জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি

ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান

অন্তর্গতঃ উচ্চতর অধ্যয়ন, রাজনীতি
Share on FacebookShare on Twitter

সূচীপত্র

  1. আমাদের কথা
  2. গ্রন্থাকারের ভূমিকা
  3. প্রথম খন্ড
    1. প্রথম অধ্যায়
    2. দ্বিতীয় অধ্যায়
    3. তৃতীয় অধ্যায়
    4. চতুর্থ অধ্যায়
    5. পঞ্চম অধ্যায়
  4. দ্বিতীয় খন্ড
    1. ষষ্ঠ অধ্যায়
    2. সপ্তম অধ্যায়
    3. অষ্টম অধ্যায়
    4. নবম অধ্যায়
    5. দশম অধ্যায়
  5. তৃতীয় খন্ড
    1. দ্বাদশ অধ্যায়
    2. ত্রয়োদশ অধ্যায়
    3. চতুর্দশ অধ্যায়
    4. পঞ্চদশ অধ্যায়
  6. চতুর্থ খন্ড
    1. ষোড়শ অধ্যায়

তৃতীয় অধ্যায়

কুরআনের রাজনৈতিক দর্শন
রাজনীতি বিজ্ঞানের মৌলিক জিজ্ঞাসা
১. কয়েকটি মৌলিক তত্ত্ব
২. জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি
৩. দীন এবং আল্লাহর আইন
৪. রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
৫. সার্বভৌমত্ব ও খিলাফতের ধারণা
৬. আনুগত্যের মূলনীতি
কুরআনুল করীম আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত সেই সর্বশেষ গ্রন্থ, যাতে আসমান ও যমীনের স্রষ্টা মানব জীবনের সকল মৌলিক বিষয়ে তার হিদায়াতের পূর্ণাংগরূপ মানুষকে প্রদান করেছেন। সাথে সাথে এই শাম্বত মূলনীতিও ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, এ হিদায়াতকে যারা মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং এর নির্দেশিত পথে জীবন যাপন করবে, তারাই হবে সফলকাম ও সৌভাগ্যবানঃ
“যারা আমার হিদায়াতের অনুসরণ অনুবর্তন করেছে, তাদের কোনো ভয় নেই, দুশ্চিন্তা নেই। আর যারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে আর আমার আয়াতকে মিথ্যে বলেছে, তারা আগুনের সাথী হবে এবং সেখানে চিরকাল থাকবে।” [আল কাবারাঃ ৩৮-৩৯]
কুরআন মানব জীবনের সকল বিভাগ সম্পর্কে মৌলিক হিদায়াত প্রদান করেছে। কুরআনের আসল আলোচ্য বিষয় হলো, মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করা। জন্ম থেকে মৃত্যু এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্যেও এতে সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা রয়েছে। সুতরাং মৌলিক রাজনৈতিক বিষয়ে আল্লাহর এই মহান কিতাব নীরব থাকার কোনো কারণ থাকতে পারেনা। কুরআন দীন ও দুনিয়ার বিভক্তিকে বিপর্যয় বলে আখ্যায়িত করেছে। কুরআন তার অনুসারীদের কাছে দাবী করেঃ “উদখুলূ ফিস, সিলমি কাফফাতান- ইসলামে প্রবেশ করো পরিপূর্ণরূপে” কুরআনের রাজনৈতিক দর্শণ’ শিরোনামের অধীনে কুরআনের রাজনৈতিক ধারণা তুলে ধরা হয়েছে।
তাফহীমুল কুরআন মাওলানা মুওদূদীর খ্যাতনামা তাফসীর গ্রন্থ। এ গ্রন্থে মাওলানা যুগসমস্যা এবং মুসলমানদের আধুনিক মনমানসিকতাকে সামনে রেখে পবিত্র কুরআনের হৃদয়গ্রাহী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। এ গ্রন্থ থেকেই আমরা এখানে রাজনৈতিক নিবন্ধগুলো সন্নিবেশিত করে দিয়েছি। – সংকলক।
রাজনীতি বিজ্ঞানের মৌলিক জিজ্ঞাসা
রাজনীতি বিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের পারস্পারিক সম্পর্কের সাথে জড়িত। এই বিজ্ঞানের কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন হলোঃ
১. রাষ্ট্রের প্রয়োজন কি?
২. রাষ্ট্রে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবেন কে?
৩. আনুগত্যের মূলনীতি কি হবে?
৪. রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও মৌলিক কার্যাবলী কি?
সম্মুখের পাতাগুলোতে কুরআনের আলোকে এই প্রশ্নগুলোর জবাব উপস্থাপন করা হলো। কুরআনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগি উপলব্ধি করা জন্যে বিশ্বজগতে মানুষের মর্যাদা ও গোটা জীবন সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভংগি কি, সেকথাটি আগেই বুঝে নেয়া জরুরী। তাই কুরআনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগি উপস্থাপন করার আগে জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি কি? সেবিষয়ে কিছু মৌলিক বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে। এরপরই কুরআনের রাজনৈতিক ধারণা উপস্থাপন করা হবে।
১. কয়েকটি মৌলিক তত্ত্ব
পাঠককে সর্বপ্রথম মূল কুরআনের সাথে পরিচিত হতে হবে। এর প্রতি তার বিশ্বাস থাকা না থাকার প্রশ্ন এখানে নেই। তবে কি কিতাবকে কুঝতে হলে প্রারম্ভিক সূত্র হিসেবে এ কিতাব নিজে এবং এর উপস্থাপক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসল্লাম যে মূল বিঝয় বিবৃত করেছেন তা গ্রহণ করতে হবে। এ মূল বিষয় নিম্নরূপঃ
১. সমগ্র বিশ্ব জগতের প্রভু, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও একচ্ছত্র শাসক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষ ও পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে দান করেছেন জানার, বাঝার ও চিন্তা করার ক্ষমতা। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য, করার, নির্বাচন, ইচ্ছা ও সংকল্প করার এবং নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার স্বাধীনতা দান করেছেন। এক কথায় মানুষকে এক ধরনের স্বাধীনতা [Autonomy]দান করে তাকে দুনিয়ায় নিজের খলীফা বা প্রতিনিধি পদে অভিষিক্ত করেছেন।
২. মানুষকে এই পদে নিযুক্ত করার সময় বিশ্ব জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষের মনে একথা দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেনঃ আমিই তোমাদের এবং সমগ্র বিশ্ব জগতের একমাত্র মালিক, মাবুদ ও প্রভু। আমার এই সাম্রাজ্যে তোমরা স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নও, কারোর অধীনও নও এবং আমার ছাড়া আর কারোর তোমাদের বন্দেগী, পূজা ও আনুগত্য লাভের অধিকারও নেই। দুনিয়ার এই জীবনে তোমাদরেকে কিছু স্বাধীন ক্ষমতা ইখতিয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি আসলে তোমাদের জন্য পরীক্ষাকাল। এই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তোমাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তোমাদের কাজগুলো যাঁচাই বাছাই করে আমি সিদ্ধান্ত নেবো তোমাদের মধ্য থেকে কে সফল হলো এবং কে হলো ব্যর্থ। তোমাদের জন্য সঠিক কর্মনীতি একটিইঃ তোমরা আমাকে মেনে নেবে তোমাদের একমাত্র মাবুদ ও শাসক হিসেবে। আমি তোমাদের জন্য যে বিধান পাঠাবো সেই অনুযায়ী তোমরা দুনিয়ায় কাজ করবে। দুনিয়াকে পরীক্ষাগৃহ মনে করে এই চেতনা সহকারে জীবন যাপন করবে যেনো আমার আদালতে শেষ বিচারে সফলকাম হওয়াই তোমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য। বিপরীত পক্ষে এর থেকে ভিন্নতর প্রত্যেকটি কর্মনীতি তোমাদের জন্য ভুল ও বিভ্রান্তিকর। প্রথম কর্মনীতিটি গ্রহণ করলে [যেটি গ্রহণ করার স্বাধীন ক্ষমতা তোমাদরে দেয়া হয়েছে] তোমরা দুনিয়ায় শান্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা লাভ করবে। তারপর আমার কাছে ফিরে আসলে আমি তোমাদের দান করবো চিরন্তন আরাম ও আনন্দের আবাস জান্নাত। আর দ্বিতীয় কর্মনীতিটি গ্রহণ করলে [যেটি গ্রহণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা তোমাদের দেয়া হয়েছে] তোমাদের দুনিয়ায় বিপর্যয় ও অস্থিরতার ‍মুখোমুখি হতে হবে এবং দুনিয়ার জীবন শেষ করে আখিরাতে প্রবেশকালে সেখানে জাহান্নাম নামক চিরন্তন মর্মজ্বালা দুঃখ কষ্ট ও বিপদের গভীর গর্ভে তোমরা নিক্ষিপ্ত হবে।
৩. একথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর বিশ্ব জাহানের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানব জাতিকে পৃথিবীতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানব জাতির দুই সদস্য [আদম ও হাওয়া] বিশিষ্ট প্রথম গুপকে তিনি পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্য বিধান দান করেন। এই বিধান অনুযায়ী তাদের ও তাদের সন্তান সন্ততিদের দুনিয়ার সমস্ত কাজ কারবার চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের এই প্রাথমিক বংশধারা মুর্খতা, অজ্ঞতা ও অন্ধকারের মধ্যে সৃষ্ট হননি। আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁদের জীবনের সূচনা করেন সম্পূর্ণ আলোর মধ্যে। তারা সত্যকে জানতেন। তাদেরকে জীবনবিধান দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর আনুগত্য [অর্থাৎ ইসলাম] ছিলো তাদের জীবন পদ্ধতি। তাঁরা তাঁদের সন্তানদেরও আল্লাহর অনুগত বান্দাহ [মুসলিম] হিসেবে জীবন যাপন করার কথা শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শত শত বছরের জীবনাচরণে মানুষ ধীরে ধীরে এই সঠিক জীবন পদ্ধতি [অর্থাৎ দীন] থেকে দুরে সরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুল কর্মনীতি অবলম্বন করেছে। গাফলতির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে তারা এক সময় এই সঠিক জীবন পদ্ধতি হারিয়ে ফেলেছে। আবার শয়তানী প্ররোচনায় একে বিকৃতও করেছে। তারা পৃথিবী ও আকাশের মানব ও অমানব এবং কাল্পনিক ও বস্তুগত বিভিন্ন সত্তাকে আল্লাহর সাথে তাঁর কাজ কারবারে শরীক করেছে। আল্লাহ প্রদত্ত যথার্থ জ্ঞানের [আল ইলম] মধ্যে বিভিন্ন প্রকার কল্পনা, ভাববাদ, মনগড়া মতবাদ ও দর্শনের মিশ্রণ ঘটিয়ে তারা অসংখ্য ধর্মের সৃষ্টি করেছে। তারা আল্লাহ নির্ধারিত ন্যায়নিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ নৈতিক ও সাংস্কৃতিক নীতি [শরীয়ত] পরিহার বা বিকৃত করে নিজেদের প্রবৃত্তি, স্বার্থ ও ঝোঁক প্রবণতা অনুযায়ী জীবন যাপনের জন্য নিজেরাই এমন বিধান তৈরী করেছে যার ফলে আল্লাহর এই যমীন যুলুম নিপীড়নে ভরে গেছে।
৪. আল্লাহ যদি তাঁর স্রষ্টাসুলভ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিপথগামী মানুষদের জোরপূর্বক সঠিক কর্মনীতি ও জীবনধারার দিকে ঘুরিয়ে দিতেন তাহলে তা হতো মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত সীমিত স্বাধীনতাদান নীতির পরিপন্থী। আবার এ ধরনের বিদ্রোহ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই তিনি যদি মানুষকে ধ্বংস করে দিতেন তাহলে সেটি হতো সমগ্র মানব জাতিকে পৃথিবীতে কাজ করার জন্য তিনি যে সময় ও সুযোগ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তার সাথে অসামঞ্জস্যশীল। সৃষ্টির প্রথমদিন থেকে তিনি যে দায়িত্বটি গ্রহণ করেছিলেন সেটি ছিলো এই যে, মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে কাজের মাঝখানে যেসব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে তার মধ্যে দিয়েই তিনি তাকে পথ নির্দেশনা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। কাজেই নিজের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি মানব জাতির মধ্য থেকে একদল লোককে ব্যবহার করতে শুরু করেন যাঁরা তাঁর ওপর ঈমান রাখতেন এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যেতেন। এদেরকে তিনি করেন নিজের প্রতিনিধি। এদের কাছে পাঠান নিজের অলংঘনীয় বাণী। যথার্থ সত্য জ্ঞান ও জীবন যাপনের সঠিক বিধান এদেরকে দান করে তিনি বনী আদমকে ভুল পথ থেকে এই সহজ সত্য পথের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দেয়ার জন্য এদেরকে নিযুক্ত করেন।
