উৎপাদনের উৎস ও উপকরণ
মানুষের জীবন অপরিহার্য প্রয়োজন ও আবশ্যকতাকে কেন্দ্র করিয়া চক্রাকারে ঘুরিতেছে। মানুষেরঅসংখ্য ও বিভিন্নপ্রকার প্রয়োজনকে মোটামুটিভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়- বৈষয়কি বা বস্তুতান্ত্রিক এবং নৈতিক বা মানবিক প্রয়োজন। এই প্রয়োজনসমূহ যথাযথভাবে পূর্ণ না করিয়া কোন মানুষই- সে সভ্য হউক, অসভ্য হউক- এক মুহূর্তের তরেওজীবন যাপন করিতে পারে না, বাঁচিয়া থাকিতে পারে না।
মানুষের এই প্রয়োজন কেবল ব্যক্তিজীবনেই অনুভূত হয় না- সমাজ ও জাতীয়জীবনেও ইহা শাশ্বত ও অনিবার্য। একই দেশের বা ইকই সমাজের ব্যক্তিদের নিজস্ব প্রয়োজন পূর্ণ হয় সমাজের লোকদের পারস্পরিক আদান প্রদানের মাধ্যমে, আর জাতীয়ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অপরিহার্য আ্তর্জাতিক লেন-দেন। এইকারণে প্রত্যেকটি প্রয়োজনেই দুইটি অবশ্যম্ভাবী। একটি দিক উহার জাতীয় বা অভ্যন্তরণী আর অপরটি আন্তর্জাতিক। এই উভয় দিকে যাবতীয প্রয়োজন যথাযথভাবে পূর্ণ হওয়া একন্তা আবশ্যক। অন্যথায় মানুষের ব্যক্তি-জীবন ও রাষ্ট্রীয়-জীবনকঠিন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইতে বাধ্য।
মানুষের এই উভয়বিধ-সর্ববিধ-প্রয়োজন পূর্ণ করর জন্য যাবতীয অপরিহার্য উপায়-উপাদন মানব-সমাজ ও বিশ্ব-প্রকৃতির বুকে পূর্ব হইতেই আল্লাহতাআলা একত্রিত করিয়া রাখিয়াছেন। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মুক্ত ও নির্মল বায়ু উদার প্রকৃতির বুকে সতত প্রবাহমান। জলীয় প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য রহিয়াছে অফুরন্ত জল। আলো ও উত্তাপ অনুরূপভঅবে সহজলভ্য। এই তিনটি প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য সাধারণভাবে মানুষকে বিশেষ কোন শ্রম-মেহনত বা চেষ্টা-সাধনা ব্যতীত পূর্ণ হইতে পারে না।
মানুষের খাদ্য ও আচ্ছাদনের প্রয়োজন পূর্ণ করিবার জন্য যে সকল উপাদানের আবশ্যক তাহা যদিও বিশ্ব-প্রকৃতির বুকে অফুরন্তভাবে ছড়াইয়অ রহিয়াছে, কিন্তু মোটামুটিভাবে তাহা উপার্জন সাপেক্ষ, মানুষের শ্রম-মেহনতের সাহায্যেই উহাকে ব্যবহারোপযোগী করিয়া তোলা আবশ্যক। উহার সহিত মেহনত যুক্ত না হইলে তাহা মানুষের কোন প্রয়োজনই পূরণ করিতে পারে না। উপরন্তু, মানুষের কেবল বাঁচিয়া থাকারই প্রয়োজন নয়, যেন-তেন প্রকারের শুধু জীবন ধারণ করাই মানুষের কাম্য নয়। এই উন্নত, সুসভ্য-সর্বোপরি বিশ্বের সেরা সৃষ্টি হিসেবে, উচ্চতর সংস্কৃতি-সম্পন্ন জাতি হিসাবে বাঁচিয়া থাকার জন্যওতাহার বহুবি উপাদান উপকরণ আবশ্যক। এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় উপাদনসমূহও ব্যবহারোপযোগী হইতে পারে স্বভাবজাত উপকরণের সহিত মানুসের শ্রম, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মমুশলতার যোগ হইলে।
বস্তুত মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য সম্পদ-উৎপাদন আবশ্যক। উৎপন্ন অর্থ-সম্পদ ওদ্রব্য-সামগ্রীর ভোগ-ব্যবহারের জন্য আবশ্যক সম্পদ বন্টনের। সম্পদ বন্টন প্রসংগেই পারস্পরিক বিনময় ব্যবস্থাও অপরিহার্যহইয়া পড়ে এবং সর্বশেশে জাগে লব্ধ ধন-সম্পদ ব্যয় করার প্রশ্ন।
অর্থশাস্ত্রের এই বিভিন্ন পর্যায় ও দিক সম্মুখে রাখিয়াই ইসলামের অর্থনীতির আলোচনা করিতে হইবে। এই আলোচনা হইতেদুইটি কথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হইবে। প্রথম এই যে, অর্থনৈতিক সমস্যার ইসলামীসমাধান অতি স্বাভাবিক, সুবিচারমুলক ও সহজসাধ্য; আর দ্বিতীয় এই যে, মানুষের সর্ববিধ অর্থনৈতিক সমস্যার সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য সমাধান একমাত্র ইসলামই দিতে সক্ষম- অন্য কোন ব্যবস্থঅ নয়।
উৎপাদনের উৎস
মানব-সমাজের অভ্যন্তরীণ বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূর্ণ করার প্রধঅনতম ও স্বভাবজাত উপায় (Productive Resources) দুইটি: প্রথমজমি এবং দ্বিতীয় জন্তু-জানোয়ার।
পত্যেক দেশেই সাধারণতঃ তিন প্রকারের জমি বর্তমান পাওয়া যায়: (১) চাষযোগ্য, (২) খনিজ সম্পন্ন, (৩) বন-জঙ্গল (প্রান্তর এবং মরুভূমিও ইহার মধ্যে গণ্য)।
জন্তু-জানোয়ার সাধারণতঃ দুই পকার: (১) স্থলভঅগের ও (২) জলভাগের।
(১) স্থলভাগের জন্তু-জানোয়ার তিন প্রকার হইয়া থাকে: (ক) চতুষ্পদ জন্তু (খ) পাখী(গ) পোকা মাকড়।
(২) জলভাগের জন্তুও দুই প্রকার (ক) জলভাগের পাখী ও মৎস্য এবং (খ) জলজন্তু
এতদ্ব্যতীত বিদ্যুৎ, বাষ্প, বায়ু, অগ্নি বা সূর্যের উত্তাপ প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানও অর্থোৎপাদনের উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। বর্তমান সভ্যজগতে অর্থনীতির মূলে এই উপাদানসমূহের বিশেষগুরুত্ব রহিয়াছে।
উল্লিখত সকল প্রকার উৎপাদনীয় উপায়ই বিশ্বস্রস্টা আল্লাহতাআলা প্রকৃতির বুকেপূর্বে হইতেই সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছেন কিন্তু এই উপাদন সমূহের কোন একটি হইতেও মানুষ উপকৃত হইতে পারে না। অন্য কতায় এই সব উপাদানের ব্যবহারিক মূল্যহইতে পারে না- যতক্ষণ না এই সবের সহিত মানুষের শ্রম যুক্ত হইবে। এইজন্য সম্পদ লাভের উল্লিখিত উপায় সমূহের সঙ্গে শ্রম-মেহনতকেও একটি উৎপাদনী উপায় হিসাবে গণ্য করিতে হইবে। তাই অর্থনীতিবিদ মার্শাল শ্রমের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন: Any exertionn of mind or body undergone, party or wholvy with a vies to some good other than the pleasure devived diretly from the work’ অর্থাৎ মানসি বা শারীরিক যে কোন প্রকারের শ্রম যাহা আংশিকভাবে আনন্দ ছাড়া অন্য কোন উপকারের নিমিত্ত করা হয়,তাহাই শ্রম।
বস্তুত মানুষের শ্রম-শক্তি তিন প্রকার (ক) বুদ্ধি শক্তি, জ্ঞান-প্রতিভা (Intellect) (খ) শৈল্পিক দক্ষতা ও কুশলতা (Skill and Expert knowledge) ও (গ) দৈহিক বল (Physical power)
(ক) বুদ্ধি বা মানসিক শক্তি চার প্রকার: (১) সাংবাদিকতা বিষয়ক (Journalistic) (২) গবেষণামূলক (Research), (৩) সাংগঠনিক কার্য সম্বন্ধীয় (Adminstrative), (৪) বিচার বিভাগীয় (Judicial)।
(খ) শৈল্পিক দক্ষতা ওকুশলতা তিন প্রকার: (১) কৃষি কার্যে দক্ষতা (Agricultural skill and knowledge) শিল্পকার্য সম্পর্কীয়দক্সতা এবং (৩) বাণিজ্য সম্বন্ধীয় (Commmercial) দক্ষথা্
(গ) দৈহিক শক্তি কেবল মজুর ও শ্রমিক-শ্রেণীর লোকদের জন্যই একটি উৎপাদক উপায়। তাহারা সাধারণত এই একটি মাত্র শক্তির সাহায্যেই জীবিকা উপার্জন করিয়া থাকে। মস্তিষ্কবা চিন্তাশক্তি থাকিলেও তাহা প্রয়োগের খুব বেশী আবশ্যক হয় না, অবকাশও থাকে না। বস্তুত এই শ্রেণীর লোকেরা সমাজের মেহনতী জনতারই প্রয়োজন পূর্ণ করিতে পারে- সকল প্রকার ‘কাজের লোক’ ইহাদের মধ্যে হইতেও পাওয়া যায়। আর সমাজের সকল বিভাগে প্রয়োজন অনুযায়ী ইহাই বিভক্ত হইয়া পড়ে।
