পঞ্চদশ অধ্যায়
ইমলামী রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান নীতিমালা
(কুরআনের আলোকে)
১। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য
২। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি
৩। পরামর্শ বা শূরা
৪আদল ও ইহসান
৫। নেতৃত্ব নির্বাচনের মূলনীতি
৬। প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধ ও সন্ধির মূলনীতি
৭। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষানীতির সাধরণ মূলনীতি
৮। নাগরিকত্ব ও পররাষ্ট্রনীতি
এ খন্ডের শেষ নিবন্ধটির শিরোনাম হলো “ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান নীতিমালা”। এ বিষয়টি সংকলিত হয়েছে মাওলানার বিখ্যাত তাফসীর তাফহীমুল কুরআনে প্রদত্ত বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যামূলক টীকার সমন্বয়ে। মাওলানার এ তাফসীর আধুনিককালের ইসলামী সাহিত্য সম্বরের শিরমনি। প্রথম খন্ডে আমরা এ তাফসীরের টীকা দিয়েই ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন, অংশটি উপস্থাপন করেছি। এখন সে তাফসীরের টীকা দিয়েই ইসলামী রাষ্ট্রের কার্যব্যবস্থা ও তার পলিসির প্রধান প্রধান নীতিমালা উপস্থাপন করছি। এখানে সংক্ষিপ্ত কিন্তু সর্বাংগিনতার সাথে সেই সব নীতিমালা উল্লেখ হয়েছে, যেগুলোর ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্র আর্থ রাজনৈতিক এবং শিক্ষা ও সামাজিক পলিসি প্রণয়ন করবে। এখনে উল্লেখিত প্রতিটি মূলনীতিই স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিকারী। এগুলো কার্যকর করার মাধ্যমে সুন্দরতম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, আর এটাই ইসলামের কাম্য। যাতে করে মানুষ পৃথিবীতে এমনভাবে জীবন-যাপন করতে সক্ষম হয় যে, এ পৃথিবীতেও থাকবে তারা শান্তিতে ও নিরাপদে আর পরকালের জীবনেও থাকবে অতীব সুখে। আয়াতগুলোর অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা স্বয়ং মাওলানার লিখিত। বক্তব্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্যেই কেবল সংকলক মাঝে মাঝে দু’একটি বাক্য সংযোজন করে দিয়েছেন। -সংকলক
১. রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য
কুরআনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলোদ, সততা, সুবিচারও আল্লাহ্র আইনের প্রতিষ্ঠাঃ
ক. “এরা হলো সেসব লোক, যাদেরকে আমরা পৃথিবীর কর্তৃত্ব দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত পরিশোধ করবে, সৎ কর্মের নির্দেশ দেবে এবং অসৎ কর্মে বাঁধা দেবে। সকল কাজের পরিণতি আল্লাহ্র ইখতিয়ারভুক্ত।” (সূরা আল হজ্জঃ ৪১)
অর্থাৎ আল্লাহ্র সাহায্যকারী এবং তাঁর সাহায্য ও সহায়তা লাভের অধিকারী লোকদের গুণাবলী ব্যক্তিগত জীবনে ফাসেকী, দুষ্কৃতি, অহংকার ও আত্মম্ভরিতার শিকার হবার পরিবর্তে নামাজ কায়েম করবে। তাদের ধন সম্পদ বিলাসিতা ও প্রবৃত্তি পূজার পরিবর্তে যাকাত দানে ব্যায়িত হবে। তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র সৎকাজকে দাবিয়ে দেবার পরিবর্তে তাকে বিকশিত ও সম্প্রসারিত করার দায়িত্ব পালন করবে। তাদের শক্তি অসৎকাজকে ছাড়াবার পরিবর্তে দমন করার কাজে ব্যবহৃত হবে। একটি বাক্যের মধ্যে ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য এবং তার কর্মী ও কর্মকর্তাদের বৈশিষ্টের নির্যাস বের করে দেয়া হয়েছে। কেউ যদি বুঝতে চায় ইসলামী রাষ্ট্র আসলে কোন জিনিসের নাম, তাহলে এ একটি বাক্য থেকেই তা বুঝে নিতে পারে।
এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশেষত্ব হলো এই যে, তাদেরকে গোটা মানবতার জন্য সত্য কল্যাণ ও ন্যায়ের আহবায়ক বানানো হয়েছে। তাকে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে হবেঃ
খ. “আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি ‘মধ্যপন্থী’ উম্মতে পরিণত করেছে, যাতে তোমরা দুনিয়াবাসীদের ওপর সাক্ষী হতে পারো এবং রসূল হতে পারেন তোমাদের ওপর সাক্ষী। (সূরা আল বাকারাঃ ১৪৩)
এটি হচ্ছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের নেতৃত্বের ঘোষণাবাণী। ‘এভাবেই’ শব্দটির সাহায্যে দুদিকে ইংগিত করা হয়েছে। একঃ আল্লাহ্র পথ প্রদর্শনের দিকে ইংগিত করা হয়েছে। যার ফলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যাকারীর সত্য সরল পথের সন্ধার পেয়েছে এবং তারা উন্নতি করতে করতে এমন একটি মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে যেখানে তাদেরকে ‘মধ্যপন্থী’উম্মত গণ্য করা হয়েছে। দুইঃ এ সাথে কিবলাহ পরিবতর্নের দিকেও ইয়গিত করা হয়েছে।
অর্থাৎ নির্বোধরা একদিক থেকে আর এদিকে মুখ ফিরানো মান করছে। অথচ বাইতুল মাকদিস থেকে কাবার দিকে মুখ ফিরানোর অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ্ বনী ইসরাঈলরকে বিশ্ববাসীর নেতৃত্ব পদ থেকে যথা নিয়মে হটিয়ে উম্মতে মুহাম্মদীয়কে সে পদে বসিয়ে দিলেন।
‘মধ্যপন্থী উম্মত’ শদ্বটি অত্যন্ত গভীর ও ব্যপক তাৎপর্যর অধিকারী। এর অর্থ হচ্ছ, এমন একটি উৎকৃষ্ট ও উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন দল, যারা নিজেরা ইনসাফ, ন্যায় নিষ্ঠা ও ভারসাম্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, দুনিয়ার জাতিদের মধ্যে যারা কেন্দ্রীয় আসন লাভের যোগ্যতা রাখে, সত্য ও সততার ভিত্তিতে সবার সাথে যাদের সম্পর্ক সমান এবং কারোর সাথে যাদের কোনো অবৈধ ও অন্যায় সম্পর্ক নেই।
বলা হয়েছে, তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মতে পরিণত করার কারণ হচ্ছে, “তোমরা লোকদের ওপর সাক্ষী হবে এবং রমূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের উপর সাক্ষী হবেন।” এ বক্তব্যের অর্থ কি? এর অর্থ হচ্ছে আখিরাতে যখন সমগ্র জাতিকে একত্র করে তাদের হিসেব নেয়া হবে, তখন আল্লাহ্র পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল প্রতিনিধি হিসেবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের ব্যাপারে এ মর্মে সাক্ষ্য দিবেন যে, সুস্থ ও সঠিক চিন্তা এবং সৎ কাজ ও সুবচারের যে শিক্ষা দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল তা তিনি তোমাদের কাছে হুবহু এবং পূরোপূরি পৌঁছেযে দিয়েছেন আর বাস্তবে সেই অনুযায়ী নিজে কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থালাভিষিক্ত হিসেবে সাধারণ মানুষদের ব্যাপারে তোমাদের এই মর্মে সাক্ষ্য দিতে হবে যে, রসূল তোমাদের কাছে যা কিছু পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন তা তোমরা সাধারণ সনুষের কাছে পৌঁছেয়ে দিয়েছো। আর তিনি যা কিছু কার্যকর করে দেখিয়ে ছিলেন তা তাদের কাছে কার্যকর করে দেখাবার ব্যাপারে তোমরা মোটেই গড়িমসি করোনি।
এভাবে কোনো ব্যাক্তি বা দলের এ দুনিয়ায় আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দানের দায়িত্বে নিযুক্ত হওয়াটাই মূলত তাকে নেতৃত্বের মর্যাদার অভিষিতক্ত করার নামান্তর। এর মধ্যে যেমন একদিকে মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধির প্রশ্ন রয়েছে তেমনি অন্যদিকে রয়েছে দায়িত্বের বিরাট বোঝা। এর সোজা অর্থ হচ্ছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে এ উম্মতের জন্য আল্লাহ্ ভীতি, সত্য সঠিক পথ অবলম্বন, সুবিচার, ন্যায় নিষ্ঠা ও সত্য প্রীতির জীবন্ত সাক্ষী হয়েছেন, তেমনিভাবে এ উম্মতকেও বিশ্ববাসীর জন্য জীরন্ত সাক্ষীতে পরিণত হতে হবে। এমন কি তাদের কথা, কর্ম, আচরণ ইত্যাদি প্রত্যেকটি বিষয় দেখে দুনিয়াবাসী আল্লাহ্ ভীতি, সততা, ন্যায় নিষ্ঠা ও সত্য প্রীতির শিক্ষা গ্রহণ করবে। এর আর একটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্র হিদায়াত আমাদের কাছে পৌছাবার ব্যাপারে যেমন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দায়িত্ব ছিলো বড়ই কঠিন, এমনকি এ ব্যাপারে সামান্য ত্রুটি বা গাফলতি হলে আল্লাহ্র দরবারে তিনি পকড়াও হতেন, অনুরূপভাবে এ হিদায়াতকে দুনিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবার ব্যাপারেও আমাদের ওপর কঠিন দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। যদি আমরা আল্লাহ্র আদালতে পথার্থই এ সাক্ষ্য দিতে ব্যার্থ হই যে, “তোমার রসূলের মাধ্যমে তোমার যে হিদায়াত আমরা পেয়েছিলাম তা তোমার বান্দাদের কাছে পৌঁছাবার ব্যাপারে আমরা কোনো প্রকার ত্রুটি করিনি” তাহলে আমরা সেদিন মারাত্মকভাবে পকড়াও হয়ে যাবো। সেদিন এ নেতৃত্বের অহংকার সেখানে আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাড়াবে। আমাদের নেতৃত্বের যুগে আমাদের যথার্থ ত্রুটির কারণে মানুষের চিন্থায় ও কর্মে যে সমস্ত গলদ দেখা দেবে, তার ফলে দুনিয়ায় যেসব গোমরাহী ছড়িয়ে পেড়বে এবং যতো বিপর্যয় ও বিশৃংখলার রাজত্ব বিস্তৃত হবে, সেসবের জন্য অসৎ নেতৃবর্গ এবং মানুষ ও জিন শয়তানদের সাথে সাথে আমরাও পকড়াও হবো। আমাদের জিজ্ঞেস করা হবে পৃথিবীতে যখন যুলুম নির্যাতন, অন্যায়, অত্যাচার, পাপ ও ভ্রষ্টতার রাজত্ব বিস্তৃত হয়েছিল তখন তোমরা কেথায় ছিলে?
গ. “এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনো।” (সূরা আলে ইমরানঃ ১১০)
ইতোপূর্বে সূরা বাকারার ১৭ রুকুতে যে কথা বলা হয়েছেল এখনোও সেই একই বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে। নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীদের বলা হচ্ছে, নিজেদের অযোগ্যতার কারণে বনী ইসরাঈলকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও পথ প্রদর্শনের যে আমন থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে সেখানে এখন তোমাদেরকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। করণ নৈতিক চরিত্র ও কার্যকলাপের দিক দিয়ে এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী। সৎ ও ন্যায় নিষ্ঠা নেতৃত্বের জন্য যেসব গুণাবলীর প্রয়োজন সেগুলো তোমদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে। অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে ন্যায় ও সৎবৃত্তির প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় ও অসৎবৃত্তির মূলোৎপাটন করার মনোভাব ও কর্ম স্পৃহা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এই সংগে তোমরা এক ও লা শরীক আল্লাহ্কেও বিশ্বাসগত দিক দিয়ে এবং কাজের দায়িত্ব এখন তোমাদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা নিজেদের দায়িত্ব অনুধাবন করো এবং তোমাদের পূর্ববর্তীরা যেসব ভুল করে গেছে তা থেকে নিজেদের দূরে রাখো।
ঘ. “বনী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তাদের ওপর দাউদ ও মরিয়মের পুত্র ঈসার মুখ দিয়ে অভিসম্পাত করা হয়েছে। করণ তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি করতে শুরু করেছিল, তারা পরস্পরকে খারপ কাজ থেকে বিরত রাখা পরিহার করেছিল, তাদের গৃহীত সেই কর্মপদ্ধতি ছিলো বড়ই জঘন্য।” (সূরা মায়েদাহঃ ৭৮-৭৯)
প্রত্যেক জাতির বিকৃতি শুরু হয় কয়েক ব্যক্তি থেকে। জাতির সামগ্রিক বিবেক জাগ্রত থাকলে সাধারণ জনমত ঐ বিপথগামী লোকদের দমিয়ে রাখে এবং জাতি সামগ্রিকভাবে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু জাতি পদি ঐ ব্যক্তিগুলোর ব্যাপারে উপেক্ষা অবহেলা ও উদাসীনতার নীতি অবলম্বন করে এবং দুষ্কৃতকারীদের তিরস্কার ও নিন্দা করার পরিবর্তে তাদেরকে সমাজে খারপ কাজ করার জন্য স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়,তাহলে যে বিকৃতি প্রথমে কয়েক ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো তা ধীরে ধীরে সমগ্র জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বনী ইসরাঈল জাতির বিকৃতি এভাবেই হয়েছে।
ঙ. “এবং তাঁর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করো সম্ভবত তোমরা সফলকাম হতে পারবে।”(সূরা মায়েদাহঃ ৩৫)
এখানে ‘জাহিদু’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নিছক ‘প্রচেষ্টা ও সাধনা’ শব্দ দুটির মাধ্যম এর অর্থের সবটুকু প্রকাশ হয়না। আর ‘মুজাহাদা’ শব্দটির মধ্যে মুকাবিলার অর্থ পাওয়া যায়। এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, যেসব শক্তি আল্লাহ্র পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা তোমাদের আল্লাহ্র মর্জি তোমাদের পুরোপুরি আল্লাহ্র বান্দা হিসেবে জীবন যাপন করতে দেয়না এবং নিজের বা আল্লাহ্র ছাড়া আর কারোর বান্দা হবার জন্য তোমাদের বাধ্য করে, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ওপর তোমাদের সাফল্য এবং আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ নির্ভর করছে।
এভাবে এ আয়াতটি মুমিন বান্দাকে প্রতিটি ক্ষেত্রে চতুর্থমুখী ও সর্বাত্মক লড়াই করার নির্দেশ দেয়। একদিকে আছে অভিশাপ্ত ইবলীস এবং তার শয়তানী সেনাদল। অন্যদিকে আছে মানুষের নিজের নফ্স ও তার বিদ্রোহী প্রবৃত্তি। তৃতীয় দিকে আছে এমন এক আল্লাহ্র বিমুখ মানব গোষ্ঠী যাদের সাথে মানুষ সব ধরনের সামাজিক, তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সূত্র বাঁধা। চতুর্থ দিকে আছে এমন ভ্রান্ত ধর্মীয় তামাদ্দুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যার ভিত্তিভূমি গড়ে উঠেছে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ওপর এবং সত্যের আনুগত্য করার পরিবর্তে মিথ্যার আনুগত্য করতে মানুষকে বাধ্যক করে। এদের সবার কৌশল বিভিন্ন কিন্তু সবার চেষ্টা একমুখী। এরা সবাই মানুষকে আল্লাহ্র পরিবর্তে নিজের অনুগত করতে চায়। বিপরীত পক্ষে, মানুষের পুরোপুরি আল্লাহ্র অনুগত হওয়া এবং ভিতর থেকে বাহির পর্যন্ত একমাত্র আল্লাহ্র নির্ভেজাল বান্দায় পরিণত হয়ে যাওয়র ওপরই তার উন্নতি ও আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের মর্যাদায় উন্নীত হওয়া নির্ভর করে। কাজেই এ সমস্ত প্রতিবন্ধক ও সংঘর্ষশীল শক্তির বিরুদ্ধে একই সাথে সংগ্রাম মূখর হয়ে, সবসময় ও সব অবস্থায় তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত থেকে এবং এ সমস্ত প্রতিবন্ধককে বিধ্বস্ত ও পর্যুদস্ত করে আল্লাহ্র পথে অগ্রসর না হলে নিজের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানো তার পক্ষ্যে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
২. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি
ইসলামী রাষ্ট্রের রয়েছে একটি বিশিষ্ট স্বভাব প্রকৃতি। এ রাষ্ট্র একজন অহবায়ক ও সংস্কারকের ভূমিকা রাখে। এ রাষ্ট্র তার ক্ষমতার সীমার মধ্যে দীনকে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রচষ্টা চলায়, আর বাকী বিশ্বের সকল জাতির কাছে ইসলামের মর্মবাণী পৌঁছে দেয়। এ রাষ্ট্রের মর্যাদা হলো একজন প্রচারক, শিক্ষকও সয়স্কারকের মর্যাদা। এর সমস্ত কাজ ভালোবাসা, ভ্রতৃত্ব, পরামর্শদ,সহানুভূতি ও মমতার ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়া হয়, আর এটাই এ রাষ্ট্রের বিশিষ্ট স্বভাব প্রকৃতি।
ক. “যদি আল্লাহ্র ইচ্ছা হতো, তাহলে (তিনি নিজেই এমন ব্যবস্থা করতে পারতেন যাতে) এরা শির্ক করতোনা। তোমাকে এদের উপর পাহারাদার নিযুক্ত করিনি এবং তুমি এদের অভিভাবকও নও। আর (হে ঈমানদারগণ) এরা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে যাদেরকে ডাকে দোমরা তাদর গালি দিয়োনা। কেননা,এরা শির্ক থেকে আরো খানিকটা অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতবশত যেনো আল্লাহ্কে গালি দিয়ে না বসে”। (সূরা আনয়ামঃ ১০৭-১০৮)
এর অর্থ হচ্ছে, তোমাকে অহবায়ক ও প্রচারকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কোতোয়ালের দায়িত্ব নয়। লোকদের সামনে এ আলোকবর্তিকাটি তুলে ধরা এবং সত্যের কাজ। এখন কেউ এ সত্যটি গ্রহণ না করতে চাইলে না করুক। লোকদেরকে সত্যপন্থী বানিয়েই ছাড়তে হবে, এ দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয়নি। তোমার মবূওয়তের প্রভাবধীন এলাকার মধ্যে মিথ্যার অনুসারী কোনো এক ব্যক্তিও থাকতে পারবেনা, একথাটিকে তোমার দায়িত্ব ও জবাবদিহির অন্তুর্ভুক্ত করা হয়নি। কাজেই অন্ধদেরকে কিভাবে চক্ষুমান করা যায় এবং যারা চোখ খুলে দেখতে চায়না তাদেরকে কিভাবে দেখানো যায়? –এ চিন্তায় তুমি খামখা নিজের মন মস্তিষ্ককে পেরেশান করোনা। দুনিয়ায় একজনও বাতিলপন্থী থাকতে না দেয়াটা যদি যথার্থই আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে হতো তাহলে এ কাজটি তোমাদের মাধ্যমে করাবার আল্লাহ্র কি প্রয়োজন ছিলো? তার একটি মাত্র প্রাকৃতিক ইংগিতই কি দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে সত্যপন্থী করার জন্য যথেষ্ট ছিলোনা। কিন্তু সেখানে এটা আদতে উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্তই নয়। সেখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের জন্য সত্য ও মিথ্যার মধ্য থেকে কোনো একটি বাছাই করে নেবার স্বাধীনতা বজায় রাখা, তারপর সত্যের আলো তার সামনে তুলে ধরে উভয়ের মধ্য থেকে কোনটিকে সে গ্রহণ করে তার পরীক্ষা করা। কাজেই যে আলো তোমাকে দেখানো হয়েছে তার উজ্জ্বল আভায় তুমি নিজে সত্য সরল পথে চলতে থাকো এবং অন্যদেরকে সে পথে চলার জন্য আহবান জানাও। এটিই হচ্ছে তোমার জন্য সঠিক সর্মপদ্ধতি। যারা এ দাওয়াত গ্রহণ করে তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরো এবং দুনিয়ার দৃষ্টিতে তারা যতোই নগন্য হোক না কেন তাদেরকে বুকে জড়িয়ি ধরো এবং দুনিয়ার দৃষ্টিতে তারা যতোই নগণ্য হোক না কেন তাদেরকে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন করোনা। আর যারা এ দাওয়াত গ্রহণ করেনি তাদের পেছনে লেগে থেকোনা। তারা যে অশুভ পরিণামের দিকে নিজেরাই চলে যেতে চাল এবং যাবার জন্য অতি মাত্রায় উদগ্রীব, সেদিকে তাদেরকে যেতে দাও।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীদেরকে এ উপদেশ দেয়া হয়েছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল, নিজেদের ইসলাম প্রচারের আবেগে তারা যেনো এমনই লাগামহীন ও বেসামাল হয়ে না পড়ে যার ফলে তর্ক বিতর্ক ও বিরোধের ব্যপারে এগিয়ে যেতে যেতে তারা অমুসলিমদের আকীদা বিশ্বাসের কঠোর সমালোচনা করতে গিয়ে তাদের নেতৃবৃন্দ ও উপাস্যদেরকে গালিগালাজ করে না বসে। কারণ, এগুলো তাদেরকে সত্যের নিকটবর্তী করার পরিবর্তে তা থেকে আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে।
খ. “(হে নবী) এটা আল্লাহ্র বড়ই অনুগ্রহ যে, তোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল। নয়তো যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত হতে, তাহলে তারা সবাই তোমার চারপাশ থেকে সরে যেতো। তাদের ত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করো এবং দীনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শে তাদের অন্তর্ভুক্ত করো। তারপর যখন কোনো মতের ভিত্তিতি তোমরা স্থির সংকল্প হবে তখন আল্লাহ্র উপর ভরসা করো। আল্লাহ্ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর উপর ভরসা করে কাজ করে।” (সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯)
গ. “আর উত্তম পদ্ধতিতে ছাড়া আহলে কিতাবের সাথে বিতর্ক করোনা। তবে তাদের মধ্যে যারা যালিম।”(সূরা আনকাবূতঃ ৪৬)
অর্থাৎ বিতর্ক ও আলাপ আলোচনা উপযুক্ত যুক্তি প্রমাণ সহকারে, ভদ্র ও শালীন ভাষায় বুঝবার ও বুঝাবার ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে করতে হবে। এর ফলে যার সাথে আলোচনা হয় তার চিন্তার সংশোধন হবে। প্রচারকের চিন্তা করা উচিত, তিনি শ্রোতার হৃদয় দুয়ার উন্মুক্ত করে সত্য কথা তার মধ্যে বসিয়ে দেবেন এবং তাকে সঠিক পথে আনবেন। একজন পাহ্লোয়ানের মতো তার সাথে লড়াই করা উচিত নয়, যার উদ্দেশ্যই হয় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেয়া। বরং একজন ডাক্তারের মতো তাকে সবসময় উদ্বিগ্ন থাকতে হবে, যিনি তার রোগীর চিকিৎসা করার সময় একথাকে গুরুত্ব দেন যে, তাঁর নিজের কোনো ভুলের দরুন রোগীর রোগ যেনো আরো বেশী বেড়ে না যায় এবং সর্বধিক কম কষ্ট সহ্য করে যাতে তাঁর রোগীর নিরাময় হওয়া সম্ভব হয় এজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আহলে কিতাবের সাথে বিতর্ক আলোচনা করার ব্যাপারে এ নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এটা কেবলমাত্র বিশেষভাবে আহ্লি কিতাবদের জন্য নয় বরং দীনের প্রচারের ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ নির্দেশ। কুরআন মজীদের বিভিন্ন এর উল্লেখ রয়েছে। যেমনঃ “আহবান করো নিজের রবের পথের দিকে প্রজ্ঞ ও উৎকৃষ্ট উপদেশের মাধ্যমে এবং লোকদের সাথে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক আলোচনা করো।” (সূরা আননাহলঃ ১২৫)
“সুকৃতি ও দুষ্কৃতি সমান নয়। (বিরোধীদের আক্রমণ) প্রতিরোধ করো উৎকৃষ্ট পদ্ধতিতে। তুমি দেখবে এমন এক ব্যক্তি যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিলো সে এমন হয়ে গেছে যেমন তোমার অন্তরংগ বন্ধু।” (সূরা হা-মীম আস্সাজদাহঃ ৩৪)
“তুমি উত্তম পদ্ধতিতে দুষ্কৃতি নির্মূল করো। আমি জানি (তোমার বিরুদ্ধে)তারা যেসব কিছু তৈরী করে।”(সূরা আল মু‘মিনূনঃ ৯৬)
“ক্ষমার পথ অবলম্বন করো, ভালো কাজ করার নির্দেশ দও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চলো। আর যদি (মুখে মুখে জবাব দেবার জন্য) শয়তান তোমাকে উস্কানী দেয় তাহলে আল্লাহ্র আশ্রয় চাও।” সূরা আল আ’রাফঃ ১৯৯-২০০)
অর্থাৎ যারা যুলুমের নীতি অবলম্বন করে তাদের সাথে তাদের যুলুমের প্রকৃতি বিবেচনা করে ভিন্ন নীতিও অবলম্বন করা যেতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে, সবসময় সব অবস্থায় সব ধরনের লোকদের মুকাবিলায় নরম ও সুমিষ্ট স্বভাবের হয়ে থাকলে চলবেনা। যেনো মানুষ সত্যের আহবানের ভদ্রতাকে দুর্বলতা ও অসহায়তা মনে না করে বসে। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে অবশ্যই ভদ্রতা, বিনয়, শালীনতা ও যুক্তিবাদীতার শিক্ষা দেয়, কিন্তু হীনতা ও দীনতার শিক্ষা দেয়না। তাদেরকে প্রত্যেক যালিমের যুলুমের সহজ শিকারে পরিণত হবার শিক্ষা দেয়না।
ঘ. “প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ফেরাউন পৃথিবীতে বিদ্রোহ করে এবং তার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দেয়।” (সূরা কাসাসঃ ৪)
অর্থাৎ তার রাজ্য শাসনের নীতি অনুযায়ী আইনের চোখে দেশের সকল অধিবাসী সমান থাকেনি এবং সবাইকে সমান অধিকার দেয়াও হয়নি। বরং সে সভ্যতা সংস্কৃতি ও রাজনীতির এমন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে যার মাধ্যমে রাজ্যের অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দেয়া হয়। একদলকে সুযোগ সুবিধা ও বিশেষ অধিকার দিয়ে শাসক দলে পরিণত করা হয় এবং অন্যদলকে অধীনে করে পদানত, পর্যুদস্ত, নিষ্পেষিত ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা হয়।
এখনে কারো এ ধরনের সন্দেহ করার অবকাশ নেই যে, ইসলামী রাষ্ট্রেও তো মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে ফারাক করা হয় এবং তাদের অধিকার ও ক্ষমতাও সকল দিক দিয়ে সমান রাখা হয়নি। এ সন্দেহ এজন্য সঠিক নয় যে, ফেরাউনী বিধানে যেমন বংশ, বর্ণ, ভাষা বা শ্রেণীগত বিভেদের ওপর বৈষম্যের ভিত রাখা হয়েছে ইসলামী বিধানে ঠিক তেমনটি নয়। বরং ইসলামী বিধানে নীতি ও মতবাদের ওপর এর ভিত রাখা হয়েছ। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অমুসলিম ও মুসলমানের মধ্যে আইনগত অধিকারের ক্ষেত্র মোটেই কোনো ফারাক নেই। সকল পার্থক্য একমাত্র রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে। আর এ পার্থক্যের কারণ এছাড়া আর কিছুই নয় যে, একটি আদর্শিক রাষ্ট্রে শাসকদল একমাত্র তারাই হতে পারে যারা হবে রাষ্ট্রের মূলনীতির সমর্থক। এদলে এমন প্রত্যেক ব্যক্তি শামিল হতে পারে যে এ মূলনীতি মেনে নেবেনা। এপার্থক্য ও ফেরাউনী ধরনের পার্থক্যের কোনো মিল নেই। কারণ, ফেরাউনী পার্থক্যের ভিত্তিতে পরাধীন প্রজন্মের কোনো ব্যক্তি কখনো শাসক দলে শামিল হতে পারেনা। যেখানে পরাধীন প্রজন্মের লোকেরা রাজনৈতিক ও আইনগত অধিকার তো দূরের কথা মৌলিক মানবিক অধিকারও লাভ করেনা। এমন কি জীবিত থাকার অধিকারও তাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়া হয়। সেখানে কখনো পরাধীনদের জন্য কোনো অধিকারের জামানত দেয়া হয়না। সব ধরনের স্বার্থ, মুনাফা, সুযোগ সুবিধাও মর্যাদা একমাত্র শাসক সমাজের জন্য নির্দিষ্ট থাকে এবং এ বিশেষ অধিকার একমাত্র শাসক জাতির মধ্যে জন্মলাভকারী ব্যক্তিই লাভ করে।
ঙ. “হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় করো। তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তারপর তাদের দু’জনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছিড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী।”(সূরা নিসাঃ১)
যেহেতু সামনের দিকের আয়াতগুলোতে মানুষের পারস্পারিক অধিকারের কথা আলোচনা করা হবে, বিশেষ করে পারবারিক ব্যবস্থাপনাকে উন্নত সুগঠিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন কানুন বর্ণনা করা হবে, তাই এভাবে ভুমিকা ফাঁদা হয়েছে, একদিকে আল্লাহ্কে ভয় করার ও তাঁর অসন্তোষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য জোর তাকীদ করা হয়েছে এবং অন্যদিকে একথা মনের মধ্যে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, একজন মানুষ থেকে সমস্ত মানুষের উৎপত্তি এবং রক্ত-মাংস ও শারীরিক উপাদানের দিক দিয়ে তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের অংশ।
“তোমাদের একটি প্রাণ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” অর্থাৎ প্রথমে এক ব্যক্তি থেকে মানব জাতির সৃষ্টি করেন। অন্যত্র কুরআন নিজেই এর ব্যাখ্যা করে বলেছে যে, সেই প্রথম ব্যাক্ত ছিলেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম। তাঁর থেকেই এ দুনিয়ায় মানব বংশ বিস্তার লাভ করে।
“সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া।” এ বিষয়টির বিস্তরিত জ্ঞান আমাদের কাছে নেই। সাধারণ ভাবে কুরআনের তাফসীরকারগণ যা বর্ণনা করেন এবং বাইবেলে যা বিবৃত হয়েছে তা হচ্ছে নিন্মরুপ, আদমের পাঁজর থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তালমুদে আর একটু বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে, ডান দিকের ত্রয়োদশ হাড় থেকে সষ্টি হয়েছে। কিন্তু কুরআন মজীদ এ ব্যাপারে নীরব। আর এর সপক্ষে যে হাদীসটি পেশ করা হয় তার অর্থ লোকেরা যা মনে করে নিয়েছে তা নয়। কাজেই কথাটিকে আল্লাহ যেভাবে সংক্ষিপ্ত ও অস্পস্ট রেখেছেন তেমনি রেখে এর বিস্তারিত অবস্থা জানার জন্য সময় নষ্ট না করাই ভালো।
চ. “ দীনের ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি নেই।” (সূরা আল বাকারাঃ ২৫৬)
এখানে দীন বলতে পূর্ববর্তী আয়াত আয়াতুল কুরসীতে বর্ণিত আল্লাহ্ সম্পর্কিত আকীদা ও সেই আকীদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠেত জীবন ব্যবস্থা বুঝানো হয়েছে। আয়াতের অর্থ হচ্ছে, “ইসলাম” এর এই আকীদাগত এবং নৈতিক ও কর্মগত ব্যবস্থা কারো ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া যেতে পারেনা। যেমন কাউকে ধরে তার মাথায় জোর করে একটা বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়, এটা তেমন নয়।
উপরে উল্লোখিত আয়াত ও সেগুলোর ব্যাখ্যা থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের বিশেষ ধরনের স্বভব প্রকৃতি পরিস্ফুট হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র এ প্রকৃতির অনন্য রাষ্ট্র, যে তার সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেও দয়া, মমতা ও বন্ধুতার সাথে প্রয়োগ করে। বল প্রয়োগ এর প্রকৃতিতে নেই। কঠোরতার সাথে এর সম্পর্ক নেই। এটা হলো সেই রাষ্ট্র, যা মানবতার জন্য রহমত হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। পরাসর্শের ভিত্তিতে কাজ করাও এর বিশিষ্ট প্রকৃতিরই এক অনিবার্য দাবি।
৩. পরামর্শ বা শূরা
আল্লাহ্ তায়ালার ঘোষণাঃ
“এবং তারা নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে চালায়।”(সূরা শূরাঃ৩৮)
এ বিষয়টিকে এখানে ঈমানদারদের সর্বোত্তম গুণাবলীর মধ্যে গণ্য করা হয়েছে এবং সূরা আল ইমরানে (আয়াত ১৫৯) এর জন্য আদেশ করা হয়েছে। এ কারণে পরামর্শ ইসলামী জীবন প্রণালীর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। পরামর্শ ছাড়া সামষ্টেক কাজ পরিচালনা করা শুধু জাহেলী পন্থাই নয়, আল্লাহ্র নির্ধারিত বিধানের সুস্পষ্ট লংঘন। ইসলামে পরামর্শকে এই গুরুত্ব কেন দেয়া হয়েছে? এর কারণসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করলে আমাদের সামনে তিনটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়ঃ
এক. যে বিষয়টি দুই বা আরো বিশী লোকের স্বার্থের সাথে জড়িত সে ক্ষেত্রে কোনো এক ব্যক্তির নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের উপেক্ষা করা যুলুম। যৌথ ব্যাপারে কারো যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার নেই। ইনসাফের দাবী হচ্ছে,কোনো বিষয়ে যতো লোকের স্বার্থ জড়িত সে ব্যাপারে তাদের সবার মতামত গ্রহণ করতে হবে এবং তাতে যদি বিপুল সংখ্যক লোকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকে তাহলে তাদের আস্থাভাজন প্রতিনিধিদেরকে পরামর্শের মধ্যে শামিল করতে হবে।
