রাষ্ট্রীয় ব্যয়
ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা হইয়াছে। এখন ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যয় ও ব্যয়ের সংগত খাতের আলোচনা করা যাইতেছে।
কিন্তু এই আলোচনার সূচনায়- ইসলামী রাষ্ট্রকে কি কি দায়িত্ব পালন করিতে হয় এবং কোন কোন খাতে উহাকে অর্থ ব্যয় করিতে হয়, তাহা আমাদের অনুধাবন করিতে হইবে। এই সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা করিয়া লওয়ার পরই উহার ব্যয়ের খাত সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা সম্ভব হইতে পারে।
ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলামী রাষ্ট্রকে নিম্নলিখিত কর্তব্য ও দায়িত্বসমূহ যথাযথরূপে পালন করিতে হয়:
(১) দ্বীন ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করা, উহাকে সুদৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপিত করা সেই অনুযায়ী জাতীয় পুনর্গঠন ব্যবস্থা করা।
(২) দেশ রক্ষার জন্য সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পন্ন করা, সেই জন্য শক্তিশারী সশস্ত্র বাহিনী এবং নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীকে ইসলামী আদর্শের সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ করিয়া তোলা। আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন:
(আরবী***********)
তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী শক্তি সামর্থ্য অর্জন কর ও প্রস্তুত রাখ, প্রস্তুত রাখ প্রয়োজনীয় যানবাহন, যেন তোমরা উহার সাহায্যে আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের দুশমনকে ভীত ও বিতাড়িত করিতে সক্ষম হও।
(৩) অভ্যন্তরীণ শান্তি, শৃংখলা, শাসন ও বিচার-ইনসাফ সুপ্রতিষ্ঠিত করা, সেজন্য পুলিশ ও দেশরক্ষা বাহিনী এবং আদার ও সকল প্রকর বিচারালয় স্থান ও ইসলামের নীতি অনুযায়ী উহার পরিচালনা করা।
(৪) দেশবাসীর নাগরিক অধিকার রক্ষা করা, অভার-অভিযোগ ও পারস্পরিক ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করা। দুর্ভিক্ষ, বন্য, অজম্মা প্রভৃতি জরুরী পরিস্থিতিতে এককালীন সাহায্য ও বিনা সুদে ঋণ বিতরণ করা।
(৫) নির্বিশেষে সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করা। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, মীরাসী আইন কার্যকর করণ, সামাজিক জটিলতার মীমাংসা করণ। সকল প্রকার প্রয়োজনীয় শিক্ষা দানের জন্য প্রাথমিক স্তর হইতে বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চস্তরে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপন, বিনামূল্যে শিক্ষাদান ও জনস্বাস্থ্যের জন্য সকল প্রকার আয়োজন ও বিধিব্যবস্থা করা।
(৬) রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ যোগাগো-রাস্তা, পুল-রেললানি, বিমান পথ, টেলিগ্রাম, টেলিফোন লাইন ও বেতারকেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি।
(৭) বৈদেশিক বাণিজ্য ও আমদানী-রফতানীর জন্য সামুদ্রিক যান বাহন ও বন্দর স্থাপন, আলোক-স্তম্ভ ও বিমানঘাটি প্রস্তুত করণ।
(৮) কৃষিকার্যের উন্নতি বিধানের জন্য পানি সেচের বিভিন্ন উপায় অবলম্বন, বড় বড় পুষ্করিনী, খাল ও কূপ খনন, বাঁধ বাধার আধুনিক যন্ত্রপাতির আমদানী ও সার প্রয়োগে উৎপাদন হার বৃদ্ধি।
(৯) প্রয়োজনীয় শিল্পের উন্নয়ন, জনগণের প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য উৎপাদন ও সুষ্ঠু এবং জনগণও উন্নত জীবনমান উপযোগী দরকারী দ্রব্যাদি সহজেই লাভ করিতে পারে।
(১০) দুনিয়অর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সহিত বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সকল মিত্র দেমে রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনার স্থায়ীভাবে নিয়োগ এবং তৎসংশ্লিষ্ট যাবতীয খরচ বহন; দেশ-বিদেশে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যাতায়াত, নিজ দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় শহরে মুসাফিরখানা স্থাপন করা, যেন দেশী বা বিদেশী কোন ব্যক্তিই ফুটপাত বা গাছ তলায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়িয়া থাকিতে বাধ্য না হয়।
(১১) ভূমি, বন-জঙ্গল ইত্যাদি জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ ও উহার উন্নতি বিধান; কৃষক, মজুর ও শ্রমিকের অধিকার রক্ষার নিখুঁত ব্যবস্থা করা।
ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থব্যয়ের এই মোট এগারোটি খাতের উল্লেখ করিয়াই ক্ষান্ত হইতেছি। ইহা হইতে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরাট ব্যয়-ভার সম্পর্কে প্রত্যেক চিন্তাশীল ব্যক্তিই অনুমান করিতে পারেন। ইহা সুস্পষ্ট কথা যে, এই বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন; কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র এই অর্থ অন্ধ শোষক ও লুন্ঠনকারীর ন্যায় নির্বিচারে দুই হাতে লুটিয়া সংগ্রহ করিতে পারে না। বরং নিরপেক্ষ ন্যায়নীতি, সহৃদয়তা ও সহানুভূতি এবং বৃহত্তর কল্যাণ কামনাই হইবে উহার জন্য কর ধারায করণ ও আদায় করার মুল ভিত্তি।
কারণ, প্রথম সরকারী ব্যয়-নীতির সহিত সমগ্র দেশ ও জাতির স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িত। সরকারী ব্যয়-নীতি যত সুষ্ঠু, সংযত ও সুবিচার পূর্ণ হইবে, দেশ ও দেশবাসীর ততই কল্যাণ সাধিত হইতে পারে। দ্বিতীয়ত, দেশের রাজকোষে জনগণের হার ভাঙ্গা খাটুনী খাটিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া, বুকের রক্ত পানি করিয়া উপার্জন করা” অর্থসম্পদই সঞ্চিত হইয়া থাকে, এই জন্র রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়ের ব্যাপারে পরিপূর্ণ সতর্কতা, বিচক্ষণতা, সামগ্রিক সামঞ্জস্য ও মিতব্যয়িতা রক্ষা করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
শুধু নৈতিকতার কথাই নয়, ইসলামী শরীয়তে এ সম্পর্কে রীতিমত আইন ও বিধান রহিয়াছে। কারণ রাষ্ট্রীয় অর্থ তাহাদের পৈতৃক সম্পত্তি বা [নিজেদের পরিশ্রম-লব্ধ নয়, তাহা দেশের আপামর জনগণেরই শ্রমার্জিত ধন। কাজেই ইসলামের রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করার ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদিকের এই ব্যাপারে কিছুতেই অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া যাইতে পারে না- নিজেদের ইচ্ছামত ব্যয় করার অধিকার ও সযোগ দেওয়া যাইতে পারে না। অন্যথায়, রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়ে মারাত্মক অপচয় দেখা দেওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রহিয়াছে। ঠিক এই জন্যই ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতিদাতা আল্লাহ তা’আলা এ সম্পর্কে সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণও বিধিনিষেধ আরোপ করিয়াছেন। তাহাতে একদিকে যেমন আয়কে নিয়ন্ত্রণ করা হইয়াছে, অপরদিকে ব্যয়কেও সুষ্ঠু ও সুসংযত করা হইয়াছে।
ইসলামের রাষ্ট্রীয় অর্থনীীততে মেযন আয়ের কতকগুলি খাত সুনির্দিষ্ট তদনুরূপ ব্যয়েরও কতকগুলি ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। অবশ্য আয় ব্যয়ের কতকগুলি খাত এমনও আছে যাহা মজলিসে শু’রা- তথা গণ-প্রতিনিধিত্বমূলক পার্লামেন্টের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারণ করার অধিকার রাষ্ট্রনেতাক দেওয়া হইয়াছে।
