প্রথম খন্ড
ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন
ধর্ম ও রাজনীতি
ইসলামের রাজনৈতিক মতাদর্শ
কুরআনের রাজনৈতিক দর্শন
খিলাফতের তাৎপর্য
জাতীয়তার ইসলামী ধারণা
প্রথম অধ্যায়
ধর্ম ও রাজনীতি
১. ধর্ম সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি
২. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজন কেন?
৩. ইসলাম ও কর্তৃত্ব
৪. ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক কারার ভ্রান্ত মতবাদ
৫. ধর্ম রাজনীতিকে পৃথক করার মতবাদ খন্ডন
ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অধ্যয়নকালে আমাদের সামনে সর্বপ্রথম যে প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলো ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কি ধারণা পেশ করে আর রাজনীতি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব এবং সামাজিক জীবনের সামগ্রিক বিষয়েই বা ইসলামের দৃষ্টিভংগি কি? ধর্ম সম্পর্কে সীমাবদ্ধ ধারণার কারণে ধর্মই অধিকতর বিভ্রান্তিকর ধারণার শিকার হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক মহলই নয়, ধর্মীয় মহলও এ বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত। তাই আমরা এ গ্রন্থের সূচনাই করতে চাই ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের আলোচনা মধ্য দিয়ে।
আধুনিক কালের ইসলামী চিন্তা গবেষণার ময়দানে এ বিশেষ অবদান কেবল মাওলানা মাওদূদীরই যে, তিনি ধর্ম ও রাজনীতির পার্থক্যকরণের উপর হেনেছেন এক কার্যকর আঘাত। আয়নার মতো স্বচ্ছ করে পেশ করেছেন ইসলামের পূর্ণাংগ ও বৈপ্লবিক রূপরেখা। এ ধ্যায়টিকে আমরা সজ্জিত করেছি। তাঁর কয়েকটি অমূল্য রচনার সমন্বয়ে। বিভিন্ন সময়ে রচিত এ প্রবন্ধগুলোকে এখানে আমরা মুক্তার মালার মতো গেঁথে দিয়েছি বাস্তব পরস্পরায়।– সংকলন।
ধর্ম ও রাজনীতি [এ অংশ সংকলন করা হয়েছে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুসলমান গ্রন্থ থেকে।]
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবূয়্যত লাভের পূর্বে পৃথিবীর ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ ধারণা এই ছিলো যে, জীবনের অনেকগুলো দিক ও বিভাগের মধ্যে এটাও একটা বিভাগ। অন্য কথায়, এটা মানুষের পার্থিপ জীবনের একটা লেজুড় বিশেষ, যা পরপারের জীবনে ত্রাণ লাভের জন্যে একটা সার্টিফিকেট হিসেবে ব্যবহৃত হবে। মানুষ ও তার উপাস্যের মধ্যে যে সম্পর্ক, ধর্মের সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে কেবলমাত্র সেই সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে ব্যক্তি মুক্তির উচ্চতর মর্যাদা প্রত্যাশা করে, তার জন্যে পার্থিব জীবনের অন্য সকল বিভাগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে কেবল এ বিভাগটির কাজে নিয়োজিত ও নিবেদিত হওয়া আবশ্যক। কিন্তু এতো উচ্চ মর্যাদা যার কাম্য নয়, বরং শুধুমাত্র মুক্তিলাভ করাকেই সে যথেষ্ট মনে করে এবং সেই সাথে এটাও তার প্রত্যাশা যে তার মাবুদ তার উপর অনুগ্রহ ও করুণা বর্ষণ করতে থাকুক এবং তাকে পার্থিব জীবনের সমস্ত তৎপরতায় কল্যাণ ও সমৃদ্ধি দান করুক, সে ব্যক্তির জন্যে তার পার্থিব জীবনের সাথে ধর্মের এ লেজুড়টাও জুড়ে রাখা যথেষ্ট। দুনিয়ার যাবতীয় কাজকর্ম যেমন চলছে তেমনই চলবে, সেই সাথে কিছু কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার মাধ্যমে মাবুদকেও খুশী করা হতে থাকবে। নিজের সত্তার সাথে, সমাজের অন্যান্য লোকদের সাথে এবং আশপাশের সমগ্র জগতের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক, তা এক জিনিস। আর আপন মা’বুদের সাথে তার যে সম্পর্ক, সেটা ভিন্ন আরেক জিনিস। এ দু’সম্পর্কের মধ্যে কোনো পারস্পরিক যোগসূত্র নেই। এ ছিলো জাহেলিয়াতের ধ্যান ধারণা। এ ধ্যান ধারনার ভিত্তিতে কোনো মানবীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইমারত গড়ে ওঠা সম্ভব ছিলোনা। সভ্যতা ও সংস্কৃতি বলতে মানুষের গোটা জীবনকেই বুঝায়। যে জিনিস মানব জীবনের জন্যে নিছক লেজুড় বিশেষ, তার ওপর যে সমগ্র জীবনের ইমারত কিছুতেই তৈরী হতে পারেনা, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এ কারনেই দুনিয়ার সর্বত্র ধর্ম এবং সভ্যতা কৃষ্টি সব সময়ই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো। যদিও এ উভয় জিনিস পরস্পরের ওপর কমবেশী প্রভাব বিস্তার করেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা ছিলো একান্তই পরস্পর বিরোধী কতিপয় বস্তুর একত্র অবস্থানের ফলে সৃষ্টি প্রভাবের মতই। তাই এ প্রভাব কোথাও এ দুটির কোনোটির জন্যই উপকারী ও ফলপ্রসূ হয়ে দেখা দেয়নি। ধর্ম যখন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবান্বিত করেছে, তখন তাতে ঢুকিয়ে দিয়েছে বৈরাগ্যবাদ, বস্তুগত সম্পর্ক ও সংযোগের প্রতি ঘৃণা, পার্থিব স্বাদ সম্ভোগে বিতৃষ্ণা ও অনীহা, জাগতিক উপায় ও উপকরণের সাথে সম্পর্কহীনতা, মানবীয় সম্পর্ক ও বন্ধনসমূহের ব্যাপারে ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা, পারস্পরিক বিদ্বেষ ও বৈষম্য এবং সংকীর্ণতা ও গোড়ামীর উপাদান। এ প্রভাব কোনো অর্থেই উন্নতি ও প্রগতির সহায়ক ও পোষাক ছিলোনা। বরং পার্থিব অগ্রগতির পথে তা ছিলো এক বিরাট প্রতিবন্ধক। পক্ষান্তরে সে সভ্যতা ও সংস্কৃতি যা ছিলো আগাগোড়াই বস্তুবাদ ও স্বেচ্ছাচার ভিত্তিক, তা যখনই ধর্মের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে, তাকে দুষিত ও নোংরা করে ছেড়েছে। প্রবৃত্তি পূজার যাবতীয় পংকিলতা আবীলতা ও কদর্জতা দিয়ে তাকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। প্রবৃত্তির প্রতিটি নিকৃষ্ট ও জঘণ্য কামনা বাসানাকে সে ধর্মীয় পবিত্রতা ও মাহাত্ম্যের পোশাক পরিয়ে দিয়ে সর্বদা এরূপ স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেছে যেনো নিজের বিবেকও তাকে দংশন না করতে পারে এবং অন্য কেউও তার বিরোধিতা করতে সক্ষম না হয়। এরূপ প্রভাব বিস্তারের কারণেই আমরা কোনো কোনো ধর্মের আনুষ্ঠানিক উপাসনাতে পর্যন্ত ভোগাসক্তি ও নির্লজ্জতার এমনসব আচরণ দেখতে পাই। যাকে ধর্মীয় অংগনের বাইরে স্বয়ং সেইসব ধর্মের অনুসারীরাও চরিত্রহীনতার কাজ বলে আখ্যায়িত না করে পারেনা।
ধর্ম ও সভ্যতার এ পারস্পরিক প্রভাব আদান প্রদানকে উপেক্ষা করলেও যে বাস্তব সত্যটি সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে, তা হলো, পৃথিবীর সর্বত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইমারত ধর্মহীনতার ভিত্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত।
প্রকৃত ধর্মপারায়ন লোকেরা আপন মুক্তির দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছে। আর দুনিয়াদাররা দুনিয়াবী কর্মকান্ডকে আপন প্রবৃত্তির কামনা ও বাসনা এবং আপন আপন অসম্পূর্ণ ও অপরিপক্ক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারিতার অধীনে সম্পন্ন করেছে। যদিও তাদের সে অভিজ্ঞতাকে প্রত্যেক যুগেই পরিপক্ক ও নির্ভূল বলে ধরে নেয়া হয়েছে। এবং সে যুগে অতিক্রান্ত হলেই তা অপরিপক্ক ও ত্রুটিপূর্ণ বলে সাব্যস্ত হয়েছে। দুনিয়াদাররা দুনিয়াবী কর্মকান্ড স্বেচ্ছাচারীভাবে সম্পন্ন করলেও প্রয়োজন মনে করলে সেই সাথে আপন প্রভুকে খুশী করার জন্য একটু আধটু ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিও পালন করেছে। যেহেতু ধর্ম তাদের কাছে জীবনের নিছক একটা লেজুড় বিবেচিত হতো, তাই তাদের দুনিয়াবী কর্মকান্ডের পাশাপাশি যেটুকু ধর্মের অবস্থান ছিলো, সেটুকু নেহায়েত লেজুড়ের আকারেই ছিলো। সকল রকমের যুলুম-নির্যাতন, অর্থনৈতিক অবিচার, সামাজিক ভারসাম্যহীনতা এবং সাংস্কৃতিক ভ্রষ্টতা ও অনাচারের সাথেই এ লেজুড়টি সংযুক্ত ছিলো। দুস্যবৃত্তি ও ঠগবাজির সাথে যেমন তার সহাবস্থান ছিলো। আগ্রাসন, লুটতরাজ, শোষণ, ত্রাস, সুদখোরী, অর্থলোলুপতা, অশ্লীলতা ও বেশ্যাবৃত্তির সাথেও তার নিরন্তর সহগামিতা এবং সহযোগিতা ছিলো।
১. ধর্ম সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই প্রেরিত হয়েছিলেন যে, ধর্ম সংক্রান্ত জাহেলী ধ্যাণ ধারণার অপনোদন করে একটি যুক্তিসংঙ্গত ও সুষ্ঠ চিন্তা- ধারণা পেশ করবেন। আর পেশ করেই শুধু ক্ষান্ত হবেননা, বরং তার ভিত্তিতে সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি পরিপূর্ণ কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে কার্যকরভাবে ও সফলভাবে সাথে তা চালু করে দেখিয়েও দেবেন। তিনি বললেন, ধর্ম যদি জীবনের নিছক একটা বিভাগ বা লেজুড় হয়, তবে তা নেহায়েৎ ফালতু ও অর্থহীন জিনিস। এমন জিনিসকে ধর্ম নামে আখ্যায়িত করাই ভুল। আসলে ধর্ম বা দ্বীন কেবল সেই জিনিসকেই বলে যাবে, যা জীবনের কোনো অংশ বিশেষের নয়, বরং গোটা জীবনের আদর্শ হতে পারে। হতে পারে মানুষের সমগ্র জীবনের প্রেরণার উৎস ও পরিচালিকা শক্তি। হতে পারে বুদ্ধি, বিবেচনা, উপলব্ধি, চিন্তা ও দৃষ্টির পথ প্রদর্শন, ন্যায় ও অন্যায় এবং ভুল ও নির্ভুল যাচাই করার কষ্টিপাথর। যা দেখাতে পারবে জীবনের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ও প্রতিটি পদক্ষেপে হকপথ ও বাতিল পথের পার্থক্য যা মানুষকে বাঁচাতে পারবে অন্যায় ও অসত্য পথ থেকে আর সত্য ও ন্যায়ের পথে দৃঢ়তার সাথে টিকে থাকা সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগাবে এবং দুনিয়া থেকে আখিরাত পর্যন্ত বিস্তৃতি জীবনের এ সুদীর্ঘ ও অফুরন্ত অভিযাত্রায় মানুষকে কামিয়াবী ও সৌভাগ্যের সাথে প্রতিটি মঞ্জিল অতিক্রম করাতে পারবে।
এ ধর্মের না ইসলাম। এটা জীবনের লেজুড় হয়ে থাকার জন্য আসেনি। তাকে যদি প্রাচীন জাহেলী ধ্যাণ ধারণা অনুসারে জীবনের একটা লেজুড় বলে ধরে নেয়া হয়, তবে তার আগমনের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যেতে বাধ্য। ইসলাম মানুষ ও আল্লাহর সম্পর্ক নিয়ে যতোটা আলোচনা করে, ঠিক ততোটাই আলোচনা করে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে এবং ঠিক ততোটাই আলোচনা করে মানুষের সাথে বিশ্ব প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়েও। ইসলামের আবির্ভব শুধু এ তত্ত্বটাই মানুষকে জানানোর জন্যে যে, সম্পর্ক ও সম্বন্ধের এ বিবিধ ক্ষেত্রগুলো পৃথক নয় কিংবা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি সমষ্টিরই সমন্বিত ও সংগঠিত অংশ মাত্র। মানুষের সাথে বিশ্ব প্রকৃতির সম্পর্ক সঠিক হতেই পারেনা যতক্ষণ না মানুষের সাথে বিশ্ব স্রষ্টার সম্পর্ক সঠিক হয়। কাজেই এ দু’সম্পর্ক পরস্পরের পরিপূরক ও পরিশোধক। উভয়ে মিলিত হয়ে একটি সফল জীবন গড়ে তোলে। ধর্মের আসল কাজ হলো, সফল জীবনের জন্যে মানুষকে মানসিক ও চারিত্রিকভাবে প্রস্তুত করা। যে ধর্ম এ কাজটি করেনা তা ধর্মই নয়। আর যে ধর্ম এ কাজটি করে থাকে, তারই নাম ইসলাম। এ জন্যই বলা হয়েছেঃ
“আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র জীবন বিধান।” [আল কুরআন]
ধর্ম ও সংস্কৃতি
বস্তুত ইসলাম হলো চিন্তার একটা বিশিষ্ট প্রণালী [Attitude of mind] এবং গোটা জীবন সম্পর্কে একটা বিশেষ ধরনের দৃষ্টিভংগিও [Out look on life] । তাছাড়া ঐ বিশেষ চিন্তা প্রণালী এবং জীবন সংক্রান্ত বিশেষ দৃষ্টিভংগির আলোকে নির্মিত একটা অনন্য কর্মপদ্ধতিও। এ চিন্তা প্রণালী ও কর্মপদ্ধতির সংযোগ ও সমন্বয়ে যে কাঠামো গড়ে ওঠে, সেটাই হলো দীন ইসলাম। সেটাই সভ্যতা ও কৃষ্টি। এখানে দীন এবং সভ্যতা সংস্কৃতি কোনো আলাদা আলাদা বস্তু নয়, বরং এসব কয়টি মিলে একটা সুসমন্বিত সমষ্টির জন্ম হয়। এই একই চিন্তা পদ্ধতি ও জীবন যাপন প্রণালী মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করে। মানুষের ওপর আল্লাহর অধিকার কি কি, তার নিজের কি কি অধিকার, মা, বাপ, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শী, লেনদেন ও কায়কারবারের অংশীদারের, স্বধর্মী এবং বিধর্মী শত্রু ও বন্ধু, গোটা মানব জাতি, এমনকি বিশ্ব প্রকৃতির বস্তু ও শক্তি নিচয়ের কি কি অধিকার? এসমস্ত অধিকারের মধ্যে ইসলাম পূর্ণ ভারসাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। একজন মানুষের মুসলমান হওয়াই এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত নিশ্চয়তা প্রদান করে যে, সে এসকল অধিকার পূর্ণ সততা ও ন্যায় নিষ্ঠাতার সাথে প্রদান করবে এবং অন্যায়ভাবে এক অধিকার আদায় করতে গিয়ে অন্য অধিকার বিনষ্ট করবেনা।
চিন্তার এ বিশিষ্ট পন্থা ও জীবন সংক্রান্ত এ বিশেষ মতবাদ মানব জীবনের জন্য এক অতি উন্নত ও মহৎ নৈতিক লক্ষ্য এবং একটা পবিত্র আধ্যাত্মিক মঞ্জিলে মকসুদ নির্ধারণ করে দেয়। জীবনের সকল চেষ্টা সাধনাকে তা সে যেকোনো কর্মক্ষেত্রেই হোকনা কেন, এমন কতোগুলো রাজপথে নিয়ে পৌছে দেয়, যে রাজপথগুলো সকল দিক থেকে একই কেন্দ্রের দিকে ধাবমান।
এ কেন্দ্র হলো একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী বিষয়। প্রতিটি জিনিসের মান নির্ধরিত হয় এরই নিরীখে এবং প্রতিটি জিনিসের যাচাই হয় এ মানদন্ডে। এ কেন্দ্রীয় মঞ্জিলে মকসুদে পৌছার ব্যাপারে যে জিনিস সহায়ক, তা গ্রহণ করা হয়। আর যা এর পথে অন্তরায় তা করা হয় বর্জন। ব্যক্তি জীবনের ক্ষদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয় থেকে শুরু করে সমাজ জীবনের বড় বড় ব্যাপারেও এ মানদন্ড সমানভাবে প্রযোজ্য। পানাহারে, পোশাকে পরিচ্ছেদে, ব্যবহারে, শিল্প কারখানার পারস্পরিক সম্পর্কে, লেনদেনে, কথাবার্তায় মোটকথা জীবনের প্রতিটি কাজকর্মে কোনো ব্যক্তির কি কি সীমা ও বিধিনিষেধ মেনে চলা দরকার এবং মেনে চললে সে মঞ্জিলে মকসুদ অভিমুখী সোজা পথে অগ্রসরমান থাকতে পারবে এবং বক্র ও ভ্রষ্ট পথে পা বাড়ানোর, তারও ফয়সালা এ মানদন্ড দ্বারাই হয়ে থাকে। একই মানদন্ড এও নির্ণয় করে দেয় যে, সামষ্টিক জীবনে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক কোন নীতিমালার ভিত্তিতে বিধিবদ্ধ হলে সামাজিক আচার আচরণ, অর্থনৈতিক লেনদেন, রাজনৈতিক কর্যকলাপ এক কথায় জীবনের সকল ক্ষেত্রের বিকাশ ও উন্নয়ন উক্ত মঞ্জিলে মকসুদ অভিমুখী পথ ধরেই সম্পন্ন হতে পারবে এবং উক্ত মঞ্জিলে মকসুদ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এমন পথে সম্পন্ন হবেনা। আকাশ ও পৃথিবীর যেসকল উপায় উপকরণের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যেসকল জিনিসকে তার অনুগত ও বশীভূত করে দেয়া হয়েছে, তাকে সে কোন কোন পন্থায় ব্যবহার করলে তা তার সাফল্যের পথে অন্তরায় হবে বলে তা তার এড়িয়ে চলা উচিত, সে সম্পর্কেও ঐ মানদন্ডের নিরীখেই সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। একই মানদন্ডে এ ব্যাপারেও ফয়সালা করা সম্ভব যে, ইসলামী সমাজের লোকদেরকে অনৈসলামী সমাজের সাথে শত্রুতায় ও মিত্রতায়, যুদ্ধে ও সন্ধিতে, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ঐক্যে ও বিভিন্নতায়, বিজয়ী অবস্থায় ও পরাজিত অবস্থায়, বিদ্যা ও জ্ঞানার্জনে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির আদান প্রদানে কোন নীতিমালা অনুসরণ করা কর্তব্য, যাতে করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এসব বিভিন্ন স্তরে তারা আপন লক্ষ্য হারিয়ে না বসে বরং যতোদূর সম্ভব, মানবজাতির এ অজ্ঞ ও বিপথগামী সদস্যদেরকে দিয়েও ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, সচেতনভাবে কিংবা অবচেতনভাবে, সেই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের কাজ নিতে পারে, যা মূল স্বভাব ধর্মের বিচারে মুসলমানদের মতো তাদেরও জীবনের উদ্দেশ্য।
মোটকথা, মসজিদ থেকে শুরু করে বাজার ও রণাঙ্গণ পর্যন্ত, ইবাদত উপাসনার নিয়মকানুন থেকে শুরু করে রেডিও ও উড়োজাহাজের ব্যবহারবিধি পর্যন্ত; ওজু, গোসল, পবিত্রতা অর্জন ও পেশাব, পায়খানার খুটিনাটি মাসয়ালা মাসায়েল থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জীবনের মূলনীতি পর্যন্ত, মকতবের হাতে খড়ি শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক নিদর্শনাবলীর পর্যবেক্ষণ ও মহাজাগতিক নিয়মাবলীর সর্বোচ্চমানের তত্বানুসন্ধান ও গবেষণা পর্যন্ত জীবনের সকল চেষ্টা সাধনা এবং চিন্তা ও কর্মের সকল বিভাগকে ঐ একই দৃষ্টিভংগি এমন একটি সুসমম্বিত এককে পরিণত করে, যার সকল অংশ উদ্দেশ্যগতভাবে সুবিন্যাস্ত এবং স্বেচ্ছাগতভাবে মিলিত হয় যে, এগুলোর সম্মিলিত ক্রিয়া ও চালনা দ্বারা একই ফল উৎপন্ন হয়।
ধর্মের জগতে এটা ছিলো এক বৈপ্লবিক ধারণা। নিরেট জাহেলিয়াত থেকে উদগত মস্তিষ্কে এ ধারনা কখনো পুরোপুরিভাবে স্থান লাভ করতে পারেনি। জ্ঞান বিস্তার ও বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে আজকের পৃথিবী খৃষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর চাইতে অনেক বেশী অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও এত সেকেলে ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা বিরাজমান যে, ইউরোপের বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত লোকেরাও এ বৈপ্লবিক আদর্শকে উপলব্ধি করতে ঠিক ততখানিই অক্ষম, যতখানি অক্ষম ছিলো আদিম জাহেলী সমাজের গন্ডমূর্খ নির্বোধ লোকগুলো। হাজার হাজার বছর ধরে ধর্ম সম্পর্কে যে ভ্রন্ত ধারণা পুরুষানুক্রমে চলে আসছে, তাদের মস্তিষ্ক আজও তার বজ্র আঁটুনীতে আবদ্ধ। যুক্তিভিত্তিক সমালোচনা ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসন্ধানের সর্বোত্তম প্রশিক্ষণেও সে বন্ধন খোলা সম্ভব হচ্ছেনা। মসজিদ ও খানকার অন্ধকারে প্রকোষ্ঠে অবস্থানকারীরা যদি ধার্মিকতার অর্থ নির্জনে বসে আল্লাহ আল্লাহ জপ করা মনে করে এবং দীনদারী বলতে আনুষ্ঠানিক ইবাদত উপাসনার গন্ডীতে আবদ্ধ থাকা বুঝে, তাহলে সেটা তেমন বিস্ময়ের ব্যাপারে হয়না। কেননা তারা তো আদতেই রক্ষণশীল। অজ্ঞ জনসাধারণ যদি ধর্মকে বাদ্য বাজানো তাজিয়া অনুষ্ঠান এবং গোপূজার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করে তাহলে তাতেও অবাক হবার কিছু থাকেনা। কিন্তু বড় বড় বিদ্বান ও পন্ডিতদের কি হয়েছে যে, তাদের মস্তিষ্ক থেকেও সেকেলে ধ্যান ধারণার অন্ধকার দূরিভূত হলোনা? অমুসলিম প্রাচীন জাহেলী ভাবধারার আওতাধীন ধর্মকে যে অর্থে গ্রহণ করে, ঠিক সেই অর্থেই ইসলামকে একটা ধর্ম মনে করে থাকে এ পন্ডিত মহোদয়রা।
আমাদের রাজনীতিতে জাহেলী চিন্তাধারার প্রভাব
উপলব্ধির ও সীমাবদ্ধতা ও অনুধাবনের এ অক্ষমতার দারুন মুসলিম শিক্ষিত শ্রেণীর একটা বৃহৎ অংশ শুধু যে নিজেরাই ভ্রান্ত পথে চলছে তাই নয়, বরং গোটা দুনিয়ায় তারা ইসলাম এবং ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পর্কে নিদারুণ ভুল ধারণার প্রসার ঘটাচ্ছে। মুসলিম জাতির যেসব প্রকৃত সমস্যা সমাধানের ওপর তাদের বাঁচা মরা নির্ভরশীল, সেগুলো তাদের একেবারেই বুঝে আসেনা। অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলোকেই তারা আসল সমস্যা মনে করে উদ্ভট পন্থায় সেগুলোর সমাধনের চেষ্টা করছে। এসমস্ত চেষ্টার মধ্য দিয়ে বস্তুত ধর্মের সেই পুরনো সংকীর্ণ ধারাই বিভিন্ন রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। কেউ বলেন, আমি প্রথমে ভারতীয়, তারপর মুসলমান। এ কথাটা তারা যখন বলেন, তখন তাদের মন মস্তিষ্কে ধর্ম সম্পর্কে ও ধারণাই বিদ্যমান থাকে যে, ইরানী ইসলাম, মিশরীয় ইসলাম, ভারতীয় ইসলাম, অতপর ভারতীয় ইসলামের মধ্যেও আবার বাঞ্জাবী, বাঙ্গালী, দাক্ষিণাত্মীয়, মাদ্রাজী প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ইসলাম হতে পারে। প্রত্যেক অঞ্চলের মুসলমানরা নিজ নিজ আঞ্চলিক অবস্থা অনুপাতে আলাদা আলাদা চিন্তাধারা অবলম্বন করতে পারে ও জীবন সম্পর্কে ভিন্ন রকমের দৃষ্টিভংগি ও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে। বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন মূলনীতি ও মতাদর্শ অনুসারে যেসব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিজেদের মধ্যে চালু করে নিয়েছে তার মধ্য তারাও মিলে মিশে যেতে পারে এবং তার পরেও পার্থিব জীবনের যে কোনো পথ ও পদ্ধতির সাথে সংযুক্ত হতে সক্ষম।
আরেক ভদ্র লোক বলেন, মুসলমানদের বৈষয়িক ও ধর্মীয় ব্যাপারগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্ণয় করা উচিত। ধর্মের সম্পর্ক হলো মানুষ ও আল্লাহর মধ্যকার ব্যাপারগুলোর সাথে। অর্থাৎ আকিদা বিশ্বাস ও ইবাদতের সাথে। এগুলোর ক্ষেত্রে মুসলমানরা স্বতন্ত্র নিয়য়ে চলতে পারে। কেউ তাদেরকে এ পথ থেকে হটাতে চাইবেওনা, পারবেওনা। কিন্তু বৈষয়িক ব্যাপারগুলোর কথা আলাদা। সে ব্যাপারে ধর্মের নাকগলানোর দরকার নেই। দুনিয়ার অন্যান্য লোকেরা যেভাবে বৈষয়িক ব্যাপার আঞ্জাম দিয়ে থাকে, মুসলমানদেরও সেভাবে আঞ্জাম দেয়া উচিত।
অপর এক ভ্রদ্র মহোদয় বলেন, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অধিকারের ক্ষেত্রে মুসলমানদের একটা আলাদা পদ্ধতি নিসন্দেহে থাকা চাই। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে তাদের পৃথক সমাজ গঠনের প্রয়োজন নেই। এসব ব্যাপার মুসলিম ও অমুসলিমের ভেদাভেদ নিতান্তই অবান্তর ও কৃত্রিম। এ ক্ষেত্রে অন্য যেসব সম্প্রদায় ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসারে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাবলীর সমাধানের চেষ্টা করছে, তাদের সাথে মুসলিম জাতির বিভিন্ন শ্রেণীর নিজ নিজ স্বার্থ ও উদ্দেশ্য অনুসারে ভিড়ে যাওয়াই বাঞ্চনীয়।
মুসলিম জাতির ঝিমিয়ে পড়া সত্তায় নতুন প্রাণ সঞ্চারের উদ্যেক্তারূপে আবির্ভূত আরেক ভদ্রলোকের অভিমত হলো, আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস স্থাপন এবং কুরআন সুন্নাহর অনুসরণ আসল জিনিস নয়, বরং জগতের বস্তু নিচয়কে বশীভূত করা, প্রাকৃতিক বিধিসমূহ অবগত হওয়া এবং আইন শৃংখলার শক্তি দিয়ে উক্ত বশীভূত বস্তুনিচয় ও আহরিত বিধিসমূহকে কাজে লাগানোটাই হলো আসল প্রতিপাদ্য বিষয়। এগুলোকে কাজে লাগানোর মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা ও পরাক্রম লাভ করা সম্ভব। এ ভদ্রলোক বস্তুগত ও বৈষয়িক উন্নতিকেই মানুষের আসল ও প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য বলে অভিহিত করেন। তাই এ উন্নতির সহায়ক উপায় উপকরণগুলোই তাঁর কাছে যথার্থ গুরুত্বের অধিকারী। পক্ষান্তরে জ্ঞান ও বুদ্ধির পশ্চাতে যে মন-মগজ ক্রিয়াশীল এবং যা আপন বিশিষ্ট চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভংগির নিরীখে উন্নয়নের উপায়-উপকরণসমূহ ব্যবহারের উদ্দেশ্য, সভ্যতা ও কৃষ্টির উৎকর্ষ ও অগ্রগতির পথ ও পন্থা এবং পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা ও পরাক্রম লাভের প্রক্রিয়া নির্ণয় করে, সেই মন মগজের কোনো গুরুত্বই তাদের দৃষ্টিতে নেই। সে মস্তিষ্ক জাপানী, জার্মান, বা ইটালিয়ান হোক অথবা তা হোক ওমর ফারুক কিংবা খালেদ বিন ওলীদের মন মস্তিষ্ক, সেটা তাদের আদৌ বিবেচ্য বিষয় নয়। তাদের দৃষ্টিতে এসব একই রকমের “ইসলামী” মন মগজ। কেননা এ সবেরই কর্যক্রম তাদের চোখে একই ফল দর্শায়। অর্থাৎ একই পার্থিব প্রতিষ্ঠা ও পারাক্রম তার দ্বারা অর্জিত হয়। তাদের দৃষ্টিতে “পৃথিবীর উত্তরাধিকার” [অর্থাৎ প্রতিষ্ঠা ও কর্তৃত্ব] যে পেয়েছে, সেই “ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ”, চাই সে ইবরাহীমের মোকাবিলায় নমরুদেই হোক। অন্য কথায় বলা যায়, যে ব্যক্তি পরাক্রান্ত ও বিজয়ী সেই, “মুনিন”, চাই সে হযরত ঈসার মোকাবিলায় রোম সম্রাটই হোক না কেন।
