দ্বিতীয় খন্ড
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা : মূলনীতি ও কর্মপন্থা
ইসলামে সাংবিধানিক আইনের উৎস
ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিসমূহ
ইসলামী সংবিধানের ভিত্তিসমূহ
ইসলামী রাষ্ট্রের দৃষ্টান্তমূরক যুগ
ইসলামে আইন প্রণয়ন ও ইজতিহাদ
কতিপয় সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বিষয়
ষষ্ঠ অধ্যায়
ইসলামে সাংবিধানিক আইনের উৎস
১ কুরআন মজীদ
২ রসূলূল্লাহ(স)-এর সুন্নাহ
৩ খিলাফতে রাশেদার কার্যক্রম এবং উম্মদের মুজতাহিদগণের সিদ্ধান্ত
৪ সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা
গ্রন্থের এই দ্বিতীয়ভাগে আমরা ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি ও তার কর্মপন্থার রূপরেখা পেশ করবো। ফলে আমাদের সামনে ইসলামী সংবিধানের একটি সুস্পষ্ট খসড়াও এসে যাবে। পুস্তকের এই অংশে আমরা সর্বপ্রথম ইসলামের সাংবিধানিক আইনের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করা যক্তিসংগত মনে করি, যাতে করে পরের সমস্ত আলোচনার ভিত্তিমূল আমাদের সামনে এসে যেতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে যদি প্রথম পদক্ষেপেই একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তার মূর উৎস হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা নয়, তাহলে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারবেনা। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী এবং তথাকথিত আধুনিকতাবাদীদের মূল চিন্তাগত বিভ্রান্তি এই যে, তারা কথা তো বলে ইসলামী রাষ্ট্রের, কিন্তু উৎস হিসেবে রুজু হয় পাশ্চাত্য জাতিসমূহের প্রতি। আমরা নিশ্চয়ই অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হতে পারি, তবে তা আমাদের নিজেদের ব্যবস্থার সীমার মধ্যে অবস্থান করে এবং তার প্রাণসত্তাকে অটুট রেখে। এ কারণেই আমরা সর্বপ্রথম সাংবিধানিক আইনের উৎস এবং তাকে কাজে লাগানোর পথের অসুবিধাগুলো তুলে ধরবো।
আরও একটি কারণ এই আলোচনার প্রয়োজন হয়েছে এবং তা হচ্ছে হাদীস অস্বীকার করার ফেতনা। একটি দল হাদীস সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক সন্দিহান করে তোলার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে। তারা হাদীসকে আইনের উৎস ও প্রমাণ্য দলীল [হুজ্জাত] হওয়ার বিষয়ে আপত্তি তোলে। এই দৃষ্টিভংগির সমালোচনার এবং সঠিক ও বাস্তব অবস্থার ব্যাখ্যা প্রদানের সীমাহীন প্রয়োজন রয়েছে। সত্য কথা হলো, হাদীস ব্যতীত ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণীত হতেই পারেনা।
আলোচ্য অধ্যায়ে গ্রন্থকারের বিভিন্ন প্রবন্ধের প্রয়োজনীয় অংশ সংকলিত করা হয়েছে এবং টীকায় সেসব নির্দেশ করা হয়েছে। (আমরা এসব গ্রন্থে বাংলা সংস্কারণ উল্লেখের চেষ্টা করবো- অনুবাদক)
-সংকলক।
ইসলামে সাংবিধানিক আইনের উৎস
যে রাষ্ট্র আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব এবং খিলাফত আলা মিনহাজিন নবূয়্যত [নবুয়্যতের পদ্ধতিতে শাসনকার্য পরিচালনা]-এর ব্যবস্থাকেতার যাবতীয় বৈশিষ্ট্যসহ প্রতিষ্ঠিত করে, তাকে ইসলামী রাষ্ট্র বলে। আজ পৃতিবীর যেখানেই এরূপ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এবং তার ধরন ও কর্মপন্থা নির্ধারণের প্রচেষ্টা চালানো হবে সেখানেই কয়েকটি বিশেষ উৎসের দিকে রুজু হতে হবে। সেগুলো হচ্ছে কুরআন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ, খিলাফতে রাশিদার কার্যক্রম এবং উম্মাতের মুজতাহিদ আলেমগণের সিদ্ধান্ত। ইসলামের অলিখিত রাষ্ট্রীয় সংবিধাদেনর উৎস এই চারটি এবং এগুলো অধ্যয়ন করলে ইসলামী রাষ্ট্রের ধরন ও তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যাবে এবং ইসলামী সংবিধানের আনুষঙ্গিক নীতিমালা ও ধারাসমূহ তা থেকে বের করা যাবে।
১. কুরআন মজীদ
ইসলামী সংবিধানের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ উৎস হচ্ছে কুরআন মজীদ। ইসলামের পরিভাষায় “কিতাব” বলতে সেই গ্রন্থকে বুঝায় যা মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর রসূলগণের উপর নাযিল করা হয়। এ অর্থের প্রেক্ষিতে “কিতাব” হচ্ছে সেই পয়গামের সরকারী বিবৃতি [Official Version] অথবা ইসলামী পরিভাষা অনুযায়ী ‘খোদায়ী কালাম’ যা মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে, যার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে এবং যাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে দুনিয়ায় পয়গাম্বর প্রেরিত হয়ে থাকে। আল্লাহর স্থায়ী নিয়ম এই যে, পয়গাম্বরের মাধ্যমে মানুষকে যে শিক্ষাদান করা আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্য তার মূলনীতি ও মৌল বিষয়াদি তাঁর তরফ থেকে পয়গাম্বরের হৃদয়ের প্রত্যদিষ্ট হয়। তার ভাষা এবং অর্থ কোনোটাতেই পয়গাম্বরের নিজস্ব বুদ্ধি ও চিন্তা, তাঁর ইচ্ছা ও আকাঙ্খার বিন্দু পরিমাণ দখল থাকেনা। এ কারণেই তা শব্দ এবং অর্থ উভয়দিক থেকেই আল্লাহর কালাম, পয়গাম্বরের নিজস্ব রচনা নয়। পয়গাম্বর একজন বিশ্বস্ত দূত হিসেবে এ কালাম আল্লাহ্র বান্দাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়ে থাকেন। তদুপরি তিনি আল্লাহর দেয়া দূরদৃষ্টির সাহায্যে কিতাবের অর্থ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। এসব খোদায়ী মূলনীতির ভিত্তিতে পয়গাম্বর নৈতিকতা, সামাজিকতা এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক পূর্ণাংগ কাঠামো গড়ে তোলেন। তিনি শিক্ষা প্রচার, সদুপদেশ এবং নিজের পূত চরিত্রের মাধ্যমে লোকদের ধ্যানধারণা, ঝোঁক প্রবণতা ও চিন্তাধারায় এক মৌলিক পরিবর্তন সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে তাকওয়া, পবিত্রতা, নির্মলতা ও সদাচারণের ভাবধারা সঞ্চারিত করেন। শিক্ষাদীক্ষা ও বাস্তব পথ নির্দেশের দ্বারা তাদেরকে এমনভাবে সুসংহত করেন যে, নতুন মানসিকতা, নতুন চিন্তা ও ধ্যান ধারণা, নতুন রীতি নীতি এবং নতুন আইন কানুনের সংগে এক নতুন সমাজের অভ্যুদয় ঘটে। পরন্তু তিনি তাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব এবং সেই সংগে নিজের শিক্ষা দীক্ষা ও পূত চরিত্রের এমন নিদর্শন রেখে যান, যা হামেশা সমাজ এবং পরবর্তী বংশধরদের জন্যে হিদায়াতের আলোক বর্তিকার কাজ করে।
আল্লাহ্র নাযিলকৃত কিতাবসমূহের মধ্যে কুরআন মজীদ সর্বশেষ ও পূর্ণাংগ আসমানী কিতাব। মুসলমানগণ তো সমস্ত আসমানী কিতাবের উপর ঈমান রাখে, কিন্তু তাদের জন্য হিদায়াতের বিধান ও জীবন যাপনের আইন কানুন প্রদানের মর্যাদা কেবল কুরআন মজীদের জন্য সংরক্ষিত। আমাদেরকে উত্তমরূপে বুঝি নিতে হবে যে, যেখান থেকে কার্যত আনুগত্য ও অনুসরণের সীমারেখা শুরু হয় সেখান থেকে অন্যান্য আসমানী কিতাবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এই কিতাব আমাদের জন্য হিদায়াত লাভের মূল ও হুজ্জাত [Authority] হবার বিভিন্ন কারণ রয়েছে।
১. রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব শব্দসম্ভারে কুরআন মজীদ পেশ করেছেন তা অবিকল সেসব শব্দ সহকারে সংরক্ষিত রয়েছে। প্রথম দিন থেকে হাজারো লাখো ও কোটি কোটি মানুষ প্রত্যেক যুগে তা অক্ষরে অক্ষরে স্মৃতিতে ধরে রেখেছে, লাখো কোটি মানুষ তা দৈনন্দিন তিলাওয়াত করছে সর্বদা তা পুস্তকাকারে লিখিত ও মুদ্রিত হচ্ছে এবং কখনও তার মূল পাঠে ক্ষুদ্রতম মতভেদ পাওয়া যায়নি। অতএব এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের জবানিতে যে কুরআন শ্রুত হয়েছিলো তা আজও অবিকল দুনিয়াতে বিদ্যমান এবং চিরকাল বিদ্যমান থাকবে, তাঁর একটি শব্দেরও পরিবর্তন হয়নি এবং হতেও পারেনা।
২. কুরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে, যা আজও একটি জীবন্ত ভাষায়। আজ দুনিয়ায় কোটি কোটি আরবী ভাষাভাষী লোক বর্তমান। কুরআন অবতরণকালে যেসব পুস্তক এ ভাষায় শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ সাহিত্য ছিলো, আজ পর্যন্ত তাই রয়েছে। মৃত ভাষাগুলোর পুস্তকাদি বুঝতে আজ যেসব অসুবিধা দেখা দেয়, এর অর্থ ও মর্ম উপলব্ধি করতে সেরকম কোনো অসুবিধাই নেই।
