অষ্টম অধ্যায়
ইসলামী সংবিধানের ভিত্তিসমূহ]
১. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
২. রিসালাতের মর্যাদা
৩. খিলাফতের ধারণা
৪. পরামর্শের নীতিমালা
৫. নির্বাচনের নীতিমালা
৬. নারীদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ
৭. রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য
৮. শাসক ও তার আনুগত্যের নীতিমালা
৯. মৌলিক অধিকার ও সামাজিক সুবিচার
১০. জনকল্যাণ
নিবন্ধটি ১৯৫২ সালের শেষ প্রান্তে রচিত। এই সময় একজন খ্যাতনামা উকীল ও লেখক চ্যালেঞ্জ করেছিলেন যে, কুরআন মজীদ থেকে কোনো সংবিধানে কাঠামো পাওয়া যায় কিনা। এই প্রসঙ্গে তিনি বিস্তারিত আলোকপাত করেন। মাওলানা মওদূদী তখন নিম্নোক্ত প্রবনধ রচনা করেন এবং তাতে সংবিধানের এক একটি ধারার উল্লেখপূর্বক কুরআন ও হাদীসে তার ভিত্তিসমূহ নির্দেশ করেন।
ইসলামী সংবিধানের ভিত্তিসমূহ
দেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজ যখন শেষ পর্যায়ে তখন বুদ্ধিজীবী সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধান প্রণয়ন পরিষদকে যথার্থ ইসলামী সংবিধান প্রণয়নে যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা। এ ব্যাপারে আমি যথাসাধ্য সহযোগিতা করতে থাকবো। ১৯৫১ সালের শুরুতে মুসলমানদের সকল ফের্কার প্রতিনিধি স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। [পরিশিষ্ট-১ দ্রঃ]। কিন্তু একদল লোক অনবরত একদিকে মুসলিম জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজকে এবং অপরদিকে সংবিধান প্রণয়ন পরিষদের সদস্যদেরকে যতোদূর সম্ভব ভুলবুঝাবুঝির শিকারে পরিণত করার অপচেষ্টায় নিরত থাকে। তাদের পক্ষ থেকে বার বার বিভিন্ন শব্দের মারপ্যাচের এ ধারণার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে যে, কুরআন মজীদে সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারে কোনো পথনর্দেশ প্রদান করা হয়নি এবং ইসলাম কোনো বিশেষ পদ্ধতির রাষ্ট্র ব্যবস্থার দাবি করেনা এবং ইসলামী সংবিধান বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। এই বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের পেছনে কোনো যুক্তি নাই। কিন্তু ইসলামী জ্ঞান চর্চার এই পতনযুগে বুদ্ধির বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই অপপ্রচার প্রভাবশালী হতে পারে। তাই একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে সাংবিধানিক বিধির সাথে সংশ্লিষ্ট কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যসমূহ একত্র করে পেশ করা প্রয়োজন মনে করছি, যাতে জনগণ জানতে পারে যে, আজ পর্যনত আলেমগণ যেসব মূলনীতিকে ইসলামের সাংবিধানিক নীতিমালা হিসেবে পেশ করেছেন তার মূল উৎস কি এবং সাথে সাথে সংবিধানে প্রণয়ন পরিষদের সদস্যদের সামনে যেনো আল্লাহ্ পাকের দলীল প্রমাণ পূর্ণমাত্রায় উদ্ভাসিত হয় এবং তারা যেনো কখনও এই ওজর পেশ করতে না পারে যে, আমাদেরকে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের বিধানসমূহ বলে দেয়া হয়নি।
উপরোক্ত প্রয়োজন পূরণের জন্য এই নিবন্ধ লেখা হচ্ছে। এতে আমি ক্রমিক নম্বর অনুসারে এক একটি সাংবিধানিক বিষয় সম্পর্কে কুরআনের বাণী এবং সহীহ হাদীসসমূহ পেশ করবো এবং সাথে সাথে এও বলে দেবো যে, তাথেকে কি বিধান নির্গত হয়।
১. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
হুকুম [সার্বভৌমত্ব] কেবল আল্লাহর জন্য। তাঁর নির্দেশ হলো, তোমরা তাঁর ব্যতীত আর কারো দাসত্ব করবেনা, এটাই সঠিক দীন। [সূরা ইউসুফ: ৪০]
এই আয়াত পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, ফায়সালা করার এখতিয়ার এবং শাসনকার্যের অধিকার [ভিন্ন শব্দে সার্বভৌমত্ব] আল্লাহ তায়ালার জন্য সুনির্দিষ্ট। এই সার্বভৌমত্বকে শুধুমাত্র “বিশ্বজনীন সার্বভৌমত্বের” [Universal Sovereignty] অর্থে সীমাবদ্ধ করার মতো কোনো শব্দ বা সম্বন্ধ এখানে বিদ্যমান নেই। আল্লাহ্ তায়ালার এই সার্বভৌমত্ব যেমন বিশ্বজনীন, তদ্রুপ রাজনৈতিক, আইনগত, নৈতিক ও বিশ্বাসগত সব দিকেই পরিব্যপ্ত। স্বয়ং কুরআন মজীদে সর্ব প্রকারের সার্বভৌমত্ব আল্লাহ তায়ালার জন্য সুনির্দিষ্ট হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ বিদ্যমান রয়েছে। অতএব কুরআন মজীদ পরিষ্কার বাক্যে বলে যে, আল্লাহ তায়ালা কেবল “রব্বুন নাস” [মানুষের প্রভু] ও “ইলাহুন নাস” [মানুষের উপাস্য]-ইন নন বরং “মালিকুন নাস” [মানুষের শাসক]-ও :
“বলো [হে মুহাম্মাদ], আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রভু, মানুষের শাসক এবং মানুষের উপাস্যের নিকট।” [সূরা নাস: ১-৩]
কুরআন মজদ বলে, আল্লাহ্ তায়ালাই শাসনকর্তৃত্বের মালিক, কর্ণধার এবং এই বিষয়ে তাঁর কোনো অংশীদার নেই:
“বলো : হে আল্লাহ! শাসন কর্তৃত্বের মালিক! তুমি যাকে চাও শাসন কর্তৃত্ব দান করো এবং যার নিকট থেকে চাও তা ছিনিয়ে নাও।” [সূরা আলে ইমরান: ২৬]
“রাজত্বের ব্যাপারে তার কোনো অংশীদার নাই।” [সূরা বনী ইসরাঈল : ১১১]
কুরআন মজীদ আরও পরিষ্কার ভাষায় বলে, নির্দেশ প্রদানের অধিকার কেবল আল্লাহ্ তায়ালার, কারণ তিনিই স্রষ্টা:
“সাবধান! সৃষ্টি তাঁরই এবং নির্দেশও [চলবে] তাঁর।” [সূরা আরাফ: ৫৪]
একথা পরিষ্কার যে, এটা কেবল বিশ্বজনীন সার্বভৌমত্ব নয় বরং সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব এবং তার ভিত্তিতেই কুরআন মজীদ আইনগত সার্বভৌমত্বও আল্লাহ তায়ালার জন্য নির্ধারণ করেছে:
“তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত জিনিসের অনুসরণ করো এবং তাঁকে ত্যাগ করে অন্যান্য অভিভাবকের অনুসরণ করোনা।” [সূরা আরাফ: ৩]
“যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান মোতাবেক ফায়সালা করেনা সে কাফের।” [সূরা মায়েদা: ৪৪]
আল্লাহ্ তায়ালার রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্বের এই ধারণা ইসলামের সর্ব প্রাথমিক মৌলিক নীতিমালাসমূহের অন্তর্ভুক্ত এবং প্রাথমিক কাল থেকে আজ পর্যন্ত ইসরামের আইনবিদগণ [ফুকাহা] এই ব্যাপারে একমত যে, হুকুম দেয়ার অধিকার আল্লাহ তায়ালার জন্য সুনির্ধারিত। সুতরাং আল্লামা আমিদী উসূলে ফিক্হের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “আল ইহ্কাম ফী উসূলিল আহ্কাম” এ লিখেছেন:
