দশম অধ্যায়
ইসলামে আইন প্রণয়ন ও ইজতিহাদ
১. ইসলামে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র এবং তাতে ইজতিহাদের গুরুত্ব
২. কয়েকটি অভিযোগ ও তার জবাব
৩. আইন প্রণয়ন শূরা ও ইজমা
৪. ইসলামী ব্যবস্থায় বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঠিক পন্থা
১৯৫৮ সালের জানুয়ারীতে লাহোরে আন্তর্জাতিক ইসলামী মজলিশে মুযাকিরা’র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদ এবং সারাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদগণ অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনেরই একটি অধিবেশনে (৩০ জানুয়ারী ১৯৫৮) মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী আইন প্রণয়ণ ও ইজতিহাদ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এ প্রবন্ধটি অর্থাৎ “ইসলামী রাষ্ট্রে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা” আমাদের এই গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। তাই ওটিকে এখানে সংকলিত করে দেয়া হলো। প্রবন্ধের শেষে সেই প্রশ্নমালার জবাবও দিয়ে দেয়া হলো, যা জনৈক প্রগতিবাদীর জবাবে মাওলানা মওদূদী লিখেছিলেন। প্রসংগক্রমে সেসব আলোচনাও এখানে পেশ করা হলো যেগুলো আইনের ব্যাখ্যার সাথে সম্পর্কিত। সংকলক।
১. ইসলামে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এবং তাতে ইজতিহাদের গুরুত্ব [লেখক এই প্রবন্ধটি ১৯৫৮ সালের ৩ জানুয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে পাঠ করেন।]
ইসলামে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কতোটুকু এবং তাতে ইজতিহাদের কতোটা গুরুত্ব আছে তা অনুধাবন করার জন্য সর্বপ্রথম আমাদের দৃষ্টির সামনে দুটি বিষয় পরিষ্কার থাকা দরকারঃ এক, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও দুই, নবূয়্যতে মুহাম্মদী।
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
ইসলামে সার্বভৌমত্ব নির্ভেজালভাবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য স্বীকৃত। কুরআন মজীদ তৌহিদের আকীদার যে বিশ্লেষণ করেছে তার আলোকে এক এবং অদ্বিতীয় লা-শরীক আল্লাহ কেবল ধর্মীয় অর্থেই মা’বুদ নন বরং রাজনৈতিক এবং আইনগত অর্থের দিক থেকেও তিনি একচ্ছত্র অধিপতি, আদেশ নিষেধের অধিকারী এবং আইন প্রদানকারী। আল্লাহ তায়ালার এই আইনগত সার্বভৌমত্ব [Legal Sovereignty] কুরআন এতোটা পরিষ্কারভাবে এবং এতোটা জোরের সাথে পেশ করে যতোটা জোরের সাথে এবং পরিষ্কারভাবে তাঁর ধর্মীয় সার্বভৌমত্বের আকীদা পেশ করে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর এদুটি মর্যাদা তাঁর উলুহিয়াতের [খোদায়ী] অবশ্যম্ভাবী ফল। এর একটিকে অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়না। এর কোনো একটিকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর উলুহিয়াতকে অস্বীকার করা। তাছাড়া ইসলাম এরূপ সন্দেহ করারও কোনো অবকাশ রেখেনি যে, খোদায়ী কানুন বলতে হয়তো প্রাকৃতিক বিধানকে বুঝানো হয়েছে। পক্ষান্তরে ইসলামের গোটা দাওয়াতের ভিত্তি এই যে, মানুষ তার নৈতিক এবং সামাজিক জীবনে আল্লাহর সেই শরয়ী আইন স্বীকার করে নেবে যা তিনি তাঁর নবীদের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। এই শরয়ী আইন মেনে নেয়া এবং এর সামনে নিজের স্বাধীন সত্তাকে বিলিয়ে দেয়ার নাম তিনি ইসলাম [Surrender] রেখেছেন এবং এখানে যেসব ব্যাপারে ফায়সালা আল্লাহ এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করে দিয়েছেন সেসব ক্ষেত্রে মানুষের ফায়সালা করার অধিকার অস্বীকার করা হয়েছেঃ
“আল্লাহ এবং তাঁর রসূল যখন কোনো ব্যাপারে ফায়সালা করে দেন তখন কোনো মুমিন পুরুষ বা নরীর নিজের সে ব্যাপারে ভিন্নরূপ ফায়সালা করার অধিকার নেই। আর যেব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হয়, সে নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হলো।” [সূরা আহযাবঃ ৩৬]
নবূয়্যত মুহাম্মাদী
আল্লাহর একত্ববাদের মতো দ্বিতীয় যে জিনিসটি ইসলামে মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী তা হচ্ছে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সর্বশেষ নবী। মূলত এই সেই জিনিস যার বদৌলতে আল্লাহর একত্ববাদের আকীদা শুধু কল্পনা বিলাসের পরিবর্তে একটি বাস্তব ব্যবস্থার রূপ লাভ করে এবং এর উপরই ইসলামের গোটা জীবন ব্যবস্থার ইমারত নির্মিত হয়েছে। এই আকীদার আলোকে পূর্ববর্তী সমস্ত নবীর আনীত শিক্ষা অনেক পরিবর্ধন সহকারে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেয়া শিক্ষার মধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে। এজন্য খোদায়ী হিদায়াত এবং শরীয়তের স্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য উৎস এখন কেবল এই একটিই এবং ভবিষ্যতেও এমন আর কোনো হিদায়াত এবং শরীয়তের আগমন ঘটবেনা যে দিকে মানুষের প্রত্যাবর্তন করা জরুরী হতে পারে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই শিক্ষাই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন [Supreme Law] যা মহান বিচারক আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে। এই বিধান আমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দুই আকারে পেয়েছি। এক, কুরআন মজীদ, যা অক্ষরে অক্ষরে মহাবিশ্বের প্রতিপালক নির্দেশ ও হিদায়াতের সমষ্টি। দুই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উসওয়ায়ে হাসানা বা উত্তম আদর্শ তাঁর সুন্নাহ, যা কুরআনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যর ব্যাখ্যা প্রদান করে।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু আল্লাহর বাণীর ধারকই ছিলেননা যে, কিতাব পৌছে দেয়া ছাড়া তাঁর কোনো কাজ ছিলোনা। তিনি তাঁর নিযুক্ত পথপ্রদর্শক, আইনপ্রণেতা এবং শিক্ষকও ছিলেনা। তাঁর দায়িত্ব ছিলো এই যে, তিনি নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহর বিধানের ব্যাখ্যা পেশ করবেন, তার সঠিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করবেন, এই উদ্দেশ্য মুতাবিক লোকদের প্রশিক্ষণ দেবেন, অতপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদেরকে একটি সুসংগঠিত জামায়াতের রূপ দিয়ে সমাজের সংস্কার সাধনের চেষ্টা করবেন, অতপর এই সংশোধিত সমাজকে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের রূপ দান করে দেখিয়ে দেবেন যে, ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে একটি পূর্নাংগ সভ্যতার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা কিভাবে কায়েম হতে পারে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এই গোটা কাজ যা তিনি নিজের তেইশ বছরের নবূয়্যতী জীবনে আঞ্জাম দিয়েছেন-সেই সুন্নাহ যা কুরআনের সাথে মিলিয়ে হয়ে মহান আল্লাহর উচ্চতর আইনকে বাস্তাব রূপদান ও পরিপূর্ণ করে। ইসলামের পরিভাষায় এই উচ্চতর আইনের নামই হচ্ছে শরীয়া।
আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে
স্থুল দৃষ্টি সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি এ মৌলিক সত্যটি শুনার পর ধারণা করতে পারে যে, এ অবস্থায় কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে মানবীয় আইন প্রণয়ন করার মোটেই কোনো সুযোগ নেই। কেননা এখানে তো আইনদাতা হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। আর মুসলমানদের কাজ হচ্ছে কেবল নবীর মাধ্যমে দেয়া আল্লাহর এই আইনের আনুগত্য করে যাওয়া। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো, ইসলাম মানুষের আইন প্রণয়নকে চূড়ান্তভাবেই নিষিদ্ধ করে দেয়না বরং তাকে আল্লাহর আইনের প্রাধান্যের দ্বারা সীমাবদ্ধ করে দেয়। এই সর্বোচ্চ আইনের অধীনে এবং তার নির্ধারিত সীমার মধ্যে মানুষের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র কি তা আমি এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করছিঃ
আইনের ব্যাখ্যা
মানুষের ব্যবহারিক জীবনের যাবতীয় বিষয়ের মধ্যে এক ধরনের বিষয় এমন রয়েছে, যে সম্পর্কে কুরআন এবং সুন্নাহ সুস্পষ্ট এবং চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে, অথবা কোনো বিশেষ মূলনীতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এ ধরনের বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো ফকীহ কোনো কাযী [বিচারক] অথবা কোনো আইন প্রণয়নকারী সংস্থা শরীয়ার দেয়া নির্দেশ অথবা তার নির্ধারিত মূলনীতি পরিবর্তন করতে পারেনা। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এর মধ্যে আইন প্রণয়নের কোন সুযোগই নেই। এ অবস্থায় মানুষের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে হচ্ছে এই যে, প্রথমে সঠিকভাবে জানতে হবে আসলে নির্দেশটি কি? অতপর তার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য নির্ধারণ করতে হবে এবং কোন অবস্থা ও ঘটনার জন্য এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা অনুসন্ধান করতে হবে। অতপর বাস্তব ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারে তার উপর এই নির্দেশ প্রয়োগের পন্থা এবং সংক্ষিপ্ত নির্দেশের আনুসংগিক ব্যাখ্যা করতে হবে। সাথে সাথে এও নির্ধারণ করতে হবে যে, ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থা ও পরিস্থিতিতে এসব নির্দেশ ও মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ কোথায় এবং কোন সীমা পর্যন্ত রয়েছে।
কিয়াস
দ্বিতীয় প্রকারের বিষয় হলো, যে সম্পর্কে শরীয়া সরাসরি কোনো নির্দেশ দেয়নি কিন্তু তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে শরীয়া একটি নির্দেশ দান করে। এ ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের কাজ এভাবে হবে যে, নির্দেশের কারণসমূহ সঠিকভাবে উপলব্ধি করে যেসব ক্ষেত্রে বাস্তবিকপক্ষেই এই কারণসমূহ পাওয়া যাবে সেখানে এই জারী করতে হবে এবং যেসব ক্ষেত্রে বাস্তবিকই এই কারণসমূহ পাওয়া যাবেনা সেগুলোকে এ থেকে স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করতে হবে।
ইস্তিন্বাত [বিধান নির্গতকরণ]
এমন এক প্রকারের বিষয়ও রয়েছে যেখানে শরীয়া নির্ধারিত কোনো হুকুম নেই বরং কতিপয় সংক্ষিপ্ত কিন্তু পূর্নাংগ মূলনীতি দান করা হয়েছে। অথবা শরীয়তদাতা এই উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন যে, কোন জিনিস পছন্দনীয় যার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন এবং কোন জিনিস অপছন্দনীয় যার বিলুপ্ত হওয়া প্রয়োজন। এরূপ ব্যাপারে আইন প্রণয়নের কাজ হচ্ছে এই যে, শরীয়তের এই মূলনীতিসমূহ ও শরীয়াতদাতার এই উদ্দেশ্যেকে অনুধাবন করতে হবে এবং বাস্তব সমস্যার সমাধানের জন্য এমন আইন কানুন প্রণয়ন করতে হবে যার ভিত্তি এই মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং শরীয়াতদাতার উদ্দেশ্যও পূর্ণ করবে।
স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র
উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহ ছাড়াও এমন অনেক বিষয় রয়েছে যে সম্পর্কে শরীয়া সম্পূর্ণ নীরব, এ সম্পর্কে সরাসরি কোনো হুকুমও দেয়না এবং এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে শরীয়াতে এমন কোনো নির্দেশও পাওয়া যায় না যার উপর এটাকে কিয়াস করা যেতে পারে। এই নীরবতা স্বয়ং একথার প্রমাণ বহন করে যে, মহান আইনদাতা আল্লাহ এ ক্ষেত্রে মানুষকে নিজের রায় প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দিচ্ছেন। এজন্য এ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। কিন্তু এই আইন প্রণয়নের কাজ এমনভাবে হতে হবে যেনো তা ইসলামের প্রাণশক্তি এবং তার সাধারণ মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তার মেজাজ প্রকৃতি ইসলামের মেজাজ প্রকৃতির বিপরীত না হয় এবং তা যেনো ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় সঠিকভাবে সংস্থাপিত হতে পারে।
ইজতিহাদ [গবেষণা]
আইন প্রণয়নের এসব কাজ-যা ইসলামের আইন ব্যবস্থাকে গতিশীল রাখে এবং যুগের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সাথে তার ক্রমবিকাশে সহায়তা করে- এক বিশেষ ইলমী তাহকীক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। ইসলামের পরিভাষায় একে বলে ইজতিহাদ’। এই শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “কোনো কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করা।” কিন্তু এর পরিভাষিক অর্থ হচ্ছে- “আলোচ্য কোনো বিষয়ে ইসলামের নির্দেশ অথবা তার উদ্দেশ্য কি তা জানার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করা।” কোনো কোনো লোক ভ্রান্তির শিকার হয়ে মতের সম্পূর্ণ স্বাধীন ব্যবহারকে ইজতিহাদের অর্থের মধ্যে গণ্য করে থাকে। ইসলামী আইনের স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত এমন কোনো ব্যক্তি এই ভুল ধারণায় পতিত হতে পারেনা যে, এই ধরনের একটি আইন ব্যবস্থায় স্বাধীন ইজতিহাদের কোনো অবকাশ থাকতে পারে। এখানে তো আইনের উৎস হচ্ছে কুরআন এবং হাদীস। মানুষ যে আইন প্রণয়ন করতে পারে তা অপরিহার্যরূপে- হয় আইনের উৎস থেকে গৃহীত হতে হবে অথবা যে সীমা পর্যন্ত সে স্বাধীন মত প্রয়োগের সুযোগ দেয় তা সেই সীমার মধ্যে প্রণীত হতে হবে। এই বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করে যে ইজতিহাদ করা হবে, তা না ইসলামী ইজতিহাদ আর না ইসলামী আইন ব্যবস্থায় তার কোনো স্থান আছে।
ইজতিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী
ইজতিহাদের উদ্দেশ্য যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত আইনকে মানব রচিত আইনের দ্বারা পরিবর্তন করা নয় বরং তাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা এবং আইন পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের আইন ব্যবস্থাকে যুগের গতির সাথে গতিশীল করে তোলা- এজন্য আমাদের আইন প্রণয়নকারীদের মধ্যে নিম্নেক্ত গুণাবলী বর্তমান না থাকলে কোনো সঠিক এবং সুস্থ ইজতিহাদ হতে পারেনাঃ
১. আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়তের উপর ঈমান, তা সত্য হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস, তা অনুসরণ করার একনিষ্ঠ সংকল্প, তার বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার খায়েশ না থাকা এবং উদ্দেশ্য, মূলনীতি মূল্যবোধ অন্য কোনো উৎস থেকে গ্রহণ করার পরিবর্তে শুধু আল্লাহ্ প্রদত্ত শরীয়া থেকে গ্রহণ করা।
২. আরবী ভাষা, তার ব্যাকরণ ও সাহিত্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। কেননা কুরআন এই ভাষায় নাযিল হয়েছে এবং সুন্নাহ্কে জানার উপকরণও এই ভাষার মাধ্যেই রয়েছে।
৩. কুরআন ও সুন্নাহ্র জ্ঞান-যার মাধ্যমে ব্যক্তি শুধু আনুসংগিক নির্দেশ এবং তার প্রয়োগস্থান সম্পর্কেই অবহিত হবেনা বরং শরীয়াতের মূলনীতে এবং তার উদ্দেশ্যসমূহও ভালোভাবে হৃদয়ংগম করবে। তাকে একদিকে জানতে হবে যে, মানব জীবনের সংশোধন ও সংস্করের জন্য শরীয়তের সামগ্রিক পরিকল্পনা কি এবং অন্যদিকে জানতে হবে যে, এই সামগ্রিক পরিকল্পনায় জীবনের প্রতিটি বিভাগের মর্যাদা কি, শরীয়ত তার গঠন কোন্ কাঠামোয় করতে চায় এবং তা গঠন তার সামনে কি কল্যাণ রয়েছে? অন্য কথায় বলা যায়, ইজতিহাদের জন্য কুরআন ও সুন্নাহ্র এমন জ্ঞান দরকার যা শরীয়তের মূলে পৌঁছে যায়।
৪. উম্মতের পূর্ববর্তী মুজতাহিদদের অবদান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। ইজতিহাদের প্রশিক্ষণের জন্যই শুধু এর প্রয়োজন নয় বরং আইনগত বিবর্তন ও ক্রমবিবাশের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্যও প্রয়োজন। ইজতিহাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই এই নয় এবং এই হওয়াও উচিত নয় যে, প্রতিটি উত্তরসূরী [Generation] পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া নির্মাণ কাঠামো ধ্বংস করে দিয়ে অথবা পরিত্যক্ত ঘোষাণা করে সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্মাণ শুরু করবে।
৫. বাস্তব জীবনের অবস্থা, পরিস্থিতি ও সমস্যা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। কেননা এগুলোর উপরেই শরীয়াতের নির্দেশ ও মূলনীতি প্রযোজ্য হবে।
৬. ইসলামী নৈতিকতার মানদন্ড অনুযায়ী উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে। কেননা তাছাড়া কারো ইজতিহাদ জনগণের কাছে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য গণ্য হতে পারেনা। চারিত্রহীন লোকের উজতিহাদের মাধ্যমে যে আইন রচিত হয় তার প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হতে পারেনা।
এসব বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার উদ্দেশ্য এই নয় যে, প্রত্যেক ইজতিহাদকারীকে প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে, তার মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য বর্তমান রয়েছে। বরং এর উদ্দেশ্য কেবল একথা প্রকাশ করা যে, ইজতিহাদের মাধ্যমে ইসলামী আইনের ক্রমবিকাশ যদি সঠিক কাঠামোর উপর হতে হয়, তাহলে তা কেবল সেই অবস্থায়ই হতে পারে যখন আইনের শিক্ষাও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আলেম তৈরী করতে পারে। এছাড়া যে আইন প্রণয়ন করা হবে তা ইসলামী আইন ব্যবস্থার মাধ্যে নিজের স্থানও করে নিতে পারবেনা এবং মুসলিম সমাজও তা একটি উপদেয় খাদ্য হিসেবে হজম করতে পারবেনা।
ইজতিহাদের সঠিক পন্থা
ইজতিহাদ এবং তা ভিত্তিতে প্রণীতব্য আইন গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারটিস যেভাবে ইজতিহাদকারীর যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল অনুরূপভাবে এই ইজতিহাদ সঠিক পন্থায় হওয়ার উপরও নির্ভরশীল। মুজতাহিদ চাই আইনের ব্যাখ্যা দান করুক অথবা কিয়াস ও ইস্তিস্বাত করুক অবশ্যই তাকে নিজের যুক্তির ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাতের উপর রাখতে হবে। বরং বেধ কাজ [মুবাহ] সমূহের আওতায় স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়ন করতে গিয়েও তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, কুরেআন ও সুন্নাহ্ বাস্তবিকপক্ষেই অমুক ব্যাপারে কোনো নির্দশ অথবা মূলনীতি নির্ধারণ করেনি এবং কিয়াসের জন্যও কোনো ভিত্তি সরবাসরহ করেনি। অতপর কুরআন ও সুন্নাহ্ থেকে যে প্রমাণ পেশ করা হবে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ আলেমদের স্বীকৃত পন্থায় হতে হবে। কুরআন থেকে প্রমাণ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনো আয়াতের এমন অর্থই গ্রহণ করতে হবে, আরবী ভাষার অভিধান, ব্যাকরণ এবং প্রচলিত ব্যবহার যেরূপ অর্থ করর সুযোগ রয়েছে। এই অর্থ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাক্যের পূর্বাপরের সাথে মিল থাকতে হবে, একই বিষয়ে কুরআনের অন্যা্ন্য বর্ণানার সাথে তা সংঘর্ষপূর্ণ হবেনা এবং সুন্নতের মৌখিক অথবা বাস্তব ব্যাখ্যায় তার সমর্থন বর্তমান থাকতে হবে অথবা অন্ততঃপক্ষে সুন্নাহ্ এই অর্থের বিরোধী হবেনা। সুন্নাহ্ থেকে দলীল গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ভাষা এবং তার ব্যাকরণ ও পূর্বাপরের দিকে লক্ষ্য রাখার সাথে সাথে এটাও জরুরী যে, যেসব রিওয়ায়াত থেকে কোনো বিষয়ের সমর্থন বা প্রমাণ গ্রহণ করা হচ্ছে তা ইলমে উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী নির্ভরযোগ্য হতে হবে, এই বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য নির্ভরযোগ্য হাদীসও দৃষ্টির সামনে রাখতে হবে এবং কোনো একটি হাদীস থেকে এমন কোনো সিদ্ধান্ত বের করা যাবেনা, যা নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত অন্যান্য হাদীসের পরপন্থী।
এসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থর প্রতি লক্ষ্য না রেখে পছন্দসই ব্যাখ্যার মাধ্যমে যে ইজতিহাদ করা হবে, তাকে যদি শক্তবলে আইনের মর্যাদা যেয়াও হয়, তবে মুসলমানদের সামাগ্রিক বিবেক তা গ্রহণ করতে পারেনা। আর তা বাস্তবে ইসলামী আইন ব্যবস্থার অংশও হতে পারেনা। যে রাজনৈতিক শক্তি তা কার্যকর করবে তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাথে সাথে এই আইনও আবর্জনার পাত্রে নিক্ষিপ্ত হবে।
ইজতিহাদ কিভাবে আইনের মর্যাদা লাভ করে
কোনো ইজতিহদের আইনের মর্যাদা লাভ করার ব্যাপারে ইসলামী আইন ব্যবস্থায় বিভিন্ন পন্থা রয়েছে। যেমনঃ
১. এর উপর গোটা উম্মাহ্র বিশেষজ্ঞ আলেমগণের ইজমা হওয়া।
২. কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার ইজতিহাদ সাধারণভাবে গৃহীত হওয়া এবং লোকের নিজ থেকেই তা অনুসরণ করতে শুরু করা। যেমন হানাফী, শাফিঈ, মালিকী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
৩. কোনো ইজতিহাদকে কোনো মুসলিম সরকার কর্তৃক আইন হিসেবে গ্রহণ করে নেয়া। যেমন তুর্কী উসমানী রাজত্ব এবং ভারতের মোগল রাজত্ব হানাফী ফিকাহকে নিজেদের রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে গ্রহণ করেছিলো।
৪. রাষ্ট্রের অধীনে কোনো সংস্থার সাংবিধানিক মর্যাদাবলে আইন প্রণয়নের অধিকার লাভ করা এবং তাদের ইজতিহাদের মাধ্যমে কোনো আইন প্রণয়ন করা।
এসব পন্থা ছাড়া বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ আলেম যেসব ইজতিহাদ করে থাকেন তার মর্যাদ ফতোয়ার অধিক নয়। এখন থাকলো কাযীদের [ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারক] সিদ্ধান্ত। তা ঐসব বিশেষ মোকাদ্দমায় তো অবশ্যই আইন হিসেবে প্রযোজ্য হয় যেসব মামলায় ঐ সিদ্ধন্ত কোনো আদালত করেছে। এগুলো কোর্টের নযীর হিসেবেও মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে। কিন্তু সার্বিক অর্থে তা আইন নয়। এমনকি খোলাফায়ে রাশেদীন কাযী হিসেবে যেসব ফায়সালা করেছেন তাও ইসলামে আইন হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ইসলামী আইন ব্যবস্থায় কাযীদের প্রণীত আইনের [Judge Made Law] কোনো ধারণা বর্তমান নেই। [তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮]
১. জনৈক হাদীস প্রত্যাখ্যানকারীর অভিযোগ ও তার জবাব
ইসলামে আইন প্রণয়ন ও ইজতিহাদের বিষয় সম্পর্কেত আমার প্রবন্ধের উপর যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, আমি এখানে অতি সংক্ষেপে তার জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো।
কুরআনের সাথে সুন্নতের যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে, প্রথম প্রশ্ন তার উপর উত্থাপন করা হয়েছ। এর জবাবে ক্রমিক ধারা অনুযায়ী আমি কয়েকটি কথা বলবো যাতে বিষয়টি আপনাদের সামনে পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে যায়।
১. এটা এমন এক ঐতিহাসিক সত্য যা কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায়না যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবূয়্যতের পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে শুধু কুরআন পৌঁছে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি, বরং একটি ব্যাপাক আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছেন। এর ফলশ্রুতিতেই একটি মুসলিম সমাজের গোড়াপত্তন হয়, সভ্যতা সংস্কতির এক নতুন ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে এবং একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম হয়। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কুরআন পৌঁছে দেয়া ছাড়াও এসব কাজ যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন- তা শেষ পর্যন্ত কি হিসেবে করেছেন? এসব কাজ কি নবীর কাজ হিসেবে সম্পাদিত হয়েছেলো যার মধ্যে তিনি আল্লাহ্র মর্জীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন- যেমনটি কুরআন আল্লাহ্র মর্জীর প্রতিনিধিত্ব করছে? নাকি তাঁর নবূয়্যতী মর্যাদা কুরআন শুনিয়ে দেয়ার পর শেষ হয়ে যেতো এবং এরপর তিনি সাধারণ মুসলমানদের মতো শুধু একজন মুসলমান হিসেবে থেকে যেতেন, যার কথা ও কাজ নিজের মধ্যে কোনো আইনের সনদ ও দলীলের মর্যাদা রাখতোনা? যদি প্রথম কথাটি মেনে নেয়া হয় তাহলে সুন্নহ্কে কুরআনের সাথে আইনের উৎস ও দলীল হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। অবশ্য দ্বীতিয় অবস্থায় সুন্নাহ্কে আইনের মর্যাদা দেয়ার কোনো কারণ থাকতে পারেনা।
২. কুরআনের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল পত্রবাহক ছিলেননা বরং আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নিযুক্ত করা প্রথপ্রদর্শক, আইন প্রণেতা এবং শিক্ষকও ছিলেন, যাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করা মুসলমানদের জন্য
{১. ১৯৫৮ সালোর ৩ জানুয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী সোমিনারে পূর্বোক্ত প্রবন্ধ পাঠের পর জনৈক মুনকিরে হাদীস [হাদীস প্রত্যাখ্যানকারী] উঠে দাঁড়িয়ে তার উপর কতিপয় অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। ঐ মজলিসেই প্রবন্ধাকারের পক্ষ থেকে এ জবাব দেয়া হয়।}
বাধ্যতামূলক ছিলো এবং যাঁর জীবনকে সমগ্র ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য নমুনা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছিলো। বুদ্ধিবিবেক সম্পর্কে যতোদূর বলা যায়, তা একথা মেনে নিতে অস্বীকার করে যে, একজন নবী কেবল আল্লাহ্র কালাম পড়ে শুনিয়ে দেয়া পর্যন্ত তা নবী থাকবেন, কিন্তু এরপর তিনি একজন সাধারণ ব্যক্তি মাত্র রয়ে যাবেন। মুসলমানদের সম্পর্কে যতোদূর বলা যায়, তারা ইসলামের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিটি যুগে এবং গোটা দুনিয়ায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদর্শ, তাঁর অনুসরণ অপরিহার্য এবং তাঁর আদেশ নিষেধের আনুগত্যকে বাধ্যতামূলক বলে স্বীকার করে আসছে। এমনকি কোনো অমুসলিম পন্ডিতও এই বাস্তব ঘটনাকে অস্বীকার করতে পারেনা যে, মুসলমানরা সব সময় তাঁর এই মর্যাদা স্বীকার করে আসছে এবং এরই ভিত্তিতে ইসলামের আইন ব্যবস্থায় সুন্নাহ্কে কুরআনের সাথে আইনের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছে।
এখন আমি জানিনা, কোনো ব্যক্তি সুন্নাতের এই আইনগত মর্যাদা কিভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে পরিষ্কারভাবে না বলে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু কুরআন পড়ে শুনিয়ে দেয়া পর্যন্ত নবী ছিলেন এবং একাজ সম্পন্ন করার সাথে সাথে নবূয়্যতী মর্যাদা শেষ হয়ে গেছে? অনন্তর সে যদি এরূপ দাবী করেও তাহলে তাকে বলতে হবে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই ধরনের মর্যাদা সে নিজেই দিচ্ছে না কুরআন তাঁকে এই ধরনের মর্যাদা দিয়েছে? প্রথম ক্ষেত্রে থেকে তার দাবীর সপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে।
৩. সুন্নাহ্কে স্বয়ং আইনের একটি উৎস হিসেবে মেনে নেয়ার পর এই প্রশ্ন দেখা দেয় যে, তা জানার উপায় কি? আমি এর জবাবে বলতে চাই, আজ চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়ে যাবার পর এই প্রথম বারের মতো আমরা এ প্রশ্নের সন্মূখীন হইনি যে, দেড় হাজার বছর পূর্বে যে নবূয়্যতের আবির্ভাব হয়েছিলো তা কি সুন্নহ্ রেখে গেছে? দুটি ঐতিহাসিক সত্য কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায়নাঃ
একঃ কুরআনের শিক্ষা এবং মুহাম্ম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের উপর যে সমাজ ইসলামের সূচনার প্রথম দিন কায়েম হয়েছিলো তা সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত অবিরত জীবন্ত রয়েছে, তার জীবনে একটি দিনেরও বিচ্ছিন্নতা ঘটেনি এবং তার সমস্ত বিভাগ ও সংস্থা এই পুরো সময়ে উপর্যুপরি কাজ করে আসছে। আজ সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে আকীদা বিশ্বাস, চিন্তাপদ্ধতি, চরিত্র নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ইবাদত ও মুয়ামালাত, জীবন পদ্ধতি এবং জীবন পন্থার দিক থেকে যে গভীর সামঞ্জস্য বিরাজ করছে, যার মধ্যে মতভেদের উপাদানের চাইতে ঐক্যের উপাদান অধিক পরিমাণে বর্তমান রয়েছে, যা তাদেরকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও একটি উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত রাখার সবচেয়ে বড় বুনিয়াদ। কারণ- এগুলোই একথার পরিষ্কার প্রমাণ যে, এ সমাজকে কোনো একটি সুন্নাতের উপরই কায়েম করা হয়েছিলো এবং সে সুন্নাত শতাব্দীর পর শতাব্দার দীর্ঘতায় অবিরতভাবে জারী রয়েছে। এটা কোনো হারানো জিনিস নয় যা অনুসন্ধান করার জন্য আমাদেরকে অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়াতে হবে।
দুইঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর থেকে প্রতিটি যুগে মুসলমানরা এটা জানার জন্য অবিরত চেষ্টা করতে থাকে যে, প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত সুন্নাত কি এবং নতুন কোনো জিনিস তাদের জীবন ব্যবস্থায় কোনো কৃত্রিম পন্থায় অনু্প্রবেশ করছে কিনা? সুন্না্ত যেহেতু তাদের জন্য আইনের মর্যাদা রাখতো, এর ভিত্তিতে তাদের বিচারালয়সমূহে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো এবং তাদের ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্তকার ব্যবস্থা পরিচালিত হতো, এজন্য তারা এর তথ্যানুসান্ধানে বেপরোয়া ও নির্ভীক হতে পারেনা। এই অনুসন্ধানের উপায় এবং তার ফলাফলও ইসলামের প্রথম খিলাফতের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমরা বংশানুক্রমে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে গিছি এবং কোনো বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই প্রতিটি জেনারেশনের অবদান সংরক্ষিত আছে।
এই দুটি সত্যকে যদি কোনো ব্যক্তি ভালোভাবে হৃদয়ংগম করে নেয়া এবং সুন্নাতকে জানার উপায় ও মাধ্যমগুলো রীতিমতো অধ্যয়ন করে তাহলে সে কখনো এই সন্দেহের শিকার হতে পারেনা যে, এটা কোনো সমাধানের অযোগ্য ধাঁ ধাঁ, তারা যারা সন্মুখীন হয়ে পড়েছি।
৪. সুন্নাতের অনুসন্ধান, পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিসন্দেহে অনেক মতবিরোধ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে। কিন্তু এরূপ মতবিরোধ কুরআনের অস্যখ্য নির্দেশ ও বাণীর অর্থ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও হয়েছে এবং হতে পারে। এসব মতবিরোধ যদি কুরআনকে পরিত্যাগ করার জন্য দলীল হতে না পারে তাহলে সুন্নাত পরিত্যাগ করার জন্য্ এই মতবিরোধকে কিভাবে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে? এই মূলনীতি পূর্বেও মান্য করা হয়েছে এবং আজো তা না মেনে কোনো উপায় নেই যে, যে ব্যক্তিই কোনো নির্দেশকে কুরআনের নির্দেশ অথবা সুন্নাতের নির্দেশ বলে দাবী করবে তাকে নিজের একথার সপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। তার কথা যদি বলিষ্ঠ হয় তাহলে উম্মতের বিশেষজ্ঞ আলেমদের দ্বারা অথবা অন্ততপক্ষে তাদের কোনো বিরাট অংশের দ্বারা নিজের মতকে গ্রহণযোগ্য করিয়ে নেবে। আর যেকথা প্রমাণের দিক থেকে দুর্বল হবে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। এই সেই মূলনীতি যার ভিত্তিতে দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী কোটি কোটি মুসলমান কোনো একটি ফিকাহ ভিত্তিক মাযহাবে সম্মিলিত হয়েছে এবং তাদের বিরাট বিরাট জনবসতি কুরআনী নির্দেশের কোনো ব্যাখ্যা এবং প্রতিষ্ঠিত সুন্নাতের কোনো সমষ্টির উপর নিজেদের সামগ্রিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে।
আমার প্রবন্ধের উপর দ্বিতীয় প্রশ্ন এই করা হয়েছে যে, আমার বক্তব্যে স্ববিরোধীতা রয়েছে। অর্থাৎ আমার এ বক্তব্যঃ “কুরআন ও সুন্নাতের সুস্পষ্ট এবং চূড়ান্ত নির্দেশসমূহের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করার অধিকার কারো নেই।” প্রশ্নকারীর মতে আমার এই বক্তব্য আমার নিন্মোক্ত বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিকঃ “ব্যতিক্রমধমী অবস্থা ও ঘটনার ক্ষেত্রে এই নির্দেশসমূহ থেকে সরে গিয়ে কাজ করার অবকাশ এবং ইজতিহাদের মাধ্যমে তার প্রয়োগস্থান নির্দিষ্ট করা যেতে পারে।” আমি বুঝতে পারছিনা এর মধ্যে কি বৈপরিত্য অনুভব করা হয়েছে। একান্ত উপায়ান্তরহীন পরিস্থিতিতে সাধারণ নীতির ব্যতিক্রম দুনিয়ার প্রতিটি আইনে রয়েছে। কুরআনেও এধরনের অনুসতির অনেক দৃষ্টান্ত মওজূদ রয়েছে। এই দৃষ্টান্তসমূহ থেকে ফিকাহবিদগণ সেই মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন যাকে অনুমতির সীমা ও তার প্রয়োগস্থান নির্ধারণ করা জন্য বিবেচনায় রাখতে হয়। যেমনঃ
তৃতীয় প্রশ্ন সেসব লোকদের সম্পর্কে করা হয়েছে যারা এখানে নিজেদের প্রবন্ধসমূহে ইজতিহাদের কতিপয় শর্ত বর্ণনা করেছেন। আমিও যেহেতু তাদের মধ্যে একজন, তাই এর জবাব দেয়ার দায়িত্ব আমারও রয়েছে। আমি আবেদন করবো, অনুগ্রহপূর্বক আর একবার আমার বর্ণনাকৃত শর্তগুলোর উপর দষ্টি নিবদ্ধ করুন। অতপর বলুন, আপনি এর মধ্যকার কোন্ শর্তটি বাদ দিতে চান। এই শর্তটি কি, ইজতিহাদকারীদের মধ্যে শরীয়তকে অনুসরণ করার একনিষ্ঠ ইচ্ছা থাকতে হবে এবং তারা এর সীমা লংঘন করার খাহেশমান্দ হবেননা? নাকি এই শর্তটি যে, তাদেরকে কুরআন ও সুন্নাতের ভাষা অর্থাৎ আরবী ভাষা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে হবে? নাকি এই শর্তটি, তাদেরকে অন্তত কুরআন ও সুন্নাত এই পরিমাণ অধ্যয়ন করতে হবে যাতে তারা শরীয়তের ব্যবস্থা ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হয়? অথবা পূর্বেকার মুজতাহিদদের কৃত কাজের উপরও তাদের দৃষ্টি থাকতে হবে- এই শর্তটি? অথবা তাদের চলমান বিশ্বের বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে অবহিত থাকতে হবে- এই শর্তটি? অথবা তারা দুশ্চরিত্র এবং ইসলামের নৈতিক মানদন্ড থেকে নীচে অবস্থান করবেননা- এই শর্তটি?