এই জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালের আয়-ব্যয়কে দুইভাগে ভাগ করা যাইতে পারে:
(১) কুরআন মজীদ যেসব ব্যয়ের খাত নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে: গণীমতের মাল, যাকাত বাবদ আদায়কৃত অর্থ এবং বিনা যুদ্ধে সাধারণ নিয়মে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ ‘ফাই’ এই ভাগে গণ্য হইতে পারে।
এই সব খাত লব্ধ অর্থ ব্যয় করার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় বায়তুলমাল এবং রাষ্ট্র-সরকা শুধু আমানতদার ও মাধ্যম মাত্র; ইহাতে কোন ব্যক্তি বা শক্তিকেই নিজস্ব বিচার-বিবেচনা ও রুচি অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকারই দান করা হয় নাই। তবে এ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার পন্থা ও পদ্ধতি সম্পর্কে অবশ্যই বিচার-বিবেচনা করার অধিকার থাকিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
(২) যে আমদানীর ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করা রাষ্ট্র সরকাররের বিচার বিবেচনার উপর ন্যস্ত করা হইয়াছে: খারাজ, জিজিয়া, শুল্কের তিন-চতুর্থাংশ এবং অন্যান্য আমাদনী। এইসব আমাদানী ব্যয় করার ব্যাপারে মজলিশে শু’রা (পার্লামেন্টের) পরামর্শ ও মঞ্জুরী গ্রহণ একান্ত আবশ্য।
বায়তুলমালের আমদানীকে ব্যয়ের খাতের দৃষ্টিতে পাঁচটি বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা হইয়াছে:
(১) গণীমতের মাল, খনজ সম্পদ ও তৎলব্ধ অর্থ এবং ভূ-গর্ভ হইতে প্রাপ্ত প্রাচীন সম্পদের এক পঞ্চমাংশ।
(২) যাকাত, জমির ওশর ও মুসলিম ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে প্রাপ্ত শুল্ক।
(৩) ‘ফাই ও বিনা যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ’।
(৪) খারাজ, জিজিয়া, অমুসলিম সংখ্যালঘু ও বৈদেশিক আশ্রয়প্রার্থী ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে প্রাপ্ত অর্থ।
(৫) লা-ওয়ারিশ মাল।
ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালের উল্লিখিত প্রত্যেক প্রকার আমদানীর জন্য আলাদা আলাদা খাত ঠিক করা আবশ্যক। যেন এক খাতে আয় অপেক্ষা ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে গেলে অন্য খাতে উদ্বৃত্ত অর্থ হইতে ঋণ বাবদ অর্থ গ্রহণ করা যায় এবং ইহা ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পূর্ণরূপে জায়েয।[দুররে মুখতার-২য় খণ্ড]
কুরআননের নির্দিষ্ট ব্যয়ের খাত
(১) গণীমতের মাল: ইহার ব্যয়ের খাত কুরআন মজীদে নিম্নরূপ নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে:
(আরবী***********)
জানিয়া রাখ, গণীমতের হিসাবে যে মাল-সম্পদেই লাভ হইবে, উহার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর জন্য, তাহার রাসূলের জন্য এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃসম্বল পথিকদের জন্য নির্দিষ্ট।
কুরআনের এই নির্দেশ অনুসারে নবী করীম (স) গণীশতের মালের বিরাট অংশ পাঁচ ভাগের চার ভাগ- সামরিক লোকদের মধ্যে বন্টন করিয়া দিয়াছিলেন এবং উহার এক-পঞ্চমাংশ মাত্র উল্লিখিত খাতে ব্যয়ের জন্য বায়তুলমালে জমা দিয়াছিলেন।
নবী করীম (স)-এর অন্তর্ধানের পর গণীমতের মাল পাঁচ ভাগের পরিবর্তে মোট তিন ভাগে ভাগ করা হইত। খুলাফাযে রাশেদুন কুরআন উল্লিখিত রাসূল এবং তাঁহার নিকটাত্মীয়দের অংশ বাতিল করিয়া দিয়াছিলেন। [কিতাবুল খারাজ, ১১পৃঃ কিতাবুল আমওয়াল, ৩২৬ পৃঃ] বর্তমানকালে উল্লিখিত দুইটি বাতিল করার পরিবর্তে তাহা সামরিক অস্ত্র-শস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম ক্রয়ে ব্যয় করাই যুক্তিযুক্ত হইবে। [কিতাবুল খারাজ, ১১পৃঃ কিতাবুল আমওয়াল, ৩২৬ পৃঃ]
(২) ‘ফাই’ ও বিনাযুদ্ধে লব্ধ ধন-সম্পদ: ইহার ব্যয়ের খাতও কুরআন মজীদে নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহা পথম রাষ্ট্রীয় মালিকানার অন্তর্ভুক্ত হইবে এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যয়িত হইবে। হযরত নবী করীম (স) এই ধরনের যাবতীয় মাল-সম্পদকে নিজেরই তত্ত্বাবধানে ব্যয় ও বন্টন করিয়াছেন। কুরআন মজীদে বরা হইয়াছে:
(আরবী*********)
আল্লাহ গ্রামবাসীদের-রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের- নিকট হইতে তাহার রাসূলকে যাহা কিছু বনা যুদ্ধে দান করিয়াছেন, তাহা আল্লাহ, তাহার রাসুল, তাহার নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকদের জন্য (বন্টন করা) হইবে, যেন ধন-সম্পত্তি তোমাদের কেবল ধনীদেরই কুক্ষিগত হইয়া না থাকে।
আয়অতে উল্লিখিত ‘রাসূল এবং তাঁহার নিকটাত্মায়ের অংশ বর্তমান সময় বাতিল হইয়া যাইবে এবং যাহা দেশবাসীর সামগ্রিক কল্যাণকর কাজে- রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পূরণ করা এবং দেশের যাবতীয় উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় – ব্যয় করা হইবে। ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্য যে অশ্যটি নির্দিষ্ট রহিয়াছে, তাহা তাহাদের জন্যই ব্যয় করিতে হইবে।
মুসলমানদের কল্যাণ ব্যবস্থার দৃষ্টিতে অন্য কোন জাতির উপকার করা, তাহাতে ঋণ দেওয়া কিংবা তাহাদের সহানুভূতি লাভ করার জন্য অর্থদান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত ইহলে এই অর্থ সেজন্যও খরচ করা হইবে।
মনে রাখিতে হইবে, কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াতে ‘ফাই’ বাসাধারণ রাষ্ট্রীয় ধন-সম্পদের মাত্র এক-পঞ্চমাংশের ব্যয়েংর খাত নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। অবশিষ্ট চার-পঞ্চমাংশ ব্যয় করার ভার ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচালকদের উপর ন্যস্ত করা হইয়াছে।
পসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, গণীমত ও ফাই’রন ধন-সম্পদের খুমুস বা এক-পঞ্চমাংশ ব্যয় করার ব্যাপারে যদি কোনরূপ মতবিরোধ দেখা দেয়, তবে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানই উহার মীমাংসা করিয়া দিবে।
এখন চূড়ান্ত কথা এই যে, খারাজ, জিজিয়া ও আমদানী শুল্ক- প্রভৃতি সকল ধন-সম্পদই ফাই’র অন্তর্ভুক্ত। কাজেই তাহা সবই উল্লিখিতরূপে ব্যয়-ব্যবহার করা হইবে।
(৩) যাকাত: যাকাতের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার খাতও কুরআন মজীদ নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে। বলা হইয়াছে:
(আরবী*********)
যাকাতের সম্পদ কেবল ফকীর ও মিসকীনদের জন্য, তাহাদের জন্যও যাহারা তাহা সংগ্রহ করার কাজে কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত ইহয়া আছে। তাহাদের জন্যও যাহাদের মন আকৃষ্ট করার জন্য সাহায্য দান প্রয়োজন বোধ হয়। ক্রীতদাস মুক্ত করার কাজে এবং ঋণগ্রস্তকে জগদ্দল ঋুণভার হইতে মুক্ত করার জন্যও উহা ব্যয় হইবে। আর তাহা আল্লাহর পথেও ব্যয় হইবে, নিঃস্ব পথিকতেরও তাহা হইতে দান করা যাইবে। বস্তুত ইহা আল্লাত তা’আলার ধার্যকৃত ফরয; আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান।
(ক) বেকার শ্রমজীবী ও রুজিহীনদের সামাজিক নিরাপত্তা
