ইসলামী অর্থনীতি চিন্তার ক্রমবিকাশ
ইসলামী জ্ঞানের বিকাশ ও সমকালীন যুগ জিজ্ঞাসার উত্তরের সর্বশেষ উৎস ইজতিহাদ। অর্থনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান শতাব্দীতে ইসলামী অর্থনীতি যে রূপে আমাদরে সামনে উপস্থিত তা দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর ইজতিহাদেরই ফসল। আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) আমল হতেই ইজতিহাদের শুরু। তিনি জি হাদে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের মধ্যে বিজিত এলাকার জমি বন্টনের রীতি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিই তাঁকে এই ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করেছিলো। উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে মুসলিম দার্শনিক, ফকীহ ও মুজাদ্দিদগণের চেষ্টা ছিলো নতুন নতুন পরিস্থিতিতে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রদান। ক্ষেত্রবিশেষে সমস্যার যথার্থ বিশ্লেষণও ছিলো প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ পাওয়অর ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ। এই পথ ধরেই বিংশ শতাব্দীতে সুদ উচ্ছেদের চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় মুসলিম ফকীহ ও অর্থনীতিবিদদের সমন্বিত প্রয়াসে ইজতিহাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং ও বীমা পদ্ধতি। বস্তুতঃপক্ষে ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তাধারা সময়ের চ্যালেঞ্জ মুকাবিলায় মুসলিম চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সাড়া। স্বাভাবিকভাবেই এই চিন্তাধারা আল-কুরআন ও সুন্নাহ্ দ্বারা অনুপ্রাণিত। ‘অর্থনৈতিক চিন্তাধারা’ বলতে যা বোঝায় তা হলো দরিদ্র্য ও প্রাচুর্য, উৎপাদন ও বন্টন, বিনিময় ও ভোগ, দাম ও অর্থ ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের চিন্তাধারা। এর আওতায় আসে অর্থনৈতিক বিষয়াদির বিবরণ, অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট উপাদানসমূহের ব্যাখ্যা ও সুপরিশ এবং কোন সুনির্দিষ্ট নীতির সম্ভাব্য ফলাফল নিরুপণ ও বিশ্লেষণ।
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় যখন যে সমস্যা দেখা দিতো ফকীহরা সে ব্যাপারে আল-কুরআন ও হাদীসের আলোকে সে সবের ভাল-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরতেন এবং তাঁদের মতামত দিতেন। মানুষ যাতে শুধুমাত্র জাগতিক ব্যাপারেই নিজেদের ব্যাপৃত না রাখে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন সুফিগণ। মুসলিম দার্শনিক-অর্থনীতিবিদগণ তাঁদের মতামত মূলতঃ সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিষয়াদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ, বিদ্যমান সমস্যার সমাধান এবং ভবিষ্যতের জন্যে গৃহীতব্য কর্মসূচী প্রসঙ্গে তাঁদের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মহান খুলাফায়ে রাশিদূনের সময় হতে মোঘল শাসন আমলের শেষ পর্যন্ত অসংখ্য ফকীহ ও দার্শনিকের সন্ধান পাওয়া যায় যাঁরা অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় অবদানের বিবরণ সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
কালক্রম অনুসারে প্রথমেই আসে আবু ইউসুফ-এর কথা। তাঁর পুরো নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবন ইবরাহীম ইবন হাবীব ইবন হুবাইশ ইবন সা’দ ইবন বুজায়ের ইবন মুয়াবিয়া আল-আনসারী আল-কুফী (১১৩-১৮২হি./৭৩১-৭৯৮ খ্রী.)। জন্ম কুফায়। তিনি ইমাম হিসাবেও খ্যাত চিলেন। তাঁর কিতাব- আল খারাজ ইসলামী অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এ বিষয়ে পরে অন্যান্য ফকীহরাও লিখেছেন। তবে তাঁর মত যুক্তিপূর্ণ ও দৃঢ় বক্তব্য আর কারো লেখায় পাওয়া যায় না। আবু ইউসুফ যেসব বিষয়ে তৎকালীন শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তার মধ্যে রয়েছে: জনগণের প্রয়োজন পূরণের উপর তাগিদ এবং করের ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতা রক্ষার উপর জোর। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় প্রায় বারো শত বছর পূর্বে তাঁর লেখায় আধুনিককালের Cannons of Tasation-এর মতই তিনি করের তিনটি কানুনের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো: (১) কর প্রদানের সামর্থ্য, (২) কর প্রদানের উপযোগী পদ্ধতি এবং (৩) কর প্রদানকারীদের কর প্রদানের জন্যে সুবিধাজনক সময় নির্ধারণ। তিনি কর প্রশাসন বিষয়ক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকেই যৌক্তিক বিবেচনা করেছেন।
তিনি কৃষি উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষি ভূমির উপর কর আরোপের সুপারিশ করেন। বিস্ময়ের বিষয়, প্রগতিশীল করের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়েও তিনি সুচিন্তিত ও দৃঢ় বক্তব্য রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনার দ্বারা দেখিয়েছেন ভূমির উপর আনুপাতিক বা স্থির হারে খাজনা নির্ধারণ অপেক্ষা প্রগতিশীল হারে কর আরোপের ফলে আদায়কৃত করের পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি সামাজিক সাম্যও প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রগতিশীল কর আরোপের ক্ষেতে তাঁর যুক্তিপূর্ণ আলোচনার জন্যে নিঃসন্দেহে তিনি পথিকৃত চিন্তাবিদ হিসেবে গণ্য হবেন। তিনি পূর্ত কর্মসূচী, বিশেষতঃ সেচ ব্যবস্থা সড় নির্মাণ রাষ্ট্রেরই অর্থনৈতিক দায়িত্ব বলে সাব্যস্ত করেন। এ সবের ব্যয় কিভাবে মেটানো যায় সে ব্যাপারেও সুস্পষ্ট মতামত প্রদান করেছেন। আবু ইউসুফের মৌলিক অবদান সরকারী অর্থায়ন প্রসঙ্গে, কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়েও তিনি আলোচনা করেছেন। দাম কিভাবে নির্ধারিত হয়, বিভিন্ন রকম নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে তিনি শাসকের ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন।
আল–শায়বানীর পুরো নাম ইমাম মুহাম্মদ ইবন আল-হাসান আল-শায়বানী (১৩২-১৮৯ হি./৭৫০-৮০৪ খ্রী)। কিতাব আল-ইকতিসাব ফিল রিযক আল-মুসতাতব বইয়ের জন্যেই তাঁর খ্যাতি। এই বইয়ে কিভাবে সৎ উপায়ে উপার্জন করা যায় তার বিবরণ পাওয়া যায়। সৎ উপার্জনের জন্যে তিনি যেসব পদ্ধতির সুপারিশ করেছেন সে সবের মধ্যে ইজারাহ্ (ভাড়া), তিজারাহ (ব্যবসা), যিরাআহ্ (কৃষি) এবং সিনআহ (শিল্প) উল্লেখযোগ্য। একজন ভাল মুসলমান তার আয় ব্যয় করার ক্ষেত্রে পরহিতপরায়ণ হবে এবং সে যাতে ভিক্ষা না করে তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আল-শায়বানী কৃষিকাজকে সকল পেশার মধ্যে মহত্তম বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ম তে সমগ্র সমাজের জন্যে এটি সবচেয়ে অপরিহার্য ও উপকারী। তাঁর মত সমকালীন অন্যান্য ইমাম ও ফকীহদের থেকে তাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। কারণ অন্যান্যরা ব্যবসা বাণিজ্যকেই কৃষিকাজের উপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আবু ইউসুফের যোগ্য শিষ্য ও উত্তরসূরী।
