পঞ্চম অধ্যায়
১. ইসলামী জাতীয়তার ধারণা
২. ইসলামী জাতীয়তার প্রকৃত তাৎপর্য
দেশ বিভাগের পূর্বে উপমহাদেশের রাজনৈতিক বাকবিতন্ডার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো জাতীয়তা। মুস-লমানরা সবসময় নিজেদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার ধারণা পোষণ করে এসেছে। তারা অমুসলিমেদের সাথে মিলিত হয়ে এক জাতিতে পরিণত হওয়ার ধারণাকে কখনো মেনে নেয়নি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের প্রভাব ও হিন্দু রাজনীতের যোগসাজশে সম্মিলিত জাতীয়তার বিভ্রান্তিকর আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠির ওপর এ আন্দোলন সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। আল্লামা ইকবাল, মাওলানা মওদুদী ও অন্যান্য চিন্তানায়কগণ এ চ্যালেঞ্জের জবাব দেন এবং সম্মিলিত জাতীয়তার ধারণার কঠোর সমালোচনা করেন। এই সময়োচিত সমালোচনার সুফল হলো এই যে, মুসলমানরা সম্মিলিত জাতীয়তার বিভ্রন্তি থেকে রক্ষা পেলো এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে উঠলো। মাওলানা মওদুদীর রচনাবলী এই জাগরণ সুষ্টিতে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। আমাদের বর্তমান সংকলনটিতে বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্যের পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানার দুটো প্রবন্ধ সন্নিবেশিত করা হচ্ছে। এ প্রবন্ধ দুটো মাসিক তরজমানুল কুরআন নভেম্বর ডিসেম্বর ১৯৩৩ সংখ্যা এবং জুন ১৯৩৯ সংখ্যা থেকে নেয়া হয়েছে। ইতিপূর্বেও এ প্রবন্ধ দুটি অন্যান্য সংকলনে সন্নিবেশিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে এবং বহু পাঠকের চিন্তায় তা আলোড়ন তুলেছে। -সংকলক
ইসলামী জাতীয়তার ধারণা
আদিম বন্য জীবন থেকে সভ্য জীবন অভিমুখে মানব জাতির অভিযাত্রার প্রথম পদক্ষেপেই এটা অনিবার্য হয়ে ওঠে যে, বিশাল মানব সমাজের মধ্যে থেকে একটি স্বতন্ত্র ঐক্যের ধারা গড়ে ওঠবে এবং সম্মিলিত উদ্দেশ্যে ও স্বার্থে কতিপয় ব্যক্তি মিলিত হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও যৌথ তৎপরতার কর্মসূচী গ্রহণ করবে। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে এই সামষ্ঠিক ঐক্যের পরিধিও সম্প্রসারিত হতে থাকবে। অবশেষে এক সময় এর আওতায় চলে আসবে বিপুল সংখ্যাক মানুষ। এই সম্মিলিত মানবসমষ্টির নামই “জাতি”। “জাতি” ও “জাতীয়তা” এ দুটি শব্দ যদিও এদের বিশিষ্ট পারিভাষিক অর্থে আধুনিক কালের সৃষ্টি। কিন্তু এ শব্দ দুটি উচ্চরণ করা মাত্রই যে জিনিসটি বুঝে আসে, তা ঠিক সভ্যতার মতোই প্রাচীন। ‘জাতি’ ও ‘জাতীয়তা’ যে কাঠামোর নাম, তা আজকের ফ্রান্স, বৃটেন, জার্মানী ও ইটালিতে যেমন আছে, প্রাচীন মিশর, ব্যাবিলন, রোম ও গ্রীসেও তেমনিই ছিলো।
জাতীয়তার অবিচ্ছেদ্য উপাদান সমূহ
একথা সন্দেহাতীত যে, জাতীয়তার সূচনা একটি নিস্প্রাণ আবেগ থেকেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ তার প্রাথমিক উদ্দশ্য এটাই হয়ে থাকে যে, একটি বিশেষ গোষ্ঠির লোকেরা নিজেদের সম্মিলিত স্বার্থ ও কল্যাণের জন্য কাজ করবে এবং নিজেদের সামগ্রিক প্রয়োজনে একটি “জতি” হিসেবে বসবাস করবে। কিন্তু তাদের ভেতরে যখন “জাতীয়তার”উদ্ভব ঘটে, তখন অনিবার্যভাবে তাতে “গোষ্ঠীপ্রীতি”র বৈশিষ্ট সৃষ্টি হয়। “জতীয়তাবাদের” আবেগ যতোই তীব্রতর হয় “গোষ্ঠীপ্রীতি” ততোই প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। যখনই কোনো জাতি স্বীয় স্বার্থের সেবা ও কল্যাণের সংরক্ষণের জন্য নিজেকে একটি ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবে অথবা অন্য কথায় বলা যায়, নিজের চারপাশে “জাতীয়াতর” দেয়াল গড়ে তুলবে, তখন সে অনিবার্যভাবে ঐ দেয়ালের বাইরের লোক ও ভেতরের লোকদের মধ্যে আপন ও পরের বাছবিচার করবেই। আপন লোকদেরকে সকল ব্যাপারে পরের ওপর অগ্রাধিকার দেবেই। পরের মোকাবিলায় সে আপনদেরকে সমর্থন না দিয়ে পারবেনা। দুই গোষ্ঠীর স্বার্থ ও কল্যাণের বিষয়ে যখন বিরোধ দেখা দেবে, তখন সে নিজের স্বার্থের হিফাজত করবে এবং অপরের স্বার্থকে বিসর্জন দেবে। এসব কারণে তাদের মধ্যে যুদ্ধও হবে, সন্ধিও হবে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান হোক, কিংবা আলোচনার বৈঠক হোক সর্বত্র তাদের উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তার সীমারেখা বহাল থাকবেই। এ জিনিসটার নামই গোষ্ঠীপ্রীতি ও জাতিগত বৈষম্য। এটা জাতীয়তার অপরিহার্য ও সহজাত বৈশিষ্ট্য।
জাতীয়তার উপাদান সমূহ
ঐক্য ও অংশীদারত্বের যেকোনো একটি উপাদান থেকে জাতীয়তার পত্তন হতে পারে। তবে শর্ত হলো, যে উপাদান থেকে জাতীয়তার পত্তন হবে, তাতে সংযোগ ও নিয়ন্ত্রণের এমন দুরন্ত শক্তি থাকা চাই যে, মানুষের বিপুল সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও তা যেনো সকলকে একই বাণী, একই চিন্তা, একই লক্ষ্য ও একই কর্মসূচীতে ঐক্যবদ্ধ করে দেয় এবং জাতীর বিপুল সংখ্যক বিচিত্র জনমন্ডলীকে জাতীলতার বন্ধন এমন মজবুতভাবে আবদ্ধ ও সম্পৃক্ত করে দেয় যে, তারা একটা জমাট পাথরে পরিণত হয়। ঐক্য ও অংশীদারত্বের যে উপাদানটি এই জাতীয়তার ভিত রচনা করবে, তার সমগ্র জনমন্ডলীর মন ও মগজের ওপর এতো বেশী আধিপত্য, প্রতপ ও নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হওয়া চাই যে, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং অর্জনে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার প্রস্তুত থাকবে।
ঐক্য ও অংশীদারিত্বের উপাদানতো অনেক থাকতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতোগুলো জাতীয়তার উদ্ভব ঘটেছে, তন্মধ্যে একমাত্র ইসলামী জাতীয়তা ছাড়া আর সবগুলোই নিম্মলিখিত ঐক্যসমূহের কোনো একটির ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। ঐত্যের এই উপাদানের সাথে আনুসংগিকভাবে অন্যান্য উপাদানও শামিল হয়ে গেছেঃ
ক. বংশীয় ঐক্য। একে প্রজাতিক ঐক্যও বলা হয়।
খ.জন্মভূমির ঐক্য। একে দেশীয় বা ভুমিগত ঐক্যও বলে।
গ.ভাষাগত ঐক্য। চিন্তার ঐক্য সৃষ্টির একটা প্রভাবশালী মাধ্যম হওয়ার কারণে এটি জাতীয়তা গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ঘ. বর্ণগত ঐক্য। এটি একই বর্ণের লোকদের মধ্যে স্বজাত্যবোধ গড়ে তোলে।
অতঃপর এই স্বজাত্যবোধ আরো অগ্রসর হয়ে তাদেরকে ভিন্ন বর্ণের লোকদেরকে এড়িয়ে চলতেও অবজ্ঞা করতে প্ররোচিত করে।
ঙ. অর্থনৈতিক স্বার্থগত ঐক্য। এ উপাদানটি এক ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্মলিত সমাজের লোকদেরকে ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাধারী ব্যবস্থা সম্মলিত সমাজের লোকদেরকে ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাধারী সমাজ থেকে পৃথক করে। এর ভিত্তিতে উভয় সমাজের মানুষ পরস্পরের মোকাবিলায় নিজ নিজ অর্থনৈতিক অধিকার ও কল্যাণ লাভের জন্য চেষ্টা সাধনা করে।
চ. শাসন ব্যবস্থার ঐক্য। এ উপাদানটি একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে একটি সম্মিলিত শাসন ব্যবস্থার যোগসূত্রে আবদ্ধ করে এবং ভিন্ন রাষ্ট্রর নাগরিকদের সাথে তাদের ব্যবধানের সীমা চিহ্নিত করে।
প্রাচীনতম যুগ থেকে শুরু করে আজকের বিংশ শতাদ্বীর আলোকোজ্জ্বল যুগ পর্যন্ত যতো ধরনের জাতীয়তার উপাদান অনুসন্ধান কারা হোক না কেন, সবগুলোর ভেতরে এই কয়টি উপাদানই যাওয়া যাবে।
আজ থেকে দুই তিন হাজার বছর পূর্বে গ্রীক, রোমক, ইসরাইলী, ইরানী, প্রভৃতি জাতীয়তা এই ভিত্তিগুলোর ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলো। আর আজকের জার্মান, ইটালীয়, ফরাসী, ইংরেজ, মার্কিন, রুশ ও জাপানী প্রভৃতি জাতীতাও এসব ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে।
একথা ষোল আনা সত্য যে, বিশ্বের বহু সংখ্যক জাতীয়তা নির্মাণের এই ভিত্তিগুলো খুবই বলিষ্ঠভাবে জাতিগুলোকে সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ করেছে। তবে সেই সাথে এই সত্যও অস্বীকার করা যায়না যে, এ ধরনের জাতীয়তা মানবজাতির জন্য এক ভায়াবহ বিপদ ডেকে এনেছে। এসব জাতীয়তা মানব জগতকে শত শত হাজার হাজার অংশে বিভক্ত করে দিয়েছে। আর এই বিভক্তিও এমন চরম যে, একটি অংশেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যায় বটে, কিন্তু অন্য অংশে পরিবর্তিত করা যায়না। একটি বংশধর অপর বংশধরে পরিণত হতে পারেনা, একটি ভূমি বা দেশ অন্য ভূমি ও দেশে পরিণত হতে পারেনা, একটি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীতে পরিবর্তিত হতে পারেনা। এক বর্ণের মানুষ অন্য বর্ণের মানুষে রূপান্তরিত হতে পারেনা, একটি জাতির অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অবিকল অন্য জাতির উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও আশা আকাংখায় পরিণত হতে পারেনা এবং একটি রাষ্ট্র কখনো অন্য রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারেনা। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, এসব ভিত্তির ওপর যেসব জাতীয়তা নির্মত হয়, তাদের ভেতরে পারস্পরিক সমঝোতা ও আপোষরফার কোনো পথই খুঁজে পাওয়া যায়না। জাতীয় আভিজাত্যবোধ ও জাত্যভিমানের কারণে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দিতা ও পরস্পরকে প্রতিরোধের এক চিরস্থায়ী দ্বন্দসংঘাতে লিপ্ত হয় এবং একে অপরকে পদপিষ্ট করার চেষ্টা চালায়। তারা পরস্পরে লড়াই করতে করতে ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর পুনরায় একই উপাদানে নতুন জাতীয়তা গড়ে ওঠে এবং একই ধরনের দ্বন্দসংঘাতে জড়িয়ে পড়াই হয় তার শেষ পরিণতি। এই জাতীয়তা পৃথিবীতে ফেৎনাফাসাদ, অরাজকতা, অশান্তি ও পাপাচারের উৎস, আল্লাহ্র সবচেয়ে বড় অভিশাপ এবং মানুষকে ধ্বংস করার কাজে শয়তানের সবচেয়ে অব্যর্থ হাতিয়ার।
জাহেলী বিদ্বেষ ও আভিজাত্যবোধ
এ ধরনের জাতীয়তার স্বাভাবিক দাবী হলো, তা মানুষের ভেতরে জাহেলী বিদ্বেষ ও আভিজাত্যবোধ সৃষ্টি করে। এক জাতিকে অপর জাতির সাথে বিরোধ ও শত্রুতা পোষণে এটি শুধু এজন্য প্ররোচিত করে যে, তারা ভিন্ন জাতি। সত্য, সততা ও ন্যায়ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকেনা। এক ব্যক্তির চামড়া কালো শুধু এ কারণেই সে সাদা চামড়াওয়ালার চোখ তুচ্ছ বিবেচিত হয়। এক ব্যক্তি এশিয়ার অধিবাসী- শুধুমাত্র এজন্যই সে ফিরিংগীদের তাচ্ছিল্য, অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়। আইনষ্টাইনের ন্যায় বিজ্ঞানী শুধুমাত্র ইহুদী হওয়ার কারণে জার্মানদের বিদ্বেষ ও অবজ্ঞার পাত্রে পরিণত হন। শুধুমাত্র কৃষ্ণকায় নিগ্রো হওয়ার কারণে একজন ইউরোপীয়কে শাস্তি দেয়ার অপরাধে তাশকেদীর রাজ্য ছিনিয়ে নেয়াকে সম্পূর্ণ বৈধ সাব্যস্ত করা হয়। ১. {তাশকেদী বসুয়ানা ল্যান্ডের বামিংভাটু গোত্রের গোত্রপতি। একজন ইউরোপীয় অপরাধীকে বেত্রদন্ড প্রদান তার এতা গুরতর অপরাধ বিবেচিত হয় যে, বৃটিশ সাম্রাজ্য তাকে তার রাজত্ব থেকে বঞ্চিত করে দেয়। অথচ স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে এই ফিরিংগী লোকটির দুঃখজনক আচরণের কথা স্বয়ং হাই কমিশনারও স্বীকার করতেন। পরে বেচারা তাশকেদীকে শুধুমাত্র এই বলে অঙ্গীকার কারার পর রাজত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয় যে, কোনো ইউরোপীয় ব্যক্তি জড়িত এমন কোনো মামলার নিষ্পত্তি তিনি করবেননা। অথচ সে অংগীকারনামায় ইউরোপীয়দেরকে স্থানীয় লোকদের জানমাল ও সন্ত্রমে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে পারে এমন কোনো ধারা ছিলোনা।}
আমেরিকার সুসভ্য নাগরিকদের জন্য নিগ্রোদেরকে ধরে ধরে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ বৈধ হয়ে যায় শুধু এজন্য যে, তারা নিগ্রো। নিগ্রোদেরকে শ্বেতাংগদের বাড়ীঘরে থাকতে না দেয়া, সড়কের ওপর দিয়ে চলতে না দেয়া এমনকি তাদেরকে ভোটাধিকার থেকে পর্যন্ত বঞ্চিত করা মার্কিনীদের জন্য বৈধ হয়ে যায়। একজন ফরাসী নাগরিক ও একজন জার্মান নাগরিকের পরস্পরকে ঘৃণা করার জন্য এটাই যথেষ্ট বিবেচিত হয় যে, তাদের একজন ফরাসী আর অপরজন জার্মান। তারা এজন্য পরস্পরকে শুধু ঘৃণা করেই ক্ষান্ত হয়না বরং একজনের যাবতীয় সদগুণ অপরজনের চোখে শুধুই দোষ মনে হয়। সীমান্ত প্রদেশের স্বাধীনচেতা আফগানরা আফগান বলেই ইংরেজরা তাদের ওপর বোমাবর্ষন করা আর দামেস্কের অধিবাসীরা আরব বলেই ফরাসীরা তাদেরকে পাইকারী হত্যা করা সম্পূর্ণ ন্যায়সংগত মনে করে। মোট কথা এই জাতিগত বৈষম্য এমন এক বস্তু যা মানুষকে ন্যায়নীতি ও ইনসাফের ব্যাপারে একেবারেই অন্ধ বানিয়ে দেয়। এর কারণে বিশ্বখ্যাত নৈতিকতা ও সৌজন্যের সূলনীতিগুলিও জাতীয়তার রূপ ধারণ করে কোথাও যুলূম, কোথাও সুবিচার, কোথাও সত্য, কোথাও মিথ্যা, কোথাও সৌজন্যে এবং কোথাও অসৌজন্যে পরিণত হয়।
মানুষের জন্য এর চেয়ে অযৌক্তিক মানসিকতা আর কি হতে পারে যে, সে একজনস অযোগ্য ও অসৎ লোককে শুধু এজন্য একজন যোগ্য ও সৎ লোকের চেয়ে অগ্রগণ্য মনে করবে যে, প্রথমজন এক বংশে এবং দ্বিতীয়জন ভিন্ন বংশে জন্মেছে? প্রথমজন সাদা এবং দ্বিতীয়জন কালো? প্রথমজন একটি পাহাড়ের পশ্চিমে জন্মেছে এবং দ্বিতীয়জন তার পূর্বে? প্রথমজন এক ভাষায় কথা বলে এবং দ্বিতীয়জন অন্য ভাষায়? প্রথমজন এক সাম্রাজ্যের অধিকারী এবং দ্বিতীয়জন অপর সাম্রাজ্যের? চামড়ার রং কি আত্মার পরিচ্ছন্নতা নোংরামিকে পাল্টে দিকে পারে? বিবেক কি একথা বিশ্বাস করে যে, পাহাড় ও সমুদ্রের সাথে চরিত্র ও মানবিক গুণাবলীর কোনো সম্পর্ক আছে? প্রাচ্যে যা সত্য, পাশ্চাত্যে গিয়ে তা মিথ্যা হয়ে যাবে এটা কি কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ মেনে নিতে পারে? সততা, ন্যায়নীতি, ভদ্রতা ও মানসিক সদগুণবলীকে ধমনীতে প্রবহমান রক্ত, সুখের উচ্চারিত ভাষা ও জন্মস্থানের মাটির মানদন্ডে যাচাই করা উচিত, এমন ধারণা কি কোনো সুস্থ মনে স্থান পেতে পারে? নিশ্চয়ই বিবেক এসব প্রশ্নের নেতিবাচক জবাবই দেবে। কিন্তু বর্ণ, বংশ, জন্মস্থান ও অন্যান্য বৈষম্যের প্রবক্তার অত্যন্ত ধৃষ্টতার সাথে জবাব দিয়ে থাকে যে, হাঁ, ব্যাপারটা এ রকমই।
জাতীয়তার উপাদান সমূহের পর্যালোচনা
কিছুক্ষণের জন্য উপরোক্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা স্থাগিত রাখুর। একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর সকল সদস্যের সাধ্যে সমভাবে বিরাজমান যতগুলো বৈশিষ্ট্য জাতীয়তার ভিত্তি রচনা করে, আগে সেগুলোর নিজস্ব সত্তা নিয়ে চিন্তা করুন এবং ভাবুন, স্বতন্ত্রভাবে এসব বৈশিষ্টোর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি আছে কি, না এগুলো নিছক কাল্পনিক মরিচিকার মতো?
প্রথমে ধরা যাক, প্রজাতিক বা বংশীয় অংশীদারিত্ব ও সমতার কথা। এটাতো নিছক রক্তের ঐক্য। মাতা ও পিতার বীর্য হলো এর সূচনাবিন্দু। এ দ্বারা রক্তের সম্পর্ক গড়ে ওঠে কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যে। তারপর এর বৃত্ত আরো সম্প্রসারিত হয়ে সৃষ্টি হয় পরিবার গোত্র ও বংশধরের। এই সর্বশেষ সীমা অর্থাৎ বংশধর পর্যন্ত পৌছতে পৌছতে মানুষ তার বংশধরের। প্রতিষ্ঠাতা পিতা থেকে অনেক দূরে সরে যায়। এতো দূরে সরে যায় যে, ঐ পিতার উত্তর পুরুষ হিসেবে তার নাম নিতান্তই গৌণ ও তাৎপর্যহীন হয়ে যায়। তাথাকথিত বংশধরের এই বিশাল নদীতে বহিরাগত রক্তের অনেক উপনদীও শাখানদী এসে মিলিত হয়। ফলে কোনো জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একথা দাবী করতে পারেনা যে, এই নদী যে উৎস থেকে বেরিয়েছিলো, তার সেই আসল পানিই এতে প্রবাহিত। এতো ভেজালের মিশ্রর সত্তেও যদি রক্তের সম অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মানুষ একটি “বশধর” কে নিজের জন্য ঐক্যের বন্ধন হিসেবে মেনে নিতে পারে, তাহলে যে রক্তের বন্ধন সমগ্র সানবজাতিকে তাদের আদিপিতা ও আদিমাতার সাথে সংযুক্ত করে তাকেই ঐক্যের বন্ধন হিসেবে মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়? সকল মানুষকে একই ব্যশধর এবং একই মূলসুত্রের সাথে সম্মন্ধযুক্ত করলে ক্ষতি কি? যেসকল ব্যক্তিকে আজকাল বিভিন্ন ব্যশধর ও বিভিন্ন প্রজন্মের প্রতিষ্ঠাতা মনে কারা হয়, তাদের সকলেরই বংশপরস্পরা উপরে গিয়ে কোথাও না কোথাও একই ধারায় মিলিত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত একথা না মেনে উপায় থাকেনা যে, তারা সবাই একই উৎস থেকে উদ্ভুত। তাহলে আর্য অনার্য নামে এই বিভক্তির যৌক্তিকতা কোথায়?