আর একটা বড় গোষ্ঠী মুসলমানদের জাতীয় স্বার্থ ও অথিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে ময়দানে নেমেছে। তাদের মতে, মুসলমানদের ধর্ম ও সে ধর্মের বিধিবদ্ধ পারিবারিক আইন সংরক্ষণের আশ্বাস প্রদান, তাদের ভাষাকে বর্ণমালা সমেত অন্যতম সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান এবং একমাত্র ইসলামী বেশভূষা ধারীদেরকেই মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার প্রদান করা হলেই ইসলাম এবং ইসলামী সভ্যতা ও কৃষ্টি সংরক্ষিত হয়। নির্বাচনযোগ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে ও সরকারী চাকুরীতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব তাদের মতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর যাদি এরূপ স্থির করে দেয়া হয় যে, মুসলিম প্রতিনিধিদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কর্তৃক গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত ইসলামের একন্ত ধর্মীয় ব্যাপারে কোনো নিষ্পত্তি হবেনা, তাহলে তাদের মতে মুসলিম অধিকার যেনো ষোল আনাই আদায় হয়ে গেলো।
দেখলেন তো? বাহ্যিক রূপের কি বিস্তার পার্থক্য, কিন্তু ভেতরের মূল জিনিসটি এর সবকয়টিতে একই থেকে যাচ্ছে। এসবই হচ্ছে ধর্ম সংক্রান্ত জাহেলী ধ্যান ধারণার বিভিন্ন রূপ মাত্র, যা ইসলামী ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে প্রত্যেক যুগেই নিত্য নতুন আকারে বিদ্রোহ প্রকাশ করে আসছে।
তারা যদি যথাযথভাবে উপলব্ধি করেন যে, মুসলমান কাকে বলে এবং সত্যিকার অর্থে ইসলামী সমাজ বা উম্মাহ বলতে কোন গোষ্ঠিকে বোঝায়, তাহলে তাদের সকল ভুল ধারণার অপনোদন হওয়া সম্ভব। আইনগতভাবে তো যে ব্যক্তি মুখে কালেমা পড়ে এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো মেনে নেয়, সে মুসলিম হিসেবে গন্য। কিন্তু যিনি এ অর্থে মুসলমান তাঁর মর্যাদা শুধু এতোটাকুই যে, তিনি ইসলামের চৌহদ্দীর ভেতরে আছেন। আমরা তাকে কাফের বলতে পারিনা এবং শুধুমাত্র ইসলাম গ্রহণের কারণে মুসলিম সমাজে তার যেসব অধিকার প্রাপ্য হয়, তা দিতে অস্বীকারও করতে পারিনা। এটুকুই আসল ইসলাম নয়, বরং কেবলমাত্র ইসলামের সীমানায় প্রবেশের অনুমতিপত্র। আসল ইসলাম হলো এই যে, গোটা মন মানস ইসলামের সাথে গড়ে ওঠবে। তার চিন্তা ভাবনার পদ্ধতি হবে হুবহু কুরআনের চিন্তাপদ্ধতি। জীবন ও তার সকল তৎপরতা ও আচরণের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভংগি হবে অবিকল কুরআনের দৃষ্টিভংগি। কুরআন সকল জিনিসের মূল্যবান নির্ণয়ের যে মানদন্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে, ঠিক সেই মানদন্ডই সে সকল জিনিসের মান নির্ণয় করবে। তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে অবিকল তাই, যা কুরআন দেখিয়ে দিয়েছে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে রকমারি মত ও পথ বর্জন করে তারা একটিমাত্র পথ বেছে নেবে এবং সেই বাছাই কাজটাও সম্পন্ন করবে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে যা কুরআন ও রাসূলের পথনির্দেশ থেকে তারা লাভ করেছে।
কোনো মুসলমানের মন মগজকে যদি এটা আকৃষ্ট করতে না পারে এবং কুরআনের মনোভংগির আলোকে তার মনোভংগি গড়ে উঠতে প্রন্তুত না হয়, তাহলে ইসলামের চৌহদ্দীর মধ্যে ঢুকতে বা বহাল থাকতে কেউ তাকে বাধ্য করেনা। সততা ও বুদ্ধিমত্তার দাবী এই যে, এমতাবস্থায় তাদেরকে ইসলামের চৌহদ্দীর বাইরেই নিজের জন্যে উপযুক্ত স্থান খুঁজে নেয়া উচিত। পক্ষান্তারে তার মন মগজ যদি এ জিনিসটাকে গ্রহণ করে এবং সে নিজের মন মানসিকতাকে কুরআনের মতো করে গড়ে তুলতে চায়, তাহলে কুরআন যাকে মুমিনদের পথ বলে অভিহিত করা হয়েছে, তাথেকে তার মত ও পথ কোনো ব্যাপারেই স্বতন্ত্র বা পৃথক হতে পারেনা।
কুরআনী দৃষ্টিভংগি
ইসলামী মন-মানস বা কুরআন অনুসারী মন-মানস আসলে এক এবং অভিন্ন জিনিস। তা যে বিশেষ জীবন বিধানের আওতাধীন কতিপয় আকীদার ওপর ঈমান আনে, কতিপয় আনুষ্ঠানিক ইবাদত নির্ধারণ করে, কাতিপয় ধর্মীয় রীতিনীতি অবলম্বন করে, ঠিক সেই একই জীবন বিধানের অধীন সে পানাহারের দ্রব্যাদিতে, পরিধানের পোশাক পরিচ্ছদে, পোশাকের ধরন ও আকৃতিতে, সামাজিক রীতিনীতি ও চালচলনের পদ্ধতিতে, বাণিজ্যিক আদান প্রদানে, অর্থনৈতিক বন্দোনস্ত ও লেন দেনে, রাজনীতির নিয়ম প্রক্রিয়ায়, সভ্যতা ও সংস্কৃতির রকমারি বহিপ্রকাশে, আর বস্তুগত উপায় উপকরণ ও প্রাকৃতিক নিয়ম বিধি সংক্রান্ত জ্ঞান প্রয়োগের বিবিধ কর্মপন্থায় কতোগুলোকে বর্জন ও কতোগুলোকে গ্রহণ করে থাকে। এ সবগুলোর ব্যাপারে যেহেতু দৃষ্টিভংগি, চিন্তা পদ্ধতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং গ্রহণ ও বর্জনের মাপকাঠি এক ও অভিন্ন, তাই জীবন যাপনের পদ্ধতি, চেষ্টা ও তৎপরতার পন্থা এবং পার্থিব জীবনের আচার আচরণের নীতি নিয়ম বিভিন্ন রকমের হতে পারেনা। একথা সত্যি যে, খুঁটিনাটি বিষয়ে বাস্তব কর্মপদ্ধতির বিভিন্নতা ও বৈচিত্র আর নির্দেশমালার ব্যাখ্যায় ও নিত্যদিনের ঘটনাবলীতে মূলনীতির প্রয়োগে কমবেশী মতপার্থক্য ঘটা স্বাভাবিক। একই মস্তিষ্কের চিন্তাধারার রকমারি রূপ পরিগ্রহ করাও বিচিত্র নয়। কিন্তু এ বিভিন্নতা নিছক বাহ্যিক রূপগত বিভিন্নতা, মৌলিক ও উপাদানগত বিভিন্নতা কখনো নয়। যে মূল ভিত্তির ওপর ইসলামে গোটা জীবনের জন্যে পূর্ণাংগ বিধান রচনা করা হয়েছে এবং জীবনের সকল অংশ ও বিভাগকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে, তাতে কোনো ধরনের বিভিন্নতার অবকাশ নেই। আপনি ভারতীয় হোন কিংবা তুর্কী, কিংবা মিশরীয়, তাতে কিছু আসে যায়না। আপনি যদি মুসলমান হন, তাহলে আপনাকে এ পূর্ণাংগ বিধান পূরোপুরিভাবে তার অন্তর্নিহিত ভাবধারা সহকারেই গ্রহণ করতে হবে। আর যে কোনো বিধান স্বীয় মূলনীতি ও ভাবধারার বিচারে এ বিধানের বিরোধী হবে তাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
এখানে আপনার পক্ষে পার্থিব ও ধর্মীয় অংশগুলোকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করাই সম্ভব নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়া ও আখিরাত একই ধারাবাহিক জীবনের দুটি ধাপ মাত্র। প্রথম ধাপটা হলো চেষ্টা ও কর্মের আর দ্বিতীয়টা কর্মফলের। জীবনের প্রথম ধাপে আপনি দুনিয়াকে যেভাবে গ্রহণ করবেন, পরবর্তী ধাপে সে ধরনের ফলই প্রকাশিত হবে। ইসলামের লক্ষ্য হলো আপনার চিন্তা ও কর্মকে এমনভাবে তৈরী করে দেয়া, যাতে জীবনের এ প্রাথমিক ধাপে আপনি দুনিয়াকে সঠিকভাবে গ্রহণ করেন এবং ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় ধাপে সঠিক ও সুষ্ঠু ফল লাভ করতে পারেন। কাজেই ইসলামে সমগ্র পার্থিব জীবনই ‘ধর্মীয় জীবন’। এতে আকীদা বিশ্বাস ও ইবাদত বন্দেগী থেকে শুরু করে সভ্যতা, কৃষ্টি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ধারা উপধারা পর্যন্ত সবকিছু একই নৈতিক ও উদ্দেশ্যগত যোগসূত্র বাঁধা।
আপনি যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে ইসলামের নির্দেশিত বিধান ছাড়া অন্য কোনো বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করতে চান, তাহলে এটা হবে আংশিকভাবে ইসলামকে পরিত্যাগ করার শামিল, যা শেষ পর্যন্ত ইসলামকে পূরোপূরিভাবে পরিত্যাগ করার পর্যায়ে পৌছিয়ে দিয়ে থাকে। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আপনি ইসলামের শিক্ষাগুলোকে যাচাই বাছাই করে তার কতককে গ্রহণ ও কতককে বর্জন করলেন। ইসলামের আকিদা বিশ্বাস ও মৌলিক ইবাদতসমূহকে তো আপনি গ্রহণ করেছেন আর এসব ইবাদতের ভিত্তিতে যে সর্বব্যাপী জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রথমত এ যাচাই বাছাই করাটাই ইসলামের দৃষ্টিতে ভুল। ইসলামের প্রতি যথার্থভাবে ঈমান রাখে এমন কোনো মুসলমান এ ধরনের কাজে প্রবৃত্ত হতেই পারেনা। কেননা তাহলে আল্লাহ যে সূরা বাকারার ৮৫ আয়াতে বলেছেনঃ
“তোমরা কি আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ মানবে আর কিছু অংশ করবে অস্বীকার?”
সেই কথাটাই সত্য হয়ে দাঁড়ায়। আর যদি এ যাচাই করে আংশিক ইসলামকে গ্রহণ করে ইসলামের গন্ডীর মধ্যে টিকে থাকারও সংকল্প নেন, তাহলেও আপনি এ গন্ডীর ভেতর বেশী দিন টিকে থাকতে পারবেননা। কারণ বাস্তব জীবন যাপন পদ্ধতির সাথে সংশ্রবহীন হওয়ার পর ইসলামী আকীদা ও ইবাদত সবই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। ওসবের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। অনৈসলামিক জীবনাদর্শের ওপর ঈমান আনার পর কুরআনের ওপর ঈমান বজায় থাকতেই পারেনা। কেননা কুরআন তো প্রতি পদে পদে ওসব বাতিল জীবনাদর্শকে খন্ডন করে।
পক্ষান্তরে আপনি যদি ইসলামী বিধান অনুসারে নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করতে চান, তাহলে আপনার আলাদা আলাদা দলে বিভক্ত হবার দরকার নেই। একই দল অর্থাৎ আল্লাহর দল এসব কাজের জন্যে যথেষ্ট। কেননা এখানে পুঁজিপতি ও শ্রমিক, ভূস্বামী ও চাষী, শাসক ও শাসিতের মধ্যে কোনো বিবাদ নেই। বরং তাদের মধ্যে সমন্বয় ও অংশীদারীত্ব সৃষ্টিকারী মূলনীতি বিদ্যমান। এসব মূলনীতি অনুসারে আপন জাতির বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সংহতি ও সমন্বয় সৃষ্টির চেষ্টা আপনি কেন করবেননা? যাদের কাছে এসব মুলনীতি নেই, তারা যদি অনন্যোপায় হয়ে শ্রেণী সংগ্রামের আগুনে ঝাঁপ দেয়, তাহলে আপনিও সেই আগুনে ঝাঁপ দেবেন কোন কারণে?
অনুরূপভাবে আপনি যদি বস্তুগত উন্নতি চান, পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়াতে ও প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চান, তাহলে ইসলাম নিজেই এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। তবে সে শুধু এটুকু চায় যে, আপনি ফেরাউন ও নমরূদের পরাক্রম এবং মূসা ও ইবরাহীমের পরাক্রমের মধ্যে যেনো পার্থক্য করেন। আজকের জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ড পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে আবার সাহাবায়ে কিরাম এবং ইসলামের প্রাথমিক শতাব্দীগুলোর মুসলমানরাও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। দুটোই প্রতিষ্ঠা এবং দুটোই পার্থিব উপায় উপকরণকে করায়ত্ব করা, প্রয়োগ ও ব্যবহার করা এবং প্রাকৃতিক নিয়ম সংক্রান্ত জ্ঞান ও তা কাজে লাগানোরই ফসল। কিন্তু উভয়ের উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভংগিতে আকাশ পাতাল ব্যাবধান। এ উভয় ফসলের বাহ্যিক এবং একেবারেই আপাত দৃশ্যমান সাদৃশ্য আপনার চোখে পড়ছে। অথচ উভয়ের মধ্যে মৌলিক ও নৈতিক দিক দিয়ে যে সুমেরু কুমেরুর ব্যবধান বিরাজমান, তা আপনার নজরে আসছেনা। দুনিয়া পূজারীদের উন্নতি ও প্রতিষ্ঠা প্রাকৃতিক উপায় উপকরণ করায়ত্ব করণের এমন এক প্রক্রিয়ার ফল, যার মূলে সক্রিয় রয়েছে জীবনের পাশবিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে যে ধরনের প্রতিষ্ঠা ও পরাক্রমের প্রতিশ্রুতি কুরআন দিয়েছে যদিও সেটি পার্থিব উপায় উপকরণ করায়ত্ব করা ও প্রয়োগ করার দ্বারাই অর্জিত হওয়া সম্ভব, কিন্তু তার গভীরে জীবনের উচ্চতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য বর্তমান থাকা প্রয়োজন। আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস যতক্ষণ পূরোপূরিভাবে বদ্ধমূল না হয় এবং নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের সাহায্যে যে লৌহ বেষ্টনীকে অধিকতর মজবুত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তার অধীন জীবনের সকল কর্যকলাপ ও চেষ্টা সাধনা নিয়ন্ত্রিত না হয়, ততক্ষণ সেই উচ্চতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করা অসম্ভব। অথচ ইসলামের উক্ত বুনয়াদী স্তম্ভগুলোকে আপনারা মোল্লা মৌলবীদের ভ্রান্ত ধর্ম বিশ্বাসের উদ্ভট আবিষ্কার বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
২. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজন কেন? [এক আহম ইস্তেফতা পুস্তক থেকে এ অংশ নেয়া হয়েছে।]
আমরা আগেই একথা পরিষ্কার করে বলেছি, মুসলমানরা যদি মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করতে চায়, তাবে তাদের নিজেদের গোটা জীবনকে আল্লাহর আনুগত্যের অধীন করে দিতে হবে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের সকল বিষয়ের ফয়সালা কেবলমাত্র আল্লাহর আইন ও শরীয়াহ মোতাবেক করতে হবে, এছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। আপনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি ঈমান পোষণ করার ঘোষণা করবেন আর জীবনের সামগ্রিক বিষয়াদি পরিচালনা করবেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের আইন অনুযায়ী, ইসলাম কোনো অবস্থাতেই এমনটি বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। এর চাইতে বড় স্ববিরোধিতা আর কিছু হতে পারেনা। এই স্ববিরোধিতাকে বরদাশত করার জন্যে নয়, নির্মূল করার জন্যে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। আমরা যে ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসনতন্ত্র দাবী করছি, তার পেছনে এই অনুভূতিই কাজ করছে যে, মুসলমান যদি আল্লাহর আইনই মেনে না চলে, তবে তো তার মুসলমান হবার দাবীই সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়ে। গোটা কুরআনই এই নির্জলা সত্য কথাটির প্রমাণঃ
১. কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহই সমস্ত জগত ও সম্রাজ্যের মালিক। তিনি স্রষ্টা, সৃষ্টিজগত তাঁর। তাই স্বাভাবিকভাবেই শাসনের অধিকার [Right to Rule] কেবল তাঁরই থাকা উচিত। তাঁর রাজ্যে [Dominion] তাঁর সৃষ্টির উপর তাঁর ছাড়া অপর কারো শাসন সার্বভৌমত্ব চলা মূলতই ভ্রান্ত। সঠিক পন্থা কেবল একটিই। তাহলো, তাঁর খলীফা ও প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর প্রদত্ত আইন ও বিধান অনুযায়ী শাসন পরিচালিত হবে এবং কার্যসম্পাদিত হবে। তাঁর অকাট্য ঘোষণা হলোঃ
ক. বলোঃ হে সাম্রাজ্য ও সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে চাও রাজ্যক্ষমতা দান করো। আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও। [সূরা আলে ইমরানঃ ২৬]
খ. তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রভূ প্রতিপালক। গোটা সাম্রাজ্য তাঁর। [সূরা ফাতিরঃ ১৩]
গ. রাজত্বে তাঁর কোনো অংশীদার [Partner] নেই। [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১১১]
ঘ. সুতরাং সমস্ত কর্তৃত্ব সমুচ্চ মহান আল্লাহর। [সূরা আল মুমিনঃ ১২]
ঙ. তিনি তাঁর কর্তৃত্বে কাউকেও অংশীদার বানাননা। [সূরা আল কাহাফঃ ২৬]
চ. সাবধান! সৃষ্টি তার, কর্তৃত্বও তাঁর। [সূরা আ’রাফঃ ৫৪]
ছ. ওরা জিজ্ঞেস করছেঃ কর্তৃত্বে আমাদেরও অংশ আছে কি? বলোঃ কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট। [সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৪]
২. এই মূলনীতির ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের অধিকার মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। কারণ, মানুষ তো হলো আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর রাজত্বের প্রজা। তাঁর দাস এবং তাঁর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের অধীন। তাই মানুষের কাজ হলো কেবল তার স্রষ্টা রাজাধিকারাজের আইন মেনে চলা। এক্ষেত্রে তাঁর প্রদত্ত আইনের সীমার মধ্যে অবস্থান করে ইজতিহাদ ও গবেষণার মাধ্যমে প্রাসংগিক বিধি প্রণয়নের নিয়ন্ত্রিত অধিকারই কেবল মানুষের রয়েছে। তাছাড়া আল্লাহ এবং তাঁর রসূল যেসব বিষয়ে প্রত্যক্ষ ও সরাসরি কোনো হুকুম প্রদান করেননি, সেসব ক্ষেত্রেও শরীয়তের প্রাণসত্তা এবং ইসলামের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল বিধি প্রণয়নের অধিকারও মুমিনদের দেয়া হয়েছে। কেননা এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রসূলের সরাসরি কোনো বক্তব্য না থাকাটাই একথার প্রমাণ যে এসব ক্ষেত্রে নিয়ম বিধি প্রণয়নের আইনগত অধিকার মুমিনদের দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে মৌলিক কথাটি সূর্যালোকের মতো সম্মুখে স্পষ্ট থাকতে হবে, তাহলো, আল্লাহ প্রদত্ত আইনের আওতামুক্ত হয়ে যে ব্যক্তি বা সংস্থা নিজেই স্বাধীনভাবে কোনো আইন প্রণয়ন করবে, কিংবা অপর কারো রচিত আইন মেনে চলবে, সে তাগুত, বিদ্রোহী এবং খোদার আনুগত্য থেকে বিচ্যুত। আর এমন ব্যক্তির কাছে যে-ই ফায়সালা ও সিদ্ধান্ত চাইবে এবং তার প্রদত্ত ফায়সালা ও সিদ্ধান্ত মেনে নেবে সেও বিদ্রোহের অপরাধে অপরাধী। এসব ফায়সালা স্বয়ং আল্লাহরঃ
ক. আর তোমাদের মুখ যেসব জিনিসের কথা উচ্চারণ করে, সেসব বিষয় তোমরা মনগড়াভাবে বলোনা যে, এটা হালাল [lawfull] আর এটা হারাম [unlawfull] । [সূরা আন নহলঃ ১১৬]
খ. তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যাকিছু অবতীর্ণ হয়েছে, তারই অনুসরণ করো। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো [মনগড়া] কর্তা ও পৃষ্ঠপোষকের অনুসরণ করোনা। [সূরা আ’রাফঃ ৩]
গ. আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী যারা ফায়সালা করেনা, তারা কাফির। [সূরা আল মায়িদাঃ ৪৪]
ঘ. হে নবী! তুমি সেইসব লোকদের দেখনি যারা মুখেতো সেই হিদায়াতের প্রতি ঈমান এনেছে বলে দাবী করে যা তোমার এবং তোমার পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে? কিন্তু তারা নিজেদের যাবতীয় বিষয়ে ফায়সালা করিয়ে নিতে চায় তাগুতদের দিয়ে। অথচ তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো তাগুতকে অস্বীকার করতে। [সূরা আন নিসাঃ ৬০]
৩. বিশ্বজগতের মালিক আল্লাহ তা’য়ালার এই পৃথিবীতে সঠিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা কেবল সেটাই, যা তাঁর নবী রসূলদের মাধ্যমে প্রেরিত আইনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর এরি নাম হলো, খিলাফত। কুরআন বলেঃ
ক. আমি যে রসূলকেই পাঠিয়েছি, এজন্যেই পাঠিয়েছি, যেনো আল্লাহর নির্দেশের ভিত্তিতে তার আনুগত্য করা হয়। [সূরা আন নিসাঃ ৬৪]
খ. হে নবী! পূর্ণ সত্যতার সাথে আমরা এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে করে আল্লাহর দেখানো সত্যালোকের মাধ্যমে তুমি মানুষের মধ্যে ফায়সালা করতে পারো। [সূরা আননিসাঃ ১০৫]
গ. আর আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী তুমি তাদের মাঝে ফায়সালা করো। তাদের ইচ্ছা বাসনার অনুসরণ করেনা। সাবধান থেকো, তারা যেনো তোমাকে ফিতনার নিমজ্জিত করে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান থেকে এক বিন্দুও বিভ্রান্ত করতে না পারে। [সূরা আল মায়িদাঃ ৪৯]
ঘ. তারা কি জাহিলিয়াতের শাসন ফায়সালা চায়। [সূরা আল মায়িদাঃ ৫০]
ঙ. হে দাউদ! আমরা তোমাকে পৃথিবীতে খলীফা বানিয়েছি। সুতরাং তুমি লোকদের মধ্যে সত্যের ভিত্তিতে শাসন চালাও। ইচ্ছা বাসনার অনুসরণ করোনা। তাহলে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। [সূরা সোয়াদঃ ২৬]
৪. পক্ষান্তরে এমন প্রতিটি রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থাই খোদাদ্রোহী, যার ভিত্তি বিশ্বজগতের মালিক আল্লাহ তা’য়ালার নবী রসূলদের আনীত আইনবিধানের পরিবর্তে অপর কারো রচিত আইনবিধানের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এসব রাষ্ট্র ও আদালতের ধরন প্রকৃতির মধ্যে যতোই বিভিন্নতা থাকুকনা কেনো, তাতে কিছু যায় আসেনা। এগুলোর সমস্ত কর্মকান্ড ভিত্তিহীন, বৈষম্যপূর্ণ ও ভ্রান্ত। শাসন পরিচালনা এবং রায় প্রদানের মুলতই তাদের কোনো বৈধ ভিত্তি নেই। রাজ্যও সাম্রাজ্যের প্রকৃত মালিকই যখন তাদেরকে Charter প্রদান করেননি তখন কী করে তাদের রাষ্ট্র ও আদালত পরিচালনা বৈধ হতে পারে? [এমন সরকার ও আদালতই বিশ্বজগতের মালিক আল্লাহ তা’য়ালার Charter লাভ করে, যারা তাঁকেই বিশ্বজগতের মালিক এবং নিজেদেরকে তার খলীফা [প্রতিনিধি, স্বাধীন নয়] মনে করে, তাঁর প্রেরিত নবী রসূল ও কিতাবকে স্বীকার করে এবং তাঁর প্রদত্ত শরীয়ার অধীনে থেকে কাজ করতে নিজেদেরকে বাধ্য মনে করে। স্বয়ং কুরআনেই এ Charter প্রদান করা হয়েছেঃ “তাদের মধ্যে শাসন ফায়সালা কারো আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী” [আল মায়িদাঃ ৪৯]। Charter প্রদান বলতে আমরা এখানে একথাই বাঝিয়েছি।] তারা যা কিছু করছে, আল্লাহর আইনের দৃষ্টিতে তাতো সবই নাস্তি। মুমিনরা [আল্লাহর অনুগত প্রজা] তাদের অস্তিত্বকে একটি Defacto হিসেবে স্বীকার করতে পারে, কিন্তু একটি Dejure হিসেবে স্বীকার করতে পারেনা। নিজেদের প্রকৃত মালিক [আল্লাহ]-র বিদ্রোহীদের আনুগত্য করা এবং তাদের কাছে নিজেদের বিষয়াদির ফায়সালা চাওয়া মুমিনদের কাজ নয়। যদি কেউ এমনটি করে, তাবে নিজেকে মুমিন ও মুসলিম দাবী করা সত্ত্বেও সে আল্লাহর অনুগতদের দল থেকে বিচ্যুত। একথা সরাসরি বিবেক বুদ্ধির সাথেও সাংঘর্ষিক যে, কোনো সরকার একটি গোষ্ঠীকে বিদ্রোহী বলেও আখ্যায়িত করবে, আবার স্বীয় প্রজাদের উপর সেই বিদ্রোহীদের কর্তাগিরি করাকেও বৈধ বলে মেনে নেবে এবং প্রজাদের তাদের শাসন মেনে চালারও অনুমতি দেবে। দেখুন কুরআন কি বলেঃ
ক. হে নবী, তাদের বলোঃ আমরা কি তোমাদের বলবো, নিজেদের আমলের দিক থেকে সবচে’ ব্যর্থ ও অসফল লোক কারা? তারা হলো সেইসব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের যাবতীয় চেষ্টা সাধনা বিপথগামী হয়েছে। [অর্থাৎ মানুষের চেষ্টাসাধনার মূল উদ্দেশ্য হাসিলের পথে ধাবিত হয়েছে।] অথচ, তারা মনে করছে যে তারা দারুণ ভালো কাজ করছে। এরা হলো সেইসব লোক, যারা তাদের মালিকের আয়াতসমূহ মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর নিকট উপস্থিত হবার বিষয়টিও বিশ্বাস করেনি। তাই তাদের যাবতীয় আমল নিষ্ফল [শূণ্য] হয়ে গেলো। কিয়ামতের দিন আমরা তাদের কোনো গুরুত্বই দেবনা। [সূরা আল কাহাফঃ ৩-৫]
খ. এ হচ্ছে আ’দ [জাতি], যারা তাদের প্রভুর বিধান মানতে অস্বীকার করেছিলো এবং তাঁর রসূলদের আনুগত্য পরিহার করেছিলো আর অনুগামী হয়েছিলো সত্যদীন অমান্যকারী প্রত্যেক দাম্ভিক দুর্দন্ড দুশমনের। [সূরা হুদঃ ৫৯]
গ. আমরা আমাদের নিদর্শন ও সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ মূসাকে ফিরাউন আর তার রাজন্যবর্গের প্রতি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা ফিরাউনের নির্দেশেরই অনুগামী হলো, অথচ ফিরাউনের নির্দেশ সঠিক ছিলোনা [অর্থাৎ বিশ্বসম্রাটের হুকুমের অনুগামী ছিলোনা]। [সূরা হুদঃ ৯২]
ঘ. এমন কোনো ব্যক্তির আনুগত্য করোনা, যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে [অর্থাৎ আমি যে তার প্রকৃত মালিক ও মনিব ও অনুভূতি থেকে] গাফল করে দিয়েছি এবং যে স্বীয় কমনা বসনার অনুগামী হবার নীতি গ্রহণ করেছে আর যার কর্মনীতিই সীমালংঘমূলক। [সূরা আল কাহাফঃ ২৮]
ঙ. হে মুহাম্মদ! বলো, আমার প্রভু অশ্লীলতাকে তার গোপনীয় ও প্রকাশ্য সকল দিক সমেত, পাপ কাজকে, অন্যায়ভাবে পরস্পরের প্রতি বাড়াবাড়ি করাকে এবং আল্লাহ প্রদত্ত প্রমাণ ছাড়াই কাউকেও আল্লাহর [কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে] প্রতিপক্ষ বানানোকে হারাম করে দিয়েছেন। [সূরা আল আ’রাফঃ ৩৩]
চ. আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা যাদের দাসত্ব করছো, তারাতো কতগুলো নাম ছাড়া আর কিছু নয়, যে নাম তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষরা নিজেরাই রেখেছিলে। আল্লাহ সেগুলোর সপক্ষে কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি। সার্বভৌম ক্ষমতা কেবলমাত্র আল্লাহর। তাঁর নির্দেশ হলো, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো গোলামী করোনা। [ সূরা ইউসূফঃ ৪০]
ছ. সঠিক পথ স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেবার পরও যে ব্যক্তি রসূলের সাথে বিরোধ করবে এবং মুমিনদের নীতি আদর্শের বিপরীত পথে চলবে, তাকে আমরা সিদিকে চালাবো, যেদিকে সে নিজেই মোড় নিয়েছে। আর তাকে আমরা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো, যা খুবই নিকৃষ্ট স্থান। [সূরা আন নিসাঃ ১১৫]
