ইসলামী রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ইসলামী রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ব্যাংক-ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা এবং মুদ্রা ও ব্যাসায় সংক্রান্ত সরকারী নীতির বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কায়েম করা অপরিহার্য। এই ব্যাংক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের অধীনে চলিবে। মুনাফা লাভ করা ইহার উদ্দেশ্য হইবে না; বরং সার্বিকভাবে জন-স্বার্থ সংরক্ষণ ও জনকল্যাণমূলক কার্যাবলীল উন্নয়ন সাধনই হইবে উহার আসল দায়িত্ব।
ইসলামী রাষ্ট্রের সুদবিহীন অর্থব্যবস্থায়ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলির মতই কাজ করিবে। উহা কারেন্সী নোট জারী করিতে পারিবে।সরকারের যাবতীয় অর্থনৈতিক কাজকর্ম, অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক লেন-দেনও ইহার মাধ্যমেই সম্পন্ন হইবে। অন্যান্য দেহের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কজনিত আর্থিক দায়-দায়িত্ব ও ব্যাপারসমূহের নিয়ন্ত্রলও এই ব্যাংক করিবে। একটি সাধারণ ব্যাংক কারবারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের ক্ষেত্রে যেসব দায়িত্ব পালন করিয়া থাকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের জন্য সেইসব দায়িত্ব পালন করিবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন কোন দেশে একান্তভাবে সরকার পরিচালিত হইয়া থাকে। আবার অনেক রাষ্ট্রে জনগণ ও সরকারের সম্মিলিত ব্যবস্থাধীনও উহা চলিতেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেয়ার-মূলধন (Share capital) হয় একা গভর্ণমেন্ড দিকে; কিংবা জনগণ ও সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতায় উহা গড়িয়া উঠিবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সমূহ পালন করিতে হয় বিধায় উহার সরকারী ব্যবস্থাধীন প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হওয়াই বিধেয়। তাই উহার পরিচালনার ভার জনগণ ও সরকার নির্বাচিত ডাইরেক্টর্স বোর্ডের উপর অর্পণ করা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার সহিত অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বীয় দায়িত্ব নিম্নোদ্ধৃত কার্যাবলীর মাধ্যমে পালন করিবে:
(১) মুদ্রা প্রচলন উহার নিয়ন্ত্রণ: ব্যাংক রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে এই দায়িত্ব পালন করিবে, ইহা সম্পূর্ণ সুদ বিবর্জিত পদ্ধতিতে। বর্তমান ব্যাংক-কারবারের এই কাজে কোন সুদের অবকাশ নাই।
(২) Supply of credit: বর্তমানে এই কাজ সম্পূর্ণরূপে সুদের ভিত্তিতে সম্পন্ন হইতেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বীয় সদস্য ব্যাংকও অন্যান্য মূলধন সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান (Credit agencies) সমূহের মাধ্যমে সমগ্র দেশে ঋণ বিতরণ করিবে। ইসলামী কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমগ্র দেশ হইতে সুদী কারবারকে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করিবে এবং স্বীয় সদস্য-ব্যাংক গুলিকে ঋণ দেওয়ার পরিবর্তে পুঁজি বিনিয়োগ করিবে। এই পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সদস্য ব্যাংকসমূহের লাভ-লোকসানের অংশীদার হইবে।সারা দেশের ঋণের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার ইহা এক উত্তম পন্থা। সদস্য ব্যাংক সঠিকভাবে কাজ না করিলে উহা কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত যাবতীয সুযোগ সুবিধা হইতে বঞ্চিত হইবে এবং স্বীয় কাজ-কারবারকে সম্প্রসারিত করিতে সমর্থ হইবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সদস্য ব্যাংকসমূহকে উহাদের কারবারের লাভ-লোকসানে শরীক না হইয়াও ঋণ দিতে পারে। দেশের মূলধন (credit) সহস লভ্যতাকে অধিক ব্যাপক করা এবং উহার মাধ্যমে জাতীয় কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যেই এই কাজ ক রিবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক উহার অকাজে পড়িয়া থাকা মূলধন সদস্য ব্যাংকগুলিকে বিনাসুদে ঋণ বাবদ দিতে পারে। ফলে ব্যাংকসমূহ প্রয়োজনানুযায়ী সাধ্যমত কেন্দ্রীয় ব্যাংক হইতে বিনাসুদে ঋণ লাভ করিতে পারিবে।
(৩) ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ (control of banking system) কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকটি পন্থাই প্রয়োগ করিতে পারে, তাহা হইল, ব্যাংকের রিজার্ভ পরিমাণ, খোলা বাজারের রীতিনীতি ও ব্যাংকের হার-এর সীমা নির্ধারণ প্রভৃতি। ইসলামী কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদবিহীন নীতি ও সার্বিক কল্যাণকর যাবতীয পন্থায়ই কাজ করিতে পারিবে।
(৪) রাষ্ট্রীয় অর্থ ও জনগণের ফান্ড : মূলত রাষ্ট্র সরকারই ইহার নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণকারী। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এই কাজ সম্পন্ন হইবে। ইহার দুইটি খাত থাকিবে: আয় ও ব্যয়। অনেক সময় ব্যয় আয়ের তুলনায় অনেক বেশী হইয়া থাকে। তখন নূতন কর ধার্যের সাহায্যে অভাব পূরণ করা হয়; কিংবা সরকারী দায়িত্বে বন্ড্স আকারে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ইহাকে গণ-ঋণ (Public Debit) বলা হয়। প্রত্যেকটি উন্নত রাষ্ট্রই এইরূপ ঋণ গ্রহণ করিয়া থাকে। ইহাতে যে সুদ দেওয়া হয় তাহার বোঝা প্রকারন্তরে সমগ্র দেশের করপ্রদাতা জনগণের উপরই চাপানো হয় এবং ইহা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের সুদ।
বস্তুত, প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই গণ-ঋণ গ্রহণে বাধ্য। না নিলে উহা কোন কাজই করিতে পারে না, এমন কোন কথা নাই। কেননা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াজন ভিন্নতর উপায়েও পূরণ করা যাইতে পারে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, আমেরিকার ফেডারেল সরকার ও রাজ্য সরকার সমূহও গণ-ঋণ গ্রহণ করে এবং আর্থিক উন্নয়নে গণ-ঋণ অপরিহার্য বলিয়া মনে করে। কিন্তু এই দেশেরই ইন্ডিয়ান রাজ্য সরকার কোন গণ-ঋণ গ্রহণ করিতেছে না। এই রাজ্যসরকার গৌরব সহকারে বারবার ঘোষণা করিয়াছে।
‘ইন্ডিয়ানা- সম্পূর্ণ ঋণমুক্ত, প্রথম বৎসরকারলীন শিল্পোন্নয়নে অগ্রবর্তী, অধিকাংশ শিল্প-সংস্থা ঋণ-বিমুক্ত ইন্ডিয়ানা রাজ্যেই কারবার করিতে চাহে কেন?
