ধন-বন্টন
ইসলামের শিল্পনীতি ও ভূমি-ব্যবস্থার দীর্ঘ আলোচনা হইতে অর্থোৎপাদনে সংগত পন্থা সম্পর্কে আমরা অবহিত হইয়াছি। এই আলোচনা হইতে আমরা ইহাও জানিতে পারিয়অছি যে, ব্রক্তি-মানুষ সংগত উপায়ে যাহা কিছু উপার্জন করিবে- তাহা নগদ সম্পদই হউক আর জমি-জায়গা ও দালান কোঠাই হউক- সে তার ‘মালিক’ হইবে। এইভাবে ব্যক্তিগত মালিকানার সূত্রে এক-এক ব্যক্তির নিকট বিপুল ধন-সম্পত্তি একীভূত ও কুক্ষিগত হইতে পারে। অথচ এইরূপে ধন-সম্পদের একীভূত হইতে দেওয়া মানব সমাজের পক্ষে যে কত মারাত্মক তাহা কাহারো অবিদিত নয়। ইহারই সুযোগে দুনিয়ার পুঁজিবাদের সৃষ্টি হয় এবং তাহা বিরাট মানবতাকে (Humamity at large) জীবন-যাত্রা নির্বাহের বুনিয়াদী ও অপরিহার্য প্রয়োজন হইতে নির্মমভাবে বঞ্চিত করে।কাজেই ইসলাম বিশ্ব-মানবতার যে স্বাভাবিত ও বিজ্ঞান সম্ত অর্থ ব্যবস্থা উপস্থাপিত করিয়াছে, তাহাতে এইরূপ মানবতা-বিরোধী নীতি কিছুতেই অব্যাহতভাবে চালু থাকিতে পারে না। এইজন্য ইসলাম সকল প্রকার ধন ও সম্পত্তি সম্পর্ক মূলনীতি হিসাবে ঘোষণা করিয়াছে:
(আরবী*********)
যাবতীয় ধন-সম্পত্তির আবর্তন যেন তোমাদের শুধু ধনিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হ ইয়া না থাকে।
কিন্তু অর্থ এবং সম্পদের উৎপাদন যতই প্রচুর হউক না কেন, উহার বন্টন ব্যবস্থা যদি বিশুদ্ধ নীতি ও নির্ভুল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কার্যকর না হয়, তবে তাহা নির্বিশেষে দেশ ও দেশবাসীর পক্ষে সাংঘাতিক হইতে পারে। বন্টন-ব্যবস্থার ভুল নীতির দরুনই বর্তমান মানুষে-মানুষে আকাশছোঁয়অ বিরোধ ও বৈষম্যের সৃষ্টি হইয়াছে। একদিকে ধনের প্রাচুর্য এবং অপরদিকে দুঃসহ দারিদ্রের সর্বগ্রাসী আক্রমণ মানব-সমাজকে ভারসাম্যহীন (Balanceless) করিয়া একেবারে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করিয়াছে এবং কেবল ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির পরস্পরের মধ্যেই আজ অনুরূপ বৈষম্য প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে।
অথচ ধন-সম্পদ যদি বাস্তবিকই নির্ভুল ও সুবিচারপূর্ণ পন্থায় বন্টন হইতে পারে, ধন-সম্পদের আবর্তন-উৎপাদন ও বন্টন- যদি বৈজ্ঞানিক ও স্বাভাবিক পন্থায় হয়, স্থায়ী ও সর্বকালের প্রয়োজ্য কোন বিধানের মারফতে হয়, তাহা হইলে সমগ্র পৃথিবীর বুক হইতেই অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত হইতে পারে। একদিকে অর্থ-সম্পদের পর্বত তুষারস্তুপের ন্যায় বিগলিত হইয়া এমন উদ্দাম ঝর্ণাস্রোতরূপে প্রবাহিত হইতে পারে, যাহা নিকট ও দূরের সকল ‘শুষ্ক অঞ্চল’কেই সিক্ত করিতে পারে। একটি অর্থোৎপাদনকারী যন্ত্রের উৎপাদন অসংখ্য খাতে বাহিয়া অসংখ্য মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করিতে পারে।
ইসলামী অর্থনীতিতে ধন-বন্টনের স্বাভাবিক পন্থা অনুযায়ী চারটি প্রধান উপায় অবলম্বন করা হইয়াছে।
(ক) নিজের, পরিবার-পরিজন, পিতামাতা, নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশী সর্বসাধারণ মুসলমানের অধিকার পূর্ণ করার দায়িত্ব পালন।
(খ) সমাজের অক্ষম, অভাবী পংগু ও অর্থোৎপার্জনের প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ লোকদের প্রয়োজন পূর্ণকণার্থে অবশ্য দেয়- যাকাত, ছদকা, ফিতরা এবং কুরবানী, সাধারণ দান-খয়রাত ইত্যাদি।
(গ) সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োন পূর্ণ করার জন্য দেয় নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় করার বাধ্যবাধকতা, প্রয়োজনবশতঃ আরো অধিক দানের কর্তব্য।
(ঘ) মালিকের অন্তর্ধানের পর তাহার যাবতীয় ধন-সম্পদ তাহার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে (ইসলামী বিধান অনুযায়ী) বন্টন করিয়া দেওয়া।
ধন-ব্যয়
সম্পদ উৎপাদনে নির্দেশদান ও উৎপাদনের সংগত পন্থা নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গে উহার বন্টন ও ব্যায়ের উপর ইসলামী অর্থনীতি খুব বেশী জোর দিয়াছে। কারণ, অর্থসম্পদ ব্যয় করা না হইলে তাহা রএক কড়াক্রান্তিও মূল্য নাই। ধন-সম্পদ স্বাভাতই এমন একটি জিনিস, যাহা ব্যয় করা, ব্যবহার করা ও অপরের হাতে তুলিয়া দেওয়া ছাড়া উহা হইতে কোন প্রকার কল্যাণ লাভ করা যায় না।
এই জন্য সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা মানুষকে একদিকে কৃপণতা পরিহার করিতে নির্দেশ দিয়াছেন:
(আরবী*********)
আল্লাহর নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যে সব ধন-সম্পদ দান করিয়াছেন, তাহা যাহারা কৃপণতা করিয়া সঞ্চয় করিয়া রাখে, তাহারা যেন এই কাজকে নিজেদের পক্ষে মঙ্গলকর বলিয়া মনে না করে। কারণ প্রকৃতপক্ষে ইহা এই দুনিয়ায় তাহাদের পক্ষে খুবই অনিষ্টকর হইবে। শুধু তাহাই নয়, কিয়ামতের দিন এই সঞ্চিত ধন-সম্পদেই তাহাদের গলার বেষ্টকচক্র বানাইয়া দেওয়া হইবে।
অন্যত্র বলিয়াছেন: (আরবী*********)
তোমার হস্ত তোমার কণ্ঠের সহিত বাঁধিয়া রাখিও না- অর্থাৎ কৃপণতা করিও না।
অন্যদিকে গোটা সমাজকে লক্ষ্য করিয়অ নির্দেশ দিয়াছেন:
(আরবী*********)
তোমরা আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় কর এবং তোমরা নিজদিগকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করিও না।
এই আয়অতে গোটা সমাজের ধ্বংস এবং জাতীয় অর্থ সম্পদ ব্যয় করাকে সমান পর্যায়ে দাঁড় করা হইয়াছে। অন্য কথা, জাতীয় পর্যায়ে ধনসম্পদ ব্যয় না করিলে জাতীয় ধ্বংস অনিবার্য বলিয়া আয়াতটিতে ঘোষণা করা হইয়াছে।
অপর এক আয়াতে বলা হইয়াছে:
(আরবী*********)
তোমরা তোমাদের মাল ও জানপ্রাণ দিয়া আল্লাহর পথে জিহাদ কর। ইহাতেই তোমাদের সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত রহিয়াছে, যদি তোমরা জান ও বোঝ। অতএব অর্থ ব্যয় একটি জাতীয় কর্তব্য।
একদিকে অর্থসম্পদ ব্যয় করার আদেশ করিয়া এবং অপরদিকে কৃপণতা করিতে নিষেধ করিয়া মানুষকে নিরংকুশ ও বল্গাহারা হওয়া হইতে বিরত রাখা হইয়াছে। অযথা ব্যয়, অপচয়, নিষিদ্ধকাজে ব্যয়-বিলাসিতা ইত্যাদি করিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধও করা হইয়াছে। এত পরিমাণ ব্যয় করিতেও নিষেধ করা হইয়াছে, যাহার ফলে ব্যক্তিকে একেবারে নিঃস্ব হইয়অ যাইতে হয়। ইরশাদ হইয়াছে:
(আরবী*********)
ধন-সম্পদ অপচয় করিও না, যাহারা এইভাবে ধন-সম্পদের অপচয় করে, তাহারা শয়তানের ভাই।
(আরবী*********)
তোমার হাত এতখানি উন্মুক্ত করিয়া দিও না, যাহার ফলে তুমি লজ্জিত, তিরষ্কৃত এবং দুঃখীত হইতে পারে।
এরজন্য অর্থব্যয় করার ব্যাপারেও ইসলাম মধ্যম পন্থা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়াছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
(আরবী*********)
খাও, পান কর, কিন্তু বেহুদা খরচ করিও না। কারণ বেহুদা খরচারকীকে আল্লাহ ভালবাসেন না।
নবী করীম (স) বলিয়াছেন: (আরবী*********)
দারিদ্র ও প্রাচুর্য উভয় অবস্থায়ই অর্থব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
ডাঃ ই.ভী রবিনস বলিয়াছেন:
যে দেশের আয় ব্যয় অপেক্ষা বেশী হয়, সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হইতে বাধ্য কিন্তু ব্যয় যদি আয় অপেক্ষা বেশী হইয়া পড়ে তবে তাহার ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটা অনিবর্য।[কাওয়ার এ্যান্ড কারমাইকেল।: “ইলিমেন্টস অব ইকনমিক্স।”]