জ. তোমার প্রভূর শপথ [হে মুহাম্মদ], তারা কিছুতেই মুমিন হতে পারেনা, যতক্ষণ না তারা তাদের পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে তোমাকে বিচারপতি মেনে নেবে। [সূরা আন নিসাঃ ৬৫]
ঝ. যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, সেদিকে এসো এবং রসূলের নীতি গ্রহণ করো, তখন তুমি এই মানুফিকদের দেখতে পাবে, তারা তোমার কাছ থেকে কেটে পড়ছে। [সূরা আননিসাঃ ৬১]
ঞ. আর তিনি কাফিরদের [অর্থাৎ তাঁর রাজত্বের বিদ্রোহীদের] জন্যে মুমিনদের [তাঁর অনুগতদের] উপর জয়লাভ করার কোনো পথই খোলা রাখেননি। [সূরা আন নিসাঃ ১৪১]
এগুলো হলো কুরআনের অকাট্য সুস্পষ্ট নির্দেশনাবলী। এগুলোতে সন্দেহ সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। আর এই হলো সেই কেন্দ্রীয় আকীদা বিশ্বাস, যার উপর ইসলামের চিন্তাদর্শন, নৈতিক চরিত্র ও সমাজ সভ্যতার ভিত স্থাপন করা হয়েছে। আর মুসলমানরা ততক্ষন পর্যন্ত তাদের ঈমানের দাবী পূরণ করতে পারেনা, যতক্ষণ না তারা ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। আল্লাহর আইনের বিজয় ও প্রতিষ্ঠা ছাড়া মুসলমানরা মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করতে পারেনা। তাই তাদের দীন ও ঈমানের দাবীই হলো ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা [খিলাফত] প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিজেদের যাবতীয় বিষয়াদি আল্লাহর আইনের ভিত্তিতে মীমাংসা ও পরিচালিত করা। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যেই নবীগণ প্রেরিত হয়েছেন। সে জন্যেই তো হিজরতের পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জবানীতে এই দোয়া করানো হয়েছেঃ
“প্রার্থনা করোঃ প্রভূ, আমাকে যেখানেই নিয়ে যাবে সত্যতার সাথে নিয়ে যেয়ো। আর যেখানে থেকেই বের করবে সত্যতার সাথেই বের করো। আর তোমার পক্ষ থেকে একটি ক্ষমতাসীন কর্তৃত্বকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও।” [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৮০]
অর্থাৎ, হয় আমাকেই ক্ষমতা দান করো, নয়তো অপর কোনো রাষ্ট্রকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও, যেনো আমি তার ক্ষমতার সাহায্য নিয়ে বিশ্বের এই মহাবিপর্যয়কে প্রতিরোধ ও সংশোধন করতে পারি। যেনো অশ্লীলতা ও পাপের এই প্লাবনের মোকাবিলা করতে পারি। যেনো তোমার সুবিচারপূর্ণ আইনকে কার্যকর করতে পারি। হাসান বসরী এবং কাতাদা (র) এ আয়াতের এই তাফসীরই করেছেন। ইবনে কাসীর এবং ইবনে জরীরের মতো মর্যাদাবান মুফাসসিরগণও এ মতই প্রকাশ করেছেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত হাদীসটিও এ ব্যাখ্যারই সমর্থন করে। তিনি বলেনঃ
“আল্লাহ রাষ্ট্র ক্ষমতার সাহায্যে সেইসব জিনিসও বন্ধ করে দেন, যা কেবল কুরআন দ্বারা বন্ধ হয়না।”
এ থেকে প্রমাণ হলো, ইসলাম বিশ্বে যে সংস্কার সংশোধন চায়, তা শুধুমাত্র উপদেশ নসীহতের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারেনা। তা কার্যকর করার জন্যে রাষ্ট্রক্ষমতাও অপরিহার্য। তাছাড়া আল্লাহ নিজেই যখন তার নবীকে এই দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, তখন তা থেকে তো একথা পরিষ্কারভাবেই প্রমাণ হয় যে, আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করা, তাঁর শরীয়াকে কার্যকর করা এবং তার আইন ও বিধানকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা পেতে চাওয়া এবং তা পাওয়ার জন্যে চেষ্টা সংগ্রাম করা যে শুধু জায়েয তাই নয়, বরঞ্চ কাম্য এবং মংগলজনকও বটে। যারা এই কাজকে দুনিয়া পূজা বা দুনিয়াদারী বলে মনে করে, তারা সাংঘাতিক ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত। তবে একথা সত্য, যদি কেউ নিজের জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চায়, তবে তা নিসন্দেহে দুনিয়া পূজা। কিন্তু ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর করার জন্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা পেতে চাওয়া কোনোক্রমেই দুনিয়া পূজা হতে পারেনা। বরঞ্চ আল্লাহর গোলামী করার প্রকৃত দাবীই এটা।
৩. ইসলাম ও কর্তৃত্ব [এ নিবন্ধটি তরজমানুল কুরআন ১৯৪২ইং সেপ্ট-নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।]
এ যাবতকার আলোচনা থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা সুস্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন কারণে ধর্ম রাজনীতিকে আলাদা করণের শয়তানী দর্শন স্বয়ং মুসলমানদের মন মগজকেও প্রভাবিত করেছে এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োগ করে তারা এই বিভক্তির সপক্ষে অবকাশ সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে, সেজন্যে এখন আমরা খতিয়ে দেখবো, আসলে ইসলাম কোন ধরনের বিপ্লব সংঘটিত করতে চায় আর এ ব্যাপারে যেসব ভ্রান্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রচার করা হচ্ছে সেগুলোর উৎস কোথায়? সূরা বাকারায় ১৯৩ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ
“যতক্ষন ফিতনার অবসান না ঘটে এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে না হয়ে যায় ততক্ষন তাদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাও। এরপর যদি তারা ক্ষ্যান্ত হয় তাহলে যালেমদের ওপর ছাড়া আর কারো ওপর বাড়াবাড়ি করা বৈধ নয়।”
তাফহীমুল কুরআনে এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, “ক্ষ্যন্ত হওয়ার অর্থ কাফিরদের শিরক ও কুফরী পরিত্যাগ করা নয়, বরং ফিতনা থেকে ক্ষ্যান্ত হওয়া।” কাফির, মুশরিক, নাস্তিক প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে, যার যা ইচ্ছা আকীদা পোষণ করুক, যার খুশী পূজা উপসনা করুক অথবা একেবারেই কারো পূজা উপাসনা না করুক। এ ভ্রষ্টতা থেকে তাকে বের করে আনার জন্য আমরা তাকে বুঝাবো এবং উপদেশ দেবো ঠিকই, কিন্তু তার সাথে লড়াইতে লিপ্ত হবোনা। তাবে এ অধিকার তার কখনো নেই যে, আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে নিজের বাতিল আইন চালু করবে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করবে।
“তারবারী দিয়েই এ ফিতানার উচ্ছেদ ঘটাতে হবে এবং কাফিররা যতক্ষণ তাদের বর্তমান আচরণ থেকে বিরত না হবে, ততক্ষণ মুমিনরা অস্ত্র সংবরণ করবেনা।”
তফসীরের এ রেখাচিহ্নিত অংশটুকু সম্পর্কে তরজুমানুল কুরআনের পাঠকবর্গের মধ্য থেকে জনৈক বিদ্ব্যান নিম্নরূপ আপত্তি তুলেছেনঃ
ক. এর মানে হলো, ইসলাম যা কিনা শান্তি ও নিরাপত্তার সমর্থক, সে অন্যদের ধর্মে হস্তক্ষেপ এবং সে জন্য লড়াইয়ের অনুমতি দেয়। অথচ এ কাজটা সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতের لاَ اِكْرَاهُ فِى الدِّيْنِ “ধর্মে জোর জবরদস্তি নেই” – এর বিপরীত।
খ. ইসলাম বিরোধীদের নিজ নিজ ধর্ম ও আকীদা বিশ্বাসের ওপর অবিচল থাকার স্বাধীনতা সূরা কাফিরুনের শেষ আয়াতঃ
“তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমার জন্য আমার ধর্ম।”
এ থেকেও সুস্পষ্ট, যে ব্যক্তি আকীদা ও বিশ্বাসে স্বাধীন, তার সে আকীদা বিশ্বাস প্রচার করারও স্বাধীনতা থাকা উচিত, কেননা সে ঐসব আকীদাকেই সঠিক মনে করে। কুরআনের বক্তব্য থেকে এ স্বাধীনতার সমর্থন পাওয়া যায় এবং পারস্পরিক বিতর্কেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমনঃ
“সর্বোত্তম পন্থায় ব্যতীত আহলে কিতাবের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়োনা।” [সূরা আনকাবূতঃ ৪৫]
তাদের উপাসনালয় এবং উপাসনা পদ্ধতি ইসলামের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থেকেছে। এমনকি মসজিদে নববীতে পর্যন্ত আহলে কিতাবকে নিজস্ব পদ্ধতিতে উপাসনা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। মিসরের শাসক আযীয যার আকীদা ও কার্যকলাপ মুশরিকদের মতো ছিলো- হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার চাকরি করেছিলেন।
অবশ্য তিনি শন্তিপূর্ণ উপায়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ইসলামের প্রচার চালিয়ে গেছেন। যেমন সূরা ইউসুফের ৩৯ নং আয়াতঃ
“হে আমার কারাগারের সাথীদ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন প্রভু থাকা ভালো, না এক, অদ্বিতীয় ও মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ ভালো?
এ থেকে বুঝা যায় যে, এভাবে অন্যদেরও নিজ নিজ ধ্যান ধারণা প্রচার করার অধিকার রয়েছে।
গ. রেখাচিহ্নিত কথা কয়টির আলোকে মুসলমানরা কোথাও মিশ্র জনবসতিতে নিরূপদ্রব জীবন যাপন করতে পারেনা। অমুসলিমরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়েও মুসলমানদের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা ও উদায় নীতির ভিত্তিতে আচরণ করবে কোন কারণে যখন তাদের রাজনৈতিক ও মৌলিক আকীদাই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়? এ ধরনের মুসলমানরা ইরান ও তুরস্কে বসবাস করলেও আপনার কথামতো তাদেরকে সেখানেও জিহাদের পতাকা উত্তোলন করতে হবে। কেননা সেসব দেশে ইসলামের আইন ও ফৌজদারী বিধি চালু নেই। এযুগে বিশ্বরাজনীতি এমন ধারায় প্রবাহিত যে, কোনো দল অস্বাভাবিক ও অপ্রচলিত পন্থায় অমুসলিমদের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা ও লেনদেন চালাতে পারেনা। কেননা আপনার কথিত যুক্তি যে কোনো ধরনে যৌথ কর্মকান্ডের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। মুসলিম জনগোষ্ঠী যদি স্বীয় আকীদা বিশ্বাস প্রচার করার অধিকার হয়, তাহলে অমুসলিমদেরকেও সে অধিকার দিতে হবে, বিশেষত তারা যদি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। যে জিনিস নিজের জন্য পছন্দ নয়, তা অন্যের জন্য পছন্দ করোনা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার ইহুদী জনগোষ্ঠির সাথে পারস্পরিক আচরণবিধি স্থিরপূর্বক যে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, যে চুক্তি এ ধরনের শর্তের ভিত্তিতেই সম্পাদিত হয়েছিলো? মক্কী জীবনের প্রাথমিক স্তরটা আপনার যুক্তির পক্ষে নয়। অন্য কথায়, একটি অমুসলিম সরকারের জন্য এ ধরনের জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব একটা প্রকাশ্য হুমকি, যে জনগোষ্ঠী সুযোগ পেলেই ঐ সরকারের আইন ও শাসন ব্যবস্থা উৎখাত করার জন্য অস্ত্র ধারণ করবে । তাদেরকে কে বরদাশত করবে?
এ আপত্তির সংক্ষিপ্ত জবাব কয়েকটি মাত্র বাক্যে দিয়েও দেয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ আপত্তিটার মূলে রয়েছে ভুল বুঝাবুঝির এক বিরাট স্তূপ। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণাসমূহ ব্যাপক আকারে ছাড়িয়ে পড়েছে। এমনকি এর ফলে মুসলিম জনগণ সামগ্রিকভাবে নিজেদের ধর্মের মৌলিক দাবী বুঝতেও অক্ষম হচ্ছে। এজন্য এখানে ব্যাপারটা নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হলো।
ইসলামী মিশন
ইসলাম শান্তির ধর্ম কোন অর্থে? আরবী************* এবং আরবী************ এর প্রকৃত মর্ম কি? আর হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের লক্ষ্য নবূয়্যতের দায়িত্ব পালন করা ছিলো নাকি জীবিকার অন্বেষণ করা? সেসব আলোচনা পরে করা যাবে। এসব বিষয়ের আগে যে প্রশ্নের সমাধান হওয়া প্রয়োজন তাহলো, পৃথিবীতে ইসলামের প্রকৃত লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি? স্বৈরাচারী লোকেরা যাতে মানুষের ঘাড়ে চড়াও হতে পারে, তারই সুবিধা করে দেয়ার জন্য মানুষকে তৈরী করতে কি ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিলো? এক একজন স্বৈরাচারী একনায়ক যখনই পৃথিবীতে আপন প্রভুত্ব কায়েম করতে আসবে, তখন ইসলামের অনুসারীদেরকে যাতে নিজের অনুগত ভৃত্য হিসেবে পেতে পারে, সেজন্যই কি ইসলাম এসেছিলো? সে কি সারা পৃথিবীর সরকারসমূহের ও সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য শান্তিপ্রিয় প্রজা সংগ্রহ করে দেয়ার ইজারা নিয়েছিলো যে, যেকোনো ধরনের মতাদর্শের অনুসারী শাসকরা নিজেদের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার জন্য েইসলামের কারখানা থেকে তৈরী যন্ত্রাংশ পেয়ে কৃতার্থ হবে? ইসলামের কাজ কি শুধু এই যে, কিছু মৌলিক আকীদা ও নৈতিক আদর্শ শিক্ষা দিয়ে মানুষকে এতটা বিনয়াবনত ও নমনীয় করে গড়ে তুলবে যাতে সে সকল ধরনের সমাজ ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে? ব্যাপার যদি সত্যি তাই হয়, তাহলে ইসলাম বৌদ্ধ ধর্ম ও সেন্ট পলের গড়া খৃষ্ট ধর্ম থেকে পৃথক কিছু নয়। আর তেমনটি হলে এটা আমাদের জন্য দুর্বোধ্য যে, এমন ধের্মের গ্রন্থে قَاتِلُوْهُم [তাদের সাথে লড়াই কর] এর মতো ভয়ংকর শব্দ উচ্চারণই বা হলো কেমন করে? এরতো নিজের অনুসারীদেরকে জিহাদ ও যুদ্ধের নির্দেশ দেয়ার পরিবর্তে শত্রুদেরকেই এবলা উচিত ছিলোঃ
“আমরা হতভাগাদের তোমরা কেন মারছ? আমরা শাসন ব্যবস্থায় কোনো বিপ্লবও আনতে চাইছিনা, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায়ও কোনো রদবদল ঘটাতে চাইছিনা। ক্ষমতা যার হাতেই থাক, তার অধীনে শান্তশিষ্ট নাগরিক হিসেবে বাস করাই আমাদের নীতি এবং ক্ষমতাশীন সরকারের আনুগত্যই আমাদের ঈমান ও ধর্ম। এমতবস্থায় আমাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা পোষণের কি কারণ থাকতে পারে? আমাদের ধর্ম বিশ্বাস ও পূজা উপাসনার রীতি প্রথা নিয়ে আপত্তি? কিন্তু এতে তোমাদের অসুবিধা কি? তোমাদের কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং কোন স্বার্থ আমাদের উপাসনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
এ জবাব যদি যথার্থ লাগসইভাবে দেয়া হতো এবং কার্যত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুসারীগণ আনুগত্য সহকারে সমাজ সেবার কাজ চালিয়ে যেতেন, তাহলে মক্কার মুশরিকরা আমাদের ইংরেজ প্রভুদের তুলনায় এতো বেশী গোঁয়ার ও কান্ডজ্ঞানহীন ছিলোনা যে, মসজিদে আযান ও নামাযের স্বাধীনতা এবং ধর্ম প্রচারণামূলক সমিতি ইত্যাদি করার স্বাধীনতাও দিতোনা। [উল্লেখ যে, এ নিবন্ধ ১৯৪২ সালে লেখা হয়েছিলো।]
কিন্তু বাস্তব ব্যাপার যদি সেরকম না হয়ে থাকে, বরং ইসলামের যদি নিজস্ব জীবন ব্যবস্থা যাতে আকীদা বিশ্বাস এবং আখলাক ও ইবাদতের পাশাপাশি ব্যক্তিগত কর্মকান্ড ও সামষ্টিক জীবনের যাবতীয় তৎপরতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধি নির্দেশ থেকে থাকে, যদি ইসলামের আহবান তার সমগ্র জীবন ব্যবস্থাই সত্য ও নির্ভুল এবং একমাত্র তাতেই মানুষের সঠিক কল্যাণ নিহিত, আর এছাড়া অন্য প্রত্যেকটি জীবন ব্যবস্থাই বাতিল ও ভ্রান্ত, তাহলে এসবের সাথে সাথে এটাও অনিবার্য হয়ে উঠে যে, ইসলাম পৃথিবীতে নিজের জীবন ব্যবস্থাকে বিজয়ী এবং অন্য সকল ব্যবস্থাকে পরাভূত করার দাবী জানাবে। একটি জীবন ব্যবস্থাকে সত্য ও সঠিক বলে দাবী করার পর কার্যত তা প্রতিষ্ঠিত করার দাওয়াত না দেয়া একটা সম্পূর্ণ অর্থহীন ব্যাপার। আর এর চেয়েও অর্থহীন ব্যপার হলো, অন্যান্য জীবন ব্যবস্থাকে বাতিলও বলা হবে আবার তার বিজয়কেও বরদাশত করা হবে। তাছাড়া একটা জীবন ব্যবস্থার অধীন বসবাস করে আর একটা জীবন ব্যবস্থার অনুকরণ ও অনুসরণ করা একেবারেই অসম্ভব। তাই একই সময় নিজের উপস্থাপিত জীবন ব্যবস্থার অনুকরণেরও দাবী জানানো আবার সেই সাথে অন্য ব্যবস্থার অধীন শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের শিক্ষা দেয়া একজন উন্মাদের পক্ষেই সম্ভব।
সুতরাং ইসলাম যদি নিজের বিশেষ ধাঁচের জীবন ব্যবস্থার দিকে দাওয়াত দিযে থাকে, তাবে সেই দাওয়াতের স্বাভাবিক তাগিদেই তার এ দাবী জানানোও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায় যে, অন্যান্য ব্যবস্থাকে উৎখাত করে তার স্থলে তার নিজস্ব ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা হোক। তাছাড়া যতো উপায়ে চেস্টা তদবীর ও সংগ্রাম করলে এ উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে থাকে, তার সব ক’টি উপায় অবলম্বনের দাবী জানানোও তার জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। এমনকি যারা তার অনুসারী হবার দাবীদার, তারা জান মাল উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে এই চেষ্টা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়, না বাতিল ব্যবস্থার অধীন জীবন যাপন করতে রাজী থাকে এ প্রশ্নকেই সে উক্ত দাবীদারদের ঈমান যাচাইয়ের মানদন্ড নির্ধারণ করা জরুরী মনে করে। কুরআন ও হাদীস দুটোই খুলে দেখুন। সুস্থ মন দিয়ে অধ্যয়ন করলে আপনি দেখতে পাবেন, ইসলামের আসল নীতি এটাই, আপনি যেটা বলছেন সেটা নয়।
এই যখন ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ এবং স্বরূপ জেনেই যখন আমরা ইসলামের প্রতি ঈমান এনেছি, তখন যেকোনো ইসলাম বিরোধী সরকারের জন্য আমাদের অস্তিত্বই যে হুমকি বলে বিবেচিত হবে, সেটা তো বলাই বাহুল্য। কেউ সহ্য করুক বা না করুক এবং অমুসলিমদের সাথে আমাদের সহযোগিতা ও পারস্পরিক সদ্ভাব সম্ভব হোক বা না হোক, আমরা আমাদের ঈমানে নিষ্ঠাবান ও সত্যবাদী হলে সেখানেই আল্লাহর আইন চালু নেই সেখানে তা চালু করার যথাসাধ্য চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। আমাদের মুসলমান হওয়া এরূপ শর্ত যুক্ত নয় যে, যারা আল্লাহর অবধ্য তারা আমাদের এই চেষ্টা সাধনাকে বরদাশত করলেই আমরা মুসলমান থাকবো এবং আল্লাহর আইন চালু করার চেষ্টা করবো অন্যথায় নয়। অমুসলিমদের সাথে সহযোগিতা ও সদ্ভাবও আমাদের জন্য এমন ব্যাপার নয় যে, যে জীবন ব্যবস্থার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি, তার বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে অমুসলিমদের সাথে সহযোগিতা ও সদ্ভাব সম্ভব হবেনা বলে আমরা সে চেষ্টা পরিত্যাগ করবো। নিঃসন্দেহে ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষক ও সমর্থক। তবে তার দৃষ্টিতে যে শান্তি ও নিরাপত্তা আল্লাহর বিধান কার্যকর করার মাধ্যমে অর্জিত হয়, সেটাই প্রকৃত শান্তি ও নিরাপত্তা। শয়তানী শাসন ব্যবস্থার অধীন যাবতীয় কাজকারবার নিরূপদ্রবে চলতে থাকবে আর মুসলমানরা তাতে কিছুমাত্র বিব্রতবোধ করবেনা, এটাকে যারা শন্তি ও নিরাপত্তা অর্থ মনে করছেন তারা ইসলামের দৃষ্টিভংগিকে মোটেই বোঝাননি। তাদের জানা উচিত যে, ইসলাম কখনো এ ধরনের শন্তি ও নিরাপত্তার সমর্থন ও পক্ষপাতী নয়। বাতিল শক্তির প্রতিষ্ঠিত শান্তি নয়, বরং নিজের প্রতিষ্ঠিত শান্তিই তার কাম্য এবং এতেই সে মানুষের সার্বিক কল্যাণ দেখতে পায়।
এখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে “ইসলামে জোর জবরদস্তি নেই” একথাটার মর্ম কি? এর মর্ম শুধু এই যে, ইসলাম তার আকীদা বিশ্বাসকে মেনে নিতে কাউকে বাধ্য করেনা। কেননা এটা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার জিনিস নয়। অনুরূপভাবে, তার আকীদা বিশ্বসাসের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত ইবাদতকেও সে কারোর ওপর বল প্রয়োগ চাপিয়ে দেয়না। কেননা সুষ্ঠু ঈমান ছাড়া এসব ইবাদত একেবারেই অর্থহীন। এই দুটো ব্যাপারেই সে প্রত্যেক মানুষকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু ইসলাম এটা সহ্য করতে প্রস্তুত নয় যে, সমাজ ও সভ্যতাকে পরিচালনাকারী যে আইন ও বিধানের ওপর রাষ্ট্রের কাঠামো ও বিধিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ রচনা করে দিক, আল্লাহর বিদ্রোহী ও অবাধ্য লোকেরা আল্লাহর যমীনে তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করুক এবং মুসলমানরা তাদের তাবেদার হয়ে থাকুক। এব্যাপারে একটি জনগোষ্ঠীকে অন্য জনগোষ্ঠীর “ধর্মে” অবশ্যই হস্তুক্ষেপ করতে হবে। মুসলমানরা যদি “কুফরী ধর্মে” হস্তক্ষেপ না করে তাহলে কুফরী আদর্শের অনুসারীরা “ইসলাম ধর্মে” হস্তক্ষেপ করেই ছাড়বে। আর এর ফল এই দাঁড়াবে যে, মুসলমানদের জীবনের একটা বিরাট অংশে কুফরী ব্যবস্থা প্রচলিত হয়ে পড়বে। সুতরাং হস্তক্ষেপটা খোদাদ্রোহীদের পক্ষ থেকে না হয়ে মুসলমানদের পক্ষ থেকে হোক এবং মুসলমানরা সামনে অগ্রসর হয়ে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে দখল করে নিক এটাই ইসলামের দাবী ও তাগিদ। একাজটা সম্পন্ন হওয়ার পর কেবলমাত্র আকীদা বিশ্বাস ও ইবাদত উপাসনার প্রশ্নে অমুসলিমদের সাথে “ইসলামে জোর জবরদস্তি নেই” এই নীতি অনুসরণ করতে হবে।
উদারতার ভ্রন্ত ধারণা ও তার পর্যালোচনা
আলোচ্য আপত্তি উত্থাপক ভদ্রলোক যেসব যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন এবং যার ওপর তার সমমনা লোকেরা সাধারণত আস্থাশীল হয়ে থাকেন এবার সেই যুক্তিগুলোর ওপর একটা নজর বুলানো যাক।
তার পয়লা যুক্তি হলো, আপনি যখন ফিতনা শব্দটি কুফরী ব্যবস্থার বিজয় এবং কুফরী ব্যবস্থার ধারকবাহক ও অনুসারীদের পরাক্রম ও প্রভুত্ব অর্থে গ্রহণ করেন, আর আপনার এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী সে জিনিস ফিতনা পদবাচ্য তাকে উৎখাত করে তদস্থলে আল্লাহর দীন কায়েম করাকেই যখন জিহাদের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন, তখন এটা স্বীকার না করে উপায় থাকেনা যে, ইসলাম একটা দুমুখো ও পরস্পর বিরোধী ভূমিকা অবলম্বন করবে। একদিকে সে ঘোষণা করছে যে, ইসলামে কোনো জবরদস্তি ও বল প্রয়োগের স্থান নেই। অপরদিকে সে অমুসলিমদের নিজস্ব আদর্শ ও মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার দিতে অস্বীকার করছে এবং তাদের আইন প্রয়োগ বন্ধ করে জোরপূর্বক তাদের ওপর “আল্লাহর দীন” চাপিয়ে দিতে চাইবে। একদিকে সে তোমার জন্য তোমার ধর্ম এবং আমার জন্য আমরা ধর্ম” বলে সকল ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে নিজ নিজ ধর্মমতের ওপর অবিচল থাকার স্বাধীনতা দেয়। অপরদিকে, তারা নিজেদের নীতি আদর্শ অনুসারে দুনিয়ার কর্মকান্ডে পরিচালনা কেন করে এ প্রশ্ন তুলেই তাদের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। ইসলামে এতো বড় স্ববিরোধিতা যে থাকতে পারেনা, তা সর্বজন বিদিত। অতএব, আপনার ব্যাখ্যাটিই আসলে ভুল।
দ্বিতীয় যুক্তি এই যে, ইসলাম বিরোধী সরকারের অস্তিত্বই যদি ইসলামের দৃষ্টিতে ফিতনা হতো এবং তার উচ্ছেদ ঘটানোর জন্য যদি মুসলমানরা আদিষ্ট হতো, তাহলে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম কর্তৃক মিসরের অনৈসলামিক সরকারে মন্ত্রীত্ব চাওয়া কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো এবং স্বীয় মন্ত্রীত্বের আমলে মিসরের রাজকীয় আইনের অনুগত থেকে কাজ করাই বা তার পক্ষে কিভাবে সঙ্গত হয়েছিলো। সূরা ইউসূফের ৭৬ নং আয়াতেঃ
“রাজকীয় আইনে আপন ভাইকে গ্রেফতার করা তাঁর সম্ভব ছিলোনা।”
এ থেকে বুঝা যায় যে, তিনি রাজকীয় আইনের ঊর্ধে ছিলেননা।
তৃতীয় যুক্তি এই যে, আয়াতের যে ব্যাখ্যা আপনি দিয়েছেন তি সঠিক বলে মেনে নিলে এটা স্বীকার করতে হয় যে, ইসলাম পৃথিবীতে একটা চিরস্থায়ী যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে সচেষ্ট এবং তার অনুসারীদেরকে আগ্রাসী যুদ্ধ চালানোর এমন দায়িত্ব অর্পন করে যার দরুন মুসলমানরা দুনিয়ার কোথাও শান্তিতে থাকতে পারেনা। সত্যি বলতে কি, এ তফসীর অনুসারে, শুধু দুনিয়ার সকল অমুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই নয়, বরং যেসব মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী আইন চালু নেই তার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। আর এটাই যখন আমাদের আদর্শ এবং ধর্মীয় কর্তব্য, তখন অমুসলিমরা আমাদেরকে তাদের শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশী ভেবে আমাদের সাথে নিশ্চিন্তে ও নির্ভাবনায় সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে এবং অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহ তাদের আওতাভুক্ত এলাকায় আমাদের অস্তিত্ব বরদাশত করবে এটা কিভাবে সম্ভব?