৫. এরা ছিলেন আল্লাহর নবী। বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে আল্লাহ তাঁর নবী পাঠাতে থাকেন। হাজার হাজার বছর থেকে তাদের আগমনের এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। তাঁদের সংখ্যা ছিলো হাজার হাজার। তাঁরা সবাই একই দীনের তথা জীবন পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রথমদিন থেকেই মানুষকে যে সঠিক কর্মনীতির সাথে পরিচিত করানো হয়েছিলো তাঁরা সবাই ছিলেন তারই অনুসারী। তাঁরা সবাই ছিলেন একই হিদায়াতের প্রতি অনুগত। অর্থাৎ প্রথম দিন থেকেই মানুষের জন্য নৈতিকতা ও সমাজ সংস্কৃতির যে চিরন্তরন নীতি নির্ধারণ করা হয়েছিলো তাঁরা ছিলেন তারই প্রতি অনুগত। তাঁদের সবার একই মিশন ছিলো। অর্থাৎ তাঁরা নিজেদের বংশধর, গোত্র ও জাতিকে এই দীন ও হিদায়াতের দিকে আহবান জানান। তারপর যারা এ আহবান গ্রহণ করে তাদেরকে সংগঠিত করে এমন একটি উম্মতে পরিণত করেন যাঁরা নিজেরা হন আল্লাহর আইনের অনুগত ও দুনিয়ায় আল্লাহর আইনের আনুগত্য কায়েম করার এবং তাঁর আইনের বিরুদ্ধাচরণ প্রবণতা প্রতিরোধ করার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাতে থাকেন। এই নবীগণ প্রত্যেকেই তাঁদের নিজেদের যুগে অত্যন্ত সুচারুরূপে এ মিশনের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সবসময় দেখা গেছে মানব গোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ তাঁদের দাওয়াত গ্রহণ করতে প্রস্তুতই হয়নি। আর যারা এই দাওয়াত গ্রহণ করে উম্মতে মুসলিমার অংগীভুত হয় তারাও ধীরে ধীরে নিজেরাই বিকৃতির সাগরে তলিয়ে যেতে থাকে। এমনকি তাদের কোনো কোনো উম্মত আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াতকে একেবারেই হারিয়ে ফেলে। আবার কেউ কেউ আল্লাহর বাণীর সাথে নিজেদের কথার মিশ্রণ ঘটিয়ে এবং তার মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে তার চেহারাই বিকৃত করে দেয়।
৬. সবশেষে বিশ্বজাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরব দেশে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমকে পাঠান । ইতিপূর্বে বিভিন্ন নবীকে তিনি যে দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন মুহাম্মদ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরও সেই একই দায়িত্ব অর্পণ করেন। সাধারণ মানুষের সাথে সাথে পূর্বের নবীদের পথভ্রষ্ট উম্মতদেরকেও তিনি আল্লাহর দীনের দিকে আহবান জানান। সবাইকে সঠিক কর্মনীতি ও সঠিক পথ গ্রহণের দাওয়াত দেন। সবার কাছে নতুন করে আল্লাহর হিদায়াত পৌছিয়ে দেয়া এবং এই দাওয়াত ও হিদায়াত গ্রহণকারীদেরকে এমন একটি উম্মতে পরিণত করাই ছিলো তাঁর কাজ, যারা একদিকে আল্লাহর হিদায়াতের ওপর নিজেদের জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে এবং অন্যদিকে সমগ্র দুনিয়ার সংশোধন ও সংস্কার সাধনের জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাবে। এই দাওয়াত ও হিদায়াতের কিতাব হচ্ছে এই কুরআন। মুহাম্মদ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আল্লাহ এই কিতাবটি অবতীর্ণ করেন। [তাফহীমুল কুরআনের ভুমিকা থেকে গৃহীত।]
২. জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি
কুরআন এ বিশ্বে মানুষের সঠিক মর্যাদা ও জীবন সম্পর্কে তার পূর্ণাংগ দৃষ্টিভংগি একটি আয়াতেই বলে দিয়েছেঃ
“প্রকৃত ব্যাপার হলো, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধনসম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে। তাদের প্রতি তাওরাত, ইনজীল ও কুরআনে [জান্নাতের ওয়াদা] আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা বিশেষ। আর আল্লাহর চাইতে বেশী নিজের ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনাবেচা করেছো সেজন্য সুসংবাদ গ্রহণ করো। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।” [সূরা আততওবাঃ ১১১]
আল্লাহ ও বান্দাহর মধ্যে ঈমানের যে ব্যাপারটা স্থিরকৃত হয় তাকে কেনাবেচা বলে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, ঈমান শুধুমাত্র একটা অতি প্রাকৃত আকীদা বিশ্বাস নয়, বরং এটা একটা চুক্তি। এ চুক্তির প্রেক্ষিতে বান্দাহ তার নিজের প্রাণ ও নিজের ধনসম্পদ আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দেয়। আর এর বিনিময়ে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ওয়াদা কবুল করে নেয় যে, পরবর্তী জীবনে তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু অনুধাবন করার জন্য সর্বপ্রথম কেনাবেচার তাৎপর্য ও স্বরূপ কি তা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে।
নিরেট সত্যের আলোকে বিচার করলে বলা যায়, মানুষের ধনপ্রাণের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। কারণ, তিনিই তার এবং তার কাছে যা কিছু আছে সব জিনিসের স্রষ্টা। সে যা কিছু ভোগ ও ব্যবহার করছে তাও তিনিও তাকে দিয়েছেন। কাজেই এদিক দিয়ে তো কেনাবেচার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। মানুষের এমন কিছু নেই, যা সে বিক্রি করবে। আবার কোনো জিনিস আল্লাহর মালিকানার বাইরেও নেই, যা তিনি কিনবেন। কিন্তু মানুষেল মধ্যে এমন একটি আছে, যা আল্লাহ পুরোপুরি মানুষের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে তার ইখতিয়ার অর্থাৎ নিজের স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি [Free will and freedom of choice] । এ ইখতিয়ারের কারণে অবশ্যি প্রকৃত সত্যের কোনো পরিবর্তন হয়না। কিন্তু মানুষ এ মর্মে স্বাধীনতা লাভ করে যে, সে চাইলে প্রকৃত সত্যকে মেনে নিতে পারে এবং চাইলে তা অস্বীকার করতে পারে। অন্য কথায়, এ ইখতিয়ারের মানে এ নয় যে, মানুষ প্রকৃতপক্ষে তার নিজের প্রাণের, নিজের বুদ্ধিপৃত্তি ও শারীরিক শক্তির এবং দুনিয়ায় সে যে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেছে, তার মালিক হয়ে গেছে। এ সংগে এ জিনিসগুলো সে যেভাবে চাইবে সেভাবে ব্যবহার করার অধিকার লাভ করেছে, একথাও ঠিক নয়। বরং এর অর্থ কেবল এতোটুকুই যে, তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো প্রকার জোর জবরদস্তি ছাড়াই সে নিজেই নিজের সত্তার ও নিজের প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর আল্লাহর মালিকানা ইচ্ছা করলে স্বীকার করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে নিজেই নিজের মালিক হয়ে যেতে পারে এবং নিজেই একথা মনে করতে পারে যে, সে আল্লাহ থেকে বেপরোয়া হয়ে নিজের ইখতিয়ার তথা স্বাধীন কর্মক্ষমতার সীমানার মধ্যে নিজের ইচ্ছামত কাজ করার অধিকার রাখে। এখানেই কেনাবেচার প্রশ্নটা দেখা দেয়। আসলে এ কেনাবেচা এ অর্থে নয় যে, মানুষের একটি জিনিস আল্লাহ কিনতে চান। বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, যে জিনিসটি আল্লাহর মালিকানাধীন, যাকে তিনি আমানত হিসেবে মানুষের হাতে সোপর্দ করেছেন এবং যে ব্যাপারে তিনি মানুষের কাছে দাবী করেন, আমার জিনিসকে তুমি স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে [বাধ্য হয়ে নয়] আমার জিনিস বলে মেনে নাও এবং সারা জীবন স্বাধীন মালিকের মর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নয় বরং আমানতদার হিসেবে তা ব্যবহার করার বিষয়টি গ্রহণ করে নাও। এ সংগে খেয়ানত করার যে স্বাধীনতা তোমাকে দিয়েছি তা তুমি নিজেই প্রত্যাহার করো। এভাবে যদি তুমি দুনিয়ার বর্তমান অস্থায়ী জীবনে নিজের স্বাধীনতাকে [যা তোমার অর্জিত নয় বরং আমার দেয়া] আমার হাতে বিক্রি করে দাও তাহলে আমি পরবর্তী চিরন্তন জীবনে এর মূল্য জান্নাতের আকারে তোমাকে দান করবো। সে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কেনাবেচার এ চুক্তি সম্পাদন করে সে মুমিন। ঈমান আসলে এ কেনাবেচার আর এক নাম। আর সে ব্যক্তি এটা অস্বীকার করবে অথবা অঙ্গীকার করার পরও এমন আচরণ করবে যা কেবলমাত্র কেনাবেচা না করার অবস্থায় করা যেতে পারে, সে কাফের। আসলে এ কেনাবেচাকে পাস কাটিয়ে চলার পরিভাষিক নাম কুফরী।
কেনাবেচার এ তাৎপর্য ও স্বরূপটি অনুধাবন করার পর এবার তার অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করা যাকঃ
এক. এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ মানুষকে দুটি বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। প্রথম পরীক্ষাটি হচ্ছে, তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেবার পর সে মালিককে মালিক মনে করার এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহের পর্যায়ে নেমে না আসার মতো সৎ আচরণ করে কিনা? দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নিজের প্রভু ও মালিক আল্লাহর কাছ থেকে আজ নগদ যে মূল্য পাওয়া যাচ্ছেনা বরং মরার পর পরকালীন জীবনে যে মূল্য আদায় করার ওয়াদা তাঁর পক্ষ থেকে করা হয়েছে, তার বিনিময়ে নিজের আজকের স্বাধীনতা ও তার যাবতীয় স্বাদ বিক্রি করতে স্বেচ্ছায় ও আগ্রহে রাজী হয়ে যাবার মত আস্থা তাঁর প্রতি আছে কিনা।
