ইসলামী ব্যাংকিংএর রূপরেখা
ক. বৈশিষ্ট্য
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় সর্বকালের জন্যে, সকল বনি আদমের জন্যে একদিকে যেমন ব্যবসাকে বৈধ ঘোষণা করেছেন অন্য দিকে সুদ ও সুদভিত্তিক সকল কার্যক্রমকে চিরতরে নিষিদ্ধ করেছেন। অথচ আজকের দুনিয়ায় সুদের সর্বগ্রাসী সয়লাব চলছে। সব ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেন, ব্যবসায়িক কায়-কারবার সর্বত্রই সুরেদ অপ্রতিহত ও অবারিত গতি। সুদ সমাজ শোষণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, যুলুমের সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র। সুদের মাধ্যমে সমাজকে সবচেয়ে সুকৌশলে ও বেশী শোষণ করছে আজকের সনাতনী ব্যাংক ব্যবস্থা। কি পুঁজিবাদী দেশ, কি সমাজতন্ত্রী দেশ, কি মুসলিমপ্রধান দেশ সর্বত্রই সনাতনী ব্যাংকগুলো সুদী কারবারে লিপ্ত। যারা ব্যাংক হতে নানা প্রয়োজনে ঋণ নেয় তারা তো সুদ দিতে বাধ্য হয়ই, এমন কি যারা শুধু নিরাপত্তা ও সঞ্চয়ের জন্যেই ব্যাংকে টাকা আমানত রাখে তাদেরও মুনাফার লেবাস পরিয়ে ব্যাংক সুদ নিতে প্ররোচিত করে।
সমাজবিধ্বংসী, যুলুমকারী এবং শোষণের সকল মাধ্যম এই সুদের হাত থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করার জন্যেই বর্তমানকালে সৃষ্টি হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (OIC) জেনারেল সেক্রেটারিয়েট ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে- “Islamic bank is a financial institution whose states, rules and procedures expressly state its commitment to the principles of Islamic Shariah and to the banning of the receipt and payment of interest on any of its opeations”.
অর্থাৎ, ইসলামী ব্যাংক এমন একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা তার বিধি, আইন-কানুন এবং কর্মপদ্ধতির মধ্যে দিয়ে ইসলামী শরীয়াহর নীতিমালার প্রতি সুস্পষ্ট আনুগত্য প্রকাশ করে এবং তার কোন কার্যক্রমেই সুদের কোনও রকম লেনদেন করে না।
যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান সেহেতু ইসলামে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পারস্পরিক লেন-দেন প্রভৃতি সব কিছুরই সুস্পষ্ট বিধি-বিধান রয়েছে। অথচ সুদ প্রথা চালু থাকার কারণে ইসলামী বিধি-বিধান মেনে এসব কাজে অংশ গ্রহণ করা মুসলমানদের পক্ষে অসম্ভব। ইসলামী ব্যাংক এই সমস্যা পূরণের জন্যেই এগিয়ে এসেছে। এর কাজের পদ্ধতি অন্যান সব ধরনের ব্যাংক হতে পৃথক এবং কিভাবে এই ব্যাংক তার কার্যপদ্ধতি পরিচালনা করে থাকে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। এই পার্থক্যগুলো ইসলামী ব্যাংকিং-এর বৈশিষ্ট্য।
ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে পাঁচটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। যথা- (১) সুদ বর্জন, (২) শরীয়াহ্সম্মত উপায়ে শিল্পোদ্যোগ ও ব্যবসায়ে অংশ গ্রহণ, (৩) শরীয়াহ সুপারভাইজারী বোর্ড, (৪) যাকাত ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, এবং (৫) সমাজ উন্নয়নে অংশ গ্রহণ।
১. সুদ বর্জন: ইসলামী ব্যাংকের প্রথম ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ব্যাংক সুদের ভিত্তিতে কোন প্রকার লেন-দেন বা ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না। যে সুদ হারাম, ঘৃণ্য ও সমাজবিনাশী সেই সুদের অনুপ্রবেশ যেন ইসলামী সমাজে ঘটতে না পারে সেজন্যে এই ব্যাংক নিজেই শুধু সুদী কারবার হতে বিরত থাকবে না, অন্যকেও বিরত থাকতে সহায়তা করবে। সুদ নেবে না, দেবে না, খাবে না এবং খাওয়াবে না। সুতরাং সুদের হিসাব রাখা বা সাক্ষী থাকারও প্রয়োজন হবে না। সহীহ হাদীস অনুসারে সুদের হিসাব রাখা ও সুদের সাক্ষী থাকাও কবীরা গুণাহ। তাই সুদের পাপ হতে মুসলিমদের মুক্ত রাখার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা করবে এই ব্যাংক। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কল-কারখানা স্থাপন, বৈদেশিক লেন-দেন সব ক্ষেত্রেই এই ব্যাংকের নীতি ও কৌশল হচ্ছে সুদ বর্জন করা এবং ধীরে ধীরে সমাজ হতে এর উচ্ছেদ করা।
২. শরীয়াহসম্মত শিল্পোদ্যোগহ ও ব্যবসায়ে অংশ গ্রহণ: ইসলামী ব্যাংকের দ্বিতীয বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শরীয়াহসম্মত শিল্পোদ্রোগ ও ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ। শিল্পোদ্রোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগের সময় ঐসব উদ্যোগ শরীয়াহর বিচারে হালাল না হারাম তাও ইসলামী ব্যাংক বিচার করে থাকে। প্রচলিত পদ্ধতিতে কোন ঋণ দেওয়ার সময় আদৌ বিচার করা হয় না যে, উদ্দেশ্রে ঋণ দেওয়া হচ্ছে সেই কাজটি সমাজের জন্যে কল্যাণকর না ক্ষতিকর। সমাজের তাতে মঙ্গল হবে, না সর্বনাশডেকে আনচে? সমাজের বিপর্যয় ও সর্বনাশ সৃষ্টিকারী মদ ও মাদক দ্রব্যের ব্যবসা, চরিত্রবিধ্বংসী নানা ধরনের উপকরণসহ সিনেমা, নাচ-গান, তামাক ও সিগারেটের মতো জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর সামগ্রী উৎপাদন, মজুতদারী, মুনাফাখোরী প্রভৃতি নানা কাজে সুদী ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে থাকে। েএতে সমাজের সর্বনাশ আরও বেশী ডেকে আনা হয়। আগুনে পেট্রোল চাললে যেমন আগুন আরও দাও দাউ করে জ্বলে ওঠে এও ঠিক তেমনি। সমাজ হতে অনাচার, পাপাচার, অশ্লীলতা প্রভৃতি দূর করার চেষ্টা করা দূরে থাকা সুদী ব্যাংকগুলো নির্বিচার ঋণ দেওয়ার ফলে এসব বরং আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক এর প্রতিরোধ করতে চায়। এ জন্যেই শুধু শরীয়াহসম্মত শিল্প-কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতিতে এই ব্যাংক সহযোগিতা করে। ব্যাংক দুভাবে একটি করে থাকে: (ক) লাভ-লোকসানের অংশীদারীত্বের চুক্তিতে অংশ গ্রহণ এবং (খ) প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ
(ক) লাভ–লোকসানের অংশীদারীত্বের চুক্তিতে অংশ গ্রহণ: ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, কল-কারখানা প্রভৃতি তৈরীতে তার মূলধন বা তহবিল দিয়ে অংশ গ্রহণ করে থাকে। ব্যাংক এক্ষেত্রে উদ্যোক্তার সাথে লাভ-লোকসানে অংশগ্রহণের চুক্তিকে পুঁজির অংশবিশেষ বা পুরোটাই সরবরাহ করতে পারে। এসব কাজে লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন পূর্ব নির্ধারিত শর্ত অনুসারেই ব্যাংক তা ভাগাভাগি করে নেবে। অর্থাৎ, লাভ হলে ব্যাংক যেমন তার পূর্ব নির্ধারিত অংশ পাবে, তেমনি লোকসান হলে তারও অংশ ব্যাংক বহন করবে।
(খ) প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ: ইসলামী ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিল এবং আমানতকারীদের সম্মতিক্রমে তাদের তহবিল হতে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে নিজস্ব মালিকানাতেই শরীয়াহ অনুমোদিত ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা প্রভৃতি গড়ে তুলবে। এ ক্ষেত্রে লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন তার দায়-দায়িত্ব ব্যাংকেরই। সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো এরকমকোন উদ্যোগ নেয় না।
সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার কোথাও এমন পদ্ধতি নেই। প্রচলিত ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয় ঠিকই কিন্তু ব্যাংক নিজে এসব প্রকল্প ও ব্যর্থতা নিয়ে ব্যাংকের কোন মাথা ব্যাথা নেই। বরং লোকসানের কোন রকম সম্ভাবনা দেখলেই সুদনির্ভর ব্যাংকগুলো তাদের দেওয়া ঋণ দ্রুত পরিশোধের জন্যে চাপ দেয় কিংবা ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ঐ ব্যবসা বা কারবারটি আরও সংকটের সম্মুখীন হয়, এমন কি ধ্বংসও হয়ে যায়।
৩। শরীয়াহ সুপারভাইজরী বোর্ড: ইসলামী ব্যাকসমূহের একটি প্রধান ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্র হচ্ছে এর শরীয়াহ সুপারভাইজারী বোর্ড। ব্রাংকের লেন-দেন ব্যবসা-বাণিজ্য, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মূলধন বা তহবিল বিনিয়োগ, নিজস্ব প্রকল্প স্থাপন ইত্যাদি কোন কিছুতেই যেন সুদের স্পর্শমাত্র না থাকে, কোন কাজেই যেন শরীয়াহর বরখেলাপ না হয় তা দেখার জন্যে প্রতিটি ইসলামী ব্যাংক তার প্রতিষ্ঠার শুরুতেই গঠন করে শরীয়াহ বোর্ড।ঠ কোন কোন ইসলামী ব্যাংকে এর নাম শরীয়াহ সুপাইজরী কাউন্সিল। এই বোর্ডের সদস্য সংখ্যা সাধারণত পাঁচ বা সাত জন হয়ে থাকে। এদের মধ্যে সংখ্যাগুরু থাকেন সুবিজ্ঞ আলেম ও ফকিহগণ। বাকীদের মধ্যে থাকেন একজন প্রখ্যাত প্রবীণ ব্যাংকার। এরা শুধু যে ব্যাংককে শরীয়াহসম্মতভাবে চলতে পরামর্শই দেন তা নয়, ব্যাংক ভুল পথে চলতে চাইলে ব্যাংকের আর্টিকেলস অব এগ্রিমেন্টেই তাতে বাঁধা দেবার ক্ষামতাও এই বোর্ডের রয়েছে।
৪। যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন: ইসলামী ব্যাংকের চতুর্থ ও অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হ চ্ছে যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। যাকাত ইসলামের পাঁচটি রুকুনের অন্যতম এবং গুরুত্বের দিক দিয়ে নামাযের পরেই এর স্থান। ইসলামী ব্যাংক তার উদ্ধৃত্ত তহবিল ও অব্যবহৃত অর্থের উপর যাকাত দিয়ে থাকে। ব্যাংক তার গ্রহকদের নিকট থেকেও যাকাত সংগ্রহ করে থাকে। যাকাত তহবিলের এই টাকা ব্যাংক শরীয়াহসম্মত খাতেই ব্যয় করা হয়। আজকের সমাজে মুসলমানরা বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ও উদ্দেশ্যহীনভাবে যাকাত প্রদান করে থাকে। এতে সমাজের কোন স্থায়ী কল্যাণ সাধন হয় না। দরিদ্র ও সমাজের কম ভাগ্যবানদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। তাই ইসলামী ব্যাংক চেষ্টা করে যাকাত তহবিলের অর্থ দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান, কর্মসংস্থানমুখী উপকরণ সরবরাহ ও শিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা করার পাশাপাশি স্কুল, মক্তব ও হাসপাতাল প্রভৃতির মতো সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান ও নিয়মিত আয়ের একটা নিশ্চয়তা গড়ে তুলতে ইসলামী ব্যাংকগুলো বদ্ধপরিকর। সমাজে ধনী-দরিদ্রের-শ্রেণী বৈষম্য হ্রাস করার জন্যে এটি একটি কার্যকর ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
৫। সমাজ উন্নয়নে অংশগ্রহণ: ইসলামী ব্যাংকের সর্বশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো, অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সামাজিক উন্নতি অর্জন করা। দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় ও সম্পর্ক না থাকলে কারোরই প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। তাই ইসলামী ব্যাংক কি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসায়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, কি নিজস্ব প্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে সব সময়েই এই লক্ষ সামনে রাখে যে, এসব কাজ সমাজের উন্নতিতে কতটা সহায়ক হবে? ব্যক্তির অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে জনসাধারণের উন্নতি কতটা হবে?