আমেরিকার Capital journal পত্রিকা ১৯৫৯ সালের নভেম্বর সংখ্যাংয় ইহার কারণ পর্যালোচনা করিয়া লিখিয়াছে:
‘এই রাজ্যে গণ-ঋণ বলিতে কিছুই নাই। ইন্ডিয়ানা আজও সেই ষোলটি রাজ্যের অন্যতম, যাহা স্বীয় আয়ের দ্বারাই চলিতেছে। ১৯৪৬ সনে এইরূপ রাজ্যের সংখ্যা ছিল ৪১টি। ইন্ডিয়ানা রাজ্যে সরকার কোন গণ-ঋণে ঋণী নয়। অথচ পূর্বে ইহার ষাট বিলিয়ন ডলারের রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় ঋণে ঋণী ছিল। অতঃপর ইহাতে গণ-ঋণ গ্রহণ করা শাসনতান্ত্রিকভাবেই নিষিদ্ধ করা হইয়াছে। এই কারণে, এখানকার শিল্পসংস্থা অতীতের ঋণের ভিত্তিতে কোন সওদা করে না।’
(Reported bu Indiana Department of commerce, Indiana P. 45 Indiana, U.S.A)
ইহা হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, গণ-ঋণ ব্যতীত এবং কেবলমাত্র নিজস্ব আমদানীর উপর নির্ভর করিয়া প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই সুষ্ঠুরূপে চলিতে পারে এবং সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করিতে পারে। তাই ইসলামী রাষ্ট্র সাধারণত সুদভিত্তিক ঋণ তো দূরের কথা, কোন প্রকার ঋণ ব্যতীতই স্বীয় কাজ সমাধা করিবে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে অগ্রসর হইতে থাকিবে।
এতদসত্ত্বেও আমরা এখানে এমন একটি পন্থা নির্দেশ করিতে পারি, যাহা অবলম্বন করিয়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের জন্য বিনাসুদে অর্থ সংগ্রহ করা যাইতে পারে।
ইসলামী রাষ্ট্র জনগণের নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করিয়া পাবলিক ফান্ড শুরু করিবে না। এই ফান্ডটিকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কায়েম করিয়া জনগণকে উহাতে অর্থদানের সাধারণ আহ্বান জানান হইবে। ইহাতে যে মূলধন সংগৃহীত হইবে, সরকার তাহা বিভিন্ন জাতীয় কল্যাণমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করিবে। উহা হইতে লব্ধ মুনাফা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হার মত বন্টন করা হইবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, সরকার রেল বিভাগ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করিবে। উহার জন্য জনগণের মধ্যে অংশ বিক্রয় করিয়া মুলধন সংগ্রহ করা হইবে। এজন্য সরকারী পর্যায়ে সিকিউরিটি সার্টিফিকেট (Investment securities) ইস্যু করা হইবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পর ইহাতে যে মুনাফা হইবে তাহা মূলধন প্রদাতাদের মধ্যে তাহাদের মূলধনের পরিমাণ অনুপাতে ভাগ করিয়া দেওয়া হইবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা Trut Fund-ও সরকারী নেতৃত্ব চালাইতে পারে। তাহাতে ব্যাংক উহার উদ্ধৃত্ত সম্পদ বিনিয়োগ করিতে পারে। যেসব সরকারী পরিকল্পনায় মুনাফা হওয়ার সম্ভাবনা নাই, মুনাফামূলক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের কাজ শুরু করাও উহার পক্ষে সম্ভবপর হইবে। বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করিতে হইবে। সর্বাপেক্ষা বড় দায়িত্ব হইল ইসলামের ব্যাংক-ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা। যাহার ফলে আধুনিক ইসলামী সমাজের সমস্ত আর্থিক প্রয়োজন ইসলামসম্মত পন্থায় পূরণ হইতে পারিবে ও আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুকাবিলাও করিবে। উহার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হইল, জাতীয় সম্পদকে জনগণের মধ্যে ইনসাফ মুতাবিক বন্টন ও আবর্তিত হওয়ার নির্ভযোগ্য ব্যবস্থা করা, উহাকে মুষ্টিমেয় কতিপয় ধনীদের মুষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ হইতে না দেওয়া, কেবল বড় বড় পুঁজিপতি প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানাকেই ঋণ দানের ব্যবস্থা করিয়া ক্ষুদ্রায়তন শিল্প-ব্যবসায়েও যাহাতে প্রয়োজন পরিমাণ ঋণ ও মূলধন সংগ্রহের ব্যবস্থা করা যায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। ইহার ফলে দেশের সর্বসাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত ও সুখ সমৃদ্ধিপূর্ণ হইতে পারিবে। এই উদ্দেশ্যে আধুনিক ব্যাংক-ব্যবস্থার ব্যপকতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সমস্ত ব্যাংক ব্যবসায়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করিতে হইবে, যেন সমাজে সুস্থ ব্যবসায়ী প্রতিযোগিতা ও সুষ্ঠু ব্যাংক ব্যবসায় ব্যাপকভাবে চালু হইতে পারে।
এই পর্যায়ে মনে রাখিতে হইবে:
কুরআন ও হাদীসের অকাট্য দলীল সুদ কে শুধু হারাম বলিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই। উহা যে সর্বাধিক ঘৃণ্য ও বীভৎস তাহা ও স্পষ্ট করিয়া তুলিয়াছে। সব গুনাহ সর্বতোভাবে এক ও অভিন্ন নহে। কোন কোন কবীরাহ্ গুনাহ অপর কোন কবীরাহ্ গুনাহ অপেক্ষা অধিক মারাত্মক ও ভয়াবহ হইতে পারে। সুদ এই পর্যায়ের একটি গুনাহ। ইহা গোটা অর্থনীতি ও অর্থব্যবস্থাকেই সম্পূর্ণ নাপাক বানাইয়া দেয়। ইহার দরুন ব্যক্তির মনে স্বার্থপরতা ও স্বার্থান্বেষণ তীব্র হইয়া উঠে। স্বার্থান্ধ মানুষ ভাল-মন্দ-ন্যায়-অন্যায় যে কোন পথে ও উপায়ে স্বীয় হীন-স্বার্থোদ্ধারের জন্য পাগলের মত ছুটিতে থাকে। স্বার্থলিপ্সা কুটিল হইতেও কুটিলতর পন্থা উদ্ভাবন ও অবলম্বনের জন্য প্রতি মুহূর্তেই উদগ্রীব হইয়া থাকে। মানবীয় দায়-সহানুভূতি, কল্যাণ কামনা ও সম্প্রীতি হৃদয়-মন হইতে কর্পূরের ন্যায় উঠিয়া যায়। সাধারণ মানবীয় মন-মানসিকতা ও চরিত্রহীন হইতেও হীন হইয়া যায়।