দুই. যে ফিকহের আইনের ভিত্তিতে দুনিয়ায় ইসলামী সমাজ গঠিত হয় তার দৃষ্টিতে ঈমান শুধুমাত্র কতিপয় বিশ্বাসের স্বীকৃতির নাম। ও স্বীকৃতির পর নিজের স্বীকৃতি ও অংগীকারের ক্ষেত্রে মিথ্যুক হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ না পওয়া পর্যন্ত শরীয়াতের কোনো বিচারক কাউকে অমুমিন বা ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত ঘোষণা করতে পারেনা। কিন্তু আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য ঈমানের তাৎপর্য ও স্বরূপ হচ্ছে, বান্দাহ তার চিন্তা ও কর্ম উভয়ের স্বাধীনতা ও স্বাধীন ক্ষমতা আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দিবে এবং নিজের মালিকানার দাবী পুরোপুরি তাঁর সপক্ষে প্রত্যাহার করবে। কাজেই যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামের কালেমার স্বীকৃতি দেয় এবং নামায রোযা ইত্যাদির বিধানও মেনে চলে, কিন্তু নিজেকে নিজের দেহ ও প্রাণের, নিজের মন, মস্তিষ্ক ও শারীরিক শক্তির, নিজের ধনসম্পদ, উপায়, উপকরণ ইত্যাদির এবং নিজের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণাধীন সমস্ত জিনিসের মালিক মনে করে এবং সেগুলোকে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করার স্বাধীনতা নিজের জন্য সংরক্ষিত রাখে, তাহলে হয়তো দুনিয়ায় তাকে মুমিন মনে করা হবে, কিন্তু আল্লাহর কাছে সে অবশ্যি অমুমিন গণ্য হবে। কারণ কুরআনের দৃষ্টিতে কেনাবেচার ব্যাপারকে ঈমানের আসল তাৎপর্য ও স্বরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ সে আল্লাহর সাথে আদতে কোনো কেনাবেচার কাজই করেনি। যেখানে আল্লাহ চান সেখানে ধনপ্রাণ নিয়োগ না করা এবং যেখানে তিনি চান না সেখানে ধনপ্রাণ নিয়োগ ও ব্যবহা করা এ দুটি কার্যধারাই চূড়ান্তভাবে ফায়সালা করে দেয় যে, ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি তার ধনপ্রাণ আল্লাহর হাতে বিক্রি করেইনি অথবা বিক্রির চুক্তি করার পরও সে বিক্রি করা জিনিসকে যথারীতি নিজের জিনিস মনে করছে।
তিন. ঈমানের এ তাৎপর্য ও স্বরূপ ইসলামী জীবনাচরণকে কাফেরী জীবনাচরণ থেকে সম্পূর্ন আলাদা করে দেয়। যে মুসলিম ব্যক্তি সঠিক অর্থে আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে সে জীবনের সকল বিভাগে আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হয়ে কাজ করে। তার আচরণে কোথাও স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিভংগী প্রকাশ ঘটতে পারেনা। তবে কোনো সময় সাময়িকভাবে সে গাফলতির শিকার হতে পারে এবং আল্লাহর সাথে নিজের কেনাবেচার চুক্তির কথা ভুলে গিয়ে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা অবলম্বন করাও তার পক্ষে সম্ভ। এটা অবশ্যি ভিন্ন ব্যাপার। অনুরূপভাবে ঈমানদারদের সমন্বয় গঠিত কোনো দল বা সমাজ সমষ্ঠিগতভাবেও আল্লাহর ইচ্ছা ও তাঁর শরয়ী আইনের বিধিনিষেধ মুক্ত হয়ে কোনো নীতি পদ্ধতি, রাষ্ট্রীয় নীতি, তামাদ্দুনিক ও সাংস্কৃতিক পদ্ধতি এবং কোনো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক আচরণ অবলম্বন করতে পারেনা। কোনো সাময়িক গাফলতির কারছে যদি সেটা অবলম্বন করেও থাকে তাহলে যখনই সে এ ব্যাপারে সতেচন হবে তখনই স্বাধীন ও স্বৈরাচারী আচরণ ত্যাগ করে পুনরায় বন্দেগীর আচরণ করতে থাকবে। আল্লাহর আনুগত্য মুক্ত হয়ে কাজ করা এবং নিজের ও নিজের সাথে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে নিজে নিজেই কি করবো না করবো, সিদ্ধান্ত নেয়া অবশ্যি একটি কুফরী জীবনাচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। যাদের জীবন যাপন পদ্ধতি এরকম তারা “মুসলমান” নামে আখ্যায়িত হোক বা “অমুসলিম” নামে তাতে কিছু যায় আসেনা।
চার. এ কেনাবেচার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর যে ইচ্ছার আনুগত্য মানুষের জন্য অপরিহার্য হয় তা মানুষের নিজের প্রস্তাবিত বা উদ্ভাবিত নয় বরং আল্লাহ নিজে যেমন ব্যক্ত করেন তেমন। নিজে নিজেই কোনো জিনিসকে আল্লাহর ইচ্ছা বলে ধরে নেয়া এবং তার আনুগত্য করতে থাকা মূলত আল্লাহর ইচ্ছার নয় বরং নিজেরই ইচ্ছার আনুগত্য করার শামিল। এটি এ কেনাবেচার চুক্তির সম্পূর্ণ বিরোধী। যে ব্যক্তি ও দল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর হিদায়াত থেকে নিজের সমগ্র জীবনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে একমাত্র তাকেই আল্লাহর সাথে কৃত নিজের কেনাবেচার চুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হবে।
এ হচ্ছে এ কেনাবেচার অন্তর্নিহিত বিষয়। এ বিষয়টি অনুধাবন করার পর এ কেনাবেচার ক্ষেত্রে বর্তমান পার্থিব জীবনের অবসানের পর মূল্য [অর্থাৎ জান্নাত] দেবার কথা বলা হয়েছে কেন তাও আপনা আপনিই বুঝে আসে। “বিক্রেতা নিজের প্রাণ ও ধনসম্পদ আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দেবে” কেবলমাত্র এ অংগীকারের বিনিময়েই যে জন্নাত পাওয়া যাবে তা নয়। বরং “বিক্রেতা নিজের পার্থিব জীবনে এ বিক্রি করা জিনিসের ওপর নিজের স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার প্রত্যাহার করবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত তৎপরতার বিনিময়েই জান্নাত প্রাপ্তি নিশ্চিত হতে পারে। সুতরাং বিক্রেতার পার্থিব জীবনকালে শেষ হবার পর যখন প্রমাণিত হবে যে, কেনাবেচার চুক্তি করার পর সে নিজের পার্থিব জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত চুক্তির শর্তসমূহ পুরোপুরি মেনে চলেছে একমাত্র তখনই এ বিক্রি সম্পূর্ণ হবে। এর আগে পর্যন্ত ইনসাফের দৃষ্টিতে সে মূল্য পাওয়ার অধিকারী হতে পারেনা।
৩. দীন এবং আল্লাহর আইন
“ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ প্রত্যেককে এক’শ কোড়া মারো। তাদের উপর আল্লাহর আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে তোমাদের মনে যেনো অনুকম্পা না জাগে, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখো।” [সূরা নুরঃ ২]
এ আয়াতে প্রথম উল্লেখযোগ্য জিনিসটি হচ্ছে, এখানে ফৌজদারী আইনকে “আল্লাহর দীন” বলা হচ্ছে। এথেকে জানা যায, শুধুমাত্র নামায, রোযা হজ্জ ও যাকাতই দীন নয়, বরং দেশের আইনও দীন। দীন প্রতিষ্ঠার অর্থ শুধু নামায প্রতিষ্ঠা নয় বরং আল্লাহর আইন ও শরীয়া ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাও। যেখানে এসব প্রতিষ্ঠিত হয়না যেখানে নামায প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও অসম্পূর্ণ দীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বলে মনে করা হবে। যেখানে একে বাদ দিয়ে অন্য কোনো আইন অবলম্বন করা হয় সেখানে অন্য কিছু নয় বরং আল্লাহর দীনকেই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
৪. রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
“আর হে নবী দোয়া করোঃ আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে যেখানেই তুমি নিয়ে যাও সত্যতার সাথে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকেই বের করো সত্যতার সাথে বের করো। এবং তোমার পক্ষ থেকে একটি কর্তৃত্বশীল পরাক্রান্ত শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও।” [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৮০]
অর্থাৎ এ আয়াতে আল্লাহ নবীকে এভাবে প্রার্থনা করতে শিখিয়ে দিচ্ছেন যে, তুমি বলো, হে আল্লাহ! তুমি নিজেই আমাকে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ব্যবহার করে আমি দুনিয়ার বিকৃত জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারি, অশ্লীলতা ও পাপের সংলাব রুখে দাঁড়াতে পারি এবং তোমার ন্যায় বিধান জারি করতে সক্ষম হই। হাসান বসরী ও কাতাদাহ এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই করেছেন। ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীরের ন্যায় মহান তাফসীরকারগণও এ ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত হাদীস থেকেও এরি সমর্থন পাওয়া যায়ঃ
“আল্লাহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলে এমনসব জিনিসের উচ্ছেদ ঘটান কুরআনের মাধ্যমে যেগুলোর উচ্ছেদ ঘটাননা।”
এথেকে জানা যায়, ইসলাম দুনিয়ায় যে সংশোধন চায় তা শুধুমাত্র ওয়ায নসীহতের মাধ্যমে হতে পারেনা বরং তাকে কার্যকর করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতাও প্রয়োজন হয়। তারপর আল্লাহ নিজেই যখন তাঁর নবীকে এ দোয়া শিখিয়েছেন তখন এথেকে একথাও প্রমাণ হয় যে, দীন প্রতিষ্ঠা ও শরীয়তী আইন প্রবর্তন এবং আল্লাহ প্রদত্ত দন্ডবিধি জারী করার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা হাসিল করার প্রত্যাশা করা এবং এজন্য প্রচেষ্টা চালানো শুধু জায়েযই নয় বরং কাংখিত ও প্রশংসিতও এবং অন্যদিকে যারা এ প্রচেষ্টা ও প্রত্যাশাকে বৈষয়িক স্বার্থ পূজা ও দুনিয়াদারী বলে আখ্যায়িত করে তারা ভুলের মধ্যে অবস্থান করছে। কোনো ব্যক্তি যদি নিজের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করতে চায় তাহলে তাকে বৈষয়িক স্বার্থ পূজা বলা যায়। কিন্তু কেউ আল্লাহর দীনের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করতে চাইলে ও চাওয়া বৈষয়িক স্বার্থ পূজা নয় বরং আল্লাহর আনুগত্যের প্রত্যক্ষ দাবী।
এ জিনিসটাই হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের জীবনাদর্শে আমরা দেখতে পাই। তিনি যে নৈতিক ও সংস্কার বিপ্লবের আহবায়ক ছিলেন কর্তৃত্ব ছিলো তার জন্য অপরিহার্য। যখন পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূল দেখা দিলো তখন তিনি সে সুযোগ গ্রহণ করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিষয়টিই কুরআন মজীদে চিত্রিত হয়েছে এভাবেঃ
“বাদশাহ বললো, “তাকে আমার কাছে আনো, আমি তাকে একান্তভাবে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেবো।” ইউসূফ যখন তার সাথে আলাপ করলো, সে বললো, “এখন আপনি আমাদের এখানে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী এবং আপনার আমানতদারীর ওপর পূর্ণ ভরসা আছে।” ইউসূফ বললো, “দেশের অর্থসম্পদ আমার হতে সোপর্দ করুন। আমি সংরক্ষণকারী এবং জ্ঞানও রাখি।” [সূরা ইউসূফঃ ৫৪-৫৫]