এসব শর্তের যেটিকে আপনি অপ্রয়োজনীয় মনে করেন তা চিহ্নিত করে দিন। একথা বলা যে, গোটা ইসলামী দুনিয়ায় দশ বারজনের অধিক এমন লোক পাওয়া যাবেনা, যারা এই শর্তের মানদন্ডে উৎরে যেতে পারে-আমার মতে দুনিয়াব্যপী মুসলমানদের সম্পর্কে এটা অত্যন্ত জঘন্য মন্তব্য। খুব সম্বব আজ পর্যন্ত আমাদের বিরোধীরাও আমাদেরকে এতাটা পতিত মনে করেনি যে, চল্লিশ পঞ্চাশ কোটি মুসলমানের মধ্যে এই বৈশিষ্টের অধিকারী ব্যক্তিত্বের সংখ্যা দশ বারজনের অধিক হবেনা। তদুপরি আপনি যদি ইজতিহাদের দরজা পন্তিত মূর্খ নির্বিশেষে সবার জন্য খুলে দিতে চান তাহলে আনন্দের সাথে খুলে দিন। কিন্তু আমাকে বলুন দুশ্চরিত্র, জ্ঞানহীন এবং অসৎ উদ্দেশ্য সম্পন্ন লোকেরা যে ইজতিহাদ করবে তাকে আপনি আপনি কিভাবে মুসলিম জনতার কন্ঠনালীর নীচে নামাবেন? [তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারী ১৯৫৮]
৩. আইন প্রণয়ন, শূরা [পরামর্শ পরিষদ] ও ইজমা
ইসলামী আইন প্রবর্তনের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী আইন প্রণয়ন সম্পর্কে বিভিন্ন রকম মত প্রকাশ করা হচ্ছে। এই প্রসংগে এক বন্ধু নিজের মনের জটিলতা দূর করার উদ্দেশ্যে লিখেছেনঃ
“ইসলামে আইন প্রণয়নের যথার্থতা ও প্রকৃতি এবং তার কর্মপরিসর নির্ধারণে অনেক বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। একদিকে বলা হচ্ছে, ইসলামে আইন প্রনয়নের মূলত কোনো অবকাশই নেই। আল্লাহ এবং তাঁর রসূল আইন প্রণয়ন করে দিয়েছেন। মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে তদনুযায়ী কাজ করা এবং তা কার্যকর করা। অপরদিকে কতিপয় লোকের মতে বর্তমানে আইন প্রণয়নের পরিসর এতোটা প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে যে, মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের এই অধিকার দেয়া হয়েছে যে, তারা ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত বিস্তারিত নিয়ম কানুনে পরিবর্তন ও সংকোচন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, তারা নামায এবং রোযার বাহ্যিক কাঠামোর মধ্যে সংকোচন ও সংযোজন করতে পারেন।
অনুগ্রহপূর্বক বিস্তারিতভাবে বলে দিন যে, ইসলামে আইন প্রণয়নের সীমা এবং তার বিভিন্ন পর্যায় কি কি? তাছাড়া একথাও পরিষ্কারভাবে বলে দিন যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের ব্যক্তিগত এবং শূরাভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও ফিকাহের ইমাম ও মুজতাহিদদের রায়ের আইনগত মর্যাদা কি? এই সাথে যদি শূরা [পরামর্শ পরিষদ] এবং ইজমার [ঐক্যমত] তাৎপর্যের উপর কিছুটা আলোকপাত করা হয় তাহলে ভালোই হয়।”
১. জবাবঃ আইন প্রণয়নের বুনিয়াদী মূলনীতি
ইসলামে ইবাদতের পরিমন্ডলে চূড়ান্তভাবেই আইন প্রণয়নের কোন অবকাশ নেই। অবশ্য ইবাদত ছাড়া নির্বাহী কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে কেবল সেখানেই আইন প্রণয়নের অবকাশ রয়েছে যেখানে কুরআন ও সুন্নাহ নীরবতা অবলম্বন করেছে। ইসলামে আইন প্রণয়নের ভিত্তি হচ্ছে এই মূলনীতি যে, “ইবাদতের ক্ষেত্রে কেবল সে কাজ করো যা বলে দেয়া হয়েছে এবং নিজের পক্ষ থেকে ইবাদতের কোনো নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করোনা। আর মুয়ামালাতের নির্বাহী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার আনুগত্য করো, যা থেকে বিরত রাখা হয়েছে- তা করা থেকে বিরত থাকো এবং যে জিনিস সম্পর্কে শরীয়া প্রণেতা [আল্লাহ এবং তাঁর রসূল] নীরব থেকেছেন সে ক্ষেত্রে তোমরা নিজেদের সঠিক দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী কাজ করার জন্য স্বাধীন।” ইমাম শাতিবী [রহঃ] তাঁর ‘আল-ই’তিসাম’ গ্রন্থে উল্লেখিত মূলনীতিটি এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
ইবাদতের নির্দেশ অভ্যাসের নির্দেশ থেকে ভিন্নতর। অভ্যাসের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে এই যে, যে জিনিস সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে, তাতে যেনো নিজের সঠিক দৃষ্টিকোণের উপর কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে ইবাদতের ক্ষেত্রে এমন কোনো কথা ইস্তিম্বাতের [কারণ দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ] মাধ্যমে বের করা যায়না যার মূল শরীয়াতে বর্তমান নেই। কেননা ইবাদতের কাঠামো পরিষ্কার নির্দেশ এবং পরিষ্কার অনুমতির সম্পর্ক দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছে, অভ্যাসের ক্ষেত্রে তদ্রূপ নয়। এই পার্থক্যের কারণ এই যে, অভ্যাসের ক্ষেত্রে মোটমুটিভাবে আমাদের জ্ঞান সঠিক পথ জেনে নিতে পারে এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের জ্ঞানের সাহায্যে এটা জানতে পারিনা যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ কোনটি।” [২য় খন্ড, পৃঃ ১১৫]
২. আইন প্রণয়নের চারটি বিভাগ
মুয়ামালাত বা আদান প্রদান ও নির্বাহী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের চারটি বিভাগ রয়েছেঃ
১. ব্যাখ্যা বিশ্লেষণঃ অর্থাৎ যেসব ব্যাপারে শরীয়ত প্রণেতা আদেশ অথবা নিষেধের ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন সে সম্পর্কে নসের [কুরআনের আয়াত] অর্থ অথবা তার উদ্দেশ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা।
২. কিয়াসঃ অর্থাৎ যেসব ব্যাপারে শরীয়ত প্রণেতার সরাসরি কোনো নির্দেশ বর্তমান নেই, কিন্তু যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাপারের নির্দেশ বর্তমান আছে। এর মধ্যে নির্দেশের কারণ নির্ধারণ করে এই নির্দেশকে এই ভিত্তির উপর জারী করা যে, এখানেও ঐ একই কারণ পাওয়া যায়- যার ভিত্তিতে ঐ নির্দেশ তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনার ক্ষেত্রে দেয়া হয়েছিলো।
৩. ইস্তিম্বাত ও ইজতিহাদঃ অর্থাৎ শরীয়তের বর্ণিত ব্যাপক মূলনীতিকে প্রাসংগিক মাসায়ালা ও বিষয়ের অনুকূল করা এবং নসসমূহের ইংগিত, লক্ষণ ও দাবীকে উপলব্ধি করে বুঝে নেয়া যে, শরীয়ত প্রণেতা আমাদের জীবনের ব্যাপারসমূহকে কোন আকারে ঢেলে সাজাতে চান।
৪. যেসব ব্যাপারে শরীয়ত প্রণেতা কোনো পথ নির্দেশ দেননি সেসব ক্ষেত্রে ইসলামের ব্যাপক উদ্দেশ্য ও সার্বিক স্বার্থ সামনে রেখে এমন আইন প্রণয়ন করা, যা প্রয়োজনও পূরণ করবে এবং সাথে সাথে ইসলামের সামগ্রিক ব্যবস্থার প্রাণসত্ত্বা ও মেজাজ প্রকৃতির পরিপন্থীও হবেনা। ফিকাহবিদগণ এই জিনিসকে ‘মাসালিহে মুরসালা’ ও ‘ইস্তিহসান’ ইত্যাদি নামকরণ করেছেন। মাসালিহে মুরসালার অর্থ হচ্ছে, সেই সার্বিক কল্যাণকর জিনিস যা আমাদের সঠিক দৃষ্টিভংগির উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর ইস্তিহসানের অর্থ হচ্ছে কোনো একটি ব্যাপারে কিয়াস প্রকাশ্যত একটি হুকুম আরোপ করে, কিন্তু দীনের মহান স্বার্থে অন্যরূপ নির্দেশের দাবী করে। এজন্য প্রথম নির্দেশের পরিবর্তে দ্বিতীয় নির্দেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে তা কার্যকর করা হয়।
৩. মাসালিহে মুরসালা ও ইস্তিহসান
ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, কিয়াস ও ইস্তিম্বাতের জন্য তো অধিক আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। অবশ্য মাসালিহে মুরসালা ও ইস্তিহসানের উপর আরো কিছু আলোকপাত করবো। ইমাম শাতিবী (রহঃ) তাঁর ‘আল ই’তিসাম’ গ্রন্থে এ বিষয়ের উপর একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রচনা করেছেন এবং এসম্পর্কে এতো মূল্যবান আলোচনা করেছেন যে, এর চেয়ে ভালো আলোচনা উসূলে ফিকহের কোনো কিতাবে দৃষ্টিগোচর হয়নি। এতে তিনি বিস্তারিত দলীলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, মাসালিহে মুরসালার অর্থ আইন প্রণয়নের অবাধ অনুমতি নয়, যেমন কতিপয় লোক মনে করে থাকে। বরং এর জন্য তিনটি অপরিহার্য শর্ত রয়েছেঃ
একঃ এই পন্থায় যে আইন প্রণয়ন করা হবে তা শরীয়তের উদ্দেশ্যর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, তার পরিপন্থী হতে পারবেনা।
দুইঃ যখন তা জনগণের সামনে পেশ করা হবে, সাধারণ জ্ঞানের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
তিনঃ তা কোনো প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ করার জন্য অথবা কোনো প্রকৃত অসুবিধা দূর করার জন্য হতে হবে। [আল-ই’তিসাম, ২য় খন্ড, পৃঃ ১১০-১১৪]
অতপর তিনি ইস্তিহসান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, প্রকাশ্যত কোনো দলীলের ভিত্তিতে যদি কিয়াসের দাবী এই হয় যে, একটি ব্যাপারে একটি বিষয়ে নির্দেশ দেয়া প্রয়োজন, কিন্তু ফিকহের দৃষ্টিতে এই নির্দেশ সামগ্রিক স্বার্থের পরিপন্থী, অথবা এর দ্বারা এমন কোনো ক্ষতি বা ত্রুটি সংঘটিত হতে পারে যা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দূর করার যোগ্য, অথবা তা উরফের [প্রচলিত রীতি] পরিপন্থী- তখন এটাকে পরিত্যাগ করে ভিন্নতর নির্দেশ দান হচ্ছে ইহসান। অবশ্য ইস্তিহসানের জন্য শর্ত হচ্ছে এই যে, প্রকাশ্য কিয়াসকে পরিত্যাগ করে কিয়াসের পরিপন্থী নির্দেশ দানের জন্য কোনো শক্তিশালী কারণ বর্তমান থাকতে হবে যাকে যুক্তিসংগত দলীল সহকারে বিবেচনাযোগ্য প্রমাণ করা যেতে পারে। [আল-ই’তিসাম, ২য় খন্ড, পৃঃ ১১৮-১৯]
৪. আদালতের সিদ্ধান্ত এবং রাষ্টীয় আইনের মধ্যেকার পার্থক্য
এই চারটি বিভাগ সম্পর্কে কোনো মুজতাহিদ অথবা ইমামের ব্যক্তিগত রায় এবং পর্যালোচনা একটি পজ্ঞাপূর্ণ রায় এবং পর্যালোচনা তো হতে পারে, যার ওজন রায়দাতার বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিত্বের ওজন অনুযায়ী-ই হবে। কিন্তু তথাপি তা আইনের মর্যাদা লাভ করতে পারেনা। আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ইসলামী রাষ্টের আরবাবে হল ওয়াল আকদের [সিদ্ধান্ত এবং সমাধান পেশ করার মত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের] পরামর্শ পরিষদ থাকবে এবং তারা নিজেদের ইজমা অথবা অধিকাংশের মতের ভিত্তিতে একটি ব্যাখ্যা, একটি কিয়াস, একটি ইস্তিম্বাত ও ইজতিহাদ অথবা একটি ইস্তিহসান ও মুসলিহাতে মুরসালাকে গ্রহণ করে তাকে আইনের রূপ দেবেন। খিলাফতে রাশেদার আমলে আইন প্রণয়নের জন্য এই ব্যবস্থাই ছিলো। আমি আমার “ইসলামী দস্তুর কী তাদবীন” [ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন] পুস্তিকায় এর ব্যাখ্যা করেছি। অতএব এখানে তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। [উক্ত পুস্তিকাটি এগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।] এখানে আমি মাত্র কয়েকটি দৃষ্টন্ত উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে করবো। তা থেকেই অনুমান করা যাবে যে, খিলাফতে রাশেদার যুগে জাতীয় প্রয়োজন দেখা দিলে কিভাবে আইন প্রণয়ন করা হতো এবং সে যুগে আইন ও আদালতের ফায়সালাসমূহের মধ্যে কি পার্থক্য ছিলো।
কতিপয় দৃষ্টান্ত
১. মদ সম্পর্কে কুরআন মজীদে কেবল হারাম হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এই অপরাধের জন্য শাস্তির কোনো সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এজন্য কোনো নির্দিষ্ট শাস্তি নির্ধারণ করা হয়নি বরং তিনি যাকে যেরূপ শাস্তি প্রদান উপযুক্ত মনে করতেন তা দিতেন। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজেদের যুগে চল্লিশটি বেত্রাঘাতের শাস্তি নির্ধারণ করেন, কিন্তু এ জন্য রীতিমতো কোনো আইন প্রণয়ন করেননি। হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর যুগে যখন শরাব পানের অভিযোগ বৃদ্ধি পেতে লাগলো, তখন তিনি সাহাবাদের পরামর্শ পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করেন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রস্তাব দিলেন যে, এজন্য আশি বেত্রদন্ডের ব্যবস্থা করা হোক। পরামর্শ পরিষদ তাঁর সাথে একমত হলেন এবং ভবিষ্যতের জন্য ইজমা সহকারে এই আইন প্রণয়ন করেন। [আল-ই’তিসাম, ২য় খন্ড, পৃঃ ১০১]
২. খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে এই আইনগত প্রণয়ন করা হলো যে, কারিগর বা শিল্পীদের যদি কোনো জিনিস তৈরী করতে দেয়া হয় [সেলাই করার জন্য কাপড়, অথবা অলংকার বানানোর জন্য সোনা] এবং তা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তাদেরকে এর মূল্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। এই সিদ্ধান্তও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নিম্নোক্ত ভাষণের ভিত্তিতে হয়েছে যে, কারিগরদের যদিও এই অবস্থায় বাহ্যত দোষী সাব্যস্ত করা যায়না, যখন তা তার অবহেলার কারণে ধ্বংস না হয়ে থাকে, কিন্তু যদি এরূপ না করা হয় তাহলে জিনিসপত্রের হিফাজতের ক্ষেত্রে শিল্পীদের অবহেলা প্রদর্শনের আশংকা রয়েছে। এজন্য সামগ্রিক স্বার্থের দাবী হচ্ছে এই যে, তাদেরকে এই জিনিসের জামানতদার সাব্যস্ত করা হবে। সুতরাং এই সিদ্ধান্তও ইজমার সাহায্যে হয়েছে। [ই’তিসাম, ২য় খন্ড, পৃঃ ১০২]
৩. হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এক ব্যক্তির হত্যাকান্ডে যদি একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকে তাহলে সবার উপর কিসাসের দন্ড কার্যকর হবে। ইমাম মালেক এবং ইমাম শাফিঈ [রহঃ] এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নেন, কিন্তু এটাকে আইন হিসেবে মেনে নেয়া হয়নি। কেননা এটি একটি আদালতী ফায়সালা ছিলো, পরামর্শ পরিষদে ইজমার মাধ্যমে অথবা অধিকাংশের মতের ভিত্তিতে আইন হিসেবে বানানো হয়নি। [ই’তিসাম, ২য় খন্ড, পৃঃ ১০৭]
৪. নিখোজ ব্যক্তির স্ত্রী যদি আদালতের অনুমতিক্রমে দ্বিতীয় বিবাহ করে নেয়, অতএব তার পূর্বতন স্বামী ফিরে আসে, তাহলে তাকে কি প্রথম স্বামী পাবে না সে দ্বিতীয় স্বামীর কাছে থাকবে? এই প্রসংগে খোলাফায়ে রাশেদীন বিভিন্নরূপ ফায়সালা করেন। কিন্তু কোনো ফায়সালাই আইনের মর্যাদা লাভ করেনি। কেননা এই প্রসংগটিকে পরামর্শ পরিষদে পেশ করে ইজমা অথবা অধিকাংশের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কোনো ফায়সালায় পরিণত করা হয়নি। [ই’তিসাম, ২য় খন্ড পৃঃ ১২৬]
উপরে উল্লেখিত আলোচনা থেকে জানা যায় যে, ইংরেজ আইনে আদালতের সিদ্ধান্তের যে মর্যাদা রয়েছে, ইসলামে আদালতের সেদ্ধান্তের সে মর্যাদা নেই। বৃটিশ আইনের বিচারকদের সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্তসমূহ আইনের মর্যাদা লাভ করতে পারে কিন্তু ইসলামে নসের একটি ব্যাখ্যা গ্রহণ করে, অথবা নিজের কিয়াস অথবা ইজতিহাদের ভিত্তিতে করে থাকেবেন, কিন্তু তা একটি স্বতন্ত্র আইনের মর্যাদা লাভ করতে পারেনা। বরং একই বিচারক একটি মামলায় একটি ফায়সালা দেয়ার পর সব সময়ের জন্য নিজের এই ফায়সালা অনুসরণ করা তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এরপরও তিনি উল্লেখিত মামলার সাথে সামঞ্জ্যসপূর্ণ অন্যান্য মামলায় ভিন্নরূপ ফায়সালা করতে পারেন- যদি তার সামনে পূর্বেকার ফায়সালার ত্রুটি পরিষ্কার হয়ে যায়।
খিলাফতে রাশেদার পর যখন পরামর্শ পরিষদ ব্যবস্থা এলোমেলো হয়ে যায়, তখন মুজতাহিদ ইমামগণ ফিকহের যে বিভিন্ন ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন- তা আধা আইনের মর্যাদা এজন্য লাভ করে যে, কোনো এলাকার অধিবাসীদের সর্বাধিক সংখ্যক আইনের মর্যদা এজন্য লাভ করে যে, কোনো এলাকার অধিবাসীদের সর্বাধিক সংখ্যক লোক কোনো এক ইমামের ফিকাহ গ্রহণ করে নেয়। যেমন ইরাক ইমাম আবু হানীফার ফিকাহ, স্পেনে ইমাম মালেকের ফিকাহ, মিসরে ইমাম শাফিঈর ফিকাহ ইত্যাদি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু এই ব্যাপক গ্রহণ কোথাও কোনো ফিকাহকে সঠিক অর্থে আইনে পরিণত করেনি। যেখানেই তা আইনে পরিণত হয় তা এই ভিত্তিতে যে, দেশের সরকার তাকে আইন হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে।
ইজমার সংজ্ঞা
ইজমার সংজ্ঞা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম শাফিঈ [রহঃ]-এর মতে, “কোনো মাসয়ালার ক্ষেত্রে সমস্ত বিশেষজ্ঞ আলেমের ঐক্যমত এবং এর পরিপন্থী কোনো মত বর্তমান না থাকলে তাকে ইজমা বলে।” ইবনে জারীর তাবারী [রহঃ] এবং আবু বাকর আল-রাযী [রহঃ]-এর পরিভাষায় অধিকাংশের মতকেও ইজমা বলে। ইমাম আহমদ [রহঃ] যখন কোনো মাসয়ালার ক্ষেত্রে একথা বলেন যে, “আমাদের জানা মতে এর পরিপন্থী কোনো মত নেই,” তখন এর এই অর্থ গ্রহণ করা হয় যে, তাঁর মতে এই মাসয়ালার উপর; ইজমা হয়েছে।
ইজমা হুজ্জাত হওয়ার মর্যাদাটি সবার কাছে স্বীকৃত। অর্থাৎ নসের যে ব্যাখ্যার উপর, অথবা যে কিয়াস ও ইজতিহাদের উপর অথবা সামগ্রিক কল্যাণ সম্বলিত যে আইনের উপর উম্মাতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। ইজমার হুজ্জাত হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই, নিন্তু ইজমার প্রমাণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্র সম্পর্কে মতবিভেদ আছে। খোলাফায়ে রাশেদীনে যুগ সম্পর্কে বলা হয়, এ যুগে যেহেতু ইসলামী সংগঠন ব্যবস্থা যথারীতি কায়েম ছিলো এবং পরামর্শ পরিষদের অধীনে তা পরিচালিত ছিলো, তাই সে সময়কার ইজমা ও অধিকাংশের ফায়সালা জ্ঞাত এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনার দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন সংগঠন ব্যবস্থা এলোমেলো হয়ে গেলো এবং পরামর্শ পরিষদ ব্যবস্থাও বিলুপ্ত হয়ে গেলো তখন এটা জ্ঞাত হওয়ার কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকলোনা যে, বাস্তবিকপক্ষে কোন্ জিনিসের উপর ইজমা আছে আর কোন্ জিনিসের উপর নেই। এর কারণে খিলাফতে রাশেদার যুগের ইজমা তো স্বীকৃত এবং তা প্রত্যাখ্যান করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু পরবর্তী যুগের কোনো লোক যখন দাবী করে যে, অমুক মাসয়ালার উপর ইজমা হয়েছে, তখন বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তার এ দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণে আমাদের মতে, কোনটির উপর ইজমা হয়েছে আর কোনটির উপর হয়নি তা জানার জন্য ইসলামী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন।
ইমাম শাফিঈ [রহঃ] এবং ইমাম আহমদ [রহঃ] আদৌ ইজমার অস্তিত্বকে স্বীকার করতেননা বলে যে কথা সাধারণভাবে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে, অথবা অন্য কোনো ইমাম ইজমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন- এসব কিছু উপরে উল্লেখিত কথা না বুঝার কারণেই হয়েছে। আসল ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যখন কোনো মাসয়ালার উপর আলোচনা করতে গিয়ে কোনো ব্যক্তি দাবী করে যে, যখন কোনো মাসয়ালার উপর আলোচনা করতে গিয়ে কোনো ব্যক্তি দাবী করে যে, সে যা কিছু বলছে তার উপর ইজমা রয়েছে- কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর কোনো প্রমাণ বর্তমান থাকতোনা-তখন এই লোকেরা উল্লেখিত দাবী মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতেন। ইমাম শাফিঈ [রহঃ] তাঁর ‘জিমাউল ইলম’ গ্রন্থে এই বিষয়ের উপর ব্যাপক আলোচনা করে বলেছেন যে, ইসলামী বিশ্বের পরিধি বিস্তৃত হওয়া ও বিভিন্ন এলাকায় বিশেষজ্ঞ আলেমদের বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া এবং সংগঠন ব্যবস্থা এলোমেলো হয়ে যাবার পর এখন কোনো আংশিক বা আনুসংগিক মাসয়ালার ব্যাপারে আলেমদের মতামত কি তা জানাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য আনুসংগিক মাসয়ালার ক্ষেত্রে ইজমার দাবী করাটা মূলত ভুল। অবশ্য ইসলামের মূলনীতিসমূহ, তার রুকনসমূহ এবং বড় বড় মাসয়ালা সম্পর্কে এটা অবশ্যই বলা যায় যে, এর উপর ইজমা রয়েছে। যেমন নামাযের ওয়াক্ত পাঁচটি, অথবা রোযার সীমারেখা এই ইত্যাদি। একথাটিকে ইমাম ইবনে তাইমিয়া [রহঃ] এভাবে বলেছেনঃ
“ইজমার অর্থ হচ্ছে, কোনো মাসয়ালার উপর উম্মতের সমস্ত আলেমের একমত হয়ে যাওয়া। আর যখন কোনো মাসয়ালার উপর গোটা উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন কোনো ব্যক্তির তা থেকে বেরিয়ে আসার অধিকার থাকেনা। কেননা গোটা উম্মত কখনো গোমরাহীর উপর একমত হতে পারেনা। কিন্তু এমন অনেক মাসয়ালাও রয়েছে, যে সম্পর্কে কোনো কোনো লোকের ধারণা হচ্ছে যে, তার উপর ইজমা হয়েছে। কিন্তু মূলত তা হয়নি বরং কখনো কখনো ভিন্নমত অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে।” [ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪০৬]
উপরে উল্লেখিত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কোনো মাসয়ালার ক্ষেত্রে শরীয়াতের নসের কোনো ব্যাখ্যার উপর, অথবা কোনো কিয়াস বা ইস্তিম্বাতের উপর, অথবা কোনো মাসালিহে মুরসালার উপর আজো যদি প্রজ্ঞার অধিকারী ব্যাক্তিগণের ইজমা হয়ে যায়, অথবা অধিকাংশের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তা হুজ্জাতের মর্যাদা লাভ করবে এবং আইনে পরিণত হবে। যদি গোটা বিশ্বের মুসলিম মনীষীগন এই ধরনের মাসয়ালায় ঐক্যমত হয়ে যান, তাহলে সেটা গোটা দুনিয়ার জন্য আইনে পরিণত হবে। আর যদি কোনো একটি ইসলামী রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞগণ ঐক্যমত হন, তাহলে অন্ততপক্ষে ঐ রাষ্ট্রের জন্য তা আইনে পরিণত হবে। [তরজমানুল কুরআন, শা’বান ১৩৭৪; মে ১৯৯৫]
৪. ইসলামী ব্যবস্থায় বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঠিক পন্থা
তাফহীমুল কুরআনের পাঠকদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি নিম্নোক্ত আয়াত সম্পর্কে নিজের একটি জটিলতার বর্ণনা করে লিখেছেনঃ
কুরআন মজীদের আয়াতঃ
“হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো তাঁর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যেকার কর্তৃত্বের অধিকারী লোকদের। অতপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো মতবৈষম্যের সৃষ্টি হয়, তবে তা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের দিকে ফিরেয়ে দাও, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহ্ এবং আখিরাতের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাকো। এটাই সঠিক কর্মনীতি এবং পরিণতির দিক থেকেও এটাই উত্তম।” [সূরা নিসাঃ ৫৯]
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আপনি তাফহীমুল কুরআনে লিখেছেন, “আলোচ্য আয়াতে যে কথা স্থায়ী এবং চূড়ান্ত মূলনীতির আকারে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তা এই যে, ইসলামী ব্যবস্থায় আল্লাহর নির্দেশ এবং রসূলের তরীকা মৌলিক আইন এবং সর্বশেষ ও চূড়ান্ত সনদের মর্যাদা রাখে। মুসলমানদের মাঝে অথবা সরকার ও জনগণের মাঝে যে বিষয়কে নিয়েই বিতর্ক সৃষ্টি হবে, সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের জন্য কুরআন ও সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আর এখানে যে ফায়সালা পাওয়া যাবে তার সামনে সবাই আত্মসমর্পণ করবে। এভাবে জীবনের যাবতীয় সমস্যার ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহর সুন্নাতকে সনদ, প্রত্যাবর্তনস্থল এবং সর্বশেষ কথা হিসেবে মেনে নেয়া ইসলামী সমাজের এমন একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য যা তাকে কুফরী জীবন ব্যবস্থা থেকে পৃথক করে দেয়। [তাফহীমুল কুরআন, ১ম খন্ড, সূরা নিসা, আয়াতঃ ৫৯।]
“আপনার এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে একথা পরিষ্কারভাবে সামনে এসে যায় যে, যাবতীয় বিতর্কিত বিষয়ে সর্বশেষ এবং সিদ্ধান্তকারী জিনিস হচ্ছে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ। এই প্রসংগে একটি জটিলতা হচ্ছে এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় এটাতো সম্পূর্ণই সম্ভব ছিলো যে, যখনই কোনো মতবৈষম্য দেখা দিয়েছে সাথে সাথে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু এখন যেহেতু তিনি আমাদের মাঝে বর্তমান নেই বরং শুধু তাঁর শিক্ষাই আমাদের সামনে উপস্থিত আছে, এ সময় যদি ইসলামের কোনো নির্দেশের ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে একটি ইসলামী ব্যবস্থায় কোন্ ব্যক্তি বা সংস্থা এই বিষয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার লাভ করবে যে, এ ব্যাপারে শরীয়াতের লক্ষ্য কি? আশা করি আপনি এ ব্যাপারে পথ প্রদর্শন করে বাধিত করবেন।
জবাবঃ
বিরোধ দূরীকরণে কুরআনের তিনটি মৌলিক হিদায়াত
এই প্রশ্নে যে জটিলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা দূর করার জন্য কুরআন, সুন্নাহ্, সাহাবাদের যুগের কার্যাবলী একত্র হয়ে আমাদের সাহায্য করে। সর্বপ্রথম কুরআনকে দেখুন। তা এ ব্যাপারে তিনটি মৌলিক হিদায়াত দান করেঃ
প্রথম হিদায়াতঃ আহলে যিকিরের কাছে প্রত্যাবর্তন
“এই আহলুয যিকর-এর কাছে জিজ্ঞেস করে দেখো, যদি তোমরা নিজেরা না জানো।” [সূরা নহলঃ ৪৩; আম্বিয়াঃ ৭]
এ আয়াতে “আহলুয যিকর” শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। কুরআন মজীদের পরিভাষায় ‘যিকির’ শব্দটি বিশেষভাবে আল্লাহ এবং তাঁর রসূল কোনো জাতিকে যে শিক্ষা দিয়েছেন, তা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃহ হয়েছে। আর যে লোকদের এই শিক্ষা দেয়া হয় তাদের বলা হয় ‘আহলুয-যিকর’। এই শব্দের অর্থ কেবল জ্ঞান [Knowledge] মনে করা যেতে পারেনা। বরং এর অর্থ অপরিহার্যরূপে কিতাব ও সুন্নাতের জ্ঞানই হতে পারে। অতএব এই আয়াত সিদ্ধান্ত দিচ্ছে যে, সমাজে প্রত্যাবর্তন স্থলের অধিকারী কেবল এমন লোকদের হওয়া উচিৎ, যারা আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান রাখেন এবং যে পথে চলার জন্য আল্লাহর রসূল শিক্ষা দিয়েছেন সে সম্পর্কে যারা অবহিত।
দ্বিতীয় হিদায়াতঃ কর্তৃত্বসম্পন্ন লোকদের কাছে প্রত্যাবর্তন
“আর যখনই তাদের সামনে শান্তিপূর্ণ অথবা ভীতিপ্রদ কোনো ব্যাপার এসে যায়, তখন এটাকে সর্বত্র প্রচার করে দেয়। অথচ তারা যদি এটাকে রসূল এবং নিজেদের কর্তৃত্ব সম্পন্ন লোকদের পর্যন্ত পৌঁছে দিতো, তাহলে যেসব লোক এর সঠিক ফলাফল বের করতে সক্ষম তারা এটা জানার সুযোগ পেতো।” [সূরা নিসাঃ ৮৩]
এ থেকে জানা গেলো, সমাজ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সম্মুখিন হবে- চাই তা শান্তিপূর্ণ অবস্থার সাথেই সম্পর্কিত হোক, অথবা যুদ্ধকালীন অবস্থার সাথে, ভয়ংকর ধরনের হোক অথবা সাধারণ প্রকৃতির- তাতে কেবল মুসলমানদের কর্তৃত্ব সম্পন্ন লোকেরাই হতে পারেন প্রত্যাবর্তনস্থাল, যাদের উপর সমাজের সামগ্রিক পরিচালনভার অর্পণ করা হয় এবং যারা ইস্তিম্বাত করার যোগ্যতা রাখেন। অর্থাৎ আগত সমস্যার প্রকৃতিও অনুধাবন করতে পারেন যে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ। এই আয়াত সমষ্টিগত সমস্যা এবং সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহে সাধারণ আহলে যিকিরদের পরিবর্তে কর্তৃত্বশীল লোকদের প্রত্যাবর্তনস্থল ঘোষণা করে। কিন্তু তাদেরকেও অবশ্যই আহলে যিকিরদের মধ্যেকার ব্যক্তিই হতে হবে। কেননা তাদের সামনে যে সমস্যা এসেছে তাতে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রসূলের দেয়া মৌখিক এবং কর্মগত হিদায়াতকে দৃষ্টির সামনে রেখে তারাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
তৃতীয় হিদায়াতঃ শূরা বা পরামর্শ পরিষদ গঠন
তারা নিজেদের যাবতীয় সামগ্রিক ব্যাপার পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে। [সূরা শূরাঃ ৩৮]
এই আয়াত পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, মুসলমানদের সমষ্টিগত ব্যাপারসমূহের সর্বশেষ ফায়সালা কিভাবে হওয়া উচিৎ?
