ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের সমস্যাঃ প্রসঙ্গ বাংলাদেশ
ইসলামী অর্থনীতি সম্বন্ধে জানার ও তার বাস্তবায়নের জন্যে বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ ও উদ্দীপনা রয়েছে। বিশেষতঃ কিভাবে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করাযায় যে সম্বন্ধে তরুণ সমাজে যথেষ্ট কৌতুহল বিদ্যমান। কিন্তু এক্ষেত্রে সঠিক পথ নির্দেশনার যথেষ্ট অভাবই শুধু প্রধান অন্তরায় নয়, সমস্যাসমূহ যথাযথ চিহ্নিত করা হয়নি আজ অবধি। শুধু সস্তা শ্লোগান বা আন্তরিক সদিচ্ছা এদেশে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করে দেবে না। বরং এজন্যেই চাই প্রকৃত সমস্যাগুলো সনাক্ত করার প্রয়াস। এই আলোচনায় সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। আশা করা যায়, এসব সমস্যা সমাধানের জন্যে ইসলামপ্রিয় ব্যক্তিমাত্রই সচেতনভাবে চিন্তা এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন আন্তরিকতার সাথে।
সমস্যাসমূহ
১. বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের প্রথম সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক এদেশের সরকার। বাংলাদেশের জনসাধারণের ৮৬% মুসলিম। তাই সরাসরি এদের জীবনাদর্শের বিরোধিতা করা কোন সরকারের পক্ষেই আদৌ সম্ভব নয়। এজ৮ন্যে শেখ মুজিবর রহমান যেমন তাঁর বক্তৃতায় ‘ইনশাল্লাহ’, ‘আল্লাহর রহমতে’ বলতেন, তেমনি জিয়াউর রহমানও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ দিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুরু করতেন। নির্বাচনের সময়ে জনগণের কাছে ভোট চাইতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে বলতে হয ‘নৌকার মারিক তুই আল্লাহ। “বি.এন.পি. বলে –“ধানের শীষে বিসমিল্লাহ”। কিন্ত ঐ পর্যন্তই। ক্ষমতার মসনদে একবার অসীন হওয়ার পর সবাই পূর্বকথা ভুলে যান বেমালুম। তাই জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোথাও ইসলামী অর্থনীতির কোন দাবী বা বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়নের প্রতি সরকারের কোন আগ্রহ থাকে না। সরকার এক্ষেত্রে জনগণের দাবীকে কিন্তু সরাসরি বিরোধিতা করেন না। বরং কৌশল হিসাবে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করেন বা কমিশন বসান যার সদসদের অধিকাংশই ইসলামী জীবনাদর্শের বিরোধী, অথবা খুব বেশী হলে সেক্যুলার মতাদর্শের অনুসারী। সুতরাং, এসব রিপোর্ট আদৌ জনগণের আশা-আকাংখার অনুসারী হয় না। অনেক ক্ষেত্রে রিপোর্টগুলো চলে যায় হিমাগারে। এভাবেই সরকারের অনহিা কিংবা সত্যিকার আগ্রহের অভাবেই ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের যে-কোন গণদাবী এদেশে কার্যতঃ উপেক্ষিত ও অবহেলিত।
২. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দু’ একটি দল ছাড়া প্রায় সকল দলই ইসলামী জীবন-বিধান বাস্তবায়নের বিরোধী। রাজণৈতিক দলসমূহের চেষ্টার ফলেই জনগণের আশা-আকাংখা বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ ঘটে। কিন্তু তারাই যদি জনগণের ঈমান-আকিদার সাথে সাংঘর্ষেক বিষয়ে কথা বলে তাহলে জনগণের আশা-আকাংখা বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারে না। ইসলামী জীবনাদর্শবিরোধী রাজণৈতিক দলগুলো সন্ত্রাস, শঠতা ও ধোঁকাবাজীর মাধ্যমে ক্ষমতায় যাবার চেষ্টায় ব্যপৃত। এদেশে জামায়াতে ইসরামী বাংলাদেশ, ইত্তেহাদুল উম্মাহ, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, মুসলিম লীগ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়নের কথা বলে থাকে। এদের মধ্যে কেবলমাত্র জামায়াতে ইসলামীরই সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী রয়েছে এবং একটি সুশৃংখল কর্মীবাহিনী রয়েষে সেই কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্যে। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা বাস্তবে রূপ লাভ করছে না একারণেই যে, না তারা জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে ক্ষমতায় যেতে পেরেছে, না সহযোগী সংগঠনগুলো তাদের পুরো মদদ যোগাচ্ছে। বরং ইসরাম বাস্তবায়ন যাদের নির্বাচনী মেনিফেষ্টোতে নেই তারাই বার বার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কাণে বর্তমান ত্রিশংকু অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
৩. এদেশে কর্মরত এনজিওগুলোর প্রায় সবগুলোই ইসরামীবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত। বাংলাদেশ সরকার এদের কর্মসূচী জেনেও এদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। গত ১৯শে আগষ্ট, ১৯৯২ সরকার এনজিওগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এডাবের সরকারী নিবন্ধন বাতিলের ঘোষণা দেন। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ঐদিন বিকালেই আরেকটি আদেশ জারী ক রে পূর্বের আদেশ বাতিল করা হয় এনজিও কর্মকর্তা ও দাতা দেশগুলোর চাপে। [দৈনিক সংগ্রাম, ২৪ আগষ্ট, ১৯৯২]
এদেশে এনজিওগুলো বিকল্প সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এ অভিযোগ নতুন নয়। সরকারের কর্তৃত্ব অনেকক্ষেত্রেই এনজিওগুলো গ্রাহ্য করে না। সরকারের কাছে জবাবদিহিতারও প্রয়োজনবোধ করে না। এরা বিদেশী উৎস হতে প্রতি বছর কি পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করে এবং তা কোথায় কোন কর্মসূচীতে খরচ করে তার কোন স্বচ্ছ হিসাবও তারা সরকারকে দেয় না। উপরন্তু এতই এদের খুঁটির জোর, এদের পেছনে দাতা দেশগুলোর অবস্থান এতই শক্ত যে, এদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সরকার আরও ৈএকবার পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯ বস্তিতে এনজিও কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকার এক নির্দেশ জারী করে। সকলেই জান বস্তিগুলো এনজিওদের কার্যক্রমের এক বিরাট ক্ষেত্র। এরাই প্রধানতঃ বস্তিগুলো জিইয়ে রাখার কাজ করে যাচ্ছে। অথচ বস্তিগুলোই নগর জীবনের বিভিন্ন প্রকার অপকর্ম ও অপরাধের উৎস ও আশ্রয়স্থল। এজন্যে সরকার যখন একই সংগে বস্তি উচ্ছেদের কর্মসূচী গ্রহণ ও বস্তিতে এনজিও কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেয় তখন দেশবাসী তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু এনজিওগুলো এর প্রবল বিরোধিতা করে।এ থেকেই এদের বস্তিপ্রেমের রহস্য বুঝতে কারও বাকী থাকার কথা নয়। এদেরই চাপে মাত্র আড়াই মাসের মাথায় (১ ডিসেম্বর, ১৯৯৯) সরকার তার নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। (দৈনিক ইনকিলাব, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৯)
উল্লেখ্য, শহুরে দারিদ্র্য দূরীকরণে এনজিওদের আদৌ কোন ভূমিকা নেই। গ্রামীন দারিদ্র্য দূরীকরণেও অধিকাংশ এনজিও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ইউএনডিপির এক রিপোর্টে মাঠ জরীপের ভিত্তিতে বাংলাদেশের এনজিওদের তৎপরতার মূল্যায়নে বলা হয়েছে এনজিওদের প্রদত্ত ঋণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তেমন উপকার আসছে না। এছাড়া এনজিওদের প্রদত্ত ঋণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তেমন উপকারে আসছে না। এছাড়া এনজিওদের প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ স্বল্প, কিন্তু সুদের হার, ঋণদাতাদের দুর্ব্রবহার এবং ঋণগ্রহীতাদের