৩. কুরআন পুরেপুরি সত্য ও অভ্রান্ত এবং আদ্যপান্ত খোদায় শিক্ষায় পরিপূর্ণ। এতে কোথাও মানবীয় আবেগ, প্রবৃত্তির লালসা, জাতীয় বা গোত্রীয় স্বার্থপরতা এবং মুর্খতাজাত গোমরাহীর চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যায়না। এর ভেতর খোদায়ী কালামের সংগে মানবীয় কালাম অনু পরিমাণ ও মিশ্রিত হতে পারেনি।
৪. এতে গোটা মানবজাতিকেই আহ্বান জানানো হয়েছে এবং এমন আকীদা বিশ্বাস, চরিত্রনীতি ও আচরণবিধি পেশ করা হয়েছে তা কোনো দেশ, জাতি এবং যুগ বিশেষের জন্য নির্দিষ্ট নয়। এর প্রতিটি শিক্ষা যেমন বিশ্বজনীন তেমনি চিরস্থায়ীও।
৫. পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থাবলীতে যেসব সত্যতা, মৌলিকতা এবং কল্রঅন ও সৎকাজের কথা বিধৃত হয়েছিলো, এতে তার সবই সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। কেনো ধর্মগ্রন্থ থেকে এমন কোনো সত্য ও সৎকাজের কথা উদ্ধৃত করা যাবেনা, কুরআনে যার উল্লেখ নেই। এমন পূর্ণাংগ গ্রন্থের বর্তমানে মানুষ স্বভাবতই অন্য সমস্ত গ্রন্থ থেকে মুখাপেক্ষাহীন হয়ে যায়।
৬. কুরআন হচ্ছে আসমানী হিদায়াত ও খোদায়ী শিক্ষা সংক্রান্ত সর্বশেষ [Latest Edition] গ্রন্থ। অতীতের গ্রন্থাবলীতে বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে যেসব বিধি ব্যবস্থা দেয়া হয়েছিলো, এতে তা বাদ দেয়া হয়েছে এবং অতীতের গ্রন্থাবলীতে অনুপস্থিত এমন অনেক নতুন শিক্ষাও এতে সংযোজিত করা হয়েছে:
“আমরা কোনো আয়াত রহিত করলে কিংবা বিস্মৃত হতে দিলে তা থেকে উত্তম বা তার সমতুল্য কোনো আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জানোনা যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।” [সূরা আলবাকারা: ১০৬]
কাজেই যে ব্যক্তি পূর্ব পুরুষদের নয়, বরং খোদায় হিদায়াতের অনুসারী তার পক্ষে এই সর্বশেষ আসমানী কিতাবের অনুসরণ করা একান্ত আবশ্যক, পুরনো গ্রন্থাবলীয় নয়। এখন কুরআন মজীদই হচ্ছে হুজ্জাত [Authority], তার পূর্বেকার কিতাবসমূহ নয়। এসব কারণে ইসলাম অন্য সমস্ত আসমানী কিতাবের সাথে আনুগত্যের সম্পর্ক ছিন্ন করে শুধুমাত্র কুরআনের সাথে আনুগত্যের সমর্ক স্থাপন করেছে এবং গোটা মানবজাতিকে আহ্বান জানাচ্ছে, তারা যেনো এই কিতাবকে তাদের জীবন যাপনের পথনির্দেশিকা বানায় এবং মুসলমানদের জন্য এই কিতাবকে হিদায়াতের প্রথম উৎস সাব্যস্ত করে। মহান আল্লাহ বলেন:
“আমি এ কিতাব তোমার প্রতি সত্যসহ নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের মধ্যে আল্লাহ্র দেয়া সত্য জ্ঞানসহ বিচার ফয়সালা করতে পারো।” [সূরা আননিসা: ১০৫]
“অতএব যারা এ নবীর প্রতি ঈমান এনেছে এবং যারা তাঁর সাহায্য ও সহায়তা করেছে, এবং তাঁর সংগ অবতীর্ণ নূরের অনুসরণ করে চলেছে, তারাই কল্যাণপ্রাপ্ত।” [সূরা আরাফ: ১৫৭]
“আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা ফয়সালা করেনা তারাই কাফের….. তারাই যালেম…… তারাই সত্য ত্যাগকারী।” [সূরা আলমায়েদা:৪০-৪৭]
“[তাফহীমুল কুরআন, সূরা মায়েদা ৭৭ নং টীকার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছে।] যেসব লোক আল্লাহ্র নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করেনা আল্লাহ্ তায়ালা তাদের জন্য এখানে তিনটি উক্তি করেছেন। [এক] তারা কাঅের [দুই] তারা যালেনম [তিন] তারা ফাসেক। এর সুস্পষ্ট অর্থ হলো, যারা আল্লাহর নির্দেশ এবং তাঁর নাযিলকৃত বিধান ত্যাগ করে নিজেদের বা অন্যদের রচিত আইনের ভিত্তিতে বিচার ফয়সালা করে তারা মূলত তিনটি মারাত্মক অপরাধ করে। [এক] তাদের এই কাজ আল্লাহর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি স্বরূপ, তা কুফর, [দুই] তাদের এই কাজ সুবিচারের পরিপন্থী। কেননা পুরোপুরি সুবিচার অনুযায়ী যা কিছু নির্দেশ বা হুকুম হতে পারে তাতো আল্লাহই নাযিল করেছেন। অতএব আল্লাহর বিধান হতে বিচ্যুত হয়ে অন্য কোনো ফায়সালা করলে তারা পরিষ্কার যুলুম করে, [তিন] বান্দাহ হওয়া সত্ত্বেও যখন তারা নিজে মালিক ও প্রভুর অমান্য করে এবং নিজস্ব বা অপর কারো আইন জারী করে, তখন সে কার্যত বন্দেগী ও আনুগত্য অস্বীকারের ক্ষেত্রেও সীমালংঘন করে। এটাই হচ্ছে ফিসক বা ফাসেকী [সত্য ত্যাগ]। এই কুফর, যুলুম ও সত্য ত্যাগ মূলতঃ আল্লাহর বিধান অমান্য করারই বাস্তব রূপ। যেখানেই আল্লাহর বিধান লংঘন করা হবে সেখানেই এই তিনটি বিষয় অপরিহার্যরূপে বিদ্যমান থাকবে। অবশ্য আল্লাহর বিধান লংঘনের মাত্রা ও পর্যায়ে যেমন পার্থক্র হতে পারে, এই তিনটি বিষয়েও অনুরূপ পার্থক্য হয়ে থাকে।”
[‘ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা’ থেকে উদ্ধৃত।] মুসলমানদের জন্য আসল সনদ ও প্রমাণ হচ্ছে কুরআন মজীদ। যা কুরআনের পরিপন্থী তা কখনও অনুসরণীয় ও অনুবর্তনযোগ্য নয়।:
“হে মুহাম্মাদ! বলে দাওঃ আমি এ কিতাবকে নিজের তরফ থেকে বদলাবার অধিকার নাই। আমি তো কেবল সেই ওহীরই আনুগত্য করি, যা আমার প্রতি নাযিল করা হয়। আমি যদি আমার প্রভুর অবাধ্য হই তাহলে আমার কঠিন দিন সম্পর্কে ভয় হয়।” [সূরা ইউনুস: ১৫]
“যা কিছু তোমাদের প্রভুর তরফ থেকে তোমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করো এবং তাকে ছেড়ে অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকদের মাত্রই অনুসরণ করোনা।” [সূরা আলআরাফ: ৩]
[‘ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন’ থেকে উদ্ধৃত।] কুরআন মজীদ ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তাধারার সর্বপ্রথম উৎস। তার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার বিধান ও ফরমানসমূহ বিদ্যমান। এসব বিধান ও ফরমান গোটা মানব জীবনের যাবতীয় বিষয়ের উপর পরিব্যপ্ত। কুরআন মজীদে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত চারিত্র, নৈতিকতা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দান করা হয়নি বরং সামাজিক ও সামগ্রিক জীবনের [Social Life] প্রতিটি দিক ও বিভাগের সংস্কার, সংশোধন ও সংগঠনের জন্যও কিছু নীতিমালা ও কিছু বিধান প্রদান করা হয়েছে এবং এই প্রসংগে বলে দেয়া হয়েছে যে, মুসলমানগণ কোন্সব নীতিমালার ভিত্তিতে কি উদ্দেশ্যে তারে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।
২. রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ [বিষয়টির উপর বিস্তারিত আলোচনার জন্য পাঠ করুন- এই গ্রন্থকারের পুস্তক “সুন্নাতে রসূলের আইনগত মর্যাদা” এবং “নির্বাচিত রচনাবলী” ১ম ও ২য় খণ্ড।]
ইসলামী সংবিধানের দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। সুন্নাহ্র সাহায্যে জানা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মজীদের নির্দেশ ও হিদায়াত এবং কুরআন প্রদত্ত মূলনীতিসমূহ আরব ভূমিতে কিভাবে কার্যকর করেছেন, কিভাবে ইসলামের চিন্তাকে বাস্তব রূপদান করেছেন, কিভাবে সেই চিন্তার ভিত্তিতে একটি সমাজ কাঠামো গঠন করেছেন, অতপর কিভাবে ইই সমাজকে সুসংগঠিত করে একটি রাষ্ট্রের কাঠামোয় দাঁড় করেছেন এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগকে কিভাবে পরিচালনা করেছেন। এসব কিছু আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ থেকেই জানতে পারি এবং তার সাহায্যে আও জানতে পারি যে, কুরআনের সঠিক ও যথার্থ লক্ষ ও উদ্দেশ্য কি। সুন্নাহ মূলত কুরআন মজীদ প্রদত্ত নীতিমালার বাস্তব ও প্রয়োগিক রূপ যা থেকে আমরা ইসলামী সংবিধানের জন্য অতীব মূল্যবান নজীর [Precedents] লাভ করতে পারি এবং সাংবিধানিক ঐতিহ্যের [Conventions of Constitution] খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংগ্রহ করতে পারি।
সুন্নাহ আমাদের সাংবিধানিক আইনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিছুকাল ধরে একটি সম্প্রদায় তার গুরুত্বকে খাটো করে এবং তার আইনের উৎস হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। তাই আমরা এখানে সুন্নাহ্র আইনের উৎসস হওয়ার উপর কিছু আলোকপাত করবো।