ভৌগলিক তথা জন্মভূমিভিত্তিক ঐক্যের ব্যাপারটা এর চেয়েও বেশী কাল্পনিক। মানুষের প্রকৃত জন্মস্থান তো কিছুতেই এক বর্গ গজের চেয়ে বেশী নয়। এতা ক্ষুদ্র আয়তনের ভুমিকে যদি সে নিজের জন্মভূমি বলে স্থির করে, তাহলে সে হয়তো কোনো দেশকেই নিজের জন্মভূমি বলতে পারবেনা। কিন্তু এই ক্ষুদ্র ভূখন্ডের চারপাশে সে শত শত বা হাজার মাইল পর্যন্ত সীমারেখা এঁকে নেয় এবং বলে যে, ঐ পর্যন্ত আমার মাতৃভূমি, ঐ সীমারেখার বাইরে যা কিছু আছে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, এটা শুধু তার দৃষ্টির সংকীর্ণতা। নচেত সমগ্র পৃথিবীকে নিজের মাতৃভূমি বলে দাবী করতে তাকে কেউ বাধা দিতে পারেনা। যে যুক্তির ভিত্তিতে এক বর্গগজ জায়গার মাতৃভূমি হাজার হাজার বর্গগজ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে। সেই একই যুক্তির বলে তা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মানুষ যদি নিজের দৃষ্টিভংগীকে সংকুচিত না করে তাহলে সে বুঝতে পারে যে, এই সমুদ্র, পাহাড়, নদী ইত্যাদি যাকে সে নিছক নিজের খেয়ালের বশে সীমান্তরেখা সাব্যস্ত করতঃ তার ভিত্তিহেত এক ভূখন্ড ও অপর ভূখেন্ডের মধ্যে পার্থাক্য করে তা সবই একই প্রথিবীর অংশ। তাহলে কিসের ভিত্তিতে সে পাহাড় নদী ও সমুদ্রকে এই অধিকার দিলো যে, তারা তাকে একটা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বন্দী করে রেখে দেক? সে কেন বলেনা যে, আমি পৃথিবীর অধিবাসী, গোটা পৃথিবী আমার মাতৃভূমি ও স্বদেশ এবং সারা বিশ্বে যতো মানুষ বাস করে সবাই আমার স্বদেশবাসী? কেন সে দাবী করেনা যে গোটা পৃথিবীতে আমার সেই জন্মগত অধিকার রয়েছে, যা রয়েছে আমার এই এক বর্গগজ জন্মভূমিতে?
ভাষাগত অংশীদারিত্বের ফায়দা শুধু এতোটুকু যে, যারা একই ভাষায় কথা বলে তাদের পারস্পরিক সমঝোতা ও ভাবের আদান প্রদানের সুযোগ বেশী। এতে পরস্পরের মধ্যে অজানা অচেনার ভাবটা অনেকাংশে কেটে যায় এবং সমভাষীরা নিজেদের মাঝে অধিকতর ঘনিষ্ঠতা অনুভব করে। কিন্তু একাধিক ব্যক্তির মনোভাব ব্যক্ত করার মাধ্যম এক রকম হলেই যে খোদ্ মনোভাবটাও একই রকম হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। একই মনোভাব দশটা বিভিন্ন ভাষায় ব্যক্ত হতে পারে, আর সেই দশটা ভাষায় মনোভাব ব্যক্তকারীদের একই মনোভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাওয়া সম্ভব। পক্ষান্তরে দশটা রকমারি মনোভাব একই ভাষায় প্রকাশ করা যায় এবং এটাও বিচিত্র নয় যে, একই ভাষাভষীর সেইসব রকমারি ধ্যান ধারণায় বিশ্বাস স্থাপন করে পরস্পরের বিরোধী হয়ে যেতে পারে। সুতরাং যে মাতমতের ঐক্য জাতীয়তার প্রাণ তা ভাষাগত ঐক্যের মুখাপেক্ষী নয়। অনুরূপভাবে একই ভাষাভাষীদের একই মতামত ও চিন্তাধারার অধিকারী হওয়া জরুরী নয়। এরপর আমাদের যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মখীন হতে হয় তা এই যে, মানুষের মানুষ্যত্ব এবং তার ব্যক্তিগত ভালো বা মন্দে তার ভাষার অবদান বা প্রভাব কতোটুকু? এক জার্মানকে শুধু জার্মান ভাষাভাষী হওয়ার কারণেই কি একজন ফরাসী ভাষাভাষীর ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে? না তা কখনো নয়। দেখতে হবে তার ব্যক্তিসত্তা কি ধরনের দোষ বা গুণে ভূষিত? শুধু ভাষা দেখলে চলবেনা। বড় জোর এতোটুকু বলা যেতে পারে যে, একটা দেশের প্রশারনিক কাজকর্ম এবং সাধারণ কায়কারবার চালাতে সেই দেশের ভাষা জানা আছে এমন লোকই বেশী উপকারী ও সফল প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু মানবতার বিভজন ও জাতীয় বৈষম্যের জন্য এটা কোনো সঠিক ভিত্তি নয়।
এরপর আসে বর্ণের প্রসংগ। মানব সমাজে বর্ণভিত্তিক ব্যবধান ও বৈষম্য সবচেয়ে অর্থহীন ও বাজে জিনিস। বর্ণতো নেহায়েত শরীরের একটা গুণ বা অবস্থার নাম। কিন্তু মানুষ শুধু তার শরীরের কারণে সম্মানের পাত্র নয় বরং তার আত্মাও বিবেবের বদৌলতে। এই আত্মা ও বিবেকের কোনো রং নেই। সুতরাং মানুষে মানুষে সাদা, কালো লাল ও হলুদের বৈষম্যের অর্থ কি? আমসরাতো কালো ও সাদা গাভীর দুধে পার্থাক্য করিনা। কেননা আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুধ, গাভীর রং নয়। কিন্তু আমাদের বিবেকবুদ্ধি এতোই বিকারগ্রস্ত ও মতিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে যে, আমরা মানুষের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাগুণের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তার বর্ণের দিকে বেশী মনোযোগী হয়ে পড়েছি। অর্থনৈতিক স্বার্থের অংশীদারিত্ব আসলে মানুষের স্বার্থপরতার এক অবৈধ সন্তান। এটা আল্লাহ্র সৃষ্টি করা জিনিস নয়। মানবশিশু মায়ের পেট থেকেই কর্মক্ষমতা ও কর্মস্পৃহা নিয়ে ভুমিষ্ঠ হয়ে থাকে। পৃথিবীতে এসে সে চেষ্টা সাধনার এক বিস্তৃত ময়দান লাভ করে এবং জীবনের অসংখ্য উপায় উপকরণ তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু সে নিজের জীবিকার দুয়ার উম্মুক্ত হওয়াতেই শুধু খুশী থাকতে চায়না বরং সেই সাথে অন্যের দুয়ার রুদ্ধ হোক তাও কামনা করে। এই স্বার্থপরতায় কোনো বৃহৎ মানব গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তির ফলে যে ঐক্য গড়ে ওঠে তা তাদেরকে একজাতিতে পরিণত হতে সাহায্য করে। আপাতঃ দৃষ্টিতে তারা মনে করে যে, তার অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার একটা বৃত্ত বানিয়ে নিজেদের অধিকার ও স্বার্থকে নিরাপদ করেছে। কিন্তু যখন এ ধরনের অনেকগুলো গোষ্ঠী নিজেদের চারপাশে অনুরূপ বৃত্ত বানিয়ে নেয়, তখন মানুষ নিজ হাতেই নিজের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলো। তার নিজের স্বার্থপরতা তার পায়ে বেড়ি এবং হাতে কড়া পরিয়ে দেয়। অন্যদের জন্য জীবিকার দুয়ার রুদ্ধ করার চেষ্টা করতে গিয়ে সে নিজেই নিজের জীকিকার চাবিকাঠি হারিয়ে বসে। আজ আমাদের চোখের সামনে এ দৃশ্য বিদ্যমান যে, ইউরোপ, আমেরিকা এবং জাপানের সাম্রাজ্যগুলো কিভাবে তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করছে। তারা এখন বুঝতেই পারছেনা যে, যেসব অর্থনৈতিক দুর্গ তারা নিজেদের নিরাপত্তার সর্বোত্তম উপায় মনে করে নির্মান করেছিলো তা কিভাবে ভেংগে চুরমার করা যায়। এরপরও কি আমরা বুঝতে পারবোনা যে, জীবিকা উপার্জনের জন্য বৃত্ত গড়ে তোলা এবং তার ভিত্তিতে জাতীয় বৈষম্য সৃষ্টি করা একটা নির্বোধসুলভ কাজ? আল্লাহ্র বিশাল পৃথিবীতে মানুষকে আপন প্রতিপালকের অনুগ্রহ অন্বেষণ করার স্বাধীনতা দেয়ায় দোষোর কি আছে?
শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত মতৈক্য মূলত একটা দৃর্বল ও ক্ষণস্থয়ী জিনিস। এর ভিত্তিতে কোনো স্থয়ী জাতীয়তার পত্তন কখনো সম্বব নয়। একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে তার চিরস্থয়ী আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে একটি জাতিতে পরিণত করার চিন্তা কখনো সাফল্যের মুখ দেখেনি। রাষ্ট্র যতোক্ষণ পরাক্রান্ত ও শক্তিশালী থাকে তাতেক্ষণ নাগরিকরা তার আইনের বাঁধনে বাঁধা থাকে। এই বাঁধন যখনই ঢিলা হবে অমনি তা খন্ডবিখন্ড হয়ে যাবে। মোগল সম্রাজ্যে কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর ভরতের বিভিন্ন অঞ্চলকে নিজস্ব পৃথক পৃথক জাতিসত্তা গড়ে তুলতে কোনো কিছুই আর বাধা দিতে পারেনি। ওসমানী সাম্রাজ্যের একই পরিণতি ঘটেছিলো। শেষ যুগে তুর্কী যুবকদের সংগঠন “ইয়ং তুর্ক” উসমানী জাতীয়তার প্রাসাদ নির্মাণে অনেক চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু একটিা ঠেলা লাগতেই গোটা প্রাসাদ হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়লো। অষ্ট্রিয়া ও হাংগেরীর ঘটনা সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। এছাড়াও ইতিহাস থেকে আরো অনেক উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। সেসব উদাহরণ দেখার পরও যারা রাজনৈতিক জাতীয়তা গড়া সম্মব মনে করে তারা শুধু তাদের কল্পনার নৈপুণ্যের জন্য অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মানব সমাজে এভাবে যতো বিভাজন করা হয়েছে, তার কোনো যুক্তিসংগত ভিত্তি নেই। এগুলো কেবল বস্তুগত ও আবেগ নির্ভর বিভজন। দৃষ্টিভংগীকে কিছুমাত্র প্রসারিত করলেই এসব বিভাজনের প্রতিটি বৃত্ত ভেংগে যায়। অজ্ঞতা ও মুর্খতার অন্ধকার, দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা ও অন্তরের সংকীর্ণতার ওপর এসব বিভাজনের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। জ্ঞানের আলো যতো ছাড়াতে থাকে, অন্তর্দৃষ্টি যতো লক্ষ্যভেদী হয়, হৃদয়ে যতো বেশী উদারতা ও প্রশস্ততার উদ্ভব হয় ততোই এসব বস্তুগত ও আবেগ নির্ভর পর্দা সরে যেতে থেকে। অবশেষে বর্ণবাদ ও প্রজানম্নবাদকে মানবতার জন্য এবং স্বাদেশিকতাবাদকে আন্তর্জাতিকতার জন্য স্থান খালি করে দিতে হয়। বর্ণ ও ভাষার বৈচিত্রের মধ্য দিয়ে মানবতার ঐক্য নামক মূল সত্যটি উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে। আল্লাহ্র পৃথিবীতে আল্লাহ্র সকল বান্দার অর্থনৈতিক কামনা বাসনা একই হয়ে থাকে। রাজনৈতিক ব্যবস্থাবলী কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নামক সূর্যর ছায়া মাত্র, যা ঐ সুর্যর গতিবিধি অনুসারে চলাফেরা করে এবং বাড়ে কমে।
ইসলামের প্রশস্ত দৃষ্টি ভংগী
উপরে আমি যেসব কথা বলেছি, অবিকল ওটাই ইসলামের বক্তব্য। ইসলাম মানুষে মানুষে কোনো বস্তুগত ও আবেগ নির্ভর ভেদাভেদ ও বৈষম্য স্বীকার করেনা। সে বলে, সকল মানুষ একই উৎস থেকে উদগতঃ
“আল্লাহ্ তোমাদেরকে একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং উভয় থেকে অসংখ্য নারী ও পুরুষ [বিশ্বময়] ছড়িয়ে দিয়েছেন।” [সূরা আননিসাঃ ১]
ইসলাম বলে, তোমাদের মধ্যে জন্মস্থান, মৃত্যুস্থান ও মাতৃভূমির পার্থক্য কোনো মৌলিক বিষয় নয়। আসলে তোমরা সবাই একই প্রাণ থেকে সুষ্টি করেছেন। তারপর প্রত্যেকেরই একটা অবস্থান স্থল ও সমাধিস্থাল হবে।” [সূরা আল আনয়ামঃ ৯৮]
এরপর সে বংশ ও গোত্রের পার্থক্যের তাৎপর্যও এভাবে ব্যাখ্যা করেছেঃ
“ওহে মানবমন্ডলীঃ আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ও গোত্রে গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। কিন্তু আসলে তোমাদের মধ্যে অধিকতর সম্মানিত ব্যক্তি তো সেই-ই, যে অধিকতর পরহেজগার।” [সূরা আল হুজরাতঃ ১৩]
অর্থাৎ এতো যে জাতি ও গোত্রের বিভিন্নতা, তা পরস্পরের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ, গর্ব ও দ্বন্দ সংঘাতের জন্য নয়, বরং পারস্পরিক পরিচয়ের সুবিধার জন্য। এই বিভিন্নতায় তোমরা মানবজাতির উৎপত্তির উৎস যে এক ও অভিন্ন সে কথা ভুলে যেওনা। তোমাদের মধ্যে যদি সত্যি সত্যি কোনো পার্থক্য ও ভেদাভেদ থেকে থাকে, তাবে তা চরিত্র ও কর্মের সততা ও অসততার ভিত্তিতে হয়ে থাকে।
এরপর বলা হয়েছে, এইসব রকমারি দল ও গোষ্ঠীগত বিভেদ আল্লাহ্র আযাব স্বরূপ। এ দ্বারা তোমাদেরকে পারস্পরিক শত্রুতার যন্ত্রণা উপভোগ করানো হয়ঃ
“নয়তো তিনি তোমাদেরকে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দেবেন এবং তোমাদেরকে পরস্পরের শক্তি ও পতিপত্তির স্বাদ উপভোগ করাবেন।” [সূরা আল আনয়ামঃ ৬৫]
এই দলাদলিকে ইসলাম একটা অপরাধ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং বলেছে যে, ফেরাউন এই অপরাধের কারণেই অভিশপ্ত ও শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিলোঃ
“ফেরাউন পৃথিবীতে অহংকার করলো এবং দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করলো।” { ফেরাউন মিষরের অধিবাসীদেরেকে কিবর্তী ও অকিবর্তী গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে এবং উভয় গোষ্ঠীর সাথে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ করে যে ঐতিহাসিক অপরাধ সংঘটিত করে তার প্রতি ইংগিত।}[সূরা ক্কাসাসঃ ৪১]
ইসলাম আরো বলেছে যে, পৃথিবী আল্লাহ্র। তিনি মানবজাতিকে এখানে খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, এখানকার সকল জিনিসকে মানুষের অনুগত ও বশীভূত করে দিয়েছেন। মানুষ কোনো একটা ভূখন্ডের গোলাম হয়ে থাকতে বাধ্য নয়। এই বিশাল পৃথিবী তার জন্য উম্মুক্ত। এক জায়গা তার জন্য সংকীর্ণ ও অনাবাসযোগ্য হলে অন্যত্র যেতে পারে। সে যেখানেই যাবে, আল্লাহ্র প্রদত্ত সম্পদরাজি বিদ্যমান দেখতে পাবেঃ
“[আদম সুষ্টির সময় আল্লাহ্ বললেন] আমি পৃথিবীতে একজন পতিনিধি নিযুক্ত করতে যচ্ছি।” [সূরা আলবাকারাঃ ৩০]
“তোমরা কি দেখতে পাওনা যে, পৃথিবীতে বিরাজমান সকল জিনিসকে আল্লাহ্ তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন?” [সূরা হাজ্জঃ ৬৫]
“আল্লাহ্র পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিলোনা, যে তোমরা তার অভ্যন্তরে হিজরত করতে?” [সূরা আননিসাঃ ১০০]
আপনি সমগ্র কুরআন পড়ে যান। এতে একটি শদ্বও আপনি বর্ণ, বংশ ও ভৌগলিক আঞ্চলিকতা বা স্বাদেশিকতার সমর্থনে পাবেনা না। তার দাওয়াত গোটা মানবজাতিকে মম্বোধন করে উচ্চারিত হয়েছে। সারা পৃথিবীর মানব জাতিকে সে সততা ও কল্যাণের দিকে ডাকে। এক্ষেত্রে কোনো জাতি ও ভূখন্ডেরি ভেদাভেদ নেই। সে কোনো ভূখন্ডের সাথে যদি বিশেষ সম্পর্ক গড়ে থাকে তবে শুধু মক্কার সাথে গড়েছে।
“মক্কার স্থায়ী অধিবাসী এবং বাহিরাগত মুসলমান সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী।” {এ তারণেই মুসলিম ফিকাহবিদদের একটা দল মক্কার মাটিতে কারো মালিকানা অধিকার স্বীকার করেননি। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মক্কাবাসীকে ঘরের দরজা পর্যন্ত বন্ধ করতে নিষেধ করতেন, যাতে হাজীরা যে ঘরে ইচ্ছা উঠতে পারে। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয মক্কায় ঘরবাড়ী ভাড়া করতে নিষেধ করতেন এবং মক্কার শাসকর্তাকে চিঠি লিখেছিলেন, তিনি যেনো লোকদেরকে একাজ থেকে নিষেধ করেন। কোনো কোনো ফকীহ্র মতে নিজ খরচে ঘর বানালে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন মক্কা পবিত্র, জায়গার ওপর সবার অধিকার রয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন মক্কা পবিত্র, এর খলি জায়গা বিক্রি করা ও ঘর ভাড়া দেয়া। জায়েয নয়। অন্য হাদীসে বলেন, মক্কায় যেখানে যে ব্যক্তি প্রথম পৌছবে, সেখানে তারই অধিকার। ইসলাম যে জায়গাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে, এ হচ্ছে তার অবস্থা।}[ সূরা হজ্জঃ ২৫]
আর যে মোশরেকরা সেখানকার আসল অধিবাসী তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ওরা নাপাক ওদেরকে বহিস্কার করো।