হয়রানি অনেক বেশী। একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, মহাজনী ঋণের চড়া সুদের হার থেকে রেহাই দেওয়ার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট এদেশের শীর্ষস্থানীয় এনজিওধর্মী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের আদায়কৃত প্রকৃত সুদের হার ২১৯% -এরও অদিক। (দৈনিক ইনকিলাব, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫)। উপরন্তু দারদ্র্য দূরীকরণের নামে আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ধ্বংস, অর্থনৈতিক শোষণ আরও স্থায়ী, গোষ্ঠীগত বা বিশেষ রাজনৈতিক দলের খবরদারী এবং পারিবারিক ভাঙন সৃষ্টিতে তৎপর থাকার মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে প্রায় সকল এনজিওর বিরুদ্ধে।
আজ কে না জানে ওয়ার্ল্ড ভিশন অব বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড মিশনারী ইভানজেলিজম, দ্য স্যালভেশন আর্মি, সেভেনথ ডে এ্যাডভেনটিষ্ট চার্চ, বাংলাদেশ লুথারিয়ান মিশন, ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ, হীড বাংলাদেশ, কারিতাস, ওয়ার্ল্ড মিশন প্রেয়ার লীগ, দীপ শিখা, ফ্রি ব্যাপটিষ্ট চার্চ, ইয়ং ক্রিশ্চিয়ান ওয়ার্কার্স, ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন, তেরে দেস হোমস, ভলান্টারী সার্ভিস ওভারসীজ, শান্তাল মিশন, খ্রস্টিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (CCDB) , মিশনারীজ অব চ্যারিটি, খ্রীষ্টিয়ান লাইফ বাংলাদেশ, চার্চেস অব গড মিশন, সেভ দ্য চিলড্রেন (অষ্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), রাড্ডা বারনেন, দামিয়েন ফাউন্ডেশান, অষ্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট মিশনারী, ল্যাপরসি মিশন প্রভৃতি সংস্থা এদেশের দরিদ্র ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সেবা ও সাহায্য বিতরণের নামে আসলে ইসলামবিরোধী ধ্যানধারণারই প্রচার ও প্রসারের কাজে লিপ্ত। ছলে-বলে-কৌশলে তারা ধর্মান্তকরণের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু খ্রীষ্টান না হওয়ার অপরাধে পাঁচ শতাধিক কর্মচারীকে ছাঁটাই করেছে ওয়ার্ল্ড ভিশন অব বাংলাদেশ (দৈনিক সংগ্রাম, ১১ নভ্বের, ১৯৯৯)। চার্চিয়ান ফেডারেশনের রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে খৃষ্টানদের সংখ্যা ছিল ১৯৭১ সালে ২,০০,০০০। মাত্র বাইশ বছরে অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭,৯১,৩০০। উপরন্তু ২০০০ সালের মধ্যে ৩৫টি এরিয়া ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে খ্রীষ্টবাদের প্রচার ও নবদীক্ষিত খ্রীষ্টানসহ খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের পুনর্বাসনের জন্যে ৩০০ কোটি টাকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে অব্যাহত গতিতে।
এই অপচেষ্টার সয়লাবের বিপরীতে রাবিতাত আল-আলম আল-ইসলামী, মুসলিম এইড বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন, মডেল বাংলাদেশ, রয়াল ইকনমিক সার্ভিস এন্ড কেয়ার ফর দি আন্ডার প্রিভিলেজড (RESCU), আল মারকাজুল ইসলামী, আহসানিয়া ওয়েলফেয়ার মিশন, ইসরা ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রভৃতি ব্যতিক্রমধর্মী ইসলামী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রচেষ্টা বিশাল সমুদ্রে বিপুল জলরাশির মধ্যে গোস্পদ মাত্র।
