ইসলামী অর্থনীতিতে আয় ও সস্পদ বন্টন
১.
আয় ও সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের উপরই নির্ভর করে একটি জাতির বা দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতি। দেশের জনসাধারণের কর্মসংস্থান, উৎপাদন বৃদ্ধি, বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি এবং সেই সাথে কারা হাতে যেন সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে না পারে তা নির্ভর করেসমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। সমাজে কি ধরনের অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে তার উপরেই নির্ভর করে আয় ও সম্পদ বন্টন সুষ্ঠু হবে, না বৈষম্যপূর্ণহ হবে। সম্পদের মালিকানার ধরন, আইনগতভাবে তার পরিচালনা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেতার যথাযথ নিয়ন্ত্রণের উপরে আয় ও বন্টনের সাম্য বা বৈষম্য নির্ভর করে। রাষ্ট্র শুধুমাত্র কিছু আইন প্রণয়ন ও কর আরোপ করে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু খাত রাষ্ট্রের নিজস্ব জিম্মাদারীতেও থাকে। কিন্তু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সততা এবং নৈতিকতার উপর কিছুমাত্র নজর দেয় না। যেহেতু নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা এবং পরকালে আল্লাহর নিকট পুঁজিবাদী দর্শনের ভিত্তি নয় সেহেতু পুঁজিবাদী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ নানা কৌশলে, সাধারণতঃ অসৎ ও অবৈধ উপায়ে আয়-উপার্জনের চেষ্ট করে।
অপরদিকে সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি মালিকানার সীমারেখা খুবই সংকুচিতহ। কোন ক্ষেত্রে একেবারেই নেই। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে আয় ও সম্পদ বন্টন পুরোপুরি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের খেয়াল-খুশীর উপর নির্ভরশীল। এই খেয়াল-খুশী যে কতখানি ব্যক্তিনির্ভর তা আজকের দুটি বৃহৎ সমাজবাদী দেশ-সোভিয়েত রাশয়া ও গণচীনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সহজেই উপলব্ধি হবে। ইসলাম এই দুই চরমধর্মী প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নিয়েছে। অর্তা, ইসলামে ব্যক্তি মালিকানার স্বীকতি রয়েছে; আয়, ভোগ, বন্টন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সাফল্যের অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু কোনটিই লাগামহীন নয়, নিরংকুশভাবে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বা রাষ্ট্রের এখতিয়ারভুক্ত নয়। ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্র আল-কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত পথেই সম্পদ উপার্জন ও ভোগ করবে; সমাজে আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রিত হবে, বৈধতার ভিত্তিতেই উপায়-উপার্জন করবে এবং সম্পদের মালিকানা ও বন্টন নির্ধারিত হবে।
মূলতঃ অসৎ ও অবৈধ উপায়ে উপার্জনের ফলেই সমাজে ধনবন্টন বৈষম্য দেখা দেয়। এসব অসৎ ও অবৈধ উপায়কে তিনটি বড় ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ অবৈধ উপায়ে আয়ের সুযোগের মধ্যে রয়েছে মজুতদারী, মুনাফাখোরী, ঘুষ, কালোবাজারী, ফটকাবাজারী প্রভৃতি। এসব অবৈধ ও অনৈতিক উপায়ে ব্যক্তির হাতে সম্পদের পাহাড় জমে ওঠে। যে সমাজে নৈতিক দিক দিয়ে এসব অবৈধ পন্থা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই সে সমাজে শুধু আইন প্রয়োগ করে কোন সাফল্য অর্জিত হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। দ্বিতীয়তঃ সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখার সুযোগ। এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে ধনসম্পদ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টিত হতে না দেওয়া। সম্পদ এখানে শধুমাত্র বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে এবং সেনা-রূপা-হীরা-জহরত, বিপুল জমি, প্রাসাদোপম বাড়ী অলংকারের মাধ্যমে বিত্ত ক্রমাগত মুষ্টিমেয় লোকের হাতে মজুদ হয়। কোনক্রমেই এই সম্পদ বিত্তহীন বা কম সৌভাগ্যবান লোকদের কাজে আসে না। শোষণের ও ধনবন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টির তৃতীয় যে বড় অবৈধ উপায় সমাজে বিদ্যমান তা হলো সুদ এবং মহাজনী প্রথার ঋণ। সুকৌশলে সমাজের সর্বস্তরের লোকদের শোষণর সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার সুদ। সুদের কারণেই অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয়, ভারসাম্যহীনতা, মন্দা ও অস্থিরতা দেখা দেয়। অথচ সুদই পুঁজিবাদের জীয়নকাঠি বা Lifeblood।
২.
