বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতি চর্চার প্রসারে প্রতিবন্ধকতা
বার কোটি তৌহিদী জনতার দেশ বাংলাদেশ। ভারত বিভাগের সময় হতেই এদেশের আপামর মুসলিম জনসাধারণের ইচ্ছা-আকাংখা ছিল দেশে ইসলামী জীবন বিধান কায়েম হোক। এমন কি দেশের শাসকগোষ্ঠীও পর্যন্ত মাঝে-মধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন এদেশে মুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোন আইন পাশ হবে না। কিন্তু মুসলিম জনতার অন্তরের প্রকৃত আকাংখা বাস্তবায়নের জন্যে তাদের কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনা তো ছিলই না, বরং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলে এদেশে সেক্যুলার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ গৃহীত হতে থাকে সরকারীভাবেই। স্বাধীনতার পরেও বৃটিশের রেখে যাওয়া শিক্ষানীতির তেমন কোন পরিবর্তন হলো না। না পাকিস্তান আমলে, না বাংলাদেশ আমলে। ফলে মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করা কোটি কোটি বনি আদম বেড়ে উঠতে থাকলো দিকভ্রান্ত মানুষ হিসাবে। তার সামনে জীবনের কোন আদর্শবাদী লক্ষ্য রইলো না, বরং পাশ্চাত্যের Eat, drink and be merry-এর ভোগবাদী দর্শনের প্রতি সে প্রলুব্ধ হয়ে পড়লো। তার জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য হয়ে গেল শংকর; ধর্মীয় জীবনে সে ইসলামের অনুসারী রইলেও কর্মজীবনে হয়ে গেল পাশ্চাত্যের তথাকথিত সেক্যুলারধর্মী তথা আকণ্ঠ ভোগের দাসানুদাস। ফলে তার জীবনে আল্লাহ ও তার রাসূলের (স) শিক্ষা রয়ে গেল ক্রমঅপসৃয়মান।
এরই বিপরীতে মুষ্টিমেয় মুসলমান ইসলামের শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরে রইলো। তারা সকলেই যে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত এমননয়। বরং পাশ্চাত্যের ধর্মীহীন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও বেশ কিছু মুসলমান ইসলামী জীবন আদর্শের অনুসারী তো রইলই, উপরন্তু তারা সমাজজীবনে পরিবর্তন আনার জন্যে ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করলো। মূলতঃ এই ধারার প্রচেষ্টার ফলেই ইসলাম সম্পর্কে জনগণের, বিশেষতঃ যুবকদের মধ্যে জানবার ও এর জীবন-আচরণ পালনের প্রতি লক্ষ্যণীয় আগ্রহ দেখা দিতে থাকে। এদেরই প্রচেষ্টার ফলে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকেই নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যে হলেও বলতে শুরু করেছে-Islam is the complete code of life- ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের প্রতি এদেশের জনগণের আগ্রহ আরও সক্রিয়ভাবে তীব্রতা অর্জন করে আফ্রো-এশিয়ায় মুসলমানদের নবজাগরণের ফলে। পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পাশ্চাত্যের জড়বাদী দর্শনের প্রতি সেসব দেশের বহুলোকের বিতৃষ্ণা ও বীতরাগ ইসলাম সম্বন্ধে নতুন করে জানার ও বোঝার জন্যে কৌতুহলী করে তোলে এদেশের শিক্ষিত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে।
উপরন্তু একদা পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে গেল এবং স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের মতো লোকের শ্রেণী সংগ্রামের চাইতে সভ্যতার দ্বন্দ্ব, Class Struggle-এর চাইতে Clash of Civilizaiton-এর কথা স্বীকার করে নিয়ে ইসলামই পাশ্চাত্যের জীবনাদর্শের প্রতি আগামী দিনে অমোঘ চ্যালেঞ্জ হিসাবে স্বীকার করে নেন তখন মুসলিম যুবমানস এক অজানা আনন্দ ও সাফল্যের গর্বে স্বীকার করে নেন তখন মুসলিম যুবমানস এক অজানা আনন্দ ও সাফল্যের গর্বে আবেগদাড়িত হয়। কিন্তু নিজের দেশের দিকে, সমাজের দিকে তাকিয়ে সে যুগপৎ হতাশ ও বিচ্ছিন্ন বোধ করে। সে দেখে তার শিক্ষা, জীবিকা, পরিবেশ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিরাট অংশেই ইসলাম নেই, বরং রয়েছে ইসলামের প্রতি প্রবল বিরোধিতা। তার তখন মনে হয় সে যেন আপন গৃহেই পরবাসী। এই দোদুল্যমান অবস্থা, চিত্তের এই শংকা কাটিয়ে উঠতে সে খোঁজে শিকড়ের সন্ধান। তখন জানতে চায় ইসলামকেই আমুলাগ্র। এভাবেই ধীরে ধীরে জনে জনে সৃষ্টি হয় বিশাল জনতার। তাদের চাপের কাছে, তাদের দাবীর মুখে দেশের সরকারকেও ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে মৌখিকভাবে হলেও নমনীয় হতে হয়। এরই পথ ধরে ইসলামী অর্থনীতি চর্চার পথও কিছুটা খুলে যায়।
এক্ষেত্রে অবশ্য দেশের মাদরাসাগুলোর চাইতে বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এদেশের ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের প্রেক্ষিতে এই উদ্যোগ আরও জোরদার হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকিং ও ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতির সাফল্য, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থানের ইসলামের মৌলিক কর্মকৌশলের ব্যাপক ও সুদুরপ্রসারী ভূমিকা এই উদ্যোগকে আরও সামনে এগিয়ে নিতে উৎসাহিত করে। দীর্ঘ দুই দশকের চেষ্টার ফলে বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী অর্থনীতি, যা ইসলামী জীবন বিধারেই অবিচ্ছেদ্য অংশ, পাঠদানের কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এতে উল্লসিত হবার কিছু নেই। বরং এদেশে ইসলামী অল্থনীতি চর্চা ও প্রয়োগের পথে রয়েছে হিমালয়সম প্রতিবন্ধকতা। সেসব প্রতিবন্ধকতাকে চিহ্নিত করা ও তা অপসারণের উপায় সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো।
এদেশে ইসলামী অর্থনীতি চর্চার প্রসারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো এদেশের শিক্ষানীতি। এদেশের শিক্ষানীততে ইসরামী জীবনদর্শনকে ভালভাবে অনুধাবন করারই কোন সুযোগ নেই, ইসলামী অর্থনীতি তো দূরের কথা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ড. কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে যেমন এদেশে সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষা প্রসারের বিরোধিতা করা হয়েছে তেমনি বিরোধিতা করা হয়েছে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও। অবশ্য জনমতের প্রবল চাপে শেখ মুজিবুর রহমান যেমন শেষ পর্যন্ত কুদরত-ই-খুদা কমিমনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে পারেননি, তেমনি শেখ হাসিনা ওয়াজেদও শামসুল হক কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে পারেননি। যাদের নিয়ে এই দুটো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল তাঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন সেক্যুলার জীবনাদর্শে বিশ্বাসী। ইসরাম বাস্তবায়নের জন্যে তাঁদের কোন কমিটমেন্ট ছিল না। তাই তাদের রিপোর্ট ছিল প্রবলভাবে ইসলামবিরোধী। পক্ষান্তরে এদেশের তৌহিদী জনতা প্রবলভাবেই ইসলামী শিক্ষা তথা জীবনদর্শনের প্রতি অনুরাগী। সেজন্যেই কোন সরকারের আমলেই শিক্ষা কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়িত হতে পারেনি। কিন্তু ইসলামী শিক্ষা তথা ইসলামী অর্থনীত পঠন-পাঠনের সুযোগকেও অবারিত করা যায়নি। শিক্ষানীতিতে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা নেই বলেই এমনটি হতে পেরেছে।
এর প্রতিবিধানের জন্যে শিক্ষা কমিশন নতুন করে গঠন করে কিভাবে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আদর্শ ও বিশ্বাসের ভিত্তি ইসলামকে জানা ও বোঝা যায় তার পদক্ষেপ নিতে হবে। কমপক্ষে সর্বশেষ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে এ বিষয়ে যথাযথ কর্মসূচী অন্তর্ভুক্তির পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এ জন্যে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে: বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? এজন্যে অবশ্যই আগ্রহী গোষ্ঠীকে জনমত গঠনের জন্যে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেসব পদক্ষেপের মাধ্যমেই সরকারের উপর অব্যাহত চাপ দিয়ে যেতে হবে।
দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনার্স ও মাষ্টার্স পর্যায়ে ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে যেটুকু পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে তা অপূর্ণাংগ ও অসম্পূর্ণ। উপরন্দু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোর্সের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও সামঞ্জস্যহীনতাও বিদ্যমান। উদাহরণতঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পর্যায়ে ইসলামী অর্থনীতির যে কোর্স রয়েছে তার সাথে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কোনভাবেই তুলনীয় নয়। একইভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান চতুর্থ বর্ষে ইসলামী অর্থনীতি ঐচ্ছিক পত্র হিসেবে থাকলেও ঐ পর্যায়ের কোর্স আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। অর্থনীতি চিন্তার বিকাশে মুসলিম অর্থনীতিবিদদের অবদান সম্পর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে যতটুকু রয়েছে দেশের অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে তা নেই। তবুও বলতেই হবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়েল পাঠ্যক্রমেই ইসলামী অর্থনীতির পূর্ণাংগ পাঠ নেই। এই অভাব পূরণ ও সমন্বয়হীনতা দূল করার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের আলোচনা ও সমন্বিত সিলেবাস তৈরী নিতান্তেই জরুরী। উল্লেখ্য, ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কোন শ্রেণী বা বর্ষেই ইসলামী অর্থনীতিবিষয়ক কোন পাঠই নেই।
তৃতীয়তঃ এদেশের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায়, যা অনেকের কাছেই ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা বলে পরিচিত, ইসলামী অর্থনীতর পাঠদান শুরু হয়েছে অনেক পরে। কিন্তু তাপরপরেও সেই পাঠ যথার্থ অর্থে ইসলামী অর্থনীতির পাঠ নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতিবিষয়ক পাঠ। এটা খুবই দুঃখের বিষয় (খানিকটা আশ্চর্যের বিষয়ও বটে) মাদরাসা ব্যবস্থায় শিক্ষিত বহু পন্ডিতজনেরই ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে আদৌ কোন সুষ্ঠু ধারণা নেই। যে সিলেবাস অনুসারে মাদরাসার বই লেখা হয়েছে সে সিলেবাসেও েইসলামী অর্থনীতির প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো অনুপস্থিত। এজন্যে ঐ পাঠ্যবইও সেই দাবী পূরণে ব্যর্থ। আরও দুঃখের বিষয়, ইসলামী অর্থনীতির কয়েকটি মৌলিক বিষয় মাদরাসায় পড়ানো হলেও সেসবের অর্থনৈতিক তাৎপর্য ও ব্যবহারিক দিক সম্বন্ধে আলোচনা হয় না বললেই চলে। উদাহরণতঃ সুদ, যাকাত ও ব্যবসায় পদ্ধতির ক থা উল্লেখ করা যেতে পারে। আল-কুরআনে সুদ নিষিদ্ধ। কিন্তু সেই সুদের আর্থ-সামাজিক কুফলগুলো কি এবং কিভাবে মুসলমানরা সুদ ব্যতিরেকে তাদের আর্থিক লেনদেন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে পারে তার কোন সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে না ফাজিল বা কামিল পাস ছাত্রদের কাছ থেকে। একইভাবে যাকাত বিষয়ে দীর্ঘ উল্লেখ রয়েছে সহীহ আল-বুখারীতে। কিন্তু কিভাবে যাকাতের অর্থ ব্যবহার করে সমাজ হতে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বেকারত্ব মোচন সম্ভব সে সম্বন্ধেও কোন আলোচনা হয় না।
হেদায়া নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ইসলামী রীতি-পদ্ধতিতে ব্যবসায়ের কৌশল সম্বন্ধে ফতওয়া ও মাসায়েল থাকলেও সেগুলো যে আজকের যুগে প্রয়োগযোগ্য সে ব্যাপারেও কোন দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না। অবশ্য দেশে বিজ্ঞ ও চিন্তাশীল ইসলামী ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যারা এসব বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিতে সক্ষম। এদের বাদ দিলে দেশের প্রচলিত নিউস্কীম বা আলীয়া মাদরাসায় শিক্ষিত হাজার হাজার ছাত্রদরে সাথে ইসলামী অর্থনীতির ধ্যান-ধারণার ব্যাপারে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে কোনই পার্থক্য নেই। এই সমস্যা দূর করার জন্যে যথোচিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে দুই ধারার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কোন সমন্বয় হবে না। ফলশ্রুতিতে ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগ বা ব্যবহার পিছিয়ে যাবে আরও বহুকালের জন্যে।
চতুর্থ যে সমস্যাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবী রাখে সেটি হলো যথার্থ পাঠ্যপুস্তকের অভাব। এদেশে কলেজ পর্যায়ে সম্মান শ্রেণীতে ইসলামী অর্থনীতিতে যতটুকু পাঠদানের সুযোগ রয়েছে সেটুকুও ছাত্র/ছাত্রীরা গ্রহণ করতে পারছে না শুধুমাত্র মানসম্মত টেক্সট বইয়ের অবাবে। সম্প্রতি দু-তিনটি বই লিখিত হয়েছে এই অভাব পূরণের জন্যে। কিন্তু সেগুলি হয় বাজারে সহজলভ্য নয়, নয়তো বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসকে সামনে রেখে লেখা বলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাজে আসছে না। ইসলামী অর্থনীতরি বই বলতে দেশে এখনও ইসলামের অর্থনৈতিক দিক-নির্দেশনা সম্পর্কে আল-কুরআন ও সুন্নাহ হতে বাছাই করা আয়াত ও হাদিসের উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যার সংকলনকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এ বিষয়ে প্রথম যিনি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন তিনি এদেশর ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণায় শুধু দিকপালই নন, বরং প্রবাদপুরুষ মাওলানা মুহম্মদ আব্দর রহীম। তাঁর বই ইসলামের অর্থনীতি এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এই বইয়ে তিনি আধুনিক অর্থনীতির ব্যবহার্য টেকনিক ও টার্ম প্রয়োগ করেই আল-কুরআন সুন্নাহর শিক্ষাকে বর্তমান সময়ের সমস্যা সমাধানের উপযোগী করে তুলে ধরেছেন।
ইসলামী অর্থনীতি চর্চায় বাংলা ভাষায় লিখিত তাঁর এই বইটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য হবে। তারপর দীর্ঘদিন ধরে এসব বই প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো আধুনিক অর্থনীতি বইয়ের মাপকাঠিতে ধোপে টেকে না। ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে ইংরেজিতে পূর্ণাংগ টেক্সট বই লিখেছেন প্রফেসর এম. এ. হামিদ পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যবহৃত টেকনিক অনুসরণ করে। বইটি বাংলায় অনুবাদও হয়েছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উপযোগী হলেও কলেজের উচ্চমাধ্যমিক বা ডিগ্রী পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপযোগী নয়। এই স্তরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কথা মনে রেখে যথার্থ মানসম্পন্ন ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ক বই প্রকাশ খুবই জরুরী। এই উদ্যোগ না নিতে পারলে ইসলামী অর্থনীতির পঠন-পাঠন প্রসারে কাংখিত সাফল্য আসা অসম্ভব।
বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতি চর্চার ক্ষেত্রে পঞ্চম যে বাঁধাটি গুরুত্বসহ উল্লেখের দাবী রাখে তা হলো আমাদের আরবী ও ইংরেজী ভাষাজ্ঞানের অবাব। ইসলামী অর্থনীতির চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের পশ্চাৎপদতার এটি অন্যতম কারণ। ইসলামী অর্থনীতরি উপর আরবী ও ইংরেজী ভাষায় গত ত্রিশ বছরে শত শত বই রচিত হয়েছে। উর্দু ভাষাতেও রচিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই। আরবী ভাষাতে ইসলামী অর্থনীতরি উপর উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে বহু গুরুত্বপূর্ণ বই রচিত হলেও সেসব বই আধুনিক রচনাশৈলী ও বিশ্লেষণাত্মক ধরনের নয়। কিন্তু আকর গ্রন্থ হিসেবে সেগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামী অর্থনীতির উপর হাল আমলে রচিত বইসমূহের মধ্য থেকে বাছাই করা আড়াইশ বইয়ের উল্লেখ রয়েছে বর্তমান বইয়ে ইসলামী অর্থনীতির পাঠসহায়ক বইপত্র অধ্যায়ে। এসব বই হতে ইসলামী অর্থনীতির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয়বিধ প্রসঙ্গেই সম্যক অবহিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এ দেশের ইংরেজী শিক্ষিত লোকেরা যেমন সচরাচর আরবীতে পারঙ্গম নন, তেমনি আরবী ভাষায় শিক্ষিত লোকদের অনেকে ইংরেজীতে বেশ কাঁচা। এজন্যে এই দুই ভাষাতেই যেসব বই ও গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে সেগুলো ব্যবহার করে বাংলায় মানসম্পন্ন বই রচিত হচ্ছে না। অথচ উঁচু মানের বই রচনার জন্যে এই উদ্যোগ গ্রহণ খুবই জরুরী। বাংলাদেশের বিশ্বদ্যিালয় পর্যায়ে অধ্যাপকদের মধ্যে যারা বই লিখতে পারেন তাদেরকে ইংরেজী বইয়ের পাশাপাশি আরবী বইগুলোও ব্যবহার করতে হবে। তাহলে ঐসব বইয়ের মান যেমন উন্নত হবে তেমনি যুগ জিজ্ঞাসার জবাবেরও সন্নিবেশ ঘটবে। আরবী ভাষায় বইগুলিতে আল-কুরআন ও হাদীসের আলোকে যেসব সমস্যার সমাধান দেওয়া আছে সেগুলি এদেশের মুসলমানদের অবহিত হওয়ার প্রয়োজন। ইসলামী অর্থনীতি যেহেতু শরীয়াহর বিধি-বিধান মান্য করেই প্রয়োগ ও ব্রবহার হবে সেহেতু এই সম্মিলন অপরিহার্য। অথচ আমাদের মেশে এই উদ্রোগের বড়ই অভাব।
বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতির চর্চার ক্ষেত্রে ষষ্ঠ প্রতিবন্ধকতা হলো উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও সরকারী পৃষ্ঠপাষকতার অভাব। উদাহরণতঃ বারো কোটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে ইসলামের অন্যতম বিধান যাকাতের প্রায়োগিক চর্চা খুবই অবহেলিত। বহু লোক রয়েছে যারা সাহেবে নিসাব হওয়া সত্ত্বেও যাকাত আদায় করে না। এজন্যে উপযুক্ত প্রাতিষ্টানিক কাঠামোর অবাব ও সরকারী অবিমৃষ্যকারীতাই দায়ী। উশর তো এদেশে আদায় হয়ই না বলা চলে। অঞ্চল বিশেষে কেউ কেউ উশর আদায় করলেও সারা দেশে এর কোন প্রভাব পড়ে না। তাই যাকাত ও উশর সূত্রে যে বিপুল অর্থ আদায় হতে পারতো তার উপকার হতে সমগ্র দারিদ্র জনগোষ্ঠিই, যারা বাংলাদেশের জনগণের ৮০%, বঞ্চিত। এ ব্যাপারে সরকার যেমন নির্লিপ্ত, তেমনি শিক্ষিতরাও উদাসীন। এদেশে ইসলামী অর্থনীতির সঠিক প্রায়োগিক চর্চা হলে এর প্রতিবিধান হতো এবং বিপুল সাফল্য বয়ে আনতো।
ইসলামী অর্থনীতি চর্চার সপ্তম প্রতিবন্ধকতা হলো উপযুক্ত ব্যক্তি, মানসিকতা ও প্রতিষ্ঠানে তীব্র সংকট। ব্যক্তি ও সমষ্টি পর্যায়ে ইসলামী অর্থনীতির চর্চার ক্ষেত্রে যেমন রয়েছ হালাল-হারামের বাছ-বিচার তেমনি রয়েছে বৈধ পন্থায় উপার্জন ও ব্যয়ের প্রসঙ্গ। উপরন্তু কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের জন্যে যেসব ইসলামী কর্মপদ্ধতি অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে সেসবের মধ্যে মুদারাবা, মুশারাকা ও করযে হাসানা প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে শুধু অভাবী লোকের সাময়িক প্রয়োজন পূরণ হয় না, উদ্যোগী ও কর্মী লোকদের কর্মসংস্থানের উপায় হয় হালাল পদ্ধতিতেই। ইসলামের সোনালী যুগে তো বটেই, আইয়ামে জাহেলিয়ায়ও মুদারাবা ও মুশারাকা পদ্ধতি চালু ছিল। বর্তমানে সুদের সর্বগ্রাসী সয়লাব এবং ব্যক্তি চরিত্রের নিদারুণ অবনতির কারণে না করযে হাসানা প্রদান করা যায় না মুদারাবা ও মুশারাকার উদ্যোগ নেওয়া যায়। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া খুবই জরুরী। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী অর্থনীতির চর্চা করার জন্যে চাই ইসলামী জীবনাচরণের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াসমূহ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান ও তা পালনের জন্যে আন্তরিক আকাংখা। নইলে শুধুমাত্র মৌখিক সহানুভূতির দ্বারা ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়িত হয়ে যাবে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আলোচ্য ক্ষেত্রে সর্বশেষ যে প্রতিবন্ধকতা উল্লেখযোগ্য সেটি হলো এদেশের লোকের আবেগপ্রবণতা এবং বাহ্যিক আচরণেই সন্তুষ্টি। এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি খুবই তীব্র। কিন্তু প্রকৃত দ্বীনি শিক্ষার অভাবে এই অনুভূতি বহুলাংশে আবেগবহুল এবং ইসরামের বহিরঙ্গ নিয়েই তৃপ্ত। জীবন ও সমাজকে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রঙ্গীন করার লক্ষ্য তার কাছে গৌণ। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর এই চেতনার অভাবে ইসরামের প্রতি তাদের আবেগতাড়িত অনুভূতিকে সুসংহতভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ ইসলামী অর্থনীতি চর্চার জন্যে সেটাই সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। বাংলাদেশের ইসরামপ্রিয় জনগোষ্ঠীকে ইসলামী জীবন যাপনের জন্যে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে প্রয়োজনীয় কর্মতৎপরতা গ্রহণ ও ক্ষেত্রবিশেষে ত্যাগ স্বীকারের দীক্ষায় উজ্জীবিত করতে এবং সুসংহত করে সুগঠিত শক্তিতে রূপান্তর করতে যে উদ্যোগ ও তৎপরতা প্রয়োজন এই মুহূর্তে তার বড়ই অভাব। এই প্রয়োজন পূরণই বর্তমান সময়ে এদেশে ইসলামী অর্থনীতি চর্চার সবচেয়ে বড় সমস্যা ও বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর যথোচিত মুকাবিলা করতে পারলে কাংখিত মনযিলে মকসুদে পৌঁছানে সম্ভভ।