এর আগে যেসব আলোচনা হয়েছে তার আলোকে পর্যালোচনা করলে একথা পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, কোন পদলোভী ব্যক্তি বাদাশাহর ইশারা পাওয়ার সাথে সাথেই যেমন কোনো পদলাভের জন্য আবেদন করে বসে এটি তেমনি ধরনের কোনো চাকরির আবেদন ছিলোনা। আসলে এটি ছিলো একটি বিপ্লবের দরজা খোলার জন্য সর্বশেষ আঘাত। হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালামের নৈতিক শক্তির বলে বিগত দশ বারো বছরের মধ্যে ও বিপ্লব ক্রমবিকাশ লাভ করে আত্মপ্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো এবং এখন এর দরজা খোলার জন্য শুধুমাত্র একটি হালকা আঘাতের প্রয়োজন ছিলো। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম একটি সুদীর্ঘ ধারাবাহিক পরীক্ষার অংগন অতিক্রম করে আসছিলেন। কোনো অজ্ঞান স্থানে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং বাদশাহ থেকে শুরু করে মিসরের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই এ সম্পর্কে অবগত ছিলো। এসব পীক্ষার মাধ্যমে তিনি একথা প্রমান করে দিয়েছিলেন যে, আমানতদারী, সততা ধৈর্য, সংযম, উদারতা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতার ক্ষেত্রে অন্তত সমকালীন লোকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর ব্যক্তিত্বের ও গুণগুলো এমনভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছিলো যে, এগুলো অস্বীকার করার সাধ্য কারোর ছিলোনা। দেশবাসী মুখে এগুলোর পক্ষে সাক্ষ দিয়েছিলো। তাদের হৃদয় এগুলোর দ্বারা বিজিত হয়েছিলো। বাদশাহ নিজেই এগুলোর সামনে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এখন তাঁর “সংরক্ষণকারী” ও “জ্ঞানী” হওয়া শুধুমাত্র একটি দাবীর পর্যায়ভুক্ত ছিলোনা বরং এটি ছিলো একটি প্রমাণিত ঘটনা। সবাই এটা বিশ্বাস করতো। এখন শুধু রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা কর্তৃত্ব পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করার ক্ষেত্রে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সম্মতিটুকুই বাকি ছিলো। বাদশাহ, তাঁর মন্ত্রীপরিষদ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ একথা ভালোভাবেই জেনেছিলেন যে, তিনি ছাড়া এ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করার মতো আর দ্বিতীয় কোনো যোগ্য ব্যক্তিত্বই নেই। কাজেই নিজের এ উক্তির সাহায্যে তিনি এ সম্মতিটুকুরই প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন মাত্র। তাঁর কন্ঠে এ দাবীটুকু উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই বাদশাহ ও তাঁর রাজ পরিষদ যেভাবে ‍দুহাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করে নিয়েছেন তা একথাই প্রমাণ করে যে, ফল পুরোপুরি পেকে গিয়েছিলো এবং তা ঝরে পড়ার জন্য শুধুমাত্র একটা ইশারার অপেক্ষায় ছিলো। [তালমূদের বর্ণনামতে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দান করার ফায়সালাটি কেবল বাদশাহ একাই করেননি। বরং সমগ্র রাজপরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছিলো।
৫. সার্বভৌমত্ব ও খিলাফতের ধারণা
ইসলামে সার্বভৌমত্বের ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। আল্লাহ এই বিশ্ব জগতের স্রষ্টা এবং তিনি সর্বোচ্চ শাসক। সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব কেবল তারই। মানুষের মর্যাদা হলো, সে সর্বোচ্চ শাসকের প্রতিনিধি এবং তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা হবে সর্বোচ্চ শাসকের আইনের অনুগামী। প্রতিনিধির কাজ হলো, সর্বোচ্চ শাসকের আইনকে তাঁর প্রকৃত লক্ষ্য অনুযায়ী কার্যকর করা এবং তাঁর নির্দেশিত পথে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা করা। কুরআনের ভাষ্য দেখুনঃ
ক. “হে জেলখানার সাথীরা! তোমরা নিজেরাই ভেবে দিখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু সংখ্যক রব ভালো, না এক আল্লাহ যিনি সবার ওপর বিজয়ী। তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের গোলামী করছো তারা শুধুমাত্র কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয়, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ পুরুষরা রেখেছো, আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোনো প্রমাণ পাঠাননি। শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই। তাঁর হুকুম হলো, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর দাসত্ব করবেনা। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানেনা।” [সূরা ইউসূফঃ ৩৯-৪০]
এটি ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভাষণের একটি অংশ। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাওহীদের ব্যাপারে এটি সর্বোত্তম ভাষণসমূহের একটি। এতে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম শ্রোতাদের সামনে দীনের এমন একটি সুচনা বিন্দু তুলে ধরেন যেখানে থেকে সত্যপন্থী ও মিথ্যাবন্থীদের পথ পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অর্থাৎ তিনি তাওহীদ শিরকের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। আবার এ পার্থক্যকে এমন যুক্তিসংগত পদ্ধতিতে সুস্পষ্ট করেছেন, যার ফলে সাধারণ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তিই তা অনুভব না করে পারেননা। বিশেষ করে সে সময় যাদেরকে সম্বোধন করে তিনি একথা বলছিলেন তাদের মন মস্তিষ্কে তীরের মতো একথা গেঁথে গিয়ে থাকবে। কারণ তার ছিলো কর্মজীবি গোলাম। নিজেদের মনের গভীর তারা একথা ভালোভাবে অনুভব করতো যে, একজন প্রভুর গোলাম হওয়া ভালো, না একাধিক প্রভুর গোলাম হওয়া? আর সারা দুনিয়ার একক প্রভু যিনি, তার দাসত্ব করা ভালো, না তার দাসদের দাসত্ব করা? তারপর তিনি একথাও বলেননা যে, তোমাদের ধর্ম ত্যাগ করো এবং আমার দীন গ্রহণ করো। বরং চমৎকার কৌশল বলছেন, আল্লাহর কতোবড় মেহেরবানী, তিনি আমাদের তাঁর ছাড়া আর কারো দাস হিসেবে পয়দা করেননি , অথচ অধিকাংশ লোক তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনা বরং অনর্থক নিজেরাই মনগড়া প্রভু তৈরী করে তাদের পূজা ও দাসত্ব করছে। তারপর তিনি শ্রোতাদের অনুসৃত ধর্মের সমালোচনাও করেছেন, কিন্তু অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবে এবং কোনো প্রকার মনোকষ্ট না দিয়ে। তিনি এতোটুকু বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন যে, এই যেসব মাবুদ যাদের কাউকে তোমরা অন্নদাতা, কাউকে অনুগ্রহদাতা ও করুণানিধি, কাউকে ভূমির অধিপতি এবং কাউকে ধনসম্পদের মালিক অথবা স্বাস্থ্য ও রোগের একচ্ছত্র অধিপতি ও পরিচালক ইত্যাদি বলে থাকো- এরা নিছক কিছু অন্তসারশূন্য নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। এ নামগুলোর পিছনে কোনো সত্যিকার অন্নদাতা, অনুগ্রহকারী, তোমরাও বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক বলে স্বীকার করে থাকো। তিনি এসব মালিক ও প্রভূদের কাউকে মালিকানা, প্রভুত্ব ও উপাস্য হবার ছাড়পত্র দেননি। তিনি সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্বের যাবতীয় অধিকার ও ক্ষমতা নিজের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন এবং তাঁরই আদেশ হচ্ছে, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবেনা।
খ. “আর ফেরাউন বললো, হে সভাসদবর্গ! আমি তো আমাকে ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ আছে বলে জানিনা।” [সূরা আল কাসাসঃ ৩৮]
এ উক্তির মাধ্যমে ফেরাউন যে বক্তব্য পেশ করেছে তার অর্থ এ ছিলোনা এবং তা হতেও পারতোনা যে, আমিই তোমাদের এবং পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা। কারণ কেবলমাত্র কোনো পাগলের মুখ দিয়েই এমন কথা বের হতে পারতো। অনুরূপভাবে এর অর্থ এও ছিলোনা এবং হতে পারতোনা যে, আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই। কারণ মিসরবাসীরা বহু দেবতার পূজা করতো এবং স্বয়ং ফেরাউনকেই যেভাবে উপাস্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছিলো তাও শুধুমাত্র এই ছিলো যে, তাকে সূর্য দেবতার অবতার হিসেবে স্বীকার করা হতো। সবচেয়ে বড় সাক্ষী ‍কুরআন মজীদ নিজেই। কুরআনে বলা হয়েছে ফেরাউন নিজে বহু দেবতার পূজারী ছিলো।
এদিক দিয়ে চিন্তা করলে যেসব রাষ্ট্র আল্লাহর নবী প্রদত্ত শরীয়তের অধীনতা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের তথাকথিত রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্বের দাবীদার, ফেরাউনের অবস্থাক তাদের থেকে ভিন্নতর ছিলোনা। তারা আইনের উৎস এবং আদেশ নিষেদের কর্তা হিসেবে অন্য কোনো বাদশাকে মানুক অথবা জাতির ইচ্ছার আনুগত্য করুক, যতক্ষণ তারা এরূপ নীতি অবলম্বন করে চলবে যে, দেশে আল্লাহ ও তার রসূলের নয় বরং আমাদের হুকুম চলবে, ততক্ষণ তাদের ও ফেরাউনের নীতি ও ভূমিকার মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য থাকবেনা। এটা ভিন্ন কথা যে, অবুঝ লোকেরা একদিকে ফেরাউনকে অভিসম্পাত করতে থাকে, অন্যদিকে ফেরাউন রীতিনীতির অনুসারী এসব শাসককে বৈধতার ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। যে ব্যক্তি প্রকৃত সত্যের জ্ঞান রাখে, সে শব্দ ও পরিভাষা নয়, অর্থ ও প্রাণশক্তি দেখবে। ফেরাউন নিজের জন্য ইলাহ শব্দ ব্যবহার করেছিলো এবং এরা সেই একই অর্থে “সার্বভৌমত্বের” পরিভাষা ব্যবহার করছে।
“তিনি হলেন সেই সত্ত্বা, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বের মালিক। তিনি কাউকেও পুত্র বানাননা। তাঁর রাজত্বে কোনো অংশীদার নেই। প্রতিটি জিনিস তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর একটি তাকদীর নির্ধারণ করেছেন।” [সূরা আল ফুরকানঃ ২]
মূলে মুলক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি বাদশাহী, রাজত্ব, সর্বময় কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের [Sovereignty] অর্থে বলা হয়ে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহই এ বিশ্ব জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক এবং তাঁর শাসন ক্ষমতায় কারো সামান্যতমও অংশ নেই। একথার স্বতঃস্ফূর্ত ও অনিবার্য ফল এই যে, তাহলে তিনি ছাড়া আর কোনো মা’বুদ নেই। কারণ, মানুষ যাকেই মা’বুদে পরিণত করে একথা মনে করেই করে যে, তার কাছে কোনো শক্তি আছে, যে কারণে সে আমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে এবং আমাদের ভাগ্যের ওপর ভালো মন্দ প্রভাব ফেলতে পারে। শক্তিহীন ও প্রভাবহীন সত্তাদেরকে আশ্রয়স্থল করতে কোনো একান্ত নির্বোধ ব্যক্তিও রাজি হতে পারেনা। এখন যদি একথা জানা যায় যে, মহান আল্লাহ ছাড়া এ বিশ্ব জাহানে আর কোনো শক্তি নেই তাহলে বিনয় নম্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করার জন্য কোনো মাথা তাঁর ছাড়া আর কারো সামনে ঝুঁকবেনা, কোনো হাতও তাঁর ছাড়া আর কারো সামনে নজরানা পেশ করার জন্য এগিয়ে যাবেনা, কোনো কণ্ঠও তাঁর ছাড়া আর কারো প্রশংসাগীতি গাইবেনা বা কারো কাছে প্রার্থনা করবেনা ও ভিক্ষা চাইবেনা এবং দুনিয়ার কোনো নিরেট মূর্খ অজ্ঞ ব্যক্তিও কখনো নিজের প্রকৃত ইলাহ ছাড়া আর কারো অনুগত্য ও দাসত্ব করার মতো বোকামী করবেনা অথবা কারো স্বয়ংসম্পূর্ণ শাসনাধিকার মেনে নেবেনা। “আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব তাঁরই এবং তাঁরই জন্য” ওপরের এ বাক্যাংশটি থেকে এ বিষয়বস্তুটি আরো বেশী শক্তি অর্জন করে।
ঘ. “ আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। তোমাদের অন্তরে যা কিছু আছে তা প্রকাশ কারো কিংবা গোপন রাখো সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ সেগুলোর হিসেবে নেবেন। অতপর তিনি যাকে চাইবেন মাফ করে দেবেন, আর যাকে চাইবেন শাস্তি দেবেন, তিনি সবকিছু কারতে সক্ষম।” [সূরা আল বাকারাঃ ২৮৪]
এটি হচ্ছে দীনের প্রথম বুনিয়াদ। আল্লাহ এই পৃথিবীর ও আকাশ সমূহের মালিক এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছু তাঁর একক মালিকানাধীন, প্রকৃতপক্ষে এই মৌলিক সত্যের ভিত্তিতেই মানুষের জন্য আল্লাহর সামনে আনুগত্যের শির নতো করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কর্মপদ্ধতি বৈধ ও সঠিক হতে পারেনা।
