ত্রয়োদশ অধ্যায়
অমুসলিমদের অধিকার
শাসনতান্ত্রিক সমস্যাগুলোর মধ্যে সংখ্যালঘু সংক্রান্ত সমস্যা সবচেয়ে জটিল। এ ব্যাপারে অনেক ভুল বুঝাবুঝি পরিক্ষিত হয় এবং সেজন্য মানসিক দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার ধারণ করছে। মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন এবং এর সকল দিক বিশ্লেষণ করে বলেন, মাওলানা সাহেবের সে নিবন্ধটাই দিনি স্বয়ং সম্পাদনা করে দেয়ার পর প্রকাশ করা হচ্ছে। এটি ১৯৪৮ সালের আগষ্ট মাসের তরজমানুল কুরআন থেকে নেয়া হয়েছে। এতে একদিকে অমুসলিমদের সাংবিদানিক অবস্থান মুসলিম সমাজের দায়িত্বসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলিই হচ্ছে অমুসলিমদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের আচরণের নির্দেশক মূলনীতি। সংকলক।
অমুসলিমদের অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করার আগে এ কথা বুঝে নেয়া দরকার যে, ইসলামী রাষ্ট্র আসলে একটা আর্দমবাদী [Ideologica] রাষ্ট্র এবং তার ধারণ ও প্রকৃতি একটা জাতীয় গণতান্ত্রিক[National Denocratic] রাষ্ট্র থেকে একেবারেই ভিন্ন। এই উভয় ধরনের রাষ্ট্রের উক্ত প্রকৃতিগত পার্থক্যের দরুন আলোচ্য বিষয়ের ওপর কিরূপ পড়ে, সেটা নিন্মোক্ত বক্তব্যসমূহ দ্বারা ভালোভাবে বুঝা যাবে।
১. যে আর্দশ ও সূলনীতির ওপর ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, তাকে কে মানে আর কে মানেনা, সে হিসেবেই ইসলামী রাষ্ট্র স্বীয় নাগরিকদের বিভক্ত করে থাক। ইসলামী পরিভাষার উক্ত দুই ধরনের জনগোষ্ঠীকে যথাক্রমে মুসলিম ও অমুসলিম বলা হয়ে থাকে।
১. যে জাতি মূলত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, কারা সেই জাতির বংমোদ্ভুত আর কারা তা নয়, তার ভিত্তিতেই একটা জাতীয় রাষ্ট্র স্বীয় নাগরিকদেরকে বিভক্ত করে ফেলে। আধুনিক পরিভাষায় উক্ত দু’ধরনের জনগোষ্ঠীকে যথাক্রমে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বালা হয়ে থাকে।
২. ইসলামী রাষ্ট্র চালানো আসলে তার আদর্শ ও মূলনীতিতে যারা বিশ্বাসী তাদের কাজ। এ রাষ্ট্র স্বীয় প্রশাসনে অমুসলিমদের সেবা গ্রহণ করতে পারে বটে, তবে নীতি নির্ধারক ও প্রশাসনের পদ তাদের পদ তাদের দিতে পারেনা।
২. জাতীয় রাষ্ট্র স্বীয় নীতি নির্ধারণ প্রশাসনের কাজে শুধু আপন জতির লোকদের ওপরই নির্ভর করে। অন্যান্য সংখ্যালঘু নাগরিকদেরকে এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়না। এ কথাটা স্পষ্ট করে বলা না হলেও কার্যত এটাই হয়ে থাকে। সংখ্যালঘুদের কোনো ব্যক্তিকে যদি কখনো কোনো শীর্ষ স্থানীয় পদ দেয়াও হয়, তবে তা নিছক লোক দেখানো ব্যাপার হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে তার কোনোই ভূমিকা থাকেনা।
৩. ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতিই এমন যে, সে মুসলিম ও অমুসলিমদের সুস্পষ্টভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করতে বাধ্য। অমুসলিমদের কি কি অধিকার দিতে পারবে আর কি কি অধিকার দিতে পাবেনা তা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে দাড়ায়।
৩. জাতীয় রাষ্ট্রের পক্ষে এরূপ দ্বিমূখী আচরণ করা নিতান্তই সহজ কাজ যে , সে দেশের সকল অধিবাসীকে নীতিগতভবে সকল জাতি আখ্যায়িত করে কাগজে কলমে সকলকে সমান অধিকার দিয়ে দেবে। কিন্তু কার্যত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ভেদাভেদ পুরোপুরি বহাল রাখবে এবং সংখ্যালঘুদের বাস্তবিক পক্ষে কোনো অধিকারই দেবেনা।
৪. ইসলামী রাষ্ট্র স্বীয় প্রমাসনে অমুসলিমের উপস্থিতি জটিলতার সমাধান এভবে করে যে, তাদেরকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গিকারের কার্যকর নিশ্চয়তা [Guaranteel] দিয়ে সন্তুষ্ট করে দেয়। নিজেদের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থাপনায় তাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করে এবং তাদের জন্য সব সময় এ ব্যাপারে দরজা খোলা রাকে যে, ইসলামী আদর্শ যদি তাদের ভালো লেগে যায় তাহলে তারা তা গ্রহণ করে শাসক দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে।
৪. একটি জাতীয় রাষ্ট্র স্বীয় রাষ্ট্রকাঠামোতে বিজাতীয় লোকদের উপস্থিতিজনিত জটিলতার সমাধান তিন উপায় করে। প্রথমত, তাদরে স্বতন্ত্র জাতি সত্তাকে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত করে নিজেদের জাতি সত্তাঃয় বিলীন করে নেয়। দ্বিতীয়তঃ তাদের জাতি সত্তাকে নির্মূল কারার জন্য হত্যা, লুটতরাজ ও দেশান্তরীকরণের নিপীড়ন মূলক কর্মপন্থা অবলম্বন করে। তৃতীয়তঃ তাদেরকে নিজেদের ভেতরে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রেখে দেয়। দুনিয়ার জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এই তিনটে কর্মপন্থা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে এবং এখনও গৃহীত হয়ে চলেছে। আজকের ভারতে খোদ মুসলমানদেরকে এ সব নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার তিক্ত অভিজ্ঞতার সন্মূখীন হতে হচ্ছে।
৫. ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিম সংখ্যালঘু নাগরিকদেরকে শরীয়ত প্রদত্ত অধিকারগুলো দিতে বাধ্য। এসব অধিকার কেড়ে নেয়া বা কমবেশী করার এখতিয়ার কারো নেই। এসব অধিকার ছাড়া অতিরিক্ত কিছু অধিকার যদি মুসলমানরা দিতে চায় তবে ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী না হলে তা দিতে পারে।
৫. জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদেরকে যে অধিকারই দেয়া হয় তা সংখ্যাগুরুর দেয়া অধিকার। সংখ্যাগুরুর ওসব অধিকার যেমন দিতে পারে তেমনি তাতে কমবেশী করা একেবারে ছিনিয়ে নেয়ারও অধিকার রাখে এ ধরনের রাস্ট্রে সংখ্যালঘুরা পূরোপূরিভাবে সংখ্যাগুরুর করুনার ওপর নির্ভন করে বেঁচে থাকে। তাদের জন্য মৌলিক মানবাধিকারের পর্যন্ত কোনো স্থায়ী নিশ্চয়তা থাকেনা।
উল্লিখিত মৌলিক পার্থক্যগুলো দ্বারা সুস্পষ্টভবে বুঝা যায় যে, অমুসলিম সংখ্যালঘুদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের আচরণ এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্তার সাথে জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আচরণে কি আকাশ পাতাল ব্যবধান। এ ব্যবধানকে বিবেচনায় না আনলে মানুষ এই ভুল বুঝাবুঝি থেকে মুক্ত হবেনা যে, আধুনিক যুগের জাতীয় সংকীর্ণতার পরিচয় দেয়।
এই অত্যাবশ্যকীয় বিশ্লেষণের পর আমি মূল আলোচ্য বিষয়ে ফিরে যেতে চাই।
১. অমুসলিম নাগরিকরা কতো প্রকারের?