জুয়অখেলা ও নেশার দ্রব্য ব্যবহার করিয়া অযথা অর্থের অপচয় করা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ:
(আরবী*********)
হে ঈমানদারগণ! জানিয়া রাখ, মদ, জুয়া, অখোদার উপাস্য স্থল ব্যবহার এবং গায়েব জানিবার জন্য পাশা খেলা, ফাল গ্রহণ ইত্যাদি অপবিত্র জিনিস ও শয়তানের কাজ। অতএব তোমরা তাহা পরিহার কর; তাহা হইলে তোমরা কল্যাণ লাভ করিতে পারিবে।
বক্তিগত প্রয়োজনে অর্থব্যয়
ধন-সম্পদ ব্যয় করার সকল নিষিদ্ধ পথ উল্লেখ করার পর আল্লাত তা’আলা মানুষকে লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছেন:
(আরবী*********)
এই দুনিয়ায় ও দ্রব্য সামগ্রীতে তোমার জন্য যে অংশ নির্দিষ্ট করা হইয়াছে তাহা তুমি ভুলিয়া যাইও না।
অর্থাৎ দুনিয়ায় জীবন যাপনের জন্য নিখিল মানুষের বুনিয়াদী প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী এই পৃথিবীতেই সংরক্ষিত হইয়াছে, তাহা আহরণ করিয়া-অর্জন করিয়া- ভোগ –ব্যবহার করা প্রত্যেকটি মানুষের কর্তব্য। তাহা ভুলিয়া গিয়া বৈরাগ্যবাদে দীক্ষিত হওয়া মাত্রই বাঞ্ছনীয় নয়।
ইসলামী অর্থনীতি ধনব্যয় সম্পর্কে সর্বপ্রথম দায়িত্ব দিয়াছে ব্যক্তির উপর- ব্যক্তির নিজের ও নিজের পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূর্ণ করার কাজে ব্যয় করার আদেশ ব্যক্তিকে দেওয়া হইয়াছে। একজন সাহাবী নবী করীম (স)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন: আমার নিকট মুদ্রা আছে, আমি তাহা কি করিব? উত্তরে নবী করীম (স) ইরশাদ করিলেন:
(আরবী***********)
নিজের জন্য নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার কাজে- উহা ব্যয় কর।
অন্য একটি হাদীসে অর্থব্যয় প্রসংগে নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
অর্থব্যয়ের কাজ নিজ হইতে শুরু কর। অর্থাৎ প্রথমে নিজের জীবিকা সংস্থানের কাজ ইহা ব্যয় কর।
ইসলামী অর্থনীতি উপার্জিত ধন-সম্পদের উপর স্বয়ং উপার্জনকারীরই প্রথম অধিকার স্বীকার করিয়াছে। আত্মহত্যা করা, অনশন ধর্মঘট করা এবং ইচ্ছামূলকভাবে অনাহারে মৃত্যুবরণ করা হারাম হওয়ারই ইহাই অন্যতম প্রধান কারণ। অতঃপর নিজের পরিবারবর্গ- স্ত্রী-পুত্র, কন্যা ও ব্যক্তির সহিত একত্রে বসবাসকারী লোকদের জন্য অর্থব্যয় করিতে হইবে। নবী করীম (স) বলিয়াছেন: (আরবী***********)
তোমার নিজের জন্য ব্যয় করার পর তোমার পরিবারবর্গের যে সব লোক তোমার উপর নির্ভরশীল, তাহাদে জন্য ব্যয় করিবে।
পরের জন্য অর্থ ব্যয় কাজ পরিবারবর্গের জন্য ব্যয় করার দ্বারা শুরু করিবে। [ইমাম ইবনে হাজার ইহার অর্থ লিখিয়াছেন:
(আরবী***********)
তোমার পরিবারবর্গের মধ্য হইতে যাহারা তোমার সঙ্গে থঅকে ও যাহাদের খরচ বহন করা তোমার কর্তব্য, প্রথমে তাহাদের জন্য ব্যয় করিবে। ইহার পর অবশিষ্ট থাকিলে তাহা অন্যদের জন্য ব্যয় করিবে।
নিকটাত্মীয়দের জন্য অর্থব্যয়
প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত অধিকার ও প্রয়োজন পূর্ণ করার পর তাহার পক্ষে সর্বাপেক্ষা নিকটাত্মীয়দের অধিকার পূরণ করার প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করা হইয়াছে। ইসলামী পরিভাষায় ইহাকে বলা হয় “ছেলায়ে রেহম”। তাই কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে: (আরবী***********)
হে নবী, জানাইয়া দাও, মুসলমানগণ যেন তাহাদের পিতামাতা নিকটাত্মীয়, এতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকতের জন্য সম্পদ ব্যয় করে, এতদ্ব্যতীত মানুষের উপকারার্থে আরো যত কাজ করিবে আল্লাহ (তাহা কবুল করিবেন, তিনি) সে সম্পর্কে অবহিত।
এই আয়াত হইতে প্রমাণিত হইতেছে যে, ব্যক্তির নিজের ও নিজের পরিবারবর্গের প্রয়োজন পূর্ণ করার পরেই নিকটাত্মীয়দের, নিকটবর্তী প্রতিবেশীর, সমাজের অসহায় শিশু, গরীব, দুঃখী এবং নিঃস্ব পথিকদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অর্থ ব্যয় করা বাঞ্ছনীয়। কোন কোন নিকটাত্মীয়দের জীবিকা নির্বাহের পূর্ণ দায়িত্ব ব্যক্তির উপর অর্পণ করা হইয়াছে। অক্ষম উপার্জনহীন পিতা-মাতা ইত্যাদি এই পর্যায়ে উল্লেখ্য।
এই জন্যই ইসলামী সমাজ নিকটাত্মীয়দের অধিকার-লংঘনকারীকে স্বাভাবতই কখনো বরদাশ্ত করিতে পারে না। দুর্নিবার সামাজিক চাপে তাহাতে এই অধিকার পূরণ ও দায়িত্ব পালনে একান্তভাবে বাধ্য করা হয়। এই জন্য নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
নিজ প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত রহিয়াছে এ কথা জানা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি পেট ভরিয়অ আহর করে এবং সুখের নিদ্রায় অচেতন হয়, তাহার ঈমান আছে বলিয়া কোন প্রমাণ নাই।
অভাবগ্রস্ত প্রতিবেশীর জন্য অর্থব্যয়ের ব্যাপারে আরো অধিক উৎসাহ দানের ব্যাপারে নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী***********)
******১৮৪তম পৃষ্ঠার শেষের দুই লাইন স্পষ্ট নয়।****
একটি মুদ্রা তোমার পরিবারবর্গের জন্য ব্যয় করিলে; জানিয়া রাখ, এই সকল মুদ্রার মধ্যে তোমার পরিবারবর্গের জন্য ব্যয়কৃত মুদ্রাটিই সওয়াব ও পূণ্যের দিক দিয়া শ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য হইবে।
নিজ পরিবারবর্গের প্রয়োজন পূরণের পর নিকটাত্মীয়দের জন্য অর্থ ব্যয় করা এবং গরীব আত্মীয়দিগকে দান-ছদকার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রত্যেক মুসলমানেরই কর্তব্য বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে।
হাদীসে বলা হইয়াছে: (আরবী***********)
মিসকীনকে দান করা হইলে তাহা একটি দান মাত্র। কিন্তু নিকটাত্মীয় গরীবকে দান করা হইলে তাহা যেমন দান, তেমনি তাহা আত্মীয়তার হক্ রক্ষারও ব্যবস্থা।
সামাজিক প্রয়োজনে অর্থব্যয়- যাকাত
এইভাবে ব্যক্তির ধন-সম্পদ ব্যয় করার ক্ষেত্র অধিকার বিশাল ও বিস্তীর্ণ হইয়া পড়ে। বস্তুত ইহা ব্যক্তির উপর সমাজের অধিকার। এই অধিকার পূর্ণ করা ইসলামী সমাজের প্রত্যেকটি মানুষেরই কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন করার জন্য প্রথমতঃ ব্যক্তির উপর ‘যাকাত’ ফরয করা হইয়াছে। যাকাত কেবল সঞ্চিত অর্থ সম্পদের উপরই আরোপ করা হয় নাই, ব্যক্তির নিকট যে পুঁজিই সঞ্চিত ও পুঞ্জীভূত হইয়া রহিয়াছে- তাহা পালিত জন্তু জানোয়ার হউক, জমি ক্ষেত-খামার হউক, ব্যবসায়-বাণিজ্যের পণ্য হউক, খনিজ দ্রব্য হউক কিংবা পুঞ্জীকৃত নগদ টাকা আর স্বর্ণ-রৌপ্য হউক- এই সব কিছুরই উপর যাকাত ফরয করা হইয়াছে। এই যাকাতের অর্থ ব্যয় করার যে ক্ষেত্র ইসলাম নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে, দুনিয়ার কোন অর্থনীতিতেই তাহার তুলনা মেলে না।
মূলত ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাতের স্থায়ী ব্যবস্থা পুঁজিবাদ ধ্বংস করার সর্বপ্রধান হাতিয়ার। কোন সমাজে এই ব্যবস্থা যথাযথরূপে কার্যকর হইলে তথায় পুঁজিবাদ কখনই মাথাচাড়া দিয়া উঠিতে পারে না। যাকাত ব্যক্তির শ্রম-মেহনত এবং সৎভাবে ও সদুপায়ে উপার্জিত স্তুপীকৃত ধন-সম্পদ অনিবার্যরূপে বিগলিত করিয়া সমাজের প্রতি রন্ধে-রন্ধে ও কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছাইয়া দেয়- সূর্যতাপ পূর্বতশৃংগে অবস্থিত বরফস্তুপ গলাইয়া যেমন করিয়া প্লাবিত করে দিগ্-দিগন্তকে।
কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে: (আরবী***********)
নামায কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর।
বস্তুত যাকাত-আদায় করা দ্বীন ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত। তাই কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে:
(আরবী***********)
যদি তাহারা নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, তবে তাহারা তোমাদের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত ভাই হইবে।
ইহার পরিষ্কার অর্থ এই যে, মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হইতে হইলে যাকাত আদায় করা কর্তব্য। অন্যথায় কেহ মুসলমানেই হইতে পারে না। [বলা বাহুল্য, যাহাদের উপর যাকাত ফরয হয়, যাকাত আদায় করার এই আদেশ কেবল তাহাদেরই জন্য।] আল্লাত তা’আলা যাকাতের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের কথা এত বলিষ্ঠভাবে বলিয়া দিয়াছেন যে, ইহা সঠিকভাবে আদায না করিলে সে মুশরিক বা কাফির হইয়া যাইবে বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন:
(আরবী***********)
যে সব মুশরিক যাকাত দেয় না এবং পরকালকে অস্বীকার করে, তাহারা কাফির, তাহাদের জন্য কঠিন শাস্ত নির্দিষ্ট রহিয়াছে।
‘যাকাত’ শব্দের অভিধানিক অর্থ, পাক বা পবিত্র করা ও উৎকর্ষ সাধন করা, এই জন্য ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় ‘যাকাত’ বলা হয় সেই আর্থিক ইবাদাতকে, যাহা আল্লাহ ও বান্দাহর হক আদায় করিয়া ধন-সম্পদ পবিত্র করার জন্য এবং নিজের নফস ও সমাজ পরিবেশকে সকল প্রকার কৃপণতা, স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, কুটিলতা ও দারিদ্রের পংকিলতা হইতে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে সমর্থ লোকদের উপর কর্তব্য বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। ‘মুসলমান’ হইয়াও যাহারা যাকাত দেয় না পূর্বোক্ত আয়াতে তাহাদিগকেই মুশরিক বলা হইয়াছে।
বস্তুত যাকাত-বাবদ আদায়কৃত অর্থ যদি একটি নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে ব্যয় করা যায়, তবে ইহা দ্বারা বিরাট জাতীয় কল্যাণকর কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। দেশের এয়াতীম, মিসকীন, অক্ষম, পংগু, অন্ধ, অসহায় সম্বলহীন বিধবা ইত্যাদি সকল মানুষের জন্যই স্থায়ী সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা-ব্যবস্থা চালু করা সম্ভবপর।
ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাত যদিও (ধনী) ব্যক্তির প্রতি ফরয করা হইয়াছে, কিন্তু মূলত ইহা একটি সামাজিক ও জাতীয় কল্যাণ-ব্যবস্থা। কাজেই ব্রক্তিগতভাবে আদায় না করিয়া সামাজিক ও জাতীয় ও জাতীয় কল্যাণ-ব্যবস্থা। কাজেই ব্যক্তিগতভাবে আদায় না করিয়া সামাজিক ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান- ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালের’ –মাধ্যমেই আদায় করা ইসলামের নির্দেশ।[এই গ্রন্থের অর্থনৈতিক দৃষ্টিদে যাকাত দ্রষ্টব্য।]
সাধারণ দান
‘যাকাত’ বাধ্যতা মূলকভাবে প্রত্যেক ধনশালী ব্যক্তির নিকট হইতে আদায় করা হয়। কিন্তু এই যাকাত প্রদান করিয়াই কোন ব্যক্তি জাতীয় ও সামাজি দায়িত্ব হইতে সম্পূর্ণরূপে রেহাই পাইতে পারে না। সমাজ ও জাতির জন্য আরো অর্থের প্রয়োজন হইতে পারে এবং সে প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য যাকাত আদায় করার পর আরো অর্থ ব্যয় করার দায়িত্ব রহিয়াছে। কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে:
(আরবী***********)
তাহাদের (ধনীদের) ধনসম্পদে প্রয়োজনশীল প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রহিয়াছে। [আলামা বদরুদ্দীন আইনী এই আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন: (আরবী**********)
মুসলমান মুক্তাকীদের ধনমাল, যাহাদের পরিচয় ইহার পূর্বে দেওয়া হইয়াছে।
(আরবী**********)
যে লোকদের নিকট চায় ও দান পাইবার জন্য প্রার্থনা জানায়।
(আরবী**********)
অর্থ: যে লোক বাহ্যত ধনী বলিয়া মনে হয় এবং কাহারো নিকট কিছু চায় না বিধায় দান পাওয়া হইবে বঞ্চিত থাকিয়া যায়। অথবা কিছু না কিছু উপার্জন করে বটে, কিন্তু তাহাও যথেষ্ট হয় না, তাই অসুবিধা ভোগ করে।]
যাকাত আদায় করিলেই এই অধিকার পূর্ণ হইয়া যায় না। ইহা যাকাত আদায় করার পরই বর্তিবে। তাই কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে: (আরবী**********)
তাহারা জিজ্ঞাসা কর যে, তাহারা কি খরচ করিবে। বলিয়া দিন যে, তোমরা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ সমাজ ও জাতির জন্য আল্লাহর পথে ব্যয় কর।
এই জন্যই নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
যাকাত ছাড়াও (তাহাদের ধনসম্পদে জাতির অধিকার রহিয়াছে। অতঃপর তিনি সূরা বাকারার আয়াত পড়িলেন: ‘কেবল পূর্ব-পশ্চিম দিকে মুখ করাই কোন সত্যিকার নেকা কাজ নয়। বরং আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, কিতাব ও নবীগণের প্রতি ঈমান আনা ও আল্লাহর ভালোবাসার বশবর্তী হইয়া নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, নিঃসম্বল পথিক, অভাবগ্রস্থ ও দাস লোকদের জন্য অর্থ ব্যয় করা এবং নামায পড়া ও যাকাত দেওয়াই হইল যথার্থ নেক আমল।
এই আয়াতে ঈমানের পরে পরে নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, নিঃসম্বল পথিক সওয়ালকারী ও দাস বা ঋণগ্রস্থের মুক্তির জন্য আল্লাহর মুহাব্বতের কারণে অর্থদান করর কথা প্রথেমে বলা হইয়অছে এবং নামায কায়েম করা ও যাকাত দেওয়ার কথা বলা হইয়াছে তাহার পর। ইহা হইতে স্পষ্ট প্রমাণিত হইতেছে যে, সম্পদশালী ব্যক্তির উপর ঈমানের পরে পরেই সাধারণ অভাবগ্রস্থদের জন্য অর্থদান করা কর্তব্য হইয়া পড়ে এবং এই অর্থ দানের দরুন যাকাত দেওয়ার কর্তব্য হইতে মুক্তি পাওয়া যাইবে না। বরং তাহার পরও যাকাত দিতে হইবে। অথবা বলা যায়, যাকাত দেওয়ার পরও লোকদের অধিকার আদায় করিতে প্রস্তুত থাকিতে হইবে।
ইহা ছাড়া সমাজের লোকদের আকষ্মিক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ‘করজে হাসানা’ দেওয়াও ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানদের একটি কর্তব্য।
এই ‘করজে হাসানা’ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দুই পর্যায়ের প্রয়োজনেই দিতে প্রস্তুত থাকা আবশ্যক। কেননা উভয় ক্ষেত্রেই আকস্মিক প্রয়োজন দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। কুরআন মজীদে এই উভয় পর্যায়ে ‘করজে হাসানা’ দেওয়ার জন্য বিশেষ উৎসাহ দান করা হইয়াছে। ইরশাদ করা হইয়াছে:
(আরবী**********)
কোন্ লোক আল্লাহ তা’আলাকে ‘করজে হাসানা’ দিতে প্রস্তুত আছে? যদি কেহ তাহা দেয়, তবে আল্লাহ উহার বদলে উহার কয়েকগুণ বেশী তাহাকে দান করিবেন। বস্তুত আল্লাহ রুজী ও রোজগারের পরিমাণ কমও করেন, প্রশস্তও করিয়া দেন আর শেষ পর্যন্ত তাঁহার দিকেই তোমাদিগকে ফিরিয়া যাইতে হইবে।