যেসব সূফী শরীয়াহর বিধান ত্যাগ করে অন্যের খাদ্য গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন না তিনি তাদের সমালোচনা করেন। আল-শায়বানী সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্যে যতটুকু আয় করা প্রয়োজন অন্ততঃ ততটুকু আয় করার জন্যে সবাইকে পরামর্শ দেন। তাঁর কিতাব-আল-আসল এবং অন্যান্য রচনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লেনদেন সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সালাম (অগ্রিম ক্রয়), শিরকাত (অংশীদারিত্ব) ও মুদারাবাহ (মুনাফার অংশীদারিত্ব) ইত্যাদি।
আবু উবায়দ–এর পুরো নাম আবু উবায়দ আল-কাসিম ইবন সাল্লাম (১৫৪-২২৪ হি./৭৬৬-৮৩৮ খ্রী.)। ইমাম হিসেবেও তা৭র খ্যাতি রয়েছে। তাঁর কিতাব-আল-আমওয়াল সরকারী অর্থব্যবস্থার একটি ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই বইয়ে প্রজাদের উপর শাসকেরদ অধিকার এবং শাসকদের উপর প্রজাদের অধিকার ছাড়াও যাকাত ও উশর, খুমস এবং ফাই (খারাজ ও জিজিয়াসহ) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। ইসলামের প্রথম দু’শতাব্দীর অর্থনৈতিক ইতিহাস হিসাবেও বইটির সবিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
ইয়াহিয়া বিন আদম–এর পুরো নাম আবু জাকারিয়া ইয়াহিয়া ইবন আদম ইবন সুলাইমান আল-কুরাইশী আল-উমায়ী আল কুফী (১৩৪-২০২ হি./৭৫২-৮১৮)। তাঁর রচিত বইয়ের মধ্যে কিতাব আল-খারাজ ইসলামী ভূমি রাজস্বের ইতহিাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত। এর প্রধান কারণ এটি তাঁর উস্তাদ আবু ইউসুফের কিতাব আল-খারাজ-এর উপস্থাপিত বক্তব্যের জবাব বা বিতর্কমূলক উত্তর। ভূমি কর সম্বন্ধে তিনি তাঁর বিখ্যাত শিক্ষকদের বক্তব্য খণ্ডন করে হাদীসকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বালাযুরী তাঁর রচনায় এই বইটি বহুল ব্যবহার করেছেন। শুধুমাত্র খারাজের প্রসঙ্গে আলোচনা সীমাবদ্ধ না রেখে ইয়াহিয়া বিন আদম অন্যান্য ভূমি কর ও উশর বিষয়েও বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। স্থাপর সম্পত্তির উপরও উশর আদায় করা যেতে পারে বলে তিনি অভিমত পোষণ করেন।
আল–মুহাসিবির পুরো নাম আবু আবদ আল্লাহ হারিস ইবন আসাদ আল-আনাযী আল-মুহাসিবি (১৬৫-২৪৩ হি./৭৮১-৮৫৭ খ্রী.)। তাঁর জন্ম বসরায়। মূলতঃ সুফী হলেও অর্থনৈতিক ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান রয়েছে। তাঁর মতে সম্পদ কারোরই অণ্বেষার বিষয় হওয়া উচিত নয়। বরং অল্পে তৃপ্ত হওয়াতেই কল্যাণ নিহিত। উপরন্তু যা শরীয়াহতে নিষিদ্ধ তা থেকে দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। তিনি যুহদ বা মিতাচারের প্রবক্তা ছিলেন। ভোগের জন্যে লালায়িত হলে হালালের সীমা লংঘনের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। তাই ব্যক্তির সাথে তার সম্পদের সম্পর্ক হবে খুবই নিয়ন্ত্রিত ও সতর্কতামূলক। ভোগ-লালসাকে তিনি মহাপাপ বলে নিন্দা করেছেন। তাঁর মতে সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বার্থপরতা ও করযে হাসানা না দেওয়া বস্তুতঃপক্ষে আল্লাহকে তার প্রাপ্য প্রদানে অস্বীকারতুল্য। এসব প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনা রয়েছে তাঁর রিসালাহ আল-মাকাসিব ওয়াল ওয়ারা ওয়াল শুবুহাহ বইয়ে।
কুদামা বিন জাফর–এর পুরো নাম কুদামা ইবন জাফর আবুল ফারাজ আল-কাতিব আল-বাগদাদী (মৃত্যু ৩৩৭ হি./৯৪৮ খ্রী.)। এক খৃষ্টান পরিবারে তাঁর জন্ম। খলীফা আল-মুকতাফীর রাজস্বকালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কালের ধ্বংস হতে তাঁর যে তিনটি বই রক্ষা পেয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুই খণ্ডে সমাপ্ত কিতাব আল-খারাপ। এই বইয়ে তিনি তৎকালীন খলীফার শাসনাধীন এলাকার প্রদেশসমূহের বিবরণের পাশাপাশি সরকারী ডাক ব্যবস্থা ও আদায়কৃত করের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর আলোচনা থেকে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের ফাইন্যান্সিয়াল পদ্থতি, করের শ্রেণী, কর হতে আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে জানা যায়। প্রশাসনিক কাঠামোর সাথে কর আদায়ের সম্পর্ক বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন।
খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীর শেষ ভাগে আল–মাওয়ার্দীর জন্ম। তাঁর পুরো নাম আবুল হাসান আলী ইবন মুহাম্মদ ইবন হাবীব আল-বসরী আল-বাগদাদী (৩৪০-৪৫০ হি./৯৭৪-১০৫৮ খ্রী.)। তিনি ইরাকের বসরা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন এবং জীবনের দীর্ঘ সময় বাগদাদে অতিবাহিত করেন। তিনি বাগদাদের প্রধান কাযীর পদও অলংকৃত করেন। তাঁর আল-আহকাম-আল-সুলতানিয়া সরকার ও প্রশাসন সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এতে একজন শাসকের কর্তব্য, সরকারী আয় ও ব্যয়, সরকারী জমি, খাস জমি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। একজন আদর্শ শাসক বাজার তদারকী করবে, সঠিক ওজন ও মাপ নিশ্চিত করবে, প্রতারণা রোধ করবে এবং ব্যবসায়ী ও কারিগরেরা যাতে তাদের লেনদেনের ক্ষেত্রে শরীয়াহর নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে সে দিকে নজর দেবে। তাঁর কিতাব আদাব আল-দ্বীন ওয়াল দুনইয়া বইয়ে একজন মুসলমানের অর্থনৈতিক আচরণ কেমন হবে সে বিষয়ে শরীয়াহর আলোকে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেন সৎ উপার্জনের জন্যে চারটি পথ খোলা রয়েছে- কৃষি কাজ, পশু পালন, ব্যবসা এবং শিল্প।
ইবন হাযমের পুরো নাম আবু মুহাম্মদ আলী ইবন আবু উমার আহমদ ইবন সাঈদ ইবন হাযম আল-কুরতুবী আল-আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হি./৯৯৪-১০৬৪ খ্রী.)। স্পেনের কর্ডোভার এক ধনী ও বিখ্যাত পরিবারে তাঁর জন্ম। ইমাম হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিলো। তাঁর রচনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে আল-মুহল্লাহ শারহ আলা মিনহাজ আল-তালিবীন। তাঁর লেখায় মানুষের মৌলিক চাহিদা ও দারিদ্র্য, ভূমিসত্ব ব্যবস্থা, কর ও যাকাতের প্রসঙ্গই সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। মানুষের বিশেষতঃ সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব স্ব স্ব এলাকায় ধনীদের। তারা এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে বা এড়িয়ে যেতে চাইলে তাদের সম্পদ হতে অংশবিশেষ এই কাজে প্রদানে বাধ্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
ভূমিসত্ত্ব প্রসঙ্গে ইবনে হাযম মুযারাআহ-কে ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ বলেছেন। তাঁর মতে বর্গাচাষীদের বেলায় মালিকদের নির্দিষ্ট হিস্যা-ফসলের অংশ, অর্থ বা অন্য যে কোন কিছু-পূর্বেই নির্ধারিত করে নেওয়া ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। কর প্রসঙ্গে তাঁর সবচেয়ে উদ্বেগ ছিলো কর আদায়ের পদ্ধতি নিয়ে। তিনি পীড়নমূলক ও শোষণধর্মী করের বিরুদ্ধে ছিলেন। কর সংগ্রহের পদ্ধতি বিষয়েও তাঁর উদ্বিগ্নতা লক্ষ্যণীয়। কর আদায়ের অন্যায় ও জবরদস্তি মূলক পদ্ধতি প্রসঙ্গে তিনি কঠোর মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে শরীয়াহর বিধান লংঘন করে কর আদায় করা যাবে না। যাকাত আদায়ের ব্যাপারে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে বলেছেন। উপরন্তু কেউ যাকাত আদায় না করে মৃত্যুবরণ করলে তার সম্পদ হতে যাকাত আদায় করে নেওয়ার পক্ষে তিনি দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে মানুষের প্রাপ্য যদি মৃত্যুর পরেও পরিশোধযোগ্য হয় তাহলে আল্লাহর প্রাপ্য কেন পরিশোধযোগ্য হবে না?