ইসলামী অর্থনীতি তথা ইসলামী সমাজে আয় ও ধনবন্টন কিভাবে হবে তার মূলনীতিগুলো করআন ও সুন্নাহতে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী আকিদা মুতাবিক সমস্ত সম্পদের মালিকানা আল্লাহরই। তিনিই এর স্রষ্টা। মানুষকে সীমিত সময়ের জন্যে তিনি শর্তাধীন মালিক করে দিয়েছেন। তাকে নিরংকুশ মালিকানা দেওয়া হয়নি। ব্যাপারটা অনেকটা বাড়ীর মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যের সম্পর্কের মতো। বাড়ীর মালিকই হলো প্রকৃত মালিক, ভাড়াটিয়া বা ইজারা গ্রহীতা কতকগুলো শর্তপূরণ সাপেক্ষে সেই বাড়ীর বসবাস বা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারেন। শর্তের মধ্যে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করা ছাড়াও থাকতে পারে দেয়াল ভাংগা বা জানালা বদলানো যাবে না, গাছ কাটা যাবে না, ছাদে বাগান করা যাবে না ইত্যাদি। অনুরূপভাবে কতকগুলো শর্ত পালন সাপেক্ষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রতিনিধি মানুষ বা ইনসানকে তাঁর সম্পদ ব্যবহার করার অধিকার দিয়েছেন।
ইসলামে স্বেচ্ছাধীনভাবে আয়ের যেমন সুযোগ নেই তেমনি ইচ্ছামত ভোগ ও ব্যয়েরও কোন সুযোগ নেই। এই মূল দৃষ্টিভংগীর প্রেক্ষিতে কুরআন ও হাদীসে সম্পদ উপার্জন, ব্যবহার ও বন্টনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ এসেছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
“হে ঈমানদারগণ! একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য যদি পরস্পরের সম্মতিক্রমে হয় তবে আপত্তি নেই।” (সূরা আন-নিসা: ২৯ আয়াত)
“অতি পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও সেই লোকদের যারা স্বর্ণ-রৌপ্য পুঁজি করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না।” (সূরা আত-তাওবা: ৩৪ আয়াত)
“ইহা জীবন যাপনের ব্যবস্থা সেই মুত্তাকীনদের জন্যে যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে।” (সূরা আল-বাকারা: ২-৩ আয়াত)
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।” (সূরা আল বাকারা: ২৭৫ আয়াত)
“সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যেই অবর্তিত না হয়।” (সূরা আল-হাশর: ৭ আয়াত)
“নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বনি ইসরাইল: ২৭ আয়াত)
“তাদের ধন-সম্পদের মধ্যে প্রার্থী ও অভাবগ্রস্তদের অংশ নির্ধারিত রয়েছ।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)
অনুরূপভাবে হাদীস শরীফেও প্রচুর নির্দেশ রয়েছে। যেমন:
“যারা দাম বৃদ্ধির উদ্দেশ্রে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি চল্লিশ দিনের বেশী মজুদ রাখে তাদের সাথে আমার (অর্থাৎ রাসূলের) কোন সম্পর্ক নেই।” (মিশকাত)
“যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে পেট পুরে খায় সে প্রকৃত মুমিন নয়।” (বুখারী)
“যারা অন্যকে ঠকায় ও অন্যের সাথে প্রতারণা করে তাদের আমাদের (অর্থাৎ মুমিনদের) মধ্যে নেই। (বুখারী)
“বর্গাদারী প্রথায় যদি কোন পক্ষের তাদের ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশাংকা থাকে তবে তা নিষিদ্ধ হবে।” (মিশকাত)
উপরোক্ত নির্দেশসমূহের আলোকে রাসুলে করীম (স) তাঁর জীবদ্দশাতেই মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মহান খুলাফায়ে রাশিদূনও (রা) সেই একই পথ অনুসরণ করেছিলেন। সে সময়ে ইসলামী দুনিয়ার বিস্তৃতি ঘটেছিল অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিতে। সুদূর স্পেনে কর্ডোভা হতে দূর প্রাচ্রের ইন্দোচীন (আজকের ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া) পর্যন্ত েইসলামের সুশীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবািইজান, কাজাখাস্তান পার হয়ে সুদূর চীনের কাশগড়, জিনিজিয়াং, গানসু প্রভৃতি অঞ্চল পর্যন্ত ইসলামের জীবন বিধান বাস্তবায়িত হয়েছিল। সেই আমলে রাষ্ট্রের বিস্তৃত কর্মকাণ্ড, নতুন নতুন এলাকার বিশেষ বিশেষ অবস্থা ইত্যাদির প্রেক্ষিতে ইসলামী চিন্তাবিদরা ইসলামী অর্থনীতি সম্বন্ধে আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে বিস্তৃত গবেষণা করেন। আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে যেসব মুসলিম অর্থনীতিবিদ বক্তব্য রেখেছেন তাঁদের মধ্যে আবু ইউসুফ, ইবনে তাইমিয়া, আবু ইসহাক আল-শাতিবী, নাসিরুদ্দীন তুসী, ইবনে খালদুন প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
৩.