এই পরম সত্যকে সম্মুখে রাখিয়া সেইসব অর্থনৈতিক লেন-দেন দূরে থাকিতে চেষ্টা করিতে হইবে যাহাতে সুদের বিন্দুমাত্র চিহ্ন ও সাদৃশ্যও পাওয়া যাইবে। বহু সংখ্যক হাদীসে সুদের সন্দেহ হয় এমন সব ক্রয়-বিক্রয় ও লেন-দেনকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হইয়াছে। একালে সুদের নূতন নূতন সংজ্ঞা রচিত হইয়াছে ও নানা প্রকারের নবতর ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে সুদকে জায়েয বানাবার উদ্দেশ্যে অভিনব উপায়ে ইজতিহাদ করিতে চেষ্টা করা হইতেছে। এই কারণে এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন দেখা দিয়াছে। কেননা বর্তমানে সুদ মুক্ত ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন দেখা দিয়াছে। কেননা বর্তমানে সুদ মুক্ত ব্যাংকের নামে নূতন গজাইয়া উঠা বহু ব্যাংকিং পদ্ধতিতে অজ্ঞাতসারে কিংবা হীন কৌশলের সাহায্যে ভিন্নতর পথে সুদী কারবারই চালাইয়া যাওয়া হইতেছে। এই জঘন্য কার্যকলাপ ঈমানদার লোকদের গোচরীভূত হইলে তাঁহারা চিৎকার করিয়া উঠেন। কিন্তু প্রতিকারের পথ না পাইয়া সুদে মুক্ত ব্যাংক কিংবা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী পদ্ধতিতে ব্যাংক পরিচালনার সম্ভব্যতা সম্পর্কেও তাহারা সন্দেহের মধ্যে পরিয়া যান অতি স্বাভাবিকভাবে।
এই পর্যায়ে মনে রাখিতে হইবে, সুদ মুক্ত ব্যাংক, কিংবা ইসলামী ব্যাংকের নাম দিয়া ভিন্নতর পন্থায় এমনভাবে লেন-দেন করা- যাহাতে কোন না কোন মাত্রায় সেই সুদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়- লোকদেরকে বেঈমান বানাইবার কারণ ঘটাইতে পারে। নগদ মূল্যে ক্রয় করিলে পণ্যের এক মূল্য এবং বাকি মূল্যে ক্রয় করিলে সেই পণ্যকেই অধিক মূল্যে বিক্রয় করা সুস্পষ্টরূপে সুদী কারবার। অথচ কোন কোন ইসলামী নামধারী ব্যাংক এই পন্থায় কাজ করিতেছে। ইহাকে শুধু সুদকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয় না, একটা প্রচণ্ড ধোঁকাবাজিও করা হয়।
বৈদেশিক বিনিময় ও ইসলামী ব্যাংক
বস্তুত ইসলামী ব্যাংককে বিশ্বব্যাপী ব্যবসায় ও ধন-বিনিময়ের অপরাপর আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সহিত যোগাযোগ, সহযোতিা ও আদান প্রদান করিতে হইবে। দুনিয়ার অমুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের সহিত ব্যবসায় সংক্রান্ত যোগাযোগ মজবুত করার দায়িত্বও উহাকেই পালন করিতে হইবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুদ বিমুক্ত লেন-দেনের ব্যবস্থা কার্যকর করা সহজ হইলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইহা বড়ই কঠিন ব্যাপার হইয়া দাড়াইবে। কেননা বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুদই হইল যাবতীয় লেন-দেন ও আমদানী রপ্তানীর ভিত্তি। রপ্তানীকারক দেশ রপ্তানী পণ্যের উপর এবং আমদানীর ক্ষেত্রে আমদানীকারক দেশ আমদানী পণ্যের উপর নিশ্চিতরূপে সুদ ধার্য করিয়া থাকে। ব্যাংকের মাধ্যমে এল. সি (Letter of credit) খোলার জন্য বর্তমানে সুদ দেওয়া-নেওয়া অনিবার্য হইয়া আছে অথচ ইসলামী ব্যাংককে ইহা সর্বতোভাবে পরিহার করিয়া কাজ সমাধা করতে হইবে।
এইরূপ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সর্বপর্যায়ের ব্যবসায় কেন্দ্রীয় ইসলামী কমার্সিয়াল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন হইতে হইবে এবং বৈদেশিক সুদের আদান-প্রদানের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এমনভাবে পালন করিতে হইবে, যাহাতে শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মক সুদী লেন-দেন খতম করা সম্ভবপর হয়। এজন্য আমরা প্রথম পর্যায়ে একটি ‘বৈদেশিক সুদমুক্তির ফান্ডৎ (Pool for foreign interest) গঠনের প্রস্তাব করিব। বৈদেশিক ব্যবসায়ের সব কাজ এই ফান্ডের মাধ্যমে সমাধা করিতে হইবে। এই ফান্ডের সাহায্যে ইসলামী ব্যাংকের আমদানীকারক অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ের আনুপাতিক বিকল্প বৈদেশিক ব্যবসায়ের উপর অন্যান্য দেশ হইতে অর্জিত সুদের বদলে অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ের আনুপাতিক মুনাফা ইসলামী ব্যাংককে প্রদান করা হইবে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রের কোন ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান বিদেশ হইতে যদি পণ্য আমদানী করে এবং সে জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের বৈদেশিক ব্যাংকে এল. সি. খোলে, তবে আমদানীকারককে সে ব্যাংককে অবশ্যই পণ্য মূল্য পরিমাণ নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সুদ নিতে হইবে। অনুরূপভাবে ইসলামী রাষ্ট্র হইতে কোন দ্রব্য কোন বিদেশী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানী করিতে হইলে এদেশের ইসলামী ব্যাংকেই এল. সি. খুলিতে হইবে ও আনুপাতিক হারে উহাকে সুদ আদায় করিতে হইবে। এই বৈদেশিক সুদের লেন-দেন বন্ধ করার জন্য ইসলামী ব্যাংক উপরোক্ত ফান্ডের মাধ্যমে উহাকে নিয়ম সম্মত বানাইয়া লইবে। উহার বাস্তব পন্থা এই হইবে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের আমদানীকারক অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় লব্ধ মুনাফার আনুপাতিক অংশ (Equitable share) নিজ দেশের ব্যাংককে আদায় করিয়া দিবে, যাহা কেন্দ্রীয় ইসলামী ব্যাংকের এই ফান্ডে জমা করা হইবে এবং এই ফান্ড হইতে বিদেশী ব্যাংকের বিকল্প সুদ আদায় করিয়া দেওয়া হইবে। অনুরূপভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের রপ্তানীকারী ব্যাংকের বিকল্প সুদ আদায় করিয়া দেওয়া হইবে। অনুরূপভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের রপ্তানীকারী ব্যাংক আমাদানীকারী বিদেশী ব্যাংক হইতে বৈদেশিক ব্যবসায়ের পরিমাণের উপর মেয়াদ অনুযায়ী সুদ লাভ করিবে। এই সুদ ও উক্ত ফান্ডে জমা করিয়া দেওয়া হইবে। আর কেন্দ্রীয় ইসলামী ব্যাংক এই ফান্ড হইতে বিকল্প অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ে আনুপাতিক মুনাফা ইসলামী ব্যাংককে দান করিবে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের এই ফান্ডে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ চলিবে। ব্যাংক ব্যবস্থার প্রয়োজন অনুযায়ী ইহাতে কমবেশী করারও অবকাশ রহিয়াছে। বৈদেশিক ক্ষেত্রে সুদ বর্জনের জন্য এইরূপ পন্থা অবলম্বন কিছুমাত্র অভিনব বা ইসলামী আদর্শের প্রকৃত-বিরোধী নহে। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা)-এর খিলাফত আমলে ইসলামী রাষ্ট্রের বৈদেশিক ব্যবসায়ীদের পণ্যের উপর বিদেশী রাষ্ট্রসমূহ রাষ্ট্রীয় শুল্ক ধার্য করিয়াছিল। ইহার জওয়াবে হযরত উমর (রা) ও ইসলামী রাষ্ট্রে বৈদেশিক ব্যবসায়ীদের পণ্যের উপর সরকারী শুল্ক ধার্য করিয়াছিলেন। আমাদের সুদ মুক্তির আলোচ্য পরিকল্পনা ইহারই আধুনিক বিবর্তিত রূপ মাত্র।
পূর্বোক্ত আলোচনা হইতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্র অতি সহজেই সুদের আন্তর্জাতিক আদান-প্রদানের প্রথা চিরতরে খতম Eliminated করিতে সক্ষম হইবে। কেননা উক্ত পরিকল্পনার শেষ পরিণতি এইরূপ সংশোধন করিয়া লওয়া যাইবে যে সুদের আর্থিক মূল্য ও আনুপাতিক মুনাফার আর্ধিক মূল্য নির্ধারণের পরিবর্তে অর্থ আদায়ের জন্য কোন উপযুক্ত মেয়াদ নির্ধারণ করা হইবে এবং ৩০, ৬০, কিংবা ৯০ দিনের sight bill of usance bills-এর পবর্তন করা হইবে, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য Bill of exchange- এর নিয়মে সমস্ত আদান-প্রদান নিয়মিত করিয়া লইতে হইবে। এইভাবে আর্থিক জগতে ইহার বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুদকে খতম করিতে হইবে। ইহার ফলে ইসলামী অর্থ-ব্যবস্থা কেবল বাস্তব (Practicale) প্রমাণিতই হইবে না, ইহার দরুণ উহার উন্নতি বিধান করিয়া সমগ্র জগতের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভবপর হইবে। শেষ পরিণতি স্বরূপ সমস্ত আর্থিক লেন-দেনে সুদের হার শুণ্যের (Zero rate of interest) কোঠায় আসিবে এবং বিশ্বমানবতা সর্বপ্রকার শোষণ ও নির্যাতন এবং হারাম কাজের অভিশাপ হইতে চিরতরে মুক্তিলাভ করিতে সক্ষম হইবে।
উন্নয়ন
ইসলাম অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। এই জন্য বিপুলভাবে উৎসাহ দিয়াছে ও বিভিন্ন কথা ও যুক্তির মাধ্যমে জনগণকে সে জন্য উদ্বুদ্ধ করিতে চেষ্টা করা হইয়াছে। সামাজিক ন্যাং বিচার এবং নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থা কার্যকর করাই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার উন্নয়নের চরম লক্ষ্যরূপ ঘোষিত হইয়াছে।
অর্থনৈততিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ণ ইসলামী অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অবশ্য এই পরিকল্পনা একটা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ধারণা ও মৌলিক প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করিয়া রচনা করিতে হইবে। এই পর্যায়ে সিদ্ধান্ত সূত্র (Primises) রূপ তিনটি নিতিবাচক ও দুইটি ইতিবাচক মৌলনীতির উল্লেখ করা যায়।
ইসলামী অর্থনীতিতে উন্নয়ন মূল্যবোধ নিরপেক্ষ হইতে পারে না। তাহা নকলবিশির কলাকৌশলও হইতে পারে না। বিনিয়োগযোগ্য বাড়তি মূলধন প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সহজ শিল্পোয়ানের পথেও উহা অগ্রসর হইতে পারে না। উপরন্তু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ও কাঠামো লব্ধ উন্নত অর্থনীতি পশ্চাত্যে দেশসমূহে কিছুটা কল্যাণবহ হইলেও আমাদের মত অবস্থা সহিত উহার প্রকৃত সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য নাই বললেও অত্যুক্তি হইবে না। তাই উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্ধভাবে পশ্চিমা প্রক্রিয়ার অনুসরণ করিয়া যাওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার হইয়া দাড়াইতে বাধ্য।
ইসলামের অর্থনীতিতে উন্নয়ন অবশ্যই আদর্শিক, নৈতিক ও মূল্যবোধ ভিত্তিক (Value oriented) হইতে হইবে। এই মূল্যবোধের মৌল ভাবধারা কুরআন ও সুন্নাহর বিধৃত। আর তাহা হইল:
An effrot to weld the technological and idiological aspects and to make our values explicit in icdision-making
উপরন্তু এই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবতামুখী ও প্রয়োগবাদী (Pragmatic) হইতে হইবে। ইহার মাধ্যমেই ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধকে বাধ্যতামূলকভাবে বাস্তবায়িত হইতে হইবে। বাস্তবতাহীন ও ইসলামী মূল্যবোধ শূণ্য কোন উন্নয়ন ইসলামী অর্থনীতিতে আদৌ স্বীকৃতব্য নয়। উন্নয়নের কাজ হইল সামাজিক পরিবর্তন ও পুনর্গঠন। এই পর্যায়ে ইসলামের দৃষ্টিকোণ হইল:
(ক) সামাজিক পরিবর্তন অবশ্যই উদ্দেশ্যপূর্ণ ও পূর্বপরিকল্পিত হইতে হইবে। একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য সম্মুকে রাখিয়া কাজ শুরু করিতে হইবে। সেজন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উদ্ভাবিত ও পরিচালিত হইতে হইবে। মনে এই দৃঢ়মূল করিয়া লইতে হইবে যে, মানুষ এই বিশ্বলোকে মহান স্রষ্টার এক বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি এবং এই পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর খলীফা। অতএব মানুষই হইল এখানকার সামাজিক পরিবর্তনের আসল হোতা, উদ্যোক্তা ও সক্রিয় কর্মকর্তা।
(খ) সামাজিক পরিবর্তন ইসলামে কোন সংকীর্ণ অর্থে গ্রহীত নয়। ইহার ব্যাপক তাৎপর্যই ইসলামে কাম্য। গোটটা পবেশের পরিবর্তন, ব্যক্তিগণের চিন্তা-বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও কর্মনীতি দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তন, জীবন লক্ষ্য পুনঃনির্ধারণ ও উহার বাস্তবায়ণ এই সব কিছুই প্রস্তাবিত পরিবর্তনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও ক্ষেত্রে।
