এক নূতন অর্থনীতির প্রয়োজন
দুনিয়ার অর্থনৈতিক পরিমন্ডলেএকটা নূতন চিৎকার ধ্বনিয়া উঠিয়াছে। এই চিৎকার যদি ভাঙ্গা গলার,তেমন বলিষ্ঠও নয়; তবু উহার প্রতি জনগণের উৎকণ্ঠা না জাগিয়া পারে নাই। সে চিৎকার হইল, একটু নূতন অর্থব্যবস্থা (New Economic order) চাই যাহা বর্তমানের বিরাজমান অর্থ ব্যবস্থার দুর্বহচাপে নির্যাতিত নিষ্পেষিত ও শোষিত –বঞ্চিত জনগণকে নিষ্কৃতি ও স্বস্তি দিতে পারিবে। কেননা বর্তমানের যাবতীয় মানব-রচিত অর্থব্যবস্থা মানবজাতির অর্থনৈতিক সমস্যারসমাধান দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছে। শুধু তাহাই নয়, যে অর্থ ব্যবস্থা বর্তমানে বিভিন্ন দেশে কার্যকর রহিয়াছে, তাহা পুঁজিবাদ হউক, কি সমাজতন্ত্র, মানুষের জীবনে নিত্য নূতন জটিল সমস্যা ও অর্থনৈতিক ব্যধিরসৃষ্টি করিয়াচলিয়াছে। সাধারণ মানুষকে ঠেলিয়া দিতেছে নির্মমকষ্টদায়ক দারিদ্র ও দুঃসহ অভাব অনটনের গভীরতম পংকে। এই অর্থব্যবস্থা নির্বিশেষেসমস্ত মানুষকে পেট ভরিয়া খাবার, লজ্জা ঠাকারবস্ত্র ও রৌদ্র-বৃষ্টি, পথিকের শানিত-উষ্ণ দৃষ্টিবান হইতে রক্ষাকারী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করিয়া দিতে সম্পূর্ণ অক্ষমতার প্রমাণ দিয়াছে। নানাবিধ রোগ-ব্যাধি, রক্তহীনতা ও অপুষ্টি হইতেমুক্তি দেওয়া উহার পক্ষে সম্ভবপর হয় নাই। অথচ এই মানব-দুশমন অর্থব্যবস্থাই বর্তমান সময়ের বিশ্বমানবতাকে অক্টোপাশে বাঁধিয়া রাখিয়াছে,বন্দী করিয়াছে দাসত্বের দুশ্ছেদ্র শৃঙ্খলে। উহার দাপট-প্রতাপে প্রত্যেকটি নর-নারী কঠিনভাবে প্রকম্পিত হইতেছে প্রতি মুহূর্তে। ধনী ওদরিদ্রের মধ্যকার আকাশ ছোঁয়া পার্থক্য দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে। বরং দরিদ্ররা ক্রমশ অধিকতর দারিদ্রের গভীরে তলাইয়া যাইতেছে। আর ধনীরা শনৈঃ শনৈঃ উচ্চ হইতেও উচ্চতর পর্যায়ে উঠিয়া সাধারণ মানুষের নাগালের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে। ইহারফলে সমাজ-সভ্যার স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট হইতেছে। মুদ্রাস্ফীতির প্লাবন-স্রোতে সাধারণ মানুষ রসাতলে ভাসিয়া যাইতেছে। ক্ষুধা ও রোগ মানব দেহের গোশত ও মগজ কুরিয়া কুরিয়া খাইতেছে, বিন্দু বিন্দুকরিয়া শুষিয়া নিতেছে রক্তের শেষবিন্দুটিও। দরিদ্র জনতা করভারে জর্জরিত। কর প্রথার পর্বত তাহাদের মেরুদণ্ড ভাংগিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া দিতেছে। সুদী কারবার সুদভিত্তিক অর্থনীতি লুটিয়া নিতেছে মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া ও রক্ত নিঙড়াইয়া উপার্জন করা শেষকরিটিও। বস্তুত এই হইল বর্তমান দুনিয়ার প্রচলিত সর্বপ্রকার অর্থব্যবস্থার তিক্ত বিষাক্ত পরিণতি। অথচ এই সব কয়টি অর্থব্যবস্থা-ইমানুষকে ভূ-স্বর্গের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তা-অগ্রগতি দানের প্রতিশ্রুতি দিয়া জনজীবনে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এখানে তাহাই তাহাদিগকে লইয়া যাইতেছে দারিদ্রের দাউ-দাউ করিয়া জ্বলিতে থাকা জাহান্নামের দিকে অতি দ্রুত গতিতে। উহাদের গাল ভরা দাবি ও ওয়াদা প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রমাণিতহইয়াছে।
