শিল্পনীতি
বিশ্ব প্রকৃতির অন্তর্নিহিত নানাবিধ শক্তি, সম্পদ ও দ্রব্য-সামগ্রী মানুসের ব্যবহারোপযোগী করিয়া গড়িয়া তোলার নাম হইতেছে শিল্প। প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যে উহার সহিত মানুষের শ্রম-মেহনতকে, বুদ্ধি-প্রতিভাবে যোগ করিয়া পণ্যোৎপাদন করার কাজ আবহমানকাল হইতেই চলিয়া আসিয়াছে। সভ্যতার প্রথম স্তরে ইহা ক্ষুদ্রায়তন এবং হস্তশিল্পের সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মানববুদ্ধির ক্রমবিকাশ ও বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পোৎপাদনের জন্য মানুষ নানাবিধ যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করিয়াছে। এই যন্ত্রপাতির সাহায্যে মানুষের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য বৃহদায়তন উৎপাদন কার্য শুরু করা হইয়াছে। সংক্ষেপে শিল্প ও শিল্পোৎপাদনের ইহাই হইল গোড়ার কথা।
প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করিবার জন্য এক দিকে যেমন শ্রমের আবশ্যক, অন্যদিকে ইহার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ মূলধনও একান্ত অপরিহার্য। কাজেই প্রাকৃতিক সম্পদ, মানুষের শ্রম এবং মূলধন- এই তিনটিই হইল শিল্পের বুনিয়াদ্ ইসলামের দৃষ্টিতে শিল্পোৎপাদনের মূল উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য অত্যধিক মুনাফা রুণ্ঠন নয়, নিরীহ শ্রমিক-মজুরদিগকে শোষণ করাও নয়, বরং জনগণের প্রয়োজন পূর্ণ করা, জীবন যাপনের চাহিদা মিটানো জাতীয় সম্পদ বুদ্ধি এবং মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন সাধনই হইতেছে উহার মূল লক্ষ্য। কাজেই শিল্পোৎপাদনের ব্যাপারে সর্ব প্রথম লক্ষ্য দিতে হইবে মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করার দিকে- মানুষের চাহিদা মিটানোর দিকে। যেসব পণ্যের উৎপাদনে মানুষের অপরিহার্য প্রয়োজন পূর্ণ হইতে পারে, ইসলামী সমাজে সর্বপ্রথম সেই সব শিল্পের উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে- যেন কোন মানুষই জীবনের মৌলিক প্রয়োজন হইতে বঞ্চিত না থাকে।
শিল্পের দুই দিক
শিল্পের প্রধানত দুইটি দিক রহিয়াছে। প্রথমত, কাঁচামাল হইতে শিল্প-পণ্যেরউৎপাদন এবং দ্বিতীয় হইতেছে ব্যবসায় ও বাণিজ্যের মারফরত উৎপন্ন পণ্যের বন্টন। উৎপাদন-শিল্প দুইভাবে কার্যকর হইয়া থাকে। প্রচুর যন্ত্রপাতি লইয়া যেসব কল-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেইগুলিতে পণ্য উৎপন্ন হয় বহুল পরিমাণে এবং এইসব কারখানা বহুসংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন থাকে। প্রচুর যন্ত্রপাতি লইয়া যেসব কল-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেগুলিতে পণ্য উৎপন্ন হয় বহুল পরিমাণে এবং এইসব কারখানা বহুসংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন হইয়া থাকে। কুটির শিল্প এই প্রকার যন্ত্র শিল্পের ঠিক বিপরীত। কুটির শিল্পে কারিগর ও যন্ত্রপাতি লাগে কম, মূলধন লাগে যৎসামান্য এবং উৎপন্ন পণ্যের পরিমাণও হয় অপেক্ষাকৃত অল্প। সাধারণ গ্রাম্য কারিগর তাহার নিজের বাড়িতে পরিবারভুক্ত লোকজনের সহায়তায়ই কুটির শিল্প পরিচালনা করিয়া থাকে।
ইসলাম অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য এই উভয় প্রকার শিল্পের উপরই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। কুরআন মজীদে সাধারণ হস্তশিল্প হইতে শুরু করিয়া বৃহদায়তন যন্ত্রশিল্পের দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করা হইয়াছে। কিন্তু ইসলাম দেশীয় অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য হস্তশিল্প- তথা কুটির শিল্পের প্রতি অধিকতর লক্ষ্য আরোপ করিয়াছে। সমাজের সকলের পক্ষেই বৃহদায়তন যন্ত্রশিল্প সংস্থাপন করা সম্ভব হয় না, সে জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করাও সকলের পক্ষে সহজসাধ্য হয় না। অথচ হস্তশিল্প ও ছোটখাটো যন্ত্রের সাহায্যে কুটির শিল্পের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব। হস্তনির্মিত তাত চালাইয়অ কাপড় বোনা অধিকাংশ লোকের পক্ষেই সহজসাধ্য, কিন্তু কাপড়ের একটি মিল স্থাপন করার জন্য কোটি কোটি টাকা প্রয়োজন, যা অনেক লোকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। এতদসত্তেও এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কোন প্রকার শিল্পোৎপাদনই কিছু মূলধন বিনিয়োগ ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। মূলধনের সাহায্যেই সকল প্রকার শিল্পকার্য সুসম্পন্ন করা যাইতে পারে। অনুরূপভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্যেও প্রচুর পরিমান মূলধন আবশ্যক।
মূলধন প্রয়োগ করিয়া কুটির শিল্পের সূচনা করা হউক, কি বৃহদায়তন যন্ত্রশিল্প কিংবা ছোটখাটো আকারে বাণিজ্য, সকল ক্ষেত্রেই মূলধনের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য কর্মচারী ও শ্রমিক বিনিয়োগ একান্তভাবে অপরিহার্য হইয়া পড়ে।
এখানে আমরা ইসলামের অর্থনীতি অনুযায়ী মূলধনের বিভিন্ন প্রয়োগ, পুঁজি ও শ্রমিকের বিবিধ সমস্যা এবং অর্থনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে আলোচনা করিব।
মূলধন বিনিয়োগের পন্থা
ইসলামী সমাজে ব্যক্তির হাতে মূলধন সঞ্চিত হইতে পারে, ব্যক্তিগতভাবে উহার প্রয়োগ ও বিনিয়োগ হইতে পারে, তাহাতে কোনরূপ আপত্তি করা চলে না। ব্যক্তিগতভাবে মূলধন বিনিয়োগগের প্রথম পন্থা এই যে, ব্যক্তি নিজেই নিজের মূলধন খাটাইয়া ব্যবসায় করিবে, বাণিজ্য করিবে, শিল্পোৎপাদনের কাজে টাকা খাটাইয়া কারখানা স্থাপন করিবে এবং সেজন্য শ্রমিক নিযুক্ত করিবে। বস্তুত, ব্যবসায় বাণিজ্য ইসলামী সমাজে চিরদিনই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা লাভ করিয়াছে। আজিও ব্যক্তিগত মালিকানার সূত্রে ব্যবসায় কিংবা শিল্পোৎপাদনের কাজে মূলধন বিনিয়োগ হইতে পারে, তাহা হইতে মুনাফা লাভ কিংবা প্রচুর পরিমাণ পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন করা যাইতে পারে এবং সমষ্টিগতভাবে গোটা সমাজ ও জাতি তাহা হইতে উপকৃত ও লাভবান হইতে পারে।
ব্যক্তিবিশেষ নিজের তত্ত্বাবধানে মজুর শ্রমিক দ্বারা কাজ করাইতেহ পারে। এইভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অসংখ্য কারখানা ও পণ্যোৎপাদনকারী যন্ত্র সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত হইতে পারে। ইসলামী সমাজ-ইতিহাসের স্বর্ণযুগে এইরূপ কাজ করাইতে কোনরূপ বাধা-বিঘ্ন ছিল না, আজও থাকিতে পারে না।
ব্যক্তিগত মূলধন বিনিয়োগের আর একটি পন্থা হইতেছে, একজনের মূলধন অপরজনের শ্রমের সহিত যুক্ত হইয়া কোন অর্থকরী কাজের সুচনা করা। আরবী ভাষার এইরূপকাজকে ‘কিরাজ’ বা ‘মুজারিবাত’ (আরবী***********) বলা হয়, আর ইংরেজীতে বলা হয় Sleeping Partnership. এইরূপ কাজে একজন মূলধন দেয়, অপর জন সেই মূলধন লইয়া শ্রম করে, অর্থোৎপাদনের চেষ্টা করে। এইভাবে কাজ করার পর যে সম্পদ মুনাফা হিসাবে লাভ হয়, তাহা পূর্বনির্ধারিত অংশ ও হার অনুযায়ী নিয়মিতভাবে উভয়ের মধ্যে বন্টন করা হয়। ইসলামী অর্থনীতিবিদদের মতে ‘কিরাজের’ ইহাই সর্ববাদী সম্মত সংজ্ঞা।
মূলধন বিনিয়োগের উল্লিখিত দুইটি পন্থার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য রহিয়াছে। প্রথম প্রকার পন্থায় শ্রমিকের নির্দিষ্ট মজুরী যথাসময় আদায় করা পুঁজি মালিকের দায়িত্ব। তাহার নিজের লাভ হউক, লোকসান হউক, কম লাভ হউক কি বেশী হউক, শ্রমিকের মজুরী নির্দিষ্ট পরিমাণে তাহাকে অবশ্যই দিতে হয়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার কাজে- ‘কিরাজ’ বা ‘মুজারিবাত এ শ্রমিকের মজুরীর পরিমাণ নির্দিষ্ট হার অনুসারেই তাহার তাহা পাইবে: আর লাভ না হইলে কিছুই পাইবে না।
মূলধন বলিতে কেবল নগদ টাকা বুঝায় না, প্রত্যেক উৎপাদক শক্তি ও যন্ত্রই মুলধন বলিয়া অভিহিত হইতে পারে। অততএব চাষের জমি, কারখানা কোন যন্ত্রপাতিকে কেন্দ্র করিয়াও অর্থোৎপাদনের উল্লিখিত পন্থায় কাজ হইতে পারে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে তাহা নাজায়েয হইবে না।
খয়বর বিজয়ের পর নবী করীম (স) তথাকার বিজিত জমি-ক্ষেত স্থানীয় প্রাচীণ অধিবাসীদের নিকট এই শর্তে রাখিয়া দিয়াছিলেন যে, তাহারা এই জমিতে চাষাবাদ করিবে, ফসল উৎপাদন করিবে এবং ফসলের অর্ধেক তাহারা মজুরী হিসাবে গ্রহণ করিবে।
এই কর্মনীতির আলোকে বর্তমান যুগের ইসলামী সমাজে একটি প্রেস, একটি কারখানা, একটি আড়ত, একটি মোটরগাড়ী ইত্যাদিকে ভিত্তি করিয়া অনুরূপভাবে অর্থোৎপাদনের কাজ হইতে পারে এবং তৎলব্ধ মুনাফা উৎপাদনে যন্ত্রের মালিকক ও শ্রমিকের মধ্যে নির্দিষ্ট হারে বন্টনও হইতে পারে।
নবী করীম (স)-এর সাহাবায়ে কিরামও অনুরূপভাবে কাজ করিয়াছেন। হযরত উসমান (রা) কোন কোন লোককে নগদ টাকা বা কোন উৎপাদন যন্ত্র উক্তরূপ নিয়ম অনুযায়ী দিয়াছিলেন এবং নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ ভাগ করিয়া লইয়াছিলেন।
এই ধরনের পুঁজি-বিনিয়োগ ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পূর্ণ সংগত। ইসলামের ইতিহাসে এই ব্যাপারে কোনদিনই দ্বিমত দেখা দেয় নাই। কারণ মূলত ইহা দুই ব্যক্তি বা পক্ষের মধ্যে এক প্রকারের স্বেচ্ছামূলক চুক্তি বিশেষ। এক ব্যক্তি পুঁজি সংগ্রহ করে, অপরজন তাহাতে নিজের শ্রম, মেহনত, কর্মক্ষমতা ও সংগঠন প্রতিভা প্রয়োগ করে। এইজন্য উভয়ই তাহা হইতে মুনাফা লাভ করিবার অধিকারী। পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থায় এই ধরনের ব্যবসায়ে যত শোষণ ও জুলুমের অবকাশ থাকে, ইসামী সমাজে তাহার কোন সুযোগই থাকিতে পারেনা। কাজেই ইসলামী সমাজে এইরূপ ব্যবসায় নাজায়েয হওয়ার কোনই কারণ নাই।
সমাজে এমন লোক থাকিতে পারে- থাকা অপরাধ নয়- যাহাদের নিকট মূলধন রহিয়াছে, কিংবা তাহা প্রয়োগ করিবার মত অপরিহার্য শ্রমশক্তি নাই- ব্যবসায়ী বুদ্ধির অভাব কিংবা কোন শরীয়তী প্রতিবন্ধকতার কারণে এই কাজ করার তাহার সুযোগ অথবা সাধ্য নাই (যথা স্ত্রীলোক, শিশু, বৃদ্ধ, পংগু, অক্ষম) অন্যদিকে মূলধনবিহীন অথচ প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি এবং শ্রম করিয়া অর্থোৎপাদনের মত বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতা সম্পন্ন বহুলোক সমাজে থাকিতে পারে, প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের লোকদেরও কোন অপরাধ নাই। যেমন একজন চিন্তাবিদ মনীষী একখানি মহামূল্যবান গ্রন্থ রচনা করিলেন, কিন্তু উহা প্রকাশ করিবার মত মূলধন ও ব্যবস্থপাপনা তাঁহার নাই। তখন অপর একজন মূলধদন ও ব্যবস্থঅপনা নিয়োগ করিয়া উহা প্রকাশ করিতে পারে। ইহাতে জনগণের বিপুল কল্যাণ সাধিত হইতে পারে এবং গ্রন্থকার ও মুলধন বিনিয়োগকারী উভয়ই হার মত কিংবা ইনসাফভিত্তিক রেওয়াজ অনুযায়ী মুনাফা ভাগ করিয়া লইতে পারে। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে শুধু মূলধনের যেমন কোন ব্যবহারিক মূল্য হইতে পারে না, অনুরূপভঅবে নিছক শ্রমশক্তিও এককভাবে কিছুমাত্র অর্থোৎপাদন করিতে সমর্থ নয়। এমতাবস্থায় শ্রম ও মূলধনের সংমিশ্রণ বা সম্মিলনের মাধ্যমে উৎপাদনের কাজ সম্পন্ন করা হইতেছে। ফলে প্রত্যেক শ্রমিকই সরকারী কারখানা বা পারিবারিক চাকুরী- সকল ক্ষেত্রেই বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত কাজ করিতেছে, উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে। [চীনা কমিউনিজম, অধিকৃত এলাকার অবস্থা-আলস্ নিংটন।]
আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মুলধনবিহীন কোটি কোটি লোক নিছক মজুরীর বিনিময়ে কাজ করিতেছে। ইহারা অসহায় দিন-মজুর মাত্র; অপরের প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাহাদিগকে মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হয় ফলে একদিকে যেমন সকল শ্রমিক কাজ করার সুযোগ পায় না-বেকার সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠে, অপরদিকে (যাহারা কোন কারখানায় নিযুক্ত হয়, তাহরা শেমনি নিজেদের সকল প্রকার স্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত হয়। এই দিক দিয়াও একজনের মূলধন লইয়া অপর জনের শ্রম-বিনিয়োগের ইসলাম-সম্মত পন্থার সুযোগ থাকা একান্ত আবশ্যক। তাহাতে প্রত্যেকেই নিজের নিজের স্বাধীনতা রক্ষা করিয়অ কাজ করিতে পারে এবং মুনাফার নির্দিষ্ট অংশ লাভ করিয়া নিজের প্রয়োজন পূরণ করিতে সমর্থ। পূর্ব হইতেই নির্ধারিত হইয়া থাকে। শ্রমিক নিজের শ্রমের বিনিময়ে মজুরী লাভ ক রিতে পারিবে। একজন মূলধন দিবে, অপরজন উহা লইয়া ব্যবসায় ও বাণিজ্য করিবে এবং মুনাফার পূর্ব নির্ধারিত শর্তানুযায়ী অংশ গ্রহণ করিবে। ফিকাহর পরিভাষায় ইহাকে (****) কিরাজ বলা হয। ইমাম কুরতবী বলিয়াছেন:
(আরবী*********)
কিরাজ ব্যবসায় জায়েয হওয়া সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে কোন মত-পার্থক্য নাই।
এইরূপ ব্যবসায়ে শ্রমদানকারীর নিকট ব্যবসায়ের পুঁজি আমাত স্বরূপ থাকিবে। কোন বাহ্যিক কারণে তাহা নষ্ট হইয়া গেলে শ্রমিক সেজন্য কিছু মাত্র দায়ী হইবে না। বস্তুত, এই ক্ষেত্রে মজুরের প্রতি কোন প্রকার জুলুম ও শোষণ হওয়ার কোন সুযোগও থাকিতে পারিবেনা।
নবী করীম (স) বলিয়াছেন: (আরবী*********)
নির্দিষ্ট বেতনে নির্দিস্ট সময়ের জন্য নিযুক্ত মজুরের হাতে কোন জিনিস নষ্ট হইয়া গেলে তাহাকে সেজন্য কোনরূপ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা যাইবে না- যদি না তাহা ইচ্ছাপূর্বক হইয়া থাকে।
ইমাম কুরতুবি লিখিয়াছেন: (আরবী*********)
নির্দিষ্ট বেতনে নিযুক্ত কর্মচারী যদি ইচ্ছাপূর্ব মূলধনের ক্ষতি না করিয়া থাকে, উহা অন্য কোন কারণে বিনষ্ট বা ক্ষতি হইয়া থাকিলে উহার ক্ষতিপূরণ দিতে কর্মচারীকে বাধ্য করা যাইবে না।
