অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে যাকাত
যাকাত ইসলামের বুনিয়াদী ইবাদাতসমূহের অন্যতম। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যেক মুসলিম নাগরিককে ইহার অপরিহার্যতা সম্পর্কে যেমন বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে, অনুরূপভাবে ইহা সুনিয়মিতরূপে আদায় করা ও প্রত্যেক ধনশালী ব্যক্তির উপর আইনত একান্তই কর্তব্য।
এতদ্ব্যাতীত প্রথমত যাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মেরুদন্ড। পুঁজিবাদী সমাজের অর্থব্যবস্থায় যেমন ভিত্তি হইতেছে সুদ, এবং কমিউনিস্ট সমাজের বুনিয়াদী অর্থনীতি হইতেছে সম্পত্তির জাতীয়করণ, ইসলামী সমাজের তদনরূপ গুরুত্ব রহিয়াছে যাকাতের। কিন্তু ধর্মব্যবস্থা ও অর্থনীতি এই উভয় দিকদিয়া যাকাতের গুরুত্ব এবং উহার সর্বব্যাপকতা অনুধাবন করিতে না পারিয়া, বর্তমান সমাজের লোক ইহার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছে। এক শ্রেণীর লোক ইহাকে মধ্যযুগীয় ‘খয়রাতি ব্যবস্থা’ মনে করিয়া ইহার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। আর আধুনিক কালের বস্তুবাদী অর্থশাস্ত্রবিদগণ যাকাতের কল্যাণকারিতা- অন্য কথায় ইহার অর্থনৈতিক মূল্য- স্বীকার করিতে আদৌ প্রস্তুত নহেন। তাহারা মনে করেন, শতকরা আড়াই টাকা হিসাবে যাকাত আদায় করিলে শতকরা নব্বেই জন অভাবগ্রস্ত ও দারিদ্রপিষ্ট সমাজের কি-ই বা কল্যাণ যাইতে পারে এবং যুগ যুগ সঞ্চিত এই অর্থনৈতিক অসাম্য ইহা দ্বারা দূর করাই বা কিরূপে সম্ভব হইবে? যাকাত সম্পর্কে তাহাদের এইরূপ ধারণার কারণ সুস্পষ্ট। ইহারা আজ পর্যন্ত যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি পৃথিবীর কোন অংশেই প্রত্যক্ষ করিতে পারেন নাই বলিয়া উহার বাস্তব ও ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কে কোনরূপ ধারণা করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই। দ্বিতীয়ত, একটি নীতি হিসাবেও (Theoretically) তাহারা ইহার পর্যালোচনা, গবেষণা এবং ইহার অর্থনৈতিক মুল্য যাচাই করিয়া কখনই দেখেন নাই, বরং তাহারা ধনী লোকদের দেখিয়াছেন গরীব ভিখারীদের মধ্যে যাকাত দানের বিলাসিতা করিতে; দানের দোহাই দিয়া সম্মান, প্রতিপত্তি সুখ্যাতি লাভ করিতে। এইরূপ অবাঞ্চিত দৃশ্য কোন চিন্তাশীল ও আত্ম-মর্যাদা-বোধ-সম্পন্ন মানুষকেই যে আকৃষ্ট করিতে পারে না তাহা বলাই বাহুল্য। বস্তুত যাকাত আদায়ের এহেন অবাঞ্ছিত ও অপমানকর পদ্ধতি ইহার কল্যাণকারিতা ও অর্থনৈতিক মূল্য সম্পর্কে অন্তত বিদগ্ধ সমাজকে নিরাশ করিয়াছে। যাকাত যে একটি ‘দান’ নয়, ইহা আদায় করার বর্তমান পদ্ধতি যে ভুল ও ইসলাম বিরোধী এবং এক উন্নত নির্ভুল ও সুষ্ঠু পন্থায় যাকাত আদায় করাই যে ইসলামের নির্দেশ- এইসব কথা জানিতে পারিলে যাকাত সম্পর্কে লোকদের বর্তমান ধারা পরিবর্তিত হইবে, তাহা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
যাকাত একদিকে ধন-সম্পদকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে। ইহা ধন-সম্পদের উপর প্রথম আল্লাহর হক এবং দ্বিতীয়ত সমাজের জনগণের হক। এক দিকে ব্যক্তির কল্যাণে ইহা ব্যয়িত হইবে। অপরদিকে জনগণের সাধারণ কল্যাণেও ইহা নিয়োজিত হইবে। ব্যক্তি সমষ্টি-প্রাসাদেরই অংশ ইট। এক ব্যক্তির কল্যাণেও সমষ্টিরই কল্যাণ সাধিত হয় এবং সামগ্রিক কল্যাণের প্রকাশ হয় স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির দিকে।