“মোশরেকরা অপবিত্র। কাজেই এ বছরের পর তারা যেনো মসজিদুল হারামের ধারে কাছেও ঘোষণার পর ইসলামে দেশ ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ হয়ে যায়। একজন মুসলামান অনায়াসে ঘোষণা করতে পারে যে “প্রতিটি দেশ আমাদের দেশ, কেননা তা আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্র দেশ।”
বিদ্বেষ ও ইসলামের সাথে শত্রুতা
ইসলামে অভ্যুদয়কালে এই বর্ণ, বংশ ও মাতৃভূমি সংক্রা্ন্ত বিভেদ, বিদ্বেষ ও আভিজাত্যবোধই ছিলো তার পথের সবচেয়ে বড় বাঁধা।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজ গোত্র এই আভিজাত্য ও কৌলিন্য ফলানোর প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলো। গোত্রসমূহের গৌরব গাথা এবং ব্যক্তিগত ও বংশীয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা তাদের ইসলাম গ্রহণের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা বলতো, এই কুরআন যদি আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই এসে থাকে তবে তা মক্কা বা তায়েফের কোনো মান্যগণ্য ব্যক্তির কাছেই আসতোঃ
“তারা বলেঃ এই কুরআন দুই জনপদের কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির কাছেই নাযিল হলো না কেন? [সূার যুখরুফঃ ৩১]
আবু জাহেল মনে করতো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবূয়্যতের দাবী করে নিজের গোত্রের জন্য আরো একটি গৌরব বৃদ্ধি করতে চান। সে বলতোঃ
“আমাদের আর বনু আবদে মানাফের সাথে বসকিছুতেই প্রতিযোগিতা হতো। ঘোড় দৌড়ে, গণভোজনের আয়োজনে ও দান দক্ষিণায় তাদের সাথে আমরা সমান ছিলাম। এখন তারা বলছে, আমাদের এক ব্যক্তির কাছে ওহি আসা শুরু হয়েছে। খোদার কছম, আমরাতো মুহাম্মদকে কখনো নবী মানবোনা।”
এটা আবু জাহেলেরই বক্তব্য ছিলোনা; বরং কোরেশ বংশীয় সকল মোশরেকদের দৃষ্টিতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীতে দীনে এই একটাই ‘খুত’ ছিলো যেঃ
“মুহাম্মদের ধর্ম কোরেশ বংশকে তার বংশীয় আভিজাত্য ও দেশীয় গৌরব থেকে বঞ্চিত করবে এবং তার আরবীয় আভিকাত্য বিনষ্ট করবে। তার দৃষ্টিতে ছোট বড় সব সমান এবং সে নিজের ভৃত্যের সাথে একসাথে বসে আহার করে। সে আরবের সম্ভ্রান্ত লোকরেদ মর্যাদা বোঝেনা, হাবশীদের সাথেও সে মিলে মিশে চলে। সাদা কালো সবাইকে সে একাকার করে ফেলেছে এবং সম্মানিত লোকদের সম্মান হানি করেছে।”
এ কারণে কোরেশ বংশের সকল গোত্র বনু হাশেম গোত্রের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। আর বনু হাশেমও এই গোত্রীয় আভিজাত্যবোধের ভিত্তিতেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্র্রতি সমর্থন জানায় অথচ তাদের অধিকাংশই মুসলামন ছিলোনা। ‘শিয়াবে আবু তালেব’ নামক গীরিবর্তে বনু হাশেমকে এ কারণেই অবরুদ্ধ করে রাখা হয় এবং সমগ্র কোরেশ বংশ তাদেরকে বয়কট করে। যেসব মুসলামানের গোত্র দুর্বল ছিলো, তারা ভয়াবহ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আবিসিনিয়ার হিজরত করতে বাধ্য হয়। আর যাদের গোত্র শক্তিশালী ছিলো, তার ইসলামের পক্ষাবলম্বনের জন্য নয় বরং গোত্রীয় শক্তির কারণে কোরেশ বংশের অত্যাচার থেকে কিছুটা নিরাপদ থাকে।
আরবের ইয়াহুদীরা বনী ঈসরাইলী নবীদের ভবিষ্যদ্বানীরি আলোকে বহুদিন যাবত একজন নবীর অপেক্ষায় ছিলো। তাদেরই প্রচারিত ভবিষ্যদ্বনীর ফল ছিলো এইযে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত প্রকাশ পাওয়ার পর মদীনার বহুসংখ্যক অধিবাসী ইসলাম গ্রহণ করে। অথচ খোদ্ ইয়াহুদীরা যে কারণে তাঁর প্রতি ঈমান আনা থেকে বিরত থাকে সেটি ছিলো এই বংশীয় আভিজাত্যবোধ। তাদের আপত্তি ছিলো এইযে, নবী যখনে এলেনই, তখন তিনি ইয়াহুদীদের মধ্য থেকে না এসে ইসমাইলের বংশধরের মধ্য থেকে এলেন কেন? এই বিদ্বেষ তাদেরকে এতো বেসামাল করে দেয় যে, তারা একত্ববাদীদের ছেড়ে মোশরেকদের সহযোগী হয়ে গেলো।
খৃষ্টানদের অবস্থাও ছিলো তদ্রুপ। তারাও একজন নবীর আগমনের অপেক্ষয় ছিলো। কিন্তু তাদের ধারণা ছিলো, তিনি সিরিয়ার খৃষ্টানদের মধ্য থেকে আবির্ভুত হবেন। আরবের কোনো নবীকে মেনে নিতে তারা প্রস্তুত ছিলোনা। হিরাক্লিয়াসের কাছে যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বার্তা পৌঁছালো, তখন সে কোরেশ বণিকদের বললোঃ
“আমি জানতাম যে একজন নবীর আবির্ভাব আসন্ন হয়ে উঠিছে, কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্য থেকে আবির্ভুত হবেনা এমনটি আশা করিনি।”
মিশরের মুফাওকিসের কাছে যখন ইসলামের দাওয়াত গেলো, তখন সে বললোঃ
“এখনো একজন নবী আসতে বাকী আছে, তাতো আমি জানি, তবে আমার আশা ছিলো যে, তিনি সিরিয়ায় আসবেন।”
অনারব বিশ্বেও এই জাত্যাভিমান তীব্রভাবে বিদ্যামান ছিলো। ইরানের শাহ খসরু পারভেজের কাছে যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান দাওয়াতী চিঠি পৌঁছলো, তখন কোন্ কারণে সে আক্রোশে ফেটে পড়লো? সে কারণ ছিলো এটাই যে, “একটি গোলাম জাতির এক ব্যক্তির কিনা এতো স্পর্ধা যে, সে আযমের বাদশাকে এভাবে সম্বোধন করলো।” সে আরব জাতিকে নিকৃষ্টি জাতি মনে করতো। তাদেরকে সে নিজের অধীন মনে করাতো। এমন একটি জতির মধ্যে সত্যের দিকে আহবানকরী কোনো মানুষ জন্ম নিতে পারে তা সে ভাবতেও পারতোনা।
ইসলামের চরম শত্রু ইয়াহুদীদের কাছে ইসলামের প্রসার ঠেকানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার ছিলো মুসলমানদের মধ্যে গোত্রীয় বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার অপকৌশল। এ কারণেই মদীনার মোনাফেক তথা ভন্ড ও কপট মুসলমানদের সাথে তাদের গোপন যোগসাজশ ছিলো। একবার তার বুগাস যুদ্ধের প্রসংগ তুলে দুটো আনসার গোত্র আওস ও খাজরাজের মধ্যে বিদ্বেষের এমন আগুন জ্বালালো যে, উভয় পক্ষের তরবারী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো। এই ঘটনা উপলক্ষে এ আয়াত নাযিল হয়ঃ
“হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আহলে কিতাবের একটি গোষ্ঠীর কথামত চলো, তাহলে তারা তোমাদেরকে ঈমান থেকে কুফরির দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।” [সূরা আল ইমরান: ১০০]
এই একই বংশগত ও ভূখন্ডগত বিদ্বষের কারণে মদীনায় কোরেশী নবীর শাসন চলতে দেখে এবং আনসারদের খেজুরের বাগানে ও ফলের বাগানে মোহাজিরদের বিচরণ করতে দেখে মদীনার মোনাফিকরা তেলে বেগুণে জ্বলতে থাকতো। মোনাফিকদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উপাই বলতো, “এই দরিদ্র কোরেশীরা আমাদের এখানে এসে আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। এদের উপমাহ হলো কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা তাজা বানানোর মতো যাতে কুকুর তার মালিককেকই ছিড়ে ভূঁড়ে খেতে পারে।”
সে আনসারদের বলতো: “তোমরা ওদেরকে মাথায় চড়িয়েছো। নিজেদের দেশে আশ্রয় দিয়েচো, নিজেদের সম্পদের ভাগ দিয়েছো। আল্লাহর কছম, আজ যদি তোমরা তাদের সাথে সহযোগিতা বন্ধ করো,তাহলে দেখবে ওরা ঘুরে বেড়াবে।” তার এসব উক্তির জবাব কুরআনে এভাবে দেয়া হয়েছে:
“এরাইতো সেইসব লোক যারা বলে, রাসূলুল্লাহর সংগীদের জন্যে অর্থ ব্যয় করোনা, যাতে তারা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। অথচ আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদের একমাত্র মালিক আল্লাহ্। কিন্তু মুনাফেকরা তা বোঝে না। তারা বলে, আমরা যদি [রণাংগন থেকে] মদীনায় ফিরে যাই তাহলে প্রতাপশালীরা দুর্বলদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করবে। অথচ প্রতাপ ও প্রতিপত্তি মূলতঃ আল্লাহর, তার রসূলের এবং মুমিনদের। কিন্তু মোনাফেকরা তা জানেনা।” [সূরা মুনাফিকূন: ৭-৮]
এই স্বজাত্যবোধের অন্ধ আবেগই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার ওপর অপবাদ আরোপ প্ররোচিত করে এবং এই আবেগের বশেই খাজরাজ গোত্রের সমর্থনে আল্লাহ ও রসূলের এই কট্টর দুশমন নিজের কৃতকর্মের শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়।
গোষ্ঠীবাদ ও জাত্যাবিমানের বিরুদ্ধে ইসলামের জিহাদ
উপরোক্ত বিবরণ থেকে একথা ভালোভাবেই জানা গেছে যে, কুফরী ও শিরকের জাহেলিয়াতের পর ইসলামী দাওয়াত বিস্তারের সবচেয়ে বড় বাধা ও সবচেয়ে কট্টর দুশমন যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা এই বংশ পূজা ও স্বাদেশিকতার শয়তান। আর এ কারণেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুফরী ও শিরকের পরে যে জিনিসটার উচ্ছেদের জন্য সর্বাধিক চেষ্টা সাধনা করেছেন তা ছিলো জাহেলিয়াতের তৈরী এই জাত্যাভিমান। আপনি হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলী পড়ে দেখলে বুঝতে পারবেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে রক্ত, মাটি, বর্ণ ও ভাষা এবং ইতর ও কুলীণের ভেদাভেদ নির্মূল করেছিলেন। কিভাবে মানুষে মানুষে বিরাজমান অস্বাভাবিক বৈষম্যের প্রাচীরগুলো ভেংগে চুরমার করেছিলেন এবং মানুষ হিসাবে সকল আদম সন্তানকে সমানাধিকার প্রদান করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা ছিলো:
“যে ব্যক্তি জাত্যাভিমান ও গোষ্ঠীবাদের জন্য প্রাণ দিলো, সে আমার দলভুক্ত নয়। যে ব্যক্তি জাত্যাভিমানের প্রতি আহবান জানালো সে আমার দলভুক্ত নয়। যে ব্যীক্ত জাত্যাভিমান নিয়ে লড়াই করলো সে আমার দলভুক্ত নয়।”
“ধর্মপরায়ণতা ও খোদাভীতি ছাড়া আর কোনো জিনিসের ভিত্তিতে একজন অপর জনের ওপর অগ্রাধিকারের যোগ্য নয়। সকল মানুষ আদম আলাইহিস সালামের সন্তান এবং আদম আলাইহিস সালাম ছিলেন মাটির তৈরী।”
প্রজন্মবাদ, স্বাদেশিকতাবাদ, ভাষা ও বর্ণের বৈষম্য তিনি এই বলে নিশ্চিহ্ন করেন:
“অনারবদের ওপর আরবের এবং আরবের ওপর অনারবের কোনো অগ্রাধিকার বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমরা সবাই আদম আলাইহিস সালামের সন্তান।”
“কোন অনারবের ওপর আরবের, আরবের ওপর অনারবের, কালোর ওপর সাদার এবং সাদার ওপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তবে শুধমাত্র সততা ও খোদাভীতির শ্রেষ্ঠত্ব থাকতে পারে।”
“শোনো ও আনুগত্য করো, এমনকি যদি তোমাদের আমীর এমন একজন নিগ্রো দাসকেও নিয়োগ করা হয়, যারমাথাটা কিশমিশের মতো কদাকার, তবুও।” [উল্লেখ্য যে, এই নির্দেশ আরবের অভিজাত সরদার ও নেতাদের উদ্দেশ্যে জারী করা হয়েছিলো যে, তোমাদের আমীর কোনো নিগ্রো মুসলমানহলেও তাকেমেনে চলো। কোনো জাতীয়তাবাদী কি একথা কল্পনাও করতে পারে?]
মক্কা বিজয়ের পর যখন তরবাররির শক্তির সামনে কোরেশী সরদারদের গর্বিত মস্তক অবনমিত হলো, তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিতে দাঁড়িয়ে তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে গোষণা করলেন:
“শুনে রাখো, কৌলীন্য ও আভিজাত্যের যেকোনো পুঁজি এবং রক্ত ও সম্পদের যেকোনো দাবী আমার পায়ের নিচে দাবিয়ে দিলাম।”
“হে কোরেশ: আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জাহেলিয়াতের জাত্যাভিমান এবং বাপ দাদার গৌরব গাথা নির্মল করে দিয়েছেন।
“ওহে মানব মন্ডলী! তোমরা সকলে আদম থেকে এসেছো আর আদমের জন্ম হয়েছে মাটি থেকে। বংশ নিয়ে গৌরবের কোনো অবকাশ নেই। কোনো অনারবের ওপর আরবের এবং আরবের ওপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সৎ ও খোদাভীরু, সেই সবচেয়ে বেশী সম্মানের পাত্র।”
আল্লাহর ইবাদাতেরপর তিনি আল্লাহর সামনে তিনটে জিনিসের সাক্ষ্য দিতেন। প্রথমতঃ “আল্লাহর কোনো শরীক নেই,” অতঃপর এই মর্মে সাক্ষ্য দিতেনযে, “মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅম আল্লাহর বান্দা ওরাসূল।” অতঃপর তৃতীয় যে বিষয়টির সাক্ষ্য দিতেন তাহলো এই যে, “আল্লাহর বান্দারা সবাই ভাই ভাই।”
ইসলামী জাতীয়তাবাদ ভিত্তি
জাহেলিয়াতের যে কয়টি সংকীর্ণ বস্তুগত, আবেগ প্রসূত ও কাল্পনিক ভিত্তির ওপর দুনিয়ার বিভিন্ন জাতীয়তার প্রাসাদ গড়ে উঠেছিলো, আল্লাহ ও তাঁর রসূল সেগুলিকেক নিশ্চিহ্ন করে দেন। মানুষ নিজের চরম অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে বর্ণ, বংশ, জন্মভূমি, ভাষা অর্থনীতি ও রাজনীতির যেসব অযৌক্তিক ভেদাভেদ ও সৈষম্যের ভিত্তিতে মানব সমাজকে বিভক্ত করে রেখিছিলো ইসলাম সেগুলোর মূলোৎপাটিত করে এবং মানবতার ক্ষেত্রে সকল মানুষকে পরস্পরের সমমর্যাদা সম্পন্ন বলে ঘোষণা করে।
এই ভাংগার পাশাপাশি সে সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত ভিত্তিতে একটি নতুন জাতীয়তা গড়ার কাজও সম্পন্ন করে। এ জাতীয়তার ভিত্তিও এক ধরনের বৈষম্যের ওপর স্থাপিত হয়েছিলো। তবে সেটা বস্তুগত ও ভৌতিক বৈষম্য নয় বরং আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ভেদাভেদ। সে মানুষের সামনে একটি স্বভাবসিদ্ধ সত্য পেশ করে যার নাম “ইসলাম।” সে আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য, মনের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা এবং আমলেরসততা ও পরহেজগারীর প্রতি সকলকে দাওয়াত দেয়। তারপর জানিয়ে দেয় যে, এই দাওয়াতকে যে ব্যক্তি গ্রহণ করবে সে একটা জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে আর যে ব্যক্তি প্রত্যাখ্যান করবে, সে একটা ভিন্ন জাতির সদস্যরূপে পরিগণিত হবে। এ দুই জাতির একটি ইসলামী জাতি এবং এর সকল ব্যক্তি মিলে একটা উম্মাত গঠিত হয়। পবিত্র কুরআনে এই উম্মাহকে মধ্যমপন্থী ও ভারসাম্যপূর্ণ উম্মাহ্ বলা হয়েছে।
“আমি এইভাবে তোমাদের সকলকে মধ্যমপন্থী উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত বানিয়ে দিয়েছি।
আর একটি জাতি কুফরি ও ভ্রষ্টতার জাতি হিসেব পরিচিত এবং এর অনুসারীরা নিজেদের মধ্যে তীব্র মতভেদ থাকা সত্ত্বেও একই গোষ্ঠী।
“আল্লাহর সত্য অস্বীকারকারীদের সুপথে পরিচালিত করেন না।”
উপরোক্ত দুটি জাতির মধ্যে পার্থক্যের ভিত্তি বর্ণ ও বংশ নয় বরং বিশ্বাস ও কাজ। এমনকি একই পিতার দুইছেলে ইসলাম ও কুফরীর বিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে পারে এবং সম্পূর্ণ অচেনা দুই ব্যক্তি ইসলামে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে একই জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে।
উক্ত জাতি দুটির মধ্যে পার্থক্যের ভিত্তি জন্মভূমির বিভিন্নতা নয়। এখানে পার্থক্য ও বিভেদ-বৈষম্যের ভিত্তি হলো হক ও বাতিল, যার কোন নির্দিষ্ট দেশ বা জন্মভূমি নেই। একই শহর, একই মহল্লা, এমনকি একই ঘরের দুই ব্যক্তির জাতীয়তা ইসলাম ও কুফরীর বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন হয়ে যেতে পারে। একজন নিগ্রো ইসলামের বন্ধনে আবদ্ধ হবার কারণ একজন মক্কাবাসীর স্বজাতিভুক্ত হয়ে যেতে পারে।
বর্ণের বিভিন্নতাও এখানে জাতিগত বিভেদের কারণ নয়। এখানে চেহারার বর্ণ কেমন তার কোনো গুরুত্ব ও মূল্য নেই। বরং গুরুত্ব হলো আত্মার রংয়ের এবং সেটাই শ্রেষ্ঠ রং:
“আল্লাহর রং ধারণ করো। তার রংয়ের চেয়ে ভালো আর কার রং হবে?”
