দ্বিতীয় অধ্যায়
ইসলামের রাজনৈতিক মতাদর্শ
১। ইসলামী রাজনীতির উৎস
২। রাজনীতির গোড়ার কথা
৩। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও ধরন
৪। খিলাফত ও তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
হিমালয়ান উপমহাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক জাগরণ সাথে করে নিয়ে আসে অনেক প্রশ্ন ও জটিলতা। এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিলো ভবিষ্যতে মুসলমানদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেমন হবে? প্রতিটি মুসলমানদের উদগ্র আন্তরিক আকংখা এই ছিলো এবং আছে যে, তার সামাজিক ব্যবস্থা ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্য হলো, তারা ইসলামকে ভালোবাসে বটে, কিন্তু ইসলামের সঠিক ধারণা তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। এর কারণেই তারা ইসলামের জন্যে জান দিতে তৈরী থেকেও ইসলামের ভিত্তিতে বেঁচে থাকতে জানেনা।
মুসলমানদের এই মানসিক অবস্থা অনুধাবন করেই মাওলানা মওদুদী [র] ইসলামী জীবনব্যবস্থার মৌলিক বিষয়গুলোকে উপযোগী ব্যাখ্যার সাথে উপস্থাপন করেছেন। এ প্রসংগে ১৯৩৯ সালের অক্টোবর মাসে তিনি লাহোর ইন্টার কলেজিয়েট মুসলিম ব্রাদার হুড- এর সম্মেলনে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এ সময় পর্যন্ত মুসলমানরা নিজেদের কোনো সুস্পষ্ট জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেনি। মাওলানা তাঁর এই প্রবন্ধে মুসলিম উম্মাহকে জানিয়ে দিয়েছেন ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি কি? কি কি উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার বুনিয়াদী আদর্শই বা কি কি?
সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে প্রবন্ধটির পুনরীক্ষণ করার পর উপস্থাপন করা হলো। পুনরালাচনা থেকে বাঁচার জন্যে প্রবন্ধটির সে অংশ এখানে থেকে বাদ দেয়া হলো যাতে নির্বাহী বিষয়ের আলোচনা ছিলো। কারণ সম্মুখের অধ্যায়গুলোতে সম্মানিত গ্রন্থাকারের আরো যেসব লেখা সংকলিত হয়েছে, সেসব অধ্যায়ে সে আলোচনা সবিস্তারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। -সংকলক
ইসলামের রাজনৈতিক মতাদর্শ
ইসলাম সম্পর্কে আপনারা প্রায়ই শুনে থাকেন, “ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা” “ইসলাম একনায়কতন্ত্রের সমর্থক”, “ইসলাম সমাজতন্ত্রের পতাকাবাহী”, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিগত শতাব্দীর শেষভাগ থেকে এধরনের কথা বার বার উচ্চারণ করা হচ্ছে। কিন্তু কথাগুলো যাদের মুখ থেকে বের হচ্ছে, আমার দৃঢ়বিশ্বাস তাদের মধ্যে হাজারে একজনও এমন নেই, যিনি ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে যথাযথ অধ্যয়ন করেছেন এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। তারা একথাও বুঝার চেষ্টা করেননি যে, ইসলামে গণতন্ত্রের ধরন ও মর্যাদা কি, কিংবা সামাজিক সুবিচার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যে সে কি মূলনীতি পেশ করেছে? তাদের কেউ কেউতো ইসলামের সাংগঠনিক কাঠামোর দু’চারটি বাহ্যিক রূপ দেখে ইসলামের উপর গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রের নামাংকিত করে দিয়েছেন। আর তাদের অধিকাংশের মানসিক অবস্থা হলো, পৃথিবীতে [বিশেষ করে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের জগতে অধিষ্ঠিত শক্তিসমূহ এবং নিজ নিজ দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকদের মধ্যে] যে জিনিস সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে, সেটাকে কোনো না কোনো ভাবে ইসলামের মধ্যে বর্তমান আছে বলে প্রমাণ করে দেয়াই তাদের দৃষ্টিতে এই ধর্মটির সবচাইতে বড় খেদমত। সম্ভবত তারা ইসলামকে ঐ এতীম শিশুটির মতো মনে করে, যে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করলেই ব্যস ধ্বংস থেকে রক্ষা পেতে পারে। অথবা সম্ভবত তাদের ধারণা হলো, কেবল মুসলমান হিসেবে আমাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা, বরঞ্চ আমাদের নীতির মধ্যে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত কোনো অস্তিত্ব দেখাতে পারলেই আমাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। এই মানুসিকতার পরিণতি হলো, বিশ্বে যখন সমাজতন্ত্রের ধুম পড়ে গেলো, তখন মুসলমানদের মধ্যেই কিছু লোক চিৎকার করে উঠলো, সমাজতন্ত্রতো কেবল ইসলামেরই একটি নতুন সংস্করণ। আবার যখন একনায়কতন্ত্রের শাসন শুরু হলো, তখন আবার অন্য কিছু লোক এখানে আমীরের আনুগত্যের নমুনা দেখতে পেলো এবং বলতে শুরু করলো, ইসলামের গোটা সাংগঠনিক ব্যবস্থাই একনায়কতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।
মোটকথা, আজকে ইসলামের রাজনৈতিক মতাদর্শ একটি প্রহেলিকা ও ধুম্রজালে পরিণতি হয়ে আছে। এখান থেকে এমন সব জিনিসই বের করে দেখানো হয়, যার বাজার গরম। বাস্তবিকপক্ষে ইসলামের রাজনৈতিক মতাদর্শ কি, তার যথাযথ বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। এর ফলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা এসব ভ্রান্ত ধারণাই কেবল দূর হবেনা, কেবল ঐসব লোকের মুখই বন্ধ হবেনা যারা ইদানিং প্রকাশ্যে লিখিতভাবে নিজেদের ও অজ্ঞাতার ঘোষণা দিয়েছে যে, “ইসলাম আদতেই কোনো রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রস্তাব করেনা।” বরঞ্চ অন্ধকারে হাবুডুবু খাওয়া বিশ্বের সামনে এমন এক আলোর প্রদীপ উদ্ভাসিত হবে, বিশ্ব আজ যার বড় মুখাপেক্ষী। অবশ্য এই মুখাপেক্ষীতার চেতনাই সে আজ হারিয়ে বসেছে।
১. ইসলামী রাজনীতির উৎস
সর্বপ্রথম একথাটি ভালোভাবে বুঝে নিন যে, ইসলাম কেবল গুটিকয়েক বিক্ষিপ্ত বিশ্বাস এবং কর্মপন্থার সমষ্টিই নয়, যাতে এদিক ওদিক থেকে বিভিন্ন ধরনের মতের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। বস্তুত, ইসলাম একটি সুসংবদ্ধ ও সুষ্ঠু জীবন ব্যবস্থা। এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে কতিপয় আদর্শ ও মূলনীতির উপর। এর বড় বড় স্তম্ভ হতে শুরু করে একেবারে আনুষংগিক বিষয়াদি পর্যন্ত প্রত্যেকটি জিনিসের সাথে এর আদর্শ ও মূলনীতির এক যুক্তিসংগত সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম মানব জীবনের সকল বিভাগ ও বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে যতো নিয়ম কানুন ও বিধি বিধান পেশ করেছে, তার সবগুলোরই আভ্যন্তরীণ প্রাণসত্তা ও বাহ্যিক রূপকাঠামো এর সেই প্রাথমিক মূলনীতিও আদর্শ থেকেই গৃহীত হয়েছে। এই আদর্শ ও মূলনীতি থেকে যাবতীয় আনুষংগিক বিষয়াদিসহ একটি পূর্ণাংগ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ঠিক সেভাবে গঠিত হতে পারে, যেভাবে একটি গাছের ক্ষেত্রে আপনারা দেখতে পান বীজ থেকে শিকড়, শিকড় থেকে কান্ড, কান্ড থেকে শাখা এবং শাখা থেকে প্রশাখা ও পত্র পল্লব ফুটে বের হয়। গাছটি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়ে পড়লেও তার দূরবর্তী পাতাটি পর্যন্ত মূল শিকড়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকে। সুতরাং ইসলামী জীবন ব্যবস্থার যেকোনো দিক ও বিভাগকে বুঝার জন্যে এর মূলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা অপরিহার্য। কেননা এছাড়া এর প্রাণসত্তা এবং মূল ভাবাধারা কিছুতেই হৃদয়ংগম করা যেতে পারেনা।
নবীদের মিশন
ইসলাম সম্পর্কে দুটি কথা প্রায় সকল মুসলমানেরই জানা আছে। একটি হলো, সব নবীর মিশনই ছিলো ইসলাম। এটা কেবল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়াসাল্লামের মিশনই নয়। বরঞ্চ মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম অধ্যায় হতে আল্লাহর পক্ষ থেকে যতো নবীই এসেছেন , তাদেঁর সকলের এই একই মিশন ছিলো। দ্বিতীয় কথাটি হলো, সকল নবীই মানুষকে এক আল্লাহর কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব স্বীকার করানো এবং একমাত্র তাঁরই আনুগত্য করানোর উদ্দেশ্যে এসেছিলেন।
মুসলমান মাত্রই এ দুটি সত্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা অতিসাধারণ ব্যাপার। প্রত্যেক মুসলমান একথা শুনেই বলবে, এটাতো জানা কথা, একজন গ্রাম্য মুসলমানও এটা জানে। কিন্তু আমি চাই এ সংক্ষিপ্ত কথাটির আবরণ উন্মুক্ত করে আপনারা এর গভীর প্রবেশ করুন। আসল ব্যাপার এই আবরণের অন্তরালে চাপা পড়ে আছে। অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভালোভাবে চিন্তা করে দেখুন, আল্লাহর প্রভুত্ব স্বীকার করানোর উদ্দেশ্য কি? একমাত্র তাঁরই আনগত্য দাসত্ব করানোর অর্থ কি? আর এতে এমন কি কথাটি ছিলো যে, যখন আল্লাহর এক বান্দা [নবী] “আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ নেই” বলে ঘোষণা করলেন, তখন সকল আল্লাহদ্রোহী শক্তি তাঁকে জংগলের বিষাক্ত কাঁটার মতো বিদ্ধ করতে শুরু করে দিলো? বিষয়টা কেবলমাত্র যদি এরকমই হতো, যেমন আজকাল মনে করা হয় যে, মসজিদে গিয়ে আল্লাহর সামনে সিজদা করো আর মসজিদের বাহিরে এসে ক্ষমতাসীন সরকারের [ক্ষমতায় যে-ই অধিষ্ঠিত থাকনা কেনো] শর্তহীন আনুগত্য ও অনুবর্তনে লেগে যাও, তবে এমন কোন সরকার আছে যে তার এধরনের অনুগত ও বাধ্যগত প্রজাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে?
