জনসংখ্যা সমস্যা
পৃথিবীর লোকসংখ্যা তীগ্রগতিতে বৃদ্ধি পাইতেছে। একমাত্র উপমহাদেশের লোকসংখ্যা বৎসরে গড়ে প্রায় ৫০ লক্ষ বৃদ্ধি পাইতেছে। ১৯৩১ খৃস্টাব্দের আদমশুমারীরে গোটা উপমহাদেশের লোকসংখ্যা ৩৩ কোটি ৮০ লক্ষ ধরা হইয়াছিল, ১৯৪১ সনে আদমশুমারীতে ৩৯৮ কোটি ৯০ লক্ষ্য দাড়াইয়াছি। সম্প্রতি এক হিসাবে প্রকাশ, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হইয়া দাড়াইবে। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশত কোটি। ইহা বৃদ্ধি পাইয়অ আগামী ৩০ বছরে ৬০০ কোটিতে পরিণত হইবে বলিয়া বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশে এক বছরে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে, তাহা লক্ষ্য করিলে সারা বিশ্বের জনসংখ্যা যে কি বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহা বুঝিতে পারা যাইবে। ১৯৫৩ সালের ১লা এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ৯০ লক্ষ ১৭ হাজার। ১৯৫৪ সনের ১লা এপ্রিল উহা ১৬ কোটি ১৭ লক্ষ ৬৩ হাজারে পরিণত হইয়াছে। এক বৎসরে ২৭ লক্ষ ৪৬ হাজার লোক অর্থাৎ জনসংখ্যার শতকরা ১.৭ ভাগ বৃদ্ধি পাইয়অছে।[দৈনিক আজাদ, ১১মে, ১৯৫৪ সাল] বাংলাদেশ এলাকায় ১৯৫৭-৫৮ সনে প্রতি বৎরে প্রায় ৮ লক্ষ লোক বৃদ্ধি পাইয়াছে। আগামী ২৫ বৎসরে এখানে এক কোটির অধিক লোক বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া ধারণা করা যাইতেছে। বর্তমানে কঠিন সংকটের সাবধান বাণী হিসাবে বলা হইতেছে যে, বর্তমান বৃদ্ধিহার অব্যাহত থাকিলে আগামী ২০০৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২৩ কোটি হইবে বলিয়া অনুমান করা হইয়াছে। এই আলোচনা হইতেই সমগ্র পৃথিবীতে- পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ক্রমিক হার এবং উহার তীব্রতা সম্পর্কে অতি সহজেই ধারণা করা চলে।
লোকসংখ্যার এইরূপ বৃদ্ধিতে দুনিয়ার এক শ্রেণীর অর্থনীতিবিদদের মনে বিশেষ আতংকের সৃষ্টি হইয়াছে। তাহারা মনে করিতেছেন যে, লোকসংখ্যা বৃদ্ধির এই তীব্রতা বন্ধ করা না হইলে সমষ্টিগতভাবে সমগ্র পৃথিবীর পক্ষে এবং বিশেষ করিয়া অর্থনৈতিক অনুন্নত দেশগুলির পক্ষে তাহা মারাত্মক হইয়া দেখা দিবে। তাহাদের মতে, প্রত্রেক দেশেই আহরণযোগ্য সম্পদের তুলনায় লোকসংখ্যা যদি এমন এক অবস্থায় পৌঁছায়, যখন দেশবাসীর মাথাপিছু সাচ্ছল্যসূচক পরিমাণে পণ্যোৎপাদন সম্ভব হয় না, তখন সেখানে লোকসংখ্যার অতিবৃদ্ধি (Over population) ঘটিয়াছে বলিয়া মনে করিতে হইবে। আর যে দেশেই এইরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হইবে, সে দেশের জনগণকে নিশ্চিতরূপেই কঠিন খাদ্যসমস্যার সম্মুখীন হইতে হইবে, সে দেশের চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিবে এবং অধিবাসীগণ অনাহারে মৃত্যুবরণ কিংবা খাদ্যাভাবে ও অর্ধাহারে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করিতে বাধ্য হইবে। কাজেই এই শ্রেণীর অর্থনীতিবিদগণ বিশ্ববাসীকে এই আসন্ন বিপদ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য পূর্ব হইতেই সতর্ক করিয়া দিয়াছেন।
ইহার জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে কেবল সাবধান করিয়া দিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, ইহা হইতে আত্মরক্ষা করিবার, আসন্ন বিপদ পূর্বাহ্নেই প্রতিরোধ করার পন্থাও নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন। তাহারা বলিয়াছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কঠিন ও সর্বগ্রাসী বিপদ হইতে দেশবাসীকে রক্ষা করিতে হইলে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির পথকেই বন্ধ করিতে হইবে, এমন ব্যবস্থা ও কার্যকর উপায় অবলম্বন করিতে হইবে, যেন লোকসংখ্যা বৃদ্ধির এই তীব্রগতি ব্রাহত ও নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ পূর্বেই যাহারা পৃথিবীতে আসিয়া সকল প্রকার চব্য-চোষ্য-পেয় দ্বারা জীবনকে পরিতৃপ্ত ও কামনা-বাসনা চরিতার্থ ব্যাঘাত সৃষ্টি করিতে না পারে- ইহাই হইতেছে তাহাদের মনোভাব। অতএব সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী লোকসংখ্যা বৃদ্ধির পথ নিশ্চিতরূপে বন্ধ করা তাহাদের মতে একান্তই অপরিহার্য।
জনসংখ্যাকে পরিমিত করিতে হইলে কার্যকর প্রতিরোধমূরক পন্থা গ্রহণ করিতেই হইবে। অন্যথায় প্রকৃতি দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদির ভিতর দিয়া নাকি ইহার প্রতিশোধ গ্রহণ করিবে। নিম্ন লিখিত পন্থা বা অবস্থা সমূহ লোকসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কাজে বিশেষ কার্যকর হয় বলিয়া অর্থনীতিবিদগণ মত প্রকাশ করিয়াছে- (ক) বিবাহিত লোকের স্বল্পহার, (খ) দুর্বল প্রজনন শক্তি, (গ) সন্তান ধারণকালের দীর্ঘমেয়াদীতা, (ঘ) স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস, (ঙ) কৃত্রিম উপায়ে জন্মনিরোধ, (চ) সামাজিক বিধিব্যবস্থা, শিশুমৃত্যুর আধিক্য ইত্যাদি।
উল্লিখিত অবস্থা বিরাজিত এবং প্রতিষেধক পন্থাগুলি চালু না থাকিলে সমাজে অস্বাভাবিকরূপে অধিক সংখ্যক লোক বর্তমান রহিয়াছে বলিয়া অর্থনীতিবিদগণ ধারণা করেন। অতএব, তাহাদের মতে এইরূপ জনসংখ্যা সমাজের পক্ষে অচিরেই মারাত্মক হইয়া দেখা দিতে পারে।
ম্যালুথাস ও অন্যান্য পন্ডিতদের মতবাদ
জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রতিরোধ করিবার জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণের নীতিকে ইংলন্ডের প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবিদ টমাস রটার্ট ম্যালূথাস (Malthus) দার্শনিক যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ১৭৯৮ খৃস্টাব্দে তিনি “An Eassy on the principle of population as it affects the futureimprovement of society” নামে একখানি বই লিখিয়া সারা পৃথিবীকে জানাইয়া দিলেন, পৃথিবীতে যে অনুপাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছে, সেই অনুপাতে খাদ্য অনেক কম পরিমাণই উৎপাদিক হইতেছে। তাহার মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে (Geometrical Progression) আর খাদ্যসামগ্রী বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে (Arithmetical progression) ১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২, ৬৪- এই ধারাকে জ্যামিতিক হার বলা হয়। আর ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭- এই ধারাকে বলা হয় গাণিতিক হার। তিনি দেখাইতে চাহিলেন যে, জনসংখ্যা খাদ্য-সামগ্রীর তুলনায় অথিক তীব্রগতিতে বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। আর এত বেশী জনসংখ্যার খাদ্য যোগাইতে পৃথিবী অক্ষম বিধায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে। এই কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ সংক্রান্ত যাবতীয় মতবাদ ও পন্থার মধ্যে তাহার মত ও পন্থা পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। ম্যালূথুসের মতে, জনসংখ্যা তখনি একটা সমস্যা হইয়া দেখা দেয়, যখন খাদ্যসামগ্রীর পরিমাণের তুলনায় লোকসংখ্যা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তিনি বলিয়াছেন, সাধারণত কোন দেশের অন্নসংস্থানের সীমানা হিসাবে সেই দেশের জনসংখ্যা নির্ধারিত হইয়া থাকে, জনসংখ্যা সীমা অতিক্রম করিলেও দেশে তদনুপাতে সম্পদ বৃদ্ধি পায় না এবং শেষ পর্যন্ত বিপদগ্রস্থ জনসাধারণ ন্যায়-অন্যায় নির্বিচারে যে কোন উপায়েই হউক না কেন- দেশের লোকসংখ্যা ও অন্নসংস্থানের সুযোগের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করে।
ভারত সরকারের প্রাক্ত অর্থসদস্য স্যার জেরেমী রেইসম্যনের মতেও লোকসংখ্যা পরিমিত করিতে না পারিলে কোন দেশের জনকল্যাণমূরক কোন বৃহত পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব নয়। এই জন্য তিনি ভারত সরকারকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিধিবিধান অবলম্বন ও বিভিন্ন স্থান সরকারী ক্লিনিক স্থাপনে উদ্যোগী হইতে পরামর্শ দিয়াছেন। ভারত সরকারও সম্প্রতি এই কাজে খুবই উৎসাহিত হইয়াছে এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের অনুকূলে জনমত গঠন করিবার জন্যও কয়েকজন বৈদেশিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে গ্রহণ করিয়াছে। এই জন্য Family planning Research and programme commitee নামে একটি কমিটিও গঠন করা হইয়াছে।
অর্থনীতির দৃষ্টিতে ম্যালথুসের মতবাদ
