ইসলামী ব্যাংকের পরিকল্পনা
আমরা এখানে একটি ইসলামী ব্যাংক গঠন ও সেজন্য কাজ শুরু করার বাস্তব পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করিতেছি। প্রসংগত একটা চালু ব্যাংকের কার্যদ্বারা কি হইবে এবং ইসলামী আদর্শের সহিত পূর্ণ সঙ্গতি রক্ষা করিয়া উহা কিভাবে আধুনিক ব্যাংকের সর্বপ্রকার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হইবে, তাহাও বিশ্লেষণ করিতে চেষ্টা হইবে।
বস্তুত ঈমানদার মুসলমানরা যখন জানিতে পারে যে, Interest এবং Usury উভয়টিই ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম, তখন তাহাদের মনে এই প্রশ্ন তীব্র হইয়া জাগিয়া উঠে যে, ইহা ছাড়া এ যুগে ব্যাংক চলিতে পারে কিভাবে? তখন তাহারা এই দুইটিকে সম্পূর্ণ পরিহার করিয়া ইসলামী আদর্শকে বাস্তব রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি ব্যাংক সংগীত ও চালু করা যায় কিনা তাহা চিন্তা করিতে শুরু করিতে পারে। তখন তাহারা মুনাফা ও শরীকদারীর ভিত্তিতে ব্যাংক গঠনের উদ্দেশ্যে একটি Promoters company গঠন করিয়া অংশীদার হইতে করিয়া অংশীদার হইতে ইচ্চুক লোকদের প্রতি Share capital সংগ্রহ করিবার আবেদন প্রচার করিতে পারে।
পরে জনগণের নিকট হইতে ব্যবসায়ের অংশীদার হিসাবে যেসব Subscription পাওয়া যাইবে। তাহাতে প্রত্যেককে আলাদদা আলাদা Share certificate দিয়া দিবে। ফলে ইহারা প্রত্যেকেই মুল ব্যাংক ব্যবসায়ের অংশীদার রূপে গণ্য হইবে। এই অংশীদাররা নিজেদের একটি অধিবেশনে বোর্ড অব ডাইরেক্টরস (Board of Directors) নির্বাচন করিবে এবং এই ডাইরেক্টরস বোর্ড ব্যাংকের কর্মচারী নিয়োগ করিবে।
বর্তমান সময়ে ব্যাংকের অংশীদাররা নির্দিষ্ট হারে dividend পাইয়া থাকে, কোন কোন ব্যাংক আবার অংশীদারদের মধ্যে নির্দিষ্ট মেয়াদের হিসাবান্তে অর্জিত মুনাফা (Profit) বন্টন করিয়া থাকে। ইসলাম যেহেতু অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যাংক ব্যবসায় ও মলধন বিনিয়োগ সমর্থন করে, তাই প্রস্তাবিত ব্যাংকে অংশীদাররাও একটি আর্থিক বছর শেষান্তে নিজ নিজ অংশের মুকাবিলায় আনুপাতিক divedends পাইতে পারে।
ব্যাংকে অর্থ জমাকারীদের অবস্থা
এইভাবে ব্যাংক কাজ শুরু করিয়া দিলে জনগণ তাহাদের উদ্বৃত্ত টাকা ইহাতে জমা দিতে শুরু করিবে। ব্যাংক এমন সব জমাও গ্রহণ করিবে যাহা পূর্ব অবগতি ব্যতীতই ফেরত চাওয়া চাইবে। এই জমাকে পরিভাষায় বলা হয় Demand Deposists। এই টাকা ব্যাংকে রাখা হয় শুধু সংরক্ষণ ও হেফাজত লাভের উদ্দেশ্যে। ব্যাংক তাহাদের নামে হিসাব খুলিয়অ দিবে এবং চাহিদা অনুযায়ী লেণ-দেন করিবে। এইরূপ জমায় ব্যাংক জমাকারীদের নিকট হইতে Service charge আদায় করিতে পারিবে।
ব্যাংকে কেবল এই ধরনের টাকাই জমা করা হয় না; সেই সঙ্গে এমন বহু টাকাও জমা করা হয় যাহা দীর্ঘ মেয়াদী এবং কোনরূপ পূর্ব অবগতি ব্যতীত কখনও ফেরত চাওয়া হয় না; এইরূপ টাকার পরিমাণই বেশী হইয়া থাকে। তখন ব্যাংক এই টাকা cerified deposists হিসাবে গ্রহণ করিবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে deposist certificates ইস্যু করিবে। এইসব সার্টিফিকেট তিন মাস হইতে ১২ মাসের জন্য ইস্যু করা যাইতে পারে। এই জমাকারীরা কোন service charge দিবে না। বরং তাহারা ব্যাংকের আর্তিক বৎসরান্তে আনুপাতিক মুনাফা লাভ করিতে পারিবে। ইহাও Dividends রূপে দেওয়া যাইবে।