প্রাকৃতিক উপাদানকে ব্যবহারযোগীকরিয়া তুলিতে হইলে একদিকে যেমন উহারসহিত মানুষের শ্রমশক্তির প্রয়োগহওয়া একান্ত আবশ্যম, অপরদিকে মূলধন ব্যতীতমানুষের এই শ্রমশক্তিকখনই ফলপ্রসূ হইতে পারে না। এই জন্য মূলধনও অর্থোৎপাদনের একটি অন্যতম উপায় (Factor) হিসাবে অবশ্যই গণ্য হইবে।
অতএব প্রাকৃতিক সম্পদ, ভূমি, জন্তু-জানোয়ার, শ্রমশক্তি এবং মূলধন এই পাঁচটিই অর্থোৎপাদনেরমূল উৎস।মানুষের সাধারণ জৈবিক প্রয়োজন পূর্ণ করিতে এবং উন্নত, সুসভ্য ও সংস্কৃতিক সম্পন্ন জীবন-যাপন করিতে হইলে এই পাঁচটি জিনিসকে ভিত্তি করিয়াই তাহার অর্থনীতিকে গড়িয়া তুলিতে হইবে। এই উপায়সমূহ সম্পর্কেসাধারণভাবে ও বিস্তারিতরূপে আলোচনা করা আবশ্যক।
প্রাকৃতিক উপাদান
মানুষ প্রাকৃতিক জীবসমূহের অন্যতম। মানবদেহ যেসব মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে সৃষ্টি করা হইয়াছে, খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে তাহাই দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করার উপরই মানুষের দৈহিক-জীবন একান্তভাবে নির্ভর করে। এই উপাদানসমূহ আল্লাহ তা’আলা প্রকৃতির বুকে সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছেন। মানুষের বস্তুতই যে সব দ্রব্য-সামগ্রীর প্রয়োজন, তাহা সবকিচু প্রকৃতিরবুকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিয়াছে। আকাশ, পৃথিবী,বায়ু, পানি,চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, প্রভৃতি সবকিছুই মানুষের জৈবিক প্রয়োজন পূর্ণ করার আয়োজন সতত কর্মনিরত হইয়া আছে। আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেন:
(আরবী********)
পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে তাহাসবই আল্লাহ তা’আলা- হে মানুষ, তোমাদেরইকল্যাণ বা প্রয়োজন পূরণ করার জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন।
বিশ্ব-প্রকৃতির প্রত্যেকটি অণূ-পরমাণূ, প্রত্যেকটি পদার্থ বিশেষকরিয়া সূর্য এবংচন্দ্রকে, উভয়ের আবর্তনকে- এক স্থায়ী নিয়মের শৃঙ্কলে আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে। বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
এবং তোমাদের জন্য সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়ন্ত্রিত ও অভিন্ন নিয়ামনুবর্তী বানানো হইয়াছে।
এই জন্যই প্রকৃতির সকল উপাদান মানুষেরই জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী হিসাবে সৃষ্টি করা হইয়াছে। কুরআনের ঘোষণা:
(আরবী*********)
দুনিয়অর এই সব দ্রব্য-সামগ্রী দুনিয়ার জীবন যাপনের উপাদান ছাড়া আরকিছুই নয়।
প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী কেবল মানুষেরই নয়- সকল প্রকার জীবজন্তুরই জৈবিকপ্রয়োজন পূরণেরজাগতিক ব্যবস্থা করারদায়িত্ব স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাইগ্রহণ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
পৃথিবীরসকল জীবের রিযিক-জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান-পরিবেশন করার দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলার।
অর্থাৎ বিশ্ব-প্রকৃতির সকল প্রকার জীবন-জন্তুও বস্তব্যবহার করা, যাবতীয কাজ সম্পাদন করা এবং প্রয়োজনীয় উপাদান লাভ করার জন্য তাহা প্রয়োগ করামানুষের কর্তব্য। কারণ মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা ইহাতেই নিহিত রহিয়াছে। ইহার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন না করা আল্লাহর উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত;’ তাহা বৈরাগ্যবাদ, অতএব ইসলামে তাহা শুধু পরিত্যজ্যই নয়: প্রকৃতপক্ষে তাহা অপরাধজনকও নিঃসন্দেহে।
(আরবী***********)
আল্লাহ তা’আলা মানুষের জীবনকে সুন্দর, সমৃদ্ধ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করিয়া তোলার জন্য যেসব উপাদান ওদ্রব্য-সামগ্রী সৃষ্টি করিয়াছেন এবং এখানে যেসব পবিত্র ও উৎকৃষ্ট খাদ্য-দ্রব্য রহিয়াছে, সেসবকে হারাম ও নিষিদ্ধ করিয়া দিতে পারে কে?
বস্তুত, এই সকল দ্রব্য-সামগ্রী ও উপায়-উপাদানকে হারাম ও নিষিদ্ধ মনে করার প্রবণতাকেই বলা হয় বৈরাগ্যবাদ। এবং
(আরবী***********)
বৈরাগ্যবাদ তাহাদের নিজেদেরই মনগড়া, আমি আল্লাহ তাহাদিগকে এইরূপ করার কোন নির্দেশ দানকরি নাই।
পশুর অর্থনৈতিক মূল্য
পশু ও জন্তু-জানোয়ার অর্থোৎপাদনের এক প্রাচীনতম উপাদান। পশু শিকার করিয়া আহার করা যাইতে পারে, বিক্রয় করিয়া অর্থলাভ করা যাইতে পারে, লালন-পালন ও উহার বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করিয়া সম্পদ অর্জনের পথ সুগম করা যাইতে পারে। পমুর চামড়া, হাড়, পশমও দুগ্ধ ইত্যাদি মানব সভ্যতার প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের অন্যতম, বিশেষ পশুকে যানবাহন ও ভার বহনের কাজেও ব্যবহার করা যায়। বিশেষত রেল-লাইন ও জলযানবিহীন এলকার অভ্যন্তরীণ পণ্য ও লোক চলাচলের বাহন হিাবে গরু, মহিষ, অশ্ব, গর্দভ প্রভৃতি আদিম কাল হইতেই ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে এবং বর্তমান কালেও এগুলোর বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। পশুর এই বহুবিধ ব্যবহার সম্পর্কে কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট উল্লেখ রহিয়াছে।
(আরবী*********)
আল্লাত তা’আলা তোমাদেরই(ব্যবহার ও উপকারের) জন্য পশু সৃষ্টি করিয়াছেন। তাহাতে পশম রহিয়াছে এবং উহার আরো বহুবিধব্যবহারিক মূল্য বা পন্থা রহিয়াছে। (তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই যে) তোমরা উহা খাদ্য হিসাবেও ব্যবহার করিয়া থাক।
বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
এমন সব চতুষ্পদ জন্তও সৃষ্টি করিয়াছেন, যাহা যানবাহন ও ভার বোঝা বহনের কাজে ব্যবহারকরা হয় এবং এমন জন্তুও, যাহা খাদ্য হিসাবে ও শয্যার সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আল্লাহর দেওয়া রিযিক হিসাবে তোমরা তা খাও।
অপর এক আয়াতে বলা হইয়াছে:
(আরবী************০
ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা এই জন্য সৃষ্টি করা হইয়াছে যে, এই সবকে তোমরা যানবাহন কিংবা ভারবহনের কাজে ব্যবহার করিবে এবং ইহা তোমাদের জীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করিবে।
বস্তুত ঘোড়া ইতিহস-পূর্বকাল হইতে দ্রুতগামী যানবাহন হিসাবে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। স্থুল যুদ্ধে আজও ঘোড়া ব্যবহৃতহইতেছে।বর্তমান সভ্যতার অবদান মোটরবা রেলগাড়ী দ্রুতগতিবান যানবাহন হিসাবে ব্যবহৃত হইলেও অম্বের গতিশক্তি(Horse Power) শক্তি-পরিমাপের একক মানদন্ড হিসাবে এখনো গণ্য হইতেছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতা যে প্রাচীন সভ্যতার ক্রোড়েই লালিত-পালিত এবং উহারই প্রভাবাধীন হইয়া আছে, তাহা কি অস্বীকার করা যায়?
