চতুর্থ অধ্যায়
খিলাফতের তাৎপর্য
এটা কেবল ইসলামের রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগিই নয়, বরঞ্চ গোটা ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় মানুষ আল্লাহ্র প্রতিনিধি হবার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিগত অধ্যায়গুলোতে ইসলামরে রাজনৈতিক দর্শনের উপর যেসব কথা বলা হয়েছে, তাতেও এই ধারণা কেন্দ্রীয় গুরুত্বের মর্যাদা লাভ করেছে। এ নিবন্ধে খিলাফত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। এখানে নিবন্ধটির শেষাংশ উদ্ধত করা হলো। মাওলানার এ নিবন্ধটি তরজমানুল কুরআন ফেব্রুয়ারী ১৯৩৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। -সংকলক
খিলাফতের তাৎপর্য
কুরআনের দিক নির্দেশনা
এবার আমি কুরআনের কতিপয় দিক নির্দেশনার দিকে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করবো। এ থেকে জানা যাবে, মানুষকে যে খিলাফত দান করা হয়েছে তা আসলে আল্লাহ্রই খিলাফত।
কুরআন বলছে, আল্লাহ্ মানুষকে সর্বোত্তম কাঠামো দিয়ে সৃষ্টি করেছেনঃ
তাকে তিনি নিজই তৈরী করেছেন। [সূরা ত্বীনঃ ৪]
তিনি নিজের পক্ষ থেকে তার মধ্যে রূহ সঞ্চারিত করেছেন। [সূরা সোয়াদঃ ৭৫]
তাকে জ্ঞানের মত সম্পদে সমৃদ্ধ করেছেন। [সূরা সিজদাঃ ৯]
আকাশ ও পৃথিবীর সকল জিনিসকে তার অনুগত ও অধীনস্থ করে দিয়েছেন। [সূরা আল-বাকারাঃ ৩১]
এই সমস্ত গুণ বৈশিষ্ট্য সহকারে মানুষকে যখন সৃষ্টি করা হলো, তখন আল্লাহ্ ফেরেশতাদেরকে তার সামনে সিজাদা করার নির্দেশ দিলেন। [সূরা জাসিয়াঃ ১৩]
এ নির্দেশটা সূরা সোয়াদের শেষাংশে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তা বিশেষভাবে বিবেচনার দাবী রাখেঃ
“যখন তোমার প্রভু ফেরেমতাদের বললেন, আমি মাটি দিয়ে মানুষ সুষ্টি করতে যাচ্ছি। সেটা যখন সম্পূর্ণরূপে বানানো হয়ে যাবে এবং তাতে আমি নিজের হতে আত্মা সঞ্চারিত করবো, তখন তোমরা তার সামনে সিজাদায় পতিত হয়ো। অতপর সকল ফেরেশতা সিজদা করলো। কিন্তু ইসলীস সিজদা করলোনা। সে দাম্ভিকতায় লিপ্ত হলো এবং আদেশ লংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। আল্লাহ্ বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে গড়লাম, তাকে সিজদা করতে তোমাকে বাধা দিলো কিসে? তুমি কি নিজেকে খুব বড় মনে করে বসেছো, না সত্যই বড় কিছু হয়ে গেছো? সে বললো, আমি ওর চেয়ে ভালো। তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছো আর ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে। তখন আল্লাহ্ বললেনঃ “তুই এখান থেকে বেরিয়ে যা। কেননা তুই ধিক্কৃত।” [সূরা সোয়াদঃ ৭১-৭৭]
এ আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায়, মানুষকে সিজদা করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো তার কারণ এই ছিলো যে, আল্লাহ্ তাকে স্বহস্তে নির্মান করেছিলেন, অর্থাৎ সে ছিলো আল্লাহ্র অসীম ক্ষমতা ও শিল্প নৈপুণ্যের চূড়ান্ত প্রতীক। আর তার ভেতরে তিনি নিজের পক্ষ থেকে একটা অসাধারণ রূহ সঞ্চারিত করেছিলেন এবং যে গুণাবলী সর্বোচ্চ মাত্রয় স্বয়ং আল্লাহ্র মধ্যেই পাওয়া যায়, সেই গুণাবলীই সীমিত মাত্রায় তার মধ্যে সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। এরূপ মর্যাদা ও গুণবৈশিষ্ট্য সহকারে মানুষকে সৃষ্টি করার পর ঘোষণা করা হলো, আমি তাকে পৃথিবীতে খলীফা নিয়োগ করতে যাচ্ছি। সূরা বাকারার চতুর্থ রুকুতে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। ফেরেশতারা এ ব্যাপারে নিজেদের কিছু সন্দেহ সংশয় প্রকাশ করলে আল্লাহ্ তাদের সামনে মানুষের শ্রেষ্ঠতম বৈশিষ্ট্য জ্ঞানের প্রদর্শনী করলেন। এভাবে খিলাফতের জন্য মানুষের যোগ্যতা প্রমাণিত করার পর ফেরেশতাদের হুকুম দেয়া হলো, তার খিলাফত মেনে নাও এবং মেনে নেয়ার আলামত হিসেবে তাকে সিজদা করো। সকল ফেরেশতা মেনে নিলেন এবং সিজদা করলেন। কিন্তু শয়তান তার খিলাফত প্রত্যাখ্যান করলো এবং দরবার থেকে বিতাড়িত হলো।