বিনিয়োগকারীদের অবস্থা
ইসলামী ব্যাংক মূলন সংগ্রহের জন্য dedentures ইস্যু করিবে না। কেননা তাহাতে নির্দিষ্ট পরিমাণের মুনাফঅ দেওয়ার প্রশ্ন দেখা দেয়। ইসলামী ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী মূলধন পাওয়ার জন্য জনগণকে নির্দিষ্ট মেয়াদ কিংবা নির্দিষ্ট উৎপাদনী কাজে মুনাফা ভিত্তিতে অর্থ বিনিয়োগের আহ্বান জানাইতে পারে। ব্যাংক এইসব কাজ হইতে লব্ধ মুনাফার অংশ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তাহাদের মূলধন অনুপাতে ভাগ করিয়া দিবে। ইহাদের নামে বিনিয়োগ সনদ (Investment certificate) দেওয়া যাইবে এবং এক বৎসর হইতে পাঁচ বৎসর পর্যন্ত চলিতে পারিবে।
সমাজে এমন বহুলোক রহিয়াছে যাহারা নিজেদের উদ্বৃত্ত মূরধন সংরক্ষণ ও মুনাফামূলক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করার উপায় সন্ধান করিতেছে। ইসলামী ব্যাংক যেহেতু জনগণের নিকট খুবই বিশ্বাস্য ও আস্থাভাজন হইবে, তাই ইহা এই শ্রেণীর লোকদের মূলধন রাখা ও ব্যবসায়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিবেচিত হইতে পারিবে। ফলে ব্যাংক এইসব মূলধন পাইয়া উহার সুষ্ঠু ব্যবহার ও নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট লোকদের বিরাট কল্যাণ সাধন করিতে পারে এবং সেই সংগে এ ধরনের অবশিষ্ট আরও বহু লোকের নিকটও আস্থাভাজন হইয়া তাহাদেরও মূলধন গ্রহণের বিপুল সুযোগ পাইতে পারে; ব্যাংক এই ব্যক্তিদের নামে investment certificate ইস্যু করিতে পারে। ইহা দীর্ঘ মেয়াদী কিংবা অনির্দিষ্ট কালের জন্য হইতে পারে, হইতে পারে ৫বা ১০ বৎসরের মেয়াদের জন্যও। এই সনদধারী লোকেরা ব্যাংকৈর মূল মুনাফার আনুপাতিক অংশীদার হইবে। অবশ্য সময় ও অন্যান্য কার্য-কারণের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া মুল অংশীদার এবং আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মুনাফার হার বন্টন করিতে হইবে।
ব্যাংকের মূলধন সংগ্রহের জন্য ইহা খুবই কার্যকর ও বাস্তব পন্থা বিশেষ। পাশ্চাত্য দেশের কোন কোন ব্যাংক এই পন্থাকে কাজে লাগাইয়াছে এবং এই উপায়ে তাহার বিপুল পরিমাণ মূলধন সংগ্রহ করিতেছেন। তাহাতে Investment certificates কিংবা Investment bonds জারী করা হয় এবং তাহা করা হয় নির্দিষ্ট রেটের rate সুদের (interest) ভিত্তিতে।
বর্তমান যুগে অর্থনীতির ক্ষেত্রে ঋণ বা অগ্রিম মূলধন পাওয়ার গুরুত্ব অত্যধিক। কয়েকটি অত্যুন্নত দেশে শিল্প ও ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা সর্বাধিক কল্যাণকর প্রমাণিত হইয়াছে। সেই সব দেশে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক সুফল পাওয়া গিয়াছে। কাজেই ইসলামী রাষ্ট্রেও ব্যাংকের মাধ্যমে এই সুবিধা (facilities) ও সুযোগ জনগণের জন্য নিশ্চয় করিতে হইবে। দেশের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলে এই cresit facelities সম্প্রসারিত হইলে অধিক কল্যাণ লাভের সম্ভাবনা। ব্যবসায় বাণিজ্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি লাভের উদ্দেশ্যে এ কাজ বিশেষ জরুরী এবং ইসলামী ব্যাংককে এ কাজ অবশ্যই করিতে হইবে।