মূলধন বিনিয়োগের আর একটি পন্থা কমিশনের বিনিময়ে কাজ করিবার সুযোগ দান। পণ্য-মালিক যদি কাহাকেও এই শর্তে পণ্য দেয় যে, সে নির্দিষ্ট পাইকারী মুল্যের অধিক যে কোন মূল্যে যত পণ্যই বিক্রয় করিবে, তাহা তাহার প্রাপ্য হইবে, অথবা শতকরা বা টাকা প্রতি সে এত কমিশন পাইবে; তবে ইহা ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ শরীয়ত-সম্মত কারবার। এইরূপ কারবারে মুলধন-বিহীন শ্রমজীবিদের পক্ষে অর্থোৎপাদনের বিশেষ সুযোগ ঘটে। ইসলামী সমাজে এইরূপ কাজের যথেষ্ট অবকাশ রহিয়াছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছে: ‘আমার এই কাপড় বিক্রয় করিয়া দাও, ইহাতে আমার নির্দিষ্ট মূল্যের অধিক যাহাই পাইবে, তাহা তোমার হইবে- এইরূপে শর্তে কোন ব্যক্তিকে কমিশন এজেন্ট নিযুক্ত করায় ইসালামী অর্থনতিতে কোন বাধা নাই’। [বুখারী শরীফ।]
যৌথ কারবার
যৌথ কারবার মুলধন বিনিয়োগের এক গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। দুনিয়ার মানব সমাজের চিরদিনই এই যৌথ কারবার(Partnership of Contract) প্রচলিত ছিল। বিরাট কোন ব্যবসায় বা শিল্প কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম ও মূলধন সঞ্চয় করা এক ব্যক্তির পক্ষে অনেক সময় সম্ভব নাও হইতে পারে। এইজন্য একাধিক লোকের মিলিত পুঁজিও শ্রমের পারস্পরিক মিলনে এই কাজ সম্পন্ন করা খুবই সঙ্গত এবং বাঞ্ছনীয়, সন্দেহ নাই। বর্তমান দুনিয়ার অর্থনীতিতে ইহা পারস্পরিক ব্যবসায়ের এক সুদৃঢ় ভিত্তি হইয়া দাড়াইয়অছে।[মার্শাল: প্রিন্সিপাল্স অব ইকনমিক্স, ৩০১ পৃঃ।] ইহাতে একাধিক লোক মিলিত হইয়া মুলদন সংগ্রহ করে এবং সকলেই লাভ-লোকসানের অংশীদার হয়। এইরূপ ব্যবসায় ইসলামী অর্থনতিতে সম্পূর্ণরূপে বিধিসম্মত।
যৌথ কারবার পারস্পরিক চুক্তির ফলেই সম্ভব হয়।কাজেই ইহার অংশীদার হইতে ইচ্ছুক এমন সকল লোকরই তাহাতে সম্মত হওয়া অপরিহার্য এবং এই চুক্তি ও সংশ্লিষ্ট ব্যাপারের যাবতীয় শর্তাদি সকলের সম্মুখে স্পষ্টভাবে লিখিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় ইহা পরস্পরের মধ্যে কোন এক স ময় এবং কোন খুঁটিনাটি ব্যাপার লইয়অ ঝগড়া-বিবাদ, মত-বিরোধ ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি করিতে পারে। এই জন্যই কুরআন মজীদে আল্লাহর নির্দেশশ উক্ত হইয়াছে:
(আরবী*********)
হে মুসলমানগণ, কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যখন তোমরা কোন লেনদেন বা কারবার করিবার চুক্তি করিবে, তখন তাহা অবশ্যই লিখিয়া লইবে।
বস্তুত কাহার কত মূলধন নিয়োগ (Invest) করা হইর এবং এই ব্যাপারে কি কি শর্ত নির্ধারিত হইল তাহা সবই সুস্পষ্ট ভাষায় লিখিত না হইলে ভয়ানক অসুবিধা ও গন্ডগোলের কারণ হইতে পারে। এইজন্য ইসলামী রাষ্ট্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা লাভের উদ্দেশ্যে তাহা রেজিস্ট্রিও করিয়া লওয়া যাইতে পারে।
যৌথ কারবার কেবল নগদ টাকার মুলধনের ভিত্তিতেই হয় না, নিছক শ্রম-মেহনতকে কেন্দ্র করিয়াও একাধিক লোক যৌথ নীতিতে কারবার ও আয়-উপার্জনের কাজ করিতে পরে। বিশেষতঃ নগত মুলধনহীন শ্রমজীবী লোকদের পক্ষেই ইহাই হইতেছে অর্থোৎপাদনের উত্তম পন্থা।এই নিয়ম অনুসারে সকলেই মিলিতভাবে কাজ করিবে এবং লব্ধ মুনাফা মজুরী নির্দিষ্ট হারে সকলেই ভাগ করিয়া লইবে।
যৌথ নীতিতে খনিজ সম্পদ উদ্ধার করা এবং তাহা লইয়া কারবার করাও ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েয। পরিবহন বা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীও যৌথ নীতিতে স্থপিত ও পরিচালিত হইতে পারে।
মূলধনের একটি পরিমাণ নির্দিষ্ট করতঃ তাহাকে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা এবং তাহা লোকদের মধ্যে বন্টন ও বিক্রয় করিয়া নির্দিষ্ট মুলধন সংগ্রহ করার নীতি বর্তমান যুগে খুব বেশী প্রচলন লাভ করিয়াছে। বিরাটাকারে কোন ব্যবসায় বা শিল্প-সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যে পরিমাণ পুঁজির আবশ্যক, তাহা ব্যক্তিগতভাবে কেবল একজন লোকের পক্ষে সংগ্র করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। অথচ এইসব কাজ ব্যতী জাতীয় অর্থনীতির উন্নতি অসম্ভব এবং জাতীয় পুনর্গঠন ও শিল্পায়নের প্রচেষ্টা কিছুতেই সাফল্য লাভ করিতে পারে না। এই জন্য অসংখ্য লোকের অংশীদারিত্বে বিপুল পরিমাণ মূলধন সংগ্রহ করা অপরিহার্য হইয়া পড়ে। এইরূপে যেসব শিল্প বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্টিত হয, তাহার প্রতি অন্ততঃ অংশদিারদের আন্তরিক আগ্রহ ও মনের টান বর্তমান থাকা স্বাভাবিক। ফলে ইহাতে বিশেষ উৎকর্ষ লাভও সহজ হইয়া পড়ে। এইভাবে শিল্প, কৃষি, ব্যবসায় এবং অন্যান্য নানাবিধ কারবার শুরু করা এবং উহার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনতির পুনর্গঠন সম্ভব হয়।
এইরূপ লিমিডেট কোম্পানীর পুঁজি মালিক- অন্য কথায় উহার অংশীদারগণ-প্রত্যেকেই তাহার নিজ অংশের মূলধনের এই মূলধন ব্যবহারকারী বা ব্যবসায় পরিচালকগণ তাহাদের সংগঠনকার্য ও দক্ষতা প্রয়োগের জন্য লাভ্যাংশ পাইতে পারে। অপরদিকে মজুর-শ্রমিকগণ- উহার নানা কার্যে নিযুক্ত হইতে অসংখ্য কর্মচারীগণও- মজুরী ও বেতন পাইবার অধিকারী হইবে।
কোম্পানীর পরিচালক বা সংগঠকগণ প্রত্যেক অংশীদারের পক্ষ হইতে আমানতদার ও কোম্পানীর পরিচালক বা সংগঠকগণ প্রত্যেক অংশীদারের পক্ষ হইতে আমানতদার ও প্রতিনিধি হিসাবে কারবার পরিচালনা এবং উহার দেখাশুনা ও সংরক্ষণ করিয়া থাকে। এই জন্য নিছক সাংগঠনিক কাজের দরুন মুনাফার অংশ এবং বেতন লাভ করার তাহাদের পূর্ণ অধিকার রহিয়াছে।
এই ধরনের কোম্পানীতে একশ্রেণীর লোকের পক্ষে অত্যদিক পুঁজির বলে সর্বাধিক মুনাফা লুটিবার সুযোগ থাকা কিছুতেই সঙ্গত নয়। এইরূপ সুযোগ প্রথম দিকেই বন্ধ করিয়া দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কোম্পানীর সর্বাত্মক অংশীদার হইতে বা সর্বাপেক্ষা বেশী অংশ খরিদ করিতে কাহাকেও দেওয়া যাইতে পারে না। সেজন্য কম মূল্যের অংশ প্রচুর পরিমাণে জনগণের মধ্যে বন্টন করিয়া দেওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। তাহাতে অধিকসংখ্যক লোকের পক্ষে উহার অংশ খরিদ করার এবং তাহা হইতে বা সর্বাপেক্ষা বেশী অংশ খরিদ করিতে কাহাকেও দেওয়া যাইতে পারে না। সেজন্য কম মূল্যের অংশ প্রচুর পরিমাণে জনগণের মধ্যে বন্টন করিয়া দেওয়াই অধিকতর যুক্তযুক্ত। তাহাতে অধিকসংখ্যক লোকের পক্ষে উহর অংশ খরিদ করার এবং তাহা হইতে লভ্যাংশ লাভ করার সুযোগ হইতে পারে। ইসলামী অর্থনীতিতে যে সম্পদ এককেন্দ্রীভূত হওয়া(Accumultionn of wealth) নিষিদ্ধ তাহা এই উপায়েই কার্যকর হওয়া সম্ভব।
মোটকথা অর্থোৎপাদনের জন্য যে কোন সৎব্যবসায় হউক না কেন তাহাতে যদি লভ্যাংশ কাহারো জন্য পূর্ব হইতে নির্দিষ্ট না হয়, -এইভাবে যে, তাহাকে শতকরা এত টাকা মুনাফা দেওয়া হইবে, তবে ইসলামী অর্থনীতি অনুসারে তাহা সম্পূর্ণ জায়েয। কিন্তু বর্তমান যুগে লোকেরা নিতান্ত বুদ্ধিহীনতার দরুন এই হালাল উপার্জনকেই- জাতীয় পুনর্গঠনমূলক এই সৎব্যবসায়কে একটু সামান্য কারণে হারাম করিয়া তুলিয়াছে। অসংখ্য লোকের পুঁজি মিলিত হইয়া বিশেষ কোন কাজ নিয়োগ হইলে যে তাহাতে মুনাফা হইবে এবং পূর্ব-নির্দিষ্ট হারে তাহা বন্টন করা যাইবে এ কথা কোন কালের কোন দেশের মানুষেই নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারে না। তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিলেই এবং শতকরা নির্দিষ্ট হারে ‘মুনাফা’ (সুদ) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেই সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে অবৈধ ও শোষণমূলক উপায় অবলম্বন করিতে হইবে। কারণ যদি তাহাতেহ মোটেই লাভ ভ না হয়- যদি লোকসান হয়, তবে সুদ বাবাদ দেয় টাকা কোথা হইতে আসিবে? যদি মুনাফা হয়, কিন্তু দেয় সুদের সমান পরিমাণে না হয় তাহা হইলে অবশিষ্ট টাকা যে কোন রকমেই হউক, সংগ্রহ তো করিতে হইবে; কিন্তু তাহা কিরূপে এবং কোথা হইতে আসিবে? আর তাহাতে যুদি প্রচুর লাভ হয় তবে প্রত্যেকের অংশ মূল্যের মাথাপিছু যাহা লাভ হইল, তাহার বাবদ সেই পরিমাণ লাভ না দিয়া দেওয়া হইবে নির্দিষ্ট হারে সুদ- যাহা লভ্যাংশের অনেক কম। প্রকৃতপক্ষেই ইহাই হইতেছে শোষণ, ইহাই হইতেছে পরস্বাপহরণ এবং ইহাই হইতেছে সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদের মূল ভিত্তি। উপরন্তু এই ধরনের কারবাররের প্রতি জনগণের একবিন্দু সহানুভূতি ও সহৃদয়তা থাকিতে পারে না।
ইসলামী অর্থনীতি এই সকল জুলুম-শোষণ ও পুঁজিবাদের এই পথ চিরতরে বন্ধ করিয়া দিয়াছে। এই ধরনের মূলধনভিত্তিক কারবারে কাহাকেও নির্দিষ্ট মুনাফার নামে ‘সুদ’ দেওয়া যাইতে পারে না- ইহা সম্পূর্ণরূপে হারাম। বরং ইসলামী সমাজে নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ দেওয়ার শর্তেই এ ধরনের কারবার হইতে পারে- আর তাহাতে জুলুম ও শোষণমূলক কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া মোটেই সম্ভব নয়।
প্রথম পুঁজির অংশ অনুযায়ী লভ্যাংশ বন্টন করা অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা একমাত্র সহজ পন্থা। ইহার প্রতি জনগণের আন্তরিক অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ এই উপায়েই সম্ভব হইতে পারে। কারণ, জনগণ মনে করে যে, এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে বিপুল অর্থসম্পদ উপার্জিত হইবে তাহা বিশেষ কোন ব্যক্তি বা মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতির পকেটে কুক্ষিগত হইয়া যাইবে না, তাহা অসংখ্য লোকের মধ্যে বিস্তৃত হইয়া পড়িবে।
দ্বিতীযত এইরূপ প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শ্রমিক ও মজুরের কাজ করার সুযোগ হয় এবং তাহারা ইহা হইতে নিজেদের জীবিকা-নির্বাহের উপায় লাভ করিতে পারে। এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত হাদীসটি স্মরণীয়, তিনি বলিয়াছেন:
(আরবী*********)
ব্যবসায়ী মাত্রই কিয়ামতের দিন অপরাধী হিসাবে পুনরুত্থিত হইবে। তবে তাহারা নয়, যাহারা ব্যবসায় কার্যে আল্লাহকে পূর্ণমাত্রায় ভয় করিয়াছে, সংশ্লিষ্ট জনগণের প্রতি কল্যাণপূর্ণ ব্যবহার এবং ব্যবসায় ক্ষেত্রে পূর্ণ সততা রক্ষা করিয়াছে।
অর্থনৈতিক সংগঠন
সংগঠন বা ‘অর্গানাইজেশন’ এক প্রকার মানসিক শ্রম। কার্য সম্পাদনের যোগ্যতা বা সাংগঠনিক শক্তি ব্যতীত কোন দেশেই বিরাট আকারে ও প্রচুর পরিমাণে অর্থোৎপাদন হইতে পারে না। ঠিক এই কারণেই অর্থনীতিবিদগণ সংগঠনকেও স্বতন্ত্রভাবে অর্থোৎপাদনের একটি উপায় (Factor) হিসাবে গণ্য করিয়াছেন। কারণ ‘মূলধন’ ব্যতী যেমন অর্থোৎপাদন সম্ভব নয়, এই সংগঠন ব্যতীতও অর্থোৎপাদন কার্য বর্তমান সময়ে প্রায় অসম্ভব। কুরআন মজীদেও এই সংগঠন ব্যতীত অর্থোৎপাদন কার্য বর্তমান সময়ে প্রায় অসম্ভব। কুরআন মজীদেও এই সংগঠন-শক্তি বা পরিশ্রমযোগ্যতার উল্লেখ পাওয়া যায়। মিশরাধিপতি যখন রাজ্রের সর্বময় কর্তৃত্বভার হযরত ইউসুফ (আ)-এর উপর অর্পণ করিয়াছিলেন, তখন তিনি তাহার পরিচয় দিয়া বলিয়াছেন:
(আরবী*********)
আজ হইতে আপনি আমাদের নিকট বড়ই সম্মান ও মর্যাদাসম্পন্ন সুপ্রতিষ্ঠালব্ধ ও সর্বতোভাবে বিশ্বস্ত।
তখন হযরত ইউসুফ (আ) বলিলেন:
(আরবী*********)
দেশের অর্থভাণ্ডার (ব্যবস্থাপনা ও বন্টনের) দায়িত্ব আমর নিকট সোপর্দ করুন। আমি নিশ্চিতভাবে উহার হিফাযতকারী এবং আমি এই বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞানেরও অধিকারী।
বস্তুত, এখানে দৌহিক শক্তির কথা না বলিয়া মানসিক শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা এবং সংগঠন পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার যোগ্যতার কথাই উল্লেখ করা হইয়াছে।
অর্থনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে চিন্তা করিলে বুঝিতে পারা যায়, মূলত ইহা ইসলামী জীবন-ব্যবস্থায় এক নিগূঢ় সত্য কথা। ইসলাম আগাগোড়াই একটি অখন্ড সংগঠন। ইসলামের প্রত্যেকটি কাজ সংগঠনের মাধ্যমেই সম্পন্ন করিতে হয়। সাধারণভাবে সমাজ-জীবনে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নবী করীম (স) সংগঠনকে অপরিহার্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। ইসলামী হুকুমাতের খলীফাকেক রাজনৈতিক সংগঠনকারী হিসাবে প্রয়োজন পরিমাণ বেতন দেওয়া সংগত বলিয়া বিঘোষিত হইয়াছে।
কর্মসংস্থান
বেকার, বে-রোজগার ও অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্য কর্মসংস্থান করা- জীবিকা উপার্জনের উপায় সংগ্রহ করিয়া দেওয়া- অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক চিরন্তনী সমস্যা হইয়া দেখা দিয়াছে। বহু কর্মক্ষম শ্রমজীবী এবং দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতাসম্পন্ন লোকও বেকার সমস্যার সর্বগ্রাসী বিপদে নিমজ্জিত হইয়া তিলে তিলে ধ্বংস হইতে চলিয়াছে। অথচ ইহারা কাজ পাইলে একদিকে নিজেদের অন্তর্নিহিত বুদ্থি, প্রতিভা ও কর্মক্ষমতার বাস্তব স্ফূরণ সাধনের সুযোগ পাইত, অন্যদিকে জাতীয সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাস্তব স্ফুরণ সাধনের সুযোগ পাইত, অন্যদিকে জাতীয সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিরাট কার্য সমাধা করিতে পারিত। একদিকে তাহার নিজেদের পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূর্ণ করিতে পারিত, অপরদিকে তাহারা প্রচুর অর্থোৎপাদন করিয়া অর্থনৈতিক আবর্তন-সৃষ্টির সাহায্যে সমাজক্ষেত্র হইতে দারিদ্র ও আর্থিক অসাম্য দূর করিতে সমর্থ হইত। তখন ইহারা সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে অবাঞ্ছনীয় বোঝা না হইয়া সমাজ ও জাতির একনিষ্ঠ খাদেম হইতে পারিত।