দুই. যৌথ ব্যাপারে মানুষ স্বেচ্ছাচারিতা করার চেষ্ট করে অন্যদের অধিকার নস্যাত করে নিজের ব্যক্তি স্বার্থ লাভ করার জন্য, অথবা এর কারণ হয় সে নিজেকে বড় একটা কিছু এবং অন্যদের নগণ্য মনে করে। নৈতিক বিচারে এই দুটি জিনিসই সমপর্যায়ের হীন। মু’মিনের মধ্যে এ দুটির কোনেটিই পাওয়া যেতে পারেনা। মু’মিন কখনো স্বার্থপর হয়না। তাই সে অন্যদের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে নিজে অন্যায় ফায়দা চাইতে পারেনা এবং অহংকারী বা অত্মপ্রশংসিতও হতে পরেনা যে নিজেকেই শুধু মহাজ্ঞানী ও সবজান্তা মনে করবে।
তিন, যেসব বিষয় অন্যদের অধিকর ও স্বার্থের সাথে জড়িত সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি বড় দায়িত্ব। যে ব্যক্তি আল্লহ্কে ভয় করে এবং একথা জানে যে এর জন্য তাকে তার প্রভর কাছে কতো কঠিন জবাবদিহি করতে হবে সে কখনো একা এই শুরুভার নিজের কাঁধে উঠিয়ে নেবার দুঃসাহস করতে পারেনা। এ ধরনের দুঃসাহস কেবল তারাই করে যারা আল্লাহ্র ব্যাপারে নির্ভিক এবং আখিরাত সম্পর্কে চিন্তাহীন। খোদাভীরু ও আখিরাতের জবাবদিহির অনুভূতি সম্পন্ন লোক কোনো যৌথ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কিংবা তাদের নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধিদেরকে পরামর্শ গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই ইনসাফ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত কিংবা তাদের নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধিদেরকে পরামর্শ গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই শরীফ করার চেষ্টা করবে যাতে সর্বাধিক মাত্রায় সঠিক, নিরপেক্ষ এবং ইনসাফ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে যদি অজ্ঞাতসারে কোনো ত্রুটি হয়েও যায় তাহলে কোনো এক ব্যক্তির ঘাড়ে তার দায়দায়িত্ব এসে পড়বেনা।
এতিনটি কারণ এমন, যদি তা নিয়ে কেউ গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করে তাহলে অতি সহজেই সে একথা উপলব্ধি করতে পারবে যে, ইসলাম যে নৈতিক চরিত্রের শিক্ষা দেয় পরামর্শ তার অনিবার্য দাবী এবং তা এড়িয়ে চলা একটি অতি বড় চরিত্রহীনতার কাজ। ইসলাম কখনো এ ধরনের কাজের অনুমতি দিতে পারেনা। ইসলামী জীরন পদ্ধতি সমাজের ছোট বড় প্রতিটি ব্যাপারেই পরামর্শের নীতি কার্যকরী হোক তা চায়। পারিবারিক ব্যাপার হলে সে ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী পরামর্শ করে কাজ করবে এবং ছেলেমেয়ে বড় হলে তাদেরকেও পরামর্শে শরীফ করতে হবে। খান্দান বা গোষ্ঠীর ব্যাপার হলে সে ক্ষেত্রে গোষ্ঠীর সমস্ত বুদ্ধিমান ও বয়প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। যদি একটি গোত্র বা জাতিগেষ্ঠী কিংবা জনপদের বিষয়াদি হয় এবং তাতে সব মানুষের অংশগ্রহণ সম্ভব না হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব পঞ্চায়েত বা সভা পালন করবে যেখানে কোনো সর্বসম্মত পন্থা অনুসারে সংশিষ্ট আস্থাভাজন প্রতিনিধিরা শরীফ হবে। গোটা জাতির ব্যাপার হলে তা পরিচালনার জন্য সবার ইচ্ছানুসারে তাদের নেতা নিযুক্ত হবে জাতীয় বিষয়গুলোকে সে এমন সব ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ অনুসারে পরিচালনা করবে জাতি যাদেরকে নির্ভরযোগ্য মনে করে এবং সে ততক্ষণ পর্যন্ত নেতা থাকবে যতক্ষণ জাতি তাকে নেতা বানিয়ে রাখতে চাইবে। কোনো ঈমানদার ব্যক্তি জোরপূর্বক জতির নেতা হওয়ার বা হয়ে থাকার আকাংখ্যা কিংবা চেষ্টা করতে পারেনা। প্রথম জোরপূর্বক জাতির ঘাড়ে চেপে বসা এবং পরে জবরদস্তি করে মানুষের সম্মতি আদায় করা, এমন প্রতারণাও সে করতে পারেনা। তাকে পরামর্শ দানের জন্য মানুষ স্বাধীর ইচ্ছানুসারে নিজেদের মনোনীত প্রতিনিধি নয় বরং এমন প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবে। যে তার মর্জি মুতাবিক মতামত প্রকাশ করবে, এমন চক্রান্তও সে করতে পারেনা। এমন আকাংখা কেবল সে মানুষের মধ্যেই সৃষ্টি হতে পারে যার মন অসৎ উদ্দেশ্য দ্বারা কলুষিত। এই আকাংখার সাথে এর বাহ্যিক কাঠামো নির্মাণ এবং তার বাস্তব প্রণসত্তাকে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রচষ্টা শুধু সে ব্যক্তিই চালাতে পারে যে আল্লাহ্ এবং তাঁর সৃষ্টিকে ধোঁকা দিতে ভয় করেনা। অথচ না আল্লাহ্কে ধোকা দেয়া সম্ভব না আল্লাহ্র সৃষ্টি মানুষ এমন অন্ধ হতে পারে যে, প্রকাশ্য দিবালোকে কেউ ডাকাতি করছে আর মানুষ তা দেখে সরল মনে ভারতে থাকবে যে, সে ডাকাত নয়, মানুষের সেবা করছে।
এর নিয়মটি প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে পাঁচটি জিনিস দাবী করেঃ
এক. যৌথ বিষয়সমুহ যাদের অধিকার ও স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত তাদের মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধিনতা থাকতে হবে এবং কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারহুলো কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে সে বিষয়ে তাদের অবহিত রাখতে হবে। তারা যদি তাদের ব্যাপারগুলো নেতৃত্বে কোনো ত্রুটি, অপবিপক্কতা বা দুর্বলতা দেখে তহলে তা তুলে ধরার ও তার প্রতিবাদ করার এবং সংশোধিত হতে না দেখলে পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের পরিবর্তন করার অধিকার থাকতে হবে। মানুষের মুখ বন্ধ করে, হাত পা বেঁধে এবং তাদেরকে অনবহিত রেখে তাদের সামষ্টিক ব্যাপারসমূহ পরিচালনা করা সুস্পষ্ট প্রবঞ্চনা। কেউই এ কাজকে নীতির অনুসরণ মানতে পারেনা।
দুই. যৌথ বিষয়সমুহ পরিচালনার দায়িত্ব যাকেই দেয়া হবে তাকে যেনো এ দায়িত্ব সবার স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে দান করা হয়। জবরদস্তি ও ভয়ভীতি দ্বারা অর্জিত কিংবা লোভ লালসা দিয়ে খরিদকৃত অথবা ধোঁকা প্রতারণা ও চক্রান্তের মাধ্যমে লুন্ঠিত সম্মতি প্রকৃতপক্ষে কোনো সম্মতি নয়। যে সম্ভাব্য সব রকম পন্থা কাজে লাগিয়ে কোনো জাতির নেতা হয় সে সত্যিকার নেতা নয়। সত্যিকার নেতা সেই যাকে মানুষ নিজেদের পছন্দানুসারে সনন্দ চিত্তে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে।
তিন. নেতাকে পরামর্শ দানের জন্যও এমন সব লোক নিয়োগ করতে হবে যাদের প্রতি জতির আস্থা আছে। এটা সর্বজনতিদিত যে, যারা চাপ সৃষ্টি করে কিংবা অর্থ দ্বারা খরিদ করে অথবা মিথ্যা ও চক্রান্তর সাহায্যে বা মানুষকে বিভ্রান্ত করে প্রতিনিধিত্বের স্থানটি দখল করে তাদেরকে সঠিক অর্থে আস্থাভাজন বলা যায়না।
চার. পরামর্শদাতাগণ নিজেদের জ্ঞান, ঈমান ও বিবেক অনুসারে পরামর্শ দান করবে এবং এভাবে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। এ দিকগুলো যেখানে থাকবেনা, যেখানে পরামর্শদাতা কোনো প্রকার লোভ লালসা বা ভীতির কারণে অথবা কোনো দলাদলির মারপ্যাঁচের কারণে নিজের জ্ঞান ও বিবেকের বিরুদ্ধে মতামত পেশ করে সেখানে প্রকৃতপক্ষে হবে খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা এর অনুসরণ নয়।
পাঁচ. পরাসর্শদাতাদের ‘ইজমা’র (সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত) ভিত্তিতে যে পরামর্শ দেয়া হবে, অথবা যে সিদ্ধান্ত তাদের অধিকাংশের সমর্থন লাভ করবে তা মেনে নিতে হবে। কেননা সবার মতামত জানার পরও যদি এক ব্যাক্তি অথবা একটি ছোট্র গ্রুপকে স্বেচ্ছাচার চালানোর সুযোগ দেয়া হয় তাহলে পরামর্শ অর্থহীন হয়ে যায়। আল্লাহ্ একথা বলছেননা যে, “তাদরে ব্যাপার তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়” বরং বলছেন, “তাদের কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে চলে।” শুধু পরামর্শ করলেই এ নির্দেশ পালন করা হয়না। তাই পরামর্শের ক্ষেত্রে সর্বসম্মত অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজকর্ম পরিচালনা প্রয়োজন।
ইসলামের পরামর্শ ভিত্তিক কাজ পরিচালনা নীতির এই ব্যাখ্যার সাথে সাথে এই মৌলিক কথাটির প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, মুসলমানদের পারস্পরিক বিষয়সমূহ পরিচালনায় এই শূরা স্বেচ্ছাচারী এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নয়, বরং অবশ্যই সেই দীনের বিধি বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ আল্লাহ্ নিজেই যার জন্য বিধান রচনা করেছেন। সাথে সাথে তা সেই মূল নীতিরও আনুগত্য করতে বাধ্য, যাতে বলা হয়েছে “যে ব্যাপারেই তোমাদের মধ্যে মতভেদ হবে তার ফয়সালা করবেন আল্লাহ্।” এবং “তোমাদের মধ্যে যে বিরোধই বাঁধুক না কেনো সে জন্য আল্লাহ্ তাঁর রসূলের দিকে ফিরে যাও। “ এই সাধারণ সূত্র অনুসারে মুসলমানরা শর’য়ী বিষয়ে মূল গ্রন্থের কোন্ অংশের কি অর্থ এবং কিভাবে তা কার্যকর করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করতে পারে যাতে তার মূল ইদ্দেশ্য পূরণ হয়। কিন্তু যে ব্যাপারে আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সে ব্যাপারে তার নিজেরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এ উদ্দেশ্যে কোনো পরামর্শ করতে পারেনা।
৪. আদল ও ইহসান
“আল্লাহ্ আদল, ইহসান ও আত্মীয় স্বজনকে দান করার হুকুম দেন এবং অশ্লীলতা নির্লজ্জতা ও দুষ্কৃতি এবং অত্যাচার বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন।” (সূরা আননহলঃ ৯০)
এ ছোট্র বাক্যটিতে এমন তিনটি জিনিসের হুকুম দেয়া হয়েছে যেগুলোর ওপর সমগ্র মানব সমাজের সঠিক অবকাঠামোতে ও যথার্থ চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত থাকা নির্ভরশীল।
প্রথম জিনিসটি হচ্ছে আদল। দু’টি স্থায়ী সত্যের সমন্বয়ে এর ধারণাটি গঠিত। এক. লোকদের মধ্যে অধিকারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও সষমতা থাকতে হবে। দুই. প্রত্যেককে নির্দ্বিধায় তার অধিকার দিতে হবে। আমাদের ভাষায় এ অর্থ প্রকাশ করার জন্য “ইনসাফ” শদ্ব ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ শদ্বটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এ থেকে অনর্থক এ ধারণা সৃষ্টি হয় যে, দু’ ব্যক্তির মধ্যে “নিস্ফ” “নিস্ফ” বা আধাআধির ভিত্তিতে অধিকার বন্টিত হতে হবে। তারপর এ থেকেই আদল ও ইনসাফের অর্থ মনে করা হয়েছে সাম্য ও সমান সমান ভিত্তিতে অধিকার বন্টন। এটি সম্পূর্ণ প্রকৃতি বিরোধী। আসলে “আদল” সমতা বা সাম্য নয়, বরং ভারসাম্য ও সমন্বয় দাবী করে। কোনো কোনো দিক দিয়ে “আদল” অবশ্যই সমাজের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সাম্য চায়। যেমন নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে। কিন্তু আবার কোনো কোনো দিক দিয়ে সাম্য সম্পূর্ণ “আদল” বিরোধি। যেমন পিতা মাতা ও সন্তানদের মধ্যে সামাজিক ও নৈতিক সাম্য এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মজীবী ও নিন্ম পর্যায়েল কর্মজীবীদের মধ্যে বেতনের সাম্য। কজেই আল্লাহ্ যে জিনিসের হুকুম দিয়েছেন তা অধিকারের মধ্যে সাম্য নয় বরং ভারসাম্য ও সমন্বয় প্রতিষ্ঠা। এ হুকুমের দাবী হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইনগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার পূর্ণ ঈমানদারীর সাথে প্রদান করতে হবে।
দ্বিতীয় জিনিসটি হচ্ছে ইহ্সান। এর অর্থ হলো, পরোপকার তথা সদাচার, ঔদার্যপূর্ণ ব্যবহার, সহানুভূতিশীল আচরণ,সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীরতা, পারস্পরিক সুযোগ সাবিধা দান, একজন অপর জনের মর্যাদা রক্ষা করা, অন্যকে তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশী দেয়া এবং নিজের অধিকার আদায়ের বেলায় কিছু কমে রাযী হয়ে যাওয়া। এহচ্ছে আদলের অতিরিক্ত এমন একটি জিনিস যার গুরুত্ব সামষ্টিক জীবনে আদলের চাইতেও বেশী। আদল যদি হয় সমাজের বুনিয়াদ তাহলে ইহ্সান হচ্ছে তার সৌন্দর্য ও পূর্ণতা। আদল যদি সমাজকে কটুতা ও তিক্ততা থেকে বাঁচায় তাহলে ইহ্সান তার মধ্যে সমাবেশ ঘটায় মিষ্ট মধুর স্বাদের। কোনো সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি সর্বক্ষণ তার অধিকার কড়ায় গন্ডায় মেপে মেপে আদায় করতে থাকবে এবং তারপর ঐ নির্দিষ্ট পরমাণ অধিকর আদায় করে নিয়েই তবে ক্ষান্ত হবে, আবার অন্যদিকে অন্যদের অধিকারের পরিমাণ কি তা জেনে নিয়ে কেবলমাত্র যতোটুকু প্রাপ্য ততোটুকুই আদায় করে দেবে, এরূপ কট্রর নীতির ভিত্তিতে আসলে কোনো সমাজ টিকে থাকতে পারেনা। এমনি ধরনের একটি শীতল ও কাঠখোট্টা সমাজে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত থাকবেনা ঠিকই কিন্তু ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, ঔদার্য, ত্যাগ, আন্তরিকতা, মহানুভাবতা ও মঙ্গলাকাংখার মতো জীবনের উন্নত মূল্যবোধগুলোর সৌন্দর্য সুষমা থেকে সে বঞ্চিত থেকে যাবে। আর এগুলোই মূলত এমন সব মূল্যবোধ যা জীবনে সুন্দর আবহ ও মধুর আমেজ সৃষ্টি করে এবং সামষ্টিক মানবীয় গুণাবলীকে বিকশিত করে।
তৃতীয় যে জিনিসটির এ আয়াতে হুকুম দেয়া হয়েছে সেটি হচ্ছে আত্মীয় স্বজনকে দান করা এবং তাদের সাথে সদাচার করা। এটি আত্মীয় স্বজনদের সাথে ইহ্সান করার একটি বিশেষ ধরন নির্ধারণ করে। এর অর্থ শুধু এই নয় যে, মানুষ নিজের আত্মীয়দের সাথে তাদের সাহায্যকারী ও সহায়ক হবে। বরং এও এর অর্থের অন্তরভুক্ত যে, প্রত্যেক সমর্থ ব্যক্তি নিজের ধন সম্পদের ওপর শুধুমাত্র নিজের ও নিজের সন্তান সন্ততির অধিকার আছে বলে মনে করবেনা বরং একই সংগে নিজের আত্মীয় স্বজনদের অধিকারও স্বীকার করবে। আল্লাহ্র শরীয়ত প্রত্যেক পরিবারের সচ্ছল ব্যক্তিবের্গের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে যে, তাদের পরিবারের অভাবী লোকেরা যেনো অভুক্ত ও বস্ত্রহীন না থাকে। তার দৃষ্টিতে কোনো সমাজের এর চেয়ে বড় দুর্গতি আর হতেই পারেনা যে, তার মধ্যে বসবাসকারী এক ব্যক্তি প্রাচুর্যর মধ্যে অবস্থান করে বিলাসী জীবন যাপন করবে এবং তারই পরিবারের সদস্য তার নিজের জ্ঞাতি ভাইয়েরা ভাত কাপড়ের অভাবে মানবতার জীবন যাপন করতে থাকবে। ইসলাম পরিবারবে সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গণ্য করে এবং এ ক্ষেত্রে এ মূলনীতি পেশ করে যে, প্রত্যেক পরিবারের গরীব ব্যক্তিবর্গের প্রথম অধিকার বর্তায় তাদের পরিবারের সচ্ছল ব্যক্তিবর্গের ওপর, তারপর অন্যদের ওপর তাদের অধিকার আরোপিত হয়। আর প্রত্যেক পরিবারের সচ্ছল ব্যক্তিবর্গের ওপর অধিকার আরোপিত হয় তাদের গরীব আত্মীয় স্বজনদের, তারপর অন্যদের অধিকার তাদের ওপর আরোপিত হয়। এ কথাটিই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। তাই বিভিন্ন হাদীসে পরষ্কার বলে দেয়া হয়েছে, মানুষের ওপর সর্বপ্রথন অধিকার তার পিতামাতার, তারপর স্ত্রী সন্তানদের, তারপর ভাই বোনদের, তারপর যার তাদের পরে নিকটতর এবং তারপর যারা তাদের পরে নিকটতর। এ নীতির ভিত্তিতেই হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একটি ইয়াতীম শিশুর চাচাত ভাইদেরকে তার লালন পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন। তিনি অন্য একজন ইয়াতীমের পক্ষে ফয়সালা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, যদি এর কোনো দূরতম আত্মীয়ও থাকতো তাহলে আমি তার ওপর এর লালন পালনের দায়িত্ব অপরিহার্য করে দিতাম। অনুমান করা যেতে পারে, যে সমাজের প্রতিটি পরিবার ও ব্যক্তি (Unit) এ ভাবে নিজেদের ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব নিজেরাই নিয়ে নেয় সেখানে কতোখানি অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, কেমন ধরনের সামাজিক মাধুর্য এবং কেমনতর নৈতিক ও চারিত্রিক পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও উন্নত পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।
