সুদ : অর্থনৈতিক কুফল ও উচ্ছেদের উপায়
“…এবং আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল ও সুদকে করেছেন হারাম।” (সূরা আল-বাকারাহ: ১৭৫ আয়াত)
আল্লাহতায়ালা কালাম-ই-পাকে এই দ্ব্যার্থহীন ঘোষণার মাধ্যমে সর্বকালেল এ সকল বনি আদমের জন্যে একদিকে যেমন ব্যবসাকে বৈধ ঘোষণা করেছেন অন্যদিকে সুদ ও সুদভিত্তিক সকল কার্যক্রমকে চিরতরে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন। অর্থনীতিতে শোষণের অবসান ও যুলমতন্ত্রের বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান যে মোক্ষম আঘাতটি ইসলাম হেনেছে তা হচ্ছে সুদের উচ্ছেদ। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় ও অর্থনীতিতে যাবতীয অসৎ কাজের মধ্যে সুদকে সবচেয়ে পাপের জিনিস বলে গণ্য করা হয়েছে। বস্তুতঃ সুদের মত সমাজবিধ্বংসী অর্থনৈতিক হাতিয়ার আর দুটি নেই। সুদের কুফলগুলোর প্রতি একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে কেন সুদ চিরতরে হারাম ঘোষিত হয়েছে।
সুদের অর্থনৈতিক কুফল
মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করে ও বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গবেষণা হতে সুদের নানাবিধ কুফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। সুদের নৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আন্তর্জাতিক এমনকি মনস্তাত্তিবক কুফলও রয়েছে। কিন্তু সেসব আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। শুধুমাত্র দৃশ্যমান ও বড় ধরনের অর্থনৈতিক কুফল সম্পর্কে নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
১। সুদ সমাজ শোষণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম বা উপায়। একদল লোক বিনাশ্রমে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসায় সুদের সাহায্যেই। ঋণ গ্রহীতা যে কারণে টাকা ঋণ নেয় সে কাজে তার লাভ হোক বা না হোক তাকে সুদের অর্থ দিতেই হবে। এর ফলে বহু সময়ে ঋণ গ্রহীতাকে স্থাপর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হলেও সুদসহ আসল টাকা পরিশোধ করতে হয়্ সুদ গ্রহীতারা সমাজের পরগাছা। এরা অন্যের উপার্জন ও সম্পদে ভাগ বসিয়ে জীবন যাপন করে। উপরন্তু বিনাশ্রমে অর্থলাভের ফলে সমাজের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এদের কোন অবদান থাকে না।
২। সুদের কারণেই সমাজে দরিদ্র শ্রেণী আরও দরিদ্র এবং ধনী শ্রেণী আরও ধনী হয়। পরিণামে সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য বেড়েই চলে। দরিদ্র এবং ধনী শ্রেণী আরো ধনী হয়। পরিণঅমে সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য চলে। দরিদ্র অভাবগ্রস্ত মানুষ প্রয়োজনের সময়ে সাহায্যের কোন দরজা খোলা না পেয়ে, উপায়ন্তর না দেখে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সেই ঋণ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় প্রকার কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে তার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাই লোপ পায়। পুঁজিবাদী সমাজে করযে হাসানার কোন সুযোগ না থাকায় অনুৎপাদনী খাতে ঋণ তো দূরের কথা, উৎপাদনী খাতেও বিনা সুদে ঋণ মেলে না। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো তাকে সুদ শোধ করতে হয়। এর ফলে সে তার শেষ সম্বল যা থাকে তাই বিক্রি করে উত্তমর্ণের ঋণ শুধরে থাকে। এই বাড়তি অর্থ পেয়ে উত্তমর্ণ আরো ধনী হয়। বৃদ্ধি পেতে থাকে সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য।
বাংলাদেশে ধনীরা যে ক্রমাগত ধনী হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান কারণ সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার বিশেষ সহযোগিতা। যোগ্যতা ও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয জামানত দিতে না পারার কারণে সুদী ব্যাংকগুলো হতে ঋণ পায় না, অথচ বিত্তশালী ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তারা সহজেই ঋণ পায়। ব্যাংক হাজার হাজার লোকের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে, কিন্তু ঐ অর্থ ঋণ আকারে পায় মুষ্টিমেয় বিত্তশালীরাই। এ থেকে উপার্জিত বিপুল মুনাফা তাদের হাতেই রয়ে যায়। ফলে সঞ্চয়কারী হাজার হাজার লোক তাদের অর্থের প্রাপ্য তা জনগণের কাছ থেকে দ্রব্যমূল্যের সাথেই তুলে নেয়। ফলে তাদের গায়ে আঁচড় লাগে না, কিন্তু অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণ হয় সাধারণ জনগণের। পরিণামে ধনীরা আরও ধনী হয়, গরীবরা হয় আরও গরীব। সমাজে হিতৈষীরা তাই যতই ‘গরীবি হঠাৎ’ বলে চিৎকার করুক সমাজের মধ্যেই এই দৃঢ়মূল সুকৌশল ও সর্বব্যাপী শোষণ পক্রিয়া বহাল থাকা অবস্থায় দারিদ্র্য দূরীকরণের কোন প্রেসক্রিপশনই কার্যকর হবে না।
৩। সুদ মানুষকে স্বার্থপর ও কৃপণ করে। অর্থলিপ্সা, কার্পণ্য ও স্বার্থপরতা সুদখোরদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনাশ্রমে উপার্জনের আকাংখা ও অর্থলিপ্সা হতেউ সুদ প্রথার জন্ম। সুদের মাধ্যমে নিশ্চিত ও নির্ধারিত আয়প্রাপ্তির লোভ সুদখোরদের বিচার-বিবেচনা, আবেগ-অনুভূতি এমনকি বিবেককে পর্যন্ত নিঃসাড় করে দেয়। সুদখোরদরে মধ্যে লোভ ও কৃপণতা ক্রমে ক্রমে এতদূর প্রসার লাভ করে, তাদের আচার-আচরণের এতখানি পরিবর্তন ঘটে যে তারা হয়ে ওঠে সমাজের ঘৃণিত জীব। তাদের প্রবাদতুল্য কৃপণতা গল্প-কাহিনীর খোরাক হয়ে ওঠে। ইংরেজী সাহিত্যের অবিসংবাদী সম্রাজ সেক্সপীয়রের অমর সৃষ্টি শাইলকের (The Merchant of Venice) নাম কে না জানে? ইটালীর সাহিত্যের মহাকবি দান্তে সুদখোরদরে ঠাঁই দিয়েছেন নরকের অগ্নিবৃষ্টিময় সপ্তম বৃত্তে (Divina Comedia)। মধ্য যুগে ইউরোপে চার্চ সুদখোরদরে আচরণ ও সীমাহীন লোভের জন্যে তাদেরকে দেহপসারিণীদের সাথে তুলনা করেছিল।