পাখীর অর্থনৈতিক মুল্য
অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে পাখীরও যথেষ্ট মূল্য রহিয়াছে। প্রথমত উহার গোশত ও ডিম মানুষের উৎকৃষ্ট খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। উহার লালন পালন করিয়া, আরো অধিক পাখী উৎপাদন করিয়া এবং তাহা বিক্রয় করিয়া প্রচুর অর্থোপার্জন করা খুবই সহজ। পাখীর পালক দ্বারাও বহুবিধ মূল্যবান জিনিস প্রস্তুতহইতে পারে। দ্বিতীয়ত, পাখীরব্যবসায় অক্ষাকৃত কম মূলধন-সাপেক্ষ। এই জন্য নবী করীম (সা) সচ্ছল অবস্থায় লোকদিগকে পশুপালন এবংসংগতিহীন লোকদিগকে পাখী পালন ব্যবসায় করার নির্দেশ দিয়াছেন।[ইবনে মাহা ও কানযুল উম্মাল]
মৌমাছির উৎপন্ন মধু এবং মোম হইতে প্রচুর অর্ধাগম হইতে পারে বলিয়া মানব-সমাজে উহার যথেস্ট অর্থনৈতিক মূল্য রহিয়াছে।মধু পুষ্টিকরখাদ্য, উহা ঔষধ হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। মধু সম্পর্কেকুরআন মজীদেবলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
ইহাতেমানুষের উপকার এবং রোগ-আরোগ্য-গুণ বর্তমান রহিয়াছে।
বস্তুত মধুকে ক, খ ও গ খাদ্য-প্রাণ বর্তমান। ইহা দীর্ঘকাল পর্যন্ত অবিকৃত থাকে এবং অনায়াসে বহুদূর পথে রফতানী করা চলে। অভিজ্ঞতা হইতে দেখা যায়, মৌমাছি পালন খুবই লাভজনক ব্যবসায়। ইহাকুটির শিল্পসমূহের অন্তর্ভুক্ত। কোন যন্ত্র বা শিল্পের সহিত ইহার কোন প্রতিযোগিতিা নাই। এইজন্যই ইহার জাতীয় ও অর্থনৈতিক মূল্য অত্যধিক। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে, মধুর ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কেগবেষণার যথেষ্টঅবকাশ এবং প্রয়োজন রহিয়াছে। কারণ কুরআন শরীপেমধুর ব্যবহারিক মূল্যের কথা উল্লেখককরিয়া সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণকরা হইয়াছে এইবলিয়া:
(আরবী*************)
চিন্তাশল- অনুশীলনকারী ও অুসন্ধিৎসু লোকদের জন্য ইহাতে যথেষ্ট গবেণার বিষয় রহিয়াছে।
অনুরূপভাবে গুটিপোকা পালনর যথেষ্ট আর্থিক মুল্য রহিয়াছে। এই পোকা রেশম তৈয়ার করে। এই রেশম বিক্রয় করিয়া কিংবা উহারকাপড় বুনিয়া প্রচুর অর্থোপার্জন করা যাইতে পারে।
বন-জঙ্গল
জন্তু-জানোয়ারের ন্যায় বন-জঙ্গলেরগাছ-পালা ও লতগা-গুল্ম হইতেনানা ভাবে অর্থোৎপাদন হওয়া সম্ভব। শুধু তাহাই নয়, ইহা মানব-জীবনে তথা মানব-সভ্যতার পক্ষে এক অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। যুগ-যুগান্তকালহইতে ইহা নানাভাবে মানব-সমাজের প্রয়োজন পূর্ণ করিয়া আসিতেছে।বন-জঙ্গল হইতে প্রভূত পরিমাণেজ্বালনী কাষ্ঠ সংগ্রহ করা যাইতেহ পারে। কাষ্ঠ হইতে প্রচুর উত্তাপ সৃষ্টি হইতে পারে বলিয়া শক্তি-সম্পদ হিসাবেও ইহারমূল্য যথেষ্ট। যে কয়লাভিন্নআধুনিক সভ্যতার প্রায় সকলকাজই আচল হইয়া পড়ে, তাহাও এই শক্ত কাঠেরই রূপান্তর।কুরআনে বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
কাঁচাসবুজবৃক্ষ হইতে তোমাদের জন্য আল্লাহ অগ্ন্যুৎপাদনের ব্যবস্থা করয়া দিয়াছেন। তাই তাহাই তোমরাজ্বালাইয়া থাক।
জ্বালানি কাষ্ঠ ছাড়াও বিপুল পরিমাণ শক্তকাঠ বন-জঙ্গলে পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র,দালান-কোঠার দরজা-জানালা ও কড়িকাঠ, রেল লাইনস্থাপন, নৌকা, পুল ইত্যাদিক নির্মাণ করা- প্রভৃতি অসংখ্য কাজে এই কাষ্ঠ ব্যবহার করা হয়।
কুরআনহাদীসে বন-সম্পদের অর্থনৈতিক মূল্যের বিশেষ উল্লেখ রহিয়াছে। নবী করীম (স) বলিয়াছেন, “আল্লাহর শপথ, রশি লইয়া জঙ্গলে গিয়া কাষ্ঠ আহরণ করা এবং নিজ কাঁধে বহন করিয়া আনিয়া বিক্রয় করিয়া অর্থলাভ করা অপরের সম্মুখের ভিক্ষা হস্ত প্রসারিত করা হইতে অধিক কউত্তম” (বুখারী শরীফ)। এতদ্ব্যতীত নানাবিধ ফল-মূল, শাকসব্জি এবংকফিও এই বন-সম্পদেরই অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মজীদে এই দিকে লক্ষ্য করিয়াই বলা হইয়াছে:
(আরবী************)
আকাশ হইতে আল্লাহ তা’আলা বৃষ্টিপাত করেন এবং উহার সাহায্যে বিবিধ প্রকার উদ্ভিদ, বৃক্ষলতা ও শাক-সব্জি উৎপাদন করেন। হে মানুষ, তোমরা ইহা নিজেরা খাও এবং তোমাদের জন্তু-জানোয়ারকেও খাইতে দাও।
কৃষিকার্যও বাগান রচনা
মানুষেরপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের অধিকাংশইকৃষিকার্যের সাহায্যে লাভ করা যায়। এই জন্যই অর্থনীতির দৃষ্টিতে ভূমি কর্ষণ ও বাগান রচনার গুরুত্ব অপরিসীম।
মানুষের দৈনিক প্রয়োজনীয় দ্রব-সামগ্রীর শতকরা অন্তত ৯০ ভাগ ভূমি হইতেই লাভকরিতে হয়। কৃষিকার্যকে সুষ্ঠু ও দোষ-ত্রুটি মুক্ত করিয়া তোলা প্রত্যেক দেশের এবং প্রত্যেক সমাজেরই অবশ্য কর্তব্য। এই সর্বশ্রেষ্ঠ উৎপাদন উপায়ের প্রতি উপেক্ষা ও অমনোযোগিতার দরুন মানব-সমাজ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদের সম্মুখীন হয়। এই জন্য কৃষিকার্য ও ভূমি সংরক্ষণের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য আরোপ করা এবং উন্নত প্রণালীতে এই কার্য সম্পাদনকরার দিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য।কৃষিকার্য দ্বাা একদিকে মেযন ধান, গম, যব প্রভৃতি খাদ্যশস্য লাভ করা যায়, অন্যদিকে পাট, তুলা, রাবার প্রভৃতি অর্থকরী শৈল্পিক উপাদানওতাহা হইতে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। পুষ্টির জন্য খাদ্য হিসাবে যে শাক-সব্জির গুরুত্ব অনেক তাও এই জমি চাষ হইতেই পওয়া সম্ভব। মূলত মানুষ ও গৃহপালিত পশুর খাদ্যের মূর উৎসই হইল ভূমি চাষ।
কৃষিকার্য সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন হওয়ার পথে বিভিন্ন অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা থাকিতে পার। এই প্রতিবন্ধকতা অনতিবিলম্বে দূর না করিলে প্রয়োজনীয় শস্যোৎপাদন মারাত্মকরূপে ব্যাহত হইতেবাধ্য। নিকৃষ্ট ধরণেরজমিতে পানি সেচেরব্যবস্থা করিলে, সার প্রয়োগের সাহায্যে উর্বরতা বৃদ্ধি করিলে এবং অন্যান্য দিক দিয়া জমির অপচয় ও ক্ষয় প্রতিরোধ করিলে শস্যোৎপাদন প্রচেষ্টা বিপুলভাবে সাফল্য লাভ করিতে পারে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃস্টি, প্লাবন, জমির ক্ষয়-ক্ষতি, উপযুক্ত সারের অভাব প্রভৃতি প্রাকৃতিকপ্রতিবন্ধকতা যথাসম্ভব সত্তরদূর করা একান্ত আবশ্যক।
মানব দেহের পুষ্টি সাধনের জন্য বিভিন্ন প্রকার উপাদেয় ফল খাওয়ারও যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে। এজন্য বাগান রচনা করা এবং তাহাতে সুস্বাদূ ফলের বৃক্ষ রোপণ করাকর্তব্য। এইসব বাগান হইতে কেবল খাদ্যোপযোগী ফলই লাভ হইবে না, বহুবিধ ব্যবহারিক প্রয়োজন মিটাইবার উপযোগী দ্রব্যাদিওতাহা হইতে সংগ্রহ করা যাইবে। অতএব ভূমি কর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে বাগান রচনারও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই কাজে উৎসাহ দানের জন্য নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
যে মুসলমান কৃষিকাজ করিবে, ফসল ফলাইবে, বৃক্ষ রোপণ করিবে এবং কোন পাখী, মানুষ কিংবা জন্তু উহা হইতে কিছু খাইবে তাহার পক্ষ হইতে দান স্বরূপ গণ্য হইবে (এবং এইজন্য সে সওয়াব পাইবে) ।
প্রস্তর ও খনিজ সম্পদ
প্রস্তর ভূপৃষ্ঠের আর একটি অতি দরকারী বস্তু্ ইহা মানুষের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয় সম্পদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। দালানকোঠা ব্রীজ-কালভার্ড ও সড়ক –প্রাচীর নির্মাণের ব্যাপারে প্রস্তর,, চুনা, সুরকী ইত্যাদি অপরিহার্য উপাদান হিসাবে পরিগণিত হইয়া থাকে। কাজেই অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে প্রস্তরেরওযথেষ্ট মূল্য রহিয়াছে।
