ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংক
বর্তমান সময় বিভিন্ন প্রকার ব্যায়ক প্রয়োজনশীল লোকদিগকে সুদের বিনিময়ে ঋণদানের কাজ করিতেছে। সে ঋণ ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যও পাওয়া যাইতেছে, আবার ব্যবসায়-বাণিজ্যে বিনিয়োগের জন্যও। এইরূপ ঋণদানে অভাবগ্রস্ত লোকদের আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট উপকার হইতেছে বলিয়া মনে হয় এবং বিরাট বিরাট ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা এই ব্যাংক হইতে প্রাপ্ত মূলধনের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হইতেছে এবং চলিতেছে, এ কথাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এই আপতঃ উপকার ও ব্যবসায়-শিল্পের এই বাহ্যিক চাকচিক্য প্রকৃতপক্ষে মানব সমাজকে এক বিরাট বাঙন ও কঠিন বিপর্যয়ের মুখে ঠেলিয়া দিতেছে। ইহার দরুন সমাজের মূল বুনিয়াদ চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যাইতেছে। শোষন-পীড়নের প্রচন্ডতায় মানব সমাজের একাংশ নিঃস্ব ও সর্বস্বা্ত হইয়া পড়িতেছে, আর অপর অংশ-যাহাদের সংখ্যা শতকরা দশ জনেরও কম-হইয়অ যাইতেছে পুঁজিপতি ও কোটিপতি। মানব সমাজকে এই মারাত্মক বিপদের গ্রাসহইতে উদ্ধার করার অন্যতম প্রধান উপায় হইল বিনাসুদে ঋণদানের ব্যবস্থা। বিনাসুদে ঋণদান কার্য বায়তুলমালের মাধ্যমেই সম্পন্টন হইদে পারে। আর মে জন্য ব্যাংকও স্থাপন করা যাইতে পারে। বর্তমান ব্যাংক আধুনিক কালের ধন-বিনিময়ের এক উন্নততর ব্যবস্থা, সন্দেহ নাই। আর সত্য বলিতে কি, ব্যাংকের সাহায্য ভিন্ন অর্থনৈতিক লেন-দেন ও আদান-প্রদান বর্তামানে প্রায় অসম্ভব। উপরন্তু বর্তমান সময় আন্তর্জাতিক ধন-বিনিময় তো ইহা ভিন্ন অন্য কোন প্রকারের সম্পন্নই হইতে পারে না। কাজেই ব্যাংক চালু না রাখিয়া উপায় নাই। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে বর্তমান নিয়ম-নীতি অনুযায়ী ব্যাংক-ব্যবস্থা কিছুতেই চলিতে দেওয়া যাইতে পারে না। কারণ সুদ হইল বর্তমান ব্যাংক-ব্যবস্থার ভিত্তি, আর এই সুদ ইসলামী ব্যাংকই স্থাপিত করিতে হইবে। কিন্তু সুদ ছাড়াও কি ব্যাংক চলিতে পারে? সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি না দিলে ব্যাংক কে মূলধন দিকে কে? বৃহদায়তন শিল্পোৎপাদন- যাহা ব্যতীত জাতীয় উন্নতির কল্পনাও করা যায় না- কিরূপে সম্ভব হইবে? উপরন্তু, বর্তমান সময়ে ব্যাংক হইতে সমাজ যে ব্যাপক কল্যাণ লাভ করিতেছে, সুদ বন্ধ করিয়া দেওয়া হইলে অনুরূপ সুবিধা ও কল্যাণ লাভের আর কি পন্থা হইতে পরে?…. আধুনিক শিক্ষিত লোকদের মনে সাধারণভাবে এই জিজ্ঞাসা প্রচন্ড হইতে দেখা দিয়াছে। তাহাদের জ্ঞান মতে সুদ ছাড়া ব্যাংক আদৌ চলিতে পারে না, আর ব্যাংক ভিন্ন অর্থনৈতিক লেনদেন বর্তমান যেহেতু অসম্ভব, তাই ইসলামী অর্থনীতিও এ যুগে অচল।
কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে,সুদ ভিন্ন ব্যাংক চলা এবং তাহা হইতে বর্তমানের ন্যায় সকল কল্যাণ লাভ করা- আর সঙ্গে সঙ্গে সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক সকল ধ্বংসকারিতা হইতে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা- কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। এখানে ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক ও সহজবোধ্যভাবে আলোচনা করিতে চেষ্টা করিব। কিন্তু তাহার পূর্বে ব্যাংক ব্যবস্থা এবং উহার কাজ ও ও কর্ম-পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ আবশ্যক।
আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার রূপ