ইসলামী আইন স্বীয় অমুসলিম নাগরিকদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেঃ
এক. যারা কোনো সন্ধিপত্র বা চুক্তি বলে ইসলামী রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত হয়েছে।
দুই. যারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
তিন. যারা যুদ্ধ কিংবা সন্ধি ছাড়া অন্য কোনো পন্থায় ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
যদিও উক্ত তিন প্রকারের নাগরিকরাই সংখ্যালঘু অমুসলিমদের জন্য নির্ধারি ত সাধারণ অধিকারগুলোতে সমভাবে অংশীদার, কিন্তু প্রথমোক্ত দুই শ্রেণী সংক্রান্ত বিধিতে সামান্য কিছু পার্থাক্যও রয়েছে। তাই অমুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার বিশদভাবে বর্ণনা করার আগে আমি এই বিশেষ দুটি শ্রেণীর আলাদা আলাদা বিধান বর্ণনা করবো।
চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক
যারা যুদ্ধ ছাড়া অথবা যুদ্ধ চলাকালে বশ্যতা স্বীকার করতে সম্মত হয়ে যায় এবং ইসলামী সরকারের সাথে সুনির্দষ্ট শর্তবলী স্থির করে সন্ধিবদ্ধ হয় তাদের জন্য ইসলামরে বিধান এই যে, তাদের সাথে সকল আচরণ তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুযায়ী করা হবে। আজকালকার সভ্য জাতিগুলো এরূপ রাজনৈতিক ধড়িবাজীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে, শত্রু পক্ষকে বশ্যতা স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কিছু উদার শর্ত নির্ধারণ করে নেয়। তারপর যেই তারা পূরোপূরি আয়াত্তে এসে যায় অমনি শুরু হয়ে যায় ভিন্ন ধরনের আচরণ। কিন্তু ইসলাম এটাকে হারাম ও মহাপাপ গণ্য করে। কোনো জাতির সাথে যখন কিছু শর্ত স্থির করা হয়ে যায়। (চাই তা মনোপুত হোক বা না হোক) এখন তাতে চুল পরিমাণও হেরফের করা যাবেনা। চাই উভয় পক্ষের আপেক্ষিক অবস্থান, শক্তি ও ক্ষমতায় [Relative position] যতোই পরিবর্তন এসে থাকনা কেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
“যদি তোমরা কোনো জাতির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হও, বিজয়ী হও এবং সেই জাতি নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের প্রাণ রক্ষার্থে তোমাদের মুক্তিপণ দিতে রাযী হয় (অপর বর্ণনায় আছে যে, তোমাদের সাথে কোনো সন্ধিপত্র সন্পাদন করে) তাহলে পরবর্তী সময়ে ঐ নির্ধারিত মুক্তিপণের চেয়ে কণা পরিমাণও বেশী নিওনা। কেননা সেটা তোমাদের জন্য বৈধ হবেনা।” (আবুদাউদ, কিতাবুল জিহাদ)
অপর হাদীসে আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
“সাবধান! যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ নাগরিকের ওপর যুলুম করবে কিংবা তার প্রাপ্য অধিকার থেকে তাকে কম দেবে, তার সামর্থের চেয়ে বেশী বোঝা তার ওপর চাপাবে, অথবা তার কাছ থেকে কোনো জিনিস তার সম্মতি ছাড়া আদায় করবে, এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি নিজেই তার সম্মতি ছাড়া আদায় করবে , এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি নিজেই ফরিয়াদী হবো।” [আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ]
উক্ত উভয় হাদীসের ভাষা ব্যাপক অর্থবোধক। তাই ঐ হাদীস দুটি থেকে এই সাধারণ বিধি প্রণয়ন করা হয় যে, চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকদের সাথে সন্ধিপত্রে যেসব শর্ত নির্ধারিত হবে, তাতে কোনো রকম কমবেশী করা কোনোক্রমেই জায়েয হবেনা। তাদের ওপর কর খাজনাও বাড়ানো যাবেনা। তাদের জমিজমাও দখল করা যাবেনা, তাদের ঘরবাড়ী দালান কোঠাও কেড়ে নেয়া যাবেনা। তাদের ওপর কড়া ফৌজদারী দন্ডবিধিও চালু করা যাবেনা, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করা যাবেনা। তাদের ইজ্জত সম্মানেরও ক্ষতি করা যাবেনা এবং তাদের সাথে এমন কোনো আচরণ করা যাবেনা, যা যুলুম, অধিকারহরণ, সামর্থের সাত্রারিক্ত বোঝা চাপানো অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে সম্পতি হস্তগত করার পর্যায়ে পড়ে। এই নির্দেশাবলীর কারণেই ফকীহগণ সন্ধি বলে বিজিত জাতিগুলো সম্পর্কে কোনো আইন প্রনয়ন করেনি। বরং শুধুমাত্র একটি সাধারণ সনংক্ষিপ্ত বিধি প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত থেকেছেন। সেটি এই যে, তাদের সাথে আমাদের আচরণ হুবহু সন্ধির শর্ত অনুসারে পরিচালিত হবে। ঈমাম আবু ইউসুফ লিখেছেনঃ
“তাদের সন্ধিপত্রে যা নেয়া স্থির হয়েছে, তাদের কাছে থেকে শুধু তাই নেয়া হবে। তাদের সাথে সম্পদিত সন্ধির শর্ত পুরণ হবে। কোনো কিছু বাড়ানো হবেনা।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠাঃ ৩৫]
যুদ্ধে বিজিত অমুসলিম নাগরিক
দ্বিতীয় প্রকার অমুসলিম নাগরিক হচ্ছে যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুসলমানদের সাথে লড়াই করেছে এবং ইসলামী বাহিনী যখন তাদের সকল প্রতিরোধ ভেংগে তাদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করেছে, কেবল তখনই অস্ত্র সংবরণ করেছে। এ ধরনের বিজিতদেরকে যখন “সংরক্ষিত নাগরিকে” (যিম্মী) পরিণত করা হয় তখন তাদের কয়েকটি বিশেষ অধিকার দেয়া হয়। ফিকহ্ শাস্ত্রীয় প্রন্থাবলীতে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। নিন্মে এই সকল বিধির একটি সংক্ষিপ্ত সার দেয়া হচ্ছে। এ থেকে এই শ্রেণীর অমুসলিম নাগরিকদের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাবেঃ
১. মুসলমানদের সরকার তাদরে কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা মাত্রই তাদের সাথে সংরক্ষণ চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবে এবং তাদরে জান ও মালের হিফাযত করা মুসলমানদের জন্য ফরয হয়ে যাবে। কেননা জিযিয়া গ্রহণ করা মাত্রই প্রমাণিত হয় যে, জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। (বাদায়েউস্ সানায়ে, ৭ম খন্ড, ১১১ পৃষ্ঠা)
এরপর মুসলিম সরকারের বা মাধারণ মুসলমানদের এ অধিকার থাকেনা যে তাদের দম্পত্তি দখল করবে বা তাদেরকে দাসদাসী বানাবে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আবু উবায়দাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেনঃ
“যখন তুমি তাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করবে, তখন তোমার আর তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবেনা।” (কিতাবুল খারাজ পৃষ্ঠা ৮২)
২.“সংরক্ষিত নাগরিক” (যিম্মি) পরিণত হয়ে পাওয়ার পর তাদের জমির মালিক তারাই হবে। সেই জমির মালিকানা উত্তরাধিাকার সূত্রে হস্তান্তরিত হবে এবং তারা নিজেদের সম্পত্তি বেচা, কেনা, দান করা ও বন্ধক রাখা ইত্যাদির নিরংকুশ অধিকারী হবে। ইসলামী সরকার তাদেরকে বেদখল করতে পারবেনা। (ফাতুহুল কাদীর ৪র্থ খন্ড পৃষ্ঠাঃ ৩৫৯)