৪। সুদ শ্রমবিমুখতা ও অলসতার সৃষ্টি করে। সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে কোন পরিশ্রম ও ঝুঁকি ছাড়াই সুদের মাধ্যমে নির্ধারিত হারে অর্থ পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থা যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রতিভাবান ও কর্মঠ লোককেই অকর্মণ্য ও অলস বানিয়ে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা স্থাপন অর্থাৎ উৎপাদনধর্মী কাচে যে চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণের দরকার সুদভিত্তিক সঞ্চয়কারীরা তা আর করে না। বরং ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ হতে বিনাশ্রমে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত হারে আয় পেয়ে তারা পরিতৃপ্ত থাকে। ধীরে ধীরে আলস্য তাদের গ্রাস করে। এভাবে সুদের কারণে যাদের হাতে অঢেল বিত্ত রয়েছে তাদের শ্রম, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার ফসল হতে সমাজ বঞ্চিত হয়। সৃষ্ট হয় শ্রমবিমুখতা ও অলসতা। এ দেশের সাহিত্য হতেই এর ভুরি ভুরি নজীর মিলবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান সুদী ব্যবস্থায় কেউ ব্যাংকে দশ লাখ টাকা জমা রেখে কোন রকম ঝুঁকি বা দুঃশ্চিন্তা ছাড়াই ঘরে বসে প্রতি মাসে এগারো হাজার টাকা পেতে পারে।
৫। সুদভিত্তিক বিনিয়োগের ফলেই সামাজিক শোষণ সার্বিক ও সামষ্টিক, দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক হওয়ার সুযোগ হয়েছে। সুদভিত্তিক ব্যাংক ও বীমা ব্যবসার কারণে ছোট ছোট সঞ্চয় সমাবেশ ও সঞ্চালনের সুযোগ বিরাট পুঁজি গড়ে উঠছে। বীমা ও ব্যাংক ব্যবসায়ে নিযুক্ত মুষ্টিমেয় ব্যক্তি এই পুঁজি চড়া সুদে ঋণ দিয়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। একই সাথে ঋণ দেবার ক্ষেত্রে ধনী ও দারিদ্রের বাছ-বিচারের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক শ্রেণী বৈষম্য। অর্থাৎ, শ্রেণী বৈষম্য হ্রাস না পেয়ে আরও গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। উপরন্তু বাংলাদেশের সুদী ব্যাংকগুলো তাদের প্রদত্ত সুদকে ক্ষেত্রবিশেষে মুনাফার লেবাস পরিয়ে চালিয়ে দেবার অপচেষ্টাও করছে। ফলে প্রতারিত হচ্ছে সরল প্রাণ ধর্মভীরু মানুষ।
সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে শোষণ যে কত সার্বিক ও কৌশলপূর্ণ একটা উদাহরণের সাহায্যে তা তুলে ধরা হলো। ব্যাংকে আমানতকারীরা যে অর্থ সঞ্চিত রাখে তার পুরোটা ব্যাংক কখনই গচ্ছিত রাখে না। সাধারণতঃ ঐ অর্থের ৯০% ঋণ দিয়ে থাকে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী-উদ্যোক্ততাদের। তারা এই অর্থের জন্যে ব্যাংককে যে সুদ দেয তা আদায় করে নেয় জনগণের নিকট হতেই তাদের প্রদত্ত সেবা ও পণ্যসামগ্রীর মূল্যেই সঙ্গেই। এদের মধ্যে ঐ সব আমানতকারীরাও রয়েছে যারা ব্যাংকে অর্থ রেখেছে সুদের মাধ্যমে নিশ্চিত নিরাপদ আয়ের উদ্দেশ্যে। আদায়কৃত সুদ হতে ব্যাংক েএকটা অংশ নিজস্ব ব্যয় নির্বাহের জন্যে রেখে বাকি অংশ আমানতকারীদের হিসাবে জমা করে দেয় তাদের প্রাপ্য সুদ বাবদ। এভাবেই ব্যাংক মাছের তেলে মাছ ভেজে নেয়। অন্যদিকে প্রতারিত হয় আমানতকারীরা। কিন্তু তারা কি কখনও তা তলিয়ে দেখার অবকাশ পায়? বরং বছর শেষে পাশ বই বা কম্পিউটারাইজট একান্ট শীটে যখন জমার বিপরীতে সুদ বাবদ প্রাপ্ত অর্থঞ দেখে তখন তারা দৃশ্যতঃ পুলকিত বোধ করে।
উদাহরণ-১
সুদ বাবদ আমানতকারী (=ভোক্তা) ব্যবসায়/উৎপাদনকারীকে মূল্যের আকারে প্রদান করে
-সুদ বাবদ আমানতকারী ব্যাংক হতে পায় |
১৬%
৮% |
=ব্যাংকে জমার বিপরীতে আমানতকারীর নীট লোকসান দাঁড়ায় | ৮% |
বিদ্যমান সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতি ও আইন এবং সমষ্টি অর্থনীতির (Maroeconomics) কর্মকৌশলের প্রেক্ষিতে কোনভাবেই এই অদৃশ্য অথচ প্রকৃতই লোকসান তথা শোষণ প্রতিরোধের উপায় নেই। এর প্রতিবিধান রয়েছে একমাত্র ইসলামী বিনিয়েঅগ ও ব্যাংকিং পদ্ধতির কর্মকৌশলের মধ্যে।
৬। সুদের কারণেই ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষকেরা ফসল ফলাবার তাগিদেই নিজেরা খেতে না পেলেও ঋণ করে চমি চাষ করে থাকে। এই ঋণ শুধু যে গ্রামের মহাজনের কাছ থেকেই নেয় তা নয়। সরকারের কৃষি ব্যাংক থেকেও নেয় নেয় অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সমবায় প্রতিষ্ঠান থেকেও। যথোপযুক্ত বা আশানুরূপ ফসল হওয়া সব সময়েই অনিশ্চিত। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্বিপাক তো রয়েছেই। যদি ফসল আশানুরূপ না হয় বা প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের ফলে ফসল খুবই কম হয় বা মোটেই না হয় তবু কিন্তু কৃষককে নির্দিষ্ট সময়ান্তে সুদসহ ঋণ শোধ করতে হয়। তখন হয়তাকে আবার নতুন ঋণের সন্ধানে বের হতে হয় অথবা জমি-জিরাত বেচে কিংবা বন্ধক রেখে সুদ-আসলসহ শুধতে হয়। তা না হলে কি মহাজন, কি ব্যাংক সকলেই আদালতে নালিশ ঠুকে তার সহায়-সম্পত্তি ক্রোক করিয়ে নেবে। নীলামে চড়াবে দেনার দায়ে।
ধরা যাক, কৃষি ব্যাংক হতে আলু চাষের জন্যে কোন কৃষক ১৬% সুদে ২০০০/- টাকা ঋণ নিলো। তাকে অবশ্যই এজন্যে বছর শেষে বাড়তি ৩২০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ, ঐ কৃষকের জমিতে আরও বেশী আলু উৎপন্ন হতে হবে। গড়ে আশি টাকা মণ হলে বাড়তি চার মণ আূ উৎপাদন হওয়া চাই। মজা হলো, আলু ফলন বেশী হলে তা সবারই ক্ষেতে হবে। ফলে দাম পড়ে যাবে। আলুর দাম যদি মণপ্রতি টাঃ ৮০/- হতে টাঃ ম৭০/-তে নেমে আসে তাহলে চাষীর মণপ্রতি টাঃ ১০/- অর্থাৎ মোট টাঃ ৪০/- ঘাটতি থেকে যাবে। ঋণের পরিমাণ যত বেশী হবে ঘাটতির পরিমাণও তত বেশী হবে। বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র কী? ১৯৪৭ সালে ভঅরত বিভাগের সময়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের ২৭% ভূমিহীন ছিল। কিন্তু মাত্র ৩৭ বছরের মধ্যে এই চিত্র পাল্টে গেছে। ১৯৮৩-৮৪ সালের কৃষি শুমারী হতে দেখা যায়, বাংলাদেশের ভূমিহীন কৃষক পরিবারের সংখ্যা মোট কৃষিনির্ভর পরিবারের ৬৮.৮% এ দাঁড়িয়েছে (সূত্র: স্ট্যাটিস্টিকাল পকেট বুক অব বাংয়লাদেশ ১৯৯৬, পৃ. ১৭৯)।
