দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামী সরকারের ভূমিকা
পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকাশের সেই প্রথম যুগ হতে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহামন্দা (Great Depression) সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত অর্থনীতি শাস্ত্রে আয় বৈষম্য দূরীকরণ, ধনবন্টনে সাম্য অর্জনের প্রয়াস এবং দারিদ্র্য বিমোচনে প্রয়োজনীয় সরকারী উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ প্রসঙ্গ কোন গুরুত্বই লাভ করেনি। কুইজনের *****এর সময় হতে শুরু করে ফিজিওক্রাটদের যুগ পেরিয়ে মার্কন্ট্যাইলজিমের দার্দণ্ড প্রতাপকাল শেষ করে Laissaz fail-এর যুগ পর্যন্ত কোথাও সমাজের দরিদ্র্য বঞ্চিত ও মন্দাভাগ্যদের স্বার্থ সংরক্ষণ তথা মানুষের মতো জীবন যাপনের গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু সময়ের পরক্রমায় ইংল্যান্ডে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মজবুত ভিত্তি অর্জন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহামন্দার ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ বিপর্যয় পুঁজিবাদী অর্থনীতরি ভিতে শুধু কাঁপনিই ধরায় নি, বরং তাতে এক গভীর ফাটল সৃষ্টি করে। অবশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হতে ধনীদের দ্বারা দরিদ্রদের বেপরোয়া শোষণের অবসান এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও মন্দা দূর করার জন্যে সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ প্রসঙ্গ অর্থনীতির আলোচনায় ক্রমেই গুরুত্ব পেতে থাকে। সরকারী বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই দরিদ্রদের জন্যে আয়বর্ধন ও কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প গ্রহণ তথা সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পূর্ণ কর্মসংস্থান অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ বা কৌশল অবলম্বন সম্পর্কে জে. এম. কেইনস ও তাঁর অনুসারীরা আলোচনা শুরু করেন।
কিন্তু এটা যেমন অর্থনীতি শাস্ত্রে তাঁদের নতুন অবদান ছিল না তেমনি সত্যিকার বলিষ্ঠ ও কার্যকর পদক্ষেপ উদ্ভাবনেও তাঁরা সমর্থ হননি। বরং পুঁজিবাদী সভ্যতা বিকাশের বহু শতাব্দী পূর্বে ইসলামই ঘোষণা করেছিল যে সমাজের বাগ্যবিড়ম্বিত, বঞ্চিত ও দরিদ্ররা যেন তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা দেশের শাসক তথা সরকারেরই অপরিহার্য দায়িত্ব। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সময়ের পরিবর্তনে মুসলিম শাসকদের আত্মবিস্মৃতির পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ এবং বিদেশী সভ্যতার প্রভাবের ফলে মুসলিম দেশসমূহে ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধ অনুসরণে দারুণ ব্যত্যয় ঘটে। ফলে সমাজে যেমন শোষণ, বঞ্চনা, একচেটিয়া কারবার ও ধনীদের নির্যাতন বৃদ্ধি পেতে থাকে তেমনি বৃদ্ধি পেতে থাকে দরিদ্র ও বেকার জনতার ভীড়। চৌদ্দশ হিজরীর শেষের দিক হতে এই অবস্থার ধীর পরিবর্তন শুরু হয়। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন করে আত্মোপলব্ধির ফলে নব জাগরণের সূচনা হয় এবং সামাজিক বিভক্তি রোধ ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে শত-সহস্র পরামর্শ বা সুপারিশ পেশ করা হয়। পরিতাপের বিষয়, সীমিত সময়ের বাইরে এসব পরামর্শ স্থায়ী ও কার্যকর সুফল সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। কারণ মুসলিম দেশসমূহের সরকার এসব কর্মকাণ্ডে কার্যকরভাবে অংশ গ্রহণ করেনি। অথচ সরকারের সর্বাত্মক ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পূর্ণ দায়বদ্ধতা ব্যতিরেকে দারিদ্র্য বিমোচনের কোন কর্মসূচীই সার্থকভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে না। উপরন্তু এক্ষেত্রে ইসলামী পদ্ধতি ও উপায়-উপকরণের যথাযথ ব্যবহার ছাড়া সার্বিক সাফল্য আশা করা বৃথা।
বস্তুতঃপক্ষে দারিদ্র্যের মূলোৎপাটন, সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং প্রবৃদ্ধির কাম্য হার অর্জনের লক্ষ্য কেবল মাত্র সরকারের কার্যকর ও সক্রিয় অংশ গ্রহণের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। পাশাপাশি মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত সরকারী নীতিমালা ও কর্মসূচী যার দ্বারা এমন সুযোগ সৃষ্টি করা যাতে জনগণ তাদের ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সম্পদের অধিকারসমূহ নিশ্চিত করতে পারে। কোন ইসলামী সরকারের উচিত হবে না বাজারের নিয়ন্ত্রিত শক্তি উপর সম্পদের বন্টন ছড়ে দেওয়া। কারণ বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ, বিশেষ করে অভাবী ও অসহায়দের কল্যাণ নিশ্চিত করা আদৌ সম্ভব নয়। এ জন্যেই সরকারের উচিত ইসলামের দিক –নির্দেশনার আলোকে কার্যকর ও বাস্তবানুগ কর্মকৌশল প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো তৈরীর মাধ্যমে অর্থনীতিতে একটি দৃঢ় ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা।
সমাজের প্রতিটি নাগরিকের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন তথা অন্ন বস্ত্র বাসস্থান স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রতিটি সরকার তথা রাষ্ট্রের নৈতিক ও আবশ্যিক দায়িত্ব। দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জনসাধারণের জীবন যাপনের মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইসলামী সরকারের দায়িত্ব বিপুল। প্রত্যেক নাগরিকই যেন হালাল বা বৈধ উপায়ে উপার্জন করতে পারে তার নিশ্চযতা বিধান যেমন সরকারের দায়িত্ব তেমনি সব ধরনের হারাম বা অবৈধ কর্মকান্ড সমাজ হতে উচ্ছেদও সরকারের পবিত্র ও আবশ্যিক দায়িত্ব। কারণ হারামের রন্ধ্র পথেই সমাজে অকল্যাণ ও সর্বনাশের প্রবেশ ঘটে। সরকারের এই আবশ্যিক দায়িত্ব সম্বন্ধে আল-কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেণ-
“তারা এমন লোক যে তাদেরকে আমরা যদি যমীনে ক্ষমতা দান করি তবে তারা নিয়মিত নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে।” (সূরা আল-হজ্জ্ব: ৪১ আয়াত)
মানবতার মুক্তিদূত মহানবী মুহাম্মাদ মুস্তফা (স) তাঁর বাণীতে বলেছেন- “আল্লাহ যাকে মুসলমানদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে শাসক বানিয়েছেন সেই শাসক তাদের দারিদ্র্য মোচন ও প্রয়োজন পূরণের প্রতি উদাসীন রইলো আল্লাহও তার দারিদ্র্য ও প্রয়োজনের প্রতি উদাসীন রইবেন।” (সুনান আবু দাউদ: ২য় খন্ড, পৃ. ১১২)
তিনি আরও বলেছৈন- ‘যার কোন সহায় নেই, শাসকই তার সহায়। (সুনান আবু দাউদ: ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৮১)
রাসূলে খোদার (স) এসব বাণী গরীব জনসাধার ণের দুঃখ-দুর্দশা দূর ও মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যকেই দ্ব্যার্থহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মহান খুলাফায়ে রাশিদূন (রা) তাঁদের খিলাফত কালে যে সকল কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন সেসবও এই বক্তব্যকেই দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। প্রত্যেক আমীরুল মুমিনীনের গৃহতি পদক্ষেপ সুস্পষ্টভাবে নিরেদশ কর যে সরকারের আবশ্যিক কর্তব্যই হচ্ছে অভাবগ্রস্ত দরিদ্র ও বঞ্চিতদের মৌলিক প্রয়োজন এমনভাবে পূরণ করা যেন সমাজ হতে দারিদ্র্য দূর হয়ে যায়।
প্রখ্যাত ফকীহ ও ইসলামী শাস্ত্রবেত্তাগণ একবাক্যে বলেছেন জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন, বিশেষতঃ মৌলিক প্রয়োজন পূরণে শাসকেরই দায়িত্ব। এই দায়িত্ব তিনি এমনভাবে পালন করবেন যেন তাদেরকে এ ব্যাপারে আর কারও কাছে প্রার্থ না হতে হয়। মুজাদ্দিদ ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে রাষ্ট্র উৎপাদন, বন্টন, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্ত কর্মসূচীর আঞ্জাম দেবে। অনুরূপভাবে ইমাম আবু ইসহাক আল্-শাতিবী বলেন আল্লাহর আইন পাঁচটি বিষয়ের নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা দেয়—ধর্ম, জীবন, সন্তান, সম্পদ এবং বুদ্ধিমত্তা। এই নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব সরকার বা রাষ্ট্রেরই।
ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁর এক ভাষণে বলেন- রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনগণের প্রত্যেকেরই সমান অধিকার রয়েছে। এই সম্পদে কারোরই, এমনকি খলীফার নিজেরও অন্যের চেয়ে বেশী দাবীর সুযোগ নেই। প্রখ্যাত দার্শনিক ইমাম আল-গাজ্জালীর মতে ইসলামী শরীয়াহ প্রতিটি মুসলমানের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং তা সংরক্ষণেরও নিশ্চয়তা দেয়। এর একটি হচ্ছে প্রত্যেকের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা যার মধ্যে রয়েছে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা শিক্ষা এবং এমন অন্যান্য অনুসঙ্গী বিষয় যা সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্যে অপরিহার্য বলে বিবেচিত।
সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ সমাজে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও ন্যূনতম সামাজিক সাম্য অর্জনের পাশাপাশি ভারসাম্যপূর্ণ আয় ও সম্পদের সুষম বন্টনেরও নিশ্চয়তা দেয়। মৌলিক প্রয়োজন পূরণের প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চালু থাকলে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের মধ্যে সম্পদ আবর্তিত হতে শুরু করে। এর ফলে চাহিদা উৎপাদন বিনিয়োগ কর্মসংস্থান উপার্জন প্রবৃতি অর্থনৈতিক বিষয়ের মধ্যে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পরিণামে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিপুলবাবে আলোড়িত হয়ে ধনাত্মক গতিবেগ লাভ করে। এ কারণেই ইসলাম আপামর জনসাধারণের প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণের গ্যারান্টির প্রসঙ্গটি সরকারের জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের মজুত তহবিল হতে ব্যয় সংকুলান না হলে অবশ্য প্রদেয় যাকাত উশর কর খাজনা এবঙ সাদাকাহ ছাড়াও সম্পদশালীদের নিকট হতে বাধ্যতামূলকভাবে সম্পদ সংগ্রহের ক্ষমতা ও এখতিয়ার আল-কুরআনের বিধান অনুযায়ীই সরকারের রয়েছে।
ইবনে হাযম সমাজের দুঃস্থদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের জন্যে ধনীদের উপর বাড়তি কর আরোপের কথাও বলেছেন। তাঁর মতে- “প্রত্যেক এলাকার সম্পদশালী ব্যক্তিগণ তাদের স্ব স্ব এলাকায় বসবাসরত অসহায় ও নিঃসম্বলদের মৌলিক চাহিদা পূরণে বাধ্য। যদি বায়তুল মালে মজুদ সম্পদ এজন্যে পর্যাপ্ত না হয় তাহলে দুঃস্থ ও দরিদ্রদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে রাষ্ট্রপ্রধান সম্পদশালীদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে তা আদায়ে তাদের বাধ্য করতে পারেন।” (আল-মুহাল্লা: ষষ্ঠফ খন্ড, পৃ. ১৬৬৬)
একেবারে সাম্প্রতিক কালের প্রখ্যাত চিনতাবিদদের মধ্যে শহীদ সাইয়েদ কুতুব, সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, ইউসুফ আল-যকারযাবী, নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী প্রমুখ এই মর্মে ঐক্যমতে পৌঁচেছেন যে, প্রতিটি মুসলিম সরকারের দুটি যৌথ দায়িত্ব রয়েছে: (ক) প্রত্যেক নাগিরকের জন্য ন্যূনতম মানের জীবন যাপনের নিশ্চয়তা বিধান করা এবং (খ) মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে না দেওয়া।
উপরের আলোচনা হতে একথা স্পষ্ট যে, দরিদ্র জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং সমাজে আয় বৈষম্য হ্রাসের জন্যে গৃহীতব্য কর্মসূচীতে সরকারের অংশ গ্রহণ শুধু প্রয়োজনই নয়, বরং অপরিহার্যও। সরকারে সক্রিয় ও কার্যকর অংশ গ্রহণ ছাড়া উল্লেখিত লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে কোন কর্মসূচীই কাংখিত সাফল্য অর্জনে সমর্থ হবে না। কারণ একমাত্র সরকারই একই সঙ্গে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় বিধি ও নীতিমালা তৈরী এবং জনগণের অর্থ ব্যয় করার ক্ষমতা রাখেন। বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠান, তার ক্ষমতা ও আয়তন যত বড়ই হোক না কেন, কোনক্রমেই এসব ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সমর্থ নয়। তাদের কর্মসূচী কখনই সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য হবে না। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে এযাবৎ বেসরকারী পর্যায়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ নানা ধরনের কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্য দূর হয়নি। বরং মৌলিক চাহিদার ব্যয় পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চ দরিদ্র্য রেখা ব্যবহার করলে জাতীয় পর্যায়ে দেশের দারিদ্র্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৯.৮ শতাংশ। (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০৪, পৃ. ১৫৬)
ইউএনডিপি প্রকাশিত হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট, ১৯৯৮-এ পৃথিবীর ১৭৪টি দেশে বিদ্যমান মানব সম্পদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। মানব উন্নয়ন সুচক (Human Development Index) অনুসারে এই রিপোর্টে বাংলাদেশের স্থান ১৪৭তম, অপরদিকে সার্কভুক্ত দেশ শ্রীলংকার স্থান ৮৯তম। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ কুয়েতের (৫১তম) অনেক উপরে স্থান ল্যাটিন আমেরিকার মাঝারি আয়ের দেশ উরুগুয়ের (৩২তম)। অর্থাৎ, ধনী দেশ হলেই জনসাধারণের সর্বিক জীবন যাপনের মান উন্নত হয়ে যায় না বা মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের গ্যারান্টি পাওয়া যায় না। তা যদি হতো তাহলে আজ উন্নয়নের চুঁইয়ে পড়া তত্ত্ব (Trickle Down Theory) মুখ থুবড়ে পড়তো না। এক সময়ে এই তত্ত্বের কথা খুব জোরে-শোরে বলা হতো। ব লা হতো শহরের উন্নতি হলে, পুঁজি ও অন্যান্য সম্পদ যুগিয়ে বিত্তবানদের আরও সম্পদশালী করতে পারলে তাদের হাতের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়বে, উপরিকাঠামোর প্রবৃদ্ধি ঘটলে সেখান থেকে যা আপনাআপনিই নিচের দিকে চুঁইয়ে আসবে তাতেই দরিদ্ররা বেঁচে যাবে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই ঘটেছে? সত্য হলো এই বাংলাদেশের অর্ধেকেরমত লোক বাস করছে দারিদ্র্য সীমার নীচে। সুতরাং, স রকারকে আজ প্রকৃতই কল্যাণমুখী এবং দরিদ্র জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্যে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের এগিয়ে আসতে হবে।
বিদ্যমান অবস্থার মধ্যেই অর্থাৎ দেশে এই মুহূর্তে যে আর্থ-সামাজিক ও আইনগত ব্যবস্থা বর্তমান তার মধ্যে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন না ঘটিয়ে এবং প্রশাসন যন্ত্রের উপর কোন বাড়তি বোঝা না চাপিয়ে কিভাবে ইসলামী শরীয়অহ অনুমোদিত উপায়-উপকরণের পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে নীচে সেই কৌশল আলোচিত হলো। কারণ এক্ষেত্রে সার্বিক অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনগত কাঠামোর যে পরিবর্তন আনয়ন জরুরী তা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে দায়বদ্ধ সরকার ছাড়া কারোরই পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারের গৃহীতব্য কর্মসূচীকে তিনটি বড় ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:-
ক. ভূমি সংক্রান্ত পদক্ষেপ;
খ. অর্থ সংক্রান্ত পদক্ষেপ; এবং
গ. নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ
ক. ভূমি সংক্রান্ত পদক্ষেপ