ভূপৃষ্ঠের সীমা সংখ্যাহীন উপাদান-সামগ্রী ও কাঁচামাল ব্যতীত ভূগর্ভস্থখনিজ সম্পদের অসামান্য গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মানব-সভ্যতার স্থিতি ও প্রগতির পথে উহার ভূমিকা বিস্ময়কর। মাটির অতল গভীরে অসংখ্য প্রকারমহামূল্যবান খনিজ দ্রব্যের স্তুপ স্বাভাবিকভাবেই পুঞ্জীভূত হইয়া আছে, উহার পরিমাপ করা মানুষের সাধ্যাতীত। মানুষের জৈব জীবনের পক্ষে অপরিহার্য খনিজ পদার্থ মাটির সহিত মিশিয়া আছে। ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাস,গন্ধক, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়োডিন প্রভৃতি খনিজ পদার্থ মানুষেরস্বাস্থ্যরক্ষার পক্ষে অপরিহার্য।[কেননা মাটির এই সব মৌলিক উপাদান দিয়াই মানব দেহের সৃষ্টি হইয়াছে।] বৃক্ষ-লতা-গুল্ম-সব্জি ইত্যাদি মাটি হইতে রস গ্রহণ করিয়াই বাঁচে এবং ইহারা মটিররসের সঙ্গে এই সব খনিজ দ্রব্যও আহরণ করিয়া থঅকে। আর মানুষ এইসব গাছ ও লতার ফল-মূল এবং শাক সব্জি ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে বলিয়া উল্লিখিত খনিজ পদার্থ সমূহের সারাংশ মানবদেহে প্রবেশ করে।
মানব-সভ্যতার পক্ষে অপরিহার্য লৌহ. তাম্র, পিতল, ইস্পাত, স্বর্ণ-রৌপ্য, হরা-মানিক্য, পেট্রোল ও কেরোসিন ইত্যাদি দ্রব্য মানুষ খনিজ হইতেই লাভ করে। এইসবের অর্থনৈতিক মূল্যের প্রতি লক্ষ্য করিয়াই নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
মাটির গভীর তলদেশে-ভূপৃষ্ঠের পরতে পরতে-জীবিকার সন্ধান কর।
যে লৌহ বর্তমান বৈজ্ঞানিক সভ্যতার মেরুদন্ড এবং সকল প্রকার বৈঞ্জানিকআবিষ্কার উদ্ভাবনী ও শৈল্পিক যন্ত্রপাতির আদি পিতা, সে সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেন:
(আরবী********)
আমি লৌহ সৃষ্টি করিয়াছি, তাহাতে বিরাট শক্তি নিহিত রহিয়াছে, এবং আাছে মানুষের প্রভূতকল্যাণ সাধিত হওয়ার অপূর্ব সম্ভাবনা।
সমুদ্র –সম্পদ
সৃষ্টির আদিকাল হইতে পৃথিবীর বহু দেশ ও দ্বীপপুঞ্জ সন্নিহিত সমুদ্রের মধ্যে নিমজ্জিত হইয়া যাইতেছে। তাহার ফলেসমুদ্র-গর্ভে অশেষ অসীম পরিমাণ খনিজ, উদ্ভিজ ও প্রাণীজ সম্পদ সঞ্চিত হইয়া রহিয়াছে।
ভূভঅগের শতকরা ৭১ ভাগ সমুদ্র পরিবেষ্টিত। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণকরিয়া দেখিয়াছেন, এই বিশাল সামুদ্রিক ভান্ডারে ৫ কোটি লক্ষ টন পরিমাণ দ্রবীভূত উপাদান বা লবন বর্তমান আছে। পৃথিবীব্যাপী প্রগতিশীলসমাজের খনিজ ও ধাতববস্তুর চাহিতা মিটাইবার পক্ষে এই পরিমাণ যথেষ্ট। এতদ্ব্যতীত সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ মাছ, খাদ্য উপযোগী কঠিন আবরণ বিশিষ্ট জীবসমূহ বিড়ি মাছ ইত্যাদি শৈবাল ওসামুদ্রিকগাছ-পালাও রহিয়াছে- তাহা দ্বারা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার খাদ্যসংস্থান অনায়াসেই হইতে পারে।
উর্বরতার দিক হইতে সমুদ্র যে-কোন সু-উর্বর জমির সঙ্গে তুলনীয়। প্রকৃতপক্ষে প্রতি একর জমির উর্বরতার তুলনায় সমুদ্র অধিক উর্বর। ইহার ছাড়া পৃথিবীর উপরিভাগের জমির বেলায় যেমন জলাভাব বা বন্যার ভয় রহিয়াছে, সমুদ্রে তাহা নাই। উপরন্তু পোকা-মাকড়ের আক্রমণে বা গাছপালার ব্যধির ফলে জমিতে উৎপন্নশশ্যাদি অনেক পরিমাণ নষ্ট হয়, সমুদ্রে তাহা হইতে থাকে অতি সামান্য পরিমাণে। কিন্তুমানুষ সমুদ্রের উদ্ভিজ্জও প্রাণীজ সম্পদের অতি অল্প অংশ মাত্র এখন পর্যন্ত তাহারা কাজে লাগাইতে সামর্থহইয়াছে।
অধিকন্তু, সামুদ্রিক প্রাণীদের সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিকগণ যতখানি অবহিত, সামুদ্রিক আগাছা বা অন্যান্য উদ্ভিদ সম্বন্ধেততদূর অভিজ্ঞ নহেন।
রাষ্ট্রসংঘের পার্থিব সম্পদের সংরক্ষণ ও সদ্ব্যাবহার সম্পর্কি সাম্প্রতিক এক সম্মেলনে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা এই অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন যে, বর্তমানে যে গড়ে দুই কোটি পরিমাণ মাছ পৃথিবীর সম্সত সমুদ্রহইতে আহরত হয়, যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করিলে ২০ বছরের মধ্যে উহার পরিমাণ শতকরা ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করা যাইতে পারে।
সামুদ্রিকসম্পদের এই বিপুল সম্ভাবনার জন্যই আল্লাহতা’আলাঅশান্ত তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ ও সর্বগ্রাসী নদী-সমুদ্রকে মানুষের আয়ত্বাধীন করিয়া দিয়াছেন। মানুষ ইহারতলদেশে অবস্থিত সকল প্রকার সম্পদই আহরণ করিতে পারে।
নদী-সমুদ্র হইতে একদিকে যেমন মানুষের প্রধান খাদ্যমৎস্য আহরণ করা যায়, অপরদিকে মুক্তা-মুংগা প্রভৃতি বহুমূল্য সম্পদও লাভ করা যায়। এইসব সম্ভাবনার দিকে ইংগিত করিয়া আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেন:
(আরবী*************)
‘সমুদ্রকে তোমাদের জন্য বাধ্যও অধীন বানাইয়া রাখা হইয়াছে- যেন তাহা হইতে তোমরা টাটকা মাংস (মাছ) এবং মুক্তা-মুংগা প্রভৃতি অলংকার ও ধাতব দ্রব্য আহরণ করিতে পার।
বস্তুত মাছ মানব সভ্যতার শুরু হইতেই মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। আগুন আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বেই ইহার সন্ধান পাওয়া গিয়াছিল বর্তমান যুগেও মৎস্য শিকার এক উল্লেখযোগ্য অর্থকরী শিল্প বিশেষ। মানুষের খাদ্যের মধ্যে ‘প্রোটিন’ একটি অপরিহার্য দ্রব্য। মাছের মধ্যে ইহা যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়।
এতদ্ব্যাতীত সমুদ্র হইতে নানাপ্রকার জলজন্তুও শিকার করা যায়, যাহামানুষের বিবিধ উপকারেব্যবহৃত হইয়া থাকে এবং যাহা বিদেশে রপ্তানি করিয়া বিপুলপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যাইতে পারে।
বায়ু, বিদ্যুৎ ও বৃষ্টি
বায়ু, বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ মানুষের প্রয়োজনীয় সম্পদ উৎপাদনের কাজে অপরিহার্য। বায়ু এবং বৃষ্টি না হইলে প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন রক্ষা পাইতে পারে না। ইহাদের বাঁচিয়া থাকার জন্য অপরিহার্য খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদদদনের জন্যও ইহার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। কুরআন মজীদেএইজন্র স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত হইয়াছে:
(আরবী**************)
এবং বায়ুর প্রবাহ ও আবর্তন এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে আবদ্ধ ও নিয়মানুবর্তী মেঘমালা প্রভৃতিতে বুদ্ধিমান ও মননশীল জনগণের পক্ষে আল্লাহর অস্তিত্বের অনেক নিদর্শন এবং গবেষণার প্রভূত বিষয়বস্তু ও উপকরণ বর্তমান রহিয়াছে।
বিদ্যুৎও অনুরূপ একটি অতি প্রয়োজনীয় বস্তু- ইহা বর্তমান সভ্যতার পক্ষে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, সন্দেহ নাই। বিদ্যুৎ আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত না হইলে বর্তমানে সভ্যতা ও বিজ্ঞানের এই অদ্ভূত চরম উন্নতি উৎকর্ষ লাভ যে মোটেই সম্ভব হইত না, তাহা বলাই বাহুল্য। এইজন্য কুরআনের ভাষায়, বিদ্যুৎ মানুষ জাতির আশা ভরসার প্রধান কেন্দ্র এবং অপূর্ব সম্ভাবনার উৎসবিশেষ। ইহার সদ্ব্যবহারে মানুষের যে বিরাট কল্যাণের সম্ভাবনা নিহিত রহিয়াছে,কুরআন শরীফে তাহারও উল্লেখ করা হইয়াছে। পরন্তু এই বিদ্যুতের অপব্যবহারহইলেবা পাশবিক দৃষ্টিতে ইহার ব্যবহার করা হইলে যে বিশ্ব-মানবতার ধ্বংস সাধন হইতে পারে কুরআন মজীদে সেদিকেও ইংগিত রহিয়াছে। বলা হইয়াছে:
(আরবী***********)
তাঁহার নিদর্শনাবলীর মধ্যে ইহাও একটি যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদিগকে বিদ্যুৎ প্রদর্শন করেন ভয় ও আতংকের জিনিসরূপে এবং আশা ও আকাঙ্ক্ষার উৎসসরূপে এবং তিনি উর্ধ্বলোক হইতে পানি বর্ষণ করেন, পরে উহার সাহায্যেমৃত জমি সঞ্জীবিত করেন। বস্তুত ইহাতে আল্লাহ তা’আলার অস্তিত্বের নিদর্শন বর্তমান; চিন্তাশীল লোকদের জন্য গবেষণার বহু বিষয়ও ইহাতে রহিয়াছে।