অবশ্র মজার কথা হইল, বর্তমানে প্রচলিত পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি পরস্পরকে এই অবস্থার জন্য অভিযুক্ত ও দায়ী করিতেছে। কেননা বর্তমান মানবতার মর্মান্তিক অবস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করিতে কোনটাই প্রস্তুত নয় বরং এই সবের প্রত্যেকটিই অপরটিকে প্রতিরোধ করিবার জন্য সর্বশক্তি নিযোগ করিয়া চলিয়াছে। অথচ মানবরচিত এই কয়টি অর্থনীতির সারনির্যাস অভিন্ন পরিণতি সর্বতোভাবে এক। একই পরিণতির দিকে লইয়া যাইতেছে সমগ্র মানবকুলকে। এককথায়, সে পরিণতি হিইল Exploitation of masses by a handful coterie মুষ্টিমেয় কতিপয় কর্তৃক ব্যাপক জনগোষ্ঠীর শোষণ।
বর্তমানে প্রচলিত অর্থব্যবস্থা সমূহেরমধ্যে নামের পার্থক্য থাকিলেও এই সব গুলিই একই মৌল হইতে নির্গত, একই উৎস হইতে উৎসারিত। কমিউনিস্ট ঘোষণাপত্র (Communists manifesto) এবং মিলস –এর Political Economy দুইটি ভিন্ন ভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী অর্থব্যবস্থা উপস্থাপিত করিলেও উভয়টিই একই সময়ে- ১৮৪৮ সনে প্রকাশিত ও উপস্থাপিত হইয়াছিল। একই স্থান- অর্থাৎ লন্ডন- হইতে দুইটিই আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। আর এই দুইটি অর্থব্যবস্থার পশ্চাতেই প্রেরণাদায়ী শক্তি হিসাবে কাজ করিয়াছে বিশ্ব ইহুদীবাদ। এই দুইটি অর্থব্যবস্থার মধ্যে একটি হইল ব্যক্তিতান্ত্রিক পুঁজিবাদ আর অপরটি হইল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ- যদিও উহার নাম দেওয়া হইয়াছে সমাজতন্ত্র (Socialism)। কিন্তু দুইটিই জনমানুষকে শোষণ করার উপর নির্ভরশীল। এই দুইটির মধ্যে কোন পার্থক্য থাকিলে তাহা শুধু মাত্রার পার্থক্য মাত্র। কিন্তু শোষণ এক ব্যক্তি দ্বারা হউক, কি হউক রাষ্ট্র বা সরকার কর্তৃক, তাহাতে মূল বা পরিণতির দিক দিয়া কোনই পার্থক্য সূচিত হয় না। তবে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে রাষ্ট্রের হাতে অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির সম্পূর্ণ একীভূত হওয়ার কারণে উহার শোষণটা সর্বাত্মক যেমন, তেমনি খুবই নির্দয় ও মর্মান্তিক। সেখানে মানুষ সম্পূর্ণ রূপে নিরুপায় ও চরমভাবে অসহায়। ব্যক্তিতান্ত্রিক পুঁজিবাদী শোষণে- মানুষ বলিয়া- কিছুটা দয়ার অবকাশ থাকিলেও থাকিতে পারে, কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক শক্তি হিসাবে রাষ্ট্রের শোষণে দয়া-মায়া-ক্ষমার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না। বরং সেখানে দয়া, সহানুভূতি বা মানবিক সহমর্মিতার কথা চিন্তা করাই অবাস্তব। কমিউনিজম সমাজতন্ত্রের চরম ও চূড়ান্ত রূপ। উহারই উপর অর্পিত হইয়াছে পুঁজিবাদকে চিরস্থায়ীকরণের কঠিন দায়িত্ব এবং উহা তাহাই করিতেছে সমগ্র রাষ্ট্রশক্তি নিয়োগ করিয়া। কেননা সমাজতন্ত্রের নিজস্ব কোন অর্থনীতি নাই, ইহা স্বতঃসিদ্ধ কথা। আসলে উহা একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ব্যবস্থা (Political System) মাত্র। প্রকৃত পক্ষে উহার অর্থসংস্থা ও ব্যবস্থাপনা ঠিক তাহাই, যাহা পুঁজিবাদের সংস্থা