১. ইসলামী মীরাসী আইনের কঠোর প্রয়োগ: সনাতন অর্থনীতিতে উৎপাদনের জন্যে যে চারটি উপকরণকে বিবেচনা করা হয় জমি বা ভূমি তার মধ্যে প্রথম। জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে যে মুসলিম দেশগুলো একেবারে উপরের দিকে রয়েছে সেগুলো প্রধানতঃ কৃষিনির্ভর। সঙ্গতঃ কারণে কৃষিই এসব দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রধান জীবিকা। তাই উপার্জনের এই বৃহৎ উপকরণটি যদি মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কুক্ষিগত হওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে ধনবন্টনে বৈষম্য সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিত। এজন্যেই মীরাসী আইন উৎপাদনের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি সুষ্ঠু বন্টনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করেছে যেন মাত্র কিছু লোকের হাতে আয় ও সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার সুযোগ না হয়। মীরাসী আইনে শরীয়াহ নির্দেশিত অংশ অনুসারে মৃতের উত্তরাধিকারীগণ তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা পাবে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। [সূরা আন-নিসা: ১১-১২ আয়াত দ্রষ্টব্য]
সমাজে ধনবন্টনের ক্ষেত্রে যে কয়টি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ উপায় রয়েছে ইসলামের মীরাসী আইন তার অন্যতম। সমাজ হতে দরিদ্র্য হ্রাসেও এই আইন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত উমার ইবনে আবদুল আজীয (র) পর্যন্ত এই আইনের প্রয়োগ হয়েছে যথাযথভাবে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মুসলিম শাসকবর্গ রাজতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ায় এবং আইনের কঠোর ও তাৎক্ষনিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে শৈথিল্যের কারণে ধীরে ধীরে মীরাসী আইনের আক্ষরিক প্রয়োগ হ্রাস পেতে থাকে। পরিণামে আদালতে জমে উঠতে থাকে মামলা-মোকদ্দমার ভীড়। এক শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তারা দুর্নীতিপরায়ণ ও অসৎ ব্যক্তিদের মদদ জোগায়। ফলে মীরাসী আইনের প্রয়োগ ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতাই হয়ে ওঠে প্রবল বাধা।
একথা সত্য যে মুসলিম দেশসমূহে ইসলামী মীরাসী আইন সরকারীভাবে স্বীকৃত এবং আইন-আদালতের মাধ্যমে তা প্রয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অবস্থা এই যে, এর সুষ্ঠু প্রয়োগের কোন সামাজিক বাধ্য-বাধকতা নেই, বিশেষ করে যখন ইয়াতীম ও মহিলাদের প্রসঙ্গ যুক্ত হয়। মহিলা উত্তরাধিকারীরা দুটি বড় অসুবিধার কারণে জমির উত্তরাধিকারত্ব অর্জনে অসমর্থ হয়: (ক) বিদ্যমান আইনে দেওয়ানীমামলা বিচারে অস্বাভাবিক দীর্ঘসূত্রীতা, এবং (খ) বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব অর্থাৎ, হিন্দু ও খৃষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত রীতি দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। বাংলাদেশ পাকিস্তান ভারত প্রভৃতি দেশে এর নজীর হাজার হাজার।
এই প্রেক্ষিতে যদি সম্পত্তিতে মহিলাদের অংশ বা যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সরকার সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হয় তাহলে অর্থনীতিতে ধনবন্টনে বৈষম্য হ্রাসের পাশাপাশি দারিদ্র্যও অনেকখানি দূর হবে। প্রথমতঃ এর ফলে পুরুষ সদস্যের অবর্তমানে তারা উপার্জনের অনিশ্চয়তায় ভুগবে না এবং দ্বিতীয়তঃ আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তাদের অধিকতর ফলপ্রসু অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। অধিকাংশ মুসলিম দেশে এখনও মহিলারা পুরষদের তুলনায় কম শিক্ষিত এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ। অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে মহিলাদের এই তুলনামূলক পশ্চাৎপদতা শরীয়াহ আদৌ সমর্থন করে না। সুতরাং, মহিলাদের-যারা সমাজের অরধাংশ-ন্যাংসঙ্গত অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠার জন্যে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ছাড়াও সরকারকে বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে।
২. ওয়াকফ সম্পত্তি: মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে ওয়াকফ সম্পত্তি একাধারে জনকল্যাণে সহায়ক ও সরকারী ভূমি প্রশাসনেও গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। দরিদ্র ও অভাবী জনগণের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণে সহায়তার উদ্দেশ্যে দানশীল ও বিত্তশালী মুসলিমরা তাদের সম্পত্তি ওয়াকফ করে যান। একদা ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে বিপুল সংখ্যক লোকের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ হতো ওয়াকফ সম্পত্তির আয় হতেই। আমাদের দেশে এর ভুর ভুরি নজীর রয়েছে। হাজী মুহাম্মদ মোহসীন ওয়াকফ এস্টেট ও নবাব ফয়জুন্নিসা ওয়াকফ এস্টেটের কথা এদেশের কোন্ শিক্ষিত মানুষ না জানে? দুর্ভাগ্যের বিষয়, মুসলিম সংখ্যালঘু দেশে তো বটেই, মুসরিম সংখ্যাগুরু দেশেও সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে এসব ওয়াকফ সম্পত্তি হয় সরকার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে অথবা এলাকার শক্তিধর ব্যক্তি বা রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট লোকের জবরদখল করে ভোগ করছে।
প্রসঙ্গতঃ ওয়াকফ উৎস হতে বাংলাদেশে বার্ষিক কত আয় হতে থাকে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা ভাল। ওয়াকফ শুমারী ১৯৮৬ অনুসারে বাংলাদেশ সরকারের কাছে রেজিস্ট্রিকৃত ওয়াকফ এস্টেটের সংখ্যা ৯৭,০৪৬টি, মৌখিকভাবে ও দলিলপত্রে স্বীকৃত ৪৫,৬০৭টি িএবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় চলে আসছে ৭,৯৪০টি। দেড় লক্ষাধিক এই ওয়াকফ এস্টেটের আওতায় ফলের বাগান, পুকুর ও আবাদী জমি মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ১.২০ লক্ষ িএকর জমি, সরকারী হিসাব মতেই যার বার্ষিক আয় ৯০.৬৫ কোটি টাকা। এই আয়ের সিংহভাগই চলে যায় প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহ এবং মসজিদ, মাদ্রাসা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে মাসোহারা/ভাতা প্রদানে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পিত ব্যবহার হলে এই উৎস হতেই যেমন আরও বেশী আয় হতে পারত তেমনি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী গ্রহণের মাধমে অধিকতর কল্যাণমুখী (কর্মসংস্থান ও আয়বর্ধনমূলক) কাজ করাও সম্ভব হতো। ইতিমধ্যে যেসব ওয়াকফ সম্পত্তির পুরোটা বা অংশবিশেষ বেহাত ও জবরদখল হয়ে গেছে সেগুলো উদ্ধারের জন্যে সরকার প্রকৃতই তৎপরত হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা সুযোগ, অপুষ্টি দূরীকরণ, চিকিৎসার ব্যবস্থা ও অভাব-অনটন অনেকখানিই দূল হতে পারতো।
৩. উশর: গ্রামাঞ্চলে কৃষি জমির মালিকানাসূত্রে আয়বন্টনজনিত পার্থক্য খুবই প্রকট। বিশেষতঃ বড় জমির মালিকেরা ক্রমশঃই বিপুল বিত্তের মালিক হয়ে উঠতে পারে। এর প্রতিবিধানের অন্যতম ইসলামী কৌশল হলো ফসলের উশর আদায়। উশর ব্যবস্থা চালূ হলে কৃষি আয় বন্টনে বিরাজমান দুস্তর বৈষম্যের অবসান এবং সমাজে শ্রেণী বৈষম্যেরও হ্রাস ঘটবে। রাসূলে করীম (স) বলেন-
“যে জমি বৃষ্টিপাত বা নদীর পানিতে আপনা আপনিই সিক্ত হয় সে জমির ফসলের এক-দশমাংশ (১০%) এবং যে জমি পানি সেচের দ্বারা সিক্ত করা হয় তার ফসলের এক-বিংশতি অংশ (৫%) আদায় করে দিতে হবে।” (সহীহ আল-বুখারী: কিতাব আল-যাকাত)।
শরীয়াহ অনুসারে যারা যাকাতের হকদার উশরেরও তারাই হকদার। উশর আদায়ের ক্ষেত্রে যাকাতের মতোই নিসাপ পরিমাণ ফসল উৎপাদন হওয়ার শর্ত রয়েছে। উশরের ক্ষেত্রে এই নিসারে পরিমাণ পাঁচ ওয়াসাক বা ৩০ মণ। ইরাকী পরিমাপ অনুসারে এর পরিমাণ ৯৮৮.৮ কেটি এবং হিযাজী পরিমাপ অনুসারে এর পরিমাণ ৬৫৩.০ কেজি। জমির পরিমাণ কম হলে (যেমন ২/৩ বিঘা) নিসাপ পরিমাণ ফসল হওয়ার সম্বাবনা খুবই কম। তাই উশর আদায়ের ব্যবস্থা হলে ক্ষুদে ও প্রান্তিক কৃষকদের সুবিধা হবে। যেহেতু পরিমাণের পরিবর্তে উৎপাদনের পরিমাণের উপর উশর নির্ভরশীল সেহেতু নিসাপ পরিমাণ ফসল না হলে উশর দেওয়া হতে তারা রেহাই পাবে। উল্লেখ্য, ধনী কৃষকেরা ঋণ, বিপণন ও অধিক জমির মালিক হওয়ার কারণে ফসলের বহুধাকরণের সুবাদে যে নিশ্চিত ও অধিক আয়ের সুযোগ পায় গরীব কৃষকেরা সে সুযোগ হতে বঞ্চিত। ক্ষুদে ও প্রান্তিক চাষীরা জমির স্বল্পতা, ঋণের দুর্লভতা ও উৎপাদনের অনিশ্চয়তার জন্যে ক্রমেই ভূমিহীন কৃষকের কাতারে গিয়ে যুক্ত হচ্ছে। সুতরাং, উশর আদায়ের ব্যবস্থা গ্রামীন পরিমণ্ডলে আয় বৈষম্য হ্রাসে সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