(গ) পরিবর্তন অর্থ বর্জন ও গ্রহণ-গ্রহণ ও বর্জন, সম্পর্কেও কাটছাট, সমতার একটা পর্যায় হইতে উচ্চতর একটা পর্যায়ের অথবা অসমতার একটা অবস্থা হইতে সমতার একটা অবস্থার দিকে সুসমগতি অবলম্বন। পরিবর্তনটা হইবে অতীব ভারসাম্যপূর্, বিকাশমান ও ক্রমিক পদ্ধতির অনুসারী।
ইসলামের দৃষ্টিতে উন্নয়ন বলিতে গোটা মানববতার উন্নয়নই বুঝায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন উহার একটি অংশ মাত্র। উহা কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। ইসলামের মানবীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবিচ্ছিন্নভাবে সম্ভব। ইসলামে উন্নয়নের দার্শকিন ভিত্তি হইল (১) তওহীদ- আল্লাহর একত্ব ও অন্যান্যতা, (২) জীব ও প্রাণীকূলের সঠিক জীবিকার দায়িত্ব ও ব্যবস্থা গ্রহণ, (৩) মানবীয় খিলাফত বেং (৪) তাযকীয়া। ইসলামের উন্নয়নের পরিকল্পনা এই চারওটি মৌল আকীদাহর উপর নির্ভরশীল।
বিশ্ব নিখিলের সৃষ্টিকরাতা ও নিয়ন্ত্রক পরিচালক একমাত্র আল্লাহ। তাঁহারই বিধান যেমন প্রাকৃতিক জগতের প্রতিটি অণু-পরমাণুর উপর কার্যকর, তেমনি কার্যকর হইতে হইবে সমগ্র মানুষের ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক জীবনের প্রত্যেকটি কাজের উপর। সমস্ত মানুষ এক আদমের সন্তান-বংশধর। অতএব মানুষে মানুষে কোন দিক দিয়াই কোনরূপ তারতম্য বা পার্থক্য হইতে পারিবে না। এই পৃথিবীতে মানুষ মহান স্রষ্টা আল্লাহর খলীফা- প্রতিনিধি। অতএব জীবন পরিচালনার জন্য মানুষ নিজেরা কোন মৌলিক বিধান রচনা করিবে না, আল্লাহর দেওয়া বিধান পালন, অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করিবে জীবনের সমগ্র দিকে ও বিভাগে। আর এই বিধান পালন অনুসরণ বাস্তবায়নের চরম লক্ষ্য হইল মানুষের সঠিক তাযকীয়া- পরিচ্ছন্ন, পরিস্কার ও পবিত্র করণ- হৃদয়-মন-চরিত্র ও যাবতীয় কাজ-কর্মের। তাযকীয়াও শুধু তাযকীয়ার জন্য নয়। বরং ইহকাল ও পরকালীণ ফালাহ- পূর্ণমাত্রার কল্যাণ লাভই ইহার চূড়ান্ত লক্ষ্য।
এই চারটি মূল আকীদাহ শাশ্বত ও চিরন্তন। কাল ও অবস্থা পরিবর্তনের কোন এক বিন্দু প্রভাবও ইহার কোন একটির উপরও প্রতিফলিত হইতে পারে না। এই মূল্যমাণ ভিত্তিক উন্নয়ন সংক্রান্ত ধারণা অবশ্যই বিশাল ক্ষেত্রে ও ব্যাপকভাবে সম্পন্ন হইবে। তাহাতে শামিল থাকিবে নৈতিক আত্মিক-আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক-বস্তুগত সমস্ত দিক ও বিভাগ। এখানে উন্নয়ন একটা মূল্যমান সমন্বিত কর্মতৎপরতা। মানুষের সটিক ও পূর্ণাঙ্গ কল্যাণ সাধনের আশাবাদ অনুপ্রাণিত। এখানে মানুষই হইল উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কেনদ্র বিন্দু (Center Point)। তাহই ইসলামের উন্নয়ন অর্থ মানুষের সার্বিক উন্নয়ন, তাহার প্রাকৃতিক ও মানসিক ও বৈষয়িক উন্নয়ন এবং সামাজিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। বস্তুতঃ ইসলামের উন্নয়ন-ক্ষেত্র বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত।
উন্নয়ন মুসলমানদের জন্য কেবল জাতীয় পর্যায়েই প্রয়োজনীয় নয়, বর্তমানকালের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দৃষ্টিতেও উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিক দিয়া মুসলিম জাহানের একটা বড় দায়িত্ব অর্থনৈতিক পুণর্গঠন। এই পুনর্গঠনের কার্যক্রম মুসলিম জাহানের আদর্শিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়া-বিশ্বদায়িত্বের সহিত সমানুপাতিক (Commensurate) হইতে হইবে। পশ্চিমা শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সহিত গোঁজামিলের প্রতিযোগিতা করাই উহার লক্ষ্য হইতে পারে না। এজন্য মুসলিম জাহানকে সামগ্রিকভাবে নিজস্ব মানদন্ড বা Model কে সম্মুখে লইয়া কাজ করিতে হইবে। এই পর্যায়ে তিনটি অবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে এবং তাহা সম্পূর্ণরূপে এড়াইয়া যাইতে হইবে:
(ক) মুসলিম জাহানের ব্যাপক অর্থনৈতিক অনুন্নত অবস্থা অনগ্রসরতা ও পশ্চাদতা। অব্যবহৃত ও অপর্যাপ্ত ব্যবহৃত মানবিক ও প্রাকৃতিক উপায় উপকরণের ব্যবহার ও প্রয়োগ। মূলত, ইহা না হওয়অর কারণেই মুসলিম জাহানের দারিদ্র স্থবিরতা ও গতিহীনতার উদ্ভব ঘটিয়াছে।
(খ) মুসিলম দেশসমূহে সৃষ্ট ব্যাপক কাঠামোগত, সামাজিক নৈতিক বিফলতা ও সম্বাৎসরিক অনশন।
(গ) প্রবৃদ্ধি আত্মস্থ করিতে না পারা। ফলে পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির উপর নির্ভরশীলতা তীব্র ও প্রকট হওয়া। আমদানী করা প্রযুক্তি প্রয়োগে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অন্ধভাবে নকলনবিশী করা।
পরিকল্পনা
দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের সর্বাধিক বুনিয়াদী প্রয়োজন পূর্ণ করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু শুধু এতটুকুতেই উহার এই দায়িত্ব প্রতিপাতি হইতে পারে না। নাগরিকদের জীবনযাত্রা মান উন্নত করার জন্য বিশেষভাবে যত্নবান হওয়া ও ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য। কিন্তু এই কাজ যথাযথরূপে সম্পন্ন করা- কিছুতেই সম্ভব নয়- যতক্ষণ না দেশে প্রয়োজন পরিমাণ পণ্যোৎপাদন হইতে শুরু করিবে এবং উহার বন্টন সুবিচারপূর্ণভাবে ও ন্যায় নীতির ভিত্তিতে হইতে থাকিবে। এই জন্য দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হয়। ইসলামী রাষ্ট্রকেও অনুরূপ পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হইবে।
রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সর্বপ্রথম নিজের দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির গভীরভাবে যাচাই করিতে হইবে। সমগ্র দেশকে একটি আধুনিক ও উন্নত দেশ হিসাবে গড়িয়া তুলিবার জন্য এবং দেশের বিপুল জনগণকে একটি সংস্কৃতিসম্পন্ন জাতি ও সভ্য মানুষের সমাজ হিসাবে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য- বিশেষ করিয়া একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ইসলামী নাগরিকদের ন্যায় সকল মর্যাদা সহকারে জীবন ধারণের সুযোগ করিয়া দিবার জন্য- কি কি জিনিসের অপরিহার্য প্রয়োজন রহিয়াছে। নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করিয়া সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করিয়া লইতে হইবে। প্রয়োজনীয় জিনিসের পরিমাপ হইয়া যাওয়াপর পর যাঁচাই ও তদন্ত করিয়া দেখিতে হইবে যে, দেশের এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলির মধ্যে কোন্ কোন্টি কোথায, কি পরিমাণের ও কি অবস্থায় বর্তমান আছে; এবং কি কি জিনিস মওজুদ নাই। আর মওজুদ জিনিসগুলিকে অধিকতর কার্যকর করিয়া তুলিতে হইলে কি ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক এবং সেজন্য কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হইতে পারে, তাহাও গভীর দৃষ্টিতে বিবেচনা করিয়া দেখিয়া হইবে।
অতঃপর যেসব অপরিহার্য জিনিস বর্তমান নাই, তাহা লাভ করিবার উপায় ও সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে। প্রতেক দেশেই প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর পরিমাণে বর্তমান থাকে। পরিকল্পনা গ্রহণকালে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাপ করা একান্ত আবশ্যক। বস্তুত সম্পদ অপরিমেয় ও সীমাসংখ্যাহীন হইতে পারে না- সীমাসংখ্যাহীন হইয়া থাকে দেশের অনিবার্য প্রয়োজন ও সমস্যা; এই জন্যই সুষ্ঠূ পরিকল্পনা মারফতে সীমাবদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদকে অপরিসীম জাতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করার কাজে প্রয়োগ করিতে হয়। অতএব প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন ও বন্টনের মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য স্থাপন করা হইতেছে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার গোড়ার কথা।
হাদীসে উল্লেখিত হইয়াছে, হযরত নবী করীম(স) বলিয়াছেন: (আরবী***********)
‘দারিদ্র্য কুফরে পরিণত হইতে পারে’ বা ‘দারিদ্র্য মানুষকে কাফির বানাইয়া দেয়।’ অথচ কুফরকে নির্মূল করিবার জন্যই হইবে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। কাজেই দারিদ্র দূরীভূত ও দেশকে দারিদ্র মুক্ত করিবার জন্য উহার সমগ্র শক্তি নিয়োজিত হইতে হইবে। সেই সঙ্গে দেশবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করার জন্য উহাকে প্রাণপণে চেষ্টা করিতে হইবে।
দেশের জনশক্তিকে (Human Power) ও পুরাপুরি কাজে লাগানো ও কর্মক্ষম সব মানুষের জন্য কাজের ও উপার্জন উপায়ের ব্যবস্থা করাও ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব বিধায় সর্বাধিক পরিমাণে জনশক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা একান্তভাবে আবশ্যক। বিশেষ করিয়া আধুনিক অনুন্নত দেশগুলির পক্ষে বেকার সমস্যা একটি অতি বড় হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ হইয়া দেখা দেয়, তাহাতে সন্দেহ নাই। উপরন্তু ইহা এক বিরাট অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবীয় সমস্যাও বটে। কাজেই বেকার সমস্যার সমাধান না করা পর্যন্ত কোন রাষ্ট্রই কল্যাণ রাষ্ট্র হওয়ার দায়িত্ব পালন করিতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় তাই ইহার প্রতি যথোপযুক্ত গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে।
কিন্তু এই ব্যাপারে ইসলামী রাষ্ট্রকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিতে হইবে। প্রাচীন উপায় ও দেশ-প্রচলিত পন্থাকেই বাঁচাইয়া রাখিতে হইবে এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন বা অভিনব পন্থা গ্রহণ করা যাইবে না, ইসলামী অর্থনীতিতে এন কোন কথাই থাকিতে পারে না।
মূল উদ্দেশ্য লাভ করার জন্য অনুকূল অনেক নূতন উপায় ও পন্থা ইসলামী রাষ্ট্রকে গ্রহণ করিতে হইবে। এই হিসাবে, একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ভূমিকা অন্যান্য সকল প্রকার রাষ্ট্র হইতেই ভিন্নতর হইবে, সন্দেহ নাই। উহা নিজেকে কেবল প্রাচীনের অন্ধকুঠরীতে আবদ্ধ করিয়া রাখিবে না, আবার নূতনত্বের উচ্ছসিত আবেগে ও চোখ ঝলসানো চাকচিক্যে একেবারে দিশেহারাও হইয়া যাইবে না- আধুনিকতা ও অভিনবত্বের গড্ডলিকা প্রবাহেও উহা ভাসিয়া যাইবে না। কাজেই, উৎপাদন উপায়ে প্রয়োজন অনুযায়ী অনেক কিছু রদবদল করিয়া লওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ বাধা থাকিতে পারে না। নিছক কৃষিনির্ভর হওয়া যেমন উচিত নহে, তেমনি কৃষিকে উপেক্ষা করিয়া কেবলমাত্র শিল্পবিলাসী হওয়াও চলিতে পারে না। বরং কৃষি ও শিল্প এই উভয় জন্থাকেই জাতীয় পণ্যোৎপাদনে কাজে বিশেষভাবে প্রয়োগ করিতে হইবে, যেন অর্থনৈতিহক প্রয়োজনের দরুণ উহাকে অন্য কোন রাষ্ট্রের সম্মুখে ভিক্ষার হাত দারাজ করিতে না হয়।
পরিকল্পনার ব্যাপারে উল্লিখিত বিষয়গুলির প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রাখার পর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক সুবিচারের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে। ধন-সম্পদের ভুল অবিচারমূলক বন্টন-ব্যবস্থা চূর্ণ করিতে হইবে। আর জাতীয় সম্পদের প্রবাহ ও আবর্তন এত অবাধ করিতে হইবে যেন জাতীয় দেহের একটি অঙ্গও তাহা হইতে বঞ্চিত না থাকে। বরং প্রত্যেকটি অঙ্গই পরিচ্ছন্ন ও সতেজ রক্ত ধারায় পরিপ্লুত হইয়া সমষ্টিগতভাবে গোটা মানব দেহটা যেন সজীব ও শক্তিশালী করিয়া তুলিতে পারে।