ইসলামের কারণে একজন শ্বেতাংগ ও একজন কালো মানুষ একই জাতিভুক্ত হয়ে যেতে পারে এবং কুফরীর কারণে দু’জন সাদা মানুষেরও পৃথক পৃথক জাতীয়তা হওয়া সম্ভব।
ভাষার পার্থক্যও ইসলাম ও কুফরীর মধ্যে বিরোধের কারণ ঘটায়না। এক্ষেত্রে মুখের ভাষা নয়, মনের ভাষায় বিবেচ্য বিষয়। মনের ভাষা সারা পৃথিবীতেই প্রচলিত এবং সকলেই তা বোঝে। এ হিসেবে একজন আরব ও একজন আফ্রিকানের ভাষা একই হতে পারে। পক্ষান্তরে দু’জন আরবের ভাষা দু’রকম হতে পারে।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্নতাও ইসলাম ও কুফরীর বিরোধে কোনো গুরুত্ব রাখেনা। এখানে বিতর্কের বিষয় টাকা নয়, ঈমানী সম্পদ। বিতর্কের বিষয় মানুষের রাজত্ব নয়, আল্লাহর সাম্রাজ্য। যারা আল্লাহর কর্তৃত্বের অনুগত এবং তাঁর কাছে নিজেদের জীবন বিক্রিয় করে দিয়েছে, তারা সবাই এক জাতিভুক্ত, চাই তারা ভারতের অধিবাসী হোক কিংবা তুর্কিস্তানের। আর যারা আল্লাহর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা ওড়ায় এবং শয়তানের সাথে জান ও মালের ব্যাপারে আপোষ রফা করে তারা ভিন্ন জাতির লেক। তারা কোন্ রাষ্ট্রের নাগরিক এবং কোন্ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীন, তা এখানে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।
এভাবে ইসলাম জাতীয়তার যে বৃত্ত একেঁছে, তা কোনো বস্তুগত বা ইন্দ্রিয় গোচর বৃত্ত নয়, বরং সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক বৃত্ত। একই পরিবারের দুই ব্যক্তি এই বৃত্তে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে আবার পাশ্চাত্যের একজন ও প্রাচ্যের একজনের ভেতরে মিলিত হতে পারে। কবির ভাষায়:
এখানে ভালোবাসার সাথে রক্তের নেই কোনো সম্পর্ক
রোম, সিরিয়অ বা সেমিটিকের নেই কোনো ভেদাভেদ
এ নক্ষত্র প্রাচ্যেরও নয়, নয় পাশ্চাত্যের
এর না আছে অস্তাচল না সীমানায় উত্তর না দক্ষিণ।
এ বৃত্তকে যে জিনিস ঘিরে রেখেছে তা হচ্ছে কালেমা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ।” এই কালেমাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে শত্রুতা ও বন্ধুতা। এই কালেমার স্বীকৃতি মিলনের পথ উন্মুক্ত করে আর অস্বীকৃতি নিয়ে যায় বিচ্ছেদের পথে। এ কালেমা যাদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছে, তাদেরকে রক্তের সম্পর্কও একত্রিত করতে পারেনা, মাটির সম্পর্কও নয় এবং ভাষা, বর্ণ, খাদ্য কিংবা সরকারের অংশীদারিত্বও নয়। আর এই কালেমা যাদেরকে একত্রিত করেছে, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা কারো নেই। কোনো নদনদী, পাহড় পর্বত, সমুদ্র, ভাষা, বংশ, বর্ণ এবং সম্পদ ও ভূমির বিরোধ ও বিভিন্নতার এ অধিকার ও ক্ষমতা নেই যে, ইসলামের অভ্যন্তরে বিভেদের রেখা এঁকে দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ বৈষম্য বা পার্থক্যের সৃষ্টি করে। প্রত্যেক মুসলমান, চাই সে চীনের অধিবাসী হোক কিংবা মরক্কোর, সাদা হোক কিংবা কালো, হিন্দী বলুক বা আরবী, সেমিটিক হোক কিংবা আর্য, এক রাষ্ট্রের নাগরিক হোক কিংবা অন্য রাষ্ট্রের, সর্বাবস্থায় সে মুসলিলম উম্মাহর সদস্য, ইসলামী সমাজের সদস্য, ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক, ইসলামী সেনাবাহিনীর সৈনিক এবং ইসলামী আইনের সংরক্ষণ সুবিধার অধিকারী। ইসলামী শরীয়ত একটি বিধিও এমন নেই, যা ইবাদত, পারস্পরিক লেনদেন, সামাজিক আচার আচরণ, অর্থনীতি, রাজনীতি মোটকথা জীবনের কোনো একটি দিকেও জাতীয়তা, ভাষা বা জন্মভূমির ভিত্তিতে এক মুসলমানকে অপর মুসলমানের চেয়ে কম বা বেশী অধিকার দেয়।
ইসলামের মিলন ও বিচ্ছেদের নীতি
এরূপ ভুল ধারণা যেনো কারো মনে না জন্মে যে, ইসলাম যাবতীয় বৈষয়িক, সামাজিক ও মানবিক সুসম্পর্কগুলোকে ছিন্ন করে দিয়েছে। কখ্খনো নয়। বরঞ্চ সে মুসলমানদের আত্মীয়তার বন্ধন অব্যাহ রাখা ও মজবুদ করার নির্দেশ দিয়েছে। রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিন্ন করতে নিষেধ করেছে। মাতাপিতার আনুগত্য ও ফরমাবদরদারীর তাগিদ দিয়েছে। রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার ক্ষেত্রে সম্পত্তির উত্তরাধিকার চালু করেছে। দান সদকা ও বদান্যতায় আত্মীয় স্বজনকে অনাত্মীয়দের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে। নিজের পরিবার পরিজন, ঘরদোর ও ধনসম্পদকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। যালেমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বলেছে এবং এ ধরনের লড়ইতে নিহত ব্যক্তিকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছে। জীবনের সকল ব্যাপারে জাতিধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের প্রতি সমবেদনা, সদাচর ও স্নেহমমতা প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়েছে। তার কোনো বিধি বিধানের এমন ব্যাখ্যা দেয়ার অবকাশ নেই যে, ইসলাম স্বদেশ, স্বজাতির সেবা ও প্রতিরক্ষায় অবদান রাখতে নিষেধ করে, কিংবা অমুসলিম প্রতিবেশীর সাথে আপোষ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে বাধা দেয়।
[উল্লেখযোগ্য যে, অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের দুটো দিক রয়েছে। একটি দিক হলো, মানুষ হিসেবে আমরা ও তারা সমান। দ্বিতীয দিক এই যে, ইসলাম ও কুফরীর বিভিন্নতা আমাদেকে তাদের থেকে আলাদা করে দিয়েছ। প্রথম বিষয়টির বিচারেআমরা তাদের সাথে সহানুভূতি, উাদারতা, বদান্যতা ও সৌজন্যমূলক যাবতীয় সদাচার অব্যাহত রাখবো। কেননা এটা মানবতার দাবী। আর যদি তারা ইসলামের ও মুসলমানদের সক্রিয় দুশমন না হয়, তবে আমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব, আপোষ ওসহাবস্থানও করবো। যৌথ কল্যাণমূলক কাজে আমরা তাদেরসাথে সহযোগিতাও করতে দ্বিধা করবো না। কিন্তু কোনো বস্তুগত বা দুনিয়াবী, সামাজিক ও মানবিক যৌথ ও সম্মিলিত কর্মকাণ্ড আমাদেরকে তাদের সাথে এমনভাবে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেলতে পারবে না যে, আমরাও তারা এক জাতিতে পরিণত হবো এবং ইসলামী জাতীয়তা পরিত্যাগ করে কোনো সম্মিলিত ভারতীয়, চৈনিক বা মিশরীয় জাতীয়তা গ্রহণ করবো। কেননা আমাদের সম্পর্কের দ্বিতীয় দিকটি এধরনের একত্রীকরণের বাধা দেয়। বস্তুতঃ কাফের ও মুসলমানদের মিলিত এক জাতিতে পরিণত হওয়া একেবারেই অসম্ভব।]
এগুলো হলো এসব বস্তুগত ও পার্থিক সম্পর্কের বৈধ ও স্বাভাবিক সুবিধা। কিন্তু যে জিনিসটি জাতীয়তার ব্যাপারে ইসলাম ও কুফরীর নীতিকে ভিন্ন ভিন্ন রূপ দিয়েছে তা হলো, অন্যরা এসব সম্পর্কের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা জাতীয়তা তৈরী করে নিয়েছে, কিন্তু ইসাম এগুলিকৈ জাতীয়তার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেনি। সে ঈমানের বন্ধনকে এ সকল সম্পর্কের ঊর্ধ্বে স্থান দেয় এবং প্রয়োজন হলে এসব সম্পর্কের প্রত্যেকটিকে ঈমানী সম্পর্কের জন্য বিসর্জন দেয়ার দাবী জানায়। তারা কথা হলো:
“তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাঁর সাথীদের মধ্যে অনুকরণীয় আদর্শ ছিলো। তারা তাদের জাতিকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলো, তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহ্কে ছাড়া অন্য যাদের পূজা করো তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে বর্জন করেছি এবং আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরস্থায়ী শত্রুতার সৃষ্টি হয়ে গেছে- যতক্ষণ না তোমরা ঈমান আনো।” [সূরা আল মুমতাহিনা: ৪]
সে আরো বলে!
“তোমাদের বাপ ও ভাইয়ের যদি ঈমানের চেয়ে কুফরীকে বেশী ভালোবাসে তবে তাদেরকেও প্রিয়জন হিসেবে গ্রহণ করোনা। যারা তাঁদেরকে প্রিয়জন হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা যালেম হিসেবে গণ্য হবে।” [সূরা আততাওবা: ২৩]
ইসলাম আরো বলেছে:
“তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান সন্ততীর মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু আছে [ইসলামের দৃষ্টিতে] কাজেই তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকো।” [সূরা আত্তাগাবুন: ১৪]
সে বলে, যদি তোমাদের ধর্ম ও মাতৃভূমির মধ্যে বিরোধ বেঁধে যায়, তবে ধর্মের খাতিরে মাতৃভূমি ত্যাগ করে চলে যাও। যে ব্যক্তি দেশপ্রেমকে ধর্মপ্রেমের খাতিরে বিসর্জন দিয়ে হিজরত করেনা, সে মোনাফেক। তার সাথে তোমাদের কোন সম্পর্ক নেই।
“যতক্ষণ তারা হিজরত না করে ততক্ষণ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করোনা।” [সূরা আননিসা: ৮৯]
এভাবে ইসলাম ও কুফরীর বিভেদের কারণে ঘনিষ্ঠতম রক্ত সম্পর্কও ছিন্ন হয়ে যায়। শুধুমাত্র ইসলামের বিরোধী হওয়ার কারণে মাতা পিতা ভাইবোন ছেলে মেয়ে সবাই পার হয়ে যায়। আল্লাহর দুশমন হওয়ার কারণে একই বংশোদ্ভূত গোত্রকেও পরিত্যাগ করা হয়। ইসলাম ও কুফরীর সংঘাত চালু থাকার কারণে নিজের জন্মভূমিকেও পরিত্যাগ করা হয়। মোটকথা, দুনিয়ার সকল জিনিসের ওপর ইসলামকে কোনো কিছুর জন্যে বিসর্জন দেয়া যায়না। অপরদিকটিও লক্ষ করুন। যাদের ভেতরে রক্তের সম্পর্কও নেই, যাদের জন্মভূমিও এক নয়, ভাষাও এক নয় এবং যাদের সাথে বর্ণেরও মিল নেই, তাদেরকেও ইসলাম ভাই ভাই বানিয়ে দেয়। সকল মুসলমানকে সম্বোধন করে কুরআন বলে:
“তোমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে রাখো। পরস্পরে বিভেদ বিচ্ছেদে ও কোন্দলে লিপ্ত হয়োনা। তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো যে, তোমরা পরস্পরের শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্র ও সম্প্রীতির সৃষ্টি করে দিলেন এবং তোমরা তাঁর অনুগ্রহে [ইসলামের বদৌলতে] পরস্পরের ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা [পারস্পরিক বিদ্বেষের দরুন] আগুন ভর্তি গহবরে কিনারে দাঁড়িয়েছিলে। আল্লাহ তোমাদেরকে তা থেকে উদ্ধার করেছেন।” [সূরা আল ইমরান: ১০৩]
সকল অমুসলিম সম্পর্কে বলা হয়েছে:
“তারা যদি কুফরী থেকে তওবা করে, নামায পড়ে ও যাকাত দেয়, তবে তারা তোমাদের দীনি ভাই।”
আর মুসলমানদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে:
“মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল। আর যারা তা সাথী তারা কাফিরদের সামনে অবিচল এবং পরস্পরের প্রতি দয়ার্দ্র।” [সূরা আল ফাতাহ: ২৯]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
“লোকেরা যতক্ষণ এই মর্মে সাক্ষ্য না দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রসুল, যতক্ষণ তারা আমাদের কিবলার দিকে মুখ না ফেরাবে, আমাদের যবেহ করা জন্তু না খাবে এবং আমাদের মতো নামায না পড়বে, ততক্ষণ তাদের সাথে যুদ্ধ করতে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যখনই তারা এসব কাজ করবে, আমাদের ওপর তাদের রক্ত ও ধনসম্পদ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, তবে হক ও ইনসাফের খাতিরে যদি তা হালাল করা হয় তাহলে ভিন্ন কথা। এরপর তাদের অধিকার ও কর্তব্য অন্যসকল মুসলমানদের অধিকার ও কর্তব্যের মতোই।” [আবুদাউদ]
শুধু যে অধিকার ও কর্তব্যে সকল মুসলমান সমান তাই নয়, বরং তাতে কোনো পার্থক্য ও ভেদাভেদরও অবকাশ নেই। বরঞ্চ সেই সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথাও বলেছেন:
“মুসলমানের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক একটা প্রাচীরের বিভিন্ন অংশের মতো। প্রতিটি অংশ অপর অংশ থেকে শক্তি অর্জন করে।”[মিশকাত]
তিনি আরো বলেছেন:
“পারস্পরিক মমত্ব, সহানুভূতি ও দয়া দাক্ষিণ্যের দিক দিয়ে মুসলমানদের অবস্থা একটি একক দেহের মতো। দেহের একটি অংগ ব্যথা পেলে যেমন সমস্ত শরীরটারই নিদ্রা ও সুখশান্তি বিনষ্ট হয়ে যায়, তাদের অবস্থাও ঠিক তেমনি।” [মিশকাত]
মুসলিম জাতির এই দেহকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “জামায়াত” নামে আখ্যায়িত করেছেন এবং এই জামায়অত সম্পর্কে তিনি বলেছেন:
“জামায়াতের ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে। যে ব্যক্তি জামায়অত থেকে বিচ্ছিন্ন হবে সে আগুনে যাবে।”
“যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণও জামায়াত থেকে দূরে সরে গেলো সে নিজের গলা থেকে ইসলামের রজ্জু যেন খুলে ফেললো।”
শুধু এখানেই শেষ নয়। তিনি এ কথাও বলেছেন:
“যে ব্যক্তি তোমাদের জামায়াতকে খন্ড বিখন্ড করতে চেষ্টা করবে তাকে হত্যা করো।”
তিনি আরো বলেছেন:
“যে ব্যক্তি এই উম্মতের বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করতে উদ্যত হয়, তরবারী দিয়ে তাকে আঘাত করো তা সে যাই হোক না কেন।”
ইসলামী জাতীয়তা কিভাবে তৈরী হলো?
শুধুমাত্র ইসলামের ভিত্তিতে সংগঠিত এই জামায়াত বা দলের ভেতরে রক্ত, মাটি, ভাষা ও বর্ণের কোনো ভেদাভেদ ছিলোনা। এখানে ইরামেন সামলমা ছিলেন। তাঁকে কেউ পিতৃ পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন আমি ইসলামের ছেলে সালমান। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর সম্পর্কে বলতেন, “সালমান আমাদের তথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত বাযানকে ইয়অমানের এবং তাঁর ছেলেকে সানার শাসক নিয়োগ করেছিলেন। এই জামায়াতে আবিসিনিয়ার অধিবাসী বিলালও ছিলেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর সম্পর্কে বলতেন: “বিলাল আমাদের মনিবের ভৃত্য এবং আমাদেন মনিব।” রোমের অধিবাসী সোহায়েবও ছিলেন এই জামায়াতের সদস্য। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে নিজের জায়গায় নামাযের ইমামতিতে দাঁড় করিয়েছিলেন। হযরত আবু হুযায়ফার গোলাম সালেমও এই সংগঠনের ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে হযরত ওমর রাদিযাল্লাহু তায়ালা আনহু নিজের ইন্তিকালের সময় বলেছিলেন যে, সালেম জীবিত থাকলে আমি তৃতীয় খলিফা হিসেবে তাকেই মনোনীত করতাম। এই জামায়াতে যায়েদ বিন হারেসা নামক এক গোলামও ছিলেন, যাঁর সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ফুফাতো বেন যয়নব রাদিয়াল্লাহু তায়ালঅ আনহাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। হযরত যায়েদের ছেলে উসামা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন এই জামায়াতের আর এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই উসামা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে যে সেনাবাহিনীর সেনাপতি নিয়োগ করেছিলেন, তাতে সৈনিক হিসেবে শরীক হয়েছিলেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহের মতো মর্যাদাবান সাহাবীগণ। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একবার নিজের ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বলেছিলেন, “উসামার পিতা তোমার পিতার চেয়ে উত্তম এবং উসাম স্বয়ং তোমার চেয়ে উত্তম।”
মুহাজেরদের আদর্শ চরিত্র
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে পরিচালিত এই মহান সংগঠন বংশ, জন্মভূমি, ভাষা ও বর্ণ ইত্যদি নামে যেসব মূর্তির পূজা আদিম জাহেলিয়াত থেকে শুরু হয়ে আধুনিক জাহেলিয়াতের যুগেও অব্যাহত রয়েছে, সেগুলিকে ইসলামের কুড়াল দিয়ে ভেংগে গুড়িয়ে দেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং নিজের জন্মভূীম মক্কা ছেড়ে নিজের সংগী সাথীদের নিয়ে মদীনায় হিজরত করেন। এর দ্বারা একথা বুঝায়না যে, নিজ মাতৃভূমির প্রতি মানুষের যে স্বাভাবিক ভালোবাসা থাকে, তা তাঁর ও মুহাজেরদের ছিলোনা। মক্কা থেকে বিদায় হওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন! “হে মক্কা, পৃথিবীতে তুমি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান। কিন্তু উপায় কি, তোমার অধিবাসীরা আমাকে এখানে থাকতে দিলোনা।” হযরত বিলাল যখন মদীনায় গিয়ে অসুস্থ হলেন, তখন মক্কার প্রতিটি জিনিসের কথা স্মরণ করেন। তাঁর আবৃত্তি করা কবিতার নিম্ন লিখিত লাইন কয়টি আজও প্রসিদ্ধ:
“হায়, যদি জানতে পারতাম, আর কোনোদিন ফাখ্ নামক জায়গায় রাত কাটাতে পারবো কিনা, যেখানে আমার পাশে সুগন্ধীযুক্ত আযখার ঘাষ এবং বাবুনার চারাগাছগুলো শোভা পাবে। আর আমি কোনোদিন মাজাতার [জায়গার নাম] ঘাটেও উপস্থিত হতে পারবো কিনা, যেখান থেকে শামা নামক পাহাড় ও তোফায়েল নামক জায়গা দেখা যাবে।”
কিন্তু তথাপি তাঁদের দেশপ্রেম তাদেরকে ইসলামের খাতিরে দেশত্যাগে বিরত রাখতে পারেনি। [“দেশপ্রেম ঈমানের অংগ” এইমর্মে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি বানোয়অট হাদীস বর্ণিত আছে। আসলে এধরনের কোনো বিশুদ্ধ হাদীস রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত নেই।]
আনসারদের দৃষ্টান্ত
অপরদিকে মদীনার অধিবাসীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং মুহাজেরদেরকে সাদরে গ্রহণ করলো। তাঁরা তাঁদের জানমাল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে পেশ করে দিলো। এ কারণেই হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, “মদীনা কুরআন দ্বারা বিজিত হয়েছে।” রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার ও মুহাজেরগণকে পরস্পরের ভাই বলে ঘোষণা করলে তাঁরা এমন ভাই ভাই হলেন যে, দীর্ঘদিন যাবত তারা একে অপরের উত্তরাধিকার পেতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করলেন:
“রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়রা উত্তরাধিকার লাভের ব্যাপারে পরস্পরের অধিকতর হকদার।”
এই আয়াত নাযিল করে এই উত্তরাধিকার বন্ধ করে দেন। আনসারগণ নিজেদের ক্ষেত ও বাগান পর্যন্ত অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে আপন মুহাজের ভাইদেরকে প্রদান করেন। এমনকি যখন ইহুদী গোত্র দ্বারা বনুনাযীরের ভূসম্পত্তিসমূহ হস্তগত হলো, তখন তাঁরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, “এসব জমিও আমাদের মুহাজের ভাইদের দিয়ে দিন।” এই ত্যাগ ও কুরবানীর প্রশংসা করেই আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“তারা স্বয়ং অভাবী হওয়া সত্ত্বেও অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আওফ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত সা’দ বিন রবীয়া আনসারীর মধ্যে যখন দীনী ভ্রাতৃত্বের চুক্তি সম্পাদন করা হলো, তখন হযরত সা’দ তার দীনী ভাইদের জন্য সম্পত্তির অর্ধেক দিলেন এবং নিজের স্ত্রীদের মধ্য থেকে একজনকে তালাক দিয়ে তার সাথে বিয়ে দিতেও প্রস্তুত হয়ে গেলেন। রিসালাত যুগের পর যখন মুহাজিরগণ একের পর এক খিলাফতের পদ অলংকৃত করতে লাগলেন, তখন কোনো মদীনাবাসী একথা বলেনি যে, তোমরা বহিরাগতরা কোন্ অধিকারে আমাদের দেশ শাসন করছো? এমনকি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং দ্বিতীয় খলীফা ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন মদীনার আশপাশে মুহাজেরদেরকে ভূসম্পত্তি বরাদ্দ করেন। তখনও কোনো আনসারী টু শব্দটিও করেনি।
ইসলামী সম্পর্কের জন্য পার্থিব সম্পর্কের কুরবানী
বদর যুদ্ধে ও ওহুদ যুদ্ধে মক্তা থেকে আগত মুহাজিরগণ ইসলামের জন্য আপন আত্মীয় স্বজনের সাথে যুদ্ধ করেন। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজের ছেলে আব্দুর রহমানের ওপর তরবারী উত্তোলন করেন। হুযায়ফা নিজের পিতা আবু হুযায়ফাকে আক্রমণ করেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজের মামাকে হত্যা করেন। স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আব্বাস, চাচাতো ভাই আকীল ও জামাতা আবুল আ’স বদরে যুদ্ধবন্দী হন এবং তাদেরকে সাধারণ কয়েদীদের মতো রাখা হয়। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুতো সকল বন্দীকে হত্যা করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রত্যেক মুসলমান নিজ নিজ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে নিজ হাতে হত্যা করুক- এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
মক্কা বিজয়ের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভিন্ন গোত্র ও ভিন্ন এলাকার লোকদেরকে নিয়ে নিজ মাতৃভূমির ওপর হামলা চালান এবং বহিরাগতদের হাতে কতিপয় মক্কাবাসীকে হত্যা করান। কোনো ব্যক্তি নিজ গোত্র ও নিজ মাতৃভূমির ওপর অপর গোত্রের লোকজন দিয়ে আক্রমণ করাবে, আর তাও কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ কিংবা প্রাপ্য ভূমি সহায় সম্পদ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে নয় বরং নিছক একটি সত্যের কলেমা ও আদর্শের খাতিরে। এটা তৎকালীন আরব জনগণের কাছে একেবারেই অভাবনীয় ব্যাপার ছিলো। যখন কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্রের গুন্ডাপান্ডারা মারা যেতে লাগলো, তখন আবু সুফিয়ান মিনতি জানালো যে, “হে রসূল! কুরাইশ বংশের তরুণ প্রজন্ম নিহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আজকের পর আর কুরাইশ বংশের নাম নিশানা থাকবেনা।” এ কথা শুনে দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষণাত মক্কাবাসীকে নিরাপত্তা দান করলেন। আনসারগণ ভাবলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের গোত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। তাদের কেউ কেউ বললো: “রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো মানুষই। নিজের গোষ্ঠী গোত্রের প্রতি মায়ামমতা তো দেখাবেনই।” এসব কথা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কানে গেলো। তিনি আনসারদেরকে সমবেত করে বললেন! “নিজ গোত্রের ভালোবাসা আমাকে কখনো আকৃষট করেনি। আমি আল্লাহর বান্দা ও রসূল। আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হিজরত করে তোমাদের কাছে চলে এসেছি। এখন আমার বাঁচা মরা সবই তোমাদের সাথে হবে।” রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বলা এই কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্য করে দেখালেন। যে কারণে তিনি হিজরত করেছিলেন, মক্কা বিজয়ের পর সে কারণ আর অবশিষ্ট ছিলোনা। কিন্তু তবুও তিনি মক্কায় থেকে যাননি, এ দ্বারা এ কথাও প্রমাণিত হয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো প্রতিশোধমূলক মনোভাব বা মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের আবেগ নিয়ে মক্কার ওপর আক্রমণ চালাননি, বরং তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো শুধুমাত্র আল্লাহর কালেমাকে তথা তাঁর দীনকে বিজয়ী করা।
এরপর যখন হাওয়াযেন ও সাকীফ গোত্রদ্বয়ের জমি ও সহায়সম্পদ মুসলমানদের দখলে এলো, তখন পুনরায় সেই একই ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনীমত হিসেবে প্রাপ্ত সম্পদের বেশীর ভাগ কুরাইশ বংশের নওমুসলিমদেরকে দিলেন। আনসারদের কতক তরুণ মনে করলেন, এসব কিছু নিজ গোত্রের লোকদেরকে খুশী করার জন্য করা হচ্ছে। তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে বললন! “আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাফ করুন। তিনি কুরাইশদেরকে দান করেন আর আমাদেরকে বঞ্চিত করেন। অথচ এখনো আমাদের তরবারী থেকে তাদের রক্ত ঝরছে।” একথা জানতে পেরে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার তাদেরকে ডেকে একত্রিত কররেণ এবং বললেন:
“আমি তাদেরকে এজন্য বেশী দিচ্ছি যে, তারা নতুন নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছে। শুধু তাদের মনকে প্রীত করাই আমার উদ্দেশ্য। তোমরা কি এতে খুশী নও যে, এরা দুনিয়ার সম্পদ নিয়ে যাক, আর তোমরা আল্লাহর রসূলকে নিয়ে যাও?”