সমাজের প্রয়োজন ব্যাপক ও ব হুমুখী। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এজন্যেই সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো সিনেমা হল নির্মাণ বা সিনেমা শিল্পে অর্থ ঋণ দেওয়া ইসলামী ব্যাংক তা আদৌ চাইবে না। কারণ সিনেমার প্রসারের ফলে সমাজের ণৈতিক অবক্ষয় আরও দ্রুত ও ব্যাপক হবে। সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আদৌ এ বিষয়ে মাথা ব্যাথা নেই। আবার ইসলামী ব্যাংকগুলো সৎ ও যোগ্যতাসম্মপন্ন বিত্তহীন লোককে করযে হাসানা বা মুদারাবার ভিত্তিতে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করবে, কিন্তু সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো এই উদ্যোগ নেবে না। ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য হলো ব্যক্তির কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তার ও তার পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের সুযোগ সৃষ্টি ক রা। ফলে সমাজে সুস্থ ও কল্যাণধর্মী পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পক্ষান্তরে সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো শুধু স্ব স্ব স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে তৎপর। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ক্ষেত্রে সুদভিত্তিক ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে দুস্তর ও দুরতিক্রম্য ব্যবধান রয়েছে। বিশেষ করে সমাজকলাণ ও সমাজের সুস্থ ও সুষ্ঠু উন্নয়নের জন্যে সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর কোন পরিকল্পনা নেই। এদিক দিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো একটি স্বস্তিকর ও মহৎ ব্যতিক্রম। এটি এই ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যও বটে।
এ সব বৈশিষ্ট্য অর্জনের সাথে সাথে নিচের উদ্দেশ্যগুলো অর্জনেও ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকগুলোকে তৎপর থাকতে হবে। তাহলে একাধারে ইসলামী বৈশিষ্ট্য অর্জন ও দেশের অর্থনীতিতে কাঙ্খিত অবদান রাখার পাশাপাশি বর্তমান সময়ে অর্থণৈতিক কর্মকাণ্ডে যারা অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ তাদের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক সত্যিকার কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও গুরুত্ব অর্জনে সক্ষম হবে। এসবের মধ্যে রয়েছে:
১। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা;
২। বিত্তহীন ও স্বল্প আয়েল লোকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন;
৩। মানব সম্পদ উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি;
৪. ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ; এবং
৬. মানব কল্যাণের সাথে পরিবেশ উন্নয়ন।
খ. বিনিয়োগ কৌশল
সুদী ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের যে বিপুল পার্থক্য তার প্রায় সবটাই কাজের প্রকৃতির ক্ষেত্রে। ব্যাংককে যেমন তহবিল ও আমানত সংগ্রহ করতে হয় তেমনি তা কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জনও করতে হয়। আমানত সংগ্রহ ও সংগৃহীত অর্থ ব্যবহার দুটি ভিন্নধর্মী কাজ। প্রথমটির ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের পদ্ধতির সাথে সুদী ব্যাংকিং পদ্ধতির সাথে যথেষ্ট মিল রয়েছে। পার্থক্য যা তা অধিকাংশই আমানতের শিরোনাম ও ব্যবহারগত। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সুদী ব্যাংকের সাথে রয়েছে তার আমুল পার্থক্য।
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, অর্থনৈতিক দিক থেকে চালু ও সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকতে হলে এবং অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চাইলে ইসলামী ব্যাহক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসমূহকে যথেষ্ট পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে হবে। এথেকে তার নিজস্ব পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মেটানো ছাড়াও শেয়ারহোল্ডার, বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীরে সন্তোষজনক হারে ডিভিডেণ্ড ও মুনাফা দিতে হবে। এই সমুদয় কাজই করতে হবে শরীয়াহসম্মত উপায়ে। কিন্তু কিভাবে?
প্রচলিত সুদী ব্যাংকগুলো এমন অনেক উপায়ে উপার্জন করে যেগুলো শরীয়াহর দৃষ্টিতে বৈধ। কিন্তু যেহেতু সেই আয় পৃথক করে না রেখে অন্যান্য সুদী আয়ের সাথে সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয় সেহেতু তা শরীয়াহর দৃষ্টিতে আর হালাল বা বৈধ থাকে না। সুদী ব্যাংকের এসব আয়ের মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট সার্ভিস চার্জ বা ‘উজরার’ (ফি ও কমিশন) বিনিময়ে জনসাধারণের জন্যে নানা ধরনের সেবামূলক কাজ। উদাহরণস্বরূফ ডিমাণ্ড ড্রাফট, পে-অর্ডার, ক্রেডিট কার্ড প্রবৃতি ইস্যু, বিভিন্ন বিলের অর্থপ্রদান, অর্থ সম্পদ হস্তান্তর, লকার সার্ভিস, স্থাপর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়ে সাহায্য প্রভৃতির উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা গেছে সুদভিত্তিক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের মোট আয়ের ৩০%-এর বেশী এই ধরনের সেবামূলক কাজ হতে আয় করে থাকে। ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকও জনগণকে এইধরনের সেবা দিয়ে যাবে এবং সঙ্গতঃভাবেই তার মোট আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এই প্রথাগত কিন্তু হালাল উপায়ে উপার্জন করবে।