হাদীসের ঘোষণানুযায়ী সাধারণ দানের তুলনায় করজে হাসানা দেওয়া অধিক সওয়াবের কাজ। ইহার কারণস্বরূপ বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
কেননা সওয়ালকারী সব সময় কিছু-না-কিছু চাহিতেই থাকে; কিন্তু যে করজ চায়, সে প্রয়োজন ছাড়া কখনো চায় না।
এই ‘করজে হাসানা’রই আর একটি দিক হইল সাধারণ দান। সমাজের সচ্ছল লোকরেদ জন্য ইহাও এক অবশ্য কর্তব্য। এইরূপ দান করিতে সমাজের অবস্থাপন্ন লোকদিগকে অবশ্য প্রস্তুত করিতে এবং থাকিতে হইবে। এ দানকে কুরআনে ‘আল্লাহর পথে দান বা ব্যয়’ বলা হইয়াছে এবং কেহ তাহা করিলে তাহা কিছু মাত্র ব্যর্থ যাইবে না বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে।
কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
তোমরা আল্লাহর পথে দান রূপে যাহা কিছুই ব্যয় করিবে আল্লাহ তাহা তোমাদিগকেই পূর্ণ মাত্রায় ফিরাইয়অ দিবেন। এই ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনরূপ জুলুম করা হইবে না।
বস্তুত এই ধরনের দান বা ব্যয়ে কেবল অন্য লোকদের কল্যাণ সাধিত হয় না, কেবল সমাজেরই উপকার হয় না, নিজেদেরও পরম কল্যাণ ইহাতে নিহিত রহিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
তোমরা যে ধন-সম্পদই ব্যয় কর না কেন তাহা তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণে নিয়োজিত হয়।
নবী করীম (স) এই পর্যায়ে বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
হে আদম সন্তান! তুমি যদি তোমার উদ্ধৃত সম্পদ আল্লাহর ওয়াস্তে ব্যয় কর, তবে তাহা তোমার জন্য ভাল। আর যদি তাহা হইতে বিরত থাক, তবে তাহা তোমার জন্য অকল্যাণ। তোমার প্রয়োজন পূরণের জন্য কমসেকম পরিমাণ যদি রাখ, তবে সে জন্য তোমাকে তিরষ্কৃত করা হইবে না। তোমার দায়িত্বাধীন পরিবারবর্গের জন্য প্রথমেই ব্যয় করিবে। আর জানিয়া রাখ, দাতার হস্ত গ্রহীতার হস্ত হইতে উত্তম।
এ পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল লোকদের জন্য হযরত আলীর (রা) নিম্নোক্ত কথাটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
নিশ্চয়ই আল্লাত তা’আলা সচ্ছল লোকদের জন্য ইহা ফরয করিয়া দিয়াছেন যে, তাহারা গরীবদের জন্য এমন পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিবে যাহা তাহাদের ভরণ পোষণ ও জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট হইবে। ইহার পরও যদি তাহারা অভুক্ত থাকে, নগ্ন পায়ে চলিতে বাধ্য হয় এবং কষ্টে পড়ে, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে যে, ধনীরা তাহাদের (গরীবদের) হক আদায় করিতেছে না বলিয়াই এইরূপ অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে। এইরূপ অবস্থায় কিয়ামতের দিন ধনীদের নিকট হিসাব লওয়া ও সেই অনুপাতে তাহাদিগকে শাস্তি দেওয়া আল্লাহর এক দায়িত্ব হইয়া পড়ে।
এতদ্ব্যতীত রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্ম সুসম্পনট্ন করার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে কর, খাজনা ইত্যাদি বাবদ অনেক অর্থই ব্যয় করিতে হয়। এইভাবে এক ব্যক্তির আয় হইতে তাহার জীবদ্দশায়ই ধন-সম্পদ বিক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত হইয়া চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়ে। এক স্থানে পুঞ্জিকৃত হইয়া পুঁজিবাদের সৃস্টি হওয়ার বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকিতে পারে না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যাহার নিকটই যে পরিমাণ ধন-সম্পদ একত্রিত হয়, তাহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তাহা নানাভাবে খন্ড-বিখন্ড ও বিভক্ত হইয়া অসংখ্য হস্তে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে। ইসলামী অর্থনীতিতে ধন-সম্পত্তির এইরূপ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ার বিধানকে বলা হয় ‘মীরাসী আইন’।
মীরাসী আইন
মীরাসী আইনের মনস্তাত্বিক ও সামাজিক ভিত্তি অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। প্রত্যেকটি মানুষিই মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার সময় স্বভাবতই নিজের সন্তান সন্ততি ও নিকটতম আত্মীয়গণকে সচ্ছল অবস্থায় দেখিয়া যাইতে চাহে। অপরদিকে ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ার পর তাহার যোগ্য লোকগণ যদি সহসা নিঃস্ব ও অসহায় হইয়া পড়, তাহা হইলে তাহাদের ভরণ-পোষণের পূর্ণ দায়িত্ব অতি আকস্মিকভাবেই সমাজের উপর ন্যস্ত হয়। তখন এই অবস্থায় লোকগণ সমাজের উপর একটি দুর্বহ বোঝা হইয়া পড়ে। কিন্তু সমাজের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা খুব সহজ কার্য নহে। এই জন্যই নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক মানুষ নিজের প্রিয়তম ও নিকটতম লোকদের সচ্ছল ও পরমুখাপেক্ষিহীন দেখিতে ইচ্চুক হয়। নবী করীম (স) এই জন্যই ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
উত্তরাধিকারীগণকে সচ্ছল ও পরমুখাপেক্ষীহীন রাখিয়া যাওয়া তাহাদিগকে নিঃস্ব ও দরিদ্র রাখিয়া যাওয়া অপেক্ষা অনেক উত্তম। কারণ, তাহাদিগকে দরিদ্র ও সর্বহারা করিয়া রাখিয়া গেলে তাহারা সমাজের লোকদের সম্মুখে ভিক্ষার হাত দরাজ করিতে বাধ্য হইবে।
বস্তুত ইসলামী অর্থ-ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার যে অধিকার রহিয়াছে, তাহা ব্যক্তির নিজ জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, তাহা উত্তরাধিকার সূত্রে বংশানুক্রমিকভাবে অনন্তকাল পর্যন্ত চলিতে থাকিবে। ব্যক্তির নিজের জীবনে যেসব লোকের সহিত তাহার বৈষয়িক কিংবা আত্মিক অথবা রক্তের নিকট সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছে এবং যেসব লোক তাহার লাভ-লোকসাকে নিজের লাভ-লোকসান বলিয়া মনে করিয়াছে, তাহার মালিকানা ধন-সম্পত্তি তাহার মৃত্যুর পর ঐসব লোকের মধ্যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে বন্টন করা হইবে। এই উত্তরাধিকার আইন ব্যক্তির কেবল উৎপন্ন দ্রব্রের উপরই প্রবর্তিত হইবে না, উৎপাদন উপায়ের (Means of production) উপরও ইহা অনিবার্যরূপে কার্যকর হইবে।
ইসলামী জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মীরাসী আইনের গুরুত্ব যে কত, তাহা নবী করীম(স)-এর নিম্নলিখিত বাণী হইতে সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায়। তিনি বলিয়াছেন:
(আরবী************)
উত্তরাধিকার আইন নিজেরা শিখ, অন্যকে শিক্ষা দাও। কারণ ইহা ইসলাম সম্পর্কীয় যাবতীয় জ্ঞানের অর্ধেক।
নবী করীম (স) মীরাসী আইন অনুযায়ী ধন-সম্পদ বন্টন করার নির্দেশ দিয়া বলিয়াছেন:
(আরবী************)
থন-সম্পদকে উহার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আল্লাহর বিধান অনুাযায়ী বন্টন কর।
অধ্যাপক টাসগ্ লিখিয়াছেন: উত্তরাধিকার আইনের প্রভাব সুদুর-প্রসারী। একমাত্র এই ব্যবস্থাই যে ধনী ও নিঃস্বদের মধ্যে চিরন্তনী ব্যবধানকে দূরীভূত করিতে পারে, তাহা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হইয়াছে।[টাগ্স-প্রিন্সিপাল্স অব ইকনমিকস্, ২য় খন্ড-২৪৬]