এটা [১৯৫৮ সালের ৩৪রা জানুয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী সেমিনার এই গ্রন্থকারের একটি নিবন্ধ পাঠের পর জনৈক মুনকিরে হাদীস [হাদীস অস্বীকারকারী] উঠে দাড়িয়ে উক্ত প্রবন্ধের উপর কতিপয় অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। উক্ত সেমিনারেই নিবন্ধকার এই জবাব দেন।] এমন এক ঐতিহাসিক সত্য যা কোনো ক্রমেই অস্বীকার করা যায়না যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবূয়্যতের পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে শুধু কুরআন পৌঁছে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি বরং একটি ব্যাপক আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছেন। এর ফলস্বরূপ একটি মুসলিম সমাজের গোড়াপত্তন হয়, সভ্যতা সংস্কৃতির এক নতুন ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে এবং একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম হয়। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কুরআন পৌঁছে দেয়া ছাড়াও এসব কাজ যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন তা শেষ পর্যন্ত কি হিসেবে করেছেন? এসব কাজ কি নবীর কাজ হিসেবে সম্পাদিত হয়েছিলো যার মধ্যে তিনি আল্লাহর মর্জীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন? নাকি তাঁর নবূয়্যতী মর্যাদা কুরআন শুনিয়ে দেয়ার পর শেষ হয়ে যেতো এবং এরডপর তিনি সাধারণ মুসলমানদের মতো শুধু একজন মুসলমান হিসেবে থেকে যেতেন, যাঁর কথা ও কাজ নিজের মধ্যে কোনো আইনের সনদ ও দলীলের মর্যাদা রাখতোনা? যদি প্রথম কথাটি মেনে নেয়া হয় তাহলে সুন্নাতকে কুরআনের সাথে আইনের সনদ ও দলীল হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। অবশ্য দ্বিতীয় অবস্থায় সুন্নাতকে আইনের মর্যাদা দেয়ার কোনো কারণ থাকতে পারেনা।
কুরআনের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল পত্রবাহক ছিলেননা বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত পথপ্রদর্শক, আইন প্রণেতা এবং শিক্ষকও ছিলেন যাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিলো এবং যাঁর জীবনকে সমগ্র ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য নমুনা হিসেবে বাস্যস্ত করা হয়েছে। বুদ্ধিবৃবেক সম্পর্কে যতোদূর বলা যায়, তা একথা মেনে নিতে অস্বীকার করে যে, একজন নবী কেবল খোদার কালাম পড়ে শুনিয়ে দেয়া পর্যন্ত তো নবী থাকবেন, কিন্তু এরপর তিনি একজন সাধারণ ব্যক্তিমাত্র রয়ে যাবেন। মুসলমানদের সম্পর্কে যতোদূর বলা যায়, তারা ইসলামের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিটি যুগে এবং গোটা দুনিয়ার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদর্শ, তাঁর অনুসরণ অপরিহার্য এবং তাঁর আদেশ নিষেধের আনুগত্যকে বাধ্যাতামূলক বলে স্বীকার করে আসছে। এমনকি কোনো অমুসলিম পণ্ডিতও এই বাস্তব ঘটনাকে অস্বীকার করতে পারেনা যে, মুসলমানরা সবসময় তাঁর এই মর্যাদা স্বীকার করে আসছে এবং এরই ভিত্তিতে ইসলামের আইন ব্যবস্থাকে সুন্নাহ্কে কুরআনের সাথে আইনের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছে।
আজি জানিনা, কোনো ব্যক্তি সুন্নাতের এই আইনগত মর্যাদা কিভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত সে পরিষ্কারভাবে না বলে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু কুরআন পড়ে শুনিয়ে দেয়া পর্যন্ত নবী ছিলেন এবং একাজ সম্পন্ন করার সাথে সাথে তাঁর নবূয়্যতী মর্যাদা শেষ হয়ে গেছে। তাছাড়া সে যদি এরূপ দাবি করেও তাহলে তাকে বলতে হবে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই ধরনের মর্যাদা সে নিজেই দিচ্ছে, নাকি কুরআন তাঁকে এই ধরনের মর্যাদা দিয়েছেন? প্রথম ক্ষেত্রে ইসলামের সাথে তার কথার কোনো সম্পর্ক নেই এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাকে কুরআন থেকেতার দাবির সপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে।
এব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখা হয়নি যে, কুরআন মজীদ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কি মর্যাদা নির্ধারণ করেছে এবং রিসালাতের পদের কোন্ কোন্ কাজ তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন।
ক. রসূরুল্লাহ (স) শিক্ষক ও মুরুব্বী হিসেবে [সুন্নাতে রসূলের আইনগত মর্যাদা গ্রন্থ থেকে সংযোজিত।]
আলকুরআনে চার স্থানে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের পদমর্যাদা সম্পর্কে নিম্নোক্ত বক্তব্য রয়েছে:
“স্মরণ করো, ইবরাহীম ও ইসমাঈল যখন এই [কা’বা] ঘরের প্রাচীর নির্মাণ করছিলো [তখন এই বলে তারা দোয়া করেছিলো: ]….. হে আল্লাহ! এদের নিকট এদের জাতির মধ্যে থেকেই এমন একজন রসূলু প্রেরণ করো, যিনি তাদেরকে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞানের শিক্ষাদান করবেন এবং তাদের বাস্তব জীবনকে পরিশুদ্ধ করবেন।” [সূরা আলবাকারা: ১২৭-১২৯]
“যেমন আমি তোমাদের নিকট স্বয়ং তোমাদের মধ্য থেকে একজন রসূল পাঠিয়েছি, যে তোমাদের আয়াত পাঠ করে শুনায়, তোমাদের জীবন পরিশুদ্ধ করে, তোমাদের কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান দান করে এবং তোমরা যে জ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানতেনা তা তোমাদের শিক্ষা দেয়।” [সূরা আলবাকারা: ১৫১]
“প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার লোকদের প্রতি আল্লাহ্ এই বিরাট অনুগ্রহ করেছেন যে, স্বয়ং তাদের মধ্য থেকে এমন একজন নবী বানিয়েছেন যিনি তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পড়ে শুনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদের কিতাব ও জ্ঞান বিজ্ঞানের শিক্ষা দেয়।” [আলে ইমরান: ১৬৪]
“তিনিই উম্মীদের মধ্যে [এমন] একজন রসূল স্বয়ং তাদেরই মধ্য থেকে প্রেরণ করেছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ শুনায়, জীবন পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দেয়।” [সূরা জুময়া: ২]
উপরোক্ত আয়াতসমূহে বার বার যে কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পূনর্ব্যক্ত হয়েছে তা হলো, আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলকে শুধুমাত্র কুরআনের আয়াতসমূহ শুনিয়ে দেয়ার জন্য পাঠাননি বরং তার সাথে নবী হিসেবে প্রেরণের আরও তিনটি উদ্দেশ্য ছিলো:
১. তিনি লোকদের কিতাবের শিক্ষাদান করবেন।
২. এই কিতাবের উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করার কৌশল [হিকমাহ] শিক্ষা দিবেন।
৩. তিনি ব্যক্তি ও তাদের সমাজের পরিশুদ্ধি করবেন। অর্থাৎ নিজের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দোষত্রুটি দূর করবেন এবং তাদের মধ্যে উত্তম গুণাবলী ও উন্নত সমাজব্যবস্থার বিকাশ সাধন করবেন।
প্রকাশ থাকে যে, কিতাব ও হিকমাতের শিক্ষা দান অবশ্যি কুরআনের শব্দ শুনিয়ে দেয়ার অতিরিক্ত কোনো কাজই ছিলো, অন্যথায় পৃথকভাবে তার উল্লেখ অর্থহীন। অনুরূপভাবে ব্যক্তি ও সমাজের প্রশিক্ষণের জন্য তিনি যেসব উপায় ও পদ্ধতি গ্রহণ করতেন, তাও কুরআনের শব্দ পাঠ করে শুনিয়ে দেয়ার অতিরিক্ত কিছুছিলো, অন্যথায় প্রশিক্ষণের এই পৃথক কার্যক্রমের উল্লেখের কোনো অর্থ ছিলোনা। এখন বলুন,কুরআন মজীদ পৌঁছে দেয়া ছাড়াও এই শিক্ষক ও মুরুব্বীর পদ যা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ন্যস্ত ছিলো, তা কি তিনি শক্তিবলে দখল করেছিলেন, না আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে এ পদে নিয়োগ করেছেন। কুরআন মজীদের এই সুস্পষ্ট ও পুনরুক্তির পরও এই কিতাবের উপর ঈমান পোষণকারী কোনো ব্যক্তি কি একথা বলার দুঃসাহস করতে পারে যে, এই দুটি পদ রিসালাতের অংশ ছিলোনা এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব পদের দায়িত্ব ও কার্যক্রম রসূল হিসেবে নয় বরং ব্যক্তিগতভাবে আঞ্জাম দিতেন? সে যদি তা বলতৈ না পারে তবে আপনি বলুন, কুরআন মজীদের পাঠ শুনিয়ে দেয়ার অতিরিক্ত যেসব কথা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিতাবের শিক্ষা ও হিকমাত [কৌশল] প্রসংগে বলেছেন এবং নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজের যে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বলে স্বীকার করতে এবং তাকে সনদ [দলীল প্রমাণ] হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করলে তা স্বয়ং রিসালাত অস্বীকার করা নয় কি?