৩. জিযিয়ার পরিমাণ তাদের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। যারা ধনী, তাদের কাছ থেকে যারা মধ্যবিত্ত তাদের কাছ থেকে কম এবং যারা দারিদ্র তাদের কাছ থেকে অনেক কম নেয়া হবে। আর যার কোনো উপার্জনের ব্যবস্থা নেই, অথবা যে অন্যের দান দক্ষিণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে, তার জিযিয়া মাফ করে দেয়া হবে। জিযিয়ার জন্য যদিও কোনো বিশেষ পরিমাণ নিদিষ্ট নেই। তবে তা অবশ্যই এ ভাবে নির্ধারিত হওয়া চাই যাতে তা দেয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ধনীদের ওপর মাসিক এক টাকা, মধ্যবিত্তদের ওপর মাসিক ৫০ পয়সা এবং গরীব লোকদের ওপর মাসিক ২৫ পয়সা জিযিয়া আরোপ করেছিলেন। (কিতাবুল খারাজ পৃষ্ঠাঃ ৩৬)
৪. জিযিয়া শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে সক্ষম লোকদের ওপর আরোপ করা হবে। যারা যুদ্ধ করতে সমর্থ নয়, যথা শিশু, নারী, পাগল, অন্ধ, পংগু উপাসনালয়ের সেবক, সন্যাসী, ভিক্ষু, খুনখুনে বৃদ্ধ। বছরের উল্লেখযোগ্য সময় রোগে কেটে যায় এমন রোগী, এবং দাস দাসী ইত্যাদিকে জিযিয়া দিতে হবেনা। (বাদায়ে ৭ম খন্ড পৃষ্ঠাঃ ১১১-১১৩)
৫.যুদ্ধের মাধ্যমে দখলীকৃত জনপদের উপাসনালয় দখল করার অধিকার মুসলমানদের রয়েছে। তবে সৌজন্য বশত এই অধিকার ভোগ করা থেকে বিরত থাকা এবং উপাসনালয়গুলোকে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় বহাল রাখাপ উত্তম। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে যতো দেশ বিজিত হয়েছে তার কোথাও কোনো উপাসনালয় ভাঙ্গা হয়নি বা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়নি। ইমাম আর ইউসুফ লিখেছেনঃ
“সেগুলোকে যেমন ছিলো তেমনভাবেই রাখা হয়েছে। ভাঙ্গা হয়নি বা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়নি।” (কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠাঃ ৮৩)
তবে প্রাচীন উপাসনালয়গুলোকে ধ্বংস করা কোনো অবস্থায়ই বৈধ নয়। (বাদায়ে, ৭ম খন্ড পৃষ্ঠাঃ ১১৪)
২. অমুসলিম নাগরিকদের সাধারণ অধিকার
এবার আমি শ্রেণীর নাগরিকের সকলেই এ অধিকারগুলোতে অংশীদার।
প্রাণের নিরাপত্তা
অমুসলিম নাগরিকের রক্তের মূল্য মুসলমানদের রক্তের মূল্যের সমান। কোনো মুসলমান যদি অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে, তাহলে একজন মুসলমান নাগরিককে হত্যা করলে যেমন তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো ঠিক তেমনি মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলে জনৈক মুসলমান জনৈক অমুসলিমকে হত্যা করলে তিনি খুনীকে কৃত্যুদন্ড দেন। তিনি বলেনঃ
“যে নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে, তার রক্তের বদলা নেয়ার দায়িত্ব আমারই।”{ইনায়া শরহে হিদায়া ৮ম খন্ড ২৫৬ পৃষ্ঠা।}
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের এক ব্যক্তি জনৈক হীরাবাসী অমুসলিম যিম্মীকে হত্যা করে। তিনি খুনীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হতে সমর্পণের আদেশ দেন। অতঃপর তাকে উত্তরাধিকারীদের হতে সমর্পন করা হলে তারা তাকে হত্যা করে। (বারহান শরহে মাওয়াহিবুর রাহমানঃ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৮৭)
হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে হযরত ওমরের ছেলে উবায়দুল্লাহকে হত্যার পক্ষে ফতুয়া দেয়া হয়। কেননা তিনি হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে হুরমুযান ও আবু লুলুর মেয়েকে হত্যা করেন।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে জনৈক মুসলমান জনৈক অমুসলিমের হত্যার দায়ে গ্রেফতার হয়। যথারীতি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। এই সময় নিহত ব্যক্তির ভাই এসে বললো, “আমি মাফ করে দিয়েছি।” কিন্তু তিনি তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে বললেনঃ ওরা বোধ হয় তোমাকে ভয় দেখিয়েছে।” সে বললো! “না, আমি রক্তপণ পেয়েছি এবং আমি বুঝতে পারছি যে, ওকে হত্যা করলে আমার ভাই ফিরে আসবেনা।” তখন তিনি খুনীকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেনঃ
“আমাদের অধীনস্থ অমুসলিম নাগরিকদের রক্ত আমাদের রাক্তের মতোই এবং তাদের রাক্তপণ আমাদের রক্তপণের মতোই।”২{বুরহান ২য় খন্ড ২৮২ পৃষ্ঠা।}
অপর এক বর্ণনা মুতাবিক হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছিলেনঃ
“তারা আমাদের নাগরিক হতে রাযী হয়েছেই এই শর্তে যে, তাদের সম্পত্তি আমাদের সম্পত্তির মতো এবং তাদের রক্ত আমাদের মতো মর্যাদাসম্পন্ন হবে।”
এ কারণেই ফকীহগণ এই বিধি প্রণয়ন করেছেন যে, কোনো অমুসলিম নাগরিক কোনো মুসলমানের নিহত হবার ক্ষেত্রে দিতে হয়। (দুর্রে মুখতার, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২০৩)
ফৌজদারী দন্ডবিধি
ফৌজদারী দন্ডবিধি মুসলিম অমুসলিম সকলের জন্য সমান। অপরাধের যে সাজা মুসলমানকে দেয়া হয়, অমুসলিম নাগরিককেও তাই দেয়া হবে। অমুসলিমের জিনিস যদি মুসলমান চুরি করে কিংবা মুসলমানের জিনিস যদি অমুসলিম চুরি করে, তাহলে উভয় ক্ষেত্রেই চোরের হাত কেটে ফেলা হবে। কারো ওপর ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে অপবাদ আরোপকারী মুসলমানই হোক আর অমুসলমানই হোক উভয়কে একই শাস্তি দেয়া হবে। অনুরূপভাবে ব্যভিচারের শাস্তিও মুসলিম ও অমুসলিমের জন্য একই রকম। তবে মদের বেলায় অমুসলিদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ১{কিতাবুল খারাজ পৃঃ ২০৮,২০৯, আল মাব্সূত, ৯ম খন্ড, পৃঃ ৫৭-৫৮, ইমাম মালেকের মতে অমুসলিমকে মদের ন্যায় ব্যভিচারের শাস্তি থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ইমাম মালেকের অভিমতের উৎস হলো হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এই সিদ্ধান্ত যে, অমুসলিম নাগরিক ব্যভিচার করলে তার ব্যাপারটা তাদের সম্প্রদায়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ তাদের ধর্মীয় বা পারিবারিক আইন অনুসারে কাজ করতে হবে।}
দেওয়ানী আইন
দেওয়ানী আইনেও মুসলমান ও অমুসলমান সমান। “তাদের সম্পত্তি আমাদের সম্পত্তির মতো” হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এই উক্তির তাৎপর্য এই যে, মুসলমানের সম্পত্তি যেভাবে হিফাযত করা হয় অমুসলিমের সম্পত্তির হিফাযতও তদ্রূপ করা হবে এবং আমাদের ও তাদের দেওয়ানী অধিকার সমান ও অভিন্ন হবে। এই সাম্যের অনিবার্য দাবী অনুসারে দেওয়ানী আইনের আলোকে মুসলমানের ওপর যে সব দায় দায়িত্ব অর্পিত হয় অমুসলিমের ওপরও তাই অর্পিত হবে।