১. উল্লিখিত যুক্তিগুলোর মধ্যে প্রথমটা একটা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে উত্থাপন করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে একটা মতবাদে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবনে একটা বিশেষ নিয়ম নীতি অনুসরণ করা এক কথা, আর তার নিজ মতাদর্শ অনুসারে সামষ্টিক জীবনের জন্য একটা পদ্ধতি গড়ে তোলে এবং সেই পদ্ধতিটা জোরপূর্বক একটি দেশের জনজীবন চালু করে দেয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। [উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্র মূলত বল প্রয়োগ ও জবরদস্তিরই Coercive আর এক নাম। যে মতবাদ, মূলনীতি ও আইন কোনো রাষ্ট্রের ভিত্তিরূপে বিবেচিত হবে, সেটা যে ঐ রাষ্ট্রের আওতায় বসবাসকারী সকল মানুষের ওপর বল প্রয়োগই চালু করা হবে, সেটা সর্বজনবিদিত।] আপত্তি উত্থাপনকারীরা এই দুটো বিষয়কে এক মনে করে বসেছেন এবং দুটোর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা উপেক্ষা করে “ইসলামে জোর জবরদস্তি নেই” এবং “তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম এবং আমার জন্য আমার ধর্ম” এ দুটো আয়াতকে উক্ত দুটো বিষয়ের ওপর সামষ্টিকভাবে প্রয়োগ করেছেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে এ আয়াত দুটোর সম্পর্ক প্রথম ব্যাপারটার সাথে। একথা সত্য যে, আমরা কোনো অমুসলিমকে তার আকীদা বিশ্বাস পরিত্যাগ করে ইসলামী আকীদা বিশ্বাস গ্রহণ ও নিজস্ব ধর্মীয় পূজা অর্চনা পরিত্যাগ করে নামায, রোযা পালন করতে বাধ্য করবোনা। তবে আমরা তার এ অধিকার স্বীকার করতে পারিনা যে, সে নৈতিকতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও আইন ইত্যাদি সামষ্টিক ব্যাপারে আপন মতবাদগুলোকে নিজস্ব নিয়মনীতি অনুসারে চলতে দেয়া নিঃসন্দেহে পরমত সহিষ্ণুতা। কিন্তু আমাদের নিজস্ব নিয়মনীতির বিরুদ্ধে আমাদের ওপর অন্যদের মতাদর্শ ও রীতিনীতি চাপিয়ে দেয়াকে বরদাশত করা কোনো পরমত সহিষ্ণুতা নয়। দেশের শাসন ব্যবস্থা যে জীবন দর্শনের ভিত্তিতে গঠিত হবে ঐ দেশের সমস্ত আইন কানুন, সমগ্র প্রশাসনিক নীতি এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম সেই দর্শনের ভিত্তিতে চলতে বাধ্য। আর এ ধরনের শাসনব্যবস্থার অধীনে বাস করে আমাদের জীবনধারাকে আমাদের নিজস্ব ধর্ম ও মতাদর্শ অনুসারে পরিচালিত করা আমাদের পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। আমরা রাজী হই বা না হই, বিরুদ্ধবাদী ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের রাজনৈতিক পরাক্রম ও আধিপত্যের দাপটে আপন মতাদর্শকে, জোরপূর্বক আমাদের সমগ্র জীবনে প্রয়োগ ও বাস্তবায়িত করে ছাড়বে। এব্যাপারে নমনীয়তা, উদারতা বা পরমতা সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের অর্ত হলো, তারা যদি ব্যভিচারকে বৈধ মনে করে এবং জনগণকে এ ব্যাপারে আবাধ অনুমতি দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের সরকারের নিরুপায় প্রজা হিসেবে স্বয়ং আমাদের সমাজে ব্যভিচারের বিস্তার ঘটতে থাকবে আর আমরা তা নীরবে বরদাশত না করে পারবোনা। তারা যদি সুদকে বৈধ মনে করে এবং তাদের সরকার স্বয়ং সুদভিত্তিক লেনদেন করতে অভ্যস্ত হয়ে থাকে, তাহলে দেশের প্রশাসন তাদের হাতে থাকার কারণে আমাদের একজন অতি বড় পরহেজগার লোকও সুদের কুলষতা থেকে রেহাই পাবেনা। এমনকি একটা দিয়াশলাই এবং এক টুকরো রুটিও আমরা কিনতে পারবোনা যতক্ষণ না তার মূল্য থেকে সুদের একটা অংশ পরোক্ষ করের আকারে আমাদের পকেট থেকে বেরিয়ে যায়। তারা যদি নাস্তিক্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী হয় তাহলে দেশের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার গোটা কাঠামো এই নাস্তিক্যবাদী চরিত্রের আলোকেই গড়ে উঠবে। শুধু তাই নয়, এহেন নরকের দরজা ছাড়া দেশবাসীর জন্য উন্নতি ও সমৃদ্ধির অন্য সকল দরজা রুদ্ধ হয়ে যাবে। আর আমাদের অতি বড় কোনো খোদাভীরু লোকও আপন বংশধরকে সেই সান্তিক্যবাদী মতাদর্শ ও নৈতিকতার প্রভাব থেকে বাঁচাতে সক্ষম হবেনা। তারা যদি আল্লাহর আইনকে বাতিল করে নিজস্ব আইন রচনা করে এবং দেশের সমাজব্যবস্থাকে নিজেদের রচিত আইনের ভিত্তিতে গড়ে তোলে, তাহলে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটা বিরাট অংশ আমরা যে আইনবিধির ওপর ঈমান এনেছি, তার আনুগত্য থেকে মুক্ত হয়ে যেতে বাধ্য হবে এবং সে আইনবিধিতে আমাদের ঈমান ও আস্থা নেই তার অনুসরণ করতে আরম্ভ করবে। এটা কি ধরনের পরমত সহিষ্ণুতা এবং কি ধরনের উদার নীতি? “ধর্মে জোর জবরদস্তি নেই” আয়াতটার এ অর্থ কোন যুক্তিতে এবং কোন বিবেকের রায় অনুসারে শুদ্ধ হতে পারে যে, অন্যদের পক্ষ থেকে আমাদের ধর্মের ওপর যে বল প্রয়োগ করা হবে তা আমরা বরদাশত করবো?
রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা
একথা অনস্বীকার্য যে, সামষ্টিক জীবনের শৃংখলা বহাল রাখার জন্য সর্বাবস্থায়ই একটা বল প্রয়োগকারী শক্তি Coercive Power থাকা প্রয়োজন এবং তাকেই রাষ্ট্র বলা হয়। নৈরাজ্যবাদীরা ছাড়া কেউ এর প্রয়োজনীয়তা আজ পর্যন্ত অস্বীকার করেনি। সমাজতান্ত্রিক দর্শনেও এমন একটা স্তর কল্পনা করা হয়েছে, যেখানে পৌছে মানুষের সামষ্টিক জীবন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা আর অনুভাব করেনা। [এখানে গ্রন্থকার সমাজতন্ত্রের সর্বশেষ স্তরের প্রতি ইংগিত করছেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং এঞ্জলস এবং লেলিনের বক্তব্য হলো, এতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগ কাঠামো তিরোহিত হয়ে যাবে এবং এমন একটি শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, যা পরিচালিত হবে সামাজিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এবং যাতে রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব থাকবেনা। লেলিন লিখেছেনঃ
কেবল সমাজতন্ত্রই রাষ্ট্রকে নির্ঘাত নিষ্প্রয়োজনীয় বস্তুতে পরিণত করে দেয়। তাই সেখানে এমন কোনো শ্রেণী অবশিষ্ট থাকেনা যাকে দমন ও নির্মূল করা যেতে পারে। [Lenin: the state and revolution, N.Y. 1935, P-75] এ প্রক্রিয়ার রাষ্ট্রকে সমাজতন্ত্রের পরিভাষায় বলা হয় The State within away [সংকলক]] কিন্তু এসব কথাবার্তা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। এসব কথার সপক্ষে কোনো অভিতজ্ঞতা বা চাক্ষুস সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করা সম্ভব নয়। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা এবং মানবীয় স্বভাব প্রকৃতি সংক্রান্ত তত্ত্বজ্ঞান থেকে একথাই জানা যায় যে, সুসভ্য ও সমাজবদ্ধ মনব জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য একটা “দমনমূলক শক্তি”র প্রয়োজনীয়তা সন্দেহাতীত। তথাপি এ কথাও অবস্বীকার্য যে, আপন অজেয় ক্ষমতা ও পরাক্রমশীলতার জোরে সমাজ ও সভ্যতার অবকাঠামোকে সংরক্ষণকারী এই দমনমূলক শক্তি তথা রাষ্ট্র শক্তি নিজেও কোনো না কোনো মতবাদ এবং কোনো না কোনো সামষ্টিক নীতির প্রবক্তা ও পাতাকাবাহী হয়ে থাকে। সেই মতবাদ ও নীতির আলোকে সে নিজের জন্য একটা কর্মসূচী রচনা করে। সে আপন দোর্দন্ড ক্ষমতা প্রয়োগ করে সমাজ এই কর্মসূচীকেই জীবনে বাস্তবায়িত করে। আর এই দোর্দন্ড ক্ষমতার ধরন এবং এই কর্মসূচীর নীতিগত ও বিস্তারিত রূপটির ভূমিকা সভ্য সমাজ জীবনের ভাঙ্গাগড়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল সামষ্টিক জীবন নয়, ব্যক্তিগত জীবনও অনেকাংশে ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, রাষ্ট্রিয় আধিপত্য ও পরাক্রমের প্রভাবে সম্পূর্ণরূপে প্রভাবিত হয়ে যেতে বাধ্য হয়। একটি রাষ্ট্রের অধিবাসীরা ঐ রাষ্ট্রের মতবাদ ও বিস্তারিত কর্মসূচীতে বিশ্বাসী ও সম্মত না হলেও তাদেরকে বাধ্য হয়ে নিজেদের বিশ্বাস ও আদর্শের শতকরা ৯০ ভাগকে পরিত্যাগ করে রাষ্ট্রিয় আকীদা ও আদর্শ অনুসারে চলতে হয়। আর বাদবাকী ১০ ভাগেও তাদের আকীদা ও আদর্শের নিয়ন্ত্রণ ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে যেতে থাকে। রাষ্ট্রের এই বৈশিস্ট্যের প্রতি দৃষ্টি দান এবং সামষ্টিক জীবনে রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করার পর একজন চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষে একথা বুঝা মোটেই কঠিন নয় যে, কোনো মানবগোষ্ঠী যদি প্রচলিত সংকীর্ণ অর্থে কেবল ধর্মের অনুসারী না হয়ে একটা সর্বব্যাপী জীবন ব্যবস্থা অর্থাৎ দীনের প্রতি বিশ্বাস হয়, তারা আপন বিশ্বাসে নিষ্ঠাবান ও সত্যবাদী হয় এবং আপন বিশ্বাসের বিপরীত জীবন যাপন করতে ইচ্ছুক না হয়, তাহলে যে রাষ্ট্র সমাজ জীবনের সর্বাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা এবং আপন শক্তি দ্বারা তাকে বহাল রাখার কাজে নিয়োজিত রয়েছে, সেই রাষ্ট্রকে করায়ত্ত্বে করার চেষ্টা করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। তারা যদি রাষ্ট্রকে করায়ত্ত্ব না করে, তবে অন্যরা করবে এবং তখন এই গোষ্ঠী নিজেদের জীবনের অন্তত শতকরা ৯০ ভাগ ব্যাপারে নিজেদের পছন্দসই দীন বা জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে অন্যদের জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ করতে বাধ্য হবে। সুসভ্য মানব জীবনে বল প্রয়োগের এ কাজটা আমাদের কোনো না কোনো পক্ষকে করতেই হবে। আমরা না করলে খোদাদ্রোহীরা করবে। সুতরাং ইসলাম বিরোধীরা এ পরিমন্ডলে আমাদের ওপর বলপ্রয়োগ করবে এবং আমাদেরকে টেনে হিচঁড়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে তার চেয়ে ভালো আমরাই তাদের ওপর বল প্রয়োগ করে তাদের এমন অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য করি, যেখানে থেকে তারা ইচ্ছা করলে সহজেই বেহেশতের পথের সন্ধান লাভ করতে পারে।
এ হলো ব্যাপারটার একটা দিক। এর আর একটা দিক হলো, পৃথিবীর মালিক আল্লাহ তায়ালা। তাঁর পৃথিবীতে বাস করে তাঁর নেয়ামতরাজি ভোগ করা এবং তাঁর মালিকানাধীন সম্পদ ব্যবহার করার অধিকার কেবল তাঁর বান্দাদেরই থাকতে পারে, যারা তাঁর প্রাকৃতিক ও শরীয়তী আইন কানুন অনুসরণ করে। যারা তা করেনা তারা যালিম, অনধিকার চার্চাকারী ও বিদ্রোহী। তাদের এই অনধিকার চর্চা কেবল অন্যায়ই নয়, বরং পৃথিবীর প্রশানসে অরাজকতা সৃষ্টি এবং পৃথিবীবাসীর জীবন বিপর্যস্ত ও অতিষ্ঠ করে তোলার নামান্তর। সুতরাং প্রকৃত ব্যাপার তো এই যে, যারা খোদাদ্রোহী এবং খোদার প্রাকৃতিক ও শরীয়তী বিধানের বিরুদ্ধাচারণে লিপ্ত, তাদের পৃথিবীতে বেচেঁ থাকার অধিকারও থাকা উচিত নয়। কিন্তু আল্লাহর অতিশয় দয়া ও মহানুভবতা এবং তাঁর চরম সহনশীলতার গুণে তিনি তাদেরকে শুধু যে জীবন ধারণের সুযোগ দিয়েছেন তা নয়, বরং তাদেরকে তাদের কুফরী, শিরক ও নাস্তিকতার ওপর টিকে থাকারও এতোখানি সুযোগ দিয়েছেন, যাতে তাদের খোদাদ্রোহিতা আল্লাহর অন্যান্য বান্দাদের জীবন অরাজকতা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে না পারে। তাদেরকে এ অধিকার তিনি কখনো দেননি যে, আল্লাহর শরীয়তী বিধান বাতিল করে তারা নিজেদের মনগড়া আইন কানুন দ্বারা তার পৃথিবীর প্রশাসন চালাবে এবং এভাবে তার যমীনে অরাজকতার তান্ডব সৃষ্টি করবে। তাই ইসলাম তার শরীয়তী বিধানকে যারা মেনে নিয়েছে তাদেরকে নির্দেশ দেয় যে, অমুসলিমদেরকে আল্লাহর সত্য দীন গ্রহণ করতে বাধ্য করোনা। কিন্তু কুফরী ব্যবস্থার আধিপাত্য ও প্রাধান্য এবং কাফিরদের কর্তৃত্ব প্রভুত্ব যা কিনা সাধারণ মানুষ ও মুমিনদের জন্য আল্লাহর সত্য দীনের আনুগত্য করার পথে প্রতিবন্ধক তাকে সর্বশক্তি দিয়ে উৎখাত করো, যেনো পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন কার্যত আল্লাহর দীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে যারা আল্লাহর দীনকে মানেনা, তারা “কতৃত্বশীল” নয়, এবং প্রতাপান্বিত নয় বরং “অধিনস্ত” বরং বিনীত হয়ে থাকবে। সূরা তওবার ২৯ নং আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছেঃ
“যতক্ষণ না তারা বিনীতভাবে স্বহস্তে জিজিয়া দেবে ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও।” [এ লড়াই করার উদ্দেশ্য এ নয় যে, এর ফলে তারা ঈমান আনবে এবং ইসলাম পালন করতে শুরু করবে। বরঞ্চ এর উদ্দেশ্য হলো, এর ফলে তাদের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব শেষ হয়ে যাবে এবং পৃথিবীতে তারা শাসক ও কর্তৃত্বসম্পন্ন হয়ে থাকতে পারবেনা। বিশ্বের জীবন ব্যবস্থার বাগডোর এবং কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের ক্ষমতা অর্পিত হবে সত্যদীনের অনুসারীদের হাতে। আর ওরা এদের অধীনে অনুগত ও বাধ্যগত হয়ে থাকবে।
ইসলাম রাষ্ট্র যিম্মীদের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের যে দায়িত্ব পালন করে, জিযিয়া তারই বিনিময়। আর তারা যে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনতা মেনে নিয়েছে, তারও নিদর্শন বটে। স্বহস্তে জিযিয়া দেয়ার অর্থ সোজাসোজি ও সুস্পষ্ট আনুগত্যের ভাবধারা অনুযায়ী জিযিয়া প্রদান করা। আর বিনীতভাবে মানে বিশ্বে তারা কোনোদিক দিয়ে বড় বলে বিবেচিত হবেনা। বড় বিবেচিত হবে কেবল সেই মুমিনরা, যারা আল্লাহর খিলাফতের দায়িত্ব পালনে নিরত।]
ইউসুফ আলাইহিস সালাম ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব
২. উল্লেখিত তথ্যসমূহ হৃদয়ঙ্গম করার পর দ্বিতীয় যুক্তির প্রখরতা আপনা থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম যদি যথার্থই আল্লাহর প্রেরিত নবী থেকে থাকেন তাহলে অন্যান্য নবীগনের পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যা ছিলো, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যও নিশ্চিতভাবে তাই ছাড়া আর কিছু থাকতে পারেনা। অর্থাৎ অন্যসকল জীবন ব্যবস্থার ওপর আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করা। এটা একটা মৌলিক তত্ত্ব। সকল নবীর জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এ তত্ত্বটাকে একটা সাধারণ মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় আমরা যদি একথা স্বীকার করি যে, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাঁর শাসনামলে মিশরে আল্লাহর দীনের পরিবর্তে রাজকীয় বিধি বিধান চালু করতেন, তাহলে তো তাঁর মধ্যে এবং স্যার সিকান্দার হায়াত খান ও একে ফজলুল হকের [এ নিবন্ধ লেখার সময়ে পাঞ্জাবে স্যার সিকান্দার হায়াত ও বাংলায় এ কে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এখন তাদের স্থলে যেকোনো অনৈসলামী সরকারের মুসলমান মন্ত্রীকে ধরে নেয়া যেতে পারে।] মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য থাকেনা। দুঃখের বিষয় যে, অনেকে এ ব্যাপারে প্রকৃত ঘটনা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তারা আসলে ইউসুফ আলাইহিস সালামের কিসসাটা বুঝতেই পারেননি। তাদের ধারণা, ইউসুফ আলাইহিস সালাম যে সমসাময়িক বাদশাহকে বলেছিলেনঃ
“আমাকে এই ভুখন্ডের সহায় সম্পদের তদারকীর দায়িত্ব দিন।” [সূরা ইউসুফঃ ৫৫]
সেটা ছিলো নেহায়েতই তাঁর পক্ষ থেকে একটা চাকরির আবেদন। আর এর ফলে তিনি সম্রাট আকবরের দরবারে টোডর মল্লের পদের মতো একটা পদ সেখানে লাভ করেছিলেন। অথচ সেখানকার ব্যাপারটা ছিলো সম্পূর্ণ অন্য ধরনের।
মহান নবী হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম শুরুতে আল্লাহর সত্য দীন কায়েমের জন্য সকল নবীদের চিরাচরিত পন্থাই অনুসরণ করেছিলেন। অর্থাৎ প্রথমে সাধারণ দাওয়াত ও অতপর যারা ঐ দাওয়াত গ্রহণ করে তাদেরকে সংগঠিত ও সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলা, অতপর তাদেরকে সাথে নিয়ে দীন কায়েমের জন্য চেষ্টা সাধনা। দাওয়াতের কাজটা তিনি কারাগার থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন। সূরা ইউসুফের ৫ম রুকুতে তাঁর দাওয়াতী স্তরের একটা অতুলনীয় ভাষণ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আকস্মিকভাবে তিনি এমন একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলেন, যার মাধ্যমে তিনি সংক্ষিপ্ত পথ ধরে আপন লক্ষ্যস্থলে পৌছতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন যে, মিশর সরকারের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব আযীযের স্ত্রী ও তার সঙ্গীদের ব্যাপারে তিনি যে পবিত্র ও অনমনীয় চরিত্রের পরিচয় দিয়েছিলেন এবং তার পরে স্বপ্নের তাবীর করার মধ্যদিয়ে তিনি যে প্রজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছিলে, তার কারণে মিসরের বাদশাহ তার প্রতি এতো অনুরক্ত হয়ে গেছেন যে, তিনি যদি তখন দেশ শাসনের পূর্ণাংগ ক্ষমতা তার কাছে চেয়ে বসেন তবে বাদশাহ নির্দিধায় তা দিয়ে দেবেন। এজন্য গণআন্দোলনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার চাইতে সরকারী ক্ষমতা অবিলম্বে দখল করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা তাঁর কাছে নিকটতর ও সহজতর পথ মনে হলো। তাই তিনি বাদশাহের কাছে اِجْعَلِى عَلى خَزَائِنُ الْاَرْضِ “দেশের যাবতীয় উপায় উপকরণ আমার কর্তৃত্বে দিয়ে দিন” এই দাবী করে বসলেন। এটা কেবল অর্থমন্ত্রীর গদী লাভের দাবী ছিলোনা, যদিও কেউ কেউ এটাই মনে করে থাকেন। বরঞ্চ এটা ছিলো সর্বাধিনায়ক ও সার্বভৌম শাসকের পদের দাবী। এর ফলে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম যে পদমর্যাদা ও ক্ষমতা লাভ করলেন তা বর্তমানে ইতালীতে মুসোলিনী যে পদমর্যাদায় সমাসীন, তার প্রায় অনুরূপ। [এ প্রবন্ধ লেখার সময় মুসোলিনী ইতালীর একনায়ক ছিলেন] পার্থক্য শুধু এতোটুকু যে, ইতালীর রাজা মুসোলিনীর ভক্ত নন, কেবল তার দলের প্রভাব প্রতিপত্তির দাপটে নতি স্বীকার করেছেন। আর মিসরের বাদশাহ স্বয়ং হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের মুরীদ হয়ে গিয়েছিলেন। [প্রখ্যাত তাফসীরকার ইমাম মুজাহিদ বলেন যে, বাদশাহ হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের হাতে ইসলামও গ্রহণ করেছিলেন। [ইবনে জারীর]]
হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ক্ষমতা কিরূপ ছিলো সে সম্পর্কে আল্লাহর স্বয়ং সাক্ষ্য দেন যেঃ
“এভাবে আমি ইউসুফেকে সেই ভূখন্ডে ক্ষমতাসীন করলাম। সে ঐ ভূখন্ডের যে অংশে ইচ্ছা নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম ছিলো।” [সূরা ইউসূফঃ ৫৬]
অর্থাৎ গোটা দেশে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজ করতো। সূরা মায়েদাতে আমরা এ সম্পর্কে আরো সাক্ষ্য পাই। সেখানে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম স্বীয় জনগণকে বলেনঃ
“হে আমার জাতি! আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ করো। তিনি তোমাদের মধ্যে বহু নবীর আবির্ভাব ঘটিয়েছেন, তোমাদেরকে শাসন জাতি বানিয়েছেন এবং পৃথিবীতে কাউকে যা দেননি, তা তোমাদেরকে দিয়েছেন।” [সূরা মায়েদাঃ ২০]
এ থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম মিসরে যে ক্ষমতা লাভ করেছিলেন, তাঁর কল্যাণে সেখানে পরিপূর্ন বিপ্লব সংঘটিত হয়, ফিরাউনদের পরিবর্তে বনী ইসরাঈলের শাসন চালু হয় এবং তারা উন্নতির এতো উচ্চ শিখরে আরোহণ করে, যা তাদের সমকালীন জাতিগুলোর মধ্যে আর কারো ভাগ্যে ঘটেনি। তাছাড়া হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম মিসরে যে ধর্মীয় প্রভাব প্রতিপত্তি রেখে যান, তার বিবরণ আমরা সূরা মুমিনে পাই। সেখানে জনৈক ঈমানদার কিবতী হযরত মূরা আলাইহিস সালামের ফিরাউনকে সম্বোধন করে বলেনঃ
“ইতিপূর্বে ইউসুফ তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু প্রথমে তো তোমরা তাঁর নিয়ে আসা নিদর্শনের ব্যাপারে সন্দেহে লিপ্ত ছিলে। আর যখন সে মারা গেলো তখন তোমরা বললেঃ এখন আল্লাহ আর কোনো রসূল পাঠাবেননা।” [সূরা মুমিনঃ ৩৪]
অর্থাৎ তোমরা বললে যে, অমন উচু দরের মানুষ এখন আর আসতে পারেনা। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এই নিগূঢ় তত্ত্ব জানার পর এরূপ যুক্তি প্রদর্শনের সাহস কে করতে পারে যে, তাই যেহেতু একজন নবী এরকম কাজ করেছেন? অবশ্য সূরা ইউসূফের ৭৬ নং আয়াতঃ
“তার পক্ষে রাজীয় আইনের অধীন আপন ভাইকে আটক করা সম্ভব ছিলোনা।”
এর আলোকে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়ে থাকে যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম ফিরাউনী আইন মেনে চলতেন। এ আয়াতের মর্ম ও তাৎপর্য সম্পর্কে অনেক কিছু বলার অবকাশ রয়েছে। তথাপি এর যে অর্থ সচরাচর বর্ণনা করা হয় তা যদি সঠিক মেনে নেয়াও হয়, তবু তা থেকে বড় জোর একথাই প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের শাসন আমলের যে পার্যায়ে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে [পূর্বাপর বর্ণনা থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, এটা প্রাথমিক যুগেরই ঘটনা। কেননা তাঁর মিসরের শাসক হওয়ার কয়েক বছর পরই সাত বছরব্যাপী ইতিহাসখ্যাত সেই দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, যার করাল গ্রাসে পতিত হয়ে তার ভাইদেরকে খাদ্যশস্য নেয়ার জন্য মিসর আসতে হয়েছিলো।] তখন পর্যন্ত মিসরে পূর্বতন ফৌজদারী আইনই চালু ছিলো। একটা দেশের রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক ব্যবস্থাকে যে রাতারাতি পাল্টানো যায়না, সেকথা সবার জানা। এ কাজ পর্যায়ক্রমেই সমাধা করা সম্ভব। স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলেও আরবের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা পাল্টাতে দশ বছর লেগে গিয়েছিলো। উত্তরাধিকার আইন বদলানো হয়েছিলো ৩য় অথবা ৪র্থ হিজরীতে। বিয়ে ও তালাকের বিধি হিজরতের পর পাঁচ ছয় বছরে সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী করা হয়েছিলো। ফৌজদারী বিধি সম্পূর্ণ করতে পুরো আট বছর লাগে। দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো পর্যায়ক্রমে ৯ বছর পাল্টানো হয়। মদ চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ হয় ৮ম হিজরীতে এবং সুদ পুরোপুরিভাবে রহিত করা হয় ৯ম হিজরীতে। এভাবে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামও যদি দেশের আইন সংস্কারের কাজ পর্যায়ক্রমে করে থাকেন এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাঁর শাসনামলে সাবেক আইন চালু থেকে থাকে, তাহলে তার ভিত্তিতে একথা কিছুতেই বলা চলেনা যে, একজন নবী আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানব রচিত অনৈসলামিক আইনকে বৈধ মনে করে তা মেনে চলতেন।
৩. আবার আসুন তৃতীয় যুক্তির প্রসংগে। এটাকে আসলে যুক্তি বলে অজুহাত বলাই সমীচীন। এ অজুহাতের জবাব আমি পূর্বেই দিয়েছি। এখানে শুধু আবু দাউদ বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করাই যথেষ্ট মনে করছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
“আমি যখন বনূয়্যত লাভ করেছি তখন থেকেই জিহাদের সূচনা এবং এই উম্মতের শেষ জনগোষ্ঠির দাজ্জালের সাথে যিহাদে লিপ্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত তা চালিয়ে যাওয়া উচিত। কোনো অত্যাচারীর অত্যাচার এবং কোনো ন্যায়বিচারকের ন্যায়বিচার জিহাদের রহিত করতে পারেনা।”
অর্থাৎ আজ আমাদের ওপর চরম স্বৈরাচারী শাসকরা চেপে বসেছে, এই অজুহাতে যেমন জিহাদ বন্ধ করা চলবেনা, তেমনি কাফির শাসক হলেও মুসলমানদের প্রতি সুবিচার হচ্ছে এবং তারা শান্তিতে আছে এই বাহানা দিয়েও তা থেকে বিরত হওয়া চলবেনা। এমনকি মুসলমানদের নিজ দেশে সুবিচার ও ইনসাফের রাজত্ব থাকলেও তাদের নিশ্চিন্ত হওয়া এবং বাইরের জগত যে যুলুম, নির্যাতন ও অশান্তির আগুন জ্বলছে, তার দিক থেকে চোখ বুজে থাকা বৈধ নয়।
৪. ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করার বাতিল মতবাদ এবং ইউসূফ আলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে ভ্রান্ত যুক্তি গ্রহণ
তরজমানুল কুরআনের [এ অংশটি তরজমানুল কুরআন রবিউসসানী ১৩৬৩ হিজরী মোতাবেক এপ্রিল ১৯৪৪ ঈসায়ী সংখ্যায় প্রকাশ হয়। – সংকলক।] জনৈক পাঠক লিখেছেনঃ