ব্যাংক আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির সর্বশেষ অবদান। আর সত্য কথা এই যে, ব্যাংকের বর্তমান রূপ ও সংগঠন পুঁজিবাদীদের শোষন-পীড়নের একটি মারাত্মক হাতিয়ার। ব্যাংকে সাধারণত দুই প্রকারের পুঁজি সংগৃহীত হইয়া থঅকে, প্রথম, অংশীদারদের দেওয়া পুঁজি এবং দ্বিতীয়ত, ধনীদের আমানতস্বরূপ প্রদত্ত টাকা। আমানত স্বরূপ রক্ষিত টাকা তিন প্রকার। প্রথম, যাহা চাওয়া মাত্রই ফিরাইয়া পাওয়া যায়, যাহাকে বলা হয় Corrent deposit! দ্বিতীয, যাহা এক নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ব্যাংকের নিকট অর্পণ করা হয়; ইহাকে বলা হয় Fixed Deposit তৃতীয় হইতেছে Savint Deposit; সপ্তাহে একবার ইহার এক-তৃতীয়াংশ অর্থ-ফিরাইয়া লওয়া যায়। [ধন-সম্পদ আমানতস্বরূপ গ্রহণকারী ঋণ ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানকেই বলা হয় ব্যাংক। হোরেস হোইট (Horac white) তাঁহার Money and Banking গ্রন্থে লিখিয়াছেন Bank a manufacturer of credit and a machine for facilitng exchange –ব্যাংক হইল মূলধন সংগ্রহকারী ও বিনিয়োগ সুবিধার মাধ্যম।] ব্যাংক সংগৃহীত পুঁজির একাংশ নিজের নিকট সংরক্ষিত পুঁজি (Reserved capital) হিসাবে সব সময়ের জন্য জমা রাখিয়া দেয়। উহার নিত্য-নৈমত্তিক প্রয়োজন ইহা হইতে পূর্ণ করা হয়। ইহার পর কিছু পরিমাণ পুঁজি বাজারে (Money Market) ঋণ বাবদ দেওয়া হয়। এই পুঁজিও নগদ রিজার্ভ টাকার ন্যায় সকল সময়ই আদায়যোগ্য ও ব্যবহরযোগ্য। (Liquid) হইয়া থাকে। এই পুঁজিও নর্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরাইয়া পাওয়া যোগ্য বলিয়া ইহাতেও সুদে পরিমাণ খুবই সামান্য। অতঃপর ব্যাংক-পুঁজির একটি বিরাট অংশ এমন সব কাজ লগ্নি করা হয় যাহাতে পুজির নিরাপত্তা সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত অধিকক নিশ্চিত হওয়া চলে। প্রয়োজন হইলে তাহা বিক্রয় করিয়াও মূল পুঁজি উদ্ধার করা যাইতে পারে। এইরূপ অর্থ বিনিয়োগ শতকরা ২-৪ টাকা সুদও পাওয়া যায়। সরকারী সিকিউরিটি এবং কোম্পানীর অংশ ও ডিবেঞ্চারস (Debentures) ইত্যাদি এই শ্রেণীতেই পড়ে। নগদ রিজার্ভ পুঁজির পর ব্যাংক এই সব ক্ষেত্রেও পুঁজি বিনিয়োগ করিয়া থাকে। কারণ ব্যাংকের আত্মরক্ষা ও স্থিতিস্থাপনের জন্য ইহা অপরিহার্য। ইহার ফলেই ব্যাংকের মেরুদন্ড অধিকরত দৃঢ় হয়, বিপদের সময় ইহা উহার পৃষ্ঠপোষক হইয়া দাঁড়াইতে পারে।
ব্যাংকপুঁজির সর্বপ্রধান অংশ নিয়োগ করা হয় কারবারী ও ব্যবসায়ী লোকদিগকে এবং প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ও সমবায় প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রদত্তঋণ বাবদ। বস্তুত ব্যাংকর আমদানী সর্বপ্রথম উপায় ইহাই। এই ক্ষেত্রেই সর্বাপেক্ষা উচ্চহারে সুদ লাভ হইয়া থাকে। এই জন্য প্রত্যেকটি ব্যাংকই স্বীয় পুঁজির সর্বপ্রধান অংশ ব্যবসায়- সংক্রান্ত কাজ কারবারে বিনিয়োগ করিতে চেষ্টা করে। প্রত্যেক ব্যাংকই সাধারণত শতকরা ৩০ হইতে ৬০ ভাগ পর্যন্ত পুঁজি এই কাজেই বিনিয়োগ করিয়া থাকে।
মোট কথা, ব্যাংক আমানতদারদের নিকট হইতে প্রাপ্ত এবং নিজেদের লগ্নিকৃত পুঁজি যতভাবেই বিনিয়োগ ও ব্যয় করে, তাহা সবই সুদের ভিত্তিতে হইয়া থাকে। বস্তুত এই সুদ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্থানীয় সমাজের জনগণের নিকট হইতেই আদায় করা হয় এবং তাহাদের শ্রমার্জিত অর্থ সুদ বাবদ শোষিত হইয়া (জাতীয সম্পদ) মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতির নিকট পুঞ্চীভূত হয়। আমানতকারীগণ সুদ-বাবদ যাহা পায় তাহা ঋণ-বাবদ লগ্নিকৃত অর্থের নির্দিষ্ট হারে আদায়কৃত সুদেরিই অংশ মাত্র। ঋণ গ্রহণকারীদের নিকট হইতে ব্যাংক উচ্চহারে সুদ আদায় করে এবং আমানতদারীদিগকে ব্যাংক অপেক্ষাকৃত কম হারে সুদ দেয়। এইভাবে ব্যাংকের ভাগের সুদের অবশিষ্ট অংশ হইতে ব্যাংকের যাবতীয় খরচপত্র নির্বাহ করা হয় এবং তাহার পরও যে অংশ উদ্ধৃত্ত থাকে, তাহাই ব্যাংক ব্যবসায়ের মূল অংশীদারদের মধ্যে ঠিক সেই নিয়মেই বন্টন করা হয়, যেমন অংশীদার-ভিত্তিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সমূহের লভ্যাংশ বন্টন করা হয় উহার অংশীদারদের মধ্যে।
বস্তুত ব্যাংক ছোট-বড় যত কাজেই করে, সুদের বিনিময়ে টাকা খাটানোই হইল উহার আসল ও প্রধান কাজ। ব্যাংক সাধারণত নিজে কোন ব্যবসায় করে না, ব্যবসায়ীদের জন্য সুদের বিনিময়ে পুঁজি যোগার করাই উহার দায়িত্ব। ব্যাংক নিজে কোন করখানা খোলে না, বরং শিল্পোৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপনকারী লোকদের পুঁজি সংগ্রহ করিয়া দেওয়া এবং তাহদের নিকট হইতে উচ্চহারে সুদ আদায় করা উহার কাজ।