কুরআনের পরিভাষায় ‘ফকীর’ এমন মজুর ও শ্রমজীবীকে বলা হয়, শারীরিক স্বাস্থ্য ও শক্তির দিক দিয়া যে খুব মজবুত এবং কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও প্রতিকূল অবস্থার কারণে সে বেকার ও উপার্জনহীন হইয়া পড়িয়াছে। কুরআন শরীফে ঠিক এই অর্থেই ইহা ব্যবহৃত হইয়াছে। এই দিক দিয়া সেই সব অভাবগ্রস্ত মেহনতী লোককেও ‘ফকীর’ বলা যাইতে পারে, যাহার কোন জুলুম হইতে আত্মরক্ষা করার জন্য নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া আসিয়াছে। কোন সামরিক এলাকা হইতে বিতাড়িত লোকদেরও ‘ফকীর’ বলা যাইতে পারে। কুরাইশদের অত্যাচারে যেসব মুসলমান হিজরাত করিয়া মদীনায় গিয়া আশ্রয় লইয়াছিলেন এবং রুজি-রোজগারের সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত হইয়াছিলেন, কুরআন মজীদে তাহাদিগকে ‘ফকীর’ বলিয়া আখ্যায়িত করা হইয়াছে:
(আরবী**********)
যাকাতের সম্পদ সেই সব ফকীর-মুহাজিরদের জন্য. যাহারা নিজেদের ধন-সম্পত্তি ও ঘর-বাড়ি হইতে বিতাড়িত হইয়াছে এবং আল্লাহর ‘অনুগ্রহ’ ও ‘সন্তুষ্টির সন্ধান করিতেছে।’
(খ) মজুর শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা
মজুর শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা দানের জন্য যাকাত বাবদ সংগৃহীত অর্থের একটি অংশ নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। গরীবদের সাহায্য দান এবং সকল প্রকার দুঃখ-দুর্ভোগ ও অভাব-অনটন হইতে মুক্তিদানই এই বিভাগের উদ্দেশ্য, যেন সমাজ-ক্ষেত্রের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় তাহারা পূর্ণ শক্তি ও সামর্থ্য লাভ করিতে পারে- যেন তাহাদের বুনিয়াদি প্রয়োজন পূর্ণ করিয়া দিয়া তাহাদের জীবন-যাত্রার মান উন্নত করা যায়। বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্রের শ্রমজীবীদের জন্য ইহা এক চিরস্থায়ী রক্ষা কবচ। ইহার আরো একটি দিক এই যে, এইরূপ ব্যবস্থা থাকার কারণে ইসলামী সমাজে পুজি ও কারখানা মালিকগণ শ্রমিক-মজুরদের কখনই শোষণ করিতে পারিবে না। তাহারা উপযুক্ত বেতন দিয়া মজুর রাখিতে বাধ্য হইবে এবং মজুর রাখিয়া যথাসময়ে ও যথেষ্ট পরিমাণে তাহাদের বেতন আদায় করিতেও বাধ্য থাকিবে। আর তাহারা যদি শ্রমিকদরে বিপদগ্রস্ত করার জন্য সহসা কারখানা বন্ধ করিয়া দেয় বা সহসা কারখানা বন্ধ করিয়া দেওয়ায় শ্রমজীবীগণ বিপদের সম্মুখীন হইয়া পড়ে, তবে তাহাতেও মালিক শ্রেণীর পরাজয় হইবে। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্রের এই বিভাগ এইসব শ্রমিকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দানের জন্য পূর্ব হইতেই প্রতিষ্ঠিত থাকিবে।
মজুর-শ্রমিকদের সকল প্রকার বিপদ হইতে রক্ষা করার জন্য স্বয়ং ইসলামী রাষ্ট্রই সম্পূর্ণ দায়ী। সেখানে কোন ট্রেড ইউনিয়নের বিন্দুমাত আবশ্যকতা নাই। বস্তুত যাকাতের এই ব্যবস্থা পুঁজিদার ও মালিকদের শোষণক্ষমতার বিষদাঁত একেবারে চূর্ণ করিয়া দেয়। পুঁজিদার যদি নিজের মূলধন কোন অর্থকরী কাজে নিযুক্ত না করে, তবুও তাহাদের সঞ্চিত ও পুঞ্জীকৃত অর্থে যাকাত ধার্য হইবে। ফলে তাহারা মজুর-শ্রমিকদিগকে ঠিক সেই পরিমাণ মজুরী দিতে বাধ্য হইবে, যতখানি ইহারা পণ্যোৎপাদনের মূল ব্যাপারে সাহায্য করিয়াছে।
(গ) অক্ষম লোকদের সামাজিক নিরাপত্তা
‘ফকীর’দের ন্যায় মিসকীনদের জন্যও যাকাতের অংশ নির্দিষ্ট করা হইয়াছে। ‘মিসকীন’ তাহাকেই বলা হয়, দৈহিক অক্ষমতা যাহাকে চিরতনে নিষ্কর্মা ও উপার্জনহীন করিয়া দিয়াছে; বার্ধক্য, রোগ অক্ষমতা ও পংগুতা যাহাকে উপার্জনের সুযোগ-সুবিধা হইতে বঞ্চিত করিয়া দিয়াছে অথবা যে ব্যক্তি উপার্জন করিতে পারে বটে, কিন্তু যাহা উপার্জন করে তাহা দ্বারা তাহার প্রকৃত প্রয়োজন মাত্রই পূর্ণ হয় না; অন্ধ, পক্ষাগাতগ্রস্ত, পংগু ইত্যাদি সকল লোককেই ‘মিসকীন’ বলা হয়। ইমাম আবূ হানীফা (র) বলেন, মিসকীনের অবস্থা ফকীর অপেক্ষাও বেশী বিপর্যস্ত হইয়া থাকে। কারণ অর্থনৈতিক অসামর্থ্যই তাহাকে দরিদ্র ও অকর্মণ্য করিয়া দিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে এমন পরিমাণ অর্থ সাহায্য দিতে হইবে যাহাতে তাহাদের প্রয়োজন মেটে এবং দারিদ্রের দুঃখময় পরিস্থিতি হইতে মুক্তি পাইয়া স্বাচ্ছন্দ্যলাভের দিকে পদক্ষেপ করিতে পারে।
ইসলাম একদিকে যেমন লোকদিগকে ভিক্ষাবৃত্তি হইতে নিবৃত্ত করিয়াছে, অপরদিকে রাষ্ট্রীয় বাজেটে বেকার, পংগু, অক্ষম, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও উপার্জন ক্ষমতাহীন লোকদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দানেরও পূর্ণ ব্যবস্থা করিয়াছে। ইসলামের অর্থনীতি যে কতখানি সমাঞ্জস্যপূর্ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ তাহা ইহা হইতে প্রমাণিত হয়।
(ঘ) যাকাত বিভাগের কর্মচারীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
যাকাত বিভাগের কর্মচারীগণ দুই ভাগে বিভক্ত হইবে। এক ভাগ যাকাত আদায় করার কাজে নিযুক্ত থাকিবে, আর অপর ভাগ তাহা সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট পন্থায় বন্টন করার কাজ সম্পন্ন করিবে। এই উভয় কাজেই যত কর্মচারী নিযুক্ত থাকিবে, তাহাদের সকলের প্রকৃত প্রয়োজন পরিমাণ বেতন দেওয়া এবং এই গোটা বিভাগের যাহা কিছু ব্যয় হইবে তাহা যাকাতের আমদানী হইতেই খরচ করার অনুমতি আল্লাহ দিয়াছেন। এই বেতন প্রত্যেক কর্মচারী যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার অনুপাতে দিতে হইবে। কিন্তু উহার নিম্নতম হার হইতেছে নিম্নতম প্রয়োজন পূরণ।
(ঙ) মুসলিমদের সংরক্ষণ-ব্যবস্থা
যাকাতের পঞ্চম অংশ ব্যয় করা হইবে ‘মানুষের মন আকৃষ্ট’ করার জন্য। কুরআনে ব্যবহৃত শব্দের মুল হইতেছে ‘তালীফে কুলুব’। ইহার প্রকৃত উদ্দেশ্য হইতেছে, ইসলাম প্রচারের কাজ কোথাও প্রতিরুদ্ধ ও প্রতিহত হইলে, কিংবা মুসলমানদের উপর কোথাও অত্যাচার হইলে এবং তাহা টাকা দ্বারা দূর করা সম্ভব হইলে সেই ক্ষেত্রে যাকাতের এই অংশের অর্থ ব্যয় করা হইবে। যেন ফেতনা ও ফাসাদ, অশান্তি ও বিপর্য সৃষ্টি না হইতে পারে। অত্যাচারীও অনেক সময় টাকা পাইয়া অত্যাচার-নিপীড়ণ বন্ধ করে; এমনকি, কখনো এইরূপ ব্যবহার দেখিয়া মুগ্ধ-বিস্মিত হইয়া শুধু জুলুমই বন্ধ করে না, অনেক সময় ইসলামও গ্রহণ করিয়া থাকে। অনুরূপভাবে সংগতিহীন নও মুসলিমকেও ইহা দ্বারা নিজ পায়ে দাড়াইবার যোগ্র করিয়া তুলিতে চেষ্টা করা হইবে। [তাফসীরে বাইজাবী- প্রথম খণ্ড।]
কিন্তু ইসলামী রাস্ট্র ও জনতা যদি কখনো সামগ্রিকভাবে সমধিক ঐশ্বর্যশালী হইয়া উঠে এবং তখন নিজদেশে এইরূপ অর্থদানের আর কোন প্রয়োজনই না থাকে, তবে এই খাতের অর্থ বৈদেশিক মুসলমান তথা মিত্র রাষ্ট্রের সাহায্যার্থে ব্যয় করা যাইতে পারিবে।
(চ) ক্রীতদাসদের মুক্তিবিধান
যাকাতের ষষ্ঠ অংশ ব্যয় হইবে দাসত্বের বন্ধনগ্রস্ত লোকদের মস্তক মুক্ত ও স্বাধীন করার কাজে। এই অর্থ দ্বারা ক্রীতদাস খরিদ করিয়া তাহাকে মুক্তি করা হইবে; ক্রীতদাস নিজে এই অর্থ লাভ করিয়া উহার বিনিময়ে নিজেকে গোলামীর বন্ধন হইতে মুক্ত করিতে পারিবে।
ইসলাম-সূর্যের প্রথম উদয় লগ্নে আরবদেশে দাস-প্রথার খুব বেশী প্রচলন ছিল। ইসলামী রাষ্ট এই অমানবিক প্রথা বন্ধ করার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং সরকারী অর্থের সাহায্যে শান্তিপূর্ণবাবে এই প্রথার মূলোৎপাটনের ব্যবস্থা করে। ফলে খুলাফায়ে রাশেদুনের যুগে এই প্রথা চূড়ান্তভাবে রহিত হইয়া যায়।
আমেরিকার দাস-প্রথা বন্ধ করার জন্য রীতিমত গৃহযুদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু ইসলামী হুকুমাত এমন এক অর্থনীতির প্রচলন করিয়াছে যে, ইহার সাহায্যে প্রথমবার আরব দেশের এই যুগ-যুগন্তকালের প্রথাটিকে নিঃশেষে খতম করা সম্ভব হইয়াছিল এবং অনন্তকাল পর্যন্তক যখনই যে দেশেরই এই সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠিবে,সেখানেই এই অর্থনীতির দ্বারা শান্তিপূর্ণভাবে মানবসমাজের এই বিরাট ও জটিল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা যাইতে পারিবে।