এই তিনটি মূলনীতিকে যদি একত্র করে দেখা যায় তাহলে সমস্ত বিতর্কিত বিষয়ে “ ফারুদ্দুহু ইলাল্লাহি ওয়ার রসূলি”র উদ্দেশ্য পূর্ণ করার বস্তাব পন্থা হচ্ছে এই যে, মানুষের জীবনে সাধারণত যেসব সমস্যা এসে থাকে তা তারা আহলুয যিকিরদের কাছে রুজু করবে এবং তারা তাদের বলে দেবেন, এ ব্যাপারে আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের কি নির্দেশ রয়েছে। যেসব বিষয় রাষ্ট্র ও সমাজের দিক থেকে গুরুত্বের দাবীদার, তা কর্তৃত্ব সম্পন্ন লোকদের (উলিল আমর) সামনে পেশ করতে হবে। তারা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবেন যে, আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহর সুন্নাতের আলোকে কোন্ জিনিস হক ও সত্যের অধিক কাছাকাছি?
নববী যুগে উল্লেখিত মূলনীতিসমূহের প্রতি গুরুত্ব আরোপে
এখন দেখা যাক রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কল্যাণময় যুগে এবং তাঁর পরে খিলাফতে রাশেদার যুগের কার্যপ্রণালী কিরূপ ছিলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবদ্দশায় যেসব বিষয় সরাসরি তাঁর কাছে পৌঁছতো, সেগুলোর ক্ষেত্রে আল্লাহ্ ও তারঁ রসূলের উদ্দেশ্য বর্ণনা এবং তদনুযায়ী বিতর্কিত বিষয়ে ফয়সালাকারী ছিলেন তিনি নিজিই। কিন্তু পরিষ্কার কথা হচ্ছে এই যে, গোটা ইসলামী রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা জনবসতি যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতো তার সবই সরাসরি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পেশ করা হতোনা এবং ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছ থেকে সিদ্ধান্ত অর্জন করা হতোনা। এর পরিবর্তে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে তাঁর পক্ষ থেকে শিক্ষকগণ নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। তারা লোকদের আল্লাহর দীনের শিক্ষা দান করতেন। সাধারণ লোকেরা নিজেদের দৈনন্দিন ব্যাপারসমূহের ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে জেনে নিতো যে, আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ কি এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন্ তরীকা শিখিয়েছেন। তাছাড়া প্রতিটি এলাকায় গভর্ণর, কার্যনির্বাহী অফিসার এবং বিচারক নিযুক্ত থাকতো। তারা নিজ নিজ কর্মপরিসরে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান পেশ করতো। এই লোকদের জন্য ‘ফারুদ্দুহু ইলাল্লাহি ওয়ার রসূলি’র উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যে পন্থা পছন্দ করেছেন তা হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিখ্যাত হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ
“রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুয়ায ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ইয়ামনের কাযী করে পাঠালেন কখন জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কিভাবে ফায়সালা করবে? তিনি আরয করলেন, আল্লাহর কিতাবে যে হিদায়াত রয়েছে তদনুযায়ী। রসূলুল্লাহ বললেনঃ যদি আল্লাহর কিতাবে না পাওায়া যায়? তিনি আরয করলেন, তাহলে রসূলের সুন্নাহ্ অনুযায়ী। রসূলুল্লাহ বললেনঃ আল্লাহর রসূলের সুন্নাতেও যদি না পাওয়া যায়? তিনি আরয করলেন, আমি আমার রায়ের মাধ্যমে [সত্য পর্যন্ত পৌছার] পূর্ণ চেষ্টা করবো। এর উপর তিনি বললেনদঃ যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আল্লাহর রসূলের দূতকে এমন পন্থা অবলম্বন করার তৌফিক দিয়েছেন যা আল্লাহর রসূলের পছন্দনীয়।“ [তিরমিযীঃ আবওয়াবুল আহকাম, আবু দাউদঃ কিতাবুল আকদিয়া]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কল্যাণময় যুগে পরামর্শ পুরষদ [শূরা] ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং এমন প্রতিটি ব্যাপারে, যে সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি কোনো নির্দেশ পাননি- সমাজের রায় প্রদানের যোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের সাথে পরামর্শ করতেন। তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো, নামাযের ওয়াক্তসমূহে লোকদের একত্র করার জন্য কি পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে, এ সম্পর্কে তিনি যে পরামর্শ গ্রহণের ব্যবস্থা করেছিলেন তা। আর এর ফলশ্রুতিতেই শেষ পর্যন্ত তিনি আযানের পন্থা নির্ধারণ করেন।
খিলাফতে রাশেদার যুগে উল্লেখিত মূলনীতির প্রতি গুরুত্বারোপ
রিসালাত যুগের পর খিলাফতে রাশেদার যুগেও প্রায় এই কর্মপন্থাই কার্যকর ছিলো। শুধু এতোটুকু পার্থক্য ছিলো যে, রিসালাত যুগে স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্তমান ছিলেন। এজন্য যাবতীয় বিষয়ের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছ থেকেই গ্রহণ করা যেতো। পরবর্তীকালে তাঁর সত্তা আর প্রত্যাবর্তনস্থল [মারজা] রইলোনা বরং তাঁর রেখে যাওয়া ঐতিহ্য হয়ে গেলো প্রত্যাবর্তনস্থল, যা তাঁর সুন্নাতের আকারে লোকদের কাছে সংরক্ষিত ছিলো। এই যুগে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি সংস্থার অস্তিত্ব দেখা যায়। এগুলো নিজ নিজ স্থান ও অবস্থানের দিক থেকে “ফারুদ্দুহু ইলাল্লাহি ওয়ার রসূলি”র উদ্দেশ্য পূর্ণ করতোঃ
১. সাধারণ আলেম সমাজ, যারা কিতাবুল্লাহর জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন এবং যাদের কাছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালাসমূহ, অথবা তাঁর কর্মপন্থা, অথবা তাঁর অনুমোদন [অনুমোদন (তাকরীর) বলতে বুজায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের যুগে কোনো কাজ করা হয়েছিল এবং তিনি বহাল রেখেছেন।] সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান বর্তমান ছিলো।
কেবল সাধারণ লোকেরাই তাদের জীবনের বিভিন্ন ব্যাপারে এদের কাছ থেকে ফতুয়া জানতেননা বরং খোলাফায়ে রাশেদীনেরও যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এটা জানার প্রয়োজন দেখা দিতো যে, সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো নের্দেশ দিয়েছেন কিনা- তখন এই লোকদের কাছে রুজু করতেন। কখনো কখনো এরূপও হতো যে, সমসাময়িক খলীফা অজ্ঞতা বশত কোনো ব্যাপারে নিজের রায়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দিতেন, অতপর যখন জানা যেতো যে এ ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভিন্নতর সিদ্ধান্ত বর্তমান রয়েছে, তখন তিনি নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নিয়েছেন। এই আলেম সমাজের বর্তমান থাকাটা শুধু এতোটুকু উপকারীই ছিলোনা যে, ব্যক্তিগতভাবে তারা জনসাধারণ ও ক্ষমতাসীন লোকদের [উলিল আমর] জন্য ইলমের একটি মাধ্যমের কাজ দিতেন বরং এর চেয়েও বড় ফায়দা এই ছিলো যে, তারা সামগ্রিকভাবে সে কোনো আদালত, কোনো সরকার এবং কোনো মজলিশে শূরা যেনো আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রসূলের সুন্নাতের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিতে না পারে দায়িত্বও পালন করেন। তাদের সুদৃঢ় রায় সাধারণ ইসলামী ব্যবস্থার আশ্রয়াধীন ছিলো। প্রতিটি ভুল সিদ্ধান্তের সমালোচনার জন্য তাদের সজাগ সতর্ক থাকাটা ইসলামী ব্যবস্থার সঠিকভাবে চলার জন্য গ্যারান্টি ছিলো। কোনো বিষয়ে তাদের ঐক্যমত প্রমাণ করতো যে, এই বিশেষ ব্যাপারে দীনের রাস্তা সুনির্ধারিত এ থেকে বিচ্যুত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারেনা। আবার তাদের মতবিরোধের অর্থ এই ছিলো যে, এ ব্যাপারে দুই অথবা ততোধিক মত পোষণের সুযোগ রয়েছে, যদিও সিদ্ধান্ত একটির উপরই হয়েছে। তাদের বর্তমান থাকার কারণে উম্মতের মধ্যে সাধারণভাবে কোনো বিদায়াত চালু হওয়া অসম্ভব ছিলো। কেননা সর্বত্র দীনের জ্ঞানসম্পন্ন লোক এ ব্যাপারে পাকড়াও করার জন্য বর্তমান ছিলো।
২. কাযা অর্থাৎ বিচার বিভাগ। কাযী শূরাইর নামে লিখিত হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর একটি নির্দেশনামায় এর ব্যাখ্যা বর্তমান রয়েছেঃ
“আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ অনুযায়ী ফায়সালা করুন। যদি আল্লাহর কিতাবে না থাকে, তাহলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামেরা সুন্নাহ্ অনুযায়ী ফায়সালা করুন। যদি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের সুন্নাতে না থাকে, তাহলে সালিহীনগণ যে ফায়সালা করেছেন তদনুযায়ী ফায়সালা করুন। কিন্তু যদি কোনো ব্যাপারের নির্দেশ আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের সন্নাতে পাওয়া না যায় এবং সালিহীনদের ফায়সালার নজীরও না পাওয়া যায় তাহলে আপনার এখতিয়ার রয়েছে, ইচ্ছা করলে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, অথবা অপেক্ষাও করতে পারেন। তবে আমার মতে অপেক্ষা করাটাই আপনার জন্য অধিক কল্যাণকর।”[অপেক্ষা করার দ্বিবিধ অর্থ হতে পারে। এক, অন্য কোনো আদালত অনুরূপ কোনো ব্যাপারে সামনে অগ্রসর হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত স্থাপন করে কিনা। দুই, বিচারক নিজে ফয়সালা করার পরিবর্তে বিষয়টি পূর্বোল্লেখিত তৃতীয় সংস্থার কাছে রুজু করবে।] [নাসায়ী, কিতাবুল আদাবিল কুদাত]
এই পন্থাকে হযরত আব্দুল্লাহ মাসউদ রাদয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিম্নোক্ত ভাষায় ব্যক্ত করেছেনঃ
“এমন এক যামানা অতীত হয়েছে যখন আমরা ফায়সালা করতামনা এবং ফায়সালা করার মর্যাদাও আমাদের ছিলোনা। [অর্থাৎ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের যুগ]। এখন তাকদীরে ইলাহীর কারণে আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যা তোমরা দেখতে পাচ্ছো। অতএব এখন তোমাদের সামনে ফায়সালার জন্য কোনো বিষয় উত্থাপিত হলে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফায়সালা করবে। যদি এমন কোনো বিষয় এসে যায় যার হুকুম আল্লাহর কিতাবে বর্তমান নেই, তাহলে এর ফায়সালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামও অনুরূপ বিষয়ের ফায়সালা করেননি তাহলে সালিহীনগণ যে ফায়সালা করেছেন তদনুযায়ী ফায়সালা করবে। যদি এমন কোনো বিষয় সামনে এসে যায় যার হুকুম আল্লাহর কিতাবেও বর্তমান নেই, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামও অনুরূপ বিষয়ের সিদ্ধান্ত দেন নাই এবং সালিহীনদের থেকেও অনুরূপ বিষয়ের সিদ্ধান্ত বর্তমান নেই, তাহলে সে বিষয়ে ইজতিহাদের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার পূর্ণ চেষ্টা করবে। কিন্তু একথা বলবেনা, আমি ভয় করছি, আমি ভয় পাচ্ছি। কেননা হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। আর এ দু’টি জিনিসের ক্ষেত্রে এমন ফায়নসালা করতে হবে যা ব্যক্তির মনকে দোদুল্যমান না করতে পারে। আর দোদুল্যমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে ব্যক্তিকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।” [নাসায়ী, কিতাবুল আদাবিল কুদাত]
এই বিচার বিভাগ কেবল জনসাধারণের পারস্পরিক বিবাদের মীমাংসা করারই অধিকারী ছিলোনা বরং তা সরকারী প্রাশাসনের [Executive] বিরুদ্ধেও জনগণের অভিযোগ শ্রবণ করতো এবং তা ফায়সালা দান করতো। এই আদালতের সামনে হাযির হওয়ার ব্যাপারে কোনো গভর্নরও আইনের উর্ধ্বে ছিলোনা এবং সমসাময়িক খলীফা এবং সরকারকেও। যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত বা সরকারী অভিযোগ থাকতো তাহলে আদালতের সাহায্য নিতে হতো এবং আদালতই সিদ্ধান্ত করতো যে, আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের বিধানের আলোকে এর সঠিক ফায়সালা কি হতে পারে।
৩. উলিল আমর, অর্থাৎ খলীফা এবং তাঁর মজলিসে শূরা। এটা সর্বশেষ কর্তৃত্বশালী সংস্থা যা কুরআনের হিদায়াত অনুযায়ী পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো যে, সমাজ এবং রাষ্ট্র যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, সেসব ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সুন্নাতে কি হুকুম প্রমাণিত রয়েছে? যদি কোনো ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাতের ফায়সালা বর্তমান না থাকে তাহলে এ ব্যাপারে কোন্ ধরনের কর্মপন্থা দীনের মূলনীতি ও তার প্রাণসত্তা এবং মুসলিম সমাজের সার্বিক স্বার্থের দিক থেকে সত্যের অধিকতর কাছাকাছি? এই সংস্থার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত হাদীস এবং ফিকহের গ্রন্থসমূহে নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে সংকলিত হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফায়সালা গ্রহণ করাকালীন সময়ে শূরার বৈঠকে সাহাবাদের মধ্যে যে আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছিলো তাও সংকলিত হয়েছে। তার মূল্যায়ন করলে জানা যায়, এই সংস্থা পূর্ণ কঠোরতার সাথে যে মূলনীতির অনুসরণ করতো তা ছিলো এই যে, প্রতিটি বিষয়ে সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালার কিতাবের দিকে রুজু করতে হবে। অতপর জানতে হবে যে, এই ধরনের কোনো বিষয় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের যুগে উদ্ভূত হলে তিনি এ ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। অতপর যদি এ দুটি উৎস থেকে কোনো পথনির্দেশ না পাওয়া যায় তাহলে কেবল তখনই নিজের নির্ভুল চিন্তার সাহায্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো ব্যাপারেই আল্লাহর কিতাবের কোনো আয়াত অথবা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ্ থেকে কোনো নযীর পাওয়া গেলে তারা তা থেকে সরে গিয়ে ভিন্নতর কোনো ফায়সালা করতেননা। সাহাবাদের গোটা যুগে এই মূলনীতি বিরোধী একটি দৃষ্টান্তও পাওয়া যাবেনা। যদিও রাষ্ট্রে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এখতিয়ার কার্যত উলিল আমরের হাতেই ছিলো, কিন্তু আইনত কুরআন এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ্ সর্বশেষ সিদ্ধান্তকারী সনদ হিসেবে স্বীকৃত ছিলো। মুসলিম সমাজও এই ভরসার ভিত্তিতে তাদের কর্তৃত্বের আনুগত্য করতো যে, তারা নিজেদের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাতের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যাবেনা। তাদের কারো মন মগজে এই ধারণা পর্যন্ত ছিলোনা যে, তারা কুরআনের অকাট্য প্রমাণের পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন অথবা নির্দেশ দেয়ার অধিকারী। অনুরূপভাবে তাদের কারো মনে এরূপ দূরতম ধারণাও ছিলোনা যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁর যুগের নির্দেশদাতা ছিলেন এবং আমরা আমাদের যুগের নির্দেশদাতা এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁর শাসনকালে যে ফায়সালা দিয়েছেন তার নযীর অনুসরণ করতে আমরা বাধ্য নই। তাঁর ইন্তিকালের পর যেদিন খিলাফত নামক সংস্থা অস্তিত্ব লাভ করলো, সেদিনই প্রথম খলীফা তাঁর ভাষণে ঘোষণা করলেনঃ “আমি যতক্ষণ আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবো তোমরা ততক্ষণ আমার আনুগত্য করবে। আমি যদি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হই তাহলে আমার আনুগত্য করা তোমাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।”
উপরোক্ত ঘোষণা থেকে পরিষ্কার জানা যায়, খিলাফতের সংস্থা কেবল এই উদ্দেশ্যেই কায়েম হয়েছিলো যে, খলীফা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবেন এবং উম্মাত খলীফার আনুগত্য করবে। অন্য কথায় জনগণের জন্য খলীফার আনুগত্য ছিলো শর্তসাপেক্ষ আর তা হচ্ছে তিনি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের নির্দেশের আনুগত্য করবেন। এই শর্ত বিলীয়মান হয়ে গেলেই উম্মতের উপর থেকে খলীফার আনুগত্য করার কর্তব্য আপনা আপনি রহিত হয়ে যায়।
বিতর্কের সমাধানে সাধারণ জ্ঞানের দাবী
অতপর সাধারণ জ্ঞানের সাহায্যে সামান্য চেষ্টা করে দেখুন, কুরআন মজীদের আলোচ্য আয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি এবং তার দাবী কার্যত কিভাবে পূর্ণ হতে পারে। এই আয়াতে গোটা মুসলিম সমাজকে সম্বোধন করে তাকে ক্রমিক পর্যায়ে তিনটি জিনিসের আনুগত্য করতে বাধ্য করে। প্রথমে আল্লাহর আনুগত্য, অতপর তাঁর রসূলের আনুগত্য এবং সমাজের মধ্য থেকে নির্বাচিত উলিল আমরের আনুগত্য। বিতর্কিত বিষয়ের ক্ষেত্রে এই আয়াতের নির্দেশ হচ্ছে, এর ফায়সালার জন্য আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের দিকে রুজু করো। এ থেকে আয়াতের যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রকাশ পায় তা হচ্ছে- আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করা সমাজের জন্য বাধ্যতামূলক। আর উলিল আমরের আনুগত্য আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের অধীন। মতবিরোধ কেবল জনসাধারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। জনসাধারণ এবং উলিল আমরের মধ্যেও মতবিরোধ হতে পারে। মতবিরোধের যাবতীয় ক্ষেত্রে সর্বশেষ সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষ উলিল আমর নয় বরং আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল। তাঁদের যে নির্দেশ পাওয়া যাবে তার সামনে জনসাধারণকেও এবং উলিল আমরেকেও মাথা নতো করতে হবে।
এখন প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, ফায়সালার জন্য আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের দিকে রুজু করার তাৎপর্য কি? একথা পরিষ্কার যে, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ্ স্বয়ং সামনে উপস্থিত থাকবেন এবং তাঁর সামনে মুকদ্দমা পেশ করে সিদ্ধান্ত হাসিল করা হবে, বরং এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন করে জানতে হবে বিতর্কিত বিষয়ে তাঁর নির্দেশ কি? অনুরূপভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের দিকে প্রত্যাবর্তন করার তাৎপর্যও এই হতে পারেনা যে, রসূলের সত্ত্বার কাছ থেকে সরাসরি সিদ্ধান্ত লাভ করতে হবে। কিন্তু নিঃসন্দেহে এর অর্থ হচ্ছে এই যে, রসূলের শিক্ষা এবং তাঁর কথা ও কাজ থেকে পথনির্দেশ লাভ করতে হবে। এটাতো স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায়ও সম্ভব ছিলোনা যে, এডেন থেকে তাবুক পর্যন্ত এবং বাহরাইন থেকে জিদ্দা পর্যন্ত গোটা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক নিজের প্রতিটি ব্যাপারের সিদ্ধান্ত সরাসরি তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করবে। এ যুগেও রসূলের সুন্নাহই নির্দেশের উৎস।
অতপর দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, মতবিরোধের ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রসূলের সুন্নাহ্ থেকে ফায়সালা হাসিল করার পন্থা কি হতে পারে? পরিষ্কার কথা হচ্ছে এই সিদ্ধান্ত মানুষই দেবে, কিতাব ও সুন্নাহ্ নিজে তো আর বলবেনা। কিন্তু অবশ্যই তাকে কিতাব ও সুন্নাতের নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। আর কিতাব ও সুন্নাতের ভিত্তিতে ফায়সালাকারী অবশ্যই মতভেদে লিপ্ত পক্ষদ্বয় হতে পারেনা, তাদের ছাড়া এমন কোনো তৃতীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তি বা সংস্থা হতে হবে, যে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। কোন্ ধরনের মতবিরোধের ক্ষেত্রে ফায়সালা দেয়ার জন্য কোন্ ব্যক্তি উপযুক্ত হবে- তা বিতর্কের ধরন ও প্রকৃতির উপর নির্ভর করবে। এক ধরনের মতবিরোধ এমন রয়েছে যার মীমাংসা যে কোনো জ্ঞানবান ব্যক্তি করতে পারে। অন্য এক ধরনের বিবাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন হবে। আবার কতিপয় বিবাদের ধরন এমনও হতে পারে যার চূড়ান্ত ফায়সালা উলিল আমর ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রেই ফায়সালার উৎস হবে কুরআন ও সুন্নাহ্।
এই সেকথা যা সাধারণ জ্ঞানের সাহায্যে আয়াতের শব্দগুলোর উপর চিন্তা করে প্রত্যেক ব্যক্তিই অনুধাবন করতে পারে। তবে শর্ত হচ্ছে তার মন মগজে কোনোরূপ বক্রতা থাকবেনা। এখন এটাও এক নযর দেখা যাক যে, এই আয়াতের পেশকৃত ব্যবস্থা এবং তার কার্যকর পন্থা অনুধাবন করার ক্ষেত্রে দুনিয়ার প্রসিদ্ধ পন্থা আমাদের কি সাহায্য করে। দুনিয়াতে আজ আইনের শাসনের [Rule of Law] খুব চর্চা চলছে এবং বলা হচ্ছে যে, দুনিয়াতে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের সার্বভৌমত্ব একান্ত অপরিহার্য। এর সামনে বড় ছোট সবাই সমান বিবেচিত হবে এবং জনসাধারণ, সরকারী কর্তৃপক্ষ ও স্বয়ং সরকারের উপর নিরপেক্ষ পন্থায় কার্যকর হবে। একটি সংসদেরই এই আইন প্রণয়ন করা উচিৎ। কিন্তু যখন তা আইনে পরিণত হয়ে যাবে তখন এটা বলবৎ থাকা পর্যন্ত স্বয়ং সংসদকেও তার অনুসরণ করতে হবে। আইনের সার্বভৌমত্বের এই মতবাদকে যেখানেই বাস্তবরূপ দান করা হয়েছে, সেখানেই চারটি জিনিসের উপস্থিতি অপরিহার্য মনে করা হয়েছেঃ
১. এমন একটি সমাজ যা আইনের প্রতি হবে শ্রদ্ধাশীল এবং তার আনুগত্য করার প্রকৃতই ইচ্ছা রাখে।
২. সমাজে এমন অনেক লোক থাকতে হবে যারা আইন সম্পর্কে অবগত, যারা জনগণকে আইনের অনুসরণের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। এবং তাদের সামগ্রিক জ্ঞান ও প্রভাবের দরুন সমাজও আইনের পথ থেকে বিচ্যুত হতে পারবেনা এবং সরকারী কর্তৃপক্ষও আইনকে উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারবেনা।
৩. একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ থাকবে, যা জনসাধারণ, সরকারী কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মধ্যেকার বিবাদে আইন অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত দান করবে।
৪. একটি অতীব শক্তিশালী সংস্থা থাকবে, যা সমাজে উদ্ভূত যাবতীয় সমস্যার সর্বশেষ সমাধান পেশ করবে এবং তা আইন হিসেবে সমাজে কর্যকর হবে।
এসব বিষয় সামনে রেখে যখন আপনি চিন্তা করবেন তখন জানতে পারবেন, কুরআন মজীদের আলোচ্য আয়াত মূলত ইসলামী সমাজে আইনের শাসন কায়েম করে এবং তাকে কার্যকর করার জন্য উল্লেখিত চারটি জিনিসের প্রয়োজন। যদি কোনো পার্থক্য থেকে থাকে তাহলে তা হচ্ছে এই যে, কুরআন যে আইনের শাসন কায়েম করে সে মূলতই তার অধিকারী আর দুনিয়াতে যে আইনের সার্বভৌমত্ব কায়েম করা হচ্ছে তা তার অধিকারী নয়। কুরআন আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আইনকে সার্বভৌম আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যার সামনে সবাইকে মাথা নতো করে দিতে হবে এবং যার অধীন হওয়ার ক্ষেত্রে সবাই সমান। তা এমন একটি সমাজকে সম্বোধন করে যা এই আইনের উপর ঈমান রাখে এবং নিজেদের বিবেকের দাবীতে তার আনুগত্য করে। এর উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে- সমাজে আহলুয যিকরের এক ব্যাপক সংখ্যক লোক বর্তমান থাকবে, যাদের সাহায্যে সমাজের সদস্যগণ নিজেদের জীবনের ব্যাপারসমূহে প্রতিটি স্থানে প্রতিটি মুহূর্তে এই সার্বভৌম আইন থেকে পথ নির্দেশ লাভ করতে থাকবে এবং যাদের মাধ্যমে জনমত এই ব্যবস্থার হিফাজতের জন্য সব সময় সজাগ থাকবে। এর আরো দাবী হচ্ছে এই যে, একটি বিচার ব্যবস্থা বর্তমান থাকতে হবে, যা শুধু জনসাধারণের মধ্যেই নয় বরং জনসাধারণ এবং প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের মাঝেও এই সার্বভৌম আইন মুতাবিক ফায়সালা করবে। তা উলিল আমরের এমন একটি সংস্থারও দাবী করে, যে নিজেও এই সার্বভৌম আইনের অধীন হবে এবং সমাজের সামগ্রিক প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং এর অধীনে ইজতিহাদ করার সর্বশেষ এখতিয়ারও ব্যবহার করবে। [তরজমানুল কুরআন, রজব ১৩৭৭, এপ্রিল ১৯৫৮০]
একাদশ অধ্যায়
কতিপয় সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বিষয়
১. ইসলামী রাষ্ট্রের কয়েকটি দিক
২. খিলাফাত ও স্বৈরতন্ত্র
৩. জাতীয় রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ
৪.অমুসলিমদের অধিকার
৫. আরো কয়েকটি বিষয়
মাওলানা মওদূদী দেশে সাংবিধানিক বিতর্ক চলাকালে সৃষ্ট বিভিন্ন সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক (তাত্ত্বিক) বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে বক্তব্য রেখেছেন। কতক বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন লাহোরের দাংগা সংক্রান্ত তদন্ত আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে, কতক বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন পত্রপত্রিকায় প্রদত্ত বিবৃতিতে ও সভাসমিতিতে প্রদত্ত বক্তৃতায়। আবার কতক বিষয়ের জট খুলে দিয়েছেন লিখিত প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে। এ জাতীয় সক্তব্যের সংখ্যা যদিও প্রচুর, তবে আমরা এ সবের মধ্য থেকে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য বাছাই করে এখানে পেশ করছি। -সংকলক
১. ইসলামী রাষ্ট্রের কয়েকটি দিক
ক. ধর্মেহীন গণতন্ত্র, ধর্মীয় রাষ্ট্রে ও ইসলামী রাষ্ট্র
যে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ আমাদের লক্ষ্য, তা পাশ্চাত্য পরিভাষা অনুযায়ী কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্রও [Theocracy] নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও নয়, বরং তা হচ্ছে এই উভয় ব্যবস্থার মধ্যবর্তী এক পৃথক ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আজকাল পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকদের মনে “ইসলামী রাষ্ট্র” সংক্রান্ত ধারণাকে কেন্দ্র করে যে দ্বন্দ্ব ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, মূলত সংশ্লিষ্ট পাশ্চাত্য পরিভাষাগুলোর ব্যবহার থেকেই এর উৎপত্তি। পাশ্চাত্যের এই পরিভাষাগুলো স্বাভাবতই এবং অনির্বার্যভাবেই পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণা ও চিন্তাধারা, এবং পাশ্চাত্যের ইতিহাসের একটা ধারবাহিক রূপও পাঠকের মানসপটে তুলে ধরে। পাশ্চাত্য পরিভাষায় ধর্মীয় রাষ্ট্র তথা [Theocracy] দুটো মৌলিক ধারণার সমষ্টিঃ
১. আল্লাহর রাজত্ব, তবে সেটা আইনগত সার্বভৌমত্ব [Legal Sovereignty] অর্থে।
২. পাদ্রী ও ধর্মযাজকদের একটা গোষ্ঠী, যারা আল্লাহর প্রতিনিধি ও মুখপাত্র হয়ে আল্লাহর এই রাজত্বকে আইনগত ও রাজনৈতিকভাবে কার্যকর করে।
উল্লিখিত দুটো ধারণার ওপর তৃতীয় একটা বাস্তব ব্যাপারও সংযুক্ত হয়েছে।সেটি এই যে, হযরত ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইঞ্জীলের নৈতিক শিক্ষা ছাড়া কোনো আইনগত নির্দেশাবলী রেখে না যাওয়ার কারণে সেন্টপল শরীয়াতকে অভিশাপ আখ্যায়িত করে খৃষ্টানজগতকে তাওরাতের নির্দেশাবলী থেকে অব্যাহতি দেন। এরপর ইবাদত, সামাজিক আচার আচরণ, লেনদেন ও রাজনীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে খৃষ্টানদের যখন বিভিন্ন আইন ও বিধির প্রয়োজন দেখা দিলো, তখন তাদের ধর্মযাজকরা মনগড়া আইন দিয়ে সেই প্রয়োজন পূরণ করলো। আর সেসব আইনকে আল্লাহর আইন বলে চালিয়ে দিলো। ইসলামে এই ধর্মীয় রাষ্ট্রের কেবল একটা অংশ স্থান পেয়েছে। সে অংশটি হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্বের আকীদা, এর দ্বিতীয় অংশটি [অর্থাৎ ধর্মযাজকদের শাসন] ইসলামে আদৌ গৃহীত হয়নি। তৃতীয় অংশটির স্থলে ইসলামে কুরআন স্বীয় সর্বব্যাপী ও বিস্তৃত বিধিবিধানসহ বিদ্যমান। আর তার ব্যাখ্যার জন্য রয়েছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও কর্মকান্ডের বিবরণ সম্বলিত হাদীস। এসব হাদীসের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করার নির্ভরযোগ্য উপায় উপকরণও আমাদের হাতে রয়েছে। এ দুটি উৎস থেকে আমরা যা কিছু পাই, সেটাই আমাদের আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বিধান। এছাড়া কোনো ফকীহ, ইমাম, ওলী বা আলেমের এ মর্যাদা নেই যে, তার কথা ও কাজকে আল্লাহর হুকুমের মতো নির্বিবাদে মেনে নেয়া যেতে পারে। এই সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান থাকতে ইসলামী রাষ্ট্রকে পাশ্চাত্যের পরিভাষা অনুসারে ধর্মীয় রাষ্ট্র [Theocracy] বলা সম্পূর্ণ ভুল।
অপরদিকে পাশ্চাত্যে যে জিনিসকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র [Democracy] বলা হয়। তাও দুটো মৌলিক ধারণার সমন্বিত রূপ। যথাঃ
১. জনগণের আইনগত ও রাজনৈতিক সার্বভৌত্ব, যা কার্যকরী হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন অথবা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মাধ্যমে।
২. রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার জনগণের অবাধ ও স্বাধীন ইচ্ছা বলে গঠিত ও পরিবর্তিত হতে পারবে।
ইসলাম এর কেবল দ্বিতীয় অংশকে পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করে। আর প্রথমাংশকে দুইভাগে বিভক্ত করে। আইনগত সার্বভৌমত্বকে সে শুধু আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে। এজন্য কুরআন অথবা হাদীসের মাধ্যমে প্রাপ্ত আল্লাহর আইন ও বিধান রাষ্ট্রের জন্য অকাট্য ও অপরিবর্তনীয় আইনের মর্যাদা রাখে। আর রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বকে “সার্বভৌমত্বের” পরিবর্তে খিলাফত [অর্থাৎ প্রকৃত শাসক আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব] নামে আখ্যায়িত করে রাষ্ট্রের সাধারণ মুসলিম অধিবাসীদের কাছে সমর্পণ করে। এই খিলাফত মুসলিম জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অথবা তাদের আস্থা সম্পন্ন প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। এই মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান থাকতে ইসলামী রাষ্ট্রকে পাশ্চাত্য পরিভাষা অনুসারে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র [Democracy] বলাও সঠিক নয়।
খ. ইসলামে আইন প্রণয়ন
উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে একথা আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ইসলাম যে ধরনের রাষ্ট্র গঠন করে তাতে একটা আইনসভা [Legislature] থাকা জরুরী। এ আইনসভা মুসলিম জনগণের আস্থা সম্পন্ন প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হবে এবং তার সর্বসম্মত রায় অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের রায় ইসলামী রাষ্ট্রে আইনরূপে চালু হবে। এই আইনসভার গঠন, তার কার্যপরিচালনা বিধি এবং তার সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতি ইসলামে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। প্রত্যেক যুগের পরিস্থিতি পরিবেশ ও প্রয়োজনের দাবী অনুসারে এর আলাদা আলাদা ধরণ ও রূপ অবলম্বন করা যেতে পারে। কিন্তু নীতিগতভাবে যে বিষয়গুলো স্থির করে দেয়া হয়েছে, তা হচ্ছেঃ
১. রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকান্ড পরামর্শের ভিত্তিতে চালাতে হবে।
২. সিদ্ধান্তসমূহ সর্বসম্মতি অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতিক্রমে গৃহীত হবে।
৩. কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত সর্বসমম্মতভাবেও গ্রহণ করা যাবেনা।
৪. কুরআন ও সুন্নাতের বিধির যে ব্যাখ্যা সর্বসম্মতভাবে অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় মুতাবিক গৃহীত হবে, তা রাষ্টীয় আইনে পরিণত হবে।
৫. যেসব ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর কোনো নির্দেশ থাকেনা। সেসব ব্যাপারে মুসলিম জনপ্রতিনিধিরা আইন প্রণয়ন করতে পারেন এবং তাদের সর্বসম্মত অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
৬. নাগরিকদের মধ্যে, সরকার ও জনগণের মধ্যে, আইনসভা ও জনগণের মধ্যে অথবা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা অংশের মধ্যে যে কোনো বিবাদ বিসম্বাদ ঘটুক, তার নিস্পত্তি যাতে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে করা যায়, সেজন্য একটা যুৎসই ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হবে।
গ. ইসলামী রাষ্ট্র কেনো?
