বায়তুলমাল
‘বায়তুলমাল’ শব্দটি সাধারণত: ‘রাষ্ট্রীয় কোষাগার’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ‘বায়তুলমাল’ বলিতে সরকারের অর্থ-বিভাগীয় কর্মকেন্দ্রকে বুঝায় না, পুঞ্জিকৃত ধন-সম্পদকেই বলা হয় ‘বায়তুলমাল’। ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকেরই ইহা সম্মিলিত মালিকানা সম্পদ। এই জন্য বলা হইয়াছে: (আরবী***********)
বায়তুলমালের সম্পদ মুসলমানদের (ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের) সম্মিলিত সম্পদ।
বায়তুলমালে সঞ্চিত রাষ্ট্রীয় সম্পদে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকেরই সমান অধিকার স্বীকৃত। কি রাষ্ট্র-প্রধান, কি সরকারী কর্মচারী বা সাধারণ মানুষ, উহার উপর কাহারই একচেটিয়া বিশষ অধিকার স্বীকৃত হইতে পারে না। এই কথাই ঘোষিত হইয়াছে নবী করীম (স)-এর এই বাণীতে-
(আরবী***********)
আমি তোমাদিগকে দান-ও করি না, নিষেধও করি না, আমি তো বন্টনকারী মাত্র। আমাকে যেরূপ আদেশ করা হইয়াছে, আমি সেইভাবেই জাতীয় সম্পদ বন্টন করিয়া থাকি।
বায়তুলমালের সূচনা
অতএব এ কথা বলা যাইতে পারে যে, মদীনা নগরে প্রথম যেদিন ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল, মূলত সেই দিন হইতেই বায়তুলমালের সূচনা হইয়াছিল। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে বায়তুলমালে কোনরূপ ধন-সম্পদ সঞ্চয় করিয়া রাখা হইত না, তাহার অবকাশও তখন ছিল না। কারণ তখন সাধারণ নাগরিক ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় আয়ের অবস্থা অত্যন্ত নগন্য ছিল বলিয়াই ধন-সম্পদ হস্তগত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবী করীম (স) অভাবী লোকদের মধ্যে তাহা বন্টন করিয়া দিতেন।
হযরত আবূবকর (রা)-এর খিলাফতকালেই সর্ব প্রথম বায়তুলমাল বাস্তব রূপ লাভ করে এবং হযরত আবূ উবাইদাহ (রা)-কে উহার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তখনো জাতীয প্রয়োজনের তীব্রতা হেতু আমদানীকৃত সম্পদ অবিলম্ব বন্টন করিয়া দেওয়া হইত। এই জন্য বায়তুলমালের দ্বারা প্রায় সব সময়ই তালাবদ্ধ হইয়া থাকিত। হযরত আবূ বকর(রা)-এর পর দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক (রা) দায়িত্ব গ্রহণের পর বায়তুলমালকে একেবারে শুন্যে দেখিতে পাইয়াছিলেন।
দ্বিতীয় খলিফার সময়েই ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালের প্রচুর আমদানী হইতে থাকে। ফলে প্রদেশসমূহেও বায়তুরমাল স্থাপিত হয়।
হযরত উমর ফারূক (রা) ও এই কথাই বলিয়াছিলেন তাঁহার এই বিপ্লবী ঘোষণায়:
(আরবী***********)
আল্লাহর নামে শপথ, এই রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর কেহ অপর কাহরো অপেক্ষা অধিক অধিকার লাভের দাবি করিতে পারে না। আমি নিজেও অপর কাহারো অপেক্ষা অধিক অধিকারেরদাবি নহি। আল্লাহর শপথ, প্রত্যেক মুসলিমেরই জন্য এই সম্পদে নির্দিষ্ট অংশ রহিয়াছে। আরআমি যদি বাঁচিয়া থাকি, তাহা হইলে ছান্য়া পর্বতের রাখাল নিজ স্থানে পশু চরাইবার কাজে ব্যস্ত থাকিয়াও এই মাল হইতে তাহার নিজের ন্যায্য অংশ লাভ করিত পারিবে।’
বস্তুত হযরত উমর (রা) প্রথমে উদ্ধৃত নবী করীমের বাণীটুকুর ভিত্তিতেই এই কথা বলিয়াছিলেন এবং তাঁহার ন্যায় চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রা)ও উহা হইতে এই অর্থই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তাই তিনিও বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
জানিয়া রাখ, তোমাদের যাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ধনমালের চাবি আমার নিকট রক্ষিত। সেই সঙ্গে ইহাও জানিয়অ রাখিও যে, উহা হইতে তোমাদিগকে বাদ দিয়া বা বঞ্চিত করিয়া একটি পয়সাও গ্রহণ করা আমার কোন অধিকার নাই।
বস্তুত ইসলামে যাবতীয় ধনমালের প্রকৃত মালিক যে আল্লাহ এবং উহাতে যে সব মানুষেরই সমান অধিকর রহিয়াছে, তাহা এই সব সুস্পষ্ট বিপ্লবী ঘোষণা হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। উপরন্তু ইহা যে কেবল মৌখিক ঘোষণাই ছিল না, ইহাই ছিল খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলের অর্থনৈতিক নীতি, তাহাতেও কোন সন্দেহ নাই।
বায়তুলমাল হইতে জনগণের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান
বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালে সঞ্চিত ধন-সম্পদের উপর সর্ব-সাধরণের সাধারণ অধিকার স্বীকৃত। রাষ্ট্রের সীমার মধ্যেকোন একজন নাগরিকও যাহাতে মৌলিক প্রয়োজন হইতে বঞ্চিত থাকিতে বাধ্য না হয়, তাহার ব্যবস্থা করা বায়তুলমালের প্রথমও প্রধান দায়িত্ব। তাহার অর্থ এই নয় যে, বায়তুলমাল লোকদেরকে বেকার বসাইয়া খাওয়াইতে থাকিবে। বরং লোকেরা সাধ্যানুযায়ী শ্রম করিবে, উপার্জন করিবে, সমাজের সচ্ছল অবস্থার লোকেরা তাহাদের দরিদ্র নিকটাত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশীর প্রয়োজন পূরণ করিবে; তাহার পরও যদি কেহ তাহর মৌলিক প্রয়োজন পূরণে অসমর্থ থাকিয়া যায়, তাহা হইলে তাহা পরিপূরণের দায়িত্ব হইবে বায়তুলমালের। ইসলামী অর্থনীতিতে ইহাই হইল নাগরিকদের জন্য অর্থণৈতিক নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা।
ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের এই অপূরনিত মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রনায়কের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। যে রাষ্ট্রনায়ক এই কাজ করে না, মনে করিতে হইবে, সে এই দায়িত্ব পালন করিতেছে না। এ পর্য়ায়ে নবী করীম (স)-এর দুইটি উক্তি উদ্ধৃত করা যাইতেছে। তিনি বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা মুসলমানের দায়িত্বপূর্ণ কাজসমূহ আঞ্জাম দেওয়ার কর্তৃত্ব দিবেন, সে যদি জনগণের প্রয়োজন পূরণ ও অভাব মোচনের দায়িত্ব পালন হইতে বিরত থাকে, তাহা হইলে আল্লাহ তা’আলাও সেই ব্যক্তির প্রয়োজন ও অভাব মোচন হইতে বিরত থাকিবেন।
নবী করীম(স) অন্যত্র বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
যে রাষ্ট্রনায়ক অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্য নিজেদের দুয়ার বন্ধ করিয়া রাখে- অভাব পূরণ করে না, আল্লাহও তাহার জন্য আসমানের (রহমতের) দুয়ার বন্ধ করিয়া দেন।’
এই হাদীস দুইটি হইতে এ কথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হইতেছে যে, জন গণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ ও অভাব দূর করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন না করা হইলে আল্লাহর তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া অবধারিত। এই কারণে খুলাফায়ে রাশেদুনের পরে হযরত আমীর মুয়াবীয়র শাসনামলে এই কাজের প্রতি যখন উপেক্ষা প্রদর্শন করা হইতেছিল, তখন তাঁহাকে রাসূলে করীম(স)-এর এই কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া হইলে তিন অনতিবিলম্বে এ কাজের দায়িত্ব পালনের জন্য একজন লোক নিযুক্ত করিলেন।
ইসলামী রাষ্ট্রের মূল কাঠামোই যে জনকল্যাণমূলক, তাহা খিলাফতের সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। হযরত সালমান ফারেসী (রা) বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
খলীফা- ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক- সে, যে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করে এবং জনগণের সেই কল্যাণ-কামনার অন্তর্ভুক্ত, যাহা ইসলামেরমদিক দিযা রাষ্ট্রনায়কে প্রধান দায়িত্বরূপে ঘোষিত হইয়াছে। যে রাষ্ট্রনায়ক এই দায়িত্ব পালন করিবে না, তাহার পরিণাম অত্যন্ত মর্মান্তিক হইবে। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
য লোককে আল্লাহ তা’আলা জনগণের শাসন-পরিচালক বানাইয়া দিবেন, সে যদি তাহাদের পুরামাত্রায় কল্যাণ সাধন না করে, তবে সে জান্নাতের সুগন্ধিও লাভ করিতে পারিবে না।
বায়তুলমাল ও খলীফাতুল মুসলিমীন
বায়তুলমাল যদিও ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানেরই নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে এবং তাহারই নির্দেশক্রমে পরিচালিত হয়; কিন্তু তবু ব্যক্তিগতভাবে তাহার নিজস্ব কোন কর্তৃত্বইউহার উপর স্বীকৃত বা কার্যকর হইতে পারে না। কারণ:
(আরবী***********)
ধন-সম্পদ মুসলিম জনগণ ও নাগরিকদের জন্য খলীফার নিকট আমানত স্বরূপ।[তাককাতে ইবনেসায়াদ, তৃতীয় খণ্ড।]
জাতীয় কোষাগারের উপর একজন বাদশাহ বা একজন ডিক্টেটরের যে স্বেচ্ছাকারমূলক কর্তৃত্ব স্থাপিত থাকে এবং তাহরা যেভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগ ব্যবহার করে, ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালের উপর খলীফঅতুল মুসলেমীনের অনুরূপ কর্তৃত্ব স্থাপিত হইতে পারে না। তদ্রুপ যথেচ্ছ ভোগ-ব্যবহার করার অধিকারও তাহার নাই। রাজতন্ত্র ও ডিক্টেটরবাদ এবং ইসলামের মধ্যে এখানে মূলগত ও নীতিগত পার্থক্য সুস্পষ্ট।
হযরত উমর ফারূক ক(রা) একদা প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত সালমান ফারেসী (রা)-কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘আমি বাদশা, না খলীফা?”