এথেকে কি বুঝা গেলো? এ দ্বারা সকল সৃষ্টির ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা হলো। আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা হলো। বলা হলো, মানুষ আমার গুণাবলীর পূর্ণতম ও উৎকৃষ্টতম বাহক এবং তার মধ্যে আমি নিজের পক্ষ থেকে বিশেষ রূহ সঞ্চারিত করেছি। তাকে সিজদা করার নির্দেশ দেয়া হলো, তাও আর কাউকে নয় ফেরেশতাদেরকে। এসব করার সাথে সাথে তাকে খলীফা বানানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হলো। এতো প্রস্তুতি ও আড়ম্বর সহকারে যে খলীফার খিলাফত ঘোষিত হলো, সে কি কেবল পৃথিবীর আদিম অধিবাসীদেরই খলীফা ছিলো? ব্যাপার যদি কেবল এতাটুকুই হয়ে থাকে যে, প্রাচীন অধিবাসীর জায়গায় অন্য এক অধিবাসীকে অধিষ্ঠিত করা হচ্ছে, তাহলে ফেরেশতাদের সামনে তার খিলাফতের ঘোষণা দেয়া এবং এভাবে তার শ্রেষ্ঠত্ব যাহির করার কি দরকার ছিলো? আর ফেরেশতাদেরকে এ নির্দেশই বা দেয়া হলো কেন যে, ভূমন্ডলের এই নতুন অধিবাসীকে যে কি না কেবল অন্যদের পরিত্যক্ত জায়গায় বসতি স্থাপন করতে যাচ্ছিলো সিজদা করো?
আল্লাহ্র খিলাফতের মর্ম কি?
পবিত্র কুরআনের অন্যত্র অন্য যে উক্তিটি করা হয়েছে, তা আল্লাহ্র খিলাফতের মার্ম কি সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট আলোকপাত করে। আল্লাহ্ বলেনঃ
“আমি আকাশ, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বতের কাছে এ আমানত পেশ করেছিলাম, কিন্তু তারা কেউ এর ভার গ্রহণ করতে সম্মত হয়নি এবং তারা ভয় পেয়ে যায়। এর ভার মানুষ গ্রহণ করলো। বস্তুত সে যালেম ও অপরিণামদর্শী সাব্যস্ত হয়েছে।” [সূরা আহযাবঃ ৭৩]
এ আয়াতে আমানতের অর্থ নির্বাচনের স্বাধীনতা [Freedom of choic] এবং দায়িত্ব ও জবাবদিহী [Responsibility] আল্লাহ্র এ উক্তির মর্মার্থ হলো, আকাশ, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বতের এ দায়িত্বের গুরুভার গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিলোনা। মানুষের পূর্বে এ দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো সৃষ্টিরই অস্তিত্ব ছিলোনা। অবশেষে মানুষের আবির্ভাব ঘটলো এবং সে এ দায়িত্ব গ্রহণ করলো। এ বক্তব্য থেকে কয়েকটি তথ্য জানা যায়ঃ
১. মানুষের পূর্বে আকাশ ও পৃথিবীতে কোনো সৃষ্টি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। মানুষই এ দায়িত্ব গ্রহণকারী প্রথম সৃষ্টি। সুতরাং আমানত গ্রহণের ক্ষেত্রে সে কারো স্থালাভিষিক্ত [Successor] নয়।
২. সূরা বাকারায় যে জিনিসকে খিলাফত বলা হয়েছে এখানে ‘আমানত’ শব্দ দ্বারা সেটাই বুঝানো হয়েছে। কেননা সেখানে ফেরেশতাদের সামনে প্রমাণ করে দেয়া হয়েছিলো যে, তারা খিলাফতের উপযুক্ত নয়, মানুষই তার উপযুক্ত। আর এখানে বলা হয়েছে যে, আকাশ ও পৃথিবীর কোনো সৃষ্টি আমার আমানতের ভার কাঁধে নেয়ার যোগ্য ছিলোনা, শুধু মানুষই তা বহন করতে পেরেছে।
৩. খিলাফতের তাৎপর্য আমানত শব্দ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায়। আর এই দু’টো শব্দ একত্রে বিশ্ব প্রকৃতির অবকাঠামোতে মানুষের প্রকৃত অবস্থান নির্দেশ করে। মানুষ হলো পৃথিবীর শাসক ও পরিচালক। তবে তার এই শাসনকর্তৃত্ব মৌলিক নয়, বরং অর্পিত [Delegated] । সুতরাং আল্লাহ্ তার ওপর অর্পিত ক্ষমতা ও দায়িত্বকে [Delegated power] আমানত বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ এই অর্পিত ক্ষমতাকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই ব্যবহার করে বলে তাকে খলীফা [Vicegerent] বলা হয়েছে। এ হিসেবে খলীফা বলতে সে ব্যক্তিকে বুঝায়, যে কারো অর্পিত বা প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে। [Person exercising delegated power] [তরজমানুল কুরআন, জ্বিলকদ ১৩৫৩ হিঃ ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৫]