জাতীয় সম্পদের সুবিচারপূর্ণ বন্টনের ফলে উদ্বৃত্তি ও পুঁজিবিনিয়োগ সমানভাবে চলিতে থাকিবে এবং বেকার সমস্যা দেশ হইতে চিরতর বিলুপ্ত হইবে। লর্ড কিনসের (Lord keynes) মত উদ্বৃত্তি ও পুঁজিবিনিয়োগের। অসামঞ্জস্যই হইতেছে অর্থনৈতিক মন্দাভঅবের প্রকৃত কারণ। এই অবস্থাকে যতদিন দূরীভূত করা সম্ভব না হইবে ততদিন পর্যন্ত কোন সমাজে স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য আর্থিক সচ্ছলতা ও স্বাচ্ছন্যের আশা করা বাতুলতা মাত্র। দেশের সকল নাগরিকের জন্যই কাজের সংস্থান করিয়া দেওয়া যে রাষ্ট্রের কর্তব্য, দুনিয়ার সকল অর্থনীতিবিদই এ সম্পর্কে একমত। বেকারত্ব একটি মারাত্মক ও সংক্রমক ব্যাধি, ইহা সমাজের কোথায়ও স্থান পাইলেই গোটা সমাজ-দেহকে পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত করিয়া দেয়, সে জাতিকে সর্বোতভাবে ধ্বংসের চরম সীমায় নিয়া পৌঁছায়। শুধু তাহাই নয়, বেকার-সমস্যায় সামগ্রিকভাবে জাতির কর্মক্ষমতা নৈতিক চরিত্র ও আত্মসম্মান-জ্ঞান প্রভৃতি সকল মহৎ গুণই সমূলে বিনষ্ট হইয়া যায়।
এই জন্য দেশীয় সকল প্রকার কৃষিকার্য ও শিল্পোৎপাদনকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার আয়ত্বাধীন করিতে হইবে। শিল্পোৎপাদনের ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছৃঙ্খলা ও অসংবদ্ধতা বড়ই মারাত্মক হইয়া থাকে। ইহার পথ বন্ধ করা জাতীয় জীবনের সুষ্ঠুতা বিধানের জন্য অপরিহার্য। সম্পত্তি সম্পদ জাতীয়করণ (সমূহবাদ) এবং স্বাধীন ও নিরংকুশ পদ্ধতিতে ধনোৎপাদনের (পুঁজিবাদের) মধ্যবর্তী এক সুবিচারপূর্ণ ও প্রয়োজন পূর্ণকারী নীতি হইল পরিকল্পনা গ্রহণ ও পরিকল্পনা অনুসারে ধনোৎপাদনের সকল ‘ফ্যাক্টর’ সক্রিয় করিয়া তোলা। পুঁজিদার ও কারখানা মালিককে নিজ নিজ স্বাধীন ইচ্ছামত পুঁজি বিনিয়োগ ও পণোৎপাদনের অবাধ সুযোগ দেওয়া এবং একান্তভাবে তাহাদের উপর নির্ভর করা সমাজের পক্ষে মারাত্মক। বরং একটি সুষ্ঠু ও সর্বাত্মক পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের ধন উৎপাদনের সমগ্র ‘ফ্যাক্টরকে’ জাতীয় কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করিতে হইবে। ইসলামের সামাজিক সুবিচার ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন অবাধ ও নিরংকুশ ধনোৎপাদনের পথ (Liassez Faire) বন্ধ করিতে হইবে।
সর্বোপরি পরিকল্পনায় কেবল যান্ত্রিক উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি রাখিলেই চলিবে না, বিশেষ সতর্কতার সহিত লক্ষ্য করিতে হইবেযে, যে ধন-উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হইয়াছে, তাহা হইতে নির্বিশেশষে সকল দেশবাসীর প্রয়োজন পূরণ, সর্বধিক কল্যাণ সাধন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব হইবে কিনা। বস্তুত পরিকল্পনা উদ্দেশ্য লাভের একটি উপায় মাত্র- নিজেই কোন উদ্দেশ্য নয়। এই জন্য সমাজতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও ইসলামী পরিকল্পনায় মৌলিক পার্থক্য থাকিতে বাধ্য।
প্রত্যেকটি পরিকল্পনায় উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের ও ফসলে সঠিক মূল্যের স্থায়িত্ব সম্পর্কে বিশেষ লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। দেশের দ্রব্যমূল্যের উত্থঅন-পতনের সর্বগ্রাসী আবর্তনে শিল্পপণ্য ও কৃষি-উৎপন্ন ফসলেরই ক্ষতি হয় সর্বাপেক্ষা বেশী। তাই পরিকল্পনায় এই সব উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে যেরূপ দৃষ্টি দেওয়া হইবে, এ সবের সঠিক মূল্য স্থির করিয়া দেওয়ার উপরও অনুরূপভাবে গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে। বৈদেশিক নীতি এমন হওয়া আবশ্যক যে, তাহার ফলে দেশের রপ্তানী উচ্চমূল্য লাভ যেন খুবই সহজ হয়।
দেশের কুটিরশিল্প ও ছোট আকারের শিল্পের উপরও এই পরিকল্পনায় বিশেষ জোর দিতে হইবে। কারণ, প্রত্যেক দেশেই কুটিরে শিল্পে ও ছোট আকারের শিল্পই হয় জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সর্বপ্রধান উপায়। এই ধরনের শিল্প উন্নয়নের জন্য খুব বেশী মূলধনেরও আবশ্যক হয় না। অথচ ইহার সাহায্যে প্রত্যেক সমাজের বিপুল-সংখ্যক মানুষকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করিয়া তোলা সম্ভব এবং দেশ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বুনিয়াদী প্রয়োজন পূর্ণ করার যোগ্য হইতে পারে। দেশের জাতীয় অর্থনীতির যে প্রধান চাপ থাকে কৃষিকার্যের উপর, কুটির শিল্প উন্নয়নের সাহায্যে তাহা অনেকটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশেষত কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার শুরু হইলে যেসব লোকের বেকার হইয়া পড়ার আশংকা রহিয়াছে, কুটির ও ছোট আকারের যন্ত্রশিল্প উন্নয়নের দ্বারা তাহাদিগকে কর্মে পুনর্নিয়োগ করা সম্ভব হইতে পারে।
পূর্বেই বলিয়াছি, কুটির শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে বৃহদায়ন যন্ত্রশিল্পেরও প্রসার করিতে হইবে, ইহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় বর্তমান যান্ত্রিক দুনিয়ার প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখ টিকিয়া থাকা সম্ভব হইবে না। কিন্তু যন্ত্রশিল্পের প্রসার সৃষ্টির সময় বিশেষ সতর্কতার সহিত লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে, উহার প্রবল ও অপ্রতিহিত চাপে পড়িয়া কুটির শিল্প যেন ধ্বংস হইয়া না যায়। এই জন্যই ইসলামী রাষ্ট্র এই উভয়বিধ শিল্পের সংরক্ষণ এবং উভয়েরই ক্ষেত্র ও সীমা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ সর্ব প্রথম ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ; ভারী শিল্পের উৎপাদন ইহার পরে স্থান লাভ করে। প্রথমটিকে উপেক্ষা করিলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অপ্রতুলতা তীব্র হ৮ইয়া উঠিবে এবং ভারী শিল্প উৎপাদনের উদ্দাম গতিতে জনসাধারণের জীবন দুর্বিসহ হইয়া পড়িবে। অধিকতর রুটি, মাখন, কাপড় ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে তখন বন্দুক, বেয়নেট ও বোমার উৎপাদনই বৃদ্ধি পাইবে।