সূরা ইউসূফের দুটো জায়গা সম্পর্কে আপনার কুরআন বিষয়ক তত্ত্বজ্ঞান থেকে উপকৃত হতে চাই।
কুরআন থেকে জানা যায়, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামকে পৃথিবীতে ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠা দান করা হয়েছিলো এবং তিনি বিশিষ্ট পদমর্যাদা নিয়ে সরকারে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু তিনি যে একজন রসূল ছিলেন এবং সেজন্য নবূয়্যতের দায়িত্ব পালনও তাঁর জন্য জরুরী ছিলো সেকথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ফিরাউনের দরবারের একজন অকুতোভয় মুমিন তাঁর ভাষণে এ আভাস দিয়েছিলেন যে, ফিরাউনের লোকেরা হযরত ইউসূফ আলাইহস সালামের নবূয়্যতের প্রতি ঈমান আনেনি। তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম নিজের ইন্তিকালের সময় পর্যন্ত নমনীয় ভাব বজায় রেখেছিলেন। এথেকে বুঝা যায়, তিনি নিজের নবূয়্যতের প্রতি ঈমান আনার আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরাউন ও তার লোকজন ঈমান আনেনি। এতদসত্ত্বেও হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম তাদের সরকারে অন্তর্ভূক্ত থাকেন। এখন প্রশ্ন উঠে, আল্লাহর একজন নবী একটি অনৈসলামিক সরকারে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারলেন? অথচ তিনি সেই জাতির কাছে নিজের বনী হওয়ার কথা ব্যক্তও করেছিলেন এবং সেই জাতি তাঁর নবূয়্যত মেনে নেয়নি। ইসলামের দাওয়াতকে এভাবে যারা প্রত্যাখান করলো, তাদের সাথে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের জিহাদ করা উচিত ছিলো। নতুবা নিদেন পক্ষে তাঁর সেখান থেকে হিজরত করা উচিত ছিলো। কিন্তু তিনি না করলেন হিজরত, আর না করলেন তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ, এমনকি তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ কিংবা অসন্তোষ ব্যক্ত করতেও তাঁকে দেখা যায়না। এ জটিল রহস্যের কোনো সমাধান কি আপনি দিতে পারেন?
জবাব
বনী ইসরাঈলের ইতিহাসের যে যুগটি হযরত মুসা আলাইহিস সালামের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। বলতে গেলে সেটা একেবারেই অন্ধকারাচ্ছন্ন। এজন্য কুরআনের সংক্ষিপ্ত ইংগীতসমূহের বিস্তারিত তথ্য অবগত হওয়া খুবই কঠিন। তবু কুরআনের এই সব সংক্ষিপ্ত ইংগিত থেকেও একথা সন্দেহাতীতভাবে জানা যায়, মিসরে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম সরকারের একজন সাধারণ অংশীদার ছিলেননা। বরং একচ্ছত্র ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক ছিলেন। তিনি শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেনই এই শর্তে যে, তাঁর হাতে সার্বিক ক্ষমতা অর্পণ করা হবে। নিম্নের আয়াত দুটি মনোনিবেশ সহকারে পড়ে দেখুনঃ
“ইউসূফ আলাইহিস সালাম বললেন, আমাকে দেশের যাবতীয় সহায়-সম্পদের কর্তৃত্ব দান করুন। নিশ্চয়ই আমি যথাযথভাবে সংরক্ষক এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞানের অদিকারী। এভাবে আমি ইউসূফকে ঐ ভূখন্ডের কর্তৃত্ব দান করেছিলাম। সেখানে সে যথায় খুশী স্বীয় আবাস প্রতিষ্ঠা করতে পারতো।” [বাইবেল এবং তালমুদ থেকেও এ সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানা যায়না। আর মিসরের প্রাচীন ইতিহাস এবং প্রাচীন নিদর্শনাবলী থেকেও এ ব্যাপারে কিছু জানা যায়না।] [সূরা ইউসূফঃ ৫৫-৫৬]
এই রেখা চিহ্নিত ব্যক্যগুলো তেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, তিনি সার্বিক ক্ষমতাই চেয়েছিলেন আর পেয়েছিলেনও সার্বিক ক্ষমতাই। “দেশের সহায় সম্পদ” কথাটা দেখে কেউ কেউ ভুল ধারণায় লিপ্ত হয়েছেন যে, এ পদটা বোধহয় অর্থমন্ত্রীর অথবা রাজস্ব কর্মকর্তা পর্যায়ের। অথচ প্রকৃতপক্ষে এর অর্থ হলো দেশের সমগ্র উপায় উপকরণ [Resources] । হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের দাবী ছিলো, মিসর সাম্রাজ্যের সমস্ত উপায় উপকরণ তাঁর কর্তৃত্ব সমর্পণ করা হোক। আর এ দাবীর ফলে তিনি এমন ক্ষমতা লাভ করেছিলেন যে, গোটা মিসর ভূখন্ড তাঁর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো। “সেখানে যে যথায় খুশী স্বীয় আবাস প্রতিষ্ঠা করতে পারতো।” কথাটারও অনেকে অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে এর মর্ম শুধু এতটুকু যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম সর্বত্র বসবাস করার বা বাড়ী তৈরী করার অবাধ অনুমতি পেয়েছিলেন। অথচ প্রকৃতপক্ষে একথাটা দ্বারা এটাই বুঝাতে চাওয়া হয়েছে যে, এক ভূস্বামীর তার স্বভূমিতে যেরূপ অবাধ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকে, সমগ্র মিসর ভূখন্ডে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ঠিক তদরূপ একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
এরপর যে প্রশ্নটি অবশিষ্ট থাকে তা হলো, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের কারায়াত্ব এই নিরংকুশ ক্ষমতা দ্বারা তিনি দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, নৈতিকতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ইসলামী আদর্শ অনুসারে পরিবর্তিত করতে কতোখানি চেষ্টা করেছিলেন এবং তাতে তিনি কতদূর সাফল্য লাভ করেছিলেন? ইতিহাসে আমরা এ প্রশ্নের কোনো বিস্তারিত জবাব পাইনা। তবে সূরা মায়েদার একটি উক্তি থেকে পরোক্ষভাবে আমরা এতোটুকু নিশ্চতভাবে জানতে পারি যে, মিসরে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের শাসন কোনো ব্যক্তি বিশেষের ক্ষণস্থায়ী শাসন ছিলোনা। বরং তার পরেও দীর্ঘকালব্যাপী তাঁর উত্তরসূরীরা মিসরের শাসন ক্ষমতার অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তাঁরা নিঃসন্দেহে মুসলমান ছিলেন। শুধু তাই নয়, এই শাসকবর্গ সমসাময়িক পৃথিবীতে নজীরবিহীন প্রভাব প্রতিপত্তি ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। আয়াতটি নিম্নরূপঃ
“স্মরণ করো, যখন মূসা তার জাতিকে বলেছিলোঃ হে আমার জাতি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো, তিনি তোমাদের মাঝে নবীদেরকে আবির্ভূত করেছেন। তোমাদের শাসক বানিয়েছেন এবং পৃথিবীর কাউকে যা দেননি, তা তোমাদের দিয়েছেন।” [সূরা মায়েদাঃ ২০]
এথেকে অনুমান করা চলে যে, এই সর্বাত্মক ইসলামী আধিপত্য ও বিজয় অনিবার্যভাবে দেশের সমগ্র কর্মকান্ডে প্রভাব বিস্তার করেছিলো।
সূরা আলমুমিনের যে আয়াত থেকে আপনি এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, কিবতী সম্প্রদায় হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামকে মেনে নেয়নি, আসলে সে আয়াতটি থেকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ যুক্তিসঙ্গত নয়। আমার উপলব্ধি এই যে, সেখানে ভারতের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলো। দেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং বিরাট সংখ্যাগুরু অংশ মুশরিক থেকে গিয়েছিলো। [বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী মিসর থেকে মূসা আলাইহিস সালামের সাথে যেসব লোক বের হয়ে এসেছিলো তাদের মধ্যে ছয় লাখ কেবল যোদ্ধা পুরুষই ছিলো। এথেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, তাদের মোট সংখ্যা বিশ লাখের কম ছিলোনা এবং মিসরের জনসংখ্যার সমপক্ষে তারা ১০% শতাংশ ছিলো।] যে অংশ ইসলাম গ্রহণ করে সে অংশটিই দীর্ঘকালব্যাপী ক্ষমতাসীন ছিলো। কিন্তু ক্রমাগত নৈতিক ও আকীদাগত অধপতন তাদের গোলামী ও গোমরাহীর গভীর আবর্তে নিক্ষেপ করে। শেষ পর্যন্ত এই জনগোষ্ঠীটি ব্যক্তিপূজা ও ধর্মীয় বাড়াবাড়ীর বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়ে এমন অবস্থার শিকার হয় যে, অন্যান্য পৌত্তলিকদের সাথে তাদের কার্যত কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভেদ ছিলোনা। ফিরাউনের দরবারের ঈমানদার লোকটি এ বিষয়ের দিকে ইংগিত করেই বলেছেনঃ
“ইতোপূর্বে ইউসূফ তোমাদের কাছে সুম্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি যা নিয়ে এসেছিলেন, তা নিয়ে তোমরা অনবরত সন্দেহে লিপ্ত রইলে। অতপর তিনি যখন ইন্তিকাল করলেন, তখন তোমরা বললে, এখন ওর পরে আল্লাহ আর কোনো রসূল পাঠাবেননা।” [সূরা মুমিনঃ ৩৪]
রেখা চিহ্নিত কথাগুলোর মধ্যে প্রথমটি থেকে বুঝা যায়, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের জীবদ্দশায় দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁর নবূয়্যত সম্পর্কে সন্ধিহান ছিলো, যেমনটি অধিকাংশ নবীদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। দ্বিতীয় কথাটি থেকে বুঝা যায়, তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর ভক্তরা তাঁর ব্যক্তিত্বের পূজারী হয়ে বাড়াবাড়ী শুরু করে দেয় এবং বলতে থাকে যে, এখন আর কোনো রসূল আসতে পারেনা! এরই ভিত্তিতে তারা পরবর্তী নবীদেরকে অগ্রাহ্য করে। পরবর্তী সময়ে ইহুদী ও খৃষ্টানরা এ কাজই করেছিলো। অথচ হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম কিংবা হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম, এঁদের কারো পরেই আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়্যত সমাপ্তির ঘোষণা দেয়া হয়নি।
তবে কোনো অবস্থাতেই আয়াতটির এরূপ মর্মোদ্ধারের অবকাশ নেই যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ওপর দেশের কেউ ঈমান আনেনি। বরং অন্যান্য আভাস-ইংগীত থেকে এটাই অনুমিত হয় যে, দেশে মুমিনদের একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিলো। তারা বনী ইসরাঈলের সাথে মিলিত হয়ে দীর্ঘদিন ইসলামী শাসন চালু রেখেছিলো। তবে পরবর্তী সময় তারা ক্রমান্বয়ে অধোপতনের [Degenerate] শিকার হয়ে পড়ে।
৫. ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করার মতবাদ খন্ডন এবং তার পর্যালোচনা
[“সূরা ইউসূফ সংক্রান্ত কাতিপয় প্রশ্ন” শীর্ষক নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পর একজন খ্যাতনামা মনীষী, যিনি এখন জীবিত নেই, যিনি খান বাহাদুর উপাদিতে ভূষিত ছিলেন এবং ইউপিতে কালেক্টর ও ভারতের একটি রাজ্যে দেওয়ানে পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, আমার উক্ত নিবন্ধের দীর্ঘ সমালোচনা লেখেন। উক্ত মনীষীর সমালোচনা না পড়ে আমার জবাব বুঝা সম্ভব নয় বিধায় আমরা এখানে প্রথমে তার সমালোচনার সংশ্লিষ্ট অংশ উদ্ধৃত করছি। এরপর আমাদের জবাব উদ্ধৃত করবো।][এ পার্যালোচনাটি তরজমানুল কুরআন জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ১৯৪৫ সংখ্যা থেকে সংকলিত।]
প্রশ্নকর্তা যেকথা জানতে চেয়েছিলেন এবং যেকথা প্রকৃতপক্ষে বিবেচ্য বিষয়, তা শুধু এতোটুকুই যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের এ কাজটি ইসলামী দৃষ্টিভংগিতে জায়েয ছিলো কি না? মাওলানা মওদূদী সাহেব জবাবে বলেন, “হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের পদমর্যাদা মিসরে অনৈসলামিক সরকারের একজন অংশীদারের অনুরূপ ছিলোনা।” আশ্চার্য্যর বিষয় তিনি তাঁর এই মতের সমর্থনে কুরআনের সেই আয়াতই অর্থাৎ [সূরা ইউসূফঃ ৫৫] পেশ করেন, যা প্রকৃতপক্ষে এর বিপরীতটাই প্রমাণ করে।
উক্ত আয়াতের শাব্দিক অনুবাদ শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের ভাষায় নিম্নরূপঃ
“ইউসূফ বললেন, আমাকে নিযুক্ত করুন দেশের ধন ভান্ডার সমূহের দায়িত্বে। আমি প্রচুর জ্ঞানের অধিকারী এবং রক্ষক। এভাবে আমি ইউসূফকে ক্ষমতা দিলাম সেই ভূখন্ডে। তিনি স্থান গ্রহণ করতেন সেই ভূখন্ডে যেখানে চাইতেন।”
লক্ষ্য করুন, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম ফেরাউনের কাছে আবেদন জানালেন, আপনি আমাকে দেশের ধন ভান্ডারের দায়িত্বে নিযুক্ত করুন। ফিরাউন তার আবেদন মঞ্জুর করেন এবং তিনি অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। স্পষ্টতই এর ফল দাঁড়ালো এই যে, তিনি ফিরাউনের সরকারের একজন সদস্য বা অংশীদার হয়ে গেলেন। এই স্বাভাবিক ফলশ্রুতিকে পাশ কাটানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে গিয়ে মাওলানা মওদূদী বলেন, “দাবী ছিলো নিরংকুশ ক্ষমতার এবং পেয়েছিলেনও নিরংকুশ ক্ষমতা।”……
প্রথমত নিরংকুশ বা সার্বিক ক্ষমতাবোধক শব্দ কুরআনে নেই। এ শব্দটা মাওলানা সাহেব নিজের পক্ষ থেকে কুরআনে সংযোজন করতে চান, যাতে কুরআন মাওলানার ব্যক্তিগত মতাদর্শের বাহক হয়ে যায়, এ জন্য নয় যে, মাওলানা নিজের ব্যক্তিগত মতবাদকে কুরআন অনুযায়ী শুধরে নেবেন। এ ধরনের মনোবৃত্তি সম্পর্কে সম্ভবত মরহুম কবি ইকবাল বলেছিলেনঃ “তারা নিজেরা শুধরায়না। বরং কুরআনকে বদলায়।” কিন্তু এই সার্বিক বা নিরংকুশ শব্দটার অবৈধ সংযোজন সত্ত্বেও মাওলানার গবেষণা বা মতবাদের সমর্থন পাওয়া যায়না। ধরে নিলাম, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম অর্থ সম্পদ সংক্রান্ত সার্বিক ক্ষমতা চেয়েছিলেন এবং পেয়েছিলেনও সার্বিক ক্ষমতাই। কিন্তু এই ক্ষমতা তিনি মিসরের ফিরাউনের কাছেইতো চেয়েছিলেন এবং মিসরের ফিরাউনইতো সেটা দিয়েছিলো। সুতরাং নিরংকুশ ও সার্বিক ক্ষমতা লাভ করা সত্ত্বেও তখনকার শাসন ব্যবস্থায় তাঁর অবস্থান একজন সদস্য বা অংশীদারের উর্ধের কিছু হতে পারেনা।
মাওলানা মওদূদী সাহেবের এ উক্তিও বাস্তবতার বিপরীত যে, “হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের দাবী ছিলো, মিসর সম্রাজ্যের সকল উপায় উপকরণ আমার দায়িত্বে সমর্পণ করা হোক এবং দাবীর পরিণতিতে তিনি যে ক্ষমতা লাভ করলেন তাতে সমগ্র মিসরের ভূমি তাঁর নিজস্ব ভূমিতে পরিণত হলো।” একথা যদি মেনে নেয়াও হয় যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম অর্থ সংক্রান্ত সার্বিক ক্ষমতা দাবী করেছিলেন এবং অর্থ সংক্রান্ত একচ্ছত্র কর্তৃত্ব তার হাতে অর্পন করা হয়েছিলো। তথাপি একথা সবার জানা, একটি রাষ্ট্রে অর্থ ছাড়া আরো বহু বিভাগ থাকে। যেমন- পুলিশ, সশস্ত্রবাহিনী ও বিচার বিভাগ। এসবের কোনেটির দায়িত্ব ইউসূফ আলাইহিস সালাম চানওনি, এগুলো তাঁর দায়িত্বে অর্পিতও হয়নি। তা যখন হয়নি, তখন মাওলানার একথা বলা যে, “তিনি যে ক্ষমতা লাভ করেছিলেন তাতে সমগ্র মিসরের ভূমি তাঁর নিজের ভূমিতে পরিণত হয়েছিলো” সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
অতএব হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম বিসরের সমস্ত অর্থ সম্পদের দায়িত্ব প্রাপ্ত হলেও তাঁর সাম্রাজ্যের ক্ষমতার প্রকজন অংশীদার বা সরকারের সদস্যের পর্যায়েই থাকে যতক্ষণ কোনো উপায়ে প্রমাণিত না হয় যে, মিসরের ফিরাউন সাম্রাজ্যের শাসন থেকে অবসর নিয়েছিলো এবং হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের তাঁর স্থলে মিসরের সম্রাট হয়ে গিয়েছিলো। অথচ তাঁর সম্রাট হওয়ার কথা ইতিহাস থেকেও প্রমাণিত হয়না, কুরআন থেকেও নয়। বরং কুরআন থেকে এ ধারণা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যাত। আলোচ্য আয়াতের অব্যবহিত পূর্বের আয়াতটি লক্ষ্যণীয়ঃ
“সম্রাট বললো, তোমরা তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে নিজের জন্য মনোনীত করবো। অতপর সে যখন ইউসূফের সাথে কথা বললো, বললো যে, নিশ্চয়ই আপনি আজ আমাদের কাছে সম্মানিত ও বিশ্বস্ত।” [সূরা ইউসূফঃ ৫৪]
উভয় আয়াত থেকে সম্পূর্ণ স্পষ্ট যে, মিসরের ফিরাউন হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামকে স্বীয় সাম্রাজ্যের সম্মানিত ও বিশ্বস্ত সদস্য এবং নিজের বিশেষ উপদেষ্টা নিযুক্ত করেন। এ আয়াত দুটিতে এমন কোনো আভাসও নেই যে, মিসরের ফিরাউন স্বীয় সম্রাজ্য অথবা ক্ষমতা পরিত্যাগ করেছিলেন। এছাড়া পরবর্তী একটি আয়াত থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম কর্তৃক মিসরের সকল অর্থ সম্পদের দায়িত্ব গ্রহণেরও অনেক পর পর্যন্ত মিসরে ফিরাউনের রাজত্ব বহাল ছিলো এবং তাঁর ধর্মই দেশে চালু ছিলো। কেননা ইউসূফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা যখন দ্বিতীয়বার খাদ্যশস্য আনার জন্য মিসরে আসে তখন হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ইচ্ছা মোতাবেক তাঁর আপন ভাই বিন ইয়ামিনকেও নিয়ে আসে। হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম তাঁর ভাই বিন ইয়ামিনকে নিজের কাছে রেখে দেন এবং তাকে জানিয়েও দেন যে, তিনি তাঁর আপন ভাই, কিন্তু তাঁর অন্যান্য ভাইদের কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেননি। এই সময় যেহেতু ইউসূফ আলাইহিস সালাম ভাইদের কাছে বিন ইয়ামীন তার আপন ভাই একথা প্রকাশ না করেই বিন ইয়ামিনকে নিজের কাছে রেখে দিতে চেয়েছিলেন, তাই এ উদ্দেশ্যে তিনি একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। ইউসূফ আলাইহিস সালামের ভাইদের জন্য যখন তাদের আসবাবপত্র প্রস্তুত করা হলো, তখন বিন ইয়ামিনের আসবাবপ্রত্রের ভিতর একটা পানপাত্র লুকিয়ে রাখা হলো। অতপর কাফেলা রওনা দিতে আরম্ভ করলে এ ঘোষক চিৎকার করে বললো, ওহে কাফেলার লোকেরা! তোমরা নিশ্চয়ই চোর। ইউসূফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা একথা অস্বীকার করলে ঘোষখ বললো, তোমরা যদি মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হও, তাহলে এর কি শাস্তি গ্রহণ করবে? হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা বললো, যার আসবাবপত্রে এটা পাওয়া যাবে, সেই তার বদলায় যাবে। আমরা অপরাধীদের এরকম শাস্তিই দিয়ে থাকি। এরপর তাল্লাশি চালানো হলে পানপাত্রটি বিন ইয়ামিনের আসবাবপত্র থেকে বের হলো। এভাবে পানপাত্রের বদলায় বিন ইয়ামিনকে আটক করা হলো। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ
“আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া ইউসূফের পক্ষে বাদশাহের ধর্ম অনুসারে আপন ভাইকে আটক করা সম্ভব ছিলোনা।” [সূরা ইউসূফঃ ৭৬]
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, মিসরের রাজকীয় আইন তখনো দেশে প্রচলিত ছিলো এবং সে আইন অনুসারে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম স্বীয় ভাই বিন ইয়ামিনকে চুরির দায়ে ভাইদের কাছ থেকে ধরে রাখতে পারতেননা। কিন্তু আল্লাহ স্বয়ং তাঁর ভাইদের মুখ দিয়ে একথা বলিয়ে নিলেন যে, যার আসবাবপত্র থেকে পানপত্র পাওয়া যাবে তাকেই তার বিনিময়ে থেকে যেতে হবে। এ আয়াতের তাফসীর প্রসংগে মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী বলেনঃ
“অর্থাৎ ভাইদের মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরুলো, যার কাছে জিনিসটা পাওয়া যাবে তাকে গোলাম বানিয়ে নাও। এজন্যই তাকে গ্রেফতার করা হলো। নচেৎ মিসরের আইন এরকম ছিলোনা।”
তাই বলে একথা বলা চলেনা যে, মিসরের মন্ত্রীত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম ইসলাম প্রচারের কাজ করেননি কিংবা নিজের নবূয়্যতের কথা ব্যক্ত করা থেকে বিরত থেকেছেন। বরঞ্চ তিনি জেলে থাকাকালেই তাওহীদের মর্মবাণী প্রচার করা শুরু করে দিয়েছিলেন। হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম নিজের সহবন্দীদ্বয়কে সম্বোধন করে বলেনঃ
“হে আমার কারা বন্দীদ্বয়। ভিন্ন ভিন্ন প্রভু ভালো, না একমাত্র মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ? তোমরা যেসব সত্ত্বার পূজা করো সেগুলোতে কেবল তোমাদেরই নির্ধারিত কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছু নয়। যার সমর্থনে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি। বিচার ফায়সালা ও শাসন করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তিনি আদেশ দিয়েছেন, তাঁর ব্যতীত আর কারোর ইবাদত করোনা।” [সূরা ইউসূফঃ ৩৯-৪০]
এমনিভাবে এটাও ধরে নেয়া যায় যে, মন্ত্রী হওয়ার পরও হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম ইসলাম প্রচারের কাজ অবশ্যই অব্যাহত রেখেছিলেন। তবে এ আয়াতগুলো থেকে একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম একটা অনৈসলামিক সরকারের সদস্য হয়েছিলেন নিজেরই আগ্রহ ও আবেদনক্রমে। আর তাঁর সরকারের সদস্য হওয়ার পরও দেশে অনৈসলামিক শাসন ব্যবস্থা এবং অনৈসলামিক আইনই চালু ছিলো। তাঁর এ কাজে আল্লাহর তরফ থেকে কোনো তিরস্কারতো করাই হয়নি, অধিকন্তু তাঁর এ রকম প্রশংসাই করা হয়েছে। কেননা হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের মিসরের ভূখন্ডে প্রতিষ্ঠা লাভ করাকে আল্লাহর পুরস্কার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ
“এভাবেই আমি ইউসূফকে সেই ভূখন্ডে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে সে তার যেখানেই ইচ্ছা নিজের স্থান করে নিতে পারে। আমি যাকে চাই, আমার অনুগ্রহে সিক্ত করি আর সৎকর্মশীলদের পুরস্কার আমি কখনো বিনষ্ট করিনা।”
এথেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, সাধারণ মুসলমানতো দূরের কথা নবীদের পক্ষেও অনৈসলামিক সরকারের সদস্য হওয়া বৈধ। শুধু বৈধই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে ফরযে কিফায়ার মতো অপরিহার্য কর্তব্যও বটে। কেননা হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের নিজ আগ্রহে মিসরের অর্থ ভান্ডারের দায়িত্বশীল হওয়া থেকে প্রমাণিত হয়, এ কাজকে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম নিজের জন্যে কেবল বৈধ নয়, কর্তব্যও মনে করতেন। তা না হলে ফিরাউনের কাছে তিনি কখনো এ ব্যাপারে নিজের অভিলাষ প্রকাশ করতেননা এবং এরূপ অভিলাষ প্রকাশ করার সময় নিজের অভিজ্ঞ ও রক্ষক হওয়ার কথাও ব্যক্ত করতেননা। কেননা তাঁর মতে যদি মিসরের ওজারতীর দায়িত্ব গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অবশ্য কর্তব্য না হতো, তাহলে তাঁর পক্ষে নিজেকে অভিজ্ঞ ও রক্ষক বলা অবান্তর আত্মপ্রশংসার পর্যায়ে পড়ে।
[এরপর তিনি নিজ বক্তব্যের সমর্থনে কয়েকজন মনীষীর বক্তব্য উল্লেখ করেন। নিজের পক্ষ থেকে কিছু যুক্তিও পেশ করার চেস্টা করেন। তাছাড়া হাবশার হিজরত থেকেও যুক্তি গ্রহণ করেন। যেহেতু তার যুক্তি প্রমাণের মণিমুক্তা উপরে এসে গেছে তাই দীর্ঘয়িত হবার ভয়ে বাকী অংশ এখানে উল্লেখ করা হলোনা।]
জবাব
আমি জনাব খান বাহাদুর সাহেবের নিকট কৃতজ্ঞ যে, তিনি প্রশ্নটার অবতারণা ক আমাকে আরো একবার আমার দৃষ্টিভংগি পরিস্কারভাবে তুলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমি শুধু এই আশায় এ আলোচনায় সময় ব্যয় করছি যে, এতে করে বহু সংখ্যক ছাড়া অন্যান্য শক্তি বা কর্তৃপক্ষের আনুগত্য করা অথবা অন্য কথায় আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য শক্তি বা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করাকে বৈধ এবং কুফরী শাসন ব্যবস্থার গোলামী করাকে মুবাহ এমনকি ফরজে কিফায়া সাব্যস্ত করার জন্য পেশ করা হয়ে থাকে।
হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ঘটনার আলোচ্য দিকটি নিয়ে ইতিপূর্বে আমি দুবার আলোচনা করেছি। তন্মধ্যে প্রথম আলোচনাটা অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে ও যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়েছিলো। আর দ্বিতীয়টা ছিলো সংক্ষিপ্ত। কিন্তু খান বাহাদুর সাহেব বিস্তারিত আলোচনাটা বাদ দিয়ে সংক্ষপ্তি আলোচনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক তুলেছেন। এটা কোন কারণে করলেন জানিনা। অথচ তিনি স্বীয় নিবন্ধে যেসব আপত্তি তুলেছেন, তার অধিকাংশ বরং সম্ভবত সব কটারই জবাব আমার প্রথম আলোচনায় পাওয়া যেতে পারে। [এ বইয়ের ইসলাম ও কর্তৃত্ব শীর্ষক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য] সে যা হোক, এ পাশ কাটানোর কারণ যেটাই হোকনা কেন, আমাদের সামনে এর কল্যাণকর দিকটাই প্রধান হয়ে ফুটে উঠেছে। যে কথাগুলো আমরা নিজেরা বারংবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিস্কার করে বলতে পারতাম না, অন্যদের খোঁচানোতে তা স্পষ্ট করে বলার সুযোগ আমাদের হস্তগত হয়েছে।
ইসলামে কি স্বাবিরোধীতা আছে?