৪. সামাজিক-সাংস্কৃতিক পর্যায়েও দুর্লভ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকলেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টির জন্যে সদা সচেষ্ট। ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্যে যে মানসিক ও সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ তেরী হওয়া জরুরী, এদেশের অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী অহর্নিশ তার বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে। বিভিন্ন পেশাজীবীদের সংগঠনের মাধ্যমেই বৃহত্তর জনমানুষের দাবী আদায় সহজ হয়। কিন্তু সেসব সংঠনের হোতারাই যদি হন ইসলামী জীবনাদর্শের বিরোধী তাহলে ইসলামের আলোকে অধিকার আদায় তো দূরে থাক, ইসরামবিরোধী কর্মসূচী বাস্তবায়নই হবে পরিণাম ফল। বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি, ইসলামবিরোধী কর্মসূচী বাস্তবায়নই হবে পরিণাম ফল। বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ তাঁতী কল্যাণ সমিতি, ব্যাংকার্স কল্যাণ পরিষদ, ইসলামী সমাজকল্যাণ সংস্থা প্রভৃতি গুটিকয়েক সামাজিক এবং সাইমুম, বিপরীত উচ্চারণ, কাফেলা, রেনেসাঁ, টাইফুন, প্রত্যয় প্রভৃতি মুষ্টিমেয় কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান কোনক্রমেই চৌদ্দ কোটি লোকের চাহিদা পূরণ বা আশা আকাংখা বাস্তবায়নে যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে না। পক্ষান্তরে সংগঠিত উপায়ে জনগণের প্রকৃত আশা-আকাংখার বিপথে পরিচালিত করার জন্যে অনৈসলামী সামাজিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলি উপর্যুপরি কর্মসূচী গ্রহণ করে চলেছে।
৫. বাংলাদেশের প্রচার ও গণসংযোগ মাধ্যমসমূহও ইসলামী ধ্যান-ধারণা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিদারুণ বৈরী। সাধারণভাবে দেশের গণসংযোগ মাধ্যম এবং প্রচার যন্ত্রগুলি জনগণের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে। জনগণের ধ্যান-ধারণাকে সুষ্ঠুভাবে বিকশিত করে তোলাই এদের কাজ। কিন্তু বাংলাদেশের রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রসমূহের আচরণ ও নীতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ইসলাম বিরোধিতাই এদের ব্রত। এদেশের টেলিভিশন ও মঞ্চ নাটকের প্রতি নজর ফেরালো এসত্য দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সরকারী গণমাধ্যমগুলির, বিশেষ করে টেলিভিশনের ইসলাম বিরোধিতা এতই তীব্র যে, বিজ্ঞাপনের জন্যে নির্ধারিত হারে অর্থ পরিশোধের চুক্তিতে পর্যন্ত ‘ইনশাআল্লাহ’ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করা যায় না। সরকারী দপ্তরে এজন্যে ব্যাখ্যা চেয়েও কোন উত্তর মেলে না।
খবরের কাগজ ও সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার অবস্থাও তথৈবচঃ। এখানে ইসলাম বিরোধিতার পাশাপাশি রয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে তীব্র কটুক্তি ও বিষোদগার। সরকারের গৃহীত উদার প্রকাশনা নীতির সুবাদে এই অবস্থা বর্তমানে আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। বেশ কিছু ভুঁইফোড় সাপ্তাহিক ও সদ্য গজিয়ে ওঠা দৈনিক পত্রিকা ইসলামের রীতি-নীতি, ইসলামী ইতহিাস ও ইসলামী ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে কুৎসিত ও কদর্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এদের রীতিবিরুদ্ধ এই জোয়ারের বিরুদ্ধে ইনকিলাব, সংগ্রাম, আল-মুজাদ্দেদ, সোনার বাংলা, মুসলি জাহান, বিক্রম, পৃথিবী, মদীনা, কলম, পালাবদল, দারুস সালাম, আত-তাহরীক প্রভৃতি দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকা দুঃসাহী ব্যতিক্রম। এরাই মুসলিম গণমানুষের চিন্তা-চেতনাকে তুলে ধরছে দেশের কাছে, দশের কাছে। কিন্তু সরকারের নিদারুণ ঔদাসীন এবং ইসলামবিরোধীদের গোয়েবলসীয় প্রচারণার বিরুদ্ধে এই প্রয়াস কতদূর ও কতখানি সফলতা অর্জনে সক্ষম?