কিন্তু আদর্শবাদ ও বৈজ্ঞানিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে বিচার করিলে নিঃসন্দেহে প্রমানিত হইবে যে, ম্যালথুসের মতবাদ সম্পূর্ণ ভুল এবং তাহার প্রদর্শিত পন্থা মানবতার পক্ষে মারাত্মক। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কে ম্যালথুসের ধারণা যে ভুল, তার বহু পূর্বেই তাহার সহযোগী অন্যান্য অর্থনীতিবিদগণই প্রমাণ করিয়াছেন। কারণ, প্রকৃতপক্ষে জনসংখ্যা চক্রবৃদ্ধিহার বৃদ্ধি পায় না, বৃদ্ধি পায় ক্রমিক সংখ্যার অনুপাতে। এবং মানব বংশের সংখ্যা বৃদ্ধি অপেক্ষা মানুষের জীবনযাত্রা নির্বাহের প্রয়োজন পূর্ণ করার দ্রব্যসামগ্রীই অধিকতর তীব্রগতিতে বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর সর্বত্র খাদ্যপণ্য উৎপাদনের ক্রমশ বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিতেছে। শুধু তাহাই নয়, ম্যালথুসের এই মত আধুনিক শিল্প বিপ্লব ও অর্থোৎপাদনের নাবাবিষ্কৃত পথ ও পন্থা উদ্ভাবিত হওয়ার বহু পূর্বে প্রচারিত হইয়াছিল। তিনি কেবল জমিকেই অর্থ ও খাদ্যোৎপাদনের একমাত্র উপায় বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলেন। কেননা আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উদ্ভাবনীর যুগ তখনো শুরু হয় নাই। ইহাতো উনবিংশ শতাব্দীর ব্যাপার। তিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভূমিকাকেও কোন গুরুত্ব দেন নাই। কাজেই বর্তমান শিল্প ব্যবসা’র প্রেক্ষিতে ম্যালথুসের মত কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। বস্তুত অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে বর্তমান জনসংখ্যা কোন সমস্যা-ই নয়। এখানকার সময়ে সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা হইল সম্পদ বন্টনের।
বস্তুত ‘অতিরিক্ত জনসংখ্যা’ কথাটি একান্তই আপেক্ষিক। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর উৎপাদনের পরিমাণও বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব। ফল জনসংখ্যা ও খাদ্য পরিস্থিতির মধ্যে সহজেই সামঞ্জস্য রক্ষিত হইতে পারে। অধ্যাপক কানান ইহাকে বলিয়াছে Optimum population অর্থাৎ বাঞ্ছনীয় জনসংখ্যা।
লোকসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে পৃথিবীতে খাদ্য-সামগ্রী মওজুদ নাই বলিয়া দাবি করা মূলতই ভুল। প্রকৃতপক্ষে জমির বুকে বিশ্বস্রষ্টা এত বেশী পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য এবং সব মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করার উপযোগী সামগ্রী সৃষ্টি করিয়া দিয়াছেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিছুকাল পূর্বে বৃটেনের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অন্যতম কর্মকর্তা ডক্টর পি. ডি. সুখাতমি বৃটেনের রয়াল স্ট্যটিষ্টক্যাল সোসাইটির নিকট জনসংখ্যা ও খাদ্যোৎপাদন সম্পর্কে এক রিপোর্ট পেশ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ এবং উৎপাদনের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাইয়া আসিয়াছে। সে কারণে কোন সময়ই পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্দির হার খাদ্যোৎপাদনের হারকে ছাড়াইয়া যাইতে পারে নাই। অর্থাৎ প্রতি বৎসর পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়িয়াছে, তেমনি খাদ্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পাইয়াছে।
ডক্টর সুখাতমি হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন যে, পৃথিবীতে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহাতে ১৯৮০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা যাহা দাড়াইবে তাহার চাহিদা মিটাইতে হইলে খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ দ্বিগুণ এবং ২০০ সালে তিনগুণ বৃদ্ধি করিতে হইবে। -এই কথায় মাথা চক্কর দেওয়ার কোন কারণ নাই। কেননা ঐ পরিমাণ খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য বছর খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ বাড়াইতে হইবে শতকরা ৩ ভাগেরও কম। আর উহা অসম্ভব হওয়ার কোন কারণ নাই। কিছুদিন পূর্বে এক ইংরেজী পত্রিকায় R.G. Hainsworth এর লিখিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল How may people can earth feed- লেখক পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের উৎপাদনী ক্ষমতা, জমির প্রকার-ভেদ, পানিসেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারত আলোচনা করার পর উপসংহারে সিদ্ধান্তরূপ লিখিয়াছেন:
উল্লিখিত পরিকল্পনা অনুসারে একতা স্পষ্টরূপে অনুমিত হয় যে, গোটা পৃথিবীর সামগ্রিকভাবে সারা দুনিয়ার অধিবাসীদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী উৎপানের যোগ্যতা রহিয়াছে। যে যাহাই হউক, দুনিয়ার জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুমান এবং মাটির খাদ্যোৎপাদক ক্ষমতা ও উৎপাদন প্রণালীর উৎকর্ষ সাধন করিলে পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যার তিনগুণ বেশী অধিবাসীর জন্য বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও পরিতৃপ্তিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করা খুবই সহজ হইবে বলিয়া আশা করা যায়। আর লোক-বৃদ্ধির বর্তমান প্রমিক হার যদি স্থায়ী ও অব্যাহত থাকেও তবুও উল্লিখিত সংখ্যা পর্যন্ত পৌছিতে অন্তত একটি শতাব্দী লাগিবে।
এতদ্ব্যাতীত, ইহা বিবেচনার বিষয় যে, পৃথিবীর এক ভাগ মাটি এবং তিন ভাগ পানি। এই তিন ভাগ হইতে শতকরা মাত্র এক ভাগ খাদ্য পাওয়া যায়, বাকি ৯৯ ভাগ লাভ করিতে হয় মাটির উপর হইতে। অথচ বিশেষজ্ঞগণের মত নদ-নদী-সমুদ্র হইতে আরও অনেক বেশী খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়া সম্ভব। সমুদ্রের এক কিউবিক মাইল পানিতে প্রায় চৌদ্দ কোটি টন সাধারণ লবন আছে। তাহা ছাড়া আছে ম্যাগনেসিয়াম এবং ব্রোমাইড। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, যেহেতু সমুদ্রর পানিতে ২০ হইতে ৩০ গুণ অধিক কার্বণ ডায়োক্সাইড রহিয়াছে, সেইহেতু সেখানে অধিক পরিমাণ গাছপালা জন্মানোর সুযোগ আছে। সর্বোপরি, পানি জগতে মৎস্য-সম্পদ অফুরন্ত। এই অবস্থা পর্যালোচনা করিয়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্তার বিশেষজ্ঞগণ মৎস্য ও জলীয় উদ্ভিদ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং উহা খাদ্যের জন্য আহরোণের ব্যবস্থা উন্ন ব্যবস্থা, মৎস্যকুলে সংখ্যা বৃদ্ধির আয়োজন এবং আহারযোগ্য জলীয় উদ্ভিদ উৎপাদনের ব্যবস্থা করিলে মানুষের খাদ্যসমস্যার চূড়ান্ত সমাধান না হউক, বহুল পরিমাণে সমাধান হইবে।
বস্তুত দুনিয়ার মানুষ এক দিকে চরম স্বার্থপরতা ও সর্বগ্রাসী লোভ ও লালসার দরুন এবং অন্যদিকে প্রকৃত-জয়ের দুরন্ত সাহস ও উচ্চাশার অবাবহেতু অন্যান্য সকর মানুষের জন্য খাদ্যসংগ্রহের দ্বারা রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে। আসলে খাদ্যাভাব বা খাদ্যসমস্যা বলিতে কিছুই নাই। জীবিকার অনুসন্ধান, খাদ্যোৎপাদনের নূতন নূতন পথ ও উপায় অবলম্বন এবং উৎপন্ন খাদ্যের সুবিচারপূর্ণ বন্টনের ব্যবস্থা না করা, আর গভীর সহানুভূতিপূর্ণ উদার মানবীয় দৃস্টিভংগীর নিদারুণ অভাবই বিশ্ব-মানবকে বর্তমান কঠিন দুর্দশায় নিক্ষিপ্ত করিয়াছে। দুনিয়ার কোন কোন অংশে অজিও খাদ্যপণ্যের এমন প্রাচুর্য রহিয়াছে, যাহা সংশ্লিষ্ট দেশের সমগ্র অধিবাসীদের প্রয়োজনের মূল পরিমাণ অপেক্ষা অনেক বেশী। কিন্তু সেই সব দেশে কৃত্রিম উপায়ে অভাব ও চাহিদা সৃষ্টির জন্য খাদ্যপণ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। কোথায়ও খাদ্যপণ্য গুদামজাত করিয়া, খোলা বাজার হইতে লুপ্ত করিয়া, কালোবাজারে বিক্রয় করিয়া নিদারুণ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করা হয়। এই ধরনর দুর্ভিক্ষের ফলে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ মৃত্যুর কবলে ঢলিয়া পড়িতে বাধ্য হয়। ইহা অপেক্ষা মারাত্মক দুঃসহ দৃশ্য দেখা যায় সেইসব দেশে, যেখান একদিকে খাদ্যপণ্যের আকাশছোঁয়া স্তুপ রহিয়াছে, অন্যদিকে পরিতৃপ্ত ও ভরশা-পেটের লোকদের পাশাপাশি কোটি কেটি অন্নহীন, বস্ত্রহীন ও আশ্রয়হীন মানুষ হামাগুড়ি দিয়া চলা। একই দেশের অধিবাসীদের মধ্যে খাদ্য প্রাচুর্যে পরিতৃপ্ত উজ্জ্বল মুখের স্বতঃস্ফূর্ত হাসিও দেখা যায়, আবার ক্ষুধার্ত মানবদেহের মালিন্য ও কান্নাভারাক্রান্ত মুখমন্ডলেও এত বেশী দেখা যায় যেন তাহার কোন ইয়ত্তা নাই।
বর্তমান দুনিয়ার সমগ্র লোকসংখ্যা ও খাদ্যপণ্যের পরিমাণ যাচাই করিয়া দেখিলে এবং বৈজ্ঞানিক পন্থানুশীলনের ফলে খাদ্যপণ্য বৃদ্ধিলাভের সম্ভাবনা লক্ষ্য করিলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, আজিকার লক্ষ-কোটি নির্দোষ মানুষকে কঠোর ক্ষুধা, অনশন ও দুর্ভিক্ষে পীড়িত করিয়া তাহাদের বুকের তাজা তপ্ত রক্তধারা নিঃশেষে শুষিয়া লওয়ার জন্য মানব রচিত বিপর্যয়কারী অর্থনীতিই একমাত্র দায়ী। আর প্রত্যেক দেশেই চোরাকারবার, খাদ্যপণ্যের গোপন সঞ্চয় ও মুনাফা লুন্ঠনের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ ব্যাপক আকারে খাদ্যাভাব সৃষ্টি হইয়া থাকে, তাহাও অস্বীকার করা যায় না।