দুনিয়াতে একজন কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন ও সুস্থ বিবেকধারী মানুষের কাছ থেকে যেসব জিনিস আশা করা হয়, তার মধ্যে পয়লা জিনিস সম্ভবত এটাই যে, তার কথাবার্তা যেনো পরস্পর বিরোধী না হয়। একজন স্বল্প বৃদ্ধির মূর্খ গোঁয়ার লোকও যখন কাউকে এ ধরনের পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা বলতে দেখে, তখন সংগে সংগেই তাতে আপত্তি তোলে। কেননা তারা অমন স্থুল বুদ্ধিও স্ববিরোধী কথাবর্তার বোকামী সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু এটা বড়ই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, অত্যন্ত নিন্মমানের বুদ্ধির লোকের কাছ থেকেও যা আশা করা যায়না, সেটাই সেই আল্লাহর কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে, যিনি নিজেই বিবেকবুদ্ধির সৃষ্টিকর্তা এবং সমস্ত প্রজ্ঞা ও সৃক্ষ্মজ্ঞানের অধিকারী। আরো আশ্চার্যর ব্যাপার হলো, আল্লাহর কাছ থেকে এহেন চরম নির্বুদ্ধিতা যার আশা করছে, তারা কোনো অজ্ঞ ও নির্বোধ লোক নয়, বরং সারা দুনিয়ার মানুষকে জ্ঞান ও বুদ্ধির সবক শেখানোর কাজে নিয়োজিত বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ। দুনিয়ার যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করার ক্ষেত্রে এই পন্ডিতদের ক্ষুরধার বুদ্ধি নিরন্তর যুদ্ধে লিপ্ত। এমন সচেতন ও জাগ্রত বিবেকের অধিকারী হয়েও তারা চান এবং আশা করেন যে, আল্লাহর কথার স্ববিরোধীতা থাকুক। অর্থাৎ তিনি একদিকে বলবেন যে, আমি আকাশ ও পৃথিবীর একচ্ছত্র সম্রাট। আবার অপরদিকে তিনি পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে অন্যের রাজত্ব ও আধিপত্য বহাল থাকাকেও স্বীকার করে নেবেন। একদিকে তিনি বলবেন, তোমরা সকলে একমাত্র আমার হুকুমের আনুগত্য করো। পরক্ষণে তিনিই আবার মানুষকে সেইসব শাসকের আনুগত্য করার অনুমতি দেবেন, এমনকি আনুগত্য করাকে ফরয পর্যন্ত ঘোষণা করবেন, যেসব শাসক আল্লাহর আদেশের সার্টিফিকেট ছাড়াই বরঞ্চ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তাঁর আদেশের বিরুদ্ধে আদেশ দান করে থাকে। তিনি মানুষের জন্য একটা আইন রচনাও করবেন এবং একথাও ঘোষনা করবেন যে, এটাই আমার আইন, এ আইন ছাড়া আর সব কিছুই বাতিল। আবার সেই সাথে অন্যান্য আইন প্রবর্তন ও প্রচলনকেও বৈধ করে দেবেন এবং যে মানুষের জন্য তিনি নিজে আইন রচনা করেছেন, সেই মানুষকেই এ “অধিকার” দেবেন যে, ইচ্ছা হয় তারা নিজেরা নিজেদের জন্য কোনো আইন রচনা করে নিক, নতুবা অন্য কারো আইন ধার করে এনে অনুসরণ করতে থাকুক। পৃথিবীর অধিবাসীদেরকে আল্লাহর দীন গ্রহণের দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্য তিনি তাঁর নবীদেরকেও পাঠাবেন, আবার সেই নবীদেরকেই বা তাঁদের কাউকে এ অনুমতিও দেবেন [এমনকি খান বাহাদুর সাহেবের বক্তব্য অনুসারে এজন্য তাদেরকে অভিনন্দিতও করবেন] যে, আল্লাহর এ দীন ছাড়া অন্য কোনো দীনের আওতাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কর্মচারীও ভৃত্য হয়ে যাক এবং তাকে সফলতার সাথে পরিচালনা করতে নিজেদের যোগ্যতা ও প্রতিভাকে কাজে লাগাক। তিনি সারা দুনিয়ার অধিবাসীদের মধ্য থেকে বাছাই করে একটি বিশেষ উম্মত এ উদ্দেশ্য তৈরী করবেন যে, তারা আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত সৎ কাজগুলোর আদেশ দেবে এবং আল্লাহ কর্তৃক ধিক্কৃত অসৎ কাজগুলোকে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করবে। আবার খোদাদ্রোহীদের দৃষ্টিতে ভালো লাগা অসৎ কাজগুলোকে কায়েম করা ও চালু রাখার কাজে অংশ গ্রহণ এবং তাদের দৃষ্টিতে খারাপ বলে বিবেচিত সৎ কাজগুলোকে উৎখাত করা ও দমিয়ে দেয়ার কাজে ব্যবহৃত ও নিয়োজিত হওয়াকে সেই উম্মতের জন্যই বৈধও করে দেবেন, এমনকি তার কোনো কোনো “মনোনীত” বান্দার জন্য এ কাজকে ফরযে কিফায়াও ঘোষণা করবেন, এগুলো এমন সুস্পষ্ট স্ববিরোধী ব্যাপার যে, এগুলোর স্বরিরোধীতা বুঝতে কোনো গভীর চিন্তা গবেষণার প্রয়োজন পড়েনা। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যারা কুরআনের তাফসীর লেখা এবং ফিকহ ও অন্যান্য যুক্তিনির্ভর বিদ্যায় অধ্যাপনা করার মতো পারদর্শিতা রাখেন, যারা কালেক্টরী, তারা এসব দুমুখো কার্যকলাপে যেনো কোনো স্বরিরোধীতাই দেখতে পাননা। এমনকি স্বয়ং বিশ্বপ্রতিপালক সম্পর্কে তাদের ধ্যান ধারণা এতোই খারাপ যে, একজন নিরেট মুর্খ গোঁয়ার লোকও তার আশপাশের কোনো বন্ধুর মধ্যে যেসব বেকুফী ও গোঁয়ার্তুমী দেখে তা সহ্য করতে পারেনা। তা স্বয়ং আল্লাহর মধ্যেও থাকা সম্ভব বলে তারা মনে করেন। খান বাহাদুর সাহেব তাঁর উক্ত নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেনঃ
“পরবর্তী একটি আয়াত থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রমাণিত হয়, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের মিসরীয় অর্থ ভাণ্ডারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভের পরও ফিরাউনের রাজত্ব বহাল ছিলো এবং ফিরাউনের বিধি বিধানই মিসরে প্রচলিত ছিলো।
“বাদশাহর প্রচলিত বিধান অনুযায়ী তিনি কখনো আপন ভাইকে নিতে পারতেননা, আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত।” [সূরা ইউসূফঃ ৭৬]
এবাক্যটি সুস্পষ্টরূপে বলে দিচ্ছে যে, ফিরাউনের রাজকীয় আইনই তখন পর্যন্ত মিসরে চালু ছিলো।”
দীন বলতে কি বুঝায়?
এ কথাগুলো লেখার সময় খান বাহাদুর সাহেবকে একটা নির্দিষ্ট তত্ত্ব প্রমাণ করার নেশায় এমনভাবে পেয়ে বসেছিলো যে, তাঁর এই মনগড়া তাফসীরের দারুন এখানে কুরআনের বর্ণনায় যে সুস্পষ্ট স্ববিরোধীতার উদ্ভব হয়, তা ক্ষণিকের জন্যও ভেবে দাখার ফুরসত তিনি পাননি। তাঁকে অনুরোধ করি, তিনি যেনো আমার দৃষ্টি আকর্ষণে সাড়া দিয়ে এখন অন্তত একটু ভেবে দেখেন। তাঁর উদ্ধৃত আয়াতে ফিরাউনের সার্বভৌমত্ব ভিত্তির রাষ্ট্রিয় আইন ও বিধানকে “দীনুল মালিক” অর্থাৎ “রাজকীয় দীন” শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। এথেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, দীন শুধু উপাসনালয়ে যে পূজা অর্চনা করা হয় তার নাম নয়, বরং যার বলে পুলিশ অপরাধীদেরকে পাকড়াও করে, যার অধীনে আদালত দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার বিচার ফয়সালা করে, যার অনুসরণে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয় এবং যার ওপর সমাজ ও সভ্যতার গোটা কাঠামো প্রতিষ্ঠিত, সেই আইন কানুন ও বিধি বিধানের নাম দীন। মানব জীবনের এই সকল দিক ও বিভাগ সামগ্রিকভাবে যে নিয়ম নীতি ও প্রথা পদ্ধতি অনুসারে চলে, কুরআনী পরিভাষায় তাকেই দীন বলা হয়। যেহেতু মিসরে প্রচলিত তৎকালীন নিয়ম নীতি ও প্রথা পদ্ধতি ফিরাউনের ইচ্ছা থেকেই উদগত ও উৎপন্ন হতো এবং তার সার্বভৌম ও নিরংকুশ ক্ষমতাই ছিলো তার উৎপত্তির উৎস ও ভিত্তি, তাই কুরআন সেটাকে “দীনুল মালিক” [রাজার দীন] বলে আখ্যায়িত করেছে। এথেকে বুঝা গেল যে, দীন” শুধু মসজিদের চার দেয়ালে এবং নামায রোযার মধ্যেই সীমিত উপাসনা ও পূজা পার্বনের অনুষ্ঠানের নাম নয়, বরং এটাও আল্লাহর গোটা শরীয়ত ব্যবস্থার আনুগত্যের নাম, যার উদ্ভব ঘটে আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি থেকে, যার উৎপত্তি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব থেকে এবং যা মানুষের সামাজিক জীবনের সকল দিক ও বিভাগ নিয়ে ব্যস্ত ও বিস্তিৃত। এখন প্রশ্ন হলো, হযরত ইউসূফ আল্লইহিস সালাম কোন কাজের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন? “আল্লাহর দীনের দাওয়াত দিতে, না রাজার দীন কে চালু করতে এবং উৎকর্ষ দিতে? খান বাহাদুর সাহেবের ব্যাখ্যা এবং তিনি যে মনীষীদের নামোচ্চারণ করে আমাদেরকে ভড়কিয়ে দিতে চান তাদের তাফসীর যদি মেনে নেয়া হয়, তাহলে এ কথাও মেনে নিতে হয় যে, আল্লাহ তায়ালা একদিকে তাঁর নবীকে এই মর্মে নির্দেশ দিচ্ছেন, তিনি যেনো তাঁর বান্দাদেরকে- বিশেষত মিসরবাসী বান্দাদেরকে “আল্লাহর দীন” গ্রহণের দাওয়াত দান, আর অপরদিকে সেই নবী স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে “রাজার দীন” কায়েম করা ও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিয়োজিত হয়ে গেলেন। আরো মজার ব্যাপার হলো, এমন সুস্পষ্ট পরস্পর বিরোধী কার্যকালাপে কোনো বৈপরিত্য ও বৈসাদৃশ্য আছে কিনা আল্লাহ তা টেরই পেলেননা, বরং নবীর ঐ কার্যকালাপকে খানবাহাদুর সাহেবের ভাষায় অভিনন্দন জানাতে ও প্রশংসা করতে লাগলেন। শুধু তাই নয়, কুফরী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তাঁর নবীর ওজারতী লাভকে “খোদায়ী পুরস্কার” বলে আখ্যায়িত করতে লাগলেন। অর্থাৎ কিনা আল্লাহ মিয়া, নাউজুবিল্লাহ, আমাদের যামানার সেইসব ধর্মপ্রাণ মুরব্বীদের মতো, যারা নিজেরা তো কপালে কালো দাগ নিয়ে জায়নামাযে সিজদার ওপর সিজদা দিয়ে যান, কিন্তু স্বীয় পুত্ররত্ন যখন এম এ পাস করে আধা ইংরেজ হয়ে খৃষ্টান সরকারের অধীনে কাস্টম ইনসপেক্টরের চাকরি পায়, তখন সেই আপাদমস্তক ধর্মের সাজে সজ্জিত মুরব্বী এজন্যে আল্লাহর শোকর আদায় করেন যে, তিনি তার বংশধরকে স্বীয় অনুগ্রহে সিক্ত করেছেন। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে খান বাহাদুর সাহেব আবার বলেনঃ
“তাই বলে একথা বলা যায়না যে, মিসরের ওজারতীতে অভিষিক্ত হবার পর হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম ইসলাম প্রচারের কাজ করেননি, কিংবা নিজের নবূয়্যতের ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন। বরঞ্চ তিনি জেলে থাকাকালেই তাওহীদের মর্মবাণীর প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। ….. তবে যেকথা এ আয়াত থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় তা হলো, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম একটি অনৈসলামিক শাসন ব্যবস্থায় নিজ আগ্রহে এবং আবেদনক্রমেই সদস্য হয়েছিলেন এবং হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের সে সরকারের সদস্য হওয়ার পরও দেশে অনৈসলামিক শাসন ব্যবস্থা এবং অনৈসলামিক আইনই কার্যকর ছিলো।”
এখানেও আবার সেই একই স্ববিরোধীতা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। অথচ খান বাহাদুর সাহেব নিজ মতের চিন্তায় বিভোর থাকার সেদিকে মনোযোগ দিতে পারেননি। হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম যে তাওহীদ বা একত্ববাদ প্রচার করেছিলেন সেটা কি ধরনের একত্ববাদ ছিলো? এই একত্ববাদের অর্থ যদি এটাই হয়ে থাকে যে, উপাসনালয়ে যে উপাসনা করা হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রশাসন ও নিয়ম শৃংখলা যে আইনানুগত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তার সবই হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য, অন্য কথায় যার অর্থ হলো, সমগ্র জীবন আল্লাহর আনুগত্যের আওতাধীন হয়ে যাওয়া, তাহলে দেখা যায়, খান বাহাদুর সাহেবের ব্যাখ্যা অনুসারে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম বাদশাহর চাকরী করে নিজেই নিজের প্রচারিত সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। আর যাদি তাঁর প্রচারিত তত্ত্ব এই হয়ে থাকে যে, উপাসনালয়ে আল্লাহর বিধান চালু হবে আর দেশ ও সমাজের গোটা ব্যবস্থা চলতে থাকবে রাজার বিধান অনুসারে, তাহলে এটা যে একত্ববাদের নয় বরং দ্বিত্ববাদের তথা দুমুখো নীতির প্রচার ছিলো, সেটা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এখানে এ প্রশ্নও না উঠে পারেনা যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম তাহলে কোন অর্থে নিজের নবূয়্যতের ঘোষণা দিয়েছিলেন? তিনি যদি বাদশাহসহ সকল মানুষকে বলে থাকেন যে, আমি আসমান ও যমীনের মালিকের প্রতিনিধি! সুতরাং তোমরা আমার আনুগত্য করো। যেমন সকল নবী বলতেনঃ
“আল্লাহকে ভয় করো ও আমার আনুগত্য করো।” [সূরা শুয়ারাঃ ১০৮]
তাহলে এরূপ ঘোষণার সাথে তাঁর একজন অমুসলিম রাজার প্রভূত্ব মেনে নেয়া এবং তাঁর আনুগত্যের আওতায় ইসলামী রাষ্ট্রের পরিবর্তে ইসলাম বিরোধী রাষ্ট্রের খিদমত করা কিছুতেই সামঞ্জস্যশীল হতে পারেনা। আর যদি তিনি একথা বলে থাকেন যে, ওহে জনগণ! আমি যদিও আকাশ ও পৃথিবীর রাজাধিরাজের প্রতিনিধি, তথাপি আমার নীতি হলো, মিসরের বাদশাহর আনুগত্য করবো আর তোমাদেরকেও দাওয়াত দিচ্ছি যে, আমার নয় বরং বাদশারই আনুগত্য করো, তাহলে এটা একটা সুস্পষ্ট স্ববিরোধী বক্তব্য, যাকে স্বাভাবিক ভাবগাম্ভীর্যর সাথে গ্রহণ করার তো প্রশ্নই উঠেনা, বরং তা অট্টহাসি দিয়ে উড়িয়ে দেয়ারই যোগ্য। আর এ ধরনের ঘোষণাকারীর মন্ত্রণালয়ে নয় বরং পাগলা গারদেই স্থান পাওয়ার কথা ছিলো। শুধু তাই নয়, কোনো আসমানী কিতাব যদি একদিকে এরূপ মূলনীতি বর্ণনা করে যে, আল্লাহ যাকেই রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন আল্লাহর নির্দেশে তার আনুগত্য করতে হবে।
“আমরা যে রসূলই পাঠিয়েছি, পাঠিয়েছি এজন্য যেনো আল্লাহর নির্দেশ তাঁর আনুগত্য করা হয়।” [সূরা আননিসাঃ ৬৪]
অপরদিকে সেই কিতাবই যদি এমন এক ব্যক্তিকে আল্লাহর রসূল বলেও ঘোষণা করে যিনি আনুগত্য লাভ করাতো, দূরে থাক, নিজেই আল্লাহ ছাড়া অন্যের আনুগত্য করেছেন এবং জনগণকেও গায়রুল্লাহর আনুগত্য করতে বলেছেন, তাহলে এ ধরনের কিতাবের ওপর আদৌ ঈমান আনা সমিচীন হতে পারেনা। কুরআন যে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষে থেকেই প্রেরিত গ্রন্থ, সেকথা প্রমাণ করার জন্য সে যে মাপকাঠি দিয়েছে সেটি হচ্ছেঃ
“এ কিতাব যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর পাঠনো কিতাব হতো তাহলে মানুষ এতে অনেক স্ববিরোধী ও পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা দেখতে পেতো।” [সূরা আননিসাঃ ৮২]
কিন্তু আমরা যদি জনাব খান বাহাদুর সাহেব ও তার সমমনা লোকদের ধ্যান ধারণা মেনে নিই, তাহলে দেখা যাবে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনায় এমন প্রকাশ্য স্ববিরোধীতা বিদ্যমান, যার দরুন কুরআন তার নিজেরই প্রতিষ্ঠিত মাপকাঠি অনুসারে আল্লাহর নয় বরং অন্য কারো গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর তাও কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক বিশিষ্ট মানুষের গ্রন্থ বলে বিবেচিত হবেনা।
আসল ব্যাপার হলো, খান বাহাদুর সাহেব যে চিন্তাধারার প্রতিধ্বনি করছেন, তার পশ্চাতে নৈতিক অধোপতনের এক দীর্ঘ ও মর্মন্তুদ ইতিহাস রয়েছে।
ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে বিভাজনের ঐতিহাসিক এবং মানসিক পার্যালোচনা
মুসলমানরা যখন তাদের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে এবং তাদের সত্যিকার করণীয় কাজ পরিত্যাগ করে দুনিয়া পূজায় লিপ্ত হয়েছে, যখন দীনদারীর অর্থ তাদের কাছে হয়েছে ইবাদাত ও আচার আচরণে কিছু শরীয়তসম্মত রীতি নীতি মেনে চলা, তা সে জীবনের উদ্দেশ্য দুনিয়া পূজারীদের মতোই হোক না কেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কর্তৃত্ব নেককার কিংবা পাপিষ্ঠ যাদের হাতেই থাকুক না কেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব নীতিগত ও আদর্শগতভাবে ইসলাম হোক কিংবা ইসলামী বিরোধী। তখন এই উদাসীনতা ও শৈথিল্যের শাস্তি আল্লাহর তরফ থেকে এভাবেই দেয়া হয়েছে যে, তাদের বিরাট বিরাট অঞ্চল ও জনগোষ্ঠী একে একে কাফেরদের অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এতদসত্ত্বেও তারা ও তাদের আলেম সমাজ তাকে শাস্তি মনে না করে এবং যে পাপের জন্য তাদের এ শাস্তি হয়েছে তার প্রতিকার না করে উল্টো এটাই ভাবতে শুরু করেছে যে, কাফের শাসিত ঐ রাষ্ট্র ও সমাজে কিভাবে “মুসলমানী জীবন” যাপন করা যায়। এজন্য “ইজতিরার” তথা “অনন্যোপায় অবস্থা”র ওজুহাত তুলে শরীয়তসম্মত মুসলমানী জীবনের এমন এক চিত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা অনৈসলামিক ও শরীয়ত বিরোধী সমাজ ও রাষ্ট্রে চালু রাখা যায়।
এর ফলে আল্লাহর তরফ থেকে আরো শাস্তির পালা শুরু হলো। তারা অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসে, না গোমরাহীতে আরো দূরে সরে যায়, সেটা পরীক্ষা করাই ছিলো এর উদ্দেশ্য। যে অবস্থাটাকে প্রথমে একটা অনন্যোপায় অবস্থা ভাবা হয়েছিলো, আল্লাহর চিরন্তন রীতি অনুসারে তা আরো বেড়ে গেলো এবং স্থায়ী ক্রমবর্ধমান ও অফূরন্ত আযাবের রূপ ধারণ করলো। প্রতিটি গোলামী মুসলমানদেরকে প্ররোচিত করতে থাকলো যে, একটা কুফরী ব্যবস্থার অধীন এবং তার অভ্যন্তরে ইসলামী জীবন যাপনের জন্য তোমরা যে কর্মপন্থা অবলম্বন করেছো, তা সংশোধিত করো এবং ক্রমান্বয়ে সুংকুচিত করতে থাকো। কিন্তু আল্লাহর তরফ থেকে আগত এসব আযাব মুসলমানদের সচেতন করতে পারলোনা। তারা স্থায়ীভাবে এই নীতি অবলম্বন করলো যে, অনন্যোপায় অবস্থায় যখন পড়েছি, তখন ইসলামী জীবনের পরিধি সংকুচিত করাই দরকার এবং কুফরীর আধিপত্য সম্প্রসারিত হতে থাকুক।
কিছুদিন যেতে না যেতে এই অনন্যোপায় গোলামীদশা তাদের বিবেককে দংশন করতে আরম্ভ করলো। কেননা অনন্যোপায় অবস্থার পশ্চাতে নিষিদ্ধতার ধারণা অবশ্যম্ভাবীরূপে বিদ্যমান থাকে। কোন বিবেকবান মানুষ ও সস্পষ্ট ব্যাপারটা অনুভন না করে পারেনা যে, আপনি যখন নিছক অনন্যোপায় হওয়ার কারছে শূকরের গোশত খাচ্ছেন, তখন শূকরের গোশত যে হারাম, সে কথাটাতো আপনার ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। অতপর যখন ওটা মূলত হারাম জেনেও বাধ্য হয়ে খান, তখন আপনার মনে তার প্রতি ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা না থেকে পারেনা। এটা একেবারেই অসম্ভব যে, আপনি মজা করে পেট ভরে খাবেন এবং ওটার কাবাব কোর্মা ও পোলাও বানানের চিন্তা করবেন। এধরণের ঘৃণা ও অবস্থার মানসিকতা সেই ক্ষেত্রেও অবিবার্যভাবে সৃষ্টি হয়, যেখানে আপনি সামগ্রিক জীবন ধারাকে মৌলিকভাবে হারাম বলে জানা সত্ত্বেও কেবলমাত্র অপরাগতা ও বিকল্প ব্যবস্থা না থাকার কারণে সাময়িকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। কিন্তু গোটা একটা জাতির পক্ষে এ ধরনের দোটানা জীবন যাপন সম্ভব নয়। একটি জাতির পক্ষে সফল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে সার্বক্ষণিকভাবে এরূপ জীবন ধারণ করা কার্যত সম্ভব নয় যে, নিজেকে শরীয়তের দিক দিয়ে এবং মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে অনন্যোপায় ও অক্ষমও ভাবতে থাকবে, আবার সে সমসাময়িক জীবনধারা থেকে ঘৃণা ও বিদ্বেষের সাথে পাশ কাটিয়েও চলতে থাকবে এবং শুধুমাত্র যতোটুকু না হলেই চলেনা ততোটুকু সম্পর্ক বজায় রাখবে। এধরনের পরিস্থিতি অল্প সময়ের জন্য ছাড়া বরদাশত করা সম্ভব নয়। অচিরেই মানুষ এর আঘাতে জর্জরিত হয়ে ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে। মুসলমানদের মধ্যে এই ক্লান্তি ও অবসাদ যথাসময়েই এসেছে। কিন্তু আগে থেকে বলে আসা ধর্মীয় পশ্চাদপদতা এই অবসন্ন মস্তিষ্কগুলোকে নিজেদের ত্রুটি খতিয়ে দেখার দিকে মনোনিবেশ করতে দেয়নি। “কুফরী ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলামী জীবন যাপন সম্ভব” এই মর্মে তারা ইতিপূর্বে যে মত স্থির করেছিলো, তা যে কতখানি ভ্রন্ত, সেকথা পুনরায় ভেবে দেখতে তাদের উদ্বুদ্ধ করেনি। যে অনন্যোপায় অবস্থার কারণে তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ জিনিষের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিলো এবং নোংরা অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো, সেই অনন্যোপায় অবস্থার অবসান কিভাবে ঘটানো যায়, তা চিন্তা করার সুযোগ দেয়নি। বরং ক্রমাগত ধর্মীয় অধপতনের দারুন তারা একথাই ভাবতে প্ররোচিত হয়েছে যে, এই “অনন্যোপায় অবস্থার” অজুহাতটাকেই শেষ করে দেয়া দরকার, যাতে যেসব বিষিদ্ধ ও হারাম বস্তুর বাধা বিপত্তিতে কফূরী সমাজ ব্যবস্থায় তাদের উন্নতি ও বিলাসিতা ব্যাহত হয়ে চলেছে, তার অবসান ঘটে এবং তা হালাল ও বৈধ হয়ে যায়।
