ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা ও মূলনীতি
ইসলামী অর্থনীতি কি?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর রাসূল (স) প্রদত্ত জীবন বিধানই ইসলাম। যেহেতু ইসরাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান সেহেতু এর অনুসারীদের জন্যে রয়েছে ব্যক্তিজীবন, গোষ্ঠী জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও উপযুক্ত নীতিমালা। এর মধ্যে অন্তর্বুক্ত রয়েছে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইন ও বিচার প্রভৃতি। অর্থনীতি যে কোন জাতি বা রাষ্ট্রের জন্যে একটি অপরিহার্য প্রসঙ্গ। ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারীদের জন্যেও একথা সত্য। তাই ইসলামী অর্থনীতি বলতে ঐ অর্থনীতিকেই বোঝায় যার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, কর্মপদ্ধতি এবং পরিণাম ফল ইসলামী আকিদা মুতাবিকই নির্ধারিত হয়। এই অর্থনীতির মূলনীতি ও দিক-নির্দেশনা বিধৃত রয়েছে আল-কুরইান ও সুন্নাহতে।
ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি বা দর্শন
প্রত্যেক জাতি বা সমাজের একটি জীবন দর্শন থাকে। সেই জীবন দর্শন অনুসারেই তার জীবন তথা জাগতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। মুসলমানদরে জীবনে সেই দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। পক্ষান্তরে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থনীতির দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে বস্তুবাদ তথা ভোগবাগ। অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তি দ্বান্দ্বিক বাস্তবাদ। মুসলিম উম্মাহর আকীদা হচ্ছে এই বিশ্বচরাচরের একজন মহান স্রষ্টা আছেন। তিনি এক, অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান। একমাত্র তাঁরই নির্দেশিত পথে চ ললে মিলবে কল্যাণ ও মুক্তি। এই নির্দেশিত পথটি কি এবং কেমন করে সেপথে চলতে হবে তা জানাবার জন্যে সেই বিশ্বস্রষ্টাই আবার যুগে যুগে পাঠিয়েছেন নবী-রাসূলদের। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) সেই ধারায় সর্বশেষ রাসুল এবং তাঁরই মাধ্যমে দ্বীনের পূর্ণতা প্রদান করা হয়েছে।
আল্লাহর এই একত্ব ও নিরংকুশ ক্ষমতার মালিকানাকেই ইসলামে বলা হয়েছে তৌহিদ এবং তাঁর পাঠানো নবী-রাসূলদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকেই রিসালাত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অধিকন্তু এই জীনই শেষ নয়, এর পরে রয়েছে এক অনন্ত জীবন বা আখিরাত। সেই জীবনে ইহকালীন সুকৃতির জন্যে রয়েছে পুরস্কার এবং দুষ্কৃতির জন্যে রয়েছে শাস্তি। তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের এই সামষ্টিক বিশ্বাস মুসলমানের ঈমানের পূর্ণতা দান করে। এর তিলমাত্র ব্যতিক্রম শুধু তার ঈমন নয়, তার সমগ্র কর্মজীবনেই এনে দেয় নানা সংশয়, সন্দেহ ও অপূর্ণতা। শয়তান সেই সন্দেহের মধ্যে দিয়ে তাকে টেনে নেয় ধ্বংসের দিকে। মুসলমানের সমগ্র জীবন ও কর্মকাণ্ড তাই তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। অর্থনীতি যেহেতু সেই জীবন ও কর্মকাণ্ডেরই এক গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে সেহেতু এ ক্ষেত্রেও তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাস ও তার দাবী সমভাবেই প্রযোজ্য, এই দর্শনের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত হয় মুসলিমদের জীবনের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম। গড়ে উঠে সমৃদ্ধ ও গতিশীল অর্থনীতি।
ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা
এই দার্শনিক ভিত্তিভূমিকে কেন্দ্র করে বর্তমান সময়ের কয়েকজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ইসলামী অর্থনীতির একটি সুসংবদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। সেসবের মধ্যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা এখানে উল্লেখ করা হলো।
ড. এস. এম. হাসানউজ্জামানের মতে- “Islamic Economics is the knowledge and application of injunctions and rules of the Shariah that prevent injustice in the acquisition and disposal of material resources in order to provide satisfaction to human beings and enable them to perform their obligations to Allah and the society.”[ Hassanuz Zaman, S.M., “Definition of Islamic Economics”]
অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হচ্ছে শরীয়াহর বিধি-নির্দেশ সম্বন্ধীয় জ্ঞান ও তার প্রয়োগ যা বস্তুগত সম্পদ আহরণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে অবিচার প্রতিরোধে সমর্থ যেন এর ফলে মানবমণ্ডলীর সন্তুষ্টি বিধান করা যায়। ফলে আল্লাহ ও সমাজের প্রতি তারা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম হবে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ডা এম. উমার চাপরার মতে- “Islamic economics is that branch of knowledge which helps realize human wellbeing through an allocation and distribution of scarce resources that is in conformity with Islamic teachings without unduly curbing individual freedom or creating continued macroeconomic and ecological imbalabces.”[Chapra, M. Umer, What is islamic Economics? Islamic Research and Training Institute, Islamic Development Bank, Jeddah, 1996, p. 33]
অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি জ্ঞানের সেই শাখা যা ইসলামের শিক্ষার সাথে সংগতি রেখে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বন্টন ও বরাদ্দের মাধ্যমে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা অযথা খর্ব ও সমষ্টি অর্থনীতি এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি না করে মানবীয় কল্যাণ অর্জনের সহায়তা করে।
ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক-অর্থনীতিবিদ ডঃ এম. নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকীর মত হলো- “Islamic economics is the Muslim thinkers’ response to the economic challenges of their times. In this endeavour they are aided by the Quran and the Sunnah as well as by reason and experience.” [Siddiqui, M. Nejatullah, “History of Islamic Economic Thouht” in Ausaf Ahmad and K.R. Awan (eds.), Lectures on Islamic Economic, IRTI/IDB, Jeddha, 1992 p. 69.] অর্থাৎ, সমকালীন সময়ের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় মুসলিম চিন্তাবিদদের জবাবিই হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতি। এই প্রয়াসে তারা কুরআন ও সুন্নাহ এবং যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সহায়তা নিয়ে থাকেন।
ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম পথিকৃত ডঃ এম.এ. মান্নান তাঁর যুগান্তকারী বই Islamic Economics: Theory and Practice- এ একটি সরল অথচ কার্যকর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেন- “Islamic economics is a social science which studies the economic problems of a people imbued with thevalues of Islam” [Mannan, Muhammad Abdul, Islamic Economics; Theory and Practice, TheIslamic Academy; Cambridge, (Rev. Edb.) 1986, p. 18] অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা ইসলামী মূল্যবৈাধে উজ্জীবিত মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে থাকে।
ইসলামী অর্থনীতির চর্চা ও বিকাশে অসামান্য অবদানের জন্যে যিনি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পুরস্কারে প্রথম ভূষিত হয়েছেন সেই প্রফেসর খুরশীদ আহমদ ইসলামী অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- “Islamic economics represents a systematic eftort to try to understand the economic problem and man’s behaviour in relationto that problem from an Islamic perspective.”[Ahmed, Khurshid, “Nature and Significance of Islamic Economics” in Ausaf Ahmed & K.R. Awan (eds.) Lectures on Islamic Economics; Jeddah: IRTI/IDB, 1992, p. 19.] অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হলো অর্থনৈতিক সমস্যা ও ঐসব সমস্যার প্রেক্ষিতে মানবীয় আচরণকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে উপলব্ধি করার এক পদ্ধতিগত প্রয়াস।
প্রখ্রাত শিক্ষাবিদ এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও দারুল ইসহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হামিদের মতে ইসলামী অর্থনীতি হলো “ইসলামী বিধানের সেই অংশ যা প্রক্রিয়া হিসেবে দ্রব্য ও সেবা সামগ্রী উৎপাদন, বন্টন ও ভোগের প্রসঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক আচরণকে সমন্বিতভঅবে অধ্যয়ন করে।” [হামিদ, েএম. এ., ইসলামী অর্থনীতি: একটি প্রাথমিক বিশ্লেষণ, অনুঃ শাহ্ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, ২য় সং, ২০০২, পৃ. ১৯।]