৬. এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন তথা এর প্রচার ও প্রসারের বিরোধী। মাদরাসা শিক্ষাসহ দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই ইসলামী অর্থনীতি পড়ানো হয় না। রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণীর অর্থনীতি সংক্রান্ত পাঠ্যসূচীর কোন কোন পত্রে সামান্য মাত্র ইসলামী ব্যাংকিং, অর্থনীতি চিন্তা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের একমাত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাষ্টার্স ডিগ্রী নিয়েও ইসলামী অর্থনীতি সম্বন্ধে ছাত্রদের সঠিক তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক জ্ঞান অর্জিত হয় না। মাদরাসা শিক্ষাতেও ইসলামী অর্থনীতি নামে যা পড়ানো হয় তা আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ঐ অর্থনীতি পড়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা বা ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে জানার কোন উপায় নেই। আসলেই বৃটিশ আমলে প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক কোন পরিবর্তন এদেশে হয়নি- না পাকিস্তান আমলে, না বাংলাদেশ আমলে। যে পরিবর্তন হয়েছে তা শুধু বহিরঙ্গ বা উপরে কাঠামোর, ভেতরে কোন কার্যকর পরিবর্তন আজ অবধি হয়নি। এদেশের জনগণের চিন্তা-চেতনার পরিপোষক পাঠ্যক্রম তৈরী করতে সরকারের যথোচিত উদ্যোগের অভাবের কথা কাউকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার দরকার নেই।
৭. বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থাও ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের প্রতিকূল এদেশের আইন ব্যবস্থা বৃটিশ আমলে প্রবর্তিত আইন ব্যবস্থারই কিছু সংশোধিত রূপ। মূলতঃ এই আইন বৃটিশ ও রোমন আইনের সংমিশ্রণ। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসলামী আইনের বিধান বিদ্যমান রয়েছে। যেমন পারিবারিক আইন, সম্পত্তির বাঁটোয়ারা ও উত্তরাধিকার আইন। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রম, কর, ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা প্রভৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ইসলামী অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী আইন প্রয়োগের কোন সুযোগ নেই। বিদ্যমান ব্যবসায় আইন সুদের সপক্ষে; ইসলামী ব্যাংক, বিনিয়োগ ব্যবস্থা ও বীমার বিপক্ষে।তাই এই আইন কাঠামোর আওতায় ইসলামী ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন গড়েস তোলা দুঃসাধ্য।
এদেশে ইসলামী শ্রমনীতি প্রয়োগের সুযোগ নেই। বিদ্যমান শ্রমনীতি পুঁজিবাদের অনুসারী। তাই এই শ্রমনীতি ইসলামের অনুশাসনের কাছাকাছিও নয়। তথাকথিত বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের শ্রমনীতিও ইসলামী শ্রমনীতির মূল বক্তব্যের ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। ইসলামী শ্রমনীতির মর্মকথা- ‘শ্রমিক-মালিক ভাই ভাই’। এই বিধানের স্বীকৃতি খোদ আই.এল.ও. কনভেনশনের চার্টারে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তাই একদিকে যেমন রয়েছে মালিকের অব্যাহত শোষণ ও নানা দুর্নীতি, শ্রমিক নেতাদের লেঅভ ও অন্যায় চাপ, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে সরকারের দুর্বলতা এবং সাধারণ শ্রমিক শ্রেণীর নিদারুণ বঞ্চনা। শ্রমিকদের জন্যে প্রবর্তিত ইসলামী শ্রমনীতি-যাকে বলা হয় মানবিক শ্রমনীতি-প্রবর্তনের ক্ষে্রেত এদেশে বাধা রয়েছে তিন পক্ষের। প্রথম পক্ষ খোদ শিল্প মালিকেরা, দ্বিতীয় পক্ষ শ্রমিকদের স্বার্থের ধ্বজাধারী ট্রেড ইউনিয়ন এবং তৃতীয় পক্ষ সরকার নিজেই। বিশেষতঃ সরকার শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের চাইতে মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রতি অধিক যত্নবান। আইন কাঠামো পরিবর্তন না করে তাই এদেশে ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়ন দুরূহ ব্যাপার।
