অর্থনৈতিক অসাম্য
বর্তমান দুনিয়অর সকল দেশ ও সকল সমাজে অর্থনৈতিক অসাম্য বিরাজিত। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যেমন এই অসাম্য প্রচন্ড রূপ ধারণ করিয়াছে, অনুরূ অসাম্য রহিয়াছে সাম্যবাদী- তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজেও। মানুষের কোন সমাজই ইহা হইতে মুক্ত নয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ সাম্যবাদের মুখরোচক ও চিত্তহারী শ্লোগান তুলিয়া দুনিয়ার একশ্রেণীর শোষিত, ও বুভুক্ষ মানুষকে আলোড়িত ও উত্তেজিত করিয়া তুলিয়াছে। তাহারা অর্থনৈতিক অসাম্যকে অমানুষিক এবং সাম্যকে মানবিক ও স্বাভাবিক ব্যবস্থা বলিয়া প্রমাণ করিতে সচেষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, অর্থতিক অসাম্য কি সত্যই অস্বাভাবিক এবং অর্থনৈতিক সাম্যই কি পরম স্বাভাবিক?
বস্তুত দুনিয়ার শুরু হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানব-সমাজে যে অর্থনৈতিক অসাম্য বিরাজিত, প্রকৃত পক্ষে তাহাই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সহিত পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। মানুষের পরস্পরের রিযিকের দিক দিয়া এই পার্থক্য আল্লাহ তা’আলারই সৃষ্টি। তিনিই তাঁহার নিজস্ব বিশ্ব-পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে এক শ্রেণীর মানুষকে অন্যান্য বিভিন্ন দিক দিয়া কয়েকগুণ বেশী শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য দান করিয়া থাকেন। ইহা এক বাস্তব সত্য। বিশ্ব-প্রকৃতির যে দিকেই দৃষ্টিপাত করা যাইবে, সেদিকেই এই পার্থক্য প্রকট রূপে লক্ষ্য করা যাইবে। এবং একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিবেচনা করিলে ইহার যথার্থতা ও গভীর তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব হইবে।
বর্তমানে যদিও অর্থনৈতিক সাম্যবাদের আওয়াজে আকাশ-বাতাশ মুখরিত, এই এহেন স্বাভাবিক নীতির কথা বলাও যেন অনেকের পক্ষেই এক কঠিন লজ্জাষ্কর ব্যাপার। কিন্তু এই অসাম্যকে যতই অস্বীকার করা হউক না কেন, ইহাই যে সত্য ও স্বাভাবিক তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই।
দুনিয়ার ইতিহাস, ভুয়োদর্শন, বিবেক-বুদ্ধি ও বাস্তব পর্যবেক্ষণ- সব-কিছুই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে মানুষের মধ্যে যে অর্থনৈতিক অসমতা হইয়া থাকে তাহা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। এই অসাম্য আল্লাহর বিশ্ব ব্যবস্থার ভিত্তিতেই সৃষ্টি হইয়া থাকে। এই কারণে ইতিহাসের কোন পর্যায়েই আল্লাহর আদর্শবাদী বান্দহরা উহাকে আপত্তিকর বলিয়া মনে করেন নাই। উহাকে জোর পূর্বক খতম করিয়া কৃত্রিমভাবে পূর্ণ সমতা সৃষ্টির জন্য যত চেষ্টাই করা হউক না কেন, তাহা কখনও সফরকাম হইতে পারে না। বরং এই ধরনের সকল চেষ্টাই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইয়া যাইতে বাধ্য। তাই কোন সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির মানুষই স্বাভাবিক অসাম্য দূর করিয়া