ইসলামী বীমা বা তাকাফুল : বৈশিষ্ট্য ও কর্মপদ্ধতি
১. ভূমিকা
আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বীমা একটি অত্রন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ক্ষেত্রবিশেষে এর গুরুত্ব ব্যাংকের চাইতেও বেশী। কেননা দুর্ঘটনার কারণে কারো ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হলে অথবা বাণিজ্যিক পতিষ্ঠান কোন কারণে ধ্বংস হয়ে গেলে বীমা ব্যবস্থা যেভাবে তার পাশে দাঁড়াতে ও সহায়তার কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে ব্যাংকের সে ক্ষমতা বা সুযোগ নেই। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পরিবারের প্রধান বা মূল উপার্জনকারীর দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বা মৃত্যু হলে পরিবারের যখন দুঃখের অমানিশা নেমে আসে ও আর্থিক নিরাপ্তাহীনতা দেখা দেয় তখন বীমাই তাদের কার্যকর সহায়তা দিতে পারে। মূলতঃ এই উদ্দেশ্যেই ব ীমা উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। উপরন্তু ব্যাংকিং ব্যবস্থার সফলতার জন্যেও বীমার সহযোগিতা অপরিহার্য। আইনগত কারণেই ব্যাংকিং সেক্টর বীমার সাহায্য নিতে বাধ্য। তাছাড়া বীমা কোম্পানীর সংগৃহীত তহবিল ব্যাংকিং খাতে মূলধন যোগায়। এসব কারণে ব্যাংক ও বীমা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ও পরস্পর নির্ভরশীল।
২. প্রচলিত বীমার বিরুদ্ধে ইসলামের আপত্তি
প্রচলিত সনাতন বীমা মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্য নয় বলে ইসলামী শরীয়াহ বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বিপদ-মুসিবত ও আকস্মিক দুর্যোগ মুকাবিলা ও সন্তান-সন্ততিদের জন্যে নিরাপদ ভবিষ্যত তৈরীর ক্ষেত্রে ইসরামে কোন আপত্তি নেই। স্বয়ং রাসূলে করীম (স) বলেছেন-
“তোমাদের উত্তরাধিকারীদের নিঃস্ব, পরমুখাপেক্ষী ও অপর লোকদের উপর নির্ভরশলী করে রেখে যাওয়া অপেক্ষা তাদেরকে সচ্ছল, ধনী ও সম্পদশালী রেখে যাওয়া তোমাদের পক্ষে অনেক ভাল।” (সহীহ আল্-বুখারী)
তিনি আরও বলেন- “যে ব্যক্তি কোন সংকটাপন্ন লোকের সংকট নিরসন করার উদ্যোগ নেয় আল্লাহ তা’য়ালা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সংকট হতে অব্যাহতি দেবেন।” (মুসলিম)
আপাতঃ দৃষ্টিতে প্রচলিত সুদভিত্তিক বীমা ব্যবস্থা ভবিষ্যত প্রয়োজন মেটাবার ক্ষেত্রে একটি স্বেচ্ছাদীন সঞ্চয়ী ব্যবস্থা বলেই মনে হয়। কিন্তু এতে এমন পাঁচটি মৌলিক শরীয়াহবিরোধী উপাদান রয়েছে যার অপনোদন বা প্রতিবিধান না ঘটলে মুসলমানদের পক্ষে ঈমান-আকীদা বজায় রেখে এই বীমা পদ্ধতিতে অংশ গ্রহণ করা অসম্ভব। শরীয়াহবিরোধী এই উপাদানগুলো হচ্ছে: (১) আল্-ঘারার, (২) আল্-মাইসির, (৩) আল-রিবা, (৪) শরীয়াহবিরোধী নোমিনী মনোয়ন এবং (৫) প্রিমিয়াম প্রদানের বিদ্যমান শর্ত।
১. আল্-ঘারার (অজ্ঞতা/অনিশ্চয়তা): প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় বীমা গ্রহীতা বীমা কোম্পানীর (সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই) সাথে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার পলিসি গ্রহণের চুক্তি সম্পন্ন করার পর সেই টাকা অনেকগুলো সমান কিস্তিতে প্রিমিয়াম হিসাবে নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে জমা দিয়ে থাকেন। িএক্সেত্রে কয়েকটি প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার পর বীমা গ্রহীতা দুর্ঘটনা কবলিত হলে বা মৃত্যুবরণ করলে বীমা কোম্পানী পলিসির চুক্তি মুতাবেক পুরো টাকাটাই বীমা গ্রহীতা বা তার নোমিনীকে প্রদান করে থাকে। কিন্তু এই টাকা কোথা থেকে কিভাবে প্রদান করা হলো তা বীমা গ্রহণকারীর কাছে অজানা বা অজ্ঞাত থাকে। প্রচলিত সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা উভয় ক্ষেত্রেই এই অজ্ঞতা বা অনিশ্চয়তার উপাদান বিদ্যমান। শরীয়াহর পরিভাষায় একে বলা হয় আল-ঘারার।