ওপরে তিনটি সৎ কাজের মুকাবিলায় আল্লাহ্ তিনটি অসৎ কাজ করতে নিষেধ করেন। এ অসৎকাজগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সমাষ্টিক পর্যায়ে সমগ্র সমাজ পরিবেশকে খারাপ করে দেয়। প্রথম জিনিসটি হচ্ছে অশ্লীলতা নির্লজ্জতা। সব রকমের অশালীন, কদর্য ও নির্লজ্জ কাজ এর অন্তরভূক্ত। এমন প্রত্যেকটি খারাপ কাজ যা স্বভাবতই কুৎসিত, নোংরা, ঘৃণ্য ও লজ্জাকর। তাকেই বলা হয় অশ্লীলতা। যেমন কৃপণতা, ব্যাভিচার, উলংগতা, সমকামিতা, মাহরাম আত্মীয়কে বিয়ে করা, চুরি, শরাব পান, ভিক্ষাবৃত্তি, গালাগালি করা, কটু কথা বলা ইত্যাদি। এভাবে সর্ব সমক্ষে বেহায়পানা ও খারাপ কাজ করা এবং খারাপ কাজকে ছড়িয়ে দেয়াও অশ্লীলতা নির্লজ্জতার অন্তরভুক্ত। যেমন মিথ্যা প্রচারণা, মিথ্যা দোষারোপ, গোগন অগরাধ জনসমক্ষে বলে বেড়ানো, অসৎকাজের প্ররোচক গল্প, নাটক ও চলচ্চিত্র, উলংগ চিত্র, মেয়েদের সাজগোজ করে জনসমক্ষে আসা, নারী পুরুষ প্রকাশ্যে মেলামেশা এবং মঞ্চে মেয়েদের নাচগান করা ও তাদর শারীরিক অংগভংগির প্রদর্শনী করা ইত্যাদি।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে দুষ্কৃতি। এর অর্থ হচ্ছে এমন সব অসৎ কাজ যেগুলোকে মানুষ সাধারণভাবে খারাপ মনে করে থাকে, চিরকাল বলে আসছে এবং আল্লাহ্র সকল শরীয়ত যে কাজ করতে নিষেধ করেছে।
তৃতীয় জিনিসটি যুলুম বাড়াবাড়ি। এর মানে হচ্ছে, নিজের সীমা অতিক্রম করা এবং অন্যের অধিকার তা আল্লাহ্র হোক বা বান্দার লংঘন করা ও তার ওপর হস্তক্ষেপ করা।
৫. নেতৃত্ব নির্বাচনের মূলনীতি
ইমলামী রাষ্ট্রে নেতৃত্ব নির্বাচনের নীতিও অন্যান্য রাষ্ট্রের চেয়ে ভিন্নতর। এখনে বিবেচ্য বিষয় হলো যোগ্যতা, বেশ্বস্ততা, নির্ভরযোগ্যতা, আল্লাহ্ভীতি ও উত্তম আচরণঃ
ক.“হে মুসলিমগণ! আল্লাহ্ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদের হাতে ফেরত দেবার নির্দেশ দেচ্ছেন। আর লোকদের মধ্যে ফায়সালা করার সময় ‘আদল’ ও ন্যায়নীতি সহকারে ফায়সালা করো। আল্লাহ্ তোমাদের বড়ই উৎকৃষ্ট উপদেশ দান করেন। আর অবশ্যি আল্লাহ্ সবকিছু শোনেন ও দেখেন।”(সূরা আন-নিসাঃ ৫৮০)
অর্থাৎ বনী ইসরাঈলরা যেসব খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে গেছে তোমরা সেগুলো থেকে দূরে থেকো। বনী ইসরাঈলদের একটি মৌলিক দোষ ছিলো এই যে, তারা নিজেদের পতনের যুগে আমানতসমূহ অর্থাৎ দায়িত্বপূর্ণ পদ, ধর্মীয় নেতৃত্ব ও জাতীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মর্যাদাপূর্ণ পদসমূহ (Posutions of trust) এমন সব লোকদের দেয়া শুরু করেছিল যারা ছিলো অযোগ্য, সংকীর্ণমনা, দুশ্চরিত্র, দুর্নীতিপরায়ণ, খিয়ানতকারী ও ব্যভিচারী। ফলে অসৎ লোকদের নেতৃত্বে সমগ্র জাতি অনাচারে লিপ্ত হয়ে গেছে। মুসলমানদের উপদেশ দেয়া হচ্ছে, তোমরা এই বনী ইসরাঈলদের মতো আচরণ করোনা। বরং তোমরা যোগ্য লোকদেরকে আমানত সোপর্দ করো। অর্থাৎ আমানতের বোঝা বহন করার ক্ষমতা যাদের আছে কেবল তাদের হাতে আমানত তুলে দিয়ো। বনী ইসরাঈলদের দ্বিতীয় বড় দুর্বলতা এই ছিলো যে, তাদের মধ্যে সুবিচার ও ন্যায়নীতির প্রাণশক্তি বিলু্প্ত হয়ে গিয়েছিল। ব্যক্তিগত ও জাতীয় স্বার্থে তারা নির্দ্বিধায় ঈমান বিরোধী কাজ করে চলতো। সত্যকে জেনেও সুস্পষ্ট হঠধর্মীতায় লিপ্ত হতো। ইনসাফের গলায় ছুরি চালাতে কখনো একটুও কুষ্ঠাবোধ করতোনা। সে যুগের মুসলমানরা তাদের বেইনসাফীর তিক্ত অভিজ্ঞতা হতে কলমে লাভ করে চলছিল। একদিকে তাদের সামনে ছিলো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর ওপর যারা ঈমান এনেছিল তাদের পুতপবিত্র জীবনধারা। অন্যদিকে ছিলো এমন এক জনগোষ্ঠীর জীবন যারা মূর্তিপূজা করে চলছিল। তারা কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতো। বিমাতাদেরকেও বিয়ে করতো। উলংগ অবস্থায় কাবাঘরের চারদিকে তাওয়াফ করতো। এই তথাকথিত আহলি কতিাবরা এদের মধ্য থেকে প্রথম দলটির ওপর দ্বিতীয় দলটিকে প্রাধান্য দিতো। তারা একথা বলতে একটুও লজ্জা অনুভব করতোনা যে, প্রথম দলটির তুলনায় দ্বিতীয় দলটি অধিকতর সঠিক পথে চলছে। মহান আল্লাহ্ তাদের এই বেইনসাফির বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পর এবার মুসলমানদের উপদেশ দিচ্ছেন, তোমরা ওদের মতো অবিচারক হয়োনা। কারো সাথে বন্ধুতা বা শত্রুতা যাই হোক না কেন সব অবস্থায় ইনসাফ ও ন্যায়নীতির কথা বলবে এবং ইনসাফ ও সুবিচার সহকারে ফয়সালা করবে।
খ.“যেসব লাগামহীন লোক পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং কোনো সংস্কার সাধন করেনা তাদের আনুগত্য করোনা।” (সূরা শুয়ারাঃ ১৫১-১৫২)
অর্থৎ তোমাদের যেসব রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ এবং শাসকদের নেতৃত্বে এ ভ্রান্ত বিকৃত জীরন ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে তাদের আনুগত্য পরিহার করো। এরা সব লাগাম ছাড়া। নৈতিকতার সমস্ত সীমা লংঘন করে এরা লাগামহীন পশুতে পরিণত হয়েছে। এদের দ্বারা সমাজ সভ্যতার কোনো সংস্কার হতে পারেনা। এরা যে ব্যবস্থা পরিচালনা করবে তার মধ্যে বিকৃতিই ছড়িয়ে পড়বে। তোমাদের জন্য কল্যাণের কোনো পথ যদি থাকে তাহলে তা কেবলমাত্র এই একটিই। অর্থাৎ তোমরা নিজেদের মধ্যে আল্লাহ্র ভয় সৃষ্টি করো এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের আনুগত্য পরিহার করে আমার আনুগত্য করো। কারণ আমি আল্লাহ্র রসূল। আমার আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তোমরা পূর্ব থেকেই অবগত আছো। আমি একজন নিস্বার্থ ব্যক্তি। নিজের কোনো ব্যক্তিগত লাভের জন্য আমি এ সংস্কারমূলক কাজে হাত দেইনি। এ ছিলো হযরত সালেহ আলাইহিস্ সালামের ঘোষণাপত্রের সংক্ষিপ্তসার। নিজের জাতির সামনে তিনি এটি পেশ করেছিলেন। এর মধ্যে শুধু প্রচারণাই ছিলোনা বরং একই সংগে তামাদ্দুনিক ও নৈতিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক বিপ্লবের দাওয়াতেও ছিলো।
গ. “এমন কোনো লোকের আনুগত্য করোনা যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফিল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির কামনা বাসনার অনুসরণ করেছে এবং যার কর্মপদ্ধতি কখনো উগ্র, কখনো উদাসীন।” (সূরা আল কাহফঃ ২৮)
অর্থাৎ তার কথা মেনোনা, তার সমনে মাথা নতো করোনা, তার ইচ্ছা পূর্ণ করোনা এবং তার কথায় চলোনা। এখানে আনুগত্য শদ্বটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হয়েছে।
৬. প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধ ও সন্ধির মূলনীতি
ইসলামী রাষ্ট্রের একটি বুনিয়াদী পলিসি হলো, তা সর্বদিক থেকে হবে মজবূত, সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠিত সামরিক দিক থেকেও, অথনৈতিক দিক থেকেও। সে যে মহান দায়িত্ব পালন করবে তা প্রবল প্রতিরক্ষা শক্তির প্রস্তুতি ছাড়া কিছুতেই পালন করা সম্ভব নয়ঃ
ক. “আর তোমরা নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী সর্বাধিক পরিমাণ শক্তি ও সদাপ্রস্তুত ঘোড়া তাদের মুকাবিলার জন্য যোগড় করে রাখো। এর মাধ্যমে তোমরা ভীত সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহ্র শত্রুকে, নিজের শত্রুকে এবং অন্য এমন সব শত্রুকে যাদের তোমরা চিনোনা। কিন্তু আল্লাহ্ চিনেন।” (সূরা আনফালঃ ৬০)
এর অর্থ হচ্ছে, তোমাদের কাছে যুদ্ধোপকরণ ও একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী (Standing Army) সর্বক্ষণ তৈরী থাকতে হবে। তাহলে প্রয়োজনের সময় সংগে সংগেই সামরিক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভবপর হবে। এমন যেনো না হয়, বিপদ মাথার ওপর এসে পরার পর হতবুদ্ধি হয়ে তাড়াতাড়ি স্বেচ্ছাসেবক, অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য রসদপত্র যোগাড় করার চেষ্টা হবে এবং এভাবে প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন হতে হতেই শত্রু তার কাজ শেষ করে ফেলবে।
খ. “যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে লড়াই এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শলিবিদ্ধ করা হবে বা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে। অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় তাদের জন্য এ অপমান ও লাঞ্ছনা নির্ধারিত রয়েছে আর আখিরাতে রয়েছে তদের জন্য এর চাইতেও বড় শাস্তি।” (সূরা মায়িদাঃ ৩৩)
পৃথিবী বলতে এখানে পৃথিবীর সেই অংশ ও অঞ্চল বুঝাচ্ছে যেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কায়েম করার দায়িত্ব ইসলামী সরকার গ্রহণ করেছে। আর আল্লাহ্ ও রসূলের সাথে লড়াই করার অর্থ হচ্ছে, ইসলামী সরকার দেশে যে সৎ ও সত্যনিষ্ঠা সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন করেছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা। পৃথিবীতে একটি সৎ ও সত্যনিষ্ঠা রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই আল্লাহ্র ইচ্ছা এবং এ জন্য নিজের রসূল পাঠিয়েছেলেন। সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে পৃথিবীতে অবস্থানকারী মানুষ, পশু, বৃক্ষ ইত্যাদি সমস্ত সৃষ্টি শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবে, মানবতা তার প্রকৃতির কাংখিত পূর্ণতায় পৌঁছতে সক্ষম হবে এবং পৃথিবীর সমুদয় উপায় উপকরণ এমনভাবে ব্যবহৃত হবে যার ফলে সেগুলো মানবতার ধ্বংস ও বিলুপ্তির নয় বরং তার উন্নতির সহায়ক হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা কোনো ভূখন্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর তাকে নষ্ট করার প্রচেষ্টা চালানো, বা ক্ষুদ্র পরিসরে হত্যা, লন্ঠন, রাহাজানি, ডাকাতি ইত্যাদি পর্যায়ে চালানো হোক অথবা আরো বড় আকারে, এ সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যবস্থাকে উৎখাত করে তার জায়গায় কোনো বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেই চালানো হোক না কেন, তা আসলে আল্লাহ্ ও তার রসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবেই বিবেচিত হবে। এটা ঠিক তেমনি যেমন ভারতিয় দন্ডবিধিতে কোনো ব্যক্তির ভারতে বৃটিশ সরকারের ক্ষমতা উচ্ছেদের প্রচেষ্টাকে “সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” (Waging war against the king) করার অপরাধে অভিযুক্ত গণ্য করা হয়েছে- সে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো একজন মামূলী সিপাইয়ের বিরুদ্ধে কিছু করলেও এবং সম্রাট তার নাগালের বহু দূরে অবস্থান করলেও তার অপরাধের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়না।
বিভিন্ন ধরনের শাস্তির কথা এখানে সংক্ষেপে বলে দেয়া হয়েছে, যাতে করে কাযী বা সমকালীন ইসলামী শাসক নিজের ইজতিহাদের মাধ্যমে প্রত্যেক অপরাধীকে তার অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারেন। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা প্রকাশ করা যে, ইসলামী হুকুমতের আওতায় বাস করে কোনো ব্যক্তির ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার প্রচষ্টা চালানো নিকৃষ্ট ধরনের কোনো ব্যক্তির ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার প্রচষ্টা চালানো নিকৃষ্ট ধরনের অপরাধ এবং এ জন্য তাকে উল্লেখিত চরম শাস্তিগুলোর মধ্য থেকে কোন্ শাস্তি দেয়া যেতে পারে।
গ. “আহলি কিতাবদের যারা আল্লাহ্ ও পরকালি ঈমান আনেনা, যা কিছু আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল হারাম গণ্য করেছেন তাকে হারাম করেনা এবং সত্য দীনকে নিজেদের দীনে পরিণত করেনা, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যে পর্যন্ত না তারা নিজেদের হাতে জিযিয়া দেয় ও পদানত হয়ে থাকে।”(সূরা তওবাঃ ২৯)
আল্লাহ্ তাঁর রসূলের মাধ্যমে যে শরীয়ত নাযিল করেছেন তাকে যারা নিজেদের জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করেনা, এখানে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
তারা ঈমান আনবে ও আল্লাহ্র সত্য দীনের অনুসারী হয়ে যাবে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য লক্ষ্য তা নয়। বরং যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছেঃ তাদের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য খতম হয়ে যাবে। তারা পৃথিবীতে শসন কর্তৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারবেনা। বরং পৃথিবীতে মানুষের জীবন ব্যবস্থার লাগাম এবং মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করা ও তাদের নেতৃত্ব দান করার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার সত্যের অনুসারীদের হাতে থাকবে এবং তারা এ সত্যের অনুসারীদের অধীনে অনুগত জীবন যাপন করবে।
যিম্মীদেরকে ইসলামী শাসনের অওতায় যে নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ দান করা হবে তার বিনিময়কে জিযিয়া বলা হয়। তাছাড়া তারা যে হুকুম মেনে চলতে এবং ইসলামী শাসনের আওতাধীন বসবাস করতে রাযী হয়েছে, এটা তার একটা আলামত হিসেবেও চিহ্নিত হবে। “নিজের হাতে জিযিয়া দেয়” –এর অর্থ হচ্ছে, সহজ সরল আনুগত্যের ভংগিতে জিযিয়া আদায় করা। আর “পদানত হয়ে থাকে” এর অর্থ, পৃথিবীতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাদের নয় বরং যে মুমিন ও মুসলিমরা আল্লাহ্র খিলাফত ও প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করেছে তাদের হাতে থাকবে।
প্রথম দিকে ইহুদী ও খৃষ্টানদের কাছ থেকে জিযিয়া আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছেল। কিন্তু পরবর্তীকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে মাসজীদের (অগ্নিউপাসক) থেকে জিযিয়া আদায় করে তাদেরকে যিম্মী করেন। এরপর সাহাবায়ে কিরাম সর্বসম্মতিক্রমে আরবের বাইরের সব জাতির ওপর সাধারণভাবে এ আদেশ প্রয়োগ করেন।