পরিপূর্ণ সাম্য সৃস্টির জন্য চেষ্টিত হইতে পারে না। সেই সঙ্গে স্বাভাবিক সাম্যকে অস্বাভাবিক উপায়ে খতম করিয়া কৃত্রিমভাবে অসাম্য সৃষ্টি করাও কখনই বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না। এক কথায় স্বাভাবিক সাম্য কৃত্রিম উপায়ে অসাশ্যে পরিণত করা এবং স্বাভাবিক অসাম্যকে কৃত্রিম উপায়ে ও জোর জবরদস্তির দ্বারা সাম্যে পরিণত করা মানব সভ্যতার পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক। এই অকাট্য প্রমাণ ছাড়াও এই পর্যায়ে অপর এক অনস্বীকার্য দলীল হইতেছে দুনিয়ার একমাত্র সত্য-গ্রন্থ কুরআনমজীদ। কুরআনেরকতিপয় আয়াতে ইঙ্গিতে ও স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছে যে, মানুষের পরস্পরের মধ্যে রিযকের দিক দিয়া যে পার্থক্য হইয়া থাকে, তাহা আল্লাহরই সৃষ্টি। এখানে কয়েকটি আয়াতে উদ্ধৃত করা যাইতেছে।
সূরা আন-আমের আয়াতে বলা হইয়াছে:
(আরবী************)
সেই মহান আল্লাহ, যিনি তোমাদিগকে পৃথিবীতে খলীফা বানাইয়াছেন এবং তোমাদের পরস্পরকে পরস্পরের তুলনায় উচ্চ মর্যাদায় তুলিয়াদিয়াছেন যেন তিনি তোমাদিগকে যাহা কিছু দিয়াছেন তাহাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করিতে পারেন।
এই আয়অতে প্রথমতঃ বলা হইয়াছে, মানুষ এই দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তাঁহার খলীফা দ্বিতীয়তঃ বলা হইয়াছে, আল্লাহর এই প্রতিনিধিদের মধ্যে মর্যাদার দিক দিয়া পার্থক্র ও অসাম্য রহিয়াছে। মানুষের পরস্পরে বহুবিধ বিষয়ে পার্থক্য থাকা সম্পর্কে এই আয়াত অকাট্য, স্পষ্টভাষী। বিবেক-বুদ্ধি-প্রতিভা, রাজনৈতিক জ্ঞান –বিবেচনা, দূলদৃষ্টি প্রভৃতির দিক দিয়া মানুষের পরস্পরে অনেক পার্থক্র বিদ্যমান। কর্মক্ষমতা, যোগ্যতা ও কর্ম-কুশলতার দিক দিয়াও তাহাদের মধ্যে জন্মগতভাবেই পার্থক্য সুস্পষ্ট। আর এই কারণেই মানুষের উপার্জন পরিমাণে ও উপার্জিত সম্পদ সংরক্ষণেও পার্থক্য হওয়া অতি স্বাভাবিক। এই পার্থক্য আল্লাতহর সৃষ্টি-নীতিরই পরিণাম। অর্থনৈতিক দিক দিয়া মানুষের মধ্যে পার্থক্য হওয়ার কারণও ইহাতে বিধৃত রহিয়াছে। বস্তুতঃ বুদ্ধি, বিবেচনা, কর্মকুশলতার দিক দিয়া পার্থক্য হওয়াই অর্থনৈতিক পার্থক্যের ভিত্তি।
তৃতীয়তঃ বলা হইয়াছে,মানুষকে যাহাকিছু দেওয়া হইয়াছে তাহা সবই দেওয়া হইয়াছে শুধু পরীক্ষার উদ্দেশ্র।
সূরা নহল-এ বলা হইয়াছে: (আরবী************)
আল্লাহ তোমাদের পরস্পরকে পরস্পরের তুলনায় রিযিকের দিক দিয়া প্রাধান্য ও আধিক্য দান করিয়াছেন।
পূর্বোক্ত সূরায় মানুষের পরস্পরের সমষ্টিগত অসাম্যের মাঝে অর্থনৈতিক অসমতার দিকেও ইঙ্গিত করা হইয়াছে। কিন্তু সূরা নাহলে এ আয়াতটিতে এক কথাটিকে স্বতন্ত্রভাবে স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে। ইহা হইতে নিঃসন্দেহে জানা গেল যে, জীবন-জীবিকায় মানুষের পরস্পরে যে পার্থক্য হয়, তাহা মূলগতভাবেই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর বিশ্ব-পরিকল্পনারই একটি অপরিহার্য অংশ।
সূরা জুখরুফে বলা হইয়াছে:
(আরবী************)
দুনিয়ার জীবনে আমরা তাহাদের মধ্য জীবিকার উপায়-উপকরণ বন্টন করিয়া দিয়াছি। এই বন্টনে আমরা তাহাদের পরস্পরের উপর কয়েকটি মাত্রায় প্রধান্য ও আধিক্য দান করিয়াছি, যেন তাহাদের কেহ অপর লোকদের দ্বারা কাজ করাইতে পারে।
জীবন-জীবিকা, রুজি-রোজগার ও জীবন যাপনের উপায়-উপকরণের দিক দিয়া মানুষের পরস্পরে যে পার্থক্য রহিয়াছে, এই বিষয়ে এই আয়াতটি অধিকতর সোচ্চার। এই পার্থক্য স্বয়ং আল্লাহরই সৃস্টি, মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। এই আয়াতের শেষ বাক্যাংশে মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে খাটাইবার কাহারো অধিকার নাই বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে। বরং মানুষ মাজ সম্পর্কে আল্লাহর পরিকল্পনার দিকে ইহাতে ইঙ্গিত করা হইয়াছে এবদ্দ অর্থনৈতিক দিক দিয়া যে পার্থক্য রহিয়অছে উহার মুল কারণ বুঝাইতে চাওয়া হইয়াছে। বস্তুত হাতের পাঁচটি আংগুলের আকার আকৃতি ও স্থাপনে যে জন্মগত পার্থক্য তাহা হাতের কার্য সম্পাদনে অত্যন্ত জরুরী। সেই আংগুলিগুলি কাটিয়া সমান-আকা করিয়া দিলে আংগুলির উদ্দেশ্যই ব্যাহত হইবে। অনুরূপভাবে দুই খর্হৃ দুই চোখের আকার ও আকৃতির যে সমতা তাহা নষ্ট করিয়া দিলে কান ও চোখের শোনা ও দেখার কাজই করিতে ব্যর্থ হইবে।
‘পরস্পরের দ্বারা কাজ করাইবে’ এ কথার অর্থ সামাজিক জীবনে মানুষ হইবে মানুষের প্রতি মুখাপেক্ষী, পরস্পর নির্ভরশীল- পারিবারিক রাজনৈতিক দিক দিয়াও যেমন, অর্থণৈতিক দিক দিয়াও তেমনি। এবং ইহার কারণে তাহাদের মধ্যে পারস্পরিক নিবিড় সমঝোতা, সম্পর্ক এবং ব্যাপক সহযোগিতা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গড়িয়া উঠিবে। আর ইহার ফলেই দুনিয়ায় রচিত হইবে মানুষের সমাজ, সভ্যতা, বৈষয়িক উন্নতি ও উৎকর্ষতা। মানুষ মানুষের সহিত গভীর ও নিবিড়ভাবে মিলিত হইয়া দুনিয়ার জীবনকে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, তৃপ্তি ও স্বার্থকতায় ভরিয়া তুলিবে, মানুষ হইবে মানুষের সহযোগী।
অর্থনৈতিক অসাম্য কেন?
মানব সমাজে অতি স্বাভাবিকভাবে যে অর্থনৈতিক অসাম্য বিরাজিত থাকে উহার যৌক্তিকতা স্বীকার করিতে অনেকেই কুণ্ঠিত ও দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া থাকে। আল্লাহর বিশ্ব-পরিকল্পনা ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ সম্যকরূপে বুঝিতে অক্ষম হওয়াই ইহার মুলীভূত কারণ। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা সম্যকরূপে বুঝিতে অক্ষম হওয়াই ইহা মূলীভূত কারণ। ইসরামের জীবন-ব্যবস্থা বিশ্ব-ব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি। বিশ্ব-প্রকৃতিতে সৃষ্টি-কূলের মাঝে যোগ্যতা ক্ষমতা আকার-আকৃতি ও শক্তি ক্ষমতার দিক দিযা যেমন পার্থক্য রহিয়াছে, তেমনি রহিয়াছে পারস্পরিক নিবিড় ও গভীর সহযোগিতা। এই পার্থক্য অসাম্য ও পারস্পরিক সহযোগিতাই ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা তথা ইসলামী অর্থনীতির মৌল ভাবধারা।
