বন-সম্পদ আয়
ইসলামী রাজ্রের বন-সম্পদ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির আমদানীর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য উপায়। ইহা সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীন থাকিবে এবং উহার যাবতীয় আয় রাষ্ট্রীয় বায়তুলমালে জমা হইবে।
সামুদ্রিক সম্পদের আয়
সকল প্রকর সামুদ্রিক সম্পদ ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম উপায়। সামুদ্রিক সম্পদ-বিশেষ করিয়া মৎস্য, মুক্তা ও সুক্তি- উৎপাদনের উপর কর ধার্য হইতে পারে। হযরত উমর (রা) সামুদ্রিক সম্পদের উপর কর ধার্য করা এবং তাহা যথাযথভাবে সংগ্রহ করার জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী নিযুক্ত করিয়াছিলেন। কোন এক কর্মচারীর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলিয়াছিলেন: ‘সমুদ্র হইতে উৎপন্ন সকল দ্রব্য হইতেই রাজস্য বাবদ এক-পঞ্চমাংশ আদায় করিতে হইবে। কারণ, ইহাও আল্লাহ তা’আলারই একটি দান, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আক্কাস (রা)-ও এই মতই প্রচার করিয়াছেন। নদী, ঝিল, বিল ইত্যাদি হইতে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণে যে মৎস্য উৎপাদন হইবে তাহারও এক-পঞ্চমাংশ ইসলমী রাষ্ট্রের বায়তুলমালের প্রাপ্য হইবে। হযরত আলী (রা) কার্যত: ইহার সূত্রপাত করিয়াছিলেন। হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের মতেও জলভাগ হইতে যাহা কিছু উৎপন্ন হইবে, তাহা হইতেও রাজস্ব আদায় করিতে হইবে। কারণ তাহা স্থলভাগের কনিজ সম্পদেরই সমতুল্য। হযরত উমর (রা) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
মহান আল্লাহ তা’আলা সমুদ্র হইতে যাহা উৎপাদন করিয়াছেন, তাহা হইতে এক-পঞ্চমাংশ রাজস্ব বাবদ দিতে হইবে। [কিতাবূল খারাজ- আবূ ইউসুফ (৭০ পৃঃ) এ পর্যায়ে ইমাম আবূ হানীফা (র) যদিও ভিন্নমত পোষন করিতেন, কিন্তু তাঁহার-ই প্রধান শাগরিদ ইমাম আবূ ইউসুফ হযরত উমর ফারূকের উদ্ধৃত ঘোষণার ভিত্তিতে সে মত মানিয়া লইতে অস্বীকার করিয়াছেন। হযরত উমর ফারূক (রা) ইয়ালা ইবন উমাইয়াকে যে ফরমান লিখিয়া দিয়াছিলেন তাহাতে সমগ্র সম্পদকে(আরবী**********) ‘আল্লাহর অপরিমেয় দানের মধ্যে ইহাও একটি দান’ বলিয়া অভিহিত করিয়াভেন। (ঐ ৭০ পৃঃ)]
মালিকবিহীন সম্পদ
ইসরামী রাষ্ট্র সমগ্র দেশের প্রতিনিধিস্থানীয়- আল্লাহ এবং রাজ্রের জনগণের খলীফা। অতএব দেশের যে সব ধন-সম্পদের বস্তুতই কেহ মালিক বা উত্তরাধিকারী থাকিবে না, তাহার মালিক হইবে ইসলামী রাষ্ট্র। বায়তুলমালেই তাহা জমা করিতে হইবে এবং রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেই তাহা ব্যয় করা হইবে। হযরত উমর ফারূক (রা) মিসরের শাসনকর্তার এক প্রশ্নের জওয়াবে বলিাছেন, ‘মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী থাকিলে পরিত্যক্ত সম্পত্তি তাহাদের মধ্যেই বন্টন করা হইবে। আর যাহার কোন ওয়ারিস নাই তাহার যাবতীয় ধন-সম্পত্তি বায়তুলমালে জমা হইবে। নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
যাহার কোন উত্তরাধিকারী নাই, তাহার উত্তরাধিকারী আমি। আমি-ই তাহার ত্যাক্ত সম্পত্তি পাইব এবং তাহার তরফ হইতে দায়িত্ব পালন করিব।
বস্তুত নবী করীম (স) রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবেই এই কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন। হযরত উমর ফারূক (রা)-ও এইরূপ নির্দেশদিয়া বলিয়াছিলেন:
(আরবী**********)
যাহাদের উত্তরাধিকারী থাকিবে, মৃতের ধন-সম্পত্তি তাহার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন কর। আর যাহার উত্তরাধিকারীরূপে পাশ্চোতে কেহ নাই, তাহারধন-সম্পদ মুসলমানে বায়তুলমালেমা করিয়া দাও।
মুর্তাদ- ইসলামত্যাগী ব্যক্তির সম্পত্তিও সরকারে বাজেয়াফত হইবে। যেসব পড়িয়া থাকার মাল কোথাও পাওয়া যাইবে এবং যাহার মালিক খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না, তাহাও অনুরূপভাবে বায়তুলমালে শামিল হইবে।
মুদ্রাশিল্প হইতেও ইসলমী রাষ্ট্রের যথেষ্ট আয় হইতে পারে। টাকশালের শ্রমিকদের মজুরী এবং অন্যান্য খরচাদি ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে তাহা ব্যয় করা হইবে।
যাকাত ও সাদকা
