ইসলামী ভোক্তার স্বরূপ
১. ইসলামী ভোক্তা কে?
“আমি তাদের পরে তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্থলাভিষিক্ত করেছি, তোমরা কি প্রকার আচরণ কর তা পরীক্ষা করার জন্যে।” (সূরা ইউনুস: ১৪ আয়াত)
এই আয়াতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পূর্ববর্তী জাতিসমূহকে ধ্বংস করে আর একটি জাতিকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন মূলতঃ তাদের আচরণ পরীক্ষা করার জন্যে, আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালনের দায়বদ্ধতা পরীক্ষা করার জন্যে।
মানুষের পার্থিব জীবনে যত ধরনের আচরণ রয়েছে ভোগের ক্ষেত্রে আচরণ সেসবের মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেককেই কিছু না কিছু ভোগ করতেই হয় তার জীবন যাপনের জন্যে। আবার তার পরিবার পরিজন রয়েছে, রয়েছে আত্মীয়-স্বজন। তাদের প্রতিও তার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সব মিলিয়ে তার সামষ্টিক ভোগের পরিধি বেশ বড়ই। এক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়াহর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে, রয়েছে শরীয়াহর আহকাম। সেসব মেনে চলাও একজন মুমিনের জন্যে মৌলিক পরীক্ষা।
ভোগ হয় রিযিক বা সাধারণ অর্থ খাদ্যবস্তু, কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র ইত্যাদি ব্যয় ও ব্যবহারের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিধি-বিধান মেনে চলার জন্যে জোর তাগিদ রয়েছে ইসলামী শরীয়াহতে। রাসূলে কারীম (স) বলেছেন- “হালাল রুজী ঈমানের দশ ভাগের নয় ভাগ।”
আরেক হাদীসে বলা হয়েছে –“আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়অ কবুলের অন্যতম শর্ত হালাল রুজীর উপর বহাল থাকা।” (মুসলিম)
একজন মুমিন ভোক্তা সম্পূর্ণ সচেতনভাবে সব সময় শুধুমাত্র হালাল দ্রব্য ও সেবা ভোগ করবে এবং হারাম দ্রব্য ও সেবা বর্জন করবে। ইসলামী পরিভাষার আলোকে ঐসব দ্রব্যকে হালাল দ্রব্য বরা হয় যার নৈতিক ও আদর্শগত গুণাগুণ থাকে, যেগুলোর ভোগ উপকার ও কল্যাণই বয়ে আনে। আজকের দিনে মুসলমানরনা সাধারণভাবে হালাল রুজী বা রিযিকের তথা ভোগের উৎসের ব্যাপারে কতখানি মনোযোগী বা সতর্ক সে প্রশ্নে না গিয়ে সাহাবায়ে কিরাম এবং ইমামরা কেমন আমল করতন, কতটা সতর্ক ছিলেন এ ব্যাপারে তার দু’ একটা উদাহরণ আমাদের চোখে খুলে দিতে পারে।
সিদ্দীকে আকবর আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁকে একজন খাদেম দেওয়া হয়েছিলো রাষ্ট্রের পক্ষ হতে তার ব্যক্তিগত কাজে সহায়তার জন্যে। এই খাদেমের অন্যতম দায়িত্ব ছিলো খলীফার খাবারের প্রতি মনোযোগ রাখা ও তা পরিবেশন করা। খলীফারও অভ্যাস ছিলো খাবার সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে তারপর খাওয়া। একদিন খাবারের শুরুতে খাদেমকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলেন সেদিনের খাবার কোথা হতে কিভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে তিনি যখন খাদেমকে জিজ্ঞাসা করলেন তখন সে জবাবে জানালো আজকের খাবারে উৎকৃষ্ট মধু ও দুধ রয়েছে। এগুলো তাকে দিয়েছে এক গোত্রের লোকেরা। কারণ হিসেবে জানালো সে যখন কাফির ছিলো তখন যাদুমন্ত্র জানতো। তাতে অনেকের উপকারও হতো। এই গোত্রের লোকেরা তার কুফরী কালের যাদুমন্ত্রে উপকৃত হয়েছিলো। তাদের সাথে আজ হঠাৎ দেখা হওয়ায় তারা কৃতজ্ঞতাবশতঃ উৎকৃষ্ট মধু ও উটের দুধ দিয়েছে উপঢৌকন হিসেবে। সেটাই সে খলীফার আজকের খাবার প্রস্তুতের কাজে লাগিয়েছে।