আমেরিকার একজন উদ্ভিতত্ববিদ প্রমাণ করিয়াছেন যে, ভূ-পৃষ্ঠের অসংখ্য ও অপরিমিত উদ্ভিদরাজির মধ্যে অতি কম ও নগণ্যসংখ্যক উদ্ভিদ সম্পর্কে মানুষ এখন পর্যন্ত কিছুটা জ্ঞানলাভ করিতে পারিয়াছে মাত্র এবং এই সামান্য সংখ্যক উদ্ভিদকেও মানুষের কল্যাণ ও উপকারমূলক কাজে ব্যবহার করার দিকে কোন প্রবণতাই পরিলক্ষিত হয় না। উদ্ভিদের খাদ্যাংশ ও অখাদ্যংশের বৈজ্ঞানিক ও রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উহাকে বিশেষ কাজে ব্যবহার করা যাইতে পারে এবং এই উপায়ে এত বেশী পরিমাণ খাদ্য ও ধন উৎপন্ন হইতে পারে যে, তাহার কোন সীমা নির্ধারণ করা যায় না।
খাদ্যাভাব প্রতিরোধের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণকে উপায় হিসাবে গ্রহণ করার প্রবণতাকে বিদ্রুপ করিয়া Dr.C.E.D.W.nshewo এক প্রবন্ধ লিখিয়াছেন:
“দারদ্র ও খাদ্যাভাব দেখিয়া কিছুসংখ্যক লোক এতদূর বিব্রত ও বিচলিত হইয়া পড়িয়াছে যে, কঠোরভাবে শক্তি প্রয়োগে সাহায্যে জন্মহারকে বন্ধ করিয়া দেওয়া ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি হইতে আত্মরক্ষা করার আর কোন উপায়ই তাহারা দেখিতে পায় না। ইদানীং এই যুক্তি বার বার আমাদের সম্মুখে পেশ করা হইতেছে যে, পৃথিবীর জনসংখ্যা যুদ্ধপূর্বকাল অপেক্ষা শতকরা দশজন করিয়া বৃদ্ধি পাইয়াছে। মাথাপিছু আয় যুদ্ধপূর্ণকাল অপেক্ষা শতকরা পাঁচ হইতে দশের দিকে নিম্নগতি লাভ করিয়াছে।”
কিন্তু লোকসংখ্যা বৃদ্ধির তীব্রতা দেখিয়া যাহারা আতংকিত হইয়া পড়িয়াছে, তাহারা খাদ্যপণ্য বৃদ্ধি করার সুযোগ ও বিরাট সম্ভাবনার দিকে মোটেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাই। অথচ-
“খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আধুনিক কৃষি-বিজ্ঞান অসংখ্য উপায় উদ্ভাবন করিয়াছে। নদীর তীরভূমি কাটিয়া নদীশেকাস্তী Erusion বন্ধ করা, বালুকাময় মরুভূমিতে পানি সেচের জন্য উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগ করা, আধুনিক সার ব্যবস্থার সাহায্যে জমিকে অধিক উর্বর ও উৎপাদন শক্তি সম্পন্ন করিয়া তোলা এবং বিভিন্ন উপায়ে খাদ্যপণ্যের চাষ করা ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।”
উক্ত প্রবন্ধ লেখকের হিসাব অনুযায়ী খাদ্যোৎপাদনের আধুনিক পন্থা সমূহের মধ্যেও মাত্র তিনটি উপায় ব্যবহার করিলেই কমপক্ ১০ বৎসরের মধ্যে প্রতি একর জমিতে শতকরা ৩০ ভাগ অধিক খাদ্য উৎপন্ন হইতে পারে। আর যেসব দেশে প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয় না, সেসব দেশে অন্যান্য নানাবিধ কার্যকর উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে। খনিজ পদারথ উৎপাদন, প্রকৃতিক উপাদান ব্যকবহার, কাষ্ঠ ও স্থানীয় শিল্পের সাহায্যে উৎপন্ন পণ্যের বিনিময়ে কৃষিপ্রধান এলাকা হইতে খাদ্যপণ্য। আমদানী করা যাইতে পারে।
বিখ্যাত কৃষিবিদ স্যর এলবার্ট হাওয়ার্ড (sir albert Howard) বলিয়াছেন, বিশ্বের মানবজাতি যদি তাহাদের উর্বরতা, গো-সম্পদের উন্নয়ন এবং শস্যবীজের উৎকর্ষের জন্য সামান্যতম চেষ্টাও করিত, তাহা হইলে বিশ্বের জমির ক্ষমতা অন্ততঃ তিনগুণ বৃদ্ধি পাইত। বর্তমানে বিশ্বের সমুদয় জমির শতকরা মাত্র ১১ ভাগ চাষাবাদের অধীন। এই ১১ ভাগের পরিমাণ হইতেছে ৩৫০ কোটি একর। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এই আবাদী জমির পরিমাণ আরও প্রায় দ্বিগুণ- ৬৬০ কোটি একর বৃদ্ধি করা সম্ভব। (দৈনিক ইত্তেফাক ১২-১-৭৪) অনেক দেশে আবর কর্মক্ষম লোকদের জন্য কাজের সংস্থান করা হয় না বলিয়া বেকার সমস্যা দেখা দেয়। ফলে খাদ্যভাব ও দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। এই বাড়তি লোকসংখ্যার জন্য অন্যত্র কর্মসংস্থান হইলে কোনরূপ বিপর্যয় সৃষ্টি হইতে পারে না।
বস্তুত সামগ্রিকভাবে দুনিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের কোন অভাবই নাই। এই বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ও অজস্র সুলভ শ্রমশক্তি প্রয়োগ করিয়া শিল্পের প্রসার করিতে পারিলে কৃষিপ্রধান দেশে বেকার লোকদের জন্য কর্ম ও অন্ন সংস্থান তো হইবেই, সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থ সাচ্ছল্য ও যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পাইবে। কৃষকও তাহার উদ্বৃত্ত শস্য বিক্রয় করিয়া অতিরিক্ত অর্থসম্পদ উপার্জন করিতে পারিবে। এইরূপ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নাই বলিয়াই দেশে দেশে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি বিশেষ আতংকের বিষয় হইয়া দাড়াইয়াছে।
অথচ কৃষি-শিল্পের পুনর্গঠনের ভিতর দিয়া প্রত্যেক দেশের আর্থিক সাচ্ছল্য সৃষ্টি হইলে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি কোনদিনই একটি সমস্যা হইয়া দাঁড়াইবে না। বরং এই লোকসংখ্যা জাতির পক্ষে অধিকতর কল্যাণকর প্রমাণিত হইতে পারে। অতএব কোন উন্নয়নশীল অর্থনীতিতেই লোকসংখ্যা বৃদ্ধি কোন সমস্যা রূপে গণ্য নয়, কর্মসংস্থান ও প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্যোৎপাদনের অব্যবস্থাই হইতেছে প্রকৃত সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান হইলে অতিরিক্ত জনসংখ্যা মানব সমাজে এক অভিনব মুক্তির মর্যাদা প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায়। সেসব দেশে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াও তাহা দেশের পক্ষে কোনরূপ সমস্যা হইয়া দাঁড়ায় নাই। বৃটেন, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড প্রভৃতির লোকসংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে, কিন্তু এইসব দেশে বাড়তি লোকগুলির জন্য কর্মসংস্থানের কিছু না কিছু ব্যবস্থা করা হইয়াছে বলিয়া লোকসংখ্যা বৃদ্ধি তেমন কোন সমস্যার সৃষ্টি করিতে পারে নাই।
আরো একটি উদাহরণ পেশ করা যাইতে পারে। ১৯৫৭ সনের হিসাব মতে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের ৪ কোটি ২১ লক্ষ অধিবাসীর জন্য প্রতি বৎসর প্রায় ২১ কোটি মন চাউলের প্রয়োজন হয়। আর প্রতি বৎসর উৎপন্ন হয় ১৮ কোটি ২৭ লক্ষ হইতে ২১ কোটি ৫৪ লক্ষ মণ। কিন্তু সব বৎসর প্রয়োজন অনুযায়ী চাউল উৎপন্ন হয় না বলিয়া, (পশ্চিম) পাকিস্তান হইতে চাউল আমদানী করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করিতে হয়। পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি একর জমিতে গড়ে ১৩ মণ ধান্য উৎপন্ন হয়। একর প্রতি উৎপাদনের পরিমাণ যদি আরো দুই-তিন মণ বৃদ্ধি করা যায়, তবে প্রদেশের খাদ্যাভাব অতি সহজেই পূরণ করা যাইতে পারে। প্রাদেশিক সরকারের কৃষি বিভাগের সেক্রেটারী ১৯৬৭ সনে প্রদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বার্ষিক কৃষি উৎপাদন ১ কোটি ২০ লক্ষ টনে উন্নীত করার তাকীদ করিয়াছিলেন। (দৈনিক আজাদ- ১০-৬৫৭)
দ্বিতীয়তঃ বর্তমানে বাংলাদেশের সীমারেখায় ভূমির পরিমাণ সাড়ে তিন শত কোটি একর। ইহার মধ্যে বর্তমান ২ শত ৯০ কোটি একর জমি আবাদযোগ্য রহিয়াছে। প্রতি বছর গৃহ-নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, শিল্প কারখানা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ১ লক্ষ একরের উপর জমি হইতে হয়। অপর এক হিসাবে জানা গিয়াছে, এদেশে আবদাযোগ্য খাস-জরি মোট পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি লক্ষ ৯১ হাজার ৯ শথ ৪০ একর।[দেশকে খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণ করিয়া তোলার জন্র ৭৭-৭৮ সন নাগাদ ১ কোটি ৫০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করা কর্মসূচী গ্রহণ করা হইয়াছে। মনে রাখা আবশ্যক যে, বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাত কোটির উপর। (দৈনিক ইত্তেফাক ১০-৪-৭৪)] এই জমিগুলিতে চাষ করার ব্যবস্থা হইলে দেশ খাদ্যপণ্য ও ধনসম্পদের দিক দিয়া সচ্ছল- বরং প্রাচুর্যপূর্ণ হইতে পারে, এই পরিমাণ চাষের জমিতে ১ কোটি ৪ লক্ষ টনের কিছু বেশী চাউল উৎপন্ন হইতে পারে। প্রায় ৮০ লক্ষ একর জমিতে বৎসরে দুই হইতে তিনটি করিয়া ফসল ফলানো সম্ভভ। এইসব উপায়ে বর্তমান উৎপন্ন খাদ্য সম্পূর্ণতা ১৫-১৬ ভাগ বৃদ্ধি করিতে পারিলেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন খুবই সহজ। যুক্তরাষ্ট্রের হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জরিপে বলা হইয়াছে যে, আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ ও পর্যাপ্ত সার ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বর্তমান ১ কোটি ২৩ লক্ষ টন হইতে ৫ কোটি টনে বৃদ্ধি করা যাইতে পারে। (দৈনিক ইত্তেফাক ১০-১০-৭৪) অর্থনীতিবিদগণ এই কথা সহজেই বুঝিতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতির এই অফুরন্ত অবদানকে মানবকল্যাণকর কাজে ব্যবহার করিয়া মানুষের জীবিকার সংস্থান করিতে চেষ্টা না করিয়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির পথই যদি বন্ধ করা হয়, তবে তাহা অপেক্ষা অমানুষিক আচরণ আর কি হইতে পারে।
অতএব বৈজ্ঞানিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে ম্যালথুসের মতবাদ যে ভুল এবং বর্তমান যুগেও যাহারা এই মতবাদকে কার্যকর করিবার জন্য চেষ্টিত তাহারা যে মানবতার প্রকাশ্য দুশমন, তাহাতে আর কোনরূপ সন্দেহ থাকিতে পারে না।
