চতুর্দশ অধ্যায়
ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার
ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলো সামাজিক সুবিচার ও জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজের সীমার মধ্যে অবস্থান করে প্রতিটি মানুষের জন্যে সন্মানজনক জীবন যাপনের ব্যবস্থাকে সহজতর করা। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত মু’তামারে আলমে ইসলামীর সম্মেলনে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এখানে সে প্রবন্ধটি সংকলিত হলো। এতে ইসলামী রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক নীতিমালার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। -সংকলক
ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার
[১৩৮১ হিজরী মুতাবেক ১৯৬২ ঈসায়ীতে হজ্জ উপলক্ষ্যে মুতামারে আলমে ইসলামীর উদ্যোগে মক্কা মুয়াজ্জামায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এই প্রবন্ধ পাঠ করা হয়]
আধুনিক কালের কতিপয় প্রতারণা
আল্লাহ্ তায়ালা মানুষকে যে সর্বোত্তম কাঠামোর সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে রয়েছে একটি বিস্ময়কর চমৎকারিত্ব। সে সুস্পষ্ট ফিতনা ফাসাদ ও প্রকাশ্য বিপর্যয় বিশৃংখলার দিকে খুব কমই ঝুঁকে পড়ে। এজন্য শয়তান তার নিজের ফিতনা ফাসাদকে কোনো না কোনো ভাবে সংস্কার সংশোধন ও কল্যাণের ছদ্মবরণে মানুষের সামনে তুলে ধরে। শয়তান যদি বেহেশতে আদম আলাইহিস সালামকে একথা বলতো, “আমি তোমাদের দ্বারা আল্লাহর নাফারমানী করাতে চাই এবং এর ফলে তোমাদের বেহেশত থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হবে” তাহলে সে কখনোও তাঁদেরকে ধোঁকা দিতে পারতোনা। বরং তাঁদের সে এই বলে ধোঁকা দিলোঃ
“তোমাকে সেই গাছটি দেখিয়ে দেবো কি যার মাধ্যমে চিরন্তন জীরন ও অক্ষয় রাজত্ব লাভ করা যায়?” (সূরা ত্বাহাঃ ১২০)
মানুষের প্রকৃতি আজ পর্যন্ত এ পথেরই অনুগামী হয়েছে। আজও শয়তান তাকে যতো প্রকার বিভ্রন্তি ও নির্বুদ্ধিতায় নিক্ষেপ করেছে তার সবই কোনো না কোনো বিভ্রান্তিকর শ্লোগান এবং মিথ্যার ছত্রছায়ায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে চলেছে।
উল্লেখিত প্রতারণাসমূহের মধ্যে একটি মারাত্মক প্রতারণা হচ্ছে, সেই প্রতারণা যা বর্তমানে সামাজিক সুবিচারের (Socisl Justice) নামে মানবজাতির সাথে করা হচ্ছে। প্রথমে শয়তান একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুনিয়াকে ব্যক্তি স্বাধীনতা (Individual liberty) এবং উদার নীতির (Liberalism) নামে ধোঁকা দিতে থাকে এবং এবই ভিত্তিতে সে অষ্টাদশ শতকে পুঁজিবাদ ও ধর্মহীন (Secular) গণতন্ত্র কায়েম করায়। এক সময় এই ব্যবস্থার এতোই প্রভাব ছিলো যে, দুনিয়াতে মানবজাতির উন্নতির জন্য এটাকে চূড়ান্ত হাতিয়ার মনে করা হতো এবং প্রত্যেক ব্যক্তি, যে নিজেকে প্রগতিবাদী এবং প্রগতিশীল বলে পরিচয় করাতে পছন্ত করতো সে স্বাধীনচেতা ও উদারপন্থী হওয়ার শ্লোগান দিতে বাধ্য ছিলো। লোকেরা মনে করতো, মানব জীরনের জন্য যদি কোনো ব্যবস্থা থেকে থাকে তাহলে কেবল এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং এই ধর্মহীন গণতন্ত্রই আছে যা পাশ্চাত্যে কায়েম হয়েছে। কিন্তু দেখতে দেখতে সেই সময় এসে গেলো যখন গোটা বিশ্ব অনুভব করতে লাগলো যে, এই শয়তানী ব্যবস্থা পৃথিবীকে যুলুম ও স্বৈরাচারে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। এরপর অভিশপ্ত ইকলীসের পক্ষে এই শ্লোগানের দ্বারা মানুষেকে আর অধিক সময় ধোঁকা দেয়া সম্ভর ছিলোনা।
অদপর খুর বেশী সময় অতিবাহিত হতে পারেনি, এর মধ্যেই শয়তান সামাজিক সুবিচার ও সমাজতন্ত্রের নামে আরেকটি প্রতারণার জন্ম দেয়। এখন সে এই মিথ্যার ছদ্মবরণে অন্য একটি ব্যবস্থ কয়েম করাচ্ছে। এই নতুন ব্যবস্থা বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে এতো মারাত্মক যুলুম নির্যাতন ও স্বৈরাচারে প্লাবিত করে দিয়েছে যার দৃষ্টান্ত মানব জাতির ইতিহাসে কখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই প্রতারণাপূর্ণ মতবাদটি এতোই শক্তিশালী যে, আরো কিছু সংখ্যক দেশ এটাকে উন্নতির সর্বশেষ উপায় মনে করে তা গ্রহণ করার জন্য তৈরী হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই প্রতারণার মুখোশ পূর্ণরূপে উন্মোচিত হয়নি।[ ১. এটি ১৯৬২ সালের বক্তৃতা। ইতোমধ্যেই মুখোশ উন্মোচিত হয়ে এ প্রতারণা একেবারে নগ্ন হয়ে পড়েছে। -আ. শ. ন-]