কুরআন ও সুন্নাহর শাশ্বত নির্দেশাবলীর পাশাপাশি উপরের সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে ইসলামী অর্থনীতির যে মূলনীতিসমূহ সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় সেগুলো সম্পর্কে পরবর্তী অংশে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। এখানে গভীর পরিতাপের সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এবং সেই সাথে প্রচলিত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে আমাদের অন্ধকারে রেখেছে। উপরন্তু এদেশের দীর্ঘদিন ইংরেজ শাসনের ফলে এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানী শাসকদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্যে ইসলামী অর্থনীতির দর্শন, মূলনীতি, রূপরেখা বা বৈশিষ্ট্য এবং এর প্রয়োগিক দিক সম্বন্ধে ধারণা প্রসার লাভ করেনি।
ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি
ইসলামী অর্থনীতির রয়েছে সাতটি অনন্যধর্মী ও কালজয়ী মূলনীতি। এই মূলনীতিগুলোর নিরিখেই ইসলামী অর্থনীতির সকল স্ট্রাটেজি বা কর্মকৌশল, কর্মপদ্ধতি ও কর্মদ্যোগ নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। এগুলো যথাক্রমে:
১. সকল ক্ষেত্রে আমর বিল মারুফ এবং নেহী আনিল মুনকার-এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাযকিয়া ও তাকওয়া অর্জন;
২. সকল কর্মকাণ্ডেই শরীয়াহর বিধান মান্যকরা;
৩. আদল (বা ন্যায়বিচার) ও ইহসান (বা কল্যাণ)-এর প্রয়োগ;
৪. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা;
৫. ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের প্রয়াস;
৬. যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ অর্জন।
১. সকল ক্ষেত্রে আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকার–এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাযকিযা ও তাকওয়া অর্জন
আমর বিল মারুফ বা সৎকাজে আদেশ (অন্য কথায় সুনীতির প্রতিষ্ঠা) এবং নেহী আনিল মুনকার বা অন্যায় কাজে নিষেধ (অন্য কথায় দুর্নীতির উচ্ছেদ) ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি। যে অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় যুগপৎ সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদের জন্যে বলিষ্ঠ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেই সেই অর্থনীত ও সমাজ ব্যবস্থায় অসহায় ও মজলুমের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের ফরিয়াদে দিগন্ত হয়ে ওঠে সচকিত। আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের বিধান নেই বলেই পুঁজিবাদ মানুষের কাংখিত কল্যাণ অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু সেই অর্থনীতি সচল রাখার উদ্দেশ্যে কৌশল বদলানো হচ্ছে বারবার। কখনও বা মার্কেন্টাইলিজমকে দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব, কখনও বা ‘অদৃশ্য হস্ত’কে। কখনও গুরুত্ব পেয়েছে কল্যাণ অর্থনীতির (Welfare Economics) ধারণা, আবার কখনও বা প্রাধান্য পেয়েছে উন্নয়ন অর্থনীতি।
কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। নৈতিকতা বিবর্জিত ও ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক মানুষের সৃষ্ট সংকট মোচনেও দায়িত্ব শেষ অবধি রাষ্ট্রকে নিতে হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের (Structural adjustment) কথা। কিন্তু ইতিমধ্যেই এর বিপক্ষেও তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যে সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নেই সে সমাজ ধ্বঙস হয়ে গেছে। ইতিহাস তার সাক্ষী। এরই প্রতিবিধানের জন্যে ইসলামের সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদের জন্যে কঠোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে মানুষের মধ্যে, সমাজেরসকল স্তরে সত্য ও মিথ্যার যে দ্বন্দ্ব রয়েছে তারই প্রতিবিধানের জন্যে সুনীতির সপক্ষে ও দুর্নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। মানুষের চূড়ান্ত কল্যাণ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ ইসলামের এই নির্দেশ অমোঘ ও কালজয়ী। অর্থনীতির ক্ষেত্রে একথা বেশী করে প্রযোজ্য।
এই নীতি প্রয়োগের মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে পরিশুদ্ধ করা। তার জীবন ও সমাজকে পবিত্র করা। খোদাভীতি বা তাকওয়া এরই ভিত্তি। কুরআন সুন্নাহর সকল বিধানের মুল লক্ষ্য হলো ইহকালীন জীবনে মানুষকে সঠিক ও সত্য পথে পরিচালনার মাধ্যমে তাকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। এজন্যে তাকে অবশ্যই পরিশুদ্ধ বা পবিত্র হতে হবে। খোদাভীতি এর অপরিহার্য সোপান। যার মধ্যে খোদাভীতি রয়েছে সে চারিত্রিক পরিশুদ্ধি বা তাযকিযা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তার দ্বারা দুনিয়ার কোন অকল্যাণ সংঘটিত হবে না। আখিরাতেও সে আল্লাহর বা তার রবের সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম। খোদায়ী বিধানের লক্ষ্যই হলো ও পবিত্রতা ও পরিপূর্ণতা অর্জনে মানুষকে সাহায্য করা। এজন্যে খোদাভীতি বা তাকওয়া সৃষ্টি জরুরী। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো সকল অপরাধমূলক, নাশকতামূলক, হিংসাত্মক ও চরিত্রবিধ্বংসী কাজসহ খোদাদ্রোহিতা থেকে বিরত থাকা যেন মানুষ মানসিক, চারিত্রিক ও শারীরিক পরিশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে উসওয়াতুন হাসানা ও ইনসানে কামিলের প্রতিবিম্ব হতে পারে। তাকওয়া ছাড়া এই লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কোন জাগতিক আইন, বিধি-নিষেধ এমনকি জেল যুলুমও মানুষকে অন্যায় ও কলুষতা হতে বিরত রাখতে সমর্থ হয়নি। এই বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা নিছক খেয়াল-খুশীর বশে মানুষ সৃষ্টি করেন নি। তার একটি মহৎ উদ্দেশ্য এর পিছনে অন্তর্নিহিত ছিল। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবই তার গোচরীভূত। সকল কাজের পুরস্কার বা তিরস্কারের তিনিই মালিক, এই বোধ-বিশ্বাস অন্তরে সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কাউকে অসৎ কাজ হতে স্থায়ীভাবে বিরত রাখতে সমর্থ হয়নি। এজন্যেই ইসলামে আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের সঙ্গেই তাযকিয়া ও তাকওয়ার উপর এত বেশী গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে, জোর দেয়া হয়েছে। ইসলামী অর্থনীতর মূলনীতিসমূহের মধ্যে একটি সর্বাগ্রগণ্য স্থান পেয়েছে এ কারণেই।
২. সকল কর্মকাণ্ডেই শরীয়হা বিধান মান্য করা
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় কিছু কিছু পেশা, খাদ্য ও পানীয় এবং কর্মকাণ্ডকে হারাম বা অবৈধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐসব কাজ করা এবং খাদ্র ও পানীয়ের ভোগ উৎপাদন, বিপণন ইত্যাদি সকল কিছুই হারাম বা নিষিদ্ধ। অনুরূপ শরীয়াহর সীমার মধ্যে বেশ কিছু কাজকে হালাল বা বৈধ বলেও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোন অর্থনীতিতেই এই ধরনের বৈধ-অবৈধ বা হালাল-হারামের এই বিধান নেই। বরং সরকার বা আইন পরিষদ বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থ বা প্রয়োজনের তাগিদেই কোন কাজকে বৈধ আবার কোন কাজকে অবৈধ বলে চিহ্নিত করে থঅকে। মানুষের মনগড়া মতবাদেই কেবল এই সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে একই ধরনের কাজ একবার আইনতঃ নিষিদ্ধ আবার অন্য সময়ে আইনতঃ সিদ্ধ হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মদ পান ও মদ বৈরী নিষিদ্ধকরণ ও পরবর্তীকালে পুনরায় অনুমোদনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
ইসলামে এই ধরনের মনগড়া সিদ্ধ-নিষিদ্ধের সুযোগ রাখা হয়নি। যা সিদ্ধা বা বৈধ তা চিরকালের জন্যে ও সকলের জন্যেই বৈধ এবং যা নিষিদ্ধ বা অবৈধ তা চিরকারে জন্যে ও সকলের জন্যে অবৈধ। উদাহরণস্বরূপ পুনরায় মদের উল্লেখ করা যেতে পারে। গোটা পশ্চিমা বিশ্বে আঠারো বছর বয়সের নীচে মদপান নিষিদ্ধ। কিন্তু যদনি পরিবারের ছেলেমেয়ের কারো বয়স আঠারো বছর পূর্ণ হয় সেদিন ঘটা করে মদপানের উৎসব করা হয়। এই ধরনের দ্বিমুখী আচরণ ও মানসিকতার সুযোগ ইসলামে নেই। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের অনুমতি থাকলে বা আইনের বিধান করে নিলে যেকোন সমাজবিধ্বংসী ও মানবতার জন্যে অবমাননাকর কাজও বৈধতার রূপ পেয়ে যায়। জুয়াখেলা ও পতিতাবৃত্তি এর জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ। প্রথমটি সমাজবিধ্বংসী এবং পরবর্তীটি মানবতার জন্যে অবমাননাকর। কিন্তু যথোপযুক্ত ফি দিয়ে লাইসেন্স করে নিলে কি পুঁজিবাদী অর্থনীত, কি সমাজতান্ত্রিক অর্থনতি উভয় ক্ষেত্রেই এ দুটি কাজ শুধু বৈধতা নয়, সমাজেরও অনুমোদন পেয়ে যায়। বিপরীতক্রমে যা হালাল বা বৈধ তা প্রাপ্তির বা অর্জনের চেষ্টা করা এবং যা হারামবা অবৈধ তা পরিত্যাগ বা বর্জনের চেষ্টা করা ইসলামী জীবন বিধান তথা ইসলামী অর্থনীতির দাবী।
ইসলামী বিধান অনুযায়ী যেকোন ব্যক্তি হালাল বা বৈধ পদ্ধতিতে ধন-সম্পদ উপার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। এজন্যে সে নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ অনুসারে যেকোন উপায় অবলম্বন করতে পারে এবং যেকোন পরিমাণ অর্থও উপার্জন করতে পারে। তার এই বৈধ মালিকানা থেকে তাকে বঞ্চিত করার কেউ নেই। তবে হারাম বা নিষিদ্ধ পন্থায় এক কপর্দকও উপার্জন করার তার অনুমতি নেই। বরং হারাম পদ্ধতিতে উপার্জন থেকে আইন প্রয়োগ করেই বিরত রাখা হবে। এক্ষেত্রে অপরাধের পর্যায় বা গুরুত্ব অনুসারে তাকে অবশ্যই কারাদণ্ড ও/বা অর্থদণ্ড দেওয়া যেতে পারে; এমনকি তার ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত পর্যন্ত করা যেতে পারে।