এই পর্যায়ে ১৩৯৩ বাংলা সনের ১৫ই চৈত্র (৩০-৪-৮৭ ইং) দৈনিক ইত্তেফাক-এর অর্থনীতির পাতায় বিশ্ব অর্থনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন, শীর্ষক প্রবেন্ধের প্রয়োজনীয় অংশটুকু এখানে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করিতে চাই। তাহাতে বলা হইয়াছিল।
‘দরের পরিবর্তন এবং চাহিদা হ্রাসের পূর্বাভাস আগে কেউ দিতে পারেন নি। দশ বছর আগে ‘ক্লাব অব রোম’ নামের বিশেষজ্ঞদের নোট টি বলেছিল: ১৯৮৫ নাগাদ বিশ্ব জুড়ে কাঁচামালের অভাবে হাহাকার পড়ে যাবে। ১৯৮০ সনে কার্টার সরকার ২০০০ সনে বিশ্বের হাল সম্পর্কে যে রিপোর্ট গ্রহণ করিয়াছিল, তাতে বলা হয়েছিল যে, আগামী ২০ বছর পর্যন্ত সারা বিশ্ব খাদ্যের উৎপাদন কমে যাবে।
‘কিন্তু এই ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক ছিল না। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের মোট খাদ্যোৎপাদন ১৯৭২ থেকে ১৯৮৫-এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যা সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চ স্বল্পোন্নত দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছ অতি দ্রুত। একইভাবে সব ধরনের বন-সম্পদ গত দশবছরে ২০ হতে ৩৫ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে, আর তার মধ্যেও অগ্রগতিটা বেশী হয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ্। (বাংলাদেশ ইহার বাহিরে নয়।)
এর কারণ কি? প্রশ্নের জওয়াবে প্রবন্ধটিতে লেখা হয়েছে:
বিশ্ব জুড়ে খাদ্য-শস্যের চাহিদা বেড়েছে ক্লাব অব রোম ও গ্লোব্যাল ২০০০ রিপোর্টে অনুমিত হারেই। কিন্তু খাদ্যের সরবরাহ বেড়ে গেছে ততোধিক দ্রুততার সাথে। এটা কেবল জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পায় নি, সারা বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকেই ছাড়িয়ে গেছে।
এই কথা হইতে নিঃসন্দেহে মনে করা যায় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির দরুন বিশে যে কোন দেশেই- খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার আতংক সৃষ্টিকারী সব ভবিষ্যদ্বাণীই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং সেই কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রোধ করার চেষ্টা চরম পাগলামী ছাড়া আর কিছুই নয়।
খাদ্যের প্রয়োজন-পরিমাণ উৎপাদন না হওয়ার কারণেই যে খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং কোন দেশে মানুষকে না খাইয়া থাকিতে হয়, তাহাও সত্য নয়। কেননা জাতিসংঘ কৃষি ও খাদ্য সংস্তার F.A.O মহাপরিচালক মিঃ এড ওয়ার্ড সাওমার ফাও- এর বিশ্বখাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কি কমিটির কাছে পেশকৃত রিপোর্টে বলিয়াছেন: বিশ্বে পর্যাপ্ত খাদ্য মওজুত থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি গরীব জনসাধাণকে প্রয়োজনীয় খাদ্যের জন্য হাহাকা করিতে হইতেছে’। (দৈনিক ইত্তেফাক-২৭শে চৈত্র ১৩৯৩ দ্রঃ)
জনসংখ্যা অনুপাতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য উৎপন্ন হয় না, উক্ত কথার প্রেক্ষিতে তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। অতএব এই অজুহাতে জনসংখ্যা কম রাখিবার জন্য নৈতিকতা ও সমাজ ধ্বংসকারী ‘পরিবার পরিকল্পনাকে মানবতার দুশমন ও চরিত্রহীনতার প্রবর্তনকারীদের মারাত্মক ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই বলা যায় কি?
জনসংখ্যা সমস্যা ও ইসলাম
এই আলোচনার শেষ ভাগে বিষয়টি সম্পর্কে ইসলামী নীতি পেশ করা একান্ত আবশ্যক। পৃথিবীতে শান্তি শৃংখলা স্থাপন এবং মানব সমাজের সুস্ঠু পরিচালনার জন্য আল্লাহ তা’আলা স্বাভাবিকভাবে দুইটি প্রধান জিনিসের ব্যবস্থা এইজন্য করিয়াছেন যে, জীবিত লোকদিগকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাঁচইয়া রাখা এবং তাহাদের মধ্যে কর্মক্ষমতা সঞ্চার করা ইহা ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে সম্ভব নয়। এইজন্য বিশ্বস্রষ্টা মানুষকে কেবল খাদ্য দান করিয়া ক্ষান্ত হন নাই, খাদ্য গ্রহণ করার স্বাভাবিক আগ্রহ ও প্রয়োজনবোধও তাহাদের মধ্যে সঞ্চারিত করিয়াছেন। অন্যথায় কোন সৃষ্টজীবের পক্ষেই জীবন রক্ষা করা সম্ভব হইত না। কিন্তু বিশ্বস্রষ্টার নিকট ‘ব্যক্তি’র জীবন অপেক্ষা ‘জাতি’র জীবন (জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে) অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ‘ব্যক্তি’র জন্য জীবনে আয়া খুবই সীমাবদ্ধ, আর ‘জাতি’র জীবন অনন্ত। কাজেই এই সমাজ পরিচালনার জন্য ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বেই তাহার স্থলাভিষক্ত অন্য ব্যক্তির প্রস্তুত হওয়া একান্ত অপরিহার্য। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বিশ্বপ্রকৃতিতে ‘বংশ’ বৃদ্ধির স্বাভাবিত ব্যবস্থা করা হইয়াছে এবং প্রাণীর মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা দান করা হইয়াছে। বস্তুত বিশ্বস্রষ্টান এই মহান উদ্দেশ্য যাহাতে সঠিকরূপে কার্যকর হইতে পারে, ইসলম তাহারই অনুকূল নীতি পেশ করিয়াছে।
প্রথম ব্যবস্থা সম্পর্কে ইসলামের ঘোষণা এই :
(আরবী*********)
‘পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীর খাদ্য প্রয়োজন পূর্ণ করার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আলআহর’[আল্লাহ যে অনেক অনেক বেশী মানুষকে জীবকে খাদ্য দিয়া বাঁচাইতে পারেন এবং তাহা আল্লাহর পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন নয়- তাহাতে যে আল্লাহর খাদ্য ভান্ডারে কোন অভাব পড়িবে না, তাহাতে এক বিন্দু সন্দেহ থাকিতে পরে না নবী করীম (স) আল্লাহর কথা বর্ণনা করিয়াছেন এই ভাষায়:
(আারবী*******)
হে আমার বান্দাগণ, তোমাদের প্রথমকার ও পরবর্তীকালের লোকেরা তোমাদের সমস্ত মানুষ ও জ্বীন যদি একটি কাষ্ঠের উপা দাঁড়াইয়া আমার নিকট প্রার্থনা করে এবং আমি প্রত্যেকের প্রার্থনানুযায়ী দান করি, তাহা হইলেও আমার নিকট রক্ষিত সম্পদ হ্রাসপ্রাপ্ত হইবে না- হইবে শুধু এতটুকু পরিমাণ, যতটুকু পরিমাণ সমুদ্রে সূঁচ ডুবাইয়া উঠাইলে হয়।’]।
এবং এইরূপ ব্যবস্থা বর্তমান থাকায় মানব বংশ ধ্বংস করার নীতি ও মনোবৃত্তির তীব্র প্রতিবাদ করিয়া কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে:
(আারবী*******)
‘তোমরা তোমাদের সন্তানদিগকে দারিদ্র ও অন্নভাবের ভয়ে হত্যা বা ধ্বংস করিও না। কারণ তাহাদের-এবং তোমাদের- প্রয়োজনীয় ‘রিযিক’ আমিই দান করিয়া থাকি। কাজেই মানব বংশ ধ্বংস করার নীতি মারাত্মক ভুল ও মহা অপরাধ, সন্দেহ নাই।
বস্তুত যাহারাই বংশ বৃদ্ধির পথ বন্ধ করিতে চেষ্টা করয়াছে, তাহারা বিভিন্ন দিক দিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে। তাহরা একদিকে খাদ্যোৎপাদনকারী যুবশক্তি নির্মল করিয়াছে, অন্যদিকে খাদ্যোৎপাদনে অক্ষম লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া সমাজকে একেবারে অচল করিয়া দিয়াছে। বৃদ্ধ, পংগু,অক্ষম ও অকর্মণ্য লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া সমাজকে এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন করিয়া দিয়াছে। অর্থনীতির দৃষ্টিতে ইহা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি, সন্দেহ নাই।
কুরআন মজীদের নিম্নলিখিত আয়াতে ঠিক এই কথাই বলা হইয়াছে:
(আারবী*******)
যাহারা নিজেদের সন্তান-সন্ততিকে অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে হত্যা করিবে এবং আল্লাহ-প্রদত্ত অবদানকে আল্লাহ-সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করিয়া নিজেদের উপর হারাম করিয়া লইবে, তাহারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। তাহারা পথভ্রষ্ট হইয়াছে এবং তাহারা হেদায়েত প্রাপ্ত হইবে না।
বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেও বিশ্বমানবের সম্মুখে আজ এই সত্য তত্ত্ব উৎঘাটিত হইয়াছে যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ- জনসংখ্যাবৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করা- অর্থনীতির দৃষ্টিতে মারাত্মক ভুল।আর জনসংখ্যা হ্রাস করা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের (Economical Depression) মূল কারণ সমূহের মধ্যে অন্যতম। যেহেতু মানুষের জন্মহার হ্রাস পাইলে উৎপাদন ও উপার্জনক্ষম লোকদের (Producing population) সংখ্যা ব্যয়কারী লোকদের (Consuming population) অপেক্ষা অনেক কম হইয়া পড়িবে। ইহার অনিবার্য পরিণতিতে জনসমাজে বেকার সমস্যা দেখা দিবে। ফলে সমষ্টিগতভাবে ব্যয়কারী লোকদের সংখ্যাও অত্যধিক কম হইয়া পড়িবে, উৎপন্ন পণ্যক্রয়কারী লোকদের সংখ্যাও হ্রাস পাইবে; মজুর-শ্রমিকগণ কাজ কাম পাইবে। ইহার অনিবার্য পরিণামে মানব জাতির অগ্রগতি মারাত্মকরূপে ব্যহত হইবে। জার্মানী ও ইটালীর অর্থনীতিবিদগণ এই জন্যই জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন।