প্রশ্ন হলো: ইসলামী ব্যাংক কিভাতে তার তহবিল বিনিয়োগ করবে? সুদের ভিত্তিতে বিনিয়োগ ইসলামে নিষিদ্ধ, কিন্তু লাভ-লোকসানের অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ শরীয়াহ্ সম্মত। সুতরাং, ইসলামী ব্যাংক সুদের পরিবর্তে লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করেই উপার্জনের চেষ্টা করবে। বস্তুঃপক্ষে ইসলামী ব্যাংকের সকল ধরনের আর্থক সহযোগিতাই বিনিয়োগমূলক, সুদী ব্যাংকের মতো ঋণমূলক নয়। এভাবে বিনিয়োজিত অর্থ হতে প্রাপ্ত মুনাফা থেকেই ইসলামী ব্যাংক তার পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ ছাড়াও শেয়ারহোল্ডার, বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের মুনাফা দেবে। বিভিন্ন দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে এবং তাদের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে কুড়িটি পদ্ধতি আর্থিক দিক দিয়ে সফল বলে প্রমানিত হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো শুধু যে আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে তাই নয়, বরং উত্তরোত্তর সাফল্য অল্জন করে চলেছে। তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। শুধু মসিলম দেশসমূহেই নয়, অমুসলিম দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকগুলোও একই পদাংক অনুসরণ করে চলেছে। এই পদ্ধতিগুলো সম্পূর্ণ শরীয়াহসম্মত। নিম্নে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া গেল।
১. মুদারাবা: এই পদ্ধতিতে ব্যাংক কোন যৌথ উদ্যোগ ব্যবসায় বা কারবারে একাই সমুদয় অর্থ সরবরাহ করে এবং উদ্যোক্তা তার শ্রম, সময় ও অভিজ্ঞতা বিনিয়োগ করে থাকে। এখানে ব্যাংককে বলা হয় সাহিব আল-মাল এবং তহবিল ব্যবহারকারী বা উদ্যোক্তাকে বলা হয় মুদারিব। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক সরাসরি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয় না অথবা মুদারিবের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। মুদারাবা পদ্ধতিতে ব্যাংক ও উদ্যোক্তা পূর্ব নির্ধারিত হারে (৭৫%: ২৫%; ৭০%:৩০%; ৬০%:৪০%; ৫০%:৫০%; ৪৫%:৫৫%; ৪০%:৬০%; ইত্যাদি) লাভের অংশ ভাগ করে নেয়। মূলধনের পরিমাণের সাথে লাভের অংশ কোনক্রমেই সম্পর্কযুক্ত নয়। উপরন্তু কোনপক্ষই মুনাফার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে নিতে পারবে না। তবে লোকসান হলে তার পুরোটাই ব্যাংক বহন করবে। এক্ষেত্রে মুদারিব বা উদ্যোক্তাকে হারাতে হয় তার শ্রম ও সময়, কোন আর্থকলোকসান তাকে বহন করতে হয় না। অবশ্য যদি নিরপেক্ষ তদন্তে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, মুদারিবের গাফলতির জন্যেই লোকসান হয়েছে তাহলে ব্যাংক লোকসানের পুরো দায়ভার বহনে সম্মত নাও হতে পারে।
মুদারাবা পদ্ধতিতে ব্যবসা বৈধ হতে হলে নীচের শর্তগুলো পূরণ করা অত্যাবশ্যক। যথা:
ক) সাহিব আল-মাল ও মুদারিবের মধ্যে লিখিত চুক্তি হতে হবে। চুক্তিতে মূলধনের পরিমাণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।
খ) মুলধন নগদ অর্থের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে; পণ্য সামগ্রীকেই মূলধন হিসাবে গণ্য করা যাবে না।
গ) সমুদয় মূলধন মুদারিবের কাছে হস্তান্তর করতে হবে যেন মুদারিব নিজেই তা বিনিয়োগ করতে পারে।
ঘ) যদি সাহিব আল-মাল মুদারিবের সাথে সরাসরি ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে তাহলে চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে।
ঙ) কারবারে মুনাফায় মুদারিবের সুনির্দিষ্ট অংশের উল্লেখ থাকবে কোন সুনির্দিষ্ট অংকের উল্লেখ থাকবে না।
চ) মুদারিব কারবারের মুনাফা হতেই তার অংশ পাবে, মূলধন হতে নয়। যদি কারবারে লোকসান হয় তবে কোন অবস্থাতেই মুদারিব মূলধন থেকে কিছু দাবী করতে পারবে না।
এই পদ্ধতি স্বনির্ভর সমাজ গঠনে উৎসাহ যোগায়। দক্ষ কিন্তু অসচ্ছল ব্যক্তিরা মুদারাবা পদ্ধতিতে নিজেদের কর্মসংস্থান করতে পারে। ফলে বেকার জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ব্যাংকও বিনা ঝামেলায় পুঁজি বিনিয়োগ ও মুনাফা উপার্জনের সুযোগ পায়। এসব সুবিধার জন্যেই মুসলিম দেশ ছাড়াও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সম্প্রতি বহু মুদারাভিত্তিক বিনিয়োগ কোম্পানী গড়ে উঠছে। এগুলো ক্রমেই সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কোম্পানী ব্যবসায় সফল প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইতিমধ্যে পরিচিতও লাভ করেছে।
২. মুশারাকা: এই পদ্ধতিতে ব্যাংক ও উদ্যোক্তার বা উদ্যোক্তাদের মধ্যে অংশীদারী ভিত্তিতে চুক্তি অনুসারে সুনির্দিষ্ট কারবার পরিচারিত হয়। আরবী পরিভাষায় একে বলা হয় শিরকাতুল উকুদ। ব্যাংকসহ সকল অংশীদারই পরস্পর সম্মত অংশ অনুসারে মূলধন সরবরাহ করে এবং স্বীকৃত অনুপাত অনুসারে মুনাফা ভাগ করে নেয়। লোকসান হলে অবশ্য প্রত্যেক মূলধনের অনুপাতেই তার ভাগ নেবে। এই পদ্ধতিতে লোকসান হলে অবশ্য প্রত্যেকে মূলধনের অনুপাতেই তার ভাগ নেবে। এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগের কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। যথা: অংশীদারগণ তাদের কারবারের যাবতীয হিসাব সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করবে, অংশীদারদের ণৈতিক মান উন্নত হবে এবং কারবারের/প্রকল্পের যথাযথ তদারকী ও পর্যবেক্ষণের জন্যেও উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যাপ্ত সংখ্যক জনশক্তিও থাকতে হবে। পুঁজির প্রকৃতি অনুসারে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যাপ্ত সংখ্যক জনশক্তিও থাকতে হবে। পুঁজির প্রকৃতি অনুসারে শিরকাতুল উকুদ চার ধরনের হয়ে থাকে: (ক) শিরকাত আল-মুফাওয়াদা (সমঅংশীদারী কারবার); (খ) শিরকাত আল-ইনান (অসমঅংশীদারী কারবার); (গ) শিরকাত আল-সানায়ী (পেশাভিত্তিক অংশীদারী কারবার); এবং (ঘ) শিরকাত আল-ওয়াজুহ (সুনামভিত্তিক অংশীদারী কারবার)। মধ্যম শ্রেণীর বিত্তবান লোকেরা বা বিভিন্ন সংস্থা এই পদ্ধতিতে ব্যাংকের সহায়তা লাভের সুযোগ নিতে পারে। ফলে ব্যাংক যেমন বিস্তৃত পরিসরে বিনিয়োগের সুযোগ পায় তেমমনি অর্থনীতিতে কর্ম উদ্যোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৩. বায়ই মুরাবাহা: ইসলামী অর্থনীতিতে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ ও সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের পণ্য সামগ্রীর আমদানী-রপ্তানী ও ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসায়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারে। ব্যাংক সাধারণত আগ্রহী ক্রেতার চাহিদামাফিক পণ্য ক্রয় করে তার সাথে একটা মুনাফা (মার্ক আপ নামে পরিচিত) যুক্ত করে তার কাছেই এটা বিক্রয় করে দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি সম্পূর্ণ বৈধ। তবে পদ্ধতিটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্যে নীচের শর্তগুলো আরোপ করা হয়েছে।