৩. আদল (ন্যায় বিচার) ও ইহসান (কল্যাণ)-এর প্রয়োগ
আদল বা ন্যায়বিচার এবং ইহসান বা কল্যাণ প্রতিষ্ঠা ইসলামের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিধান। ইসলামী অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তা সমভাবেই প্রযোজ্য। পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র বা অন্য কোন ইজমের অর্থনীতিতে সুবিচারের এই প্রসংগটি একেবারেই অনুপস্থিত। সেখানে বরং মানুষের স্বাভাবিকতা বা ফিতরাতের বিরোধী নীতিই কার্যকর রয়েছে। ঐ সব অর্থনীততে দুর্বলের, দরিদ্রের, বঞ্চিতের তথা সমাজের মন্দভাগ্য লোকদের জন্যে স্বীকৃত কোন অর্থনৈতিক অধিকার ছিল না। পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহামন্দা এবং শিল্পসমৃদ্ধ দেশসমূহের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর প্রচণ্ড চাপের মুখে পরবর্তীকালে কিছু কিছু কল্যাণধর্মী পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। এই সমাজে একচেটিয়া কারবারী, মুনাফাখোর ব্যবসায়ী, ঘৃণ্য চোরাকারবারী, ধনী মজুতদার ও দুর্নীতিপরায়ণ আমলার কথাই আইনের মর্যাদা পেয়ে থাকে। দেশের আইনের আশ্রয় ও আনুকূল্য তাদেরই জন্যে। ফলে দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে, ধনী হচ্ছে আরও ধনী। ধনবৈষম্য হচ্ছে আরও প্রকট। ইউএনডিপির সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে বিলম্বে হলেও এই সত্য স্বীকার করে নেয়াহয়েছে।
অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে সমাজে জবাবদিহিতার উপস্থিতি অপরিহার্য। ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার ইবনে খাত্তাবের (রা) আমলে মদীনার জনগণের মধ্যে বিলিকৃত কাপড় সকলেই পেয়েছিলেণ এক খণ্ড করে। কিন্তু তিনি কিভাবে দুখণ্ড কাপড় ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন তার জবাব দিতে হয়েছল জনতার সামনে খুতবা দেওয়ার পূর্বেই। আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাসূল (স) জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলীকে (রা) হাজির হতে হয়েছিল কাযীর এজলাসে সাধারণ নাগরিকের মতোই। বর্মের মালিকানার সেই মামলায় তিনি হেরে গিয়েছিলেন। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের যুগেও বিচারের এই ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ন্যায়বিচারের অন্য অর্থ সমাজ হতে অন্যায় ও জুলুমের উচ্ছেদ এবং সবল প্রতিরোধ্ ইসলামী শরীয়াহ ব্যত্যয় যুলুমকেই ডেকে আনে। তার সময়োচিত প্রতিরোধ ও উচ্ছেদ না হলে দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণীই প্রতরিত ও নিদৃহীত এবং বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্যেই ইসলামী অর্থনীতিতে এর প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। আদল বা সুবিচারের স্বার্থে আইনে তাৎক্ষনিক ও যথাযথ প্রয়োগ ইসলামী বিধানের অপরিহার্য অঙ্গ।
এই সঙ্গে ইহসান বা কল্যাণের প্রসঙ্গটি ইসলামী অর্থনীতিতে যতখানি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়ে থঅকে অন্য কোনও অর্থনীততে তা অনুপস্থিত। দুর্বলের প্রতি, অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিতের প্রতি কল্যাণের হাত প্রসারিত করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মূলতঃ এই কারণেই যাকাতের মতো একটি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উশর, সাদাকাতুল ফিতর ও করযে হাসানা। সমাজে যারা মন্দভাগ্য ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল তাদের সমস্যার কিছুটা হলেও সুরাহা হয় যদি যথোচিতভাবে যাকাত ও উশর আদায় ও বন্টন হয়, ফিতরা প্রদান করা হয় এবং করযে হাসানার দুয়ার উন্মুক্ত রাখা হয়। দুর্বল, বঞ্চিত, ইয়াতীম, ঋণগ্রস্ত মুসাফির, পীড়িত ও আর্তজনেরা অর্থনৈতিক এই কল্যাণ ইসলামী সমাজে পায় তাদের অধিকার হিসেবেই, দয়অর দান হিসেবে নয়।
৪. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা
ইসলাম ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এজন্যে বিভিন্ন পদ্ধতির কথাও উল্লেখ করেছে। আল-কুরআনে নিকট আত্মীয়দের অধিকারের বর্ণনা রয়েছে। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে কোন ব্যক্তির উপার্জিত অর্থে তার নিজের ছাড়া আত্মীয়-স্বজনেরও হক রয়েছে। সমাজে কোন ব্যক্তি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হয় এবং তার আত্মীয়দের কেউ ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণে অসমর্থ হয় তাহলে সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ আত্মীয়কে সহায়তা করা তার সামাজিক দায়িত্ব। এভাবে কোন জাতির বা দেশের এক-একটি পরিবার যদি স্ব স্ব আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িযে দেয় তাহলে দেশ হতে দারিদ্র্য যেমন দূল হবে তেমনি পরমুখাপেক্ষী পরিবারের সংখ্যাও হ্রাস পাবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে ঘোষণা করেছেন-