মূলত যাকাত ধনীদের প্রতি আল্লাহ নির্দেশিত একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বিশেষ। ইসলামী রাষ্ট্রই তাহা অর্থশালী লোকদের নিকট হইতে সংগ্রহ করিবে (কেহ তাহা দিতে অস্বীকার করিলে রাষ্ট্র তাহার বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করিবে) এবং রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায়-ই তাহা সমাজের গরীবদের মধ্যে এক উন্নত ও বৈজ্ঞানিক পন্থায় বন্টন করা যাইবে।
যাকাত ব্যবস্থার প্রকৃত লক্ষ্য হইতেছে ইসলামী রাষ্ট্রে নাগরিকদের মৌলেক ও অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণ করার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করা। অভাবব গ্রস্ত ব্যক্তি, পরিবার বা এলাকায়ই ইহা বিতরণ করা হইবে। বস্ততু জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূর্ণ করার স্থায়ী নিরাপত্তা দানের জন্য ইহা এক ‘বীমা’ বিশেষ এবং ইসলামী রাষ্ট্র যে উহার প্রত্যেকটি নাগরিকেরই খাওয়া, পরা, থাকা, শিক্ষা ও চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তাহাও এই যাকাত-ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল।
অর্থনীতিবিদগণ অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দৃষ্টিতে যাকাত-ব্যবস্থার যাচাই করিলে ইহার বিপুল সম্ভাবনা দেখিয়া বিস্ময়াভিভূত না হইয়া পারিবেন না। বস্তুত যাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীন ক্রম-উৎকর্ষ সাধনের ব্যাপারে কি বিরাট কার্য সম্পাদন করিতে পারে এবং কোন প্রকার ধ্বংসাত্মক বৈপ্লবিক কার্যক্রম ব্যতিরেকেই সমাজের অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক অসাম্য দূরীভূত করিয়া এক সুষ্টু ও স্বভাবসম্মত সামঞ্জস্য বিধান করিতে সক্ষম, তাহা যাকাতের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের সাহায্যেই স্পষ্টরূপে হৃদয়ংগম করা যায়। উপরন্তু, এই বিশ্লেষণ হইতে এ কথাও প্রমাণিত হইবে যে, হযরত নবী করীম (স) যাকাতের যে হার নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, তাহার রদবদল করার প্রয়োজন নাই।
কিন্তু এই কাজ যে কত দূরূহ, কষ্টসাধ্য ও দায়িত্বপূর্ণ তাহা অর্থশাস্ত্রবিদগণই অনুভব করিতে পারেন। এই কাজে সর্ব প্রধান বাধা এই যে, এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরিসংখ্যান Facts and Figure বর্তমান অবস্থায় সঠিকভাবে জানিবার কোনই উপায় নাই। কাজেই এই ব্যাপারে আমাদের মত সাধারণ লোকদের আন্দাজ ও অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া কথা বলিতে হয়। কিন্তু তবুও এই আন্দাজ-অনুমান যে একেবারেই ভিত্তিহীন নয় তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। এই কারণে ইসলামী অর্থনীতি রূপায়ণে উৎসাহী ব্যক্তিদের এদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা একান্তই কর্তব্য।
দেশের অর্থোৎপাদনের বিভিন্ন সূত্র ও ক্ষেত্র সম্পর্কে সর্বশেষ ও সাম্প্রতিক তথ্য ও পরিসংখ্যান খোঁ করিয়া বাহির করা আমার পক্ষে সম্ভপর হয় নাই। আমার মনে হয়, তাহা না হইলে যে এ বিষয়ে কোন আলোচনাই করা যাইতে না এমন কথাও নয়। মূলত এ আলোচনার উদ্দেশ্য হইল যাকাতের কল্যাণকর ভূমিকা সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট দারণা দেওয়ার চেষ্টা করা। এজন্য যে কোন দেশের যে কোন সময়ের একটা পরিসংখ্যানকে ভিত্তি করিলেও চলিতে পারে। তাই বর্তমান আলোচনাকে আমরা এভাবেই পেশ করিতে চাহিতেছি।