পাকিস্তানকে এ ধরনের একটা ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার সপক্ষে আমাদের দাবীর একাধিক যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে তিনটিঃ
প্রথমঃ এটি আমাদের ঈমানের ঐকান্তিক দাবী। স্বাধীনতা ও সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের পরও এবং কুরআন ও রসূলের বাণীর সত্যতায় বিশ্বাসী হয়েও যদি আমরা কুরআন ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশাবলী কার্যকর করতে না পারি, তাহলে আমরা আমাদের ঈমানে কখনো নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক হতে পারিনা।
দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী করাই হয়েছিলো এজন্য যে, এখানে আল্লাহ্ ও রসূলের হুকুম বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা হবে। আর এই আকাংখ্যার পেছনেই লক্ষ লক্ষ মুসলিম নর নারী নিজেদের জান মাল ও ইজ্জত বিসর্জন দিয়েছিলো। তৃতীয়তঃ পাকিস্তানের অধিবাসীদের বিপুল সংখ্যাগুরু অংশ চায় যে, তাদের জাতীয় রাষ্ট্র একটা ইসলামী রাষ্ট্র হোক এবং সংখ্যাগুরুর এই দাবীর বাস্তবায়ন সর্বাসস্থায় কাম্য। একথা সত্য যে, এখানে মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোক এমন রয়েছে যারা পাশ্চাত্য সভ্যতা ও কৃষ্টি এবং তার মতবাদগুলোকে সঠিক মনে করে এবং তাদের পক্ষে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা মেনে নেয়া দুষ্কর। তাছাড়া পাকিস্তানের আমলা শ্রেণীতেও এমন কিছু লোক বিদ্যমান, যাদের সমস্ত তাত্ত্বিক, মানসিক ও বাস্তব প্রশিক্ষণ পাশ্চাত্য ধাঁচের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার জন্যই হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ আয়োজন দেখে তাদের মনে নানা ধরনের ভীতি ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু যে জিনিস অনিবার্য ও অবধারিত, তার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে প্রস্তুত করাই সমীচীন, যেমন ইতিপূর্বে তাদের পূর্ব পুরুষেরা ইংরেজ শাসন সমাগত দেখে নিজেদেরকে নবযুগের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। তাদের অধিকাংশ নিজেদেরকে গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক রূপে জাহির করে থাকেন। এখন এটা তাদেরই ভেবে দেখা উচিত যে, মুষ্টিমেয় কিছু লোক বা- পরিবারের সুবিধার খাতিরে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যা চায়, তার পথরোধ করা কতোখানি সঠিক এবং কোথাকার গণতন্ত্র?
ঘ. ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের মর্যাদা সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলোর জবাব ধারাবাহিকভাবে নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
ক. ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদেরকে ইসলামী পরিভাষায় “যিম্মী” তথা “সংরক্ষিত নাগরিক” বলা হয়। “যিম্মী” কোনো গালি নয়। এটা শুদ্র বা ম্লেচ্ছের সমার্থকও নয়। আরবী ভাষার ‘যিম্মা’ শব্দটা [Guarantee] বা নিশ্চয়তার সমার্থক। যিম্মী সে ব্যক্তিকে বলা হয় যার অধিকার প্রদান ও সংরক্ষণের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্র গ্রহণ করেছে। ইসলামী সরকার এ দায়িত্ব শুধু নিজের পক্ষ থেকে বা মুসলিম অধিবাসীদের পক্ষ থেকে নয় বরং আল্লাহ্ ও রসূলের পক্ষ থেকে গ্রহণ করে। এ দায়িত্বের গুরুত্ব এতো বেশী যে, কোনো অমুসলিম দেশে যদি মুসলমানদেরকে পাইকারী হারে হত্যা করেও ফেলা হয়, তথাপি আমরা আমাদের দেশে অবস্থানরত ঐ দেশের অধিবাসীদের সমধর্মাবলম্বী যিম্মীদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারিনা। একটি ইসলামী রাষ্ট্রের আইনসভা তাদের শরীয়াত সম্মত অধিকারসমূহ ছিনিয়ে নেয়ার আদৌ কোনো অধিকার রাখেনা।
খ. যিম্মীরা তিন শ্রেণীরঃ এক যারা কোনো চুক্তির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছে। দুই, যারা যুদ্ধে বিজিত হয়েছে। তিন, যারা বিজিতও নয়, চুক্তিবদ্ধও নয়। প্রথম শ্রেণীর যিম্মীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী আচরণ করা হবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর যিম্মীদের শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত অধিকার প্রদান করা হবে। আর তৃতীয় শ্রেণীর যিম্মীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর অধিকার তো দেয়াই যাবে, উপরন্ত ইসলামী মূলনীতির পরিপন্থী নয় এবং আমাদের পরিস্থিতির আলোকে সমীচীন হয় এমন কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধাও আমরা তাদেরকে দিতে পারি।
গ. যিম্মীদের [অমুসলিম প্রজাদের] যে ন্যূনতম অধিকার শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত তা নিম্নরূপঃ পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্মীয় শিক্ষার অনুমতি, ধর্মীয় বই পুস্তকের মুদ্রণ ও প্রকাশনার অনুমতি, আইনের আওতায় ধর্মীয় আলোচনার অনুমতি, উপাসনালয়ের রক্ষণাবেক্ষণ, পারিবারিক আইনের রক্ষণাবেক্ষণ, জানমাল ও ইজ্জতের হিফাজত, দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনে মুসলমানদের সাথে পুরোপুরি সমতা, সরকারের সাধারণ কর্মকান্ডে মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যহীনতা, অর্থনৈতিক কায়কারবারের সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের মতো সমান সুযোগ দান। অভাবী হলে মুসলমানের ন্যায় যিম্মীদেরও রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সাহায্য লাভের সমান অধিকার। এসব অধিকার ইসলামী রাষ্ট্র শুধু কাগজে কলমেই দেয়না বরং সে আপন দীন ও ঈমানের আলোকে কার্যত তা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য। এক্ষেত্রে আদৌ একথা বিবেচনায় আনা হবেনা যে, অমুসলিম রাষ্ট্রগুলো মুসলমানদের সাথে কাগজে কলমেই বা কি কি অধিকার দিচ্ছে, আর বাস্তবেই বা কি দিচ্ছে।
ঘ. অমুসলিমদেরকে শহর এলাকা ছাড়া আর কোথাও উপাসনালয় বানাতে নিষেধ করা হয়েনি, তবে শহর এলাকায় অবস্থিত পুরানো উপাসনালয়গুলোর মেরামত করা যাবে। এখানে শহর এলাকা বলতে মুসলমানরা শুধুমাত্র নিজেদের বসবাসের জন্য যেসব শহর নির্মাণ করেছে, সেগুলোকে বুঝানো হয়েছে। যেমন কুফা, বসরা ও ফিসতাত। অন্যান্য শহরে নতুন উপাসনালয় নির্মাণ ও পুরানো উপাসনালয় মেরামতের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
ঙ. কিছু কিছু ফিকাহ শাস্ত্রীয় গ্রন্থে অমুসলিমদের ওপর পোশাক ইত্যাদির ব্যাপারে যেসব কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধের উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা ভুলবুঝাবুঝির শিকার হওয়া উচিত নয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের ফকীহগণ পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের তাগিদে যে তিন ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করেছিলেন তা হচ্ছেঃ
১. তাদেরকে সামরিক পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করা হয়েছিলো। মুসলমানদের নিষেধ করা হয়নি। কেননা সে সময় প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ওপর সামরিক চাকুরী করা বাধ্যতামূলক ছিলো। অমুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিলোনা।
২. মুসকলমানদেরকে অমুসলমানদের এবং অমুসলমানদেরকে মুসলমানদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ পোশাক পরতে নিষেধ করা হয়েছিলো। কেননা এধরনের সাদৃশ্য দ্বারা নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এতে আশংকা আছে যে, রকমারি কৃষ্টির মিশ্রণে একটা জগাখিচুড়ি কৃষ্টি তৈরী হয়ে যেতে পারে। এমন আশংকাও আছে যে, মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয়ে হতোদ্যম হয়ে অমুসলিমদের ভেতরে দাসসুলভ বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়ে যাবে। এধরনের দাসসুলভ মানসিকতার কারণে পরাজিত জাতি পোশাক পরিচ্ছদ ও চালচলনে বিজয়ী জাতির অনুকরণ করতে থাকে। ইসলাম এধরনের মানসিকতা কোনো কাফিরের মধ্যেও সৃষ্টি হোক তা দেখতে চায়না। এজন্য অমুসলিমদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা নিজেদের কৃষ্টি সংস্কৃতি, চালচলন, বেশভূষা ও নিজেদের ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলো যেনো সংরক্ষণ করে এবং মুসলমানদের অনুকরণ না করে। হানাফী ফিকাহর বিখ্যাত গ্রন্থ “বাদায়েউস্ সানায়ে” তে এ নির্দেশটি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
অমুসলিমদের এমন আলামত ও নিদর্শন বহাল রাখতে বাধ্য করা হবে, যা দ্বারা তাদের চেনা যায়। তাদেরকে পোশাক পরিচ্ছদে মুসরমানদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হতে দেয়া হবেনা।[৭ম খন্ড, ১১৩ পৃঃ]
এছাড়া এতে আইনগত জটিলতা সৃষ্টির আশংকাও আছে। উদাহরণ স্বরূপ, মুসলমানদের জন্য মদ খাওয়া, রাখা ও বিক্রয় করা ফৌজদারী অপরাধ। অথচ অমুসলিমদের জন্য সেটা অপরাধ নয়। এমতাবস্থায় একজন মুসলমান যদি অমুসলিমদের সদৃশ পোশাক পরে, তবে সে এ জাতীয় অপরাধ করেও পুলিশের ধর পাকড় থেকে রেহাই পেতে পারে। আর কোনো অমুসলিম মুসলমানদের সদৃশ্য পোশাক পরলে সে পুলিশের ধর পাকড়ের শিকার হতে পারে।
৩. আরেক ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিলো তৎকালীন বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। সে সময় সিন্ধু থেকৈ স্পেন পর্যন্ত বহুসংখ্যক দেশ মুসলমানদে দ্বারা বিজিত হয়েছিলো। আর স্বাভাবিকভাবেই ঐসব দেশের অধিবাসীদের মধ্যে সাবেক শাসক গোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যক লোক বিদ্যমান ছিলো। তাদের ভেতরে নিজেদের হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের উচ্চাভিলাষ তখনো ছিলো। মুসলমনিরা দুনিয়ার অন্যান্য বিজেতাদের ন্যায় এসব জনগোষ্ঠীকে কচুকাটা তো করেইনি বরং ‘যিম্মী’ বানিয়ে তাদেরকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ করেছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক প্রয়োজনে তাদেরকে কিছু না কিছু দমিত রাখাও জরুরী ছিলো, যাতে তারা আবার মাথা তোলার সাহস না করে। এজন্য তাদের বেশভূষায়, যানবাহনে ও অন্যান্য চালচলনে এমন জাকজমক প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো, যা দ্বারা তাদের অতীত শাসনামলের স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত হয়। তবে এধরনের নির্দেশাবলী নিতান্তই সাময়িক ছিলো, চিরস্থায়ী ছিলোনা। আর এসব বিধি ফিকাহ শাস্ত্রীয় গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ থাকলেও তাকে চিরদিন সকল অমুসলিম প্রজার ওপর প্রয়োগ করা চলেনা।
চ. রাষ্ট্র প্রধান, মন্ত্রী, সেনাপতি, বিচারপতি ও এধরনের অন্য যেসব শীর্ষ পদে আসীন হয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণে অংশীদার হওয়া যায়, সেসব পদে কোনো অমুসলিম সমাসীন হতে পারবেনা। এর কারণও কোনো সংকীর্ণতা বা জাতি বিদ্বেষ নয়। বরং এর সোজা ও সঠিক কারণ এই যে, ইসলামী রাষ্ট্র একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র। তাই এই রাষ্ট্রে এসব পদে এমন ব্যক্তিরাই অধিষ্ঠিত হতে পারবে, যারা এই আদর্শকে ভালোভাবে উপলদ্ধি করে এবং একে বিশুদ্ধ ও সত্য বলে মানে। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে; তাই সে নিজের অমুসলিম প্রজাদের মধ্যে ভাড়াটে মানসিকতা সৃষ্টি করা পছন্দ করেনা। বরঞ্চ সে তাদেরকে বলে যে, তোমরা যদি আমাদের আদর্শকে ও নীতিমালাকে সঠিক মনে করো তাহলে প্রকাশ্যে তাকে সত্য ও সঠিক বলে ঘোষণা করো। তোমাদের জন্য শাসকদলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত রয়েছে। আর যদি তোমরা তার সত্যতায় বিশ্বাসী না হও, তাহলে নিছক পেট ও পদমর্যাদা লাভের খাতিরে এই ব্যবস্থার পরিচালনা ও উৎকর্ষ সাধনের কাজে অংশ নিওনা। কেননা আকীদা বিশ্বাসের দিক দিয়ে তো তোমরা ওটাকে ভ্রান্তই মনে করে থাকো।
ছ. অমুসলিম দেশগুলো আপন আপন রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে মুসলমানদের সাথে কী আচরণ করে এবং কী আচরণ করেনা, সে প্রশ্ন আমাদের কাছে মোটেই কোনো গুরুত্ব রাখেনা। আমরা যে জিনিসকে সত্য ও সঠিক মনে’করবো, নিজেদের দেশে তাকে বাস্তবায়িত করবো। অন্যেরা যে জিনিসকে সঠিক মনে করে, তাকে তারা বাস্তবায়িত করবে কিনা, সেটা তাদের ব্যাপার। এ ব্যাপারে তারা পুরোপুরি স্বাধীন। আমাদের ও তাদের সামগ্রিক কর্মকান্ড বিশ্বজনমতের সামনে একদিন আমাদের ও তাদের সত্যিকার পরিচয় তোলে ধরবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আমরা এরূপ ভন্ডামী করতে পারিনা যে, আমাদের সংবিধানের পাতায় প্রদর্শনীমূলকভাবে অমুসলিমদেরকে সকল অধিকার দিয়ে দেবো, কিন্তু বাস্তবে তাদেরকে ভারতের মুসলমানদের, আমেরিকার বেড ইন্ডিয়ানদের এবং রাশিয়ার অকম্যুনিষ্টদের মতো শোচনীয় দশায় ফেলে রাখবো। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এমতাবস্থায় অমুসলিম সংখ্যালঘুরা কি ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত থাকতে পারবে? এর জবাব এই যে, সংবিধানের কয়েকটি শব্দ থেকেই আনুগত্য ও আনুগত্যহীনতার উৎপত্তি হয়না বরং সামগ্রিকভাবে ও বাস্তবে সরকার ও সংখ্যালগু জনগোষ্ঠী নিজেদের অধীনস্থ সংখ্যালঘুদের সাথে যে আচরণ করে থাকে তা থেকেই তার উৎপত্তি ঘটে।
ঙ. ইসলামে মুরতাদের শাস্তি
ইসলামে মুরতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কেউ যদি বলতে চায়, এমনটি হওয়া উচিত নয়, তাহলে সেকথা বলার স্বাধীনতা তার রয়েছে। কিন্তু সে যদি বলে, এধরনের শাস্তি আসলেই ইসলামে নেই, তাহলে সে হয় ইসলামী আইন সম্পর্কে অজ্ঞ, নচেত “প্রতিবেশীর বিদ্রূপে” লজ্জা পেয়ে নিজ ধর্মের একটা বিধানকে সে গোপন করে। ইসলামের এই আইনকে বুঝতে লোকেরা যে অসুবিধার সম্মুখীন হয় তার একাধিক কারণ রয়েছেঃ
প্রথমতঃ তারা ধর্ম হিসেবে ইসলাম এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামের পার্থক্য বোঝেনা। ফলে একটার বিধান অপরটার ওপর প্রয়োগ করে। অথচ উক্ত দুটি অবস্থার ধরন ও বিধিতে পার্থক্য রয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ তারা বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে এই বিধানটি বিবেচনা করে। বর্তমান পরিস্থিতি এই যে, অমুসলিম দেশের কথা বাদ দিন, খোদ মুসলিম দেশেও অনৈমলামিক শিক্ষা ও অনৈসলামিক কৃষ্টির প্রভাবে মুসলমানদের নতুন প্রজন্মে বহুলোক গোমরাহ হয়ে আর্বিভূত হচ্ছে। অথচ একটা যথার্থ ইসলামী রাষ্ট্র বিদ্যমান থাকলে তার সর্বপ্রথম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এই যে, যেসব কারণে কোনো মুসলমান সত্যি সত্যিই ইসলাম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ ও মুরতাদ হবার প্ররোচণা পায়, সেসব কারণ দূর করবে। ইসলামী রাষ্ট্র যদি নিজের যথার্থ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে, তাহলে তো অমুসলিমদের পক্ষেও কুফরীর প্রতী সন্তুষ্ট থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানের পক্ষে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা।
তৃতীয়তঃ তারা একথা ভুলে যায় যে, মুসলিম সমাজই ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রস্তর। এই ভিত্তি প্রস্তর কতোখানি মজবুত, তার ওপরই রাষ্টের মজবুতী নির্ভর করে। পৃথিবীতে এমন রাষ্ট্র কোথায় আছে, যা তার নিজের ভেতরেই নিজের ধ্বংসের উপায় উপকরণ লালন ও সংরক্ষণ করে? আমরা তো যথাসাধ্য চেষ্টা করবো যাতে রাষ্ট্রের এই ভিত্তি প্রস্তরটির সাথে তার প্রতিটি কণা অন্তর দিয়ে লেগে থাকে। তা সত্ত্বেও যদি এমন কোনো কণা বেরিয়েই পড়ে, যা ঐ প্রস্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকেই অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে আমরা তাকে বলবো যে, তুমি যদি বিচ্ছিন্ন হতেই চাও, তবে আমাদের সীমানা থেকে বেরিয়ে যাও। নচেত এখানে বসে তুমি অন্যান্য কণারও নষ্ট হওয়ার কারণ হবে, তা আমরা হতে দিতে পারিনা এবং সেজন্য তোমাকে স্বাধীন ছেড়ে দিতে পারিনা।
চতুর্থতঃ সকল ধরনের মুরতাদের সর্বাবস্থায় হত্যাই করা হবে তারা এই ভুল ধারণায় নিমজ্জিত আছে। অথচ একটা অপরাধের চরম শাস্তি কেবল অপরাধটির নিকৃষ্টতম ধরনের ওপরই প্রয়োগ করা হয়, সাধারণ পর্যায়ের অপরাধের ওপর নয়। কখনো এমন হয়ে থাকে যে, এক ব্যক্তি কেবল আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। অপর একজন প্রকাশ্যে ইসলাম ত্যাগ করে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে বসে। তৃতীয়জন শুধু মুরতাদ হয়েই ক্ষ্যান্ত হয়না বরং ইসলামের বিরোধীতায় সক্রিয় তাৎপরতা চালাতে থাকে। এধরনের সকল মানুষকে ইসলামী আইন সর্বাবস্থায় একই দৃষ্টিতে দেখবে, এটা কিভাবে ভাবা যায়? [ মাওলানা মওদূদী রচিত “ইসলামী আইনে মুরতাদের শাস্তি” নামক গ্রন্থে বিশদ আলোচনা দ্রষ্টব্য। -সম্পাদক]
চ. ইসলামের সমর আইন ও দাস প্রথা
ইসলামের সমর আইন ও দাস প্রথা নিয়েও কিছু প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসংগে বুঝে নিতে হবে যে, ইসলামের যুদ্ধ আইন বাস্তবিক পক্ষে একটি আইন এবং ইসলামী রাষ্ট্র তাকে অবশ্যই কার্যকর করা হবে, চাই আমাদের সাথে যুদ্ধরত অন্যান্য জাতি এ আইনের বিধিনিষেধ ও সীমা সংরক্ষণ করুক বা না করুক। পক্ষান্তরে যে জিনিসটাকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইন নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে, তা আসলে কোনো আইন নয়, বরঞ্চ আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের একটি সমষ্টি মাত্র। এর সীমা ও বিধিসমূহ মেনে চলতে সকল জাতিই এই আশায় ও এই সমঝোতার ভিত্তিতে রাযী হয়েছে যে, অন্যান্য জাতিও যুদ্ধের সময় এগুলো মেনে চলবে। ইসলাম আমাদেরকে যুদ্ধের কয়েকটি নূন্যতম বিধি ও নৈতিক নীতিমালার আনুগত্য করতে আদেশ দিয়েছে। এগুলো অন্যেরা ভংগ করলেও আমরা ভংগ করতে পারিনা। আর ওগুলোর চেয়ে বেশী আরো কিছু সুসভ্য আইনে যদি অন্যান্য জাতি সম্মত হয়, তাহলে আমরা শুধু যে তাদের সাথে এ ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে পারি তা নয়, বরং যুদ্ধে অধিকতর সুসভ্য আচরণ করতে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা আমাদেরই কর্তব্য। উদাহরণ স্বরূপ, দাস প্রথার ব্যাপারটাই ধরুন। ইসলাম এর অনুমতি শুধু সে অবস্থায় দিয়েছে, যখন শত্রুপক্ষ যুদ্ধবন্দী বিনিময়েও সম্মত হয়না, আবার মুক্তিপণের বিনিময়ে নিজেদের বন্দী মুক্ত করা ও আমাদের বন্দী ছাড়ার প্রস্তাবও গ্রহণ করেনা। এরূপ পরিস্থিতিতে ইসলাম বন্দীদেরকে কারাগারে পাঠানো কিংবা শ্রমশিবিরে রেখে শ্রম খাটাতে বাধ্য করা পছন্দ করেনি। বরং তাদেরকে মুসলিম সমাজের সদস্যদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে বন্টন করে দেয়ার নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যাতে তাদের মুসলমানদের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ার সহজতর হয়। একথা সত্য যে, সেকালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও যুদ্ধবন্দীদেরকে দাসদাসী হিসেবেই রেখে দিতো এবং দাসত্ব বা গোলামী শব্দটা মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকল জাতির যৌথ সম্পত্তি ছিলো। তবে দাসদাসীদের জীবনে ইসলাম যে পরিবর্তন এনেছিলো, তার যৌথ সম্পত্তি ছিলো। তবে দাসদাসীদের জীবনে ইসলাম যে পরিবর্তন এনেছিলো, তার নজীর পৃথিবীতে বিরল। মুসলিম জাতি ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো জাতিতে এতো বেশী সংখ্যক দাস ও দাসপুত্র উচুঁ স্তরের পন্ডিত ও মনীষী, বিচারপতি, সেনাপতি ও শাসক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে- এমন দৃষ্টান্ত দেখানো যাবেনা। ইসলামী আইন আমাদেরকে মানবতা ও সভ্যতার যে ন্যূনতম মানে প্রতিষ্ঠিত করে, তা ছিলো এই যে, দাস প্রথা রহিত করা যখন সম্ভব ছিলোনা তখনও দাসদেরকে সমাজে এতো সম্মানজনক আসন দিয়েছে। এখন যদি দুনিয়ার অন্যান্য জাতি যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের নীতি গ্রহণ করে থাকে, তবে তাকে স্বাগত জানাতে আমাদেরকে বাধা দেবে এমন কিছুই ইসলামে নেই। আমাদের জন্য তো এটা আনন্দের ব্যাপার যে, যে জিনিস গ্রহণের জন্য আমরা শত শত বছর আগে দুনিয়াবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলাম, তা অবশেষে জগতবাসী গহণ করেছে।
ছ. ইসলাম ও শিল্পকলা
এই মর্মেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে শিল্পকলার কী দশা হবে, বিশেষত স্থির চিত্র, চলচ্চিত্র, ভাস্কর্য, নাটক, গানবাজনা ইত্যাদির? আমি এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দেবো যে, শিল্পকলা তো মানুষের স্বভাব প্রকৃতির একটা জন্মগত চাহিদা। স্বয়ং বিশ্বস্রষ্টাও তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্মে শিল্পকলার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। তাই গোটা শিল্পকলার অবৈধ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা। তবে আজকাল পাশ্চাত্য সভ্যতায় শিল্পকলার যে প্রকাশ ও অভিব্যক্তি দেখতে পাওয়া যায়, সেটাই মেনে নেয়া জরুরী একথা ঠিক নয়। বরং প্রত্যেক সভ্যতা স্বীয় চিন্তাধারা, মতাদর্শ ও ভাবপ্রবণতার আলোকে বিভিন্ন পন্থায় মানবীয় স্বভাব প্রকৃতির এই চাহিদার স্ফুরণ ঘটায় এবং অন্যান্য সভ্যতার গৃহীত সেসব বৈধ কি অবৈধ, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। পাশ্চাত্য জগত থেকে যে জিনিস আমদানী করা হচ্ছে, কেবল তারই নাম শিল্পকলা, এটা কোন যুক্তিতে ধরে নেয়া হয়েছে? পাশ্চাত্যের শিল্পকলায় কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে শিল্পকলায় কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে শিল্পকলাটাই খতম হয়ে যাবে- এমন আশংকাই বা কেন করা হয়? শিল্পকলা সম্পর্কে ইসলামের একটা স্বতন্ত্র মতাদর্শ রয়েছে। মানব মনের এই স্বভাব সুলভ চাহিদাকে সে পৌত্তলিকতা, সৌন্দর্য পূজা ও যৌন লালসার পথে ঠেলে দেয়ার বিরোধী। এর প্রকাশ ও স্ফুরণের জন্য সে ভিন্ন পথ দেখায়। ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামের নিজস্ব মতাদর্শই কর্তৃত্বশীল হবে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও মতাদর্শের কর্তৃত্ব সেখানে কোনোমতেই চালু থাকতে পারবেনা।
জ. ফিকাহ শাস্ত্রীয় মতভেদ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় নয়
এ প্রশ্নও তোলা হয়েছে যে, মুসলিম ফের্কাসমূহের মধ্যে আকীদাগত ও বিধিগত মতভেদের ধরন কী? তাদের মধ্যে যখন মৌলিক বিষয়েও মতৈক্য নেই, এমনকি “সুন্নাহ্” পর্যন্ত শীয় ও সুন্নীদের মধ্যে সর্বসম্মত বিষয় নয়, তখন একটা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসন কিভাবে চলবে? এর জবাবে আমি শুধু এতোটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করি যে, কথিত ৭৩ ফের্কার সমস্যাটির অস্তিত্ব কার্যত পাকিস্তানে নেই। আর কোনো ব্যক্তি কোনো পত্রপত্রিকায় যে কোনো একটা উদ্ভট চিন্তা তোলে ধরলেই এবং বিক্ষিপ্তভাবে কিছু লোক তা গ্রহণ করলেই তা কোনো উল্লেখযোগ্য ফের্কার উৎপত্তি ঘটায়না। আমাদের দেশে বাস্তবিক পক্ষে মাত্র তিনটে ফের্কা রয়েছেঃ [১] হানাফী ফের্কা। দেওবান্দী ও বেরেলভী এই দুই উপদলে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও এই ফের্কার ফিকাহ্ শাস্ত্রে কোনো বিভেদ নেই। [২] আহলে হাদীস এবং [৩] শীয়া। এই তিন ফের্কার মতভেদ কার্যত একটা উসলামী রাষ্ট্র গঠনে ও পরিচালনায় কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করেনা । যদি এই নীতি সর্বসম্মতভাবে মেনে নেয়া হয় যে, পারিবারিক আইন, ধর্মীয় রসমাদি ও ইবাদত এবং ধর্মীয় শিক্ষার পর্যায়ে প্রত্যেক ফের্কার অনুসৃত রীতি অন্য ফের্কার হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে এবং দেশের প্রশাসন সংসদের সংখ্যাগুরু সদস্য কর্তৃক নির্ধারিত আইন ও বিধি অনুসারে চলবে। এ প্রসংগে ৭৩ ফের্কার কল্প কাহিনীটির রহস্য উন্মোচন করে দেয়াও আমি সমীচীন মনে করছি। কেননা লোকেরা খামাখাই এই বিষয়টি নিয়ে মানসিক দ্বন্দ্বে ভোগে। আসল ব্যাপারে এই যে, বিভিন্ন বইপুস্তকে মুসলমানদের যে বিপুল সংখ্যক ফের্কার উল্লেখ পাওয়া যায়, তার একটি বিরিাট অংশের নেহাত কাগজে অস্তিত্ব ছাড়া আগেও কোনো অস্তিত্ব ছিলোনা, এখনো নেই। কোনো ব্যক্তি যখনই কোনো নতুন চাঞ্চল্যকর মতামত পেশ করেছে এবং দুই একশো অনুসারী সৃষ্টি হয়ে গেছে, অমনি আমাদের গ্রন্থকারগণ তাকে একটা ফের্কা হিসেবে গণনা করে ফেলেছেন। এ ধরনের ফের্কাগুলো ছাড়াও বেশ কিছু সংখ্যক ফের্কা এমনও রয়েছে, যা বিগত ১৪শ বছরে জন্মেছেও আবার নিশ্চিহ্নও হয়ে গেছে। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় মুসলমানদের বড়জোর ৬/৭টি ফের্কা বা উপদল অবশিষ্ট রয়েছে।
মৌলিক মতপার্থক্যের কারণে এগুলোকে স্বতন্ত্র ফের্কা বলা যায় এবং অনুসারীর সংখ্যার বিচারেও এগুলো মোটামুটি উল্লেখযোগ্য। তবে এগুলোর মধ্যেও কোনো কোনোটি অতিমাত্রায় ক্ষুদ্রাকৃতির। এগুলো হয় বিশেষ বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ, নচেত সারা দুনিয়ায় এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে, কোথাও তাদের কোনো উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা নেই। দুনিয়ার বড় বড় মুসলিম ফের্কা মাত্র দুটোঃ সুন্নী ও শীয়া। তন্মধ্যে উম্মাহর বিপুল সংখ্যাগুরু অংশ সুন্নীদের নিয়ে গঠিত। এদের শাখা প্রশাখাগুলোর মধ্যে সত্যিকার অর্থে মৌলিক মতপার্থক্য নেই। শুধুমাত্র খুটিনাটি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণকারী কিছু মাযহাব [School of thought] রয়েছে, যাকে তার্কিকেরা ফের্কাররূপ দিয়ে ফেলেছে। কোনো বাস্তবতাবাদী রাজনীতিক যদি দুনিয়ার কোনো দেশে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে এসব মতভেদ তার পথে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।
[১. এ পর্যন্ত সমগ্র আলোচনাটি তদন্ত আদালতে প্রদত্ত মাওলানার জবানবন্দী থেকে গৃহীত এবং এটি “কাদিয়ানী সমস্যা এবং তার নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক” নামক গ্রন্থের একটি অংশ। – সংকলক।
২. খিলাফত ও স্বৈরতন্ত্র
ক. ইসলামী রাষ্ট্র ও খিলাফত প্রসংগে কয়েকটি প্রশ্ন
[জনৈক জার্মান ছাত্র ইসলামী রাষ্ট্র ও খিলাফত সম্পর্কিত কতিপয় সমস্যার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাবার উদ্দেশ্যে এ প্রশ্নগুলো করেন। আসল প্রশ্নগুলো ছিলো ইংরেজীতে। নীচে তার অনুবাদ দেয়া হলো।]
প্রশ্নঃ এক. ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের জন্যে কি শুধুমাত্র ‘খলীফা’ শব্দটিই ব্যবহার করা যেতে পারে?