একথা শুনে খলীফা খুব রাগতস্বরে বললেন, তুমি তো আমাকে বরবাদ করে দিয়েছ। এরপর গলার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে তিনি বমি করতে চেষ্টা করলেন এবং এক সময়ে তিনি গলা থেকে রক্ত বের করে ফেললেন। এই সংবাদ হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) কাছে পৌঁছালে তিনি দেখতে এলেন আমীরুল মুমিনীনকে। সব শুনে তিনি বললেন, সন্দেহজনক খাদ্য বমি করে ফেলে দিয়েছেন সেটা ভালোই হয়েছে। কিন্তু রক্ত বের করার মতো ক্লেশ তিনি না করলেই পারতেন। তার উত্তরে হযরত আবু বকর (রা) জবাব দিয়েছিলেন “উমার তুমি কি শোন নি রাসুলে আকরাম (সা) বলেছেন হারাম খাদ্যবস্তু হতে শরীরে যে রক্ত-গোশত পয়দা হয় তা দোযখের আগুনের খোরাক।” এরপর হযরত উমার নিরুত্তর হয়ে গেলেন।
ইমামে আযম হযরত আবু হানীফঅ (রহ) একজন বড় মাপের বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। একদিন তিনি তাঁর দোকানের কর্মচারীদের একটা কাপড় দেখিয়ে বললেন সেটাতে একটা খুঁত রয়েছে। বিক্রির সময়ে সেটা নেয অবশ্যই ক্রেতাকে দেখানো হয়। দিনশেষে হিসাব নেয়ার সময়ে তিনি কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলেন ঐ খুঁতযুক্ত কাপড়টিও বিক্রি হয়ে গেছে কিনা। তারা হাঁ সূচক উত্তর দিলো। তিনি জানতে চাইলেন তারা খুঁতটার কথা উল্লেখ করেছিলো কি না? তারা নিরুত্তর রইলো। হযরত আবু হানীফঅ (রহ) সেদিনের বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ দানি করে দিলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন- খুঁতযুক্ত কাপড়টার জন্যে যে উচিৎমূল্য আদায় করা হয়েছে সেই দিরহাম কোনগুলো? যেহেতু সেগুলো চিহ্নিত করার সুযোগ নেই তাই সন্দেহযুক্ত আয় পারিবারিক কাজে লাগিয়ে তিনি ঈমান ও আমল বরবাদ করতে চাননি। সত্যিকার ইসলামী ভোক্তার স্বরূপ তো এটাই। আমাদের দেমের মুসলমান ব্যবসায়ীদের কতজন এই ঘটনা জানেন?
গভীর পরিতাপ ও দুঃখের বিষয়, ইসলামী মূল্যবোধ বিবর্জিত ভোগলিপ্সা আজ মুসলমানদের চরম দুনিয়ামুখী করে তুলেছে। আখিরাতের চাইতে দুনিয়াতে আঁকড়ে ধরার অশুভ প্রবণতা তার ঈমানের শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছে। তাই একদা যে বিশ্ব তার বশীভুত ছিল আজ সেই-ই বিশ্বের বশীভূত হয়ে পড়েছে। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। সেজন্যেই চাই সচেতন ও সক্রিয় উদ্যোগ। ইসলামী অর্থনীতি তথা একজন মুসলমানের অর্থনৈতক জীবনাচরণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন ছাড়া তা অসম্ভব।
ইসলামের দাবী হলো প্রকৃত মুসলমান সচেতনভাবেই তার সকল আচরণের দ্বারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করবে। এজন্যে আপাতঃ বা বাহ্যিক দৃষ্টিতে ক্ষতি মনে হলেও সেতা হৃষ্টচিত্তে মেনে নেবে। সে হালাল রিযিক অর্জনের জন্যে যেমন সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে তেমনি হারাম বর্জনের জন্যেও তার মধ্যে বিরাজ করবে জিহাদী জযবা। দুনিয়ার এই নশ্বর জীবনে ক্ষণিকের সুখভোগের জন্যে সে কোনক্রমেই অনন্ত আখিরাতের জীবনকে বরবাদ করবে না। েএকমাত্র মরদুদ শয়তানের কুহকে পড়লেই সে এটা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, একজন মুসলমানের তথা ইসলামী ভোক্তার আচরণ তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাস দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে। এর কোনো ব্যত্যয় হলে তওবা করে তা থেকে ফিরে না আসলে কঠিন শাস্তিময় দোযখ তার জন্যে অপেক্ষা করছে।
২. ইসলামী ভোক্তার বৈশিষ্ট্য
বস্তুতঃ একজন ইসলামী ভোক্তার প্রধান ও মূল বৈশিষ্ট্য হলো তার ভোগসম্পর্কিত আচরণের মাধ্যমে সব সময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা চালানো। অন্যভাবে দেখলে ভোগ আচরণকে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটা পন্থা হিসেবে গণ্য করে। তার এই লক্ষ্য অর্জনে ভোগ আচরণ ইসলামী যুক্তিশীলতা (rationalism) দ্বারা পরিচালিত ইসলামী শরীয়াহ দ্বারা নির্দেশিত। অপরপক্ষে একজন অমুসলমান বা পুঁজিবাদী ভোক্তার আচরণ অর্থনৈতিক যুক্তিশীলতা দ্বারা পরিচালিত, যা তার নিজ স্বার্থের দ্বারাই প্রভাবান্বিত। প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ মনযের কা’ফ ভোক্তার আচরণ বিশ্লেষণে ভোক্তার ইসলামী মূল্যবোদকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন। যথা:
(১) শেষ বিচারের দিনের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস;
(২) ইসলামী সাফল্যের উপর বিশ্বাস; এবং
(৩) ইসলামী ধন-সম্পতের প্রতি বিশ্বাস।
শেষ বিচারের দিনের তথা আখিরাতের প্রতি একজন ভোক্তা যখন পূর্ণ বিশ্বাস রাখে অর্থাৎ পরকালের অনন্ত শান্তি ও পুরষ্কার প্রাপ্তি অথবা ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে তখন তার আর শরীয়াহর নির্দেশ লঙ্ঘন করার সুযোগ থাকে না। ইসলামী সাফল্যের উপর বিশ্বাসের অর্থ হলো ইসলামী সাফল্য অর্জিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে, নিছক ধন-সম্পদ অর্জনের মধ্য দিয়ে নয়। তাই ইসলামী ভোক্তার মূল লক্ষ্যই থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াস। ইসলামী ধন-সম্পদের প্রতি বিশ্বাসের অর্থ হলো ইসলামের ধন-সম্পদের সুনির্দিষ্ট পৃথক কিছু তাৎপর্য রয়েছে। এক হাদীসেই তার উল্লেখ রয়েছ। রাসূল (স) বলেন-
“তুমি যা খাও তা নিঃশেষ করে ফেলো, যে পোশাক পরো তা ব্যবহার কর ফরিয়ে ফেলো, আর যা দান করো তা তোমার পরকালের জন্যে সঞ্চয়। এছাড়া তুমি প্রকৃতপক্ষে আর কোন ধন-সম্পদের অধিকারী নও।” (মুসলিম)
একজন ইসলামী ভোক্তার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো সে তার মোট ব্যয়কে দুই অংশে ভাগ করে- পার্থিব ব্যয় ও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়। পার্থিব ব্যয় বলতে নিজের ও পরিবার-পরিজনদের জন্যে ব্যয়কে বোঝানো হয়েছে। অপরদিকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় বলতে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে ব্যয় এবং গরীব-মিসকীন অসহায় ও দুঃস্থজনদের জন্যে ব্যয়কে বুঝানো হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে বিত্তশালীদের ধন সম্পদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গরীব-দুঃখীদের হক বা অধিকার নিশ্চিত কর দিয়েছেন। তিনি বলেন-
“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)।
আল-কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে- “আত্মীয়-স্বজনদের তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত মুসাফিরকেও।” (সরা বনি ইসরাঈল: ২৬ আয়াত)
ইসলামী ভোক্তার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো সে সম্পদ মজুদ করে না। তাকে সংসারির ব্যয় নির্বাহের জন্যে অবশ্যেই উপার্জন করতে হবে এবং আপৎকালীন খরচ মেটাবার জন্যে তাকে সঞ্চয়ও করতে হবে। এই সঞ্চয় তাকে উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগও করতে হবে। কারণ বিনিয়োগে ব্যর্থ হলে সঞ্চিত অর্থের যাকাত আদায় করতে গিয়ে তার সঞ্চয় নিসাব এর নিচে চলে আসতে পারে।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের শুরুতেই মুমিন হওয়ার যে শর্তাবলী আল্লাহ উল্লেখ করেছেন সেখানেও আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক হতে তারই ব্যয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (দ্রষ্টব্য: সূরা আল-বাকারাহ: ৩ আয়াত।) ইনফাক ফি সাবিল আল্লাহর মোট ব্যয়ের ঐ অংশকে বোঝায় যা একজন ভোক্তা কোনও প্রকার পার্থিব সুবিধা বা প্রতিদানের আশা না করেই আল্লাহর পথে ব্যয় করে শুধুমাত্র তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে। অবশ্য এজন্য সে আখিরাতে পুরস্কৃত হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ স্বয়ং আল-কুরআনে বলেছেন, তারা আল্লাহ প্রেমে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীদের আহার্য দান করে। তারা বলে:
“কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।” (সরা আদ দাহর: ৮-৯ আয়াত)
একজন ইসলামী যুক্তিশীল ব্যক্তি চিন্তা করবে তার নিকট যা কিছু রয়েছে তা সবই আল্লাহর দান বা আমানত। যদি সমস্ত ধন-সম্পদ তাঁর প্রতি ব্যয় করা হয় তবেই মাত্র তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের হক আদায় হবে। যাকাত সাদাকাহ ফিতরা ইত্যাদির বাইরে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে স্বেচ্ছাধীন দানই ইনফাক ফি সাবিল আল্লাহ বলে বিবেচিত।
এর বিপরীতে একজন অমুসলিম ভোক্তার লক্ষ্য হচ্ছে: “Eat, Drink and be merry”। অর্থাৎ, খাও-দাও পান করো আর ফূর্তি করো। কারণ তার বোধ-বিশ্বাসে পরকালীন জীবনের জবাবদিহিতার প্রসঙ্গই নেই। নম্বর এই জীবনে সে বোগ করবে চূড়ান্ত বাবে এবং সেখানে হালাল-হারাম বা বৈধ-অবৈধতার প্রশ্ন নেই। ভারতীয় জীবন দর্শমেনর সাথে পাশ্চাত্যের এই জীবন দর্শনের খুব একটা অমিল নেই। সেখানেও জীবনকে আকণ্ঠ ভোগ করতে বলা হয়েছে। এমনকি ঋণ করে হলেও। ভারতীয় দার্শনিক চার্বাক বলেন-
“যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ
ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেং।”
অর্থাৎ, যতদিন বাঁচো, সুখেই বাঁচো, আর ঋণ করে হলেও ঘি খাও।
একজন ইসলামী ভোক্তার চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো ভোগের ক্ষেত্রে অবশ্যই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে। তার আচরণ কৃপণের মতোও হবে না, আবার সে অমিতব্যয়ীও হবে না। আল্লাহ নিজেই এ সম্বন্ধে বলেন- “তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না, এবং তাদের পনথা হয় এ দুয়েল মধ্যবর্তী।” (সূরা আল-ফুরকান: ৬৭ আয়াত)। উপরন্তু ইসলামী ভোক্তা অপব্যয়কারীও হবে না। কারণ আল্লাহ অপব্যয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। (দ্রষ্টব্য: সূরা বনি ইসরাঈল: ২৭ আয়াত)
ইসলামী অর্থনীতিতে কঠোর কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন কিংবা লাগামহীন ভোগের কোন সুযোগ নেই। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
৩. ইসলামের দৃষ্টিতে অভাব ও প্রয়োজন
সনাতন অর্থাৎ অনৈসলামী ভোক্তার আচরণে ধরে নেওয়া হয় মানুষের অবাব অসীম এবং সকল ভোক্তাই তাদের সকল অবাব মেটাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। অভাবই ভোক্তার আচরণের প্রেরণা বা শক্তি যোগায়। এটা আবার উপযোগের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কোনো দ্রব্যের উপযোগ থাকলে মানুষতা ভোগ বা অর্জন করার চেষ্টা করে। ইসলামী অর্থনীতিতে কিন্তু অভাব ও উপযোগের এরকম ধারণা গ্রহণ করা হয়নি। এখানে প্রয়োজন অভাবেরএবং মাসলাহ উপযোগের স্থান দখল করেছে। প্রয়োজন ও অভাবের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো- প্রয়োজন সসীম কিন্তু অভাব অসীম। প্রয়োজন মাসলাহ দ্বারা নির্ধারিত আর অভাব উপযোগ দ্বারা নির্ধারিত। মাসলাহ শব্দটি আরবী। এর অর্থ কল্যাণ। কল্যঅণ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কল্যাণেল মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে পার্থিব ও আখিরাতের কল্যাণ।
ইমাম আল-শাতিবীর মতে এ মাসলাহই জীবনের অপরিহার্য মৌলিক উপাদানগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি মানুষের জীবনের অপরিহার্য পাঁচটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা:
১. আল-ঈমান (বিশ্বাস)(
২. আন-নফস (জীবন);
৩. আল-মাল (সম্পদ);
৪. আল-আকল (বুদ্ধিমত্তা) এবং