সতর্কতার সহিত যে তথ্য ও পরিসংখ্যান ধরা হইয়াছে, তাহার উপর ভিত্তি করিয়া এখানে উহার যাকাতের পরিমাণ বাহিত করিতে প্রয়াস পাইব। আমাদের এই অনুমান, যাকাতযোগ্য জিনিসের সঠিক পরিমাণের অন্তত; অর্ধেক হইবে বলিয়া মনে করা যায়। কিন্তু ইহা হইতেও যে পরিমাণ যাকাত সংগ্রহ করা যাইতে পারে, তাহা বাস্তবিকই বিস্ময়কর।
কৃষি-উৎপন্ন ফসলের যাকাত
কৃষি উৎপন্ন ফসল হইতে যাকাত গ্রহণের নিয়ম নিম্নরূপ:
১. বৃষ্টি কিংবা জোয়ারের পানিতে সিক্ত জমির ফসলের ১০ ভাগের এক ভাগ।
২. কৃত্রিম উপায়ে সিক্ত জমির ফসলের ২০ ভাগের এক ভাগ যাকাত বাবদ আদায় করিতে হইবে।
৩. চারণ-ভূমির উপর কোনই যাকাত ধার্য হইবে না।
৪. বৎসরে ১০ মণ ফসল জন্মানো- এমন সব ভূখন্ডও এই হিসাবের বাহিরে থাকিবে। কারণ, তাহা হইতে ওশর গ্রহণ করা হইবে না।
৫. অমুসলমানদের জমিও ইহা হইতে বাদ পড়িবে।
কাজেই মোট আবাদী জমি হইতে এক-তৃতীয়াংশ ভাগ বাদ দিতে হইবে। এইজন্য প্রথমেই মোট উৎপন্ন ফসলের মূল্য হইতে এক-তৃতীয়াংশ বাদ দিয়া লইতে হইবে।
জমির ফসল হইতে যাহা গ্রহণ করিতে হয়, ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষা উহাকে ‘ওশর’ বলা হইলেও উহার এবং সাদারণ যাকাতের ব্যয়-ক্ষেত্র একই। কাজেই ওশরও যাকাতের সহিত সামিল হইবে।
অর্থোৎপাদনকারী মূলধনের উপরও শতকরা আড়াই টাকা হিসাবে যাকাত ধার্য হইবে। এতদ্ব্যাতীত সকল প্রকার নগদ ধন-সম্পদ, ৫২ তোলা রৌপ্য এবং তোলা পরিমাণ স্বর্ণেরও যাকাত আদায় করিতে হইবে। এই সম্পদ ব্যাংকেই জমা থাকুক কি নিজের ঘরেই সঞ্চিত রাখা হউক, অথবা অলংকাররূপেই থাকুক, তাহাতে নির্দিষ্ট হারে অবশ্যই যাকাত ধার্য হইবে। কিন্তু এই ব্যাপারে নিম্নলিখিত কথাগুলি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখিতে হইবে।
১. রিজার্ভ ব্যাংকের সমস্ত হিসাবকেই ইহা হইতে বাদ দিতে হইবে। কারণ, উহাতে সরকারের সংরক্ষিত, আমানত স্বরূপ রক্ষিত এবং প্রদত্ত মূলধনের অংশই অধিক। আর উহার উপর যাকাত ধার্য হয় নাঃ অন্যান্য ব্যাংকের হিসাবও উহাতে থাকে, কাজেই ইহার উপর যাকাত ধার্য হইলে একই মূদনের উপর অন্ততঃ দুইবার যাকাত ধার্য হওয়ার আশংকা রহিয়াছে।
২. অন্যান্য ব্যাংকমূহের যাবতীয আদায়কৃত মুলধন, রিজার্ভ ফান্ড (যেহেতু ইহাও অংশীদারদেরই আমানতিস্বত্ত্ব; ইহাকে ব্যবসায়ী মূলদনও মনে করা যাইতে পারে এবং নগদ সুরক্ষিত মুলধনও)-এই সকল মূলধনের অর্ধেক টাকা বৈদেশিক মূলদন হিসাবে আমাদর হিসাবের বাহিরে রাখিতে হইবে। অনুরূপভাবে ইন্সিওরেন্স কোম্পানী, জয়েন্ট স্টক ব্যবসায়ী কোম্পানীসমূহের অর্ধেক মূলধনই ধার্য হইবে।
৩. প্রথমত, আমদানী-রফতানী কার্যে নিযুক্ত সমস্ত মূলধনের চারভাগের একভাগ এই হিসাবের মধ্যে গণ্য করা যাইতে পারে। কারণ তাহাতে অর্ধেক পরিমাণ বৈদেশিক মূলধন থাকার সম্ভাবনা রহিয়াছে। দ্বিতীয়ত, এই ধরণের ব্যবসায়ে ব্যাংকের সাহায্যে মোট নগদ মূলধনের দিগুণ টাকার কাজ হইয়া থাকে। কাজেই এই কাজে নিযুক্ত যাবতীয় মূলধনের চার ভাগের একভাগ গণ্য করাই যুক্তিযুক্ত।