এই বাক্যটিতে আরো দুটি কথা বলা হয়েছে। এক, প্রত্যেক ব্যক্তি এককভাবে আল্লাহর কাছে দায়ী হবে এবং এককভাবে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। দুই, পৃথিবী ও আকাশের যে একচ্ছত্র অধিপতির কাছে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে তিনি অদৃশ্য ও প্রকাশ্যের জ্ঞান রাখেন। এমনকি লোকদের গোপন সংকল্প এবং তাদের মনের সংগোপনে যেসব চিন্তা জাগে সেগুলিও তাঁর কাছে গোপন নয়।
এটি আল্লাহর নিরংকুশ ক্ষমতারই একটি বর্ণনা। তাঁর ওপর কোনো আইনের বাঁধন নেই। কোনো বিশেষ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য তিনি বাধ্য নন। বরং তিনি সর্বময় ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। শাস্তি দেয়ার এবং মাফ করার পূর্ণ ইখতিয়ার তাঁর রয়েছে।
কুরআনে ঈসা আলাইহিস সালামের বক্তব্য উল্লেখ হয়েছে এভাবেঃ
ঙ. “আমি সেই শিক্ষা ও হিদায়াতের সত্যতা ঘোষণা করার জন্য এসেছি, যা বর্তমানে আমার যুগে তাওরাতে আছে। আর তোমাদের জন্য যেসব জিনিস হারাম ছিলো তার কতকগুলি হালাল করার জন্য আমি এসেছি। দেখো, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে আমি নিশানী নিয়ে এসেছি। কাজেই আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। আল্লাহ আমার রব এবং তোমাদেরও রব। কাজেই তোমরা তাঁর দাসত্ব করো। এটিই সোজাপথ।” [সূরা আল ইমরানঃ ৫০-৫১]
এথেকে জানা গেলো অন্যান্য সকল নবীর মতো হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দাওয়াতেরও তিনটি মৌলিক বিষয়বস্তু ছিলোঃ
এক, সার্বভৌম কর্তৃত্ব, যার দাসত্ব ও বন্দেগী করতে হবে এবং যার প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে নৈতিক ও তামদ্দুনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত বলে স্বীকার করতে হবে।
দুই, ঐ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীর প্রতিনিধি হিসেবে নবীর নির্দেশের আনুগত্য করতে হবে।
তিন, মানুষের জীবনকে হালাল ও হারাম এবং বৈধতা ও অবৈধতার বিধিনিষেধে আবদ্ধকারী আইন ও বিধিবিধান একমাত্র আল্লাহ দান করবেন। অন্যদের চাপানো সমস্ত আইন ও বিধি নিষেধ বাতিল করতে হবে।
কাজেই হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবীর মিশনের মধ্যে আসলে সামান্যতম পার্থক্যও নেই। যারা বিভিন্ন নবীর মিশন বিভিন্ন বলে গণ্য করেছেন এবং তাদের মিশনের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য দেছিয়েছেন, তারা মারাত্মক ভুল করেছেন। বিশ্বজাহানের সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারীর পক্ষ থেকে তাঁর প্রজাদের জন্যে যে ব্যক্তিই নিযুক্ত হয়ে আসবেন তাঁর আসার উদ্দেশ্য এছাড়া আর দ্বিতীয় কিছুই হতে পারেনা যে, তিনি প্রজাদেরকে অবাধ্যতা, স্বেচ্ছাচরিতা ও শির্ক [অর্থাৎ সার্বভৌম প্রভুত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বিশ্বজাহানের একচ্ছত্র মালিক ও প্রভু আল্লাহর সাথে আর কাউকে অংশীদার করা এবং নিজের বিশ্বস্ততা ও ইবাদাত বন্দেগীকে তাদের মধ্যে বিভক্ত করে দেয়া] থেকে বিরত রাখবেন এবং আসল ও প্রকৃত মালিকের নির্ভেজাল আনুগত্য, দাসত্ব, পূজা, আরাধনা ও ইবাদত করার আহবান জানাবেন।
দুঃখের বিষয়, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মিশনকে উপরে কুরআনে যেমন সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, বর্তমান ইনজীলে তেমনটি করা হয়নি। তবুও উপরে যে তিনটি মৌলিক বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে তা বিক্ষিপ্তভাবে ইশারা ইংগিতের আকারে হলেও বর্তমানে ইনজীলে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর দাওয়াত দিয়েছিলেন, একথা ইনজীলের নিন্মোক্ত ইংগিত থেকে সুস্পষ্ট হয়ঃ
তোমার ইশ্বর প্রভুকে প্রতিপাত [সিজদা] করো এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করো। [মথি ৪ : ১০]
তিনি যে কেবল এরি দাওয়াত দিয়েছিলেন তা নয়, বরং তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যেই ছিলো, আকাশ রাজ্যে যেমন সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন আল্লাহর নিরংকুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অনুরূপভাবে পৃথিবীতেও একমাত্র তাঁরই শরিয়াত আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
তোমার রাজ্য আসুক। তোমার ইচ্ছা যেমন আকাশে পূর্ণ হয় তেমনি পৃথিবীতেও পূর্ণ হোক। [মথি ৬:১০]
তাছাড়া হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজেকে নবী ও আসমানী রাজত্বের প্রতিনিধি হিসেবেই পেশ করতেন এবং এ হিসেবেই লোকদেরকে নিজের আনুগত্য করার দাওয়াত দিতেন। তাঁর ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্যগুলো থেকে জানা যায়, তিনি নিজের জন্মভূমি ‘নাসেরা’ [নাজারাথ] তে নিজের দাওয়াতের সূচনা করলে তাঁর আত্মীয় স্বজন ও শহরবাসীরাই তাঁর বিরোধীতায় নেমে পড়ে। এ সম্পর্কে মথি, মার্ক ‍ও লুক একযোগে বর্ণনা করেছেন যে, ‘নবী তাঁর স্বদেশে জনপ্রিয় হননা।” তারপর জেরুসালেমে যখন তাঁর হত্যাক চক্রান্ত চলতে লাগলো এবং লোকেরা তাঁকে অন্য কোথাও চলে যাবার পরামর্শ দিলো তখন তিনি জবাব দিলেনঃ “নবী জেরুসালেমের বাইরে মৃত্যুবরণ করবে, এটা সম্ভব নয়” [লুক ১৩:৩৩] শেষবার যখন তিনি জেরুসালেম প্রবেশ করছিলেন তখন তাঁর শিষ্যবর্গ উচ্চস্বরে বলতে লাগলোঃ “ধন্য সেই রাজা যিনি প্রভুর নামে আসছেন।” একথায় ইহুদী আলেমরা অসন্তুষ্ট হলেন এবং তারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে বললেনঃ “আপনার শিষ্যদের মুখ বন্ধ করুন।” হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বললেনঃ “ওরা যদি মুখ বন্ধ করে তাহলে পাথরগুলি চিৎকার করে উঠবে।” [লুক ১৯: ৩৮-৪০]
আর একবার তিনি বললেনঃ
হে শ্রমজীবিরা! হে ভারবহনে পিষ্ট লোকেরা! আমার কাছে এসো। আমি তোমাদের বিশ্রাম দান করবো। আমার জোয়াল তোমাদের কাঁধে উঠিয়ে নাও।——– আমার জোয়াল সহজে বহনীয় এবং আমার বোঝা হালকা। [মথি ১১: ১৮-৩০]
এছাড়া হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম মানব রচিত আইনের পরিবর্তে আল্লাহ প্রদত্ত আইনের আনুগত্য করতে চাইতেন একথাও মথি ও মার্কের বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়। তাদের বর্ণনার সার নির্যাস হচ্ছেঃ ইহুদী আলেমগণ অভিযোগ করলেন, আপনার শিষ্যরা পূর্ববর্তী সম্মানীয় বুযুর্গদের ঐতিহ্যের বিপরীত হাত না ধূয়েই আহার করে কেন? হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর জাবাবে বললেনঃ তোমাদের মতো রিয়াকারদের অবস্থা হচ্ছে ঠিক তেমনি যেমন হযরত ইয়ারয়া নবীর কণ্ঠে এ তিরস্কার করা হয়েছেঃ “এই উম্মত মুখে আমার প্রতি মর্যাদার বাণী উচ্চারণ করে, কিন্তু তাদের হৃদয় আমার থেকে দূরে। কারণ এরা মানব রচিত আইনের শিক্ষা দেয়।” তোমরা আল্লাহর হুকুমকে বাতিল করে থাকো এবং নিজেদের বানোয়াট আইনকে প্রতিষ্ঠিত রাখো। আল্লাহ তাওরাতের মধ্যমে তোমাদের হুকুম ‍দিয়েছিলেন, মা বাপের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো এবং যে ব্যক্তি মা বাপকে সম্মান করবেনা তার প্রাণানাশ করো। কিন্তু তোমরা বলছো যে ব্যক্তি মা বাপকে একথা বলে দেয়, আমার যে খিদমত তোমার কাজে লাগতে পারে তাকে আমি আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি, তার জন্য মা বাপের খিদমত না করা সম্পূর্ণ বৈধ। [মথি ১৫: ৩-৯, মার্ক ৭: ৫-১৩]
চ. “প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদের রব, যিনি আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি নিজের কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছেন। তিনি রাত দিয়ে দিনকে ঢেকে দেন তারপর রাতের পেছনে দিন দৌড়িয়ে আসে। তিনি সূর্য ও চন্দ্র ও তারকারাজী সৃষ্টি করেছেন। সবাই তাঁর নির্দেশের অনুগত। জেনে রাখো, সৃষ্টি তাঁরই এবং নির্দেশও তাঁরই। আল্লাহ বড়ই বরকতের অধিকারী। তিনি সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রতিপালক।” [সূরা আ’রাফঃ ৫৪]
আল্লাহর “কর্তৃত্বের আসণে সমাসীন হওয়া” র বিস্তারিত স্বরূপ অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে কঠিন। খুব সম্ভবত সমগ্র বিশ্বজাহান সৃষ্ট্রির পর মহান আল্লাহ কোনো একটি স্থানকে তাঁর এ অসীম সাম্রাজ্যের কেন্দ্র নির্ধারণ করেন এবং সেখানে নিজের আলোক রশ্মীর বিচ্ছুরণকে কেন্দ্রীভূম করে দেন আর তারই নাম দেন “আরশ” [কর্তৃত্বের আসন] সেখান থেকে সমগ্র বিশ্বজাহানে নব নব সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে ও ক্রমাগত শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটছে। সেই সাথে সৃষ্টি জগতের পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনাও অব্যাহত রয়েছে। আবার এও সম্ভব হতে পারে যে, আরশ অর্থ শাসন কর্তৃত্ব এবং আরশের ওপর সমাসীন হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ এ বিশ্বজাহান সৃষ্টি করার পর এর শাসনদন্ড নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। মোটকথা আরশের ওপর সমাসীন হওয়ার বিস্তারিত অর্থ যাই হোক না কেন মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ যে এ বিশ্বজগতের নিছক স্রষ্টাই নন বরং এর পরিচালক এবং ব্যবস্থাপকও সেকথা ভালোভাবে হৃদয়ংগম করানোই কুরআনে এর উল্লেখের আসল উদ্দেশ্য। তিনি এ দুনিয়াকে অস্তিত্বশীল করার পর এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোথাও বসে যাননি। বরং কার্যত তিনিই সারা বিশ্বজাহানের ছোট বড় প্রত্যেকটি বস্তুর ওপর কর্তৃত্ব করছেন। পরিচালনা ও শাসন কর্তৃত্বের যাবতীয় ক্ষমতা কার্যত তারই হাতে নিবদ্ধ। প্রতিটি বস্তু তাঁর নির্দেশের অনুগত। অতি ক্ষুদ্র অনু পরমাণুও তাঁর নির্দেশ মেনে চলে। প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর ভাগ্যই চিরন্তনভাবে তাঁর নির্দেশের সাথে যুক্ত। যে মৌলিক বিভ্রান্তিটির কারণে মানুষ কখনো শিরকের গোমরাহীতে লিপ্ত হয়েছে, আবার কখনো নিজেকে স্বাধীন ক্ষমতাসম্পন্ন ঘোষণা করার মতো ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কুরআন এভাবে তার মুলোৎপাটন করতে চায়। বিশ্বজাহানের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা থেকে আল্লাহকে কার্যত সম্পর্কহীন মনে করার অনিবার্য ফল দাঁড়ায় ‍দুটি। হয় মানুষ নিজের ভাগ্যকে অন্যের হাতে বন্দী মনে করবে এবং তার সামনে মাথা নতো করে দেবে অথবা নিজেকেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা মনে করবে এবং নিজেকে সর্বময় কর্তৃত্বশালী স্বাধীন সত্তা মনে করে কাজ করে যেতে থাকবে।