প্রসংগতঃ মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতেই এদেশে কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কৃষকদের অব্যাহতভাবে ঋণ দেওয়া শুরু করে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে তাঁর নির্দেশে দেওয়া একশ কোটি টাকার আই.আই.সি.পি. ঋণের প্রায় সবটাই আজও অনাদায় রয়ে গেছে। এরপরও বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নির্বাচনী ওয়াদা মুতাবিক পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ মওকুফ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের আমলে ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা প্রদান রহিত করা হয়। এরপরেও কেন দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে? এর অন্যতম কারণ সুদভিত্তিক ঋণ প্রদান বা গ্রহণ। শুধু এদেশেই নয়, যে সমস্ত দেশে কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক কৌশলগত কোন পরিবর্তন ঘটেনি অথবা মূল্য সহায়তা (Price support) বা উৎপাদন ভর্তুকী (Input subsidy) আকারে বিশেষ সরকারী সহায়তা দেওয়া হয়নি সেসব দেশে সুদনির্ভর লেনদেনে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা ক্রমেই ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে।
৭। সুদের পরোক্ষ ফল হিসেবে একচেটিয়া কারবারের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা যে শর্তে ও যে সময়ের জন্যে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রকিষ্ঠান হতে ঋণ পেতে পারে ছোট ব্যবসায়ীরা সেভাবে ঋণ পায় না। এজন্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তারতম্য ঘটে। সে প্রতিযোগিতায় অসম সুবিধা ভোগের সুযোগ নিয়ে বড় কারবারী বা ব্যবসায়ী আরো বড় হয়। ছোট কারবারী বা ব্যবসায়ী টিকতে না পেরে ধ্বংস হয়ে যায়। বৃহদায়তন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাই। এই জাতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুধু ব্যাংকই নয়, পুঁজিপতি ও অনৈসলামী সরকারসমূহ যে বিশেষ সুবিধা ও ন্যূনতম সুদের হারে টাকা ঋণ দিয়ে থাকে, ছোট বা ক্ষুদ্রায়তন শিল্পের জন্যে আদেও সে সুযোগ নেই। ফলে বড় শিল্পপতিরা প্রতিযোগিতাহীন বাজারে একচেটিয়া কারবারের সমস্ত সুযোগ লাভ করে। পরিণামে সামাজিক বৈষম্য আরো প্রকট হয়।
৮। সুদের ফলেই মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে পুঁজি সীমাবদ্ধ থাকার সুযোগ পায়। তাদের হাতেই পুঁজি আবর্তিত ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেননা সুদের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, হাত গুটিয়ে বসে থাকা একটি শ্রেণী বিনাশ্রমে এর সাহায্যে উপার্জন করতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে, অবৈধভাবে বা অন্য কোন উপায়ে কেউ প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করতে পারলে সুদের বদৌলতেই সে তা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে যেতে পারে। এজন্যে এদের মধ্যে অকর্মণ্যতা, বিলাসিতা ও দুষ্কর্মের প্রকার ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই তখন সামাজিক শান্তি ও শৃংখলা বিঘ্নিত হয়।
৯। সুদের জন্যে দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সুদবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী উৎপাদন খরচর উপর পরিবহন খরচ, শুল্ক (যদি থাকে), অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় এবং স্বাভাবিক মুনাফা যোগ করে পণ্যসামগ্রীর বিক্রি মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে দ্রব্যের এই স্বাভাবিক মূল্যের উপর উপর্যুপরি সুদ যোগ দেওয়া হয়। দ্রব্য বিশেষের উপর তিন থেকে চার বার পর্যন্ত, ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশীবার সুদ যুক্ত হয়ে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ আমাদের দেশের বস্ত্র শিল্পের কথাই ধরা যেতে পারে। এই শিল্পের প্রয়োজন আমদানীকারকরা ব্যাংক হতে যে ঋণ নেয় বিদেশ থেকে তুলা আমদানীর জন্যে তার সুদ যুক্ত হয় ঐ তুলার বিক্রি মূল্যের উপর। এরপর সূতা তৈরীর কারখানা ব্যাংক হতে যে ঋণ নেয় তারও সুদ যুক্ত হয় ঐ তুলা থেকে তৈরী সূতার উপর। পুনরায় ঐ সূতা হতে কাপড় তৈরীর সময়ে বস্ত্রকল সংস্থা বা কোম্পানী যে ঋণ নেয় সেই সুদ যুক্ত হয় কাপড়ের উপর। এরপর কাপড়ের এজেন্ট বা ডীলার তার ব্যবসার উদ্দেশ্যে ব্যাংক হতে যে ঋণ নেয় তারও সুদ যোগ করে দেয় ঐ কাপড়েরর কারখানা মূল্যের উপর। এভাবে চারটি স্তর বা পর্যায়ে সুদের অর্থ যুক্ত হয়ে বাজারে কাপড় যখন খুচরা দোকানে আসে বা প্রকৃত ভোক্ত ক্রয় করে তখন সে আসল মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশী দাম দিয়ে থাকে।
একটা নমুনা হিসাবের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলো। ধরা যাক, বিদেশ হতে তূলা আমদানীর জন্যে কোন ব্যবসায়ী ব্যাংক হতে এক লক্ষ টাকা ঋণ নিলো। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে পার হয়ে তা থেকে তেরী কাপড় বাজারে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে পার হয়ে তা থেকে তৈরী কাপড় বাজারে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত সুদজনিত মূল্যবৃদ্ধির চিত্রটি কেমন দাঁড়াবে? দুটো অনুমিতি (assumption) এখানে ধরা হয়েছে: (ক) উৎপাদন, বিপণন, গুদামজাতকরণ প্রভৃতি প্রতিটি ক্সেত্রেই ব্যাংক হতে ঋণ নেওয়া হয়েছে, এবং (খ) সুদের হার সকল ক্ষেত্রেই ১৬%। এউ উদাহরণে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্যান্য আবশ্যকীয় ব্রয় (যেমন-জাহাজ ভাড়া, কুলি খরচ, বিদ্যুৎ/জালানী ব্যয়, গুদাম ভাড়া, পরিবহন ব্যয়, শ্রমিকের বেতন/মজুরী, সরকারী কর/শুল্ক ইত্যাদি) ধরা হয়নি।