আসুন, আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি, আল্লাহ সম্পর্কে আম্বিয়ায়ে কিরাম ও বিশ্বের অন্যান্য শক্তিগুলোর মধ্যে আসলে কোন কথাটির ব্যাপারে বিরোধ ও বিবাদ হয়েছিলো?
কুরআন মজীদ একাধিক স্থানে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছে, যেসকল কাফিরও মুশরিকদের সাথে নবীদের সংঘাত সংঘর্ষ হয়, মূলত তাদের কেউই আল্লাহর সত্তার অস্বীকারকারী ছিলোনা। তাদের সকলেই আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলো। তারা স্বীকার করতো এবং বিশ্বাস করতো, আল্লাহই আসমান যমীনের স্রষ্টা এবং স্বয়ং সেই কাফির মুশরিকদেরও স্রষ্টা। বিশ্ব জগতের গোটা ব্যবস্থাপনা তাঁরই ইংগিতে পরিচালিত হয়। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তাঁর হুকুম অনুযায়ী বায়ু গতিশীল। চন্দ্র, সূর্য এবং পৃথিবী সবকিছুই তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীনঃ
“তাদের জিজ্ঞেস করো, পৃথিবী এবং এতে যাকিছু আছে তা কার, বলো, যদি তোমাদের জানা থাকে? তারা অবশ্যি বলবেঃ আল্লাহর। বলো, তবে কেন তোমরা ভেবে দেখনা? তাদের জিজ্ঞেস করো, সাত আসমান ও মহান আরশের মালিক কে? তারা বলবেঃ আল্লাহ। তুমি বলো, তাহলে তোমরা তাঁকে ভয় করনা কেন? তাদের জিজ্ঞেস করো, প্রতিটি জিনিসের কর্তৃত্ব কার হাতে, যিনি সকলকে আশ্রয় দান করেন, যাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কাউকেও আশ্রয় দান করতে পারেনা, তিনি কে, বলো, যদি তোমরা জেনে থাকো! তারা বলবেঃ আল্লাহ। তুমি বলো, তাহলে তোমরা কোন প্রতারণায় নিক্ষিপ্ত হয়েছো?” [সূরা মুমিনঃ ৮৪]
“আকাশ ও পৃথিবীকে কে সৃষ্টি করেছে? এবং সূর্য ও চন্দ্রকে কে নিয়ন্ত্রিত ও নিয়মানুগত করেছে, তা তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা নিশ্চয়ই বলবেঃ আল্লাহ। কিন্তু তবুও এরা বিভ্রান্ত হয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে?” [সূরা আনকাবুতঃ ৬১]
“তাদের যদি জিজ্ঞেস করো, আকাশ হতে কে পানি বর্ষণ করে আর তা দিয়ে মৃত যমীনকে জীবন দান করে কে? তাবে তারা নিশ্চয়ই বলবেঃ আল্লাহ। [সূরা আনকাবুতঃ ৬৩]
“তাদের যদি জিজ্ঞেস করো, তোমাদের কে সৃষ্টি করেছে? তবে তারা নিশ্চয়ই বলবেঃ আল্লাহ তা সত্ত্বেও তারা বিভ্রান্ত হয়ে কোথা চলে যাচ্ছে?” [সূরা যুখরুফঃ ৮৭]
অতএব এ আয়াতগুলো থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে এবং তাঁর সৃষ্টিকর্তা, আকাশ ও পৃথিবীর একচ্ছত্র মালিক ও প্রভূ হওয়ার ব্যাপারে মানব সমাজে কোনো কালেই কোনো মতভেদ ছিলোনা। জনগণ চিরদিনই এসব কথা স্বাভাবিকভাবেই স্বীকার করতো। কাজেই এসব কথার পুনঃ প্রচার এবং জনগণের দ্বারা তা স্বীকার করানোর জন্য নবী পাঠাবার কোনো প্রয়োজনীয়তা নিঃসন্দেহে ছিলোনা। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, দুনিয়ায় নবীদের আগমণের উদ্দেশ্য কি ছিলো? আর প্রতিপক্ষের সাথে তাদের বিরোধ বিবাদই বা ছিলো কী বিষয়ে?
কুরআন মজীদ এর সুস্পষ্ট জবাব দিয়েছে। কুরআন বলে, সমস্ত বিরোধ বিবাদের মূল কারণই ছিলো নবীদের এই বক্তব্যঃ “যিনি তোমাদের এবং আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, বস্তুত তোমাদের রব এবং ইলাহও একমাত্র তিনিই। অতএব তাঁকে ছাড়া আর কাউকেও রব এবং ইলাহ বলে স্বীকার করোনা। কিন্তু মানুষ নবীদের এই বক্তব্য মেনে নিতে মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা।
আসুন একটু অনুসন্ধান করে দেখি কেন তারা নবীদের সাথে বিরোধ করলো? ‘একমাত্র ইলাহ’ বলতে কি বুঝায়? রব কাকে বলে? আল্লাহকেই রব ও ইলাহ, স্বীকার করো একথার উপর নবীরা কেন এতোটা অটলতা অবলম্বন করেছিলেন? আর প্রতিপক্ষই বা কেন একথার বিরোদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো?
’ইলাহ’ ও ‘রবে’র অর্থ কি?
ইলাহ শব্দের অর্থ মা’বুদ বা উপাস্য, একথা সবাই জানে। পাঠক আমাকে ক্ষমা করবেন, মা’বুদ এর অর্থ মুসলমানরা ভুলে গেছে। মা’বুদ শব্দটা আবদ’ ধাতু থেকে এসেছে। আবদ অর্থ হলো বান্দা, গোলাম বা দাস। ইবাদাতের অর্থ নিছক পূজা নয়। একজন বান্দা, গোলাম বা দাস যে জীবন দাসত্ব ও গোলামীর অবস্থায় অতিবাহিত করে, তার পুরোটাই আগাগোড়া ইবাদত। খিদমত বা সেবার জন্য দাঁড়ানো, ভক্তিভরে বুকে হাত বাঁধা, দাসত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ মাথা নোয়ানো, আনুগত্যের মনোভাব ও জজবায় সর্বক্ষণ উজ্জীবিত থাকা, হুকুম পালনের জন্য চেষ্টাসাধনা ও ছুটোছুটি করা, যে কাজ সম্পাদনের ইংগিত দেয়া হয় তা সম্পন্ন করা, মনিব যা চান তা প্রদান করা, তার শক্তি ও প্রতাপের সামনে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করা, তার প্রবর্তিত আইনের আনুগত্য করা, যার বিরুদ্ধে তিনি নির্দেশ দেন তার ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা, যে ব্যাপারে তার নির্দেশ থাকবে তার জন্য প্রয়োজনে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দেয়া এসব হলো ইবাদাতের আসল অর্থ ও মর্ম। মানুষ এভাবে যার ইবাদত করে, তিনিই তার প্রকৃত মা’বুদ।
আর রব অর্থ কি? আরবী ভাষায় রবের মূল অর্থ হচ্ছে লালনপালনকারী। যেহেতু দুনিয়ার রীতি হলো, যে লালনপালন করে, তারই আনুগত্য ও ফরমাঁবরদারী করা হয়। তাই রবের আরেকটি অর্থ দাঁড়ালো মালিক ও মনিব। একারণেই আরবীতে সম্পদের মালিককে রব্বুল মাল’ [সম্পদের মালিক] এবং বাড়ীর মালিককে রব্বুল দার’ বলা হয়ে থাকে। মানুষ যাকে নিজের রিযিকদাতা ও লালনপালনকারী বলে জানে, যার কাছ থেকে অনুগহ ও উন্নতির আশা করে, যার কাছ থেকে সম্মান, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার প্রত্যাশী হয়, যার দর্য়াদ্র সৃষ্টি না পেলে নিজের জীবন বরবাদ হয়ে যাওয়ার আশংকা করে, যাকে নিজের মালিক ও মনিব বলে স্বীকার করে এবং কার্যত যার আনুগত্য করে, সে-ই তার রব। [উক্ত পরিভাষা দুটির বিশদ ব্যাখ্যার জন্য গ্রন্থকারের ‘কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা’ গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য।]
এই দুটো শব্দের অর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে একটু গভীরভাবে ভেবে দেখুনতো, মানুষের সামনে, আমি তোমার ইলাহ, আমি তোমার রব, এবং আমার ইবাদত ও দাসত্ব করো এই দাবী নিয়ে কে দাড়াতে পারে? গাছ কি পারে এমন দাবী করতে? পাথর কি এমন দাবী করার যোগ্যতা রাখে? সমুদ্র কি এরূপ দাবী করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে? এমন ঔদ্ধত্য দেখাতে পারে কি কোনো জীব জানোয়ার, চাঁদ, সূর্য বা নক্ষত্র? মানুষের সামনে এসে এই দাবী করার স্পর্ধা কি কারো আছে? না, কক্ষনো নয়। মানুষের ওপর খোদায়ী দাবী করা কেবল মানুষের পক্ষেই সম্ভব এবং মানুষই এ অপকর্মটি করে থাকে। প্রভুত্ব করার সখ ও সাধ একমাত্র মানুষের মাথায়ই জন্মে, অন্য কারো নয়। সীমাতিরিক্ত ক্ষমতার লালসা ও মাত্রাতিরিক্ত ভোগের স্পৃহা মানুষকে প্ররোচিত করে অন্য মানুষদের প্রভু হতে তাদেরকে নিজের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করতে তাদেরকে নিজের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য করতে, তাদের ওপর নিজের হুকুম জারী করা, এবং তাদেরকে নিজের প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত করতে। মানুষের প্রভু বা খোদা হওয়া এতো মজাদার জিনিস যে, মানুষ আজ পর্যন্ত এর চেয়ে মজাদার কোনো জিনিসের সন্ধান পায়নি। যার যতটুকু শক্তিসামর্থ, ধনসম্পদ, চালাকী চাতুরী, বিচক্ষনতা ও প্রজ্ঞা অথবা অন্য কোনো ধরনের কোনো ক্ষমতা থাকনা কেন, সে এটাই কামনা করে যে, তাকে যেভাবেই হোক নিজের বৈধ ও স্বভাবসিদ্ধ সীমানা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, চারদিকে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে হবে এবং নিজের খোদায়ীর দাপট ও প্রতাপ ছড়িয়ে দিতে হবে।
এ ধরনের প্রভুত্ব অভিলাষী মানুষ দু ধরনের হয়ে থাকে এবং দুটো ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করে থাকে।
১. সরাসরি দাবীদার
এক ধরনের মানুষ অপেক্ষাকৃত সাহসী হয়ে থাকে, অথবা তাদের কাছে প্রভুত্ব বিস্তারের প্রচুর উপকরণ বিদ্যমান থাকে। তারা সরাসরি নিজেদের খোদায়ী বা প্রভুত্বের দাবী তুলে থাকে। এর একটি দৃষ্টান্ত হলো ফেরাউন। নিজের রাজকীয় ক্ষমতা ও সৈন্য সামন্তের ওপর নির্ভর করে সে মিসরের অধিবাসীদেরকে বলেছিলোঃ “আমি তোমাদের সর্বোচ্চ প্রভু” [সূরা আননাযিয়াতঃ ২৪]। সে আরো বললোঃ “আমি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ আছে বলেতো আমার জানা নেই।” [সূরা কাসাসঃ ৩৮]। যখন হযরত মুসা আলাইহিস সালাম তার সামনে আপন জাতির স্বাধীনতার দাবী পেশ করলেন এবং তাকে বললেন, তুমি নিজেও বিশ্বপ্রভুর দাসত্ব মেনে নাও, তখন সে বললো, আমি তোমাকে জেলে পাঠাতে পারি, কাজেই তুমি আমাকে খোদা মনে নাও। “তুমি যদি আমাকে ছাড়া আর কাউকে খোদা মানো তাহলে আমি তোমাকে বন্দী করবো” [সূরা আশশুয়ারাঃ ২৯]। অনুরূপ আর একটি দৃষ্টান্ত হলো হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে যার বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সেই রাজা। কুরআনে যে ভাষায় এটি উল্লেখ করা হয়েছে তা লক্ষ্য করুনঃ
“তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখোনি, যে ইবরাহীমের সাথে ইবরাহীমের প্রভু কে, তাই নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলো? এ বিতর্কে সে লিপ্ত হয়েছিলো এজন্য যে, আল্লাহ তাকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। ইবরাহীম যখন বললো, জীবন ও মৃত্যু যার হাতে ন্যস্ত, তিনিই আমার প্রভূ। তখন সে বললোঃ জীবন ও মৃত্যুতো আমার হাতে। ইবরাহীম বললোঃ বেশ, আল্লাহতো সূর্যকে পূর্বদিক থেকে উদিত করেন, তুমি পশ্চিম দিক থেকে ওটা উদিত করোতো দেখি! একথা শুনে সেই কাফের হতচকিত হয়ে গলো।” [সূরা আল-বাকারাঃ ২৫৮]
ভেবে দেখুনতো, এই কাফের কি কারণে হতচকিত হয়ে গেলো? কারণ সে আল্লহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতোনা। আল্লাহই যে, সমগ্র বিশ্বনিখিলের একমাত্র অধিপতি ও শাসক তিনিই যে সূর্যকে উদিত ও অস্তমিত করেন তাও সে জানতো। বিশ্বনিখিলের মালিক ও মনিব কে? সেটা বিতর্কের বিষয় ছিলোনা। বিতর্কের বিষয় এই ছিলো যে, মানুষের বিশেষত ইরাকের অধিবাসীদের মনিব ও প্রভুকে। সে আল্লাহ হবার দাবী করতোনা, তার দাবী ছিলো শুধু এইযে, ইরাক সম্রাজ্যের অধিবাসীদের প্রভু ও মালিক মোক্তার আমি। আর এ দাবী সে এজন্য করতে যেহেতু শাসন ক্ষমতা তার হাতেই ছিলো। দেশবাসীর প্রাণ ছিলো তার হাতের মুঠোয়। সে যাকে ইচ্ছা ফাঁসিতে ঝুলাতে এবং যাকে খুশী ফাসি থেকে অব্যাহতি দিতে পারতো। সে মনে করতো, তার মুখ থেকে যেকথা বেরোয় সেটাই আইনের মর্যাদা রাখে এবং সকল প্রজার ওপর তার শাসন চলে। তাই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে সে আদেশ দিয়েছিলো, তুমি আমাকে প্রতিপালক মেনে নাও এবং আমার ইবাদত ও দাসত্ব করো। কিন্তু হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন বললেন, যিনি পৃথিবী ও আকাশের প্রভু এবং এই সূর্যও যার আনুগত্য করে, আমি শুধু তাঁকেই প্রভু ও প্রতিপালক মানবো এবং তাঁরই ইবাদত ও দাসত্ব করবো। তখন সে হতভম্ব হয়ে গেলো এবং শুধু এই ভেবে হতভম্ব হলো যে, এ ধরনের লোককে আমি কিভাবে বশীভূত করি। [বিষয়টির আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য গ্রন্থকারের “কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা” দেখুন।]
খোদায়ীর এই যে দাবী নমরুদ এবং ফেরাউন করেছিলো তা শুধু তাদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা, দুনিয়ার সকল জায়গায় সকল শাসকের দাবী এটাই ছিলো এবং এটাই আছে। ইরান সম্রাটের জন্য খোদা খোদাওয়ান্দ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। আর তার সামনে বন্দনার যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হতো। অথচ কোনো ইরানী তাকে সকল খোদার বড় খোদা তথা আল্লাহ মনে করতোনা। এমনকি স্বয়ং রাজারাও সে দাবী করতোনা। এমনিভাবে ভারতেও শাসকরা নিজেদেরকে দেবতাদের বংশধর বলে দাবী করতো। এজন্য সূর্যবংশী, চন্দ্রবংশী ইত্যাকার বংশীয় খেতাব এখনো প্রসিদ্ধ। রাজাকে অন্নদাতা বলা হতো এবং তাঁর সামনে সিজদা করা হতো। অথচ কোনো রাজা যেমন নিজেকে পরমেশ্বর বা পরমাত্মা বলে দাবী করতোনা, তেমনি প্রজারাও তেমনটি ভাবতোনা। দুনিয়ার অন্যান্য দেশের অবস্থাও ছিলো তখন তথৈবচ এবং এখনো আছে। কোথাও কোথাও শাসকের জন্য ইলাহ ও রবের সমার্থক শব্দ এখনো খোলাখুলিভাবে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু যেখানে যেখানে এসব শব্দ প্রয়োগ করা হয়না, সেখানেও এসব শব্দের অর্থের ভেতর যে প্রেরণা ও ভাবধারা সুপ্ত রয়েছে সেটাই কার্যত বিরাজমান। এধরনের খোদায়ী দাবী করার জন্য স্পষ্ট ভাষায় ইলাহ বা রব হবার কথাই ঘোষণা করতে হবে এটা জরুরী নয়। নমরুদ ও ফেরাউন মানুষের ওপর যে নিরংকুশ ও সার্বভৌম ক্ষমতা, যে স্বৈরাচারী শাসন এবং যে প্রভুত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো, অবিকল সেই জিনিস যারাই প্রতিষ্ঠা করবে, তারা আসলে ইলাহ’ ও রব’ দ্বারা যা বুঝায় তারই দাবী জানায়, চাই মুখে ইলাহ এবং রব শব্দ উচ্চারণ করুক বা না করুক। আর যারা তাদের আনুগত্য ও দাসত্ব করে তারা মুখ দিয়ে যাই বলুক না কেন আসলে তারা তাদেরকে ইলাহ ও রব বলেই মেনে নেয়।
২. পরোক্ষ দাবীদার
সারকথা হলো, এক ধরনের মানুষ সরাসরি ও প্রত্যক্ষভাবে নিজের খোদায়ী ও প্রভুত্বের দাবী করে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় আর এক প্রকারের মানুষ আছে, যাদের কাছে এতো শক্তিও থাকেনা, উপায় উপকরণও থাকেনা যে, নিজেই এধররেন দাবী নিয়ে ময়দানে নামবে এবং জনগণকে তা মেনে নিতে উদ্বুদ্ধ করে ফেলবে। তবে তাদের কাছে চাতুর্যও ধড়িবাজীর অস্ত্র থাকে এবং তা দিয়ে তারা সাধারণ মানুষের মনমগজে যাদু করতে সক্ষম হয়। এসমস্ত উপায় উপকরণ প্রয়োগ করে তারা কোনো আত্মা, দেবতা, প্রতিমা, কবর, নক্ষত্র, অথবা কোনো গাছকে খোদা বানিয়ে দেয়। তারপর তারা জনগণকে বলে, এরা তোমাদের ক্ষতি ও উপকার করতে সক্ষম, তোমাদের মনস্কামনা পূরণ করতে সক্ষম এবং এরা তোমাদের অভিভাবক, রক্ষক ও সাহায্যকারী। এদেরকে যদি সন্তুষ্ট না করো তাহলে এরা তোমাদের রোগ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও নানা রকমের দুর্যোগ আক্রান্ত করবে। আর যদি ওদেরকে সন্তুষ্ট করে মনস্কামনা পূরণের প্রার্থনা করো, তাহলে তারা তোমাদের সাহায্য করবে। কিন্তু তাদেরকে কিভাবে খুশী করা যায় এবং কিভাবে তাদেরকে তোমাদের প্রতি আকৃষ্ট করা যায় সেটা আমাদের জানা আছে। তাদের সান্নিধ্যে উপনীত হওয়ার মাধ্যম একমাত্র আমরাই হতে পারি। সুতরাং আমাদের বড়ত্ব ও বুজুর্গী মেনে নাও। আমাদরেকে খুশী করো এবং আমাদের হাতে তোমাদের জানমাল ও ইজ্জত সব সোপর্দ করে দাও। বহু নির্বোধ মানুষ এই ফাঁদে আটকা পড়ে। আর এভাবেই ভূয়া খোদাদের আড়ালে পুরোহিত, পূজারী ও খাদেমদের খোদায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
এই শ্রেণীর মধ্যেই আর একটা গোষ্ঠী আছে। তারা জ্যোতির্বিদ্যা, তাবীজ-তুমার ও যাদুমন্ত্র ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত হয়। তাছাড়া আরো কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বের স্বীকৃতি দেয় বটে, তবে তারা এও বলে যে, তোমরা সরাসরি আল্লাহর কাছে পৌছতে পারবেনা। তাঁর দরবারে পৌছার মাধ্যম আমরা। ইবাদতের আচার অনুষ্ঠান আমাদের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। তোমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান আমাদের হাতেই সম্পন্ন হবে। এমন আরো কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহর কিতাবের রক্ষক ও পারদর্শী, কিন্তু সাধারণ লোকদেরকে তার জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করে, আর নিজেরা আল্লাহর স্বকল্পিত বরকন্দাজ সেজে হালাল হারামের মনগড়া বিধি চালু করতে থাকে। এভাবেই তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি কথাই আইনে পরিণত হয়। তারা মানুষকে আল্লাহর নয় বরং নিজেদের হুকুমের দাসে পরিণত করে। পৃথিবীর আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামে ও ভিন্ন ভিন্ন আকৃতিতে দেশে দেশে ও অঞ্চলে অঞ্চলে যে ভ্রাক্ষ্মণ্যবাদ ও পোপতন্ত্র চালু রয়েছে, তার মূল কথা এটাই, এরই বদৌলতে কোনো কোনো বংশ, বর্ণ ও শ্রেণী সাধারণ মানুষের ওপর নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করে রাখে।
বিভ্রান্তির উৎস
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জানা যাবে, পৃথিবীতে সকল বিভ্রান্তি এবং সকল বিপর্যয় ও অশান্তির মূল উৎস হলো মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব- চাই তা প্রত্যক্ষভাবে হোক কিংবা পরোক্ষভাবে। যাবতীয় অনাচার ও দুস্কৃতির সূচনা এই জিনিস থেকেই হয়েছে এবং এথেকেই আজও প্রস্ফুটিত হচ্ছে হাজারো বিষাক্ত ঝর্ণা। মানব স্বভাব প্রকৃতির যাবতীয় রহস্য আল্লাহ তায়ালারতো এমনিই জানা আছে। কিন্তু এখন হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতা দ্বারা খোদ আমাদেরও একথা পুরোপুরিভাবে জানা হয়ে গেছে যে, মানুষ কাউকে না কাউকে ইলাহ বা রব না মেনে থাকতেই পারেনা। কেউ তার প্রভু বা ইলাহ না হলে তার যেনো বাঁচতে অসম্ভব। সে যদি আল্লাহকে না মানে, তাহলেও ইলাহ ও প্রভুর হাত থেকে তার নিস্কৃতি নেই। বরং সেক্ষেত্রে তার ঘাড়ের ওপর অসংখ্য ইলাহ ও প্রভু চেপে বসবে। আজও আপনি যেদিকেই তাকান দেখবেন, কোথাও একজাতি অপর জাতির ইলাহ বা খোদা হয়ে বসে আছে। কোথাও এ শ্রেণী অপর শ্রেণী বা গোষ্ঠীর প্রভু হয়ে রয়েছে। কোথাও একটি দল ইলাহ ও রবের পদটি দখল করে বসে আছে। কোথাও জাতীয় রাষ্ট্র খোদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে। আবার কোথাও কোনো স্বৈরাচারী হুংকার ছাড়ছে যে, “আমি ছাড়া তোমাদের কোনো খোদা আছে বলেতো জানিনা” [সূরা কাসাসঃ ৩৮]। দুনিয়ার কোনো একটি স্থানেও মানুষ ইলাহ বা প্রভু ছাড়া জীবন যাপন করেনি।
