পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলাম
ভূমিকা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদেরধর পর হতে ইসলাম সমগ্র বিশ্বে এক নব জাগরণের সূচনা করেছে। এর বিপরীতে পুঁজিবাদ তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে তুমুল সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন তার রণকৌশল পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজতন্ত্র তো ইতিমধ্যেই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। যেমন আকস্মিক তার আবির্ভাব তেমনি আকস্মিক তার তিরোভাব। যেসব দেশ এখওন সমাজতন্ত্রের দাবীদার তারা বহুবার সংশোধনের মাধ্যমে প্রকারান্তরে পুঁজিবাদের নামাবলী গায়ে চড়িয়ে দিয়েছে। অপর দিকে আজ দেশে দেশে দিকে দিকে ইসলামী আন্দোলনের সবুজ ঝান্ডা উড়ছে। বহু দেশ আজ ইসলামের নামেই রাষ্ট্রপতাকা উড্ডীন করেছে। যেসব দেশে একদা ইসলামী জীবনাদর্শ চর্চা নিষিদ্ধ ছিলো, ছিলো অপাংক্তেয়, সেসব দেশে ইসলাম আজ শুধু অগ্রসরমান শক্তিই নয়, বরং তারা সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের অচলায়তন ভেঙে নতুন জীবনের ডাক দিচ্ছে। সেজন্যেই Economist-এর মতো পত্রিকা বেসামাল হয়ে ধান ভানতে শিবের গীত গেয়েছে। অর্থনীতির আলোচনা বাদ দিয়ে ‘ইসলাম ঠেকাও জিগির তুলেছে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পুঁজিবাদের চিন্তাশীল নেতারা গত শতাব্দীতেই বলেছে- “পুঁজিবাদের মুকাবিলায় আগামী শতাব্দীর চ্যালেঞ্চ ইসলাম।” স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের মতো লোকেরা বলছেন শ্রেণী দ্বন্দ্ব (Class Struggle) নয়, সভ্যতার সংঘর্ষই (Clash of Civilization) ইতিহাসের ধ্রুব সত্য। পুঁজিবাদী সভ্যতার মুকাবিলায় ইসলামী সভ্যতা তার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে কেন ইসলামকে তাদের এত ভয়, তাদের গলতগুলো কি, এবং তাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা কোথায় তা আজ ভালভাবে জানা প্রয়োজন। এই আলোচনায় সেই চেষ্টাই করা হয়েছে।
উদ্ভব ও বিকাশ
ইসলামের পূর্ণ রূপলাভ ঘটে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ বিশ্বের কালজয়ী আদর্শপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আমলে, তাঁর মদীনার জীবনে। ইসলামী সমাজদর্শন তথা জীবন বিধানের ভিত্তি হলো তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। আল-কুরআন ও সুন্নাহ এবং ইজমা ও ক্বিয়াস অর্থাৎ ইজতিহাদের মাধ্যমে এই জীবন ব্যবস্থা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত গতিধারায় বহমান থাকবে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদমের স্রষ্টা আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধানের মধ্যেই যেমন রয়েছে তার জন্যে শান্তি ও পূর্ণতা তেমনি রয়েছে সার্বিক কল্যাণ ও মঙ্গল।
এরই বিপরীতে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা তাদের নিজেদের মনগড়া মতবাদ ও জীবন বিধানের প্রেসক্রিপসান দিয়ে পৃথিবীতে যে অশান্তি, ধ্বংস, হানাহানি ও সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তার একমাত্র তুলনা তারা নিজেরাই। পুঁজিবাদের ইতিহাস শোষণ-নিপীড়ন, অন্যায় যুদ্ধ ও সংঘাতের ইতিহাস। পুঁজিবাদের দর্শন চরম ভোগবাদী ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার দর্শন। পুঁজিবাদের প্রাথমিক উর্মেষ ঘটে মধ্যযুগীয় ইউরোপে। সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণীর ক্রমবিকাশের ধারায় বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। পুরোহিদের সাথে যোগসাজসে রাজতন্ত্র হয়ে ওঠে চরম শোষণতন্ত্র ও একই সাথে পীড়নবাদী শাসনব্যবস্থা। ফ্রান্সে ভূমিবাদীদের প্রভাব মিলিয়ে না যেতেই প্রথমে ইংল্যান্ডে ও পরে সমগ্র ইউরোপে বাণিজ্যবাদ বা মার্কেন্টাইলিজমের বিকাশ ঘটে। এদের মূল কথা ছিলো বেশী রপ্তানী করো, প্রাপ্য অর্থ সোনাদানায় বুঝে নাও আর গোটা দুনিয়ার সম্পদ এনে জড়ো করো নিজের দেশে। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলো দুনিয়অর সেরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বৃটেন। পুঁজিবাদের বীজ নিহিত ছিলো এসব কর্মকান্ডের মধ্যেই। সেটি আরও উচ্চকিত ও প্রবল হয় শিল্প বিপ্লবের ফলে। এ সময়েই রচিত হলো পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তির কালজয়ী গ্রন্থ –An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations (১৭৭৬)।
শিল্প বিপ্লবের ফলে উপনিবেশবাদ আর জাঁকিয়ে বসে। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের আবিষ্কার ও শিল্প উৎপাদনের ক্রমবিকাশমান কলাকৌশলকে বেনিয়ারা নিজেদের স্বার্থে ব্যাপক ও নির্দয়ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এরই ফসল শিল্প বিপ্লব। একই সাথে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হলো “খাও, দাও আর ফুর্তি করো” এই ভোগবাদী দর্শনদিয়ে। প্রকৃতপক্ষে যান্ত্রিক ও ইতর বস্তুবাদ হয়ে পড়লো সমাজ দর্শনের ভিত। ভোগবাদী জীবন ও বস্তুবাদের সমন্বয়ের আগুনেঘি ঢালার কাজটি সম্পন্ন করলো অবাধ ও নিরংকুশ ব্যক্তি মালিকানা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যান-ধারণা। প্রথম দিকে চার্চের পুরোহিতরা কিছুটা বাধার সৃষ্টি করতে চাইলেও তাদের সে চেষ্টা রাজন্যবর্গ ও বুর্জোয়া শ্রেণীর চাপে স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। এরই সাথে পরবর্তীকালে যুক্ত হলো মানবতার অস্তিত্ববিনাশী ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামত ভোগে চরম বাধাসৃষ্টিকারী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ। পুঁজিবাদ এভাবেই তার শক্তিমত্তা ও দাপট বৃদ্ধি করে চললো। বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ দিয়ে তার শুরু। ক্রমে শিল্প পুঁজি, বিনিয়োগ পুঁজি ইত্যাদি পর্যায়ে পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বহুজাতিক পুঁজির বিশাল বাজারে। এ বাজার তারই রচিত, বিশ্বকে শোষণের জন্যে তারই উদ্ভাবিত কৌশল। এর অপ্রতিহত গতি ও সাফল্যকে ধরে রাখতে পুঁজিবাদের উদ্ভাবিত সর্বশেষ কৌশল হলো বিশ্বায়ন (Globalization) ও উদারীকরণ (Liberalization)।
জার্মান ইহুদী কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) ভাগ্যের অন্বেষণে ঘুরতে ঘুরতে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম হয়ে এক সময়ে পৌঁছে যান পুঁজিবাদের তৎকালীন সবচেয়ে বড় ধ্বজাধারী দেশ ইংল্যান্ডে। সেদেশে তখন রবার্ড ওয়েন, থমাস হজকিন্স, সিডনী ওয়েব, চার্লস ফুরয়ার, সেন্ট সাইমন, লুই ব্লাঁ, জেরেমি বেনথামেরমতো ফেবিয়ান সোস্যালিস্ট, হবসন ও বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো গিল্ড সোসালিস্ট ও পিশুর মতো গণদ্রব্য সরবরাহ করার প্রবক্তাদের আলোচনা ও লেখালেখির ফলে বিদগ্ধ মহলে সমাজতন্ত্র নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছিলো। এই পটভূমিতেই কার্ল মার্কস দেখলেন শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট শ্রমিকদের বেদনাবিধুর বিপর্যস্ত মানবেতর জীবন যাপন। এরই সমাধানের জন্যে তিনি গ্রহণ করলেন দ্বান্দ্বিক বাস্তুবাদ তত্ত্ব, ডাক দিলেন শ্রেণী সংগ্রামের। তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ Das Dapital (১৮৬৭) এই সময়েইরচিত। তাঁর Theory of Surblus Value এই পটভূমিতেই উদ্ভাবিত। তাঁর প্রস্তাবিত শ্রেণী সংগ্রামের পথ ধরে পরবর্তীকালে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির মাধ্যমে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার সময়ে শ্রেণী শত্রু উৎখাত ও নির্মূলের নামে কত লক্ষ বনি আদম যে বন্দুকের নলের শিকার হয়েছিলো, কত লক্ষ লোক ভিটেমাটি হতে উচ্ছিন্ন হয়ে সুদূর সাইবেরিয়ায় নির্বাচিত হয়েছিলো তার হদিস মিলবে না কোনো দিনই। সমাজতন্ত্র যখন একটা সংগঠিত শক্তির রূপ নেওয়া শুরু করে তখন তার কার্যাবলীর মধ্যে প্রধান হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার উচ্ছেদ, সর্বহারা একনায়কত্বের (Dictatorship of the Proletariat) নামে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, জনগণের মালিকানর নামে উৎপাদনের উপায় উপকরণে রাষ্ট্রীয় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার এবং ধর্মের আমূল উচ্ছেদ।
মার্ক্স-এঙ্গেলসের পুঁথিগত ও নিজস্ব ধ্যান-ধারণার উপর ভিত্তি করে রচিত জীবন দর্শনকে অভ্রান্ত মনে করে পরবর্তীকালে লেলিন-স্যালিন-ক্রশ্চেভ রাশিয়ায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলো সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে নবতর কৌশল উদ্ভাবন করতে হয়েছে, দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। এমনকি তুরুপের তাস হিসেবে গ্লানস্ত ও পেরেসত্রয়কাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কমরেড মিখাইল গরবাচেভ্ তাতে বরং আগুনে পেট্রোল ঢালারই কাজ হয়েছিলো। খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়লো পৃথিবীর দ্বিতীয় পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন।
রাশিয়ার প্ররোচনায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়েছিলো পূর্ব ইউরোপীয় দেশ পোলান্ড হাঙ্গরী রুমানিয়া বুলগেরিয়া আলবেনিয়া ও যুগোস্লোভিয়ায়। এজন্যে অনেক ক্ষেত্রে রাশিয়া সরাসরি সামরিক মদদ যুগিয়েছে, ট্যাংকের বহর পাঠিয়েছে। একই চেষ্টা চললো কিউবায়, আফ্রিকার কাঙ্গো এঙ্গোলা নামিবিয়া ও ইথিওপিয়ায়। এ ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো চীনেও। কিন্তু তাত্ত্বিক নীতি ও আদর্শ পরিবর্তিত হতে শুরু করলো বাস্তবের কঠিন পরিস্থিত মুকাবিলা করতে যেয়ে। শতাব্দী প্রাচীন কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো (১৮৪৮) ততদিনে লক্ষ লক্ষ লোককে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে। আরও লক্ষ লক্ষ বনি আদমকে ভিটেমাটি ছাড়া করেছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা বাধ্যতামূলক শ্রমশিবিরে যে কত লোক লাপাত্তা হয়েছে তার কোন লেখাজোখা বা বাধ্যতামূলক শ্রমশিবিরে যে কত লোক লাপাত্তা হয়েছে তার কোন লেখাজোখা নেই। যাহোক বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে পশ্চিমা দেশগুলোর সাতে তাল মিলিয়ে চলার বাসনায় সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী দেশগুলো তাদের পূর্বঘোষিত আদর্শের পরিবর্তন পরিমার্জনা করে পুঁজিবাদের সাথে আপোষরফার নীতি গ্রহণ করে। এ উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যুগোশ্লোভিয়া। পরবর্তীকালে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সোস্যালিস্ট বা কম্যুনিস্ট পার্টি কর্তৃক গৃহীত সোস্যালিজমবা কম্যুনিজমের নতুন ব্যাখ্যা চাই বহুক্ষেত্রেই ছিলো মার্কসবাদের সাতে দারুণ অসংগতিপূর্ণ।
চীনও এর ব্যতিক্রম নয়। কমরেড মাও ঝে দং লং মার্চের মাধ্যমে চীনে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। রেড গার্ড আন্দোলনের নামে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে বিরোধ মনোভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবীদের মেথরে স্তরে নামিয়ে আনেন। মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের হত্যা ও পাইকারী হারে বন্দী করেন। উইঘুরদের (চীনে মুসলমানদের উইঘুর ও হুই বলা হয়) নাম-নিশানা মুছে ফেলার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমাজতন্ত্রের ইতিহাস সীমাহীন রক্তপাত ধ্বংসযজ্ঞ নির্যাতন পতারণা ও ছলনার ইতিহাস। চীন তার ব্যতিক্রম হবে কি করে? কিন্তু এত করেও শেষ রক্ষা হয়নি। মাওয়ের মৃত্যুর পর পরই দেং জিয়াও পিং মার্কিন ও ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের উদার আমন্ত্রওণ জানালেন, উপকূলবর্তী সকল এলাকা মুক্ত অঞ্চল গোষিত হলো; কাজের মান ও পরিমাণ অনুযায়ী উঁচুহারে বেতন নির্ধারিত হলো। এমনকি গণকমিউনিকেও (People’s Commune) ঢেলে সাজানো হলো। আর কিউবার মহান (!) ফিদেল ক্যাস্ট্রো কর্তৃক খ্রীস্টান বিশ্বের ধর্মগুরু পোপকে তার দেশে আমন্ত্রণ জানাবার কথা কে না জানে?