উদাহরণ-২
ক) আমদানীকারীর বিদেশী তূলার ক্রয়মূল্য টা: ১,০০,০০০/০০ হলে তূলার বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টা: ১,১৬,০০০/০০;
খ) সূতা তৈরীর মিলের তুলার ক্রয়মূল্য টা: ১,১৬,০০০/০০ হলে সূতার বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টাঃ ১,৩৪,৫৬০/০০;
গ) কাপড় তৈরীর মিলের সুতার ক্রয়মূল্য টা: ১,৩৪,৫৬০/০০ হলে কাপড়ের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টা: ১,৫৬,০৮৯/০০;
ঘ) মিল হতে এজেন্ট/ডিলারের কাপড়ের ক্রয়মূল্য টা: ১,৫৬,০৮৯/০০ হলে বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টা: ১,৮১,০৬৪/০০;
ঙ) এজেন্টের কাছ থেকে পাইকারী বিক্রেতার কাপড়ের ক্রয়মূল্য টা: ১,৮১,০৬৪/০০ হলে বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টা: ২,১০,০৩৪/০০।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, যে তূলার মূল ক্রয়মূল্য ছিল টা: ১,০০,০০০/০০ সেই তূলা হতে তৈরী কাপড় ভোক্তার নিকট পর্যন্ত পৌঁছাতে সুদ বাবদেই মূল্যের সাথে অতিরিক্ত টা: ১,১০,০৩৪/০০ যুক্ত হয়েছে যা ভোক্তাকেই দিতে হবে। কারণ চূড়ান্ত বিচারে শেষ অবধি প্রকৃত ভোক্তাইা মোট সুদের ভার বহন করে। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হচ্ছে সুদ দিতে না হলে অর্থাৎ সুদ উচ্ছেদ হলে এই অতিরিক্ত অর্থঘ (টাকাপিছু ১.১০ টাকা) ভোক্তাকে দিতে হতো না।
এভাবে সমাজে দৈনন্দিন জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রত্যেকটিতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদ জড়িয়ে আছে। নিরুপায় ভোক্তাকে বাধ্য হয়েই সুদের জন্যে সৃষ্ট এই চড়া মূল্য দিতে হয়। কারণ সুদনির্ভর অর্থনীতিতে এছাড়া তার গত্যন্তর নেই। অথচ সুদ না থাকলে অর্থাৎ, সুদবিহীন অর্থনীতি চালু থাকলে এই যুলুম হতে জনসাধারণ রেহাই পেত। এতে শুধু তাদের জীবন যাত্রার ব্যয়ই কম হতো না, জীবন যাপনের মান হতো আরো উন্নত।
১০। সুদ মজুরী বৃদ্ধির অন্যতম বড় প্রতিবন্ধক। কারণ সুদের হার উচ্চ থাকলে বিনিয়োগ থাকে ন্যূনতম কোঠায়। তখন শিল্প উদ্যোক্তার পক্ষে মুনাফা অর্জনই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে সময়ে মজুরী বৃদ্ধি মানেই লোকসানে;র ঝুঁকি নেওয়ংা। সুদের হার কম থাকলে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশী হতে পারে কিন্তু পুঁজির সরবরাহ বৃদ্ধি পায় না। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ কম হওয়ার ফলে শ্রমিকের চাহিদাও কম থাকে। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের যোগান অনেক বেশী থাকার ফলে তাদের দিক থেকে মজুরী বৃদ্ধির দাবী উত্থাপন আদৌ সহজ হয় না। উপরন্তু কম মজুরীতেই চাহিদার চেয়ে শ্রম সরবরাহ বেশী হওয়ায় উদ্যোক্তারা মজুরী বৃদ্ধির দাবী মেনে নিতে চায় না। ফলে অনিবার্যভাবেই সংঘাত দেখা দেয়। কর্মবিরতি ঘেরাও ধীরে চলে ধর্মঘট হরতাল অবস্থান ধর্মঘট এরই বাস্তব রূপ। পরিমাণে মালিক পক্ষ ছাঁটাই, লক আউট ইত্যাদি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। পূর্বেই বলা হয়েছে সুদের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে বিক্রীও হ্রাস পায়। এই অবস্থায় মজুরী বৃদ্ধি পেলে মুনাফার হ্রাস পেয়ে সুদের হারের চেয়েও নীচে নেমে যেতে পারে। তাই মজুরী বৃদ্ধির কোন দাবীই শিল্প মালিকদের পক্ষে বিবেচনায় আনা সম্ভব হয় না।
এই কারণেই জাপানে মেইজী শাসন আমলে মজুরী বৃদ্ধির জন্যে শ্রমিকদের জোর দাবী থাকলেও যাইবাৎসু গোষ্ঠী তা মেনে নেয়নি, সরকারও এ ব্যাপারে শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। বৃটেনেও কৃষকদের স্বার্থে প্রণীত ১৮১৫ সালের শস্য আইন (Cmo Law) ত্রিশ বছর পরেই বাতিল করা হয় শিল্পপতিদের স্বার্থে। শস্য আইন বহাল থাকলে গমের দাম বৃদ্ধি পেতো। এতে কৃষকেরা লাভবান হতো। কিন্তু শিল্প শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি করা অপরিহার্য হয়ে পড়তো যার ফলে শিল্পপতিদের মুনাফা হ্রাস পেতো।
১১। সুদ দীর্ঘ মেয়াদী ও স্বল্প লাভজনক ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।সুদনির্ভর ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্রাংকগুলো দীর্ঘ সময় ধরে পুঁজি আটকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এমন ধরনের বিনিয়োগ আদৌ উৎসাহ দেখায় না। এ জন্যেই দেশে ব্যয়বহুল বড় শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে পারে না। এসব শিল্প-কারখানা স্থাপনে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয় তা সুদের ভিত্তিতে যোগান দিলে প্রতি বছর বিপুল অর্থ সুদ হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। বড় বড় কারখানা সাধারণতঃ প্রতিষ্ঠিত হয়ে চালু হতে দুই হতে তিন বছরের gestation period প্রয়োজন হয়। এই দীর্ঘ সময়ে সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এমন অংক দাঁড়াবে যে সে বোঝা বহন করা লাভজনক শিল্পের পক্ষেও সম্ভব নয়। আর লোকসান হলে সুদে-আসলে ঋণের যে অংক দাঁড়ায় তা পরিশোধ করা কখনো সম্ভব হয় না। স্বাভাবিকভাবেই উদ্যোক্তা তখন দেউলিয়া হতে বাধ্য হয়।
১২। সুদ সঞ্চয়কে অনুিৎপাদনশীল বিনিয়োগে উৎসাহিত করে। সুদী অর্থনীতির ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যাংকাররা ঝুঁকিমুক্ত, নিশ্চিত ও নির্ধারিত আয় পাওয়ার উদ্দেশ্যে জনগণের গচ্ছিত আমানতের বিরাট এক অংশ ট্রেজারী বিল ক্রয়, বিনিময় বিল ভাঙানো, সরকারী সিকিউরিটি বা ঋণপত্র ক্রয় ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে উৎপাদনশীল কালে বিনিয়োগের জন্যে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব দেখা দেয়। পরিণামে সুদের হার বৃদ্ধি পায় এবং পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতা আরো হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পায়। কর্মসংস্থানের সংকোচন ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটে। অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় সংকটের। এই অবস্থায় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হয় সংকট মোচনের জন্যে।