বনুল মোস্তালিক যুদ্ধে গিফারী গোত্রের জনৈক মুসলিম এবং আওফী গোত্রের অপর এক মুসলিম যুবকের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়ে গেলো। উত্তেজনার এক পর্যায়ে গিফারী আওফীকে থাপ্পর মেরে বসলো। এতে আওফী আনসারদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকলো, আর গিফারী ডাকলো মোহাজেরদেকে। দু’পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্শের আশংকা দেখা দিল। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পেরে উভয়পক্ষকে ডেকে বললেন, “তোমরা এ কি ধরনের জাহেলী ধাঁচের ডাকাডাকিতে লিপ্ত হয়ে গেলে?” সাহাবীরা বললেন, “জনৈক মোহাজর জনৈক আনসারীকে প্রহার করেছে।” রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাই বলে জাহেলিয়অতের রীতি অনুসারে গোষ্ঠী গোত্রের নাম ধরে ডাকাডাকি করোনা। এটা বড়ই ঘৃণ্য রীতি।”
এই যুদ্ধে মদীনার নামকরা জাতীয়তাবাদী নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইও অংশ গ্রহণ করেছিলো। সে যখন শুনলো, মুহাজের পক্ষের লোক আনসার পক্ষের লোককে মেরেছে, তখন সে আনসার পক্ষকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য বললো! “এই মোহাজেররা আমাদের দেশে এসে আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। এখন আমাদের সামনেই মাথা তুলছে। ওরা প্রবাদবাক্যের সেই কুকুরের মতো, যাকে খাইয়ে দাইয়ে মোটাতাজা বানানো হয়েছিলো যাতে সে তার মনিবকেই ছিড়েভুরে খেতে পারে। খোদার কছম, মদীনায় ফিরে যাওয়ার পর আমাদের মধ্যে যারা প্রভাবশালী, তারা দুর্বলদেরকে ওখান থেকে বের করে দেবে।” তারপর সে আনসারদেরকে বললো: “তোমাদের কি এমন ঠেকা পড়েছিলো যে ওদের নিজেদের দেশে আশ্রয় দিলে এবং নিজেদের ধনসম্পদ তাদেরকে বন্টন করে দিলে? আল্লাহর কছম, তোমরা যদি আজ ওদের সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করে দাও, তবে ওরা শুধু বাতাস খেয়ে বেড়াবে।” এসব কথা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কানে গেলে তিনি তার পুত্র হযরত আব্দুল্লাহকে জানালেন, তোমার বাবা এসব কথা বলে বেড়াচ্ছে। হযরত আব্দুল্লাহ তাঁর পিতাকে এতোই ভালোবাসতেন, তিনি গর্ব করে বলতেন, খাজরাজ গোত্রে কোনো ছেলে তার বাবাকে তাঁর মতো ভালোবাসেনা। কিন্তু এই ঘটনা শুনে তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “হে আল্লাহর রসূল! আপনি আদেশ দেনতো এক্ষুনি ওর মাথা কেটে আনি।” রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: না। তথাপি যুদ্ধ থেকে মদীনায় ফির এসে হযরত আব্দুল্লাহ নিজের পিতার সামনে খোলা তলোয়ার নিয়ে দাড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, “রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত তোমাকে মদীনায় ঢুকতে দেবোনা। তুমি বলেছো, প্রভাবশালীরা দুর্বলদেরকে মদীনা থেকে বের করে দেবে। এখন তুমি জানতে পারবে, যাবতীয় প্রতাব ও মানসম্মান শুধু আল্লাহ ও তাঁর রসূলের।” এই পরিস্থিতিতে ইবনে উবাই এই বলে চেচাঁমেচি শুরু করে দিলো যে, “ওহে খাজরাজ গোত্র! দেখো, আমার ছেলে আমাকে বাড়ীতে ঢুকতে দিচ্ছেনা।”সাধারণ মুসলমানরা এসে হযরত আব্দুল্লাহকে অনেক বুঝালেন। কিন্তু তিনি বললে: “রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি ছাড়া সে মদীনার ছায়ার নিচেও আশ্রয় নিতে পারবেনা।” অবশেষে লোকেরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হয়ে ঘটনার কথা জানালে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “তোমরা আব্দুল্লাহকে বলো সে যেনো তার বাবাকে বাড়ীতে ঢুকতে দেয়।” আব্দুল্লাহ এ আদেশ শুনে তরবারী রেখে দিয়ে বললেন,! “রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আদেশ দিয়েছেন তখন সে যেতে পারে।” [এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তাফসীরে ইবনে জারীরে (২৮শ খণ্ড, ৬৬-৭০ পৃঃ) দেখুন।]
বনু কাইনুকা নামক ইহুদী গোত্রের ওপর যখন হামলা করা হলো, তখন হযরত উবাদা ইবনুস সামিতকে তাদের ব্যাপারে শালিশ মানা হলো। তিনি সমগ্র ইহুদী গোত্রটিকে মদীনা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিলেন। বনু কাইনুকা গোত্র হযরত উবাদার গোত্র খাজরাজের মিত্র ছিলো। কিন্তু তিনি এই সম্পর্কের কোনো তোয়াক্কা করলেননা। অনুরূপভাবে বনু কুরাইযার ব্যাপারে হযরত সা’দ বিন মায়া’যকে শালিশ মানা হয়। আওস গোত্রের সরদার সা’দ বিন মায়া’য আদেশ দিলেন, বনু কুরায়যার সকল পুরুষকে হত্যা, সকল নারী ও শিশুকে যুদ্ধবন্দী এবং তাদের সমস্ত ধনসম্পদ গনীমত হিসেবে বাজেয়াপ্ত করা হোক। এক্ষেত্রে বনু কুরায়াযা ও আওস গোতের মধ্যে যে দীর্ঘস্থায়ী মৈত্রীর সম্পর্ক ছিলো, তার প্রতি তিনি কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলেননা। অথচ তৎকালীন আরব সমাজে মৈত্রীর গুরুত্ব কিরূপ ছিলো তা সবার জানা। তাছাড়া ইহুদী গোত্র বনু কুরায়াযা মদীনায় শত শত বছর যাবত আনসারদের প্রতিবেশীও ছিলো।
ইসলামী জাতীয়তাবাদ আসল প্রাণশক্তি
উল্লিখিত উদাহরণসমূহ থেকে একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে জানা যাচ্ছে যে, ইসলামী জাতীয়তা বিনির্মাণে বংশ,বর্ণ, ভাষা ও বাসভূমির আদৌ কোনো অবদান নেই। যে নির্মাতা এই প্রাসাদের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করেছেন, তার চিন্তা ও পরিকল্পনা সারা দুনিয়ার চিন্তাধারা থেকে ভিন্ন ও অভিনব। তিনি সমগ্র মনুষ্যজগতের কাঁচা মালের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন এবং যেখানে যেখানে উত্তম ও মজবুত মালমশলা পেয়েছেন সেখান থেকে তা বাছাই করে নিয়েছেন। এসব বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে যে জিনিস দ্বারা পরস্পরের সাথে গেঁথে পাকাপোক্ত করেছেন তা হচ্ছে আমলে সালেহ ত থা সৎকর্ম ও নির্মল চরিত্ররূপী মজবুত চুন। এভাবে তিনি এমন এক বিশ্বজোড়া জাতীয়তাবার প্রাসাদ তৈরী করলেন, যাসমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত। এই সুবিশাল প্রাসাদকে স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে বর্ণ, বংশ, উৎপত্তির উৎস ও বাসস্থান নির্বিশেষে এর সকল অংশকে নিজ নিজ পৃথক উৎপত্তির উৎসগুলোকে ভুলে গয়ে একটি মাত্র উৎসকে মনে রাখতে হবে। নিজেদের পৃথক পৃথক বর্ণকে ভুলে গিয়ে একটি মাত্র রং-এ রঞ্চিত হতে হবে এবং নিজেদের আলাদা আবাসভূমিকে ভুলে গিয়ে একটি মাত্র সত্যের আবাসে প্রবেশ করতে হবে। এই আদর্শিক ঐক্যই এই শীষা ঢালা গাঁথুনির প্রাণ। এই ঐক্য যদি ভেংগে যায়, ইসলামী আদর্শিক জাতির অংশগুলোর মধ্যে যদি নিজেদের উৎপত্তি স্থলগুলোর বিভিন্নতা, প্রজাতিক ও বংশীয় ধারার বিভিন্নতা, নিজ নিজ আবাস ও জন্মস্থানের বিভিন্নতা, নিজেদের দেহের বর্ণ ও আকৃতির বিভিন্নতা এবং নিজেদের পার্থিব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের স্বাতন্ত্র্যের অনুভূতি জাগে, তাহলে এই প্রাসাদের দেয়ালে ফাটল ধরবে, এর ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাবে এবং এর সকল অংশ ছিন্ন ভিন্ন ও খান খান হয়ে ধ্বসে পড়বে। একটি সাম্রাজ্যে যেমন একাধিক সাম্রাজ্য বা একটি রাষ্ট্রে একাধিক রাষ্ট্র হওয়া সম্ভব নয়, তেমনি একটি জাতীয়তার মধ্যে কয়েকটি জাতীয়তার সৃষ্টি সম্ভব নয়। ইসলামী জাতীয়তার মধ্যে কয়েকটি জাতীয়তার সৃষ্টি সম্ভব নয়। ইসলামী জাতীয়তার অভ্যন্তরে বর্ণ, বংশ, ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক আলাদা আলাদা জাতীয়তার সমাবেশ একেবারেই অসম্ভব। এই দুই ধরনের জাতীয়তার যে কোনো একটিই টিকেক থাকতে সক্ষম। আল্লামা ইকবালের ভাষায়:
“বর্ণ, বংশ, ভাষা ও বাসভূমি ইত্যাদি ভিত্তিক জাতীয়তার পোশাক ইসলামী জাতীয়তার জন্য কাফন স্বরূপ।” সুতরাং যে ব্যক্তি মুসলমান আছে এবং মুসলমান থাকতে চায়, তাকে ইসলামী জাতীয়তা ছাড়া অন্যসব জাতীয়তার চেতনা প্রত্যাখ্যান এবং মাটি ও রক্তের সম্পর্কগুলোকে ছিন্ন করতেই হবে। এসব সম্পর্ককে যে বহাল রাখতে চায়, তার সম্পর্কে আমরা এটাই বুঝবো যে, তার হৃদয়ে ও অন্তরাত্মায় ইসলাম প্রবেশ করেনি। তার মনমগজে এখনো জাহেলিয়াত আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। আজ হোক কাল হোক, ইসলামকে সে বর্জন করবে এবং ইসলামও তাকে বর্জন করবেঃ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তিম উপদেশ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন জীবনের শেষভঅগে যে জিনিসটি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী আশংকায় ভুগতেন, তা ছিলো, মুসলমানদের ভেতরে জাহেলিয়াতসুলভ গোষ্ঠীপ্রীতি তথা ভাষা, বর্ণ, বংশ ও ভূমি ভিত্তিক বিভেদ বৈষম্য ও আভিজাত্যবোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কিনা এবং তার কারণে ইসলামী জাতীয়তার বিশ্বজোড়া প্রাসাদ ভেংগে খান খান হয়ে যায় কিনা? এ আশংকাবোধ করেই তিনি বারবার বলতেন:
“আমার পরে তোমরা আবার যেনো কুফরীতে লিপ্ত হ’য়ে পরস্পরে মারামারি কাটাকাটি শুরু না করে দাও।” [বুখারী]
জীবনের শেষ বিদায় হজ্জ্বে গিয়ে স্বীয় আরাফাতের ভাষণে সাধারণ মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে তিনি বলেন:
“শুনে নাও, জাহেলিয়াতের সকল জিনিস আজ আমার দুই পায়ের তলায় দলিত। অনারবের ওপর আরবের এবং আরবের ওপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তোমরা সবাই আদম সন্তান এবং আদম ছিলেন মাটির তৈরী। মুসলমান মুসলমানের ভাই এবং সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। জাহেলিয়াতের সকল দাবী রহিত করা হলো। এখন তোমাদের জান মাল ও সম্ভ্রম তোমাদের পরস্পরের জন্য ঠিক তেমনি হারাম, যেমন আজকের দিন এই মাস এবং তোমাদর এই শহর হারাম।”
এরপর তিনি মীনাতে গিয়ে আরো জোর দিয়ে এই ভাষণের পুনরাবৃত্তি করেন এবং এই কথাটা সংযোজন করেন!