আল–গাযালীর পুরো নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ আল-তুসী আল-শাফিঈ আল-গাযালী (৪৫১-৫০৫ হি./১০৫৫-১১১১খ্রী.)। খোরাসানে তাঁর জন্ম। ইমাম হিসেবেই তাঁর সমধিক প্রসিদ্ধি। ইহইয়া উলূম আল-দীন তাঁর অবিস্মরণীয় ও কালজয়ী গ্রন্থ। মানুষ যে সময়ে জাগতিক সুবিধাদির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল সে সময়েই আল-গাযালীর আবির্ভাব। যে সময় ইসলামে নানা শিরক ও বিদয়াতের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, নানা সংশয় ঘিরে ধরেছিল মুসলমানদেরকে সে সময়ে তাঁর আবির্ভাব।
তাঁর লেখায় সুফী মতবাদের ছাপ সুস্পষ্ট। তিনি সৎ নিয়্যাত ও অভীষ্ট লক্ষ্যজনিত কাজকর্মের উপর অতিশয় গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন একজন ব্যবসায়ী এমনভাবে তার দায়িত্ব পালন করবে যাতে তার সামাজিক বাধ্যতামূলক কর্তব্যও (ফরয-ই-কিফায়া) পালিত হয়। একজন ব্যক্তির সাধারণভাবে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য যতটুকু আয় করা দরকার তার বেশী বা কম আয় করার চেষ্টা করা উচিত নয়। মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে থাকবে আসবাপত্র, বিবাহ ও সন্তানাদি পালন এবং কিছু সম্পত্তি। তিনি কখনও খুব উঁচু মানের জীবন যাপনের পক্ষে ছিলেন না। রাসূল (স) ও তাঁর সাহাবীরা যেরূপ জীবন যাপন করতেন সেটিই ছিলো তাঁর পছন্দ। যারা তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপার্জন করে এবং মজুত করে রাখে এবং তার গরীব ভাদের সহায়তা করে না তাদেরকে তিনি অত্যাচারী হিসাবে আখ্যায়িত করেন।
প্রজাদের সাহায্য করা, তাদের প্রয়োজনের দিকে নজর দেওয়া, দুর্ণতি বন্ধ করা িএবং শরীয়াহ বিরোধী কর আরোপ না করার জন্যে তৎকালীন শাসকদের তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। জনগণ যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে নিপতিত হ য় তাদের সে সময় খাদ্র ও বস্ত্র ছাড়াও সরকারী কোষাগার হতে আর্থিক সাহায্য দেবারও পরামর্শ দেন। শ্রম বিভাগ ও মুদ্রার ক্রমবিকাশের উপরও গাযালীর অবদান রয়েছে। রিবা আল-ফদল নিষিদ্ধ হবার ব্যাপারে তিনি বলেন এটা মুদ্রার প্রকৃতি ও কার্যাদিকে লঙ্ঘন করে। মুদ্রা গচ্ছিত করে রাখা নিষিদ্ধ হবার ব্যাপারে তিনি যুক্তি দেখান যে মুদ্রা আবিষ্কৃতই হয়েছে বিনিময়ের মাধ্যমে হিসাবে কাজ করার জন্যে, কিন্তু গচ্ছিত মুদ্রা সেই প্রক্রিয়াকে ব্যহত করে।
ইবনে তাইমিয়ার পুরো নাম তাকিয়ুদ-দীন আবুল আব্বাস আহমদ ইবন শিহাবিদ্দীন আবদিল হালীম ইবন মাজদিদ-দীন আবদিস সালাম ইবন আবদিল্লাহ ইবন মুহাম্মদ ইবনিল খদর ইবন মুহাম্মদ ইবনিল খাদর ইবন আলী ইবন আবদিল্লাহ ইবন তায়মিয়া আল-হাররানীর আল-হাম্বলী (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রী.)। মুজাদ্দিদ ও ইমাম হিসাবে তাঁর খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। তিনি একটি পান্ডিত্যপূর্ণ পরিবারে মানুষ হন। তাঁর মৌলিক অবদান ফিকহ শাস্ত্র ও সমাজকে অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে। সমাজই ছিল তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূরণ বই আল-হিসবাহ ফী আল-ইসলাম। এ বইয়ের আলোচনায় যেসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সামাজিক বিষয়াদি যেমন চুক্তি ও তার বাস্তবায়ন, দাম ও কোন্ কোন্ অবস্থায় তা ন্যায্য ও পক্ষপাতহীন হিসাবে গণ্য করা যায়, বাজার তদারকীতে মুহতাসিবের দায়িত্ব, সরকারী অর্থব্যবস্থা ও জনগণের প্রয়োজন পূরণর সরকারের ভূমিকা ইত্যাদি।
তিনি দুর্নীতিবাজ সরকার ও শুধুমাত্র জাগতিক কাজকর্মে লিপ্ত থাকা ব্যক্তিদের খুব নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এ জন্যেই সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার উপর জোর দিয়েছেন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সীমানা নির্ধারণ করেছেন। তাঁর মতে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজ শরীয়াহর নিয়মের মধ্যে চলবে ততক্ষণ সমাজে অনৈতিক কর্মকান্ড হতে পারে না। ইবনে তাইমিয়া এমন সমাজের স্বপ্ন দেখেন যেখান অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে চলবে এবং ব্যক্তিগত সম্পদ নৈতিক বিবেচনায় সীমাবদ্ধ থাকবে। তিনি লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্ত চুক্তি ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে সম্পাদান করার পরামর্শ দেন। এটা তখনই সম্ভব যখন চুক্তিতে আবদ্ধ অংশীদারগণ স্বেচ্ছায় সব শর্ত মেনে নেয়। এক্ষেত্রে কোন রকম জোর-যুলুম বা অত্যাচার থাকবে না। ইবনে তাইমিয়াই প্রথম ইসলামী অর্থনীতিবিদ যিনি ন্যায্য দমনের উপর বিস্তারিত অবদান রাখেন। ইসলামী অর্থনৈতিক ইতিহাসে তাঁর আরও একটি অবদান হলো বিভিন্ন ধরনের অংশীদারিত্বের উপর জোর।
ইবনে তাইমিয়া যেসব বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং সুচিন্তিত মতামত দিযেছেন সে সবের মধ্যে রয়েছে:
১. নাগরিকদের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন নিশ্চিতকরণের রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্র,
২. রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ও তার সীমারেখা,
৩. বাজার তদারকি তথা মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ন্যায্য মুনাফা,
৪. সম্পদের মালিকানার ধরন এবং
৫. প্রতিষ্ঠান হিসাবে আল-হিসবাহ-এর প্রতিষ্ঠা।