আবু ইউসুফ তাঁর কিতাবুল খারাজ বইয়ে সম্পদ কিভাবে সমাজে বন্টিত হবে তার পদ্ধতি ও কর্মকৌশল সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনায় কৃষি জমির উশর ও খারাজ আদায় চাড়াও জমির মালিকানার ধরন ও পদ্ধতি বিষয়েও মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে জমি যেমন অনাবাদী রাখা যাবে না তেমনি কেউ এত বেশী জমির মালি হতে পারবে না যা তার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে চাষাবাদ করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া তিনি আনুপাতিক হারে কর বৃদ্ধিরও কথা বলেছেন। সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে তিনি উত্তরাধিকার আইরে যথাযথ প্রয়োগের উপরও সমধিক জোর দিয়েছেন।
ইবনে তাইমিয়া তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ আল-হিসবাহ ফি আল-ইসলাম বইয়ে জনগণের উপার্জন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের আবশ্যিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকার কথা বলেছেন। জনসাধারণের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের আয়-উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে রাষ্ট্র একদিকে যেমন উপায়-উপকরণ সরবরাহ করবে তেমনি অন্যদিকে তাদেরকে কাজের উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠারও সুযোগ সৃষ্টি করবে। গর মৌসুম বা Slack Season-এ যখন ক্ষেতে-খামারে কাজ মেলে না সে সময়ে রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন রাস্তা ও সেতু তৈরী ও মেরামত, মুসাফিরখানা সংস্কার, রাস্তার ধরে গাছ লাগানো প্রবৃতি কাজের মাধ্যমে বেকার ও ছদ্মবেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। এভাবেই সমাজে সাধারণ লোকের আয়ের নিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। অনুরূপভাবে সরকার সকল অবৈধ উপায়ে আয়ের পথ রুদ্ধ করে দেবে এবং ধনী ব্যক্তি ও বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের উপর নজর রাখবে। প্রয়োজনে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করে বন্টন ও বাজার ব্যবস্থাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্বও সরকারেরই। ইবনে হাযমের মতে উপযুক্ত কর আরোপের মাধ্যমে ধনীদের আয়হ্রাস ও গরীবদের কল্যাণের দায়িত্বও সরকারেরই।
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও আধুনিক ধনবিজ্ঞানের জনক হিসাবে পরিচিত ইবনে খালদূনও তাঁর সুপ্রসিদ্ধ বই আল-মুকাদ্দামা-তে সমাজে আয় আবর্তন ও সম্পদ বন্টনের বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোচনা করেছেন। উপরন্তু সমকালীন সমাজে সে সবের প্রয়োগ পদ্ধতি ও তার সুফল সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিশেষ করে বেতনভোগী শ্রেণীর পদ্ধতি ও তার সুফল সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। উপরন্তু সমকালীন সমাজে সে সবের প্রয়োগ পদ্ধতি ও তার সুফল সম্পর্কে উল্লেখ করেছন। তিনি বিশেষ করে বেতনভোগী শ্রেণীর ক্রয় ক্ষমতার নিশ্চয়তা বিধান, কৃষিজীবিদের উৎপাদিত পণ্যের মূলের স্থিতিশীলতা ও সৈনিকদের বেতন নির্ধারণ বিষয়েও আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ েএলাকার মধ্যে আয় বৈষম্য ও তা দূর করার উপায় সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন।
একেবারে সাম্প্রতিক কালের কথা যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে হিজরী চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগ হতে যে ইসলামী পূনর্জাগরণ শুরু হয়েছে সে ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতিবিদরাও পিছিয়ে নেই। শহীদ সাইয়েদ কুতুব হতে শুরু করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, খুরশীদ আহমদ, উমর চাপরা, নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, ইউসুফ কারযাবী, বাক্কীর আল-সদর, হাসান আবু রুকবা, মনযের কা’ফ, আনাস জারকা, এস.এন.এইচ. নকভ, িআবুল হাসান এম. সাদেক প্রমুখ প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ তাঁদের বিভিন্ন মুখী আলোচনায় দেখাবার প্রয়াস পেয়েছেন যে, যতক্ষণ না আমরা হযরত মুহাম্মদ (স) প্রদর্শিত আমর বিল মারুফ (বা সুনীতির প্রতিষ্ঠা) এবং নেহী আনিল মুনকার (বা দুর্নীতির উচ্ছেদ) এর পথ বাস্তবিকই অনুসরণ করছি এবং উপার্জনের ও ধনবন্টনের সকল ক্ষেত্রে হালালকে গ্রহণ ও হারামকে বর্জন না করছি ততক্ষণ সমাজে শান্তি ও স্বস্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ আসতে পারে না। অর্থনতি তার স্বাভাবিক গতিধারায় চলতে পারে না।
৪.