৯. ভূমিস্বত্ব, ভূমি প্রশাসন ও ভূমি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এদেশে ইসলামী অর্থনীতির বিধি-বিধান প্রয়োগের সুযোগ নেই। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে, এদেশের আইন ব্যবস্থা বৃটিশ আইন ব্যবস্থার অনুসারী। তাই এসব ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিমালা প্রয়োগ আদৌ সম্ভবপর নয়। ফলশ্রুতিতে ইসলামী অর্থনীতির সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সকলেই। ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি রাজস্ব ও উশর আদায় এবং ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ ইসলামীকরণ করতে হলে প্রথমেই বাধা আসবে এদেশের বড় বড় জোতদার ও বড় মাপের জমির মালিকদের পক্ষ থেকে। তাদের সমর্থন জোগাবে গ্রামীন টাউন ও রাজনৈতিক মাস্তানরা। সরকারও এদের অন্যায় দাবীর কাছে নতি স্বীকার করবে (অতীতেও যেমন করেছে) ভোটের জন্যে।
১০. উপযুক্ত লোক, প্রতিষ্ঠান ও মানসিকতার অভাবে মুদারাবা, মুশারাকা ও করযে হাসানা প্রদানের ব্যবস্থা করা এদেশে এখন অসম্ভব ব্যাপার। ইসলামী অর্থনীতি চালু করতে হলে যেসব কর্মপদ্ধতি অতি অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে সেসবের মধ্যে করযে হাসানা প্রদান ও মুদারাবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই পদ্ধতির মাধ্যমেসমাজে অভাবী লোকের সাময়িক প্রয়োজন পূরণ এবং কর্মসংস্থানের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। ইসলামের সোনালী যুগে তো বটেই, এমন কি আইয়ামে জাহেলিয়ায়ও মুদারাবা পদ্ধতি চালূ ছিল। কিন্তু বর্তমানে সুদের সর্বগ্রাসী প্রকোপ এবং ব্যক্তি চরিত্রের নিদারুণ অবনতির কারণে না করযে হাসানা প্রদান করা যায়, না মুদারাবার উদ্রোগ নেওয়া যায়। ইসলামী ব্যাংকগুলি পর্যন্ত বাংলাদেশে মুদারাবা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করতে ভরসা পাচ্ছে না ব্যক্তি চরিত্রের অবনতি ও আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগের অভাবে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতেই মসজিদকেন্দ্রিক করযে হাসানা প্রদান ও মুদারাবা পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে। মানসিকতার পরিবর্তন এই উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান তৈরীর ব্যর্থতাই এক্সেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক।
১১. বাংলাদেশে যাকাত আদায় ও বিলিবন্টনের জন্যে উপযুক্ত সরকারী আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। এদেশে ইনস্টিটিউশন হিসাবে যাকাতের ব্যবহার নিদারুণভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত। যাকাতের আর্থ-সামাজিক উপযোগিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। খুলাফায়ে রাশেদার (রা) আমলে যাকাত প্রদানের অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাকাত আদায় ও বিলিবন্টনের উপযুক্ত উদ্যোগ নেই। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকান্ডের কাংখিত সুফল হতে জাতি বঞ্চিত। প্রসঙ্গতঃ বলা ভাল, সরকারীভাবে যাকাত আদায়ের আইন তৈরী ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন যেমন আশু কর্তব তেমনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করাও অতীব জরুরী।
১২. ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম প্রধান শত্রু সুদ। অথচ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সুদের সর্বগ্রাসী আক্রমণ কবলিত। দেশের সব ধরনের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ কোন-না-কোনভাসে সুদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত। সুদের উচ্ছেদ ইসরামী অর্থনীতির শুধু অন্যতম দাবীই নয়, সুদ বিদ্যমান থাকলে ইসলামী অর্থনীতি তার সঞ্জীবনী শক্তি হারাবে। সুদ সমাজে শোষণের নীরব অথচ বলিষ্ঠ হাতিয়ার। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ নানা বেইনসাফীর উৎসমূল এই সুদ। কিন্তু বাংলাদেশে কি সরকার, কি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, কি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কেউই সুদ উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সোচ্চার নয়। সুদী কার্যক্রম নিরোধের এবং সুদের যুলুম হতে পরত্রাণ পাওয়ার জন্যে কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবনে কোন মহলেরই আগ্রহ নেই। উপরন্তু আইনের সাহায্যে সুদকে সর্বব্যাপী করে দেওয়া হয়েছে এদেশের ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