ক) ক্রেতা ও বিক্রেতা উভফপক্ষই দ্রব্য সামগ্রীর মূল ক্রয়মূল্য সম্বন্ধে অবহিত থাকবে;
খ) উভয়পক্ষের অন্তর্নিহিত মুনাফার পরিমাণ বা হার সম্বন্ধে অবহিত থাকবে;
গ) মূল ক্রয় মূল্য এবং নির্ধারিত মূল্যের মধ্যে সুদের কোন অংশ বা সংশ্রব থাকবে পণ্যের প্রকৃতি, পরিমাণ, গুণাগুণ সরবরাহের স্থান ও সময় প্রভৃতির সুনির্দিষ্ট উল্লেখ থাকবে, এবং
ঘ) ব্যাংক গ্রাহকের নিকট বিক্রির উদ্দেশ্য পণ্যের মূল্য নির্ধারণের সময়ে ক্রয়মূল্য ছাড়াও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচও যোগ করার এখতিয়ার রাখে।
ক্রেতা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাংকের নিকট থেকে একেবারে কিংম্বা কিস্তিতে পণ্যটি পূর্ব নির্ধারিত মূল্যের ক্রয় করে। চুক্তিতে পণ্যটি পূর্ব নির্ধরিত মূল্যেই ক্রয় করে। চুক্তিতে নির্ধারিত মুনাফা কোনভাবেই বৃদ্ধি করা যাবে না, এমনকি গ্রাহক যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যটির ডেলিভারী নাও নেয়। এই পদ্ধতিতে যদি পণ্য সামগ্রী তাৎক্ষণিক ক্রয়-বিক্রয় হয় তাহলে হবু ক্রেতাকে কোন সিকিউরিটি বা জামানত দিতে হয় না, অথবা মূল্যের কোন অংশ পূর্বাহ্নেই আমানত হিসাবে ব্যাংকের জমা রাখতে হয় না। শুধু একটা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয় যেন হবুক্রেতার পক্ষে ব্যাংকই বিক্রয়ের ঝামেলা বা দায় সম্পন্ন করতে পারে এবং সঙ্গত কোন কারণে হবু ক্রেতা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যটি কিনতে অপারগ হয়ে ব্যাংক পণ্য অন্যের কাছে বিক্রী করে দিতে পারে।
এদেশে বিদ্যমান ব্যাংকিং আইনের আওতায় কোন ব্যাংকই সরাসরি পণ্য বাণিজ্যে নিয়োজিত হতে পারে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের ইসলামী ব্যাংকগুলো অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক পণ্য বাণিজ্য সরাসরি অংশগ্রহণ করছে। েএটি ইসলামী ব্যাংকের আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংকের আর্ধক কর্মকাণ্ডের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে এই পদ্ধতি।
৪. ব্যয়–ই–সালাম: (অগ্রিম ক্রয়): এই পদ্ধতিতে ব্যাংক কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে পণ্য সামগ্রী ক্রয়ের চুক্তি করতে পারে এই শর্তে যে বিক্রেতা আগাম মূল্য নেবে এবং নির্ধারিত সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে পণ্যটি সরবরাহ করবে। ব্যাংক পণ্যটি পরে নিজের পছন্দমতো সময়ে ও মূল্যে বিক্রয় করতে পারবে। অগ্রিম ক্রয় চুক্তি সম্পাদনের সময়েই বিক্রেতার নিকট মূল্য হস্তান্তরিত হবে। চুক্তি বৈধ হওয়ার স্বার্থে চুক্তিপত্রে পণ্যের ধরণ, পরিমাণ, গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্য সরবরাহের স্থান, পরিবহন খরচ, গুদামভাড়া ইত্যাদি যাবতীয শর্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। কৃষিজাত পণ্য ও কুটিরশিল্পের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা খুবই উপযোগী। ইসলামী ব্যাংকগুলো সাফল্যেল সাথে পদ্ধতিটি ব্যবহার করে আসছে এবং প্রভূত মুনাফা অর্জন করছে। কৃষিপ্রধান দেশে এই পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদরেও স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।
৫. ব্যয়–ই–মুয়াজ্জাল (বাকীতে বিক্রয়): এই পদ্ধতিতে বিক্রেতা (ব্যাংক বা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান) ক্রেতার পক্ষে পণ্য সামগ্রী ক্রয় বা সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট মূল্যে তার কাছে বিক্রয়ের চুক্তি করে। ক্রয়মূল্য পরিশোধের পূর্বেই পণ্য সামগ্রী ক্রেতার মালিকানায় চলে যায়। এ পদ্ধতিতে বিক্রেতা ক্রেতাকে পণ্যের ক্রয়মূল্য, লাভের পরিমাণ ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরজ জানাতে বা চুক্তিপত্রে উল্লেখ করতে বাধ্য নয়। কেবল বিক্রয়মূল্য উল্লেখই যথেষ্ট। এই ব্যবস্থার নির্ধারিত বিক্রয়মূল্য নির্দিষ্ট সময়ের পরে একসাথে বা কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে। চুক্তিপত্রে পণ্যের ধরণ, গুণাগুণ, পরিমাণ সরবরাহের স্থান ও সময়, গ্রাহক কর্তৃক মূল্য পরিশোধের সময়সীমা ও পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা যাবে না। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অর্থ যোগানোর জন্যেও এ পদ্ধতিটি বিশেষ ফলপ্রসূ। শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি উপযোগী। ব্যাংক কৃষকদের সার, বীজ, কীটনাশক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এই ব্যবস্থায় সরবরাহ করতে পারে। কৃষকরা শস্য কাটার পর বা অন্য কোন নির্দিষ্ট সময়ে এই অর্থ পরিশোধ করতে পারে। বিভিন্ন দেশের ইসলামী ব্যাংক সাফল্যের সাথে পদ্ধতিটি ব্যবহার করছে।
৬. ইজারা: মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্যে ইজারা একটি বিশেষ কৌশল। এই পদ্ধতিতে সম্পদের মালিকানা ইজারাদারেরই (এক্ষেত্রে ব্যাংকের) থাকে। ইজারাগ্রহীতা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নির্দিষ্ট অর্থ প্রদানের চুক্তিতে ইজারাকৃত সম্পত্তি ব্যবহার ও ভোগ দখল করে থাকে। এই পদ্ধতিতে ইজারাদাতা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে পণ্যের সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ থেকে তার মূলধন ব্যয় পুরণ করে মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এ প্রক্রিয়ায় ঝুঁকিও অনেক কম। ইসলামী ব্যাংকসমূহ বিশেষ সাফল্যেল সাথে এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করে আসছে। এর ফলে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহও পুঁজিনিবির মূলধন সামগ্রী ব্যবহার করার সুযোগ পায়। উদাহরণস্বরূপ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পণ্যবাহী জাহাজ, তেলবাহী ট্যাংকার, রেলওয়ে ওয়াগন, মাছ ধরার ট্রলার, দামী ও অথ্যাধুনিক ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম প্রভৃতি আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছে, ক্ষেত্রবিশেষে উন্নয়নশল দেশের সরকারের কাছেও ইজারা দিচ্ছে।