১৩। সুদ বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ায়। উন্নয়নশীল দেশের সরকার প্রায়শঃ শিল্প ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো বিনির্মাণেল জন্যে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে। ঐ সব ঋণ নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে সুদসহ পরিশোধযোগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রায়ই দেখা যায় ঐসব ঋণ না নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত দেওয়া যায়, না উপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে কাংখিত উন্নতি অর্জন করা যায়। ফলে ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, অনেক সময় শুধু সুদ শোধ দেওয়াই দায় হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় পূর্বের ঋণ পরিশোধের জন্যে এসব দেশ আবার নতুন করে ঋণ গ্রহণ করে। এই নতুন ঋণ সুদে-আসলে পূর্বের ঋণকে ছাড়িয়ে যায়।
অনুরূপভাবে দেশে কোন বিপর্যয় বা সংকট দেখা দিলে অথবা খাদ্য শস্যের মতো অপরিহার্য পণ্যের ঘাটতি ঘটলে তা পূরণের জন্যে সরকারকে বন্ধ দেশ বা ঋণদানকারী কনসার্টিয়াম থেকে ঋণ নিতে হয়। ভোগের জন্যে গৃহীত এই ঋণেল বিপরীতে যেহেতু কোন উৎপাদন বা কর্মসংস্থান হয় না, সেহেতু এই ঋণের আসল পরিশোধ তো দূরের কথা সুদই পরিশোধ করা সম্ভব হয় না্ সুদ-আসলে সমুদয় ঋণই জনগণের কাছ থেকে আদায় করতে হয়, নয়ত আবারও ঋণ নিতে হয়।
১৪। সুদের বিদ্যমানতার ফলে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। পূর্বেই দেখানো হয়েছে যে, সুদের কারণেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় অবশ্যম্ভাবীভাবে ও অপ্রতিহত গতিতে। উপরন্তু অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতি ঘটার অন্যতম কারণও সুদ। এই দুইয়ের যোগফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। নির্দিষ্ট আয়ের শ্রমজীবী, সাধারণ কৃষিজীবী, নানা ধরনের পেশাজীবী ও বেতনভুক্ত কর্মচারীরা এই সাধারণ মানুষের কাতারে শামিল। এদের আয়ের স্তর ও পরিমাণ যেহেতু মোটামুটি একটা দীর্ঘ সময় ধরে একই রকম থাকে সেহেতু দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে একদিকে যেমন জীবন যাপনের মানের অবনতি ঘটে অন্যদিকে বাজারে কার্যকর চাহিদার সংকোচন ঘটে। এরই চূড়ান্ত পরিণাম হিসাবে কলকারখানার মুনাফার পরিমাণ হ্রাস পায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনাও রুদ্ধ হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মুনাফার পরিমাণ ঠিক রাখার জন্যে এক্ষেত্রে পুনরায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় শিল্প-উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা তখন কমে যায় আরও এক ধাপ।
১৫। সুদভিত্কি ঋণে তৈরী প্রতিষ্ঠান কোন ক্ষতির সম্মুখীন হলে উদ্যোক্তা সম্পূর্ণ পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। উদ্যোক্তা যতক্ষণ ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করে ততক্ষণ যখনই কারবারে লোকসান দেখা দেয় তখন ব্যাংক নতুন অর্থ লগ্নি করা দূরে থাক পূর্বের ঋণ ফেরত দেবার জন্যেই চাপ দেয়। এই অবস্থায় উদ্যোক্তা মাথায় হাত দেয়। কারণ তার নিজের পুঁজি ছিল সামান্যই, পুরো ব্যাপারটাই ছিল পরের ধনে পোদ্দারী। ফলে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। পরিণামে গোটা কারবারটি বন্ধ বা ধ্বংস হয়ে যায়।
১৬। সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়াত্বের বোঝা চাপে সমগ্র জাতির ঘাড়ে। বাংলাদেশ এর উজ্জ্বলতম উদাহরণ। ধনী ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিরা নির্দিষ্ট হার সুদ প্রদানের অঙ্গীকারে ব্যাংক হতে তাদের দেওয়া Collateral বা জামানতের বিপরীতে দশগুণ বা তারও বেশী পরিমাণ ঋণ পেয়ে থাকে। অর্থাৎ, নিজেদের দশ লক্ষ টাকা থাকলে তারা এক কোটি টাকা ঋণ পায়। এক্ষেত্রে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব বা সম্পৃক্তাতও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোটি টাকারও বেশী এই অর্থের ব্যবসা বা শিল্পে যে মুনাফা হয় তার সবটুকুই ভোগ করে ঐ ঋণগ্রহণকারী উদ্যোক্তা। ব্যাংকে অর্থ আমানতকারীরা সুদ পেলেও মুনাফার কোন অংশই তারা পায় না। অথচ লোকসানের কারণে ঐ প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলে তার দায়ভার চাপে গোটা জাতির উপর। জনগণের সঞ্চয় তখন আর ফেরত হলেও (যদিও পূর্বের মুনাফা সে পুরোটা একাই ভোগ করেছে) জনসাধারণের লোকসান পুরো কোটি টাকাই। কষ্ট করে এই টাকা যারা সঞ্চয় করে ব্যাংকে আমানত রেখেছিল তাদেরই এখন ফতুর হবার পালা।
বাংলাদেশের ঋণ খেলাপী শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সমুদয় সম্পত্তি বিক্রী করে দিলেও ব্রাংক হতে তাদের গৃহীত ঋণ শোধ হবার নয়। কারণ এর পিছনে অদৃশ্য হাতের কারসাজি কাজ করেছিল। রাজনৈতিক মদদে ঋণ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্যরই নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশের কোন তোয়াক্কা না করেই। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ প্রকল্প সমীক্ষাও করা হয় না। শুধুমাত্র সুদের হিসাব কষেই কল্পিত মুনাফার লোভনীয় টোপ দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা যা আর কোন দিনই ব্যাংকে ফিরে আসবে না। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো সরকারী তহবিলের মদদ পেলেও বেসরকারী ব্যাংকগুলো এই দায় উদ্ধারের জন্যে কার মদদ পাবে?