এরপর মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তার ফল কি দাড়ায় তাও ভেবে দেখা দরকার। একজন অযোগ্য লোককে পুলিশ কমিশনার বা একজন মূর্খ লোককে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিলে যে ফলাফল দেখা দিয়ে থাকে, এখানেও সেটাই দেখা দেবে। একেতো প্রভুত্বের নেশাটাই এমন যে, কোনো মানুষ এই মদ খেয়ে স্থির থাকতেই পারেনা। আর যদি ধরেও নেয়া যায় যে, স্থির থাকতে পারবে, তথাপি প্রভুত্বের দায়িত্ব পালন করতে যে জ্ঞানের প্রয়োজন এবং যেরূপ নিঃস্বার্থ ও পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত হওয়া আবশ্যক, তা মানুষ কোথায় পাবে? একারণেই যেখানে যেখানে মানুষের প্রভুত্ব ও নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে কোনো না কোনো উপায়ে যুলুম, নিপীড়ন, আগ্রাসন, অবৈধ স্বার্থভোগ, অবিচার ও অসম আচরণের প্রাদুর্ভাব না ঘটে ছাড়েনি। মানবাত্মা আপন স্বাভাবিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত না হয়ে পারেনি। মানুষের মনমগজের ওপর এবং তার সহজাত ক্ষমতা, যোগ্যতা ও প্রতিভার ওপর এমন কড়াকড়ি আরোপিত না হয়ে পারেনি, যা মানবীয় ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও উন্নয়নকে থামিয়ে দিয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথার্থই বলেছেনঃ
“আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ আমি আমার বান্দাদেরকে নিখুত ও নির্মল স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছিলাম। পরে শয়তান তাদেরকে এসে ঘিরে ধরলো, তাদেরকে তাদের স্বভাবসুলভ নির্ভুল পথ থেকে বিচ্যুত করলো এবং আমি যা কিছু তাদের জন্য হলাল করেছিলাম তা থেকে শয়তানরা তাদের বঞ্চিত করলো।” [হাদীসে কুদসী]
বস্তুতঃ এই জিনিসটাই মানুষের সকল বিপদ মুসিবত, সকল ধ্বংস ও বিপর্যয় এবং সকল বঞ্চনার মূল কারণ। তার উন্নতির পথে এটাই অন্তরায়। এটাই সেই সর্বনাশা রোগ যা তার নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে, তার জ্ঞান ও চিন্তা শক্তিকে, তার সমাজ ও সভ্যতাকে, তার রাজনীতি ও অর্থনীতিকে, এক কথায় তার সমগ্র মনুষ্যত্বকে যক্ষারোগের মতো খেয়ে ফেলেছে। আদিমতম যুগ থেকে খেয়ে আসছে এবং আজও সমানে খেয়ে চলেছে। এ রোগের একমাত্র চিকিৎসা হলো, মানুষ সকল রব ও সকল ইলাহকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র বিশ্বপ্রভূ আল্লাহকে নিজের প্রভু, ইলাহ ও রব বলে ঘোষণা করবে। এছাড়া তার মুক্তির আর কোনো পথ নেই। কেননা নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহী হলেও তো অসংখ্য জাগতিক খোদা ও প্রভুর হাত থেকে তার নিস্কৃতি নেই।
নবীগণের আসল সংস্কারমূলক কাজ
নবীগণ মানুষের জীবনে যে মৌলিক সংস্কারমূলক কাজটি করে গেছেন সেটি হলো এই কাজ। আসলে মানুষের ওপর থেকে মানুষের প্রভুত্বের অবসান ঘটাতেই তারা এসেছিলেন। মানুষকে এই যুলুম থেকে, এসব মিথ্যা ও ভূয়া খোদাদের দাসত্ব থেকে এবং এই আগ্রাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি দেয়াই ছিলো তাদের আসল ব্রত ও লক্ষ্য। যে মানুষ মনুষ্যত্বের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তাকে ধাক্কা দিয়ে আবার সীমার মধ্যে ফিরিয়ে আনা এবং যাদেরকে এই সীমার নিচে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো তাদেরকে এই সীমা পর্যন্ত উঠিয়ে আনাই ছিলো তাঁদের লক্ষ্য। সবাইকে তারা এমন একটা সুষম ও সুবিচার ভিত্তিক জীবনব্যবস্থার অনুগত করতে চেয়েছিলেন, যেখানে কোনো মানুষ অন্য কোনো মানুষের দাসও হবেনা, মনিবও হবেনা। উপাস্যও হবেনা, উপাসকও হবেনা। বরং সবাই এক আল্লাহর গোলামে পরিণত হবে। আদিকাল থেকে এযাবত যতো নবী দুনিয়ায় এসেছেন তাদের সকলের একই বানী ছিলো যে, “হে জনতা! তোমরা সবাই আল্লাহর দাসত্ব করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই।” হযরত নূহ আলাইহিস সালাম, হযরত হুদ আলাইহিস সালাম, হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম ও হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালামও একথাই বলেছেন। আর সর্বশেষ আরবের মাটিতে জন্ম নেয়া বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একথাই ঘোষণা করেছেনঃ
“আমি কেবল একজন সাবধানকারী। সেই আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই যিনি একও সকলের ওপর জয়ী। যিনি আকাশ, পৃথিবী ও তার মধ্যবর্তী সব কিছুর প্রভু।” [সূরা সাদঃ ৬৫-৬৬]
“নিশ্চয় সে আল্লাহই তোমাদের প্রভু, যিনি আকাশ ও পৃথিবীকে……………. এবং সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রকে সৃষ্টি করেছেন। সবাই তার আদেশের অনুগত। সাবধান, সৃষ্টি তাঁর এবং শাসনও তাঁরই। [সূরা আরাফঃ ৫৪]
“সেই এক আল্লাহই তোমাদের প্রভু। তিনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। তিনি সকল জিনিসের স্রষ্টা। কাজেই তোমরা তাঁরই আনুগত্য করো, তিনি সকল জিনিসের সংরক্ষক।” [সূরা আনয়ামঃ ১০২]
“একনিষ্ঠ আনুগত্যও একাগ্রতা সহকারে আল্লাহর দাসত্ব করা ছাড়া মানুষকে আর কোনো কাজের আদেশ দেয়া হয়নি।” [সূরা আলবাইয়িনাঃ ৫]
“যেকথা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এক ও অভিন্ন তার দিকে এসো। সেটি হলো, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবোনা, তাঁর খোদায়ীতে আর কাউকে শরীক করবোনা এবং আমাদের মধ্য থেকে কেউ কাউকে আল্লাহর বিকল্প প্রভু বানিয়ে নেবোনা।” [সূরা আল ইমরানঃ ৬৪]
এ আহবানই মানুষের আত্মাকে, তার চিন্তা ও বুদ্ধিকে এবং তার মানসিক ও বস্তুগত শক্তিগুলোকে বিদ্যমান গোলামীর বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলো। এটি ছিলো মানুষের জন্য সত্যিকার স্বাধীনতার সনদ। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কীর্তি সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ
“মানুষ যে বোঝার নিচে পিষ্ট হচ্ছিলো, এই নবী তাথেকে তাদের উদ্ধার করেন এবং যেসব বন্ধনে তারা আবদ্ধ ছিলো তা তিনি ছিন্ন করেন।” [সূরা আরাফঃ ১৫৭]
২. রাজনীতির গোড়ার কথা
নবী আলাইহস সালামগণ মানবজীনের জন্য যে বিধিব্যবস্থা তৈরী করে দিয়েছেন তার কেন্দ্রবিন্দু ও ভিত্তি, তার মূল প্রাণশক্তি এবং সার নির্যাসই হচ্ছে এই আকিদা ও বিশ্বাস। ইসলামী রাজনীতির গোড়ার কথাই হচ্ছে এই মূলনীতি যে, আদেশ প্রদান ও আইন রচনার ক্ষমতা ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে এবং সামষ্টিকভাবে সকল মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে। কারো জন্য এ অধিকার মেনে নেয়া হবেনা যে, সে নির্দেশজারী করবে এবং অন্যেরা তার আনুগত্য করবে। এ অধিকার ও ক্ষমতা কেবলমাত্র আল্লাহর রয়েছে, আর কারো নয়।
“আল্লাহ ছাড়া আর কারো শাসন চলবেনা, তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করোনা, এটাই সঠিক জীবন ব্যবস্থা।” [সূরা ইউসুফঃ ৪০]
“তারা জিজ্ঞাসা করে, ক্ষমতায় আমাদের কিছু অংশ আছে কি? তুমি বলে দাও, যাবতীয় ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহর। [সূরা আলা ইমরানঃ ১৫৪]
“নিজ নিজ মুখ দিয়ে ভ্রান্তভাবে একথা বলোনা যে, এটা হালাল আর এটা হারাম।” [সূরা আননাহলঃ ১১৬]
“আল্লাহর নাযিল করা শরীয়া মোতাবেক যারা ফায়সালা করেনা তারাই কাফের।” [সূরা মায়েদাঃ ৪৪]
এ মতাদর্শ অনুসারে সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার। আইন রচনাকারী আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ নয়। কোনো মানুষ, চাই নবীই হোকনা কেন, স্বতন্ত্রভাবে হুকুম দেয়া ও নিষেধ করার অধিকারী নয়। নবী নিজেও আল্লাহর আদেশেরই অনুগত।
“আমি শুধু ওহীযোগে প্রাপ্ত নির্দেশই মেনে চলি।” [সূরা আনয়ামঃ ৫০]
সাধারণ মানুষকে নবীর আনুগত্য করা নির্দেশ শুধু এজন্যই দেয়া হয়েছে যে, তিনি নিজের হুকুম নয় বরং আল্লাহর হুকুম জারী করেন।
“আমি যাকেই রসূল করে পাঠিয়েছি, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর আনুগত্য করা হবে- এজন্যই পাঠিয়েছি।” [সূরা আননিসাঃ ৬৪]
“এই সকল ব্যক্তিবর্গকেই আমি কিতাব, কর্তৃত্ব ও নবূয়্যত দান করেছি।” [সূরা আনয়ামঃ ৮৯]
“কোনো মানুষের এ অধিকার নেই যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, কর্তৃত্ব ও নবূয়্যত দান করবেন আর সে জনগণকে বলবে, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার দাস হয়ে যাও। বরং সে শুধু একথাই বলবে যে, তোমরা আল্লাহর দাস হয়ে যাও।” [সূরা আল ইমরানঃ ৭৯]
সুতরাং কুরআনের উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের যে কয়টি প্রাথমিক ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায় তা নিম্নরূপঃ
১. কোনো ব্যক্তি, পরিবার, শ্রেণী বা গোষ্ঠী এমনকি রাষ্ট্রের সমগ্র জনগোষ্ঠী মিলিত হয়েও সার্বভৌমত্বের অধিকারী নয়। সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক শুধু আল্লাহ তায়ালা। বাদবাকী সবাই নিছক প্রজার মর্যাদা রাখে।
২. আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। সকল মুসলমান মিলিত হয়ে না পারে নিজেদের জন্য কোনো আইন বানাতে, আর না পারে আল্লাহর প্রণীত কোনো আইন সংশোধন করতে।