জেনে রাখো! আল্লাহ্ ছাড়া কোনো হাকিম [শাসক] নাই এবং তিনি যে হুকুম [বিধান] দিয়েছেন তাই কেবল হুকুম [বিধান] হিসেবে গণ্য।
শায়খ মুহাম্মাদ খুদারী তাঁর ‘উসূলুল ফিক্হ’ গ্রন্থে এটাকে গোটা মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্যবদ্ধ আকীদা [বিশ্বাস] প্রমাণ করেছেন:
মূলত আল্লাহর ফরমানকে হুকুম বলা হয়। অতএব হুকুম দেয়ার অধিকার আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারো নাই। এটা এমন একটি কথা, যে সম্পর্কে সমস্ত মুসলমান একমত।
অতএব কোনো সংবিধান যখন সর্ব প্রথম আল্লাহ্ তায়ালার রাজণৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নেয় এবং অকাট্য বাক্যে একথা তাতে লিখতে হয় যে, এই রাষ্ট্র আল্লাহ্র আনুগত আর তাঁকে সর্বোচ্চ ও সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী স্বীকার করে এবং তাঁর বিধান পালন বাধ্যতামূলক মনে করে, তখনই তা ইসলামী সংবিধান হিসেবে গণ্য হতে পারে।
২. রিসালাতের মর্যাদা
সাধারণভাবে সকল নবী রসূল এবং বিশেষভাবে মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তায়ালার এই রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্বের প্রতিভু। অর্তাৎ যে মাধ্যমৈ আল্লাহ তায়ালার এই সার্বভৌমত্ব মানুষের মাঝে কার্যকর হয় সে মাধ্যম হলেন আল্লাহর নবী। একজন্য তাঁর নির্দেশাবলীর আনুগত্য করা তার প্রদর্শিত পন্থার অনুসরণ করা এবং ফায়সালাসমূহ বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়া এমন প্রত্যেক ব্যক্তি, দল ও সমাজের জন্য অপরিহার্য, যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব স্বীকার করে। বিষয়টি কুরআন মজীদে বার বার সুস্পষ্ট বাক্যে বিধৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ দেখা যেতে পারে:
“যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করলো সে মূলত আল্লাহ্রই আনুগত্য করলো।” [সূরা নিসা: ৮০]
“আমরা যে রসূলই প্রেরণ করেছি তাকে এজন্য প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশের ভিত্তিতে তার আনুগত্য করা হবে।” [সূরা নিসা: ৬৪]
“[হে মুহাম্মাদ!] আমরা এই কিতাব সত্য সহকারে তোমার নিকট নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের মাঝে ফায়সালা করো যা তোমাকে আল্লাহ্ হৃদয়ংগম করান তদনুযায়ী।” [সূরা নিসা: ১০৫]
“আর রসূল তোমাদের যা কিছু দেয় তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদের বাধা দেয় তাত্থেকে বিরত থাকো।” [সূরা হাশর: ৭]
“অতএব না! তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা যতক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবেনা যতক্ষণ তোমাকে তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদে মীমাংসাকারী মেনে না নেয়, অতঃপর তুমি যে মীমাংসা করবে তাতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হবেনা এবং তা সন্তোষসহকারে মেনে নিবে।” [সূরা নিসা: ৬৫]
এটি ইসলামী সংবিধানের দ্বিতীয় ভিত্তি। তাতে আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়অর পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহকে আইনের উৎস হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সুন্নাহ পরিপন্থী বিধান দেয়ার, বিধান প্রণয়নের ও ফায়সালা প্রদানের এখতিয়ার থাকবেনা।
৩. খিলাফতের ধারণা
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, আল্লাহ্ তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি তাদের অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব দান করবেন, যেমন তিনি শাসন কর্তৃত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের।” [সূরা নূর: ৫৫]
উপরোক্ত আয়াত থেকে দুটি সাংবিধানিক বিষয় অবগত হওয়া যায়। [এক] ইসলামী রাষ্ট্রের সঠিক মর্যাদা হচ্ছে “খিলাফতের” [প্রতিনিধিত্বের] “সার্বভৌমত্বের” নয়। [দুই] ইসলামী রাষ্ট্রে খিলাফতের বাহক বা দায়িত্ব বহনকারী, কোনো ব্যক্তি, গোত্র পরিবার গোত্র হবে না, শ্রেণী বরং গোটা মুসলিম উম্মাহ হবে তার বাহক, যাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালা স্বাধীন রাষ্ট্র দান করবেন।
প্রথমোক্ত বিষয়ের ব্যাখ্যা হলো, সার্বভৌমত্ব তার মূল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই দাবি করে যে, সার্বভৌমত্বের অধিকারী সত্তার বাইরে এমন সত্তা থাকবেনা যে তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে সীমাবদ্ধ করতে পারে এবং তাকে তার বানানো বিধান ও নীতিমালা ব্যতীত উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া বিধান ও নীতিমালার অনুগত বানাতে পারে। [এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে।] এখন যদি একটি রাষ্ট্র প্রথম পদক্ষেপেই স্বীকার করে নেয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের হুকুম তার জন্য চূড়ান্ত ও অকাট্য বিধান, শাসন বিভাগ এর পরিপন্থী কাজ করতে পারবেনা, আইন প্রণয়ন বিভাগ এর পরিপন্থী কোনো বিধান রচনা করতে পারবেনা এবং তার বিচার বিভাগও এর পরিপন্থী কোনো রায় দিতে পারবেনা, তবে তার পরিষ্কার অর্থ দাঁড়ায়, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের বিপরীতে সার্বভৌমত্বের দায়িত্ব থেকে বিরত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় মূলত আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রনিধির [খলীফা] মর্যাদা গ্রহণ করে নিয়েছে। এই অবস্থায় তার জন্য যথার্থ পরিভাষা “সার্বভৌমত্ব” নয় বরং “খিলাফতই” হতে পারে। অন্যথায় উপরোক্ত মর্যাদা বহাল রেখে তার জন্য “সার্বভৌমত্ব” শব্দের ব্যবহার করা কেবল পারিভাষিক বৈপরিত্য ছাড়া আর কি হতে পারে। অবশ্য সে যদি তার সর্বময় কর্তৃত্বকে আল্লাহর হুকুম ও রসূলের সুন্নাতের আনুগত্য করার সাথে শর্তযুক্ত না করে তবে নিঃসন্দেহে তার সঠিক মর্যাদা হবে “সার্বভৌমত্বের,” কিন্তু এ অবস্থায় তার জন্য “ইসলামী রাষ্ট্র” পরিভাষাটি ব্যবহার করাও পারিভাষিক বৈপরিত্য হবে।