প্রসঙ্গতঃ বলা ভালো এই অনন্যসাধারণ প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে অনেকেরই সুস্পষ্ট ধারণা নেই। অথচ ইসলামের ইতিহাসে এর গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যক্তিরা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ব্যক্তি ও সমাজের ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হতে পারে, সমাজবিরোধী কাজের মাধ্যমে জ নগণ ও দেশের অকল্যাণ ডেকে আনতে পারে। এর প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্যেই ইসরামী অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আল-হিসবাহর প্রতিষ্ঠা। আরবী শব্দ হিসবা-র ধাতুগত অর্থ গণনা। এ থেকে উৎপন্ন শব্দ ইহতাসাবার অর্থ কোন বিষয় বিবেচনায় আনা। ব্যবহারগত দিক থেকে হিসবাহর অর্থ এমন এক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যার দায়িত্ব সৎ কাজে মানুষকে সহায়তা করা বা নির্দেশ দেওয়া (আমর বিল মারুফ) এবং অসৎ কাজে বাধা দেওয়া বা নিরস্ত করা (নেহী আনিল মুনকার)। বস্তুতঃপক্ষে ইসলামী অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের দায়িত্বই হচ্ছে এমন ব্যবস্থার আয়োজন করা যার দ্বারা অপরিহার্যভাবেই সুনীতির (মারুফ) প্রতিষ্ঠা হবে এবং দুর্নীতির (মুনকার) উচ্ছেদ হবে।
মদীনায় ইসরামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর রাসূলে করীম (স) প্রথম দিকে রাষ্ট্রীয় এই দায়িত্ব পালনের ভার নিজের দকাঁধেই তুলে নেন। বহু প্রসিদ্ধ হাদীছ হতে দেখা যায়, তিনি নিজেই বাজার পরিদর্শন করেছেন, ব্যবসায়ীদের ওজনে কারচুপি ও দ্রব্যসামগ্রীতে ভেজাল দিতে নিষেধ করেছেন, মজুতদারীর (ইহতিকার) বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। যখনই কাউকে জনস্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত দেখেছেন তাকে কঠোরভাবে শায়েস্তা করেছেন। পানির নহরের ব্যবস্থাপনা, খেজুর বাগানের তত্ত্বাবধান, ইয়াতীমদের ভরণ-পোষণ ইত্যাদি বিষয়েও তিনি প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান করেছেন। এ জন্যেই ইসলামের ইতিহাসে তাঁকে প্রথম মুহতাসিব (আল-হিসবার দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত ব্যক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পরবর্তীতে কাজের পরিধি বৃদ্ধি পেলে তিনি মদীনায় হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) এবং মক্কায় হযরত সাঈদ বিন আল-আসবিন আল-আসকে (রা) মুহতাসিব নিয়োগ করেন।
খুলাফায়ে রাশিদূনের আমলে মুহতাসিবের দায়িত্ব ও কর্মক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু যে সময়ে ইবনে তাইমিয়ার আবির্ভাব সে সময়ে আল-হিসবাহর কার্যক্রমে শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়, মুসলিম শাসকবর্গও এ বিষয়ে যথোচিত মনোযোগী ছিলেন না। সে জন্যেই তিনি তাঁর বইয়ে এ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে আল-হিসবাহকে স্বমর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে প্রতিষ্ঠিত করার উপর জোর দেন। এই ফলশ্রুতি হিসেবে ইসলামী শাসন ক্ষমতা পতনের পূর্ব পর্যন্ত বিস্তীর্ণ মুসলিম এলাকায় নানা নামে মুহতাসিবের পদটি চালু ছিল। বাগদাদের উত্তরাঞ্চলে প্রদেশসমূহের দায়িত্বশীলের পদবী ছিল মুহতাসিব, উত্তর আফ্রিকায় এটি ছিল সাহিব আল-সুউক, তুরষ্কে ছিল মুহতাসিব আগাজী এবং ভারতবর্ষে কোতোয়াল।
আল-হিসবাহর আওতায় মুহতাসিবের দায়িত্ব কি কি সে সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন ইবনে তাইমিয়া। তাঁর মতে মুহতাসিবের কাজের মূলনীতি হবে আমর বিন মারুফ এবং নেহী আনিল মুনকারের যথাযথ প্রয়োগ। তার কার্যক্রমের মধ্যে থাকবে:
১. দ্বীনি আহকাম বাস্তবায়ন
২. জুয়া ও সুদের কারবার উচ্ছেদ
৩. দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ
৪. মূল্য নিয়ন্ত্রণ
৫. ঋণ প্রদান ও ঋণ গ্রহণ
৬. সম্পদের মালিকানার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ
৭. জনশক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার
৮. সরকারী কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধান
৯. পৌর সুবিধার নিশ্চয়তা সবিধান
১০. আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা।
মূল্য নিয়ন্ত্রণ, দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত এবং ব্যবসায়ীদের অনৈতিক কার্যকলাপ রোধ প্রসঙ্গে মুহতাসিবের দশটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে আল-হিসবাহ ফী আল-ইসলাম গ্রন্থে। প্রাসঙ্গিক গুরুত্ব বিবেচনা করে নীচে এগুলো উল্লেখ করা হলো। এ থেকেই বাঝা যাবে বাজার সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল কত বিস্তৃত ও গভীর। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণকারী বিষয়গুলো বর্তমানেও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচ্য। এ সবের মধ্যে রয়েছে:
১. ইসলামী শরীয়াহতে যা সুস্পষ্টভাবে হারাম তেমন কোন কিছুর উৎপাদন, ভোগ ও বন্টনের জন্যে রাষ্ট্র বা ব্যক্তির সহায-সম্পদ কোনক্রমেই যেন ব্যবহৃত হতে না পারে তার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা;
২. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, বিশেষতঃ খাদ্যদ্রব্যের নিয়মিত সরবরাহের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা;
৩. সকল প্রকার বাণিজ্যিক লেদেন সম্পন্ন হবে প্রকাশ্যে। কারণ গোপন লেদেন শুধু সরবরাহের পরিমাণ ও সময়েই বিঘ্নিত করে না, স্বাভাবিক মূল্যঅন্তর প্রতিষ্ঠায়ও বাধা দেয়;
৪. ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে যেন আপোষে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস না করতে পারে; কারণ এতে ক্রেতা সাধারণ বা নতুন বিক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়;
৫. নতুন ব্যবসায়ীকে বাজারে প্রবেশ করতে তথা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে বাধা দেয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘ বা গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হতে না দেওয়া;