সমাজে ধন-সম্পদের আবর্তন ও বিস্তার সাধনের উদ্দেশ্যেই ধনীদের উপর যাকাত ফরয করা হইয়াছে। দরদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে ইহা বন্টন করা হইবে। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
যাকাত মুসলিম সমাজের ধনীদের নিকট হইতে আদায় করা হইবে এবং সেই সমাজেরই গরীবদের মধ্যে তাহা বন্টন করা হইবে।
বস্তুত সকল প্রকার বর্ধিষ্ণু বা পরিবর্ধনযোগ্য সম্পদের উপরই যাকাত ধার্য হইবে। ইহার লক্ষ্য হইতেছে যুগপৎভাবে ধনীর হৃদয় ও তাহার ধন-মালের পরিশুদ্ধি। আর যাকাত সঠিক ভাবে আদায় করিলে যে এই উদ্দেশ্য পুরাপুরিভাবেই বাস্তবায়িত হইতে পারে। তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়।
যাকাত ধার্যযোগ্য সম্পদ প্রধানত দুই প্রকার। প্রথম, সাধারণ প্রকাশ্য সম্পদ, যথা- গরু, ছাগল, উট প্রভৃতি গৃহপালিত পশু। যাকাত আদায়কারী কর্মচারীগণ প্রকাশ্যভাবেই উহাদের যাঁচাই করিতে পারে। দ্বিতীয়, অপ্রকাশিত সম্পদ, যথা- স্বর্ণ, রৌপ্য বা টাকা ও ব্যবসায়পণ্য।
ব্যবসায়-পণ্যের যাকাত ফরয হওয়ার প্রমানস্বরূপ নিম্নলিখিত হাদীসটি উল্লেখযোগ্য:
(আরবী**********)
সামুরা বিন জুন্দুব হইতে বর্ণিত হইয়াছে- তিনি বলিয়াছেন যে, হযরত নবী করীম (স) আমাদিগকে বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুতকৃত দ্রব্যাদি হইতে যাকাত আদায় করার নির্দেশ দিতেছিলেন।
ইমাম শাওকানী লিখিয়াছেন: (আরবী**********)
ব্যবসায় পণ্যের যাকাত দেওয়া যে ফরয, তাহা ইসরামের ইজমা’র দলীল দ্বরা প্রমাণিত।
বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্রে পালিত পশুর উপর যাকাত ফরয হইবে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা পর্যন্ত পৌঁছিলে। যমন- বিশটি গরুর মধ্যে একটি যাকাত বাবদ আদায় করিতে হইবে। আর ব্যবসায়ের জন্য পালিত হইলে ব্যবসায়ের পণ্য হিসাবে মোট মূল্যেল শতকরা আড়াই টাকা (৪০ ভাগের এক ভাগ) যাকাত আদায় করিতে হইবে। এই উভয়বিধ দ্রব্য-সম্পদের যাকাত আদায় করার জন্য পূর্ণ একটি বৎসর অতিবাহিত হইতে হইবে। কেননা নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
মালিকের মালিকানাধীন কোন সম্পদের পূর্ণ এক বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে উহার উপরকখনো যাকাত ধার্য হইবে না।
স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ টাকা, ব্যবসায়-পণ্য ও কারখানায় উৎপন্ন দ্রব্যের উপর যাকাত ফরয হওয়ার নিম্নতম পরিমাণ সাড়ে ৫২ তোলা। অলংকারে ব্যবহৃত স্বর্ণ বা রৌপ্যেও উক্ত হিসাব অনুসারে যাকাত ফরয হইবে। নবী করীম(স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
রৌপ্যে শতকরা আড়াই টাকা (শতকরা এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ- অর্থাৎ আড়াই টাকা) ধার্য হয়। ইহার কম পরিমাণ হইলে তাহতে কোন যাকাত নাই।
ফকীহ আল-কাসানী লিখিয়াছেন: (আরবী**********)
ব্যবসায় পণ্যে যাকাতযোগ্য পরিমাণ নির্ধারণ করা হইবে উহার আর্থিক মূল্য অনুযায়ী টাকা ভিত্তিতে। তাই যাহার মুল্য দুইশ’ বিশ মিসকাল স্বর্ণ পরিমাণ হইবে না, উহাতে যাকাত ধার্য হইবে না। এই পরিমাণ হইলে তাহাতে অবশ্য যাকাত ধার্য হইবে। সর্বসাধারণ আলিম এই মতই পোষণ করেন।
নবী করীম (স) বলিয়াছেন: (আরবী**********)
মুসলিম নারীদেরকে তাহাদের অলংকারর যাকাত আদায় করার নির্দেশও দাও।
ধাব মুদ্রা ও কাগজের নোট উভয়েল উপর যাকাত ফরয হইবে। কারণ, এই উভয় প্রকার মুদ্রারই সমান পরিমাণ ক্রয়-ক্ষমতা বিদ্যমান। ব্যাংকে গচ্ছিত টাকায়ও এক বৎসরান্তে যাকাত ফরয হইবে। অন্যান্য রেজিষ্ট্রীকৃত প্রতিষ্ঠানে গচ্ছিত টাকায়ও অনুরূপভাবে যাকাত ফরত হইবে।
বৈদেশিক মুদ্রাকে দেশীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করা সহজ হইলে তাহা নিঃসন্দেহে নগদ টাকার সমতুল্য। অতএব তাহা হইতেও যাকাত আদায় করিতে হইবে, কিংবা তাহাতে যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণের স্বর্ণ-রৌপ্য থাকিলে উহার উপরও যাকাত ধার্য হইবে।
(১) ওর্য়া ইবনে জুবাইর, সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যেব ও কাসেম প্রমুখ মণীষী বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
এই যাকাত প্রতি বৎসরই আবর্তিত হইবে এবং পরবর্তী বৎসরের সেই নির্দিষ্ট মাস- যে মাসে একবার যাকাত দেওয়া হইয়াছে- না আসা পর্যন্ত যাকাত আদায় করা যাইবে না।