১৩. জুয়ার উচ্ছেদ ইসলামী অর্থনীতির অপর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবী। কিন্তু বাংলাদেশে জুয়ার উচ্ছেদের পরিবর্তে এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে এবং বহুক্ষেত্রেই তা সরকারী ছত্রছায়াতেই। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর শুধুমাত্র ঘোড়দৌড় বা রেসের জুয়াই সরকারী নির্দেশে বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য সব জুয়া রয়ে গেছে পূর্বের মতই। বরং যাত্রার প্যান্ডেলে হাউজি এবং ট্রেন স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড সর্বত্রই নানা রূপে ও নানা কৌশলে জুয়া চলেছে অপ্রতিহত গতিতে। এর উচ্ছেদে না হওয়ায় সাধারণ লোক ক্রমাগত ঠকছে, নিঃস্ব হচ্ছে। ইসলামী অর্থনীতি ইনসাফ, আদল ও ইহসানের অর্থনীতি। জুয়ার অবস্থান এর বিপরীত মেরুতে। বড় বড় কোম্পানী, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং ধনী লোকেরাই নানা অবয়বে জুয়ার ব্যবসায়ে লিপ্ত। জুয়া উচ্ছেদের বাধা আসবে প্রথমতঃ তাদের কাছ থেকেই। কিন্তু সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা ও আপামর জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে এর উচ্ছেদ অপরিহার্য।
১৪. ব্যবসায়িক অসাধুতার প্রশ্রয়দান ইসলামী অর্থনীতির বাস্তবায়নে বৈরীতার নামান্তর। কোন সৎ ও সভ্য সমাজে ব্যবসায়িক অসাধুতা প্রশ্রয় পায় না। চোরাকারবারী, মুনাফাখোরী, মজুতদারী, কালোবাজারী, পণ্যে ভেজাল দেওয়া, ওজরে কারচুপি, নকল করা প্রভৃতি সকল দেশেই ঘৃণ্য অপরাধ। এর জন্যে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে রাসূলে করীমের (স) যুগ হতে ‘হিসবাহ্’ ও ‘হিজর’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান অব্যাহতভাবে কাজ করে গেছে সব ধরনের ব্যবসায়িক অসাধুতা ও প্রতারণা নিরোধ ও উচ্ছেদের জন্যে। বাংলাদেশেও েএর প্রতিবিধানের জন্যে ফৌজদারী আইন রয়েছে। এমনকি ফায়ারিং স্কোয়াডে চোরাকারবারীর মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু কাজীর গুরু কেতাবেই থাকে, গোয়ালে নয়। তাই আজকের বাজার ব্যবস্থা চরম অনিয়ন্ত্রিত এবং অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের শিকার। এজন্যে আইনের দীর্ঘসূত্রীতা এবং আমলাতান্ত্রিকতা দায়ী। ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করতে হলে কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্র ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। আমলাতান্ত্রিকতা ও আইন প্রয়োগের দীর্ঘসূত্রীতা দ্রুত পরিহার করতে হবে। তবেই ইসলামী অর্থনীতির আদল ও ইহসানের সুফল পৌঁছাবে জনগণের ঘরে ঘরে।
১৫. কালো টাকাও এদেশে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধক। বাংলাদেশে বর্তমানে কালো টাকার পরিমাণ ষাট হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে গেছে (দৈনিক আমার দেশ, ৬ এপ্রিল ২০০৫)। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ পরিচালিত এক জরীপ অনুযায়ী দেশের প্রতিটি মানুষকে বছরে গড়ে ৩৮৫ টাকা ঘুষ দিতে হয়। নয়টি গুরুত্বপূর্ণ সরকারী খাতে পঁচিশ ধরনের সেবা দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের কাছ থেকে বছরে আনুমানিক ৬,৭৯৬ কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে আদায় করে (দৈনিক সংগ্রাম, ২১ এপ্রিল ২০০৫)। এভাবে যারা নানাবিধ অসামাজিক অনৈতিক ও বেআইনী কাজের মাধ্যমে কোটি কোটি কালো টাকার মালিক হয়েছে ও হচ্ছে তারা কিছুতেই ইসলামী ইনসাফ আদল ও ইহসানের কাছে নতি স্বীকার করতে চাইবে না। কর ফাঁকি দেওয়া, জালিয়াতি, মাদকদ্রব্যের ব্যবসা, দুর্নীতি, ঘুষ ও চাঁদাবাজি, বৈদেশিক বাণিজ্যে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং প্রভৃতি হেন অপকর্ম নেই যা এই চক্রের লোকেরা করে না। অসদুপায়ে অর্জিত এই অর্থের অংশবিশেষ দিয়ে তারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ফায়দা লোটে, সামাজিক মর্যাদার শীর্ষে আরোহণ করে। এমন কি জাতীয় নির্বাচনেও তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের পক্ষের শক্তিকে জিতে সাহায্য করে যেন তাদের স্বার্থবিরোধী কোন পদক্ষেপ গৃহীত হতে না পারে। ফলে আপামর জনসাধারণ যে ভয়ানক আর্থিক ও সামাজিক দুর্গতি ও ভোগান্তির শিকার হয় তার সীমা-পরিসীমা নেই।