ঊনিশ শতকে মুসলিম মিল্লাতের পতন ও অবনতির যুগে এ ‘জিযিয়া’ সম্পর্কে মুসলমানদের পক্ষ থেকে বড় বড় সাফাই পেশ করা হতো। সে রকম কিছু লোক এখনো রয়েছে এবং তারা এখনো এ ব্যাপারে সাফাই গেয়ে চলেছে। কিন্তু আল্লাহ্র দীন এসবের অনেক উর্দ্ধে। আল্লাহ্র বিধানের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহের ভূমিকায় অবতীর্ণ, ও সোজা কথায়, যারা আল্লাহ্র দীনকে গ্রহণ করেনা এবং নিজেদের বা অন্যের উদ্ভাবিত ভুল পথে চলে, তার বড় জোর এতোটুকু স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রাখে যে, নিজেরা ভুল পথে চলতে চাইলে চলতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্র যমীনে কোনো একটি জায়গায়ও মানুষের ওপর শাসন চালাবার এবং নিজেদের ভ্রান্তনীতি অনুযায়ী মানুষের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত করার আদৌ কোনো অধিকার তাদের নেই। দুনিয়ার যেখানেই তারা এ জিনিসটি লাভ করবে সেখানেই বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। তাদেরকে এ অবস্থান থেকে সরিয়ে দিয়ে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ জীবন বিধানের অনুগত করার জন্য প্রচষ্টা চালানোই হবে মুমিনদের কর্তব্য। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, এ জিযিয়া কিসের বিনিময়ে দেয়? এর জবাব হচ্ছে, ইসলামী শামন কর্তৃত্বের আওতাধীনে নিজেদের গোমরাহীর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য অমুসলিমদের যে স্বাধীনতা দান করা হয় এটা তারই মূল্য। আর যে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা তাদের এ স্বাধীনতাকে কাজে লাগাবার অনুমতি দেয় এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণ করে তার শাসন ও আইন শৃংখলা ব্যবস্থা পরিচালনায় এ অর্থ ব্যয়িত হওয়া উচিত। এর সবচেয়ে বড় ফায়দা হচ্ছে এই যে, জিযিয়া আদাল করার সময় প্রতি বছর যিম্মীদের সধ্যে একটি অনুভূতি জাগতে থাকবে। প্রতি বছর তারা মনে করতে থাকবে, তারা আল্লাহ্র পথে যাকাত দেবার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত আর এর পরিবর্তে গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য তাদের মূল্য দিতে হচ্ছে। এটা তাদের কত বড় দুর্ভাগ্য। এ দুর্ভাগ্যের কারাগারে তারা বন্দী।
ঘ. “তবে যারা তোমাদের হাতে ধরা পড়ার আগেই তওবা করে তাদের জন্য নয়। তোমাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী।” (সূরা মায়িদাঃ ৩৪)
অর্থাৎ যদি তারা বিপর্যয় সৃষ্টির প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয়, সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন ও তাকে ছিন্নভিন্ন করার অপচেষ্টা পরিহার করে এবং তাদের পরবর্তী কর্মনীতি একথা প্রমাণ করে যে, তারা শান্তিপ্রিয়, আইনের অনুগত ও সদাচারী হয়ে গেছে আর তারপর যদি তাদের আগের অপরাধের কথা জানা যায়, তাহলে ওপরে বর্ণিত শাস্তিগুলোর মধ্য থেকে কোনো শাস্তি তাদেরকে দেয়া হবেনা। তবে যদি তারা মানুষের অধিকারের ওপর কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করে থাকে, তাহলে তার দায়িত্ব থেকে তাদেরকে মুক্ত মুক্ত করা যাবেনা। যেমন তারা যদি কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে থাকে অথবা কারোর সম্পদ অন্যায়ভাবে হস্তগত করে থাকে বা অন্য কোনো অপরাধ করে থাকে, তবে এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে ঐ বিশেষ অপরাধ সংক্রন্ত ফৌজদারী মামলা চালানো হবে। কিন্তু বিদ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতা বা আল্লাহ্ ও রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা সম্পর্কিত কোনো মামলা তাদের বিরুদ্ধে চালানো হবেনা।
৭. সমাজনীতি রাজনীতি ও শিক্ষানীতির সাধারণ মূলনীতি
“তোমার রব ফায়সালা করে দিয়েছেনঃ
১. তোমরা কারোর ইবাদত করোনা, একমাত্র তাঁরই ইবাদত করো!
২. পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার করো। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোনো একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে “উহ” পর্যন্তও বলোনা এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়োনা বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে বথা বলো। আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাকো এবং দোয়া করতে থাকো এই বলেঃ হে আমার প্রতিপপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতাসহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। তোমাদের রব খুব ভালো করেই জানেন তোমাদের মনে কি আছে। যদি তোমরা সৎকর্মশীল হয়ে জীবন যাপন করো তাহলে তিনি এমন লোকদের প্রতি ক্ষমাশীল যারা নিজেদের ভুলের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে বন্দেগীর নীতি অবলম্বন করার দিকে ফিরে আসে।
৩. আত্মীয়কে তার অধিকার দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও তাদের অধিকার দাও।
৪. বাজে খরচ করোনা। যারা বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ।
৫. যদি তাদের থেকে (অর্থাৎ অভাবী, আত্মীয় স্বজন মিসকীন ও মুসাফির থেকে) তোমাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় এ জন্য যে, এখনো তুমি আল্লাহ্র প্রত্যাশিত রহমতের সন্ধান করে ফিরছো, তাহলে তাদেরকে নরম জবাব দাও।
৬. নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখোনা এবং তাকে একবারে খোলাও ছেড়ে দিয়োনা, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে। তোমার রব যার জন্য চান রিযিক প্রশস্ত করে দেন আবার যার জন্য চান সংকীর্ণ করে দেন। তিনি নিজের বান্দাদের অবস্থা জানেন এবং তাদেরকে দেখছেন।
৭. দারিদ্রের আশংকায় নিজেদের সন্তান হত্যা করোনা। আমি তাদেরকেও রিযিক দেবো এবং তোমাদেরকেও। আসলে তাদেরকে হত্যা করা একটি মহাপাপ।
৮. যিনার কাছেও যেয়োনা, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ।
৯. আল্লাহ্ যাকে হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন, সত্য ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করোনা। আর যে ব্যক্তি মযলুম অবস্থায় নিহত তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবী করার অধিকার দান করেছি। কাজেই হত্যার ব্যাপারে তার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়, তাকে সাহায্য করা হবে।
১০. এতীমের সম্পত্তির ধারে কাছে যেয়োনা, তবে হ্যাঁ সদুপায়ে, যে পর্যন্ত না সে বয়োপ্রাপ্ত হয়ে যায়।
১১. প্রতিশ্রুতি পালন করো, অবশ্যই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
১২. মেপে দেবার সময় পরিমাপ পাত্র ভরে দাও এবং ওজন করে দেবার সময় সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। এটিই ভালো পদ্ধতি এবং পরিণামের দিক দিয়েও এটিই উত্তম।
১৩. এমন কোনো জিনিসের পেছনে লেগে যেয়োনা যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই। নিশ্চিতভাবেই চোখ. কান ও দিল সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
১৪. যমীনে দম্ভভরে চলোনা। তুমি না যমীনকে চিরে ফেলতে পারবে, না পাহাড়ের উচ্চতায় পৌছে যেতে পারবে।
এ বিষয়গুলোর মধ্য থেকে প্রত্যেকটির খারাপ দিক তোমার রবের কাছে অপছন্দনীয়। তোমার রব তোমাকে অহীর মাধ্যমে যে হিকমতের কথাগুলো বলেছেন এগুলো তার অন্তর্ভুক্ত। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৩-২৯)
এখানে এমন সব বড় বড় মূলনীতি ধারাবাহিকভাবে পেশ করা হয়েছে যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ইসলাম মানুষের সমগ্র জীবন ব্যবস্থার ইমারত গড়ে তুলতে চায়। একে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আন্দোলনের ঘোষণাপত্র বলা যায়। মক্কী যুগের শেষে এবং আসন্ন মাদানী যুগের প্রারন্ত লগ্নে এ ঘোষণাপত্র পেশ করা হয়। এভাবে এ নতুন ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের বুনিয়াদ কোন্ ধরনের চিন্তামূলক, নৈতিক, তামাদ্দুনিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত মূলনীতির ওপর রাখা হবে তা সারা দুনিয়ার মানুষ জানতে পারবে। এ প্রসংগে সূরা আন’য়ামের ১৯ রুকু’ এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট টীকার ওপরও একবার চোখ বুলিয়ে নিলে ভালো হয়।
ধারা ১: এর অর্থ কেবল এতটুকুই নয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো পূজা উপাসনা করোনা বরং এ সংগে এর অর্থ হচ্ছে, বন্দেগী, গোলামী ও দ্বিধাহীন আনুগত্য একমাত্র আল্লাহ্রই করতে হবে। একমাত্র তাঁরই হুকুমকে হুকুম এবঙ তাঁরই আইনকে আইন বলে মেনে নাও এবং তাঁর ছাড়া আর কারো সার্বভৌম কর্তৃক স্বীকার করোনা। এটি কেবলমাত্র একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত কর্মধারার জন্য একটি পথনির্দেশনাই নয়। বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদীনা তাইয়েবায় পৌছে কার্যত যে রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক ও নৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেন এটি হচ্ছে সেই সমগ্র ব্যাবস্থার ভিত্তি প্রস্তরও। এ ইমারতের দুনিয়াদ রাখা হয়েছিল মতাদর্শের ভিত্তিতে যে, মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ই সমগ্র বিশ্বলোকের মালিক ও বাদশাহ এবং তাঁরই শরীয়ত এ রাজ্যের আইন।
ধারা ২: এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্র পরে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী হক ও অগ্রধিকার হচ্ছে পিতামাতার! সন্তানকে পিতামাতার অনুগত, সেবা পরায়ণ ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন হতে হবে। সমাজের সামষ্টিক নৈতিক বৃত্তি এমন পর্যায়ের হতে হবে, যার ফলে সন্তানরা বাপমায়ের মুখোপেক্ষাহীন হয়ে পড়বেনা। বরং তারা নিজেদেরকে বাপমায়ের অনুগৃহীত মনে করবে এবং বুড়ো বয়েসে তাদেকে ঠিক তেমনিভাবে বাপমায়ের খিদমত করা শেখবে যেমনিভাবে বাপমা শিশুকালে তাতে পরিচর্যা ও লালান পালন এবং মান অভিমান বরদাশ্ত করে এসেছে। এ আয়াতটিও নিছক একটি নৈতিক সুপারিশ নয় বরং এরি ভিত্তিতে পরবর্তী পর্যায়ে বাপমায়ের জন্য এমনসব শর’য়ী অধিকার ও ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে যেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ আমরা হাদীসে ও ফিকাহর কিতাবগুলোতে পাই। তাছাড়া ইসলামী সমাজের মানসিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণ এবং মুসলমানদের সাংস্কৃতিক শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে বাপমায়ের প্রতি আচরণ ও আনুগত্য এবং তাদের অধিকারে রক্ষণাবেক্ষণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ জিনিসগুলো চিরকালের জন্য নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র নিজের আইন কানুন, ব্যবস্থাপনামূলক বিধান ও শিক্ষানীতির মাধ্যমে পরিবার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালি ও সংরক্ষিত করার চেষ্টা করবে, দুর্বল করবেনা।
ধারা ৩-৫: তিনটি ধারার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ নিজের উপার্জন ও ধন দৌলত শুধুমাত্র নিজের জন্যই নির্ধারিত করে নেবেনা বরং ন্যায়সংগতভাবে ও ভারসাম্য সহকারে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার পর নিজের আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী ও অন্যান্য অভাবী লোকদের অধিকারও আদায় করবে। সমাজ জীবনে সাহায্য সহযোগিতা, সহানুভুতি এবং অন্যের অধিকার জানা ও তা আদায় করা প্রবণতা সক্রিয় ও সঞ্চারিত থাকবে। প্রত্যেক আত্মীয় অন্য আত্মীয়ের সাহায্যকারী এবং প্রত্যেক সমর্থ ব্যক্তি নিজের আশপাশের অভাবী মানুষেদের সাহায্যকারী হবে। একজন মুসফির যে জনপদেই যাবে নিজেকে অতিথি বৎসর লোকদের মধ্যেই দেখতে পাবে। সমাজে অধিকারে ধারণা এতো বেশী ব্যাপক হবে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যাদের মাধ্যে অবস্থান করে নিজের ব্যক্তি সত্তা ও ধন সম্পদের ওপর তাদের সবার অধিকার অনুভব করবে। তাদের খিদমত করার সময় এ ধারণা নিয়েই খিদমত করবে যে সে তাদের অধিকার আদায় করছে, তাদেরকে অনুগ্রহ পাশে আবদ্ধ করছেনা। কারোর খিদমত করতে অক্ষম হলে তার কাছে ক্ষমা চাইবে এবং আল্লাহ্র বান্দাদের খিদমত করার যোগ্যতা লাভ করার জন্য আল্লাহ্র কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করবে।
ইসলামের ঘোষণাপত্রের এ ধারাগুলোও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নৈতিকতার শিক্ষাই ছিলোনা বরং পরবর্তী সময়ে মদনিা তাইয়েবার সমাজে ও রাষ্ট্রে এগুলোর ভিত্তিতেই ওয়াজিব ও নফল সদকার বিধানসমূহ প্রদত্ত হয়, অসিয়ত, মীরাস ও ওয়াকফের পদ্ধতি নির্ধারিত হয়, এতিমের অধিকার সংরক্ষণেল ব্যাবস্থা করা হয়, প্রত্যেক জনবসতির ওপর মুসাফিরের কমপক্ষে তিনদেন পর্যন্ত মেহমানদারী করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং সংগে সমাজের নৈতিক ব্যবস্থা কর্যত এমন পর্যায়ে উন্নীত করা হয় যার ফলে সমগ্র সামাজিক পরিবেশে দানশীলতা, সহানুভূতি ও সহযোগিতার মনোভাব সঞ্চারিত হয়ে যায়। এমনকি লোকেরা স্বতস্ফুর্তভাবে আইনগত অধিকারসমূহ দেয়া ছাড়াও আইনের জোরে যেসব নৈতিক অধিকার চওয়া ও প্রদান করা যায়না সেগুলোও উপলব্ধি ও আদায় করতে থাকে।
ধারা ৬: “হাত বাঁধা” একটি রূপক কথা। কৃপণতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর “হাত খোলা ছেড়ে দেয়ার মানে হেচ্ছে, বাজে খরচ করা। ৪র্থ ধারার সাথে ৬ষ্ঠ ধারাটির এ ব্যক্যোংশটি মিলিয়ে পড়লে এর পরিষ্কার অর্থ এই মানে হয় যে, লোকদের মধ্যে এতোটুকু ভারসাম্য হতে হবে যাতে তারা কৃপণ হয়ে অর্থের আবর্তন রুখে না দেয় এবং অপব্যয়ী হয়ে নিজের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংস না করে ফেলে। এর বিপরীত পক্ষে তাদের মধ্যে ভারসাম্যের এমন সঠিক অনুভূতি থাকতে হবে যার ফলে তারা যথার্থ ব্যয় থেকে বিরত হবেনা আবার অযথা ব্যয়জনিত ক্ষতিরও শিকার হবেনা। অহংকার ও প্রদর্শনেচ্ছামূলক এবং লোক দেখানো খরচ, বিলাসিতা, ফাসেকী ও অশ্লীল কাজে ব্যয় এবং এমন যাবতীয় ব্যয় যা মানুষের প্রকৃত প্রয়োজনেও কল্যাণমূলক কাজে লাগার পরিবর্তে ধন সম্পদ ভুল পথে নিয়োজিত করে, তা আসলে আল্লাহ্র নিয়ামত অস্বীকার ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা এভাবে নিজেদের ধন-দৌলত খরচ করে তারা শয়তানের ভাই।