যাকাত সম্পর্কে নীতিগতভাবে মনে রাখা দরকার যে, ইহা কোন ট্যাক্স নয়- মূলত, ইহা অর্থনৈতিক ইবাদত মাত্র। ট্যাক্স ও ইবাদতের মৌলিক দারণা ও নৈতিক ভাবধারার দিক দিয়া উভয়েল মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রহিয়াছে। কাজেই যাকাতকে কোন দিনই যেন ট্যাক্স মনে না করা হয় সেদিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা ইসলামী জনতার অন্যতম দায়িত্ব।
যাকাতকে রাষ্ট্রীয় আয় হিসাবে গণ্য করার কারণেও কাহারো মনে উক্ত ধারণা সৃষ্টি হওয়া উচিত নয়। কেননা, মুসরমানদের সকল প্রকার সমষ্টিগত ইবাদাত-বন্দেগীর নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার ও সুষ্ঠুতা বিধানের উদ্দেশ্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইসলামী রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব বলিয়া অর্থনৈতিক ইবাদাত- যাকাত-আদায়কেও উহারই একটি খাত হিসাবে গণ্য করা হইয়াছে মাত্র। প্রসঙ্গত স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, যাকাতের যে হার নবী করীম (স) ইসলামী শরীয়তের বিধানদাতা হিসাবে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী নির্দিষ্ট করিয়াছেন, তাহাতেও বিন্দুমাত্র পরিবর্তনস ও পরিবর্ধন করার কাহারো ক্ষমতা নাই। আর অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে যাঁচাই করিলে উহার অপ্রয়োজনীয়তাও সমপ্রমাণিত হয়। কারণ, অভাবগ্রস্ত নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধান সংক্রান্ত রাষ্ট্রের সকল দায়িত্ব পালনের জন্য শুধু যাকাতের অর্থ যথেষ্ট না হইলে স্বতন্ত্রভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করা যাইতে পারে। কাজেই প্রয়োজনের তুলনায় যাকাতের হার স্বল্প মনে করিয়া উহাতে হ্রাস-বৃদ্ধি করা আল্লাহর শরীয়তের উপর হস্তক্ষেপ এবং বড় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। ইসলামী অর্থনীতিতে সেই জন্য এই মূলনীতি সর্বজনস্বীকৃত হইয়া রহিয়াছে।
(আরবী**********) তোমার ধন-সম্পদে যাকাত ছাড়াও (সমাজের) অধিকার রহিয়াছে।
সাদকায়ে ফিতর
রমযান মাসান্তে ঈদের দিন প্রত্রেক ধনী ব্যক্তি গরীবদের মধ্যে যে শস্য কিংবা উহার মুল্য রোযার ফিত্র বাবদ বন্টন করে, উহার নাম সাদকায়ে ফিতর। এই সাদকা প্রত্যেক ধনী ব্যক্তি তাহার পরিবারের সকল সদস্যের পক্ষ হইতে আদায় করিতে বাধ্য। ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে ইহাকেও রাষ্ট্রীয় আয় হিসাবে গণ্য করা হইয়াছে। ইমাম বুখরী (র) লিখিয়াছেন- ‘ইসলামী খিলাফতের যুগে এই সাদকাও বায়তুল মালে জমা করা হইত এবং তথা হইতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনুযায়ী এলাকার গরীবদের মধ্যে উহা বন্টন করা হইত।’
জিজিয়অ কর
ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত অমুসলিম বাসিন্দাদের নিকট হইতে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য নির্দিষ্ট পরিমণে একটি বিশেষ কর গ্রহণ করা হইবে। ইসলামের অর্থনৈতিক পরিভাষায় ইহাকে ‘জিজিয়া কর’ বলা হয়। ‘জিজিয়া’ অর্থ ‘বিনিময়’ রাষ্ট্র প্রজা-সাধারণের রক্ষণাবেক্ষণেরযে দায়িত্ব গ্রহণ করে, তাহাদিগকে যে নিরাপত্তা দান করে, রাষ্ট্র তাহারিই বিনিময়ে প্রয়েঅজন পরিমাণে কর আদায় করার অধিকার লাভ করিয়া থাকে। ‘জিজিয়া’ অনুরূপ একটি কর। কুরআন মজীদে নিম্নোদ্ধৃত আয়অতে এই কথাই বলা হইয়াছে: (আরবী**********)
যতক্ষণ পর্যন্ত না তাহারা অধীনতা ও রাষ্ট্রের স্বীকার করিয়া ‘জিজিয়া’ দিতে প্রস্তুত হইবে।
অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন অমুসলিম প্রজাদের প্রধানত দুইটি কর্তব্য রহিয়াছে। প্রথম, রাষ্ট্রের পূর্ণ আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করা এবং দ্বিতীয়, রাষ্ট্রীয় কার্যপরিচালনার আর্থিক প্রয়োজন পূরণের জন্য সাধ্যানুসারে অর্থ দান করা।
জিজিয়া অর্থনৈতিক মূল্য
‘জিজিয়া’ সম্পর্কে যত প্রশ্নই উত্থাপিত হউক না কেন উহার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যৌক্তিকতা এবং মূল্য অনস্বীকার্য। প্রথমতঃ রাষ্ট্র-সরকার দেশের সর্বাপেক্ষা সুসংগঠিত ও বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান। সমগ্র দেশের রক্ষণাবেক্ষণের, জীবিকা পরিবেশন ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানরই উপরই অর্পিত হইয়া থাকে। অতএব ইহার আর্থিক প্রয়োজন সর্বাধিক, তীব্রতর ও অপরিহার্য।