ব্যবসায়ের যেসব পন্থা আমাদের নিষিদ্ধ, তা তাদের জন্যও নিষিদ্ধ। তবে অমুসলিমরা শুধুমাত্র শুয়রের বেচাকেনা খাওয়া এবং মদ বানানো, পান ও কেনাবেচা করতে পারবে। (আল মাবসূত, ১৩শ খন্ড, পৃঃ৩৭-৩৮)
সম্মানের হিফাযত
কোনো মুসলমানকে জিহ্বা বা হাত পা দিয়ে কষ্ট দেয়া, গালি দেয়া, মারপিট করা, বা গীবত করা যেমন অবৈধ, তেমনি এসব কাজ অমুসলিমের বেলায়ও অবৈধ। দুর্রে মুখতারে আছেঃ
“তাকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব এবং তার গীবত করা মুসলমানের গীবত করার মতোই হারাম।”[৩য় খন্ড, পৃঃ ২৭৩-২৭৪]
অমুসলিমদের চিরস্থায়ী নিরাপত্তা
অমুসলিমদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চুক্তি মুসলমানদের জন্য চিরস্থায়ীভাবে বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ এই চুক্তি করার পর তারা তা ভাংতে পারেনা। অপরদিকে অমুসলিমদের এখতিয়ার আছে যে, তারা যতোদিন খুশি তা বহাল রাখতে পারে এবং যখন ইচ্ছা ভেংগে দিতে পারে। ‘বাদায়ে’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
“অমুসলিমদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দানের চুক্তি আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। মুসলমানরা কোনো অবস্থাতেই তা ভাংতে পারেনা। পক্ষান্তরে অমুসলিমদের পক্ষে তা বাধ্যতামূলক নয়। [অর্থাৎ তারা যদি আমাদের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চায় তবে তা করতে পারে।”] [দুর্রে মুখতার, ৭ম খন্ড, পৃষ্টা ১১২]
অমুসলিম নাগরিক যতো বড় অপরাধই করুক, তাদের রাষ্টীয় রক্ষাকবচ সম্বলিত নাগরিকত্ব বাতিল হয়না। এমনকি জিযিয়া বন্ধ করে দিলে, কোনো মুসলমানকে হত্যা করলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বেয়াদবী করলে অথবা কোনো মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করলেও তার নিরাপত্তার গ্যারান্টিযুক্ত নাগরিকত্ব বাতিল হয়না। এসব কাজের জন্য তাকে অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু বিদ্রোহী আখ্যয়িত করে নাগরিকত্বহীন করা হবেনা। তবে শুধু দুই অবস্থায় একজন অমুসলিম নাগরিকত্বহীন হয়ে যায়। এক. যদি সে মুসলমানদের দেশ ছেড়ে গিয়ে শত্রুদের সাথে মিলিত হয়। দুই. যদি সে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে অরাজকতার সৃষ্টি করে। [বাদায়ে, ৭ম খন্ড, পৃঃ ১১৩, ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৮১-৩৮২]
ঘরোয়া কর্মকান্ড
অমুসলিমদের ঘরোয়া কর্মকান্ড তাদের নিজস্ব পারিবারিক আইন (personal law) অনুসারে স্থির কারা হবে। তাদের ওপর ইসলামী কার্যকর করা হবেনা। আমাদের ঘরোয়া জীরনে যেসব জিনিস অবৈধ, তা যদি তাদের ধর্মীয় ও জাতীয় আইনে। বৈধ হয়, তাহলে ইসলামী আদালত তাদের আইন অনুসারেই ফয়সালা করবে। উদাহরণ স্বরূপ, সাক্ষী ছাড়া বিয়ে, মুহ্র ছাড়া বিয়ে, ইদ্দ্তের মধ্যে পুনরায় বিয়ে অথবা ইসলামে যাদের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ তাদের সাথে বিয়ে যদি তাদের আইনে বৈধ থেকে থাকে তাহলে তাদের জন্য এসব কাজ বৈধ বলে মেনে নেয়া হবে। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং তাদের পরবর্তী সকল যুগে ইসলামী সরকারগুলো এই নীতিই অনুসরণ করেছে। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয এ ব্যাপারে হযরত হাসান বস্রীর কাছে নিম্নরূপ প্রশ্ন করেছিলেনঃ
“খোলাফায়ে রাশেদীন অমুসলিম নাগরিকদেরকে নিষিদ্ধ মেয়েদের সাথে বিয়ে, মদ ও শুয়রের ব্যাপারে স্বাধীন ছেড়ে দিলেন কিভাবে?
জাবাবে হযরত হাসান লিখলেনঃ
“তারা জিযিয়া দিতে তো এজন্যই সম্মত হয়েছে যে, তাদেরকে তাদের আকীদা বিশ্বাস অনুসারে জীবন যাপন করার স্বাধীনতা দিতে হবে। আপনার কর্তব্য পূর্ববর্তীদের পদ্ধতি অনুসরণ করা, নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা নয়।”
তবে কোনো ক্ষেত্রে যদি বিবদমান উভয় পক্ষ স্বয়ং ইসলামী আদালতে আবেদন জানায় যে, ইসলামী শরীয়ত মুতাবিক তাদের বিবাদের ফয়সালা করা হোক, তবে আদালত তাদের ওপর শরীয়তের বিধান কার্যকর করবে। তাছাড়া পারিবারিক আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো বিবাদে যদি একপক্ষ মুসলমান হয়, তাহলে ইসলামী শরীয়ত মুতাবিক ফালসালা হবে। উদাহরণ স্বরূপ, একজন খৃষ্টন মহিলা কোনো মুসলমানের স্ত্রী ছিলো এবং তার স্বামী মারা গেলো। এমতাবস্থায় এই মহিলাকে শরীয়ত মুতাবিক স্বামীর সে বিয়ে বাতিল হবে। [আল মাবসূত ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮-৪১]
ধর্মীয় অনুষ্ঠান
অমুসলিমদের ধর্মীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠানদি প্রকাশ্যভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপন করা সম্পর্কে ইসলামের বিধান এই যে, অমুসলিমরা নিজস্ব জনপদে এটা অবাধে করতে পারবে। তবে নির্ভেজাল ইসলামী জনপদগুলোতে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার ইচ্ছা করলে তাদেরকে এ ব্যাপারে অবাধ স্বাধীনতাও দিতে পারবে। আবার কোনো ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করতে চাইলে তাও করতে পারবে।১{নির্ভেজাল ইসলামী জনপদ শরীয়তের পরিভাষায় “আমসারুল মুসলিমীন” (বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদ) আখ্যায়িত অঞ্চলকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যে সব অঞ্চলের ভূসম্পত্তি মুসলমানদের মালিকানাভুক্ত এবং যে সব অঞ্চলকে মুসলমানরা ইসলামী অনুষ্ঠানাদি ও উদযাপনের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে।} বাদায়ে গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
“যেসব জনপদ বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদ নয়, সেখানে অমুসলিমদেরকে মদ ও শুকর বিক্রি, ক্রুশ বহন করা ও শংখ ধ্বনি বাজানোতে বাধা দেয়া হবেনা। চাই সেখানে মুসলিম অধিবাসীদের সংখ্যা যতোই বেশী হোকনা কেনো। তবে বিধিবদ্ধ ইসলামী অঞ্চলে এ সব কাজ পছন্দনীয় নয়। অর্থাৎ যেসব জনপদকে জুম্য়া, ঈদ ও ফৌজদারী দন্ডবিধি প্রচলনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।……তবে যে সমস্ত পাপ কাজকে তারাও নিষিদ্ধ মনে করে যেমন ব্যভিচার ও অন্যান্য অশ্লীল কাজ, যা তাদের ধর্মেও নিষিদ্ধ সেসব কাজ প্রকাশ্যে করতে তাদেরকে সর্বাবস্থায়িই বাঁধা দেয়া হবে। চাই সেটা মুসলমানদের জনপদে হোক কিংবা তাদের জনপদে হোক।”২{বাদায়ে, ৭ম খন্ড, পৃঃ ১১৩}
কিন্তু বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদগুলোতেও তাদেরকে শুধুমাত্র ক্রুশ ও প্রতিমাবাহী শোভাযাত্রা বের করতে এবং প্রকাশ্যে ঢাকঢোল বাজাতে বাজাতে বাজারে বাজারে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে প্রাচীন উপাসনালয়গুলোর অভ্যন্তরে তারা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে। ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করবেনা [শর্হে সিয়ারুল কবীর, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৫১]