৭. ইজারা বিল–বায়ই (ক্রয়ের চুক্তির ভাড়া): এ পদ্ধতিতে ব্যাংক সম্পূর্ণ নিজস্ব তহবিল দিয়ে গ্রাহকের ফরমায়েশ অনুযায়ী কোন সামগ্রী ক্রয় করে এবং তার নিকট এই শর্তে ভাড়া দেয় যে, গ্রাহক যদি কিস্তিতে সামগ্রীর মূল্য ও নির্ধারিত হারে ভাড়া পরিশোধ করে তাহলে চুক্তি মুতাবিক নির্ধারিত সময় শেষে গ্রাহক সামগ্রটির মালিক হয়ে যাবে। সম্পদের মূল্য সম্পূর্ণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক নির্ধারিত হারে ভাড়া পেতে থাকবে। চুক্তি সম্পাদন হওয়ার সাথে সাথে চুক্তিবদ্ধ সম্পদ গ্রাহকের নিকট হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সম্পদটির মালিকানা থাকে ব্যাংকের হাতেই। এক্ষেত্রে গ্রাহকের ব্যবহার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়, মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিক্রিত সম্পতের পূর্ণ মূল্য ও নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধের সাথে সাথে সম্পদের মালিকানা গ্রাহকের নিকট হস্তান্তরিত হয়। বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো সাফল্যের সাথে পদ্ধতিটি ব্যবহার করে আসছে।
৮. হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক (যৌথ মালিকানাভিত্তিক ভাড়ায় ক্রয়–বিক্রয়): এ পদ্ধতিতে ব্যাংক গ্রাহকের আবেদন অনুযায়ী তার নিকট বিক্রী করার চুক্তিতে অংশীদারী ভিত্তিতে পুঁজির যোগান দিয়ে গাড়ী, যন্ত্রপাতি, বাড়ী ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে। এরপর নির্ধারিত কিস্তিতে বিক্রীমূল্য পরিশোধের শর্তে গ্রাহক পণ্যটি ক্রয়ের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়। একই সাথে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্ধারিত হারে ভাড়া প্রদানের জন্যেও অঙ্গীকার করে। যৌথভাবে পুঁজির যোগান দেবার কারণে ব্যাংক ও গ্রাহক নির্ধারিত ভাড়া তাদের স্ব স্ব পুঁজির অংশ অনুপাতে ভাগ করে নেয়। সামগ্রীটির ব্যাংকের মালিকানাভুক্ত অংশের বিক্রয় ম্যূ ও ভাড়ার অংশ কিস্তিতে পরিশোধিত হয়ে গেলে চুক্তির শর্তানুযায়ী নির্ধারিত সময়ের পর গ্রাহক সামগ্রীটির নিরংকুশ মালিকানা লাভ করে। পদ্ধতিটি বর্তমানে খুব জনপ্রিয়।
৯. কিস্তিতে বিক্রয়: ইসলামী ব্যাংকসমূহের বিনিয়োগের অপর অন্যতম কৌশল হলো কিস্তিতে বিক্রয়। এ পদ্ধতিতে স্বল্প আয়ের লোকদের, বিশেষতঃ চাকুরীজীবিদের কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের ভিত্তিতে ব্যাংক গৃহসামগ্রী, কম্পিউটার, এয়ারকুলার ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকে। ফলে স্বল্প আয়ের লোকেরা যেমন উপকৃত হয় তেমনি ব্যাংকও তহবিল বিনিয়োগের মাধ্যমে উপার্জন করতে পারে।
১০. ইসতিসনা: এ পদ্থতিতে ব্যাংক কোন প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদনকারীকে ফরমায়েশ মত কোন জিনিস নির্দিষ্ট মূল্যে নির্ধারিত সময়ে তৈরী বা উৎপাদন করে সরবরাহের প্রস্তাব করলে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষ তা মেনে নিলে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সম্পাদিত সবলে গণ্য হয়। িএ ক্ষেত্রে ফরমায়েশকৃত দ্রব্য সামগ্রীর দাম, পরিমাণ, প্রকৃতি, গুণাগুণ ইত্যাদি চুক্তিপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। ফলে ভবিষ্যতে উৎপাদনকারী (সানী) এবং ফরমায়েশ দাতার (মুসতাসনি) মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ার পথ রুদ্ধ হয়। চুক্তি সম্পাদনের পর কোন পক্ষই এক তরফাভাবে শর্তের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা এককভাবে চুক্তি বাতিল করতে পারবে না। প্রকৃতিগতভাবে তাই ইসতিসনা চুক্তির চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয়। ইসতিসনায় সাধারণতঃ অগ্রিম কোন অর্থ প্রদান করতে হয় না।
১১. জু’আলাহ: জু’আলাহ প্রকৃতিতে অনেকটাই ইসতিনার মতো। ইসতিসনায় বিক্রেতা দ্রব্য সামগ্রী বা পণ্য সরবরাহ করে, জু’ৎআলাহতে বিক্রেতা সেবা সরবরাহ করে থাকে। বিক্রেতা নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে সেবা প্রদান বা সরবরাহ করে থাকে। এক্ষেত্রে নিয়োগকারীকে বলা হয় জায়েল, স্বীকৃত মজুরী বা দেয় অর্থকে বলা হয় জোআল এবং সরবরাহকারী বা ঠিকাদারকে বলা হয় আমেল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক বা অন্যান্য সেবামূলক কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব গ্রহণ করে ব্যাংক নিজেই আমেল-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। যেক্ষেত্রে ব্যাংক এধরনের ভূমিকা নেবে সেক্ষেত্রে জো’আলাহ চুক্তিতে অন্য কাউকে ব্যাংক আমেল হিসেবে নিয়োগের ক্ষমতা রাখে এমন ব্যবস্থাও থাকতে পারে। এটি হতে পারে মূল চুক্িতর আওতায় সহযোগী চুক্তি। অনুরূপভাবে ব্যাংক যখন জায়েল তখন মূল আমেল ব্যাংকের পূর্ণ অনুমতি নিয়ে কাউকে সহযোগী আমেল হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। সেবা প্রদানের জন্যে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও উপায়-উপকরণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আমেল বা জা’য়েল যে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবে তাও সংশ্লিষ্ট চুক্তিতে উল্লেখ থাকতে পারে।
১২. মুজারাহ: এই পদ্ধতিতে ব্যাংক যদি কোন কৃষি জমির মালিক বা অন্য কোনভাবে স্বত্তাধিকারী হয় তাহলে তা চাষ করার জন্যে কৃষকদের সাথে চুক্তি করতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যাংক (মোজারে) নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডটি কৃষককে (আমেল) চাষের জন্যে দেবে। বিনিময়ে ব্যাংক নির্ধারিত হারে উৎপাদিত ফসলের অংশ পাবে। চুক্তির মধ্যেই উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণাগুণ বৃদ্ধির জন্যে উন্নতমানের বীজ সার সেচসুবিধা পরিবহন ও কৃষি সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। অবশ্য এজন্যে ফসলের প্রাপ্য হারেরও তারতম্য হবে।