৪. আমদানী রফতানী বাণিজ্যে সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে যে মূলধন ব্যবহৃত হয় তদনুযায়ী বাহিরের শিল্প-পণ্য অভ্যন্তরীণ খরীদ্দারদের নিকট পর্যন্ত পৌঁছান এবং দেশীয় কাঁচামাল বিদেশে প্রেরণ করার নীচের দিকে চারটি পর্যায় রহিয়াছে। ব্যবসায়ের এই চারটি পর্যায়ে নিম্নরূপ:
(ক) আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী। (খ) আঞ্চলিক কমিশন এজেন্ট (গ) ছোট বাজার ও বন্দর (ঘ) সাধারণ দোকানদার।
এই চারটি পর্যায়ের প্রত্যেকটি হইতে ব্যবসায়ী পণ্য সম্মুখের দিকে অগ্রসর হেইতে শুরু করিয়া সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌছাইতে ঠিক সেই পরিমাণ মূলদনেরই প্রয়োজন হয় যাহার প্রয়োজন একমাত্র সর্বোচ্চ পর্যায়ে। অতএব একই সম্পদের ব্যবসার পণ্য আমদানী রফতানীর জন্য চারগুণ কাজ করে। হিসাব ইহারই অনুরূপ ধরিতে হইবে।
৫. সাধারণ অনুমানের সাহায্যে আমদানী-রফতানী বাণিজ্য এবং অভ্যন্তরীন বাণিজ্য- অন্য কথায় পণ্যদ্রব্যের চলাচলের হার ৪-১ ধরা হইয়াছে। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়ের চারগুণ অধিক মূলধন ধার্য করা হইয়াছে।
৬. মোট ব্যবসায়ী মূলধনের অর্ধেক এই ধারণায় বাদ দেওয়া হইয়াছে যে, ইহাতে বৈদেশিক মূলধন ইহাও হইতে পারে; এই সকল দিক বিবেচনা করার পর নগদ মূলধনের যে আনুমানিক পরিমাণ হইতে পারে, তাহা কোন অংশেই সামান্য হইবে না।
ব্যক্তিগত মূলধনর যাকাত
ব্যক্তিগতভাবে নাগরিকদের নিকট যে মূলধন বিচ্ছিন্নভাবে পড়িয়া থাকে, সেই বিষয়ে অনুমান করিয়া বলা যায় যে, শতকরা অন্তত ১৫ জন লোকের নিকট ৫০.০০ টাকার পরিমাণ টাকা নগদ কিংবা অলংকারবাবদ মওজুদ রহিয়াছে। ইহাদিগকে চারটিন শ্রেণীতে গণ্য করিয়া ইহাদের বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনুমান করা যায় যে, বার্ষিক ২.৫০ টাকা হেইতে ৭৫.০০ টাকা পর্যন্ত যাকাত দাতাদের নিকট হেইতে বড় পরিমাণ প্রতিবৎসর যাকাত বাবদ পাওয়া যাইবে।
সরকারী ঋণে নিযুক্ত টাকার যাকাত
সরকারী ঋণ বাবদ জনগণের যে টাকা সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হইয়া রহিয়াছে, তাহাকে ব্যবসায়ী মূলধন মনে করিতে হইবে। অন্ততঃ এই টাকাগুলি তো সুরক্ষিত রহিয়াছে- একদিন- না-একদিন ইহা অবশ্যই ফেরত পাওয়া যাইবে। কাজেই ইহার অবস্থা সাধারণ ঋণের মত নহে, বরং ইহাকে নিজের হাতে পুঞ্জীকৃত টাকার মতই মনে করিতে হইবে এবং এই জন্যই ইহার উপরও যাকাত ধার্য হইবে। অন্তত যখনি এই টাকা ফেরত পাওয়া যাইবে, তখনি বিগত বৎসরসমূহের যাকাত একত্রে আদায় করিতে হইবে।
গৃহপালিত পশুর যাকাত
গৃহপালিত পশুর উপরও যাকাত ধার্য হয়। উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যদির ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত ধার্য হইয়া থাকে। একটি দেশে ব্যবসায় কিংবা বংশ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কত সঙখ্যক পশু পালিত হইতেছে এবং এই বাবদ কাহার উপর কত যাকাত ধার্য হইতে পারে, তাহার সঠিক পরিমাণ জানা সে দেশের সরকারের পক্ষে সম্ভব। এই বাবদ একটা বিরাট পরিমাণ টাকা প্রতি বৎসর ইসলামী রাষ্ট্রের যাকাত ফান্ডে জমা হইবে এবং ইসলামের নির্ধারিত ক্ষেত্রে- গরীব, মিসকীন, ইয়াতীম, বিধবা, অসহায় আকস্মিক বিপদে সর্বহারা এবং প্রয়োজন পরিমাণ অর্থোপার্জনে অসমর্থ লোকদের প্রয়োজন পূরণেও তাহাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে ব্যয় করা হয়, তবে সে দেশ হইতে অতি অল্পসময়ের মধ্যে সকল প্রকার অভাব ও দারিদ্রতা দূরভীত করা যায় এবং এক স্বচ্ছন্দ অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব, তাহা সকলেই বুঝিতে পারেন।