মুসলমানদের অবস্থা এই যে, তাদের কাছে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রসূলের সুন্নাহ বর্তমান রয়েছে। এর মধ্যে তাদের জন্য চিরস্থায়ী জীবন বিধান মওজুদ রয়েছে। তা তাদেরকে শয়তানের ধোঁকা সম্পর্কে সতর্ক করা এবং জীরনের সার্বিক ব্যাপারে পথনির্দেশ দেয়ার ক্ষেত্রে চিরকালের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এই ভিক্ষুকেরা নিজেদের দীন সম্পর্ক চরম অজ্ঞ এবং সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অক্রমণে নিকৃষ্টরূপে পরাজিত। এজন্য দুনিয়ার জাতিগুলোর শিবির থেকে যে শ্লোহানই উত্থিত হয় তা এখান থেকেও ত্বরিত প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে। যে যুগে ফরাসী বিপ্লব থেকে উত্থিত চিন্তা দর্শনের জোর ছিলো, মুসলিম দেশসমূহের প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তি এখানে সেখানে এই চিন্তা দর্শনের প্রকাশ এবং তারই আলোকে নিজেকে গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক মনে করতে। পশ্চাদপন্থী মনে করা হবে। এই যুগটা যখন শেষ হলো, আমাদের আধুনিক শিক্ষিত সমাজের কেবলাও পরিবর্তন হতে শুরু করলো। নতুন যুগের সূচনা হতেই আমাদের মাঝে সামাজিক সুবিচার এবং সমাজতন্ত্রের শ্লোগান উচ্চারণকারীদের আবির্ভাব হতে থাকলো। এ পর্যন্ত পৌঁছেও ধৈর্য ধারার মতো ছিলো। কিন্তু পরিতাপের ব্যাপার হলো, আমাদের মাঝে এমন একটি দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো যারা নিজেদের কেবলা পরিবর্তন করার সাথে সাথে চাইতো যে, ইসলামও তার কেবলা পরিবর্তন করুক। মনে হয় বেচারারা যেনো ইসলাম ছাড়া বাঁচতে পারছেনা। তাদের সাথে ইসলামেরও থাকা দরকার আছে। কিন্তু তাদের খাহেশ হচ্ছে, সেও সন্মানিত হবে এবং ‘সেকেলে ধর্ম’ হওয়ার অপবাদ থেকেও বেঁচে যাবে। এই কারণে প্রথমে ব্যক্তি স্বাধীনতা, উদার নৈতিকতা, পুঁজিবাদ ও ধর্মহীন গণতন্ত্রের পাশ্চাত্য দৃষ্টিভংগিকে অবিকল ইসলামী প্রমাণ করার চেষ্টা করা হতো। আর আজ এরই ভিত্তিতে প্রমাণ হচ্ছে যে, ইসলামেও সমাজতান্ত্রিক দর্শনের সামাজিক সুবিচার বর্তমান রয়েছে। এটা সেই স্তর
যেখানে পৌছে আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর মানসিক গোলামী এবং তাদের চরম অজ্ঞতার প্লাবন অপমানের চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে।
সামাজিক সুবিচারের তাৎপর্য
আমি এই সংক্ষিপ্ত প্রবেন্ধে বলতে চাই যে, আসলে সামাজিক সুবিচার বলতে বুঝায় এবং এর প্রতিষ্ঠার সঠিক পন্থাই বা কি? যদিও এটা খুব কমই আশা করা যায় যে, যেসব লোক সমাজতন্ত্রকে ‘সামাজিক সুবিচার’ প্রতিষ্ঠার একমাত্র পন্থা মনে করে তা বাস্তবায়িত করার জন্য লেগে আছে তারা নিজেদের ভুল স্বীকার করে নেবে এবং তা থেকে প্রত্যাবর্তন করবে। কেননা মূর্খ যতক্ষণ মূর্খ থাকে ততোক্ষণ তার সংশোধনের কিছু সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু যখন সে শাসন দন্ড হতে পায় তখন “মা আলিমতু লাকুম মিন ইলাহিন গাইরী- আমি তো নিজেকে ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো খোদাকে জানিনা” (সূরা কাসাসঃ ৩৮) এই অহমিকা তাকে কোনো বুদ্ধিমান মানুষের অবস্থা ভিন্নরকম। যুক্তিযুক্ত পন্থায় তাদেরকে কথা বুঝিয়ে দিতে পারলে তারা শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে সর্তক হতে পারে। এই সাধারণ লোকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ধোঁকা দিয়ে পথভ্রষ্ট লোকেরা নিজেদের ভ্রন্তির প্রসার ঘটায়। এজন্য সাধারণ লোকদের সামনে প্রকৃত সত্য তুলে ধরাই মূলত আমার এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।
কেবল ইসলামেই রয়েছে সামাজিক সুবিচার
এ প্রসংগে আমি আমার মুসলমান ভাইদের সর্বপ্রথম যে কথা বলতে চাই তা হলো, যেসব লোক “ইসলামেও সামাজিক সুবিচার মওজূদ রয়েছে”- এই শ্লোগানে মূখর, তারা সম্পূর্ণ একটি ভাল কথা বলে। বরং সঠিক কথা হলো, “কেবলমাত্র ইসলামেই সামাজিক সুবিচার রয়েছে।” ইসলাম সেই সত্য জীবন ব্যবস্থা যা বিশ্বজাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক মানবজাতির পথ পদর্শনের জন্য নাযিল করেছেন। মানবজাতির মধ্যে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের জন্য কোনটি ন্যায় ইনসাফ এবং কোনটি ন্যায় ইনসাফ নয় তা নির্ণয় করা মানবজাতির সৃষ্টিকর্তারই কাজ। অন্য কেউ ন্যায় ইনসাফ ও যুলুমের মানদন্ড নির্ধারণের অধিকার রাখেন এবং তাদের মধ্যে প্রকৃত অর্থে ইনসাফ কায়েম করার যোগ্যতাও নেই। মানুষ নিজেই নিজের মালিক এবং কর্তা নয় যে, সে নিজের জন্য নিজেই সুবিচারের মানদন্ড নির্ধারণের ক্ষমতা রাখে। বিশ্বে তার মর্যাদা হচ্ছে খোদার প্রজা বা অধীনস্থ হিসেবে। এজন্য সুবিচারের মানদন্ড নিরুপণ করা তার কাজ নয়, তার মালিক এবং শাসকের কাজ। তাছাড়া মানুষ যতো উন্নত মর্যাদা সম্পন্নই হোক না কেন, এক ব্যক্তির পরিবর্তে উচ্চ মর্যাদা ও যোগ্যতা সম্পন্ন অসংখ্য লোক একত্রিত হয়ে নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি খরচ করুক না কেন মানবীয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, এর ক্রটি, অনিপুণত ও অপূর্ণাংগতা এবং মানবীয় জ্ঞানের উপর প্রবৃত্তি ও গোঁড়ামির প্রভাব এসব কিছু থেকে মুক্ত হওয়া কোনো অবস্থায়ই