১৭। সুদ অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতার অন্যতম মুখ্য কারণ। একথা সর্বজনবিদিত যে পুঁজি বাজার মূলধনের চাহিদা হ্রাস পেলে সুদের হার হ্রাস পায়, আবার মূলধনের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে সুদের হারও বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন দেশের সুদের হারের ওঠানামা কালীন সারির তথ্য (Time series data) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোন দেশে সুদের হার দীর্ঘকাল স্থিতিশীল থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোন কারণে তেজীভাব শুরু হলে মূলধনের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পুঁজির যোগানদার তখন সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে পুঁজির চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করে, এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে তা পূর্বের চেয়েও হ্রাস পায়। এর মুকাবিলায় সুদের হার আবারও হ্রাস করা হয়। পুনরায় মূলধনের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে সুদের হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এভাবে সুদের হারের ঘন ঘন ওঠা-নামার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিক্ষিপ্ত হয় অনিশ্চয়তার মধ্যে। এরই ফলে বিনিয়োগ, শেয়ার, পণ্য ও মুদ্রা বাজারে দারুণ অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রীডম্যান বলেছেন সুদের হারের অনিশ্চিত ও অনির্ধারিত ওঠানামার ফলে যেকোন দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক অস্থিরতার সৃষ্টি হতে পারে।
১৮। সুদের কারণে অর্থনীতির কল্যাণকর খাতে বেসরকারী বিনিয়োগ হ্রাস পেতে বাধ্য। পরিণঅমে সামাজিকভাবে কাম্য সেবা ও দ্রব্য সামগ্রীর সরবরাহ সংকোচন ঘটে অনিবার্যভাবেই। সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, তা উৎপাদনমুখীই হোক আর সেবামূলকই হোক, একই হারে মুনাফা হয় না। কোন ক্ষেত্রে মুনাফা হার সুদের হারের চেয়ে বেশী, কোথাও সমান, আবার কোথাও বা কম। সাধারণভাবে বিলাস সামগ্রী ও সমাজের জন্যে অকল্যাণকর খাতে উৎপাদন ও ব্যবসায়ে মুনাফার হার হয়ে থাকে সর্বোচ্চ। প্রসাধন ও বিলাস সামগ্রী, সৌখিন দ্রব্য, মদ ও নেশার বস্তু ইত্যাদি তার পকৃষ্ট উদাহরণ। পক্ষান্তরে সমাজের জন্যে অত্যাবশ্যকীয় ও কল্যাণকর দ্রব্য সামগ্রী ও সেবার ক্ষেতে মুনাফার হার প্রায়শঃই খুব কম থাকে। এমন কি তা প্রদেয় সুদের হারের চেয়েও বেশী সেখানেই বিনিয়োগ হয় সর্বাধিক। অপর দিকে যেসব অত্যাবশ্যকীয় খাতে মুনাফার হার সুদের হারের সমান বা কম সেখানে কোন বিনিয়োগকারী এগিয়ে আসতে আগ্রহী হয়না। কারণ সুদ প্রদানের পর তার আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। অথচ সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এই খঅতে বিনিয়োগ সবচেয়ে জরুরী। যদি অর্থনীতিতে সুদ নাথাকতো তাহলে বিনিয়োগকারীরা (এবং মূলধনের যোগানদাদরেরাও) প্রাপ্তব্য মুনাফাতেই (তার হার যত কমই হোক না কেন) পুঁজি বিনিয়োগে দ্বিধা করতো না। ফলে সমাজের অপরিহার্য ও কল্যাণকর খাতের সম্প্রসারণ ও কর্মদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হতো।
১৯। সুদের কারণেই অর্থনীতিতে ব্যবসায় চক্রের (Business Cycle) সৃষ্টি হয়। অর্থনীতিতে বারবার মন্দা ও জেতীভাবের আবর্তন হতে থাকে। যার ফলে সব সময় অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। যেকোন অর্থনীতির জন্যে এ অবস্থা অনাকাংখিত। অর্থনীতিতে যখন তেজীভাব থাকে তখনসুদের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে সুদের হার যখন অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায় তখন ঋণ গ্রহীতারা হিসেব করে যদি দেখে যে অতিরিক্ত সুদের হারের কারণে লাভের সম্ভাবনা খুব কম তখন তারা ঋণ নেওয়া বন্ধ কর দেয়। িএর ফলে পুঁজি বিনিয়োগে ভাটা পড়ে, উৎপাদন কমে যায়, শ্রমিক ছাঁটাই হয়, ব্যবসায়ে সৃষ্টি হয় মন্দা। এভাবে পুঁজির চাহিদা খুব কমে যাওয়ায় ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে দেয়। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা নতুন করে ঋণ নিয়ে তখন উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দেয়। ক্রমে মন্দা কেটে গিয়ে পুনরায় তেজীভাবে সৃষ্টি হয়। এভাবে বারবার মন্দা ও তেজীর সৃষ্টি অর্থনীতির জন্যে যে অত্যন্ত অশুভ ও ভয়াবহ পরিণতির জন্য দেয় সে বিষয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির শ্রেষ্ঠ প্রবক্তরাও একমত।
অনেকের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সঞ্চয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সুদ আসলেই অর্থনীতির জন্যে অপরিহার্য নয়, সঞ্চয়ের জন্যে তো নয়ই। বরং তা অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিবন্ধক। সুদনির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা বিশ্ববিশ্রুত অর্থনীতিবিদ লর্ড জেন মেনার্ড কেইনস তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ The General Theory of Emplyment Interest and Money-তে প্রমাণ করেছেন সঞ্চয়ে সুদের কোন ভূমিকা নেই। সুদ বিদ্যমান না থাকলেও লোকে ব্যক্তিগত কারণে অর্থ সঞ্চয় করবে। দুর্দিনে খরচও আকস্মিক বড় ধলনের ব্যয় মেটাবার প্রয়োজনেই তারা সঞ্চয় করে।
২০। সুদ ধনবন্টনের অসহায়তার কারণ ও পূর্ণ কর্মসংস্থানের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক। কীনস দেখিয়েছেন সুদের জন্যেই বরং বিনিয়োগ সীমিত হয়ে পড়ে। যেকোন দেশের অর্থনীতির পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সুদের উচ্চ হারের সময়ে বিনিয়েঅগের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মপ্রয়াস সংকুচিত হয়েছে। অপরদিকে সুদের হার যখন ন্যূনতম তখনই বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মপ্রয়াসও বেড়ে গেছে। এসব হতে বুঝতে বাকি থাকে না যেসুদ অর্থনৈতিক সাম্যেরই বিরধী নয়, অগ্রগতিরও বিরোধী।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনীতির জন্যে সুদ কি ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে।সুদের যে সব অকল্যাণকর দিক সম্বন্ধে বলা হলো সেসব ছাড়াও সুদের ণৈতিক সামাজিক মনস্তাত্বিক রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষতিকরদিক রয়েছে। এখানে সেসব আলোচনার সুযোগ নেই। সুদনির্ভর অর্থনীতি প্রকৃতপক্ষে কতদূর বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হতে পারে তা তুলে ধরাই ছিল এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার উদ্দেশ্য।