সমাজতন্ত্র একদা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে তার আপাতঃমধুর মোহনীয় বাক্যজালে প্রভাবিত করেছিলো। মুসলিম বিশ্বের অনেক শে এই ভ্রান্তির বেড়াজালে আটকেছিলো। লিবিয়া মিশর সুদান সিরিয়া ও ইরাক তার প্রকৃষ্ট নজীর। তবে এরা পুঁজিবাদকেও পুরো বর্জন করতে পারেনি। সেজন্যেই এদের ব্যবহারিক দর্শনে একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুসঙ্গ জাতীয়তাবাদ পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। এই মিশ্রণ তাদের জন্যে কোন কোন দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ বা মঙ্গল বয়ে আনেনি। বরং শেষ অবধি অনেক দেশেরেই মোহভঙ্গ ঘটেছে। কিন্তু ততদিনে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে।
এখানেই শেষ নয়। পরাভূত মৃতপ্রায় সমাজতান্ত্রীরা পুনরায় তাদের থাবার লুানো নখর বের করতে শুরু করেছে। নানা নতুন নামে জনগণকে আবার ধোঁকা দেবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতারণা ও ছলনার নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করছে। তাদের পুরনো দোসররাও বসে নেই। তারাও নিমকহালালীর পরিচয় দেবার জন্যে নেতাদের জন্মদিন, স্মরণ উৎসব, প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, বৈজ্ঞানিক চিন্তার অনুশীলন ইত্যাকার নানা উপলক্ষ্য বের করে সেমিনার সিম্পোজিয়াম সমাবেশ আলোচনা সভা ইত্যাদির আয়োজন করে চলেছে। উপরন্তু বৈজ্ঞানিক চিন্তার আদর্শ অনুসারী, মুক্তবুদ্ধি চর্চার একনিষ্ঠ কর্মী, সংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল তরুণ বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি চটকদার শব্দের লোভনীয় টোপ ফেলে গেঁথে তুলছে নামের লোভে স্বীকৃতির মোহে পাগলপারা তরুণ-তরুণীদের। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া সেসব ছাত্র-ছাত্রীরাই এদের পাতা ফাঁদে পা ফেলে যারা নিজেদের অতীত ঐতিহ্যকে জানে না, জানার চেষ্টাও করেনি। একই সঙ্গে ভবিষ্যত সম্পর্কেও এদের সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। এরাই নব্য সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীদের সহজ শিকার।
মৌলিক পার্থক্য
পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সাথে ইসলামের তুলনা করতে হলে অর্থাৎ এদের বিভিন্নতা বুঝতে হলে প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য বা পার্থক্যও জানতে হবে।
পুঁজিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য
১. জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গী
২. ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রদর্শন
৩. অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা
৪. উন্মুক্ত বা অবাধ অর্থনীতি
৫. ব্যক্তির নিরংকুশ মালিকানা
৬. লাগামহীন চিন্তার স্বাধীনতা
৭. গণতন্ত্রের নামে বুর্জোয়া শ্রেণীর শাসন
৮. পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদী।
সমাজতন্ত্রে প্রধান বৈশিষ্ট্য
১. দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ
২. ধর্মের উৎখাত
৩. ব্যক্তি স্বাধনিতার উচ্ছেদ
৪. নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি
৫. রাষ্ট্রীয় নিরংকুশ মালিকানা
৬. চিন্তার পরাধীনতা
৭. সর্বহারা নামে একদলীয় শাসন
৮. তাত্ত্বিকভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হলেও বাস্তবে সাম্রাজ্যবাদী।
ইসলামের প্রধান বৈশিষ্ট্য
১. তৌহিদভিত্তিক বিশ্বাস
২. আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা
৩. শরীয়াহ অনুমোদিত ব্যক্তিস্বাধীনতা
৪. পরিমিতির অর্থনীতি
৫. শরীয়াহ স্বীকৃত মালিকানা
৬. সুস্থ চিন্তার স্বাধীনতা
৭. শুরাভিত্তিক শাসন
৮. পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী।
এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিত্তিতে উল্লেখিত তিনটি মতাদর্শের তথা জীবন দর্শনের পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যেতে পারে। প্রমাণ করা যেতে পারে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের এবং আগামী শতাব্দীতে তার অনিবার্য বিজয়ের কথা। নীচে পর্যায়ক্রমে বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণের ও সেসবের তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
১. জীবন দর্শনের পার্থক্য
ইসলাম, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রে পার্থিব জীবন আচরণে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। পুর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে পুঁজিবাদের জীবন দর্শন হলো জড়বাদী বা বস্তুবাদী জীবন দর্শন যেখানে এই নশ্বর জীবন পুরোপুরি ভোগের বস্তু বলে স্বীকৃত। ভোগের পরিমাণও লাগামহীন ও অপরিমেয়। সেখানে প্রকাশ্যে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি গোষিত না হলেও বাস্তবতা তাই-ই। ভোগের সামগ্রী আহরণের জন্যে, ইন্দ্রিয় লালসা চরিতার্থতার জন্যে হালাল-হারাম বৈধ-অবৈধ ও ন্যায়-অন্যায়ের বাছ-বিচার করা হয় না। জীবনটা যেহেতু স্বল্প দিনের এবং তার সমাপ্তি তা জানা নেই তাই কত অল্প সময়ে কত বেশী ভোগ করা যায়, কত ক ম ব্যয়ে কত বেশী অর্থ উপার্জন করা যায় সেই প্রতিযোগিতাই এখানে তীব্র। আসলেই জড়বাদী সভ্যতায় ইন্দ্রিয়পরায়ণতা এত দূর পৌঁচেছে, পরিবারে যে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে, যৌনজীবনের যে ভয়াবহ সও কদর্য বিকৃতি ঘটেছে তা শুধু রাসূল (স) পূর্ব যুগের আরবের সমাজের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয। পুঁজিবাদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষেট্ট্র সমকামতার মতো জঘন্য অপরাধকেও রাজনৈতিক স্বার্থে আইন করে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
এর বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক জীবন দর্শনের মূল ভিত্তি হলো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)। জার্মান দার্শনিক হেগেলের বিরোধমূলক বিকাশের ধারণার দ্বারা মার্ক্স বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। এ তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- থিসিস, এন্টিথিসিসি ও সিনথিসিস। আজকের সত্যই থিসিস। এই থিসিসের বিরুদ্ধে তৈরী হয় িএন্টিথিসিস। দুয়ের সংঘর্ষে উদ্ভব হয় সিনথিসিসের। এই সিনথিসিসই পরবর্তীতে পুনরায় থিসিস হয়ে দাঁড়ায়। হেগেলের এই দ্বান্দ্বিক বিকাশের ধারণাকেই কার্ল মার্ক্স তাঁর সমাজবিকামের ধারণা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। মার্ক্স ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে তাঁর তত্ত্ব নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছেন। সেই প্রয়াসে তিনি বারবার তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁর প্রিয় প্রসঙ্গ শ্রেণী সংগ্রামকে। তাঁর মতে পৃথিবীর বিকাশ হয়ে বিবর্তনবাদ ও শক্তিবাদের মধ্য দিয়ে। চার্লস ডারউইনের (১৮০৯-১৮৮২) বিবর্তনবাদ (Theory of Evolution) ও প্রকৃতির নির্বাচন (Natural Selection) বা যোগ্যতমেরই বেঁচে থাকার অধিকার তত্ত্ব (Survival of the Fittest) মার্ক্সকে তাঁর মতবাদে আস্থাশীল হতে বিপুলভাবে সহায়তা করেছিলো। ফলে তিনি তাঁর ও অনুসারীরা জোরে-শোরেই বললেন- পৃথিবীর ইতিহাসে শক্তিমানরাই শুধু টিকে থাকবে, অন্যেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাদের মত পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস, শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সমাজ অগ্রসর হয়েছে।
মার্কসের বস্তুবাদী ও নাস্তিক্যবাদী মতবাদের ভিত হিসেবে কাজ করেছিলো ডারউইনের On the Origin of Species (১৮৫৯) বইটি। দুর্ভাগ্যবশতঃ খোদ ডারউইন আজ আর আগের মত বিজ্ঞানী মহলে আদৃত নন। তাঁর বিবর্তনবাদ ও প্রকৃতির নির্বাচন তত্ত্ব পরবর্তীকালের বৈজ্ঞানিক তথ্য ও যুক্তির কাছে মার খেয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিকরা দেখিয়েছেন তেলাপোকা লক্ষ বধর ধরে টিকে রয়েছে, কিন্তু শক্তিধর অতিকায় সব প্রাণী পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, আজও যাচ্ছে। িএর পিছনে যত না তাদের নিজেদের দুর্বলতা দায়ী তার চেয়ে অনেক বেশী দায়ী মানুষের অবিবেচনা ও অর্থগৃধ্নুতা। অনুরূবভাবে কবে কখন কি প্রক্রিয়ায় বানর মানুষষের রূপান্তরিত হয় তার কোন সর্বজনগ্রহা্য ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায় নি। কেনইবা বানর ও গরিলা এখন মানুষে রূপান্তরিত হচ্ছে না তারও কোন ব্যাখ্যা নেই।
বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে প্রাণিবিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, অনুজীব বিজ্ঞানী, এমনকি গণিতবিদরা পর্যন্ত বিবর্তনবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং এর অসারতা ও যুক্তিহীনতাকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এদের তালিকা বেশ দীর্ঘ; এখানে শুধু কয়েকজনের নাম উল্লেখই যথেষ্ট হবে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন Louis Bounoure, Lemonie, W. R. Bird, Falmmarion, D. Dewar, S. H. Slusher, Agassiz, E. Schute, P. S. Morhead, M. M. Kaplan, Arthur Koester প্রমুখ খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা। নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী প্রাণরসায়নবিদ J. Monod-এর মতে বিবর্তন দূরে থাক, পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনাই প্রকৃতপক্ষে শূন্য। এইচ. এম. মরিস বলেন, পরীক্ষামূলকভাবেও বিবর্তনের প্রমাণ করা সম্ভব নয় (H. M. Morris, Evolution in Turmoil, San Deigo, Californina: Creation Life Publishers, 1982)। প্রখ্যাত অষ্ট্রেলীয় অনুজীব বিজ্ঞানী মাইকেল ডেনটনের মতে বৈজ্ঞানিক যুক্তির সাহায্যে ডারউইনের তত্ত্ব প্রমাণ করা অসম্ভব (Michal Denton, Evolution: A Theory in Crisis, London: Burnett Books, 1985, p. 323)। জেনেটিক কোডের আবিষ্কারক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী স্যার ফ্রান্সিস ক্রীকের মতে ডারউইনের তত্ত্বের মধ্যে শুধু অসগতিই নেই, অসম্ভবতাও বিপুল (Sir Francis Crick, Life Itself, New York; Simon & Schuster, 1971, p 71)।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, বিবর্তনবাদ ও শক্তিবাদের তত্ত্বের উপর নির্মিত মার্ক্স-এঙ্গেলসের শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব। পৃথিবীর সৃষ্টি হতে ধ্বংস পর্যন্ত সময়কে মার্ক্স পাঁচটি পর্বে ভাগ করেছেন। পর্বগুলো হলো: (ক) আমিদ সমাজ, (খ) দাসভিত্তিক সমাজ, (ঘ) সামন্ত সমাজ, (ঘ) পুঁজিবাদী সমাজ এবং (ঙ) সমাজতান্ত্রিক সমাজ তথা সাম্যবাদ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের কট্টর অনুসারীরা সর্বশেষ এই ভ্রান্ত মতাদর্শের জন্যে অর্থ শতাব্দীর বেশী সময় ধরে চেষ্টা চালিয়ে রক্তের স্রোত ও অত্যাচারের বিভীসিকা সৃষ্টি করেও মার্ক্সের ঈপ্সিত সমাজ দর্শন কায়েমে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
জীবন দর্শন সম্পর্কে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গীর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান ইসলামের। ইসলামী জীবন দর্শনের মুল ভিত্তিই হলো তওহদি, রিসালাত ও আখিরাত। মানুষের স্রষ্টা আল্লাহই তার রব এবং তিনিই তার ইহকাল ও পরকালের জীবনের মালিক। ইহকালের এই জীবনে চলার পথ দেখাবার জন্যে তিনি যুগে যুগে নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন, তাঁদের মাধ্যমে মানব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন হেদায়েতের বাণী। সে আলোকে চললে জীবন হবে সত্য ও সুন্দরের, কল্যাণ ও মঙ্গলের। পরিণামে আখিরাতে তার জন্যে রয়েছে অনন্ত পুরস্কার ও শান্তি। এরই ব্যত্যয় ঘটাতে মরদুদ শয়তান সদা সচেষ্ট। তার কুমন্ত্রণা ও কুপ্ররোচনার ফলেই চলে আসছে সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব, হক ও বাতিলের লড়াই। এই লড়াইয়ে জিততে হলে যে অস্ত্র চাই সে অস্ত্র ঈমানের। সে অস্ত্র কেমন হবে, তার লড়াইয়ের শক্তি কতটা হবে তা জানবার একমাত্র উপায় নবী-রাসূলদের অনুসরণ করা। শুধু তাই নয়, ইহকালের কৃতকর্মের ফল অবধারিত রয়েছে আখিরাতে এই বোধ ও বিশ্বাস যার মধ্যে, যে জনসমষ্টির মধ্যে যত বেশী তারাই তত বেশী সফলকাম। মুমিনের কাছে এই দুনিয়া পরকালের জন্যে কর্ষণক্ষেত্রে। সুতরাং, তার কাছে জড়বাদীতা যেমন গ্রহণযোগ্য নয় তেমনি গ্রহণযোগ্য নয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। বরং আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস, তাঁরই প্রেরিত ঐশী বাণী আল-কুরআন ও রাসূলে করীমের (স) সুন্নাহ হলো তার জীবনের ধ্রুবতারা।
২. ধর্মীয় বিশ্বাস
পুঁজিবাদী জীবন দর্শনে ধর্মের কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই। ধর্ম সেখানে সাক্ষী গোপালের মতো। রাষ্ট্র বা সরকার যতটা আচরণের সুযোগ দেয় ব্যক্তি ততটাই মাত্র ধর্মীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের সুযোগ বা স্বাধীনতা পায়। প্রকৃতপক্ষে খ্রীষ্টান ইহুদী বৌদ্ধ জৈন হিন্দু প্রভৃতি ধর্ম ইসলামের মতো জীবনের সকল ক্ষেত্রের নিয়ামত শক্তি নয়, সর্বব্যাপী এবং সার্বিকও নয়। বিভিন্ন ধর্মে ব্যক্তিজীবন, এমনকি পারিবারিক জীবনের আচরণবিধি থাকলেও সমষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনদর্শন কারোরই নেই। অর্থনৈতিক আচরণবিধি থাকলেও সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনদর্শন কারোরই নেই। অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক- কোনো ক্ষেত্রেই ঐসব ধর্মের কোন নীতি-নির্দেশনা নেই, কোনো বিধি-বিধান নেই। পুঁজিবাদে সব ধর্মই সহঅবস্থঅন করতে পারে। কর্মক্ষেত্রে অসুবিধা না ঘটিয়ে, পুঁজিবাদী উৎপাদন চক্রের কোনোও রকম বিঘ্ন না ঘটিয়ে বা রাষ্ট্র ক্ষমতায় হস্তক্ষেপের কোন আশংকা সৃষ্টি না করে ব্যক্তি তার আপন গৃহে অথবা উপাসনালয়ে ধর্মচর্চা করতে পারে। সেটুকু স্বাধীনতা তার আছে।
পুঁজিবাদে ধর্ম আপোষরফা করেছে রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে। মধ্যযুগে এক সময়ে ইউরোপে চার্চের ক্ষমতা প্রবল হয়ে উঠলে রাজন্যবর্গ এর বিরোধিতা শুরু করে। খোদ ইংল্যান্ডেই গীর্জার সাথে বিরোধ বাধে রাজার। ফলে ক্যাথলিক রাজা হয়ে যান প্রটেস্ট্যান্ট। খ্রীস্টানদের মধ্যে যে বহুধা বিভক্তি বিদ্যমান তার মূল নিহিত এই বিরোধের মধ্যেই। এক সময়ে অবশ্য আপোষরফা হয়। সেজন্যে পরবর্তীকালে বলা শুরু হয়- পোপকে তার প্রাপ্য দাও, রাজকে দাও তার প্রাপ্য। বৌদ্ধ হিন্দু বা জৈন ধর্মে যখন রাজা প্রবল হয়ে ওঠে তাদের ধর্ম তখন রাজধর্ম রূপে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু রাজার পতনের সাথে সাথে ধর্মের সেই গুরুত্ব লোপ পায়। যাজকরা তখন হয়ে পড়ে পরের অনুগ্রভাজন। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকাই আর থাকে না।
শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুঁজির গুরুত্ব যখন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে রাষ্ট্র ক্ষমতার উপরও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। পুঁজিই হয়ে ওঠে সমাজের প্রধান নিয়ামক শক্তি। এই প্রেক্ষিতে ধর্মের সাথে আপোষরফার জন্যে তৈরী হলো নতুন মতবাদ-ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা সেক্যুলারিজম। সেক্যুলারিজমের মৌখিক বক্তব্য যাই হোক, বাস্তব অবস্থা হলো ধর্মহীনতা। রাষ্ট্রের অনুমোদন ও প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার মাত্রার উপরেই ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতায় রূপান্তররিত হওয়া না-হওয়া সম্পূর্ণতঃ নির্ভরশীল। ধর্মীয় শিক্ষার পরিবেশ রুদ্ধ করে, ধর্মাচরণের সুযোগ সংকীর্ণ করে, ধর্মীয় নেতাদের সামাজিক গুরুত্ব ও মর্যাদা হ্রাস করে, ধর্মীয় নীতিমালার উপর পুঁজিবাদের নিয়ম ও স্বার্থের প্রাধান্য চাপিয়ে দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যক্তিকে আসলে ধর্মহীনতা তথা স্বেচ্ছাচারিতার দিকেই ক্রমান্বয়ে ঠেলে দেয়।
সেক্যুলারতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় খোদায় আইন ও বিচার তথা জীবন বিধানকে অস্বীকার এবং পরকালের অনন্ত জীবনের শান্তি/শাস্তি সম্পর্কে খ্রীষ্টীয় বিশ্বাসের কারণে গোটা পাশ্চাত্য তথা বিশ্বের জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ খ্রীষ্টান সম্প্রদায় উপযোগবাদ (Utilitarianism) এবং ভোগবাদকে (Epicurism) তাদের উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে। যথেচ্ছ ভোগলিপ্সা ও ধর্মীয় বিশ্বাসসঞ্জাত নৈতিকতা বিবর্জিত হওয়ার কারণে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থার প্রতি নজর ফেরালে এ সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বছর পাঁচেক পূর্বের এক পরিসংখ্যান হতে দেখা যায় সেখানে প্রতি বারো সেকেণ্ডে একটি অপরাধ, প্রতি ঘন্টায় একটি খুন, প্রতি পঁচিশ মিনিটে একটি ধর্ষন, প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি ডাকাতি এবং প্রতি মিনিটে একটি গাড়ী চুরির ঘটনা ঘটে। সেদেশে ভীতিপ্রদ অবরাধ বৃদ্ধির হার জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের চেয়ে তেরো গুণেরও বেশী (দৈনিক সংগ্রাম, ২৯ নভেম্বর, ১৯৯৯)। নতুন শতাব্দীতে এই হার যে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, পশ্চিমা শক্তি মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণের জন্যে শুধু প্রভাবিত করাই নয়, রীতিমতো চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এর অন্তর্নিুহিত আসল উদ্দেশ্য হলো ইসলামকে জানা ও তা পালনে প্রতিবন্ধখতা সৃষ্টি করা। এর ফলে ধীরে ধীরে দেশের কিশোর ও যুবসমাজ ধর্মীয় জীবনদর্শন ও তার বিধিবিধান জানার ও তা যথাযথ পালনের সুযোগ হারাতে থাকবে। এসব দেশে খ্রীষ্টবাদ প্রচার ও প্রসারের জন্যে পশ্চিমারা কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের পথ রুদ্ধ করার সকল অপতৎপরতার এরা নেপথ্যে থেকে ইন্ধন যোগাচ্ছে। পক্ষান্তরে খ্রীষ্টধর্ম সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে বাংরাদেশের মতো মুসলিম প্রধান দেশেও তারা আলাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এদেরই অপতৎপরতার ফলে আফ্রিকার বেশ কয়েকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে খ্রীষ্টানরা সংখ্যাসাম্য অর্জন করতে চলেছে। নিজেদের স্বার্থরক্ষায় এরা সিদ্ধহস্ত। মুখে সেক্যুলারিজমের কথা বললেও খ্রীষ্টধর্ম প্রচারকসহ গীর্জার ও নবদীক্ষিত খ্রীষ্টানদের সামান্যতম ক্ষতি হলে পশ্চি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সকল রাজধানী হতে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। এরাই ইউরোপে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যুদয় প্রয়াস বরদাশত করতে রাজী নয়, বরং সুকৌশলে তা নস্যাৎ করার চেষ্টা চালায়।
সমাজতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর (Corner Stone) হলো নাস্তিক্যবাদ (Atheism)। মার্কস-এঙ্গেলস গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ধর্মই সব অনর্থের মূল। ধর্মের কারণে সমাজে শোষণ দৃঢ়মূল হয়ে রয়েছে। তাই এর বিনাশ ও উচ্ছেদ অপরিহার্য। মার্ক্সের বিশ্বাস এক অর্থে অংশতঃ ঠিক ছিলো। কারণ তিনি যে শোষণ-নির্যাততন লক্ষ্য করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন তা ছিলো খ্রীষ্ট সমাজে চার্চের পীড়ন ও শোষণ। সমগ্র ইউরোপে তো বটেই, আফ্রিকাতেও চার্চের অত্যাচার ছিলো নির্মম। সেই সাথে রাজ-ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় এই অত্যাচার-শোষণ-নিপীড়ন হয়েছিলো দীর্ঘস্থায়ী, সর্বব্যাপী ও সমাজে আমূল প্রোথিত। ভারতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিলাসী জীবন এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু ও অচ্ছ্যুতদের উপর তাদের অত্যাচারের কাহিনী ইউরোপে অজানা ছিলো না। কিন্তু মার্ক্সের যা অজানা ছিলো তা হলো ইসলামী সমাজদর্শন। মার্ক্স-এঙ্গেলস ইসলাম সম্বন্ধে আদৌ পড়াশুনা করেছেন বা এর সংস্পর্শে এসেছিলো এমন কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ধর্ম বলতে তিনি চোখের সামনে যা দেখেছিলেন তারই ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছিলো ধর্মকে উৎপাটনের কর্মসূচী ও নাস্তিক্যবাদের ফর্মূলা। এ মতবাদে ধর্মকে মনে করা হয় শোষণ ও যুলুমের হাতিয়ার। আফিমের সাথে তুলনা করা হয়েছে ধর্মকে। তাই এর উৎখাতের জন্যে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের নেতারা বদ্ধপরিকর। এমনকি এজন্যে তারা শঠতা ও ধূর্ততার আশ্রয় নিতে কসুর করেনি।
লেনিনের নেতৃত্বে জার নিকোলাইকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের সময়ে ব লশেভিক পার্টির প্রয়োজন ছিলো মুসলমান ও খ্রীষ্টানদের সহযোগিতা ও সমর্থনলাভ। মুসলমানদের ধর্মাচরণ এবং জানমালের নিরাপত্তার ওয়াদা দিয়েছিলেন স্বয়ং লেনিন। কিনতউ সমাজতন্ত্রের অন্যতম আপ্তবাক্য হলো-লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে প্রতারণা শঠতা ছলনা হত্যা কোনো কিছুই অন্যায় নয়। তাই গোটা মধ্য এশিয়ায় প্রথমে ইসলামের সাথে সহঅবস্থান, পরে ব্যক্তিজীবনে ইসলামী অনুশাসনের সীমিত অনুসরণের অনুমতি এবং শেষ অবধি ইসলামের উৎখাতের জন্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বশক্তি প্রয়োগ করা হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চীন আলবেনিয়া বুলগেরিয়া পোল্যান্ড ও যুগোশ্লোভিয়ায়। এতসবের পরেও সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীরা ইসলামের অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। তার প্রমাণ দিয়ে চলেছে চেচনিয়া দাগেস্তান কসোভা বসনিয়া-হারজেগোভিনা, চ ীনের হোনান গানসু জিনজিয়াং সিচুয়ান প্রভৃতি জনপদ।
সোভিয়েত রাশিয়ায় ধর্মকে উচ্ছদের জন্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করার ফলে যে ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয় তার একটা ক্ষুদ্র নমুনাহল:
“যতটা নৃশংসভাবে কোকন্দ অধিকৃত ও ভস্মীভূত হয় তা মধ্যযুগীয় দেশজয়ী মঙ্গোলেরও (অর্থাৎ চেঙ্গিস খান) বিস্ময়ের কারণ ছিলো। চৌদ্দ হাজারেরও বেশী লোককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মসজিদ ও ধর্মস্থানের অবমাননা চরমে পৌঁছে। মুসলিম সাহিত্যের সুন্দর সুন্দর গ্রন্থাগার পুড়িয়ে অবমাননা চরমে পৌঁছে। মুসলিম সাহিত্যের সুন্দর সুন্দর গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং অবরোধের ফলে স্থানীয় অধিবাসীগণের পক্ষে পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে খাদ্যশস্য আমদানী করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাদের মজুদ খাদ্যশস্য এরই মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়। কারণ তার অধিকাংশেই কমিউনিস্টগণ বাজেয়াপ্ত করে নেয়। নয় লক্ষ লোক দুর্ভিক্ষে মারা যায়।” (Lt. Col. P.T. Elerton-In the Heart of Asia, 1926, p. 153)
সোভিয়েত রাশিয়ার তথা বলশেভিক পার্টির ইসলামবিরোধী আগ্রাসন প্রতিরোধের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন মুস্তফা চোকাইয়েভ (কোকন্দ), জাবিদ খাঁ (আজারবাইজান), শামিল বেগ (দাগেস্তান) প্রমুখ। এই উদ্দেশ্যে নানা সংগঠনও গড়ে ওঠে। মুস্তাফা চোকাইয়েভ গড়ে তোলেন মিলিজে তুর্কীস্তান বিরলিগা, জামাল পাশা ও আনোয়ার পাশা গড়ে তোলেন বাসমাকী আন্দোলন, মুরাদ ওরাজত তুর্কমেন আজতলিগি, আবদুর রহীম বাইয়েভ ওয়ালী ইবরাহীমভ মিল্লি ফিরকা এবং মুহাম্মদ আমীন ও ফতেহ আলী খাঁ আজারবাইজান প্রতিরোধ আন্দোলন। অন্যান্য যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বিশ্বজনতম গড়ে তোলার জন্যে বিদেশ সফর করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আয়ায ইসহাকী, জাকি ওয়ালিদী তুকতারভ, সাদরী মাকসুদী আসাল, মির্যা বালা কুলতুক, হামদী ওরলূ, সাইয়ীদ শামিল, ইউসুফ আকচুরা, আলী মারদান বে তোপচিবাসী, ইসমাইল বে গ্যাসপিরিলি, আবু সাদ আহতেম ও সাইয়ীদ গিরাই আলকীন প্রমুখ বরেণ্য ও ত্যাগী ব্যক্তিত্ব।
ধর্ম তথা ইসলামকে সমূলে উৎখাতের জন্যে সোভিয়েত রাশিয়ার গৃহীত কর্মসূচীর ফলাফল জানা যাবে ড. হাসান জামানের সুবিখ্যাত গ্রন্থ কমিউনিস্ট শাসনে ইসলাম হতে:
“১৯০৭ সালের হিসাবে দেখা যায় যে, ইউরোপীয় রাশিয়াতেই মসজিদের সংখ্যা ছিলো ৭,০০০। ১৯৪২ সালে ১৬ই মে প্রকাশিত Soviet War News-এ দেখা যায় যে, সমগ্র রাশিয়াতে মজদের সংখ্যা মাত্র ১,৩১২-তে। ১৯১৭ সালে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিলো ৮০০। ১৯১৮ সালে এর একটিরও অস্তিত্ব ছিলো না। মসজিদসমতে এসব ধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র নাট্যশালা, প্রেক্ষাগৃহ, ক্লাব ও গুদামে পর্যবসিত করা হয়েছে।” (পৃ. ১৩)
সমাজতন্ত্রী ও কম্যুনিস্টদের শঠতা ও প্রবঞ্চনার আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ককেশীয় মুসলমানরা ১৯১৭ সালে দাগেস্তান নামে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। তুরস্ক, জার্মানী এমনকি রাশিয়াও এই স্বাধীন রাষ্ট্রকে সার্বভৌম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বলশেভিক শাসনের সূচনাতেও দাগেস্তানের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে। এমনকি ১৯২১ সালেও স্ট্যালিন দাগেস্তানের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বলশেভিক পার্টির নীতি পরিবর্তিত হয়। শুরু হয় বিশ্বাসঘাতকতার নতুন ধারা। ফলশ্রুতিতে ১৯৩৭ সালে ককেশাস অঞ্চলে সংঘটিত হয় ইতিহাসের েএক মর্মন্তুদ অধ্যায়। লেলিনের উত্তরসূরীরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দাগেস্তানকে সোভিয়েত শাসনের আওতায় নিয়ে আসে। এ জন্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় দশ লক্ষ মুসলমানকে, লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে নির্বাসনে পাঠানো হয় সুদূর সাইবেরিয়ায়। পাইকারীভাবে হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের। ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয় শত শত মসজিদ ও মাদরাসা।
ইহুদী ও খ্রীষ্টানরাও এ অত্যাচারের বিভিষীকা হতে রেহাই পায়নি। তবে ইহুদীদের সৌভাগ্যে তারা দলে দলে দেশ ত্যাগ করে ইঙ্গ-মার্কিন তৎপরতায় প্রতিষ্ঠিত নতুন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলে এসে আশ্রয় নেয়। খ্রীস্টানদেরও বিরাট এক অংশ পশ্চিম ইউরোপে পাড়ি জমায়। দেশ ত্যাগের সুবিধা ছিলো না শুধু মুসলমানদের। তাছাড়া তারা জন্মভূমি ও স্বদেশ ছেড়ে আসার চেয়ে নিজেদের আজাদী রক্ষার লড়াইয়ে শহীদ হওয়াই শ্রেয় বিবেচনা করেছিলো।
একই অবস্থা ঘটে মহাচীনেও। ইসলামের সঙ্গে চীনের মুসলমানদের সংযোগ বহু শতাব্দী প্রাচীন। হযরত মুহাম্মদের (স) মৃত্যর পাঁচ বছর পূর্বেই ৬২৭ খৃষ্টাব্দে ক্যান্টনে দেশের প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এদেশে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক মুসলমান বাস করে জিনজিয়াং (পূর্বের সিনকিয়াং) এলাকায়। এর আদি নাম ছিলো পূর্ব তুর্কিস্তান। এর পরেই রয়েছে সিচুয়ান, ইউনান এবং কানসূ (বর্তমানে গানসু) ও শানসী। চীনা কম্যুনিস্টরা সর্বপ্রথম আঘান হানে কানসু শানসী এলাকায়। মুসলমানরা এখানে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তখন প্রলোভন দেখিয়ে কম্যুনিস্টরা এ আন্দোলন ১৯৫০ সালে স্তিমিত করে দেয়। তারা খুব সতকর্তকার সাথে মুসলিম নেতৃবৃন্দের নামে অপপ্রচার চালাতে থাকে। একই সাথে দ্বিতীয় জাতীয কমিটিতে মা সুং তিং ও তা পু কোন্ নামে দুজন মুসলিম সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
জিনজিয়াং কমিউনিস্ট দখলে আসে ১৯৪৯ সালে। বহু আলিম, মুসলিম রাজকর্মচারী ও নেতাকে বন্দী করা হয়। আহমদ জান, ইসহাক বেগ, লি সু বাং, চেং আন ফু, শাও শফূ, শাও চেং তান, আবদুল করীম আবাসভ, ডা. মাসুদ সাবেরী প্রমুখ গণ্যমান্য নেতাকে হত্যা করা হয়। তা সত্ত্বেও মুসলমানরা দীর্ঘদিন ই মিং, আ হো মাইতি এবং শাই মুর নেতৃত্বে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। ১৯৩৮ সালের হিসাব অনুযায় চীনে মুসলমানের সংখ্যা ছিলো পাঁচ কোটির কাছাকাছি, মসজিদের সংখ্যা ছিলো ৪২,৩২১টি। সেই চীনেই কম্যুনিস্ট সরকার প্রদত্ত ১৯৫২ সালের তথ্য অনুযায়ী মুসলমানের সংখ্যা এক কোটিরও নীচে, মসজিদের সংখ্যা মাত্র ৪,০০০। মাত্র চৌদ্দ বছরে চার কোটি মুসলমান কোথায় হারিয়ে গেল? ম্যালথাসের তত্ত্ব অনুযায়ী লোকসংখ্যা তো বৃদ্ধি পাওয়ারই কথা ছিলো।
বুলগেরিয়ার কম্যুনিস্ট সরকার ১৯৫১ সালে সেদেশের ষাট হাজার মুসলমান পরিবারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাদের সে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়। যুগোশ্লোভিয়ায়ও মুসলমানদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়, তাদের নেতাদের পাইকারী গ্রেফতার ও গুমখুন করা হয়। সকল পূর্ব ইউরোপীয় কম্যুনিস্ট দেশে প্রধান প্রধান দু-একটি মসজিদ রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে রেখে বাকী সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুসলমানদের আরবী ভাষার নাম পরিত্যাগে বাধ্য করা হয় জাতিগত স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্তির হীন উদ্দেশ্যে। কুরআন-হাদীস চর্চা দূরে থাক, শুধুমাত্র কুরআন শরীফ পড়াই ছিলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশ্বব্যাপী কম্যুনিজম ও সোস্যালিজমের পতন দশা শুরু হওয়া পর হতে এই অবস্থার পরিবর্তন শুরু হতে শুরু করেছে। অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে ইসলামের দ্রুত প্রসার ঘটেছে এসব দেশে।
ইসলামের অবস্থান এ দুয়ের বিপরীতে। ব্যক্তিজীবন হতে শুরু করে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন সকল ক্ষেত্রেই ধর্মের অনুশাসন বাস্তবায়ন অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত বিধি-নির্দেশ বাস্তবায়ন ইসলামের দাবী। এই লক্ষ্যেই নবী-রাসূলরা সংগ্রাম করে গেছেন আজীবন। ব্যক্তি পূজা, মুর্তি পূজা, ইন্দ্রিয় পূজা সকল কিছুর বিরুদ্ধেই ইসলামের অবস্থান। মানুষ একমাত্র তার ইলাহ বা রব ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত করবে না, আর কারো হুকুম মান্য করবে না এ শিক্ষা ইসলামের। মানুষের মনগড়া মতবাদ আসলেই তাগুতী মতবাদ। এ মতবাদ একটা-দুটো নয়, শত-সহস্র। এসবের কিছু অস্ত্রের জোরে, কিছু অস্ত্রের জোরে, কিচু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাবে আবার কিছু শঠতা বা চতুরতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে নানা সময়ে। খোদাদ্রোহীতা বা ধর্মের পূর্ণ উচ্ছেদ এরই আরেক চরম ও বিপরীত রূপ। কিন্তু এসবের পরিণাম হয়েছে নিদারুণ হতাশাব্যঞ্জক ও অমানবিক। ইতিহাস সাক্ষী, রাসূলে করীমের (স) মাধ্যমে যে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তার মাধ্যমে যে কল্যাণ ও মঙ্গলময় সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজীরবিহীন। ইসলামের দূতরা তাই যখনই যেদিকে গেছে মজলুম জনতা, তাগুতী ধর্মের পীড়নে ক্লিষ্ট জনতা, মনগড়া আইনের শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতায় অতিষ্ট জনতা তাদের সাদর আহ্বান জানিয়েছে। ইসলামতাদের আশার বাণী শুনিয়েছে। তাদের আত্মাকে স্বাধীনতা দিয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-দেশ-কাল-পাত্র সব কিছুকেই দু পায়ে মাড়িয়ে আল্লাহই মহান ও সর্বশক্তিমান এবং মানুষ একমাত্র তার দাস, আর কারো নয়- এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। এজন্যেই ক্লিমোভিচ দুঃখ করে বলেছেন- “আধ্যাত্মিক ব্যাপারে আমরা ইসলামের সাথে এঁটে উঠতে পারি না। ইসলামের দুদর্ম ধর্মবিশ্বাস বিরাট শক্তির পরিচায়ক।” (Kilmovich-Islam Vs Tsarsky Rossi, Moscow, 1936)
৩. ব্যক্তি স্বাধীনতা
পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সাথে ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে। পুঁজিবাদে ব্যক্তির স্বাধীনতা নিরংকুশ; সমাজতন্ত্রে এই স্বাধীনতা অস্বীকৃত ও উপেক্ষিত। ইসলামে এই স্বাধীনতা শরীয়াহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পুঁজিবাদী জীবন ব্যবস্থায় একজন লোকের নিজের খেয়াল-খুশী মতো যেকোন কিছুই করার স্বাধীনতা রয়েছে। তার এই স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে শুধু তারই তৈরী আইন অর্থ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত পার্লামেন্ট অথবা স্বৈরাচারী শাসক, ক্ষেত্রবিশেষে সামরিক জান্তা। তার ভোগের পেয়ালা উপচে পড়লেও সে নিবৃত্ত না হলে দোষের কিছুই নেই। শত সহস্র বনি আদম ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হলেও তার খাবার টেবিল বহুবিচিত্র পদে সজ্জিত ও ভরপুর থাকা চাই। শুধু ভোগই নয়, বিনিয়োগ, বন্টন, উৎপাদন পারিবারিক জীবন, সাংসারিক জীবন-সর্বত্রই তার এই স্বাধীনতা স্বীকৃত ও কাজে-কর্মে প্রতিফলিত। ইন্দ্রিয়পরায়ণতাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য।
সমাজতন্ত্রের অবস্থান এর বিপরীত মেরুতে। ব্যক্তিকে সেখানে ‘কথা বলার যন্ত্রের চািইতে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তার জীবনের সর্বক্ষেত্রই-পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সবই রাষ্ট্র তথা পার্টি নিয়ন্ত্রিত। যতটুকু স্বাধীনতা পার্টি অনুমোদন করবে তার বেশী চাইবার অধিকার তার নেই। পার্টিই ঠিক করে দেবে তার আচরণ, কর্মক্ষেত্র, বিশ্বাস, এমনডকি তার পরিবারও। এর ব্যতয় ঘটলো কি না তার তদারকী ও খোঁজ-খবর নেবার রয়েছে গোয়েন্দা বাহিনী। সে বাহিনী এতই বিশাল, এতই ব্যাপক তার নেটওয়ার্ক যে সেখানে স্বামী স্ত্রীর বিরুদ্ধে, স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে, পুত্র পিতার বিরুদ্ধে, পিতা পুত্রের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করে। পার্টি বসের, এলাকর কমরেড চীফের বন্তুষ্টি অর্জন হয়ে দাঁড়ায় জীবনের সর্বপ্রধান বা একমাত্র ব্রত। তাইতো সুযোগ পেলেই তারা ছিটকে বেরিয়ে আসে প্রিয় স্বদেশ(?) হতে। এদের বিপুল সংখ্যক জীবন দিয়েছে বিত্যুতায়িত কাঁটা তারের বেড়ায়, লুটিয়ে পড়েছে পাহারারত সেন্ট্রির গুলিতে। এর পরও সারা জীবন যাদের বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রামের শিক্ষা পেয়েছে সেই শ্রেণী শত্রুর দেশে যেয়ে তারা আশ্রয় নেয়। সেই বার্লিন ওয়াল আজ আর নেই, কিন্তু তার রক্তাক্ত ক্ষত রয়ে গেছে হাজার হাজার পরিবারে। আজও রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে তারা আঁতকে ওঠে।
এর ভিন্ন একটা চিত্রও রয়েছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে যেটুকু সুযোগ এখন সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের মক্কা, মস্কো ও বেইজিং এর নাগরিকেরা অর্জন করেছে এবং তার ফলে তাদের প্রাত্যহিক জীবন আচরণে যে পরিবর্তন এসেছে তা অভাবিত। যত দ্রুত তারা পুঁবিাদী সভ্যতার ভোগবাদী জীবনকে গ্রহণ করেছে তা বিস্ময়কর। মেট্রোপলিস দুটোর যুবক-যুবতীরা নিউইয়র্ক শিকাগো লস এঞ্জেলস শহরের মতো ভোগ-বিলাসপূর্ণ জীবনযাপনের জন্যে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মদ জুয়া ডিসকো নাচ ক্যাবারে পপ সঙ্গীত ম্যাকডোনাল্ডের ফাস্ট ফুট সফ্ট ড্রিংক হতে শুরু কর কালোবাজারী চোরাকারবারী ও বেশ্যাবৃত্তি কোনো কিছুই বাদ নেই। পাশ্চাত্যের উদ্দাম উচ্ছৃংখল ও নৈতিকতাহীন জীবনের অন্ধ অনুকরণে তারা মেতেছে ব্যক্তি স্বাধীনতার নামেই। ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ ও শান্তিময় জীবন তাদের কাছে অজ্ঞাত। তাদের কাছে তা তুলে ধরার সুযোগ ধ্বংস করেছে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের মোড়লরাই।
ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ইসলামের দাবী খুবই যৌক্তিক। ইসলামে আল্লাহ ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দিয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত অবাধে চলাফেরার, স্বাধীনতার সকল কর্মকান্ড পরিচালনার। এক্ষেত্রে তার নিয়ন্তা হবে তারই বিবেক, তার ধ্রুবতারা হবে আল-কুরআন ও সুন্নাহ। বিবেক কখনোই মানুষকে অশুভ বা অন্যায়ের দিকে ধাবিত হতে রায় দেয় না। সেই রায় আরও সুন্দর, কল্যাণময়ী ও সমাজের জন্যে সর্বৈব মঙ্গলের হয়ে দাঁড়ায়্ যখন তা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা পরিচালিত করে তার নিজের ও সমাজের কল্যাণই নিশ্চিত করে। এখানে না আছে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ, না আছে ব্যক্তি মানুষের মনগড়া আইনে নিগড়ে বন্দী হওয়ার আশংকা। ব্যক্তি এখানে না প্রবৃত্তির দাস, না এখানে অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইসলামে ব্যক্তি স্বাধীনতা তাই একাধারে যেমন খুবই মূল্যবান তেমনিসমাজের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে তার ভূমিকা অসাধারণ।
অর্থনৈতিক দর্শন
অর্থনৈতিক দিক নির্দেশনার ক্ষেত্রেও আলোচ্য তিনটি মতবাদের মধ্যে চরম বিরোধ ও বৈপরীত্য বিদ্যমান। জড়বাদী জীবন দর্শনের অর্থনৈতিক মতাদর্শ পুরোপুরিই ভোগবাদী ও ব্যক্তির ইচ্ছা-আকাঙ্খা নির্ভর। সমাজের কল্যাণ বা রাষ্ট্রীয় মঙ্গলের প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে গৌণ। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এই ইচ্ছারও রূপান্তর ঘটেছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে কিভাবে ভূমিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ক্রমে মার্কেন্টাইলিজম, সংরক্ষণবাদ, অবাধ অর্থনীতি এবং অদুনা উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাজার অর্থনীতির নামে অবাধ ও অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরীতে রাষ্ট্রও উৎসাহ ও মদদ যুগিয়েছে। সেভাবেই তৈরী হয়েছে দেশের বিচার ও আইন কাঠামো। নিজ দেশের সম্পদ যখন পর্যাপ্ত মনে হয়নি তখন ছলে-বলে-কৌশলে অন্যের সম্পদ আহরণে তৎপর হয়েছে। কখনও এরা জোট বেধে চড়াও হয়েছে অন্যের উপর, কখনও বা একাকী প্রাকৃতিক সম্পদ ও কাঁচামাল লুটে নিয়েছে। শুধু বাণিজ্যের নামেই পুঁজিবাদ যা করেছে ও করছে তা নজীরবিহীন। ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর স্বার্থেই গড়ে উঠেছে World Bank। বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের জন্যে GATT, UNCTAD হতে উত্তরণ ঘটেছে WTO–তে। অসম প্রতিযোগিতা ও অসীম মুনাফার জের ধরে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। এরাই অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার পুঁজিবাদী বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠানকে এরাই কুক্ষিতগ করে রেখেছে। ফলে পূঁজিবাদী দেশগুলোয় বারবার আবির্ভাব হয়েছে মন্দার, কখনো তার রূপ হয়েছে মহামন্দার। পরিবর্তিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও তার আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয়েছে।
চরম ব্যক্তিস্বার্থপরতা, একচেটিয়া কারবার, অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জনের অভিলাষ এবং নিত্র প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনে গরুত্ব না দিয়ে বিলাস সামগ্রী উৎপাদন জোরদারের ফলশ্রুতিতে ১৯৩০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে সংঘটিত হয়েছিলো মহামন্দা (Great Depression)। একদিকে হাজার হাজার টন গম সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, ক্ষেত্রে ভুট্টা ক্ষেতেই পড়েছে, আপেল-আঙ্গুর-পীচ-কমলা গাছতলাতেই পচেছে, অন্যদিকে নিরন্ন বুভুক্ষ লক্ষ লক্ষ নর-নারী কর্মহীন উপার্জনহীন ও চরমদারিদ্র্যক্লিষ্ট অবস্থায় কাটিয়েছে। ব্যাংকের পর ব্যাং লালবাতি জ্বালিয়েছে, কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সেই গভীর সংকট হতে উত্তরণের জন্যে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হয়েছে, পুঁজি বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। অসহায় শ্রমিকদের বাঁচাবার জন্যে ভাতা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
সুদ পুঁজিবাদের জীয়নকাঠি। সুদের মাধ্যমেই তার সকল লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু যে অপরিমেয় ক্ষতি করে সুদ তা পুষিয়ে নেবার বা তার প্রতিবিধানের কোন উপায় নেই এই অর্থনীতিতে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান উৎপাদন, বন্টন, ভোগ, মুনাফা সকল কিচুরই নেপথ্যে নির্ণয়াক ও নির্ধারক শক্তি সুদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে রাষ্ট্র সুদের হার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও তা সব সময়ে ফলপ্রসু হয় না। এর পরিণাম ফলও সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আসে না। নয়া অর্থনৈতিক মতবাদ বা কল্যাণ অর্থনীতির কথা বললেও মিল্টন ফ্রীডম্যান, ম্যাক্স ওয়েবার, গুনার মিরডাল, পল এন্থনী স্যামুয়েলসন, ডাবলিউ, ডাবলিউ, রস্টো, আর্থার লুইস, টি. ডাবলিউ সুলজ, সাইমন কুজনেটস, জন কেনেথ গলব্রেথ অথবা অমর্ত্য সেন-কেউই পুঁজিবাদের অশুভ চক্রের খপ্পর হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বরং সকলেই একে ঘষে-মেজে নাট-বল্টু পাল্টিয়ে প্রকারান্তরে এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছেন। একজনের ভুল প্রেসক্রিপসন অন্যজন শুধরে দিয়েছেন। ফন হায়েক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারী হস্তক্ষেপের ঘোরতর বিরোধিতা করলেও কেইনস, গলব্রেথরা এগিয়ে এসেছেন সরকারের হাতকেই শক্ত করতে। পুঁজিবাদের রেলগাড়ী লাইনচ্যুত হয়ে গেলে তাকে আবার লাইনে তুলে দিয়ে সচল করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে অবস্থান সমাজতন্ত্রের কঠোর নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি। এর অপর নাম কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি (Centrally Planned Economy)। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তির পরিবর্তে রাষ্ট্রই সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বলাই হয়ে থাকে, প্রলেতারিয়েতদের জন্যে নতুন অর্থনীতি বিনির্মাণ করা দরকার। আসলেই প্রলেতারিয়েতদের নিজেদের শ্রম চাড়া বিক্রির জন্যে কিচুই থাকে না। কারণ অন্য সব কিছুই ইতিমধ্যে পার্টির দখলে চলে গেছে। তাই প্রকৃত অর্থেই তারা এখন সর্বহারা। সর্বহারা রাষ্ট্রের নামে পার্টির পক্ষে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় কোনো দ্রব্য কি পরিমাণে কোথায় কখন এবং কিভাবে উৎপন্ন হবে। একইভাবে উৎপাদিত দ্রব্য কত মূল্যে কতখানি কোন্ জায়গায় কার মাধ্যমে বিক্রি হবে সে সিদ্ধান্তও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের। প্রলেতারিয়েতরা এবং পার্টির কমরেড ডিরেক্টর ও পলিটবুরোর সদস্যরা কতখানি ভোগ করতে তারও সিদ্ধান্ত দেয় সরকারই। দুর্ভাগ্যের বিষয়, অসকার লাঙ্গে বা জাঁ টিনবার্জেনের মতো অর্থনীতিবিদদের হাতেও এর পূর্ণতা আসেনি। খোলা বাজারে চাহিদা ও যোগানের পারস্পরিক ক্রিয়া-পতিক্রিয়ার পরিবর্তে সমাজতন্ত্রে মূল্য নির্ধারিত হয়ে আসছে Trial and Error প্রক্রিয়ায়। ফলে কোন দ্রব্যের সঠিক বা উচিৎ মূল্য কি হবে সে বিসয়ে সমাজতন্ত্র কোন সর্বসম্মত সমাধান নেই। বাজারে অর্থনীতির পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি তথা পরিকল্পিত অর্থনীতি এবং ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা সমাজতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
এই অবস্থা কিছুতেই কাঙ্খিত হতে পারে না। এতে জনগণের সার্বিক কল্যাণ অর্জিত হতে পারে না, পারেও নি। সোভিয়েত রাশিয়ার সুবিখ্যাত সিজার্স ক্রাইসিস কিংম্বা চীনের গ্রেট লীপ ফরওয়ার্ড-এর নেপথ্যে কাহিনী যারা জানেন তাদের বিস্তারিত করে বলার দরকার নেই। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের নামে কৃষি জমি জবরদখলের পর যখন দেখা গেল উৎপাদনের পরিমাণ বিপ্লব পূর্বকালের চেয়ে হ্রাস পেয়েছে, সৈন্য দিয়ে গ্রাম থেকে খাদ্য ছিনিয়ে এনেও শহরের অভাব পূরণ হচ্ছে না, লাল ফিতা ও পদক উপহার দিয়েও কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা যাচ্ছে না, বরং লাশের স্তূপ বাড়ছেই তখন কিচেন গার্ডেনের নামে ব্যক্তিগত খামার গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়া হলো। চীন রাশিয়া যুগোশ্লোভিয়া কিউবা পোল্যান্ড হাঙ্গেরী- কোনো দেশই এর ব্যতিক্রম নয়। আসলেই মানুষের স্বভাবধর্ম বা ফিতরারতকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করে যাই-ই তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই-ই পরিণামে বুমেরাং হয়ে আঘাত করেছে উদ্যোক্তাদেরকেই।
ইসলামের অবস্থান এ দুয়ের মাঝামাঝি। ইসলাম ব্যক্তিগত উদ্যোগকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়নি আবার তার পায়ে শিকল পরিয়ে বেঁধেও রাখেনি। বরং হিসবাহ ও হিজর-েএর দ্বারা ইসলামী সরকার ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নজরদারী করে; শরীয়াহর সীমা লংঘনকারীকে শাস্তি দেয়। ব্যক্তিকে শরীয়াহ অনুমোদিত উপায় অনুসরণ করে শরীয়াহর সীমার মধ্যেই উপায়-উপার্জন করতে এবং ভোগ ও ব্যয়কে সীমিত রাখতে বলে। রাষ্ট্র এখানে না Laissez Faire নীতি অবলম্বন করে, না এই অর্থনীতির কর্মকান্ড Command নির্ভর, অর্থাৎ পুরোপুরি কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত। সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্য অর্জন এই অর্থনীতি তথা জীবনদর্শনের অন্যতম দাবী। ব্যক্তির উৎপাদন ও উপার্জনের অধিকার এখানে স্বীকৃত। যাকাত ও উশর আদায় ছাড়াও ইনফাক ফি সাবিল আল্লাহ এই অর্থনীতির অন্যতম ভিত। সর্বক্ষেত্রে হালাল উপার্জন ও হারাম বর্জন পরিমিতির এই অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া আল-কুরআনে বলা হয়েছে- সম্পদ যেন কেবল তোমাদরে ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়। আরও বলা হয়েছে- সম্পদশালীদের ধন-সম্পদে হক রয়েছে বঞ্চিত ও অভাবগ্রস্তদের।
৫. সম্পদের মালিকানা
সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রেও তিনটি মতাদর্শের মধ্যে ঘোরতর পার্থক্য রয়েছে। পুঁজিবাদে ব্যক্তি তার অর্জিত ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের নিরংকুশ মালিকানা ভোগ করে। এই সম্পত্তি সে ইচ্ছামতো ব্যবহার করলে তার বাধা দেবার কেউ নেই। আত্মীয়-স্বজনকে বঞ্চিত কর কুকুর-বিড়ালকে সম্পদ দিয়ে গেলেও বলার কেউ নেই। মৃতের সম্পদের ওয়ারিশ তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বা পরিবারের সবাই নয়, বরং ব্যক্তি যার নামে উইল করে যাবে বা যাকে নোমিনী করবে সম্পদ সেই পাবে। অন্যথায় পাবে জীবিত জ্যেষ্ঠ পুত্র বা কন্যা। এ ব্যবস্থা ইনসাফ ও ইহসানের বরখেলাপ।
সমাজতন্ত্রে সম্পদের উপর ব্যক্তির স্থায়ী মালিকানা ও উত্তরাধিকারিত্বের স্বীকৃতি নেই। সে যা ভোগ করছে তার মৃত্যুর পর সবই পুনরায় রাষ্ট্রের মালিকনায় চলে যাবে। তার স্ত্রী-পরিজনসরা রাষ্ট্রের আনুকুল্য লাভের জন্যে নতুন করে আবেদন জানাবে এ ব্যবস্থা মানবতা তথা ইনসাফ ও ইহসানবিরোধী। কৃষি জমির মালিকানার ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ঠেকে ঠেকে কিছু ছাড় দিলেও ঘর-বাড়ী বা অন্যান্য সম্পত্তির ক্ষেত্রে সেই ছাড় প্রযোজ্য নয়। অবশ্য সমাজতন্ত্রের পতনের পর এখন রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোয় ব্যক্তিগত উদ্যোগেই স্বাধীন ব্যবসা করা যায়। হোটেল চালানো যায়। ব্যাংক ব্যালেন্সের মালিক হওয়া যায়, বাড়ি-ঘঞরের মালিকও হওয়া যায়। চীনেও এখন একই অবস্থা বিরাজমান। সেখানে এখন দ্রুত শিল্পপতি গড়ে উঠছে, ব্যবসায়ের বিত্তে কোটিপতি তৈরী হচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থায় ফিরে আসার জন্যে অগণিত মানুষকে জানমালের কি বিপুল খেসারতই না দিতে হয়েছে।
ইসলামে ব্যক্তি মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের জিম্মাদার বা ট্রাস্টি। সে এই সম্পদ ভোগ-দখল করতে পারবে, ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু তার অপচয়ং ও অপব্যবহার করতে পারবে না। উপরন্তু তার মৃত্যুর সাথে সাথেই তা বন্টিত হয়ে যাবে তার ওয়ারিশদের মধ্যে। অবশ্য ঋণ রেখে মারা গেলে তা সবার আগে পরিশোধিতব্য। ব্যক্তি ইচ্ছা করলে স্বজনদের মধ্যে বিশেষ কাউকেও সম্পত্তির অংশবিশেষ দান করতেও পারবে, তবে কোনক্রমেই এক-তৃতীয়াংশের বেশী নয়। ব্যক্তি এখানে সম্পদের নিরংকুশ মালিক নয়, সে ব্যবহারকারী মাত্র। এই ধ্যান-ধারণা বা বোধ-বিশ্বাস জাগ্রত করা ও বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানোই ইসলামী জীবনাদর্শের লক্ষ্য দুনিয়াজোড়ে যে জানাজানি ও রক্তপাত তার অধিকাংশের মূলে রয়েছে সম্পত্তির মালিকানা ও দখল নিয়ে বিবাদ-বিসম্পাদ, সীমানা নিয়ে বিরোধ। সম্পত্তি নারীর অধিকারের স্বীকৃতি ইসলামের অনন্য অবদান। নারী শুধু তার পিতার সম্পত্তিরই অংশ পায় না, বিবাহিতা নারী স্বামীর সম্পত্তিরও অংশীদার। উপরন্তু সমাজসেবা ও জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে সম্পত্তি ওয়াক্ফ করারও বিধান রয়েছে ইসলামে। জায়গাজমি ভোগ-দখলের অধিকার ও স্বাধীনতা না থাকলে যেমন উৎপাদন বাড়ে না, সমাজের অগ্রগতি ঘটে না তেমনি অবাধ, অসীম ও নিরংকুশ মালিকানা লাভের উদগ্র লালসা সমাজে রক্তপাত, জিঘাংসা ও সংঘাতকে অনিবার্য করে তোলে। ইসলাম এর প্রতিবিধানের জন্যেই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে; সম্পত্তির মালিকানা, বন্টন ও উত্তরাধিকারিত্বের ক্ষেত্রে আদল ও ইহসানের যৌথ নীতি গ্রহণ করেছে।
৬. চিন্তার স্বাধীনতা
সমাজের অগ্রগতি ও শ্রীবৃদ্ধির জন্যে চিন্তার স্বাধীনতা ও বিকাশের সুযোগ থাকা অপরিহার্য। আল্লাহ নিজেই বারংবার আল-কুরআনে আহ্বান জানিয়েছেন তার সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনার জন্যে, গবেষণার জন্যে। চিন্তাশীলদের আল্লাহ পছন্দ করেন। চিন্তার ক্ষেত্রে চাই বিবেকের শাসন, সামাজিক কল্যাণ ও মঙ্গলের দৃষ্টিভঙ্গি, সর্বোপরি সুস্থ মানসিকতা। পুঁজিবাদের ইতিহাসে চিন্তহার স্বাধীনতার নামে যা ইচ্ছা বলার অবারিত সুযোগ রয়েছে, সমাজতন্ত্রে রয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। সেখানে রাষ্ট্র, সরকার, পার্টি এবং সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের দর্শন নিয়ে কটুক্তি দূরে থাক, বিন্দুমাত্র সমালোচনাও সহ্য করা হয় না। সমালোচার পুরস্কার বাধ্যতামূলক শ্রমশিবির বা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী জীবন যাপন অথবা কারো অন্তরালে অনির্দিষ্টকালের জন্যে অন্তরীণ হওয়া। খুবই সৌভাগ্যবান হলে দেশের বাইরে নির্বাসিত হওয়ার দুর্লভ সুযোগ জোটে। কিন্তু সবাই সোলঝেনিৎসিন হওয়ার ভাগ্য নিয়ে আসে না। কারাজীবন হতে মুক্তির জন্যে আন্দ্রে শাখারভের মতো সৌভাগ্র সকলের হয় না। চিন্তার পার্থক্রের কারণেই নোবেল পুরস্কার পেয়েও প্রত্যাখ্যান করতে হয় বোরিস পাস্তারনাকের মতো সাহিত্যকদের। এর উল্টো চিত্রও আছে। সমাজতন্ত্রের বন্দনা করে গুণগান গাইলে, মহান লেলিন-স্ট্যালিন-ক্রুশ্চেভের জয়গাঁথা রচনা করলে, কুলাক বা গুলাগ নিধন ও বাশকিরীদের উচ্ছেদকে স্বাগত জানালে, চেচেন-ইংগুশদের ধ্বংস কামনা করলে, তুর্কী তাতারদের ভিটেমাটি হতে উচ্ছেদ সমাজতন্ত্রেরই মহান দায়িত্ব বলে সংগতি রচনা করলে অর্ডার অব লেলিনসহ নানা রাষ্ট্রীয় ভূষণ ও সম্মান তার পায়ে লুটোয়। অ-কবিও রাতারাতি সেরা কবি হয়ে যায়।
চিন্তার স্বাধীনতার নামে পুঁজিবাদী বিশ্বে যেভাবে ইসলাম বিরোধিতার প্রশ্রয় দেওয়া হয় সেভাবে তার নিজেদের ধর্ম-খ্রীষ্টধর্মকে সমালোচিত হতে দেয় না। খোদ ইংল্যান্ডে খ্রীষ্টধর্মও যীশুখ্রীষ্টকে নিয়ে ব্যঙ্গচিদ্রুপ বা তীক্ষ্ম সমালোচনা সে দেশের ব্লাসফেমী আইনে ফঅঁসির মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেদেশেই ইসলামের জীবন দর্শন ও পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নবী মুহাম্মদের (স) জীবন নিয়ে স্যাটানিক ভার্সেস লিখলে মুরতাদ রুশদীর শাস্তি তো হয়ই না, বরং পুরস্কারে পাশাপাশি সরকারী নিরাপত্তা বা হেফাজত লাভের সৌভাগ্য জোটে। আল-কুরআনে শাশ্বত বিধানের অশোভন ও অরুচিকর সমালোচনা করলে, মুসলিম জীবনে মসীলিপ্ত ব্যঙ্গচিত্র আঁকালে বিদেশের সাহিত্য পুরষ্কার জোটে, জোটে বিদেশের ইসলাম বিরোধীচক্রের সাদর আমন্ত্রণ, অভ্যর্থনা ও আশ্রয়। সে সম্মান হতে বাংলাদেশী ললনাও বঞ্চিত নয়।
অপরপক্ষে চিন্তার স্বাধীনতার কথা সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। স্বাধীন চিন্তা দূরে থাক, ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা দূরে থাক, লেনিন স্ট্যালিন ক্রশ্চেভ ব্রেঝনেভ অথবা মাও ঝে দং, লিন পিয়াও, দেং জিয়াও পিং বা কিম লি সুং এর জীবননিয়ে বেফাঁস কথা বললে দশ বছর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কাটানো মোটেই বিচিত্র নয়। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদে পরিবর্তন যা এসেছে তা সেদেশের জনগণ বা বুদ্ধিজীবীদের চিন্তার ফসল হিসেবে নয়। সে পরিবর্তন এসছে মুকাবিলার অসাধ্য অভ্যন্তরীণ সংকট ও অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার ও বাইরের দুনিয়ায় মিত্র অনুসন্ধানের স্বার্থে। সমাজতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে তাকে গ্রহণযোগ্র করে তোলার উদ্দেশ্যে অকম্যুনিস্ট বিশ্বের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী (যারা নব্য মার্ক্সবাদী বলে সাধারণ্যে পরিচিত) হাল আমলেবেশ লেখালেখি করে চলেছেন। এই দলে রয়েছেন অসভালদো সানকেল, সেলসো ফূর্তাদো, পল ব্যারন, আদ্রেঁ গুন্দার ফ্রাক, সামির আমিন প্রমুখ।
এর বিপরীতে ইসলামের বরাবরই সুস্থ ও গঠনমূলক চিন্তাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইজমা ও কিয়াস তথা ইজতিহাদের বিধান এই চিন্তার স্বাধীনতারই স্বীকৃতি। সমস্যা মুকাবিলায় সঠিক পন্থা উদ্ভাবনের জন্যে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বিজ্ঞানের যে সূত্র আবিষ্কারের জন্যে প্রকাশ্যে গ্যালিলিওকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিলো তার চেয়ে ঢের বেশী গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। সেজন্যে তাঁদের কিন্তু রাজদরবারে কৈফিয়ত দিতে দাঁড়াতে হয়নি। চিন্তার স্বাধীনতার সুযোগ ইসলামে অবারিত রয়েছে বলেই শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত সামাজিক পরিবর্তনের সাথে ইসলাম অনায়াসে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। আল-কুরআন বা সুন্নাহর কোথাও আধুনিক ব্যাংক বা বীমার উল্লেখ নেই। কিনতউ সেজন্যে ইসলাম বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরং অর্থয়ানের এই নতুন প্রক্রিয়াকে ইসলাম প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে আত্মস্থ করেছে। ইসলামে চিন্তার স্বাধীনতার অর্থ খোদাদ্রোহীতা বা তাগুতী শক্তির পক্খে কলম চালানো নয়। বরং ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় যা সত্য ও সুন্দর, মানবতার পক্ষে কল্যাণকর তার জন্যেই চিন্তাশীলরা কাজ করবে। বুদ্ধিজীবীরা সমাজের সচেতন লোক হিসেবে সে উদ্দেশ্যেই তাদের লেখনী পরিচালনা করবে। অন্যায় ও অসত্যকে নির্মূল করার জন্যে, সকল ইবলিসী তৎপরতার মূলোচ্ছেদের জন্যে এবং তাগুতী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মুমিনদের উদ্বুদ্ধ করার জন্যেই চিন্তার স্বাধীনতাকে কাজে লাগানো ইসলামী আচরিত ও স্বীকৃত উপায়।
৭. গণতন্ত্র বনাম প্রলেতারিয়েততন্ত্র
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালিত হয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে। রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো বলেই ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯) এত গুরুত্ব। আধুনিক গণতন্ত্রের আন্দোলন সেই থেকে দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে। যদিও রাষ্ট্রযন্ত্রকে বলা হচ্ছিল Necessary Evil বা প্রয়োজনীয় অশুভ প্রতিষ্ঠান কিন্তু রাজতন্ত্রের অত্রাচার থেকে রেহাই পাবার জন্যে সমকালীন ইউরোপে এর কোন বিকল্পও জানা ছিলো না। গ্রীক দার্শনিক পেরেক্লিস হতে শুরু করে জন লক, জন স্টুয়ার্ট মিল, জাঁ জ্যাক রুশো, টমাস জেফারসন, হ্যারল্ড জে. লাস্কি, লর্ড ব্রাসি প্রমুখ ধনতান্ত্রিক জীবনাদর্শে বিশ্বাসী দার্শনিক-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা। অপরদিকে গণতন্ত্রের যারা চুলচেরা বিশ্লেষণ ও কঠোর সমালোচনা করে একে অগ্রহণযোগ্য বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন গ্রীক দার্শনিক প্লেটো, ঐতিহাসিক লেকী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টেলি র্যাণ্ড, স্যার হেনরী মেইন, এমিল ফাগুয়ে প্রমুখ ব্যক্তিত্ব।
প্লেটো তার রিপাবলিক গ্রন্থে গণতন্ত্রকে মূর্খের শাসন বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, সমাজে বুদ্ধিমানের চেয়ে মূর্খ ও অবিবেচকের সংখ্যাই বেশী। তাই সংখ্যাধিক্যের শাসনের অর্থ এদেরই শাসন। এমিল ফাগুয়ের মতে বিজ্ঞ ও বিদগ্ধ জনেরা নির্বাচনের হট্টগোলে যেতে নারাজ। দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিয়ে ভোট ভিক্ষাতেও তারা অসমর্থ। ফলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সত্যিকার বিজ্ঞজনদের অবদান রাখার কোনোই সুযোগ নেই। টেলি ব্যাণ্ড গণতন্ত্রকে ‘শয়তানের শাসন’ ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক লেকী বলেন গণতন্ত্র কোনোক্রমেই শ্রেষ্ঠতম প্রশাসনিক ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেয় না। অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন স্যার হেনরী মেইন। উপরন্তু গণতন্ত্র শুধু অপচয়ধর্মী ব্যবস্থাই না, দুর্নীতির প্রশ্রয়দানকারীও বটে। পৃথিবীর যে কোন গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের প্রতি নজর দিলে এ সত্য সহজেই উপলব্ধি করা যাবে। গণতন্ত্রে ধনীদের প্রভাব খুব বেশী। নির্বাচনের সময় চাঁদা দিয়ে তারা দলের নেতাদের হাত করে এবং পরবর্তীতে তাদের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করতে বাধ্য করে। বিপুল অরথ ব্যয়ে নিরন্তর প্রচারণা ও ক্ষেত্র বিশেষে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে পছন্দসই লোককে ভোট দিতে সাধারণ ভোটারদের উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করে। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল অংকের চাঁদা দেয় যেন বিজয়ী দল তাদের স্বার্থবিরোধী কোন পদক্ষেপ নিতে না পারে। নির্বাচনে বিজয়ী দল তাদের সমর্থকদের মধ্যে ঠিকাদারীর কাজ, লাইসেন্স, পারমিট ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিতরণ করে। ফলে সরকারী তহবিলের পুরোটাই ব্যবহৃত হয় দলীয় স্বার্থে। সাধারণ জনগণের এখানে ঠাঁই কোথায়?
এতসব অসংগতি ও ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও পুঁজিবাদী দেশগুলো বিশ্বের কাছে তাদের আচরিত গণতন্ত্রকে গ্রহণ করতে এবং সেটিই যে শ্রেষ্ঠ তা প্রমাণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টিতে আব্রাহাম লিংকনের প্রদত্ত সংজ্ঞার সরকারই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ধারক ও বাহক। কারণ সে সরকার হলো জনগণের দ্বারা জনগণের জন্যে জনগণের সরকার (Government of the people, by the people and for the people) এই সরকারই গণতন্ত্রের সর্বোত্তম রক্ষাকবচ। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি আসলে তাই? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে ‘জনগণের ইচ্ছা’ আসলে ‘জনগণের’ও না ‘ইচ্ছা’ও না। কতিপয় নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিমান ব্যক্তির গৃহীত ও চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তই জনগণের সিদ্ধান্ত বা রায় বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে, জিতে আসা সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে। নির্বাচনী কর্মকান্ড এখন এমন এক বিশাল ব্যয়বহুল ব্যাপার যে শুধুমাত্র ধনীরাই এতে অংশ নিতে পারে। মার্ক্স যে বুর্জোয়া শ্রেণীকে তার শ্রেণী সংগ্রামের অন্যতম প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন সেই শ্রেণী শত্রুরাই নির্বাচনে দাঁড়ায়। নির্বাচনী কর্মকাণ্ড দেশব্যাপী এক বিশাল হুলস্থুল ব্যাপার। রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন হলে তো কথাই নেই। এর ব ্যয়বার বহন একা কোন প্রার্থীর পক্ষে শুধু দুঃসাধ্য নয়, দুঃস্বপ্নের শামিল। সে ব্যয়বহন করে দল। দল চাঁদা তোলে, হাজার ডলার দামের ডিনারে আমন্ত্রণ জানায় সমর্থকদের। মার্কিন মুলূকে রস পেরেট েএর মতো ধনীরাই শুধু নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। অন্যদিকে নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেও নাম প্রত্যাহার করে নেয় মিসেস এলিজাবেথ ডোলের মতো প্রার্থীরা। খবরের কাগজে প্রকাশ্য বিবৃতি দেন রিপাবলিকান দলের এই প্রার্থ- তার পর্যাপ্ত অর্থ নেই বলে নির্বাচনী যুদ্ধ হতে সরে দাঁড়ালেন। (দৈনিক ইনকিলাব, ২২ অক্টোবর, ১৯৯৯)। পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বত্রই এই একই চিত্র দেখা যাবে।
নির্বাচনে যারা জেতে তারা কি প্রকৃত অর্থেই অধিকাংশ লোকের সমর্থন পেয়ে নির্বাচিত হয়? তারা কি সত্যিকার অর্থেই সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের প্রতিনিধি? যদি তিনজন প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং একজন ৪০%, অপরজন ৩২% এবং বাকী অন্যজন ২৮% ভোট পায় তাহলে প্রথম জনই নির্বাচিত বলে স্বীকৃত হবে। তার সিদ্ধান্তই গৃহীত হবে, চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। অথচ বাস্তবতা হলো তার পেছনে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের অর্থাৎ ৬০% লোকেরই সমর্থন নেই। এই হলো গণতন্ত্রের ফাঁকি। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শাসন পরিচালনার এই পদ্ধতি না জনগণের বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম, না এখানে সৎ দক্ষ ও যোগ্য লোকের মূল্য আছে, না রয়েছে বিত্তহীনদের জন্যে কোন সুযোগ। এরপরেও যদি কোন দেশে গণতন্ত্রের েএই ভোটাভুটির মাধ্যমে এমন কোনো লোক বা দল ক্ষমতায় এসে যায় পুঁজিবাদের মোড়লদের কাছে যারা পছন্দনীয় নন তাহলে তাকে উৎখাত করা হয় অস্ত্রের মুখে। জারী করা হয় সামরিক শাসন। তখন ঐ দেশের জন্যে গণতন্ত্রের চ র্চা আর অনুমোদনযোগ্য থাকে না। আলজেরিয়া এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এ ধরনের দ্বিচারণে অভ্যস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসররা। এ জন্যেই পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের পথ ধরে বা এই প্রক্রিয়ায় মিশর লিবিয়া সিরিয়া ইরাক নাইজেরিয়া ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া বা পাকিস্তানে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ইরানে ইসলামী বিপ্লব তথা রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্রের মাধ্যমে নয়, ইসলামী জিহাদের মাধ্যমে।]
সমাজতন্ত্রে গণতনেত্রর নাম-নিশানাও থাকে না। বরং সেখানে চালু হয় একনায়কতন্ত্র যা আরও ভয়ঙ্কর, আরও বিভীসিকাময়। সমাজতন্ত্র বা কম্যুনিজমের ধ্বজাধারীরা বুর্জোয়া গণতন্ত্র উচ্ছেদের ডাক দিয়ে ‘জালিমশাহী নিপাত যাক’ শ্লোগান দিয়ে, ‘দুণিযার মজদুর এক হও’ আওয়াজ তুলে রক্তপাত, শঠতা ও ধূর্ততার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েই তাদের ভোল্ট পাল্টে ফেলে। প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারাদের নামে দখল করা ক্ষমতায় আর কেউ যেন ভাগ না বসাতে পারে সে জন্যে একদিকে যেমন চালু হয় একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ও একনায়কতন্ত্র (যেমন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে হয়েছিলো বাকশাল) তেমনি অন্যদিকে বিরোধীদের নির্মূল করার জন্যে চালানো হয় সাঁড়াশী অভিযান। পৃথিবীর কোনো সোস্যালিস্ট ও কম্যুনিষ্ট দেশে এর কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। এর বিপরীত উদাহণ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না নতুন এই শাসন ব্রবস্থার গাল ভরা নাম দেওয়া হয় সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র বা Dictatorship of the Proletariat।
গণতন্ত্র তো তদূরের কথা, সত্যিকার অর্থে গৃহযুদ্ধ ছাড়া শুধুমাত্র বিপ্লবের দ্বারা সমাজতন্ত্র কায়েম হতে পারে না। খোদ লেনিনেরই কথা হলো: “….a Socialist revolution in particular, even if there were no external war, is inconceivalble without internal war i. e., Civil war” অর্থাৎ, যদি বৈদেশিক যুদ্ধ নাও থাকে তাহলে বিশেভভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ অর্থাৎ, গৃহযুদ্ধ ছাড়া অচিন্ত্যনীয়। (Lenin, Selected Works, Russian Edition, Vol. 2, p. 278)
তিনি আরও বলেন, “…. The Soviet Socialist Democracy is in no way inconsistant with the rule and dictatorship of one person.” (Collected Works, Vol. xvii, p. 89, 1923)। অর্থাৎ, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র কোনোভাবেই একব্যক্তি ছাড়া কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা না কায়েম হতে পারে না, না তা একদণ্ড স্থায়ী হতে পারে।
এজন্যেই যে মেহনতী জনতার হাতুড়ী-শাবল-কাস্তে নিয়ে রাজপ্রাসাদের বন্ধ দুয়ার খুলেছিলো তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছিলো তাদের সাবেক জায়গাতেই। ক্ষমতার মসনদে অসীন হলো পার্টির প্রধানরাই, ক্ষমতার মালিক হলো পল্যিটব্যুরোর সদস্যরা। একবার পলিটব্যুরোর সদস্য হতে পারলে সেখান হতে সরবার আর কোন সম্ভাবনা নেই। একমাত্র গুপ্ত হত্যা বা কয়েদ ছাড়া স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তবেই এর অবসান ঘটে। মাও ঝে দং, ভ্লাদিমীর ইলিচ লেনিন, যোসেফ ব্রজ টিটো, ফিদেল কাস্ট্রো, হো চি মিন, কিম ইল সুং, যোশেফ স্ট্যালিন, লিওনিদ ব্রেঝনেভ, এনভের হোক্সা (আনোয়ার হোজা) সকলেই আমৃত্যু থাকেন কমরেড কমান্ডার, দেশের সর্বময় হর্তাকর্তা।
পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর অনেকেরই গাঁটছড়া বাধা ছিলো পুঁজিবাদের সাথে। কিন্তু পুঁজিবাদের শোষণ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পর (বৃটেন কর্তৃক মিশরে সুয়েজ খাল দখল করে রাখা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ) তারা বিকল্প আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজতে থাকে। সেই সময়েই এরা সোভিয়েত কূটনীতির খপ্পরে পড়ে। দেশে সমাজতান্ত্রিক দল গটিত হয় এবং তারাই সুকৌশলে ক্ষমতা দখল করে। কখনো বা ক্ষমতাসীন সরকার এদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় টিকে থাকে। তাই মিশর লিবিয়া সিরিয়া ইরাক প্রভৃতি মুসলিমপ্রধান দেশে ব্যক্তিজীবনে ইসলাম আচরণের সুযোগ থাকলেও সেসব দেশে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজতন্ত্রের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক দর্শন। এসব দেশে পার্টি প্রধানরাই একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। আমৃত্যু তাই ক্ষমতায় থাকেন জামাল আবদুল নাসের, আনোয়ার সাদাত, হাফিস আল-আসাদ, মুয়াম্মমের গাদ্দাফী। সাদ্দাম হোসেনরা ক্ষমতায় থাকেন গ্রেফতারীর পূর্বপর্যন্ত।
মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে খিলাফত প্রথা উৎখাত করে তুরস্কেই সবা আগে পাশ্চাত্য ধাঁচের গণতন্ত্র প্রবর্তিত হয়। ইসলামের দুশমন মুস্তফা কামাল পাশা এই সর্বনাশা পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সর্ববিধ উপায়ে জীবনের সকল ক্ষেত্র হতে ইসলামকে উৎখাতের জন্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। কুরআন শরীফ লেখার চেষ্টা করা হয় রোমান হরফে। মসজিদে আযান দেওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়। অধুনা হিযাব পরিধানের বিরুদ্ধে সে দেশের পার্লামেন্ট আইন তৈরী করেছে। তুরস্কের ইসলামবিরোধী রাষ্ট্রনেতাদের বড় সাধ ইউরোপ তথা পাশ্চাত্য তাকে তাদেরই একজন বলে গ্রহণ করুক। কিন্তু ময়ূরপুচআছ ধারণ করলেই দাঁড়কাক ময়ূর হয়ে যায় না। পাশ্চাত্য তাকে গ্রহণ করতে চাইছে না। কারণ শত নির্যাতন পীড়ন দলন সত্ত্বেও তুরস্কে আজও ইসলাম তার অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়েই টিকে রয়েছে।
আসলেই মানুষের মনগড়া মতবাদ কোনো কল্যাণ নেই। নেই আপামর জনসাধারণের সার্বিক স্বাধীনতা, নেই সার্বজনীনতা তথা বিশ্বজনীনতা। মানুষের তৈরী দু-দুটো ভিন্নধর্মী ও বিপরীতমুখী রাষ্ট্রদর্শনের যাঁতাকলে পরে অগণিত মানুষের নিষ্পিষ্ট হওয়ার কাহিনীতে ইতিহাস ভরপুর। ইসলামের পরামর্শভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা বা শুরা পদ্ধতি এ দুয়ের প্রত্যেকটির চেয়েই উত্তম ও বৈজ্ঞানক পদ্ধতি। খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন হয় হযরত আবু বকরের (রা) সময় হতে। মহান খুলাফায়ে রাশিদূনের (রা) যুগের শেষে শুরু হয় রাজতন্ত্র যা ইসলামে আদৌ কাম্য ছিলো না। অবশ্য সুলতান ও আমীররা (যাদের অনেকেই খলীফা পদবী ব্যবহার করতেন) রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে দেশের গুণীজনদরে মধ্যে থেকে লোক বাছাই করে তাদের পরামর্শ সভার সদস্য করতেন। ইসলামের দাবী হলো তাকওয়া (খোদাভীতি) ও পরহেজগারীর ভিত্তিতে সর্বোত্তম লোকেরাই হবে সরকারের পরামর্শ সভা বা শুরার সদস্য। দেশ শাসনের জন্যে আল-কুরআন ও সুন্নাহই হবে আইনের উৎস। সকল ক্ষমতা, শক্তি ও আইনের উৎস হবেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। এপথে না এগুবার কারণেই অর্থাৎ সঠিক শুরাভিত্তিক রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা না করার কারণেই মুসলিম মিল্লাতে আজ এই দশা। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রদর্শন, জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র যার অন্যতম ভিত, মুসলিম উম্মাহর জন্যে একেবারেই অনুপযুক্ত। একইভাবে অনুপযুক্ত সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের রাষ্ট্রদর্শন। মুসলমানের যথার্থ মুক্তি ও সাফল্য নিহিত রয়েছে রসূলে করীম (স) প্রদর্শিত ও প্রবর্তিত রাষ্ট্র দর্শনে। পৃথিবীর অন্য কোনো মতবাদই এর সমকক্ষ নয়, তারা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়নি।
কিন্তু সমাজতন্ত্র যেমন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা জীবন দর্শনকে মেনে নেয়নি তেমনি পশ্চিমা পুঁজিবাদী শক্তি, বিশেষতঃ তার মোড়ল গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাস্ট্র কখনই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তথা ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়নকে বরদাশত করতে রাজী নয়। বরং সুকৌশলে এর বিরোধিতার জন্যে এবং একই সঙ্গে বিশ্বজনমতকে ধোঁকা দেবার জন্যে জাতিসংঘকে তাদের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। পাশ্চাত্র শক্তি কোন মুসলিম দেশকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিতে নারাজ। বরং সবাইকে সে অনুগত গোলাম করে রাখতে চায়। সুদান লিবিয়া ইরাক ইরান তার গোলামী মেনে নেয়নি। সেজন্যে তাদের উপর অর্থনৈতিকক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আধুনিক সভ্যতার দাবীদার গোটা পাশ্চাত্য সমাজ তাতে নীরব সম্মতি জ্ঞাপন করছে।
৮. আন্তর্জাতিক
ইসলাম যে অর্থে আন্তর্জাতিক সেই অর্থে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র আন্তর্জাতিক নয়। ইসলামের রয়েছে বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গী বা উম্মাহর ধারণা। এ ধারণা অপর দুটি মতবাদে নেই। সমাজতন্ত্রে একদা যে অর্থে কমরেড শব্দ ব্যবহৃত হতো আজ সেই অর্থে শব্দটি চালু নে নেই, বরং দ্রুত বিলুপ্তির পথে। পুঁজিবাদের আন্তর্জাতিকতা প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্রবাদেরই ভদ্র খোলস। মার্কেন্টাইলিজমের সময় হতে পাশ্চাত্যের দেশগুলো বিশ্ব জুড়ে গড়ে তুলেছিলো তাদের উপনিবেশ বা কলোনী। কলোনীগুলো হতে তাদের দেশে (হোমল্যান্ড বা মাদারল্যান্ড) যেত লুট করা ধনরত্ন কাঁচামাল সস্তা শ্রম পুঁজি দাস খনিজ সামগ্রী ঠিক যেভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশ হতে ধমনী দিয়ে রক্ত চলে যায় হৃদপিন্ডে। কলোনীগুলো নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো বৃটেন ফ্রান্স স্পেন হল্যান্ড ও জার্মানীর মধ্যে। শেষ অবধি অবশ্য বৃটেনের সাম্রাজ্যই ছিলো সর্ববৃহৎ– এত বিশাল ও বিস্তৃত যে একদা এ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনই অস্তমিত হতো না। রাজনৈতিকভাবে আজ পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী দেশগুলোর উপনিবেশ নেই সত্যি, কিন্তু তাদের সাম্রাজ্যবাদী কৌশল রয়ে গেছে ঠিকই। এই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বৃহৎ ফাইন্যান্স ক্যাপিটালের মাধ্যমে। বিশ্বব্যাপী পুঁজির যোগানদার হিসেবে পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলো আজ নব্য উপনিাবেশ গড়ে তুলেছে। এদের মদদগার হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, সহায়ক শক্তি হলো বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো। এদের দোসর হয়ে কাজ করেছে এদেরই মদদপুষ্ট এনজিওগলো।
নব্য উপনিবেশবাদ তথা আন্তর্জাতিকতাবাদের আরেক রূপ হলো সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাহায্যে চালাচ্ছে তথ্যসন্ত্রাস ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বশেস প্রযুক্তি –কম্পিউটার ও স্যাটেলাইট। এসবের নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন যেমন পুঁজিবাদী গোষ্ঠী নিজেদের হাতে রেখে দিতে চাইছে তেমনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে আরও সুসংহত ও শক্তিশালী করার স্বার্থে তার বেপরোয়া ব্যবহারও করে চ লেছে। মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী আধিপত্য ও কর্তৃত্ব বহাল রাখা। এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাদের অন্যতম সমাজবিজ্ঞানী Michael Kunezik বলেন,“Cultural imperalism through communication is a vital process for securing and maintaining economic domination is a vital process for securing and maintaining economic domination and political hegemmony over others.” (Television in the Third World)। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন ও তা বহাল রাখার জন্যে যোগেোগ মাধ্যমের সহায়তায় সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডি এন্টেনার সাহায্যে পাশ্চাত্যের ধর্মবিমুখ খোদাদ্রোহী ইন্দ্রিয়পরায়ণ ভোগবাদী জীবনের সকল অনুসঙ্গই আজ মুসলমানদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে। এর বিষময় ফল ফলতে শুরু করছে। েএকারণেই পৃথিবীর অনেকদেশে ডিস এন্টেনার ব্যবহার সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করছে। বিশেষ বিশেষ ক্যাসেট ও বাজেয়াপ্ত করছে। কিনতউ তাতেও কি শেষ রক্ষা হচ্ছে?
সমাজতন্ত্র তাত্ত্বিকভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হলেও বাস্তবিকতা এ থেকে অনেক দূরে। সমাজতন্ত্র সত্যি সত্যি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে বিকাশ লাভ করতে না চাইলে তার মোড়ল সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার ওয়ারশ চুক্তি করার প্রয়োজন হতো না। প্রয়োজন হতো না নেপথ্যে থেকে বান্দুং কনফারেন্স সফলতার জন্যে সকল আয়োজন সম্পন্ন করার। হাঙ্গেরী পোল্যান্ড অষ্ট্রিয়া বা চেকোশ্লোভাকিয়াতে সমাজতনত্্র আদৌ কায়েম হতো না যদি না সোভিয়েত রাশিয়া সেসব দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালাতো। ভিয়েতনাম ও কম্পুচিয়ায় বছরের পর বছর হাজার হাজার লোক নিহত, গৃহহীন ও পঙ্গু হতো না যদি না রাশিয়া তাদের সমাজতনত্্র কায়েমের জন্যে স্বপ্ন দেখাতো, এজন্রে রসদ ও যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা না করতো। কিউবায় সোভিয়েত মদদের কথা কে না জনে? একইভাবে সমাজতন্ত্র তার দীর্ঘ বাহু বিস্তৃত করেছে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায়। পেরু বলিভিয়া চিলি নিকারাগুয়া কিংবা কঙ্গো এ্যঙ্গোলা নামিবিয়া ও ইথিওপিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, গুপ্ত হত্যা, ষড়যন্ত্র ও রক্তপাতের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরীর পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক মত ও পথ গ্রহণের নেপথ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার ভূমিকা ছিলো সর্বজনবিদিত।
ইসলাম বরাবরই আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। প্রকৃতিগতভাবেই ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীতে যুগে যুগে দেশে দেশে যখনই অত্যাচার, শোষণ পীড়নের সয়লাব বয়ে গেছে, ক্ষমতাসীনদের নির্যাতন ও কুশাসনে জনসাধারণের মধ্যে আর্তরব উঠেছে তখনিইসলাম তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশেই মুসলিম বীর সেনানীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মুক্তির দূত হিসেবে। কিন্তু কোথাও তারা সাম্রাজ্যবাদ কায়েমকরেনি, উপনিবেশ স্থাপন করেনি। বরং বিজয়ী ও বিজিত এক হয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্যে কাজ করেছে। ইসলাম পুরোপুরি আধিপত্যবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, এমনকি সংকীর্ণ জাতীযতাবাদেরও বিরোধ। বরং কিভাবে বিশ্ব মুসলিম এক উম্মাহর পতাকা তলে জমাযেত হবে, কিভাবে মুসলমানরা সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করবে তাই তার লক্ষ্য। কোন জাতি বা রাষ্ট্র বিশেষকে পদানত করে রাখা, তার সম্পদের উপর লোলুপ থাবা বিস্তার কখনই মুসলমানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিলো না। প্রকৃত অর্থেই মুসলমানরা আন্তর্জাতিকবাদী। তার কাছে আরব-আযমের কোন ভেদাভেদ নেই। তার মধ্যে জাতীয়তাবাদের ভেদবুদ্ধি অনুপ্রবেশ করিয়েছে পাশ্চাত্যের সুযোগ সন্ধানী কুচক্রী মমহল। ক্ষুদ্র স্বার্থের বেড়াজালে আটকে তাকে বৃহৎ স্বার্থের বিরোধী করেছে পাশ্চাত্যের ভোগবাদী দর্শন। প্রকৃত মুমিনের শিক্ষা হতে বিচ্যুতির কারণে, আরও সঠিক করে বললে ইসলামের যথার্থ শিক্ষা করে মোহমুক্তি ঘটাতে পারলেই আবর প্রস্ফুটিত হবে তার সত্যিকার চেহারা, বিকশিত হবে তার যথার্থ চরিত্র। মানব জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই ইসলামের এই কল্যাণমুখী ভ্রাতৃত্বধর্মী আন্তর্জাতিকবাদ ও উম্মাহর ধ্যান-ধারণা গ্রহণ এখন সময়ের দাবী।
অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
উপসংহারে পৌঁছানোর পূর্বে পুঁজিবাদের অপরাপর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যও তুলে ধরা প্রয়োজন। এ সবের মধ্যে এই জীবন দর্শনে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন প্রয়াসের অনুপস্থিতির কথাই আসে সবার আগে। বৈষয়িক উন্নতিই এর একমাত্র বা চূড়ান্ত লক্ষ্য। চরম ব্যক্তি স্বার্থ ও উপযোগিতাবাদই এর আইন-কানুন বা নীতি নির্ধারণের প্রধান মানদন্ড হিসেবে কাজ করে থাকে। এ জন্যেই আইন করে এরা একবার ধূমপান নিষিদ্ধ করে পরক্ষণে সেই আইন আবার নাকচ করে। ব্যবসায়ী তথা মুনাফা লুটেরাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে বলে ধূমপান নিষিদ্ধ না করে, সিগারেট উৎপাদন বন্ধ না করে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর’ শ্লোগান সিগারেট প্যাকেটে ছাপার নির্দেশ দিয়েই সামাজিক দায়িত্ব সচেতনতার পরাকাষ্ঠা দেখায়। এখানে সম্পদ ও ক্ষমতার দাপটে মানুষ মানুষের উপর প্রভূত্ব করে। চরিত্রহীনতার সংজ্ঞা এখানে নতুন করে লেখা হচ্ছে। মানুষের স্বার্থে মানুষের মনগড়া আইন দিয়েই এই সমাজব্যবস্থা পরিচালিত বলে পুঁজিবাদী জীবনদর্শন ভারসাম্যহীন ও একদেশদর্শী।
পুঁজিবাদের বর্তমান চরিত্রকে সংক্ষেপে তুলে ধরলে যা দাঁড়ায়:
১. একক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ;
২. চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজমান (ধনী-দরিদ্রের জীবন যাপনের ব্যয়সূচক বিগত দুই দশকে ১০:১ হতে ৭০:১ এ উন্নীত);
৩. বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের ছলে বিশ্বকে শোষণের কৌশল গ্রহণ;
৪. যুগপৎ চরম দারিদ্র্য ও ভোগ-বিলাসপূর্ণ জীবন যাপন নিত্যকার দৃশ্য;
৫. গণতন্ত্রের ধোঁকা দিয়ে মুষ্টিমেয় বিত্তশালী লোকের শাসন প্রতিষ্ঠা;
৬. স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রবাহ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পুঁজিবাদী জীবনাদর্শের স্লো পয়জনিং;
৭. এনজিও কালচার পত্তনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে শোষণের বিস্তৃতি;
৮. আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল; এবং
৯. ইসলামের মুকাবিলায় সমাজতন্ত্রের সাথে অভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ
একইবাবে সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে সম্যক জানার স্বার্থে তার আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী বা কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা জীবন দর্শনের এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের অস্বীকৃতি, বেতন ও সুযোগ-সুবিধার নিদারুণ বৈষম্যের কথা বাদ দিলেও পার্টিসৃষ্ট সামাজিক বৈষম্য (রুশ প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রীপরিষদ সদস্যবৃন্দ, পলিটব্যুরোর সদস্যবৃন্দ ও জেনারেলরা বিশ্রামের জন্যে যে ডাচা-তে সময় কাটান তা সাধারণ রুশ নাগরিকের শুধু কল্পনাতীত নয় তার ধারে কাছে ঘেঁষাও অপরাধ), ধর্মহীনতাকে নৈতিকতার মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ, মানুষের উপর মানুষের অন্যায় প্রভুত্ব, রেজিমেন্টেড জীবন যাপন, সর্বোপরি অবাস্তব ও অলীক আশার বাণী শুনিয়ে ধোঁকা দেবার অভ্যাস।
সমাজতন্ত্রের মদাদুর্ভাগ্য হলো এর প্রফেট কার্ল মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়া। মার্ক্স তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীতে শুনিয়েছিলেন পুঁজিবাদী দেশে শিল্প শ্রমিকদের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হবে। ফলে তারাই সংহত হয়ে শ্রেণী সংগ্রাম করবে। বাস্তবে তা তো হয়ই নি, বরং সেসব দেশের শ্রমিকদের জীবন যাপনের মান সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী দেশের শ্রমিকদের চেয়ে ঢের বেশী উন্নত। তিনি আশা করেছিলেন মুনাফা হার ক্রমাগত হ্রাস পাবে এবং জাতীয় আয়ের মজুরীর অবদানও দ্রুত কমে আসবে। বাস্তবে ঘটেছে এর উল্টোটা। তার ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো ব্যাপক শিল্প উৎপাদনের ফলে বাজারে পণ্যের স্তূপ জমে যাবে। ফলে দেখা দেবে ব্যাপক বেকারত্ব িএবং ঘন ঘন মন্দা, ফলশ্রুতিতে নাভিঃশ্বাস উঠবে পুঁজিবাদের। সরকারী হস্তক্ষেপের ফলে, বিশেষতঃ কেইনসের উদ্ভাবিত তত্ত্ব অনুসরণের ফলে মার্ক্সের এই প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি। মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো, ইতিহাসের অমোধ নিয়মে বিবর্তনবাদের পরিণতি হিসেবেই পুঁজিবাদ তার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের কারণেই ধ্বংস হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীও সফল হয়নি। বিশ্বের বহুদেশেই পুঁজিবাদ ছিলো, আজও আছে। সেসব দেশে পুঁজিবাদের মৃত্যুঘন্টা বাজেনি। অপরদিকে যেসব দেশে রক্ষক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীরা ক্ষমতার কুক্ষিগত করেছিলো সেসব দেশে পুঁজিবাদ বলে তেমন কিছু ছিলো না। বরং তাদের সবগুলোই ছিলো সামন্তবাদী বা আধাসামন্তবাদী দেশ, শিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদী দেশ কখনই নয়।
এখানেই শেষ নয়। যে পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে এত রক্তপাত, এত শত্রুতা ও শঠতা সেই দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের আদর্শের দশা আজ এই পর্যায়ে পৌঁচেছে যে স্কোয়ারে স্কোয়ারে স্থাপিত কার্ল মার্ক্স আর লেনিনের ব্রোঞ্জের তৈরী অতিকায় মূর্তিগুলো ক্রেন দিয়ে টেনে নামানো হয়েছে। তারপর সেগুলো নীলামে চড়ানো হয়েছে অথবা ফ্যাকটরীতে নিয়ে গয়ে ফেলা হয়েছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের পতনে বিশেষ অবদান রাখার জন্যে পুরস্কৃত করা হয়েছে ছয় জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে। এদের মধ্যে রয়েছে মিখায়েল গরবাচেভ, লেস ওয়ালেসা, জর্জ বুশ, মার্গারেট থ্যাচার, হেলমুট কোহল এবং ফ্রাঁসোয়া মিতেরা। পুরস্কারটি দিয়েছেন চেক প্রেসিডেন্ট ভেক্লাব হ্যাভেল। (দৈনিক ইনকিলাব, ৪ নভেম্বর, ১৯৯৯)। নব্য মার্ক্সবাদীরা মার্ক্সবাদের এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে এর নতুন ব্যাখ্যা, নতুন প্রেক্ষিত ও সংশোধন আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই অব্যাহত সংশোধন ও পরিবর্তনের ফলে সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্র শুধু তাদের চরিত্রই হারায় নি, কঠোর বাস্তবতার মুকাবিলায় নিজেদের অস্তিত্বকেই সংকটাপন্ন করে তুলেছে।
সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের বর্তমান বৈশিষ্ট্যকে সংক্ষেপে তুলে ধরলে যা দাঁড়ায়:
১. সমাজতন্ত্রের বর্তমান গতি ক্রমাগত সংশোধনবাদের দিকে;
২. পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলো ক্রমাগত গ্রহণ (সুদ, ব্যক্তিমালিকানা, বাজার ব্যবস্থা, মুনাফা ইত্যাদি);
৩. শিল্প উৎপাদনে পুঁজিবাদী বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ;
৪. পার্টি এলিট ও জনসাধারণের মধ্যে শোষণমূলক সম্পর্ক;
৫. পীড়নমূলক, ধোঁকাপূর্ণ গোঁজামিলের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পর্যবসিত;
৬. রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি;
৭. অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য বিলুপ্ত করতে ব্যর্থ;
৮. পুঁজিবাদের সাথে সহঅবস্থানের নীতি গ্রহণ; এবং
৯. ইসলামের মুকাবিলায় পুঁজিবাদের সাথে অভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ।
এই আলোচনা শেষ করার আগে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের অন্তর্নিহিত কতকগুলো বড় বড় ত্রুটি বা গলওদ তুলে ধরা সমীচিন। তা না হলে এই আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসম্পূর্ণতা ও বিচ্যুতিগুলো উল্লেখ করা জরুরী। এ থেকে উভয় মতবাদের অপূর্ণতা ও ব্যর্থতা সম্পর্কে আরও সুষ্ঠু ধারণা জন্মাবে।
পুঁজিবাদের ত্রুটি:
১. অপচয়মূলক প্রতিযোগিতা;
২. অর্থনৈতিক অস্তিতিশীলতা ও বেকারত্ব;
৩. সম্পদের ত্রুটিপূর্ণ বন্টন;
৪. একচেটিয়া ব্যবসায়ীর উদ্ভব ও তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা সংহতকরণ;
৫. চাণিজ্য চক্রের পর্যায়ক্রমিক উপস্থিতি; এবং
৬. চরম নৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের ক্রম বিস্তৃতি।
সমাজতন্ত্রের ত্রুটি:
১. সম্পদের ভুল মালিকানা ও অসম বন্টন;
২. প্রকৃত চাহিদা নির্ধারণ ও সঠিক মূল্য নিরূপণে ব্যর্থ;
৩. ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের সুযোগ না থাকায় প্রেষণা অকার্যকর;
৪. ভোক্তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণ;
৫. কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা সত্ত্বেও কাংখিত অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যর্থ; এবং
৬. নৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ।
উপসংহার
ইসলামী জীবনাদর্শ এক কালজয়ী জীবনাদর্শ হিসাবে চলতি শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করবে এ সত্য দিবালোকের মত স্পষ্ট। মুসলমানদের উপলব্ধির আগেই এ সত্য উপলব্ধি করেছে পুঁজিবাদের সমাজবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা। এজন্যে তারা উদ্বেগকুল। তারা উপায় খুঁজজে ইসলামের এই দুর্নিবার জোয়ার প্রতিরোধের। কতকগুলো উপায় তারা উদ্ভাবন করেছেও। সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হলো যেখানেই মুসলমানদের জাগরণ শুরু হয়েছে, সেখানেই মৌলবাদের জিগির তুলে ত াকে প্রতিহত করা। তাদরে সে উদ্দেশ্য কোথাও কোথাও সাময়িকভাবে সাফল্য হয়েছে। এরা মুসলিম নেতাদের চরিত্র হননের বিশ্বব্যাপী ষড়যন্ত্রও চালিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই পুঁজিবাদের মোড়লরা সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ ও ইসলামকে একাকার করে ফেলেছৈ। পৃথিবীর সেখান যত নাশকতামূরক কাজ, ধ্বংস ও হত্যা সব কিছুরই দায়ভার চাপানো হচ্ছে ইসরামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের উপর।
ইসলামের নামে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম এদের কাছে বড়ই না পছন্দ-। পরিকল্পিতভাবে এর ধ্বংসের জন্যে যুব সমাজকে প্ররোচিত করছে ভোগ-লালসাময় জীবনের দিকে। কাশ্মীর মিন্দানাও আচেহ চেচনিয়া ইংগুশতিয়া বসনিয়া হারজেগোভিনায় পাইকারী হারে মুসরিম নিধন যজ্ঞে তারা কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে শাস্তি উদ্যোগের নামে মাসের পর মাস কালক্ষেপণ করে। রেড ক্রিসেন্টের সাহায্য ও শান্তিবাহিনী পৌঁছাতে পৌঁছাতে জনপদের পর জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আলীয়া ইজত বেগোভিচ কিংবাআসলান মাসখাদভকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্যে তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। এরই বিপরীতে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রতি বিশ্বজনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে তাদের নেতাদের নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সেখানকার খ্রীষ্টানদের জন্যে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে শান্তি স্থাপনের শর্তে ঝাঁকে ঝাঁকে বিমান বোঝাই সৈন্য ও রসদগ পাঠাতে খ্রীষ্টান বিশ্বের কোনো বিলম্ব হয় না, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এর বিরুদ্ধে কোনো ভেটো পড়ে না। অথচ অধিবাসীদের ৯০% মুসলমান হওয়ার ‘অপরাধে’ কাশ্মিরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার পঞ্চাশ বছরেরও বেশী ভূলুন্ঠিত। এশিয়ার নব্য আগ্রাসী শক্তি ভারত তাকে জবর দখল করে রাখলেও তার বিরুদ্ধে টু শব্দটি করে না বিশ্ব মোড়লরা।
পাশ্চাত্যের তথা পুঁজিবাদের দ্বিমুখী ও দ্বিচারিণী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে আণবিক বোমার ক্ষেত্রেও। যে আণবিক বোমা ফাটানোর কারণে সিটিবিটিতে স্বাক্ষর না করলে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া হবে না বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে সেই একই ‘অপরাধ’ অনেক আগেই ভারত করলেও তাকে সিটিবিটিতে স্বাক্ষর করার জন্যে নেই সে ধরনের কোনো চাপ। একই কারণে ইরাকের আণবিক প্রকল্প বোমা মেরে উড়িয়ে দিলে ইসরাইল বাহবা কুড়ায়। এখন সেই একই পায়তারা চলেছে ইরানের বিরুদ্ধে। ওসামা বিন লাদেন এদের কাছে ভয়ংকর সন্ত্রাসী। কারণ তিনি ইসলামী জীবনদর্শন বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর। অথচ তার চেয়ে সত্যিকার অর্থেই বহুগুণ বেশী সন্ত্রাসী জর্জ বুশ জুনিয়র ও দুঃশ্চরিত্র বিল ক্লিনটনের দেশে দেশে পূঁজিত ব্যক্তি। কারণ অনেকের কাছেই মার্কিন মুলুক দুনিয়ার বেহেশত হিসেবে বিবেচিত এবং এরা দুজন সেদেশেরই মহাশক্তিধর কর্ণধার। গণচীনও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। চরম পীড়ন, দলন ও দমন চলেছে জিনজিয়াং সিচুয়ান ও গানসু প্রদেশে। সেদেশে জনসংখ্যা নীতির প্রধান টার্গেট মুসলমানরাই। জিয়াং জেমিনের আমলেই ২১০ জন মুসলমান ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানো হয়েছে (দৈনিক সংগ্রাম, ৯ নভেম্বর, ১৯৯৯)। তাদের অপরাধ তারা ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারী ছিলো, ইসলামী হুকুমাতের প্রত্যাশী ছিলো।
এটাই নির্মম বাস্তবতা। কারণ আল্লাহ নিজেই বলেছেন- “আল-কুফরু মিল্লাহু ওয়াহিদাহ্।” অর্থাৎ, সমস্ত বাতিল শক্তিই এক। তাই তারা যে এক পর্যায়ে হকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, জীবনপণ করে লড়বে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বরং সেটাই নিষ্ঠুর সত্য, রূঢ় বাস্তবতা। এর মুকাবিলায় জয়ী হতে হলে, ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইলে দরকার বিশ্ব মুসলিমের সমবেত সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রয়াস। সেই প্রয়াসে কুরবানী করতে প্রস্তুত থাকতে হবে জীবনের সকল প্রিয় সম্পদকে। কারণ শাহাদতের সিঁড়ি বেয়েই আসে ফাতহুম মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয়।
শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান: সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে খুলনা জেলার জায়গীরমহলে জন্ম। বাগেরহাট টাউন হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও পি.সি. কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচ.এস.সি. পাশ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি. এ (অনার্স) (১৯৬৬) ও এম. এ (১৯৬৭) ডিগ্রী অর্জনের পর বাগেরহাট পি. সি. কলেজে অধ্যাপনা শুরু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপনায় যোগ দেন ১৯৭০ সালে, ১৯৯৭-এ প্রফেসর পদে উন্নীত হন।
সুদীর্ঘ কর্মজীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট, সিন্ডিকেট, ফাইন্যান্স কমিটি, একাডেমিক কাউন্সিল সদস্য, প্রেস প্রকাশনা ও জ নসংযোগ দপ্তর পশাসকের দায়িত্ব পালন করেছন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও ফাইন্যান্স কমিটির সদস্য ছিলেন। ছাত্র জীবনেই বক্তৃতা ও বিতর্কের পাশাপাশি জাতীয় ইংরেজী ও বাংলা দৈনিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির শুরু ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়নে তার লেখনী নিবেদিত। এ যাবৎ প্রকাশিত মৌলিক ও অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২। তার লেখা ছোটদের ইসলামী অর্থনীতি (১৯৮০) ইসলামের অর্থনৈতিক বিপ্লব (৩য় সংস্করণ ২০০৪) ইসলামী ব্যাংক কি ও কেন? (২য় সংস্করণ ১৯৮৪) ইসলামী ব্যাংক: কতিপয় ভ্রান্তি মোচন (১৯৮৬) ইসলামী অর্থনীতি : একটি প্রাথমিক বিশ্লেষণ (২য় সংস্করণ, ২০০২) বিবর্তনতত্ত্ব: ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে মূল্যায়ন (২০০০) অর্থনীতি, পুঁজিবাদ ও ইসরাম (২০০৩) অর্থনীতিতে রাসূলের (স) দশদফা (২০০৩) ইসলামী ব্যাংকিং: পেছন ফিরে দেখা (২০০৪) শীর্ষক গ্রন্থগুলো ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ৪০-এর অধিক। বাংলা একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, ইসলামিক ইকনমিকস রিসার্চ ব্যুরো ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থটসহ বেশ কয়েকটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও পেশাজীবী সংগঠনের আজীন সমস্যা। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠার পর হতেই এর শরীয়াহ কাউন্সিলের সদস্য। সেমিনার ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য পকিস্তা, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া সফল করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে দুই পুত্র ও দুই জন্যা সন্তানের জনক।
দি রাজশাহী স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন: ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ছাত্র, যুবক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো যাতে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে দ্বীনি অনুভূতি অর্জন ও ইসলামী আদর্শের গণভিত্তি রচিত হতে পারে। এর কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে: ক. ইসলামের ব্যাপক দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা, খ. উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছুক গরীব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান; গ. পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষাসহ আধুনিক জ্ঞান অর্জনে সহায়তা দান; ঘ. দুঃস্থ ও আর্ত মানবতার সেবার সার্বিক সহযোগিতা প্রদান; ঙ. ইসলামী আদর্শ তুলে ধরার জন্যে বই-পত্র ও সাময়িকী প্রকাশ এবং চ. সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান আদর্শ তুলে ধরা।