সম্ভব নয়। এজন্যই ন্যায় ইনসাফের উপর ভিত্তিশীল কোনো জীবন বিধান নিজেদের জন্য রচনা করা মানুষের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। মানুষের বিধান ব্যবস্থা আপাত প্রকাশ্যত যতোই ন্যায়ানুগ বলে দৃষ্টিগোচর হোক, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা খুব দ্রুত প্রমাণ করে দেয় যে, মূলত এর মধ্যে কোনো ন্যায়ইনসাফ নেই। এজন্য মানব মস্তিষ্ক প্রসূত প্রতিটি ব্যবস্থা কিছুকাল চলার পর তা অকেজো প্রমাণ হ্য় এবং মানুষ তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় একটি নির্বুদ্ধিতা প্রসূত পরীক্ষা নীরিক্ষার দিকে ধাবিত হয়। প্রকৃত সুবিচার কেবল সেই ব্যবস্থার মধ্যেই মহাপবিত্র এক মহান সত্তা তৈরী করেছেন।
সুবিচার প্রতিষ্ঠাই ইসলামের উদ্দেশ্য
দ্বিতীয় কথা যা প্রথমেই বুঝে নেয়া দরকার তা হচ্ছে, যে ব্যক্তি “ইসলামে সুবিচার আছে” বলে, সে বাস্তব ঘটনা থেকে কম বলে। বাস্তব কথা এই যে, সুবিচার হচ্ছে ইসলামের লক্ষ্য। আর সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলামের আগমন। মহান আল্লাহ্ বলেন:
“আমি আমার রাসূলদের উজ্জ্বল নিদর্শনসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও মীযান (মানদন্ড) নাযিল করেছি- যেনো লোকেরা সুবিচারের উপর কায়েম হয়ে যায়। আর আমরা লৌহ নাযিল করেছি। এর মধ্যে রয়েছে অসীম শক্তি এবং মানুষের জন্য কল্যাণ। আল্লাহ্ জানতে চান কে না দেখেই আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলদের সহযোগী হয়্ নিশ্চিতই আল্লাহ্ মহাশক্তির অধিকারি এবং পরাক্রমশালী।” (সূরা আল হাদীদঃ ২৫)
এই দুটি কথা সম্পর্কে যদি কোনো মুসলমান অমনোযোগী না হয় তাহলে সে সামাজিক সুবিচারের খোঁজে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলকে ছেড়ে অন্য কোনো উৎসের দিকে ধাবিত হওয়ার ভ্রান্তিতে লিপ্ত হতে পারেনা। যে মুহূর্তে তার সুবিচারের প্রয়োজনীতা অনুভূত হবে তৎক্ষণাতই সে জানতে পারবে যে, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কারো কাছে সুবিচার নেই এবং থাকতেও পারেনা। সে এও জানতে পারবে যে, আদল কয়েম করার জন্য এছাড়া আর কিছুই করার নেই যে, ইসলাম, পূরাপূরি ইসলাম, এবং যোগ বিয়োগ ছাড়াই ইসলাম কায়েম করতে হবে। সুবিচার ইসলাম থেকে স্বতন্ত্র কোনো জিনিসের নাম নয়, স্বয়ং ইসলামই সচ্ছে সুবিচার। ইসলাম কায়েম হওয়া এবং সুবিচার কায়েম হওয়া একই জিনিস।
সামাজিক সুবিচার কি?
এখন আমাদের দেখতে হবে মূলত কোন জিনিসটির নাম সামাজিক সুবিচার এবং তা কায়েম করার সঠিক পন্থাই বা কি?
ব্যক্তিত্বের বিকাশ
প্রতিটি মানব সমাজ হাজার হাজার লাখ লাখ এবং কোটি কোটি মানুষের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এই মিশ্র সমাজির প্রতিটি ব্যক্তি সজীব, বুদ্ধিমান এবং সচেতন হয়ে থাকে। প্রতিটি সদস্যই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীন সত্তার অধিকারী। এর বিকাশ এবং ফলে ফুলে সুশোভিত হওয়ার জন্য সুযোগের প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিটি সদস্যেরই একটি ব্যক্তিগত ঝোঁক প্রবণতা রয়েছে। তার নিজের কিছু আকর্ষণ ও কামনা বাসনা রয়েছে। তার দেহ ও সত্বার কিছু প্রয়োজন রয়েছে। সমাজের এই সদস্যদের অবস্থা কোনো প্রণতীন যন্ত্রের খুচরা অংশের মতো নয় যে, মূল জিনিস হচ্ছে মেশিন আর খুচরা অংশগুলো তারই প্রয়োজনে তৈরী করা হয়েছে এবং এই অংশগুলোর নিজস্ব কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। বরং মানব সমাজ জীবন্ত এবং জাগ্রত মানুষের একটি সমষ্টি। এই ব্যক্তিগণ একত্র হয়ে এই সমষ্টি বা সংগঠন এজন্যই কায়েম করে যে, পরস্পরের সহায়তায় তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস অর্জন এবং দেহ ও অত্মার দাবি পূর্ণ করার সুযোগ পাবে।
ব্যক্তিগত জবাবদিহি
তাছাড়া সমস্ত মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহি করতে হবে। প্রতিটি ব্যক্তিকে এই দুনিয়ায় একটি নির্দিষ্ট সময় পরীক্ষার মধ্য দিয়ে (যা প্রতিটি ব্যক্তির জন্য পৃথক পৃথকভাবে নির্ধারিত) অতিবাহিত করার পর আল্লাহর দরবারে জবাবদিহির জন্য হাযির হতে হবে। তাকে এই পৃথিবীতে যে শক্তি, যোগ্যতা ও উপায় উপকরণ দান করা হয়েছেল তা কাজে লাগিয়ে সে নিজের জন্য কি ধরনের ব্যক্তিত্ব গঠন করে নিয়ে এসেছে এজন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ্র দরবাবে মানবজাতির এই জবাবদিহি সম্মিলিতভাবে নয় বরং ব্যক্তিগতভাবে হবে। সেখানে বংশ, গোত্র, জাতি একত্রে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করবেনা বরং দুনিয়ার যাবতীয় সম্পর্ক থেকে ছিন্ন করে আল্লহ্ তায়ালা প্রতিটি ব্যক্তিকে পৃথক ভাবে নিজের আদালতে হাযির করবেন এবং প্রত্যেককে স্বতন্ত্রভাবে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি করে এসেছো এবং কি হয়ে এসেছো?