ইসলামী অর্থনীতি প্রথমত একদিকে পুঁজিবাদের মূলোৎপাটন করিয়াছে, সুদকে চিরতরে হারাম করিয়াছে, সাধাণভাবে একচেটিয়া ব্যবসায় ও নিরংকুশ ইজারাদারী নিষিদ্ধ করিয়াছে, জুয়া, প্রতারণামূলক ব্যবসায় ও ধন সম্পদ বিনা কাজে আটক করিয়া রাখাকে কঠিন পাপ বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে। অন্যদিকে যাকাত ও মীরাসী আইন জারী করিয়া অর্থনৈতিক অসাম্য ও সম্পদ সম্পত্তির একস্থানে পুঞ্জীভূত হইয়া যাওয়ার সকল পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করিয়া দিয়াছে। কাজেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধুয়া তুলিয়া ইসলামী সমাজে জন্মনিয়নস্ত্রণ বা ভ্রুণ হত্যার প্রচলন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। বরং সত্য কথা এই যে, ইসলামী সমাজে যাহারাই এই কাজ করিতে উদ্যত হইবে, তাহারা ফৌজদারী আইনে অভিযুক্ত হইবে। ইসলমী সমাজে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কোন দিনই কোন সমস্যা হইয়া দাঁড়াইবে না, ইসলামী রাষ্ট্র এই বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যাকে উৎপাদনকারী শক্তি হিসাবে প্রয়োগ করিয়া বিশ্বস্রষ্টার অফূরন্ত ধনভান্ডার-এই বিশ্বপ্রকৃতিকে ‘জয়’ করিবে। বস্তুত ধনসম্প ও খাদ্য-পণ্য উৎপাদনের যত উপায় ও উপকরণই দুনিয়ায় রহিয়াছে, তাহার সবগুলিকেই মানুষের বুনিয়াদী প্রয়োজন পূর্ণ করার কাজে ব্যবহার করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য। ইহার ফলে ধন ও খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাইবে, উৎপন্ন খাদ্যপণ্য কোনক্রমেই অপচয় বা নষ্ট করা হইবে না বলিয়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রকৃত হার কোনদিনই খাদ্যাভাব ঘটাইবার কারণ হইবে না। দ্বিতীয়ত ধনসম্পত্তি ও খাদ্যপণ্যের সুবিচারপূর্ণ বন্টন করা হইবে বলিয়া তথায় কেহ কাহারো উপর জুলুম বা শোষণ করিবে না বরং বিশ্বস্রষ্টার বিধান-অনুযায়ী তাঁহার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূর্ণ করাই হইবে ইসলামী অর্থনীতির মুল লক্ষ্য।
সবচেয়ে বড় কথা এই যে, ইসলামী অর্থনীতি কার্যকর ও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হইবে যে, রাষ্ট্রব্যবস্তার মারফতে, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা দেশ ও রাজ্যের প্রত্যেকটি মানুষ- তথা প্রত্যেকটি প্রাণীর অপরিহার্য জৈবিক প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করিবে। এই জন্য ইসলামী রাষ্ট্র জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুসারে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদনের পরিমাণও বৃদ্ধি করিতে থাকিবে। খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি না করিয়া মানুষের বংশ ধ্বংস করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা দিকে উহার কোন প্রবণতাই থাকিবে না।
বস্তুত যে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা মানুষের বংশ ধ্বংস করিবার জন্য উদ্যোগী হয়, ক্রমবর্ধিষ্ণু মানুষের জন্য খাদ্যোৎপাদনর ব্যবস্থা করে না, সে রাষ্ট্রব্যবস্থা মানবতার দুশমন, বিশ্বস্রষ্টার মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী এবং অস্বাভাবিক। এইরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থাও অস্বাভাবিক অর্থনীতিকে নির্মূল করার জন্যই ইসলামের চিরন্তন লড়াই।
জনসংখ্যা সমস্যা ও প্রাচুর্যের পৃথিবী
[‘ইসলামের অর্থনীতি’ বই’র প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের একটি সরকারী ডিগ্রী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বইখানির জনসংখ্যা সম্পর্কিত আলোচনা পর্যায়ে কিছু আপত্তি জানাইয়া অভিমত প্রকাশ করেন। উহার জওয়াব লিখিত তথ্যপূর্ণ চিঠিখানি এখানে সন্নেবেশিত করা হিইল।]
আমি জানিয়া বিশেষ সুখী হইয়াছি যে, আপনি আমার লিখিত বই ‘ইসলামের অর্থনীতি’ সম্পূর্ণ পড়িয়াছেন এবং ইহা পড়িয়া যারপর নাই উৎসাহিত হইয়াছেন। সেই সঙ্গে এ কথাও জানিতে পারিলা যে, বইখানি ‘জনসংখ্যা সমস্যা’ সম্পর্কীয় আলোচনা এবং ইহার সমাধানের জন্য আমি যে পন্থা পেশ করিয়াছি তাহা আপনাকে প্রতি কারিত পারে নাই। বরং এই বিষয়ে আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগিয়াছে যে, জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়িতেই থাকিবে এবং তাহাতে খাদ্য সমস্যাও দেখা দিবে। এমতাবস্থায় জন্মনিয়ন্ত্রণ যদি অনুমোদিত না হয়, তাহা হইলে এই সমস্যার সুস্পষ্ট ও কার্যকর সমাধান কি হইতে পারে?
আমার বইতেই প্রসঙ্গটির বিস্তারিত আলোচনা রহিয়াছে। কিন্তু মন হইতেছে যে, আপনি আমার আলোচনা যথাযথভাবে অনুধাবন করিতে পারেন নাই। তাই বর্তমান পত্রে আপনার সম্মুখে আমার বক্তব্য আরো বিস্তারিত রূপ পেশ করিতেছে। অবশ্য এই আলোচনাও নিছক অর্থনৈতিক তথ্য পরিবেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে। বলা বাহুল্য, যেসব তথ্য আমার গ্রন্থে উল্লেখিত হইয়াছে, এখানে উহর পুনরোল্লেখ করা হইবে না। আশা করি, আমার এই কথাগুলিও গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখিবেন।
‘ইসলামের অর্থনীতি’ বইতে আমি জনসংখ্যা-সমস্যা সম্পর্ক আলোচনা করিতে গিয়া মোট চারটি কথা বলিয়াছি। প্রথম কথা এই যে, পৃথিবীতে জনসংখ্যা তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পাইতেছে এ কথা ঠিক, কিন্তু সেইজন্য এক শ্রেণীর অর্থনীতিবিদ জনসংখ্যা রোধের যে উপদেশে দিয়াছেন, তাহা কিছামাত্র যুক্তসংগত নহে। কেননা ইহা হইতে চরম স্বার্থপরতা প্রমাণিত হয় এবং মানবতার সহিত চরম দুশমনি করা হয়। ইহা হইতে এই মনোবৃত্তি প্রকাশ পায় যে, আমরা যাহারা দুনিয়ায় আসিয়াছি, তাহারাই যে এখানে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকিতে ও ভোগ-বিলাস করিতে পারি, অন্য কেহ যেন আমাদের সহিত ভাগ বসাইতে এবং আমাদিগকে অভাবগ্রস্ত করিতে না পারে।
দ্বিতীয় এই যে, কিছু সংখ্যক অর্থনীতিবিদ জনসংখ্যা সমস্যা দেখাইতে গিয়া যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহাও ভুল। যেহেতু জনসংখ্যা চক্রবৃদ্ধিহার বাড়ে না বাড়ে ক্রমিক সংখ্যার অনুপাতে। এবং খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদনও ঠিক সেই অনুপাতেই বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রকৃত পক্ষে কোন সমস্যা নহে।
তৃতীয়তঃ বর্তমান পৃথিবীতে যাহাকিছু খাদ্যসম্পদ আছে, তাহা শুধু বর্তমান জনসংখ্যার জন্য নয়, ইহার বর্তমান আয়োজন দিয়াই ইহার তিনগুণ বেশী লোকের জন্যও বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্য ও পরিতৃপ্তি সহকারে খাদ্য সরবরাহ করিতে পারে। এই প্রসঙ্গে আমি বৈজ্ঞানিকদের উক্তির উল্লেখ করিয়া নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণ করতে চেষ্টা করিয়াছি যে, পৃথিবীর স্থলভাগ ও জলভাগে এত উপাদান রহিয়াছে, বৈজ্ঞানিক পন্থা যাহার অনুশীলন করিলে খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ বর্তমান অপেক্ষা তিন-চারগুণ বৃদ্ধি পাইতে পারে।
আর চতুর্থ এই যে, ইসলাম জনসংখ্যা সমস্যার সমাধানের জন্য কোন প্রকারের জন্মনিয়ন্ত্রণই আদৌ সমর্থন করে না। বরং ইসলামী তীব্র ভাষায় এই ধরন মনোবৃত্তি ও প্রচেষ্টার প্রতিবাদ করিয়াছে এবং দেখাইয়াছে যে, জন্মনিয়ন্ত্রণের পন্থা অবলম্বন করিলে জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান হইবে না; বরং ঠিক তখনই এই সমস্যার সৃষ্টি হইবে। কেননা স্বাভাবিক অবস্থায় ইহা কোন সমস্যাই নহে।
আমি জানি না, আমার আলোচা হইতে আপনি এই কথাগুলি হৃয়ংগম করিতে পারিয়াছেন কিনা। কেননা, যদি তাহা করিতে পারিতেন, তাহা হইলে আপনার নিকট হইতে এই প্রশ্ন আমার নিকট নিশ্চয়ই আসিত না।