খ. রসূরুল্লাহ (স) আল্লাহর কিতাবের ভাষ্যকার হিসেবে
সূরা আননাহল-এ আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“এবং [হে নবী!] এই যিকির তোমার উপর নাযিল করেছি যেনো তুমি লোকদের সামনে সেই শিক্ষা ধারার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে থাকো, যা তাদের উদ্দেশ্য নাযিল করা হয়েছে।” [আননাহল: ৪৪]
উপরোক্ত আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিলো যে, কুরআন মজীদে আল্লাহ তায়ালা যে হুকুম আহ্কাম ও পথনির্দেশ দিয়েছেন, তিনি তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দান করবেন। স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিও অন্তত এতোটুকু কথা বুঝতে সম্ভব যে, কোনো কিতাবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুধুমাত্র সেই কিতাবের মূলপাঠক পড়ে শুনিয়ে দিলেই হয়ে যায়না বরং ব্যাখ্যাদানকারী তার মূলপাঠের অধিক কিছু বলে থাকেন, যাতে শ্রবণকারী কিতাবের অর্থ পূর্ণরূপে বুঝতে পারে। আর কিতাবের কোনো বক্তব্য যদি কোনো ব্যবহারিক [Practical] বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হয় তাহলে ভাষ্যকার ব্যবহারিক প্রদর্শনী [Practical Demonstration] করে বলে দেন যে, গ্রন্থকারের উদ্দেশ্য এভাবে কাজ করা, তা না হলে কিতাবের বিষয়বস্তু তাৎপর্য ও দাবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাকারীকে কিতাবের মূলপাঠ শুনিয়ে দেয়াটা মকতবের কোনো শিশুর নিটও ব্যাখ্যা বা ভাষ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারেনা। এখন আপনি বলুন, এই আয়াতের আলোকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের ভাষ্যকার কি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন, নাকি আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ভাষ্যকার হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন? এখানে তো আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর রসূলের উপর কিতাব নাযিল করার উদ্দেশ্যই বর্ণনা করেছেন যে, রসূল নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে কিতাবের তাৎপর্য তুলে ধরবেন। অতপর কিভাবে এটা সম্ভব যে কুরআনের ভাষ্যকার হিসেবে তাঁর পদমর্যাদাকে রিসালাতের পদমর্যাদা থেকে পৃথক সাব্যস্ত করা হবে এবং তাঁর পৌঁছে দেয়া কুরআনকে গ্রহণ করে তাঁর প্রদত্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো হবে? এই অস্বীকৃতি কি সরাসরি রিসালাতের অস্বীকৃতির নামান্তর নয়?
গ. রসূলুল্লাহ (স) নেতা ও অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে
সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“[হে নবী] বলো, তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করো তবে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন…… বলো, আল্লাহ ও রসূলের অনুগত্য করো। অতপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে কাফেরদের আল্লাহ্ পছন্দ করেননা।” [ইমরান: ৩১-৩২]
সূরা আহযাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“তোমাদের জন্য আল্লাহ্র রসূলের মধ্যে অনুসরণীয় আদর্শ রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ্ ও আখিরাতের আকাংখী।” [আহযাব: ২১]
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নেতা সাব্যস্ত করেছেন, তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছেন, তার জীবন চরিত্রকে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন এবং পরিষ্কার বলছেন যে, তাঁর নীতি অবলম্বন না করলে আমার নিকট কোনো আশা রেখোনা। এছাড়া আমার ভালোবাসা লাভ করা যায়না। তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া কুফরী। এখন আপনি বলুন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি স্বয়ং নেতা ও পথপ্রদর্শক হয়ে গিয়েছিলেন? নাকি মুসলমানগণ তাঁকে নির্বাচন করেছিলো? আর নাকি আল্লাহ তায়ালাই তাঁকে এই পদে সমাসীন করেছেন? কুরআনুল করীমের এ আয়াত দ্ব্যর্থহীনভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নিযুক্ত পথপ্রদর্শক ও নেতা সাব্যস্ত করার পরও তাঁর আনুগত্য ও তাঁর জীবন চরিত্র অনুসরণ করার ব্যাপারটি কিভাবে প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে? এই প্রশ্নের জবাবে একথা বলা সম্পূর্ণ অর্থহীন যে, এর দ্বারা কুরআন মজীদের অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে, যদি তাই অর্থ হতো তবে “[কুরআনের অনুসরণ করো]” বলা হতো “[আমার অনুসরণ করো] বলা হতোনা।” এ অবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিত্রকে উত্তম আদর্শ বলার তো কোনো অর্থই ছিলোনা।
ঘ. শরীয়ত প্রণেতা হিসেবে রসূলুল্লাহ (স)
সূরা আরাফে মহান আল্লাহ্ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উল্লেখপূর্ব ইরশাদ করেন:
“সে তাদেরকে ন্যায়ানুগ কাজের আদেশ করে, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, তাদের জন্য পাক জিনিসসমূহ হালাল এবং নাপাক জিনিসসমূহ হারাম করে, আর তাদের উপর থেকে সেই বোঝা সরিয়ে দেয় যা তাদের উপর চাপানো ছিলো এবং সেই বন্ধনসমূহ খুলে দেয় যাতে তারা বন্দী ছিলো।” [আরাফ: ১৫৭]
উল্লেখিত আয়াতের শব্দসমূহ একটি বিষয় সম্পূর্ণ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করছে যে, আল্লাহ তায়ালা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা [Legislative Powers] প্রদান করেছেন। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আদেশ নিষেধ, হালাম হারাম শুধু কুরআন মজীদে বর্ণিতগুলোই নয় বরং এর সাথে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু হালাল অথবা হারাম ঘোষণা করেছেন, অথবা যেসব জিনিসের হুকুম দিয়েছেন বা নিষেধ করেছেন তাও আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। এজন্য তাও আল্লাহ্র বিধানের একটি অংশ। এ কথাই সূরা হাশরে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণিত হয়েছে:
“রসূল তোমাদের যা কিছু দেয় তা গ্রহণ করো, আর যে জিনিস থেকে বিরত রাখে [নিষেধ করে] তা থেকে বিরত থাকো, আল্লাহ্কে ভয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা।” [হাশর: ৭]
উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের কোনোটিরই এই ব্যাখ্যা করা যায়না যে, তার মধ্যে কুরআনের আদেশ নিষেধ ও কুরআনের হালাল হারামের কথা বলা হয়েছে, এটা ব্যাখ্যা নয় বরং আল্লাহর কালামের পরিবর্তনই হবে। আল্লাহ তায়ালা তো এখানে আদেশ নিষেধ ও হালাল হারামকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কার্যক্রম সাব্যস্ত করেছেন, কুরআনের কার্যক্রম নয়। এরপরও কি কোনো ব্যক্তি আল্লাহ্ বেচারাকে বলতে চায় যে, আপনার বক্তব্যে ভুল হয়ে গেছে। আপনি ভুল করে কুরআনের পরিবর্তে রসূলের নাম উল্লেখ করেছেন [নাউযুবিল্লাহ]!
ঙ. বিচারক হিসেবে রসূলুল্লাহ (স)
কুরআন মজীদের এক স্থানে নয় বরং অসংখ্য স্থানে আল্লাহ্ তায়ালা এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন যে, তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিচারক নিয়োগ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ করা হলো:
“[হে নবী!] আমরা এই কিতাব পূর্ণ সত্যসহকারে তোমার উপর নাযিল করেছি, যেনো আল্লাহ্ তোমাকে সত্যপথ দেখিয়েছেন, তদনুসারে লোকদের মধ্যে মীমাংসা করতে পারো।” [নিসা: ১০৫]
“আর [হে নবী বলো! আল্লাহ্ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি যেনো তোমাদের মাঝে সুবিচার করি।” [শূরা: ১৫]
“ঈমানদার লোকদের কাজ তো এই যে, তাদেরকে যখন আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের দিকে ডাকা হবে, যেনো রসূল তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, তখন তারা বলবে, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম।” [নূর: ৫১]
“তাদের যখন বলাহয়, আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সেদিকে এবং তাঁর রসূলের দিকে আসো, তখন এই মুনাফিকদের তুমি দেখতে পাবে যে, তারা তোমার নিকট আসতে ইতস্তত করছে এবং পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।” [নিসা: ৬১]
“অতএব [হে নবী] তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনও ঈমানদার হতে পারেনা, যতক্ষণ তারা নিজেদের পারস্পরিক মতভেদের ব্যাপারসমূহে তোমাকে বিচারপতিরূপে মেনে না নিবে।” [নিসা : ৬৫]
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হচ্ছে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ংসিদ্ধভাবে অথবা মুসলমানদের নিযুক্ত বিচারক ছিলেননা, বরং আল্লাহ তায়ালার নিয়োগকৃত বিচারক ছিলেন। তৃতীয় আয়াতটি বলে দিচ্ছে, তাঁর বিচারক হওয়ার মর্যাদা বা পদ রিসালাতের পদ থেকে স্বতন্ত্র ছিলোনা বরং রসূল হিসেবে তিনি বিচারকও ছিলেন এবং একজন মুমিনের রিসালাতের প্রতি ঈমান তখন পর্যন্ত সঠিক ও যথার্থ হতে পারেনা যতক্ষণ না সে তাঁর এই মর্যাদার সামনেও শ্রবণ ও আণুগত্যের ভাবধারা গ্রহণ করবে। চতুর্থ আয়অতে “[আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন]” অর্থাৎ কুরআন এবং রসূল উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন উল্লেখ করা হয়েছে, যা থেকে পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয় যে, মীমাংসা লাভের জন্য দুটি স্বতন্ত্র প্রত্যাবর্তন স্থল রয়েছে। [এক] কুরআন, আইন বিধান হিসেবে এবং [দুই] রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিচারক হিসেবে। আর এই দুই জিনিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে ব্যক্তি বিচারক হিসেবে না মানে সে মুনিই নয়, এমনকি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত ফায়সালা সম্পর্কে যদি কোনো ব্যক্তি নিজেদের অন্তরে সংকীর্ণতা অনুভব করে তবে তার ঈমান বরবাদ হয়ে যায়। কুরাআন মজীদের এই সুস্পষ্ট ব্যক্তব্যের পরও কি আপনি বলতে পারেন যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রসূল হিসেবে বিচারক ছিলেননা বরং দুনিয়ার সাধারণ জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের ন্যায় তিনিও একজন বিচারক ছিলেন মাত্র? তাই তাদের ফায়সালাসমূহের ন্যায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা ও আইনের উৎস হতে পারেনা? দুনিয়ার কোনো বিচারকের কি এরূপ মর্যাদা হতে পারে যে, তার ফায়সালা যদি কেউ না মানে, অথবা তার সমালোচনা করে অথবা অন্তরে তাকে ভ্রান্ত মনে করে তবে তার ঈামন নষ্ট হয়ে যায়?