ব্যক্তি স্বাধীনতা
এই দুটি ব্যাপারে অর্থাৎ পৃথিবীতে ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং আখিরাতে মানুষের জবাবদিহির দাবি হচ্ছে পৃথিবীতে সে স্বাধীনতার অধিকার লাভ করবে। কোনো সমাজে যদি ব্যক্তিকে তার পছন্দমতো নিজের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের সুযোগ না দেয়া হয় তাহলে তার মধ্যে মানবতা শবদেহের মতো নির্জীব হয়ে যায়, তার দম বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, তার শক্তি সামর্থ ও যোগ্যতা চাপ পড়ে যায়। সে নিজেকে অবরুদ্ধ ও বন্দিদশায় দেখতে পেয়ে জড়তা ও অকর্মন্যতার শিকার হয়ে পড়ে। আখিরাতে এ ধরনের অবরুদ্ধ ও পরাধীন ব্যক্তির দোষ ত্রুটি বেশীর ভাগ দায় দায়িত্ব এই ধরনের সমাজ ব্যবস্থা গঠনকারী ও পরিচালনাকারীদের ঘাড়ে চাপবে। তাদের কাছ থেকে কেবল তাদের ব্যক্তিগত কর্যকলাপের হিসাব নিকাশই নেয়া হবেনা; বরং তারা যে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম করে অসংখ্য মানুষকে নিজেদের মর্জির বিরুদ্ধে এবং তাদের মর্জিমত ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে বাধ্য করেছে এজন্যও তাদের জবাবদিহি করতে হবে। প্রকাশ থাকে যে, কোনো ঈমানদার ব্যক্তি এ ধরনের ভরি বোঝা নিজের কাঁধে চাপিয়ে আখিরাতে আল্লাহ্র দরবারে হাযির হওয়ার কল্পনাও করতে পারেনা। সে যদি আল্লাহ্ভীরু মানুষ হয়ে থাকে তাহলে সে অবশ্যেই আল্লাহ্র বান্দাদের অধিক পরিমাণে স্বাধীনতা প্রদানের দিকেই ঝুঁকে পড়বে যেনো প্রতিটি ব্যক্তি যা হবার নিজের দায়িত্বেই হতে পারে। সে যদি নিজেকে ত্রুপিপূর্ণ ও ভ্রান্তি ব্যক্তিত্ব হিসেবে গঠন করে তাহলে এ দায়িত্ব তখন আর সমাজের পরিচালকদের উপর চাপবেনা। সামাজিক সংস্থা এবং এর কতৃত্ব
এতো গেলো ব্যক্তি স্বধীনতার ব্যাপার। অপরদিকে সমাজকে দেখুন যা পরিবার, বংশ গেত্র, জাতি এবং গোটা মানবতার আকারে পর্যয়ক্রমিকভাবে কায়েম আছে। একজন পুরুষ এবং একজন স্ত্রীলোক ও তাদের সন্তানদের নিয়ে এই সমাজের সূচনা হয়। এদের দ্বারা একটি পরিবার গঠিত হয়। পরিবারের সমন্বয়ে বংশ, গোত্র ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠে। তাদের সমন্বয়ে একটি জাতি অস্তিত্ব লাভ করে এবং জাতি তার সামষ্টিক ইচ্ছা আকাংখার বাস্তবায়নের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কয়েম করে। বিভিন্ন আকৃতিতে এই সামাজিক সংস্থাগুলো আসলে যে উদ্দেশ্যের জন্য প্রয়োজন তা হচ্ছে এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে ও এর সহায়তায় ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের সুযোগ লাভ করবে, যা তার একার প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। কিন্তু এ মৌলিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে হলে উল্লেখিত প্রতিটি সংস্থার হাতে ব্যক্তিদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার থাকতে হবে, যাতে এই সংস্থাগুলো এমন ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতিরোধ করতে পারে যা অন্যদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা পর্যায়ে পৌঁছে সামাজিক সুবিচারের প্রশ্ন দেখা দেয় এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির পরস্পর বিরোধী দাবিসমূহ একটি গ্রন্থির আকার ধানণ করে। একদিকে মানব কল্যাণের দাবি হচ্ছে হলো, সমাজে ব্যক্তির স্বাধীনতা থাকতে হবে যেনো সে নিজের যোগ্যতা ও পছন্দ মাফিক নিজের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। অনুরূপভাবে পরিবার, বংশ গোত্র, ভ্রতৃবন্ধন এবং অন্যান্য সংস্থা যেনো নিজেদের চেয়ে বৃহত্তর পরিধির মধ্যে স্বাধীরতা ভোগ করতে পারে যা তাদের কর্মক্ষেত্রের সীমার মধ্যে তাদের অর্জিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু অপর দিকে মানব কল্যাণেরই দবি হচ্ছে ব্যাক্তির উপর পরিবারের, পরিবারের উপর বংশের, ভ্রাতৃবন্ধনের এবং সমস্ত লোকের ও ছোট সংস্থার উপর বড় সংস্থার এবং বৃহৎ পরিসরে বাষ্ট্রের কর্তৃত্ব থাকতে হবে, যেনো কেউ নিজের সীনা অতিক্রম করে অন্যদের উপর যুলুম নির্যাতন ও বাড়াবাড়ি করতে না পারে। আরো সামনে অগ্রসর হলে গোটা মানব জাতির ক্ষেত্রেও এই একই প্রশ্ন দেখা দেয়। একদিকে প্রতিটি জাতি এবং রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বজায় থাকার প্রয়াজন রয়েছে, অপরদিকে কোনো উচ্চতর ক্ষমতা সম্পন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার বর্তমান থাকারও প্রয়োজন রয়েছে যাতে কোনো জাতি বা রাষ্ট্র সীমা লংঘন করতে না পারে।
এখন সামাজিক সুবিচার যে জিনিসের নাম তা হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, বংশ, ভ্রাতৃসমাজ এবং জাতির মধ্যে প্রত্যেকের যুক্তিসংগত পরিমাণ স্বাধীনতাও থাকতে হবে এবং সাথে সাথে যুলুম শত্রুতা ও সীমা লংঘনকে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাসমূহের হাতে ব্যক্তিদের উপর এবং একে অপরের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারও থাকতে হবে। যাতে করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে জনকল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় সেবাও আদায় করা যেতে পারে।
পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ত্রুটি
এই সত্যকে যে ব্যক্তি ভালোভাবে হৃদয়ংগম করে নেবে সে প্রথম দৃষ্টিতেই জানতে পারবে যে, ফরাসী বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি স্বাধীনতা, উদার নৈতিকতা, পুঁজিবাদ এবং ধর্মহীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে ভাবে সামাজিক সুবিচারের পরিপন্থী ছিলো ঠিক তদ্রূপ বরং তার চেয়েও অধিক পরিমাণ সমাজতান্ত্রিক মতবাদ সামাজিক সুবিচারের সম্পূর্ণ বিরোধী, যা কার্লমার্কস এবং এঞ্জেলসের দর্শনের অনুসরণে গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রথমোক্ত ব্যবস্থার ত্রুটি হচ্ছে হলো, সে ব্যক্তিকে যুক্তিসংগত সীমার অধিক স্বাধীনতা দান করে পরিবার, বংশ, প্রতিবেশী, সমাজ এবং জাতির উপর বাড়াবাড়ি করার অবাধ সুযোগ দিয়ে দিলেছে এবং তার কাছ থেকে সামাজিক কল্যাণরে জন্য সেবা গ্রহণ করার জন্য সমাজের নিয়ন্ত্রক শক্তিকে খুবই ঢিলা করে দিয়েছে। আর দ্বিতীয় ব্যবস্থাটির ত্রুটি হচ্ছে এই যে, তা রাষ্ট্রকে সীমাতিরিক্ত শক্তিশালী করে ব্যক্তি, পরিবার, বংশ ও ভ্রাতৃবন্ধনের স্বাধীনতার প্রায় সবটুকুই হরণ করে নেয় এবং ব্যক্তির কাছ থেকে সমষ্টির জন্য সেবা আদায় করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে এতো অধিক ক্ষমতা দেয় যে, ব্যক্তি প্রাণবন্ত মানুষ হওয়ার পরিবর্তে একটি মেশিনের প্রাণহীন অংশে পরিণত হয়। কেউ যদি বলে এই মতবাদের মাধ্যমে সামাজিক সুবিচার কায়েম হতে পারে, সে ডাহা মিথ্যা কথা বলে।
সামাজিক নির্যাতনের নিকৃষ্টমত রূপ সমাজন্ত্র
এটা মূলত সামাজিক যুলুম ও নির্যাতনের সেই নিকৃষ্টতম রূপ যা কখনো কোনো নমরূদ, কোনো ফিরাউন এবং কোনো চেংগিজ খানের যুগেও ছিলোনা। শেষ পর্যন্ত এই জিনিসিটিকে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি “সামাজিক সুবিচার” নামে ব্যাখ্যা করতে পারে যে, এক ব্যক্তি অথবা কয়েক ব্যক্তি বসে নিজেদের একটি সামাজিক দর্শন রচনা করে নেবে, অতপর রাষ্ট্রের সীমাহীন ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এই দর্শনকে জোরপূর্বক পূরা করবে, জমাজম দখল করে নেবে, শিল্প কারখানা জাতীয় মালিকানায় নিয়ে নেবে এবং গোটা দেশটাকে এমন একটি জেলখানায় পরিণত করবে যার মধ্যে সমালোচনা, ফরিয়াদ, অভিযোগ ও সাহায্য প্রার্থনা করার পথ রূদ্ধ হয়ে যাবে? দেশের মধ্যে কোনো দল থাকবেনা, কোনো সংগঠন থাকবেনা, কোনো প্লাটফরম থাকবেনা যেখানে লোকেরা মুখ খুলতে পারবে, কোনো প্রেস থাকবেনা যেখানে লোকেরা মত প্রকাশের সুযোগ পাবে এবং কোনো বিচারালয় থাকবেনা ইনসাফ পাবার আশায় যার দরজার কড়া নাড়া যাবে। গোয়েন্দাগিরির জাল ব্যপকভাবে বিস্তার করে দেয়া যাতে প্রতিটি ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ভয় করবে যে, হয়তো এও গোয়েন্দা বিভাগের লোক। এমনকি নিজের ঘরের মধ্যেও মুখ খোলার সময় কোনো ব্যক্তি জবান তার কথা সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য নিকটে কোথাও লুকিয়ে নেই তো? তাছাড়া গণতন্ত্রের ধোঁকা দেয়ার জন্য নির্বাচন অনুষ্টান করানো হবে, কিন্তু সমগ্র প্রচেষ্টা নিয়োজিত হবে যাতে এই দর্শন রচনাকারীদের সাথে দ্বিমত পোষণকারী এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে না পারে এবং এমন কোনো ব্যক্তিও যেনো তাতে প্রবেশ করতে না পারে যার স্বতন্ত্র মত রয়েছে এবং যে নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিক্রি করতে প্রস্তুত নয়।
যদি ধরেও নেয়া যায় যে, এই পন্থায় আর্থিক সমবন্টন হতে পারে, কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে আজ পর্যন্ত কোনো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তা করতে সক্ষম হয়নি। তারপরও কি অর্থিক সমতার নামই কেবল সামাজিক সুবিচার? আমি এ প্রশ্ন তুলছে না যে, এই ব্যবস্থায় শাসক এবং শাসিতের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য আছে কি না? আমি এ প্রশ্নও তুলছি না যে, এই ব্যবস্থায় ডিকটেটর এবং তার অধীন একজন কৃষকের জীরন যাত্রার মধ্যে সমতা আছে কি না? আমি কেবল এই প্রশ্ন করছি যে, বা্স্তবিকই যদি তাদের মধ্যে পূর্ণ আর্থিক সমতা কায়েম হয়েও থাকে তাহলে এরই নাম কি সামাজিক সুবচার হবে? এটা কি ধরনের সামাজিক সুবিচার যে, এক ডিকটেটর ও তার সাংগপাংগরা যে দর্শন রচনা কনেছে তা পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা ব্যবস্থার সহায়তায় জাতির, ঘাড়ে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন হবে এবং জাতির কোনো ব্যক্তির এই দর্শনের উপর, অথবা তা কর্যকর করার কোনো ক্ষুদ্রতর পদক্ষেপের বিরুদ্ধেও মুখ দিয়ে একটি বাক্যও বের করার স্বাধীনতা থাকবেনা? এটা কি ধরনের সামাজিক সুবিচার যে, এ ডিকটেটর ও তার মুষ্টিমেয় সাথী নিজেদের দর্শনের প্রজার ও প্রসারের জন্য গোটা দেশের উপায় উপকরণ ব্যবহার এবং যে কোনো ধরনের সংগঠন ও সংস্থা কায়েম করার অধিকার ভোগ করবে, কিন্তু তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী দুই ব্যক্তিও একত্র হয়ে কোনো সংগঠন কায়েম করতে পারবেনা, কোনো জনসমাবেশে