প্রাকৃতিক উপাদানকে মানুষ আজ নানাভাবে ব্যবহার করে, তাহা হইতে নানাবিধ শক্তি আহরণ করিয়া অসংখ্য কাজে নিয়োগ করে। পানি ও আগুনের ব্যবহারেবাষ্প ও বিদ্যুৎ এবং ঝর্ণাধারা, তীব্র জলস্রোত ও বায়ু প্রবাহ হইতে বিরাট শক্তি উৎপন্ন হইয়া মানব-সভ্যতাকে আজ অপূর্ব সম্ভাবনাময় করিয়া তুলিয়াছে। সূর্যকিরণ, সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা, আণবিক শক্তি প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তি নানাদিকক দিয়া মানুষ জীবনসমাজকে বিপুলভাবে উন্নত করিয়াছে।
শিল্প
পূর্বেই বলা হইয়াছে,মানুষের সর্ববিদ প্রয়োজনীয় উপাদান কোন না কোনরূপে প্রকৃতির বুকে বর্তমান রহিয়াছে। কিন্তু এই উপাদানসমূহ মানুষ উহাদের স্বাভাবিক অবস্থায় কখনও ব্যবহার করে না, ব্যবহার করে উহাদের বর্তমান রূপ পরিবর্তন করিয়া। ভেড়ার পশম কেহ ব্যবহার করে না,তাহা হইতে কম্বল বা বিভিন্ন প্রকার পোশাক-পরিচ্ছদ তৈয়ারকরা হইলে পরই তাহা মানুষের ব্যবহার আসে। খনির কাচা লৌহ মানুষের কোন কল্যাণই করিতে পারে না- যতক্ষণ না তাহা আগুনে জ্বালাইয়া উহা হইতে মানুষের ব্যবহারোপযোগী ও প্রয়োজনীয অস্ত্র-শস্ত্র, কল-কব্জা বা যন্ত্রপাতি নির্মাণ করা হইবে। কাষ্ঠ কাঁচামাল হিসাবে কেবল জ্বালানির কাজেই ব্যবহৃত হইতে পারে অথচ তাহাতে মানুষের বুদ্ধি ও শ্রমের যোগ হইলে তাহা হইতে নৌকা, জাহাজ, ঘরবাড়ি, দালান-কোঠার সরঞ্জাম এবং নানাবিধ মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় ফার্ণিচার তৈয়ার করা সম্ভব। শুধু তাহাই নয়, সভ্যতার অপরিহার্য উপাদান কাগজ এবং এক প্রকার পোশাক ও ইহা হইতে প্রস্তুত করা যাইতে পারে।
বস্তুত কাঁচামাল প্রাকৃতি-উপাদানের স্বাভাবিক অবস্থা, উহার বাহ্যিক রূপ এবং আকৃতি ও আঙ্গিক পরিবর্তন সাধন করিলে উহার ব্যবহারিক মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। অর্তনীতির পরিভাষায ইহাকে বলা হয় শিল্প (Industries)। শিল্প-কার্যমানুষের অর্থোৎপাদনের একটি উপায় মাত্র নয়, মূলত অর্থনৈতিক দর্শনের দৃষ্টিতে ইহাই মানব-সভ্যতার অর্থনৈতিক ভিত্তি।
শিল্প প্রধানত দুই প্রকার। মানুষ ব্যক্তিগতভাবে কিংবা পারিবারিক পরিবেষ্টনীতে যেসব শিল্পকর্মসম্পন্ন করিয়া থঅকে তাহা কুটীর-শিল্প নামে অভিহিত হয়। আর সাধারণ ভাষায় ইহাকে বলা হয় হস্তশিল্প। কারণ প্রধানত এইকাজ হস্ত দ্বারাই সম্পন্ন করা হয়-কল-কব্জার ব্যবহার ইহাতে বিশেষ হয় না।বর্তমান সময়ের ছোট ছোট যন্ত্রের সাহায্যে এককভাবে বা ছোট আকারে (Small Scale Production) যেসব শিল্পোৎপাদন হয় তাহাও এই গার্হস্থ্য শিল্পেরই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান মানুষের সামনে বিরাট বিরাট কল-কারখানা স্থাপন এবং বৃহদায়তন শিল্পোৎপাদনের সিংহদ্বার উদঘাটন করিয়া দিয়াছে। ইহাকে আমরা ‘যন্ত্র-শিল্প’ নামে উল্লেখ করিতে পারি। প্রথম প্রকার শিল্পোৎপাদনে অধিক মুলধনের আবশ্যক করে না; কিন্তু শেষোক্ত প্রকার শিল্পোৎপাদন পর্যাপ্ত ও প্রচুর মূলধন ব্যতীত কিছুতেই সম্ভভ হইতে পারে না।
বস্তুত এই উভয় প্রকার শিল্পেরই উল্লেখ পাওয়া যায় কুরআন মজীদে। মানব-সভ্যতার প্রাচীনতম কাল হইতেই এই উভয় প্রকার শিল্পকার্যের প্রওচলন হইয়অছে। তন্মধ্যে নৌকা, জাহাজ, লৌহ-দুর্গ, বয়লার, খেলনা, পানির কূপ, লৌহ চাদর, প্রাচীন ও বিরাট আকরে তৈজসপত্র প্রস্তুত করার বিষয় কুরআন মজীদে উল্লেখ পাওয়া যায়।
(আরবী***********)
শিল্পী-কারিগরগণ কারখানা মালিকের নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গ, খেলনা, পানির পাত্র এবং বড় বড় বয়লার ইত্যাদি নির্মাণ করিতেছে।
(আরবী**********)
তোমরা আমর নিকট লৌহ-নির্মিত চাদর উপস্থিত কর, (তাহা আনিয়া এক প্রাচীর নির্মাণ করা হইলে) যখন উভয়ের মধ্যখানে এই প্রাচীর উহাদেরই সমান উচু করা হইল তখন লোকদিগকেবলা হইল, এখন আগুনের কুণ্ডলি উত্তপ্ত কর। শেষ পর্যন্ত যখন এই লৌহ প্রাচীর সম্পূর্ণরূপে আগুনের মত লাল হইয়া উঠিল,তখন সে বলিল, আন, আমি ইহার উপর গলিত তামা ঢালিয়া দিব।
এই আয়াতটি লৌহ ও তাম্র ব্যবহার ও উহার শিল্প গড়িয়া তোলার দিকে সুস্পষ্ট ইংগিত করিতেছে। বর্তমান সভ্যতার চরম মাত্রার উন্নতির মূলে লৌহ ও তাম্র শিল্পের গুরুত কোন ক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।
মৃৎশিল্প
মাটির দ্বারাওপারিবারিক ও সামাজিক প্রয়োজনের অসংখ্র দ্রব্য প্রস্তুত করা যায়। স্থাপত্য, কাঁচ ও আয়নার নির্মণও এই মৃৎশিল্পেরই অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাবে ইহার যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও ব্যবহারিক মুল্য রহিয়াছে।
বয়ন-শিল্প
মানব-সভ্যতায় বয়ন বা বস্ত্রশিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। ইহা এইদিকে যেমন মানুষের লজ্জা নিবারণের উপায়, অপরদিকে ইহা মানুষের ভূষণৗ বটে। আল্লাহ তা’আলা মানুষের জন্য যে পোশাকের ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহা মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অসীম অনুগ্রহের নিদর্শন, সন্দেহ নাই। নিম্নোক্ত আয়াতে এই কথা বলা হইয়াছে।
(আরবী**********)
হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য পোশাক সৃষ্টি করিয়াছি, ইহা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে, অন্য পক্ষে ইহা তোমাদের ভূষণও বটে।
এই পোষাকই মানুষকে শীত-গ্রীষ্মেরপ্রবল আক্রমণ হইতে রক্ষা করে। কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতে তাহাই বলা হইয়াছে:
(আরবী***********)
আল্লাহ তা’আলাই তোমাদের জন্য টুপি ও জামা-কোর্তা তৈয়ার করিয়াছেন, যাহা গ্রীষ্মের ও শীতের আক্রমণ হইতে তোমাদিগকে রক্ষা করে, এতদ্ব্যতীত বর্ম ইত্যাদিও প্রস্তুত করিয়াছেন, যাহা যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে।
তাঁবু, ছাতা, সিল্ক ইত্যাদির কাপড় প্রস্তুত করা এই রয়ন শিল্পেরই বিভিন্ন দিক। এই সবের যে বিরাট অর্থনৈতিক ব্যবহারিক মূল্য রহিয়াছে, তাহা কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত হইয়াছে।
চর্ম শিল্প বা ট্যানারী
গরু, ছাগল, উট এবং অন্যান্য জন্তুর চর্ম হইতে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে ব্যবহার্য অসংখ্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য তৈয়ার হইয়া থাকে। নবী করীম (স)মৃতজন্তুর চর্ম কি করা হয় জিজ্ঞাসা করিলে আসহাবগণ উহার ব্যহার করার বৈধতা সম্পর্কে হযরতের নিকট জানিতে চাহিলেন। উত্তরে তিনি বলিলেন: মৃত জন্তুর গোশত খাওয়া হারাম ইহলেও উহার চামড়া ও চশম ব্যবহার করা হারাম নয়। তাহা নিঃসন্দেহে যে কোন অর্থকরী কাজে নিযুক্ত ও ব্যবহৃত হইতে পারে।
চামড়া হইতে জুতা, ব্যাগ, বাকল বড় বড় বই-কিতাবের উৎকৃষ্ট বাঁধাই এবং শীতপ্রধান দেশের জন্য এক প্রকার মোজা ও জামাও তৈয়ার করা হয়।
পরিবহন ও যানবাহন
পণ্যদ্রব্যের আমদানি-রপ্তানির জন্য মানুষ আল্লাহ-প্রদত্ত বুদ্ধি ও কৌশলের সাহায্যে বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ার ব্যবহার করিতে পারে, পারে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উদ্ভাবনীর মাধ্যমে বিভিন্ন ভারবাহী যন্ত্র ও যানবাহন প্রস্তুত করিতে।
পণ্যদ্রব্য স্থানান্তরিত করার জন্য প্রধানত দুইটি পথই ব্যবহৃত হইয়া থাকে- জলপথ ও স্থলপথ।
জলপথে নৌকা ও জাহাজই হইতেছে প্রধানতম বাহন। কালামে পাকে বলা হইয়াছে:
(আরবী*********)
এবং নৌকা, জাহাজ মানুষের পক্ষে প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর দ্রব্যসামগ্রী লইয়া নদী-সমুদ্রে চলাচল করে।
বস্তুত ভারী পণ্য-দ্রব্যের আন্হর্জাতিক বাণিজ্য সমুদ্রগামী বিরাট বিরাট জাহাজ ব্যতীত সম্ভব নয়।
স্থলপথে আমদানি-রফতানির কাজ সাধারণত এক এক দেশের অভ্যন্তরীণ এলাকার মধ্যেই সম্পন্ন হইতে পারে। এই কাজে প্রাচীনকালে- যন্ত্র সভ্যতার পূর্বকাল পর্যন্ত- চতুষ্পদ জন্তুই অধিকতর ব্যবহৃত হইয়াছে।