“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়অত)
“তুমি আত্মীয়-স্বজন এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও তোমার নিকট হতে তাদের পওনা দিয়ে দাও।” (সূরা বনি ইসরাইল: ২৬ আয়াত)
উপরর আয়াত দুটি হতে সুস্পষ্টভাবে এই সত্য প্রতিভাত হয় যে, বৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ-সম্পদে অন্যদেরও অধিকার রয়েছে। বিশেষতঃ আত্মীয়-স্বজন েএবং সমাজে যারা মন্দভাগ্য তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া ঈমানী দায়িত্ব। যাকাতের অর্থ প্রদান সাহেবে নিসাব ব্যক্তিদের জন্যে বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে কুরআনুল করীমের নির্দেশ অনুসারে প্রয়োজনীয ব্যয় নির্বাহের পর যাদের বঞ্চিত, ভাগ্যহত লোকদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে এই অর্থ ব্যয় বাধ্যতামূলক। পৃথিবীর অন্য কোনও অর্থনীতিতে সমাজের বিত্তহীন ও অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্যে এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বঞ্চিতের হতাশা ও কর্মদ্যোগে তাদের অংশগ্রহণ না থাকার ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা অনেকখানি স্তিমিত হয়ে পড়ে। সমাজে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এবং পূর্ণ কর্মসংস্থান যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির কাঙ্খিত লক্ষ্য সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি সমাজের নীচতলার লোকেরা সকলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি বলেই। অর্থনীতির নিয়ম অনুসার যখন প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা সর্বোচ্চ হয় তখন বিনিয়োগ চাহিদা, উৎপাদন ও কর্মসংস্তান একই সংগে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভোগপ্রবণতা বৃদ্ধি পায় তখনই যখন সমাজের অধিকাংশ লোকের ক্রয়ক্ষমতা থাকে। সেই অবস্থায় সৃষ্টি হতে পারে আল্লাহ প্রদত্ত উপরের নির্দেশের যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়েই।
৫. ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের প্রয়াস
ইসলাম সর্বস্ব ত্যাগের বা সন্যাসের ধর্ম নয়, আকন্ঠ ভোগের বা চরম আসক্তিরও ধর্ম নয়। বরং ত্যাগ ও ভোগ-এ দুয়ের মাঝামাঝি জীবন যাপনের জন্যেই ইসলাম তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সে সংসারত্যাগী সে দুনিয়ার অর্থনৈতিক কোন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করার জন্যে আদৌ আগ্রহ বোধ করে না। তাই দুনিয়ার লোকদের কোন উপকার করা তার সাধ্য বা ক্ষমতা বহির্ভূত। অপরপক্ষে যে ভোগী, যে কোন উপায়ে ভোগলিপ্সা চরিতার্থ করাই তার একান্ত বাসনা। ভোগ করার জন্যে, নিজের বিলাস-বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে সব রকম উপায়ে সে ধন-সম্পদ উপার্জনে সচেষ্ট থাকবে। এক্ষেত্রে তার কাছে ন্যায়নীতি বা বৈধতা-অবৈধতার প্রশ্ন যেমন তুচ্ছ তেমনি পরের কল্যাণে অরথ-সম্পদ ব্যয় করা তার কাছে মূর্খতা। নিজে তো সে কৃপণতা করেই অন্যকেও কৃপণতা করতে প্ররোচিত করে। কৃপণতার অর্থনৈতিক তাৎপর্য হলো ব্যয় সংকুচিত হওয়া, ফলে চাহিদা সংকুচিত হওয়া এবং পরিণামে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন সংকুচিত হওয়া। অর্থনীতিতে এর পরিণাম নিদারুণ অশুভ।
ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের মূল বক্তব্যই হলো নিজে সৎ সুন্দরভাবে বাঁচতে চেষ্টা করা, অন্যকেও সেভাবে বাঁচতে সহযোগিতা করা। প্রকৃত মুসলমান আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের জন্যে না নিজের সব মূল্যবোধ ও ঈমানী চেতনাকে বিসর্জন দেবে, না অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে। বরং কল্যাণ ও মঙ্গলের পথে তার যাত্রার সহযোগী করে নেবে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব ও সমাজের মন্দভাগ্য লোকদের। পক্ষান্তরে ধনলিপ্সা মানুষকে অন্যায়ের পথে প্ররোচিত করে। পরিণামে ডেকে আনে নিজের ও সমাজের অশেষ অমঙ্গল। অপব্যয় ও অপচয়ের মাধ্যমে নিজের দন জাহির করা এদের অনেকেরই কুৎসিৎ অভ্যাস। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এসবই নিন্দিত ও ঘৃণিত।
মহান আল্লাহ তায়ালা আল্-কুরআনে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন-