দ্বিতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যা এই যে, একটি ইসলামী রাষ্ট্রে তার সমস্ত মুসলিম মূলনীতিগত সত্য যার উপর ইসলামে গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। ইসলাম পরিপন্থী গণতন্ত্রের ভিত্তি যেভাবে “জনগণের সার্বভৌমত্বের” [Popular Sovereignty] নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত, অনুরূপভাবে ইসলামী গণতন্ত্রের ভিত্তি “সামগ্রিক প্রতিনিধিত্বের” [Popular Vicegerency] উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ব্যবস্থায় সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে খিলাফত পরিভাষা এজন্র গ্রহণ করা হয়েছে যে, এখানে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আল্লাহর দান হিসেবে বিবেচিত এবং দানকে আল্লাহ্ নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করেই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু খিলাফতের এই সীমাবদ্ধ কর্তৃত্ব কুরআনের উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে কোনো এক ব্যক্তি বা শ্রেণীর জন্য নয় বরং রাষ্ট্রের সকল মুসলমানের উপর একটি জামায়াত বা সমষ্টি হিসেবে অর্পণ করা হয়েছে, যার অনিবার্য দাবি হলো, মুসলমানদের মর্জি মতো সরকার গঠিত হবে, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবে এবং তার প্রতি মুসলমানগণ যতক্ষণ সন্তুষ্ট থাকবে সেই সরকার ততক্ষণই ক্ষমতায় থাকবে। এই কারণেই হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজেকে “আল্লাহ্র খলীফা” বলতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন। কারণ খিলাফত মূলত মুসলিম উম্মহকে প্রদান করা হয়েছিলো, সরাসরি তাঁকে নয়। তাঁর মর্যাদা কেবল এই ছিলো যে, মুসলমানগণ তাদের মর্জি মাফিক তাদের খিলাফতের কর্তত্ব তাঁর নিকট অর্পণ করেছিলেন মাত্র।
এই দুইটি বিষয় বিবেচনায় রেখে ইসলামী রাষ্ট্রে সংবিধান এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যা সার্বভৌমত্বের দাবি থেকে মুক্ত হবে এবং যার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য খিলাফত হিসেবে প্রতিভাত হবে।
৪. পরামর্শের নীতিমালা [শূরার আদর্শ]
সামষ্টিক খিলাফতের উপরোক্ত দাবিকে কুরআন মজীদ নিম্নোক্ত বাক্যে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে:
এবং তাদের কাজ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। [সূরা শূরা: ৩৮]
এ আয়াতে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার এই বিশেষত্ব বর্ণনা করা হয়েছে যে, এখানে সমস্ত সামাজিক বিষয় পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। এখানে শুধু বৈশিষ্ট্যই বর্ণনা করা হয়নি বরং বাক রীতির আওতায় পরামর্শের নির্দেশও প্রদান করা হয়েছে। এজন্য কোনো সামাজিক সামষ্টিক কাজ পরামর্শ গ্রহণ ব্যতীত সম্পাদন করা নিষেধ, খতীব বাগদাদী (র) হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নিম্নোক্ত রিওয়ায়াত উল্লেখ করেছেন:
“আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনার পরে এমন বিষয়ের উদ্ভব হবে যে সম্পর্কে না কুরআন মজীদে কিছু অবতীর্ণ হয়েছে, আর না আপনার নিকট থেকে কিছু শোনা গেছে। তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বললেন, আমার উম্মতের ইবাদত গুজার লোকদের একত্র করো [অর্থাৎ এমন লোক যারা আল্লাহর ইবাদত করে এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে একনায়কত্ব সুলভ স্বৈরাচারী আচরণ ও বিদ্রোহাত্মক ভূমিকা গ্রহণকারী নয়।] এবং বিষয়টি পরামর্শের জন্য তাদের সামনে উপস্থিত করো, কিন্তু একজনের মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিওনা।” [তাফসীরে রুহুল মায়ানী]
রসূলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] নিম্নোক্ত বাক্যে ঐ পরামর্শের প্রাণসত্তাকে তুলে ধরেছেন:
“যে ব্যক্তি তার ভাইকে এমন পরামর্শ দান করে, যে সম্পর্কে সে জানে যে যথার্থ বিষয় এর বিপরীত রয়েছে, সে মূলত তার ভাইয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো।” [আবু দাউদ]
এই হুকুম খুবই ব্যঅপক শব্দে প্রদান করা হয়েছে এবং এখানে শূরার [পরামর্শ পরিষদের] কোনো বিশেষ কাঠামো নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। কারণ ইসলামের বিধান গোটা দুনিয়ার জন্য এবং চিরকালের জন্য। যদি পরামর্শ পরিষদের কোনো বিশেষ কাঠামো নির্দিষ্ট করে দেয়া হতো তবে তা বিশ্বজনীন, সর্বাত্মক ও স্থায়ী হতে পারতোনা। পরামর্শ পরিষদ কি সরাসরি সমস্ত লোকের সমন্বয়ে গঠিত হবে, না তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হবে? প্রতিনিধিগণ কি জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হবেন না বিশিষ্ট লোকদের ভোটে? নির্বাচন কি দেশব্যাপী হবে, না কেবল রাজধানী শহরে হবে? নির্বাচন কি ভোটের আকারে হবে, না এমন লোক প্রতিনিধি হিসেবে নেয়া হবে যারা সমাজে নেতৃস্থানীয়? পরামর্শ পরিষদ কি এক কক্ষ বিশিষ্ট হবে, না দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট? এগুলো এমন কতোগুলো প্রশ্ন যার একটিমাত্র উত্তর প্রত্যেক সমাজ ও প্রতিটি সভ্যতার জন্য একইভাবে যুতসই হতে পারেনা। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উপরোক্ত প্রশ্নাবলীর উত্তর বিভিন্নরূপ হতে পারে এবং পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন অবস্থার উদ্ভব হতে পারে। এজন্য ইসলামী শরীয়া বিষয়টিকে স্বাধীন ছেড়ে দিয়েছে, কোনো বিশেষ কাঠামো নির্দিষ্ট করে দেয়নি এবং কোনো বিশেষ কাঠামো নিষিদ্ধও করেনি। অবশ্য নীতিগতভাবে উপরোক্ত আয়াত এবং তার ব্যাখ্যা প্রদানকারী হাদীসমূহ তিনটি বিষয় বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে:
১. মুসলমানদের কোনো সামাজিক সামষ্টিক কাজ পরামর্শ ব্যতীত সম্পন্ন হওয়া উচিত নয়। এ বিষয়টি রাজতন্ত্রের শিকড় কেটে দেয়। কারণ রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র প্রধানের নিয়োগ। অন্যান্য বিষয়ে যদি পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক হয় তবে জোরপূর্বক রাষ্ট্র প্রধানের পদ দখল কি করে বৈধ হতে পারে? অনুরূপভাবে উপরোক্ত বিষয়টি রাষ্ট্র প্রধানের পদ দলখ কি করে বৈধ হতে পারে? অনুরূপভাবে উপরোক্ত বিষয়টি একনায়কত্বকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কারণ একনায়কত্বের অর্থ হচ্ছে স্বেচ্ছাচার বা স্বৈরাচার এবং স্বৈরাচার এবং স্বেচ্ছাচার ও স্বৈরাচার পরামর্শের পরিপন্থী। অনুরূপভাবে সংবিধানকে সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে স্থগিত বা বাতিল করার এখতিয়ারও এ হুকুমের উপস্থিতিতে রাষ্ট্র প্রধানকে দেয়া যেতে পারেনা। কারণ সংবিধান স্থগিত থাকাকালে অবশ্যই সে স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় গ্রহণ করবে এবং স্বেচ্ছাচার নিষিদ্ধ।