দ্বিতীয়তঃ ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে দেশরক্ষা ও যুদ্ধসংক্রান্ত কাজের নীতিগত ও মূলগত দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় আদর্শে বিশ্বাসী (মুসলিম) নাগরিকদের উপর ন্যস্ত হয়, -তাহাতে অবিশ্বাসী লোকদের (অমুসলিমদের) উপর নহে। রাষ্ট্রের উপর কোন বহিরাক্রমণ হইলে দেশরক্ষা কাজের জন্য সর্বতোভাবে ঝাঁপাইয়া পড়া দেশের সমগ্র মুসলিমদের ধর্মীয় ফরয বিশেষ, কিন্তু অমুসলিমদের অবস্থা অনুরূপ নহে।
এই জন্য ইসলামী রাষ্ট্র তাহাদের নিকট হইতে দেশরক্ষা খাতে একটি বিশেষ কর আদায় করার নীতি অবলম্বন করিয়াছেন। এই হিসাবে এই ব্যবস্থাকে ‘সুবিচারপূর্ণ কর্মবন্টন’ বলা যাইতে পারে। কারণ, ইহার ফলে দেশরক্ষায় ব্যাপকহারে মুসলীমগণ জনশক্তি (Man Power) সরবরাহ করিবে, আর দেশের অমুসলিমগণ করিবে আর্থিক প্রয়োজন পূরণ। ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিগত আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে উহার রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে এইরূপ নীতি অবলম্বন- আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের প্রধান দায়িত্ব উক্ত আদর্শের বিশ্বাসীদের উপর ন্যস্তকরণ- এক বিজ্ঞানসম্মত ও সুবিচারমূলক ব্যবস্থা তাহা কেহই অস্বীকার করিতে পারে না। যেহেতু আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণ ও আক্রমণ-প্রতিরোধের ব্যাপারেও উক্ত আদর্শের পূল্ণ অনুসরণে অপরিহার্য এবং এই কাজ রাষ্ট্রীয় আদর্শে বিশ্বাসী লোকদের দ্বারাই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হইতে পারে। বস্তত ইসলামী রাষ্ট্রের দেশরক্ষা সংক্রান্ত কাজে ঝাঁপাইয়অ পরার মৌলিক দায়িত্ব আদর্শে বিশ্বাসীদের উপর ন্যস্ত করা এবং সে জন্য আর্থিক প্রয়োজন পূরণের প্রধান দায়িত্ব আদর্শে অবিশ্বাসীদের উপর অর্পণ করার মূলে কোন পক্ষপাতমূলক বা বৈষম্যমূলক ভূমিকা বর্তামন নাই।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, এইরূপ করার নাম ‘জিজিয়া’ই রাখিতে হইবে, ইসলামী অর্থনীতিতে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই। অমুসলিমগণ ইচ্ছা করিলে ইহার পরিবর্তে মুসলিমদের ন্যায় যাকাত দেওয়ার প্রথাও চালু করিতে পারে। ‘জিজিয়া’ কিংবা অনুরূপ অর্থ কেবল সেসব লোকের নিকট হইতে আদায় করা হইবে, সাধারণতঃ যাহাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা আছে এবং সেই সঙ্গে এইরূপ অর্থদানের সামর্থ্যও রহিয়াছে। পক্ষান্তরে যাহাদের অনরূপ ক্ষমতা নাই- যেমন স্ত্রীলোক, শিশু, অক্ষম বৃদ্ধ, পাগল, অন্ধ ও পংগু লোক কিংবা যাহারা নীতিগতভাবে যুদ্ধ বিমুখ বা যুদ্ধবিরোধী যথা পাদ্রী, পুজারী, ঠাকুর, গৃহত্যাগী বৈষ্ণব, বৈরাগী প্রভৃতি- তাহাদের উপর এই ধরনের কোন কর-ই ধার্য হইবে না।
বস্তুত সকল প্রকার ধনী মুসলমানের উপরই যাকাত আদায় করা যখন ফরয তখন অমুসলিমদের উপর একমাত্র ‘জিজিয়া’ কর আদায়ের নীতি প্রয়োগে তাহাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হয় নাই, তাহা অতি সহজেই বোধগম্য হইতে পারে।
জিজিয়া যে অমুসলিমরে সর্ববিধ রক্ষণাবেক্ষণের বিনিময়ে গ্রহণ করা হয়, তাহার একটি প্রকাশ্য প্রমাণ এই যে, ইসলামী রাষ্ট্র যদি কখনো এই দায়িত্ব পালন করিতে অক্ষম হয় তবে ইহা তাহাদের নিকট হইতে মোটেই গ্রহণ করা হয় না, আর একবার গ্রহণ করা হইয়া থাকিলেও তাহা প্রত্যার্পণ করা হয়। [তারীখ-ই-তাবারী ১২ হিজরী সনের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণীয়।]
জিজিয়ার পরিমাণ নর্ধারণের কাজ রাষ্ট্র-সরকার ও অমুসলিম সংখ্যালঘুদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন করাই সঠিক ইসলামী পন্থা। প্রত্যেক ধনশালী উপার্জনশীল ব্যক্তির আর্ধিক সামর্থ্য ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন- এই উভয় দিকে লক্ষ্য রাখিয়াই তাহা করিতে হইবে এবং এই ব্যাপারে দাতা ও গৃহীতা- কাহারো প্রতি বিন্দুমাত্র অবিার না হয সেদিকে উভয়কেই তীক্ষ্ণ ও সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইবে।