এক্সচেঞ্জ ব্যাংকসমূহ সাধারণ বৈদেশিক পণ্য বা পুঁজি বিনিময়ের কাজ করিয়া থাকে। বাংলাদেশের কোন ব্যবসায়ী আমেরিকা হইতে কোন পণ্য ক্রয় ও আমদানী করিতে চাহিলে কিংবা অন্য কোন কারণে মূলধন বিনিময় করিতে ইচ্ছা করি তাহাকে এই ব্যাংকের আশ্রয় লইতে হয়। এক্সচেঞ্জ ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় (কিংবা ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বিভাগ) টাকা জমা দিলেই উহার মার্কিন মূল্যমান অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা উহার আমেরিকাস্থ শাখা কিংবা Coresponent Blance এর মারফতে পণ্য বিক্রয়কারী ফার্মে আদায় করা হয়। এই রূপ এক্সচেঞ্জের কাজ করিয়া ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন লাভ করিয়া থাকে। এতদ্ব্যতীত হুন্ডীর বিনিমযে এল.সি.খোলার মাধ্যমেও সুদ লইয়া থাকে।
এ সম্পর্কে স্পষ্ট কথা এই যে, ব্যাংকের এই সমস্ত কাজে সামগ্রিকভাবে সমস্ত মানুষেরই অসাধারণ কল্যাণ সাধিতগ হইয়া থাকে, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই কল্যাণকর- আধুনিক যুগের এই অপরিহার্য- প্রতিষ্ঠানটি প্রধানত যে কারণে কলুষিত ও সমষ্টিগতভাবে মানবসমাজের জন্য মারাত্মক হইয়া দাড়াইয়াছে তাহা হইল সুদ। এই সুদ বন্ধ করিয়া দিলেই এই প্রতিষ্ঠানটি সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য ও গোটা মানবতার পক্ষে প্রকৃতভাবে কল্যাণকর হইতে পারে।
আধুনিক ব্যাংক-ব্যবস্থার মারাত্মক দোষ
পূর্বেই বলিয়াছি, প্রথম বর্তমান যুগে সুসভ্য মানব-সমাজের জন্য ব্যাংক যেন একটি অত্যাবশ্যকীয় ব্যবস্থা তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। অনেক বড় বড় অর্থনৈতিক কাজই এমন রহিয়াছে, যাহা একমাত্র ব্যাংকের সাহায্যেই সম্পন্ন করা সম্ভব। আর ব্যাংক না হইলে তাহা সম্পন্ন করা অত্যন্ত কঠিন হইয়া পড়ে। ব্যাংকের সাহায্যে অনেক ‘এজেন্সী সার্ভিস’ও সুসম্পন্ন হইয়া থাকে। সমাজের অসংখ্য লোকের হাতে কম ও বেশী পরিমাণের যে পুজি বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিয়াছে, তাহা এই ব্যাংকের মারফতেই একটি স্থানে কেন্দ্রীভূত হইয়া সামষ্টিক কল্যাণমূলক কাজে বিনিয়োগ হইতে পারে। কিন্তু বলিয়াছি, এই সব অসংখ্য কল্যাণকর কাজ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে ইহাই মানবতার মারাত্মক ক্ষতি করিতেছে শুধু সুদ প্রথার কারণে। [অর্থনীতিবিদ বিশারদ লর্ড কীনস এর মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, অর্থ বন্টনের অসমতা এবং পরিপূর্ণ কর্ম বিনিয়োগ (Full employment) পথেরবাধার মূল কারণ হইতেছে এই সুদ প্রথা। কেননা ইহার দরুন মূলধন সংগ্রহ ও বিনিয়োগ সীমিত হইয়া পড়ে। এই কারণে সুদের হার কমসেকম করা অবশ্যক। বরং প্রয়োজন অনুযায়ী মূলধন সংগ্রহ ব্যবস্থা সুষ্ঠু হইলে সুদ সম্পূর্ণ রূপে খতম করা খুবই সম্ভব। (The general theory of employment, interest and money)]
দ্বিতীয়ত, ব্যাংকের মারফতে অসংখ্য হাতে বিক্ষিপ্ত পুঁজি এককেন্দ্রিক হইয়া তাহা মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুঁজিপতির একচেটিয়া কর্তৃত্বাধীন হইয়া পড়ে। ফলে সৃষ্টি হয় একচেটিয়া পুঁজিবাদ। ব্যাংক পরিচালকরা এই পুঁজি জাতীয স্বার্থের বিপরীত কাজে- দেশবাসীর নিকট অবশিষ্ট ধন-সম্পদ নিঃশেষে লুটিয়া লইবার জন্য- ব্যবহার করে। সুদ-ভিত্তিক ব্যাংক ব্যাবস্থা যে সমাজে স্থাপিত হয়,তথায় মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ব স্থাপিত না হইয়া পারে না। কারণ, পুঁজিবাদি সমাজে রাষ্ট্রীয় কর্তত্ব ও ক্ষমতা পুঁজির হাতেই কুক্ষিগত হয়। আর মুষ্টিমেয় ধনিকরাই হয় সেখানে সকল পুঁজির একচ্ছত্র মালিক।
এই ব্যাংক অসংখ্য লোক টাকা জমা দেয় এ কথা ঠিক; কিন্তু জমা দেওয়া পর এই টাকার সহিত প্রত্যক্ষভাবে তাহাদের কোন যোগাযোগ বা সম্পর্ক থাকিতে পারেনা। তাহাদের দেওয়া মূলধন কোন ধরনের কাজে বিনিয়োগকৃত হইতেছে বা হইয়াছে,তাহা দ্বারা সমষ্টিগতভাবে দেশের কল্যাণ করা হইতেছে, কি অকল্যাণ সে সম্পর্কে তাহাদের কিছুই বলিবার থাকে না। প্রতিশ্রুতি হারে প্রতি বৎসর সুদ আদায় করিয়া তাহারা সন্তুষ্ট। ফলে তাহাদের মূলধন প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানা কিংবা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাহাদের একবিন্দু কৌতুহল বা দরদ থাকিবার কথা নয়। উহার লাভ লোকসান, উন্নতি-অবনতি