২. আল্-মাইসির (জুয়া): বীমার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জীবন বীমার ক্ষেত্রে আল-ঘারার বিদ্যমান থাকার কারণেই জুয়া বা আল-মাইসির-এর উদ্ভব ঘটে। উদাহরণতঃ যখন জীবন বীমার কোন পলিসি গ্রহীতা তার বীমার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন তখন চুক্তিবদ্ধ প্রিমিয়ামের আংশিক পরিশোধ করা হলৌ তার নোমিনী বা মনোনীত ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অর্থের পুরোটাই পেয়ে থাকেন। শরীয়াহর দৃষ্টিতে এটা জুয়া।
৩. আল–রিবা (সুদ): প্রচলিত বীমা কোম্পানীগুলোর কার্যক্রমে সুদের লেনদেন, সুদভিত্তিক বিনিয়োগ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আদান-প্রদান অব্যাহত থাকে যা শরীয়াহ আইন ও অনুশাসনের পরিপন্থী বলে ফকীহ্গণ সর্বসম্মত রায় দিয়েছেন।
৪. শরীয়াহবিরোধী নোমিনী মনোনয়ন: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সুরা আল-নিসায় মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের চিহ্নিত এবং তাদের হক নির্ধারিত করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় বীমা গ্রহীতা তার ইচ্ছামাফিক যে কোন ব্যক্তিকে নোমিনী নির্ধারণ করতে পারে। সকল ওয়ারিশকে বঞ্চিত করে এই নোমিনীই বীমার পুরো অর্থ পাবে যা শরীয়াহর সুস্পষ্ট বরখেলাপ। এটা আদল ও ইহসানবিরোধী।
৫. প্রিমিয়াম প্রদানের বিদ্যমান শর্ত: বিদ্যমান বীমা আইনে (জীবনবীমা ব্যতীত) বীমা পলিসি কার্যকর হওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট একটি মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে। ঐ মেয়াদের মধ্যে একটি কিস্তিও যদি অনাদায়ী থাকে তাহলে বীমা গ্রহীতা ঐ সময় পর্যন্ত যত টাকা প্রিমিয়াম হিসাবে দিয়েছেন তার পুরোটাই মার যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রচলিত সাধারণ বীমা ব্যবস্থায় বীমা কার্য়কর হওয়ার জন্যে ন্যূনতম দুই বছর প্রিমিয়াম দেওয়া বাধ্যতামূলক। কোন বীমা গ্রহীতা যদি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে প্রিমিয়াম দেন তাহলে তাকে দু’বছর মোট আটটি কিস্তি দিতে হবে। কিন্তু তিনি যদি সাতটি কিস্তি জমা দেওয়ার পর বাকী কিস্তিটি কোন কারণে দিতে না পারেন তাহলে ঐ পলিসিটি কার্যকর বলে গণ্য হবে না এবং সংশ্লিষ্ট বীমা গ্রহীতা বা তার নোমিনী কিছুই পাবেন না। অর্থাৎ, বীমা গ্রহীতার মূলধনই খোয়া যাবে। এটা আদল ও ইহসানের পরিপন্থী।
৩. ইসলামী তাকাফুল
উপরোক্ত সমস্যাগুলোকে সামনে রেখে এবং একই সাথে মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজন পূরণ ও ইসলামে গ্রহণযোগ্য একটি বিকল্প বীমা ব্যবস্থার সন্ধানে ইসলামী আইনবেত্তা ও বীমা বিশেষজ্ঞগণ দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা-ভাবনা, গভীর গবেষণা ও পর্যালোচনা করেন। শেষ পর্যন্ত তারা ইসলামী পদ্ধতির বীমা ব্যবস্থা উদ্ভাবনে সমর্থ হয়েছেন। ইসলামী শরীয়াহসম্মত বীমা পরিচালনা প্রসঙ্গে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬১ সালে দামেস্কে, ১৯৬৫ সালে কায়রোয়, ১৯৭৫ সালে মরোক্কো ও লিবিয়ায় এবং ১৯৭৫ সালে মরোক্কা ও লিবিয়ায় এবং ১৯৭৬ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত সম্মেলন বিশেষ উল্লেখযোগ্র। অবশেষে ১৯৮০ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে সংস্থাভুক্ত দেশসমূহে ইসলামী বীমা চালূ করার সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। উল্লেখ্য বাহরাইনে সর্বপ্রথম ইসলামী বীমার কার্যক্রম শুরু হয়। এজন্যে সে দেশে পৃথক আইনও প্রণীত হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী বীমা বিস্তৃতি লাভ করে। আফ্রিকায় এর কার্যক্রম প্রথম শুরু হয় সুদানে। দূর প্রাচ্যে মালয়েশিয়া এ ব্যাপারে এগিয়ে রয়েছে। ইসলামী বীমার প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্যে যে দেশে ‘মালয়েশিয়া তাকাফুল এ্যাক্ট, ১৯৮৪” নামে পৃথক আইন প্রণীত হয়েছে।
ইসলামী বীমা তাকাফুল নামেই বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। আরবী কাফালা শব্দ থেকে এটি উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ যৌথ জামিননামা বা সমষ্টিক নিশ্চয়তা, অর্থাৎ পারস্পারিক দায়িত্ব গ্রহণ। বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাকাফুল হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সদস্য গ্রুপের যৌথ নিশ্চয়তার অঙ্গীকার যা দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সদস্য বা সদস্যদের ক্ষতিপূরণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। গ্রুপের সদস্যগণ এমন একটি যৌথ নিশ্চয়তার চুক্তিকে আবদ্ধ হন যাতে কোন সদস্য দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের শিকার হলে তার ক্ষতিপূরণের জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লাভ করতে পারেন। বস্তুতঃ এটি হচ্ছে গ্রুপের সদস্যগণ তাদেরই একজনের বিপদে সাহায্য করার জন্যে সকলেই একযোগে সুনির্দিস্ট পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে আসেন। তাকাফুল ব্যবস্থার ভিত্তি হলো ভ্রাতৃত্ব (Brotherhood), সংহতি (Solidarity) ও পারস্পরিক সহযোগিতা (Mutual Assistance)। ইসলামী তাকাফুল তাই একই সঙ্গে একটি সহায়তামূলক ও কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠান এবং এক মুমিন ভাইয়ের আপদকাল তার সাহায্যে এগিয়ে আসার গোষ্ঠীবদ্ধ উপায়ই বটে।
এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় গৃহীত তাকাফুল এ্যাক্টের সংজ্ঞাটি প্রণিধানযোগ্য। এতে বলা হয়েছে-
“Takaful means a scheme based on brotherhook, solidarity and mutual assistance which provides for mutual financial aid and assistance to the participants in case of need whereby the participants mutually agree to contribute for the purpose…. its aims and operations do not involve any element which is not approved by the Shariah.”
অর্থাৎ, ভ্রাতৃত্ব, সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তির উপর গড়ে ওঠা তাকাফুল এমন এক স্কীম যেখানে প্রয়োজনের সময়ে অংশগ্রহণকারীরা পারস্পরিক আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা যোগায়। এই উদ্দেশ্যে তারা পরস্পর সম্মত হয়েই দান কর থাকে….. শরীয়াহর অনুমোদন নেই এমন কোন উপাদান এর উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকে না।
৪. ইসলামী বীমার বৈশিষ্ট্য
ইসলামী শরীয়াহ বিশেষজ্ঞগণ বিদ্যমান সুদী বীমা ব্যবস্থাকে ইসলামীকরণের জন্যে যেসব পরিবর্তনের সুপারিশ করেছেন সেগুলো এক কথায় যুগান্তকারী ও বীমা গ্রহীতার স্বার্থ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে খুবই বলিষ্ঠ ও কার্যকর। এসব পরিবর্তন ও সংযোজনই ইসরামী তাকাফুল ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত। যথা-