জিজিয়া সাধারণতঃ টাকায় আদায় করা হইবে। কিন্তু পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বিশেষ কোন শিল্পপণ্যের আকারেও তাহা আদায় করা অসংগত হইবে না। নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুন বিভিন্ন শিল্পোৎপাদনকারীদের নিকট হইতে জিজিয়া বাবদ শিল্পপণ্যও গ্রহণ করিয়অছেন। [আল-আহকামুস-সুলতানিয়অ, কিতাবুল আমওয়াল ও কিতাবুল খারাজ দ্রষ্টব্য। (আরবী***********)] ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম লিখিয়াছেন:
(আরবী***********)
জিজিয়ার পরিমাণ কি হইবে এবং কিসের মাধ্যমে তাহা আদায় করা হইবে, শরীয়তে তাহা পূর্ব নির্ধারিত নহে।
ইমাম আবু ইউসুফ লিখিয়াছেন: (আরবী***********)
জিজিয়া কেবলমাত্র সক্ষম পুরুষদের উপরই উহা ধার্য হইবে, স্ত্রী ও শিশু বালক ইত্যাদি অক্ষম ও সামর্থহীনদের উপর তাহা ধার্য হইবে না। (কিাতাবুল খারাজ , ১১২পৃঃ)
তিনি আরো লিখিয়াছেন: ‘দান গ্রহণযোগ্র গরীব-মিসকীন, আয়-উপার্জনহীন অন্ধ ও ভিক্ষাবৃত্তি-নির্ভর অমুসলিমের উপরও জিজিয়া ধার্য হইবে না। (ঐ) বলা বাহুল্য, জিজিয়া বৎসরে মাত্র একবারই আদায করা হইবে, তাহার অধিক নহে। এই ব্যাপারে নবী করীম (স)-এর নিম্নলিখিত বাণীটি চূড়ান্ত ঘোষণা হিসাবে মানিয়া লইতে হইবে:
(আরবী***********)
যে ব্যক্তি কোন ‘চুক্তিবদ্ধ জাকিত’ (অমুসলিম সংখ্যালঘুর ) প্রতি জুলুম করিবে কিংবা তাহাদের সামর্থ্যের অধিক কোন কাজের বোঝা তাহাদের উপর চাপাইয়া দিবে, (কিয়ামতের দিন) আমিই তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করিব এবং প্রতিবাদী হইব।[কিতাবুল খারাজ- আবু ইউসুফ: ৩২৫ পৃঃ)
হযরত উমর ফারূক (রা)ইন্তিকালের পূর্ব মুহূর্তে ইহারই ভিত্তিতে বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
আমার পর যিনি খলীফা পদে বরিত হইবেন তাঁহাকে আমি অসিয়ত করিতেছি, তিনি যেন রাসূলের গৃহীত দায়িত্ব পূর্ণমাত্রায় পালন-করেন, যিম্মীদের সহিত করা সব ওয়াদা যথাযথভাবে পূরণ করেন। তাহাদের পক্ষ হইতে প্রয়োজন হইলে যেন যুদ্ধ করেন এবং তাহাদের শক্তি ও সামর্থের অধিক কোন কাজের দায়িত্বযেন তাহাদের উপর চাপাইয়া না দেন। (কিতাবুল খারাজ-আবূ ইউসুফ, ১২৫ পৃঃ)
আমদানী শুল্ক
প্রত্যেক রাষ্ট্রই নিজ দেশের শিল্প-বাণিজ্যের উৎকর্ষ সাধন এবং বৈদেশিক শিল্পপণ্যের আমদানীর প্রতিরোধ করিবার চেষ্টা করিতে বাধ্য। ইসলামী রাষ্ট্রকেও এজন্য সর্বপ্রথম বৈদেশিক পণ্য আমাদানী নিয়ন্ত্রণ করিতে এবং উহার উপর শুল্ক ধার্য করিতে হইবে। অনুরূপভাবে বৈদেশীক রাষ্ট্রে যেসব নাগরিক ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন থাকিয়া ব্যবসায়-বাণিজ্য করিবে, তাহাদের উপরও এই শুল্ক ধার্য হইবে। কারণ তাহাদের জানমাল ও স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের উপর অর্পিত এবং এই দায়িত্ব পালনের বিনিময় কিংবা এই কাজের প্রয়োজনীয় অর্থ-সংস্থানের জন্য তাহাকে অবশ্যই শুল্ক আদায় করিতে হইবে। ইসলামের ইতিহাসে হযরত উমর ফারূক (রা)-এর সময়ই এই শুল্ক সর্বপ্রথম ধার্য হইয়াছিল। [কিতাবুল আমওয়াল, আবূ উবাইদ, ৪:৫ পৃঃ, কিতাবুল খারাজ আবূ ইউসুফ: ১৩৫ পৃঃ] বস্তুত এই শুল্ক প্রদান করিয়াই বিদেশী নাগরিকগণ ইসলামী রাজ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও জান-মালের পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করিতে পারে।
আমদানী শুল্কের পরিমাণ
বলা বাহুল্য, ব্যবসায়ী তাহার ব্যবসায়পণ্যের যে শুল্ক আদায় করে, তাহা তাহাদের নিজ পকেট হইতে কখনও আদায় করে না, আদায করে ক্রেতার পক্ষ হইতে কারণ উহপর পণ্যের আসল মূল্যের উপর চাপাইয়অ দেওয়া হয় এবং সাধারণ ক্রেতাগণই তাহা আদায় করিয়া থাকে। এইভাবে বৈদেশিক ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে তাহা আদায না করিলে তাহাদের পণ্যের মুল্য অপেক্ষাকৃত কম হইবে। পরিমাণে তাহাদর পণ্য অবিলম্বে বিক্রয় হইয়া যাইবে; কিন্তু বৈদেশিক পণ্যেল মূল্য বেশী হওয়ার কারণে তাহা সহজে বিক্রয় হইবে না। তখন তাহাকে বাধ্য হইয়া পণ্যমূল্য হ্রাস করিয়া দেশীয় শিল্পের সমানস্তরের মুল্য ধার্য করিতে হইবে। অন্যথায় তাহার পণ্য অবিক্রিতই থাকিয়া যাইবে। এই জন্র যে, একই প্রকার পণ্যের মূল্যে একই বাজারে কখনো অত্যধিক পার্থক্য থাকিতে পারে না।