বস্তুত জীবন সম্পর্কে ইসলমের দৃষ্টিকোণ বুঝিতে পারিলেই মানবসাধারণের অর্থনৈতিক অসাম্যের তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব। এই নীতিতে চিন্তা করা হইলে অর্থনৈতিক দিক দিয়া পারস্পরিক পার্থক্য ও অসাম্যের স্বাভাবিকতা ও অনিবার্যতা অনস্বীকার্য হইবে। বাহ্যত এই পার্থক্য যতই অমানবিক ও অবাঞ্জনীয় মনে করা হউক না কেন, ইহাই বিবেকসম্মত বলিয়া বিবেচিত হইবে।
জীবন সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিকোণ হইল: মহান স্রষ্টা এই ভূবনে মানুষকে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনিই মানুষকে জীবন দান করিয়াছেন। সর্বোত্তম সক্ষম সুঠাম দৈহিক সংগঠন দিয়াছেন। উচ্চমানের বিবেক-বুদ্ধি ও প্রতিবা-মনীষা দানে তিনি মানুষকে ভূষিত করিয়াছেন, ভাল ও মন্দ গুণের অধিকারী করিয়াছেন তাহাকে। বেশুমার উপাদান উপকরণ ও উপায় পন্থা মানুষের আয়ত্তাধীন করিয়া দিয়াছেন। তাই যথেচ্ছা ব্যবহার ভোগ ও প্রয়োগের ক্ষমতা দান করিয়াছেন। এই সবকিছু দান করার পর আল্লাহ তাঁহার নবী-পয়গম্বর ও কিতাবের মাধ্যমে জানাইয়া দিয়াছেন যে, পরীক্ষাই হইল মানব-সৃষ্টির মৌল উদ্দেশ্য; মানুষ জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ অবস্থা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়া কি ধরনের আচরণ করে, আল্লাহ তা’আলা তাহাই দেখিতে চাহেন।
ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, বাদান্যতা, সহানুভূতি, দয়াশীলতা, ত্যাগ-তীতিক্ষা, উদারতা, কল্যাণ কামনা এবং অন্যা যাবতীয় মঙ্গলকর কাজে-কর্মে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা চিরকালই মানুষের উত্তম গুণ-বৈশিষ্ট্য রূপে স্বীকৃত। আল্লাহ এই গুণাবলীকে পছন্দ করেন এবং উহাতে ভূষিত হইবার জন্য তিনি মানুষকে নির্দেশও দিয়াছেন। পক্ষান্তরে ধৈর্যহীনতা, না-শুকরি, কার্পণ্য, নির্দয়তা, স্বার্থপরতা, অনুদারতা, লোব ও প্রতিহিংসা এবং জনকল্যাণমূরক কাজে অনিচ্ছা ও অসহযোগিতা চিরকালই মানবতা বিরোধী ও নিকৃষ্ট চরিত্র বলিয়া বিবেচিত। আল্লাহ তা’আলা উহাকে অপছন্দ করিয়াছেন এবং মানুষকে ইহা পরিহার করিয়া চলিতে উপদেশ দিয়াছেন।
অতএব প্রথমোক্ত গুণাবলীতে মানব সমাজকে গড়িয়া তোলাই মানুষের কর্তব্য। আর অর্থনৈতিক অসমতাপূর্ণ সমাজেই এইসব মহত গুণের পূর্ণ ও স্বাভাবিক প্রকাশ সম্ভব।
একটু গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করিলেই লক্ষ্য করা যাইবে, এই দুনিয়ায় মানুষকে যাহা কিছু দেওয়া হইয়াছে তাহা মূলত বড় দুইটি ভাগে বিভক্ত। একটি হইল জীবন ও প্রাণ এবং দ্বিতীয়টি ধন-মাল ও অর্থসম্পদ। মানবতার উত্তম ও উন্নত এবং হীন নিকৃষ্ট গুণাবলীর দিক দিয়া মানুষের পরীক্ষা করার জন্য অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণে অসাম্য জরুরী না সাম্য, তাহা এই প্রেক্ষিতে চিন্তা করিলেই স্পষ্ট হইয়া উঠে। জৈবিক উপায়-উপকরণও ধন-সম্পদের দিক দিয়া জীবনের অবস্থা বিভিন্ন রকম হওয়াই সমীচীন, না পার্থক্য ও অসমতাপূর্ণ, তাহাও অনুধাবনীয়।