এখানে আরো একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। স্রষ্টা ও সৃষ্টির ম্যধকার সম্পর্ক সুস্পস্ট করার জন্য কুরআন মজীদে মানুষের ভাষা থেকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এমনসব শব্দ, পরিভাষা, উপমা ও বর্ণনাভংগী গ্রহণ করা হয়েছে, যা রাজত্ব ও শাসনের সাথে সম্পর্ক রাখে। এ বর্ণনাভংগী কুরআনে এতো বেশী স্পষ্ট যে, অর্থ বুঝে কুরআন পাঠকারী যেকোনো ব্যক্তিই এ বিষয়টি অনুভব না করে থাকতে পারবেননা। কোনো কোনো অর্বাচীন সমালোচক স্বীয় বিকৃত চিন্তা ও মানসিকতার কারণে ও বাচনভংগী থেকে বুঝেছেন যে, এ কিতাবটি যে যুগের ‘রচনা’ সে যুগে মানুষের মনমস্তিষ্কে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিলো। তাই এ কিতাবের রচয়িতা [এ বিবেকহীন নিন্দুকদের মতে এর রচয়িতা নাকি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আল্লাহকে একজন রাজা ও বাদশাহ হিসেবেই পেশ করেছেন। অথচ কুরআন যে শাশ্বত ও অনাদি অনন্ত সত্য উপস্থাপন করছে তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সে সত্যটি হচ্ছে, ভূমন্ডলে ও নভোমন্ডলে একমাত্র আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত। সার্বভৌমত্ব [Sovereignty] বলতে যা বুঝায় তা একমাত্র তারই সত্তার একচেটিয়া অধিাকর ও বৈশিষ্ট্য। আর বিশ্বজাহানের এ ব্যবস্থাপনা একটি পূর্ণাংগ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা বিশেষ, যেখানে ঐ একক সত্তা সমস্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। কাজেই এ ব্যবস্থার মধ্যে যে ব্যক্তি বা দল নিজের বা অন্য কারুর আংশিক বা পূর্ণ কর্তৃত্বের দাবীদার হয়, সে নিজেকে নিছক প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাছাড়া এ ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থান করে মানুষের পক্ষে ঐ একক সত্তাকে একই সাথে ধর্মীয় অর্থেও একমাত্র মা’বুদ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থেও একমাত্র শাসক [Sovereign] হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো সঠিক দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতি হতে পারেনা।
“আরশের উপর সমাসীন হলেন” বাক্যটির মাধ্যমে সংক্ষেপে যে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এখানে তারই কিছুটা অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ নিছক স্রষ্টাই নন, তিনি হুকুমকর্তা এবং শাসকও। তিনি সৃষ্টি করার পর নিজের সৃষ্ট বস্তুসমূহকে অন্যের কর্তৃত্বের সোপর্দ করে দেননি অথবা সমগ্র সৃষ্টিকে বা তার অংশ বিশেষকে ইচ্ছামতো চলার জন্য স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেননি। বরং কার্যত সমগ্র বিশ্বজগতের পরিচালনা ব্যবস্থা আল্লাহর নিজের হিতেই কেন্দ্রীভুত রয়েছে। দিন রাত্রির আবর্তন আপনা আপনিই হচ্ছেনা। বরং আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে। তিনি যখনই চাইবেন দিন ও রাতকে থামিয়ে দেবেন আবার যখনই চাইবেন এ ব্যবস্থা বদলে দেবেন। সূর্য, চন্দ্র, তারকা এরা কেউ নিজস্ব কোনো শক্তির অধিকারী নয়। বরং এরা সবাই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কর্তৃত্বাধীন। এরা একান্ত অনুগত দাসের মতো সেই কাজই করে যাচ্ছে যে কাজে আল্লাহ এদেরকে নিযুক্ত করেছেন।
ছ. “নিঃসন্দেহে আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেন।” [সূরা মায়েদাঃ ১]
অর্থাৎ আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক। তিনি নিজের ইচ্ছামতো যে কোনো হুকুম দেবার পূর্ণ ইখতিয়ার রাখেন। তাঁর নির্দেশ ও বিধানের ব্যাপারে কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য করার বা আপত্তি জানানোর কোনো অধিকার মানুষের নেই। তাঁর সমস্ত বিধান জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যুক্তি, ন্যায়নীতি ও কল্যাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঈমানদার মুসলিম যুক্তিসংগত, ন্যায়ানুগ ও কল্যাণকর বলেই তার আনুগত্য করেনা বরং একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর হুকুম বলেই তাঁর আনুগত্য করে। যে জিনিসটি তিনি হারাম করে দিয়েছেন তা কেবল তাঁর হারাম করে দেবার কারণেই হারাম হিসেবে গণ্য। আর ঠিক তেমনি যে জিনিসটি তিনি হালাল করে দিয়েছেন সেটির হালাল হবার পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই বরং যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ এসব জিনিসের মালিক তিনি নিজের দাসদের জন্য এ জিনিসটি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলেই এটি হালাল। তাই কুরআন মজীদ সর্বোচ্চ বলিষ্ঠতা সহকারে এ মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, কোনো বস্তুর হালাল ও হারাম হবার জন্য সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ভিত্তিরে আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহ যে কাজটিকে বৈধ গণ্য করেছেন সেটি বৈধ এবং যেটিকে অবৈধ গণ্য করেছেন সেটি অবৈধ, এছাড়া মানুষের জন্য কোনো কাজের বৈধ ও অবৈধ হবার দ্বিতীয় কোনো মানদন্ড নেই।
জ. “আর তোমাদের কণ্ঠ ভূয়া হুকুম জারী করে বলতে থাকে এটি হালাল এবং ওটি হারাম, এভাবে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করোনা। যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তারা কখনোই সফলকাম হবেনা। [সূরা আননাহলঃ ১১৬]
এ আয়াতটি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, হালাল ও হারাম করার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। অথবা অন্য কাথায়, একমাত্র আল্লাহই আইন প্রণেতা। অন্য যে ব্যক্তিই বৈধতা ও অবৈধতার ফয়সালা করার ধৃষ্টতা দেখাবে, সে নিজের সীমালংঘন করব। তাবে যদি সে আল্লাহর আইনকে অনুমতিপত্র হিসেবে মেনে নিয়ে তার ফরমানসমূহ থেকে প্রমান সংগ্রহ করে বলে, অমুক জিনিসটি অথবা কাজটি বৈধ এবং অমুকটি অবৈধ তাহলে তা হতে পারে। এভাবে নিজের হালাল ও হারাম করার স্বাধীন ক্ষমতাকে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ বলে অভিহিত করার কারণ হলো, যে ব্যক্তি এ ধরনের বিধান তৈরী করে তার এ কাজটি দুটি অবস্থার বাইরে যেতে পারেনা। হয় সে দাবী করছে যে, যে জিনিসকে সে আল্লাহর কিতাবের অনুমোদন ছাড়াই বৈধ বা অবৈধ বলছে তাকে আল্লাহ বৈধ বা অবৈধ করেছেন। অথবা তার দাবী হচ্ছে, আল্লাহর নিজের হালাল ও হারাম করার ক্ষমতা প্রত্যাহার করে মানুষকে স্বাধীনভাবে তার নিজের জীবনের শরীয়া তৈরী করার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। এ দুটি দাবীর মধ্য থেকে যেটিই সে করবে তা নিশ্চিতভাবেই মিথ্যাচার এবং আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ ছাড়া আর কিছুই হবেনা।
ঝ. “হে নবী তাদের বলো, তোমরা কি কখনো একথা চিন্তা করেছো যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যে রিযিক অবতীর্ণ করেছেন তার মধ্য থেকে তোমরা নিজেরাই কোনোটাকে হারাম ও কোনোটাকে হালাল করে নিয়েছো? নাকি তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছো?” [সূরা ইউনুসঃ ৫৯]
রিযিক বলতে আমাদের ভাষায় শুধুমাত্র পানাহারের জিনিসপত্র বুঝায়। এ কারণে লোকেরা মনে করে ধর্মীয় সংস্কার ও রসম রেওয়াজের ভিত্তিতে খাদ্য সামগ্রির ক্ষুদ্রতর পরিসরে লোকেরা যেসব আইন কানুন প্রণয়ন করে রেখেছে এখানে শুধুমাত্র তারই সমালোচনা করা হয়েছে। এ বিভ্রান্তিতে শুধুমাত্র অজ্ঞ অশিক্ষিত ও সাধারণ মানুষরাই ভুগছেনা, শিক্ষিত সমাজ এবং আলেমরাও এর শিকার হয়েছেন। অথচ আরবী ভাষায় রিযিক শব্দটি নিছক খাদ্যের অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং রকমারি দান, অনুদানও এর আওতাভুক্ত রয়েছে। আল্লাহ দুনিয়ায় মানুষকে যা কিছু দিয়েছেন তা সবই তাঁর রিযিক। এমনকি সন্তান সন্ততিও রিযিক। আসমাউর রিজাল তথা রাবীদের জীবনী গ্রন্থসমূহে রিযক, রুযাইক ও রিযকুল্লাহ নামে অসংখ্য রাবী পাওয়া যায়। আমাদের দেশে আল্লাহ বখশ, খোদা বখশ নামগুলো প্রায় এই একই অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটি বহুল প্রচলিত দোয়ার ভাষা হলোঃ
“হে আল্লাহ! সত্যকে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট করে দাও এবং আমাদের তার অনুসরণ করার রিযিক দাও।
প্রচলিত আরবী প্রবাদে বলা হয় অর্থাৎ رزق علما অর্থাৎ অমুক ব্যক্তিকে তাত্ত্বিক জ্ঞান দেয়া হয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহ প্রত্যেক গর্ভবতীর পেটে একজন ফেরেশতা পাঠান। তিনি ‍শিশুর রিযিক এবং তার আয়ু ও কর্ম লিখে দেন। এখানে রিযিক মানে শুধু খাদ্য নয়, যা ভূমিষ্ঠ হবার পরে এশিশু লাভ করবে। বরং এ দুনিয়ায় তাকে যা কিছু দেয়া হবে সবই রিযিকের অন্তরভুক্ত।
ঞ. “আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করেনা তারাই কাফির………..যালিম……….ফাসিক……..।” [সূরা মায়েদাঃ ৪৪-৪৭]
যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করেনা তাদের সম্পর্কে আল্লাহ এখানে তিনটি বিধান দিয়েছেন। এক, তারা কাফের। দুই, তারা যালিম। তিন, তারা ফাসিক। এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র হুকুম ও তাঁর নাযিল করা আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিতে ফয়সালা করে সে আসলে বড় ধরনের অপরাধ করে। প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহ্র হুকুম অস্বীকার করার শামিল। কাজেই এটি কুফরী। দ্বিতীয়ত তার এ কাজটি সুবিচার ও ভারসাম্যনীতের বিরোধী। কারণ, আল্লাহ্ পথার্থ ইনসাফ ও বারসাম্যনীতি অনুযায়ীই হুকুম দিয়েছিলেন। কাজেই আল্লাহ্র হুকুম থেকে সরে এসে যখন সে ফায়সালা করলো তখন সে আসলে যুলুম করলো। তৃতীয়ত, দাস হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করলো তখনই সে আসলে দাসত্ব ও আনুগত্যের গন্ডীর বাইরে পা রাখলো। আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসিকী। এ কুফরী, যুলুম ও ফাসিকী তার নিজের ধরন ও প্রকৃতির দিক দিয়ে অনিবার্যভাবেই পুরোপুরি আল্লাহ্র হুকুম অমান্যেরই বাস্তব রূপ। যেখনে আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করা হবে সেখানে এ তিনটি বিষয় থাকবেনা, এটা কোনোক্রমেই সম্বব নয়। তবে আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করার যেমন পর্যায়ভেদ আছে তেমনি এ তিনটি বিষয়েরও পর্যায়ভেদ আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ্র হুকুমকে ভুল এবং নিজের বা অন্য কোনো মানুষের হুকুমকে সঠিক মনে করে আল্লাহ্র হুকুম বিরোধী ফায়সালা করে সে পুরোপুরি কাফির, যালিম ও ফাসিক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্র হুকুমকে সত্য বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফালসালা করে, সে ইসলামী মিল্লাত বহির্ভুত না হলেও নিজের ঈমানকে কুফুরী, যুলুম ও ফাসিকীর সাথে মিশিয়ে ফেলছে। অনুরীপভাবে যে ব্যক্তি সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করে সে সকল ব্যাপারেই কাফির, ফাসিক ও যালিম। আর সে ব্যক্তি কিছু ব্যাপারে অনুগত এবং কিছু ব্যাপারে অবাধ্য তার জীরনে ঈমান ও ইসলাম এবং কুফরী , যুলুম ও ফাসিকীর মিশ্রণ ঠিক তেমনি হারে অবস্থান করছে যে হারে সে আনুগত্য ও অবাধ্যতাকে একসাথে মিশিয়ে রেখেছে। কোনো কোনো তাফসীরকার এ আয়াতগুলোকে আহ্লি কিতাবদের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত বলে গণ্য করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আল্লাহ্র কালামের শব্দের মধ্যে এ ধরনের ব্যাখ্যা করার কোনো অবকাশ নেই। হযরত হুযইফা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর বক্তব্যই এ ধরনের ব্যাখ্যার সঠিক ও সর্বোত্তম জবাব। তাঁকে একজন বলেছেলো এ আয়াত তিনটিতো বনী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। সে বুঝাতে চাচ্ছিলো যে, ইহুদীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আল্লাহ্র নাযিল করা হুকুমরে বিরুদ্ধে ফালসালা করে সে-ই কাফির, যালিম ও ফাসিক। একথা শুনে হযরত হুযাইফা বলে ওঠেনঃ