১৩. মুশাকাত: এই পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক তার মালিকানাধীন অথবা কোন না কোন ভাবে স্বত্তাধীন বৃক্ষ, ফলের বাগান ইত্যাদির পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে কৃষককে দায়িত্ব অর্পণের জন্যে চুক্তি করে। উৎপন্ন ফল বা কাঠ উভয়ের মধ্যে চুক্তি অনুসারে বন্টিত হয়। মুজারাহ পদ্ধতির মতো এ ক্ষেত্রে সেচ, পরিবহন বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহের সুবিধা প্রদান এবং সেই অনুসারে ফসলের অংশ প্রাপ্তির শর্তের তারতম্য হতে পারে।
১৪. শেয়ার ক্রয়–বিক্রয়: ইসলামী ব্যাংক শেয়ার বাজরে শেয়ার কেনা-বেচায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে এবং কার্যত নিচ্ছেও। যথাযথভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হলে এটিও ব্যাংকের বিনিয়োগ ও আয়ের অন্যতম উৎস হওয়া সম্ভব। সুপ্রতিষ্ঠিত, সুপরিচালিত ও সন্তোষজনকহারে ডিভিডেন্ট দিতে বা কোম্পানীর স্টক ও শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক তার তহবিল বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করতে পারে। তবে এই ব্যাংক যেহেতু তার তহবিল বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করতে পারে। তবে এই ব্যাংকে যেহেতু শুধুমাত্র হালাল ব্যবসায়ে অংশ গ্রহণ করতে পারে সেহেতু শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং দেখতে হবে এসব কোম্পানীর কার্যক্রমে হালাল-হারামের বাছ-বিচার করে কি না। যদি তা না হয় তাহলে ঐসব কোম্পানীর শেয়ার কেনা-বেচায় অংশ নেওয়া যাবে না।
১৫. বৈদেশিক মুদ্রার উপস্থিত ক্রয়–বিক্রয়: ইসলামী ব্যাংক খোলা বাজার হতে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে আবার তা খোলা বাজারেই বিক্রয় করতে পারে। এ থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। শরীয়াহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার স্বার্থে বৈদেশিক মুদ্রা উপস্থত ক্রয় বা বিক্রয় করতে হবে এবং তা অবশ্যই নগদ মূল্যে হতে হবে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশে বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই সেসব দেশের ইসলামী ব্যাংক এই ব্যবসায়ে অর্থ বিনিয়োগ করছে এবং এ থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জন করছে। কোন কোন ব্যাংকের মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশই অর্জিত হচ্ছে এই একটি মাত্র পদ্ধতি থেকেই।
১৬. মেয়াদী অংশগ্রহণকারী সার্টিফিকেট: ইসলামী ব্যাংকগুলো কখনও তারল্যের সমস্যায় পতিত হয়নি। বরং তাদের হাতে বিপুল অব্যবহৃত আমানত পড়ে থাকে। এই অর্থ অনায়াসে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্যে ব্যবহার করা যায়। বহু ইসলামী ব্যাংক তাই বর্তমানে পাঁচ হতে দশ বছর মেয়াদী বিনিয়োগ সার্টিফিকেট ইস্যু করছে যেন গৃহ নির্মাণ, স্থাপর সম্পত্তির উন্নয়ন, শিল্প কারখানা স্থাপন প্রভৃতি কাজে এই অর্থ বিনিয়োগ করা যায়। এই ধরনের সার্টিফিকেট ন্যূনতম এক বছরের পূর্বে ভাঙানো যায় না। লাভ-লোকসানের অংশ নিতেও প্রস্তুত থাকে। দেখা গেছে এসব বিনিয়োগে মুনাফাই হয়ে থাকে। অভিজ্ঞতায় আরও লক্ষ্য করা গেছে, ইসলামী ব্যাংক এই ধরনের সার্টিফিকেট ক্রেতাদের সরকার ঘোষিত ন্যূনতম নিশ্চিত বা গ্যারান্টিযুক্ত সুদের চেয়েও বেশী হারে মুনাফা প্রদান করেছে। এ থেকে এই ধরনের বিনিয়োগ ইসলামী ব্যাংকের সাফল্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়।
১৬. বিনিয়োগ নীলাম: বিনিয়োগ নীলামে ইসলামী পদ্ধতিতে বিনিয়োগের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। শিল্পখাতে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক বিনিয়োগ বা সহযোগিতার জন্যে একটি কার্যকর পন্থা। এ পদ্ধতিতে ব্যাংক একা কিংবা অন্যের সাথে যৌথভাবে শিল্প প্রস্তুত করে এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। এরপর ঐ প্রকল্পটি নীলামের ব্যবস্থা করে। অবশ্য প্রকল্পটি তৈরীর কাজ সম্পূর্ণ করেও ব্যাংক নীলামে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। যুক্তিসঙ্গত হারে লাভ ধরেই ব্যাংক প্রকল্পটির বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। যে কোন দরপত্র বা নীলাম ডাক গ্রহণ বা বর্জনের অধিকারও ব্যাংকের থাকে। কৃতকার্য ক্রেতার নিকট থেকে ব্যাংক সম্পূর্ণ অর্থ নগদে গ্রহন করতে পারে অথবা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ক্রেতাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের সুযোগ দিতে পারে। ইসলামী ব্যাংকের জন্যে এটি একটি লাভজনক বিনিয়োগ কৌশল। দ্রুত শিল্পায়ন, কর্মসংস্থাতন ও পুঁজি সংগঠনের জন্যেও পদ্ধতিটি নিঃসন্দেহে সহায়ক।
১৮. সরাসরি বিনিয়োগ: ইসলামী ব্যাংক কারো সাহায্য না নিয়ে নিজেই কোন লাভজনক প্রকল্প বা আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে প্রয়োজনীয় নানা ধরনের প্রকল্প স্থাপন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের স্কীম তৈরী থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি যাবতীয় কাজ ব্যাংক নিজস্ব উদ্যোগেই করে থাকে। প্রকল্পের মূলধন সরবরাহ, নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং স্থায়ী মালিকানা সকল কিছুই ব্যাংকের নিজের হাতে থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর লাভ হলে তার পুরোটাই ব্যাংকের। লোকসান হলে তারও পুরোটাই ব্যাংক বহন করে। পৃথিবীর বহু ইসলামী ব্যাংকের এ ধরনের নিজস্ব প্রকল্প রয়েছে। এসবের মধ্যে ডেইরী ফার্ম হতে এলুমিনিয়াম ও ফাইবার গ্লাস ফ্যাক্টরী, মাছ ধরার ট্রলার হতে গৃহায়ন প্রকল্প সবই রয়েছে।