বৈদেশিক পণ্যের শুল্ক মূল পণ্য মূল্যের এক-দশমাংশ ধার্য করা যাইতে পারে। আর কোন কারণবশতঃ যদি বেশী পণ্যের উপরও শুল্ক ধার্য করিতে হয়, তবে দেশের অমুসলিমদের পণ্যে এক-দশমাংমের অর্ধেক ধার্য করিতে হইবে। কারণ তাহাদের উপর জিজিয়া নামক আর একটি কর পূর্ব হইতেই ধার্য হইয়া রহিয়াছে। মুসলমানদের পণ্যের চল্লিশভাগের এক ভাগ শুল্ক বাবদ আদায় করা যাইতে পারে। যেহেতু নগদ টাকা ও পালিত জন্তুর যাকাত তাহাদিগকে অনিবার্যরূপে প্রদান করিতে হয়।
কিন্তু দুইশত মুদ্রার কম পুঁজির ব্যবসায়ের উপর এই শুল্ক আদৌ ধার্য হইতে পারে না। হযরত উমর ফারূক (রা)-এর বিভিন্ন নির্দেশনামা হইতে উল্লিখিত পরিমাণটি জানিতে পারা যায়।[কিতাবুল খারাজ আবূ ইউসুফ ১৩৫ পৃঃ] বর্তমান সময় সেই পরিমাণকেই যে বজায় রাখিতে হইবে এন কোন কথা নাই। বরং আধুনিক প্রয়োজন, পরিবেশ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও পরিপূর্ণ সহৃদয়তার সহিত এই শুল্কের পরিমাণ ধার্য করিতে হইবে।
ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে পণ্যদ্রব্যের চলাচল- একই স্থান হইতে অন্য স্থানে আমদানী-রফতানী করার উপর কোনরূপ শুল্ক ধার্য হইতে পারে না। ইজতিহাদের সাহায্যেও ইহাতে কোনরূপ রদ-বদল করার অবকাশ নাই। যেসব ফল অল্প সময়ের মধ্যে খারাপ হইয়া যায়, তাহার উপর শুল্ক ধার্য না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। [কিতাবুল খারাজ ৮৬ পৃঃ] বৈদেশিক পণ্যের উপর একবারই শুল্ক ধারায হওয়া উচিত। অর্থাৎ বৈদেশিক পণ্যের সীমান্ত পার হইয়া দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সময় তাহা হইতে একবার শুল্ক আদায় হইয়া গেলে, উহাকে যদি পুনরায় সীমান্ত পার হইতে হয়, তবে আবার উহা হইতে শুল্ক আদায় করা হইবে না। হযরত উমর ফারূক (রা)-এর খিলাফত কালে একজন বিদেশী খৃস্টান ব্যক্তি ঘোড়া বিক্রয় করিবার উদ্দেশ্যে ইসলামী রাষ্ট্রে আগমন করিয়াছিল এবং সীমান্ত পার হওয়ার সময় উহার শুল্ক আদায় করিয়া লওয়া হইয়াছিল। কিন্তু ঘোড়া বিক্রয় করিতে না পারায় তাহা লইয়া প্রত্যাবর্তনের পথে সীমান্ত পার হইতে চাহিলে তখন পুনরায় তাহার নিকট শুল্কের দাবি করা হইল। খৃস্টান ব্যবসায়ী অসন্তুষ্ট হইয়া উহরত উমরের নিকট আসিয়া বিষয়টি পেশ করিলে আমীরুল মু’মিনীন শুল্ক অফিসারকে লিখিয়া পাঠাইলেন- একবার যঝন ঘোড়ার শুল্ক আাদায় করিয়াছ, তখন পুনরায় উহা হইতেতাহা আদায় করিতে পারিবে না। [মবসুত- ২য় খণ্ড, ২০১ পৃঃ]
শুল্ক সম্পর্কে শেষ কথা এই যে, ইসলামী অর্থনীতি মূলত স্বাধীন ব্যবসায়ের পক্ষপাতী। সকল দেশের সকল পণ্যের উপরই যে শুল্ক ধার্য করিতে হইবে এমন কোন বাধ্য-বাধকতা নাই। ইসলামী রাষ্ট্র ইচ্ছা করিলে কোন কোন বিদশী রাষ্ট্রের সহিত শুল্ক গ্রহণ না করারও চুক্তি করিতে পারে এবং চুক্তিবদ্ধ দেশসমূহের পরস্পরের মধ্যে স্বাধীন ব্যবসায় চলিতে পারে। কিন্তু বিদেশী রাষ্ট্র যখনই ইসলামী রাষ্ট্রের পণের উপর শুল্ক ধার্য করিবে, তখনই ইলামী রাষ্ট্রও সকল প্রকার বিদেশী শিল্প-পণ্যের উপর অনুরূপ হারে শুল্ক ধার্য করিবে।
জরুরী পরিস্থিতিতে কর ধার্য করণ
ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মাল কোন সময় এমন কোন পরিস্থিতিতে যদি যদি সম্পূর্ণরূপে শূন্য হইয়া পড়ে; কিয়বা ব্যয় অপেক্ষা আয় অত্যন্ত কম হইতে শুরু হয়, অথবা জরুরী পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার কারণ- কি কোন নতুন জাতীয় কল্যাণমূলক পরিকল্পনা কার্যকর করিবার জন্য- অধিক অর্থের প্রয়োজন হইয়া পড়ে, অথবা সকল প্রকার আয়ের পরেও রাজ্যের সকল মানুষের বুনিয়াদী প্রয়োজন পূর্ণ করা সম্ভব না হয়; বা বন্যা, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ও বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তাহা হইলে ইসলামী রাষ্ট্র দেশবাসীর উপর আরো অতিরিক্ত কর ধার্য করিতে পারিবে। ইসলামী রাজনীতিবিদ ইমাম মা-অর্দীর ‘আল-আহাকামু-সুলতানীয়া’ গ্রন্তের অষ্টাদশ অধ্যায়ে (২০৪ পৃঃ) লিয়িয়াছেন- ‘জরুরী অবস্থায় সকল প্রকার ব্যয় বহনের দায়িত্ব সমগ মুসলমানদের উপরই বর্তিবে, প্রয়োজনের সময় তাহাদের নিকট হইতে প্রয়োজন পরিমাণ অর্থ আদায় করা যাইতে পারিবে।