আয় বৈষম্য হ্রাসে জমির মালিকানার সীমা বেধে দেওয়া আর একটি কার্যকর উপায়। বহু মুসলিম দেশেই ভূমি সংস্কারের উদ্রোগ গৃহীত হয়েছে এবং জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে। পরিতাপের বিষয়, বৃহৎ ভূস্বামীরা প্রায়ই এই সীমারেখা মানে না। ব রং নানা কৌশলে তারা জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে চ লে। তাই আইনের প্রয়োগ কঠোরতর ও যথাযথ হওয়অর জন্যে সরকারকে অবশ্যই যত্নশীল ও তৎপর হতে হবে। পাশাপাশি জমির বিদ্যমান মালিকানা সীমারও পুনর্মূল্যায়ন হওয়া বাহ্ছনীয়। বাংলাদেশে মোট চাষযোগ্য জমির ৩৩%-এর মালিক মাত্র ৭% কৃষক যাদের প্রত্যেকেরই জমির পরিমাণ ৯ একর বা তার বেশী। বৃহত্তর দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় এমন অনেক জমির মালক আছেন যারা তাদের সব জমির উপযুক্ত তত্ত্বাবধান ও নিবিড় চাষাবাদ করতে পারেন না। অপরদিকে ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকেরা বর্গার চাষ করার জন্যে একখন্ড জমি পেতে অনেক সময় প্রতিকূল শর্তও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাই কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র গঠনের স্বার্থে এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও আয় বৈষম্য হ্রাসের উদ্দেশ্যে সরকারের উচিৎ হবে বৃহৎ জমির মালিকদের আইনের মারপ্যাঁচে আরও জমির মালিক হওয়অর পথ রুদ্ধ করা এবং একই সঙ্গে ক্ষুদে ও প্রান্তিক চাষীদের যে জমিটুকু এখনও রয়েছে তা বিক্রী বা হস্তান্তর রোধের জন্যে কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করা।
খ. অর্থসংক্রান্ত পদক্ষেপ
১. যাকাত আদায় ও বন্টন: দরিদ্র্য বিমোচনসহ প্রতিটি নাগরিকের ন্যূনতম মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে সরকার প্রথম যে বলিষ্ঠ ও কার।যকর পদক্ষেপ নিতে পারে তা হলো যাকাতের সুষ্ঠু আদায় ও পরিকল্পিত ব্যবহার। যাকাত আদায় প্রতিটি সাহেবে নিসাব মুসলিম নর-নারীর জন্যে বাধ্যতামূলক। দুঃখের বিষয়, এদেশের অধিকাংশ সাহেবে নিসাব লোকই যাকাতরেঅর্থ বিলি-বন্টন করে থাকে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এবং অপরিকল্পিতভাবে। অথব সমাজে ধনবৈষম্য হ্রাস এবং দরিদ্রদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে যাকাত আদায় এবং তার পরিকল্পিত ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর উপায়।
ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়া যাকাতরে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বহুবিধ। মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে না দেওয়া তার মধ্যে অন্যতম। কারণ সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ায় সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য গভীর হয় ইসলাম যার ঘোর বিরোধী। ইসলামের দাবীই হচ্ছে একটা উন্নত ও সুখী সামাজিক কাঠামো বিনির্মাণে বিত্তশালীরা অবশ্যই শরীয়াহসম্মত উপায়ে তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় ও ব্যবহার করবে। কুরআন শরীফে সূরা আত-তওবায় যাকাত কাদের প্রাপ্য সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এর মধ্যে তিন ধরনের লোক সরাসরি দরিদ্র ও অভাবী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই শ্রেণীর জনগণ যখন যাকাতের অর্থ পায় তখন অর্থনৈতিক কার্যক্রম চাঙ্গা হয়ে ওঠে। যেহেতু দরিদ্রদের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা ধনীদের চেয়ে অনেক বেশী সেহেতু তাদের হাতে অর্থ স্থানান্তর হলে কার্যকর চাহিদা পরিমাণ প্রভূত বৃদ্ধি পায়। ফলে বাণিজ্য, উৎপাদন ও নির্মাণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি পায়। পরিণামে সমগ্র অর্থনৈতিক পরিমন্ডলেই তেজীভাব সৃষ্টি হয়। [দ্রষ্টব্য: দরিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নে যাকাত শীর্ষক প্রবন্ধ।]
মুসলিম বিশ্বের গুটিকয়ে দেশের উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া যাকাতরে অর্থ আদায়, বিলি বন্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনা বা ব্যাপক পরিকল্পনা নেই। ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও উদ্যোগই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। ফলে যাকাতরে সত্যিকার সুফল হতে মুসলিম মিল্লাত বঞ্চিত হচ্ছে। তাই সরকারের উচিৎ হবে মহান খুলাফায়ে রাশিদুনের (রা) অনুকরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার কর্মসূচী গ্রহণ করা। বস্তুতঃ উপযুক্ত পরিকল্পনা, যথাযথ প্রেষণা এবং সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার উপরেই যাকাত হতে কাংখিত আর্থ-সামাজিক কল্যাণলাভ নির্ভরশীল।
আয় পুনর্বন্টন ছাড়াও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যাকাতরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে বলে ফকীহ ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ সর্বসম্মত রায় দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা হতে দেখা গেছে ইয়াতীম নিরক্ষর অদক্ষ প্রতিবন্দী ও পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ ব্যক্তিরা সরাসরি প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করতে পারে না। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত শিক্ষা, শারীরিক যোগ্যতা ও চলাফেরার স্বাধীনতার অভাবই এর কারণ। এরা সরকারের টার্গেট হওয়া উচিৎ এবং এদের জন্যে বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। সমাজ হতে দরিদ্র্য, বেকারত্ব ও হতাশা দূর করতে হলে মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি এদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। এজন্যে যাকাতের অর্থ সরকারের বড় সহায়ক হতে পারে। যাকাত যারা আদায় করে না সেই অমনোযোগী সাহেবে নিসাবদের সতর্ক করা, প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থা করাও সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।
২. কুরবানীর চামড়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ: শরীয়াহ অনুসার কুরবানীকৃত পশুর চামড়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ গরীব-দুঃখীদের হক। সাধারণতঃ যিনি কুরবানী করেন তিনি নিজেই এই অর্থ নিজস্ব পছন্দ মতো গরীবদের মধ্যে বিলি-বন্টন করে দেন। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সমাজসেবী সংগঠন ও মাদরাসাসমূহের লিল্লাহ বোর্ডিং পরিচালনা কর্তপক্ষ পূর্বাহ্নেই সম্ভাব্য কুরবানীকারীর সঙ্গে যোগেোগ করে কুরবানীর পুরো চামড়া অথবা বিক্রয়লব্ধ অর্থের অংশ বিশেষ সংগ্রহ করছেন। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো এককালীন বেশ কিছু অর্থ সংগ্রহে সমর্থ হচ্ছে এবং তাদের প্রয়োজন কিছুটা হলেও পূরণ হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, বেশীর ভাগ চামড়া বিক্রীর অর্থ কোন পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই অভাবী জনগণের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়। এতে সাময়িকভাবে তাদের অভাব কিচুটা পূরণ হলৌ তাদের দরিদ্র্য রয়ে যায় স্থায়ীভাবেই। অথচ এলাকাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী প্রণয়ন করে সেই অনুসারে এই অর্থ ব্যবহার করলে ক্রমে দারিদ্র্যই দূর হতে পারতো।