(আরবী*********)
ঘোড়া, খচ্চর(গরু, উট ইত্যাদিও) পরিবহন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করার জন্যই সৃষ্টি করা হইয়াছে।
যদিও বর্তমান যুগে এই চতুষ্পদ জন্তুই একমাত্র যানবাহন নয়- কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই ঘোড়া আজিও প্রাচ্যদেশসমূহ গতির এবং পাশ্চাত্য দেশসমূহে শক্তির প্রতীক হইয়া আছে। ‘হর্স পাওয়ার’ (Horse Power) কথাটি বর্তমানে সব দেশেই প্রচলিত, ঘোড়া-খচ্চর-গরু-গাধা যানবাহন হিসাবে আজ পর্যন্তও সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয় নাই; বর্তমানেও তাহা যথেষ্ট ব্যবহৃত হইতেছে। বর্তমান সময়ে মোটর, ট্রাক, রেলগাড়ী প্রভৃতি বাষ্পচালিত যানবাহন এই কাজ অত্যন্ত সহজ করিয়া দিয়াছে। এইসব আধুনা-আবিষ্কৃত যানবাহনের সাহায্যে অধিক ভারী দ্রব্যাদি বিপুল পরিমাণে ও অতি অল্প সময়ে দূরবর্তী স্থানসমূহের মধ্যে আমদানী-রফতানি করা চলে। এক কথায় বর্তমান সভ্যতার রক্তচলাচল এইসব যানবাহন ব্যতীত মাত্রই সম্ভব নয়। এই জন্যই আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেন:
(আরবী*************)
এইসব যানবাহন তোমাদের দ্রব্য-সামগ্রী দূরবর্তী এমন সব শহর ও স্থান পর্যন্ত বহন করিয়া লইয়া যায়, যে পর্যন্ত তাহা বহন করিয়া নেওয়া তোমাদের পক্ষেবিশেষ কষ্টকর ব্যাপার ছিল; কিন্তু তোমাদের রব্ব বড়ই অনুগ্রহশীল ও দয়াময় (বলিয়াই তিনি এইসব যানবাহনের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন)।
মানুষের জীবন সুখী ও সমৃদ্ধিশালীকরিয়া তুলিবার জন্য আল্লাত তা’আলা প্রকৃতির রুদ্ধদ্বার উদারভাবে উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন। জল ও স্থলের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপিত করিয়া মানুষ এখন অন্তরীক্ষের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছে। বায়ুকে করায়ত্ব করিয়া-উহার উপর বিজয় রথ চালাইয়া- দিগ দিগন্তকে একই কেন্দ্রবিন্দুর সহিত নিবিরভাবে সংযুক্ত করিয়া দিয়াছে। বস্তুত এই আকাশপথ –এই ব্যোমযানেই-পৃথিবীর দূর-দূরান্তরে অবস্থিত বিক্ষিপ্ত মানব সমাজকে পরস্পরের অতি নিকটবর্তী করিয়া দিয়াছে। এই কথাই বলা হইয়াছে কালামে পাকের নিম্নলিখিত আয়াতে:
(আরবী***********)
বায়ুকে মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়ন্ত্রণাধীন করিয়া রাখিয়াছি। তাহা আল্লাহর প্রাকৃতিক নিয়মানুযায়ী খুবই হালকা ও নম্রবাবে প্রবাহিত হয়, যেখানেই উহা পৌঁছায়।
মাটি, পানি ও বায়ুকে আয়ত্তাধীন করিয়া মানুষ অগ্নিকেও কাজে প্রয়োগ করিয়াছে এবং আগুন ও পানির সম্মিলনে বাষ্প সৃষ্টি করিয়া এক বিরাট শক্তি (Power) লাভ করিয়াছে। ইহার দরুন এক দেশের উদ্বৃত্ত বা অপ্রয়োজনীয়পণ্য অন্য দেশে রফতানি করা সম্ভবপর হইতেছে। যানবাহনের এই উন্নত শক্তির সাহায্যে প্রত্যেক দেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন পূরণ করা যেমন সহজ হইয়অছে, বিরাট আকারে অর্থকরী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার পথও অনুরূপভাবে সুগম হইয়া গিয়াছে। পৃথিবীর জাতিসমূহের এবং একই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলসমূহের পারস্পরিক অর্থনৈতিক অসাম্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব দূর করা ইহার সাহায্যে অতীব সহজসাধ্য হইয়া পড়িয়াছে।
ব্যবসায়-বাণিজ্য
যানবাহন ও আমাদানি-রফতানির সাহায্যে জীবন-যাত্রার পক্ষে অপরিহার্য পণ্যদ্রব্য বাজার ও ব্যবসাকেন্দ্রে পৌঁছায়। ব্যবসায়ী তাহা খরিদ করিয়া পুনরায় অন্যত্র বা অন্যভাবে বিক্রয় করিতে চেষ্টা করে। কাজেই অর্থোৎপাদনের অন্যান্য অসংখ্য উপায়ের মধ্যে ব্যবসা- বাণিজ্যও একটি অন্যতম উপায়। ব্যবসা- বাণিজ্য দ্বারা অর্থোৎপাদনের জন্য কুরআন মজীদ যথেষ্ট উৎসাহ দান করিয়াছে। বলা হইয়াছে:
(আরবী***********)
নামায সমাপ্ত হওয়ার পর তোমরা পৃথিবীতে ইতস্তত ছড়াইয়া পড় আল্লাহর অনুগ্রহ- ধনসম্পদ- অনুসন্ধান, আহরণ ও উপার্জন কর।
ব্যবসায়-বাণিজ্যের সাহায্যে অর্থোপার্জন করারই নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে উল্লি্খিত আয়াতে।
অন্যত্র বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
মুসলমানগণ, তোমরা অন্যায়ভাবে অসদুপায়ে পরস্পর পরস্পরের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করিও না। তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের মারফতেই অর্থের আদান-প্রদান কর।
নবী করীম (স) মুসলমানদিগকে ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য বিশেষ উৎসাহ প্রদান করিয়াছেন এবং ইসলামী সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও ন্যায়পন্থী ব্যবসায়ীর বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী আম্বিয়া, সিদ্দীক ও শহীদ প্রভৃতি মহান ব্যক্তিদের সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত হইবেন।
এই জন্যই ইসলামী অর্থনীতি ব্যবসায়-বাণিজ্যের অপরিসীম গুরুত্ব রহিয়াছে। ইহা একদিকে যেমন প্রচুর অর্থোপার্জনের পথ উন্মুক্ত করিয়া দেয়, অপরদিকে ইহামানুষের নৈতিক চরিত্রকে সুদৃঢ় ও উন্নত করিয়া তোলে, অন্য কথায়, ইহা মানুষের খোদাভীতি (তাকওয়া) ও নৈতিক চরিত্রের এক কঠোর পরীক্ষা-ক্ষেত্র।
কালামে পাকে বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
আল্লাহ তা’আলাক্রয়-বিক্রয়-ব্যবসায়-বাণিজ্য হালাল করিয়াচেন, কিন্তু সূদ ও সূদভিত্তিক যাবতীয় কারবার হারাম বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।
নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
রুজীর দশ ভাগের নয় ভাগেই রহিয়াছে ব্যবসায়-বাণিজ্যের মধ্যে। বস্তুত জাতীয় জীবনে ব্যবসা-বাণিজ্য একটি বিরাট স্তম্ভ বিশেষ; তাই বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
ব্যবসায়-বাণিজ্যের এই ব্যবস্থা না হইলে তোমাদের জীবন দুর্বিসহ ও অপরের উপর দুর্বহ বোঝা হইয়া পড়িত।
শ্রম ও উপার্জনের অধিকার
মানুসের জীবন-যাত্রা নির্বাহ এবং উন্নত, সমৃদ্ধ ও সুসভ্য জীবন-যাপনের জন্য আল্লাত তা’আলা যেসব দ্রব্যসামগ্রী ও উপাদান-উপকরণ বিশ্বপ্রকৃতির বুকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা সব মূলতই মুবাহ- তাহা ভোগ ও ব্যবহার করার অধিকার সাধারণভাবে সকল মানুষেরই সমানভাবে বর্তমান। প্রত্যেক মানুষই তাহা হইতে নিজের প্রয়োজন পরিমাণ দ্রব্য গ্রহণ করিতে পারে, তাহা প্রয়োগ ও বিক্রয় করিয়া অর্থোপার্জও করিতে পারে। ইহা প্রত্যেক মানুষেরই জন্মগত বা স্বাভাবিক অধিকার। এইসব স্বভাবজাত দ্রব্য-সামগ্রী সৃষ্টি করার ব্যাপারে কোন মানুষেরই কিছুমাত্র শ্রম-মেহনত ব্যয়িত হয় নাই। কাজেই নৈসর্গিক উপাদানের উপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব বা নিরংকুশ ভোগাধিকার স্থাপিত হইতে পারে না। ‘শ্রমেরও ব্যবহারিক বা বিনিময় মূল্য রহিয়াছে এবং তাহাও এক প্রকার সম্পদ বা উৎপাদন উপায়, ইসলামী অর্থনীতি এ কথা স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করিয়াছে। মানুষের মধ্যে শ্রমশক্তি জন্মগতভাবেই নিহিত ও সুপ্ত রহিয়াছে। আল্লাহর বাণী এই শক্তিকে পূর্ণমাত্রায় উদ্বোধিত করিয়াছে। কুরআন মজীদে নানাভাবে মানুষকেকর্মশক্তি প্রয়োগ করার ও এই ব্যাপারে কোনরূপ অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও গাফিলতি প্রদর্শন না করার জন্য আকুল আহবান জানানো হইয়াছে।
একটি আয়াতে বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
তাহারা যেন উহার ফসল ভোগ করে, যেন ভোগ করে তাহাদের হাত যেসব কাজ করিয়াছে তাহার ফলও। এইরূপ অবস্থায় তাহারা কি শোকর করিবে না?
ইহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যায়, মানুষের খাদ্য দুইটি উপায়ে পাওয়া যাইতে পারে। একটি জমিতে গাছ-গাছড়া জন্মাইয়া উহার ফল ও ফসল খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করা। আর দ্বিতীয়টি- হাত দ্বারা কোন পণ্যদ্রব্য তৈয়ার করা এবং উহার সরাসরি বিনিময়ে অথবা উহার দরুন লব্ধ মজুরীর বিনিময়ে খাদ্য-দ্রব্য খরিদ করা। আর এই দুইটি উপায়ের মূলে মানুষের শ্রমই অপরিহার্য উৎস। শ্রম না হইলে এই দুইটি পথের কোন পথেই মানুষের খাদ্যদ্রব্য সংগৃহীত হওয়া সম্ভব হইতে পারে না।
নবী করীম (স) শ্রমকরিয়া জীবিকার্জনে অভ্যস্ত ছিলেন এবং শ্রম করার কারণে তাঁহার হাতে ফোসকা পড়িয়া গিয়াছিল। এই ফোসকা পড়া হাত দেখাইয়া তিনি বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
আল্লাহ তা’আলা এবং তাহাররাসুল এইরুপই শ্রমাহত হাত খুবই পছন্দ করন ও ভালবাসেন।
শ্রমিকের কোন কাজই নিষ্ফল যাইতে পারে না। শ্রমিক যে শ্রমই করিবে উহার মজুরী সে অবশ্যই পাইবে। শ্রমেরমূল্য ও মজুরী হইতে তাহাকে বঞ্চিত করা মানবতা বিরোধী কাজ।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
যে লোক দুনিয়ার জীবন ও ইহার সৌন্দর্য লাভের উদ্দেশ্যে কাজকরিবে আমরা তাহাদিগকে তাহাদের কাজের ফল পূর্ণমাত্রায় দান করিব এবং এই ব্যাপারে তাহারা কিছুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হইবে না।
আয়াতটি যদিও পরকালে অবিশ্বাসী লোকদের সম্পর্কে উদ্ধৃত হইয়াছে, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও আয়াতটির বৈষয়িক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। ইহার বাহ্যিক অর্থ এই কথাই প্রমাণ করে যে, যে-লোক যে-কাজই করিবে, সে-ই উহার প্রতিফল লাভের অধিকারী হইবে এবং এই শ্রমের প্রতিফলতথা মজুরী হইতে কাহাকেও বঞ্চিত করা আল্লাহর নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই ইসলাম পরিশ্রম করিয়া সম্পদ আহরণ ও অর্থোপার্জন করার নির্দেশ দিয়াছে।
কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
আল্লাহ ছাড়া তোমরা আর যাহার যাহার উপাসনা ও দাসত্ব কর,তাহারা কেহই তোমাদের রিযিক-এর মালিক নয়- তাহারা কেহই তোমাদিগকে রিযিক দিতে পারে না। অতএব তোমরা আল্লাহর নিকটই রিযিক-এর সন্ধান কর।
এই আয়াত হইতে দুইটি কথা স্পস্ট ভাষায় জানা যায়। প্রথমত, মানুষের রিযিকের মালিক- রিয্কদাতা- আল্লাহ ছাড়া আর কেহ নয় এবং দ্বিতীযত, আল্লাহ মানুষকে রিযিক দানের যে নিয়ম করিয়া দিয়াছেন তাহা এই যে, মানুষের নিজেকেই তাহা সন্ধান করিতে হইবে- তাহা উপার্জনের জন্য মানুষকে রীতিমত পরিশ্রম করিতে হইবে। ইসলামী অর্থনীতি অর্থোপার্জনের জন্য পরিশ্রম করা মানুষের পক্ষে অপরিহার্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে।
কুরআন মজীদে ইরশাদ হইয়াছে:
(আরবী**********)
সেইমহান আল্লাহই জমিকে তোমাদের জন্য নরম মসৃণ বানাইয়া দিয়াছেন। অতএব, তোমরা ইহা পরতে পরতে সন্ধানকার্য চালাও এবং এই সবের মাধ্যমে আল্লাহ দেওয়া রিযিক তোমরা আহার কর এবং শেষ পর্যন্ত তাঁহার নিকটই ফিরিয়া যাইতে হইবে (এই কথা অবশ্যই স্মরণে রাখিবে)।
এই আয়াতের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞগণ বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
যে লোক জমির উপর শ্রম করিবে সে-ই খাদ্য পাইবে। যে তাহার সাধ্য ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শ্রম করবে না, সে খাদ্য না পাওয়ার যোগ্য।
অতএব, শ্রম খাদ্য উপার্জনে প্রধানপ্রথম উপায়। আল্লাহ তা’আলা মানুষের রিযিক লাভ করাকে তাহার নিজের শ্রম করার উপর নির্ভরশীল করিয়াছেন।
সূরা আল-জুম’আর আয়াতে বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
যখন নামায পড়া সমাপ্ত হইয়া যায়, তখন তোমরা জমির দিকে ছড়াইয়া পড় এবং আল্লাহর নিকট অনুগ্রহের সন্ধান কর।
এই আয়াত অনুযায়ী যে লোক আল্লাহর নিকট হইতে রিযিক লাভেরজন্য অনুসন্ধান চালাইবে ও শ্রম করিবে, সে অবশ্যই খাইতে পাইবে।
নবী করীম (স) বলিয়াছেন : (আরবী**********)
হালাল রুজী উপার্জন করাসর্বপেক্ষা প্রধান কর্তব্য।
অন্যত্র বলিয়াছেন: (আরবী**********)
শ্রমজীবী ও উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু।
অপর হাদীসে ইরশাদ হইয়াছে (আরবী**********)
নিজ হস্তে উপার্জিত খাদ্য অপেক্ষা অধিক উত্তম খাদ্য আর কিছু নাই।
সাহাবাগণ নবী করীম (স) কে জিজ্ঞাসা করিলেন: (আরবী**********)
কোন্ প্রকারের উপার্জন উত্তম?