জাতীয় পরিকল্পনার সাফল্য নিম্নলিখিত কয়েকটি মূলনীতির উপর নির্ভর করে:
সর্বপ্রথম মূলনীতির এই যে, সর্বাগ্রগণ্যতা ও সর্বাধিক প্রয়োজনের দিকে প্রথম দৃষ্টি দিতে হইবে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক সম্পদ জরীপ ও যাচাই করিয়া দেখিতে হইবে যে, অসংখ্য জাতীয় প্রয়োজনের মধ্যে কোন্ প্রয়োজনটি সর্ব প্রথম পূরণ করা আবশ্যক এবং সে জন্য কোন উপায় ও পন্থা সর্বাগ্রে কাজে লাগাইতে হইবে।
জাতীয় রক্ষা ও দেশের উন্নয়রে জন্য মূল প্রয়োজন সর্বপ্রথমে পূরণ করার ব্যবস্থা করাই হইতেছে ইসলামী পরিকল্পনার প্রথম মূলনীতি।
দ্বিতীয়তঃ পরিকল্পনা গ্রহণকারী কমিটিকে নিম্নলিখিত নীতিসমূহের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখিতে হইবে:
(১) পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারে বৈদেশিক রাষ্ট্রের- সে যে রাষ্ট্রই হউক না কেন- অন্ধ অনুকরণ কিছুতেই বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না। পরিকল্পনা প্রণয়নের ব্যাপারে প্রধানত ইহাকে বাস্তবে রূপায়িত করার সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
কাজেই অন্ধভাবে পরের অনুকরণ না করিয়া জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও সঙ্গতির দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিয়াই পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হইবে।
(২) পরিকল্পনা এমন হওয়া উচিত যাহাকে বাস্তবে রূপায়িত করা নিজ দেশীয় উপাদান ও কাচামালের সাহায্যেই সম্ভব হইবে- বৈদেশিক মূলদন ও ঋণ গ্রহণের আবশ্যক হইবে না। কারণ তখন বিদেশ হইতে কেবল টাকা আর মূরধনই আসে না, সেই সঙ্গে ঋণদাতা বৈদেশিক রাষ্ট্রের রাজনৈকিত বন্ধন এবং বাধ্যবাধকতাও গোটা দেশকে গোলামীর নাগপাশে বন্দী করিয়া ফেলে। শুধু রাজনৈতিক গোলামীই নয়, বৈদেশিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি, নৈতিক দৃষ্টিভংগী ও মাপকাঠি এবং মতবাদ ও চিন্তাধারার সর্বপ্লাবী সয়লাব আসিয়াও সারা দেশটিকে নিমজ্জিত করে। আর কোন ইসলামী রাষ্ট্রই যে তাহা বরদাশত করিতে পারে না, তাহা অনস্বীকার্য সত্য। কাজেই পরিকল্পনা রচনার সময় নিজ দেশীয় শ্রমশক্তি, মূলধন ও প্রাকৃতিক উপায়-উপাদানের পরিমাণের প্রতি বিশেষ সজাগ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। দেশের সীমাবদ্ধ সম্পদ ও অর্থ এমনভাবে প্রয়োগ করিতে হইবে, যাহাতে স্বল্পতম অর্থব্যয় করিয়া বৃহত্তম ফল লাভ করা যাইবে, অর্থনীতির ভাষায়: General allocation of resources and obious result.
(৩) পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য অনেক জিনিস যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি-বিদেশ হইতেও আমদানী করা যাইতে পারে। সেজন্য ইসলামী রাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতিকে অধিকতর মজবুত করিয়া তুলতে হইবে। অনুরূপভাবে সে বাণিজ্য এমন সব দেশের সহিত হওয়া উচিৎ, যেসব দেশ হইতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য ও যন্ত্রপাতি আমদানী করা সম্ভব হইবে। অন্যথায় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হইয়া যাওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে।
(৪) সকল প্রকার পরিকল্পনা সুষ্ঠুরূপে কার্যকর ও বাস্তবে রূপায়িত করিয়া তোলা একান্তভাবে নির্ভর করে কর্মনিষ্ঠা, ঐকান্তিক বিশ্বাস-পরায়ণতা ও দায়িত্ব জ্ঞানের উপর। ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের মধ্যে এইসব গুণ যতক্ষণ পর্যন্ত না পূর্ণরূপে স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রভাবশালী হইয়া উঠিবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন পরিকল্পনাই বাস্তবে রূপায়িত হইতে পারে না। এই জন্যই ইসলামী রাষ্ট্রকে সাধারণভাবে সমগ্র দেশবাসীর মধ্যে এবং বিশেষ কিরয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের মধ্যে এইসব গুণ সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করিতে হইবে।
(৫) প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করাও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একান্ত অপরিহার্য! পরিকল্পনা অনুসারে রাষ্ট্র-সরকার ও জনগণ যদি মূলধন বিনিয়োগ না করে তকে কোন পরিকল্পনাই কার্যকর হইতে পারে না। অর্থনৈতিক কার্যক্রম ‘আলাউদ্দীনের প্রদীপ নয়’; চক্ষু বন্ধ করিয়া সপ্ত আকাশ ভ্রমণ করও নয়। ইহা এক রূঢ় কঠিন ও বাস্তব কার্যক্রম। এখানে কোনরূপ অবাস্তব কল্পনা বিলাস ও রংগীন স্বপ্ন সাধের অবকাশ নাই।
পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজনীয মূলধন সংগ্রহ নির্ভর করে জাতীয আয়ের উদ্বৃত্তির উপর। জাতীয় উদ্বৃত্তির জন্য দরকার ব্যক্তিগত বুনিয়াদী প্রয়োজন পূর্ণ করার পর যাহাতে কিছু না কিছু অর্থ অবশ্যই সঞ্চিত হয় তাহার ব্যবস্থা করা, যেন তাহার নিজ নিজ ব্যক্তিগত উদ্বৃত্তিকে রাষ্ট্র-সরকারের নির্দেশ অনুসারে জাতীয় উন্নয়নমূলক কাজে বিনিয়োগ করিতে পারে।
শেষ কথা এই যে, নির্ভুল তথ্য ও সংখ্যা পরিসংখ্যান সংগ্রহ করিয়া একটি চমৎকার পরিকল্পনা রচনা কিছুমাত্র কঠিন কাজ নয়; বরং কঠিন কাজ হইতেছে তাহা কার্যে পরিণত করা। এই জন্য নাগরিকদের ও কর্মকর্তাদের মধ্যে ঐকান্তিক নিষ্ঠার প্রয়োজন।