দুই. উমাইয়া খলীফাদের কি সঠিক অর্থে খলীফা বলা যেতে পারে?
তিন. আব্বাসীয় খলীফাগণ বিশেষ করে আল মামুন সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
চার. হযরত ইমাম হাসান রাদিয়ায়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়ায়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়ায়াল্লাহু তায়ালা আনহুর রাজনৈতিক কার্যক্রমকে আপনি কোন্ দৃষ্টিতে দেখেন? আপনার মতে ৬৮০ইং সালে মিল্লাতে ইসলামীয়ার আসল নেতা কে ছিলো, হুসাইন না ইয়াযীদ?
পাঁচ. ইসলামী রাষ্ট্রে বিদ্রোহ কি একটি সৎকর্ম গণ্য হতে পারে?
ছয়. বিদ্রোহীরা যদি মসজিদ বা অন্যান্য পবিত্র স্থানসমূহে [যেমন কা’বা ও হারাম শরীফ] আশ্রয় নেয়, তাহলে এ অবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্র তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে?
সাত. ইসলামী রাষ্ট্র কুরআন ও সুন্নাহর বিধান অনুযায়ী তার নাগরিকদের কাছ থেকে কোন্ ধরনের কর আদায় করতে পারে?
আট. কোনো খলীফা কি এমন কোনো কাজ করতে পারে, যা পূর্ববর্তী খলীফাদের কার্যক্রম থেকে ভিন্নতর?
নয়. গভর্নর ও শাসক হিসেবে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
দশ. ইসলামী রাষ্ট্র কি এমন কোনো কর আরোপ করার অধিকার রাখে, যা কুরআন ও সুন্নাতে উল্লিখিত হয়নি এবং পূর্ববর্তী খলীফাদের আমলেও যার কোনো নজীর নেই?
জবাবঃ আপনি যে প্রশ্নগুলো পাঠিয়েছেন তার বিস্তারিত জবাব দিতে গেলে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন, আর সে সময় আমার নেই। তাই এগুলোর সংক্ষিপ্ত জবাব দিচ্ছি।
এক ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানের জন্য ‘খলীফা’ শব্দটি এমন কোনো অপরিহার্য পারিভাষা নয় যে, এছাড়া অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা। আমীর, ইমাম, সুলতান ইত্যাদি শব্দগুলোও হাদীস, ফিকহ, কালাম ও ইসলামের ইতিহাসে বিপুল পরিমাণে ব্যবহৃহ হয়েছে। কিন্তু নীতিগতভাবে যে জিনিসটির প্রয়োজন তা হলো, রাষ্ট্রের ভিত্তি খিলাফতের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। একটি সঠিক ইসলামী রাষ্ট্র কখনো রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র হতে পারেনা। আবার তা এমন কোনো গণতন্ত্রও হতে পারেনা, যা জনগণের সার্বভৌমত্বের [Popular Sovereignty] ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। বিপরীত পক্ষে, একমাত্র সে রাষ্ট্রকেই ইসলামী রাষ্ট্র বলা যেতে পারে, যে রাষ্ট্র আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেয়া, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের শরীয়তকে শ্রেষ্ঠ আইন এবং আইনের প্রধান ও প্রথম উৎস বলে মেনে নেয় এবং আল্লাহ্ নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে কাজ করার স্বীকৃতি দেয়। এই রাষ্ট্রে কর্তৃত্বশালীদের কর্তৃত্ব লাভের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর বিধানের পুনরুজ্জীবন এবং তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী অসৎ বৃত্তির বিনাশ ও সৎবৃত্তির বিকাশ সাধন। এই রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কোনো সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নয় এবং এটা হচ্ছে আল্লাহর কর্তৃত্বের প্রতিনিধিত্ব ও তাঁর আমানতত। এরি নাম খিলাফত।
দুই. উমাইয়া শাসকদের সরকার আসলে খিলাফত ছিলোনা। যদিও ইসলামই ছিলো তাদের সরকারের আইন, কিন্তু শাসনতন্ত্রের অনেকগুলো ইসলামী ধারাকে তারা নকচ করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও তাদের সরকারের প্রাণসত্তা ইসলামী ধারাকে তারা নাকচ করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও তাদের সরকারের প্রাণসত্তা ইসলামের প্রাণসত্তা থেকে বেশ দূরে সরে গিয়েছিলো। তাদের শাসনকালের প্রথম দিকেই এ বিষয়টি অনুধাবন করা হয়েছিলো। তাই এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আমীর মু’য়াবীয়া রাদিয়ায়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজেই বলেন, ‘আনা আউয়ালুল মুলক’ [অর্থাৎ আমি সর্বপ্রথম বাদশাহ] আর যে সময় আমীর মু’য়াবীয়া রাদিয়ায়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর ছেলেকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন, তখনই হযরত আবু বকর রাদিয়ায়াল্লাহু তায়ালা আনহুর পুত্র আবদুর রহমান রাদিয়ায়াল্লাহু তায়ালা আনহু উঠে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এতো রোমের কাইজারদের পদ্ধতিই হলো, কাইজার মরে গেলে তার পুত্রই কাইজার হয়।’
তিন. নীতিগতভাবে আব্বাসীয় খলীফাদের অবস্থাও বনী উমাইয়াদের মতোই। পার্থক্য শুধু এতোটুকু, উমাইয়া খলীফারা দীনের ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন [Indifferent], বিপরীত পক্ষে আব্বাসীয় খলীফারা নিজেদের ধর্মীয় খিলাফত ও আধ্যাত্মিক রাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য দীনের ব্যাপারে ইতিবাচক আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। কিন্তু তাদের এ আগ্রহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীনের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। যেমন মামুনের আগ্রহ এমনভাবে আত্মপ্রকাশ করে, যার ফলে তিনি দর্শনের একটি বিষয়, যা আসলে দীনের বিষিয় ছিলোনা, তাকে অনর্থক দীনের বিষয়ে পরিণত করেন। দীনের একটি আকীদারূপে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান এবং সরকারী ক্ষমতাবলে জোর করে মুসলমানদের কাছ থেকে তার সপক্ষে স্বীকৃতি আদায় করার জন্য অমানুষিক যুলুম নির্যাতন চালান।
চার. যে যুগ সম্পর্কে এ প্রশ্নটি করা হয়েছে সেটি ছেলো আসলে ফিতনার যুগ। সে সময় মুসলমানরা মারাত্মক মানসিক নৈরাজ্যের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। সে সময় কার্যত মুসলমানদের আসল নেতা কে ছিলো একথা বলা বড় কঠিন। কিন্তু একথা দিবালোকের মতো সত্য, ইয়াযীদের যা কিছু রাজনৈতিক প্রভাব ছিলো তার মূল ভিত্তি ছিলো মাত্র একটি তার হাতে ছিলো ক্ষমতার চাবিকাঠি। তার পিতা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করে তাকে সে রাষ্ট্রের শাসক বানিয়ে দিয়েছিলেন। ঘটনাটা যদি এভাবে সাজানো না হতো এবং ইয়াযীদ সাধারণ মুসলমানদের কাতারে থাকতো, তাহলে সম্ভবত নেতৃত্বের আসনে বসাবার জন্য মুসলমানদের সর্বশেষ দৃষ্টি তার ওপর পড়তো। বিপরীতপক্ষে হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়ায়াল্লাহু তায়ালা আনহু সে সময় উম্মতের সুপরিচিত ও সর্বজন সমাদৃত ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং কোনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সম্ভবত মুসলিম জনতার সর্ব প্রথম দৃষ্টি তাঁর ওপরই পড়তো।
পাঁচ. কোনো সৎ ও ইনসাফ ভিত্তিক সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা থাকলে যালিম শাসকদের মুকাবিলায় বিদ্রোহ করা কেবল বৈধই নয়, ফরযও। এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফার [রঃ] মতামত অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আবু বকর জাসসাস তাঁত ‘আহকামুল কুরআন’ এবং আল মুওয়াফফিকুল মূলকী তাঁর ‘মানাকিবে আবু হানীফা’ গ্রন্থে এর ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পক্ষান্তরে সৎ ও ইনসাফ ভিত্তিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ একটি বিরাট গুনাহ। এই ধরনের বিদ্রোহ দমন করার ব্যাপারে সরকারের সাথে সহযোগিতা করা সমস্ত মুমিন সমাজের অপরিহার্য কর্তব্য। মাঝামাঝি অবস্থায় যখন সরকার ন্যায়নিষ্ঠ নয়, কিন্তু অন্যদিকে সৎ ব্যক্তিদের বিপ্লবের সম্ভাবনাও সুস্পষ্ট নয়, এ ক্ষেত্রে অবস্থা সংশয়িত হয়ে যায়। ফিকহের ইমামগণ এ অবস্থায় বিভিন্ন নীতি অবলম্বন করেছেন। কেউ কেউ এ অবস্থায় কেবল হক কথা বলে দেয়াটাই যথেষ্ট মনে করেছেন, কিন্তু বিদ্রোহকেও বৈধ গণ্য করেছেন। অনেকে বিদ্রোহ বৈধ করেছেন এবং শাহাদতবরণ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আবার অনেকে সংশোধনের আশায় সরকারের সাথে সহযোগিতাও করেছেন।
ছয়. ন্যায়নিষ্ঠ সরকারের মুকাবিলায় যারা বিদ্রোহ করে তারা যদি মসজিদে আশ্রয় নেয়, তাহলে তাদেরকে অবরোধ করা যেতে পারে। যদি তারা ভেতর থেকে গোলাবর্ষণ করে, তাহলে তাদের জবাবে গোলাবর্ষণ করা যেতে পারে। তবে যদি তারা বাইতুল হারামে আশ্রয় নেয়, তাহলে এ অবস্থায় কেবলমাত্র তাদেরকে অবরোধ করে তাদের এতোটা সংকটে ফেলা যেতে পারে, যার ফলে তারা নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। হারাম শরীফে রক্তপাত করা বা পাথর ও গোলাবর্ষণ করা জায়েয নয়। বিপরীত পক্ষে, একটি যালিম সরকারের অস্তিত্বই হচ্ছে মূর্তিমান গুনাহ। আর তার প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্বের জন্য প্রচেষ্টা চালানোও কেবল গুনাহ বৃদ্ধিই করে মাত্র।
সাত. কুরআন ও সুন্নাহ কর আরোপ করার জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়নি। বরং মুসলমানদের ওপর ইবাদত হিসেবে যাকাত এবং অমুসলিমদের ওপর আনুগত্যের চিহ্ন হিসেবে জিযিয়া কর আরোপ করার পর দেশের প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে জনগণের ওপর কর আরোপ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারের ওপর ন্যস্ত করেছে।
খারাজ, শুল্ক, আমদানী ও রপ্তানী কর, এগুলো একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কুরআন ও সুন্নাহ শরীয়তের বিধান হিসেবে এগুলো আরোপ করেনি বরং ইসলামী হুকুমতগুলো নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো আরোপ করেছিলো। এ ব্যাপারে আসল মানদন্ড হচ্ছে দেশের প্রকৃত প্রয়োজন। কোনো শাসক নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যদি কোনো কর আদায় করে তাহলে তা হারাম গণ্য হবে। দেশের যথার্থ প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য দেশবাসীর সমর্থন নিয়ে কর আরোপ করলে তা বৈধ ও হালাল বিবেচিত হবে।
আট. জী হ্যাঁ। কেবল এটিই নয় বরং নিজের পূর্বের সিদ্ধান্তগুলোও বদলাতে পারেন।
নয়. হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ পার্থিব রাজনীতির দৃষ্টিতে বড়ই যোগ্য ছিলেন, আর দীনি দৃষ্টিতে একজন নিকৃষ্ট যালিম শাসক।
দশ. হ্যাঁ, ৭ নং প্রশ্নের উত্তরে উল্লিখিত শর্তসাপেক্ষে। [তর্জমানুল কুরআন, মে ১৯৫৯]
খ. আল খিলাফাত না আল হুকুমাত
প্রশ্নঃ বিংশ শতাব্দীতেও যদি ইসলামের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয়, তাহলে বর্তমান ভাবধারা ও মতাদর্শের স্থলে ইসলামের ভাবধারা ও মতাদর্শকে অভিষিক্ত করতে গিয়ে যে বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে, তা নিরসনে ইবনে খালদুনের আল হুকুমাহ ও [আল খিলাফাহ] এই দুই তত্ত্বের কোনটি বেশী সহায়ক হবে?
জবাবঃ বর্তমান যুগে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার পথে যে জিনিস প্রধান অন্তরায় এবং যে ভাবধারা ও মতাদর্শ তার পথ আগলে রয়েছে, তা পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, মুসলিম দেশগুলোতে তা পশ্চিমা জাতিসমূহের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক আধিপত্য ও প্রভুত্বের সৃষ্টি। পশ্চিমা জাতিগুলো যখন আমাদের দেশগুলোতে আপন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তখন তারা আমাদের আইন কানুন বাতিল করে নিজেদের আইন চালু করে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে তারা নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণকারী লোকদের তারা বরখাস্ত করে এবং তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে বেরুনো লোকদের জন্য সকল সরকারী চাকুরী নির্দিষ্ট করে দেয়। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তারা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানাদি ও রীতিনীতি চালু করে এবং অর্থনীতির ময়দানও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারক বাহকদের জন্য হয়ে যায় একচেটিয়া। এভাবে তারা আমাদের ভেতরেই আমাদের সভ্যতা, কৃষ্টি ও আদর্শ বিবর্জিত একটি জেনারেশন গড়ে তোলে যা ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী শিক্ষা ও ঐতিহ্য থেকে কাজেকর্মেও যেমন সম্পর্কচ্যুত, আবেগ অনুভূতিতে এবং মন মানসিকতায়ও তেমনি সংশ্রবহীন। মূলত এ জিনিসটাই আমাদের ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তনে অন্তরায়। আর এ কারণেই এ ভ্রান্ত ধারণারও সৃষ্টি হয়েছে যে, ইসলাম বর্তমান যুগে কার্যোপযোগী নয়। যাদের সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা অনৈসলামিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়েছে, তাদের ইসলামকে অবাস্তব ও অনুপযোগী বলা ছাড়া আর কিইবা বলার থাকতে পারে? কেননা তারা ইসলামকে জানেওনা, তদনুসারে কাজ করার জন্যও তাদেরকে গড়ে তোলা হয়নি। যে জীবন ব্যবস্থার উপযোগী করে তাদেরকে তৈরী করা হয়েছে সেটাকেই কার্যোপযোগী ভাবা তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় অনিবার্যভাবে আমাদের সামনে দুটো পথই থাকে। হয় আমাদেরকে জাতি হিসেবে কাফির হয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে এবং অনর্থক ইসলামের নাম নিয়ে বিশ্বকে ধোঁকা দেয়া বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে [মুনাফিকীর সাথে নয়] আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে। এ শিক্ষা ব্যবস্থার পুংখানুপুংখ বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে, এর কোন্ কোন্ উপাদান আমাদেরকে ইসলাম থেকে বিপথগামী করে দেয় এবং এতে কি কি পরিবর্তন এনে আমরা ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার যোগ্য লোক বানানোর কাজ এর দ্বারা নিতে পারি। আমি অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাদের শিক্ষা কমিশন এ বিষয়ের দিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেয়নি। অথচ এ সমস্যাটা খুব ঠান্ডা মাথার বিচার বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিলো। কেননা যতক্ষণ আমরা এ সমস্যার সামাধান না করবো ততক্ষণ ইসলামী বিধানের বাস্তবায়নের পথ কিছুতেই সুগম হবেনা।
ইবনে খালদুনের কোনো মতবাদই এ সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবেনা। কেননা এ সমস্যার যে গুণগত অবস্থা এখন সৃষ্টি হয়েছে, তা ইবনে খালদুনের আমলে সৃষ্টি হয়নি। সমস্যাটার প্রকৃত ধরন এই যে, পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ বিদায় নেয়ার সময় আমাদের দেশে তাদের নিজস্ব শিক্ষা সংস্কৃতির দুধকলা দিয়ে পোষা এমন একটি শ্রেণীকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে রেখে গেছে, যারা দৈহিক দিক দিয়ে আমাদের জাতির অংশ হলেও জ্ঞান, চিন্তা, মামসিকতা ও চরিত্রের দিক দিয়ে ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজদের যথার্থ উত্তরাধিকারী। এ শ্রেণীর শাসন থেকে যে সমস্যার উদ্ভব হয় তার সমাধান এতো জটিল যে, তার সমাধান ইবনে খালদুনের মতবাদের সাধ্যতীত। এজন্য অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করা এবং পরিস্থিতি বুঝে সংস্কারের নতুন পথ উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। [তরজামানুল কুরআন, অক্টোবর ১৯৬১]
গ. ইসলামী রাষ্ট্র এবং পোপতন্ত্রের আদর্শিক পার্থক্য
প্রশ্নঃ আবু সায়ীদ বযমী সাহেব ‘রিসালায়ে হক’ নামক সাময়িকীতে তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেনঃ সেটাও ইসলামী রাজনীতির একটি ধারণা, ইদানীং মাওলানা আবুল আলা মওদূদী খুব জোরে শোরে যা উপস্থাপন করেছেন। তাঁর পেশকৃত ইসলামী রাজনীতির মৌলিক দৃষ্টিকোণ হচ্ছে এই যে, সরকার জনগণের নিকট জবাবদিহী করবেনা। ঐতিহাসিক দিক থেকে এটা কোনো নতুন মূলনীতি নয়। ইউরোপে দীর্ঘকাল পর্যন্ত থিওক্রেসি [Theocracy] নামে এরি চর্চা হচ্ছিলো। রোমের প্রধান পোপের নেতৃত্ব এই ধারণারই ফলশ্রুতি। কিন্তু লোকেরা মনে করছে, যেহেতু খোদা কোনো বক্তব্য প্রকাশক প্রতিষ্ঠান নয়, তাই খোদার নামে যে ব্যক্তিই ক্ষমতা ও নেতৃত্ব লাভ করে সে খুব সহজেই তা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করতে পারে। মাওলানা মওদূদীর সমর্থকরা দাবী করছে যে তাদের উপস্থাপিত রূপরেখা পোপতন্ত্রের চাইতে ভিন্নতর, কিন্তু যেহেতু সে সরকার জনগণের সামনে জবাবদিহী করতে বাধ্য নয় এবং এর ভিত্তিতে গণতন্ত্রকে ভ্রান্ত মনে করে, তাই এ ধারণা এবং পোপতন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকেনা।
অতপর বযমী সাহেব নিজের পক্ষ থেকে একটা সমাধান পেশ করেন। কিন্তু সেটাও সন্তোষজনক নয়। মেহেরবাণী করে তরজমানুল কুরআনের মাধ্যমে এ ভ্রান্ত ধারণা দূর করে সঠিক দৃষ্টিকোণ পেশ করবেন।
জবাবঃ বযমী সাহেব সম্ভবত আমার “ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ” বইটি পড়ে দেখেননি। পড়লে তিনি দেখতেন, আমার নীতির উপর তিনি যেসব আপত্তি তোলেছেন, সেগুলোর পূর্ণ জবাব তাতে রয়েছে। কিন্তু তিনি যদি বইটি পড়ে থাকেন, তবে তাঁর মন্তব্যের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই আমার করার নেই। এ ব্যাপারে আমার সে বইটির নিম্নোক্ত বাক্যগুলো দেখুনঃ
“কিন্তু ইউরোপ যে থিওক্রেসির সাথে পরিচিত, ইসলামী থিওক্রেসি তার চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। ইউরোপ তো সেই থিওক্রেসীর সাথেই পরিচিত, যাতে একটা বিশেষ ধর্মীয় শ্রেণী খোদার নাম করে নিজেদেরই মনগড়া আইন কানুন চালিয়ে দেয় এবং কার্যত সকল নাগরিকের উপর নিজেদেরই মনগড়া আইন কানুন চালিয়ে দেয় এবং কার্যত সকল নাগরিকের উপর নিজেদের খোদায়ী চাপিয়ে দেয়। এ রকম রাষ্ট্রকে খোদায়ী রাষ্ট্র বলার পরিবর্তে ভিন্নতর। সেটা কোনো বিশেষ ধর্মীয় শ্রেণীর মুষ্টিবদ্ধ থাকেনা, বরঞ্চ তা থাকে সাধারণ মুসলমানদের করায়ত্বে। আর মুসলমান সাধারণ এ রাষ্ট্রকে আল্লাহর কিতাব এবং রসূলের সুন্নাহ্ মুতাবিক পরিচালিত করে। আমাকে যদি একটি নতুন পরিভাষা তৈরী করার অনুমতি দেয়া হয় তবে আমি এ পদ্ধতির রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে “খোদায়ী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র” [Theo Democratic state] নামে অবিহিত করবো। কেননা এতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং তার সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধীনে মুসলমানদেরকে একটি সীমিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দান করা হয়েছে। এর কার্যনির্বাহী পরিষদ তৈরী হবে মুসলমানদের মতামতের ভিত্তিতে। এ পরিষদকে পদচ্যুত করার ক্ষমতাও মুসলমানদেরই হাতে থাকবে। যাবতীয় প্রশাসনিক বিষয় এবং সেসব বিষয়, যেগুলো সম্পর্কে আল্লাহর শরীয়তে কোনো স্পষ্ট নির্দেশ বর্তমান নেই- সেগুলো মুসলমানদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফায়সালা হবে। আর যেখানে খোদায়ী কানুনের ব্যাখ্যা দান প্রয়োজন হবে সেখানে কোনো তবকা এবং গোত্রের লোকেরা নয়, বরঞ্চ সর্ব সাধারণ মুসলমানদের মধ্য থেকে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ব্যাখ্যা প্রদানের জন্যে উপযুক্ত বিবেচিত হবেন, যিনি ইজতিহাদের যোগ্যতা সম্পন্ন।”
অতপর এ বাক্যগুলোর নিচে আমি একটি টিকায় আরো স্পষ্ট করে বলেছিঃ
খ্রীষ্টান পাদ্রী ও পোপদের নিকট ঈসা আলাইহিস সালামের কয়েকটি নৈতিক শিক্ষা ছাড়া আর কিছুই নেই। মানুষের বাস্তব ধর্ম ও সামাজিক জীবনের জন্যে মূলত তাদের নিকট কোনো শরীয়তই ছিলোনা। তাই তারা নিজেদের মর্জী মতো নিজেদের লালসা ও ইচ্ছা বাসনা অনুসারে আইন তৈরী করতো এবং সেটাকেই আল্লাহর দেয়া আইন বলে চালু করতো।
যে ব্যক্তি খৃষ্টান ধর্ম এবং পোপতন্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিফহাল এ বাক্যগুলোতে আমি যেদিকে ইংগিত করেছি, তিনি তা বুঝতে ভুল করতে পারেননা। ইউরোপের পোপতন্ত্র ছিলো সেন্ট পলের অনুসারী । ইনি মূসা আলাইহিস সালামের শরীয়তকে অভিশপ্ত আখ্যায়িত করে কেবল সেসব নৈতিক শিক্ষার উপর খৃষ্টবাদের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করেন যা নিউ টেষ্টমেন্টে পাওয়া যায়। এসব নৈতিক শিক্ষার মধ্যে এমন কোনো আইন কানুন বর্তমান নেই, যদ্বারা একটি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করা যেতে পারে। কিন্তু পোপরা যখন ইউরোপে বিনা করণে বা কারণে থিওক্রেসী প্রতিষ্ঠা করলো, তখন তারা একটি আইনের বিধানও তৈরী করলো। একথা সুস্পষ্ট যে তাদের এ বিধান কোনো অহী বা ইলহাম থেকে গৃহীত হয়নি। বরঞ্চ এ ছিলো তাদের মনগড়া জিনিস। এতে তারা যে আকীদাহ বিশ্বাসের বিধান, ধর্মীয় কর্মকান্ড ও আচার অনুষ্ঠানে যেসব নযর নিয়াজ এবং যেসব সামাজিক বিধি বন্ধন প্রভৃতি তৈরী করে নিয়ে ছিলো, তার কোনোটিই আল্লাহর কিতাব থেকে গ্রহণের কোনো প্রমাণ তাদের নিকট ছিলোনা। এমনি করে আল্লহ এবং বান্দার মাঝখানে তারা ধর্মীয় নেতাদের যে স্থায়ী মিডিয়া নির্ধারণ করেছে, সেটাও সম্পূর্ণই তাদের মনগড়া। এ ছাড়া গীর্জা ব্যবস্থার কর্মীদের জন্যে তারা যেসব ক্ষমতা ও অধিকার ধার্য করেছে এবং লোকদের উপর ধর্মীয় টেক্স ধার্য করেছে এগুলোও তারা গ্রহণ করেছে তাদের নিজেদের ইচ্ছা আকাংখা এবং কামনা বাসনা থেকে। এ ধরনের ব্যবস্থাকে তারা যতোই থিওক্রেসী নাম দিক না কেন প্রকৃত পক্ষে এটা থিওক্রেসী নয়। এটাকে ইসলামী হুকুমাত বা খোদায়ী শরীয়ত ভিত্তিক রাষ্ট্রের সাথে কিভাবে তুলনা করা যেতে পারে? ইসলামী রাষ্ট্র তো কিতাব ও সুন্নাতের এক অপরিবর্তনীয় রদবদল অযোগ্য সমুদ্ভাসিত চিরস্থায়ী শাশ্বত বিধান। এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব বিশেষ কোনো ধর্মীয় শ্রেণী ইজারা করে নেয়নি।
বযমী সাহেবের এ বক্তব্য আরো অধিক বিস্ময়কর, যাতে তিনি বলেছেন যে, আমি ইসলামের খলীফাকে সে পজিশন দিয়েছি, খৃষ্টবাদে পোপের যে পজিশন রয়েছে এবং আমি খলীফাকে জনসাধারণের নিকট জবাবদিহী করতে হবেনা বলে মনে করেছি। এর জবাবে আমার সে বইটি থেকেই আরো কয়েকটি অংশ উল্লেখ করে দেয়াই যথেষ্ট মনে করছিঃ
“যারা ঈমান এনে আমলে সালেহ্ ( যোগ্যতার সাথে কাজ) করবে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, তিনি তাদের তেমনি রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করবেন, যেমন দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের।” (সূরা আননূরঃ ৫৫)
এ আয়াতটি উল্লেখ করে আমি লিখেছিঃ
“এ আয়াত থেকে দ্বিতীয় যে তত্ত্বটি পাওয়া যায়, তা হচ্ছে এই যে, খলীফা নিযুক্তির প্রতিশ্রুতি সকল মুমিনের সংগেই দেয়া হয়েছে। মুমিনদের কোনো একজনকে খলীফা বানাবো,- আয়াতে এ কথা বলা হয়নি। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মূলত সকল মুমিনই খিলাফতের দায়িত্বশীল খলীফা। আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের যে খিলাফত দান করা হয়েছে তা সর্বজনীন খিলাফত।”
আরেকটু সামনে অগ্রসর হয়ে আমি লিখেছিঃ
“এখানে প্রত্যেক ব্যক্তিই খলীফা। মুসলমান জনসাধারণের খিলাফত অধিকারকে হরন করে কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টি নিজেরাই নিরংকুশ ক্ষমতার মালিক ও হর্তাকর্তা হয়ে বসা সম্ভব নয়। শাসন শৃংখলা স্থাপনের জন্যে ইসলামী সমাজের প্রত্যেক নাগরিক-ইসলামী পরিভাষা অনুযায়ী প্রত্যেক খলীফা নিজ নিজ খিলাফত অধিকার যখন স্বেচ্ছায় ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে, তখন সে-ই ইসলামী সমাজের শাসনকর্তা। সে ব্যক্তি এক দিকে আল্লাহর নিকট দায়ী থাকে। অপর দিকে দায়ী থাকে জনগণ তথা সাধারণ খলীফাদের নিকট যারা নিজেদের খিলাফত অধিকার তার হাতে সোপর্দ করেছে।”
অতপর বইয়ের অন্য স্থানে আমি স্পষ্ট করে বলেছিঃ
“ইসলামী রাষ্ট্রের ইমাম, আমীর বা রাষ্ট্রপতির প্রকৃত মর্যাদা হচ্ছে এই যে, স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহ্ প্রদত্ত যে খিলাফত লাভ করেছে, সে ক্ষমতা সে নিজ সমাজ থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে তাঁর হাতে স্বেচ্ছায় আমানত রাখে মাত্র। তাকে যে খলীফা নামে অভিহিত করা হয় তার অর্থ এ নয় যে, তিনি একাই আল্লাহর খলীফা। বরঞ্চ সর্ব সাধারণ মুসলমানের স্বতন্ত্র খিলাফত তার মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়েছে বলেই তাকে খলীফা বলা হয় মাত্র।”
অতপর নিম্নোক্ত প্যারাটিও আমার বইটিতে বর্তমান আছেঃ
“আমীর সমালোচনার উর্ধ্বে নন। প্রত্যেক মুসলমানই তার সমালোচনা করতে পারে। কেবল তার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সম্পর্কেই যে সমালোচনা করা যাবে তা নয়, বরঞ্চ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও সমালোচনা করার অধিকার প্রত্যেকের আছে। [প্রয়োজনে] আমীরকে পদচ্যুতও করা যাবে। আইনের দৃষ্টিতে একজন সাধারণ নাগরিকের মতোই তার মর্যাদা। তার বিরুদ্ধে আদালতে মুকাদ্দমা দায়ের করা যাবে। আদালতকে তার সাথে বিশেষ সম্মানের আচরণ করতে হবে এ অধিকার তিনি রাখেননা। আমীরকে পরামর্শ করে কাজ করতে হবে। এমন লোকদের নিয়ে পরামর্শ পরিষদ গঠন করতে হবে, যারা হবে সাধারণ মুসলমানদের আস্থাভাজন। মজলিসে শূরার সদস্যদেরকে মুসলমানরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার ব্যাপারেও শরয়ী কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সর্বাবস্থায় সর্বসাধারণ মুসলমানরা একথার প্রতি লক্ষ্য রাখবে যে, আমীর তার এই ব্যাপক ক্ষমতা তাকওয়া এবং খোদা ভীতির সাথে ব্যবহার করছে, নাকি নিজের খেয়াল খুশী মতো? অন্য কথায়, জনগণে রায় ইসলামী রাষ্টের আমীরকে পদচ্যুত করতে পারে।”
এ সব সুস্পষ্ট বক্তব্যের পরও কোনো ব্যক্তি যদি আমাদের থিওক্রেসীকে রোমের পাদ্রীদের তৈরী করা থিওক্রেসীর সংগে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করে তবে আমরা তো আর তাকে তার স্বাধীন মতামত প্রকাশ করা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার রাখিনা। কিন্তু একথা বলার অধিকার অবশ্যি রাখি যে, তার এই মতামত জ্ঞান, যুক্তি ও দলিল প্রমাণের সীমা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
ঘ. ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিম রাষ্ট্র
[১. ১৯৫২ সালের ২৪ শে নভেম্বর করাচী বার সমিতির পক্ষ থেকে যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ঘ তে বর্ণিত প্রশ্নোত্তর সেখানে থেকে নেয়া হয়েছে। -সংকলক]
প্রশ্নঃ খিলাফতে রাশেদার পর মুসলমানদের যেসব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলো ইসলামী রাষ্ট্র ছিলো, না অনৈসলামিক রাষ্ট্র?
উত্তরঃ আসলে সেগুলো পুরোপুরি ইসলামী রাষ্ট্রও ছিলোনা, পুরোপুরি অনৈসিলামিক রাষ্ট্রও ছিলোনা। ঐসব রাষ্ট্রে ইসলামী শাসনতন্ত্রের দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে বিকৃত করে ফেলা হয়েছিলো। প্রথমতঃ নেতৃত্বকে নির্বাচিত হতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ সরকারের কর্মকান্ড পরামর্শের ভিত্তিতে চালাতে হবে।
এছাড়া ইসলামী শাসনতন্ত্রের বাদবাকী অংশও যথাযথ প্রাণশক্তি সহকারে বহাল ছিলোনা। তবে তাকে পরিবর্তিত বা রহিতও করা হয়নি। ঐসব রাষ্ট্রে কুরআন ও সুন্নাহকে আইনের উৎস বলে গণ্য করা হয়েছেলো। আদালতগুলোতে ইসলামী আইনই কার্যকর হতো এবং ইসলামী আইন বাতিল করে তার জায়গায় মানব রচিত আইন চালু করার ধৃষ্টতা মুসলিম শাসকরা কখনো দেখায়ন। আর যদিও বা কখনো কোনো শাসক এই স্পর্ধা দেখিয়ে থাকে। তবে ইসলামের ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে যে, আল্লাহর কোনো না কোনো বান্দা তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদ পরিচালনা করেছে এবং শেষ পর্যন্ত ঐ মহাপাপের উচ্ছেদ সাধিত হয়েছে। ইবনে তাইমিয়া ও মুজাদ্দিদে আলফে সানী [রঃ] এ ধরনের ঘৃণ্য উদ্যোগের বিরুদ্ধে কিরূপ ভূমিকা পালন করেছেন, ইতিহাস তার সাক্ষী রয়েছে।
৩. জাতীয় রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ
ক. আইন সভায় মহিলাদের অংশগ্রহণের প্রশ্ন
আমার কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, মহিলাদের আইন সভার সদস্য হওয়া কোন্ ইসলামী বিধি বলে বিষিদ্ধ? আইন সভাকে কুরআন ও হাদীসের কোন্ উক্তিতে শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে?
এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে একটি বিষয় আমাদের খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। সেটি হলো, যে আইন সভার সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার সম্পর্কে বিতর্ক চলছে, সেই আইন সভার চরিত্র ও প্রকৃতি কি ধরনের?