ক. কোম্পানী তার তহবিল শরীয়াহসম্মত উপায়ে বিনিয়োগ করবে। শরীয়াহতে নিষিদ্ধ ও সুদের সংশ্রব রয়েছে এমন কোন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বা কার্যক্রমে কোন অর্থ বিনিয়োগ বা লেনদেন করা চলবে না। তাকাফুল পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ডের বিধি-বিধানের উৎস হবে শরীয়াহ।
খ. প্রচলিত বীমা ব্যবসায়ে সৃষ্ট তহবিল বীমা কোম্পানীর মালিকানায় থাকে। কিন্তু ইসলামী বীমা কোম্পানীতে পলিসি গ্রহীতাদের অর্থে সৃষ্ট তহবিল তাদেরই মালিকানায় থাকে। বীমা গ্রহীতাগণকে কোম্পানীর শেয়ারহোল্ডারদের মতোই বিবেচনা করা হয় যেন তারা কোম্পানীর মুনাফা বা নীট উদ্বৃত্তের অংশীদার হতে পারেন।
গ. কোম্পানীর বোর্ড অব ডিরেকটর-এ বীমা গ্রহীতাগণের পক্ষ হতে পর্যাপ্ত প্রতিনিধি থাকবে। তারা কোম্পানীর নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে সকল হিসাব পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা রাখবে।
ঘ. কোন নির্দিষ্ট বছরে বীমা গ্রহীতাগণ যে প্রিমিয়াম প্রদান করেছেন তাতে যদি কোম্পানীতে তাদের অংশের লোকসান পূরণ না হয় তাহলে তারা অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে বাধ্য থাকবেন।
ঙ. বীমা প্রতিষ্ঠানটির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই একটি শরীয়াহ সুপারভাইজারী বোর্ড থাকবে। এই বোর্ড শরীয়াহর আলোকে প্রতিটি কাজ তদারক এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবেন।
চ. ইসলামী তাকাফুল ব্যবস্থায় নোমিনী বা মনোনীত ব্যক্তি ট্রাস্টি বা অছি হিসাবে কাজ করবে। প্রাপ্ত অর্থ শরীয়াহ সম্মত ওয়ারিশদরে মধ্যে বন্টন করে দেওয়া তারই দায়িত্ব।
ছ. বীমা কোম্পানী দুটি পৃথক ও সুস্পষ্ট হিসাব (Accounts) রক্ষা করবে: (ক) শেয়ারহোল্ডারদের হিসাব ও (খ) পলিসি গ্রহীতাদের হিসাব। পলিসি গ্রহীতাদের হিসাবে তাদের জমাকৃত প্রিমিয়াম, চাঁদা এবং তাদের তহবিল বিনিয়োগ করার ফলে অর্জিত মুনাফায় তাদের যে অংশ সবই জমা হবে।
পলিসি গ্রহীতাদের হিসাব থেকে সার্ভিস চার্জ ও দাবী পূরণের পর উদ্বৃত্ত হতে প্রয়োজনীয় রিজার্ভ আলাদা রেখে অবশিষ্ট অর্থ তাদের মধ্যেই পুনঃবন্টিত হবে। যদি কখনো কোন ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে তা সাধারণ রিজার্ভ তহবিল হতে পূরণ করা হবে। অবশ্য যদি সাধারণ রিজার্ভ তহবিল ঘাটতি পূরণের জন্যে যথেষ্ট বিবেচিত না হয় তাহলে শেয়ারহোল্ডারদের রিজার্ভ ও মূলধন হতে তা করযে হাসানা আকারে গ্রহণ করা হবে। ভবিষ্যতে পলিসি গ্রহীতাদের হিসাবে উদ্বৃত্ত হলে তা থেকে প্রথমেই এই করযে হাসানা পরিশোধিত হবে। শেয়ারহোল্ডারগণ কোনক্রমেই পলিসি গ্রহীতাদের তহবিল বা উদ্বৃত্ত গ্রহণ করতে পারবে না। শেয়ার মূলধন বিনিয়োগ হতে উপার্জিত আয় শেয়ারহোল্ডারদের একাউন্টেই দেখানো হবে এবং চলতি ব্যয় ও অন্যান্য দাবী পরিশোধের পর উদ্বৃত্ত অর্থ তাদের মধ্যেই বন্টিত হবে।
জ. একটি যাকাত বা সাদাকাহ তহবিল গটিত হতে হবে। শেয়ার মূলধন, রিজার্ভ ও মুনাফা হতে প্রতি বছর ২.৫% হারে গ্রহণ করে এই তহবিলে জমা করা হবে। পলিসি গ্রহীতাদের সম্মতি সাপেক্ষে তাদের হিসাবের নীট উদ্বৃত্ত হতেও বার্ষিক ২.৫% হারে যাকাত আদায় করে এই তহবিলে জমা দেওয়া যেতে পারে। তহবিলটি কোম্পানীর বোর্ড অব ডিরেক্টরসের গৃহীত উপবিধি অনুসারে বোর্ড ট্রাষ্টি দ্বারা পরিচালিত হবে।
৫. তাকাফুলের প্রকারভেদ
প্রচলিত বীমা ব্যবস্থার মত ইসলামী তাকাফুল বা বীমাও দুই ধরনের। যথা:-
ক. পারিবারিক তাকাফুল বা ইসলামী জীবন বীমা;
খ. সাধারণ তাকাফুল বা ইসলামী সাধারণ বীমা।
ক. পারিবারিক তাকাফুল বা ইসলামী জীবন বীমা