২. পরামর্শের বিষয়টি যেসব লোকের সামাজিক বা সামষ্টিক কাজের সাথে জড়িত তাদের সকলকে পরামর্শে অংশগ্রহণ করতে হবে, চাই তারা সরাসরি অংশগ্রহণ করুক অথবা নিজেদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে অংশগ্রহণ করুক।
৩. পরামর্শ স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও নিষ্ঠাপূর্ণ হতে হবে। শক্তি প্রয়োগে অথবা প্রলোভন দিয়ে ভোট বা পরামর্শ লাভ করা মূলত পরামর্শ গ্রহণ না করারই সমতুল্য।
অতএব সংবিধানের বিস্তারিত রূপ যাই হোক তাতে শরীয়াতের এই তিনটি নীতিমালার প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কোনো সময় জনগণের অথবা তাদের নির্ভরযোগ্য প্রনিধিগণের পরামর্শ গ্রহণ ব্যতিরেকে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযেডাগ সংবিধানে রাখা উচিত নয়। সংবিধানে এরূপ নির্বাচন পদ্ধরি ব্যবস্থা রাখা উচিত যাতে গোটা জাতি পরামর্শে অংশগ্রহণ করতে পারে। জনগণকে অথবা তাদের প্রতিনিধিগণকে ভীতি প্রদর্শন করে অথবা প্রলোভন দিয়ে যাতে তাদের মতামত গ্রহণ করা সম্ভব না হয় তার ব্যবস্থাও সংবিধানে থাকতে হবে।
৫. নির্বাচনের নীতিমালা
রাষ্ট্র প্রধান, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, পরামরশ পরিষদ সদস্য এবং প্রশাসক নির্বাচনে কি কি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে সে সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহর দিক নির্দেশনা নিম্নরূক:
“আল্লাহ্ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যেনো তোমরা আমানতসমূহ [অর্থাৎ বিশ্বস্ততার যিম্মাদারী] বিশ্বস্ত লোকদের কাছে সোপর্দ করো।” [সূরা নিসা: ৫৮]
“তোমাদের সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক খোদাভীরু।” [সূরা হুজরাত: ১৩]
মহানবী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেন:
“তোমাদের সর্বোত্তম নেতা হলো সেসব লোক যাদের তোমরা ভালোবাসো এবং তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে, যাদেরকে তোমরা দোয়া করো এবং তারাও তোমাদের জন্র দোয়া করে। তোমাদরে নিকৃষ্টতম নেতা হলো সেসব লোক যাদের তোমরা ঘৃণা করা এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে, যাদের তোমরা অভিসম্পাত করো এবং তারাও তোমাদেরকে অভিসম্পাত করে।” [সহীহ মুসলিম] “আল্লাহর শপথ! আমরা আমাদের এ জাতীয় কোনো দায়িত্বে এমন কোনো ব্যক্তিকে নিয়ো করবোনা, যে তা পাওয়ার জন্য আবেদন করে অথবা তা পেতে লালায়িত।” [বুখারী ও মুসলিম]
“আমাদের নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় খিয়ানতকারী হলো সে ব্যক্তি যে ঐ পদের প্রার্থী হয়।” [আবু দাউদ]
হাদীস অতিক্রম করে একথা ইতিহাসের পাতায়ও স্থান দখল করে নিয়েছে যে ইসলামের পদে প্রার্থ হওয়া খুবই অপছন্দনীয় কাজ। কালকাশানদী তাঁর সুবহুল আ’আশা গ্রন্থে লিখেছেন:
“হযরত আবু বকর [রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সরকারী পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হে আবু বকর! এই পদ তার জন্র যার উক্ত পদের প্রতি আকর্ষণ নাই, তার জন্য নয় যে, তা পাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তা সে ব্যক্তির জন্য, যে উক্ত পদ এড়ানোর জন্য চেষ্টারত থাকে, তার জন্য নয়, যে তার জন্য ঝাপিয়ে পড়ে। ঐ পদ তার জন্য যাকে বলা হয় যে, এটা তোমার প্রাপ্য; তার জন্য নয় যে বলে, এটা আমার প্রাপ্য।” [১খ পৃঃ ২৪০] [উপরোক্ত বর্ণনাটি হুবহু ঐ শব্দসহযোগে আমরা হাদীসের কিতাবে পাইনি বরং এটা একজন ঐতিহাসিকের বর্ণনা। কিন্তু আমরা তা এজন্য উদ্ধৃত করেছি যে, হাদীসের দুইটি নির্ভরযোগ্য বর্ণনা আমরা উপরে বর্ণনা করেছি। যার সাথে এ বর্ণনার অর্থগত সামঞ্জস্য রয়েছে। এ ধনের দুর্বল রিওয়াতের অনুকূলে সহীহ হাদীস বিদ্যমান থাকলে তা অর্থগত দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে যায়।]
উপরোক্ত দিক নির্দেশনা যদিও কেবল নীতিগত পর্যায়ের এবং তাতে একথা বলা হয়নি যে, বাঞ্ছিত গুণাবলীর অধিকারী নেতা বা প্রতিনিধি নির্বাচনের এবং অবাঞ্চিত লোকদের প্রতিহত করার হাতিয়ার কি, কিন্তু তথাপি এই দিক নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য যুক্তিসংগত পন্থা বা পদ্ধতি আবিষ্কার করা সমকালীন সংবিধান রচয়িতাদের কাজ। তাদেরকে নির্বাচনের এমন ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে যাতে বিশ্বস্ত ও খোদাভীরু এবং জনগণের প্রিয়জনের ও কল্যাণকামী লোক নির্বাচিত হয়েও জনগণের নিকট ঘৃণার পাত্র, যাদেরকে সর্বত্র থেকে অভিসম্পাত করা হয়, যাদেরকে লোকেরা বদদোয়া করে এবং যাদেরকে সরকারী পদ প্রদান করা হয়না বরং তারা স্বয়ং উক্ত পদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৬. নারীদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ
আল কুরআনে বলা হয়েছে:
“পুরুষরা নারীদের কর্তা।” [সূরা নিসা: ৩৪]
একটি হাদীসে নবী করীম (স) বলেছৈন:
“যে জাতি নিজেদের বিষয়সমূহ নারীদের উপর সোপর্দ করে সে জাতি কখনও সফলকাম হতে পারেনা।”[বুখারী]
উপরোক্ত আয়াত এবং রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী এ বিষয়ে অকাট্য দলীল যে, রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদ [তা রাষ্ট্র প্রধানের পদ হোক, অথবা মন্ত্রিত্ব হোক, অথবা সংসদের সদস্যপদ হোক অথবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার প্রশাসনিক পদ হোক] নারীদের উপর সোপর্দ করা যায়না। তাই কোনো ইসরামী রাষ্ট্রের সংবিধানে নারীদের উপরোক্ত পদে নিয়োগের ব্যবস্থা বা সুযোগ রাখা ঐসব সুস্পষ্ট দলীলের পরিপন্থী।আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য স্বীকারকারী রাষ্ট্র উপরোক্ত মূলনীতির বিরোধিতা করাই মোটেই অধিকার রাখেনা। [বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হওয়ার জন্য এ গ্রন্থের ১১ নং অধ্যায়ে [কতিপয় সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বিষয়] পাঠ করা যেতে পারে।]