অর্থনীতি সুদবিহীন হলে বিনিয়োগের জন্যে যেমন অর্থের অব্যাহত চাহিদা থাকবে তেমনি সঞ্চয়েরও সদ্ব্যবহার হবে। এর ফলে নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে অধিক উৎপাদন কর্মসংস্থান ও সম্পদের সুষম বন্টন ঘটবে। প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। একচেটিয়া কারবার হ্রাস পাবে। অতি মুনাফার সুযোগ ও অস্বাভাবিক বিনিয়োগ প্রবণতা দূর হবে। এই সমস্ত উদ্দেশ্য সাধন ও বড় ধরনের শোষণের পথ বন্ধ করেদেওয়ার জন্যেই ইসলাম সুদকে হারাম বা অবৈধ ঘোষণা করছে। বস্তুতঃ যুলুম ও বঞ্চনার অবসান ঘটাতে হলে তার উৎসকেই সমূলে বিনাশ করতে হয়। সেটাই বৈজ্ঞানিক পন্থা্
সুদ উচ্ছেদের উপায়
প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে দীর্ঘদিন ধরে সুদভিত্তিক অর্থনীতি চালু রয়েছে সেদেশে কিভাবে সুদ উচ্ছেদ করা সম্ভব? সুদের অভিশাপ মু্ত হয়ে কিভাবে ইসলামের অর্থনৈতিক সুবিচারের ছায়াতলে আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে? এজন্যে নীচে উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যায়। আমাদের বিশ্বাস যদি প্রচেষ্টায় আমরা আন্তরিক ও যত্নবান হই তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর অসীম রহমতের ছায়াতলে আমাদের ঠাঁই দেবেন।
ক. ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান স্থাপন
এ কথা আজ অবিসংবাদী সত্য রূপে প্রতিষ্ঠিত যে বর্তমান প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি শুধু সফলই প্রমাণিত হয়েছে তাই নয়, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর চাইদে অধিকতর যোগ্যতার সাথে কাজ কর যাচ্ছে। এজন্যে আজ অমুসলিম দেশে, এমনকি অমুসলিম পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এর বড় উদাহরণ লুক্সেমবার্গ, ডেনমার্ক, ইংল্যাণ্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে প্রথম ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুই দশকেরও বেশী আগে এবং সাফল্যেল সাথে ব্যাংকটি কাজ করেযাচ্ছে। আরও দুটি ব্রাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৫ সালে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এদেশের জনগণের মন মানসিককাত প্রবলভাবে ইসলামমুখী অথচ বিদ্যমান আইন কাঠামো, সমাজব্যবস্থা এমনকি ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই মন-মানসিকতা ইসলামবিরোধী। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও রোমান-বৃটিশ আইন দ্বারা আজও এদেশের ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই প্রতিকূল অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখেই বলা যায়, বাংলাদেশে আরও ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন এবং সেসবের সেবা গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া আবশ্যক।
খ. করযে হাসানাও মুদারিবাত ব্যবস্থার প্রবর্তন
সমাজে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি এবং বিত্তহীন দক্ষ ও যোগ্য লোকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারে করযে হাসানা ও মুদারিবাত পদ্ধতি। ইসলামী সমাজের এই অপরিহার্য বিধানটি এদেশে অনুপস্থিত। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, এমনকি সংখ্যালঘু মুসলমানের দেশ শ্রীলংকাতেও মসজিদভিত্তিক করযে হাসানা প্রদান ও সোসাইটিভিত্তিক মুদারিবাত ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ দেশেও এই ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। সমাজের বিত্তশালী লোকদের করযে হাসানা দেওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এই উদ্যোগ যদি মসজিদকেন্দ্রিক হয় তাহলে সত্যিকার যোগ্য লোককে যেমন সুযোগ দেওয়া যাবে তেমনি এলাকাভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি সমাজ সচেতনতা ও সমাজকল্যাণ নিশ্চিত হবে।
মুদারাবা পদ্ধতি এদেশে চালু করতে সময়ের প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে আইন কাঠামো বদলানোর পাশাপাশিউত্তম চরিত্রের লোক সৃষ্টির। ুত্তম ও যোগ্য লোকেরা মুদারাবার মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধি উভয়বিধ উপায়েই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে পারে। উপরন্তু সমাজের বিত্তশালী লোকদের মনোভাব পরিবর্তনের জন্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্যে প্রয়োজন তাদের ইসলামী অনুশাসন জানতে ও অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করা। করযে হাসানা দিলে সেই অর্থের জন্যে আয়কর দিতে হবে না এবং মুদারাবার ক্ষেত্রে সাহিব আল-মালকে মুনাফার নির্দিষ্ট পরিমাণ উর্ধের জন্যে আয়কর দিতে হবে এমন আইন করে বিত্তশালী মুসলিমদের মনোযোগ আকর্ষণ করা সম্ভব।
গ. পাঠ্যসূচীতে ইসলামী অর্থনীতি চালু করা
বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগণের তথা মুসলমান জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য এই যে শিক্ষার বিষয়বস্তুর সঙ্গে তাদের ঈমানও আকীদার কোন সংশ্রব নেই। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রবর্তিত ইসলামী শিক্ষার কথা বাদ দিলে উচ্চতর শিক্ষা এবং বিশেষ শিক্ষার কোন পর্যায়েই ইসলাম যে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা তাজানার ও অনুশীলনের কোনও সুযোগ নেই। এই অবস্থার নিরসন হওয়া দরকার। দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পাঠ্যসূচীতে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ঈমান-আকীদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। মাদরাসা শিক্ষার পাশাপাশি সকল শিক্ষাক্রমে ইসলামী অর্থনীতি পাঠ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পৃথিবীর বহু মুসলিম দেশেতো বটেই, অমুসলিম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও ইসলামী অর্থনীতির পাঠ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এদের সবার পেছনে। দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের পাঠ্যক্রমে বিক্ষিপ্তভাবে কোন কোন পত্রে ‘ইসলাম’ শব্দ জুড়ে দিয়ে দায় সারা হচ্ছে। অথচ প্রয়োজন গোটা পাঠ্যসূচীর সংস্কার। যারা আগামী দিনে এদেশের প্রশাসন বিচার আইন ব্যবসা-বাণিজ্য ও কল-কারখানার কর্ণধার হবে তাদের যদি এখনই সুদী অর্থনীতির কুফল ও ধ্বংসাত্মক দিক সম্বন্ধে অবহিত করা না যায় এবং পাশাপাশি ইসলামী অর্থনীতির গঠনমূলক ও হিতকর দিকগুলো জানানো না যায় তাহলে জাতি যে তিমীরে রয়েছে সেই তিমিরেই রয়ে যাবে।