পারিবারিক তাকাফুল বা ইসলামী জীবন বীমা মূলতঃ একটি বিনিয়োগ কর্মসুচী যে বিনিয়োগ বীমা গ্রহীতাদের নিজেদের ও তাদের পরিবারের ভবিষ্যত আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা কর। এই কার্যক্রম পরিচালিত হয় দীর্ঘমেয়াদী মুদারাবা নীতি অনুসারে। এর আওতায় কোন ব্যক্তি নিয়মিত প্রিমিয়াম প্রদানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করন। এই সঞ্চয় লাভজনক কাজে বিনিয়োজিত হয় এবঙ মুনাফা তার হিসাবে জমা হয়। সমুদয় অর্থই বীমা গ্রহীতা ও তার পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ও নিরাপত্তার কাজে আসে। উপরন্তু এই কর্মসূচীর আওতায় বীমা গ্রহীতাদের কারো মৃত্যু ঘটলে ঐ সদস্যের পরিবারবর্গ বীমা চুক্তির সমুদয় অর্থ ও অর্জিত মুনাফা পেয়ে থাকে।
খ. সাধারণ তাকাফুল বা ইসলামী সাধারণ বীমা
সাধারণ তাকাফুল বা ইসলামী সাধারণ বমিার আওতায় কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ একক বা দলবদ্ধভাবে তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের (কল-কারখানা, গুদামঘর, পণ্য, যানবাহন ইত্যাদি) সম্ভাব্য দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডজনিত কারণে ক্ষয়-ক্ষতি বা ধ্বংসের বিপরীতে বীমা সম্পাদন করতে পারে। ইসলামী জীবন বীমার অনুরূপ এ বীমার চুক্তি ও শর্তাবলী নির্ধারিত হয় মুদারাবা নীতির উপর ভিত্তি করে। সাধারণ তাকাফুলের মেয়াদকাল সাধারণতঃ এক বছর। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুনরায় নবায়ন করা যায়।
তাকাফুল ব্যবস্থার অধীনে বীমা গ্রহীতা যে প্রিমিয়াম প্রদান করে তার নির্দিস্ট একটি অংশ তাবাররু বা ডোনেশন হিসাবে গণ্য হয়। দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত কারণে বীমা গ্রহীতাদের সম্পদের আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্যে এই তাবাররু ও কোম্পানীর মুনাফার অংশবিশেষ সমন্বয়ের তহবিল গঠিত হয়। সাধারণত তাকাফুল কোম্পানী বীমা তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করে যে মুনাফা অর্জন করে তাও ঐ তহবিলে জমা হয়। পারস্পরিক সহযোগিতার নীতির ভিত্তিতেই বীমা কর্তৃপক্ষ ঐ তহবিল থেকেই বীমা গ্রহীতার যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করে থাকে। মূলতঃ তাকাফুল কোম্পানী ঐ তহবিলের ট্রাস্ট্রী হিসাবে কাজ করে। তাকাফুল পদ্ধতির অভিন্ন লক্ষ্য ক্ষতিপূরণ প্রদান হলেও সাধারণত তাকাফুলে পারিবারিক তাকাফুলের অনুরূপ সঞ্চয়ের বিষয়টি প্রাধান্য রঅভ করে না।
তবে এই বীমার অধীনে গ্রহাককে যদি কোন ক্ষতিপূরণ দিতে না হয় এবং বীমা কার্যক্রম পরিচালনার আনুসঙ্গিক খরচ বাদে বীমা গ্রহীতার একাউন্টে যদি উবৃত্ত অর্থ (মুনাফাসহ) জমা থাকে তাহলে ঐ উদ্বৃত্ত অর্থ বীমাকারী ও বীমা গ্রহীতার মধ্যে মুদারাবার নীতি অনুসরণ পূর্ব নির্ধারিত আনুপাতিক হারে (যথা ৬:৪, ৫.৫:৪.৫ বা ৫:৫) বন্টিত হবে। বীমার মেয়াদকাল শেষে তিনি ঐ অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন। প্রচলিত সুদনির্ভর সাধারণ বীমা ব্যবস্থার সঙ্গে ইসলামী তাকাফুল ব্যবস্থার এখানেই বিরাট পার্থক্য এবং ইসলামী পদ্ধতি যে বাস্তবিকই একই সঙ্গে আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম এটা তার প্রকৃত নজীর।
৬. ইসলামী বীমার কার্যপদ্ধতি