৭. রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য
মহান আল্লাহ:
“আমরা তাদেরকে [মুসলমানদেরকে] পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎ কার্য নিষিদ্ধ করবে।” [সূরা হজ্জ: ৪১]
উপরোক্ত আয়াতে ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব লাভের উদ্দেশ্য ও তার মৌলিক কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কাফের রাষ্ট্রের মতো তার কাজ কেবল রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ শৃংখলা রক্ষা করা, সীমান্তরেখা বরাবর দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং দেশের বৈষয়িক উন্নতির জন্য চেষ্টা করাই নয়, বরং একটি ইসলামী রাস্ট্র হওয়ার সুবাদে তার সর্ব প্রথম কর্তব্য হলো নামায ও যাকাত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা, যেসব বিষয়কে আল্লাহ ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কল্যাণকর বলেছেন তার প্রসার ঘটানো এবং যেসব বিষয়কে আল্লাহ্ ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকৃষ্ট ও ক্ষতিকর বলেছেন তার প্রতিরোধ করা। নামায কায়েম হচ্ছে কি হচ্ছেনা, যাকাত প্রদান হচ্ছে কি হচ্ছেনা, কল্যাণকর বিষয় প্রসার লাভ করছে না পরাভূত হচ্ছে এবং নিকৃষ্ট ও ক্ষতিকর বিষয় পরাভূত হচ্ছে না মাথাচারা দিয়ে উঠছে- এসব ব্যাপারে যে রাস্ট্রের কোন মাথা ব্যথা নাই সে রাস্ট্রকে ইসলামী রাস্ট্র বলা যেতে পারেনা। যে রাস্ট্রের সীমার মধ্যে যেনা, ব্যভিচার, মদ, জুয়া, অশ্লীল সহিত্য ও পত্র পত্রিকা, অশ্লীল বিনোদন ও আনন্দ-স্ফূর্তি, অশ্লীল গানবাজনা, সহশিক্ষা, জাহিলী যুগের দৈহিক সৌন্দর্য প্রদর্শনী এবং নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার ব্যাপক প্রচলন থাকে এবং এসব সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ কার্যাবলীর উপর বিধিনিষেধ আরোপিত নাই, কোনো ধরপাকড় নাই- সে রাস্ট্রের নাম ইসলামী রাস্ট্র রাখা খুবই বেমানান। অতএব একটি ইসলামী সংবিধানে অনিবার্যরূপে ইসলামী রাস্ট্রকে সেসব বিষয়ের অনুসরন করতে বাধ্য করতে হবে যেগুলোকে কুরআন মাজীদ মৌলিক কর্তব্যরূপে নির্ধারন করেছে।
৮. কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের নীতিমালা
‘‘হে মুমিনরা! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাকো তবে তোমরা অনুগত্য করো আল্লাহর, অনুগত্য করো রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে কতৃত্বের অধিকারী তাদের। অতপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা আল্লাহ্ ও রসূলের প্রতি সোপর্দ করো। এটাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। ”
[সূরা নিসাঃ ৫৯]
উপরোক্ত আয়াতে তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয় আলোকপাত করা হয়েছে। সাংবিধানিক বিষয়ের সাথে এর প্রত্যেকটির গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
বিষয়গুলো নিম্নরূপঃ
১. আল্লাহ্ ও তার রসূলের আনুগত্যই হলো আসল আনুগত্য, প্রত্যেক মুসলমানকে ব্যাক্তি হিসেবে এবং মসলিম উম্মাহকে সমষ্টিগতভাবে আল্লাহ ও তার রসূলের অনুগত হতে হবে। এই আনুগত্য অন্য যে কোনো প্রকারের আনুগত্যের তুলনায় অগ্রগণ্য। এরপরে হচ্ছে কর্তৃত্ব সম্পন্ন লোকের আনুগত্য, আগে নয় এবং এই আনুগত্য হবে উপরোক্ত আনুগত্যের অধীনে, স্বাধীন আনুগত্য নয়। এ বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমরা কুরআনের নিন্মোক্ত আয়াত ও রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস থেকে পেতে পারি।
‘‘কোনো বিষয়ের মীমাংসা আল্লাহ্ ও তার রসূল করে দিলে আবার সে বিষয়ে কোনো মুমিন পুরুষ বা নারীর নিজস্বভাবে মীমাংসা করার অধিকার নাই। যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের অবাধ্যাচরণ করলে সে পথভ্রষ্টতায় বহু দূরে চলে যাবে।’’
(সূরা আহযাবঃ ৩৬)
‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান মোতাবেক ফায়সালা করেনা তারা কাফের—তারা যালেম— তার ফাসেক।’’ (সূরা মায়েদাঃ ৪৪,৪৫,৪৭)
‘‘স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় মুসলমানের জন্য {নির্দেশ} শোনাও আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক, যতক্ষণ না তাকে পাপাচারের নির্দেশ দেয়া হয়। অতএব তাকে পাপাচারের নির্দেশ দেয়া হলে কোনো শ্রবণও নাই, আনুগত্যও নাই।’’ (বুখারী ও মুসলিম)
‘‘যদি কোনো কর্তিতনাসা ক্রীতদাসকেও তোমাদের শাসক নিযুক্ত করা হয় এবং সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের নেতৃত্ব দান করে তবে তার নির্দেশ শোনো এবং মান্য করো।’’ (সহীহ মুসলিম)
‘‘পাপাচারের বেলায় কোনো আনুগত্য নাই, আনুগত্য কেবল সৎকাজে।’’ (বুখারী ও মুসলিম)
‘‘আল্লাহর অবাধ্যচারীর আনুগত্য করা যাবেনা।’’ (তাবরানী)
‘‘স্রষ্টার নাফরমানী হয় এমন কোনো বিষয়ে সৃস্টির আনুগত্য করা যাবেনা।’’ (শারহুস সুন্নাহ)
কুরআন ও হাদীসের উপরোক্ত অকাট্য দলীলসমূহ চুড়ান্তভাবে বলে দিচ্ছে যে, একটি ইসলামী রাস্ট্রে আইন প্রণয়নকারী সংসদের আল্লাহ্ ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধানের পরিপন্থি আইন প্রণয়নের কোনোই অধিকার নাই। তারা এরূপ কোনো আইন প্রণয়ন করলে তা সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং তা কার্যকর হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেনা।
অনুরূপভাবে উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ একথাও পরিস্কারভাবে বলে দিচ্ছে যে, একটি ইসলামী রাস্ট্রের বিচারালয়সমূহে আল্লাহ ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধানই কার্যকর হতে হবে এবং যে কথা কুরআন ও হাদীসের দলীল দ্বারা সত্য প্রমাণিত হবে তাকে কোনো বিচারক একথা বলে রদ করতে পারবেনা যে, আইন প্রণয়নকারী সংসদের প্রণীত আইন তার পরিপন্থি। বৈপরিত্যের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধান নয় বরং সংবিধানের সে আইন সংবিধান থেকে খারিজ করে দিতে হবে।