তবুও যুদ্ধের সময় নবী করীম (স) যাকাত, ওশর ইত্যাদি আদায় করার পরও আকস্মিকভঅবে আরো অধিক অর্থের প্রয়োজন বোধ করিয়াছিলেন এবং মুসলমানদের নিকট তিনি সে জন্য অর্থ সাহায্যের দাবি পেশ করিয়াছিলেন। হযরত উমর ফারূক ও উসমান (রা) এই সময় তাহাদের যাবতীয় ধন-সম্পদের অর্ধেক উপস্থিত করিয়াছিলেন এবং হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) তাঁহার সম্পূর্ণ বিত্ত-সম্পদ আনিয়া নবী করীম (স)-এ খিদমতে পেশ করিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার পরিবারবর্গের জন্য কিছু অবশিষ্ট রাখিয়া আসিয়াছেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হইলে উত্তরে বলিয়াছিলেন: তাহাদের জন্য আল্লাহ এবংতাহার রাসলই যথেষ্ট, ইহার অতিরিক্ত আর কিছুরই প্রয়োজন নাই।
এইরূপ জরুরী অবস্থায় যে কর ধার্য করা হয় তাহা দুই প্রকার হইয়া থাকে:
প্রথম, সেইসব কর, যাহা সাধারণভাবে সকল মানুষের প্রয়োজন পূলণ ও কল্যাণ সাধনের জন্য ধার্য করা হয়।
দ্বিতীয়, সেই সব কর, যাহা অত্যাচারী ও শোষক-শাসনকর্তা কেবল বিলাসিতার পানপাত্র উচ্ছাসিত করিয়া তুলিবার জন্য আদায় করিয়া থাকে এবং প্রকৃত জনস্বার্থের সহিত যাহার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নাই। এই উভয়বিধ কর ককনো সাময়িকভাবে ধার্য করা হয়, আবার কখনো কখনো স্থায়ীভাবেও ধার্য হইয়া থাকে।
দ্বিতীয় প্রকারের কর সম্পর্কে এ কথা স্থির নিশ্চিত যে, ইসলামী রাষ্ট্রে ইহার বিন্দুমাত্র অবকাশ নাই। কিন্তু প্রথম প্রকারের কর ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পূর্ণ সংগত- অবশ্য যদি তাহা সংগত ও ন্যায়নীতি অনুসারে ধার্য হয় এবং এইরূপ কর কোন ইসলামী রাষ্ট্রকর্তৃক ন্যায়সঙ্গতভাবে ধার্য করা হইলে তাহা আদান প্রদান করা দেশবাসীর একান্ত কর্তব্য- ফরয, এই সম্পর্কে ইসলামী অর্তনীতিবিদ সকলেই একমত। ইবনে হুম্মাম নামক একজন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ইহার কারণ দর্শাইয়া লিখিয়াছেন যে, এই ধরনের নূতন কর আদায় করা প্রত্যেক সমর্থ মুসলমানের (নাগরিকের) কর্তব্য। কেননা ইহা ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশ ও ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের ন্যায়সঙ্গত ও জনকল্যাণকর সকল আদেশ পালন করা সকল নাগরিকেরই কর্তব্য।
কিন্তু অন্যায়ভাবে জনস্বার্থ হানিকর কোন কাজের জন্য যদি অতিরিক্ত ট্যাক্স ধার্য করা হয় তবে তাহা প্রদান করা মুসলমানদের কর্তব্য নয়। কারণ এই ধরনের ট্যাক্স ধার্য করা সম্পর্কে নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
অতঃপর জানিয়া রাখ, আল্লাহ তা’আলা শাসক ও রাষ্ট্র কর্তাদিগকে জাতি ও জনগণের সংরক্ষক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী হওয়ার আদেশ করিয়াছেন এবং তাহাদিগকে এই জন্য রাষ্ট্রকর্তৃক নিযুক্ত করা হয় নাই যে, তাহারা জাতি ও দেশবাসীকে নূতন নূতন করভারে জর্জরিত ও নিঃস্ব করিয়া দিবে।
মুসলমানগণ এই ধরনর কর কেবল যে প্রদান করিবে না তাহাই নয়, ইহার বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিরোধ গড়িয়া তোলাও একান্ত আবশ্যক।
সামরিক কর
ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালে অর্থসম্পদ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও জনগণের উপর অতিরিক্ত কর ধার্য করা-এমনকি যুদ্ধের জন্য হইলেও- মাত্রই উচিত নয়। কারণ, (আরবী***********)
-‘বায়তুলমালের ধন জনগণের প্রয়োজনের সময় ব্যয় হওয়ার জন্যই মওজুদ আছে’।
কিন্তু তাহা না থাকিলে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ-দেশ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ক্ষুদ্র ও সামান্য ক্ষতি স্বীকার করিতে কোনই আপত্তি থাকিতে পারে না।
সরকারী ঋণ
সাধারণভাবে রাষ্ট্র-সরকারের যে আয় হইয়া থাকে, সেই অনুসারে রাষ্ট্র-সরকারের যাবতীয় খরচ বহন করা বাঞ্ছনীয়। অবশ্য জররী পরিস্থিতিতে আকস্মিক প্রয়োজন দেখা দিলে জরুরী কর ধার্য করিয়া তাহা পূরণ করিতে হয়। কিন্তু ইহাতে যদি প্রয়োজন পূর্ণ না হয়, -কাজ সম্পন্ন না হয়- তাহা হইলে সরকারকে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হইয়া ঋণ গ্রহণ করিতে হয়।