বাংলাদেশে কুরবানীর চামড়া বিক্রী থেকে কি পরিমাণ অর্থ পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই। এক্ষেত্রে বছরওয়ারী হিসাব দেওয়া সম্ভব না হলেও একটা নির্ভরযোগ্য তথ্য উপাস্থাপন করা যায়। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যুরো অব স্টাটিস্টিকসের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জী, কৃষি শুমারী ও ট্যানারী শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা যায়, এদেশে গত এক দশকে প্রতিবছর গড়ে গরু-মহিষ ও ছাগ-ভেড়া হতে এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ পিস চামড়া পাওয়া গেছে। যারা চামড়া ব্রবসায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট, বিশেষ করে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও আধা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ট্যানারী ও ফ্যাক্টরীতে সরবরাহ করে তাদের কাছ থেকে জানা গেছে তাদের বার্ষিক সংগৃহীত চামড়ার মধ্যে কমপক্ষে ৩০% চামড়া সংগ্রহ হয় শুধুমাত্র ঈদুল আযহার দিনে। তাদের মতে এই দিনে সংগৃহীত গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়ার চামড়ার অনুপাত দাঁড়ায় সাধাণত: ৩:২। এই হিসাব অনুসারে এই দিনে প্রাপ্ত অন্যূন ৪৫ লক্ষ পিস চামড়ার মধ্যে গরুর চামড়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ লক্ষ পিস এবং ছাগল-ভেড়ার চামড়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ লক্ষ পিস। অন্য এক হিসাবেও এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়। ১৯৯১ সালে আদম শুমারী অনুযায়ী এদেশে পরিবারের (Household) সংখ্যা দুই কোটিরও বেশী। এদের মধ্যে অন্ততঃপক্ষে ২০% পরিবার ঈদুল আযহার দিনে কুরবানী করে তাহলেও ৪০ লক্ষ পশুর কুরবানী হওয়ার কথা। উল্লেখ্য, অনেক পরিবারই গরুর পাশাপাশি ছাগল বা ভেড়াও কুরবানী করে থাকে। গরুর কাঁচা চামড়ার দাম আকার নির্বিশেষে প্রতিটি গড়ে টা: ১,০০০/- এবং ছাগল-ভেড়ার কাঁচা চামড়ার দাম প্রতিটি গড়ে টা: ৭৫/- ধরলে বিক্রয়লব্ধ অর্থের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় টা: ২৮৩.৫০ কোটি। বাস্তবে এই পরিমাণ যে আরও বেশী হবে তা বলাই বাহুল্য।
সকল মুসলিম দেশে তো বটেই, অমুসলিম দেশেও মুসলমানরা কুরবানী করে থাকে। গরীবের হক এই বিপুল অর্থ পরিকল্পিত উপায়ে সংগ্রহ করে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী অনুসারেই তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্যেই ব্যবহৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়। দরিদ্র জনসাধারণের হক এই বিপুল অর্থ বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে ব্যয়িত হওয়ার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।
৩. সুদবিহীন সরকারী ঋণ: বর্তমান যুগে ধনীদের ব্যয় প্রবণতা হ্রাসের মাধ্যমে ধনবন্টনে বৈষম্য দূর করার প্রয়াস চলেছে। এক্ষেত্রে গৃহীত কার্যকর পদক্ষেপের মধ্যে সরকারী ঋণ অন্যতম। যদিও সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণ, উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্যে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই জাতীয় ঋণের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যই থাতে বিত্তশালীদের হাতে যে অব্যয়িত সম্পদ রয়েছে তার একটা অংশ বিনিয়োগমূলক কাজে লাগানো এবং একই সঙ্গে তাদের ব্যয় প্রবণতা হ্রাস করা। ফলশ্রুতিতে সমাজের ধনবৈষম্য কিছুটা হলেও হ্রাস পায়, নতুন নতুন কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষতঃ সরকারী উন্নয়নমূলক ব্যয় ও পূর্ব কর্মসূচীর সিংহভাগ অর্থই সমাজের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে যায়।
সুদী ব্যাংকগুলো প্রদত্ত বিপুল ঋণের কারণে সমাজে যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয় তার যথাযথ নিয়ন্ত্রণেল অন্যতম উপায় সরকারী ঋণ। অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ, ব্যবহার ও মেয়াদের উপর অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও সামাজিক কল্যাণ বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই কেন্দ্রীয় ব্রাংকের মাধ্যমে এ ব্যাপারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখা সরকারে অন্যতম দায়িত্ব। বিভিন্ন বৃহৎ ও লাভজনক উন্নয়নমুখী প্রকল্পের জন্যে সরকার সুদভিত্তিক ঋণ গ্রহণর পরিবর্তে মুদারাবা সার্টিফিকেট বা বন্ড চালু করলে উভয় পক্ষেরই মঙ্গল। বিত্তশালীরা এতে অংশ গ্রহণ করে যেমন মেয়াদান্তে লাভের অংশ পেতে পারেন, তেমনি সরকারও সমাজের অব্যয়িত অর্থ শিল্প উন্নয়নসহ বিবিধ উৎপাদনমূলক কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের পাশাপাশি বেকার ও অর্ধবেকার লোকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন। নিরাপদ বিনিয়োগের জন্যে সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট বা বন্ড সব সময়েই সকল মহলে সমাদৃত। তাই মুনাফার হার কম হলেও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্যে সমান আগ্রহী থাকবে। এই বন্ড বা সার্টিফিকেটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর রেয়াতের সুবিধা প্রগতিশীল হারে বৃদ্ধি করলে সম্পদশালীরা এগুলো ক্রয়ে উৎসাহিত হবে। মুখ্যতঃ দরিদ্র্যও বেকারত্ব নিরসনের জন্যে যে ভৗত অবকাঠামো নির্মাণ বিশেষ জরুরী সেজন্যে অর্থায়নের উদ্দেশ্যে এই জাতীয় বন্ড ব্যবহার করলে কাংখিত ফল লাভ আরও ত্বরাণ্বিত হবে।
৪. বাধ্যতামূলক সাদকাহ ও ঐচ্ছিক দানের ব্যবহার: মুসলিম উম্মাহর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকতর কল্যাণের জন্যে যাকাত আদায় ছাড়াও ইসলামে আরও কিছু দান-সাদকাহ প্রদানের নিয়ম রয়েছে যেগুলো সাধ্যানুসারে সকল সঙ্গতিসম্পন্ন মুসলমানই পালন করে থাকেন। সাধারণ ধর্মপ্রাণ নর-নারী বিশেষতঃ বিত্তশালী মুসলমানরা আশুরা (১০ মুহাররম), লাইলাতুল বারাআত (১৫ শাবান), লাইলাতুল কদর (২৭ রমাযান), রাসুলুল্লাহ (স) জন্ম-মৃত্যু দিবস (১২ রবিউল আউয়াল) প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দিন এবং নিজেদের মুরুব্বী ও প্রিয়জনদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গরীব-দুস্থদের মধ্যে নগদ অর্থ, খাদ্র ও কাপড়-চোপড় বিতরণ করে থাকে। এভাবে ব্যয়িত অর্থ তাদের সাময়িক ও খুবই অস্থায়ী উপকার করতে সমর্থ। কিন্তু তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও অভাব-অনটন দূর করার জন্যে কোন কার্যকর কোন স্থায়ী সমাধান দিতে সমর্থ নয়।
ঈদুল ফিতরের দিন যে মুসলমানের ঘরে যাকাতের নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকবে তাকে তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করতে হয়। ফিতরার এই অর্থ পুরোপুরি গরীবের হক। ফিতরার পরিমাণ সাধারণতঃ ১.৭০ কেজি গম বা তার বাজারমূল্য ধরা হয়। পরিবারের সদস্য সংখ্যা হিসাবে ঐ পরিমাণ গম বা তার মূল্য দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে দিতে হয়। মুসলিম উম্মাহর এসব ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ বিশেষ তাৎপর্যবহ দিনে দানের অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী পরিকল্পিত উপায়ে সংগ্রহ করে যদি তহবিল গঠন করা যেতো এবং তা থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্যে কার্যকর স্থায়ী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা যেতো তবে হতভাগ্য বনি আদমদের ধারাবাহিক ও স্থিতিশীল উপার্জনের ব্যবস্থা হতে পারতো। এই বিরাট দায়িত্বের সুষ্ঠু আনজাম দিতে পারে একমাত্র সরকারই।
৫. করযে হাসানা: হযরত মুহাম্মদ (স) এর সময় হতে মুসলিম সমাজে করযে হাসানার বিধান চলে আসছে। ইতহাস সাক্ষ্য দেয়, বিত্তশালী ব্যক্তিরা সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্যে নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধের শর্তে করযে হাসানা দিতেন। করযে হাসানা প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেন-