কাজেই বেকর-সমস্যা সমাধান করা, কর্মক্ষম লোকদের জন্য কাজের সংস্থান করা, মানব-কল্যাণকামী প্রত্যেক সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। এবং যে অর্থনীতিতে নির্বিশেষ সকল শ্রেণীর বেকার লোকদের জন্য এইরূপ কর্মসংস্থানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে, প্রকৃত পক্ষে তাহাই হইতে পারে মানুষের জন্য কল্যাণকর অর্থনীতি। আর যাহাতে এইরূপ ব্যবস্থা নাই, তাহা কোনদিন মানুষের কোন কল্যাণ সাধন করিতে পারে না। দুনিয়ায় চিরদিনই এমনএক অর্থব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল এবং তা এখনো রহিয়াছে, যাহার অধীন কেহ বেকার ও বে-রোজগার থাকিবে না; প্রত্যেকেরই জন্য সেখানে কর্মের সংস্থান করা হইবে। নিতান্ত অসহায় ও উপায়হীন করিয়া কাহাকেও উপেক্ষিত অবস্থায় ফেলিয়া রাখা হইবে না; বরং এইরূপ প্রত্যেক ব্যক্তিকেই হাত ধরিয়া উপরে তোলা হইবে। কর্মে নিযুক্ত করিয়া তাহাদিগকে মানুষের মত বাঁচিবার ও মাথা তুলিয়অ দাড়াইবার উপযুক্ত করিয়া তোলা হইবে।
এই দিকে দিয়া ইসলামী অর্থনীতিই মানুষের অভাব মোচনকারী ও বেকার সমস্যার সমাধানকারী একমাত্র অর্থব্যবস্থা। হযরত নবী করীম (স) ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রোজগারহীন লোকদের জন্য কর্মের সংস্থান করার দায়িত্ব পালন করিতেন। তিনিনিজে বেকার লোকদিগকে কাজে নিযুক্ত করিতেন। জীবিকা উপার্জনের কার্যকর পন্থা লোকদের বলিয়া দিতেন। উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যাইতেছে।
একদা একজন সাহাবী নবী করীম (স)-এর নিকট কিছু খাদ্যের প্রার্থনা করিলেন। নবী করীম (স) তাহার ঘরে কোন জিনিস আছে কিনা তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে তিনি বলিলেন: ‘তাহার একখানা কম্বল আছে, উহার একাংশ তিনি পরিধান করেন ও অপর অংশ শয্যা ও গাত্রাচ্ছাদন রূপে ব্যবহার করেন। এতদ্ব্যতীত পানি পান করার জন্য একটিও পাত্রও তাহার আছে।” নবী করীম (স) তাহাকে এই দুইটি জিনিসই তাহার নিকট উপস্থিত করিবার আদেশ করিলেন। তিনি জিনিস দুইটি লইয়া আসিলে নবী করীম (স) নিজেই উহার নীলাম ডাকিয়া তাহা দুই ‘দিরহাম’ মূল্যে বিক্রয় করিলেন এবং এক দিরহামের বিনিময়ে তাহাকে একখানি কুঠার ক্রয় করিয়া আনিতে বলিলেন। কুঠার লইয়া আসিলে পর দেখা গেল, শ্রেষ্ঠ মানব- সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) নিজেই উহার তাহল লাগাইয়া দিলেন এবং জঙ্গলে গিয়া উহার দ্বারা কাষ্ঠ কাটিয়া বাজারে বিক্রয় করার জন্য উক্ত সাহাবীকে আদেশ করিলেন। সেই সঙ্গে ক্রমাগতগ পনের দিবস পর্যন্ত এই কাজে লিপ্ত থাকিতেও তাহাকে তাগিদ করিলেন। ফলে পনের দিন পর তাহার আর্থিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়। তখন নবী করীম (স) ইরশাদ করিলেন: ‘অপরের সম্মুখে ভিক্ষার হাত দরাজ করা এবং তার পরিণামে কিয়ামতের দিন লাঞ্ছিত হওয়া অপেক্ষা জীবিকার্জনের ইহাই অনেক বেশী উত্তম পন্থা।’
এখানে লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, নবী করীম (স) উক্ত সাহাবীকে ভিক্ষা দিয়া ভিক্ষাবৃত্তির উৎসাহ দান করেন নাই, বরং পরিশ্রম করিতে উৎসাহিত করিয়াছেন এবং তাহার কার্যকর উপায় ও পন্থাও নির্ধারণ এবং আবিষ্কার করিয়া দিয়াছেন। প্রত্যকটি মানুষই যতদূর সম্ভব নিজের পায়ে দাঁড়াইবে, অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য ও সচ্ছলতা লাভ করিবে- ইহাই তিনি অন্তরের সহিত কামনা করবেন। তাঁহার গৃহীত কর্মপন্থা ইসলামী সমাজের বেকার-সমস্যার সমাধানের জন্য সুনিশ্চিত পথ নির্দেশ করে। এজন্যই প্রত্যেক নাগরিকের জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থখা করিয়া দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্বত্য।
নবী করীম (স) প্রায়ই বলিতেন:
(আরবী**********)
যিনি আমার প্রাণের মালিক, তাহার শপথ করিয়া বলিতেছি, তোমাদের একজনের রশি লইয়া জঙ্গলে যাওয়া, কাষ্ঠ আহরণ করা, তাহা পিঠের উপর রাখিয়া বহন করিয়া আনা এবং বাজারে বিক্রয় করিয়া অর্থোপার্জন করা অপরের নিকট ভিক্ষা চাওয়া অপেক্ষা অনেক উত্তম। বিশেষতঃ এই অবস্থায় যে, সেই অপর ব্যক্তি তাহাকে দিবে কি দিবে না তাহার নিশ্চয়তা কিছুই না। (বুখারী শরীফ)
হযরত উমর ফারূক (রা) –এর খিলাফতকালে একজন স্বাস্থ্যবান ও শক্তিসম্পন্ন যুবক মসজিদে প্রবেশ করিয়া জনগণের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিল। উমর ফারূক (রা) তাহাকে নিজের নিকট ডাকিয়া উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞাসা করিলেন: নিজের জমিতে কাজ করাইবার জন্য এই যুবককে মজুর হিসেবে নিয়োগ করিতে কে প্রস্তুত আছে? একজন আনসার তাহাকে মজুর রাখিতে রাযী হইলেন। খলীফা তাহার মজুরী নির্দিষ্ট করিয়া তাহাকে কাজে নিযুক্ত করিয়া দিলেন।
হযরত উমর (রা) যখনি কোন উপার্জনক্ষণ বেকার পুরুষ দেখিতে পাইতেন, তখনি তিনি বলতেন:
(আরবী**********)
মুসলমানের সমাজের গলগ্রহ ও অন্য লোকের উপর নির্ভরশীল হইও না।
মোট কথা, সমাজের বেকার লোকদের জন্য কর্ম-সংস্থানের চেষ্টা করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। ইহার কারণ এই যে, সমাজের লোকদের মাত্র একাংশ যদি উপার্জন করে আর অপর অংশ বেকার বসিয়া থাকে, তবে এ দিকে যেমন উপার্জনকারীদের উপর অর্থনৈতিক চাপ তীব্র হইয়া পড়িবে, অন্যদিকে উৎপাদনের পরিমাণ অত্যন্ত কম হইবে। ফলে জাতীয় অর্থসম্পদ মারাত্মকরূপে হ্রাস পাইয়া যাইবে।[কারওয়ার এ্যান্ড কারমাইকেল: ইলেমেন্টস অব ইকনমিকা।]
তাই ইসলামী অর্থনীতিতে দুনিয়ার সম্পর্ক ত্যাগ করা- উপার্জন পরিহার করিয়া বেকার হিইয়া বসা এবং অন্য লোকদের গলগ্রহ হইয়া থাকা যেমন নিষিদ্ধ, অনুরূপভাবে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করাও অতিশয় হীন ও ঘৃণ্য কাজ। ভিক্ষালব্দ খাদ্যকে নবী করীম (স) জাহান্নামের অগ্নিদগ্ধ পাথর বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।
নবী করীম (স) বলিতেন:
(আরবী**********)
তোমাদের মধ্য যাহারা ভিক্ষা করে- অথচ ইহা হইতে মুক্ত থাকার মত সম্পদ বা শক্তি-সামর্থ্য তাহাদের রহিয়াছে- তাহারা যখন কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে হাযির হইবে, তখন তাহাদের মুখমন্ডল একেবারে সাংসহীন ও বীভৎস হইয়অ যাইবে।
অপর হাদীসে বলা হইয়াছে: (আরবী**********)
যে লোক ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিবে সে আল্লাহর সহিত এমনভাবে সাক্ষাৎ করিবে যে, তাহার মুখমন্ডল মাংসহীন হইয়া যাইবে।
এইভাবে বিশ্বমানবের একমাত্র বন্ধু ও কল্যাণ ব্যবস্থাপক হযরত নবী করীম (স) তাঁহার সাহাবাদের মন-মস্তিষ্ক ও চিন্তাধারায়- তথা স্বভাবে ও প্রকৃতিতে- অমূল পরিবর্তন আনিয়াছিলেন। ফলে ইসলামী সমাজের লোকগণ সর্বহারা হওয়া সত্ত্বেও কখনো ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেন নাই।
ভিক্ষাবৃত্তি তো দূরের কথা, সাহাবায়ে কিরাম কাহারো নিকট কিছু চাওয়া পর্যন্ত অপমানকর মনে করিতেন। নৈতিক শিক্ষা ও উন্নত মহান আদর্শের ভিত্তিতে অতি সহজেই তাহাকের জীবন এইরূপ পরিবর্তন সৃষ্টি করা হইয়াছিল। সেজন্য কাহারো উপর কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি বা শাস্তি প্রয়োগ করিতে হয় নাই! কিন্তু ইংলন্ডের ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধের ব্যাপারে মানুষের উপর যে অমানুষিক জুলুম ও পীড়ন চালানো হইয়াছিল, পাশবিকতার দিক দিয়া তাহার কোনই তুলনা পাওয়া যায় না। ইংলন্ডের রাজা অষ্টম হেনরী কর্মক্ষম ভিক্ষুকদের জন্য কর্মের সংস্থান না করিয়া তাহাদিগকে মোটরের পিছনে উলঙ্গ করিয়া বাঁধিয়া দিয়া বিদ্যুৎগতিতে মোটর চালাইতে আদেশ করিয়াছিলেন। কখনো কখনো ভিক্ষুকদের চাবুক মারিতেও বলা হইত। [ইকনমিক হিষ্ট্রি অব ইংল্যাণ্ড, ১৩৪ পৃঃ।] ১৫৪৭ সনে আইনের বলে ভিক্ষুকদের উত্তপ্ত লৌহ দ্বারা চিহ্নিত করা হইয়াছিল, তাহাদিগকে বড়লোকদের দাসানুদাস বানাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। অনেক সময় তাহাদিগকে শিকল দিয়া বাধিয়াও রাখা হইত। কিন্তু ইসলামের অর্থনীতি ভিক্ষুক সমস্যার সমাধান করিয়াছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে। একদিকে ভিক্ষা কার্য হইতে মানুষকে বিরত রাখিবার জন্য নিষেধ বাণী উচ্চারণ করা হইয়াছে অপরদিকে উপার্জনে আত্মনিয়োগ করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হইয়অছে, এবং তাহাদের জন্য কর্মসংস্থানের অনুকূলে ব্যাপক চেষ্টা চালানো হইয়াছে।
উপরের আলোচনা হইতে একথা প্রমাণিত হইয়াছে যে, ইসলামী সমাজে বেকার সমস্যার সমাধান করা গরীব-দুঃখীদের দুর্দশা ও অভাব দূর করা এবং মুহাজিরদের পুণর্বাসন প্রভৃতি সমস্যাবলীর সমাধান করা কিছুমাত্র কঠিন কাজ নয়। হযরত নবী করীম (স) এর আদেশ অনুসরণ করিলে ইহা অতি সহজেই কার্যকর হওয়া সম্ভব।
শ্রম, শ্রমিক ও মজুরী সমস্যা
উপরে একথা সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হইয়াছে যে, আল্লাহ প্রদত্ত বিপুল নৈসর্গিত উপাদান এবং মূলধন একক ও বিচ্ছিন্নভাবে মানুষের কোন কল্যাণই করিতে পারে না, মানুষের ব্যবহারোপযোগী কোন পণ্যও কেহ উৎপাদন করিতে সমর্থ হয় না- যতক্ষণ না উহার সহিত মানুষের শ্রমের যোগ হইবে। কিন্তু যেখানেই শ্রমও মূলধনের যোগ হয়, সেখানেই শ্রম, শ্রমিক ও মূলধনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের দিক দিয়া এবং শ্রমের অধিকার ও মজুরী এবং মূলধন ও পুঁজি-মালিকের অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণের ব্যাপারে বিরাট বিরাট সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠে। শিল্পোৎপাদন যেহেতু মানব সমাজের একটি মৌলিক প্রয়োজন, সেই জন্যই এই ব্যাপারে কিছুমাত্র অসামঞ্জস্যতা দেখা দিলে মানব সমাজের পক্ষে ইহা এক মারাত্মক সমস্যা হইয়া দেখা দেয়। এইরূপ সমস্যা এক একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের বিত্তিকে পর্যন্ত চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া দিতে পারে। তাই, পুঁজিবাদী সমাজে যে সমস্যা মানুষকে তিল তিল করিয়া নিঃশেষ ধ্বংস করে, আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে সমস্যার সমাধান করার গাল ভরা দাবি করা সত্ত্বেও কোন সমাধান করা সম্ভব হয় না, ইসলামী অর্থনীতিই তাহার চূড়ান্ত সমাধান করিয়া দিয়াছে।
শ্রমিকের মর্যাদা
শ্রম ও শ্রমিকের প্রথম সমস্যা হইল তাহাদের সামাজিক মর্যাদা। আধুনিক সমাজে- বর্তমানের বিজ্ঞানোজ্জ্বল সমাজেও-শ্রম করা নিতান্ত অপমানকর কাজ বলিয়া বিবেচিত হয়। এখানে শ্রমিকদিগকে সাধারণ কোনরূপ সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয় না। তাহাদিগকে ঘৃণিত ও লাঞ্চিত বলিয়া মনে করা হয়। ইসলাম সর্বপ্রথম কৃত্রিম আভিজাত্যবোধ ও সামাজিক বৈষম্যের উপর চরম আঘাত হানিয়াছে। ইসলাম মানুষের মধ্যে প্রকৃত সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধই শুধু জাগ্রত করে নাই, কার্যকরভাবে শ্রমজীবী ও মজুরদের সম্মান ও মর্যাদা সমাজক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করিয়অছ। ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল কাজে ও হালাল পথে শ্রম এবং হাড়ভঙ্গা খাটুনি খাটিয়াও জীবিকা উপার্জন করা কিছুমাত্র লজ্জার ব্যাপর নহে। তাহা করিলে কাহাকেও সামাজিকতার দিক দিযা মর্যাদাহীন প্রতিপন্ন হইতে হয় না। ইসলামের প্রত্যেক নবীই দৈহিক পরিশ্রম করিয়া উপার্জন করিয়াছেন বলিয়া দ্বীনি গ্রন্থাবলীতে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করা হইয়াছে। কুরআন মজীদ এই উপার্জনের জন্য মানুষকে বিশেষভাবে উৎসাহ দান করিয়াছে।
মজুরী-সমস্যা
এই ব্যাপারে সর্বপেক্ষা অধিক জটিল বিষয় হইতেছে শ্রমিকদের মজুরী সমস্যা এবং ইহারই সুষ্ঠু ও সুবিচারপূর্ণ সমাধান হওয়া উচিত সর্বাগ্রে। কেননা ইহারই উপর কেবল শ্রমিক শ্রেণীর জীবন যাত্রা নহে, গোটা সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি একান্তভাবে নির্ভর করে।
অধ্যাপক বেনহাম মজুরীর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন: এমন পরিমাণ অর্থকে মজুরী বলা যাইতে পারে, যাহা পূর্ব নির্ধারিত চুক্তি অনুসারে মজুর তাহার কাজের বিনিময়ে লাভ করিয়া থাকে।
মজুরের পক্ষে এই মজুরী লাভই হইতেছে জীবন-ধারণের একমাত্র উপায়। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত মজুরের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ঠিক মধুমক্ষিকার ন্যায়। শ্রমের নিঃশব্দ আঘাতে তাহাদের স্বাস্থ্যের মেরুদন্ড পূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যায়, বুকের রক্ত পানি হইয়া যায়। কিন্তু ইহার পরও যদি তাহাদের বাঁচিবার জন্য অপরিহার্য পরিমাণ মজুরী তাহারা লাভ করিতে না পারে, যদি তাহাদের কর্মক্ষমতা অপেক্ষা অধিক খাটিতে হয়, খাটিতে খটিতে যদি তাহাদের স্বাস্থ্য চিরতরে ভাঙিয়া পড়ে, যদি কোন অঙ্গহানি ঘটে- সারা দিনের শ্রম-মেহনতের পর সন্ধ্যাকালে আশ্রয় লইবার মত –হাত পা ছড়াইয়া বিশ্রাম করিবার মত উন্মুক্ত বায়ু সমন্বিত কোন ঘরবাড়ি যদি তাহারা না পায়, রোগব্যাধি হইলে যদি উহার চিকিৎসার ব্যবস্থা না হয়, যদি তাহাদের সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা-দীক্ষা ও লালন-পালনের সুব্যবস্থা না হয়, তাহা হইলে তাহাদের দুঃখের আর অবধি থাকে না। এইরূপ অবস্থায় তাহারা স্বাধীন মানুষের মত মেরুদন্ড খাড়া করিতে ও মাথা উচু করিতে দাঁড়াইতে কোনদিনই সমর্থ হয় না। বস্তুত ইহাই বর্তমান দুনিয়ার শ্রমিক-মজুরদের সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা। এই সমস্যা কেবল পুঁজিবাদী সমাজেই বর্তমান আছে তাহা নয়, সোভিয়েত দুনিয়ার শ্রমিকদেরও ইহাই প্রধানতম সমস্যা। এই সমস্যাবলীর একটিও কোন সমাধান আজ পর্যন্ত হয় নাই- না সোভিয়েত দুনিয়ায়, না কোন পুঁজিবাদী দেশে।
কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি এই সকল সমস্যার সমাধান করিয়া দিয়াছে। এমন কি অর্থনীতির দুনিয়ায় এই সমস্যাবলীর ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাব-সম্মত সমাধান করার কৃতিত্ব একমাত্র ইসলামেরই প্রাপ্য। নবী করীম (স) এর নিম্নোদ্ধৃত হাদীসে ইসলামী সমাজে শ্রমিকদের সঠিক মর্যাদা ও অধিকারের কথা উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষিত হইয়াছে। তিনি ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
তাহারা (মজুর, শ্রমিক ও অধীনস্থ বেতনভোগী কর্মচারীরা) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাহাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর অর্পণ করিয়াছেন। কাজেই আল্লাহ যাহাদের উপর এইরূপ দায়িত্ব চাপাইয়া দিয়াছেন, তাহাদের কর্তব্য এই যে, তাহারা যেরকম খাদ্য খাইবে তাহাদিগকে সেই রকম খাইতে দিবে, যাহা তাহারা পরিধান করিবে, তাহাদিগকে সেই ধরনের পোশাক পরিধান করার ব্যবস্থা করিয়া দিবে। আর যে কাজ করা তাহাদের পক্ষে কষ্টকর, সাধ্যাতীত, তাহা করিবার জন্য তাহাদিগকে কখনো বাধ্য করিবে না। আর সেই কাজ যদি তাহাদের দ্বারাই সম্পন্ন করিতে হয়, তবে সেজন্য তাহাদের প্রয়োজন অনুপাতে সাহায্য অবশ্যই করিবে।
এই হাদীস হইতে নিম্নলিীখত মূলনীতিসমূহ আমরা জানিতে পারি:
১. মালিক ও পুঁজিদার মজুর ও শ্রমিকদের নিজের ভাইয়ের মত মনে করিবে। দুই সহোদর ভাইয়ের মধ্যে যেমন মৌলিক কোন পার্থক্য থাকে না এবং যেরূপ সম্পর্কও সম্বন্ধ বর্তমান থাকে বা থাকা উচিৎ, তাহাদের সহিতও অনুরূপ সম্পর্ক স্থাপন করিবে।
২. খাওয়া-পরা-থাকা প্রভৃতি মৌলিক প্রয়োজন-পুরণের মান মালিক ও শ্রমিকের উভয়েরই সমান-হইতে হইবে। মালিক ও পুঁজিদার নিজে যাহা খাইবে ও পরিবে, মজুর-শ্রমিককে তাহাই খাইতে পরিতে দিবার ব্যবস্থা করিবে; কিংবা অনুরূপ মানের (Standard) পরিমাণ অর্থ মজুরিস্বরুপ দান করিবে।
৩. সময় এবং কাজ উভয় দিক দিয়াই সাধ্যাতীত পরিমাণ দায়িত্ব মজুরের উপর চাপান যাইতে পারে- প্রাণান্তকর ও সধ্যাতীত মাত্রার কিছু নয়। এমন কাজ নয় যাহাতে মজুর ও শ্রমিক শ্রান্ত, ক্লান্ত ও পীড়িত হইয়া পাড়িতে পারে। এত দীর্ঘ সময় পর্যন্তও একাধারে মেহনত করিতে বাধ্য করা যাইতে পারে না, যাহা করিলে শ্রমিক অক্ষম হইয়া পড়ে। বস্তুত সময় এবং মজুরী লইয়া মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ও মতবৈষম্য বর্তমান পৃথিবীকে বিড়ম্বিত ও বিক্ষুদ্ভ করিয়অ তুলিয়াছে, তাহার সমাধান এবং উভয়ের মধ্যে ইনসাফপূর্ণ সমন্বয় বিধান ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন মতাদর্শই করিতে পারে না।
৪. যে কাজ সম্পন্ন করা শ্রমিকের পক্ষে অসাধ্য, সে কাজ অকৃত থাকিয়া যাইবে, ইসলাম এমন কথা বলে না। পক্ষান্তরে, বাঁচুক কি মরুক, সে কাজ তাহার দ্বারাই করাইতে হইবে- এমন কথা ও হইতে পারে না। এমতাবস্থায় উক্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনানুসারে মজুরকে সাহায্য করিতে হইবে। অধিক সময়ের প্রয়োজন হইলে দীর্ঘ সময়ের অবকাশ দিতে হইবে; অধিক মজুর শ্রমিকের সহযোগিতার প্রয়োজন হইলে তাহা দিয়াই তাহার সাহায্য করিতে হইবে।’
প্রত্যেক মজুরকে দৈনিক কত ঘন্টা কাজ করিতে হইবে, তাহাও একটি কম সমস্যা নয়। নবী করীম (স)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, কোন ধরনের কাজ উত্তম? উত্তরে তিনি বলিয়াছিলেন: ক্রমাগতত ও নিরবচ্ছিন্ন কাজ- যদিও তাহা পরিমাণে কম হউক না কেন! সেই পরিমাণ কাজেরই দায়িত্ব গ্রহণ কর।
মজুরের কাজের সময় এবং উহার পরিমাণ নির্ধারণের ব্যাপারে নবী করীম (স)-এর এই নির্দেশ মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করিতে হইবে। প্রকৃত পক্ষে দৈনিক একসঙ্গে যত ঘন্টা কাজ করা একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব, যত ঘন্টা কাজ করিলে শ্রমিকের স্বাস্থ্য ও কর্মদক্ষতার উপর কোনরূপ আঘাত পড়ে না, একজন মজুর ঠিক তত ঘন্টা এক সঙ্গে ঠিক সেই পরিমাণ কাজই করিবে, তাহার বেশী নয়।
(আরবী**********)
মজুরগণ যে পরিমাণ কাজ সহজে এবং সুষ্ঠুভঅবে সম্পন্ন করিতে পারিবে, যে পরিমাণ কাজ করা তাহাদের সাধ্য ও শক্তিতে কুলাইবে, তাহাদিগকে সেই পরিমাণ কাজেই নিযুক্ত করিবে।
বর্তমান দৈনিক ৮ ঘন্টা সময় এক সঙ্গে কাজ করার কথা কার্যকালের এক স্থায়ী মান হিসাবে সর্বত্র গৃহীত হইয়া আছে। অতএবে উহাকেই স্থায়ী কার্যমানরূপে গ্রহণ করিতে হইবে। ইহার অধিক সময় (Overtime) কাজ করাইতে হইলে সে সময়ের জন্য বাড়তি মজুরী দিতে হইবে। ইহা নবী করীম (স)-এর এই বক্যাংশ হইতেই প্রমাণিত (আরবী**********) তোমরা যদি তাহাদের উপর অধিক কাজ করার দায়িত্ব চাপাও, তবে সেই হিসাবে বাড়তি মজুরী দিয়া তাহাদিগকে সাহায্য কর।
মজুর শ্রমিকদের দ্বারা স্বাস্থ্য নষ্ট করার মত কোন কাজ কিছুতেই করাইবে না। অর্থনীতিবিদগণ বলেন: সাধারণত দেখা যায় যে, কোন স্থানে কাজের পরিমাণ অপেক্ষা মজুরীর পরিমাণ হ্রাস পাইয়অ যা। মজুরের পক্ষে জীবন ধারণের প্রয়েঅজন পরিমাণ মজুরী লাভ করাও অসম্ভব হইয়া পড়ে। কুরআন মজীদ এই সম্পর্কে বলে যে, এমতাবস্থায় মজুরদের দেশ বিদেশ আসা-যাওয়অ এবং মজুরীর সন্থানে এক স্থান হইতে অন্যত্র চলিয়া যাওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখিতে হইবে- যেন প্রত্যেকেই নিজের শ্রমশক্তির সঠিক মূল্য লাভের অনুকূল ক্ষেত্রে সন্ধান করিতে পারে। কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
আল্লাহর পথে যে হিজরত করিবে, সে দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ্য ও বিপুল প্রাচুর্য লাভ করিবে।
দেশ-বিদেশে শ্রমের সন্ধানে যাতায়াত করার উন্মুক্ত থাকিলে এক স্থানে অধিক মজুরের সমাবেশ হওয়া এবং অনুরূপ সংখ্যায় কর্মসংস্থান না হওয়ার দরুন মজুরী হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা দূর হইতে পারে।
যদি এমতাবস্থায়ও মজুর শ্রমিকের অভাব ও দারিদ্র্য পূর্ণরূপে দূর করিবার জন্য রাষ্ট্রকে তৎপর হইতে হইব এবং ম জুরদের প্রয়েঅজন মিটাইয়অ তাহাদের জীবন মান উন্নত করিবার জন্য যাকাত-ভান্ডারকে বিশেষভাবে সক্রিয় করিয়া তুলিতে হইবে। ইহা হইতে মজুর ও শ্রমজীবী, তথা- দেশের জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সম্ভব। মজুরদের জন্য ইসলামের এই অর্থনেতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা স্যার উইলিয়াম বেভারিজ উপস্থাপিত পরিকল্পনা অপেক্ষা অধিক স্বাভাবিক এবং নিঃসন্দেহে কল্যাণকর।
সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের রিযিক ও যাবতীয প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের উপররে ন্যস্ত করা হইয়াছে। কুরআনের নির্দেশ অনুসারে প্রত্যেক প্রাণীকেই জীবিকাদানের বার রিযিক-দাতা আল্লাহ তা’আলা নিজে গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
দুনিয়ার সকল প্রকার জীবজন্তু ও প্রাণীর জীবিকার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া আল্লাহর কাজ।
(আরবী**********) তাহাদের জৈব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় রিযিক আমিই দেই এবং পরে যাহারা আসবে তাহাদিগকেও আমিই দিব।
আর মানব সমাজে আল্লাহর তরফ হইতে এই দায়িত্ব পালনের ভার অর্পিত হয় ইসলামী রাষ্ট্রের উপর। এইজন্য নির্দেশ দিয়া বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
তাহাদের (ধনীদের) ধনমাল হইতে যাকাত আদায় কর। ইহা তাহাদের মন-আত্মা ও জীবনকে পবিত্র করিবে, ক্রমশ: উন্নত ও বিকশিত করিবে।
যাকাতের সম্পদ বন্টন করা সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
যাকাত সমাজের ধনীদের নিকট হইতে আদায় করা হইবে এবং সেই সমাজের দরিদ্রদের মধ্যে তাহা বন্টন করা হইবে।
বস্তুত যাকাত ইসলামী সমাজের মালিক ও পুঁজিদারদের শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে একটি অন্যতম প্রধান প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তাহারা মজুরদের প্রতি কোন শোষণমূলক আচরণ করিলে, তাহাদিগকে ছাঁটাই বা পদচ্যুত করার ভয় দেখাইয়া কম মজুরী দিবার সুযোগ গ্রহণ করিতে চেষ্টা করিলে কিংবা কারখানা বন্ধ করিয়া মজুরদের বেকার করিয়া দেওয়ার ভয় দেখাইলে এই প্রতিরোাধ ব্যবস্থাই তাহাদের নির্ভরযোগ্য পৃষ্ঠপোষক হইবে। ইসলামী রাষ্ট্র একদিকে ধনী ও মালিকদের উপর কর ধার্য করিবে, অন্যদিকে কারখানা যাহাতে বন্ধ না হয় ও মজুর শ্রমিকগণ বেকার হইয়া না পড়ে, তাহারও আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।
মেহনতী জনতা- মেহনত দৈহিক কি মানসিক- সকল প্রকার শ্রমিকদের পেট ভরা খাদ্য দিতেই হইবে। অন্যথায় তাহাদের কর্মক্ষমতা লোপ পাইবে, যোগ্যতার মান নিম্নগতি ধারণ করিবে। দেশে যথেষ্ট পরিমাণ পণ্যদ্রব্য উৎপন্ন হইবে না। ফলে গোটাজাতি দারিদ্র ও অভাবের গভীর পংকে নিমজ্জিত হইবে।
মজুর ও মালিকের সম্পর্ক
মজুর ও মালিকের মধ্যে কিরূপ সম্পর্কে হওয়া উচিত উল্লিখিত দীর্ঘ হাদীস হইতে সে সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া গিয়াছে। তাহাতে মালিকের সম্বোধন করিয়া বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
মজুর শ্রমিকগণ তোমাদেরই ভাই, আল্লাহ তাহাদিগকে তোমাদের দায়িত্ব, ব্যবস্থাপনা ও সংস্থার অধীন করিয়া দিয়াছেন।
কুরআন মজিদে দুইজন নবীর একজনকে মালিক ও মুনীব এবং অন্যজনকে মজুর-শ্রমিক হিসাবে পেশ করিয়অ উভয়ের মধ্যস্থিত সম্পর্ক ও প্রয়োজনীয় গুণাগুণ ওজন করিয়া সকলের সমক্ষে পেশ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
তুমি যাহাকেই মজুর হিসাবে নিযুক্ত করিবে, তন্মধ্যে শক্তিমান ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিই সর্বপেক্ষা উত্তম।
ইহা হইতে জানা গেল যে, ইসলামী সমাজের মজুরদের মধ্যে দুইটি গুণ অপরিহার্য। পথম- শক্তিমান, কর্মক্ষম ও সুদক্ষ হওয়া এবং দ্বিতীয় বিশ্বাস পরায়ণ ও আস্থাভাজন হওয়া। মজুরদের মধ্যে এই দুইটি গুণ যথেষ্ট পরিমাণে বর্তমান না থাকিলে কোনরূপ পণ্যোৎপাদন যে সম্ভব নয়, তাহা অতি সুস্পষ্ট কথা। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে, মজুরদের মধ্যে উল্লিখিত উভয় প্রকার গুণের সঞ্চার করার উপযুক্ত শিক্ষা ও ট্রেনিং দানের ব্যবস্থা করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
মালিক (নবী), মজুর (নবী) কে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন:
(আরবী**********)
আমিম তোমার উপর কোনরূপ কঠোরতা করিতে চাহি না, কোন কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ তোমার উপর চাপাইতেও চাহি না, আল্লাহ চাহিলে তুমি আমাকে সজ্জন ও সদাচারী হিসাবেই দেখিতে পাইবে।
অন্য কথায়- ইসলামী সমাজে মালিক ও পুঁজিদারকে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল জনদরদী , সততাপূর্ণ ও সত্যপ্রিয় হইতে হইবে। সে মজুরকে যেমন শোষণ করিবে না, কোন দুঃসহ কষ্টকর ও সাধ্যাতীত বা স্বাস্থ্যহানিকর কাজে নির্দয়ভাবে নিযুক্ত করিবে না এবং নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্তকাল কাজ করিতেও বাধ্য করিবে না। অনুরূপ সে তাহাকে কোনরূপ শাস্তি দিয়া অভাব, দারিদ্র ও বেকারত্বের মুখে ঠেলিয়া দিয়া সমাজ-শৃংখলা চূর্ণ করিবে না।
নবী করীম (স) মজুরদের সহিত সহৃদয়তাপূর্ণ ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, ‘মজুর ও চাকরের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা মহত্বের লক্ষণ।’ তিনি নিজেও তাহাদের প্রতি মধুর ব্যবহার করিতেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) দীর্ঘ দশ বৎসরকাল পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে নবী করীম (স)-এর সঙ্গে খাদেম হিসাবে ছায়ার মত রহিয়াছেন। কিন্তু এই দীর্ঘ কালের মধ্যেনবী করীম (স) তাহা নিকট কোন কৈফিয়ত চাহেন নাই, কোন কাজের দরুন তাহাকে ভর্ৎসনাও করেন নাই।
মজুর ও মালিকের সাম্য
ইসলামী অর্থনীতি শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপন করিয়া তাহাদের মধ্যে পরিপূর্ণ সাম্য প্রতিষ্ঠা করিতে চাহে্ পূর্বোল্লিখিত মূল নীতির ভিত্তিতে যে সমাজ গঠিত হইয়াছিল, তাহাতে এই সাম্য পুরাপুর প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সেই সমাজের আমীরুল মুমিনীন বা রাষ্ট্রপ্রধান এবং দেশের জনগণের সাধারণ জীবন ধারায় জীবনযাত্রার মানে বিশেষ কোন পার্থক্র ছিল না।
উতবা ইবনে ফরকাদ্ আজার বাইজান (বর্তমান রুশীয় তুর্কীস্থানে অন্তর্ভুক্ত) জয় করিয়া তথা হইতে উত্তম মিষ্টদ্রব্য আমিরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা)-এর জন্য পাঠাইয়াছিলেন। তিনি উহার স্বাদ গ্রহণ করিয়া বিশেষ প্রীত হইলেন। এই মিষ্টদ্রব্য সকল মুহাজিরও খাইয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছে কিনা তাহা জানিতে চাহিলে তিনি জানিতে পারিলেন যে, ইহা কেবল আমীরুল মুমিনীনের জন্যই প্রেরণ করা হইয়াছে, অন্য কাহাকেও ইহা দেওয়া হয় নাই। এই কথা শুনিয়া খলীফা উমর (রা) উতবাকে লিখিয়া পাঠাইলেন: ‘এই মিষ্টিদ্রব্য তোমার নিজের শ্রম ও মেহনতের ফল নয়, তোমার মা-বাবার চেষ্টাও ইহাও তৈরী হয় নাই। যে বস্তু সর্বসাধারণ মুসলমান খাইতে পায় না, আমরা তাহা কিছুতেই আহার করিতে পারি না।
পরবর্তীকালে এই উতবাকে কোন এক দেশের শাসনকর্তা থাকাকালে হযরত উমর (রা) কে অতি সাধারণ খাদ্য আহার করিতে দেখিয়া বিস্ময় করিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন: আমিরুল মুমিনীন কি ময়দা নামক কোন বস্তু খাদ্য- হিসাবে গ্রহণ করেন না? খলীফা বলিলেন- ‘আমার অপেক্ষা অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন এখানে কেহ নাই; কিন্তু জিজ্ঞাসা করি ময়দা কি সব মুসলমানই খাইতে পায়?’
হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতকালে একবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় জনসাধারণ প্রয়োজন পরিমাণ গোশত পাইত না বলিয়া খলীফাও গোশ্ত খাওয়া বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন এবং ঘৃতের বদলে তৈল ব্যবহার করিতে শুরু করিয়াছিলেন। ইহাতে খলীফার চেহারা বিবর্ণ হইয়া গিয়াছিল।
ইরানের যুদ্ধে সেনাপতি হযরত আবূ উবায়দা বিন জররাহ্ (রা) ইরানীদের জাকজমকপূর্ণ নিমন্ত্রণ শুধু এই জন্যই প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন যে, তাঁহাকে সাধারণ সৈনিকদের অনুরূপ ভোজ দেওয়া হয় নাই। তিনি বলিয়াছিলেন: আল্লাহর শপথ, আল্লাহর দেওয়া দ্রব্য-সামগ্রী হইতে আবূ উবায়দা কেবল সেই জিনিসই আহার করিতে পারে, সাহা সর্বসাধরণ মুসলমান খাইতে পায়।
উল্লেখযোগ্য যে, হযরত উমর (রা) দুর্ভিক্ষের সময় রেশন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করিয়াছিলেন। কিন্তু খাদ্য-বরাদ্দ করার ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হইয়াছিল। তাহাতে প্রত্যেকেই প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করিতে পারিত। সেখানে কাহাকেও কালোবাজারী করিতে হইত না, গরীবদের শোষণ করিয়া ধন লুটিতে হইত না। আর ভুয়া ও অতিরিক্ত রেশন কার্ডও রাখিতে হইত না।
ইসলামী সমাজের লোকদের মধ্যে এইরূপ সাম্য কেবল খাদ্যের ব্যাপারই কার্যকর ছিল না, পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়াও তথায় পূর্ণ সমতা রক্ষা করা হইত। এইজন্যই সেখানে কে মজুর আর কে মালিক, তাহার বিশেষ কোন বাহ্যিক প্রমাণ পাওয়া যাইত না। ইহা শ্রেণী-পার্থক্যের মূল কারণকে চূর্ণ করিয়াছে, কাজেই তথায় কোন দিনই শ্রেণী-সংগাম দেখা দেয় নাই।
শ্রমিক ও মজুরগণ মজুরী উপার্জন করিবার উদ্দেশ্যেই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করিয়া থাকে। কারণ তাহাদের পরিবারবর্গের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করিবার জন্য এই মজুরীই হইতেছে তাহাদের একমাত্র উপায়। কিন্তু পরিশ্রম করিয়অও যদি মজুরী না পায়,ম যদি প্রয়োজন অপেক্ষা কম পায়, কিংবা নির্দিষ্ট সময়-মত প্রাপ্য না পায়, তবে মজুরের দুঃখের অবদি থাকে না। দুঃখ এবং হতাশায় তাহাদের হৃদয়-মন পূর্ণ ও ভারাক্রান্ত হইয়া পড়ে। তাহাদের অপরিহার্য প্রয়োজন পূর্ণ না হইলে জীবন ও সমাজের প্রতি তাহাদের মন বীতশ্রদ্ধা ও বিতৃষ্ণার ভাব সৃষ্টি হওয়া এবং নিজেদের জীবন সম্পর্কে নৈরাশ্য জাগিয়া ওঠা স্বাভাবিক। ইসলামী অর্থব্রবস্থা এই ধরনের সকল সমস্যার নির্দিষ্ট ও স্থায়ী সমাধান করিয়া দিয়াছে। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অভিযোগ উত্থপন করিবেন, তন্মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হইতেছে :
(আরবী**********)
একজনকে মজুর হিসাবে খাটাইয়অ ও তাহার দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করিয়াও যে লোক তাহার পারিশ্রমিক আদায় করে নাই…
অপর একটি হাদীস হইতে জাা যায়, নবী করীম (স) নিজেও এই তিন জনের বিরুদ্ধে ফরিয়াদী হইয়া দাড়াইবেন। (ইবনে মাজাহ)
এ সম্পর্কে কেবল পরকালীন শাস্তির ভয় দেখাইয়াই ক্ষান্ত করা হয় নাই। বরং কাজ সম্পন্ন হওয়া বা নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মজুরের মজুরী আদায় করার জন্য স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। ইসলামী রাষ্ট্র এই নির্দেশ বাস্তবায়িত করিবার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী থাকিবে। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
মজুরের মজুরী তাহার গায়েল ঘাম শুষ্ক হইবার পূর্বেই আদায় কর।
অপর হাদীসের শেষ অংশ এইরূপ: (আরবী**********)
শ্রমিকের কাজ বা কাজের মেয়াদ শেষ হইলেই তাহার মজুরী পুরাপুরি আদায় করিয়া দিতে হইবে।
ইমাম শাওকানী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন:
(আরবী**********)
এই হাদীসে এ কথার দলীল রহিয়াছে যে, মজুরী পাওয়ার অধিকার জন্মে কাজ করা। সম্পন্ন হইয়অ গেলে এবং মালিকানা নির্দিষ্ট হয় সরকারী বিলি-বন্টনের সাহায্যে।
শ্রমিক ও (কারখানা) মালিকদের মধ্যে দৈনন্দিন যেসব ঝগড়া-বিবাধ হইয়া থঅকে, তাহার শতকরা ৭৫ ভাগ হয় মজুরী লইয়া। এই জন্যই ইসলামী অর্থনীতিতে মজুরকে কাজে নিযুক্ত করার পূর্বেই তাহার মজুরী নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয় বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, শ্রমিক-মজুরের মজুরী দানের ব্যাপারে নবী করীম (স)-এর নীতি ছিল স্পষ্ট। হাদীসে বলা হইয়াছে।
(আরবী**********)
নবী করীম (স) মজুর-শ্রমিকের মজুরী দানের ব্যাপারে কোনরূপ জুলুম করিতেন না, জুলূমের প্রশ্রয় দিতেন না।
(আরবী**********)
মজুরের মজুরী নির্ধারণ না করিয়া তাহাকে কাজে নিযুক্ত করিতে নবী করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন।
অপর এক হাদীসে বলা হইয়াছে: (আরবী**********)
তুমি যখন কোন মজুর নিয়োগ করিবে তখন তাহাকে মজুরী কত হইবে অবশ্যই জানাইয়া দিবে।
বস্তুত এই সব মূলনীতির ভিত্তিতে আজিকার শ্রমিক-মালিক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা যাইতে পারে। উভয়ের মধ্যে মধঘুর ও সুবিচারপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব।
শ্রমের অধিকার
মজুর-শ্রমিকদের শ্রমের বদলে মজুরী পাইবার অধিকারীই নয়, তাহাদের নিয়মিত বিশ্রাম গ্রহণের অধিকারও ইসলামে স্বীকৃত। নবী করীম (স)-এর হাদীস হইতে ইহা প্রমাণিত। তিনি বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
তোমার নিজের উপর তোমার একটা অধিকার আছে। তোমার দেহের একটা অধিকার আছে তোমার উপর, তোমার স্ত্রীর অধিকার আছে তোমার উপর, তোমার চক্ষুরও অধিকার রহিয়াছে তোমার উপর।
এই অধিকারসমূহ যথাযথভাবে আদায় করতে বাধ্য প্রত্যেকটি মানুষ। শ্রমিকরাও মানুষ। অতএব তাহারা যাহাতে এই অধিকারগুলির সঠিকভাবে আদায় করিতে পারে, পারে, এই দায়িত্বসমূহ পুরাপুরিভাবে পালন করিতে, সমাজে তাহার ব্যবস্থা থাকিতেই হইবে। কাজেই শ্রমিক-মজুরদের জন্য ছুটি ও অবসর যাপনের যথেষ্ট সময় থাকিতে হইবে, যেন তাহারা এই অধিকারসমূহ যথারীতি আদায় করিতে সক্ষম হয়। যে শ্রমনীতি শ্রমিকদের জন্য এইরূপ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে না, তাহা ইসলামী অর্থঞনীতি-সম্মত নীতি হইতে পারে না। উহাকে মানুষের উপযোগী অর্থনীতিও মনে করা যায় না।
শ্রমিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
নির্দিষ্ট মজুরীর বিনিময়ে কোন কাজে শ্রমিক নিযুক্ত হইলে কাজ বা কাজের নির্দিষ্ট মেয়াদ পরিসমাপ্তির পর যেমন সেই পূর্ব-নির্ধারিত মজুরী পাওয়ার শ্রমিকের অধিকার রহিয়াছে এবং শ্রমের মালিকের যেমন তাহা যথারীতি আদায় করিয়া দেওয়া কর্তব্র, অনুরূপভাবে শ্রমিকের উপরও এই ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্য রহিয়াছে।
এই পর্যায়ে শ্রমিকের সর্বপ্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য হইল, তাহকে বিশেষ আন্তরিক ও গভীর মনোযোগ সহকারে নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করিতে হইবে এবং কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময় পুরাপুরি কাজের মধ্য দিয়াই অতিবাহিত করিতে হইবে। কাজে অমনোযোগিতা বা উপেক্ষা অবহেলা প্রদর্শন কিংবা কাজ না করিয়া যেন-তেন প্রকার নির্দিষ্ট সময় কাটাইয়া দেওয়া ইসলামের শ্রম-আইনের দৃষ্টিতে বিশেষ অপরাধ বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। এইরূপ করা হইলে তাহাকে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধ হইবে এবং এজন্য তাহাকে আল্লাহর নিকট দোষী সাব্যস্ত হইতে হইবে। কেননা সে যখন একটি কাজের জন্য দায়ীত্বশীল হইয়াছে, তখন সাধারণ নৈতিকতার দৃষ্টিতেই তাহার প্রতি এই আশা পোষণ করা হয় যে, সে পূর্ণ সততা ও বিশ্বাসপরায়ণতা সহকার শ্রম করিবে ও দায়িত্ব পালন করিবে। এই কাজের জন্য তাহাকে অবশ্যই আল্লাহর নিকট জওয়াবদিহি করিতে হইবে। কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
এবং তোমরা যাহা কিছু করতেছিলে সে বিষয়ে আমরা তোমাদিগকে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করিব।
নবী করীম (স) এইজন্য উত্তমভাবে কাজ সম্পাদন করার জন্য উৎসাহ দিয়াছেন এবং মূল কাজ কোনরূপ ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিবার জন্য নির্দেশ দিয়াছেন। তিনি ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
শিল্পী-মজুর যখন কাজ করিবে তখন সে উত্তমভাবে কাজ করিবে, আল্লাহ তা’আলা ইহাই ভালবাসেন ও পছন্দ করেন।
অপর হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে: (আরবী**********)
তেহামাদের কেহ যখন কোন শ্রমের কাজ করিবে তখন তাহা নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করিবে, ইহাই আল্লাহ তা’আলা ভালবাসেন।ৎ
ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, শ্রমিকের কাজ অনুপাতে সেই কাজে আল্লাহর সাহায্য বর্ষিত হইয়া থাকে। লিখিয়াছেন:
(আরবী**********)
যাহার কাজ পূর্ণাঙ্গ, উত্তম নিখুঁত ও মজবুত হইবে তাহার নেকী কয়েক গুণ বেশী হইবে।
এই প্রসঙ্গে কাজে ‘সাবোটাজ’ করার ব্যাপারটিও উল্লেখযোগ্য। শ্রমিক অনেক সময় কাজ করিতে করিতে মুল কাজের বা কাজের যন্ত্রপাতির ক্ষতি সাধন করিয়া থাকে। অনেক শ্রমিক এইভাবে মালিকের বিরুদ্ধে স্বীয় ক্ষোপ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিতে উদ্ধত হয়। কিন্তু নৈতিকতা ও জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিতে ইহার মত মারাত্মক কাজ আর কিছু হইতে পারে না। কুরআনের ভাষায় ইহাকে খিয়ানত বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
যে লোক বিশ্বাস ভঙ্গ করে- অর্পিত কাজ বা জিনিস বিনষ্ট করে- আল্লাহ তাহাকে ভালবাসেন না।
নবী করীম (স) এই ধরনের খিয়ানতকে জাতীয় পর্যায়ের প্রতারণা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
যে লোক আমর সহিত ধোঁকাবাজী করিবে, সে আমর উম্মতের মধ্যে গণ্য হইবে না।
এইসব কারণে শিল্প-কারখানায় এই ধরনের কাজের প্রতিরোধ করা সরকারী দায়িত্ব বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে এবং এইরূপ কাজ যে করিবে তাহাকে কঠোর শাস্তি দানেরও নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই স্ব-স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হইবে। কর্মচারী তাহার মনিবের মালের জন্য দায়িত্বশীল এবং সেজন্য তাহাকে জওয়াবদিহি করিতে হইবে।
অতএব শ্রমিক যদি ইচ্ছাপূর্বক কাজ নষ্ট করে অথবা কাজের যন্ত্রপাতি বিকল বা বিনষ্ট করে তাহা হইলে সেজন্য তাহার নিকট হইতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা যাইবে। অবশ্য তাহার পূর্বে নিরপেক্ষা তদন্তের মাধ্যমে এ কথা প্রমাণিত হইতে হইবে যে, সে ইচ্ছা করিয়াই এই কাজ করিয়াছে এবং ইহার মাধ্যমে শিল্পের মালিককে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা মূল শিল্পকেই বিনষ্ট করা তাহার উদ্দেশ্য ছিল। এই জন্য ইসলামী ফিকহার কিতাবে মূলনীতি স্বরূপ বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
ক্ষতি যথাসাধ্য প্রতিরোধ ও পূরণ হইতে হইবে।
আর যদি ক্ষতি ও বিনষ্ট হওয়ার মূলে শ্রমিকের নিজস্ব কোন ইচ্ছা বা অসদুদ্দেশ্য প্রসূত চেষ্টা না থাকিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহাকে কোনরূপ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা যাইবে না।
পারস্পরিক দ্বন্দ্বে সরকারী হস্তক্ষেপ
শ্রমিক ও কারখানা মালিকের মধ্যে কোন ব্যাপারে মত-বৈষম্য ও ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হইলে উহার মীমাংসার জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার অধিকার রহিয়াছে। শুধু অধিকারই নয়, রাষ্ট্র সরকারের তাহা অন্যতম কর্তব্যও। মজুর-শ্রমিকের উপর কোন প্রকার অযথা বাড়াবাড়ি করা, মজুরী কম দেওয়া, অধিক কাজের চাপ দেওয়া, কিংবা শ্রমিকের কাজে ফাঁকি দেওয়া, দায়িত্ব পালন না করা বা কম কাজ করিয়া বেশী মজুরী লওয়ার চেষ্টা করা প্রভৃতি যে সমস্যাই হউক না কেন, ইসলামী রাষ্ট্র তাহাতে সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপ করিয়া বিবাদ-মীমাংসা করিয়া দিবে। কারণ ইসলামী রাষ্ট্র তাহাতে সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপ করিয়া বিবাদ-মীমাংসা করিয়া দিবে। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রদর্শন অনুযায়ী লোকদের পারস্পরিক সকল প্রকার বিবাদ মীমাংসা করার সুবিচার ও ইনসাফ কায়েম করা এবং প্রত্যেকেরই হক যথাযথরূপে আদায় করিয়া দেওয়াই হইতেছে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ও কর্তব্য।
মালিকের বিরুদ্ধে মজুরের সাধারণত দুই প্রকার অভিযোগ হইতে পারে, মজুরী কম দেওয়র অভিযোগ বা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সাধ্যাতীত কাজের চাপ দেওয়ার অভিযোগ। ইসরামী অর্থনীতি এই উভয় প্রকার অভিযোগই দূর করিবার ব্যবস্থা করিয়াছেন। প্রথম প্রকার অভিযোগ দূর করিয়া নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
মজুর-শ্রমিক-ভৃত্যদিগকে যথারীতি খাদ্য ও পোষাক দিতে হইবে।