নিঃ রিম্জে “মোহামাডান ল” গ্রন্থের ভূমিকায় লিখিয়াছেন: ‘আধুনিক সভ্য পৃথিবী ধন-বন্টনের যদ নিয়ম ও পন্থা আবিষ্কার করিতে পারিয়াছে, ইসলামের উত্তরাধিকার আইন তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বৈজ্ঞানিক ও নির্ভুল। এই আইনের অন্তর্নিতিহ সৌন্দর্য ও নিখুঁত সামঞ্জস্য অপরিসীম। ইহা কেবল আইন শিক্ষার্থীদেরই শিক্ষণীয় বিষয় নয়, জ্ঞানান্বেষী সকল ব্যক্তির পক্ষেই ইহা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
মীরাসী আইনের মূলনীতি
ইসলামের মীরাসী আইনের মুলনীতি নিম্নলিখিত আয়াথে উল্লিখিত হইয়াছে;
(আরবী************)
পিতা-মাতা এবং নিকটতম আত্মীয়দের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পুরুষদের নির্দিষ্ট অংশ রহিয়াছে এবং পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে স্ত্রীলোকদের জন্যও নির্দিষ্ট অংশ রহিয়াছে। প্রত্রেকের জন্যই এই অংশ সুনির্দিষ্ট, পরিমাণে তাহা কমই হউক কি বেশীই হউক।
এই আয়াত হইতে তিনটি মূলনীতি প্রমাণিত হইয়াছে:
প্রথম এই যে, পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়গণ যে সম্পদ ও সম্পত্তি রাখিয়া যাইবে- তাহা স্থাবর হউক কি অস্থাবর, তাহাতে উত্তরাধিকারীদের অংশ রহিয়াছে এবং উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন অবশ্যই বন্টন করিতে হইবে।
দ্বিতীয়, পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের সম্পত্তির অংশ স্ত্রী-পুরুষ সকলেই লাভ করিতে পারিবে। স্ত্রীলোক বলিয়া কাহাকেও অংশীদার হওয়ার অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইতে পার না কিংবা এমন কোন বাহ্যিক ব্যবস্থাও চালু করা যাইতে পারে না, যাহার ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির ভোগ-ব্যবহার করার অধিকার হইতে কাহাকেও বঞ্চিত করা যাইতে পারে।
মীরাসী আইন প্রসঙ্গে তৃতীয় মূলনীতিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাহা হইল (আরবী************) ‘সর্বাপেক্ষা অধিক নিকটবর্তী ব্যক্তি মীরাস লাভের অধিকারে সর্বাগ্রগণ্য।’ উদাহরণস্বরূপ বল যাইতে পারে যে, মৃত ব্যক্তির পিতা এবং পিতামহ বর্তমান থাকিলে মীরাস লাভের ব্যাপারে পিতাই অগ্রগণ্য হইবে। কারণ, উভয়েল মধ্যে পিতাই মৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়। অনুরূপভাবে পুত্র এবং পৌত্র অপেক্ষা পুত্রই মৃত ব্যক্তির অপেক্ষাকৃত বেশী নিকটবর্তী।
এতদ্ব্যাতীত নিম্নলিখিত তিনজন লোক মীরাস হইতে বঞ্চিত হইবে”
(ক) হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির মীরাস লাভ করিতে পারিবে না। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী************) হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির মীরাস লাভ করিবে না।
(খ) ধর্মের বিভিন্নতার দরুণ একজন অপরজনের মীরাস হইতে বঞ্চিত হইবে। বুখারী শরীফের একটি হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হইয়াছে:
(আরবী************)
মুসলমান ব্যক্তি কাফিরের এবং কাফির ব্যক্তি মুসলিমের উত্তরাধিকার লাভ করিতে পারিবে না।[কোন মুসলমানের ওয়ারিস মুর্তাদ হইয়া গেলে সেও তাহার সম্পত্তির অংশ পাইবেনা। ইমম নবী লিখিয়াছেন: (আরবী************)
‘মুর্তাদ মুসলমানের অংশীদার হইবে না, ইহাতে সকল বিশেষজ্ঞ সম্পূর্ণ একমত।’
তাহা হইলে তাহার অংশ কি করা হইবে? এ বিষয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। কেহ বলিয়াছেন, উহা অবশ্যি অংশীদারদের মধ্যে বন্টন করা হহইবে। আর কেহ বলিয়াছেন, উহা বায়তুলমালে জমা হইবে।]
(গ) দেশ বা রাজ্যের বিভিন্নতার দরুনও এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির মীরাস লাভ হইতে বঞ্চিত হইতে পারে। বর্তমান আন্তর্জাতিক আইনের সহিত ইহার সামঞ্জস্য রহিয়াছে। ইসলামী রাজ্যের ধন-সম্পত্তি যাহাতে কাফির রাজ্যে স্থানান্তরিত হইতে না পারে সেই উদ্দেশ্যেই এই আইন বিধিবদ্ধ করা হইয়াছে। কিন্তু কেহ অস্থায়ীভাবে পর্যটন কিংবা ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে রাজ্যের বাহির চলিয়া গেলে, তাহার উপর মীরাস হইতে বঞ্চিত হওয়ার এই আইন প্রযোজয় হইবে না।
অসিয়ত
ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবকাশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী অর্থনীতি সম্পত্তির উপর ব্যক্তির নিজ ইচ্ছা-বাসনা কার্যকর করার সীমাবদ্ধ অধিকার দান করিয়াছে। মৃত্যুর পূর্বে ব্যক্তির অসিয়ত করার অধিকার তন্মধ্যে অন্যতম। এই পর্যায়ে প্রথমে যে আয়াতটি নাযিল হইয়াছে তাহা এই:
(আরবী************)
তোমাদের কাহারও মৃত্যু উপস্থিত হওয়া কালে ধন-মাল রাখিয়া যাইতে থাকিলে অসিয়ত করা তোমাদের জন্য ফরয করা হইয়াছে।
এই আয়াত অনুাযায়ী ইসলামী সমাজে অসিয়ত চালু হইয়া যায়। কেননা তখন পর্যন্ত মীরাসের আয়াত নাযিল হয় নাই। অতএব প্রত্যেক সম্পত্তি-মালিক মৃত্যুর পূর্বে নিজ ধন-সম্পত্তি সম্পর্কে যদি কোন অসিয়ত করে, তবে মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তাহার অসিয়ত পূরণ করিতে হইবে। প্রকৃত পক্ষে ধন-বন্টনের দিক দিয়া ইসলামী অর্থনীতিতে এই অসিয়তেরও যথেষ্ট মুল্য রহিয়াছে। এমন অনেক নিকটাত্মীয় থাকিতে পারে যাহারা বাহ্যিক বা আইনগত কোন কারণবশতঃ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি হইতে মীরাস লাভ করিতেপারে না- বরং বঞ্চিত হয় এবং তাহা হইতে বঞ্চিত হইয়া সম্পূর্ণরূপে নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হইয়া পড়ে, নিতান্ত অসহায় হইয়া পড়ে। তখন সম্পত্তি-মালিকের কর্তব্য আল্লাহর দেওয়া এই সুযোগকে ব্যবহার করা এবং বঞ্চিত নিকটাত্মীয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের জন্য মৃত্যু পূর্বেই অসিয়ত করিয়া যাওয়া।
মূলত নিকটাত্মীয়দের মধ্যে সম্পত্তি বন্টনের জন্য এই অসিয়তই ছিল সর্ব প্রাথমিক ব্যবস্থা। মীরাসী আইন নাযিল হওয়ার পূর্বে এই অসিয়তের প্রচলন করা হয়। কিন্তু মিরাসী আইন জারী হওয়ার পর হযরত নবী করীম (স) অসিয় ও মীরাস সংক্রান্ত আইনের ব্যাখ্যা করিয়া দুইটি মুল নিয়ম নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন:
প্রথম নিয়ম এই যে, মীরাসী আইন জারী হওয়ার পর কেহ ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারীর জন্য কোন অসিয়ত করিতে পারে না। অর্থাৎ মীরাসী আইনের মাধ্যমে যে সব নিকটাত্মীয়ের অংশ কুরআন মজীদে নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে, তাহাদের জন্য অসিয়ত করিয়া উক্ত অংশে কোনরূপ হ্রাস-বৃদ্ধি করা যাইতে পারে না। কোন ওয়ারিসকে মীরাস হইতে অসিয়তের সাহায্যে বঞ্চিত করা সম্পূল্ণ বেআইনী কাজ; আর কোন অংশীদারকে তাহার বিধিসম্মত অংশ ব্যতীত অসিয়তের সাহায্যে অতিরিক্ত জিনিস দেওয়া বিধেয় নহে। নবী করীম (স)-এর কথাটি এই:
(আরবী************)
নিশ্চয়ই মীরাসী আইনের মাধ্যমে আল্লাত তা’আলা প্রত্যেক হকদারকে তাহার হক দিয়া দিয়াছেন। যে লোক উত্তরাধিকারী তাহার জন্য কোন অসিয়ত নাই।
দ্বিতীয় নিয়ম এই যে, অসিয়ত মোট সম্পত্তির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণেল উপরই কার্যকর হইবে, তাহার বেশী অংশ সম্পর্কে অসিয়ত করিলেও তাহা কার্যকর হইবে না। নবী করীম (স) হযরত সায়াদ বিন্ আবী-অক্কাস (রা)-এর এক প্রশ্নের জওয়াবে বলিয়াছিলেন: (আরবী************)