শুধু তাহাই নয়, কাফিরদের সহিত যুদ্ধ সংগ্রাম হওয়ার ফলে মুসলিম মুজাহিদগণ যদি শত্রুর হাতে বন্দী হইয়া পড়ে, তবে এই অর্থ দ্বারা তাহাদিগকে মুক্ত করার ব্যবস্থা বা চেষ্টা করা যাইতে পারিবে। [মা-অর্দী প্রণীত ‘আল আহকামুস সুলতানীয়া’।]
(ছ) ঋণ মুক্তির স্থায়ী ব্যবস্থা
যাকাতের সপ্তম অংশ নির্দিষ্ট হইয়াছে ঋণগ্রস্ত লোকদের সাহায্যার্থে। ঋণগ্রস্ত লোক সাধারণত দুই প্রকার: (১) যাহারা নিজেদের নিত্য-নৈমিত্তিক প্রয়োজন পূর্ণ করার ব্যাপারে ঋণ গ্রহণ করে। এই ঋণগ্রস্ত লোক যদি নিজে ধনী না হয়, তবে তাহাদিগকে যাকাতের এই অংশ হইতে সাহায্য করা হইবে। (২) দ্বিতীয় সেই সব লোক, যাহারা মুসলমানদের সামষ্টিক কল্যাণ সাধন ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জর্য ঋণ গ্রহণ করে। ইহারা ধনী হউক নির্ধন হউক- ঋণ করার পরিমাণ অর্থ যাকাতরে এই অংশ হইতে তাহাদিগকে দেওয়া যাইতে পারিবে।
ইমাম আবূ ইউসুফ কিতাবুল খারাজে লিখিয়াছেন ‘গা-রিমীন’ –তাহাদিগকে বলা হয়, যাহারা নিজেদের ঋণ শোধ করিতে অসর্থ। ‘হিদায়াত’ নামক প্রসিদ্ধ ফিকাহ গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে: ‘গারিম’ তাহাকে বলে যাহাদের নিজেদের ঋণের পরিমাণ অপেক্ষা অতিরিক্ত কোন অর্থ সম্পদ নাই। তাফসীল-ই তাবারী গ্রন্থে ‘গারিম’ শব্দ হেইতে সেই সব লোক বুঝান হইয়াছে, যাহারা ঋণের দুর্বহ ভারে বন্দী ও অবনত মস্তক; কিন্তু তাহাদের এই ঋণ অপচয়, অপব্যয়, অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি কিংবা দারিদ্র্য প্রভৃতি কারণৈ হয় নাই। যাহার বাড়ি-ঘর জ্বলিয়া ভষ্ম হইয়া গিয়াছে, কিংবা বন্যা-প্লাবনে মাল-আসবাব ভাসিয়া গিয়াছে, এই জন্য সে তাহার পরিবার পরিজনের ভরণ পোষণ করিতে সমর্থ হইতেছে না; তাহাকেও ‘গারিম’ বলা হয়। এই সকল ব্যক্তির পক্ষ হইতেই:
(আরবী**********)
ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল হইতে এই সব লোকের ঋণ আদায় করিয়া দেওয়া রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য।
নবী করীম (স) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবেই ঘোষণা করিয়াছেন:
(আরবী**********)
যে লোক ধন-সম্পত্তি রাখিয়া মরিয়া যাইবে তাহা তাহার উত্তরাদিকারীদের মধ্যে বন্টন করা হইবে। আর যে লোক কোন ঋণের বোঝা অনাদায় রাখিয়া যাইবে (তাহার পরিত্যক্ত সম্পত্তি হইতেযদি উহার আদায় না করা যায়, তবে) তাহা আদায় করার দায়িত্ব আমার উপর বর্তিবে।
অপর এক হাদীসেতাহার কথাটি এ ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে:
(আরবী**********)
যে ব্যক্তি কোন দায়িত্বভার রাখিয়া যাইবে তাহা বহন করার দায়িত্ব আমর উপর বর্তিবে। যে ব্যক্তি ধন-মাল রাখয়া যাইবে তাহা তাহার উত্তরাধিকারীদের হইবে। আর যাহার কেহই উত্তরাধিকারী থাকিবে না, আমিই তাহার উত্তরাধিকারীদের হইবে। আর যাহার কেহই উত্তরাধিকারী থাকিবে না, আমিই তাহার উত্তরাধিকারী হইব। আমি তাহার অসিয়ত পূরণ করিব।
নবী করীম (স)-এর এই ঘোষণায় নিঃস্ব ঋণগ্রস্ত লোকদের ঋণ পরিশোধ করার এবং তাহাদের পরিবার-পরিজনের জীবিকা-ব্যবস্থার ভার সরাসরিভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের উপর অর্পণ করা হইয়াছে।
এ সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা এই যে, আকস্মিক দুর্ঘটনা কিংবা কোন বাহ্যিক প্রতিকূলতার কারণে যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়িবে, যাকাতের এই অংশ হইতে তাহাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করিতে হইবে।
(জ) বিনাসুদে ঋণ দান
ইসলামী রাষ্ট্র ঋণগ্রস্ত লোকদিগকে কেবল ঋণভার হইতে মুক্ত করিবে তাহাই নয়, ইতিবাচকভাবে জনগণের উৎপাদনমূলক কাজে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন অনুসারে ঋণ দেওয়ারও ব্যবস্থা করিবে। কিন্তু তাহা সুদের ভিত্তিতে হইবে না। উপরন্তু যাকাতরে যে অংশ ঋণ শোধ করার জন্য নির্দিষ্ট রহিয়াছে, তাহা হইতে লোকদিগকে পূর্বাহ্নেই ঋণ দেওয়া যাইতে পারে।
ইসলামী অর্থনীতিতে সুদী কারবার ও সুদের লেন-দেন একেবারেই জায়েয নহে। কাজেই কেহ কাহাকেও টাকা ঋণ দিলে তাহাতে কোন ক্রমেই সুদ লওয়া বা দেওয়া যাইতে পারে না। কোন নাগরিকই যাহাতে সুদের বিনিময়ে ঋণ গ্রহণ করিতে না পারে বা ঋণ-লইয়া সুদ দিতে না বাধ্য না হয়- ইসলামী রাষ্ট্রে তাহার পুরাপুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদিগকে এই সুদ দেওয়া ও নেওয়ার পাপ-অভিশাপ হইতে চিরতরে মুক্ত করার জন্য রাষ্ট্রীয় বায়তুলমাল হইতে বিনাসুদের ঋণ দেওয়ার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করা হইবে। বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার জন্য বায়তুলমালের একটি বিভাগ স্থায়ীভাবে কাজ করিবে। দেশের জনগণ- এমনকি স্বয়ং খলীফাও এই ফান্ড হইতে প্রয়োজন অনুসারে ঋণ গ্রহণ করিতে পারবে।
খুলাফায়ে রাশেদুনের যুগে এই ব্যবস্থা বিশেষভাবে কার্যকর হইয়াছিল বলিয়া এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক বায়তুলমালসমূহ এই জন্য তৎপর থাকিতে বলিয়া সেকালে সুদী কারবারের অস্তিত্ব পর্যন্ত কোথায়ও ছিল না।
যে সব দেশে অবাধ-স্বাধীন অর্থনীতির (Laissez faire) পচলন থাকে এবং রাষ্ট্র-সরকার যে দেশের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করে না, সে দেশে অসংখ্য প্রকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জটিল সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠে। সেখানে মহাজন ও পুঁজিপতিরা সুদের বিনিময়ে ঋণ দান করিয়া অভাবী লোকদিগকে জোঁকের মত শোষণ করিতে পারে। ইউরোপ আমেরিকা- এমনকি রাশিয়া, কোথায়ও ইহার কোন ব্যতিক্রম নাই। একদিকে শোষকগণ মারাত্মকভাবে সুদের জাল-বিস্তার করিয়া অর্থ-লুণ্ঠনের ব্যবস্থা করে এবং অন্যদিকে ইহাদের নামে স্থাপিত আদালতসমূহ সেই শোষণকে আইনসম্মত গণ্য করিয়া উহাকে অধিকতর কার্যকর করিয়া তোলে। পরিণামে পাঁচ-দশ টাকা ঋণ গ্রহণের কারণে এক এক ব্যক্তির যাবতীয় বিত্ত-সম্পত্তি নিলামে উঠিয়া নিঃশেষ হইয়া যায়। মিঃ এইচ, উলফ-এর কথায়, সমগ্র দেশ সুদখোরদের উদগ্র গ্রাসের মধ্যে বন্দী ইহযঅ আছে, ঋণের লৌহ শলাকা দেশের শৈল্পিক ও কৃষ্টি ক্ষেত্রের সর্ব প্রকার উন্নতির পথ রুদ্ধ করিয়া দাড়াইয়া আছে। অথচ কোন মানুষই এমন সমাজব্যবস্থা কিছুতেই বরদাশত করিতে পারে না, যাহাতে অধিকাংশ লোকই ঋণী হইয়া জন্মগ্রহণ করে, ঋণী হইয়া তিক্ত জীবন যাপন করে এবং ঋণগ্রস্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শুধু তাহাই নয়, মৃত্যুর পরও এই ঋণের জাল ছিন্ন হয় না, নিজের সন্তানদিগকেও তাহারা এই ঋণভারে জর্জরিত করিয়া রাখিয়া যায়।
এই চিত্র পুঁজিবাদী সমাজের সঠিক রূপই উদ্ভাসিত করে; কিন্তু ইসলামী সমাজের রূপ ইহা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। ইসলাম একদিকে যেমন সুদকে চিরতরে হারাম করিয়া দিয়াছে, অপর দিকে যাকাতরে অর্থ হইতে অভাবী লোকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিয়াছে এবং সুদের শর্তে ঋণ গ্রহণের কোন বাধ্যবাধকতাই অবশিষ্ট থাকিতে দেয় নাই।