৬. শহুরে ব্যবসায়ীরা পথিমধ্যেই পল্লীর সরবরাহকারীর সাথে যেন মিলিত হতে না পারে, কারণ এর ফলে তারা ঐ সব সরবরাহকারীকে শহরে বিদ্যমান মূল্যস্তর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করে নেবে এবং শহরবাসীর কাছে তা চড়া মূণ্যে বিক্রী করে প্রভূত মুনাফা অর্জনের সুযোগ পাবে;
৭. পল্লী অঞ্চলের সরবরাহকারীদের বাজারে সন্নিকটেই পণ্যসামগ্রী মজুত, বিশ্রাম ও অবস্থানের সুযোগ করে দেওয়া যেন তারা নিজেরাই বাজারে হাল-হকীকত বুঝতে পারে এবং সুবিধামত সময়ে ও দরে তাদের পণ্য বিক্রয় করতে পারে;
৮. বেচাকেনার সকল পর্যায় হতে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল, বেপারী ও ফড়িয়া শ্রেণীর উৎখাত করা; কারণ এরাই পণ্যসামগ্রীর কোনো গুণবাচক পরিবর্তন না ঘটিয়েই ক্রেতা০বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকে মুনাফা লুটে নেয়, এরাই বাজারে সরবরাহ বিঘ্নিত করে। বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং ক্রেতা ও বিক্রেতার স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে এই শোষক শ্রেণীর উচ্ছেদ করতে হবে কঠের হাতে;
৯. বাজার দখল বা প্রতিদ্বন্দী ব্যবসায়ীকে ঘায়েলের উদ্দেশ্যে দ্রব্যসামগ্রীর ডামপিং প্রতিহত করা; এবং
১০. ব্যবসায়ী ও কারিগরদের পণ্য সামগ্রীর ত্রুটি-বিচ্যুতি বা খুঁত প্রকাশে বাধ্য করবেন। ক্রেতাদের সামনে যেন মিথ্যা শপথ নিতে না পারে সেই নিশ্চয়তা বিধানও তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
তাঁর মতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। বায়তুল মাল হতেই এই উদ্যোগ নিতে হবে। প্রাপ্ত যাকাত ও আদায়কৃত কর ও শুল্ক হতে যদি দরিদ্র জনগণের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ না হয় তাহলে সরকার ধনীদের উপর আরো কর আরোপ করবে। তাতেও ব্যয় সংকুলান না হলে তাদের কাছ থেকে ঋণ নেবে। তারপরও ঘাটতি রয়ে গেলে ধনীদের উদ্বৃত্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নেবে। কারণ আল্লাহই সরকারকে এই অধিকার দিয়েছে (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)]
তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করতে না পারলে বেকারত্ব দূর হবে না। এজন্যে সরকারকে যথোচিত কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। একচেটিয়া করবার মজুতদারী মুনাফাখোরী ফটকাবাজারী কালোবাজারী ওজনে কারচুপি সবই জনস্বার্থবিরোধী। তাই এসব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে তিনি মূল্য নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিয়েছেন। তবে ব্যবসায়ীরা যেন ন্যায্য মুনাফা হতে বঞ্চিত না হয় সেদিকেও নজর রাখতে বলেছেন। বাজারে যেন ন্যায়সঙ্গত প্রতিযোগিতা বজায় থাকে তা দেখার দায়িত্ব মুহতাসিব তথা সরকারেরই। তার মতে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সরকার জনস্বার্থেই ব্যক্তির অধিকারবিশেষ খর্ব ও বাতিল করারও এখতিয়া রাখে।
নাসিরদ্দীন তুসীর (৫৯৭-৬৭২ হি./১২০১-১২৭৪খ্রী) আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল সরকারী অর্থব্যবস্থা। তাঁর রিসালা-ই-মালিয়াত-এ তিনি করের বোঝা হ্রাসের পরামর্শের পাশাপাশি শরীয়াহর অনুমোদন নেই এমন সব করের বিরোধিতা করেছেন। কৃষিকাজকে তিনি সর্বগ্রগণ্য হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং ব্যবসা ও অন্যান্য পেশাকে গৌণ বিবেচনা করেছেন। সঞ্চয়ের উপর জোর দিয়েছেন এবং স্বর্ণালঙ্কার ও আবাদ অযো্য জমি ক্রয়ের বিরোধিতা করছেন। আম্বরপূর্ণ ভোগব্যয়কে তিনি জোরালো ভাষায় নিন্দা করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন কৃষিই যে সমগ্র অর্থনীতির ভিত্তি এবং প্রজাদের মঙ্গলের মধ্যেই যে সমৃদ্ধি নিহিত এই সত্য যেন তৎকালীন মোঙ্গোল শাসকেরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়।
ইবনুল কাইয়্যিমের পুরো নাম শামস আল-দ্বীন আবু আবদ আল্লাহ মুহাম্মদ ইবন আবু বকর ((৬৯১-৭৫১ হি./১২৯২-১৩৫০ খ্রী)। তাঁর বিখ্যাত বই আল-তুরুক্ব আল-হুকমিয়্যাহ। তাঁর মতে ব্যক্তি যদি তার সম্পদ সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার কর তাহলে রাষ্ট্র অবশ্যই তাতে হস্তক্ষেপ করবে। তিনি ন্যাংসঙ্গত মুল্য, যুক্তিসঙ্গত ক্ষতিপূরণ, উপযুক্ত মজুরী এবং সঙ্গত মুনাফার পক্ষপাতি ছিলেন। একচেটিয়া কারবার অথবা বাজারে অপূর্ণতা থাকলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জন্যে মূল্য নিয়ন্ত্রণের একটি বিস্তারিত নীতিমালাও তিনি নির্ধারণ করেছিলেন। বাজার মূল্যের সাথে সংগতি রেখে কারিগরদের মজুরী নির্ধারণের উপর জোর দিয়েছেন। েইবনে তাইমিয়ার মতো তিনিও প্রতিষ্ঠান হিসাবে আল-হিসবাহর কার্যক্রমের সমর্থক ছিলেন। তাঁর অর্থনীতি চিন্তার প্রধান লক্ষ্য ছিল সুবিচার (আদল) প্রতিষ্ঠা, জনস্বার্থ সংরক্ষণ (আল-মাসলাহাহ আল আমমাহ) এবং সে সব কাজের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ (সাদ আল-ঝারিয়াহ) যেগুলো জনস্বার্থ ও সুবিচারের মূল লক্ষ্যকেই নস্যাৎ করতে পারে।
আল–শাতিবীর পুরো নাম আবু ইসহাক ইবরাহীম ইবন মুসা আল-লাখমী আল-শাতিবী (মৃত্যু ৭৯০হি./১৩৮৮ খ্রী.)। ইমাম হিসেবেও তিনি বহুল পরিচিত। তাঁর সর্বাধিক আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো আল-মুয়াফীক্বাত ফী উসূল আল-শারীআহ। যে শরীয়াহর দ্বাা মানব জীবনের সকল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রি সেই শরীয়াহর প্রকৃত উদ্দেশ্য (মাক্বাসিদ আল-শারীয়াহ) অর্জন কৌশল তাঁর আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর মতে রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো হলো:
১. যাকাত প্রতিষ্ঠা,
২. জীবনের মৌলিক পাঁচটি চাহিদা পূরণ,
৩. সম্পত্তি সংরক্ষণ, সম্পদের অপচয়বোধ এবং অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পত্তি গ্রাস থেকে বিরত রাখা এবং