৩. আল্লাহর নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে যে আইন দিয়েছেন, তার ভিত্তিতেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। আর এই রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার শুধুমাত্র আল্লাহর আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়নকারী সরকার হিসেবেই এবং যতক্ষণ আল্লাহর আইন প্রয়োগ করতে থাকবে ততক্ষণই আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী হবে।
৩. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও ধরন
যে কোনো ব্যক্তি উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি একটি নজর বুলিয়েই বুঝতে পারে যে, এটা পাশ্চাত্য ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র Secular Democracy] নয়। কেননা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রতো বলাই হয় এমন শাসন ব্যবস্থাকে, যাতে দেশের সাধারণ অধিবাসীদের সার্বভৌমত্ব থাকে, তাদের মতেই দেশের আইন তৈরী হয় এবং তাদের মতানুসারেই আইনের সংশোধন ও রদবদল হয়ে থাকে। যে আইন তারা চাইবে তা চালু আর যে আইন তারা চাইবেনা তাকে আইনের বই থেকে খারিজ করে দেয়া হবে। ইসলামে একথা খাটেনা। এখানে একটা সর্বোচ্চ মৌলিক বিধান স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রসূলের মাধ্যমে দেন, যার আনুগত্য সরকার ও রাষ্ট্রকে করতেই হয়। সুতরাং এ অর্থে তাকে গণতন্ত্র বলা যায়না। এর জন্য অধিকতর নির্ভুল নাম হচ্ছে “খোদায়ী শাসন” যাকে ইংরেজীতে [Theocracy] বলা হয়ে থাকে। তবে ইউরোপ যে থিওক্র্যাসীর সাথে পরিচিত, ইসলামী থিওক্র্যাসী তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইউরোপ যে থিওক্র্যাসীর সাথে পরিচিত, তাতে একটা বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠী [Priest class] আল্লাহর নামে নিজেদের বানানো আইনকুনুন চালু করে। [খৃষ্টান পোপ ও পাদ্রীদের কাছে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কিছুসংখ্যক নৈতিক শিক্ষা ছাড়া কোনো শরীয়ত তথা আইন বিধান আদৌ ছিলোনা। তাই তারা নিজেদের ইচ্ছামতো আপন প্রবৃত্তির খায়েশ মোতাবেক আইন বানাতো আর তাকে আল্লাহর আইন আখ্যায়িত করে বাস্তবায়িত করতো। সূরা বাকারার ৭৯ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ “যারা নিজ হাতে বই লেখে এবং বলে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ পরিণাম।”] এভাবে তারা কার্যত জনসাধারণের ওপর নিজেদের প্রভুত্ব চাপিয়ে দেয়। এধরনের শাসনকে খোদায়ী শাসন বলার চেয়ে শয়তানী শাসন বলাই অধিকতর মানান সই। পক্ষান্তরে ইসলাম যে থিওক্র্যাসী পেশ করে, তা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ থাকেনা, বরং সাধারণ মুসলমানদের হাতে নিবদ্ধ থাকে। আর এই সাধারণ মুসলমানরা আল্লাহর কিতাব ওরসূলের সুন্নাহ অনুসারে তা পরিচালনা করে। আমাকে যদি একটা নতুন পরিভাষা উদ্ভাবনের অনুমতি দেয়া হয়, তবে আমি এই শাসন ব্যবস্থাককে “ইসলামী গণশাসন” নামে অভিহিত করবো। কেননা এতে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন মুসলমানদেরকে একটা সীমিত গণসার্বভৌমত্ব [Limited popular sovereignty] দেয়া হয়েছে। এতে শাসন বিভাগ [Executive] ও আইনসভা [Legrslature] মুসলিম জনগণের মতানুসারে গঠিত হবে। মুসলিম জনগণই এই দুটিকে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকারী হবে। প্রশাসনিক ও অন্যান্য যেসব বিষয়ে আল্লাহর শরীয়তে কোনো সুস্পষ্ট বিধান নেই, তা মুসলিম জনগণের ঐক্যমতেই নিষ্পন্ন হবে। আল্লাহর আইন যেখানে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হবে, সেখানে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা প্রজন্ম নয়, বরং সাধারণ মুসলমানদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তিই ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জন করেছে, সে তার ব্যাখ্যা দেয়ার অধিকারী হবে। এদিক থেকে এটা গণতন্ত্র বটে। কিন্তু একটু আগেই যেমন বললাম, যেখানে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অকাট্য নির্দেশ বিদ্যমান থাকবে, সেখানে মুসলমানদের কোনো নেতা, কোনো আইনসভা, কোনো মুজতাহিদ, কোনো আলেম, এমনকি সারা দুনিয়ার মুসলমানরাও যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়, তথাপি তাদের উক্ত নির্দেশের এক চুল পরিমাণ সংশোধন করারও অধিকার নেই। এদিক থেকে এটা থিওক্র্যাসী বা ধর্মীয় শাসন।
সম্মুখে অগ্রসর হবার আগে আমি এ ব্যাপারে সামান্য ব্যাখ্যা দিতে চাই যে ইসলামে গণতন্ত্রের ওপর এসব বিধিনিষেধ ও কড়াকড়ি কি জন্য আরোপ করা হয়েছে এবং কি ধরনের বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। যারা আপত্তি তোলে, তারা বলতে পারে, এভাবে তো আল্লাহ তা’য়ালা মানুষের বিবেক ও আত্মার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছেন। অথচ আপনারা বলে থাকেন, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানুষকে জ্ঞানবুদ্ধি, চিন্তা, দেহ ও প্রাণের স্বাধীনতা দেয়। এর জবাব হলো, আল্লাহ তা’য়ালা যে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নিজের হাতে রেখেছেন, সেটা মানুষের স্বাভাবিক ও জন্মগত স্বাধীনতা হরণ করার জন্য নয়, বরং তা রক্ষা করার জন্যই রেখেছেন। মানুষকে বিপথগামী হওয়া ও নিজের পায়ে কুড়াল মারা থেকে রেহাই দেয়াই এর উদ্দেশ্য।
পাশ্চাত্যের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র সম্পর্কে দাবী করা হয় যে, তাতে গণ সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু উক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পর্যালোচনা কারলে এই দাবীর সারবত্তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যে জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে একটা রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, তারা সবাই স্বয়ং আইন প্রণয়নও করেনা, তা কার্যকারীও করেনা। কতিপয় নির্দিস্ট ব্যাক্তির হাতে নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তারা বাধ্য হয়, যাতে ঐ ব্যক্তিবর্গ তাদের পক্ষ থেকে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। এ উদ্দেশ্যেই নির্বাচনের একটা ব্যবস্থা ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। যেহেতু সমাজ সামগ্রিকভাবে নৈতিকতা, সততা ও আমানতদারীর মতো অমুল্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত এবং এসব ধারণার তেমন কোনো গুরুত্বও স্বীকার করেনা, তাই যারা জনগণকে নিজ নিজ বিদ্যাবুদ্ধি, ধনসম্পদ, চালাকী-চাতুরী ও মিথ্যা অপপ্রচার দ্বারা বোকা বানাতে পারে, তারাই এই নির্বাচনে অধিক সংখ্যায় নির্বাচিত হয়। শুধু তাই নয়, তারা জনগণের ভোটেই নির্বাচিত হয়ে তাদের ইলাহ বা প্রভু হয়ে বসে। আর নির্বাচিত হয়ে তারা জনগণের উপকারার্থে নয়, বরং নিজেদের ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত স্বার্থের তাগিদ আইন রচনা করে। অতঃপর জনগণের দেয়া ক্ষমতা বলেই এসব গণবিরোধী আইন জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। আমেরিকাই বলুন, বৃটেনই বলুন কিংবা অন্য যেসব দেশ নিজেকে গণতন্ত্রের স্বর্গরাজ্য বলে মনে করে তাদের কথাই বলুন, সকল দেশেরই এই একই শোচনীয় দশা।
তারপর এদিকটা যদি উপেক্ষা করে মেনেও নিই যে, ওসব দেশে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা অনুসারেই আইন প্রণীত হয়ে থাকে, তথাপি অভিজ্ঞতা থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, সাধারণ জনগণ নিজেরা নিজেদের ভালো মন্দ পুরোপুরি বুঝতে পারেনা। মানুষের এটা একটা স্বাভাবিক দুর্বলতা যে, নিজের জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবতার কিছু দিক সে উপলব্ধি করে এবং কিছু উপলব্ধি করতে পারেনা। এজন্য তার সিদ্ধান্ত সাধারণত একপেশে হয়ে থাকে। ভাবাবেগ ও প্রবৃত্তির কামনা বাসনা তার ওপর এতো প্রবল হয়ে উঠে যে, সে সম্পূর্ণ নির্ভজাল জ্ঞানগত ও যুক্তিসংগত উপায়ে নির্ভুল ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত ও মতামত খুব কমই গ্রহণ করতে পারে। এমনকি অনেক সময় জ্ঞানগত ও যৌক্তিক দিক দিয়ে যে বিষয়টি তার কাছে সত্য বলে প্রতিভাত হয়, তাকেও সে ভাবাবেগে ও প্রবৃত্তির কামনা বাসনার মোকাবিলায় আগ্রাহ্য করে। এর প্রমাণ হিসেবে বহু সংখ্যক উদাহরণ আমি দিতে পারি। তবে দীর্ঘ সূত্রিতা এড়ানোর জন্য আমি আমেরিকার মদ নিষিদ্ধকরণ আইনের উদাহরণটি তুলে ধরবো। যাবতীয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, তথ্য ও যুক্তির আলোকে এ বিষয়টি সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিলো যে, মদ স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিগুলোর ওপর খারাপ প্রভাব বিস্তার করে এবং মানব সভ্যতার বিকৃতি ও বিপর্যয় আনয়ন করে। এই তথ্যের ভিত্তিতে মার্কিন