ইসলামী তাকাফুল যেহেতু একটি ইসলামী ব্যবসা পদ্ধতি তাই এর সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয় ইসরামী শরীয়াহ মুতাবিক অর্থাৎ, আহকাম আল-মুয়ামালাহ-র নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী। তাকাফুলের সকল চুক্তি (আকাদ) সম্পাদিত হয় মুদারাবা নীতির ভিত্তিতে। এই নীতির ভিত্তিতে গটিত ইসলামী বীমা বা তাকাফূল ব্যবস্থাপনারন অধীনে বীমা কোম্পানী মুদারিব হিসাবে বীমা গ্রহীতার (সাহিবন আল-মা) নিকট হতে কিস্তিতে যে প্রিমিয়াম গ্রহণ করেন তার নাম রাস আল-মাল।
ব্যবসায়িক চুক্তি হিসাবে তাকাফুলে এটা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকবে যে, কোম্পানী (মুদারিব) কিভাবে বীমা গ্রহীতাদের (সাহিব আল-মাল) নিকট হতে গৃহীত প্রিমিয়াম (রাস আল-মাল) কাজে খাটাবে। তাকাফুলের নিয়ম-নীতির মুতাবিক বীমা গ্রহীতা ও বীমাকারী কোম্পানী উভয়ের দায়-দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করে চুক্তি সম্পাদিত হবে। উপরন্তু মুদারাবার নিয়ম অনুসারেই বীমা গ্রহীতাকে তার বিনিয়োগকৃত প্রিমিয়ামের লভ্যাংশ প্রদানের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে পূর্বেই জানিয়ে দেওয়া হবে। উভয় পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে এই লভ্যাংশ বন্টনের অনুপাত ৭:৩, ৬:৪, ৫:৫, ৪:৬ অথবা অন্য যে কোন স্বীকৃত অনুপাত হতে পারে। তবে সাথী বীমা গ্রহীতাদের ক্ষতিপূরণে সহায়তা প্রদানের দায়-দায়িত্ব পূরণের পরই কেবল তাকাফুলে মুনাফা বা উদ্বৃত্ত অর্থ বন্টন কার্যকর হয়।
তাকাফুলে যে অভিনব ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত হয়ে ৈএকে পুরো ইসলামী চরিত্র দান করেছে তার নাম তাবাররু বা ডোনেশন। তাকাফুল পদ্ধতির যৌথ জামানত এবং পারস্পরিক সাহায্য প্রদানের দায়-দায়িত্ব পালনের জন্যে ইসলামী তাকাফুলে অংশগ্রহণকারীগণ তাদের দেয় প্রিমিয়ামের নির্দিষ্ট একটি অংশ সহযোগীদের দুঃসময়ে দান করার অঙ্গীকারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জমাদিয়ে থাকেন। এটাই তাবাররু।
এজন্যেই ইসলামী তাকাফুলে বা বীমা গ্রহীতাদের একাউন্টে দুটি ভাগ থাকে (১) পারটিসিপেন্টস একাউন্ট (পি.এ.) এবং (২) পারটিসিপেন্টস স্পেশাল একাউন্ট (পি.এস.এ)। বীমা গ্রহীতার কিস্তিতে প্রিমিয়ামের প্রায় পুরোটাই পি.এ.-তে জমাহয় শুধুমাত্র সঞ্চয়তথা বিনিয়োদের উদ্দেশ্যে। অবশিষ্ট সামান্য অংশ পি.এস.এ.-তে জমা হয় তাবাররু হিসাবে। চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরণকারী কোন বীমা গ্রহীতার উত্তরাধিকারীদের অথবা দুর্ঘটনা কবলিত খোদ বীমা গ্রহীতাকেই তাকাফুল ফায়দা প্রদান করার জন্যে পি.এস.এ বা তাবাররুর এই অর্থ ব্যবহৃত হয়। তাই পি.এ. সঞ্চয় সংগ্রহে ভূমিকা রাখে এবং পি.এস.এ. মৃত্যুজনিত বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে পরিশোধযোগ্র একটি পারস্পরিক সাহায্য তহলিব গঠনে ভূমিকা রাখে। তাকাফুল প্রিমিয়ামের কত অংশষ পি.এ.-তে এবং কত অংশ পি.এস.এ-তে তাবাররু হিসাবে জমা হবে তা নির্ধারিত হবে বীমা গ্রহীতার বয়স, অংশ গ্রহণের মেয়াদ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদির ভিত্তিতে। বিভিন্ন মুসলিমদেশে মূল প্রিমিয়ামের ২% ন্যূনতম তাবারু হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।
পারিবারিক তাকাফুল বা ইসলামী জীবন বীমায় অংশ গ্রহণকারীর যদি তাকাফুলের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই মৃত্যু হয় তাহলে বীমা গ্রহীতার উত্তরাধিকারীগণ তার পলিসি গ্রহণের তারিখ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পারনটিসিপেন্টেস একাউন্টে পরিশোধিত কিস্তির সমুদয় টাকা এবং কিস্তির বিনিয়োগকৃত টাকার জন্যে প্রাপ্ত মুনাফার অংশও পাবেন। উপরন্তু ঐ ব্যক্তি জীবিত থাকলে অবশিষ্ট কিস্তিগুলোতে মোট যত অর্থ জাম দিতেন তার সমপরিমাণ এই অর্থ প্রদান করা হয়। অপরদিকে কোন বীমা গ্রহীতার তার সম্পাদিত পারিবারিক তাকাফুলেল মেয়া পূর্ণ হওয়ার পর জীবিত থাকলে তার নিজস্ব পরিশোধিত প্রিমিয়ামসমূহের সমুদয় টাকা এবং টাকার বিপরীতে প্রাপ্ত মুনাফার অংশ সবই পাবেন।