প্রসঙ্গতঃ মনে রাখা দরকার, ইসলামী অর্থনীতির মূল বুনিয়াদ তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাত এবং এই অর্থনীতি একটি ব্যবস্থাপনা নির্ভর অর্থনীতি (Managed economy)। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি মূলতঃ উন্মুক্ত বা অবাধ অর্থনীতি (Open economy) এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি হচ্ছে সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি (Totally controlled economy)। সুতরাং, আদর্শগত ও প্রয়োগগত পার্থক্যের কারণেই ইসলামী অর্থনীতির কর্মধারা এবং তার বাস্তব রূপও ভিন্নতর হতে বাধ্য। সে কারণেই সামাজিক সাম্য অরজন, ইনসাফপূর্ণ বন্টন, দরিদ্র শ্রেণীর হক আদায় ও অধিকতর মানবিক জীবন যাপনের সুযোগ প্রদান এবং ধনীদের বিলাসিতা, অপচয় ও অপব্যয় বন্ধের জন্যে আয় ও বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলাম যে মূলনীতিগুলোর আবেদন ও প্রয়োগ সার্বজনীন ও সর্বকালীন। ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যতদিন মুসলিম দেশসমূহ ইসলামী ভাবধারা ও নীতিমালা অনুসরণ করেছে ততদিন তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে; জনজীবনে স্বস্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত হয়েছে। পক্ষান্তরে এর ব্যতিক্রম মুসলিম সমাজের পতন ডেকে এনেছে।
এতক্ষণে একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ইসরামী অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে অনুসৃতব্য মূলনীতিসমূহের ভিত্তি হচ্ছে আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকার। বস্তুতঃ সামাজিক সাম্য অর্জনের জন্যে চাই কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে সম্পদের ইনসাফপূর্ণ বন্টন ও ব্যবহার এবং প্রকৃত আন্তরিক প্রয়াস। উপরন্তু ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্যে চাই ইসলামী আইন ও সমাজ ব্যবস্থা। এই সমাজে মানুষ যা উপার্জন করবে তা অবশ্যই বৈধ পন্থায় হবে-একথা স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অবৈধ উপায়ে আয়ের তথা ভোগ বন্টনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। প্রত্যেকেই যা হালাল তা অর্জনের জন্যে যেমন সচেষ্ট থাকবে তেমনি যা হারাম তা বর্জনের জন্যেও সর্বাত্মক প্রয়াস চালাবে।
কাজে ফাঁকি দেওয়া, পণ্যে ভেজাল দেওয়া, ওজনে কম দেওয়া, অন্যের জমি ও সম্পদ জবরদখল করা চোরাচালান মজুতদারী মুনাফাখোরী কালোবাজারী দামে হেরফের করা কর ফাঁকিত দেওয়া, মাদক দ্রব্যের ব্যবসা, টেন্ডার ছিনতাই, ঘুষ ও চাঁদাবাজি প্রভৃতি সকল ধরনের অসাধুতার পথ ইসলামে সকলের জন্যেই চিরতরে বন্ধ। কিন্তু মানুষ যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে দুর্বল, শয়তানের প্ররোচনা নিরন্তন তাকে হাতছানি দেয়, তাড়া করে বেড়ায় তাই অসৎ ও অবৈধ উপায়ে আয়ের প্রবণতা তার মধ্যে থাকতে পারে। এই অবস্থা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করার জন্যেই রাসূলে করীম (স) ও তাঁর পরবর্তী যুগেও হিসবাহ ও হিজর নামে দুটি প্রতিষ্ঠান কার্যকর ছিল। প্রতিষ্ঠান দুটির দায়িত্বই ছিল উপরে উল্লেখিত অসৎ কাজ হতে সমাজের লোকদের বিশেষতঃ ব্যবসায়ীদের নিরস্ত্র রাখা এবং প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থা করা। প্রতিষ্ঠান দুটির এতদূর ক্ষমতা ছিল যে, তারা আধ ও দুর্বিনীত ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারতো।
বেহুদা ব্যয় বা অপব্যয়, বিলাস-ব্যসনেও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ। তাই সৎ বা বৈধভাবে অর্জিত অর্থও বেহুদা ব্যয় করা নিষেধ। বেহুদা খরচ সম্পর্কে মহান খুলাফায়ে রাশিদুন (রা) েএতদূর সতর্ক ছিলেন যে, মিষরের গভর্ণর তার সরকারী বাসভবনের প্রাচীর তৈরী করালে তা ভেঙ্গে ফেলার জন্যে লোক পাঠানো হয় এবং গভর্ণরকে পদচ্যূত করা হয়। সরকারী কর্মকর্তাদের মিতব্যয়ী হতে বলা হতো, তাদেরকে কলমের নিব সরু করে নিতে এবং কাগজের মার্জিনেও লিখতে পরামরশ দেওয়া হতো। এ থেকেই বোঝা যায় তাঁরা কি অপরিসীম নিষ্ঠার সাথে বেহুদা ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাতেন। অথচ আজকের সমাজে নানা সামাজিক অনুষ্ঠাননে যে অর্থ অপচ্যয় হয় তা দিয়ে কয়েকটা পরিবারের সারা মাসের খরচ নির্বাহ হতে পারে।