জনমত মদ নিষিদ্ধ করণের আইন পাশ করার পক্ষে সম্মতি দেয়। জনগণের সেই রায় অনুসারেই মার্কিন কংগ্রেস ১৯১৮ সালে এই আইন পাশ করে। কিন্তু আইনটি যখন কার্যকর হলো, তখন যে জনতার রায়ে তা পাশ হয়েছিলো তারাই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো। তারা অবৈধভাবে আরো খারাপ মদ বানানো এবং পান করলো। আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী মদ ব্যবহৃত হলো, অপরাধ আরো বৃদ্ধি পেলো। অবশেষে যে জনতার ভোটে মদ একদিন হারাম হয়েছিলো, তাদের ভোটেই পুনরায় তাকে হালাল করা হলো। ১৯৩৩ সালে মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে এই হারাম হওয়ার ফতোয়াটি যে হালাল হওয়ার ফতোয়ায় পরিবর্তিত হয়ে গেলো, তার কারণ এ ছিলোনা যে, তাত্ত্বিক ও যৌক্তিকভাবে তখন মদ খাওয়া উপকারী সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। বরং এর একমাত্র কারণ এই ছিলো যে, জনগণ তাদের জাহেলী প্রবৃত্তির লালসার গোলামে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। তারা তাদের সার্বভৌমত্বকে নিজ নিজ প্রবৃত্তির পরিচালক শয়তানের কাছে সমর্পণ করেছিলো, আপন কামনাবাসনাকে নিজেদের খোদা বানিয়ে নিয়েছিলো এবং এই খোদার গোলামী করতে গিয়ে তারা যে আইনকে একদিন তাত্ত্বিক ও যৌক্তিকভাবে সঠিক মনে করেছিলো, তাকে পরিবর্তন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে গিয়েছিলো। এধরনের আরো বহু নজীর রয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মানুষ তার নিজের জন্য আইন প্রণেতা [Legislature] হবার পুরোপরি যোগ্যতা রাখেনা। সে অন্যান্য প্রভুর গোলামী থেকে রেহাই পেলেও নিজের অবৈধ খায়েশের গোলাম হয়ে যাবে এবং নিজ প্রবৃত্তির পরিচালক শয়তানের খোদা বানিয়ে নেবে। সুতরাং তার নিজ স্বার্থেই তার স্বাধীনতার ওপর যুক্তিসংগত সীমারেখা ও বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন।
এ কারণেই আল্লাহ তা’য়ালা কতিপয় বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। এগুলোকে ইসলামী পরিভাষায় “হুদুদুল্লাহ” তথা আল্লাহর সীমারেখা [Divine Limits] বলা হয়। জীবনের প্রত্যেক বিভাগে কতিপয় মূলনীতি, বিধি ও অকাট্য নির্দেশাবলীর সমন্বয়ে রচিত এই বিধিনিষেধ সংশ্লিষ্ট বিভাগের ভারসাম্য ও সুষমতা বজায় রাখার জন্য আরোপ করা হয়েছি। এগুলো দ্বরা মানুষের স্বাধীনতার শেষ সীমা চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে এবং বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই সীমারেখার মধ্যে থেকে তোমরা নিজেদের আচরণের জন্য প্রাসংগিক বিধি প্রণয়ন করে নিতে পারো। কিন্তু তোমাদের এই সীমা লংঘন করার অনুমতি নেই। এই সীমা অতিক্রম করলে তোমাদের জীবন বিপর্যয় ও বিকৃতির শিকার হয়ে যাবে।
উদাহরণ স্বরূপ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের কথাই ধরুন। এতে আল্লাহ তা’য়ালা ব্যক্তি মালিকানার অধিকার নিশ্চিত করে, যাকাতের ফরয করে, সূদকে হারাম করে, জুয়াকে নিষিদ্ধ করে, উত্তরাধিকারের আইন জারী করে এবং সম্পদ উপার্জন, সঞ্চয় ও ব্যয় করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে কয়েকটি সীমান্ত রেখা চিহ্নিত করে দিয়েছেন। মানুষ যদি এই সীমান্ত চিহ্নগুলো ঠিক রাখে এবং এগুলোর আওতাধীন থেকে লেনদেন ও কায়কারবার সংগঠিত করে, তাহলে একদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতাও বহাল থাকবে, অপরদিকে শ্রেণী সংগ্রাম এবং এক শ্রেণীর ওপর অন্য শ্রেণীর আধিপত্যের সেই পরিবশও সৃষ্টি হতে পারেনা, যা শোষণ-নিপীড়নমূলক পুঁজিবাদ থেকে শুরু হয়ে শ্রমিকদের একনায়কত্বে গিয়ে সমাপ্ত হয়।
অনুরূপভাবে পারিবারিক জীবনে আল্লাহ তায়ালা শরীয়ত সম্মত পর্দা, পুরুষের আধিপত্য, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান ও পিতামাতার অধিকার ও কর্তব্য, তালাক ও খুলার বিধান, শর্ত সাপেক্ষে একাধিক বিয়ের অনুমতি এবং ব্যভিচার ও ব্যভিচারের অপবাদজনিত শাস্তির বিধান দিয়ে এমন সীমানা চিহ্নিত করে দিয়েছেন যে, মানুষ যদি এই সীমানা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে এবং এর গন্ডীর মধ্যে অবস্থান করে নিজের ঘরোয়া জীবনকে সুশৃংখলভাবে গড়ে তোলে, তাহলে গৃহ যেমন যুলুম নির্যাতনের নিগড়ে পরিণত হবেনা, তেমনি যে লাগামহীন নারী স্বাধীনতার উদ্দাম পৈশাচিক বন্যা সমগ্র মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের হুমকি দিচ্ছে তাও এর সেখান থেকে ফুটে বেরুবেনা।
অনুরূপভাবে মানবীয় সমাজ ও সভ্যতার সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ কিসাসের [হত্যার দায়ে প্রাণদন্ড] আইন, চুরির দায়ে হাত কাটা, মদের নিষিদ্ধ হওয়া, শারীরিক সতর ঢাকার সীমা এবং এধরনের কয়েকটি স্থায়ী বিধি নির্ধারণ করার মাধ্যমে বিকৃতির দুয়ার চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছেন।
আল্লাহর এসব সীমা নির্ধারণী বিধিসমূহের একটা পূর্ণাংগ তালিকা পেশ করা এবং তার প্রত্যেকটি বিধি যে মানব জীবনে ভারসাম্য ও সুষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য কতো জরুরী তা এখানে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করার অবকাশ নেই। এখানে আমি শুধু এতোটুকু কথা পাঠকের মনে বদ্ধমূল করতে চাই যে, আল্লাহ এভাবে এমন একটা স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় সংবিধান মানুষকে দিয়েছেন যা তার স্বাধীনতার প্রাণশক্তিকে এবং তার চিন্তাশক্তি ও বোধশক্তিকে নিস্ক্রিয় করে দেয়না। বরং তার জন্য একটা সুস্পষ্ট ও নির্ভুল সোজা পথ দেখিয়ে দেয়, যাতে সে নিজের অজ্ঞতা ও দুর্বলতা বশত পথভ্রষ্ট হয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত না হয়। তার শক্তি ও প্রতিভাগুলো ভুল পথে অপব্যয়ের শিকার হয়ে বিনষ্ট না হয়, বরং সে যেনো নিজের সত্যিকার কল্যান ও সমৃদ্ধির পথে সোজাসুজিভাবে এগিয়ে যেতে পারে। পাঠক, আপনার যদি কখনো দুর্গম পার্বত্য পথ চলার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়ে থাকে তাহলে আপনি নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন, পেঁচানো পার্বত্য পথের একদিকে গভীর খাদ এবং অপরদিকে উচ্চ প্রস্তরময় প্রাচীর দাঁড়ানো থাকে। আর সেই পথের দুই কিনারকে এমনসব প্রতিবন্ধক দ্বারা সুরক্ষিত করা হয় যাতে পথিক খাদের দিকে চলে যেতে না পারে। এসব প্রতিবন্ধক স্থাপনের উদ্দেশ্য কি পথিকের স্বাধীনতা হরণ করা? না তা নয়। বরং এর উদ্দেশ্য শুধু তাকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করা এবং প্রত্যেক মোড়ে ও প্রত্যেক সম্ভাব্য শংকার সময় তাকে বলে দিয়া যে, তোমার পথ ওদিক এদিক। তোমাকে ওদিকে নয় এদিকে মোড় ঘুরতে হবে, যাতে তুমি নিরাপদে আপন মানযিলে মাকসুদে পৌছে যেতে পারো। আল্লাহ তায়ালা তাঁর সংবিধানে যে কড়াকড়ি বিধি আরোপ করেছেন, তা উদ্দেশ্যও এটাই। এসব সীমারেখা মানুষের জীবন পথে পরিভ্রমণের সঠিক দিক নির্দেশ করে এবং প্রত্যেক বিপদজ্জনক মোড়ে তাকে জানিয়ে দেয় যে, শান্তি ও নিরাপত্তার পথ এদিকে এবং তোমাকে ওদিকে নয় বরং এদিকে যেতে হবে।
আল্লাহর রচিত ও সংবিধান অপরিবর্তনীয়। আপনি ইচ্ছা করলে অন্যান্য পাশ্চাত্যভক্ত মুসলিম দেশের ন্যায় ও সংবিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারেন, কিন্তু তাকে বদলাতে পারবেননা। এটা কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য অটল ও অপরিবর্তনীয় সংবিধান। ইসলামী রাষ্ট্র যখন প্রতিষ্ঠিত হবে তখন এ সংবিধানের ভিত্তিতেই হবে।যতদিন কুরআন ও রসূলের সুন্নাহ পৃথিবীতে বহাল থাকবে, ততদিন এ সংবিধানের একটি ধারাকেও স্থানান্তরিত করা যাবেনা। যে মুসলমান থাকতে চাইবে তাকে এর অনুসরণ করতেই হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য
এ সংবিধানের আওতায় যে রাষ্ট্র গঠিত হবে, তার জন্য একটা লক্ষ্যও আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং কুরআনের একাধিক স্থানে তার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেমনঃ
“আমি রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দিয়ে পাঠিয়েছি আর তাদের সাথে কিতাব এবং মানদন্ড দিয়েছি, যাতে লোকেরা সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। আর আমি লোহা নাযিল করেছি, এতে প্রচন্ড শক্তি এবং জনগণের জন্য উপকারিতা রয়েছে।” [সূরা হাদীদঃ ২৫]
এ আয়াতে লোহা দ্বারা রাজনৈতিক শক্তি বা প্রয়োগ ক্ষমতাকে [coercive Power] বুঝানো হয়েছে। আর রসূলের কাজ নির্ধারণ করা হয়েছে এই যে, আল্লাহ তাদেরকে যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন এবং নিজের কিতাবে যে দাড়িপাল্লা অর্থাৎ যে সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার প্রতি তাদেরকে আহবান জানিয়েছেন সে অনুসারে সামাজিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করবেন। অন্যত্র বলেছেনঃ