অনুরূপভাবে উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহে একথাও পরিষ্কার বলে দিয়েছে যে, ইসলামী রাস্ট্রের শাসন বিভাগ এমন কোনো নির্দেশ প্রদানের বা নীতিমালা প্রণয়নের অধিকার রাখেনা যার দ্বারা আল্লাহ্ ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানী করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। প্রশাসন যদি এমন কোনো নির্দেশ দেয় এবং জনগণ তা মান্য না করে তবে তারা অপরাধী সাব্যস্ত হবেনা বরং পক্ষান্তরে স্বয়ং সরকারই বাড়াবাড়ি করছে বলে সাব্যস্ত হবে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এইযে, কোনো ইসলামী রাস্ট্রের উলীল আমর তথা কর্ণধার কেবল একজন মুসলমানই হতে পারেন। তার দুইটি প্রমাণ স্বয়ং উপরোক্ত আয়াতেই বিদ্যমান রয়েছ। {এক} ‘‘হে ঈমানদারগণ’’ বলার পর‘ তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বের অধীকারী’’ বলার অর্থ কেবল এ হতে পারে যে, এখানে যে কর্তৃত্বের অধিকারীর আনুগত্য করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে তাকে মুসলমানদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত করতে হবে। (দুই) বিরোধের ক্ষেত্রে বিরোধপূর্ণ বিষয়ের মীমাংসার জন্য আল্লাহ ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রত্যক্ষ নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর একথা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, দেশের নাগরিক ও রাস্ট্রের মধ্যে বিবাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ ও তার রসূলের নির্দেশ কেবল মুসলমান উলীল আমরই (কর্তৃত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি) মানতে পারে, কাফের উলীল আমর মানতে পারেনা। উপরন্তু নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহের বক্তব্যও এর সমর্থন বরং জোর তাকিদ করে। এইমাত্র উপরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একটি কর্তিতনাসা ক্রীতদাসকেও যদি তোমাদের আমীর বানানো হয় এবং সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের নেতৃত্ব দান করে তবে তার কথা শোনো এবং মান্য করো।’’ আরও এইযে, ‘‘ যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যচারী তার আনুগত্য করা যাবেনা’’। আরও একটি হাদীস হযরত উবাদা ইবনুস সামিত [রাদিয়াল্লাহু তায়লা আনহু] বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিন্মোক্ত বাক্যে আমাদের শপথ করিয়েছেনঃ
‘‘আমরা আমাদের শাসকদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হবোনা। কিন্তু আমরা যদি তাদেরকে প্রকাশ্য কুফরীতে লিপ্ত দেখি, যে সম্পর্কে আমাদের নিকট তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রমাণ রয়েছে। [তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করবো]।’’ [বুখারী ও মসলিম]
অপর এক হাদীসে এসেছে যে, সাহাবায়ে কিরাম [রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম] যখন নিকৃষ্ট দুরাচার শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অনুমতি চাইলেন তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ
‘‘না, যতক্ষন তার তোমাদের মাঝে নামায কায়েম করতে থাকে।’’ [মুসলিম]
উপরোক্ত আলোচনার পর এ বিষযে কোনো সন্দেহ থাকতে পারেনা যে, কোনো ইসলামী রাস্ট্রে কোনো অমুসলিম ব্যক্তির ‘‘উলিল আমর’’ হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। ব্যাপারটি ঠিক এরূপ, যেমন কোনো সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্রে সমাজতন্ত্রবাদ প্রত্যাখ্যানকারী কোনো ব্যক্তি কর্নধার হতে পারেনা এবং কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বিরোধী কোনো ব্যক্তির যুক্তিসংগতভাবে এবং কার্যত ‘‘উলীল আমর’’ হতে পারেনা।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উপরোক্ত আয়াতের আলোকে দেশের নাগরিকগণের কোনো বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধিদের সাথে মতভেদে লিপ্ত হওয়ার অধিকার রয়েছে। এবং এ ধরনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত মীমাংসাকারী হবে আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। এ সর্বশেষ ও চূড়ান্ত সনদ যার অনুকূলেই ফায়সালা দান করবে তা সর্বান্তকরণে মেনে নিতে হবে, সে ফায়সালা উলীল আমরের পক্ষেই হোক অথবা নাগরিকগণের পক্ষেই হোক। এখন পরিষ্কার কথা এইযে, এ নির্দেশের দাবি পূরণের জন্য এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব থাকতে হবে যার নিকট বিবাদপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করা যেতে পারে এবং যার কাজ হবে আল্লাহর কিতাব ও রসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক বিবাদের মীমাংসা করা। এ পতিষ্ঠান চাই বিশেষজ্ঞ আলেমগণের কমিটি হোক অথবা সুপ্রিম কোর্ট হোক অথবা অনা কোনো কিছু- তার বিশেষ কোনো কাঠামো শরীয়ত আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দেয়নি যে, তাই মানতে হবে। কিন্তু যাই হোক, রাষ্ট্রের মধ্যে অনুরূপ কোনো প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে এবং তা এতোটা ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে যে, তার নিকট সরকার, সংসদ বা আইন প্রণয়নকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগের বিধান ও সিদ্ধান্তসমূহের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা যাবে। এ প্রতিষ্ঠানের মৌলিক নীতিমালা এই হবে যে, সে আল্লাহর কিতাব ও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক সত্য ও মিথ্যার মধ্যে মীমাংসা করবে।
৯. মৌলিক অধিকার ও সামাজিক সুবিচার
মহান আল্লাহ বলেনঃ
‘‘আমানত তার প্রকৃত প্রাপকের নিকট পৌছে দেয়ার জন্য আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। আর তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।’’ [সূরা নিসাঃ ৫৮]
‘‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেনো তোমাদেরকে কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করো, এটা তাকওয়ার নিকটতর।’’ [সূরা মায়েদাঃ ৮]
এই আয়াতদ্বয় যদিও ব্যাপক অর্থে মুসলমানদেরকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে সুবিচার কায়েমের জন্য বাধ্য করে, কিন্তু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে ইসলামী রাষ্ট্রও মুক্ত থাকতে পারেনা। অবশ্যম্ভাবীরূপে ইসলামী রাষ্ট্রকেও ন্যায়বিচার ও সুবিচারের অনুাসরী হওয়া উচিৎ বরং তাকে উত্তমরূপেই তার অনুসারী হতে হবে। কারণ মানুষের মাঝে সর্বাধিক শক্তিশালী বিচারক সংস্থা হচ্চে রাষ্ট্র। অতএব তার আইনে বা ফয়সালায় যদি সুবিচার বিদ্যমান না থাকে তবে সমাজের অন্য কোথাও সুবিচার পাওয়ার আশা করা যায়না।