যে কোন সমাজে আয় ও সম্পদে বন্টনে বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সুদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশে যে সমাজে, যে অর্থনীতিতে একবার সুদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সে অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে গেছে, সে সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে। ধনী-গরীবের পার্থক্য হয়েছে বিপুল আর নির্যাতিত বঞ্চিত মানুষের আহাজারিতে ভরে গেছে আকাশ, বাতাস, জনপদ। সুদের বিদ্যমানতার ফলে অর্থনীতিতে যেসব প্রত্যক্ষ কুফল লক্ষ্য করা গেছে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যাবে সুধঃ অর্থনৈতিক কুফল ও উচ্ছেদের উপায় শীর্ষক প্রবন্ধ হতে।
ঐসব কুফলের জন্যেই ইসলামে সুদকে এত কঠোরভাবে হারাস বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং রাসূলে করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর হতেই সুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে গেছেন। বিদায় হজ্বের অমর বাণীতেও তিনি এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁরই চেষ্টায় প্রথমে মদীনা হতে ও পরবর্তকিালে সমগ্র ইসলামী বিশ্ব হতে সুদ নির্মুল হয়ে যায়। সুদের ভয়াবহ পরিণাম ও আখিরাতে তার শাস্তি সম্পর্কেও তিনি উল্লেখ করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইসলামী হুকুমাতের পতন দশা শুরু হওয়ার পর যখন খৃস্টান শাসকগোষ্ঠী তথা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যলিপ্সু শক্তি একের পর এক মুসলিম দেশে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করে তখন তাদের সহযোগিতায় ও তাদেরই তৈরি আইনের আওতায় সুদভিত্তিক লেনদেন শুরু হয়ে যায়। অবশ্য বিলম্বে হলেও সুদনির্ভর অর্থনীতির দেশে এর মারাত্মক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কুফল সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি শুরু হয়েছে।
ধনবন্টনে সাম্য স্থাপনের ক্ষেত্রে ইসলামী মীরাস বা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বাঁটোয়ারা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। ইসলাম-পূর্ব যুগে বিশ্বে সম্পদ বন্টনের কোন বৈজ্ঞানিক ও স্বাভাবিক পন্থা বিদ্যমান ছিল না। ইসলামের সর্ব প্রথম মৃতের সম্পদ তার আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে একদিকে যেমন তাদের তাৎক্ষণিক অসহায় অবস্থা দুল করতে সমর্থ হয়েছে তেমনি অন্যদিকে ব্যক্তিবিশেষের হাতে সকল সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার বিপদও দূর করেছে। উপরন্তু সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। কিভাবে ও কাদের মধ্যে স্থাপর-অস্থাবর সম্পদ বাঁটোয়ারা হবে সে বিষয়ে সূরা আন-নিসায় ব্যাপক ও বিস্তৃত নির্দেশনা রয়েছে। এত ব্যাপক ও বিস্তৃত নির্দেশ আর কোন ধর্ম বা ইজমে নেই।
পসঙ্গতঃ যুক্তি হিসাবে বলা যেতে পারে সম্পদের অধিকতর সুষ্ঠু বন্টনের জন্যে মৃতের সম্পত্তি সর্বহারাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যেত অথবা নির্দেশ দেওয়া যেত রাষ্ট্রয়াত্তব করে নেওয়ার। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের নিকট আত্মীয়দের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনায় স্বীয় জীবদ্দশাতে সব সম্পদ ব্যয় করার চেষ্টা করতো। তার ফলে সমাজে দেখা দিত আরও বেশী বিশৃংখলা। পক্ষান্তরে মৃতের সম্পত্তি তার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও নিকট আত্মীয়েরা লাভ করায় সম্পদের বন্টন যেমন সার্থক ও অর্থবহ হয় তেমনি তারাও রাতারাতি সর্বহারাদের কাতারে গিয়ে শামিল হওয়া থেকে বেঁচে যায়।
এখানে উল্লেখ করা আদৌ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আমাদের দেশে বেআইনী বা জবরদস্তিমূলক স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল করা বর্তমানে একটা রেওয়াজ বা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের জমি, ইয়াতীম ও নাবালকদের সম্পত্তি, এমন কি প্রতিবেশীর জমি-বাগান-দালান ছাড়াও শত্রু সম্পত্তি কিংবা সরকারী সম্পত্তি (খাস জমিসহ), বাড়ীঘর, প্রতিষ্ঠান জবর দখল করে, কিংবা জাল/ভূয়া দলির করে এক শ্রেণীর মানুষ রাতারাতি বিত্তশালী (এবং একই সাথে প্রতিপত্তিশালী) হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে। এদের যেন কেউ রুখবার নেই। আইন এদের কাছে বড়ই অসহায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে ইসলামের দোহাই পেড়ে বা রাষ্ট্রধর্মের বরাত দিয়ে দেশে শ্রেণী বৈষম্য দূর করা কখনই সম্ভব হবে না। বরং বৈষম্যই শুধু বাড়বে না, সেই সঙ্গে বাড়বে নির্যাতন, নিপীড়ন, যার পরিণাম কোটি বনি আদমে বেদনাক্লিষ্ট ও হতাশাপূর্ণ জীবন।
৫.