১৯৬৩ সনে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা গিয়াছে যে, জাতিসংঘের বিশেষ তহবিল গঠনের পর অসংখ্য সম্পদ জরিতেপর ফলে স্পষ্ট রূপে প্রমাণ পাওয়া গিয়অছে যে, এই পৃথিবী অত্যন্ত সম্পদশালী এক গ্রহ। জাতিসংঘর সাধান পরিষদে প্রদত্ত রিপোর্ট উল্লেখিত তহবিলে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পলজিহফম্যান বলিয়াছেন, এমন বহু দেশ রহিয়াছে, যেখানে জমিতে সার এবং উন্নত বীজ ব্যবহার করা হইলে শস্যোৎপাদনের পরিমাণ বর্তমান তুলনায় দুই-তিনগুণ বৃদ্ধি পাইবে।তিনি জানান, বহুস্থানে অপরিমিত খনিজ সম্পদ অনাবৃষ্কৃত রহিয়াছে। বহু স্বল্প আয়ের দেশে পানি সম্পদ এখন পর্যন্ত বিদ্যুত উৎপাদন ইত্যাদির কাজে ব্যবহার করা হয় নাই। তিনি বলেন, পৃথিবীতে এখনো কোটি কোটি একজর জমির পানি সরাইয়া অথবা লবণ্যক্ততা দূর করিয়া চাসোপযোগী জমিতে পরিণত করা যাইতে পারে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি পারলেই তাহা কোন সমস্যায় পরীণত হয় নাই আমার এই কথাটির ভিত্তি বিশ্বেবৈজ্ঞানিক আবিষ্কৃত উদ্ভাবনী এবং উহার ক্রমবৃদ্ধির হারে উপর স্থাপিত। গোটা পৃথিবীকে সম্মুখে রাখিয়া চিন্তা করিলে আমরা দেখিতে পাই যে, মানুষের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাইতেছে, ঠিক তেমনি খাদ্যোৎাদনের পরিমাণও বৃদ্ধি পাইতেছে। মনে করুন, আজ হইতে একশত বৎসর পূর্বে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল- ধরা যাক- বর্তমান সংখ্যার তিনভাগের দুই ভাগ। খাদ্যের পরিমাণ সম্পর্কেও চিন্তা করিলে আমরা বুঝিতে পারিব যে, বর্তমানে যে পরিমাণ খাদ্য নানাভাবে পাওয়া যায় তত পরিমাণ খাদ্য নিশ্চয়ই তখন উৎপন্ন হইত না। আমার মতে বর্তমান পরিমাণের তিনভাগের দুইভাগ পরিমাণই হয়ত উৎপন্ন হইত। খাদ্য সংগ্রহের এমন অনেক পন্তা বা যন্ত্র এখন আবিষ্কৃত হইয়াছে যাহা অতীতে কোনদিন ছিল না শুধু নয়, সেই সূত্রে যে পরিমাণ খাদ্য-সংগ্রহ হইতে পারে তাহা কেহ চিন্তাও করিতে পারিত না। বিশেষতঃ কৃষির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ চিন্তা করিল এই কথা আর জোরালোভাবে প্রমাণিত হয়যে, ইহার দ্বারা খাদ্যের পরিমাণ প্রয়োজন পরিমাণ অপেক্ষাও অনেক বেশী বাড়ানো যাইতে পারে।
পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীর দেশে বিজ্ঞানের সাহায্যে খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ যেভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে তাহা পর্যালোচনা করিলেই আমার উপরোক্ত দাবী প্রমাণিত হইবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ রাশিয়ার কথাই ধরা যাক। ১৯১৮ সালে রাশিয়ায় উৎপন্ন খাদ্যের পরিমাণ ছিল ছয় কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টন। আর বিগত ৫৪ সনে প্রকাশিত হিসাবে জানা গিয়াছে যে, সেখানে উৎপাদিত খাদ্যের পরিমাণ হইয়াছ এগার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টন। আমেরিকা সম্পর্কে জানা যায় যে, বিগত ২০ বৎসরের মধ্যে খাদ্যের উৎপাদন একর প্রতি শতকরা ৩৭ ভাগ বৃদ্ধি পাইয়াছে। এক এক-একটি ফার্মের চাষী শ্রমিক পূর্বাপেক্ষা শতকরা ৪০ ভাগ বেশী উৎপাদন করিতে পারিতেছে। বলা হইয়াছে, ১৯৫২ সন খাদ্যের মওজুদ পরিমাণ ছিল ২৫৪০ লক্ষ বুশেলস, ১৯৫৩ সনে ৫৫ লক্ষ বুশেলস এবং ১৯৫৪ সনে এই পরিমাণ বৃদ্ধি পাইয়া ৬৪০০ লক্ষ বুশেলস হইয়া গিয়াছে।
ইহা হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইতেছে এবং আমার দাবি এই যে, প্রয়োজন পরিমাণই বৃদ্ধি পাইতেছে। বাস্তবিকই খাদ্যোৎপাদনের ব্যাপারে যদি নূতন নূতন যন্ত্র ও উন্নত বৈজ্ঞনিক পন্থার প্রয়োগ করা হয়, ভাল বীজ এবং আধুনিক সার ব্যবহার করা হয়, তবে খাদ্যোৎপাদনে পরিমাণ বর্তমান অপেক্ষা দ্বিগুন-তিন গুণ বৃদ্ধি করা যাইতে পারে। ভাল বীজের সাহায্যে খাদ্যোৎপাদন যে পরিমাণ বৃদ্ধি করা যাইতে পারে তাহা দেখাইতে গিয়া T.jenkins নামক প্রসিদ্ধ কৃষি-বিজ্ঞানী বলিয়াছেন যে, -প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিন বৎসরের মধ্যে ৮ বিলিয়ন (Billion) বুশেলস শস্য ৩১০০ লক্ষ একর জমিতে উৎপন্ন করা হইয়াছিল, কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিন বৎসরের মধ্যে ৯১ বিলিয়ন বুশেলস শস্য শুধু ২৮১০ লক্ষ একর জমিতে উৎপাদন করা সম্ভব হইয়াছিল।
বৃটেনও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বে উৎপাদন পরিমাণ অপেক্ষা শতকরা ৪০ ভাগ বৃদ্ধি করিয়াছে। উহার দাবি এই যে, দেশে সমগ্র জনতার পেট ভরিয়া খাওয়ার পক্ষ যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য সেখানে উৎপন্ন হয়। “এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিল’ কৃষি বিষয়ে গবেষণা শুরু করিয়াছে। কাউন্সিলের তরফ হইতে ঘোষণা করা হইয়াছে যে, বীজকে তরল Nurient- ভিজাইয়অ বপন করল খুব ভাল ফসল হইয়া থাকে। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে যে, সাদা বীজ বপন করিলে ২০ বুশেলস এবং Phosphete-এ ভিজাইয়া বপন করিলে একর প্রতি ২৫ বুশেলস খাদ্য উৎ’পাদন হইতে পারে।
খাদ্যোৎপাদনের ক্ষেত্রে আনবিক শক্তি প্রয়োগ করিতে পারিলে- যেজন্য চারিদিকে গবেষণা ও পরীক্ষা-নীরীক্ষা চলিতেছে- উৎপাদন পরিমাণ অভাবিতরূপে বৃদ্ধি পাইতে পারে। David-E-Lilunthal ১৯৪৯ সনে লিখিয়াছিলেন যে, বিজ্ঞানীগণ গত দুই বৎসর যাবত চেষ্টা করিতেছেন কৃষি ক্ষেত্রে আনবিক শক্তি ব্যবহার করার জন্য। ১৯৪৮ সনে বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে কৃষি উৎপাদন আনবিক শক্তি কিরূপে কার্যকর হইতে পারে- এই সম্পর্কে তিনি আলোচনা করিতে গিয়া বলিয়াছিলেন: আনবিক বিজ্ঞানের একটি অপূর্ব অবদান এই যে, উহা মানব বংশের এক কঠিন সমস্যার সমাধান পেশ করিয়াছেন এবং তাহা হইতেছে দুনিয়ার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ। বৃটেনের আনবি বিজ্ঞানী ডাঃ জন এইচ ফ্রেমলিন (Dr John H. Fremlion) Atomic Scientist News’পত্রিকায় লিখিয়াছেন যে, প্রাচ্য দেশসমূহে খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ অপেক্ষা জনসংখ্যার পরিমাণ বেশী। কিন্তু রাশিয়া সহ সমগ্র পাশ্চাত্য দেশে খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির গতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি অপেক্ষা অনেক তীব্র। তিনি অনুন্নত দেশসমূহ- বিশেষ করিয়া ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানে- কৃষি ক্ষেত্রে আনবিক শক্তির প্রয়োগের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন।
তিনি আরো বলিয়াছেন, বৃটেন ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে এ সম্পর্কে এতদূর তথ্য পাওয়া যায় যে, এই সম্যার সমাধান খুবই সহজে করা যাইতে পারে। তাহার মতে শিক্ষিত ও শিল্পায়িত পাক-বাংলা-ভারতে বর্তমান জনসংখ্যার দ্বিগুণ লোকের খাদ্যের ব্যবস্থা করা কিছুমাত্র কঠিন কাজ নহে।
আলবেনিয়অ একটি ক্ষুদ্র দেশ। কিন্তু সেখানেও একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫১-৫৫০) তৈয়ার করা হইয়াছে, যাহার দরুন জাতীয সম্পদ শতকরা একশ’ ভাগ বৃদ্ধি পাইয়াছে। ১৯৫০ সনে জনসেচের জমির পরিমাণ ছিল ৩৯০০০ হেকটার্স। পাঁচ বৎসরের শেষ ভাগে তাহা হইয়াছে ৮৩০০০ হেকটার্স। ইহাতে খাদ্যশস্যের পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইহা হইতে সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায় যে, এইসব ক্ষুদ্র দেশ ও আনবি পক্রিয়ায় খাদ্য পরিমাণ জনসংখ্যা প্রয়োজন অনুপতে বৃদ্ধি করিয়া লইয়াছে এবং তাহা কিছুমাত্র অসম্ভব নহে।
দুনিার বিভিন্ন দেশ খাদ্যশস্য ছাড়াও আরো অনেক প্রকারের খাদ্যদ্রব্য ও খাদ্যের আরো অসংখ্য প্রকারের উপায় উদ্ভাবন করিয়াছে। সুইডেন সম্পর্কে জানা গিয়াছে যে, সেখানে দুইজন বিজ্ঞানী সাধার খরগোশ অপেক্ষা ২ গুণ বড় খরদগোশ উৎপাদন করিতে সমর্থ হইয়াছেন। যেখানে সাধারণ খরগোশের ওজন হয় ৫ পাউন্ড। কিন্তু বিজ্ঞানের সাহায্যে উৎপাদিত খরগোশের ওজর হইতেছে ১২ পাউন্ড পর্যন্ত। এই গবেষণার সাহায্যে মাছ, মোরগ, ছাগল, ও গরু ইত্যাদির ওজর অত্যধিক বৃদ্ধি করা যাইতে পারে এবং তাহা দ্বরা খাদ্য প্রয়োজন অনেকখানি পূরণ হইতে পারে।
বিশ্বের অন্নকষ্ট নিরসনে রসায়নবিদ্যা কতখানি সহায়ক হইয়াছে এবং ভবিষ্যতে ইহা পুষ্টিহীনতা রোধ করিয়া কিভাবে বিশ্বজোড়া মানুষের স্বাস্থোন্নতি ঘটাইতে পারে এবং প্রশ্ন লইয়া ও যথেষ্ট আলোচনা ও গবেষণা হইয়াছ। জার্মানীর বৃহত্তম বিকল্প সামগ্রী উৎপাদনী শিল্পের ডিরেক্টর বোর্ডের অধ্যপক ডঃ বার্নহার্ড টিম বলিয়াছেন, শিল্প রসায়ন ইতিমধ্যেই তিনটি ক্ষেত্রে বিশ্বজোড়া খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতি বিধানের সক্ষম হইয়াছে। ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্রগুলি রসায়নবিদদের প্রধান কর্মক্ষেত্র হইবে। ক্ষেত্রগুলি হইল, বিকল্প সার, কার্যকর কীটপতংগ নাসক দ্রব্য ও জৈবি প্রোটিন উৎপাদন বিশ্বে বর্তমান মোট সাড়ে ছয় কোটি টন নাইট্রোজেন সার উৎপন্ন হইয়া থাকে। অধ্যাপক বার্নাহার্ডের মতে ২০০০ সালে মানুষের যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন হইবে তাহা উৎপাদনের জন্য এই সবই যথেষ্ট। শিল্পোন্নত দেশগুলিতে এখন স্বনির্ভরতার যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাইতেছে তাহাতে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় এখন নাইট্রোজেন সারের কারখানা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়াছে। বিশ্বের সব্জি জাতীয় খাদ্যের প্রায় এক চতুর্থাংশই প্রতি বছর নানা রকমের কীটপতংগের আক্রমণে বিনষ্ট হয়। অথচ কীটনাশক দ্রব্য ব্যবহার করিয়া এই অবস্থার উন্নতি করা যাইতে পারে। এবং সব্জি উৎপাদনের হার শতকরা ৩০ ভাগ এমনকি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল ৫০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি কা যাইতে পারে। জৈবিক প্রোটিন সমৃদ্ধ পশুখাদ্যের সাহায্যে পশুবংশ বৃদ্ধিরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা সম্ভব। রাসায়নবিদদের বিশ্বাস, রসায়নিক প্রোটিন সমৃদ্ধ পশু খাদ্যের সাহায্যে বিশ্বের গৃহপালিত পশু দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা যাইতে পারে।