ইসলাম নির্দিষ্ট মুনাফা (Interest, usury)-(সুদ) হারাম করিয়াছে। কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, অগ্রিম ভিত্তিতে ব্যবসায় বা শিল্পে অর্থবিনিয়োগেরও নিষেধ করিয়াছে। ইসলঅমে সর্বপ্রকার অর্থ বিনিয়োগ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হইতে হইবে। মুনাফা হইলে উভয় পক্ষই তাহা পাইবে এবং লোকসান হইলে উভয়ই তাহার বোঝা বহন করিবে। মন্দা অবস্থার ঝুঁকি কেবল একটি পক্ষের উপর চাপাইয়া দেওয়া কোনদিক দিয়াই সংগত হইতে পারে না।
অংশীদারদের অংশের টাকা আমানতদারী জমা এবং বিনিয়োগকারীদের দেওয়া মূলধন হস্তগত হওয়া এবং ব্যাংকের নিজস্ব সম্পদ ও ইহার সহিত যোগ হওয়ার পর কোন নির্ভরযোগ্য মুনাফা-সম্ভব শিল্প কর্মে তাহা লগ্নি করিতে হইবে। এলাকার ব্যবসায় ও শিল্পে বিনিয়োগ প্রয়োজন পূর্ণার্থেও ব্যাংক টাকা লাগাইতে পারে- ঠিক যেমন ব্যবসায়ী ব্যাংক (Commercial bank) করিয়া থাকে।
অতঃপর এখানে আমরা স্বল্প-মেয়াদী মুলধন বিনিয়োগ এবং তাহার পর দীর্ঘ-মেয়াদী বিনিয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করিব।
শিল্পকর্মে অর্থ বিনিয়োগ
শিল্পকর্মে অর্থবিনিয়োগ হইতে পারে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। ইসলামী ব্যাংক নির্দিষ্ট শিল্পে এই শর্তে অর্থবিনিয়োগ করিবে যে, লাভ ও লোকসান ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট শিল্পের মধ্যে আনুপাতিক হারে বন্টন করা হইবে।
একালের সাধারণ অর্থবিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আমরা দেখিতে পাই যে, কোন শিল্প কর্মে অর্থবিনিয়োগের প্রশ্ন দেখাদিলে উহার আর্থিক অবস্থা সর্বাত্মকভাবে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষাও পর্যালোচনার পর সংশ্লিষ্ট শিল্প অর্থবিনিয়োগের যোগ্য বিবেচিত হইলে এবং ব্যাংকের মূলধন এখানে সংরক্ষিত থাকিবে মনে করা গেলে, তাহার পরই ব্যাংক অর্থবিনিয়োগে প্রস্তুত হইতে পারে। ইসলামী ব্যাংকও অনুরূপভাবে সর্বপ্রকার অর্থবিনিয়োগের ক্ষেত্রকে পরীক্ষা করিবে, পরীক্ষা করিবে শুধু একটা ব্যাংক হিসাবেই নয়, বরং সম্ভাব্য অংশীদার হিসাবেই পরীক্ষা-কার্য সম্পন্ন করিবে এবং বিষয়টির প্রকৌশলী (Technical) দৃষ্টিতেও বিচার করিবে। এজন্য ব্যাংক যে Technical staff নিযুক্ত করিবে তাহা শিল্পকর্মেরও বিশেষ উপকারে আসিবে। ব্যাংক ইহার সাহায্যে মেযন প্রতিটি শিল্পকর্মের ব্যাপারে কার্যকর পরামর্শ দিতে পারিবে, তেমনি মুলধনসহ শিল্পকর্মর ব্যবসায়ের অবস্থার সহিত পূর্ণ সহযোগিতাও করিতে সমর্থ হইবে। পারস্পরিক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়মিত পরিদর্শনের (Regular inspection) মাধ্যমে স্বীয় মূলধনেরও সংরক্ষণ করিতে পারিবে:
(১) বিশেষ শিল্পকর্ম মূলধন (Working Capital) হিসাবে কাজ করার জন্য ইসলামী ব্যাংক এ ‘লোন’ (Loan) মঞ্জুর করিবে। আমরা ইহাকে Bank investment বলিতে পারি (Short term financing)।
(২) প্রস্তাবিত শিল্পকর্মে নিয়োজিত যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জামের সমপরিমাণ মূলধন ব্যাংক দিতে পারে। কিংবা শিল্পকর্মের প্রকৃতি অনুযায়ী আনুপাতিক হারেও মুলধন বিনিয়োগ কারা যাইতে পারে।
(৩) ব্যাংক শিল্পকর্ম পরিচালক কোম্পানী একটি অংশীদারিত্বের চুক্তিতে স্বাক্ষর করিবে। ইহাতে কোম্পানীর ব্যবহার্য সম্পত্তির (assets) উপর ব্যাংকের আনুপাতিক মালিকানা স্বীকৃত হইবে। ফলে ব্যাংক যাহাতে মূলধন বিনিয়োগ করিয়াছে সেই সব শিল্পকর্মের উপর উহা আইনগত মালিকানার অধিকারী হইবে।
(৪) শিল্পকর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের মজুরী ও পরিচালনা বিভাগের বেতন ইত্যাদিতে যেমন পণ্যের উৎপাদন খরচায় (cost of production) গণ্য করা হয়, তেমন ব্যাংক উক্ত শিল্পকর্ম পরিদর্শন, উপদেশ দান এবং উহার হিসাব রক্ষার্থে নিয়োজিত কর্মচারীদের বেতন বাবদ যাহা ব্যয় করিবে তাহাও যুক্তভাবে উৎপাদন খরচরূপে গণ্য হইতে পারিবে। অবশ্য মূল কাজ শুরু করার পূর্বে কৃতচুক্তিতে এইসব সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইবে।
(৬) ব্যাংকের দেওয়া Loan ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা না হইলে সরকার কোর্টের বিচার মাধ্যমে উভয় পক্ষের সাথে পরামর্শক্রমে একটি Trusteeship নিযুক্ত করিতে পারিবে। উহা ব্যবসায়টিকে নির্বিঘ্নে চালাইবে ও কম-সে-কম মেয়াদ প্রদত্ত ঋণ পরিশোধ করিবে। উহাতে বর্তমান মুনাফা ও উদ্বৃত্ত সম্পত্তি (Assets) এমনভাবে ব্যবহার করিতে হইবে, যাহাতে একদিকে ঋণ পরিশোধ হয় এবং অপদিকে মুল ব্যবসায়টিও যথাযথভাবে পরিচালিত হইতে পারে। এইভাবে ব্যবসায় গুটানো এবং দেওউলিয়া প্রপ্তি (Bank roptcy) কে সমূলে উৎখাত করা যাইতে পারে।
এতদ্ব্যাতীত ইসলামী ব্যাংক ‘মুদারিবা’ (আরবী********) ভিত্তিতে কোন শিল্প-পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে পারে। একটি অনুন্নত দেশে- যেখানে শ্রম খুবই সস্তব পাওয়া যায় এবং স্থানীয় মুলধন যেখানে অব্যহৃত হইয়া বেকার পড়িয়া রহিয়াছে- মূলধন সংগ্রহ ব্যাপক কর্মবিনিয়োগ (Employment) এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে এই পরিকল্পনা বিশেষ কল্যাণ সাধন করিতে পারে।
ব্যবসায় ও বাণিজ্যে মূলধন বিনিয়োগ