যাকাতের পরিমাণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা
প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে জাতীয সম্পদ যেভাবে তীব্রগতিতে বৃদ্ধি পাইতেছে এবং যাহার ফলে ব্যবসায়ী মূলধন ও উদ্বৃত্তির পরিমাণ বাড়িতেছে তাহাতেও প্রত্যেক বৎসর যে যাকাতের পরিমাণও বৃদ্ধি পাইবে, তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। যাকাতের ব্যয়-সম্পর্কে একটি পঞ্চ-বর্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করিলে সমগ্র গরীব লোকের যে বৃহত্তর কল্যাণ সাধণ করা যাইতে পারে, তাহা এই মুহূর্তে কল্পনাও করা যায় না।
যাকাত ব্যয়ের পরিকল্পনা
বাৎসরিক যাকাতরে যে পরিমাণ সম্পর্কে উপরে একটি ধাণা দেওয়া হইল উহাকে সঠিকভাবে ও সুষ্ঠু পন্থায় উপযুক্ত লোকদের মধ্যে বিতরণের জন্য একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা রচনা করা একান্তই আবশ্যক। বর্তমান সন্দভে আমি ইহার একটি আভাস মাত্র পাঠকদের সম্মুখে পেশ করিতে চেষ্টা করিব।
ইহাতে কোনই দ্বিমত নাই যে, দেশের গরীব, মিসকীন, অন্ধ, অসহায়, শিশু, বৃদ্ধ, বিধবা, পংগু, আতুর, বিপদগ্রস্ত পথিক এবং প্রয়োজন পরিমাণ অর্থোৎপার্জনে অসমর্থ লোকদের মধ্যে যাকাতের টাকা বিতরণ করিতে হইবে। এই ধরনের লোক রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগে, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে এবং দেশের প্রতি কেন্দ্রে ছাড়াইয়া রহিয়াছে। আমরা অনায়াসে ইহাদের দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত করিতে পারি। প্রথম শ্রেণীতৈ তাহাদের গণ্য করিতে পারি- যাহারা বিভিন্ন সরকারী বিভাগ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বেতনভোগী কর্মচারী হিসাবে প্রয়োজন পরিমাণ অর্থ হইতে বঞ্চিত হইয়া বহু কষ্টে কালাতিপাত করিতেছে। যাকাতের মোট টাকার অর্ধেক তাহাদের জীবনযাত্রার মান-উন্নয়নে ব্যয় করা হইবে এবং তাহাদের জন্য গঠিত পারস্পরিক সাহায্য-সংস্থায় তাহাদেরই নামে এই টাকা নির্দিষ্ট হারে জমা করা হইবে, যেন ইহার সুফল তাহারাই ভোগ করিতে পারে। গরীকবদের বিনামূল্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, আদালতী বিচার লাভের সুযোগ করিয়া দেওয়া যাইতে পারে। সাধারণ গরীবদের জন্য নির্দিষ্ট অসংখ্য প্রকার কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠা গড়িয়া তোলা এই ফান্ডের দ্বারা সম্ভব। বলাবাহুল্য, যাকাত আদায়ের জন্য যে কর্মচারী নিযুক্ত হইবে তাহাদের বেতনও এই টাকা হইতেই দেওয়া হইবে।
বাকী অর্থের টাকা নিম্নলিখিত রূপে দুই ভাগে ভাগ করা যাইতে পারে:
(১) গরীবদের জন্য স্থায়ীভাবে ধনোৎপাদনের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে এবং
(২) ব্যক্তিগতভাবে তাদের নগদ টাকা বা প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করিয়া দেওয়ার খাতে ব্যয় করা হইবে।
স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা
গরীবদের জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করিয়া দেওয়ার উপায় হইতেছে, তাহাদের জন্য প্রয়োজন পরিমাণ কৃষিজমি ক্রয়ক করিয়া দেওয়া ও কারখানা স্থাপন করা। বলাবাহুল্য, এই কারখানায় কেবল গরীবেরাই মজুর ও পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত হইবে এবং তাহারাই হইবে ইহার মালিক ও স্বত্বাধিকারী। অনেক গরীবকে আবার ব্যবসায়ের প্রয়োজন পরিমাণ পুঁজি হিসাবেও টাকা দেওয়া যাইতে পারে।
জমি খরিদের দাম
কৃষক ও কৃষিজীবী পরিবারদের মধ্যে যাহারা ভূমিহীন কিংবা প্রয়োজন পরিমাণ ভূমি যাহাদের নাই,- তাহাদিগকে জমি ক্রয় করিয়া দেওয়ার জন্য প্রতিবৎসর মোট যাকাতের একটি অংশ- মনে করুন তিন কোটি টাকা- যদি নির্দিষ্ট করা হয়, তবে তাহা দ্বারা অনায়অসেই কম-বেশী ৬ একর বিশিষ্ট দশ হাজার খন্ড জমি খরীদ করিয়া দিয়া অন্ততঃ দশ হাজারটি পরিবারকে অভাব দারিদ্রের করাল গ্রাস হইতে রক্ষা করা যাইতে পারে।
কারখানা স্থাপন
যাকাতের ফান্ডের আর একটি অংশ- মনে করুন দশ কোটি টাকা- শুধু কারখানা স্থাপনের জন্য নির্দিষ্ট হইতে পারে। পূর্বেই বলা হইয়াছে- এই কারখানায় গরীব, অভাবক্লিষ্ট ও শ্রমজীবী লোকই ‘কর্মচারী’ হিসাবে নিযুক্ত হইবে। আর সমবেতভাবে তাহারাই হইবে উহার স্বত্বাধিকারী। কারখানা স্থাপন সাফল্যের সহিত ইহা চালাইয়া দেওয়া পর্যন্তই হইবে ইসলামী রাষ্ট্রের করত্য বা কর্তৃত্ব্ উন্নত ধরনের মধ্যম শ্রেণীর কারখানা স্থাপন করিলে গড়ে কারখানা প্রতিদুই কোটি টাকা হিসাবে মূলধন দ্বারা অন্ততঃ পাঁচটি উল্লেখযোগ্য কারখানা প্রতি বৎসর স্থাপন করা যাইতে পারে। প্রতি বৎসর এত লেকের বেকার সমস্যার সমাধান হওয়া-শুধু তাহাইনয়- একটি বিরাট অর্থোৎপাদক কারখানার মূল্যবান অংশের অংশীদার হওয়া কোনক্রমেই সামান্য কথা নয়। ইহাতে প্রতি বৎসর এই পাঁচ-ছয় হাজার পরিবারের এবং ২০/২৫ হাজার লোকের ভরণ-পোষণের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হইতে পারে, তাহাতে আর কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নাই।
ব্যবসায়ে পুঁজি সংগ্রহ
প্রতি পৎসর উপার্জনহীন লোকদেগিকে ব্যবসায়ের পুঁজি সংগ্রহ করিয়া দেওয়া বাবদ অন্ততঃ ১০ কোটি টাকা নিযুক্ত করা যাইতে পারে। এই টাকাকে বিশ হাজার অংশে ভাগ করিয়া ততটি পরিবারকে দান করিলে শুধু ব্যবায়ের মাধ্যমেই প্রতি বৎসর অন্ততঃ ৮০/৯০ হাজার লোকের জীবিকার ব্যবস্থা বিশেষ সাফল্যের সহিত হইতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে দান
উপরে উল্লিখিত খাতসমূহে যাকাতের টাকা ব্যয় করার এই ফান্ডের যত টাকাই উদ্বৃত্ত থাকিবে, তাহা সরাসরিভাবে উপযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে নগদ দান হিসাবে তুলিয়া দেওয়া যাইবে। এই ‘দান’ এককালীনও হইতে পারে, কিংবা মাসিক ‘বৃত্তি’ হিসাবেও ইহা বন্টন করা যাইতে পারে। এই টাকার একটা প্রধাং অংশকে নিম্নলিখিতরূপে পাঁচটি ভাগে ভাগ করিয়া দিলে এবং কাহাকেও আংশিক আর কাহাকেও পূর্ণ প্রয়োজন মিটাইবার জন্য অধিক পরিমাণ দেওয়া হইলে অন্ততঃ ১৮ কোটি টাকা নিম্নলিখিতরূপ খরচ করা যাইতে পারে:
(ক) কোটি টকা- পরিবার প্রতি বাৎসরিক এক হাজার টাকা হিসাবে এক লক্ষটি পরিবারকে।
(খ) ৪ কোটি টাকা –পরিবার প্রতি পাঁচশত- টাকা মাসিক হিসাবে ৮০ হাজারটি পরিবারকে।
(গ) ২ কোটি টাকা –পরিবার প্রতি আড়াই শত টাকা হিসাবে ৮০ হাজারটি পরিবারকে।
(ঘ) ২ কোটি টাকা –পরিবার প্রতি এক শত টাকা হিসাবে ২ লক্ষটি পরিবারকে।