“দেখো, আমার পরে তোমরা গোমরাহীতে প্রত্যাবর্তন করে পরস্পরকে হত্যা করতে লেগে যেওনা। অচিরেই তোমরা আপন প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে এবং তোমাদের কাছে তোমাদের কাজের হিসাব চাওয়া হবে। শোনো কোনো নাককাটা হাবশীকেও যদি তোমাদের আমীর বানিয়ে দেয়া হয় এবং সে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করে, তবে তার কথা শুনো এবং আনুগত্য করো।”
একথা বলার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি তোমাদেরকে আল্লাহর বিধান দিয়েছি?” সমবেত জনতা বললো: হাঁ, হে রসূল! তখন তিনি বললেন! “হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো।” জনতাকে বললেন, “যারা উপস্থিত হয়েছে, তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার এ বাণী পৌঁছে দিও।” [বুখারী, মুসলিম, সীরাতে ইবনে হিশাম]
হজ্জ থেকে ফিরে ওহদের শহীদদের গোরস্তানে গেলেন এবং সমবেত মুসলমানদের বললেন:
আমি এ আশংকা করিনা যে, আমার পরে তোমরা পৌত্তলিকতায় লিপ্ত হবে, কেবল এই ভয় পাই যে, তোমরা দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে যাও কিনা এবং পরস্পরে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হও কিনা। এরূপ করলে তোমরা ধ্বংস হ’য়ে যাবে যেমন পূর্ববর্তী জাতিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইসলামের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক বিপদ
যে মারাত্মক বিপদটি সম্পর্কে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশংকা বোধ করেছিলেন, তা বাস্তবিক পক্ষেই দেখা দিয়েছিলো এবং তা যেমন ধ্বংসাত্মক হবে বলে তিনি পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন, তেমনি ধ্বংসাত্মকও প্রমাণিত হয়েছিলো। প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর যে বিপর্যয়ই এসেছে, এর কারণেই এসেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের মাত্র কয়েক বছর পরই হাশেমী ও উমাভী গোষ্ঠীবাদের ভয়াবহ সংঘাতময় পুনরুত্থান ঘটলো এবং তা ইসলামের আসল রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অবকাঠামোকে চিরদিনের জন্য বিদ্ধস্ত করে দিলো। তারপর পুনরায় আরবীয়, অনারবীয় এবং তুর্কী আঞ্চলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আকারে আবির্ভূত হলো এবং তা ইসলামের রাজনৈতিক ঐককে ধ্বংস করে দিলো। এরপর বিভিন্ন দেশে যেসব মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সেগুলোর ধ্বংসের মূলেও এই একই বিভ্রান্তিকর মতবাদ সক্রিয় ছিলো। সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বড় দুটো মুসলিম সাম্রাজ্য ছিলো ভারতে ও তুরস্কে। এই দুটো সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করেছিলো ভৌগলিক, বংশীয়, বর্ণগত ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। ভারতে মোগল ও ভারতীযদের পারস্পরিক বিদ্বেষ এবং তুরস্কে তুর্কী, আরব ও কুর্দী কোন্দল সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়।
ইসলামের সমগ্র ইতিহাস পড়ে দেখুন। যেখানেই কোনো শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্য আপনি দেখবেন, তার ভিত্তি বর্ণ বংশ নির্বিশেষে বিভিন্ন জাতির রক্তের ওপর গড়ে উঠেছে। সেসব সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা, সেনাপতি, লেখক, সৈনিক, সবই ছিলো বিবিধ অঞ্চল ও বিবিধ ভাষা, বংশ ও বর্ণের মানুষ। আপনি দেখতে পাবেন ইরাকের মানুষ আফ্রিকায়, সিরিয়ার মানুষ ইরানে এবং আফগানিস্তানের মানুষ ভারতে অবিকল সেই ধরনের সততা, নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা নিয়ে মুসলিম সরকার সমূহের প্রাণপন সেবায় নিয়োজিত, যা নিয়ে তারা নিজ দেশের সরকারের সেবা করতো। মুসলিম সাম্রাজ্য ও রাষ্ট্রসমূহ কখনো নিজের জনশক্তি সংগ্রহে কোনো একটি দেশ বা একটি প্রজাতির ওপর নির্ভরশীল থাকতোনা। সকল জায়গা থেকে দক্ষ হাত ও প্রতিভাধর মস্তিষ্ক মুসিলম শাসকদের কাছে সমবেত হতো। তারা প্রত্যেক মুসলিম দেশকে নিজেদের দেশ মনে করতো। কিন্তু যখন স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বজাতিপ্রীতি ও গোষ্ঠীবিদ্বেষের ন্যায় বিপজ্জনক প্রবণতা ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের উদার ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবরেত বর্ণ বংশ ও ভূমিকেন্দ্রিক বৈষম্য ও সংকীর্ণতার উদ্ভব ঘটলো তখন পরস্পরকে ঘৃণা ও হিংসা করা শুরু হলো। দলাদলি, কোন্দল ও ষড়যনেত্রর প্রসার ঘটলো এবং যে শক্তি ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে ব্যয়িত হতো তা পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যয়িত হতে লাগলো। এক পর্যায়ে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের বিস্তার ঘটলো এবং মুসলিম শক্তিগুলো পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হ’য়ে গেলো।
পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ
পাশ্চাত্যের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে সকল দেশের মুসলমানরা আজ বংশীয়, ভৌগলিক, ভাষাভিত্তিক ও বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আওয়ায তুলছে। আরবরা তাদের আরবীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করছে। মিশরীয়দের মনে পড়ছে তাদের ফেরাউনদের কথা। তুর্কীরা তাদের তুর্কী ঐতিহ্য নিয়ে এতো মেটে উঠেছে যে, চেংগীজ ও হালাকু খানের সাথে নিজেদের যোগসূত্র স্থাপন করছে। ইরানীরা ইরানী হওয়ার আবেগে বলে বেড়াচ্ছে যে, আমাদের আসল জাতীয় হিরো তো ছিলো রুস্তম ও ইসফেন্দিয়ার। কিন্তু আরব সাম্রাজ্যবাদ জোর করে হোসেন রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে আমাদের হিরো বানিয়ে দিয়েছে। ভারতেও এমন মুসলমান জন্ম নিচ্ছে, যারা ভারতীয জাতীয়তাবাদের সাথে নিজেদের সংযোগ ঘটাতে তৎপর। এখানে এমন মুসলমানও আছে যারা যমযমের পানির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে গংগার পানির ভক্ত হতে চায়। এমন লোকও রয়েছে, যারা ভীম ও অর্জুনকে নিজেদের জাতীয় হিরো বানাতে ইচ্ছুক। এখানে এমন মুসলমানও রয়েছে যারা ভুলেও মক্তা মদীনাকে মনে করেনা, কিন্তু তক্ষশীলা, মহেনজোদারো ও হরপ্পার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে রাত দিন ব্যাকুল থাকে। কিন্তু এসব কিছু শুধু এজন্য হচ্ছে যে, এইসব মূর্খ লোকেরা নিজেদের সভ্যতাতেও চেনেনি। পাশ্চাত্য সভ্যতাকেও চেনেনি। উভয় সভ্যতার নিগুঢ় তত্ত্ব ও তথ্য তাদের চোখের আড়ালে রয়েছে। তারা নিছক বাহ্যদর্শী। বহিরাচরণে যে রেখাগুলো তাদের চোখে অধিকতর দর্শনীয় ও চমকপ্রদ মনে হয়, তার ওপরই তারা লুটিয়ে পড়তে থাকে। তারা একেবারেই জানেনা যে, পাশ্চাত্য জাতীয়তার জন্য যা অমৃত, ইসলামী জাতীযতাতর জন্য তা বিষতুল্য। পাশ্চাত্য জগতে বংশ, বর্ণ, ভাষা ও জন্মভূমিভিত্তিক জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত। তাই ভিন্ন গোত্র, ভিন্ন বংশ ও ভিন্ন ভাষার মানুষকে এড়িয়ে চলতে প্রত্যেকেই বাধ্য, চাই সে মানুষটি তার সীমান্ত থেকে মাত্র একমাইল দূরত্বেই অবস্থান করুক না কেনো। সেখানে এক জাতির মানুষ অন্য জাতির নিষ্ঠাবান সদস্য হতে পারে না। কোনো জাতি কোনো ভিন্ন জাতির লোকের ওপর আস্থা রাখতে পারেনা যে, সে নিজ জাতির স্বার্থের চেয়ে তাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু ইসলামী জাতীযতার ব্যাপারে ঠিক এর বিপরীত। এখানে জাতীযতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে জন্মভূমি ও বংশের পরিবর্তে বিশ্বাস ও কাজের তথা চরিত্রের ওপর। সারা দুনিয়ার মুসলমানরা পরস্পরের সহযোগী ও সুখ দুঃখের অংশীদার- তার জাতিগত পরিচয় যাই হোক না কেন। একজন ভারতীয় মুসলমান ভারতের যেমন বিশ্বস্ত নাগরিক, তেমনি মিশরেরও বিশ্বস্ত নাগরিত হতে পারে। একজন আফগান খোদ আফগানিস্তানের জন্য যেরূপ জীবনপণ যুদ্ধ করতে পারে, সিরিয়ার প্রতিরক্ষার জন্যও তদ্রুপ যুদ্ধ করতে পারে। তাই এক দেশের মুসলমানের সাথে আরেক দেশের মুসলমানের কোনো ভৌগলিক ও প্রজাতিক ভেদ বৈষম্যের কোনো কারণ নেই। এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি ও প্রজাতিক ভেদ বৈষম্যের কোনো কারণ নেই। এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি পাশ্চাত্যের মূলনীতির একেবারেই বিপরীত। ওখানে যা সবলতার উপকরণ, এখানে তা দুর্বলতার উপকরণ। এখানে যা জীবনী শক্তির উজ্জীবক, ওখানে তা প্রাণবিনাশী হলাহল। আল্লামা ইকবালের ভাষায়:
“পাশ্চাত্য জাতিগুলোর সাথে নিজের জাতির তুলনা করোনা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে গড়া এ জাতির গঠন প্রণালীটাই ভিন্ন রকমের। বংশ ও দেশের ওপর পাশ্চাত্যের জাতীযতা নির্ভরশীল, কিন্তু তোমার জাতীয়তা ধর্মের শক্তিতেই শক্তিমান।”
অনেকে এরূপ ভুল ধারণায় লিপ্ত আছে যে, ভৌগলিক বা বংশীয় জাতীয়তার চেতনা জাগ্রত হওয়ার পরও ইসলামী জাতীয়তার বন্ধন মুসলমানদের মধ্যে অটুট থাকতে পারে। এজন্য এই উভয় প্রকারের জাতীয়তা পাশাপাশি চলবে বলে তারা আত্মপ্রতারণায় লিপ্ত। তাদের ধারণা, দুটো একসাথে চলতে থাকলে একটি অন্যটি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেনা, অধিকন্তু আমরা উভয়টির সুফল লাভ করবো। কিন্তু এ ধারণা নিছক অজ্ঞতা ও অপ্রতুল চিন্তার ফসল। আল্লাহ যেমন এক বুকেট দুটো হৃদয় স্থান করেননি। তদ্রুপ তিনি একই হৃদয়ে এক সাথে দুটো জাতীয়তার পরস্পর বিরোধী ও পরস্পর সংঘর্ষমুখর আবেগকে একত্রিত করার অবকাশও রাখেননি। জাতীয়তার অনুভূতির অনিবার্য ফল আপন পরের বিভেদ ও বৈষম্য। ইসলামী জাতীয়তার চেতনার স্বতস্ফূর্ত দাবী এই যে, মুসলমানকে আপন ও অমুসলিমকে পর মনে করা হবে। আর দেশভিত্তিক বা বংশভিত্তিক জাতীয়তার অনুভূতির স্বাভাবিক দাবী হলো, আপনি স্বদেশী ও স্বগোত্রীয়কে আপন এবং বিদেশী ও ভিন্ন গোত্রের বা বংশের লোককে পর মনে করবেন। এমতাবস্থায় এই দুটো অনুভূতি বা চেতনা কিভাবে একই জায়গায় এক সাথে সমবেত হতে পারে, তা কোনো বুদ্ধিমান ব্যাখ্যা করুক তো দেখি। এটা কিভাবে সম্ভব যে আপনি অমুসলিম স্বাদেশীকে আপনও ভাববেন, পরও ভাববেন আর বিদেশী মুসলমানকে এড়িয়েও চলবেন আবার তার ঘনিষ্ঠও হবেন? এই দুটো কি আদৌ একত্রিত হতে পারে? এরূপ বিপরীতমুখী চিন্তার অধিকারীদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আপনাদের মধ্যে একজনও কি সুস্থমনা লোক নেই?
সুতরাং একথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, মুসলমানদের মধ্যে ভারতীয়, তুর্কী, আফগান, আরব, ইরানী ইত্যাদি হওয়ার অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার অর্থই হবে ইসলামী জাতীয়তার অনুভূতি ধ্বংস হওয়া এবং ইসলামী ঐক্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া। এটা শুধু যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয় বরং বহুবার এর বাস্তব দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে যখনই ভূীম বা দেশভিত্তিক কিংবা বংশভিত্তিক বৈষম্য ও বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠোছে, তখনই মুসলমানের হাতে মুসলমান গলাকাটা অবধারিত হয়ে উঠেছে এবং “আমার পরে তোমরা কুফরির দিকে প্রত্যাবর্তন করে একে অপরের হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়োনা” রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই শংকা সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। কাজেই জন্মভূমি বা দেশমাতৃকা কেন্দ্রিক জাতীয়তার প্রবক্তারা যদি এ জিনিসটির প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতেই চান, তাহলে তাদের জন্য এটাই উত্তম হবে যে, তারা যেনো নিজেদেরকে ও বিশ্ববাসীকে ধোকা না দেন। বরং যাই করেন একথা জেনে শুনেই যেনো করেন যে, জন্মভূমি কেন্দ্রিক জাতীয়তার দাওয়াত আর যাই হোক, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত নয়, বরং তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
২. ইসলামী জাতীয়তার প্রকৃত তাৎপর্য
সাম্প্রতিকাকালে মুসলমানদের সমাজের জন্য ‘কওম’ বা জাতি শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের সামষ্টিক অবস্থাকে প্রকাশ করার জন্য সাধারণভাবে এই পরিভাষাটি কার্যত চালু হয়ে গেছে। কিন্তু এটা একটা বাস্তবতা যে, কুরআনও হাদীসে মুসলমানদের জন্য ‘কওম’ শব্দটি [অথবা জাতি বা নেশন বুঝাবার মতো আর কোনো শব্দকে] পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি। তবে এ কথাও সত্য যে, কোনো মহল এ পরিস্থিতি থেকে নিজেদের অবৈধ উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করেছে। যাই হোক, এই পরিভাষাটিতে এমন কি অসুবিধা রয়েছে, যার জন্য ইসলামে এটিকে গ্রহন করা হয়নি এবং কুরআন ও হাদীসে এর বিকল্প কোন্ কোন্ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা আমি সংক্ষেপে আলোচনা করবো। এটা নিছক কোনো তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, বরং এর দ্বারা আমাদের জীবনটাকে যে মৌলিকভাবে ভ্রান্ত পথে চালিত করেছি, এমন কিছু ধ্যানধারণা স্পষ্ট হবে।
“কওম” শব্দটি এবং তার সমার্থক ইংরেজী শব্দ “নেশন” [Nation] বা জাতি মূলতঃ জাহেলিয়াতের ধ্যানধারণা থেকে উৎপন্ন অনৈসলামিক পরিভাষা। জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার ধারক বাহক ও প্রতিষ্ঠাতাগণ “কওমিয়াত” বা [Nationality] বা জাতীয়তাকে কখনো খাঁটি সাংস্কৃতিক ভিত্তিক [Cultural Basis] ওপর দাঁড় করায়নি। প্রাচীন জাহেলিয়াতের যুগেও নয়, আধুনিক জাহেলিয়াতের যুগেও নয়। তাদের মনমগজে বংশীয় ও ঐতিহ্যগত বন্ধনপ্রীতি এমনভাবে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছিলো যে, তারা জাতীয়তার ধারণাকে কখনো প্রজাতিক যোগসূত্র ও প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে মুক্ত করতে পারেনি। প্রাচীন আরবে যেমন ‘কওম’ শব্দটি দ্বারা সাধারণত একটি বংশধর বা একটি গোত্রকে বুঝানে হতো, তেমনি আজও “নেশন’ Nation শব্দটি দ্বারা যে মনোভাব প্রকাশ করা হয় তাতে একক প্রজন্ম বা Common Descent এর ধারণা অনিবার্যভাবেই অন্তর্ভুক্ত থাকে। আর এ জিনিসটা যেহেতু মৌলিকভাবে ইসলামী জাতীয়তার ধারণার পরিপন্থী, তাই কুরআনে “কওম” এবং তার সমার্থক অন্যান্য আরবী শব্দকে মুসলমানদের ক্ষেত্রে পরিভাষা হিসেবে প্রয়োগ করা হয়নি। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, যে মানবগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মূলে বর্ণ, বংশ, দেশ এবং এ ধরনের অন্যান্য জিনিসের আদৌ কোনো হাত ছিলোনা, যে দলকে শুধুমাত্র একটি আদর্শ ও জীবনবিধানের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ করা হয়েছিলো এবং যার সূচনাই হয়েছিলো হিজরত, বংশীয় বন্ধন ও অন্যান্য পার্থিব সম্পর্ক ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে, তার জন্য এমন শব্দ কিভাবে বা ব্যবহৃত হবে?
কুরআনে যে শব্দ মুসলমানদের সামষ্টিক সত্তার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, তাহলে “হিযব” বা দল। ‘কওম’ বা জাতির উৎপত্তি হয় জন্মসূত্রে ও বংশধর থেকে। কিন্তু দল গটিত হয় আদর্শ ও নীতির ভিত্তিতে। এদিক দিয়ে মুসলমানরা আসলে জাতি নয় বরং একটি দল। কেননা তাদেরকে শুধু এ কারণে সারা পৃথিবী থেকে স্বতন্ত্রভাবে পরস্পরের সাথে সংঘবদ্ধ করা হয়েছে যে, তারা একটা নির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী ও অনুসারী। আর এই নীতি ও আদর্শে যারা বিশ্বাসী ও অনুসারী নয়, তারা তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতম পার্থিব আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হলেও তারা তাদের আপনজন নয় এবং তাদের সাথে কোনো মিল নেই। কুরআনের দৃষ্টিতে পৃথিবীর গোটা মানব বসতির মাত্র দুটো দলই বিরাজ করে! একটি আল্লাহর দল হিযবুল্লাহ, অপরটি শয়তানের দল হিযবুশ শয়তান। শয়তানের দলে নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে যতোই পারস্পরিক বিরোধ থাকুক না কেন, কুরআন তাদের সকলকে একই দলভুক্ত মনে করে। কেননা তাদের চিন্তা ও কাজের ধরন আর যাই হোক ইসলাম নয় এবং খুঁটিনাটি মতভেদ সত্তেও তারা সকলেই শয়তানের আনুগত্যের ব্যাপারে একমত। কুরআন ব লে:
“শয়তান তাদের ওপর বিজয়ী হয়ে গেছে। তাই সে তাদেরকে আল্লাহর সম্পর্কে গাফেল ও উদাসীন করে দিয়েছে। তারা শয়তানের দল। জেনে রেখো, শয়তানের দল শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবেই।” [সূরা আল মুজাদালা : ১৯]
পক্ষান্তরে আল্লাহর দলের লোকেরা যখন আল্লাহর শেখানো চিন্তা ও কর্মের বিধান মেনে নিতে সম্মত ও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন তারা প্রকৃতপক্ষে খোদায়ী রজ্জুতে পরস্পরের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আল্লাহর দলভুক্ত হয়েছে এবং এই নয়া দলে প্রবেশ করা মাত্রই শয়তানের সাথে তাদের যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, চাই তারা জন্মগতভাবে যেকোনো বংশোদ্ভূত, যেকোনো দেশের অধিবাসী, যেকোনো ভাষাভাষী এবং যেকোনো ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক হোক না কেন, এসব ব্যাপারে তাদের পরস্পরে যতো বিভেধ পার্থক্য থাকুক না কেন, এমনকি তাদের বাপ দাদাদের মধ্যে চরম শত্রুতা থেকে থাকুক না কেন।
একজনের আল্লাহর দলভুক্ত হওয়া আর অপর জনের শয়তানের দলভুক্ত হওয়া যে দলগত ও আদর্শগত বিভেদ ঘটে, তা পিতা পুত্রের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। এমনকি পিতার উত্তরাধিকার থেকেও পুত্র বঞ্চিত হয়। হাদীসে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে:
“দুই ধর্মের অনুসারী পরস্পরের উত্তরাধিকারী হয়না।”
দলের তথা আদর্শের এই বিভিন্নতা স্ত্রীকে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এমনকি মতভেদ হওয়া মাত্রই উভয়ের মেলামেশা হারাম হয়ে যায়। এর কারণ শুধু এই যে, উভয়ের জীবন যাপনের পথ আলাদা হয়ে গেছে। কুরআনে বলা হয়েছে:
“স্ত্রীরাও স্বামীদের জন্য হালাল নয়, স্বামীরাও স্ত্রীদের জন্য হালাল নয়।” [সূরা মুমতাহিনা: ১০]
দলের এই বিভিন্নতা একই পরিবারের এবং একই বংশের বা গোত্রের লোকদের মধ্যে পুরোপুরি সামাজিক বয়কটের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয়। এমনকি আল্লাহর দলভুক্ত লোকের পক্ষে নিজের গোত্র ও বংশের মধ্যে যারা শয়তানের দলভুক্ত তাদের সাথে বিয়েশাদী করাও হারাম হয়ে যায়। কুরআন বলেছে:
“মুশরিক মহিলারা যতক্ষণ ঈমান না আনে তাদেরকে বিয়ে করোনা। মুমিন দাসী মুশরিক স্বাধীন মহিলার চেয়ে ভালো, চাই সে তোমাদের কাছে যতোই ভালো লাগুক না কেন। আর তোমাদের মেয়েদের মুশরিক পুরুষের সাথে বিয়ে দিওনা যতক্ষণ তারা ঈমান না আনে। মুমিন গোলাম মুশরিক স্বাধীন পুরুষের চেয়ে ভালো, সে তোমাদের কাছে যতই পছন্দনীয় হোক না কেন।” [সূরা আল বাকারা: ২২১]
দলের এই বিভিন্নতা ভৌগলিক ও বংশীয় সম্পর্ক শুধু ছিন্নই করেনা বরং উভয়ের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের সৃষ্টি করে দেয় এবং এই দ্বন্দ আল্লাহ্র দল বহির্ভূতরা এই দলের আদর্শ ও নীতি মেনে না নেয়া পর্যন্ত বহাল থাকে। কুরআন বলে:
“ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের [জন্মসূত্রীয়] জাতিকে বলেছিলো, তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব উপাস্যকে পূজা করে থাকো তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি এবং আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরদিনের জন্য শত্রুতা বিরাজ করছে যতক্ষণ না তোমর এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনবে। তবে ইবরাহীম যে তার কাফের পিতাকে বলেছিলো, ‘আমি তোমার ক্ষমার জন্য দোয়া করবো’, এতে কোনো আদর্শ নেই।” [সূরা মুহতাহিনা: ৪]
“ইবরাহীম যে নিজের পিতার গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করেছিলো তা ছিলো পিতাকে ইতিপূর্বে দেয়া একটি প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য। কিন্তু যখনই তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে তার পিতা আল্লাহর দুশমন, তখন সে ঐ দোয়া থেকে ফিরে এলো।” [সূরা আততাওবা: ১১৪]
দলের এই বিভিন্নতা একই পরিবারের লোকদের মধ্যে এবং ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়দের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক নিষিদ্ধ করে দেয়। এমন কি বাপ, ভাই কিংবা ছেলেও যদি শয়তানের দলভুক্ত হয়, তাহলে আল্লাহর দলভুক্তরা তার সাথে প্রীতি ভালোবাসা রাখলে আপন দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে বলে বিবেচনা করা হবে। কুরআনে বলা হয়েছে:
“তুমি এমন কখনো পবেনা যে, কোনো দল আল্লাহ্ ও আখেরাতের ওপর ঈমানও পোষণ করে আবার আল্লাহ্ ও তার রাসূলের দুশমনদের সাথে সন্ধুত্বও রাখে, চাই তারা তাদের বাপ, ছেলে, ভাই কিংবা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনই হোক না কেন। ….. এরাই আল্লাহর দলের লোক এবং জেনে রেখো, আল্লাহ্র দলই শেষ পর্যন্ত কল্যাণ লাভ করবে।” [সূরা মুজাদালা: ২২]
আল কুরআন মুসলমানদের জন্য অন্য যে শব্দটি ব্যবহার করেছে তা হলো ‘উম্মাহ’ এবং এটিও ‘দল’ বা ‘হিযব’ এরই সমর্থক। হাদীসেও এ শব্দের ব্যবহার হয়েছে। উম্মাহ্সেই দল বা সংঘকে বলে যা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছে। যারা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সমভাবে অংশীদার তাদেরকেও উম্মাহ বলা হয়ে থাকে। যেমন কোনো বিশেষ যুগের লোকদের ‘উম্মাহ’ বলা হয়। কোনো বিশেষ দেশের অধিবাসী এবং কোনো একটি প্রজন্মকেও উম্মাহ বলা হয়ে থাকে। মুসলমানদের যে বিষয়ে সম অংশীদারিত্বের জন্য উম্মাহ্ বলা হয়, তা কোনো প্রজন্ম, মাতৃভূমি বা অর্থনৈতিক লক্ষ্য নয় বরং তাদের জীবনের উদ্দেশ্য এবং তাদের দলের নীতি ও আদর্শ। কুরআন বলছে:
“তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম উম্মাহ, যাদেরকে মানবজাতির কল্যাণের জন্য তৈরী করা হয়েছে তোমরা সৎ কাজের আদেশ দিবে, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান রাখচে।” [সূরা আলে ইমরান: ১১০]
“এভাবে আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মাহ্ বানিয়েছি, যেনো তোমরা মানবজাতির তত্ত্বাবধায়ক হও এবং রসূল তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক হয়।” [সূরা আল বাকারা: ১৪৩]
উপরোক্ত আয়অতগুলো নিয়ে ভাবুনস। “মধ্যপন্থী উম্মাহ্” দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, “মুসলমান” একটা আন্তর্জাতিক দলের [International Party] নাম। পৃথিবীর সকল জাতির মধ্য থেকে সেই লোকগুলোকে বেছে বের করে এই দল গঠন করা হয়েছে, যারা একটা বিশেষ আদর্শ ও নীতিমালা মেনে চলতে, একটা বিশেষ কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করতে এবং একটা নির্দিষ্ট মিশন বা ব্রত সম্পন্ন করতে প্রস্তুত। যেহেতু এই লোকগুলো সকল জাতির মধ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছে এবং একটা দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর অন্য কোনো জাতির সাথে তাদের সম্পর্ক নেই, তাই তারা মাঝখানের উম্মাহ্। কিন্তু প্রত্যেক জাতির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর সকল জাতির সাথে তাদের অন্য একটা সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে এবং সেটি হলো, তাদেরকে দুনিয়াতে আল্লাহর আইন চালু করতে হবে। “তোমরা মানবজাতির তত্ত্বাবধায়কঃ কথাটা দ্বারা বুঝা হচ্ছে যে, মুসলমানরা আল্লাহর দুনিয়াতে আল্লাহর নিযুক্ত রক্ষী বা পাহারাদার। “মানব জাতির কল্যাণের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে” কথাটার স্পষ্ট বক্তব্য হলো, মুসলমানদের মিশন সারা পৃথিবী জোড়া মিশন। এই মিশনের সংক্ষিপ্ত সার হলো, আল্লাহর দলের নেতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তায়ালা চিন্তা ও কর্মের যে বিধান দিয়েছিলেন, তাকে সকল মানসিক, নৈতিক ও বস্তুতগত শক্তি প্রয়োগ করে দুনিয়াতে বাস্তবায়িত করতে হবে এবং তার মোকাবিলায় অন্যসকল নীতি, আদর্শ ও বিধানকে পর্যুদস্থ ও পরাভূত করতে হবে। এই হলো সেই কাজ যা সম্পাদনের জন্য মুসলমানদের একটি উম্মাহ্ হিসেবে গঠন করা হয়েছে।
তৃতীয় যে পরিভাষাটি মুসলমানদের সামষ্টিক অবস্থা ও পদমর্যাদাকে বুঝানোর জন্য প্রায়ই ব্যবহার করা হয়েছে, তাহলো “জামায়াত”। এটি ‘হিযব’ শব্দটির মতো দল বা পার্টির সমার্থক। বহু হাদীস পর্যালোচনা করলে মনে হয় যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছাকৃত ভাবেই ‘কওম’ বা শা’য়াব [জাতি] বা অনুরূপ অর্থবোধক শব্দগুলো প্রয়োগ করা থেকে বিরত থেকেছেন এবং তার পরিবর্তে ‘জামায়াত’ শব্দটাই পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি কখনো বলেননি যে, “সর্বদা ‘কওমের’ সাথে থাকো” বা “আল্লাহর হাত কওমের ওপর থাকে।” বরং এ ধরনের প্রতিটি কথায় তিনি ‘জামায়াত’ শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। এর একমাত্র কারণ হলো, মুসলমানদের সংঘবদ্ধতা বা সমাজবদ্ধতার ধরনটি বুঝতে “কওম” [বা জাতির] তুলনায় ‘জামায়াত’ ‘হিযব’ এবং ‘উম্মাহ’ [তথা পার্টি বা দলই] অধিকতর উপযোগী। ‘কওম’ শব্দটা সাধারণভাবে যেসব অর্থে ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে, সে অনুসারে কোনো ব্যক্তি যেকোনো আদর্শ, বা নীতির অনুসারী হোক না কেন, সর্বাবস্থায় একটা কওম বা জাতির অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, যদি সে সেই কওমে বা জাতিতে জন্ম নিয়ে থাকে এবং নিজের নাম, জীবন যাপন প্রণালী ও সামাজিক সম্পর্কের দিক দিয়ে সেই কওম বা জাতির সাথে সংযুক্ত থাকে। কিন্তু জামায়াত, হিযব বা পার্টি এই শব্দগুলোর অর্থ পর্যালোনা করলে বুঝা যায়, শুধুমাত্র নীতি বা আদর্শই পার্টিতে বা দলে শামিল থাকেনা থাকার আসল মাপকাঠি। আপনি একটা দলের নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর কখনো সেই দলে থাকতে পারেননা। ঐ দলের নামও ব্যবহার করতে পারেননা। তার প্রতিনিধিও হতে পারেননা, তার স্বার্থের তদারককারী হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারেননা। সে দলের লোকদের সাথে আপনার কোনো সহযোগিতার সম্পর্কও থাকতে পারেনা। আপনি যদি বলেন, দলের নীতি ও আদর্শের সাথে আমি তো একমত নই, তবে আমার মাতাপিতা এ দলের সদস্য ছিলেন এবং আমার নামের সাথে এই দলের সদস্যদের নামের মিল আছে। তাই আমার ও দলের সদস্যদের সমান অধিকার থাকা উচিত। তাহলে আপনার এই যুক্তি এতটা হাস্রকর হবে যে, শ্রোতারা হয়তো আপনার মাথা ঠিক আছে নাকি খারাপ হয়ে গেছে, তা নিয়েই সংশয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু দলের অর্থকে জাতির অর্থ দ্বারা পাল্টে ফেলুন। এরপর এসব কথা আর আবোল তাবোল মনে হবেনা এসব কথা বলার অবকাশ সৃষ্টি হবে।
ইসাম তার আন্তর্জাতিক দলের সদস্যদের মধ্যে সংহতি ও একাত্মতা এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও আচরণে সমতা ও সামঞ্জস্য সৃষ্টির মাধ্যমে তাদেরকে একক সমাজে পরিণত করার আদেশ দিয়েছিলো যে, নিজেদের মধ্যেই বিয়েশাদী করো। সেই সাথে তাদের সন্তানদে জন্য শিক্ষাদীক্ষার এমন ব্যবস্থা নির্দেশ করেছিলো যে, তারা আপনা আপনি দলের নীতি ও আদর্শের অনুসারী হয়ে গড়ে উঠবে। প্রচারের পাশাপাশি বংশধর বৃদ্ধির মাধ্যমেও দলের শক্তি বাড়তে থাকবে। এখান থেকেই এ দলের জাতিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে এক সাথে সমাজবদ্ধ জীবন যাপন, প্রজাতিক সম্পর্ক ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ও ঐতিহ্য এই জাতীয়তাকে আরো শক্তিশালী করেছে।
এ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে ঠিকই হয়েছে। [একটি আদর্শবাদী দল স্বাভাবিক সামাজিক প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়ে জাতিতেও রূপান্তরিত হয়েছে এতে দোষের কিছু ছিলোনা।] কিন্তু ক্রমে ক্রমে মুসলমানরা এই সত্যটিই ভুলে যেতে থাকলো যে তারা আসলে একটা আদর্শবাদী দল এবং দল হিসেবেই তাদের জাতীয়তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। এই ভ্রান্তি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে পেতে এতোদূর গড়ালো যে, দলীয় ভাবধারা জাতীযতার ভাবধারায় একেবারেই বিলীন হয়ে গেলো। এ পর্যায়ে এসে মুসলমান শুধুই একটা জাতিতে পর্যবসিত হলো, অবিকল তদ্রুপ একটি জাতি, যেমন জার্মানরা, জাপানীরা ও ইংরেজরা এক একটা জাতি। তারা ভুলে গেছে যে, যে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ইসলাম তাদেরকে একটা উম্মাহ্ বানিয়েছিলো, সেই নীতি ও আদর্শই আসল জিনিস। যে দায়িত্ব বা মিশন সম্পাদনের জন্য ইসলাম তার অনুসারীদেরকে একটা দল বা পার্টি হিসেবে সংগঠিত করেছিলো, সেই দায়িত্ব ও মিশনই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। এই সত্যকে ভুলে গিয়ে তারা অমুসলিম জাতিগুলোর কাছ থেকে জাতীয়তার জাহেলী ধারণা গ্রহণ করেছে। এটি এমন মৌলিক ভ্রান্তি এবং এর কুফল এতো ব্যাপক বিস্তৃত যে, এ ভ্রান্তি দূর না করা পর্যন্ত ইসলামের পুনরুজ্জীবনে এক কদমও অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।
একটি দলের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, সাহায্য ও সহযোগিতা যাই হয়, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কারণে হয়না বরং শুধুমাত্র একই নীতি ও আদর্শের বিশ্বাস ও আনুগত্যের কারণে হয়ে থাকে। দলের কোনো সদস্য যদি দলীয় আদর্শ ও মূলনতি লংঘন করে, তাহলে দলের অন্যরে ওপর তাকে সাহায্য করাতো কর্তব্য থাকেইনা, উপরন্তু দলের এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকসুলভ বিদ্রোহাত্মক কর্মমাণ্ড থেকে তাকে নিষেদ করাই কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। নিষেধ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে দলীয় কার্যবিধি অনুসারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এরপরও যদি না মানে তবে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা উচিত। দুনিয়ায় এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে যে, যেব্যক্তি দলীয় নীতি ও আদর্শের মারাত্মক বিরুদ্ধাচরণ করে তাকে হত্যাও করা হয়। [একারণেই ইসলামে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়ে থাকে। রুশ সমাজতন্ত্রীরাও সমাজতন্ত্র ত্যাগীদেরকে এই শাস্তিই দিতো। বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন: “ইসলামে মুরতাদের শাস্তি” রচনা মাওলানা আবুল আ’লা মওদুদী। -সম্পাদক] কিন্তু মুসলমানদের অবস্থাটা একটু দেখুন যে, নিজেদেরকে আদর্শবাদী দলের পরিবর্তে জাতি অর্থাৎ জন্মসুত্রে সংঘঠিত মানবগোষ্ঠী মনে করে কি সাংঘাতিক বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হ’য়ে গেছে। তাদের কোনো ব্যক্তি যখন নিজের স্বার্থে অনৈসলামিক রীতিনীতি অনুসারে কাজ করে তখন অন্য মুসলমানরা তাকে সাহায্য করবে বলে আশা করে। আর সাহায্য না করলে ক্ষোভ প্রকাশ করে যে, দেখো মুসলমান মুসলমানের কাজে আসেনা। যারা সুপারিশ করে তারা এরূপ ভাষায় করে যে, একজন মুসলমান ভাই এর কল্যাণ হবে, তোমরা তার সাহায্য করো। যারা সাহায্য করে তারা তাদের এই কাজকে ইসলামী সমমর্মিতা নামে অভিহিত করে। প্রত্যেকের মুখে ইসলামী সহমর্মিতা, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, ইসলামের ধর্মীয় সম্পর্ক ইত্যাদি শব্দ মুহুর্মুহু উচ্চারিত হয়। অথচ প্রকৃতপক্ষে ইসলাম বিরোধী কাজ করার জন্য ইসলামেরই বরাত দেয়া এবং তার নামে সহানুভূতি চাওয়া ও সহানুভূতি করা এক নিদারুণ বেহুদা ব্যাপার। যে ইসলামের নাম নিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলে, তা যদি যথার্থই মুসলমানদের মধ্যে জীবিত থাকতো, তাহলে ইসলামী উম্মাহর কোনো ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করছে, একথা জানা মাত্রই তারা তার বিরুদ্ধে দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং তাকে তওবা করিয়ে তবে ছাড়তো। কারো সাহায্য চাওয়া তো দূরের কথা, একটি জীবন্ত ইসলামী সমাজে তো কোনো ব্যক্তি ইসলাম বিরোধী কোনো তৎপরতার নামও মুখে আনতে পারেনা। কিন্তু আমাদের সমাজে রাতদিন এসব হচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হলো, আমাদের মধ্য জাহেলী জাতীয়তার ধারণা জন্মে গেছে। যে জিনিসকে আপনার ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বলছেন, তা আসলে অমুসলিমদের কাছ থেকে ধার করা জাহেলী জাতীয়তার বন্ধন।
এই জাহেলিয়াতের একটা কৃতিত্ব এই যে, তা মুসলিম জনগনের মধ্যে “জাতীয় স্বার্থ” সংক্রান্ত এক আজব ধারণার জন্ম দিয়েছে। এ জিনিসটাকে তারা নিঃসংকোচে “ইসলামী স্বার্থ”ও বলে থাকে। এই তথাকথিত জাতীয় স্বার্থ বা ইসলামী স্বার্থ কি জিনিস? সেটি শুধু এই যে, যারা “মুসলমান” নামে পরিচিত, তাদের কল্যাণ হোক, তাদের হাতে বিপুল ধনসম্পদ আসুক, তাদের মান ইজ্জত ও প্রভাপ্রতিপত্তি বাড়ুক, তাদের হাতে ক্ষমতা আসুক, এক কথায়, কোনো না কোনোভাবে তাদের জাগতিক সমৃদ্ধি লাভ হোক। এইসব স্বার্থ ও কল্যাণ ইসলামী আদর্শ ও ইসলামী মূলনীতির আনুগত্যের পথে না বিরোধিতার মধ্য দিয়ে অর্জিত হলো সেটা তাদের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। জন্মসূত্রের মুসলমান বা বংশগত মুসলমানদের আমরা সর্বাবস্থায় মুসলমান বলি, চাই তাদের চিন্তাচেতনা ও কাজকর্মে কোথাও ইসলামী গুণাবলী খুঁজেও না পাওয়া যাক। এর অর্থ হলো, আমাদের কাছে মুসলমান আত্মার নাম নয়, শুধু দেহের নাম। ইসলামের গুণ ও ভাবধারা আছে কিনা, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেও কাউকে মুসলমান বলা যায়। এই ভ্রান্তধারণার বদৌলতে যে দেহগুলোকে আমরা মুসলমান নাম দিয়ে রেখেছি, তাদের সরকারকে ইসলামী সরকার, তাদের উন্নতিকে ইসলামের উন্নতি বা প্রগতি এবং তাদের স্বার্থকে ইসলামী স্বার্থ নামে আখ্যায়িত করে চলেছি, চাই সেই সরকার এবং সেই উন্নতি প্রগতি ও স্বার্থ সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পরিচন্থি হোক না কেন। জার্মান জাতীয়তা যেমন কোনো নীতি বা আদর্শের নাম নয়, নিছক একটি জাতীয়তার নাম এবং একজন জার্মান জাতীয়তাবাদী যেমন জার্মানদের উত্থান ও শ্রেষ্ঠত্ব চায়, চাই যে পন্থায়ই হোক না কন, তেমনিভাবে আমরা “মুসলমানত্ব” কেও নিরেট আপন জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি চায়, তা সে উন্নতি ও সমৃদ্ধি নীতিগতভাবে বা কার্যত ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত পন্থা অনুসরণের মাধ্যমেই হোক না কেন। এটা কি জাহেলিয়াত নয়? আসলে মুসলমান যে পৃথিবীতে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণার্থে একটা বিশেষ মতবাদ ও বাস্তব কর্মসূচী নিয়ে কর্মরত একটি আন্তর্জাতিক দলের নাম, তা কি আমরা একেবারেই ভুলে যাইনি? সেই আদর্শ ও কর্মসূচীকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার পর কেবল নিজের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক মর্যাদায় যারা অন্য কোনো আদর্শ ও কর্মসূচী অনুসারে কাজ করে, তাদের কাজকে কিভাবে “ইসলামী” বলা যায়? একথা কে কবে শুনেছে যে, যে ব্যক্তি পুঁজিবাদী নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে কাজ করে, তাকে সমাজতন্ত্রী বলা হয়? কেউ কি পুঁজিবাদী সরকারকে সমাজতন্ত্রী সরকার বলে? ফ্যাসিবাদী প্রশাসনকে কি কেউ গণতান্ত্রিক প্রশাসন বলে? কেউ যদি এ ধরনের পরিভাষাগুলোর অপপ্রয়েঅগ করে, তবে আপনি হয়তো তাকে বেকুফ বা মুর্খ বলতে কিছুমাত্র সংকোচবোধ করবেননা। কিন্তু এখানে আমরা দেখতে পাই, ইসলাম ও মুসলমান পরিভাষাটি দুটির শোচনীয় অপপ্রয়োগ হচ্ছে। অথচ এতে কেউ মুর্খতা বা জাহেলিয়াতের গন্ধও অনুভব করেনা।
মুসলিম শব্দটা আপনা থেকেই প্রকাশ করছে যে, এটা কোনো জাতিবাচক নাম নয় বরং গুণবাচক নাম। এর অর্থ ইসলামের অনুসারী ছাড়া আর কিছু হতেই পারেনা। মানুষের যে বিশেষ মানসিক, নৈতিক ও বাস্তব গুণকে “ইসলাম” বলা হয়, মুসলমান শব্দটি সেই গুণকেই প্রকাশ করে। সুতরাং হিন্দু, জাপানী বা চৈনিক শব্দ যেমন একজন হিন্দু, জাপানী ও চৈনিস ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, মুসলমান শব্দটাকে টিক সেভাবে কোনো মুসলমান ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়না। মুসলমান নামধারী কোনো ব্যক্তি যখনই ইসলামী নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়, অমনি তার কাছ থেকে মুসলমানত্ব আপনা আপনি চলে যায়। এরপর সে যাই করুক, নিজের ব্যক্তিগত মর্যাদায় করে। ইসলামের নাম ব্যবহার করার কোনো অধিকার তার থাকেনা। অনুরূপভাবে “মুসলমানের স্বার্থ”, “মুসলমানের উন্নতি ও সমৃদ্ধি,” “মুসলিম সরকার ও রাষ্ট্র” “মুসলিম মন্ত্রীসভা” “মুসলিম সংগঠন” এবং এ ধরনের শব্দগুলো শুধু সেই ক্ষেত্রেই বলা যায়, যেখানে এই জিনিসগুলো অর্থাৎ স্বার্থ, উন্নতি, সরকার, রাষ্ট্র ইত্যাদি ইসলামী নীতি ও আদর্শের অনুসারী হবে এবং ইসলাম যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে এসেছে তার সফলতার অনুকূল হবে। তা না হলে এর কোনো একটির সাথেও মুসলমান বা মুসলিম শব্দ ব্যবহার করা সংগত নয়। [মুসলমানদের স্বার্থ ও কল্যঅণ মূলতঃ কোনো অন্যায় ব্যাপার নয়। কিন্তু যে জিনিস ইসলামের পরিপন্থী তাতে মুসলমানদের কোনো স্বার্থ ও কল্যাণ থাকতেই পারেনা। এজন্য সবকিছুকে ইসলামের কষ্টিপাথরে পরখ করেই জেনে নিতে হবে কোন্টি মুসলমানদের জন্য হিতকর কোন্টি ক্ষতিকর। [সংকলক] সেক্ষেত্রে এসব জিনিসের আর যে নাম খুশী রখা যেতে পারে, কিন্তু মুসলমান বা মুসলিম নাম কখনো রাখা যেতে পারেনা। কেননা ইসলামের গুণ বা বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে মুসলিম বা ইসলাম আদৌ কোনো জিনিসই নয়। সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা জাতি যখন সমাজতন্ত্রী হতে পারেনা, সমাজতনত্র ছাড়া কোনো স্বার্থকে যখন সমাজতান্ত্রিক স্বার্থ, কোনো সরকার বা সংগঠনকে সমাজতান্ত্রিক সরকার ও সংগঠন এবং কোনো উন্নতিকে সমাজতন্ত্রীদের উন্নতি বলা চলেনা, তখন একমাত্র মুসলমানদের সম্পর্কে এমন ধারণা কেন পোষণ করা হয় যে, ইসলামী গুণবৈশিষ্ট্য থাক বা না থাক, মুসলমান কোনো ব্যক্তি বা জাতিগত নাম হতে পারে এবং যে কোনো জিনিসকে ইসলাম বল যেতে পারে?
