বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান
ডাঃ মরিস বুকাইলি
অনুবাদঃ ওসমান রনি
প্রকাশকের কথা
“বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান” পৃথিবীর বিখ্যাত একটি গ্রন্থ| গ্রন্থটি রচনা করেছেন ফ্রানসের প্রক্ষাত সার্জন, বৈজ্ঞানিক ও গবেষক ডাঃ মরিস বুকাইলি। ফরাসী ভাষায় রচিত তার”লা বাইবেল, লা কুরআন য়েট লা সাইন্স” নামক বই খানি সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালের মে মাসে পেরিসে প্রকাশিত হলে সঙ্গে সঙ্গে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষন করে। ইংরাজী ও আরবী সহ পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয়।
মহাগ্রন্থ আল কোরআন মানবতার ইহ ও পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের চাবিকাঠি এবং এক মাত্র নির্ভুল আসমানী কিতাব। অথচ যুগে যুগে এ সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ চেষ্টা চলেছে প্রধানত ইহুদী ও খ্রিষ্টান পন্ডিতদের দ্বারা এবং বৈজ্ঞানিকগণ কর্তৃক।
এই বইয়ে তিনি আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে পাওয়া জ্ঞানের সঙ্গে বাইবেলের বর্ণনার সঙ্গতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। বিজ্ঞানের এ চরম উৎকর্ষতার যুগে প্রকৃত সত্যকে যারা আবিষ্কার করতে চান এ বইটি তাদের প্রভূত উপকারে আসছে বিধায় দুনিয়া জোড়া বইটি ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট জনাব ওসমান গনি এ অসাধারণ গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করলে প্রথমে তা কয়েক বৎসর ধারাবাহিকভাবে মাসিক পৃথিবী পত্রিকায় ছাপা হয়। সম্প্রতি মরহুম ওসমান গনির দিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক দোয়ার মাহফিলে সুধীবৃন্দ বইটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন যে, বইটি প্রকাশিত হলে এটি মরহুমের পরকালের নাজ্জাতের উছিলা হতে পারে এবং মৃত্যুর পরও তিনি সদকায়ে জারিয়ার সওয়াবের হকদার হতে পারেন।
এ দিকটি বিবেচনায় এনে মরহুমের সুযোগ্য সন্তান এবং পরিবার বর্গ বইটি প্রকাশে সানন্দে সম্মত হলে আল কোরআন একাডেমী বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
আল কোরআন একাডেমী কোরআনের শিক্ষা ও বাণী প্রচার ও প্রসার এবং মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে তা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্শে গঠিত একটি মিশনারী সংস্থা। কোরআন কেন্দ্রীক গবেষণা এবং গবেষনার ফসল প্রকাশ ও প্রচার করাই এ সংস্থার প্রধান কাজ। ইতিমধ্যে আমাদের সহযোগিতায় প্রকাশিত হয়েছে আল কোরআন একাডেমী লন্ডনের ডাইরেক্টর হাফেজ মুনীর উদ্দীন আহমেদ রচিত”DICTIONARY OF THE HOLY QURAN”,”কোরআনের অভিধান”, আল কোরআন একাডেমী ঢাকার ডাইরেক্টর আসাদ বিন হাফিজ রচিত” আল কোরআনের বিষয় অভিধান” এবং আতা সরকারের লেখা অসাধারণ কোরআন কাহিনী”সুন্দর তুমি পবিত্রতম”।
আল কোরআন একাডেমী ঢাকা কোরআনের ওপর আরো ব্যাপক কাজ করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ইতিমধ্যে আল কোরআন একাডেমী লন্ডনের সহযোগিতায় এবং আমাদের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর”ফি জিলালিল কোরান” অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছে।
আল্লাহ যেন আমাদের সকল নেক মাকসুদ পূর্ণ করেন এবং এ গ্রন্থের লেখক, অনুবাদক, ও প্রকাশককে পরকালে নাজাতের হকদার করেন সকলের কাছে এ দোয়াই কামনা করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তার কালাম জানা, বুঝা ও সেই অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দিন।
আমীন।
ভুমিকা
তৌহিদবাদী তিনটি ধর্মেরই নিজস্ব গ্রন্থ আছে। ইহুদী হোক, খৃস্টান হোক, মুসলমান হোক, ঐ গ্রন্থই হচ্ছে তার ঈমানের বুনিয়াদ। তাদের সকলের কাছেই তাদের নিজ নিজ গ্রন্থ হচ্ছে আসমানী কালামের লিখিত রূপ। হযরত ইব্রাহীম ও হজরত মুসার কাছে ওই কালাম সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। আর হজরত ঈসা ও হজরত মুহাম্মদ (স:) এর কাছে এসেছে অপরের মারফত। হজরত ঈসা বলেছেন, তিনি তার পিতার নাম কথা বলেছেন। আর হজরত মুহাম্মদ (স:) যে কালাম প্রচার করেছেন, তা তিনি পেয়েছেন আল্লাহর কাছ থেকে ফেরেশতা জিব্রাইলের মারফত।
ঐতিহাসিক তথ্যের নিরিখে বিচার করলে দেখা যায়, ওল্ড টেস্টামেন্ট, গসপেল, এবং কুরআন একই শ্রেণীভুক্ত। অর্থাত আসমানী কালামের লিখিত সংকলন। মুসলমানগণ এ মতবাদে বিশ্বাস করে। কিন্তু প্রধানত ইহুদী-খৃস্টান প্রভাবে প্রভাবান্বিত পাশ্চাত্যের অধিবাসীগণ কুরআনকে আসমানী কালামের মর্যাদা দিতে চায় না।
এক ধর্মের লোকেরা ওপর দুই ধর্মের গ্রন্থ সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করে থাকে তা বিবেচনা করা হলে পাশ্চাত্যের ঐ মতবাদের একটি ব্যাখ্যা সম্ভবত পাওয়া যেতে পারে।
ইহুদীদের আসমানী গ্রন্থ হচ্ছে হিব্রু বাইবেল। খৃস্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্টের সঙ্গে তার পার্থক্য হচ্ছে এই যে, ওল্ড টেস্টামেন্টে এমন কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে, যা হিব্রু বাইবেলে ছিল না। এ পার্থক্য অবশ্য কার্যক্ষেত্রে তেমন কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করে না। কেননা ইহুদীগণ তাদের নিজেদের কিতাবের পর আর কোন গ্রন্থ নাযিল হয়েছে বলে স্বীকার করে।
খ্রিস্টানগণ হিব্রু বাইবেলকে নিজেদের গ্রন্থ বলে মেনে নিয়েছে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে আর ও কিছু যোগ করে নিয়েছে। তবে হজরত ঈসার বাণী প্রচারের উদ্দেশ্শে লিখিত ও প্রকাশিত সকল রচনাকে তারা গ্রহণ করেনি। খৃস্টান পাদ্রীগণ হজরত ঈসার জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে লিখিত অনেক গ্রন্থই বাতিল করে দিয়েছেন। নিউ টেস্টামেন্টে তারা অতি অল্পসংখ্যক রচনায় বহাল রেখেছেন। তার মধ্যে চারটি কেনোনিক গসপেলই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিস্টানগণ হজরত ঈসা এবং তার সাহাবীদের পরবর্তীকালীন কোনো আসমানী কালামই স্বীকার করে না। সুতরাং কুরআনকেও তারা আসমানী গ্রন্থ বলে স্বীকার করে না।
কুরআন হজরত ঈসার ছয়শত বছর পরে নাযিল হয়। এ কিতাবে হিব্রু বাইবেল এবং গসপেলের অনেক তথ্যই পুনর্বর্নিত হয়েছে। কারণ কুরানে তাওরাত ও গসপেল থেকে বহু উধৃতি আছে। (তাওরাত বলতে বাইবেলের প্রথম পাচখানি গ্রন্থ, অর্থাত হজরত মুসার পঞ্চকিতাব-জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভেটিকাস, নাম্বারস ও ডিউটারোনমি বুঝায়) । ‘ কুরআনের পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনার জন্য খোদ কুরআনেই মুসলমানদের উপর হুকুম আছে (সুরা-৪ আয়াত ১৩৬) । ‘ তাছাড়া আসমানী কালামে হজরত নুহ, হজরত ইব্রাহীম ও হজরত মুসার ন্যায় পয়গম্বরদের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর হজরত ঈসাকে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কারণ কুরানে এবং গসপেলে তার জন্মকে একটি অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তার মাতা মরিয়মকেও বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কুরআনের ১১ নম্বর সুরার নামকরণ তার নাম অনুসারে হওয়ায় এ বিশেষ মর্যাদার আভাস পাওয়া যায়।
ইসলামের এ সকল তথ্য সম্পর্কে পাশ্চাত্যের অধিবাসীগণ সাধারণত অবহিত নয়। কয়েক পুরুষ যাবত তাদের যেভাবে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং ইসলাম সম্পর্কে তাদের যেভাবে অজ্ঞ করে রাখা হয়েছে তা বিবেচনা করা হলে এ অবস্থা মোটেই অসাভাবিক বলে মনে হয় না। তাদের এ অজ্ঞানতার পিছনে – এমন কি বর্তমান কালেও -”মোহামেডান ধর্ম”,”মোহামেডান জাতি” প্রভিতি শব্দের ব্যাবহারের বিরাট ভুমিকা রয়েছে। এ সকল শব্দ ও বাগধারা ব্যাবহার করে তারা এমন একটি মিথ্যা ধারণা করেছে যে, এ ধর্ম বিশ্বাস (মুহাম্মদ নামক) একজন মানুষের দ্বারা প্রচলিত হয়েছে এবং আল্লাহর (খৃস্টান ধর্মীয় অর্থে) সেখানে কোন ভুমিকা নেই। পাশ্চাত্যের অনেক সুধী ও বিজ্ঞজন এখন ইসলামের দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, কিন্তু তারা ইসলামের খোদ আসমানী কালাম সম্পর্কে কোন খোজ-খবর নেন না। অথচ ঐ কালাম সম্পর্কে তাদের প্রথমেই খোজ নেয়া উচিত।
কোনো কোনো খৃস্টান মহলে মুসমানদের যে কি ঘৃণার চোখে দেখা হয় অনেকে তা আন্দাজ ও করতে পারেন না। এ ব্যাপারে আমার একটি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। একবার আমি একই বিষয়ে বাইবেল ও কুরানে বর্ণিত কাহিনীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার শ্রোতারা এমন কি সাময়িক আলোচনার জন্য ও কুরআনের কোন বর্ণনাকে ভিত্তি হিসাবে মেনে নিতে চায়নি। তাদের ধারণা কুরআন থেকে কিছু উধৃত করার অর্থই হচ্ছে খোদ শয়তানের প্রসঙ্গে অবতারণা করা।
তবে খৃস্টান জগতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বর্তমানে কিছু পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দিতীয় ভ্যাটিকেন কাউন্সিলে আলোচিত বিষয়ের ভিত্তিতে ভ্যাটিকেন এর অখ্রিষ্টিয় বিষয়ক দফতর থেকে ফরাসী ভাষায় এক খানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নাম”ওরিয়েন্টেশন পোর আন ডায়ালগ এন্টার খ্রীশ্চিয়েন এত মুসলমানস” – খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তি। প্রকাশক এংকরা, রোম, তৃতীয় সংস্করণ ১৯৭০। ‘ এ গ্রন্থে খ্রিস্টানদের সরকারী মতবাদে সুদুর প্রসারী পরিবর্তনের আভাস রয়েছে।
মুসলমানদের সম্পর্কে খ্রিস্টানদের মনে”প্রাচীনকাল থেকে মীরাসী সুত্রে পাওয়া অযথা বিদ্বেষ ও বিরুপতায় বিকৃতি যে সেকেলে ধারণা রয়েছে”, তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এ দলীলে”মুসলমানদের প্রতি অতীতের অবিচার স্বীকার” করে নেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এজন্য খ্রীস্টিয় শিক্ষিত পাশ্চাত্য মনোবৃত্তিই দায়ী। মুসলমানদের অদৃষ্টবাদ, বৈধতাবোধ, গোড়ামি প্রভৃতি সম্পর্কে খ্রিস্টানদের মনে এতদিন যে ভুল ধারণা ছিল, তার সমালোচনা করে গ্রন্থে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসের উপর সবিশেষ জোর দেয়া হয়েছে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে এক সরকারী সম্মেলনে গিয়ে কার্ডিনাল করেনিগ কেরর আল আযহার মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এর বিখ্যাত মসজিদে যখন ঐ একত্বের কথা জোর দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, তখন শ্রোতাগণ কিভাবে বিস্মিত হয়েছিল। আরো স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ১৯৬৭ সালে রমজান মাসের রোজার শেষে ভ্যাটিকেন অফিস”আন্তরিক ধর্মীয় অনুভুতি সহকারে” মুসলমানদের প্রতি শুভেচ্ছা জানানোর জন্য খ্রিস্টানদের প্রতি আহবান জানিয়েছিল।
রোমান ক্যাথোলিক কিউরিয়া ও ইসলামের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্কের জন্য এ প্রাথমিক প্রচেষ্টার পর আর ও কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং উভয়ের মধ্যে মত বিনিময় ও যোগাযোগের মারফত এ সম্পর্ক গভীর করে তোলা হয়। এ ঘটনাগুলি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হলেও তেমন কোন প্রচারণা লাভ করেনি। অথচ এ সকল ঘটনা পাশ্চাত্য এ ঘটেছে এবং সেখানে সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের মত যোগাযোগের মাধ্যমের কোনই অভাব নেই।
১৯৭ সালের ২৪ এপ্রিল ভ্যাটিকানের অখৃস্টিয় দফতরের প্রেসিডেন্ট কার্ডিনাল পিগনেডোলি এক সরকারী সফরে সৌদি আরব গিয়ে বাদশাহ ফয়সলের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ খবরটি সংবাদপত্রের পাতায় কোনই গুরুত্ব লাভ করেনি। ফরাসী সংবাদপত্র লা মন্ডে ১৯৭৪ সালের ২৫ এপ্রিল মাত্র কয়েক লাইনে অতিশয় সংক্ষেপে এ সংবাদটি পরিবেশন করে। অথচ ঐ সাক্ষাত্কারে যা ঘটেছিল, তা খেয়াল করলে বুঝা যায় যে, সংবাদটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঐ সাক্ষাত্কারে কার্ডিনাল হিজ হোলিনেস পপ ষষ্ঠ পলের একটি বাণী বাদশাহ ফয়সলের খেদমতে পেশ করেন। বাণীতে হিজ হোলিনেস”এক আল্লাহর উপাসনায় ইসলামী ও খ্রিস্টান বিশ্বের ঐক্যে গভীর বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামী দুনিয়ার প্রধান হিসাবে হিজ ম্যাজেস্টি বাদশাহ ফয়সলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।”
ছয় মাস পর ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে সৌদি আরবের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একটি প্রতিনিধিদল সরকারী সফরে ভ্যাটিকেন গিয়ে পোপের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তখন সেখানে”ইসলামে মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকার” বিষয়ে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে একটি আলোচনা সভা হয়। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর ভ্যাটিকেন সংবাদপত্র”অবজারভেটর রোমানো” – র প্রথম পৃষ্ঠায় এ সভার বিবরণ বিরাট আকারে প্রকাশিত হয়। ঐ দিন ঐ একই পৃষ্ঠায় রোমে অনুষ্ঠিত বিশপদের সৈনদের সভার সমাপ্তি দিবসের বিবরণ অনেক ছোট আকারে প্রকাশিত হয়।
পরে জেনেভার গির্জাসমূহের একুমেনিকাল কাউন্সিল, এবং স্ট্রাসবর্গের লর্ড বিশপ হিজ গ্রেস এলচিন্গার সৌদি আলেমগনকে অভ্যর্থনা জানান। লর্ড বিশপ তার উপস্থিতিতে ক্যাথিড্রালের মধ্যেই জোহরের নামাজ আদায় করার জন্য তাদের অনুরোধ জানান। এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তা সম্ভবত একটি অসাভাবিক ঘটনা হিসাবে, ঘটনাটির গভীর ধর্মীয় তাৎপর্যের জন্য নয়। এ বিষয়ে যাদের প্রশ্ন করেছি তারা বলেছেন যে, ঘটনাটির ধর্মীয় তাৎপর্য সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলেন না।
ইসলাম সম্পর্কে পপ ষষ্ঠ পলের এ খোলা মন ও মানসিকতা দুই ধর্মের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতি অবশ্শই একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে। তিনি নিজেই বলেছেন যে, তিনি”এক আল্লাহর উপাসনায় ইসলামী ও খ্রিস্টান বিশ্বের ঐক্যের প্রতি গভীর বিশ্বাসে অনুপ্রানিত হয়েছেন।” মুসলমানদের সম্পর্কে ক্যাথোলিক চার্চ প্রধানের এ অনুভুতির পুনরুল্লেখ করার প্রয়োজন আছে। প্রকাশ্য বিদ্বেষের আবহাওয়ায় লালিত হওয়ায় বহু খ্রিস্টান নীতিগত ভাবে ইসলাম সম্পর্কে যে কোন আলোচনার বিরোধী। ভ্যাটিকানের ঐ দলীলে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এ কারণেই ইসলাম যে আসলে কি জিনিস সে সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ রয়েছে এবং ইসলামের আসমানী কালাম হওয়া সম্পর্কে তারা আগের মতই সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করছে।
তবুও একটি তৌহিদবাদী ধর্মের আসমানী কালামের কোন বৈশিষ্ট বিচার করার সময় ওপর দুটি ধর্মের অনুরূপ বৈশিষ্টের সঙ্গে তার তুলনা করার প্রয়োজন আছে। কোন বিষয়ের সামগ্রিক বিবেচনা একদেশদর্শী বিবেচনার চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো। তাই এ পুস্তকে তিনটি ধর্মের আসমানী কলামে বর্ণিত কতিপয় বিষয়ের তুলনামূলক আলোচনা হবে এবং তার মোকাবিলায় বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানে আবিষ্কৃত তথ্য তুলে ধরা হবে। এ প্রসঙ্গে উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিনটি ধর্মের এখন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কারণ তিনটি ধর্মই এখন সমানভাবে বস্তুবাদের হামলার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন সদ্ভাব নেই, এ ধারণা ইহুদী – খ্রিস্টান প্রভাবিত দেশের মত ইসলামী দেশেও বিশেষত বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। এ বিষয়টি সামগ্রিকভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হলে সুদীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন আছে।
এ পুস্তকে আমি বিষয়টির একটি মাত্র দিক তুলে ধরতে চাই। অর্থাত আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের আলোকে তিন ধর্মের আসমানী কালাম পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
তবে এ কাজে হাত দেয়ার আগে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে, আসমানী কালামের বর্তমান রূপ কতখানি আসল ও খাটি? এ প্রশ্নের জবাব
পেতে হলে যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে ঐ কালাম লিপিবদ্ধ হয়েছিল এবং যে পন্থায় ও প্রচারে তা আমাদের পর্যন্ত এসে পৌছেছে, তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।
পাশ্চাত্যে আসমানী কালামের পরীক্ষা নিরীক্ষা মাত্র সাম্প্রতিক কালে শুরু হয়েছে। শত শত বছর যাবত মানুষ ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেল যেভাবে পেয়েছে, সেইভাবে মেনে নিয়েছে। ঐ বাইবেল পরে তারা সমর্থন ছাড়া আর কিছুই করেনি। কারণ সামান্যতম সমালোচনাকেও তারা পাপ বলে গণ্য করেছে। পাদ্রীদের একটি সুবিধে ছিল এই যে, তারা সমগ্র বাইবেল পড়েছেন এবং অবহিত হয়েছেন। কিন্তু সাধরণ মানুষের অধিকাংশই গির্জায় গিয়ে অংশ বিশেষের পাঠ শুনেছেন মাত্র।
বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পরীক্ষায় মূল পাঠের সমালোচনা থেকে গুরুতর সমস্যার আবিষ্কার ও প্রচার হয়েছে। ফলে কোন তথাকথিত সমালোচনা পড়তে গিয়ে প্রায়ই হতাশ হতে হয়। কারণ দেখা যায় যে, মূলের ব্যাখ্যায় কোন প্রকৃত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে সমালোচক এমন কোন বাক্য বা অনুচ্ছেদ উধৃত করেছেন, যা দেখে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, তিনি আসল সমস্যা লুকাতে চেস্টা করেছেন। এ অবস্থায় বস্তুনিষ্ঠ বিচার ও যুক্তিসঙ্গত চিন্তা প্রয়োগ করলে দেখা যায় যে, অসম্ভাব্যতা এবং স্ববিরোধিতা আগের মতই বহাল রয়েছে। অথচ বাইবেলের এ ধরনের বাক্য বা অনুচ্ছেদকে সঠিক বলে দাবি করার জন্য প্রচেষ্টার অন্ত নেই।
এ প্রচেষ্টা চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী মানুষের আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। অভিজ্ঞতায় অবশ্য দেখা যায় যে, কিছু কিছু লোক এ অসম্ভাব্যতা ও স্ববিরোধিতা সনাক্ত করতে পারলেও অধিকাংশ খ্রিস্টান ধর্মীয় ব্যাপারে তাদের যুক্তি বা সঙ্গতিবোধ প্রয়োগ করে না।
ইসলাম ধর্মের কোন কোন হাদিসকে গসপেলের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। হজরত মুহাম্মদ (স:) এর কথা এবং তার কাজের বিবরণের সংকলনকে হাদিস বলা হয়ে থাকে। গসপেল ঈসার হাদীস ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কোন কোন হাদীস হজরত মুহাম্মদ (স :) এর ইন্তিকালের বহু বছর পরে লেখা হয়েছে। একইভাবে গসপেলও লেখা হয়েছে ঈসার ইন্তিকালের বহু বছর পরে। উভয় ক্ষেত্রে অতীতের ঘটনাবলির ব্যাপারে মানুষের সাক্ষ্য বিদ্যমান রয়েছে। তবে গসপেলের ব্যাপারে একটি পার্থক্য আছে। আমরা দেখতে পাব যে, চারটি ক্যনোনিক গসপেল যারা লিখেছেন, তারা তাদের বর্ণিত ঘটনাবলির চাক্ষুস সাক্ষী ছিলেন না। এ বইয়ের শেষভাগে উল্লেখিত কিছু হাদিসের ক্ষেত্রেও এ কথা।
তবে ঐ সাদৃশ্যের সমাপ্তি কিন্তু এখানেই। কারণ কোন কোন হাদিসের সত্যতা নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ গসপেলের ক্ষেত্রে গির্জার ইতিহাসের সেই গোড়ার দিকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সে সিদ্ধান্তে কেবলমাত্র চারখানি গসপেলকেই ক্যনোনিক অর্থাত সরকারী বলে ঘোষণা করা হয়। যদিও অনেক বিষয়েই ঐ চার্খানির মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে তথাপি ঐ সিদ্ধান্ত গ্রহনের পথে তা কোন বাধা হয়ে দাড়ায়নি। ঐ সিদ্ধান্তের পর অবশিষ্ট সকল গসপেল গোপন করে ফেলার হুকুম জারি করা হয়। এ কারণে তাদের বলা হয়”’এপোক্রিফা ‘” অর্থাত আসল নয়।
খ্রিস্টান ও ইসলামী গ্রন্থের আর একটি মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে : খ্রিস্টান ধর্মে কোন আসমানী এবং লিখিত গ্রন্থ নেই। ইসলামের কুরআন আসমানীও ও লিখিতও।
জিব্রাইল ফেরেশতার মারফত হজরত মুহাম্মদ (স:) এর নিকট নাযিল করা আসমানী কালামই হচ্ছে কুরআন। নাযিল হওয়ার পরপরই ঐ কালাম লিখে ফেলা হয়, মুসলমানগণ মুখস্ত করে ফেলে, এবং নামাজে, বিশেষত রমজান মাসের নামাযে তা তেলাওয়াত করে থাকেন। মুহাম্মদ (স:) নিজেই ঐ কালাম বিভিন্ন সুরায় বিভক্ত ও বিন্যস্ত করেন, এবং তার ইন্তিকালের পরই (১২ থেকে ২৪ বছরের সময়ের মধ্যে) খলিফা উসমানের শাসনকালে তা একখানি কিতাবের আকারে সংকলিত হয়। বর্তমানে আমরা যে কুরআনে দেখতে পাই, তা হচ্ছে ঐ সংকলিত গ্রন্থ। [আসলে এখানে একটু তথ্যে হেরফের হয়েছে। ১২ হি: সনে (৬৩৩ খ্রি) ইয়ামামার যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পর খলিফা আবু বকরের (রা :) নির্দেশে কুরআন শরীফ গ্রন্থাকারে সংকলন করা হয়। উসমান (রা :) তার শাসনকালে এই সংকলন্টিরই অনেকগুলি কপি তৈরী করিয়ে তা বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠান – অনুবাদক। ]
পক্ষান্তরে খ্রিস্টানদের গ্রন্থ হচ্ছে বিভিন্ন মানুষের পরোক্ষ বর্ণনার সংকলন। ঈসার জীবনের ঘটনাবলী নিজ চোখে দেখেছেন এমন কোন মানুষের বর্ণনা ওতে নেই। অথচ অনেক খৃস্টানই তাই ধারণা করে থাকেন। খৃস্টান ও ইসলামী গ্রন্থের সত্যতার বিষয়টি এখন এভাবেই ফয়সালা হয়ে গেছে।
আসমানী গ্রন্থের বর্ণনার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক তথ্যের মোকাবিলার বিষযটি সর্বদাই মানুষকে চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে।
এক সময় ধরে নেয়া হত যে, কোন আসমানী গ্রন্থকে সত্য বলে মেনে নিতে হলে বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। সেন্ট অগাস্টিন তার ৮২ নম্বর চিঠিতে এ নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে কায়েম করেন। পরে আমরা এ চিটি থেকে উধৃতি দেব। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বাইবেল ও বিজ্ঞানের মধ্যে মধ্যে গরমিল রয়েছে। তখন স্থির করা হয় যে, অমন তুলনা আর করা হবে না। ফলে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যার ফলে আমরা আজ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, বাইবেল ও বিজ্ঞান পরস্পর বিরোধী। আমরা অবশ্য এমন কোন আসমানী কালাম মেনে নিতে পারি না, যার বিবরণ ভুল ও অসত্য। এ অসামঞ্জস্যের মীমাংসা করার একটি মাত্র উপায় আছে, আর তা হচ্ছে : বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিরোধী বক্তব্য যে অনুচ্ছেদে আছে, তা সত্য বলে গ্রহণ না করা। কিন্তু এ সমাধান গ্রহণ করা হয়নি। তার বদলে বাইবেলই সত্য বলে সজোরে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে পাদ্রী বিশেষজ্ঞগণ এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যা বৈজ্ঞানিকের কাছে আদৌ গ্রহনযোগ্য নয়।
সেন্ট অগাস্টিন বাইবেল সম্পর্কে যা বলেছেন, সেই নীতিতে অবিচল থেকে ইসলাম সর্বদাই ধরে নিয়েছে যে, কুরআনের বর্ণনা বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাম্প্রতিক কালে ইসলামের অহী পুংখানুপুংখ রূপে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। কিন্তু ঐ নীতির কোন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। পরে আমরা দেখতে পাব যে, বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বহু বিষয়ের বিবরণ কুরআনে রয়েছে। বাইবেলেও আছে, তবে বিষয়ের সংখা অত বেশি নয়। বাইবেলের ঐ অল্পসংখ্যক বিষয় বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিরোধী। পক্ষান্তরে কুরআনের অধিক সংখ্যক বিষয় বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এদিক থেকে এ দুই কিতাবের মধ্যে কোন তুলনাই হতে পারে না। কুরআনের কোন তথ্যই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্বীকার করা যায় না, আমাদের গবেষণা থেকে এ মৌলিক সত্যই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এ বইয়ের শেষভাগে আমরা দেখতে পাব যে হাদীসের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। আগেই বলা হয়েছে যে, হাদিস হচ্ছে নবী মুহাম্মদ (স:) এর কথা ও কাজের বিবরণের সংকলন এবং কুরআনের অহী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। কোন কোন হাদীসের বিবরণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। সত্যতা নির্ণয়ের জন্য খোদ কুরআনে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও যুক্তি প্রয়োগের নীতি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, সে নীতির ভিত্তিতেই ঐ হাদিসগুলি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।
কোন কোন আসমানী গ্রন্থের বিবরণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার এ ব্যাপারটি আর একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। প্রথমেই খুব জোর দিয়ে বলা দরকার যে, বৈজ্ঞানিক তথ্য বলতে এখানে কেবলমাত্র সেই বৈজ্ঞানিক তথ্যের কথায় বলা হয়েছে, যা সঠিক ও সুনির্দিষ্টভাবে প্রমানিত ও গৃহীত হয়েছে। এ মূলনীতির কথা মনে রাখলে দেখা যাবে যে, যে সকল তত্ত্কথা একদা কোন বিষয় বা বস্তুর ওপর আলোকপাতের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষনার অগ্রগতির ফলে এখন আর তেমন কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, আমাদের বর্তমান বিবেচনা থেকে তা সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া হয়েছে। এখানে আমি কেবলমাত্র সেসকল তথ্যই ব্যবহার করব, যা সকল তর্ক ও বিরোধের উর্ধে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার থেকে যদিও কেবলমাত্র অসম্পূর্ণ তথ্যই পাওয়া সম্ভব, তবুও সেই অসম্পূর্ণ তথ্যও সর্বজন গৃহীত হবে যে, ভুল করার আর কোন আশংকাই থাকবে না।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, মানুষের দুনিয়ায় আগমনের কোন আনুমানিক তারিখও বৈজ্ঞানিকরা দিতে পারেন না। তবে তারা মানুষের কর্মের এমন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন, যা আমরা ঈসার জন্মের দশ হাজার বছর আগের বলে নিঃসন্দেহে মেনে নিতে পারি। সুতরাং এ বিষয়ে বাইবেলের বর্ণনাকে আমরা বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মেনে নিতে পারিনা। কারণ বাইবেলেরও জেনেসিস নামক অধ্যায়ে যে তারিখ ও বংশ-ইতিহাস দেয়া হয়েছে, তাতে মানুষের দুনিয়ায় আগমনের (অর্থাৎ আদমের সৃষ্টির) সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ঈসার জন্মের প্রায় সাইত্রিশ শত বছর আগে। আমাদের বর্তমান হিসাবের চেয়েও আরও নিখুত ও নির্ভুল তথ্য বিজ্ঞান হয়ত ভবিষ্যতে আমাদের দিতে পারবে। কিন্তু একটি বিষয় আমরা সুনিশ্চিত যে, বিজ্ঞান আমাদের কখনই বলবেনা যে, মানুষ সর্বপ্রথম ৪’৩৭৬ বছর আগে দুনিয়ায় এসেছিল। ১৯৭৫ সালের হিব্রু ক্যালেন্ডারে ঠিক ঐ কথায় বলা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের দুনিয়ায় আগমন সম্পর্কে বাইবেলের তথ্য সম্পূর্ণ ভুল।
বিজ্ঞানের সঙ্গে এ মোকাবিলা থেকে সকল প্রকার প্রকৃত ধর্মীয় ব্যাপার বাদ দেয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, আল্লাহ কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় মুসার কাছে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, বিজ্ঞানে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। কোন জৈবিক পিতা ছাড়া ঈসার জন্ম হওয়ার রহস্য সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে। কোন আসমানী গ্রন্থেও এ সকল বিষয়ের কোন বস্তুগত ব্যাখ্যা নেই। এ পুস্তকে কেবলমাত্র সে সকল বিচিত্র প্রাকৃতিক ঘটনা বিবেচনা করা হয়েছে, আসমানী গ্রন্থে যার বর্ণনা আছে এবং ছোট বড় ব্যাখ্যাও আছে। এ কথা মনে রাখলে যে বিষয়টি অতি সহজেই আমাদের নজরে পরে তা হচ্ছে এই যে, কোন একটি বিশেষ বিষয়ে কুরআনে প্রচুর তথ্য আছে এবং ঐ একই বিষয়ে ওপর দুখানি গ্রন্থে খুব কম তথ্য আছে।
আমি প্রথমে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ মন নিয়ে এবং কোনরকম পূর্ব ধারণা না নিয়েই কুরআনের অহী পরীক্ষা করি এবং আধনিক বিজ্ঞানের তথ্যের সঙ্গে কুরআনের বর্ণনার সামঞ্জস্যের দিকে নজর রাখি। কুরআনের তরজমা পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, ঐ গ্রন্থে নানা প্রকার প্রাকৃতিক ঘটনা ও বিষয়বস্তুর উল্লেখ আছে। কিন্তু এ সম্পর্কে তখন আমার কোন বিস্তারিত জ্ঞান ছিল না। তারপর আমি যখন মূল আরবী ভাষায় কুরআন পড়তে ও পরীক্ষা করতে শুরু করি, তখন ঐ সকল ঘটনা ও বিষয়বস্তুর একটি তালিকা প্রস্তুত করতে থাকি। এভাবে তালিকা প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর সাক্ষ্য প্রমান দেখে আমি স্বীকার করতে বাধ্য হই যে, কুরআনে এমন একটি বর্ণনাও নেই, আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যার বিরোধিতা করা যেতে পারে।
একই নিরপেক্ষ মনোভাব বজায় রেখে আমি ওল্ড টেস্টামেন্ট ও গসপেলের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরীক্ষা চালাই। ওল্ড টেস্টামেন্টের ক্ষেত্রে প্রথম পুস্তক জেনেসিস শেষ করার আগেই আমি দেখতে পাই যে, সেখানে এমন সব বর্ণনা রয়েছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের প্রমানিত তথ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।
তারপর গসপেলে হাত দিয়েই আমি একটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হই। প্রথম পৃষ্ঠাতেই ঈসার বংশ তালিকা রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে মথির (ম্যাথিউ) বর্ণনার সঙ্গে লুকের বর্ণনার সুস্পষ্ট গরমিল রয়েছে। আর একটি সমস্যা হচ্ছে এই যে, মানুষের প্রথম দুনিয়ায় আগমনের ব্যাপারে লুকের বর্ণনা আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সম্পূর্ণ বিরোধী।
তবে আমার মনে হয়, এ সকল গরমিল, অসম্ভাব্যতা এবং অসামঞ্জস্য থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের কোন অভাবের আভাস পাওয়া যায় না। ঐ গরমিল এর ব্যাপার থেকে মানুষের দায়িত্তহীনতারই আলামত পাওয়া যায় মাত্র। মূল পাঠে কি ছিল তা এখন আর কেউ বলতে পারেনা। একইভাবে কল্পনার ভিত্তিতে কিভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে অথবা কিভাবে অজ্ঞাতসারে অহী সংশোধন করা হয়েছে, তাও এখন আর কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে যে ব্যাপারটি এখন অতি সহজেই আমাদের নজরে পরে, তা হচ্ছে এই যে, আমরা যখন বাইবেল এর এ গরমিল ও স্ববিরোধিতা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠি, তখন বিশেষজ্ঞগণ হয় ভান করেন যে ওসব তাদের নজরে পরেনি, আর না হয় কথার মারপ্যাঁচে তারা একটি মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। জন ও মথি লিখিত গসপেলের আলোচনার সময় আমি বিশেসগ্গ্দের এ সুচতুর বাক্যজালের উদাহরণ পেশ করব। অসম্ভাব্যতা ও স্ববিরোধিতাকে তারা”সমস্যা” শব্দের আড়ালে গোপন করে থাকেন। এ”সমস্যা” লুকিয়ে ফেলার প্রচেষ্টায় তারা তারা সাধরণত সফল হয়ে থাকেন। এ কারণে বহু খ্রিস্টানই ওল্ড টেস্টামেন্ট ও গসপেলের এ সকল মারাত্মক ত্রুটি সম্পর্কে আদৌ অবহিত নন। এ বইয়ের প্রথম ও দিতীয় অধ্যায়ে পাঠক এ অবস্থার সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দেখতে পাবেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে ওহীর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের স্বাভাবিক প্রয়োগের দৃষ্টান্ত আছে। আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ জ্ঞান প্রয়োগ করে কুরআনের কয়েকটি আয়াতের অর্থ আরো ভালোভাবে উপলব্ধ করা সম্ভব হয়েছে। এ আয়াতগুলির অর্থ এতদিন অবোধ্য না হলেও রহস্যময় ছিল। এতে অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই। কারণ ইসলামের ক্ষেত্রে ধর্ম ও বিজ্ঞান সর্বদাই সহোদর বলে গণ্য হয়েছে। সেই শুরুতেই ইসলাম বিজ্ঞান চর্চার নির্দেশ দিয়েছে এবং সে নির্দেশ পালন করার ফলেই ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান এর যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়, তা থেকে রেনেসার আগে পাশ্চাত্য জগতও বিশেষভাবে লাভবান হয়। আধুনিক বিজ্ঞানীক জ্ঞান কুরআনের কোন কোন আয়াতের উপর যে আলোকপাত করেছে, তার ফলে অহী ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক মোকাবিলায় সমঝোতা ও উপলব্ধির একটি প্রসারিত দিগন্ত উন্মুক্ত হয়েছে। ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে ঐ আয়াতগুলি ইতিপূর্বে অস্পষ্ট ও অবোধগম্য ছিল।