যাকাত আদায় এবং তার যথোচিত ব্যবহার সম্পদের সুবিচারপূর্ণ বন্টনের ক্ষেত্রে আর একটি বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে বন্টিত ও ব্যবহৃত হয় যাদের প্রকৃতই বিত্তহীন শ্রেণীভুক্ত বা Have-notes বলা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে গরীব, মিসকীন, ঋণগ্রস্ত, মুসাফির, ক্রীতদাস এবং ক্ষেত্রবিশেষে নও মুসলিম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কয়েকটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ মুসলিম দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় এবং তা বিলি-বন্টনের ব্যবস্থা নেই। যাকাত আদায় এখন ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা পরবর্তী যুগেও বায়তুল মালের যাকাত অংশ পরিচালনার জন্যে আটটা দপ্তর বা Directorate ছিল। রাষ্ট্রের কঠোর ও নিপুণ ব্যবস্থা ছিল যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও তা উপযুক্ত উপায়ে বন্টনের জন্যে। সেজন্যেই গোটা জাযিরাতুল আরবে যাকাত নেবার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না সে সময়ে। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হলো সেদিনের আরবে দরিদ্র শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটেছিল।
ইসলামী হুকুমাত তথা ইসলামী অর্থনীতিতে উশরের মাধ্যমেও সম্পদ বন্টনের ব্যবস্থা চালু ছিল। পদ্ধতি হিসাবে এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বিজ্ঞানসম্মতও। যে জমিতেসেচ না দিয়ে ফসল উৎপন্ন করা যায় সেই জমির এক-দশমাংশ বা ১০% এবং জে জমিতে সেচ দিয়েসফল উৎপাদন করতে হয় সেই ফসলের এক-বিংশতি অংশ বা ৫% উশর হিসেবে প্রদানের শরীয় বিধান রয়েছে। জমির মালিক হয তা সরাসরি যারা যাকাতের হকদার তাদের মধ্যে বিলিবন্টন করে দেবে অথবা বায়তুল মালে জমা করে দেবে। সেই ব্যবস্থার ফলে সম্পদের, বিশেষতঃ কৃষি পণ্যের/আয়ের সুষ্টু বন্টন নিশ্চিত হতো।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এদেশে বিদ্যমান বর্গাদারী প্রথার কুফল সম্বন্ধে দু’একটি কথা উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এদেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বর্গাদারী প্রথা। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ মহাজনী ঋণ ও ব্যাংকের সুদ। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায় এদেশে ১৯৬০ সালে যেখানে ভূমিহীনদের সংখ্যা ছিল ১৭%, ১৯৭৩-৭৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.৬% েএ। ১৯৮৭-৮৮ সালে এই পরিমাণ ছিল ৫০% এরও বেশী। বাংলাদেশে প্রায় ৩৯% পরিবার কোন-না-কোন শর্তে বর্গাচাষ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যদিও ফসলের হিসাবে বর্গাদাররা অর্ধেক পায় প্রকৃতপক্ষে টাকার হিসাবে (খরচসহ) সহ তারা এক-চতুর্থাংশের বেশী পায় না। উপরন্তু তাদের নিজস্ব শ্রমের মুল্য যদি ধরা হয় তাহলে তাদের প্রকৃত আয় অনেক ক্ষেত্রেই ঋণাত্বক হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় বর্গাদাররা কোন দিনও নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখতে পারে না।
৬.