বস্তুতঃ এই ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃকি ও ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধ্যানধারণা ও আচরণকে মৌলিকভাবে ভ্রান্ত বানিয়ে দিয়েছে। যেসব রাজ্য ও রাষ্ট্র অনৈসলামিক নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিলো, তাদেরকে আমরা “ইসলামী রাষ্ট্র” বলি শুধু এজন্য যে, তার শাসক মুসলমান ছিলো্ কর্ডোভা, বাগদাদ, দিল্লী ও কায়রোর বিলাসবহুল দরবারে যে লাস্যময় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিলো, আমরা তাকে “ইসলামী সংস্কৃতি” নামে আখ্যায়িত করে থাকি। অথচ ইসলামের সাথে তার দূরতম সম্পর্কও নেই।’ আপনাকে যখন ইসলামী সভ্যতা কথা জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি চটকরে আগ্রার তাজমহলের দিকে অংগুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দেন, যেনো ওটিই ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। অথচ একটি মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য বহু একর জমি স্থায়ীভাবে বরাদ্দ করেতার ওপর কোটি কোটি টাকার সৌধ নির্মাণ করা আদৌ কোনো ইসলামী সভ্যতাই নয়। ইসলামী ইতিহাসের গৌরবময় স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে আপনি আব্বাসী, সালজুকী ও মোগলদের কীর্তিগাথা তুলে ধরেন। অথচ সত্যিকার ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এসব কীর্তির বেশীরভাগ সোনালী অক্ষরে নয় বরং কালো কালি দিয়ে অপরাধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার যোগ্য। আমরা মুসলমান রাজা মহারাজাদের ইতিহাসের নাম দিয়ে রেখেছি “ইসলামের ইতিহাস।” ভাবখানা এই যে, ঐ রাজাদের নামই যেনো ইসলাম। কোথায় ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং তার নীতি ও আদর্শের আলোকে আমরা আমাদের অতীত ইতিহাসের সমালোচনা ও পর্যালোচনা করবো এবং পূর্ণ ইনসাফের সাথে ও সততার সাথে ইসলামী আন্দোনগুলোকে অনৈসলামিক আন্দোলন থেকে আলাদা করে দেখবো এবং দেখাবো, তার পরিবর্তে অতীতের মুসলিম শাসকদের চরিত্র ও শাসন পদ্ধতির সমর্থন করাকেই আমরা ইসলামের ইতিহাসের সেবা বলে মনে করছি। আমাদের দৃষ্টিভংগীতে বক্রতা ও বিবৃতির সৃষ্টি হয়েছে শুধু এজন্য যে, আমরা মুসলমানদের সবকিছুকেই “ইসলাম” বিবেচনা করি, আর আমাদের ধারণা হলো, একজন মুসলিম নামধারী ব্যক্তি যদি অনৈসলামিক পন্থায়ও কাজ করে, তবে তার কাজকে মুসলমানের কাজ বলা যেতে পারে।
এই বক্র দৃষ্টিভংগীই আমরা আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেও অবলম্বন করে রেখেছি। ইসলামের নীতি ও আদর্শ এবং তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আমরা একটি জাতিকে “মুসলিম জাতি” বলে বিবেনা করি এবং সেই জাতির নামে, তার পক্ষ হতে তার বা তার জন্য যে কোনো ব্যক্তি এবং যে কোনো গোষ্ঠীকে যা ইচ্ছে তাই করতে অনুমতি দিয়ে থাকি। “মুসলিম জাতি”র সাথে সম্পর্ক রাখে এমন যে কোনো ব্যক্তিকে আমরা মুসলমানদের প্রতিনিধি বা নেতা মেনে নিয়ে থাকি, চাই সে বেচারার ইসলাম সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই না থাক। একটা দলের অনুসারী হলে কিছুমাত্র উপকার পাবো বলে আমাদের ধারণা হলেই ব্যাস, আর কথা নেই, দলটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইসলামের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের যতোই বিপরীত হোক না কেন, আমরা সে দলটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। মুসলমানদের জন্য কোনো মতে একবেলা খাবারের সংস্থাতন হয়ে গেলেই আমরা খুশী হয়ে যাই, চাই ইসলামের দৃষ্টিতে তা হারাম উপায়ে সংগৃহীত খাবারই হোক না কেন। কোনো অঞ্চলে কোনো মুসলমান ব্যক্তি ক্ষমতাসীন হয়েছে শুনলে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়, চাই সে একজন অমুসলিমের মতোই অনৈসলামিক উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকুক না কেন। আমরা এমন বহু জিনিসকে প্রায়ই ইসলামী স্বার্থ বলে থাকি, যা আসলেই ইসলাম বিরোধী। ইসলামী আদর্শ ও মূলনীতির সম্পূর্ণ বিরোধী এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে আমরা সর্বস্ব শক্তি ব্যয় করেথাকি এবং ইসলামেরসাথে আদৌ সংগতিপূর্ণ নয় এমনসব কাজে আমাদের অর্থ ও জাতীয় সম্পদের অপচয় করে থাকি। এসব কিছুই আমাদের একটিমাত্র মৌলিক ভুলের কুফল। সে ভুলটি হলো, আমরা নিজেদেরকে নিছক “জন্মসূত্রে গড়ে ওঠা একটা জাতি” ভেবে নিয়েছি আর এই সত্যটি ভুলে বসে আছি যে, আমরা আসলে একটা “আন্তর্জাতিক আদর্শবাদী দল” যার একমাত্র উদ্দেশ্য এবং একমাত্র লক্ষ্য হলো এ দলের নীতি ও আদর্শকে পৃথিবীতে ক্ষমতাসীন বানানো। আমরা যতক্ষণ নিজেদেরকে জন্মসূত্রে গঠিত একটি জাতির পরিবর্তে আদর্শবাদী দল ভাবতে না পারবো এবং এ ধারণাকে একটি জীবন্ত ধারণায় পরিণত না করবো, ততদিন কোনো ব্যাপারেই আমাদের ভূমিকা সঠিক ও নির্ভুল হবেনা।
সংযোজন
উপরোক্ত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকে এই মর্মে সংশয় প্রকাশ করেন যে, “ইসলামী দলকে” “জাতি”র পরিবর্তে “পার্টি” বা “দল” বলার কারণে এমন আশংকা দেখা দিয়েছে যে, তা কোনো দেশ ও জাতীযতার অংশে পরিণত হয়ে যেতে পারে। একটি জাতির মধ্যে যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকে এবং প্রত্যেক দলের স্বতন্ত্র নীতি ও আদর্শ থাকলেও সবকয়টি দল তাদের সেই বৃহত্তর সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত থাকে, যাকে “জাতি” বলা হয়। অনুরূপ ভাবে, মুসলমানরা যদি একটা দল বা পার্টি হয়ে থাকে, তবে তাও স্বীয় মাতৃভূমি তথা দেশের বসবাসরত জাতির একটা অংশ হয়ে যেতে পারে।
যেহেতু দল বা পার্টি শব্দটাকে সাধারণভাবে মানুষ রাজনৈতিক দল অর্থে গ্রহণ করে থাকে, এজন্য উপরোক্ত ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটা এর প্রকৃত অর্থ নয়, বরং একটা বিশেষ অর্থে প্রায়শঃ ব্যবহৃত হওয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। এ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো, একটা বিশেষ আকীদা, আদর্শ, মতবাদ ও উদ্দেশ্যের ওপর ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টির নামই হলো জামায়াত তথা দল বা পার্টি। এই অর্থেই কুরআন “হিযব” এবং “উম্মাহ” শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছে। এই অর্থে হাদীসে “জামায়াত” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং “পার্টি” বলতেও এটাই বুঝায়।
এই জামায়াত বা দল আবার দু’ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো, যার সামনে একটা জাতি বা দেশের বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক কর্মকৌশলের একটা বিশেষ মতবাদ ও কর্মসূচী থাকে। এ ধরনের জামায়াত নিরেট রাজনৈতিক দল হয়ে থাকে। এ ধরনের দল যে জাতির অভ্যন্তরে গঠিত হয়, সে জাতিরই অংশ হয়ে কাজ করতে পারে এবং করেও থাকে।
দ্বিতীয় ধরনের দল হলো, যা একটি সামগ্রিক মতবাদ এবং একটা বিশ্বআদর্শ [World Idea] নিয়ে আবির্ভূত হয়। এধরনের দলের কাছে জাতি বা দেশ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য একটা বিশ্বজোড়া নীতি থাকে। এদল গোটা জীবনকে এক নতুন ধাঁচে গড়ে তুলতে চায়। এদল স্বীয় মতাদর্শ ও মূলনীতি, আকীদা বিশ্বাস ও চিন্তাধারা এবং নৈতিকতার নীতিমালা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত আচরণ ও সামাজিক ব্যবস্থার খুঁটিনাটি পর্যন্ত প্রতিটি জিনিসকে নিজস্ব ধাঁচে তৈরী করতে চায়। এদল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক সংস্কৃতি ও বিশিষ্ট এক সভ্যতা [Civilization] গড়ে তুলতে উৎুক। এ দৗ মূলতঃ একটি দল বা জামায়াতই বটে। তবে এটি এমন দল হয়না যা কোনো জাতির অংশ হ’য়ে কাজ করতে পারে। এ দলের অবস্থান সীমিত বলয়ের জাতীয়তার ঊর্ধ্বে। এ দলের লক্ষ্যই হ’য়ে থাকে এই যে, যেসকল বংশীয় ও ঐতিহ্যগত আভিজাত্যবোধের ওপর পৃথিবীতে নানা রকমের জাতীয়তা গড়ে ওঠে, তার বিলোপ সাধন করতে হবে। সুতরাং সে কেমন করে এ ধরনের জাতীয়তার অঙ্গীভূত হতে পারে? এদল বর্ণ, বংশ ও ইতিহাসভিত্তিক জাতীযতার পরিবর্তে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শবাদী জাতীয়তা [Rational Nationlality] গড়ে তোলে, স্থবির জাতীয়তার পরিবর্তে বর্ধিষ্ণু ও সম্প্রসারণশীল জাতীয়তা [Expanding Nationality] গড়ে তোলে। এদল নিজে এমন একটি জাতীয়তার রূপ ধারণ করে, যা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের ভিত্তিতে পৃথিবীর গোটা মানব গোষ্ঠীকে আপন বলয়ে গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু একটি জাতীয়তায় পরিণত হওয়া পরও প্রকৃত পক্ষে তা একটা জামায়াত বা দলই হয়ে থাকে। কেননা তাতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া জন্মগত সদস্য হওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয় বরং যে মতবাদ ও আদর্শের ভিত্তিতে দলটি গঠিত হয়েছে, তার অনুসারী হওয়ার ওপর নির্ভরশীল।
মুসলমান আসলে এই দ্বিতীয় প্রকারের দলের নাম। এটি সেই ধরনের দল নয়, যা কোনো জাতির অভ্যন্তরে হয়ে থাকে। এটি এমন দল যার আবির্ভাব ঘটে একটা আলাদা সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য এবং ছোট ছোট জাতীয়তাগুলো সংকীর্ণ বৃত্ত ভেংগে দিয়ে একটি বিরাট ও বিশাল বিশ্বজোড়া জাতীয়তা [World Nationality] গঠন করতে চায়। এই দল বা জামায়াতকে “জাতি” বলা নিঃসন্দেহে শুদ্ধ হবে। কেননা সে নিজেকে পৃথিবীর বর্ণ, বংশ ও ইতিহাসভিত্তিক জাতীয়হতাগুলোর কোনো একটিরও সাথে সংযুক্ত করতে প্রস্তুত হয়না বরং নিজস্ব জীবন দর্শন ও সমাজ দর্শন [Social Philolsophy] অনুসারে নিজের সভ্যতা ও কৃষ্টিকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে তৈরী করে। কিন্তু আরেক হিসেবে সে “জাতি” হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবিকপক্ষে তা “দলই” থেকে যায়। কেননা নিছক কাকতহালীয় জন্মসূত্র [Mere accident of birth] কোনো ব্যক্তিকে তার সদস্য বানাতে সক্ষম নয় যতক্ষণ সে তার আদর্শে বিশ্বাসী ও অনুসারী না হয়। অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তির অন্য কোনো জাতিতে জন্মগ্রহণ তার নিজ জাতি থেকে বেরিয়ে এই জাতিতে প্রবেশ করার অন্তরায় নয়। যদি সে এই জাতির আদর্শকে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকে। সুতরং আমি যা বলেছি, তার মর্মার্থ হলো, মুসলিম জাতির জাতীয়তা তার একটি দল বা জামায়াত হওয়ার ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত। জামায়াত বা দলগত সত্তাই তার মূল আর জাতিগত সত্তা ডালপালা স্বরূপ। তার দলগত সত্তাকে যদি তার থেকে আলাদা করা হয় এবং সে নিছক একটা জাতি হিসেবে অবশিষ্ট থাকে তাহলে সেটা হবে পতন ও বিলুপ্তি।
প্রকৃত ব্যাপার হলো, মানবীয় সমাজ ও সংগঠনের ইতিহাসে ইসলামী জামায়াত একটা বিরল ও অভিনব সংগঠন। ইসলামের পূর্বে বৌদ্ধ ধর্ম ও খৃষ্টধর্ম জাতীয়তাসমূহের সীমান্ত অতিক্রম করে সমগ্র মানব জাতিকে সম্বোধন করেছে এবং একটা মতবাদ ও আদর্শের ভিত্তিতে বিশ্বজোড়া ভ্রাতৃত্ব গড়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই উভয় মতাদর্শের কাছে কয়েকটা নৈতিক মূলনীতি ছাড়া এমন কোনো সামাজিক ও সামষ্টিক দর্শন ছিলোন, যার ভিত্তিতে সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোনো সামগ্রিক অবকাঠামো গড়া যেতো। তাই এই দুটি মতাদর্শ কোনো বিশ্বজোড়া জাতীয়তা গড়তে পারেনি, কেবল একধরনের ভ্রাতৃত্ব [Brotherhood] বানিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে। ইসলামের পর পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটে, যা নিজের আহ্বানকে আন্তর্জাতিক আহ্বানে পরিণত কতে চেয়েছিলো। কিন্তু জন্মের প্রথম দিন থেকেই তার ঘাড়ে জাতীয়তাবাদের ভূত চড়াও হলো। তাই সেও বিশ্বজোড়া জাতীয়তা গড়তে সক্ষম হলোনা। এবার মার্কসীয় সমাজতন্ত্র এগিয়ে এসেছে। সে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতীয়তার বৃত্ত ভেংগে দিয়ে এক বিশ্বজোড়া সভ্যতা গড়তে ইচ্ছুক। কিন্তু যেহেতু এখনো তার পরিকল্পিত নয়া সভ্যতা পুরোপুরি আবির্ভূত হয়নি, তাই মার্কসবাদও এখনো বিশ্বজোড়া জাতীয়তায় রূপান্তরিত হতে পারেনি। [সত্যি বলতে কি, মার্কসবাদের ভেতরেও জাতীয়তাবাদের বীজ ঢুকে গেছে। ষ্ট্যালিন ও তার দলের কর্মকাণ্ডে রুশ জাতীযতাবাদের ভাবধারা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রুশ সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যে, এমনকি ১৯৩৬ সালের নতুন সংবিধানেও জায়গায় জায়গায় “ফাদার ল্যান্ড” [পিতৃভূমি] এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু ইসলামের দিকে লক্ষ্য করুন এর সর্বত্র “দারুল ইসলাম” শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। ফাদারল্যান্ড বা মাদারল্যান্ডের নয়।] এখন পর্যন্ত ময়দানে শুধু ইসলামই একমাত্র নীতি ও আদর্শ, যা বংশীয় ও ঐতিহাসকি জাতীয়তাসমূহের বৃত্ত ভেংগে সাংস্কৃতিক ভিত্তিতে একটা বিশ্বজোড়া জাতীয়তা গঠন করে। কাজেই যারা ইসলামের প্রাণশক্তি সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত নয় তাদের জন্য এটা বুঝা দুরূহ হয়ে পড়ে যে, একই সামষ্টিক কাঠামো কেমন করে একই সময়ে জাতি এবং দল দুটোই হতে পারে? দুনিয়ার যতোগুলো জাতি তাদের পরিচিত, তাদের মধ্যে কোনোটাই এমন নয়, যার সদস্যরা জন্মসূত্রে সদস্য হয়না বরং তাদেরকে সেচ্ছায় সদস্য হতে হ য়। তারা দেখতে পায় যে, যেব্যক্তি জন্মসূত্রে ইটালীয়, সে ব্যক্তি ইটালীয় জাতীয়তার সদস্য। আর যে ব্যক্তি জন্মসূত্রে ইটালীয় নয়, সে কোনোভাবেই ইটালীয় হতে পারে না। তারা এমন কোনো জাতীয়তাকে চেনেনা যার ভেতরে মানুষ আদর্শ ও আকিদার ভিত্তিতে প্রবেশ করে এবং আদর্শ ও আকিদা বদলে গেলে তা থেকে বেরিয়ে যায়। তাদের মতে, এ বৈশিষ্ট্য কোনো জাতির নয়, দলের হতে পারে। কিন্তু তারা যখন দেখে যে, এই অভিনব দল নিজস্ব আলাদা সভ্যতা ও সংস্কৃতি তৈরী করে, নিজের স্বতন্ত্র জাতীয়তার দাবী করে এবং কোথাও স্থানীয় জাতীযতহার সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে রাজী হয়না, তখন ব্যাপারটা তাদের কাছে এক দুর্বোধ্য রহস্যে পরিণত হয়।
অমুসলিমদের মতো মুসলমানরাও একই দুর্বোধ্যতার সম্মুখীন হচ্ছে। যুগ যুগ কাল ধরে অনৈসলামিক শিক্ষালাভ ও অনৈসলামিক পরিবেশে জীবন যাপন করতে থাকায় তাদের মধ্যে “ঐতিহাসিক জাতীয়তা” তথা জন্মগত ও বংশগত জাতীয়তার ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। তারা ভুলে গেছে যে, মুসলমানরা প্রকৃতপক্ষে এমন একটি দল, যা পৃথিবীতে একটা বিশ্বজোড়া বিপ্লব সংঘটনের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলো। যার জীবনের উদ্দেশ্য ছিলো নিজের আদর্শকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া। এবং যার সংকল্প ছিলো পৃথিবীর তাবত ভ্রান্ত সামষ্টিক ব্যবস্থাকে ভেংগে দিয়ে নিজস্ব সমাজ দর্শনের ভিত্তিতে একটা সামষ্টিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এসব কথা ভুলে গিয়ে তারা নিজেদেরকে কেবল অন্যান্য জাতিসমূহের মতো একটা জাতি মনে করে নিয়েছে। এখন তাদের সভাসমিতি ও বৈঠকাদিতে এবং তাদের পত্রপত্রিকা ও বইপুস্তকে কোথাও তাদের সামষ্টিক জীবনের এই মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো আলোচনা হয়না, যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তাদেকে সারা দুনিয়ার জাতিগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করে একটা উম্মাহ বা আন্তর্জাতিক জাতিতে পরিণত করেছিলো। এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরিবর্তে যে জিনিস এখন তাদের মনোযোগের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু, তাহচ্ছে “মুসলমানদের স্বার্থে।” মুসলমান বলতে মুসলিম মাতাপিতার ঔরসজাত সন্তান এবং স্বার্থ বলতে এইসব বংশানুক্রমিক মুসলমানের বৈষয়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থ বুঝানো হয়। এই স্বার্থের মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৈতৃক উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও অন্তর্ভুক্ত। এই স্বার্থের সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য যে কৌশলই লাভজনক ও কার্যকর মনে হয়, সেদিকেই তারা দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হ’য়ে ছুটে, ঠিক যেমন মুসোলিনী ইটালীয়দের স্বার্থের অনুকূল যেকোনো কর্মপন্থা অবলম্বনে প্রস্তুত হয়ে যেতো। কোনো আদর্শ ও নৈতিকতার তোয়াক্কা এরাও করেনা, মুসোলিনীও করতোনা। সে বলতো, ইটালীয়দে জন্য যেটাই কল্যাণকর সেটাই ভালো ও ন্যায়সঙ্গত। এই মনোভাবকেই আমি মুসলমানদের অধোপতন বলে থাকি। আর এই অধোপতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যই আমি মুসলমানদেরকে একথা স্মরণ করিয়ে দেয়া জরুরীমনে করছি যে, আপনারা বংশানুক্রমিক ও ঐতিহাসিক জাতিগুলোর মতো একটা জাতি নন, বরং প্রকৃতপক্ষে একটি জামায়াত এবং নিজেদের মধ্যে জামায়াতী চেতনা [Party sense] জাগিয়ে তোলার মধ্যেই আপনাদের মুক্তি।
এই জামায়াতী চেতনা হারানো তথা আত্মভোলা হওয়ার কুফল এতো বেশী যে, তা গুণে শেষ করা কঠিন। আজকের মুসলমানরা প্রত্যেক পথপ্রদর্শকের পেছনে ছুটতে এবং প্রত্যেক মতবাদ ও আদর্শের অনুকরণ ও অনুসরণ করতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়। অথচ এটা ভেবেও দেখেনা যে, ঐ নেতা ও আদর্শ ইসলামী বিধান ও ইসলামী আদর্শের কতো বিপরীত। এটা শুধু জামায়াতী চেতনাহীনতা ও আত্মবিস্মৃতির কারণেই সম্ভব হচ্ছে। মুসলমান জাতীয়তাবাদী হতেও কুণ্ঠিত হয়না, ফ্যাসিবাদী হতেও সংকোচবোধ করেনা এবং কমিউনিষ্ট হতেও কিছুমাত্র ইতস্ত করেনা। পাশ্চাত্যের রকমারি সামাজিক দর্শন এবং ইন্দ্রিয়াতীত চিন্তাধারা ও তাত্ত্বিক মতবাদসমূহের মধ্য থেকে প্রায় প্রত্যেকটিরই অনুসারী মুসলমানদের মধ্যে পাওয়া যাবে। পৃথিবীতে এমন কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন পাওয়া যাবেনা, যার সাথে কোনো না কোনো মুসলমান শরীক হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, তারা সবাই নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করে, মুসলমান মনে করে এবং অন্যদের কাছ থেকেও মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এইসব রকমারি পথে উদভ্রান্তের মতো বিচরণকারীদের কারো একথা মনে পড়েনা যে, “মুসলমান: জন্মসূত্রে পাওয়া কোনো খেতাব বা উপাধি নয়, বরং ইসলামের বাসতব অনুসারী হওয়ার গুণবাচক নাম। যে ব্যক্তি ইসলামের পরিবর্তে অন্য কোনো মতবাদের অনুসারী হয় তাকে মুসলমান বলা এই শব্দটির একেবারেই অপপ্রয়োগের শামিল। মুসলিম কমিউনিস্ট, মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং এই ধরনের অন্যান্য পরিভাষা “কমিউনিস্ট মহাজন” ও “বৌদ্ধ কসাই” প্রভৃতি পরিভাষার মতোই স্ববিরোধী পরিভাষা।