ইসলাম যেরূপ ব্যক্তিগতভাবে বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার জন্য ইসলামী জনতাকে উৎসাহিত করিয়াছে, ঠিক সেই সঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্রের উপরও অনুরূপ দায়িত্ব চাপাইয়া দিয়াছে। কুরআন উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিতেছে:
(আরবী**********)
আল্লাহ তা’আলাকে উত্তম ঋণ যে লোকই দান করিবে…. আল্লাহ তা’আলা তাহাকে অসংখ্যগুণ বেশী ফিরাইয়া দিবেন।
এখানে ‘উত্তম ঋণ’ এর অর্থ বিনাসুদে ঋণ দান এবং আল্লাহকে ঋণ দেওয়ার অর্থ অভাবগ্রস্ত লোককে কিংবা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক কাজে কেবল মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করিবার উদ্দেশ্যে ঋণদান করা। কৃসিজীবীদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিনাসুদে কৃষি ঋণ দেওয়া বায়তুলমালের দায়িত্ব। এ সম্পর্কে ফিকাহবিদদের ফয়সালা হইল:
(আরবী**********)
জমির মালিক যদি দারিদ্রের কারণে তাহার জমি চাষ করিতে অক্ষম হয় তাহা হইলে প্রয়োজন মত তাহাকে বায়তুলমাল হইতে বিনসুদে ঋণ দিতে হইবে, যেন সে কৃষিকাজ করিতে ও তাহার জমিতে ফসল ফলাইতে সক্ষম হয়।’
আধুনিক অর্থনীতিবিদগণও এ কথা স্বীকার করিয়াছেন যে, যে সমাজে সুদেরহার একেবারে শুণ্যের কোঠায় পৌঁছিয়াছে এবংবিনাসুদে ঋণ দেওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থা রহিয়াছে, বস্তুত তাহাই হইতেছে সর্বাপেক্ষা উন্নত ও সুসভ্য সমাজ। নীতিগতভাবে বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার যৌক্তিকতা পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণ স্বীকার করিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহা কার্যকররূপে চারু করার কোন ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত পেশ করিতে পারেন নাই। তাঁহারা যে সমবায় ঋণ দান সমিতি’ বা ব্যাংকের ব্যবস্থা দিয়াছেন, তাহা মানুষকে অর্থণৈতিক নিরাপত্তা দানের পরিবর্তে সুদের অক্টোপাশে সমগ্র দেশকে দুশ্ছেদ্যবাবে বাধিয়া ফেলিয়াছে।
ইংলন্ডের অষ্টম হেনরীর শাসনকালের পূর্বেই খৃস্টান প্রজাদিগের জন্য সুদী কারবার ও সুদী লেন-দেনকে আইনত নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু এই আইন শুধু এই জন্যই ব্যল্থ হইয়াছিল যে, সেই সঙ্গে বিনাসুদে ঋণ দেওয়ার কোন বাস্তব ব্যবস্থাই ছিল না। অন্য দিকে ইয়াহুদীদিগকে সুদী কারবার করার আবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হইয়াছিল। ফলে ইহাদের পদাংক অনুসরণ করিয়া খৃস্টানগণও সুদী কারবার করিতে শুরু করিয়াছিল। অতঃপর সরকারকে ব্যবসায়-বাণিজ্যের অবাধ স্বাধীনতা দিয়াই ক্ষান্ত ও নিষিদ্ধ হইয়া থাকিতে হইল।
কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি সুদকে হারাম ঘোষণা করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, নাগরিকগণ যাহাতে বিনাসুদে প্রয়োজন পরিমাণ ঋণ লাভ করিতে পারে, তাহার সুষ্ঠু ও স্থায়ী ব্যবস্থাও করিয়াছে ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল হইতে।
ইসলাম নাগরিকদিগকে শুধু অবাধ স্বাধীনতা দান করে না, স্বেচ্ছাচারিতার সহিত ধন লুন্ঠন ও শোষণ পীড়ন চালানোর কোন অধিকার ইসলামী রাষ্ট্র কাহাকেও দেয় নাই।
(ঝ) ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা ব্যবস্থা
যাকাতের নবম অংশ ব্যয় হইবে আল্লাহর পথে। ‘আল্লাহর পথে’ কথাটি অত্যন্ত ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহর নির্দেশিত পথে প্রত্যেক জন-কল্যাণকর কাজে-দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যত কাজ করা সম্ভব সেই সব ক্ষেত্রেই- এই অর্থ ব্যয় করা যাইবে।
(হ) নিঃস্ব পথিকদের পাথেয় সংস্থান
যাকাতের দশন অংশ ব্যয় করা হইবে ‘ইবনুস সাবীল’ বা নিঃস্ব পথিকদের জন্য। যেসব লোক কোন পাপ-উদ্দেশ্যে ঘরের বাহির হয় নাই- হইয়অছে কোন সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হইয়অ এবং এইরূপ দেশ-ভ্রমণ ব্যাপদেশে তাহারা একেবারে নিঃসম্বল হইয়া পড়িয়াছে, তাহাদিগকে যাকাতের এই অংশের টাকা হইতে এমন পরিমাণ দান করিতে হইবে যেন তাহা দ্বারা তাহাদের তাৎক্ষণিক অনিবার্য প্রয়োজন পূর্ণ হয় এবং নিজ ঠিকানায় ফিরিয়া যাইতে পারে। এমন কি, যেসব মেহনতী ও শ্রমজীবী লোক কাজের সন্থানে এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাইতে চাহে; কিন্তু তাহাদের পথ খরচের সংস্থান হয় না বলিয়া যাইতে পারে না, এইরূপ লোকদিগকে ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল এই অংশের অর্থ হইতে যাতায়াতের খরচ দান করিবে। কোন গ্রামবাসী শ্রমিক শহরে আসিয়া উপার্জন করিতে থাকা কালে আকস্মিক অনিবার্য কারণে যদি তাহাকে গ্রামে (ফিরিয়অ) যাইতে হয়, এবং তাহার পথখরচ কিছুই না থাকে,তবে তাহাকে লোকদের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার হাত দারাজ করিতে বাধ্য না করিয়া ইসলামী রাষ্ট্রই তাহার প্রয়োজন পূরণ করিয়া দিবে। এইসব আকস্মিক প্রয়োজনশীল লোকের নিজ নিজ ঘরে যদি বিপুল পরিমাণের অর্থ-সম্পদও থাকিয়া থাকে, তবুও তাহাকে এই সময় যাকাতের অর্থ হইতে সাহায্য দান করা শরীয়ত বিরোধী কাজ হইবে না।
যাকাতের এই অংশের অর্থ হইতে কেবল যে নগদ টাকা দিয়া বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা হইবে তাহাই নয়। পথিকদের জন্য মুসাফিরখানা, ওয়েটিং রুম, সাধারণ গোসলখানা ইত্যাদিও তৈয়ার করা যাইতে পারিবে। যেসব রাস্তাঘাট ও পুল ভাংগিয়া যাওয়অর দরুণ সাধারণ লোকদের পথ চলাচল কঠিন হইয়া পড়িয়াছে তাহাও এই অংশৈর অর্থ দ্বারা মেরামত বা পুণনির্মাণ করা যাইবে।
যাকাতের অর্থ যে পরিমাণই আদায় হউক না কেন, তাহা যে সব সময় বাধ্যতামূলকভাবে আটটি খাতের প্রত্যেকটিতে ব্যয় করিতে হইবে, ইসরামী অর্থনীতি এমন কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নাই। প্রয়োজন হইলে উহার বিশেষ একটি খাতেও যাকাতের যাবতীয় অর্থ ব্যয় করা যাইতে পারে। [কুরআন মজীদে যাকাত ব্যয়ের মোট আটটি খাত নির্ধারণের অর্থ এই নয় যে, উহা ভাগ ভাগ করিয়া আটওটি খাতে ব্যয় করিতে হইবে। বরং তাৎপর্য হইল, এই আটটি খাতে বা উহার যে কোন একটি খাতেও ব্যয় করা যাইবে।]
এ পর্যায়ে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, যাকাত বাবদ আদায়কৃত অর্থ আঞ্চলিকভাবে বন্টন করা আবশ্যক। স্থানীয় বায়তুলমালে উক্ত অর্থ জমা করা এবং উহারই মাধ্যমে সংশ্লিস্ট অঞ্চলে তাহা বন্টন করা বাঞ্ছনীয়। কেননা নবী করীম (স) একস্থানে আদায়কৃত যাকাত ও সদকা অন্যত্র লইয়া যাওয়অকে সমর্থন করেন নাই। এই সম্পর্কে হাদীস অত্যন্ত স্পষ্টভাষী। তবে নিতান্ত প্রযেঅজন দেখা দিলে তখনকার কথা স্বতন্ত্র। প্রসঙ্গত বলিয়া রাখা ভাল যে, আটটি খাতের বাহিরে অন্য কোন খাতে যাকাতের টাকা ব্যয় করা কিছুতেই যায়েয হইতে পারে না।
নবী করীম (স) বলিয়াছেন:
(আরবী**********)
আল্লাহ তা’আলা যাকাতের ব্যয়খাত নির্ধারণে কোন নবী বা অপর কাহারো ফয়সালার অপেক্ষায় থাকিতে রাযি হননাই। তিনি নিজেই এ খাত নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন এবং তিনি ইহার ব্যয়খাতকে আটটি ভাগে ভাগ করিয়াছেন।