ইসলামী অর্থনীতি সমাজ ব্যবস্থা তথা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থারই অন্তর্ভুক্ত। ফলে ইসলামী অর্থনতির রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে অবশ্যই প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নেতিবাচক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে কখনও ধনবন্টনে সাম্য আসে না, আসতে পারে না। ইসলামী সোনালী দিনেও মহান খলীফারা কঠোরভাবে তদারক করতেন ইসলামী বিধি-বিধানসমূহ যথাযথ প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা। প্রকৃত অর্থেই তাঁরা আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন।
আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্য অর্জনের জন্যে ইসলামে সম্পদ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনারও বিধান রয়েছে। যে সমস্ত সম্পদের সামাজিক মালিকানা থাকলে তার ব্যবহার সর্বোত্তম হবে এবং সমাজের সকল শ্রেণীর লোকই তা থেকে সুবিধা বা উপকার পাবে সে সকল উপায়-উপকরণই রাষ্ট্রের জিম্মাদারীতে থাকতে পারে। ব্যক্তিবিশেষ ভুলভাবে এসবের মালিক হয়ে গেলেও রাষ্ট্র তা নিজের জিম্মাদারীতে ফিরিয়ে নিতে পারে। অনুরূপভাবে আবাদী জমি ইচ্ছাকৃত ভাবে পতিত রেখে জাতীয় উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটালে রাষ্ট্র তাও বরদাশত করবে না। কেননা এর ফলে সমাজে খাদ্য সংকট ও কর্মসংস্থানের অভাব ঘটবে। এই দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইসলামের মহান খলীফারা (রা) প্রকৃত চাষীদের মধ্যে প্রচুর আবাযোগ্য অব্যবহৃত জমি বিলি কর দেন। তাছাড়া স্থায়ী সামজিক মূলধন উন্নয়নের মাধ্যমেম অর্থাৎ শিক্ষা স্বাস্থ্য যাতায়া গৃহায়ন প্রভৃতি সবিধার সম্প্রসারণ ও নিশ্চয়তা বিধান করেও ধনবন্টনে অধিকতর সাম্য নিশ্চিত করা সম্ভব। মহান খলীফা রা এবং মুসলিম শাসকগণ তা করেছেনও। এভাবেই ইসলামী শাসন ব্যবস্থার স্বর্ণযুগে আয় ও সম্পদের সঞ্চালন এবং বন্টন সুনিশ্চিত হয়েছে, দারিদ্র দূর হয়েছে সমাজ হতে। পরিণামে একটি কালজয়ী সমৃদ্ধ সভ্যতা হিসাবে ইসলাম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে।
মৌলিক চাহিদা পূরণ সমাজে ভারসাম্যপূর্ণ আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্য অর্জনের অন্যতম উপায়। মৌলিক কপ্রয়োজন পূরণের পথ ধরেই সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিশেষতঃ দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে সম্পদ আবর্তিত হতে শুরু করে। ফলে চাহিদা বৃদ্ধি- উৎাদন ও যোগান বৃদ্ধি- কর্মসংস্থান বৃদ্ধি- আয় বৃদ্ধি পুনরায় চাহিদা বৃদ্ধি িএকটি কাংখিত চক্র আবর্তিত হতে শুরু করে। পরিণামে অর্থনীতিতে েএকটি স্থিতিশীল তেজীভাব সৃষ্টি হয়। এ কারণেই ইসলাম জনগণের প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণের গ্যারান্টির বিষয়টি সরকারের জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। জনগণের প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যে সরকারী তহবিল হতে ব্যয় সংকুলান না হলে যাকাত উশর ও বর্ধিত কর সংগ্রহ ছাড়াও সম্পদশালীদের নিকট হতে বাধ্যতামুলক অর্থ সংগ্রহের এখতিয়ার সরকারের রয়েছে। এভাবেই ধনীদের সম্পদ দরিদ্রদের ন্যূনতম মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণে ব্যবহৃত হয়ে ধনবন্টনে ভারসাম্য অর্জিত হতে পারে।
উপরন্তু দরিদ্র শ্রেণীর আয়েল নিরাপত্তা ও ক্রয় ক্ষমতার নিশ্চয়তা বিধানের স্বার্থে সরকারকে মজুরী ও দ্রব্যমূল্যও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সমাজে বিরাজমান ধনবৈষম্য হ্রাসের জন্যে সরকারের আর্থিক ও রাজস্ব নীতিমালাও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং, এই নীতিমালা দরিদ্র্রদের কল্যাণেরর স্বার্থেই প্রণীত হওয়া উচিৎ। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, সরকারের গৃহীত নীতিমালার সুবিধা ও প্রাপ্তির পাল্লা সাধারণতঃ বিত্তবানদের দিকেই ঝুঁকে থাকে। এছাড়া ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী ও পারিষদবর্গ এবং উচ্চপদস্থ আমলারা সরকারী অর্থের সিংহভাগ ব্যয় করে থাকে নিজেদের আরাম-আয়েসে, বিলাস-ব্যসনে। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্যে মৌখিক প্রতিশ্রুতি ও কাগুজে পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই বাস্তবে লক্ষ্য করা যায় না। অথচ ইসলামী নীতি অনুসারে রাষ্ট্রীয় সম্পদে কারোরই, এমনকি রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানেরও অন্যের চেয়ে বেশী অধিকার ভোগের সুযোগ নেই। বরং খলীফা উমার (রা)-এর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী দূর পর্বতবাসী মেষ পালককেও রাষ্ট্রীয় সম্পদ হতে তার ন্যায্য অংশ আদায় করে দেওয়ার নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব সরকারেরই।
৭.