এসব পরিষদকে আইন সভা নামে আখ্যায়িত করার কারণে এই ভুল ধারণা জন্মে যে, এসব আইন সভার কাজ শুধু আইন প্রণয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অতঃপর মনের অভ্যন্তরে এই ভুল ধারণাকে বহাল রেখে একজন মানুষ দেখতে পায় যে, সাহাবায়ে কিরামের আমলে মহিলারা আইনগত বিষয়ে আলাপ আলোচনা, কর্থাবার্তা ও মতামত প্রকাশ করতেন, অনেক সভায় স্বয়ং খলীফারাও তাদের মতামত নিতেন এবং তার মূল্যও দিতেন। অতঃপর সে অবাক হয়ে ভাবে যে, তাহলে আজ ইসলামী আদর্শের নামে এ ধরনের পরিষদগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণকে ভ্রান্ত বলা যায় কিভাবে? কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, বর্তমান যুগে আইন সভা নামে আখ্যয়িত পরিষদগুলোর কাজ কেবল আইন প্রণয়নে সীমাবদ্ধ নয়, বরং কার্যত এই আইন সভাই সমগ্র দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই পরিষদই মন্ত্রীসভা ভাংগে ও গড়ে, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নিদ্ধারণ করে। অর্থনীতির সমস্যাগুলোর সমাধান করে এবং যুদ্ধ ও সন্ধির চাবিকাঠি তারই হাতে নিবদ্ধ থাকে। এ দিক থেকে এই পরিষদ শুধু ফকীহ বা মুফতী নয় বরং রাষ্ট্রের “ পরিচালক শক্তি”।
এবার আসুন দেখা যাক, কুরআন এ “পরিচালক” এর মর্যাদা কাকে দেয় এবং কাকে দেয়না।
সূরা নিসায় আল্লাহ্ বলেনঃ
“পুরুষরা নারীদের পরিচালক। আল্লাহ্ তাদের একজনকে অপরজনের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন আর যেহেতু পুরুষ স্ত্রীর ব্যয় নির্বাহ করে। সৎ নারীরা অনুগত ও আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণের আওতাধীনে অনুপস্থিতাবস্থায় রক্ষকের ভূমিকা পালন করে।” (আয়াতঃ ৩৪)
এ আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পুরুষকেই পরিচালকের মর্যাদা দিয়েছেন। আর সৎ স্ত্রীদের দুটো গুণ বর্ণনা করছেন, এক. আনুগত্যশীলতা, দুই. পুরুষের অনুপস্থিতিতে আল্লাহ্ যে সব জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণ করাতে চান, তার রক্ষণাবেক্ষণ করা।
আপনি হয়তো বলবেন, এটা তো পারিবারিক শৃংখলার জন্য, রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য নয়। কিন্তু এ ব্যাখ্যা সঠিক নয়। কারণ প্রথমতঃ এ আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা এ কথা বলেননি যে, পুরুষ শুধু ঘরোয়া বা পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীর পরিচালক, বরং কথাটা সাধারণ ও শর্তহীনভাবে বলেছেন। তাছাড়া এ ব্যাখ্যা যদি মেনে নেয়াও হয় যে, পুরুষকে পারিবারিক জীবনে নারীর পরিচালক করা হয়েছে, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে যে, যে নারীকে আল্লাহ্ ঘরের ভেতরেও পরিচালিকা ও নেত্রী বানালেননা, বরং অনুগত করে রাখলেন, আপনারা তাকে গোটা দেশের পরিচালকে পরিণত করতে চান কোন্ যুক্তিতে? গৃহাভ্যন্তরের পরিচালকের দায়িত্বের তুলনায় তো দেশের পরিচালকের দায়িত্ব অনেক বড়। আল্লাহর সম্পর্কে কি আপনি এরূপ ধারণা পোষণ করেন যে, তিনি স্ত্রী লোককে একটা গৃহের পরিচালিকা বানাবেননা, অথচ লক্ষ লক্ষ গৃহের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল দেশের পরিচালিকা বানিয়ে দেবেন?
আরো দেখুন, কুরআন স্পষ্ট ভাষায় নারীর কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত করে দিচ্ছে এই বলেঃ “নিজ নিজ গৃহে সসম্মানে অবস্থান করো এবং অতীত জাহিলিয়াতের ন্যায় সেজেগুজে বাইরে বের হয়োনা।” (সূরা আহযাবঃ ৩৩)
আপনি হয়তো আবারও বলবেন যে, এ হুকুম তো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গৃহের মহিলাদেরকে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু আমি জানতে চাই যে, আপনার মহত ধারণা অনুসারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গৃহের মহিলাদের মধ্যে কি এমন কোনো গুরুতর দোষ ছিলো যার দরুণ গৃহের বাইরের দায়িত্ব পালনে তারা অক্ষম ছিলেন? আর অন্য মহিলারা কি এদিক দিয়ে তাদের চেয়ে কোনো শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী? এখন যদি এ সংক্রান্ত সকল আয়াতকে শুধুমাত্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গৃহের মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট ধরে নিই, তাহলে স্বভাবতই এই সিদ্ধান্তেও আসতে হয় যে, অন্যান্য মুসলিম মহিলাদের জন্য জাহিলী কায়দায় সেজেগুজে বাইরে বের হওয়া জায়েয। এটা কি আপনি মেনে নেবেন? তাদের জন্য কি ভিন্ন পুরুষদের সাথে এমনভাবে কথা বলা জায়েয, যাতে তাদের মনে আকর্ষণ জন্মে? আল্লাহ্ কি স্বীয় নবীর গৃহ বাদে সকল মুসলমানের গৃহকে “অপবিত্র” দেখতে চান?
এরপর হাদীসের প্রসংগে আসুন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেনঃ
“যখন তোমাদের নেতা ও শাসকগণ তোমাদের সবচেয়ে অসৎ লোক হেব, যখন তোমাদের ধনী লোকেরা কৃপণ হবে এবং তোমাদের সামষ্টিক বিষয়ের দায়িত্ব স্ত্রী লোকদের হাতে থাকবে। তখন পৃথিবীর পেট হবে তোমাদের জন্য তার পিঠের চেয়ে উত্তম।” (তিরমিযী)
“হযরত আবু বকর থেকে বর্ণিত যে, যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন, ইরানীরা তাদের সম্রাটের মেয়েকে সম্রাট বানিয়েছে, তখন তিনি বললেন, যে জাতি কোনো নারীকে নিজেদের শাসক বানায় সে জাতি কল্যাণ লাভ করতে পারবেনা।” (বুখারী)
এই উভয় হাদীস আল্লাহ্ তায়ালার “পুরুষরা স্ত্রীদের পরিচালক” এই উক্তির যথার্থ ব্যাখ্যা প্রদান করে। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, রাজনীতি ও দেশ শাসন নারীর কর্মসীমা বহির্ভূত। প্রশ্ন ওঠে যে, তাহলে স্ত্রীর কর্মসীমা কী? এর জবাব রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত বাণীসমূহ থেকে পাওয়া যায়ঃ
“স্ত্রী লোক স্বীয় স্বামীর ঘরবাড়ী ও সন্তানদের রক্ষক। তাদের সম্পর্কে তাকে জবাবদিহী করতে হবে।” (আবু দাউদ)
“তোমরা সসম্মানে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করো” এই আয়াতাংশের যথার্থ তাফসীর উপরোক্ত হাদীসে পাওয়া যাচ্ছে। আরো কয়েকটি হাদীসে মহিলাদেরকে রাজনীতি ও দেশ শাসনের চেয়ে নিম্নতর পর্যায়ের গৃহবহির্ভূত কর্মকান্ডও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঐ হাদীসগুলো দ্বারা উক্ত আয়াতাংশের আরো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এ ধরনের দুটি হাদীস নিম্নে দিলামঃ
“জামায়াতে জুময়ার নামায পড়া প্রত্যেক মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য কেবল চার ব্যক্তি ছাড়াঃ দাস, নারী, শিশু ও রোগী।” (আবু দাউদ)
“উম্মে আতিয়া থেকে বর্ণিত যে, আমাদেরকে কফিনের সাথে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।” (বুখারী)
যদিও আমাদের কাছে নিজ দৃষ্টিভংগির সপক্ষে অকাট্য ও সুদৃঢ় যুক্তি প্রমাণও রয়েছে এবং চ্যালেঞ্জ দিলে আমরা সে সকল যুক্তি তোলে ধরতে পারি। কিন্তু প্রথমতঃ সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। দ্বিতীযতঃ আমি কোনো মুসলমানের এ অধিকার স্বীকার করতে প্রস্তুত নই যে, সে আল্লাহ ও রসূলের সুস্পষ্ট নির্দেশ জানার পরও তা পালন করার আগে এবং পালন করার শর্ত স্বরূপ যুক্তি প্রমাণ চাইতে পারে। প্রকৃতই মুসলমান হয়ে থাকলে তাকে প্রথমে হুকুম পালন করতে হবে। তারপর নিজের বিবেকের তৃপ্তির জন্য যুক্তি প্রমাণ চাইতে পারে। কিন্তু সে যদি বলে যে, আমাকে আগে যুক্তি দিয়ে সন্তুষ্ট করো, নচেৎ আমি আল্লাহ্ ও রসূলের হুকুম মানবোনা, তাহলে আমি তাকে মুসলমাসই স্বীকার করিনা, ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকারের তো প্রশ্নই ওঠেনা। হুকুম পালনের শর্ত স্বরূপ যে ব্যক্তি যুক্তির দাবী করে তার স্থান ইসলামের গন্ডীর ভেতরে নয়, বাইরে।
রাজনীতি ও দেশ শাসনে নারীর অধিকারকে যারা শরীয়তসম্মত প্রমাণ করতে চায়, তাদের একমাত্র যুক্তি এই যে, হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর হত্যার বিচার দাবী করে হযরত আলীর বিরুদ্ধে উষ্ট্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলো। কিন্তু প্রথমতঃ এই যুক্তি নীতিগতভাবেই ভ্রান্ত। কেননা যে ব্যাপারে আল্লাহ্ ও রসূলের সুস্পষ্ট নির্দেশ বিদ্যমান সে ব্যাপারে কোনো সাহাবীর ব্যক্তিগত কাজ, যদি সেই নির্দেশের বিপরীত প্রতীয়মান হয়, তবে কোনো মতেই তা গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। সাহাবায়ে কিরামের পবিত্র আদর্শ জীবন নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য আলোর মশাল স্বরূপ। কিন্তু সেটা শুধু এই উদ্দেশ্যে নয় যে, আল্লাহ্ ও রসূলের পথ নির্দেশ বর্জন করে তাদের কারো ব্যক্তিগত পদস্খলনের অনুসরণ করবো। তাছাড়া যে কাজকে সে যুগেরই বড় বড় সাহাবাগণ ভ্রান্ত আখ্যায়িত করেছিলেন, তাকে কিভাবে ইসলামে একটা নতুন বিদয়াতের সূত্রপাত করার জন্য যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে!
হযরত আয়েশার এই উদ্যোগের খবর পাওয়া মাত্রই উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তাকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তা ইবনে কুতাইবা স্বীয় “আল ইমামাতু ওয়াস্ সিয়াসাহ” নামক গ্রন্থে এবং ইবনে আব্দু রব্বিহি স্বীয় “ইকদুল ফরীদ” নামক গ্রন্থে পুরোপুরি উদ্ধৃত করেছেন। সে চিঠিটা পড়ে দেখলে বুঝা যাবে যে, কত দৃঢ়তা ও তেজস্বীতার সাথে তিনি বলেছেনঃ
কুরআন আপনাকে সংকুচিত করে দিয়েছে, আপনি নিজেকে প্রসারিত করবেননা। ….. আপনার কি মনে নেই যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামে বাড়াবাড়ি করতে আপনাকে নিষেধ করেছেন।….. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আপনাকে এ ভাবে উটের পিঠে চড়ে কোনো মরুভূমিতে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ছুটাছুটি করতে দেখতেন, তাহলে আপনি তাঁকে কি জবাব দিতেন?
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের এ উক্তিটাও স্মরণ করার মতো যে, “আয়েশা রাদিয়াল্লাহ তায়ালা আনহার জন্য তাঁর গৃহ তার উটের হাওদার চেয়ে উত্তম।”
বুখারী শরীফে হযরত আবু বকর (রা) এই উক্তি লক্ষ্য করুন যে, “আমি উষ্ট্র যুদ্ধের বিভ্রাটে পড়া থেকে শুধু এজন্য বেঁচে গিয়েছিলাম যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণীটি আমার মনে পড়ে গিয়েছিলো, যে জাতি নিজের সামষ্টিক কর্মকান্ডের দায়িত্ব কোনো নারীর হতে সোপর্দ করে, সে জাতির কল্যাণ নেই।”
সে যুগে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর চেয়ে বেশী শরীয়তের পারদর্শী আর কেউ ছিলোনা। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় হযরত আয়েশাকে লেখেন, আপনার এ উদ্যোগ শরীয়তের সীমানা বহির্ভূত। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা অতি উচ্চ স্তরের বিদুষী ও বিচক্ষণ মহিলা হওয়া সত্ত্বেও জবাবে কোনো যুক্তি প্রমাণ পেশ করতে পারেননি। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছিলেন, “একথা সত্য যে, আপনি আল্লাহ ও রসূলের খাতিরেই ক্রুদ্ধ হয়ে বাইরে বেরিয়েছেন। কিন্তু আপনি এমন একটা কাজের পেছনে লেগেছেন, যার দায়িত্ব আপনার ওপর অর্পণ করা হয়নি। যুদ্ধ ও সমাজ সংস্কারের সাথে নারীদের কী সম্পর্ক! আপনি হযরত উসমানের হত্যার বিচার দাবী করছেন, কিন্তু আমি সত্য বলছি যে, যে ব্যক্তি আপনাকে এই বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং এই গুনাহর কাজে প্ররোচিত করেছে, সে আপনার জন্য উসমানের হত্যাকারীদের চেয়ে বেশী পাপী।”
দেখুন, এই চিঠিতে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আয়েশার কাজকে সুস্পষ্ট ভাষায় শরীয়ত বিরোধী আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু হযরত আয়েশা এর জবাবে শুধুমাত্র এই কথাটা বলতে পেরেছিলেন, “ঘটনা এখন এতোদূর গড়িয়ে গেছে যে, তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করে কাজ হবেনা।”
তারপর উষ্ট্র যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটার পর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার সাথে দেখা করতে তাঁর উষ্টের কাছে গেলেন, তখন তাকে বললেনঃ
“হে উষ্ট্রারোহিনী! আল্লাহ্ আপনাকে ঘরে বসে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু আপনি যোদ্ধার বেশে বাইরে বেরিয়ে এলেন!”
কিন্তু এ সময়েও হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলতে পারেননি যে, আল্লাহ্ আমাদেরকে ঘরে বসে থাকতে বলেননি, রাজনীতি ও যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অধিকার আমাদের রয়েছে।
এ কথাও ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, অবশেষে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা অনুতাপ করতে থাকেন। আল্লামা ইবনে আব্দুল বার স্বীয় গ্রন্থ ‘আলইস্তীয়াবে’ লিখেছেন, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে অনুযোগের সূরে বলেন, “তুমি কেন আমাকে এ কাজে যেতে বাধা দিলেনা?’ তিনি জবাব দিলেন, “আমি দেখলাম, এক ব্যক্তি [অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের] আপনার মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং আপনি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলতে পারবেন বলে আমার আশা ছিলোনা।” তখন উম্মুল মুমিনীন বললেন, “তুমি যদি আমাকে নিষেধ করতে তবে আমি বেরুতামনা।”
এরপর হযরত আয়েশার কাজ দেখিয়ে এই মর্মে যুক্তি প্রদর্শনের আর অবকাশ কোথায় যে, ইসলামে নারীকেও রাজনীতি ও দেশ শসনের দায়িত্বের অংশীদার করা হয়েছে? অবশ্য যারা মনে করে দুনিয়ার বিজয়ী জাতিগুলো যে কাজ করে সেটাই সত্য ও সঠিক এবং যারা সবাই যেদিকে চলে সেদিকেই চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে, তাদেরকে কে বলেছে যে, ইসলামকেও সাথে নিয়ে যাও? তাদের যেদিক ইচ্ছা হয় চলুক। কিন্তু এতোটুকু সৎ সাহস তো তাদের থাকা উচিৎ যে, তারা আসলে যাদের অনুসারী, তাদের নামটাই বলবে এবং যুক্তি প্রমাণ ছাড়া ইসলামের ওপর এমন কোনো জিনিস চাপাবেনা যা আল্লাহর কিতাব, রসূলের হাদীস এবং প্রথম শতাব্দীগুলোর ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করছে।
খ. ইসলামী রাষ্ট্রে মহিলাদের কর্মক্ষেত্র
প্রশ্নঃ ইসলাম যখন এই দাবীতেই সোচ্চার যে, সে চরম নাজুক মুহূর্তেও নারীকে একটা মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে, তখন এ যুগের ইসলামী সরকার কি তাকে পুরুষদের সমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈততিক অধিকার দেবেনা? এ যুগে নারীকে কি পুরুষের সমান উত্তরাধিকার দেয়া যাবে? তাদেরকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা অথবা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করে দেশ ও জাতির অর্থনৈতিক অবস্থা সমৃদ্ধিশালী করার অনুমতি দেয়া হবে কি? মনে করুন, ইসলামী সরকার যদি নারীদের ভোটাধিকার দেয় এবং তারা সংখ্যাগুরু ভোটে মন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়, তাহলে এই বিংশ শতাব্দীতেও কি তারা ইসলামী নীতি মুতাবিক সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে পারবেনা? মহিলাদের সর্বোচ্চ পদ অলংকৃত করার দৃষ্টান্ত তো আজকাল ভুরি ভুরি। শ্রীলংকায় বর্তমানে মহিলা প্রধানমস্ত্রী রয়েছে। নেদারল্যান্ডের সর্বোচ্চ শাসকও একজন মহিলা। বৃটেনের রাজমুকুটও এক মহিলার মাথায় শোভা পাচ্ছে। রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে ভূপালের নবাবের বোন আবিদা সুলতানা দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান বেগম রানা লিয়াকত আলী নেদারল্যান্ডে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, মিসেস বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত বৃটেনে ভারতের বর্তমান হাই কমিশনার রয়েছেন। এর আগে তিনি জাতিসংঘের সভাপতিও ছিলেন। মোগল সম্রাজ্ঞী নূর জাহান এবং ঝাঁসীর রানী রাজিয়া সুলতানার নজীরও লক্ষ্যণীয়। নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের মহিষী হযরত মহল ইংরেজদের বিরুদ্ধে লক্ষৌতে অনুষ্ঠিত যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন।
এভাবে নারীরা নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে যোগ্য প্রমাণ করেছেন। এই পটভূমিতে মুহতারামা ফাতেমা জিন্নাহ যদি আজ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন, তাহলে ইসলামী বিধানের আলোকে পাকিস্তানের ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় তা কি অনুমোদিত হবে? মহিলারা কি এখনো ডাক্তার, উকিল, ম্যাজিষ্ট্রেট, জজ, সামরিক কর্মকতা, অথবা বৈমানিক হতে পারবেনা? নার্স হিসেবে মহিলারা রোগীদের কিরূপ পরিচর্যা করে সেটাও দেখার মতো। স্বয়ং ইসলামের প্রথম যুদ্ধে নারীরা যুদ্ধাহতদের পরিচর্যা করেছেন, পানি খাইয়েছেন এবং উৎসাহ যুগিয়েছেন। এমতাবস্থায় আজও কি ইসলামী রাষ্ট্রে অর্ধেক দেশবাসীকে বাড়ীর চৌহদ্দিতে বন্দিনী করে রাখা হবে?
জবাবঃ ইসলামী সরকার দুনিয়ার কোনো ব্যাপারেই ইসলামী আদর্শ ও মূলনীতির বিরুদ্ধে কাজ করার অধিকারী নয়। এমনকি তার ইচ্ছ করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়, যদি তার পরিচালনায় প্রকৃত ইসলামী আদর্শের নিষ্ঠাবান বিশ্বাসী ও বাস্তব অনুসারী লোকেরা নিয়োজিত থেকে থাকে। নারীর ব্যাপারে ইসলামের নীতি হলো, তারা সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে পুরুষের সমান, নৈতিক মানের বিচারেও সমান, আখিরাতে কর্মফলেও সমান, কিন্তু উভয়ের কর্মক্ষেত্র এক নয়। রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, সামরিক কর্মকান্ড এবং এ জাতীয় অন্যান্য যেসব কাজ পুরুষের কর্মক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেসব কর্মক্ষেত্রে নারীকে টেনে আনার অনিবার্য পরিণাম এই হবে যে আমাদের পরিবারিক জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে, যেখানে নারীর দায়িত্বই বেশী। তাছাড়া এতে নারীর ওপর দ্বিগুণ দায়িত্ব বর্তাবে। একদিকে তাকে তার প্রকৃতিগত দায়িত্বও পালন করতে হবে, যাতে পুরুষ কোনো ক্রমেই অংশীদার হতে পারেনা। তদুপরি পুরুষের দায়িত্বেরও অর্ধেক তার নিজের কাঁধে তুলে নিতে হবে। দ্বিগুণ দায়িত্ব পালন তো কার্যত সম্ভব নয়। কাজেই অনিবার্যভাবে প্রথম পরিণতিটাই দেখা দেবে। পাশ্চাত্য জগতের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় যে, সেখানে তা ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে এবং তাদের পারিবারিক জীবনে ধস নেমেছে। অন্যের নির্বুদ্ধিতাকে চোখ বুজে অনুকরণ করা কোনো বুদ্ধিমত্তা নয়।
ইসলামে নারীর উত্তরাধিকার পুরুষের সমান হবার কোনো অবকাশ নেই। কুরআনের অকাট্য বিধান এ ব্যাপারে অন্তরায়। উভয়ের অংশ সমান হওয়া সুবিচারের পরিপন্থী। কারণ ইসলামী বিধানে পরিবারের লালন পালনের সমস্ত আর্থিক দায়দায়িত্ব পুরুষের ওপর চাপানো হয়েছে। স্ত্রীর মোহরানা এবং ভরণপোষণও তারই দায়িত্ব। অপরদিকে স্ত্রীর ওপর কোনো দায়দায়িত্বই ন্যস্ত হয়নি। এমতাবস্থায় কোন্ যুক্তিতে নারীকে পুরুষের সমান অংশীদার করা যেতে পারে।
নীতিগতভাবেই ইসলাম নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার বিপক্ষে। পারিবারিক জীবনের স্থিতিশীলতা চায় এমন কোনো সমাজ ব্যবস্থা অবাধ মেলামেশার পরিবেশ কামনা করেনা। পাশ্চাত্য জগতে এর শোচনীয় পরিণতি দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের যদি সে পরিণতি ভোগ করার সাধ জেগে থাকে তবে সানন্দে তা ভোগ করুক। তাই বলে ইসলাম যে কাজ কঠোরভাবে নিষেধ করে, তা জোরপূর্বক বৈধ প্রমাণ করার কি দরকার পড়ছে?
ইসলামে যদি যুদ্ধের সময় নারীকে আহতদের পরিচর্যার কাজে লাগানো হয়ে থাকে, তবে তার অর্থ এটা হয়না যে, স্বাভাবিক অবস্থায়ও নারীকে অফিস আদালতে, কল কারখানায়, ক্লাবে ও পার্লামেন্টে নিয়ে আসতে হবে। পুরুষের কর্মক্ষেত্রে এসে নারীরা কখনো পুরুষের মুকাবিলায় সফল হতে পারেনা। কেননা তাদেরকে এসব কাজের জন্য তৈরীই করা হয়নি। এসব কাজের জন্য যে ধরনের নৈতিক ও মানসিক গুণাবলীর প্রয়োজন, তা মূলত পুরুষের মধ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে।
নারী যদি কৃত্রিমভাবে এসব গুণ কিছু কিছু অর্জনের চেষ্টাও করে তবে তার উল্টো ক্ষতি তার নিজের এবং সমাজের ওপর সমভাবে বর্তে। তার নিজের ক্ষতি এই যে, সে পুরোপুরি স্ত্রীও থাকেনা পুরোপুরি পুরুষও হতে সক্ষম হয়না। ফলে নিজের সহজাত কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে যায়। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি এই যে, যোগ্য কর্মীর বদলে সে অযোগ্য কর্মীকে কাজে নিয়োগ করে। নারীর আধা মেয়েলী ও আধা পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্য রাজনীতি ও অর্থনীতিকে বিপর্যস্থ করে তোলে। এ ব্যাপারে মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রাচীন মহিলার অবদান উল্লেখ করে লাভ কি? দেখতে হবে, সেখানে লক্ষ লক্ষ কর্মীর প্রয়োজন সেখানে সকল নারী মানানসই হবে কি? সম্প্রতি মিসরের সরকারী ও বাণিজ্যিক মহল অভিযোগ তুলেছে যে, সেখানে কর্মরত সর্বমোট এক লক্ষ দশ হাজার মহিলা কর্মোপযোগী প্রমাণিত হচ্ছেনা। পুরুষের তুলনায় তাদের তৎপরতা শতকরা ৫৫ ভাগের বেশী নয়। মিসরের বাণিজ্যিক মহলের সর্বব্যাপী অভিযোগ হলো, নারীদের কাছে কোনো কিছুর গোপনীয়তা রক্ষিত হয়না। পাশ্চাত্য জগতে গোয়েন্দাগিরির যেসব ঘটনা ঘটে, তাতে সাধারণত কোনো না নোনোভাবে মহিলারা জড়িত থাকে।
ইসলাম নারী শিক্ষায় বাধা দেয়না। যতো উচ্চ শিক্ষা সম্ভব তাদের দেয়ার ব্যবস্থা হওয়া উচিত, তবে কয়েকটা শর্ত আছে। প্রথমত, তারা নিজেদের বিশেষ কর্মক্ষেত্রে কাজ করার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত হতে পার, এমন শিক্ষাই তাদের দিতে হবে। হুবহু পুরুষদের শিক্ষা তাদেরকে দেয়া যাবেনা। দ্বিতীয়ত, সহশিক্ষা চলবেনা। নারীদেরকে নারীদের দ্বারা পাচালিত প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষিকা দ্বারাই শিক্ষা দিতে হবে। সহশিক্ষার সর্বনাশা কুফল পাশ্চাত্য জগতে এমন প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে যে, এখন যাদের জ্ঞানচক্ষু একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে, তারা ছাড়া আর কেউ তা অস্বীকার করতে পারেনা। উদাহরণ স্বরূপ, আমেরিকায় ১৭ বছর পর্যন্ত বয়সের যে মেয়েরা হাইস্কুলে পড়ে, সহশিক্ষার কারণে প্রতি বছর তাদের মধ্য থেকে গড়ে এক হাজার জন গর্ভবতী হয়ে পড়ে।[১. এটা ১৯৬২ সালের কথা। বর্তমানে এ সংখ্যা বহুগুণ বেশী। এমনকি বহুবিধ গর্ভনিরোধ আবিষ্কার করেও তারা কুমারীদের গর্ভধারণ ঠেকাতে পারছেনা। সম্পাদক]
যদিও এ পরিস্থিতি এখনো আমাদের দেশে দেখা দেয়নি তবে সহশিক্ষার কিছু কিছু কুফল আমাদের এখানেও দেখা দেতে শুরু করেছে। তৃতীয়ত, উচ্চ শিক্ষিত মহিলাদেরকে এমন প্রতিষ্ঠানাদিতে নিয়োগ করতে হবে, যা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্যই নির্দিষ্ট। যেমন মহিলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মহিলা হাসপাতাল ইত্যাদি।
গ. ইসলামী রাষ্ট্রে সমাজ সংস্কার ও জনশিক্ষা কার্যক্রম
প্রশ্নঃ ইসলামী সরকার কি নারী স্বাধীনতার ক্রমবর্দ্ধমান প্রবণতাকে শক্তি প্রয়োগে দমন করবে? বিচিত্র সাজসজ্জা, অর্ধ নগ্ন পোশাক ও নিত্যা নতুন ফ্যাশন ধারণের প্রবণতায় যেভাবে আধুনিক নারীরা মেতে উঠেছে, বিশেষত যুবতী মেয়েরা অত্যন্ত আঁটসাঁট ও মনমাতানো সুরভিত পোশাকে ভূষিত হয়ে রং বেরংগের প্রসাধনী শোভিত হয়ে এবং দেহের অঙ্গ প্রত্যক্ষ ও উচুনীচুর প্রদর্শনী করে যেভাবে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এবং আজকাল উঠতি বয়সের ছেলেরাও হলিউডের ছায়াছবি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যেভাবে টেডি বয় সেজে চলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কি প্রত্যেক মুসলিম ও অমুসলিম তরুণ তরুণীর লাগামহীন বেলেল্লাপনা রোধ করার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেবে? আইন লংঘনে তাদেরকে শাস্তি প্রদান এবং অভিভাবকদের থেকে জরিমানা আদায় করবে? এটা করলে আবার তাদের নাগরিক অধিকার কি ক্ষুন্ন হবেনা? গার্লস গাইড, মহিলা সমিতি, ওয়াই এম সি এ [খৃষ্টান যুব সমিতি] ওয়াই ডব্লিউ সি এ [খৃষ্টান যুবতী সমিতি ইত্যাকার প্রতিষ্ঠান কি ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় বরদাশত করা হবে? নারীরা কি আদালত থেকে নিজেই তালাক নিতে পারবে এবং পুরুষদের একাধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করা হবে? ইসলামী আদালতের সামনে কি যুবক যুবতীরা কোর্ট ম্যারেজ [Civil marriage] করার অধিকারী হবে? নারীদের যুব উৎসব, খেলাধূলা, প্রদর্শনী, নাটক, নৃত্য, ছায়াছবি অথবা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ কিংবা বিমানবালা হওয়ার ওপর কি ইসলামী সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে? জাতীয় চরিত্র বিধ্বংসী সিনেমা, টেলিভিশন ও রেডিওতে অশ্লীল গান, অশ্লীল বইপুস্তক, বাজনা, নাচ ও ঢলাঢলিতে পরিপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি কি বন্ধ করে দেয়া হবে, না এগুলোকে কল্যাণমূলক খাতে প্রবাহিত করা সম্ভব হবে?
জবাবঃ ইসলাম সমাজ সংস্কার ও জনশিক্ষার সকল কার্যক্রম কেবল আইনের ডান্ডার জোরে চালায়না। শিক্ষা, প্রচার ও জনমতের চাপ ইসলামের সংস্কার কার্যক্রমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। এ সকল উপায় উপকরণ প্রয়োগের পরও যদি কোনো ত্রুটি থেকে যায়, তাহলে ইসলাম আইনগত ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণেও কুণ্ঠিত হয়না। নারীদের নগ্নতা ও বেহায়াপনা আজলেই একটা মারাত্মক ব্যাধি। কোনো যথার্থ ইসলামী সরকার এটা সহ্য করতে পারেনা। সংশোধনের অন্যান্য পন্থা প্রয়োগে যদি এ ব্যাধি দূর না হয়, কিংবা তার কিছুটা অবশিষ্ট থেকে যায়, তাহালে আইনের সাহায্যে তা রোধ করতেই হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এর নাম যদি নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হয় তাহলে জুয়াড়িদের ধর পাকড় করা এবং পকেটমারদের শাস্তি দেয়াও নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করার শামিল। সামাজিক জীবনে ব্যক্তির উপর কিছু বিধনিষেধ আরোপ করতেই হয়। ব্যক্তি নিজের স্বভাবগত অসৎ প্রবনতা এবং অন্যদের কাছ থেকে শেখা অপকর্ম দ্বারা সমাজকে দূষিত করুক এজন্য তাকে বলগাহীন ছেড়ে দেয়া যেতে পারেনা।
গার্লস গাইডের স্থান ইসলামে নেই। মহিলাদের সমিতি থাকতে পারে। তবে শত এই যে, কেবল মহিলাদের মধ্যেই তার তৎপরতা সীমিত রাখতে হবে এবং মুখে কুরআনের বুলি কপচানো আর কাজে কুরআন বিরোধী দুর্নীতি চালিযে যাওলা বন্ধ করতে হবে। খৃষ্টান যুবতী সমিতি খৃষ্টান তরুণীদের জন্য থাকাতে পারে। কিন্তু কোনো মুসলিম নারীকে তাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া যেতে পারেনা। মুসলিম নারীরা যদি ইসলামী বিধানের আওতায় থেকে মুসলিম তরুণী সমিতি বানাতে চায় তবে বানাতে পারে।
মুসলিম নারী ইসলামী আদালতের মাধ্যমে ‘খুলা’ বিধির আওতায় বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। বিয়ে বাতিলকরণ এবং চির বিচ্ছেদ [Judicial seperation] এর ঘোষণাও আদালত দথেকে লাভ করতে পারে। তবে শর্ত হলো, শরীয়তের বিধি মুতাবিক এ ধরনের কোনো ঘোষণা অর্জনের যোগ্যতা তার মধ্যে থাকা চাই। কিন্তু তালাক [Divorce] এর ক্ষমতা কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শুধু পুরুষকেই দিয়েছে। পুরুষের এই ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনো আইনের নেই। কুরআনের নাম ভাঙ্গিয়ে যদি কুরআন বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয় তবে সেটা ভিন্ন কথা। তালাক দেয়ার ক্ষমতা পুরুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে এবং কোনো আদালত বা পঞ্চায়েত তাতে নাক গলাবে, এমন ধারণা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান শাতাব্দী পর্যন্ত গোটা ইসলামের ইতিহাসে অপরিচিত। এ ধারণা সরাসরি ইউরোপ থেকে আমাদের দেশে আমদানী হয়েছে। যারা এটা আমদানী করেছে তারা একটিবারও চোখ মেলে দেখেনি যে, ইউরোপে তালাকের এ আইনের পটভূমি কি ছিলো এবং সেখানে এর কি কি কুফল দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশে ঘরোয়া কেলেংকারীর হাড়ি যখন ঘর থেকে বেরিয়ে হাটে বাজারে গিয়ে ভাঙ্গবে, তখন আল্লাহর আইন সংশোধন করতে যাওয়ার পরিণতি কি হয় তা মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাবে।
পুরুষদের একাধিক বিয়ের ওপর আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ বা রোধ করার ধারণাও একটা বিদেশী পণ্য, যাকে কুরআনের ভূয়া লাইসেন্স দেখিয়ে আমদানী করা হয়েছে। এটা এসেছে এমন সমাজ থেকে, যেখানে কোনো মহিলাকে যদি বিবাহিত স্ত্রীর উপস্থিতিতে রক্ষিতা করে রাখা হয়, তাহলে সেটা শুধু সহনীয়ই নয় বরং তার অবৈধ সন্তানের অধিকার সংরক্ষণের কথাও ভাবা হয় [ফ্রান্সের উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে]। অথচ সে মহিলাকেই যদি বিয়ে করা হয় তাহলে সেটা হয়ে যায় অপরাধ। যেনো যতো কড়াকড়ি কেবল হালালের বিরুদ্ধে, হারামের বিরুদ্ধে কিছুই নয় । আমার প্রশ্ন হলো, কেউ যদি কুরআনের ক ও জানে তবে সে কি এই মূল্যবোধ [Value] গ্রহণ করতে পারে? ব্যভিচার আইনত বৈধ হবে আর বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ হবে, এমন উদ্ভট দর্শন কি তার কাছে ন্যায়সংগত হতে পারে? এ ধরনের আইন প্রণয়নের একমাত্র পরিণাম এই হবে যে, মুসলমানদের সমাজে ব্যভিচারের ছড়াছড়ি হবে, বান্ধবী ও রক্ষিতার সংখা বাড়াবে, কেবল দ্বিতীয় স্ত্রীর অস্তিত্ব থাকবেনা। এ ধরনের সমাজ কাঠামোগত দিক দিয়ে ইসলামের আসল সমাজ থেকে অনেক দূরে এবং পাশ্চাত্য সমাজের অনেক কাছাকাছি হবে। এ ধরনের পরিস্থিতির কথা ভাবতে কারো ভালো লাগে তো লাগুক, কোনো মুসলমানের কাছে এটা ভালো লাগতে পারেনা।
কোর্ট ম্যারেজের প্রশ্ন কোনো মুসলিম নারীর বেলায় যে ওঠেইনা, তা বলাই নিষ্প্রয়োজন। এ প্রশ্ন ওঠে কেবল কোনো মুশরিক, খৃষ্টান কিংবা ইহুদী নারীকে বিয়ে করার বেলায়। এ ধরনের বিধর্মী মহিলা ইসলামী আইন মতে ইসলাম গ্রহণপূর্বক কোনো মুসলমানকে বিয়ে করতে প্রস্তুত থাকেনা। অথচ মুসলমান পুরুষ তার প্রেমে মজে গিয়ে কোনো ধর্মের কড়াকড়ি তাকে মানতে হবেনা, এই অঙ্গীকার দিয়ে তাকে বিয়ে করে। এ ধরনের কাজ কারোর যদি করতেই হয় তবে তার ইসলামের ফতুয়া নেয়ার প্রয়োজন পড়ে কিসে? ইসলাম তার অনুগত লোককে এ কাজের অনুমতি কেন দেবে? মুসলমানদের এ ধরনের বিয়ে দেয়াটা ইসলামী আদালতের দায়িত্ব হলোই বা কবে থেকে?