এ ধারাগুলোও নিছক নৈতিক শিক্ষা এবং ব্যক্তিগত হিদায়াত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বরং এদিকে পরিষ্কার ইংগিত করছে যে, একটি সৎ ও সত্যনিষ্ঠ সমাজকে নৈতিক অনুশীলন, সামষ্টিক চাপ প্রয়োগ ও আইনগত বাঁধা নিষেধ আরোপের মাধ্যমে অযথা অর্থ ব্যয় থেকে বিরত রাখা উচিত। এ কারণেই পরবর্তীকালে মদীনা রাষ্ট্রে বিভিন্ন কার্যকর পদ্ধতিতে এ উভয় ধারা নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করা হয়। প্রথমত অপব্যয় ও বিলাসিতার বহু নীতি প্রথাকে আইনগতভাবে হারাম করা হয়। দ্বিতীয়দ পরোক্ষভাবে আইনগত কৌশল অবলম্বন করে অযথা অর্থব্যয়ের পথ বন্ধ করা হয়। তৃতীয়ত সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে এমন বহু রসম রেওয়াজের বিলোপ সাধন করা হয় যেগুলোতে অপব্যয় করা হতো। তারপর রাষ্ট্রেকে বিশেষ ক্ষমতা বলে এবং বিশেষ ব্যবস্থাপনা বিধান জারী করে সুস্পষ্ট অপব্যয়ের ক্ষেত্রে বাঁধা দেয়ার ইখতিয়ার দেয়া হয়। এভাবে যাকাত ও সদকার বিধানের মাধ্যমে কৃপণতার শক্তিকে গুড়িয়ে দেয়া হয় এবং লোকেরা সম্পদ পুঞ্জীভূত করে অর্থের আবর্তনের পথ বন্ধ করে দেবে এ সম্ভাবনাও নির্মূল করে দেয়া হয়। এসব কৌশল অবলম্বন করার সাথে সমাজে এমন একটি সাধারণ জনমত সৃষ্টি করা হয়, যা দানশীলতা ও অপব্যয়ের মধ্যকার পার্থক্য সঠিকভাবে জনতো এবং কৃপণতা ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যয়ের মধ্যে ভালোভাবেই ফারাক করতে পারতো। এ জনমত কৃপণদেরকে লাঞ্ছিত করে, ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষাকারীদেরকে মর্যাদাশীল করে, অপব্যয়কারীদের নিন্দা করে এবং দানশীলদেরকে সমগ্র সমাজের খেশবুদার ফুল হিসেবে কদর করে। সে সময়ের নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণের প্রভাব আজো মুসলিম সমাজ রয়েছে। আজো দুনিয়ার সব দেশেই মুসলমানরা কৃপণ ও সম্পদ পুঞ্জিীভূতকারীদেরকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখে এবং দানশীলরা আজো তাদের চোখে সন্মানার্হ ও মর্যাদা সম্পন্ন।
অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ নিজের বান্দাদের মধ্যে রিযিক কমবেশী করার ক্ষেত্রে যে পার্থাক্য রেখেছেন তার উপযোগিতা বুঝা মানুষের পক্ষে সম্বব নয়। কাজেই রিযিক বন্টনের যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা রয়েছে কৃত্রিম মানবিক কৌশলের মাধ্যমে তার মধ্যে হস্তক্ষেপ না করা উচিত। প্রাকৃতিক অসাম্যকে কৃত্রিম সাম্যে পরিবর্তিত করা অথবা এ অসাম্যক প্রাকৃতিক সীমার চৌহদ্দী পার করিয়ে বেইনসাফির সীমানায় পৌঁছিয়ে দেয়া উভয়টিই সমান ভুল। একটি সঠিক অর্থেনৈতিক ব্যবস্থার অবস্থান আল্লাহ্ নির্ধারিত রিযিক বন্টন পদ্ধতির নিকটতরই হয়ে থাকে।
এ বাক্য প্রাকৃতিক আইনের যে নিয়মটির দিকে পথনির্দেশ করা হয়েছেল তার কারণে মদীনা সংস্কার কর্মসূচীতে এ ধারণাটি আদতে কোনো ঠাঁই করে নিতে পারেনি যে রিযিক ও রিযিকের উপায় উপকরণগুলোর মধ্যে পার্থক্য ও শেষ্ঠত আসলে এমন কোনো অকল্যাণকর বিষয় নয়, যাকে বিলুপ্ত করা এবং একটি শ্রেণীহীন সমাজ গঠন করা কোন পর্যায়ে কাংখিত হতে পারে। পক্ষান্তরে সৎকর্মশীলতা ও সদাচারের ভিত্তিতে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বুনিয়াদ কায়েম করার জন্য মদীনা তাইয়েবায় এক বিশেষ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। সে কর্মপদ্ধতি ছিলো এই যে, আল্লাহ্র দেয়া প্রকৃতি মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য করে রেখেছে তাকে আসল প্রাকৃতিক অবস্থায় অপরিবর্তিত রাখতে হবে এবং ওপরে প্রদত্ত পথনির্দেশনা অনুযায়ী সমাজের নৈতিকতা অপরিবর্তিত রাখতে হবে এবং ওপরে প্রদত্ত পথনির্দেশনা অনুযায়ী সমাজের নৈতিকতা আচার আচরণ ও কর্মবিধানসমূহ এমনভাবে সংশোধন করে দিতে হবে, যার ফলে জীবিকার পার্থক্য ও ব্যবধান কোনো যুলুম ও বেইনসাফির বাহনে পরিণত হবার পরিবর্তে এমন অসংখ্য নৈতিক, আধ্যত্মিক ও তামাদ্দুনিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধির বাহনে পরিণত হবে, যে জন্য মূলত বিশ্বজাহানের স্রষ্টা তাঁর বান্দাদের মধ্যে এ পার্থক্য ও ব্যবধান সৃষ্টি করে রেখেছেন।
ধারা ৭: যেসব অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তিতে প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যুগে যুগে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন আন্দোলন দানা বেঁধেছে, এ আয়াতটি তার ভিত পুরোপুরি ধ্বসিয়ে দিয়েছে। প্রাচীন যুগে দারিদ্রভীতি শিশু হত্যাও গর্ভপাতের কারণ হতো। আর আজ তা দুনিয়াবাসীকে তৃতীয় আর একটি কৌশল অর্থাৎ গর্ভপাতের কারণ হতো। আর আজ তা দুনিয়াবাসীকে তৃতীয় আর একটি কৌশল অর্থাৎ গর্ভনিরোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু ইসলামের ঘোষণাপত্রের এ ধারাটি তাকে অন্নগ্রহণকারীদের সংখ্যা কমাবার ধ্বংসাত্মক প্র্রচেষ্টা ত্যাগ করে এমনসব গঠনমূলক কাজে নিজের শক্তি ও যোগ্যতা নিয়োগ করার নির্দেশ দিচ্ছে যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ্র তৈরী প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী রিযিক বৃদ্ধি থাকে। এ ধারাটির দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক উপায় উপকরণের স্বল্পতার আশংকায় বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এ ধারাটির দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক উপায় উপকরণের স্বল্পতার আশংকায় মানুষের বারবার সন্তান উৎপাদনের সিলাসিলা বন্ধ করে দিতে উদ্যত হওয়া তার বৃহত্তও ভুলগুলোর অন্যতম হিসেবে চিহিৃত হয়েছে। এ ধারাটি মানুষকে এ বলে সাবধান করে দিচ্ছে যে, রিযিক পৌঁছাবার ব্যবস্থাপনা তোমার আয়ত্বাধীন নয় বরং এটি এমন এক আল্লাহ্র আয়ত্বাধীন যিনি তোমাকে এ যমীনে আবাদ করেছেন। পূর্বে আগমনকারীদেরকে তিনি যেভাবে রুযি দিয়ে এসেছেন বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা যতোই বৃদ্ধি হতে থেকেছে ঠিক সেই পরিমাণে বরং বহুসময় তার চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে অর্থনৈতিক উপায় উপকরণ বেড়ে হেয়েছে। কাজেই আল্লাহ্র সৃষ্টি ব্যবস্থাপনায় মানুষের অযথা হস্তক্ষেপ নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ শিক্ষার ফলেই কুরআন নযিলের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো যুগ মুসলমানদের মধ্যে জন্ম শাসনের কোনো ব্যাপাক ভাবধারা জন্ম লাভ করতে পারেনি।
ধারা ৮: “যিনার কাছেও যেয়োনা” এ হুকুম ব্যক্তির জন্য এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র সমাজের জন্যও। ব্যক্তির জন্য এ হুকুমের দিক টেনে নিয়ে যায় যিনার এমন কাজ থেকে দূরে থেকেই ক্ষান্ত হবেনা বরং এ পথের দিকে টেনে নিয়ে যায় যিনার এমন সব সূচনাকারী এবং প্রাথমিক উদ্যোগ ও আকর্ষণ সৃষ্টিকারী বিষয় থেকেও দূরে থাকবে। আর সমাজের ব্যাপারে বলা যায়, এ হুকুমের প্রেক্ষিতে সমাজ জীবনে যিনা, যিনার উদ্যেগ আকর্ষণ এবং তার কারণসমূহের পথ বন্ধ করে দেয়া সমাজের জন্য ফরয হয়ে যাবে। এ উদ্দেশ্যে সে আইন প্রণয়ন, শিক্ষা ও অনুশীলন দান, সামাজিক পরিবেশের সংস্কার সাধন, সমাজ জীবনের যথাযোগ্য বিন্যাস এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।
এ ধারাটি শেষ পর্যন্ত ইসলামী জীবন ব্যবস্থার একটি বৃহত্তম অধ্যায়ের বুনিয়াদে পরিণত হয়। এর অভিপ্রায় অনুযায়ী যিনা ও যিনার অপবাদেকে ফৌজদারী অপরাধ গন্য করা হয়। পর্দার বিধান জারী করা হয়। অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার প্রচার কঠোরভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। মদ্যপান, নাচ, গান ও ছবির (যা যিনার নিকটতম আত্মীয়) ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। আর এ সংগে এমন একটি দাম্পত্য আইন প্রণয়ন করা হয় যার ফলে বিবাহ সহজ হয়ে যায় এবং যিনার সামাজিক কারণসমূহের শিকড় কেটে যায়।
ধারা ৯: কাউকেও হত্যা করা মানে কেবলমাত্র অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করাই নয়, নিজেকে হত্যা করাও এর অন্তরভূক্ত। কারণ মানুষকে মহান আল্লাহ্র মর্যাদা সম্পন্ন করেছেন। অন্যের প্রাণের সাথে সাথে মানুষের নিজের প্রাণও এ সংজ্ঞার অন্তরভূক্ত। কাজেই মানুষ হত্যা যতো বড় গুনাহ ও অপরাধ, আত্মহত্যা করাও ঠিক ততো বড় অপরাধ ও গুনাহ। মানুষ নিজেকে নিজের প্রাণের মালিক এবং এ মালিকানাকে নিজ ক্ষমতায় খতম করে দেবার অধিকার রাখে বলে মনে করে, এটা তার একটা বিরাট ভুল ধারণা। অথচ তার এ প্রাণ আল্লাহ্র মালিকানাধীন এবং সে একে খতম করে দেয়া তো দূরের কথা একে কোনো অনুপযোগী কজে ব্যবহার করার অধিকারও রাখেনা। দুনিয়ার এ পরীক্ষাগৃহ আল্লাহ্ যেভাবেই আমাদের পরীক্ষা নেন না কেন, পরীক্ষার অবস্থা ভালো হোক বা মন্দ হোক, সেভাবেই শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের পরীক্ষা দিতে থাকা উচিত। আল্লাহ্র দেয়া সময়কে ইচ্ছা করে খতম করে দিয়ে পরীক্ষাগৃহ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার এ পালিয়ে যাবার কাজটিও এমন এক অপরাধের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যকে আল্লাহ্ সুস্পষ্ট ভাষায় হারাম গণ্য করেছেন, এটা তো কোনোক্রমেই গ্রহণীয় হতে পারেনা। অন্য কথায় বলা যায়, দুনিয়ার ছোট ছোট কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপমানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মানুষ বৃহত্তর ও চিরন্তন কষ্ট ও লাঞ্ছনার দিক পালিয়ে যাচ্ছে।
পরবর্তীকালে ইসলামী আইন ‘সত্য সহকারে হত্যাকে শুধুমাত্র পাঁচটি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এক. জেনে বুঝে হত্যাকারী থেকে কেসাস নেয়া। দুই. আল্লাহ্র সত্যদীনের পথে বাঁধাদানকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। তিন. ইসলামী রাষ্ট্রে শাসন ব্যাবস্থা উৎখাত করার প্রচেষ্টাকারীদের শাস্তি দেয়া। চার. বিবাহিত পুরুষ ও নারীকে ব্যভিচার লিপ্ত হওয়ার শাস্তি দেয়া। পাঁচ. মুরতাদেকে শাস্তি দেয়া। শুধুমাত্র এ পাঁচটি ক্ষেত্রে মানুষের প্রাণের মর্যাদা তিরোহিত হয় এবং তাকে হত্যা করা বৈধ গণ্য হয়।
মূল শদ্ব হচ্ছে, “তার অভিভাবককে আমি সুলতান দান করেছে।” এখানে সুলতান অর্থ হচ্ছে “প্রমাণ” যার ভিত্তিতে সে কিসাস দাবী করতে পারে। এ থেকে ইসলামী আইনের এ মূলনীতি বের হয় যে, হত্যা মুকদ্দামার আসল বাদী সরকার নয়। বরং নিহত ব্যক্তির অভিভাবকগণই এর মূল বাদীপক্ষ। তারা হত্যাকারীকে মাফ করে দিতে এবং কিসাসের পরিবর্তে রক্তপণ করতে সম্মত হতে পারে।
হত্যার ব্যাপারে বিভিন্নভাবে সীমা অতিক্রম করা যেতে পারে। এগুলো সবই দিষিদ্ধ। যেমন প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে উন্মত্তোর মতো অপরাধী ছাড়া অন্যদেরকেও হত্যা করা অথবা অপরাধীকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা। কিংবা মেরে ফেলার পর তার লাশের ওপর মনের ঝাল মেটানো। অথবা রক্তপণ নেবার পর আবার তাকে হত্যা করা ইত্যাদি।
যেহেতু সে সময় পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই কে তাকে সাহায্য করবে, একথা স্পষ্ট করে বলা হয়েনি। পরে যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন ফয়সালা করে দেয়া হয় যে, তাকে সাহায্য করা তার গোত্র বা সহযোগী বন্ধু দলের কাজ নয় বরং এটা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র এবং তার বিচার ব্যবস্থার কাজ। কোনো ব্যক্তি বা দল নিজস্বভাবে হত্যার প্রতিশোধ নেবার অধিকার রাখেনা। বরং এটা ইসলামী সরকারে দায়িত্ব। ন্যায় বিচার লাভ করার জন্য তার কাছে সাহায্য চাওয়া হবে।
ধারা ১০: এটিও নিছক একটি নৈতিক নির্দেশনামা ছিলোনা। বরং পরবর্তীকালে যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এতিমদের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য প্রশাসনিক ও আইনগত উভয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। এর বিস্তারিত বিবরণ আমারা হাদীস ও ফিকহর কিতাবগুলোতে পাই। তার পর এখান থেকে এ ব্যাপক ভিত্তিক মূলনীতি গ্রহণ করা হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের যেসব নাগরিক নিজেরা তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যার কোনো অভিভাবক নেই আমিই তার অভিভাবক” এ হাদীসটি এদিকেই ইংগিত করে এবং এ ইসলামী আইনের একটি বিস্তৃত অধ্যায়ের ভূমিকা রচনা করে।
ধারা ১১: এটিও নিছক ব্যক্তিগত নৈতিকতারই একটি ধারা ছিলোনা বরং যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখন একেই সমগ্র জাতির আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক রাজনীতির ভিত্তি গণ্য করা হয়।
ধারা ১২: এ নির্দেশটাও নিছক ব্যক্তিবর্গেন পারস্পরিক লেনদেন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয় বরং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠির পর হাট, বাজার ও দোকানগুলোতে মাপজোক ও দাঁড়িপাল্লাগুলো তত্বাবধান করা এবং শক্তি প্রয়োগ করে ওজনে ও মাপে কম দেয়া বন্ধ করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের অন্তরভুক্ত হয়ে যায়। তারপর এখান থেকেই এ ব্যাপক মূলনীতি গৃহীত হয় যে, ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সব রকমের বেঈমানী ও অধিকার হরণের পথ রোধ করা সরকারের দায়িত্বের অন্তরভূক্ত।
ধারা ১৩: এ ধারাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধারণা ও অনুমানের পরিবর্তে “জ্ঞানের” পেছনে চলাবে। ইসলামী সমাজ এ ধারাটির প্রয়োগ ব্যাপকভাবে নৈতিক ব্যবস্থায়, আইনে, রাজনীতিতে, দেশ শাসনে, জ্ঞান বিজ্ঞান ও কারিগরী বিদ্যায় এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় তথা জীবনের সকল বিভাগে সুষ্ঠুভাবে করা হয়েছে। জ্ঞানের পরিবর্তে অনুমানের পেছনে চলার কারণে মানুষের জীবনে যে অসংখ্য দুষ্ট মতের সৃষ্টি হয় তা থেকে চিন্তা ও কর্মকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কুধারণা থেকে দূরে থাকো এবং কোনো ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার অনুসন্ধান ছাড়াই কোনো দোষারোপ করোনা। আইনের ক্ষেত্রে এ মর্মে একটি স্থায়ী মূলনীতি স্থির করে দেয়া হয়েছে যে, নিছক সন্দেহ নীতি নির্দেশ করা হয়েছে। অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতার, মারধর বা জেলে আটক করা সম্পূর্ণ অবৈধ। বিজাতিদের সাথে আচার আচারণের ক্ষেত্রে নীতি নিধারণ করা হয়েছে যে, অনুসন্ধান ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবেনা এবং নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে কোনো গুজব ছাড়ানোও যাবেনা। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যেসব তথাকথিত জ্ঞান নিছক আন্দাজ অনুমান এবং দীর্ঘসূত্রীতাময় ধারণা ও কল্পনা নির্ভর, সেগুলোকেও অপছন্দ করা হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ধারণা কল্পনা ও কুসংস্কারের মূল উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং ঈমানদারদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহ্ ও রসূল প্রদত্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রমাণেত বিষয় মেনে নেবার শিক্ষা দিয়া হয়েছে।