হ্যাঁ, এক-তৃতীয়াংশ মাত্র এবং এই এক-তৃতীয়াংশই অনেক।[নবী করীম (স) এই কথাটির প্রেক্ষিতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেন:
(আরবী************)
লোকেরা যদি অীসয়তে এক-তৃতীয়াংশ হইতে এক-চতুর্থাংশে নামিয়া আসে, তবে তাহা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।]
অর্থাৎ প্রত্যেক সম্পত্তির মালিক তাহার মেটা সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ নিজ আইন-সম্মত-উত্তরাধিকারীদের জন্য রাখিয়া অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি অ-উত্তরাধিকারীদের জন্য- নিজ ঘরের বা বাহিরের অভাবী নিকটাত্মীয়দের জন্য, কিংবা জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠান বা কাজের জন্য- অসিয়ত করিয়া যাইতে পারিবে।[বিশেষজ্ঞদের মত হইল, নবী করীমের কথা হইতে স্পষ্ট হয় যে, এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি অনেক বেশী। কাজেই উহার কম অংশের অসিয়ত হওয়া উচিৎ। ইহাম নববী লিখিয়াছেন: উত্তরাধিকারীরা গরীব হইলে তাহাই হওয়া উচিৎ। আর ধনী হইলে এক-তৃতীয়াংশ হওয়া উচিত।
বস্তুত ইসলামী অর্থনীতিতে অসিয়ত একটি সুপারিশ মাত্র নয়, ইহা অনিবার্যরূপে কার্যকর করিতেই হইবে। কুরআন মজীদ এই অসিয়ত সম্পর্কে বলিয়াছেন: (আরবী************)[সূরা আল-বাকারা: ১৮০ আয়াত] ইহা মুত্তাক্কীন ও আল্লাহভীরু লোকদেন প্রতি আল্লাহর তরফ হইতে ধার্য করা একটি অনিবার্য অধিকার বিশেষ।[এমনকি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে মীরাস বন্টনের পূর্বেই এই অসিয়ত পূরণ ও কার্যকর করতে হইবে বলিয়া কুরআন মজীদে পর পর তাকীদ করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে:
(আরবী************) যে অীসয়ত করা হইয়াছে তাহা পূরণের পরই মীরাস বন্টন করা যাইবে।]
অধিকার যথাযথরূপে আদায় করা হইলে পিতামহ কিংবা মাতামহের বর্তমানে যাহাদের পিতা কিংবা মাতার মৃত্যু হয়, তাহাদের মীরাস হইতে বঞ্চিত হওয়ার কারণ কোনরূপ অসুবিধায় পড়িবার কথা নয় এবং তাহা লইয়া কোনরূপ অভিযোগও করা চ লেনা।
পূর্বেই বলা হইয়াছে, ধন-সম্পদের সমধিক বন্টন এবং অবাধ, অজস্র ও অবিশ্রান্ত আবর্তন সৃষ্টি করাই ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। ইহার ফলে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিই দায়িত্বপূর্ণ সাংসারিক জীবন শুরু করার জন্য এই সংঘাত-সংকূর জীবন যুদ্ধে ঝাপাইয়া পড়ার অনুকূলে কিছু না কিছু কাজ-কারবার ব্যবসায়-বাণিজ্য বা শিল্প-কার্য শুরু করিবার সুযোগ পায়। -নিজের প্রাপ্ত অংশকে অধিকতর বর্ধিত করিতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করিতে পারে। উপরন্তু ইহারই পরিণামে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পাইবার বিরাট সুযোগও ঘটে।
মীরাসী আইনের গুরুত্ব
প্রসংগত: উল্লেখযোগ্য, ইসলামী সমাজে এই মীরাসী আইন এক অনস্বীকার্য বিধান। ইহাকে কার্যকর করিলে ইহকালে ও পরকালে- সর্বত্রই পরিপূর্ণ সাফল্য ও অর্থনৈতিক প্রগতি লাভ করা সম্ভব। আর এই আইনকে জারী না করিলে- ইহার ভিত্তিতেসম্পত্তি বন্টন না করিলে, ইহকাল পরকাল সকল ক্ষেত্রে চরম দুর্গতি ও লাঞ্ছনা ঘটিবে, তাহাতে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকিতে পারে না। কুরআন মজীদে মীরাসী আইন বিস্তারিতরূপে বর্ণনা করার পরেই আল্লাত তা’আলা জলদ-গম্ভীর স্বরে ঘোষণা করিয়াছেন:
(আরবী************)
এইগুলি আল্লাহ তা’আলার নির্ধারিত সীমা, এই সীমা রক্ষা করিয়া যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করিয়া চলিবে, তাহকে আল্লাহ তা’আলা এমন বেহেস্তে স্থান দিবেন, যাহার পাদদেশ হইতে প্রতিনিয়ত ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয় এবং তাহাতে সে চিরদিন বসবাস করিবে। বস্তুত ইহাই হইতেছে চরম সাফল্য। পক্ষান্তরে এই সীমা রক্ষার ব্যাপারে যে ব্যক্তি আল্লাহর ও তাঁহারা রাসূলের নাফরমানী করিবে এবং আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমা লংঘনি করিবে, আল্লাহ তাহাকে আগুনে নিক্ষেপ করিবেন- ইহাতে সে চিরদিন অবস্থান করিবে। সেখানে তাহাকে কঠিন আযাব দেওয়া হইবে।[মীরাস বন্টনের মৌলিক বিষয়াদি আল্লাহ নিজেই বলিয়া দিয়াছেন, তাহা আল্লাহর বিধান হিসাবেই মানিতে হইবে। কিন্তু আয়অতে আল্লাহর আনুগত্যের কথা বলার সাথে সাথে রাসূলের আনুগত্য করিতে হয় বলিয়া বুঝাইতে চাওয়া হইয়াছে যে, এই বিধানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও আনুসাঙ্গিক আইন রাসূল করীম (স) বলিয়াছেন।]
মীরাসী আইনে তুলনামূলক আলোচনা
উত্তরাধিকার আইন দুনিয়ার প্রত্যেক দেশ ও প্রত্যেক সমাজে কোন না কোনরূপ বর্তমান ও চালু রহিয়াছে। কিন্তু এক দেশের উত্তরাধিকার আইনের সহিত অন্য দেশের আইনর কোন সামঞ্জস্য নাই। স্কটল্যাণ্ডের মীরাসী আইন এক প্রকার, ইংল্যাণ্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকার। ফ্রান্স ও ইংলণ্ডের উত্তরাধিকারী আইনের মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য। ইংল্যান্ডের মীরাসী আইন অনুসারে একজন ইংরেজ তাহার সর্বশেষ অসিয়ত ও দস্তাবীজের সাহায্যে নিজের ইচ্ছামত একজনকে সমগ্র সম্পত্তির উত্তরধিকার দান করিতে পার, [ইকনমিক অব ইহেরটেন্স- ৪র্থ অধ্যায়, ৯০ পৃঃ] ফ্রান্সের “রোড নেপোলিয়ান” অনুযায়ী নিজ সন্তানের সংখ্যানুপাতে অসিয়তের মারফতে পরিমাণের কম-বেশী অনায়াসেই করা যাইতে পারে। সোভিয়েত রাশিয়ার গোড়ার দিকে ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকার হরণ করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকার আইনও বাতিল করা হইয়াছিল। কিন্তু বর্তমানে মানুষের স্বাভাবিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে দুনিয়ার চাপে কমিউনিস্ট মতবাদের-মার্কসীয় দর্শনের- সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যক্তিমালিকানা অধিকার স্বীকার করিয়া সঙ্গে সঙ্গ উত্তরাধিকার আইনকেও চালু করা হইয়াছে। ইউরোপে সাধারণতঃ জ্যেষ্ঠ পুত্রের সমগ্র সম্পত্তির মালিক হওয়ার রীতি খুব বেশী প্রচলিত আছে। এই জন্য অন্যান্য সন্তানাদিগকে নিতান্ত অসহায় ও পাথেয়হীন হইয়া জীবন যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়িতে হয়। ফলে সমগ্র জাতীয় সম্পত্তি মুষ্টিমেয় কয়েকজন জ্যেষ্ঠ পুত্রের হাতে একিভূত হইয়া পড়ে।
ইসলামর অর্থনীতি তথা ইসলামের মীরাসী আইন অবম্বিদ সকল প্রকার জুলুম, অবিচার, শোষণ, অসামঞ্জস্যতা ও ভারসাম্যহীন বন্টন পদ্ধতি হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। ইসলামী সমাজের মত ব্যক্তির সকল নিকটাত্মীয়ই- ছেলেমেয়ে স্ত্রী এবং পিতামাতা সকলেই –মীরাস লাভ করে। ফলে বিরাট ধন-সম্পত্তি অসংখ্য খণ্ডে বিভক্ত হইয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে পরিণত হয় এবং প্রত্যেকেরই পরিমাণ কম হওয়া কেবল উহারই উপর নির্ভর করিয়া কর্মহীন, অলস ও বিলাসী জীবন যাপন করা কাহারোও পক্ষেই সম্ভব হয় না। কাজেই মীরাসী আইন একদিকে যেমন স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূল্ত পন্থায় অবিস্রান্তভাবে ধন-সম্পত্তির বন্টন করিয়া থাকে, অন্যদিকে ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও অর্থোপার্জনের মারফতে জাতীয় সম্পদ অধিকতর বৃদ্ধি করে। অতএব এ কথা অকুণ্ঠিতচিত্তে ঘোষণা করা যাইতে পারে যে, দুনিয়ার অর্থনীতিতে ইসলামের মীরাসী আইনের কোন তুলনা নাই।