একটা ইসলামী সরকারও যদি যুব উৎসব [Youth festival , খেলাধূলা, নাটক, নাচগান ও সুন্দরী প্রতিযোগিতায় মুসলিম যুবতীদের টেনে আনে অথবা বিমানবালা নিয়োগ করে যাত্রীদের মনোরঞ্জনের কাজ নেয়, তাহলে আমি জানতে চাই যে, ইসলামী সরকারের প্রয়োজন কি? এসব কাজ তো কুফরী সমাজে এবং কাফির শাসিত রাষ্ট্রে সহজেই হতে পারে। সেখানে বরং এ কাজ আরো অবাধে হওয়া সম্ভব।
সিনেমা, ফিল্ম, টেলিভিশন, রেডিও ইত্যাদি আল্লাহর সৃষ্টি করা জাগতিক শক্তি ছাড়া কিছু নয়। এগুলোতে সৃষ্টিগতভাবে দোষের কিছু নেই। এগুলোর চরিত্র বিধ্বংসী ব্যবহারটাই শুধু দূষণীয়। এগুলোকে মানুষের কল্যাণার্থে ব্যবহার করা এবং নৈতিক বিচ্যুতির কাজে ব্যবহারের পথ বন্ধ করাই ইসলামী সরকারের একমাত্র কাজ।
৪. ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার
ক. ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিক
প্রশ্নঃ আমি হিন্দু মহাসভার কর্মী। গত বছর হিন্দু মহাসভার প্রাদেশিক প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি। কিছুদিন হলো আমি আপনার সম্পর্কে জানতে পেরেছি। ইতোমধ্যে আপনার কতিপয় গ্রন্থও পড়েছি। যেমনঃ মুসলমান ও বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত ১ম ও ৩য় খন্ড, [১. এ গ্রন্থগুলো বর্তমানে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুসলমান’ গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত। -সম্পাদক] ইসলামের রাজকনৈতিক মতবাদ, ইসলামী বিপ্লবের পথ ও শান্তি পথ প্রভৃতি। এ গ্রন্থগুলো অধ্যয়নের ফলে ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এ জিনিসটা যদি আরো কিছুকাল আগে প্রতিষ্ঠিত হতো, তবে হিন্দু মুসলমান সমস্যা এতোটা জটিল হতোনা। আপনি যে ইসলামী রাষ্ট্রের দাওয়াত দিচ্ছেন, তার অধীনে জীবন যাপন করা গৌরবের বিষয়। তবে কতিপয় প্রশ্ন আছে। এগুলোর জবাবের জন্য চিঠিপত্র ছাড়া প্রয়োজন হলে আমি আপনার সান্নিধ্যে হাযির হবো
আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে হিন্দুদের কি মর্যাদা প্রদান করা হবে? তাদের কি আহলে কিতাবদের সমপর্যায়ের অধিকার দেয়া হবে নাকি যিম্মী ধরা হবে? আহলে কিতাব এবং যিম্মীদের অধিকারের বিস্তারিত বিবরণ আপনার উক্ত গ্রন্থগুলোতেও নেই। আরবদের সিন্ধু অভিযানের ইতিহাস আমি যতোটা জানি, তাতে দেখা যায় মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং তার উত্তরসূরীরা সিন্ধুতে হিন্দুদেরকে আহলে কিতাবের অধিকার প্রদান করেছিলো। আশা করি এ বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা পেশ করবেন। আহলে কিতাব এবং যিম্মীদের অধিকারের মধ্যে কি পার্থক্য রয়েছে তাও লিখবেন। তারা দেশের প্রশাসনিক কাজে সমানভাবে অংশ গ্রহণ করতে পারবে কি? যদি না পারে তবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে আপনি হিন্দুদেরকে কোন্ মর্যাদা প্রদান করতে চাচ্ছেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে হলো, কুরআনের ফৌজদারী বিধানসমূহ কি মুসলমানদের মতো হিন্দুদের উপরও কার্যকর হবে? হিন্দুদের জাতীয় আইন [Personal Law] তাদের উপর কার্যকর হবে কিনা? আমার বক্তব্য হচ্ছে হিন্দুরা তাদের উত্তরাধিকার আইন, যৌথ পরিবার ব্যবস্থা, পালকপুত্র গ্রহণ ইত্যাদি বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী [মনু শাস্ত্রের ভিত্তিতে] জীবন যাপন করতে পারবে কি?
প্রকাশ থাকে যে, প্রশ্নগুলো একজন সত্য সন্ধানীর প্রশ্ন।
জবাবঃ পাত্রে প্রকাশিত আপনার ধ্যান ধ্যারণা আমার নিকট সম্মানার্হ। এটা বাস্তব যে ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ককে জটিল ও তিক্ত করার ব্যাপারে সেসব লোকেরাই দায়ী, যারা ন্যায় ও সত্য মূলনীতির পরিবর্তে ব্যক্তিগত, বংশগত, শ্রেণীগত, সম্প্রদায়গত এবং জাতিগত মূলনীতির ভিত্তিতে মানুষের জীবন সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে। এর পরিণাম অনিবার্যভাবেই তাই হওয়ার ছিলো যা এখন আমরা সচক্ষে দেখছি। আমরা আপনারা সকলেই এ মন্দ পরিণতির সমান অংশীদার। কল্যাণ কেউই লাভ করতে পারেনি।
আপনার প্রশ্নগুলোর সংক্ষিপ্ত জবাব ক্রমনুসারে নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
১. ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তার অবস্থা এরূপ হবেনা যে একটি জাতি আরেকটি জাতি বা অন্য জাতিগুলোর উপর শাসক হয়ে বসবে। বরঞ্চ তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য এই হবে যে, একটি আদর্শের ভিত্তিতে দেশে সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। একথা পরিষ্কার যে, এরূপ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেশের সেসব নাগরিকরাই বহন করতে পারবে যারা হবে উক্ত আদর্শের ধারক ও বাহক। যারা এ আদর্শের ধারক ও বাহক হবেনা, অন্তত এর উপর সন্তুষ্ট হবেনা, স্বাভাবিকভাবেই তারা এ রাষ্ট্রের যিম্মীর মর্যদা লাভ করবে। অর্থাৎ তাদের ‘নিরাপত্তার যিম্মাদারী’ সেসব লোকেরা গ্রহণ করবে যারা উক্ত মূলনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পরিচালক হবে।
২. আহলে কিতাব এবং সাধারণ যিম্মীদের মধ্যে একটি ছাড়া আর কোনো পার্থক্য থাকবেনা। সেটি হচ্ছে এই যে, আহলে কিতাবের মহিলাদেরকে মুসলমানরা বিয়ে করতে পারবে এবং অন্যদের পারবেনা। কিন্তু অধিকারের ব্যাপারে আহলে কিতাব এবং অন্য যিম্মীদের মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য থাকবেনা।
৩. যিম্মীদের অধিকাদরের বিস্তারিত বিবরণ তো এ চিঠিতে দেয়া সম্ভব নয়। তবে এ ব্যাপারে মৌলিক কথা হচ্ছে এই যে, যিম্মী দু’প্রকারের হতে পারে। এক প্রকার হচ্ছে সেসব যিম্মী, যারা কোনো চুক্তির ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্রের যিম্মী হয়েছে বা নিরাপত্তা গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয় প্রকার যিম্মী হচ্ছে তারা, যারা কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই যিম্মী হয়েছে। প্রথম ধরনের যিম্মীদের সংগে কৃত চুক্তি মুতাবিক আচরণ করা হবে। দ্বিতীয় প্রকার যিম্মীদের যিম্মী হওয়া দ্বারাই আমাদের উপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত হয় যে, আমরা তেমনি করে তাদের জান মাল ও ইজ্জত আবরুর হিফাযত করবো যেমনি করে হিফাযত করি আমাদের নিজেদের জান মাল ও ইজ্জত আবরুর। তাদের আইনগত অধিকার তা-ই হবে যা হবে মুসলমানদের। তাদের রক্তমূল্য তা-ই হবে যা মুসলমানদের রক্তমূল্য। নিজেদের ধর্ম পালনের পূর্ণ আযাদী তাদের থাকবে। তাদের উপাসনালয়সমূহ নিরাপদ থাকবে। তাদেরকে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের অধিকার দেয়া হবে এবং বাধ্যতামূলকভাবে তাদের উপর ইসলামী শিক্ষা চাপিয়ে দেয়া হবেনা।
আল্লাহ্ চাহেন তো অমুসলিম নাগরিকদের সম্পর্কে ইসলামের শাসনতান্ত্রিক ধারাসমূহ আমরা পৃথক পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করবো। [১. ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার’ শিরোনামে এ পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। -সম্পাদক]
৪. অমুসলিমদের “পার্সোনাল ল” তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার আবশ্যিক অংশ। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্র তাদের বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার, পালকপুত্র গ্রহণ এবং অনুরূপ অন্যান্য আইন যা দেশীয় আইনের [Law of the land] সাথে সাংঘর্ষিক নয়, তাদের উপর প্রয়োগ করবে। কেবল সেসব ক্ষেত্রে তাদের পার্সোনাল ল’কে বরদাশত করা হবেনা যেগুলোর কুফল জনগণকে প্রভাবিত করবে। যেমন কোনো অমুসলিম জাতি যদি সূদকে বৈধ রাখতে চায় তবে ইসলামী রাষ্ট্রে সূদী লেনদেনের অনুমতি আমরা দেবোনা। কারণ এতে গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রভাবিত হবে। কিংবা কোনো অমুসলিম জাতি যদি ব্যভিচার বৈধ রাখতে চায়, তবে এ অনুমতিও আমরা দেবোনা। তারা নিজেদের মধ্যেও এ কুকর্মের [Prostitution] ব্যবসা চালু রাখতে পারবেনা। কেননা এটা সর্ব স্বীকৃতভাবে মানব জাতির নৈতিকতা বিরোধী কাজ। আর এটা আমাদের ফৌজদারী আইনের [Criminal Law] সাথেও সাংঘর্ষিক। এ কথা স্পষ্ট যে, এটাই হবে রাষ্ট্রীয় আইন। এবার এরি ভিত্তিতে আপনি অন্যান্য বিষয়গুলো অনুমান করতে পারেন।
৫. আপনি প্রশ্ন করেছেন, অমুসলিমরা ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন শৃংখলার কাজে সমান অংশীদার হতে পারবে কিনা? যেমন পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় হিন্দুরা অংশ গ্রহণ করতে পারবে কিনা? যদি না পারে, তবে আপনারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে মুসলমানদের জন্যে সে অবস্থা মেনে নেবেন কি, ইসলামী রাষ্ট্রে যে মর্যাদা আপনারা হিন্দুদের প্রদান করবেন? আমার মতে আপনার এ প্রশ্নের ভিত্তি ভুল ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ এখানে আপনি একদিকে ‘আদর্শিক অজাতীয়তা ভিত্তিক রাষ্ট্রের’ [Idiolgical non-National State] সঠিক মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখেননি। অপরদিকে এ প্রশ্নের মধ্যে ব্যবসায়িক লেনদেনের মানসিকতা পরিস্ফুট বলে মনে হচ্ছে।
পহেলা নম্বর জবাবেও আমি একথা বলেছি যে, একটি আদর্শিক রাষ্ট্র পরিচালনা এবং তার নিরাপত্তার দিয়িত্ব কেবল সেসব লোকেরাই বহন করতে পারে, যারা সেই আদর্শের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী। তারাই তো এ আদর্শের মূল স্পিরিট অনুধাবন করতে পারবে। এদের থেকেই তো এ আশা করা যেতে পারে যে, পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে নিজেদের দীনী ও ঈমানী দায়িত্ব মনে করে তারা এ রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজ পরিচালনা করবে এবং একে টিকিয়ে রাখার জন্যে প্রয়োজনে লড়াইয়ের ময়দানে নিজেদের জীবন কুরবাণী করবে।
যারা এ আদর্শে বিশ্বাসী নয়, তাদেরকে যদি এ রাষ্ট্র পরিচালনা এবং এর নিরাপত্তার দায়িত্বে অংশীদার করাও হয়, তবে তারা এ আদর্শিক এবং নৈতিক স্পিরিট অনুধাবন করতে সক্ষম হবেনা। সে অনুযায়ী তারা কাজ করতেও সক্ষম হবেনা। আর এ আদর্শের জন্যে তাদের সেরূপ আন্তরিকতা সৃষ্টি হবেনা যার ওপর রাষ্ট্রয় অট্রালিকার ভিত প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তারা যদি বেসামরিক বিভাগে কাজ করে, তবে তাদের থেকে কেবল কর্মচারী সুলভ মানসিকতার প্রকাশ পাবে এবং উপার্জনের জন্যেই তারা নিজেদের সময় ও যাবতীয় যোগ্যতা বিক্রি করবে। আর যদি তাদেরকে সাসরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয় তবে তাদের অবস্থা হবে ভাড়াটে সৈনিকের [Meucenaries] মতো। তারা নৈতিক চরিত্রের সেই দাবীও পূর্ণ করতে পারবেনা ইসলামী রাষ্ট্র তার মুজাহিদদের থেকে যা আশা করে থাকে।
এজন্যে আদর্শিক ও নৈতিক কারণে ইসলামী রাষ্ট্র তার সামরিক বাহিনীতে যিম্মীদের কোনো খিদমত গ্রহণ করেনা। পক্ষান্তরে যাবতীয় সামরিক নিরাপত্তার দায়িত্ব মুসলমানরা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেয় এবং অমুসলিম নাগরিকদের থেকে শুধু একটা প্রতিরক্ষা কর গ্রহণ করাকেই যথেষ্ট মনে করে। কিন্তু কর এবং সামরিক সেবা এ উভয়টাই একত্রে অমুসলিম নাগরিকদের থেকে নেয়া যেতে পারেনা। যদি অমুসলিম নাগরিকরা স্বয়ং নিজেদেরকে সামরিক সেবার জন্যে পেশ করে তবে তা গ্রহণ করা হবে এবং এমতাবস্থায় তাদের থেকে প্রতিরক্ষা কর গ্রহণ করা হবেনা।
বেসামরিক বিভাগের key post গুলো তো সামরিক বিভাগ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ এগুলো নীতি নির্ধারণী কাজের সাথে সম্পর্কিত। এগুলোতে কোনো অবস্থাতেই অমুসলিম নাগরিকদের নিয়োগ করা যেতে পারেনা। অবশ্য কর্মচারী হিসেবে তাদের খিদমত নিতে কোনো দোষ নেই। এমনি করে রাষ্ট্রীয় পরামর্শ সভায় [ মজলিসে শূরা] অমুসলিমদের কোনো সদস্য নেয়া হবেনা। অবশ্য অমুসলিমদের ভিন্ন কাউন্সিল বানিয়ে দেয়া হবে। এ পরিষদ তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের দেখাশুনা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করবে। তাদের প্রয়োজন, অভিযোগ এবং প্রস্তাবাবলী পেশ করবে। রাষ্ট্রীয় মজলিসে শূরা [Assembly] এগুলো যথোপযুক্তভাবে বিবেচনা করবে।
সোজা কথা হচ্ছে এই যে, ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ কোনো জাতির ইজারাকৃত সম্পত্তি নয়। যে কেউ তার আদর্শ গ্রহণ করবে, সে তার পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে, চাই সে কোনো হিন্দুর পুত্র হোক কিংবা কোনো শিখের। কিন্তু যে এ রাষ্ট্রের আদর্শকে গ্রহণ করবেনা, মুসলমানের পুত্র হোক না কেন, সে এ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে বটে কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করতে পারবেনা।
আপনি প্রশ্ন করেছেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে কি মুসলমানরা সে অবস্থা গ্রহণ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে হিন্দুদেরকে যে পজিশন দেয়া হবে? এ প্রশ্ন আসলে মুসলিমলীগ নেতাদের কাছে করাই উচিত ছিলো। কারণ লেনদেনের কথা তো তারাই বলতে পারে। আমাদের নিকট জানতে চাইলে আমরা তো নিরেট আদর্শিক জবাবই দেবো।
যেখানে হিন্দুরা রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার লাভ করবে, সেখানে আপনার মূলত দুই ধরনের রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনঃ
হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, কিংবা ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেও প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
প্রথমোক্ত অবস্থায় আপনাদের মধ্যে এ প্রশ্ন জাগ্রত উচিত হবেনা যে, ইসলামী রাষ্ট্রে হিন্দুদের যতোটুকু অধিকার দেয়া হবে, আমরা “রামরাজ্যে” ও মুসলমানদেরকে ততোটুকু অধিকারই দেবো। বরঞ্চ এ বিষয়ে হিন্দু ধর্মে যদি কোনো দিক নির্দেশনা থাকে তবে কোনো প্রকার রদবদল ছাড়া হুবহু সেটাই কার্যকর করুন। নিজেদের ধর্মীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে এ বিষয়ে অন্যদের অনুসরণ করা ঠিক হবেনা। আপনাদের বিধান যদি আমাদের বিধনের চেয়ে উন্নততর হয় তবে নৈতিক ময়দানে আপনারাই বিজয়ী হবেন এবং এমনও হতে পারে যে, আমাদের ইসলামী রাষ্ট্র আপনাদরে রামরাজ্যে পরিবর্তন হয়ে যাবে। আর প্রকৃত ব্যাপার যদি এর বিপরীত হয়, তবে দেরীতে হোক কিংবা সত্ত্বর পরিণতি এর বিপরীতেই হবে।
আর যদি শেষোক্ত নীতি গ্রহণ করেন, অর্থাৎ ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তবে এ অবস্থায় আপনাদরেকে দু’টির যে কোনো একটি পথ গ্রহণ করতে হবে। হয়তো গণতান্ত্রিক [Democratic] নীতি হবে। নয়তো একথা পরিষ্কারভবে বলে দিতে হবে যে, এটা হিন্দু জাতির রাষ্ট্র এবং মুসলমানদেরকে এখানে বিজিত জাতি [Subject nation] হিসেবে থাকতে হবে।
এ দু’টি পন্থার যেটির ভিত্তিতে ইচ্ছা আপনার মুসলমানদের সাথে আচরণ করতে পারেন। সর্ববস্থায় আপনাদের নীতি ও আচরণ দেখে ইসলামী রাষ্ট্র তার সেসব নীতিতে বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন সাধন করবেনা, অমুসলমানদের ব্যাপারে কুরআন হাদীসে যেগুলো নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আপনার যদি আপনাদের রাজ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যা অভিযানও চালান এমনকি একটি মুসলমান শিশুকেও যদি জীবিত না রাখেন, তবু এসলামী রাষ্ট্র এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তার অমুসলিম নাগরিকদের একটি কেশাগ্রও বাঁকা করবেনা। পক্ষান্তরে আপনার যদি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, সেনাপতি ইত্যাদি পদে মুসলমান নাগরিক মনোনীত করেন, সে অবস্থায়ও ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিম নাগরিকদের সে একই মর্যদা ও অধিকার প্রদান করা হবে যা কুরআন ও হাদীস নির্ধারিত করে দিয়েছে। [তরজমানুল কুরআনঃ রজব-শাওয়াল ১৩৬৩ হিঃ জুলাই-অক্টোবর ১৯৪৪ ইং]
উপরোক্ত বিষয়ের অতিরিক্ত ব্যাখ্যা
প্রশ্নঃ আপনার রচিত সবগুলো গ্রন্থ এবং পূর্বের চিঠিটা পড়ার পর আমি এ বিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আপনি নির্ভেজাল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক। আর এ ইসলামী রাষ্ট্রে যিম্মি এবং আহলে কিতাবের লোকদের পজিশন হবে ঠিক তেমনি, যেমনি হিন্দুদের মধ্যে আছ্যুতদের পরিজশন।
আপনি লিখেছেন, “হিন্দুদের উপাসনালয়সমূহের সংরক্ষণ করা হবে এবং তাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের অধিকার দেয়া হবে।” কিন্তু হিন্দুদেরকে তাদের ধর্ম প্রচারের সুযোগ দেয়া হবে কিনা সেকথা তো লিখেননি? আপনি আরো লিখেছেনঃ “যে কেউ এ রাষ্ট্রের আদর্শ গ্রহণ করবে, সে এর পরিচালনা কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারবে, চাই সে হিন্দুর পুত্র হোক কিংবা শিখের।” মেহেরবাণী করে একথাটারও ব্যাখ্যা দিন যে, হিন্দু হিন্দু থেকেও কি আপনাদের রাষ্ট্রে নীতিমালার প্রতি ঈমান এনে তা পরিচালনার কাজে শরীক হতে পারবে?
আপনি লিখেছেন আহলে কিতাবের মহিলাদেরকে মুসলমানরা বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু আহলে কিতাব মুসলিম মহিলাদের বিয়ে করতে পারবে কিনা সেকথা পরিষ্কার করেননি। এ প্রশ্নের জবাব যদি না সূচক হয়, তবে এ [Superiority complex] সম্পর্কে আরো ভালোভাবে আলোকপাত কেরবেন কি? এর যথার্থাতার জন্যে আপনি যদি ইসলামের প্রতি ঈমান আনার যিম্মাদারী নেন, তবে কি আপনি একথা মানতে প্রস্তুত আছেন যে, বর্তমানকার তথাকথিত মুসলমান আপনার বক্তব্য অনুযায়ী এসব্ ইসলামী নীতিমালার মানদন্ডে টিকে যাবে? বর্তমানকালের মুসলমানদের কথা বাদই দিলাম, আপনি কি একথা স্বীকার করবেননা যে, খিলাফতে রাশেদার আমলে যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভিলাষী ছিলো? আপনি যদি একথা স্বীকার করে নিতে কুণ্ঠিত হনে, তবে বলুন তো সেই ইসলামী রাষ্ট্রটি কেন মাত্র ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর টিকেছিলো? হযরত আলীর মতো বিচক্ষণ মুজাহিদের এতো বিরোধিাত কেন হয়েছিলো এবং তাঁর বিরোধীদের মধ্যে হযরত আয়েশা পর্যন্ত কেন ছিলেন?
ইসলামী রাষ্ট্রের অভিলাষী হয়েও আপনি পাকিস্তানের বিরোধিতা করছেন। কোনো রাষ্ট্রীয় সীমা ছাড়াই কি আপনি আপনার হুকুমতে ইলাহিয়া প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন? অবশ্যই নয়। তবে তো আপনার হুকুমতে ইলাহিয়ার জন্যে সে ভুখন্ডটিই উপযুক্ত মিঃ জিন্নাহ এবং তার সংগী সাথীরা যেখানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। পাকিস্তান না চেয়ে সারা ভারতেই কেন আপনি হুকুমতে ইলাহিয়া প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন? এমন একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে অতি উচ্চমানের নৈতিক চরিত্রের অধিকারী একদল লোক আপনি কোথা থেকে সৃষ্টি করবেন? যেখানে হযরত আবু বকর, হযরত ওমর এবং হযরত ওসমানের মতো তুলনাহীন মনীষীদের হতে ঐ রাষ্ট্রটি মাত্র কয়েক বছরের বেশী টিকেনি। আজ চৌদ্দশ বছর পরে এমন কোন উপযুক্ত পরিবেশ আপনি লক্ষ্য করছেন, যার ভিত্তিতে আপনার দূরদৃষ্টি হুকুমতে ইলাহিয়া বাস্তবসম্মত মনে করছে? একথা সত্য যে, আপনার পয়গাম সব মত ও পথের মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলমানদের সাথে আমার যতো মেশার সুযোগ হয়েছে, তাতে আমি দেখেছি তারা আপনার চিন্তর প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা বলছেঃ আপনি যা কিছু বলেছেন সেটাই প্রকৃত ইসলাম। কিন্তু প্রত্যেকরে মনে সে একই প্রশ্ন যা আমি আপনার সামনে পেশ করলাম। অর্থাৎ খিলাফতে রাশেদার সে আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে সেরূপ উচ্চমানের লোক আপনি কোথায় পাবেন? তাছাড়া সে তুলনাহীন উচ্চমানের লোকেরাই যখন ঐ রাষ্ট্রটিকে অর্ধ শতাদ্বীও সাফল্যের সাথে চালাতে পারেনি, তখন এ যুগে সে ধরনের রাষ্ট্রের চিন্তা একটি অবাস্তব আশা ছাড়া আর কি হতে পারে?
এছাড়া আরেকটি কথাও নিবেদন করতে চাই। কিছুকাল পূর্বে আমার ধারণা ছিলো, আমরা হিন্দুরা এমন একটি জাতি যদির সন্মুখে কোনো একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্তমান নেই। অথচ মুসলমানদের সামষ্টিক ও সংঘবদ্ধ জীবন রয়েছে এবং তাদের সন্মুখে রয়েছে একটি মাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। কিন্তু এখন ইসলামী রাজনীতির গভীর অধ্যয়নের ফলে জানতে পারলাম যে, ওখানকার অবস্থা আমাদের চেয়েও করুণ। বাস্তব অবস্থা আপনার নিকট গোপন নয়। একজন সত্যসন্ধানী হিসেবে আমি বিভিন্ন ধ্যান ধারণার মুসলিম নেতৃবৃন্দের নিকট তাদের উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা সম্পর্কে কতিপয় বিষয়ের জবাব চেয়ে পাঠাই। তাদের জবাব আমার হতে পৌছার পর আমার পূর্ব ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণ হয়েছে। এখন আমি জানতে পারলাম, মুসলমানদের মধ্যেও কর্মপন্থা ও উদ্দেশ্য লক্ষ্যের ব্যাপারে সাংঘাতিক মতবিরোধ রয়েছে। [প্রশ্নকারী এখানে জামায়াতে ইসলামীর সাথে সতবিরোধ রাখেন এমন কতিপয় ব্যক্তির লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করেন।
দেখলেন তো আপনাদের একই আকীদা বিশ্বাসের নেতাগণ কতো কঠিন মতোবিরোধ নিমজ্জিত। এসব বাস্তব সত্যকে উপেক্ষা করে কোনো কিছু কেবল বইয়ের পৃষ্ঠায় মতাদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা এক জিনিস আর সেটার বাস্তবায়ন একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। রাজনীতি একটা বাস্তব সত্য ব্যাপার। এটাকে কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করা যেতে পারেনা। আমার এ গোটা নিবেদনকে সামনে রেখে আপনি আপনার কর্মপন্থা ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত করাবেন কি?
জবাবঃ আপনার প্রশ্নবলীর মূল টারগেট এখনো আমার কাছে পৌছায়নি। এ কারণে যে জবাব দিচ্ছি সেগুলো থেকে আপনার আরো এমন কিছু প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে, যেগুলো সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ আমার কাছে নেই। আপনি যদি মৌলিক বিষয় থেকে প্রশ্ন আরম্ভ করেন, অতপর শাখা প্রশাখা এবং সমসাময়িক রাজনীতির [Current politics] দিকে প্রত্যাবর্তন করেন, তবে আপনি আমার জবাবের সাথে পূর্ণ একমত না হলেও অন্ততপক্ষে আমাকে পরিষ্কারভবে বুঝতে পারবেন। এখন তো আমার মনে হয়, আমার পজিশন আপনার নিকট পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।
আপনি লিখেছেনঃ আপনি যে ইসলামী রাষ্ট্র স্বপ্ন দেখছেন, তাতে “যিম্মী এবং আহলে কিতাবের পজিশন তাই হবে, যা নাকি হিন্দুদের মধ্যে অচ্ছ্যুতদের।” বাক্যটি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি স্পষ্টভাবে লেখার পরও আপনি হয়তো ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিম নাগরিকদের পজিশন সম্পর্কে আপনি ওয়াকিফহাল নন। প্রথম কথা, অচ্ছ্যুতদের যে পজিশন মনুর ধর্মশাস্ত্র থেকে জানা যায়, তার সাথে ঐ সকল অধিকার ও সুযোগ সুবিধার কোনো সম্পর্ক নেই, ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রে যা যিম্মীদের প্রদান করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ অস্পৃশ্যবাদের ভিত্তি হচ্ছে বংশগত তারতম্য। পক্ষান্তরে যিম্মীর ভিত্তি হচ্ছে আদর্শ ও বিশ্বাস। কোনো যিম্মী ইসলাম গ্রহণ করলে তিনি আমাদের নেতা এবং রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত হতে পারেন। কিন্তু শুদ্র তার বিশ্বাস এবং মত ও পথ পরিবর্তনের পরও কি অরুণ আশ্রমের বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত হতে পারে?