১৬. বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এদেশের মানুষের মাসিক গঠনও অন্যতম প্রতিবন্ধক। এদেশের জনসাধারণ খুবই আবেগপ্রবণ, যুক্তি নির্ভর নয়। মনমত কথা বলে সহজেই এদের চিত্ত জয় করা যায়। তাই হাতে তসবীহ্ নিয়ে বা বিসমিল্লাহ্র দোহাই দিয়ে ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হয়। ক্ষমতায় গিয়ে জনগণকে বুড়ো আঙুল দেখালে কিছু যায় আসে না। কারণ জনগণ সংঘবদ্ধ হয়ে সোচ্চার ও সক্রিয় প্রতিবাদ জানায় না। অধিকাংশ অশিক্ষিত, আবেগপ্রবণ ও অসংগঠিত জনগণের কারণে ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ করে সরকার রেহাই পেয়ে যায়। ইসলাম অনুসারী কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন বা বাস্তবায়নের তো প্রশ্নই ওঠে না।
১৭. ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বুনিয়াদ আমর বিল মারুফ (সুনীতির প্রতিষ্ঠা) এবং নেহী আনিল মুনকার (দুর্নীতির উচ্ছেদ)। বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এ দুটি নীতির কোনটিই প্রয়োগ হচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দুষ্কৃতি এখন এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, দেশের অবসরপ্রাপ্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন—দেশে এখন শিষ্টের দমন আর দুষ্টের লালন চলছে। একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্যে কী গভীর লজ্জা ও পরিতাপের কথা! সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদের জন্যে যে ঈমানী জযবা প্রয়োজন তাও অধিকাংশ মুসলমানের মধ্যে অনুপস্থিত। ফলে ইসলামী অর্থনীতির যে ধারণা বা নীতি কায়েমী স্বার্থণ্বেষী মহলের বিরুদ্ধে যাবে তার বাস্তবায়ন প্রতি পদে বাধা পাবে এদেশে। এটা স্বতঃসিদ্ধ এবং স্বাভাবিক। সরকারও এদের মদদ যোগান-কখনও গোপনে, কখনও প্রকাশ্যে। তাই ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নে বাধা ঘরে-বাইরে সর্বত্রই।
১৮. বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলিমের ধর্মীয় অনুভূতি খুবই তীব্র ও প্রবল। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার অভাবে এই অনুভূতি বহুলাংশে আবেগবহুল। ইসরামের বহিরঙ্গ নিয়েই জনগণ তৃপ্ত। খোদায়ী জীবন বিধানের বাস্তব প্রয়োগ করে জীবনকে কুরআন ও সুন্নাহর রঙে রঙীন করার লক্ষ্য তার কাছে গৌণ। ইসলামী শরীয়াহর বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে ইহলৌকিক জীবনকে পারলৌকিক জীবনের জন্যে প্রস্তুত করে নেওয়ার দৃঢ় বাসনা তার মধ্যে প্রায়শঃই অনুপস্থিত। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর এই চেতনার অভাবে তাদের ইসলামের প্রতি আবেগতাড়িত অনুভূতিকে সুসংহতভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন বা প্রতিষ্ঠার জন্যে সেটাই সবচেয়ে বেশী জরুরী।
নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবি প্রফেসর আর্থার ল্যুইস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Principles of Economic Planning গ্রন্থে পরিকল্পনার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাবার আবশ্যিক শর্ত হিসাবে যে বিষয়টির উপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা এক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তাঁর মতে- “জনগণের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূল চালিকা শক্তি।” বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় বিপুল জনগোষ্ঠীকে ইসলামী জীবন যাপনের জন্যে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রয়োজনীয় কর্মতৎপরতার গ্রহণ ও ক্ষেত্রবিশেষে ত্যাগ স্বীকারের দীক্ষায় উজ্জীবিত করতে এবং সুসংহত করে সুগঠিত শক্তিতে রূপান্তর করতে যে উদ্যোগ ও তৎপরতা প্রয়োজন এই মুহূর্তে তার বড়ই অভাব। এই প্রয়োজন পূরণই বর্তমানের সবচেয়ে বড় সমস্যা ও বিরাট চ্যালেঞ্জ।