উপাসনালয়
নির্ভেজাল মুসলিম জনপদগুলোতে অমুসলিমদের যেসব প্রাচীন উপাসনালয় থাকবে, তাতে হস্তক্ষেপ করা যাবেনা। উপাসনালয় যদি ভেংগে যায়, তবে তা একই জায়গায় পূর্ননির্মাণের অধিকারও তাদের আছে। তবে নতুন উপাসনালয় বানানোর অধিকার নেই।[বাদায়ে, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ১১৪, শর্হে সিয়ারুল কবীর, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৫১]
তবে যেগুলো নির্ভেজাল মুসলিম জনপদ নয়, তাতে অমুসলিমদের নতুন উপাসনালয় নির্মাণের অবাধ অনুমতি রয়েছে। অনুরূপভাবে যেসব এলাকা এখন আর বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদ নেই, সরকার সেখানে জুম্য়া, ঈদ ও ফৌজদারী দন্ডবিধির প্রচলন বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানেও অমুসলিমদের নতুন উপাসনালয় নির্মাণ নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের অধিকার রয়েছে। (বাদায়ে, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ১১৪, শরহে সিয়ারুল কবীর, ৩য় খন্ড, পৃঃ২৫৭]
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর ফতুয়া নিম্মরূপঃ
“যেসব জনপদকে মুসলমানরা বাসযোগ্য বানিয়েছে, সেখানে অমুসলিমদের নতুন মন্দির, গীর্জা ও উপাসনালয় বানানো, বাদ্য বাজানো এবং প্রকাশ্যে শুয়রের গোস্ত ও মদ বিক্রি করার অধিকার নেই। আর অনারবদের হাতে আবাদকৃত, পরে অমুসলিমদের অধিকার তাদের সাথে সম্পদিত চুক্তির শর্তঅনুসারে চিহ্নিত হবে। মুসলমানরা তা মেনে চলতে বাধ্য থাকবে।”
জিযিয়া ও কর আদায়ে সুবিধা দান
জিযিয়া ও কর আদয়ে অমুসলিম নাগরিকদের ওপর কঠোরতা প্রয়োগ করা নিষিদ্ধ। তাদের সাথে নম্র ও কোমল ব্যবাহার করতে বলা হয়েছে। তারা বহন করতে পারেনা এমন বোঝা তাদের ওপর চাপাতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত ওমরের নির্দেশ ছিলো, “যে পরিমাণ সম্পদ রাষ্ট্রকে প্রদান করা তাদের সামর্থের বাইরে তা দিতে তাদেরকে বাধ্য করা চলাবেনা।” [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৮,৮২]
জিযিয়ার বদলায় তাদের ধনসম্পদ নীলামে চড়ানো যাবেনা। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার জনৈক কর্মচারীকে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন যেঃ
“কর খাজনা বাবদে তাদের গরু, গাধা, কাপড় চোপড় বিক্রী করোনা।” [ফাতহুল বায়ন, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৯৩]
অপর এক ঘটনায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু স্বীয় কর্মচারীকে পাঠানোর সময় বলে দেনঃ “তাদের শীত গ্রীষ্মের কাপড়, খাবারের উপকরণ ও কৃষি কাজের পশু খাজনা আদায়ের জন্য বিক্রি করবেনা, প্রহার করবেনা, দাঁড়িয়ে রেখে শাস্তি দেবেনা এবং খাজনার বদলায় কোনো জিনিস নীলামে চড়াবেনা। কেননা। আমরা তাদের শসক হয়েছি বলে নরম ব্যবহারের মাধ্যমে আদায় করাই আমাদের কাজ। তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে আল্লাহ্ আমার পরিবর্তে তোমাকে পাকড়াও করবেনা। আর আমি যদি জানতে পরি যে, তুমি আমার আদেশের বিপরীত কাজ করছো, তাহলে আমি তোমাকে পদচ্যুত করবো। [কিতাবুল খারজ, পৃঃ ৯]
জিযিয়া আদায়ে যে কোনো ধরনের কঠোরতা প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গভর্নর হযরত আবু উবায়াদাকে যে ফরমান পাঠিয়েছিলেন তাতে অন্যান্য নির্দেশের পাশাপাশি এ নির্দেশও ছিলোঃ
“মুসলমানদেরকে অমুসলিমদের ওপর যুলুম করা, কষ্ট দেয়া এবং অন্যায়ভাবে তাদের সম্পত্তি ভোগ দখল করা থেকে বিরতে রাখো।” [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ৮২]
সিরিয়া সফরকালে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দেখলেন, সরকারী কর্মচারীর জিযিয়া আদায় করার জন্য অমুসলিম নাগরিকদের শাস্তি দিচ্ছে। তিনি তাদের বললেন, “ওদের কষ্ট দিওনা। তোমরা যদি ওদের কষ্ট দাও তবে আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তোমাদের শাস্তি দেবেন।” [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৭১]
হিশাম ইবনে হাকাম দেখলেন জনৈক সরকারী কর্মচারী জিযিয়া আদায় করার জন্য জনৈক কিবতীকে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখছে। তিনি তাকে তিরস্কার করলেন এবং বললেন যে, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ
“যারা দুনিয়ায় মানুষকে শাস্তি দিতো, আল্লাহ্ তাদেরকে শাস্তি দেবেন।” [আবু দাউদ]
মুসলিম ফিকহ্ শাস্ত্রকারগণ জিযিয়া দেয় অস্বীকারকারীদের রড়জোর বিনাশ্রম কারদন্ড দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ইমাম আবু ইউসুফ বলেন, “তবে তাদের সাথে সদয় আচরণ করা হবে এবং প্রাপ্য জিযিয়া না দেয়া পর্যন্ত আটক করে রাখা হবে। [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ৭০]
যেসব অমুসলিম নাগরিক দারিদ্রের শিকার ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়, তাদের জিযিয়া তো মাফ করা হবেই, উপরন্তু ইসলামী কোষাগার থেকে তাদের জন্য নিয়মিত সাহায্যও বরাদ্দ করা হবে। হযরত খালিদ হীরাবাসীদের যে লিখিত নিরাপত্তা সনদ দিয়েছিলেন, তাতে এ কথাও লেখা ছিলো যেঃ
“আমি হীরাবাসী অমুসলিমদের জন্য এ অধিকারও সংরক্ষণ করলাম যে, তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বার্ধক্যের দরুণ কর্মক্ষমতা হারিয়ে বসেছে, যার ওপর কোনো দুর্যগ নেমে এসেছে, অথবা যে পূর্বে ধনী ছিলো, পরে দরিদ্র হয়ে গেছে, ফলে তার স্বধর্মের লোকেরাই তাকে দান দক্ষিণা দিতে শুরু করেছে, তার জিযিয়া মাফ করে দেয়া হবে এবং তাকে ও তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের বাইতুল মাল থেকে ভরণ পোষণ করা হবে।” [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৮৫]
একবার হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জনৈক বৃদ্ধ লোককে ভিক্ষা করতে দেখে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বললো, “কী আর করবো বাপু, জিযিয়া দেয়ার জন্য ভিক্ষে করছি।” এ কথা শুনে তিনি তৎক্ষনাত তার জিযিয়া মাফ ও তার ভরণ পোষণের জন্য মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি কোষাগারের কর্মকর্তাকে লিখলেন, “আল্লাহ্র কসম, এটা কখনো ইনসাফ নয় যে, আমরা যৌবনে তার দ্বারা উপকৃত হবো, আর বার্ধক্যে তাকে অপমান করবো।” [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৭২, ফাতহুল কাদীর, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৭৩]