ও ব্যবস্থাপনা। কালমার্কস একজন সাংবাদিক পিতার সন্তান ছিলেন। তাঁহার রাজনৈতিক বিষয়াদির সমালোচনা করার দক্ষতা ছিল প্রচন্ড। তাঁহার রচনাবলীতে অর্থনৈতিক বিষয়াদি পর্যায়ে যাহা কিছু পরিলক্ষিত হয় তাহা মূলত পুঁজিবাদ হইতে ভিন্নতর কিছু নয়। এমন কি, কমিউনিষ্টদের বাইবেল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’- পুঁজিবাদের সাফল্যের উপর একটা গুরুত্বপূর্ণ দলীল ছাড়া আর কিছুই নয়। উহাতে বলা হইয়াছে:
The bourgeosie during its rule for nearly 100years has created more massive and more clossed productive forces than have all preceding generations together.
শ্রম মূল্য মতাদর্শের (Labour theory of value) ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়, সমাজতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ বিপুল সংখ্যক সাধারণ অ-নিপুণ-অযোগ্য শ্রমিকদিগকে সকল ধরনের যোগ্য ও সুদক্ষ শ্রমিকদের সমান পর্যায়ে আনিয়া শ্রম মূল্যকে গণিত শাস্ত্রের গণনা পদ্ধতি চালু করিতে এখন পর্যন্তও সক্ষম হয় নাই। শ্রম-মূল্য মতাদর্শের ভিত্তিতে মূল্য (Value) নির্ধারণ করিতেও সফল হইতে পারে নাই সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা-বিশারদরা।
বস্তুত সমাজতান্ত্রিক মুল্য নির্ধারণ পদ্ধতি যে অতিশয় অসন্তোষজনক, তাহা সর্বজনস্বীকৃত সত্য। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের ক্ষেতে বাড়তি মূল্য ব্যক্তিগত উদ্যোগের তুলনায় অনেক উচ্চ ও বেশী। তাই উহা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ক্ষেত্রেই তাহা বেশী প্রযোজ্য। Prof. Kantorovich linear programming-এর উদগাত। তিনি যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মূল্য গণনা পদ্ধিতি প্রবর্তন করিয়অছেন, তাহা বিভিন্ন পণ্যের আপেক্ষিক দুষ্প্রাপ্যতার ভিত্তিতে গড়িয়া উঠিয়াছে,-যেমন উহার পড়তা খরচ ধরিয়া করা হয়।
বড় বড় ব্যবসায়ের পরিবর্তে সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া মালিকানার অধীন বহু সংখ্যক ব্যবসায় পরিচালিত হইতেছে। ফলে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় সংস্তা ()Corporations-সমূহ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সহকারেই সমধিক প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ট্রেড ইউনিয়নসমূহ শক্ত রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হইয়াছে। শুরু তে দুইটি পদ্ধতির মধ্যে যে সামান্য পার্থক্য ছিল, একএণ তাহা আদৌ পরিলক্ষিত হইতেছে না। বরঞ্চ উভয় পদ্ধতির মধ্যে সাদৃশ্র ও সাযুজ্য প্রকট। দুইটিই সুদের ভিত্তিতে চলে। আর তাহাই হইল সাধারণ মানুষকে শোষণ করার বড় হাতিয়অর। এই উভয় ধরনের অর্থ-ব্যবস্থার মূলে আসল অবদান ইয়াহুদীদের। আর বর্তমান দুনিয়ার অর্থনীতি যে ইয়াহুদীদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত, তাহা কাহারো অজানা থাকার কথা নয়। The jews and modern Capitalism গ্রন্থ প্রণেতা সম্বার্ট(Sombart) বলিয়াছেন: The Jews were responsible for both the outward for, and finward spirit of capitalism .