কিংবা ভাল-মন্দের সহিত তাহাদের কোন নিকট সম্পর্ক আছে বলিয়া তাহারা মনে করে না। কেননা তাহতে প্রচুর পরিমাণ লাভ হইলেও তাহাদের অধিক হারে সুদ লাভের সম্ভাবনা নাই। কারণ নির্দিষ্ট হারের সুদই তাহাদের চূড়ান্ত মুনাফা। পক্ষান্তরে তাহাদের বিরাট কোন ক্ষতি হইলেও তাহাদের কিছুই আসিয়া যায় না, যেহেতু তাহাদের নির্দিষ্ট সুদ সম্পর্কে পূর্বেই পূর্ণ নিরাপত্তা দান করা হইয়াছে। বস্তুত যে সমাজে ব্যষ্টির কল্যাণে সামগ্রিক কল্যাণ হয় বলিয়া মনে হয় না, কিংবা সমষ্টির বিপর্যয়ে ব্যষ্টিরও বিপর্যয় সংঘটিত হয় না, সে সমাজ কখনই মানুষের উপযোগী সমাজ হইতে পারে না। এহেন পরিস্থিতিতে জাতীয় অর্থনীতির উন্নতি ব্যাহত না হইয়া পারে না। এইরূপ মনোভাব জাতীয় শক্তি বিলুপ্ত হয় এবংয় সমাজের টাকা দ্বারাই সমাজের লোকদিগকে স্পর্ধার সহিত শোষণ করা হয়।
বর্তমান ব্যাংক-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ এই যে, ইহারফলে পণ্যদ্রব্যের মূল্য অত্যধিক ঊর্ধ্বগতি ধারণ করে। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলেমানুষ অনক অলাভজনক কাজে মূলধন বিনিয়োগের উৎসাহ পায়। শৈল্পিক কারবারে উন্নতি পরিলক্ষিত হইলে ব্যাংক দুই হাতে ঋণ দিতে শুরু করে, নানাবিধ শিল্পোৎপাদনের কাজে অধিক সাহায্য দান করে। ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পাইলে ব্যাংকও সুদের হার অত্যন্ত চড়া করিয়া দেয়। কারণ, পণ্য মূল্য বৃদ্ধির সময় অধিক পরিমাণ সুদ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ব্যবসায়িক উন্নতির আশায় শিল্পতি ও কারখানা মালিকগণ সুদের চড়া হারেও ঋণ লইতে প্রস্তুত হয়। ব্যাংক যখন অধিক ঋণ ইস্যু করিয়াছে বলিয়া মনে করে, তখন তাহা ফিরাইয়া লইতে চেষ্টা করে। ফলে বিলিকৃত ঋণ ফিরাইয়া লওয়া হয় এবং নূতন করিয়া আর ঋণ দেওয়া হয় না। শিল্পের আর্থিক বুনিয়াদ যতই দৃঢ় এবং উহার যতই সুনাম হউক না কন, সহসা ঋণ শোধ করা সকলের পক্ষে সহজ হয় না। তখন মূলধন স্বল্পায়তন ও হ্রাস করার একটা Depression ধারা চলিতে থাকে। ছাঁটাই ও উৎপাদন পরিমাণ হ্রাস করার ফলে বেকর সমস্যা মাতাচাড়া দিয়া উঠে এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যে নিদারুণ মন্দ দেখা দেয়।
বস্তত ব্যাংকের নিকট শিল্পের স্বার্থ অপেক্ষা নিজের লাভ-লোকসানের স্বার্থটাই অধিক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মুল শিল্পে ব্যাংকের কোনই অংশ নাই, ব্যাংক ঋণদাতা মাত্র। কাজেই শিল্পের উন্নতি-অবনতির ব্যাপারে উহার কিছুমাত্র আগ্রহ বা কৌতুহল থাকার কথা নয়। আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার এই মূলীভূত দোষ বর্তমানে খুব তীব্রভাবে অনুভূত হইতেছে।
এইজন্য শিল্প-ব্যবসায়ে অগ্রসর ও উন্নত দেশসমূহ শিল্প ও ব্যবসায়ের পারস্পরিক নিবিড় যোগাযোগ ও নিকট সম্পর্কের উপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হইতেছে। কারণ, তাহা না হইলে শিল্পের উন্নতি সম্ভব নয়। অথচ বর্তমানকালে সুদভিত্তিক ঋণদান ব্যবস্থায় ব্যাংকের সহিত উক্তরূপ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হইতে পারে না। অবশ্য ব্যাংক যেখানে কেবল ঋণ দানেরই কাজ করিবে না; বরং উহার মূল ব্যাবসায়ের অংশীদারও হইবে, একমাত্রও সেখানেই এবং এইভাবেই ব্যবসায়ের সহিত ব্যাংকের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হইতে পারে।
ইসলামী ব্যাংক
ইসলামী অর্থনীতি আধুনিক ব্যাংকের মূল ভিত্তিকেই চূর্ণ করিয়া উহাকে নূতনভাবে গঠন করার নির্দেশ দেয়। ইসলামী সমাজে ব্যাংককে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির একচেটিয়া কর্তৃত্ব হইতে মুক্ত করিয়া নির্বিশেষে সমগ্র মানুষের কল্যাণে নিযুক্ত করা হইবে। এইজন্য সর্বপ্রথম কর্তব্য হইল বিনা সুদের ব্যাংক-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা।