একটি আশংকার জওয়াব
ধন-সম্পত্তি ও জায়গা-জমিকে মীরাসী আইন অনুসারে সঠিকভাবে বন্টন করিলে তাহা টুকরা টুকরা হইয়া যাইবে এবং প্রত্যেক ভূমিখন্ডের সীমা নির্দেশের জন্য আল বাঁধিতে হইবে। ফলে উহাকে আধুনিক যান্ত্রিক পদ্থরি সাহায্যে চাষ করা কিছুতেই সম্ভব হইবে না। অন্য কথায়, বিংশ শতাব্দীর ইসলামী রাষ্ট্রের চাষে জমি পরিমাণ কম হইবে, উৎপাদন শক্তি হ্রাস পাইবে এবং ভূমিচাষ প্রথা চিরদিন মধ্যযুগের পদ্ধতিতেই সীমাবদ্ধ থাকিয়া যাইবে। তাহা যেমন কখনও ‘আধুনিক’ হইতে পারিবে না, অনুরূপভাবে তাহা কোনদিনই রাষ্ট্রের সামগ্রিক খাদ্য প্রয়োজন পূরণ করিতে সমর্থ হইবে না। অন্যদিকে এক ব্যক্তির হাতে একিভূত মূলধন, শতহাতে বন্টন হইয়া গেলে ইসলামী সমাজে বৃহদাকার শিল্প ও ব্যবসায় কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে পুঁজি লাভ করা অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইবে। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রকে শিল্পায়িত করা এবং আধুনিক সভ্যতার সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়অ চলা সম্ভবপর হইবে না।
ইসলামের মীরাসী আইন সম্পর্কে বর্তমান কালের এক শ্রেণীর লোক উল্লিখিত রূপ আশংকা প্রকাশ করিয়া থাকে। কিন্তু এই আশংকা যে কতখানি অমূলক, কত অন্তঃসারশূণ্য এবং ভিত্তিহীন, তাহা অর্থনীতি সম্পর্কে সামান্য জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিও অনুধাবন করিতে পারেন। প্রথম কথা এই যে, ইসলামে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, ইসলামী সমাজের ব্যক্তিগণ নিজেরা পরস্পর মিলিত হইয়া কোন বৃহত্তর অর্থোৎপাদনকারী কাজও করিতে পারিবে না। এইরূপ ধারণা মূলত সত্য নয়। ইসলাম ব্যক্তিকে কেন্দ্র করিয়া যেমন সমাজ সৃষ্টি করে, তদ্রুপ ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারীগণ পরস্পর মিলিত হইয়া বহৃত্তর জাতহীয় ও সমষ্টিগত কল্যাণ লাভ করিবার জন্য সকল প্রকার সামগ্রিক প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করিতে পারে। শুধু তাহাই নয়, একাধিক লোক মিলিত হইয়া সকল প্রকার কল্যাণকর কাজ করিবে, এ জন্য ইসলাম স্পস্ট ভাষায় নির্দেশেও দিয়াছে:
(আরবী************)
তোমরা সকল প্রকার সৎ ও কল্যাণকর কাজে পরস্পরের সহিত সহিযোগিতা কর- পরস্পর মিলিত হইয়া বৃহত্তর কল্যাণ লাভ করিবার জন্য কাজ কর। পাপ ও খোদাদ্রোহিতার কাজ পরস্পর মিলিত হইও না- এই কাজে কাহারো সহযোগিতা করিও না।
কাজেই ইসলামী সমাজের ভূমি মালিকগণ পরস্পর মিলিত হইয়া সমবায় ব্যবস্থা স্থাপন করিতে পারিবে এবং ইহার পক্ষ হইতে আধুনিক যন্ত্রপাতি খরিদ করিয়া চাষের কাজ করিতে পারিবে, সার ইত্যাদির ব্যবস্থা করিয়া ভূমির উর্বরতা শক্তির উৎকর্ষ সাধন করিতে পারিবে। তাহতে ভূমির সীমা নির্দেশক আল নিশ্চিহ্ন করিয়া দিলেও কোন ক্ষতি নাই। প্রত্যেকেরই অংশের পরিমাণ লিখিত থাকিবে এবং সমবায় প্রথায় চাষের পর প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভূমির অংশ অনুপাতে ফসল বন্টন করিয়া লইতে পারিবে। যৌত প্রথায় ভূমি চাষ করার সকল সুফলই এইভাবে লাভ করা যাইতে পারে, অথচ ব্যক্তিগত মালিকানার দরুন জমির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খন্ড হওয়ার ফলেও তাহা কোনরূপ অনিষ্ট করিতে পারিবে না।
বৃহদাকার শিল্প-ব্যবসায়ও অনুরূপভাবে সামষ্টিক মুলধন ও সমবেত চেষ্টা সাধনার মারফতে সুসম্পন্ন হইতে পারিবে। মূলত তাহাতেও কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হইতে পারিবে না।
এখানে আরও একটি প্রশ্ন রহিয়াছে। বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফলে শিল্প-ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পরিবার কেন্দ্রিক গোষ্ঠিবদ্ধতা মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছে। একই গোষ্ঠির মধ্যেই বৈবাহিক সম্পর্ক ও সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে। ফলে এই গোষ্ঠির লোকদের মধ্যে সম্পদ ও সম্পত্তি মীরাসী আইন অনুযায়ী বন্টন করা হইলেও তাহা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তৃতি পাইতে পারে না। ইহাতে মীরাসী আইনের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয় নাকি? এহার জওয়াবে আমাদের বক্তব্য এই যে, এইরূপ গোষ্টিবদ্থতা(Grouping) কেবল পুঁজিবাদী সমাজেই সম্ভভ। ইসলামী সমাজে এইরূপ গোষ্ঠিবদ্ধ জীবন অবিচল থাকিবে না। সেখানে বৈবাহিক সম্পর্ক সাধারণ সমাজের মধ্যে সম্প্রসারিত হইবে। ফলে উত্তরাধিকারীদের সূত্রে এক গোষ্ঠী বা বংশের ধন-সম্পদ সম্পূর্ণ ভিন্ন বংশের লোকদের মালিকানায় চলিয়া যাইবে। বস্তুত সম্পত্তি-মালিকের বংশ, পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সীমাবদ্ধ পরিবেশে ধন-বন্টনের স্থায়ী ব্যবস্থা কার্যকর করাই মীরাসী আইনের লক্ষ্য।
সোভিয়েট ইউনিয়নেও মীরাসী আইন কার্যকর এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ-সম্পত্তি লাভের অধিকার শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে স্বীকৃত। ইহার ফলে উচ্চমাত্রায় উপার্জনকারীদের (Highest inmcome earners) সন্তানরা তাহাদের সমগ্র সম্পত্তির উত্তরাধিগকারী হইতে পারে। আর ইহার দরুন ধনী আরো অধিক পরিমাণ ধন-সম্পত্তির মালিক হইয়াও বসিতে পারে।
অনুরূপভাবে গরীবরা গরীবই থাকিয়া যাইবে, অথমা মূল্যাধিক্য ও সরকারী প্রাপ্যেল দুর্বিসহ চাপের তলায় পড়িয়া তাহারা আরো অধিক মাত্রায় দরিদ্র হইয়া যাইতে পারে। শুধু তাহাই নয়, কাজ অনুযায়ী মজুরী দেওয়ার নিয়ম যদি রাশিয়ায় স্থায়ীভাবে কার্যকর হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইহার উদ্দেশ্য তথায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইয়া যাইতে বাধ্য।
মীরাস না পাওয়ার প্রশ্ন
প্রসংগত: পৌত্রের মীরাস না পাওয়ার প্রশ্ন সম্পর্কেও সংক্ষেপে দুইটি কথা বলা আবশ্যক:
পৌত্র ও পৌত্রী, কি পিতা মাতার মাধ্যমেই পিতামহের কি মাতামহের সম্পত্তির অংশীদার হইতে পারে- সরাসরিভাবে নয়; ইহাই হইতেছে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন। কিন্তু পিতা কিংবা মাতা যদি পূর্বেই মৃত্যুমখে পতিত হয়, তবে মাঝখানের সূত্র ছিন্ন হইয়া যাওয়ার দরুন মীরাস হইতে ইহাদের বঞ্চিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। ইহা যেমন যুক্তিসংগত কথা, অনুরূপভাবে ইসলাম অীভজ্ঞ সকল লোকের নিকট শুরু হইতেই ইহা সমর্থিত হইয়া আসিয়াছে। একটি ছেলে কিংবা মেয়ে পিতার বর্তামনেই যদি মারা যায়, তবে পিতার সম্পত্তিতে তাহার যেমন কোন অংশ স্বীকৃত হয় না, সংশ্লিষ্ট ব্যাপারেও তাহাই হইবে। অবশ্য উক্ত ইয়াতীমের জন্য অসিয়ত করা পিতামহের কিংবা মাতামহের কর্তব্য এবং ইসলামী অর্থনীতিতে ইহার পূর্ণ অবকাশ রহিয়াছে। [কুরআনের ঘোষণানুযায়ী এই অসিয়ত, এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইহা কার্যকর করার পূর্বে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে মীরাস বন্টন করা যাইবে না। ইহা কার্যকর করার পরই মীরাস বন্টন হইতে পারে।] আর সম্পত্তির মালিক কোন কারণে তাহাদের জন্য অসিয়ত না করিলেও সম্পত্তি বন্টনের সময় অবশ্য তাহাদিগকে উহা হইততে দিতে হইবে এই পর্যায়ে আল্লাহর রহিয়াছে।