পঞ্চদশ ও ষষ্টদশ শতাব্দীর মধ্যে (১৪৯২ খৃস্টাব্দ) ইয়াহুদীরা স্পেন (১৪৯২ খৃঃ) পর্তুগাল(১৪৯৫-১৪৯৭ খৃঃ) কলোন (১৪২৪ খৃঃ) অন্যান্য শহর-নগর এবং পরবর্তী সময়ে কতিপয় ইতালীয় শহর হইতে বহিষ্কৃত ও বিতাড়িত হইয়াছিল। দক্ষিণ দিক হইতে তাহাদিগকে উত্তর দিকে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। তাহারা বিলাস দ্রব্যের যেমন অলংকার, সিল্ক ও মূল্যবান পাথর প্রভৃতির একচেটিয়া ব্যবসায়ের মালিক হেইয়অ বসে। রপ্তানি বাণিজ্যেও তাহাদের প্রাধান্য ছিল। তাহারা বহু সংখ্যক উপনিবেশ গড়িয়া তোলার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে। কলম্বাসকেও তাহারা অপরিমেয় অর্থ দিয়াছিল। এই কলম্বাসও একজন ইয়াহুদী ব্যক্তি ছিল। এইভাবে আধুনিক রাষ্ট্রে তাহারাই অর্থের বড় যোগানদার হইয়া দাঁড়ায়। তাহারাই এই সব নূতন গড়িয়া উঠা রাষ্ট্রসমূহের নিকট বিক্রয় করে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র ও খাদ্য। The Jewes and modern Captalism গ্রন্থে বলা হইয়াছে: “Arm in arm, the jew and the ruler stride through the age”পুঁজিবাদ যত উপায় ও পন্থা-পদ্ধতির সার্থক প্রয়োগ করিয়া সাদারণ মানুষের রক্ত শোষণ করিয়াছে তাহার সবগুলিরই অস্ত্রাগার নির্মাণ করিয়াছে ইয়াহুদীরাই। তন্মধ্যে সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা, ঋণপত্রের (Securities) বাজার, Modern credit instruments, stock promotion, instalment selling, বিজ্ঞাপন ও আধুনিক পত্র-পত্রিকা পরিচালনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
মনে রাখা আবশ্য, ইয়াহুদীদের একটা বিশেষত্ব হইল, একবার যে ইয়াহুদী, সে সব সময়ই ইয়াহুদী-দ্বিতীয় ও তৃতীয় বংশ শাখায় পৌঁছিয়া গেলেও সে ইয়াহুদীই থাকিবে। এই বৈশিষ্ট্য প্রকৃতি ও কতকগুলি অবস্থানগত সুযোগ-সুবিধা ও ঘটনা দুর্ঘটনা দুনিয়ায় সর্বাধিক প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী হইয়া উঠিতে তাহাদিগকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করিয়াছে। ইয়াহুদীরা দুর্বল ও স্বল্পক সংখ্যক, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তাহারা সর্বত্র নিরবচ্ছিন্নও সার্বক্ষণিকভাবে বিরাজমান, পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত। তাহাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম ও কায়-কারবার তাহাদের নিজেদের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত ও সম্পাদিত।
আন্তর্জাতিক অর্থসংস্তা, বহুজাতিক কর্পোরেশন, বিশ্ব সমিতি, ফ্রীম্যাসন, লায়ন ও রোটারী ক্লাব, বহুল প্রচলিত আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকা,বৃত্তি, সভা-সম্মেলন এবং বহুসংখক দৃশ্যমান ও অদৃশ্য (Visible and invisible) কর্মতৎপরতা তাহারা সমানভাবে অবলীলাক্রমে চালাইতেছে এবং তাহাতে দুনিয়ার সব ধরনের মানুষকে সচেতন বা অবচেতনভাবে জড়িত করিয়া রাখিয়াছে। আর একটা অজানা পরিণতির দিকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতেছে এই নাবুঝ মানুষগুলিকে। সারা দুনিয়ার মানুষ ইয়াহুদীদের প্রতি যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করে, তাহারা এই সব কর্মতৎপরতার দ্বারা তাহারই প্রতিশোধ গ্রহণ করিতেছে মাত্র।