উদাহরণস্বরূপ সারণী-১ এ মালয়েশিয়ার শিরকত তাকাফুল মালয়েশিয়া সেনদিরিন বেরহাদ-এর অনুসৃত তাকাফুল কিস্তির পি.এ ও পি.এস.এ.-এর হার উল্লেখ করা হলো।
সারনী–১
কিস্তিতে প্রদেয় প্রিমিয়ামে পি.এ. ও পি.এস.এ–র হার
বয়সের গ্রুপ | পারিবারিক তাকাফুলেল অংশ গ্রহণের মেয়াদ | |||||
১০ বছর | ১৫ বছর | ২০ বছর | ||||
পি.এ | পি.এস.এ | পি.এ. | পি.এস.এ | পি.এ | পি.এস.এ. | |
১৮-৩০ | ৯৮% | ২% | ৯৬.৫% | ৩.৫% | ৯৫% | ৫% |
৩১-৩৫ | ৯৭.৫% | ২.৫% | ৯৫.৫% | ৪.৫% | ৯৩.৫% | ৬.৫% |
৩৬-৪০ | ৯৬.৫% | ৩.৫% | ৯৪% | ৬% | ৯১% | ৯% |
৪১-৪৫ | ৯৫% | ৫% | ৯১.৫% | ৮.৫% | – | – |
৪৬-৫০ | ৯৩% | ৭% | – | – | – | – |
উৎস: Islami Bank Bangladeshb Ltd. Islamic Banking and Insurance, Seminar Proceedings (Dhaka, 1990).
পারিবারিক তাকাফুল পরিকল্পনার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই যদি কোন বীমা গ্রহতিা তার অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে না চান অথবা কোন কারণে প্রিমিয়াম প্রদানে অপারগ হয়ে পড়েন তাহলে তিনি তার প্রদত্ত কিস্তির মোট অর্থ এবং কিস্তির অর্থ বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা যা তার পি.এ.-তে জমা হয়েছে সবই পাবেন। তবে তাবাররু হিসাবে (পি.এস. এ. জামাকৃত অর্থ বা এই হিসাবে অর্জিত মুনাফার অংশ কোন কিছুই তিনি পাবেন না।
৭. বাংলাদেশে ইসলামী বীমা
বাংলাদেশে ইসলামী পদ্ধতির বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়াস চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ইসরঅমী বীমা বা তাকাফুল কোম্পানী প্রতিষ্ঠার জন্যে জনমত গঠন ও পরিচিতির উদ্দেশ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ১৯৮৯ সালে অক্টোবর মাসে ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করে। পরবর্তীকালে ইসলামপ্রিয় কতিপয় বক্তির চেষ্টায় একটি ইসলামী তাকাফুল কোম্পানী গটিত হয় এবং বিধিবদ্ধ কোম্পানী হিসাবে কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে সরকারের কাছে আবেদন জানায়। এক দশক পরে ১৯৯৯ সালে চার/পাঁচটি ইসলামী সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানী সরকারের অনুমোদন লাভ করে কাজ শুরু করে।
তবে এর যথার্থ কার্যকারিতা ও সাফল্যের জন্যে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ দূল করা অপরিহার্য। বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে ১৯৩৮ সালের বীমা আইন ও ১৯৫৮ সালের বিধিমালার আওতায়। এই আইনের কারণে ইসলামী বীমাকে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে নীচে সংক্সেপে সেগুলোকে উল্লেখ করা গেল।
ক. প্রচলিত বীমা আইনে প্রিমিয়াম সূত্রে প্রাপ্ত অর্থের নির্ধারিত অংশ সরকারী সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের বিধান রয়েছে। এখানে সুদের প্রসঙ্গ থাকায় ইসলামী বীমার জন্যে এই আইন মানা অসম্ভব।
খ. প্রচলিত বীমা আইনে বার্ষিক হিসাব নিরীক্ষণ ও ব্যালান্সশীট তৈরীর ক্ষেত্রে মুদারাবা, তাবাররু, যাকাত, সাদাকাহ ইত্যাদি শরীয়াহসম্মত শিরোনামে হিসাব দেখাবার সুযোগ নেই। ফলে বাধ্য হয়েই ইসলামী বীমা কোম্পানীগুলোকে অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