“তারাই এসইসব লোক, যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা দিলে নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদশে দান করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে।” [সূরা আল হজ্জঃ ৪১]
অন্যত্র বলেনঃ
“মানব জাতির কল্যাণার্থে আবির্ভূত সর্বশ্রেষ্ট জাতি তোমরাই। সৎ কাজের আদেশ দান, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা এবং আল্লাহর ওপর ঈমান রাখাই তোমাদের কাজ” [সূরা আল ইমরানঃ ১১০]
ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
ক. ইতিবাচক ও সর্বাত্মক কর্মকান্ডঃ উপরোক্ত আয়াত কয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে বুঝা যায়, কুরআন যে রাষ্ট্রের ধারণা ও পরিকল্পনা পেশ করে তার উদ্দেশ্য নেতিবাচক [Negative] নয় বরং তার সামনে একটা ইতিবাচক [Positive] উদ্দেশ্য রয়েছে। তার লক্ষ্য শুধু মানুষের পারস্পরিক বাড়াবাড়ি ও অত্যাচার প্রতিহত করা, তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করা ও দেশকে বিদেশী আক্রমণ থেকে হিফাযত করা নয়; বরং আল্লাহর কিতাবে সামাজিক সুবিচারের যে সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা পেশ করা হয়েছে তা বাস্তবায়িত করাও তার লক্ষ্য। আল্লাহ তাঁর সুস্পষ্ট নির্দেশাবলীতে অন্যায় অনাচারের যতো রূপ ও ধরনের উল্লেখ করেছেন তার উচ্ছেদ সাধন এবং যতো রকমের ন্যায় ও সৎ কাজের বিবরণ দিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন ও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। এ কাজে উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক শক্তিও প্রয়োগ করা হবে। দাওয়াত ও প্রচারণার মাধ্যমেও কাজ চালানো হবে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপায় উপকরণও কাজে লাগানো হবে এবং দলীয় প্রভাব ও জনমতের চাপও প্রয়োগ করা হবে।
এ ধরনের রাষ্ট্র যে স্বীয় তৎপরতা ও কর্মকান্ডের গন্ডীকে সীমিত করতে পারেনা তা সহজেই বুঝা যায়। এটা একটা বহুমুখী ও সর্বাত্মক রাষ্ট্র। গোটা মানবজীবনই এর কর্মক্ষেত্র। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পৌর ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি বিভাগকে সে নিজের স্বতন্ত্র নৈতিক দৃষ্টিকোণ ও সংস্কারমূলক কর্মসূচী অনুযায়ী পুনর্গঠন করতে চায়। এখানে কোনো ব্যক্তি নিজের কোনো বিষয়কে ব্যক্তিগত বিষয় বলতে পারেনা। এদিক থেকে এই রাষ্ট্র কম্যুনিষ্ট ও একনায়ক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে এক ধরনের সাদৃশ্যের দাবীদার বটে। তবে আর একটু অগ্রসর হয়ে পাঠক দেখতে পাবেন যে, এহেন সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েও ইসলামী রাষ্ট্র এযগেও নিরংকুশ আধিপত্যবাদী [Totalitarian] ও [Authoritarian] সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র সমূহের মতো ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করেনা, একনায়কত্ব [Dictatorship] চাপিয়ে দেয়না। এক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্র যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভারসাম্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং হক ও বাতিলের মাঝে যে নাযুক ও সুক্ষ্ম সীমান্ত প্রাচীর স্থাপন করেছে তা দেখে একজন সত্যিকার অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের বিবেক স্বতস্ফুর্তভাবে সাক্ষ্য দেয় যে, এমন ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা উদ্ভাবন প্রকৃতপক্ষে মহাবিজ্ঞানী ও সুক্ষ্মদর্শী আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
খ. দলীয় ও আদর্শবাদী রাষ্ট্রঃ ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র, উদ্দেশ্য ও সংস্কারমূখী চরিত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে আপনা আপনিই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ রাষ্ট্র শুধু তারাই চালাতে পারে যারা এর শাসনতন্ত্রে বিশ্বাসী, যারা এর উদ্দেশ্যকে নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে, যারা এর সংস্কারবাদী কর্মসূচীর সাথে পুরোপুরি একমত, যারা এর প্রতি পুরোপুরি আস্থাশীলই শুধু নয় বরং এর প্রাণশক্তিকে ভালোভাবে হৃদয়ংগমও করে এবং এর খুঁটিনাটিও জানে। ইসলাম এক্ষেত্রে কোনো ভৌগলিক, বর্ণগত ও ভাষাগত বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। সে নিজের শাসনতন্ত্র, উদ্দেশ্য ও সংস্কারমুখী কর্মসূচীকে সকল মানুষের সামনে তুলে ধরে। যে ব্যক্তি তা মেনে নেবে, চাই সে যে কোনো বর্ণ, বংশ, দেশ ও জাতির সাথে সম্পৃক্ত হোক না কেন, সে এই রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত দলে প্রবেশ করতে পারে। আর যে তা গ্রহণ করবেনা তাকে রাষ্ট্রীয় কাজে সম্পৃক্ত করা চলবেনা। তবে সে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাধীন নাগরিক [Protecter Citizen] হিসেবে বসবাস করতে পারে। তার জন্য ইসলামী আইনে সুনির্দিষ্ট অধিকার ও সুযোগ সুবিধা নির্ধারিত রয়েছে। তবে তাকে সরকারে অংশীদারের মর্যাদা দেয়া হবেনা। কনেনা এটা একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্র যার প্রশাসনিক কাজ শুধু এর আদর্শে বিশ্বাসী লোকেরাই চালাতে পারে। [অত্র গ্রন্থের ১৬শ অধ্যায় আরো বিশদ আলোচনা দ্রষ্টব্য]
এখানেও ইসলামী রাষ্ট্রে ও কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রে খানিকটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বিদের সাথে যে আচরণ সম্যুনিষ্ট রাষ্ট্র করে থাকে, ইসলামী রাষ্ট্রের আচরণের সাথে তার কোনো সম্পর্কই নেই। বিজয় অর্জন ও ক্ষমতা হস্তগত করার সাথে সাথেই আপন সাংস্কৃতিক রীতিনীতিকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়া, বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, হত্যা ও রক্তপাত চালানো এবং হাজার হাজার মানুষকে দুনিয়ার জাহান্নাম সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে দেয়ার যে অব্যাহত ধারা কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রে শুরু হয়, ইসলামে সে সবের কোনো অস্তিত্ব নেই। ইসলাম স্বীয় রাষ্ট্রীয় সীমানায় অমুসলিমদের প্রতি যে উদার আচরণ করে থাকে এবং এ ব্যাপারে যুলুম ও ন্যায়বিচার এবং সত্য ও অসত্যের মাঝে যে সুম্পষ্ট ভেদরেখা টেনে দেয়, তা দেখে যেকোনো ইনসাফপ্রিয় মানুষ একনজরেই বুঝতে পারে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সংস্কারকগণ আসে তারা কিভাবে কাজ করে। আর পৃথিবীতে যেসব সকল ও স্বকথিত সংস্কারদের আবির্ভাব ঘটে তাদের কর্মপদ্ধতি কিরূপ হয়ে থাকে।
৪. খিলাফত ও তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
এবার আমি ইসলামী রাষ্ট্রের অবকাঠামো ও তার কর্মপদ্ধতির কিছু ব্যাখ্যা দেবো। আমি আগেই বলেছি, ইসলামে আসল সার্বভৌম শাসক হচ্ছেন আল্লাহ। এই মূলনীতির আলোকে যখন আপনি এ প্রশ্ন নিয়ে ভাববেন যে, পৃথিবীতে যারা আল্লাহর আইন চালু করতে উদ্যোগী হবে তাদের মর্যাদা ও অবস্থান কি রকম হওয়া উচিত, তখন আপনার মন আপনা থেকেই বলে উঠবে, তাদের আসল সার্বভৌম শাসকের প্রতিনিধি বলেই আখ্যায়িত হওয়া উচিত। ইসলামেও তাদের ঠিক এই মর্যাদাই দেয়া হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছেঃ
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে, তাদের সাথে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি [খলীফা] বানাবেন, ঠিক যেভাবে তাদের পূর্বে অন্যদেরকে প্রতিনিধি বানিয়েছিলেন।” [সূরা নূরঃ ৫৫]
এ আয়াত ইসলামের রাষ্ট্র তত্ত্বের ওপর অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আলোকপাত করে। এতে দুটো মৌলিক বিষয় আলোচিত হয়েছেঃ
প্রথমতঃ ইসলাম সার্বভৌম শাসনের পরিবর্তে খিলাফত বা প্রতিনিধিত্ব পরিভাষাটি ব্যবহার করে। যেহেতু তার মতাদর্শ অনুসারে সার্বভৌমত্ব আল্লাহর, তাই ইসলামী শাসনতন্ত্র অনুসারে যে ব্যক্তি পৃথিবীর কোথাও শাসক পদে অধিষ্ঠিত হবে তাকে অবশ্যই সর্বোচ্চ শাসক আল্লাহর প্রতিনিধি হতে হবে। সে শুধুমাত্র অর্পিত ক্ষমতা [Delegated power] প্রয়োগের অধিকারী।
দ্বিতীয়তঃ এ আয়াত থেকে অকাট্যভাবে জানা যায় যে, খলীফা বা প্রতিনিধি বানানোর ওয়াদা সকল মুমিনের সাথে করা হয়েছে। একথা বলা হয়নি যে, মুমিনদের মধ্য থেকে কাউকে প্রতিনিধি বানাবো। এথেকে বুঝা যায়, প্রত্যেক মুমিন খিলাফতের অধিকার প্রাপ্ত। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে খিলাফত মুমিনদেরকে দেয়া হয় তা সার্বজনীন খিলাফত। কোনো ব্যক্তি, পরিবার, শ্রেণী বা বর্ণের জন্য তা নির্দিষ্ট নয়। প্রত্যেক মুমিন স্ব স্ব স্থানে আল্লাহর খলীফা। খলীফা হিসেবে প্রত্যেকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে বাধ্য। একটি বিখ্যাত হাদীসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
“তোমাদের প্রত্যেক এক একজন রাঁখাল। প্রত্যেকে নিজ নিজ অধীনস্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”
আল্লাহর এই সার্বজনীন খিলাফতের আওতায় এক খলীফা অপর খলীফার চেয়ে কোনো দিক দিয়েই নিকৃষ্ট নয়।