এই উদ্দেশ্যে ধর্ম সম্পর্কে এক নতুন মতবাদ সৃষ্টি করা হয়েছে। মতবাদটা হলো, ধর্মের সম্পর্ক শুধু আকীদা বিশ্বাস, ইবাদত, উপসনা ও বিয়ে তালাকের মতো কয়েকটা সামাজিক ব্যাপারের সাথে। কোনো শাসন ব্যবস্থা যদি এসব ব্যাপারে মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তাহলেই ইসলামী জীবনের আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যায়। এটুকু হলেই কুফরী রাষ্ট্র মুসলমানদের জন্য শান্তির আবাস ভূমিতে পরিণত হয়। তার আনুগত্য করা ও আইন মান্য করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। সেই রাষ্ট্রের অধীন যাবতীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড [যা কিনা উক্ত নয়া মতবাদ অনুসারে ধর্মের বিপরীত দুনিয়াবী বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়] উক্ত কুফরীভিত্তিক আইন কানুন অনুসারেই সম্পন্ন হওয়া উচিত। আর এ রাষ্ট্রের আইনগত ও প্রশাসনিক অবকাঠামোকে পরিচালনা, সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করাতে মুসলমানদের জন্যে কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র “আপত্তি না থাকা” এবং হালাল ও বৈধ হয়ে যাওয়া পর্যন্তই থেমে থাকলোনা। অচিরেই অনৈসলামিক রাষ্ট্রে মুসলমানরা জৈবিক প্রয়োজনের তাগিদে তাদের নব্য বংশধরকে কুফরী ব্যবস্থার সেবায় উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টায় নিয়োজিত হতে বাধ্য হলো, যাতে করে প্রথম দিকের কিছুকাল ”আপত্তি” থাকার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হয়। এজন্য সর্বশেষ যে যুক্তিটি তুলে ধরা হয় তা এই জন্য যে, মুসলমানদের উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং কোনো ক্ষেত্রে তাদের বেঁচে থাকাটাই সম্ভব নয়- যদি না তারা অনৈসলামি রাষ্ট্রের বিচার বিভাগে, আইন সভায়, প্রশাসনে, সামরিক বাহিনীতে, শিল্পকারখানায়- এক কথায় সকল বিভাগে বেশী বেশী করে অংশ গ্রহণ না করে। নচেৎ মুসলিম উম্মাহর সার্বিক ধ্বংস অথবা কমপক্ষে উন্নতি ও অগ্রসরতার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। এ যুক্তির ফলে সহসাই যে জিনিস একদিন আগে বৈধ বা মোবাহের পর্যায়ে ছিলো তা ফরযের পর্যায়ে উন্নীত হলো। আর সবাই যদি নাও পারে, তবু অন্তত মুসলমানদের মধ্য থেকে একটা গোষ্ঠী যেন এ ফরয পালন করতে এগিয়ে আসা অব্যাহত রাখে। অর্থাৎ কিনা, আল্লাহর হুকুম যেখানে এরূপ ছিলোঃ
“মুসলমানদের প্রত্যেক শ্রেণী থেকে অন্তত একদল লোকের ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য বেরিয়ে পড়া উচিত, যাতে তারা ফিরে এসে নিজ জাতিকে সতর্ক করতে পারে। এভাবে আশা করা যায় যে, তারা সংশোধিত হবে।”
সেখানে আল্লাহর হুকুম তাদের দাবীতে এরূপ দাঁড়ালোঃ
“মুসলমানদের প্রত্যেক শ্রেণী থেকে অন্তত একটি গোষ্ঠীর কুফর সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য বেরিয়ে পড়া উচিত, যাতে তারা ফিরে এসে নিজ জাতিকে পথভ্রষ্ট্র করতে পারে। এভাবে আশা করা যায়, তারা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে।”
আর যেখানে আল্লাহর হুকুম ছিলোঃ
“তোমাদের মধ্য থেকে এমন একদল লোক অবশ্যই গড়ে ওঠা চাই যারা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে।”
সেখানে এই নব্য মতবাদের ধারক বাহকদের দবীতে আল্লাহর হুকুম দাঁড়ালো এরূপঃ
“তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি গোষ্ঠী অবশ্যই গড়ে উঠা চাই যারা মানুষকে অকল্যাণের দিকে ডাকবে, মন্দ কাজের আদেশ দেবে ও ভালো কাজ থেকে বিরত রাখবে।”
ইসলামকে বিকৃত করার এই সর্বনাশা অপকীর্তির বদৌলতেই বড় বড় পরহেজগার ও ধর্মপ্রাণ লোক তসবীহ টিপতে টিপতে ইংরেজদের অধীনে ওকালতি ও মুনসেফীর পেশায় প্রবেশ করলেন। এভাবে তারা যে আইনের প্রতি তাদের ঈমান নেই, সেই আইন অনুসারে মানুষের বিরোধের মীমাংসা ও ফয়সালা করতে লাগলেন, আর যে আইনের প্রতি তাদের ঈমান ছিলো, তা কেবল ঘরে বসে তেলাওয়াত করতে লাগলেন। এ বিকৃতির দরুনই বড় বড় মুত্তাকী ও নেক্কার লোকদের সন্তানরা আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হলো এবং সেখান থেকে ধর্মহীনতা, বস্তবাদ ও চরিত্রহীনতার সবক নিয়ে নিয়ে বেরুলো। অতপর তারা সেই অনৈসলামিক রাষ্ট্র ও সমাজের শুধু কর্মের মাধ্যমে নয় বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরিত্র ও আকীদা বিসর্জন দিয়েও খিদমত করতে লাগলো। অথচ সেই সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা শুরুতে তাদের পূর্বপুরুষদের দুর্বলতা ও শৈথিল্যের কারণে তাদের ওপর কেবল ওপর থেকেই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এই বিকৃতি শেষ পর্যন্ত এমন সর্বাত্মক রূপ ধারণ করলো যে, পুরুষদেরকে অতিক্রম করে নারীদেরকেও তার সর্বব্যাপী জাহেলিয়াম, গোমরাহী ও চরিত্র ভ্রষ্টতার সয়লাবে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। তথাকথিত সেই “ফরযে কিফায়া” যা পালন করার জন্য প্রথমে পুরুষরা এগিয়ে গিয়েছিলো, এখন নারীদের ওপরও তা আরোপিত হলো। আর এই বেচারীরাও শেষ পর্যন্ত এই “ধর্মীয় খিদমত” আঞ্জাম দিতে এগিয়ে আসতে বাধ্য হলো। এগিয়ে না এলে অমুসলিমরা তাদেরকে পেছনে ফেলে যাবে এই আশংকা ছিলো। [পাকিস্তান হওয়ার পর এব্যাপারে আরো অগ্রগতি হয়েছে। এখন সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা যদি উন্মক্ত ময়দানে সামরিক কুচকাওয়াজ না করে, মুসলিম মেয়েরা যদি নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিতে পাশ্চাত্য দেশে না যায় এবং বিদেশে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পুরুষরা ছাড়া মেয়েরাও পালন না করে তাহলে তা মুসলিম উম্মাহর টিকে থাকর আর কোন উপায়ই নেই।]
এরূপ মনে করার কোনো কারণ নেই যে, ইসলামের এই বিকৃত উপলব্ধি ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দানের পালা আজকেই নতুন শুরু হলো। আজ থেকে কয়েক শ’ বছর আগে যখন তাতারী কাফিররা মুসলমানদের ওপর চড়াও হয়, তখন থেকেই এর সূচনা। “কূফরী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীন কিভাবে ইসলামী জীবন যাপন করা যায়” সে ফর্মূলা যে সেযুগের আলেমরা শুধু আবিষ্কারই করেননি, বরং বড় বড় আলেম ও নেক্কার লোকেরা স্বয়ং সে আমলেই অনৈসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সেবা করতে আরম্ভ করেন। তাদের মধ্যে এমন লোকের সংখ্যাও প্রচুর, যাদের লেখা কিতাব পড়ে পড়ে আজকাল আমাদের আরবী মাদ্রাসাগুরোতে আলেম ও মুফতী তৈরী হয়ে থাকে। এই প্রচীনত্বের কারণেই এ ভুল এখন একটা পবিত্র ভুলে পরিণত হয়েছে। এযুগের প্রায় সকল মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ফিকাহবিদকে যদি একই বিভ্রান্তিতে লিপ্ত দেখা যায়, তাহলে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে একথা বলাই নিষ্প্রয়োজন যে, একটা ভুল অনেকদিন ধরে চলে আসছে বলেই তা বিশুদ্ধ ও নির্ভূল হয়ে যেতে পারেনা। আর বহু নামজাদা ব্যক্তি এতে আক্রান্ত- এই যুক্তিতেও তা সঠিক হয়ে যেতে পারেনা। সত্যকে প্রমাণিত করতে হলে একমাত্র আল্লাহর কিতাব ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ দ্বারাই করতে হবে।
অধপতনের এই যুগটা শুরু হয়েছে প্রাথমিক অনন্যোপায় অবস্থা থেকে উদ্ভুত “কুফরীর অধীনে ইসলাম” এই মতবাদ দিয়ে। অতপর ক্রমান্বয়ে কুফরী ব্যবস্থার খেদমত করা জায়েয হলো, তারপর মুস্তাহাব হলো, অতপর তা ফরযে কিফায়া’ পর্যন্ত গিয়ে পৌছলো। এমনকি সর্বশেষ নামতে নামতে “ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানকারী শাসকদের আনুগত্যই ইসলামের যথার্থ দাবী” এহেন চরম অবমাননাকর ধারণা পোষণের মত সর্বনিম্ন গহ্বরে গিয়ে তা পতিত হলো। পতনোন্মখ যুগের মুসলমানদের বরাবর এই চেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে হয়েছে যে, পতনের প্রত্যেকটা স্তরে তাদের আরো নীচে নামার জন্য দলীল প্রমাণ যা কিছু প্রয়োজন, আল্লাহর দীন থেকেই সংগ্রহ করা চাই। এই তাগিদ অনুভব করার মূলে তো তাদের ধারণা মোতাবেক এই ফর্মূলাই কার্যকর ছিলো যে, “যেহেতু আল্লাহর দীন আমাদের সকল প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট, তাই এখন যে প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তা পূরণের জন্যও এই দীন থেকেই আমাদের পথ নির্দেশ লাভ করতে হবে।” কিন্তু আসলে এই লোক দেখানো ফর্মূলার পেছনে যে প্রকৃত ফর্মূলা লুকিয়ে ছিলো এবং যার ভিত্তিতে তারা বাস্তবে কর্মতৎপর ছিলো তা ছিলো এই যে, “আমরা যখন আল্লাহর দীনের প্রতি এতো অনুগ্রহ করেছি, তার প্রতি ঈমান এনে তাকে ধন্য করেছি, তখন এর বিনিময়ে ইসলামের ওপর অন্ততপক্ষে এটুকু দায়িত্ব বর্তায় যে, সে আমাদের আগে আগে না চলে পেছনে চলতে আরম্ভ করবে। অর্থাৎ এখন আর তার সাথে আমাদের এরূপ সম্পর্ক থাকবেনা যে, আমরা তাদের নিজেদের ওপর ও আল্লাহর যমীনের ওপর কায়েম করার চেষ্টা চালাবো এবং এই চেষ্টার ক্ষেত্রে আমরা যেসব প্রয়োজনের সম্মুখীন হই, তা পূরণ করার দায়িত্ব সে গ্রহণ করবে। বরং এখন সম্পর্কের রূপরেখা হবে এরকম যে, আমরা ইসলামকে কায়েমের চেষ্টা তো দুরের কথা, তা চিন্তাও করবোনা। বরং নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণের জন্য আমরা যেমন খুশী, যেখানে খুশী যাবো, ইসলাম আমাদের পেছনে পেছনে ঘুরতে থাকবে। আমরা যে কোনো বাতিল ধর্মের অনুসারী হই, যে কোনো বাতিল ব্যবস্থার গোলামী করি, ইসলামের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে ধরনের জীবন পদ্ধতিই অবলম্বন করি, ইসলাম সেক্ষেত্রে আমাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করার নিশ্চয়তা দেবে।” এই ভ্রান্ত দৃষ্টিভংগি নিয়েই তারা কুরআন ও হাদীস মন্থন করে পথ নির্দেশের সন্ধানে ব্যাপৃত হলো। এর ফলে এই দাঁড়ালো যে, সমগ্র কুরআনের আর কোথাও তাদের দৃষ্টি পড়লো না- সূরা আনকাবুতেও না, কাবারাতেও না, আল ইমারানেও না, আনফালেও না, তাওবাতেও না- বরং শুধুমাত্র সূরা ইউসূফের ওপর গিয়েই তাদের দৃষ্টি থমকে দাঁড়ালো। আর তাও শুধু খান বাহাদুর সাহেবের যুক্তি সংগ্রহের পছন্দমাফিক জায়গাগুলোতে। অনুরূপভাবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীরও আর কোথাও তাদের অনুকরণীয় আদর্শ মিললোনা, মক্কার তপ্ত মরুতেও নয়, তায়েফের পাথর বর্ষণেও নয়, বদর ও ওহুদের ময়দানেও নয় বরং শুধু এই ঘটনায় যে, মুসলমানদের একটি দল হিজরত করে আবিসিনিয়ায় গিয়েছিলো এবং সেখানে এক খৃষ্টান রাজার অধীন কয়েক বছর প্রজা হিসেবে বসবাস করেছিলো।
কিন্তু যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মানসিকতা নিয়ে নয়, বরং সত্যসন্ধানী মনোভাব নিয়ে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে চায়, তার জন্য এ প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্ববহ যে, প্রকৃত পক্ষে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের আলোচ্য ঘটনাবলী এবং আবিসিনিয়া হিজরতের বৃত্তান্ত থেকে এই বিশেষ মহলটি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চান, সত্যিই কি সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার অবকাশ আছে? বেশ আপাতত না হয় ধরে নিলাম, অবকাশ আছে। অর্থাৎ একথা মেনে নেয়ার অবকাশ আছে যে, জনৈক নবী আল্লাহর নির্দেশে একটি অনৈসলামিক রাষ্ট্রের খিদমত করা এবং অনৈসলামিক আইন [রাজকীয় আইন] চালু করা ও কার্যকরী করার দায়িত্ব এই জন্য গ্রহণ করছিলেন যে, এটা মুলতই একটা অভিষ্ঠ ও করণীয় কাজ ছিলো। একথাও না হয় মেনে নিলাম যে, একটি মুসলিম কোন অমুসলিম রাষ্ট্রে কেবল মসজিদের ভেতরে ইচ্ছামত ইবাদত উপাসনা করা, বুকের ভেতরে কিছু আকীদা বিশ্বাস পোষণ করা এবং মুখ দিয়ে সেই বিশ্বাসের সপক্ষে কিছু উচ্ছাস প্রকাশের অনুমতি দিলেই সেই সমাজ ও রাষ্ট্রে মুসলমানদের সম্পূর্ণ উপযোগী আবাসভূমিতে পরিণত হয় আর এজন্যেই মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। কিন্তু এরপর আরো কতগুলো প্রশ্ন জন্ম নেয়। সে প্রশ্ন গুলো উপরোক্ত প্রশ্নের তুলনায় অনেক বেশী মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী। কেননা উপরোক্ত কথা দুটো মেনে নেয়ার পর নিম্নের প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে বের করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
কতিপয় মৌলিক প্রশ্ন ও সেগুলোর জবাব
১. আল্লাহ তায়ালা নবীদের মাধ্যমে মানব জাতির জন্য যে দীন বা জীবন বিধান পাঠিয়েছেন, তা কি শুধু উপাসনালয়ের জন্যই নির্দিষ্ট ছিলো, না সমগ্র মানব জীবনের জন্য?
২. যে সমস্ত নবী এই দীন নিয়ে এসেছেন, তাঁদের সকলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি একটাই ছিলো, নাকি এক এক জন এক এক রকমের কিংবা পরস্পর বিরোধী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলেন?
৩. মানুষের কাছে আল্লাহর প্রকৃত দাবী কি? সমগ্র জীবনের তাঁর দাসত্ব করুক এবং তাঁরই আইন ও বিধান অনুসারে কাজ করুক, নাকি কেবল পূজাটা তার করুক, আর বাদবাকী সমস্ত কর্মকান্ড যেভাবে ইচ্ছা পরিচালনা করুক?
এ প্রশ্নগুলোর একটা জবাব এরূপ হতে পারে যে, আল্লাহ যে দীন পাঠিয়েছেন তার সম্পর্ক শুধু আজকাল “ধর্মীয় জীবন” বলতে যে সীমাবদ্ধ জীবন বুঝায় তার সাথে। কিন্তু একথা মেনে নিলে কুরআনে ও অন্যান্য আসমানী কিতাবে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে এবং দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিধি, সাক্ষ্যদানের বিধি এবং যুদ্ধ ও সন্ধি ইত্যাদি সম্পর্কে যেসব নিয়মনীতি ও নির্দেশ দান করা হয়েছে, তা সব নিরর্থক হয়ে যায়। সেসব নির্দেশতো নির্দেশ নয় বরং নিছক উপদেশ ও সুপারিশমালার পরিণত হয়। অর্থাৎ ওগুলো কার্যকরী করতে পারলে ভালো। আর না করলেও তাতে আল্লাহর বিশেষ কোনো আপত্তি থাকবেনা।
অনুরূপভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য জবাব সম্ভাব্যই বা বলি কেন, আজকাল নবূয়্যত সম্পর্কে সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণাই এই যে, বিভিন্ন নবী বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন। এমনকি এক নবী যদি কুফরী সমাজ ব্যবস্থাকে উৎখাত করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক সংগ্রাম চালাতে এবং তার স্থালে ইসলামী বিধানকে পৃথিবীতে শাসন ব্যবস্থা হিসেবে কায়েম করতে এসে থাকেন, তবে অন্য আরেক নবী ঠিক তার বিপরীত কুফরী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীন সীমিত ধর্মীয় ও নৈতিক সংস্কার সাধন করেই ক্ষ্যান্ত থাকা, এমনকি সেই কুফরী ব্যবস্থার অনুগত থাকা মওকা পেলে তার পরিচালনার ও উৎকর্ষ সাধনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণেও প্রস্তুত থাকার লক্ষ্য নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এ বক্তব্য কি কুরআনের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যশীল? আসলে তা বিবেকের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করছে, সকল নবীকে একই উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে বিবেকেও একথা বিশ্বাস করতে রাজী নয় যে, আল্লাহ তায়ালা এমন স্ববিরোধী ও পরস্পর সংঘর্ষমুখর কাজ করতে পারেন। আল্লাহ যদি মানব জাতির কাছে এক সময় এক উদ্দেশ্য এবং অন্য সময় ঠিক তার বিপরীত উদ্দেশ্যে নবী পাঠান, তবে তাকে কোনো সাধারণ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও বিজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী বিশ্ববিধাতা হিসেবে মেনে নিতে পারেনা। এটাতো ভিন্ন কথা যে, কোনো নবী ইসলামী বিধান বাস্তাবায়নের সংগ্রামে সাফল্যের সর্বশেষ স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে যেতে পারেন, অপর নবী মধ্যবর্তী অথবা প্রাথমিক স্তরেই সারা জীবন কাজ করে যেতে পারেন আর তৃতীয় আর কোন বনী দাওয়াত, প্রচার অথবা যুদ্ধবিগ্রহের পরিবর্তে বিকল্প কোনো কর্মপন্থাকে নিজের সময়কার বিশেষ ধরণের পরিস্থিতিতে কার্যপযোগী পেয়ে সেটাই গ্রহণ করে নিতে পারেন। কিন্তু কর্মপদ্ধতির এতোসব বিভিন্নতা সত্ত্বেও সকলের উদ্দেশ্য একই থাকে। সকলেই আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানকে পরিপূর্ণভাবে দুনিয়ায় বাস্তবায়িত করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকাকেই নিজেদের অভিন্ন লক্ষ্য হিসেবে মেনে নিয়ে থাকেন। কিন্তু এই পদ্ধতিগত ও প্রক্রিয়াগত বিভিন্নতার অর্থ যদি কারো কাছে এই হয় যে, নবীদের প্রেরণের উদ্দেশ্যই বিভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী ছিলো, তবে সেটা হবে আল্লাহর ওপর জঘন্যতম অপবাদ আরোপের শামিল।
অনুরূপভাবে তৃতীয় প্রশ্নরও একটা সম্ভাব্য জবাব এবং আজকালকার মুসলমানদের কাছে সচরাচর সহজবোধ্য কথাও এটাই যে, আল্লহর কেবল পূজা উপাসনা করবে এবং ওযু গোছল, পাক নাপাক ও কতিপয় নির্দিষ্ট হালাল হারামের বিধি মেনে চলবে, মানুষের কাছে এতোটুকুই আল্লাহর দাবী। এর চেয়ে বেশী কিছু তিনি চানও না, আর মানুষ তার জীবনের সামগ্রিক কর্মকান্ডে নিজের প্রবৃত্তির আইন মেনে চলে, নাকি আল্লাহর বিশাল পৃথিবীতে জেঁকে বসা মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানদের কথামতো চলে, তা নিয়েও আল্লাহর কোনো মাথা ব্যথা নেই। তবে এই জবাব এযুগের জড়বাদী মানুষের কাছে যতো তৃপ্তিদায়কই হোক না কেন এবং “সরল ও সহজ পন্থাই ইসলাম” এই হাদীস এবং “আল্লাহ তোমার ওপর ইসলামে কোনো কঠিন বিধি আরোপ করেননি।” এই আয়াতের মর্ম স্বেচ্ছাচার ও লাগামহীন ভোগাধিকার ধরে নিয়ে নিজের জন্য যত আয়েসী জীবনের পথই সুগম করুক না কেন, এটা যে আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামীর প্রকৃত তত্তের পরিপন্থী, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
একজন বন্দা ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাত্র দুঘন্টার জন্য বান্দা হবে, আর বাদবাকী সময় স্বাধীন থাকবে অথবা মনিবকে শুধু সালাম ঠুকেই গোলামীর দায়িত্ব চুকিয়ে দেবে আর অন্যসব কাজ প্রভুর ইচ্ছার তোয়াক্কা না করে নিজের অথবা অন্যদের ইচ্ছামতো করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করবে, দাসত্বের এর চেয়ে হাস্যকর চিত্র বোধ হয় আর কিছু হতে পারেনা। তাছাড়া এমন খোদাকে তো খোদা মানার প্রশ্নই উঠেনা, যিনি নিজেকে একদিকে মানুষের স্রষ্টা ও পালনকর্তাও বলেন, অপরদিকে মানুষের সমগ্র সত্তা, সকল শক্তি সামর্থ এবং সময় ও উপকরণ বাদ দিয়ে তার একটা অতি ক্ষুদ্র ও গুরুত্বহীন অংশে নিজের প্রভূত্ব ও কর্তৃত্ব এবং তার গোলামী ও দাসত্বকে সীমিত রাখতে রাজী হয়ে যান। কোনো পিতা স্বীয় পুত্রের ওপর নিজের পিতৃত্বকে এরূপ সংকীর্ণ গন্ডিতে সীমিত করতে রাজী হতে পারেননা যে, আনুগত্যের প্রতীকস্বরূপ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক কাজ করেই সে দায়মুক্ত হয়ে যাবে এবং তারপর যখন যাকে খুশী পিতার আসনে বসাবে। অনুরূপ কোনো স্বামী স্বীয় স্ত্রীর ওপর নিজের স্বামীত্বের গন্ডি সীমাবদ্ধ করে বাদবাকী সময় সে স্বেচ্চাচারিনী হয়ে যখন যার খুশী মনোরঞ্চন করে বেড়াবে এ অধিকার স্বীকার করতে পারেনা। একজন শাসকও পারেনা আপন প্রজাদের ওপর নিজের কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতাকে এভাবে সংকুচিত করতে যে, প্রজারা কাতিপয় আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপ দ্বারা আনুগত্য প্রকাশ করেই দায়মুক্ত হয়ে যাবে এবং তারপর যার খুশী তার আইন মানবে, যাকে খুশী কর খাজনা দেবে এবং যার ইচ্ছা তার হুকুমের আনুগত্য করবে। অথচ কেবল বিশ্ববিধাতা আল্লাহই এমন মনিব হয়ে গেলেন যে, যে মানুষ সম্পূর্ণরূপে তাঁরই সৃষ্টি, তাঁরই লালিতপালিত এবং তাঁরই সহায়তায় তার অস্তিত্ব টিকে আছে, তার ওপর কিনা তিনি নিজের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব সীমিত করে ফেলতে রাজী এবং তার কাছ থেকে গোলামীর স্বীকৃতিস্বরূপ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক কথা ও কাজ পেয়েই তিনি আহলাদে আটখানা হয়ে গিয়ে তাকে স্বাধীন করে দিতে বা যেকোনো মনিবের গোলামী করার অনুমতি দিতে প্রস্তুত!