“তোমাদের মধ্যে কে আছে যে আল্লাহকে করযে হাসানা দিতে প্রস্তুতঃ তাহলে আল্লাহ তাকে কয়েক গুণ বেশী ফিরিয়ে দেবেন। হ্রাস-বৃদ্ধি উভয়ই আল্লাহর হাতে নিহিত।” (সূরা আল-বাকারাহ: ২৪৫ আয়াত)
করযে হাসানার এই বিধান সমাজে ইসলামী উপায়ে প্রয়োজন পূরণের জন্যে অর্থ লেনদেনের এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। করযে হাসানা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক। যথা:-
ক. বেসরকারী খাতে স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগ কার্যক্রমে সহায়তা;
খ. বিত্তশালীদের ব্যয় প্রবণতার সাময়িক হ্রাস; এবং
গ. সুদভিত্তিক ঋণের উচ্ছেদসহ মূল্যস্তরে স্থিতিশীলতা আনয়ন।
এর ফলে সমাজে যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে তেমনি নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা স্থির রাখার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব করযে হাসানার অর্থ পরিশোধের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন তৈরী এবং একই সঙ্গে বিত্তশালীদের এক্ষেত্রে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে করযে হাসানা হিসেবে প্রদত্ত অর্থ আয়কর রেয়াতের সুবিধা পাবে সরকারের এমন উদ্যোগ ফলপ্রসু হবে সন্দেহ নেই। অনুরূপভাবে বিত্তহীন বর্গাচাষী ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি উপকরণ সংগ্রহ এবং যোগ্য ক্ষুদ্র উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের (ফেরিওয়ালাসহ) উদ্যোগ গ্রহণের সুবিধার্থে করযে হাসানা প্রদান কৃষিখাতসহ পল্লী কর্মসংস্থানে শুভু প্রভাব সৃষ্টিতে সক্ষম হবে।
৬. সুদের উচ্ছেদ: ইসলামে সুদকে তার সব রকম অবয়বে চিরকালের জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মানুষের জন্যে যা অকল্যাণকর তা আল্লাহ নিষিদ্ধ বা হারাম করেছেন এবং যা কল্যাণকর তা বৈধ বা হালাল করেছেন। ইসলামী অর্থনীতিবিদদের মতে সুদের উচ্ছেদ এবং তার পরিবর্ত লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা ও উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা সম্পদের আও যুক্তিপূর্ণ বন্টন নিশ্চিত করে। পরিণামে অধিকতর ইনসাফভিত্তিক আয় বন্টন ও কর্মসংস্থারেনরই ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়।
কোন দেশের অর্থনীতি ও সমাজে সুদ যে অপরিমেয় ক্ষতি সাধন করে তা বলে শেষ করা যায় না। পুঁজিবাদের দার্শনিকগণও সুদের উপযোগিতা সম্পর্কে মতৈক্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সুদের ভয়াবহ কুফল ও মারাত্মক আর্থ-সামাজিক পরিণতি সম্পর্কে এই বইয়ের অন্যত্র দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। সেই আলোচনার আ?লোকে নিঃশংকচিত্তে বলা যায় যে, শোষণ ও নিপীড়নের এই বিষবৃক্ষকে যদি সমূলে উৎপাটন করা যায় তাহলে সমাজের মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীই শুধু প্রভূত কল্যাণ লাভ করবে তাই না, সমগ্র আর্থ-সামাজিক পরিমন্ডলেই এক সুস্থ ও কল্যাণময় পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এই মুহূর্তে সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম হতে সুদ উচ্ছেদ কিচুটা দুরূহ মনে হলেও একাজ অসম্ভব নয়। প্রয়োজন আন্তরিকতা ও দৃঢ় সংকল্পের। পর্যায়ক্রমে ছোট ছোট কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্যে পৃথক আইন কাঠামো তৈরী করলে ব্যাংকিং লেনদেন সহজ হবে এবং আমানত সংগ্রহ ও শিল্প-বাণিজ্যে বিনিয়োগ তৎপরতা-বৃদ্ধি পাবে।
সমাজ হতে কার্যকরভাবে সুদ উচ্ছেদের জন্যে ইসলামী ব্যাংক ও বীমা ব্যবস্থার আরও প্রসার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় আর্থিক নীতিমালা গ্রহণ আবশ্যক। এদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে সুদী ব্যাংকের অনুকূলে বিদ্যমান আইনের আওতায় দারুণ প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। এর প্রতিবিধানের জন্যে সরকারকে বাস্তবসম্মত ও সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে অর্থাৎ, একেবারে গ্রামাঞ্চলেও যেন ইসলামী ব্যাংকের সেবা পৌঁছায় সেজন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। অনুরূপভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সম্পদ সমাবেশ ও সঞ্চালনের জন্যে মুদারাবা মুশারাকা ইত্যাদি পদ্ধতি চালু করা সেজন্যে আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্যে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বস্তুতঃপক্ষে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঈমানী চেতনা ও ইসলামী জীবন যাপনের সুপ্ত আকাংখার পরিপোষন ইসলামী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। দারিদ্র্য বিমোচন ও আপামর জনসাধারণের ন্যূনতম মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধান এই দায়িত্ববোধের প্রতিফলন।
গৃহীতব্য কর্মসূচী
বেকার ও দুঃস্থ শ্রেণীর লোকদের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের জন্যে সংগৃহীত যাকাত দিয়ে গঠিত তহবিল ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সরকার নীচের কর্মকৌশল অনুসরণ করতে পারে। শুরুতে বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশে প্রতিটি এলাকায় ভূমিহীন কৃষকদের নিয়ে টার্গেট গ্রুপ তৈরী করাই হবে উচিৎ কাজ। বিত্তহীন বর্গাচাষী ও প্রান্তিক কৃষকদের নিয়েও অনুরূপ গ্রুপ তৈরী করা যায়। প্রতিটি গ্রুপে ১৮-৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩০ জন পর্যন্ত লোক অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। শারীরিক যোগ্যতা, মানসিক প্রবণতা, শিক্ষার মান, সামাজিক পটভূমি ও উদ্যোগ, উদ্যম ও সততার ক্ষেত্রে এদের মধ্যে একটি সাধারণ মিল বা সাদৃশ্য থাকবে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ সমন্বয়ে গঠিত গ্রুপ বা দল অপেক্ষা সমজাতীয় মানুষ সমন্বয়ে গঠিত দল সাফল্য অল্জনের জন্যে অধিকতর উপযোগী। এসব গ্রুপে একজন নেতা, একাধিক উপনেতা ও একজন সম্পাদক থাকবে। এদের প্রয়োজনীয় প্রেষণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে। এই ধরনের দল নিয়মিত পাক্ষিক সভায় মিলিত হবে এবং তাদের কার্যক্রম যথারীতি মনিটর করা হবে। দলের প্রত্যেক পরস্পরের জন্যে গ্যারান্টি দেবে।
এসব টার্গেট গ্রুপকে কোন রকম সার্ভিস চার্জ ছাড়াই উৎপাদনমুখী বা অ-ভোগ্য ঋণ সরবরাহ করা যেতে পারে। বিশেষ জরুরী ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র ভোগধর্মী ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে পারে। কৃষকেরা ফসল বা কৃষিপণ্য ওঠার পরপরই এই ঋণ শোধ করে দেবে। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদেরকে বর্ধিত সময় মনজুর করা যেতে পারে। এর পরেও যদি তারা নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে ঐ ঋণ পরিশোধ করতে না পারে তাহলে যাকাত হতে এই উদ্দেশ্যে আলাদা করে রাখা অর্থ হতেই তা মওকুফ করে দেওয়া হবে। এ ধরনের কৃষিভিত্তিক গ্রুপকে বিনামূল্যে অথবা যথেষ্ট ভর্তুকী দিয়ে উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক সামগ্রী ও সেচ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। ৈএমন কি তাদেরকে গুদামঘর হিমাগার পরিবহন ও বিপণনের সুবিধাও বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে দেওয়া উচিৎ। এর ফলে তারা ভিক্ষুক হওয়ার পরিবর্তে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ পাবে।