এখন দেখা যাক, রাষ্ট্র সম্পর্কে যদি আমরা চিন্তা করি তবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ [অনুসৃত কার্যক্রম] থেকে মানুষের মাঝে সুবিচার ও ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কি পন্থা ও মূলনীতি পাওয়া যায়।
১. বিদায় হজ্জের সুপ্রসিদ্ধ ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী রাষ্ট্রে যেসব মৌলিক নীতিমালা ঘোষণা করেছিলেন তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ন মূলনীতি এই ছিল যেঃ
‘‘নিশ্চই তোমাদের জীবন, তোমাদের ধন সম্পদ এবং তোমাদের মান ইজ্জত সেরূপ সন্মানিত যেরূপ সন্মানিত তোমাদের আজকের এই হজ্জের দিনট।’’
এই ঘোষণায় ইসলামী রাস্ট্রের সকল নাগরিকের জান মাল ও ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা ও মর্যাদার মৌলিক অধিকার প্রদান করা হয়েছে। যে রাষ্ট্র নিজেকে ইসলামী রাষ্ট্র বলে দাবি করবে তাকেই এসব দিকের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। [উপরোক্ত হাদীসে যদিও মুসলমানদের অধিকারের কথা উল্লেখিত হয়েছে, কিন্তু ইসলামী শরিয়াতের একটি সর্বস্বীকৃত মূলনীতি এইযে, যে অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্রের চতুঃসীমার মধ্যে অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তাধীনে বসবাস গ্রহন করে সে ইসলামের ফৌজদারী ও দেওয়ানী আইন অনুসারে মুসলমানদের অনুরূপ অধিকার লাভ করবে।]
২. এ মর্যাদা কোন অবস্থায় এবং কিভাবে ক্ষুণ্ণ হতে পারে? তাও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিন্মোক্ত বাক্যে বলে দিয়েছেন
‘‘অতএব লোকেরা যখন একাজ [এবত্ববাদের সাক্ষ, রিসালাতের সাক্ষ, নামায কায়েম, যাকাত প্রদান] করবে তখন তার আমার থেকে তাদের জীবন রক্ষা করে নিলো। কিন্তু ইসলামের কোনো অধিকারের ভিত্তিতে অপরাধী সাব্যস্ত হলে স্বতন্ত্র কথা এবং তাদের নিয়্যত তথা উদ্দেশ্যের হিসাব গ্রহন আল্লাহর যিম্মায়।’’ [বুখারী ও মুসলিম]
‘‘অতএব তাদের জানমাল [তাতে হস্তক্ষেপ] আমার জন্য হারাম। কিন্তু জান ও মালের কোনো অধিকার তাদের উপর বর্তাইলে স্বতন্ত্র কথা। তাদের গোপন বিষয়ের হিসাব আল্লাহর যিম্মায়।’’ [বুখারী ও মুসলিম]
‘‘অতএব যে ব্যক্তি এর [কলেমা তাওহীদের] প্রবক্তা হলো সে আমার থেকে তার মাল ও জান বাঁচিয়ে নিলো। তবে আল্লাহর কোনো অধিকার [কোনো অপরাধের কারণে] তার উপর বর্তাইলে স্বতন্ত্র কথা। তার গোপন বিষয়ের হিসেব আল্লাহর যিম্মায়।’’ [বুখারী]
উল্লেখিত হাদীসসমূহ থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো নাগরিকের জান মাল ও ইজ্জত আব্রুর উপর হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো নাগরিক ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে তার উপর [অথবা তার বিরুদ্ধে] কোনো অধিকার প্রমাণিত না হয় অর্থাৎ সে কোনো ব্যাপারে আইনত দোষী সাব্যস্ত না হয় ততক্ষণ তার উপর হস্তক্ষেপ করা যাবেনা।
৩. কোনো নাগরিকের উপর [অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে] কিভাবে অধিকার প্রমাণিত হয়? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিন্মোক্ত বাক্যে বর্ণনা করেছেন।
‘‘বাদী ও বিবাদী যখন তোমার সামনে উপস্থিত হবে তখন তুমি যেভাবে এক পক্ষের বক্তব্য শুনেছো সেভাবে অপর পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ না করা পর্যন্ত তাদের মধ্যে ফায়সালা প্রদান করবেনা।’’ [আবু দাউদ, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ] হযরত ওমর ফারূক [রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু] একটি মোকদ্দমার ফায়সালা করতে গিয়ে বলেনঃ
‘‘ইসলামে ন্যায়সংগত পন্থা ব্যতিত কোনে ব্যক্তিকে আটক করা যায়না।’’ [মূয়াত্তা ইমাম মালিক]
উপরোক্ত হাদীসে যদিও মুসলমানদের অধিকারের কথা উল্লেখিত হয়েছে, কিন্তু ইসলামী শরিয়াতের একটি সর্বস্বীকৃত মূলনীতি এইযে, যে অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্রের চতুঃসীমার মধ্যে অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তাধীনে বসবাস গ্রহন করে সে ইসলামের ফৌজদারী ও দেওয়ানী আইন অনুসারে মুসলমানদের অনুরূপ অধিকার লাভ করবে।
আলোচ্য মোকদ্দমার যে বিবরণ উক্ত মুয়াত্তা গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে তা থেকে অবগত হওয়া যায় যে, ইরাকের নব-বিজিত এলাকায় মিথ্যা অভিযোগে লোকদের গেপ্তার করা হতে থাকলে এবং তার বিরুদ্ধে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়লা আনহুর দরবারে অভিযোগ উথ্থাপিত হলে তিনি তদপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত কথা বলেন। এ বর্ণনা থেকে প্রতিভাত হচ্ছে যে, এখানে ‘‘ন্যায়সংগত পন্থা’’ অর্থ ‘যথাযথ বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম’’ [Due Process of Law] অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির অপরাধ প্রকাশ্য আদালতে প্রমাণ করতে হবে এবং অপরাধীকে নিজের নির্দোষিতার পক্ষে বক্তব্য রাখার পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া ইসলামে কোনো ব্যাক্তিকে আটক করা যায়না।
৪. হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর খিলাফতকালে খারেজী সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় হলে, যারা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই প্রস্তুত ছিলোনা, তিনি তাদের লিখে পাঠানঃ
‘‘তোমরা যথায় ইচ্ছা বসবাস করো। আমাদের ও তোমাদের মাঝে শর্ত এইযে, তোমরা খুনখারাবি করবেনা, রাহাজানি করবেনা এবং কারো উপর যুলুম করবেনা। তোমার উপরোক্ত কোনো কাজে লিপ্ত হলে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।’’ [নায়লুল আওতার]
অর্থাৎ তোমরা যে মত ইচ্ছা পোষণ করতে পারো। তোমাদের মতামত ও উদ্দেশ্যের জন্য গ্রেপ্তার করা হবেনা। অবশ্য তোমরা যদি তোমাদের মতামতের প্রেক্ষিতে প্রশাসন যন্ত্র জোরপূর্বক দখল করার চেষ্টা করে তবে অবশ্যই তোমাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