দামেষ্ক সফরের সময়ও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অক্ষম অমুসলিম নাগরিকদের জন্য বৃত্তি নির্দ্ধারণ করার আদেশ জারী করেছিলেন। [বালাযুরীঃ ফতুহুল বুলদান, পৃঃ ১২৯]
কোনো অমুসলিম নাগরিক মারা গেলে তার কাছে প্রাপ্য বকেয়া জিযিয়া তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে আদায় করা হবেনা এবং তার উত্তরাধিকারীদের ওপরও এর দায়ভার চাপানো হবেনা। ইমাম আবু ইউসুফ বলেনঃ
“কোনো অমুসলিম নাগরিক তার কাছে প্রাপ্য জিযিয়া পূরো অথবা আংশিক দেয়ার আগেই মারা গেলে তা তার উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে বা তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে আদায় করা হবেনা।” [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৭০, আল মাবসূত ১০ম খন্ড, পৃঃ ৮১]
বাণিজ্য কর
মুসলিম ব্যবসায়ীদের মতো অমুসলিম ব্যবসায়ীদেরও বাণিজ্য পণ্যের ওপর কর আরোপ করা হবে যদি তাদের মূলধন ২০০ দিরহাম পর্যন্ত পৌঁছে অথবা তারা ২০ মিসকাল স্বর্ণের মালিক হয়ে যায়। ১{কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৭০, তবে আজও কর আরোপের জন্য অবিকল এই পরিমাণ নিসাব নির্ধারণ করা জরুরী নয়। এটা সেই সময়কার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত নির্ধারিত হয়েছিল।} এ কথা সত্য যে, ফিকহ্ শাস্ত্রকারগণ অমুসলিম ব্যবসায়ীদের ওপর বাণিজ্যের শতকরা ৫ ভাগ এবং মুসলিম ব্যবসায়ীদের ওপর আড়াই ভাগ আরোপ করেছিলেন। তবে এ কাজটা কুরআন বা হাদীসের কোনো সুস্পষ্ট বাণীর আলোকে করা হয়নি। এটা তাদের ইজতিহাদ বা হবেষণালদ্ধ সিদ্ধান্ত ছিলো। এটা সমকালীন পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে করা হয়েছিল। সে সময় মুসলমানগণের অধিকাংশেই দেশরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং সমস্ত ব্যবসায় বাণিজ্য অমুসলিমদের হতে চলে গিয়েছিল। এজন্য মুসলিম ব্যবসায়ীদের উৎসাহ বৃদ্ধি এবং তাদের ব্যবসায়ের সংরক্ষণের জন্য তাদের ওপর কর কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
সামরিক চাকুরী থেকে অব্যাহতি
অমুসলিমগণ সামরিক দায়িত্বমুক্ত। শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এককভাবে শুধু মুসলমানদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। কারণ একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের রক্ষাণাবেক্ষণের জন্য কেবল তারাই উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে, যারা ঐ আদর্শকে সঠিক বলে মানে। তাছাড়া লড়াইতে নিজেদের আদর্শ ও মূলনীতি মেনে চলাও তাদের পক্ষেই সম্ভব। অন্যেরা দেশ রক্ষার জন্য লড়াই করলে ভাড়াটে সৈন্যের মতো লড়বে এবং ইসলামের নির্ধারিত নৈতিক সীমা রক্ষা করে চলতে পারবেনা। এজন্য ইসলাম অমুসলিমদের সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে এবং কেবলমাত্র দেশ রক্ষার কাজের ব্যয় নির্বাহে নিজেদের অংশ প্রদানকে তাদের কর্তব্য বলে চিহ্নিত করেছে। এটাই জিযিয়ার আসল তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য। এটা শুধু যে আনুগত্যের প্রতীক তা নয় বরং সামারিক কর্মকান্ড থেকে অব্যাহতি লাভ ও দেশ রক্ষার বিনিমসয়ও বটে। এজন্য জিযিয়া শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষদের ওপরই আরোপ করা হয়। আর কখনো যদি মুসলমানরা অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্ষম হয়, তাহলে জিযিয়ার টাকা ফেরত দেয়া হয়। ১{এ বিষেয়ে বিস্তারিত অধ্যায়নের জন্য দেখুন আলমাবসূত, ১০ম খন্ড, পৃঃ৭৮-৭৯, হিদায়া, কিতাবুল সিয়ার, ফতহুল কাদীর, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ৩২৭-৩২৮, এবং ৩৬৯-৩৭০, কোনো বহিশত্রুর আক্রমণের সময় দেশের অমুসলিম নাগরিকরা যদি দেশ রক্ষার কাজে অংশ গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে, তবে আমরা তাদেরকে অংশ গ্রহণের সুযোগ দিতে পারি। তবে সে ক্ষেত্রে তাদের জিযিয়া রহিত করতে হবে। উল্লেখ্য যে, জিযিয়ার নাম শুনতেই অমুসলিমদের মনে যে আতংক জন্মে, সেটা শুধুমাত্র ইসলামের শত্রুদের দীর্ঘকাল ব্যাপী অপপ্রচারের ফল। অন্যথায় এই আতংকের কোনো ভিত্তি নেই। জিযিয়া মূলতঃ ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা যে নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন যাপনের সুযোগ পায় তারই বিনিময়। শুধুমাত্র সক্ষম ও প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের কাছ থেকে এটা নেয়া হয়। এটাকে যদি ইসলাম গ্রহণ না করার জরিমান বলা হয়, তাহলে যাকাতকে কি বলা হবে? যাকাত তো শুধু প্রত্যেক সক্ষম পুরুষই নয় বরং সক্ষম নারীর কাছ থেকেও আদায় করা হয়। ওটা কি তাহলে ইসলাম গ্রহণেল জরিমানা?} ইয়ারমুকের যুদ্ধে যখন রোমকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশাল সামাবেশ ঘটালো এবং মুসলমানরা সিরিয়ার সকল বিজিত এলাকা পরিত্যাগ করে একটি কেন্দ্রে নিজেদের মক্তি কেন্দ্রীভূত করতে বাধ্য হলো, তখন হযরত আবু উবাইদা নিজের অধীনস্থ সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা যেসব জিযিয়া ও খাজনা অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করেছেলে তা তাদের ফিরিয়ে দাও এবং বলো যে, “এখন আমার তোমাদের রক্ষা করতে অক্ষম, তাই যে অর্থ তোমাদের রক্ষা করার বিনিময়ে আদায় করেছিলাম তা ফেরত দিচ্ছি” [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ১১১]
এই নির্দেশ মুতাবিক সকল সেনাপতি আদায় করা অর্থ ফেরত দিয়েন। এ সময় অমুসলিম নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ঐতিহাসিক বালাযুরী লিখেছেন, মুসলমান সেনাপতিগণ যখন সিরিয়ার হিম্স নগরীতে জিযিয়ার অর্থ ফেরত দেন, তখন সেখানকার অধিবাসীবৃন্দ সমস্বরে বলে ওঠে, “ইতিপূর্বে যে যুলুম অত্যাচারে আমরা নিষ্পেষিত হচ্ছিলাম, তার তুলনায় তোমাদের শসন ও ন্যায়বিচারকে আমরা বেশী পছন্দ করি। এখন আমার যুদ্ধ করে পরাজিত হওয়া ছাড়া কোনো মতেই হিরাক্লিয়াসের কর্মচারীদেরকে আমাদের শহরে ঢুকতে দেবোনা।” [ফতুহুল বুলদান, পৃঃ ১৩৭]
৩.মুসলিম ফকীহদের সমর্থন
হিজরী প্রথম শতাব্দীতে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে যে আইন প্রণীত হয়েছিল, ওপরের আলোচনার তার কিছু বিশদ বিবরণ দেয়া হলো। পরবর্তী আলোচনায় অগ্রসর হওয়ার আগে আমি এ কথাও উল্লেখ করতে চাই যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের পরবর্তী রাজতন্ত্রের যুগে যখনই অমুসলিমদের সাথে অবিচার করা হয়েছে, তখন মুসলিম ফকীহগণই সর্বাগ্রে মযলুম অমুসলিমদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। ইতিহাসের প্রসিদ্ধ ঘটনা যে, উমাইয়া শাসক ওলীদ বিন আব্দুল মালেক দামেষ্কের ইউহান্না গীর্জাকে জোরপূ্র্বক খৃষ্টানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। হযরত ওমর