অ-কৃষি শ্রেণীর লোকদের জন্যেও টার্গেট গ্রুপ তৈরী করা জরুরী। এই ধরনের গ্রুপ বা দলকে তাদের যোগ্যতা, শিক্ষার মান ও মানসিক গঠন অনুযায়ী উপযুক্ত পেশায় প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে এই ধরনের গ্রুপকে তাঁতের কাজ, দর্জির কাজ, ছুতার মিস্ত্রি, কামার, সাইকেল ও রিক্সা মেরামত, পাওয়ার পাম্প মেরামত, উন্নত জাতের হাঁস-মুরগী পালন, মৌমাছি ও মাছের চাষ প্রভৃতি কর্মসংস্থানমুখী ও উৎপাদনধর্মী বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষিত বেকার যুবকদের নানা ধরনের পেশা বা বৃত্তিমূলক কাজের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে এই তহবিল হতেই। পরিণামে তারা গ্রামাঞ্চল ছাড়া শহরেও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। ক্রমবর্ধিষ্ণু শহর ও মহানাগরীতে তো বটেই ইউনিয়ন ও থানা সদরেও ক্রমেই নানা পেশার লোকের চাহিদা বেড়ে চলেছৈ। এর মধ্যে রয়েছে উলের কাজ ও এম্ব্রয়ডারী রাজমিস্ত্রি, ছুতার মিস্ত্রি দর্জি ওয়েলডার কনফেকশনার বুক বাইন্ডার ইলেক্ট্রিশিয়ান লেদ অপরেটর রেডিও-টেলিভিশন মেকানিক, মোটর সাইকেল মেকানিক মোটর গাড়ী ও ট্রাক ড্রাইভার, ক্রমবর্ধমান ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের জন্যে দক্ষ ও কুশলী শ্রমিক এবং একেবারে সাম্প্রতিককালে প্যারামেডিক এবং ফটোকপিয়ার/ফটোষ্ট্যাট ও কম্পিউটার অপরেটর। বিশেষ করে শেষোক্ত যন্ত্রটির জন্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর চাহিদা বলা যায় অফুরন্ত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ ভিত্তিতে এই সমস্ত পেশায় প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া মহিলাদের প্রশিক্ষণের জন্যেও যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
বেকার যুবক-যুবতীদের জন্যে গৃহীতব্য এসব প্রশিক্ষণমূলক কর্মসুচীর, যা পরিণামে আয়বর্ধক ও কর্মসংস্থানমূলক, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয়ের পুরোটাই যেমন বহন করতে হবে তেমনি প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে প্রশিক্ষণার্থীর ব্যক্তিগত ব্যয়ভার বহন করার ব্যবস্থা থাকতে হবে যাকাত বা এই ধরনের অর্থ দিয়ে তৈরী তহবিল হতেই। প্রশিক্ষণ শেষে ‘আয় থেকে দায় শোধ’ নীতির ভিত্তিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও উপকরণও সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে তারা যে বেকার ছিল সেই বেকারই রয়ে যাবে। উপযুক্ত পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা নিয়ে এই কর্মসূচী গ্রহণ করলে বিপুল সংখ্যক বেকার ও আধাবেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের যেমন উপায় হবে তেমনি প্রয়োজনীয় সরঞ্চাম ও উপায়-উপকরণ পাওয়ার ফলে স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানের বিপুল সুযোগ সৃষ্টি হবে।
প্রায় সকল মুসলিম দেশে ঘুর্ণিঝড় বন্যা ভূমিকম্প খরা জলোচ্ছ্বাস নিয়মিতই দেখা দিচ্ছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শত শত পরিবার, যারা গতকালও ছিল সম্পদশালী গৃহস্থ, রাতারাতি গৃহহীন কপর্দকহীন সহায়-সম্বলহীন পথের মানুষ হয়ে দাঁড়ায়। উপযুক্ত এবং সময়োচিত মনোযোগ ও সহযোগিতার অভাবে এরা শামিল হয়ে যায় ভূমিহীন কৃষক ও দিনমজুরদের দলে। কেবলমাত্র কার্যকর ও পরিকল্পিত পুনর্বাসন কর্মসূচীই হতে পারে প্রাকৃতিক সুর্যোগ কবলিত এই মানুষগুলোকে পুনরায় তাদের পায়ে দাঁড়াবার জন্যে সাহায্য করতে। এজন্যে যাকাতের অর্থ অবশ্যই ব্যবহার করা যায়। ব্যবহার করা যায় অন্যান্য বাধ্যতামূলক দানের অল্থ ও উশরের ফসল। সরকারকে এদিকেও মনোযোগী হতে হবে।
একটি মুসলিম সরকার দরিদ্র ও অভাবীদের দারিদ্র মোচন ও কর্মসংস্থানের জন্যে করযে হাসানার অর্থও ব্যবহার করতে পারে। টার্গেট গ্রুপের লোকদের জন্যে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনমুখী উদ্যোগ গ্রহণের উদ্দেশ্য সমাজের বিত্তশালীদের সরকারের করযে হাসানা তহবিলে অর্থ প্রদানে উৎসাহিত করা সম্ভব। ব্যক্তির মর্জি ও অভিরুচির উপর এই কাজ ছেড়ে না দিয়ে সরকারী পর্যা?য়েই তহবিল সংগৃহীত হতে পারে। অবশ্য এই তহবিলে কি পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হবে তা বহুলাংশে নির্ভর করবে জনগণের আন্তরিকতা এবং সরকারী প্রশাসনযন্ত্রের দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার উপর।
বাধ্যতামূলক অন্যান্য দানের অর্থ (যথা সাদাকাতুল ফিতর, কাফফারা) দিয়েও সরকার কল্যাণ তহবিল গঠন করতে পারে। এইা তহবিলের অর্থ থেকে দরিদ্র বৃদ্ধ অন্ধ দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ সহায়-সম্বলহীন বিধবা ও ইয়াতীম গরীব পরিবারের শিশু প্রভৃতিদের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। এদেরকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা প্রদান, স্বল্পমূল্যে পুষ্টিকর খাদ্য, শীতকালে গরম কাপড় ও জ্বালানী সরবরাহ প্রভৃতি নিত্যদিনের অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা কোন সমাজকল্যাণ কর্মসূচীই ফলপ্রসু ও কার্যকর হবে না যদি শত সহস্র বনি আদম ক্ষুধাতুর ও অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ভীড় জমায় এবং ইয়াতীম ও রুগ্নরা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বিরাট এই কর্মোদ্যোগের জন্যে যে বিপুল জনবল দরকার তা কি সরকারের রয়েছে? েএজন্যে যে বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন তার সংস্থান হবে কিভাবে? উত্তরে বলা যায়, যাকাত ও অন্যান্য বাধ্যতামূলক দানের অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ও আর্থ-সামাজিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্যে প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার দেশের দুই লক্ষাধিক মসজিদের ইমামসাহেবদের সাহায্য নিতে পারেন। বিশেষতঃ সরকারের ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী ও বাংলাদেশ মসজিদ মিশন পরিচালিত ইমাম প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইমামদের একাজে লাগানো যেতে পারে। এর ফলে অর্থ সংগ্রহ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যে সরকারের যেমন আলাদা দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান তৈরীর প্রয়োজন হবে না তেমনি বেতন-ভাতা বাবদ আলাদা অর্থ ব্যয়েরও প্রয়োজন হবে না। আমাদের দেশের ইমামদের একটা অংশ তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষিত এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পর্কে সম্যক অবহিত না হলেও ধর্মীয় নেতা হিসাবে তারা সমাজের শ্রদ্ধেয়, সম্মানিত ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসাবে স্বীকৃত। সমাজে তাদের প্রভাবও যথেষ্ট। জনগণের সাথে তারা ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং জুম’আর কুতবার মাধ্যমে স্ব স্ব এলাকার বিত্তশালী লোকদেরকে তাদেরই মন্দভাগ্য প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যে পরিকল্পিত ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক দানের অর্থ একটা নির্দিষ্ট তহবিলে জমা দেওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম ও ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ের অধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে ১৯৭৯ সাল হতে ইমামদের জন্যে ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বিষযক ছয় সপ্তাতের আবাসিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী সাফল্যেল সাথে পরিচালিত করে আসছে। এ পর্যন্ত ষাট হাজারের অধিক ইমাম এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে অংশ গ্রহণ করেছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ইমামদের যদি যথাযথ দায়িত্ব দেওয়া যায় এবং সংগৃহীত অর্থের নির্দিষ্ট একটা অংশ (১০%-১২%) সম্মানী হিসেবে গ্রহণের অনুমতি দিয়ে বাকী অর্থ কোন বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিকটবর্তী শাখায় নির্দিষ্ট এ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার বিধান করা যায় তাহলে তারা যে শুধু অগ্রাহান্বিত হবেন তাই না, দেশব্যাপী যাকাতের অর্থ সংগ্রহের মত সুকঠিন ও ব্যয়বহুল একটা কাজ সুচারুভাবে সম্পনন হবে বলে আশা করা যায়।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আ্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্যে এ পর্যন্ত যে সমস্ত নীতি-নির্ধারণমূলক কৌশলের কথা বলা হলো তার বাইরেও বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক ইসলামী ও সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা, সার্বজনীনি স্বাক্ষরতা, গ্রামীন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, স্বল্প ভাড়ায় আবাসন সুবিধা, স্বল্প ব্যয়ে শৌচাগার তৈরী প্রভৃতির ব্যবস্থা করে সরকার দারিদ্র্য নিরসনে সহায়তা করতে পারে। উপরন্তু গরমৌসুমে পর্যাপ্ত পূর্ত কর্মসূচীর ব্যবস্থা করে বেকার লোকদের কর্মসংস্থান করাও সরকারের দায়িত্ব। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলের ইসলামী সরকারসমূহ ব্যাপক পূর্ত কর্মসূচী গ্রহণের মধ্যে দিয়ে প্রভূত কর্মসংস্থানের ব্রবস্থা করেছে যার ফলে তখন বেকার সমস্যার কথা শোনা যায়নি।