মনে রাখা দরকার যে, এখানে নির্দিষ্টভাবে শুধু খাদ্য ও পোশাকই লক্ষ্য নয়- মূল লক্ষ্য হইতেছে মজুরের যাবতীয় মৌলিক প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত ‘যথারীত’ শব্দটির অর্থ হইতেছে, যে পরিমাণ মজুরীর দ্বারা অপরিহার্য মৌলিক প্রয়োজন মিটানো সম্ভব হয় সেই পরিমাণ এবং দেশের সাধারণ জীবন মান রক্ষার হয় যে, পরিমাণ মজুরীতে সেই পরিমাণ। এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য যে, নবী করীম (স) তাঁহার কর্মচারী ও শ্রমিকদের মজুরী দানের ব্যাপারে এই তারতম্য করিতেন যে, পরিবার বহনকারীকে দিগুণ দিতেন এবং পারিবারিক দায়িত্বমুক্ত ব্যক্তিকে একগুণ। (বুখারী, আবূ উবাইদ)
মজুর ও কর্মচারীর মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার জন্য যদি ন্যায্য ও সুবিচারপূর্ণ ভাবে নির্ধারিত পরিমাণ মজুরী অপেক্ষা বেশী দেওয়ার প্রয়োজন হয় তবে তাহাও সংশ্লিষ্ট শিল্পের মালিক পক্ষ দিতে বাধ্য হইবে, এমন কথা জোর দিয়া বলা যায় না। তবে ইহা লাভ করার যে তাহার অধিকার আছে এবং এই অধিকার পরিপূরণে রাষ্ট্র সরকারই যে দায়ী তাহাতে সন্দেহ নাই।
দ্বিতীয় প্রকার অভিযোগ দূর করিয়া নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
তাহাদের উপর অতখানি কাজেরই চাপ দেওয়া যাইতে পারে, যতখানি তাহার সামর্থে কুলায়; সাধ্যাতীত কোন কাজের নির্দেশ কিছুতেই দেওয়া যাইতে পারে না।
অপর হাদীসে বলা হইয়াছে: (আরবী**********)
শ্রমিককে এমন কাজ করিতে বাধ্য করা যাইবে না যাহা তাহাকে উহার দুঃসাধ্যতার কারণে অক্ষম ও অকর্মণ্য বানাইয়া দিবে।
এই কারণে মজুর-শ্রমিকদের বিশ্রাম গ্রহণ করার অধিকার অনস্বীকার্য। অতএব এই অধিকার আদায় করার জন্য মজুর-শ্রমিকরা যথেষ্ট ছুটি ও বিশ্রামের সুযোগ পাইবার অধিকারী। ইবাদাতের কাজের অবসর পাওয়ার অধিকারও ইহারও অন্তর্ভুক্ত।
সরকারী নিয়ন্ত্রণ
শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ-কলহের মীমাংসা করা যেমন ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য, শ্রমিক ও মালিক-প্রত্যেকেই নিজ-নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথরূপে পালন করিতেছে কিনা তাহার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখাও ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।
আবূ মাসউদ (রা) নামক এক সাহাবী একদা তাঁহার ক্রীতদাসকে প্রহার করিতেছিলেন। পশ্চাদ্দিক হইতে সহসা আওয়াজ উঠিল: ‘হেত আবূ মাসউদ জানিয়া রাখ, আল্লাহ তোমার অপেক্ষা শক্তিমান। আবূ মাসউদ মুখ ফিরাইয়া নবী করীম (স) কে দেখিতে পাইলেন। তখনি বলিলেন: ‘আমি এই দাসকে মুক্ত করিয়া দিলাম। নবী করীম (স) বলিলেন: তুমি যদি ইহা না করিতে তাহা হইলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে জ্বালাইয়া ভস্ম করিয়া দিত।
হযরত উমর ফারূক (রা) প্রত্যেক শনিবার মদীনার নিকটে ও দূরবর্তী অঞ্চলে ঘুরিয়া লোকদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে অবহিত হইতে চেষ্টা করিতেন। কোথাও কোন মজুর-দাসকে নির্যাতিত হইতে দেখিলে কিংবা কোন প্রাণান্তকর শ্রমে নিযুক্ত দেখিলে সঙ্গে সঙ্গে তাহার দুঃখ দূর করিবার ব্যবস্থা করিতেন। [তারীক-ই তাবারী]
অতএব ভৃত্য, দাস-মজুর কাহারো উপর জুলুম, শোষণ, পীড়ন হইলে সরকারী নিয়ন্ত্রণ-বিভাগ তাহাতে সরাসরি ও অনতিবিলম্বে হস্তক্ষেপ করিবে, ইহা ইসলামী রাষ্ট্রের একটি অন্যতম প্রধান কর্তব্য।
হযরত উমর ফারূক (রা) এক জিম্মিকে ভিক্ষা করিতে দেখিয়া বিশেষ দুঃখিত হইলেন এবং বলিলেন: ‘এক ব্যক্তির যৌবনকালে তাহাদ্বারা (ট্যাক্স, কাজ ইত্যাদি দিক দিয়া) উপকৃত হওয়ার পর তাহার বার্ধক্য অবস্থায় তাহাকে অসহায় করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া আমাদের পক্ষে মোটেই শোভনীয় নয়।’ ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, কোন শ্রমিক বা কর্মচারী যদি বার্ধক্রে বা অপর কোন কারণে কর্মক্ষমতা হারাইয়া ফেলে তবে তাহাকে অসহায় করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া সুস্পস্ট রূপে জুলূম। বরং এইরূপ অবস্থায় ভরণ পোষণ ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজন পূরণ পরিমাণ ‘পেনশানের’ ব্যবস্থা করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য।
মজুর-শ্রমিকদের স্বাস্থের প্রতি লক্ষ্য রাখাও ইসলামী হুকুমাতের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। নবী করীম (স) নিজে ভৃত্য-কর্মচারীর স্বাস্থের প্রতি লক্ষ্য রাখিতেন, কেহ অসুস্থ্য বা রোগাক্রান্ত হইয়া পড়িলে তাঁহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতেন। হযরত উমর ফারূক (রা) তাঁহার খিলাফতের বিভিন্ন বিভাগে ও বিভিন্ন অঞ্চলে নিযুক্ত অফিসারগণ তাঁহাদের কর্তব্য যথাযথরূপে পালন করিয়াছেন কিনা, তাহা জনসাধরণের নিকট জিজ্ঞাসা করিতেন। এমন কি অসুস্থ্য কর্মচারীদের শুশ্রূষা বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় কিনা, তাহও তিনি জানিতে চাহিতেন। কোন অফিসার তাহার এই কর্তব্যে অবহেলা করিতেছেন জানিতে পারিলে তাহাকে পদচ্যুত করিতেন। হযরত উমর (রা) সৈনিকদের জন্য চিকিৎসকও নিযুক্ত করিয়াছিলেন।
মুনাফা ও শিল্পপণ্যে মজুরের অংশ
উল্লিখিত অধিকার ছাড়াও ইসলামী অর্থনীতি মজুর শ্রমিককে শিল্পোৎপাদনে, উৎপন্ন শিল্পপণ্যে এবং উহার মুনাফার অংশীদার হওয়ার সুযোগ করিয়া দিয়াছে। বস্তুত মালিক-মজুর সমস্যা সমাধানের ইহা একটি অন্যতম প্রধান উপায়। সম্ভবত মালিক-মজুর সমস্যা সমাধানের ইহা একটি অন্যতমম প্রধান উপায়। সম্ভবত মালিক-মজুরের দ্বন্দ্ব সমাধানে ইহাপেক্ষা অধিক সাফল্যপূর্ণ ও কার্যকর পন্থা আর কিছুই হইতে পারে না। শিল্পোৎপাদনে যে বাড়তি মূল্য লাভ হয়, পুঁজিবাদী-সমাজে একমাত্র মালিকই তাহা নিরংকুশভাবে করায়ত্ব ও ভোগ করিয়া থাকে। আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাহা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রই কাড়িয়া নেয় কিন্তু ইসলামী অর্থনীতির এই পন্থার উদ্দেশ্য হইতেছে, বাড়তি মূল্যকে মজুর ও মালিক উভয়ের মধ্যে ভাগ করিয়া দেওয়া উভয়কে শিল্পপণ্য হইতে ইনসাফের ভিত্তিতে লাভবান হওয়ার সুযোগ দেওয়া।
ইসলামী অর্থনীতিতে শ্রমিক মজুরকে মূল ব্যবসায়ের মুনাফা এবং শিল্পপণ্যে অংশীদাররূপে স্বীকার করিয়া লইবার অবকাশ রহিয়াছে তাহাই নয়, নবী করীম (স)-এর একটি হাদীস স্পষ্টভাবে ইহারই নির্দেশ পাওয়া যায়।
(আরবী**********)
তোমাদের কোন ভৃত্য যদি তোমাদের জন্য খাদ্য করিয়া লইয়া আসে তখন তাহাকে হাতে ধরিয়া নিজের সঙ্গে বসও, সে যদি বসিতে অস্বীকার করে তবু দুই-এক মুঠি খাদ্য অন্তত তাহাকে অবশ্যই খাইতে দিবে। কারণ সে আগুনের উত্তাপ ও ধুম্র এবং খাদ্র প্রস্তুত করার কষ্ট সহ্য করিয়াছে।
অন্য একটি হাদীসের শেষাংশে ইহার কারণ বলা হইয়াছে-ম ‘সে উৎকৃষ্ট খাদ্য প্রস্তুত করার জন্য আন্তরিক যত্ন গ্রহন করিয়াছে।’[এই পর্যায়ে হাদীসসমূহের প্রতিপাদ্য সম্পর্কে ইমাম নববী লিখিয়াছেন:
(আরবী**********)
এই হাদীসে শ্রমিকদের প্রতি উত্তম ও সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহারের- বিশেষ করিয়া তাহার ব্যাপারে, যে লোক উহা প্রস্তুত করয়াছে কিংবা উহা বহন করিয়া আনিয়াছে- তাহার প্রতি উৎসাহ দান করা হইয়াছে। কেননা সে এইজন্য আগুনের উত্তাপ ও ধুয়া-জ্বালা সহ্য করিয়াছে, উহার সহিত তাহার মন সম্পর্কিত এবং সে উহার গন্ধ লইয়াছে।]
একটি হাদীস খাদেমকে তাহার রান্না করা খাবার খাওয়ায় শরীক করিবার জন্য নবী করীম (স) নির্দেশ দিয়াচেন বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। [(আরবী**********)]
মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল গ্রন্থে একটি হাদীস উল্লিখিত হইয়াছে। নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
শ্রমিককে তাহার শ্রমোৎপন্ন জিনিস হইতে অংশ দান কর। কারণ আল্লাহর শ্রমিককে কিছুতেই বঞ্চিত করা যাইতে পার না।
এই হাদীসসমূহ হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, শ্রমিক-মজুরকে তাহার মজুরী ছাড়াও ব্যবসায়ের মুল মুনাফঅ এবং উৎপন্ন দ্রব্যেও অংশীদার করিতে হইবে।
বস্তুত শ্রমিক-মজুরদিগকে লভ্যাংশ দান এবং উৎপন্ন দ্রব্যের দেওয়ার নীতি যদি কার্যকর করা যায় তাহা হইলে বর্তমান কালের সর্ব প্রকারের জটিল শ্রমিক-সমস্যার অতি সহজেই সমাধান হইতে পার। ইহার ফলে মজুরদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও কর্মশীলতা এবং শ্রম ও পণ্যোৎপাদনের ব্যাপারে ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আগ্রহ উৎসাহ বৃদ্দি পাইবে। আর্থিক লাভ ছাড়াও জাতীয় সম্পদ-বৃদ্ধির দিক দিয়া ইহার মূল্য কোন অংশেই কম নয়। শ্রমিক ও মজুর যখন নিঃসন্দেহে জানিতে পারিবে যে, মূল ব্যবসায় ও শিল্পের মুনাফা হইতেও তাহাকে অংশ দেওয়া হইবে, তখন তাহার কর্মপ্রেরণা শ্রমে উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং কর্তব্য ও দায়িত্বজ্ঞান অত্যধিক বৃদ্ধি পাইবে। কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি বিশেষ সতর্কতার সহিত ব্যবহার করিবে। ফলে মূল লাভ হইতে মজুরকে যে পরিমাণ অংশ দেওয়া হইবে তাহার এই অভ্যন্তরীণ পরিবর্তিত ভাবধারার দরুণ মুল শিল্পের উৎপাদন-পরিমাণ ততোধিক বর্ধিত হইবে। পক্ষান্তরে শিল্প-মালিকও এই ব্যবস্থায় নিজের সমূহ ক্ষতি মনে করিবে না। শ্রমিকদের ঐকান্তিক নিষ্ঠাপূর্ণ কায়িক ও মানসিক সহযোগিতা লাভ করায় তাহারও মনোবল বৃদ্ধি পাইবে। পরিণামে শিল্প ও শ্রম-ব্যবসায় ক্ষেত্রে এক নির্মল পবিত্র ফল্গুধারার সৃষ্টি হইবে।
উক্ত আলোচনা হইতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করা যাইতে পারে।
১. মজুর-শ্রমিকদিগকে এমন পরিমাণ মজুরী দিতে হইবে, যাহা তাহাদের কেবল জীবন রক্ষা করার পক্ষেই যথেষ্ট হইবে না, তাহাদের স্বাস্থ্য ও দেহের শক্তি এবং সজীবতাও তাহা দ্বারা যথাযথরূপে রক্ষিত হইবে। এইজন্য তাহাদের নিম্নতম ব্যয়-হিসাবে বেতন নির্ধারণ করিতে হইবে।
২. বসবাসের জন্য তাহাদের ঘরবাড়ি স্বাস্থ্যকর ও প্রশস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়, যেন একটি পরিবার সংশ্লিষ্ট সকল লোকজনসহ তাহাদের হাত-পা ছড়াইয়া তথায় বসবাস করিতে পারে।
৩. মজুরদের স্বাস্থ্য-ভংগকারী কোন কাজ তাহাদের দ্বারা করানো যাইতে পারে না। একাধারে এত দীর্ঘ সময় পর্যন্তও কাজ করানো যাইতে পারে না, যাহার ফলে তাহারা পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িতে পারে, তাহাদের নির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক এবং তাহাতে বিশ্রামের যথেষ্ট অবকাশ থাকা বাঞ্ছনীয়।
৪. শ্রমিক-মজুরদের কাজে কোনরূপ ত্রুটি-বিচ্যুতি হইলে তাহাদের প্রতি অমানুষিক ব্যবহার ও পাশবিক নির্যাতন করার অনুমতি দেওয়া যাইতে পারে না। বরং যথাসম্ভব সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করাই কর্তব্য হইবে।
৫. কোন অবস্থাতেই তাহাদিগকে অসহায় করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া যাইতে পারে না। তাহারা বৃদ্ধ ও অক্ষম হইয়া পড়িলে তাহাদের জন্য ‘পেনশন’-এর ব্যবস্থা করিতে হইবে। আর কর্মচ্যুত করিবার প্রয়োজন হইলেও এমনভাবে তাহাদিগকে বেকার করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া যাইতে পারে না, যাহার ফলে তাহাদিগকে অনশনের সম্মুখীন হইতে হয় বা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিতে হয়। অতএব অকারণ ছাঁড়াই করাও চলিবে না।
৬. মজুর-শ্রমিকদিগকে বিশেষ কোন কাজে বা মজুরীর বিশেষ কোন পরিমাণের বিনিময়ে কাজ করিতে জবরদস্তিভাবে বাধ্য করা যাইতে পারে না। বরং তাহাদের কাজ বাছাই করার এবং মজুরীর পরিমাণ লইয়া দরকষাকষি (Bargainging) করার পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার থাকিতে হইবে। আর মজুরীরও পূর্বহ্নেই নির্দিষ্ট করিয়া লইতে হইবে।
৭. কাজ সম্পন্ন হইলেই কিংবা নির্দিষ্ট মাস-পক্ষ-সপ্তাহ অতীত হইলেই অনবিবিলম্বে মজুরী বা বেতন আদায় করিতে হইবে। এই ব্যাপারে কোন রূপ উপেক্ষা বা গাফিলতি; কিংবা টালবাহানা করা চলিবে না।
৮. মজুর-শ্রমিকদের এবং তাহাদের সন্তানাদির শিক্ষা-দীক্ষারও ব্যবস্থা করা কারখানা-মালিকের পক্ষে অবশ্যই কর্তব্য হইবে।
ইসলামী অর্থনীতিতে শ্রমিক-মজুরে যে মর্যাদা ও অধিকার নির্ধারিত হইয়াছে এবং মুল শিল্পে এই উভয পক্ষের স্বার্থ ও লক্ষ্যকে যেভাবে একীভূত করিয়া দেওয়া হইয়াছে তাহাতে এখানে শ্রমিক ও মালিকের মনে কোনরূপ দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের অবকাশ থাকিতে পারে না। বরং উভয়ের সম্মিলিত লাভই স্বাভাবিক। এখানে শ্রমিকদের ধর্মঘট করার এবং মালিক পক্ষের লক-আউট ঘোষণা করার কোন প্রয়োজনই দেখা দিতে পারে না।
সমাজতান্ত্রিক দেশ ও ইসলামী সমাজের মধ্যে পার্থক্য
সোভিয়েত রাশিয়ার শ্রমিকদের অবস্থা