উপরোক্ত আলোচনার পর এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকেনা যে, ন্যায় ইনসাফের ইসলামী ধারনা কোনো অবস্থায়ই প্রশাসন বিভাগকে প্রচলিত বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম ব্যতিত যথেচ্ছভাবে যাকে ইচ্ছা গ্রেপ্তার করার, যাকে ইচ্ছা কয়েদ করার, যাকে ইচ্ছা নির্বাসন দেয়ার, ইচ্ছামতো কারো বাকশক্তি রুদ্ধ করার এবং যাকে ইচ্ছা মতামত প্রকাশের মাধ্যম থেকে বঞ্চিত করার এখতিয়ার প্রদান করেনা। রাষ্ট্র সাধারণভাবে এ ধরনের যেসব এখতিয়ার তার প্রশাসন বিভাগকে দান করে তা ইসলামী রাষ্ট্র কখনও দান করতে পারেনা।
উপরন্তু মানুষের মাঝে মীমাংসা প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যায় ইনসাফের অনুসরণের আরেক অর্থ, যা আমরা ইসলামের বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ঐতিহ্য থেকে জানতে পারি, তা এইযে, ইসলামে রাষ্ট্র প্রধান, গভর্নর, পদস্থ কর্মকর্তা ও সর্বসাধারন সকলের জন্য একই আইন এবং একই বিচার ব্যবস্থা। কারো জন্য কোনো আইনগত স্বাতন্ত্র্য নাই, কারো জন্য বিশেষ আদালত নাই এবং কেউই আইনের হস্তক্ষেপ থেকে ব্যতিক্রম নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ সময়ে নিজেকে এভাবে পেশ করেন, আমার বিরুদ্ধে কারো কোনো দাবি থাকলে সে যেনো তা আদায় করে নেয়। হযরত উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তায়লা আনহু জাবালা ইবনে আইহাম সাসানী নামক গভর্ণরের উপর এক বেদুইনের কিসাসের দাবি পূরণ করেন। হযরত আমর ইবনুর আস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গভর্ণরের জন্য আইনগত নিরাপত্ত প্রার্থনা করলে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেন এবং জনসাধারনকে গভর্নরদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা প্রকাশ্য আদালতে উথ্থাপনের অধিকার প্রদান করেন।
১০. মহান আল্লাহ বলেনঃ
‘‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে।’’ [সূরা যারিয়াতঃ ১৯]
‘‘তাদের সম্পদ থেকে যাকাত ও দান খায়রাত করে তাদেরকে [পুতিগন্ধময় স্বভাব থেকে] পবিত্র করো এবং [পুতপবিত্র স্বভাবেরই উন্মেষ ঘটিয়ে] পবিত্র করো এবং তাদের জন্য কল্যাণের দোয়া করো।’’ [সূরা তাওবাঃ ১০৩]
‘‘আল্লাহ্ তায়ালা মুসলমানদের উপর একটি দান ফরজ করেছেন, যা তাদের সম্পদশালীদের নিকট থেকে আদায় করে তাদের গরীরদের নিকট ফেরত দেয়া হবে।’’ [বুখারী ও মুসলিম]
‘‘যার কোনো পৃষ্ঠপোষক বা অভিভাবক নাই তার অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে সরকার।’’ [আবু দাউদ, তিরমিযী, মূসনাদে আহমদ, ইবনে মাজা, দারিমী]
‘‘যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ অবস্থায় মারা গেছে এবং তা পরিশোধ করার মতো মাল রেখে যায়নি তার ঋণ পরিশোদের দায়িত্ব আমার [সরকারের]। আর যে ব্যক্তি মাল রেখে মারা গেছে তা তার ওয়ারিশদের প্রাপ্য। ‘’
‘‘অপর বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি ঋণ রেখে গেছে অথবা এমন পোষ্য রেখে গেছে যাদের ধ্বংস হওয়ার আশংকা আছে, তারা যেনো আমার নিকট আসে, আমি তাদের পৃষ্ঠপোষক।’’
‘‘অপর বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি মাল রেখে গেছে তা তার ওয়ারিশদের প্রাপ্য। আর যে ব্যক্তি যিম্মাদারীর বোঝা [অসহায় পোষ্য] রেখে গেছে তা আমাদের [সরকারের] যিম্মায়।’’ [বুখারী ও মুসলিম]
‘‘যার কোনো ওয়ারিশ নাই আমি [সরকার] তার ওয়ারিশ। আমি তার পক্ষ থেকে দিয়াত [রক্তপণ] আদায় করবো এবং তার পরিত্যক্ত মাল নিয়ে নিবো। [আবু দাউদ]
উপরে উল্লেখিত আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে পরিষ্কার জানা যায যে, ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহের মধ্যে একটি দয়িত্ব হচ্ছে যাকাত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং তার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, তার রাষ্ট্রসীমার মধ্যে কেউ সাহায্যের মুক্ষাপেক্ষী হলে, অন্ন বস্ত্র বঞ্চিত হলে তার সাহায্য করা।
এ হলো সেসব গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিধান যা আমরা কুরআন ও হাদীস থেকে পেয়ে থাকি। কুরআন ও হাদীসে যদিও আরও অনেক সাংবিধানিক দিক নির্দেশনা বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু যেহেতু তার অধিকতর সম্পর্ক সংবিধানের চেয়ে সাংবিধানিক আইনের সাথে রয়েছে, তাই আমরা সেগুলো এখানে বিবৃত করিনি। এখন সংবিধান সম্পর্কে সামান্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিও আমাদের পেশকৃত এসব আয়াত ও হাদীস দেখে স্বয়ং সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেন যে, এগুলোর মধ্যে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তিসমূহ পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে কিনা? যদি কোনো ব্যক্তি আস্থার দাবির পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করতে পারে যে, উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহের সংবিধানের সাথে কোনো সম্পর্ক নাই; এবং আমাদের বলে দেয় যে, সংবিধানের এমন কোনো কোনো বিষয় [বিস্তারিত বিবরণের প্রয়োজন নাই, শুধু মৌলিক বিষয়] রয়েছে যার সম্পর্কে কুরআন ও হাদীস থেকে কোনে পথনির্দেশ পাওয়া যায়না, তাহলে আমরা অবশ্যই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। কিন্তু যদি এটা প্রমাণ করা না যায় যে, যেসব বিষয়ে আমরা উপরে আলোচনা করেছি তা সাংবিধানিক বিষয় নয় এবং একথাও বলা যায় না যে, এসব বিষয় সম্পর্কে কুরআন ও হাদীস আলোকপাত করেনি, তবে এরপর যারা মোনাফিক নয় তাদের জন্য দু’টি বিকল্প রাস্তাই খোলা থাকে। হয় তারা সোজা পথে এসে উপরোক্ত বিধানসমূহ মেনে নিবে এবং দেশের সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত করে বিস্তারিত বিষয় যথাযথভাবে রচনা করতে থাকবে। নয়তো তারা পরিষ্কার বলে দিবে যে, আমরা না কুরআন মানি আর না হাদীস। আমরা সেই গণতন্ত্রের উপর ঈমান এনেছি, যা আমেরিকা, বৃটেন ও ভারতীয় সংবিধানে পাওয়া যায়। এই দুটি পথের যেটিই তারা অনুসরন করবে তা অবশ্যই মোনাফেকী বর্জিত অকপটে লোকেরই কাজ হতে পারে। এখন কোনো ব্যক্তি সূর্যালোক তার উজ্জল আভা নিয়ে বিচ্ছুরিত হওয়া সত্বেও যদি বলে যে, কোথাও আলো বিদ্যমান নাই তবে তার একথায় জেনগণ ধোঁকায় নিমজ্জিত হোক বা না হোক তার মানমর্যাদা ভুলন্ঠিত হবেই।