তাই বর্তমানে বিরাজিত এই সব অর্থ ব্যবস্থা যখন অচল হইয়া গিয়াছে, তখন তাহাদের আয়োজিত নাটকের নায়কেরা (Protogonists) শুরু করিয়াছে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা সম্পর্কে লোকদিগকে ভীত-সন্ত্রস্ত করিয়া তুলিতে এবং ইসলামী অর্থব্যবস্থা পূনরুজ্জীবিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সকল প্রকার চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে নানাভাবে সুদ ও জুয়ার সহিত সম্পৃক্ত করিয়া উহাকেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ করিয়া দিতে। কেননা একমাত্র এই অর্থ ব্যবস্থা-ই তাহাদের সর্বাত্মক শোষণ, স্বার্থপরতা ও ষড়যন্ত্রকে সম্পূর্ণ খতম করিয়া দিতেসক্ষম। তাহারা ভালো করিয়াই জানে ও অনুধাবন করিতে পারিয়াছে যে, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করিতে পারে কেবলমাত্র ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যবস্থা- তাহা যে রূপের ও যে আকার-আকৃতেই হউক-না-কেন। তাহাদের চালু করা বিষাক্ত সুদ প্রথা ও অন্যান্য মারাত্মক ব্যবস্থাগুলির সমস্ত খারাপ প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবকে কেবলমাত্র ইসলাম-ই পারে ধুইয়া মুছিয়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সম্পূর্ণ সুস্থ ও দোষমুক্ত করিয়া তুলিতে। তাই ইসলাম ও ইসলামী অর্থব্যবস্থায় প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে তাহারা নূতন বোতলে সেই পুরাতন মদ্যই পরিবেশন করিতে শুরু করিয়াছে সর্বাত্মক শক্তি দিয়া- যদিও তাহা কিছুটা পরিশীলিত করিয়া। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার পুরাতন ভিত্তির উপর তাহারা নূতন প্রাসাদ গড়িয়া তুলিয়াছে সমাজতন্ত্রের নামে। কিন্তু সমাজতন্ত্র কোন দিক দিয়াই কোন নূতন ব্যবস্থা নয়। এই জন্য শুরুতে তাহারা যে পদ্ধতিতে কাজ করিয়াছিল, এখনো অব্যাহতভাবে তাহাই চালাইয়া যাইতেছে। মূল অর্থব্যবস্থায় নিহিত আসল ক্ষতি ও দোষ-ত্রুটি তাহারা কিছুমাত্র দূর করে নাই। ফলে সাধারণ মানবতার বিপদকে দীর্ঘায়িতই করা হইয়াছে। এই কারণে আজ একথা বলা ছাড়া কোন উপায়ই নাই যে, বর্তমানে প্রচলত গোটা অর্থ ব্যবস্থাকেই উহার মূল ভিত্তি, শিকড় ও শাখা-প্রশাখা সহ সম্পূর্ণরূপে উৎপাটিত করিয়া সম্পূর্ণ নূতনভাবে এবং অবিলম্বেই ইসলামী অর্থব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত ও বাস্তবায়িত করিয়া তুলিতে হইবে।
আধুনিক পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইসলামী অর্থব্যবস্থা পুরাপুরি খাপ খাইয়া যাইতে পারে এবং যে কোন সময়ের যে কোন চ্যালেঞ্জকে সুষ্ঠুরূপে পূর্ণ সার্থকতা সহকারে মুকাবিলা করিতে- যে কোন সমস্যার সমাধান দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম। একমাত্র এই অর্থব্যবস্থাই যথার্থ, স্বাভাবিক এবং সর্বপ্রকারের শোষণ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত। সেই সঙ্গে সার্বিক শান্তি, সমৃদ্ধি প্রগতি ও নিরাপত্তার বিধান করা উহার পক্ষে খুবই সহজ। নির্বিশেষ সমস্ত মানুষের সার্বিক কল্যাণ বিধান কেবলমাত্র এই অর্থনীতির পক্ষেই সম্ভব। সমস্ত মানুষ জুলুম ও বঞ্চনা বন্ধ করিয়া দেয় ইসলামী অর্থনীতির বিশেষ ধন বন্টন পদ্ধতি। ইহা মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণকে বন্ধকরিয়া তোলে। ধন-সম্পদের একীভূত পুঞ্জীভূত (concentration of wealth) হওয়া ও পারস্পরিক অসাম্য ও পুঁজিবাদের অন্যান্য অশুভ প্রতিক্রিয়ার মুকাবিলায় শক্ত প্ররোধ গড়িয়া তুলিতে পারে একমাত্র এই অর্থব্যবস্থা। সেই সঙ্গে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় বেশী মাত্রার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সুনিশ্চিত করে সুষম, সুষ্ঠু ও সুবচারপূর্ণ অর্থ বন্টরে মাধ্যমে।