প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, ইসলামী অর্থনীতি মজুর শ্রমিকদিগকে ব্যক্তি-স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মত বাঁচিবার অধিকারও দেয়, সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা দান করে, জীবিকা-নির্বাহের প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহের দায়িত্ব গ্রহণ করে। নিজেদের অভাব-অভিযোগের কথা প্রকাশ করা এবং সরকারী অব্যবস্থার সমালোচনা করাও পূর্ণ অধিকার দেয়, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়র কমিউনিজমের ছায়ার তলে শ্রমিকদের জীবন বড়ই দুঃসহ, তাহাদের অবস্থা অতিশয় মর্মান্তিক। সেখানে মজুর-শ্রমিক ও চাষীদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা বলিতে কিছুরই অস্তিত্ব নাই। এক কাজ ছাড়িয়া অন্য কাজ গ্রহণ করার কোন অধিকারও তাহাদিগকে দেওয়া হয় না। কেহ তাহা করিলে- ২৬শে জুন ১৯৪০ সনের গৃহীত একটি আইন অনুযায়ী- তাহাকে চার মাসের কারদন্ডে দন্ডিত করা হয়। সামরিক রেলওয়ে এবং পানি-সরবরাহকারী বিভাগসমূহের মজুরগণ বিনা অনুমতিতে কাজ পরিবর্তন করিলে তাহাকে পাঁচ হইতে আট বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া যাইতে পারে। কোন মজুর যদি একমাসে তিনবার কিংবা দুইমাসে চারবার কাজে ২০ মিনিট সময় দেরী করিয়া আসে, তবে উপরোক্ত আইনের বলে তাহাকে সেই স্থানেই ছয়মাস কালের শিক্ষামূলক শস্তি দেওয়া হয় এবং এক চতুর্থাংশ বেতন কাটিয়া লওয়া হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার মজুরগণ সরকারের হস্তে নিস্প্রাণ কাঁচামালের মতই ব্যবহৃত হয়। সেখানে মজুরের বাসস্থানে সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য না রাকিয়া সরকারের ইচ্ছামতই যেখানে সেখানে মজুরকে বদলি করা হয় এবং তথায় উপস্থিত হইয়া কাজে নিযুক্ত হইতে মজুরকে বাধ্য করা হয়।
কিন্তু এইরূপ রাষ্ট্রের নির্মম অক্টোপাসে বাধা কলুর বলদ- মজুর-শ্রমিকগণ-সেখানে কিরূপ মজুরী পাইয়া থাকে? ইহার উত্তরে শোনা যায়ঃ অনেক, তুলনাহীন এবং তাহা হইতেছে দুই-দুইশ, চার-চারশ রুবল ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপর এই যে, একজন মজুর হয়ত মাত্র ৬০.১ রুবলেরও কম এবং অন্য একজন ১১০,০.১ রুবলেরও বেশী বেতন পাইয়া থাকে। মনে রাখিতে হইবে যে, এই রুবলের আন্তর্জাতিক মুল্য বাংলাদেশী টাকার অপেক্ষাও অনেক কম। আর দেশের অভ্যন্তরে উহার ক্রময়-ক্ষমতা আরো অনেক কম। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রাশিয়ার একজন মজুরকে এক কিলোগ্রাম [২.২] পরিমাণ মাখন খরিদ করার জন্য যেখানে ২৩ ঘন্টা ২৩ মিনিটের অর্থাৎ তিনদিনের শ্রমোপার্জিত অর্থের আবশ্যক, সেখানে একজন ইংরেজ মজুর মাত্র এক ঘন্টা ১৩ মিনিটের মজুরী দ্বারাই অত পরিমাণ মাখন খরিদ করিতে পারে।[Sovie Trade Union by Maurice Dobb]
বাধ্যতামূলক শ্রম
এতদ্ব্যতীত বাধ্যতামূলক শ্রম (Forced Labour System) প্রথা রাশিয়ার জনগণের জীবনে এক মারাত্মক অভিশাপ হইয়া দেখা দিয়াছে। দাসশ্রমের এই প্রথা রাশিয়ার যাবতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য একান্ত অপরিহার্য হইয়া পড়িয়াছে। বলা বাহুল্য, প্রত্যেক কমিউনিস্ট সমাজেরই ইহা অবিচ্ছেদ্য অংশ হইয়া রহিয়াছে। যুগোশ্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির প্রাক্তন সেক্রেটারী জেনারেল ও প্রাক্তন সহ-সভাপতি মিলন জিলাস তাঁহার The New Class নামক বইতে লিখিয়াছেন, ‘সমাজতানিত্রক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার অপরিহার্য অবিচ্ছেদ্য ও স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হইতেছে এই বাধ্যতামূলক দাসশ্রম ব্যবস্থা। (১০৬ পৃঃ) তিনি এরা লিখিয়াছেন: সমাজতন্ত্রের যে নূতন শ্রেণী গড়িয়া উঠিয়াছে তাহা শ্রমিক ও কৃষক উভয়েরেই রক্ত শোষণ করিয়া।
স্বরণীয় যে, এই বই লেখার অপরাধে গ্রন্থকারকে কয়েক বৎসর পর্যন্ত কারাগারে বন্দী থাকিতে হইয়াছিল। বস্তুত এই প্রথা ব্যতী রাশিয়ার কোন পরিকল্পনা আজ পর্যন্ত কার্যকর হইতে পারে নাই। কিন্তু ইহার পাশ্চাতে যে রাজনৈতিক কার্যকারণ রহিয়াছে, তাহা আরো মারাত্মক।
রামিয়র হাটে-বাজারে দাস ক্রয়-বিক্রয় হয় না একথা ঠিক, কিন্তু সেখানে যে বিশাল বিরাট জেল ও সুপ্রশস্ত Concetration camps মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া আছে, তাহাতে কয়েদীগণ মধ্যযুগের ক্রীতদাসের অপেক্ষাও মর্মান্তিক অবস্থায় দিন কাটাইতেছে। এই সব ক্যাম্পের একচেটিয়া ঠিকাদার হইতেছে ক্রেমলিন। ইহা অতীত কালের সকল ‘আড়তদার’ কে খতম করিয়া মানুষকে শ্রম করিতে বাধ্য করার এই লাভজনক ব্যবসায়ের আড়তদারির উপর নিরংকুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করিয়াছে। এই ঠিকাদার দাস-শ্রমিকদিগকে অপর কোন ব্যক্তির নিকট বিক্রয় করে না এ কথা সত্য; কিন্তু উহা প্রাদেশিক সরকার এবং বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে ঠিকা-হিসাবে শ্রমিক সরবরাহ করিয়া করে। সেখানে এই দাস-শ্রমিকগণ রুটি-কাপড়ের বিনিময়ে সরকারী পরিকল্পনাসমূহ কার্যকর থাকে। ১৯৪১ সনের বাজেটের ছয় শত কোটি রুবল অর্থোৎপাদনের দায়িত্ব দাস-শ্রমিক পরিবারের পরিচালক রাশিয়ার গোস্টাপ পুলিশ বিভাগের উপর ন্যাস্ত করা হয়। এই পরিমাণ অর্থ হইল সেখানকার মোট বাজেটের শতকরা চৌদ্দ ভাগ। এই সময় এই শিবিরে ২৫-৩৫ লক্ষ লোক দাস-শ্রমিক হিসাবেই কাজ করিতেছিল।
এই সব ক্যাম্পের অধিবাসী দাস-শ্রমিকগণ বাধ্যতামূলত শ্রম হইতে কোনমতেই রেহাই পাইতে পারে না। অসুস্থ হইলেও তাহাকে কাজ করিতে হয় ঠিক জন্তু জানোয়ারের মত। অন্যদিকে তাহাদের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজন পুরণের খাতে যথাসম্ভব কম খরচ করা হয। এই ভাবে যথাসম্ভব বেশী মুনাফঅ লাভ করার সর্বাত্মক পুঁজিবাদী নীতি অনুসরণ করিয়াই দাঁড়াইয়া আছে বর্তমান সোভিয়েত রাশিয়া। সেখান মনুষ্যত্বকে চিরদিনের তরে কবর দিয়া চলিয়াছে পণ্যোৎপাদনের যন্ত্র-দানব।
রাশিয়অর রক্ত বিপ্লব মানুষকে যে কোন্ মহা সম্পদ দান করিয়াছে, তাহা বাস্তবিকই বুঝা গেল না। বস্তুত যে শ্রমিক শোষণের মর্মান্তিক বিবরণ দিয়া রাশিয়ায় বিপ্লব সৃষ্টি করা হইল জার শাসিত রামিয়ায়, তাহাতে প্রাচীন জারের পতন হইলেও নির্মম জারতন্ত্রের অবসান তো হয়-ই নায়, বরং পূর্বের তুলনায় উহা আরো কঠিন ও কঠোর হইয়া দাড়াইয়াছে। দুনিয়ার অন্যান্য পুঁজিবাদী সমাজে তাহার বহু কারণ বর্তমান থাকিতে পারে বটে, কিন্তু ইসলামী সমাজে তাহার কোন কারণই কোথায়ও থাকিতে পারে না। তথায় শ্রমিকদের শোষণ করার, বঞ্চিত করার কোন উপায়ই বর্তমান থাকা সম্ভবপর নয়। মজুরগণ ইসলামী সমাজে দাস-শ্রমিক নয়-স্বাধীন মর্যাদাসম্পন্ন ও স্বেচ্ছাপূরণ দেশকর্মী নাগরিক, দেশের সম্পদ উৎপাদনকারী শক্তিমান বাহু। ইসলামী সমাজের মজুর-শ্রমিককে নিঃস্ব সর্বস্ব হইয়া থাকিতে হয় না, উৎপাদন উপায় ও উৎপাদন যন্ত্রের উপর তাহারও মালিকানা অধিকার থাকিতে পারে। শুধু তাহাই নয়, সে যে জিনিসের মালিক স্বীকৃত হইবে, উপযুক্ত কোন কারণ ব্যতীত তাহা তাহার নিকট হইতে হরণ করার অধিকার সমাজ তথা রাষ্ট্র কাহারো নাই। উপরন্তু ইসলামী সমাজের মজুর পেটের দায়ে ক্ষুধার জ্বালায় পাড়িয়া পুঁজিমালিকের ইচ্ছামত কোন শ্রম করিতে উহার বিনিময়ে মালিক পক্ষের ইচ্ছামূলকভাবে নির্দিষ্ট করা মজুরী গ্রহণ করিতে এবং নিজের শ্রমশক্তি কম মূল্যে বিক্রয় করিতে বাধ্য হয় না। ইসলামী অর্থনীতিই মানুষকে- মজুর-শ্রমিক ও জনগণকে- ইসলামী বিধানের অধীন পূর্ণ-স্বাধীনতা দান করে, যাহা দুনিয়অর আর কোন সমাজ-বিধানে লক্ষ্য করা যায় না, তাহা অন্য কোথাও সম্ভবও নয়।
কমিউনিস্ট চীন
কমিউনিস্ট চীনে মজুর-শ্রমিকদের অবস্থা আরো মর্মান্তিক। ভারতীয় শ্রমিক নেতা ব্রজকিশোর শাস্ত্রী সরকারী আমন্ত্রণে চীন সফল করিয়া তথাকার শ্রমিকদের চরম দুর্দশা সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে অর্জিত অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন:
এখানে আমরা হাল চাষে গুরু মহিষের পরিবর্তে মেয়েলোকদিগকে লাঙ্গল টানিয়া দেকিয়াছে।….. সে দৃশ্য কতই না মর্মন্তুদ, কতই না শিক্ষাপ্রদ….. গরু-মহিষের স্তান গ্রহণ করিয়াছে নারী!
নির্মীয়মাণ একটি প্রোজেক্ট নিয়োজিত শ্রমিকদের দুর্দশা বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
এই প্রজেক্টের নিয়োজিত শ্রমিকদের দুর্দশা বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
এই প্রেজেক্টের নিকটেই অফিসারদের বসবাসের জন্য বাংলো নির্মিত হইয়াছে। এখানে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করে। সব রকমের কাজ পাথর ভাঙ্গা হইতে শুরু করিয়া সুরঙ্গ খোদাই কিংবা বড় বড় পাথর স্থানান্তর পর্যন্ত সব কাজই শ্রমিকদিগকে খোলা হাতে সম্পন্ন করিতে হয়। শ্রমিকরা এখানে যে সব হাতিয়অর ব্যবহার করে তাহা অতি মাত্রায় দুর্বল ও নিম্নমানের। মনে হয়, যাদুঘর হইতে এইগুলি তুলিয়অ আনা হইয়াছে।
অতঃপর তিনি বলেন, চীনের এই নিরীহ শ্রমিকদের দুর্দশা দেখিয়া আমার মনে বড়ই দুঃখ জাগিল। মানুষ যাহাই হউক মানুষ, জন্তু বা জানোয়অর নয়। কিন্তু এখানে তাহাদিগকে ঠিক জন্তুর মতই কাজ করিতে হয়। একটি দেশের উন্নরয়ের মানুষকে জন্তু-জানোয়ারের মত শ্রম করিতে বাধ্য করা শুধু জুলুমই নয়, মনুষত্যের চরম অপমানও বটে।
তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ শ্রমিকদিগকে বহু দূরবর্তী স্থান হইতে আমদানী করা হইয়াছে এবং তাহারা ইচ্ছামত এক জায়গার কাজ ত্যাগ করিয়া অপর স্থানে শ্রমের সুযোগ গ্রহণ করিতে পারে না। তাহার অধিকারও তাহাদের নাই।
তিনি বলেন চীনা-কমিউনিস্ট পার্টি ও চেয়ারম্যান মাওসেতুং রাশিয়ার বাধ্যতামূলক শ্রমের ন্যায় পরীক্ষিত মানব-ধ্বংসকারী পন্থাকে ব্যবহার করিতেছেন।
চীনা শ্রমিকরা এইরূপ অমানুষিক শ্রম করিয়া কি পরিমাণ মজুরী লাভ করে? ইহা একটি প্রশ্ন বটে। কিন্তু জওয়াব খুবই নৈরাশ্যজনক। চীনের এইরূপ পশুবৎ খাটুনীদাতা শ্রমিকরা যে পরিমাণ মজুরী পায় তাহা বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতীয় শ্রমিকদের মজুরীর তুলনায় অনেক নিম্নমানের। একজন শ্রমিক সেখানে একহাজার হইতে পনর শত ‘ইয়ান’(Yuan) কিংবা পঞ্চাশ ইউনিট মজুরী পাইয়অ থাকে। মনে রাখা আবশ্যক, এক ‘ইয়ান’ বাংলাদেশের আধপয়সারও সমান নয়। এক ইউনিট বলিতে আট নানা কিংবা তাহার কিছু বেশী বুঝায়। আর ‘পঞ্চাশ ইউনিট’ বলিতে বাংলাদেমের ২৫-২৬ টাকার সমান হইয়া থাকে।[বাংলাদেশের শ্রমিকদের কথা না বলাই ভালো।]
‘কিন্তু এই সামান্য পরিমাণ অর্থ লইয়া যখন তাহারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদী ক্রয় করার উদ্দেশ্যে বাজারে গমন করে, তখন তাহারা আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের সম্মুখীন হইতে বাধ্য হয়। এ সম্পর্কে ব্রজকিশোর শাস্ত্রী বলিয়াছেন:
‘চীনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম ভারতের তুলনায় অনেক গুণ বেশী। চাউল, কাপড়, তৈল ও লবণের মূল্য ভারতের তুলনায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বেশী। অন্যান্য জিনিসের উচ্চমূল্য তো ধারণাতীত। (দিল্লী হইতে প্রকাশিত দৈনিক ‘দাওয়াত’ পত্রিকা, ৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৫ সন)। চীনে ‘সরকারী শিল্প ও কারখানায় শ্রমিকদের কর্ম বিধান’ পর্যায়ে শ্রমিকদের অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে যেসব আইন প্রণয়ন করা হইয়অছে, তাহার মূল দৃষ্টিকোণ হইল:
শ্রমিকদিগদের সামষ্টির দর-কষাকষি কিংবা সংগঠন করার আজাদী ভোগের কোন অধিকার নাই। নিয়ম ও শৃংখলা মানিয়া শ্রম করিয়া যাওয়াই তাহাদের একমাত্র কর্তব্য।
বস্তুত এইরূপ দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে শ্রমিকদের জন্য যে বিধান রহিত হইবে ও তাহাদিগকে যেসব অধিকার দেওয়া হইবে, তাহা যে শ্রমিকদের প্রকৃতই কোন কল্যাণ সাধন করিতে পারে না, তাহা সহজেই বুঝিয়ে পারা যায়। উক্ত বিধানে মোট চব্বিশটি ধারা সংযোজিত হইয়াছে। উহার প্রথম অধ্যায়ে বলা হইয়াছে:
যেসব শ্রমিকের নিকট সরকারী রিপোর্ট নাই, তাহাদিগকে কাজে নিয়োগ করা বে-আইনী।
আর সরকারী রিপোর্টে সে কোথায় কাজ করিয়াছে, তাহার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তাহার সম্পর্কে পুলিশের রিপোর্ট কি ইত্যাদি লিখিত থাকে।
এই বিধানের তৃতীয় ধারায় বলা হইয়াছে:
মজুরীর জন্য দর-কষাকষি করা চলিবে না। বরং প্রত্যেকটি কাজেরই মজুরী নির্ধারিত মান অনুযায়ী নির্দিষ্ট করা হইয়া থাকে।
চতুর্থ ধারায় লিখিত হইয়াছে:
কোন শ্রমিক বা আমলার কর্মচারী ম্যানেজার অথবা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তার মঞ্জুরী ব্যতীত কাজ ত্যাগ করিতে পারে না। তাহাকে স্থানান্তরে বদলীও করা যাইতে পারে না ইহা মানিয়া কাজ করা না হইলে সংগঠন ও বিধান-রীতির বিরুদ্ধতা করা হইবে।
ইহার ৫ম ধারায় বর্ণিত বাধ্যতামূলক আইনটি হইল:
কোন শ্রমিকে তাহার মর্জী না লইলে স্থানান্তরে পঠান যাইতে পারে না। কিন্তু এই বিধানের বিরুদ্ধতা করা হইলে শ্রমিক শুধু ট্রেড ইউনিয়অনের নিকট অভিযোগ করিতে পারিবে, তাহার অধিক কিছু করার তাহার অধিকার নাই।
আর ৮ম ধারায় শ্রমিকদের কর্তব্য সম্পর্কে লিখিত হইয়াছে:
শ্রমিকরা কারখানার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব গোপন তথ্য সংরক্ষিত করিবে। সরকারী মালের হিফাযত করিবে ও প্রত্যেক দিন নির্দিষ্ট সময় নিজ নিজ কাজ সম্পূর্ণ করিয়া লইবে।
কাজের সময় সম্পর্কে কয়েকটি ধারা সংযোজিত হইয়াছে। যেমন: কাজের সময় নির্ধারণের পূর্ণ ইখতিয়ার কেবল কারখানার ব্যবস্থাপকদেরই থাকিবে। কারখানায় প্রবেশকালে ও নির্গমনের সময় প্রত্যেক শ্রমিকের তল্লাসী লওয়া হইবে।