বর্তমান কালের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ব্যক্তিকে অর্থোপার্জনের অবাধ স্বাধীনতা দান করা হইয়াছে এবং গরীবদের সাহায্যার্থ তাহাদের নিকট হইতে ইনকাম-ট্যাক্স আদায় করার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। কিন্তু কার্যত ইনকাম ট্যাক্স বাবদ আদায়কৃত অর্থ দরিদ্র জনগণের কোন কল্যাণেই ব্যবহৃত হয় না, তাহা ধনীদের পকেটেই প্রত্যাবর্তন করিয়া থাকে। কারণ রাষ্ট্র-সরকারসমূহ ধনীদের নিকট হইতে মোটা রকমের অর্থ ঋণ বাবদ গ্রহণ করিয়া থাকে এবং ইনকাম-ট্যাক্স বাবদ লব্ধ অর্থ সেই ঋণের সুদ আদায় করিতে-ই ব্যয় হইয়া যায়। ফলে দেশে অর্থ-সম্পদের আবর্তনের পরিবর্তে উহার সমগ্রটা মুষ্টিমেয় পুঁজিদারদেরই কুক্ষিগত হইয়া থাকে। বস্তুত ইসলামী অর্থনীতি ছাড়া নিখিল মানুষের সর্ববিধ কল্যাণ সাধথন করার আর কোন পন্থাই নাই- থাকতে পারে না।
কুরআনে অবর্ণিত ব্যয়ের খাত
বায়তুল মালের ব্যয়
ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল হইতে আরো অনেক খাতে অর্থ ব্যয় করিতে হয়, যাহার উল্লেখ কুরআন মজীদে করা হয় নাই। ইসলামী অর্থনীতি নিত্য নূতন উদ্ভাবিত প্রয়োজন অনুাসারে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করার সীমাবদ্ধ অনুমতি ইসলামী হুকুমাতের রাষ্ট্র-প্রধানকে দিয়াছে। তন্মধ্যে এখানে বিশেষ কয়েকটি খাত সম্পর্কে আলোচনা এবং সেই সঙ্গে উক্ত খাতসমূহে অর্থ ব্যয় করার উপযুক্ত মানের উল্লেখ করা যাইতেছে।
রাষ্ট্রপ্রধানের বেতন
ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধানের বেতন বায়তুলমাল হইতেই আদায় করা হইবে। নবী করীম (স) মুসলমানদের সামগ্রিক আয় হইতেই যে অংশ গ্রহণ করিতেন, তাহা হইতেই তাঁহার এবং পরিবার-পরিজনের জীবিকা নির্বাহ হইত।
তাহার প্রথম খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত আবূ বকর (রা)কেই ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল হইতে বেতন দেওয়া হইত। হযরত আবূবকর (রা) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে ব্যবসায় করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেন। খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পরও যখন হযরত উমর ফারূক (রা) মুসলমানদের পক্ষ হইতে বলিলেন: “আপনি ব্যবসায়কার্যে লিপ্ত হইলে মুসলমাদের সামগ্রিক ও রাষ্ট্রীয় কার্য অনেকখানি ব্যাহত হইবে। অতএব আপনি ইহা ত্যাগ করুন।
হযরত আবূ বকর (রা) নিজের রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পরিবারবর্গের জীবিকা নির্বাহের দায়িত্বের কথা চিন্তা করিয়া বলিলেন: “জনগণের সামগ্রিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালন করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়-বাণিজ্যও চালাইয়া যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এই কাজে পরিপূর্ণ নির্লিপ্ততা ও ঐকান্তিকতার সহিত আত্মনিয়োগ করা আবশ্যক। ওদিকে আমার ও পরিবারবর্গের জৈবিক প্রয়োজনও রহিয়াছে।”
অতঃপর মুসলমানদের মজলিসে শু’রায় খলীফাকে বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং তাঁহার প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার উপযোগী পরিমাণ অর্থ ইসলামী হুকুমাতের বায়তুলমাল হইতে দেওয়অর ব্যবস্থা করা হয়। [বুখারী শরীফ ও তারিখ-ই তাবারী (৪র্থ খণ্ড)]
রাষ্ট্র-প্রধানের বেতনের হার
রাষ্ট্র-প্রধানকে কি পরিমাণ বেতন দেওয়া হইবে, এ সম্পর্কে হযরত উমর ফারূক (রা)-এর একটি নীতি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেন:
(আরবী***************)
‘তোমাদের সামগ্রিক ধন-সম্পদ ইয়াতীমেরধন-সম্পদের সমতুল্য এবং আমি যেন ইয়াতীমের মালেরই রক্ষণাবেক্ষণকারী। অতএব আমি যদি ধনী হই- অভাবী না হই তবে আমি বায়তুলমাল হইতে কিছুই গ্রহণ করিব না। আর যদি দরিদ্র ও অভাব হই, তবে অপরিহার্য পরিমাণ কিংবা সাধারণ প্রচলিত মানের বেতনেই আমি গ্রহণ করিব।
হযরত উমর ফারূক (রা)-এর এই বাণীটি ইয়াতীমের ধন-সম্পত্তির হিফাজতকারী সম্পর্কে আল্লাহর নিম্নলিখিত বাণীর ভিত্তিতেই উক্ত হইয়াছিল:
(আরবী***************)
ইয়াতীমের ওলী বা অভিভাবক যদি ধনী হয় তবে ইয়াতীমের মাল হইতে তাহার বেতন গ্রহণ না করাই উচিত। আর সে গরীব হইলে সাধারণ প্রচলিত পরিমাণ অনুযায়ী (বেতন) গ্রহণ করিবে।
মোট কথা ইসলামী রাষ্ট্রর রাষ্ট্র-প্রধানের বেতনের হার এই আয়াত অনুসারে তাহাই হইবে, যাহা তাহার প্রয়োজন ও সাম্প্রতিক দ্রব্য-মূল্য অনুসারে সাধারণ প্রচলিত পরিমাণ বলিয়া বিবেচিত হইবে।
হযরত আবূবকর (রা)-কে প্রথম দৈনিক ‘তিন দিরহাম’ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদের বর্ণনা অনুসারে প্রথম তাঁহার জন্য বার্ষিক ‘দুই হাজার’ দিরহামৎ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু হযরত আবূ বকর (রা) যখন ইহা দ্বারা তাঁহার প্রয়োজন পূর্ণ হইবে না বলিয়া মত প্রকাশ করিলেন, তখন বাৎসরিক আরো পাঁচশত দিরহাম বৃদ্ধি করিয়া দেওয়া হয়।
হযরত উমর ফারূকত (রা) বায়তুলমাল হইতে বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম বেতন গ্রহণ করিতেন।
হযরত উসমান (রা) খলীফা হইয়াও বায়তুলমাল হইতে কিছুই গ্রহণ করিতেন না। কারণ আল্লাহ তাহাকে বিপুল ধন-সম্পদ দান করিয়াছিলেন। এই জন্য তিনি বায়তুলমাল হইতে কিছু গ্রহণ না করিয়া বরং নিজের ধন-সম্পদ দ্বারা বায়তুলমালকে অধিকতর সমৃদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিলেন।
এ সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা এই যে, নিম্নতম প্রয়োজন নিশ্চিতরূপে পূর্ণ হওয়ার পরিমাণ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করিতে পারিতেন না। জনগণের মঞ্জুরী ব্যতীত নিজের জন্যও কোন জিনিস গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নীতি-বিরোধী কাজ বলিয়া মনে করিতেন। হযরত আবূবকর (রা) নিজের জন্য নিম্নতম প্রয়োজন পূর্ণ করার উপর এত বেশী গুরুত্ব আরোপ করিতেন যে, উহা এক বিন্দু পরিমাণ বেশী গ্রহণ করিতে তিনি কখনই প্রস্তুত হইতেন না। তাঁহার স্ত্রী দৈনিক প্রয়োজন পূর্ণ করার পরও একটি বিশেষ খাধ্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে মাসিক বেতন হইতে কিছু পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। কিন্তু হযরত আবূবকর (রা) উহাকে নিজের নিম্নতম প্রয়োজনের অতিরিক্ত মনে করিয়া উহার সবটাই বায়তুলমালে পিরাইয়া দিলেন। এমনকি, মৃত্যুর পর তাহার নিজ ধন-সম্পদ হইতে সেই পরিমাণ সম্পদই পিরাইয়া দিয়াছিলেন- যাহা তিনি বেতন বাবদ বায়তলমাল হইতে ইতিপুর্বে গ্রহণ করিয়াছিলেন।
সরকারী কর্মচারীদের বেতন
ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-প্রধানের ন্যায় অন্যান্য সরকারী কর্মচারীর বেতনও বায়তুলমাল হইতে আদায় করা হইবে। কারণ ইহারা সকলেই মুসলমান জনগণের সামগ্রিক ও সামাজিক রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম আঞ্জাম দেওয়ার ব্যাপারে নিরন্তর আত্মনিয়োগ করিয়া থাকে; অতএব জনগণের সামষ্কি ধন-ভান্ডার- বায়তুলমাল হইতে- তাহাদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করিয়া দিতে হইবে, ইহাই স্বাভাবিক। নবীকরীম (স) নিজে সরকারী কর্মচারীদের বেতন দিয়াছেন এবং খুলাফায়ে রাশেদুনের যুগেও অনুরূপ কাজ হইয়াছে।
বস্তুত রাষ্ট্র-সরকারই হইতেছে মানবীয় শক্তি(Man Power) ও শ্রম শক্তির (Labour) সর্বশ্রেষ্ট খরিদ্দার। কাজেই সাধারণভাবে দেশের শ্রম ও চাকুরীর বেতন নির্ধারণের উপর সরকার নির্ধারিত বেতনের হার ও বেতন নির্ধারণের মূলনীতি প্রত্যক্ষ প্রভাব তীব্রভাবে প্রতিফলিত হইয়া থাকে। রাষ্ট্র-সরকার যদি বেতনের সুবিচারপূর্ণ হার নির্ধারণ করে, তবে সমগ্র দেশেই সেই মান অনুযায়ী মজুর-শ্রমিক ও চাকরিবীবিদের বেতননির্ধারিত হইতে থাকিবে। এই জন্য ইসলামী অর্থনীতি সাধারণভঅবে সকল প্রকার মজুর-শ্রমিকদের-বিশেষ করিয়া সরকারী কর্মচারীদের- বেতনের হার নির্ধারণের মূলনীতি উপস্থিাপিত করিয়াছে।