ধারা ১৪: এর মানে হচ্ছে, ক্ষমতাগর্বী ও অহংকারীদের মতো আচরণ করোনা। এ নির্দেশটি ও ব্যক্তিগত কর্মপদ্ধতি ও জাতীয় আচরণ উভয়ের ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য। এ নির্দেশের বদৌলতেই এ ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে মদীনা তাইয়েবায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তার শাসকবৃন্ত, গভর্নর ও সিপাহসালারদের জীবন ক্ষমতাহর্ব ও অহংকারের ছিটোফোটাও ছিলোনা। এমনকি যুদ্ধরত অবস্থায়ও কখনো তাদের সুখ থেকে দ্বন্দ্ব ও অহংকারের কোনো কথাই বের হতোনা। তাদের ওঠা বসা, চল চলন, পোশাক পরিচ্ছদ, ঘর বাড়ী,সওয়ারী ও সাধারণ আচার আচরণে বেশে কোনো শহরে প্রবেশ করতেন তখনও দর্প ও অহংকার সহকারে নিজেদের ভীতি মানুষের মনে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করতেননা।
খ. রাষ্ট্রের শিক্ষা নীতির ব্যাপারে কুরআনে এই নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে যেঃ
“ আর মুমিনদের সবার এক সাথে বের হয়ে পড়ার কোনো দরকার ছিলোনা। কিন্তু তাদের জনবসতির প্রত্যেক অংশের কিছু লোক বেরিয়ে এলে ভালো হতো। তারা দীন সন্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতো এবং ফিরে গিয়ে নিজের এলাকার লোকদেরকে সতর্ক করতো, যাতে তারা (অমুসলমানী আচরণ থেকে) বিরত থাকতো, এমনটি হলোনা কেন?” (সূরা তওবাঃ১২২)
এ আয়াতের অর্থ অনুধাবন করার জন্য এ সূরার ৯৭ আয়াতটি সামনে রাখতে হবে। তাতে বলা হয়েছেঃ
“মরুচারী আরবরা কুফরী ও মুনাফিকীতে অপেক্ষাকৃত শক্ত এবং আল্লাহ্ তাঁর রসূলের প্রতি যে দীন নাযিল করেছেন তার সীমারেখা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশী।”
সেখানে শুধু এতোটুকু বলেই শেষ করা হয়েছেল যে, দারুল ইসলামের গ্রামীণ এলাকার বেশীরভাগ জনবসতি মুনাফিকী রোগে আক্রন্ত। কারণ এসব লোক অজ্ঞতার মধ্যে ডুবে আছে। জ্ঞানের কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ না থাকা এবং জ্ঞানবানদের সাহচর্য না পওয়ার ফলে এরা আল্লাহ্র দীনের সীমারেখা জানেনা। আর এখানে বলা হচ্ছে, গ্রামীণ জনবসতিকে এ অবস্থায় থাকতে দেয়া যাবেনা। বরং তাদের অজ্ঞতা দূর এবং তাদের সধ্যে ইসলামী চেতনা সৃষ্টি করার জন্য এখন যথাযথ ব্যবস্থা হওয়া দরকার। এ জন্য গ্রামীণ এলাকার সমস্ত আরব অধিবাসীদের নিজেরদের ঘর বাড়ী ছেড়ৈ মদীনায় জমায়েত হবার এবং এখানে বসে জ্ঞান অর্জন করার প্রয়োজন নেই। বরং এই জন্য প্রয়োজন হচ্ছে প্রত্যেক গ্রাম, পল্লী ও গোত্র থেকে কয়েকজন করে লোক বের হবে। তার জ্ঞানের কেন্দ্রগুলো যেমন মদীনা ও মক্কা এবং এ ধরনের অন্যান্য জায়গায় আসবে। এখানে এসে তারা দীনের জ্ঞান আহরণ করেবে। এখানে থেকে তারা নেজেদের জনবসতিতে ফিরে যাবে এবং সাধারণ সানুষের মধ্যে দীনী চেতনা ও জগরণ সৃষ্টিতে তৎপর হবে।
এটি ছিলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। ইসলামী আন্দোলনকে শক্তিশালী ও মজবূত করার জন্য সঠিক সময়ে এ নির্দেশটি দেয়া হয়েছিলো। শুরুতে ইসলাম যখন আরবে ছিলো একেবারেই নতুন এবং একটি চরম প্রতিকূল পরিবেশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিলো তখন এ ধরনের নির্দেশের প্রয়োজন ছিলোনা। কারণ তখন যে ব্যক্তি ইসলামকে পুরোপুরি বুঝে নিতো এবং সব দিক দিয়ে তাকে যাচাই করে নিশ্চিন্ত হতে পারতো একমাত্র সেই ইসলাম গ্রহণ করতো। কিন্তু যখন এ আন্দোলন সাফল্যের পর্যায়ে প্রবেশ করলো এবং পৃথিবীতে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো তখন দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো এবং এলাকার পর এলাকা ইসলামের সুশীলতা ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকলো। এ সময় খুব কম লোকই ইসলামের যাবতীয় চাহিদা ও দাবী অনুধাবন করে ভালোভাবে সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলে আসছিলো। নতুন মুসলিম জনবসতির এ দ্রুত বিস্তার ব্যহ্যত ইসলামের শক্তিমত্তার কারণ ছিলো। কেননা, ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা বেড়ে চলছিলো। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের জনবসতিতে ইসলামী চেতনা ছিলোনা এবং এ ব্যবস্থার নৈতিক দাবি পূরণ করতেও তারা প্রস্তুত ছিলোনা। বস্তুত তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় এ ক্ষতি সুস্পষ্ট আকারে সামনে এসে গিয়েছিল। তাই সঠিক সময়ে মহান আল্লাহ্ নির্দেশ দিলেন, ইসলামী আন্দোলনের বিস্তৃতির কাজ যে গতিতে চলছে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাকে শক্তিশালী ও সজবূত করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সে ব্যবস্থাটি হচ্ছে, প্রত্যেক এলাকার লোকদের মধ্যে থেকে কিছু লোককে নিয়ে শিক্ষা ও অনুশীলন দান করতে হবে, তারপর তারা প্রত্যেক নিজেদের এলাকায় ফিরে গিয়ে সাধারণ মানুষের শিক্ষা ও অনুশীলনের দায়িত্ব পালন করবে। এভাবে সমগ্র মুসলিম জনবসতিতে ইসলামের চেতনা ও আল্লাহ্র বিধানের সীমারেখা সম্পর্কিত জ্ঞান ছড়িয়ে পড়বে।
এ প্রসংগে এতোটুকু কথা অবশ্যি অনুধাবন করতে হবে যে, এ আয়াতে যে সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা করার হুকুম দেয়া হয়েছে তার আসল উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষকে নিছক সাক্ষারতা সম্পন্ন করা এবং তাদের মধ্যে বইপত্র পড়ার মতো যোগ্যতা সৃষ্টি করা ছিলোনা। বরং লোকদের মধ্যে দীনের বোধ ও জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে অমুসলিম সূলভ জীবনধারা থেকে রক্ষা করা, সতর্ক ও সজ্ঞান করে তোলা এর আসল উদ্দেশ্য হিসেবে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছেল। এটিই মুসলমানদের শিক্ষার উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ্ নিজেই চিরকালের জন্য এ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। প্রত্যেকটি শিক্ষা ব্যবস্থাকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করতে হবে। দেখতে হবে এ উদ্দেশ্য সে কতোটুকু পূরণ করতে সক্ষম। এর অর্থ এ নয়, ইসলাম লোকদেরকে লেখা পড়া শেখাতে বই পড়তে সক্ষম করে তুলতে ও পার্থিব জ্ঞান দান করতে চায়না। বরং পড়া অর্থ হচ্ছে, ইসলাম লোকদের নির্ধারিত আসল উদ্দেশ্যের দিকে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। নয়তো প্রত্যেক ব্যক্তি যদি তার যুগের আইনষ্টাইন ও ফ্রয়েড হয়ে যায় কিন্তু দীনের জ্ঞানের ক্ষিত্রে তারা শূণ্যের কোঠায় অবস্থান করে এবং অমুসলিম সূলভ জীরনধারায় বিভ্রান্ত হতে থাকে তাহলে ইসলাম এ ধরনের শিক্ষার ওপর অভিশাপ বর্ষণ করে।
এ আয়াতে উল্লেখিত বাক্যাংশটির ফলে পরবর্তীকালে লোকদের মধ্যে আশ্চর্য ধরনের ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে। মুসলমানরদের ধর্মীয় শিক্ষা বরং তাদের ধর্মীয় জীরনধারার ওপরও এর বিষময় প্রভাব দীর্ঘকাল থেকে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ্ “তাফাক্কুহ্ ফীদ্ দীন” কে শিক্ষার উদ্দেশ্যে পরিণত করেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে, দীন অনুধাবন করা বা বুঝা, দীনের ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা , তার প্রকৃতি ও প্রাণশক্তির সাথে পরিচিত হওয়া এবং এমন যোগ্যতার অধিকারী হওয়া যার ফলে চিন্তা ও কর্মের সকল দিকে ও জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগে কোন্ চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি ইসলামের প্রাণশক্তির অনুসারী তা মানুষ জানতে পারে। কিন্তু পরবর্তীকালে যে আইন সম্পর্কিত জ্ঞান পরিভাষিক অর্থে ফিক্হ নামে পরিচিত হয় এবং যা ধীরে ধীরে ইসলামী জীরনের নিছক বাহ্যিক কাঠামোর (প্রাণশক্তির মুকাবিলায়) বিস্তারিত জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, লোকেরা শাব্দিক অভিন্নতার কারণে সেটিই সম্পূর্ণ উদ্দে্যে ও লক্ষ্য নয়। বরং তা ছিলো উদ্দেশ্য লক্ষ্যের একটি অংশ মাত্র। এ বিরাট ভুল ধারণার ফলে দীন ও তার অনুসারীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা বিশ্লেষণ ও পর্যলোচনা করতে হলে একটি বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজন। কিন্তু এখানে আমার এ সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার জন্য সংক্ষেপে শুধুমাত্র এতোটুকু ইংগিত করছি যে, মুসলমাদের ধর্মীয় শিক্ষাকে যে জিনিসটি দীনি প্রাণশক্তি বিহীন করে নিছক দীনি কাঠমো ও দীনি আকৃতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যে করে দিয়েছে এবং অবশেষে যার বদৌলতে মুসলমানদের জীবনে একটি নিছক প্রাণহীন বাহ্যিকতা দীনদারীর শেষ মনযিলে পরিণত হয়েছে তা বহুলাংশে এ ভুল ধারণারই ফল।
৮.নাগরিকত্ব ও পররাষ্ট্রনীতি
ক. “যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহ্র পথে নিজের জানমালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদ করেছে আর যারা হিজরতকারীদের আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, আসল তারাই পরস্পরের বন্ধু ও অভিভবক। আর যারা ঈমান এনেছে ঠিকই কিন্তু হিজরত করে (দারুল ইসলামে) আসেনি তারা হিজরত করে না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বের ও অভিভাবকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে হাঁ, দীনের ব্যাপারে যদি তারা তোমাদের কাছে সাহায্য চায় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের জন্য ফরয। কিন্তু এমন কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ্ তা দেখেন।” (সূরা আনফালঃ৭২)
এ আয়াতটি ইসলামের সাংবিধানিক আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। এখানে একটি মূলনীতি নির্ধারিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে, “অভিভাবকত্বের”সম্পর্ক এমন সব মুসলমানদের মধ্যে স্থাপিত হবে যার দারুল ইসলামের বাসিন্দা অথবা বাইরে থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে এসেছে। আর যেসব মুসলমান ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে বাস করে তাদের সাথে অবশ্যি ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকবে, কিন্তু “অভিাভাবকত্বের” সম্পর্ক থাকবেনা। অনুরূপভাবে যেসব মুসলমান হিজরত করে দারুল ইসলামে আসবেনা বরং দারুল কুফরের প্রজা হিসেবে দারুল ইসলামে আসবে তাদের সাথেও এ সম্পর্ক থাকবেনা। অভিভাবকত্ব শব্দটিকে এখানে মূলে “ওয়ালায়াত” শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। আরবীতে “ওয়ালায়াত” বলতে সাহায্য, সহায়তা, সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা, মৈত্রী, বন্ধুত্ব, নিকট আত্মীয়তা, অভিাভাবকত্ব এবং এ সবের সাথে সামঞ্জস্যশীল অর্থ বুঝায়। এ আয়াতের পূর্বাপর আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে এ থেকে এমন ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বুঝানো হয়েছে, যা একটি রাষ্ট্রের তার নাগরিকদের সাথে, নাগরিকদের নিজেদের রাষ্ট্রের সাথে এবং নাগরিকদের নিজেদের মধ্যে বিরাজ করে। কাজেই এ আয়তটি “সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব” কে ইসলামী রাষ্ট্রের ভূখন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এ সীমানার বাইরের মুসলমানদেরকে এ বিশেষ সম্পর্কের বাইরে রাখে। এ অভিভাবকত্ব না থাকার আইনগত ফলাফল অত্যন্ত ব্যাপক। এখানে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। উদাহরণ হিসেবে শুধুমাত্র এতোটুকু ইংগিত করাই যথেষ্ট হবে যে, এ অভিভাবকত্বহীনতার ভিত্বিতে দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের মুসলমানরা পরস্পরের উত্তরাধিকারী হতে পারেনা এবং তারা একজন অন্যজনের আইনানুগ অভিভাবক(Guarduan) হতে পারেনা, পরস্পরের মধ্যে বিয়ে শাদী করতে পারেনা এবং দারুল কুফরের সাথে নাগরিকত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করেনি এমন কোনো মুসলমানকে ইমলামী রাষ্ট্র নিজেদের কোনো দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত করতে কোনো মুসলমানকে ইসলামী রাষ্ট্র নিজেদের কোনো দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠত করতে পারেনা। ১.তাছাড়া এ আয়াতটি ইসলামী রাষ্টের বিদেশ নীতির ওপরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে। এর দৃষ্টিতে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে যেসব মুসলমান অবস্থান করে তাদের দায়িত্বই ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। বাইরের মুসলমানদের কোনো দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়না। একথাটিই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিন্মোক্ত হাদীসে বলেছেনঃ[ ১. এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে পড়ুন লেখেকের “রাসায়েল ও মাসায়েল” ২য় খন্ডের “দারুল ইসলাম ও দারুল কুফরে মুসলমানদের মধ্যে উত্তরাধিকার ও বিয়ে-শাদীর সম্পর্ক নিবন্ধকটি।–অনুবাদক]
“আমার ওপর এমন কোনো মুসলমানের সাহায্য সমর্থন ও হিফাযতের দায়িত্ব নেই যে মুশরিকদের মধ্যে বসবাস করে।”
এভাবে সাধারণত যেসব বিবাদের কারণে আন্তর্জাতিক জটিলতা দেখা দেয়, ইসলামী আইন তার শিকড় কেটে দিয়েছে। কারণ যখনই কোনো সরকার নিজের রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে অবস্থানকারী কিছু সংখ্যালঘুর দায়িত্ব নিজের মাথায় নিয়ে নেয় তখনই এর কারণে এমন সব জটিলতা দেখা দেয়, বার বার যুদ্ধের পরও যার কোনো মীমাংসা হয়না।
এ আয়াতে দারুল ইসলামের বাইরে অবস্থানকারী মুসলমানদের “রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের” সম্পর্ক মুক্ত গণ্য করা হয়েছেল। এখন এ আয়তটি বলছে যে, তারা এ সম্পর্কের বাইরে অবস্থান করা সত্ত্বেও “ইসলামী ভ্রাতৃত্বের” সম্পর্কের বাইরে অবস্থান করছেনা। যদি কোথাও তাদের ওপর যুলুম হতে থাকে এবং ইসলামী ভ্রাতৃ সমাজের সাথে সম্পর্কের কারণে তারা দারুল ইসলামের সরকারের ও তার অধিবাসীদের কাছে সাহায্য চায় তাহলে নিজেদের এ মযলূম ভাইদের সাহায্য করা তাদের জন্য ফরয হয়ে যাবে। কিন্তু এরপর আরো বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, চোখ বন্ধ করে এসব দীনি ভাইয়ের সাহায্য করা যাবেনা। বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরোপিত দায়িত্ব ও নৈতিক সীমারেখার প্রতি নযর রেখেই এ দায়িত্ব পালন করা যাবে। যুলুমকারী জাতির সাথে যদি ইসলামী রাষ্ট্রের চুক্তমূলক সম্পর্ক থাকে তাহলে এ অবস্থায় এ চুক্তর নৈতিক দায়িত্ব ক্ষুন্ন করে মযলূম মুসলমানদের কোনো সাহায্য করা যাবেনা।