ব্যাংক কারবারের মূল ইতিহাস আলোচনা করিলে দেকিতে পাই প্রাচীন গ্রীক সমাজে যখন ব্যাংক একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ শুরু করিয়াছি, তখন টাকা লগ্নি করিয়া উহারিই বিনিময়ে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। রোমান সমাজের শুরুতে ইহা নিষিদ্ধ থাকিলেও পরে ক্রমশ সাম্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায় সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সুদ গ্রহণ শুরু হয়। খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্টে’ সুদ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ইহুদীরাই এই নিষেধ প্রকাশ্যভাবে সামান্য করে। অবশ্য রোমান ক্যাথলিকরা যতদিন শাসন কার্য চালাইয়াছে, ততদিন তাহারা সুদের কারবার চলিতে দেয় নাই। দুনিয়ায় ইহুদীরাই এই সুদী কারবারের প্রবর্তক। উত্তরকালে গোটা ব্যাংক ব্যবস্থাই সুদের ভিত্তিতে চলিতে থাকে। ইসলাম এই সুদী কারবারকে সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে। বিশ্বনীর আদর্শে গঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রে সুদী কারবার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। বর্তমানে অনুরূপ সমাজ গঠন ও সুদবিহীন ব্যাংক ব্যবস্থা কায়েম করাই মানবতার শোষণ মুক্তির একমাত্র পথ।
সুদ ছাড়াও কি ব্যাংক চলিতে পারে? এ প্রশ্নের জওয়াব আমাদের পাল্টা প্রশ্ন এইযে, সুদের ভিত্তিতে যখন ব্যাংক চলিতে পার ইহাই যুক্তিসংগত কথা। সুদই ব্যংক চালায় এবং সুদ বন্ধ করিলে ব্যাংকও অচল হইয়া পড়িবে- যুক্তির বিচার এই কথা অচল ও অগ্রহণযোগ্য।
ইসলামী ব্যাংকে জনগণের টাকা আমানতস্বরূপ রাখা হইবে; কিন্তু তাহাতে কিছু মাত্র সুদ দেওয়া বা লওয়া হইবে না। আমানতদারদের অনুমতিক্রমে তাহার টাক কোন ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা হইলে ব্যবসায় লব্ধ মুনাফার নির্দিষ্ট অংশ সে নিশ্চয়ই পাইতে পারিবে, অন্যথায় তাহা শুধু আমানত হিসাবে গচ্ছিত রাখা হইবে। উপরন্তু প্রতিবৎসর তাহা হইতে অনিবার্যরপে যাকাত আদায় করা হইবে। ব্যাংকের খরচ বাবদ কিছু কমিশনও উক্ত টাকা হইতে কাটিয়া লওয়া হইবে।
সুদপ্রথা রহিত হইলে দেশের শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনকোথায় পাওয়া যাইবে, সুদহীন ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে ইহা একটি সাধারণ প্রশ্ন। কিন্তু একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, ইসলামী সমাজে এই উদ্দেশ্যে মূলধন সংগ্রহের ব্যাপারে কোনরূপ অসুবিধা সৃষ্টি হওয়ার কোনই হেতু নাই। কারণ সেখানে যখনিই কোন শিল্প কারখানা বা লাভজনক বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খুলিবার প্রয়োজন হইবে, তখনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পূর্ণ পরিকল্পনা ও এষ্টিমেট ব্যাংকের নিকট পেশ করা হইবে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিকল্পনাটি গভীরভাবে পরীক্ষা করাইয়া দেখিবে। পরীক্ষা ও সর্বোতভাবে যাচাই করিয়া দেখার পর ইহা গ্রহণযোগ্য প্রমাণিত হইলে ব্যাংকের পক্ষ হইতে দেশের মূলধন মালিকদের নিকট সাধারণ ভাবে উহা পেশ করিয়া নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধনর জন্য আবেদন করা হইবে। তখন দেশের মূলধন মালিকগণ অর্থবিনিয়োগের একটি নির্ভরযোগ্র সুযোগ মনে করিয়াই সে সম্পর্কে উৎসাহ না হইয়া পারিবে না। অন্যতায় প্রত্যেকের নিকট পুঞ্জিকৃত অর্থ বেকার বসিয়া থাকিবে এবং প্রতি বৎসর যাকাত আদায় করিয়া তাহার মূলধন ক্ষয়প্রাপ্ত হইতে বাধ্য হইবে। অতএব, ব্যাংকের এই আবেদনে প্রচুর মূলধন সংগৃহীত হওয়ার নির্ভরযোগ্য সম্ভাবনা রহিয়াছে। বর্তমান সময়ে সুদভিত্তিক মূলধন সংগৃহীত হওয়ার নির্ভরযোগ্য সম্ভাবনা রহিয়াছে। বর্তমান সময়ে সুদভিত্তিক ব্যাংকসমূহ যত পরিমাণ মূলধনসংগ্রহ করিতে পারে, তখন ইহার পরিমাণ কিছুমাত্র কম হইবার কারণ নাই। উপরন্তু ইসলামী ভাবধারয় পরিশুদ্ধ সমাহের নির্মর পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা মানুষকে ধন-সম্পদ নিজের নিকট পুঞ্জিভূত করিয়া রাখিতে উদ্বুদ্ধ করিবে না। উহাকে অধিক বিক্ষিপ্ত এবং জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির কাজে বিনিয়োগ করাতেই জনগণ অধিক উৎসাহ পাইবে।