যে-কোন সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের করণীয় কি সে বিষয়ে ইসলামী অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তার পরেও কথা থেকে যায়। ইসলামের গৌলবোজ্জল দিনগুলোতে মুসলিম সমাজে তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ মুদারাবা মুশারাকা মুরাবাহা বায়-ই-মুয়াজ্জল বায়-ই-সালাম শিরকাত আল-মিলক ইজারা বিল-বায়ই ইত্যাদি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব পদ্ধতিতে মুসলিম সমাজে বিত্তশারী ও বিত্তহীন কিন্তু কর্মদক্ষ মানুষ, অল্পবিত্ত ও অধিক বিত্তের মানুষ যৌথভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, যে কোন নতুন কর্মদ্যোগে অংশ নিতে পারে। দুঃখের বিষয়, সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর হতে মুনাফাভিত্তিক এবং লাভ-লোকসানের অংশীদারীভিত্তিক কর্মসংস্থানের ও বিনিয়োগের পথ মুসলিম দেশগুলোতে ক্রমাবলুপ্ত হয়েছে। অথচ নবীমুস্তাফার (স) যামানা হতেই মুদারাবা মুশারাকা মুরাবাহা বায়-ই-মুয়াজ্জল বায়-ই-সালাম ইত্যাদি পদ্ধতিতে সমাজের বিত্তশালী বা ধনবান ব্যক্তিরা যারা কম বিত্তশালী বা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক যোগ্যতা রাখে তাদের সাথে একত্রে উৎপাদনমুখী ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অংশীদার হতেন। এছাড়াও বহুক্ষেত্রে করযে হাসানার মাধ্যমেও ব্যক্তিবিশেষের জরুরী প্রয়োজন পূরণের সুযোগ ইসলামী সমাজে বিদ্যমান ছিল। সেই করযে হাসানার নামই এখন অনেক মুসলমানের অজানা।
এই অবস্থা নিরসনের জন্যে তথা সুদভিত্তিক ঋণেল বিকল্প ব্যবস্থা চালু করে সমাজে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের মাধ্যমে আয় ও সম্পদের সুচারু বন্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের অনেকগুলো মুসলিম দেশে সাম্প্রতিককালে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিং পদ্ধতি চালু হয়েছে। বাংলাদেশ তার অন্যতম। এদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু হয় এবং জনগণের কাছ থেকে আশাতীত সাড়া পায়। বিগত বছরগুলোতে এই ব্যাংকিং পদ্ধতি বাংলাদেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে। পৃথিভীর যেসব দেশে ইসলামী ব্যাংক ও বিনিয়েঅগ সংস্থঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেসব দেশে এই পদ্ধতিতে কর্মসংস্থঞান, উৎপাদন ও বিনিয়োগ যে জনসাধারণেল মধ্যে বিপুল সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছে তা বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিককালে বার্ষিক রিপোর্টসমূহ হতে জানা যায়। উদাহরণস্বরূপ মিশরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী এই মুসলিম দেশটির ইসলামী ব্যাংকগুলো একত্রে সেদেশের মোট বিনিয়োগ ও বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের এক-চতুর্থাংশ বা ২৫% নিয়ন্ত্রণ করছে। সুদের অভিশাপ মুক্ত হয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র সাধ্য ও সামর্থ্যকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজে লাগাবার জন্যে অধুনা ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিং পদ্ধতি যে সুযোগ করে দিয়েছে তার ফলে সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনে একটি লক্ষ্যণীয় সুপ্রভাত অনুভব করা যাচ্ছে।
৮.
ইসলামী অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদ বন্টনে ভারসাম্য অর্জনের জন্যে যে সব উপায় বা পদধতি আলোচিত হলো সে সব বাস্তবায়নের জন্যে যুগপৎ ব্যক্তি ও সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাসহ তৎপর হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়েই উপার্জন ও সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হতে পারে; আয় ও কর্মসংস্থানের পথ সকলের জন্যে উন্মুক্ত হতে পারে। এর ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা দূর হয়ে একটি সমৃদ্ধ, গতিশীল ও সুস্থ অর্থনীতি বিনির্মাণের পথ সুগম হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠানসমহের ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস বাদ দিলে আজকের মুসলিম বিশ্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পর্যন্ত আলোচিত উপায়সমূহের কোন একটিও পুরোপুরি অনুসৃত হচ্ছে না। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে প্রকট বৈষম্য বিদ্যমান। এই অবস্থা নিরসনের জন্যে আমাদের অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করতে হবে শাশ্বত সুন্দর ও স্থায়ী সমাধানকারী ইসলামের দিকেই। ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের সত্যিকার শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের সেটাই প্রকৃষ্ট উপায়।