শিল্পকর্মর ন্যায় ব্যবসায় ও বাণিজ্যেও অনুরূপ ভিত্তিতে মূলধন, বিনিয়োগ করা যাইতে পারে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায় মালিক মূলধন, সময়-কাল (Period) এবং অন্যান্য বিষয়াদি সম্পর্কে কোন উপযুক্ত চুক্তিতে আবদ্ধ হইতে পার। মুলধন বিনিয়োগ ও নিয়মিত পরীক্ষাকার্য সম্পাদনকে ব্যাংক পাশাপাশি ও সমান্তরারলভাবে চালাইতে পারে। ব্যাংক বাজারের অবস্থা এবং মুনাফার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে সময় সময় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়া মুল ব্যাবসায়টিকে সঠিক পথে অগ্রসর করিয়া নিতে পারে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপর দেখা দিবে। তাহা হইল, বাসায়ের Bill of exchange-এ মূলধন নিয়োগে। বর্তমান সময়ে ব্যাংক Bill of exchange-এর অগ্রিম বাটা (Discount) কাটিয়া ‘লোন’ (Loan) মঞ্জুর করে ৩০,৬০ বা ৯০ দিনে জন্য। পাইকারী ব্যবসায়ীরা ও খুচরা বিক্রেতাদের অনুরূপ ভিত্তিতে ‘ঋণ’ দেয় এবং এ সুযোগের সম্প্রসারণ অনুপাতে নির্দিষ্ট হারে Discount এ Discount ধার্য করে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক এই discount ধার্য করার রীতি- এমন কি Bill of exchange কাটার নিয়মকে গ্রহণ করিতে পারিবে না, উহাকে বরং এই পদ্ধতিকে খতম করিতে হইবে। কিন্তু তাহা হইলে কার্যকর পন্থা কি হইবে, তাহা এখানে ব্যাখ্যা করা যাইতেছে।
বিল অব এক্সচেঞ্জ-এ অর্থ বিনিয়োগ
চাওয়া মাত্র অর্থ পাওয়ার ব্যবস্থা (on demand bills) বর্তমান সময়ে ব্যাংকের পূর্বনির্ধারিত ক্ষয়কারদীদের (customers) পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হইয়াছে। ব্যাংক ইহাতে সাধারণতঃ কান সুদের দাবি করে না, দাবি করে নির্দিষ্ট কমিশনের। আমেরিকায় বাহিরের কোন চেক্ পেশ করা মাত্র সাধারণ নিয়মে কোনরূপ সুদের দাবি না করিয়াই নগদ অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা রহিয়াছে। অন্যান্য কতিপয় দেশে এ খাতেও সুদ গ্রহণ করা হয়।
ইসলামী ব্যাংক বিনা সুদে এই কাজ ৩০-৬০-৯- দিনের মেয়াদের জন্য করিতে পারে। কিন্তু তাহা ব্যবসায়ের মূল অবস্থার সহিত সংগতি রক্ষা করিয়া করিতে হইবে। ঋণের জমানত (Security) হিসাবে ও ব্যাংক এইসব চেক গ্রহণ করিতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে এইসব বিল ফেরত পাওয়ার আইন (Cimmercial loans) খুব কঠোর হইতে হইবে।
কৃষি লোনে অর্থ বিনিয়োগ
কৃষিজীবীরা কৃষি খাতে মূলধন সংগ্রহের ক্ষেত্রে নানাভাবে শোষিত হইয়া আসিতেছে। তাহারা সাধারণত সুরেদ ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করিয়া থাকে; কিন্তু তাহা তাহাদের কৃষিকার্যের উন্নয়ন বা অধিক ফসল ফলানোর কাজে খুব কমই ব্যবহার করিতে পারে। তাহারা যখন ফসল কাটিয়া ঘরে লইয়া যায়, তখন উহার বেশীর ভাগই ঋণ পরিশোধের উদ্দেশ্যে বিক্রয় করিয়া ও উহা হইতে ঋণ শোধ করিয়া তাহারা সর্বস্বান্ত হইয়া যায়। তাহাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তমূলক কাজে উহার খুব সামান্য অংশই ব্যবহৃত হইতে পারে। কিন্তু ইসলামী কৃষি ব্যাংক এই খাতেও অংশীদার হিসাবে অর্থবিনিয়োগের কাজ করিতে পারিবে। কৃষিজীবীদের কল্যাণ সমবায় ভিত্তিতে মুলধন বিনিয়োগ হইতে পারে। ব্যাংক কৃষকদের কৃষিযন্ত্র (Implement) ও বীজ দিতে পারে এবং ফসলের অংশ গ্রহণ করিতে পারে। তাহা ছাড়া প্রকৌশল পর্যায়ের (technical) পরামর্শ, উন্নতমানের বীজ ইত্যাদি পরিবেশন করিয়া গ্রামীন অর্থনীতির সার্বিক উন্নতি বিধান করিতে পারে। এই নব ব্যাংক স্থানীয় ভিত্তিতে গড়িয়া উঠিতে ও নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের সহিত পারস্পরিক স্বার্থসম্পন্ন কাজ অংশ গ্রহণ করিতে পারে।