এক কথায়, প্রত্যেক্ষ বন্টনের ফলেও প্রতি বৎসর ৬ লক্ষ ২০ হাজারটি পরিবার কিংবা ২৪ লক্ষ ৮০ হাজার পরিবার প্রতি চার জন হিসাবে) ব্যক্তিতে অর্থনৈতিক অনটনের মর্মান্তিক অবস্থা হইতে ঊর্ধ্বে তুলিয়া স্বাচ্ছন্দ্যের মর্যাদায় উন্নীত করা যাইতে পারে। আর পূর্বোক্ত হিসাবকেও উহার সহত যোগ করিলে প্রতি বৎসর ইসলামী রাষ্ট্রের ২৬/২৭ লক্ষ নাগরিকের অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন করিয়া দেওয়া সম্ভব।
এমতাবস্থায় একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা লইয়া যাকাত আদায় এবং উহার সুষ্ঠু বন্টনের কাজ শুরু করিলে এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১ কোটি ৩৫ লক্ষ নাগরিককে আর্থিক অসংগতি ও সংকটের গ্রাস হইতে উদ্ধার করিয়া সুখে জীবন-যাপনের স্থায়ী ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া খুবই সম্ভব।
অন্যান্য সাদকা
প্রথমত ইসলামী সমাজের গরীব জনগণের জীবন-মান উন্নয়নের জন্য কেবল যাকাতই একমাত্র ব্যবস্থা নয়, এতদ্ব্যতীত আরো অনেক প্রকার সাদকাও এই ফান্ডকে শক্তিশালী করিয়া তোলার ব্যাপারে বিশেষ কাজ করিবে। দ্বিতীয়ত ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মুসলিমের –তাহার নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী, অসহায় পথিক কিংবা আকষ্মিক বিপদগ্রস্ত লোকদের যথাসম্ভব সাহায্য করাও কর্তব্য হইয়া রহিয়াছে। ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকগণ এই কাজ গোপনে করিবে এবং প্রকাশ্যভাবেও করিবে।
অতএব এ কথা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা যায় যে, নাগরিকদের অর্থনৈতিক নিরাপ্তা দানের যে ব্যবস্থা ইসলামী আদর্শ পেশ করিয়াছে, তাহা পৃথিবীর কোন মতবাদই পেশ করিয়াছে বলিয়া জানা যায় না। উপরন্তু একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রই সকল পর্যায়ের নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করিতে এবং তাহা যথাযথভাবে পালন করিতে পারে- অন্য কোন রাষ্ট্রই তাহা করিতে সমর্থ নয়।
শরীকানা ব্যবসায়
মূলধন একীভূত হওয়া ও সুদী কারবারের কুফল হইতে জনগণকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ইসলাম অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিভিন্ন প্রকারের উপর ও পন্থা উপস্থাপিত করিয়াছে। তন্মধ্যে পারস্পরিক শরীকানা ব্যবসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। আরবী পরিভাষায় ইহাকে ‘মুজারিবাত’ (আরবী*********) বা হয়। এই ব্যবসায়ের চুক্তি দুইটি পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। ইহাতে একজন মূলধন দেয়। পরিভাষায় তাহাকে ‘রাব্বুলমাল’ বা মূলধন মালিক বলা হয়। আর অপরপক্ষে সেই মূলধন লইয়া ব্যবসায় করে। ব্যবসায়ের সমস্ত কাজকর্ম সম্পাদনে সম্পূর্ণ শ্রম এই পক্ষকেই দিতে হয়। ফিকহর পরিভাষায় তাহাকে ‘মুজারিব’ (আরবী***) বলা হয়। ব্যবসায়ের অংশীদারিত্বকে শরীয়তি পরিভাষায় শিরকাত বা মুশরিকাতও বলা হয়। ফিকাহবিদগণ কুরআন হাদীসের দৃষ্টিতে এই শরীকানা ব্যবসায়ের চারটি পন্থা নির্ধারণ করিয়াছেন:
১. দুইজন শরীক- দুই ব্যক্তি হউক; কিংবা বহুকয়জন মিলিত হউক, সমান পরিমাণের মূলধন বিনিয়োগ করিবে। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ কাজও করিবে সমান। ফিকহর পরিভাষায় এই ধরনের শরীকানাকে বলা হয় (আরবী********) ‘শিকরকাতে মুফাবিজাহ’। এই ধরনের শরীকানা ব্যবসায়ে দুই পক্ষ সমান অংশীদারিত্ব লাভ করে। অর্থনৈতিক পরিভাষা অনুযায়ী মূলধন ও কাজ বা শ্রম এ উভয় পক্ষ সমান সমান শরীক থাকে, এই জন্য লাভ ও ক্ষতির ক্ষেত্রেও তাহারা সমানভাবে শরীক গণ্য হইবে।