“এ বনী ইসরাঈল গোষ্ঠী তোমাদের কেমন চমৎকার ভাই, তিতোগুলো সব তাদের জন্য আর মিঠাগুলো সব তোমাদের জন্য। কখ্খনো নয়, আল্লাহ্র কসম তাদেরই পথে তোমরা কদম মিলিয়ে চলবে।”
আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের এটাই একেবারে গোড়ার কথা। এ বিষয়ে কুরআনের বিভিন্নস্থানে বক্তব্য এসেছে। আল্লাহ্ ছাড়া যাকেই স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী মানা হবে কুরআনের পরিভাষায় সে হলো তাগুত। আর এটা আল্লাহ্র দাসত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ট. “এখন যে কেই তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহ্র ওপর ঈমান আনে, সে এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরে, যা কখনো ছিন্ন হয়না। আর আল্লাহ্ [যাঁকে সে অবলম্বন হিসেবে আকড়ে ধরেছে] সবকিছু শোনেন ও জানেন।” [সূরা আল বাকারাঃ ২৫৬]
আভিধানিক অর্থে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে “তাগুত” বলা হবে, যে নিজের বৈধ অধিকারের সীমানা লংঘন করেছে। কুরআনের পরিভাষায় তাগুত এমন এক দাসকে বলা হয়, যে দাসত্বের সীমা অতিক্রম করে নিজেই প্রভু ও খোদা হবার দাবীদার সাজে এবং আল্লাহ্র বান্দাদেরকে নিজের দাসত্বে নিযুক্ত করে। আল্লাহ্র মোকাবিলায় বান্দার প্রভুত্বের দাবীদার সাজার এবং বিদ্রোহ করার তিনটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায় বান্দা নীতিগতভাবে আল্লাহ্র শাসন কর্তৃত্বকে সত্য বলে মেনে নেয় কিন্তু কার্যত তার বিধানের বিরুদ্ধাচারণ করে। একে বলা হয় ফাসেকী। দ্বিতীয় পর্যায়ে সে আল্লাহ্র শাসন কর্তৃত্বকে নীতিগতভাবে মেনে না নিয়ে নিজের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় অথবা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী ও দাসত্ব করতে থাকে। একে বলা হয় কুফ্রী। তৃতীয় পর্যায়ে সে মালিক ও প্রভুর বিরুদ্ধে ঘোষণা করে তার রাজ্যে এবং তার প্রজাদের বলা হয় “তাগুত।” কোনো ব্যক্তি এই তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কোনো দিন সঠিক অর্থে আল্লাহ্র মুমিন বান্দা হতে পারেনা।
অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ
“হে নবী! তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যারা এই মর্মে দাবী করে চলছে যে, তারা ঈমান এনেছে সেই কিতাবের প্রতি যা তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং সেইসব কিতাবের প্রতি যেগুলো তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছেলো; কিন্তু তারা নিজেদের বিষয়সমূহের ভায়সালা করার জন্য ‘তাগুতে’র দিকে ফিরতে চায়, অথচ তাদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছিলো তাগুতকে অস্বীকার করার।” [সূরা আননিসাঃ ৬০]
এখানে ‘তাগুত’ বলতে সুস্পষ্টভাবে এমন শাসককে বুঝানো হয়েছে, যে আল্লাহ্র আইন বাদ দিয়ে অন্য কোনো আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে এবং এমন বিচার ব্যবস্থাকে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহ্র সার্বভৌম ক্ষমতার আনুগত্য করেনা এবং আল্লাহ্র কিতাবকে চূড়ুন্ত সনদ [Final Authority] হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়না। কাজেই যে আদালত তাগুতের ভূমিকা পালন করছে, নিজের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালার জন্য তার কাছে উপস্থিত হওয়া যে একটি ঈমান বিরোধী কাজ , এ ব্যাপারে এ আয়াতটির বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর আল্লাহ্ ও তাঁর কিতাবের ওপর ঈমান আনার অপরিহার্য দাবী অনুযায়ী এই ধরনের আদালতকে বৈধ আদালত হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানানোই প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনা ও তাগুতকে অস্বীকার কার, এদুটি বিষয় পরস্পরের সাথে অংগাংগীভাবে সংযুক্ত এবং এদের একটি অন্যটির অনিবার্য পরিণতি। আল্লাহ্ ও তাগুত উভয়ের সামনে একই সাথে মাথা নতো করাই হচ্ছে সুস্পষ্ট মুনাফিকী।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে কুরআনের সার্বভৌমত্বের ধারণা হয়ে যায়। এই ধারণা অনুযায়ী সার্বভৌমত্বে মানুষের বিন্দুমাত্র অংশ থাকতে পারেনা। তাই কুরআনমানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহ্র প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেছে। আর প্রতিনিধির প্রকৃত মিশন এই বলে জানিয়েছে যে, সে পৃথিবীতে তার মালিকের নির্দেশ মাফিক কাজ করবে। এ বিষয়ের প্রতি ইংগিত করছে নিন্মেক্ত আয়াতঃ
“যখন তোমার প্রভূ ফেরেশতাদের বললেন আমি এ পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করবো”। [সূরা আলবাকারাঃ ৩০]
যে ব্যক্তি কারো অধিকারের আওতাধীনে তারাই অর্পিত ক্ষমতা ইখতিয়ার ব্যবহার করে, তাকে খলীফা বলে। খলীফা নিজে মালিক নয় বরং আসল মালিকের প্রতিনিধি। সে নিজে ক্ষমতা ব্যবহার করে। সে নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করার অধিকার রাখেনা। বরং মালিকের ইচ্ছে পূরণ করাই হয় তার কাজ। যদি সে নিজেকে মালিক মনে করে বসে এবং তার ওপর অর্পিত ক্ষমতাকে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে থাকে অথবা আসল মালিককে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে নিয়ে তারই ইচ্ছে পূরণ করতে এবং তার নির্দেশ পালন করতে থাকে, তাহলে এগুলো বসই বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য হবে।
৬. আনুগত্যের মূলনীতি্
উপরে বর্ণিত সার্বভৌমত্ব ও প্রতিনিধিত্বের স্বাভাবিক ও যৌক্তিক দাবী হলো, আনুগত্যও করতে হবে স্রষ্টার এবং স্রষ্টার নির্দেশের। বাকী সমস্ত আনুগত্য হবে এই মূল আনুগত্যের অনুগামী। এ মূলনীতিটি কুরআন এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
“হে ঈমানদারগণ, আনুগত্য করো আল্লাহ্র এবং আনুগত্য করো রসূলের আর সেইসব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও ক্ষমতার অধিকারী। এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যাপারে বিরোধ দেখা দেয়, তবে তা আল্লাহ্ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহ্ ও পরকালের ওপর ঈমান এনে থাকো। এটিই একটি সঠিক কর্মপদ্ধতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও এটিই উৎকৃষ্ট।” [সূরা আননিসাঃ ৫৯]
এ আয়াতটি ইসলামের সমগ্র ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের বুনিয়াদ। এটি একটি ইসলামী রাষ্ট্রের কশসনতন্ত্রের পয়লা নম্বর ধারা। এখানে নিম্নলিখিত মূলনীতিগুলি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া হয়েছেঃ
এক, ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় আসল আনুগত্য লাভের অধিকারী আল্লাহ্। একজন মুসলমানের সর্বপ্রথম পরিচয় হচ্ছে, সে আল্লাহ্র দাস। এরপর সে অন্যকিছু। মুসলমানের ব্যক্তিগত্য জীবন এবং মুসলমানদের সমাজ ব্যবস্থা উভয়ের কেন্দ্র ও লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ্র আনুগত্য করা ও বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর নির্দেশ মেনে চলা। অন্যান্য আনুগত্য ও অনুসৃতি কেবলমাত্র তখনই গৃহীত হবে যখন তা আল্লাহ্র আনুগত্য ও অনুসৃতির বিপরীত হবেনা, বরং তার অধীন ও অনুকূল হবে। অন্যথায় এই আসল ও মৌলিক আনুগত্য বিরোধী প্রতিটি আনুগত্য শৃংখলকে ভেংগে দূরে নিক্ষেপ করা হবে। একথাটিকেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিম্মোক্ত বক্তব্যে পেশ করেছেনঃ
“স্রষ্টার আনুগত্য পরিহার করে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবেনা।”
দুই, ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে, রসূলের আনুগত্য। এটি কোনো স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ আনুগত্য নয়। বরং আল্লাহ্র আনুগত্যের এটিই একমাত্র বাস্তব ও কার্যকর পদ্ধতি। রসূলের আনুগত্য এজন্য করতে হবে যে, আল্লাহ্র বিধান ও নির্দেশ আমাদের কাছে পৌছার তিনিই একমাত্র বিশ্বস্ত ও অকাট্য মাধ্যম। আমরা কেবলমাত্র রসূলের আনুগত্য করার পথেই আল্লাহ্র আনুগত্য করতে পারি। রসূলের সনদ ও প্রমাণপত্র ছাড়া আল্লাহ্র কোনো আনুগত্য গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। আর রসূলের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া আল্লাহ্র বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামান্তর। নিম্মোক্ত হাদীসে এই বক্তব্যটিই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছেঃ
“যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহ্র আনুগত্য করলো এবং যে ব্যক্তি আমার নাফরমানি করলো সে আসলে আল্লাহ্র নাফারমানি করলো।”