উত্তরে সালমান (রা) বলিয়াছিলেন, “ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল হইতে একটি মুদ্রা বা তদপেক্ষাও কম পরিমাণ অর্থ আপনি যদি অপব্যয় বা অপচয় করেন, তবে আপনি বাদশাহ; অন্যথায় আপনি খলীফা।” কথাটির গভীর তাৎপর্য অনুধাবনীয়।
বায়তুলমাল হইতে বিনাসুদে ঋণ দান
ইসলামী অর্থনীতি একদিকে সুদ-সুদী কারবার ও সকল প্রকার সুদ-ভিত্তিক লেনদেন চিরতরে হারাম করিয়া দিয়াছে, অপরদিকে নাগরিকদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিনসুদে ঋুণ দানেরও চূড়ান্ত ও স্থায়ী ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
বিনানুতে ঋণ দেওয়ার কাজ প্রথমদিকে ব্যক্তিগতভাবেই সম্পন্ন হইত। সাহাবাগণ এমনকি স্বয়ং নবী করীম (স)-ও লোকদের নিকট হইতে প্রয়োজন অনুপাতে ঋণ গ্রহণ করিয়াছে। কুরআর মজীদে এজন্য বিশেষ উৎসাহ প্রদানের উদ্দেশ্যে বলা হইয়াছে:
(আরবী***********)
যে ব্যক্তি আল্লাহকে সদভাবে ঋণ দিবে আল্লাহ তাহাকে উহার কয়েকগুণ বেশী প্রত্যার্পণ করিবেন।
বলাবাহুল্য, আল্লাহকে সদ্ভাবে ঋণ দেওয়ার অর্থ অভাবগ্রস্ত ও দারিদ্র্য-পীড়িত লোকদিগেকে বিনাসুদে ঋণ দান করা। অতিএব ইসলমী রাষ্ট্রের সরকারী বাজেটে বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার একটি খাত অবশ্যই থাকিবে। হযরত উমর (রা)-এর সময় বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার কাজ ব্যাপকভাবে সস্পন্ন হইয়াছিল। সরকারী কর্মচারীগণ নিজেদের চাকুরীর জানামতে বায়তুলমাল হইতে ঋণ গ্রহণ করিতে পারিত। বস্তুত ঋণদান সমিতির ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালই সর্ব প্রথম প্রতিষ্ঠান।
ঋণ গ্রহণ লোকদের পক্ষে একটি অপরিহার্য ব্যাপার। বর্তমান সময়ও লোকেরা নিজ নিজ প্রয়োজনে সুদের বিনিময়ে ঋণ গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান-অনেক ব্যাংকও খোলা হইয়াছে সুদের বিনিময়ে ঋণ দানের ব্যবসায় চালাইবার উদ্দেশ্রে। কিন্তু এই সুদ মানুষকে শোষণ করিয়া সর্বস্বান্ত করিয়া দেয়। ইহার ফলে মানুষের মন লোভাতুর পংকিল ও স্বার্থান্ধ হইয়া পড়ে। ইসলাম এই সুদকে চিরতরে হারাম করিয়া দিয়াছে। অতএব দেশবাসীকে প্রয়োজন অনুযায়ী বায়তুলমাল হইতে বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা ইসলামী বায়তুলমালের এক বিরাট অর্থনৈতিক কর্তব্য।
উৎপাদনী ঋণ
জনগণকে নিজ নিজ প্রয়োজন পূর্ণ করিবার জন্য যেমন বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে, অনুরূপভাবে উৎপাদনী কার্যে বিনিয়োগের জন্যও ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল হইতে ঋণ দেওয়ার ব্যাবস্থা অপরিহার্য। এই ব্যাপারে স্ত্রী-পুরুষ বা মুসলিম-অমুসলিমের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য বা কাহারো প্রতি বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করা যাইতে পারে না। হিন্দ বা বিন্তে উৎবা হযরত উমর (রা)-এর নিকট হইতে ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য চার হাজার মুদ্রা জামিনে গ্রহণ করিয়াছিলেন। বসরায় শাসন কর্তা আবূ মূসা আশায়ারী (রা) আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও উবাইদাহ ইবনে উমরকে ব্যবসায় করার জন্য প্রচুর অর্থ ঋণ বাবদ দিয়াছিলেন। কৃষক দিগকে ও কৃষিকার্যের উন্নতি বিধান, বীজ সংগ্রহ ও কৃষি সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ যোগাইবার জন্য বিনাসুদে ঋণ দেওয়া ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালের কর্তব্য।