২. দুই শরীক পক্ষের বিনিয়োগকৃত মূলধন সমান পরিমাণের হইবে না, হইবে কম ও বেশী। কিন্তু কারবারি শ্রম উভয়ই মিলিতভাবে সম্পন্ন করিবে। ফিকহার পরিভাষায় এই শরীকানাকে ‘শিরকাত ইনান’ (আরবী*****) বলা হয়। মূলধনের অনুপাতে; কিংবা কারবারি দক্ষতার হার ও মান অনুযায়ী লাভ ও লোকসানে উভয়ই শরীক হইবে। এই শরীকানা ব্যবসায়সটি অধিকতর সহজসাধ্য।
৩. দুই শরীক পক্ষের কোন এক পক্ষও কোন মূলধন বিনিয়োগ করিতে পারে নাই, কিন্তু উভয় পক্ষই কোন বা কয়েকটি শিল্পকর্মের নৈপুণ্য বা দক্ষতার অধিকারী এবং বড় ও ব্যাপকভাবে কাজ করার জন্য উভয়ই এই শর্তে একত্রিত হয় যে, গ্রাহকদের নিকট হইতে কাজের বিনিময়ে যাহা কিছু পাওয়া যাইবে, তাহা হইতে বিনিময় ব্যয় নির্বাহের পর অবশিষ্ট যাহা থাকিবে তাহা হইতে বিনিময় ব্যয় নির্বাহের পর অবশিষ্ট যাহা থাকিবে তাহা আয় ধরা হইবে, তাহা হইতে বিনিময় ব্যয় নির্বাহের পর অবশিষ্ট যাহা থাকিবে তাহা আয় ধরা হইবে এবং উভয় পক্ষ নিজেদের মধ্যে সমান সমান অথবা বেশী কম যাহাহই পূর্বে সিদ্ধান্ত হইবে সেই অনুযায়ী ভাগ করিয়া নিবে। যেমন একজন দর্জী মহিলাদের পোষাক তৈরী বা সেলাই কাজে দক্ষ হইবে, আর অপরজন পুরুষদের পোষাক তৈরীর কাজে। উভয়ই মিলিত হইয়া বড় আকারে দর্জীর দোকান দিয়া বসিল, যেখানে পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই পোষাক তৈরীর কাজ হইবে।
এই শরীকানাকে শিরকাতুস-সানায়ে (আরবী******) বা ‘শিল্পকর্মে শরীকানা’ বলা হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্ম, পেশা ও কারবারকে বড় আারের করার জন্য এই অংশীদারিত্বের কারবার খোলা হয়। কারবারের ব্যয়টা বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্টন করা হইবে।
৪. উভয় শরীক পক্ষ কোন পেশা বা শিল্পে দক্ষ নয়, বড় আকারের কাজ করার জন্য প্রয়োজন পরিমাণ মূলধনও কাহারো নিকট নাই। কিন্তু উভয়েরই ব্যবসায়ী Good will বা সুনাম-সততা ও বিশ্বস্ততার খ্যাতি সমগ্র বাজারে বিরাজমান। ফলে তাহারা উভয়ই নিজেদের সুনামের বলে পাইকারী ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে পণ্য লইয়া খুচরা বিক্রয়ের দোকান খুলিতে পারে। দোকানের আয় হইতে খরচ বাদ দিয়া মুনাফা পূর্ব নির্ধারিত হার অনুযায়ী নিজেদের মধ্যে বন্টন করিয়া লইবে। এই শরীকানাকে পরিভাষায় ‘শিরকাতুল উজুহ’ (আরবী*****) বলা হয়। এ পর্যায়ের সকল প্রকার শরীকানা বিশেষ শরীয়তি আইন-বিধান ও শর্ত রহিয়াছে।
অর্থনৈতিক পরিভাষার দিক দিয়া প্রথমোক্ত দুই প্রকারের শরীকানা প্রত্যেক শরীকের পক্ষ হইতে ধন-উৎপাদনের মুলধন ও শ্রম উভয় ফ্যাক্টর (Factor) বর্তমান থাকে। কিন্তু তৃতীয় প্রকারের শরীকানায় ধন-উৎপাদনের ফ্যাক্টর হিসাবে থাকে শুধু শ্রম Labour । আর চতুর্থ প্রকারের শরীকানায় মূলধনের পরিবর্তে Good will বা ব্যবসায়ে সুনাম-সততা-বিশ্বস্ততাই প্রধান অবল্বন হইয়া থাকে। উহাকে সাধারণ অর্থনৈতিক পরিভাষায় ‘সম্পদ উৎপাদনের ফ্যাক্টরী বলা হয় না বটে; কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে এই সততা বিশ্বস্ততার খুব বেশী গুরুত্ব রহিয়াছে, যাহা কোন ক্রমেই উপেক্ষণীয় হইতে পারে না।