সাধারণত লোকেরা আমদানী অণুসারেই নিজেদের সম্পদ ব্যয় করিয়া থাকে। কিন্তু রাষ্ট্র-সরকার ইহার বিপরীত- নিজের প্রয়োজন অনুসারেই আয়ের ব্যবস্থা করে। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে, দেশবাসীর উপর নূকতন নূতন কর ধারায করণেরও একটা সীমা আছে। এই ব্যাপারে যদি সেই সীমা লংঘন করা হয়, -যদি অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত কর ধার্য করাহয়, তবে দেশবাসীর জীবনযাত্রার মান মারাত্মকরূপে নিম্নগতি ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশে চরম গণবিক্ষোভ দেখা দেওয়ারও সম্ভাবনা রহিয়াছে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার পরিবর্তে হীন হইয়া পড়িলে দেশবাসীর মারাত্মক অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী এবং ইহার ফলে পরবর্তী বৎসরের মূল আয় বর্তমান বৎসর অপেক্ষাও নিশ্চিতরূপে কম হইবে। বস্তুত সোনার ডিম দাত্রী মুরগীর পেট চিরিয়া একবারেই সব বাহির করিয়া লওয়ার মত চরম নির্বুদ্ধিতা আর কি হইতে পারে? একটা দেশের পক্ষে ইহা খুবই মারাত্মক নীতি। এমতাবস্থা নূতন কর ধার্য করার পরিবর্তে রাষ্ট্র-সরকারকে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য বাধ্য হইয়া ঋণই গ্রহণ করিতে হয়।
ইসলামী রাষ্ট্র-সরকারের ঋণ গ্রহণ অধিকর রহিয়াছে। রাষ্ট্র-প্রধান দেশে বিপর্যয় দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করিলে বায়তুলমালের দায়িত্বে ঋণ গ্রহণ করিতে পারে স্বয়ং নবী করীম (স) এইরূপ পরিস্থিতিতে বাধ্য হইয়া ঋণ গ্রহণ করিয়াছেন।
সরকারী ঋণের প্রকারভেদ
রাষ্ট্র-সরকার যে ঋণ গ্রহণ করে, তাহা সাধারণত দুই প্রকার হইয়া থাকে। হয় তাহা দেশে অতিরিক্ত অর্থোৎপানের কাজে নিয়োগ করা হয়, নয় তাহা বিশেষ প্রয়োজনের কাজে ব্যয় করা হয়। ইসলামী রাষ্ট্র –সরকারের বায়তুলমাল হইতে জনগণ এই উভয় উদ্দেশ্যেই ঋণ গ্রহণ করিত। অতএব জনসাধারণ যদি রাষ্ট্রীয় বায়তুলমাল হইতে ঋণ গ্রহণ করিতে পারে তাহা হইলে বায়তুলমালও প্রয়োজন অনুারে জনগণের নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করিতে পারে এবং এই ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে উহাকেও সেই সব শর্ত পালন করিয়অ চলিতে হইবে যাহা সে ঋণ গৃহীতা জনগণের উপর আরোপ করিয়া থাকে।
আধুনিক কালের রাষ্ট্রসরকারসমূহ জনস্বার্থের খাতিরে এবং সাধারণ উন্নয়নমূলক পরিকল্পন্ন কার্যকর করিবার জন্য ঋণ গ্রহণ করিয়া থাকে। যথা- সেচ পরিকল্পনার জন্য খাল ও পুকুর খনন, বাঁধ বাধা, রাস্তাঘাট ও পুল নির্মাণ, সামুদ্রিক বন্দর ও বিমানঘাঁটি তৈয়ার করা, প্রাচীর ও সামরিক ঘাঁটি তৈয়ার করা, রেল লাইন, ট্রাম লাইন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র স্থাপন, প্রভৃতি অর্থোৎপাদক কাজের জন্য প্রত্যেক সরকারই জনগণের নিকট সাময়িক ঋণের দাবি করে এবং এই ঋণ গ্রহণের পর সিকিউরিটি সার্টিফিকেট জারী ও সার্টিফিকেট গ্রহণকারীদিগকে নির্দিষ্ট হারে সুদ দিয়া থাকে।
ইসলামী রাষ্ট্রও প্রয়োজন হইলে এইরূপ অর্থোৎপাদক কাজের জন্য জনগণের নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করিতে পারে। কিন্তু সে ঋণ কোন মতেই সুদভিত্তিক ঋণ হইবে না। বরং তাহার পরিবর্তে সম্মিলিত মূলধনের ভিত্তিতে পারস্পরিক ব্যবসায় হিসাবেই এই ঋণ গ্রহণ করিতে হইবে এবং প্রকল্পের মূল মুনাফা হইতে নির্দিষ্ট অংশ ঋণ-দাতাদের মধ্যে বন্টন করিতে হইবে। এই মূল প্রতিষ্ঠান হইতে সরকার নিজের সাংগঠনিক শ্রম ও দায়িত্বের বিনিময় গ্রহণ করিতে পারিবে। সরকার যদি সাধারণ ঋণের সুদ দেওয়ার পরিবর্তে মূল ব্যবসায়ের লাভ-লোকসানে সমানভাবে শরীক থাকিবার ‘সিকিউরিটি’ দান করে, তাহা হইলে জনসাধারণ তাহাতে মুনাফার আশায় মূলধন বিনিয়োগ করিতে- অন্ততঃ সাময়িক ঋণ দিতে- বিশেষভাবে উৎসাহিত হইবে, তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।
অনুৎপাদক কাজের জন্য- যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, ঝড় প্লাবন প্রভৃতি জাতীয ও আকস্মিক বিপদ-আপদ প্রতিরোধের জন্যও রাষ্ট্র সরকার জনগণের নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করিতে পারে। এই ঋণ দান এবং উহা পরিশোধ করা সম্পর্কে নিম্নলিখিত আয়াতই মূলনীতি হিসাবে স্বীকৃত হইবে:
(আরবী***********)
তোমরা কাহারো উপর জুলুম করিবে না এবং তোমাদের উপর জুলুম করা হইবে না।