জওয়াবে নবী করী (স) বলিলেন:” (আরবী**********)
ব্যক্তির নিজ হাতের কাজের বিনিময় কিম্বা সুষ্ঠু ব্যবসায় লব্ধ মুনাফা।
রাসূলে করীম (স) তাকীক করিয়া বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
তোমাদের কেহ রশি লইয়া গিয়া জঙ্গল হইতে কাঠ কাটিয়া স্বীয় পিঠের উপর বহন করিয়া লইয়া আসিলে আল্লাহ তাহাকে সেই ভিক্ষাবৃত্তিহইতে রক্ষা করিবেন, যাহাতে কিছু পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নাই।
(আরবী**********)
ফজরের নামায পড়ার পর জীবিকা উপার্জনে লিপ্ত না হইয়া ঘুমাইয়া থাকিও না।
কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে আল্লাত তা’আলা ‘দি ‘-কে মানুষের জীবিকার্জনের উপযুক্ত সময় করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। যথা:
(আরবী**********)
আমি দিনের নিদর্শনকে উজ্জ্বল করিয়া দিয়াছি, যেন এই সময় তোমরা তোমাদের আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করিতে পার।
শ্রেষ্ঠ মানব হযরত নবী করীম (স) এবং তাঁহার সাহাবীগণ অর্থোপার্জনের জন্য পরিশ্রম করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করিতেন না। তাঁহারা সকলেই শ্রম করিয়া ধন উপার্জনে বা পণ্যোৎপাদনের এক উজ্জ্বলতম আদর্শ মানব সমাজের সম্মুখে স্থাপন করিয়াছেন। কুরআন মজীদে এই কাজের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করিয়া বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
আর অন্যান্য বহুলোক (সাহাবী) এমন রহিয়াছে যাহারা জমিনের দিকে দিকে ভ্রমণ করে ও আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করিয়া বেড়ায়।
তাই ইসলামে প্রত্যেকটি মানুষের জীবিকা উপার্জনের পূর্ণ আযাদী থাকা আবশ্যক। সেইজন্য সকল প্রকার উপায় ও পন্থা ব্যক্তির অর্থনৈতিক চেষ্টা সাধনার পথে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতাই থাকিতে পারে না। সামাজিক বা আইনগত কোন বাধাও থাকিতে পারে না। পক্ষান্তরে যেসব পন্থা ও ব্যবস্থা সমাজে কোন একচেটিয়া কর্তৃত্ব কিংবা ভোগাধিকার স্থাপন করে ইসলামী অর্থনীতি তাহা কিছুতেই বরদাশ্ত করিতে পারে না। এক কথায়, ইসরামী আদর্শভিত্তিক সমাজে জীবিকার্জনেরপূর্ণ স্বাধীনতা এবং সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের ব্যাপারে নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে পূর্ণ সাম্য ও সমতা রক্ষিত হইতে হইবে।
মূলধন
প্রাকৃতিক উপাদানের সহিত মানুষের শ্রমের যোগ ইলে সম্পদ উৎপাদন সম্ভব হইতে পারে। পরিশ্রমলব্ধ ও উপার্জিত এই সম্পদকে আরও অধিক লাভের উদ্দেশ্যে অর্থকরী কাজে নিয়োজিত করিলে তখন উহাকে বলা হয় মূলধন (Capital)।
বস্তুত মূলধনও অর্থোৎপাদনে একটি উপায় (Factor)। মূলধন ব্যতীত মানুষের শুধু শ্রম কখনই কোন মূলোৎপাদন করিতে পারে না। শ্রমের সঙ্গে মূলধনের মিলন হইলেই মানবসমাজে প্রচুর অর্থোৎপাদনের দ্বার উন্মুক্ত হইয়া পড়ে।
এই জন্যই ইসলাম সঞ্চিত অর্থ সম্পদকে অব্যবহৃত ও বাক্স-বন্দী করিয়া রাখিতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করিয়াছে। ব্যষ্টি বা সমষ্টির নিকট কোন মূলধন সঞ্চিত হইলে উহা আরও অধিক অর্থোৎপাদনের কোন সুসংবদ্ধ কাজে নিয়োগ করার জন্য কুরআন মজীদে তীব্র ভাষায় নির্দেশদেওয়া হইয়াছে। আল্লাত তা’আলা বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
যাহারা স্বর্ণ ও রৌপ্য (মূলধন) সঞ্চিত করিয়া রাখে, মানুষের কল্যঅণকর কাজে উহা খরচ করে না, তাহাদিগকে কঠিন শাস্তির সংবাদ দাও।
ধনসম্পদ সঞ্চিত করিয়া রাখা এবং তাহা অধিক জনকল্যাণকর কাজে নিয়োগ নাকরা ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। ফী সাবিলিল্লাহ-আল্লাহর পথে খরচ করার অর্থ কেবল গরীব-দুঃখীদের মধ্যে মুক্ত হস্তে ধন-সম্পদ বন্টন বা দান করা নয়; জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির যে কোন কাজে, বেকার জনশক্তিকে কর্মে নিয়োগের যে কোন পন্থায় মূলধন বিনিয়োগ করাও আল্লাহর পথে খরচ করারই অন্তর্ভুক্ত। কারণ এই ধরনের কাজে একদিকে যেমন জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পায়, অপরদিকে সমাজের অসংক্য বেকার ও জীবিকাহীন মানুষের জন্য জীবিকার সংস্থান করা সম্ভব হয়। বস্তুত ইহা অপেক্ষা ‘আল্লাহর পথের কাজ’ বড় আর কিছুই হইতে পারে না। এই জন্যই ইসলামী সমাজে অর্থগৃন্ধু-অর্থসঞ্চয়কারীকে তীব্র ভাষায় তিরষ্কার করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
অপরকে দোষারোপ করা এবং পরকে হীন প্রতিপন্ন করার জন্য অপমান সুচক কথা বলা যাহাদের অভ্যাস, তাহাদের প্রত্যেকের জন্য বড়ই দুঃখজনক পরিণাম। তাহারা কেবল টাকা-পয়সা জমা করে এবং (উহা কি রকম বৃদ্ধি পাইতেছে তাহা বার বার গণিয়া দেখে। উহারা ধারণা করে যে,তাহাদের ধনসম্পত্তিই তাহাদিগকে চিরঞ্জীব করিয়া রাখিবে।
ইসলামী সমাজের অর্থসম্পদ কোন ক্রমেই এক হস্তে বা একটি গোষ্ঠীর মুষ্ঠিতে পুঞ্জীভূত হইতে ও অব্যবস্থায় পড়িয়া থাকিতে পারে না। এমনকি, কোন ইয়াতীম শিশুরও কোন নগত অর্থ থাকি তাহাও যে কোন লাভজনক কাজে নিয়োগ করিতে হইবে। নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন:
(আরবী**********)
সাবধান, তোমাদের কেহ ইয়াতীমের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত হইলে এবং তাহাদের নগদ টাকা থাকিলে তাহা অবশ্যেই ব্যবসায়ে নিযুক্ত করিবে। তাহা অকাজে ফেলিয়া রাখিবে না। অন্যথায় বাৎসরিক যাকাত ও সাকাই উহার মূলধন নিঃশেষ করিয়া ফেলিবে।
কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হইয়াছে:
(আরবী**********)
ইসলামী সমাজে ধনসম্পদ যেন কেবল ধনীদের মধ্যেই কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভূত হইয়া থাকিতে না পারে।
খুলাফায়ে রাশেদুনের যুগে ইয়াতীমদের অর্থসম্পদও অধিক ধন-উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করা হইত। হযরত উমর ফারূক (রা) মূলধন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করিয়াছিলেন। এমন কি সরকারী বৃত্তিধারী লোকদেরকেও তিনি উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করিতে বলিয়াছেন। কারণ, তাহা হইলে তাহাদেরই সম্পদ বৃদ্ধি পাইবে, তাহাদিগকে অধিককাল পর্যন্ত সরকারের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হইবে না এবং তাহাদের অন্তর্ধানের পর তাহাদের সন্তান-সন্ততি সহায়-সম্বলহীন হইয়া পরের দ্বারস্থ হইতে বাধ্য হইবে না।
একজন সাহাবীর নিকট কোন শ্রমিক মজুরীবাবদ প্রাপ্য কিছু পরিমাণ অর্থ রাখিয়া চলিয়া গিয়াছিল। বহুদিন পর্যন্ত তাহার কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায় নাই। কিন্তু এই অবসরে তাহার টাকা আত্মসাৎ করিতে চেষ্টা না করিয়া উক্ত সাহাবী অধিক অর্থোৎপাদনের কাজে উহা বিনিয়োগ করিয়াছিলেন। ফলে তাহাতে প্রচুর মুনাফা অর্জিত হয়। কিছুকাল পর সেই মজুর ফিরিয়া আসিলে শুধুতাহার মজুরী বাবদ প্রাপ্য টাকাই তাহাকে প্রত্যার্পণ করা হইল না, সে সঙ্গে তদলব্ধ মুনাফঅও তাহাকেদেওয়া হইয়াছিল। ইসলামী সমাজে টাকা-পয়সা বিনা কাজে সঞ্চয় করিয়া রাখা- তাহা যে-কোন টাকাই হউক না কেন- নীতিগত ভাবেই অন্যায়। এই জন্যই উল্লিখিত সাহাবীও মজুরের প্রাপ্য অর্থকে বেকার ফেলিয়া না রাখিয়া লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করিয়াছিলেন। বস্তুত ব্যক্তিগতপর্যায়ে কাহারও মূলধন বৃদ্ধি পাইলেইসলামী সমাজে পুঁজিবাদ মাথা চাড়া দিয়া উঠে না। ইসলামে পুঁজির ব্যবহার পদ্ধতি সুষ্ঠু ও সুসংবদ্ধভাবে নির্দিষ্টহইয়া আছে এবং উহার এমন সব বাধ্যবাধকতা ও বিধি-নিষেধ আরোপ করিয়া উহাকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হইয়াছে যে, তদনুযায়ী পুঁজি বিনিয়োগ হইলেতাহা দ্বারা জাতীয় সম্পদই বৃদ্ধি পায় এবং তাহা সমাজের বিপুল জনগণের মধ্যেই তাহা দ্বারা জাতীয় সম্পদই বৃদ্ধি পায় এবং তাহা সমাজের বিপুল জনগণের মধ্যেই অব্যাহত ধারায় আবর্তিত হইয়া মানব সাধারণের অপূর্ব কল্যাণ সাধন করিতে পারে। এইজন্র নবী করীম (স) ব্যক্তি এবং সমষ্টি- উভয়কেই পুঁজি তথা মূলধন বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট থাকিতে বিশেষ উৎসাহ দান করিয়াছেন। বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
তোমাদের উত্তরাধিকারীদের নিঃস্ব, পরমুখাপেক্ষী ও অপর লোকদের উপর নির্ভরশীল করিয়া রাখিয়া যাওয়া অপেক্ষা তাহাদিগকে সচ্ছল, ধনী ও সম্পদশালী করিয়া রাখিয়া যাওয়া তোমাদের পক্ষে অনেক ভাল।