গ. নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ
দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে সমাজ আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের বাস্তবায়ন জরুরী। তাই এ পর্যন্ত যে সমস্ত উপায় ও কর্মসূচীর কথা বলা হয়েছে সে সবের বাইরেও সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। অবশ্য এসব ব্যবস্থা শরীয়াহ নির্ধারিত সীমার মধ্যেই থাকতে হবে। সাম্প্রতিক ও অতীত কালের সকল ফিকাহবিদ এ ব্যাপারে ঐক্যমত যে আর্থ-সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সরকারকে অবশ্যই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে; প্রয়োজনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও চূড়ান্ত প্রতিরোধমূলক পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
সরকারকে এই দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই দিয়েছেন। রাসূলে করীমের (স) বহু হাদীসেও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে। উপরন্তু এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ইবনে তাইমিয়া তাঁর আল-হিসবাহ ফি আল-ইসরাম গ্রন্থে, ইবনে হাযম আলোচনা করেছেন তাঁর আল-মুহাল্লায় এবং আবু ইউসুফ তাঁর কিতাবুল খারাজ বইয়ে। আল-শাতিবী, ইবনে খালদুন এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীও দারিদ্র্য বিমোচন সরকারের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের পাশাপাশি নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-
“তাদের (সম্পদশালীদের) ধনসম্পদে হক রয়েছে যঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।” [সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত]
এই নির্ধারিত অংশে ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে দরিদ্রদের কল্যাণে ব্যয় করতে হলে সরকারকে এমন সব কৌশল ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় যা প্রকৃতিতে নিবর্তনমুলক। নীতি বা কৌশল হিসাবে রাষ্ট্রের অনেক সময়েই কঠোর সন্দেহ নেই, তবে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে তা মেনে নিতেই হয়। এক্ষেত্রে শরীয়াহ মুতাবিক যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণের অনুমতি রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো:
১. ব্যক্তিবিশেষের কাজের স্বাধীনতা খর্ব;
২. ব্যবসায়িক কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ;
৩. ক্ষেত্র ও সময়বিশেষের মূল্য, মজুরী, খাজনা ও মুনাফার হার নির্ধারণ;
৪. সুবিচারপূর্ণ কর আরোপ ও কর ফাঁকি প্রতিরোধ;
৫. ক্রয়-বিক্রয় ও ভাড়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট শর্ত আরোপ;
৬. সম্পদের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ;
৭. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন;
৮. সম্পদ বা শিল্পবিশেষের আংশিক বা পূর্ণ জাতীয়করণ;
৯. আর্থিক জরিমানা আরোপ; এবং
১০. সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।
এসব পক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার ধন-বন্টনের বৈষম্য হ্রাসের পাশাপাশি দরিদ্র ও অভাবী জনগণের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের জন্যেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। কারণ আদল ও ইহসানের বাস্তবায়ন ছাড়া সহায়-সম্বলহীন মানুষের দুর্দশা লাঘব হয় না বরং উত্তরোত্তর তা বেড়েই চলে।
উপসংহার
একথা বলা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক হবে না যে, দু-একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ মুসলিম দেশের সরকারই প্রশাসনিক, আর্থিক ও সাংবিধানিক দিক থেকে ইসলামী শরীয়াহ হতে বহু দূরে। সেসব দেশের অধিকাংশই পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী দেশসমূহের অন্ধ অনুকরণে সচেষ্ট। সউদী আরব ও কুয়েতের মতো ধনী দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় দরিদ্র মুসলিম দেশের সরকারসমূহের প্রশাসনিক, আর্থিক ও সাংবিধানিক ক্ষেত্রে ইসলামী বিধি-বিধানের অনুসারী আইন ও নীতি-পদ্ধতি প্রয়োগের কোন স্বাধীনতা নেই। উপরন্তু যদিই বা কখনও কোন মুসলিম সরকার ইসলামী শরীয়াহ অনুসারে কোন আইন বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হয় তাহলে গোটা পাশ্চাত্যের মিডিয়া জগৎ, যার প্রায় পুরোটাই ইহুদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়, শুরু করে জঘন্য অপপ্রচার। ফলশ্রুতিতে পাশ্চাত্যের কৃপাভিখারী ঐ সরকার প্রস্তাবিত পদক্ষেপটি হয় বাতিল করে নতুবা পরবর্তীতে করার আশ্বাস দিয়ে ফাইলবন্দী করে রাখে।
এখানেই শেষ নয়। অনেক সময় ঐসব দেশের অভ্যন্তর হতেও তীব্র প্রতিবাদ উত্থিত হয়। কারণ প্রায় সব মুসলিম দেশেই সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো ইসলামী অনশাসন প্রতিষ্ঠার বিরোধী। এর প্রধান কারণ দুটো; (ক) প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার অভাব, এবং (খ) সরকারের সকল ধরনের উঁচুপদে সমাসীন ব্যক্তিরা পুঁজিবাদ বা সমাজবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত। কিন্তু কৌশলগত কারণে অধিকাংশই সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দেয়। ইসলামের নাম শুনলেই এদের এ্যালার্জি দেখা দেয় এবং কিভাবে তার প্রতিরোধ করা যায় তার উপায় খুঁজতে শুরু করে। সুতরাং, যদি কখনও কোন মুসলিম সরকার শরীয়াহ আইন প্রবর্তন বা ইসলামী বিধানের আলোকে বিদ্যমান আইন ও বিধি সংস্কার করতে উদ্রোগ নেয় ত াহলে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হবে এদের কাছ থেকেই। কারণ এসব বিধি-বিধান যেমন মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক জীবনকে ইসলামীকরণের দিকে এগিয়ে নেবে তেমনি কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থে কুঠারাঘাত হানবে। ইতহিাস সাক্ষী, কায়েমী স্বার্থবাদীরা কখনই সামাজিক সাম্য ও সুবিচার, আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা চায়নি। কারণ তাহলে তাদের নির্দয় শোষণ ও নির্মম অবিচারের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে।
এই সংকট হতে উত্তরণের জন্যে দুটি পথ খোলা রয়েছে। প্রথমতঃ দারিদ্র্য বিমোচনসহ সকলের ন্যূনতম মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে ব্যাপক কল্যাণধর্মী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জেন্য সরকারের দৃঢ় সংকল্পের প্রকাশ ঘটাতে হবে, এবং দ্বিতীয়তঃ মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারে সক্ষম এমন সব প্রতিষ্ঠানের উপর অন্তর্ববর্তীকালীন সময়ের জন্যে নির্ভর করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে সরকারকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কর্মসূচী শুরু করতে হবে যথোচিত দৃঢ়তা ও সংকল্পের সাথে। তাহলেই দারিদ্র্য ও হতাশামুক্ত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।