মানব জীবনের উদ্দেশ্য নানা প্রকারের গুণাবলীর পরীক্ষা। এই দৃষ্টিতে যাহারাই বিচার-বিবেচা করিবেন, তাহারাই অর্থনৈতিক অসমতাকে মানবতার জন্য সমীচীন অবস্থা মনে করিতে বাধ্য হইবেন। আর সমতা ও পার্থক্যহীনতাকে মনে করিবেন অসমীচীন। কেননা তাহাই যদি হয়, তাহা হইলে মানুষের মানবীয় গুণাবলীর পরীক্ষা হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। সমাজের সব মানুষই যদি সমানভাবে দরিদ্র হয় কিংবা হয় সমানভাবে সচ্ছল ও ধনশালী, তাহা হইলে যেমন মানুষের ধৈর্য সহ্যগুণের পরীক্ষা হইতে পারে না, তেমনি পাওয়া যাইতে পারে না মানুষের শোক্র ও নিষ্ঠার একবিন্দু পরিচয়। কৃত্রিম উপায়ে কোন সমাজের সব মানুষের আর্থিক অবস্থা সর্বোতভাবে সমান ও পার্থক্যহীন করিয়া দেওয়া হইলে মানুষের জীবন-উদ্দেশ্যই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইতে বাধ্য। ইহা শুধু ধরিয়া লওয়া কথা নয়। কেননা কার্যতঃ এইরূপ হওয়া মূলতই অসম্ভব। প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়া মজুরী নির্ধারণের একটি সামান্য ক্ষেত্রেও এই সমতা বিধান সম্ভপর হয় নাই- যদিও বিপ্লবের পূর্বে ইহারই শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মথিত করিয়া তোলা হইয়াছিল। [এখানে একটিমাত্র দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাইতেছে: এম. যাই. ইডন নাক জনৈক সমাজতন্ত্রিবাদী সমাজতান্ত্রিক দেশে-বিশেষ করিয়া রাশিয়া ১৯৭৩ সনে সর্বশ্রেণীর কর্মচারীর মাঝে বেতন হারে যে পার্থক্য ছিল তাহার চিত্র এইভঅবে আঁকিয়াছেন:
সাধারণ শ্রমকের মাসিক মজুরী ১১০-৩০০রুবল
মধ্যম শ্রেণীর অফিসারের মাসিক বেতন ৩০৩-১০০০ রুবল
উচ্চ শ্রেণীর অফিসারের মাসিক বেতন ১৫০০-১০,০০০ রুবল
সর্বোচ্চ পর্যায়ের মাসিক বেতন ২০,০০০-৩০,০০০ রুবল
রাশিয়ার অন্যতম নেতা মকওয়ান অকপটে স্বীকার করিয়াছেন যে, ২য় মহাযুদ্ধের পর এই পার্থক্য আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে।]
তাই কোন সমাজের পক্ষে সমস্ত মানুষের মধ্যে পূর্ণ অর্থনৈতিক সাম্য সংস্থাপন করিয়া মানুষের এই সার্বিক পরীক্ষা গ্রহণকে অচল করিয়া দেওয়ার সাধ্য কোন মানুষের নাই। এ পর্যায়ে ইহাই চূড়ান্ত কথা।
অর্থনৈতিক অসাম্য যুক্তি ও কল্যাণ দৃষ্টির উপর ভিত্তিশীল
মানুষের পরীক্ষার দৃষ্টিতে সমাজে অর্থনৈতিক অসাম্যই যে সমীচীন, পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা তাহা দেখিয়াছি। এখানে এই বিষয়টি অন্য এক দৃষ্টিতে বিবেচ্য। রিযকি বা জীবন-জীবিকা ও রুজি-রোজগার মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। তাহার জীবন ইহার উপর নির্ভরশী। এই কারণে কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে নানা দিক দিয়া কথা বলা হইয়াছে। কুরআন বলে: রুজি-রোজগারে দৈন্য, অভাব প্রাচুর্য এবং অর্থনৈতিক অসমতা মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও অকাট্য যুক্তির উপর ভিত্তিশীল। কয়েকটি আয়াতেই এই কথাটি ব্যক্ত করা হইয়াছে। এখানে এই পর্যায়ের কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করা যাইতেছে। সূরা বনী ইসরাইলে বলা হইয়া:
(আরবী************)
নিশ্চয়ই তোমার আল্লাহ যাহার জন্য ইচ্ছা রিযিক প্রশস্ত করিয়া দেন, আর যাহার জন্য চাহেন পরিমিত ও সংকুচিত করিয়া দেন, তিনি তাঁহার বান্দাহদের অবস্থা সম্পর্কে খুববেশী অবহিত ও দৃষ্টিবান।
আয়াতের শেষ অংশ ‘তিনি তাঁহার বান্দাহদের অবস্তা সম্পর্কে খুব বেশী অবহিত ও দৃষ্টিবান’ সামগ্রিক কল্যাণের দিকে ইংগিত করিতেছে। কল্যাণের এই ভিত্তিতেই তিনি লোকদের মাঝে রিযিক বন্টনে পরিমাণের কম বেশী করিয়া থাকেন। তিনি সৃষ্টিকর্তা, সৃস্টি-লোক সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান তিনি ছাড়া আর কাহারো থাকতে পারে না। কাহার জন্য রুজি-রোজগার প্রশস্ত হওয়া উচিত এবং কাহার পক্ষে অভাব ও দৈন্যই সমীচীণ তাহা তিনি ভালো করিয়াই জানেন।
সূরা আল-শুরা’য় ও এ কথাই বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর কুঞ্চিকা তাঁহারই হস্তে নিবদ্ধ, তিনি যাহাকে ইচ্ছা রিযিক প্রশস্ত করিয়া দেন এবং যাহাকে ইচ্ছা পরিমাপ করিয়া দেন। তিনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞানবান।
ইহাতে প্রথম বলা হইয়াছে যে, রিযিক বন্টরে পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহই। এই ব্যাপারে তাঁহার শরীক কেহই নাই। দ্বিতীয়তঃ বলা হইয়াছে যে, তিনি সর্ব বিষয়ে নির্ভুল জ্ঞান রাখেন। অর্থাৎ তিনি নির্বিচারে ও যথেষ্টভাবে রিযিক বন্টন করেন নাই, ব্যাপক, নির্ভুল ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতেই তাহা করিয়াছেন। যে লোক এই কথায় বিশ্বাসী হয় সে যতই দরিদ্র হউক না কেন সে কখনই আল্লাহর প্রতি এই করণে অসন্তুষ্ট হইতে পারে না। সূরা আজ্-জুমার-এ বলা হইয়াছে:
(আরবী**********)
তাহারা কি জানেনা, আল্লাহ যাহাকে চাহেন রিযিক প্রশস্ত করিয়া দেন, আর যাহার জন্য চাহেন সংকীর্ণ করিয়া দেন। আল্লাহর প্রতি ঈমানদার লোকদের জন্য ইহাতে সুস্পষ্ট অকাট্য নিদর্শন রহিয়াছে।
এ আয়াতের শেষাংশে বলা হইয়াছে, রিযিকের কম-বেশী হওয়ার ব্যাপারে কতগুলি নিদর্শন রহিয়াছে। ইহাতে অপরিমেয় কল্যাণ নিহিত। কিন্তু তাহা অনুধাবন করিতে পারে কেবল ঈমানদার লোকেরাই। অন্যদের পক্ষে ইহার অন্তর্নিহিত সার্বিক কল্যাণ বুঝিতে পারা সম্ভব নয় বলিয়াই এ বিষয়ে তাহারা আপত্তি তোলে ও সন্দেহে নিমজ্জিত হয়।
এই কারণেই দেখা যায়, এক শ্রেণীর অন্ধ সমাতন্ত্রবাদী অর্থনৈতিক অসাম্যের কথা শুনিলেই নাক ছিটকাইতে ও উহাকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বলিয়া প্রত্যাখ্যান ও বিদ্রুপ উপহার করিতে শুরু করে। মনে হয় তাহারা যেন সব পর্যায়ে পূর্ণ সমতা বিধানেই বদ্ধপরিকর এবং তাহাদের মনিবরা যেন তাহাদের নিজেদের সমাজতান্ত্রিক দেশ ও সমাজে তাহা কার্যত করিয়াও ফেলিয়াছে। কিন্তু কোন সমাজেই তাহা সম্ভব হয় নাই তাহা কাহারো অজানা নয়।