দুনিয়ার পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে চাকরিজীবিদের বেতন নির্ধারণের ব্যাপারে তিনটি মৌলিক ত্রুটি বিদ্যমান।
প্রথম,বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সরকারী কর্মচারীদের কমপক্ষে যে বেতন দেওয়া হয়, তাহা দ্বারা একটি পরিবারের ভরণ-পোষণ সম্পন্ন হওয়া তো দূরের কথা, এক ব্যক্তি স্বাধীনভাবে জীবন-যাপনর পক্ষেও তাহা যথেষ্ট হয় না।
দ্বিতীয়ত, বেতনের হার নির্ধারণের ব্যাপারে একজন চাকরিজীবির অর্থনৈতিক দায়িত্ব ও পোষ্যদের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র চিন্তা করা হয় না- সেদিকে লক্ষই দেওয়া হয় না। ফলে দেখা যাইতেছে য, কোন কোন কর্মচারী একাকী ও পারিবারিক দায়িত্বমুক্ত হইয়াও তিন-চারশ’ টাকা বেতন পাইতেছে, আর অন্য দিকে এক ব্যক্তির উপর ৮/১০ জন লোকের ভরণ পোষণের দায়িত্ব অর্পিত হওয়া সত্ত্বেও সে মাত্র চার-পাঁচশ’ টাকা বেতন পাইতেছে।
আর তৃতীয়ত, বেতন নির্ধারণের ব্যাপারে অবিচারমূলক আকাশছোঁয়া পার্থক্য সৃষ্টি করা হইয়াছে। সাধারণভাবে সকল দেশেই কমসে কম ও সর্বাপেক্ষা অধিক তেনের মধ্যে পার্থক্য ১-৩০ এর সমান। অন্য কথায় একতলা বাড়ি ও তিরিশ’ তলা বাড়ির পাশাপাশি দাঁড় করিলে যে পার্থক্য চোখের সম্মুখে উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হইয়া ধরাপড়ে, বর্তমানকালের বিভিন্ন সরকারী কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত বেতনের হারেও অনুরূপ পার্থক্যই রক্ষিত হইয়াছে। একই সমাজের কর্মচারীদের বেতনের এই পার্থক্য সমাজ ক্ষেত্রে ঠিক তদ্রু এক মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করিয়াছে, যেমন বিপর্যয় হইতে পারে ঘন্টায় এক মাইল গতির একটি গাড়িকে ঘন্টায় ত্রিশ মাইল দ্রুতগামী একটি গাড়ির সহিত জড়িয়া দিলে।
এইরূপ অবিচারমূলক বেতন নির্ধারণের পরিমাণ অনিবার্যরূপে অত্যন্ত মারাত্মক হইয়া দেখা দেয়। একদিকে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের মনে- যাহারা মূলতই এক একটি দেশ ও রাষ্ট্রের মেরুদন্ড- রাষ্ট্রের প্রতি ভয়ানক বীতশ্রদ্ধা ও অনাসক্তির ভাব জাগিয়া উঠে। তাহারা নিজেদের অপরিহার্য প্রয়োজন পূর্ণ করিবার জন্য দুর্নীতি করিতে ও ঘুষ লইতে বাধ্য হয়। কম বেতন প্রাপকদের মনে স্বভাবতঃ অধিক প্রাপকদের মনে অহংকার, প্রলয়ংকর মানসিক ভাব জাগিয়া উঠে। ইহার পরিণামে কোন রাষ্ট্রই যে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাইতে পারে না, তাহা নিঃসন্দেহ।
কিন্তু ইসলামের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এই অত্যাচরমূলক পদ্ধতির তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছে, মানুষের পরস্পরের মধ্যে এইরপ বৈষম্য ও পার্থক্য সৃষ্টি ইসলামী অর্থনীতি মাত্রই বরদাশত করিতে পারে না।
ইসলামী অর্থনীতি অনুযায়ী সরকারী কর্মচারীদে বেতন নির্ধারণের ব্যাপারে কর্মচারীর যোগ্যতা ও কাজের স্বরূপ প্রয়োজন ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সম্পর্কে বিশেষ বিবেচনা করা হইবে। নবী করীম (স) এ সম্পর্কে নিম্নলিখিতরূপ একটি নীতি ঘোষণা করিয়াছেন:
(আরবী**********)
যে লোক আমাদের সরকারী কর্মচারী হইবে, [সে যদি বিবাহন না করিয়া থাকে, তবে] সে বিবাহ করিয়া লইবে। তাহার কোন গৃহ চাকর না থাকিলে সে তাহা লইবে। তাহার ঘর না থাকিলে সে একখানা ঘর প্রস্তুত করিবে। ইহার অধিক যে গ্রহণ করিবে সেহ য় বিশ্বাস-ঘাতস, না হয় চোর।
এই হাদীস ছোট-বড় সকল প্রকার সরকারী কর্মচারীদের বেতন সম্পর্কে একটি স্থায়ী মান নির্ধারণ করে। ইসলামী রাষ্ট্রের কর্মচারী হওয়ার দিক দিয়া উচ্চপদস্থ নিম্নপদস্থের মধ্যে কোনরূপ তারতম্য নাই। সকল কর্মচারীই সমান দায়িত্বশীল। অতএব রাষ্ট্র সরকার সকলেই বুনিয়াদী প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করিবে। ইসলামের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি একজন গভর্ণর ও একজন পিয়ন চাপরাশর বুনিয়াদী প্রয়োজনের মান সম্পর্কেক কোনই পার্থক্য করে নাই। খুলাফায়ে রাশেদুরে যুগেও বেতনের হার উক্ত হাদীস অনুসারেই নির্ধারিত হইয়াছিল।
এ সম্পর্কেক হযরত উমর ফারূক(রা)-এর নিম্নলিখিতত বক্তৃতাংশ হইতে চূড়ান্ত মূলনীতি লাভ করা যায়।
(আরবী**********)
*এক ব্যক্তি ইসলামের জন্য কি পরিমাণ দুঃখ ভোগ করিয়াছে,
*এক ব্যক্তি ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে কতখানি অগ্রসর হইয়াছে,
*এক ব্যক্তির ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কতখানি কষ্ট স্বীকার করিয়াছে,
* এক ব্যক্তির ইসলামী জীবন-যাপনের দিক দিয়া প্রকৃত প্রয়োজন কতখানি।
* এবং এক ব্যক্তির উপর তাহার পরিবারের কতজন লোকের ভরণ পোষণের দায়িত্ব রহিয়াছে।
একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, বেতন নির্ধারণের জন্য ইহা অপেক্ষা সুবিচারপূর্ণ ন্যায়-নীতি আর কিছুই হইতে পারে না। ইসলামী অর্থনীতিতে বেতন নির্ধারণ সম্পর্কে গৃহীত এই নীতিকে বলা হয়- “ভরণ-পোষণেল দায়িত্ব পালনউপযোগী বেতন দেওয়ার নীতি”। খুলাফায়ে রাশেদুনের যুগে এই নীতিই কার্যকর ছিল। ফল একটি পরিবারে যখনি একটি সন্তানের জন্ম হইত, তখনি বায়তুলমাল হইতে তাহার জন্য বৃত্তিদান শুরু করা হইত।
দ্বিতীয়তঃ ইসলামী অর্থনীতি বেতন দেওয়ার ব্যাপারে সংখ্য-সাম্য বা পরিমাণ-সাম্যকে কখনো ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে নাই। কারণ বস্তুতই তাহা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। কিন্তু তাহাতে আকাশ পাতা অবিচারমুলক বৈষম্যকেও বরদাশত করা হয় নাই। বরং তাহা চিরতরে নির্মুল করিয়াছে। কর্মচারীদের অন্তর্নিহিত স্বাভাবিক যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, কাজের দায়িত্বের স্বরূপ এবং পদমর্যাদার স্বাভাবিক পার্থক্যকে ইসলামী অর্থনীতি স্বীকৃতি দিয়াছে। বেতনের হার নির্ধারণের ব্যাপারে এই পার্থক্য অবশ্যই বর্তমান থাকিবে। ইসলামী অর্থনীতি নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের অধিকার হরণ করিয়া, তাহাদের অনিবার্য প্রয়োজন অপূর্ণ রাখিয়া বড় বড় অফিসারদরে বিলাস বাসনের ব্যবস্থা করার অনুমতি কখনই দিতে পারে না।
লা-ওয়ারিস শিশু সন্তান প্রতিপালন
লা-ওয়ারিশ শিশু-সন্তানদের প্রতিপালন করাও ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য। যে সন্তান নিজে উপার্জনে সক্ষম নয়, যাহার নিজের কোন অর্থ-সম্পদ নাই, কিংবা যাহার কোন গার্জিয়ান বা কোন নিকটাত্মীয়ও এমন নাই যে তাহার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারে; ইসলামী রাষ্ট্রই তাহার লালন-পালন ও জীবিকার ব্যবস্থা করার জন্য দায়ী হইবে, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র এই ধরনের সন্তানদের মোটেই নিষ্কর্ম বসিয়া খাইতে দিবে না তাহাদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা করিয়া দিবে এবং স্বাধীনভাবে জীবিকা উপার্জনের উপযোগী করিয়া গড়িয়া তুলিবার জন্য বিশেষ শিল্পকার্যে ট্রেনিং দিবে। অমুসলিমদের লা-ওয়ারিস সন্তানদের সম্পর্কেও এই নীতি প্রযোজ্য হইবে।
কায়েদী ও অপরাধীদের ভরণ-পোষণ