এই সব তথ্যের উল্লেখ আমি এই জন্য করিলাম যে, ইহা দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, মানুষ এই পৃথিবীর বুক হইতে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য কেবল যে নিজের জন্য উৎাদন করিতে পারে তাহই নয়, বরং তাহার প্রয়োজনেও অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করে করা সম্ভব। কোন দেশে যদি খাদ্যের পরিমাণ কম হইয়া থাকে, তবে তাহার অর্থ এই নয় যে, খাদ্যোৎাদনের পরিমাণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়া গিয়াছে- আর বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব নয়, অতএব জনসংখ্যার সমস্যা দেখা দিয়াছে; বরং তাহার সুস্পষ্ট অর্থ এই হইতে পারে য, সেখানে প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের জন্য চেষ্টা করা হয় নাই- সে জন্য কার্যকর পন্থা অবলম্বন করা হয় নাই। বস্তুতঃ বিশ্বের যাবতীয় উপায় উপাদান মানুষের খেদমতের জন্যই সৃষ্টি করা হইয়াছে; অতএব প্রকৃতিকে জয় করা এবং তাহাকে নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যবহার করা মানুষের কর্তব্য। আল্লাহর বাণী:
(আরবী*************)
পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে তাহা সবই হে মানুষ- তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন।
এর অর্থ ও তাহাই। এই জন্য মানুষ স্বাভাবতই প্রকৃতি জয়ের জন্য আবহমান কাল হইতে চেষ্টা করিয়া আসিতেছে, আর সময় যত তীব্র গীতে মানুষের আয়ত্তে আসিতেছে। এমতাবস্থায় একমাত্র নৈরাশ্যবাদী ও আল্লাহর রিযিকদাতা হওয়া সম্পর্কে অবিশ্বাসী লোকেরাই বলিতে পারেযে, প্রকৃতিকে জয় করা সম্ভব নয়- জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছে সেই অনুপাতে খাদ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পাইতেছে না। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে পার্থক্য তো এইখানে যে, প্রকৃতির সম্মুখে অসহায় অবস্থায় আত্মসমর্পণ করার পরিবর্তে প্রকৃতিকেই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী গড়িয়া লওয়ার শক্তি আল্লাহ ত’আলা মানুষের মধ্যে দিয়াছেন এবং তাহা করাই মানুষের কর্তব্র। আর বর্তমান যুগে বিজ্ঞানই হইতেছে ইহার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এই প্রেক্ষিতে সহজেই বলাযায় যে, ম্যাথুসের থিওরী সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে। এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ বা অন্য কোন উপায়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধিরোধ না করিয়া জনসংখ্যানুপাতে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং সেজন্য আধুনিকতম যাবতীয় পন্থা প্রয়োগের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয় আপনি বলিয়াছেন, জনসংখ্যা ক্রমশঃ বাড়িতেই থাকিবে এবং তাহাতে খাদ্য সমস্যাও দেখা দিবে। আমি আপনার কথার প্রথম অংশ (জনসংখ্যা বাড়িবেই)-স্বীকার করি। কিন্তু উহার দ্বিতীয় অংশ (খাদ্য সমস্যা দেখা দিবে)- মোটেই স্বীকার করি না। কেননা জনসংখ্যা বৃদ্ধি যেমন স্বাভাবিক তেমনি স্বাভাবিক খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধিও। তদুপরি আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগে প্রয়োজন অপেক্ষাও অনেক বেশী পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব বলিয়াই আমি বিশ্বাস করি। আমার দৃষ্টিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি আদৌ কোন সমস্যা নহে বরং প্রকৃত সমস্যা হইতেছে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পন্থায় উৎপাদন না করা এবং সুবিচারপূর্ণ ভাবে উহার সুষ্ঠূ বন্টন না করা। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যদি নিত্য নব-পদ্ধতিতে চেষ্টা করা হয় তবে খাদ্যের পরিমাণ কখনিই প্রয়োজনের অপেক্ষা কম হইবে না এবং তাহা যদি সুবিচারপূর্ণভাবে বন্টন করা হয়, তবে পৃথিবীর কোন একটি অংশেও খাদ্য সমস্যা দেখা দিতে পারিবে না। আপনি এজন্য concrete plan চাহিয়াছেন। কিন্তু কাল্পনিক সমস্যাকে ভিত্তি করিয়া কি পরিকল্পনা দেওয়া যাইতে পারে, আমি বুঝিলাম না। যাহা মোটে সমস্যাই নয়, তাহাতেও আপনি বড় কঠিন সমস্যা মনে করিয়া লইয়াছেন, আর যাহা প্রকৃত সমস্যা তাহাকে আপনিমোটই গুরুত্ব দিতেছেন না। আপনি দেখিতেছেন না যে, আল্লাহর বান্দাহদের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাইতেছে, আল্লাহর খাদ্যদানের দুয়ার ও তেমনি নানাভাবে অবারিত হইতেছে। ৫৪ সনের জুলাই মাসের Readers Digest পত্রিকায় Bread from the sea (সামুদ্রিক খাদ্য) শীর্ষক এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের ভূমিকায় উল্লেখ করা হইয়াছে যে, মুঙ্গা বর্ণর এক উদ্ভিদ জাতীয় দ্রব্য সম্পরক বিজ্ঞানীগণ গভীরভাবে গবেষণা চালাইয়াছেন। সে সম্পর্কে ধারণা এই যে, তাহা মানব জাতির জন্য আনবিক শক্তি অপেক্ষাও অধিকতর মূল্যবান ও কল্যাণকর হইবে। ইহার নাম ALGAE ইহাতে প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় খাদ্যপ্রাণ প্রয়োজন পরিমাণ বর্তমান রহিয়াছে। সমুদ্র, নদী, বিল, ঝর্ণা, এমনকি ধুসর মরুভূমিতে পর্যন্ত খুব বেশী পরিমাণে এবং খুব সহজে ইহার চাষ করিলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অনুযায়ী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ২০৫০ সনের জনসংখ্যা (প্রায় সাত হাজার মিলিয়ন) খাদ্য সমস্যার সমাধান করিয়া দিতে পারিবে। শোনাযায় যে, জাপান, ইসরাঈল, আমেরিকা ও থাইল্যাণ্ডে ইহার চাষ রীতিমত শুরু হইয়া গিয়াছে। থাইল্যান্ডে ‘এ্যালগা’ ও এই ধরনের খাদ্যদ্রব্যের দ্বারা ই বার্ষিক পাঁ হাজার টন খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইহা অতীব কৌতুহল উদ্দীপক যে, জনগণের বৈজ্ঞানিক ঊর, Tramiya এর স্ত্রী Hrosti কালিফর্ণিয়ায় এক চা রাটিতে এ্যালগা হইতে প্রস্তুত রুটী শুরবা ও এ্যালগার আইসক্রীম পরিবেশন করেন।
এই আশ্চর্যজনক আবিষ্কার হইতেও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর এই পৃথিবীতে কত যে খাদ্যদ্রব্য অন্তর্নিহিত হইয়া রহিয়াছে এবং ভবিষ্যতে আরো কত যে আবিষ্কৃত হইবে, তাহার কোনই ইয়াত্তা নাই। এই জন্যইভি. আর উইলিয়ামস নামক জনৈক আধুনিক মৃৎ-বিজ্ঞানী (soil scientit) বলিয়াছেন- “There is no limit to growth of crop yields” তাই আমিও অত্যন্ত জোরালো ভাষায়ই বলিতে চাই: পৃথিবীর বর্তমান খাদ্যের আয়োজন দিয়াই ২২০ কোটির তিন গুণ- ৬৫০ কোটি মানুষের স্বাচ্ছন্দ জীবনযাত্রা চলিতে পারে।
দুনিয়ার মানুষের খাদ্য সমস্যার সমাধান পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে খাদ্য শস্য ধ্বংস করা অভিযান রোধ করিতে হইবে। মানুষ যখন খাদ্যের অবাবে হাহাকার করিতেছে তখন অতিরিক্ত উৎপাদিত গম ধ্বংস করার জন্য কানাডার ফেডারেল সরকার দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় চাষীদের ১০ কোটি ডলার (প্রায় ১২৫ কোটি টাকা) সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়াছেন। গম ধ্বংস অভিযানকে সাফল্যমন্ডিত করিবার জন্য আলবাটা সাসকাচেওয়ান, ম্যানিটোপ এবং বৃটিশ কলম্বিয়ার ১.৮০.০০ জন চাষীকে এক বৎসর আর্থিক সাহায্য দেওয়া অব্যাহত থাকিবে। যে সমস্ত চাষী গমের জমিকে পতিত হিসাবে ফেলিয়া রাখিবে তাহাদিগকে একর প্রতি ৬ ডলার সাহায্য দেওয়া হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে। আবার যে সমস্ত চাষী গমের জমিতে এক বৎসরের অধিক সবুজ ঘাস জন্মাইবে তাহারা একর প্রতি ১০ ডলার হিসাবে সর্বাধিক ১০,০০০ ডলার সাহায্য পাইবে। মানবধ্বংসকারী এই সব ব্যবস্থা রোধ করা না হইলে বিশ্বের খাদ্যসমস্যা কোনদিনই প্রতিকার করা যাইবে না। বস্তুত বিশ্বে খাদ্যসমস্যা বলিতে কিছুই নাই, সমস্যা হইল সুষ্ঠু উৎপাদন ও বন্টনের মানবিক ব্যবস্থার অভাব। বিশ্বমানবের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্য এই সব অমানবিক নীতির প্রতিরোধ করিতে হইবে।