ভাষণ দিতে পারবেনা এবং কোনো প্রচার মাধ্যমে একটি শব্দও প্রচার করতে পারবেনা? এর নাম কি সামাজিক সুবিচার যে, গোটা দেশের জমির এবং কলকারখানার মালিকদের বেদখল করে দিয়ে একজন মাত্র জমিদার এবং একজন মাত্র শিল্পপতি থাকবে যার নাম হচ্ছে রাষ্ট্র? আর সেই রাষ্ট্র থাকবে হাতে গোনা কয়েক ব্যক্তির কজায় এবং এই লোকগুলো এমন সব কর্মপন্থা গ্রহণ করবে যার ফলে গোটা জাতি সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়বে এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব তাদের দখল থেকে অন্যদের হাতে চলে যাওয়াটা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে যাবে? শুধু পেটের নাম যদি মানুষ না হয়ে থাকে এবং মানবজীবন শুধু অর্থনীতি পর্যন্ত সীমিত না হয়ে থাকে তাহলে কেবল আর্থিক সমতাকে কি করে সুবিচার বলা যেতে পারে? জীবনের প্রতিটি বিভাগে যুলুম নির্যাতন কায়েম করে, মানবতার প্রতিটি গতিকে প্রতিহত করে শুধু অর্থিক সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে জনগণকে যদি এক সমান করেও দেয়া হয় এবং স্বয়ং ডিকটেটর এবং তার সাংগপাংগরাও নিজেদের জীবনযাত্রায় জনগণের সমপর্যায়ে নেমে আসে তবুও এই বিরাট যুলুমের মাধ্যমে এই সমতা প্রতিষ্ঠা করা সামাজিক সুবিচার বলে অখ্যায়িত হতে পারেনা। বরং এটা আমি পূর্বেও যেমন বলে এসেছি সেই নিকৃষ্টতম সামাজিক নির্যাতন যার সাথে মানবেতিহাস ইতিপূর্বে কখনো সাক্ষাত লাভ করেনি।
ইসলামে সামাজিক সুবিচারের ধারণা
এবার আমি আপনাদের বলবো, ‘ইসলাম’ যার অপর নাম ‘সুবিচার’ তা কি? কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মানব জীবনের জন্য ন্যায় ইনসাফের কোনো দর্শন রচনা জনগণের উপর তা চাপিয়ে দেবে আর যে কোনো প্রতিবাদকারীর কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেবে এরূপ করার কোনো অবকাশ ইসলামে নেই। আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা অনহু এবং উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তো দূরের কথা স্বয়ং সুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরও এরুপ করার কোনো অধিকার ছিলোনা। কেবল আল্লাহ্ তায়ালারই এই অধিকার ও ক্ষমতা রয়েছে যে, মানুষ বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর সামনে মস্তক অবনত করে দেবে। স্বয়ং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর হুকুমের অধীন ছিলেন। তাঁর (নবীর) নির্দেশের আনুগত্য করা কেবল এজন্য ফরয ছিলো যে, তিনি খোদার পক্ষ থেকেই নির্দেশ দিতেন, মাআযাল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে দর্শন রচনা করে নিয়ে আসতেননা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং রসূলের খলীফাদের ব্যবস্থায় কেবল শরীয়তে ইলাহিয়াই সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলো। এরপর প্রতিটি ব্যক্তিরই যে কোনো ব্যাপরে মুখ খোলার পূর্ণ অধিকার ছিলো।
ব্যক্তি স্বাধীনতার সীমা
আল্লাহ্ তায়ালা নিজেই ইসলামে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। একজন মুসলিক ব্যক্তির জন্য কোন কাজ হারাম যা থেকে তাকে দূরে থাকতে হবে এবং কোন কোন জিনিস ফরয যা তাকে অবশ্যই পালন করতে হবে, তা আল্লাহ্ তায়ালা নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অন্যদের উপর তার কি কি অধিকার রয়েছে এবং তার উপর অন্যদের কি কি অধিকার রয়েছে, কি উপায় উপকরণের মাধ্যমে কোন সম্পদের মালিকানা তার হস্তগত হওয়া জায়েয এবং এমন কি কি উপায় উপাদান রয়েছে যার মাধ্যমে কোনো সম্পদের মালিকানা হস্তগত হলে তা জায়েয হবেনা, ব্যক্তির কল্যাণের জন্য সমষ্টির এবং সমষ্টির কল্যাণের জন্য ব্যক্তির কি দায়িত্ব রয়েছে, ব্যক্তির উন্নতির জন্য বংশ, পরিবার, গেত্র এবং গোটা জাতির উপর কি বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যায় এবং কি করা অত্যাবশ্যকীয় করে দেয়া যায়, এসব কিছুই কিতাব ও সুন্নাহর চিরস্থায়ী সংবিধানে বর্তমান রয়েছে যার উপর হস্তক্ষেপ করার এবং যাতি সংযোজন ও সংকোচন করার অধিকার কারো নেই। এই সংবিধানের আলোকে কোনো লোকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার যে গন্ডি নির্দেশ করে দেয়া হয়েছে তা হরণ করে নেয়ার অধিকার কারো নেই। আয় উপার্জনের যেসব উপায় এবং তা ব্যয়ের যেসব পন্থা হরাম করা হয়েছে সে তার কাছেও ঘেঁষতে পারবেনা। যদি সে ঐ নিষিদ্ধ পথে পা বাড়ায় তাহলে ইসলামী আইন তাকে শাস্তির যোগ্য মনে করে। কিন্তু যেসব উপায় ও পন্থা বৈধ সাব্যস্ত করা হয়েছে তার মাধ্যমে অর্জিত মালিকানার উপর তার অধিকার সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ থাকবে এবং ব্যয়ের যেসব খাত বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে তা থেকে কেউ তাকে বঞ্চিত করতে পারবেনা। অনুরূপভাবে সমষ্টির কল্যাণের জন্য ব্যক্তির উপর যেসব দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তা পালন করতে সে বাধ্য। কিন্তু এর অধিক বোঝা তার উপর চাপানো যাবেনা। তবে সে যদি স্বেচ্চায় অতিরিক্ত কছু করতে চায় তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। সমষ্টি এবং রাষ্ট্রের অবস্থাও তদ্রূপ। তার উপর ব্যক্তির যে অধিকার রয়েছে তা ব্যক্তিকে পৌছিয়ে দেয়া তার জন্য বাধ্যতামূলক, যেভাবে সমষ্টি এবং রাষ্ট্র নিজ নিজ অধিকার তার কাছ থেকে আদায় করে নেয়ার এখতিয়ার রাখে। এই চিরস্থায়ী সংবিধানকে যদি কর্যত বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে বাঞ্ছিত সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যার পর আর কোনো জিনিসের দাবি অবশিষ্ট থাকেনা। এই সংবিধান যতক্ষণ বর্তমান থাকবে, ততক্ষাণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি যতোই চেষ্টা করুক না কেন মুসলমানদের কখনো এই ধোঁকায় ফেলতে পারবেনা যে, সে কোথাও থেকে যে সমাজতন্ত্র ধার করে নিয়ে এসেছে সেটাই খাঁটি ইসলাম।