বস্তুত কৃষিকে কেন্দ্র করিয়া পারস্পরিক কৃষিব্যবসায়ের ব্যাংক গড়িয়া উঠিতে পারে। ব্যাংক কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় মূলধন বিনিয়োগ করিবে এবং ফসল হইতে পূর্ব নির্দিষ্ট হারে মুনাফা ও প্রদত্ত মূলধন ফিরাইয়া লইবে।
সুদবিহীন ব্যাংক জমা গ্রহণ ও ঋণ প্রদানের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা ছাড়াও আধুনিক ব্যাংক সংক্রান্ত অন্যান্য দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করিতে পারে। ন্যায্য খরচ আদায় করিবার জন্য মূল্যবান জিনিসসমূহ বন্ধক বা হেফাযত রাখিতে পারিবে। তাহাতে কোনরূপ সুদের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে না। অনুরূপভাবে একস্থান হইতে স্থানান্তরে মূলধন পাঠান এবং Bill collection- এর কাজ করাও সম্ভব হইবে।
মূলধনের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সুদবিহীন ব্যাংক জনগণের জমাকৃত মূলধনের সংরক্ষণ ও উহার নিরাপত্তা প্রদানের বিশেষ ব্যবস্থা করা যাইতে পারে। ব্যাংক যেসব ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ করিবে, তাহাতে অংশীদার ও মুলধন প্রদানকারী (Financier) হিসাবে কাজ করিবে। উহাতে যদি লোকসান (Loss) হয়, তবে তাহা জমাকারীদের উপর ধার্য হইবে না, কেননা তাহারা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ে সক্রিয় অংশীদার (active partners) নয়। তাহারা বড়জোর নিস্ক্রিয় অংশীদার ও মূলধন প্রদান (Sleeping partners and financiers) মাত্র। কাজেই ব্যবসায়ে ক্ষতি (Loss) হইলে তাহা হয় রিজার্ভ ফান্ত হইতে পূরণ করা হইবে, না হয় ব্যাংকের অংশীদাররা তাহা নিজেদের মধ্যে ভাগ করিয়া লইবে। কেননা, ব্যাংকে জমা রাখা টাকার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাহারাই দায়ী আর ব্যবসায়ে মুনাফা হইলেও তাহা তাহারাই পাইবে।
ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ দান
সুদবিহীন ইসলামী ব্যাংক কেবল যে ব্যবসায়ী মূলধন সংগ্রগের কাজই করিবে তাহা নয়, এই ব্যাংক ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের জন্য ও বিনাসুদে ঋণ দান করিবে।
বস্তুত সমাজের বহুলোকই ব্যক্দিগত প্রয়োজন পূরণের জন্য ঋণ গ্রহণ করিতে বাধ্য হ য়। তাহাদের হয়ত বিষয়-সম্পত্তি রহিয়াছে কিংবা ভবিষ্যতেও অর্থ আমদানীর আশা আছে। কিন্তু উপস্থিত প্রয়োজন পূরণের জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে এবং তাহার দারুণ সাময়িকভাবে স্বল্প মেয়াদী ঋণ গ্রহণ ছাড়া উপায়ন্তর নাই, তাহা ইসলামী সমাজে এসব ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণে বিনাসুদে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা থাকা একান্ত অপরিহার্য।