আপনি প্রশ্ন করেছেনঃ “কোনো হিন্দু কি হিন্দু থেকেও আপনাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রতি ঈমান এনে তা পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে?”- আপনার এ প্রশ্ন খুবই বিস্ময়কর। সম্ভবত আপনি চিন্তু করে দেখেননি যে, ইসলামী রাষ্ট্রের আদর্শের প্রতি ঈমান আনার পর হিন্দু আর থাকবেনা, বরঞ্চ সে মুসলামান হয়ে যাবে। এ দেশের কোটি কোটি মুসলমান তো আসলে হিন্দু্রই সন্তান। ইসলামী আদর্শের প্রতি ঈমান আনার ফলেই তারা মুসলমান হয়েছে। এমনি করে ভবিষ্যতেও যেসব হিন্দুর সন্তুন এ আদর্শ গ্রহণ করবে, তারাও মুসলমান হয়ে যাবে। আর তারা যখন মুসলমান হয়ে যাবে, তখন অবশ্যি ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা আমদের সংগে সমান অংশীদার হবে।
‘ইসলামী রাষ্ট্রে হিন্দুরা তাদের ধর্ম প্রচারের সুযোগ পাবে কি? আপনার এ প্রশ্নটি যতোটা সংক্ষিপ্ত তার জবাব ততোটা সংক্ষিপ্ত নয়। প্রচার কাজ কয়েক প্রকারের হতে পারে। এক প্রকার হচ্ছে এই যে, কোনো গোষ্ঠী তার ভভিষ্যতে বংশধর এবং নিজ জনগণকে নিজস্ব ধর্মের শিক্ষা প্রদান করবে। সকল প্রকার যিম্মীরাই এমনটি করার অধিকার লাভ করবে। দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় লেখনী কিংবা বক্তৃতার মাধ্যমে নিজ ধর্মকে অন্যান্য সম্প্রদায়ের নিকট পেম করবে এবং ইসলামসহ অন্য সকল ধর্মের সাথে তাদের মতভেদের কারণ জ্ঞানের যুক্তিতে পেশ করবে। এর অনুমতিও যিম্মীদের প্রদান করা হবে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসী থাকা অবস্থায় আমরা কোনো মুসলমানকে নিজের ধর্ম পরিবর্তনের অনুমতি দেবোনা। তৃতীয় প্রকার হচ্ছে, কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় নিজেদের ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে এ উদ্দেশ্যে কোনো সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলবে যে বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে ইসলামী আদর্শের পরিবর্তে তার নিজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবে, আমদের রাষ্ট্রীয় সীমার মধ্যে এরূপ প্রচার কার্যর অধিকার কাউকেও প্রদান করবোনা। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত আমার প্রবন্ধ ইসলামে মুরতাদ হত্যার নির্দেশ’ দেখে নিন। ১. [প্রবন্ধটি পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছে।]
মুসলমানদের জন্যে আহলে কিতাবের নারীদের বিয়ে করা বৈধ হওয়া এবং আহলে কিতাবের জন্যে মুসলিম নারীদের বিয়ে অবৈধ হওয়ার ভিত্তি এক নিগূঢ় সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। পুরুষরা সাধারণত প্রভাবিত হয় কম এবং প্রভাব বিস্তার করে অধিক। আর নারীরা সাধারণত প্রভাবিত হয় বেশী এবং প্রভাব বিস্তার করে কম। একজন অমুসলিম নারী যদি কোনো মুসলমানের সংগে বিবহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তবে তার দ্বারা এ মুসলমান ব্যক্তিকে অমুসলিম বানানোর আশংকা খুবই কম, বরঞ্চ তারাই মুসলমান হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশী। কিন্তু একজন মুসলিম নারী কোনো অমুসলিম ব্যক্তির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তার অমুসলিম হয়ে যাবার আশংকাই বেশী এবং তার স্বামী ও সন্তানদের মুসলমান বানাতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। এজন্যে নিজ কন্যাদের অমুসলিমদের নিকট বিয়ে দেবার অনুমতি মুসলমানদের দেয়া হয়নি। অবশ্য আহলে কিতাবের কোনো ব্যক্তি নিজ কন্যাকে কোনো মুসলানের নিকট বিয়ে দিতে রাজী হলে সে তাকে বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু কুরআনের যে স্থানে এ অনুমতি প্রদান করা হয়েছে সেখানে এ ধমকও হয়েছে যে, তোমরা যদি অমুসলিম স্ত্রীদের প্রেমে বিগলিত হয়ে নিজেদের দীন খুইয়ে ফেলো তবে তোমাদের সমস্ত সৎকর্ম বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকবে। তাছাড়া এ অনুসতি কেবল বিশেষ প্রয়োজনের সময়ই কার্যকর করা যাবে। এটা কোনো সাধারণ অনুমতি নয় এবং পছন্দনীয় কাজও নয়। বরঞ্চ কোনো কোনো অবস্থায় তো একজন করতে নিষেধও করা হয়েছে, যাতে মুসলিম সোসাইটিতে অমুসলিম লোকদের আনাগোনার ফলে কোনো অনাকাংখিত নৈতিক ও ধ্যান ধারণার বিকাশ ও লালন হতে না পারে।
ইসলামী রাষ্ট্র কেন মাত্র ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের বেশী টিকেনি আপনার এ প্রশ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। আপনি যদি খুব মনোযোগের সাথে ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করেন, তবে এর কারণসমুহ অনুধাবন করা আপনার জন্যে কোনো কঠিন ব্যাপার হবেনা। কোনো আদর্শের পতাকাবাহী দল যে জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তা তার পরিপূর্ণ মর্যাদার সাথে পরিচালিত হওয়া এবং টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজন এর নেতৃত্ব এমন বাছাইকৃত লোকদের হাতে থাকা যারা হবে সে আদর্শের প্রকৃত ও পরিপূর্ণ অনুসারী। আর এধরনের লোকদের হাতে নেতৃত্ব কেবল সে অবস্থায়ই থকতে পারে, যখন সাধারণ লোকদের উপর এদের প্রভাব বজায় থাকবে এবং সাধারণ নাগরিকদের একদল বিরাট সংখ্যক লোক এতোটা শিক্ষা দীক্ষা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবে, যাতে করে এ আদর্শের সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা ঐসব লোকদের কথা শুনতে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে যায়, যারা তাদেরকে তাদের এ নির্দিষ্ট আদর্শের বিপরীত অন্য কোনো পথে চালাতে উদ্যত হয়। একথা ভালোভাবে বুঝে নেয়ার জন্য ইসলামের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে একটি সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যে নতুন জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তার বুনিয়াদী কথা এ ছিলো যে, আরব ভূখন্ডে এক প্রকার নৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়েছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতুত্বে সৎ লোকদের যে ছোট দলটি তৈরী হয়েছিলো, গোটা আরববাসী তাঁর নেতৃত্ব কবুল করে নিয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীকালে খিলাফতে রাশেদার যুগে যখন দেশের পর দেশ জয় হতে লাগলো, তখন যতোটা দ্রুত ইসলামী রাজ্যের চৌহদ্দী বিস্তৃত হতে থাকলো, আদর্শিক মজবুতি ততোটা দ্রুততার সাথে এগুলো সম্ভব হয়নি। সেযুগে যেহেতু প্রচার প্রকাশনা এবং প্রচার ও প্রশিক্ষণের ব্যাপক কোনো মাধ্যম ছিলোনা, যেমনটি রয়েছে বর্তমানে,সেযুগে বর্তমানকালের মতো যানবাহনও যেহেতু ছিলোনা, এসব কারণে তখন যেসব লোক দলে দলে ইসনলামী সমাজে প্রবেশ করছেলো নৈতিক, মানসিক এবং আমলী থেকে তাদের পূর্ণাংগভাবে ইসলামী আন্দোলনের ছাঁচ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে সাধারণ মুসলমান বাসিন্দাদের মধ্যে খাঁটি ধরনের মুসলমানদের স্যখ্যা আনুপাতিক হরে একেবারে কম হয়ে যায় এবং কাঁচা ধরনের মুসলমানদের আনুপাতিক হার বিপুল সংখ্যায় বেড়ে যায়। কিন্তু আদর্শিক দিক দিয়ে মুসলমানদের ক্ষমতা, অধিকার এবং মর্যাদা খাঁটি ধরনের মুসলমানদের তুলনায় ভিন্নতর হওয়া মোটেই সম্ভব ছিলোনা। এ কারণে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর খিলাফতামলে যখন প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনসমূহের ১. [১ অর্থাৎ যেসব আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিলো ইসলাম থেকে প্রত্যাবর্তন করে কোনো না কোনো জাহেলিয়াতের দিকে ফিরে যাওয়া।] [Reactionary Movements] ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়, তখন সাধারণ মুসলমানদের এক বিরাট অংশ তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং যারা বিশুদ্ধ ইসলামী পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা রাখতেন তাদের হাত থেকে নেতৃত্ব ছুটে যায়। এ ঐতিহাসিক নিগূঢ় সত্যাকে উপলব্ধি করার পর খালিস ইসলামী রাষ্ট্র ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের বেশী টিকে ছিলোনা সে প্রশ্ন জাগ্রত হবার কোনো অবকাশই থাকেনা।
আজো যদি আমরা সৎ লোকদের এমন একটি দলকে সুসংগটিত করতে পারি, যাদের ধ্যান ধারণা ও মানসিকতা এবং সীরাত ও নৈতিক চরিত্র হবে ইসলামের বাস্তব নমুনা, তবে আমি আশা রাখি আধুনিক উপায় উপকরণ ব্যবহার করে আমরা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরঞ্চ অন্যান্য দেশেও একটি নৈতিক ও সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করতে সক্ষম হবো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে, এমন লোকদের একটি শক্তিশালী সংগঠন কায়েম হয়ে যাবার পর সাধারণ মানুষের নেতৃত্ব তাদের ছাড়া অন্য কোনো পার্টির হাতে যেতে পারেনা। মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা থেকে আপনি যে মত প্রতিষ্ঠা করেছেন, ঐ উজ্জ্বল অবস্থার সংগে তার তুলনা হতে পারেনা যা আমাদের সম্মুখে রয়েছে।
বিশুদ্ধ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী লোকেরা বাস্তব ময়দানে নেমে এলে শুধু মুসলমান জনসাধারণই নয়, বরঞ্চ হিন্দু, খৃষ্টান, পারসিক, শিখ সকলেই তাদের ভক্ত অনুরক্ত হয়ে যাবে এবং নিজেদের ধর্মীয় নেতাদের ত্যাগ করে এদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে যাবে। শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে এমন একদল লোক তৈরী করার কাজই এখন আমি হাতে নিয়েছি। আমি আল্লাহ্র নিকট বিনয়াবনত হয়ে দোয়া করছি, তিনি যেনো এ কাজে আমাকে সাহায্য করেন।
খ. ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার
প্রশ্নঃ ইসলামী রাষ্ট্রে খৃষ্টান, ইহুদী, বৌদ্ধ, জৈন, পারসিক প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কি মুসলমানদের মতো যাবতীয় অধিকার ভোগ করতে পারবো? আজকাল পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশে যেভাবে এসব সম্প্রদায়ের লোকেরা অবাধে ধর্ম প্রচারে লিপ্ত, ইসলামী রাষ্ট্রেও কি তারা তেমনিভাবে নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করতে পারবে? মুক্তিফৌজ [Salvation Army], ক্যাথড্রাল, কনভেন্ট, সেন্ট জন, সেন্ট ফ্রান্সিস ইত্যাকার ধর্মীয় অথবা আধা ধর্মীয় প্রতষ্ঠান কি আইন প্রয়োগ করে বন্ধ করে দেয়া হবে? [সম্প্রতি শ্রীলংকায় অথবা অন্যান্য দু’একটি দেশে যেমন হয়েছে।] অথবা, মুসলমান শিশুদের কি ঐসব প্রতিষ্ঠানে অবাধে আধুনিক শিক্ষা লাভের অনুমতি দেয়া হবে? এই শতাব্দীতেও এমব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জিযিয়া আদায়া করা সমীচীন হবে কি [বিশ্ব মানবাধিকার সনদের আলোকে বিবেচ্য?] বিশেষত তারা যখন সেনাবাহিনী ও সরকারী চাকরীতে নিয়োজিত এবং সরকারের অনুগত?
জবাবঃ ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম সম্প্রদায়গুলো সকল নাগরিক অধিাকর [Civil rights] মুসলমানদের মতোই ভোগ করবে। তাবে রাজনৈতিক অধিকারে [Political Rights] তারা মুসলমানদের সমকক্ষ হতে পারেনা। কারণ ইসলামে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন চালানো মুসলমানদের দায়িত্ব। মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেখানেই তারা শাসন ক্ষমতার অধিকারী হবে, সেখানে যেনো তারা কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা মুতাবিক সরকারী প্রশাসন চালায়। যেহেতু অমুসলিমরা কুরআন ও সুন্নহর শিক্ষাও মানেনা, তার প্রেরণা ও চেতনা অনুসারে বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করতে ও সক্ষম নয়, তাই তাদেরকে এ দায়িত্বে অংশীদার করা চলেনা। তবে প্রশাসনে এমন পদ তাদেরকে দেয়া যেতে পারে, না নীতিনির্ধারক পদ নয়। এ ব্যাপারে অমুসলিম সরকারগুলোর আচরণ হয়ে তাকে মুনাফিকী ও ভন্ডামীতে পরিপূর্ণ। কিন্তু ইসলামী সরকারের আচরণ হয়ে থাকে নিরেট সততার প্রতীক। মুসলমানরা তাদের এ নীতি খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দেয়া এবং এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের বেলায় আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহির অনুভূতি নিয়ে অমুসলিম নাগরিকদের সাথে সর্বোচ্চ উদারতা ও ভদ্রতার আচরণ করে থাকে। আর অমুসলিমার বাহ্যত লিখিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে [National minorities] যাবতীয় অধিকার প্রদান করে বটে, কিন্তু বাস্তবে মানবিক অধিকারও দেয়না। এতে যদি কারো সংশয় থাকে, তবে সে যেনো আমেরিকায় নিগ্রোদের সাথে, রাশিয়ায় অকম্যুনিষ্টদের সাথে এবং চীন ও ভারতের মুসলমানদের সাথে কি আচরণ করা হচ্ছে তা দেখে নেয়। অনর্থক অন্যদের সামনে লজ্জাবোধ করে আমাদের নিজস্ব নীতি খোলাখুলি বর্ণনা করা এবং সে অনুসারে দ্বিধাহীন চিত্তে কাজ না করার কি কারণ থকতে পারে তা আমার বুঝে আসেনা।
অমুসলিমদের ধর্মপ্রচারে ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। এটা আমাদের ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে, আমরা যদি একেবারে আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত না হই, তাহলে আমাদের দেশে অমুসলিমদের ধর্মপ্রচারের অনুসতি দিয়ে শক্তিশালী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গড়ে উঠতে দেয়ার মতো নির্বুদ্ধিতার কাজ করা সংগত হবেনা। বিদেমী পুঁজির দুধ কলা খেয়ে ও বিদেশী সরকারে আস্কারা পেয়ে সংখ্যালঘুরা লালিত পালিত হোক এবং শক্তি ও সংখ্যা বৃদ্ধি করে ফুলে ফেঁপে উঠে তুরস্কের মতো সংখ্যালঘু খৃষ্টানরা আমাদেরকেও সংকটে ফেলে দিক, এটা কিছুতেই হতে দেয়া হবেনা।
খৃষ্টান মিশনারীদের এখানে বিদ্যালয় ও হাসপাতাল চালু রেখে মুসলমানদের ঈমান খরীদ করার এবং মুসলমানদের নতুন বংশধরগণকে আপন জাতীয় ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করার [De-nationalise] অবাধ অনুমতি দেয়াও আমার মতে জাতীয় আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের শাসকরা এ ব্যাপারে চরম অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। নিকটবর্তী উপকারিতা তো তাদের বেশ চোখে পড়ে কিন্তু সুদূরপ্রসারী কুফল তারা দেখতে পায়না।
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের কাছে থেকে জিযিয়া আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয় কেবল তখনই, যখন তারা বিজিত হয় অথবা কোনো চুক্তির ভিত্তিতে জিযিয়া দেয়ার সুস্পষ্ট শর্ত অনুসারে তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। পাকিস্তানে যেহেতু এই দুই অবস্থার কোনোটাই দেখা দেয়নি, তাই এখানে অমুসলিমদের ওপর জিযিয়া আরোপ করা শরীয়তের বিধান অনুসারে জরুরী নয় বলে আমি মনে করি। [তরজমানুল কুরআন, অক্টোবর ১৯৬১]
৫. আরো কয়েকটি বিষয়
ক. সংবিধান ব্যাখ্যার অধিকার
প্রশ্নঃ সংবিধান ব্যাখ্যার অধিকার কার থাকা উচিত? আইনসভার না আদালতের? আমাদের দেশে পূর্বে এ অধিকার আদালতের ছিলো, বর্তমান সংবিধানে এ অধিকার আদালতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আইসভাবে দেয়া হয়েছে। এতে আপত্তি উঠেছে যে, বিচার বিভাগের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এ অধিকার বিচার বিভাগের হতে বহাল রাখার দাবী উঠেছে। এ সম্পর্কে এক ভদ্রলোক বলেছেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে আদালতের কাজ ছিলো শুধু বিরোধ মীমাংসা করা। আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অধিকার আদালতের ছিলোনা। আইন শুদ্ধ না ভুল, সেটা বলার এখতিয়ার আদালতের ছিলোনা। এই বক্তব্য কতোখানি সঠিক? ১.উল্লেখ্য যে, পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এবং সংবিধানের ব্যাখ্যার অধিকার বিচার বিভাগকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।]
জবাবঃ বর্তমান যুগের আইনগত ও সাংবিধানিক সমস্যাবলীতে ইসলামের প্রাথমিক যুগের নযীর প্রয়োগ করার প্রবণতা আজকাল খুবই বেড়ে গেছে। কিন্তু যারা এ ধরনের যুক্তি প্রদর্শন করেন, তারা তৎকালীন সমাজের সাথে এ যুগের সমাজের এবং তৎকালীন শাসকদের সাথে এ যুগের শাসকদের আকাশ পাতাল ব্যবধানের দিকটা লক্ষ্য করেননা।
খিলাফতে রাশেদার যুগে খলীফা স্বয়ং কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে একজন মস্ত বড় আলেম হতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে খোদাভীতির প্রাবল্যের কারণে জনগণ তাঁর প্রতি আস্থাশীল থাকতো যে, জীবনের কোনো ব্যাপারে তিনি যদি নিজস্ব চিন্তা তাঁর প্রতি আস্থাশীল থাকতো যে, জীবনের কোনো ব্যাপারে তিনি যদি নিজস্ব চিন্তা গবেষণা ও বিচার বিবেচনার [ইজতিহাদ] ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তবে তা কখনো ইসলামের আদর্শ বিরোধী বিদ্ধান্ত হবেনা। তখন মজলিসে শূরার [পরামর্শ পরিষদ] সদস্যদের সকলেই ব্যতিক্রমহীনভাবে ইসলামের সর্বোত্তম পারদর্শীও জ্ঞানী ব্যক্তি বিবেচিত হওয়ার কারণেই সদস্যপদের মর্যাদা লাভ করতেন। ইসলাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী নয়, স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে ইসলামকে বিবৃত করে, অথবা তার দ্বারা কোনো বিদয়াতী কর্যকলাপ কিংবা অনৈসলামিক প্রবণতার আশংকা থাকে, এমন কোনো ব্যক্তি তাদের দলে স্থান পেতোনা। সমাজের বিপুল সংখ্যাগুরু অংশের জীবনে কখন ইসলামী ভাবধারার ছাপ বিদ্যমান ছিলো। সেখানে এমন পরিবেশ বিরাজ করতো যে, ইসলামরে বিধান ও তার আদর্শগত চেতনার পরিপন্থী কোনো নির্দেশ বা আইনবিধি জারী করার ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্যই কেউ দেখতে পারতোনা। তৎকালীন আদালতের মানও ছিলো একই রকম উন্নত। বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হতেন তারাই, যারা কুরআন ও সুন্নহ্তে গভীর দক্ষতার অধিকারী হতেন, সর্বোচ্চ মানের মুত্তাকী ও পরগেজগার হতেন এবং আল্লাহ্র আইনকে চুল পরিমাণও লংঘন করতে প্রস্তুত ছিলেননা। এ পরিস্থিতিতে আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে সম্পর্কের ধরন যেমন হওয়ার কথা, তেমনই ছিলো। সকল বিচারক মামলার বিচার সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ অনুসারে করতেন, আর যেসব ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নহতে সুস্পষ্ট নির্দেশ না থাকায় ইজতিহাদ করার প্রয়োজন দেখা দিতো, সে ক্ষেত্রে সাধারণত নিজেরাই ইজতিহাদ করতেন। যেখানে বিচার্য বিষয় এমন হতো যে, বিচারকের ব্যক্তিগত ইজতিহাদ দ্বারা ফায়সালা করার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শরীয়তের বিধান কি, সেটা ফলীফার মজলিসে শূরা কর্তৃক নির্ণীয় হওয়ার পয়োজন অনুভূত হতো, সে ক্ষেত্রে সামষ্টিক উজতিহাদ দ্বারা ইসলামের মূলনীতিসমূহের সাথে অধিকতর সঙ্গতিশীল একটা বিধি তৈরী করা হতো। এরূপ কর্মপদ্ধতি যেখানে অনুসৃত হতো, সেখানে বিচারকদের মজলিসে শূরার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা বা রদবদলের অধিকার হতেন তবে কেবল এজন্যই হতো পারতেন যে, সে আইন আসল সংবিধানের [অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নহর বিরোধী]। অথচ যে ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নহ্র সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, সে ব্যাপারে তখন আদৌ আইন প্রণয়ন করাই হতোনা। আইন প্রণয়নের প্রয়োজন শুধু সে ক্ষেত্রেই দেখা দিতো, যেখানে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ না থাকা হেতু কুরআন ও সুন্নহর সাধারণ নীতিমালা ও ভাবধারার ভিত্তিতে চিন্তা গবেষণা চালিয়ে উপযুক্ত নীতি ও বিধি উদ্ভাবন [অর্থাৎ ইজতিহাদ অপরিহার্য হয়ে দেখা দিতো। আর এটা সুবিদিত যে, এরূপ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইজতিহাদের ইজতিহাদ এই সামষ্টিক ইজতিহাদ থেকে ভিন্ন তর হলেও তাতে কিছু আসে যায়না।
সেকালের এই সাংবিধানিক দৃষ্টান্ত আজকের পরিস্থিতিতে কোনোক্রমেই লাগসই হতে পারেনা। আজকের শসকবৃন্দের এবং আইনসভার সদস্যদের যেমন খুলাফায়ে রাশেদীন ও তাদের মজলিশে শূরার সদস্যদের সাথে কোনো তুলনা হয়না তেমনি আজকের বিচারকরাও তৎকালীন বিচারকদের মতো নয়। আর আজকের আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াতেও তৎকালীন আইন প্রণয়ন কার্যক্রমের শর্তবলী ও মান অনুসৃত হয়না। এমতাবস্থায় আমাদের গ্রহণযোগ্য কর্মপন্থা হলো, আমাদের সাংবিধানিক বিধিমালা সমসাময়িক পরিস্থিতির আলোকে প্রণয়ন করতে হবে। খিলাফতে রাশেদার দৃষ্টান্তসমূহ প্রয়াগ করার আগে তৎকালীন সে পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, যার পটভূমিতে ঐ দৃষ্টন্তগুলোর কার্যত উদ্ভাব হয়েছিলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে শরীয়ত সংক্রান্ত ব্যাপারে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ভার প্রশানকেরও অর্পণ করা যায়না, আইনসভার হতেও ন্যস্ত করা যায়না, বিচার বিভাগ কিংবা উপদেষ্টা পরিষদের হতেও ছেড়ে দেয়া যায়না। এসব প্রতিষ্ঠানের একটিও এমন নয় যে, শরীয়ত সংক্রন্ত বিষয়ে তাদের ওপর মুসলমান জনগণ পূর্ণমাত্রয় আস্থা করতে পারে। যে ইজতিহাদ শরীয়তকে বিকৃত করে, তা থেকে নিরাপদে থাকার জন্য মুসলিম জনমতকে জাগ্রত করা এবং সামগ্রিকভাবে মুসলিম জাতিকে এ ধরনের যে কোনো ইজতিহাদের প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যেসব শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে শরীয়ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক কোনো বিধান দেয়না, সে ক্ষেত্রে আইনসভাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া বর্তমান অবস্থায় নিরাপদ নয়। এজন্য একটা নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। আইনসভা আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে সাংবিধানিক সীমা লংখন করছে কিনা, সেটা পর্যবেক্ষণ করাই ঐ নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানটির কাজ। বিচার বিভাগ ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান যে এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয়, সেকথা বলাই বাহুল্য [তরজমানুল কুরআন ডিসেম্বব ১৯৬১]
খ. ইসলাম ও গণতন্ত্র
প্রশ্নঃ গণতন্ত্রকে আজকাল উৎকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কেও এরূপ ধারণই পোষণ করা হয়ে থাকে যে, তা বহুলাংশে গণতান্ত্রিক রীতিসম্মন। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে গণতন্ত্রে বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে। আমি জানতে চাই যে, ইসলাম ঐ ত্রুটিগুলো কিভাবে শুধরাতে পারে। ত্রুটিগুলো হলোঃ
১. অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতো গণতন্ত্রেও শাসন ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত জনগণের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কার্যত গুটিকয় ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং বিবেক বেচা কেনার প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত হয়। এভাবে ধনিক শ্রেণীর শাসন [Plutocracy বা Oligrachy] প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপক্রম হয়। এ সমস্যার সমাধানের উপায় কি?
২. জনসাধারণের রকমারি ও পরস্পরবিরোধী স্বার্থ একই সাথে রক্ষা করা মনস্তাত্ত্বিকভাবে খুবই দুরূহ কাজ। সর্বস্তরের মানুষের এ দায়িত্ব পালনে গণতন্ত্র কিভাবে সফল হতে পারে?
৩. জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিরক্ষর, সরল অনুভূতিহীন এবং ব্যক্তিপূজারী। স্বার্থপর লোকেরা অনবরত তাদেরকে বিপথগামী করে থাকে। এমতাবস্থায় প্রতিনিধিত্বমূলক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করা খুবই কঠিন।
৪.জনগণের ভোটে যেসব নির্বাচিত ও প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়, তার সদস্য সংখ্যা খুব বেশী হয়ে থাকে। তাদের পারস্পরিক বিতর্ক ও পরামর্শক্রমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। খুবই জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
আপনার ধারণামতে ইসলাম স্বীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব ত্রুটি থেকে কিভাবে রক্ষা করবে, এটা বুঝতে আমাকে সাহায্য করবেন।
জবাবঃ আপনি গণতন্ত্রের যে ক’টি ত্রুটি তুলে ধরেছেন, তার সব কয়টিই যথার্থ। কিন্তু এ ব্যাপারে চূড়ান্ত মত স্থির করার আগে আরো কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা জরুরী।
পয়লা বিবেচ্য বিষয় হলো, মানুষের সামষ্টিক কর্মকন্ড পরিচানার জন্য নীতিগতভবে কোন্ পদ্ধতিটা সঠিক? এর দু’টো পদ্ধতি হতে পারে। প্রথমটা এই যে, যাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হবে তাদের ইচ্ছা ও পরামর্শক্রমে কর্মকান্ড পারচালনা করবে এবং যতক্ষণ তাদের আস্থা ঐ পরিচালকের ওপর থাকবে, কেবল ততক্ষণই সে পরিচালক বা শস ক হিসেবে বহাল থাকবে। দ্বিতিয় পদ্ধতি হলো, কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেই শাসক বা পরিচালক হয়ে জেঁকে বসবে, নিজের ইচ্ছা মতোই সব কার্যনির্বাহ ও পদচ্যুতিতে তাদের বলার বা করার কিছু থাকবেনা। এ দু’টো পদ্ধতির মধ্যে যাওয়ার পথ হতে পারে সেটাই হওয়ার উচিত একমাত্র আলোচ্য বিষয়।
দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয় হলো, গণতান্ত্রের মৌল আদর্শ বাস্তাবায়নের যে রকমারি কর্মপন্থা বিভিন্ন যুগে অবলম্বন করা হয়েছে অথবা উদ্ভাবন করা হয়েছে,তার বিশদ বিবরণে না গিয়েও সেগুলোকে যদি শুধু এ দিক দিয়ে বিচার করা হয় যে, গণতেন্ত্রের মৌল আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে পূরণ করতে তা কতোখানি সফল হলেছে, তাহলে তার ব্যর্থতার তিনটি প্রধান করাণ দৃষ্টিগোচর হয়।
প্রথম কারণটি হলো, জনগণকে সার্বভৌকম [Sovereign] ও সর্বাত্মক শাসক ধরে নেয়া হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে গণতন্ত্রেকে স্বেচ্ছাচার ও স্বৈরাচারে পরিণত কারার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ স্বয়ং মানুষ যখন এ বিশ্ব চরাচরে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নয়, তখন বহু মানুষের সমষ্টি জনগণ কেমন করে সার্বভৌমতের অধিকারী হতে পারে? এ কারণেই স্বেচ্ছাচার সর্বস্ব গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত সে বিন্দুতে গিয়ে দাঁড়ায়, তা জনগণের ওপর কতিপয় ব্যক্তির বাস্তব সার্বভৌমত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলাম শুরুতেই এ গলদ শুধরে দেয়। সে গণতন্ত্রকে এমন একটা মৌলিক আইনের অধীন করে দেয়, যা বিশ্ব জাহানের আসল সার্বভৌম শসকের রচিত। জনগণ এবং তাদের শাসকবৃন্দ এ আইনের আনুগত্য করতে বাধ্য। এজন্য যে স্বৈরাচার শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা আদৌ সৃষ্টি হওয়ারই অবকাশ পায়না।
দ্বিতীয়ত, জনগণের মধ্যে যতক্ষণ গণতন্ত্রের দায়িত্ব বহনের উপযুক্ত চেতনা ও চরিত্র সৃষ্টি না হয়, ততক্ষণ গণতন্ত্র সাফল্যের সাথে চলতেই পারেনা। ইসলাম এজন্যই এক একজন করে প্রত্যেক সাধারণ মুসলমানের শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের ওপর জোর দেয়। ইসলাম কামনা করে যে, প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে ঈমানদারী, দায়িত্ব সচেতনতা এবং ইসলামের মৌলিক বিধানের আনুগত্য ও অনুসরণের দৃঢ় সংকল্প জন্ম নিক। এ জিনিসটা যতো কম হবে, গণতন্ত্রের সাফল্যের সম্ভাবনা ততোই কম হবে। আর এটা হতো বেশী হবে, তার সাফল্যের সম্ভাবনা ততোই উজ্জ্বল হবে।
তৃতীয়ত, গণতন্ত্রের সফলতা নির্ভর করে সদাজাগ্রত ও অনমরীয় জনমতের ওপর। সমাজ যখন সৎ লোকদের দ্বারা গঠিত হবে, এই সৎ লোকদেরকে সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ কর হবে এবং সে সংঘবদ্ধ সমাজ এতাটা শক্তিশালী হবে যে, অসততা ও অসৎ লোক সেখানে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবেনা এবং শুধুমাত্র সততা ও সৎ লোকই উন্নতি ও বিকাশ লভের সুযোগ পাবে। ইসলাম এজন্য আমাদেরকে যাবতীয় প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়ে দিয়েছে।
উল্লিখিত তিনটি উপকরণ যদি সংগৃহীত হয়ে যায় তাহলে গণতন্ত্রের বাস্তবায়নকারী সংস্থার রূপকাঠামো, যেরকমই হোক না কেন, গণতন্ত্র সাফল্যের সাথে চলতে পারবে। আর এই সংস্থার কোথাও কোনো অসুবিধা অনুভূত হলে তা সংশোধন করে আরো ভালো সংস্থা গড়ে তোলাও অধিকতর উন্নতি ও পরিশুদ্ধি লাভের জন্য যথেষ্ট। অভিজ্ঞতার সাহায্যে ক্রমান্বয়ে একটা ত্রুটিপূর্ণ অবকাঠামো উৎকৃষ্টতর ও পূর্ণাংগ হয়ে গড়ে উঠতে থাকবে। [তরজমানুল কুরআন, জুন ১৯৬৩]
গ. রাষ্ট্রপ্রধানের ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা
প্রশ্নঃ কিছুদিন যাবত পত্রপত্রিকার মাধ্যমে এই মর্মে প্রস্তাব পেশ করা হচ্ছে যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টেকে ‘খলিফাতুল মুসলিমীন’ বা ‘আমীরুল মুমিনীন’ সূচক সন্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করা হোক। এই প্রস্তাবকে আরো জোরদার করার উদ্দেশ্যে একথাও বলা হচ্ছে যে, রাস্ট্রপ্রধানকে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমাতও দেয়া উচিত। কেননা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা অস্বীকার করেছিলো এবং যারা নবূয়্যতের দাবী করেছিলো, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ দিয়ে তিনি সাহাবায়ে কিরামের অভিমত রদ করেন। এই যুক্তির বলে ভোটোর মতো একটা ধান্ধাবাজীপূর্ণ আইনকে শরীয়তের ভিত্তিতে মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতির আলোকে আপনার কাছে কয়েকটা প্রশ্ন রাখছি। আশা করি আপনি সুস্পষ্ট জবাব দিয়ে আশ্বস্ত করবেন।
১. হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কি আজকের যুগের প্রচলিত অর্থের ভেটো প্রয়োগ করেছিলেন?
২. যদি তাই করে থাকেন তবে এজন্য তাঁর কাছে কোনো শরীয়তসম্মত যুক্তিপ্রমাণ ছিলো কি?
জবাবঃ খুলাফায়ে রাশেদীনের শাসন ব্যবস্থা এবং বর্তমান যুগের রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। যারা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে নিরেট অজ্ঞ, তারা ছাড়া আর কেউ এ দু’টোকে এক বলেতে পারেনা। আমি এ প্রন্থে সপ্তম অধ্যায়ের তয় অনুচ্ছেদে এ পার্থক্য সবিস্তারে বিশ্লেষণ করেছি। সেটি পড়ে দেখবেন। ঐ আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যবে যে, খিলাফতে রাশেদার শাসন ব্যবস্থায় যে জিনিসটাকে “ভেটো” ক্ষমতা বলে অভিহিত করা হয়, তা বর্তমান যুগের সাংবিধানিক পরিভাষা থেকে ভিন্ন জিনিস ছিলো। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মাত্র দু’টো সিদ্ধান্তকে এ ক্ষেত্রে যুক্তির ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে। একটি হলো, উসামার নেতৃত্বে যে সেনাদলকে মিথ্য নবূ্য়্যতের দাবীদারদেরকে দমন করার জন্য অভিযানে যাওয়ার নির্দেশ স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছিলেন, কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের দরুণ অভিযান স্থগিত ছিলো, সেটা পুনরায় প্রেরণের সিদ্ধান্ত। দ্বিতিয়টি হলো, যারা ইসলাম পরিত্যাগ করা ঘোষণ দিয়েছিলো, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ। এই দু’টো ব্যাপারে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লহু তায়ালা আনহু শুধু নিজের ব্যক্তি মতে সিদ্ধন্ত নেননি। বরং নিজের মতের সপক্ষে কুরআন ও হাদীস থেকে প্রমাণ পেশ করেছিলেন। উসামার সেনাদল সম্পর্কে তাঁর যুক্তি ছিলো, যে নিয়েছিলেন, সেটিকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খলীফা হিসেবে সমাধান করাই আমার দায়িত্ব। সে ফায়সালা পরিবর্তনের অধিকার আমার নেই। ইসলাম পরিত্যাগকারীদের ব্যাপারে তাঁর যুক্তি ছিলো, যেব্যক্তি বা গোষ্ঠী নামায ও যকাতের মধ্যে পার্থক্য করে এবং বলে যে, আমি নামায পড়বো কিন্তু যাকাত দেবোনা, সে ইসলাম বহির্ভূত, তাকে মুসলমান মনে করাই ভুল। সুতরং যারা বলেঃ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়া লোকদের বিরুদ্ধে কিভাবে তরবারি উত্তোলন করা যাবে? তাদরে বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এই যুক্তির কারণেই সকল সাহাবী তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন। এটা যদি ‘ভেটো’ হয়ে থাকে তবে তা আল্লাহ্র কিতাব ও রসূলের সুন্নাহর ‘ভেটো’ রাষ্ট্র প্রধানের ভেটো নয়।
আসলে এটাকে ভেটো বলাই ভুল। কেননা হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহ তায়ালা আনহুর যুক্তি মেনে নেয়ার পর ভিন্নমত পোষণকারী সাহাবায়ে কিরাম খলীফার মতকেই [তরজমানুল কুরআন, নভেম্বর ১৯৬৩]