৫. আল-নসল (বংশধর)
যে সমস্ত দ্রব্য ও সেবার এই পাঁচটি মৌলিক উপাদান বিকাশের ক্ষমতা রয়েছে সেগুলোর মাসলাহ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই মাসলাহধর্মী দ্রব্য ও সেবাই ইসলামী অর্থনীতিতে প্রয়োজন হিসাবে চিহ্নিত।
একজন ভোক্তার কাছে কোন দ্রব্য বা সেবার মাসলাহা রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্যে সে নিজেই সর্বোত্তম বিচারক। উপযোগের সাথে এর পার্থক্য এই যে, একজন ভোক্তা কোন দ্রব্যের উপযোগ রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্যে যেসব মানদন্ডের প্রয়েঅজন তা সে নিজেই নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু মাসলাহ্র ক্ষেত্রে সেসব মানদন্ড বাছাইয়ের ক্ষমতা কোন ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এগুলো এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও স্থির। পক্ষান্তরে ব্যক্তির মাসলাহ সামাজিক মালাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উপরে মানব জীবনের যে পাঁচটি মৌলিক উপাদানের কথা বলা হয়েছে তা যেমন একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি তা গোটা সমাজের জন্যেও প্রযোজ্য।
সনাতন অর্থনীতিতে কোন দ্রব্যের উপযোগ অর্থাৎ পার্থিব কল্যাণ থাকলে ভোক্তারা তার অভাব অনুভব করে। পক্ষান্তরে কোনো দ্রব্যেল মাসলাহ অর্থাৎ পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ উভয়ই থাকলে একজন ইসলামী ভোক্তা তার প্রয়োজন অনুভব করে। ইমাম আল-শাতিবী ইসলামী শরীয়াহর পুংখানুপুংখু পর্যালোচনা করে প্রয়োজনকে তিন স্তরে ভাগ করেছেন। যথা-
(ক) যরুরয়াত বা অত্যাবশ্যকীয়;
(খ) হাজিয়াত বা পরিপূরক, এবং
(গ) তাহসানিয়াত বা উন্নতিমূলক।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজে যে বস্তুগুলো যরুরীয়াত বা অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত সেগুলো হলো-
১. জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার দাবী মেটানো;
২. সম্পত্তি সংরক্ষণ, সম্পদের অপচয়রোধ ও অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করা থেকে বিরত রাখা;
৩. যাবতীয় নেশার সামগ্রী এবং বিচার শক্তিকে কলুষিত করে এমন সব দ্রব্যের উৎপাদন, বন্টন ও ভোগ নিষিদ্ধকরণ;
৪. যাকাত আদায় ও বন্টনের ব্যবস্থা করা।
হাজিয়াতের মধ্যে ঐসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর সরবরাহ বা ব্যবনহার ব্যক্তি মানুষের জীবনকে কঠোরতা হতে কিছুটা আরাম বা স্বস্তির দিকে নিয়ে যায়। তাহসানিয়াত তার চেয়ে আরও এক ধাপ উপরে। এখানে যেসব দ্রব্যসামগ্রী ভোগ করা হয়, ব্যবহার করা হয় অথবা সেবা পাওয়া যায় তা জীবন-যাপনের গুণগত মান বৃদ্ধি করে। বিশেষতঃ পেশাদারী জীবন বা বিশেষজ্ঞদের জন্যে যা হাজিয়াত বলে বিবেচ্য সাধারণ লোকের জন্যে তাই-ই তাহসানিয়াত বলে বিবেচ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ এয়ারকুলার কোন গবেষণাগারের জন্য যরুরীয়াত, প্রতিষ্ঠানের জন্যে হাজিয়াত এবং বাসগৃহের জন্যে তাহসানিয়াত হিসেবেই গণ্য হবে।
মনে রাখা দরকার প্রকৃত ইসলামী ভোক্তার আচরণ ইসলামী জীবনেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আমাদের চরিত্রে ও বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন যত বেশী গটবে ততই আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হবো। হালাল রুজী উপার্জন ও মাসলাহ প্রাপ্তির মাধ্যমে আমাদের নশ্বর জীবনহোক কল্যাণময় এবং আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্তির মাধ্যমে হোক চরম সফলতাময়। এজন্যে আমাদের জীবন যাপনে তথা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রতিফলিত হতে হবে ইসলামী ভোক্তার সঠিক স্বরূপ।