চ. রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাসূলুল্লাহ (স)
কুরআন মজীদ একইভাবে বিস্তারিত আকারে এবং পুনরুক্তি সহকারে অসংখ্য স্থানে একথা বলেছে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন এবং তাঁকে রসূল হিসেবেই এই পদ প্রদান করা হয়:
“আমরা যে রসলূই পাঠিয়েছি তাকে এজন্য পাঠিয়েছি যে, আল্লাহর অনুমোদন [Sanction] অনুযায়ী তার আনুগত্য করা হবে।” [নিসা: ৬৪]
“যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করলো, সে মূলত আল্লাহ্রই আনুগত্য করলো।” [নিসা: ৮০]
“[হে নবী] যেসব লোক তোমার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে তারা মূলত আল্লাহর নিকটই বাইয়াত গ্রহণ করে।” [আল ফাতাহ” ১০]
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রসূলেরও আনুগত্য করো, নিজেদের আমল বিনষ্ট করোনা।” [মুহাম্মাদ: ৩৩]
“কোনো মুমিন পুরুষ ও কোনো মুমিন স্ত্রীলোকের এই অধিকার নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যখন কোনো বিষয়ে ফায়সালা করে দেবেন তখন সেনিজের সেই ব্যাপারে নিজে কোনো ফায়সালা করার এখতিয়ার রাখবে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের অবাধ্যাচরণ করবে, সে নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে লিপ্ত হলো।” [আহযাব: ৩৬]
“হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহ্র, আনুগত্য করো রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা সামগ্রিক দায়িত্বসম্পন্ন তাদেরও। অতপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি হয় তবে তা আল্লাহ্ ও রসূলের দিকে ফিয়ে দাও, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাকো।” [নিসা: ৫৯]
এসব আয়াত পরিষ্কার বলছে যে, রসূল এমন কোনো রাষ্ট্রনায়ক নন যিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের স্বয়ং কর্ণধার হয়ে গেছেন, অথবা লোকেরা তাঁকে নির্বাচন করে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়েছে। বরং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর রাষ্ট্রনায়কসূলভ কাজ তাঁর রিসালাতের পদমর্যাদা থেকে ভিন্নতর কোনো জিনিস নয়। বরং তাঁর রসূল হওয়াটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর অনুগত রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার নামন্তর। তাঁর আনুগত্য করা হলে তা মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করা হলো। তাঁর নিকট বাইয়াত হওয়াটা মূলত আল্লাহর নিকট বাইয়াত হওয়ার শামিল। তাঁর আনুগত্য না করার অর্থ আল্লাহর অবাধ্যাচরণ এবং পরিণতি হলো ব্যক্তির কোনো কার্যক্রমই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য না হওয়া। পক্ষান্তরে ঈমানদার সম্প্রদায়ের [যার মধ্যে বাহ্যত সমগ্র উম্মাহ্, তাদের শাসকগোষ্ঠী ও তাদের “জাতির কেন্দ্রবিন্দু” সব অন্তর্ভুক্ত] সর্বোতভাবেই এ অধিকার নেই যে, কোনো বিষয়ে আল্লাহ্র রসূলের সিদ্ধান্ত দেয়ার পর তারা ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
এসব সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থেকে আরও অগ্রসর হয়ে সর্বশেষ আয়াত চূড়ান্ত ব্যাখ্যা প্রদান করেছে যার মধ্যে পরপর তিনটি আনুগত্যের হুকুম দেয়া হয়েছে:
১. সর্বপ্রথম আল্লাহর আনুগত্য।
২. অতপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য।
৩. অতপর তৃতীয পর্যায়ে সামগ্রিক দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তিগণের আনুগত্য।
এর পূর্বেকার কথা থেকে জানা গেলো যে, রসূল উলিল আমর [সামগ্রিক দায়িত্বসম্পন্ন কর্তপক্ষ] এর অন্তর্ভুক্ত নন বরং তার থেকে পৃথক ও ঊর্ধ্বে এবং তাঁর স্থান আল্লাহর পরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এ আয়াত থেকে দ্বিতীয় যে কথা জানা যায় তাহলো, উলিল আমরের সাথে বিতর্ক ও মতপার্থক্য হতে পারে, কিন্তু রসূলের সাথে বিতর্ক বা মতপার্থক্র হতে পারেনা। তৃতীয়ত, জানা গেলো যে, বিতর্ক ও মতবিরোধের ক্ষেত্রে মীমাংসার জন্য দুটি প্রত্যাবর্তনস্থল রয়েছে: [এক] আল্লাহ্ [দুই] অতপর আল্লাহর রসূল। প্রকাশ থাকে যে, যদি প্রত্যাবর্তনস্থল শুধুমাত্র আল্লাহ হতেন, তবে সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্রভাবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উল্লেখ সম্পূর্ণ অর্থহীন হতো। তাছাড়া আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের অর্থ যখন আল্লাহর কিতাবের প্রতি প্রত্যাবর্তন ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন রসূলে দিকে প্রত্যাবর্তনের অর্থও আর কিছুই হতে পারেনা যে, রিসালাতের যুগে স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রত্যাবর্তন এবং এই যুগের পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। [বরং যদি গভীর দৃষ্টিতে দেখা হয় তবে জানা যায় যে স্বয়ং রিসালাতের যুগেও ব্যাপক অর্থে রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতই ছিলো প্রত্যাবর্তন স্থল। কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ যুগে ইসলামী রাষ্ট্র গোটা আরব উপদ্বীপে বিস্তার লাভ করেছিলো। দশ বারো লাখ বর্গমাইলের এই দীর্ঘ ও প্রশস্ত দেশে প্রতিটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত সরাসরি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে গ্রহণ করা কোনোক্রমেই সম্ভব ছিলোনা। অধিকন্তু এই যুগেও ইসলামী রাষ্ট্রের গভর্ণরগণ, বিচারকগণ এবং প্রশাসকগণকে বিভিন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কুরআন মজীদের পরে আইনের দ্বিতীয় যে উৎসের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হতো, তা ছিলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত।]
সুন্নাহ আইনের উৎস হওয়ার বিষয়ে উম্মতের ইজমা
এখন আপনি যদি বাস্তবিকই কুর্ন মজীদকে মানেন এবং এই পবিত্র গ্রন্থের নাম নিয়ে আপনার নিজের মনগড়া মতবাদের অনুসারী না হয়ে থাকেন তবে দেখে নিন যে, কুরআন মজীদ পরিষ্কার, সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ দ্ব্যার্থহীন বাক্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে নিযুক্ত শিক্ষক, অভিভাবক, নেতা, পথ প্রদর্শক, আল্লাহ্র কালামের ভাষ্যকার, আইন প্রণেতা [Law Giver] বিচারক, প্রশাসক ও রাষ্ট্রনায়ক সাব্যস্ত করছে এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এসমস্ত পদ এই পাক কিতাবের আলোকে রিসালাতের পদের অবিচ্ছেদ্য অংগ। কালামে পাকের এই ভাষণের ভিত্তিতে সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সমস্ত মুসলমান একমত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বীকার করেন যে, উপরোক্ত সমস্ত পদের অধিকারী হিসেবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজ করেছেন তা কুরআন মজীদের পরে আইনের দ্বিতীয় উৎস। [Source of Law]
সুন্নাহ্কে সরাসরি আইনের একটি উৎস হিসেবে মেনে নেয়ার পর এই প্রশ্ন দেখা দেয় যে, তা জানার উপায় কি? আমি এর জবাবে বলতে চাই, আজ চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়ে যাবার পর এই প্রথমবারের মতো আমরা এ প্রশ্নের সম্মুখীন হই যে, দেড় হাজার বছর পূর্বে যে নবূয়্যতের আবির্ভাব হয়েছিলো তা কি সুন্নাত রেখে গেছে? দুটি ঐতিহাসিক সত্য কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায়না।
১. কুরআন মজীদের শিক্ষা এবং মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের উপর যে সমাজ ইসলামের প্রথম দিন থেকে কায়েম হয়েছিলো, তা সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে জীবন্ত রয়েছে, তার জীবনে একটি দিনেরও বিচ্ছিন্নতা ঘটেনি এবং তার সমস্ত বিভাগ ও সংস্থা এই পুরো সময়ে উপর্যুপরি কাজ করে আসছে। আজ সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে আকীদা বিশ্বাস, চিন্তাপদ্ধতি, চরিত্র, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ইবাদত ও পারস্পরিক সামাজিক লেনদেন, জীবনপদ্ধতি ও জীবনপন্থার দিক থেকে যে গভীর সামঞ্জস্য বিরাজ করছে, যার মধ্যে মতভেদের উপাদানের চাইতে ঐক্যের উপাদান বেশী পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে, যা তাদেরকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও একটি উম্মতের অন্তর্ভুক্ত রাখার সবচেয়ে বড় বুনিয়াদী কারণ- এগুলোই একথার পরিষ্কার প্রমাণ যে, এই সমাজকে সুন্নতের উপরই কায়েম করা হয়েছিলো এবং সেই সুন্নাত শতাব্দীর পর শতাব্দীর দীর্ঘতায় অব্যাহতভাবে জারী রয়েছে। এটা কোনো হারানো বা বিলুপ্ত জিনিস নয় যা অনুসন্ধান করার জন্য আমাদেরকে অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়াতে হবে।