ইসলামী গণতন্ত্রের মর্যাদা
এই হলো ইসলামে গণতন্ত্রের প্রকৃত ভিত্তি। সার্বজনীন খিলাফতের উল্লিখিত তত্ত্বটি পর্যালোচনা করলে নিন্মোক্ত সিদ্ধান্ত সমূহে উপনীত হওয়া যায়।
১. যে সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তি আল্লাহর খলীফা এবং খিলাফতে সমান অংশীদার সে সমাজে শ্রেণীভিত্তিক বিভক্ত ও বৈষম্য এবং জন্মগত বা সামাজিক আভিজাত্য ও বৈষম্যের কোনো অবকাশ নেই। সে সমাজে সকল ব্যক্তি সমান মর্যাদাসম্পন্ন হবে। শ্রেষ্ঠত্ব যেটুকুই হবে ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতেই হবে। এ বিষয়টা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম একাধিকবার দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরেছেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি বলেনঃ
“ওহে জনতা! শুনে নাও, তোমাদের প্রতিপালক একজন। কোনো অনারবের ওপর আরবের এবং কোনো আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো কালো মানুষের ওপর সাদা মানুষের এবং সাদা মানুষের ওপর কালো মানুষের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব কেবল খোদভীরুতা তথা সততার ভিত্তিতে নির্ণিত হবে। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে খোদাভীরু, সেই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানের পাত্র।” [তাফসীরে রুহুল মায়ানী, ২৬মত খন্ড, পৃঃ ১৪৮]
মক্কা বিজয়ের পর যখন সমগ্র আরব জগত ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলো তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের পরিবারের লোকেরা আরবে পুরোহিতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলো। তাদের তিনি বললেনঃ
“আল্লাহর শোকর, তিনি তোমাদেরকে জাহেলিয়াতের দোষ ও অহংকার থেকে পবিত্র করেছেন। হে জনমন্ডলী! শোনো মানুষ দুরকমের হয়ে থাকেঃ এক যারা সৎ ও সংযত। তারা আল্লাহর কাছে সম্মানিত। দুই, যারা অসৎ ও দুষ্কর্ম পরায়ন। তারা আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট। মূলতঃ সকল মানুষ আদমের সন্তান। আর আদমকে আল্লাহ মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, হে মানব মন্ডলী! আমি তোমাদেরকে একই পুরুষ ও স্ত্রী থেকে সৃষ্টি করেছি।…………….”
২. এ ধরনের সমাজে কোনো ব্যক্তি বা কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের জন্ম, সামাজিক মর্যাদা অথবা পেশার দিক দিয়ে এমন কোনো বাধাবিপত্তি থাকা উচিত নয়, যা তাদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও প্রতিভার বিকাশে এবং তার ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ সাধনে কোনোভাবে প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিতে পারে। এখানে সমাজের সকল ব্যক্তিবর্গের উন্নতির সমান সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান থাকে। মানুষ নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতার বলে যতদুর সম্মুখে অগ্রসর হতে সক্ষম ততদুর যেনো অগ্রসর হতে পারে, সেজন্য একদিকে যেমন তার নিজের পথ খোলা থাকা চাই অপরদিকে তেমনি অন্য কারো অগ্রসরতা যেনো তার দ্বারা বাধাগ্রস্ত না হয় তারও বিশ্চয়তা থাকা চাই। ইসলামে এ জিনিসটা সর্বাধিক পরিমাণে ও পূর্ণাংগভাবে বিদ্যমান। ইসলামের ইতিহাসে বহু ক্রিতদাস ও তাদের সন্তানরা সেনাপতি ও প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছে এবং বড় বড় সম্ভ্রান্ত পরিবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাদের অধীনে কাজ করেছে। বহু চামার জুতো সেলাই করতে করতেই সহসা ইমামের মসনদে আসীন হয়ে গেছেন। বহু জোলা [কাপড় প্রস্তুতকারী] মুফতী, কাযীও ফকীহ হয়েছেন আজ তাদের নাম ইসলামের মহাপুরুষদের তালিকার অন্তর্ভুক্ত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বলেছেনঃ
“তোমাদের ওপর যদি কোনো হাবশী ক্রিতদাসকেও শাসক নিযুক্ত করা হয় তবু তার আদেশ শোনো এবং মান্য করো।” [বুখারী]
৩. এ ধরনের সমাজে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একনায়ক সুলভ শাসক হয়ে জেঁকে বসার, কোনো অবকাশ নেই। কেননা এখানে প্রত্যেকেই খলীফা। সাধারণ মুসলমানদের থেকে তাদের খিলাফত কেড়ে নিয়ে স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হওয়ার অধিকার কারো নেই। এখানে যাকে শাসক করা হয় তার প্রকৃত অবস্থা হলো, সকল মুসলমান অথবা পরিভাষিক শব্দে বলতে গেলে সকল খলীফা সেচ্ছায় নিজ নিজ খিলাফতকে প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে তার হাতে কেন্দ্রীভূত করে দেয়। সে একদিকে আল্লাহর সামনে অপরদিকে যারা তার কাছে নিজ নিজ খিলাফতকে অর্পণ করেছে সেই সমস্ত খলীফার সামনে জবাবদিহী করতে বাধ্য। এখন সে যদি দায়িত্বহীন একনায়কে রূপান্তরিত হয় তাহলে সে আর খলীফা থাকেনা বরং শোষক ও জবরদখলকারীতে পরিণত হয়। কেনান একনায়কত্ব আসলে জনগণের সার্বজনীন খিলাফতের অস্বীকৃতি। যদিও একথা সত্য যে, ইসলামী রাষ্ট্র একটা সর্বাত্মক ব্যবস্থার ভিত্তি হলো আসলে আল্লাহর যে আইন দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে সেই আইনই সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী। আল্লাহ তায়ালা জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে যেসব নির্দেশ জারী করেছেন তা অবশ্যই সর্বোতভাবে কার্যকর করা হবে। কিন্তু ঐসব নির্দেশের প্রতিকুল ইসলামী রাষ্ট্র স্বয়ং জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করতে পারেনা। সে জনগণকে কোনো পেশা গ্রহণে বা বর্জনে, কোনো কারিগরী শিখতে বা না শিখতে, শিশুদেরকে কোনো বিশেষ বিষয় শেখাতে বা না শেখাতে, বিশেষ কোনো ধরনের টুপি পরতে বা না পরতে, ভাষার জন্য বিশেষ ধরনের বর্ণমালা ব্যবহার করতো বা না করতে এবং মেয়েদেরকে কোনো বিশেষ ধরনের পোশাক পরাতে বা না পরাতে বাধ্য করতে পারেনা। রাশিয়া, জার্মানী ও ইটালীর একনায়কগণ এসব সেচ্ছাচারমুলক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিলেন এবং আতাতুর্কও তা তুরস্কে প্রয়োগ করেন। কিন্তু ইসলাম কখনো তার শাসকদেরকে এধরনের ক্ষমতা দেয়ানি। তাছাড়া একটা গরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে হলো, ইসলামে প্রত্যেক ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর কাছে দায়ী। এই ব্যক্তিগত দায়িত্বশীলতা ও জাবাবদিহী এমন একটি ব্যাপার যাতে তার কোনো অংশীদার নেই। সুতরাং আইনের সীমানার মধ্যে তার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত, যাতে সে নিজের জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করতে পারে এবং যেদিকেই তার ঝোঁক হয় সেদিকেই নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারে। শাসক যদি তার পথে বাধা দেয় তাহলে সে যুলুমকারী হিসেবে আল্লাহর কাছে জবাবদিহীর সম্মুখীন হবে। এ কারণেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে প্রজাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণের নামনিশানাও চোখে পড়েনা।
৪. এধরনের সমাজে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর ভোটাধিকার থাকা চাই। কেননা সে খিলাফাতের অধিকারী। আল্লাহ এই খিলাফাতকে কোনো বিশেষ পর্যায়ের যোগ্যতা বা ধনসম্পদের শর্তযুক্ত করেননি। শুধুমাত্র ঈমান ও সৎকর্মশীলতার শর্ত আরোপ করেছেন। সুতরাং রায় বা ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে সকল মুসলমান সমান অধিকার ভোগ করে।
একদিকে ইসলাম এহেন সর্বোচ্চ ও পূর্ণাংগ পর্যায়ের গণতন্ত্র কায়েম করেছে। অপরদিকে সামষ্টিক জীবনের সাথে সংঘর্ষশীল হয় এমন ব্যক্তি স্বাধীনতার [Individualism] বিকাশ রোধ করেছে। এখানে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যাতে কম্যুনিজম ও ফ্যাসিবাদের সামষ্টিক সমাজ কাঠামোর ন্যায় সমাজের মধ্যে ব্যক্তিস্বাধীনতা হারিয়ে না যায়। আবার পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের ন্যায় ব্যক্তিস্বাধীনতা এতো সীমাহীন না হয় যে, সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জীবনের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। সেটি হচ্ছে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। উপরন্ত ইসলামে ব্যক্তির অধিকার পুরোপুরি মেনে নেয়ার পর তার জন্য সমাজের প্রতিও কিছু কর্তব্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সামষ্টিকতার মধ্যে এমন সমন্বয় সৃষ্টি হয়েছে যে, ব্যক্তি স্বীয় যোগ্যতা ও প্রতিভা বিকাশের পুরো সুযোগও লাভ করে, আবার সে নিজের উৎকর্ষ প্রাপ্ত শক্তিগুলিকে নিয়ে সমাজ কল্যাণের কাজেও সহায়ক হয়। এটা একটা স্বতন্ত্র বিষয়। এটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। ইসলামী গণতন্ত্রের যে ব্যাখ্যা আমি কিছু আগে করেছি তার ফলে যেসব ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো তার প্রতিনিধানের উদ্দেশ্যেই এ বিষয়ে কিছু সংক্ষিপ্ত ইংগিত করলাম।