লোকসংখ্যা সমস্যা দেখাইতে গিয়া অনেকে আবার স্থান সংকুলানের প্রশ্নও উত্থাপন করেন। তাহারা বলেন যে, যে হারে লোক বৃদ্দি পাইতেছে তাহাতে পৃথিবীতে এত লোকের স্থান সংকুলান হওয়াও সম্ভব হইবে না। কিন্তু তাহারা ভবিয়া দেখেন না যে, একনো পৃথিবীর বহু অঞ্চল প্রচুর স্থান একেবারে জনশূণ্য অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, আমেরিকা এবং নিউজিল্যান্ডে মোটেই স্থানাভাব নাই। বরং সেখান ঘন বসতি কিংবা লোকের স্থান সংকুলন হয় না, সেখান হইতে এই সব শূণ্য এলাকায় লোকদের পুর্বাসন করাহইলে স্থান সংকুলান সমস্যা বলিতে কিছুতেই থাকিতে পারে না। এই সব তথ্য সম্মুখে রাখিয়া চিন্তা করিলে স্বভাবতঃই একটি প্রশ্ন জাগে যে, জনসংখ্যা সমস্যা কি দুনিয়ায় চিরদিনই ছিল? না নব্যযুগের অন্যান্য অসংখ্য প্রকার আবিষ্কারের ন্যায় ইহাও একটি অভিনব আবিষ্কার? আমার মতে, যে ভাবে ইহাকে একটি সমস্যা বলিয়া মনে করা হইতেছে, সেই ভাবে ইহা বর্তমানে নূতন কোন সমস্যা নহে, এ সমস্যা পূর্বকালেও- শত শত, হাজার হাজার বৎসর পূর্বেও ছিল। কিন্তু তখনকার লোকেরা কখনই জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে বিপদ বলিয়া মনে করে নাই এবং উহার বৃদ্ধির পথ বন্ধও করে নাই, বরং তাহার জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার অনুপাতে খাদ্য সংগ্রহের জন্য পূর্ণ দায়িত্ব সহকারে চেষ্টানুবতী হইয়াছে, মন ও মস্তিষ্ক লাগাইয়া গবেষণা করিয়অছে এবং খাদ্যোৎপাদনের নূতন নূতন পন্থা ও পদ্ধতি আবিষ্কার করিয়াছে। বস্তুত মানব ইতিহাসের ধারাই হইতেছে এইরূপ। খাদ্যাভাব অনুভূত হওয়া, উহা দূর করার জন্য প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্যোৎাদনের ব্যবস্থা করা এবং নূতন রূপে ঐ সমস্যা দেখা দেওয়া, আবার নূতন করিয়া খাদ্যোৎপাদনের জন্য লাগিয়া যাওয়া- প্রকৃতপক্ষে ইহারই নাম হইতেছে মানুষের অর্থনৈতিক চেষ্টা সাধনা। ইহা শেষ হইয়া দেলে মানুসেরও অগ্রগতি রুদ্ধ হইয়া যাইবে।
কিন্তু বর্তমান কালের এক শ্রেণীর অক্ষম রাজনীতিক প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব পালনে অসমর্থ পাশ্চাত্যের বর্বর জাতিসমূহের অনুকরণে জনসংখ্যা রোধের প্রস্তাব দিতেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণের উপদেশ খয়রাত করিতেছে এবং সেজন্য কার্যকর পন্থাও অবলম্বন করিতেছে। আমি মনে করি, মানবতার এইরূপ দুশমনী করার কোন অধিকারই তাহাদের নাই। তাহারা নিজেদের বিলাসিতা, আরাম ও ভোগ –সম্ভোগের ইন্ধন হিসাজে জাতীয় সম্পদের বিরাট অংশ নিঃশেষ করিতেছে, আর বসিয়া বসিয়া জন্মনিয়ন্ত্রণের নছীহত করিতেছে। বস্তুত ইহারা মানবতার দুশমন ছাড়া আর কিছুই নহে।
আমার মতে, দুইটি উপায়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যার মুকাবিলা করা যাইতে পারে। প্রথম, আধুনিক পদ্ধতিতে আল্লাহর দেওয়া যাবতীয় উৎপাদন উপায়কে প্রয়োগ করা, বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাহায্যে নূতন নূতন খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা। আর দ্বিতীয, সুবিচারপূর্ণ পন্থায় ও সুষ্ঠুভাবে উহার বন্টন করা এবং একটি লোককেও তাহার প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্য হইতে বঞিচত না রাখার নীতি গ্রহণ করা।
সুবিচারপূর্ণ ন্টন প্রসংগ সমাজের জনগণের মধ্যে আর্থিক ভারসাম্য স্থাপন- বেশী আয়ের হার কমানো এবং কম আয়ের হার বাড়ানো, অন্যকথায় শ্রেণী-পার্থক্য খতম করা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইহার দ্বারাই সমস্যার অর্ধেক সমাধান হইতে পারে। বর্তমানে যাহাদের আয়ের পরিমাণ কম তাহাদের লোকসংখ্যা অধীক বেশী। আার যাহাদের লোক সংখ্যা কম, তাহাদের সম্পদ অনেক বেশী, আয়ের এই তারতম্য কমিয়া স্বাভাবিক পর্যায়ে আসিবে বর্তমানের শ্রেণী-সংগ্রাম বন্ধ হইবে, অভাব-দারিদ্রের এই লাত ও মর্মান্তিক দৃশ্যও অবসৃত হইবে। প্রাচুর্যের এই পৃথিবীতে সর্বসাধারণ মানুষ মোটামুটিভাবে খাওয়া-পরা-থাকা-শিক্ষা-চিকিৎসা প্রভৃতি যাবতীয় মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার মাধ্যমে সুখে-স্বাচ্ছন্দে বসবাস ও জীবন যাপন করিতে পারিবে- বাঁচিয়া সুখী হইবে।
(আরবী*********)
ইহাই আমার দৃঢ় বিশ্বস এবং লইয়াই এই মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচিয়া আছি। আর যতদিন বাঁচিব এই আশা লইয়া বাচিব (২৫-৭-৮৭)
গ্রন্থকার পরিচিতি
মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বর্তমান শতকের এক অনন্যসাধারণ ইসলামী প্রতিভা। এ শতকে যে ক’জন খ্যাতনামা মনীষী ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা কায়েমের জিহাদে নেতৃত্ব দানের পাশাপাশি লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে একটি কালজয়ী জীবন-দর্শন রূপে তুলে ধরতে পেরেছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম।
এই ক্ষণজন্মা পুরুষ ১৩২৫ সনের ৬ মাঘ (১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারী) সোমবার, বর্তমান পিরোজপুর জিলার কাউখালী থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি শর্ষীনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম এবং ১৯৪০ ও ১৯৪২ সাল কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা তেকে যথাক্রমে ফাযিল ও কামিল ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানগর্ভ রচনাবলি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণায় নিরত থাকেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এ ভূখণ্ডে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন এবং সুদীর্ঘ চার দশক ধরে নিরলসভাবে এর নেতৃত্ব দেন।
বাংলাভাষায় ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেতে মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) শুধু পথিকৃতই ছিলেন না, ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত তাঁর ৬০টিরও বেশি অতুলনীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘কালেমা তাইয়্যেবা’, ‘ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা’, ‘মহাসত্যের সন্ধানে’,‘বিজ্ঞান ও জীবন বিধান’, ‘বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব’, ‘আজকের চিন্তাদারা’, পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’, ‘সুন্নাত ও বিদয়াত’, ‘ইসলামের অর্থনীতি’, ‘ইসলামের অর্থনীতি বাস্তবায়ন’,‘সুদমুক্ত অর্থনীতি’, ‘ইসলামের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’, ‘কমিউনিজম ও ইসলাম’, ‘নারী’, ‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন’, ‘আল-কুরআনের আলোকে উন্নত জীবনর আদর্শ’, ‘আল-কুরআনের আলোকে শিরক ও তওহীদ’, ‘আল-কুরআনের আলোকে নবুয়্যাত ও রিসালাত’, ‘আল-কুরানে রাষ্ট্র ও সরকার’, ‘খেলাফতে রাশেদা’, ‘ইসলাম ও মানবাধিকার’, ‘ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তাধারা’, ‘রাসুলুল্লাহ বিপ্লবী দাওয়াত’, ‘ইসলামী শরীয়তের উৎস’, ‘অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম’, ‘অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ইসলাম’, ‘শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ইসলামে জিহাদ’, ‘হাদীস শরীফ (তিন খণ্ড)’, ‘আল্লাহর হক বান্দার হক’ ইত্যাকার গ্রন্থ দেশের সুধীমহলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে।
মৌলিক ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী মনীষীদের রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারেও তাঁর কোন জুড়ি নেই। এসব অনুবাদের মধ্যে রহেয়ছ মাওলানা মওদূদী (রহ)-এর বিখ্যাতত তাফসীর ‘তাফহূমুল কুরআন’, আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী-কৃত ‘ইসলামের যাকাত বিধান (দুই খণ্ড)’ ও ইসলামে হালাল হারামের বিধান’, ‘মুহাম্মদ কুতুবের ‘বিশঙ শতাব্দীর জাহিলিয়াত’ এবং ইমাম আবু বকর আল-জাস্সাসের ঐতেহাসিক তাফসীর ‘আহকামুল কুরআন’। তার অনূদিত গ্রন্থেরও সংখ্যাও ৬০টিরও ঊর্ধ্বে।
মাওলানা মুহাম্মদ আবদর রহমি (রহ.) বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-এর অন্তর্গত ফিকাহ একাডেমীর একমাত্র সদস্য ছিলেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সূচীত ‘আল-কুরআনে অর্থনীতি’ এবং ‘ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস’ শীর্ষক দুটি গবেষণা প্রকল্পেরও সদস্য ছিলেন। প্রথমোক্ত প্রকল্পের অধীনে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধ তাঁর রচিত। শেষোক্ত প্রকল্পের অধীনে তাঁর রচিত ‘স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব’ এবং ‘ইতিহাস দর্শন’ নামক গ্রন্থ দু’টি সুধীজন কৃর্তৃক প্রশংসিত এবং বহুল পঠিত।
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) ১৯৭৭ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন ও রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলন, ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ইসলামী মহাসম্মেলন,১৯৮০ সালে কলোম্বোতে অনুষ্ঠিত আন্তঃপার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং ১৯৮২ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লবের বার্ষিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
এ যুগস্রষ্টা মনীষী ১৩৯৪ সনের ১৪ আশ্বিন (১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর) বৃহস্পতিবার এই নশ্বর দুনিয়া ছড়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। (ইন্ন-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন)
খায়রুন প্রকাশনী