বিন আব্দুল আযীয ক্ষমতায় এলে খৃষ্টানরা এ ব্যাপারে তার কাছে অভিযোগ দায়ের করলো। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে লিখে পাঠালেন, মসজিদের যে টুকুই অংশ গীর্জার জায়গার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে তা ভেংগে খৃষ্টানদের হাতে সোপর্দ করে দাও।”
ওলীদ বিন এযীদ রোমক আক্রমণের ভয়ে সাইপ্রাসের অমুসলিম অধীবাসীদের দেশ থেকে বহিষ্কার করে সিরিয়ায় পুনর্বাসিত করেন। এতে মুসলিম ফকীহগণ ও সাধারণ মুসলমানরা ভীষণভাবে বিক্ষুব্ধ হয় এবং তারা একে একটা মস্তবড় গুনাহর কাজ বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর যখন ওলীদ বিন এযীদ পুনরায় তাদের সাইপ্রাসে নিয়ে পুর্নবাসিত করলেন, তখন তার প্রশংসা করা হয় এবং বলা হয়, এটাই ইনসাফের দাবী। ইসমাঈল বিন আইয়াশ বলেনঃ
“মুসলমানরা তার এ কাজে কঠোর অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং ফকীহগণ একে গুনাহর কাজ মনে করেন। অতঃপর যখন এযীদ বিন ওলীদ খলীফা হলেন এবং তাদের আবার সাইপ্রাসে ফেরত পাঠালেন, তখন মুসলমানরা এ কাজ পছন্দ করেন এবং একে ন্যায়বিচার আখ্যায়িত করেন।” [ফতুহুল বুলদান, পৃঃ ১৫৬]
ঐতিহসিক বালাযুরী বর্ণনা করেন, িএকবার লেবাননের পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের মধ্য থেকে একটি গোষ্ঠী সরকারের বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সালেহ বিন আব্দুল্লাহ তাদের দমন করার জন্য একটি সেনাদল পাঠান। এই সেনাদল উক্ত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সকল সশস্ত্র পুরুষদের হত্যা করে এবং বাদবাকীদের একদলকে দেশান্তরিত করে ও অপর দলকে যথাস্থানে বহাল রাখে। ইমাম আওযায়ী তখন জীবিত ছিলেন। তিনি সালেহকে এই যুলুমের জন্য তিরষ্কার করেন এবং একটা দীর্ঘ পত্র লেখেন। পত্রটির অংশ বিশেষ নিম্নে দেয়া হলোঃ
“লেবানন পর্বতের অধিবাসীদের বহিষ্কারের ঘটনাটা তোমার অজানা নয়। তাদের ভেতরে এমনও অনেকে আছে, যারা বিদ্রেহীদের সাথে মোটেই অংশ গ্রহণ করেনি। তথাপি তুমি তাদের কতককে হত্যা করলে এবং কতককে তাদের বাসস্থানে ফেরত পাঠিয়ে দিলে। আমি বুঝিনা, কতিপয় বিশেষ অপরাধীর অপরাধমূলক কর্মকান্ডের শাস্তি সাধারণ মানুষকে কিভাবে দেয়া যায় এবং তাদের সহায় সম্পত্তি থেকে তাদের কিভাবে উৎখাত করা যায়? অথচ আল্লাহ্র সুস্পষ্ট নির্দেশ এই যে, একজনের পাপের বোঝা আরেকজন বহন করবেনা।” এটা একটা অবশ্য করণীয় নির্দেশ। তোমার জন্য আমার সর্বোত্তম উপদেশ হলো, তুমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথাটা মনে রেখো যে, “যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর যুলুম করবে এবং তাদের সামার্থের চেয়ে বেশী তার ওপর বোঝা চাপাবে, তার বিরুদ্ধে আমি নিজেই ফরীয়াদী হবো।” [ফুতুহুল বুলদান, পৃঃ১৬৯]
ইতিহাসে এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এ সব দৃষ্টান্ত থেকে বুঝা যায় যে, মুসলিম আলেম সমাজ নিরদিনই অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার থেকেছেন। কখনো কোনো রাজা বা শাসক তাদের ওপর যুলুম ও বাড়াবাড়ি যদি করেও থাকে, তবে তৎকালে ইসলামী আইনের যেসব রক্ষক বেঁচে ছিলেন, তারা কখনো সেই যালিমকে তিরস্কার না করে ছাড়েননি।
৪. অমুসলিমদের যে সব বাড়তি অধিকার দেয়া যায়
উপরে আমরা অমুসলিমদের যে সব অধিকারের উল্লেখ করেছে, সেগুলো তাদের জন্য শরীয়তে সুনির্দিষ্ট এবং সেগুলো যে কোনো ইসলামী শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।
এক্ষনে আমি সংক্ষেপে বলবো যে, বর্তমান যুগে একটি ইসলামী রাষ্ট্র তার অমুসলিম নাগরিকদেরকে ইসলামী মূলনীতির আলোকে কী কী অতিরিক্ত অধিকার দিতে পারে।
রাষ্ট্র প্রধানের পদ
সর্ব প্রথম রাষ্ট্র প্রধানের প্রশ্নে আসা যাক। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্র, তাই ধর্মহীন জাতীয় প্রজাতন্ত্রগুলো সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার সম্পর্কে যে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, ইসলামী রাষ্ট্র তার আশ্রয় নিতে পারেনা। ইসলামে রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব হলো ইসলামের মূলনীতি অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। সুতরাং যারা ইসলামের মূলনীতিকেই মানেনা, সে আর যাই হোক রাষ্ট্র প্রধানের পদে কোনোক্রমেই অভিষিক্ত হতে পারেনা।
মজলিশে শূরা বা আইন সভা
এরপর আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মজলিশে শূরা বা পার্লামেন্ট তথা আইন সভা। এই আইন সভাকে যদি শতকরা একশো ভাগ খাঁটি ও নির্ভেজাল ইসলামী আদর্শ মুতাবিক গঠন করতে হয়, তাহলে এখানেও অমুসলিম প্রতিনিধিত্ব শুদ্ধ নয়। তবে বর্তমান যুগের পরিস্থিতির আলোকে এর অবকাশ এই শর্তে সৃষ্টি করা যেতে পারে যে, দেশের সংবিধানে এই মর্মে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নিশ্চয়তা দিতে হবে যেঃ
ক.আইন সভা কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবেনা এবং এই সীমা লংঘনকারী যে কোনো সিদ্ধান্ত আইনের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হবে।
খ.দেশের আইনের সর্ব প্রধান উৎস হবে কুরআন ও সুন্নাহ।
গ.আইনের চূড়ান্ত অনুমোদনের কাজটি যে ব্যক্তি করবেন তিনি মুসলমান হবেন। এরূপ একটি পদ্ধতিও অবলম্বনম করা যেতে পারে যে, অমুসলিমদের দেশের আইন সভার অন্তর্ভুক্ত করার পরিবর্তে তাদের জন্য একটা আলাদা প্রতিনিধি পরিষদ বা আইন সভা গঠন করে দেয়া হবে। এই পরিষদ দ্বারা তারা নিজেদের সামষ্টিক প্রয়োজনও মেটাতে পারবে এবং দেশের প্রশাসন সংক্রান্ত ব্যাপারেও নিজেদের দৃষ্টিভংগি তুলে ধরতে পারবে। এই পরিষদের সদস্যপদ এবং ভোটাধিকার শুধুমাত্র অমুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে এবং এখানে তাদের মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। এই পরিষদের মাধ্যমে তারা নিম্ন লিখিত কজগুলো সমাধা করতে পারবে।
১. তারা নিজেদের পারিবারিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও আগে থেকে প্রচলিত সকল আইনের খসড়া রাষ্ট্র প্রধানের অনুমোদনক্রমে আইনে পরিণত হতে পারে।
২. তারা সরকারের প্রশাসনিক কর্মকান্ড ও মজলিশে শূরার সিদ্ধান্ত সমূহ সম্পর্কে নিজেদের অভিযোগ, পরামর্শ ও প্রস্তাব অবাধে পেশ করেতে পারবে এবং সরকার ইনসাফ সহকারে তার পর্যালোচনা করবে।
৩. তারা আপন সম্প্রদায়ের স্বার্থ দেশের অন্যান্য ব্যাপরে প্রশ্নও করতে পারবে। সরকারের একজন প্রতিনিধি তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যও উপস্থিত থাকবে।