আয়াতে চুক্তির জন্য “মীসাক” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মূল হচ্ছে “ওসূক”। এর মানে আস্থা ও নির্ভরতা। এমন প্রত্যেকটি জিনিসকে “মীসক” বলা হবে, যার ভিত্তিতে কোনো জাতির সাথে আমাদের সুস্পষ্ট ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি না থাকলেও তারা প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী আমাদের ও তাদের মধ্যে কোনো যুদ্ধ নেই এ ব্যাপারে যথার্থ আস্থাশীল হতে পারে।
তারপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ “যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে।” এ থেকে পরিষ্কর জানা যাচ্ছে, ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার কোনো অমুসলীম সরকারের সাথে যে
চুক্তি স্থাপন করে তা শুধুমাত্র দু’টি সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক নয় বরং দু’টি জাতির সম্পর্কও এবং মুসলমান সরকারের সাথে সাথে মুসলিম জাতি ও তার সদস্যরাও এর নৈতিক দায়িত্বির অন্তরভুক্ত হয়ে যায়। মুসলিম সরকার অন্য দেশ বা জাতির সাথে যে চুক্তি সম্পাদন করে ইসলামী শরীয়ত তার নৈতিক দায়িত্ব থেকে মুসলিম জাতি বা তার ব্যক্তিবর্গকে মুক্ত থাকাকে আদৌ বৈধ গণ্য করেনা। তবে দারুল ইসলাম সরকারের চুক্তিগুলো মেনে চলার দায়িত্ব একমাত্র তাদের ওপর বর্তাবে যারা এ রাষ্ট্রের কর্মসীমার মধ্যে অবস্থান করবে। এ সীমার বাইরে বসবাসকারী সারা দুনিয়ার মুলসমানরা কোনোক্রমেই এ দায়িত্ব শামিল হবেনা। এ কারণেই হুদাইবিয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার কাফিরদের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন হযরত আবু বসীর ও আবু জান্দাল এবং অন্যান্য মুসলমানদের ওপর তার কোনো দায়িত্ব অর্পিত হয়নি, যারা মদীনার দারুল ইসলামের প্রজা ছিলেননা।
খ. “আর যদি কখনো কোনো জাতির পক্ষ থেকে তোমাদের খিয়ানতের আশংকা থাকে তাহলে তার চুক্তি প্রকাশ্যে তার সামনে ছুঁড়ে দাও।” (সূরা আনফালঃ ৫৮)
এ আয়াতের দৃষ্টিতে যদি কোনো ব্যক্তি, দল বা দেশের সাথে আমাদের চুক্তি থাকে এবং তার কর্মনীতি আমাদের মনে তার বিরুদ্ধে চুক্তি মেনে চলার ব্যাপারে গড়িমসি করার অভিযোগ সৃষ্টি করে অথবা সুযোগ পেলেই সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এ ধরনের আশংকা দেখা দেয়, তাহলে আমাদের পক্ষে একতরফাভাবে এমন সিদ্ধান্ত করা কোনোক্রমেই বৈধ নয় যে, আমাদের ও তার মধ্যে কোনো চুক্তি নেই। আর এই সংগে হঠাৎ তার সাথে আমাদের এমন ব্যবহার করা উচিত নয় যা একমাত্র চুক্তি না থাকা অবস্থায় করা যেতে পারে। বরং এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হলে কোনো বিরোধীতামূলক কর্যক্রম গ্রহণ করার আগে দ্বিতীয় পক্ষকে স্পষ্টভাষায় একথা জানিয়ে দেবার জন্য আমাদের তাগিদ দেয়া হয়েছে যে, আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এখন আর কোনো চুক্তি নেই। এভাবে চুক্তি ভংগ করার জ্ঞান আমরা যতটুকু অর্জন করেছি তারও ততটুকু অর্জন করতে পারবে এব চুক্তি এখনো অপরিবর্তিত আছে, এ ধরনের ভুল ধারণা তারা পোষণ করবেনা। আল্লাহ্র এ ফরমান অনুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিন্মোক্ত স্থায়ী মুলনীতি ঘোষণা করেছিলেনঃ
“কোনো জাতির সাথে কারোর কোনো চুক্তি থাকলে মেয়াদ শেষ হবার আগে তার চুক্তি লংঘন করা উচিত নয়। এক পক্ষ চুক্তি ভংগ করলে উভয় পক্ষের সমতার ভিত্তিতে অপর পক্ষ চুক্তি বাতিল করার কথা জানাতে পারে।”
তারপর এ নিয়মকে তিনি আরো একটু ব্যাপকভিত্তিক করে সমস্ত ব্যাপারে এ সাধারণ নীতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন “যে ব্যক্তি তোমার সাথে খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা করে তুমি তার সাথে খিয়ানত করোনা” এ নীতিটি শুধুমাত্র বক্তৃতা বিবৃতিতে বলার ও বইয়ের পাতার শোভা বর্ধনের জন্য ছিলোনা বরং বস্তব জীবনে একে পূরাপূরি মেনে চলা হতো। আমীর মু’য়াবীয়া রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একবার নিজের রাজত্বকালে রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তে সেনা সমাবেশ করতে শুরু করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার সাথে সাথেই অতর্কিতে রোমান এলাকায় আক্রমণ চালাবেন। তাঁর এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আমর ইবনে আনবা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কঠোর প্রতিবাদ জানান। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীসটি শুনিয়ে চুক্তির মেয়াদের মধ্যেই এ ধরনের শত্রুতামূলক কর্যকলাপকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেন। অবশেষে আমীর মু’য়াবিয়াকে এই নীতির সামনে মাথা নোয়াতে হয় এবং তিনি সীমান্ত সৈন্য সমাবেশ বন্ধ করে দেন।
একতরফাভাবে চুক্তি ভংগ ও যুদ্ধ ঘোষণা করা ছাড়া আক্রমণ করার পদ্ধতি প্রচীন জাহিলী যুগেও ছিলো এবং বর্তমান যুগের সুসভ্য জাহিলিয়াতেও এর প্রচলন আছে। এর নতুনতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে বিগত দ্বিতিয় মহাযুদ্ধে রাশিয়ার ওপর জার্মানীর আক্রমণ এবং ইরানের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও বৃটেনের সামরিক কার্যক্রম। সাধারণত এ ধরনের কার্যক্রমের সপক্ষে ও ওযর পেশ করা হয় যে, আক্রমণের পূর্বে জনিয়ে দিলে প্রতিপক্ষ সতর্ক হয়ে যায়। এ অবস্থায় কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সন্মুখীন হতে হয় অথবা যদি আমরা অগ্রসর হয়ে হস্তক্ষেপ না করতাম তাহলে আমাদের শত্রুরা সুবিধা লাভ করতো। কিন্তু নৈতিক দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য এ ধরনের বাহানাকে যদি যথিষ্ট মনে করা হয় তাহলে দুনিয়ায় আর এমন কোনো অপরাধ থাকেনা যা কোনো না কোনো বাহানায় করা যেতে পারেনা। প্রত্যেক চোর, ডাকাত, ব্যভিচারী, ঘাতক ও জালিয়াত নিজের অপরাধের জন্য এমনি ধরনের কোনো না কোনো কারণ দর্শাতে পারে। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরিবেশে এরা একটি জাতির জন্য এমন অনেক কাজ বৈধ মনে করে যা জাতীয় পরিবেশে কোনো ব্যক্তি করলে তাদের দৃষ্টিতে অবৈধ বলে গণ্য হয়।
এ প্রসংগে একথা জেনে নেয়ারও প্রয়োজন রয়েছে যে, ইসলামী আইন শুধুমাত্র একটি অবস্থায় পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আক্রমণ করা বৈধ গণ্য করে। সে অবস্থাটি হচ্ছে, দ্বিতীয় পক্ষ যখন ঘোষণা দিয়েই চুক্তি ভংগ করে এবং আমাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে শত্রুতামূলক কাজ করে। এহেন অবস্থায় উল্লেখিত আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের পক্ষ থেকে তার কাছে চুক্তি ভংগ করার নোটিশ দেবার প্রয়োজন হয়না। বরং আমরা অঘোষিতভাবে তার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার অধিকার লাভ করি। বনী খুযায়ার ব্যাপারে কুরাইশরা যখন হুদাইবিয়ার চুক্তি প্রকাশ্যে বংগ করে তখন নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে চুক্তি ভংগ করার নোটিশ দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি এবং কোনো প্রকার ঘোষণা না দিয়েই মক্কা আক্রমণ করে বসেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কার্যক্রম থেকেই মুসলিম ফকীহগণ এ ব্যতিক্রমধর্মী বিধি রচনা করেছেন। কিন্তু কোনো অবস্থয় যদি আমরা এ ব্যতিক্রমধর্মী নিয়ম থেকে ফায়দা উঠাতে চাই তাহলে অবশ্যি সেই সমস্ত অবস্থা আমাদের সামনে থাকতে হবে যে অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এভাবে তাঁর সমগ্র কার্যক্রমের একটি সুবিধাজনক অংশ মাত্রের অনুসরণ না করে তার সবটুকু অনুসরণ করা হবে। হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলো থেকে যা কিছু প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে নিম্নরুপঃ
এক. কুরইশদের চুক্তি ভংগের ব্যাপারটি এতো বেশী সুস্পষ্ট ছিলো যে, চুক্তি ভংগ করেছে এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ ছিলোনা। কুরাইশরা এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্টি লোকেরা নিজেরাও চুক্তি যথার্থই ভেংগে গেছে বলে স্বীকার করতো। তারা নিজেরাই চুক্তি নবায়ণের জন্য আবু সুফিয়ানকে সদীনায় পাঠিয়েছিল। এর পরিষ্কার অর্থ ছিলো, তাদের দৃষ্টিতেও চুক্তি অক্ষুন্ন ছিলোনা। তবুও চুক্তি ভংগকারী জাতি নিজেই চুক্তি ভংগ করার স্বীকার করবে, এটা জরুরী নয়। তবে চুক্তি ভংগ করার ব্যাপারটি একেবারে সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীত হওয়া অবশ্যি জরুরী। দুই. কুরাইশদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভংগ করার পরও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বা ইশারা ইংগিত এমন কোনো কথা বলেননি যা থেকে এ ইশারা পাওয়া যায় যে, এ চুক্তি ভংগ করা সত্ত্বেও তিনি এখনো তাদেরকে একটি চুক্তিবদ্ধ জাতি মনে করেন এবং এখনো তাদের সাথে তাঁর চুক্তিমূলক সম্পর্ক বজায় রয়েছে বলে মনে করেন। সমস্ত বর্ণনা একযোগে একথা প্রমাণ করে যে, আবু সুফিয়ান যখন মদীনায় এসে চুক্তি নবায়ণের আবেদন করে তখন তিনি তা গ্রহণ করেননি।
তিন. তিনি নিজে কুরাইশদের বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ করেন এবং প্রকাশ্যে গ্রহণ করেন। তাঁর কার্যক্রমে কোনো প্রকার প্রতারণার সামান্যতম গন্ধও পাওয়া যায়না। তিনি বাহ্যত সন্ধি এবং গোপনে যুদ্ধের পথ অবলম্বন করেননি।
এটিই এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম আদর্শ। কাজেই ওপরে উল্লেখিত আয়াতের সাধারণ বিধান থেকে সরে গিয়ে যদি কোনো কার্যক্রম অবলম্বন করা যেতে পারে তাহলে তা এমনি বিশেষ অবস্থায়ই করা যেতে পারে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ধরনের সরল সহজ ভদ্রজনোচিত পথে তা করেছিলেন তেমনি পথেই করা যেতে পারে।
তাছাড়া কোনো চুক্তিবদ্ধ জাতির সাথে কোনো বিষয়ে যদি আমাদের কোনো বিবাদ সৃষ্টি হয়ে যায় এবং আমরা দেখি পারস্পরিক আলাপ আলোচনা বা আন্তর্জাতিক শালিশের মাধ্যমে এ বিবাদের মীমাংসা হচ্ছেনা অথবা যদি আমরা দেখি, দ্বিতীয় পক্ষ বল প্রয়োগ করে এর মীমাংসা করতে উঠে পড়ে লেগেছে, তাহলে এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য বল প্রয়োগ করে মীমাংসায় পৌছানো সম্পুর্ণরূপে বৈধ হয়ে যাবে। কিন্তু উপরোক্ত আয়াতে আমাদের ওপর এ নৈতিক দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের এ বল প্রয়োগ পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার পর হতে হবে এবং তা হতে হবে প্রকাশ্যে। লুকিয়ে গোপণে এমন ধরনের সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ করা যার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে আমরা প্রস্তুত নই, একটি অসদাচার ছাড় আর কিছুই নয়। ইসলাম এর শিক্ষা আমাদের দেয়নি।
গ. “কাজেই এ লোকদের যদি তোমরা যুদ্ধের মধ্যে পাও তাহলে তাদের এমনভাবে মার দেবে যেনো তাদের পরে অন্য যারা এমনি ধরনের আচরণ করতে চাইবে তারা দিশা হারিয়ে ফেলে। আশা করা যায়, চুক্তি ভংগকারীদের এ পরিণাম থেকে তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে।” (সূরা আনফালঃ ৫৭)
এর অর্থ হচ্ছে, যদি কোনো জাতির সাথে আমাদের চুক্তি হয়, তারপর তারা নিজেদের চুক্তির দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে আমরাও চুক্তির নৈতিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। এ ক্ষেত্রে আমরাও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ন্যায়সংগত অধিকার লাভ করবো। তাছাড়া যদি কোনো জাতির সাথে আমাদের যুদ্ধ চলতে থাকে এবং আমরা দেখি, শত্রুপক্ষের সাথে এমন এক সম্প্রদায়ের লোকেরাও যুদ্ধে শামিল হয়েছে যাদের সাথে আমাদের চুক্তি রয়েছে তাহলে আমরা তাদেরকে হত্যা করতে এবং তাদের সাথে শত্রুর মতো ব্যবহার করতে একটুও দ্বিধা করবোনা। কারণ তারা ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের সম্প্রদায়ের চুক্তি ভংগ করে তাদের ধন প্রাণের নিরাপত্তার প্রশ্নে তাদের সম্প্রদায়ের সাথে আমাদের যে চুক্তি রয়েছে তা লংঘন করেছে। ফলে নিজেদের নিরাপত্তার অধিকার তারা প্রমাণ করতে পারেনি।
ঘ. “আর হে নবী, শত্রু যদি সন্ধি ও শান্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তুমিও সেদিকে ঝুঁকে পড়ো এবং আল্লাহ্র প্রতি নির্ভর করো। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন। যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় তাহলে তোমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট।” (সূরা আনফালঃ ৬১-৬২)
অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে তোমাদের কাপুরুষোচিত নীতি অবলম্বন করা উচিত নয়। বরং আল্লাহ্র ওপর ভরসা করে নির্ভীক ও সাহসী নীতি অবলম্বন করা উচিত। শত্রু সন্ধির কথা আলোচনা করতে চাইলে নিসংকোচে তার সাথে আলোচনার টেবিলে বসে যাবার জন্য তৈরী থাকা প্রয়োজন। সে সদুদ্দেশ্যে সন্ধি করতে চায়না বরং বিশ্বাসঘাতকতা করতে চায়, এ অজুহাত দেখিয়ে তার সাথে আলোচনায় বসতে অস্বীকার করোনা। কারোর নিয়ত নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভবপর নয়। সে যদি সত্যিই সন্ধি করার নিয়ত করে থাকে তাহলে অনর্থক তার নিয়তের ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে রক্তপাতকে দীর্ঘায়িত করবে কেন? আর যদি বিশ্বাসঘাতকতা করার নিয়ত করে থাকে তাহলে তোমাদের আল্লাহ্র ওপর ভরসা করে সাহসী হওয়া দরকার। সন্ধির জন্য যে হাত এগিয়ে এসেছে তার জবাবে হাত বাড়িয়ে দাও। এর ফলে তোমাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হবে। আর যুদ্ধ করার জন্য যে হাত উঠবে নিজের তেজস্বী বাহু দিয়ে তাকে ভেংগে গুঁড়ো করে দাও। এভাবে সমুচিত জবাব দিতে পারলে কোনো বিশ্বাসঘাতক জাতি আর তোমাদের ননীর পুতুল মনে করার দুঃসাহস দেখাবেনা।
উপরোক্ত পৃষ্ঠগুলোতে যেসব আয়াত এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা কুরআনের রাজনৈতিক দর্শন ও ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান নীতিমালাকে পরিস্ফুট করে। কুরআন মানব জীবনের এই বিভাগ সম্পর্কে স্পষ্ট পথ নির্দেশনা দান করেছ। মুসলমানদের কর্তব্য হলো, নিজেদের যাবতীয় সামাজীক কার্যক্রম এগুলোর ভিত্তিতে পরিচালনা করা। কেবল এভাবেই তারা নিজেদের দীন ও ঈমানের দাবী পূরণে সক্ষম হবে।