‘শ্রমিক রাজত্বের’ এই সব আইন ও বিধান সম্পর্কে একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায়, যে সমাজে শ্রমকেই আসল কার্যকরণ (Factor) মনে করা হয়, সেখানে স্বয়ং শ্রমিকদের মানবিক অধিকার বলিতে কিছুতেই নাই। তাহারা কাজ করিবার সময় কোন কথা বলিতে পারে না। কোন সামাজিক কাজের জন্য শ্রম বন্ধ করিতে পারে না। সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য কোন সভাও করিতে পারে না। ইহার বিরুদ্থতা করা হইল অপরাধী হইবে ও বিশেষ আদালতে অভিযুক্ত হইবে। এক কথায় তাহারা সেখানে সকল প্রকার স্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত, নিছক কয়েদী জীবন-যাপন একান্তভাবে বাধ্য।
বাড়তি মূল্য ও ইসলামী অর্থনীতি
উপরের আলোচনা হইতে এ কথা প্রমাণিত হইয়াছে যে, একমাত্র শ্রমই সম্পদ উৎপাদন করে না, মূলধন এবং আরো অনেক কিছু সম্পদ উৎপাদনে অংশ গ্রহণ করিয়া থাকে। কিন্তু মার্কসের মতে একমাত্র শ্রমই মূল্যোৎপাদন করিয়া থাকে।[Labour can make value-মার্কসের একটি প্রসিদ্ধ কথা] তাঁহার মতে পণ্যদ্রব্যের সঠিক বিনিময়-মূল্য এবং বিক্রয় দমের (Selling Price) মধ্যে যে ব্যবধান থাকিয়া যায়, তাহাই হইতেছে ‘বাড়তি মূল্য’ (Surplas value) আর পুঁজিদার ইহাই অর্জন করে মজুরের প্রাপ্য কাড়িয়া লইয়া। এই বাড়তি মুল্যই (Surplus Value) হইতেছে পুঁজিবাদের ভিত্তিমূল- ইহাই পুঁজিদার সৃষ্টি করে, মানব-সমাজকে সর্বহারা শ্রমিক ও পুঁজিদার-এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করে। শেষ পর্যন্ত ইহা হইতেই শ্রেণী বৈষম্যের সৃষ্টি হয় এবং শ্রেণী মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়া সুস্থ সমাজকে চূর্ণ করে।
মার্কসের এই অভিযোগ মুলতঃই পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে এবং এই অভিযোগ যে সম্পূর্ণ সত্য তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দহ নাই। পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা নিরংকুশ ও ধন-সম্পদের উপর শংকাহীন কর্তৃত্ব ভোগ করার অপ্রতিরোধ্য অধিকার থাকে। অপরকে বঞ্চিত করিয়া শোষণ করিয়া যতকিছু সম্পত্তি করায়ত্ত করা হয়, ব্যক্তি তাহারই একমাত্র মালিক হইয়া বসে। আর সমাজতান্ত্রিক সমাজে সমস্ত ধন-সম্পদ ও যাবতীয় মানুষের বেলায় পুঁজিবাদী সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ অভিন্ন হইয়া দাড়ায়। এই উভয় সমাজই শোষণমূলক। পূঁজিবাদী সমাজে বাড়তি মূল্য পুঁজিদার নিয়া নেয়, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজে তাহা কি রাষ্ট্রের একচেটিয়া দখলে চলিয়া যায় না? কিন্তু ইসলামী সমাজে এইরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হইবার কিছু মাত্র অবকাশ থাকে না।
প্রথমত: ইসলামী সমাজে সম্পদ-উৎপাদনের মূল লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গিতেই আমূল পরিবর্তন ঘটে। সেখানে কেহ ভোগ-সম্ভোগের জন্য, বিলাসিতা ও জাঁক-জমকের জন্য ধন উৎপাদন করে না, করে জনগণের সার্বিক প্রয়োজন পুরণের জন্য, জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির জন্য, যেন তাহা নির্বিশেষে সকলেই মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করিয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। কাজেই শোষণ আর বঞ্চনা করার কোন চেষ্টাই সেখানে কেহ করিতে পারে না।
দ্বিতীয়ত: মজুর শ্রমিকদের জীবিকা-নির্বাহের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করার উপযোগী মজুরী দেওয়া, মজরদের প্রতি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি অন্যান্য কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করার পরও পুঁজিমালিক ও কারখানা মালিক যাহা কিছু লাভ করিবে, তাহা দ্বারা সে নিজের ভোগ বিলাসিতা ও সুখ-শয্যের আয়োজন করিতে পারিবে না। জোঁকের মত অর্থ শোষণ করিয়া সমাজে সর্বহারা শ্রেণীর উদ্ভাবন করিতে পারিবে না। কাজেই সেখানে অর্থ সম্পদের উপর আমানতদারী অর্থে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত হইলেও তাহা মানুষের পক্ষে কোনক্রমই মারাত্মক হইতে পারে না। বরং তাহাতে সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রেরই কল্যাণ সাধিত হওয়া অবধারিত।
তৃতীয়ত: ইসলামী সমাজে সম্পদ-উৎপাদনে ব্যাপারে মজুর-শ্রমিক ও মালিক পুঁজিদারদের পরস্পরের মধ্যে কোনরূপ শত্রুতামুলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হয় না, পণ্যোৎপাদনের উদ্দেশ্যে উভয়ের মধ্যে পরিপূর্ণ সহযোগিতা স্থাপিত হয়। কুরআন মজীদে পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে জাতীয় কল্যাণমূলক প্রত্যেকটি কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে:
(আরবী**********)
তোমরা সৎ ও পরহেজগারীমূলক সকল কাজে পরস্পরের সহযোগিতা কর, পাপ ও আল্লাহদ্রোহিতামূলক কোন কাজেই তোমরা কেহ কাহারো সহযোগিতা করিও না।[আয়াতটি ইসলামী সমাজের সমগ্র ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই অর্থনীতির ক্ষেত্রেও অবশ্যই প্রযোজ্য হইবে।]
কাজেই ইসলামী সমাজের শিল্প-বাণিজ্য-কৃষি ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই মজুর-শ্রমিক এবং মালিক ও পুঁজিদারদের মধ্যে শত্রুতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয় না, কেহ কাহাকেও শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী বলিয়া মনে করে না। বরং সেখানে সকলেই মানুষের সঠিক কল্যাণ-সাধন, সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন এবং সকলে মিলিয়া এক আল্লাহর হুকুমত কায়েম করার ব্যাপারে পরস্পরকে বন্ধু, সহযোগী ও সহকর্মী বলিয়া মনে করে। আর এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ইহাতে নিজের যোগ্যতা ও সামর্থানুসারে প্রত্যেকেই অংশ গ্রহণ করে। ইসলামী অর্থনীতির মূল ভাবধারা হইতেছে পরিপূল্ণ সহযোগিতা এবং সামঞ্জস্য বিধান; হিংসা, বিদ্বেষ বা শত্রুতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়।
মার্কসের মতে ধনিকদের ‘বাড়তি মূল্য’ লাভ করিতে হইলে তাহাদিগকে তিনটি শর্ত পূরণ করিতে হয়। তাহা হইতেছে শ্রমিকদের বেতন কম করা, শ্রমিকদের কার্যকাল বৃদ্ধি করিয়া অতিরিক্ত পণ্যোৎপাদন করিয়া লওয়া এবং উৎপাদিত দ্রব্রের অত্যধিক মূল্য গ্রহণ করা। কিন্তু ইসলামী শিল্পনীতিতে এইরূপ কোন শর্ত কিছুতেই কার্যকর হইতে পারে না। কাজেই ইসলামী সমাজে অনুরূপ শর্তের পলে বাড়তি মূল্য লাভ করিয়া শোষণের পাহাড় সৃষিট করা কোনক্রমেই সম্ভব হইতে পারে না।
এই কারণে ইসলামী সমাজে সীমাবদ্ধ পরিমাণ মুনাফা লাভ করার অবকাশ থাকা সমাজের পক্ষে কোন দিক দিয়াই ক্ষতিকর হইতে পারে না।
যান্ত্রিক উৎপাদন ও ইসলামী অর্থনীতি
প্রত্যেক সমাজে প্রচলিত স্থানীয় উৎপাদন-ব্যবস্থায় নবাবিষ্কৃত যন্ত্রের প্রয়োগ অর্থনীতির দৃষ্টিতে একটি বিশেস সমস্যা হইয়া দেখা দেয়। ইসলামী অর্থনীতি এই সমস্যার যে সমাধান পেশ করিয়অছে, এখানে তাহার সংক্ষিপ্ত আলোচনা একান্ত আবশ্যক।
প্রত্যেকে দেশেই শিল্পপণ্য ও খাদ্য-উৎপাদনের জন্য একটি বিশেষ ‘যন্ত্র’ ব্যবহৃত হইতে থাকে। সেই যন্ত্র যেরূপ হয়, অনুরূপ কর্মক্ষমতাসম্পন্ন লোকদের জীবিকার্জন সেই বিশেষ যন্ত্র ব্যবহারের উপরই একান্তভাবে নির্ভর করে। কাজেই কোন দেশের উৎপাদন-যন্ত্রের পরিবর্তন হইলে সে দেশে মারাত্মক বেকা সমস্যা দেখা দেওয়া অবধারিত হইয়া পড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দেশে হাতে-গড়া লাঙ্গল দ্বারা ভূীমচাষ হয়, সে দেশে এই লাঙ্গল চাষের যোগ্য লোকেরাই ভুীমচাষ করিয়া জীবিকার্জন করিতে পারে এবং এই লাঙ্গল চাষ হইতে খাদ্য গ্রহণের উপর কৃষিজীবি অসংখ্য মানুষের জীবিকা নির্বরশীল হইয়া দাঁড়ায়। এইরূপ একটি দেশেসহসা যদি লাঙ্গলের পরিবর্তে ট্রাক্টর দ্বারা ভুমিকর্ষণ শুরু করা হয়, তাহা হইলে দেশের বিপুল সংখ্যক লাঙ্গলচাষি বেকার হইয়া পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে কোটি কোট লোক অনশনের সম্মুখীন লাঙ্গলাষি বেকার হইয়া পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে কোটি কোটি লোক অনশনের সম্মুখীন হইতে বাধ্য হয়। অনুরূপভাবে যে দেশের প্রয়োজনীয় যাবতীয বস্ত্র তাঁত হইতে উৎপন্ন হয়, সহসা সে দেশে ব্যাপকভাবে কাপড়ের মিল হইতে বস্ত্র উৎপাদন শুরু করিলে সে দেশের সকল তাঁতীই বেকার হইয়া যাইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
বস্তুতঃ যে দিন হইতে পৃথিবীতে যন্ত্রসভ্যতার সূচনা হইয়াছে, সে দিন হইতেই এই যন্ত্র-দানব কত মানুষকে যে বেকার করিয়াছে, অসহায়ত্বের সর্বস্বান্তকারী গহবরে নিক্ষেপ করিয়াছে এবং অভাব ও দারিদ্রের নিষ্পেষণে জর্জরিত করিয়অছে, তাহার ইয়াত্তা নাই।কিন্তু ইসরামী অর্থনীতি উৎপাদন যন্ত্রের এইরূপ আকস্মিক পরিবর্তনে- যাহার দরুণ দেশের অসংখ্য শ্রমজীবী বেকার হইয়অ পড়িতে পারে- কিছুতেই অনুমতি দিবে না যতক্ষণ না উহার অনুকুল পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়া পড়িতে পারে- কিছুতেই অনুমতি দিবেনা যতক্ষণ না উহার অনুকুল পরিস্থিতির উদ্ভব হইবে। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা)-এর একটি সিদ্ধান্ত উক্ত দাবির স্বপক্ষে অকাট্য যুক্তি হিসাবে পেশ করা যায়। এক ব্যক্তি মদীনা শহরে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক ঘোড়া পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিল এবং সে জন্য খলীফার নিকট আস্তাবল নির্মাণ ঘোড়া পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিল এবং সে জন্য খলীফার নিকট আস্তাবল নির্মাণ করার অনুমতি চাহিয়াছিল। হযরত উমর ফারূক (রা) একটি শর্তে ইহার অনুমতি দিয়াছিলেন এবং সে শর্তটি এই ছিল যে, তাহার এই ঘোড়ার জন্য খাদ্য মদীনার বাহির হইতে সংগ্রহ করিতে হইবে। অন্যথায় মদীনার বর্তমান জন্তুগুলির খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রহিয়াছে এবং তাহার ফলে অসংখ্য দরিদ্র লোক ভয়ানক অসুবিধার সম্মুখীন হইয়া পড়িতে পারে।[তারিখ-ই তাবীর দ্রষ্টব্য।] বস্তুত যে সরকার জীবনে যে কোনরূপ খাদ্য-সমস্যা দেখা দিতে পারে না, তাহা বলাই বাহুল্য। এই জন্য এ কথায় আর কোনই সন্দেহ থাকে না যে, হযরত উমরের যুগে আধুনিক উৎপাদন যন্ত্র আবিষ্কৃত হইলে এবং একটি যন্ত্রের অসংখ্য মানুষ-শ্রমিককে বেকার করিয়া দেওয়ার কথা জানিতে পারিলে, তিনি ঠিক তখনিই উহা ব্যাবহাররর অনুমতি দিতেন, যখন বেকার লোকদের অপরিহার্য রুজীর কোন না কোন ব্যবস্থা করা সুসম্পন্ন হইত। একদিকে দেশবাসীর রুজীর নিরাপত্তা দানে যন্ত্র-মালিকদের নিকট হইতে তিনি পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করিতেন, অপরদিকে যন্ত্র-মালিকও ভ্রাতৃত্ব-বোধের দরুন আন্তরিক নিষ্ঠার সহিতিই এই কাজের সহযোগিতা করিত।
যন্ত্র-শিল্পের সমস্যা ও উহার সমাধান
বর্তমান যন্ত্র-সভ্যতা মানুষের জীবনে যে বিরাট ও জটিল সমস্যার সৃষ্টি করিয়াছে, সংক্ষেপে বলিতে গেলে তাহা এই যে, ইহার দরুন একদিকে গার্হস্থ্য ও ক্ষুদ্রায়তন শিল্পোৎপাদন ধ্বংস হইয়া পড়িয়াছে। অপরদিকে কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকদের জীবন শোষণমূলক শ্রমনীতির আঘাতে জর্জরিত হইয়া উঠিয়াছে। শ্রমিকদের দৈনিক কমপক্ষে আটঘন্টা করিয়া হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রম করিতে বাধ্যকরা হইতেছে; কিন্তু তাহাদের এত কমপরিমাণে মজুরী দেওয়া হইতেছে যে, তাহাদ্বারা তাহাদের নিম্নতম মৌলিক প্রয়অজনও কোনক্রমে পূর্ণ হইতে পারে না।
এই সমস্যার আসু সমাধান অপরিহার্য। বিশেষতঃ এক একটি দেশকে যখন নূতনভাবে শিল্পায়িত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয, তখন পূর্ব হইতেই এই সমস্যার সমাধান সম্পর্কে ধারণা লইয়া অগ্রসর হওয়া একান্তই বাঞ্ছনীয়। আমার মতে বৃহদায়তন যান্ত্রিক উৎপাদনের উল্লিখিত সমস্যার প্রাথমিক সমাধান একটি উপায়ে হইতে পারে।
প্রথম এই যে, শিল্পায়নের ফলে দেশের কত লোকের জীবন ও জীবিকা বিদপগ্রস্ত হইতেছে, সেদিকে সরকারকে তীব্র দৃষ্টি রাখিতে হইবে। শিল্পপতিকে কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া গেলেও দেশের কোটি কোটি লোককে জীবিকা হইতে বঞ্চিত করিয়া শুধু তাহারই খরিদ্দারে পরিণত করার কোনই অধিকার দেওয়া যাইতে পারে না। তাউ আইনের সাহায্যে জীবিকা বঞ্চিত সমস্ত লোককে কারখানার কার্যে নিযুক্ত করার জন্য কারখানা মালিককে বাধ্য করিতে হইবে। আমার মতে কাজ সুষ্ঠূরূপে সম্পন্ন হওয়অর জন্য বর্তমান কার্য সময় দৈনিক ৮ ঘন্টা হইতে কমাইয়অ মাত্র ৪ ঘন্টা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া আবশ্যক। যে কারখানায় এক লক্ষ্য মজুর দৈনিক আট ঘন্টা করিয়া কাজ করে, দৈনিক চার ঘন্টা কার্যের সময় নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইলে সেখানে দুই লক্ষ মজুর কাজ করিবার সুযোগ পাইবে। ইহার ফলে প্রত্যেক কারখানায় দিগুণ মজুরের প্রয়োজন হওয়ায় বেকার সমস্যা অনেকখানি সমাধান হইয়া যাইবে, মজুরদের কার্য সময় কম হওয়ায় তাহাদের স্বাস্থ্য বর্তমানের ন্যায় নষ্ট হইব না এবং শ্রমিকদের নিম্নতম প্রয়োজন পূরণ ভিত্তিক মজুরী দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হইলে পুঁজি মালিকের নিকট হইতে জাতীয় অর্থ বিস্তারলাভ করিয়অ প্রকৃত অভাবী ও প্রয়োনশীল লোকদের হাতে পৌঁছিতে শুরু করিবে।
বস্তুত, এইরূপ ব্যবস্থা হইলে তাহা দ্বারা শুধু জনগণ ও মজুরগণই উপকৃত হইবে না, তাহার ফলে কারখানা মালিক ও গোটা মানবতাই বিশেষভাবে উপকৃত হইবে এবং বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল পৃথিবীর অসংখ্য প্রকার জটিলতা ও অর্থনৈতিক সমস্যারও স্থায়ী সমাধান হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।