ইসলামের এই চিরস্থায়ী সংবিধান ব্যক্তি এবং সমষ্টির মধ্যে এমন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যাতে সমষ্টির স্বার্থ ক্ষুন্ন করার কোনো অধিকার ব্যক্তিকে দেয়া হয়নি এবং সমষ্টিকেও এমন কোনো এখতিয়ার দোয়া হয়নি যার মাধ্যমে সে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গঠন ও এর পরিপোষণের জন্য তার প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা হরণ করতে পারে।
সম্পদ হস্তান্তরের শর্তসমূহ
ইসলাম কোনো ব্যক্তির হাতে সম্পদ আসার মাত্র তিনটি পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। উত্তরাধিকার, দান এবং উপার্জন। কোনো সম্পদের বৈধ মালিকের কাছ থেকে ইসলামী শরীয়ত মুতাবিক কোনো ওয়ারিস যে সম্পদ লাভ করে থাকে কেবল এই ধরনের উত্তরাধিকারই গ্রহণযোগ্য। কোনো সম্পদের বৈধ মালিক শরীয়তের সীমার মধ্যে যে দান বা উপটৌকন দিয়ে থাকে কেবল তাই বিবেচনাযোগ্য। এই দান যদি কোনো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে তাহলে এটা কেবল এমন অবস্থাই জায়েয হবে যখন তা কোনো বিশেষ খিদমতের জন্য অথবা সমষ্টির স্বার্থের জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে ন্যায়ানুগ পন্থায় দেয়া হয়। অনন্তর এই ধরনের দান করার অধিকার কেবল এমন রাষ্ট্রেরই রয়েছে যা শরীয়ত ভিত্তিক সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় পন্থায় পরিচালিত হয় এবং যার কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার অধিকার জনগণের রয়েছে। এখন থাকলো উপার্জনের ব্যাপার, যে উপার্জন হারাম পন্থায় হয়নি ইসলাম কেবল তারই স্বীকৃতি দেয়। চুরি, আত্মসাত, ওজনে কম বেশী, আমানত আত্মসাত, ঘুষ, বেশ্যাবৃত্তি, মজুতদারী (নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবসা এবং নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা বিস্তারকারী ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন করা ইসলাম সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছে। এসব সীমারেখা বজায় রেখে কারো হাতে যে সম্পদ এসে যায় সে তার বৈধ মালিক, চাই তা বেশী হোক অথবা কম। এ ধরনের মালিকানার জন্য কোনো নিম্নতম সীমাও নির্ধারণ করা যেতে পারেনা, আর না উচ্চতম সীমা। পরিমাণ এই সীমার কম হওয়াতে অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে এনে তা বৃদ্ধি করে দেয়াও জায়েয নয়, আর নির্দিষ্ট সীমার অধিক পরিমাণ হয়ে গেলে তা জোরপূর্বক ছিনিয়েও নেয়া যাবেনা। অবশ্য এই বৈধ সীমা অতিক্রম করে যে সম্পদ অর্জিত হয়েছে তার সম্পর্কে মুসলমানদের এই প্রশ্ন তোলার অধিকার রয়েছে, “মিন আইনা লাকা হাযা” এ সম্পদ তুমি কোথায় পেলে? এই ধরনের সম্পদের ক্ষেত্রে প্রথমে আইনানুগ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। অতপর যদি প্রমাণ হয়ে যায় যে, তা বৈধ পন্থায় উপার্জিত হয়নি তাহলে এটা বাজেয়াপ্ত করার পুর্ণ অধিকার ইসলামী রাষ্ট্রের রয়েছে।
সম্পদ ব্যয়ের উপার নিয়ন্ত্রণ আরোপ
বৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিকে অবাধ সুযোগ দেয়া হয়নি। বরং এখানেও কিছু আইনগত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। যাতে কোনো ব্যক্তি এমন পথে তা ব্যয় করতে না পারে যা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, অথবা তার মাধ্যে স্বয়ং সম্পদের মালিকের দীনি এবং নৈতিক ক্ষতি বিদ্যমান রয়েছে। ইসলামে কোনো ব্যক্তি নিজের ধন সম্পদ পাপ কাজে ব্যায় করতে পারেনা। মদপান এবং জুয়া খেলার দরজা তার জন্য বন্ধ। যেনা ব্যভিচারের দরজাও তার জন্য রুদ্ধ। ইসলাম স্বাধীন মানুষকে ধরে নিয়ে গোলাম বাঁদীতে পরিণত করা এবং তার ক্রয় বিক্রয়ের অধিকার কাউকে দেয়না এবং তাদের ক্রয় করে সম্পদশালী লোকদের ঘর বোঝাই করার অধীকারও দেয়না। অপচয় এবং সীমাতিরিক্ত ভোগ বিলাসের উপরও ইসলাম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ব্যক্তির ভোগ বিলাসের উপরও ইসলাম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। নিজে ভোগ বিলাসে ডুবে থাকবে আর প্রতিবেশী অভুক্ত অবস্থায় রাত কাটাবে ইসলাম তা মোটেই জায়েয রাখেনি। ইসলাম ব্যক্তিকে কেবল শরীয়ত সম্মত এবং ন্যায়ানুগ পন্থায়ই সম্পদের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার অধিকার দান করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের মাধ্যমে যদি কেউ আরো অধিক সম্পদ আয় করার জন্য তা ব্যবহার করতে চায় তাহলে সে সম্পদ অর্জনের বৈধ পন্থাই অবলম্বন করতে বাধ্য। উপার্জনের শরীয়ত সম্মত পন্থার বাইরে সে যেতে পারেনা।