“সেই সব লোককে আল্লাহ পছন্দ করেন না যারা নিজেরা কার্পণ্য করে, অন্য লোককেও কার্পণ্য করার পরামর্শ দেয় এবং আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে যা তাদের দান করেছেন তা লুকিয়ে রাখে।” (সূরা আন-নিসা: ৩৭ আয়াত)
তিনি আরও বলেন- “নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বনি ইসরাঈল: ২৭ আয়াত)
বরং তিনি ব্যয়ের ব্যাপারে সঠিক পথ নির্দেশনা দিয়েছেন এভাবে-
“তারাই আল্লাহর নেক বান্দা যারা অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে না অপচয় ও বেহুদা খরচ করে, না কোনরূপ কৃপণতা করে। বরং তারা এই উভয়ের মাঝখানে মজবুত হয়ে চলে।” (সূরা আল-ফুরকান: ৬৭ আয়াত)
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ অবশ্যই ধন-সম্পদ উপার্জনের চেষ্টা করবে। নিজের ও পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব তার। সেই সঙ্গে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের প্রয়োজনের ব্যাপারেও তার সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং অন্যান্য অবাবগ্রস্ত বা সাময়িকভাবে দুর্দশায় নিপতিত মানুষের জন্যে তার থাকবে আন্তরিক দরদ। সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে ঘটবে তার বহিঃপ্রকাশ। ব্যক্তি নিজে যেমন উচ্ছৃংখল ও বিলাসী জীবন যাপন করবে না তেমনি পরের দুঃখেও সে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। এই দুয়ের মধ্যবর্তী আচরণই ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এজন্যেই অর্থনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণের উপর ইসলাম এত বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে।
৬. মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ নিশ্চিত করা
সমাজের সকল মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধান ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতি। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পাঁচটি- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। এই প্রয়োজন পূরণ করার জন্যে ইসলাম ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে যে তাগিদ দিয়েছে তার নজীর আর কোন অর্থনীতিতে নেই। মূলতঃ এই প্রয়োজন পূরণের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ববোধ থেকেই ইসলাম বায়তুল মাল হতে প্রত্যেক নাগরিকের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটাবার জন্যে ব্যয় করার বিধান রয়েছে।
ইবনে হাযম তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুহাল্লাতে বলেন- “প্রতি এলাকার ধনীরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় বসবাসরাত অসহায় ও নিঃসম্বলদের মৌলিক চাহিদা পূরণে বাধ্য। যদি বায়তুল মালে মজুদ সম্পদ এজন্যে পর্যাপ্ত না হয় তাহলে দুঃস্থ ও দরিদ্রদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে রাষ্ট্রপ্রধান বিত্তশালীদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে তা আদায়ে বাধ্য করতে পারেন।”
অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ও স্বাস্থ্যের মতো অপরিহার্য মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ না হলে একদিকে মানুষ যেমন অসুস্থ ও রুগ্ন হয়ে পড়বে তেমনি শিক্ষার অভাবে সে খাঁটি মানুষ হতে পারবে না। ইসলামে জ্ঞান অর্জন ফরয করা হয়েছে। নবী মুস্তফা (স) বদরের যুদ্ধে শিক্ষিত যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যেকের মুক্তিপণ নির্ধারণ করেছিলেন মদীনার দশ জন বালক-বালিকাকে শিক্ষাদান করা। দীর্ঘ চৌদ্দশত বছর পরে আজ বিশ্ববাসীর কাছে গণশিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। অথচ এই প্রয়োজন পূরণের জন্যে ইসলামে কত আগেই না তাগিদ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসার জন্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ও নির্দেশনা তো মাত্র হাল আমলের। পক্ষান্তরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও পদ্ধতি নিয়ে রাসূলে করীম (স) গাইড লাইন দিয়ে গেছেন সেই কতকাল আগে। অজ্ঞতার জন্যে সেসব শিক্ষা হতে আমরা বঞ্চিত রয়েছি।