শুধু তাহাই নয়, উপরোক্ত পন্থায় সংগ্রহীত মূলধন দ্বারা যে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হইবে, ব্যক্তিগতভাবে কোন লোক বা কোন ব্যাংক উহার মালিক হইবে না, উহার মালিক হইবে মুলধনদাতা পুঁজিমালিকগণ। উহার লাভক্ষতি, ভালমন্দ, সুনাম ও দুর্ণামের সহিত প্রত্যেক অংশীদারের নিবিড় যোগাযোগ থাকিবে বলিয়া এ সম্পর্কে প্রত্যেকটি লোকই সচেতন থাকিবে। এই উপায়ে প্রতিষ্ঠিত কারখানায় উৎপাদন বিন্দুমাত্র নিকৃষ্ট হইলে তখনি উহার প্রতিবিধান ও সংশোধন করিতে প্রত্যেক অংশীদারই চেষ্ট হইচে, কারখানার পরিচালকদিগকে সতর্ক করিয়া উৎকৃস্ট পণ্য উৎপাদনের নির্দেশ দিতে একটুও বিলম্ব করিবে না। কারণ কারখানায় উৎপন্ন পণ্যের উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট হওয়ার সহিত তাহার স্বার্থ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এইরূপ ব্যবস্থার ফলে ইসলামী সমাজের শিল্পকারখানাসমূহ বিপুল সংখ্যক লোকের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও পারস্পরিক সহযোগিতায় সুসমৃদ্ধ হইয়া উঠিবে। কিন্তু বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে ততোধিক পুঁজিবাদী ব্যাংকের কোন কাজের প্রতিই নাগরিকদের কিছুমাত্র সহানুভূতি থাকিতে পারে ন। কারণ আমানতদাতাগণ নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিশ্রুত পরিমাণ সুদ লাভ করিবেই; জাতীয় অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধি পাইলে কিংবা ক্ষয়প্রাপ্ত হইলে ব্যক্তিগতভাবে তাহাদে কোন লাভ-ক্ষতি নাই। বস্তত এইরূপ সমাজে মানবতা কোন নিরাপত্তা ও কল্যাণ লাভ করিতে পারে না। এখানে কাহারো প্রতি কোনই সহানুভূতি বা দরদ নাই। ইসলামী সমাজে এইরূপ ভাবধারা মুহূর্তের তরেও বরদাশত করা যায় না। বরং সেখানে সামগ্রিক সহৃদয়তা শুভেচ্ছা ও উন্নতি লাভের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা বর্তমান থাকার দরূন জাতীয় অর্থনীতির অব্যাহতভাবে উৎকর্ষ লাভে সম্ভব হইবে।
এতদ্ব্যতীত ইসলামী সমাজে ব্যাংকে মূল শিল্প-ব্যবসায়েল পুঁজি বিনিয়োগকারী অংশীদারও করা যাইতে পারে। অর্থাৎ ব্যাংক মূলধনের সুদ পাইবে না, পাইবে মুনাফার নির্দিষ্ট অংশ। অতএব উহাকে লোকসানেরও ভাগীদার হইতে হইবে। বস্তুত বর্তমান যুগে মূলধন ও মূল শিল্পের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দূর করিয়া উভয়ের মধ্যে পূর্ণ সমন্বয় সাধনের অভাব হইবে না, অনুরূপভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার দরুন জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পাইবে। বস্তুত শিল্প ও মূলধনের এইরূপ সমন্বয় সাধন এক মাত্র ইসলামী সমাজ ভিন্ন অন্য কোথায়ও সম্ভব নহে।
এখারে আর একটি কথাও স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। ইসলামের দৃষ্টিতে Usury ও Interest এর মধ্যে কোনই পার্থক্য নাই। যদিও কেহ কেহ মনে করে যে, কুরআন হাদীসে যে ‘রিবা’ হারাম করা হইয়াছে তাহা ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেওয়া, ঋণের বিনিময়ে গৃহীত অতিরিক্ত অর্থই বুঝায়। কিন্তু ব্যবসায়ী কাজে লগ্নিকৃত টাকার নির্দিষ্ট হারের মুনাফা interest গ্রহণ নিষিদ্ধ নহে।
কিন্তু এইরূপ ধারণা কুরআন হাদীসের সম্পূর্ণ ও সুস্পষ্ট পরিপন্থী। কুরআন মজীদে যে সুদ হারাম করা হইয়াছে তাহা যত রকমেরই হউক না কেন এবং উহা লাভ করার জন্য যে পন্থাই গ্রহণ করা হউক না কেন, সবই সম্পূর্ণরূপে হারাম। বিশেষত যে সময় ‘রিবা’ নিষেধের আয়াত নাযিল হইয়াছিল সে সময়কার আরব সমাজে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত প্রয়োজন প্রদত্ত ঋণের উপর সুদ লওয়া হইত, অনুরূপভাবে ব্যবসায়ে লগ্নিকৃত মূলনের উপরও সুদ গ্রহণের রীতি ছিল। এই উভয় প্রকার সুদকে তখন আরবী ভাষায় ‘রিবা’-ই বলা হইতো। আর কুরআন মজীদে এই ‘রিবা’কেই হারাম করা হইয়াছে।
বস্তুত এই উভয় প্রকারের সুদে মূলগতভাবে কোনই পার্থক্য নাই। বরং বলা যায়, ইহা এক-ই জিনিসের দুইটি দিক। আর এই দুইটি দিকই ইসলামে চিরতরে হারাম।
আধুনিক অনুসন্ধঅন ও গবেষণার ফলে এ কথা প্রমাণিত হইয়াছে যে, সুদ উদ্বৃত্তের উপর প্রভাবশালী হয় না, মূলধন বিনিয়োগের হারই কার্যত উদ্বৃত্তের হারকে প্রভাবিত করে। ইসলাম সুদকে নিষিদ্ধ করিয়াছে বটে, কিন্তু মূলধন বিনিয়োগকে শুধু যে নিষিদ্ধ করা হয় নাই তাহাই নয়, সেজন্য বলিষ্ঠভাবে উৎসাহও প্রদান করা হইয়াছে। পুঞ্জিকৃত অর্থকে ব্যবসায়ের মূরধনরূপে বিনিয়োগের জন্য যাকাত ব্যবস্থা একটা বড় কার্যকারণ। উপরন্তু ইসলাম মুনাফা লাভের ও মুনাফায় অংশীদারিত্ব (Sleeping Partnerships) তথা লাভ-লোকসানে সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করার অনুমতি দেয় বলিয়া এই কাজে শরীক হইতে ইসলামী আদর্শবাদী মানুষ অতি সহজেই অগ্রসর হইয়া আসিবে, ইহাই স্বাভাবিক।