ঠিক এই কারণে আধুনিক বিশ্বের বহু সংখ্যক অমুসলিম চিন্তাবিদ অর্থনীতিবিদ প্রকাশ্যে ইসলামী অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়নের দাবি জানাইয়াছেন। কেননা অর্্যথনৈতিক দিক দিয়া বঞ্চি নিঃস্ব সর্বস্বান্ত বিশ্ব মানবতাকে কেবল মাত্র এই অর্থ ব্যবস্থাই রক্ষা করিতে ও বাঁচাইতে পারে, বাঁচার মত বাঁচার সুযোগ করিয়া দিতে পারে। দুইজন অমুসলিম অধ্যাপকের একটা চিঠি দৈনিক Gardian পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়ছিল উহাতে তাঁহারা লিখিয়াছিলেন:
The Muslims system seems to us to have great merit. The western World should study it and perhaps adopt it in whole or in part.
কিন্তু নিজেদের মতের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসী, নাস্তিক ও সংশয়বাদী ব্যক্তিরা ইসলামী অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুই না জানিয়া না বুঝিয়া উহা অধ্যয়ন না করিয়া উহার প্রতি তীব্র বিদ্বেষাত্মক ও কপটতাপূর্ণ মনোভাব এখন পর্যন্ত পোষণ করে। এই কারণে প্রচলিত অর্থব্যস্থা পূতিগন্ধময় ক্ষুদ্রায়তন জলাশয় সেচিয়া ফেলিয়া নির্দোষ-আবিলতাহীন স্বচ্ছ পানির আগমন ও প্রবাহিত হওয়ার পথ উনমুক্ত করিয়া দিতে তাহারা প্রস্তুত হইতে পারিতেছে না। তাহারা উপসাহ ও বিদ্রূপচ্ছলে প্রশ্ন করে: What is Islamic economik system? ….. ইসলামী অর্থব্যবস্থা আবার কি? এই প্রশ্ন অবশ্য বহু সংখ্রক মুসলম নামধারী চিন্তাবিদও নীতি-ন্ধিারক ব্যক্তির মনেও ধ্বনি –প্রতিধ্বনিত হইয়াউঠিয়াছে। উঠিয়াছে হয় এই কারণে যে, তাহারা ইসলামের অর্থনীতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। অথবা ইসলামী জীবন বিধানের প্রতিই তাহারা ঈমান হারাইয়া সম্পূর্ণ ভিন্নতর মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছেন।
এই অবস্থার প্রেক্ষিতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি বিদ্যামূলক (Technological) উন্নতি-অগ্রগতির দৃষ্টিতে ইসলামী অর্থনীতির ব্যাপক ওপূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন, চিন্তা-গবেষণা এবং চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ হওয়া একান্তই আবশ্যক বলিয়া মনে করি। এই কাজে ইসলামী অর্থনীতিবিদদের যাহারা আধুনিক অর্থনীতি, উহার তত্ত্ব ও ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী- আগাইয়া আসা ও তাহাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব যথাযথ পালন করিতে চেষ্টা করা একান্তই কর্তব্য।
আমার লিখিত ‘ইসলামের অর্থনীতি’ গ্রন্থকানি লইয়া বর্তমান সময়ের বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গের নিকট আমি উপস্থিত। এই গ্রন্থটি ১৯৫৬ সনে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় বর্তমানের এই ১৯৮৭ সনেও ‘ইসলামী অর্থনীতি’ পর্যায়ে অন্ততঃ বাংলা ভাষার ইহাই একমাত্র মৌলিক ও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। বিদগ্ধ সমাজের সকল পর্যায়ে ইহার যথার্থ মূল্যায়ন হইবে বলিয়া আমার যুক্তিসঙ্গত ভাবেই আশা করতে পারি।
-মুহাম্মদ আবদুর রহীম