যে কোন সমাজে আপামর জনসাধারণের নূ্যনতম মানবিক প্রয়োজন পূরণ না হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃংখলা অবচশ্যম্ভাবী। চুরি-ডাকাতি ব্যভিচার মাদকাসক্তি হতে শুরু করে এইডসের মতো ঘাত ব্যধি সমাজে ছড়িয়ে পড়বে মহামারীর মতো। লক্ষ লক্ষ বনি আদম ঠাঁই নেবে ফুটপাতে বস্তিতে। কিশোর অপরাধ হতে শুরু করে ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষন, সন্ত্রাস, হত্যা প্রভৃতি সামাজিক অপরাধ ও নৈরাজ্যের সূতিকাগার এসব বস্তি। এসব সর্বনাশ হতে পরিত্রাণ পেতে হলে চাই মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের যথার্থ ব্যবস্থা। ইসলাম তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে এই প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করেছে। যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তির সম্পদে সমাজের Have-nots-দের অধিকার স্বীকৃতি, সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং রাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপ একযোগে এই গ্যারান্টিই দেয়।
৭. যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ অর্জন
ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইহকালীন কর্মকাণ্ডের জন্যে পরকালীন মুক্তি বা শাস্তির এমন দ্ব্যার্থহীন ও দৃঢ় ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মে দুনিয়াকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো ত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, পক্ষান্তরে ইসলামে কর্মবীর হতে বলা হয়েছে। খৃষ্ট ধর্মে সকল পাপের ভারবহনকারী হবেন যীশু। পরকালে তিনিই হবেন পরম পরিত্রাতা। সুতরাং, তাঁর উপর বিশ্বাস ও দায়িত্ব অর্পণ করে দুনিয়ার সকল বৈধ-অবৈধ ভোগ-বিলাসে মত্তা হওয়ার যেমন বাধা নেই, তেমনি বাধ্য-বাধকতা নেই উপায়-উপার্জনের এবং সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিধি-বিধান মেনে চলার। হিন্দু ধর্মে কোন সুনির্দিষ্ট ও সুলিখিত অর্থনৈতিক আচরণ বিধিই নেই। খৃষ্টধর্ম পুঁজিবাদকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। ইহুদী হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মের তো কথাই নই। রাব্বী আচার্য ও পুরোহিতরা যাই বলুক না কেন এসব ধর্মের সাধারণ অনুসারীরা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে জীবন ব্যবস্থা বলে সাদরে গ্রহণ করেছে। অন্যান্য ধর্মের অবস্থাও অথৈবচঃ।
এরই বিপরীতে সম্পীর্ণ ভিন্ন ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ ইসলামে অর্থনৈতিক সুকৃতি বা হালাল কাজের জন্যে ইহকালীন কল্যাণের সুসংবাদের পাশাপাশি পরলৌকিক জীবনেও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তিনি তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করেছেন তা থেকে ব্যয় কর। তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও ব্যয় করে তাদের জন্যে রয়েছে মহাপুরস্কার।” (সূরা আল-হাদীদ: ৭ আয়াত)
অপরদিকে যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করবে, গরীব-দুঃখীদের উপকারে সচেষ্ট হবে না বরং হারাম কাজে অংশ নেবে তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তির সংবাদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
“অতি পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও সেই লোকদের যারা স্বর্ণ-রৌপ্য পুঁজি করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না।” (সূরা: আত-তাওবা: ৩৪ আয়াত)
মুমিন মুসলমান অদৃশ্য বা গায়েবে বিশ্বাস করে বলেই আখিরাতে বিশ্বাস তার ঈমানের অংগ। তাই ইসলামী জীবন বিধান তথা ইসলামী অর্থনীতিতে আখিরাতের কল্যাণ অর্জনের প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের শেষে মুনাজাতেও বান্দাহ আল্লাহর কাছে যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণই প্রার্থনা করে। আখিরাত যে মুসলমানের জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অনুধাবনের জন্যে রাসূলে করীমের (স) একটি মাত্র উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেন- এই দুনিয়া আখিরাতের জন্যে শস্যক্ষেতস্বরূপ। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হচ্ছে এখানে যে যেমন বীজ বুনবে অর্থাৎ কাজ করবে আখিরাতে সে তেমন শস্য বা প্রতিফল পাবে। আখিরাতের শাস্তি ও পুরস্কার প্রাপ্তি সম্বন্ধে যার মনে এতটুকু ভয় ও আগ্রহ নেই তার দ্বারা দুনিয়ার যেকোন অকল্যাণ ও অসমঙ্গল সম্ভব। অপরপক্ষে তার দ্বারা হালালকে অর্জন ও হারামকে বর্জন, সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদ এবং আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা-কোনটাই সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে তাযকিয়া অর্জন ও তাকওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হলে এবং আখিরাতকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে নিলে ইহকালের জীবনধারা খোদায়ী বিধান অনুসারে পরিচালিত হতে বাধ্য এবং এই পথেই যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতর কল্যাণ অর্জন সম্ভব।