ঘ. গণসচেতনতা সৃষ্টি
ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই কে বল ইসলামী অর্থনীতি অর্জনের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হতে পারে। জনগণের চাহিদা এবং তার দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ ছাড়া সরকার নিজ থেকে খুব কমই তাদের উপযোগী ও প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েথাকে। ইসলামী অর্থনীতি চালু বা বাস্তবায়ন করা হবে প্রচলিত ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত।এজন্যে সবার আগে চাই গণসচেতনতা। আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ নিরক্ষর। সেজন্যে কাজটা একটি কঠিন ও আয়াসসাধ্য বটে তবে অসম্ভবনয়। কারণ এদেশের জনগণ ধর্মভীরু এবং সরল প্রকৃতির। তাদের যদি যথাযথভাবে ইসলামের দাবী কি এবং তা অর্জনের উপায় কি এটা বোঝানো যায়, প্রকৃতই উদ্বুদ্ধ করা যায় তাহলে এদেশের অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোয় ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ হতে পারে কিন্তু অসম্ভব নয়। এজন্যে দুটো উপায় অনুসরণ করা যেতে পারে।
প্রথমতঃ মসজিদে খুতবার সাহায্য গ্রহণ। বছরে বায়ান্ন দিন এলাকার জনগণ মসজিদে জুম’আর নামাযে শামিল হন। এই নামাযের খুতবায় নানা বিষয়ের অবতারণা করা হয়। সেসব বিষয়ের পাশাপাশি যদি খতিব বা ইমাম সাহেব সুদী অর্থনীতির কুফল এবং দেশ ও জাতির জন্যে তা কতখানি ক্ষতিকর বুজিয়ে বলেন তাহলে ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে।
দ্বিতীয়তঃ দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিলে, তাফসীর মাহফিল ও ইসলামী জলসায় ওলামায়ে কেরাম ও মুফাসসীরে কুরআনগণ বক্তৃতা করে থাকেন। ঐসব অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোকের সমাপন হয়। ঐসব অনুষ্ঠানে যদি ইসলামী অর্থনীতির উপযোগিতা এবং সুদী অর্থনীতির কুফল সম্বন্ধে বিশাদভাবে বুঝিয়ে বক্তব্য রাখা যায়তাহলে যে আলোড়ন সৃষ্টি হবে, জনমত গড়ে উঠবে তার ধাক্কাতেই সুদী অর্থনীতি উৎখাত হতে পারে, বাস্তবায়িত হতে পারে ইসলামী অর্থনীতি। এর জন্যে চাই দীর্ঘ মেয়াদী সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা।
ঙ. গণপ্রতিরোধ গঠন
উপরে বর্ণিত উপায়গুলো ছাড়াও সুদ নির্মূলকরার আরও কয়েকটি ছোট-খাট উপায় রয়েছে। এগুলো সবই অবশ্য জনগণনির্ভর। জনগণ গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে সুদের বিরুদ্ধে, সুদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে। এই প্রতিরোধ যতই ব্যাপক ও দুর্বার হবেসুদরে নাগপাশ ততই দ্রুত খসে পড়তে বাধ্য। এসব পদক্ষেপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উল্লেখ এখানে করা গেল।
১. সুদখোরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ। সমাজে যারা সুদখোর বলে পরিচিত, তাদের পরিচিত যাই হোক না কেন ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক ছেদ করতে হবে। তারা যেন বুঝতে পারে যে সুদের সঙ্গে সংশ্রব থাকার কারণেই জনগণ তাদের সংগ বর্জন করেছেন বা তাদের এড়িয়ে চলছেন। কাজটা কঠিন মনে হতে পারে কিন্তু সকলে মিলে এগিয়ে এলে মোটেই দুঃসাধ্য নয়।
২. সুদখোরদরে জনপ্রতিনিধি না বানানো। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কোন কাজে সুদখোরদের নির্বাচিত হতে দেওয়া হবে না। তারা ভোটপ্রার্থী হলে যেন ভোট না দেওয়া হয় সেজন্যে জোর প্রচারণা চালাতে হবে। জনগণকে বুঝাতে হবে এই সব লোককের কার্যক্রমের জন্যেই সমাজে শোষণ নির্যাতন নিপীড়ন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকবে।
৩. সুদখোরদরে সামাজিকভাবে বয়কট করা। যারা সুদের ব্যবসা করে, গ্রামে মহাজনী কারবারের (গ্রামাঞ্জলে সুদী ব্যবসার প্রচলিত নাম) সাথে যারা যুক্ত তাদের ছেলে-মেয়ের সাথে নিজেদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে না দেওয়া এবং তাদের জানাযা না পড়ানোও উত্তম প্রতিষেধকের কাজ করতে পারে। বাংলাদেশেই আজ হতে পঞ্চাশ ষট বছর পূর্বে গ্রামাঞ্জলে সুদখোরের দাওয়াত কেউ সহজে গ্রহণ করতে চাইতো না। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির দাপটে এবং দ্বীনি শিক্সা বঞ্চিত হওয়ার কারণে সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।
৪. সরকার যেসব ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সুদ প্রদান বাধ্যতামূলক করে রেখেছে সেগুলো রহিত করার জন্যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা যেতে পারে। উদাহরণতঃ জমির খাজনা যথাসময়ে দিতে না পারলে তার উপর সুদ দিতে হয়।সুদের বদলে সরকার জরিমানা আরোপ করতে পারে। ঈমান ও আকীদাবিরোধী সুদ কেন দিতে হবে? অনতিবিলম্বে সরকার যেন খাজনার খাত থেকে সুদ প্রত্যাহার করে নিতান্তই অপরিহারয ক্ষেত্রে জরিমানার ব্যবস্থা চালু করে সেই লক্ষ্যে জনগত গঠন করা উচিৎ।
আশা করা যায়, এসব উপায় অনুসরণের মধ্যে দিয়ে এদেশের সুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি হবে, আল্লাহ ঘোষিত হারামবর্জনের জন্যে সর্বাত্মক প্রয়াস সূচিত হবে। পাশাপাশি ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্যে আপামর জনসাধারণ অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ নিজ সাধ্যমতো দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ হবে। বস্তুতঃ আমাদের দায়িত্বই হচ্ছে চেষ্টা করাএবং তার মধ্যে দিয়ে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা। এই প্রয়াসেতিনি আমাদের সহায় হোন এবং হোক আমাদের ফরিয়াদ।