ইসলামি এই ব্যাংক-ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হইবে- লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। সুদমুক্ত এই ব্যাংক ব্যবস্থা ‘মুজারিবাত’ নীতিতে এই ধরনের আরো বহু প্রতিষ্ঠান কায়েম করার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্যকারী হইবে। ইহাতে শ্রম ও মূলধন পরস্পরের সহিত মুনাফার অংশীদার হিসাবে মিলিতগ হইবে। বস্তুত শ্রম ও মূলধনে স্থায়ী সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যাপারটিকে নৈতিক আদর্শ ও রীতিনীতির ভিত্তিতে স্থাপিত ও পরিচালিত করা সম্ভব হইবে। উভয় পক্ষের নৈতিক দায়িত্বকে উভয়ের ঈমানের অংশরূপে চিহ্নিত করা হইয়াছে। ফলে মুজারিবাতের নীতিতে উৎপাদনের বিভিন্ন ইউনিটের শরীকদারীতে সকল প্রকার কৃষি ব্যবসায় ও শিল্পসংক্রান্ত কাজে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হইতে পারে।
ইসলামী ব্যাংক ব্যবসায়ে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে মূলধনের ব্যবস্থা হওয়া Financing দরকার। কৃষিশিল্প ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক স্বল্পমেয়াদের জন্য অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মূলধন বিনিয়োগ করিতে পারে। ব্যাংকের কারবারে অচলবাস্থা দেখা দেওয়ার কারণে অনেক সময় ব্যাংক দেউলিয়াও হইয়া যাইতে পারে। এই কারণে দীর্ঘ মেয়াদী কারবারের জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান গঠন করা যাইতে পারে। এতদ্ব্যতীত ইসলামী ব্যাংক শিল্প, মূলধন কিংবা যন্ত্রপাতি সংগ্রহে ঋণ দেওয়ার জন্য ‘সিকিউরিটি’ সংগ্রহের ব্যবস্থাও করিতে পারে।
ব্যবসায়-বাণিজ্যেক্ষেত্রে সাময়িক প্রয়োজন পূরণের জন্য স্বল্পমেয়াদী ঋণ দানের ব্যবস্থা হওয়া একান্ত জরুরী, ইসলামী রাষ্ট্রে এই ধরনের ঋণ সরকারী ক্রেডিট এজেন্সী কিংবা নাগরিকদের দ্বারা গঠিত কো-অপারেটিভ সোসাইটি ঋণ গ্রহীতার মালিকানাধীন কোন সম্পত্তির উপর দলীল করিয়া অতি সহজেই দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে পারে।
মূলধন সংগ্রহ- পুঁজিগঠন এবং এই পুঁজিকে উৎপাদনী ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারী-উদ্যোগকারী (Enterpreneur)দের সহিত ব্যাংক সম্পর্কে কি হইবে? এ পর্যায়ে বলা যাইতে পারে যে, প্রথম অবস্থায় ব্যাংক হইবে ‘অপারেটর’ কিংবা বিজিনেস ম্যানেজার এবং পুঁজি সংগ্রহকারীদের অপারেটর। এই পর্যায়ে মূলধন মালিকদের অধিকার ও অপারেটরের কর্তব্য সম্পর্কে সাধারণ প্রচলিত ইনসাফমূলক রীতিনিতীর ভিত্তিতে শর্ত প্রয়োগ করা যাইতে পারে। ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারী যে মুনাফা লাভ করিবে, ব্যাংক মূলধন সঞ্চয়কারী হিসাবে স্থিরীকৃত হার অনুযায়ী উহাতে অংশীদার হইবে।
ব্যাংকক ও ব্যবসায়ীদের একত্রে অংশীদারিত্বের ভিত্তিবে কাজ করার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করার অবকাশ নাই। মিসরে সুদবিহীন ব্যাংক ব্যবসায় বিগত কয়েক বৎসর পূর্ব হইতে বিশেষ সাফল্য সহকারে চলিয়া আসিতেছে এবং উহা ক্রমশঃ বিকাশ ও অগ্রগতি লাভ করিতেছে। ইহা এই পর্যায়ে উৎসাহব্যঞ্জক সংবাদ। করাচীতেও এই ধরনের একটি সুদবিহীন তথা মুনাফা ভিত্তিক ব্যাংক কায়েম করা হইয়াছিল; কিন্তু কেবলমাত্র সরকারী অসহযোগিতার দরুনই শেষ পর্যন্ত তাহা অচল হইয়া পড়িতে বাধ্য হয়। [বর্তমান বাংলাদেশেও উহার সূচনা হইয়াছে বটে, তবে উহা সম্পূর্ণ জায়েয ও সুদমুক্তভাবে চলিতে পারিতেছে কিনা, তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখার ব্যাপার।]