১৯. স্বাভাবিক মুনাফার হারে বিনিয়োগ: চায়ের দোকান, ফেরীওয়ালা, কামার, নাপিত, মুদীওয়ালা প্রভৃতি নানা ধরনের ছোট ছোট দোকানদার রয়েছে যাদের পুঁজির প্রয়োজন। তারা ব্যবসার দৈনন্দিন হিসাবপত্র রাখে না বা রাখতে পারে না। এজন্রে উপরের পদ্ধগিুলোর কোনটির মাধ্যমেই এদের আর্থিক সহযোগিতা করতে পারলে এরা কর্মসংস্থান ও ব্যাবসা-বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। এরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ঋণ ফেরত দিয়ে থাকে। বরং বড় ঋণ গ্রহীতারাই ঋণ পরিশোধে দীর্ঘসূত্রীতা অবলম্বন করে। তাই ইসলামী ব্যাংক নির্ধারিত স্বাভাবিক হারে মুনাফা প্রদানের শর্তে এসব ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ের অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে।
স্বাভাবিক মুনাফার হার নির্ধারণের পূর্বে ইসলামী ব্যাংকসমূহ এই ধরনের ব্যবসাসমূহের কমপক্ষে তিন বছরের লেন-দেনের হিসাব নেবে, লাভ-লোকসানের হিসাব করবে এবং এর গড় হারের ভিত্তিতেই মুনাফার স্বাভাবিক হার নির্ধারিত হবে। সুদের হারের মতো এই হার স্থির বা সুনির্দিষ্ট নয়। অবশ্য বিনিয়োগের সময় চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে যে, যদি প্রকৃত লাভ নির্ধারিত স্বাভাবিক মুনাফার হারের চেয়ে বেশী হয় তাহলে ব্যবসায়ী স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত লাভের অংশবিশেষ ব্যাংককে প্রদান করবে। অপরপক্ষে যদি অর্জিত মুনাফা নির্ধারিত স্বাভাবিক হারের চেয়ে কম হয় কিংবা লোকসান হয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী তা সন্তোষজনকভাবে প্রমাণ করতে পারে তাহলে ব্যাংক মুনাফার ঐ নিম্নহার বা লোকসানই মেনে নেবে। সুতরাং, মুনাফার স্বাভাবিক হার আসলে একটি নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশল মাত্র। সন্দেহ নেই, অর্থায়নের এই পদ্ধতি খুব আকর্ষনীয় ও সহজ। কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন খুবই দুরূহ। বিশেষতঃ ঐ সব ক্ষেত্র যেখানে ‘স্বাভাবিক’ মুনাফার হার নির্ধারণ ত্রুটিপূর্ণ বা বিতর্কিত। ইসলামী অর্থনীতিবিদদের মতে প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের পদ্ধতি ব্যাংকের ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
২০. করযে হাসানা: দানের চেয়ে করযে হাসানার সওয়াব বেশী। সওয়াবের নিয়তে এবং গ্রহীতার সাময়িক প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে তার অসুবিধা দূর করার উদ্দেশ্যেই এবং কোন রকম প্রত্যুপকারের বিন্দুমাত্র আশা না করে করযে হাসানা প্রদানকারী অর্থ ঋণ দিয়ে থাকে। সুদনির্ভর ব্যাংকগুলো তো বটেই, বিত্তশালীরা পর্যন্ত এরকম ঋন দিতে নারাজ। অথচ সচ্ছল ব্যক্তিরও অনেক সময় ঋণের প্রয়োজন পড়ে সামযিক অভাব বা প্রযোজন পূরণের জন্যে। সে সময় যদি করযে হাসানার সুযোগ না থাকে তাহলে তাকে হয় সহায়-সম্বল বিক্রি করতে হবে অথবা নিরুপায় হয়েই সুদের ভিত্তিতে ঋণ নিতে হবে। ইসলামী ব্যাংক এই ধরনের সহযোগিতা পাওয়া কল্পনাতীত ব্যাপার। ইসলামী ব্যাংক তার গ্রহাকদের জরুরী ও স্বল্প মেয়াদী প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে ন্যূনতম হারে সার্ভিস চার্জের বিপরীতে ঋণ দিয়ে থাকে। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই হার ০.৫০% হতে সর্বোচ্চ ২.০% পর্যন্ত। পাকিস্তানে এই হার প্রায় ৩.০%। করযে হাসানা মঞ্জুরের সময়েই ঋণ গ্রহীতার সুবিধা অনুসারে ঋণ পরিশোধের সময় ও পদ্ধতিও নির্ধারিত হয়।
বিশ্বের ইসলামী ব্যাংকসমূহের বার্ষিক প্রতিবেদন ও ব্যালেন্সশীটসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উপরে উল্লেখিত কর্মকৌশলসমূহ ব্যবহার করে তারা শুধু বিপুল মুনাফাই অর্জন করেনি, সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তুলনায় আমানতকারীদের বেশী হারে মুনাফা প্রদান করছে। স্বরণ রাখা দরকার, সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বয়স যেখানে দুইশত বছরের বেশী ইসলামী ব্যাংকের বয়স সেখানে তিন দশকের কিছু বেশী। এখনও তার শৈশবকাল কাটিয়ে ওঠেনি ইসলামী ব্যাংক। আশার কথা, ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশনগুলো বিনিয়োগের জন্যে শরীয়াহ্র দৃষ্টিতে বৈধ নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সম্মিলিতভাবে একে অন্যের অভিজ্ঞতা হতে শেখার চেষ্টা করছে। ইসলামী ব্যাংকের সাফল্য একদিকে যেমন তার কর্মীবাহিনীর ঐকান্তিকতা, পেশাগত কর্মকুশলতা এবং দক্ষতার উপর নির্ভরশীল তেমনি নির্ভরশীল তার অংশীদারী বিনিয়োগাকারীদের সততা, যোগ্যতা এবং ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার উপর। বিশেষতঃ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রয়োজনীয় দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং সততাসম্পন্ন ব্যবসায়ী পাওয়া খুবই দুরূহ। এই সমস্যা সমাধানের জন্যে ইসলামী ব্যাংকসমূহকে নিজ উদ্যোগে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
পরিশেষে এ কথা বলতেই হবে বর্তমান অনৈসলামী পরিবেশ, বিশেষতঃ প্রচলিত বাণিজ্যিক, রাজস্ব ও দেওয়ানী আইনের অনেকগুলোই ইসলামী ব্যাংকের সুষ্ঠু কার্য পরিচালনার পথে বিষম বাধা। এসব আইনের পরিবর্তন বা সংশোধন প্রয়োজন। যেহেতু সংশ্লিষ্ট সরকারের অনুমতিক্রমে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনের দায়-দায়িত্ব তাদের উপরও বর্তায়। ইসলামী ব্যাংক এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই কাজ করে যাচ্ছে এবং ক্রমাগত সাফল্যের সোপারে উত্তরণ লাভ করছে। বস্তুতঃ সুদী ব্যাংক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইসলামী ব্যাংক এক সাহসী ও ভিন্নধর্মী চ্যালেঞ্জ। সনাতন ব্যাংকগুলো যেখানে শুধুমাত্র আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইসলামী ব্যাংকগুলো সেখানে একই সাথে আর্থিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যোগফল। এই ব্যাঙক শরীয়াহ্সম্মত উপায়ে মুসলমানের রুটি-রুজীর ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্যেও পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ইসলামী ব্যাংক তাই মুমিন মুসলমানের জন্যে প্রয়োজনীয় এক প্রতিষ্ঠানই নয়, মুসলিম উম্মাহ্র জন্যেও অপরিহার্য এক ইন্সটিটিউশন।