উপরোক্ত তিনটি পন্থায় যে কোনো একটি পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুসারে গ্রহণ করা যেতে পারে।
পৌরসভা ও স্থানীয় সরকারের স্তরগুলোতে (Local bodies) অমুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ও ভোট দানের পূর্ণ অধিকার দেয়া যেতে পারে।
বাক স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা ইত্যাদি
ইসলামী রাষ্ট্রে একজন মুসলমান যেমন বাক স্বাধীনতা, লোখার স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বধীনতা এবং মতামত ও বিবেকের স্বাধীনতা ভোগ করে, অমুসলিমরাও অবিকল সেরূপ স্বধীনতা ভোগ করবে। এ ব্যাপারে যেসব আইনগত বিধিনিষেধ মুসলমানদের ওপর থাকবে, তা তাদের ওপরও থাকবে।
আইন সংগতভাবে তারা সরকার, সরকারী আমলা এবং স্বয়ং সরকার প্রধানেরও সমালোচনা করতে পারবে।
ধর্মীয় আলোচনা ও গবেষণার যে স্বধীনতা মুসলমানদের রয়েছে, তা আইন সংগতভাবে তাদেরও থাকবে।
তারা নিজেদের ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং একজন অমুসলিম যে কোনো ধর্ম গ্রহণ করলে তাতে সরকারের কোনো অপত্তি থাকবেনা। তবে কোনো মুসলমান ইসলরমী রাষ্ট্রের চৌগদ্দীতে থাকা অবস্থায় আপন ধর্ম পরিবর্তন করতে পারবেনা। তবে এরূপ ধর্মত্যাগী মুসলমানকে আপন ধর্মত্যাগের ব্যাপারে যে জবাবদিহীর সন্মুখীন হতে হবে, সেটা তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। যে অমুসলিম ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে ইসলাম ত্যাগ করেছে, তাকে এজন্য আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবেনা।
তাদেরকে তাদের বিবেকের দিরুদ্ধে কোনো চিন্তা ও কর্ম অবলম্বনে বাধ্য করা যাবেনা। দেশের প্রচলিত আইনের বিরোধী নয় এমন যে কোনো কাজ তারা আপন বিবেকের দাবী অনুসারে করতে পারবে।
শিক্ষা
ইসলামী রাষ্ট্র গোটা দেশের জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করবে, তাদেরকে সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ইসলামের ধর্মীয় পুস্তকাদি পড়তে তাদেরকে বাধ্য করা যাবেনা। দেশের সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্টানে অথবা নিজেদের বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্টানে আপন ধর্ম শিক্ষার আলাদা ব্যবস্থা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তাদের থাকবে।
চাকুরী
কতিপয় সংরক্ষিত পদ ছাড়া সকল চাকুরীতে তাদের প্রবেশাধিকার থাকবে এবং এ ব্যাপারে তাদের সাথে কোনো বৈষম্য করা চলবেনা। মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের যোগ্যতার একই মাপকাঠি হবে এবং যোগ্য লোকদেরকে ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে নির্বাচন করা হবে।
সংরক্ষিত পদসমূহ বলতে ইসলামের আদর্শগত ব্যবস্থায় মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন নির্বাচন করা হবে।
সংরক্ষিত পদসমূহ বলতে ইসলামের আদর্শগত ব্যবস্থায় মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন পদ। একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এইসব পদ কেবল সংশ্লিষ্ট আদর্শে বিশ্বাসীদেরকেই দেয়া যেতে পারে। এই পদগুলো বাদ দেয়ার পর বাদবাকী সমগ্র প্রশাসনের বড় বড় পদেও যোগ্যতা সাপেক্ষে অমুসলিমদেরকে নিয়োগ করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরুপ, রাষ্টের মহা হিসাব রক্ষক, মহা প্রকৌশলী কিংবা। পোস্ট মাস্টার জেনারেলের ন্যায় পদে সুযোগ্য অমুসলিম ব্যুক্তিদের নিয়োগে কোনো বাঁধা নেই।
অনুরূপভাবে সেনাবাহিনীতেও শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ যুদ্ধ সংক্রান্ত দায়িত্ব সংরক্ষিত দায়িত্ব তলে গণ্য হবে। এ ছাড়া অন্যান্য সামরিক বিভাগ যার কোনো সম্পর্ক সরাসরি যুদ্ধের সাথে নেই, অমুসলিমদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও পেশা
শিল্প, কারিগরি, বাণিজ্য, কৃষি ও অন্য সকল পেশার দুয়ার অমুসলিমদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এসব ক্ষেত্রে মুসলমানরা যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে, তা অমুসলমানরাও ভোগ করবে এবং মুসলমানদের ওপর আরোপ করা হয়না এমন কোনো বিধিনিষেধ, অমুসলিমদের ওপরও আরোপ করা যাবেনা। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের অর্থনৈতিক ময়দানে তৎপরতা চালানোর সমান অধিকার থাকবে।
অমুসলিমদের নিরাপত্তার একমাত্র উপায়
একটি ইসলামী রাষ্ট্র আপন অমুসলিম নাগরিকদেরকে যে অধিকারই দেবে, তা পার্শ্ববর্তী কোন অমুসলিম রাষ্ট্র তার মুসলিম নাগরিকদেরকে কী কী অধিকার দিয়ে থাকে, বা আদৌ দেয়ানা, তার পারোয়া না করেই দেবে। আমারা একথা মানিনা যে, মুসলমানরা অমুসলিমদের দেখাদেখি আপন কর্মপন্থা নির্ণয় করবে। তারা ইনসাফ করলে এরাও ইনসাফ করবে আর তারা যুলুম করলে এরাও যুলুম করবে, এটা হতে পারেনা। আমরা মুসলমান হিসেবে একটা সুস্পস্ট ও সুনির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের অনুসারী। আমাদের যাতোদুর সাধ্যে কুলায়, নিজস্ব নীতি ও আদর্শ অনুসারেই কাজ করতে হবে। আমরা যা দেবো তা আন্তরিকতা ও সদুদ্দেশ্য নিয়েই দেবো এবং তা শুধু কগজে কলমে নয় বরং বাস্তবেই দেবো। যে দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করবো তা পূর্ণ ইনসাফ ও সততার সাথে পালন করবো।
এরপর একথা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা এই রাষ্ট্রগুলোকে পরিপূর্ণ ও নির্ভেজাল ইসলামে রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা ছাড়া আর কোনোভাবে দেয়া সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্য বশত গোটা এই উপমহাদেশ জুড়ে যুলুম ও নিপীড়নের যে পৈশাচিক বিভীষিকা চলছে, তাকে প্রশমিত করার এটাই একমাত্র অব্যর্থ উপায়। শুধুমাত্র এই পন্থা অবলম্বনেই পাকিস্তানও হতে পারে ইনসাফের আবাসভূমি আর ভারত এবং অন্যান্য দেশও ইনসাফের পথ খুঁজে পেতে পারে। পরিতাপের বিষয় হলো, অমুসলিমরা দীর্ঘকালব্যাপী ইসলামের কেবল অপব্যাখ্যাই শুনে ও দেখে আসছে। তাই তারা ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী শাসনের কথা শুনলেই আতংকিত হয়। আর তাদের কেউ কেউ দাবী জানাতে থাকে যে, আমাদের এখানেও ভারতের ন্যায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র কায়েম হওয়া উচিত। বাস্তবিক পক্ষে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র কি এমন কোনো আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রত্যাশা করা যেতে পারে? তার পরিবর্তে এমন একটি ব্যবস্থার পরীক্ষা করা কি ভালো নয় যার ভিত্তি খোদাভীতি, সততা এবং শাশ্বত সুন্দর আদর্শের অনুসরণের ওপর প্রতিষ্টিত?