দীন, নবূয়্যত এবং দাসত্বের দাবী সম্পর্কে এসব ধ্যান ধারণা যদি সঠিক না হয়ে থাকে, আল্লাহর প্রেরিত দীন যদি বাস্তবিক পক্ষে মানুষের সমগ্র ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে, বিশ্বপ্রভুর দাবী যদি তাঁর বান্দাদের কাছে এই হয়ে থাকে যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে এবং সকল অবস্থায় তাঁর আইনেরই অনুগত এবং তাঁর হিদায়েতেরই অনুসারী ও আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হবে এবং আল্লাহ যদি তাঁর নবীদেরকে এক খোদার আনুগত্য ভিত্তিক একমাত্র সত্য ও নির্ভুল জীবন বিধান কায়েম করার জন্য মানুষকে দাওয়াত দেয়া ও সেই জীবন বিধান কায়েমের চেষ্টায় নিজেদেরকেও নিয়োজিত রাখার জন্য পাঠিয়ে থাকেন, তবে একজন বিবেকসম্পন্ন মানুষের পক্ষে একথা মেনে নেয়া অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ে যে, সমস্ত নবীদের মধ্যে একমাত্র হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামই এই সাধারণ নিয়মের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত ছিলেন। কোনো কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষই একথা স্বীকার করতে পারেনা যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম এমন ব্যতিক্রমধর্মী অভিনব ধরনের নবী হয়ে এসেছেন, যাকে কিনা আল্লাহর দীন কায়েমের চেষ্টা বাদ দিয়ে ফিরাউনের কুফরী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীন অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাকরি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অনুরূপভাবে কোনো বিবেকবান মানুষ এ দুটো বেখাপ্পা কথাকেও খাপ খাওয়াতে অক্ষম যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতো একদিকে আরবের অনৈসলামিক সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, অপরদিকে তাঁর কাছে আবিসিনিয়ার অনৈসলামিক ব্যবস্থাও এতোটা সঠিক ছিলো যে, একদল মুসলমানের জন্য তা একটা মানানসই স্থয়ী বাসস্থান হবার যোগ্য ছিলো। যারা ইসলামকে একটা যুক্তিসংঙ্গত ও সুসংবদ্ধ জীবন দর্শন হিসেবে বিবেচনা করেনা বরং তাকে কতকগুলো বিচ্ছিন্ন ও পরস্পর অসংবদ্ধ তত্ত্বের সমষ্টি মনে করে, তাদের পক্ষে তো নবীদের জীবনেতিহাস, কুরআনের শিক্ষা ও ইসলামের বিধিসমূহকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রত্যেকটির আলাদা আলাদাভাবে এমন ব্যাখ্যা করা খুবই সহজ যাতে করে তার একাংশ অপরাংশের এবং একদিক অপরদিকের সম্পূর্ণ বিপরীতরূপ ধারণ করে। কিন্তু যারা একে এক মহাবিজ্ঞানী সত্তার রচিত সুসংবদ্ধ, সুশৃংখল ও সুবিন্যস্ত বিধান হিসেবে বিবেচনা করে, তাদের পক্ষে এর প্রতিটা অংশ ও প্রতিটা দিকের এমন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অবলম্বন না করে উপায় থাকেনা, যা সামগ্রিক বিধানের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা এর এমন কোনো ব্যাখ্যা মেনে নিতেই পারেনা, যাকে আল্লাহর এই সনাতন বিধানের মধ্যে বৈপরিত্য এবং এর শিক্ষার সাথে নবীদের কাজের সংঘাত অবির্য হয়ে দেখা দেয়।
এবার আমরা সূরা ইউসূফের আলোচ্য আয়াতগুলো এবং আবিসিনিয়া হিজরতের ঘটনাবলী নিয়ে সরাসরি আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো।
ইউসূফ আলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে ভ্রান্ত যুক্তি গ্রহণ
হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ঘটনা সূরা ইউসূফে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা নিবিষ্টচিত্তে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তিনি নবূয়্যত লাভের পূর্বে নিজের ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতা ও একটি বণিক দলের অসততার কারণে মিশরের “আযীয” উপাধিধারী জনৈক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ক্রীতদাসে পরিণত হন। এই দাসত্বের সময় অথবা জেলখানায় আটক থাকাকালে আল্লাহ তাকে নবূয়্যত অভিষিক্ত করেন। খুব সম্ভবত কারাবন্দী থাকাকালেই তিনি নবূয়্যত লাভ করেন। কেননা বন্দী হবার আগে তার কথাবার্তা নবীসূলভ উচ্চমার্গের না হয়ে একজন পূণ্যবান সদাচারী ব্যক্তিসূলভ মনে হয়। এ অবস্থায় নবূয়্যত লাভের সংগে সংগেই তিনি নবী হিসেবে দাওয়াতের কাজ শুরু করে দেন। নিজের সহবন্দী কয়েদীদেরকেই তিনি সর্বপ্রথম দাওয়াত দেন। সূরা ইউসূফে এই দাওয়াতের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। এটি অধ্যয়ন করে যেকোনো ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, তাঁর ডাক “ভিন্ন ভিন্ন মনিব”- এর দিকে ছিলোনা, বরং একমাত্র মনিবের গোলামী করার দিকে ছিলো। তিনি বার বার মিসরবাসীকে হুশিয়ার করেছেন যে, যে বাদশাহকে তারা খোদার আসনে বসিয়ে রেখেছে সে আমার প্রভু নয়। বরং আমার প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ। আমি যে ধর্মের অনুসরণ করি তা আল্লাহর দাসত্বের জীবন ব্যবস্থা। জেলখানায় ইসলাম প্রচারের এই কাজ চালানোর সময়েই আকস্মিকভাবে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তাঁর ব্যক্তিত্ব থেকে যে অসাধারণ সততা, বিশ্বস্ততা, বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার নিদর্শনাবলী ফুটে ওঠে, মিসরের সম্রাট তাদ্বারা গভীরভাবে অভিভূত হন। এতে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের মনে এরূপ প্রত্যয় জন্মে যে, তিনি তার কাছে সম্রাজ্যের নিরংকুশ ক্ষমতা চাইলেও তিনি তা তাঁর কাছে হস্তান্তর করতে রাজী হয়ে যেতে পারেন। ফলে এসময় হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের সামনে দুটো পথ উন্মুক্ত হয়। একটি হলো, ইসলামী বিপ্লবের লক্ষ্যে ব্যাপক দাওয়াত ও প্রচারাভিযান চালানো, কঠোর চেষ্টা সাধনা, সংগ্রাম, সংঘাত ও যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যা সাধারণ অবস্থায় অবলম্বন করতে হয়। দ্বিতীয়টি হলো, আল্লাহর অসীম ক্ষমতার কল্যাণে যে সুবর্ণ সুযোগটি তাঁর মঠোর ভিতর এসে গেছে সেটাকে কাজে লাগানো এবং তাঁর গুণমুগ্ধ ও অনুরক্ত বাদশাহর কাছ থেকে যে সুদূর প্রসারী ক্ষমতা লাভের সম্ভবনা দেখা দিয়েছে, তা হস্তগত করে দেশের চিন্তায় এ বিশ্বাসে, চরিত্রে, সমাজ ব্যবস্থায় ও রাজনীতিতে পরিবর্তন আনয়নের চেষ্টা করা। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে প্রজ্ঞা দূরদর্শিতা দান করেছিলেন, তার আলোকে তিনি প্রথম পথটির চাইতে দ্বিতীয় পথটিকে অধিকতর সহায়ক ও নিজের লক্ষ্যের নিকটতর মনে করলেন এবং সেটাই গ্রহণ করলেন।
এটা তাঁর পক্ষে প্রতিষ্ঠিত অনৈসলামিক শাসন ব্যবস্থার অধীন নিছক জীবিকা উপার্জন, ব্যক্তিগত সম্মান ও মর্যাদা লাভ অথবা বাতিল ও দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার আংশিক সংশোধনের লক্ষ্যে গৃহীত একটি চাকরি ছিলোনা। বরঞ্চ এটা ছিলো একটা কৌশল। অন্যসকল নবীর মত হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম যে উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন, সেই একই উদ্দেশ্যে এ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিলো। যারা এটাকে নিছক একটা চাকরি মনে করেছেন এবং ধারণা করেছেন যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তাবায়নের উপায় হিসেবে নয় বরং খোদাদ্রোহী ব্যবস্থা যাথরীতি বহাল রাখা এবং তার ক্রীড়নক অর্থমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই চাকরিটা গ্রহণ করেছিলেন, তাদের দৃষ্টিতে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের মর্যাদা বর্তমান (ইংরেজ) সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারীদের চেয়ে উচ্চতর কিছুই নয়। এমনকি আমাদের এ দেশে কংগ্রেসী মন্ত্রী সভাগুলোর যতোটুকু মর্যাদা, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের মর্যাদা তারা ততোটুকুও মনে করেনা। কংগ্রেসী মন্ত্রীদের কার্যকলাপ এদেশের সকল মানুষই প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের লক্ষ্য ছিলো ভারতের স্বাধীনতা। মন্ত্রীত্ব সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে, এব্যাপারে তাদের পূর্ণ বিশ্বাস না জন্মা চিন্তাও করেনি। অতপর মন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর যখন তারা দেখেছে যে, আসল ক্ষমতা [Substance of power] তাদের কাছে হস্তান্তরিত হয়নি। তখন তারা মন্ত্রীত্বের মুখে লাথি মেরে বিদায় নিয়েছে।
বাদশাহর কাছ থেকে ক্ষমতা চেয়ে নেয়া হয়েছিলো না কেড়ে নেয়া হয়েছিলো নাকি হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ক্ষমতাসীন হওয়ার সংগে সংগেই বাদশাহকে গদিচ্যুত করা হয়েছিলো, না তিনি ক্ষমতায় বহাল ছিলেন, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। প্রকৃত গুরুত্ববহ প্রশ্ন এখানে এই যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম অনৈসলামিক ব্যবস্থাটাকেই চালিয়ে যাওয়া এবং তার অধীনে চাকরি করার উদ্দেশ্যেই কি তার উমেদার হয়েছিলেন, নাকি নিজের নবূয়্যতের লক্ষ্য তথা ইসলামী বিধান কায়েমের জন্যই উদ্যোগী হয়েছিলেন? দ্বিতীয় যে প্রশ্ন গুরুত্বের অধিকারী তা হলো, দেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমূল ও সর্বাত্মক পরিবর্তন সূচিত করা যায় এমন ক্ষমতা তিনি যথার্থই পেয়েছিলেন কিনা? ইসলাম ও নবূয়্যত সম্পর্কে যে তত্ত্ব আমাদের মনে বদ্ধমূল, তার আলোকে আমি মনে করি, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম “দেশের উপায় উপকরণ আমার দায়িত্বে সমর্পণ করুন” কথাটা বলে আসলে দেশের সমস্ত উপায়- উপকরণকে তাঁর নিরংকুশ কর্তৃত্বে সমর্পন করার দাবীই জানিয়েছিলেন। খান বাহাদুর সাহেব অনর্থক খাজায়েন শব্দটাকে ’অর্থ দফতর’ অর্থে গ্রহণ করেছেন। অথচ কুরআনের কোথাও এ শব্দটা অর্থ দফতর বা অর্থ বিষয়ক কর্যক্রম অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।
কুরআনের নির্দেশাবলী অনসন্ধান করলে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, “উপায়-উপকরণ” বলতে যা বুঝায়, এ শব্দটার মর্মার্থ ঠিক তাই। [উদাহরণস্বরূপ নিম্নের আয়াত কয়টি লক্ষ্যণীয়”
“তোমার প্রভুর যাবতীয় উপকরণ কি ওদের কাছে?” [তুরঃ ৩৭]
“প্রতিটি জিনিসেরই উৎস আমার কাছে।” [সূরা হিজরঃ ২১]
“আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় উপায় উপকরণ একমাত্র আল্লাহর।” [মুনাফিকুনঃ ৭]
“দোজখবাসীরা জাহান্নামের কর্মকর্তাদেরকে বলবে…………….” [মুমিনঃ ৪৯]
এসব আয়াতে ‘খাজনা শব্দটি রেখাংকিত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।] একটি দেশের যাবতীয় উপায় উপকরণ কারো হস্তগত হওয়া এবং সেই দেশের যাবতীয় বিষয়ে তার সর্বাত্মক এ একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হওয়া একই অর্থবোধক। বাইবেল থেকেও এ কথার সমর্থন মেলে। সেখানে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, মিসরের ফিরাউন নামমাত্র রাজা ছিলো। কার্যত গোটা দেশ হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের কর্তৃত্বাধীন হয়ে গিয়েছিলো। [বাইবেলে হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের কাহিনী বর্ণনা প্রসংগে ফিরাউনের যে সংলাপ উদ্ধৃত করা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ
“ফিরাউন তার ভৃত্যদেরকে বললো!আল্লাহর আত্মধারী এই মহান ব্যক্তির মতো কোনো ব্যক্তি কি আমি খুঁজে পাবো? আর ফিরাউন ইউসূফকে বললো যেহেতু আল্লাহ তোমাকে এই সবই দিয়েছেন, তাই তোমার মত জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমান আর কেউ নেই। সুতরাং তুমি আমার বাড়ীর মালিক হবে এবং আমার সমস্ত প্রজা তোমার হুকুম মতো চলবে কেবল সিংহাসনের মালিক বলে আমি শ্রেষ্ঠতর হবো। অতপর সে তাকে সমগ্র মিসরের শাসক বানিয়ে দিলো। ফিরাউন ইউসূফকে আরো বললো আমি ফিরাউন। তবে তোমার হুকুম ছাড়া সমগ্র মিসরে কেউ হাত পা পর্যন্ত নাড়াতে পারবেনা।” [আবির্ভাব পুস্তক, অধ্যয় ৪১, আয়াত ৩৮-৪৪
উপরোক্ত রেখাচিহ্নিত কথাগুলো থেকে বুঝা যায় ফিরাউন হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো। সে যদি তাঁর নবূয়্যত স্বীকার নাও করে থাকে, তথাপি সে প্রথম সাক্ষাতেই ঈমান আনার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো। এর সাত আচ বছর পর যখন হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা মিসরে এলো, তখন হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম তাদেরকে বললেনঃ এখানে তোমরা নয়, আল্লাহই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনি আমাকে বলতে গেলে ফিরাউনের পিতা এবং তার পুরো বাড়ীর শাসক বানিয়ে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা তাড়াতাড়ি আমার পিতাকে গিয়ে বলো তোমার ছেলে ইউসুফ জানিয়েছে যে, আল্লাহ তাকে সমগ্র মিসরের মালিক বানিয়ে দিয়েছে।” [আবির্ভাব পুস্তক, অধ্যায় ৪৫, আয়াতঃ ৮-৯]]
এবার আর একটি দাবীর বিচার বিবেচনা করা প্রয়োজন। সেটি হলো, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ক্ষমতা গ্রহণের পরও নাকি দেশে ফিরাউনের আইনেরই শাসন চালু থাকে।
“বাদশাহের দীনের ভিত্তিতে তার ভাইকে গ্রহণ করা সংযত ছিলোনা।” [সূরা ইউসূফঃ ৭৬]
এ আয়াতটি থেকেই নাকি এই ধারণা জন্মে। এ সম্পর্কে পয়লা কথা হলো, এ আয়াতের সচরাচর যে অনুবাদ করা হয় তা সঠিক নয়। অনবাদকরা এ আয়াতের এরূপ অর্থ করে থাকেন যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম রাজকীয় আইন অনুসারে তার ভাইকে গ্রেফতার করতে পারতেননা। অথচ এর বিশুদ্ধ অনুবাদ হলো, রাজকীয় আইন অনুসারে স্বীয় ভাইকে গ্রেফতার করাটা হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের পক্ষে শোভন বা সমিচীন ছিলোনা। কুরআনের অন্যান্য স্থানেও আরবী ভাষার এই বাকধারাটা অক্ষমতা ও অপারগতা অর্থে গ্রহণ করা হয়নি বরং অশোভন ও অনুচিত অর্থেই গৃহীত হয়েছে। যেমন সূরা আল ইমরানের ১৭৯ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ
এ বাক্যটার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তোমাদেরকে অদৃশ্য বিষয়ে অবহিত করতে পারেননা, বরং এর তাৎপর্য হলো, তোমাদেরকে অদৃশ্য তথ্য ও তত্ত্ব জানানো আল্লাহর রীতি নয়। অনুরূপভাবে وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ [সূরা বাকারাঃ ১৪৩] فَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ এবং مَا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ এসব আয়াতে আল্লাহর অক্ষমতা বা অপারগতার কথা বলা হয়নি, বরং যুলুম করা, ঈমান ব্যর্থ করে দেয়া এবং মুমিন ও মুনাফিকদেরকে বাছাই না করে একাকার রেখে দেয়া আল্লাহর রীতিবিরুদ্ধ, একথাই বলা হয়েছে। সূরা ইউসূফেরই আলোচ্য আয়াতের পূর্বের একটি আয়াতে বলা হয়েছে যে, مَا كَانَ لَنَا أَنْ نُشْرِكَ بِاللَّهِ مِنْ شَيْءٍ [আয়াতঃ ৩৮] এর অর্থও এটা নয় যে, আমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করতে অক্ষম। বরং এর অর্থ হলো, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়। সুতরাং আলোচ্য আয়াতেও এরূপ অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয় যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম রাজকীয় আইন অনুসারে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু সে আইনে তার ভাইকে গ্রেফতার করতে পারছিলেননা। কুরআনের অনুসৃত বাকরীতি অনুসারে এর প্রকৃত মর্মার্থ এটাই যে, রাজকীয় আইনে স্বীয় ভাইকে আটক করা তার পক্ষে শোভন ছিলোনা। অবশ্য এ আয়াত দ্বারা নিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ক্ষমতাসীন হওয়া সত্ত্বেও অনৈসলামিক ফৌজদারী বিধি অন্তত সাত আট বছর [হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ভাইরা যখন সেখানে আসে] পর্যন্ত মিসরে কার্যকর ছিলো। তবে এ সম্পর্কে আমি ইহিপূর্বে বলেছি যে, একটি দেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে রাতারাতি সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়া সম্ভব নয়। ক্ষমতা হাতে আসা মাত্রই জাহেলী যুগের সমস্ত রীতিপ্রথাকে তাৎক্ষনিকভাবে পাল্টে ফেলতে হবে ইসলামী বিপ্লবের এ ধারণা ঠিক নয়। স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলেও দেশের সমাজ ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দিতে পুরো দশ বছর সময় লেগেছিলো। সুতরাং হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের শাসনামলে কয়েক বছর অবধি অনৈসালামিক ফৌজদারী বিধি এবং সেই সাথে আরো কিছু অনৈসলামিক আইন যদি চালু থেকেও থাকে, তবে সেজন্য এ সিদ্ধান্ত আসা সঙ্গত নয় যে, ইসলামী আইন চালু করার ইচ্ছাই হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের ছিলোনা এবং তিনি অনৈসলামিক বিধি ব্যবস্থাই বহাল রাখতে চেয়েছিলেন।
হাবশার হিজরত থেকে ভ্রন্ত যুক্তিগ্রহণ
এবার আসুন আলোচনার সমাপ্তি টানার আগে আবিসিনিয়ায় হিজরতের বিষয়টার ওপরও একবার নজর বুলিয়ে নেয়া যাক।
এ ব্যাপারটাকে যেভাবে তুলে ধরা হয়ে থাকে তা হলো, আবিসিনিয়ায় একটি অমুসলিম সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের একটি দলকে সেখানে ঐ সরকারের প্রজা হিসেবে বসবাস করার জন্য পাঠান। অতপর সাহাবায়ে কিরাম সেথানে গিয়ে অমুসলিম শাসকের অনুগত হয়ে গেলেন। কেননা তারা সেখানে নিজস্ব আকীদা বিশ্বাস পোষণ ও ইবাদত উপসনা করার স্বাধীনতা ভোগ করতেন। অতপর যখন এ প্রতিবেশী রাজা তার রাজ্যের ওপর আক্রমণ চালায় তখন তারা তার সাফল্যের জন্য দোয়া করেন। কিন্তু এটা ঘটনার সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বিবরণ।
১. প্রথমত, মুসলমানদের একটা দলকে আবিসিনিয়ায় পাঠানোর সময়ই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধারণা ছিলো, নাজ্জাশী একজন সত্য নিষ্ঠ ও ন্যায়পরায়ণ খৃষ্টান। হাদীসের ভাষা এরূপ, তিনি হিজরতকারীদেরকে নাজ্জাশীর রাজ্য সম্পর্কে বলেছিলেন যে, وَهِيَ اَرْضَ صِدْقِ “ওটা সত্যের দেশ।”
২. দ্বিতীয়ত, মোহাজেরদেরকে সেখানে স্থায়ী প্রজা হয়ে বসবাস করা জন্য পাঠনো হয়নি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোহাজেরগণকে হিজরতের পরামর্শ দেয়ার সময় বলেছিলেনঃ
“আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের জন্য একটা উপায় বের না করা পর্যন্ত তোমরা যদি আবিসিনিয়ায় চলে যেতে………..।”
একথা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, কাফিরদের সাথে সংঘাতের ঐ স্তরে যেসব মুসলমান অসহনীয় বিপদ মুসিবতের শিকার হচ্ছিলেন, তাদেরকে তিনি সাময়িকভাবে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলে মনে হয় এমন একটি জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন। পরে যখন পরিস্থিতি অনুকূল হবে, তখন তারা আবার ফিরে আসবেন এটাই ছিলো উদ্দেশ্য। এ ঘটনাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কিভাবে সঠিক হতে পারে যে, কোনো অমুসলিম রাষ্ট্রে আকীদা ও ইবাদতের স্বাধীনতা পাওয়া গেলে সেটাই ঐ রাষ্ট্রের অনুগত প্রজা হয়ে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য যথেষ্ট হবে এবং এর চেয়ে বেশী কিছুর প্রয়োজন হবেনা?
৩. এরপর যখন মুসলমানরা সেখানে পৌছলো এবং মক্কার কাফিররা নাজ্জাশীর কাছ থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য একটা প্রতিনিধিদল পাঠালো, তখন হাদীসবেত্তাগণ ও সীরাত বিশারদগণের সর্বসম্মত মত অনসারে হযরত জাফর ও নাজ্জাশীর কথোপকথনের পর নাজ্জাশী হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে কুরআন বর্ণিত তত্ত্বকে সমর্থন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবূয়্যতকেও সত্য বলে স্বীকৃতি দেন। এরপর নাজ্জাশীর মুসলমান হওয়ার ব্যাপারে কি সন্দেহ থাকতে পারে? ইমাম আহমদ এই ঘটনার চাক্ষস সাক্ষী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের বরাত দিয়ে নাজ্জাশীর নিন্মরূপ উক্তি করেছেনঃ
“তোমাদেরকে মুবারকবাদ এবং তোমরা যার কাছ থেকে এসেছো তাকেও মাবুরকবাদ! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রসূল, তিনি সেই ব্যক্তি যার বর্ণনা আমরা ইনজিলে পাই, তিনি সেই রসূল, যার সম্পর্কে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।”
এ উক্তি কি কোনো অমুসলিমের হতে পারে? বায়হাকীতে স্বায়ং আমল ইবনুল আস থেকে [যিনি মোহাজেরদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য মক্কার কাফিরদের তরফ থেকে আবিসিনিয়ায় প্রেরিত হয়েছিলেন] বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি ফিরে এসে মক্কাবাসীকে বলেনঃ
“আসহাবা [নাজ্জাশী] বলে যে, তোমাদের সঙ্গী [মুহাম্মদ] নবী।”
প্রশ্ন হলো, কোনো মানুষ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবূয়্যত স্বীকার করে নেয়ার পরও কি অমুসলিম বিবেচিত হতে পারে?
সীরাতে ইবনে হিশাম হযরত আমর ইবনুল আসের ইসলাম গ্রহণের যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তা থেকে বুঝা যায়, প্রথম প্রথম নাজ্জাশীর প্রচারের ফলেই তার মনে ঈমানের জন্ম হয়। হোদাইবিয়ার সন্ধির আগে তিনি নাজ্জাশীর হাতে হাত দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এই সময় নাজ্জাশী আমর ইবনুল আসকে যে কথাগুলো বলেন তা হলোঃ
“আমার কথা শোনো এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী হয়ে যাও।
কেননা নিশ্চিতভাবেই তিনি সত্যের ওপর রয়েছেন। মূসা আলাইহিস সালাম যেভাবে ফিরাউন ও তার বাহিনীর ওপর বিজয়ী হয়েছিলেন, সেইভাবে তিনিও তার বিরোধীদের ওপর অবশ্যই বিজয়ী হবেন।”
আল্লামা ইবনে আব্দুল বার স্বীয় গন্থ আল ইসতিয়াবে হযরত উম্মে হাবীবার সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গায়েবানা বিয়ে পড়ানোর সময় নাজ্জাশী যে খুৎবা দেন, তা উদ্ধৃত করেছেন। এই খুৎবায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নাজ্জাশী বলেনঃ
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল, যার আগমন সম্পর্কে মরিয়মের পুত্র হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সংবাদ দিয়েছিলেন।”
এর চেয়েও একাট্য ও বিশ্বস্ত বর্ণনা বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃতি হয়েছে যে, নাজ্জাশীর মৃত্যুর খবর শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার গায়েবানা জানাযা নামায পড়েন এবং বলেনঃ
“আজ একজন পূণ্যবান মানুষ মারা গেছে। তোমরা প্রস্তুত হও এবং তোমাদের ভাই আসহামার জানাযার নাময পড়।”
এ রেওয়ায়েতের পর আবিসিনিয়ায় হিজরতের ঘটনার সূত্র ধরে যে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়, তার ভিত্তিই চুরমার হয়ে যায়।
[তরজমানুল কুরআন, মুহাররম-সফর, ১৩৬৪ হিঃ জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ১৯৪৫]