৪. যাবতীয় নেশার সামগ্রী ও বিচারশক্তিকে কলুষিত করে এমন সব দ্রব্যের উৎপাদন, বন্টন ও ভোগ নিষিদ্ধকরণ।
মানবজীবনের প্রয়োজনকে তিনি তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। যথা: অপরিহার্য (জরুরীয়াহ), প্রয়োজনীয় (হাজিয়াহ) এবং উৎকর্ষমূলক (তাহসানীয়াহ)। জরুরীয়াহর মধ্যে রয়েছে পাঁচটি বিষয় যেগুলোর অবশ্যই নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও ভূমিকা রয়েছে। কারণ এর মধ্যে যেমন পার্থিব জীবনের কল্যাণ নিহিত রয়েছে তেমনি রয়েছে আখিরাতেরও। এগুলো হলো: (১) বিশ্বাস (আল-দ্বীন), (২) জীবন (আল-নফস), (৩) বংশধর (আল-নসল), (৪) সম্পত্তি (আল-মা’ল) এবং (৫) বুদ্ধিমত্তা (আল-আক্বল)।
ইবনে খালদুনের পুরো নাম ওয়ালী আল-দীন আবদ আল-রহমান ইবন মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ ইবন আবী বকর মুহাম্মদ ইবন আল-হাসান ইবন খালদূন (৭৩২-৮০৮ হি./১৩৩২-১৪০৬খ্রী.)। তাঁর জন্ম তিউনিসে, মৃত্যু কায়রোয়। সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী হলেও ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কেও তিনি অগাধ জ্ঞান রাখতেন। কিতাব আল-ইবার বিশ্ব ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ হলেও এই বইয়ের ভূমিকা আল-মুকাদ্দামা তাঁর বহুল পরিচিত ও প্রশংসিত গ্রন্থ। এই বইয়ে তিনি অর্থনীতির যেসব প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন সে সবের মধ্যে রয়েছেন: (১) শ্রম বিভাজন (২) মূল্য পদ্ধতি, (৩) উৎপাদন ও বন্টন, (৪) মূল সংগঠন, (৫) চাহিদা ও যোগান, (৬) মুদ্রা, (৭) জ নসংখ্যা, (৮) বাণিজ্যচক্র, (৯) সরকারী অর্থব্যবস্থা এবং (১০) উন্নয়নের স্তর। তাঁর সময়কালে যেসব বিষয় তাঁকে নাড়া দেয় তা হলো রাজবংশের উত্থান ও পতন এবং দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য। এগুলোতে তিনি বেশ কিছু প্যাটার্ন চিহ্নিত করেন।
এ্যাডাম স্মিথেরও চার শত বছর পূর্বে আল-মুকাদ্দামায় তিনি শ্রম বিভাজন এবং এর ইতিবাচক ফল সম্বন্ধে দীর্ঘ আলোচনা সকরেছেন। একদল মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্মিলিত শক্তির ভিত্তিতে যা উৎপন্ন করে তা এককভাবে একজনের উৎপাদনের চেয়ে ঢের বেশী। ফলে প্রয়েঅজন পূরণের পর যা উদ্বৃত্ত থাকে তা বিক্রি করা সম্ভব। তিনি বলেন শ্রমবিভাজনের ফলেই উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয়। শ্রমের বিশেষীকরণের মাধ্যমে উৎপাদনের সামাজিক সংগঠনের পক্ষে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন। তাঁর মতে একমাত্র বিশেষীকরণের ফলে উঁচু হারে উৎপাদন সম্ভব যা পর্যাপ্ত জীবিকা অর্জনের জন্যে অপরিহার্য। ইবনে খালদূন উৎপাদনের সামাজিক সংগঠনের ক্ষেত্রে মানবীয় শ্রমের সবিশেষ গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছেন। নানা ধরনের পেশা ও সেসবের সামাজিক উপযোগিতার কথাও তিনি আলোচন করেছেন। দারিদ্র্যের ভিত্তি এবং তার কারণ সম্বন্ধে তাঁর আলোচনার জন্যে ইবন আল-সাবিল তাঁকে প্রুঁধো, মার্ক্স ও এঙ্গেলসের পূর্বসূরী হিসেবে গণ্য করেন। তাহাবী দেখিয়েছেন ইবনে খালদূনের মডেলে জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত।
প্রাকৃতিক সম্পদ অপেক্ষা বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে শ্রমের আন্তর্জাতিক বিভাজন সম্পর্কে তাঁর ধারণার প্রশঙসা করেছেন বৌলকিয়া। ধনী ও গরীব দেশসমূহের মধ্যে বিনিময়ের হার, আমদানী ও রপ্তানীর প্রবণতা, উন্নয়নের উপর অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রভাব প্রভৃতি বিশ্লেষণসহ তিনি যে তত্ত্ব প্রদান করেছেন তা আধুনিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তত্ত্বের ভ্রুণ হিসাবে গণ্য হতে পারে। ইবনে খালদূন বিশ্লেষণ করে দেখাতে সক্ষম হন যেসব দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত সেসব দেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় ধনী। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জনসংখ্যা বেশী হলে শ্রম বিভাজন ও বিশেষীকরণ সহজ এবং এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে। এরূপ উন্নয়নে বিলাসজাত দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি ঘটে এবং শিল্পে বৈচিত্র্য আসে। তাঁকে বাণিজ্যবাদীদের পূর্বসুরী হিসাবেও গগণ্য করা হয়। কারণ সোনা ও রূপাকে তিনি যে অর্থে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন ও তার ব্যবহারের কথা বলেছেন তার সাথে পরবর্তী যুগের বাণিজ্যবাদীদের চিন্তার সাদৃশ্য রয়েছে।
তিনি ভৌগলিক অবস্থান ও জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যের বিচারে পৃথিবীকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করেন। বিষুব রেখার উভয় পার্শ্বে ঘন জনবসতির কারণে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লক্ষ্য করেন চরম উষ্ণ অঞ্চলে জনবসতি কম, কারণ এ সকল অঞ্চলে জবিনযাত্রা কঠোর। পক্ষান্তরে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের লোকেরা হয় সংযমী, মিতাচারী ও কৃষ্টিবান। এ সকল এলাকার লোকেরা সাংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও পোশাক পরিচ্ছদে স্বাভাবিকভাবেই উন্নত হয়।
মুদ্রার মূল্য সম্বন্ধেও ইবনে খালদূনের মূল্যায়ন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন সোনা ও রূপা যেহেতু সবদেশে সকলেই বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করে সেহেতু মুদ্রার মান হিসেবে এই দুই ধাতু ব্যবহার করা সমীচিন। এর দ্বারা মুদ্রার মূল্যও সংরক্ষিত হয়। যেহেতু মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের সময়ে মুদ্রার ওজন দেখা সম্ভব নয় সেহেতু টাকশালে মুদ্রার তৈরীর সময়ে সোনা ও রূপার ধাতুগত মান ও প্রতিটি মুদ্রার ওজর যেন একই রকম হয় তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। কারণ মু দ্রা শাসক কর্তৃক প্রদত্ত গ্যারান্টি বহন করে যে এর মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা বা রূপা রয়েছে। ইবনে খালদুন বলেন সকল দ্রব্যই বাজারে নানা ধরনের উঠা-নামার শিকার, কিন্তু মুদ্রা হবে তার ব্যতিক্রম। এজন্যে টাকশালকে তিনি সরাসরি খলীফার নিয়ন্ত্রণাধীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানতুল্য গণ করেছেন।
তাঁর রচনায় শ্রমের মূল্যতত্বের সন্ধান মেলে। কারো কারো মতে তাঁর শ্রমের মূল্যতত্ত্বে শ্রমিকের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ভূমিকা রয়েছে যে জন্যে তাঁকে মার্ক্সের পূর্বসূরী হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সভেৎলানার মতে তিনিই অতীতকালের প্রথম অর্থনীতিবিদ যিনি মূল্যের রহস্য ভেদে সক্ষম হন। তিনি আবিষ্কার করেন মূল্যের ভিত্তি হচ্ছে শ্রম। তাঁর মতে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যের মধ্যে তিনটি উপাদান অন্তর্ভুক্ত থাকে: (১) বেতন, (২) মুনাফা এবং (৩) কর। বেতন উৎপাদনকারী প্রাপ্য, মুনাফা ব্যবসায়ীর প্রাপ্য এবং কর সরকারের প্রাপ্য যা দিয়ে সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন ও সরকারী সেবাসমূহের ব্যয় নির্বাহ হবে। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পৃক্ত। ইতহিাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়সমূহের উপর গুরুত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেছেন। ইবনে খালদূনের সভ্যতার চক্রতত্ত্বকে অর্থনীতিবিদ জে.আ. হিকসের বাণিজ্য চক্রতত্ত্বের সাথে তুলনা করেছেন। স্পেঙ্গলার। তবে তাঁর তত্ত্বটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তরের সঙ্গে তুলনা করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
কর ও সরকারী ব্যয় সম্পর্কে তিনি বিশদ বক্তব্য রাখেন। তাঁর মতে করের পরিমাণ যতদূর সম্ভব নীচু রাখলে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যেহেতু জনগণ তখন উন্নয়নের সুবিধাদি ভোগ করার সুযোগ পায় সেহেতু তারা এতে উৎসাহিত বোধ করে। করের হার নীচু রাখার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন করের উঁচু হার প্রকৃতপক্ষে সরকারের আয় কমিয়ে দেয়। কম কর প্রাচুর্য আনয়নে ও করের ভিত্তি সম্প্রসারণে সহায়তা করে। এতে সরকারেরও আয় বৃদ্ধি ঘটে। কর প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন আদায়কৃত করের পরিমাণ যদি খুব স্বল্প হয় তাহলে সরকার তার দায়িত্ব যথাযথ পালনে সক্ষম হবে না। অথচ যে কোন সভ্যতায় জনগণের স্থাপর-অস্থাবর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে সরকারের মত একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পক্ষান্তরে খুব উঁচু হারের কম পরিণাম খারাপ। কেননা তখন উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের মুনাফা হ্রাস পায় এবং কাজের উৎসাহ উবে যায়।
তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল রাখার স্বার্থে সরকারী ব্যয় অব্যাহত রাখার সুস্পষ্ট সুপারিশ রেখেছেন। এ ক্ষেতে প্রায় সাড়ে পাঁচ শত বছর পরে আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম পুরোধা কেইনসের প্রদত্ত তত্ত্বের সাথে তাঁর আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতিশীল রাখার জন্যে যেমন সরকারী ব্যয় অপরিহার্য গণ্য করেছেন তেমনি সরকারী ব্যয়ের ফলে বাজারে দ্রব্য সামগ্রীর চাহিদা অব্রাহত থাকে বলে মত প্রকাশ করেছেন। সরকার প্রশাসন ও সেনাবাহিনীসহ যথোপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে না তুলতে জনগণের প্রয়োজন পূরণ যেমন সম্ভব নয় তেমনি তারা নিরাপত্তাহীনতায়ও ভোগে। শহরগুলোতে সমৃদ্ধির কারণেই হলো সরকারীঅ ব্যয়। তাঁর মতে শাসক এবং অমাত্যবর্গ ব্যয় বন্ধ করলে ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ে, মুনাফা হ্রাস পায় এবং মূলধনেরও স্বল্পতা দেখা দেয়। তাই সরকার যতই ব্যয় করেন ততই মঙ্গল।
অর্থনৈতিক চিন্তার আধুনিক ইতিহাসবিদদের মধ্যে শ্যূমপীটারই প্রথম ইবনে খালদূনের কথা উল্লেখ করেন। সাম্প্রতিক কালে ব্যারি গর্ডন তার Economic Analysis Before Adam Smith- Hesiod to Lessius বইয়ে ইবনে খালদূনের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের গুরুত্বের কথা খুব জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনার জন্যে জে. স্পেঙ্গলার, ফ্রাঞ্জ রোজেনথাল, টি.বি. আরভিৎ, জে.ডি. বৌলকিয়া প্রমুখ ইউরোপীয় গবেষকরা তাঁকে আধুনিক অর্থনীতির অন্যতম বুরোধা হিসেবে বিবেচনা করেন। বৌলকিয়া বলেন-
“Ibn Khaldun discovered a great number of fundamental ecomomic notions a few centuries before their officela birth. He discovered the virtue and necessity of a division of labour before (Adam) Smith and the Principle of labour value before (David) Ricardo. He elaborated a theory of population before Malthus and insisted on the role of the State in the economy before Keynes. …. but much more than that, Ibn Khaldun usedthese concepts to build a coherent dynamic system in which the economic machanism inexorably lead economic activity to long-term fluctuations. Without tools, without preexisting concepts he elaborated a genial economic explanation of the world. ….. His name should figure among the fathers of economic science.” –Jean David Boulakia, “Ibn Khaldun: A Furteenth Century Economist”, Journal of Political Economy, Vol. 79 No. 5, September-October 1971, pp.1105-1114.
শাহল্ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হি./১৭০২-১৭৬৩ খ্রী.) তার হুজ্জাতুল্লাহ্ আল-বালিগা বইয়ে ব্যক্তিগত আচরণ ও সামাজিক সংগঠনের প্রকৃতি বিষয়ে শরীয়াহ্র দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব সেহেতু তাদের সার্বিক কল্যাণ পরস্পরের সহযোগিতার মধ্যেই নিহিত। বিনিময় চুক্তি মুনাফার অংশীগারীত্ব ভাগচাষ ইত্যাদির মাধ্যমে এই সহযোগিতা বিকশিত হয়। যেসব কাজ সহযোগিতার মূলনীতি ধ্বংস করে সেগুলি প্রকৃতপক্ষেই শরীয়াহবিরোধী। উদাহরণস্বরূপ সুদ ও জুয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। জুয়া থেকে আয় আসলে জনগণের অজ্ঞতা, লোভ এবং আশার ভিত্তিতেই অর্জিত হয়। এর সাথে সহযোগিতা বা সভ্যতার কোন সংস্পর্শ নেই। সুদ নিষিদ্ধ হবার ব্যাপারে তিনি একই রকম ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
তাঁর মতে সহযোগিতার কাঠামোয় সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে জমি সমভাবে ভাগ করা উচিত। মসজিদের মত সমস্ত জমিও ভ্রমণকারীদের আশ্রয় স্থল। ‘আগে আসলে আগে পাবে’ নীতির ভিত্তিতে সবাইকে এসব সম্পদ শেয়ার করতে হবে। জমির মালিকানার ক্ষেত্রে তাঁর মতামত হলো: মালিকানার অর্থ হলো সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া। তিনি কতিপয় প্রাকৃতিক সম্পদকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রাখার উপর গুরুত্ব প্রদান করেন। মজুতদারী ও মুনাফাখোরীকে তিনি কঠোরভাবে নিন্দা করেছেন।
সরকারী অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা ছিল: প্রতিটি সভ্য সমাজের জন্যে একটি সরকার থাকবে, দেশরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার ইত্যাদির দায়িত্ব পালন করবে এবং জনগণের স্বার্থে দালান-কোঠা, রাস্তাঘাট ও পুল নির্মাণ করবে। এই ধরনের কাজ করার জন্যে সরকারকে অবশ্যই কর আরোপ করতে হবে। তবে কর আরোপের ক্ষেত্রে যাদের সামর্থ্য আছে কেবল তাদের উপরই কর আরোপ করা হবে এই নীতি অনুসৃত হতে হবে।
দেহলভী মনে করেন বিলাসবহুল জীবন যাপনে নিমগ্ন হলে সমাজে ধ্বংস অনিবার্য। অন্যান্যদের মত তিনিও প্রয়োজনের শ্রেণী বিভাগ করেন। যথা: প্রয়োজন, আরামদায়ক ও বিলাস। তৎকালীন বৃটিশ শাসনের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন এক শ্রেণীর কর্মকর্তার বিলাসবহুল জীবন যাপনের সামগ্রী যোগান দেবার জন্যে সীমিত সম্পদ বিলাসজাত দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এতে সাধারণ জনগণের চাহিদা উপেক্ষিত হয়। তাঁর নিজ দেশ ভারতবর্ষের অধঃপতনের জন্যে দুটো বিষয়কে দায়ী করেন। প্রথমতঃ কবি ও সাধু ধরনের লোকদের কার্য সম্পাদনের জন্যে অনুৎপাদনশীল কাজে ব্য এবং দ্বিতীযতঃ চাষী, ব্যবসায়ী ও কারিগরের উপর এত উঁচু হারে কর আরোপ করা হয় যে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে, তাদের উৎপাদন বৃদ্ধির উৎসাহ নষ্ট হয়ে যায়। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সম্বন্ধে তাঁর বিশ্লেষণের সাথে শত বছর পরের কার্ল মার্ক্সের বিশ্লেষণের সাদৃশ্য বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
ইসলামী অর্থনীতি আলোচনায় এর পর দীর্ঘদিনের স্থবিরতা দেখা দেয়। মুসলিম মিল্লাত জড়বাদী ম সভ্যতার নিগড়ে আবদ্ধ হয়, তার ধ্যান-ধারণা পুঁজিবাদী চিন্তাধারার নাগপাশে জড়িয়ে পড়ে। সৌভাগ্যের বিষয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতে মুসলমানদের মধ্যে পুনর্জাগরণের সূচনা হয়। ইসরামকে নতুনভাবে জানা এবং ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার প্রতিষ্ঠার জন্যে শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলন। সেই আন্দোলনে নতুন নতুন কর্মসূচী ও ইজতেহাদের মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যা ইসলামী সমাধান নিয়ে এগিয়ে এসছেন অনেক ফকীহ, গবেষক-অধ্যাপক ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁদের বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা ও যুক্তিপূর্ণ রচনা বিশাল ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছে।
এই পর্বে যার নাম সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে হয় তিনি আধুনিক যুগজিজ্ঞাসার জবাবে ইসলামকে নতুন অবয়বে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। তার সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা তাঁর লেখায় প্রাধান্য পেয়েছে। বর্তমান যুগের চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় ইসলামই যে একমাত্র সমাধান সেটি তিনি ক্ষুরধার যুক্তির আলোকে তুলে ধরেছেন। তাঁর ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ এবং সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং ইসলামী অর্থনীতির স্বরূপ উপলব্ধি ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। সুদ ইসলামে নিষিদ্ধ, কিন্তু পুঁজিবাদের জীয়নকাঠি হলো সুদ। এই সুদের ভয়ংকর সব ক্ষতিকর দিক তিনি বিশ্লেষণ করেছেন এবং সুদবিহীন ব্যাংকিং-এর তাত্ত্বিক মডেল প্রদান করেছেন।
তাঁরই পথ ধরে নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী তাঁর Banking Without Interest বইয়ে ইসলামী ব্যাংকিং-এর প্রায়োগিক মডেলের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। ইসলামে একটি গ্রহেোগ্য মুদ্রা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উমার চাপরা আলোচনা করেছেন তাঁর Towards a Just Monetary System বইয়ে। তাঁর Islam and the Economic Challange বইয়ে তিনি পুঁজিবাদের সীমাবদ্ধতা, সমাজতন্ত্রের পশ্চাদাপসরণ, কল্যাণ রাষ্ট্রের সংকট, উন্নয়ন অর্থনীতির অসঙ্গতি প্রভৃতি বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক আলোকপাত করেছেন। উপরন্তু ইসলামী বিশ্বদর্শন ও কর্মকৌশল, অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠন এবং মানবসম্পদ উজ্জীবন ও উন্নয়ন সম্বন্ধেও দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তাঁর সকল আলোচনার মূল সুর হলো মানবজীবনের অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহের সমাধান ইসলামেই নিহিত রয়েছে।
ইউসুফ কারযাবী তাঁর ফিকহ আল-যাকাহ বইয়ে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে কিভাবে যাকাতের অর্থ ব্যবহার করা উচিত তার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। যাকাত বিষয়ে তিনি যেমন কতিপয় পুরাতন প্রশ্নের বিশ্লেষণ করেছেন এবং সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন তেমনি নতুন কিছপ প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন।
বাক্বীর আল–সদর তাঁর ইকতিসাদুনা বইয়ে যতক্ষণ না প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদন নিশ্চিত হচ্ছে ততক্ষণ বিলাস সামগ্রী উৎপাদনের সম্পদ ব্যবহার না করার উপর জোর দিয়েছেন। এজন্যে রাষ্ট্রকেই ভূমিকা রাখতে হবে। উপরন্তু প্রত্যেক নাগরিকের প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধানের পাশাপাশি জীবন-যাপনের মানেরও ভারসাম্য বজায় রাখতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সামাজিক নিরাপত্তারও গ্যারান্টি দেবে। ইসলামী ব্যাংকিং-এর উপরেও তাঁর আলোচনা হয়েছে।
]সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যক্তির আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন মুহাম্মদ হিফযুর রহমান তাঁর ইসলাম কা ইকতিসাদী নিযাম বইয়ে। খারাজ নিয়ে দীর্ঘ দিনের বিতর্ক রয়েছে ফকীহদের মধ্যে। পাক-ভারত উপমহাদেশেও এ বিতর্ক ছিল্ এ বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ ও সিদ্ধান্তমূলক আলোচনা করেছেন মুফতী মুহাম্মদ শফী তাঁর ইসলাম কা নিযাম-ই আরায গ্রন্থে। ইসলামী কাঠামোয় তাঁর ইসলাম কা নিযাম-ই আরায গ্রন্থে। ইসলামী কাঠামোয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে সংঘটিত হবে, কেমন হবে তার গতি-প্রকৃতি ইত্যাকার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছেন খুরশীদ আহমদ তাঁর বই Islamic Approach to Devrlopment: Some Policy Implecations-এ, উমার চাপরা তাঁর বই Islam and Economic Depelopment-এ এবং আবুল হাসান এম. সাদেক তার Economic Development in Islam বইয়ে।
উল্লেখ্য, ইসলামী অর্থনীতির নানা বিষয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনামূলক লেখার সংখ্যা বর্তমান সময়ে ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য সকলেই যে নতুন চিন্তা বা বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট এমন নয়। তবু এসব লেখার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন প্রসঙ্গে আলোচনার অবতারণা হচ্ছে। ফলে ইসলামী অর্থনীতি চিন্তার ক্রমবিকাশ ঘটছে যার বাস্তবায়ন হলে পৃথিবী একটি শোষণ ও দরদ্র্র্যমুক্ত সমাজব্যবস্থা উপহার পেতে পারে।