বস্তুত ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা আধুনিক ব্যাংক ব্যবসায়ের তুলনায় অধিক সাফল অর্জনে সক্ষম। ইহার প্রধন কারণ এই যে, ইসলাম সুদ নিষিদ্ধ করিয়াছে বলিয়া ইহা হইবে সুদবিহীন ব্যাংক। সুদব্যবস্থা না থাকিলে উদ্ধৃত্তের পরিমাণ বৃদ্দি পাইবে না, এমন কথা বলারও কোন যুক্তি নাই। সুদ ব্যবস্থার দরুনই বরং মুলধন সংগ্রহের কাজ মন্থর গতিতে চলে ও মারাত্মক ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। ইহারই দরুন সমাজে ও দেশে ব্যাপক বেকার সমস্যা দেখা দেয়, এবং অর্থ-বন্টনের ক্ষেত্রে চরম ও মারাত্মক ধরনের অর্থনৈকি বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। ইহারই দরুন সমাজে ও দেশে ব্যাপক বেকার সমস্যা দেখা দেয়, এবং অর্থ-বন্টনের ক্ষেত্রে চরমনা-ইনসাফী ও আকাশছোয়া বৈষম্য দেখা দেয়, এবং অর্থ-বন্টনের ক্ষেত্রে চরম না ইনসাফী ও আকাশছোয়া বৈষম্য দেখা দেওয়া ইহারই কারণে অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়ে। কারণ, খাজনা উসুল, বিল আদায় ও আমদানী-রফতানীর কাজে সাহায্য করা ছাড়াও ইসলামী ব্যাংক ব্যাংক বহির্ভূত (Extra-Banking) বহু কাজও আঞ্জাম দিতে পারে, যাহার ফলে দেশে বিপুল অর্থনৈতিক উন্নতি লাভের সুযোগ হইবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ব্যাংক উহার মুনাফার একটা অংশ (যেমন শতকরা ৫টাকা) জাতীয় শিক্ষা কিংবা সাধারণ জনকল্যাণমূলক বহুবিধ কাজে বিনিয়োগ করিতে পারে। এই ধরনের বিনিয়োগ হইতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহসাই কোন সুফল হয়ত লক্ষ্য করা যাইবে না; কিন্তু কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর অর্থনৈতিক উৎকর্ষতার উপর এই কাজের সুস্পষ্ট প্রভাব অবশ্যই প্রতিফলিত হইবে। অতএব সামাজিক সামষ্টিক এই কাজের যে যথেষ্ট মূল্য ও গুরুত্ব রহিয়াছে তাহা অস্বীকার করার উপায় নাই।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহা মুদ্রা তৈরী মূলধন সংগ্রহ ও সুদ বর্জন ছাড়াও সেই সমস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করিত, যাহা আধুনিক কালের কেন্দ্রীয় বা রাষ্ট্রীয় ব্যাংক (Central or state bank) সম্পন্ন করিয়া থাকে। বর্তমান দুনিয়ার ইসলামী রাষ্ট্রগুলির ক্রমর্ধমান অভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বায়তুলমাল কায়েমের মাধ্যমে যাবতীয় কর্তব্য ও তৎপরতাকে সমন্বিত করা যাইতে পারে। এইরূপ একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উদ্যোগী হইলে মুসলিম জাহান হইতে কেবল সুদপ্রথাকে চিরতরে উৎপাটিত করা যাইবে তাহাই নয়, উহা দ্বারা মুসলিম তথা সাধারণ জনমানুষের বিশেষ কল্যাণ সাধিত হইবে, এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট ভিত্তি রহিয়াছে। [ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের ভূমিকা লক্ষ্যণীয়।]
বৈদেশিক বিনিময় ও ইসলামী ব্যাংক
ইলামী ব্যাংক বৈদেশিক পুঁজি-বিনিময়ের কাজও সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করিতে পারিবে। এইজন্য উহাকে হয়ত এমন এক মুদ্রানীতি গ্রহণ করিতে হইবে, যাহার ফলে উহার মুদ্রা সরাসরিভাবে সকল দেশেই- বিশেষ করিয়া শিল্পপ্রধান দেশসমূহের- অভাধে চলিতে পারিবে। এইরূপ নীতি অবলম্বন একান্তই অসম্ভব হইলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ও শিল্পপ্রধান দেশে (প্রেরিত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সঙ্গে) ইসলামী ব্যাংকের একটি ক্ষুদ্রায়তন শাখা খুলিয়া দিবে। এই ব্যাংক ইসলামী রাষ্ট্রের সকল প্রকার বৈদেশিক প্রয়োজন পূর্ণ করিবে। ইসলামী রাষ্ট্রের কোন ব্যবসায়ী ফার্ম বিদেশ হইতে পণ্য আমদানী করিতে চাহিলে সে স্থানীয় রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে পণ্যমূল্য আদায় করিবে। ব্যাংক নির্দিষ্ট দেশের শাখা ব্যাংককে সংশ্লিষ্ট ফার্মে উক্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জমা দেওয়ার নির্দেশ পাঠাইবে। কিন্তু এইজন্য কোন প্রকার সুদ গ্রহণ করিতে পারিবে না; যদিও খরচ বাবদ নির্দিষ্ট কমিশন আদায় করা ব্যাংকের পক্ষে অসংগত হইবে না।
সর্বোপরি বিবেচ্য বিষয় এই যে, বর্তমান সময়ে কোন দেশের অভ্যন্তরেও যদি সুদবিহীন ব্যাংক একবার স্থাপিত এবং সঠিক কাজ করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উহার অনস্বীকার্য নৈতিক প্রভাব স্থাপিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তখন আন্তর্জাতিক বিনিময় কার্যও বিনাসুদে নির্বিগ্নে ও সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন হইতে পারবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।