ব্যক্তিগতভাবে মানুষের যে প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহা দুই পর্যায়ের হইতে পারে: নিতান্ত মৌলিক প্রয়োজন এবং অন্যান্য সাধারণ ধরনের প্রয়োজন। এই উভয় পর্যায়ের প্রয়োজন যথার্থভাবে পূরণ হওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থা না হইলে জনগণের জীবনযাত্রা সুখ ও সমৃদ্ধি পূর্ণ হইতে পারে না। এই কারণে এইসব ক্ষেত্রেই জনগণের সহিত পুরাপুরি সহযোগিতার ব্যবস্থা করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব বিশেষ।
ব্যাংক মূলতঃ একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। মুনাফা অর্জনই উহার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। উহার উপর প্রধানত মুনাফঅজনক কাজ-কারবারে বিনাসুদে ঋণ প্রদানের দায়িত্ব অর্পিত। তাই ব্যাংক হইতে ঋণ পাওয়ার প্রধান অধিকারী হইলো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেও বিনাসুদে ঋণ দানর কাজ করার দায়িত্ব উহার উপর চাপানো যাইতে পারে। এজন্য দুইটি পন্থা অবলম্বন করা সম্ভব।
প্রথম এই যে, যে ব্যাংক ঋণ গ্রহণের হিসাব খোলা রহিয়াছে, বিশেষ অবস্থায় উহা হইতে জমা টাকার অধিক (overdraft) গ্রহণের সুযোগ দেওয়া যাইতে পারে। ইহা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হইবে। এইজন্য প্রয়োজন মত নির্ভরযোগ্য জামানত (security) ও গ্রহণ করা যাইতে পারে। ব্যাংকে বহু লেকের এমন বিপুল পরিমাণ অর্থও পড়িয়া থাকে, যাহা সাধারণত নিত্য-নৈমিত্তিক প্রয়োজনে তোলা হয় না এবং বিশেষ কোন ব্যবসায়েও তাহা লগ্নি করা হয় না। ব্যাংক এইসব টাকা লোকদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণার্থে বিনাসুদে ঋণ বাবদ দিতে পারে। ইহাতে ব্যাংকেরও যেমন কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, তেমনি টাকার মালিককেও এজন্য কোন ক্ষতি স্বীকার করিতে হয় না।
আর দ্বিতীয় এই হইতে পারে যে, ব্যাংক দ্রব্য ক্রয় সার্টিফিকেট জারী করিবে। কোন স্থায়ী ব্যবহার্য দ্রব্য বাকী, মূল্যে খরীদ করা হইলে সেই সার্টিফিকেট বিক্রেতাকে দিবে এবং বিক্রেতা উহা ব্যাংকে জমা করিয়া মুল্য আদায় করিয়া লইবে। ইহাতে দ্রব্যের ক্রেতার উপর অর্পিত হইবে।
এই উভয় প্রকার ব্যক্তিগত ঋণ শেষ পর্যন্ত যদি ঋণ গ্রহণ কারীর প্রকৃত আর্থিক অক্ষমতার দরুণ পরিশোধ করা না হয় তাহা হইলে উহা পরিশোধ করার দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের উপর বর্তিবে। ইহা যেমন নূতন কিছু নয়, তেমনি অবাঞ্ছনীয়ও কিছু নয়। রাষ্ট্রের যাকাত-ফিতারার ফান্ড হইতে এই ধরনের ঋণ শোধ করা ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী নিয়ম। নবী করীম (স) রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবেই ঘোষণা করিয়াছিলেন:
আমি মুসলমান জনগণের তাহাদের নিজেদের তুলনায় অনেক নিকটবর্তী। অতএব কোন মুসলমান যদি ঋণ পরিশোধ না করিয়া মরিয়া যায়, তবে উহা পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার উপর বর্তিবে। আর যে লোক সম্পদ রাখিয়া যাইবে, তাহা তাহার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টিত হইবে।