যেমন আমি বিস্তারিত আকারে বর্ণনা করে এসেছি যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নবূয়্যতকালে মুসলমাদের জন্য শুধু একজন পীর, মুরশীদ ও বক্তাই ছিলেন বরং কার্যত তাদের দলের নেতা, পথপ্রদর্শক, শাসক, বিচারক, আইনপ্রণেতা, অভিভাবক, মুরুব্বী, শিক্ষক সবকিছুই ছিলেন এবং আকীদা বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণা থেকে শুরু করে বাস্তব জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁরই দেখানো, শিখানো ও নির্ধারিত পন্থায় মুসলিম সমাজ কাঠামো পরিপূর্ণরূপে গঠিত হয়েছিলো। তাই এরূপ কখনো ঘটতে পারেনি যে, তিনি নামায, রোযা, হজ্জের নিয়মাবলীর যে শিক্ষাদান করেছেন কেবল সেগুলো মুসলমানদের মধ্যে চালু হয়ে গিয়েছে এবং তাঁর অবশিষ্ট শিক্ষা ওয়াজ নসীহত হিসেবে শ্রবণ করে মুসলমানরা ঐ পর্যন্তই ক্ষ্যান্ত হয়ে গেছে। কখনোও নয় বরং বাস্তবিকপক্ষে যা কিছু হয়েছে তা এই যে, তাঁর শিখানো নামায যেভাবে মসজিদে চালু হয়েছে এবং ঐ সময় নামাযের জামায়াত কায়েম হতে থাকে অনুরূপভাবে বিবাহ শাদী, তালাক ও উত্তরাধিকার সম্পর্কে যেসব বিধান তিনি নির্ধারণ করেন তা মুসলমানদের পরিবারে বলবৎ হতে থাকে। পারস্পরিক লেনদেনের যে নীতিমালা তিনি নির্ধারণ করেন তা বাজারে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চালু হয়ে যায়। মামলা মোকাদ্দমার যেসব রায় তিনি প্রদান করেন তাই দেশের আইনে পরিণত হ। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি শত্রুপক্ষের সাথে এবং বিজয়ের পর বিজিত এলাকার অধিবাসীদের যে ব্যবহার করেন তাই মুসলিম রাষ্ট্রের সংবিধানে পরিণত হয়। স্বয়ং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব নীতিমালার প্রচলন করেন অথবা পূর্ব থেকে প্রচলিত রীতিনীতির মধ্যে যেগুলো তিনি বহাল রেখে ইসলামী নীতিমালার অংশে পরিণত করেন সামগ্রিকভাবে ইসলামী সমাজ ও জীবন ব্যবস্থা তার সমস্ত দিক ও বিভাগসহ সেই নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই ছিলো জ্ঞাত ও সুপরিচিত সুন্নাহ্, যার ভিত্তিতে মসজিদ থেকে নিয়ে পরিবার, বংশ, হাট বাজার, ব্যবসা বাণিজ্য, বিচার ব্যবস্থা, সরকারী প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যন্ত মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনের যাবতীয় সংস্থা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায়ই কার্য পরিচালনা করতে থাকে। পরবর্তীকালে খিলাফতে রাশিদার যুগ থেকে নিয়ে বর্তমান যুগ পর্যন্ত আমাদের সামগ্রিক সংস্থার কাঠামো তার উপর ভিত্তিশীল রয়েছে। গত শতাব্দী পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতায় এক দিনের জন্যও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়নি। এরপর যদি কোনো বিচ্ছিন্তা এসে থাকে তাহলে সেটা কেবল সরকার ও বিচার ব্যবস্থা এবং গণ আইনের সংস্থাসমূহের কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কারণেই হয়েছে।….. এসবের [সুন্নাতের] ব্যাপারে একদিকে হাদীসের নির্ভরযোগ্য রিওয়াতের এবং অপরদিকে উম্মাতের অব্যাহত ও ধারাবাহিক আমল উভয়টি পরস্পরের সাথে সংগিপূর্ণ রয়েছে।
২. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর থেকে প্রতিটি যুগের মুসলমানগণ প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত সুন্নাহ অর্থাৎ সহীহ হাদীসসমূহ অবগত হওয়ার অবিরাম চেষ্টায় রত থাকেন। একদিকে ছিলো সুপ্রসিদ্ধ হাদীসমূহ যে সম্পর্কে আমি উপরে আলোচনা করেছি এবং অপরদিকে ঐসব হাদীস ব্যতীত অপর এক প্রকারের হাদীস ছিলো যা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত কোনো সিদ্ধান্ত বক্তব্য, আদেশ নিষেধ, অনুমোদন [তাকরীর[ [পরিভাষায় অনুমোদন (তাকরীর)-এর অর্থ এই যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উপস্থিতিতে কোনো কাজ হতে দেখেছেন, অথবা কোনো প্রথার প্রচলন হয়েছে এবং তিনি তা নিষেধ করেননি। ভিন্ন শব্দে তাকরীর বলতে বুঝায় কোনো জিনিসকে বা কোনো বিষয়কে বহাল রাখা।] ও অনুমতি অথবা কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করে বা শ্রবণকরে ব্যক্তি বিশেষের গোচরে বা জ্ঞানে এসেছে এবং সর্বসাধারণ এগুলো সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারেনি….. এসব সুন্নাতের জ্ঞান যা বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো, মুসলিম উম্মাহ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পরপরই তা সংগ্রহের কাজ ধারাবাহিকভাবে শুরু করে দেন। কেননা ফকীহগণ, প্রশাসকগণ, বিচারকগণ, মুফতীগণ ও জনসাধারণ সবাই নিজ নিজ কর্মসীমার মধ্যে উদ্ভূত সমস্যা সম্পর্কে নিজস্ব রায় বা ইজতিহাদের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত বা কর্মপন্থা গ্রহণ করার পূর্বে ঐ সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো পথনির্দেশ বর্তমান আছে কিনা তা অবগত হওয়া জরুরী মনে করতেন। এই প্রয়জনের পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রতিটি লোকের অনুসন্ধান শুরু হয়ে গেলো যার কাছে সুন্নাতের কোনো জ্ঞান বর্তমান আছে এবং এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যার কাছে এধরনের জ্ঞান বর্তমান ছিলো তা অন্যদের পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া নিজের জন্য ফরয মনে করতো। হাদীসের রিওয়াতেরে এটাই সুচনাবিন্দু এবং ১১ হিজরী থেকে তৃতীয় চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত এই বিক্ষিপ্ত সুন্নতগুলো একত্র করার কাজ অব্যাহত থাকে। জাল হাদীস [মুওদুয়াত] রচনাকারীরা এর মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটানোর যতোই চেষ্টা করেছে তা প্রায় সবই ব্যর্থ হয়ে গেছে। কেননা যে সুন্নতের সাহায্যে কোনো অধিকার [হক] প্রতিষ্ঠা অথবা প্রত্যাখ্যাত হতো, যার ভিত্তিতে কোনো জিনিস হালাল অথবা হারাম সাব্যস্ত হতো, যার দ্বারা কোনো ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য প্রমাণিত হতো অথবা কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পেতে পারতো, মোটকথা যেসব সুন্নাত আইন কানুনের উৎস ছিলো সে সম্পর্কে কোনো রাষ্ট্র সরকার বিচার বিভাগ এবং ফতুয়া বিভাগ এতোটা বেপরোয়া হতে পারতোনা যে, কোনো ব্যক্তি এমনি উঠে দাঁড়িয়েই বলে দেবে যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন” এবং কোনো প্রশাসক, অথবা বিচারক অথবা মুফতী তা মেনে নিয়ে এর ভিত্তিতে কোনো নির্দেশ জারী করবে। এজন্য আইন ক ানুনের সাথে যেসব সুন্নতের সম্পর্ক ছিলো সে সম্পর্কে পূর্ণ অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সমালোচনার ধারালো ছুরি দিয়ে তাতে অস্ত্রপচার করা হয়েছে, রিওয়াতের মূলনীতির ভিত্তিতে তা পরখ করা হয়েছে এবং দিরায়াতের [বুদ্ধি বিবেক] মূলনীতির ভিত্তিতেও। এবং যেসব তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে কোনো রিওয়ায়াতকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে সেসবও জমা করে রেখে দেয়া হয়েছে যাতে পরবর্তীকালে যেকোনো ব্যক্তি তা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে নিজের অনুসন্ধানী রায় কায়েম করতে পারে। তাদের জন্য যেহেতু সুন্নাহ আইন হওয়ার মর্যাদায় সমাসীন ছিলো, তার ভিত্তিতে তাদের আদালতগুলোকে বিচার মীমাংসা করতে হতো এবং তাদের ঘর থেকে নিয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিষয়াবলী তার ভিত্তিতে পরিচালিত হতো তাই এগুলোর আলোচনা পর্যালোচনা ও তত্ত্বানুসন্ধারে ক্ষেত্রে বেপরোয়া হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। এই তত্ত্বানুসন্ধানের উপায় উপকরণও এবং তার ফলাফলও ইসলামের প্রথম খিলাফতের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রজন্ম পরম্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি এবং প্রত্যেক যুগের লোকদের কাজ কোনো বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই সংরক্ষিত রয়েছে।
এই দুটি সত্যকে যদি কোনো ব্যক্তি উত্তমরূপে হৃদয়ংগম করে নেয় এবং সুন্নাহ্ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়ার উপায় উপকরণ সম্পর্কে যথারীতি পাণ্ডিত্যপূর্ণ অধ্যয়ন করে তবে সে কখনও এই সন্দেহের শিকার হতে পারেনা যে, এটা কোনো অসমাধানযোগ্য গোলক ধাঁধাঁ যার মধ্যে সে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে।
৩. খিলাফতে রাশিদার কার্যক্রম এবং উম্মাহ্র মুজাতিহদ আলেমগণের সিদ্ধান্ত
ইসলামী সংবিধানের তৃতীয উৎস হচ্ছে খিলাফতে রাশিদার কার্যক্রম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর খোলাফায়ে রাশেদীন যেভাবে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, তার নজীর ও ঐতিহ্যের বিস্তারিত বিবরণে হাদীস, ইতিহাস ও জীবন চরিতের বিরাট গ্রন্থসমূহ পরিপূর্ণ এবং এসব জিনিসই আমাদের জন্য নমুনা হিসেবে অনুসরণযোগ্য। ধর্মীয় বিধান ও নির্দেশনার যে ব্যাখ্যা সাহাবায়ে কিরাম সর্বসম্মতিক্রমে করেছেন (ইসলামের পরিভাষায় যাকে বলে ইজ্মা) এবং সাংবিধানিক ও আইনগত বিষয়সমুহে খোলাফায়ে রাশেদীন সাহাবাদের সাথে পরামর্শক্রমে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তা আমাদের জন্য অকাট্য প্রমাণ হিসেবে গণ্য এবং তাকে যাথাযথভাবেই মেনে নিতে হবে। কারণ কোনো ব্যাপারে সাহাবাদের মতৈক্য হওয়ার অর্থ এই যে, তা ইসলামী আইনের প্রামাণ্য ব্যাখ্যা এবং বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য কর্মপদ্ধতি। যে বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে সে বিষয়ে যে একাধিক ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে তা পরিষ্কার বুঝা যায়। এসব বিষয়ে যুক্ত প্রমাণের সাহায্যে একটি মতকে অপর মতের উপর অগ্রাধিকার দেয়া যায়। কিন্তু যেখানে তাঁদের পরিপূর্ণ মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে তাঁদের সিদ্ধান্ত অনিবার্যরূপ একই ব্যাখ্যা এবং একইরূপ কর্মনীতিকে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ করে। কারণ তাঁরা সরাসরি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাত্র এবং তাঁর নিকট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। কাজেই তাঁদের সকলের সমবেতভাবে দীনের ব্যাপারে ভুল করা কিংবা দীন ইসলামকে বুঝার ও হৃদয়ংগম করার ব্যাপারে সঠিকপথ হতে বিচ্যুত হওয়া কোনো মতেই সমর্থনযোগ্য নয়।
চতুর্থ উৎস হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ্র মুজতাহিদগণের সেসব ফায়সালা যা তারা (কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে) নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি দূরদৃষ্টির আলোকে বিভিন্ন সাংবিধঅডিনক সমস্যার সমাধানে পেশ করেছেন। মুজতাহিদদের সেসব সিদ্ধান্ত ইসলামী শরীয়তের অকাট্য প্রমাণ না হলেও ইসলামী সংবিধানের প্রাণসত্তা এবং এর নীতিমালাসমূহ অনুধাবন করার জন্য আমাদেরকে নির্ভুল ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দান করে।
এই চারটি হচ্ছে আমাদের ইসলামী সংবীদানের উৎস। ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন করতে হলে উল্লিখিত চারটি উৎস থেকেই এর যাবতীয় নীতিমালা একত্র করে তা প্রণয়ন করতে হবে। ঠিক যেমন ইংরেজদেরকে তাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে তাদের প্রণীত আইন [State law, Common law] এবং তাদের সাংবিধানিক প্রথা ও ঐতিহ্য [Conventions of the Constitution] হতে এক একটি খুঁটিনাটি পর্যন্ত গ্রহণ করে কাগজে লিখতে হয় এবং অনেক শাসনতান্ত্রিক বিধান ও নীতিমালা তাদেরকে তাদের আদালতসমূহের ‘রায়’ হতে বেছে বেছে গ্রহণ করতে হয়।১.{ইসলামী আইন প্রসংগে অন্যান্য আলোচনার জন্য দৃষ্টব্য এই লেখকের “ইসলামী আইন” শীর্ষক গ্রন্থ [সংকলক]
৪. সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা
ইসলামী সংবিধানের উল্লিখিত চারটি উৎসই লিখিতভাবে আমাদের কাছে বর্তমান আছে। কুরআন মজীদ তো লিখিতভাবে মুসলমানদের ঘরে ঘরে রয়েছে। “সুন্নতে রসূল” এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের কার্যক্রম সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য প্রন্হাকারে পাওয়া যায়। অতীতকালের মুজতাহিদদের সিদ্ধান্ত ও মতামতসমূহও নির্ভরযোগ্য প্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে। এগুলোর মধ্যে একটি জিনিসও দুর্বল নয় এবং দৃষ্প্রাপ্যও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বও এসব উৎস হতে এই অলিখিত সংবিধানের নীতিমালা উদ্ধার করে তাকে লিখিত রূপদান কারার ব্যাপারে কয়েকৈটি সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমি চাই যে, সম্মুখে অগ্রসব হবার পূর্বে এই কথাগুলো আপনার গভীরভাবে হৃদয়ংগম করে নিন।
ক. পারিভাষার অসুবিধা
এই প্রসংগে সর্বপ্রথম হচ্ছে ভাষার অসুবিধা। কুরআন, হাদীস এবঙ ফিক্হ গ্রন্থাবলীতে সাংবিধানিক আইনের বর্ণনা দেয়ার জন্য যেসব পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, বর্তমানে তা জনগণের নিকট প্রায় দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে। কারণ দীর্ঘকাল ধরে আমাদের এখানে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং এসব পরিভাষার ব্যবহার বর্জিত হয়েছে। কুরআন মজীদে এমন অসংখ্য শদ্ব রয়েছে যা আমরা দৈনন্দিন তিলাওয়াত করি, কিন্তু একথা জানিনা যে, এগুলো সাংবিধানিক পরিভাষা। যথা, সুলতান, মালিক, হুকুম, আমর, বিলায়েত ইত্যাদি। এমনকি এই শব্দগুলোর সাংবিধানিক অর্থ ও ভাব আরবীতেও খুব কম লোকই বুঝতে পারে। অন্য কোনো ভাষায় তার অনুবাদ করলে তো তার সম্পূ্র্ণ অর্থই বিকৃত হওয়ার আশংকা রয়েছে। ঠিক এজন্যই অনেক বড় বড় লেখাপড়া জানা পন্ডিত ব্যক্তিও কুরআনের সাংবিধানিক আইনের আলোচনা শুনে বিম্মিত হন এবং “কুরআনের কোন্ আয়াত হতে সংবিধান সম্পর্কে তথ্য জানা যায়” বলে বিম্ময়সূচক প্রশ্ন করে বসেন। বস্তুতপক্ষে এ লোকদের বিস্ময় এবং প্রশ্নের মূলীভূত কারণ এই যে, যেহেতু ‘সংবিধান’ [the Constitution] নামে কোনো সূরা কুরআন মজীদে বিদ্যমান নাই এবং বিংশ শতকের পরিভাষা অনুসারে কোনো আয়াতও নাযিল হয়নি।
খ. প্রাচীন ফিক্হ প্রন্থসমূহের হতাশাজনক সংকলন
আরেকটি অসুবিধা হলো আমাদের প্রাচীন ফিক্হশাস্ত্রের প্রন্থাবলীতে সংবিধান সম্পর্কীয় বিষয়সমূহকে আলাদাভাবে কোথোও পরিচ্ছেদ বা অধ্যায়ক্রমে সংকলিত করা হয়নি, বরং সংবিধান ও আইন তাতে পরস্পরের সাথে মিশ্রিতভাবে লিখিত হয়েছে। আপনারা জানেন, সংবিধান ও আইন সম্পর্কে আলাদা আলাদা ধারণা বহু পরবর্তী যুগের উদ্ভুত ব্যাপার বরং সংবিধান শব্দটিকে তার নতুর অর্থে ব্যবহারও সম্প্রতি শুরু হয়েছে।
অবশ্য একথা সত্য যে, যেসব ব্যাপারকে আমরা এখন সংবিধান সংক্রান্ত ব্যাপার বলে মনে করি, সে সকল বিষয়ে প্রাচীন ফিক্হবিদগণ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু মুশকিল হলো, তাদের এসব আলোচনা বড় বড় ফিক্হের কিতাবের বিভিন্ন অধ্যায়ে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। একটি বিষয়ে ‘কাযা’ [বিচার] অধ্যায় আলোচনা হলে অন্যটি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে ‘ইমারত’ [সরকার] অধ্যায়। একটি বিষয় ‘সিয়ার’ [যুদ্ধ ও সন্ধি সংক্রান্ত] অধ্যায় লিখিত হলে অন্যটি আলোচিত হয়েছে “হুদূদ” [ফৌজদারী আইন] অধ্যায়ে। আবার অন্য বিষয়ের আলোচনা হয়েছে ফাই [পাবলিক ফিনান্স] অধ্যায়ে। এতদ্ব্যতীত এগুলোর ভাষা ও পরিভাষা অধুনা প্রচলিত ভাষা ও পরিভাষা থেকে সম্পর্ণ ভিন্নতর। আইনের বিভিন্ন বিভাগ এবং এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীর পান্ডিত্ব যার নেই এবং আরবী ভাষার উপরও যার ব্যুৎপত্তি যথেষ্ট নয়, সে তা থেকে কোনো তথ্যই খুঁজে বের করতে পারবেনা। কোনোখানে দেশীয় আইনের আলোচনা ব্যাপদেশে আন্তর্জাতিক আইনের কোনো বিষয়ের প্রসংগ এসে গেলে কোথায় ব্যক্তিগত [Private] আইনের আলোচনা প্রসংগে হলে তা উপলব্ধি করা তার পক্ষে খুবই কঠিন। বিগত শতাব্দীসমূহে আমাদের সমাজের শ্রেষ্ঠ আইনজ্ঞগণ অতিমূল্যবান সম্পদ রেখে গিয়েছেন, কিন্তু আজ তাদের পরিত্যাক্ত এসব মূল্যবান সম্পদ যাচাই বাছাই করে প্রত্যেক বিভাগের আইন সম্পর্কীয় তথ্য ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সন্নিবেশিত করা এবং স্বছ্চ ও সুপরিস্ফুট করে জনসমক্ষে পেশ করা অত্যান্ত শ্রমসাধ্য ব্যাপার। এরূপ সাধনালব্ধ সম্পদ আহরণ করার জন্য আমাদের যুবসমাজ মোটেই আগ্রহান্বিত ও অগ্রসর হচ্ছেনা। যুগ যুগ ধরে তারা অপরের উচ্ছিষ্টংশ পেয়ে যথেষ্ট তুষ্ট। শুধু তাই নয়, তাদের পূর্বপুরুষেদের রক্ষিত এই মূল্যবান সম্পদকে তারা অজ্ঞাতসারে এপেক্ষা করছে, এর প্রতি ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।
গ. শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি
তৃতীয় সমস্যা হলো, আমাদের এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা সুদীর্ঘ কাল ধরে দোষ ত্রুটিতে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। আমাদের এখানে যার ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন তারা বর্তমান কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাজনৈতিক বিষয়াবলী এবং সাংবিধানিক আইন ও তার সাথে সংশিষ্ট বিষয়সমূহ সম্পর্কে অজ্ঞাত। তাই তারা কুরআন, হাদীস ও ফিক্হ অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা এবং বুঝাতে ও বুঝাতে যদিও জীবন অতিবাহিত করে দেন, কিন্তু বর্তমান যুগের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়সমূহ আধুনিক কালের ভাষা ও পরিভাষায় অনুধাবন করা এবং সে সম্পর্কে ইসলামের নীতি ও বিধান সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা কারা তাদের পক্ষে বড়ই মুশকিল ব্যাপার। তারা যে ভাষা ও পরিভাষা বুঝেন সে ভাষা ও সক্ষম হতে পারেন। তারপরই তারা বলতে পারেন যে, এসব সম্পর্কে ইসলামের নীতি এবং বিধান কি এবং তা কোথায় আলোচিত হয়েছে।
অন্যদিকে আমাদের আধুনিক শিক্ষিত লোকেরা কার্যত আমাদের রাজনীতি ও তমদ্দুন এবং আইন ও আদালতের সমগ্র বিভাগের উপর ঝোঁক বসে আছেন। এরা জীবনের আধুনিক সমস্যা সম্পর্কে তো ওয়াকিফহল, কিন্তু দীন ইসলাম সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে তাদের কি পথ নির্দেশ দিয়েছে সে ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। সংবিধান, রাজনীতি ও আইন সম্পর্কে তারা যা কিছু জানে তা সবই পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও পাশ্চাত্যের বাস্তব নমুনার সাহায্যেই জ্ঞাত। কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামী ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। কাজেই তাদের মধ্যে যারা বাস্তবিকই সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পুনঃ প্রতিষ্ঠা চান, তাদেরকেও এসব বিষয়ে ইসলামের নির্দেশ ও বিধি বিধান যে ভাষা ও পরিভাষা তারা বুঝতে পারে সে ভাষা ও পরিভাষায় বুঝিয়ে দিলেই তখন তারা তা হৃদয়ংগম করতে পারেন। কাজেই ইসলামী সংবিধান প্রণয়নের পথে বর্তমানে এটা অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছে।
ঘ. অজ্ঞদের ইজতিহাদ করার দাবী
চতুর্থ আর একটি সমস্যা রয়েছে যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে একটি কৌতুকে পরিণত হয়েছ। বর্তমানে একটি অদ্ভুত চিন্তারধারার উন্মেষ ঘটেছে যে, ইসলামে পৌরহিত্যবাদের কোনো অবকাশ নেই, কুরআন, সুন্নাহ ও শরীয়াতের উপর মোল্লার একচ্ছত্র আধিপত্য নেই যে, তারাই এর ব্যাখ্যা করবে। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও ইজতিহাদ করতে মোল্লাদের যেরূপ অধিকার আছে, আমাদেরও তদ্রূপ অধিকার আছে। দীন ইসলাম সম্পর্কে মোল্লাদের কোনো কথা আমাদের কথার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হওয়ারও কোনোই কারণ নেই।
বস্তুত এসব কথা এমন লোকেরা বলে বেড়ায় যারা না কুরআন ও সুন্নাতের ভাষা জানে, না ইসলামী ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের কিছুমাত্র ধারণা আছে, আর না তারা জীবনের কয়েকটি দিনও ইসলামের তথ্যনুসন্ধানে ব্যয় করেছে। তাদের জ্ঞানের এই ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা অনুভব করা এবং তা দূর করার পরিবর্তে তারা কুরআন হাদীস তথা ইসলাম সম্পর্কে ইজতিহাদ করার ব্যাপারে জ্ঞান থাকার আবশ্যকতাকেই সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে। তারা জেদ ধরেছে যে, ইসলামী জ্ঞানের অধিকারী হওয়া ব্যতিরেকেই তাদের মনগড়া ব্যাখ্যার দ্বারা ইসলামের অবয়বকে বিকৃত করার অধিকার তাদের দিতে হবে।
কিন্তু [ইসলাম সম্পর্কে] অজ্ঞতা ও মুর্খতার এই প্লাবনকে বাধা না দিয়ে যদি অগ্রসর হতে দেয়া হয় তবে এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। কালই হয়তো কেউ বলে উঠবে ইসলামে “উকিলবাদের” স্থান নেই। অতএব আইন সম্পর্কে প্রত্যেকেরই কথা বলার অধিকার আছে। আইন সম্পর্কে সে যদি একটি অক্ষরও না পড়ে থাকে তবুও তাকে সে অধিকার দিতে হবে। তারপর আর একদিন হয়তো কেউ বলবেঃ ইসলামে “প্রকৌশলবাদ” নেই, কাজেই ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে সকলেই কথা বলতে পারবে যদিও এই শাস্ত্রের কিছুই তার জানা নেই। এরপর আবার আর একজন দাঁড়িয়ে বলতে পারে যে, ইসলামে চিকিৎসা বিদ্যাও কেবল ডাক্তারদের একচিটিয়া উপজীবিকা নয়, রোগীদের চিকিৎসা করার অধিকার তাদেরও আছে যদিও চিকৎসা বিজ্ঞানের বাতাসও তাদের স্পর্শ করেনি। আমি অত্যন্ত স্তম্ভিত যে, আধুনিক উচ্চশিক্ষিত ও মহাসম্মানিত ব্যক্তিগণ কিভবে উক্তরূপ হাস্যকর ও বালকোচিত কথা বলতে এগিয়ে এসেছেন। এবং কেন তারা নিজেদের গোটা জাতিকে এরূপ “অপদর্থ মনে করে নিয়েছেন যে, তাদের এসব অন্তঃসারশূণ্য হাস্যকর কথা শুনে তারা তা শিরধার্য করে নিবে। নিঃসন্দেহে ইসলামে পৌরহিত্যবাদ নেই। কিন্তু এই পৌরহিত্যবাদ না থাকার অর্থ কি, তা কি তারা জানে? এর অর্থ কেবল এই যে, ইসলামে বনী ইসরাঈলের ন্যায় দীন ইসলামের জ্ঞান এবং দীন ইসলামের খিদমতের কাজ কোনো বংশ বা গোত্রের একচেটিয়া পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। ইসলামে খৃষ্টধর্মের ন্যায় দীন ও দুনিয়াকে পরম্পর বিচ্ছিন্নও করা হয়নি যে, “দুনিয়া কায়জারের নিকট সোপর্দ করা হয়েছে এবং দীন পাদ্রীদের নিকট ইজারা দেয়া হয়েছে। ইসলামে কুরআন, সুন্নাহ্ এবং শরীয়তের উপর কারো ব্যক্তিগত ইজারাদারী নেই এবং “মোল্লা” কোনো বংশ বা গোত্রের নাম নয় যে, দীন ইসলামের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার তার পৈত্রিক অধিকার। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যেমন আইন পড়ে ড উকিল ও জজ হতে পারে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে যেমন প্রত্যেক ব্যক্তিই ইঞ্জিনিয়ার ও চিকিৎসা বিজ্ঞান শিখে যেমন প্রত্যেক ব্যক্তিই ডাক্তার হতে পারে, তদ্রুপ প্রত্যেক ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ্র জ্ঞান শিক্ষালাভ করার জন্য সময় ও পরিশ্রম ব্যয় করে শরীয়তের ব্যাপারসমূহ সম্পর্কে এথা বলার অধিকার অর্জন করতে পারে। ইসলামে ‘পৌরহিত্যবাদ’ নেই- এই কথাটির কোনো বুদ্ধিসম্মত অর্থ থেকে থাকলে তা এটাই, ইসলামে পৌরহিত্যবাদ না থাকার অর্থ এই নয় যে, ইসলামকে ছেলেখেলা ব্যাপারে পরিণত করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, এখন যার ইচ্ছা উঠে দাড়িয়ে তার বিধান ও শিক্ষা সম্পর্কে অভিজ্ঞ সূলভ ফায়সালা প্রদান করতে শুরু করে দিবে, চাই সে কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা নাইবা করতে থাকুক। জ্ঞান ব্যতীত রায় দান করার অধিকারী হওয়ার দাবি দুনিয়ার কোনো ব্যাপারেই যদি গ্রহণযোগ্য না হয়ে থাকে, তবে শেষ পর্যন্ত ইসলামের ব্যাপারে উক্তরূপ দাবী প্রহণযোগ্য হবার সূলে কি যুক্তি থাকতে পারে?
ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন ও ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাকে অন্তর্হিত করার ক্ষেত্রে এই চতুর্থ বাধাটিও কমজটিলতার সৃষ্টি করেনি। আর সত্য কথা বলতে গেলে বর্তমানে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাধা। প্রথম উল্লেখিত তিনটি বাধা চেষ্টা সাধনার দ্বারা দূর করা যেতে পারে এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহে তা এক পর্যায় পর্যন্ত দূর করাও হয়েছে। কিন্তু এই নতুন জটিলতর চিকিৎসা বড়ই কঠিন বিশেষত এই জটিলতা বর্তমান শাসন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে তা আরও অধিক দূরুহ হয়ে পড়েছে।