যেসব অপরাধীকে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হইবে, যেসব অপরাধীর পৌনপুনিক অপরাধের দরুণ জনগণ অতিষ্ট হইয়া পড়িযাছে বলিয়া তাহাদিগকে দীর্ঘকাল বন্দী করিয়া রাখার সিদ্ধান্ত হইবে, তাহাদের ভরণ-পোষণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদী পরিবেশন করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অতএব তাহা বায়তুলমাল হইতে আদায় করা হইবে। যেসব লা-ওয়ারিসকয়েদী মৃত্যুমুখে পতিত হইবে, তাহাদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করাও ইসলামী রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হইবে।
ক্ষতিপূরণ দান
ইসলামী রাষ্ট্রের কোন সামষ্টিক কাজের জন্য কিংবা যুদ্ধের ঘাঁটি নির্মাণ, সৈনিকদের চলাচল অথবা বৈদেশিক আক্রমণের ফলে নাগরিকদের বিশেষ কোন ক্ষতি সাধিত হইলে উহার ক্ষতিপূর দান করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য হইবে। হযরত উমর ফারূক (রা)-এর নিকট একজন কৃষক আসিয়া অভিযোগ করিল যে, সিরিয়ার একদল সৈন্যের পথ অতিক্রমকরার সময় তাহার শস্যক্ষেত নষ্ট হইয়া গিয়াছে। এই কথা শুনিয়া তিনি বায়তুলমাল হইতে তাহার ক্ষতিপূরণ বাবদ দশ হাজার দিরহাম দান করেন।
মোট কথা, ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালের উপর এইরূপ বিভিন্ন প্রকার খরচের অসংখ্য ও বিরাট দায়িত্ব আসিয়া পড়ে, যাহা পূরণ করা উহাদের অবশ্য কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এই সব দায়িত্ব পালনের পরও বায়তুলমালের ধনসম্পদ উদ্বৃত্ত থাকিলে তাহাও জনগণেরই কল্যাণের জন্য ব্যয় করিতে হইবে। হযরত উমর ফারূক (রা) তাহাই করিয়াছেন। তিন উদ্বৃত্ত অর্থ-সম্পদ হইতে কেবল শহরবাসীদের জন্যই নয়, গ্রামবাসীদের জন্যও-কে কত পাইতে পারে, তাহা রীতিমত পরীক্ষা করিয়া সেই পরিমাণ খাদ্য বরাদ্দ করিয়া দিয়াছিলেন। উত্তরকালে সামষ্টিক অর্থ সম্পদ যখন আরো বৃদ্ধি পাইয়াছিল, তখন তিনি দেশবাসীর জন্য পোষাকেরও ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। তিনি তাহদের জন্য সুদৃঢ় ও উন্মুক্ত বায়ুময় ঘর-বাড়ি নির্মাণ করিয়াছিলেন। কুফা, বসরা ও ফুসতাত প্রভৃতি এলাকায় নূতন নূতন শহর স্থাপন করিয়াছিলেন। তাহাদের জন্য প্রশস্ত রাস্তাঘাট, দোকান ও চক ইত্যাদি নির্মাণ করিয়াছিলেন। এমনকি, প্রত্যেক মহল্লার লোকদের উট বাঁধিবার জন্য আলাদা স্থানও তৈয়ার করিয়া দিয়াছিলেন। [মাঅর্দী লিখিত “আল-আহকামুস-সুলতানীয়া” গ্রন্থে ইহার বিস্তার বিবরণ লিখিত আছে।] নূতন নূতন খাল কাটিয়া ও ঝর্ণাধারা বানাইয়া শহরে ও গ্রামে জল সেচের নিখুত ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ফলে ইসলামী রাজ্যের প্রত্যেকটি বাসিন্দাই আহারের জন্য খাদ্য, পরিধানের জন্য পোশাক এবং থাকিবার জন্য বাড়িঘর করিয়াছিলেন। হযরত উমর ইবনে আবদুল আজজের সময় অন্ধ ও গরীব নাগরিকদের পথ চলার কাজে সাহায্য করার জন্য এবং পঙ্গু ও অক্ষম লোকদের সেবার জন্য সরকারী খরচায় লোক নিযুক্ত করা হইয়াছিল। বিবাহে সঙ্গতিহীন যুবক-যুবতীদের বিবাহের ব্যবস্থা ও তৎসংক্রান্ত খরচপত্রও সরকারের তরফ হইতে বহন করা হইয়াছিল। ফল কথা, ইসলামী অর্থনীতি প্রবর্তিত ন্যায়নিষ্ঠা ও সামাজিক নিরাপত্তার ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের কোথাও দারিদ্র বা অনশন ইত্যাদির নাম-নিশানা ছিল না। বস্তুত ইসলামী অর্থনীতির ইহাই বৈশিষ্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট্য দেশ কাল নির্বিশেষে সকল সময় ও সকর দেশেই লা.ভ করা যাইতে পারে।
অমুসলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইসলামী অর্থনীতির এই সামাজিক নিরাপত্তা কেবল মুসলিম নাগরিকদিগকেই দান করা হয় নাই, প্রকৃতপক্ষে ধর্মমত নির্বিশেষ সকল দেশবাসীই এই নিরাপত্তার লাভ করিতে পারিবে। ইসলামের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে যেসব স্থানে ‘মিসকীন’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে এবং রাষ্ট্রীয় ধন-সম্পদে তাহাদের অধিকারের কথা ঘোষণা করা হইয়াছে, সকল ক্ষেত্রেই ধর্মমত নির্বিশেষে সকল নিঃস্ব-দরিদ্র নাগরিকদের বুঝানো হইয়াছে।
হযরত আবূ বকর (রা)-এর সময় ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (রা) ‘হীরা’ বাসীদের সহিত যে সন্ধির চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি স্পষ্টভাবে লিখিয়াছিলেন:
(আরবী***********)
এবং আমি তাহাদিগকে এই অধিকার দান করিলামযে, তাহাদের কোন বৃদ্ধ যদি উপার্জন ক্ষমতা হারাইয়া ফেলে কিংবা কাহারো উপর কোন আকস্মিক বিপদ আসিয়া পড়ে, অথবা কোন ব্যক্তি যদি সহসা এতদূর দরিদ্র হইয়া পড়ে যে, তাহার সমাজের লোকেরা তাহাকে ভিক্ষা দিতে শুরু করে, তখন তাহার উপার ধার্য জিজিয়া কর প্রত্যাহার করা হইবে, সেই সঙ্গে তাহার ও তাহার সন্তানদের ভরণ-পোষণ ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল হইতেই করা হইবে যতদিন সে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হইয়া থাকিবে।[কিতুবুল খারাজ, ১৪৪ পৃঃ]
হযরত উমর ফারূক (রা) দেমাশক যাত্রাকালে কুষ্ঠরোগগ্রস্ত এক খৃস্টান জনগোষ্ঠীর নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন। তাহাদের এই অবস্থা দেখিয়া তিনি তাহাদিগকে সাদকার ফান্ট হইতে অর্থদান করিবার নির্দেশ দিয়াছিলেন।[বালাজুরি লিখিত ‘ফতহুল বুলদান’।]
হযরত উমর (রা) এক বৃদ্ধ ইয়াহুদী ব্যক্তিকে ভিক্ষা করিতে দেখিয়া তাহাকে ভিক্ষা করার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। সে বলিল, আমাকে জিজিয়া আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু তাহা আদায় আমার কোনই সামর্থ্য নাই। হযরত উমর (রা) ইহা শুনিয়া তাহাকে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন, বায়তুলমাল খাজঞ্জীকে ডাকিয়া আদশে করিলেন: ‘ইহার অবস্থার প্রতি লক্ষ্য কর, ইহার জন্য বৃত্তি নির্দিষ্ট করিয়া দাও, এবং ইহার নিকট হইতে জিজিয়া লওয়া বন্ধ কর।’ অতঃপর বলিলেন: “আল্লাহর শপথ, ইহার যৌবন শক্তিকে আমরা কাজে ব্যবহার করিব, আর বার্ধক্যের অক্ষম অবস্থায় ইহাকে অসহায় করিয়া ছাড়িয়া দিব, ইহা কোনমতেই ইনসাফ হইতেপারে না”। [আবূ ইউসুফ লিখিত ‘কিতাবুল খারাজ-১৮৮ পৃঃ]
হযরত উমরের এই কথার শোষাংশ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্র। রাষ্ট্র সরকার ধনশালীদের নিকট হইতে কর, রাজস্ব ও চাঁদা ইত্যাদি আদায় করবে, যুবশক্তিকে জাতীয় কাজে নিযুক্ত করিবে, ইহা দেশবাসীর উপর রাষ্ট্রে স্বাভাবিক অধিকার, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু একজন নাগরিক যখন দরিদ্র হইয়া পড়িয়া কিংবা বৃদ্ধ হইয়া উপার্জন ক্ষমতা হারাইবে, তখন তাহার যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্র-সরকারকেই গ্রহণ করিতে হইবে- ইহা রাষ্ট্রের উপর নাগরিকদের স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার, ইহাও যথাযথভাবে পূর্ণ করা অপরিহার্য। ইসলামী অর্থনীতির এই বৈশিষ্ট্য অতুলনীয়। দুনিয়ার পুঁজিবাদী ও অন্যান্য অর্থনীতির শুধু সরকারী কর্মচারীদের জন্য বেতনের একটা সামান্য অংশ পেনশন বাবদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় বটে; কিন্তু তাহাতে তাহার মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হয় কিনা, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র করা হয় না, তাহাদের দায়িত্ব গ্রহণ করা হয় না। এই কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়।