তিন, উপরোল্লিখিত দুটি আনুগত্যের পর তাঁদের অধীনে তৃতীয় আর একটি আনুগত্য ইসলামী জীবন ব্যবস্থার আওতাধীন মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব। সেটি হচ্ছে মুসলমানদের মধ্য থেকে ‘উলিল আমর’ তথা দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারীদের আনুগত্য। মুসলমানদের সামাজিক ও সামষ্টিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে দায়িত্বসম্পন্ন ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি মাত্রই ‘উলিল আমর’ এর অন্তর্ভুক্ত। তারা মুসলমানদের মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিকে ও চিন্তাগত ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী উলামায়েকিরাম বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হতে পারেন। আবার দেশের শাসনকার্য পরিচালনাকারী প্রশাসকগণ হতে পারেন, অথবা আদালতে বিচারের রায় প্রদানকারী বিচারপতি বা তামদ্দুনিক ও সামাজিক বিষয়ে গোত্র, মহল্লাও জনবসতির নেতৃত্বদানকারী শেখ সরদার প্রধানও হতে পারেন। মোটকথা কোনো ব্যক্তি যে কোনো পর্যায়েই মুসলমানদের নেতৃত্বদানকারী হবেন তিনি অবশ্যি আনুগত্য লাভের অধিকারী হবেন। তার সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে মুসলমানদের সামাজিক জীবনে বাধাবিপত্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করা যাবেনা। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, তাকে মুসলিম দলভুক্ত হতে হবে এবং আল্লাহ্ ও রসূলের অনুগত হতে হবে। এই আনুগত্যের জন্য এই শর্ত দুটি হচ্ছে অপরিহা্র্য ও বাধ্যতামূলক। কেবলমাত্র উল্লেখিত আয়াতটির মধ্যভাগেই এ সুস্পষ্ট শর্তটি সংশ্লিষ্ট হয়নি বরং হাদীসেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপূর্ণ ব্যাপকতার সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে এটি বর্ণনা করেছেন। যেমন নিন্মোক্ত হাদীসগুলি দেখা যেতে পারেঃ
“নিজের নেতৃবৃন্দের কথা শোনা ও মেনে চলা মুসলমানের জন্য অপরিহার্য, তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যে পর্যন্ত না তাকে আল্লাহ্র অবাধ্য হবার হুকৃম দেয়া হয়। আর যখন তাকে আল্লাহ্র অবাধ্য হবার হুকুম দেয়া হয় তখন তার কিছু শোনা ও আনুগত্য করা উচিত নয়।” [বুখারী ও মুসলিম]
“আল্লাহ্ ও রসূলের অবাধ্য হতে হবে এমন কোনো আনুগত্য নেই, আনুগত্য করতে হবে শুধুমাত্র “মারূফ” বা বৈধ ও সৎকাজে।” [বুখারী ও মুসলিম]
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমাদের ওপর এমনসব লোকও শাসক কর্তৃত্ব চালাবে যাদের অনেক কথাকে তোমরা ‘মারূফ’ [বৈধ] ও অনেক কথাকে ‘মুনকার’ [অবৈধ] পাবে। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি তাদের মুনকারের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবে, সে দায়মুক্ত হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি তা অপছন্দ করবে, সেও বেঁচে যাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্ট হয় এবং তার অনুসরণ করে সে পাকড়াও হবে।” সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে এ ধরনের শাসকদের শাসনামলে কি আমরা তাদের সথে যুদ্ধ করবোনা?” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দেনঃ “না” যতদিন তারা নামায পড়তে থাকবে [ততদিন তাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারবেনা।” [মুসলিম]
অর্থাৎ নামায পরিত্যাগ করা এমন একটি আলামত হিসেবে বিবেচিত হবে, যা থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যাবে যে, তারা আল্লাহ্ ও রসূলের আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ন্যায়সংগত হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
“তোমাদের নিকৃষ্টতম নেতা হচ্ছে তারা যারা তোমাদেরকে ঘৃণা করে এবং তোমরা তাদেরকে ঘৃণা করো, তোমরা তাদের প্রতি লানত বর্ষণ করতে থাকো এবং তারা তোমাদের প্রতি লানত বর্ষণ করতে থাকে। সাহাবাগণ আরজ করেন, হে আল্লাহ্র রসূর! যখন এ অবস্থায় সৃষ্টি হয় তখন কি আমরা্ তাদের মোকাবিলা করার জন্য মাথা তুলে দাঁড়াবোনা? জবাব দেনঃ না, যতদিন তারা তোমাদের মধ্যে নমায কায়েম করতে থাকবে! না, যতদিন তারা তোমাদের মধ্যে নামায কায়েম করতে থাকবে!” [মুসলিম]
এই হাদীসটি উপরে বর্ণিত শর্তটিকে আরো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। উপরের হাদীসটি থেকে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক ছিলো যে, যতদিন তারা ব্যক্তিগত জীবনে নামায পড়তে থাকবে ততদিন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যবেনা। কিন্তু এই হাদীসটি থেকে একথা জানা যায় যে, নামায পড়া মানে আসলে মুসলমানদের সমাজ জীবনে নামাযের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ কেবলমাত্র তাদের নিজেদের নিয়মিতভাবে নামায পড়াটাই যথেষ্ট হবেনা বরং সেই সংগে তাদের আওতাধীন যে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে সেখানেও কমপক্ষে ‘ইকামতে সালাত’ তথা নামায প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরী বিবেচিত হবে। তাদর রাষ্ট্রব্যবস্থা তার আসল প্রকৃতির দিক দিয়ে যে একটি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এটি হবে তারই একটি আলামত। অন্যথায় যদি এতোটুকুও না হয়, তাহলে এর অর্থ হবে, তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের শাসন ব্যবস্থাকে উল্টে ফেলার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালানো মুসলমানদের জন্য বৈধ হয়ে যাবে। এ কাথাটিকেই অন্য একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের থেকে অন্যান্য আরো বিভিন্ন বিষয়ের সাথে এ ব্যাপারেও অংগীকার নিয়েছেনঃ
“আমরা আমাদের সরদার ও শাসকদের সাথে ঝগড়া করবোনা, তবে যখন আমার তাদরে কাজে প্রকাশ্য কুফরী দেখতে পাবো যার উপস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ্র কাছে পেশ করার জন্য আমাদের কাছে প্রমাণ থাকবে।” [বুখারী ও মুসলিম]
চার, চতুর্থ যে মূলনীতিটি এ আয়াতটি থেকে স্থায়ী ও চূড়ান্তভাবে স্থিরীকৃত হয়েছে সেটি হলো, ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় আল্লাহ্র হুকুম ও রসূলের সুন্নাহ্ হচ্ছে মৌলিক আইন ও চূড়ান্ত সনদ [Fimal Authority]। মুসলমানদের মধ্যে অথবা মুসলিম সরকার ও প্রজাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে তার মীমাংসার জন্য কুরআন ও সুন্নাহ্র দিকে ফিরে আসতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহ এ ব্যাপারে যে ফায়সালা দেবে তার সামনে মাথা নতো করে দিতে হবে। এভাবে জীবনের সকল ব্যাপারে কুরআন ও রসূলের সুন্নাহকে সনদ, চূড়ান্ত ফায়সালা ও শেষ কথা হিসেবে মেনে নেয়অর বিষয়টি ইসলমী জীবন ব্যবস্থার এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা তাকে কুফরী জীবন ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়। যে ব্যবস্থায় এ জিনিসটি অনুপস্থির থাকে সেটি আসলে একটি অনৈসলামী ব্যবস্থা।
এ প্রসংগে কউ কেউ সংশয় প্রকাশ করে বলে থাকেন যে, জীবনের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালার জন্য কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়া কিভাবে সম্ভব হতে পারে? কারণ মিউনিসিপ্যালিটি, রেলওয়ে, ডাকঘর ইত্যাদি অসংখ্য বিষয় সম্পর্কিত কোনো নিয়ম কানুনের উল্লেখই সেখনে নেই। কিন্তু এ সংশয়টি আসলে দীনের মূলনীতি সঠিকভাবে অনুধাবন না করার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। একজন মুসলমানকে একজন কাফির থেকে যে বিষয়টি আলাদা ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে সেটি হচ্ছে, কাফির অবাধ স্বাধীনতার দাবীদার। আর মুসলমান মূলত আল্লাহ্র বান্দাহ ও দাস হবার পর তার রব মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তাকে যতোটুকু স্বাধীনতা দান করেছেন, সে শুধুমাত্র ততোটুকু স্বাধীনতাই ভোগ করে। কাফির তার নিজের তৈরী মূলনীতি ও আইন বিধানের মাধ্যমে তার যাবতীয় বিষয়ের মীমাংসা করে। এইসব মূলনীতি ও বিধানের ক্ষেত্রে কোনো ঐশী সমর্থন ও স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে বলে সে মনে করেনা এবং নিজেকে সে এর মুখাপেক্ষীও ভাবেনা। বিপরীত পক্ষে মুসলমান তার প্রতিটি ব্যাপারে সর্বপ্রথম আল্লাহ ও তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিকে ফিরে যায়। সেখান থেকে কোনো নির্দেশ পেলে সে তার অনুসরণ করে। আর কোনো নির্দেশ না পেলে কেবলমাত্র এই অবস্থায়ই সে স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করে। এক্ষেত্রে তার এই কর্মের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি একথার ওপরই স্থাপিত হয় যে, এই তিনি এক্ষেত্রে কর্মের স্বাধীনতা প্রদান করেছেন।
কুরআন মজীদ যেহেতু নিছক একটি আইনের কিতাব মাত্র নয় বরং একই সংগে এটি একটি শিক্ষা ও উপদেশমূলক গ্রন্থও, তাই প্রথম বাক্যে যে আইনগত মূলনীতির বিবরণ দেয়া হয়েছিলো এই দ্বিতীয় বাক্যে তার অন্তর্নিহিত কারণ ও যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে দুটি কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, উপরোল্লিখিত চারটি মূলনীতি মেনে চলা ঈমানের অপরিহার্য দাবী। একদিকে মুসলমান হবার দাবী করা এবং অন্যদিকে এই মূলনীতিগুলো উপেক্ষা করা, এ দুটি পরস্পর বিরোধী জিনিসের কখনো একত্র সমাবেশ হতে পারেনা। দ্বিতীয়ত, এই মূলনীতিগুলির ভিত্তিতে নিজেদের জীবন বিধান নির্মাণ করার মধ্যেই মুসলমানদের কল্যাণ নিহিত। কেবলমাত্র এই একটি জিনিসই তাদেরকে দুনিয়ায় সত্য সরল পথের ওপর প্রতিষ্ঠত রাখতে পারে এবং এর সাধ্যমেই তারা পরকালেও সফলকাম হতে পারে। যে ভাষণে ইহুদিদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার ওপর মন্তব্য করা হচ্ছিলো এই উপদেশ বাণীটি ঠিক তার শেষে উক্ত হয়েছে। এভাবে অত্যন্ত সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে মুসলমানদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মত দীনের এই মূলনীতিগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে যেভাবে অধপতনের গভীর হর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তা থেকে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। যখন কোনো জনগোষ্ঠী আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর রসূলের হিদায়াত পেছনে ফেলে দিয়ে এমনসব নেতা ও সরদারের আনুগত্য করতে থাকে, যারা আল্লাহ্ ও রসূলের হুকুম মেনে চলোনা এবং নিজেদের ধর্মীয় নেতা ও রাষ্ট্রীয় শাসকাদের কাছে কুরআন ও সুন্নাহর সনদ ও প্রমাণপত্র জিজ্ঞেস না করেই তাদের আনুগত্য করেত থাকে তখন তারনা এই বনী ইসরাঈলদের মতোই অসৎ ও অনিষ্টকর কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে এমনসব দোষত্রুটি সৃষ্টি হয়ে যায়, যার হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা কোনোক্রমেই সম্ভবপর নয়।

Page 4 of 16
Prev1...345...16Next

© Bangladesh Jamaat-e-Islami

  • আমাদের সম্পর্কে
  • প্রাইভেসি পলিসি
  • যোগাযোগ
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস

@BJI Dhaka City South