সামাজিক সেবা
যে ব্যক্তির কাছে নেসাবের অতিরিক্ত সম্পদ রয়েছে, সমাজ সেবার উদ্দেশ্যে ইসলাম তার উপর যাকাত ধার্য করে। অনন্তর সে ব্যবসায়িক পণ্য, জমির ফসল, গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু এবং আরো অন্যান্য সম্পদের উপর নির্দিষ্ট হারে যাকাত ধার্য করে। আপনি দুনিয়ার কোনো একটি দেশ বেছে নিন এবং হিসেব করে দেখুন, সেখানে যদি শরীয়তের নীতি অনুযায়ী নিয়মিত যাকাত আদায় করা হয় এবং কুরআন নির্ধারিত খাতসমূহে তা বন্টন করা হয় তাহলে কয়েক বছর পরই সেখানে আর এমন কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা যে জীবন ধারণের উপকরণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে।
এরপরও কোনো ব্যক্তির কাছে যে সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকে তার মৃত্যুর সাথে সাথে ইসলাম তা তার ওয়ারিসদের মধ্যে বন্টন করে দেয়। যাতে সম্পদের এই স্তুপ একটি স্থায়ী স্তুপে পরিণত হয়ে থাকতে না পারে।
যুলুমের মূলোৎপাটন
তাছাড়া ইসলাম যদিও এটাই পছন্দ করে যে, জমির মালিক এবং শ্রমিক অথবা কারখানার মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যকার ব্যপারগুলো সন্তোষের ভিত্তিতে ন্যায়ানুগ পন্থায় সমাধান হোক এবং আইনের হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন না হোক, কিন্তু যেখানেই এই ব্যাপারে যুলুম চলছে, সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করার পূর্ণ অধিকার রাখ এবং আইনের মাধ্যমে ইনসাফের সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারে।
জনস্বার্থের জন্য জাতীয় মালিকানার সীমা
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা ইসলাম হারাম করেনি। যদি কোনো শিল্প অথবা ব্যবসা এমন হয় যে, তা জনস্বার্থের জন্য জরুরী বটে কিন্তু মালিকানায় তা পরিচালনা করতে কেউ প্রস্তুত নয় অথবা ব্যক্তি মালিকানায় তা পরিচালিত হওয়াটা সমষ্টিগত স্বার্থের পরিপন্থী, তাহলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সরকারী ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করা যেতে পারে। তাছাড়া কোনো শিল্প অথবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যদি কতিপয় ব্যক্তির মালিকানায় এমন পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় যা সমষ্টিগত স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর, এক্ষেত্রে সরকার মালিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে তা নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারে এবং অন্য কোনো পন্থায় তা পরিচালনার ব্যাপারে শরীয়তের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু ইসলাম এটাকে একটি মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেনা যে, সম্পদ সৃষ্টির যারতীয় উপায় উপকরণ সরকারী মালিকানায় থাকবে এবং রাষ্ট্রই হবে একক শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং একচ্ছত্র মালিক।
বাইতুলমাল ব্যয়ের শর্তাবলী
বইতুলমাল (ট্রেজারী) সম্পর্কে ইসলামের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই যে, তা আল্লাহ্ এবং মুসলিম জনগণের সম্পদ এবাং তা ব্যয় করার মালিকানা স্বাত্ত্ব কারো নেই। মুসলমানদের যাবতীয় বিষয়ের মতো বাইতুল মালের ব্যবস্থাপনাও জাতি অথবা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে। যার তাছ থেকেই কিছু নেয়া হবে এবং যে খাতেই সম্পদ ব্যয় করা হবে তা অবশ্যই শরীয়ত অনুমোদিত পন্থায় হতে হবে এবং এ সম্পর্কে হিসেব চাওয়ার পূর্ণ অধিকার জনগণের থাকবে।
একটি প্রশ্ন
এই আলোচনার শেষ পর্যায়ে আমি প্রতিটি চিন্তাশীল ব্যক্তির সামনে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। কেবল ‘অর্থনৈতিক সুবিচারের’ নামই যদি ‘সামাজিক সুবিচার’ হয়ে থাকে, তাহলে ইসলাম যে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে তা কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? এরপরও কি এমন কোনো প্রয়োজন অবশিষ্ঠ থাকে যার জন্য সমগ্র জাতির স্বাধীনতা হরণ করা, তাদের ধন সম্পদ হরণ করা এবং গোটা জাতিকে মুষ্টিমেয় কয়েক ব্যক্তির গোলামে পরিণত করাই অপরিহার্য হয়ে পড়বে? আমরা মুসলমানরা আমাদের দেশসমুহে ইসলামী সংবিধান অনুযায়ী শরীয়ত ভিত্তিখ খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করবো এবাং সেখানে কাটছাট ব্যতিরেকেই আল্লাহ্র দেয়া শরীয়তকে কোনো সংযোজন সংকোচন ছাড়াই কর্যকর করবো এ পথে আমাদের জন্য শেষ পর্যন্ত কি প্রতিবন্ধক থাকতে পারে? যেদিনই আমরা এটা করতে পারবো, সেদিন কেবল সমাজদন্ত্র থেকে ফয়েয গ্রহন করার প্রয়োজনীতাই শেষ হয়ে যাবেনা বরং সাথে সাথেসমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের জনগণ আমাদের জীরন ব্যবস্থা দেখে অনুভব করতে থাকবে, যে আলোর অভাবে তারা অন্ধকারে সাঁতার কাটছে তা তাদের চোখের সামনেই বর্তমান রয়েছে।