(আরবী*********)
মীরাস বন্টনের সময় নিকটাত্মীয় ইয়াতীম ও মিসকীন যারা মীরাসের নিয়মে অংশ পায় নাই, তাহাদিগকে উহা হইতে জীবিকা দাও এবং তাহাদিগকে ভাল কথা বলঅ।
আর কোনরূপ সহায়সম্বল না থাকিলেও ভয়ের কোন কারণ নাই। যেহেতু এই অসহায় ধরনের শিশুর জন্য স্বয়ং ইসলামী রাষ্ট্রই দায়ী থাকিবে, যেখানে এই আইনটি যথাযথাভাবে ও পুরামাত্রায় কার্যকর হইবে।
ইসলামী সাম্যের তাৎপর্য
বস্তুত ইসলাম মানুষকে কোন দিনই কোন দিক দিয়াই প্রতরিতি করে না, অসম্ভব ও অস্বাভাবিকের প্রতিশ্রুতি দিয়া মানুষকে প্রলোভিত করে না। ইসলাম প্রথম দিনই ঘোষণা করিয়াছে যে, দুনিয়ার সকল মানুষ সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের দিক দিয়া সম্পূর্ণরূপে সমান হইতে পারে না। তাহার কারণ, সকল মানুষের বুদ্ধি-প্রতিভা, কার্যক্ষমতা ও যোগ্যতা এবং পরিবেশগত প্রয়োজন মোটেই সমান নয়। কাজেই এইসব গুণের দৌলতে যে অর্থ-সম্পদ উপার্জিত হইবে তাহার পরিমাণও সমাণ হইতে পারে না। মানুষের মধ্যে যে স্বাভাবিক বৈষম্য (Natural Defferentiation) রহিয়াছে, ইসলাম তাহা যথাযথারূপেই স্বীকার করিয়াছে। অন্য কথায় ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক যোগ্যতা প্রতিবার পার্থক্রকে কোন কৃত্রিম উপায়ে নির্মূল করিয়া একাকার করিয়া দেওয়ার চেষ্টা করে না। বস্তুত আল্লাহ তা’আলা কোন ব্যাপারেই এবং কোন দিক দিয়াই মানুষের পরস্পরের মধ্যে নিরংকুশ সমতা স্থাপন করেন নাই। শুধু মানুষের কথাই নয়, গোটা প্রকৃতির কোথায়ও এইরূপ সমতা ও নিরংকুশ সাম্য পরিলক্ষিত হয় না। স্বভাব নিয়ম প্রত্রেকটি মানুষকে বিভিন্ন প্রকার যোগ্রতা, প্রতিভা ও ক্ষমতা দান করিয়াছে। কেহ অত্যন্ত বেশী সুন্দর ও সুশ্রী, কেহ ভয়ানক কুৎসিৎ। কাহারো মস্তিষ্ক শক্তি ও প্রতিভা-মণীষা অত্যধিক, কাহারো স্মরণশক্তি কিছুতেই নাই। কেহ পূর্ণ স্বাস্থ্যবান এবং মোটা-তাজা, কেহ দুর্বর, রুগ্ন ও কৃশ। কাহারো কণ্ঠস্বর সুমধুর, কাহারো গর্ধভের ন্যায় বিকট ও কর্কশ। এইসব বৈষম্য যেমন অতীব স্বাভাবিক ও জন্মগত, মানবসমষ্টির মধ্যে ধন-সম্পত্তির সমান সংগতি না থাকা- বরং আর্থিক সংগতির বৈষম্য থাকাও অনুরূপভাবে স্বাভাবিক। কাজেই এই স্বাভাবিক বৈষম্য যথাযথরূপে বজায় রাখা এবং কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট সমগ্র বৈষম্য পার্থক্যকে নির্মুল না করা মানব সমাজের উন্নতি, প্রগতি, ক্রমবিকাশ ও উত্থান লাভের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
আল্লাহ তা’আলা এই কথাই বলিয়াছেন কুরআন মজীদে নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে:
(আরবী*********)
আমি দুনিয়ার জীবনে মানুষের মধ্যে তাহাদের অপরিহার্য় রুজী বন্টন করিয়া দিয়াছি এবং আমি এই ব্যাপারে কোন কোন লোককে অন্যান্যের উপর প্রাধান্য দিয়াছি- যেন তাহারা পরস্পরের দ্বারা কাজ করাইতে পারে।
বস্তুত ধন-সম্পত্তির পরিমাণের এই বৈষম্যেই মানব-সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিক আদান-প্রদানের মুল কারণ। ইহা না থাকিলে, কোন সমাজই গড়িয়া উঠিতে পারে না। মানুষের পক্ষে সামাজিক জীবন-যাপন করাও কখনো সম্ভব হয় না।
ইসলাম যেমন স্বাভাবিক সাম্যকে স্বীকার ও সমর্থন করে, তেমনি স্বীকার করে স্বাভাবিক অসাম্যকে। পক্ষান্তরে, স্বাভাবিক সাম্যকে কৃত্রিম উপায়ে চূর্ণ-করা ও স্বাভাবিক অসাম্যকে কৃত্রিম উপরয়ে সাম্যে পরিণত করা ইসলামের নীত বহির্ভূত। বরং ইসলামের দৃষ্টিতে এই কৃত্রিমতা মানব সমাজের পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকর, সন্দেহ নাই। ইসলাম সমর্থিত স্বাভাবিক অসাম্যকে একটি উদাহর দিয়া বুঝান যাইতে পারে। একব্যক্তি জন্মগত পংগুও আতুর, দ্বিতীয় ব্যক্তি সুস্থ শরীর ও পূর্ণাঙ্গ বিশিষ্ট এবং তৃতীয় ব্যক্তি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, যেখানে সে শিশুকাল হইতেই মোটর গাড়ীর অধিকারী হইয়াছে। এই তিন ব্যক্তিই স্বাভাবিক বৈষম্যের ভিতর দিয়া নিজ নিজ জীবনযাত্রা শুরু করিয়াছে। ইসলারেম বিধান অনুসারে অর্থ ব্যবস্থা এতখানি সুবিচারপূর্ণ ও স্বাধীন প্রচেষ্টার অবকাশময় হওয়া আবশ্যক, যেন পংগু ও আতুর ব্যক্তি নিজ নিজ অন্তর্নিহিত স্বাভাবিক যোগ্যতা, প্রতিভা ও স্বাধীন প্রচেষ্টার বদৌলতে মোটর-মালিক হইতে পারে এবং তাহার এই পথে যেন কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা না হয়।…….. আতুরকে যেন চির জীবন আতুর হইয়া থাকিতে বাধ্য করা না হয়। তেমনি মোটর-মালিক যদি নিরেজ নির্বুদ্ধিতা ও অযোগ্যতার দরুন মোটর চলার সামর্থ্য ও সংগতি হারাইয়া ফেলে-নিজের কৃতকর্মের অনিবার্য পরিণামে তাহাকে একেবারে আতুর শ্রেণীতে আসিয়া পড়িতে হয়, তবে তাহার এই আর্থিক পতনও যেন অবাধে ঘটিতে পারে, কোন প্রকার কৃত্রিম উপায়ে যেন তাহাকে স্থায়ীভাবে চির জীবনে তরে মোটর-মালিক করিয়া না রাখা হয়। কারণ, তাহাকে এইরূপ অধিকার দিলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাহার কোন লোকাতীত মর্যাদার স্বীকৃত দেওয়া হয়। কাজেই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় স্বাভাবিক অর্থ বৈষম্যকে রক্ষা করত কৃত্রিম পার্থক্রেল মূলোৎপাটন করিতে হইবে এবং প্রত্যেকটি মানুষকে তাহার নিজ যোগ্যতা, প্রতিভা ও শ্রম-মেহনতের সাহায্যে সমাজ-স্বার্থের ক্ষতি না করিয়া উন্নতি সাধন করার সুযোগ করিয়া দিতে হইবে। বস্তুত ইহাই হইতেছে প্রকৃত ও স্বাভাবিক অর্থ ব্যবস্থা।
ইসলাম সমর্থিত স্বাভাবিক সাম্যের অর্থ-অর্থোপার্জনের জন্য চেষ্টা সাধনা করা ও ইহাতে সুযোগ গ্রহণের ব্যাপারে সকল মানুষের জন্য সমান অধিকার বর্তমান থাকা। মানুষকে পরস্পরের সহিত এমনভাবে বাধিয়া দেওয়া ইসলাম কিছুতেই সমর্থন করিতে পারে না,যাহার ফলে দ্রুত গতিশীলকেও দুর্বল ও অক্ষমের সহিত জড়িত হওয়ার কারণে মন্থর হইতে হয়, কিংবা দ্রুত চলিতে চাহিলেও অপরকে পদদলিত করিয়া চলিতে হয়। ইসলামের বিধান এই যে, যে ব্যক্তি মোটরে চড়িয়া বেড়াইতেছে, তাহাকে জোর করিয়া পদাতিক করিয়া দেওয়া যাইতে পারে না। পক্ষান্তরে মোটর মালিক হওয়ার যাহার আর্থিক সামর্থ্যনাই, কৃত্রিম উপায়ে তাহাকে মোটর মালিক করিয়া দেওয়াও সমীচীন হইতে পরে না। পরন্তু যে ব্যক্তি মোটরে চড়িয়া বেড়াইতেছে, শক্তি এবং সামর্থ্য অনুসারে দ্রুত গতিতে চলার তাহার অধিকার আছে বটে, কিন্তু তাহারই সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল কিংবা পায়ে হাঁটিয়া যাহারা চলিতেছে,তাহাদের গতি ব্যাহত করা কিংবা তাহাদিগকে পদদলিত করিয়া সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার কোনই অধিকার তাহাকে দেওয়া যাইতে পারে না। ইসলামী অর্থ-ব্যবস্থায় সমাজের বিকাশ ও প্রগতি লাভের জন্য ব্যক্তিগত যোগ্রতা ও প্রতিভাবে ক্ষুন্ন করাজুলুম ও শোষণের শামিল। মানুষকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চেষ্টা সাধনা করার অবাধ সুযোগ করিয়া দেওয়া ইসলারেম দৃষ্টিতে অতীব কল্যাণকর ও অপরিহার্য।