কিন্তু তাই বলিয়া ইসলাম পুঁজিবাদের কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট মারাত্মক ধরনের অসাম্য কোনক্রমেই সমর্থন করে না। কেননা পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক অসাম্য শুধু অসাম্যই নয়, তাহাতে একদিকে যদি থাকে সীমাহীন প্রাচুর্য, তাহা হইলে অনিবার্যভাবে অপরাদিকে দেখা দেয় নির্মম শোষণ ও বঞ্চনা। ইসলাম যেমন স্বাভাবিক অসাম্যকে জোরপূর্বক দূর করিয়া কৃত্রিম উপায়ে সাম্য সৃষ্টি করিতে চায় না, তেমনি বরদাশত করে না কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট অসাম্য। পরন্তু ইসলাম সমর্থিত অর্থনৈতিক অসাম্যের পশ্চাতে অনস্বীকার্য ভিত্তি হিসাবে বর্তমান রহিয়াছে সব মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকারের সাম্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা। অথচ পুঁজিকবাদী সমাজে এই ব্যবস্থার বর্তমানতা তো দূরের কথা, ইহার দারণার অস্তিত্বও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। ফলে পুঁজিবাদী সমাজের অসাম্য যেখানে এক শ্রেণীর- বরং সংখ্যাধিক বিপুল মানুষের-জীবনকে দারিদ্র জর্জরিত বঞ্চনা নিপীড়িত ও দুর্দশায় পর্যত করিয়া তোলে সেখানে ইসলামী সমাজে মানুষ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা লাভে ধন্য ও নিশ্চিত হইয়া পরম উৎসাহ উদ্দীপনায় নিজের অন্তর্নিহিত কর্মক্ষমতা, প্রতিভা ও বৃদ্ধিমত্তার সাহায্য উত্তর উত্তর উন্নতির দিকে অগ্রসর হইতে সক্ষম হয়। এই দুই সমাজের অসাম্যের মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্র সুষ্পষ্ট। বস্তুত ইসলাম ‘সাম্যবাদ’ সাম্যবাদ বলিয়া চীৎকার করিয়া, বঞ্চিত মানুষকে প্রলূব্ধ করিয়া প্রোলেতরী বিপ্লব ঘটাতে প্রস্তুত নয়, প্রস্তুত নয় সমাজের একজন মানুষকে তাহার মৌল প্রয়োজন হইতে বঞ্চিত থাকিার অনুমতি দিতে। পুঁজিবাদী সমাজের ন্যায় ইসলাম মানব সমাজকে ‘আছে’ (Have) ও ‘নাই’(Have Not)-এর দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া দেয় না। সেখানে প্রত্রেকটি মানুষই ‘আছে’(Hanes) শ্রেণীভুক্ত; নাই’ শ্রেণীর কোন অস্তিত্বই ইসলামী সমাজে সম্ভব নয়। সেখানে সবই কিছু না কিছুর মালিক- উহার পরিমাণে যতই পার্থক্র হউক না কেন। বস্তুত বিশ্ব-প্রকৃতিতে অবস্থিত সৃষ্টিকুলেও যে এইরূপ অবস্থাই বিরাজিত এবং ইসলামী অর্থনীতি সমর্থিত অসাম্য যে অত্যন্ত স্বাভাবিক তাহা চিন্তাশীল মাত্রই স্বীকার করিবেন।
এই অসাম্যই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক ভাবধারা এবং ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। ইসলাম অর্থ সম্পদের পরিমাণে সমতা বিধানের পক্ষপাতি নয়, ইসলাম সকল মানুষের মৌলিক অদিকার ও মানবিক মর্যাদায় পূর্ণ সমতা বিধানে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। কেননা প্রথমটা প্রকৃত-পক্ষেই সম্পূর্ণ অসম্ভব; বাস্তবতার দৃষ্টিতে কেবল দ্বিতীয়টাই সম্ভব। তাই ইসলাম অসম্ভবের পিছনে না ছুটিয়া কিংবা অসম্ভবের শ্লোগান দিয়া জনগণকে প্রতারিত না করিয়া ‘সম্ভব’কে বাস্তবায়িত করিতে সচেষ্ট। আর ইহাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ সব সুস্থ বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরও।