জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি

ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান

অন্তর্গতঃ উচ্চতর অধ্যয়ন, রাজনীতি
Share on FacebookShare on Twitter

সূচীপত্র

  1. আমাদের কথা
  2. গ্রন্থাকারের ভূমিকা
  3. প্রথম খন্ড
    1. প্রথম অধ্যায়
    2. দ্বিতীয় অধ্যায়
    3. তৃতীয় অধ্যায়
    4. চতুর্থ অধ্যায়
    5. পঞ্চম অধ্যায়
  4. দ্বিতীয় খন্ড
    1. ষষ্ঠ অধ্যায়
    2. সপ্তম অধ্যায়
    3. অষ্টম অধ্যায়
    4. নবম অধ্যায়
    5. দশম অধ্যায়
  5. তৃতীয় খন্ড
    1. দ্বাদশ অধ্যায়
    2. ত্রয়োদশ অধ্যায়
    3. চতুর্দশ অধ্যায়
    4. পঞ্চদশ অধ্যায়
  6. চতুর্থ খন্ড
    1. ষোড়শ অধ্যায়

নবম অধ্যায়

ইসলামী রাষ্ট্রের উদাহরণীয় যুগ
খিলাফতে রাশেদা ও তার বৈশিষ্ট্য
আগের অধ্যায়গুলোতে ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিমালার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এবার সেই বাস্তব আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রের আদর্শিক ও ঐতিহাসিক প্রতিবেদন পেশ করা হচ্ছে, যার সূচনা করেছিলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলিইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই এবং যার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এ রাষ্ট্রটি ছিল একটি আলোর মিনার। ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানরা সবসময় এ থেকে আলো গ্রহন করে আসছে। ইসলাম শুধু একটি আদর্শ রাষ্ট্রের ধারনাই পেশ করেনি বরং সেই সাথে সেই আদর্শ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠাও করে দেখিয়েছে। একটা দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রটি তার পূর্ণ আলোকবর্তিকা নিয়ে প্রতিষ্ঠতও ছিলো। পৃথিবীকে একটি অনন্য আদর্শিক রাষ্ট্র উপহার দেবার এই অবদান কেবল ইসলামেরই। বিশ্বের অন্য কোনো আদর্শের দাবীদাররা তাদের পরিকল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র একদিন এমনকি এক মুহূর্তের জন্যও পৃথিবীকে উপহার দিতে পারেনি। এক্ষেত্রে ইসলাম অনন্য এবং একক মর্যাদার অধিকারী। – সংকলক
১. নববী যুগ
ইসলামের অভ্যুদয়ের পর যে মুসলিম সমাজ অস্তিত্ব লাভ করে এবং হিজরতের পর রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে তা যে রাষ্ট্রের রূপ গ্রহন করে, তার ভিত্তি পতিষ্ঠিত ছিল কুরআন মাজীদের রাজনৈতিক শিক্ষার উপর। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নিন্মোক্ত বৈশিষ্ট্য তাকে অন্যান্য শাসন ব্যবস্থা থেকে পৃথক করেঃ
একঃ আল্লাহর আইনের কর্তৃত্ব
এ রাষ্ট্রে প্রথম মূলনীতি ছিলো এইযে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং ঈমানদারদের শাসন হচ্ছে মূলত খিলাফত বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বশীল শাসন। কাজেই বলগাহীনভাবে কাজ করার তার কোনো অধিকার নেই। বরং আল্লাহর কিতাব ও তার রসূলের সুন্নাহর উৎস থেকে উৎসারিত আল্লাহর আইনের অধীনে কাজ করা তার অপরিহার্য কর্তব্য। কুরআন মাজীদের যেসব আয়াতে এ মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে আগের অধ্যায়ে আমরা তা উল্লেখ করেছি। তন্মধ্যে বিশেষ করে নিন্মোক্ত আয়াতগুলো এব্যাপারে একান্ত স্পষ্টঃ
সূরা নিসাঃ ৫৯, ৬৪, ৬৫, ৮০, ১০৫; আল-মায়েদাঃ ৪৪, ৪৫, ৪৭; আল-আরাফঃ ৩; ইউসুফঃ ৪০; আন-নূরঃ ৫৪, ৫৫; আল-আহযাবঃ ৩৬ এবং আল-হাশরঃ ৭।
নবী সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তার অসংখ্য বাণীতে এ মূলনীতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেনঃ
‘‘আল্লাহর কিতাব মেনে চলা তোমাদের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহর কিতাব যা হালাল করে দিয়েছে, তোমরা তাকে হালাল মানো, আর যা হারাম করেছে, তোমরা তাকে হারাম করো।’’ [কানযূল ওম্মাল, ত্বাবরানী এবং মুসনাদে আহমদের উদ্ধৃতিতে, ১ম খন্ড, হাদীস নং-৯০৭-৯৬৬; দায়েরাতুল মায়ারেফ, হায়দারাবাদ সংস্করণ ১৯৫৫]
‘‘আল্লাহ্ তায়ালা কিছু করণীয় নির্ধারন করে দিয়েছন, তোমরা তা নষ্ট করোনা, কিছু হারাম বিষয় নির্দিষ্ট করেছেন, তোমরা তাতে ঢুকে পড়োনা, কিছু সীমা নির্ধারন করেছেন, তোমরা তা অতিক্রম করোনা, ভুল না করেও কিছু ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করেছেন, তোমরা তার সন্ধানে পড়োনা। ’’ [মিশকাত, দারেকুতনীর উদ্ধৃতিতে-বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন]
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব মেনে চলে, সে দুনিয়ায় পথভ্রষ্ট হবেনা, পরকালেও হবেনা সে হতভাগা।’’[ মিশকাত, রাযীন-এর উদ্ধৃতিতে উল্লেখিত অধ্যায়।]
‘‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে থাকবে, কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা,- আল্লাহর কিতাব এবং তার রসূলের সুন্নহ।’’[ মিশকাত মুয়াত্তর উদ্ধৃতিতে, আলোচ্য অধ্যায়, কানযুল ওম্মাল, ১ম খন্ড হাদীস নং-৮৭৭, ৯৪৯, ৯৫৫, ১০০১।]
‘‘আমি তোমাদেরকে যে বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছি, তা গ্রহণ করো, আর যে বিষয় থেকে বারণ করেছি, তা থেকে তোমরা বিরত থাকো।’’[ কানযুল ওম্মাল, ১ম খন্ড, হাদীস নং-৮৮৬।]
দুইঃ সকল মানুষের প্রতি সুবিচার
দ্বিতীয় যে মূলনীতির ওপর সে রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, তা ছিলো, কুরআন সুন্নাহর দেয়া আইন সকলের জন্য সমান, রাষ্ট্রের সামান্যতম ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট পধান পর্যন্ত সকলের উপর তা সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তাতে কারো জন্য কোনো ব্যতিক্রমধর্মী আচরণের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কুরআন মাজীদে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নবীকে একথা ঘোষণা করার নির্দেশ দিচ্ছেনঃ
‘এবং তোমাদের মধ্যে সুবিচার কায়েম করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’’ [সূরা আশ শূরাঃ১৫]
অর্থাৎ পক্ষপাতমুক্ত সুবিচার নীতি অবলম্বন করার জন্য আমি আদিষ্ট ও নিয়োজিত। পক্ষপাতিত্বের নীতি অবলম্বন করে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে যাওয়া আমার কাজ নয়। সকল মানুষের সাথে আমার সমান সম্পর্ক- আর তা হচ্ছে আদল ও সুবিচারের সম্পর্ক। সত্য যার পক্ষে, আমি তার সাথী; সত্য যার বিরুদ্ধে, আমি তার বিরোধী। আমার দীনে কারো জন্য কোনো পার্থক্যমূলক ব্যবহারের অবকাশ নেই । আপন পর, ছোট বড়, শরীফ কমীনের জন্য পৃথক পৃথক অধিকার সংরক্ষিত নেই। যা সত্য তা সকলের জন্যই সত্য; যা গুনাহ, তা সকলের জন্যই গুনাহ; যা হারাম, তা সকলের জন্যই হারাম; যা হালাল, তা সকলের জন্যই হালাল; যা ফরয, তা সকলের জন্যই ফরয। আল্লাহর আইনের এ সর্বব্যাপী প্রভাব থেকে আমার নিজের সত্বাও মুক্ত নয়, নয় ব্যতিক্রম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এ মূলনীতি বর্ণনা করেছেনঃ ‘‘ তোমাদের পূর্বে যেসব উম্মত অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা এজন্য ধ্বংস হয়েছে যে, নিন্ম পর্যায়ের অপরাধীদেরকে আইন অনুযায়ী শাস্তি দান করতো, আর উচ্চ পর্যায়ের অপরাধীদেরকে ছেড়ে দিত। সে সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ নিহিত,[মুহাম্মদের আপন কন্যা] ফাতেমাও যদি চুরি করতো, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে ফেরতাম।’’[ বুখারী, কিতাবুল হুদুদ, অধ্যায়১১-১২।]
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ
‘‘আমি নিজে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আপন সত্তা থেকে প্রতিশোধ গহন করতে দেখেছি।’’[ কিতাবুল খারাজ, ইমাম আবু ইউসুফ, পৃষ্ঠা-১১৬, আল মাতবায়াতুস সলফিয়া, মিসর, ২য় সংস্করণ, ১৩৫২ হিঃ মুসনাদে আবু দাউদ]
তিনঃ মুসলমানদের মধ্যে সাম্য
এ রাষ্ট্রের তৃতীয় মূলনীতি ছিলো, বংশ, বর্ণ, ভাষা এবং দেশকাল নির্বিশেষে সকল মুসলমানের অধিকার সমান। এ রাষ্ট্রের পরিসীমায় কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, বংশ বা জাতি কোনো বিশেষ অধিকার লাভ করতে পারেনা, অন্যের মুকাবিলায় করো মর্যাদা খাটোও হতে পারেনা ।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
‘‘মুমিনরা একে অন্যের ভাই।’’ [সূরা হুজরাতঃ১০]
‘‘হে মানব মন্ডলী! এক পুরুষ এবং এক নারী থেকে আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের নানা গোত্র, নানা জাতিতে বিভক্ত করেছি, যেনো তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। মূলত আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী সন্মানার্হ, যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে ভয় করে।’’ [সূরা হুজরাতঃ ১৩]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্মোক্ত উক্তি এ মূলনীতিকে আরও স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেঃ
‘‘আল্লাহ তোমাদের চেহারা এবং ধন সম্পদের দিকে তাকাননা বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কার্যাবলীর দিকে তাকান।’’[তাফসীরে ইবনে কাসীর, মুসলিম এবং ইবনে মাজার উদ্ধৃতিতে, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-২১৭, মুস্তফা মুহাম্মাদ প্রেস, মিসর-১৯৩৭।]
‘‘মুসলমানরা ভাই ভাই । একজনের উপর অন্যজনের কোনো মর্যাদা নেই কিন্তু তাকওয়ার ভিত্তিতে।’’[ তাফসীরে ইবনে কাসীর, তিবরানীর উদ্ধৃতিতে, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-২১৭ ]
‘‘হে মানব জাতি! শোনো, তোমাদের রব এক। অনারবের উপর আরবের বা আরবের উপর অনারবের কোনো মর্যাদা নেই। সাদার ওপর কালোর বা কালোর উপর সাদারও নেই কোনো শ্রেষ্ঠত্ব। হাঁ, অবশ্য তাকওয়ার বিচারে।’’[ তাফসীরে রুহুল মায়ানী, বয়হাকী এবং ইবনে মারদুইয়ার উদ্ধৃতিতে ২৬শ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৪৮, ইদারাতুল তাবয়াতিল মুনিরিয়া, মিসর।]
‘‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, আমাদের কেবলার দিকে মুখ করে, আমাদের মতো সালাত আদায় করে, আমাদের জবাই করা জন্তু খায়, সে মুসলমান। মুসলমানের যে অধিকার, তারও সে অধিকার, মুসলমানের যে কর্তব্য, তারও সে কর্তব্য।’’[ বুখারী কিতাবুস সালাত, অধ্যায়-২৮।]
‘‘সকল মুমিনের রক্তের মর্যাদা সমান, অন্যের মুকাবিলায় তারা সবাই এক। তাদের একজন সামান্যতম ব্যক্তিও তাদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিতে পারে।’’[আবু দাউদ, কিতাবুদ দিয়াত, অধ্যায়-১ , নাসায়ী, কিতাবুন কাসামাত, অধ্যায়-১০, ১৪।]
‘‘মুসলমানদের উপর জিযিয়া আরোপ করা যেতে পারেনা।’’[ আবু দাউদ, কিতাবুল ইমারাত, অধ্যায়-৩৪।]
চারঃ সরকারের দায়িত্ব ও জবাবদিহি
এ রাষ্ট্রের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ছিল, শাসন কর্তৃত্ব এবং তার ক্ষমতা ইখতিয়ার ও অর্থ সম্পদ আল্লাহ এবং মুসলমানদের আমানত। আল্লাহভীরু, ঈমানদার এবং ন্যায়পরায়ণ লোকদের হাতে তা ন্যস্ত করতে হবে। কোনো ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামতো বা স্বার্থবুদ্ধি প্রোণোদিত হয়ে এ আমানতে খেয়ানত করার অধিকার রাখেনা। এ আমানত যাদের সোপর্দ করা হবে তারা এজন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে বলেনঃ
‘‘আমানত বহনের যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে আমানত সোপর্দ করার জন্য আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। আন যখন মানুষের মধ্যে ফায়সালা করবে ন্যায়নীতির সাথে ফায়সালা করবে আল্লাহ্ তোমাদের ভালো উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চই আল্লাহ্ সবকিছু শোনেন ও দেখেন। [সূরা নিসাঃ ৫৮]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
‘‘সাবধান! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় নেতা-যিনি সকলের উপর শাসক হন তিনিও দায়িত্বশীল তাঁকেও তাঁর সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।’’[ বুখারী, কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-১। মুসলিম কিতাবুল ইমারাত, অধ্যায়-৫।]
‘‘মুসলিম প্রজাদের কাজ করাবারের প্রধান দায়িত্বশীল কোনো শাসক যদি তাদের সাথে প্রতারণা এবং খিয়ানতকারী অবস্থায় মারা যায় তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’’[বুখারী, কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৮। মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়-৬১; কিতাবুর ইমারাত, অধ্যায়-৫।]
‘‘মুসলিম রাষ্ট্রের কোনো পদাধিকারী শাসক যে নিজের পদের দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্ঠা সাধনা করেনা, নিষ্ঠার সাথে কাজ করেনা; সে কখনো মুসলমানদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবেনা।’’[ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাত, অধ্যায়-৫।]
[নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যরকে বলেন] ‘‘আবু যর। তুমি দুর্বল মানুষ, আর সরকারের পদ মর্যাদা একটি আমানত। কিয়ামতের দিন তা লজ্জা এবং অপমানের কারণ হবে; অবশ্য তার জন্য নয়, যে পুরোপুরি তার হক আদায় করে এবং তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে।’’ [ কানযুল ওম্মাল, ষষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩৮, ১২২।]
‘‘শাসকের জন্য আপন প্রজাদের মধ্যে ব্যবসা করা সবচেয়ে নিকৃষ্ট খিয়ানত।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৭৮।]
‘‘যে ব্যক্তি আমাদের রাষ্ট্রের কোনো পদ গ্রহন করে, তার স্ত্রী না থাকলে বিবাহ করবে, খাদেম না থাকলে একজন খাদেম গ্রহন করবে, ঘর না থাকলে একখানা ঘর করে নেবে,[যাতায়াতের] বাহন না থাকলে একটা বাহন গ্রহন করবে। যে ব্যক্তি এর চেয়ে বেশী অগ্রসর হয়, সে খিয়ানতকারী অথবা চোর।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩৪৬।]
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ
‘‘যে ব্যক্তি শাসক হবে, তাকে সবচেয়ে কঠিন হিসেব দিতে হবে, আর সে সবচেয়ে কঠিন আযাবের আশংকায় পতিত হবে। আর যে ব্যক্তি শাসক হবেনা, তাকে হালকা হিসেব দিতে হবে, তার জন্য হালকা আযাবের আশংকা আছে। কারণ শাসকের দ্বারা মুসলমানদের উপর যুলুমের সম্ভবনা অনেক বেশী। আর যে ব্যক্তি মুসলমানদের উপর যুলুম করে, সে আল্লাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং ২৫০৫।]
হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ
‘‘ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি বকরীর বাচ্চা ধ্বংস হয় তবে আমার ভয় হচ্ছে, আল্লাহ আমাকে সে জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।’’[কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড হাদীস নং-২৫১২।]
পাঁচঃ শূরা বা পরামর্শ
এ রাষ্ট্রের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ছিলো মুসলমানদের পরামর্শ এবং তাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে রাষ্ট্র প্রধান নিযুক্ত হতে হবে। তাঁকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনাও করতে হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছেঃ
‘‘আর মুসলমানদের কাজকর্ম [সম্পন্ন হয়] পারস্পরিক পরামর্শক্রমে।’’[সূরা শূরাঃ ৩৮]
‘‘হে নবী! কাজ কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করো।’’[সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯]
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে আরয করি যে, আপনার পর আমাদের সামনে যদি এমন কোনে বিষয় উপস্থিত হয়, যে সম্পর্কে কুরআনে কোনো নির্দেশ না থাকে এবং আপনার কাছ থেকেও সে ব্যাপারে আমরা কিছু না শুনে থাকি, তখন আমরা কি করবো? তিনি বলেনঃ
‘‘এ ব্যাপারে দীনের জ্ঞান সম্পন্ন এবং ইবাদত গুযার ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করো এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষের রায় অনুযায়ী ফায়সালা করবেনা।’’[২২. হাদীসে ইবাদতগুযার অর্থে এমনসব ব্যক্তিদের বুঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহর বন্দেগী করে, স্বাধীনভাবে নিজের মনমতো কাজ করেনা। এ থেকে এই অর্থ গ্রহন করা ঠিক নয় যে, যাদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহন করা হবে, কেবল তাদের ইবাদতগুযারীর গুণটি দেখে নেয়া হবে; মতামত এবং পরামর্শ দানের যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়ার জন্য অন্যান্য যেসব গুনাবলী প্রয়োজন, তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হবেনা।]
হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ
‘‘মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া যে ব্যক্তি তার নিজের বা অন্য কারো নেতৃত্বের [ইমারাত] প্রতি আহবান জানায়, তাকে হত্যা না করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৭৭। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির জোর পূর্বক চেপে বসার চেষ্টা করা এক মারাত্নক অপরাধ, তা বরদাস্ত করা উম্মতের উচিত নয়।]
অপর এক বর্ণনায় হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তি বর্ণিত আছেঃ
‘‘পরামর্শ ব্যতীত কোনো খেলাফত নেই।’’[২৪. কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৩৫৪।]
ছয়ঃ ভালো কাজে আনুগত্য
৬ষ্ঠ মূলনীতি-যার ওপর এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-এই ছিল যে, কেবল মাত্র মারুফ বা ভালো কাজেই সরকারের আনুগত্য অপরিহার্য। পাপাচারে [মা’সিয়াত] আনুগত্য পাওয়ার অধিকার কারোর নেই। অন্য কথায়, এ মূলনীতির তাৎপর্য এই যে, সরকার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের কেবল সেসব নির্দেশই তাদের অধীন ব্যক্তিবর্গ এবং প্রজাবৃন্দের জন্য মেনে চলা ওয়াজিব, যা আইনানুগ। আইনের বিরুদ্ধে নির্দেশ দেয়ার তাদের কোনো অধিকার নেই; তা মেনে চলাও কারো উচিত নয়। কুরআন মাজীদে স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাইয়াত- আনুগত্যের শপথ গ্রহনকেও মারুফে আনুগত্যের শর্তে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অথচ তাঁর পক্ষে কোনো মা’সিয়াত বা পাপাচারের নির্দেশ আসার প্রশ্নই ওঠেনাঃ
‘‘এবং কোনো মারুফ কাজে তারা তোমার নাফরমানী-অবাধ্যতা করবেনা (সূরা মুমতাহানাঃ ১২)
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা বলেনঃ
‘‘একজন মুসলমানের উপর তার আমীরের আনুগত্য করা শোনা এবং মেনে চলা ফরয; তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যতক্ষণ তাকে কোনো মা’সিয়াত বা পাপাচারের নির্দেশ না দেয় হয়। মা’সিয়াতের নির্দেশ দেয়া হলে কোনো আনুগত্য নেই।’’[বুখারী কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৪ মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৮। আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়-৯৫। নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৩। ইবনে মাজা, আবওয়াবুল জিহাদ, অধ্যায়-৪০।]
‘‘আল্লাহর নাফরমানীতে কোনো আনুগত্য নেই; আনুগত্য কেবল মারুফ কাজে।’’[ মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৮ আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়-৯৫। নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৩]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন উক্তিতে বিভিন্নভাবে এ বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। কোথাও তিনি বলেছেনঃ
‘‘যে আল্লাহর নাফরমানী করে, তার জন্য কোনো আনুগত্য নেই,’’ কখনো বলেছেনঃ স্রষ্ট্রার নাফরমানীতে সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই,’’ কখনো বলেছেনঃ ‘‘যে আল্লাহর আনুগত্য করেনা তার জন্য কোনো আনুগত্য নেই, কখনো বলেছেনঃ ‘’যে শাসক তোমাকে তোমাকে কোনো মা’সিয়াতের নির্দেশ দেয়, তার আনুগত্য করোনা।’’[ কানযুল ওম্মাল ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-২৯৩, ২৯৪, ২৯৫, ২৯৬, ২৯৯, ৩০১।]
হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার এক ভাষনে বলেনঃ
‘‘যে ব্যক্তিকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের কোনো কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, কিন্তু সে লোকদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী কাজ করেনি, তার উপর আল্লাহর অভিসস্পাত।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫০৫।]
একারনেই খলীফা হওয়ার পর তিনি তাঁর প্রথম ভাষনেই ঘোষনা করেছিলেনঃ
‘‘যতক্ষণ আমি আল্লাহ এবং তার রসূলের আনুগত্য করি, তোমরা আমার আনুগত্য করো। যখন আমি আল্লাহ্ এবং তার রাসূলের অবাধ্য হবো, তখন তোমাদের উপর আমার কোনো আনুগত্য নেই।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২২২৮। অপর এক বর্ণনায় হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শব্দগুলো এইঃ আর আমি যদি আল্লাহর নাফরমানী করি, তাহলে তোমরা আমার নাফরমানী করো। কানযুল উম্মাল ৫ম খন্ড, হাদীস-২৩৩০।]
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ
‘‘আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করা এবং আমানত আদায় করে দেয়া মুসলমানদের শাসকের উপর ফরয। শাসক যখন এভাবে কাজ করে তখন তা শুনা ও মেনে চলা এবং তদেরকে আহ্বান জানালে তাতে সাড়া দেয়া লোকদের কর্তব্য।’’[ কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৩১।]
একদা তিনি তার এক ভাষণে বলেছিলেনঃ
‘‘আল্লাহর আনুগত্য করে আমি তোমাদেরকে যে নির্দেশ দেই, তা মেনে চলা তোমাদের উপর ফরয-সে নির্দেশ তোমাদের পছন্দ হোক বা না হোক। আর আল্লাহর অবাধ্য হয়ে আমি তোমাদেরকে যে নির্দেশ দেই, তাতে আল্লাহর সাথে মা,সিয়াত বা পাপাচারের ক্ষেত্রে কারো জন্য আনুগত্য নেই; আনুগত্য কেবল মারুফে, আনুগত্য কেবল মারুফে, আনুগত্য কেবল মারুফে।’’[ কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৮৭।]
সাতঃ পদমর্যাদার দাবী এবং লোভ নিষিদ্ধ
এটাও সে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিলো যে, সাধারনত রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণে পদ বিশেষত খেলাফতের জন্য সে ব্যক্তি বেশী অযোগ্যে-অনুপযুক্ত, যে নিজে পদ লাভের অভিলাষী এবং সে জন্য সচেষ্ট।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে বলেনঃ
‘‘আখেরাতের ঘর আমি তাদেরকে দেবো, যারা জমিনে নিজের মহত্ত্ব খুঁজে বেড়ায়না, বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায়না।’’ [সূরা কাসাসঃ ৮৩]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
‘‘আল্লাহর শপথ, এমন কোনো ব্যক্তিকে আমরা এ সরকারের পদ মর্যাদা দেইনা, যে তা চায় এবং তার জন্য লোভ করে।’’[বুখারী কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৭। মুসলিম কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৩।]
‘‘যে ব্যক্তি নিজে তা সন্ধান করে, আমাদের নিকট সে-ই সবচেয়ে বেশী খেয়ানতকারী।’’[ আবু দাউদ, কিতাবুল এমারাত, অধ্যায়-২]
‘‘আমরা এমন কোনো ব্যক্তিকে আমাদের সরকারী কর্মচারী হিসেবে গ্রহন করিনা, যে নিজে উক্ত পদের অভিলাষী।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড,হাদীস নং ২০৬।]
‘‘আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রাদিয়াল্লহু তায়ালা আনহুকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবদুর রহমান সরকারী পদ দাবী করোনা। কেননা চেষ্টা তদবীর করার পর যদি তা তোমাকে দেয়া হয়, তবে তোমাকে তার হাতে সঁপে দেয়া হবে, আর যদি চেষ্টা তদবীর ছাড়াই তা লাভ করো, তবে তার হক আদায় করার ব্যপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাকে সাহায্য করা হবে।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-২০৬। এখানে কারো যেন সন্দেহ না হয় যে, এটা যদি মূলনীতি হয়ে থাকে, তাহলে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম মিশরের বাদশার নিকট সরকারের পদ দাবী করলেন কেনো? মূলত হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে এ পদ দাবী করেননি, দাবী করেছিলেন এক কাফের রাষ্ট্রে কাফের সরকারের কাছে। যেখানে এক বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক সন্ধিক্ষণে তিনি উপলব্ধি করেন যে, আমি যদি বাদশার নিকট রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ দাবী করি, তবে তা পেতে পারি। আর তার মাধ্যমে এদেশে আল্লাহর দীন বিস্তার করার পথ সুগম হতে পারে। কিন্তু আমি যদি ক্ষমতার দাবী থেকে বিরত থাকি, তাহলে কাফের জাতির হিদায়াতের যে দুর্লভ সুযোগ আমি পাচ্ছি, তা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। এটা ছিল এক বিশেষ পরিস্হিতি, তার উপর ইসলামের নিয়ম আরোপ করা যায়না।]
আটঃ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ
এ রাষ্ট্রের শাসক এবং তার সরকারের সর্ব প্রথম কর্তব্য এই সাব্যস্ত হয়েছিল যে, কোনো রকম পরিবর্তন-পরিবর্ধন ছাড়াই যথাযথভাবে সে ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করবে, ইসলামের চারিত্রিক মানদন্ডানুযায়ী ভালো ও সৎ-গুণাবলীর বিকাশ এবং মন্দ ও অসৎ গুনাবলীর বিনাশ সাধন করবে। কুরআন মাজীদে এ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
‘‘[মুসলমান তারা] যাদেরকে আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, ভালো কাজের নির্দেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে বারণ করে।’’[সূরা হজ্জঃ৪১]
কুরআনের দৃষ্টিতে মুসলিম মিল্লাতের অস্তিত্বের মূল লক্ষও এটিইঃ
‘‘এমনি করে আমি তোমাদের একটি মধ্যপন্থী উম্মত [বা ভারসাম্যপূর্ণ পথে অবিচল উম্মাত] করেছি, যেনো তোমরা লোকদের উপর সাক্ষী হও আর রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর।’’[সূরা বাকারাঃ ১৪৩]
‘‘তোমরা যে সর্বোত্তম উম্মাত, মানুষের [সংশোধন এবং পথ প্রদর্শনের] জন্য যাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।’’
এতদ্ব্যতীত যে কাজের জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার পূর্বেকার সকল নবী-রাসূল আদিষ্ট ছিলেন, কুরআনের দৃষ্টিতে তা ছিলো এইঃ
‘‘দীন কায়েম করো এবং তাতে বিচ্ছিন্ন হয়োনা।’’ [সূরা শূরাঃ ১৩]
অমুসলিম বিশ্বের মুকাবিলায় তার সকল চেষ্টা সাধনাই ছিলো এ উদ্দেশ্যেঃ
‘‘দীন যেনো সর্বতোভাবে আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত হয়ে যায়।’’ (সূরা আনফাল ৩৯)
অন্যান্য সকল নবী রসূলের মতো তার ইম্মতের জন্যও আল্লাহর নির্দেশ ছিলোঃ
‘‘তারা নিজের দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর বন্দেগী করবে।’’ [সূরা বাইয়েনাঃ ৫]
এজন্য তার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম কাজ ছিলো, দীনের পরিপূর্ণ ব্যবস্থাকে কায়েম করা, তার মধ্যে এমন কোনো সংমিশ্রণ হতে না দেয়া, যা মুসলিম সমাজে দ্বিমুখী নীতি সৃষ্টি করে। এ শেষ বিষয়টি সম্পর্কে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবী এবং স্থলাভিষিক্তদের কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেনঃ
‘‘আমাদের এ দীনে যে ব্যক্তি এমন কোনো বিষয় উদ্ভাবন করবে, যা তার পর্যায়ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।’’[ মিশকাত, বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ।]
‘‘সাবধান! নব উদ্ভাবিত বিষয় থেকে বিরত থাকবে। কারণ, সকল নব উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদয়াত, আর সকল বিদয়াতই গুমরাহী, পথ ভ্রষ্ঠতার অন্তর্ভুক্ত।’’ [মিশকাত, বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ।]
‘‘যে ব্যক্তি কোনো বিদআত উদ্ভাবকের সন্মাক করে, সে ইসলামের মূলোৎপাটনে সাহায্য করে।’’[মিশকাত, বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ।]
এ প্রসংগে আমরা তাঁর এ উক্তিও দেখতে পাই যে, তিন ব্যক্তি আল্লাহর সবচেয়ে বেশী না-পছন্দ, তাদের একজন হচ্ছে সে ব্যক্তিঃ
‘‘যে ইসলামে কোনো জাহেলী রীতিনীতির প্রচলন করতে চায়।’’[ মিশকাত, বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ।]
নয়ঃ আমর বিল মারুফ ও নাহই আনিল মুনকারের অধিকার এবং কর্তব্য
এ রাষ্ট্রের সর্বশেষ মূলনীতি যা তাকে সঠিক পথে টিকিয়ে রাখার নিশ্চয়তা দেয় তা ছিলো, মুসলিম সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি সত্যবাক্য উচ্চারণ করবে, নেকী ও কল্যানের সহায়তা করবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের যেখানেই কোনো ভুল এবং অন্যায় কার্য হতে কেখবে, সেখানেই তাকে প্রতিহত করতে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা করবে। মুসলিম সমাজের প্রতিটি সদস্যের এটা শুধু অধিকারই নয়, অপরিহার্য কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদের নির্দেশ হচ্ছেঃ
‘‘নেকী এবং তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করো এবং গুনাহ ও অবাধ্যতার কাজে সাহায্য করোনা।’’ {সূরা মায়েদাঃ ২}
ঈমানদাররা! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। {আহযাবঃ ৭০}
‘‘ঈমানদাররা! তোমরা সকলে ন্যায় বিচারে অটল অবিচল থাকো এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষদাতা হও, তোমাদের সাক্ষ্য স্বয়ং তোমাদের নিজেদের বা তোমাদের পিতা মাতা বা নিকটাত্নীয়দের বিরুদ্ধে যাকনা কেন।’’ {সূরা নিসাঃ ১৩৫}
‘‘মুনাফিক নারী পুরুষ একই থলের বিড়াল, তারা মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়, ভালো কাজ থেকে বারণ করে। আর মুমিন নারী পুরুষ একে অন্যের সাথী, তারা ভালো কাজের নির্দেশ দান করে আর মন্দ কাজ থেকে বারণ করে।’’ {সূরা তাওবাঃ ৬৭-৭১}
আল কুরআনে ঈমানদারদের এ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উক্ত হয়েছেঃ
‘‘তারা নেকীর নির্দেশ দানকারী মন্দ কাজ থেকে বারণকারী এবং আল্লাহর সীমারেখা সংরক্ষণকারী।’’ {সূরা তাওবাঃ ১১২}
এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরশাদ হলোঃ
‘‘তোমাদের কেউ যদি কোনো মুনকার {অসৎ কাজ} দেখে, তবে তার উচিত হাত দিয়ে তা প্রতিহত করা। তা যদি না পারে, তবে মুখ দ্বারা বারণ করবে, তাও যদি না পারে, তবে অন্তর দ্বারা {খারাপ জানবে এবং বারণ করার আগ্রহ রাখবে}, আর এটা হচ্চে ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’[ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায় -২০ । তিরমিযী, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-১২। আবু দাউদ; কিতাবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭ ইবনে মাজা, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-২০।]
‘‘অতঃপর অযোগ্য লোকেরা তাদের স্হানে বসবে। তারা এমনসব কথা বলবে, যা নিজেরা করবেনা, এমনসব কাজ করবে, যার নির্দেশ দেয়া হয়নি তাদেরকে। যে হাতের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে, সে মুমিন; যে জিহ্বার সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে, সে মুমিন; অন্তর দিয়ে যে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে, সে মুমিন। ঈমানের এর চেয়ে ক্ষুদ্র সামান্যতম পর্যায়ও নেই।’’[ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়-২০]
‘‘যালেম শাসকের সামনে ন্যায় {বা সত্য কথা} বলা সর্বোত্তম জিহাদ।’’[আবু দাউদ, কিতাবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭। তিরমিযী, কিতাবুল ফিতান, অধ্যায়-১২। নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৬। ইবনে মাজা, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-২০]
‘‘যালেমকে দেখেও যারা তার হাত ধরেনা {বাধা দেয়না} তাদের উপর আল্লাহর আযাব প্রেরণ করা দূরে নয়।’’[ আবু দাউদ, কিতাবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭। তিরমিযী, কিতাবুল ফিতান, অধ্যায়-১২।]
‘‘আমার পর কিছু লোক শাসক হবে। যে ব্যক্তি মিথ্যার ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করবে, সে আমার নয় এবং আমি তার নই।’’[নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৪-৩৫।]
‘‘অনতিবিলম্বে এমনসব লোক তোমাদের ওপর শাসক হবে, যাদের হাতে থাকবে তোমাদের জীবিকা, তারা তোমাদের সাথে কথা বললে মিথ্যা বলবে, কাজ করলে খারাপ কাজ করবে। তোমরা যতক্ষণ তাদের মন্দ কাজের প্রশংসা না করবে, তাদের মিথ্যায় বিশ্বাস না করবে, ততক্ষণ তারা তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেনা।
সত্যকে বরদাশত করা পর্যন্ত তোমরা তাদের সামনে সত্য পেশ করে যাও। তারপর যদি তারা সীমালংঘন করে যায়, তাহলে যে ব্যক্তি এজন্য নিহত হবে, সে শহীদ।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-২৯৭।]
‘‘যে ব্যক্তি কোনো শাসককে রাযী করার জন্য এমন কথা বলে, যা তার প্রতিপালককে নারায করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দীন থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছে।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩০৯।]
২. খিলাফতে রাশেদা ও তার বৈশিষ্ট
আগের অধ্যায়ে ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে শাসন নীতি বিবৃত হয়েছে, তাঁর পরে সেসব মূলনীতির ওপর খোলাফাফে রাশেদীনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যক্ষ শিক্ষা দীক্ষা ও কার্যকর নেতৃত্বের ভিত্তিতে যে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তার প্রত্যেক সদস্যই জানতো, ইসলামের বিধি বিধান ও প্রাণসত্তা অনুযায়ী কোন ধরনের শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়া উচিত। নিজের স্থলাভিষিক্তের ব্যাপারে হযরত সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো ফায়সালা না দিয়ে গেলেও ইসলাম একটি শূরাভিত্তিক খিলাফত দাবী করে, মুসলিম সমাজের সদস্যরা এ কথা অবগত ছিলো। তাই সেখানে কোনো বংশানুক্রমিক বাদশাহী প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বল প্রয়োগে কোনো ব্যক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি, খিলাফত লাভ করার জন্য কেউ নিজের তরফ থেকে চেষ্টা তদবীর করেনি বা নামমাত্র প্রচেষ্টাও চালায়নি। বরং জনগন তাদের স্বাধীন মর্জিমতো পর পর চারজন সাহাবীকে তাদের খলীফা নির্বাচিত করে। মুসলিম মিল্লাত এ খিলাফতকে খিলাফতে রাশেদা {সত্যাশ্রয়ী খিলাফত} বলে গ্রহন করেছে। এ থেকে আপনা আপনিই প্রকাশ পায় যে, মুসলমানদের দৃষ্টিতে এটিই ছিলো খিলাফতের সত্যিকার পদ্ধতি।
একঃ নির্বাচনী খেলাফত
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্তের জন্য হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নাম প্রস্তাব করেন। মদীনার সকলেই {বস্তুত তখন তারা কার্যত সারা দেশের প্রতিনিধির মর্যাদার অভিষিক্ত ছিলো} কোনো প্রকার চাপ প্রভান এবং প্রলোভন ব্যতীত নিজেরা সন্তুষ্টচিত্তে তাঁকে পছন্দ করে তাঁর হাতে বাইয়াত।{আনুগত্যের শপথ}করে।
হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর ওফাতকালে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সম্পর্কে ওসীয়াত লিখান, অত:পর জনগনকে মসজিদে নববীতে সমবেত করে বলেনঃ
‘‘আমি যাকে স্থলাভিষিক্ত করছি তোমরা কি তার ওপর সন্তুষ্ট? আল্লাহর শপথ! সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য বুদ্ধি বিবেক প্রয়োগে আমি বিন্দুমাত্র ত্রুটি করিনি। আমার কোনো আত্মীয় স্বজনকে নয় বরং ওমর ইবনুল খাত্তাবকে আমার স্থলাভিষিক্ত করেছি। সুতরাং তোমরা তার নির্দেশ শুনবে এবং আনুগত্য করবে।’’
সবাই সমস্বরে বলে ওঠেঃ আমরা তার নির্দেশ শুনবো এবং মানবো।[ আততাবারী-তারীখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৬১৮। আল-মাতবায়াতুল ইস্তিকামা, কায়রো ১৯৩৯।]
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর জীবনের শেষ বছর হজ্জের সময় এক ব্যক্তি বললোঃ ওমর মারা গেলে আমি অমুক ব্যক্তির হাতে বাইয়াত করবো। কারণ, আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর বাইয়াতও তো হঠাৎই হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হয়েছেন।[ তিনি এদিকে ইংগিত করেছেন যে, সাকীফায়ে বনী-সায়িদার মজলিসে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হঠাৎ দাড়িয়ে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নাম প্রস্তাব করেন এবং হাত বাড়িয়ে তখনই তার হাতে বাইয়াত করেন। তাকে খলীফা করার ব্যপারে পূর্বাহ্নে কোনো পরামর্শ করেননি।] হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এ সম্পর্কে জানতে পেরে বললেনঃ এ ব্যপারে আমি এক ভাষণ দেবো। জনগনের ওপর যারা জোরপূর্বক নিজেদেরকে চাপিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে, তাদের সম্পর্কে আমি জনগণকে সতর্ক করে দেবো। মদীনায় পৌছে তাঁর প্রথম ভাষণেই তিনি এ ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। সাকীফায়ে বনী সায়েদার ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে বলেন যে, তখন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে হঠাৎ হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নাম প্রস্তাব করে আমি তার হাতে বাইয়াত করেছিলাম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ তখন যদি এরকম না করতাম, তবে রাতারাতি লোকদের কোনো ভুল সিদ্ধান্ত করে বসার আশংকা ছিলো। আর সে ফায়সালা মেনে নেয়া এবং তা পরিবর্তন করা-উভয়ই আমাদের জন্য কঠিন হতো। এ পদক্ষেপটি সাফল্যমন্ডিত হলেও ভবিষ্যতের জন্য একে নযীর হিসেবে গ্রহন করা যেতে পারেনা। আবু বকরের মতো উন্নত মানের এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তোমাদের মধ্যে আর কে আছে? এখন কোনো ব্যক্তি যদি মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতিরেকে কারো হাতে তাহলে সে এবং যার হাতে বাইয়াত করা হবে-উভয়ই নিজেকে মৃত্যুর হাতে সোপর্দ করবে। [ বুখারী, কিতাবুল মুহারিবীন, অধ্যায়-১৬। মুসনাদে আহমাদ, ১ম খন্ড, হাদীস নম্বর-৩৯১। তৃতীয় সংস্করণ, দারুল মায়ারিফ, মিসর ১৯৪৯। মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আয়ালা আনহুর শব্দগুলো ছিলো এইঃ মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত যে ব্যক্তি কোনো আমীরের হাতে বাইয়াত করে, তার কোনো বাইয়াত নেই; এবং যার হাতে বাইয়াত করে, তারও কোনো বাইয়াত নেই। অপর এক বর্ননায় হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ বাক্যও দেখা যায়-পরামর্শ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে ইমারাত দেয়া হলে তা কবূল করা তার জন্য হালাল নয়। {ইবনে হাযার, ফাতহুল বারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠ-১২৫, আল-মাতবায়াতুল খাইরিয়া, কায়রো, ১৩২৫ হিজরী।]
তার নিজের ব্যাখ্যা করা এ পদ্ধতি অনুযায়ী হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খিলাফতের ফায়সালা করার জন্য তার ওফাতকালে একটি নির্বাচন কমিটি গঠন করে বলেনঃ ‘মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত যে ব্যক্তি জোর করে আমীর হওয়ার চেষ্টা করবে, তাকে হত্যা করো।’ খিলাফত যাতে বংশানুক্রমিক পদাধিকারে পরিণত না হয়, সে জন্য তিনি খিলাফত লাভের যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা থেকে নিজের ছেলের নাম
সুস্পস্টভাবে বাদ দিয়ে দেন।[ আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯২। ইবনুল, আসীর, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৪-৩৫। ইদারাতুল তিবরাতিল মুনীরিয়া, মিসর, ১৩৫৬ হিজরী। তাবাকাতে ইবনে সা’দ, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৪৪, বৈরুত সংস্করণ ১৯৫৭। ফাতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৯।] ছ’ব্যক্তিকে নিয়ে এ নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয়। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মতে এরা ছিলেন কওমের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয়।
কমিটির সদস্য আবদুর রহমান ইবনে আওফকে কমিটি শেষ পর্যন্ত খলিফার নাম প্রস্তাব করার ইখতিয়ার দান করে। সাধারণ লোকদের মধ্যে ঘোরাফেরা করে তিনি জানতে চেষ্টা করেন, কে সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়। হজ্জ শেষ করে যেসব কাফেলা বিভিন্ন এলাকায় ফিরে যাচ্ছিলো, তিনি তাদের সাথেও আলোচনা করেন। এ জনমত যাচাইয়ের ফলে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, অধিকাংশ লোকই হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর পক্ষে।[ আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯৬। ইবনুল আসীর, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৬। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৪৬।] তাই তাকেই খিলাফতের জন্য নির্বাচিত করা হয়। সাধারণ জনসমাবেশে তার বাইয়াত হয়।
হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শাহাদাতের পর কিছু লোক হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে খলীফা করতে চাইলে তিনি বললেনঃ‘‘ এমন করার ইখতিয়ার তোমাদের নেই। এটা তো শূরার সদস্য এবং বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কাজ। তারা যাঁকে খলীফা করতে চান, তিনিই খলীফা হবেন। আমরা মিলিত হবো এবং এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করবো।’’[ ইবনে কুতাইবা, আল-ইমামা ওয়াস সিয়াসা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪১।] তাবারী হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে, তা হচ্ছেঃ ‘‘ গোপনে আমার বাইয়াত অনুষ্ঠিত হতে পারেনা, তা হতে হবে মুসলমানদের মর্জী অনুযায়ী।’’[আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৫০।]
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ওফাতকালে লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, আমরা আপনার পুত্র হাসান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর হাতে বাইয়াত করবো? জবাবে তিনি বলেনঃ ‘‘ আমি তোমাদেরকে নির্দেশও দিচ্ছিনা, নিষেধও করছিনা। তোমরা নিজেরাই এ ব্যাপারে বিবেচনা করতে পারো।’’[ আততাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১১২। আল-মাসউদী, মূরুজুয যাহাব, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৬। আল-মাতবায়াতুল বাহিয়্যা, মিসর, ১২৪৬ হিজরী।] তিনি যখন আপন পুত্রদেরকে শেষ ওসীয়াত করছিলেন, ঠিক সে সময় জনৈক ব্যক্তি আরয করলো, আমীরুল মু’মিনীন‘‘ আপনি আপনার উত্তরসূরী মনোনয়ন করছেননা কেন? জবাবে তিনি বলেনঃ আমি মুসলমানদেরকে সে অবস্থায় ছেড়ে যেতে চাই, যে অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছিলেন রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।’’[ ইবনে কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩-১৪ মাতবায়াতুস সারাদাত, মিসর। আল-মাউদি, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৬। ]
এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, খিলাফত সম্পর্কে খোলাফায়ে রাশেদীন এবং রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের সর্বসম্মত মত
এই ছিলো যে, খিলাফত একটা নির্বাচন ভিত্তিক পদমর্যাদা। মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শ এবং তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের মাধ্যমেই তা কায়েম করতে হবে। বংশানুক্রমিক বা বল প্রয়োগের দ্বারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব করা তাঁদের মতে খিলাফত নয় বরং তা সৈরতন্ত্র। খিলাফত এবং রাজতন্ত্রের যে স্পষ্ট ও দ্ব্যতহীন ধারনা সাহাবায়ে কিরামগণ পোষণ করতেন, হযরত আবু মুসা আশয়ারী হাসান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তা ব্যক্ত করেন নিম্মোক্ত ভাষায়ঃ
‘‘ইমারাত {অর্থাৎ খিলাফত} হচ্ছে তাই, যা প্রতিষ্ঠা করতে পরামর্শ নেয়া হয়েছে। আর তরবারীর জোরে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হচ্ছে বাদশাহী বা রাজতন্ত্র।’’[ তাবকাতে ইবনে সা’দ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১১৩।]
দুইঃ শূরাভিত্তিক সরকার
এ খলীফা চতুষ্ঠয় সরকারের নির্বাহী এবং আইন প্রণয়নের ব্যাপারে জাতির বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের অধিকারী ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ না করে কোনো কাজ করতেননা। সুনানে দারামীতে হযরত মাইমুন ইবনে মাহরানের একটি বর্ণনা আছে যে, হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নীতি ছিলো, তাঁর সামনে কোনো বিষয় উথ্থাপিত হলে তিনি প্রথমে দেখতেন আল্লাহর কিতাব কি বলে। সেখানে কোনো নির্দেশ না পেলে এ ধরনের ব্যাপারে রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ফায়সালা দিয়েছেন, তা জানতে চেষ্টা করতেন। রসূলের সুন্নায়ও কোনো নির্দেশ না পেলে জাতীয় পরামর্শক্রমে যে মতই স্হির হতো, তদানুযায়ী ফায়সালা করতেন। [ সুনানে দারামী, বাবুল ফুতইয়া ওয়ামা ফীহি মিনাশ শিদ্দাহ।] হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর কর্মনীতিও ছিলো অনুরূপ। [ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস-২২৮১। ]
পরামর্শের ব্যাপারে খোলাফায়ে রাশেদীনের দৃষ্টিভংগি ছিলো, শূরার সদস্যদের সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। এ ব্যাপারে ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এক পরামর্শ সভার উদ্ধোধনী ভাষণে খিলাফতের পলিসি ব্যক্ত করেছেন এভাবেঃ
‘‘আমি আপনাদের যে জন্য কষ্ট দিয়েছি, তা এছাড়া আর কিছু নয় যে, আপনাদের কার্যাদির যে ভার আমার ওপর ন্যস্ত হয়েছে তা বহন করার কাজে আপনারাও আমার সঙ্গে শরীক হবেন। আমি আপনাদের মধ্যাকরই এক ব্যক্তি। আজ আপনারাই সত্যের স্বীকৃতি দানকারী। আপনাদের মধ্য থেকে যাদের ইচ্ছা , আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন; আবার যাদের ইচ্ছা আমার সাথে একমতও হতে পারেন। আপনাদের যে আমার মতামতকে সমর্থন করতে হবে-এমন কোনো কথা নেই এবং আমি তা চাই-ও না।‘‘[ ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা-২৫।]
তিনঃ বাইতুল মাল একটি আমানত
তারা বাইতুলমালকে আল্লাহ এবং জনগণের আমানত মনে করতেন। বেআইনীভাবে বাইতুলমালের মধ্যে কিছু প্রবেশ করা ও বেআইনীভাবে তা থেকে কিছু বের হয়ে যাওয়াকে তারা জায়েয মনে করতেননা। শাসক শ্রেণীর ব্যক্তিগত স্বার্থে বাইতুলমাল ব্যবহার তাদের মতে হারাম ছিলো। তাদের মতে খিলাফত এবং রাজতন্ত্রের মৌলিক পার্থক্যৈই ছিলো এই যে, রাজা বাদশাহরা জাতীয় ভান্ডারকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করে নিজেদের খাহেশ মতো স্বাধীনভাবে তাতে তসরুফ করতো, আর খলীফা তাকে আল্লাহ এবং জনগণের আমানত মনে করে সত্য ন্যায় নীতি মোতাবেক এক একটি পাই পয়সা উসূল করতেন, আর তা ব্যয়ও করতেন সত্য ন্যায় নীতি অনুসারে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একদা হযরত সালমান ফারসীকে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘‘ আমি বাদশাহ, না খলীফা?’’ তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দেনঃ ‘‘মুসলমানদের ভূমি থেকে আপনি যদি এক দিরহামও অন্যায়ভাবে উসূল এবং অন্যায়ভাবে ব্যয় করেন তাহলে আপনি খলীফা নন; বাদশা।’’ অপর এক প্রসঙ্গে একদা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু স্বীয় মজলিসে বলেনঃ আল্লাহর কসম, আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছিনা যে, আমি বাদশা, না খলীফা। আমি যদি বাদশাহ হয়ে গিয়ে থাকি, তবে তা তো এক সাংঘাতিক কথা!’’ এতে জনৈক ব্যক্তি বললোঃ ‘‘আমিরুল মুমিনীন! এতদোভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।’’ হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জিজ্ঞেস করলেন, কি পার্থক্য? তিনি বললেনঃ
‘‘খলীফা অন্যায়ভাবে কিছুই গ্রহন করেননা, অন্যায়ভাবে কিছুই ব্যয়ও করেননা। আল্লাহর মেহেরবাণীতে আপনিও অনূরূপ। আর বাদশাহ তো মানুষের ওপর যুলম করে, অন্যায়ভাবে একজনের কাছ থেকে উসূল করে, আর অন্যায়ভাবেই অপরজনকে দান করে।’’[ তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩০৬-৩০৭।]
এ ব্যাপারে খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মধারা প্রণিধানযোগ্য। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খলীফা হওয়ার পরদিন কাপড়ের থান কাঁধে নিয়ে বিক্রি করার জন্য বেরিয়েছেন। কারণ, খিলাফতের পূর্বে এটিই ছিল তার জীবিকার অবলম্বন। পথে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সাথে দেখা। তিনি বললেন, আপনি একি করছেন? জবাব দিলেন, ছেলে মেয়েদের খাওয়াবো কোথ্থেকে? হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, মুসলমানদের নেতৃত্বের ভার আপনার ওপর অর্পিত হয়েছে। ব্যবসায়ের সাথে খেলাফতের কাজ চলতে পারেনা। চলুন আবু ওবাইদার{বাইতুল মালের খাজা….}সাথে আলাপ করি। তাই হলো। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আবু ওবাইদার সাথে আলাপ করলেন। তিনি বললেন, একজন সাধারন মুহাজীরের আমদানীর মান সামনে রেখে আমি আপনার জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দিচ্ছি। এ ভাতা মুহাজিরদের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তির সমানও নয়; আবার সবচেয়ে দরিদ্রেরা পর্যায়েরও নয়। এমনিভাবে তাঁর জন্য একটা ভাতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর পরিমাণ ছিলো বার্ষিক চার হাজার দিরহামের কাছাকাছি। কিন্তু তাঁর
ওফাতের সময় ঘনিয়ে এলে তিনি ওসীয়াত করে যান যে, আমার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে আট হাজার দিরহাম বাইতুলমালকে ফেরত দেবে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নিকট তা আনা হলে তিনি বলেনঃ
‘‘আল্লাহ আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর প্রতি রহম করুন! উত্তরসূরীদেরকে তিনি মুশকিলে ফেলে গেলেন।’’[ কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং ২২৮০-২২৮৫।]
বাইতুলমালে খলীফার অধিকার এতোটুকু এ প্রসঙ্গে খলীফা ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একদা তাঁর এক ভাষণে বলেনঃ
‘‘গ্রীষ্মকালে এক জোড়া কাপড়, শীতকালে এক জোড়া কাপড়, কুরাইশের একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির সমপরিমাণ অর্থ আপন পরিবার পরিজনের জন্য-এছাড়া আল্লাহর সম্পদের মধ্যে আর কিছুই আমার জন্য হালাল নয়। আমি তো মুসলমানদের একজন সাধারন ব্যক্তি বৈ কিছুই নই।’’[ ইবনে কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, পৃষ্ঠা-১৩৪।
অপর এক ভাষনে তিনি বলেনঃ
‘‘এ সম্পদের ব্যাপারে তিনটি বিষয় ব্যতীত অন্য কিছুকেই আমি ন্যায় মনে করিনা। ন্যায়ভাবে গ্রহন করা হবে, ন্যায় মুতাবিক প্রদান করা হবে এবং বাতিল থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হবে। এতীমের সম্পদের সাথে তার অভিভাবকের যে সম্পর্ক, তোমাদের এ সম্পদের সাথে আমার সম্পর্কও ঠিক অনুরূপ। আমি অভাবী না হলে তা থেকে কিছুই গ্রহণ করবোনা, অভাবী হলে মারুফ পন্থায় গ্রহন করবো।’’[ ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা-১১৭।]
হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর বেতনের যে মান ছিলো, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও তাঁর বেতনের মান তাই রাখলেন। তিনি পায়ের হাঁটু ও গোড়ালীর মাঝ বরাবর পর্যন্ত উঁচু তহবন্দ পরতেন। তাও আবার ছিলো তালিযুক্ত।[ ইবনে সা’দ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৮।] সারা জীবন কখনো একটু আরামে কাটাবার সুযোগ হয়নি। একবার শীতের মওসূমে জনৈক ব্যক্তি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। দেখেন, তিনি একখানা ছেঁড়া কাপড় পরে বসে আছেন আর শীতে কাঁপছেন।[ ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩।] শাহাদাতের পর তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসাব নিয়ে দেখা গেলো মাত্র সাতশত দিরহার। তাও তিনি এক পয়সা এক পয়সা করে জমা করেছেন একটা গোলাম খরিদ করার জন্য । [ইবনে সা’দ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৮।] আমীরুল মু’মিনীন বলে চিনতে পেরে তাঁর কাছ থেকে যাতে কম মূল্য কেউ গ্রহণ না করে এ ভয়ে কোনো পরিচিত ব্যাক্তির কাছ থেকে বাজারে কখনো কোনো জিনিস কিনতেননা।[ ইবনে সা’দ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৮। ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩।] যে সময় হযরত মুয়াবিয় রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সাথে তার সংঘর্ষ চলছিলো, কেউ কেউ তাকে পরামর্শ দেনঃ হযরত মুয়াবিয়া
রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যে রকম লোকদেরকে অঢেল দান দক্ষিণা করে তাঁর সাথী করে নিচ্ছেন আপনিও তেমনি বাইতুল মালের ভান্ডার উজাড় করে টাকার বন্যা বইয়ে দিয়ে সমর্থন সংগ্রহ করুন। কিন্তু তিনি এই বলে হা প্রত্যাখ্যান করলেন ‘‘তোমরা কি চাও আমি অন্যায়ভাবে সফল হই? ’’[ ইবনে আবীল হাদীস, নাহজুল বালাগার ভাষ্য, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৮২। দারুল কুতুবিল আরাবিয়্যা, মিসর, ১৩২৯ হিজরী।] তাঁর আপন ভাই হযরত আকীল রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর কাছে টাকা দাবী করেন বাইতুলমাল থেকে। কিন্তু তিনি তা দিতে অস্বীকার করে বলেনঃ তুমি কি চাও তোমার ভাইও মুসলমানদের টাকা তোমাকে দিয়ে জাহান্নামে যাক।’’[ ইবনে কুতাইবা-আল-ইমামা ওয়াস সিয়াস, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৭১।]
চারঃ রাষ্ট্রের ধারনা
রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের ধারনা কি ছিলো, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিজের মর্যাদা এবং কর্তব্য সম্পর্কে তারা কি ধারনা পোষণ করতেন, স্বীয় রাষ্ট্রে তারা কোন্ নীতি মেনে চলতেন? খিলাফতের মঞ্চ থেকে ভাষণ দান প্রসঙ্গে তাঁরা নিজেরাই প্রকাশ্যে এসব বিষয় ব্যক্ত করেছেন। মসজিদে নববীতে গণ বাইয়াত ও শপথের পর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যে ভাষণ দান করেন, তাতে তিনি বলেছিলেনঃ
‘‘আমাকে আপনাদের শাসক নিযুক্ত করা হয়েছে। অথচ আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। সে সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন ন্যস্ত, আমি নিজে ইচ্ছা করে এ পদ গ্রহণ করিনি। অন্যের পরিবর্তে আমি নিজে এ পদ লাভের চেষ্টাও করিনি, এজন্য আমি কখনো আল্লাহর নিকট দোয়াও করিনি। এজন্য আমার অন্তরে কখনো লোভ সৃষ্টি হয়নি। মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ এবং আরবদের মধ্যে ধর্ম ত্যাগের ফেতনার সূচনা হবে- এ আশংকায় আমি অনিচ্ছা সত্বে এ দায়িত্ব গ্রহন করেছি। এ পদে আমার কোনো শান্তি নেই। বরং এটা এক বিরাট বোঝা, যা আমার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এ বোঝা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই। অবশ্য আল্লাহ যদি আমাকে সাহায্য করেন। আমার ইচ্ছা ছিলো, অন্য কেউ এ দায়িত্বভার বহন করুক। এখনোও আপনারা ইচ্ছা করলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে হতে কাউকে এ কাজের জন্য বাছাই করে নিতে পারেন। আমার বাইয়াত এ ব্যাপারে আপনাদের প্রতিবন্ধক হবেনা। আপনারা যদি আমাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানদন্ডে যাচাই করেন, তবে তার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ, তিনি শয়তান থেকে নিরাপদ ছিলেন, তাঁর ওপর ওহী নাযিল হতো। আমি সঠিক কাজ করলে আমার সহযোগিতা করবেন, অন্যায় করলে আমাকে সোজা করে দেবেন। সততা হচ্ছে একটি আমানত। আর মিথ্যা একটি খেয়ানত। তোমাদের দুর্বল ব্যক্তি আমার নিকট সবল। আল্লাহর ইচ্ছায় যতক্ষণ আমি তার অধিকার তাকে দান না
করি। আর তোমাদের মধ্যকার সবল ব্যক্তি আমার নিকট দুর্বল-যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছায় আমি তার কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে না পারি। কোনো জাতি আল্লাহর রাস্তায় চেষ্টা সাধনা ত্যাগ করার পরও আল্লাহ তার ওপর অপমান চাপিয়ে দেননি-এমনটি কখনো হয়নি। কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করার পর আল্লাহ তাদেরকে সাধারণ বিপদে নিপতিত করেননা-এমনও হয়না। আমি যতক্ষণ আল্লাহ্ ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুগত থাকি, তোমরা আমার আনুগত্য করো। আমি আল্লাহ্ ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য হলে আমার ওপর তোমাদের কোনো আনুগত্য নেই। আমি অনুসরণকারী, কোনো নতুন পথের উদ্ভাবক নই।’’[ আততাবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৫০। ইবনে হিশাম, আস সীরাতুন নববিয়্যা, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩১১, মাতবায়াতু মুস্তফা আল-বাবী, মিসর-১৯৩৬, কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২২৬১, ২২৬৪, ২২৬৮, ২২৭৮, ২২৯১, ২২৯৯। ]
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার ভাষণে বলেনঃ
‘‘লোক সকল! আল্লাহর অবাধ্যতায় কারোর আনুগত্য করতে হবে-নিজের সম্পর্কে এমন অধিকারের দাবী কেউ করতে পারেনা।… লোক সকল! আমার ওপর তোমাদের যে অধিকার রয়েছে, আমি তোমাদের নিকট তা ব্যক্ত করছি। এসব অধিকারের জন্য তোমরা আমাকে পাকড়াও করতে পারো। আমার ওপর তোমাদের অধিকার এই যে, খিরাজ বা আল্লাহর দেয়া ফাই {বিনা যুদ্ধে বা রক্তপাত ছাড়াই যে গনীমতের মাল লব্ধ হয়} থেকে বেআইনী কোনো কিছু গ্রহণ করবোনা। আর আমার ওপর তোমাদের অধিকার এই যে, এভাবে যে অর্থ আমার হাতে আসে, অন্যায়ভাবে তার কোনো অংশও আমি ব্যয় করবোনা।’’[ ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা-১১৭।]
সিরিয়া ও ফিলিস্তিন যুদ্ধে হযরত ওমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে প্রেরণকালে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হিদায়াত দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
‘‘আমর! আমর প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল কাজে আল্লাহকে ভয় করে চলো। তাঁকে লজ্জা করে চলো। কারণ, তিনি তোমাকে এবং তোমার সকল কর্মকেই দেখতে পান।….. পরকালের জন্য কাজ করো। তোমার সকল কর্মে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রেখো। সঙ্গী-সাথীদের সাথে এমনভাবে আচরণ করবে, যেনো তারা তোমার সন্তান। মানুষের গোপন বিষয় খুঁজে বেড়িয়োনা। বাহ্যিক কাজের ভিত্তিতেই তাদের সঙ্গে আচরণ করো।……. নিজেকে সংযত রাখবে, তোমার প্রজা সাধারণও ঠিক থাকবে।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৩১৩।]
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শাসনকর্তদের কোনো এলাকায় প্রেরণকালে সম্বোধন করে বলতেনঃ
‘‘মানুষের দন্ড মুন্ডের মালিক বনে বসার জন্য আমি তোমাদের মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের ওপর শাসনকর্তা নিযুক্ত করছিনা। বরং আমি তোমাদের এজন্য নিযুক্ত করেছি যে, তোমরা সালাত কায়েম করবে, মানুষের মধ্যে ইনসাফের সাথে ফায়সালা করবে, ন্যায়ের সাথে তাদের অধিকার বন্টন করবে।’’[ আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৭৩।]
বাইয়াতের পর হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রথম যে ভাষণ দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
‘‘শোনো, আমি অনুসরনকারী, নতুন পথের উদ্ভাবক নই। জেনে রেখো, আল্লাহর কিতাব এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মেনে চলার পর আমি তোমাদের নিকট তিনটি বিষয় মেনে চলার অঙ্গিকার করেছি। একঃ আমার খিলাফতের পূর্বে তোমরা পারস্পারিক সম্মতিক্রমে যে নীতি নির্ধারণ করেছো, আমি তা মেনে চলবো। দুইঃ যেসব ব্যাপারে পূর্বে কোনো নীতি পন্থা নির্ধারিত হয়নি, সেসব ব্যাপারে সকলের সাথে পরামর্শক্রমে কল্যাণাভীসারীদের পন্থা নির্ধারণ করবো। তিনঃ আইনের দৃষ্টিতে তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য না হয়ে পড়া পর্যন্ত তোমাদের ওপর হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবো।’’[আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৪৬।]
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত কায়েস ইবনে সা’দকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠাবারকালে মিসরবাসীদের নামে যে ফরমান দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
‘‘সাবধান! আমি আল্লাহর কিতাব এবং রসূল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবক আমল করবো-আমার ওপর তোমাদের এ অধিকার রয়েছে। আল্লাহর নির্ধারিত অধিকার অনুযায়ী আমি তোমাদের কাজ কারবার পরিচালনা করবো। তোমাদের অগোচরেও তোমাদের কল্যাণ কামনা করবো।’’
প্রকাশ্য জনসমাবেশে এ ফরমান পাঠ করে শোনাবার পর হযরত কায়েস ইবনে সা’দ ঘোষণা করেনঃ
‘‘আমি তোমাদের সাথে এভাবে আচরণ না করলে তোমাদের ওপর আমার কোনো বাইয়াত নেই।’’[ আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৫০-৫৫১।]
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জনৈক গভর্ণরকে লিখেনঃ
‘‘তোমাদের এবং জনসাধারনের মধ্যে দীর্ঘ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করোনা। শাসক ও শাসিতের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা দৃষ্টির সংকীর্ণতা এবং জ্ঞানের স্বল্পতার পরিচায়ক। এর ফলে তারা সত্যিকার অবস্থা জানতে পারেনা। ক্ষুদ্র বিষয় তাদের জন্য বৃহৎ হয়ে দাঁড়ায়, আর বিরাট বিষয় ক্ষুদ্র। তাদের জন্য ভালো মন্দ হয়ে
দেখা দেয়, আর মন্দ গ্রহণ করে ভালোর আকার; সত্য মিথ্যা সংমিশ্রিত হয়ে যায়।’’[ ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৮।]
‘‘হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কেবল একথা বলে ক্ষান্ত হননি, তিনি অনুরূপ কাজও করেছেন। তিনি নিজে দোররা নিয়ে কুফার বাজারে বেরুতেন, জনগণকে অন্যায় থেকে বারণ করতেন, ন্যায়ের নির্দেশ দিতেন। প্রত্যেকটি বাজারে চক্কর দিয়ে দেখতেন, ব্যবসায়ীরা কাজ কারবারে প্রতারণা করছে কিনা। এ দৈনন্দিন ঘোরাঘুরির ফলে কোনো অপরিচিত ব্যক্তি তাঁকে দেখে ধারণাই করতে পারতোনা যে, মুসলিম জাহানের খলিফা তার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কারণ, তার পোশাক থেকে বাদশাহীর কোনো পরিচয় পাওয়া যেতনা, তাঁর আগে আগে পথ করে দেয়ার জন্য কোনো রক্ষীবাহিনীও দৌড়ে যেতোনা।’’[ ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪-৫।]
একবার হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রকাশ্যে ঘোষণা করেনঃ
‘‘তোমাদেরকে পিটাবার জন্য আর তোমাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য আমি গভর্ণরদের নিযুক্ত করিনি। তাদের নিযুক্ত করেছি এজন্য যে, তারা তোমাদেরকে দ্বীন এবং নবীর তরীকা পদ্ধতি শিক্ষা দেবে। কারো সাথে এই নির্দেশ বিরোধী ব্যবহার করা হয়ে সে আমার কাছে অভিযোগ উথ্থাপন করুক। আল্লাহর কসম করে বলছি আমি তার {গভর্নরের} কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।’’ এতে হযরত আমর ইবনুল আস {মিসরের গভর্নর} দাঁড়িয়ে বলেনঃ ‘‘কেউ যদি মুসলমানদের শাসক হয়ে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদেরকে মারে, আপনি কি তার কাছ থেকেও প্রতিশোধ নেবেন?’’ হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জবাব দেনঃ ‘‘হাঁ’ আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি তার কাছ থেকেও প্রতিশোধ নেবো। আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার নিজের সত্তা থেকেও প্রতিশোধ নিতে দেখেছি!’’[ আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা-১১৫। মুসনাদে আবু দাউদ আততায়ালিসী, হাদীস নং-৫৫। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩০। আততাবারী, ৩য় খন্ড পৃষ্ঠা-২৭৩।]
আর একবার হজ্জ উপলক্ষে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সমস্ত গভর্নরকে ডেকে প্রকাশ্য সমাবেশে দাড়িয়ে বলেনঃ এদের বিরুদ্ধে কারুর ওপর কোনো অত্যাচারের অভিযোগ থাকলে তা পেশ করতে পারো নির্দ্ধিধায়। গোটা সমাবেশ থেকে মাত্র একজন লোক উঠে হযরত আমর ইবনুল আসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেনঃ তিনি অন্যায়ভাবে আমাকে একশ দোররা মেরেছেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ ওঠো এবং তার কাছ থেকে প্রতিশোধ নাও। হযরত আমর ইবনুল আস প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, আপনি গভর্ণরদের বিরুদ্ধে এপথ উন্মুক্ত করবেননা। কিন্তু তিনি বললেনঃ আমি আল্লাহর রসূলকে নিজের থেকে প্রতিশোধ দিতে দেখেছি। হে অভিযোগকারী, এসে তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহন করো।’’ শেষ
পর্যন্ত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে প্রতিটি বেত্রাঘাতের জন্য দু’আশরাফী দিয়ে আপন পিঠ রক্ষা করতে হয়।[আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা-১১৬। ]
পাঁচঃ আইনের প্রাধান্য
এ খলীফারা নিজেদেরকেও আইনের ঊর্ধ্বে মনে করতেননা। বরং আইনের দৃষ্টিতে নিজেকে এবং দেশের একজন সাধারন নাগরিককে {সে মুসলমান হোক বা অমুসলিম যিম্মি} সমান মনে করতেন। রাষ্ট প্রধান হিসেবে তাঁরা নিজেরা বিচারপতি {কাযী} নিযুক্ত করলেও খলীফাদের বিরুদ্ধে রায়দানে তারা ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন, যেমন স্বাধীন ছিলেন একজন সাধারণ নাগরিকের ব্যাপারে। একবার হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মধ্যে এক ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয়। উভয়ে হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে শালিশ নিযুক্ত করেন, বাদী বিবাদী উভয়ে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নিকট উপস্থিত হলেন। যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দাড়িয়ে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে তার আসনে বসাতে চাইলেন, কিন্তু তিনি উবাই রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সাথে বসলেন। অতঃপর হযরত উবাই রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার আর্যী পেশ করলেন, হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অভিযোগ অস্বীকার করলেন। নিয়ম অনুযায়ী যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর উচিত ছিলো হযরত ওমরের কাছ থেকে কসম আদায় করা। কিন্তু তিনি তা করতে ইতস্তত করলেন, হযরত ওমর নিজে কসম খেয়ে মজলিস সমাপ্তির পর বললেনঃ ‘‘যতক্ষণ যায়েদের কাছে একজন সাধারণ মুসলমান এবং ওমর সমান না হয় ততক্ষণ যায়েদ বিচারক হতে পারেনা।’’[ বাইহাকী, আস-সুনানূল কাবরা, ১০ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩৬। দায়িরাতুল মায়ারিফ, হায়দাবাদ, ১ম সংস্করণ, ১৩৫৫ হিজরী।]
এমনি এক ঘটনা ঘটে জনৈক খৃষ্টানের সাথে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর। কুফার বাজারে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দেখতে পেলেন, জনৈক খৃষ্টান তার হারানো লৌহবর্ম বিক্রি করছে। আমীরুল মু’মিনীন হিসেবে তিনি সে ব্যক্তির নিকট থেকে বর্ম ছিনিয়ে নেননি বরং কাযীর দরবারে ফরিয়াদ করলেন। তিনি সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করতে না পারায় কাযী তার বিরুদ্ধে রায় দান করলেন।[ বাইহাকী আস-সুনানূল কুবরা, ১০ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩৬। দায়িরাতুল মায়ারিফ, হায়দাবাদ, ১ম সংস্করণ, ১৩৫৫।]
ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লেকান বর্ণনা করেন যে, একবার হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং জনৈক যিম্মি বাদী বিবাদী হিসেবে কাযী শোরাইহর আদালতে উপস্থিত হন। কাযী দাড়িয়ে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে অভ্যর্থনা জানান। এতে তিনি {হযরত আলী} বলেন, ‘‘এটা তোমার প্রথম বে-ইনসাফী।’’[ ইবনে খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আইয়ান, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১৬৮, মাকতাবাতুন নাহযাতিল মিসরিয়্যাহ, কায়রো, ১৪৮।]
ছয়ঃ বংশ-গোত্রের পক্ষপাতমুক্ত শাসন
ইসলামের প্রাথমিক যুগের আরেকটি বৈশিষ্ট ছিলো এই যে, ইসলামের নীতি এবং প্রাণশক্তি অনুযায়ী তখন বংশ গোত্র দেশের পক্ষপাতের উর্ধ্বে উঠে সকল মানুষের সাথে সমান আচরণ করা হতো, কারো সাথে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব করা হতোনা।
আল্লাহর রসূলের ওফাতের পরে আরবের গোত্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঞ্জার বেগে। নব্যয়্যতের দাবীদারদের অভ্যুদয় এবং ইসলাম ত্যাগের হিড়িকের মধ্যে এ উপাদান ছিলো সবচেয়ে ক্রিয়াশীল। মোসাইলামার জনৈক ভক্তের উক্তিঃ আমি জানি, মোসাইলামা মিথ্যাবাদী। কিন্তু রাবীয়ার মিথ্যাবাদী মোদারের সত্যবাদীর চেয়ে উত্তম।[ আততাবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৫০৮।] মিথ্যা নবূয়্যতের অপর এক দাবীদার তোলাইহার সমর্থনে বনু গোতফানের জনৈক সর্দার বলেনঃ ‘‘খোদার কসম, কুরাইশের নবীর অনুসরণ করার চেয়ে আমাদের বন্ধুগোত্রের নবীর অনুসরণ আমার নিকট অধিক প্রিয়।’’[ আততাবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৮৭।]
মদীনায় যখন হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হাতে বাইয়াত অনুষ্ঠিত হয়, তখন গোত্রবাদের ভিত্তিতে হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার খিলাফত স্বীকার করা থেকে বিরত ছিলেন। এমনি করেই গোত্রবাদের ভিত্তিতেই হযরত আবু সুফিয়ানের নিকট তার খিলাফত ছিলো অপছন্দনীয়। তিনি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নিকট গিয়ে বলেছিলেনঃ ‘কুরাইশের সবচেয়ে ছোট গোত্রের লোক কি করে খলীফা হয়ে গেল? তুমি নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাতে প্রস্তুত হলে আমি পদাতিক এবং অশ্বরোহী বাহিনী দ্বারা সমগ্র উপত্যকা ভরে ফেলবো। কিন্তু হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এক মোক্ষম জবাব দিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেনঃ তোমরা একথা ইসলাম এবং মুসলমানদের সাথে শত্রুতা প্রমাণ করে। তুমি কোনো পদাতিক বা অশ্বারোহী বাহিনী আনো, আমি তা কখনো চাইনা। মুসলমানরা পরস্পরের কল্যাণকামী। তারা একে অপরকে ভালবাসে। তাদের আবাস ও দৈহিক সত্তার মধ্যে যতই ব্যবধান থাকনা কেন। অবশ্য মুনাফিক একে অন্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্নাকারী। আমরা আবু বকরকে এ পদের যোগ্য মনে করি। তিনি এ পদের যোগ্য না হলে আমরা কখনো তাঁকে এ পদে নিয়োজিত হতে দিতামনা।[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস-২৩৭৪। আততাবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৪৯। ইবনুআব্দিল বাব আল-ইস্তিয়াব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৬৮৯।]
এ পরিবেশে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লহু তায়ালা আনহু এবং তারপর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিরপেক্ষ এবং পক্ষপাতমুক্ত ইনসাফপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে কেবল আরবের বিভিন্ন গোত্র নয় বরং অনারব নওমুসলিমদের সাথেও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করেন এবং বংশ গোত্রের সাথে কোনো প্রকার ব্যতিক্রমধর্মী আচরণ থেকে তাঁরা সম্পূর্ণ বিরত থাকেন। এর ফলে সব রকম বংশ গোত্রবাদ বিলীন হয়ে যায়। মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের দাবী অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক প্রাণশক্তি
ফুটে ওঠে। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর খিলাফতকালে আপন গোত্রের কোনো লোককে কোনো সরকারী পদে নিয়োগ করেননি। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর গোটা শাসনকালে তার গোত্রের একজন মাত্র ব্যক্তিকে যার নাম ছিলো নো’মান ইবনে আদী-বসরার নিকটে মাইদান নামক এক ক্ষুদ্র এলাকার তহশিলদার নিযুক্ত করেছিলেন। অল্প কিছুদিন পরই আবার এ পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করেছিলেন।[ হযরত নু’মান ইবনে আদী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের অন্যতম। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আগে তিনি ইসলাম গ্রহন করেন। আবিসিনিয়ায় হিজরতকালে যারা মক্কা ত্যাগ করে আবিসিনিয়ায় চলে যান, তাদের মধ্যে তিনি এবং তার পিতা আদীও ছিলেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন তাকে মাইসানের তহসিলদার নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন, তখন তার স্ত্রী তার সংগে যাননি। তিনি সেখানে স্ত্রীর বিরহে কিছু কবিতা রচনা করেন। এ সকল কবিতায় কেবল মদের বিষয় উল্লেখ ছিলো। এতে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে পদচ্যুত করেন। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে তাকে কোনো পদ না দেয়ারও সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন তিনি। ইবনে আব্দুল বার, আল-ইস্তীয়াব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯৬। দায়িরাতুল মায়ারিফ, হায়দরাবাদ, মুজামুল, বুলদান, ইয়াকুত হামাবী, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৪২-২৪৩। দারে ছাদির, বৈরুত ১৯৫৭। অপর এক ব্যক্তি, হযরত কুদামা ইবনে মাযউন- যিনি হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ভগ্নিপতি ছিলেন-তিনি তাকে বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী এবং বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের অন্যতম। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মদ্যপানের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি তাকে বরখাস্ত করে দন্ড দান করেন। {আল-ইস্তীয়াব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা -৫৩৪, ইবনে হাজর, আল-ইসাবা} ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২১৯-২২০] এদিক থেকে এ দু’জন খলিফার কর্মধার সত্যিকার আদর্শভিত্তিক ছিলো।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জীবনের শেষ অধ্যায়ে আশংকাবোধ করলেন, তাঁর পরে আরবের গোত্রবাদ {ইসলামী আন্দোলনের বিরাট বিপ্লবী প্রভাবের ফলেও যা এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়নি} পুনরায় যেনো মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে এবং তার ফলে ইসলামের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি না হয় যায়। একদা তার সম্ভাব্য উত্তরসূরীদের সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ব্যাপারে বলেনঃ ‘‘আমি তাকে আমার স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করলে তিনি বনী আবমুয়াইত {বনী উমাইয়}-কে লোকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন। আর তার লোকদের মধ্যে আল্লাহর নাফরমানী করে বেড়াবে। আল্লাহর কসম, আমি ওসমানকে স্থলাভিষিক্ত করলে সে তাই করবে। আর ওসমান তাই করলে তারা অবশ্যই পাপাচার করবে। এ ক্ষেত্রে জনগণ বিদ্রোহ করে তাকে হত্যা করবে। [ ইবনে আব্দুল বার, আল-ইস্তীয়ার, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৬৭। শাহ ওয়ালীউল্লাহ, ইযালাতুল খিফা, মাকসাদে আউয়াল, পৃষ্ঠা-৩৪২, বেরিলী সংস্করণ। কেউ কেউ এখানে প্রশ্ন তোলেনঃ হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ওপর কি ইলহাম [সূক্ষ ওহী} হয়েছিলো, যার ভিত্তিতে তিনি হলফ করে কথা বলেছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে যা অক্ষরে অক্ষরে ঘটে গিয়েছিলো? এর জবাব এই যে, দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি কখনো কখনো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তাকে যুক্তির আলোকে পুনর্বিন্যাস করলে ভাবীকালে ঘটিতব্য বিষয় তাঁর সামনে এমনিভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, যেমন ২+২=৪। ফলে ইলহাম ব্যতিতই তিনি দিব্য দৃষ্টি বলে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। আরবদের মধ্যে গোত্রবাদের জীবাণু কতো গভীরে শিকড় গেড়ে বসেছে, হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তা জানতেন। তিনি এ-ও জানতেন যে, ইসলামের ২৫-৩০ বৎসর প্রচার এখনও সেসব জীবানু সমূলে উৎপাটিত করতে পারেনি।] ওফাতকালেও এ বিষয়টি তাঁর স্বরণ ছিলো। শেষ সময়ে তিনি
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর প্রত্যেককে ডেকে বলেনঃ আমার পরে তোমরা খলীফা হলে স্ব স্ব গোত্রের লোকদেরকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবেনা।[আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৬৪। তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৪০-৩৪৪।] উপরন্তু ছয় সদস্যের নির্বাচনী শূরার জন্য তিনি যে হিদায়াত দিয়ে যান, তাতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে নিম্মোক্ত বিষয়টিও ছিলোঃ নির্বাচিত খলীফারা একথাটি মেনে চলবেন যে, তারা আপন গোত্রের সাথে কোনো ব্যতিক্রমধর্মী আচরণ করবেননা।[ ফাতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৯-৫০। মুহিবুদ্দিন আততাবারী, আর-রিয়াযুন নাযিরা ফী মানাকিবিল আশারা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৭৬, হুসাইনিয়া প্রেস, মিসর, ১২৮৪ হিজরী।
[শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ [রঃ] তাঁর ইযালাতুল খিফায় এ বর্ণনার ইদ্ধৃতি দিয়েছেন। মাকসাদে আউয়াল, পৃষ্ঠা-৩২৪ দ্রষ্টব্য।]] কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এ ক্ষেত্রে ঈপ্সিত মানদন্ড বজায় রাখতে সক্ষম হননি। তাঁর শাসনামলে বনী উমাইয়াকে ব্যাপকভাবে বিরাট বিরাট পদ এবং বাইতুল মাল থেকে দান দক্ষিণা দেয়া হয়। অন্যান্য গোত্র তিক্ততার সাথে তা অনুধাবন করতে থাকে।[ তাবকাতে ইবনে সা’দ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৬৪, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৬।] তাঁর কাছে এটা ছিলো আত্মীয় স্বজনদের সাথে সদাচারের দাবী। তিনি বলতেনঃ ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আল্লাহর জন্য তার নিকটাত্মীয়দের বঞ্চিত করতেন, আর আমি আল্লাহর জন্য আমার নিকটাত্মীয়দের দান করছি। [আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯১।] একবার তিনি বলেনঃ ‘‘বাইতুল মালের ব্যাপারে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজেও অসচ্ছল অবস্থায় থাকা পছন্দ করতেন এবং নিজের আত্মীয় স্বজনদের সেভাবে রাখতে ভালো বাসতেন। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে আত্মীয় স্বজনদের সাথে সদাচার পছন্দ করি।[কানুযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস-২৩২৪। তাবকাতে ইবনে সা’দ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৬৪] অবশেষে এর ফল তাই হয়েছে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যা আশংকা করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিক্ষোভ দেখা দেয়। কেবল তিনি যে শহীদ হন তাই নয় বরং গোত্রবাদের চাপা দেয়া স্ফুলিঙ্গ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং অবশেষে এরি অগ্নিশিখা খিলাফতে রাশেদার ব্যবস্থাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
আটঃ গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি
সমালোচনা ও মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতাই ছিলো এ খিলাফতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যরাজির অন্যতম। খলীফারা স্বর্বক্ষণ জনগনের নাগালের মধ্যে থাকতেন। তাঁরা নিজেরা শূরার অধিবেশনে বসতেন এবং আলোচনায় অংশ গ্রহন করতেন। তাঁদের কোনো সরকারী দল ছিলোনা। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো দলের অস্তিত্ব ছিলোনা। মুক্ত পরিবেশে সকল সদস্য নিজ নিজ ঈমান এবং বিবেক অনুযায়ী মত প্রকাশ করতেন। চিন্তাশীল, উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সামনে সকল বিষয় যথাযথভাবে উপস্থাপিত করা হতো। কোনো কিছুই গোপন করা হতোনা। ফায়সালা হতো দলীল প্রমানের ভিত্তিতে, কারোর দাপট, প্রভাব প্রতিপত্তি, স্বার্থ সংরক্ষণ বা দলাদলির ভিত্তিতে নয়। কেবল শূরার মাধ্যমেই খলীফারা জাতির সম্মুখে উপস্থিত হতেননা; বরং দৈনিক পাঁচবার সালাতের জামায়াতে, সপ্তাহে একবার জুময়ার জামায়াতে এবং বৎসরে দুবার ঈদের জামায়াতে ও হজ্জের সম্মেলনে তাঁরা জাতির সামনে উপস্থিত হতেন। অন্যদিকে এসব সময় জাতিও তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেতো। তাঁদের নিবাস ছিলো জনগণের মধ্যেই। কোনো দারোয়ান ছিলোনা তাঁদের গৃহে। সকল সময় সকলের জন্য তাঁদের দ্বারা খোলা থাকতো। তাঁরা হাট বাজারে জনগণের মধ্যে চলাফেরা করতেন। তাঁদের কোনো দেহরক্ষী ছিলোনা, ছিলোনা কোনো রক্ষী বাহিনী। এসব সময়ে ও সুযোগে যে কোনো ব্যক্তি তাঁদের প্রশ্ন করতে, সমালোচনা করতে ও তাঁদের নিকট থেকে হিসেবে চাইতে পারতো। তাঁদের নিকট থেকে কৈফিয়ত তলব করার স্বাধীনতা ছিলো সকলেরই। এ স্বাধীনতা ব্যবহারের তাঁরা কেবল অনুমতিই দিতেননা বরং এজন্য লোকদেরকে উৎসাহিতও করতেন। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর খিলাফতের প্রথম ভাষণেই প্রকাশ্যে বলে দিয়েছিলেন, আমি সোজা পথে চললে আমার সাহায্য করো, বাঁকা পথে চললে আমাকে সোজা করে দেবে। একদা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জুময়ার খুতবায় মত প্রকাশ করেন যে, কোনো ব্যক্তিকে যেনো বিবাহে চারশ’ দিরহামের বেশী মোহর ধার্যের অনুমতি না দেয়া হয়। জনৈক মহিলা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেন, আপনার এমন নির্দেশ দেয়ার কোনো অধিকার নেই। কুরআন স্তূপিকৃত সম্পদ [কেনতার] মোহর হিসেবে দান করার অনুমতি দিচ্ছে। আপনি কে তার সীমা নির্ধারণকারী? হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তৎক্ষণাৎ তাঁর মত প্রত্যাহার করেন। [তাফসীরে ইবনে কাসীর, আবু ইয়ালা ও ইবনুল মুনযির, এর উদ্ধৃতিতে, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৬৭] আর একবার হযরত সালমান ফারসী প্রকাশ্য মজলিশে তাঁর নিকট কৈফিয়ত তলব করেন, ‘আমাদের সকলের ভাগে এক একখানা চাদর পড়েছে। আপনি দুখানা চাদর কোথায় পেলেন? হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ারা আনহু তৎক্ষণাৎ স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সাক্ষ্য পেশ করলেন যে, দ্বিতীয় চাদরখানা তিনি পিতাকে দিয়েছেন। [মুহিবুদ্দীন আত-তাবারী, আররিয়াযুননাযিরা ফী মানাকিবিল আশারা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৬। মিসরীয় সংস্করণ। ইবনুল জাওযী, সীরাতে ওমর ইবনে খাত্তাব, পৃষ্ঠা-১২৭] একদা তিনি মজলিশে উপস্থিত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করলেনঃ আমি যদি কোনো ব্যাপারে শৈথিল্য দেখাই তাহলে তোমরা কি করবে? হযরত বিশর ইবনে সা’দ বললেন, এমন করলে আমরা আপনাকে তীরের মতো সোজা করে দেবো। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, তবেই তো তোমরা কাজের মানুষ। [কুনুযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস- ২৪১৪।] হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সবচেয়ে বেশী সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি কখনো জোরপূর্বক কারো মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেননি। বরং সব সময় অভিযোগ এবং সমালোচনার জবাবে প্রকাশ্যে নিজের সাফাই পেশ করতেন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর খিলাফতকালে খারেজীদের অত্যন্ত কটু উক্তিকেও শান্ত মনে বরদাশত করেছেন। একদা পাঁচজন খারেজীকে গ্রেফতার করে তাঁর সামনে হাযির করা হলো। এরা সকলেই প্রকাশ্যে তাঁকে গালি দিচ্ছিলো। তাদের একজন প্রকাশ্যেই বলছিলো, আল্লাহর কসম আমি আলীকে হত্যা করবো। কিন্তু হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এদের সকলকেই ছেড়ে দেন এবং নিজের লোকদের বলেন, তোমরা ইচ্ছে করলে তাদের গালমন্দের জবাবে গালমন্দ দিতে পারো। কিন্তু কার্যত কোনো বিদ্রোহাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত নিছক মৌখিক বিরোধিতা এমন কোনো অপরাধ নয়, যার জন্য তাদের শাস্তি দেয়া যেতে পারে। [সুরুখসী, আল-মাবুসত, ১০ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১২৫। সায়াদাত প্রেস, মিসর, ১৩২৪ হিজরী।]
ওপরে আমরা খিলাফতে রাশেদার যে অধ্যায়ের আলোচনা করেছি, তা ছিলো আলোর মীনার। পরবর্তীকালে ফুকাহা-মুহাদ্দিসীন এবং সাধারণ দীনদার মুসলমান সে আলোর মীনারের প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন। ইসলামের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, নৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তাঁরা এ মীনারকেই আদর্শ মনে করে আসছেন।

Page 10 of 16
Prev1...91011...16Next

© Bangladesh Jamaat-e-Islami

  • আমাদের সম্পর্কে
  • প্রাইভেসি পলিসি
  • যোগাযোগ
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস

@BJI Dhaka City South