গ. বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে ইসলামী জীবন বীমার ক্ষে্রেত উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে বীমার সুবিধা বন্টনের সুযোগ নেই। অপরপক্ষে বর্তমান স্বেচ্ছাদীন নোমিনী মনোয়নের বিধান শরীয়াহর সাতে সাংঘর্ষিক।
ঘ. বিদ্যমান আইনে পলিসি বাজেয়াপ্তকরণের যে বিধান রয়েছে তা শরীয়াহতে অনুমোদনরেযোগ্য নয়। এর সমাধান হওয়া আবশ্যক।
ঙ. তাকাফুল চুক্তিতে সমর্পণের ক্ষেত্রে পলিসি গ্রহীতার প্রদত্ত সমুদয় প্রিমিয়াম এবং তা বিনিয়োগে যা মুনাফা হয়েছে সবই ফেরত দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে প্রচলিত জীবন বীমা পলিসিতে মেয়াদের প্রাথমিক বছরগুলোতে পলিসি গ্রহীতার পরিশোধিত প্রিমিয়াম প্রদত্ত সমর্পণ মূল্যের চেয়ে অনেক কম হয়ে থাকে।
চ. প্রচলিত আইনে বীমা প্রকল্পের যে রেটচার্ট ব্যবহৃত হচ্ছে তা ইসলামী তাকাফুলের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কারণ মুদারাবা ও তাবাররুর ভিত্তিতে রেটচার্ট তৈরী হয়নি।
ছ. তাকাফুলের পলিসি ডকুমেন্টেই লাভ-লোকসান বন্টনের এবং সুবিধা প্রদানের উৎসগুলোর উল্লেখ তাকা শরীয়াহর দাবী। অথচ প্রচলিত বীমা আইনের কারণে তা আদৌ সম্ভব না।
জ. ইসলামী তাকাফুলের জন্যে যে একচ্যুয়ারীর প্রয়োজন বাংলাদেশ তার নিদারুণ অভাব। এমনকি ওআইসি-র মত প্রতিষ্ঠানও এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়নি। এ সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিকভাবেই সকল ইসলামী তাকাফুল কোম্পানীর একযোগ এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
ঝ. প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় পুনর্বীমা করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও সুদের প্রসঙ্গ যুক্ত। উপরন্তু বাংলাদেশে ইসলামী পুর্বীমা করার কোন সুযোগ নেই। ইসলামী বীমার ক্ষেত্রে এটি দারুণ একটি সমস্যা।
ঞ. দক্ষ জনশক্তি ছাড়া তাকাফুলের দীর্ঘস্থায়ী অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাকাফুলেল সাথে যে সকল কর্মকর্তা ও মাঠকর্মী সংশ্লিষ্ট আছেন তারা এর ইসলামী কলা-কৌশল সম্পর্কে সম্যক অবহিত নন। এখানে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দের প্রায় সকলেই এসেছেন সুদী পদ্ধতির বীমা কোম্পানী থেকে। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের বিপুল অংশই তরুণ ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব সুস্পষ্ট। এজন্যে বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স একাডেমীর মানসম্পন্ন একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা সময়ের দাবী।
৮. উপসংহার
সুদনির্ভর বীমা পদ্ধতির বিকল্প হিসাবে ইসলামী পদ্ধতিতে বীমা বা তাকাফুল পরিচালনার জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করে হয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর হতেই অর্থাৎ ১৯৭৫ সালেই। বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা, আইনগত খুঁটিনাটি দূর, সর্বোপরি শরীযাহসম্মত কর্ম ও বিনিয়োগ পদ্ধতি উদ্ভাবনে কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন মুসরিম দেশে তো বটেই, অমুসলিম দেশেও ইসলামী বীমা কোম্পানী বা শিরকত আল-তাকাফুল আল-ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশেও ইসলামী বীমা ক্রমশঃ প্রসার লাভ করছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ, যার অধিকাংশই শরীয়াহর সাথে সম্পৃক্ত, দূর করতে পারলে ইসলামী তাকাফুলও ইসলামী ব্যাংকের মতই সনাতন বীমা ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।